০১. দেবগ্রামের পথে

দেবগ্রামের পথে পাশের বড় গ্রাম হইতে গাজনের সঙ আসিয়া হাজির হইয়াছে। একজন ঢাকী বড় একখানা ঢাক নাচিয়া নাচিয়া বাজাইতেছে। তাহার সঙ্গে কাসি ও শিঙা। দলটাকে অনেক। দূরে দেখা যাইতেছে। দেবগ্রামে গাজন নাই। নবগ্রামের গাজনও এ গ্রামে আসে না। এবার। ব্যাপারটা নতুন।

দক্ষিণ পাড়ার মণ্ডলবাড়ি হইতে বাহির দরজায় বধূ দুটি ছুটিয়া আসিয়া দাঁড়াইল।

গ্রামের সবচেয়ে সমৃদ্ধ মণ্ডলবাড়ি। মাটির ঘর টিনের চাল, পাকা মেঝে। বারান্দায় সুন্দর গড়নের কাঠের খুঁটি। সেতাব ও মহাতাপ মণ্ডলের বাড়ি। বধূ দুইটি দুই ভায়ের স্ত্রী কাদম্বিনী ও মানদা। কাদম্বিনী ঈষৎ দীর্ঘাঙ্গী, তন্বী এবং শ্যামবৰ্ণে চমৎকার লাবণ্যময়ী মেয়ে। মানদা মাথায় খাটো, একটু লাঙ্গী। কাদম্বিনী নিঃসন্তান, বয়স চব্বিশ-পঁচিশ, মানদার বয়স সতেরআঠের—একটি সন্তানের জননী মানদা।

ওদিকে গাজনের সঙের দল অন্য একটা রাস্তায় ভাঙিয়া ঢুকিয়া যাইতে শুরু করিল। ঢাকের বাজনার শব্দ বাঁকের আড়ালে পড়িয়া কম হইয়া আসিল।

মানদা বলিল, মরণ! ওরাস্তায় ঢুকে গেল যে মড়ার দল।

কাদম্বিনী গবেষণা করিয়া বলিল, বোধহয় ও-পাড়ায় মোটা মোড়লের বাড়ি গেল।

—মোটা মোড়লের বাড়ি? কেন? আমাদের বাড়ির চেয়ে মোটা মোড়লের খাতির বেশি। নাকি?

—তা বয়সের খাতির তো আছে। তা ছাড়া দিতে-থুতে মোটা মোড়লর নাম যে খুব।

ঠোঁটে পিচ কাটিয়া মানদা বলিল, নাম! বলে যে সেইভেতরে ছুঁচোর কেন, বাইরে কোচার পত্তন, তাই। এদিকে তো দেয় শুনি একগলা জল। ইরে দেওয়া-থোয়ার নাম।

কাদম্বিনী একটু শাসনের সুরেই বলিল, ছি, এমন করে কথা বলে না। হাজার হলেও মান্যের লোক। এখন চল, হাতের কাজ সেরে নিই। গায়ে যখন এসেছে তখন এদিকেও আসবে।

তাহারা বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়া গেল।

প্রথমেই গোশালা। গরুগুলি চালায় বাঁধা। দ্বিপ্রহরের রৌদ্রের মধ্যে শুইয়া আছে, রোমন্থন করিতেছে, একটা রাখাল গরুর গায়ে তাকিয়ার মত হেলান দিয়া ঘুমাইতেছে।

তাহার পর খামার-বাড়ি।

খামার-বাড়িতে ঢুকিতেই এক কলি গান ও দুপদুপ শব্দ শুনিতে পাওয়া গেল। গমের উপর বাঁশ পিটিয়া গম ঝরাইতে ঝরাইতে কৃষাণটা গান করিতেছে–

চাষকে চেয়ে গোরাচাঁদরে মান্দেরী ভাল।

গমের চারিপাশে পায়রা জমিয়া গম খাইতেছে।

কাদম্বিনী ফিক করিয়া হাসিয়া বলিল, কেন রে নোটন, এত আক্ষেপ কেন?

জিভ কাটিয়া নোটন বলিল, আজ্ঞে মুনিব্যান?

–চাষের চেয়ে মান্দেরী ভাল বলছিস?

–আজ্ঞে মুনিব্যান, মান্দেরী হলে কি আজ আর গম ঝরাতাম গো। চলে যেতাম গাজনের ধুম দেখতে।

মানদা বলিল, এবার গাজনের ধুম যে দেখি খুব নোটন। দুখানা গেরাম পার হয়ে আমাদের গাঁয়ে এল।

—সে তো আমাদের ছোট মোড়লের কাও গো। তুমিই তো ভাল জানবে ছোট মুনিব্যান। কাদম্বিনী সবিস্ময়ে প্রশ্ন করি, কার? মহাতাপের?

–হাঁ গো। আজ কদিন সে হোথাকেই রয়েছে।

–সে কি? সে যে গেল শ্বশুরকে দেখতে! মানুর বাপের অসুখ

মানদা তাহার দিকে অগ্নিদৃষ্টি হানিয়া বলিল, শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না বড়দি। শুধু শুধু আর মিছে কথাগুলো বোলো না তুমি!

–মানু! কি বলছিস তুই?

–ঠিক বলছি গো, বড় মোল্যান। সে যে যায় নাই, তা তুমি জান।

–আমি জানি।

–জান না? যদি না জান তবে আমার যাওয়া তুমি বন্ধ করলে ক্যানে?

—এই গরমে ছ ক্ৰোশ পথ থোকাকে নিয়ে যাবি, খোকার অসুখবিসুখ করবে, তাই বারণ করলাম। বললাম-ঠাকুরপো দেখে আসুক।

মিছে কথা। আমি জানি, আমি বুঝি। বুঝেছ, আমি সব বুঝি। আমার বাপের বাড়ি যাবে? তার চেয়ে চার দিন গাজনে নেশাভাঙ করুক, ভূতের নাচন নাচুক, সেও ভাল। আমি সব বুঝি।

মানদা হনহন করিয়া চলিয়া গেল খামার-বাড়ি পার হইয়া বাড়ির ভিতর দিকে। খামারবাড়ির ও-দিকে পাচিলের গায়ে একটা দরজা। সেই দরজাটাকে সবলে ঠেলিয়া দিয়া ভিতরে ঢুকিয়া গেল। কাদম্বিনী দাঁড়াইয়া রহিল। খানিকটা ভাবিয়া দেখিয়া বলিল, তুই ঠিক জানিস নোটন, ঘোট মোড়ল আজ কদিন নবগ্যেরামের গাজনে মেতে সেইখানেই রয়েছে?

–এই দেখ! আমি নিজে চোখে দেখে এসেছি গো। রোজ দেখা হচ্ছে।

–বলিস নাই ক্যানে?

—তার আর বলব কি বল? আর কি বলে, ছোট মোড়ল বললে—নোটন, বলিস না বাড়িতে, তা হলে দেব কিল ধমাধম। ছোট মোড়লের কিল বড় কড়া, তেমুনি ভারি, আষিঢ়ে তাল।

–হুঁ। কাদম্বিনী বাড়ির দিকে অগ্রসর হইল।

নোটন পিছন হইতে বলিল, বড় মোল্যান!

–কি?

–ছোট মোড়ল কিন্তু চাঁপাডাঙা গিয়েছিল।

–গিয়েছিল? গিয়েছিল তো নবগ্রামে থাকল কি করে?

–ওই দেখ! ছ কোশ ছ কোশ বার কোশ রাস্তা ছোট মোড়লের কাছে কতক্ষণ! যেদিন সকালে গিয়েছে, তার ফেরা দিন ফিরেছে। এসে নবগ্যেরামেই জমে যেয়েছে। ভাঙ খেয়েছে, বোম্বোম্ করছে; আর পড়ে আছে। শোনলাম, দশ টাকা চাঁদা দিয়েছে।

—দশ টাকা?

–হ্যাঁ।

–দশ টাকা?

–হ্যাঁ গো। ছোট মোল্যান তিরিশ টাকা দিতে দিয়েছিল বাপের বাড়িতে। তা থেকে দশ টাকা ছোট মোড়ল খয়রাত করে দিয়েছে।

—তোকে কে বললে?

—কে আবার! খোদ ছোট মোড়ল নিজে। সে সেই প্রথম দিনের কথা। যে দিনে যায় সেই দিনের। নবগ্যেরামে চাঁদা দিয়েটিয়ে ভাবছে-কি করি! আমার সাথে দেখা। বলে—দশ টাকা তু ধার এনে দে নোটন। বলে দোব, বড় বউ তোকে দেবে। তা কি করব? এনে দেলাম।

বড় বউ কাদম্বিনীর মুখে একটু হাসি ফুটিয়া উঠিল। হাসিয়াই সে বলিল, আর কাউকে এ কথা বলিস না নোটন, তোর টাকা আমি দোব।

বলিয়া সে বাড়ির ভিতর ঢুকিয়া গেল।

বাড়ির উঠানে ছোলা কলাই মেলিয়া দেওয়া রহিয়াছে। পাশে দুইটা ঝুড়িতে কতক তোলা হইয়াছে। বধূ দুইটি ছোলা তুলিতে তুলিতেই উঠিয়া গিয়াছিল, দেখিয়াই বোঝা যায়।

একটা ছাগল সেগুলো নির্বিবাদে খাইতেছে। দুইটি ছানা পিছনে দাঁড়াইয়া আছে, লাফাইতেছে।

ছোট বউ মানদা একটা দাওয়ায় দেওয়ালে ঠেস দিয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিতেছে।

বড় বউ ঘরে ঢুকিয়াই ছাগলটাকে তাড়াইল—মর ম সব্বনাশী রাক্ষসী, বেরো, দূর হ।

ছাগলটা পলাইল।

বড় বউ ঝুড়ি টানিয়া লইয়া বলিল, তুই বসে বসে দেখলি মানু? তাড়ালি না?

–আমার ইচ্ছে।

–আমার খুশি।

–তোর খুশি?

–হ্যাঁ। খুশি। বলি, কেন তাড়াব? কি গরজ? এ সংসারে আমার কি আছে? কি হবে?

বড় বউ তুলিতে তুলিতে বলিল, এত রাগ করে না। দিনে-দুপুরে কঁদে না, কাঁদতে নাই। আর তার কারণও নাই। নোটনকে তুই জিজ্ঞাসা করে আয়, ঠাকুরপো চাঁপাডাঙা গিয়েছিল। তবে হ্যাঁ, এক দিনের বেশি থাকে নাই। সেখান থেকে এসে নবগ্যেরামে ডেরা নিয়েছে। আয়, ছোলা কটা তুলে নে।

–পারব না আমি।

–পারতে হবে। আয়।

–তুমি মহারানী হতে পার, আমি তোমার দাসী নই। সংসার চুলোয় যাক, আমার কি?

একটা ঝুড়ি ইতিমধ্যে পূর্ণ হইয়া গিয়াছিল। সেটাকে কাঁধে তুলিয়া ঘরে লইয়া যাইবার পথে মানদার কাছে থমকিয়া দাঁড়াইয়া মৃদু স্বরে বলিল, টাকা তিরিশটা চাঁপাডাঙায় তালুয়ের হাতে পৌচেছে মানু। ঠাকুরপো দিয়ে এসেছে। সংসার চুলোয় গেলে, সে আর কখনও পাঠানো চলবে না। যা কলাইগুলো তুলে নে। কেলেঙ্কারি বাড়াস নেয়।

সে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া গেল।

মানদা চমকিয়া উঠিল। ঘরের দিকে মুখ ফিরাইয়া বলিল, কি বললে? তুমি কি বললে?

ঘরের ভিতর হইতেই কাদু জবাব দিল, কিছু বলি নাই। বলছি, ছোলাগুলো তুলে ফেল্‌।

মানদা ঘরের দিকে আগাইয়া গেল–না, টাকা বলে কি বললে তুমি বল?

কাদম্বিনী বাহির হইয়া আসিয়া হাসিয়া বলিল, বলছি টাকা নয় রে–তারিখ, তারিখ–আজ মাসের ক তারিখ বলতে পারিস? বলিয়াই সে মুখে আঙুল দিয়া চুপ করিবার ইঙ্গিত দিয়া আঙুল দিয়াই দেখাইয়া দিল। নিজে জানালা দিয়া উঁকি দিল।

ঘরের মধ্যে সেতাব খাতাপত্ৰ লইয়া হিসাব করিতেছিল। বয়স বছর বত্রিশেক। শুকনা শরীর, বিরক্তি-ভরা মুখ। এক জোড়া গোঁফ আছে। সে ঘাড় উঁচু করিয়া কান পাতিয়া কথা শুনিতেছে। কথা বন্ধ হওয়ায় সে সন্তৰ্পণে উঠিয়া দাঁড়াইল এবং পা টিপিয়া আসিয়া জানালার পাশে আড়ি পাতিল। ওদিকে পাশের দরজা ঠেলিয়া বড় বউ ঢুকিয়া দাঁড়াইল এবং বলিল, ও কি হচ্ছে কি?

সেতাব চমকিয়া উঠিল এবং উত্তরে প্রশ্ন করিল, কি?

–তাই তো জিজ্ঞাসা করছি। ওখানে অমন করে আড়ি পাতার মত দাঁড়িয়ে কেন?

–আড়ি পাতব কেন?

–তবে করছ কি?

–কিছু না। সে ফিরিয়া আসিয়া তক্তপোশে বসিল। তারপর বলিল, ভত্তি দুপহরে তোমরা দুই জায়ে ঝগড়া লাগিয়েছ কেন বল তো? পয়লা বোশেখ… শুভদিন, বলি তোমরা ভেবেছ কি? বলি ভেবেছ কি?

কথা বলিতে বলিতেই তাহার কথার তাপ বাড়িতে লাগিল।

ও-দিকের ঢাকের বাজনা ক্রমশ স্পষ্ট হইয়া উঠিতে লাগিল।

বড় বউ কাদম্বিনী বলিল, ঝগড়া? কে ঝগড়া করছে? কার সঙ্গে? কোথায় দেখলে তুমি ঝগড়া? আমাদের দুই জায়ে একটু জোরে কথা বলছি। তার নাম ঝগড়া? অমনি তুমি আড়ি পেতে শুনতে গিয়েছ?

—শুনব না? ছোট বউমা বললে না—টাকা বলে কি বললে বল? তুমি ঢাকলেনা, টাকা নয়, তারিখ তারিখ বলে? আমি তোমার স্বামী, বল তো পায়ে হাত দিয়ে?

—হায় হায় হায়! খুট করে কোনো শব্দ উঠলে বেড়াল ভাবে ইদুর। চোর ভাবে পাহারাওয়ালা। আর টাকার কথা শুনলে তোমার টনক নড়ে। ওই শুনেই তুমি আড়ি পাততে গিয়েছ।

—যাব নাঃ টাকা কত কষ্টে হয়, কত দুঃখের ধন, জান? কই, সাত হাত মাটি খুঁড়ে টাকা তো টাকা—একটা পয়সা আন দেখি! আমি বহু কষ্টে গড়েছি সংসার। বাবার দেনা শোধ করেছি, দশ টাকা নাড়াচাড়া করছি। মা-লক্ষ্মীকে পেসন্ন করেছি। সেই টাকা আমার তছনছ করে দেবে। তোমরা? তার চেয়ে তার চেয়ে–

—তার চেয়ে টাকার মাপে তোমার চামড়া কেটে দিতে কম দুঃখ পাও তুমি, তা আমি জানি। কিন্তু নিশ্চিন্ত থাক, তোমার টাকা কেউ অপব্যয় করে নি।

—না, করে নি! আমি জানি না, বুঝি না কিছু? বেশ তো, টাকা টাকা করে কি বলছিলে, বল না শুনি?

–বলছিলাম মানুর বাপের অসুখ, ঠাকুরপো চাঁপাডাঙা দেখতে গেল—সঁচটা টাকাও তো দিতে হত পথ্যির খরচ বলে। তাই মানুকে বললাম, ভাসুর না দেক সোয়ামি না দেক তুই তো নিজে নাকছবি বেচেও দিতে পারতি? তোরই তো বাপ। তাই বেঁজে উঠল মানু।

–উঁহুঁ। গড়ে বললে কথা। মিথ্যে বললে। বল আমার পায়ে হাত দিয়ে।

–তুমি অতি অবিশ্বাসী, অতি কুটিল। ছি-ছি-ছি—

–আমি অবিশ্বাসী কুটিল?

–হ্যাঁ, শুধু তাই না। তুমি কৃপণ, তুমি অভদ্র।

–কাদু।

ছোট বউয়ের বাপের অসুখে দশ টাকা তত্ত্ব বলে দেওয়া উচিত ছিল না তোমার? ভিখিরিকে ভিক্ষে দিতে তোমার মন টনটন করে। ছি তোমার টাকা-পয়সাকে।

ঢাকের আওয়াজ খুব জোর হইয়া উঠিল।

বড় বউ ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

সেতাব উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, এই মরেছে। ঢাক আবার বাড়িতে কেন রে বাবা? এই মরেছে।

সে দরজা খুলিয়া উঁকি মারিল।

দেখিল, দাওয়ায় বড় বউ ও ছোট বউ দাঁড়াইয়া আছে।

ওদিকে দরজা দিয়া উঠানে গাজনের সঙ প্রবেশ করিতেছে।

শিব সাজিয়া মহাতাপ নাচিতেছে। লম্বা-চওড়া বলিষ্ঠ শরীর।

শিব তাহাকে খুব ভাল মানাইয়াছে। দাড়ি-গোঁফ-জটায় তাহাকে চেনা যায় না।

সঙের দল গান গাহিতে গাহিতেই প্রবেশ করিল। তাহারা গাহিতেছে—গাহিতেছে পার্বতীর সখী, জয় বিজয়া।

শিবো হে, শিবো হে, অ শিবো শঙ্কর হে।
হাড়মালা খুলে ফুলোমালা পরো হে,
অ শিব শঙ্কর হে।
হায়—হায়—হায়—হায়—
ফুল যে শুকিয়ে যায়–
গলায় বিষের জ্বালায় শিবো জ্বরত্বর হে!
অ শিবো শঙ্কর হে।
শিব :- তা থৈ থৈ তা থৈ থৈ–বম্ বম্
হর হর—সব হর হে।– (নাচন)
জয় বিজয়া :-
হায় রে হায় রে–
মদন পুড়ে ছাই রে–
লাজে কাদে পার্বতী
ঝর ঝর হে–।
গাজনে নাচন শিবো সম্বর হে।
শিব শঙ্কর হে।

গান শেষ হইবামাত্র শিব-বেশী মহাতাপ ভিক্ষার থালাটা পাতিয়া ধরিল। ঘরের ভিতর হইতে সেতাব বাহির হইয়া আসিয়া বলিল, কি? বলি এসব আবার কি?

বড় বউ বলিল, থাম তুমি। দাঁড়াও, এনে দিই আমি।

–না, যত সব অনাছিষ্টি কাণ্ড! আমাদের গায়ে গাজন নাই, তা ভিন গা থেকে গাজনের সঙ! দিন দিন নতুন ফ্যাচ্যাং।

বড় বউ ফিরিয়া আসিয়া শিবের হাতের থালাটা টানিয়া লইয়া তাহাতে দুইটা টাকা দিয়া অন্যদের দিকে বাড়াইয়া ধরিল।

সেতাব বলিল, ও কি? দু টাকা? দু টাকা কি ছেলেখেলা নাকি?

—থাম বলছি। ও টাকা তোমার নয়। নাও গো, নিয়ে যাও তোমরা। বলিয়া শিব ছাড়া অন্য একজনের হাতে দিল। তারপর সঙ্গে সঙ্গেই শিবের হাতখানা চাপিয়া ধরিয়া বলিল, না। আর তোমার যাওয়া হবে না। ঢের নাচন হয়েছে। অনেক ভাঙ খাওয়া হয়েছে। চাঁপাডাঙা। যাই বলে পাঁচ দিন নিরুদ্দেশ। ছাই মেখে, ভস্ম মেখে, নেচে বেড়াচ্ছ! ছি-ছিছি! যাও, তোমরা যাও বলছি। ঢের সঙ হয়েছে। যাও। এই নাও তোমার জটা-দাড়ি-গোঁফ নাও।

দাড়ি-গোঁফ-জটা টানিয়া খুলিয়া দিল।

মহাতাপ বার-দুই চাপিয়া ধরিয়া অবশেষে কাতরভাবে অনুরোধ করিল, বড় বউ! বউদিদি! পায়ে পড়ি তোমার, পায়ে পড়ছি আমি।

মানদা দাঁড়াইয়া দেখিতেছিল। মহাতাপের স্বরূপ প্ৰকাশ হইতেই ঘোমটা টানিয়া বলিল, মরণ। বলিয়া ঘরে চলিয়া গেল।

—তাতে আমার পাপ হবে না। কিন্তু এমনি করে সঙ সেজে বেড়াতে তোমাকে আমি দেব না।

তারপর দলের লোকদের লক্ষ্য করিয়া বলিল, যাও না তোমরা। কথা বললে শোন না কেন? সঙ দেখাতে এসে সঙ দেখতে লাগলে যে! সংসারে সঙের অভাব? কারও বাড়িতে কি এমন সঙ হয় না? সকলের বাড়িতেই হয়—আমরা যাই দেখতে সে সঙ?

মহাতাপও এবার চেঁচাইয়া উঠিল, যাও যাও, সব বাহার যাও। নেহি যায়েগা; হাম নেহি যায়েগা। ভাগো। ভাগো।

সেতাব ওদিকে বারান্দায় আপন মনেই পায়চারি করিতেছিল এবং বলিতেছিল, হুঁ!! যত সব কেলেঙ্কারি! হু! মানসম্মান আর রইল না। হুঁ!

ধমক খাইয়া সঙের দল বাহিরে চলিয়া গেল।

রাস্তার উপর আসিয়া দলের মধ্যে বসা শুরু হইয়া গেল। নন্দী নিজের জটা খুলিয়া ফেলিয়া ক্ৰোধভরে বলিয়া উঠিল, তখুনি বলেছিলাম—পাগলাকে দলে নিও না! তখন সব বললে—দশ টাকা চাঁদা দেবে। চেহারা ভাল, গানের গলা ভাল। এখন হল তোর।

বিজয়া খিলখিল করিয়া হাসিয়া বলিল, অঃ, বেচার এবার শিব সাজতে না পেয়ে রাগ খুব!

–খবরদার বলছি, চ্যাংড়া ছেড়া। একটি চড়ে তোমার বদনখানি বেঁকিয়ে দেব।

—চুপ চুপ, ঝগড়া কোরো না! চল, বাড়ি চল সব। রাস্তাতে বেচাকে শিব সাজিয়ে নেব চল। উ যে এমন করবে তা কে জানে!কথাটা বলিল—জামাকাপড়ে আধুনিক ম্যাট্রিক-ফেল চাষীর ছেলে ঘোঁতন ঘোষ।

—তা–কে জানে–! কেন, মহাতাপের মাথা খারাপ সেই ছেলেবেলা থেকে, কেউ জান না, নাকি?

বিজয়া সাজিয়াছিল যে ছেলেটা, সেটা দেখিতে কুৎসিত, খুব ঢাঙা, রঙ কালো। সে আবার আসিয়া বলিল, বেচা শিব সাজলে আমি দুগ্‌গা হব। রমনা হবে বিজয়া। মুখে কাপড় দিয়া সে হাসিতে লাগিল।

হঠাৎ উচ্চ কাঁচ শব্দ করিয়া মণ্ডলবাড়ির বাহিরের দরজা খুলিয়া গেল। গলা ঝাড়িয়া সেতাব বাহির হইয়া আসিল।

জনতা স্তব্ধ হইয়া গেল। এ উহার মুখের দিকে চাহিল। দলপতি ঘোঁতনই ভ্রূ কুঁচকাইয়া বলিল, চল চল। বলিয়া সে সর্বাগ্রে হনহন করিয়া চলিতে শুরু করিল।

তাহার পিছনে পিছনে সকলে। সেতাব ডাকিল, এই ঘোঁতন, এই! এই! এই! দলের একজন বলিল, ঘোঁতনদা ডাকছে যে বড় মোড়ল!

—ডাকুক। মরুক চেঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে। বেটা আমার কাছে ধান পাবে। চলে আয়। সে। হনহন করিয়া চলিতে লাগিল।

সেতাব রাস্তায় নামিল।

ঘোঁতন তাহার কথা শুনিল না দেখিয়া রাগিয়া গেল এবং চিৎকার করিয়া বলিল, নালিশ করব আমি।

ঘোঁতন এবার ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, কর। মহাতাপ পাওনা ধান ছেড়ে দেবে আমাকে কড়ার করায় তবে ওকে আমি শিবের পাট দিয়েছি। লোকে সাক্ষি দেবে। বোঁচা বল্ না রে!

সেতাব চমকিয়া উঠিল।

ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত চাহিয়া থাকিয়া হনহন করিয়া ঘরের দিকে চলিয়া গেল।

বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়া দেখিল—উঠানে একটা জলচৌকির উপর মহাতাপ বসিয়া আছে এবং কৃষাণ নোটন উঠানের কোণের পাতকুয়া হইতে জল উঠাইতেছে, রাখালটা মাথায় ঢালিতেছে। মহাতাপ খুব আরাম করিয়া স্নান করিতেছে; মধ্যে মধ্যে মুখে জল লইয়া ফু-ফু করিয়া উপরে আশপাশে ঘুড়িতেছে। বড় বউ দাওয়ায় দাঁড়াইয়া আছে। তাহার হাতে গামছা। পাশে দড়ির আলনায় কাপড়। বড় বউয়ের কোলে মহাতাপের পাঁচ বছরের হৃষ্টপুষ্ট ছেলে মানিক।

বাপের জল-কুলকুচার রকম দেখিয়া সে খুব হাসিতেছে।

সে বলিল, বাবা কি করছে? ব-মা?

কাদু বলিল নোটন ও রাখালকেওই হয়েছে, ঢের হয়েছে। আর থাক।

মহাতাপ বলিল, উঁহুঁ। হয় নাই, এখনও হয় নাই। ঢাল্‌, নোট্‌না ঢাল্‌।

বলিয়াই জল ছুঁড়িল—ফু!

মানিক বলিল, বাবা কি করছ?

–গঙ্গা ঝরতা হ্যায় রে বেটা। শিবকে শির পর গঙ্গা ঝরতা হ্যায়। গান ধরিয়া দিল—

ঝর ঝর ঝর ঝর গঙ্গা ঝরে
শিরোপরে গঙ্গাধরের রে!
ঝর ঝর ঝর ঝরফুঃ!

আমি শিব রে বেটা, হম শিব হ্যায়।

–শিব হ্যায়?

–হ্যাঁ, তু বেটা গণেশ। মাথায় হাতির মুণ্ড বসিয়ে দেব।

সেতাব দাঁড়াইয়া খানিকটা দেখিল, তারপর, হুঁ। ছিছিছি! ছিঃ-ছিঃ! বলিয়া উঠান পার হইয়া চলিয়া গেল এবং দাওয়ায় গিয়া উঠিল। ঘরে ঢুকিবার সময় দাঁড়াইয়া বলিল, ঘরের লক্ষ্মীর চুলের মুঠো ধরে বনবাসে দেওয়ার পথ ধরেছিস তুই মহাতাপ। ছিঃ!

এবার মহাতাপ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত উঠিয়া দাঁড়াইল!—কেয়া?

বড় বউ কাদম্বিনী শঙ্কিত কণ্ঠে ডাকিল, মহাতাপ।

মহাতাপ আগাইয়া আসিয়া বলিল, নেহি নেহি নেহি। চামদড়ি কিপটে কেয়া বোলতা হ্যায়—জানতে চাই আমি। ঝুট বাত হাম নেহি শুনেগা।

বড় বউ এবার মহাতাপের ছেলেকে নামাইয়া দিয়া আগাইয়া আসিয়া তাহার হাত ধরিলছি, বড় ভাই গুরুজন, তাকে এমনি কথা বলে! কতদিন বারণ করেছি না?

মহাতাপ বলিল, ও মিছে কথা কেন বলবে? আমি তোমার চুলের মুঠো ধরে বনবাসে দোব-আমি!

সকলে অবাক হইয়া গেল।

সেতাব বলিল, তোর মাথা খারাপ, বুদ্ধি কম—শেষে তুই কালাও হলি নাকি? বলছি ঘরের লক্ষ্মীর কথা। বড় বউয়ের কথা কখন বললাম?

–কখন বললাম! বড় বউই তো ঘরের লক্ষ্মী।

বড় বউ হাসিয়া ফেলিল—মরণ আমার। নাও, খুব হয়েছে। চল, এখন মাথা মুছে কাপড় ছেড়ে খাবে চল। এস।

—যাবে, তার আগে একটু দাঁড়াও। মহাতাপ টাকা পেলে কোথায়? দশ টাকা চাঁদা দিয়েছে। গাজনের দলে সঙ সাজবার জন্যে তুমি দিয়েছ?

—নেহি। ছোট বউ, ছোট বউ দিয়েছে।

বড় বউ মুখের কথাটা কাড়িয়া লইয়া বলিল, হ্যাঁ হ্যাঁ। আমি ছোট বউকে দিয়েছিলাম তালুইয়ের অসুখে তত্ত্ব করবার জন্যে। মহাপুরুষ তাই দাতব্য করেছেন গাজনের দলে। হ্যাঁ, সে টাকা আমি দিয়েছি। তোমার সংসারে একটা দানা কি এক টুকরো তামা আমার কাছে বিষের মত; তোমার সংসারে দরকার ছাড়া যে আমি কিছুই ছুঁই না, সে তুমি জান। আমার মায়ের গহনা পেয়েছি, সেই বিক্রির টাকা থেকে দিয়েছি আমি। ও নিয়ে তুমি এমন করে ফেঁসর্ফোস কোরো না গোখরো সাপের মত। এস ঠাকুরপো।

মহাতাপের হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া সে ঘরে ঢুকিল। ঢুকিবার সময় শুকনো কাপড়টা তাহার কাঁধে ফেলিয়া দিল।

ঘরের মধ্যে কানা-উঁচু থালায় প্রচুর পরিমাণে ভাত, একটা বড় বাটিতে জলের রঙের আমানি অর্থাৎ পান্তা ভাত-ভিজানো জল, একটা বাটিতে ডাল, পোস্ত-বাটা অনেকটা, গেলাসে জল। মোটা ভারী বেশ বড়সড় একখানা কাঠের পিঁড়ি পাতা। পাশে মানদা শিল-নোড়া লইয়া কুড়তি কলাই বাটিতে বসিয়াছে। ঘস-ঘস শব্দে দুলিয়া দুলিয়া বাটিয়া চলিয়াছে।

মহাতাপকে আনিয়া বড় বউ পিড়ির উপর দাঁড় করাইয়া দিল। নাও, বস। মহাতাপ বসিয়া দেখিতে লাগিল, কি কি আছে?

বড় বউ বলিল, যা ভালবাস তাই আছে। খাও। পান্তা ভাত, আমানি, পোস্ত-বাটা, কলাইয়ের দাল, অম্বল—সব আছে। আর ওই কুড়তি কলাই তোমার সরস্বতী ঠাকরুন বাটছে।

–কি? সরস্বতী ঠাকরুন কুড়ৎ কলাই বাটছে? ওই বাটকুল-সরস্বতী ঠাকরুন?

–আমি লক্ষ্মী হলে, মানু সরস্বতী বৈকি? আমার ছোট বোন তো!

–আচ্ছা! ঘাড় নাড়িতে লাগিল মহাতাপ সমঝদারের মত।

–ঘাড় নাড়তে হবে না। খাও।

খাওয়ার ওপর ঝুঁকিয়া পড়িল মহাতাপ।

ওদিকে সেতাব দাওয়ার উপর এক হাতে হুঁকা ও অন্য হাতে কন্ধে ধরিয়া ফুঁ দিতেছিল। সে উঠানের দিকে পিছন ফিরিয়া ঘরের দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরাইয়া বসিয়া ছিল। মধ্যে মধ্যে বিরক্তিভরে বলিতেছিল, হুঁ। লক্ষ্মী! সাক্ষাৎ অলক্ষ্মী। ঘরের লক্ষ্মী তাড়িয়ে দেবে। হঁ। দশ টাকা। দশ টাকা সামান্য কথা!।—বলিয়া কায় কল্কে বসাইয়া টানিতে টানিতে উঠিয়া ঘুরিয়া দাঁড়াইল। এবার সে দেখিতে পাইল, উঠানে বাপের চৌকিতে বসিয়া মানিক গায়ে মুখে কাদা মাখিয়াছে এবং মুখে জল লইয়া ফুঁ ফু করিতেছে।

সেতাব হাঁ-হাঁ করিয়া উঠিল—এই, এই কি বিপদ। ও কি হচ্ছে, জঁ। সে উঠানে নামিয়া মানিকের দিকে অগ্রসর হইল।

মানিক বলিল, ছিব হব, ছিব। ফু। বলিয়া জল ছিটাইয়া দিল।

–ছিছিছি। অ বড় বউ। শুনছ। মাকে কি করছে দেখ।

ছোট বউ বাহির হইয়া আসিল এবং মানিকের অবস্থা দেখিয়া ছুটিয়া গিয়া তাহাকে কোলে তুলিয়া লইয়া আধ-ঘোমটায় চাপা গলায় ক্রোধভরেই বলিল, দুষ্ট ছেলে কোথাকার!

–ছিব, ছিব–আমি ছিব!

—ছিব? তা হবে বৈকি? তা না হলে আমার কপালের চিতের আগুন নিভে যাবে যে! শিব হবি? শিব হবি? ছেলের পিঠে সে চাপড় বসাইয়া দিল। মানিক কাঁদিয়া উঠিল।

সেতাব ক্রুদ্ধ হইয়া বলিল, ছোট বউমা! মেরো না বলছি।

মানদা আরও একটা কিল বসাইয়া দিল।-হারামজাদা বজ্জাত–

সেতাব আবার বলিল, ছোট বউমা! তুমি গৰ্ভে ধরেছ বলে মানিক তোমার একলার নয়। বড় বউ, বলি অ বড় বউ।

বড় বউ বাহির হইয়া আসিল।–মানু!

মানু উষ্মভরেই বলিল, কি?

–ভাসুর বারণ করছে, তবু তুই মারছিল!

–মারব না? দেখ না কি করেছে? আমার কাপড়টা কি হল দেখ!

–কাপড় তো ছাড়লেই হবে! দে, আমায় দে।

–না। আলুনো আদর দিয়ে একজনের মাথা খেয়েছ। আর না।—বলিয়া ছেলেকে কোলে করিয়া লইয়া ঘরে চলিয়া গেল।

—কি? কি বললি ছুটকী?

সেতাব পায়চারি করিতে করিতে হুঁকা টানিতেছিল। উল্টা মুখ হইতে ঘুরিয়া এবার সে বলিল, ছোট বউমা মিছে কথা বলে নাই বড় বউ। মহাতাপের মাথা তুমিই খেয়েছ। ছোট বউমা ঠিক বলেছে।

বড় বউ জবাব দিবার আগেই মহাতাপ ডালভাত-মাখা এঁটো-হাত চাটিতে চাটিতে বাহিরে আসিয়া বলিল, সরস্বতী! ওই বাটকুল, কুঁদুলে সরস্বতী—ও দুষ্টু সরস্বতী হ্যায়!

বড় বউ বলিল, সব খেয়েছ? না, না খেয়ে ঝগড়া করতে উঠে এলে কুঁদুলে ঠাকুর?

–চাট পোট! চাঁট পোট করকে খা লিয়া।

–তা হলে হাত ধোও, ধুয়ে শুয়ে পড় গে। দেখি আমি। মানু-অ মানু! বলিয়া আবার ঘরে ঢুকিল। মহাতাপ জলের ঘটি তুলিয়া লইয়া হাত ধুইতে লাগিল।

সেতাব বলিল, গাজনে দশ টাকা চাঁদাই শুধু দিস নি, ঘোঁতনা ঘোষকে ধান পাওনা ছেড়ে দিয়েছিস?

মহাতাপ তাহার মুখের দিকে চাহিল—হাঁ হাঁ-কাগজে লিখে দিয়েছি। ধান সব ছাড়িয়া দিলাম—শ্ৰীমহাতাপ মণ্ডল। দিয়েছি। ঘোঁতনার বাড়ি গেলাম, ওর মা কাঁদতে লাগল। বললে–বাবা, ঘোঁতনা তো জামা-জুতো পরে ঘুরে বেড়ায়, যাত্রা করে, চাষ করে না। ভাগীদার চাষ করে যা দেয় তাতে খেতে কুলোয় না। দেনা শোধ কি করে দেব? ঘোঁতনার বাচ্চাগুলোর টিকটিকির মত দশা। তাই ছোড় দিয়া। হ্ৰা, ছোড় দিয়া। লিখ দিয়া হ্যায়। একদম কাগজমে ঘস-ঘস করকে লিখ দিয়া হ্যায়।

—লিখে দিয়েছিস?

–হ্যাঁ। একদম লিখ দিয়া হ্যায়।

–তারপর? নিজেদের কি হবে?

মানিককে কোলে মানদা বাহির হইয়া আসিল। সে বলিল, ওই ঘোঁতনার ছেলের মত টিকটিকির দশা হবে। বলিয়া বড় বউ যে ঘরে ঢুকিয়াছিল সেই ঘরে ঢুকিয়া গেল।

মহাতাপ জ্বলিয়া উঠিল।দেব তোর পিঠে কিল ধম্‌ধম লাগিয়ে। আরে! আমার ছেলে টিকটিকির মত হবে? মহাতাপ নিজে হাতে চাষ করে। ভীম হ্যায়। মহাতাপ ভীম হ্যায়। ঘোঁতনাকে যে ধান ছেড়ে দিয়েছি, সে ধান আমি এবার বাড়তি ফিরিয়ে দেব। দম্ভভরে সে নিজের বুকে কয়েকটা চাপড় মারিল।

আবার বড় বউ বাহির হইয়া আসিল। তাই হবে, তাই ফলাবে। যাও, এখন শোও গে। চার রাত্তির বোধহয় ঘুম হয় নাই। যাও। যাও। ঠাকুরপো! যাও বলছি।

—যাচ্ছি। আমি যাচ্ছি।

মহাতাপ ঘরের মধ্যে ঢুকিতে উদ্যত হইল।

সেতাব বলিল, লক্ষ্মী আর এ বাড়িতে থাকবে না। মোড়লবাড়ির লক্ষ্মীকে ঘাড় ধরে বের করলে সবাই মিলে। সেকালের কথা এরই মধ্যে ভুলে গেলি সবাই? হায় রে হায়! হায় রে হায়!

হুঁকা ও কল্কে নামাইয়া রাখিয়া সেতাব চলিয়া গেল। বলিতে বলিতেই গেলহায় রে হায়! হায় রে হায়!

মহাতাপ হুঁকা-কটো তুলিয়া লইয়া দাদাকে ভ্যাঙচাইয়া দিল-হায় রে হায়! হায় রে হায়! ওই এক আচ্ছা বুলি শিখেছে।

1 Comment
Collapse Comments
পর্দা করা ফরজ October 14, 2022 at 11:16 pm

পড়লাম

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *