০১. নক্ষত্রের ইশারা
এক কর্নেলের গল্প শোনা যাক। যুদ্ধাহত, ক্ৰাচে ভর দিয়ে হাঁটা এক কর্নেল। কিংবা এ গল্প হয়তো শুধু ঐ কর্নেলের নয়। জাদুর হাওয়া লাগা আরও অনেক মানুষের। নাগরদোলায় চেপে বসা এক জনপদের। ঘোর লাগা এক সময়ের।
গল্পটি শুরু করা যাক লালমাটিয়ার ঐ শ্যাম্পুর বিরাট বিলবোর্ডটি থেকে। বিলবোর্ডটিতে দিনের শেষ আলো আছড়ে পড়ছে। তায় ঠিক নিচে একা দাঁড়িয়ে আছেন লুৎফা। আকাশে মেঘ করেছে। বৃষ্টি হবে বুঝি বা। কোনো দূর দেশ থেকে শীত শীত হাওয়া আসছে। একটা আকাশি রঙের চাদর গায়ে জড়িয়েছেন লুৎফা। শিরিশ গাছের কয়েকটি পাতা উড়ে এসে পড়ছে লুৎফার চাদরে। লুৎফা সেই কর্নেলের স্ত্রী। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন তার ছোট ছেলে মিশুর জন্য। মিশুর অফিসের বাস প্রতিদিন ঐ শ্যাম্পুর বিলবোর্ডের নিচে এসে দাঁড়ায়। লুৎফা সেই বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন। অন্যমনস্ক, বিষণ্ণ। যেন অন্য কোনো গ্রহের ধুলো লেগে আছে তার গায়ে। বাস থেকে নামলে মিশুকে নিয়ে একটি রিকশায় উঠবেন লুৎফা। লাল আকাশকে পেছনে রেখে বাড়ি ফিরবেন তারা; কেউ কোনো কথা বলবেন না। এভাবেই চলছে প্রতিদিন। এরকমই নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন ডাক্তার।
মিশুকে নিয়ে সমস্যায় আছেন লুৎফা। সাইকিয়াট্রিস্টের চিকিৎসাধীন আছে মিশু। মিশুর সাম্প্রতিক লেখা কবিতাটি পড়ে সাইকিয়াট্রিস্ট চিন্তিত। কবিতা মিশু লেখে মাঝে মাঝে। সম্প্রতি সে লিখেছে, খুব ঠাণ্ডা মাথায় আমি একজনকে হত্যা করতে চাই। তারপর ঐ কবিতাজুড়ে অদ্ভুত সব ইমেজ। সে নাকি মানসপটে একটি গোলাপি ট্রেনকে ঝিকঝিক করতে করতে ছুটে যেতে দেখে। প্রতিদিন সকাল সাড়ে আটটায় মহাখালী রেল ক্রসিং-এ সেই গোলাপি ট্রেনটি আসে। তখন খুব হাওয়া বয় চারদিকে। রেললাইন আর ট্রেনের চাকা পরস্পরকে লেপ্টে থাকে। মিশুর মনে হয় যেন দুটি ধাতব ঠোঁট, চুম্বন করছে পরস্পরকে। মনোলোকে সে রেল ক্রসিং এ দাঁড়িয়ে ঐ মায়াবী প্রেমের দৃশ্য দেখে৷ দমকা হাওয়ায় তার চুল উড়ে, শরীর কাঁপে। রেললাইন আর ট্রেনের চাকার অঙ্গ অঙ্গ মিলনে যেন আশ্চর্য এক সৌন্দর্য রচিত হয়। মিশু লিখেছে আমি ঐ সৌন্দর্য চেখে দেখতে চাই। অন্যভাবে বললে একজনকে হত্যা করতে চাই আমি।
ডাক্তার কথাটি আগেও বলেছেন কিন্তু এই কবিতটি পড়ে আরও নিশ্চিত হলেন এবং আবারও বললেন, মিশুর ভেতর আত্মহত্যা প্রবণতা দেখা দিয়েছে। ওকে একা হতে দেওয়া যাবে না। নজরে রাখতে হবে সবসময়। নৃবিজ্ঞানে পড়াশোনা শেষে মিশু একটি সংস্থায় গবেষণার কাজ করছে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী অফিসের সময়টিতে মিশুর ওপর চোখ রাখছেন ওর অফিসের এক শুভানুধ্যায়ী। আর অফিসের বাস মিশুকে রাস্তায় নামিয়ে দেবার পর বাড়ি ফেরার পথটুকু তাকে আগলে রাখছেন তার মা লুৎফা। মিশু বাসের হ্যান্ডেল ধরে নামবার সময় যখন ডানে বামে দেখে তখন হঠাৎ মুহূর্তের জন্য ওর চাহনি, চোয়ালের জায়গাটুকু দেখায় তাহেরের মতো। আবু তাহের, সেই কর্নেল, মিশুর বাবা।
আবু তাহেরের ফাঁসি হয়েছে। ফাঁসির আগের সবাই দেখা করতে গিয়েছিলেন তাহেরের সঙ্গে। লুৎফা নীতুকে নিয়েছেন, যীশুকে নিয়েছেন কিন্তু মিশুকে নিতে পারে নি। মিশুর বয়স তখন নয় মাস, ছিল নানার বাড়িতে। তাহেরের সঙ্গে দেখা করবার জন্য খুব অল্প সময় দিয়েছে তারা, মিশুকে নেবার আর সুযোগ হয়নি। সঙ্গে করে মিশুর একটা ছবি নিয়েছিলেন লুৎফা। জেলে ঢুকবার আগে নিয়মমাফিক তল্লাসী চালায় প্রহরীরা। আরও কিছু জিনিসের সঙ্গে মিশুর ছবিটাও জেলগেটে রেখে দেয় তারা। না মিশুকে, না তার ছবি কোনোটিই আর শেষবারের মতো দেখা হয়নি তাহেরের। মিশু অবশ্য যথারীতি বহন করছে তাহেরের চোয়াল। রোজকার মতো মিশুর অফিসের বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন লুৎফা। বৃষ্টির খবর নিয়ে আসা শীত শীত হাওয়ায় কয়েকটি শিরিশ পাতা এসে পড়ছে তার গায়ের চাদরে।
লুৎফাকে মিশুর অপেক্ষায় ওই বিলবোর্ডের নিচে দাঁড় করিয়ে রেখে বরং চলে যাওয়া যাক বেশ কয়েক বছর পেছনে। যাওয়া যাক নেত্রকোণার ঈশ্বরগঞ্জ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। তখন ১৯৬৮ সাল। এক ঝকঝকে সকালে লুৎফা ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। তার সামনে দিগন্ত বিস্তৃত পাটের ক্ষেত। ঈশ্বরগঞ্জের বিখ্যাত পাট। বিলবোর্ডের নিচে দাঁড়ানো আজকের লুৎফার চোখে যে বিষণ্ণতা ঈশ্বরগঞ্জের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো লুৎফর চোখে তা নেই। আছে স্বপ্ন, বিহ্বলতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন বিভাগের ছাত্রী লুৎফা ছুটি শেষে ফিরছেন রোকেয়া হলে। ছিপছিপে লুৎফা স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছেন আনা কারেনিনার মতো।
এর বেশ কয়েক বছর পর তাহেরের সঙ্গে অক্সফোর্ডে ড. রম্ফের বাড়িতে বসে লুৎফা যখন পিয়ানোতে টুং টাং আঙ্গুল বুলাবেন মিস্টার রম্ফ তখন তাঁকে কারেনিনা নামেই ডাকবেন। কোনো এক রুশ স্টেশনেই টলস্টয় আমাদের প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন কারেনিনার সঙ্গে। আর কারেনিনার মতোই কি এক নক্ষত্রের ইশারায় রেল স্টেশন জড়িয়ে যাবে লুৎফার জীবনে। সিগনাল পড়ে গেছে। ট্রেন আসবে এখনই। দেখা যাবে স্টেশন মাস্টার মুন্সেফ উদ্দীন তালুকদার প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে লুৎফাকে বিদায় জানাচ্ছেন : আবার কবে আসবা মা, আবার কবে ছুটি?
ঈশ্বরগঞ্জের সরকারি ডাক্তার খুরশীদুদ্দীনের মেয়ে লুৎফা। স্টেশন মাস্টার মুন্সেফ উদ্দীন ভাবেন বন্ধু খুরশীদুদ্দীনের মেয়েটা দেখতে দেখতে কেমন বড় হয়ে গেল। মুন্সেফ উদ্দীন যখন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে লুৎফাকে বিদায় জানান তখন দূর অ্যাকাশে তারায় তারায় জল্পনা চলে।
ঈশ্বরগঞ্জের কয়েক স্টেশন পরেই শ্যামগঞ্জ। সেখানে আছেন মুন্সেফ উদ্দীন তালুকদারের বড় ভাই মহিউদ্দীন আহমেদ। তিনিও স্টেশন মাস্টার। স্টেশনে স্টেশনে জীবন কাটিয়ে অবসর নিয়েছেন সম্প্রতি। থিতু হয়েছেন শ্যামগঞ্জে তাদের নিজের গ্রাম কাজলায়। অবসর নেবার পর তিনি ব্যস্ত হয়ে পরেছেন তাঁর ছেলে আবু তাহেরের বিয়ের ব্যাপারে। আবু তাহের তখন তরুণ ক্যাপ্টেন। মহিউদ্দীন আহমেদ সবাইকে বলে বেড়াচ্ছেন তাহেরের জন্য মেয়ে খুঁজতে। বলেছেন ভাই মুন্সেফ উদ্দীনকেও।
মুন্সেফ উদ্দীনের সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে লুৎফার কথা। খুরশীদুদ্দীনের ডিসপেনসারিতে গিয়ে সরাসরি প্রস্তাব দিয়ে বসেন মুন্সেফ উদ্দীন, আমার ভাইয়ের ছেলে, ক্যাপ্টেন, দারুন স্মার্ট। ইন্ডিয়ার সাথে সিক্সটিফাইভের ওয়ারে জয়েন করেছে, গুলিও লেগেছিল, আর্মি থেকে অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে।
খুরশীদুদ্দিন বলেন, ভালোই তো? লুৎফার মার সঙ্গে কথা বলে দেখি।
লুৎফার মা মল্লিকা আখতার বাধ সাধেন; আর্মিতে চাকরি করে, ওটা একটা জীবন হলো নাকি? এসব গোলাগুলি, যুদ্ধ। শুধু শুধু মেয়েটাকে ঐসব ঝামেলায় জড়িয়ে লাভ কি? কথা আর এগোয় না।
কিন্তু নক্ষত্রের ইশারা কে আর উপেক্ষা করতে পারে? বছর ঘুরে ঈশ্বরগঞ্জের বাতাস আবার ভরে ওঠে কাঁঠালের গন্ধে। একদিন আবারও লুৎফাকে দেখা যায় প্লাটফর্মে। গ্রীষ্মের ছুটিতে এসেছেন তিনি। স্টেশন মাস্টার মুন্সেফ উদ্দীন এবার ভাই মহিউদ্দীন আহমেদকে খোঁজ পাঠান। বলেন, এবার আপনে আসেন বিয়ার প্রস্তাব নিয়া।
মহিউদ্দীন আহমেদ ভেতর গোটানো মানুষ, এসব বৈঠকি আলাপে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। তিনি তাহেরের বড় ভাই আবু ইউসুফকে পাঠান। ইউসুফ তাহেরকেও সঙ্গে নিয়ে চলেন। খুরশীদুদ্দিন লুৎফাকে বলেন : বিকালে মেহমান আসবে, একটা ভালো শাড়ি পড়ে নে।
লুৎফার বুঝতে অসুবিধা হয় না। তিনি বেঁকে বসেন; আমি কোনো সাজগোজ করতে পারব না। আর আমার বিয়ের কথা কিন্তু তুলবেন না এখন। মা মল্লিকা আখতারেরও আগ্রহ কম।
খুরশীদুদ্দিন বোঝান; ওদের এত আগ্রহ, ভালো পরিবার, আর মেয়েকে তো বিয়ে দিতে হবে নাকি?
বিকালে আসেন মুন্সেফ উদ্দীন, আবু ইউসুফ, তাহের। একটা সাধারণ শাড়ি পরেই হাজির হন লুৎফা। কথা বলেন আবু ইউসুফই। নানা টুকরো আলাপ চলে। ইউসুফ এক ফাঁকে জিজ্ঞাসা করেন : কি করতে তোমার ভালো লাগে? লুৎফা বলেন : নাটক। কলেজে নিয়মিত নাটক করতেন লুৎফা, ইডেন কলেজের সাংস্কৃতিক সম্পাদিকাও ছিলেন। লুৎফা ভাবেন নাটকের কথা শুনে হয়তো ভয় পাবে, নাটক করা মেয়েকে আর কে বিয়ে করতে চায়? তাহেরের সঙ্গে কোনো কথা হয় না সেদিন; বারকয়েক দৃষ্টি বিনিময় শুধু। আলাপি ইউসুফ মন জয় করে নেন মল্লিকা আখতারের।
ওদিকে আটপৌরে, অকপট লুৎফাকে ভালো লাগে তাহেরের। ইউসুফকে বলেন; ভাইজান এ মেয়েটিকেই বিয়ে করব আমি।
দিন যায়, আসে। একদিন ইউসুফের স্ত্রী ফাতেমা রোকেয়া হলে এসে লুৎফাকে ডাকেন, শোন মেয়ে তোমার চুড়ির মাপ নিতে এসেছি।
কেমন উচাটন লাগে লুৎফার। সত্যিই বিয়ে হয়ে যাবে আমার? একজন আর্মি অফিসারের সঙ্গে? কেমন হয় আর্মির মানুষেরা?
১৯৬৯ সালের ৭ আগস্ট ঈশ্বরগঞ্জের মানুষ হঠাৎ দেখে ইউনিফর্ম পড়া এক দল সৈন্য আকাশে গুলি ছুড়তে ছুড়তে মার্চ করে গ্রামে ঢুকছে। হকচকিয়ে যায় সবাই, ভয় পায়। কোনো যুদ্ধ বেধে গেল নাকি? সেদিন লাল, নীল, হলুদ কাগজের তিনকোণা পতাকায় সাজানো ঈশ্বরগঞ্জের সরকারি ডাক্তার খুরশীদুদ্দিনের বাড়ি। মেয়ে লুৎফার বিয়ে সেদিন, সবাই বরের জনয অপেক্ষা করছে। তার মধ্যে এসব কি হাঙ্গামা?
একটু পর কে একজন হন্তদন্ত হয়ে বলে; কারবার দেখছেননি, ঐটা তো আর্মি না, বরযাত্ৰী।
তাহের ঐ সেনা কায়দাতেই তাঁর বন্ধু আর প্লাটুন নিয়ে হাজির হয়েছেন বিয়ের আসরে। বাইরে যখন বন্দুকের শব্দ হচ্ছে ঘরের ভেতর লাল শাড়ির মধ্যে জুবুথুবু লুৎফা তখন কুকড়ে গেছেন ভয়ে। যখন জানতে পারেন এ তার হবু বরেরই কাণ্ড তখন অবাক হয়ে ভাবেন : এ কেমন অদ্ভুত লোক রে বাবা!
কোনো এক দুঃসম্পর্কের বোন যখন কনে সাজাবার নামে লুৎফার কপাল, গলে তিব্বত ক্রিমের ছোট ছোট বিন্দুর নকশায় ভরে দিচ্ছে তখন তার জানবার কথা নয় কতটা অদ্ভুত এক লোকের সঙ্গে জীবন বাঁধা পড়ছে তার।
০২. মধু নেই, চন্দ্ৰিমা নেই
বিয়ের দুদিন পরই ঈশ্বরগঞ্জ থেকে ট্রেনে ঢাকা রওনা দেন লুৎফা আর তাহের। বিয়ের আগে তাহেরের সঙ্গে কোনো কথা হয়নি লুৎফার। কনে দেখবার দিন আড়চোখে দৃষ্টি বিনিময় হয়েছিল শুধু। বিয়ের পর তাহেরকে একটু একটু করে বুঝবার চেষ্টা করছেন লুৎফা।
লুৎফার হাত থেকে হঠাৎ তার রুমালটি পড়ে যায় ট্রেনের ফ্লোরে। তুলতে গেলে লুৎফাকে থামিয়ে দেন তাহের। বলেন; আমার বউয়ের পড়ে যাওয়া রুমাল সে নিজে তুলবে কেন? যেন তাহের কোনো এক অজানা রাজ্যের বাদশাহ আর লুৎফা তার বেগম। লুৎফা লক্ষ করছেন গুলি চালিয়ে বিয়ের আসরে আসবার মতো একধরনের নাটকীয়তা সবসময় লেগে আছে তাহেরের চরিত্রে। কথাবার্তায় তিনি সতর্ক কিন্তু পাশাপাশি খুব প্রাণবন্তও বটে। লোকটা কি খুব মেজাজী হবে? কেমন হবে তার সংসার এই লোকটির সঙ্গে? ট্রেনের বগিতে বসে চুরি করে তাহেরকে দেখতে দেখতে সামান্য পরিচিত এই মানুষটিকে নিয়ে ভাবনার জাল বোনেন লুৎফা।
চলতে চলতে ময়মনসিংহ স্টেশনে এসে আটকে পড়ে ট্রেন। প্ল্যাটফর্মে প্রচুর ভিড়। কোনো এক মিটিংফেরত সব মানুষ। লুৎফা তাহেরের কানে কানে বলেন : ঐ যে মতিয়া আপা।
তাহের লক্ষ করেন ভিড়ের মানুষ ঘিরে আছে মতিয়া চৌধুরী আর অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদকে। সে সময়ের রাজনীতির আলোচিত মানুষ এঁরা।
লুৎফা বলেন, মতিয়া আপা আমাকে দেখলে খুশি হতেন।
তোমার সঙ্গে পরিচয় আছে নাকি মতিয়া চৌধুরীর? খানিকটা অবিশ্বাসের সুরে জিজ্ঞাসা করেন তাহের। তুখোড় নেত্রী মতিয়া চৌধুরীর সঙ্গে লাজুক লুৎফার যোগসূত্র ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না তিনি।
ইডেন কলেজে পড়তে তো তাঁর পার্টিই করতাম। চিনি কিনা মতিয়া আপাকে জিজ্ঞাসা করে দেখলেই হয় : জানালায় তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে একটু যেন চ্যালেঞ্জ ছেঁড়ে দেন লুৎফা।
উৎসাহী হয়ে ওঠে তাহের; সত্যি বলছ?
নতুন বউয়ের সঙ্গে খুনসুটি করা ছাড়াও তাহেরের ইচ্ছা মতিয়া চৌধুরী আর অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের সঙ্গে আলাপের। ছোট ভাই আনোয়ারকে পাঠান তাহের। প্ল্যাটফর্মের ভিড় ঠেলে আনোয়ার পৌঁছে যান মতিয়া চৌধুরীর কাছে। ছুটে আসেন মতিয়া চৌধুরী। লুৎফার তখনও নতুন বউয়ের সাজ।
লুৎফাকে জড়িয়ে ধরেন মতিয়া চৌধুরী; লুৎফা তোর বিয়ে হলো আমি কিচ্ছু জানলাম না?
লুৎফা পরিচয় করিয়ে দেন স্বামী ক্যাপ্টেন থেকে সদ্য মেজর হওয়া তাহেরের সঙ্গে।
মতিয়া বলেন; ভালোই হলো তোদের সঙ্গে গল্প করতে করতেই যাবো আজকে। দাঁড়া মোজাফফর ভাইকে ডেকে আনি।
মতিয়া চৌধুরী, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ আরও কজন সঙ্গী নিয়ে উঠে পড়েন। লুৎফাদেরই কামরায়।
তাহেরের দিকে আড়াচোখে তাকিয়ে মুচকি হাসেন লুৎফা। তাহেরের সঙ্গে ছোটখাটো একটা জিত তো হলো তারা?
শরীরে বিয়ের শাড়ির ঘ্রাণ নিয়ে লুৎফা এতক্ষণ ট্রেনের জানালায় চোখ ভাসিয়ে রেখেছিলেন দিগন্তে। স্বপ্ন দেখছিলেন আগামীর। আশৈশব পরিচিত ট্রেনের সেই শব্দ আর দুলুনিতে তাহেরেরও খানিকটা ঝিম ধরেছিল বুঝিবা। কিন্তু এখন ট্রেনের কামরায় অনেকগুলো উত্তেজিত মানুষ! হৈ চৈ, বিতর্ক। আনমনা স্বপ্ন বুনবার আবহ আর নেই। ১৯৬৯-এর সেই আগস্ট তাহের আর লুৎফর মধুচন্দ্ৰিমার মাস। কিন্তু দেশজুড়ে তখন কোথাও কোনো মধু নেই, চন্দ্ৰিমা নেই।
চারদিকে এক উত্তপ্ত, অগ্নিগৰ্ভ সময়। পূর্ব পাকিস্তানের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে শুধু মিটিং, মিছিল আর বিক্ষোভ। বাতাসে স্লোগান, ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা’। মিছিলে গুলি। গুলিতে নিহত ছাত্র আসাদের শার্ট তখন হয়ে গেছে মিছিলের পতাকা।
পূৰ্ব আর পশ্চিমে ডানা মেলে দেওয়া পাকিস্তান পাখি তখন আর উড়ছে না। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মনে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে একটু একটু করে জমে ওঠা ঘৃণা আর আক্রোশ তখন তুঙ্গে। প্রতিবাদ চলছে প্রকাশ্যে, গোপনে। ট্রেনের কামরায় উঠে পড়া মানুষগুলো ফিরছিল তেমনি এক প্রতিবাদ সভা থেকেই।
ইয়াহিয়া কি ইলেকশন দিবে? জিজ্ঞাসা করে একজন।
দিবে মানে? ওর চৌদ্দগুষ্টি দিবে। উত্তেজিত উত্তর আরেকজনের। ট্রেনের কামরাভরা ক্ষুব্ধ মানুষ। ট্রেন রওনা দেয় আবার। আগস্টের ঝাঁ ঝাঁ দুপুর।
০৩. আরেক আগস্ট
তাহের আর লুৎফাকে ট্রেনের কামরায় রেখে এবার আরও খানিকটা পেছনে চলে যাওয়া যাক। চলে যাওয়া যাক এমনি আরেক আগস্টের দিনে। ওরা যখন ট্রেনে করে ঢাকার পথে যাচ্ছেন তার ঠিক বছর বাইশ আগে। ১৯৪৭ সালের আগস্টের ১৪ তারিখ; সেদিনই আকাশে উড়েছিল পাকিস্তান পাখি, যে পাখির এখন ডানা ভাঙবার উপক্ৰম। অথচ ঐদিন বাতাসে উৎসবের ঘ্রাণ! সেদিন গুজরাটি ঝীনা ভাইয়ের ছেলে মহম্মদ আলী ঝীনা যিনি কিনা সাহেবদের কল্যানে স্যুট টাই পড়া ব্যারিস্টার জিন্নাহ, শেষ ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সাথে ইসলামাবাদে লাঞ্চ করছিলেন। জাকজমকপূর্ণ লাঞ্চ পার্টি। কারণ সেদিন পৃথিবীর মানচিত্রে পূর্ব আর পশ্চিম মিলিয়ে পাকিস্তান নামে এক নতুন দেশের জন্ম হচ্ছে। পূর্বের মানুষেরা বাঙালি, পশ্চিমে অবাঙালি। তাতে কি? সবাই তারা মুসলমান। পৃথিবীতে মুসলমানদের জন্য একটি দেশের আবির্ভাব ঘটছে। কিন্তু কি মজার ব্যাপার দেখুন সেটি ছিল রোজার দিন। মুসলমানদের নেতা কিনা রোজা রমজানের দিনে দিব্বি লাঞ্চ পার্টি করে বেড়াচ্ছেন। অবশ্য ধর্ম-কর্মের ব্যাপারে জিন্নাহ, কখনই তেমন আচারনিষ্ঠ ছিলেন না। তিনি তো তরুণ বয়সে হিন্দু মুসলমানের মিলনের কথাই বলতেন। মাঝবয়সে এসে বিয়ে করলেন অমুসলিম তরুণী ঋতুকে। কিন্তু সে কথা এখন বাসি, এখন তিনি মুসলমানদের নেতা।
সারাদিন উৎসব করে তিনি রাতে যখন ঘুমাতে গেলেন, তখন কয়েক শত মাইল দূরে দিল্লিতে আতশবাজি পুড়িয়ে শুরু হয়েছে আরেক উৎসব। এ উৎসব আরেকটি নতুন দেশের জন্মের। ১৫ আগস্ট জন্ম নিচ্ছে হিন্দুদের দেশ ভারত। একদিনের ব্যবধান; দুটি দেশের জন্ম। একটি মুসলমানদের, অন্যটি হিন্দুদের। কিন্তু হিন্দুদের নেতা আরেক ব্যারিস্টার করমচাঁদ গান্ধী উৎসবের ধুমধামের মধ্যে নেই। সুট, টাই ফেলে তিনি গায়ে চড়িয়েছেন ধুতি, চপ্পল। দিল্লি থেকে অনেক দূরে কলকাতায় বিষণ্ন বসে তিনি রাতের তারা দেখচ্ছেন। তিনিও চাননি দুটো দেশ হোক! বলেছিলেন, ভারতকে ভাগ করবার আগে তোমরা আমাকে দু ভাগ করো। কিন্তু সময়ের পাগলা ঘোড়া গান্ধী আর জিন্নাহকে নিয়ে গেছে দুপ্রান্তে।
ভারতকে দুভাগ করবার নানা আয়োজন শুরু হয়ে গিয়েছিল কদিন আগেই। লন্ডন থেকে জরুরি তলব করে নিয়ে আসা হয়েছিল ড্রাফটম্যান র্যাডক্লিফকে। দিল্লির ভাইসরয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। তার দায়িত্ব ভারতকে দুভাগ করা, একভাগে হিন্দু, অন্যভাগে মুসলমান। কোনদিন ভারতে আসেন নি র্যাডক্লিফ, তার কাছে ভারত মানে টেবিলের উপর ছড়ানো ঐ ম্যাপ। র্যাডক্লিফ হিসাব করলেন কোথায় হিন্দু বেশি, কোথায় মুসলমান, তারপর পেন্সিল দিয়ে দাগ কেটে কেটে ভাগ করলেন ভারতকে। দাগের এদিকে ভারত ওদিকে পাকিস্তান। ১৫ আগস্ট ভোরে ঘুম ভেঙ্গে ভুরুঙ্গামারির আবদুল মোতালেব জানতে পারলেন তার পাশের বাড়ির নিবাস শর্মা আজ থেকে আর তার দেশের মানুষ নয়, বিদেশি। র্যাডক্লিফের পেন্সিলের খোঁচায় পাটগ্রামের খলিলের বাড়ির বৈঠক ঘর পড়ল পূর্ব পাকিস্তানে আর রান্নাঘর ভারতে; কি তুলকালাম কাণ্ড আর কি অদ্ভুত। তল্পিতল্পা গুটিয়ে এপারের হিন্দু পালালো ওপারে। আর ওপারের মুসলমান এলো এপারে। যার যার নতুন দেশে। পথে পথে কত অশ্রু ঝরল, বইল রক্তের স্রোত।
‘তেলের শিশি ভাংলো বলে খুকুর পরে রাগ করো,
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙ্গে ভাগ করো
–তার বেলা?’ আক্ষেপ করলেন
অন্নদাশংকর।
বড় মুস্কিলে পড়ল স্কুলের খোকা খুকুরা। ক্লাসে শিক্ষক বলেন : বাবুরা পাকিস্তানের ম্যাপ আঁক তো? খোকা খুকুরা রাবার দিয়ে ঘষে ঘষে আঁকে তার দেশের কিম্ভূত মানচিত্র। এক টুকরো পূর্বে, আরেক টুকরো পশ্চিমে। মাঝে বিস্তর পারাবার; খোকা খুকুদের খটকা লাগে।
কিছুদিন পর খটকা শুরু হয় বুড়ো খোকাদের মধ্যেও। পূর্ব পাকিস্তানের বুড়ো খোকারা লক্ষ্য করেন পূৰ্ব আর পশ্চিম নিয়ে পাকিস্তান হলেও সবকিছুতেই পাল্লা ভারী পশ্চিমে। দেশের হর্তকর্তা, আমলা, ব্যবসায়ী, সেনাকর্তা প্ৰায় সবাই পশ্চিম পাকিস্তানি। এমনিতে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষাদীক্ষা কম, সামান্য গুটিকয় যে শিল্প কারখানা পূর্ব পাকিস্তানে তার মালিক সব অবাঙালি, আর এ অঞ্চলে বিত্তবৈভব যাদের ছিল সেই হিন্দু জমিদাররা তো দেশ ছেড়েই পালিয়েছেন। ফলে বুড়ো খোকারা লক্ষ্য করেন প্রায় এতিম এই পূৰ্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ওপর রীতিমতো জেকে বসেছে পশ্চিম পাকিস্তানিরা।
পাকিস্তানের জাতির পিতা কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর জীবনে ঢাকায় আসলেন শুধু একবার! এসেই বাধিয়ে দিয়ে গেলেন বিশাল খটকা। বললেন, জলাজংলার দেশের চাষাভুষাদের ভাষা বাংলা নয় আশরাফ মুসলমানদের ভাষা, নবাবদের ভাষা, কায়েদে আযমসহ পাকিস্তানের শাসকদের ভাষা অভিজাত উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তারপর সেই তো ৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারির কিংবদন্তি। রাজপথে সালাম, বরকত, জব্বারের রক্ত। প্রতি বর্ষায় ধুয়ে যায় ঢাকার রাস্তা তবু রক্তের দাগ মোছে না। শুরু হয় পাখির ডানা ভাঙ্গার আয়োজন।
মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই এই ছড়ায় আর কাজ হয় না। ইতিমধ্যে মারা গেলেন জিন্নাহ, খুন হলেন তার উত্তরসূরি লিয়াকত আলী খান। গণপরিষদে শুরু হলো সরকারি আর বিরোধী দলের তুমুল বাকবিতণ্ডা, মন্ত্রীরা সব একে একে পদত্যাগ করতে শুরু করলেন। পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ হয়ে উঠল যে একদিন পরিষদের অধিবেশনে চেয়ার ছুড়ে মেরেই ফেলা হলো ডেপুটি স্পিকারকে। পাকিস্তানের রাজনীতির এই লেজেগোবরে অবস্থায় সবাইকে শায়েস্তা করতে ক্যান্টনমেন্ট থেকে গোফ বাগিয়ে এসে শাসনভার হাতে তুলে নিলেন সেনাপতি আইয়ুব খান। সব রাজনৈতিক আলোচনা নিষিদ্ধ করে দিয়ে, বাংলার সব নেতাদের জেলের ভেতর পুরে আইয়ুব খানই হয়ে উঠলেন সর্বময় কর্তা। ধীরে ধীরে নিজের সুবিধামতো আবারও রাজনীতির দরজা খুললেন তিনি, সৈনিকের পোশাক খুলে নিজেই বানিয়ে নিলেন রাজনৈতিক দল, নির্বাচন করলেন, হয়ে বসলেন দেশের রাষ্ট্রপতি।
আইয়ুব খান তখন ডায়েরি লিখছেন। সে ডায়েরি আমরা পড়তে পেলাম তার মৃত্যুর বহু বছর পর। দেখলাম তিনি লিখেছেন, বাঙালিরা হচ্ছে ছোট মনের নিচু জাতের মানুষ।
তিনি এও লিখেছেন যে, বাঙালি মুসলমানরা বড় বেশি বাঙালি, যথেষ্ট মুসলমান নয়। মারমুখী, উদ্ধত, ক্রুর ভঙ্গিতে তিনি ইসলাম রক্ষার নামে বাঙালিদের দাবড়িয়ে বেড়াতে লাগলেন। বললেন, হিন্দু কবি রবীন্দ্রনাথের গান চলবে না। আইয়ুব খানের বাঙালি চামচারা লেগে পড়লেন বাংলা কবিতার মুসলমানী করবার কাজে; সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি হয়ে গেল ফজরে উঠিয়া আমি দিলে দিলে বলি, হররোজ আমি যেন নেক হয়ে চলি।
পূর্বের বাঙালিদের যখন মুসলমান বানানোর পায়তারা চলছে তখন ওদিকে কেবলই পাল্লা ভারী হতে থাকে। পশ্চিমের। পূর্ব পাকিস্তানের পাট, চা, চামড়া বিক্রির টাকায় সুরম্য হয়ে উঠতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি। সব শীর্ষ সামরিক অফিসার, সব শীর্ষ আমলা, প্ৰায় সব শীর্ষ সরকারি পদ, সব শীর্ষ ব্যবসাবাণিজ্য পশ্চিম পাকিস্তানিদের। বাঙালির ভাগ্যে তলানীর কাছাকাছি কিছু কাজ, অধস্তন কিছু পদ, উচ্ছিষ্ট কিছু ধন।
কিন্তু ঐ ছোট মনের নিচু জাতের মানুষেরা ঘুরে দাঁড়িয়েছে ততদিনে। আইয়ুব শাসনের বিরুদ্ধে তাড়া শুরু করে দিয়েছে তীব্র প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, আন্দোলন। চারদিকে স্লোগান, আইয়ুব শাহীর গাড়িতে আগুন জ্বালো একসাথে।
বাঙালির স্যুট টাই পরা ব্যরিস্টার নেতা নেই, নেই ইউনিফর্ম পরা জেনারেলও। তাড়া দাঁড়িয়েছে ফরিদপুরের গৃহস্থের ছেলে শেখ মুজিবর রহমানের পেছনে। দাঁড়িয়েছে সিরাজগঞ্জের দরিদ্র কৃষকের মাদ্রাসায় পড়া সন্তান মাওলানা ভাসানির পেছনে। দিনের পর দিন ধরে কি করে বেড়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের জৌলুশ আর পূর্ব পাকিস্তান হচ্ছে শ্মশান, জাদুকরী বক্তৃতায় সারাদেশ ঘুরে সে ইতিবৃত্ত সবাইকে শোনান শেখ মুজিব। অসাধারন বক্তা তিনি। কোথাও বক্তৃতা দিতে দাড়ালে তাঁর চারপাহসে দাঁড়িয়ে যায় হাজার, লক্ষ মানুষ। বাঙালিদের দীর্ঘদিনের নানা দাবিকে শেখ মুজিব চুম্বক আকারে ছয়টি দফায় পরিণত করে আন্দোলন করেন স্বায়ত্তশাসনের। তাঁর কণ্ঠ রুদ্ধ করবার জন্য তঁকে জেলে পুরে দেয় পাকিস্তানি শাসক। কিন্তু জনগণের তীব্র দাবির মুখে তাকে ছেড়ে দিতেও বাধ্য হয় অ্যাবার। দিকে দিকে শ্লোগান ওঠে জেলের তালা ভেঙ্গেছি, শেখ মুজিবকে এনেছি।
অন্যদিকে গ্রামে গ্রামে দাপিয়ে বেড়ান মাওলানা ভাসানী। উত্তপ্ত করে রাখেন কৃষকদের বিশাল সমাবেশ। কৃষকরা সব লাল টুপি পড়ে জমায়েত হয়ে ধূলায় ধূলিময় করে তোলেন গ্রামের জনপদ। হরতাল ডেকে তিনি বন্ধ করে দেন গ্রামের হাট। জোতদার, পুঁজিপতিদের গদিতে আগুন লাগিয়ে দিতে বলেন তিনি। তালের টুপি মাথায় দিয়ে লুঙ্গি, পাঞ্জাবি পড়ে শ্লোগান দিতে দিতে তিনি এগিয়ে চলেন মিছিলের সামনে। ঘেরাও করেন গভর্নরের অফিস। এগিয়ে আসা আইয়ুব খানের পুলিশের রাইফেল খামচে ধরে তিনি বলেন, খামোস। বিদেশি পত্রিকা তার নাম দেয় ‘রেড মাওলানা’ বলে ‘প্রফেট অব ভায়ওল্যান্স’।
পাশাপাশি তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলে ছাত্ররাও। শেখ মুজিবের ছয় দফার পাশাপাশি তারা তুলে ধরে এগারো দফা দাবি। দাবি তোলে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাৰ্থ বিরোধী শিক্ষা ব্যবস্থা বাতিলের, দাবি তোলে স্বায়ত্তশাসনের। আন্দোলন বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতির অঙ্গনেও। রবীন্দ্রনাথকে সংগ্রামের হাতিয়ার করে তোলে ছায়ানট। হরতাল, মিছিল, শ্লোগানে তখন উত্তপ্ত সারাদেশ।
ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া খটকার দেশ পাকিস্তান তখন নড়বড়ে। একটা কোনো চূড়ান্ত পরিণতির অপেক্ষায়। এক দশক দাপটে শাসনের পর অবশেষে ছোট মনের নিচু জাতের বাঙালিদের তীব্র প্রতিবাদ আর আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন আইয়ুব খান। ক্ষমতা ছেড়ে দেন আরেক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতে।
১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট জিন্নাহ আর মাউন্টব্যাটনের লাঞ্চের মধ্য দিয়ে দুই টুকরো দেশের যে বেতাল নাটকের সূচনা হয়েছিল তার শেষ অঙ্ক অভিনীত হচ্ছিল ১৯৬৯-এর আগস্টে যখন নবদম্পতি লুৎফা আর তাহের ট্রেনে চেপে চলছেন ময়মনসিংহের ধান ক্ষেত পেরিয়ে। পেছনের এই গল্প না জানলে তাহের আর লুৎফার গল্পও ঢাকা থাকবে মেঘে।
০৪. মেজরের গোপন মুখ
ট্রেনের ভেতর চলছে তুমুল তর্ক। ইয়াহিয়া খান নামে যে নতুন জেনারেল ক্ষমতায় বসলেন তিনি কি ইল্রকশন দেবেন নাকি আইয়ুব খানের মতোই মার্শাল ল দিয়ে গদিতে বসে থাকতে চাইবেন?
এ নিয়ে উত্তপ্ত আলাপ চলছে মতিয়া চৌধুরী, মোজাফফর আহমদ আর তাঁদের সঙ্গীদের মধ্যে। ময়মনসিংহে এক সাংগঠনিক সভা করে ফিরছেন তারা। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছাত্ৰ সংগঠন যখন মস্কো আর চীনের দ্বন্দ্বে বিভক্ত, তখন মতিয়া যোগ দিয়েছেন মস্কোপন্থীদের দলে। তুখোড় বক্তা তিনি, লোকে তাঁকে বলে অগ্নিকন্যা। অন্যদিকে মাওলানা ভাসানীর দল থেকে বেরিয়ে মোজাফফর আহমদ গড়েছেন ন্যাপের নিজস্ব দল। ব্যঙ্গবিদ্রূপ মেশানো বক্তৃতায় তিনিও মাতিয়ে রাখেন সভা।
লুৎফা নীরব শ্রোতা। তাহের আগ্রহের সঙ্গে শোনেন তাদের আলাপ।
মোজাফফর আহমেদ রসিকতা করে তাহেরকে বলেন : এই যে মেজর সাহেব, আপনাদের এক জেনারেল তো ল্যাজ গুটাইয়া পালাইয়াছে, এই জেনারেলের ল্যাজে কিন্তু আমরা ঘণ্টা বাঁধিয়া দিব, যাহাতে পালাইবার সময় সবাই খবর পায়।
তাহের হাসে।
মতিয়া চৌধুরী অভিযোগের সুরে তাহেরের কাছে জানতে চান : আপনারা বাঙালি অফিসাররা আর্মিতে বসে কি করছেন বলেন তো?
তার সদ্য বিবাহিত স্বামী বেশ একটু চাপের মধ্যে পড়েছে দেখে অস্বস্তিবোধ করেন লুৎফা। কিন্তু তাহেরকে তেমন বিচলিত দেখায় না। মুখে মৃদু হাসি নিয়ে তিনি বেশ ধীরশান্ত ভঙ্গিতেই বলেন : বাঙালি আর্মি অফিসারদের মধ্যেও কিন্তু প্রচুর ক্ষোভ আছে, একটা কিছু চূড়ান্ত ঘটলে সবাই না হলেও অনেক অফিসারই বাঙালির পক্ষে এসে দাঁড়াবে। কিন্তু ইলেকশন কি হবে? আপনাদের কি মনে হচ্ছে?
মোজাফফর বলেন : সে তো নির্ভর করছে আপনার জেনারেলের ওপর।
তাহের : জেনারেল তো চাইবে ইলেকশন যতক্ষণ ঠেকিয়ে রাখা যায়।
মতিয়া চৌধুরী : ইলেকশন নিয়ে তাল বাহানা করলে আরও রক্ত ঝরবে।
তাহেরঃ কিন্তু মাওলানা ভাসানী তো ইলেকশন নিয়ে তেমন ইন্টারেস্টেড নন।
মোজাফফরঃ না, না, ভাসানীর ঐ জ্বালাও পোড়াও করলে তো হবে না। এখন একটা নিয়মতান্ত্রিক ইলেকশনে যেতে হবে।
মতিয়া মোজাফফরকে সমর্থন করে বলেন : বরং শেখ মুজিব যে গণআন্দোলনের পরিবেশ তৈরি করেছেন আমাদের এখন সেটিকেই সমর্থন করা দরকার।
হুইসেল বাজিয়ে চলে ট্রেন। এক অচেনা মেজরের সঙ্গে কথা বলেন সে সময়ের তুখোড় দুই রাজনীতিক। তাহের বলেনঃ কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচন দিয়ে কি আপনাদের লক্ষ্য অর্জন হবে? আমি তো জানি আপনারা কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করতে চান। আওয়ামী লীগের যে ছয় দফাকে আপনারা সমৰ্থন করছেন তার মধ্যে কিন্তু শ্রমিক, কৃষকের কথা নেই।
মোজাফফরঃ আপনাকে বুঝতে হবে যে এখন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরাই আমাদের প্রধান শত্ৰু, আগে তাদের হটাতে হবে তারপর শ্রমিক কৃষকের কথা ভাবা যাবে এবং নির্বাচনের মধ্য দিয়েই তাদের হটাতে হবে। চীনাপন্থীদের মতো এখনই শ্রেণীশত্রু খতম করার আওয়াজ তুললে তো হবে না।
তাহেরঃ কিন্তু চীনপন্থীরা তো মনে করেন বাঙালি অবাঙালি স্ট্রাগলটাকে একটা ফলস স্ট্রাগল। আসল হচ্ছে ক্লাস স্ট্রাগল। আর সংঘাত, সহিংসতা ছাড়া তো ক্লাস স্ট্রাগল হয় না।
মোজাফফর; শোনেন মেজর সাহেব, টাইমটাকে আপনার বুঝতে হবে। ক্লাস স্ট্রগল আর কমিউনিজম ঠেকানোর জন্য ক্যাপিটালিস্টরা বসে আছে, ওরা এখন আগের যে কোনো সময়ের চাইতে শক্তিশালী। ওদের হাতে এখন অ্যাটোমিক পাওয়ার। খামোখা সংঘাতে জড়িয়ে গেলেই তো চলবে না। আমি তো মনে করি মস্কোর নেতারা যে বলছেন এখন কৌশলে পুঁজিবাদী দেশগুলোর সঙ্গে শাস্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রাখতে হবে সেটা ঠিক। তাছাড়া শুধু শ্ৰমিক, কৃষকদের নিয়েই সংগ্ৰাম করতে হবে, সেটা তো না। দেশের মঙ্গল চায় এমন মধ্যবিত্ত, বুৰ্জ্জুয়া সবাইকে নিয়েই সংগ্ৰাম করতে হবে। সংঘাত ছাড়াই রক্তপাতহীন বিপ্লব ঘটানোর সময় এসেছে এখন।
তাহেরঃ তবে আপনারা যেমন শেখ মুজিবের পেছনে আছেন, চীনাপন্থীদের তো দেখছি সবাই দাঁড়িয়েছেন মাওলানা ভাসানীর পেছনে। আপনি নিজেও তো দীর্ঘদিন ভাসানীর সঙ্গে কাজ করেছেন।
মোজাফফরঃ তা করেছি। কিন্তু উনি তো নানা কনফিউশন তৈরি করেন। আমরা এখন আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি। সিক্সটি ফাইভের ওয়ারে চীন যখন আইয়ুব খানকে সাপোর্ট করল উনি উল্টে গেলেন। যেহেতু তিনি চীনের পক্ষে আর চীন নিয়েছে আইয়ুব খানের পক্ষ ফলে উনি বললেন আইয়ুব খানের ইন্টারনাল পলিসি খারাপ হলেও ফরেন পলিসি ভালো। এসব কপ্নট্রাডিক্টরি কথার কারণে আমি বেরিয়ে এসেছি। এখন আবার তিনি ভোটের আগে ভাত চাচ্ছেন, জোতদারের গাদিতে আগুন লাগিয়ে দিতে বলছেন। এভাবে তো হবে না। আগে নিৰ্বাচনের মাধ্যমে আমাদের দরকার প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, দরকার আইয়ুব সরকারের পতন, দরকার একটা ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক গভর্নমেন্ট। এরপর আমরা সোসালিস্ট মুভমেন্টের দিকে যাব।
তাহেরঃ কিন্তু পাকিস্তান কাঠামোর মধ্যে থেকে, আওয়ামী লীগের মতো একটা বুৰ্জ্জুয়া দলের নেতৃত্বে ন্যাশনাল গভর্নমেন্ট ফর্ম করে আপনারা কি আলটিমেটলি সোসালিজম কায়েম করতে পারবেন বলে মনে করেন?
কথায় যোগ দেন মতিয়াঃ রিস্ক তো আছেই। কিন্তু মানুষের পালসটা তো বুঝতে হবে। অধিকাংশ মানুষ এখন এটাই চায়। আমরা জানি শেখ মুজিব কমিউনিস্ট নন, কিন্তু তিনি দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী নেতা, তার দল আওয়ামী লীগও সমাজতান্ত্রিক দল না। তবু তারা সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়! আপনি জানেন যে, এখন ওপেনলি কমিউনিজমের কথা বলা সম্ভব না। এই গভর্নমেন্ট কমিউনিস্টদের ইসলামের শক্রি ঘোষণা করেছে। দেদারসে জেলে ঢুকাচ্ছে। আমাদের এখন এদের সঙ্গেই কাজ করতে হবে।
তাহেরঃ সে অর্থে মাওলানা ভাসানীও কমিউনিস্ট না। অথচ চীনাপন্থীরা ভিড়েছে তার পেছনে। আপনারা তো মস্কোপন্থী আর চীনাপন্থী করে নিজেদের এভাবে বিভক্ত করে রেখেছেন।
মোজাফফরঃ মেজর সাহেব আপনি তো পলিটিক্সের বেশ খবর রাখেন বলে মনে হচ্ছে। আপনার কি মনে হয় বলেন।
লুৎফা জানালা দিয়ে দূরে হলুদ সরিষা ক্ষেত দেখলেও কান পেতে আছেন কামরার ভেতরের আলাপে। ক্লিন শেভড, কালো গোঁফের আড়ালে মৃদু হাসি নিয়ে মেজর তাহের বলতে থাকেন : আমার তো তো মনে হয় আরও পথ আছে। যারা কমিউনিস্ট তাদের কি প্রয়োজন অকমিউনিস্ট লিডারের পেছনে যাওয়ার? নিজেদের লিডারশীপে পূর্ব পাকিস্তানকে পুরোপুরি স্বাধীন করে একটা কমিউনিস্ট স্টেট করে ফেলা যেতে পারে। এমনিতে সেটা হবে না। পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধে নামতে হবে। সেই যুদ্ধকে গ্র্যাজুয়ালি একটা সোসালিস্ট রেভুলিউশনের দিকে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে।
মোজাফফরঃ ইয়াংম্যান, ক্যান্টনমেন্টে থাকেন তো তাই মাথায় আপনাদের সবসময় যুদ্ধ। কিন্তু এ মুহূর্তে ওসব হঠকারী ভাবনা। টাইম ইজ নট রাইপ ফর দ্যাট।
রাজনীতি নিয়ে এই তরুণ আর্মি অফিসারের কৌতূহলী ভাবনা দেখে বেশ অবাক হন মোজাফফর এবং মতিয়া। অবশ্য তাদের জানবার কথা নয় যে, এই মেজরের রয়েছে আরেকটি গোপন মুখ। যে মুখ গভীর, গহীন রাজনীতিরই। ট্রেনের জানোলা দিয়ে দূরে হলুদ সরিষা ক্ষেত দেখছেন লুৎফা, জানেন না তিনিও।
০৫. যুথভ্ৰষ্টের দল
ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনে ঢাকায় ফিরে লুৎফা এবং তাহের ওঠেন কলাবাগান বশিরুদিন রোডে তাহেরের বড় ভাই আবু ইউসুফের বাসায়। পরদিন নাস্তার টেবিলে বসেছেন সবাই। নতুন বউ লুৎফার জড়তা তখনও কাটেনি। ইউসুফের স্ত্রী ফাতেমা বলেন : তাহের তুমি কিন্তু বিয়ের দিন গুলি টুলি ছুঁড়ে মেয়েটাকে একেবারে ভয় পাইয়ে দিয়েছেন।
তাহের : একটু আর্মি কায়দায় সেলিব্রেট করলাম। তাছাড়া কার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে একটু বুঝিয়ে দিতে হবে না, ভাবী?
ফাতেমাঃ তুমি আবার তোমার ইউসুফ ভাইয়ের মতো বিয়ের রাতে বৌকে মাও সেতুং-এর বই দাও নাই তো?
তাহের : ইউসুফ ভাই আপনাকে বাসর রাতে মাও দিয়েছিল নাকি? জানতাম না তো।
ফাতেমাঃ কি বলব, আমি এমন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম।
তাহেরঃ নট এ ব্যাড আইডিয়া। আগে জানলে আমিও একটা সঙ্গে নিয়ে যেতাম ঈশ্বরগঞ্জে।
ফাতেমাঃ তবে তোমরা যে সিরাজ শিকদারের সঙ্গে মিলে তোমাদের ঐসব মিটিং আর ট্রেনিং বন্ধ করেছ আমি কিন্তু খুব খুশি হয়েছি। তা না হলে কবে যে তুমি বিয়ে করার সময় পেতে!
তাহের : তা অবশ্য ঠিকই বলেছেন ভাবী, বিয়ে আর এ জনমে করা হতো। না। কিন্তু ট্রেনিংটা বন্ধ হয়ে যাওয়া আনফরচুনেট। আনোয়ার তুমি আরেকবার সিরাজের সঙ্গে কথা বলে দেখবে নাকি?
ইউসুফ বলেনঃ ওটা আর রিভাইব করার কোনো সম্ভাবনা দেখি না। আমি।
ভাইরা মিলে কি প্রসঙ্গে কথা বলছে সব? মনে মনে ভাবেন লুৎফা। কথার কোনো খেই না পেয়ে লুৎফা নাস্তার টেবিল ছেড়ে অন্য ঘরে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ায়; তাহের খপ করে লুৎফার হাত টেনে ধরে, বলেন; যাওয়া চলবে না, যে কথা আলাপ করছি সেটা তোমারও শোনা দরকার।
বাদশা তাহেরের হুকুম তামিল না করে উপায় থাকে না বেগম লুৎফার। বসে পড়েন আবার। তাহের এবং তার পরিবারের লোকজনেরা যে গড়পড়তা মানুষের মতো নন, তা লুৎফা একটু একটু করে টের পেয়েছেন আগেই। তাদের আলাপ সারাক্ষণ দেশ আর রাজনীতি নিয়ে। কিন্তু লুৎফা জেনে অবাক হন যে বিয়ের মাত্র সপ্তাহখানেক আগে কলাবাগানের বশিরুদ্দিন রোডের এই বাড়িতে বসেই তাহের আর তার ভাইয়েরা সিরাজ শিকদার নামের ঐ মানুষটির সঙ্গে মিলে রাজনীতিরই এক দুর্ধর্ষ অভিযানের প্রস্তুতি নিয়েছিল।
তাহের এবং তাঁর ভাইয়েরা তখন টগবগে তরুণ। আবু ইউসুফ একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন, তাহের আর্মিতে, ছোট ভাইয়েরা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। আপাতদৃষ্টিতে ছিমছাম মধ্যবিত্ত পরিবার। পঞ্চাশ ষাট দশকে এদেশে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত তরুণদের জীবন এগোচ্ছিল একটা নির্দিষ্ট গতিতে। দেশভাগের পর মুসলমানদের শিক্ষার সুযোগ বেড়েছিল। তরুণ তরুণীরা পড়াশোনা করছিল একটা সরকারি চাকরি পাবার লক্ষ্য নিয়ে। ডাক্তারী, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বার সুযোগও বেড়েছিল। অবসর কাটছিল ম্যাটিনি বা নাইট শো-তে সিনেমা দেখে। ১৯৬৫ এ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর পাকিস্তানে ভারতীয় ছবি আসা বন্ধ হয়ে গেল। সুচিত্রা, উত্তম বা অশোক কুমার, মধুবালার সিনেমার জায়গা নিলেন রাজ্জাক, কবরী বা মোহাম্মদ আলী, যেবার সিনেমা। কলকাতা রেডিও থেকে অনুরোধের আসরের সতীনাথ, শ্যামল মিত্রের গান শোনায় অবশ্য কোনো ছেদ পড়ল না। গলায় তখন তাদের গুন গুন গান আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে, সাত সাগর আর তেৱো নদীর পারে…। কার কারো সঙ্গী হয়তো বুদ্ধদেব বসু বা জীবনানন্দ দাশ।
কিন্তু এর মধ্যেও কিছু কিছু তরুণ চোরাস্রোতের মতো ধরেছিল অন্য এ পথ। তারা এই মধ্যবিত্তের ছক থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। তারা স্বপ্ন দেখছিল বিপ্লবের। পুরো সমাজটকে ভেঙ্গে একেবারে নতুন করে পড়বার। তারা স্বপ্ন দেখছিল কমিউনিজমের। কমিউনিজম তখন অনেক তরুণের কাছেই এক নিষিদ্ধ, রোমাঞ্চকর শব্দ; এ অঞ্চলে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ধারা চলে এসেছে। সেই বিশ শতকের গোড়া থেকেই। মাঝে দেশ ভাগ, কমিউনিস্ট শিবিরে মস্কো, চীন বিভেদ, পাকিস্তান সরকারের কঠোর কমিউনিস্ট বিরোধিতা সত্ত্বেও বিপ্লবের স্বপ্ন স্নান হয়নি তরুণদের মনে। দেশ বিদেশের বিপ্লবের খবর তখন তরুণদের কাছে। রাশিয়া আর চীনে তো বিপ্লব ঘটে গেছে সেই কবে। আমেরিকার মতো প্ৰতাপশালী কমিউনিস্ট বিরোধী দেশের একেবারে নাকের ডগায় বসে কিউবায় কমিউনিস্ট বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছেন তেত্রিশ বছরের তরুণ ফিদেল ক্যাস্ট্রে } কিউবায় সাফল্যের পর তার বন্ধু চে গুয়েভারা গেছেন বলিভিয়ার বিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে। এদিকে দেশের কাছে ভিয়েতনামে কমিউনিস্টরা হো চি মিনের নেতৃত্বে সে দেশের অর্ধেকটা দখল করে নিয়েছে। বার্মাতেও বেশ কিছু এলাকা দখল করেছে। কমিউনিস্টরা, গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে অন্য এলাকায়। লাওসেও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে কমিউনিস্ট পার্টি। ইন্দোনেশিয়ার বিশাল কমিউনিস্ট পার্টি এক আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে সে দেশের সরকারের কাছে। আশপাশের তৃতীয় বিশ্বের ছোটখাটো দেশগুলোতে এগিয়ে চলেছে কমিউনিজমের অগ্রযাত্ৰা ৷
উত্তরে, পশ্চিমে, পূর্বে চেনা, অচেনা জনপদের দুর্ভাগা মানুষেরা আশ্চর্য শক্তিতে তখন দ্রিমি দ্রিমি বাজাচ্ছে বিপ্লবের ঢাক। দূর থেকে ভেসে আসা সে ঢাকের শব্দে এদেশের অনেক তরুণেরও বুক কাঁপে। একটা বৈষম্যহীন, শোষণহীন আগামী পৃথিবীর স্বপ্ন দেখাচ্ছে কমিউনিজম। নানা দৈন্য, দুৰ্দশায় জর্জরিত দুঃখী একটি দেশ আমাদের। এদেশের অনেক তরুণকেই তাই কমিউনিজম টেনেছে চুম্বকের মতো, যেন কোনো জাদুর পাথর। পাথরের মন্ত্রবলে যুথভ্রষ্ট হয়েছে তারা। পড়াশোনা, চাকরির বাধা পথ ছেড়ে ধরেছে অজানা, বিপদসঙ্কুল পথ।
তাহের এবং তার ভাইরা কমিউনিজমের ঘোর লাগা সেইসব যুথভ্রষ্ট তরুণদের দলে। বিয়ের মাত্র সপ্তাহ খানেক আগে তাহের, বড় ভাই আবু ইউসুফ, ছোট ভাই আনোয়ার আর সিরাজ শিকদার মিলে কলাবাগান বশিরুদ্দীন রোডের ওই বাড়িতেই অনতারণা করেছিল চোরাগোপ্তা এক দুঃসাহসিক বিপ্লবী মিশনের।
ইউসুফের স্ত্রী ফাতেমা বলেন : বুঝলে লুৎফা এরা তো সব ঘরের ভেতর রীতিমত যুদ্ধের ট্রেনিং দেওয়া শুরু করেছিল। কমিউনিস্ট বিপ্লব নাকি করবে। ভাগ্যিস ওই সিরাজ লোকটার সাথে একটা গণ্ডগোল বাধল, তা না হলে তোমার আর এ বাড়িতে আসা হত না।
লুৎফার বাবা বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, লুৎফা নিজে কলেজে থাকতে মতিয়া চৌধুরীর দল করেছেন। ফলে এ জগতটা তার কাছে নতুন নয়। লুৎফা ঘোমটা ঠিক করতে করতে জিজ্ঞাসা করেন; সিরাজ শিকদার কে?
তাহের বলেন : ইঞ্জিনিয়ার, খুবই ব্রিলিয়ান্ট সন্টুডেন্ট। মেনন গ্রুপে ছিল, মাওইস্ট। কিন্তু ওদের সাথে বনিবন্যা হয়নি। দল থেকে বেরিয়ে এসে কিছু ছেলে নিয়ে একটা রিডিং সার্কেল তৈরি করছিল। তার সাথে আমাদের চিন্তু মিলে গিয়েছিল, দুজনে মিলে শুরু করেছিলাম ট্রেনিং।
লুৎফা বলেন : কিসের ট্রেনিং?
লুৎফর আগ্রহ দেখে উৎসাহিত হয়ে ওঠে তাহের, বলেন; মনে আছে ট্রেনে মোজাফফর ভাইকে বলছিলাম পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধে নামার কথা, সেই যুদ্ধকে গ্র্যাজুয়ালি একটা সোসালিস্ট রেভুলিউশনের দিকে নিয়ে যাওয়ার কথা?
লুৎফা : হ্যাঁ, এরকমই তো কি যেন একটা বলছিলে।
তাহেরঃ সেই প্ল্যানই করছিলাম। আমরা। সিরাজ শিকদার আর আমি মিলে কিছু ইয়াং ছেলেদের ট্রেনিং দিচ্ছিলাম। এই রকম একটা যুদ্ধের প্রিপারেশন নিতে। সিরাজ পলিটিক্যাল ক্লাস নিত আমি শেখাতাম আনকনভেনশনাল যুদ্ধের কৌশল।
লুৎফা : কিন্তু আর্মিতে থেকে এভাবে বাইরের লোকদের ট্রেনিং দেওয়া যায়?
