০১. ধর্ম ও ধর্মহীনতা

সেকুলার ভারতে ধর্ম ও রাজনীতি –শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়
প্রথম প্রকাশ : ৬ই ফেব্রুয়ারি ২০০৩
অগ্রজদের স্মরণে

.

লেখকের নিবেদন

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপক অনিলবরণ রায়ের তত্ত্বাবধানে ইউ.জি.সি. গবেষক হিসেবে ‘Religion and Politics in Bengal : Continuity and Change’ শীর্ষক গবেষণা সম্পাদন করার সময় (১৯৮০-১৯৮৪) ধর্ম ও রাজনীতি বিষয়ে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে কয়েকটি প্রবন্ধ লিখি। পরবর্তীকালে আরও কয়েকটি রচনা মুদ্রিত রূপ পাবার পর অনুজপ্রতিম সুহৃদ গৌতম চৌধুরির উদ্যোগে এগুলির এক সঙ্কলন ‘সেকুলার ভারতে ধর্ম ও রাজনীতি’ প্রকাশ পেতে চলেছে।

আমাদের প্রতিপাদ্য, ভারতের ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ নীতি বহাল থাকার জন্যই বিবিধ সাম্প্রদায়িক অশান্তি ঘটে চলেছে, যার বীভৎসতম রূপ ২০০২ সালের ‘গুজরাট’! এই নীতি–সমাজ ও রাজনীতি সেকুলারাইজ করতে অক্ষম। ‘সেকুলার’ শব্দের প্রকৃত অর্থ ধর্মহীন। ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা হোলো ব্রিটিশ-আমলের ‘রিলিজিয়াস নিউট্রালিটি’। স্বাধীন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতাকে এক সমাজবিজ্ঞানী মালটি রিলিজিয়াস কালচারাল পলিসি বলে অভিহিত করেছেন। পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণণ একে ‘রিলিজিয়াস ইম্পারাশিয়ালিটি’ বলেছেন। বিভিন্ন রচনায় এই কনসেপ্ট-টি এসেছে বলে আমরা প্রথম রচনায় ‘ধর্মহীনতা’কে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস পেয়েছি। পরবর্তীতে কালানুক্রম অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি। পাঠকের সামানা মনোযোগে উৎসাহ পাওয়া যাবে ভবিষ্যতের রচনার প্রস্তুতিতে। এই বইয়ের অন্তর্ভুক্ত রচনাগুলি পূর্ব-প্রকাশিত হলেও পরিমার্জন করা হয়েছে।

শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও এই বইয়ের প্রাক্কথন লিখে দিয়েছেন অধ্যাপক স্বপনকুমার ভট্টাচার্য মহাশয়। প্রথাগতভাবে তাকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি না।

পরিশেষে একটি কথা, প্রচ্ছদের আলোকচিত্রটি ‘The Week’ (২৪.৩.২০০২) পত্রিকা থেকে নেওয়া হয়েছে; তাদের কাছেও আমরা কৃতজ্ঞ।

আজ বিশেষ করে মনে হচ্ছে মা-বাবার কথা; যাদের কাছে সমাজেতিহাসের পাঠ শুরু হয়েছিল। সত্যকে সত্য বলার শিক্ষণ যারা দিয়েছিলেন।

শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়
৬.২.২০০৩
কোলকাতা-৭০০ ০৫০

.

সূচিপত্র

  • ১ ধর্ম ও ধর্মহীনতা
  • ২ যুক্তবেণীর গঙ্গা যেথায়
  • ৩ উনিশ শতকের বাঙলায় হিন্দু জাতীয়তা
  • ৪ সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা : ‘আনন্দমঠ’ বিতর্ক
  • ৫ জাতীয়তা ও জাতীয় সঙ্গীত
  • ৬ বিবেকানন্দের রাজনীতি
  • ৭ ভাষা নিয়ে রাজনীতি : সেকালে ও একালে
  • ৮ ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ও ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি
  • ৯ শ্মশ্রু–শিখা ও নারী
  • ১০ জাতিভেদপ্রথা ও অস্পৃশ্যতা : মহাত্মা গান্ধীর ভূমিকা
  • ১১ রবীন্দ্র দৃষ্টিতে হিন্দু জাতিভেদপ্রথা
  • ১২ গণতান্ত্রিক সমাজবাদ ও রাজনৈতিক ধর্ম
  • ১৩ ধর্মান্ধতা ও নির্বাচনী রাজনীতি
  • ১৪ ‘সেকুলার’ ভারতে রাজনৈতিক হিন্দুত্ব
  • ১৫ ‘সেকুলারিজম’ ও মুসলমান সাম্প্রদায়িকতা

.

০১. ধর্ম ও ধর্মহীনতা

অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মশাইকে সাম্প্রদায়িক বলার মতো লোক দেশে বোধহয় বেশি পাওয়া যাবে না। অথচ তার বিখ্যাত পুস্তক ‘তরী হতে তীর’-এ তিনি লিখেছেন, “বড়লাট কর্জন-এর মতো যাদের খ্যাতি ছিল কলকাতাপ্রেমী ব’লে তাদের ভালোবাসা ‘মুসলমানের মুরগী পোষার’ বেশি কিছু ছিল না কোনো কালে।”

সামাজিক ও লৌকিক কারণে প্রবাদ প্রবচনের উৎপত্তি। উচ্চবর্ণ হিন্দুবাবুর দৃষ্টিতে মুরগী পোষা অবশ্যই খারাপ কাজ, এক ধরনের নীচ বৃত্তি। মার্ক্সবিরোধী সমাজবিজ্ঞানী ডুর্খাইম হিন্দু বামুনের ঘরে জন্মালে অবশ্যই একে বলতেন ‘প্রফেন’ বা অপবিত্র, ধর্ম বহির্ভুত ব্যাপার। বর্ণহিন্দুরা মনে করেন ‘নেড়েরা’ মুরগী পোষে কেটে-কুটে খাওয়ার জন্য; এ কাজ শিষ্টাচারী হিন্দুবাবুদের যোগ্য কাজ নয়। এ মনোভাব থেকেই আমরা সচেতন বা অচেতনভাবে বলি ‘মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত’ অথবা ‘পড়েছি মোগলের হাতে’ ইত্যাদি।

এক সম্প্রদায়কে যখন অপর এক সম্প্রদায় অবজ্ঞা যা তাচ্ছিল্য করে তখনই এ ধরনের প্রবাদ প্রবচনের উৎপত্তি হয় এবং ক্রমশ তা বাক্যশৈলী বা রচনাশৈলীতে স্থান দখল করে নেয়। অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়ের মতো জ্ঞানী ব্যক্তিরাও তখন সামাজিক স্বভাবের বশবর্তী হয়েই এ ধরনের বাক্য ব্যবহার করেন অসচেতনভাবেই, যার অন্তত এ ব্যাপারে মুক্ত দৃষ্টি সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন ওঠে না।

মন্ত্রী, নেতা, সরকারি ব্যক্তিরা এবং বহু সাধারণ মানুষও মনে করেন সাম্প্রদায়িকতার অর্থ খুন-জখম, নারীত্বের অসম্মান, লুণ্ঠন, গৃহদাহ ইত্যাদি অপকর্ম। কিন্তু মানুষকে মানুষের পূর্ণ সম্মান জানাবার অক্ষমতাও তো সাম্প্রদায়িকতা, “মানুষের পরশেরে প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে” যে জীবন যাপন তার মতাদর্শকে আমরা সাম্প্রদায়িকতাই বলব, হোক না তা নিষ্ক্রিয়। বর্ণহিন্দু সম্প্রদায় এ মনোভাব লালন করেছে যুগ যুগ ধরে যা মনুষ্যত্বকে বহুভাবে লাঞ্ছিত করেছে, অপমানিত করেছে। ধার্মিক বর্ণহিন্দু নিষ্ঠাভরে ‘ধর্মতন্ত্র’ পালন করে এসেছেন যুগ যুগ ধরে; এই ধর্মতন্ত্র বলে–“মানুষকে নির্দয়ভাবে অশ্রদ্ধা করিবার বিস্তারিত নিয়মাবলী যদি নিখুঁত করিয়া না মানো তবে ধর্ম ভ্রষ্ট হইবে।”

ইংরেজ রাজছত্রের ‘নিরাপদ আশ্রয়ে’ স্থান লাভ করার পর বর্ণহিন্দুবাবুরা প্রধানত রামমোহনের ইতিহাসচর্চার ফলে মুসলমানের প্রতি অতিমাত্রায় বিদ্বেষী হয়ে ওঠেন। ব্রিটিশ-পূর্ব যুগে অভিজাত হিন্দু মুসলমানে বিবিধ পার্থক্য ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈষম্য থাকলেও তা উনিশ-বিশ শতকের রাজনৈতিক হিন্দুত্ব আর রাজনৈতিক ইসলামের মতো কদর্য রূপ ধারণ করেনি, ‘দ্বি-জাতি তত্ত্ব’ উদ্ভবের কারণগুলিও ব্রিটিশ-পূর্ব বাঙলা বা ভারতে অনুপস্থিত ছিল।

