ধ্রুবর বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। অথচ ওর সঙ্গে এ ব্যাপারটার কি সম্পর্ক। একজন অজ্ঞাতকুলশীল মানুষ। ভদ্রলোকের মুখ ও কোনওদিন দেখেছে কিনা জানে না। ভদ্রলোক যে এ পাড়ায় ছিলেন তাও জানত না, এবং জানার কোনওদিন প্রয়োজনও হয়নি। হয়তো এই মুহূর্তে ওঁকে দেখতে পেলে মনে পড়ত কোনওদিন আসা-যাওয়ার পথে দেখেছে কিনা। হতে পারে এই রাস্তায়, কিংবা দোকানে বাজারে ওঁকে প্রায়ই দেখতে পেত। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে সকলেই আছে, শুধু ভদ্রলোক নেই। থাকলেও বোধহয় চিনতে পারত না, কারণ ধ্রুব হাঁটাচলার পথে চোখ তুলে বড় একটা কারও মুখের দিকে তাকায় না। লোকজনকে এড়িয়ে চলাই ওর চরিত্র। পাড়ার কেউ ডেকে দুএকটা কথা বলতে চাইলেও হ্যাঁ না গোছের ক্ষুদ্র বাক্যে ভদ্রতা সারে, বড় জোর মুখে একটু স্মিত হাসি। ওটুকুও বানানো সৌজন্য। আসলে মানুষকে এড়িয়ে চলাই ওর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে, অথচ লোকে ভাবে এটা ওর অহঙ্কার। ধ্রুব নিজের মনেই হাসে, যখন আত্মীয়স্বজন কেউ এসে তেমন একটা অভিযোগ করে। কি নিয়ে অহঙ্কার করবে ও, কি আছে অহঙ্কৃত হবার মতো।
লোকটির কোনও পরিচয়ই যে জানত না, তাও স্বভাবের দোষে।
ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে খুব হনহন করে বাড়ি ফিরছিল, কিছুটা দেরি হয়ে গেছে বলে, কিছুটা চড়া রোদ্দুরের জন্যে। এই গলি দিয়ে এলে পথ অনেকখানি সংক্ষেপ করা যায়, তাই এদিক দিয়েই ওর যাতায়াত। বাস থেকে নেমে বকুলবাগানের বাড়িতে পৌঁছতে সময়ও লাগে, অনেকখানি হাঁটতেও হয়।
হনহন করে হেটেই আসছিল। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। নিছক কৌতূহল ছাড়া তখন আর কিছুই ছিল না। শুধু পথচারী দুএকজনের মুখের দিকে তাকাল, তাদের চোখেও কৌতূহল।
ডানদিক থেকে আরেকটা রাস্তা বেরিয়ে গেছে, সেটুকু পার হওয়ার সময়েই ওর হঠাৎ চোখে পড়ল। সামান্য কিছু লোকজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তা দেখে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ার মানুষ ও নয়। কোলকাতার রাস্তাঘাটে জটলা তো লেগেই আছে, সেসব দেখে সারস পক্ষীটির মতো গলা বাড়িয়ে রহস্যের হদিস পাবার চেষ্টা করে না ধ্রুব। ও বরং এসব এড়িয়েই যায়। কিন্তু ওকেও থমকে দাঁড়াতে হল।
চুম্বকের মতো একটা আকর্ষণে ও এগিয়ে গেল। কারণ দৃশ্যটার দিকে চোখ পড়তেই ওর বুকের ভিতরটা ধক করে উঠেছে। আকস্মিক কোনও ভয় যেন মুহূর্তে ওকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।
দ্রুত পায়ে ও সেদিকে এগিয়ে গেল।
এ রাস্তায় ফুটপাথ নেই বললেই চলে, তবে রাস্তাটা গলির মতো নিতান্ত সরু নয়। তারই অর্ধেক জুড়ে তুপীকৃত হয়ে পড়ে আছে একটি সংসারের যাবতীয় আসবাব। কেউ যেন ঘৃণা আর তাচ্ছিল্যে ছুড়ে ছুড়ে বের করে দিয়েছে।
খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবল, বুক কেস। ত্রিভঙ্গ হয়ে পড়ে আছে নারকেল ছোবড়ার পুরু গদি। আর চারপাশ ঘিরে বালতি, মগ, হাঁড়িকুড়ি, রাশি রাশি মসলাপাতির কৌটো। একটা পুরোনো টিন টলে পড়েছে, তা থেকে গড়িয়ে পড়ছে সরষের তেল। একজন কে গিয়ে সেটা সোজা করে বসিয়ে দিল।
ধ্রুব ততক্ষণে ভিড়ের ফাঁকে উঁকি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ওর বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে উঠল। নিজেরই মনে হল ওর মুখ কি এক অজানা আতঙ্কে বিবর্ণ হয়ে গেছে। সেই মুখ অন্যকে দেখাতেও যেন ভয়।
বিস্ময়ের চোখে ও তন্ন তন্ন করে জিনিসগুলোর ওপর দৃষ্টি বুলিয়ে যাচ্ছিল। অস্ফুটে বলে উঠল, ইস্!
এক কোণে একটা খোলা উনোন, কেউ জ্বলন্ত উনোনে জল ঢেলে দিয়েছে। আর তারই আশেপাশে কড়াইয়ে আধ রান্না কিছু একটা তরিতরকারি, অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িটা কাত হয়ে পড়ে আছে, তা থেকে ভাত গড়িয়ে পড়েছে ফুটপাথে।
একজন কে পিছন থেকে ধ্রুবকে জিগ্যেস করল, কি হয়েছে মশাই?
ধ্রুব কোনও উত্তর দিল না। প্রশ্নটা তো ওরও। পাশেই প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকানো ছেলেটি, বলে উঠল, শালা ছোটলোক, রান্না ভাতটুকুও খেতে দেয়নি।
আরেকজন ও প্রান্ত থেকে বললে, কি অবস্থা বেচারিদের।
তার গলার স্বরে বিষণ্ণতা মাখানো।
ততক্ষণে ধ্রুবর চোখ পড়ল বেশ কিছুটা দূরে একজন ভদ্রমহিলা, সঙ্গে দুটি বাচ্চা ছেলে, একটি ফ্রক পরা মেয়ে। ওরা সকলেই অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। ভদ্রমহিলা মুখ নিচু করে আছেন, লজ্জায়। পাড়ার এত লোকের সামনে এমনভাবে অপদস্থ হওয়ার লজ্জা? কিংবা কে জানে, এখন তো ওঁর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে, হয়তো লজ্জা-অপমানের বোধটুকুও আর নেই।
ব্যাপারটা কি, বুঝতে অসুবিধে বার কথা নয়।
প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকানো ছেলেটি হঠাৎ বললে, ভদ্রলোক গেলেন কোথায়?
ওপাশের ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বৃদ্ধ লোকটি জবাব দিলেন, শুনছি তিনি তো সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে গেছেন। হয়তো কোর্টে।
হাতে স্ত্রী কে ঝোলানো কাঁচাপাকা চুলের লোকটি বললে, কোর্টে গিয়ে আর এখন কি হবে, হয়তো কোনও আস্তানার খোঁজে।
না, ধ্রুব একজনও চেনা লোক দেখতে পেল না। শেষে ওই ব্রীফ কেস হাতে লোকটিকেই জিগ্যেস করল, কি হয়েছে? জানেন কিছু?
লোকটি ভারী ব্রীফ কেস হাতে ঝুলিয়েও কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললে, দেখে বুঝতে পারছেন না? ইজেক্টমেন্ট। ভাড়াটে উচ্ছেদ।
বুঝতে যে পারছিল না, তা নয়। তবু কথাটা যেন শুনতে চাইছিল না। অন্য কিছু শুনতে পেলে খুশি হত। কিন্তু সেই ভয়ঙ্কর কথাটাই শুনতে হল। ইজেক্টমেন্ট।
একজন অজ্ঞাতকুলশীল মানুষ, সে লোকটির মুখও দেখেনি ধ্রুব, কেমন চরিত্রের মানুষ, ভাল না মন্দ, কিছুই জানে না, তবু ওর বুকের মধ্যে আধখানা জুড়ে যেখানে আতঙ্ক শিকড় গেড়েছে, তারই পাশে অসহায় অচেনা মানুষটির জন্যে সমবেদনা উথলে উঠল।
ধ্রুব ধীরে ধীরে বললে, ওঁদের কেউ বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বসতে দিলেও তো পারত।
ধুতি পাঞ্জাবি পরা বৃদ্ধের কানে গেল কথাটা। তীব্র ব্যঙ্গের স্বরে বলে উঠলেন, বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বসতে দেবে? পাড়ার কেউ আসেনি মশাই, কেউ আসেনি। শুধু দোতলা তিনতলা থেকে উকি দিয়েই সরে যাচ্ছে।
প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকানো ছেলেটি প্রতিবাদ করল।পাশের বাড়ির লোক তো ডাকতে এসেছিল, ওঁরাই যাননি।
ঠিক তখনই দেখা গেল, একটি বাড়ি থেকে বেরিয়ে বছর আঠারো কুড়ির একটি মেয়ে মুখ নিচু করে দাঁড়ানো ভদ্রমহিলার কাছে গেল। কিছু বলল। হাত ধরে ডাকল। ভদ্রমহিলা প্রথমটা না না করে শেষে ছেলেমেয়েদের নিয়ে তার সঙ্গে চলে গেলেন।
ওঁরা চলে যেতেই রাস্তায় পড়ে থাকা খাট, আলমারি, বুককেস, জল ঢালা তোলা উনোন, ভাত গড়িয়ে পড়া অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি রাস্তার একপাশে বিস্ময়ের, আতঙ্কের একটা বিশাল প্রশ্নচিহ্ন হয়ে পড়ে রইল।
একে একে সকলেই চলে যাচ্ছিল। ধ্রুব দেখল, ওরা কেউই পাড়ার লোক নয়। ধ্রুবর মতোই পথ দিয়ে যেতে যেতে হয়তো দাঁড়িয়ে পড়েছে।
ধ্রুবও চলে এল। কিন্তু দৃশ্যটা মন থেকে কিছুতেই মুছে ফেলতে পারল না।
লোকটি অচেনা। সরল নিরপরাধ শান্তশিষ্ট সংসারী মানুষ, না জটিল ধুরন্ধর প্রকৃতির, তাও জানে না। তবু, নিজেরই অজান্তে কি ভাবে যেন অদেখা মানুষটির সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে।
পাড়ার কেউ এগিয়ে আসেনি। এসে থাকলেও দুএকজন। অথচ কেন? মানুষটি যত খারাপই হোক, এই দুঃসময়ে দুটো মুখের কথার সমবেদনা জানাবে না? বসার ঘরে নিয়ে গিয়ে দুদণ্ড বসতে দেবে না? এই কৌতূহলী জনতার চোখের সামনে উপহাস হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে?
ধ্রুব কোনও যুক্তি খুঁজে পাচ্ছিল না। এটা যদি ধ্রুবরই পাড়ার ঘটনা হত, ও কি এগিয়ে যেত? বলত, আসুন আমাদের বাড়িতে? ছেলেমেয়েদের বলত, এসো। তোমাদের বাবা যতক্ষণ না ফিরে আসেন…
ধ্রুব বুঝতে পারল না।
এখন তো পাড়ার মধ্যে এরা অচ্ছুত হয়ে গেছে। লাঞ্ছিত, অপমানিত একটি মানুষের সঙ্গ থেকে সকলেই দূরে সরে থাকতে চায়। পাছে তার গায়েও সেই অপমানের ছিটে লাগে। না কি ভয়? এ রাস্তার বেশির ভাগই তো ভাড়াটে। দোতলা তিনতলা বাড়ির সারি। বাড়িওয়ালা ওপরে থাকেন। নীচের একতলা দোতলা ভাড়া দিয়েছেন। ভাড়াটেরা একা একা বাড়িওয়ালাকে তোয়াজ করে চলার চেষ্টা করে। উচ্ছেদ হওয়া ভাড়াটের পাশে এসে দাঁড়ালে বাড়িওয়ালা রুষ্ট হবে সেই ভয় থেকেই কি কেউ এসে দাঁড়ায়নি।
অসম্ভব। বাড়িওয়ালাকে আজকাল কেউ এত ভয় পায় নাকি?
আসলে তা নয়। ভদ্রমহিলাই হয়তো যেতে চাননি। ওঁর সর্বাঙ্গে তো এখন অসীম লজ্জা। দুদিন আগে যাদের সঙ্গে হেসে কথা বলেছেন, তাদের চোখের সামনে এই দৃশ্য। উনি চোখ তুলে তাদের দিকে তাকাবেন কি করে! সেজন্যেই যেতে চাননি। কেউ আর এগিয়ে আসেনি। শেষে রাস্তার লোকের ভিড় থেকে পালাবার জন্যেই মেয়েটির সঙ্গে যেতে রাজি হয়েছেন।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে ধ্রুব এইসব কথাই ভাবছিল। ওর হঠাৎ মনে হল, কি আশ্চর্য। লজ্জা কি শুধু ওই ভদ্রমহিলার? আমিও তো লজ্জিত অপমানিত বোধ করছি। আমাদের রাস্তায় এ-ঘটনা ঘটলে এ অপমান আমাকে আরো বেশি করে স্পর্শ করত। আমি রাস্তায় বেরিয়ে এসে ওদের কাছে যেতে পারতাম না। কেবলই মনে হত তিনতলার ব্যালকনিতে দাঁড়ানো বাড়িওয়ালার খুশি খুশি উপহাসের দৃষ্টি আমার পিঠের ওপর আছড়ে পড়ছে। এ তো প্রতিটি ভাড়াটের লজ্জা।
ধ্রুবর নিজেরই খুব অবাক লাগছিল। বাড়িওয়ালার সঙ্গে তো ওর এখনও মৌখিক সদ্ভাব আছে। অথচ ও এখন আলাদা মানুষ হয়ে যাচ্ছে কি করে। এই মুহূর্তে বাড়িওয়ালা মানুষটিকে ধ্রুব ওর বিপরীত দিকে দেখতে পাচ্ছে কেন!
সব দিক থেকে ওরা মিলেমিশে একই মানুষ। কোনও তফাত নেই। শুধু একজনের বাড়ি আছে, আরেকজনের নেই। শুধু সেজন্যেই ওরা আলাদা মানুষ হয়ে যাবে?