আনোয়ারঃ ভাবী আপনি তো জানেন না, তাহের ভাই কিন্তু আর্মি থেকে ছুটিতে এসে আমাদেরও মিলিটারি ট্রেনিং দিতেন। আমাদের সব ভাইবোনকে। আমাদের একটা ফ্যামিলি বিপ্লবী স্কোয়াড আছে! আপনার সব দেবর, ননদেরা কিন্তু বোমা বানাতে পারে, গেরিলা যুদ্ধের টেকনিক জানে।
ইউসুফ বলেন; বুঝলে লুৎফা কঠিন জায়গায় এসে পড়েছি, সব বিপ্লবীর দল; বিপদ আছে কিন্তু তোমায়।
মুচকি হাসে লুৎফা।
তাহের বলেনঃ সিরাজ শিকদারের সঙ্গে মিলে এ ট্রেনিংটা দেবার জন্য আর্মি থেকে লম্বা ছুটি নিয়েছিলাম। অনেক বড় প্ল্যান ছিল। কথা ছিল ছেলেরা ট্রেনিং নিয়ে চলে যাবে চিটাগাং হিলস্ট্রাকসের বান্দরবানে, সেখানে তারা ঘাঁটি গড়ে তুলবে। যোগাযোগ করা হবে বার্মার কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। চিতাগাং ক্যান্টনমেন্টের আমার কমান্ড সিপাইদের ষ্ট্রেনিংএর জন্য প্রায়ই আমাকে যেতে হয় বান্দরবানে। ঠিক করেছিলাম, সুযোগমতো আমি আর্মি ছেড়ে দিয়ে আমার কমান্ডো ট্রুপ নিয়ে আর্মসসহ যোগ দেবো বান্দরবানের তরুণ বিপ্লবীদের সঙ্গে। বান্দরবান এরিয়াকে মুক্ত ঘোষনা করা হবে, সেখান থেকে শুরু হবে গেরিলা যুদ্ধ।
নতুন বউকে বিপ্লবের গল্প বলতে শুরু করেন। তাহের। লুৎফা লক্ষ করেন অন্য কনো আলাপের চাইতে এ আলাপেই তিন ভাইয়ের সমান আগ্রহ। ঘটনাটি জানতে তিনিও কৌতূহলী হয়ে ওঠেন : কি হলো তারপর? ট্রেনিং বন্ধ হলো কেন?
ফাতেমা বলেনঃ সে অনেক লম্বা কাহিনী। আরেকদিন শুনো; আজকে তো তোমাদের মোহাম্মদপুরে দাওয়াত। দাওয়াত খেয়ে আস।
তাহেরঃ ভাবী, দাওয়াতের পোলাও খেতে খেতে তো এখন পেটের অবস্থা খারাপ। অবশ্য ঠিকই বলেছেন, আরিফ ভাইয়ের দাওয়াত তো আর মিস করা যাবে না। লুৎফা কুইক রেডি হয়ে নাও।
০৬. নোনা দরিয়ার ডাক
নক্ষত্রের ইশারায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স ফ্যাকাল্টির করিডরে বুকে বই চেপে হেঁটে বেড়ানো লুৎফার সঙ্গে বিয়ে হলো ক্যান্টনমেন্টে লেফট রাইট করে বেড়ানো মেজর তাহেরের। খাকি পোশাক পড়া, রাইফেল কাঁধে সামরিক মানুষের ছবি দেখেছে লুৎফা কিন্তু এমন একজন মানুষের সঙ্গে ঘর করতে হবে ভাবেনি কখনো। বিয়ের রোমাঞ্চ ছাপিয়ে একটা অজানা আশঙ্কা তাই নিরস্তুর ভর করে ছিল লুৎফাকে। বান্ধবীরা বলেছিল, দেখিস, মিলিটারি মেজাজ বলে কথা!
কিন্তু এ কয়দিনে তাহের তাঁর উষ্ণতা দিয়ে মুছে দিয়েছে লুৎফার আশঙ্কা। প্রমাণ করেছে সে প্রেমিকও বটে। কিন্তু ইতিমধ্যে উন্মোচিত হয়েছে অনিশ্চয়তার অপ্রত্যাশিত এক জানালার। লুৎফা ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি তাঁর সঙ্গে কিনা পরিচয় হবে এক ছদ্মবেশী ঘোর বিপ্লবীর।
পরদিন সকালে ইউসুফ গেছেন অফিসে। তাহেরও বেরোন একটা কাজে। যাবার সময় আনোয়ারকে বলেনঃ তুমি তমাদের টেকনাফ মিশনের গল্পটা শোনাও তোমার ভাবীকে। ওর জানা দরকার।
লুৎফাকে বলেন : তুমি আনোয়ারের সাথে গল্প করো, আমি ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই চলে আসছি;
ইউসুফের স্ত্রী ফাতেমা ঢোকেন রান্নাঘরে। আর মেহেদী রাঙা হাতে ঘোমটা ঠিক করতে করতে নতুন বউ লুৎফা বসে দেবর আনোয়ারের কাছে বিপ্লবী অচ্যুত্থানের গল্প শুনতে। আনোয়ার তারই ডিপার্টমেন্টের জুনিয়র ছাত্র। ডিপার্টমেন্টে দেখা হয়েছে দু-একবার কিন্তু আলাপ হয়নি কখনো; এখন সে তার ঘরের মানুষ।
আনোয়ার বলেনঃ ঐ যে সিরাজ তালুকদারের কথা বলছিলেন তাহের ভাই, তাঁর সাথে যোগাযোগ হয়েছিল আমারই মাধ্যমে। আমি তখন পড়ি তেজগাঁওয়ের সরকারি বিজ্ঞান কলেজে। কলেজের হোস্টেলে থাকি। সেখানে আমার সঙ্গে পড়ত রাজীউল্লাহ আজমী। উর্দু স্পিকিং। ওর বড় ভাই সানীউল্লাহ আজমী আমাদের এক বছর সিনিয়র। উনিও থাকেন হোস্টেলে। ওরা দুই ভাই কিন্তু মনে হবে যেন দুই বন্ধু। সবসময় একসঙ্গে। ওদের বাড়ি ইন্ডিয়ার উত্তর প্রদেশ, ঘরে ওরা কথা বলে উর্দুতে। বাবা স্টেশন মাস্টার। উত্তর প্রদেশে থেকে এদেশে এসেছিলেন বদলি হয়ে আর ফিরে যাননি। আমাদের বাবাও স্টেশন মাস্টার, লাইফ কেটেছে স্টেশনে। এসব নিয়ে গল্প করতে করতেই ওদের সাথে ঘনিষ্ঠতা হয়ে গিয়েছিল। দেখতাম পড়াশোনার বাইরে দুই ভাইয়ের ধ্যান, জ্ঞান হচ্ছে রাজনীতি। ওদের রুমের ভেতর মার্ক্স, লেনিন, মাও সে তুং-এর বই ভরা। দুভাই বসে বসে বিদেশি নানা পত্রিকা থেকে কঠিন সব রাজনৈতিক প্ৰবন্ধ অনুবাদ করে। একদিন জিজ্ঞাসা করলাম : অনুবাদ করছি কোথাও ছাপাবার জন্য?
রাজীউল্লাহ খানিকটা উর্দু টানে বলে; না, না, আমাদের একটা রিডিং সার্কেল আছে। এগুন সেখানে ডিসকাশন হোবে। পরে ওদের কাছ থেকে জানতে পারলাম। ওদের একটা গোপন পাঠচক্ৰ আছে যার নাম মাও সে তুং চিন্তাধারা গবেষণাগার। ঐ পাঠচক্র থেকে একটা পত্রিকা বেয়া করে ওরা লাল ঝাণ্ডা নামে সেটাও দেখালো। ওদের নেতাই হচ্ছে সিরাজ শিকদার। রাজীউল্লাহ আর সানী উল্লাহর সারাক্ষণ চিন্তা কি করে বাঙালির মুক্তি আসবে। বলে বাঙালিরা যতই আইয়ুব খানের এগেইনস্টে আন্দোলন করুক না কেন কমিউনিস্ট রেভুলেশন ছাড়া তাদের মুক্তি আসবে না।
লুৎফা বলেন : ওরা না বললে উর্দু স্পিকিং, বাঙালিদের নিয়ে এত চিন্তা?
আনোয়ার : সেটাই তো ইন্টারেস্টিং। দুই ভাইই সিরাজ শিকদারের খুব ঘনিষ্ঠ। সিরাজ শিকদার ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির ছাত্র ইউনিয়নের বড় নেতা ছিলেন। ছাত্র ইউনিয়ন যখন মতিয়া, মেনন গ্রুপে ভাগ হয়ে গেল সিরাজ গেলেন মেননের দলে। ভাবী আপনি তো মাতিয়া আপনার সাথে কাজ করেছেন?
লুৎফা : হ্যাঁ, মেনন ভাইরা তো শেখ মুজিবকে সাপোর্ট করলেন না, ভাসানীর সঙ্গে গেলেন। বাঙালিদের স্বায়ত্ত্বশাসনের আন্দোলনের সঙ্গে তো উনারা থাকলেন না।
আনোয়ারঃ এই পয়েন্টেই কিন্তু সিরাজ শিকদার মেনন ভাইদের কাছ থেকে সরে আসেন। সিরাজ মুজিবের পক্ষেও গেলেন না, ভাসানীর পক্ষেও না। নিজের একটা পথ বের করার জন্য শুরু করলেন পাঠচক্র। তো আমিও রাজীঊল্লাহোকে জানালাম যে, আমাদের পুরো ফ্যামিলিও সবাই কমিউনিজমে বিশ্বাসী। বললাম যে, আমাদের ভাই আর্মি থেকে এসে আমাদের গেরিলা ট্রেনিং দেন। আমাদের একটা ফ্যামিলি রেভুলেশনারী স্কোয়াড আছে এইসব। শুনে ঐ দুই ভাইও খুব কৌতূহলী হলো। বলল আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবে সিরাজ শিকদারের সাথে। একদিন গেলাম ওদের সাথে।
লুৎফাঃ তাহের তোমাদের আবার গেরিলা ট্রেনিং দিত কি?
আনোয়ার : ছুটিতে বাড়িতে এলেই স্টেশনের পাশের মাঠে তাহের ভাই ফল ইন করাতেন। আমি, সাঈদ ভাই, শেলী আপা, বাহার, বেলাল। আমাদের কমান্ডো প্যারা পিটি শেখাতেন, শেখাতেন কিভাবে খালি হাতে শক্ৰকে কাবু করা যায়। বোমা বানানোর ফর্মুলাও শেখাতেন। লোকজনরা অবাক হয়ে দেখত, ভাই-বোনের দুই হাতে দুই ইট নিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে।
লুৎফা : তোমাদের কেন ট্রেনিং দিত এসব?
আনোয়ার : তাহের ভাই বলতেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে একটা যুদ্ধ হবে, আমাদের সে যুদ্ধে জয়েন করতে হবে।
লুৎফা; ও! তো সিরাজ শিকদারের কথা কি যেন বলছিলে?
আনোয়ায় : হ্যাঁ, একদিন রাজীউল্লাহ আর সামীউল্লাহর সাথে গেলাম সিরাজ শিকদারের সাথে দেখা করতে। মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার কাছে একটা টিনের ঘরে ওরা বসে। সেখানে পরিচয় হলো সিরাজ শিকদারের সঙ্গে। স্মার্ট মানুষ, কথা বলেন সুন্দর। আরও গোটা দশেক ছেলে। গোপনে ওরা ওখানে বসে অনেক রাত পর্যন্ত মার্ক্সবাদ আলাপ করে। ঘরের ভেতর অল্প পাওয়ারের বাল্বের হলুদ আলো। সিরাজ শিকদার আমাকে তাঁর থিয়োরি বোঝালেন। উনি বললেন, আমি মাওইস্ট। কিন্তু আমাদের দেশের চীনাপন্থীদের দলে আমি নেই। ছিলাম একসময় কিন্তু আমি মনে করি তারা ভুল পথে যাচ্ছে। মাও-এর তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই বলা যায় যে, একটা সমাজে কোনো একটা বিশেষ সময়ে অনেক দ্বম্বের মধ্যে একটা থাকে প্রধান দন্দ্ব, বাকিগুলো অপ্রধান দন্দ্ব। চীনাপন্থীরা যে শ্রেণী-দ্বন্দ্বের কথা বলছে সেটা ঠিক আছে কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের এই গণআন্দোলনের মুহূর্তে শ্রেণী দ্বন্দ্ব হচ্ছে অপ্রধান দ্বন্দ্ব, বরং বাঙালি জনগণের সাথে পাকিস্তানি শাসকদের যে দ্বন্দ্ব সে দ্বন্দ্বই হচ্ছে প্রধান দ্বন্দ; বিপ্লবের জন্য তাই এই জাতীয়তার দ্বন্দুকে মোকাবেলা করতে হবে প্রথম। তবে মস্কোপহীরা যেভাবে জাতীয়তার দ্বন্দ্ব মোকাবেলার কথা বলছে, বৈঠক করে কিংবা নির্বাচন করে এই দ্বন্দ্ব ঘুচিবে না। দ্বন্দ্ব মেটাতে হবে সশস্ত্ৰ পথে। পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালিদের এই আন্দোলনকে একটা কমিউনিস্ট ওয়ারের দিকে নিয়ে যেতে হবে; এ জন্য মাও সে তুংয়ের দেওয়া রণকৌশল অনুযায়ী গ্রামে নিজেদের ঘাঁটি অঞ্চল তৈরি করতে সুবে এবং তারপর ধীরে ধীরে গ্রাম দিয়ে শহরকে ঘিরে ফেলতে হবে। আজমীদের কাছে শুনেছি তোমার আর্মস ট্রেনিং আছে। তুমি কি আসবে আমাদের সঙ্গে?
এসময় ইউসুফের স্ত্রী ফাতেমা চা নিয়ে আসেন। আনোয়ারকে বলেনঃ তোমাদের আর কোনো আলাপ নাই? এই নতুন বউটার সাথে এসব আলাপ শুরু করে দিলে? বুঝলে লুৎফা এরা ভাইগুলো সব একত্র হলেই শুরু হয় এই প্রধান দ্বন্দ্ব, অপ্রধান দ্বন্দ্ব এসব।
আনোয়ার বলেন : না ভাবী, তাহের ভাই বলে গেলেন এসব একটু জানিয়ে রাখতে। আর তাহের ভাইয়ের বউ কি পলিটিস্কের বাইরে থাকতে পারবেন? আমি একতু গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করে রাখছি আর কি।
ফাতেমাঃ দেখ আবার মাথাটা তোমাদের মতো খারাপ করে দিও না।
হাসেন লুৎফা। আনোয়ারকে বলেন : তারপর তোমাদের ঐ ট্রেনিংয়ের কথা বলো।
আনোয়ার চায়ে চুমুক দিয়ে বলতে থাকেন : না ভাবী, ঐ ট্রেনিংয়ের কথা বলবার আগে আরেকটু পেছনের কথা বলতে হবে। ঐ যে বলছিলাম সিরাজ শিকদারের সাথে পরিচয় হলো, তারপর তাকে তাহের ভাইয়ের কথা বললাম। বললাম। তার চিন্তা ভাবনার সঙ্গে আমাদের মিল আছে এবং সময় হলে তাঁর সঙ্গে একত্রে কাজ করব। কিছুদিন পর কলেজের পরীক্ষা দিয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়লাম। আমরা; আমি তো ভর্তি হলাম ঢাকা ইউনিভার্সিটির বায়োকেমিস্ট্রিতে, রাজীউল্লাহ জিওলজিতে। ওদিকে সানী উল্লাহ চলে গেল জগন্নাথ কলেজে। যোগাযোগ একটু বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল আমাদের মধ্যে! একদিন হঠাৎ রাজীউল্লাহ এসে উপস্থিত আমার ইউনিভার্সিটি হলো। আমাকে ডেকে নিয়ে গেল তোপখানা রোডের ইগলু আইসক্রিমের দোকানে। একটা টেবিলে বসে দুটা ভ্যানিলা আইসক্রিমের অর্ডার দিল সে; দুপুর বেলা তেমন ভিড় নাই। রাজীউল্লাহ বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল আনোয়ার, আমাদের প্রিপারেশন শেষ হয়েছে, এখোন আমরা মাঠে নামব। আমরা যাবো টেকনাফে। রাজীউল্লাহ বললো চিটাগাং বালুখালি টু টেকনাফ একটা রোড হবে যার প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার পোস্টে জয়েন করস্তে যাচ্ছেন সিরাজ শিকদার। তারা ঠিক করেছে। ঐ পাঠচক্রের ছেলেরা জয়েন করবে। তার সাথে। টেকনাফ হবে তাদের ঘাঁটি। ওখান থেকে বার্মার কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যোগাযোগ করবে এবং তাদের কানেকশনে যোগাযোগ করবে। চীনের পার্টির সঙ্গে। চীন থেকে আর্মস আনবে এবং তারপর শুরু হবে গেরিলা ফাইট। দরকার হলে বার্মার আরাকানে তারা শেলটার নেবে। } প্লাজীউল্লাহ জিজ্ঞাস করল। আমি তাদের সাথে জয়েন করব কিনা ৷
অনেক বড় সিদ্ধান্ত; বললাম, পরদিন জানাবো। ওদের সাথে জয়েন করা মানে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়া। আর পেছনে ফিরবার সুযোগ নাই। অনেক ভেবে সিদ্ধান্তু নিলাম চলে যাবে ওদের সাথে।
লুৎফা : ইউনিভার্সিটি ছেড়ে দিলে?
আনোয়ার : হ্যাঁ, বিপ্লবের পোকা তো মাথা ঢুকে আছে অনেক আগে থেকেই। মনে মনে সমসময় ভাবতাম পরাশোনা করে কি হবে, বিপ্লব করতে হবে। একতা সুযোগের অপেক্ষা করছিলাম। সে সুযোগ পাওয়া গেল।
লুৎফা : তাহেরকে জানালে?
আনোয়ারঃ না, ঠিক করলাম আগে ওদের সাথে যেয়ে দেখি কি পরিস্থিতি, তারপর তাহের ভাইকে জানাবো। পরদিন রাজিউল্লাহকে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলাম। শুরু হলো টেকনাফে যাবার প্রস্তুতি। ফান্ড যোগাড় করা হলো। আমি আমার ব্যাংকে জমানো স্কুল বৃত্তির টাকা সব তুলে দিয়ে দিলাম বিপ্লবী ফান্ডে। একজন ওর মায়ের হাতের সোনার বালা এনে জমা দিল। ফান্ডের টাকা দিয়ে হাতুড়ি, শাবল, স্ক্র ড্রাইভার, হেক স, হ্যান্ডারস্যাক, যেখানে সেখানে শুয়ে পড়বার জন্য মযাত ইতযাদি কেনা হলো। পতকার দোকান থেকে কাঁচামাল কিনে আমি তাহের ভাইয়ের শেখানো বিদ্যায় বানিয়ে ফেললাম কয়েকটা মলোটভ ককটেল। সবাই রেডি, দুই অবাঙালি ভাই রাজীউল্লাহ আর সানীউল্লাহ তো আছেই, রাকিব, মতি, রানা, মুজিব, এনায়েত, মুক্তা ঢাকা ইউনিভার্সিটি আর বুয়েটের এমনি আরও কজন সুন্টুডেন্ট মিলিয়ে মোট ১৫ জন। ট্রাঙ্কের ভেতর কিছু যন্ত্রপাতি, কয়েকটা বোমা আর মাও সে তুংএর লাল বই নিয়ে আমরা সব রেডি হয়েছি। চিটাগাং এ সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে যোগ দেব। পড়াশোনায় ইস্তফা, নেমে পড়ব বিপ্লবে।
চুড়ির শব্দ তুলে চায়ে চুমুক দিতে দিতে লুৎফা হেসে বলেন : এভাবে বিপ্লব হয় নাকি?
আনোয়ার : শুরুটা তো এভাবেই হয় ভাবী। হো চি মিন ভিয়েতনামোয় পাহাড়ে অল্প কজন সঙ্গী নিয়েই ভিয়েতমিন দল তৈরি করেছিলেন।
লুৎফা : তারপর কি হলো?
আনোয়ার : যেদিন চিটাগাংঙের ট্রেন ধরবার জন্য রেডি হচ্ছি সেদিন হঠাৎ ফজলুল হক হলে দাদা ভাই এসে উপস্থিত।
লুৎফ! : তুমি সাঈদের কথা বলছ?
আনোয়ার : হ্যাঁ, দাদা ভাই এসে রাজীউল্লাহর সঙ্গে আলাপ জমিয়ে বসে। আমি তো বাড়ির কাউকে জানাইনি। রাজীউল্লাহর সঙ্গে কথা বলে সব খবর নিয়ে নেন দাদাভাই। তারপর বলেন, আমিও যাব তোমাদের সঙ্গে। আমি বললাম, আপনার ব্যবসা? দাদাভাই তখন কি একটা ব্যবসা করবে বলে প্যাড ট্যাড ছাপিয়েছেন।
দাদা ভাই বলেন : রাখো তোমার ব্যবসা, ঐসব ব্যবসা কইরা কি হবে। তাহের ভাই কি শুধু তোমারে ট্রেনিং দিছে, আমারে দেয় নাই? আমি যামু তোমদের সঙ্গে।
দাদাভাইও চললেন আমাদের সঙ্গে।
লুৎফা : এভাবে হুট করে এসে রওনা দিয়ে দিল?
আনোয়ার : দাদাভাই এরকমই ক্ষেপাটে মানুষ, তুমিও দেখবে। তো আমরা সব উঠে পড়লাম চিটাগাংএর ট্রেনে।
দাদাভাই বললেন : আর কাউরে না বলি, মারে একটা চিঠি লিখা দেই। বুঝলেন ভাবী মা আমাদের জীবনে অনেক বড় একটা ব্যাপার। দাদাভাই পোস্টকার্ডে লিখলেন, দেশের কাজে যাচ্ছি। চিন্তা করবেন না।
লুৎফা : শুধু ঐটুকুই?
আনোয়ার : হ্যাঁ, মা ঐটুকু জানলেই খুসি হবেন আমরা জানতাম। ট্রেনের কামরায় এক বয়স্ক যাত্রী জিজ্ঞাসা করেন, তোমরা সব স্টাডি ট্যুরে যাচ্ছ বুঝি? আমি মনে মনে ভাবি, যদি জানতেন কোনো ট্যুরে যে যাচ্ছি!
শুনতে শুনতে আনোয়ারের এই গল্পে বেশ মজাই পেয়ে যায় লুৎফা। তাহের তখনও ফেরেননি। লুৎফা জানতে চান আনোয়ারদের টেকনাফ পর্ব।
আনোয়ার বলে চলেন : চট্টগ্রাম থেকে বাসে করে আমরা গেলাম বালুখালি। সেখানে দেখি একটা জীপ নিয়ে অপেক্ষা করছেন সিরাজ শিকদার। আমাদের নিয়ে টেকনাফের পাহাড়ি জঙ্গলের দুর্গম পথ ধরে এগিয়ে চলল জীপ। সবার মনে উত্তেজনা। মনে মনে সবাই তখন আমরা যেন এক একজন চে গুয়েভারা, ছুটে চলেছি বলিভিয়ার অরণ্যে। সবাই গিয়ে উঠলাম ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের গেস্ট হাউজে। আদিম প্রকৃতি, কাছেই নাফ নদী, প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করা কিছু স্থানীয় মানুষ, এর মধ্যে বিপ্লবের স্বপ্ন নিয়ে উপস্থিত হলাম আমরা কয়জন। গেস্ট হাউজে শুরু হলো আমাদের যৌথ জীবন। নিয়ম করা হলো এখন থেকে আর কারো কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকবে না, সব কিছুই যৌথ সম্পত্তি। টাকা পয়সা তো বটেই শার্ট, ঘড়ি এসবও। সব কিছু এক জায়গায় থাকবে, যখন যার প্রয়োজনমতো সেখান থেকে নিয়ে নেবে। রান্না করা, কাপড় ধোয়া, ঘর পরিষ্কার করা সবই নিজের পালা করে করব। পরদিন থেকেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম গ্রামে।
লুৎফাঃ এতগুলো ছেলে যে তোমরা গ্রামে ঘুরে বেড়াতে লাগলে,নিজেদের কি পরিচয় দিলে গ্রামের মানুষের কাছে?
আনোয়ার : বলতাম আমরা সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র, গবেষণা করতে এসেছি। লোকজনের সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে ধনী-গরিবের ব্যবধানের কথা বলতাম, বলতাম সমাজ পাল্টানোর কথা, পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার কথা। আমাদের কথা শুনে গ্রামের লোকেরা বলে আপনারা কি কাশেম রাজার লোক?
লুৎফা : কাশেম রাজা কে?
আনোয়ার : প্রথমে আমরাও বুঝতে পারিনি। পরে জানলাম নাফ নদীর ওপারেই কাশেম রাজা বলে এক লোক ছিল যে মারা গেছে কিছুকাল হলো। তাকে নিয়ে নানা কিংবদন্তি। সে ছিল অনেকটা ঐ এলাকার রবিন হুডের মতো। বড়লোকদের কাছ থেকে সম্পদ লুট করে বিলিয়ে দিত গরিবদের মধ্যে। ওদিকে আরাকানি কমিউনিস্ট গেরিলারাও মাঝে মধ্যে নাফ নদী পেরিয়ে এপারে চলে আসত আত্মগোপন করতে। এদের কাছ থেকেই স্থানীয় লোকেরা শুনেছে বিপ্লবের কথা। আমরা বরং খুশিই হলাম যে এখানকার লোকদের অন্তত এধরনের কথার সঙ্গে পরিচয় আছে। এখন দরকার এদের সংগঠিত করা। দরকার অস্ত্র। সিরাজ ভাই চেষ্টা করতে লাগলেন বার্মিজ কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগাযোগের।
মোক্তার বলে একজন লোকের সঙ্গে যোগাযোগ হলো আমাদের, যে নিজেকে বার্মিজ কমিউনিস্ট পার্টির আরাকান অঞ্চলের নেতা বলে পরিচয় দিল। মোক্তার প্রস্তাব দিল আমরা যেন আমাদের যা কিছু আছে সেসব নিয়ে আরাকানে গিয়ে কিছুদিন থাকি। তাতে করে আমরা ওখানকার কমিউনিস্ট গেরিলাদের কাছ থেকে আরও নানা অস্ত্র চালানো শিখতে পারব, বোমা বানাতে পারব এবং এদের সাথে মিলে অপারেশনের পিরকল্পনা করতে পারব। সিরাজ ভাই আমাদের বললেন, তোমরা তাহলে যেয়ে দেখো অবস্থাটা, আমি পরে যোগ দেব। একদিন গভীর রাতে নৌকায় চেপে নাফ নদী পাড়ি দিলাম আমরা। সঙ্গে করে নিলাম আমাদের বোমা বানাবার সরঞ্জামগুলো। অন্ধকারে গোলাবারুদ নিয়ে ছপ ছপ বৈঠা বেয়ে আমরা পার হচ্ছি কয়জন বিপ্লবী। আমাদের গাইড মোক্তার। নাফ নদীর ওপারে নৌকা থেকে নেমে বেশ কিছুদূর হেঁটে আমরা ঢুকে গেলাম বার্মার সীমান্তের ভেতর। অন্ধকারে ভালো দেখা যায় না। আমরা অনুসরণ করছি মোক্তারকে। একপর্যায়ে আমাদের সবাইকে পাহাড়ের এক গুহার মধ্যে নিয়ে বসালো মোক্তার। একটু পরেই আসছে বলে বেরিয়ে গেল সে, সঙ্গে নিয়ে গেল আমাদের বোমার বাক্সগুলো। তারপর আমরা একঘণ্টা বসে আছি মোক্তারের আর দেখা নাই।
লুৎফা : তোমরা তো ওখানকার পুলিশের হাতে ধরা পড়তে পারতে।
আনোয়ার : সেই ভয়েই তো ছিলাম। পরে দাদাভাই সাহস করে গুহা থেকে বেরিয়ে এসে এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলেন। দাদাভাই চিটাগাংঙে ভাষা কিছুটা পারতেন ঐ দিয়ে তাদের সাথে আলাপ করেন। ওদের কাছ থেকেই জানতে পারি যে, মোক্তার আসলে সীমান্ত এলাকার নামকরা একজন চোরাকারবারী এবং ডাকাত। আমাদের বোমার সরঞ্জামগুলো নেওয়াই ছিল তার উদ্দেশ্য। পরে এলাকার লোকেরা আমাদের সবাইকে খাইয়ে-দাইয়ে নৌকা করে আবার পৌঁছে দেয় নাফ নদীর এপারে।
লুৎফা : তোমাদের বিপ্লব তো তাহলে প্রথমেই ধাক্কা খেলো।
আনোয়ার : তা ঠিক। ফিরে এসে সবাই বেশ হতাশ হয়ে গেল। সিরাজ ভাই হাল ছাড়লেন না। বললেন, বার্মিজ কমিউনিস্ট পার্টির সাথে আমাদের যোগাযোগ করতেই হবে। এবার সবাই না যেয়ে একজন আমাদের পক্ষ থেকে একটা চিঠি নিয়ে যাবে আরাকানে। সে সেখানে থাকবে এবং ধীরে ধীরে সেখানকার কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগাযোগের পথ খুঁজে বের করবে। আরাকানের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ হলে সে সিরাজ শিকদারের পক্ষ থেকে চিঠিটা দেবে তাদের। সিরাজ ভাই আমাদের রাজনৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যা করে, তাদের সাহায্য চেয়ে একটা চিঠি লেখেন। বাংলায় লেখা চিঠিটা ইংরেজিতে অনুবাদ করল সানীউল্লাহ। ইংরেজিতে সেই সবচেয়ে ভালো। এখন কে যাবে এই চিঠি নিয়ে? কে এগিয়ে আসল জানেন? দাদাভাই।
লুৎফা : সাঈদের তো অনেক সাহস দেখা যাচ্ছে।
আনোয়ার : হ্যাঁ, ঐ মোক্তারের ঘটনা দাদাভাই যেভাবে ট্যাকল করেছেন তাতে দলের সবাই মুগ্ধ। কিভাবে কার সঙ্গে দেখা করবে কিছুই নির্দিষ্ট নেই। তবু ফররুক নামে আরাকানের মংডু এলাকার এক ছেলেকে সঙ্গে করে দাদাভাই আবার পাড়ি দিলেন নাফ নদী। এদিকে সিরাজ ভাই আমাদের বললেন আত্মগোপন করার জন্য গভীর জঙ্গলে একটা ট্রেঞ্চ তৈরি করতে। হায়দার আলী নামে এক কাঠুরিয়া আমাদের নিয়ে গেল দুর্গম জঙ্গলের ভেতরে, সেখানে পাহাড় কেটে আমরা বানাতে লাগলাম ট্রেঞ্চ, টানেল। পাহাড় কাটতে কাটতে কোনো কোনো দিন রাত হয়ে যেত। চাঁদের আলোয় দেখতাম পাহাড়ের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝরনায় পানি খাওয়ার জনা দল বেঁধে আসছে অজস্র বন্য হাতি। কেমন যেন অচেনা জগত মনে হতো।
বিপ্লবের নেশায় পাওয়া, নোমা দরিয়ার ডাকে সাড়া দেওয়া, চন্দ্রাহত এইসব যুবকদের গল্পে বেশ বুঁদ হয়ে যায় লুৎফা।
আনোয়ার বলে চলেন : বেশ কিছুদিন অধীর আগ্রহে থাকি আমরা সবাই। কিন্তু দাদাভাইয়ের আর কোনো খোঁজ নাই। সবাই ভাবে হয়তো দাদাভাই বার্মিজ বর্ডার ফোর্সের হাতে ধরা পড়েছে। এদিকে দলের ছেলেরা আধপেটা খেয়ে দিনের পর দিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে, শাবল, কোদাল দিয়ে পাহাড় কেটে সব ক্লান্ত। দলের অনেকেরই মনোবল ভাঙ্গতে শুরু করে। অস্ত্রশস্ত্র নাই, আরাকানের সঙ্গে যোগাযোগ নাই এভাবে আর কতদিন? আমার পরিশ্রম করার অনেক অভিজ্ঞতা আছে কিন্তু এরা সব অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে এত পরিশ্রম জীবনে কখনো করেনি। এরা শহরে ফিরে যাবার জন্য অস্থির হয়ে উঠল। সবার বাড়িতেও ইতোমধ্যে খোঁজ পড়েছে। একজন দুজন করে পালিয়ে যেতে লাগল দল থেকে। ফান্ডের টাকাতেও টান পড়তে শুরু করে। এর মধ্যে সিরাজ ভাইও এক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লেন। তার সঙ্গে বিরোধ বাধলো কোম্পানির কন্ট্রাক্টারদের। কন্ট্রাক্টাররা সেখানে নানারকম করাপশন করছিল, সিরাজ ভাই সেগুলো বাধা দিতে গেলে গণ্ডগোল বাধে। এক পর্যায়ে সিরাজ ভাইও সিদ্ধান্ত নেন চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় চলে যাবেন। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো সবাই আবার ঢাকায় ফিরে যাবে এবং আরও প্রস্তুতি নিয়ে নতুন করে সংগঠিত হবার চেষ্টা করবে।
লুৎফা : তাহলে তোমাদের বিপ্লবের ওখানেই শেষ? কিন্তু সাঈদের কি হলো?
আনোয়ার : হ্যাঁ, বলতে পারো আমাদের বিপ্লবের প্রথম তারাটা ঐ টেকনাফের জঙ্গলেই খসে পড়ল।
লুৎফা : কিন্তু সাঈদের কি হলো?
আনোয়ার : হ্যাঁ, সবাই চলে গেলেও আমি রয়ে গেলাম দাদা ভাইয়ের জন্য। ভাবলাম বিপ্লবের পথে যখন বের হয়েছি আর ফিরব না। চট্টগ্রামের ষোলশহরের আমিন জুটমিলের বস্তির এক চা দোকানে টেবিল বয় হিসেবে কাজ করলাম কিছুদিন, তারপর আবার চলে গেলাম টেকনাফ। সেখানে সেই হায়দার আলী কাঠুরিয়ার সঙ্গে মাছ মেরে, কাঠ কেটে দিন কাটাতে লাগলাম আর অপেক্ষা করতে লাগলাম সাঈদ ভাইয়ের জন্য। একদিন সত্যি সত্যি ফিরে এলেন সাঈদ ভাই আর সাথের সেই ফররুক। সেদিন খুব ঝড় বাদল। দাদা ভাইকে দেখে বুকের উপর থেকে একটা পাথর নেমে গেল আমার। তার কাছে শুনলাম জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় তারা ধরা পড়ে আরাকানি কমিউনিস্ট পার্টির লোকজনের হাতে। তারা দাদাভাই আর ফররুককে গুপ্তচর, সিআইএ-র লোক ভাবে। গভীর জঙ্গলে নিয়ে গুলি করে মেরে ফেলতে উদ্যত হয়। দাদাভাই অনেক সাহসী, ওদের সাথে তর্ক করেন–কেমন কমিউনিস্ট তোমরা, বন্দীকে আত্মপক্ষ সমর্থনেরও সুযোগ দাও না? পরে তারা দাদাভাইকে কথা বলার সুযোগ দেয়। উনি সবকিছু বোঝান ওদের, সিরাজ শিকদারের চিঠিটা দেন। শেষে ওরা কনভিন্সড হয়। পরে বার্মার কমিউনিস্ট সেই গেরিলাদের সঙ্গে মিলে দাদাভাই আরাকানের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বেড়ান। তখন আকিয়াব শহরের আশপাশের এলাকা পুরোপুরি কমিউনিস্টদের দখলে। সেখানকার গ্রামবাসীরাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে কমিউনিস্ট গেরিলাদের খাবার দাবার টাকা পয়সা দিচ্ছে। এসব দেখে দাদাভাই খুব উদ্বুদ্ধ হয়ে ফিরে আসেন। বার্মিজ কমিউনিস্টরা সহযোগিতা করবে তেমন প্রতিশ্রুতিও দেয় তাকে। কিন্তু এদিকে তো সব ওলটপালট হয়ে গেছে। দাদাভাই খুব হতাশ হলেন। শেষে আমরা ঠিক করলাম ঢাকায় ফিরব। হাতে ট্রেন ভাড়ার টাকাও নাই। আমার হাতঘড়িটা বিক্রি করলাম, ঐ টাকা দিয়ে টিকিট কিনে চলে এলাম ঢাকায়। অনেকদিন পর দেখা হলো তাহের ভাই, ইউসুফ ভাইয়ের সঙ্গে।
লুৎফা বলে : তোমরা যে এতসব কাণ্ড করে ফিরলে তোমাদের কেউ কিছু বলল না?
আনোয়ারঃ অনেক দিন চুল, দাড়ি না কেটে অদ্ভুত চেহারা হয়েছিল আমার। তাহের তাই দেখে বললেন, আনোয়ার তো দেখি পুরোদস্তুর গেরিলা হয়ে গেছে। আমাদের অভিজ্ঞতা শুনতে চাইলেন। না উনি রাগ করলেন না, বললেন, তাকে বলে গেলে ভালো হতো। সিরাজ শিকদারের সঙ্গে আলাপ করতে চাইলেন। আমাকে বললেন সুউনিভার্সিটিতে ফিরে যেতে, দাদাভাইকেও ব্যবসা শুরু করাতে বললেন। বললেন সময় মতো আবার মাঠে নামা যাবে। প্রায় এক বছর পর আবার ঢুকলাম বায়োকেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরিতে। দাদাভাইকে কিন্তু বিপ্লবের নেশা ছাড়ল না। উনি আবার কাউকে না জানিয়ে গোপনে বর্ডার ক্রস করে চলে গেলেন কলকাতায়। সেখানে তখন নকশালবাড়ি বিপ্লবীদের তোড়জোড়। দাদাভাই তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন, জেলও খাটলেন।
রান্নাঘর থেকে ফাতেমা আসেন এক ফাঁকে। বলেন, রান্না করতে করতে আমিও শুনছিলাম। আনোয়ারের এসব কাহিনী এত ডিটেইল কিন্তু আমিও জানতাম না। লুৎফা বুঝতেই পারছো কাদের মধ্যে এসে পড়েছ।
লুৎফা বলে : ওদের ঐ ট্রেনির এর গল্প তো এখনও শুনলাম না।
আনোয়ার : হ্যাঁ এবার ঐ পর্বটাতেই আসছিলাম।
ফাতেমা : এই পর্বটা আমি ভালোই জানি। সব তো হলো আমার বাসাতেই।
ফাতেমা আবার চলে রান্নাঘরে।
আনোয়ার বলেনঃ টেকনাফ থেকে ফিরে তো সব যার যার মতো ব্যস্ত হয়ে গেল। রাজীউল্লাহর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। সে আমাকে জানাতে যে ঢাকার বাইরেও ওরা সংগঠন করছে। ইতোমধ্যে তো আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান রিজাইন করল। একদিন রাজীউল্লাহ এসে বলল আমাকে আবার সিরাজ ভাই দেখা করতে বলেছেন। দেখা করলাম তার সঙ্গে। উনি বললেন মানুষ এখন অনেক জঙ্গি হয়ে উঠেছে, মানুষ পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার কথা বলছে, এ সুযোগটা আমাদের নিতে হবে। তুমি আবার একটা ঘাঁটি এলাকা ঠিক করো, আমরা আবার শুরু করব। এবার টেকনাফ না, চলে যাও বান্দরবান। আমাদের ঐদিকটাই থাকতে হবে কারণ আমাদের শেলটারের জায়গা সবসময় হবে বার্মা।
এবার ঠিক করলাম সেজ ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেবো সিরাজ শিকদারের। পুরো প্ল্যানিংএ তাহের ভাইকেও ইনভলব করব। উনি তখন চিটাগাং ক্যান্টনমন্টে। দুজনের সাথে কথা বলে ঠিক করলাম মিটিং হবে তাহের ভাইয়ের বন্ধু চট্টগ্রাম সরকারি সায়েন্স ল্যাবেরেটরির ফার্মাকোলজিস্ট ড. হাইয়ের বাসায়। তার বাসা চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের কাছেই, আর নিজেও তিনি কমিউনিস্ট। সেখানে দেখা হলো তাহের ভাই আর সিরাজ ভাইয়ের। একজন ইঞ্জিনিয়ার কমিউনিস্ট একজন আর্মির কমিউনিস্ট। অনেক রাত পর্যন্ত আলাপ হলো তাদের মধ্যে। দুজনের চিন্তার অনেক মিল। দুজনেই অনেকদিন থেকে একটা আর্মস রেভুলেশনের কথা চিন্তা করছেন। দেশের পরিস্থিতি তখন উত্তপ্ত। সিরাজ শিকদারের প্রথম উদ্যোগটা ফেইল করেছে। তিনি আবার কিছু ছেলে নিয়ে একটা আর্মস স্ট্রাগল শুরু করতে চান। তারা ঠিক করলেন এবার আরও ওর্গানাইজডভাবে এগোবেন। সিরাজ ভাইয়ের পাঠচক্রের বাইরের ছেলেদেরও নেওয়া হবে। তাহের ভাই তাদের গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং দেবেন আর সিরাজ শিকদার দেবেন পলিটিক্যাল ট্রেনিং। বলাতে পারে একজন মাও সে তুং আরেকজন মার্শাল চুতে, কিংবা ধরো একজন হো চি মিন আরেকজন জেনারেল গিয়াপ। একজন পলিটিকাল কমিশার, আরেকজন মিলিটারি কমিশনার। ঠিক হলো তাহের ভাই ট্রেনিং মডিউল তৈরি করবেন এবং তারপর একটা লম্বা ছুটি নিয়ে এসে ট্রেনিং দেবেন ছেলেদের।
সিরাজ শিকদার তাহের ভাইকে বললেন, আপনার দিক থেকে রিস্কগুলো ভেবে রেখেছেন তো? আর্মিতে কোনোভাবে যদি-ইনফরমেশন যায়।
তাহের ভাই বললেন, তাহলে ডেফিনিটলি আমাকে ফায়ারিং স্কোয়াডে নেওয়া হবে। রিস্ক নেব বলেই তো এখানে এসেছি। আই হ্যাভ বিন প্রিপিয়ারিং মাইসেলফ অল মাই লাইফ জাস্ট ফর দিস।
ইতোমধ্যে আমি ঘুরে এলাম বান্দরবান। বাসে চড়ে, পায়ে হেঁটে পৌঁছালাম বান্দরবানের রুমার মুরং পাড়ায়। ওখানে পৌঁছে মনে হলো টাইম মেশিনে চড়ে পিছিয়ে গেছি কয়েক শ বছর, চোখের সামনে যেন লুই মৰ্গনের সেই আদিম সমাজ। নারী পুরুষরা সব পাহাড়ে জুম চাষ করে ফলাচ্ছে জঙ্গলি ধনি, কাউন, পাহাড়ের উপত্যকা থেকে সংগ্রহ করছে ফল, সবজি, ঘরে শুকর। গায়ে সামান্য পোশাক। শামুক, ঝিনুক, সাপ, ব্যাঙ, পোকা সবই খাচ্ছে। আমি মুরংদের বলি আপনাদের ভাষায় বলেন তো দুনিয়ার গরিব এক হও, তারা বলে বক বক নারাই মরিছা ক। ঠিক হয় ঐ মুরং পাড়াই হবে আমাদের ঘাঁটি এলাকা। সেখানে প্রাথমিক কিছু সাংগাঠনিক কাজ সেরে ফিরে আসি। তাহের ভাইও ইতোমধ্যে আর্মি থেকে মাস দুয়েকের ছুটি নিলেন।
এসময় তাহের টোকেন ঘরে। বলেন : কি আনোয়ার তোমার ভাবীকে হিস্ট্রি সব শোনালে?
আনোয়ার : এতক্ষণ টেকনাফের হিস্ট্রি শোনাচ্ছিলাম। কেবল শুরু করছিলাম ট্রেনিংয়ের কথা।
তাহের সুৎফাকে বলেন : কি মনে হচ্ছে?
লুৎফা: কি আর মনে হবে? ঐ যে ইউসুফ ভাই বলেছিলেন, আমার বিপদ আছে, তাই মনে হচ্ছে। ট্রেনিংয়ের গল্প তো এখনও শুনিই নাই।
তাহের : ট্রেনিং তো শুরু করলাম এখানেই। এই বাসাতেই। এই তো কিছুদিন আগেই।
লুৎফা : এই বাসাতে? ইউসুফ ভাই রাজি হলেন?
তাহের : রাজি কি, উনিই আমাকে বললেন, ট্রেনিংএর ভেন্যু নিয়ে ভাববে না। আমার বাসাতেই ট্রেনিং হবে।
লুৎফা : এরকম ছেলেরা সব ট্রেনিং নিতে আসছে লোকজন সব জেনে যাবে না?
আনোয়ারঃ ভাবী আমরা কঠোর গোপনীয়তা মেনে চলতাম। যাতে কেউ টের না পায় সেজন্য আমরা ছোট ছোট গ্রুপে ট্রেনিং করতাম, একসাথে ৪/৫জনের বেশি না। দিনে বেশ কতকগুলো ব্যাচে ট্রেনিং হতো।
লুৎফা : কিসের ট্রেনিং দিতে তোমরা?
তাহের : সিরাজ শিকদার তার পলিটিক্যাল থিসিস তুলে ধরত। এ মুহূর্তে পশ্চিম পাকিস্তানের কাছ থেকে সায়ত্ত্বশাসনের দাবির চাইতে সশস্ত্র স্বাধীনতার সংগ্রাম কেন জরুরি, আওয়ামী লীগ কিংবা চীনাপন্থী বা মস্কোপন্থীদের সঙ্গে কোথায় আমাদের পার্থক্য ইত্যাদি আলোচনা করে বোঝাতো। আর আমি আলোচনা করতাম বিপ্লবের মিলিটারি দিকটা নিয়ে। সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, তাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন হাতিয়ার দিয়ে কি করে শত্রুকে কাবু করা যায় এসব। শেখাতাম কি করে বোমা বানাতে হয়। আনোয়ার পুরো ট্রেনিংটা কো-অর্ডিনেট করত।
লুৎফা : ভালোই তো, তুমি ট্রেনিং দিচ্ছ, ইউসুফ ভাই বাসা ছেড়ে দিচ্ছে, আনোয়ার ট্রেনিংয়ে দেখা শোনা করছে, বেশ তোমরা ভাইরা ভাইরাই তো সব।
আনোয়ার : ট্রেনিং কিন্তু খুব ভালোই চলছিল। সেজো ভাইয়ের সেশনগুলো। ছেলেরা খুবই পছন্দ করত।
লুৎফাঃ কিন্তু এভাবে আর্মি থেকে এসে গোপনে ট্রেনিং দিচ্ছি। এতগুলো সব অচেনা ছেলে, কেউ যদি ফাঁস করে দিত।
তাহের : তা ঠিক, রিক্স তো ছিলই। কিন্তু এসব কাজে রিস্ক তো ইনভিটেবল। রিস্ক নিতেই হবে। কেউ ফাঁস করে দিলে ফায়ারিং স্কোয়াডে যেতে হতো আমাকে। কিন্তু কিভাবে মারা যাবে এই নিয়ে চিন্তা করলে তো আর বিপ্লব করা যাবে না কোনোদিন। আর সেকেন্ডলি মানুষকে বিশ্বাস করতে হবে। মানুষকে বিশ্বাস না করলে কিছুই করা সম্ভব না। কিন্তু সমস্যাটা তো হলো অন্য জায়গায়। সিরাজ বলল, এই ট্রেনিং সে চালাবে না।
লুৎফা : কেন?
আনোয়ার। আমি যেহেতু ট্রেনিংটা কো-অর্ডিনেট করছিলাম একদিন আমাকে ডেকে সিরাজ ভাই বললেন, এই ট্রেনিং আর চালাবো না। আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন? উনি এক অদ্ভুত কথা বললেন। বললেন, তাহের একজন পেটি বুর্জুয়া আর্মি অফিসার, তার কাছ থেকে ছেলেরা বিপ্লবের ট্রেনিং নিতে পারে না। তাহের ভাইকে এখনই আর্মি ছেড়ে দিতে হবে, তা না হলে তার সঙ্গে আমি ট্রেনিং করব না। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম, বললাম, এটা কেমন কথা বলছেন আপনি, তাহের ভাই এখনই কি করে আর্মি ছেড়ে দেবে, আমাদের তো কিছুই রেডি হয়নি।
লুৎত্যা : সিরাজ সিকদার হঠাৎ এমন বললেন কেন?
আনোয়ারঃ আসলে ঐ যে আপনি বলছিলেন পুরো ট্রেনিংটায় আমাদের ভাইদের একটা প্রাধানা ছিল। ইউসুফ ভাইয়ের বাসায় ট্রেনিং হচ্ছে, তাহের ভাই স্টুডেন্টদের মধ্যে খুব পপুলার হয়ে উঠেছে, আমি পুরো ট্রেনিংয়ের ম্যানেজমেন্ট করছি এতে হয়তো সিরাজ ভাই মনে করছিলেন লিডারশিপটা তার হাত থেকে সরে যাচ্ছে, তিনি সেটা চাচ্ছিলেন না।
তাহের : সিরাজ আমাকে পেটি বুর্জুয়া বলে এ থিওরিটিক্যাল ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আমি কি কারণে আর্মিতে গেছি তার সে কতটুকু জানে? আর আমি যদি পেটি বুর্জুয়া হই সে কি? আমি গেছি আর্মিতে, সে পড়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং। আর সে মুহূর্তে আমি যদি আর্মি ছেড়ে দিতাম তাহলেও বা কি লাভ হতো? আসলে এই পারস্পরিক সন্দেহ, লিডারশীপ নিয়ে দ্বন্দ্ব এসব আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির কালচারেরই একটা অংশ। এসব অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিয়ে কত হত্যা, খুন হয়ে যায়। যাহোক, আমি আলাপ করতে চাইলাম তার সঙ্গে, কিন্তু সে রাজি হলো না।
আনোয়ার : আমি সিরাজ ভাইকে গিয়ে বললাম যে তাকে শ্রদ্ধা করি কিন্তু আমি মনে করি যে তার এধরনের সিদ্ধান্ত হঠকারী।
তাহের : যাহোক বন্ধ করে দিতে হলো ট্রেনিং। একটা দারুণ চান্স আমরা মিস করলাম। লাইফে একটা বড় চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলাম, কিন্তু তা কাজে লাগল না। সিরাজ যদি কখনো তার চিন্তা বদলায় হয়তো আবার তার সঙ্গে কাজ করা হবে। লম্বা ছুটি নিয়ে এসেছিলাম, জুটির অর্ধেক শেষ না হতেই এই ঝামেলা বাধল।
কথার এই পর্যায়ে আবার যোগ দেন ফাতেমা। বুঝলে লুৎফা ওদের বিপ্লব যখন হলো না আর তাহেরের ছুটি যখন আরও বাকি তখন আমি ওদের ঠেলে পাঠিয়ে দিলাম ঈশ্বরগঞ্জে তোমাদের বাড়িতে। বিপ্লবীরা কি বিয়ে করে না? তোমার সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারটা আলাপ হচ্ছিল আগে থেকেই। এই সুযোগে সেটা পাকা করা গেল। যাহোক আমার রান্না রেড়ি, খেতে আস সবাই? আর খেতে বসে কোনো পলিটিক্সের আলাপ হবে না, সারাদিন অনেক পলিটিক্সের আলাপ হয়েছে। আর তাহের, সুৎফা তোমরা দুজন আজকে মধুমিত্তায় ইভিনিং শো দেখে আস।
বিকেলে মধুমিতা হলে সিনেমা দেখতে যায় দুজন। অন্ধকারে বসে সিনেমার পর্দার দিকে তাকিয়ে লুৎফা ভাবে অন্য কথা। সত্যিই এক বিচিত্র পরিবারের ভেতর এসে পড়েছে সে। এক ভাই ইউনিভার্সিটির পড়াশোনা ছেড়ে বিপ্লব করবে বলে টেকনাফের পাহাড়ে আস্তানা গাড়ে, আরেক জন ব্যবসার কাগজপত্র ফেলে ঘুরে বেড়ায় বার্মার জঙ্গলে, এক ভাই আর্মির ভেতরে থেকে লুকিয়ে এসে বোমা বানানো শেখায় অচেনা তরুণদের, আরেক জন তার বেডরুম ছেড়ে দেয় গেরিলা ট্রেনিং দেওয়ার জন্য।
লুৎফার তখনও জানবার কথা নয় যে সামনেই যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবে তখন এই সবকটি ভাই একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়বে যুদ্ধে, এদের সঙ্গে যোগ দেবে ছোট দুই ভাই বেলাল, বাহার, আর দুই বোন ডালিয়া এবং জুলিয়াও। তারপর স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতির নাটকীয়তম ঘটনাটির সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়বে এই গোটা পরিবার। আসাম বাংলার স্টেশনে স্টেশনে বেড়ে ওঠা এই পরিবারটির দিকে এবার লক্ষ করা যাক।
০৭. ধুলায় ঈষৎ ঢাকা মহিলাটি
দৃশ্যটি ডালিয়ার খুব মনে পড়ে। শ্যামগঞ্জ স্টেশনে নেমে তারা হেঁটে যাচ্ছেন কাজলা গ্রামের দিকে। মাইল তিনেক পথ, কোন যানবাহন নেই, হেঁটে যাওয়াই নিয়ম তখন। গ্রামের রাস্তার ধুলা উড়িয়ে তারা লাইন ধরে হাঁটছেন। সবার আগে মা। ছোটখাটো মানুষ, ঘাড়টা সামান্য কাত করে হন হন করে হেঁটে যাচ্ছেন তিনি। কাজলা পৌঁছানোর আগে পর্যন্ত একবারও থামছেন না। কোনো মহিলাকে ডালিয়া এত একাগ্রতার সঙ্গে এত দ্রুত হাঁটতে দেখেননি কোনোদিন। ধুলায় ঈষৎ ঢাকা ঐ ছোটখাটো মহিলাটিকে আমাদের লক্ষ রাখা দরকার। একটি একনিষ্ঠ পাখির মতো একটু একটু করে ছানাদের তিনি মুখে পুরে দিয়েছেন অলৌকিক মন্ত্র। সে মন্ত্র বুকে নিয়ে তারা ছানারা সব উড়ে গেছে অসম্ভবের দেশে।
ব্রিটিশ রেলের কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইউনুস মিয়া তার মেয়ে আশরাফুন্নেসাকে বিয়ে দিয়েছিলেন লাকসামের আলী আশরাফের সঙ্গে। একটা ছেলেও হলো সে ঘরে। নাম রাখা হলো হিরু, ভালো নাম আরিফুর রহমান। আরিফের বয়স যখন সাত আট মাস তখন আলী আশরাফকে টাইফয়েড়ে ধরল। টাইফয়েড তখন এক ভুতুড়ে লোগ। পৃথিবী তখন স্যালাইন দেখেনি, এন্টিবায়টিক দেখেনি। আলী আশরাফ মারা গেলেন। শুরুতেই ব্যর্থ হয়ে গেল আশরাফুন্নেসার সংসারের স্বপ্ন। শিশু আরিফকে নিয়ে আশরাফুন্নেসা চলে এলেন বাবার কাছে আসামের বদরপুরে। বিধবা মেয়েটিকে দেখে বুক ভেঙ্গে আসে ইউনুস মিয়ার। আসামের গভীর অরণ্য চারপাশে। সুর্য ডুবলেই কেমন নিঝুম হয়ে আসে চারদিক। হরিণেরা উঠানে ঘুরে বেড়ায়। অনেক রাতে বাঘ এসে ঘরের দেয়ালে গা ঘষে। গভীর রাতে ঘটং ঘট, ঘটং ঘট শব্দ করে লম্বা মালগাড়ি যায়। হরিণেরা দৌড়ে পালায়। বোন মরিয়মন্নেসার সঙ্গে মিলে আরিফের দেখাশোনা করতে থাকেন আশরাফুন্নেসা।
একদিন বদরপুর রেলস্টেশনে চাকরি নিয়ে আসেন নেত্রকোণার তালুকদার বাড়ির ছেলে মহিউদ্দীন আহমেদ। ইউনুস মিয়ার নিস্তরঙ্গ আরণ্যক জীবনে একটা মৃদু ঢেউ ওঠে যেন। খানিকটা লাজুক, সুদর্শন মহিউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে বেশ আড্ডা জমে ইউনুস মিয়ার।
ইউনুস মিয়া জিজ্ঞাসা করেন : তোমার দাদার তাহলে তালুক পেয়েছিলেন দুর্গাপুরের মহারাজার কাছ থেকে?
মহিউদ্দীন : হ্যাঁ ঐ পূর্বধলা থানার কাজলাসহ গোটা তিনেক গ্রাম পেয়েছিলেন তারা।
ইউনুস : তা তুমি বাবা নামের শেষে তালুকদার লাগাও না কেন?
মহিউদ্দীন : না, ঐ পদবি বাদ দিতে চাই। আমি তো আর তালুকদার না। তাছাড়া খাজনা তোলার ব্যাপারে দাদাদের যেসব কীর্তি কাহিনী শুনি তাতে ঐ পদবি ব্যবহার করতে লজ্জাই হয়।
মহিউদ্দীনদের পূর্বপুরুষের তালুক অনেক আগেই ক্ষয়িষ্ণু পর্যায়ে পৌঁছেছিল। মহিউদ্দীনের বাবার তেমন বিশেষ সম্পত্তিও ছিল না। মহিউদ্দীন এন্ট্রান্স পাস করার পর হঠাৎ মারা গেলেন তার বাবা। অকালমৃত্যু তখন নেহাত আটপৌড়ে ব্যাপার। মহিউদ্দীনের আর পড়াশোনা হলো না। জমি জিরেতের ওপরও ভরসা করার উপায় রইল না। চাকরি খুঁজতে হলো একটা। ব্রিটিশ ভারতে চাকরির কটাই বা সুযোগ? খুঁজতে খুঁজতে মিলল আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের একটা চাকরি। শর্ত এই, চাকরি দেওয়া হবে কিন্তু চার বছর কোনো বেতন দেওয়া হবে না। তাই সই। বছর চারেক বাবার সম্পত্তি দিয়ে চালিয়ে নিতে পারবে মহিউদ্দীন। তালুকদার বাড়ির প্রথম একজন সদস্য কৃষি জীবন ছেড়ে শুরু করল চাকরি জীবন। মহিউদ্দীনের প্রথম পোস্টিং হলো বদরপুরে। বিদেশ বিভূঁইয়ের ঐ জঙ্গলাকীর্ণ জনপদে মহিউদ্দীনের স্বস্তির আশ্রয় হলো ইউনুস মিয়া আর তার পরিবার।
মহিউদ্দীন যখন ইউনুস মিয়ার সঙ্গে গল্প করেন তখন প্রায়ই বাচ্চার দুধের বাটি হাতে দ্রুত উঠান পেরিয়ে যান আশরাফুনেসা। এই কিশোরী বিধবাকে দেখতে দেখতে বাঘ, হরিণ আর ধাতব ট্রেনের প্রেক্ষাপটে মহিউদ্দীনের মনে একটা ইচ্ছা ফুল ফুটে উঠতে থাকে ক্রমশ। দিন যায়। দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে মহিউদ্দীন ইউনুস মিয়াকে একদিন বলে বসেন। আপনার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমি আশরাফুন্নেসাকে বিয়ে করতে চাই।
নিভৃত ঐ জনপদে বিষণ্ণ এক বালিকার মুখ বুঝিবা বিহ্বল করেছিল সারা জীবনই চুপচাপ, লাজুক মানুষ মহিউদ্দীন আহমেদকে। সাহসের সঙ্গে মেয়ের বাবার কাছে নিজেই বিয়ের এই প্রস্তাব রাখা মহিউদ্দনের স্বভাবের সঙ্গে মেলে না। অবাক হন ইউনুস মিয়া কিন্তু বুক থেকে একটা পাথর নেমে যায় তার।
এইটুকুই বুঝি দরকার ছিল আশরাফুন্নেসার। একটা পাটাতন। তারপর তার সেই ঘা একটু বাঁকিয়ে হন হন করে কেবলই এগিয়ে যাওয়া। একবারও পেছনে না তাকানো। বদরপুর ছেড়ে তারপর স্টেশন মাস্টার স্বামীর সঙ্গে এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশনে। সমান্তরাল রেললাইন, ট্রেনের হুইসেল, লাল ইটের দালান কোন মন্ত্রবলে তার জীবনের অনিবার্য অংশ হয়ে দাঁড়ায়। আরিফসহ এগাবোটি সন্তানের জন্ম দিলেন আশরাফুন্নেসা। সবাই প্রায় পিঠাপিঠি। একটি মারা গেল অল্প বয়সে। দশটি সন্তানের একটি সংসার রীতিমতো একটা প্রতিষ্ঠানের মতো করে গড়ে তুললেন আশরাফুন্নেসা।
সব ছেলে মেয়েদের বেশ মনে আছে বাবা মা দুজনেই খুব ভোরবেলা উঠতেন। তারা সবাই তখন বিছানায়। বিছানায় আধো ঘুমের মধ্যে তারা শুনছে মা অবিরাম নিচুস্বরে বাবাকে শাসন করে যাচ্ছেন। আপনি এত পরিশ্রম করেন কেন? এত বেশি চা খান কেন? বাবা স্টেশনে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে একটা চায়ের কাপে একটু একটু করে চুমুক দিচ্ছেন। তার মুখে প্রশান্তি। যেন তিনি এই বকা বেশ উপভোগ করছেন। ছেলে মেয়েরা ঘুম খেকে উঠলে চালু হয়ে যাবে চাকা। সব কিছু রুটিন করে দেওয়া। আজ সোমবার, অতএব
শেলী
অর্তাৎ সালেহা রুটি বেলাবে।
হীরু অর্থাৎ আরিফ কুয়া থেকে পানি তুলবে,
মন্টু অর্থাৎ ইউসুফ হাঁস মুরগি আর কবুতরের খোপ খুলে দেবে,
নান্টু অর্থাৎ তাহের গরুকে খৈল দেবে,
খোকা অর্থাৎ সাঈদ গোয়াল
ঘর পরিষ্কার করবে,
মনু অর্থাৎ আনোয়ার উঠান ঝাড় দেবে,
মঙ্গলবার আবার দায়িত্ব অদল বদল হবে। এভাবে চলবে প্রতিদিন। স্কুলে যাবার আগে এবং পরে প্রতিটা ছেলেমেয়ের জন্য বরাদ্দ আছে নির্দিষ্ট কাজ। সংসারে যারা পরে এসেছে, বেলাল, বাহার, ডালিয়া, জুলিয়া কেউই বাদ যায়নি এ নিয়ম থেকে। তার সন্তান বাহিনীর কাজ কঠোরভাবে তদারকী করেন আশরাফুন্নেসা। বন্ধুরা ডাকছে মাঠে খেলার জন্য কিন্তু ঘর ঝাড় দেওয়া না হওয়া পর্যন্ত কোথাও নড়া যাবে না, গরুর খৈল দেওয়া না পর্যন্ত অন্য কোনো কাজ করা চলবে না। কত কত পয়েন্টসম্যান স্টেশনে, স্টেশন মাস্টার বাবুর যে কোনো কাজ করে দেবার জন্য দুই হাত, পা বাড়িয়ে আছে তারা। কিন্তু না আশরাফুন্নেসা। সরকারি কোনো লোক নিজের বাড়ির কাজে লাগাবেন না।
স্টেশন থেকে ফিরে মহিউদ্দীন আহমেদও হাত লাগান ঘরের কাজে। ছেলে মেয়েদের চোখে এখনও ভাসে বা দূরের মাঠ থেকে মাথায় ঝাঁকা ভর্তি করে গরুর জন্য ঘাস কেটে আনছেন, হাতে কাঁচি। মহিউদ্দীন আহমেদের ছিল সবজি বাগানের শখ। যে স্টেশনেই যেতেন, স্টেশনের আশপাশে পতিত জায়গার অভাব হতো না। মহিউদ্দীন আহমেদ সেখানে শুরু করে দিতেন নানা রকম সবজির চাষ। আলু, মটর, কালাই, পেঁয়াজ। সহযোগী তার ছেলেমেয়েরা, কেউ নিড়ানি দিচ্ছে, কেউ আগাছা সাফ করছে, কেউ সার দিচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যেই মাটির তলায় পুষ্ট পুষ্ট আলু। তারপর দল বেঁধে মাটির তলা থেকে আলু তোলা, আলুর গায়ে লেগে ধাকা মাটি পরিষ্কার করা। যেন এক উৎসব।
এক স্টেশনে বছর তিনেক পার হলেই আশরাফুন্নেসা ছেলেমেয়েদের বলেন, আমার পা চুলকাচ্ছে, তোদের বাবা আবার বোধহয় বদলি হবেন!
ব্যাপারটা তাই হতো। কিছুদিনের মধ্যেই দেখা যেত বদলির অর্ডার এসে হাজির হয়েছে। হয়তো আসাম সিলেট সীমান্তের জুড়ি স্টেশন থেকে টিলাগাও স্টেশন। পরিচিত জায়গা ছেড়ে যেতে চাইত না ছেলেমেয়েরা। বলত; বদলিটা ঠেকানো যায় না আব্বা? না, মহিউদ্দীন আহমেদ বদলি ঠেকানোর কোনো চেষ্টাই করতেন না। ছেলেমেয়েদের বলতেন–মন্দ কি? নতুন নতুন জায়গা দেখবে তোমরা।
ছেলেরা বায়না ধরত : বদলি যদি হতেই হয় তাহলে একটা বড় কোনো জংশনে বদলি হলেই তো ভালো?
মহিউদ্দীন আহমেদের তাতেও আগ্রহু নেই। বলতেন, বড় স্টেশনে অনেক ঝামেলা, আমি নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে চাই।
বদলির অর্ডার এলে নেমে পড়তেন বদলির আয়োজনে। ওয়াগনে মালপত্র উঠানো শুরু হতো, সঙ্গে গরু, ছাগল, মুরগী, কবুতর সব। গরুকে রেলের ওয়াগনে উঠানো মহাঝক্কি। মাচা বানিয়ে তারপর উঠাতে হয়। সেসব নিয়ে ছেলে মেয়েদের বিপুল উত্তেজনা। সবাই মিলে ওঠে পড়ে ওয়াগনেই। খুবই ধীর গতিতে চলে ওয়াগন। ২/৩ দিন ধরে চলে তবে পৌঁছায় গন্তব্যে। পথে পথে থেমে বাজার ঘাট হয়, খাওয়া দাওয়া হয়। একবার তো ওয়াগনের ভেতরেরই গাভীর বাচ্চা প্রসব হয়ে গেল।
নতুন স্টেশনে গিয়ে মহিউদ্দীন আহমেদ আর ছেলেমেয়েদের নিয়ে নেমে পড়েন আশপাশের জমি সাফ করায়, কোদাল দিয়ে কুপিয়ে চাষ উপযোগী করায়। তারপর শুরু হয় ঋতু অনুযায়ী নানা শস্য আর সবজির চাষ। শীতকাল এলে কাছের শহর থেকে কিনে আনেন র্যাকেট আর কর্ক। কোয়ার্টারের সামনের খালি জায়গায় কোর্ট কেটে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিলে ব্যাডমিন্টন খেলেন। মাটি, প্রকৃতি আর তার সন্তানদের নিয়ে তার নির্বার্ট জীবন। ৫০, ৬০ দশকজুড়ে আসাম, বাংলা এলাকার নানা অখ্যাত স্টেশনে স্টেশন মাস্টারের দায়িত্ব পালন করেছেন মহিউদ্দীন আহমেদ। নিজের পেশায় ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। সতোর জন্য একবার ব্রিটিশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পেয়েছিলেন স্বর্ণপদক।
নতুন স্টেশনে গিয়ে আশরাফুন্নেসাও ফিরে যান পুরনো নিয়মে। ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভাগ করে দেন গৃহস্থালির কাজ। এভাবে শ্রম বিভাজন করার কারণে আশরাফুন্নেসা আর মহিউদ্দীন আহমেদের পক্ষে দশ সন্তানের বিশাল পরিবারের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ড সামাল দেওয়া সম্ভব হয়েছিল বটে কিন্তু এতে করে অলক্ষে সন্তানদের হয়ে যাচ্ছিল কঠোর নিয়ানুবর্তিতার প্রশিক্ষণ, হচ্ছিল প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ, কেটে গিয়েছিল কায়িক শ্রম নিয়ে শিক্ষিত মানুষের প্রচলিত দূরত্বের বোধ। কৈশোরের এই প্রতি তাদের সবাইকে দিয়েছে বৃত্ত ভাঙ্গার সাহস।
রেলওয়ে কোয়ার্টারগুলোর যে পরিসর তাতে মহিউদ্দীন আহমেদের এত বড় পরিবারের জায়গা হতো না। তিনি নতুন স্টেশনে গিয়ে একটা বাড়তি ঘর বানিয়ে নিতেন যাতে লম্বা একটা বারান্দা থাকত, নিয়ম ছিল সব ছেলেমেয়েরা সন্ধ্যে হলেই সে বারান্দায় লাইন করে পড়তে বসবে। পড়তে হবে শব্দ করে জোরে জোরে যাতে আশরাফুন্নেসা অন্য ঘর থেকে শুনতে পান। প্রতি সন্ধ্যা তাই মহিউদ্দীন আহমেদের রেলওয়ে কোয়ার্টার সরগরম হয়ে উঠত অনেক ছেলেমেয়ের পড়ার শব্দে। আশরাফুন্নেসার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব বেশি দূর ছিল না, পড়েছিলেন প্রাথমিক স্কুল পর্যন্ত কিন্তু তার পড়বার আগ্রহ, জানার আগ্রহ ছিল প্রবল। ছেলেমেয়েদের মধ্যে পড়ার নেশা সবচেয়ে বেশি নান্টু অর্থাৎ তাহেরের। ক্লাসের বই নয় সে পড়ে বাইরের বই, যার নাম তখন আউট বই। আশরাফুন্নেসার নজর ঐ আউট বইগুলোর দিকে। তাহের একটু বড় হয়ে হোস্টেলে চলে গেলে আশরাফুন্নেসা ফরমাস করতেন : নান্টু, ছুটিতে আসবার সময় আমার জন্য অবশাই কয়টা আউট বই আনবি।
তাহের প্রতিবার মনে করে বই আনেন মার জন্য। সব রাজনীতি আর স্বদেশপ্রেমের বই। সব কাজ শেষ হলে রাতে আশরাফুন্নেসা হারিকেন জ্বালিয়ে আলোর কাছে মেলে ধরেন সাঁওতাল বিদ্রোহের ওপর বই ভাগনা দিহীর মাঠে কিম্বা স্বদেশী আন্দোলনের উপর লেখা কাঞ্চনজংঘার ঘুম ভাঙ্গছে।
ছেলেমেয়েদের নিয়ে আহ্লাদ, আদিখ্যেতা একদম অপছন্দ আশরাফুন্নেসার। একদিন বটিতে পা কেটে বেশ রক্ত ঝরছে বেলালের। ভয় পেয়ে হাউ মাউ করে কাঁদছে বেলাল। আশরাফুন্নেসা মোটেও বিচলিত নন। তিনি একবারও বাবা আমার, সোনা আমার এসব করবেন না। ক্ষতস্থান ধুয়ে, গাঁদা পাতা ছেচে পট্টি দিয়ে বেঁধে দেন তিনি। বলেন, কান্নাকাটির কিছু নাই, যা খেলতে যা, একটু পরেই ভালো হয়ে যাবে।
ডালিয়া, জুলিয়াকে ৫/৬ বছর বয়সেই তিনি ভর্তি করে দিয়েছিলেন ভারতেশ্বরী হোমসের হোস্টেলে। বলতেন, নিজের মতো থাকতে শিখুক।
ছুটি শেষ হলে ডালিয়া, জুলিয়া যেতে চাইত না হোস্টেলে। আশরাফুন্নেসা ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে ওদের বলেন : নো ক্রাইং। মার্চ করতে করতে চলে যাবি স্কুলে, একদম পেছনে তাকাবি না।
মনু অর্থাৎ আনোয়ার তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। ছুটি হয়েছে। আশরাফুন্নেসা বললেন : কাজলায় চলে যা, ধান উঠেছে, কামলাদের মাড়াইয়ে সাহায্য কর!
আনোয়ার এর আগে একা কখনো ময়মনসিংহ থেকে কাজলায় যায়নি। আশরাফুন্নেসা বললেন : পথ চিনে চিনে চলে যাবি।
মহিউদ্দীন আহমেদ সাবধানী মানুষ। বলেন : এতটুকু ছেলে, রাস্তা হারিয়ে টারিয়ে ফেলে কিনা?
আশরাফুন্নেসা বলেন : এতটুকু ছেলে কোথায়? রাস্তা হারালে খুঁজে নেবে। একা চলতে হবে না?
এরকমই ছিলেন আশরাফুন্নেসা। সন্তানকে আগলে রাখা বাঙালি মায়েদের পরিচিত চেহারার সঙ্গে কোনো মিল নেই তার। টিলাগাঁও স্টেশনে থাকতে একবার কাছাকাছি এক জায়গায় আসাম থেকে বক্তৃতা করতে এসেছিলেন মাওলানা ভাসানী। খোকা অর্থাৎ সাঈদ তার এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে কাউকে না জানিয়ে চলে যায় সেই বক্তৃতা শুনতে। সন্ধায় তাদের খোঁজ পড়ে। না পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে দুই পরিবার। কে একজন বলে দুজনকে লোকাল ট্রেনে উঠতে দেখেছে। খোকার বন্ধুটির বাবা উদ্বিগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন প্ল্যাটফর্মে। মহিউদ্দীন আহমেদ স্টেশনে খোঁজ নিতে গেলে আশরাফুন্নেসা বাধা দেন : বস তো ও ঠিকই চলে আসবে।
বেশ রাতে লোকাল ট্রেনে বক্তৃতা শুনে ফেরে দুজন। খোকার বন্ধুটির বাবা বন্ধুটিকে স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম থেকেই পেটাতে পেটাতে বাড়ি নিয়ে যায়। আর আশরাফুন্নেসা খোকাকে বাড়ির এক কোণে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসা করেন : ভাসানী দেখতে কেমনরে? বক্তৃতায় কি কি বলল আমাকে খুলে বল।।
স্টেশন মাস্টারের এমন বিশেষ আর্থিক সঙ্গতি ছিল না যাতে সব ছেলেমেয়ের সাধ আহাদ পূরণ করতে পারবেন। তাদের বিলাস ছিল বছরে দুবার, হাফ ইয়ারলি আর ফাঁইনাল পরীক্ষা শেষে সবাই মিলে কাছের শহরে সিনেমা দেখতে যাওয়া। প্রতি ঈদে সবার নতুন জামা মিলত না। পালা করে পাওয়া যেত নতুন জামা। শীতে পুরনো সোয়েটার খুলে সেই উল দিয়েই ছেলেমেয়েদের নতুন ডিজাইনের সোয়েটার বুনে দিতেন আশরাফুন্নেসা। মাঝে মাঝে ঘরে বসাতেন আসর। আশরাফুন্নেসা বলতেন, শেলী মা, গান ধরো তো একটা। শেলীর গলায় ছিল মিষ্টি সুর, গাইত, ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে কিবা মৃদু বায়। তাহেরকে বলতেন, নান্টু, নজরুলের ঐ কবিতা কর তো, ঐ যে কি যেন অর্ধেক নারী…। তাহের আবৃত্তি করতেন-এ পৃথিবীতে যা কিছু মহান, চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। আশরাফুন্নেসা নিজেও গান ধরতেন। যদিও গলায় সুর ছিল না তেমন, তবু কন্ঠে আবেগ নিয়ে কবিতার মতো করে গুনগুন করে আওড়াতেন
জোনাকী
জ্বালবে আলো
বঁধূ কি বাসবে ভালো
মালা
কি পড়বে গলে?
মহিউদ্দীন আহমেদ ছিলেন নীরব শ্রোতা। আশরাফুন্নেসার সব রকম কর্মকাণ্ড, উদ্যোগকে নীরবে সমর্থন দিয়ে গেছেন তিনি। মহিউদ্দীন আহমেদ ছিলেন যতটা চুপচাপ, নিভৃতচারী, আশরাফুন্নেসা ছিলেন ততটাই সরব। কথা বলতে পছন্দ করতেন তিনি, পছন্দ করতেন মানুষের সঙ্গ। যে নতুন স্টেশনে যেতেন অল্প সময়ের মধ্যে সেখানকার পয়েন্টসম্যান, গার্ড, রেলের ড্রাইভার একান্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে যেত তার। ট্রেন হয়তো স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে, লেট হবে, গার্ড এসে নির্ঘাত এক কাপ চা খেয়ে যাবেন আশরাফুন্নেসার হাতে। শুধু রেলের কর্মচারী নয়, আশপাশের গ্রামের সাধারণ মানুষ হয়ে উঠত তার অতি আপনজন। বিকেল বেলা দল বেঁধে গ্রামের মহিলারা আসতেন তার সঙ্গে গল্প করতে। সুযোগ পেলে তিনিও চলে যেতেন গ্রামের এ বাড়ি ও বাড়ি। কাজলায় যখন থাকতেন তখন তো তিনি যেন পুরো গ্রামের অভিভাবক। গোলাপ নামে কাজলার এক দুস্থ আত্মীয় বালককে লালনপালন করতেন তিনি। সন্ধ্যায় গোলাপকে ডেকে বলতেন, হারিকেনটা নে তো গোলাপ, আমার সঙ্গে চল।
তারপর গ্রামের অন্ধকার পথ হারিকেনের আলো ফেলে ফেলে তিনি যান এবাড়ি থেকে ও বাড়ি। আয়েশার জ্বর হয়েছে দেখে আসা দরকার, বাবুলের মার সংসারে অশান্তি, স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না, একটা কোনো ব্যবস্থা করা দরকার।
একেবারে অচেনা সানুষকে নিমেষে আপন করে নেবার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল আশরাফুন্নেসার। মহিউদ্দীন আহমেদের মৃত্যুর পর ঢাকায় ছেলেমেয়েদের বাড়িতে সময় কাটাতেন তিনি। ঢাকায় থাকতে তার এক নিত্যকালীন অভ্যাস দাঁড়িয়েছিল সকালে মর্ণিং ওয়াক করা। সকালে হাঁটতে গিয়ে অগণিত বন্ধু, ভক্ত, অনুরাগী তৈরি হয়েছিল তার। বিশেষ করে ডালিয়ার উত্তরার বাসায় যখন থাকতেন তখন প্রায়ই সকালে হাঁটতে গিয়ে একজনকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন বাসায়, একদিন আনলেন এক বাদামওয়ালাকে, একদিন রাস্তার পাশে ইট ভাঙ্গে এমন এক মহিলাকে। এনে বলেন; ওকে নাস্তা খেতে দাও। মাঝে মাঝে বিরক্ত হন ডালিয়া। রেগে যান আশরাফুন্নেসা, বলেন; একজন অতিরিক্ত মানুষকে নাস্তা খাওয়াতে কি তোমাদের খুব অসুবিধা? চুপ হয়ে যান ডালিয়া।
আশরাফুন্নেসার মৃত্যুর পরের একটি স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে আছে ডালিয়ার স্বামী রানার মনে। আশরাফুন্নেসা মারা গেছেন সপ্তাহখানেক হলো। একদিন রানা দেখেন একজন লুঙ্গি, গেঞ্জি পড়া লোক মাথায় মস্ত বড় এক অ্যালুমেনিয়ামের পাতিল নিয়ে হন হন করে উঠে আসছেন সিঁড়ি দিয়ে। দরজা খুলে দিলে লোকটি বলেন, নানী কই? রানা বুঝতে পারেন লোকটি আশরাফুন্নেসকে খুঁজছেন এবং সে তার মৃত্যুর খবর জানে না। রানা লোকটিকে ভেতরে আসতে বলেন এবং তাকে আশরাফুন্নেসার মৃত্যু সংবাদ জানান। লোকটি মাথা থেকে পাতিলটিকে নামিয়ে মেঝের উপর রাখেন এবং হু হু করে কাঁদতে থাকেন। এরপর জানান যে, তিনি একজন রিকশাচালক এবং আশরাফুন্নেসা যখন রোজ সকালে হাঁটতে যেতেন তখন তাঁর বস্তির বাড়িতে ঢুকে খবর নিতেন। তার মেয়েটির বড় অসুখ হয়েছিল এবং আশরাফুন্নেসা টাকা দিয়েছিলেন চিকিৎসার। সে চিকিৎসায় ভালো হয়ে উঠেছিল তার মেয়ে। রিকশাচালক লোকটি আশরাফুন্নেসাকে কথা দিয়েছিলেন যে গ্রামের বাড়ি থেকে জিওল মাছ এনে খাওয়াবেন। লোকটি আপসোস করতে থাকেন : পাতিল ভইরা জিওল মাছ আনলাম আর নানী দুনিয়া ছাইরা চইলা গেল?
অন্যকে দেবার একটা নেশা যেন আশরাফুন্নেসার। বেঁচে থাকতে নিজের সামর্থ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব তার সবটুকু উজার করে দিয়েছেন, মৃত্যুর আগে দিয়ে গেছেন তার চোখ। আশরাফুন্নেসার চোখের আলো নিয়ে এখন পৃথিবী দেখে মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ির বেতকা গ্রামের আমজাদ। আমাদের জীবন শুধু আমাদের নিজের জন্য নয়, এ জীবনের ওপর দাবি আছে আশপাশের চেনা অচেনা মানুষেরও, এমন একটা বোধ আশফুন্নেসা তার সব ছেলেমেয়েদের মধ্যে সঞ্চালিত করেছেন বরাবর। তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদের খুব ছোটবেলাতেই মুখ ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের কাদা মাটির দিকে, সাধারণ আটপৌরে মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখের দিকে, কল্যাণের দিকে। আর নিরন্তর বলেছেন বৃত্ত ভাঙ্গবার কথা : খালি নিজের কথা ভাববি না, মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করবি।
একটা কিছু করা যা শুধু নিজের স্বার্থের জন্য নয়, অন্যের জন্য, অন্য কোনো বৃহত্তর স্বার্থের জন্য এই খেয়াল পোকা আশরাফুন্নেসা আর মহিউদ্দীন আহমেদের সব ছেলেমেয়েই তাদের করোটিতে বহন করে বেড়িয়েছে। এরা কেউ যেন ঠিক একক মানুষ নয়, পুরো পরিবার মিলে যেন একটা যৌথ ব্যক্তিত্ব। পরিবারের সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধে, একত্রে নেমে পড়েছে দুর্ধর্ষ বিপ্লবে। সবার মধ্যে নিভৃতে লুকিয়ে থাকা মোমবাতির আলোটুকু নিজ হাতে জালিয়ে দিয়েছেন ঈষৎ ঘাড় বাঁকানো, ছোটখাটো এই নারী। কোনো এক অজানা জনপদের পৌরাণিক কোনো চরিত্র যেন বা এই আশরাফুন্নেসা।
০৮. সহদোর সহোদরা
বিপ্লবের ঘোর লাগা আনোয়ার আর সাঈদের চোরাগোপ্তা জীবনের খোঁজ আমরা পেয়েছি। দেশের এক ক্রান্তিকালে আমরা বেলাল আর বাহারকে দেখতে পাবো রোমহর্ষক এক আত্মঘাতি অভিযানে। পরিবারের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য ডালিয়া আর জুলিয়ার সঙ্গে আমাদের দেখা হবে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে। শেলের আঘাতে যখন উড়ে যাচ্ছে তাহেরর পা তখন তার কয়েক গজ দূরত্বেই থাকবে তার সবকটি ভাইবোন।
সবার বড়ভাই আরিফ বাকি সব ভাইবোনের যাবতীয় কর্মকাণ্ড সামাল দিয়েছেন পেছন থেকে। মহিউদ্দীন আহমেদ চাকরি থেকে অবসর নিলে এই বিরাট সংসারের ভার নিয়েছিলেন আরিফ। পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রণালয়ে চাকরি করতেন তিনি। তখনও অনেক ভাইবোন স্কুল, কলেজে পড়ছে। চাকরি করে, টিউশনি করে সে পড়ার খরচ যুগিয়েছেন তিনি। শান্তশিষ্ট, নেপথ্যের মানুষ আরিফ, পরিবারের ঘোর সংকটের মুহূর্তগুলোতে হয়ে উঠেছেন প্রধান অবলম্বন। মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন সব ভাইবোনেরা রণাঙ্গনে, যখন তাদের বাবা মা পাকবাহিনীর হাতে বন্দি হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন তখন আরিফকে আমরা দেখব তাদের পাশে। স্বাধীনতার পর যখন দেশের এক ঘোর রাজনৈতিক সংকটে জড়িয়ে পড়েছে পুরো পরিবার, যখন ভাইদের কেউ জেলে, কেউ পলাতক তখনও আরিফকে দেখবো সামাল দিচ্ছেন সে ক্রান্তিকাল। বাকি নয় ভাইবোন দীর্ঘদিন জানতেনই না যে আরিফ তাদের সৎ ভাই। আশরাফুন্নেসা আর মহিউদ্দীন আহমেদ জানাননি ছেলেমেয়েদের। সবাই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে নানা ঘটনাচক্রে জানতে পেরেছেন তার পরিচয়। তাতে অবশ্য তাদের ভাবান্তর হয়নি কোনোই। বড় ভাইজানের ছায়া তাদের পিঠের পর তারা অনুভব করেছেন সারা জীবন।
আবু ইউসুফকে ভর্তি করা হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানের মারীর লোয়ারটোপা স্কুলে, যেখান থেকে তিনি সরাসরি যোগ দেন বিমান বাহিনীতে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে দ্রুত উপার্জনের কথা ভেবেই এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইউসুফ সৌদি আরবে কিন্তু পালিয়ে এসে যোগ দেন রণাঙ্গনে তার অন্য ভাইদের সঙ্গে। যুদ্ধে অবদানের জন্য ভাইদের সবাই পেয়েছেন খেতাব, কেউ বীরপ্রতীক, কেউ বীরউত্তম। আবু ইউসুফ পেয়েছেন বীরবিক্রম। ভাইয়ের বিপ্লবী প্রশিক্ষণের জন্য আৰু ইউসুফ ছেড়ে দিয়েছেন তাঁর বাড়ি। স্বাধীনতার পর তাহের যখন দ্বিতীয় এবং চূড়ান্তবার আরও একটি বিপ্লবের নেতৃত্ব দেবেন তখনও আমরা দেখব সে বিপ্লবের সব গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকগুলো বসছে আৰু ইউসুফের বাড়িটিতেই। অন্য ভাইদের সঙ্গে তাকেও দেখা যাবে ব্যর্থ বিপ্লবের গোপন এক বিচারের আসামি হিসেবে কারাগারের গরাদের আড়ালে।
আশরাফুন্নেসা আর মহিউদ্দীন আহমদের সপ্তম সন্তান এবং প্রথম মেয়ে, ছোটদের বুবু আর বড়দের শেলীকে বড় পয়মন্ত ভাবতেন মহিউদ্দীন আহমেদ। শেলীর জম্মের পর বেতন বেড়েছিল মহিউদ্দীন আহমেদের। ষাট দশকের শেষের দিকে ময়মনসিংহ জংশনের কাছের ছোট স্টেশন ময়মনসিংহ বোড়। স্টেশনের স্টেশন মাস্টার মহিউদ্দীন আহমেদ। সেটাই ছিল তার শেষ পোস্টিং। ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী স্কুল থেকে পাস করে শেলী ভর্তি হয়েছেন মমিনুন্নেসা কলেজে। কলেজে সবাই এক নামে চেনে শেলীকে। স্পোর্টসে চ্যাম্পিয়ান, শূটিংয়ে ফাস্ট, বক্তৃতায় সেরা শেলী দূরন্ত এক পাখির মতো দাপিয়ে বেড়ান কলেজ। আশ্চর্য সাহস তার, চলন্ত ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে নেমে তাক লাগিয়ে দেন ভাইদের। মন যখন ভালো থাকে মহিউদ্দীন আহমেদ শেলীকে গান গাইতে বলেন। মিষ্টি গলায় গান শোনান শেলী। শেলী এক পর্যায়ে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ে রাজনীতিতে। ভাইবোনদের মধ্যে শেলীই প্রথম সাংগঠনিকভাবে রাজনীতি শুরু করেন। জনপ্রিয় শেলী নির্বাচিত হন মমিনুন্নেসা কলেজের ভিপি। তার সংশ্লিষ্টতা বাম ধারার ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গেই। কমিউনিস্ট পার্টি তখন নিষিদ্ধ। ময়মনসিংহ এলাকার তুখোড় কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে তখন যোগাযোগ তার। এক পর্যায়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির মিটিংগুলো বসতে থাকে শেলীদের ময়মনসিংহ রোডের বাসাতেই। কমিউনিস্ট নেতা আলোকময় নাহা, রবী নিয়োগী গোপনে আসেন বৈঠক করতে। মহিউদ্দীন আহমেদ এসবে জড়ান না কিন্তু সমর্থন দিয়ে যান নীরবে।
এর মধ্যেই হঠাৎ ঘটে যায় এক ছন্দ পতন। কলেজ ম্যাগাজিনে শেলীর একটি লেখা পড়ে এবং ছাপানো ছবি দেখে তাকে চিঠি লিখে বসে লন্ডন প্রবাসী এক বাঙালি যুবক। সেই চিঠিতে থাকে শেলীর মেধার প্রশংসা আর তার মুগ্ধতা। দূরন্ত পাখির পালকে এক অজানা পৃথিবীর হাওয়া এসে লাগে। মন উচাটন হয় শেলীর। শেলীও সে চিঠির উত্তর দেন। চিঠি দেওয়া নেওয়া চলতে থাকে অনেকদিন। গোপনে বুঝি শেলীর মনের পাড় ভাঙ্গে, একটু একটু করে বদলে যেতে থাকে নদীর গতিপথ। গোপন মিটিং, শূটিংয়ের বন্দুক আর বক্তৃতার মঞ্চ ছেড়ে একদিন শেলী পাড়ি জমায় কুয়াশাচ্ছন্ন লন্ডনে সেই যুবকের ঘরণী হতে। কিন্তু হিসেব মেলে না। লন্ডনের হিমে অচিরে শীতল হয়ে যায় তাদের অনুরাগ। একটি অসুখী সংসার জীবন কাটে শেলীর। একটি মেয়ের জন্ম হয় তাদের কিন্তু এক দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হন শেলী। স্বাধীনতার পর পরই অকাল মৃত্যু ঘটে শেলীর। আশরাফুন্নেসা আত্মীয়দের চিঠি লেখেন, আমাদের মেয়ে শেলী শান্তি কুলে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। এভাবে ধূমকেতুর মতো জ্বলে উঠে চকিতে নিভে যান শেলী। পয়মন্ত মেয়েটির মৃত্যুর সাথে সাথে যেন অশুভ ছায়া নেমে আসে পরিবারের ওপর। শেলীর মৃত্যুর পর অল্প সময়ের ব্যবধানে তার আরও দুই ভাইয়ের মৃত্যু হয় অপঘাতে।
০৯. আমি মাতি যুদ্ধে হেথায় সেথায়
তাহের আশরাফুন্নেসার তিন নম্বর সন্তান। আমাদের গচের কর্নেল। তৃতীয় সন্তান হলেও তিনিই ভাই বোনদের নেতা। যে পাগলা হাওয়ার তোড়ে এ পরিবারের প্রতিটি সদস্য বার বার বেরিয়ে এসেছেন পারিবারিক গণ্ডি অতিক্রম করে সে খাওয়া সবচেয়ে দূরে টেনে নিয়ে গেছে তাহেরকে। এক নাটকীয় জীবনে নিজেকে ঠেলে দিয়েছেন তাহের।
তাহের যখন ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে কবিতা আবৃত্তি করছেন, নিজ হাতে পড়ে নিচ্ছেন ফাঁসির দড়ি তখন তার সাহসিকতায় জেলার, কারাগারের ডাক্তার, জল্লাদ বিস্মিত। কিন্তু সে কথা পরে শুনে অবাক হয়নি তার পরিবারের কেউ। তাহেরের সাহসের গল্প তারা একে অনাকে বলেছে বহুবার।
আশরাফুন্নেসা বলেন : তোদের শাফাত ডাকাতের কথা মনে আছে? আমরা তখন সিলেটের জুড়ি স্টেশনে। ওখানে সবাই চিনত ঐ শাফাত ডাকাতকে। হীরু, মন্টু ওদের হয়তো মনে পড়বে। পাকিস্তান ভাগ হলো তখন, চারদিকে দাঙ্গা। হিন্দুরা সব দলে দলে চলে যাচ্ছে আসামে। একদিন এক হিন্দু সাধু বর্ডার পার হওয়ার জন্য রওনা দিয়েছে। ঐ শাফাত ডাকাত দিনের বেলা সবার সামনেই এই সাধুর সবকিছু নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। ওর হাতে ছুড়ি। কেউ সাহস পাচ্ছে না তার সামনে যাবার কিন্তু নান্টু গিয়ে তার পথ আগলে দাঁড়ালো। কতই আর বয়স তখন ওর, বারো, তেরো। ঐটুকু ছেলের সাহস দেখে সবাই।
ইউসুফ বলেন : আপনার মনে আছে মা, ঐশ জুড়ি স্টেশনেই একটা ঘোড়া নিয়ে কি কাণ্ড ঘটেছিল? কোথা থেকে যেন একটা বেওয়ারিশ ঘোড়া এসে হাজির হয়েছিল জুড়ি স্টেশনে। এলাকার ছেলেরা ঘোড়াটা নিয়ে হৈ চৈ। একজন একজন করে ঘোড়ার পিঠে চড়ছে। আমরা তখন নতুন গেছি ঐ স্টেশনে। ওখানকার ছেলেদের সঙ্গে তখনও-ভালো পরিচয় হয়ে ওঠেনি। আমারও একটু ইচ্ছা হলো ঘোড়ায় উঠার। ঘোড়ার কাছে গিয়ে একবার উঠবারও চেষ্টা করলাম কিন্তু ঐ ছেলেরা এসে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল আমাকে। আমি ভাবলাম ওদের সাথে আর ঝামেলা করে লাভ নাই, সরে আসলাম ওখান থেকে। দূর থেকে ব্যাপারটা দেখছিল তাহের। ও এসে বলে, মেজ ভাই দাঁড়ান। তারপর সোজা চলে গেল ছেলেগুলোর কাছে। বলে, তোমরা আমার ভাইরে ফেলে দিলা কেন? এক ছেলে বলে, কি হইছে তাতে? তাহের বলে, কি হইছে মানে? বলে সে এক ঘুষি বসিয়ে দেয় ছেলেটাকে। বাকি ছেলেরা মিলে তখন সব মারতে আসে তাহেরকে। তাহেরও একাই মারামারি করে যায় অতগুলো ছেলের সঙ্গে। পরে আমি গিয়ে মারামারি থামালাম।
আশরাফুন্নেসা বলেন : খুব মনে আছে আমার। পরে নান্টুরে বলছিলাম, ঠিক করছিস। অন্যায়রে প্রশ্রয় দিবি না।
বাবা মহিউদ্দীন ভুলতে পারেন না ট্রেনে ঢিল ছোঁড়ার সেই ঘটনাটি। তার চাকরি নিয়ে রীতিমতো ঝামেলায় পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। এবার একা নয়, দল বেধে ঘটনা ঘটান তাহের। সেটা ১৯৫২ সাল। রক্তাক্ত ২১ ফেব্রুয়ারি গেছে মাস কয়েক আগে। তিনি তখন চট্টগ্রামের মোলশহর স্টেশনের স্টেশন মাস্টার। একদিন শোনা গেল ভাষা আন্দোলনের রক্তারক্তির হোতা মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন ট্রেনে চেপে দোহাজারী যাবেন। তাকে যেতে হবে ষোলশহর স্টেশন পেরিয়ে। তাহের আরও কয়েকজন ছেলেকে নিয়ে ঠিক করে নুরুল আমিনের ট্রেনে পাথর ছুঁড়ে মারবে। নুরুল আমিন ঠিক ঠিক যখন ষোলশহর পেরিয়ে যাচ্ছেন, তাহেরের নেতৃত্বে ঝোঁপের আড়ালে বসে থাকা কিছু বালক ট্রেনটিকে লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়ে মারে। নুরুল আমিনের গায়ে লাগল না ঠিক কিন্তু মনের ঝালটা তো মেটানো গেল? কিন্তু পুলিশের নজর এড়ায়নি ব্যাপারটি। তদন্ত হয় এবং খোঁজ পাওয়া যায় যে স্টেশন মাস্টারের ছেলেও জড়িত আছে এতে! ব্যাপারটিকে অল্প বয়সী ছেলেদের দুষ্টুমী হিসেবে তখন বিবেচনা করা হলেও ছেলের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলা হয় স্টেশন মাস্টার মহিউদ্দীন আহমদকে। বলা হয় ভবিষ্যতে এমন কিছু ঘটলে তার চাকরি চলে যাবে।
কৈশোরে তাহেরের সঙ্গে মিলে জঙ্গল অভিযানের স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে আছে ছোট ভাই আনোয়ারের ভ্রাম, চট্টগ্রাম আর সিলেটের রেল স্টেশনগুলো সব একরকম জঙ্গলের ভেতরেই। আর সুযোগ পেলেই তাহের চলে যেতেন জঙ্গলের ভেতরে। দুর্গম সব এলাকায় ঘুরে বেড়াতেন একা একা। তখন তারা চট্টগ্রামের মিরেশ্বরাই স্টেশনে। পাশেই পাহাড় আর তার ওপর ঘন বন।
আনোয়ার বলেন, আমার মনে আছে একদিন রাতে ভাত খেতে খেতে তাহের ভাই বললেন, কালকে খুব ভোরে নাস্তা খাওয়ার আগে জঙ্গলে যাব। শুনলাম অনেক ভিতরে নাকি একটা আমলকী বন আছে, খুঁজে বের করব। কে কে যাবে? আমি হাত তুললাম, হাত তুললেন দাদাভাই, শেলী আপী। মা আপনি ভাত বেড়ে দিতে দিতে বললেন; সঙ্গে এবং ম্যাচ নিবি, জন্তু জানোয়ার দেখলে আগুন জ্বালায়ে দিবি।
পরদিন সূর্য ওঠার আগে জঙ্গলে রওনা দিলাম আমরা। আমলকী বন খুঁজে বের করব। আমাদের অ্যাডভেঞ্চারের নেতা তাহের ভাই। আমি, দাদাভাই, শেলী আপা ফলোয়ার। ঘন গাছ আর লতা পাতা সরিয়ে অনেক ভেতরে যেতে যেতে সত্যি আবিষ্কার করলাম আমলকী বন। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। চারদিকে শুধু আমলকী আর আমলকী। গাছে গাছে আমলকী, মাটিতে পড়ে আছে আমলকী। মুখে পুরলাম অনেক। শুরুতে টক, পরে মিষ্টি ঐ আজব ফল খেলাম কতকগুলো, পকেটে পুরলাম। হঠাৎ এক বিপদ। দেখি চারদিক থেকে অনেক বিশাল বিশাল হনুমান সব ছুটে আসছে আমাদের দিকে। মা আপনার কথা মতো তাহের ভাই পকেটে ম্যাচ নিয়েছিলেন। খুব তাড়াতাড়ি কতকগুলো শুকনা পাতা জড়ো করে পকেট থেকে ম্যাচটা বের করে আগুন ধরিয়ে দিলেন উনি। পালিয়ে গেল হনুমানগুলো। সেদিন সত্যি ভয় পেয়েছিলাম খুব।
আকৈশোর অ্যাডভেঞ্চারের জন্য মুখিয়ে থাকতেন তাহের। তখন তার অ্যাডভেঞ্চারের পরিধি অবশ্য ডাকাত ধরা আর হনুমান তাড়ানোর মতো নিরীহ বিষয়গুলোতে সীমাবদ্ধ। কিন্তু তাহেরের ভাবনায় একটা বড় বদল ঘটে চট্টগ্রাম প্রবর্তক সংঘ স্কুলে পড়বার সময়। তার ভাবনায় তখন যোগ হয় রাজনৈতিক মাত্রা। প্রবর্তক সংঘ স্কুলে তাহের এক শিক্ষককে পান যিনি ছিলেন মাস্টারদা সূর্যসেনের সহযোগী। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। তাহের তার কাছ থেকে শোনেন ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের গল্প!
শিক্ষক ক্লাসে বলেন : তোমাদের এখন যা বয়স তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বয়স, অসম্ভবকে সম্ভব করার বয়স। আমরা যখন ব্রিটিশদের অস্ত্রাগার লুট করে জালালাবাদ পাহাড় থেকে ওদের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলাম তখন আমার বয়স তোমাদের মতোই, পনেরো, ষোলো। আমাদের দলের অধিকংশই ছিল এমনি নবীন কিশোর। আমরা কজন মিলে এই চট্টগ্রামে বসে পুরো ব্রিটিশ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলাম। চট্টগ্রামকে স্বাধীন করে ফেলতে চেয়েছিলাম আমরা।
রোমাঞ্চিত হন তাহের, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের আরও গল্প শুনতে চান সেই শিক্ষকের কাছে। কিশোর তাহেরের উৎসাহ দেখে সে শিক্ষক একদিন তাহেরকে বলেন : চলো, তোমাকে একদিন জালালাবাদ পাহাড়ে নিয়ে যাবো।
সেই শিক্ষক আর তাহের একদিন গিয়ে পৌঁছান চট্টগ্রাম হাটহাজরী রোডের ঝরঝরিয়া বটতলীর কাছের জালালাবাদ পাহাড়ে। স্তব্ধ পাহাড়ের উঁচু নিচু খাদে প্রবীণ শিক্ষকের পাশে পাশে হাঁটেন তাহের।
শিক্ষক বলেন : মাস্টারদা পুরো ভারতবর্ষকে একটা ঝাঁকুনি দিতে চেয়েছিলেন। সেই ত্রিশ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়েছিল। যুগান্তর, অনুশীলন এসব বিপ্লবী দল ছিল কিন্তু তারা তখন শুধু শরীরচর্চা আর আইন অমান্য আন্দোলনের মধ্যেই নিজেদের সীমিত রেখেছিল। মাস্টারদা তখন অনেক বিপ্লবীদের সঙ্গে কথা বলেছেন একটা বড় কোনো অভ্যুত্থান সংগঠিত করবার সম্ভাবনা নিয়ে। কিন্তু তারা সবাই বলতেন অভ্যুত্থানের সময় এখনও আসেনি। মাস্টারদা তাদের সাথে একমত ছিলেন না। তিনি তখনই একটা চূড়ান্ত কিছু করতে চাইছিলেন। নিজেই তাই একটা গোপন বিপ্লবী দল করে অভিনব একটা কিছু করবার পরিকল্পনা করেন। আমি সেই গোপন দলে যোগ দিয়েছিলাম। আমরা ঠিক করেছিলাম সশস্ত্র অভুত্থানের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামকে স্বাধীন ঘোষণা করব।
তাহের : কিন্তু স্যার, এতবড় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভেতর শুধু চট্টগ্রামকে স্বাধীন করে কি খুব একটা লাভ হতো, আপনারা পুরো ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার কথা ভাবলেন না কেন?
শিক্ষক : আমাদের অত শক্তি তো ছিল না। আমরা জানতাম শুধুমাত্র একটা জেলায় অধ্যান করলে বিশাল ক্ষমতাধর ব্রিটিশরা তা দমিয়ে দেবে। কিন্তু মাস্টারদা বলতেন আমরা যদি কিছুদিনের জন্য হলেও চট্টগ্রামকে স্বাধীন রাখতে পারি, তাহলে সেটাও ব্রিটিশদের জন্য একটা বিরাট আঘাত হতে পারে। আমরা যদি ব্যর্থও হই, মৃত্যুবরণ করি তাহলেও এটি হতে পারে ভারতবর্ষের মানুষের জন্য বিশাল প্রেরণা। আমাদের আত্মহুতি ভারতের মুক্তি আন্দোলনকে জোরদার করতে পারে।
আগ্রহী তাহের ঐ অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের গল্পটি আরও বিস্তারিত জানতে চান, বলেন। আপনারা স্যার কয়জন ছিলেন ঐ দলে?
শিক্ষক : আমরা অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অপারেশনে সর্বসাকুল্যে তেষট্টিজন ছিলাম। পাহাড়তলী রেলওয়ের ওখানে ব্রিটিশদের অস্ত্রাগার ছিল। আমরা ঠিক করেছিলাম সেই অস্ত্রাগার লুট করব। সেই অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করব দামপাড়ার রিজার্ভ পুলিশ ঘাঁটি। পাশাপাশি আমরা ব্রিটিশদের প্রমোদের জায়গা ইউরোপিয়ান ক্লাব এবং টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন অফিসও আক্রমণ করব। আরও ঠিক করেছিলাম জেলের ফটক খুলে মুক্ত করে দেবে সব রাজবন্দিদের। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম শহরের প্রধান শক্তিগুলো আমাদের দখলে আনবার পর আমরা চট্টগ্রামকে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করব এবং মাস্টারদা সূর্যসেনকে ঘোষণা করব প্রজাতন্ত্রের সভাপতি।
তাহের : এই সব কাজই কি স্যার করতে পেরেছিলেন?
শিক্ষক : সবগুলোতে সফল না হলেও টেলিগ্ৰাফি অফিস আর অস্ত্রাগার ঠিকই দখল করেছিলাম। যদিও শেষ পর্যন্ত আমরা সেটা রক্ষা করতে পারিনি। পুরো অপরেশনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন মাস্টারদা। ১৮ এপ্রিল ১৯৩০-এ আমরা অপারেশনটি করেছিলাম। আগের দিন চট্টগ্রাম শহরে তিনটি ইস্তেহার বিলি করেছিলাম। একটি আমাদের দল ভারতীয় প্রজাতান্ত্রিক বাহিনীর উদ্দেশ্যে, একটি ছাত্র, যুবকদের উদ্দেশ্যে, একটি সাধারণ চট্টগ্রামবাসীদের উদ্দেশ্যে। এখনও আমার সেই ইস্তেহারের ভাষা মনে আছে … ভারতীয় প্রজাতান্ত্রিক বাহিনীর চট্টগ্রাম শাখা এতদ্বারা ঘোষণা করিতেছে যে, যুগ যুগ ধরিয়া যে ব্রিটিশ এবং তার সরকার ভারতের ত্রিশ কোটি জনসাধারণকে তাহাদের হিংস্র শোষণনীতি দ্বারা নিপীড়িত করিয়াছে… তাহার বিরুদ্ধে প্রবল সংগ্ৰাম ঘোষিত হইল। ভারতবর্ষের জনসাধারণই ভারতের প্রকৃত অধিকারী … এরকম।
তাহের : আপনারা কি অস্ত্রাগারই প্রথম আক্রমণ করলেন?
শিক্ষক : আমরা অনেকগুলো দলে ভাগ হয়ে গিয়েছিলাম। সবাই আমরা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর পোশাক খাকি শার্ট আর হাফপ্যান্ট পরে নিয়েছিলাম। সাথে ছিল শুখা ভোজালি, ওয়াটার পট এসব। আমাদের প্রথম দলটি যায় নন্দনকাননে টেলিফোন, টেলিগ্রাফ অফিসে ওদের সংবাদ সরবরাহ ব্যবস্থা বিকল করে দিতে। ঐ দলে ছিল আনন্দগুপ্ত, তখন মিউনিসিপল স্কুলে ক্লাস টেনে পড়ত। ঠিক তোমার সমান। অম্বিকা চক্রবর্তী ঐ দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। আনন্দই গিয়ে টেলিগ্রাফ অপারেটরকে ঘায়েল করে দখল করে নেয় দপ্তরটি। অস্ত্রগার দলের নেতৃত্বে ছিলেন নির্মল সেন, অনন্ত সিংহ আর লোকনাথ বল। তাদের দলটি পিস্তু দিয়ে পাহাড়তলীর অস্ত্রাগার রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্রিটিশ সার্জেন্ট ফ্যারেলকে হত্যা করে। অন্য রক্ষীরা আত্মসমর্পণ করলে তারা অস্ত্রাগারের সব অস্ত্র ভাড়া করা একটি মোটরগাড়িতে করে দামপাড়া রিজার্ভ পুলিশ ঘাঁটিতে নিয়ে আসে। মাস্টারটা সেখানেই তার দল নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। সেখানেই ছিল অভ্যুত্থানের হেডকোয়ার্টার। আমিও মাস্টারটা সঙ্গে ছিলাম। সেদিন রাতে ঘর থেকে বেরুবার আগে মাকে প্রণাম করেছিলাম। মা অবাক হয়ে বলেছিলেন, হঠাৎ এই রাতের বেলা প্রণাম করছিস কেন? আমি বলেছিলাম, এমনিতেই প্রণাম করতে ইচ্ছা হলো তাই। কিন্তু বলতে পারিনি যে কিছুক্ষণ পরেই ঘর থেকে বেরিয়ে যাব, হয়তো আর ফিরব না।
অস্ত্রাগার থেকে আনা অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আমরা দামপাড়া ঘাঁটি আক্রমণ করি। আমাদের সব খাকি পোশাক দেখে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল পুলিশের। ঘটনার আকস্মিকতায় তারা প্রতিবাদ ছাড়াই আত্মসমর্পণ করে। পুলিশ ফাড়ি আমাদের দখলে চলে আসে। আমরা স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করে তুলি চট্টগ্রামের আকাশ, বন্দে মাতরম, স্বাধীন ভারত কি জয় আরেকটি দল ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ক্লাবেও আক্রমণ করতে যায়। পরে অবশ্য খোঁজ পেয়ে ব্রিটিশ বাহিনী সাঁড়াশি আক্রমণ চালায় দামপাড়ায়। মাস্টারদা আমাদের এখান থেকে সরে যাবার নির্দেশ দেন। আমরা যথাসম্ভব অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নানা পথ ঘুরে শেষে জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্র্য নিই।
কিন্তু শেষে এক কাঠুরিয়া আমাদের দেখে খোঁজ দেয় পুলিশকে। পুলিশ ঘিরে ফেলে জালালাবাদ পাহাড়। শুরু হয় দুর্ধর্ষ লড়াই। পুলিশ কিছুক্ষণ পাহাড়ের নিচ থেকে তারপর পাশের একটি পাহাড়ে উঠে সেখান থেকে গুলিবর্ষণ শুরু করে। আমরাও পাল্টাগুলি চালাই। যেখানে তুমি দাঁড়িয়ে আছে সেখানে শুয়েই রাইফেল হাতে বিপ্লবীরা তুমুল যুদ্ধ চালিয়ে গেছে।
তাহের : ঠিক এ জায়গাটাতেই স্যার?
শিক্ষক : হ্যাঁ। আমার মনে পড়ছে মাস্টারদা ক্রলিং করে করে সবাইকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন আমার পাশেই প্রথম গুলিবিদ্ধ হলো হরিগোপাল বল, ক্লাস নাইনে বুঝি পড়ত সে। আমাদের সাথে প্রচুর গোলাবারুদ ছিল। ফলে আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাই। পুলিশ ভাবতেই পারেনি যে আমরা সংখ্যায় এত কম হতে পারি। এক পর্যায়ে তারা পিছু হঠে। আমাদের সাময়িক বিজয় হয়। যদিও আমরা সে যুদ্ধে আমাদের তেরো জন বিপ্লবীকে হারাই।
শিহরিত তাহের জালালাবাদ পাহাড়ে দাঁড়িয়ে যেন শোনেন বহুবছর আগের সেই গুলির শব্দ। অবচেতনে ঘটে যায় তার অভ্যুত্থানের পাঠ। এ গল্প গভীরভাবে মনে গেঁথে যায় তাহেরের। সেই শিক্ষক তাকে নানা দেশের সশন্তু অন্ধনের ইতিহাস বিষয়ক বই দেন। তার কাছ থেকেই তাহের খোঁজ পান আইরিশ নেতা মাইকেল কলিন্স আর ডি-ভ্যালেরার। তোলপাড় ঘটতে থাকে তাহেরের কিশোর মনে মনে ভাবেন, শাফাত ডাকাত নয়, দরকার একটা বড় কোনো শত্রু, যার সঙ্গে এভাবে লড়াই করা যাবে। বহু বছর পর তাহের যে অভূত্থানটির নেতৃত্ব দেবেন আমরা দেখে অবাক হবো সেই অপারেশনটির সঙ্গে কি বিস্তর মিল রয়েছে। তারু কিশোর মনে ঘোর লাগা এই অস্ত্রাগার লুণ্ঠন অপারেশনের।
প্রবর্তক সংঘের সেই শিক্ষকের সঙ্গে তাহেরের সাহচর্যে ছেদ পড়ে তার বাবার বদলি হবার কারণে। আবার স্কুল বদল করতে হয় তাহেরকে। এবার তিনি ভর্তি হন কুমিল্লার ইউসুফ স্কুলে পড়াশোনায় মনোযোগী হলেও ইতোমধ্যে তার মনের ভেতর ঢুকে গেছে বিপ্লব আর গোপন বিপ্লবী রাজনীতির বীজ। বই পড়ার নেশায় পেয়েছে তাকে। ইউসুফ স্কুলে বিতর্ক আর খেলাধুলা করে বেশ নামও হয়েছে তার। স্কুলের এক বিতর্ক অনুষ্ঠানে তাহেরের পরিচয় হয় তাহের উদ্দীন ঠাকুরের সঙ্গে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের তরুণ নেতা তাহের উদ্দীন ঠাকুর। চৌকশ তাহের নজর কাড়ে তাহের উদ্দীন ঠাকুরের। তাহেরকে তিনি বলেন : ম্যাট্রিক পাস করে চলে এসো ভিক্টোরিয়া কলেজে, আমার সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়ন করবে। তাহের উদ্দীন ঠাকুর রাজনীতির আরও নতুন অনেক বই তুলে দেন তাহেরের হাতে। রুশ বিপ্লব, চীনা বিপ্লবের বই। একটু একটু করে নতুন এক জগত ক্রমশ উন্মোচিত হতে থাকে তার সামনে
এর মধ্যে তাহের ব্যস্ত হয়ে পড়েন ম্যাট্রিক পরীক্ষা নিয়ে। কিন্তু ঝামেলা বাধে একটি ব্যাপারে। নিয়মমাফিক ম্যাট্রিকে ছাত্রছাত্রীদের বিষয় হিসেবে হয় উর্দু নয়তো আরবি নিতে হবে। তাহের বাগড়া বাধান।
প্রধান শিক্ষককে গিয়ে বলেন স্যার আমি আরবি পড়ব না।
শিক্ষক বলেন : তাহলে উর্দু পড়ো।
তাহের : উর্দু তো স্যার প্রশ্নই ওঠে না। আমি সংস্কৃত পড়তে চাই। আমি স্যার বোর্ড থেকে সিলেবাস বই যোগাড় করে দেখেছি, কেউ চাইলে বিকল্প হিসেবে সংস্কৃতও পড়তে পারে।
শিক্ষক বলেনঃ কিন্তু আমাদের তো সংস্কৃত শিক্ষক নাই, তোমাকে কে পড়াবে?
তাহের : আমি স্যার তাহলে বোর্ডে লিখব একটা কোনো ব্যবস্থা করতে।
শেষে খোঁজ পাওয়া যায় যে দূরের একটি স্কুলে একজন সংস্কৃত শিক্ষক আছেন। তাহেরকে বলা হয় যদি তিনি ঐ শিক্ষকের কাছে গিয়ে সংস্কৃত পড়ে আসতে পারেন তবে তাকে অনুমতি দেওয়া হবে। বেশ অনেকটা হাঁটা পথ কিন্তু তিনি তাতেই রাজি। নাছোড়বান্দা তাহের আরবি নয় সংস্কৃত নিয়েই ম্যাট্রিক দেন।
খানিকটা চারন বিপ্লবীপনা, কিছুটা গোপন রাজনীতির রোমাঞ্চের ছোঁয়া আর নিরন্তর প্রতিবাদের উত্তেজনা নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকেন তাহের। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর ভর্তি হতে চান ভিক্টোরিয়া কলেজে। তাহের উদ্দীন ঠাকুর তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছেন আগেই। বাধ সাধেন বড় ভাই আরিফ! আরিফই অভিভাবক তখন। তাহেরের পড়াশোনার খরচও চালাচ্ছেন তিনি। আরিফ বলেন; ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়া চলবে না, ওখানে গেলে তুমি পলিটিক্স করবে, পড়াশোনা আর হবে না।
আরিফ তাকে বলেন সিলেটের মুরারী চাঁদ কলেজে ভর্তি হতে। মুরারী চাঁদ কলেজ, এম সি কলেজ নামে পরিচিত। ভালো একটা হোস্টেল আছে সেখানে। তাছাড়া কড়া শাসন আর শৃঙ্খলার জন্য কলেজটি তখন বিখ্যাত। মৃদু প্রতিবাদ করলেও তাহেরের সঙ্গে বড় ভাই আরিফের সম্পর্ক শ্রদ্ধার। তার সিদ্ধান্তই মেনে নেন তাহের। তাহের উদ্দীন ঠাকুরের সঙ্গে সেখানেই যোগাযোগের ছেদ পড়ে তাহেরের। অনেক বছর পর আবার তাহেরুদ্দীন ঠাকুরের সঙ্গে তাহেরের দেখা হবে দেশের নাটকীয় এক পরিস্থিতিতে। তখন তারা দুজন পৃথক দুই জগতের বাসিন্দা।
এম সি কলেজে গিয়ে ভালোই লাগে তাহেরের। ব্যারাকের মতো চারটা ব্লকে হোস্টেল, ঘন্টা বাজিয়ে ডাইনিং এ দেওয়া হয় খাবার। সকাল বেলা রুমে রুমে চা দিয়ে যায় ডাইনিং বয়। বেশ আয়োজন। তবে তিনি লক্ষ্য করেন ছাত্রদের মধ্যে দুটো ভাগ সেখানে। সিলেটি আর অসিলেটি। দুদলের মধ্যে বেশ একটা চাপা দ্বন্দ্বও আছে। অবশ্য অসিলেটি দলটি খুবই ক্ষুদ্র। কলেজের পঁচানব্বই ভাগ ছাত্রই সিলেটি। ফলে অসিলেটরা বেশ কোণঠাসা। তাহের যদিও অসিলেটি কিন্তু কলেজে এসেই খেলাধুলা, বক্তৃতা ইত্যাদি করে তার জায়গাটা বেশ শক্ত করে নিয়েছেন।
অধিকাংশ অসিলেটিরা একটু অপ্রতিভ থাকলেও দুজন ছাত্রকে তাহের বেশ দাপটে ঘুরে বেড়াতে দেখেন। একজন বগুড়ার মঞ্জু আর অন্যজন আসামের মজুমদার। দুজনই তার ক্লাস নিচে পড়াশোনা করছেন কিন্তু তাদের সাহসী চলাফেরার কারণে ওদের সঙ্গেই সখ্যতা গড়ে ওঠে তাহেরের।
মঞ্জু এক কাণ্ড করে বসেন একদিন। ঘটনা জালালী কবুতর নিয়ে। কলেজের হোস্টেলে ভিড় করে থাকে প্রচুর জালালী কবুতর। সিলেটিদের কাছে অতি পবিত্র এই পাখি। কথিত আছে এই পাখি সিলেটের হযরত শাহজালালের স্নেহধন্য। সিলেটিরা তাই জালালী কবুতরকে সমীহের চোখে দেখে। ধরা তো দূরের কথা কখন বিরক্তও করে না। কিন্তু একদিন কয়েকটি জালালী কবুতর ধরে একেবারে জবাই করে রান্না করেন মঞ্জু। সিলেটিদের মধ্যে তুলকালাম পড়ে যায়। ওদের ক্ষেপানোর জন্যই কাজটা করেন তিনি। প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ সিলেটি ছেলেরা মঞ্জুকে পেটানোর পরিকল্পনা করে। তাহেরের মধ্যস্থতায় শেষে ব্যাপারটার নিস্পত্তি হয়।
আগে হলে তাহেরও হয়তো মজা পেতেন এই অ্যাডভেঞ্চারে কিন্তু ইতোমধ্যে এসব বালখিল্যতার পর্ব যেন পেরিয়ে এসেছেন তিনি। মঞ্জুকে বলেন : এসব করে পারকে ওদের সঙ্গে? এসব পেটি এনিমির বিরুদ্ধে, সিলি প্রটেস্ট করে কোনো লাভ নেই। লেট আস থিংক বিগ।
তাহেরের মাথায় তখন বিগ থিংকিং। তিনি সত্যিই তখন ধীরে ধীরে নিজেকে অনেক বড় ভাবনায় জড়িয়ে ফেলছেন। কলেজে উঠে পড়াশোনার মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে তাহেরের। দিনরাত বই পড়ার নেশায় মত্ত তিনি। যতটা পড়ার বই, তার চেয়ে বেশি আউট বই। দেশ বিদেশের আন্দোলন আর বিপ্লবের বই বুঁদ হয়ে পড়েন তাহের। রুশ, চীন, আলজেরিয়ার সশস্ত্র বিপ্লব, এমনকি এদেশের সাঁওতাল বিদ্রোহ, নানকার বিদ্রোহের ইতিহাস পড়েন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। রাজনীতির নতুন নতুন পাঠে তাহের তখন উত্তেজিত।
ইতিহাসের পাতা থেকে যখন ফিরে আসেন নিজের দেশে তখন বুঝে নিতে চেষ্টা করেন রাজনীতির সমীকরণগুলো। মনে তার ভাবনার বুদ্বদ। একটা বড় কিছু করতে হবে বড় কোনো শত্রুর বিরুদ্ধে। বাঙালি তরুণের কাছে তখন মূর্তিমান শত্রু পশ্চিম পাকিস্তান। লড়তে হবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে। সেসব নিয়ে আজ্ঞা চলে মঞ্জু আর মজুমদারের সঙ্গে।
মফস্বল শহর সিলেটের এম সি কলেজের কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে টগবগ করেন তাহের, মঞ্জু, মজুমদার। একবার ঠিক করেন তিনজন মিলে একটা দেয়াল পত্রিকা বের করবেন। বের হয় পত্রিকা এবং তিনজন মিলেই লেখেন পত্রিকার লেখাগুলো। রাজনৈতিক লেখা। তাহের লেখেন ভাষা-অন্দোলন নিয়ে। স্পষ্ট লেখেন পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের বনবে না কখনোই। এখন ওরা ভাষা নিয়ে বাগড়া বাঁধিয়েছে, সামনে আরও নতুন নতুন ঝামেলা তৈরি করবে। লেখেন ব্রিটিশরা ভারত ভেঙ্গেছে এবার আমার প্রকিস্তান ভাঙ্গতে হবে। এ লেখা পড়ে ছেলেরা হাসে। তাকে খেতাব দেয় দেশ ভাঙ্গার মিস্ত্রি।
সন্দেহ নেই পঞ্চাশ দশকের সামাঝি মফস্বলের এক কলেজের অখ্যাত তরুণের দেশ ভাঙ্গার ভাবনা নিতান্তই ঠাট্টার ব্যাপার। তবে অখ্যাত এই তরুণের মনের কথা কিছুদিনের মধ্যেই শোনা যায় বিখ্যাত এক রাজনৈতিক নেতার মুখেও। মাওলানা ভাসানী এক সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিজাতীয় আচরণ নিয়ে কড়া ভাষায় বক্তৃতা দেন। এও বলেন আপনাদের সঙ্গে বনিবনা না হলে আমরা কিন্তু বলে দেব, ওয়ালাইকুম আসসালাম।
তাহেরের হাতে একদিন আসে কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো। বইটি পড়ে খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়েন তাহের। বইটি বদলে দেয় তার সব ভাবনা। বইটি তাকে এতই প্রভাবিত করে যে অনেক বছর পরে ছোট ভাই আনোয়ারকে যখন তিনি বইটি পাঠান তখন সাথে লেখেন-রিড় দিস। দিস ইজ দি বেস্ট বুক দ্যাট আই হাত রেড সো কার।
কাঁচা বয়সের নানা বিক্ষিপ্ত উত্তেজনা এম সি কলেজে থাকতেই ক্রমশ তাহেরের মধ্যে একটা সুসংহত রূপ নিতে থাকে। তার স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের প্রণোদনার সঙ্গে যুক্ত হয় স্পষ্ট রাজনৈতিক মাত্রা। কৈশোরে ব্রিটিশবিরোধী সন্ত্রাসবাদীদের রোমহর্ষক অভিযান, তাদের আত্মত্যাগ, দেশপ্রেম তাহেরকে উদ্দীপিত করলেও যৌবনে এসে তাহের টের পান শত্রুর সঙ্গে মোকাবেলা করবার জন্য এগুলোই শেষ কথা নয়, প্রয়োজন একটি বিশ্ববীক্ষা। শত্রুকে সরিয়ে ঠিক কি ধরনের একটা সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাই প্রয়োজন তার একটা স্পষ্ট রূপরেখা। তাহের সেই বিশ্ববীক্ষা পান মার্ক্সবাদী বইপত্র পড়ে। তার মনে হয় দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ দিয়েই পৃথিবীকে দেখা যায় সবচেয়ে স্পষ্টভাবে। মনে হয় পৃথিবীতে বুঝিবা এখনও চলছে প্রাগৈতিহাসিক কাল, যেদিন মানুষের শ্রেণীতে শ্রেণীতে ব্যবধান ঘুচে যাবে, যেদিন পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হবে সমাজতন্ত্র বুঝি সেদিনই শুরু হবে প্রকৃত ইতিহাস।
তাহের সমাজতন্ত্রের ব্যাপারে আকৃষ্ট হন তখনকার অনেক তরুণের মতোই। তবে এর সঙ্গে যুক্ত হয় ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের ব্যাপারে তার কৈশোরিক আকর্ষণ। ফলে মার্ক্সবাদের সামরিক দিকটির ব্যাপারে তাহের বিশেষভাবে মনোযোগ দেন। কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করতে হলেও চাই যুদ্ধ, চাই অস্ত্র এই ধারণা তাহেরকে উদ্বুদ্ধ করে বেশি। কমিউনিজমের সঙ্গে যুদ্ধের সম্পর্ক নিয়ে মার্ক্স, এঙ্গেলস উভয়ের লেখাগুলোই খুঁটিয়ে পড়েন তিনি। পান পলিটিকো মিলিটারি লিডারশিপের কথা। এ নিয়ে ভাই ইউসূফ আর আনোয়ারের সঙ্গে শুরু করেন আলাপ, বইপত্র দেওয়া নেওয়া।
বিশেষ করে এঙ্গেলস তার এন্টিডুরিং বইয়ে যুদ্ধের সমাজতান্ত্রিক এবং দার্শনিক দিক নিয়ে যে আলোচনা করেছেন তা মনোযোগ আকর্ষণ করে তাহেরের। লাল কালি দিয়ে দাগিয়ে রাখেন সে সব লাইন যেখানে তৎকালীন প্রশিয়ার জেনারেল ক্লাউসউইৎস বলছেন, যুদ্ধবিদ্যাকেও শিখতে হবে ঠিক চিকিৎসাবিদ্যা বা পদার্থবিদ্যার মতো। সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে একটা ন্যায়যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তার কথা বিশেষেভাবে তাহের উপলব্ধি করেন লেনিন, রোজা লুক্সেমবার্গ, বুখারিন, ট্রটস্কি এদের লেখা পড়ে। মাও সে তুং এর মিলিটারি রাইটিংগুলো আনোয়ারকে নিয়মিত পাঠাতে থাকেন তিনি। যারা কমিউনিস্ট, পাশাপাশি সশস্ত্র যোদ্ধা তাদের ব্যাপারেই আকর্ষণ বোধ করেন তাহের। সে সূত্র ধরেই পরবর্তীতে তিনি ভক্ত হয়ে ওঠে হো চি মিন, ক্যাস্ট্রো আর চে গুয়েভারার। কৈশোরে জালালাবাদের পাহাড়ে শোনা অদৃশ্য গুলির শব্দ তাহের যেন বয়ে বেড়ান আজীবন। চিকিৎসাবিদ্যা আর পদার্থবিদ্যার মতো যুদ্ধবিদ্যাটি শিখবার অদম্য ইচ্ছা হয় তার।
একদিন মঞ্জুকে ডেকে তাহের বলেন, ভেবে দেখলাম পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের একটা যুদ্ধ করতে হবে। যুদ্ধ ছাড়া ওদের হঠানো যাবে না।
মঞ্জু : কি বলেন আপনি এসব, পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমরা কি করে যুদ্ধ করব তাহের ভাই?
তাহের : কেন ব্রিটিশদের মতো এমন বিশাল পাওয়ারের বিরুদ্ধে আমাদের ইয়াং ছেলেমেয়েরা ফাইট করেনি? ওরা ওর্গানাইজড ছিল না বলে হেরে গেছে কিন্তু রীতিমতো ভয় পাইয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশদের। তবে ইউ আর রাইট এমনি যুদ্ধে পারা যাবে না ওদের সাথে, গেরিলা ওয়ার করতে হবে। ঠিক করেছি কলেজ থেকে পাস করে আর্মিতে যাব।
মজুমদারঃ জোক করছেন? পাকিস্তান আর্মিতে যেয়ে আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন?
তাহেরঃ ওয়ার ফেয়ারটা শিখতে হবে না? ওদের কাছ থেকে যুদ্ধ বিদ্যাটা শিখে ওদের বিরুদ্ধেই সেটা ব্যবহার করব। আর্মি ট্রেনিংটা নেওয়া থাকল সময় সুযোগমতো আর্মি থেকে বেরিয়ে এসে নিজেই একটা গেরিলা দল তৈরি করব। আই এম সিরিয়াস। জোক করছি না কিন্তু।
মঞ্জুঃ ভালো কথা জোক করছেন না। কিন্তু আমাদের কি হবে? আমাদের নেবেন আপনার গেরিলা দলে?
তাহের : অফকোর্স। মঞ্জু তুমি হবে আমার সেক্রেটারি আর মজুমদারের গায়ে তো বেশি শক্তি নাই, ও যুদ্ধ পারবে না, মজুমদার হবে আমার পারসোনাল অ্যাডসস্টান্ট।
মঞ্জু : গুড আইডিয়া। তাহলে ধরে নেন আজকে থেকেই আপনি প্রেসিডেন্ট, আমি সেক্রেটারি আর মজুমদার পি এ।
তাহের বলেন : ওকে দেন। সেক্রেটারি দেখে আস তো আজকে ডাইনিং এ কি মেন্যু।
মঞ্জু স্যালুট দিয়ে বলে : ইয়েস স্যার।
অ্যান্ড ইউ মাই পিএ, গেট মি সাম পেপারস : মজুমদারকে বলেন তাহের।
মজুমদার ছুটে যান কাগজ আনতে।
সেই থেকে তিনজনের মধ্যে এই এক খেলা শুরু। খেলাচ্ছলে যেন নেতৃত্বের প্র্যাকটিস চলে তাহেরের। আশ্চর্য এই যে সেদিনের পর থেকে তারা সারা জীবন কখনো আর একে অপরকে নাম ধরে ডাকেননি। মঞ্জু আর মজুমদারের কাছে তাহের স্যার আর তাহেরের কাছে একজন সেক্রেটারি অনাজন পিএ।
তাহেরের অভ্যাস পরীক্ষার আগের রাতে কিছু না পড়া, বইয়ের ধারে কাছেও না যাওয়া। মঞ্জু আর মজুমদাররের রুমে গিয়ে তাহের বলেন : ইউ সেক্রেটারী অ্যান্ড পি এ, আজকে কোনো পড়াশোনা নাই। উই গুড় গো আউট টু ওয়াচ এ মুভি টু নাইট এ্যান্ড দ্যাটস এন ওর্ডার।
দুজন দাঁড়িয়ে বলেন : ইয়েস স্যার। তিনজন মিলে দেখতে যান সুচিত্রা উত্তমের ছবি।
সুখে দুখে মান অভিমানে এই তিনজন এম সি কলেজের দিনগুলো কাটিয়ে দেন একসাথে। কলেজ জীবনের এই দুই বন্ধুই কেবল সাক্ষী হয়ে থাকেন পঞ্চাশ দশকের তাহেরের। তাহেরের মৃত্যুর পর তার স্মরণে যখন কর্নেল তাহের সংসদ গঠিত হলো, তখন সে সংসদে সবচেয়ে মোটা অঙ্কের অনুদান দিলেন লন্ডন প্রবাসী এক ভদ্রলোক, নাম মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জু। জানা গেল ইনিই তাহেরের সেই কলেজ বান্ধব মঞ্জু। প্রৌড় মঞ্জুর সঙ্গে দেখা করলেন আনোয়ার, তার সূত্রে দেখা হলো মজুমদারের সঙ্গেও, যিনি তখন কৃষিবিদ্যার অধ্যাপক। সেইসব সোনালী দিনগুলোর কথা স্মরণ করলেন তারা। মঞ্জু বললেন : আমরা কিন্তু সেই ফিফটিজেই ধরে নিয়েছিলাম স্যার একদিন ওরকম একটা আর্মড রেলেশনকে লিড করবেন। কিন্তু কতকগুলো ভুল করে ফেললেন স্যার।
কত বছর পেরিয়ে গেছে তবু সেই মৃত বন্ধুকে স্যার বলেই সম্বোধন করেন তারা। অশ্রু সজল হয়ে ওঠে মঞ্জু, মজুমদার দুজনেরই চোখ।
এম সি কলেজ থেকেই বি এ পাস করেন তাহের। শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন চট্টগ্রামের মিরেশ্বরাইয়ের দুর্গাপুর স্কুলে। কিন্তু লক্ষ তাহের আগেই স্থির করে রেখেছেন, যোগ দেবেন আর্মিতে। চোখ কান খোলা রাখেন কখন সেনাবাহিনীতে ভর্তির ঘোষণা হয়। তারপর একদিন ঘোষণা হতেই আবেদন করে বসেন তিনি। ভর্তি পরীক্ষায় লেগে যায় গোলমাল। লিখিত, শারীরিক সব পরীক্ষায় পাস করলেও ঝামেলা বাধে মৌখিক পরীক্ষায়। ভাইবা বোর্ডে প্রশ্চিম পাকিস্তানি সব জাদরেল কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার। নানা রকম প্রশ্ন করবার পর এক অফিসার তাহেরকে নামাজের কয়েকটি সূরা পড়তে বলেন। আর্মিতে ঢুকবার শর্ত হিসেবে তার মুসলমানিত্বের পরিচয় নেওয়া হচ্ছে দেখে মনে মনে ক্ষুদ্ধ হন তিনি। তাছাড়া সূরাও তেমন মুখস্থ ছিল না তার। ফলে আটকে যান তাহের। তাকে বাদ দেওয়া হয়। আর্মিতে চুকবার প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় তাহেরের।
হতাশ হন কিন্তু হতোদ্যম হন না। ঠিক করেন আবার চেষ্টা করবেন। এই ফাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে এম এ তে ভর্তি হন তিনি। ভাবেন এ সুযোগে সমাজবিজ্ঞানটা খানিকটা ভালোমতো পড়ে নেওয়া যাক। একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকেন তাহের। কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো পড়ে ইতোমধ্যেই পুরোপুরি বাম রাজনীতির দিকে ঝুঁকেছেন তিনি। ঢাকায় এসে মার্ক্সীয় সাহিত্যের আরও লেখাপত্র যোগাড় করে তার ভাবনাগুলো গুছিয়ে নিতে থাকেন তাহের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ে পড়তে পড়তেই পরের বছর আবার আর্মিতে পরীক্ষা দেন তিনি। এবার আগে থেকে কিছু সূরাও শিখে রাখেন। কিন্তু এবার আর ধর্ম বিষয়ক প্রশ্নের জটিলতায় পড়তে হয়নি তাকে। তাহের সেনাবাহিনীর জন্য নির্বাচিত হয়ে যান।
শুরু হয় মিলিটারি একাডেমীর নতুন জীবন। মাথার ব্ৰহ্মতাল কাঁপিয়ে প্যারেড, পিটি করেন তাহের, শেখেন অস্ত্রচালনার খুঁটিনাটি। কিন্তু একডেমীর কারো জানবার কথা নয় তার গোপন মিশনের কথা, টের পাবার কথা নয় যে প্রশিক্ষণরত একজন ক্যাডেট বস্তুত ছদ্মবেশী বিপ্লবী। প্রশিক্ষণ শেষে বালুচ রেজিমেন্টে কমিশন পান তাহের। যদিও কমিশন পেয়ে অফিসার হওয়াই তার মূল উদ্দেশ্য নয়, তবু তিনি জানেন পেছনের সারির অফিসার হয়ে থাকলে তার চলবে না। সম্ভাব্য সব রকম অভিজ্ঞতা তাকে নিতে হবে। তাহেরের একাগ্রতা আর উদ্যম নজর কাড়ে সিনিয়র অফিসারদের। তাকে নেওয়া হয় প্যারা কমান্ডো দলে। ১৯৬৫-র পাক ভারত যুদ্ধে তাহের যুদ্ধ করেন কাশ্মীর আর শিয়ালকোট সেক্টরে। আহতও হন। অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী তাহের বিশেষ কৃতিত্ব দেখান প্যারাসুট জাম্পিংয়েও। তিনি তখন একমাত্র বাঙালি অফিসার যাকে মেরুন প্যারাসুট উইং সম্মান দেওয়া হয়। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনী জানে না, তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।
যেমন বলেছিলেন মঞ্জুকে তেমন পরিকল্পনা নিয়েই এগুতে থাকে তাহের। সবসময় ভাবেন তার শেখা যাবতীয় সামরিক বিদ্যা ছড়িয়ে দিতে হবে বাঙালিদের মধ্যে, তাদের প্রস্তুত করতে হবে একটা যুদ্ধের জন্য, পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। তাহের তার কল্পনার প্রথম গেরিলা বাহিনীটি গড়ে তোলেন তার ছোট ভাই বোনদের নিয়ে। আর্মি থেকে যখন ছুটিতে আসেন তখন কিছুদিনের জন্য তাদের রেলওয়ে কোয়ার্টারটিকে তিনি বানিয়ে তোলেন একটা মিলিটারি ট্রেনিং ক্যাম্প। তাহের সাধারণত আসেন শীতের সময়। সঙ্গে করে আনেন অনেক ফল। ডালিয়া আর জুলিয়া ঘুম থেকে উঠে দেখে বাড়ির বারান্দায় দড়িতে ঝুলছে আঙ্গুর, মাটিতে আপেল, আখরোট। চিলগোজা নামের এক ধরনের ফল আনেন তাহের যা এদেশে পাওয়া যায় না। ডালিয়া আর জুলিয়ার কার্ডিগেনের পকেটে ছোট ছোট চিলগোজা গুঁজে তাহের বলেন, স্কুলে সবাইকে দিয়ে খাবেন, একা একা খাবেন না কিন্ত। ছোট দুটি বোনকে আদর করে সবসময় আপনি বলেই ডাকেন তাহের।
ভোর বেলা কোয়ার্টারের সামনের মাঠে তাহেরের নির্দেশে লাইন করে দাঁড়ান আনোয়ার, সাঈদ, শেলী, বাহার, বেলাল। তার ব্যক্তিগত ব্যাটালিয়ান। তাহের তাদের শেখান আর্মি থেকে শিখে আসা কমান্ডো প্যারা পিটি, শেখান কিভাবে খালি হাতে শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় আঘাত করে তাকে কাবু করা যায়। শেখান হাত বোমা বানাতে। বলেন, শোন একদিন বাঙালিদের সাথে যুদ্ধ হবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের। সে যুদ্ধে তোমরা হবে গেরিলা ফাইটার।
কুয়াশায় ঢাকা কয়েকজন ক্ষুদে যুদ্ধবাজ গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনে তাদের কমান্ডারের নির্দেশ।
শীতের রাতে কোনো কোনোদিন উঠানে সবাই গোল হয়ে বসে। আশরাফুন্নেসা বানান উঠান পোড়া পিঠা। চালের গুড়াকে পেঁয়াজ, মরিচ, আদা দিয়ে মাখিয়ে কলা পাতা দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়। উঠানে বিছানো হয় খড়, সে খড়ের উপর রাখা হয় কলা পাতায় মোড়ানো সেই পিঠা, তারপর আবার সেই পিঠাগুলোকে চাপা দেওয়া হয় এক গাদা খড় দিয়ে। এর পর সেই পড়গুলোতে লাগিয়ে দেওয়া হয় আগুন! পিঠা পুড়তে থাকে আবার চারপাশে বসে শীতের রাতে আগুন পোহানও হয়। খড়ের আগুন উঁচু হতে থাকে। আরেকটু খড় দিলে আরেকটু উঁচু হয় আগুনের শিখা। তাহের বলেন, শর্ত আছে। যারা লাফ দিয়ে এই আগুন পার হতে পারবে, শুধু তারাই এই পিঠা পাবে।
শীতের রাত। হিম অন্ধকারে নিঝুম হয়ে আছে কাজলা গ্রাম। আশরাফুন্নেসার উঠানে জ্বলে আগুন। তাহেরের নির্দেশে এক এক করে ভাই বোনেরা দেন আগুন পার হওয়ার পরীক্ষা। যেন কোনো আদিম গোত্র প্রধান নিজেদের টোটেমকে সামনে রেখে দলের সদস্যদের দীক্ষিত করছেন আসামি কালের বাইসন শিকারের মন্ত্রে।
খানিকটা দলছুট, ছেলেমানুষের মতো পারিবারিক প্লাটুন বানালেও তাহের জানেন যে এভাবে বিপ্লব হয় না। প্রয়োজন যথার্থ পার্টির। কোনো পার্টির সাথে নিজেকে যুক্ত করবার চেষ্টাও চালিয়ে যান তিনি। তৎকালীন কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। আর্মিতে থাকবার কারণে সে যোগাযোগটা দুরূহ হলেও ছুটিতে বাড়ি এলে এব্যাপারে সর্বাত্মক চেষ্টা চালান তিনি। সুযোগটা তিনি বিশেষভাবে পান ময়মনসিংহে। বাবা তখন ময়মনসিংহ রোডের স্টেশন মাস্টার। ভাইবোনদের মধ্যে সক্রিয় পার্টি রাজনীতিতে প্রথম যোগ দিয়েছেন ছোট বোন শেলী। আমরা আগেই জেনেছি যে ছাত্র ইউনিয়নের ব্যানারে মমিনুন্নেসা কলেজের ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। তার সূত্র ধরেই তাদের ময়মনসিংহ রোডের বাড়িতে তখন অনেক কমিউনিস্ট নেতার আনাগোনা। ছুটিতে এলেই সে সব নেতা কর্মীদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেন তাহের।
কিন্তু বিপ্লব বিষয়ে তার চিন্তাভাবনার সঙ্গে মেলে এমন কাউকে পান না। তিনি। তাহের সশ্বস্ত্র কমিউনিষ্ট বিপ্লবের কথা বলেন। কিন্তু ষাট দশকের মাঝামাঝি এ অঞ্চলের কমিউনিস্টদের মধ্যে সশস্ত্র ধারার আন্দোলনে আগ্রহী কাউকে পাওয়া দুস্কর। পাকিস্তান সরকারের কঠোর দমন নীতির মধ্যে তখন হিমশিম খাচ্ছেন কমিউনিস্টরা। কোনোরকম আত্মগোপন করে চালিয়ে যাচ্ছেন নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রাম। কমিউনিস্টদের মধ্যে এমন কাউকে সে সময় পাওয়া দুর্লভ যিনি পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরূদ্ধে একটা গেরিলা যুদ্ধে নেমে পড়বার কথা ভাবছেন। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বিশাল কমিউনিস্ট পার্টিতেও তখন সশস্ত্র ধারাটি তেমন আলোচিত নয়। পশ্চিম বাংলার নকশালবাড়ি থেকে চারু মজুমদারের সশস্ত্র কমিউনিস্ট বিপ্লবের আওয়াজ তোলেন আরও পড়ে, ষাট দশকের শেষে। ফলে তাহের ছুটিতে এসে যে কমিউনিস্টদের সঙ্গে আলাপ করেন। তাদের মধ্যে সশস্ত্র বিপ্লবে আগ্রহী কারো সঙ্গে দেখা হয় না তার।
বিচ্ছিন্নভাবে এ অঞ্চলে কেউ কেউ সে সময় এ সম্ভাবনার কথা ভাবছেন অবশ্য। ছাত্র সংগঠনের মধ্যে সিরাজুল আলম খান, কাজী আরেফ আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক প্রমুখরা মিলে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামে একটা নিউক্লিয়াস গড়ে তুলে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে একটা জঙ্গিরূপ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করবার সম্ভাবনার কথা ভাবছেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে তাহেরের যোগাযোগ হয়নি। ফলে একরকম নিঃসঙ্গভাবেই নিজেকে তখন প্রস্তুত করছেন তিনি। প্রস্তুত হচ্ছেন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধের জন্য, যে যুদ্ধ একই সঙ্গে হবে স্বাধীনতার এবং সমাজতন্ত্রের জন্য। ঠিক যেমন হচ্ছে ভিয়েতনামে। যেমন হো চি মিন গেরিলা যুদ্ধ করছেন সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা থেকে ভিয়েতনামকে মুক্ত করে সেখানে একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র কায়েমের জন্য। প্রাথমিক উদ্যোগ হিসেবে তাই নিজের পরিবারের মধ্যেই শুরু করে দিয়েছেন গেরিলা ট্রেনিং।
ষাট দশকের শেষের দিকে কমিউনিস্ট পার্টি যখন বিভক্ত হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তানে যখন গণআন্দোলন তীব্র হচ্ছে তাহের তখন পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে। কিন্তু পরিস্থিতির ওপর গভীর নজর রাখছেন তিনি। বিভিন্ন পত্র পত্রিকা পড়ে তো বটেই, ক্যান্টনমেন্টে বসে নিয়মিত নানা দেশের রেডিও শোনা তাহেরের নিত্যকার অভ্যাস তখন। ভয়েস অব আমেরিকা, বিবিসি, রেডিও অস্ট্রেলিয়া। তাহের কান পেতে থাকেন কখন কোথায় কিম বিষয়ে খবর থাকে। আর দেশে তিনি নিয়মিত চিঠিতে যোগাযোগ রাখেন বড় ভাই ইউসুফ আর ছোট ভাই আনোয়ারের সঙ্গে। চিঠিতে বিশেষ করে আনোয়ারের কাছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেশের পরিস্থিতি জানতে চান তাহের। আনোয়ারও সবিস্তারে সব কিছু লিখে চিঠি পাঠিয়ে দেন ক্যান্টনমেন্টের ঠিকানায়। কমিউনিস্ট পার্টির মস্কো আর মাওবাদী ভাঙ্গনের সব খবরাখবরই পানি তিনি।
আনোয়ারকে লেখেন, ওদের দেখাদেখি আমাদের দেশের কমিউনিস্টদেরও চীনা আর মস্কোপন্থীতে ভাগ হয়ে যাওয়া ঠিক হলো কিনা আমি জানি না। কিন্তু মস্কো তো আর্মস স্ট্রাগল বাদ করে দিয়েছে, সুতরাং আমাদের খেয়াল রাখতে হবে চীনাপন্থীদের দিকে। সশস্ত্র বিপ্লব ছাড়া আমাদের দেশের মুক্তি আসবে না জেনে রেখো।
ব্যাপারটা মোটেও কাকতালীয় নয় যে পূর্ব পাকিস্তানে চীনাপন্থী দলের সবচেয়ে জঙ্গি যে অংশ সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে তখন দানা বাঁধছিল তার সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে যায় আনোয়ার আর তাহেরের। কমিউনিস্ট মন্ত্রে দীক্ষিত হবার পর সশস্ত্র আন্দোলনের যে ভাবনা তাড়িত করেছে তাহেরকে, সে ভাবনার সঙ্গী তিনি খুঁজছিলেন দীর্ঘদিন, খুঁজছিলেন একটা পার্টি। সিরাজ শিকদারের ভেতর সেটি পেয়ে যান তিনি। সিরাজ শিকদারও পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার কথা বলছেন, ঋলছেন সশস্ত্র সংগ্রমের মধ্য দিয়ে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার কথা। ঠিক এইরকম একটি ভাবনা করোটিতে নিয়েই তাহের শুরু করেছেন তার নিঃসঙ্গ যাত্র, সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ সেই যাত্রারই একটি ধাপ। ফলে সিরাজ শিকদারের সঙ্গে পরিচয়ের পর আর একমুহূর্তও দেরি করেননি তিনি। নেমে পড়েছিলেন কাজে। মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে সেনাবাহিনীর ভেতরে থেকেও গোপনে শুরু করেছিলেন বিপ্লবীদের সামরিক ট্রেনিং। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সময় সুযোগমতো সেনাবাহিনী ছেড়ে দিয়ে সম্পূর্ণ ঝাঁপিয়ে পড়বেন বিপ্লবী আন্দোলনে।
শৈশবে মা বলেছিলেন, অন্যায়কে প্রশ্রয় দিবি না। শাফাত ডাকাতের পথ আগলে দাঁড়িয়েছিলেন তাহের। জালালাবাদ পাহাড়ের উঁচুতে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশদের অস্ত্র লুটের গল্প শুনতে শুনতে বুঝেছিলেন ক্ষমতাবানরা স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দেয়। দেয় না, কেড়ে নিতে হয়। কমিউনিস্ট মেনুফেস্টো পড়ে পেয়েছিলেন পৃথিবীকে দেখবার নতুন চোখ, পেয়েছিলেন পৃথিবীটাকে বদলে ফেলবার মন্ত্র। যুদ্ধ করে। পৃথিবীকে বদলে ফেলবেন বলে নিলেন কমান্ডো ট্রেনিং। এবার তিনি প্রস্তুত মাঠে নামবার জন্য, নেমেও ছিলেন।
কিন্তু হিসাব মেলে না। জীবন আমাদের জন্য অনেক অপ্রত্যাশিত বাক মজুদ রাখে। মানুষ কাছাকাছি আসে আবার সরে যায় দূরে। নানা পথ ঘুরে দুই টগবগে তরুণ বিপ্লবী মিলেছিলেন এক বিন্দুতে। একজন বিপ্লবী সৈনিক, একজন বিপ্লবী প্রকৌশলী। কিন্তু ইতিহাসের অভিপ্রায় তা নয়। তুচ্ছ কারণে বিভক্ত হয়ে গেলেন তারা। নিলেন ভিন্ন দুই পথ। স্বাধীন বাংলাদেশের ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ফুলকির মতো আবার আবির্ভূত হবেন তারা, অপঘাতে মৃত্যু হবে দুজনেরই। কিন্তু আপাতত দুজনের পথ বেঁকে গেল দুদিকে।
স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলেন তাহের পতন হলো অকস্মাৎ। মন খানিকটা ভাঙ্গল বটে তার। কিন্তু সে মনের ওপর তখন এসে পড়েছে এক নতুন ছায়া। একজন নারীর, তার জীবনসঙ্গিনীর। যেন বিপ্লবের জন্য মজুত রাখা উত্তেজনাগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছে আকাশে, তেমনি কায়দায় গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে অভিনব বর সেজে ঢুকলেন বিয়ের আসরে। বিপ্লবীর মনে তখন বসন্তের হাওয়া।
১০. না প্রেমিক, না বিপ্লবী
অভ্যুত্থান, এঙ্গেলস আর প্যারাসুট জাম্পিংয়ের ঝড়ে ধুলোয় ঢাকা ছিল তাহেরের প্রেমিক মন। তেমন একটা মন তার আছে কিনা তাও ঠিক স্পষ্ট ছিল না তার। কাছে যেন। কোনো সহপাঠিনীর চুলের অরণ্যে হারিয়ে যাবার চকিত বাসনা। হয়েছিল হয়তো কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়েছে প্লেখানভর বইটা পড়ে শেষ করতে হবে, কিংবা লেনিনের। ডুবে গেছেন বইয়ে আর সেই সহপাঠিণী কখন তার চুলের অরন্য নিয়ে চলে গেছে দৃরে। হালকা পাখায় ভর করা প্রেম প্রজাপতি ব্যস্ত, চঞ্চল তাহেরের মনে আলতো করে বসবারও ফুসত পায়নি কখনো। লুৎফার মধ্য দিয়েই নারীর এক নতুন দিগন্তের সঙ্গে পরিচয় তাহেরের। এ যেন এক নতুন গ্রহে অবতরণ। কত তার অজানা প্রান্তর। নতুন এক ঝড়ে হঠাৎ উড়ে যায় জমে থাকা সব ধুলো। সেখান থেকে মাটি ফুড়ে বের হন প্রেমিক তাহের। বিয়ের পর দিনরাত লুৎফাকে পাঠ করেন তাহের যেন পড়ছেন কোনো নিষিদ্ধ ইস্তেহার।
কিন্তু ঘণ্টা বাজে জীবনের। ছুটি শেষ। ফিরে যেতে হবে কাজে। তাহের তখন চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে। খবর আসে তাকে বদলি করা হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের আটক ফোট। চট্টগ্রামে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে তাকে যেতে হবে পশ্চিম পাকিস্তান। লুৎফার যাওয়া হবে না এখনই কারণ কদিন পরেই তার এমএসসি পরীক্ষা। চিটাগাং মেলে তাহেরকে তুলে দিয়ে হঠাৎ বুকটা কেমন ফাঁকা লাগে লুৎফার। এই তো সেদিন পরিচয় মানুষটির সঙ্গে অথচ এরই মধ্যে সে নেই বলে কেমন শূন্য লাগছে চারদিক। পরীক্ষার পড়ায় আর মন বসে না লুৎফার। চোখ বইয়ের পাতায় থাকলেও চোখের নিচে ফুটে থাকে তাহেরের কথা বলবার ভঙ্গি, খুনসুটি, আলিঙ্গন। বায়োকেমেস্ট্রির ফর্মুলা ভুল হয়ে যায় বার বার। পরীক্ষা দিয়ে প্রতিদিন ইউনিভার্সিটি থেকে বিরস মনে ফেরেন লুৎফা। মনে মনে ভাবেন কবে যে ছাই শেষ হবে এই পরীক্ষা।
একদিন বিকেলে পরীক্ষা দিয়ে ফিরছেন লুৎফা, বাড়ির কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ কে যেন পেছন থেকে দু হাত দিয়ে চেপে ধরে তার চোখ। লুৎফা ঘুরে দেখেন তার সামনে তাহের। একটু ঘোর লাগে লুৎফার, স্বপ্ন দেখছেন না তো? তাহের বলেন : দুটা খবর নিয়ে এসেছি। একটা ভালো খবর, একটা খারাপ।
লুৎফা : আগে ভালো খবরটা বলো।
তাহের : আমেরিকায় যাচ্ছি ট্রেনিং-এ। নর্থ ক্যারোলিনার ফোর্ট ব্রেগের স্পেশাল ফোর্সেস অফিসার্স ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে ছয় মাসের ট্রেনিং। আমিই প্রথম বাঙালি অফিসার এই ট্রেনিংয়ের জন্য সিলেক্টেড হয়েছি।
লুৎফা : আর খারাপটা?
তাহের : আর খারাপ খবর হলো আবার আমাদের বিচ্ছেদ হবে।
দ্বিতীয় খবরটাই লুৎফার কাছে বড় খবর। বিষণ্ণ হয়ে পড়েন তিনি। নিঃশব্দে তাহেরের পাশেপাশে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকেন লুৎফা। চুপচাপ হাঁটতে হাঁটতে টের পান তার হাতের আঙ্গুলগুলো চেপে ধরছে আরেকটি হাত।
লুৎফা বলেন : হাত ছাড়ো। এটা কি তুমি আমেরিকার রাস্তা পেয়েছ?
তাহের : আরে বউয়ের হাত ধরেছি তাতে অসুবিধা কি? আর আমেরিকার কথা যখন বললে, আমি ঠিক করেছি আমাদের হানিমুনটা হবে আমেরিকাতেই। ইচ্ছামতো হাত ধরাধরি করে হাঁটব সেখানে।
ঢাকা থেকে আটক ফোর্ট হয়ে আমেরিকায় উড়ে যান তাহের। বিয়ের পর মাত্র সপ্তাহ তিনেকের হযরল সংসার লুৎফার।
আমেরিকা থেকে তাহের লেখেন : এখানে বোধহয় হানিমুনটা করা হবে না। প্রচণ্ড কy ট্রনিং, এক মুহূর্তও ফঁক নেই। ভিসার সমস্যা আছে, টেনিংয়ের পর বেশিদিন এখানে থাকাও যাবে না। আমরা বরং ইংল্যান্ডে হানিমুন করব।
তাহেরের ছোট বোন শেলী তখন স্বামীর সঙ্গে লন্ডনে আর লুৎফার বড় ভাই রাফি আহমেদ তখন ফিজিক্সে পিএইচডি করছেন অক্সফোর্ডে। সিদ্ধান্ত হয় মাস ছয়েক পরে লুৎফা চলে যাবেন অক্সফোর্ডে তার ভাইয়ের কাছে আর তাহের আমেরিকা থেকে ট্রেনিং শেষ করে সেখানে মিলিত হবেন লুৎফার সঙ্গে। অক্সফোর্ড, লন্ডনে বেশ কিছুদিন ছুটি কাটিয়ে তারপর ফিরবেন তারা। দিন গোনেন লুৎফা। স্বপ্নের জাল বুনতে বুনতে কখন পেরিয়ে যায় ছয় মাস। আমেরিকা থেকে তাহের চিঠি লিখে পাঠান আবু ইউসুফকে, আমার বউকে আমি চাই অক্সফোর্ডে। বাদশা তাহেরের হুকুম।
ইংল্যান্ডে পাড়ি দেন লুৎফা। গিয়ে ওঠেন অক্সফোর্ডের নর্থ পার্কের পাশে, নরহাম গার্ডেন রোডে ভাই রাফি আহমদের ছোট্ট ফ্ল্যাটে। রাফি লেজার নিয়ে গবেষণা করছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিছুদিন পর ট্রেনিং শেষে আমেরিকা থেকে উড়ে আসেন তাহের। অক্সফোর্ডে শুরু হয় লুৎফা আর তাহেরের মধুচন্দ্রিমা।
পৃথিবীর প্রাচীন একটি বিশ্ববিদ্যালয় বুকে নিয়ে ছিমছাম দাঁড়িয়ে আছে অক্সফোর্ড শহর। পাথরের রাস্তা, শতাব্দী পুরনো দালান, রাস্তার পাশে পুরনো দিনের লাম্পপোস্ট। নিরিবিলি শহরে সাইকেলে টুং টাং শব্দ তুলে আরও নিরিবিলি সব গলিতে অদৃশ্য হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। ঐ ছবির মতো শহরে নিশ্চিন্তে হাত ধরাধরি করে বেড়ান লুৎফা আর তাহের। এমনিতে কুয়াশা আর মেঘেই বছরের বেশি ভাগ সময় ঢেকে থাকে ইংল্যান্ডের আকাশ। কিন্তু লুৎফা আর তাহের যখন গেছেন তখন সেখানে গ্রীস্মকাল, ওদের সামার। আকাশ পরিষ্কার, বাইরে রোদ্দুর, চারদিকে ডেফোডিল ফুলের ছড়াছড়ি, মানুষের মনে ফুর্তি। ফুরফুরে বাতাস আর বিকালের সোনালি রোদে সুরম্য নর্থ পার্কের বেঞ্চিতে গিয়ে বসেন দুজন। নাম না জানা গাছের পাতা এসে পড়ে ওদের পায়ের কাছে। তাদের কন্ঠে উত্তেজনা নিয়ে লুৎফাকে শোনান নর্থ ক্যারোলিনার ট্রেনিংয়ের গল্প।
তাহের : কি যে সব টাফ ট্রেনিং কি বলব তোমাকে একবার তো আমাদের এক ডিপ ফরেস্টে ছেড়ে দিয়ে বলল দশ দিন এখান থেকে বের হতে পারবে না। সঙ্গে খাবার দাবার কিছু না, শুধু কয়েকটা যন্ত্রপাতি। জঙ্গলে ঘোরার অভ্যাস অনেক আছে আমার কিন্তু, খাবার দাবার, তাবু টাবু ছাড়া দশ দিন! গাছ কেটে পাতা টাকা দিয়ে ঘর একটা বানিয়ে থাকা গেল। কত রকম যে পোকা মাকড়, আর সাপ। বানর ছিল অনেক। বানর কোনো গাছের ফল খায় তাই দেখে দেখে ফল খেলাম। জঙ্গলে তো নানা রকম পয়জনাস ফল আছে, বানর খেলে বুঝতে পারি ঐটাতে বিষ নাই। ফল খেয়ে আর কত দিন চলে। একদিন এক খরগোশ ধরে পুড়িয়ে খেলাম, ব্যাঙ খেয়ে কাটালাম কয়েকদিন।
লুৎফা চেঁচিয়ে উঠেন : ব্যাঙ খেয়েছ তুমি?
তাহের : ব্যাঙ কি, যা অবস্থা তাতে পারলে তখন সাপও খাই।
দূরে বেজে ওঠে চার্চের ঘণ্টা। বেঞ্চেই লুৎফার কোলের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ে তাহের। বলে : কেমন অদ্ভুত লাগে চার্চের ঘণ্টা, তাই না? আমার হেমিংওয়ের উপন্যাসটার কথা মনে পড়ে : ফর ইন দি বেল টোলস।
রাতে ঘরে ফিরে লুৎফাকে ফোর্ট ব্যাগের সার্টিফিকেট দেখান তাহের : দেখ দেখ কি লিখেছে ওরা। সার্টিফিকেটে লেখেছে, আবু তাহের ইজ ফিট টু সার্ভ উইথ এনি আর্মি আভার এনি কন্ডিশন ইন দি ওয়ার্ল্ড।
তাহের বলেন : ওরা লিখেছে পৃথিবীর যে কোনো জায়গায়, যে কোনো পরিস্থিতিতে আমি কাজ করতে সক্ষম। কিন্তু আমি তো পৃথিবীর কোথাও যেতে চাই না লুৎফা। আমি ফিরে যেতে চাই বাংলাদেশে! যে কাজটা অসমাপ্ত রয়ে গেছে সেটা শেষ করতে চাই। আই হ্যাভ প্রমিসেস টু কিপ, অ্যান্ড মাইলস টু গো বিভোর আই স্লিপ … প্রেমিক তাহেরের বুকের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা বিপ্লবী বাঘটি মুহূর্তের জন্য আড়মোড়া ভাঙ্গে।
কিন্তু অক্সফোর্ডে বিপ্লবী নয়, প্রেমিক তাহেরেরই জয়। রাফি আর তার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মিলে এক উৎসব মুখর, নির্ভার সময় কাটে লুৎফা আর তাহেরের। তখন বেশ কিছু পাকিস্তানি তরুণ পড়াশোনা করছেন অক্সফোর্ডে, অধিকাংশ পশ্চিম পাকিস্তানের। বাঙালি হলেও মেধাবী, আমুদে রাফি আহমেদই পাকিস্তানি তরুণদের নেতা। অক্সফোর্ডের পাকিস্তান সোসাইটির সেক্রেটারি তিনি। রাফি ব্যাচেলার মানুষ, কোনো পিছু টান নেই, প্রায়ই কোনো পাবে বা বন্ধুর বাড়িতে চলে অনেক রাত অবধি আড্ডা। শুধু দেশী নয় বিদেশিদের কাছেও সমান জনপ্রিয় রাফি। অনেক ব্রিটিশ বন্ধু, বান্ধবী রাফির।
কাছেই টেমস নদীর একটি শাখা, সেখানে কোনো কোনো দিন ক্যানুইংএ যান কয়জন মিলে। লুৎফা কিছুতেই নৌকায় উঠতে চান না। কিন্তু তখন তাহেরের যাবতীয় বীরত্ব যেন লুৎফাকে ঘিরে। লুৎফাকে জয় করার মধ্যেই যেন যাবতীয় আনন্দ। তাহের ব্লে, আরে ভীতুর ডিম, আসো তো!
একরকম জোর করেই তাহের লুৎফাকে টেনে তোলেম ছোট ক্যানুইং বোটে। দুদিকে বৈঠা ঠেলে তর তর করে এগিয়ে যান প্রবল স্রোতের দিকে। লুৎফা চিৎকার করেন। থামো, থামো নেমে যাবো আমি।
তাহের আরও জোরে ছুটে চলেন খরস্রোতের দিকে। লুৎফা চোখ বুজে তাহেরকে জাপটে ধরে বসে থাকেন।
কোনোদিন সারাটা সময় কাটান কাছের অ্যাসমোলিয়াম মিউজিয়ামে। মিসরের পিরামিড আর মমীর রহস্যময় জগতে ঘুরে বেড়ান দুজন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত বদলিয়ান লাইব্রেরিতে ঢুকে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে থাকেন তাহের। পাঁচ শ বছরের পুরনো লাইব্রেরি। লাইব্রেরির ভূগর্ভস্থ অংশ আর উপরের অংশ মিলিয়ে কয়েক লাখ বই। তাহের কিছু কিছু বই ছুঁয়ে দেখেন, গন্ধ শুকে দেখেন, অন্যমনস্ক হয়ে বলেন, এই সব বই পড়তে কটা জীবন লাগবে? সময় পেলেই তাহের টু মারেন বিখ্যাত বইয়ের দোকান ব্ল্যাকওয়েলে। কিনে ফেলেন পছন্দের নানা বই।
কোনো কোনোদিন অনেক রাত পর্যন্ত কাটে পার্টিতে হুল্লোড় করে। বিশেষ কার রাফির বন্ধু রঞ্চ প্রায়ই তার বাসায় নিমন্ত্রণ করেন তাহের আর সুফাঁকে। তারা সন্ধ্যাটা কাটিয়ে আসেন বক্ষের বাসায়। বিচিত্র এক মানুষ র। পেশায় প্লাক্তার। জার্মানিতে গিয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ইয়ুংয়ের মনস্তত্ত্ব নিয়ে। একসময় সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে আগ্রহী হয়ে উঠেন নৃবিজ্ঞানে। আদিম মানুষের মনস্ত ও নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। তার আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় নানা প্রচীন গুপ্তবিদ্যা। ভারতের তান্ত্রিক সাধনা, আফ্রিকার ভুদু এদের নিয়ে গবেষণা শুরু করেন তিনি। চিকিৎসা আর নৃবিজ্ঞানের বাইরে র সাহিত্য, চিত্রকলা আর সঙ্গীতের গভীর সমঝদার। তার ঘরের দেয়াল মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত পেইন্টিংএ ভরা, এক ঘরে ঠাসা ধ্রুপদী মিউজিকের লং প্লে। আর নানা রকম বইয়ের বিশাল সংগ্রহ তো আছেই। ব্যাচেলর রম্ফ নিজের বাসায় বন্ধুবান্ধবদের ডেকে প্রায়ই ড্রিংকসের আয়োজন করেন। নিজে খুব বেশি কথা বলে না কিন্তু অন্যের সাহচর্য উপভোগ করেন। বহুমুখী আগ্রহের মানুষ এই রম্ফের সঙ্গে আড্ডা তাহেরও উপভোগ করেন। তাহের আর লুৎফাকে দেখলেই রম্ফ বলে উঠেন, হ্যালো, লাভ বার্ডস।
ডিনারে দাওয়াত দিয়ে জগত সংসারের যাবতীয় প্রসঙ্গে আলাপ করেন তিনি। ফ্রয়েড আর ইয়ুংয়ের মনস্তত্ত্ব নিয়ে আলাপ করতে করতে চলে যান মোজার্ট আর বিঠোফেন প্রসঙ্গে। এক ফাঁকে উঠে গিয়ে সিবাস্তিয়ান ৰাখের সঙ্গীত ছেড়ে দেন রম্ফ।
রম্ফ লুৎফাকে জিজ্ঞাসা করেন : তোমার পেইন্টিং এ আগ্রহ আছে?
লুৎফা বলেনঃ আমি পেইন্টিং তেমন বুঝি না।
রম্ফ : চল তোমাকে পেইন্টিং দেখাই।
ঘরের অন্য এক কোণে বসেন রাফি আর তাহের। তাহেরের হাতে ওয়াইনের গ্লাস। রথ লুৎফাকে নিয়ে তার ঘরের দেয়ালজুড়ে থাকা পেইন্টিংগুলো ঘুরে ঘুরে। দেখান। রাফায়েল, রিউবেনসহ সব মাস্টার পেইন্টারদের ছবি। পেইন্টিংগুলোর কিছু মৌলিক, অধিকাংশই রিপ্রোডাকশন। রখ লুৎফাকে বোঝান কি করে এল গ্রেকো ভিন্ন ধারার যীশুর ছবি এঁকেছেন, শোনান চিত্রকর মদিগ্নিনির বেদনার্ত জীবনের কথা। পেইন্টিংগুলো দেখতে দেখতে লুৎফা নিঃশব্দে রফের কথা শোনেন। এককে রকে জিজ্ঞাসা করেন : এত বড় বাড়ি তোমার একা থাকো বিয়ে করনি কেন?
রম্ফ হাসতে হাসতে বলেন : বিয়ে করিনি বলাটা ঠিক হবে না আসলে আমাকে কেউ বিয়ে করেনি।
মুচকি হাসেন লুৎফা। তাদের কথাকে ঘিরে থাকে বাখের সঙ্গীত। এ দেয়াল থেকে ও দেয়ালে ঘুরতে ঘুরতে এক পর্যায়ে বক্ষ দূরে বসে থাকা তাহেরকে জিজ্ঞাসা করেন : তাহের, তোমার বউকে যদি আমি কারেনিনা নামে ডাকি তোমার কোনো আপত্তি আছে?
তাহের : নট এট অল। কিন্তু কেন বলো তো?
রম্ফ : টলস্টয়ের আনা কারেনিনার যে ইমেজ আমার মনে আছে তার সঙ্গে তোমার বউয়ের কেন্ধিায় যেন মিল আছে। ম্যালানকোলিক কিন্তু এলিগান্ট।
হো হো করে হেসে ওঠে তাহের বলেন : তাই নাকি? নোটিস করিনি তো।
রম্ফের ঘরের এক কোণে রাখা পিয়ানোর সামনে বসে টুং টাং বাজাতে চেষ্টা করেন লুৎফা। ছোটবেলায় হারমোনিয়াম বাজিয়েছেন লুক! ফলে পিয়ানোতে সী রে গা মার সুর খানিকটা তুলতে পারেন। রম্ফ গ্লাসে নতুন করে ওয়াইন ভরে এনে ধুপ করে এসে বসেন পিয়ানোর পাশে রাখা সোফাটাতে। বলেন : কারেনিনা, তুমি পিয়ানো শিখবে? আমি ডোমাকে পিয়ানো শেখাব।
চোখে মুগ্ধতা নিয়ে বিষণ্ণ রূপসী লুৎফার দিকে তাকিয়ে থাকেন রম্ফ। রম্ফের আগ্রহ যেন একটু মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে মনে হয় লুৎফার। অস্বস্তি বোধ করেন তিনি। লুৎফাকে ঘিরে মনের মধ্যে জেগে ওঠা এই অযাচিত মুগ্ধতার কথা পরে একদিন বন্ধু রাফির কাছে বলেই ফেলেন রম্ফ। বলেন : আই উইস আই কুড ফল ইন লাভ উইথ ইওর সিস্টার।
ক্ষেপে যান রাফি : ডোন্ট টক ননসেন্স।
ক্ষণিক পরিচয়ের এই নিঃসঙ্গ মানুষটিকে ভুলেই গিয়েছিলেন লুৎফা। অনেক বছর পর তাকে তার আবার মনে পড়বে যখন অপ্রত্যাশিত এক চিঠি আসবে তার কাছে অদ্ভুত এক সময়ে। তখন তাহের আর এই পৃথিবীতে নেই, লুৎফা তার তিনটি সন্তান নিয়ে অস্তিত্বের কঠিন লড়াই করছেন। ছোট্ট একটি চিঠি আসবে লুৎফার কাছে, কারেনিনা, আমি সব খবর পেয়েছি, সমবেদনা জানাবার ভাষা আমার নেই। তোমার জন্য আমার ঘরের দরজা সব সময় খোলা। তোমার এই দুর্দিনে এই অভাজন যদি তোমার পাশে এসে দাঁড়াতে চায় তুমি কি তাকে গ্রহণ করবে?—রম্ফ।
চমকে উঠবে লুৎফা। ভাববে, বলে কি লোকটা!
সেসব অনেক পরের কথা। আমরা আছি রম্ফের বাড়ির পার্টিতে। বাখের মিউজিক শুনে আর ওয়াইনের বোতল উজাড় করে অনেক রাতে গল্প করতে করতে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফেরেন তাহের, লুৎফা, রাফি। পথে হঠাৎ টিপ টিপ বৃষ্টি নামলে তাহের তার জ্যাকেটটা খুলে মাথা ঢেকে দেন লুৎফার।
লুৎফা জানেন না ইংল্যান্ডের এই দিনগুলোই হবে তার জীবনের একমাত্র মধুময় সময়। তিনি জানেন না, এই ভাবনাহীন নিরবচ্ছিন্ন আনন্দের সময় তার জীবনে আর কখনো ফিরে আসবে না। জানেন না, তাহেরকে এতটা দীর্ঘ সময় ধরে, এতটা কাছে তিনি আর কখনই পাবেন না।
অক্সফোর্ড ছাড়াও কিছুদিন কার্ডিফ, কিছুদিন লন্ডনে সময় কাটান দুজন। লন্ডনে ঘুরে ঘুরে দেখেন পিকাডেলি সার্কাস, ব্রিটিশ মিউজিয়াম, বার্কিংহাম প্যালেস। দেখতে দেখতে পেরিয়ে যায় মাস। আবারও শেষ হয়ে আসে দুটি। শেষের দিকে বিভিন্ন শপিং মলে ঘুরে আত্মীয় স্বজনদের জন্য কেনাকাটা করেন দুজন মিলে। লুৎফার নিজের জন্য পছন্দ কার্ভিাগেন। তাহের লুৎফাকে দামী দুটো কার্ডিগেন কিনে দেন লন্ডন থেকে। তাহেরের বিশেষ আগ্রহ জুতার ব্যাপারে। নিজের জন্য দামী দুজোড়া জুতা কেনেন তিনি। লুৎফা পছন্দ করে তাহেরকে কিনে দেন একটা সোনার আংটি।
ফিরার সময় যখন ঘনিয়ে আসছে তখন তাহেরের মাথায় এক অদ্ভুত খেয়াল চাপে। একদিন রাফি আহমেদের বাসায় নাস্তার টেবিলে তিনি বলেন : আমি ঠিক করেছি লন্ডন থেকে একটা গাড়ি কিনব এবং ড্রাইভ করে ইউরোপ, টার্কি, আফগানিস্তান হয়ে পাকিস্তান পৌছাব।
রাফি বলেন : ইন্টারেস্টিং আইডিয়া, কিন্তু রিস্কি।
তাহের : আরে রাফি লাইফে একটু রিস্ক না থাকলে চলে নাকি?
লুৎফা : বল কি? তুমি এই হাজার হাজার মাইল গাড়ি ড্রাইভ করবে?
তাহেরঃ ভয় পাচ্ছ? রাফি তোমার এই ভীতু বোনটাকে নিয়ে বড় মুশকিল।
ধু-ধু প্রান্তরে ল্যান্ডরোভার গাড়িতে ধুলো উড়িয়ে একের পর এক সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে তাহের, পাশে প্রেমিকা, স্ত্রী লুৎফা। কোনো এক অজানা জনপদে তাবু খাটিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে রাত। এই অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় তখন বুঁদ তাহের। লুৎফাকে বলেন : শোন প্লেনে গেলে ধুপ করে উঠে টুপ করে নেমে পড়ব, দেখার মধ্যে দেখা হবে আকাশের মেঘ। গাড়িতে দেশ দেখতে দেখতে, মানুষ দেখতে দেখতে যাবো।
লুণ্যা ইতোমধ্যে টের পেয়েছেন, এ এক ছুটে চলা মানুষ, তার গতির সঙ্গে তাল মেলানোর দীক্ষা তাকে নিতে হবে। জানেন একবার যখন তাহেরের মাথায় ঢুকেছে এ কাণ্ড তিনি করেই ছাড়বেন। ফলে তিনিও এই অ্যাডভেঞ্চারের জন্য মনে মনে প্রস্তুত হতে থাকেন।
কিন্তু সপ্তাহ খানেক পর গাড়ি কিনবার জন্য তাহের যখন দোকানে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, লুৎফা বলেন : গাড়িতে যাওয়া হবে না।
তাহের : কেন, ভয় পাচ্ছ এখনও?
লুৎফা : হ্যাঁ, পাচ্ছি। আমার জন্য না অন্য আরেকজনের জন্য।
তাহের : মানে?
কিছু বলেন না লুৎফা। নিঃশব্দে কাপড় গোছাতে থাকেন। জুতার ফিতা লাগাতে লাগাতে থমকে যান তাহের, গভীরভাবে তাকান লুৎফার দিকে। লুৎফা মুচকি হাসেন। উত্তেজনায় লাফ দিয়ে উঠেন তাহের : মাই গুডনেস! বল কি? লুৎফাকে জড়িয়ে ধরে চুমু এঁকে দেন কপালে। রাতে বিছানায় শুয়ে বলেন, দেখো ঠিক মেয়ে হবে। নাম রাখব জয়া।
পুরো টা দিয়ে উপকৃত করবেন