প্রধানত ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ (১৭৯৩) উদ্ভুত বঙ্গসমাজে বর্ণহিন্দুর উচ্চমন্যতা আর অর্থলোভ, মুসলমানের রাজ্য হারানোর নিষ্ফলা ক্ষোভ, ইংরেজ বিদ্বেষ, হীনমন্যতা এবং ব্রিটিশের ইন্ধনের ফলে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ১৮৪৮ সালে লর্ড এলেনবোরো বাহাদুর বলেন, “আমি এই জাতি [race] (মুসলমান)-র [শত্রুতা] উপেক্ষা করতে পারি না; এরা আমাদের জাত-শত্রু! এ কারণে আমাদের উচিত হিন্দুদের দলে টানা।”(১) ব্রিটিশের এই কৌশলের ফলেই হিন্দু-মুসলমানে পারস্পরিক বিদ্বেষের জন্ম হয়, বিস্তৃত হতে শুরু করে “ঐ জাজিমতোলা আসনের বহুদিনের মস্ত ফাঁক”! পরবর্তীকালে হিন্দুবাবুরা বুঝতে পারেননি ঐ ফাঁকটা “ছোট নয়, ওখানে অকূল অতল কালাপানি, বক্তৃতা মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে ডাক দিলেই তা পার হওয়া যায় না।” ‘কালাপানি’ পার হওয়া যায়নি, ইতিহাস কলঙ্কিত, দেশ ভাগ হয়েছে।

আজ বিভিন্ন বর্ণের নেতারা বক্তৃতা মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে ডাক দেন–“এক জাতি, এক প্রাণ, একতা”–কিন্তু একতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি, আজও বহু মানুষ রবীন্দ্রনাথ কথিত সেই স্বদেশী প্রচারকের ভাবনায় ভাবিত! স্বদেশী বাণীর প্রচারক এক গ্লাশ জল খাবার সময় তাঁর মুসলমান সহযোগীকে দাওয়া থেকে নেমে যেতে বলতে কিছুমাত্র সঙ্কোচ বোধ করেননি। এ তো প্রচারকের ধর্মবিধি! আজকের ভারতেও এই ধর্মবিধি পালন অসাংবিধানিক নয়।

আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগে বহুবিজ্ঞাপিত বঙ্গীয় বেনেশাসেব প্রথম পুরুষ রামমোহন রায় ব্রাহ্মনত্বের অহমিকা ত্যাগ করতে পারেননি। ভারতবর্ষের সফলতম ক্যারিজমাটিক রাজনৈতিক নেতা মহাত্মা গান্ধী মুসলমান বা খৃষ্টানের গৃহে ফল ছাড়া কিছু খেতেন না।(২) “শাস্ত্রে হিন্দু-মুসলমান সম্বন্ধে পরস্পরকে এমন করিয়া ঘৃণা করিবার তো কোনো বিধান দেখি না। যদি-বা শাস্ত্রের সেই বিধানই হয় তবে সে শাস্ত্র লইয়া স্বদেশ-স্বজাতি স্বরাজের প্রতিষ্ঠা কোনো দিন হইবে না। মানুষকে ঘৃণা করা যে দেশের ধর্মের নিয়ম, প্রতিবেশীর হাতে জল খাইলে যাহাদের পরকাল নষ্ট হয়, পরকে অপমান করিয়া যাহাদিগকে জাতি রক্ষা করিতে হইবে, পরের হাতে চিরদিন অপমানিত না হইয়া তাহাদের গতি নাই।” স্বরাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, স্বদেশ নিয়েও কম কাণ্ডকারখানা চলছে না, নেতারাও ঢাক পেটাচ্ছেন আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে, কিন্তু স্বজাতির অভিষেক আজও হয়নি, অকূল অতল কালাপানি আজও যোজন বিস্তৃত।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মারফৎ স্বাধীনতা প্রাপ্তি ঘটলেও এই হতভাগ্য দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ও ‘সেকুলারিজম’-এর পক্ষে কোনো আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। দাঙ্গাবিধ্বস্ত খণ্ডিত ভারতে ‘সেকুলারিজম’-এর কথা বারবার উচ্চারিত হলেও ক্ষমতালোভী রাষ্ট্রনায়করা সেকুলারিজম-এর প্রকৃত অর্থ গোপন করে যাবতীয় ধর্মান্ধতা আর কুসংস্কারে উৎসাহ-দান করার ব্রিটিশ-কৌশলকেই বরণ করে নেন। স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ইতিহাসের ছাত্র ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ ভারতের সেকুলারিজম সম্পর্কে বলেন, “যেহেতু আমরা এক সেকুলার রাষ্ট্র গড়েছি, এ কারণে অনেকে মনে করেন যে আমরা ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী নই। [আমাদের সেকুলারিজম-এর প্রকৃত অর্থ] আদৌ তা নয়; আমরা আমাদের দেশে প্রত্যেকে নিজ পছন্দমতো মত ও পথ পালন ও প্রচার করার পূর্ণ অধিকার ভোগ করি ও প্রতিটি ধর্মের মঙ্গল চাই এবং তাদের বাধাহীন বিকাশ চাই।”

আর নেহরু বলেন, “সেকুলার রাষ্ট্র মানে এমন কোনো রাষ্ট্র নয় যেখানে মানুষে ধর্ম পরিত্যাগ কবে, সেকুলার রাষ্ট্র মানে এমন এক রাষ্ট্র যেখানে রাষ্ট্র সমস্ত ধর্মকে রক্ষা করে, কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট এক ধর্মের মূল্যে অন্য কোনো ধর্মের পক্ষাবলম্বন করে না বা কোনো ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে না।”

আরও পরবর্তীকালে ভারতের সংবিধানে ‘সেকুলার’ শব্দটি সংযোজিত হয় রুদ্রাক্ষের কণ্ঠহারে সজ্জিত ইন্দিরা গান্ধীর কল্যাণে! অথচ তিনিও সেকুলার শব্দের প্রকৃত অর্থ গোপন করেন। একে রাজনৈতিক অসাধুতা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।

আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইতিহাস বা সমাজবিজ্ঞান লিখিত হয় রাজনৈতিক নির্দেশে বা প্রাপ্তির আশায়। তাই অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীই সেকুলারিজম-এর ভারতীয় ভাষ্য বা ধর্মনিরপেক্ষতা লাভ করেই সন্তুষ্ট, কখনো-বা প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এঁরা ভারতরাষ্ট্রের ধর্ম বিষয়ক উদারতায় মুগ্ধ।

রাষ্ট্র–সেকুলার, রাজনীতি–সেকুলারিজম-এর অনুবর্তী, অথচ তুচ্ছ কারণেই নিষ্ক্রিয় সাম্প্রদায়িকতা সক্রিয় হয়ে ওঠে। দেশভাগের এতদিন পরেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে, শিশু পিতৃহারা হয়, মা হন পুত্রহারা। চোখের জল আর হৃৎপিণ্ডের রক্ত ধর্ম বোঝে না, ‘জাত’ বোঝে না, অথচ কত সহজেই দাঙ্গার তালিকায় সংযযাজিত হয় নতুন নতুন তথ্য।

১৯৬৯ সালের শীতে কোলকাতার এক জনসভায় ‘সীমান্ত গান্ধী’ আব্দুল গফফর খান বলেন, “ভারত ও পাকিস্তানে ধনীবাই দাঙ্গা লাগিয়ে দেয়, আর এই দাঙ্গায় কখনোই ধনীদের মৃত্যু হয় না।”(৩) সরল সত্য! এদেশে ধনপতি কুবের আর তার রক্ষাকর্তারা জানেন কী করে প্লীহা-সম্বল মুসলমান কৃষক–আর কীটদষ্ট শ্বাসযন্ত্র-সম্পন্ন হিন্দু-মজুরের মধ্যে দাঙ্গা লাগিয়ে দেওয়া যায়।(৪) দ্বি-জাতি তত্ত্ব এখন সংবিধান আর রেডিও-টেলিভিশনে স্থান পেয়েছে; স্থান পেয়েছে নির্বাচনী ইস্তাহার আর ব্যালট বাক্সে। এ সবই ঘটে বিভিন্ন গোত্রের রাজনৈতিক দল ও নেতৃবর্গ, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মগুরুর দল আর সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী-পণ্ডিতদের সম্মিলিত কণ্ঠে আবৃত্ত ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মনিবপেক্ষতা নামক সুবিধাবাদী শব্দযুগলের ছত্রছায়ায়। দাঙ্গা হয়, নিহত হয় মানুষ, প্রাণের মূল্য’ চুকিয়ে দেওয়া হয় নিষ্প্রাণ মুদ্রার মূল্যে! প্রবল প্রতাপে বিরাজ করেন ‘সর্বত্যাগী ধর্মগুরুর দল; লজ্জাহীন, লোভী রাজনৈতিক নেতা; প্রশাসন আশ্রয় দেয় হত্যাকারীকে; ‘সেকুলার’ দেশ এগিয়ে চলে’ ধর্মের পথে, ভক্তির পথে, গভীর থেকে গহন অন্ধকারে।