বকুলবাগানের এই বাড়িতে ঢোকার সময় অজান্তেই ওর চোখ চলে যায় ওপাশের তেতলার বারান্দায়। কেউ সেখানে না থাকলে নিশ্চিন্ত।
আসলে ধ্রুবরা এদিকের ফ্ল্যাটে ভাড়া আছে অনেকদিন। ওদিকটায় আরেক ভাড়াটে। বাড়িওয়ালা তো তেতলায়। ইদানীং ভদ্রলোকের সঙ্গে আর তেমন ভাব ভালবাসা নেই। হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে দুজনের মুখেই মিষ্টি হাসি দেখা যায়, দুচারটে অন্তরঙ্গ ভনিতা। তারপর ধ্রুবই ব্যস্ততা দেখিয়ে ছিটকে বেরিয়ে আসে। কারণ ওর আশঙ্কা, আর কিছুক্ষণ সময় দিলেই রাখালবাবু কথাটা তুলবেন। সঙ্গে সঙ্গে সারাদিনের জন্যে মেজাজ নষ্ট হয়ে যাবে। ধ্রুব অবশ্য হেসে হেসেই কিছু একটা বলবে, স্তোক দেবে, হয়তো মিথ্যে স্তোক। কিংবা মুহূর্তে রেগে গিয়ে কিছু একটা বলে বসবে। তখন তার আবার কি প্রতিক্রিয়া হবে কে জানে!
সেজন্যেই ও তেতলার বারান্দার দিকে চোখ তুলে তাকায় না। চোখাচোখি হওয়াকেও ভয়। কতদিন তো রাস্তায় দূর থেকে রাখালবাবুকে আসতে দেখে ও ফুটপাথ পাল্টেছে।
কিন্তু আজ আর শুধু রাখালবাবুকেই ভয় নয়। ভয় প্রীতিকেও।
রাস্তার ওপর ছুড়ে ফেলে দেওয়া একটা গোটা সংসার, কয়েকটা অভুক্ত মানুষের সুকোনোমুখ, ব্যস, এই দৃশ্যটুকু দেখার পর থেকে ধ্রুবর মনে হচ্ছে ওর যেন হাঁটুতে কোনও জোর নেই। নিজেকে কেমন অসহায় লাগছে।
প্রীতির কাছে এসব কথা গোপন রাখতে পারবে না। ধ্রুবর যা স্বভাব, কোনও কথাই গোপন রাখতে পারে না। অথচ প্রীতিকে এই দৃশ্যটার কথা বললেই, ও জানে, প্রীতির মুখখানা নিমেষে বিবর্ণ হয়ে যাবে।
বাড়িতে ঢুকে ধ্রুব চুপচাপ শার্ট খুলল, প্যান্ট বদলে পাজামা পরল। কথাটা চেপে রাখার চেষ্টা করছে ও তখনও। যদি না বলে পারা যায়, প্রীতিকে অকারণ ভয় পাইয়ে দিয়ে কি লাভ। কিন্তু না বলেও পারছে না। কোনও একজনকে না বলে ফেলতে পারলে
ও নিজেই যে হাকা হতে পারবে না।
চেয়ারটা বেশ শব্দ করে টানল, রান্নাঘর থেকে প্রীতি যাতে শুনতে পায়। হয়তো জানেই না, খুব ফিরে এসেছে।
সকালের দিকে এই সময়টুকু ধ্রুব নিজে যত ব্যস্ত, প্রীতি তার হাজারগুণ। হাতের ঘড়িটা একবার দেখে নিল ধ্রুব।
খুট খাট ঠুং ঠাং শব্দ শোনা যাচ্ছে। কথাও। কখনও বালতি টানার কিংবা জল ঢালার শব্দ, কখনও হুঁড়ি কড়াই খুন্তির। এ সময় প্রীতির কাজ কি একটা। ঠিকে ঝি একদিকে, অন্যদিকে একজন রান্নার কাজের জন্যে–সুধা, তাদের ওপর নানারকম নির্দেশ দিতে দিতে প্রীতি নিজেও ছোটাছুটি করে কাজ করে। কি কাজ তা অবশ্য খুব ঠিক জানে না, জানার চেষ্টাও করে না। এ সময়টা সমস্ত বাড়িটার যেন এক জট পাকানো অবস্থা। এসব সময়ে ধ্রুব একটু দূরে সরে থাকতে চায়। এমন কি এক কাপ চায়ের কথা বলতেও দ্বিধা।
চায়ের কথা বলতে হল না। প্রীতির গলা শোনা গেল, সুধা দেখ, বোধহয় দাদাবাবু ফিরেছে, চা করে দে।
অথাৎ চেয়ার টানার শব্দটা ওর কানে গেছে।
যথা সময় চা এল। সুধাই নিয়ে এল।
চা খেতে খেতে খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিল ধ্রুব।
প্রীতি ঘরে ঢুকল কাপড় কাচার গুড়ো সাবানের প্যাকেট হাতে নিয়ে। বোধহয় রাখতে এসেছিল।
ধ্রুব কাগজ থেকে চোখ তুলে বললে, মন খারাপ হয়ে গেল আজ, একটা জিনিস দেখে।
কি দেখে এসেছে ও, বলতে গেল। জানো, আজ রাস্তায়, বিশুর পানের দোকানের পাশের রাস্তায়…
আরো একটু এগিয়েছে, বর্ণনা দিতে শুরু করেছে ও, শুনেই প্রীতি বলে উঠল, শুনেছি, কাজল বলছিল।
কাজল ওই ঠিকে ঝিয়ের নাম, ধ্রুব আন্দাজে বুঝে নিল। হয়তো এর আগে শুনেছে, মনে পড়ে গেল। আসলে ওই নামগুলো তো এক থাকে না, তিন মাস অন্তরই বদলে যায়। এত মনে রাখাও যায় না। যেমন ওই চব্বিশ ঘন্টার কাজের লোক সুধা। যাকে দিয়ে প্রীতি এখন রান্না করায়। ও নামটাও কতবার যে বদলে গেছে। র্যাশন কার্ডে ওরা সকলেই অবশ্য মীরা…পদবী কি মনে নেই। মান্ধাতা আমলে ওই নামের কেউ ছিল, সেই নামই চলে আসছে। বার বার নাম বদলানো তো সম্ভব নয়, ধ্রুব হাসতে হাসতে একবার বলেছিল, দুমাস অন্তর কার্ড বদলাতে গেলে তো মশাই গভর্নমেন্টই গণেশ ওল্টাবে।
ইনস্পেক্টর ভদ্রলোকও হেসে ফেলেছিলেন।
শুনেছি, কাজল বলেছিল। বাস, ওইটুকু বলেই প্রীতি চলে গেল।
আশ্চর্য, একটা কথা শোনার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, সময় নেই ওর কথা বলার। এতই ব্যস্ত। বলবে তো কি শুনেছে? ঠিকে ঝিরাই তো পাড়ার গেজেট। সত্যিমিথ্যে মিশিয়ে নানারকম গুজব তো ওরাই ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়। তিলকে তাল বানায়। কথাটা মনে হতেই খুব ভাবল, আমরা ভদ্রলোকরাই বা কম কি। ওই ভাড়াটে ভদ্রলোককে নিয়ে এতক্ষণে বাড়িতে বাড়িতে কত গুজব রটে গেছে কে জানে।
কিন্তু কাজল কি শুনে এসেছে, কি বলেছে প্রীতিকে তা জানার কৌতূহল চেপে রাখতে পারছিল না ধ্রুব। এইসব সময়ে ও তাই মাঝে মাঝে প্রীতির ওপর চটে যায়। কাজ তো সকলেই করে, তা বলে দুটো কথা বলার সময় হবে না?
আর কিছুক্ষণ পরে ধ্রুবরও তাড়াহুড়ো। মান, খাওয়া, পোশাক বদলানো, এটা ওটার খোঁজ। লেটে অফিস যাওয়া।
অফিস যাওয়া মানে তো বিভীষিকা। যত দেরি হবে, তত ভিড় বাড়বে বাসে। লেটে গেলে তবু কিছুটা স্বস্তি। লেটে, অর্থাৎ সেই বারোটায়।
প্রীতি আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এল এতক্ষণে। এসেই বেশ রাগত স্বরে বললে, দেখলে তো। ঠাকুমা বলত, গরিবের কথা বাসী না হলে মিষ্টি হয় না।
ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধে হল না। ও তবু প্রীতির রাগ কমাবার জন্যে হেসে বললে, যা বাবা, আমি আবার বড়লোক হয়ে গেলাম কবে থেকে। আর আমি বড়লোক হলে তো তুমিও বড়লোক, গরিব হতে যাবে কোন দুঃখে।
উল্টো কাজ হল। মেয়েরা কথায় কথায় হাসে ঠিকই, কিন্তু ওদের সেন্স অফ হিউমার কম। ধ্রুবর রসিকতায় হেসে ফেলার বদলে প্রীতি প্রচণ্ড রেগে গেল।
বলে বসল, দেখবে দেখবে, যেদিন ওদের মতোই সব ঘর থেকে টেনে বের করে দেবে, সেদিন বুঝতে পারবে।
ধ্রুবর মুখ নিমেষে চুপসে গেল। এই একটা কথাই তো ও দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছিল। কোথায় সাহস দেবে, বলবে, তুলে দেওয়া অত সহজ নয়, আইন আছে তার বদলে…
খুব প্রতিবাদ করার বা হেসে উড়িয়ে দেবার জোর পেল না। তাই ধীরে ধীরে জিগ্যেস করল, কাজল কি বলেছে? কি করে তুলে দিল?
কি করে আবার। কাজল বলছিল, ভদ্রলোক নাকি ভীষণ ভালমানুষ, সবাইকে বিশ্বাস করেছিল…।
একটু থেমে বেশ রাগের স্বরে আবার বললে, ভালমানুষ হয়েই থাকো। ভালমানুষির আর দিন নেই, বুঝলে!
ধ্রুব আর কোনও কৌতূহল দেখায়নি, আর কোনও প্রশ্ন করেনি। কৌতূহল দেখিয়েই বা কি লাভ। কাজল তো বাসন মাজার ঠিকে ঝি। ঝি, ঠিকে ঝি বললে প্রীতি অবশ্য চটে যায়। ওর ভাষায় কাজের লোক। এখন বলে কাজল। এর আগেরটা ছিল লক্ষ্মীর মা। ধ্রুবর অতশত নাম মনে থাকে না।
চটি ছিঁড়ে গিয়েছিল বলে প্রীতিকে একদিন বলেছিল, মুচিটা যখন যাবে এদিক দিয়ে, ডেকে দিয়ে তো!
সঙ্গে সঙ্গে ভুরু কুঁচকে ফিরে তাকিয়েছিল প্রীতি। প্রায় ধমকের সুরে বলেছিল, মুচি আবার কি? জুতো সারাই বলতে পার না! বাথরুম পরিষ্কার করতে আসে যে লোকটা, তাকে জমাদারও বলা যাবে না। একদিন বলেছিল, কেন, ওর কি নাম নেই? রঘুয়া বললেই তো পারো। কথাগুলোর পিছনে যুক্তি আছে, কিন্তু অভ্যাস কি এত সহজে বদলানো যায়। প্রীতিই বা কি করে অভ্যাস বদলে নিল। ওরা, মেয়েরা বোধহয় এসব চটপট পারে।
ধ্রুব শুনতে পেল, ওদিকের বারান্দায় প্রীতি হেসে হেসে কাজলের সঙ্গে কথা বলছে। রান্নার লোক সুধাব সঙ্গেও এভাবেই কথা বলে। ওদের কারও সামান্য অসুখবিসুখ হলে কত মিষ্টি মিষ্টি করে খোঁজ খবর নেয়, উপদেশ দেয়, এমন কি দুচারটে ওষুধের বড়িও।–দেখো কাজল, মনে করে খেয়ো কিন্তু, দিনে তিনবার।
আসলে এ-সবই এক ধরনের তোষামোদ। কাজল একদিন না এলে, কিংবা সুধা অসুখে দুদিন পড়ে থাকলে ও যে চোখে অন্ধকার দেখবে। সে জন্যেই এত হেসে হেসে কথা।
তোষামোদ দরকার হয় না শুধু ধ্রুবর বেলায়, তখন আর মুখে হাসি আসে না।
ধ্রুব একদিন বলেছিল, ওদের এত তোয়াজ করে কি হবে, পাঁচটা টাকা কোথাও বেশি পেলেই তো কেটে পড়বে। তখন আর…
প্রীতি রেগে গিয়ে বলেছিল, হেসে হেসে কথা বলব না তো কি দিনরাত ওদের নিয়ে অশান্তি করব।
সকলের সঙ্গে দিব্যি শান্তি বজায় রেখে চলবে প্রীতি, কিন্তু ধ্রুবর ভালমানুষিতেই ওর আপত্তি। যাও, বাড়িওয়ালা রাখালবাবুকে কড়া করে বলে এসো। অথচ ও বাড়িওয়ালা লোকটিকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলতে চায়, মুখোমুখি হলেই উদ্বেগ বাড়ে, অশান্তি বাড়ে। এমনকি ভাড়া দেওয়ার পর রসিদটা দিতে দুএক সপ্তাহ দেরি করলেও ওর কাছে গিয়ে মনে পড়াতেও ইচ্ছে করে না। রাখালবাবুদের চাকর-বাকরকে বলে, বাবুকে বলিস, রসিদটা এখনও পাইনি। কিংবা গোঁপওয়ালা বিহারী দারোয়ানকে বলে বাবুকে মনে পড়িয়ে দিতে।
তারপরও হা-পিত্যেশ করে বসে থাকা, কবে বাবুটি রসিদ পাঠাবেন। আর রসিদে কে যে সই করে কে জানে, ধ্রুব প্রথম দিকে রসিদের সঙ্গে সই মিলিয়ে দেখেছে; এখন আর একেবারেই মেলে না। এ-সবে কোনও আইনের প্যাঁচ আছে কিনা তাও জানে না। অথচ ধ্রুবর ভদ্রতাবোধে লাগে, বলতে পারে না, মশাই সইটা আমার সামনেই করুন। কিংবা টাকা দিচ্ছি, রসিদটা এখনই দিয়ে দিন।
এ যেন জমিদার আর প্রজার সম্পর্ক। ভাড়ার টাকাটা দিতে যাবার সময় নিজেকে বড় ছোট লাগে।
অফিসের অবিনাশ হাসতে হাসতে বলেছিল, যত কমিউনিজম গ্রামের জমি নিয়ে, কলকাতায় যোলো আনা ধনতন্ত্র।
ধ্রুব বলেছিল, ধনতন্ত্র বলছ কেন, এখনও সেই ফিউডেলিজ। দশ বিশখানা বাড়ি থাকলেও কোনও আপত্তি নেই।
ও-সব কথা বলে মনের ঝাল মেটানো যায়। কিন্তু বুকের ভিতর থেকে উদ্বেগ দূর করা যায় না। ভাড়াটে হয়ে থাকা মানেই একটা চিরন্তন অশান্তির সঙ্গে সহবাস করা।
সকালে দেখা দৃশ্যটা বারবার মনে পড়ছিল বলেই খুব মন থেকে উদ্বেগটা দূর করতে পারছিল না। সকলেই তো বলে আজকাল নাকি ভাড়াটেকে তুলে দেওয়া যায় না। তা হলে ওই দৃশ্যটা দেখতে হল কেন?
শেষ অবধি অবিনাশকেই বললে।
অবিনাশের পৈতৃক সূত্রে পাওয়া কিছু জমিজমা আছে হুগলিতে। গ্রামে চাষবাস হয়। এখানে বাড়ি ভাড়া করে আছে, কিন্তু র্যাশনকার্ড জমা দিয়ে পারমিট করিয়ে দারুণ ভাল চাল নিয়ে আসে গ্রাম থেকে।
ধ্রুব ওকে তাই ঠাট্টা করে বলে জমিদার।
অবিনাশের বেশ কিছু জমি ভেস্ট হয়ে গেছে, ক্ষতিপূরণের টাকা এখনও পায়নি। পেলেও তা সামান্য টাকা, সেজন্যে ঘুষ-ঘাস দিয়ে আদায় করার চেষ্টাও করেনি। বলে, যা ছোটাছুটি করতে হবে খরচ পোষাবে না।
কলকাতার বাড়িওয়ালাদের ওপর ওর রাগ সেজন্যেই। রাগ আসলে বাড়িওয়ালাদের ওপর, না কি আইনকানুনের ওপর, তা ঠিক বোঝা যায় না। আসলে ভেস্ট হয়ে যাওয়া জমির মায়া ও ভুলতে পারে না। বলে, কলকাতার একটা ফ্ল্যাটের দাম তো গ্রামের একশো বিঘে জমির চেয়ে বেশি। কিন্তু এখানে কোনও গরমেন্টই হাত বাড়াবে না।
অবিনাশকে কিন্তু বর বেশ ভালই লাগে। ওর দেশে জমিজমা আছে বলে কোনও ঈষাও হয় না। বরং অবিনাশও ভাড়াটে বলে কেমন এক ধরনের আত্মীয়তা বোধ করে।
বেশ প্রাণখোলা মানুষ এই অবিনাশ। গায়ের রঙ চাপা, কালোই বলা চলে। চুলে ঈষৎ পাক ধরেছে। পাঞ্জাবির ওপর একটা জহরকোট পরে। মাঝে মাঝেই দাড়ি কামাতে ভুলে যায়, কিংবা দাড়ি কামায় না। কেউ সেকথা বললে হাসতে হাসতে বলে, কি হবে গাল চকচকে করে, অফিসার করে দেবে? না কি এ বয়সে কোনও মেয়ে এসে গালে হাত বুলিয়ে দেবে?
যেন প্রতিদিন দাড়ি কামানোর প্রয়োজন ওইসব কারণেই।
সকাল থেকেই ধ্রুবর মনে অনেকগুলো প্রশ্ন। প্রীতির কাছ থেকেও শুনতে পায়নি কাজল কি জেনে এসেছে।
ও তো এতদিন বেশ নিশ্চিন্ত ছিল। রাখালবাবু যত অশান্তিই ঘটাক, ওকে তো আর বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারবে না। আইন ভাড়াটেদের পক্ষে।
কিন্তু তা হলে ওই ভদ্রলোকের আসবাবপত্র টেনে বের করে দিল কি করে? ভাড়া বাকি পড়েছিল? ভাড়া দিত না?
শেষে অবিনাশকেই বললে।
–আজ সকাল থেকেই ভাই মনটা খারাপ হয়ে আছে।
খাটো মাপের চেহারায় খাদির খয়েরি জ্যাকেটে অবিনাশকে আরো বেঁটে লাগে। কিন্তু সবসময়েই মুখে হাসি লেগে থাকে বলে দাড়ি কামিয়েছে কি কামায়নি চোখে পড়ে না।
অবিনাশ হাসল।—আরে বৌ কাছে থাকলে মাঝে মাঝে মন খারাপ হবে না তাও কি হয়?
একটু থেমে বললে, আমি তো ভাই মাঝে মাঝেই বৌকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিই, বৌয়েরও মন ভাল থাকে, আমারও মন ভাল থাকে। নো খিটিমিটি, নো ঝগড়া।
ধ্রুব হেসে ফেলল। ও জানে অবিনাশ এই রকমই। বয়সে ধ্রুবর চেয়ে দুবছরের বড় হলেও হতে পারে, কিন্তু সব দিক থেকে মানুষটা হাফ সেঞ্চুরি পেছিয়ে আছে। চেহারায়, পোশাক পরিচ্ছদে, কথা বলার ধরনে। আবার গুণগুলোতেও। হাফ সেঞ্চুরি আগেকার মানুষের মতোই খোলামেলা মন, কোথায় একটা আন্তরিকতা আছে। বিপদের সময় এগিয়ে আসে, সান্ত্বনা দেয়। ওর সঙ্গে কি করে যে এত বন্ধুত্ব হল ধ্রুব খুঁজে পায় না। ধ্রুব তো পোশাক আশাকের ব্যাপারে রীতিমতো খুঁতখুঁতে। শার্টের কিংবা ট্রাউজারের ক্রিজ নষ্ট হল কিনা তা নিয়ে সদাই সচেতন।
প্রীতির কথাটা হঠাৎ মনে পড়ে গেল। কি নিয়ে যেন ঝগড়াটা শুরু, ঝাঁঝের গলায় বলেছিল, তোমার শার্ট প্যান্টে ইস্ত্রি ঠেলে ঠেলে হাতের কজি তো খসে গেল।
কথাটা মিথ্যে নয়। ধ্রুব সত্যি একটু ঝকঝকে থাকতে ভালবাসে।
অফিসে এসে হাসতে হাসতে অবিনাশকে সে প্রসঙ্গ বলতেই অবিনাশ ধীরেসুস্থে কৌটো থেকে সুগন্ধি সুপুরি বের করে মুখে পুরে বলেছিল, জবাব দিলে না?
ধ্রুব হেসে বললে, কি জবাব দেব?
অবিনাশ হাসল।–বলতে হত, ম্যাডাম, পোশাক আশাক কি আর নিজের জন্যে? ওসবে আমার কি দরকার। তবে কিনা তোমার স্বামী বলে তো পরিচয় দিতে হবে।
ক্যান্টিনে আরো কে কে যেন ছিল, শব্দ করে হেসে উঠেছিল।
এই হল অবিনাশ।
সকালের দৃশ্যটার কথা বললে ও হয়তো তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবে। কিন্তু না বলেও উপায় নেই। মনের মধ্যে একটা উদ্বেগ, একটা দুভাবনা। কোনও একজনকে তো বলতে হবে। বলে হাল্কা হতে হবে। ভেবেছিল প্রীতিকে বলবে, কিন্তু সে তো বলার সুযোগই দিল না। কাপড়ে কতখানি সাবানের গুঁড়ো দিতে হবে, থালায় কেন ছাই লেগে আছে, আর বালতিতে জল ভরা নিয়েই ব্যস্ত। ঠিকে ঝি কিংবা রান্নার লোকের সঙ্গে, সেই ফাঁকে, গল্প জুড়ে দেয়। শুধু ধ্রুবর সঙ্গে কথা বলার সময় নেই। সকালের প্রীতি আর সন্ধের প্রীতি যেন দুটো পৃথক মানুষ।
শেষ অবধি অবিনাশকেই বলল। আসলে ও জানতে চায়, কিভাবে এটা সম্ভব হল। ও তো শুনে আসছে, আজকাল ভাড়াটেকে খোলা যায় না। তবে? আইনের নিশ্চয় কোনও ফাঁকফোকর আছে, সেটাই জানতে চায়। ও নিজেও না কোনওদিন আইনের সেই ক্ষুরস্য ধারায় পড়ে যায়।
অবিনাশের কাছে দৃশ্যটা বর্ণনা করে বলতে অবিনাশ বলে উঠল, ইস!
বেশ যন্ত্রণার ছাপ ফুটে উঠল ওর চোখেমুখে।
ধ্রুব তো লোকটিকে চেনেও না, দেখেনি কোনওদিন। তবু দৃশ্যটা দেখেছে। অবিনাশ সেটুকুও দেখেনি। তবু মনে হল ও যেন প্রচণ্ড ধাক্কা খেল।
অবিনাশ একটু পরে বললে, ইনহিউম্যান।
এই শব্দটা ধ্রুবর মনের মধ্যেও সকাল থেকেই ঘুরছে। ওর কেবলই মনে প্রশ্ন জাগছে, ভদ্রলোক কোনও ব্যবস্থা করতে পারলেন কিনা। এই এত সব ফার্নিচার, হাঁড়িকুড়ি, একটা গোটা সংসার। হয়তো দশ কিংবা বিশ বছর ধরে একটু একটু করে সাজিয়েছিলেন। এখন কোথায় নিয়ে গিয়ে তুলবেন! স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোথায় গিয়ে উঠবেন?
ধ্রুব বললে, ভদ্রলোক হয়তো ইদানীং অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ভাড়া বাকি পড়েছিল। অসুখ-বিসুখ চললে কার মনে থাকে!
অবিনাশ বললে, উহু, সেও তো আজকাল ইনস্টলমেন্টে দেওয়া যায়। অবশ্য জানি না…
ভাড়া বাকি পড়ার কথাটাই ভাবতে ভাল লাগছিল ধ্রুবর। কারণ, তা হলে ও নিশ্চিন্ত। ভাড়া বাকি ফেলার কথাই ওঠে না ওর ক্ষেত্রে। ফাইলের মধ্যে রসিদগুলো ঠিক ঠিক সাজিয়ে রেখেছে।
বেশ বোঝা গেল অবিনাশ নিজেও চিন্তিত। অবিনাশও তো ভাড়া বাড়িতেই থাকে, স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে। প্রথম জীবনটা ওর কেটে গেছে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে, তারপর একটু সচ্ছল হতেই গ্রামের বাড়ি থেকে সংসার তুলে এনেছে।
ধ্রুব বললে, আমি ভাবছি ভদ্রলোকের কথা। আজকাল তো সকলেরই মাত্র দুতিনখানা ঘর নিয়ে সংসার, বেচারির কোনও আত্মীয়টাত্মীয় থাকলেও কি আর থাকার জায়গা পাবে!
অবিনাশও যেন ভদ্রলোকের জন্যে চিন্তিত। বললে, সত্যি, রাতটা কোথায় যে কাটাবে। তাছাড়া অত সব জিনিসপত্র। কি করবে কে জানে।
দুজনই সেই অজানা অচেনা ভদ্রলোকের সমস্যার কথা ভেবে দুশ্চিন্তায় ড়ুবে গেল।
ধ্রুব হঠাৎ বললে, বোধহয় ভাল করে মামলা লড়তেও পারেনি। অবস্থা তো তেমন ভাল নয়, তোলা উনোন ছিল, গ্যাস স্টোভ কি সিলিন্ডার তো দেখলাম না। ফ্রিজও না।
কথাটা বললে বোধহয় মনে জোর পাবার জন্যে। অথাৎ প্রয়োজন হলে ও নিজে কিন্তু ভাল উকিল দিয়ে মামলা লড়তে পারবে। ওর গ্যাস স্টোভও আছে। ফ্রিজও আছে। এই সব দুঃস্থ টাইপের লোকদের সঙ্গে এতদিন ও খুব একটা একাত্ম বোধ করেনি। বরং দূরত্ব রেখেই চলত। অভাবে ওদের স্বভাব নষ্ট হয়, অনেকসময় ওদের ছেলেমেয়েরা বিগড়ে যায়, এই সব যুক্তি বানাত। অথচ এখন ওই ভদ্রলোক যেন আপনজন হয়ে উঠেছেন। কারণ উনিও ভাড়াটে।
অবিনাশ চাপা দুশ্চিন্তার হাসি হেসে বললে, রসিদৗসিদগুলো দেখে রাখতে হবে, শালা এমনিতেই তো জল দেয় না।
তারপর একটু থেমে বললে, আমাদের পাড়ায় অবশ্য একজনকে গুণ্ডা লাগিয়ে তুলে দিয়েছিল, সে অনেককাল আগে।
ধ্রুব অবাক হয়ে বললে, গুণ্ডা লাগিয়ে? এই কলকাতা শহরে?
অবিনাশ হাসল।–হ্যাঁ হে, এই কলকাতায়। এখানে কি না হয়? তবে সে ভদ্রলোক মামলা লড়ে ফিরে পেয়েছিলেন, কিন্তু লজ্জায় আর আসতে চাইলেন না।
—এই যে বাড়িওয়ালা! শোনো শোনো তোমাদের কির্তি।
সুনন্দকে যেতে দেখে অবিনাশ হাঁক দিল।
সুনন্দই বোধহয় প্রথম অবিনাশকে জমিদার আখ্যা দিয়েছিল, কারণ দেশে ওর কিছু জমিজমা আছে। তার পাল্টা জবাবে অবিনাশ ওকে বাড়িওয়ালা বলে ডাকে। কারণ সুনন্দর পৈতৃকসূত্রে পাওয়া একটা বাড়ি আছে।
বেশ ভাল বাড়ি, তিনতলা। আমহার্স্ট স্ট্রিটের ওপর।
বাড়িওয়ালা বললে সুনন্দ প্রথম প্রথম ক্ষুণ্ণ হত। ওটা নিশ্চয় কোনও সম্মানজনক পরিচয় নয়।
একদিন রেগে গিয়ে বলেছিল, কি বাড়িওয়ালা বাড়িওয়ালা করেন।
পরক্ষণেই রেগে যাওয়াটা অশোভন মনে হওয়ায় ইয়ার্কির ঢঙে বলেছিল, যদি বলতেই হয়, ল্যান্ডলর্ড বলুন, আপত্তি করব না।
অবিনাশ চোখ কপালে তুলে বলেছে, আরে ব্বাস, ল্যান্ডলর্ড! লর্ড বলতে হবে।
সুনন্দ তখনই চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়েছে অবিনাশের কাছে। তারপর সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বলেছে। অবিনাশদা, বাড়ি একটা আমার আছে ঠিকই, কিন্তু আমার অধিকারে মাত্র দুখানা ঘর, তিনতলায়। শরিকি ঝামেলা বিস্তর, বেচে দেব তার উপায়ও নেই, তার ওপর ভাড়াটেদের অত্যাচার।
অবিনাশ হেসে ফেলেছে। -তাই নাকি? ভাড়াটেরাও অত্যাচার করে? সুনন্দ বোঝাবার চেষ্টা করেছে, অত্যাচারের বিবরণ দিয়েছে। বলেছে, বাবা সেই কোনকালে ভাড়াটে বসিয়ে দিয়ে গেছে, কত ভাড়া পাই জানেন?
সব শুনে মুখে বিষণ্ণ ভাব এনেছে অবিনাশ, কিন্তু ওর দুঃখ-বেদনা কিংবা আরেকখানা ঘরের অভাব, এসবের কিছুই অবিনাশকে স্পর্শ করেনি।
বলেছে দ্যাখো ভাই, তোমার অনেক দুঃখ মানছি, কিন্তু তোমার ভাড়াটেদের দুঃখ আরো বেশি। এই যেমন তুমি তাদের ভাড়াটে বল।
অবিনাশের আশেপাশে যারা ছিল, তারা শব্দ করে হেসে উঠেছে। কিন্তু আঘাত দেবার জন্যে বলেনি অবিনাশ। ও তাই সঙ্গে সঙ্গে বলেছে, এই যেমন দেখ, আমার জমিজমা চলে গেছে, গভর্নমেন্ট নিয়ে নিয়েছে, তার জন্যে আমারও খুব দুঃখ। কিন্তু যাদের জমি নেই, পরের জমিতে চাষবাস করে, তাদের চেয়ে বেশি দুঃখ তো নয়।
সেই সুনন্দকে অবিনাশ আজ আর ডাকল বাড়িওয়ালা বলে। এখন আর বাড়িওয়ালা বললে সুনন্দ চটে না। ও বুঝে নিয়েছে, এটা অবিনাশের নিদোষ ঠাট্টা। তাছাড়া এ অফিসে এই এতগুলো ভাড়াটের মধ্যে একা সুনন্দরই বাড়ি আছে, সে পরিচয়টা খারাপ কিসে! বাড়ি মালিক হওয়ার মধ্যেও তো বেশ একটা গর্ব আছে।
তাই ডাক শুনে হাসতে হাসতে এসে বসল সুনন্দ।
আর ধ্রুব সকালে যা যা দেখেছে বলে গেল। যতখানি দয়া মায়া এবং সমবেদনা সেই অচেনা অজানা ভদ্রলোকের জন্যে ঢেলে দেওয়া সম্ভব, কথার মধ্যে তা মিশিয়ে দিয়ে। তাঁর স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ের বিষণ্ণ লজ্জিত মুখের বর্ণনা দিল। এবং শেষে বললে, যাই বল সুনন্দ, এটা একটা ইনহিউম্যান ব্যাপার।
সুনন্দর মুখ দেখে বোঝা গেল ও খুব আহত হয়েছে। যেন ধ্রুব বলছে, সুনন্দ, তুমিও একটা অমানুষ। হয়তো সত্যি তাই।
সুনন্দ প্রতিবাদ করল।–দেশে আইন আছে, কোর্টকাছারি আছে। লোকটার নিশ্চয় গলদ কিছু ছিল…
অবিনাশ হাসতে হাসতে সুনন্দর উরুর ওপর একটা থাপ্পড় বসাল। বললে, সেটাই তো জানতে চাইছি। তুমি তো ভাই একজন ল্যান্ডলর্ড, অন্ধিসন্ধি তোমারই জানার কথা। কোনও প্যাঁচে তাকে ওঠাল বল তো, আমরা তা হলে সাবধান হতে পারি।
সুনন্দ কোনও কথাই বলেনি, উঠে চলে গিয়েছিল। বেশ বোঝা গিয়েছিল ও রেগে গেছে।
ও চলে যাওয়ার পর ধ্রুব আর অবিনাশ দুজনেরই অনুশোচনা হল। এভাবে সুনন্দকে আঘাত দেওয়া ঠিক নয়। অথচ আঘাত তো দিল। কিন্তু কেন? ঈর্ষা? সুনন্দর একটা বাড়ি আছে বলে কি ওদের মনে কোনও ঈর্ষা আছে? কই, কখনও তো মনে হয়নি। সুনন্দর সঙ্গে এতদিনের বন্ধুত্ব, পাশাপাশি টেবিলে বসে কাজ করে, একজনের বিপদে আরেকজন এসে দাঁড়িয়েছে কতদিন, অথচ তাকেই ওরা ভাবল বিপরীত দিকের মানুষ। কি আশ্চর্য, একজন অজ্ঞাতকুলশীল, কেমন ধরনের লোক কে জানে, ধ্রুব তাকে কোনওদিন দেখেওনি, চেনে না, জানে না, সেই নোকটাই ওদের সমবেদনা পেল। মনে হল আপনজন, আত্মীয়! শুধু সেও একজন ভাড়াটে বলেই?
বাড়ি ফেরাব পথে ধ্রুবর মনে আবার উদ্বেগ ফিরে এল।
প্রীতি একসময় প্রায়ই বাড়ি করার কথা বলত। মাথা গোঁজার মতো একটা আশ্রয়। কিন্তু ধ্রুবর তখন বিষয়আশয়ের দিকে মন ছিল না। কিংবা ওর তেমন বিষয়বুদ্ধিই ছিল না। না, ওসব নিতান্তই অজুহাত। বাড়ি করার মতো টাকাই ছিল না ওর।
এখনও নেই। তবু একটা আশ্রয়ের কথা ভাবতে হচ্ছে। দিনরাত অশান্তি নিয়ে বাস করা যায় না।
ফেরার পথে ধ্রুব সেই রাস্তাটা দিয়েই এল। এখনও সব আসবাবপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে কিনা দেখে আসবে। ওগুলো যেন ওর বুকের ওপরই চেপে বসে আছে।
নাঃ, সব সরে গেছে, রাস্তাটা পরিষ্কার। কোথাও কিছু পড়ে নেই। কখন নিয়ে গেছে কে জানে, কোথায় গেছে তাই বা কে বলবে।
ওর বুকের ওপর থেকে একটা গুরুভার যেন নেমে গেল। তা হলে একটা কিছু ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু কি ব্যবস্থা। ধ্রুব ভেবেই পেল না। আজকাল তো আগেকার দিনের মতো বাড়িতে বাড়িতে টু লেট ঝোলে না।
দাদুর কাছে ধ্রুব শুনেছে ওঁদের সময়ে নাকি বাড়িওয়ালারাই ভাড়াটে পেলে ধন্য হয়ে যেত। নিয়মিত ভাড়া পেলে তো কথাই নেই। বাড়িওয়ালা আর ভাড়াটের মধ্যে কোনও ঈষা-দ্বন্দ্ব-দ্বেষ ছিল না। দুয়ে মিলে যেন একই সংসার। একজনের বিপদ মানে অপরেরও। তখন পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা ছিল না, শত্রু ছিল বাইরে। চোর, গুণ্ডা, মাতাল।
কিন্তু এখন অন্যরকম। বাড়িভাড়া কথাটাই মিথ্যে হয়ে গেছে। বাড়ি কোথায়, দুএক ঘরের ফ্ল্যাট যদি বা পাওয়া যায়, মাসমাইনের অর্ধেকটাই দিয়ে দিতে হবে। তার ওপর মোটা টাকা অ্যাডভান্স। কোত্থেকে পাবে সে-চিন্তা আমার নয়, দেবার লোক আছে। তাও কাছেপিঠে পাবে না, সরে যেতে হবে শহরের শেষপ্রান্তে। ফ্ল্যাটটাও মনঃপূত হবে না।
তা হলে ভদ্রলোক কি করে ঘণ্টাকয়েকের মধ্যে ব্যবস্থা করে ফেললেন? হয়তো পাঁচজন আত্মীয়ের বাড়িতে ছড়িয়ে রেখেছেন। পরে নিয়ে যাবেন। কিন্তু নিজেরা? সেটা অবশ্য দুপাঁচদিনের জন্যে সমস্যা নাও হতে পারে।
বুকের ওপর থেকে গুরুভার নেমে যেতেই বেশ হাল্কা মনে বাড়ি ফিরল ধ্রুব।
দরজার বাইরে থেকেই বেশ খুশি খুশি অনেকগুলি কণ্ঠে হইহল্লা শুনতে পাচ্ছিল। নিজেদের ফ্ল্যাটে, নাকি ওপাশের ফ্ল্যাট থেকে, বুঝতে পারেনি।
না, নিজেদের ফ্ল্যাটেই। দরজাটাও খোলা, তাই অনেকগুলো চটি দেখতে পেল। মেয়েদের স্লিপার।
প্রীতি ফ্রিজ থেকে কি বের করছিল, ধ্রুবকে দেখতে পেয়েই হাসি হাসি মুখে বললে, কে এসেছে দেখবে এসো। ঢুকেই অবাক। ছোটপিসিমা আর দুই পিসতুতো বোন। রুনি আর সুমি।
প্রীতির এত খুশি হওয়ার কারণ ছোটপিসিমা বড় একটা ধ্রুবদের বাড়িতে আসে না। ওদের অবস্থা খুবই ভাল। পিসেমশাই বড় চাকরি করেন। সেজন্যে ধ্রুবর হয়তো নিজেকে ও বাড়িতে নগণ্য মনে হত। ওরা আসে না বলে ধ্রুবও যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। যায়, ওই একবার বিজয়ার পর। ব্যস।
রুমি বড়, এর মধ্যে আরো বড় হয়ে গেছে। দেখতেও বেশ সুন্দর হয়েছে। শুনেছিল গতবার এম-এ পাশ করে গেছে। ধ্রুব ওদের হাতের দিকে তাকাল, রুমিব বিয়ে নাকি! কই, নিমন্ত্রণের চিঠিফিটি তো নেই।
অথচ সবারই মুখে হাসি উপছে পড়ছে।
পিসিমা হাসি হাসি মুখে এগিয়ে এসে ধ্রুবর হাতখানা ধরে বললে, কি রে, সব সম্পর্কটম্পর্ক ছেড়ে দিলি নাকি? একবারও যাস না।
ধ্রুবকেও হাসতে হল। সময় কই বল, তার ওপর বাসট্রামে যা ভিড়।
বাসট্রামে ভিড়ের জন্যেই মানুষে মানুষে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, না সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাওয়ার একটা ভাল অজুহাত এই বাসট্রামের ভিড়, সেই মুহূর্তে বুঝতে পারল না ও।
সুমি ছোট, কিন্তু কথার খৈ ফোটে ওর মুখে। বলে বসল, ট্রামবাসে ভিড় বলে যাও, না? তা ধ্রুবদা, একটা ফোন করে দিলেই পারো, গাড়ি পাঠিয়ে দেব।
এতক্ষণে ধ্রুবর মনে পড়ল, বাড়ির সামনে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িটা চিনতে পারেনি, হয়তো ড্রাইভার বদলে গেছে বলে। তাছাড়া, ওর মনেও হয়নি গাড়ি করে কেউ ওর কাছে আসতে পারে। ভেবেছিল অন্য কোনও বাড়িতে কেউ এসেছে।
সুমির কথা শুনে ধ্রুব ভিতরে ভিতরে একটু অপ্রসন্ন হলেও মুখে হাসি আনল। গাড়ি যখন আছে, তখন তোরা এলেই তো পারিস।
পিসিমা তখনও হাত ছাড়েনি ধ্রুবর। হাসতে হাসতে বললে, ভাইবোনের ঝগড়া এখন রাখ। যোধপুর পার্কে ফ্ল্যাট কিনেছি। এই মঙ্গলবার গৃহপ্রবেশ। তোরা যাবি কিন্তু।
এই ব্যাপার! এর জন্যেই এত উচ্ছল হাসি আনন্দ।
ধ্রুবরও কিন্তু শুনতে বেশ ভাল লাগল। আত্মীয়স্বজন কি খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব, কেউ বাড়ি করলে কিংবা ফ্ল্যাট কিনলে এক ধরনের আনন্দও হয়। কেমন একটা আশা জাগে, তা হলে আমিও হয়তো পারব।
ধ্রুব খুশি-খুশি মুখেই বললে, দারুণ খবর। তা হলে ভাড়াটে নাম ঘুচল, কি বলিস সুমি!
তারপরই বললে, আমরা তো ভেবেছিলাম, বাড়ি করবে! ফ্ল্যাট কেন?
সঙ্গে সঙ্গে বললে, তবে আমি তো আজকাল পাওয়াই যায় না। বোধহয় সান্ত্বনা দিতে চাইলে।
পিসিমা বললে, প্রীতি বলছিল, তোরাও একটা কিছু করার কথা ভাবছিস। করে ফেল এখনই।
প্রীতির মুখে তখনও হাসি। এগিয়ে এসে পিসিমাকে বলল, ওকে বলুন না সেই জমির কথা।
পিসিমা বললে, শোন ধ্রুব, যাস একদিন। জমিই হোক ফ্ল্যাটই হোক, যদি চাস, তোর পিসেমশাইয়ের কাছে অনেক খবর পাবি।
বেশ কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে ধ্রুবর পিসিমারা চলে গেল।
প্রীতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।–এবার আমাদেরও একটা কিছু করে নিতে হবে।
ধ্রুব কোনও জবাব দিল না।