দেবলোকের যৌনজীবন
গ্রীকপুরাণ থেকে দেবলোকের যৌনজীবনের যে চিত্র পাওয়া যায়, তা দিয়েই আমি আমার বই শুরু করছি। হিন্দুদের মত গ্রীকরাও তাদের দেবদেবীদের মানুষের প্রতিরূপেই কল্পনা করত। সেজন্য মনুষ্য সমাজে নারীপুরুষের আচরণে যে সব দোষ-গুণ থাকে গ্ৰীক দেবদেবীদের মধ্যেও আমরা তাই দেখি। মনুষ্যসমাজে পুরুষ অপরের স্ত্রীর প্রতি লালসা প্রকাশ করে বা অপরের স্ত্রীকে অপহরণ ও ধর্ষণ করে বা নারী-পুরুষ অজাচার ও ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। গ্রীক দেবদেবীদের মধ্যেও তাই হতো।
গ্রীকদের সবচেয়ে বড়ো দুই দেবদেবী ছিল জ্যুস্ ডিমিত্রাস্। এ দুজনেই আদর্শ চরিত্রের দেবতা ছিলেন না। জ্যুস তার অনূঢ়া ভগিনী ডিমিত্রাসে উপগত হয়ে কৃষিদেবী পারসিফোনের জন্ম দিয়েছিল। আবার পড়ি নিজ দুহিতা মিরহাতে উপগত হয়ে তার পিতা অ্যাডোনিস-এর জন্ম দিয়েছিল। এই অজাচারের জন্য মিরহাকে বৃক্ষে পরিণত হতে হয়েছিল। আবার পড়ি অ্যাক্টিয়ন নামে এক পৌরানিক শিকারী আর্টেমিসকে নগ্ন অবস্থায় স্নান করতে দেখেছিল বলে সে মৃগীতে পরিণত হয়েছিল। আবার পড়ি অ্যালকিন্তু তার নিজ ভগিণী এরিট্রকে বিয়ে করেছিল। এরূপ অজাচারের অনেক দৃষ্টান্তই গ্রীকপুরাণে আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বীভৎস হচ্ছে ইডিপাসের নিজ মাতাকে বিয়ে করে তার গর্ভে চারটি সন্তান উৎপাদন করা। প্রণয়ের দেবী অ্যাফ্রোড়িটিকে আমরা ব্যভিচারে লিপ্ত হতে দেখি এবং ওই ব্যভিচারের ফলে তার অনেকগুলি সন্তান হয়েছিল। অ্যাপোলোকে আমরা দেখি ড্রাইওপি নামক পরীকে অপহরণ করতে। টিটিয়াসকে আমরা দেখি লিটোকে ধর্ষণ করতে উদ্যত হতে। আবার দেখি সতীত্বের প্রকৃষ্ট প্রতীক হিসাবে। যদিও আর্টেমিসের সঙ্গে আটলাণ্টাকে একীকরণ করা হয়েছিল তা হলেও আটলাণ্টা কুমারী অবস্থায় মেলিয়াগারকে প্রসব করেছিল।
গ্রীক পুরাণে আরও আছে যে দেবতারা যৌনলিন্সার বশীভূত হয়ে পৃথিবীতে আসতো মর্ত্যের মানবীদের সঙ্গে মিলিত হতে। সুতরাং এই বইয়ে হিন্দুদের দেবলোকের যৌনজীবনের যে চিত্র অঙ্কিত করা হয়েছে তাতে আশ্চৰ্য্য হবার কিছু নেই। সবদেশের পুরাণেই দেবতাদের এরূপ যৌনাচারের বিবরণ আছে। তবে এই বইয়ে আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে মাত্র হিন্দুদের দেবলোকের যৌনাচার। সেজন্য এই বইয়ে আমরা হিন্দুদের দেবলোকের যৌনাচার নিয়েই আলোচনা করব।
॥ দুই ॥
মামুষ গোড়া থেকেই তার দেবতাকে নিজের স্বরূপে কল্পনা করে নিয়েছিল। সেজন্য মানুষের যে সব দোষ-গুণ আছে, তার দেবতাদেরও তাই ছিল। এটা বিশেষ করে লক্ষিত হয় দেবতাদের যৌনজীবনে। যৌনজীবনে মানুষের যে সব গৰ্হিত আচরণ আছে, দেবতাদেরও তাই ছিল। যৌনজীবনে সবচেয়ে গৰ্হিত আচরণ হচ্ছে ইনসেষ্ট’ বা অজাচার। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মধ্যে যে যৌনসংসর্গ ঘটে, তাকেই অজাচার বলা হয়। তবে যে সমাজের মধ্যে এরূপ সংসর্গ ঘটে, সেই সমাজের নীতি-বিধানের ওপরই নির্ভর করে কোনটা অজাচার, আর কোনটা অজাচার নয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যেতে পারে যে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের কোন কোন উপজাতির মধ্যে বিধবা বিমাতা ও বিধবা শাশুড়ীকে বিবাহ করার প্রথা আছে। অন্যত্র এটা অজাচার। উত্তর ভারতে বিবাহ সপিণ্ড-বিধান ও গোত্র-প্রবর-বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সেখানে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মধ্যে অজাচার ঘটবার উপায় নেই। আবার দক্ষিণাত্যে মামা-ভাগ্নী ও পিসতুতো-মামাতো ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ সামাজিক নিয়ম-কানুন দ্বারা স্বীকৃত। সেখানে এরূপ যৌনসংসর্গ অজাচার নয়। আবার প্রাচীনকালে ভ্রাতা ও ভাতৃবধুর মধ্যে যৌন-সংসর্গ অজাচার বলে গণ্য হত না। ভ্রাতা অস্বীকৃত হলে, অপরকে ডেকেও বিধবা বধূদের গর্ভসঞ্চার করানো হত। এরূপ গর্ভসঞ্চারের ফলেই মহাভারতের দুই প্রধান কুলপতি ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর জন্ম হয়েছিল। অথর্ববেদে (৮৬৭ ) পিতা-পুত্রী ও ভ্রাতা-ভগিনীর মধ্যে যৌনমিলনের উল্লেখ আছে। নহুষ তার ‘পিতৃকন্যা’ বিরজাকে বিবাহ করেছিল ও তার গর্ভে ছয়টি সন্তান উৎপাদন করেছিল।
॥ তিন ॥
মানুষের এরূপ যৌনাচারের প্রতিফলন আমরা দেবতাদের জীবনেও লক্ষ্য করি। মানুষের যৌনজীবনে যেমন সংযমের অভাব দেখা যায়, দেবতাদের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই ছিল। বস্তুতঃ দেবতাদের আমরা ইন্দ্রিয়পরায়ণ, কামাসক্ত, অজাচারী, বহুপত্নীক ও ব্যভিচারীরূপে দেখি। আর ইন্দ্রের দেবসভা, মর্ত্যের রাজারাজড়াদের অনুকরণেই কল্পিত হয়েছিল। সেই দেবসভার সঙ্গে আমরা পরবর্তীকালের মোগল বাদশাহদের দরবারের বা জমিদার-তালুকদারদের বৈঠকখানা ও বাগানবাড়ীর নাচঘরের কোন প্রভেদ দেখি না। দেবসভায় আমরা যখন অপ্সরাদের নাচতে দেখি, তখন আমাদের মনে হয় তারা যেন নাচছে মহারাজ নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুরের শোভাবাজারের রাজবাড়ীর হলঘরে ব। রাজ রামমোহন রায়ের মানিকতলা বাগানবাড়ীতে। বস্তুত দেবসভা মুখরিত হয়ে থাকত অঙ্গরাদের নাচগানে। নামজাদা অপ্সরাদের মধ্যে ছিল উর্বশী, মেনকা, রস্তা, তিলোত্তম, ঘৃতাচী, মুকেশী, মঞ্চঘোষা, অলম্বুষা, বিদ্যুৎপর্ণা, সুবাহু, মুপ্রিয়া, সরসা, পঞ্জিকাস্থল ও বিশ্বাচী। নৃত্যকলায় এরা সকলেই ছিল পারদর্শিনী। তাদের সৌন্দর্য ও যৌন আবেদনের কথা সব সময়ই বিশেষভাবে উল্লিখিত হয়েছে। তারা ছিল স্বর্গের স্বাধীন নারী। তার মানে মর্ত্যলোকের বারযোযিতদের সঙ্গে তাদের কোন প্রভেদ ছিল না।
এবার দেবতাদের যৌনজীবনের দিকে তাকানো যাক। ঋগ্বেদে দেখি যমী তার যমজ ভ্রাতা যমের কাছে সঙ্গম প্রার্থনা করছে ; দস্ত নিজ ভগিনী মায়াকে, লোভ নিজ ভগিনী নিবৃত্তিকে, ক্রোধ নিজ ভগিনী হিংসাকে ও কলি নিজ ভগিনী নিরুক্তিকে বিবাহ করছে। আবার উষা সূর্যের জনয়িত্রী। কিন্তু সূর্য প্রণয়ীর ন্যায় তার অনুগমন করছে ও তাকে স্ত্রীরূপে বরণ করছে। ( পরে দেখুন)। মৎস্যপুরাণ অনুযায়ী শতরূপ ব্ৰহ্মার কন্যা। কিন্তু ব্ৰহ্মা কন্যার রূপে মুগ্ধ হয়ে তার সঙ্গে অজাচারে লিপ্ত হন। এই কন্যার গর্ভে ব্ৰহ্মা হতে স্বায়ম্ভুব মনুর জন্ম হয়। কিন্তু অন্য মতে ইনি স্বায়ম্ভুব মনুর স্ত্রী ও স্বায়ম্ভুব মনু হতে শতরূপার গর্ভে প্রিয়ত্রত ও উত্তানপাদ নামে দুই পুত্র ও কাকুতি ও প্রস্থতি নামে দুই কন্যা জন্মগ্রহণ করে। আবার এদের পুত্রকন্যা হতে মনুষ্য জাতির উদ্ভব হয়। তার মানে জন্ম থেকেই মনুষ্যজাতির রক্তের মধ্যে অজাচারের বীজ উপ্ত হয়েছিল।
যৌনজীবনে দেবতাদের কোনরূপ সংযম ছিল না। আদিত্যযজ্ঞে মিত্র ও বরুণ উর্বশীকে দেখে কামলালসায় অভিভূত হয়ে যজ্ঞকুম্ভের মধ্যে শুক্রপাত করে। অগ্নি একবার সপ্তর্ষিদের স্ত্রীদের দেখে কামোন্মত্ত হয়েছিল। ঋক্ষরজাকে দেখে ইন্দ্র ও সূর্য দুজনেই এমন উত্তেজিত হয়েছিল যে ইন্দ্র তার চিকুরে ও সূর্য তার গ্রীবায় রেতঃপাত করে ফেলে। রামায়ণ অনুযায়ী সূর্যের বীর্য তার গ্রীবায় ও ইন্দ্রের বীর্য তার বালে ( কেশে ) পড়েছিল।
॥ চার ॥
সূর্য অজাচারী দেবতা। চন্দ্র ব্যভিচারী দেবতা। চন্দ্র দক্ষের সাতাশটি মেয়েকে বিবাহ করেছিল। কিন্তু তাতেও তার কাম-লালসা পরিতৃপ্ত হয়নি। কামাসক্ত হয়ে সে দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী তারাকে অপহরণ ও ধর্ষণ করে। দেবগুরু বৃহস্পতি নিজেও সাধু চরিত্রের দেবতা ছিলেন না। তিনি কামলালসায় অভিভূত হয়ে নিজ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রী মমতার অন্তস্বত্বা অবস্থায় বলপূর্বক তার সঙ্গে সঙ্গম করেছিলেন। আবার ঋগ্বেদে দেখি রুদ্রদেব তার নিজ কন্যা উষার সঙ্গে অজাচারে লিপ্ত হয়েছিলেন। পৌরাণিক যুগে বিষ্ণুই হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা। কিন্তু তিনিও পরস্ত্রী বৃন্দা ও তুলসীর সতীত্ব নাশ করেছিলেন।
এই তো গেল দেবলোকের যৌনজীবনের নমুনা। আগেই সূর্যের স্ত্রী উষার কথা বলেছি। উষাকে পাবার জন্য অগ্নি, সূর্য, ইন্দ্র ও অশ্বিনীদ্বয় দেবগণের মধ্যে ভীষণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। এই পাঁচজন শক্তিমান দেবতা উষার পাণিপ্রার্থী হওয়ায় প্রজাপতিগণ ঘোষণা করেন যে অনন্ত আকাশপথ অনুধাবনে যিনি কৃতকার্য হবেন ও সেই সঙ্গে যত বেশী স্বরচিত বেদমুক্ত উচ্চারণ করতে পারবেন তারই হাতে উষাকে সমর্পণ করা হবে। এই পথের কথা শুনে অগ্নি, ইন্দ্র ও সূর্য আজীবন অগ্রসর হন, কিন্তু তাদের সে চেষ্টা বিফল হয়। তখন অশ্বিনীদ্বয় ইন্দ্রের কাছ থেকে বেদমুক্ত লাভ করে সফল হন ও উষাকে লাভ করেন। কিন্তু এরা সূর্যের অনুচর বলে উষাকে প্রতিগ্রহ করেন নি। তখন সূর্য উষাকে স্ত্রীরূপে বরণ করেন।
॥ পাঁচ ॥
বৈদিক দেবতাদের মধ্যে ইন্দ্রের স্থানই সর্বাগ্রে। ঋগ্বেদের তৃতীয় মণ্ডলে উক্ত আছে যে দেবগণ অসুরগণকে বধ করবার জন্য তাকে সৃষ্টি করেছিলেন। দেবমাতা অদিতি তার মা। আর অদিতির বোন দিতি হচ্ছে দৈত্য বা অসুরগণের মা।
ইন্দ্র অত্যন্ত সুরা ( সোমরস ) পায়ী। ঋগ্বেদে বলা হয়েছে যে সোমরস পান করে ইন্দ্রের উদর স্ফীত হয়েছে। ইন্দ্র নিজ পিতার কাছ থেকেও কেড়ে নিয়ে সুরাপান করে। তার উদর হচ্ছে সোমরসের হ্রদ। তিনি একতন্ত্রী দেবতা। শত অশ্বমেধ যজ্ঞের ফলে পাছে কেউ ইন্দ্রত্ব লাভ করে, সেই ভয়ে ইন্দ্র তপস্বীদের তপস্যা ও সাধনার নানা বিঘ্ন ঘটান। এই কাজে তিনি অঙ্গরাদের নিযুক্ত করেন।
ইন্দ্রের স্ত্রী ইন্দ্রাণী বা শচী। তৈত্তিরীয়ব্রাহ্মণ অনুযায়ী ইন্দ্র তার যৌন আবেদনে আকৃষ্ট হয়ে অত্যান্ত সুন্দরীদের প্রত্যাখ্যান করে ইন্দ্রাণীকে বিবাহ করেছিল। অন্য মতে ইন্দ্র ইন্দ্রাণীর সতীত্ব নষ্ট করে, এবং শাপ থেকে রক্ষা পাবার জন্য ইন্দ্রাণীর পিতা পুলমাকে হত্যা করে ইন্দ্রাণীকে বিয়ে করেছিল।
ইন্দ্র যে মাত্র ইন্দ্রাণীর সতীত্ব নষ্ট করেছিল, তা নয়। মহাভারত অনুযায়ী ইন্দ্র গৌতম মুনির অনুপস্থিতিতে গৌতমের রূপ ধারণ করে তাঁর স্ত্রী অহল্যার সতীত্ব নাশ করেছিল। ইন্দ্র এইভাবে মর্ত্যলোকে এসে মানবীদের সঙ্গে মিলিত হত। এইভাবে বালী ও অর্জুনের জন্ম হয়েছিল। ধর্মও মর্ত্যে এসে মানবীদের সঙ্গে মিলিত হতেন। ধর্মের ঔরসেই কুন্তীর গর্ভে যুধিষ্ঠিরের জন্ম হয়। অনুরূপভাবে অগ্নির ঔরসে মাহিষ্মতী নগরীর ইক্ষাকুবংশীয় রাজকন্যা সুদর্শনার গর্ভ হয়। পবনদেবও হনুমানের পিতা কেশরীরাজের স্ত্রী অঞ্জনার গর্ভে এক পুত্র উৎপাদন করেছিলেন। সেই পুত্রই হনুমান।
পাছে কেউ ইন্দ্রের আসন অধিকার করে, এই ভয় ইন্দ্রের সব সময়েই ছিল। রামায়ণে কথিত আছে একবার রাবণ স্বর্গে গিয়ে স্বৰ্গরাজ্য অধিকারের জন্য ইন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল। রাবণ-পুত্র মেঘনাদ কর্তৃক পরাজিত হয়ে ইন্দ্র লঙ্কায় নীত হয়। এ জন্যই মেঘনাদ ইন্দ্রজিৎ নামে সুপরিচিত। ব্ৰহ্মা ইন্দ্রের মুক্তি দিতে অস্বীকৃত হয়। ব্ৰহ্মা প্রত্যাখ্যান করলে, ইন্দ্রজিৎ এমন এক রথ প্রার্থনা করে যে রথে আরোহন করে যুদ্ধযাত্রা করলে ইন্দ্রজিৎ অবধ্য হবে। অভীষ্ট বরের বিনিময়ে ব্রহ্ম ইন্দ্রকে মুক্ত করেন এবং বলেন যে অহল্যার সতীত্ব নাশের জন্যই ইন্দ্রের এই দুৰ্গতি।
একবার ইন্দ্র ব্ৰহ্মহত্যা ও বৃত্ৰাসুরকে মিথ্যাচারে বধ করে শ্রান্ত ও অচেতন হয়ে জলমধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে অবস্থান করছিলেন। তখন দেবতা ও মহৰ্ষিরা নতুষকে দেবরাজ করেন। কিন্তু কথায় বলে, যে আসে লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। ইন্দ্রত্ন লাভ করে নতুষ কামপরায়ণ ও বিলাসী হয়ে, ইন্দ্রের স্ত্রী শচীকে পাবার আকাঙ্খা করে। শচী বৃহস্পতির শরণাপন্ন হয়। তারপর কৌশল করে বৃহস্পতি স্বৰ্গলোক থেকে নতুষের পতন ঘটান ও শচীকে রক্ষা করেন।
ইন্দ্র যে মাত্র পরস্ত্রীর সতীত্ব নষ্ট করেছিল, তা নয়। সে পরনারীর গর্ভনাশও ঘটিয়েছিল। অমৃতলাভের জন্য দেবামুরের মধ্যে যুদ্ধে দেবতারা যখন ইন্দ্রকে হত্যা করতে পারে, এমন এক সন্তান প্রার্থনা করে, তখন কশ্যপ বলেন, দিতি যদি এক সহস্ৰ বৎসর শুচি হয়ে থাকে, তবে প্রার্থিত পুত্র লাভ করবে। ৯৯০ বৎসর তপস্যা করবার পর দিতি একদিন পা না ধুয়ে নিদ্রা যাচ্ছিল। ইন্দ্র তাকে অশুচি জ্ঞানে তার উদরে প্রবেশ করে বজ্রদ্বারা তার গর্ভ সপ্তখণ্ড করে।
॥ ছয ॥
এতক্ষণ দেবলোকের পুরুষদের যৌন চরিত্রের কথা বলা হয়েছে। এখন দেবলোকের দেব-স্ত্রীদের কথা কিছু বলি স্বাহা দক্ষের কন্যা। ইনি অগ্নিকে কামনা করতেন। একবার সপ্তর্ষিদের যজ্ঞে অগ্নি সপ্তর্ষিদের স্ত্রীদের দেখে কামার্ত হয়ে ওঠেন। স্বাহা এটা লক্ষ্য করেন। স্বাহা তখন এক এক ঋষিপত্নীর রূপ ধরে ছয়বার অগ্নির সঙ্গে মিলিত হন। এবং ছয়বারই অগ্নির বীর্য কাঞ্চনকুণ্ডে নিক্ষেপ করেন। এই ঘটনার পর সপ্তর্ষির তাদের স্ত্রীদের সন্দেহ করে পরিত্যাগ করে। সপ্তর্ষিদের অন্যতম বশিষ্ঠের স্ত্রী অরুন্ধতীর তপঃপ্রবাহে স্বাহা আর তার নিজের রূপ ধারণ করতে পারেন নি। বিশ্বামিত্র প্রকৃত ব্যাপার জানতেন বলে তিনি ঋষি-পত্নীদের নির্দোষী বলেন। কিন্তু ঋষিরা তা বিশ্বাস করেন না। পরে স্বাহ৷ অগ্নির স্ত্রী হন। কিন্তু স্বর্গে গিয়েও স্বাহার স্বভাব পরিবর্তিত হয় না। তিনি নিজ স্বামীকে ছেড়ে, কৃষ্ণকে স্বামীরূপে পাবার জন্য তপস্যা করতে লাগলেন। বিষ্ণুর বরে স্বাহা দ্বাপরে নগ্নজিৎ রাজার কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করেন ও কৃষ্ণকে স্বামীরূপে পান।
॥ সাত ॥
দেবতাদের মধ্যে শিবই হচ্ছেন সবচেয়ে সংযমী দেবতা। তিনি সংহারকর্তা। আবার সংহারের পর নূতন জীবনের তিনি সৃষ্টি করেন। সে জন্য তাঁর নাম শঙ্কর। সৃষ্টির রক্ষক হিসাবে তার প্রতীক লিঙ্গ বা প্রজননের চিহ্ন। এই প্রতীকের সঙ্গে যোনি বা স্ত্রীশক্তি সংযুক্ত হয়ে তিনি সর্বত্র পূজিত হন। কিন্তু তিনি মহাযোগী, সর্বত্যাগী, সন্ন্যাসী, কঠোর তপস্যা ও নিগুৰ্ণ ধ্যানের প্রতীক-স্বরূপ। তিনি পত্নীপরায়ণ দেবতা। সে জন্যই মেয়ের শিবের মত পতি প্রার্থনা করে। শিব প্রথম বিয়ে করেছিলেন দক্ষের মেয়ে সভ্যতাকে ভৃগুযজ্ঞে শিব শ্বশুরকে প্রণাম করেন নি বলে, দক্ষ ক্রুদ্ধ হয়ে শিবহীন যজ্ঞ করেন। সতী অনিমন্ত্রিতা হয়েও এই যজ্ঞে উপস্থিত হন। সেখানে সতীর কাছে দক্ষ শিবনিন্দ শুরু করায় সতী যজ্ঞস্থলে দেহত্যাগ করেন। শিবের কাছে যখন এই খবর যায় তখন শিব ক্রুদ্ধ হয়ে নিজের জটা ছিড়ে ফেলেন। সেই জটা থেকে বীরভদ্রের উদ্ভব হয়। বীরভদ্র দক্ষালয়ে গিয়ে দক্ষযজ্ঞ নাশ করে দক্ষের মুগুচ্ছেদ করে। শিব সতীর মৃতদেহ নিয়ে মৃত্য করতে শুরু করলে প্রলয়ের আশঙ্কায় বিষ্ণু সুদৰ্শন চক্রদ্বারা সতীর দেহ খণ্ড খণ্ড করে কেটে ফেলেন।
এরপর সতী হিমালয়ের পত্নী মেনকার গর্ভে পার্বতীরূপে জন্মগ্রহণ করে শিবকে পাবার জন্য কঠোর তপস্যা করে। শিবও তখন কঠোর তপস্যায় রত ছিলেন। শিব ও পার্বতীর মিলন করাতে এসে মদন শিবের কোপে পড়ে ভস্মীভূত হন। তারপর শিব ও পার্বতীর মিলন হলে, মদন পুনর্জীবন লাভ করেন। শিব ও পার্বতীর দাম্পত্যজীবন খুবই রমণীয়। একবার পার্বতী কৌতুক করে শিবের দুটো চোখ হাত দিয়ে চেপে ধরে। তাতে সমস্ত জগৎ অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয় ও আলোর অভাবে সমস্ত জগৎ বিনষ্ট হবার উপক্রম হয়। শিব তখন জগৎরক্ষার জন্য ললাটে তৃতীয় নেগ্র উদ্ভব করেন। সেই থেকে শিবের তিন নেত্র। শিব কামগামী দেবতা নন, যদিও অর্বাচীন কালের সাহিত্যে শিবকে কোচপাড়ায় গিয়ে কুচনীদের সঙ্গে প্রেম করার কাহিনী রচিত হয়েছে। কিন্তু প্রাচীন শাস্ত্রে শিব ব্যভিচারী দেবতা নন।
॥ আট ॥
মনুষ্যলোকে যেমন আমরা মানুষের কৌতুহল দেখি অপরের রমণক্রিয়া দেখবার, দেবতাদেরও সেরূপ কৌতুহলজনক প্রবৃত্তি ছিল। কালিদাসের কুমারসম্ভবে আমরা দেখি যে উমার সহিত মহাদেবের রমণকালে অগ্নিদেব পারাবতাকারে সেই রমণক্রিয়া দেখেছিলেন। উমাদেবী অগ্নিদেবকে দেখে লজ্জাবশতঃ রমণক্রিয় হতে নিবৃত্ত হন ও মহাদেব ক্রোধবশতঃ তার বীর্য অগ্নিদেবের প্রতি নিক্ষেপ করেন। অগ্নিদেব সে বীর্ষের তেজ সহ্য করতে না পেরে তা গঙ্গায় বিসর্জন দেন নয়।
এবার স্বর্গের এক অনুপম প্রেম কাহিনীর কথা বলব। কচ ও দেবযানীর কথা। কচ দেবগুরু বৃহস্পতির পুত্র। আর দেবযানী দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের মেয়ে। দেবতাদের সঙ্গে নিহত অসুরদের শুক্রাচার্য সঞ্জীবনী বিদ্যাবলে পুনজীবিত করতেন। দেবতারা এ বিদ্যা জানতেন না। দেবতারা তখন কচকে শুক্রাচার্যের সমীপস্থ হয়ে, তার প্রিয় কন্যা দেবযানীকে সন্তুষ্ট করে মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা আয়ত্ত করতে বলেন। কচ হাজার বছরের জন্ত শুক্রাচার্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। কচ গুরু ও গুরুকন্যার সেবারত হয়ে পূর্ণ ব্রহ্মচর্য পালন করতে থাকে। ঘটনাচক্রে দেবষানী রূপবান কচের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। কিন্তু পাচশ বৎসর অতীত হবার পর, অসুররা কচের অভিসন্ধি বুঝতে পারে। তারা, একদিন গোচারণকালে কচকে বধ করে তার মাংস কুকুরকে খাইয়ে দেয়। দেবযানীর অনুনয়ে শুক্রাচার্য র্তার সঞ্জীবনী বিদ্যার প্রভাবে কচকে পুনর্জীবিত করেন। এরপর অসুররা কচকে আবার হত্যা করে। শুক্রাচার্য কচকে আবার জীবিত করেন। তৃতীয়বার অসুররা কচকে ভস্ম করে সেই ভস্ম সুরার সঙ্গে মিশিয়ে শুক্রাচার্যকে পান করতে দেন। দেবযানী পুনরায় কচের জীবন প্রার্থনা করলে শুক্রাচার্য বলেন যে কচকে পুনর্জীবিত করতে হলে তার মৃত্যু অনিবার্য, কেননা তার উদর বিদীর্ন না করলে কচ পুনর্জীবিত হবে না। এই কথা শুনে, দেবযানী শুক্রাচার্যকে বলে, তাদের দুজনার মৃত্যুই তার কাছে শোকাবহ, এবং কারুর মৃত্যু ঘটলে তারও মৃত্যু অনিবার্য। তখন শুক্রাচার্য কচকে সঞ্জীবনী-বিদ্যা দান করে বলেন যে তুমি পুত্ররূপে আমার উদর থেকে নির্গত হয়ে আমাকে সঞ্জীবনী মন্ত্রদ্বারা পুনজীবিত কর। কচ শুক্রাচার্যের পেট থেকে বেরিয়ে এসে তাকে পুনর্জীবিত করে এক হাজার বৎসর উত্তীর্ণ হলে কচ স্বৰ্গলোকে ফিরে যেতে চায়। দেবযানী তখন তাকে প্রেম নিবেদন করে তাকে বিয়ে করতে চায়। কচ বলে, দেবযানী তার গুরুকন্তী, সেজন্য তাকে বিয়ে করা তার পক্ষে একেবারে অসম্ভব। দেবযানী পীড়াপীড়ি করাতে কচ আবার বলে, ‘শুক্রাচার্যের দেহ থেকে তোমার উৎপত্তি, আমিও শুক্রাচার্যের দেহে বাস করেছি, সুতরাং তুমি আমার ভগিনী। সেজন্য এ বিবাহ একেবারে অসম্ভব।’ দেবযানী তখন রেগে গিয়ে অভিশাপ দেয় যে কচ যে সঞ্জীবনী বিদ্যা শিখেছে, তা ফলবতী হবে না। কচও দেবযানীকে অভিশাপ দিয়ে বলে, তোমার কামনাও সিদ্ধ হবে না। কোন ব্রাহ্মণ বা ঋষিপুত্র তোমাকে বিবাহ করবে না। তোমার অভিশাপে আমার বিদ্যা বিফল হলেও, আমি ষাকে এ বিদ্যা দেব, তার এ বিদ্যা ফলবতী হবে। এই বলে কচ স্বৰ্গলোকে চলে যায়। এরপর রাজা যযাতির সঙ্গে দেবযানীর বিবাহ হয়। তবে সে আর এক দীর্ঘ কাহিনী। তা পরে বিবৃত করেছি।
॥ দশ ॥
শুক্র ও দেবযানীর উদ্ভব সম্বন্ধে এখানে কিছু বলা প্রাসঙ্গিক হবে। শুক্র মানে বীর্য, যা পুরুষের শিশ্নমুখ দিয়ে নির্গত হয়। দৈত্যগুরু শুক্রের এরূপ বিচিত্র নাম হল কেন ? মহাভারতের শান্তিপর্বে পিতামহ ভীষ্ম তা যুধিষ্ঠিরের কাছে ব্যাখ্যা করেছিলেন। শুক্রাচার্যের আদি নাম ছিল দেবর্ষি উশনা। গোড়ায় তিনি দেবদ্বেষী ছিলেন না। একবার দেবগণের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য অসুররা দেবর্ষি উশনার মা ভূগুপত্নীর আশ্রমে আশ্রয় নিয়েছিল। দেবতারা সেখানে প্রবেশ করতে পারেনি। বিষ্ণু তখন তার চক্র দিয়ে ভৃগুপত্নীর শিরচ্ছেদন করেন। এই ঘটনার পর দেবর্ষি উশনা দেবদ্বেষী হন। একদিন তিনি যোগবলে কুবেরকে বদ্ধ করে তার সমস্ত ধন অপহরণ করেন। কুবের মহাদেবের কাছে অভিযোগ করে। মহাদেব কুবেরের অভিযোগ শুনে শূল হস্তে উশনাকে মারতে আসেন। উশনা মহাদেবের শূলের ডগায় আশ্রয় নেন। মহাদেব উশনাকে ধরে মুখে পুরে গ্রাস করে ফেলেন। তার ফলে উশনা মহাদেবের পেটের ভিতর থেকে যায়। মহাদেব মহাহদের জলের মধ্যে দশ কোটি বৎসর তপস্যা করেন। পেটের ভিতর থাকার দরুন, এই তপস্যার ফল উশনাতেও অর্শায়। মহাদেব জল থেকে উঠলে, উশনা মহাদেবের পেট থেকে বেরিয়ে আসার জন্ত বারম্বার প্রার্থনা করে। মহাদেব বলে তুমি আমার শিশ্নমূখ দিয়ে নির্গত হও। মহাদেবের শিশ্নমুখ দিয়ে নির্গত হওয়ার দরুণ, তার নাম হয় শুক্র। মহাদেব শুক্রকে দেখে আবার শূল দিয়ে তাকে মারতে যান। এমন সময় ভগবতী বলেন শুক্র আমার পুত্র। তোমার পেট থেকে যে নির্গত হয়েছে, তাকে তুমি মারতে পার না।
কিন্তু কাহিনীটার শেষ এখানে নয়। হরিবংশ অনুযায়ী বিষ্ণু শুক্রের মার শিরচ্ছেদ করেছিলেন বলে শুক্রের পিতা মহর্ষি ভৃগু ক্রুদ্ধ হয়ে বিষ্ণুকে অভিশাপ দেন যে স্ত্রীবধ-হেতু পাপের জন্য বিষ্ণুকে সাতবার মনুষ্যলোকে জন্মগ্রহণ করতে হবে। তারপর তিনি মন্ত্রবলে শুক্রজননীকে আবার জীবিত করে তোলেন। এই ঘটনার পর দেবতারা ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। সবচেয়ে বেশী ভয় পান ইন্দ্র। কেননা মহাদেবের আদেশে শুক্র ব্রহ্মচারী হয়ে তপস্যা করেছিলেন এক প্রার্থিত বর পাবার জন্ত ! ইন্দ্র শুক্রের এই তপস্যা ভঙ্গ করবার জন্য নিজ কন্যা জয়ন্তীকে শুক্রের কাছে পাঠিয়ে দেন। দীর্ঘকাল তপস্যার পর শুক্র তার ইন্সিত বর পান। এদিকে জয়ন্তীর ইচ্ছানুসেের শুক্র অদৃশ্য হয়ে থেকে জয়ন্তীকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেন। সেই সুযোগে বৃহস্পতি শুক্রের রূপ ধরে অসুরদের মধ্যে আসেন ও অসুররা তাকে প্রকৃত শুক্র ভেবে গুরু হিসাবে সংবৰ্দ্ধনা করেন। অদৃশ্য অবস্থায় থাকাকালীন শুক্রের ঔরসে ও জয়ন্তীর গর্ভে দেবযানী নামে এক কন্যা হয়। শুক্র যখন ফিরে এল, অসুররা তখন তাকে চিনতে না পেরে তাড়িয়ে দেয়। তারপর যখন তারা বৃহস্পতির ছলনা বুঝতে পারল, তখন তারা শুক্রকে গ্রহণ করে তার কোপ নিবৃত্ত করল।
আগেকার দিনে দেবতারা যেমন মর্ত্যে আসতেন, মর্ত্যের লোকও স্বর্গে ষেত। পরবর্তীকালের এক কাহিনী অনুযায়ী মর্তবাসিনী নেতা স্বগের ধোবানী ছিল, এবং তার সাহায্যে বেহুলা দেবসভায় গিয়েছিল। যাক, বৈদিক যুগের কথাই বলি। শতপথব্রাহ্মণ অনুযায়ী রাজা পুরুরবা একবার দেবসভায় আহুত হয়েছিলেন। দেবসভায় নৃত্যকালে পুরুরবার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকালে উর্বশীর তালভঙ্গ হয়। ফলে ইন্দ্রের শাপে উৰ্বশীকে মর্ত্যে এসে বাস করতে হয়। মর্ত্যে এসে পুরুরবা ও উর্বশী পরস্পর প্রণয়াসক্ত হয়ে পড়ে। উর্বশী কয়েকটি শর্তে পুরুরবার স্ত্রীরূপে থাকতে সম্মত হয়। মহাভারতের বনপর্ব অনুযায়ী পাণ্ডুপুত্র অর্জনও দিব্যাস্ত্র সংগ্রহের জন্য স্বর্গে গিয়েছিলেন এবং সেখানে পাঁচ বৎসর বাস করেছিলেন। সে সময় উর্বশী তার কাছে তার প্রেম নিবেদন করেছিল। কিন্তু অর্জুন তা প্রত্যাখান করেছিলেন। রামায়ণ অনুযায়ী রাবণও একবার স্বর্গে গিয়ে স্বৰ্গরাজ্য অধিকারের জন্য ইন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল। নহুষকেও দেবতারা স্বর্গে নিয়ে গিয়ে ইন্দ্রের আসনে বসিয়েছিলেন।
॥ এগার ॥
দেবলোকের যৌনজীবন সম্পর্কে উপরে যে সকল ঘটনা বিবৃত করা হয়েছে, সেগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দেবলোকের একটা কদৰ্য আলেখ্য অঙ্কনের উদ্দেশ্যে সেগুলোর এখানে সমাবেশ করা হয়নি। যে পরিমণ্ডলের মধ্যে এই সকল ঘটনা ঘটেছিল সেই পরিমণ্ডলকে আমরা দেবসমাজ বলে অভিহিত করতে পারি। মানুষ যখনই তার নিজ প্রতিচ্ছবিতে তার দেবতাকে কল্পনা করেছিল, তখনই সে দেবসমাজকে তার নিজ সমাজেরই ভাবমূর্তি নিয়ে কল্পনা করে নিয়েছিল। তার মানে মনুষ্যসমাজের আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি ও আচরণ সবই দেবসমাজেও আরোপিত হয়েছিল। সেজন্য মর্ত্যের রাজসভায় বিলাসমণ্ডিত ও লাস্যময় পরিবেশের প্রতিবিম্বই ইন্দ্রের দেবসভায় দেখতে পাই। সুন্দরী স্ত্রীলোক দেখলে তার প্রতি আসক্ত হওয়া বা চিত্তদেীর্বল্যের প্রতিঘাতে রেতস্থলন হয়ে যাওয়া, দেবলোক ও মনুষ্যলোক, এই উভয় লোকেরই কোন বিচিত্র ব্যাপার নয়। নারীহরণ মনুষ্যসমাজে যেমন আছে, দেবসমাজেও তাই ছিল। গুরুপত্নীর সঙ্গে ব্যভিচার প্রাচীন ভারতে সচরাচর ঘটত। ধর্মশাস্ত্রকারগণ এর নাম দিয়েছিলেন গুরুতল্ল। সুতরাং চন্দ্রের গুরুপত্নী তারার সঙ্গে ব্যভিচার কোন অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। আবার দ্রৌপদীর বা জানকীর বিবাহসভার প্রতিবিম্বই আমরা ইন্দ্র, সূর্য প্রভৃতি দেবতাগণের উষার পানিপ্রার্থী হওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে দেখি ভগিনী বিবাহ প্রাচীন ভারতে প্রচলিত ছিল। তার বহু উল্লেখ আমরা জাতক কাহিনী সমূহে ও জৈন সাহিত্যে পাই। পরবর্তীকালের সামাজিক রীতিনীতি অনুযায়ী এগুলো অবশ্য গহিত আচরণ ছিল। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, কোনো সমাজ কখনও স্থিতিশীল হয়ে একই জায়গায় অনড় অবস্থায় দাড়িয়ে থাকে না। যুগে যুগে তার রীতিনীতির পরিবর্ত ঘটে। দেবসমাজেরও এরূপ বিবর্তন ঘটেছিল। যেমন, যদিও এক সময় ভাই-বোনের মধ্যে মিলন স্বীকৃত হয়েছিল, পরবর্তীকালে আবার কচ-দেবযানীর কাহিনী থেকে জানতে পারা যায় ষে এরূপ মিলন অজাচার বলেই পরিগণিত হয়েছিল। বস্তুতঃ যেটা প্রচলিত রীতি, সেটাই অনুমোদিত রীতি। সেজন্য একজন বিখ্যাত মৃতত্ববিদ উইলিয়াম গ্রাহাম সামনার বলছেন যে mores can set anything right। তবে ইন্দ্র ও বিষ্ণুর অনেক আচরণ প্রশ্নাতীত। ইন্দ্র বৈদিক যুগের দেধরাজ, আর বিষ্ণু পৌরাণিক যুগের দেবাধিপতি। মানবীয় জগতে যেমন বলা হয় রাজার বেলায় কোন নিয়ম-কানুন খাটে না (King is above law), দেবলোকেও ইন্দ্র ও বিষ্ণু সম্বন্ধে সেই একই কথা বলা চলে। তবে মানুষের হাতে অভিশপ্ত হওয়ার হাত থেকে তাদের অব্যাহতি ছিল না। গৌতম, বৃন্দা ও তুলসীর অভিশাপ তার দৃষ্টান্ত। মনুষ্যসমাজে যৌন অনাচারের জন্য যেমন অপরাধীকে একঘরে করে দেওয়া হত, দেবসমাজেও তেমনই অপরাধীকে সমাজবহির্ভূত করে মর্ত্যে পাঠানো হত।
মনে রাখতে হবে যে মনুষ্যসমাজে কোনদিন ব্রহ্মচর্য পালন সাধারণ বিধি ছিল না। দেবসমাজেও নয়। মানুষ যখন দেবতাদের তার নিজ প্রতিচ্ছবিতে কল্পনা করেছিল, তখন দেবতাদেরও physiological e biological needs দিয়েছিল। সেজন্যে মানুষের মত দেবতারাও বিবাহ করতেন, সন্তান উৎপাদন করতেন, পরিবার গঠন করতেন, আবার ব্যভিচারও করতেন। এক কথায় যৌন জীবনচর্যায় দেবলোকের সঙ্গে মনুষ্যলোকের বিশেষ কোন বিভেদ ছিল না।
লেখা অসঙ্গত, তথ্যের দিক থেকে বলছি না। অনেক বানান ভুল আছে, অনেক বাক্য বোঝাা যাচ্ছে না