স্বাধীন ভারতে সম্প্রদায়িক অশান্তির কারণ দর্শাতে গিয়ে কথা প্রসঙ্গে আবু সৈয়দ আয়ুব বলেছেন, “আমাদের সংবিধান উদার, সহিষ্ণু এবং নিরপেক্ষ…” ইত্যাদি! আমাদের মনে হয় কোনো সাম্প্রদায়িক সমাজে ‘উদার’, ‘নিরপেক্ষ’ সংবিধান নিস্ফলা হতে বাধ্য। এর কারণ ভারতের সমাজ ও রাজনীতি বহুলাংশেই ধর্মান্ধতার প্রভাবে প্রভাবিত। সমাজ ও রাজনীতিকে ‘সেকুলারাইজ’ করার কোনো প্রচেষ্টাই স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রনায়করা নেননি বরং এর ভ্রান্ত ব্যাখ্যা প্রচার করে জনসাধারণকে সচেতন না করে, আলোকিত না করে মধ্যযুগীয় কুসংস্কার আর অন্ধতাকে ‘জাতীয় সংস্কৃতি’ রূপে বরণ করে নিয়েছেন। এর ফলে পৃথক নির্বাচনী রাজনীতির বিলুপ্তি ঘটলেও ভারতের গণতান্ত্রিক প্রবাহে ধর্মীয় ‘সংখ্যাগুরু’ ও ‘সংখ্যালঘু’ বিভাজন আজও দৃষ্ট হয়। ভারতের রাজনৈতিক-সংস্কৃতি ধর্মাশ্রয়ী হওয়ার জন্য কেবলমাত্র সাম্প্রদায়িক চিন্তাই নয়–জাতপাত শুরুবাদ ইত্যাদির প্রকাশ্য-প্রভাব তথাকথিত সেকুলার নেতাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যকলাপে দেখা যায়।

কোনো কোনো সমাজবিজ্ঞানী ভারতরাষ্ট্রকে “Non-interventionist” সেকুলার রাষ্ট্র বলেছেন। অর্থাৎ ভারতরাষ্ট্র বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় সম্পর্কে নিরপেক্ষ, তাদের ধর্ম পালনের ব্যাপারে উদার এবং জনসাধারণের ধর্মীয় বিশ্বাস সংক্রান্ত কোনো (যতক্ষণ না তা আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গ করছে বা নৈতিকতা ক্ষুণ্ণ করছে) ব্যাপারেই হস্তক্ষেপ করে না বা নাক গলায় না। এই কারণে, সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলি প্রকাশ্যেই তাদের কার্যকলাপ চালিয়ে যায়। একদা জহরলাল নেহরু “organised religion” বা সংগঠিত ধর্মগুলিকে প্রতিক্রিয়াশীল বলেন। হিন্দুধর্মে কোনো ‘চার্চ’ না থাকলেও হিন্দু সমাজটাই ‘থিওক্র্যাটিক’ সমাজ অর্থাৎ ধর্মাশ্রয়ী সমাজ; শত সহস্র বছর ধরে জাতিভেদপ্রথার অচলায়তন হিন্দুর বুকের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে আছে। খৃষ্টান বা মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্মবোধ আজও বহুলাংশেই প্রাতিষ্ঠানিক ও সংগঠিত বা ‘অর্গানাইজড’; সুতরাং প্রগতি-বিরোধী। এই পশ্চাৎমুখী সমাজ-প্রবণতার বিপরীতে ধর্মের প্রভাব হ্রাস পাওয়ার প্রক্রিয়াকে ‘সেকুলারাইজেশন’ বলা যায়। সেকুলারাইজেশনের ফলে ব্যক্তিমানুষ জীবিকা, রাজনীতি, বিবাহ, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি সামাজিক ক্রিয়াকলাপে সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তিসিদ্ধ পথে, ধী-র পথে, প্রজ্ঞার পথে–ধর্মীয় অনুভূতি বা অন্ধবিশ্বাস তথা লোকাঁচারের ক্রীড়নক হয়ে নয়।(৫)

আমরা আগেই বলেছি, আমাদের দেশে সেকুলার শব্দের অর্থ করা হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ, ধর্মনিরপেক্ষতা। আমাদের ধারণা–‘সেকুলারিজম’-এর অর্থ বাঙলা শব্দ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’য় সঠিকভাবে পরিস্ফুট হয় না। ওপার বাংলার লেখক সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন ‘সেকুলার শব্দের অর্থ করেছেন ‘ইহজাগতিক’। রশীদ আল ফারুকী ‘সেকুলার’ শব্দের বাঙলা অর্থ হিসেবে ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’ শব্দযুগল ব্যবহার করেছেন। বদরুদ্দীন উমর ‘সেকুলারিজম’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা না করলেও অতি সংক্ষেপে এর তাৎপর্য আংশিকভাবে বিবৃত করেছেন, “একটি সমাজে সেকুলারিজম বলতে যেটা বোঝায় তাকে ধর্মনিরপেক্ষতাই বলুন বাঙলায় বা অন্যকিছু বলুন, সেকুলারিজম একটা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না, একটা রাষ্ট্র ধর্ম থেকে বিযুক্ত হতে পারে না, যদি সেই সমাজে যাকে বলা হয় একটা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব না হয়।” একথা বললেও উমর সাহেব একই আলোচনার অন্যত্র ‘সেকুলারিজম’ এর বাংলা অর্থ হিসেবে ‘ইহজাগতিকতা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।

আনন্দবাজার পত্রিকার লেখক গৌতম রায় লিখেছেন, “ভারত যেহেতু একটি গণতন্ত্রী রাষ্ট্র তাই এখানে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীও নিজের ভাবধারার প্রচারের এবং সংগঠন গড়ার সুযোগ পায়।” অর্থাৎ রায় মশাইয়ের দৃষ্টিতেও ‘সেকুলারিজম’ আর ধর্মনিরপেক্ষতা সমার্থক। তিনি লিখেছেন, “ভারত রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতায় প্রতিশ্রুত রাষ্ট্র….,”(৬) কিন্তু এদেশে ধর্মনিরপেক্ষতাকে মান্য করা হয় না, এবং এই প্রবণতার সূচনা ইন্দিরাজীর আমল থেকে। নেহরু-ভক্ত গৌতম রায়ের এই কথা গ্রাহ্য হলে বলতে হয়, নেহরুর বন্ধুবান্ধব যেমন বল্লভভাই প্যাটেল, রাজেন্দ্রপ্রসাদ, চক্রবর্তী রাজাগোপাল প্রমুখ ছিলেন খাঁটি সেকুলার এবং এদের আমলে ভারতবর্ষে সেকুলারিজম–এর আদর্শ মান্য করা হতো। অথচ ইতিহাস কিন্তু একথা বলে না। আমরা বিশেষ জোর দিয়েই বলতে পারি–দেশবিভাগ-উত্তরকালে একমাত্র নেহরু ছাড়া আর কোনো নেতা প্রকৃত অর্থে সেকুলার ছিলেন না। ব্যক্তিগত জীবনে নেহরু অজ্ঞেয়বাদী তথা সেকুলার ছিলেন; কিন্তু অন্য জ্যোতিষ্করা প্রায় সকলেই ছিলেন ধর্মান্ধ, কূপমণ্ডুক এবং সাম্প্রদায়িক। এ কারণে কংগ্রেসের অনেক নেতা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য মুসলমানদের দায়ী করেন এবং মুসলমানদের এই ব’লে উপদেশ দেন যে, তাদের উচিৎ পাকিস্তানে গিয়ে বসবাস করা।(৭)

আনন্দবাজারের অপর এক লেখক এ. কে. রায় কিন্তু লিখেছেন ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ “শত ধর্ম প্রস্ফুটিত হোক” নয়, অথবা “বহু ধর্মীয় রাষ্ট্রও নয়…”(৮) ভারতবর্ষের প্রচারিত ও প্রচলিত ধর্মনিরপেক্ষতা আর যা-ই হোক, তা যে সেকুলারিজম নয়, একথা এ. কে. রায়ের রচনায় প্রকাশ পেলেও–বিস্তৃত আলোচনার মধ্যে তিনি যাননি। তাঁর রচনায় কিছু ইতিবাচক ইঙ্গিত থাকলেও আলোচনা গভীরতা লাভ করেনি।

হিন্দু সাম্প্রদায়িকরা ভারতরাষ্ট্রকে সেকুলার রাষ্ট্র মনে করেন না। তারা ভারতের ‘সেকুলারিজম’কে ‘সিউডো সেকুলারিজম’ বা ‘মেকি ধর্মনিরপেক্ষতা’ বলেন এবং সমস্ত লাজলজ্জা বিসর্জন দিয়ে হিটলারী কায়দায় দীর্ঘদিন ধরে গণহত্যা চালিয়ে নির্বোধ দম্ভে ঘোষণা করেন, “রাশিয়া যেমন কমিউনিজমের, আমেরিকা যেমন ধনতন্ত্রের, তেমনই ভারত হোলো হিন্দু সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চিন্তাধারার গবেষণাগার।”(৯) আর ‘রিলিজিয়াস ইমপারশিয়ালিটি’ তথা ‘মালটি রিলিজিয়াস কালচারাল পলিসি’কে সরাসরি অগ্রাহ্য করে আস্ফালন করেন, “মুসলিমদের নিরাপত্তা হিন্দুদের সদিচ্ছার উপর নির্ভরশীল।”(১০) অথবা “মুসলিমদের উচিৎ ইসলামকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করা।”(১১)–সত্যিই এরা ‘বর্বর’।

মুসলমান সাম্প্রদায়িকরা সেকুলার রাজনীতি অথবা সেকুলারিজম-এর মতাদর্শকে সম্পূর্ণ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তীব্রভাবে আক্রমণ করে থাকেন। লক্ষ করার বিষয় হলো এরা সেকুলার রাজনীতির প্রকৃত তাৎপর্য সম্পর্কে কিছু পরিমাণে অবগত আছেন এবং এ কারণে এঁদের বক্তব্য সেকুলারিজম-এর আদর্শের প্রতি অতিমাত্রায় বিদ্বেষপূর্ণ। এঁরা প্রচার করেন, “জনসাধারণকে নীতিহীন রাজনীতির পরিবর্তে নীতিযুক্ত রাজনীতিতে অভ্যস্ত করা সময়ের একটা বড় দাবি। ধর্ম ও রাজনীতিকে যারা পৃথক মনে করেন, তাদের কাছে এই কঠিন রোগের [নীতিহীন রাজনীতি] কোনো দাওয়াই নেই। এ দাওয়াই তাদের কাছেই আছে যারা ধর্মকে রাজনীতি মনে করেন আর রাজনীতিকেও মনে করেন ধর্ম। ধর্মহীন রাজনীতির…. কুফল ও তার বিকল্প সম্পর্কে তাই সাধারণ মানুষের আজ চিন্তা করার সময় এসেছে।”(১২)

আমাদের বিচারে ‘সেকুলারিজম’-এর বাঙলা প্রতিশব্দ যদি খুঁজতেই হয়, তবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ থেকে ‘ধর্মহীনতা’ শব্দটি অধিকতর উপযুক্ত। ধর্মনিরপেক্ষতা ও সেকুলারিজম–এই দুটি ‘কনসেপ্ট’ বা ধারণা মূলগতভাবেই পৃথক। সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে আমাদের মনে হয় সেকুলারিজম-এর সঙ্গে ধর্মহীনতার নৈকট্য রয়েছে। পাশ্চাত্যের সমাজবিজ্ঞানীরা বলেছেন–‘সেকুলার’ শব্দটির অর্থ হোলো “ধর্মের থেকে পৃথক”, “ধর্মবিরোধী”, “ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীন….” ইত্যাদি। সেকুলারিজম পরজগৎকে স্বীকার করে না–এ কারণে সেকুলারিজম-এর বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ‘ইহজাগতিকতা’কেও গ্রহণ কবা যায় না। আধুনিক ভারতের রাজনৈতিক ট্র্যাডিশন অনুসরণ করে ধর্মনিরপেক্ষতা’কে আমরা রিলিজিয়াস নিউট্রালিটি’ বলতে পারি। ধর্মপ্রাণ, পণ্ডিত রাধাকৃষ্ণণ ‘সেকুলারিজম’কে ‘রিলিজিয়াস ইমপারশিয়ালিটি বলেছেন। ভারতের শাসক-এলিট-অনুসৃত এই নীতি তত্ত্বগতভাবে প্রধান দু’টি সম্প্রদায় সম্পর্কে নিরপেক্ষ। অর্থাৎ ‘ইঁটপুজো’, আর ‘বোরখা’ ‘তালাক’-এর দাবির প্রতি সস্নেহে সহনশীল, শিখা আর শ্মশ্রুর দ্বন্দ্বে নিরপেক্ষ। দাঙ্গাহাঙ্গামা ঘটলে নেতৃবৃন্দ ‘ক্ষতিপূরণ’ করেন; সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করেন না–ভোট হারাবার ভয়ে।

কার্ল মার্ক্সকে ‘ধর্মের সমাজতত্ত্ব’ (Modern Sociology of Religion)-এর জনক বলা যায়। মার্ক্স বলেছেন–ধর্ম মানুষকে তৈরি করে না, মানুষ ধর্মকে তৈরি করে। মার্ক্স-পূর্ব যুক্তিবাদীরাও মনে করতেন মানুষ ধর্মের অগ্রজ। কিন্তু যুগে যুগে ধর্মবেত্তা আর সমাজকর্তার দল প্রচার করেছেন–ধর্ম ঈশ্বরের কথা বলে, ধর্ম আদর্শ জীবন-যাপনের পাথেয়, ধর্ম ঈশ্বর লাভের সোপান। মহান ভারতে ‘গীতা’র শিক্ষা–নিষ্কাম কর্ম, বর্ণগত বৃত্তি–ধর্মনিষ্ঠ ও সৎ জীবন-যাপনের একমাত্র উপায়, যার অনুসরণ ধার্মিক মানুষকে পরজন্মে দেয় অধিকতর শান্তি, স্বীকৃতি, বৈভব, অবশেষে মুক্তি! সমাজে বৈষম্য, অবিচার, অনধিকার সবই পরম করুণাময়ের ইঙ্গিত-বাহিত, তাকে অনুসরণ করাই বর্ণ ধর্ম। প্রশ্ন নয়, বিদ্রোহ নয়, চাই নিষ্ঠা, চাই অসূয়াহীন কর্ম। ‘শাশ্বত ভারত’ উদ্ভাসিত হয়েছে ব্রাহ্মণ তত্ত্বজ্ঞানী আর ক্ষত্রিয় নৃপতির পারস্পরিক সহযোগিতার অনড় অটল ব্যবস্থায়।

শান্তি সাম্য আর ভ্রাতৃত্বের আদর্শ প্রচার করেছে নবীন ধর্ম ইসলাম। এর ব্যাখ্যা-কর্তা সুগভীর বিশ্বাসে বিধাতার নির্দেশের কথা বলেছেন, “জীবিকা উপার্জনের জন্য চেষ্টা করার অধিকার সর্বসাধারণ প্রাণী ও মানুষের জন্যই সর্বতোভাবে সমান। খোদর নির্দিষ্ট পথে (হালাল উপায়ে) যে যত পারো উপার্জন করো এবং খোদার নিয়মে তাহা ভোগ ও ব্যবহার করো। অবশ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে সকল মানুষই যে একেবারে সমান উপার্জন করিতে পারিবে, এমন কোনো কথাই হইতে পারে না। কারণ মানুষের বুদ্ধি, প্রতিভা, কর্মক্ষমতা ও কর্মকৌশল স্বভাবতই সমান নহে। কাজেই উপার্জনক্ষমতাও সকলের সমান হইবে না। তাই কাহারও ধন বেশি আর কাহারও কম হওয়া অস্বাভাবিক কিছুই নহে–অন্যায়ও নহে…. দুনিয়ার জীবনে মানুষের রুজি আমিই তাহাদের মধ্যে বন্টন করিয়া দিয়াছি এবং আমিই (রুজির ব্যাপারে) কাহারও অপেক্ষা কাহাকেও বেশি দান করিয়াছি–যেন পরস্পর পরস্পরের দ্বারা কাজ করাইতে পারে।”(১৩)

সেইন্ট মার্ক-এর সুসমাচারের অনুজ্ঞা “রাজার প্রাপ্য রাজাকে দাও, ঈশ্বরের প্রাপ্য ঈশ্বরকে দাও!” বিধাতার আশীর্বাদেই রাজার শাসন বৈধ! শাসন মেনে চলো!

যুগে যুগে সভ্যতার প্রেক্ষাপটে পয়গম্বরের আবির্ভাব হয়েছে; শাস্ত্রজ্ঞানী ব্রাহ্মণকুল, উলেমা, ‘স্বর্গ নরকের বার্তার প্রচারক’ ও ‘স্বর্গের চাবির নিয়ন্ত্রণ কর্তা’ যাজক সম্প্রদায় ঈশ্বরের বাণী প্রচার করেছেন। তাদের সুসমাচারের মূলকথা বৈষম্যভিত্তিক সমাজে সঙঘবদ্ধ জীবন; দ্বন্দ্ব নয়–সহযোগিতা; যুক্তি নয়–বিশ্বস; সংগ্রাম নয়–আত্মসমর্পণ; ইহজগৎ নয়–পরজগৎ! ভাগ্যের লিখন অমোঘ, ‘সভ্যতার পিলসুজ’-এর উচিৎ এই বিধান মেনে নেওয়া; ইহজাগতিক ক্লেশ দেবে পরজীবনে অমরত্বের প্রতিশ্রুতি। উপনিষদে তত্ত্বজ্ঞানীর উপদেশ–“বিত্তের দ্বারা অমরত্বের কোনো আশা নাই”। পরম করুণাময় ঈশ্বর শ্রমজীবীকে অমরত্বের সন্ধান দিয়েছেন আর নিষ্ঠুর নরপতির শাসন-দক্ষতায় ঈশ্বরের আসন অটুট রয়েছে। ধর্মভীরু মানুষের মনে গভীরভাবে প্রোথিত হয়েছে ঈশ্বরের বাণী। সৃষ্টি হয়েছে “বিপরীত জগৎ চেতনার”।(১৪)

তবুও সমাজের প্রগতি ঘটেছে, আর প্রগতির শর্তই হোলো জিজ্ঞাসা অনুসন্ধিৎসা আর দ্বন্দ্ব। তাই বিত্তহীনের দল ভেবেছেন, সংগ্রাম করেছেন, কখনো কখনো বিদ্রোহ করেছেন। ভারতে চার্বাকপন্থীরা জড়বাদ প্রচার করেন। এঁরা বলেন, “যারা দেহোত্তর অস্তিত্বের কথা বলে, তারা মিথ্যা বাকৃবিস্তার করে। শরীরের যখন মৃত্যু হয়, মূর্খ আর জ্ঞানী–সকলেই সমানভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। মৃত্যুর পর কিছু বাকি থাকে না।” পাশ্চাত্যে আধুনিকতার উদ্বোধনে কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩), ব্রুনো (১৫৪৮-১৬০০), গ্যালিলিও (১৫৬৪-১৬৪২) চরম অত্যাচারের মুখোমুখি হয়েছেন; ‘বে-শারা’র দল মন্দির-মসজিদের চৌহদ্দির বাইরে ‘প্রেমময়’-এর সন্ধান করেছেন; প্রতীচ্যে এসেছে নবজাগরণ আর এদেশের কবি গেয়েছেন “সবার উপরে মানুষ সত্য।”

পাশ্চাত্য জগতে এক যুগসন্ধিক্ষণে সেকুলারিজম সংক্রান্ত চিন্তার উন্মেষ ঘটে। এই মতবাদ–বিশ্বাসের উপরে স্থান দেয় যুক্তিকে, নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের আহ্বানের উপরে স্থান দেয় জিজ্ঞাসাকে, ধর্মান্ধতার উপরে স্থান দেয় বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গিকে। ক্রান্তিলগ্নের আলোড়নে বিধিলিপি অস্বীকার করার স্ফূর্তিতে ব্যক্তি আপন ইতিহাস গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করে, নির্দিষ্ট এক সম্প্রদায়ের মানুষ হয়ে ওঠে একক, অনুসন্ধিৎসু। একক মানুষ ঈশ্বর ও ধর্ম সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির আলোয় সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।

সমাজবিজ্ঞানীদের মতানুসারে সেকুলারিজম-এর মতাদর্শ রেনেশাস ও ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফলশ্রুতি। রেনেশাসের মানবতাবাদ অদেখা জগৎ বা পরজগতের বিশ্বাসকে অস্বীকার করে; মানবজীবনের অর্থ সন্ধানে ব্যাপৃত হয় বস্তুজগতের সীমার মধ্যে। ম্যাকিয়াভেলী (১৪৬৯-৩৫) যাজকদের ভণ্ডামী, আপ্তবাক্যের জঞ্জাল আর ঈশ্বরতন্ত্রের কোলাহল থেকে রাজনীতির ব্যাখ্যাকে মুক্ত করার প্রয়াস পান। মাটির পৃথিবীতে আস্থাশীল মানুষ অগ্রসর হয় অকুতোভয়ে।

ধর্মসংস্কার আন্দোলন পাদ্রীতন্ত্রের যাবতীয় দুর্নীতি স্বেচ্ছাচার আর অত্যাচারের মূলে কুঠারাঘাত করে। প্রতিবাদী মানুষ চার্চ ও ধর্মান্ধতার বন্ধন ছিন্ন করে একক ব্যক্তিরূপে ঈশ্বরের মুখোমুখি দাঁড়ায়। মনস্তাত্ত্বিক বিচারে “আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রের এই একাকীত্ব” প্রতিযোগী অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের একাকীত্ব থেকে মূলগতভাবে ভিন্ন ছিল না।(১৫) একক ব্যক্তি যখন অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সন্ধান করে তখন এই প্রক্রিয়া ব্যক্তির রাজনৈতিক স্বাধীনতার পথেও পাথেয় হয়ে ওঠে। ব্যক্তিমানুষ তখন সাম্প্রদায়িক বা গোষ্ঠী-মানসিকতার বন্ধন ছিন্ন করে নতুন জীবনবোধের সন্ধান পায়। এই নবচেতনার ফলে একক মানুষ ট্র্যাডিশন-আশ্রয়ী ধর্মান্ধতার সনাতন পথ পরিত্যাগ করে পরিপূর্ণ আধুনিক মানুষ হয়ে ওঠে।(১৬) প্রকৃত অর্থেই প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মমত নবীন বুর্জোয়া যুগের উপযুক্ত ধর্ম হয়ে ওঠে। এর পাশাপাশি বলিষ্ঠ নাস্তিক্যবাদেরও উন্মেষ হয়। যুগসন্ধিক্ষণে প্রতীচ্যের মানবসমাজে এক অত্যাশ্চর্য বুদ্ধিবিপ্লব ঘটে। অজ্ঞানতা আর অন্ধতার অন্ধকার থেকে আলোকোজ্জ্বল যুক্তির উদ্ভব হয়। বেকন (১৫৬১-১৬২৬)–অনুসন্ধান ও পরীক্ষার দ্বারা সত্যানুসন্ধানের নতুন পথ দেখান। লক (১৬৩২-১৭০৪) ঘোষণা করেন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও মানস-প্রত্যক্ষ বিষয় ছাড়া আর কোনো কিছু জানবার উপায় নেই।

আটের শতকে বেকন ও লক প্রদর্শিত মুক্তচিন্তা কয়েকজন মনীষী–ধর্মের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন। ফরাসী যুক্তিবাদীরা যুক্তিবাদের পথের অভিযাত্রী হন। তারা রোমান ক্যাথলিক ধর্মযাজকদের ভণ্ডামী আর বিবিধ অপকর্মের তীব্র সমালোচনা করেন। এরা ছিলেন নাস্তিক, জড়বাদী, সংশয়বাদী (Scepticism) ইত্যাদি। ঈশ্বর, আত্মার অবিনশ্বরতা এবং পাপ-পূণ্য ও পরলোকে তার বিচার ও শাস্তি বা পুরস্কারের সুপ্রাচীন বিশ্বাসের অচলায়তনে এঁরা আঘাত হানেন। ডেভিড হিউম (১৭১১-১৭৭৬) ছিলেন সংশয়বাদের প্রবক্তা, অলৌকিক ক্রিয়ায় তার বিশ্বাস ছিল না। বৈজ্ঞানিক যুক্তির প্রণালীতে তিনি ধর্মের উৎপত্তি ও ইতিহাস ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পান। ধর্মের বাহ্যিক অনুষ্ঠানকে হিউম–যাজকদের চাতুরী বলে বিশ্বাস করতেন। “প্রায় দুই শতাব্দী ধরে পাশ্চাত্যের সমাজে এই বৈপ্লবিক চিন্তালোড়ন চলতে থাকে।”(১৭)

নবচেতনার এই প্লাবনে ভেসে যায়, হারিয়ে যায় পুরোনো মূল্যবোধ, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের উল্লাসে পরাভূত হয় ভ্রান্তবিশ্বাস, গতির কাছে হার মানে জড়তা আর স্থবিরতা। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চলে দুঃসাহসিক অভিযান; শুরু হয় ব্যক্তিমানুষের জয়যাত্রা। জীর্ণ হয়ে যাওয়া ধর্মবিশ্বাসের নিগড় ভেঙে ব্যক্তিমানুষ নতুন এক ধর্মের সন্ধান পায়। সময়, পরিশ্রম, অর্থ, বস্তু, দূরান্তে উপনিবেশ স্থাপন–এ সবই হয়ে ওঠে জীবন যাপনে আরাধ্য। পরজগতে সুখ-শান্তির আকুতি মলিন হয়ে যায় ইহজগতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুকঠিন সংগ্রামে! স্বর্গের বাসনা নয়, পৃথিবী হয়ে ওঠে বরণীয়, আদরণীয়। কান্ট (১৭২৪-১৮০৪) ও রুশোর (১৭১২-১৭৭৮) দর্শন মানবজীবনে অতিপ্রাকৃত কর্তৃত্ব অস্বীকার করে। বেন্থাম (১৭৪৮-১৮৩২)-এর ‘উপযোগিতাবাদ’ সমাজ সংস্কারের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। হলব্যাখ (১৭২৩-১৭৮৯) প্রচার করেন বস্তুবাদ ও নাস্তিকতা। শুরু হয় অতিবৃদ্ধ ঈশ্বর আর মূঢ় অত্যাচারী ধর্মধ্বজাধারী যাজককুলের নির্বাসনের পালা।

নবীন বুর্জোয়াশ্রেণী এবং তাদের মুখপাত্র স্বাধীন বুদ্ধিজীবীসম্প্রদায় সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে অক্লান্ত সংগ্রামে রত হন। যুগ সৃষ্টিকারী শিল্পবিপ্লব, গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও আধুনিক নগরের বিস্তার সেকুলারাইজেশন-এর প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। বস্তুজগতের বৈপ্লবিক পরিবর্তন–রাজনীতি, রাষ্ট্রব্যবস্থা, ধর্ম, শিল্পকলা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, দর্শন–সব কিছুরই আমূল পরিবর্তন ঘটায়। যুগারম্ভে এক নতুন বিশ্ববীক্ষার জন্ম নেয়–‘সেকুলারিজম”। যাকে সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, নেগেটিভলী রিলিজিয়াস’ অর্থাৎ ধর্ম বা ধর্মান্ধতার প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। এই নতুন বিশ্ববীক্ষার ফলস্বরূপ নবজীবনধারা ধর্মনির্দেশিত পথ পরিত্যাগ করে। এই মতবাদের উত্থানের ফলে ধর্ম আর রাজনীতির মধ্যে গড়ে ওঠে এক ‘অলঙঘ্যনীয় প্রাচীর! পুরাতন মতাদর্শ আর প্রগতির সঙঘাতে ‘সেকুলারাইজেশন’-এর প্রক্রিয়া গতিলাভ করে; এর ফলে ধর্মীয় চিন্তা ধর্মাচরণ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির সামাজিক গুরুত্ব লোপ পায় বা হ্রাস পায়। সমাজবিজ্ঞানী প্র্যাট লিখেছেন, তিনশো বছর আগে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রসঙ্গে কোনো দ্বিমত ছিল না। আজ ঈশ্বরের অস্তিত্বে বহু মানুষ অবিশ্বাসী, অনেকে সন্দিহান, আর অনেকে মনে করেন এ সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তা করাটাই অর্থহীন।(১৮) অপর এক সমাজবিজ্ঞানীর মতে ‘সেকুলারিজম’ [এর মতবাদ] ধর্মীয় বা অতিপ্রাকৃতিক [বন্ধন থেকে] মুক্ত। এই মতবাদ ঈশ্বরের অস্তিত্ব আত্মার অবিনশ্বরতা ইত্যাদি সম্পর্কে বিতর্ক চালাবার অধিকার দেয়। এই মতবাদ এমন এক বস্তুজগতের সন্ধান কবে যেখানে মানুষ দরিদ্র নয়, নয় বঞ্চিত!(১৯) আধুনিক যুগে ভাগ্যবিধাতার অস্তিত্ব সম্পর্কে, পরজগৎ সম্পর্কে জিজ্ঞাসু মানসভূমি সেকুলারিজম-এর অবদান। আবুল ফজল লিখেছেন, “ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, ঈশ্বর তাবৎ পৃথিবীর মালিক–এ সব সামাজিক দিক থেকে স্রেফ হাওয়ায় বেলুন ওড়ানো। এর কোনো সামাজিক মূল্যই নেই। এতে কোনো সামাজিক তথা মানবীয় সমস্যারই সমাধান হয় না। এ সব ব্যক্তিবিশেষের বিশ্বাসের অঙ্গ হতে পারে। কিন্তু কোনো বিশ্বাসই [ অর্থাৎ ধর্মবিশ্বাস সামাজিক শান্তি বা শৃঙ্খলা আনতে সক্ষম নয়।”(২০)

অতিবৃদ্ধ ঈশ্বরের নির্বাসনের পালা মধ্যযুগের অবসান ঘটায়।

সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, সেকুলারিজম প্রাগ্রসর আধুনিকতার অন্তরঙ্গ সঙ্গী। আরজ আলী মাতুব্বর লিখেছেন, “বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারের ফলে ধর্ম হোঁচট খাচ্ছে পদে পদে। কোনো ধর্মের এমন শক্তি নেই যে আজ ডারউইনের বিবর্তনবাদ বাতিল করে দেয়, নাকচ করে দেয় মর্গানের সমাজতত্ত্ব, এবং ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত করে কোপার্নিকাস-গ্যালিলিওর আকাশ তত্ত্ব, নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব, এবং আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বকে!”(২১)

আমরা আগেই বলেছি, সমাজবিজ্ঞানীদের মতে সেকুলারিজম–প্রাগ্রসর আধুনিকতার অন্তরঙ্গ সঙ্গী। যখন যুবক প্রধানমন্ত্রী কোনো এক ‘মাচান বাবা’র শ্রীপদে মস্তক ঠেকান অথবা রাষ্ট্রপতির পদলাভ করার পর এক প্লুরাল সোসাইটির প্রথম নাগরিক–ধর্মস্থানে গিয়ে মস্তক মুণ্ডন করে আসেন তখন মনে হয় আমাদের দেশের হর্তাকর্তাদের বৌদ্ধিক পরিমণ্ডলে মধ্যযুগের ভাবাদর্শ দোর্দণ্ডপ্রতাপে বিরাজ করছে; এর সঙ্গে রাজনৈতিক প্রচারের কৌশল তো আছেই। এ প্রসঙ্গে আবুল ফজলের মন্তব্য উদ্ধৃতিযোগ্য, “রাজনীতিবিদের মুখে এখন ধর্মের যত বুলি শোনা যায়, স্বয়ং ধর্মপ্রবর্তকদের মুখেও কোনোদিন তত ধর্ম-বুলি শোনা যায়নি।”২২ এ তো ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপাদান! ইংরেজ তার সাম্রাজ্য গড়ার জন্য, অটুট রাখার জন্য এই রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দেয়। এ কারণে আজও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্ষুধার্ত, অজ্ঞ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভোটাব নামক প্রাণীরা ধর্ম-রাজনীতিবিদের প্রতারণার শিকার হন। এই হতভাগ্য উপমহাদেশে ‘আধুনিকতার’ সূচনা “ক্লাইভের খঞ্জর” “বাঙালির খুনে লাল” হবার সৌজন্যে! তাই বর্তমানের বহু-বিজ্ঞাপিত ধর্মনিরপেক্ষ দেশে মধ্যযুগের অবসান হয়নি; “পর দীপমালা নগরে নগরে/ তুমি যে তিমিসা তুমি সে তিমিরে!” নগরে নগরে আজ আধুনিকতম বিলাস-ব্যসন-ব্যভিচারে নিমজ্জিত ঈশ্বর-ভাগ্য-পরকাল-বিশ্বাসী ক্ষমতালোভী মানুষের দল; অন্নহীন ভারতবর্ষ পুঞ্জিভূত তমসায় ভারাক্রান্ত, অনাহার আর ঈশ্বর-বিশ্বাস তার নিত্যসঙ্গী। এ দেশে “কী দিবে তোমারে ধর্ম!”

ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারীরা “লুটের স্বরাজ” খুঁজে পায় ধর্মান্ধ ভারতে। স্থিতাবস্থা এদের স্বার্থ সাধন করে। এ কারণে এরা প্রকৃত সেকুলার রাজনীতি বা ধর্মহীন রাজনীতি সভয়ে এড়িয়ে চলে। সংবিধানে বিধৃত মহান ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করে মসজিদ ভেঙে দেওয়া হয় অবলীলায়, পঁচিশটি মসজিদকে মন্দিরে পরিণত করার প্রতিজ্ঞা করেন ‘দেশভক্তের দল’, আর মানুষকে বোঝানো হয় বিধর্মীর উপাসনালয়ে জন্ম নিয়েছিলেন অবতার।

এ দেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতি অর্থাৎ শাসকশ্রেণীর সংস্কৃতি–টেলিভিশন, রেডিও, সিনেমা, তথা যাবতীয় প্রচারমাধ্যম-মারফৎ নিত্য আমাদের শাসন করে, এই সংস্কৃতি মূলত ধর্মাশ্রয়ী সংস্কৃতি। হিন্দুধর্মাশ্রয়ী-সংস্কৃতি আর ইসলাম-আশ্রয়ী-সংস্কৃতি দ্বি-জাতি তত্ত্বের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। ধর্মের এই অচলায়তন বৈশ্য সম্রাটের নিতান্ত প্রয়োজনীয়। ধর্ম–ক্ষুধার্ত মানুষকে অন্ধতা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না। বিপরীত জগৎ চেতনায়’ মোহাচ্ছন্ন মানুষ আবহমান কালের বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থাকে বৈধ ও ঈশ্বর-নির্দেশিত বলেই মনে করে। পরকালের মোহে ইহলোকের অবিচার নীরবে মেনে নেয়; সামান্য ইন্ধনেই ভ্রাতৃঘাতী সঙঘর্ষে লিপ্ত হয়।

ধর্মান্ধ এই দেশে–ধর্মাশ্রয়ী-সংস্কৃতির বিপরীতে–ধর্মহীন সেকুলার সংস্কৃতির বিকাশ প্রসার ও প্রচার আশু কর্তব্য। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “বেদ, কোরাণ, পুরাণ, পুঁথি-পাওড়া এখন কিছুদিন শান্তি লাভ করুক–প্রত্যক্ষ ভগবান দয়া প্রেমের পুজো দেশে হোক।” “তিনি প্রেমরূপে সর্বভূতে প্রকাশমান। আবার কি কাল্পনিক ঈশ্বরের পুজো হে বাপু!” আমাদের দেশে এই “কাল্পনিক ঈশ্বরের” নির্বাসনের জন্য আমরা তার কথার প্রতিধ্বনি করে বলতে পারি, “আমি তোমাদের কুসংস্কারগ্রস্ত নির্বোধের চেয়ে ঘোর নাস্তিকরূপে বরং দেখতে চাই। কারণ নাস্তিকরা প্রাণবন্ত, মৃত নয়, তাদের দিয়ে কিছু করা যেতে পারে।”

আমরা আগেই বলেছি আমাদের দেশে ধর্মহীনতার বীজ প্রোথিত হয় চার্বাক দর্শনে, মধ্যযুগ উদ্ভাসিত শাস্ত্রবিরোধী মানবধর্মের উদাত্ত প্রচারে। আমাদের দেশে ব্রিটিশ-রাজমুকুটের শাসন কায়েম হবার পর উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ পত্রিকা ‘তত্ত্ববোধিনী’র নাস্তিক সম্পাদক অক্ষয় কুমার দত্ত প্রচার করেন, “পরিশ্রমেই ফসল পাওয়া যায়, ঈশ্বর উপাসনার ফল শূন্য।”

উনিশ শতকের ‘ইয়ং বেঙ্গল’ বা ‘ডিরোজিয়ান’রা ছিলেন ঘোরর নাস্তিক। এঁদের অনেকেই জাতপাতের ধারণা, পূজার্চনা, বা অন্য আচার অনুষ্ঠান-এ বিশ্বাস ত্যাগ করেন। প্যারীচাঁদ মিত্র লিখেছেন, “ছেলেরা উপনয়নকালে উপবীত লইতে চাহিত না; অনেকে উপবীত ত্যাগ করিতে চাহিত; অনেকে সন্ধ্যা-আহ্নিক পরিত্যাগ করিয়াছিল; তাহাদিগকে বলপূর্বক ঠাকুরঘরে প্রবিষ্ট করিয়া দিলে তাহারা বসিয়া সন্ধ্যা-আহ্নিকের পরিবর্তে হোমারের ইলিয়ড গ্ৰন্থ হইতে উদ্ধৃত অংশসকল আবৃত্তি করিত।” “..অনেক বালক ইহা অপেক্ষাও অতিরিক্ত সীমান্তে যাইত; তাহারা রাজপথে যাইবার সময়, মুণ্ডিত-মস্তক ফোঁটাধারী ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত দেখিলেই তাহাদিগকে বিরক্ত করিবার জন্য আমরা ‘গরু খাই গো, আমরা গরু খাই গো’ বলিয়া চিৎকার করিত…. কেহ কেহ স্বীয় স্বীয় ভবনের ছাদের উপর উঠিয়া প্রতিবেশীগণকে ডাকিয়া বলিত, ‘এই দেখ মুসলমানের জল মুখে দিতেছি…’ ইত্যাদি।”২৩

সেকালের শ্রেষ্ঠ পত্রিকা তত্ত্ববোধিনীর সম্পাদক অক্ষয় কুমার দত্ত ছিলেন নাস্তিক। তিনি ছিলেন প্রথম আমলের দীক্ষিত ব্রাহ্ম। তিনি বেদের অভ্রান্ততায় বিশ্বাস করতেন না। আরও পরে অক্ষয় কুমার “প্রার্থনাদির প্রয়োজন স্বীকার করতেন না এবং শেষ বয়সে অনেকটা অজ্ঞাবাদী হয়ে পড়েন।”

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (১৭৯৩) উদ্ভুত শিক্ষিত-বাবুসম্প্রদায় এদের সজোরে প্রত্যাখ্যান করেন। তাই পরবর্তীকালে কেশবচন্দ্র সেনের ভণ্ডামী(২৪) আর রামকৃষ্ণের ভক্তিবাদ বাঙালি হিন্দুকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। নবহিন্দুবাদের জোয়ারে বঙ্গসমাজ প্লাবিত হয়ে যায়; অক্ষয় কুমারের শিক্ষা বিনষ্ট হয়।

শোনা যায়–বাঙলার নয়নের মণি ক্ষুদিরাম বসু ছিলেন সংশয়বাদী। বিপ্লবী হেমচন্দ্র কানুনগো ছিলেন নাস্তিক, মার্ক্সবাদের সঙ্গেও তার পরিচয় ছিল। ফাঁসির আসামী কানাইলাল দত্ত পবিত্র গীতা পুকুরের জলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। আর ভগৎ সিং যাঁর সর্বভারতীয় জনপ্রিয়তা ছিল গান্ধীজীর জনপ্রিয়তার সমতুল্য, তিনিও মার্ক্সবাদে প্রভাবিত হয়েছিলেন, নাস্তিকতায় তার দৃঢ় বিশ্বাসের পরিচয় পাওয়া যায় তার রচনায়।

আমাদের বক্তব্য হোলো, সেকুলারিজম, অর্থাৎ ধর্মহীনতা প্রচার করার ব্যাপারে প্রভূত সাহায্য পাওয়া যেতে পারে আমাদের মাতৃভূমির ইতিহাস থেকেই। কারণ প্রকৃত সেকুলারিজম বস্তুত নাস্তিকতার সমীপবর্তী। মানবেন্দ্রনাথ রায় ও তার অনুগামীরা সেকুলারিজমকে শ্রেণী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চাননি বা পারেননি। এ কারণে রায়ের প্রভাব মুষ্টিমেয় উচ্চশিক্ষিত মানুষের এক ক্ষুদ্র গণ্ডীতে সীমাবদ্ধ থেকে গেছে।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “ধর্মমোহের চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভালো।” আবুল ফজলের ভাষায় বলি “…মুসলমান খাঁটি মুসলমান আর হিন্দু খাঁটি হিন্দু হলেই মিলন সহজ হবে–একথা আমার কাছে সোনার পাথরবাটি; বরং মানুষ যখন এবং যেখানে প্রচলিত মুসলমানত্ব ও হিন্দুয়ানীকে ছাড়িয়ে গেছে সেখানে মিলন সহজ ও অবাধ হয়েছে।” এই শিক্ষা বাঙালিকে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথই।

উপসংহারে আমরা বলি, উষালগ্নের আবাহনে ধর্মহীন বিশ্ববীক্ষা হোক আমাদের ধ্রুব!

আদি শৃঙ্খল সনাতন শাস্ত্র-আচার মূল সর্বনাশের, এরে ভাঙিব এবার!
ভেদি দৈত্য কারা
আয় সর্বহারা!
কেহ রহিবে না আর পর-পদ-আনত।

.

টীকা ও তথ্যসূত্র

১. Quoted in Atulananda Chakrabarti : The Recovery of India. Calcutta 1972. p. 87.

২. রামভক্ত মহাত্মাজীর এমত মনোভঙ্গি আমরা অন্যত্র উল্লেখ করেছি; মহাকাব্যের রামচন্দ্র কিন্তু শূদ্র ও চণ্ডাল ঊনমানব গুহক চণ্ডালের কাছে ফলমূল গ্রহণ করেননি; ক্ষত্রিয় রামচন্দ্র মুনি-ঋষিদের আতিথ্য গ্রহণ করতেন।
সুকুমারী ভট্টাচার্য, রামায়ণ ও মহাভারত : আনুপাতিক জনপ্রিয়তা, কোলকাতা ১৯৯৬; পৃ. ১৪

৩. Vide Atulananda Chakrabarti. Op. cit. p. 105.

৪. পরাধীন ভারতে গান্ধীজীর কোষাগার আর স্বাধীন ভারতে ধনপতি-চুড়ামনি শ্ৰীযুক্ত ঘনশ্যাম দাস বিড়লা মহাশয় এবং তার পুত্র-পৌত্রাদি কীভাবে ধর্মান্ধতা তথা সাম্প্রদায়িকতার পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকেন, তার এক নজীর উপস্থাপিত করা যায়, “শুধু সুখসম্পদের পিছনে ছুটলে চলবে না…। কোলকাতার বালীগঞ্জে ‘ঘনশ্যাম দাস বিড়লা সভাগর’-এর উদ্বোধনের সময় জগৎগুরু শঙ্করাচার্য স্বামী স্বরূপানন্দ সরস্বতী এই অভিমত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, নানা ভাষা নানা মত থাকা সত্ত্বেও ধর্মের সূত্রই ভারতবাসীদের ঐক্যডোরে বেঁধে রেখেছে। ধর্মের সংরক্ষণে বিড়লা পরিবার ও ঘনশ্যাম দাসের সহায়তার কথা তিনি উল্লেখ করেন।”
আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩.১২.১৯৮৪
এই শঙ্করাচার্যরাই ‘সতী মাহাত্মের নামে জ্যান্ত মানুষ পুড়িয়ে মারার সমর্থনে বাণী দেন; মহিলাদের বেদম্পর্শে প্রবল আপত্তি জানান; অথবা ভিন্ন সম্প্রদায়ের উপাসনাগৃহে অবতার পত্নীর হেঁসেল আবিষ্কার করে পুজো করা ইট-পাটকেল বহন করে মূঢ় ধর্মান্ধ মানুষের মননে সাম্প্রদায়িক চিন্তায় উস্কানি দেন; আর সদর্পে ঘোষণা করেন–“প্রধানমন্ত্রী আমাকে ভয় পান, আমি তাকে ডরাই না।”
আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫.৪.১৯৯৪
একথা সুবিদিত যে ঘনশ্যাম দাসজী হিন্দু সাম্প্রদায়িক সংগঠন আর.এস.এস.-এর সঙ্গে শ্ৰীতিডোরে বাঁধা ছিলেন।
মহান ভারতে, ক্ষুধার্ত ভারতে ঐশ্বর্যের চূড়ায় অধিষ্ঠান করলেও ঘনশ্যাম দাসজী নিজেকে ‘যোগী’ রূপে প্রচার করতেন। Organiser, Vol. x x x IV. No. 27, 21-27, November 1942
‘যোগী’র বিরুদ্ধে মজুর খ্যাপাবেন কে?
এই “যোগী” ভবলীলা সাঙ্গ করার পর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার এক মার্ক্সবাদী সদস্য বিড়লাজীকে ‘দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শিল্পপতি’ রূপে বর্ণনা করেন এবং মুখ্যমন্ত্রী তার ভস্মাধারে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন।
ডালমিয়া সাম্রাজ্যের বড় শরিক শ্রীযুক্ত বিষ্ণুহরি ডালমিয়া মহাশয় ‘বিশ্ব হিন্দু পরিষদ’ এর সভাপতি। তিনি মসজিদ ভেঙে মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে চান।
অপর এক পুঁজিপতি মোদি-গোষ্ঠী তাদের বাৎসরিক লাভের পাঁচ থেকে দশ শতাংশ অর্থ ধর্মের সেবায় ব্যয় করেন।
Samita Bhatia. ‘Religious Capital’, The Telegraph Magazine, 8.5.1994

৫. সেকুলারাইজেশন-এর ফলে সমাজ রাজনীতি ও রাষ্ট্র ধর্মহীন হয়ে উঠতে পারে। আমাদের ধারণা আদর্শ সেকুলার বা ধর্মহীন রাষ্ট্র বাস্তবে এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শিল্পবিপ্লব উত্তর ধনতান্ত্রিক ইংল্যাণ্ডের (তথা য়ুরোপের) সমাজ বহুলাংশে ধর্মহীন হ’লেও রাষ্ট্রের সঙ্গে চার্চের নিকট-সম্পর্ক রয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ ভারত-পাকিস্তান-বাঙলাদেশের সমাজ থেকে অনেক অনেক বেশি সেকুলার বা ধর্মহীন, কিন্তু সেখানেও টাকার ওপর লেখা থাকে “আমরা ঈশ্বর বিশ্বাস করি।”

আমাদের দেশের হিন্দুদের মধ্যে জাতিপ্রথা বা ‘কাস্ট সিস্টেম’–সমাজ রাজনীতি ও রাষ্ট্রকে সেকুলারাইজ করার ক্ষেত্রে বিরাট বাধা। নগরায়নের ফলে জাতপাতের ধারণায় ভাঙনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে কেউ কেউ দাবি করেন; কিন্তু সাধারণ অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, ব্রাহ্মণ বা বৈদ্যসন্তান পাদুকাবিপণি খুলে বসলেও বিবাহের সময় স্বজাতি কন্যারই পাণিগ্রহণ করেন।
কলকারখানায়-অফিসে উচ্চবর্ণ আর নিম্নবর্ণের মানুষ হয়তো একই ক্যান্টিন থেকে একই কাপ-ডিশে চা বা খাবার খান; কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে তারাই আবার উচ্চবর্ণের অহমিকা আর কুসংস্কারের পরিচয় দিয়ে থাকেন। ব্রাহ্মণ শ্রমিকও উপবীতর অভিমান বজায় রাখেন। আর হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক দূরত্ব আজও যোজন-বিস্তৃত এবং তা স্পষ্ট, নগ্ন। এ কারণে আজও শহর মফস্বলের ‘হিন্দু হোটেলে মুসলমান প্রবেশ করেন না বললেই চলে। ১৯৯২ সালে প্রকাশিত পুস্তকে আবদুর রউফ লিখেছেন আজও বর্ণহিন্দু-বাঙালি “জ্ঞাতে অজ্ঞাতে বহন করে চলেছেন মজ্জাগত মুসলিম-অবজ্ঞার সংস্কার…. এই মনোভাবের প্রকাশ প্রায়শ এতই সূক্ষ্ম যে সবসময় তাকে চিহ্নিত করা যায় না। কিন্তু প্রতিক্রিয়া যেখানে যা হবার ঠিকই হয়। এইভাবে আর যা-ই হোক, সম্মিলিত বাঙালিসত্তার স্ফুরণ কখনই হতে পারে না। হিন্দুদের মধ্যে এই মনোভাব আজ বর্ধমান, একথা বললে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না।
আমাদের দেশে ধর্মীয় আইডেনটিটিকে বিনষ্ট করেই শ্রেণী-দৃষ্টিভঙ্গি বিকশিত হতে পারে কারণ উভয় উভয়ের পরিপূরক, ধর্মান্ধতা স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিবন্ধক।

৬. গৌতম রায়; মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই সাজানো লড়াই; আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৯.৪.১৯৯০

৭. Dilip Hiro. Inside India Coday. London 1976. p. 238
মুসলমানদের প্রতি কংগ্রেস নেতাদের এমত উপদেশের কারণ তারা মুসলমান-ধৰ্মান্ধতার তোয়াজ করার চেষ্টা চালালেও আক্রমণাত্মক হিন্দুধর্মান্ধতার অচলায়তনে সামান্য আঘাতও করতে চান না; তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হিন্দু-দাঙ্গাকারীদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

৮। এ. কে. রায়; ঈশ্বরের রাজনীতি’; আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩.১.১৯৮৮

৯। আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩০.৪.২০০২

১০। উপরোক্ত

১১। উপরোক্ত

১২। ‘মীযান’, ২৩.৫.১৯৮২

১৩। মুহাম্মদ আব্দুর রহীম; ইসলামী রাজনীতির ভূমিকা; ঢাকা ১৯৭৬; পৃ. ১০৬-১০৭

১৪। মার্ক্সীয় সমাজবিজ্ঞান অনুসারে বিপরীত জগৎ চেতনা’র অর্থ–“এক নির্দিষ্ট সমাজ চেতনা যা জনগণের মনে পার্থিব শক্তিগুলি, যা তাদের ওপর প্রবল প্রভাব বিস্তার করে থাকে, এক অপার্থিব, অবাস্তব শক্তি, অর্থাৎ ভাগ্যনিয়ন্তা অদৃষ্ট ঈশ্বর রূপে প্রতীয়মান হয়।” Dictionary of Philosophy Moscow 1967 p. 357

১৫. Enich Fromm. The Fear of Freedom. London 1960. pp. 93-94

১৬। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শাসন-শোষণের সঙ্গে ধর্মান্ধতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে। এ কারণে পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই রাজনৈতিকবোধে-উদ্বুদ্ধ মানুষ ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও সংগ্রাম করেন।
স্পেনের গৃহযুদ্ধের (১৯৩৬) পূর্বাহ্নে বিক্ষুব্ধ শোষিত জনতা দুশোটি গীর্জা পুড়িয়ে ছাই করে দেন পাদ্রীতন্ত্রকে ধ্বংস করার জন্য।
“প্রাচ্যের দুঃখী ‘মহাদেশ’ চীনেও বিপ্লবী গৃহযুদ্ধের যুগে.. লুঙফেঙ মহিলা আশ্রমে কৃষকরা ও ইস্কুল-শিক্ষকরা মাংস রান্নার জন্য কাঠের দেবমূর্তিগুলো টুকরো টুকরো করে জ্বালানী করে নিয়েছিল…. তুঙফুঙ মন্দিরে তিরিশটির বেশি দেবমূর্তি–ছাত্র ও কৃষকেরা মিলে পুড়িয়ে দিয়েছিল।”
মাও সে তুঙ; নির্বাচিত রচনাবলী; কোলকাতা ১৯৭০ (প্রথম খণ্ড); পৃ. ৫২
এশিয়া-ইউরোপের অপর এক দেশ তুরস্কে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের যুগে মুস্তাফা কামাল মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রশক্তির সহায়তায় বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ১৯২৪ সালে ‘খলিফাতন্ত্র’ উচ্ছেদ করা হয়। ১৯২৬ সালে ‘শরিয়াত’ বা ‘মুসলিম ব্যক্তিগত আইন’ নির্বাসনে যায় এবং আধুনিক তুরস্ক সুইজারল্যাণ্ড, ইটালী ও জার্মানী প্রভৃতি দেশের অনুসরণে সেকুলার আইনকানুন প্রণয়ন করে।

১৭। বিনয় ঘোষ; বিদ্রোহী ডিরোজিও; কোলকাতা ১৯৮০; পৃ. ৯০

১৮. Vernon Prat. Religion and Secularaisation. London 1970. p. 11.

১৯. The Encyclopaedia Americana. New York Volume XXIV. 1959. p. 52.

২০। আবুল ফজল; ‘মানবতন্ত্র’; অরুণ সেন ও আবুল হাসনাত (সম্পাদনা); বাঙালি ও বাঙলাদেশ; কোলকাতা ১৯৯৯; পৃ. ৩৯

২১। আরজ আলী মাতুব্বর; ‘আমার পরিচয়’; উপরোক্ত পৃ. ৩১

২২। আবুল ফজল; পূর্বোক্ত; পৃ. ৩৪।

২৩। শিবনাথ শাস্ত্রী; রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ; কোলকাতা ১৯৮৩; পৃ. ১০২

২৪। বিনয় যোব; বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা; কোলকাতা ১৯৬৮; পৃ. ৩০৫

(অনীক, জুলাই ১৯৯৪)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *