১. ধার্মিক বুর্জোয়া এবং অধার্মিক সর্বহারা
[১৯২৭ সালের মার্চ মাসের ৬ তারিখে জাতীয় ধর্ম-নিরপেক্ষ সমাজের দক্ষিণ লন্ডন শাখার দ্বারা আয়োজিত বাটেরেসা টাউন হলে উক্ত বিষয়ে এক ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠানে বাট্রান্ড রাসেলের দ্বারা প্রদত্ত ভাষণ]
এতক্ষণ আপনাদের সামনে শ্রদ্ধেয় সভাপতি মহাশয় যে বিষয়ে তাঁর বক্তব্য রাখলেন উক্ত বিষয় প্রসঙ্গে এই মনোজ্ঞ রাতে আমি আমার বক্তব্য পেশ করতে চলেছি। বিষয়টি হল, কেন আমি ধর্মবিশ্বাসী নই। এই বিষয়টি বুঝতে হলে আমাদের প্রথমেই ভালো করে বুঝতে হবে যে একজন ব্যক্তি ধর্মবিশ্বাসী বা খ্রীস্টান বলতে ঠিক কী বোঝে। বর্তমানে বহু মানুষ এই শব্দটিকে খুবই হাল্কা অর্থে ব্যবহার করে থাকেন। কিছু কিছু মানুষ এই শব্দটির দ্বারা সেই সব মানুষদের বোঝেন যারা তাদের জীবনকে সৎ, সুন্দর ও মঙ্গলজনক পথে পরিচালিত করতে চায়। যদি খ্রীস্টান শব্দটির অর্থ এই হয়, তবে আমি বলব সমস্ত জাতি ধর্মে যারাই সৎ, সুন্দর ও মঙ্গলজনক পথে নিজেদের পরিচালিত করেছেন তারাই খ্রীস্টান। ভাবার্থের দিক থেকে খ্রীস্টান শব্দটিই যে কেবল সৎ সুন্দর মঙ্গলজনক জীবনের অর্থ বহন করে তা আমি মনে করি না, কেননা যারা খ্রীস্টান নন অর্থাৎ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী, কনফুসীয় ধর্মাবলম্বী কিংবা মহম্মদীয় ধর্মাবলম্বী বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বী, তারা যেহেতু খ্রীস্টান নন, তাই তারা সৎ, সুন্দর ও মঙ্গলজনক জীবন অতিবাহিত করবার চেষ্টা করছেন না। আমি খ্রীস্টান অর্থে সেই সব মানুষদের কথাও বলছি না, যারা নিজেদের আলোয় সুন্দরভাবে জীবনকে চালাবার চেষ্টা করেন। আমি কেবল মনে করি, নিজেকে একজন খ্রীস্টান বলে মনে করার অধিকার পেতে গেলে আপনাকে অবশ্যই সেই নির্দিষ্ট পরিমাণ বিশ্বাসের অধিকারী হতে হবে, যে বিশ্বাসের দ্বারা আপনি নিজেকে একজন খ্রীস্টান বলতে পারবেন। একটা কথা আপনাদের মনে রাখতেই হবে যে খ্রীস্টান শব্দটি সেন্ট অগস্টাইন এবং সেন্ট টমাস অ্যাকুইনাসের সময় যে পূর্ণ অর্থ বা প্রাণ-পূর্ণ রক্তিম অর্থে ব্যবহার হত সেই অর্থে শব্দটিকে বর্তমানে ব্যবহার করা হয় না। অর্থাৎ ব্যাপারটি অনেকটা এইরকম, যেমন–আপনি পৃথিবীর সমস্ত ধর্মমতকে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করলেন, যে ধর্মমতগুলি যথার্থরূপে নিজের নিজের ক্ষেত্রে বিকশিত এবং সেইসব ধর্মমতের প্রতিটি অক্ষরকে আপনি বিশ্বাস করেন আপনার দৃঢ় বিশ্বাসের পূর্ণ শক্তিতে।
ঈশ্বর বিশ্বাস বলতে কী বোঝায়?
বর্তমানে ঈশ্বর বিশ্বাস ব্যাপারটি সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধ নয়। খ্রীস্টান শব্দটির অর্থ আমরা ক্রমশই অস্পষ্টরূপে বুঝতে বাধ্য হচ্ছি। কেননা, আমি মনে করি যে, দুটি স্বতন্ত্র বিষয় সেই ব্যক্তির জন্য একান্ত অপরিহার্য যে ব্যক্তি নিজেকে একজন খ্রীস্টান বলতে চায়। বিষয়টি হল নিশ্চিতভাবে কথিত কিন্তু প্রমাণহীন– অর্থাৎ আপনাকে অবশ্যই ঈশ্বর ও তার অমরত্বের উপর বিশ্বাসপরায়ণ হতে হবে। যদি এই দুটি বিষয়ে আপনি বিশ্বাসী না হন, তবে আমার মনে হয় না যে আপনি নিজেকে একজন যাথার্থ ঈশ্বরবিশ্বাসী বলতে পারেন। এরপরেও, আর কিছুটা এগিয়ে বলা যায়, ধর্মটি যার নামে নামাঙ্কিত, সেই খ্রীস্টের উপর আপনার এক ধরনের বিশ্বাস থাকা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, মহম্মদীয় ধর্মাবলম্বীরাও ঈশ্বর ও তার অমরত্বের উপর বিশ্বাসপরায়ণ অথচ তারা নিজেদের খ্রীস্টান বলে মনে করে না। আমি মনে করি, কিছু না হলেও খ্রীস্টের উপর আপনার এই বিশ্বাস অবশ্যই আছে যে তিনি যদি স্বর্গীয় না-ও হন, অন্তত তিনি সমস্ত মানুষের চেয়ে উত্তম ও জ্ঞানী মানুষ। যদি আপনি খ্রীস্টের উপর বেশিরভাগ বিশ্বাসটি না করে উঠতে পারেন, তা হলে আমি মনে করি না যে আপনার নিজেকে একজন খ্রীস্টান বলে ডাকার অধিকার আছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে হুইটেকারের পঞ্জিকা থেকে আপনারা আর একরকম পথের সন্ধান পেয়েছেন এবং ভূগোলের বইগুলি থেকে আপনারা জানতে পেরেছেন যে পৃথিবীর সমগ্র জনগণকে খ্রীস্টীয়, মহম্মদীয়, বৌদ্ধ ও কৃতাসম্পন্ন উপাসক সম্প্রদায় এবং আরও বহু ধরনের সম্প্রদায়ে বিভক্ত করা হয়েছে, কিন্তু এরকম ভাবে ধরলে আমরা সবাই খ্রীস্টান। ভূগোলের বইগুলিতে আমরা সবাই নিজেদের জাতি সম্প্রদায়ের নামে তালিকাভুক্ত, কিন্তু তা কেবলমাত্র জ্ঞানের দাবিতেই, অন্য কিছু নয়। বর্তমান আলোচনার ক্ষেত্রে এই প্রসঙ্গটিকে আমরা পাশ কাটিয়ে যেতে পারি। এইজন্য উক্ত বিষয় আলোচনা করতে গিয়ে যখন আমি আপনাদের বলে থাকি যে আমি কেন খ্রীস্টান নই, তখন আমি আপনাদের দুটি বিভিন্ন বিষয় বলতে বাধ্য হই, প্রথমত, কেন আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না এবং বিশ্বাস করি না তার অমরত্বে এবং দ্বিতীয়ত, কেন আমি মনে করি না যে যীশু খ্রীস্ট সমগ্র মানুষের থেকে জ্ঞানী ও উত্তম মানুষ, যদিও আমি তার মঙ্গলময় নৈতিকতা সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করে থাকি।
কিন্তু অতীতে ঈশ্বর-অবিশ্বাসীদের সকল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আমি ঈশ্বরবিশ্বাস সম্পর্কে তাদের মতো স্থিতিস্থাপক কোন ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করে নিতে পারিনি। আমি আগেই বলেছি যে প্রাচীন কালে এই শব্দটিকে পূর্ণ রক্তিম চেতনার সঙ্গে ব্যবহার করা হত। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, শব্দটির নিষ্পত্তি ঘটে নরক-বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে। শাশ্বত নরকের বিশ্বাসে খ্রীস্টানদের কাছে কিছুদিন আগে পর্যন্ত আগুন একটি অনিবার্য উপাদান ছিল। আপনারা জানেন, এই দেশে প্রিভি কাউন্সিলের সিদ্ধান্তের ফলে অনিবার্য উপাদান হিসেবে আগুনকে বাদ দেওয়া হয়েছে এবং এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্যান্টারবারির আর্কবিশপ ও ইয়র্কের আর্কবিশপের মধ্যে মতভেদও হয়েছে, কিন্তু এই দেশে, আমাদের ধর্ম পার্লামেন্টের অ্যাট বা সংসদীয় আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ফলে প্রিভি কাউন্সিল এই জঘন্য করুণাকে পদদলিত করবার সামর্থ্য অর্জন করতে পেরেছে এবং খ্রীস্টানদের কাছে নরকের প্রয়োজনীয়তা আর বেশি দিন থাকতে পারেনি। ফলস্বরূপ আমিও কোন খ্রীষ্টানকে নরকে বিশ্বাসী হবার জন্য উৎসাহিত করব না।
ঈশ্বরের অস্তিত্ব
ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রশ্নে আসতে গেলে, প্রশ্নটি যেমন বড় হবে তেমনই তা ভাবগম্ভীর হবে। যদি আমার পক্ষে এই ধরনের প্রশ্ন ঠিক করা সম্ভব হত তবে আমি ঈশ্বরের রাজত্ব আসার আগে পর্যন্ত আপনাদের এখানেই ধরে রাখতাম, যাতে আপনারা আমাকে ক্ষমা করতে পারতেন প্রশ্নটি অপেক্ষাকৃত জোর করে করার জন্য। আপনারা জানেন যে ক্যাথলিক চার্চ ঈশ্বরের অস্তিত্বের সম্পর্কে এই মতো পোষণ করে থাকে যে ঈশ্বরকে প্রমাণ করা যেতে পারে অসহযোগিতামূলক বিচার শক্তি (unaided reason) দ্বারা। এই ধরনের মতবাদ কিছুটা কৌতূহলোদ্দীপক হলেও তাদের অনেকগুলি মতবাদের মধ্যে এটাও একটি। এই ধরনের মতবাদ তারা প্রচার করেছিল এই কারণে যে কোন একটি সময় মুক্তচিন্তাবিদরা প্রায়শই সেইসব বিভিন্ন যুক্তি-তর্ক উত্থাপন করে দেখাতেন যেগুলি ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিপক্ষে ব্যবহার করা যেতে পারে, কিন্তু সেইসব মুক্তচিন্তাবিদরা জানতেন যে তাদের বিশ্বাসের দিক থেকে ঈশ্বর অবশ্যই বিদ্যমান। এই বিষয়ে যুক্তিপ্রদর্শন ও তর্কবিতর্ক এমন একটা জায়গায় পৌঁছে গেল যে, ক্যাথলিক চার্চ অনুভব করল, এগুলোর অবশ্যই থাকার প্রয়োজন আছে। এইজন্যই তারা এই ধরনের মতবাদ প্রচার করল যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যেতে পারে অসহযোগিতামূলক বিচারশক্তির দ্বারা এবং তারা সেই ধরনের তর্কবিতর্কগুলিকেই সামনে রেখেছে যেগুলি ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের স্বপক্ষে যেতে পারে। এই ধরনের অনেকগুলি যুক্তি আছে, কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র কয়েকটিকে নিয়েই আমরা আলোচনা করব।
প্রথম-কারণের উপর বিতর্ক
প্রথম কারণের ওপর আলোচনাটি বোঝাবুঝির দিক থেকে সব থেকে সরল ও সোজা [আমাদের আগেই বুঝে রাখা দরকার যে জগতের যা কিছু আমরা দেখতে পাই, সবকিছুর একটি কারণ আছে। এই কারণকে প্রশ্ন করতে করতে আপনি পেছনের দিকে এগিয়ে গিয়ে অবশ্যই প্রথম কারণের (First cause) সম্মুখীন হবেন, এবং এই প্রথম কারণকেই আপনি ঈশ্বর বলে অভিহিত করেন।] আমি মনে করি উক্ত বিতর্কটি বর্তমান যুগের পরিপ্রেক্ষিতে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ, প্রথমত যে কারণটিকে ব্যবহার করা হবে সেটি সম্পূর্ণ নয়। দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা উক্ত কারণের উপর কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন, যে কারণটি মোটেই তেমন প্রাণবন্ত নয় যেমনভাবে অতীতে তাকে প্রাণবন্ত করে দেখানো হত। কিন্তু এতদ্বতিরিক্ত আপনি একটি যুক্তি দেখাতে পারেন যে প্রথম কারণ বলে একটি কারণ অবশ্যই আছে যার কোন বৈধতা নেই। যখন আমি যুবক ছিলাম তখন এই প্রশ্নগুলি নিয়ে নিজের মনেই ভাবগম্ভীর তর্ক-বিতর্ক চালিয়েছিলাম। প্রথম কারণের উপর বিতর্ক আমি বহুদিন ধরে গ্রহণ করেছিলাম, কিন্তু একদিন, যখন আমার বয়স আঠারো, আমি জন স্টুয়ার্ট মিলের আত্মজীবনী পড়লাম, এবং সেখানে এই বাক্যটি দেখলাম : আমার বাবা আমাকে এই প্রশ্নগুলি শেখালেন, ‘কে আমাকে তৈরি করেছে?’ আমার দ্বারা এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব হয়নি কিন্তু এই ধরনের প্রশ্ন আমাকে সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি প্রশ্ন করার পথে নিয়ে গেল, সেটি হল, ‘কে ঈশ্বরকে তৈরি করেছে?’ আমি এখনও মনে করি এই সরল বাক্যটি প্রথম কারণ সম্পর্কিত যুক্তির দোষটি সেই প্রথম আমাকে দেখালো। যদি প্রতিটি জিনিসের একটি কারণ থাকে তবে ঈশ্বরেরও কারণ আছে (If everything mrust have cause, then god must have a cause)। যদি কারণ ছাড়াই কোন কিছু থাকতে পারে তবে তা ঈশ্বরের জগৎ সম্পর্কেও সমানভাবে প্রযোজ্য। সুতরাং যুক্তি-তর্কের আর কোন মূল্যই থাকে না। এই ব্যাপারটি অনেকটা হিন্দুদের দৃষ্টিভঙ্গির মতো, যেমন জগৎ একটি হাতির উপর অবস্থান করছে এবং হাতিটি একটি কচ্ছপের উপর অবস্থান করছে এবং যখন কেউ প্রশ্ন করে কচ্ছপটি কার উপর অবস্থিত? তখন ভারতীয়রা বলে থাকে মনে হয় আমরা বিষয়টিকে পরিবর্তন করছি। সত্যি করে বলতে গেলে এর থেকে ভালো যুক্তি আর নেই। কোনরকম কারণ ছাড়াই জগৎ বর্তমান অস্তিত্বে আসতে পেরেছে এরকম ভাবার যেমন কোন কারণ নেই, অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, এরকম কি কোন কারণ থাকতে পারে যে কেন জগতের সর্বদাই বিদ্যমান থাকা উচিত হয়নি। এরকম ভাবারও কোন কারণ নেই যে পৃথিবীর একটি শুরু ছিলো। আমাদের কল্পনার অভাবেই আমাদের এরকম ভাবতে হয় যে, বস্তুসমূহের অবশ্যই একটি শুরু ছিল। এই জন্য আমি প্রথম কারণের যুক্তির উপর অযথা সময় নষ্ট করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি না।
প্রাকৃতিক আইন সম্পর্কিত যুক্তি
প্রাকৃতিক আইন থেকে একটি অতি সাধারণ যুক্তি পাওয়া যেতে পারে, যে যুক্তিটি সমগ্র অষ্টাদশ শতক ধরে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, বিশেষত, স্যার আইজ্যাক নিউটন ও তাঁর বিশ্বতত্ত্বের প্রভাবের ফলে। মাধ্যাকর্ষণের সূত্র অনুযায়ী সাধারণ মানুষ এই সত্যটি জানলে যে সমস্ত গ্রহগুলি সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে এবং তারা মনে করল যে ঈশ্বর এসমস্ত গ্রহগুলিকে এই বিশেষভাবে ঘোরার আদেশ দিয়েছিলেন বলেই তারা ওই ভাবে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। তাদের এই ভাবনাটি এত সরল ও সোজা ছিলো যে তার ফলে তাদের মাধ্যাকর্ষণের সূত্রটিকে আরও খতিয়ে দেখার সমস্যাকে গ্রহণ করতে হয়নি। কিন্তু আইনস্টাইনের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে এই মাধ্যাকর্ষণের সূত্রটির ব্যাখ্যা আমাদের কাছে কিছুটা জটিল হয়ে পড়ল। নিউটনীয় ব্যবস্থায় যে ব্যাখ্যাটি অতি দ্রুত দেওয়া যেত, এখন থেকে তা আর হল না, কেননা যে ভাবেই হোক ব্যাখ্যাটি সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়ল। আইনস্টাইন কিভাবে মাধ্যাকর্ষণের সূত্রটিকে ব্যাখ্যা করেছেন সে সম্পর্কে আমি কোন ভাষণ দিতে চাই না, কারণ তা কিছুটা সময় নিয়ে নেবে, তবে সেই নিউটনীয় ব্যবস্থায় প্রাকৃতিক আইনটিকে আপনারা আর বেশিদিন ধরে থাকতে পারলেন না, যেখানে, কোন কারণবশত কেউ বুঝে উঠতে পারেনি, কেন প্রকৃতি সমরূপ ধরনের (Uniform fashion) আচরণ করে থাকে। এবার আমরা বুঝতে পারলাম অনেক কিছু, যাদেরকে আমরা প্রাকৃতিক আইন বলে মনে করতাম সেগুলো বাস্তবে বিভিন্ন মানবিক প্রথা (Human connection)। আপনারা জানেন যে বহুদূরবর্তী তারকামণ্ডিত অনন্তেও তিন গজে এক ফুট হয়। এটা নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, কিন্তু আপনি এই ব্যাপারটি প্রাকৃতিক আইন বলে ভাবতে পারেন না এবং এইরকম বহু জিনিস যাকে আমরা প্রাকৃতিক আইন ভেবে থাকি, আসলে সেগুলো উক্ত ঘটনাটির মতো। অন্যদিকে, পরমাণুগুলো কিভাবে কাজ করে সে সম্পর্কিত বিষয় যদি আপনি জানেন তবে দেখবেন যে সেগুলো ঠিক তেমনভাবে প্রাকৃতিক আইন মেনে কাজ করে না যেমনভাবে সাধারণ মানুষ ভাবে। আপনি যে-সব প্রাকৃতিক আইনগুলি সম্পর্কে জানেন সেগুলো পরিসংখ্যানগত গড় হিসেবে আকস্মিক ঘটনা থেকে উদ্ভূত। এরকম একটি ঘটনার কথা বলা যেতে পারে যা বলতে গেলে আমরা সবাই জানি। পাশাখেলার ক্ষেত্রে দেখা যায় ছত্রিশবার দান ফেললে আপনি একবার হঠাৎ দুটি ছয়ের দান ফেলতে পারেন, এর জন্য আপনি এরকম মনে করতে পারেন না যে আপনার দানের ক্ষেত্রে এই রকম ঘটনা কোন একটা নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। অন্যভাবে বলা যায় যে প্রতি ছত্রিশবারে যদি একবার দুটো ছক্কা পড়ে তবে বলা যেতে পারে যে ব্যাপারটি একটা নিয়মে চলছে। প্রাকৃতিক আইনগুলি বহু ক্ষেত্রেই অনেকটা এইরকম। পরিসংখ্যানগত গড় হিসেবের দিক থেকে তারা প্রায় সবাই আকস্মিকতার আইন (Laws of chance) থেকে উদ্ভূত এবং এই ধরনের ঘটনার ফলে পূর্বের তুলনায় বর্তমানে প্রাকৃতিক আইনগুলিকে অনেক কম মর্মস্পর্শী বলে মনে হয়। এর থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে বলা যেতে পারে যে উপযুক্ত আইনগুলি বিজ্ঞানের ক্ষণিক পরিস্থিতির (Momentary state of science) প্রতিনিধিত্ব করলেও কাল সেগুলো বদলে যেতে পারে। প্রাকৃতিক আইনই মূলত আইন প্রণেতা এই ধরনের সমগ্র ধারণাটি প্রাকৃতিক আইন ও মানবিক আইনের মধ্যে একটা বিভ্রান্তির ফলেই ঘটেছে। মানবিক আইনগুলো এমন কতকগুলি আদেশ যা কোন একটি নির্দিষ্ট পথে আপনার আচরণকে নিয়ন্ত্রিত করে, যে পথে আপনি আচরণ করতেও পারেন, আবার না-ও করতে পারেন সেটা আপনার পছন্দের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু প্রাকৃতিক আইন হল বস্তুর বাস্তব আচরণের বর্ণনা এবং প্রাকৃতিক আইনগুলো বস্তুর বাস্তব আচরণের বর্ণনা বলেই আপনি কখনও এই ধরনের তর্ক উত্থাপন করতে পারেন না যে, কেউ বস্তুগুলোকে ঠিক ওই ধরনের আচরণ করতে আদেশ দিয়েছে, কেননা যদি আপনি এই ধরনের কথা বলেন তবে প্রশ্ন উঠবে, কেন ঈশ্বর অন্য কিছু না করে ঠিক এমন ধরনের প্রাকৃতিক আইন তৈরি করলেন?’ তখন যদি আপনি বলেন যে তিনি তাঁর আনন্দের জন্যেই এই ধরনের প্রাকৃতিক আইন তৈরি করেছেন এবং যার কোন কারণ নেই, তখন আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন যে এখানে এমন কিছু একটা আছে যা আইনের বিষয়বস্তু নয় এবং সেখানেই আপনার প্রাকৃতিক আইন সম্পর্কিত ধারণা বিঘ্নিত হবে। যদি আপনি গোঁড়া ধর্মবেত্তাদের মতো অনুসরণ করে এই কথা বলেন যে ঈশ্বর সর্বোত্তম বিশ্ব সৃষ্টি করবার জন্যেই কেবল এই ধরনের আইনের সৃষ্টি করেছেন, অন্য আর কোন কারণ নেই, তবে যেভাবে ব্যাপারটিকে আপনি কখনই ভেবে দেখেননি, সে ভাবেই বলতে হয়, যে যদি প্রাকৃতিক আইনগুলি ঈশ্বরেরই রচনা এইরূপ কারণ থাকে তবে ঈশ্বর নিজেও উক্ত আইনের বশবর্তী এবং এই কারণেই ঈশ্বরকে মধ্যস্থ কোন সত্তা বলে পরিচিত করানোর মধ্যে কোন লাভ নেই। আপনার স্বর্গীয় আদেশের বাইরে ও সম্মুখে সত্যই একটি আইন আছে এবং ঈশ্বর আপনার উদ্দেশ্যকে কখনই সফল করে তুলতে পারবেন না, কেননা তিনি কখনই কোন আইনপ্রণেতা নন। সংক্ষেপে, প্রাকৃতিক আইন সম্পর্কে সমগ্র যুক্তি আগে যে শক্তির সঙ্গে ব্যবহৃত হত এখন তা আর রইল না। বিষয়গুলি সম্পর্কে সমালোচনা করার জন্য আমি ঠিক সময়েই এগিয়ে চলেছি। বিষয়টি হল ঈশ্বরের অস্তিত্বকে নিয়ে যা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। এই বিষয়গুলি প্রথমে ছিল যথেষ্ট কঠিন ও বুদ্ধিদীপ্ত, কিন্তু অবশ্যই ভ্রমাত্মক ছিল । আমরা আধুনিক যুগে প্রবেশ করা মাত্রই তারা বুদ্ধিগত দিক দিয়ে কম সম্মানিত হয়ে পড়ল এবং ক্রমশ এক ধরনের নৈতিক অস্পষ্টতার দ্বারা আক্রান্ত হল।
অভিসন্ধিজাত আলোচনা
পরবর্তী পদক্ষেপ আমাদের অভিসন্ধিজাত আলোচনায় (Argument from design) নিয়ে আসে। অভিসন্ধিজাত আলোচনা সম্পর্কে আপনারা সবাই জানেন: জগতের সবকিছুই এমনভাবে তৈরি হয়েছে যাতে জগতে আমরা বেঁচে থাকার উপায় পেতে পারি এবং যদি এই জগৎ একটুখানি অন্যরকম হত তবে আমরা এখানে বেঁচে থাকার উপায় পেতাম না। এটাই অভিসন্ধিজাত বিষয়। বিষয়টি কখনও কখনও কৌতূহলোদ্দীপক হয়ে ওঠে, উদাহরণস্বরূপ, এই বলে যুক্তি প্রদর্শন করা হয় যে গুলি করার সুবিধার জন্যই খরগোসের সাদা লেজ। আমি জানি না কিভাবে একটি খরগোস এই ধরনের ব্যাপারটি দেখবে। এটা একটি ব্যঙ্গ-কাব্যের সহজ বিষয়। আপনারা সবাই ভলতেয়ারের সেই জনপ্রিয় উক্তিটির কথা জানেন যে নাকটি এমনভাবে গঠিত হয়েছে যাতে সেখানে চশমাটি ঠিক মতো বসে। অষ্টাদশ শতকে এই ধরনের ব্যঙ্গোক্তি সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে খুব একটা অসংগতিকর কথা হয়ে উঠতে পারেনি কেননা ডারউইনের সময় থেকে আমরা অনেকটা বুঝে গিয়েছিলাম যে কেন জীবন্ত সৃষ্টি তাদের পরিবেশের সঙ্গে নিজেদেরকে অভিযোজিত করে নেয়। এটা নয় যে তার পরিবেশটিকে নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নেয় যেখানে তারা মানাতে পারবে, বরঞ্চ তারাই পরিবেশটির পক্ষে মানানসই হয়ে ওঠে এবং এটাকেই অভিযোজনের ভিত্তি বলা হয়ে থাকে। এ সম্পর্কে অভিসন্ধির কোন প্রমাণ নেই। আপনি যখন নকসা বা অভিসন্ধিটিকে খতিয়ে দেখতে চাইবেন, তখন একটা আশ্চর্যজনক জিনিস আপনি দেখতে পাবেন যে মানুষ বিশ্বাস করে এই জগৎ ও তার অভ্যন্তরে সমগ্র বস্তু তাদের অপূর্ণতা সত্ত্বেও অবশ্যই এক অসাধারণ সৃষ্টি বা সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞ লক্ষ লক্ষ বছর ধরে সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে। আমি বস্তুতই ব্যাপারটিকে বিশ্বাস করতে পারি না। আপনি কি এটা ভেবে দেখেছেন যে যদি আপনাকে সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞ করে দেওয়া হয় এবং লক্ষ লক্ষ বছরের মধ্যে আপনাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় জগৎকে একটা পূর্ণতার সঙ্গে গঠন করার, তবে আপনি কু-ক্লুক্স-ক্ল্যান বা ফ্যাসিস্তদের থেকে ভালো কিছু তৈরি করে উঠতে পারবেন না? এছাড়াও, যদি আপনি বিজ্ঞানের সাধারণ সূত্রগুলি গ্রহণ করেন তবে আপনাকে অবশ্যই ধরে নিতে হবে যে এই গ্রহটির উপর মানবজীবন ও সাধারণ জীবন একটি নির্দিষ্ট সময়ে অবশ্যই শেষ হয়ে যাবে। সৌর-ব্যবস্থার ক্ষয়জাত এটি একটি বিশেষ পর্যায় মাত্র, উক্ত ব্যবস্থার ক্ষয়ের একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে আপনি উষ্ণতাকে একটি বিশেষ অবস্থায় পেলেন এবং যে উষ্ণতায় প্রোটোপ্লাজম সৃষ্টি সম্ভব হয়ে উঠল এবং সমগ্র সৌর-ব্যবস্থার আয়ুর উপর নির্ভর করে এখানে কিছুদিনের জন্য জীবনলীলার সূচনা হল (There is life for a short time in the life of the whole solar system) lontanist চাঁদে এমন কিছু দেখেন যা পৃথিবীতে হতে চলেছে, অর্থাৎ কিছুটা মৃত, ঠাণ্ডা এবং জীবনহীন।
আমাকে বলা হল যে এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি বিষণ্ণতামূলক এবং মানুষ আপনাদের বলবে যে যদি তারা এই ধরনের বিশ্বাস করে তবে তারা পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সামর্থ্য জোগাড় করে উঠতে পারবে না। এটা বিশ্বাস করবেন না, এটা একেবারেই বাজে কথা। এখন থেকে লক্ষ লক্ষ বছর পরে কি ঘটবে তা নিয়ে কেউ উদ্বিগ্ন নয়। এমনকি যদি তারা ভাবে যে তারা সত্যই ব্যাপারটাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন তবে তারা নিজেদেরকে বঞ্চিত করছে। তারা এমন কিছু নিয়ে উদ্বিগ্ন যা অনেকটা পরিমাণ পার্থিব অথবা ব্যাপারটি তাদের বদহজম হয়েছে। কিন্তু লক্ষ লক্ষ বছর পরে পৃথিবীতে কি ঘটতে যাচ্ছে তা ভেবে অবশ্যই কেউ দুঃখকে উৎপাদন করবে না। যদিও এটা একটা বিষণ্ণতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি যে পৃথিবীতে জীবনলীলা একদিন শেষ হবে, অন্তত আমরা যেন এই সত্যটা বুঝতে পারি । যদিও কখনও কখনও মানুষ পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে যে-সব জিনিসগুলি করে থাকে তা নিয়ে আমার অনুশোচনা হয় কেননা এগুলো কেবলমাত্র এক প্রকার সান্ত্বনা ছাড়া আর কিছুই নয়, তবে এই সান্ত্বনাগুলো আর যাই হক জীবনলীলাকে অন্তত দুর্বিসহ করে তোলে না।
পরমেশ্বরের স্বপক্ষে নৈতিক যুক্তি
এখন আমরা আর একটা স্তর এগিয়ে এলাম যে স্তরটিকে আমরা বুদ্ধিবৃত্তি সংক্রান্ত অবতরণ (Intellectual descent) বলব, অর্থাৎ যে পথে ঈশ্বরবিশ্বাসী বা আস্তিকেরা তাদের যুক্তি প্রয়োগ করেছেন এবং আমরা এখন সেই বিষয়টিকে নিয়ে আলোচনা করব যাকে বলা হয়ে থাকে ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষে তিনটি বিচারবুদ্ধি-সংক্রান্ত যুক্তি ছিল, যার সবগুলোই ইমানুয়েল কান্ট তার “Critioue for Pure Rason” গ্রন্থে গ্রহণ করেছিলেন; কিন্তু যেই তিনি এই তিনটি যুক্তি গ্রহণ করলেন সঙ্গে সঙ্গে তিনি একটি নতুন যুক্তি আবিষ্কার করে ফেললেন এবং সেই যুক্তিটি ছিল একটি নৈতিক যুক্তি যা তাকে সহজেই প্রভাবিত করে ফেলেছিল। তিনি সাধারণ আর সব মানুষদের মতোই ছিলেন। কিন্তু বুদ্ধি-সংক্রান্ত ব্যাপারে তিনি ছিলেন সন্দেহবাদী, তবে নৈতিক বিষয় তিনি সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করতেন যে তিনি মাতৃচরণে পূর্ণভাবে সমর্পিত। এই ধরনের মনোভাব সম্পর্কে মন বিশ্লেষকরা যা জোর দিয়ে বলে থাকেন তা হল কিশোর বয়সে আমরা যে পরিবেশে (Association) বড় হই তা আমাদের জীবনে একটি গভীর প্রভাব ফেলে যা পরিণত বয়সের পরিবেশ ফেলতে পারে না।
আমার মতে কান্ট ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে একটি নতুন নৈতিক যুক্তি আবিষ্কার করলেন যেটি বিভিন্নভাবে ঊনবিংশ শতকে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এই যুক্তিটি বিভিন্ন ধরনের আকারবিশিষ্ট, এদের মধ্যে একটি হল ঈশ্বরের অস্তিত্ব না থাকলে জগতে ভালো-মন্দ বলে কিছুই থাকত না। জগতে ভালো-মন্দের মধ্যে সত্যই কোন স্বতন্ত্রতা আছে কিনা, সে বিষয়ে এখনই কোন আলোচনা করতে আমি আগ্রহী নই। বর্তমানে আমি যে বিষয়টিকে নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী তা হল, যদি আপনি ভালো-মন্দের স্বতন্ত্রতা স্বীকার করে নিতে চান তবে যে প্রশ্নের সম্মুখীন আপনি হবেন তা হল, ঈশ্বরের আদেশেই কি এই স্বতন্ত্রতা, নাকি তা নয়? যদি এটা ঈশ্বরের আদেশ হয়ে থাকে তবে স্বীকার করে নিতে হয় যে ঈশ্বরের নিজের কাছে ভালো বা মন্দের মধ্যে কোনরকম স্বতন্ত্রতা নেই। তাই ঈশ্বর মঙ্গলময় এই কথাটির আর কোন অর্থই হয় না। এর পরেও যদি ধর্মবেত্তাদের মতো আপনি বলতে চান যে ঈশ্বর মঙ্গলময় তবে আপনি এ কথা বলতে চাইছেন যে ভালো-মন্দের এমন একটি অর্থ আছে যা ঈশ্বরের আদেশের উপর নির্ভর করে না, কেননা ঈশ্বরের আদেশ সর্বদাই ভালো, তা কখনই নিজের থেকে মন্দ হতে পারে না। এরপরে যদি আপনি একথা বলতে চান যে ভালো-মন্দ ব্যাপারটি এই ঈশ্বরের থেকে আসেনি কেননা ভালো-মন্দ ব্যাপারটি ঈশ্বরের পূর্ববর্তী হওয়ায় যুক্তিগত দিক দিয়ে তা ঈশ্বরের উপর নির্ভর করে না। এবার উক্ত যুক্তির উপর নির্ভর করে আপনি অবশ্যই বলতে পারেন যে এই ঈশ্বরের পূর্ববর্তী আর এক পরম ঈশ্বর আছেন যিনি এই জগতে প্রকৃত খ্রীস্টান অথবা এই জায়গায় কোন পরম ঈশ্বরকে না বসিয়ে কোন শয়তানকেও বসাতে পারেন। শেষোক্ত ঘটনাটিকে আমি অনেকটা বেশি বাস্তব বলে মনে করি। বস্তুত আমাদের পরিচিত এই জগৎটি কোন এক মুহূর্তে শয়তানের দ্বারা তৈরি যে মুহূর্তে ঈশ্বর কিছুই দেখছিলেন না। এতক্ষণে এই ব্যাপারটির সম্পর্কে আমরা যথেষ্ট ভালোভাবে বুঝেছি এবং যা বুঝেছি তা অবশ্যই আমার দ্বারা খণ্ডিত হবে না।
অন্যায় প্রতিকারার্থে যুক্তি
শেষমেশ আমরা নৈতিক যুক্তি সম্পর্কে একটি কৌতূহলপূর্ণ দিক খুঁজে পাই, সেটা হল, তারা বলে থাকেন যে জগতে মঙ্গল প্রতিষ্ঠার জন্য ঈশ্বরের অস্তিত্ব একান্তভাবে প্রয়োজন। আমরা জানি যে বিশ্বের এই অংশে অন্যায়ের রাজত্ব এবং প্রায়শই কঠিন সংগ্রাম ও কখনও শয়তানের অগ্রগতি। কেউ এটা ঠিক বুঝতে পারে না এর মধ্যে কোনটা বেশি বিরক্তিকর। কিন্তু যদি আপনারা এই বিশ্বে ন্যায় বস্তুটিকে লাভ করতে চান তবে ব্যাপারটি এমন দাঁড়াবে যে আপনারা বস্তুত আপনাদের ভবিষ্যৎ জীবনে পৃথিবীর ভারসাম্যমূলক উপশম চাইছেন। এই জন্যে ঈশ্বর বিশ্বাসীরা বলে থাকেন অবশ্যই ঈশ্বর আছেন। ভবিষ্যতে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যেই পৃথিবীতে স্বর্গ ও নরকের অস্তিত্ব একান্ত প্রয়োজন। এই যুক্তিটি বেশ কৌতূহলপূর্ণ। যদি ব্যাপারটিকে আপনি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখেন তবে আপনি অবশ্যই বলতে বাধ্য হবেন, আমি কেবলমাত্র এই জগৎকেই চিনি, বিশ্বের অন্যান্য অংশ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। সম্ভাব্যতার তত্ত্বের উপর নির্ভর করে যতটা সম্ভব যুক্তি প্রদর্শন করে একজন একথা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হবেন যে এই জগৎটি একটি সুন্দর নিদর্শন, যদি এখানে অন্যায় থাকে তবে বিশ্বের সর্বত্রই অন্যায়কে দেখা যাবে। ব্যাপারটি অনেকটা এইরকম, যেমন ধরুন আপনি একটি কমলালেবুর বাক্স আনলেন, যার ঢাকনাটা খুলে আপনি দেখলেন যে উপরিভাগের কমলালেবুর সবগুলিই খারাপ, তখন আপনি এরকম যুক্তি দেখিয়ে বলতে পারেন না যে ভারসাম্যের নিয়মানুযায়ী নীচে অবশ্যই ভালো কমলালেবু আছে। আপনার বলা দরকার, সম্ভবত এই বাক্সের সব লেবুগুলিই খারাপ এবং একজন বৈজ্ঞানিক ব্যক্তি সমগ্র বিশ্ব সম্পর্কে এই ধরনের যুক্তি পোষণ করবেন। তিনি সম্ভবত বলবেন, এই জগতেই আমরা এত বেশি পরিমাণ অন্যায় দেখি যে তা দেখে মনে হয় না বিশ্বের কোন জায়গায় ন্যায় শাসন চলতে পারে এবং এই যুক্তিই যে নৈতিক যুক্তির উত্থাপন করে তা ভগবান বা অন্য ওইরকম কারুর অস্তিত্বকে স্বীকার করে না। তবে এই ধরনের বুদ্ধিদীপ্ত যুক্তিগুলি, যেগুলি নিয়ে আমি এতক্ষণ আলোচনা করেছি, সেগুলি জনসাধারণকে খুব একটা প্রভাবিত করে না। যা মানুষকে ঈশ্বরের বিশ্বাসের দিকে পরিচালিত করে তা অবশ্যই এই সব বুদ্ধিদীপ্ত যুক্তিগুলি নয়। বেশিরভাগ মানুষ ঈশ্বরকে বিশ্বাস করে এই জন্য যে তারা শিশু বয়স থেকে ঈশ্বরকে বিশ্বাস করতে শেখে এবং এটাই হল প্রধান কারণ।
আমি মনে করি বাঁচবার ইচ্ছাটাই সব থেকে শক্তিশালী কারণ। এটা এমন এক ধরনের অনুভব যা মানুষকে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মতো রক্ষণাবেক্ষণ করে। এই ধরনের অনুভবই মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে এমন মৌলিকভাবে প্রভাবিত করেছে যাতে সে ঈশ্বর বিশ্বাসী হতে বাধ্য হয়েছে।
খ্রীষ্টের চরিত্র
এখন আমি এমন একটি বিষয়ের উপর কথা বলতে চাই যে বিষয়টিকে নিয়ে যুক্তিবাদীরা ঠিক মতো আলোচনা করেন না বলে আমার প্রায়ই মনে হয় এবং তা হল– খ্ৰীষ্ট মানুষের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও জ্ঞানী কিনা। এটা সাধারণত আগেই মেনে নেওয়া হয় যে আমরা ব্যাপারটিকে মেনে নেব কেননা ব্যাপারটা ওইরকম। কিন্তু ব্যাপারটিকে আমি নিজে এরকমভাবে মেনে নিই না। আমি মনে করি এমন অনেক বিষয় আছে যেখানে আমি খ্রীষ্টের সঙ্গে যতটা একমত হতে পারব ততটা একমত পেশাদার খ্ৰীষ্টানরাও হতে পারবে না। আমি জানি না খ্রীষ্টের সঙ্গে আমি সমগ্র পথটা হাঁটতে পারব কিনা, কিন্তু যে-কোন পেশাদার খ্রীষ্টানের থেকে অনেক বেশি পথ আমি তার সঙ্গে যেতে পারব। আপনারা মনে রাখবেন যে তিনি বলেছিলেন, ‘অশুভকে প্রতিরোধ কোর না, কেউ যদি তোমার গালে আঘাত করে, বা গালটাও পেতে দিও। এটা কোন নতুন আদর্শ বা ধারণা নয়। খ্রীষ্টের জন্মের পাঁচ ছ’শ বছর আগে লাওৎসে এবং বুদ্ধ এই ধরনের আদর্শকে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এই ধরণের আদর্শ বস্তুত কোন খ্রীষ্টানই গ্রহণ করেন না। উদাহরণ হিসেবে আমি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর (স্ট্যানলি বালডুইন) কথা বলতে পারি যিনি নিঃসন্দেহে একজন নৈতিক খ্রীষ্টান, কিন্তু তাই বলে আমি আপনাদের কারুকে এই উপদেশ দেব না যে যান, গিয়ে তার একটি গালে আঘাত করে আসুন। আমি মনে করি আপনি দেখতে পারেন যে মন্ত্রীমহাশয় এই ব্যাপারটিকে দৈহিক আঘাতরূপে ধরে নেবেন।
এখানে আর একটি দিক আছে যে দিকটিকে আমি দারুণ বলে মনে করি। আপনি মনে রাখবেন যে খ্ৰীষ্ট বলেছেন নিজেকে বিচার না করে অপরকে বিচার করতে যেও না। আমি মনে করি না এই ধরনের আদর্শ খ্রীষ্টান দেশগুলোর আইন আদালতে জনপ্রিয়রূপে দেখতে পাবেন। আমার সময়ে আমি অনেক বিচারকদের চিনতাম যারা গোঁড়া খ্রীষ্টান ছিলেন এবং তারা এটাই জানেন না যে তারা যে কাজ করতেন তা খ্রীষ্টীয় আদর্শের ঠিক বিপরীত। খ্রীষ্ট আরও বলেন, তাকে তাই দাও যা সে তোমার কাছে চাইছে এবং তাকে যা ধার দিয়েছো তা তার কাছ থেকে ফিরিয়ে নিও না। এটা একটা সুন্দর আদর্শ।
আপনাদের সভাপতি মহাশয় আপনাদের একথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে এখানে কোনরকমভাবে রাজনৈতিক কথা চলবে না, কিন্তু আমাকে শেষ সাধারণ নির্বাচনের কথা বলতেই হচ্ছে। এই নির্বাচনটি সংঘটিত হয়েছিল এই আশায় যে এই নির্বাচনে আপনারা তাদের যে ধার দিয়েছিলেন তা তারা ফিরিয়ে দেবে। তাহলেই দেখুন আপনাদের সংরক্ষণশীল দল (Conservative party) ও উদারনৈতিক দল (Liberal Party) এমন কিছু মানুষদের নিয়ে তৈরি যারা খ্রীষ্টীয় হয়েও খ্রীষ্টের শিক্ষাকে মানেন না, কেননা নির্বাচনের ফলাফলের মধ্যে দিয়েই তারা যা দিয়েছিল তার সবটাই জোর করেই ফিরিয়ে নিয়েছে।
খ্রীষ্টের আর একটি উপদেশের কথা আমি জানি যেটি আমার মতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আমার কিছু খ্রীষ্টান বন্ধুদের মধ্যে তাকে জনপ্রিয় রূপে দেখেনি। এই উপদেশে তিনি বলেছেন, যদি তুমি সঠিক হতে পার, তবে তোমার যা আছে তা নিয়ে যাও ও বিক্রি কর এবং দরিদ্রকে দাও।’ এটা সত্যই একটা সুন্দর নীতি কিন্তু এই নীতিটিকে খুব একটা অনুসরণ কেউ করে না। আমি মনে করি, এই সব নীতিগুলি নিঃসন্দেহে মঙ্গলজনক, যদিও এগুলি অনুসরণ করে জীবনে বাঁচা ব্যাপারটি খুব কষ্টকর। বেঁচে থাকবার জন্য আমি নিজের জীবনেও এই নীতিগুলি অনুসরণ করি না, কিন্তু এটা অবশ্যই বলব যে আমার ব্যাপারটা ঠিক খ্রীষ্টানদের মতন নয়।
খ্রীষ্টের শিক্ষার ভ্রান্তিসমূহ
এই নীতিগুলোকে অতি উত্তম বলে স্বীকার করে নিলেও, আমি এ কথা বিশ্বাস করতে পারি না যে একজন মানুষকে চরম জ্ঞানী বলা যেতে পারে কিংবা খ্রীষ্টের ঈশ্বরতত্ত্বকে চরম রূপে দেখানো যেতে পারে, যেরকমভাবে দেখানো হয়েছে। গসপেলে।
যদিও এখানে কে ঐতিহাসিক প্রশ্নের সঙ্গে যুক্ত তা দেখানো আমার কাজ নয়, তবুও এ কথা বলতেই হয় যে ঐতিহাসিক দিক দিয়ে খ্রীষ্টের অস্তিত্ব কোনদিন ছিল কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে এবং তিনি থেকে থাকলেও তার সম্বন্ধে কোন কিছুই জানি না, অতএব আমি এই ধরনের ঐতিহাসিক প্রশ্নের ধারে-কাছেও যেতে চাই না যা যথেষ্ট দুঃসাধ্য। আমি শুধু সেই খ্রীষ্ট সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই যাকে গপেলে বর্ণনা করা হয়েছে। গসপেলের বর্ণনাগুলিকে যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করে কেউ একথা বলতে পারবে না যে সেখানে যা পাওয়া যায় সেগুলো খুব জ্ঞানদীপ্ত। একটা জায়গায় অবশ্য সে ভাববে যে সেই সময় জীবিত সব মানুষদের মরবার আগে খ্রীষ্টের দ্বিতীয় আবির্ভাব ওইসব মানুষদের মধ্যে তাঁর সম্পর্কে এক গৌরবের মেঘমালার সৃষ্টি করেছিল। আমরা প্রচুর গ্রন্থ থেকে এই ঘটনার প্রমাণ পাই। উদাহরণস্বরূপ, তিনি বলেন, “তোমরা ইজরায়েলের নগরীগুলোতে ততদিন পর্যন্ত যেতে পারনি যতদিন মানবের সন্তান না এসেছে। তারপর তিনি আরও বলেন, সেখানে এমন একটি অবস্থা দাঁড়ালো, যে-অবস্থা ততদিন পর্যন্ত মৃত্যুর স্বাদ নিতে পারেনি যতক্ষণ না মানবের সন্তান তার নিজের রাজত্বে ফিরে এসেছেন। এইরকম উদাহরণ পাওয়া যায় যেখানে পরিষ্কারভাবে দেখা যায় যে তিনি বিশ্বাস করতেন যে সেই সময়ের জীবিত মানুষদের জীবদ্দশাতেই তিনি দ্বিতীয়বার ফিরে আসবেন। খ্রীষ্টের তৎকালীন অনুগামীদের এই বিশ্বাসই ছিল এবং তার নৈতিক শিক্ষার এটাই ছিল মূলভিত্তি। যখন তিনি বলেন, “পরের দিনের জন্য কোন চিন্তা রেখো না এইরকম আরও কয়েকটি উদাহরণকে সামনে রেখে আমরা বলতে পারি, যে খ্ৰীষ্ট এই ধরনের কথাগুলো বলতে পেরেছিলেন এই কারণে, যে তিনি জানতেন তাঁর দ্বিতীয় আবির্ভাব খুব তাড়াতাড়ি ঘটতে চলেছে এবং এই কারণেই পার্থিব সব কারণগুলিকে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। বস্তুত, আমি কিছু খ্রীষ্টানদের চিনি যারা বিশ্বাস করে যে দ্বিতীয় আবির্ভাব আসন্ন ছিল। আমি এমন একজন ব্যক্তিকে চিনি যিনি তাঁর ধর্মসভাকে এই বলে শাসিয়ে ছিলেন যে খ্রীষ্টের দ্বিতীয় আবির্ভাব আসন্ন, কিন্তু সেই ধর্মসভায় উপস্থিত ব্যক্তিরা তাকে তার বাগানে বৃক্ষরোপণ করতে দেখে যথেষ্ট সান্ত্বনা পেয়েছিল। সেই যুগের খ্রীষ্টানরা এই ব্যাপারটিকে যথার্থই বিশ্বাস করত এবং তার ফলে তারা তাদের বাগানে বৃক্ষেরোপণ থেকে বিরত থাকত, কেননা তারা খ্রীষ্টের থেকে এই বিশ্বাস গ্রহণ করতে পেরেছিল যে তাঁর দ্বিতীয় আবির্ভাব আসন্ন। উক্ত প্রসঙ্গে এ কথা পরিষ্কার করে বলা যেতে পারে যে অন্যান্য মানুষদের মতোই তিনি যথেষ্ট জ্ঞানী ছিলেন না এবং তিনি কখনই পরম জ্ঞানী ছিলেন না।
নৈতিক সমস্যা
এবার আপনি নৈতিক প্রশ্নে আসুন। খ্রীষ্টের নৈতিক চরিত্রকে নিয়ে আমার মনে একটি গভীর সন্দেহ আছে এবং সেটি হল যে তিনি নরকে বিশ্বাস করতেন। আমি নিজে এই ব্যাপারটিকে কিছুতেই মেনে উঠতে পারি না যে খ্রীষ্টের মতো একজন পূর্ণমানব এইরকম চিরশাস্তিকে বিশ্বাস করতে পারেন। সুসমাচারগুলোতে খ্রীষ্টের এমন অনেক ছবি আঁকা হয়েছে যেখানে তাকে চিরশাস্তিকে বিশ্বাসীরূপে দেখা যাচ্ছে এবং যে-কেউ এই ব্যাপারটি দেখতে পাবেন যে যারা খ্রীষ্টের বাণী প্রচারে কান দিচ্ছে না তাদের বিরুদ্ধে তার সমর্থনকারীদের উন্মত্ততা। বাণী প্রচারকদের কাছে এই রকম ঘটনা কোন নতুন ঘটনা নয়, কিন্তু এই ধরনের ঘটনা তাদের গুরুগিরির গুরুত্বকে বেশ কিছুটা হ্রাস করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে আপনি সক্রেটুসের আচরণ লক্ষ্য করেননি। যে-সব মানুষ সক্রেটসের কথা শুনতো না তাদের কাছে তিনি ছিলেন অতিশয় নম্র ও ভদ্র। আমার মত অনুযায়ী এই ধরনের আচরণই একজন সাধু ব্যক্তির পক্ষে অধিকতর উপযুক্ত আচরণ। উপরোক্ত প্রচারক গুরুদের কর্কশ আচরণ কখনই উপযুক্ত আচরণ হতে পারে না। সম্ভবত আপনারা সবাই মনে রেখেছেন সেইসব কথাগুলোকে যা সক্রেটস তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে বলেছিলেন এবং সেই কথাগুলোও নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে যে কথাগুলো তিনি তাদের বলতেন যারা তার কথা শুনতে না।
আপনারা দেখতে পাবেন যে তিনি তার সুসমাচারগুলোতে বলেছেন, ‘ওরে শয়তানগ্রস্ত, ওরে বিষধর সর্পের বংশধর, তোরা কি নরকের করাল গ্রাস থেকে কোনভাবে উদ্ধার পাবি?’ এই ধরনের কথা তাদের বিরুদ্ধেই বলা হয়েছে যারা তাঁর প্রচারে কান দেয়নি। এই ধরনের কথাগুলিকে আমার মন কিছুতেই উত্তম বলে মেনে নিতে পারেনি। নরক সম্পর্কে এ ধরনের অনেক উদাহরণ আপনি সুসমাচারগুলোতে দেখতে পাবেন। পবিত্র আত্মার বিরুদ্ধে পাপ সম্পর্কিত জনপ্রিয় একটি গ্রন্থের কথা আমরা জানি, যেখানে বলা হয়েছে, যারা পবিত্র আত্মার বিরুদ্ধে কোন কথা বলবে তারা এ-জগতেও যেমন স্থান পাবে না, তেমনি আগত জগতেও কোন স্থান পাবে না। এই জনপ্রিয় গ্রন্থটিতে সেইসব মানুষদের জন্য এই জগতে অব্যক্ত সব নিদারুণ যন্ত্রণার উল্লেখ করা হয়েছে যারা কল্পনাতেও পবিত্র আত্মার বিরুদ্ধে কোনরকম পাপ করে ফেলেছে এবং এটা চিন্তা করা হয়ে থাকে যে তারা ইহজগৎ বা পরজগৎ কোন জায়গাতেই ক্ষমা পাবে না। আমি সত্যই একথা চিন্তাও করতে পারি না যে চরিত্রের দিক থেকে খ্রীষ্টের মতো এমন একজন কোমল হৃদয়সম্পন্ন মানুষের পক্ষে জগতে এইরকম ভয় এবং প্রচণ্ড ভীতির সঞ্চার সম্ভব হয়ে থাকতে পারে।
এখানেই খ্রীষ্ট থেমে থাকলেন না। তিনি আরও বললেন, মানবের সন্তান তার দেবদূত পাঠাবেন এবং তারা তাঁর রাজত্বে যা কিছু বিরক্তিকর সেইসব কিছুকে বার করে এক জায়গায় একত্রিত করবে, এবং শুধু তাদেরই নয়, যারা পাপ করেছে। তাদেরও তারা এক জায়গায় করবে। তারপর তাদের জ্বলন্ত আগুনের চুল্লীতে নিক্ষেপ করবে। সেখানে শোনা যাবে দাঁত কিড়মিড় ও আর্তনাদের শব্দ। তিনি সেই আর্তনাদ ও দাঁত কিড়মিড়ের দিকেই এগিয়ে চলেছেন। তাঁর সুসমাচারগুলোতে এই ধরনের কথা বার বারই এসেছে। এটা পাঠকদের কাছে স্পষ্ট যে এই ধরনের দাঁত কিড়মিড় ও আর্তনাদের সম্পর্কে অনুতাপ করে এক ধরনের সুখ লাভ করা যায়। এই ধরনের অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, যেমন আপনাদের অবশ্যই মনে আছে সেই ভেড়া ও ছাগলের উপাখ্যানের কথা। ভেড়া ও ছাগলদের দ্বিতীয়বার ভাগ করতে এসে তিনি ছাগলদের বলেন, ‘ওরে অভিশপ্তর দল, দূর হ আমার সামনে থেকে, এবং অনন্ত আগুনে পুড়ে মর। এরপর তিনি আরও বলেন, যদি তোমার হাত তোমাকে বিরক্ত করে তবে তাকে কেটে ফেল, দু’হাত থেকে যদি সেই নরকে যেতে হয় যে নরকের আগুন কখনও নেভে না, উষ্ণতা কখনও হ্রাস পায় না তপ্ততা কখনও ঠাণ্ডা হয় না, তার থেকে অনেক ভালো দু’হাত কেটে অঙ্গহীনতার জীবন কাটানো, বার বার তিনি এই কথা বলেছেন। আমি অবশ্যই বলব যে এই ধরনের নীতি, যা পাপ করার জন্য নারকীয় আগুনের শাস্তি দেয়, তা নিষ্ঠুর নীতি। এই ধরনের নীতি জগতে নিষ্ঠুরতাকে বৃদ্ধি করেছে এবং যুগের পর যুগ ধরে নিষ্ঠুর অত্যাচারের রাজত্ব চালিয়েছে। সুসমাচারের খ্রীষ্টকে যদি আপনারা তার যুগের সময় থেকে পর্যবেক্ষণ করেন তবে দেখবেন যে তিনি এরজন্য আংশিক হলেও দায়ী।
এধরনের আরও অন্যরকম গল্প পাওয়া যায় যেগুলো অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ। গাদারেনের শূকরের উপাখ্যান আর একটি দৃষ্টান্ত। সেখানে ছোট শূকরদের মধ্যে শয়তানকে স্থাপন করে তাদের পাহাড় থেকে ছুটিয়ে নামিয়ে সমুদ্রের দিকে নিয়ে যাওয়াটা মোটেই কোন সহৃদয়তার পরিচয় নয়। আপনারা নিশ্চয়ই মনে রাখবেন যে তিনি সর্বশক্তিমান এবং তিনি ইচ্ছে করলে শয়তানকে তাড়িয়ে দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা না করে ছোট্ট শূকরদের মধ্যে শয়তানকে পাঠালেন। এছাড়াও ডুমুরগাছ নিয়েও একটি কৌতূহলোদ্দীপক গল্প আছে, যে গল্পটা আমাকে সর্বদাই বিমূঢ় করে রাখে : ‘সে ছিল ক্ষুধার্ত এবং দূরে পাতায় ভরা একটি ডুমুরগাছ দেখে খুশী হয়ে সেখানে এলো এই আশায় যদি সেখানে কিছু পাওয়া যায়। গাছের কাছে এসে সে দেখলো গাছের পাতা ছাড়া আর কিছুই নেই, কেননা সেই সময়টা ডুমুর ফলার সময় ছিল না। এই জন্য যীশু ডুমুরগাছকে অভিশাপ দিয়ে বললেন, “কোন মানুষ এবার থেকে তোমার ফল খাবে না কখনও।”… পিটার তাঁকে বললেন, “প্রভু দেখুন, ঐ যে ডুমুরগাছ, তোমাদের মধ্যে যারা অভিশপ্ত তারা দূর হও।” এই গল্পটি সত্যই একটি কৌতূহলোদ্দীপক গল্প, কেননা বছরের সেই সময় ডুমুর ফলার সময় ছিল না, এই কারণে কোনভাবেই আপনারা ডুমুরগাছকে দোষারোপ করতে পারেন না। আমি নিজে ভাবতে পারি না যে যীশু ইতিহাসে পরিচিত তিনি কিছু মানুষের থেকে জ্ঞানে অথবা ধর্মে সবচেয়ে বড় ছিলেন। আমি মনে করি বুদ্ধ ও সক্রেটস এই ব্যাপারে তার চেয়ে অনেক বড় ছিলেন।
আবেগের কারণ
আমি আগেই বলেছি, মানুষ কেন ধর্মকে গ্রহণ করে তার প্রকৃত কোন কারণ না থাকার ফলে যুক্তি-তর্কের দ্বারা কিছু করা যাবে বলে আমি মনে করি না। তারা কেবলমাত্র আবেগের বশবর্তী হয়ে ধর্মকে গ্রহণ করে। কোন একজনকে প্রায়ই বলা হত যে ধর্মকে আক্রমণ করাটা একটা বিরাট ভুল, কেননা ধর্ম মানুষকে পুণ্যবান করে তোলে। এরকমই আমাকে বলা হয়, কেননা আমি ধর্মকে লক্ষ্যই করি না। আপনারা অবশ্যই জানেন, উক্ত বিষয়ের উপর যুক্তিকে নিয়ে ব্যঙ্গকাব্যে রচিত স্যামুয়েল বাটলারের গ্রন্থ এরিউহন রিভিজিটেড-এর কথা। আপনারা মনে রাখবেন যে এরিউহনে (Erewhon) হিগ্স নামে একটি চরিত্র আছে যে একটি দূরবর্তী দেশে পৌঁছলো। সেখানে কিছুদিন কাটাবার পর সে সেই দেশ থেকে বেলুনে চড়ে পালালো। কুড়ি বছর পর সে সেই দেশে ফিরে এলো এবং একটি নতুন ধর্মকে দেখলো, যে ধর্মে সেই পূজিত হচ্ছে সূর্যপুত্রের নামে এবং এই প্রবাদবাক্য সেখানে প্রচলিত ছিল যে সে স্বর্গে আরোহণ করেছে। সে দেখলো তার সেই আরোহণের দিনটিকে সেখানে উৎসব হিসাবে পালিত হতে। সে শুনলো দুজন অধ্যাপক হ্যাঁঙ্কি ও প্যাঙ্কি বলছে যে তারা মানুষ হিগসের উপর কখনও তাদের চোখ রাখতে পারে না এবং কোনদিন পারবেও না বলে তারা আশা করে। কিন্তু সূর্যপুত্রের ধর্মে তারাই ছিলেন উচ্চ পুরোহিত। এতে হিগস্ খুব রেগে গেল। সে তাদের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, “আমি তোমাদের সমস্ত প্রবঞ্চনার কথা জানাতে যাচ্ছি এবং এরিউহনের সব মানুষদের আমি বলে দেব যে দেখ আমাকে, আমি সেই মানুষ হিগস এবং আমি বেলুনে চড়ে চলে গিয়েছিলাম। তখন তাকে বলা হল, তুমি এরকম কাজ অবশ্যই কোর না। এদেশের সব নৈতিক আদর্শগুলো এই পৌরাণিক গাথার উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে। একবার যদি তারা জানে যে তুমি স্বর্গে আরোহণ করনি তবে তারা বদমাস হয়ে যাবে।’ সে তাদের সেই কথা শুনলো এবং শান্তভাবে চলে গেল।
এটাই হল ব্যাপার যে আমরা যদি খ্রীষ্টান ধর্মকে আঁকড়ে না ধরি তবে আমরা সবাই খারাপ হয়ে যাবো। আমার কাছে মনে হয়, যে মানুষেরা এই ধর্মটাকে আঁকড়ে ধরেছে তাদের বেশিরভাগই ভীষণ বদমাস। আপনারা একটি কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা দেখতে পাবেন, যে কোন যুগে ধর্ম যত তীব্র হয়েছে এবং ধর্মশাস্ত্রের প্রতি বিশ্বাস মানুষের যত দৃঢ় হয়েছে, ততই সেখানে নিষ্ঠুরতা বেড়েছে এবং সামাজিক সম্পর্ক ও দৈনন্দিন জীবনের অবস্থা ততই খারাপ হয়ে উঠেছে। বিশ্বাসের সেই সব যুগগুলোতে, যখন মানুষ সত্যই খ্রীষ্টধর্মকে উক্ত ধর্মের সব কিছু সমেত বিশ্বাস করত, তখন সেই প্রচলিত ধর্মমতের বিরুদ্ধ মতো দমনের জন্য স্থাপিত বিচারালয় যেমন ছিল, তেমন ছিল তার অত্যাচার। সেই সময় বহু হতভাগী মহিলাদের ডাইনি সন্দেহে আগুনে পুড়ে মরতে হয়েছিল। ধর্মের নামে মানুষের উপর সমস্ত রকমের অত্যাচার ও নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করা হয়েছিল।
জগতের দিকে তাকিয়ে দেখলে আপনারা দেখতে পাবেন, যখনই মানুষের অনুভবে যৎকিঞ্চিত অগ্রগতি ঘটেছে, অপরাধের আইনে যখনই কোন উন্নতি ঘটেছে, যখনই যুদ্ধ হ্রাস করার কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, বা যখনই বর্ণ বৈষম্যকে দূর করার কোন চেষ্টা করা হয়েছে, যখনই দাসত্বকে হ্রাস করবার চেষ্টা করা হয়েছে বা জগতে প্রতিটি নৈতিক অগ্রগতি যখনই ঘটেছে, তখনই জগতের সমস্ত সংগঠিত গীর্জা সর্বদা তার বিরুদ্ধাচরণ করে এসেছে। আমি স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ কথাই বলব যে খ্রীষ্টধর্ম, যা তার গীর্জাগুলোকে ভিত্তি করে সংগঠিত, তা সর্বদা ও এখনো পর্যন্ত জগতের নৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে প্রধান শত্রু।
কেমনভাবে গীর্জাগুলো অগ্রগতিকে বাধা দিয়েছে
আপনারা হয়ত ভাবছেন যে এখনো গীর্জাগুলো অগ্রগতিকে বাধা দিয়ে যাচ্ছে বলে আমি খুব বাড়াবাড়ি করছি। কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি করছি বলে আমি মনে করি না। আচ্ছা, একটা ঘটনার কথা বলা যাক। যদি আমি ঘটনাটার কথা উল্লেখ করি তা হলে আপনারা আমার সঙ্গে অবশ্যই তা সহ্য করবেন, কেননা ঘটনাটা খুব আনন্দদায়ক নয়। গীর্জা কোন একজনকে সত্য বলতে বাধ্য করেছিল যেটা খুব একটা আনন্দদায়ক ছিল না। ধরুন আজকের যে জগতে আমরা বাস করছি। সেখানে একটি অভিজ্ঞ মেয়ে একজন সিফিলিটিক (যৌনরোগাক্রান্ত) মানুষকে বিবাহ করেছিল। এই ঘটনায় ক্যাথলিক গীর্জা বলেছিল, এটা খ্রীষ্টধর্মের একটা অচ্ছেদ্য আদর্শ। তোমাদের অবশ্যই সারা জীবনের জন্য একসঙ্গে থাকতে হবে। সেই মহিলাকে একটি সিফিলিটিক শিশুকে জন্ম দেওয়ার থেকে বিরত হবার জন্য কোনরকম ব্যবস্থা নিতে দেওয়া হয়নি। এই ঘটনাটা ঘটেছিল গীর্জার ঐ কথার জেরেই। আমি মনে করি এই ঘটনাটা ছিল জঘন্য নিষ্ঠুরতা এবং যাদের প্রাকৃতিক সহানুভূতি শাস্ত্রের নিয়মের দ্বারা আবদ্ধ নয়, সমস্ত দুঃখ-কষ্টের প্রতি যাদের নৈতিক চরিত্র একেবারেই মরে যায়নি, তারা এই ধরনের ঘটনাকে সঠিক ও যথার্থ ভেবে চলতে দেওয়া উচিত বলে মনে করবে না।
এটা কেবলমাত্র একটি উদাহরণ। এখনো, বর্তমানে অনেক পথেই গীর্জাগুলো নৈতিক আদর্শের নামে সমস্ত রকমের মানুষকে নানারকম অনুচিত ও অপ্রয়োজনীয় কষ্টের দিকে ঠেলে দেয়। এ বিষয়ে আরও বলতে গেলে, আমাদের পূর্বের আলোচনাকে টেনে এনে আবার বলতে হয়, যে-কোন পথের অগ্রগতি এবং উন্নতির যা জগতের দুঃখ-কষ্টকে হ্রাস করতে পারে, তারই বিরুদ্ধাচরণ করে আসছে এই গীর্জাগুলো। কারণ এরা তাদের ইচ্ছামত কিছু নৈতিক আদর্শকে গড়ে নিয়েছে। এই আদর্শগুলোকে তারা তাদের সংকীর্ণ শাসনের দ্বারা পরিচালিত করে থাকে, যা কোনভাবেই মানুষকে সুখী করে তুলতে পারে না। যখন আপনারা বলে থাকেন এটা বা ওটা অবশ্যই করা উচিত, কেননা তা মানুষের সুখের জন্যই বলা হয়েছে, তখন তারা মনে করে যে সেগুলো করে কোন লাভই নেই। নীতিকথার সঙ্গে মানুষের সুখের সম্পর্কটা কী? নীতিকথার বিষয়গুলি মানুষকে কখনই সুখী করতে পারে না।
ধর্মের ভিত্তিকে ভয় করুন
আমি মনে করি প্রাথমিকভাবে ধর্ম প্রধানত ভয়ের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। এটা আংশিকভাবে অজানার ভয় এবং আংশিকভাবে আপনার সেই অনুভব প্রবণতা যার দ্বারা আপনি এমন ভাবেন যে আপনার কিছু দরদী ভাই আছে যারা আপনার যে কোন বিপদে ও সমস্যায় আপনার পেছনে দাঁড়াবে। ভয়টাই হল আসল ভিত্তি- রহস্যের ভয়, পরাজয়ের ভয়, মৃত্যুর ভয়। ভয় হল নিষ্ঠুরতার জনক-জননী। এই জন্যেই এটা বললে খুব একটা আশ্চর্য শোনাবে না যে ধর্ম এবং নিষ্ঠুরতা পরস্পরের হাত ধরে চলে। এটার কারণ, ভয়ই হল নিষ্ঠুরতা ও ধর্ম এই দুই বস্তুর আসল ভিত্তি। এই জগতের বস্তুকে বুঝতে আমরা এখন অল্প চেষ্টা করতে পারি, এবং সেই বিজ্ঞানের সাহায্যে উক্ত বস্তুর উপর অল্প-স্বল্প প্রভুত্বও করতে পারি, যে বিজ্ঞান খ্রীষ্টধর্ম, গীর্জা ও সব পুরোনো ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে প্রতি পদক্ষেপে লড়াই করে এগিয়ে এসেছে। বিজ্ঞান এই অতি নীচ ভীতি থেকে মনুষ্যজাতিকে উদ্ধার করে আমাদের সাহায্য করতে পারে যে ভীতির অধীনে সে যুগের পর যুগ ধরে বেঁচে এসেছে। বিজ্ঞান আমাদের শিক্ষা দিতে পারে এবং আমি মনে করি, আমাদের হৃদয়ও আমাদের এই শিক্ষা দিতে পারে, যাতে আমরা আর বেশি দিন কাল্পনিক সহযোগিতার আশায় বসে না থাকি, যাতে আর আমরা আকাশে কানাগলি খুঁজে না মরি, ববং আমরা আমাদের সমস্ত প্রচেষ্টা দিয়ে জগৎকে বাসযোগ্য করে তুলবো সেই জায়গার পরিবর্তে যে জায়গায় গীর্জাগুলো শত শত বছর ধরে জগৎকে পৌঁছে দিয়েছে।
আমাদের অবশ্যই কী করা উচিত
আমাদের অবশ্যই নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে হবে এবং জগৎকে ভোলা চোখে দেখতে হবে। ভোলা চোখে দেখতে হবে জগতের ভালো দিক, মন্দ দিক, জগতের সৌন্দর্য এবং কুৎসিত দিকসমূহ। জগৎকে জগতের মতোই দেখতে হবে এবং তার জন্য ভয় পেলে চলবে না। বুদ্ধিব দ্বারা জগৎকে জয় করতে হবে। জগৎ থেকে উঠে আসা ভয়গুলোর দৌরাত্মে দাসতুকে মেনে নিলে আর চলবে না। ঈশ্বর সম্পর্কে সমগ্র ধারণাটি জগৎজোড়া প্রাচীন স্বৈরাচারী কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। মুক্ত মানুষের ক্ষেত্রে এই ধরনের কল্পনা নিছক বাতুলতা মাত্র। যখন আপনারা শোনেন, যে মানুষ গীর্জায় গিয়ে নিজেদের শোচনীয় পাপী বলে ছোট করে, বা এ ধরনের সব রকমের কাজ শুধু নিন্দনীয়ই নয়, তা মানুষের মতো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতির পক্ষে উপযুক্তও নয়। আমাদের উঠে দাঁড়ানো উচিত এবং সম্মুখ জগৎকে উন্মুক্তভাবে দেখা উচিত। জগতের ভালো সম্পর্কে আমরা যতটা করতে পারি ততটাই আমাদের করা উচিত। যদি যতটা ভালো চাইলাম ততটা ভালো না-ও হয়, তবুও যুগের পর যুগ ধরে ওরা যা করে এসেছে তার থেকে অপেক্ষাকৃত ভালো হবে বলে আশা করা যায়। একটি মঙ্গলময় জগৎ সৃষ্টি করতে চাই জ্ঞান, দয়া এবং সাহস। ঘৃণ্য অতীতের ধ্বজা আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকলে আর চলবে না, অথবা বহু যুগ আগের অজ্ঞ মানুষদের মুক্তবুদ্ধি প্রসূত কথার জালে আটকে থাকলেও চলবে না। এর জন্য প্রয়োজন ভয়হীন দৃষ্টিভঙ্গি এবং মুক্তবুদ্ধি। এর জন্য দরকার ভবিষ্যৎ গঠনের আশা, যে অতীত মৃত তার দিকে মুখ করে বসে থাকলে আর চলবে না, যে অতীতকে আমরা বিশ্বাস করি তাকে অতিক্রম করে চলে যাবে ভবিষ্যৎ কেননা আমাদের বুদ্ধি সৃষ্টি করতে পারে।