১. দৃশ্যমান ও প্রকৃত সত্তা
যুক্তিবদ্ধ কোন মানুস সংশয় প্রকাশ করতে পারে না, এমন কোন সুনিশ্চিত জ্ঞান কি পৃথিবীতে বর্তমান আছে? আপাতদৃষ্টিতে প্রশ্নটি খুবই সহজবোধ্য মনে হলেও অনেক অতীব কঠিন প্রশ্নের মধ্যে এটি একটি। আমরা যখন সহজসরল ও সুনিশ্চিত উত্তরের সামনে প্রতিবন্ধকতা অনুভব করি, বলা যেতে পারে তখনই আমরা দর্শনচর্চার ক্ষেত্রে প্রবেশ করি। দর্শনশাস্ত্রে এই ধরণের মূল প্রশ্নসমূহের উত্তর দেবার চেষ্টা করে, কিন্তু উদাসীন বা অযৌক্তিকভাবে নয়–আমরা প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় যেভাবে দিয়ে থাকি, এমনকি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও। দর্শন কিন্তু বিচার-বিবেচনাপূর্বক উত্তর দেবার চেষ্টা করে যে যে বিষয় এই প্রশ্নগুলোকে গোলমেলে করে তুলেছে তাদের খুঁজে বের করার পর এবং আমাদের ধরণাসমূহের মধ্যে ভ্রান্তিমূলক ও দোদুল্যমান যেসব বিষয় প্রচ্ছন্নভাবে অবস্থান তাদের অনুধাবন করার পর।
প্রাত্যহিক জীবনযাপনে আমরা সুনিশ্চিত বলে অনেক কিছু গ্রহণ করে থাকি, কিন্তু ভালভাবে পর্যালেচনা করার পর দেখা যায় সেগুলো পরস্পর আপাত বিরোধিতায় পূর্ণ। শুধুমাত্র গভীর চিন্তাভাবনাই আমাদের জানতে সাহায্য করে। বিষয়টির প্রকৃত সত্তা, যা আমরা নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতে পারি। স্বাভাবিকভাবে আমাদের বর্তমান অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণাসমূহ দিয়েই নিশ্চিততত্ত্বের খোঁজ শুরু করা উচিত, কোন কোন ক্ষেত্রে এদের থেকে কিছু জ্ঞানও অর্জন করা যেতে পারে। বিষয়টি কি–এ সম্বন্ধে আমাদের তাৎক্ষণিক লব্ধ অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে কোন বক্তব্য কিন্তু ভুল হবার দিকে যেতে পারে। এটা আমার মনে হতেই পারে যে আমি এখন একটি চেয়ারে বসে আছি কোন একটি বিশেষ আকারের টেরিলের সামনে, যার ওপরে ছাপা অথবা হাতে-লেখা কিছু কাগজপত্র দেখতে পাচ্ছি। পিছনে তাকালে জানালা দিয়ে বাড়িঘর, মেঘ ও সূর্য দেখতে পাচ্ছি। আমার বিশ্বাস সূর্য পৃথিবী থেকে প্রায় তিরানব্বই মিলিয়ন মাইল দূরে অবস্থিত একটি জ্বলন্ত গোলাকার অগ্নিপিন্ড যা পৃথিবীর থেকে অনেকগুণ বড়, পৃথিবীর আহ্নিক গতির কারণে সূর্য প্রতিদিন সকালে ওঠে এবং ভবিষ্যতেও অনন্তকাল ধরে উঠবে। কোন স্বাভাবিক ব্যক্তি আমার ঘরে এলে এই চেয়ার, টেবিল, বই এবং কাগজপত্র দেখবে যেমন আমি দেখছি এবং যে টেবিলটা আমি আমার দৃষ্টি-ইন্দ্রিয় দিয়ে দেখছি এবং হাত ছুঁইয়ে স্পর্শ-ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করছি তা একই জিনিস। এসব বিষয়গুলো এতই প্রমাণ নিরপেক্ষ যা বলারই অপেক্ষা রাখে না শুধুমাত্র সেই ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে যিনি আমার কোন কিছু জানার বিষয়েই সন্দেহ প্রকাশ করতে পারেন। তবুও এই সমস্ত কিছুকে সঙ্গতভাবেই সন্দেহ করা যেতে পারে এবং সমস্ত বিষয়গুলোই সম্যক গুরুত্ব সহকারে আলোচনার অপেক্ষা রাখে, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা নিশ্চিত হচ্ছি যে আমরা বিষয়গুলোকে যেভাবে প্রকাশ করতে চাইছি তা সম্পূর্ণ সত্য।
এই অসুবিধাগুলো সহজ ভাষায় প্রকাশ করার জন্য, আসুন আমরা টেবিলেই মনঃসংযোগ করি। দৃষ্টি-ইন্দ্রিয়ে এটি আয়তাকার, বাদামি রঙের এবং উজ্জ্বল বর্ণের, স্পর্শেন্দ্রিয়ে এটি মসৃণ, শীতল ও কঠিন। টোকা দিলে কাঠের আওয়াজ পাই আমি। কোন ব্যক্তি, যে টেবিলটি দেখছে, অনুভব করছে এবং শব্দ শুনছে, সে-ও এই বর্ণনার সাথে একমত হবে। সুতরাং এর থেকে মনে হবে পারে এই বর্ণনায় কোনরূপ মতবিরোধ হবার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু যেইমাত্র আমরা একটু নিখুঁত বর্ণনা দেবার চেষ্টা করতে যাব, তখনই গন্ডগোলের সূত্রপাত হবে। সম্পূর্ণ টেবিলটা প্রকৃতই একই রঙের বলে যদিও আমি বিশ্বাস করি, তবুও যে অংশটায় আলো পড়ে প্রতিফলিত হচ্ছে সেটা অন্য অংশের চেয়ে উজ্জ্বলতর এবং কিছু অংশ আলোর প্রতিফলনের কারণে বেশ সাদাই লাগছে। আমি যদি স্থান পরিবর্তন করি তাহলে আলোর প্রতিফলিত অংশটিও সরে যাবে এবং টেবিলের রঙের আপাত-সৃষ্ট সমতা পরিবর্তিত হবে। এর থেকে প্রতিপন্ন হয় যে বেশ কয়েকজন ব্যক্তি যদি একই মুহূর্তে টেবিলের দিকে তাকায় তবে তাদের কেউই টেবিলের রঙের তারতম্য একই রকম দেখবে না, কেননা তারা কেউই একই দৃষ্টিকোণ থেকে টেবিলটা দেখছে না–দৃষ্টিকোণের যে-কোন পরিবর্তন প্রতিফলিত আলোর অংশের তারতম্য ঘটায়।
ব্যবহারিক ক্ষেত্রের বেশির ভাগ জায়গায় এসব পার্থক্যগুলো অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে, কিন্তু চিত্রকরদের কাছে বিষয়টা অতীব প্রয়োজনীয়। একটা জিনিসের যে রঙ থাকা উচিত বলে মনে হয়, যাকে সাধারণ মানুষ সেই জিনিসের রঙ বলে মনে করে, একজন চিত্রকরকে সেভাবে দেখার অভ্যাস ভুলতে হয় এবং জিনিসটা দৃশ্যত বা বাস্তবে কিভাবে প্রতিভাত হচ্ছে তা দেখা রপ্ত করতে হয়। ইতিমধ্যেই আমরা এখানে সেই পার্থক্যগুলোর একটার শুরুতে চলে গিয়েছি যা দর্শনে গভীরতম বিরোধ সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায় দৃশ্যমান এবং প্রকৃত সত্তা-র পার্থক্য বিষয়টি যা দেখায় (মনে হয়) এবং প্রকৃতই সে যা। চিত্রকর জানতে চায় বিষয়টি দৃশ্যত কেমন দেখাচ্ছে, একজন বাস্তববোধযুক্ত মানুষ এবং দার্শনিক জানতে চাইবে বস্তুত জিনিসটা কি। যেহেতু দার্শনিকের জানার ইচ্ছে বাস্তববোধযুক্ত মানুষটির চেয়ে বেশি, সে কারণে জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রের মতো জিজ্ঞাসার উত্তর দেওয়াও অনেক বেশি দুরূহ।
টেবিলের প্রশ্নে ফিরে যাওয়া যাক। উপরের আলোচনার ভিত্তিতে এটা পরিষ্কার যে এমন কোন রঙ নেই যা পূর্বের থেকে টেবিলের রঙ বলে বা টেবিলের কোন বিশেষ অংশের রং বলে পরিচিত। দৃশ্যগতভাবে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন রঙ পাওয়া যাচ্ছে এবং এটা মনে করার কোন কারণ নেই যে অন্যদের তুলনায় এদরে মধ্যে কোন কোন রঙ টেবিলের প্রকৃত রঙ। এমনকি এটাও আমরা জানি যে-কোন একটি উপরস্থাপিত দৃষ্টিকোণ থেকে এই রঙ আলাদা দেখাবে, একজন বর্ণান্ধ মানুষের কাছে বা কৃত্রিম আলোতে অথবা নীলচশমা পরিহিত কোন ভদ্রলোকের কাছে, আবার অন্ধকারে কোন রঙই থাকবে না, যদিও স্পর্শে ও শব্দে টেবিলটি অভিন্ন থাকবে। এই রঙটি এমন কিছু নয় যা টেবিলের সহজাত, বরং এমন কিছু যা টেবিল, দর্শক এবং টেবিলের আলোর প্রতিফলনের উপর নির্ভর করে। যখন আমরা প্রাত্যহিক জীবনে টেবিলের রঙের কথা বলি, তখন তার দ্বারা আমরা সেই রঙকে বোঝাই যা একজন সাধারণ মানুষ দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাভাবিক আলোতে দেখে। কিন্তু অন্যান্য রঙ যা অন্যান্য শর্তসাপেক্ষ, তারাও প্রকৃত বলে দাবি করতে পারে। সুতরাং কোন পক্ষে না গিয়ে আমরা একথা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে প্রকৃতপক্ষে টেবিলটির কোন একটি বিশেষ রঙ নেই।
এই একই কথা টেবিলের বহিরাবরণ সম্পর্কেও বলা যায়। খালি চোখে আমরা কাছের বিন্যাস কেউ দেখতে পাই, তা না হলে টেবিলটি মসৃণ এবং সমান। যদি আমরা অণুবীক্ষণযন্ত্রের সাহায্যে দেখি তাহলে এর অমসৃণতা ও বিভিন্ন উঁচু-নিচু অংশ এবং অন্যান্য বিষয় দেখতে পাবো যা খালি চোখে দেখা যায় না। এদের মধ্যে কোনটি প্রকৃত টেবিল? স্বাভাবিকভাবে আমরা বলবো, অণুবীক্ষণযন্ত্রের সাহায্যে যা আমরা দেখছি তা-ই প্রকৃত টেবিল। কিন্তু এই মত আবার বেশি শক্তিশালী অণুবীক্ষণযন্ত্রের সাহায্যে দেখার পর পাল্টে যাবে।
তাহলে, যদি আমরা খালি চোখে যা দেখি তার উপর বিশ্বাস রাখতে না পারি, তাহলে কেনই বা যা আমরা অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে দেখছি, তার উপরে বিশ্বাস রাখবো?
এভাবে ইন্দ্রিয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা, যা দিয়ে আমরা শুরু করেছিলাম, তা আমরা বজায় রাখতে পারছি না।
টেবিলের আকারও কোন আশা দিচ্ছে না। আমরা প্রত্যেকে বিষয়ের প্রকৃত আকার নিয়ে বিচার করতেই অভ্যস্ত এবং আমরা চিন্তা না করেই এটা করে থাকি আর ভাবি যে আমরা বিয়য়ের প্রকৃত রূপ দেখছি। কিন্তু আসলে যদি আমরা আঁকতে চাই তাহলে যে-রকম আমাদের শিখতে হয়, ঠিক সে রকমই একটি বিষয়েকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন আকারের দেখায়। যদি আমাদের টেবিলটি সত্যিই আয়তাকার হয়, তাহলে প্রায় সব দৃষ্টিকোণ থেকে মনে হবে যে এটির যেন দুটি তীক্ষ্ণ কোণ এবং দুটি স্কুল কোণ আছে, যদি বিপরীত দিকগুলো সমান হয় তাহলে মনে হবে যেন দর্শকের দিক থেকে সরে এসে তারা মিলিত হয়েছে কোন একটি দিকে। যদি তারা সমান দৈর্ঘ্যের হয় তাহলে মনে হবে যেন কাছের দিকটি বেশি লম্বা। সাধারণভাবে টেবিলকে দেখলে এই সমস্ত দিকগুলো। বোঝা যায় না, কেননা অভিজ্ঞতা আমাদের দৃশ্যত আকারের থেকে প্রকৃত আকার গড়তে শেখায় এবং এই প্রকৃত আকারই সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করে। কিন্তু আমরা যা দেখি তা সর্বদা প্রকৃত আকার নয় এবং এটা হল যা দেখা হয় তার থেকে অনুমান করা। আমরা যা দেখি তা আকারের দিক থেকে পাল্টাচ্ছে যখনই আমরা ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এই কারণে এখানে আমাদের ইন্দ্রিয় টেবিলের যথাযথ রূপ সম্বন্ধে সত্যতা ব্যক্ত করছে না, শুধুই টেবিলের দৃশ্যগত সত্যতা দিচ্ছে।
একই ধরনের অসুবিধার সৃষ্টি হয় যখন আমরা টেবিলের স্পর্শ নিয়ে আলোচনা করি। এটা সত্যি যে টেবিলটি সবসময় আমাদের একটা শক্ত কিছুর অনুভূতি দেয় এবং আমরা অনুভব করি এটি চাপদানে বাধা দেয়। কিন্তু যে অনুভুতি আমরা পাচ্ছি তা নির্ভর করে কতটা জোরে আমরা টেবিলে চাপ দিচ্ছি এবং শরীরের কোন অংশ দিয়ে চাপ দিচ্ছি তার উপর। এভাবে বিভিন্ন অনুভূতিগুলো বিভিন্ন চাপের দ্বারা বা শরীরের বিভিন্ন অংশের দ্বারা অনুভূত হয়ে কখনই সরাসারিভাবে টেবিলের কোন নির্দিষ্ট গুণাবলি ব্যক্ত করতে পারে না, যা পারে তাহল কতকগুলো গুণাবলির প্রতীক জানাতে যা হয়তো অনুভূতিগুলোর কারণ, কিন্তু যা প্রকৃতই তাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না। এই সবই শব্দের ক্ষেত্রে আরও বেশি সুস্পষ্ট, যা টেবিলে শব্দ করে প্রমাণ করা যায়।
তাহলে এটা পরিষ্কার যে প্রকৃত টেবিল, যদি আদৌ তা থাকে, সেটি তা নয় যা আমরা দেখা, স্পর্শ করা বা শোনার অভিজ্ঞতায় জানি। প্রকৃত টেবিল, যদি আদৌ তা থাকে, তা তাৎক্ষণিকভাবে আমরা জানতে পারি না, অনুমানের মাধ্যমে জানি। এ থেকে দুটি কঠিন প্রশ্ন জাগে : ১. সত্যিই কি কোন প্রকৃত টেবিল আছে? ২. যদি থাকে তাহলে সেটি কি ধরনের বস্তু?
এই প্রশ্নগুলো বুঝার জন্য আমরা কতকগুলো পদ ব্যবহার করতে পারি যার অর্থ সুনির্দিষ্ট ও পরিষ্কার। আসুন আমরা ইন্দ্রিয়-উপাত্ত নাম দিই সেসব বস্তুকে যা সংবেদনে তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়, যেমন রঙ, শব্দ, গন্ধ, কঠোরতা, রুক্ষতা ইত্যাদি। বিষয়বস্তু সম্পর্কে তাৎক্ষণিক সচেতনতাকে আমরা সংবেদন আখ্যা দিতে পারি। এভাবে যখনই আমরা রঙ দেখি, তখনই আমাদের রঙের সংবেদন হয়, কিন্তু রঙটি নিজে হল একটি ইন্দ্রিয়-উপাত্ত, সংবেদন নয়। রঙটি হল সেই বিষয় যার সম্পর্কে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে সচেতন হই এবং এই সচেতনতা নিজেই একটি সংবেদন। এটা স্পষ্ট যে যদি আমরা টেবিল সম্পর্কে কিছু জানতে চাই তাহলে আমাদের ইন্দ্রিয়-উপাত্তের সাহায্যেই জানতে হবে, যেমন বাদামি রঙ, আয়তাকার গঠন, মসৃণতা ইত্যাদি, যেগুলোকে আমরা টেবিলের সঙ্গে যুক্ত করে থাকি, কিন্তু যে সমস্ত কারণ দেয়া হয়েছে তার ভিত্তিতে আমরা একথা বলতে পারি না যে টেবিলটি হল একটি ইন্দিয়-উপাত্ত বা ইন্দ্রিয়-উপাত্ত হল টেবিলের প্রত্যক্ষ গুণাবলি। এভাবে আরও একটি সমস্যা তৈরি হচ্ছে ইন্দ্রিয়-উপাত্তের সঙ্গে টেবিলের সম্পর্ক যদি আমরা ধরে নিই এরকম কিছু আছে।
প্রকৃত টেবিল বলে যদি কিছু থাকে তাহলে তাকে আমরা বাহ্য বস্তু নাম দিতে পারি। এভাবে আমাদে ইন্দ্রিয়-উপত্তের সঙ্গে বাহ্য বস্তুর সম্বন্ধে বিবেচনা করতে হবে। সমস্ত বাহ্য বস্তুর একত্রীকরণেকে জড় বলা হয়। আমাদের দুটি প্রশ্নকে পুনরায় উপস্থাপন করা যায় এভাবে–১. জড় পদার্থ বলে কোন কিছু আছে কি? ২. যদি থাকে, তাহলে তার আকার কি?
যে দার্শনিক প্রথম সুস্পষ্টভাবে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উপস্থিত তাৎক্ষণিক বিষয়গুলোর স্বাধীন অস্তিত্ব আমাদের কাছে নেই বলে কারণ দেখান, তিনি হলেন বিশপ বার্কলে (১৬৮৫-১৭৫৩) তাঁর সন্দেহবাদী ও নিরীশ্বরবাদীদের বিরুদ্ধে হাইলাস ও ফিলোনাসের মধ্যে তিনটি কথোপকথন নামক গ্রন্থে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে জড় বস্তু বলে কিছু নেই এবং জগতে শুধুমাত্র মন ও ধারণার অস্তিত্ব রয়েছে। জড়বস্তুতে বিশ্বাস করতেন, কিন্তু তাঁর সঙ্গে ফিলোনাসের কোন তুলনা হয় না। যে ক্ষমাহীনভাবে পরস্পরবিরোধী এবং আপাত-বিরোধী সত্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে এবং নিজের জড়বস্তু অস্বীকারকে শেষে এমনভাবে উপস্থাপন করেছে যেন মনে হয় এটাই স্বাভাবিক। সেখানে দেওয়া যুক্তিগুলোর বিভিন্ন মাত্রা রয়েছে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ এবং নিশ্চিত, কিছু গোলামেলে বা বাকচাতুরিপূর্ণ। কিন্তু বার্কলে তার দক্ষতা এমনভাবে প্রকাশ করেছেন যে তার জড়বস্তুর অস্বীকারকেঅস্বাভাবিক বলে মনে হয় না এবং যদি এমন কোন কিছু থাকে যা ব্যক্তি ছাড়া স্বাধীনভাবে থাকতে পারে, তা কখনই আমাদের তাৎক্ষণিক সংবেদনের বিষয় হতে পারে না।
যখন আমরা জড়বস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করি তখনই দুটি প্রশ্ন জড়িয়ে পড়ে এবং এই দুটি প্রশ্নকে আলাদা রাখা প্রয়োজন। সাধারণত জড় বলতে আমরা মনের বিপরীত বুঝে থাকি, এমন কিছু যা নিজ জায়গা নিয়ে থাকে এবং যাতে কোন চিন্তা বা চেতনা নেই। প্রধানত এই অর্থেই বার্কলে জডুকে অস্বীকার করেছেন। বলতে গেলে ইন্দ্রিয়-উপাত্ত, যা টেবিলের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রমাণ দেয়, যা আমাদের থেকে স্বাধীনভাবে আছে, তাকে তিনি অস্বীকার করেননি, তিনি আসলে এগুলোর অ-জড় হওয়াকে, এগুলো যে মন বা মনের দ্বারা কৃত কোন ধারণা, তাকেই অস্বীকার করেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন যে যদি আমরা স্বর থেকে চলে যাই বা চোখ বন্ধ করে থাকি তাহলেও কিছুর অস্তিত্ব অবশ্যই থাকবে এবং আমরা যাকে টেবিল বলে জানি তার স্বপক্ষে অবশ্যই কিছু কারণ উপস্থাপন করা যাবে, যার দ্বারা আমরা বিশ্বাস করতে পারবো যে আমরা না দেখলেও কোন কিছু অবশ্যই থাকবে। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেন যে এই বস্তুটি প্রকৃতিগতভাবে যা আমরা দেখি তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হতে পারে না এবং স্বাধীনভাবে থাকতে পারে না, যদিও এই বস্তুটি অবশ্যই আমাদের দেখার থেকে স্বাধীনভাবে আছে। এভাবে তিনি এই ধারণায় উপনীত হন যে প্রকৃত টেবিলটি ঈশ্বরের মনের এক ধারণা মাত্র। এই ধারণার স্বাধীনতা ও চিরস্থায়িত্ব রয়েছে। অবশ্যই জড়ের ধারণা যা জানা যায় না শুধুমাত্র আমরা অনুমান করতে পারি, কিন্তু কখনই সোজাসোজি ও তাৎক্ষণিকভাবে জানতে পারি না।
বার্কলের পর অন্যান্য দার্শনিকরা এই অভিমত পোষণ করেন যে যদিও টেবিলটি তার অস্তিত্বের জন্য আমাদের উপর নির্ভর করে না, কিন্তু এর অস্তিত্ব কোন মনের উপর নির্ভর করে যদিও এটা আবশ্যিকভাবে ঈশ্বরের ধারণা না-ও হতে পারে কিন্তু বিশ্বের সমস্ত মনের একত্রীকরণের উপর নির্ভর করে।
এই ধারণা তাঁরা পোষণ করেন বার্কলের মতন প্রধানত এই কারণে, কেননা তারা মনে করেন কোন কিছুর সত্তা বা কোন কিছুকে সত্য বলে জানা যায় না শুধুমাত্র মন এবং তার চিন্তা ও অনুভূতি ছাড়া। যে যুক্তির মাধ্যমে তারা এই মত সমর্থন করেন তাকে আমরা এভাবে ব্যক্ত করতে পারি :
যা কিছু ভাবা যায় তা হল ব্যক্তির মনের ধারণা যা সে চিন্তা করে, সুতরাং মনের ধারণা ছাড়া আর কিছু চিন্তা করা যায় না। সুতরাং অন্য সবকিছু হল অভাবনীয় এবং যা কিছু অভাবনীয় তার কোন অস্তিত্ব থাকতে পারে না।
আমার মতে এ ধরনের যুক্তি ত্রুটিপূর্ণ এবং এই মত পোষণ করেন তারা এই মতকে কিছুতেই এত সংক্ষেপে বা এত স্থূলভাবে উপস্থাপন করবেন না। কিন্তু সত্য হোক বা না-ই হোক, এই যুক্তিটি কোন-না-কোন আকারে প্রদর্শিত হয়ে থাকে এবং অনেক দার্শনিক, হয়তো বা বেশিরভাগই মনে করেন যে মন এবং তার ধারণা ছাড়া আর কোন কিছুই সত্য নয়। এই সমস্ত দার্শনিকরা ভাববাদী বলে পরিচিত। যখনই তাঁরা জড়কে ব্যাখ্যা করতে চান, তখনই তারা হয় বার্কলের মতো বলেন যে জড় হলো আসলে কতকগুলো ধারণার সমষ্টি, নয়তো লাইবনিজের (১৬৪৬-১৭১৬) মতো বলেন যে জড় বলে যা প্রতিভাত হয় তা আসলে কতকগুলো মৌলিক মনের সমষ্টি মাত্র।
কিন্তু এই দার্শনিকরা মনের বিপরীত জড়কে অস্বীকার করলেও অন্য আরেক অর্থে জড়কে স্বীকার করেন। এটা আমাদের মনে থাকা উচিত যে আমরা দুটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলাম–১. প্রকৃত টেবিল বলে কিছু আছে কি? ২. যদি থাকে তাহরে সেটি কি ধরনের বস্তু? এখন বার্কলে এবং লাইবনিজ এই দুজনেই মনে করেন যে প্রকৃত টেবিল আছে, কিন্তু বার্কলে বলেন এটি হলো নিজের মনের কিছু ধারণা এবং লাইবনিজ বলেন এটি আত্মার বাসগৃহ (Colony) সুতরাং এঁরা দুজনেই প্রথম প্রশ্নটির সার্থক উত্তর দেন এবং সাধারণ মানুষের মতো থেকে দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তরের সময় মতপার্থক্য দেখান। সত্যি বলতে কি, প্রায় সমস্ত দার্শনিকরা এই বিষয়ে একমত যে প্রকৃত টেবিল আছে, তারা প্রায় প্রত্যেকেই একমত যে যদিও আমাদের ইন্দ্রিয়-উপাত্ত-রঙ, আকারে মসৃণতা ইত্যাদি আমাদের উপর নির্ভর করে, তা সত্ত্বেও তাদের প্রত্যক্ষীভূত হওয়া হলো এমন একটি প্রমাণ যা দেখায় যে কিছু বস্তু আমাদের থেকে স্বাধীনভাবে অস্তিত্বশীল, হয়তো তারা আমাদের ইন্দ্রিয়-উপাত্তের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং সেই ইন্দ্রিয় উপাত্তগুলোর কারণ হল আমাদের প্রকৃত টেবিলের সংযোগে আসা।
এখন স্বভাবতই এই সিদ্ধান্ত, যাকে সমস্ত দার্শনিকরা একমত যে প্রকৃত টেবিল আছে, তার স্বরূপ যাই হোক–তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। টেবিলের প্রকৃত স্বরূপ নিয়ে পুনরায় প্রশ্ন তোলার আগে এটা খুবই প্রয়োজনীয় বিবেচনার বিষয় যে এই ধরনের মত গ্রহণ করার কারণ কি। সুতরাং আমাদের পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা সেই কারণগুলো দেখাব যার সাহায্যে মনে করা হয় যে প্রকৃত টেবিল আছে।
আরও বিশদভাবে আলোচনার আগে বিবেচনা করা দরকার যে যা আমরা এতক্ষণ ধরে আবিষ্কার করলাম সেই বিষয়টি কি। এটা মনে হয় যে যদি আমরা কোন সাধারণ বিষয়কে, যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, গ্রহণ করি, তাহলে ইন্দ্রিয় আমাদের তাৎক্ষণিকভাবে সেই বিষয় সম্পর্কে, যা আমাদের থেকে আলাদা, কিছু জানায় না, শুধুই ইন্দ্রিয়-উপাত্ত সম্পর্কে কিছু সত্য জানায় যা, যতদূর আমরা দেখেছি, বিষয় এবং আমাদের সম্পর্কের উপর নির্ভর করে। সুতরাং যা আমরা সরাসারি দেখি এবং অনুভব করি তা হল দৃশ্যমান সত্তা যা প্রকৃত সত্তার প্রতিচ্ছবি। কিন্তু যদি প্রকৃত সত্তা কখনও দৃশ্যমান না হয় তাহলে আমাদের জানার কি কোন উপায় থাকবে যে প্রকৃত সত্তা বলে কিছু আছে কিনা? তাই যদি হয় তাহলে আমাদের জানার কোন উপায় আছে কি যে বিষয়টি কি? এই সমস্ত প্রশ্নগুলো রীতিমতো চমকিত করার মতন এবং এটা জানা খুবই কঠিন যে অদ্ভুত কল্পনাগুলো সত্য নাও হতে পারে। এভাবে আমাদের অতি পরিচিত টেবিল, যা আমাদের মনে পূর্বে কোন চিন্তা জাগরিত করেনি, এমন একটি সমস্যায় পরিণত হয়েছে যা নানা সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ। একটা বিষয় আমরা জেনেছি যে বিষয়টিকে যা মনে হয় তা সে নয়। এই সাধারণ ফলটুকু ছাড়া, বিষয় সম্পর্কে আমাদের অনুমান করার রাস্তা খোলা রয়েছে। লাইবনিজ আমাদের জানিয়েছেন এটা আত্মার সমাহার। বার্কলে জানিয়েছেন যে সবই হল ঈশ্বরের মনের ধারণা। বিজ্ঞানের মতে এ হলো বৈদ্যুতিক তরঙ্গ যা নাকি প্রচণ্ড গতিবেগে আলোড়িত হচ্ছে।
এ সমস্ত বিস্ময়কর সম্ভাবনার মধ্যে সন্দেহ জাগে যে হয়তো কোন টেবিলই নেই। দর্শন, যদি এটি এতসব প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারে যা জানতে আমরা চাই, অন্তত প্রশ্ন করার ক্ষমতা রাখে যা পৃথিবী সম্বন্ধে কৌতূহল জাগায় এবং দেখায় যে অতি সাধারণ বিষয়গুলো যা দৈনন্দিন জীবনের রয়েছে তার মধ্যে বিস্ময় এবং অত্যাশ্চর্যতা (বিচিত্রতা) রয়েছে।