০১. ধামরাইয়ের বংশী নদীর তীরে

ইতি স্মৃতিগন্ধা – সাদাত হোসাইন

প্রকাশকাল : একুশে বইমেলা ২০২২

উৎসর্গ

নাসরিন আলো
আমার মা যা কিছু আমার ভালো, তার সবটুকু তিনি।

প্রচণ্ড জ্বর!

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের ৪০১/এ-তে শুয়ে আছি। সিঙ্গেল রুম। রুমে আমি ছাড়া কেউ নেই। ভুল বললাম, আমার সামনেই দেয়ালে দুটো টিকটিকি আছে। তারা কিছুক্ষণ পর পর টিকটিক করছে। একটা জীবন্ত পোকার দখল নিয়ে তীব্র যুদ্ধ। প্রবল জ্বরে আমার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। আমি এটা-সেটা দেখছি। টিকটিকি দুটোকে মাঝে-মাঝেই আমার প্রকাণ্ড দুটি কুমির মনে। হচ্ছে। পোকাটাকে মনে হচ্ছে মানুষ। সেই মানুষটা হচ্ছি আমি। আমার মনে হচ্ছে দুটো কুমির আমাকে নিয়ে কামড়াকামড়ি করছে। যে-ই জিতুক, আমার হার বা মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।

অসুস্থতা মানুষের চিত্তকে দুর্বল করে ফেলে। আমার প্রচণ্ড ভয় হতে লাগল। জ্বরের ঘোরে মনে হতে লাগল, টিকটিকি দুটি বিশাল কুমিরের মতো হাঁ করে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। এরা আমায় গিলে খাবে। আমি জ্বরের ঘোরে ‘আম্মা আম্মা করতে লাগলাম। তারপর কী হলো আমার মনে নেই। আমার ঘুম ভাঙল পরদিন ভোরে। আমার বন্ধুরা বলল, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। আমি তাদের সঙ্গে বের হলাম। যাব সাভার এনাম মেডিকেলে। সাভার অবধি এসে আমি সিদ্ধান্ত বদলালাম। আমার ডাক্তার আসলে সাভার এনাম মেডিকেলে নেই, আমার ডাক্তার বাড়িতে। মাদারীপুর জেলার কালকিনি থানার কয়ারিয়া গ্রামে। সেখানে আমার মা থাকেন।

আমার জ্বর হলে আমি তার শাড়ির আঁচল ধরে শুয়ে থাকতাম। সেই আঁচলে অদ্ভুত এক ঘ্রাণ। সেই ঘ্রাণে আমার বুকের ভেতর অবধি ডুবে থাকত। আমার কেবল মনে হতো, এই জনমের বাকিটা সময় আমার জ্বর ভালো না হোক। এমন প্রবল জ্বরেই কেটে যাক একটা জনম। আম্মা এভাবে পাশে বসে থাকুক। তার শাড়ির আঁচল এমন ঘ্রাণ বিলাক। মায়ের আঁচলের ঘ্রাণে, মমতার চাদরে কেটে যাক একটা জীবন…।

আমি সেই থরথর কম্পমান শরীরে নানা উপায়ে গভীর রাতে বাড়ি পৌঁছালাম। খেয়ানৌকায় নদী পার হয়ে বাড়ির উঠানে এসে দেখি ঘরে আলো জ্বলছে!

আমার মা জেগে বসে আছেন বারান্দায়!

তার পরনে নামাজের কাপড়। হাতে তসবিহ। যেন তিনি জানতেন আমি আসব। কিন্তু কীভাবে? মায়েরা কি সত্যি সত্যিই কোনো এক অলৌকিক উপায়ে দূর দেশে থাকা সন্তানের ভালো না-থাকা টের পেয়ে যান?

এই প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না। জানতেও চাই না। আমি আম্মাকে কিছু বললাম না। আম্মাও না। তিনি শুধু আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আর আমি চোখ বন্ধ করে ঘ্রাণ নিতে থাকলাম।

মমতার ঘ্রাণ, ভালোবাসার ঘ্রাণ…।

ভূমিকা

‘পারু তাহলে কোথায়?

রুদ্ধশ্বাস এই প্রশ্নে শেষ হয়েছিল স্মৃতিগন্ধার প্রথম খণ্ড। ইতি স্মৃতিগন্ধা’র শুরু সেখান থেকেই। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এই উপন্যাসের দ্বিতীয় বা শেষ খণ্ড লিখতে গিয়ে হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, আমি নিজেও যেন প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়েই অপেক্ষা করছি পারুর জন্য।

কোথায় সে? কার কাছে? কী হয়েছে তার?

সঙ্গে আরো অনেক প্রশ্ন–ফরিদের সঙ্গে তার দেখা হবে তো? কিংবা মহিতোষের সঙ্গে?

পাঠক এখানে এসে বিভ্রান্ত হতে পারেন। তাদের মনে হতে পারে, লেখক নিজেই কি তাহলে জানতেন না এই সব প্রশ্নের উত্তর?

আমি ব্যাপারটা ভেবে দেখেছি। ভেবে মনে হলো, আসলেই জানতাম না। কিংবা জানলেও গল্প শেষ অবধি কোথাও না কোথাও আর লেখকের ভাবনার পথ ধরে হাঁটে না। সে এতটাই স্বাধীন, এতটাই জীবন্ত হয়ে ওঠে যে তৈরি করে নিতে থাকে নিজের পথ, গতি ও গন্তব্য। লেখককে তখন বরং তার চেনা পথ, চেনা ভাবনা ছেড়ে হাঁটতে হয় গল্পের পথে।

স্মৃতিগন্ধা সেই গল্পের পথে হেঁটে যাওয়া এক আখ্যান। যেখানে পারু, ফরিদ কিংবা মহিতোষের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশই শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে প্রথম খণ্ডে আড়াল হয়ে থাকা আরো অনেক অপ্রধান চরিত্র। তাদের এই আচমকা আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠায় লেখক নিজেও যেন বিস্মিত হন। খানিক বিপর্যস্তও। তার মনে হতে থাকে, উপন্যাসের চরিত্রগুলো তাকে হারিয়ে দিচ্ছে। হয়ে উঠছে লেখকের চেয়েও শক্তিশালী।

কিন্তু কে না জানে, এই পরাজয় লেখকের জন্য আনন্দময়। দুই খণ্ডে সমাপ্য। স্মৃতিগন্ধার এই সুদীর্ঘ যাত্রা তাই লেখকের সৃষ্ট চরিত্রের কাছে লেখকের আশ্চর্য এক আত্মসমর্পণের গল্পও।

–সাদাত হোসাইন
০৭.১২.২০২১

ধামরাইয়ের বংশী নদীর তীরে বিশাল বালুর মাঠ। মাঠে তিল ঠাই নেই। লোকে লোকারণ্য। প্রতিবছরের মতো এ বছরও এখানে মেলা বসেছে–সঙ্গে রথযাত্রা। এবার অনিবার্য কারণে মেলার সময় এগিয়ে আনা হয়েছে। তাতে অবশ্য জৌলুস কিছু কমেনি। বরং বেড়েছে। এবার বৃষ্টির উৎপাত নেই। জল-কাদা নেই। খটখটে শুকনো চারিদিক। আবহাওয়াও শীতল। ফলে লোক বেড়েছে আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। মাসব্যাপী এই মেলায় দূর-দূরান্ত থেকেও নানা মানুষজন আসে। এবারও এসেছে। নদীর ঘাট গমগম করছে মাঝি-মাল্লাদের ভিড়ে। অসংখ্য নৌকা, বজরা বাঁধা ঘাটে। মেলা উপলক্ষে বিশাল বাজার বসেছে চারধারে। সেই বাজারে নানারকম পণ্য নিয়ে হাজির হয়েছে বৃহৎ-ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। দল বেঁধে বাউল সাধকরা এসেছেন। এসেছেন জটাধারী তান্ত্রিক, সাধুর দল। তারা উত্তর দিকে নদীর তীরঘেঁষে ডাল-পালা ছড়ানো বিশাল বটগাছের নিচে আসর জমিয়ে বসেছেন। সেখানেও কৌতূহলী মানুষ। বরিশালের পালরদি থেকে এসেছে দেশ বিখ্যাত লক্ষ্মণ দাশের সার্কাস। ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জ থেকে এসেছে পুতুলনাচ ও যাত্রাপালার দল। চারদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু মানুষ আর মানুষ। এই জনসমাগম অবশ্য বাড়তে থাকে দুপুরের পর থেকে। সময় যত গড়ায়, তত বাড়ে। নানা ধরনের লোক আসে এখানে। কুস্তি থেকে শুরু করে শারীরিক কসরত, জাদু, বায়োস্কোপ দেখানোর লোক যেমন আসে, তেমনি আসে বেদেদের দলও। তারা এসে মাদুর বিছিয়ে বসে। তারপর সাপের খেলা দেখায়। বাত-ব্যথা, যকৃতের পীড়া থেকে শুরু করে নারী-পুরুষের নানা গোপন অসুখ-বিসুখের ওষুধও বিক্রি করে। এদের প্রত্যেককে নিয়েই মানুষের আগ্রহ তুঙ্গে। ফলে চারদিকে তুমুল হুল্লোড়, ভিড়ভাট্টা, কোলাহল।

এ যেন এক হইহই কাণ্ড, রইরই ব্যাপার!

তবে মেলা ঘিরে এবার খানিক শঙ্কার কালো মেঘও জমেছে। এই মেলা মূলত আয়োজন করেন বিভুরঞ্জন রায়। তিনি এ অঞ্চলের বিগত জমিদার মনোহর রঞ্জন রায়ের পৌত্র। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পিতামহের রেখে যাওয়া সেই প্রভাব-প্রতিপত্তি আর তাদের নেই। ক্রমশই খর্ব হয়েছে। স্তিমিত হয়েছে জৌলুস। দেশভাগের সময় বড়সড় ধাক্কা খেয়েছিল রায় পরিবার। তখন তাদের অনেকেই দেশান্তরীও হয়েছিল। কিন্তু সদ্য কৈশোর পেরুনো বিভুরঞ্জন তাতে রাজি হননি। তিনি রয়ে গিয়েছিলেন। তার এই বিশাল পৈতৃক ভিটেতেই। খুব যে খারাপ থেকেছেন, তা নয়। কিন্তু হঠাৎ করেই মুক্তিযুদ্ধের সময় যেন নিজেকে আবিষ্কার করলেন নিজভূমে পরবাসী হিসেবে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ভয়ানক বৈরিতার স্বীকার হতে হয় তাদের। ফলশ্রুতিতে সাময়িকভাবে দেশ ত্যাগও করতে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু যুদ্ধের বছরতিনেক পর আবার নিজ দেশে ফিরে এসেছেন তিনি। ইচ্ছে ছিল সবকিছু আবার আগের মতো গুছিয়ে নিয়ে জাকিয়ে বসবেন। কিন্তু ততদিনে তার রেখে যাওয়া ভিটে-মাটি, পাড়া-প্রতিবেশী, চেনা মানুষদের অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। আগের অবনত, আন্তরিক মানুষগুলোও যেন হয়ে উঠেছে অচেনা, উদ্ধত, অন্য মানুষ।

সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, তার রেখে যাওয়া অনেক সম্পত্তিই ততদিনে বেদখল হয়ে গেছে। এমনকি এই নদীর তীরের বিশাল বালুর মাঠও বেহাত হয়েছে। উড়ে এসে জুড়ে বসেছে দুষ্টু কিছু লোক। সেখানে তারা ইটের ভাটা বসিয়েছে। দিনরাত সেই ভাটার গনগনে আগুনে ইট পুড়ছে। সেইসঙ্গে পুড়ছে বিভুরঞ্জনের বুকও। এই দহন থেকে তাঁর মুক্তি মেলে না। প্রতিবছর কী আড়ম্বর করেই না মেলা বসত এখানে। আশপাশের বহু অঞ্চলের মানুষ ছুটে আসত একটু দর্শন, উদযাপনের জন্য। তাদের সকলের সবচেয়ে বড় আনন্দের উৎসব ছিল এই মেলা। ছোট-বড় ব্যবসায়ীদের কাছে বার্ষিক বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থলও। অনেকের কাছে এ যেন আবার এক তীর্থস্থানও। বছরান্তে এখানে না এলে তাদের আত্মার শান্তিটুকু আর মেলে না। ফলে এই মেলা হয়ে উঠেছিল ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল মানুষের এক আশ্চর্য মিলনস্থল। অথচ সেখানেই কি না এখন আগুন জ্বলছে দিন-রাত!

সেই আগুনে কাঠ পুড়ে কয়লা হচ্ছে, মাটি পুড়ে ইট হচ্ছে আর বিভুরঞ্জনের হৃদয় পুড়ে হচ্ছে খাক।

বিভুরঞ্জন অবশ্য দেশে ফিরেই এই জায়গা উদ্ধারের চেষ্টায় নেমে পড়েছিলেন। তা পেরেছিলেন। কাজটা সহজ না হলেও মানুষের আবেগ-অনুভূতির কথা ভেবেই হয়তো প্রশাসন থেকে শুরু করে প্রভাবশালী অনেকেই তাকে সমর্থন করেছে। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে জায়গাটা শেষ অবধি উদ্ধার হয়েছে। তবে এতে করে বিভুরঞ্জনের ক্ষতিও কিছু কম হয়নি। তাঁর শত্রু বেড়েছে। যাদের বেশির ভাগই লুকানো ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে আছে একদম ঘাড়ের কাছে। যেকোনো সুযোগে সেই ছুরি পিঠে বিধিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না তারা।

বেশ কয়েক বছর বিরতির পর বছরতিনেক ধরে মেলা আবার শুরু হলেও তার আগের সেই জৌলুস যেন আর ফিরে আসছিল না। বিভুরঞ্জন নিজের সর্বোচ্চ পরিশ্রম দিয়ে চেষ্টা করছিলেন মেলাকে আবার আগের চেহারায় ফিরিয়ে নিতে। কিন্তু পারছিলেন না। কোথায় যেন একটা খামতি থেকেই যাচ্ছিল। এই নিয়ে ভীষণ মনোকষ্টে ভুগতেন তিনি। কিন্তু নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত বিভুরঞ্জন কোনো সমাধান বের করতে পারেননি। তবে এবারের মেলা শেষ পর্যন্ত তার সেই মনোকষ্ট দূর করতে শুরু করেছে। দিন যত যাচ্ছে মেলা যেন ততই জমে উঠেছে। আরো বেশি জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ছাড়িয়ে যাচ্ছে আগের সব আয়োজনকে। কিন্তু তারপরও খুশি হতে পারছেন না বিভুরঞ্জন। তার মনের ঈশান কোণ থেকে শঙ্কার কালো মেঘ যেন আর দূর হচ্ছে না।

ফরিদ এই মেলার কথা শুনেছে ছোটবেলায়। তখন সে রাতে মামার সঙ্গে ঘুমাত। তার মামা আব্দুল ওহাব রাতভর গল্প করতেন। সেই গল্পে কতবার যে এই মেলার কথা এসেছে তার ইয়ত্তা নেই। পরে সে নানা বই-পত্রেও পড়েছে। কিন্তু কখনোই নিজ চোখে দেখা হয়নি। দীর্ঘদিন থেকেই পারুর শরীর-মন ভালো নেই। একটা ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে তাকে। সারাক্ষণ কী এক অজানা আতঙ্কে জড়সড় হয়ে থাকে। কদিন আগে রাতের বেলায় জানালার বাইরে কাউকে দেখে প্রচণ্ড ভয়ও পেয়েছিল সে। কে হতে পারে লোকটা?

আজিজ মিয়া কি তবে তাদের খোঁজ পেয়ে গেছে? ভাবতেই ভয়ে শরীরে কাটা দিয়ে উঠেছিল ফরিদের। এমন অনুনমেয়, ভয়ানক মানুষ সে আর দেখেনি। ঘটনার পর থেকে পারুকে একা বাসায় রেখে রাতে আর কোথাও যাবে না বলেই মনস্থির করল সে। তবে তার চেয়েও জরুরি পারুকে নিয়ে কোথাও থেকে একটু ঘুরে আসা। একটু খোলা আকাশ, তাজা হাওয়া, লোকের সমাগমে খানিক সময় কাটানো। তাহলে হয়তো মুহূর্তের জন্য হলেও সে ভুলে থাকতে পারবে এই দুঃসহ ঘরবন্দি সময়। দমবন্ধ স্যাঁতসেঁতে অনুভব।

এই ভেবেই আজ এখানে এসেছে ফরিদ। সে ভেবেছিল বালুর মাঠ বুঝি সত্যি সত্যিই বালুর মাঠ। কিন্তু কাছে আসতেই ভুল ভাঙল তার। নদীর পাড় বলেই হয়তো মাটিতে জলের উপস্থিতি পেয়ে সবুজ ঘাসে ছেয়ে আছে পুরো মাঠ। সেই মাঠে যতদূর চোখ যায় কেবল মানুষ আর মানুষ। সঙ্গে হরেকরকম পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসা দোকান। দেকানগুলো মূলত তৈরি করা হয়েছে রংবেরঙের কাপড় টানিয়ে। ফলে চারদিকে তাকাতেই চোখে ভাসে কেবল বর্ণিল এক পৃথিবীর ছবি। সেখানে অসংখ্য সুখী মানুষের মুখ। যেন কোথাও কোনো দুঃখ নেই, দহন নেই, বিষাদ-বিসংবাদ নেই। সকলই কেবল আনন্দে পরিপূর্ণ। মানুষের চোখে মুখে কৌতূহল আর উচ্ছ্বাস।

পারু অবশ্য সবকিছু দেখে হকচকিয়ে গেছে। তার পরনে লাল টুকটুকে শাড়ি। সে আজ খানিক সেজেছে। মুখে একটু প্রসাধনী মেখেছে। ঠোঁটজোড়াও খানিক রাঙিয়েছে। আর চোখভর্তি কাজল। তবে সবচেয়ে যে বিষয়টিতে ফরিদ আশ্চর্য হয়েছে, তা হলো পারু তার সিঁথিতে সিঁদুর পরেছে। বাসার সামনে দিয়ে কবে যেন এক ফেরিওয়ালা যাচ্ছিল। তার কাছ থেকে ফরিদকে না জানিয়েই গোপনে কিনেছিল সে। আজ পরেছে। এখন তাকে দেখতে লাগছে নতুন বউয়ের মতো। তার মুখ থেকে চোখ ফেরানো যায় না। বাসা থেকে বের হয়ে যখন তারা রিকশা নিল বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশে, তখন ঝলমলে রোদ উঠেছে। সেই রোদ থেকে পারু তার চোখ আড়াল করতে যেতেই খেয়াল করল ফরিদ ড্যাবড্যাব চোখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। পারুর এত লজ্জা লাগছিল! সে গলা নিচু করে বলেছিল, ‘লোকে দেখলে কী বলবে?

কী বলবে?

বলবে লোকটা কী বেহায়া।’

“কেন?’

“কেন আবার? কেউ কারো দিকে এই রাস্তাঘাটে এভাবে তাকিয়ে থাকে?

‘কেউ থাকে কি না জানি না, তবে আমি থাকি। আমার বউয়ের দিকে আমি তাকিয়ে থাকতে পারব না?

‘আমি আপনার বউ?’ প্রশ্নটা করেই থমকে গেল পারু। ফরিদও। আসলেই তো, সে কি ফরিদের বউ? তাদের তো এখনো বিয়ে হয়নি। এমনকি কখনো হবে বলেও মনে হচ্ছে না। যে বিপদে তারা পড়েছে এই বিপদ থেকে মুক্তির কোনো উপায়ও তাদের জানা নেই। পারুর আচমকা মন খারাপ হয়ে গেল। এই জীবনে সে কি কখনো সত্যি সত্যি বউ হতে পারবে না?

ফরিদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার উদ্দেশ্যেই সম্ভবত বলল, কী হলো?

‘কিছু না। গম্ভীর গলায় জবাব দিল পারু।

বলো?

‘কিছু না।’ বলে সামান্য থামল পারু। তারপর বলল, আর আপনি এভাবে তাকিয়ে থাকবেন না। এভাবে কেউ কারো দিকে তাকিয়ে থাকে না।

‘থাকে।

‘কে?

ফরিদ নির্বিকার গলায় বলল, “আমি।’

পারু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আপনি এমনভাবে তাকিয়ে থাকবেন না। আপনি এমনভাবে তাকিয়ে আছেন যে দেখে মনে হচ্ছে এর আগে কখনো আপনি আমাকে। দেখেননি!

‘দেখিইনি তো।

‘দেখিইনি মানে?

‘দেখিইনি মানে এর আগে কখনো এই তোমাকে আমি দেখিনি।

‘এই আমাকে মানে কী?

‘এই তোমাকে মানে…।’ বলে খানিক থমকাল ফরিদ। কী যেন ভাবল। তারপর বলল, “এই তোমাকে মানে হলো…এই যে লাল টুকটুকে নতুন বউয়ের মতো তোমাকে।

ফরিদ ভেবেছিল কথাটা শুনে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যাওয়া পারু খানিক আনন্দিত হবে। তার মন ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। বরং পারু আরো গম্ভীর হয়ে গেল। তার মাথায় ঢুকে গেল ফরিদের কথাটা বউয়ের মতো তোমাকে। তার মানে সে আর কখনো সত্যি সত্যিই বউ হতে পারবে না? তাকে সারাজীবন থাকতে হবে ফরিদের বউয়ের মতো হয়েই?

বাকিটা সময় চুপ করে রইল পারু। ফরিদ কত কী চেষ্টা করল, কিন্তু লাভ হলো না। পারু আর সহজ স্বাভাবিক হতে পারল না। বরং কত কী ভাবতে লাগল একা একা। রাজ্যের দুশ্চিন্তা, দুঃখ যেন আবার ফিরে আসতে লাগল একে একে। তবে সেই সব দুশ্চিন্তা যেন এক ঝলকেই মিলিয়ে গেল হাওয়ায়।

যখন তারা মেলার মাঠের পাশে এসে দাঁড়াল, তখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। পারুর আচমকা মনে হলো চোখের সামনে এমন আনন্দময়, এমন বিশাল, এমন জাঁকজমকপূর্ণ কিছু বহুকাল দেখেনি সে। তার আনন্দে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছিল রঙিন বেলুন হাতে প্রজাপতির মতো ভেসে বেড়ানো ওই শিশুদের সঙ্গে। কিংবা ওই যে চরকিতে উড়ে বেড়াচ্ছে হাসি হাসি মুখের মানুষগুলো, তাদের সঙ্গে। ওই হাওয়াই মিঠাইগুলো সব কিনে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল তার। এত আনন্দময় কেন সবকিছু? যেন কোথাও কোনো দুঃখ নেই, বিপদ-বিষাদ নেই। সকলই কেবল ভালো আর আলোময়। এই কোলাহল আর ভিড়ের ভেতর তার হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে শক্ত করে তার হাতের মুঠোয় ফরিদের হাতটা ধরে রাখল, যদি হারিয়ে যায়–এই ভয়ে। তারপর বলল, এখানে আজ আমরা থাকব?

ফরিদ মৃদু হেসে বলল, হুম, থাকব।’

সারারাত?

সারারাত তো আর মেলা হয় না।’

যতক্ষণ হয়?

‘হু, থাকব।

‘আমি পুতুলনাচ দেখব?

আচ্ছা।

সার্কাসও দেখব।’ দূরের আকাশ সমান উঁচু প্যান্ডেল দেখিয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল পারু। ওখানে কত বড় হাতি দেখেছেন? আমি ওই হাতিও দেখব।’

আচ্ছা।’ বলে মৃদু প্রশ্রয়ের হাসি হাসল ফরিদ।

ওই যে ওখানে বীণ বাজিয়ে সাপের খেলা দেখাচ্ছে, আমি সাপখেলা দেখব।

ফরিদ বলল, “চলো।’

তারা হেঁটে হেঁটে সাপের খেলার কাছে এলো। পারু অবশ্য বেশিক্ষণ দেখতে পারল না। গোখরা সাপগুলো যখন ভয়ানক ফণা তুলে ফোঁস-ফাঁস শব্দ করতে লাগল, তখন সে ভয়ে ফরিদের শার্টের আস্তিন চেপে ধরে ফ্যাকাশে গলায় বলল, আমার ভয় করছে। আমার ভয় করছে।’

‘কেন?’

জানি না কেন! তবে রাতে আর আমি ঘুমাতে পারব না। সারারাত দুঃস্বপ্ন দেখব। এই সাপগুলো তখন ঘুমের মধ্যে আমাকে তাড়া করতে থাকবে।’

ফরিদ তাকে শক্ত করে আগলে ধরে নিয়ে গেল নদীর কাছে। সেখানে বটগাছের তলায় বাউলরা একতারা বাজিয়ে গান গাইছে

‘ওহে মন কি মেলে সাধন ছাড়া, মন কি মেলে অহমে?
মনের মানুষ মিলবে যদি মনখানা রয় সহজে,
নষ্ট মনের হিসেব কঠিন, হিসেব কঠিন কু-মনে,
জীবন সহজ, যাপন সহজ, ভালোবাসার ভুবনে।
তবু কেন মনের মধ্যে ঘেন্না-বিবাদ বহ হে?
মনের মানুষ মিলবে যদি মনখানা রয় সহজে…।

পারু জানে না কেন, তার চোখে হঠাৎ জল চলে এলো। সে ফরিদের হাত চেপে ধরে বলল, আমি একটু এখানে বসি?

‘এখানে কোথায় বসবে?

‘এই ঘাসের মধ্যে?

ফরিদ কী ভেবে বলল, বসো।’

পারু আর কথা বলল না। সে তন্ময় হয়ে গান শুনতে লাগল। ফরিদ আচমকা আবিষ্কার করল, পারুর দু গণ্ড বেয়ে নেমে আসছে জলের ধারা। সে হাত বাড়িয়ে তাকে খানিক কাছে টেনে নিল। তারপর বলল, কী হয়েছে?

পারু জবাব দিল না। ফরিদ বলল, বাড়ির কথা মনে পড়ছে?

উঁহু।

তাহলে?

পারু সামান্য চুপ থেকে বলল, ‘বাবার কথা মনে পড়ছে। আমার সারাক্ষণ কী মনে হয় জানেন?

কী?

‘এই যে আমি যেখানে যেখানে যাচ্ছি, বাবাও ঠিক তার আশপাশে কোথাও আছে। আমাকে খুঁজছে। আমার খুব কাছেই কোথাও। আমি হঠাৎ পেছন ফিরে তাকালেই তাকে দেখতে পাব। একটু অপেক্ষা করলেই সে এসে আমাকে দেখতে পাবে। এই জন্য আমি সারাক্ষণ বাসার জানলা খুলে রাখতাম। আপনার নিষেধ সত্ত্বেও মাঝেমধ্যেই বাড়ির সামনের ওই রাস্তাটাতে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতাম। আমার কেবল মনে হতো, ওই বুঝি বাবা এসে আমাকে খুঁজে না পেয়ে চলে গেল। পথ ভুল করল।

ফরিদ কথা বলল না। তবে তার হাতের মুঠোয় শক্ত করে সে পারুর হাতখানা ধরে রাখল। পারু খানিক চুপ করে থেকে বলল, “ওই যে গান গাইছে যে লোকটা, মুখভর্তি দাড়ি, লম্বা চুল মাথায়–ওই লোকটাকে কেমন আমার বাবার মতো লাগছে না?

‘তোমার বাবার মতো!’ ফরিদ ভ্রু কুঁচকে তাকাল। তারপর বলল, কই? না তো!’

পারু সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল না। চুপচাপ একদৃষ্টিতে লোকটার দিকে তাকিয়ে বসে রইল। তারপর বেশ কিছুক্ষণ বাদে বলল, তাও তো ঠিক। বাবার তো এমন চুল-দাড়ি নেই। অমন করে গানও গাইতে পারে না। তার পরও কেন যেন মানুষটার ওই চোখজোড়া দেখে আমার হঠাৎ মনে হলো, এ বুঝি বাবাই। বাবাও তো অমন করেই তাকাত। আচ্ছা, যদি এমন হয় যে বাবা আমার চিন্তায় অস্থির হয়ে এভাবেই গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়ায়? এভাবেই লম্বা চুল-দাড়ি নিয়ে পথে পথে ভিখারির বেশে ঘুরতে থাকে? আমি তো তাহলে তাকে দেখলেও কখনো চিনতে পারব না! পারব?

পারুর গলা ভারী। চোখের কোলে আবারও মেঘ জমতে শুরু করেছে। ফরিদ হঠাৎ দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, চলো তোমাকে চুড়ি কিনে দিই। ওই যে ওখানে দেখো, কী সুন্দর চুড়ি বিক্রি হচ্ছে।

এক প্রৌঢ়া রমণী রংবেরঙের কাঁচের চুড়ির পসরা সাজিয়ে বসেছে। তার সামনে রাখা বেতের ডালায় থরেথরে সাজানো বাহারি জিনিসপত্র। দেখেই মন ভালো হয়ে গেল পারুর। সে সেখান থেকে হাতভর্তি করে চুড়ি কিনল। কিনল চুলের ফিতা, টিপ, লিপস্টিক, ছোট্ট আয়না, গলার হারসহ আরো কত কী! ঘরের জন্য প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিসপত্রও কিনল। খানিক আগের মেঘলা আকাশে যেন ভোরের ঝলমলে আলো ফুটেছে। কিশোরী মেয়ের মতো উচ্ছ্বাস খেলা করছে তার চোখেমুখে। দেখে কী যে ভালো লাগল ফরিদের! সে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল। তার মুখে প্রশ্রয়ের হাসি। পারুর আনন্দ যেন আর ধরে না। তবে খানিক বাদেই ম্লান চোখে তাকাল সে। তারপর বলল, আপনার সব টাকা শেষ করে দিচ্ছি। আমি, তাই না?

ফরিদ বিচলিত ভঙ্গিতে বলল, ‘হুম।

ইশ! এখন তাহলে? পারু আঁতকে ওঠা গলায় বলল। এমনিতেই তো আপনার হাতে টাকা-পয়সা তেমন নেই। আর আমি কী না…।

ফরিদ এবার হাসল। তারপর বলল, এই পুরোটা মেলা আমি তোমাকে একদিন কিনে দেব। কিন্তু আজ তো পারব না। এইজন্য আজ অর্ধেক মেলা কিনে দেয়ার মতো টাকা নিয়ে এসেছি। অর্ধেক মেলায় তোমার হবে?

মানে?’ চোখ বড় বড় করে বিভ্রান্ত চোখে তাকাল পারু।

ফরিদ প্যান্টের ভেতরের দিকে পকেটে হাত ঢুকিয়ে একগোছা টাকা বের করল। তারপর বলল, আমার যে প্রায়ই বাড়ি ফিরতে দেরি হতো, কেন জানো?

পারু কথা বলল না। তবে উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইল। ফরিদ বলল, এই যে এই মেলায় আসব তোমাকে নিয়ে, এইজন্য। আমি ওষুধের দোকানের বাইরেও কিছু কাজ জুটিয়েছিলাম। তাতে অবশ্য মাঝেমধ্যেই একটু-আধটু মিথ্যে বলতে হতো দোকানে। ফাঁকি-টাকিও দিতে হয়েছে কখনো কখনো। তবে শেষমেশ কিছু টাকাও জমেছে। কী এই টাকায় অর্ধেকটা মেলা কেনা যাবে না?

পারুর চোখে আবার জল চলে এলো। আজ তার কী হয়েছে কে জানে, কথায় কথায় চোখ ভিজে আসছে। এই কান্নায় দুঃখ যেমন আছে, তেমনি আনন্দও। এই যে সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে, বিসর্জন দিয়ে এক অসীম অনিশ্চয়তার পথে সে পা। বাড়িয়েছে, সেই পথ তাকে শেষ অবধি ছুঁড়ে ফেলেনি। বরং প্রবল মমতায় বুকে টেনে নিয়েছে। পারু হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছতে মুছতে হেসে ফেলল। তারপর বলল, “এই কটা টাকায়তো অর্ধেকটা মেলা কেনা যাবে না।

‘তাহলে?’ ম্লান গলায় বলল ফরিদ।

পারু এই ভিড়ের মধ্যে ফরিদের আরো গা ঘেঁষে দাঁড়াল। তারপর বলল, এই টাকায় পুরো পৃথিবীটা কেনা যাবে। আস্ত পৃথিবীটা।

কথাটায় কী ছিল কে জানে! ফরিদ এক হাত দিয়ে পারুকে তার আরো কাছে টেনে নিতে চাইল। কিন্তু পারল না। তার আগেই পেছন থেকে আসা তীব্র গতির ভিড়ের স্রোতে হঠাৎ ছিটকে গেল পারু। তখন বিকেল প্রায় মরে এসেছে। সন্ধ্যা নামাবে বলে অপেক্ষা করছে অন্ধকার। তবে সেই অন্ধকারের অপেক্ষাকে আরো প্রলম্বিত করে দিয়ে মেলার মাঠে একে একে জ্বলে উঠতে লাগল রংবেরঙের আলো। সেই আলোয় আরো রঙিন, আরো ঝলমলে হয়ে উঠতে লাগল চারপাশ। বিচলিত ফরিদ পেছন ফিরে তাকাল। আর ঠিক তখুনি লম্বা, গৌর বর্ণের একজন লোককে কেন্দ্র করে একটা ভিড় এগিয়ে আসতে দেখল সে। লোকটার নাকের নিচে পাকানো গোঁফ। মাথাভর্তি ঘন কালো চুল। পরনে ধবধবে সাদা সিল্কের পাঞ্জাবি। তিনি চারপাশটা দেখতে দেখতে ধীর পায়ে এগিয়ে আসছেন। তার চোখে-মুখে স্পষ্ট পরিতৃপ্তির আভা। কয়েকজন দশাসই শরীরের লোক তার আগে আগে লাঠি হাতে লোকজন সরিয়ে জায়গা করে দিচ্ছে। এ কারণেই এদিকটাতে হঠাৎ ছোটাছুটি বেড়ে গেছে। ভিড় বেড়েছে। পারু সেই ভিড়েই ছিটকে গেছে।

ফরিদ খানিক পেছনে ছুটে গিয়ে তাকে খুঁজে বের করল। তারপর তার হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো মেলা থেকে দূরে। এখানে তেমন কোলাহল নেই। সবকিছু শান্ত, চুপচাপ। কিন্তু তারপরও পারুর চোখে-মুখ থেকে ভয়ের ছাপটা যেন আর গেল না। সে শক্ত করে ফরিদের হাত ধরে বসে রইল। ফরিদ বলল, ভয় পেয়েছিলে?

পারুর ঠোঁট কাঁপছে। সে সম্ভবত ভিড়ের ধাক্কা, হুড়োহুড়িতে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। তার লাল শাড়িতে ধুলোবালি লেগে আছে। ফরিদ তাকে আরো খানিকটা দূরে সরিয়ে নিয়ে এলো। এখানটাতে একদমই মানুষ নেই। পাশ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে বংশী নদী। এই সময়ে নদী খুব একটা ভরভরন্ত না হলেও জলের অভাবও তেমন নেই। বরং মেলা থেকে ঠিকরে আসা রংবেরঙের আলো, নদীর ঘাটজুড়ে বাঁধা অসংখ্য নৌকা আর মাঝিদের হৈ-হুঁল্লোড়ে বেশ একটা জমজমাট ভাব। যদিও সন্ধ্যার ম্লান আলোয় বিশাল বংশী নদীর ওপারটা ঠিক ঠাওর করা যাচ্ছে না। ফরিদ পারুকে একটা গাছের তলায় বসাল। তারপর বলল, কী হলো, তোমাকে এত ফ্যাকাশে লাগছে কেন?

পারু চেষ্টা করছে নিজেকে সামলে নেয়ার। কিন্তু পারছে না। সে প্রায় ভাঙা গলায় বলল, আমার খুব ভয় করছে। খুব ভয় করছে।’

‘কেন? এখানে ভয় পাওয়ার কী আছে?

‘আমি ঠিক জানি না। কিন্তু আমার খুব ভয় হচ্ছে।’

কীসের ভয়? এইটুকুতেই কেউ এত ভয় পায় নাকি বোকা মেয়ে?’ আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল ফরিদ।

‘আপনি যদি আমাকে আর খুঁজে না পেতেন?

কেন খুঁজে পাব না? একটু যেন অবাকই হলো ফরিদ।

‘এই যে এত ভিড় ওখানে। মানুষ যেভাবে পাগলের মতো এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছিল, আমি যদি হারিয়ে যেতাম? যদি আপনাকে আর খুঁজে না পেতাম?

ফরিদ পারুর পাশে বসল। তারপর আলতো হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বোকা মেয়ে, তুমি হারিয়ে যাবে কেন?’

‘আমি শুনেছি অনেকেই মেলায় হারিয়ে যায়। তারপর আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায় না তাদের। আজ যদি আমিও আর আপনাকে খুঁজে না পেতাম, তাহলে কী হতো আমার? কই যেতাম আমি? কী করতাম?

ফরিদ এবার হাসল। তারপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য খানিক রসিকতার স্বরেই বলল, কী আর করতে? আমাকে এখানে একা ফেলে রেখে ঢাকায় চলে যেতে। আমিও তোমাকে রাতভর খুঁজে না পেয়ে ভোরবেলা বাসায় ফিরে যেতাম। গিয়ে দেখতাম তুমি বাসায় আমার জন্য রান্নাবান্না করে অপেক্ষা করছ।’

‘আমি তো বাসা চিনি না। ঠিকানাও জানি না। যদি আমি সত্যি সত্যি হারিয়ে যেতাম…!’

পারুর ঠোঁট কাঁপছে। তার চোখে ভীত-সন্ত্রস্ত দৃষ্টি। এই সামান্য ঘটনায় যে কেউ এমন ভয় পেতে পারে তা ফরিদের ভাবনাতেও ছিল না। তবে একটা বিষয় সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে, গত কিছুদিনের ঘটনায় পারুর ভেতর স্থায়ী একটা ভয় ঢুকে গেছে। সে সারাক্ষণ ভাবতে থাকে এই বুঝি ভয়ংকর কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে। কিংবা ফরিদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এটা অনেকটা দুঃস্বপ্নের মতো। এই দুঃস্বপ্ন তাকে সারাক্ষণ তাড়া করে বেড়াচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে, এর থেকে তাকে কী করে মুক্তি দেবে ফরিদ?

মেলার ঝলমলে ভাবটাও এখানে তেমন নেই। সন্ধ্যার ম্লান আলো ক্রমশই জেঁকে বসেছে। সেই আলোয় দু হাতে শক্ত করে পারুকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে রাখল ফরিদ। তারপর তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “এত কষ্টে যাকে পেয়েছি, তাকে হারিয়ে ফেলা যায়?

পারু কথা বলল না। ফরিদ বলল, হারিয়ে ফেলার জন্য তো তোমাকে আমি পাইনি পারু। তোমাকে পেয়েছি এভাবে ধরে রাখার জন্য। তুমি আমাকে বিশ্বাস কর না?”

‘খুব করি।’ অস্ফুটে বলল পারু।

তাহলে?

‘তারপরও সারাক্ষণ ভয় হয়। মনে হয় যদি আপনাকেও হারিয়ে ফেলি। আপনি ছাড়া তো আমার আর কেউ নেই…।’ কথাটা বললেও আচমকা থমকে গেল। পারু। যেন হঠাৎ করেই কিছু একটা মনে পড়েছে তার। কিন্তু সেই কথাটা এখন, এই মুহূর্তেই ফরিদকে বলবে কি না সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।

ফরিদ সোজা হয়ে পারুর মুখোমুখি বসল। তারপর আঙুলের ডগায় তার চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, যদি তোমার আর কেউ থাকত, তাহলে কি আমাকে হারিয়ে যেতে দিতে? নাকি তখন আর আমাকে হারিয়ে যেতে দিলেও কোনো ক্ষতি নেই?

পারু এই কথার উত্তর দিল না। তার কেবল মনে হতে লাগল, সে খানিক আগে যা বলেছে তা ঠিক করেনি। ফরিদ ছাড়াও এই মুহূর্তে তার সঙ্গে আরো একজন আছে। সেই একজনের কথা সে ভুলে গিয়েছিল। অথচ সে-ই তার সবচেয়ে অবিচ্ছেদ্য অংশ। সবচেয়ে আপনও। পারু স্পষ্ট টের পাচ্ছে তার শরীরের ভেতরে বেড়ে উঠছে আশ্চর্য মায়াময় এক অস্তিত্ব। ওই অস্তিত্বটুকুর জন্য হলেও সে ফরিদকে কখনো হারাতে দিতে চায় না। আচ্ছা, সে কি এখন ফরিদকে কথাটা বলবে? নাকি আরো খানিক অপেক্ষা করবে?

পারু অবশ্য কথাটা বলার সুযোগই পেল না। তার আগেই আচমকা উঠে দাঁড়াল ফরিদ। তারপর বলল, এই দেখো, সার্কাস দেখার সময় বোধহয় হয়েই এলো।

পারুর এখন আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। এই এখানেই চুপচাপ বসে থাকতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে জানে, ফরিদ এখন আর তাকে এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে দেবে না। সে তার মন ভালো করে দেয়ার জন্য নানা কিছু করতে থাকবে। তারপরও সে বলল, এখানে আরেকটু বসি?

‘এখানে? এই অন্ধকারে?

হুম।

“কেন?”

ভালো লাগছে।’

‘আপনার একা ভালো লাগলে তো হবে না ম্যাডাম। আমারওতো ভালো লাগতে হবে। না হলে কিন্তু আপনাকে একা এই অন্ধকারে রেখে আমি মেলা দেখতে চলে যাব।’ রসিকতার স্বরে কথাগুলো বলে সামান্য হাসল ফরিদ। তারপর মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে বলল, “জানি যাচ্ছি ফেলে সন্ধ্যা, সাথে তোমাকেও স্মৃতিগন্ধা।

‘এই লাইন দুটো আর কখনো বলবেন না তো।’ বিরক্ত গলায় বলল পারু।

‘কেন?

ভালো লাগে না আমার। মনে হয়, কেউ একজন চিরতরে বিদায় নিয়ে যাচ্ছে। আর বিদায় নেয়ার আগে মন্ত্র পড়ে যাচ্ছে। চিরবিদায়ের মন্ত্র।’

পারুর কথা শুনে হা হা হা করে হাসল ফরিদ। তারপর কয়েক পা সামনে এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এলো। তারপর পারুকে ধরে দাঁড় করিয়ে তার কাঁধে মাথা রেখে ফিসফিস করে বলল,

‘যেতে যেতেও ফিরে আসবার বাহানা কুড়াই,
স্মৃতিগন্ধা-অচেনা সন্ধ্যা, তোমাতে উড়াই।

ফরিদের এইটুকু কথায় কিংবা এই মন কেমনের সন্ধ্যায় কিংবা ওই বলার ধরনে কিছু একটা ছিল। পারুর আচমকা মন ভালো হয়ে গেল।

কী এক কারণে সার্কাস শুরু হতে খানিক দেরি হবে। ফরিদরা তাই যাত্রাপালা দেখতে এসেছে। আজকের পালার নাম রাজরানি’। শো-এর আগে অনির্ধারিত এক বক্তব্য দিতে মঞ্চে উঠলেন মেলার আয়োজক বিভুরঞ্জন রায়। খানিক আগেই লম্বা, পাকানো গোঁফের এই মানুষটিকে নিয়ে মেলায় ভিড় লেগে গিয়েছিল। হৈ-হট্টগোল শুরু হয়েছিল। ফরিদ তখন বুঝতে পারেনি যে ইনিই এই মেলার প্রধান ব্যক্তি। বিগত জমিদার মনোহর রঞ্জন রায়ের উত্তরাধিকার। মানুষটিকে মঞ্চে উঠতে দেখেই অপেক্ষমাণ দর্শকরা কোলাহল থামিয়ে চুপ হয়ে গেল। যেন সকলেই উন্মুখ হয়ে আছে তার কথা শোনার জন্য। বিভুরঞ্জন দীর্ঘকায় সুদর্শন সুপুরুষ। তার কথা বলার ভঙ্গিও তেমনই। তিনি বক্তব্যের শুরুতেই এই অনাকাঙ্ক্ষিত সময় ক্ষেপণের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিলেন। তারপর বললেন, ‘আমি জানি, আপনারা এখানে নির্মল আনন্দ প্রাপ্তির জন্যই আসেন। এর মধ্যে আমার মতো কোনো উটকো লোক এসে যদি হঠাৎ এমন খটমটো কথা শুরু করে, তবে তা শুনতে ভালো লাগার কথা নয়। নিশ্চয়ই আপনাদেরও লাগছে না। কিন্তু তারপরও আজ আমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলার জন্য এখানে এসেছি।

বলে সামান্য থামলেন বিভুরঞ্জন। তারপর বললেন, ‘আপনারা জানেন, বেশ কয়েকবছর বন্ধ থাকার পর বহু বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে মেলা আবার শুরু হয়েছে। কিন্তু যারা এই মেলার মাঠ দখল করে ইট ভাটা করেছিল, তারা কিছুতেই এটি মেনে নিতে পারছিল না। ফলে দিন-রাত নানা অপপ্রচার করেই যাচ্ছিল। ভয় ভীতিও দেখাচ্ছিল সাধারণ মানুষকে। এসব কারণে মেলাটাকে আর কিছুতেই আগের চেহারায় ফিরিয়ে আনা যাচ্ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আপনাদের সকলের সহযোগিতায় মেলা আবার জমে উঠেছে। শুধু যে জমেই উঠেছে, তা-ই নয়। বরং আগের যেকোনো বারের চেয়ে বেশি জমজমাট হয়েছে। অনেকদিন বাদে এবার। আমার মন ভালো। পরিতৃপ্ত এক মানুষ আমি। মনে হচ্ছে, এখন আমি শান্তিতে মরতে পারব। কিন্তু আমাকে একটা কথা দিতে হবে আপনাদের, আমি না থাকলেও এই মেলা যেন থাকে। এই মেলা যেন কিছুতেই বন্ধ না হয়। কারণ এই মেলা আপনাদের। আমি এর রক্ষণাবেক্ষণ করেছি মাত্র। আমি রায় পরিবারের পক্ষ থেকে এই মেলা আপনাদের হাতে তুলে দিলাম। এখন থেকে আপনারাই এর রক্ষাকর্তা। কোনো দুষ্টু লোক বা দল যেন কখনো এর কোনো ক্ষতি করতে না পারে। এটা আপনারা খেয়াল রাখবেন। আপনাদের কাছে এই আমার অনুরোধ।

বিভুরঞ্জন রায় থামলেন। তার গলা ভেজা। চোখ ছলছল। উপস্থিত দর্শকরা। সমস্বরে তাঁকে সমর্থন জানালেন। তিনি দু হাত জড় করে প্রণামের ভঙ্গিতে বললেন, আপনাদের পালা দেখার আনন্দে বিঘ্ন ঘটানোর জন্য আমি দুঃখিত। আমাকে ক্ষমা করবেন।’

বলেই তিনি মঞ্চ থেকে নেমে গেলেন। ফরিদের কেন যেন লোকটাকে ভালো লেগে গেল। খানিক আগে, সন্ধ্যায়, মেলার মাঠে অমন ভিড় করার জন্য লোকটার প্রতি যে বিরক্তি তৈরি হয়েছিল তা যেন নিমিষেই উধাও হয়ে গেল। শো শুরু হলো তার কিছুক্ষণের মধ্যেই। খুবই দুঃখের গল্প। এক রাজকুমারী শিকারে এসে দলছুট হয়ে পড়েছে। জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলেছে সে। কিন্তু কোনোভাবেই আর নিজের লোকদের কাছে ফিরতে পারল না সে। কেউ তাকে খুঁজেও পেল না। বিপদগ্রস্ত রাজকুমারী ধরা পড়ল বনদস্যুদের হাতে। বনদস্যুদের সর্দারের খুব পছন্দ হয়ে গেল তাকে। সে বিয়ে করতে চাইল। কিন্তু রাজকুমারী তাতে কিছুতেই রাজি নয়। এদিকে একমাত্র কন্যাকে হারিয়ে রাজা পাগলপ্রায়। তার কান্নায় আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত। শুরু হলো নিদারুণ কষ্টের এক কাহিনি। সেই কাহিনি দেখতে দেখতে পারুর বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেল। চোখের ভেতরটা যন্ত্রণায় যেন উপচে উঠতে লাগল। সে ফরিদের বাহুলগ্না হয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

ফরিদ গলা নিচু করে বলল, ‘চলো আমরা বেরিয়ে যাই। এত কষ্টের গল্প দেখার কোনো মানে হয় না।’

কিন্তু পারু যাবে না। যত কষ্টই হোক, সে দেখবেই। ওই কন্যাহারা পিতার সঙ্গে সে যেন তার পিতার মিল খুঁজে পাচ্ছে। তার বাবাও কি তাকে এমন করেই খুঁজছে?

গল্পের বাকি অংশ আরো করুণ। রাজকুমারীকে শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করলেন অন্য এক রাজা। তিনি তার পরিচয় শুনে এবং রূপে-গুণে মুগ্ধ হয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। রাজকুমারীও সানন্দে রাজি হয়ে গেল। তার বাবার সঙ্গেও দেখা হলো। বিয়ে হলো ধুমধাম করে। কিন্তু এরপর হঠাৎই জানা গেল, রাজকুমারী কখনো মা হতে পারবে না। এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ল দিগ্‌বিদিক। রাজকুমারীকে অপয়া হিসেবে অভিযুক্ত করা হলো। বলা হলো রানি যদি সন্তান ধারণে অক্ষম হন, তবে তা প্রজাদের জন্য অমঙ্গল বয়ে আনে। ফলে তাকে নির্বাসনে পাঠাতে হবে। শুরু হলো আরেক ভয়ানক জীবন। একটি শিশু সন্তানের জন্য রাজকুমারীর আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠতে লাগল চারপাশ। গল্পের বাকি অংশ কী আছে, কেন এই গল্পের নাম রাজরানি’ তা আর জানা হলো না কারোর। তার আগেই ভয়ানক এক দুর্ঘটনা ঘটে গেল।

পারু তখন ফরিদের কাঁধে মাথা রেখে মঞ্চের দিকে নিস্পলক তাকিয়ে আছে। রানির কান্নায় ক্ষণে ক্ষণে দ্রবীভূত হয়ে উঠছে সে। তার হঠাৎ মনে হলো, সে এখুনি ফরিদকে কথাটা বলতে চায়। ওই যে রানি একটি শিশুসন্তানের জন্য অমন করে কাঁদছে, প্রার্থনা করছে, কাটিয়ে দিচ্ছে ভয়ানক অভিশাপের এক জীবন। অথচ অমন একটা শিশুর ভ্রণ সে তার শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছে। অথচ সেই কথাটি সে এখনো শিশুটির পিতাকে জানায়নি? এটা তার একদম ঠিক হয়নি।

আচ্ছা, সে যদি এখন ফরিদের কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস করে কথাটা বলে, তাহলে কী করবে ফরিদ? সে কী এই এত এত মানুষের মধ্যে চিৎকার করে উঠবে আনন্দে? নাকি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলবে? পারু শুনেছে, সে যখন তার মায়ের পেটে এসেছিল, সেই সংবাদ শুনে বাবা কী পাগলামিটাই না করেছিল। আচ্ছা, ফরিদও কি তেমন কিছুই করবে?

কিন্তু কী করে কথাটা বলবে সে? কীভাবে বলবে? এই যে শোনেন, আমি না মা হতে চলেছি? নাকি বলবে, এই যে দেখেন, এখানে আমার পেটের ভেতর ছোট্ট একটা বাবু আছে। এই বাবুটা আমাদের। আপনার আর আমার। এমন করে বলবে? পারুর হঠাৎ এত লজ্জা লাগতে লাগল! মনে হলো এই কথাটা সে কখনোই নিজের মুখে ফরিদকে বলতে পারবে না। আচ্ছা, ফরিদ নিজে কিছু বুঝতে পারবে না? তাকে দেখে অবশ্য এখুনি কিছু বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু ফরিদ যেদিন নিজে নিজেই বুঝতে পারবে, সেদিন যদি জিজ্ঞেস করে যে সে এতদিন কেন বলেনি? যদি মন খারাপ করে সে?

নাহ, সেটা ঠিক হবে না। অনেক ভেবে কথাটা বলার সিদ্ধান্ত নিল পারু। কিন্তু কীভাবে বলবে কিছুতেই তা ঠিক করতে পারল না। সে আচমকা ফরিদের হাতটা তার দিকে টেনে নিল। তারপর আলতো করে শাড়ির ওপর দিয়ে তার পেটের ওপর রাখল। ফরিদ আচম্বিতে ফিরে তাকাল। আধো আলো অন্ধকারেও তার চোখের বিভ্রান্ত দৃষ্টি চোখ এড়াল না পারুর। সে ফরিদের হাতটা আরো খানিকটা জোরে চেপে ধরল তার পেটের সঙ্গে। তারপর বড় করে দম নিল। যেন কথাটা বলার জন্য সাহস সঞ্চয় করছে সে। ফরিদ এদিক-সেদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?

পারু মাথা নাড়ল, উঁহু।

‘তাহলে?

পারু কিছুতেই কথাটা গুছিয়ে বলতে পারল না। সে কোনোভাবে এলোমেলো গলায় বলল, “আপনাকে… একটা কথা বলতে চাই… কিন্তু…।’ বলে আপনা আপনিই থমকে গেল পারু।

কী কথা?

‘বলছি।’ বলে ঢোক গিলল পারু। চোখ সরিয়ে নিল ফরিদের চোখ থেকে। তবে তার হাতটা তখনো পেটে চেপে ধরে আছে সে। ফরিদ বলল, “কী? পেট ব্যথা করছে? খারাপ লাগছে তোমার?

পারু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। মনে মনে গুছিয়ে আনছিল কথাটা। ঠিক এই মুহূর্তেই দুর্ঘটনাটা ঘটল। দাউদাউ করে জ্বলে উঠল যাত্রাপালার প্যান্ডেল। চারধার থেকেই জ্বলে উঠল আগুনের লেলিহান শিখা। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে রইল ভেতরে বসা মানুষগুলো। কিন্তু যতক্ষণে বুঝতে পারল ততক্ষণে আগুন ধেয়ে আসতে লাগল সর্বগ্রাসী মৃত্যু দানবের মতো। মুহূর্তেই যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল সবকিছু। ওই সাজানো মঞ্চ, আলোকসজ্জা, বাহারি রঙের প্যান্ডেল, শামিয়ানা, দর্শক-কুশীলব সকলই যেন বিধ্বংসী এক ঝোড়ো হাওয়ায় ওলট-পালট হয়ে যেতে লাগল। যে যেদিকে পারল রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে লাগল। চিৎকার, কান্নায় ভারী হয়ে উঠল রাতের বাতাস। ঘটনা বুঝতে খানিক সময় লাগল ফরিদেরও। মেলায় আগুন লেগেছে?

কিন্তু ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটা মানুষগুলোর এলোমেলো কথা শুনে মনে হচ্ছে, মেলা বন্ধ করার জন্য কেউ ইচ্ছে করে আগুন লাগিয়েছে। ফরিদ বাইরে তাকাল। পুড়ে যাওয়া প্যান্ডেলের বাঁ দিকের ফাঁক দিয়ে দেখা দৃশ্যটা শরীর হিম করে দিল ফরিদের। চারদিকে শুধু আগুন আর আগুন। মানুষের আর্তচিৎকার আর ছোটাছুটিতে সে এক ভয়ানক দৃশ্য। ফরিদ চকিতে উঠে দাঁড়াল। তারপর টেনে নিল পারুকে। পারু ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। ফরিদ বলল, ভয় পেয়ো না। বিপদে ভয় পেলে বিপদ আরো বাড়ে। শক্ত করে আমাকে ধরে রাখবে। কোনোভাবেই ছাড়বে না। মনে থাকবে?

পারু মাথা নাড়ল। তবে তার চোখ দেখে মনে হচ্ছে না সে সত্যি সত্যিই কিছু পারবে। ফরিদ লাভ দিয়ে একটি কাঠের বেঞ্চি টপকাল। তারপর পারুকে ধরে পার করাল। তারপর লোকের ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এলো বাইরে। সেখানে হাজার হাজার লোক ছুটছে। তাদের চিৎকার, আর্তনাদে কান পাতা দায়। চারদিকে আগুনের প্রলয়ংকরী শিখাগুলো যেন ঊর্ধ্বমুখে রুদ্ধশ্বাসে ছুটছে। ফরিদ কী করবে ভেবে পেল না। এই ভিড় আর মৃত্যু আতঙ্কে দিশেহারা মানুষের মাঝখান দিয়ে সে পারুকে নিয়ে কীভাবে যাবে?

পশ্চিম দিকটা খানিক ফাঁকা মনে হলো ফরিদের। ওদিকটাতে লোকজনও ছুটছে কম। সে হ্যাঁচকা টানে পারুকে সেদিকে টেনে নিয়ে গেল। তারপর বলল, “খবরদার, কোনোভাবেই আমার হাত ছাড়বে না। কোনোভাবেই না।

পারু ফাঁসফেঁসে গলায় কিছু একটা বলল। কিন্তু ফরিদ তা শুনতে পেল না। সে তার হাত ধরে পশ্চিম দিকে ছুটতে লাগল। কিন্তু কিছুক্ষণ গিয়েই থমকে দাঁড়াতে হলো তাকে। এ দিকটাতে কম লোক থাকার কারণ এতক্ষণে বুঝতে পারল সে। সার্কাসের হাতি দুটো যেখানে ছিল, সেখানেও আগুন লেগেছে। ফলে হাতিগুলো প্রায় উন্মাদ হয়ে গেছে। তারা ছুটতে চেষ্টা করছে, কিন্তু লোহার ভারী শেকল দিয়ে বাঁধা হাতিগুলো এখনো নিজেদের ছাড়াতে পারেনি। তবে অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে না যে খুব বেশিক্ষণ আর তারা ওই বাঁধনে আটকে থাকবে।

তারপর কী হবে? ভাবতেই শিরদাঁড়া হিম হয়ে গেল ফরিদের। পাগলের মতো দিগ্‌বিদিক ছুটতে শুরু করবে হাতিগুলো। তাদের পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে মারা যাবে অসংখ্য মানুষ। আতঙ্কিত ফরিদ এবার ঘুরে উল্টো দিকে ছুটতে শুরু করল। পারু বলল, আমি আর দৌড়াতে পারছি না।’

ফরিদ চকিতে পিছু ফিরে বলল, কেন?

‘আমার শাড়ি জড়িয়ে যাচ্ছে পায়ে।

ফরিদ কী বলবে বুঝতে পারল না। সে দিশেহারার মতো চারদিকটা একবার দেখে নিল। তারপর হঠাৎ বলল, ‘এক কাজ করো, শাড়িটা একটু ওপরের দিকে তুলে নাও। দ্রুত।

পারু সম্ভবত কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু সেই সুযোগ আর তাকে দিল না ফরিদ। সে তার হাত ধরে আড়াআড়ি মেলার মাঠ ধরে ছুটতে লাগল। পারু দুইবার হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। একবার সামান্য আগুনও দেখা গেল তার শাড়ির আঁচলে। তবে তা বিপজ্জনক হয়ে ওঠার আগেই হাতের থাবায় নিভিয়ে দিল পারু। ফরিদ অবশ্য এতকিছু কিছুই খেয়ালই করল না। সে পারুকে শক্ত হাতে ধরে টেনে হিঁচড়ে এগোতে লাগল সামনে। তাদের সামনের পথ তখন বন্ধ। প্রলয়ংকরী। আগুনে সাক্ষাৎ নরকে পরিণত হয়েছে জায়গাটা। একমাত্র নদীর দিকটাতে যাওয়ার পথটাই খানিক নিরাপদ। ফরিদ সেদিকেই ছুটল। শুধু তারাই নয়, আরো অনেকেই ছুটছে নদীর দিকে। ফলে ফরিদের জন্য কাজটা আরো কঠিন হয়ে উঠেছে। কিন্তু মুহূর্তের জন্যও পারুর হাতখানা ছাড়েনি সে। কিন্তু যতক্ষণে সে নদীর কাছে পৌঁছাল, ততক্ষণে পারুর অবস্থা মৃতপ্রায়। সে এতক্ষণ ঘোরগ্রস্ত মানুষের মতো ছুটেছে। যেন চারপাশে কী ঘটছে তার কিছুই সে জানে না। সে কেবল জানে, ফরিদের হাতখানা তাকে শক্ত করে ধরে থাকতে হবে। আর ছুটতে হবে তার সঙ্গে। তা পারু ছুটেছেও। ওই অত অত আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ আর আগুনের লেলিহান শিখা পেরিয়ে সে নদীর ধারে এসে পৌঁছেছে। কিন্তু পৌঁছেই থমকে গেল ফরিদ। পারুর শাড়িতে আগুন ধরে গেছে। তার আঁচল জ্বলতে শুরু করেছে দাউদাউ করে। এখন কী করবে সে? পারুর অবশ্য এতকিছু খেয়াল নেই। সে যেন এক সম্মোহিত মানুষ। তার চোখে শূন্য দৃষ্টি। এমন নারকীয় পরিস্থিতির মুখোমুখি আর কখনো হয়নি সে। ফরিদ চিৎকার করে বলল, শাড়িটা খুলে ফেলো পারু। শাড়িটা খুলে ফেলো।

পারু অবশ্য তার কথা শুনল কি না বোঝা গেল না। সে টলমল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েই রইল। হতবুদ্ধি ফরিদ ছুটে এসে তার পরনের টকটকে লাল শাড়িখানা খুলে দিতে লাগল। পারু বাধা দিল না। সাহায্যও করল না। এমনকি লজ্জায় সংকুচিতও হয়ে গেল না। সে যেমন ছিল তেমনই দাঁড়িয়ে রইল। যেন এসবের কোনো কিছুই সে অনুভব করতে পারছে না। ফরিদ পারুকে ডাকল। আর তখুনি খেয়াল করল, তার কানের পাশ দিয়ে নেমে আসছে রক্তের স্রোত। ছুটে আসবার সময় কোনো কিছুতে আঘাত পেয়েছে পারু। ফরিদ নিজেও পেয়েছে। তার কপালেও রক্ত ঝরছে। কিন্তু সেসব দেখার সময় কই তার?

পারুকে দেখে মনে হচ্ছে সে যেকোনো সময় লুটিয়ে পড়বে মাটিতে। দিশেহারা ফরিদ তাকে জড়িয়ে ধরল। আর তখুনি দৃশ্যটা চোখে পড়ল তার। যে যেভাবে পারছে নেমে যাচ্ছে নদীর তীর ধরে। কেউ কেউ উঠে যাচ্ছে নৌকায়। গায়ে আগুন নিয়ে কেউ কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ছে পানিতে। দিশেহারা ফরিদ আচমকা কাঁধে তুলে নিল পারুকে। তারপর ছুটে যেতে থাকল নদীর তীরের দিকে। কিন্তু মানুষের ভিড় দেখে খানিক থমকে দাঁড়াল সে। যে দিকটা চাতালের মতো ঢালু হয়ে নিচে নেমে গেছে, সেদিক দিয়ে সে কিছুতেই পারুকে নিয়ে নামতে পারবে না। সেখানে অসংখ্য মানুষ। তারা ছুটছে পাগলের মতো। যে যেভাবে পারছে সরে যেতে চাইছে এই নারকীয় অগ্নিকুণ্ড থেকে। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না। কারো। প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি দেখাচ্ছে না। ছুটতে গিয়ে কেউ কেউ ছিটকে পড়ছে মাটিতে, তাকে পায়ের তলায় পিষ্ট করেই ছুটে যাচ্ছে মানুষ। আহত মানুষের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠছে বাতাস। নাকে এসে লাগছে পোড়া লাশের গন্ধ। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত ফরিদ কী ভেবে হঠাৎ এগিয়ে গেল নদীর দুরূহ পাড়ের দিকটাতে। এদিক থেকে নদীতে নামার পথ ঢালু নয়। বরং পাহাড়ের মতো খাড়া। এই পথে নদীতে নামার একমাত্র উপায় ওপর থেকে লাফিয়ে পড়া। তা অনেকেই লাফিয়ে পড়ছেও। তবে বেশির ভাগই ছুটে যাচ্ছে ঢালু পথের দিকে। ফরিদের আচমকা মনে হলো সেও এই খাড়া পাড় থেকেই লাফিয়ে পড়বে। পারুকে আলগোছে ধরে দাঁড়া করাল সে। তারপর তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, সাবধান, আমরা লাফিয়ে পড়ব নিচে। একটু সাবধান, হ্যাঁ?’

পারু কথা বলল না। লোকের ভিড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না সে। তারপরও টলমল শরীরে যতটা সম্ভব দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করল। এই মুহূর্তে খানিকটা ডানদিকে নিচে বড়সড় একটা নৌকার আদল চোখে পড়ল ফরিদের। নৌকাটা সম্ভবত নড়তে শুরু করেছে। এই সুযোগটা কিছুতেই হাতছাড়া করতে চায় না সে। তার ভয়, নিচের অন্ধকার জলে যদি পারু সাঁতার কাটতে না পারে? যদি তলিয়ে যায়?

এ কারণেই নৌকাটা দেখে চট করে বুদ্ধিটা মাথায় এলো ফরিদের। নৌকার ছইয়ের ওপর লাফিয়ে পড়তে চায় সে। চকিতে পারুকে আবারও কাঁধে তুলে নিল। তারপর ছুটতে লাগল যতটা সম্ভব দ্রুত। কিন্তু ছুটন্ত, আতঙ্কিত মানুষের চাপে নিজেকে স্থির রাখা কঠিন হয়ে পড়ল। নৌকার সমান্তরালের জুতসই ওই জায়গাটা এখনো বেশ খানিকটা দূরে। তা ফরিদ হাল ছাড়ল না। পারুকে কাঁধে চেপে হাঁটতেই লাগল। তবে এত লোকের ভিড়ে সেটি ক্রমশই অসম্ভব হয়ে উঠছে। এক পা সামনে এগোলে দু-পা পেছাতে হচ্ছে তাকে। তা ছাড়া, সে নিজেও আহত। মনে হচ্ছে না আর বেশিক্ষণ এই চাপ সহ্য করতে পারবে। তারও মাথা টলছে। পা কাঁপছে। ক্ষণে ক্ষণে অন্ধকার হয়ে আসছে দৃষ্টি।

তারপরও প্রাণপণ চেষ্টায় জায়গাটার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেল ফরিদ। আর কয়েক কদম এগোলেই খাড়া ঢাল। নিচেই নৌকাটা। ফরিদ মনে মনে হিসেব কষে দূরত্বটুকু মেপে নিল, ঠিক কতটা লাফিয়ে যেতে পারলে নৌকার ছাউনিতে পড়তে পারবে সে? সমস্যা হচ্ছে, পারুকে কাঁধে নিয়ে অতটা যাওয়া কঠিন। তার ওপর নৌকাটাও ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। সম্ভবত ঘাট ছেড়ে চলে যাচ্ছে মাঝি। দ্বিধাগ্রস্ত ফরিদ শেষ অবধি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা নিল। ঝুঁকিটা নেবে সে। সর্বশক্তি দিয়েই লাফিয়ে পড়ার চেষ্টা করবে নৌকার ছাদে।

কিন্তু ফরিদ পারল না। তার আগেই পেছন থেকে হুড়মুড় করে নেমে আসা ভিড়ের তীব্র ধাক্কায় নদীতে ছিটকে পড়ল সে। তার কাঁধ থেকে ছিটকে গেল পারুও। ফরিদের মাথাটা আঘাত হানল শক্ত কিছুতে। চোখের সামনের পৃথিবীটা মুহূর্তেই অন্ধকার হয়ে গেল। শূন্য হয়ে গেল বুক। তারপরও পতনের সময় হাওয়ায় হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে সে উন্মাদের মতো চিৎকার করে ডাকতে লাগল, পারু, পারু।

কিন্তু পারু কোনো সাড়া দিল না। কিংবা ওই অসংখ্য মানুষের আর্তচিল্কারের ভিড়ে তার কণ্ঠ হারিয়ে গেল। হারিয়ে গেল ফরিদও। সে আর জলের ভেতর থেকে উঠে দাঁড়াতে পারল না। খুঁজতে পারল না পারুকে। তার মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগল। তীব্র যন্ত্রণায় বিবশ হয়ে রইল সে। তার মনে হলো সে মারা যাচ্ছে। এই জনমে আর কখনোই সে তার পারুকে দেখতে পাবে না।

ফরিদের চেতনা ফিরল প্রায় ভোর রাতের দিকে। মেলার আগুন ততক্ষণে নিভু নিভু। ওই খোলা মাঠে দাহ্য যা কিছু ছিল তার সব উদরপূর্তি করেই যেন ক্ষিদে মিটেছে আগুনের। উদ্ধারকারীদলও এসে পৌঁছেছে। তবে তাতে ক্ষয়ক্ষতি যে কম কিছু হয়েছে তা নয়। বরং তারা এসে ঘটনার ভয়াবহতা দেখে হতভম্ব হয়ে গেছে। এই হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে উদ্ধারকারী অগ্রগামী দলের মাত্র বিশ পঁচিশজনের সংখ্যা বড় অপ্রতুল। এমনকি আশপাশের এলাকা থেকে ছুটে আসা দর্শনার্থীদের ভিড় ঠেলে সহসাই তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারল না। আর যখন পৌঁছাল, তখন আগুনে পোড়া শরীরের মানুষগুলোর নরক যন্ত্রণার মরণ চিৎকার শোনা ছাড়া আসলে তেমন কিছু করারও ছিল না।

তবে অন্তত একটা কাজ তারা করতে পেরেছে। ওই আগুন ডিঙিয়ে মেলার মাঠে ঢুকতে না পারলেও শেষ রাতের দিকে নদী থেকে প্রচুর আহত-নিহত মানুষ তারা তুলতে শুরু করেছে। তাদের স্তূপ করে রাখা হয়েছে নদীর পাড়ের বালিয়াড়িতে। ফরিদ জেগে উঠল তেমনই এক স্থূপের ভেতর থেকে। তবে চেতনা ফেরার পরও দীর্ঘ সময় সেখানেই নিঃসাঢ়ে পড়ে রইল সে। ওই সময়টুকুতে অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা হলো তার। মনে হলো কোনো এক সুদূর শূন্য অচিনপুর থেকে সে তীব্র গতিতে ফিরে আসছে একের পর এক আলো-অন্ধকারের জগৎ পেরিয়ে। গ্রহ নক্ষত্রের সীমানা পেরিয়ে। সে ভেসে যাচ্ছে পলকা মেঘের মতো। ঝোড়ো হাওয়ার মতো। নিয়ন্ত্রণহীন। তার চারপাশে কোথাও কিছু নেই, যা আঁকড়ে ধরে সে তার এই পতন কিংবা ছুটে যাওয়া ঠেকাতে পারে। স্থির হতে পারে মুহূর্তের জন্য। শেষ অবধি সে থামল স্যাঁতসেঁতে ভেজা এক অনুভূতির ভেতর। তার মাথার ওপর নরম সিক্ত শীতল অনুভব। তার শরীর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে অন্য কারো শরীরে। সে নড়ার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। বরং আচমকা দম বন্ধ লাগতে লাগল। কয়েকবার খুকখুক করে কাশলও সে। এই কাশির শব্দটুকুই হয়তো তাকে বাঁচিয়ে দিল। একটি অপরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেল সে, “ওই, দেখতো ওই দিকে কোনখান থেকে জানি কাশির শব্দ আসল? ওই যে, ওইটা দেখ, ওইখান থেকে আসছে।’

পরক্ষণেই কয়েকজনের পায়ের শব্দ পেল ফরিদ। দুজন লোক তার মাথার ওপর চেপে বসে থাকা ভেজা ভারী বোঝাটা সরিয়ে দিয়ে তাকে খুঁজে বের করল। তারপর তার নাকের কাছে হাত নিয়ে কী পরীক্ষা করে দেখল। তারপর তাকে চ্যাঙদোলা করে নিয়ে রাখল খানিক দূরে বালির ওপর। সেখানে সারিবদ্ধভাবে আরো অনেক লোক শুয়ে আছে। কেউ কেউ উঠে বসে কাতরাচ্ছে। ফরিদও উঠে বসল। তার শরীরজুড়ে অবর্ণনীয় যন্ত্রণা। মাথা ঝিমঝিম করছে। সে একবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। বসে পড়ল আবার। তারপর রক্তে প্রায় বুজে যাওয়া চোখগুলো হাতের উল্টোপিঠে মুছে সে তাকাল। তার সামনেই বিশাল নদী। চারদিক থেকে টর্চলাইটের এলোমেলো আলো এসে পড়ছে সেই নদীতে। কেউ কেউ নৌকা নিয়েও নেমে গেছে। চিৎকার করে আহত মানুষ খুঁজছে, আছেন কেউ? পানিতে কেউ আছেন? থাকলে আওয়াজ দেন।’

আর তখুনি পারুর কথা মনে পড়ল ফরিদের। মুহূর্তেই তার হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠল। বুক শূন্য হয়ে গেল। সে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এগোলো। জলের কাছে। তারপর চোখে-মুখে মাথায় নদীর ঠাণ্ডা জল ছেটাতে লাগল। পরিষ্কার করে নিতে লাগল দৃষ্টি, মস্তিষ্ক। তারপর উঠে দাঁড়াল। পুবাকাশে তখন আলো ফুটতে শুরু করেছে। দূরের কোনো মসজিদ থেকে ভেসে আসছে ফজরের আজানের ধ্বনি। একটা দুটো পাখিও কি ডাকতে শুরু করেছে? ফরিদ জানে না। তবে তার বুকের ভেতর ডেকে যেতে লাগল তীব্র এক অশনিসংকেত। সেই অশনিসংকেত জুড়ে কেবল একজন মাত্র মানুষ। পারু।

বেলা যত বেড়েছে, যত আলো ফুটেছে, তত নদীর পাড় ধরে ছুটেছে ফরিদ। এদিক থেকে সেদিক। এখান থেকে ওখানে। একটা একটা করে মানুষের মুখ উল্টেপাল্টে দেখেছে। কিন্তু পারু কোথাও নেই। তার স্পষ্ট মনে আছে, সে নৌকার একদম কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। সম্ভবত ইঞ্জিনযুক্ত একখানা ট্রলার ছিল সেখানে। ট্রলারে কিছু জিনিসপত্রও ছিল। কিন্তু এত মানুষ দেখে ভড়কে গিয়েছিল মাঝি। সে চেষ্টা করছিল ট্রলার ছেড়ে দিতে। কিন্তু এত লোকের কারণে সেটি পারছিল না। আর লোকেরাও সবাই একযোগে উঠতে গিয়ে ভজঘট পাকিয়ে ফেলছিল। কেউই উঠতে পারছিল না। পেছন থেকে একটা বড় ভিড় হুড়মুড় করে নেমে আসছিল বেনিচের দিকে। সেই ভিড়ের ধাক্কায়ই ছিটকে গিয়েছিল ফরিদ। সে পড়ে গিয়েছিল। পানিতে। কিন্তু পারু? পারু কোথায় পড়েছিল? সে কি ওইটুকু ওপর থেকে নিচে ট্রলারের গলুইয়ের ওপর ছিটকে পড়েছিল? নাকি পানিতে?

কথাটা আর মনে করতে পারল না ফরিদ। সে পাগলের মতো খুঁজতে থাকল তাকে। একটা একটা করে মুখ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকল। কিন্তু পারু কোথাও নেই। ততক্ষণে দিনের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে চারপাশ। উদ্ধারকারী লোকের সংখ্যা বাড়ছে। উৎসুক দর্শনার্থী জনতাও নেমে পড়েছে উদ্ধারে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, চিকিত্সক, সাংবাদিকরাও ধীরে ধীরে আসতে শুরু করেছে। তাদের কেউ একজনই তাকে কিছু খাবার দিল। খানিক চিকিৎসা সেবারও চেষ্টা করল। তবে ফরিদ তাতে খুব একটা আগ্রহ দেখাল না। সে খানিক ভালো অনুভব করতেই আবার ছুটতে থাকল নদীর ধারে। কিন্তু সেই নদীর ধারে পড়ে থাকা অসংখ্য মানুষের ভিড়ে ওই একটি মাত্র মুখই আর সে দেখতে পেল না। কোথাও না।

দুপুর নাগাদ ফরিদ প্রায় পাগলের মতো হয়ে গেল। সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না পারু নেই। কেউ তাকে শুশ্রূষার জন্য নিয়ে যেতে চাইল। খাবার, চিকিৎসা দিতে চাইল। কিন্তু ফরিদ তার কোনো কিছুই গ্রহণ করল না। বরং সে সেই পুড়ে যাওয়া বটগাছটার নিচে শূন্য চোখে বসে রইল। একা, নিঃসঙ্গ, সর্বহারা এক মানুষ যেন। যেন এই জগৎ-সংসারে তার চেয়ে শূন্য, তার চেয়ে রিক্ত আর কোনো মানুষ নেই। এখানে তার বেঁচে থাকার আর কোনো কারণ নেই। নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য এতটুকু হাওয়া নেই। পান করবার জন্য জল নেই। এ যেন এক নিদাঘ বিরাণ মরু প্রান্তর। এখানে কেবল শূন্যতা আর শূন্যতা। মৃত্যু আর মৃত্যু।

পারু কি তবে নদীতে ভেসে গেছে? আরো অসংখ্য মানুষের মতো? সে যে অন্তত আগুনে পুড়ে মারা যায়নি, সে ব্যাপারে ফরিদ নিশ্চিত। তাহলে? স্বজনহারা মানুষের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠছে চারপাশ। তাদের কান্নার শব্দে কান পাতা দায়। সেই কান্নাজুড়ে আগুনে পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া অচেনা-অজানা অসংখ্য লাশও। কে জানে, হয়তো এই চেহারাবিহীন কয়লার মতো শরীরগুলোই এখানে খুঁজতে আসা কারো প্রিয়তম স্বজন। কিন্তু কী করে চিনবে তারা? চেনার কোনো উপায় যে আর অবশিষ্ট নেই!

.

সারাটা দিন ফরিদ কাঁদল, চুপ করে বসে রইল, ভাবল, অসংখ্যবার খুঁজে বেরাল। পারুকে। বুক অবধি নদীর জলে নেমে হাতড়াল। কিন্তু পারুকে পেল না। সে কোথাও নেই! পারু কি তবে জলে ভেসে গেছে? যদি তা-ই হয়, তাহলে? ভাবতেই গা শিউরে উঠল ফরিদের। তার স্পষ্ট মনে আছে, বাঁচার চেষ্টায় বেপরোয়া মানুষের উন্মত্ত পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে মারা গেছে কত মানুষ। পারুরও যদি অমন কিছু হয়? যদি সেও অমনভাবে পিষ্ট হয়। তারপর ভেসে চলে যায় জলে? তাহলে কী হবে তার? এই জনমে আর কখনো তাকে খুঁজে পাবে না ফরিদ? ওই মুখ আর কখনো দেখতে পাবে না? আর যদি পায়, তবে সে তখন আর পারু থাকবে না। থাকবে পচা গলা কোনো লাশ। সেই লাশ আর এই আগুনে পুড়ে ভস্ম হয়ে যাওয়া মৃত মানুষের শরীরের সঙ্গে কোনো পার্থক্য থাকবে না! ফরিদ আচমকা দু হাতে মুখ ঢাকল। তারপর হাউমাউ করে কাঁদল। তার সেই কান্না ফুরাল অদ্ভুত এক ঘোরগ্রস্ততায়। নিজেকে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করল সে। নিশ্চয়ই পারুর অমন কিছু বেহয়নি। নিশ্চয়ই কোনো একটা ভুল হচ্ছে তার। কিংবা অলৌকিক কোনো উপায়ে সে ঠিক থাকবে। তাকে খুঁজে পাবে ফরিদ। এমন অসংখ্য চিন্তা একে একে তাকে আচ্ছন্ন করে দিতে থাকল। কিংবা এলোমেলো করে দিতে লাগল তার মন-শরীর। ক্রমশই অসংলগ্ন হয়ে উঠতে থাকল তার আচরণ, চিন্তা। শরীরও হাল ছেড়ে দিতে লাগল। দীর্ঘ মানসিক-শারীরিক চাপে অবশেষে যেন সবকিছু হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। ক্লান্ত, আহত ফরিদ যেন বুঝতে পারল না, সেকি ঘুমিয়ে পড়ল? নাকি জ্ঞান হারাল আবারও?

.

সকালে যে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি ফরিদকে সাহায্য করতে চেয়েছিল, তাদের গাড়িতেই সন্ধ্যায় ঢাকায় ফিরল সে। তখনো আধো ঘুম আধো জাগরণের অবচেতন এক জগতে ডুবে আছে সে। এক ধরনের প্রবল দুঃস্বপ্ন তাকে গ্রাস করে ফেলছে। মনে হচ্ছে, এতক্ষণ যা ঘটেছে, তার সবই স্বপ্নের ভেতর। খানিক বাদেই তার ঘুম ভেঙে যাবে। সে ঘুম থেকে উঠে দেখবে পারু তার পাশে বসে আছে। সে পরে আছে লাল টুকটুকে ওই শাড়িটা। তার হাতভর্তি কাঁচের চুড়ি। সে সেই চুড়িতে ঝনঝন শব্দ তুলে ফরিদকে ডাকছে। তার ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করছে। ফরিদ তড়িঘড়ি করে ঘুম থেকে উঠে দেখল ভোর হয়ে গেছে। আজ তার পারুকে নিয়ে মেলা দেখতে যাওয়ার কথা। অথচ সে কি না এখনো ঘুমাচ্ছে?

ফরিদ উঠতে গিয়ে দেখে তার সত্যি সত্যি ঘুম ভেঙে গেছে। কিংবা প্রতিবার ঠিক এই জায়গাতে এসেই তার ঘোর কেটে যায়। তখন মনে হয়, সে এতক্ষণ যা দেখেছে তা সত্যি নয়। বরং স্বপ্ন। আসল সত্যিটা ভয়ংকর। পারু নেই। সে পারুকে হারিয়ে ফেলেছে। আর কখনোই তাকে খুঁজে পাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু সে তার সব শক্তি দিয়ে এই ভয়ংকর সত্যি থেকে পালিয়ে যেতে চায়। আর পালিয়ে যেতে চায় বলেই বারবার ফিরে যায় স্বপ্নের ঘোরে। দেখতে চায় ওই দৃশ্যটিই। কিন্তু বারবার তার ঘোর কেটে যায়। স্বপ্ন ভেঙে যায়। এই পৌনঃপুনিকতা চক্রাকারে চলতেই থাকে।

তবে শেষের দিকে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। ফরিদকে ডেকে তুলল গাড়ির ড্রাইভার। তারপর বলল, আপনি না এইখানে নামবেন? আপনার বাসাতো এইদিকেই?

ফরিদ চোখ তুলে ড্রাইভারের দিকে তাকাল। তারপর আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলল, হ্যাঁ, এইখানেই। এইটুক পথ আমি হেঁটেই যেতে পারব।’

তা ফরিদ পারলও। তার কোমরে, পায়ে ব্যথা থাকলেও হেঁটে যেতে খুব একটা অসুবিধা হলো না তার। সে যখন বাসায় পৌঁছাল তখন চারদিকটা অন্ধকার। ঠিক অন্ধকার নয়, কেমন এক আবছা আলো-আঁধারির খেলা। সে দরজার তালা খুলতে গিয়ে দেখল দরজা খোলা। কী আশ্চর্য, দরজা খুলল কে? ফরিদ ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়াল। পারু বসে আছে বিছানার ওপর। তার পরনে সেই লাল টুকটুকে শাড়িখানা। শাড়ির কোথাও এতটুকু মলিনতা নেই, পোড়া দাগ নেই। যেন সে এই মাত্র ট্রাংক থেকে বের করে নতুন শাড়ি পরেছে। ফরিদ রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে বলল, তুমি? তুমি এইখানে?

পারু খিলখিল করে হাসছে। সে বলল, “কেন? আমার তো এখানেই থাকার কথা ছিল?

কখন? তুমি কীভাবে এলে?

আপনাকে খুঁজে খুঁজে না পেয়ে আমি একা একাই চলে এসেছি। কারণ, আপনি তো বাসায় ফিরবেনই।’

‘কিন্তু তুমি তো বাসার ঠিকানা জানো না! কখনো বাসা থেকে বেরও হওনি। এই ঢাকা শহরের কিছুই জানো না তুমি। তাহলে এলে কী করে?

এই কথায় পারুর খুব মন খারাপ হলো। সে বলল, তাহলে আপনি আমাকে ঠিকানাটা দেননি কেন? বলেননি কেন কখনো? তাহলে তো আমি ঠিকঠাক চলে আসতে পারতাম!’

এই কথায় মন খারাপ হয়ে গেল ফরিদের। সে বলল, “এখুনি তোমাকে আমি ঠিকানা লিখে দিচ্ছি। এখুনি। তুমি একদম মুখস্ত করে ফেলবে। ঠিক আছে?’

পারু কথা বলল না। তার মুখ থেকে খানিক আগের হাসি মিলিয়ে গেছে। একটা অদ্ভুত বিষাদ ভর করেছে সেখানে। ফরিদ বলল, কই, কলম কই? আমাকে একটা কলম দাও।’

পারু তাকে কলম দিতে উঠল না। সে যেমন বসে ছিল, তেমন বসেই রইল। তবে খানিক আগে দেখা তার পাটভাঙা নতুন শাড়িটাকে এখন যেন কেমন ম্লান লাগছে ফরিদের কাছে। কেমন বিবর্ণ, ভেজা আর এলোমেলো। খানিক পোড়া গন্ধও যেন। কী আশ্চর্য, এমন হচ্ছে কেন? ফরিদ কলমটাও খুঁজে পাচ্ছে না। সে দীর্ঘ সময় ধরে খুঁজল, কিন্তু কলম কোথাও পেল না। কোথাও না। অথচ তার স্পষ্ট মনে আছে, ডিসপেনসারি থেকে একগাদা কলম এনে সে এখানেই রেখেছিল। এই টেবিলের ওপর। অথচ তার একটিও কোথাও নেই! এ কেমন কথা? ফরিদ পাগলের মতো কলম খুঁজতে লাগল। তার এই অবস্থা দেখে পারু আবার হাসতে লাগল। কিশোরী বালিকার মতো হাসি। ফরিদ তাকিয়ে দেখে পারুর হাতভর্তি কলম। একটা দুটো নয়, অনেকগুলো রংবেরঙের কলম। সে সেই কলমের জন্য পারুর কাছে হাত জোড় করে অনুরোধ করতে লাগল। কিন্তু পারু তাকে একটা কলমও দিল না। সে হঠাৎ মিলিয়ে গেল হাওয়ায়। ফরিদের ঘুম ভেঙে গেল। সে জেগে উঠে দেখল সে শুয়ে আছে গাড়ির সিটে। তার অকস্মাৎ মনে হলো, সে এখুনি বাসায় ফিরে যাবে। এখুনি। লোকগুলো তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু সে এখন আর কোথাও যেতে চায় না। সে আগে বাসায় যেতে চায়। এমনকি হতে পারে যে পারু সত্যি সত্যিই বাসায় চলে গেছে? সে গিয়ে দেখবে সত্যি সত্যি পারু তার জন্য অপেক্ষা করছে? হতে পারে এমন?

ধীরে ধীরে ফরিদের সংবিৎ ফিরে আসছে। সে জানে, এটা প্রায় অসম্ভব এক কল্পনা। তারপরও সে সেটিকে উড়িয়ে দিতে পারল না। অস্বীকার করতে পারল না সে একপ্রকার জোর করেই গাড়ি থেকে নেমে গেল। এখান থেকে তার বাসা খুব একটা দূরে নয়। রিকশা করেই চলে যেতে পারবে সে। কিন্তু বাসায় গিয়ে সত্যি সত্যি কী দেখবে ফরিদ?

তখন চারদিকে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। এদিকের রাস্তাটা নির্জন। দু পাশের গাছগুলো কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে ঝুঁকে আছে মাথার ওপর। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোগুলো সেই পাতায় বিচ্ছুরিত হয়ে অদ্ভুত এক নৈসর্গিকতার ছবি এঁকে দিয়েছে। সেই ছবিজুড়ে বেজে যাচ্ছে নশ্বর এক পৃথিবীর অবিনশ্বর নিঃসঙ্গতার সংগীত।

মহিতোষ মাস্টারকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। ডাক্তারদের প্রাথমিক ধারণা তিনি স্ট্রোক করেছেন। কী এক ভয়ানক যন্ত্রণার সুদীর্ঘ পথ পেরিয়েই না তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন পারুকে স্পর্শ করার হাত ছোঁয়া দূরত্বে! অথচ শেষ অবধি তিনি তার ছায়াটুকুও দেখতে পেলেন না। দেখতে পেলেন না তার পিতৃতেষ্টায় পিপাসার্ত মুখখানাও। বরং ওইখানে পারু ছিল, ওই যে ঘরের দরোজা, ঠিক তার ওপারে, ওই পথে–ওই যে ওখানে লেগেছিল তার গায়ে ঘ্রাণ, এই অনাঘ্রাত অনুভব নিয়েই তাকে ফিরে আসতে হলো বিপুল বিষাদে। কর্পূরের মতো যেন সবকিছু মিলিয়ে গেল হাওয়ায়। এলোমেলো হয়ে গেল মহিতোষ মাস্টারের জগৎ-সংসার। পারু যেন মরুভূমির মরীচিৎকার মতো, ওই দূর সীমানায় তার আভা দেখা যায়, কিন্তু কাছে গেলেই সে দূরে সরে যায় আরো। আরো দূরে। কখনোই আর তাকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। স্পর্শ করা যায় না তার ছায়াটুকুও।

মহিতোষ যেন এখন জানেন, এই জনমে পারুর সঙ্গে আর কখনোই তার দেখা হবে না। কথা হবে না। সে তার কাছে আমৃত্যু রয়ে যাবে স্মৃতির একটুকরো ছবি হয়েই। কিংবা অনিমিখ যন্ত্রণার এক স্মৃতিভস্ম হয়ে। সেই স্মৃতি কখনোই সুবাস। ছড়াবে না। কেবল খাক করে দিতে থাকবে বুকের গহিন। এই যন্ত্রণা নিয়ে মানুষ। বাঁচে কী করে!

মহিতোষ জানেন না। শারীরিক-মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মহিতোষ এই যন্ত্রণা আর নিতে পারেননি। তিনি স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলেন সংজ্ঞাহীন ফরিদের পাশে। তার মাথার ভেতর একদল বীভৎস ঝিঁঝি পোকা যেন কুৎসিত স্বরে একনাগাড়ে ডেকে যাচ্ছিল। তারা যেন ঘুণপোকার মতো খুঁটে খুঁটে খেয়ে যাচ্ছিল তার মগজ। অবশ করে দিচ্ছিল সায়ু।

তাকে হাসপাতালে ভর্তি করাল মইনুল। সঙ্গে ফরিদকেও। ফরিদও পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। প্রবল জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে তার। মাঝেমধ্যেই ঘুমের ভেতর ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে জেগে ওঠে সে। পাগলের মতো প্রলাপ বকতে থাকে। এই সময়ে তাকে শান্ত করা কঠিন। মইনুল অবশ্য ধৈর্য ধরেই সব করে যাচ্ছে। তার কেন যেন মনে হচ্ছে, এই মানুষ দুজনের জীবনের সঙ্গে ক্রমশই জড়িয়ে যাচ্ছে সেও। ফলে তাদের প্রতি অদ্ভুত এক ধরনের কৌতূহলও তৈরি হয়েছে তার। একটা অনুভূতিও। সেই অনুভূতির নাম অবশ্য সে জানে না। হতে পারে একই গল্পের সুতোয় বাঁধা এই বিপরীত মেরুতে দাঁড়ানো দুজন মানুষের জীবনের অমিত অন্ধকারের যন্ত্রণা তাকে অবচেতনেই ছুঁয়ে গেছে গভীর সংবেদনে।

আজ দিন কয়েক হলো ফরিদরা হাসপাতালে ভর্তি। তাদের ভর্তি হতে সাহায্য করেছে তরু। পৃথিবীর কিছু রহস্যময় হিসেব আছে। সমীকরণও। সেই সমীকরণ মানুষ মেলাতে পারে না। ফলে সে জীবনভর কেবল তার অপ্রাপ্তি আর আক্ষেপের গল্পগুলোই বড় করে দেখে। কিন্তু সে যা কখনো চাওয়ার কথা ভাবেনি, কিংবা যেখানে তার কোনো প্রত্যাশা-প্রাপ্তির অধিকার নেই, সেখান থেকেও যখন সে অযাচিত প্রাপ্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, তখন সে তা উপলব্ধি করতে পারে না। অনুভব করতে পারে না। ফলে তার জীবন কাটে অবিরাম আক্ষেপ আর অপেক্ষায়।

না হলে এই যে তরু, কিংবা মইনুল–এমন অপরিচিত, অনাত্মীয় দুজন মানুষ কেন এমন করে মহিতোষ মাস্টারের জন্য উৎকণ্ঠিত হয়ে রইবে? আগলে রাখতে চাইবে পরম মমতায়। এর ব্যখ্যা কী? তরু এটা ভেবেছে। কিন্তু কোনো উত্তর পায়নি। তবে তার ধারণা, উত্তর না জানা অনুভবগুলোই মানুষকে সবচেয়ে বেশি আবিষ্ট করে রাখে। তৈরি করে জনম জনমের সম্পর্ক। এই মানুষটার সঙ্গে তার কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই, জানাশোনা নেই। অথচ তারপরও কোনো এক আশ্চর্য কারণে সারাক্ষণ তার জন্য মন কেমন করে। বুকের ভেতর একটা আলতো নরম। অনুভব আলগোছে ছুঁয়ে দিতে থাকে। সে কি এই মানুষটার ভেতর অবচেতনেই তার বাবাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছে? তরু জানে না। হবে হয়তো। সে তার বাবার মুখটা সহসা মনে করতে পারে না। বাবা যখন মারা যান, তখন কত বয়স ছিল তার? পাঁচ কি ছয়। ওই বয়সের স্মৃতি খুব একটা মনে থাকার কথা না। তারও নেই। তাহলে মহিতোষ মাস্টারের ভেতর নিজের বাবাকে কী করে খুঁজে পায় সে?

মইনুলও রোজ এসে মহিতোষ মাস্টারকে দেখে যায়। ফরিদকেও। তাদের দুজনের অবস্থারই উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু পারুর বিষয়টা নিয়ে ভীত সে। ভীত মহিতোষ মাস্টার ও ফরিদকে নিয়েও। সুস্থ হওয়ার পর কী করবেন তারা? সেদিন রাতে হাসপাতালে ভর্তির পর একটু সুস্থির বোধ করতেই সবাইকে ঘটনা খুলে বলেছিল ফরিদ। শুনে যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সকলে। ভেতরে ভেতরে অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠেছিল। তাদের কারোই যেন বিশ্বাস হতে চাইছিল না যে ভাগ্য কারো প্রতি এমন বিরূপ হতে পারে। এমন নিষ্ঠুর, নির্দয় হতে পারে।

এরপর থেকে ফরিদ আবার শয্যাশায়ী। মহিতোষ মাস্টারও সেই অর্থে সচল সজ্ঞান নন। ফলে মইনুল নিজে নিজেই একটু-আধটু চেষ্টা করেছিল পারুর খোঁজ খবর নেয়ার। কিন্তু তাতে লাভ বিশেষ হয়নি। কারণ এর মধ্যেই মেলার ঘটনা জটিল আকার ধারণ করেছে। বিভুরঞ্জন রায় আগুনে পুড়ে মারা গেছেন। তবে পুলিশের ধারণা তাকে খুন করা হয়েছে। একটি সংঘবদ্ধ চক্র মেলার মাঠে আগুন লাগিয়েছে। তারাই খুন করেছে বিভুরঞ্জন রায়কে। খুন করে তার লাশ পুড়িয়ে দিয়েছে মেলার আগুনে। যাতে লোকে কিছু সন্দেহ করতে না পারে। কিন্তু আগুন লাগানোর ঘটনায় একজন প্রত্যক্ষদর্শীকে আটক করেছে পুলিশ। তার কাছ থেকে তথ্য আদায়ের চেষ্টা করা হচ্ছে। তদন্ত শুরু হচ্ছে পুরোদমে। আর এসব কারণেই। মেলার ঘটনাটি আর সাধারণ দুর্ঘটনায় আটকে নেই। তদন্তের স্বার্থে ঘটনাস্থলে সর্বসাধারণের প্রবেশও নিষিদ্ধ করেছে পুলিশ। কারো স্বজন নিখোঁজ হলে তার সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য-পরিচয় সরবরাহ করতে হবে পুলিশকে। তারপর যা করার করবে তারাই। সমস্যা হচ্ছে, পারু সম্পর্কে কী তথ্য দেবে মইনুল? সেতো তার আত্মীয় কিংবা পরিচিতজনও নয়। ফলে পুলিশের জিজ্ঞাসার জবাবে সে তেমন কোনো তথ্যই দিতে পারল না।

তবে ফরিদের ফিরে আসার সেই সন্ধ্যার অন্য একটি ঘটনা নিয়েও দুশ্চিন্তায় মইনুল। ফরিদ যখন বিধ্বস্ত অবস্থায় তার বাড়ির গেটের কাছে এসে পৌঁছাল, ঠিক তখন সেখানে যেন অন্য কারো উপস্থিতিও টের পাচ্ছিল সে। মনে হচ্ছিল, দেয়ালের আড়ালের অন্ধকার জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে যেন কেউ কথা বলছে। নড়াচড়া করছে একাধিক লোক। চকিতে একটা কু ডাক ডেকে গেল মইনুলের মনে, আজিজ মিয়া নয় তো? সে তো ছায়ার মতোই সবসময় অনুসরণ করে যাচ্ছে ফরিদ আর পারুকে। কেবল পুলিশের ভয়েই নিজে সরাসরি কিছু করতে পারছে না। তবে কি ওই রাতের অন্ধকারে সেও এসেছে? কথাটা ভাবতেই একটা গা শিরশিরে অনুভূতি টের পেল মইনুল। কিন্তু মহিতোষ, পারু আর ফরিদের চিন্তায় তখন অন্য কিছু করার কথাও মাথায় আসছিল না তার। বরং রাজ্যের উল্কণ্ঠা নিয়েই মনে মনে অপেক্ষা করছিল। নিজের আশু কর্তব্য নিয়ে ভাবছিল। শেষমেশ ফরিদদের পাশের ঘরের লোকটাকে ডাকল সে। যদ্রুত সম্ভব ফরিদকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। একটা স্কুটার বা রিকশা খুব জরুরি দরকার। লোকটাকে সেখানে দাঁড় করিয়ে রেখে ছুটে বাইরে বেরিয়ে এলো মইনুল। আর ঠিক তখুনি গেটের আড়ালে আজিজ মিয়াকে দেখতে পেল সে। অন্ধকার থেকে হেলেদুলে বের হয়ে আসছে। লোকটা। তার এতদিনকার চেনা, প্রিয় মানুষ সেই আজিজ মিয়া! তার মুখে কূঢ় রহস্যময় হাসি। মইনুল কী করবে বুঝতে পারছিল না। তাকে অবশ্য বুঝতেও হলো না। তার আগেই সাইরেন বাজিয়ে ছুটে এলো একটা পুলিশের গাড়ি। তারা হন্যে হয়ে খুঁজছিল আজিজ মিয়াকে। সম্ভবত তার পেছনে কোনো ইনফর্মারও লাগানো ছিল। নাহলে ঠিক ওই মুহূর্তেই ওভাবে পুলিশের গাড়িটা ওখানে আসার কথা না। হলদে ল্যাম্পপোস্টের ম্লান আলো হঠাৎ ঝলসে দিল গাড়ির হেডলাইট। তীব্র শব্দে সাইরেন বেজে উঠল। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেল আজিজ মিয়া। তবে এসব পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত সে। ফলে দ্রুতই সে তার হতবুদ্ধি ভাবটা কাটিয়ে উঠল। তারপর দুলাভাই জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে রেখেই চট করে পাশের দেয়াল টপকে অন্ধকার এক গলিতে হারিয়ে গেল। পুলিশ অবশ্য হাল ছাড়ল না। তারাও ছুটল পিছু পিছু। এরপরের খবর মইনুল জানে না।

তবে আজকের পত্রিকা দেখে আজিজ মিয়ার ব্যাপারে কিছু সংবাদ পেল সে। কামাল ওরফে আজিজ মিয়া এখনো ধরা না পড়লেও শিগগিরই ধরা পড়বে বলে পুলিশ আশ্বস্ত করেছে। সে এখন আত্মগোপনে আছে গাজীপুরের গভীর জঙ্গলে। গতরাতে তাকে ধরার খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু একটুর জন্য তাকে ধরা সম্ভব হয়নি। তবে পুলিশের গুলিতে মারাত্মক আহত হয়েছে সে। পুলিশ আশা করছে আহত আজিজ মিয়াকে দু-একদিনের মধ্যেই গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে। এই খবর শুনে বেশ স্বস্তি লাগছে মইনুলের। বহুবিধ যন্ত্রণার মধ্যে অন্তত এই একটি যন্ত্রণা থেকে তো মুক্তি মিলছে তাদের। কিন্তু পারুর কী হবে? কোথায় আছে সে?

.

মানসিকভাবে না হলেও শারীরিকভাবে মোটামুটি সুস্থই হয়ে উঠল ফরিদ। কিন্তু মহিতোষ মাস্টার আর সেভাবে সুস্থ হয়ে উঠলেন না। তিনি তখন অনেকটাই চলৎশক্তিহীন। একা একা বিছানা থেকে উঠতে পারেন না। সারাক্ষণ শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকেন। কারো সঙ্গে কথা বলেন না। কোনো প্রশ্নের উত্তর দেন না। যেন বধির, নির্বাক এক মানুষ। ফরিদও চুপচাপ হয়ে গেছে। সে রোজ ভোরবেলা বালুর মাঠের পাশে গিয়ে বসে থাকে। আশপাশে ঘুরঘুর করে। পুলিশের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে। এর-ওর কাছ থেকে এটা-সেটা জানার চেষ্টা করে। যদি পারু সম্পর্কে কোনো খবর পাওয়া যায়। যদি সামান্যও আশার আলো দেখা যায়। কিন্তু পারুর খবর মেলে না। ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করে। পুলিশ বালুর মাঠের বাধ্যবাধকতা তুলে নেয়। ফরিদ গিয়ে সেই একাকী নিঃসঙ্গ বটগাছটার নিচে একা একা বসে থাকে। তার কেবল মনে হতে থাকে, কোনো একদিন পারু এখানে ফিরে আসবে। এই এখানে। সেইদিন সে মহিতোষ মাস্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। পারুকে ছাড়া তার সামনে গিয়ে সে দাঁড়াতে পারবে না। কখনোই না। এই জীবনে এতবড় সাহস তার নেই। ওই মানুষটার জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছে সে। তার চেয়ে বড় অপরাধী আর এ জগতে নেই। সে কী করে ওই মানুষটার মুখোমুখি দাঁড়াবে?

কিন্তু মাস গেলেও পারুর কোনো খোঁজ মিলল না। এমনকি তার লাশেরও না। তাহলে কি নদীতে ভেসে গেছে পারু? জীবিত কিংবা মৃত? তারপর ডুবে গেছে অতল জলের তলে? পচে গলে মিশে গেছে? কিংবা মাছের খাবার হয়েছে? এই অবধি ভেবেই আর কুলকিনারা পায় না ফরিদ। এমন কিছু কখনোই হতে পারে। তার বিশ্বাস পারু একদিন ফিরে আসবে। আসবেই। কিন্তু পারু আর আসে। ফরিদের দিন-রাত্রি সব একাকার হয়ে যায়। সে বেচে থাকে মৃতপ্রায় এক মানুষের মতো। আর মহিতোষ? মহিতোষের কথা কেউ জানে না। কারণ তিনি কাউকে কিছু বলেন না। যেন নির্জীব, নিষ্প্রাণ এক মানুষ।

ফরিদ একদিন তার সকল সাহস সঞ্চয় করে মহিতোষের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর আলগোছে তার হাতখানা ধরে বলে, স্যার।

মহিতোষ জবাব দেন না। যেমন শুয়ে ছিলেন, তেমনই শুয়ে থাকেন। ফরিদ আবার ডাকে, স্যার, আমি ফরিদ।

মহিতোষ এবারও জবাব দেন না। তবে চোখ তুলে তাকান। ফরিদ বলে, ‘পারু বেঁচে আছে স্যার। পারু বেঁচে আছে…।’

মহিতোষ কথা বলেন না। যেন পারু বিষয়ক কোনো কিছুতেই তার আর কোনো আগ্রহ নেই। আস্থা, বিশ্বাস নেই। যেন তিনি জানেন, এ জীবনে আর কখনোই তিনি পারুর দেখা পাবেন না। দেখা পাবেন না তার স্ত্রী, আরেক কন্যা চারু কিংবা মায়েরও। তিনি এই জগতে যেমন একা এসেছিলেন, তেমন একা চলে যাওয়াই তার নিয়তি। ফরিদ বলে, আমি জানি পারু বেঁচে আছে। তাকে আমি খুঁজে বের করবই স্যার। এই যে, আমি আপনার হাত ছুঁয়ে কথা দিচ্ছি। তাকে আমি খুঁজে বের করবই।

মহিতোষ ফরিদের চোখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকেন। তার হাতখানা। নিথর। তবে চোখে কেমন উদ্ৰান্ত দৃষ্টি। মাঝে মাঝে ঠোঁটজোড়া কেঁপে ওঠে তার। যেন কিছু বলতে চেয়েও পারছেন না। ফরিদ বলে, আমি আপনার পারুকে আপনার কাছে ফিরাই এনে দেব স্যার। যেভাবেই পারি, আমি তারে আপনার। কাছে এনে দেবই। স্যার… স্যার…।

হঠাৎ মহিতোষের নিষ্পলক, স্থির চোখের কোল গড়িয়ে এক ফোঁটা জল তার গাল বেয়ে নেমে আসতে থাকে। ফরিদ সেই জলের ফোঁটাটুকু মোছে না। বরং হাউমাউ করে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতেই বলে, আমি জানি… আমি জানি এই সব কিছুর জন্য আমি দায়ী স্যার। শুধু আমি। আমার জন্যই এই সব কিছু হয়েছে। আমি যদি পারুকে…।

ফরিদ তার কথা আর শেষ করতে পারে না। তার গলা বুজে আসে কান্নায়। তবে সেই বুজে আসা কান্নাক্লান্ত কণ্ঠেই সে বলে, আমি না থাকলে এতকিছু হতো না স্যার। আপনাকেও এমন কষ্ট পেতে হতো না। পারুও হারাই যেত না… স্যার…।’

মহিতোষের পলকহীন চোখের কোলে ক্রমশই জমে উঠতে থাকে টলমল অশ্রুর ফোঁটা। সেই অশ্রুর ফোঁটাটাকে তিনি যেন ঝরে যেতে দিতে চান না। রেখে। দিতে চান চোখের কোলেই। সেখানেই শুকিয়ে ফেলতে চান। কিন্তু অশ্রু কি আর মানুষের কথা শোনে? কান্না কি শোনে ইচ্ছের বারণ?

সে টুপটাপ ঝরে পড়তে থাকে বিষাদ ও বিলাপের বৃক্ষে ফোঁটা মৃতপ্রায় পুষ্পের বিবর্ণ পাপড়ির মতো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *