০১. দারোয়ান ফকিরচাঁন

নেক্সট – বেগ-বাস্টার্ড সিরিজ ৬ – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

উত্সর্গ :

বেগ-বাস্টার্ড সিরিজের সেই সব ভক্ত কিংবা ভক্তদেরকে… যারা সিরিজটির এমন নামকরণ করে আমাকে ছোট্ট একটা বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে!

মুখবন্ধ

ভুলভালভাবে শিষ বাজাচ্ছে আশরাফ আলী। কেউ শুনলে বুঝতেই পারবে না ঠিক কোন্ গানটির সুর তোলার চেষ্টা করছে। যদিও জনপ্রিয় একটি হিন্দি সিনেমার গান।

রাত ন-টার দিকে নিজের এই গোপন লাক্সারি অ্যাপার্টমেন্টে আসার আগে থেকেই তার মন মেজাজ খুব ভালো। একটু আগে বাথরোব পরে ড্রইংরুমে বসে টিভি ছেড়ে দিয়ে শিষ বাজাচ্ছে আর পা নাচাচ্ছে। জামাকাপড় ছেড়ে এই জিনিসটা পরার আদৌ কোনো দরকার ছিল কি না বুঝতে পারছে না। তার কাছে মনে হচ্ছে গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেলজাতীয় ব্যাপার গেছে। অপেক্ষা আর উত্তেজনায় ছটফট করছে সে। বার বার হাতে থাকা অরিজিনাল রোলেক্স ঘড়িটা দেখছে। এখন আর রেপ্লিকা ব্যবহার করে না। পাঁচ বছর আগেই ওসব পরা বাদ দিয়ে দিয়েছে। পারফিউমের কড়া গন্ধ বেরোচ্ছে শরীর থেকে। মাউথওয়াশ দিয়ে কুলি করে নিয়েছে একটু আগে। আফটার শেভ লোশন আর বগলে ডিওডোরান্ট ব্যবহার করতেও ভোলেনি। সব মিলিয়ে এ মুহূর্তে তার শরীর থেকে তিন-চারটা ব্র্যান্ডের সুগন্ধি ভেসে আসছে। যে উদ্দেশ্যে এসবের ব্যবহার করেছে তা যে পুরোপুরি ভেস্তে গেছে সেটাও বুঝতে পারছে না আশরাফ আলী।

কলিংবেলের টুং-টাং শব্দটা কানে যেতেই পা নাচানো বন্ধ করে দিলো, আস্তে করে উঠে চলে গেল মেইন দরজার কাছে। পিপহোলে চোখ রাখতেই ঠোঁটে ফুটে উঠল লম্পট হাসি, সেই হাসি মুখে এঁটেই দরজা খুলে দিলো সে।

দরজার বাইরে ভীত হরিণের মতো দাঁড়িয়ে আছে মাথা ঘুরিয়ে দেবার মতো এক সুন্দরী। মেয়েটা পরে আছে খুবই আধুনিক আর জমকালো পোশাক। তার সাজগোজও বেশ প্রকট।

এই মেয়েগুলো সব সময় এতো কড়া সাজ সেজে থাকে কেন আশরাফ আলী জানে না। তবে এটা তার ভালোই লাগে। আজ অবশ্য এসবের কোনো দরকারই নেই। প্যাকেজিংয়ের ভ্যালু যতোই থাকুক, ব্যবহারিক মূল্য নেই-এটা তার চেয়ে বেশি কে জানে। যারা শুধু দেখবে তারা খাবে প্যাকেট, সে খাবে প্যাকেটের ভেতরের…

“হ্যালো?”

সম্বিত ফিরে পেলো আশরাফ আলী। জিভে কামড় দিলো। “আসো আসো…” দরজাটা পুরোপুরি খুলে দিলো সে।।

ভীত হরিণী আরো বেশি নার্ভাস হয়ে ভীরুপায়ে ঢুকে পড়লো আশরাফ আলীর বিলাসবহুল খাঁচায়। দরজাটা লক করে দিলে ভীতসন্ত্রস্ত মেয়েটি পেছনে ফিরে তাকালো একবার।

“নো উরি,” আশ্বস্ত করার হাসি দিলো আশরাফ আলী।

তার ভুলভাল ইংরেজি আর উচ্চারণ সব সময়ই হাসির উদ্রেক করে, সে নিজেও এটা কমবেশি জানে। কিন্তু পণ করেছে, ইংরেজি সে বলবেই।

মেয়েটার পিঠে আলতো করে হাত রাখতেই চমকে উঠল কিছুটা, কিন্তু ওই পর্যন্তই। যেন জোর করে নিজের আসল অভিব্যক্তি লুকাচ্ছে।

ট্রিম করা গোঁফের নিচে আশরাফ আলীর যে হাসিটা ফুটে উঠল সেটা পুরোপুরি ক্ষুধার্ত নেকড়ের। মেয়েটাকে ড্রইংরুমের সোফায় বসিয়ে দাঁত বের করে হাসতে লাগলো সে। তাকে বেশ বোকা বোকাও লাগছে।

“বসো।” ভীত হরিণীর পাশে বসে দু-হাত কচলালো সে। কী বলবে, কথাবার্তা কিভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। “তুমারে কি উমি কইয়া ডাকবো?” অবশেষে বলল।

মেয়েটি চেয়ে রইলো আশরাফ আলীর দিকে। শুধরে দেবার দরকারই মনে করলো না। এই লোকের কাছে অমি আর উমির কোনো পাথর্ক নেই।

অমির ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি ঘুরে বেড়ালো ঘরের চারপাশে। যেন সমস্ত ভয় আর উদ্বেগ দূর করার জন্য কিছু একটা খুঁজছে। কিংবা অন্য কোথাও দৃষ্টি ফেলে পাশের লোকটার উৎকট গন্ধ আর কামার্ত দৃষ্টির হাত থেকে পালাতে চাইছে।

“ড্রিঙ্ক করবা?” অপ্রাসঙ্গিকভাবেই বলে ফেলল আশরাফ আলী।

এমন বেমক্কা কথায় খুব অবাক হলো মেয়েটি।

“একদম ইজি হইয়া যাও…উকে?” একটু শরমিন্দা দেখালো ব্যবসায়িকে।

মাথা নেড়ে সায় দিলো অমি নামের মেয়েটি। লক্ষ্য করলো আশরাফ আলীর চোখ তার বুকের দিকে বিদ্ধ। হালকা-পাতলা শরীরে সমৃদ্ধ এই বুক সব পুরুষের মনোযোগ কাড়ে, কিন্তু এই লোকটা যেন চোখ দিয়েই খেয়ে ফেলতে চাইছে!

“আ-আমি একটু ওয়াশরুমে যাবো,” ঢোক গিলে বলল সে।

“অ্যাঁ?” কথাটা প্রথমে বুঝতে পারলো না কয়েকদিন আগে সফল জুয়েলারি আর গার্মেন্টস ব্যবসায়ি থেকে টিভি চ্যানেলের মালিক বনে যাওয়া আশরাফ আলী।

“টয়লেটে যাবো একটু,” আবারো বলতে হলো উঠতি মডেলকে।

“ও। যাও যাও!” মুখে কৃত্রিম হাসি এঁটে হাত তুলে দেখিয়ে দিলো, “ওই যে…ওই দিকে…”

সোফা থেকে উঠে ওয়াশরুমের দিকে যেতেই অমি টের পেলো তার পা দুটো টলে যাচ্ছে। কেমন অবশ করা অনুভূতিতে হেঁয়ে যাচ্ছে পুরো শরীর, সেই সাথে বুকটা ধরফর করছে তার। জোর করে, যান্ত্রিকভাবে নিজের শরীরটা বয়ে নিয়ে গেল। এর আগে কখনও এ রকম অভিজ্ঞতা হয়নি। অবশ্য মডেল হিসেবে সে খুব একটা পরিচিতও নয়, মাত্র দুটো টিভিসি করেছে। শেষ যেটা করে মোটা অঙ্কের টাকা পেয়েছিল সেটা এই আশরাফ আলীর স্বনামখ্যাত জুয়েলার্সের। এই ব্যবসা করেই লোকটা টাকা বানিয়েছে। তো নিজের পণ্যের বিজ্ঞাপনে তাকে ব্যবহার করার পর আশরাফ আলীর খায়েশ জাগে খোদ মডেলকেই ব্যবহার করবার। আনস্মার্ট আর অর্ধশিক্ষিত ব্যবসায়ির সাথে ডিনার করে দুধের বদলে ঘোল খাইয়ে ভেবেছিল সফলভাবে মিশন শেষ করতে পেরেছে, কিন্তু এরপর শুরু হয় অন্য এক যন্ত্রণা। লোকটা প্রতিদিনই ফোন দিতে শুরু করে তাকে, ফোন না ধরলেই এসএমএস করতো। ইনিয়ে-বিনিয়ে কিছু ইঙ্গিত করতো। সবটা না বোঝার ভান করে বেশ ভালোমতোই সামলাতে পেরেছিল। তার এই সামলানোর সক্ষমতা অর্জনের পেছনে রুমানা আপাকে কৃতিত্ব না দিলেই নয়। এই মহিলা গভীর জলের মাছ। আশরাফ আলীর মতো ব্যবসায়িদের মোকাবেলা করতে করতে যৌবন ক্ষয় করে ফেলেছে। এখন পড়ন্ত যৌবনে এসে একটি মডেলিং এজেন্সি দিয়েছে। অমির মতো উঠতিদের গ্রুমিং করার পাশাপাশি ক্লায়েন্ট হ্যান্ডেল করারও কার্যকরী ‘সবক’ দিয়ে থাকে।

“শোনো, খুব সহজে যদি সব দিয়ে দাও তাহলে লিটেরেলিই ফান্ড হয়ে যাবা, বুঝছো?” স্ট্রেইটকাট রুমানাআপার সোজাসাপ্টা কথা।

অমিসহ বাকি উঠতি মডেলরা এমন কথার জবাবে শুধু মাথা নেড়ে সায় দিয়ে গেছিল। অভিজ্ঞতা বলে কথা, তার একটা আলাদা গুরুত্ব আছে। তাদের মতো আনাড়িদের এ নিয়ে সন্দেহ করার কোনো অবকাশই নেই।

“আবার ওদেরকে ইগনোর করাটাও হবে ক্যারিয়ার সুইসাইড করা…গট ইট?”

এটা না বললেও সবাই ভালো করেই বোঝে। কেউ তো আর বাবামায়ের কোল থেকে লাফ দিয়ে মডেলিংয়ে নেমে পড়ে না।

“তাহলে কী করবে, উমমম?” রুমানাআপা তুড়ি বাজিয়ে প্রশ্নটা করলেও জবাবটা নিজেই দিয়েছিল। “একটু ছিনিমিনি খেলতে হবে বুড়োখোকাদের সঙ্গে, বুঝেছো?” চোখ টিপে বলেছিল কড়া মেকআপের আড়ালে থাকা অভিজ্ঞ মাঝবয়সি মহিলা। তারপর খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে, অনেকটা যুদ্ধরত জেনারেলের মতো পায়চারি করতে করতে একগাদা উঠতি মডেলদেরকে সৈন্যজ্ঞান করে বুঝিয়ে দিয়েছে কিভাবে কার সাথে কখন কী রকম ছিনিমিনি খেলাটা খেলতে হবে। রুমানাআপার কথা শুনে মনে হয়েছিল এই খেলাটা জগতসংসারে সবচেয়ে জরুরি একটি খেলা।

কিন্তু দুদিন আগে এই রুমানা আপা-ই তাকে বলে, লোকটার প্রস্তাবমতো অমি যেন তার ফ্ল্যাটে যায়। কথাটা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল সে।

“এত অবাক হবার কী আছে?” মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল রুমানা আপা। “তুমি জাস্ট যাবা…কিচ্ছু করতে হবে না।”

তার পরও বুঝতে না পেরে ঢোক গিলেছিল অমি।

“কিচ্ছু করতে হবে না মানে, তোমাকে কিছুই করতে পারবে না ঐ লোক, ওকে?”

এরপর আর কথা বাড়ায়নি সে। রুমানা আপার উপরে তার অগাধ বিশ্বাস। কোনো মেয়ে যদি রাজি না হয়, তাহলে উনি ক্লায়েন্টের কাছে পাঠান না। তাকে যখন পাঠাচ্ছে, নিশ্চয় এর মধ্যে কোনো ব্যাপার আছে।

ওয়াশরুমের ভেতরে গভীর করে দম নিয়ে নিলো অমি। বাঘের খাঁচায় ঢুকে পড়েছে বলে একটু নার্ভাস হয়ে গেছে। এখন দ্রুত নিজেকে গুছিয়ে নিতে হবে।

যতোটুকু জেনেছে, মাঝবয়সি, বিবাহিত এক লোক এই আশরাফ আলী। এমন এক প্রত্যন্ত গ্রামে তার শৈশব কেটেছে, যেখানে টয়লেট থাকলেও সেটার কোন ছাদ ছিল না। তবে টাকা কামানোর বুদ্ধিসুদ্ধি বেশ ভালো লোকটার। ঢাকায় এসে টুকটাক ব্যবসা করতে করতে স্বর্ণ চোরাচালানী সিন্ডিকেটে ঢুকে পড়ে, তারপরই দ্রুত টাকার কুমির বনে যায়। পরিশ্রমী আর ধূর্ত হিসেবে পরিচিত। কয়েক দিন আগে জাতে ওঠার জন্য ঢাকা ক্লাবের মেম্বারশিপও বাগিয়ে নিয়েছে কোটি টাকা খরচ করে। অবশ্য ক্লাবের অভিজাত সদস্যরা আশরাফ আলীকে পেয়ে মোটেও খুশি হতে পারেনি। ওখানকার মানুষগুলো মাতৃভাষা ছেড়ে ইংরেজিতে কথা বলতেই বেশি গর্বিত বোধ করে। আশরাফ আলীর সমস্যা আরো প্রকট। তার মাতৃভাষা মানে নিজের অঞ্চলের ভাষা। শুদ্ধ করে বাংলা বলতে পারে না এ লোক। প্রমিত বাংলা না শিখেই ইদানিং এক ছোকরা টিচার রেখে ইংরেজি শিখতে শুরু করেছে। সেই ছোকরা তাকে বলেছে, ভুলভাল হলেও সে যেন কথাবার্তায় ইংরেজি শব্দ-বাক্য ব্যবহার করার চেষ্টা করে। এভাবে টুকটাক বলতে বলতেই একদিন গরগর করে ইংরেজি বলতে পারবে। কিন্তু এটা করতে গিয়ে খোদ বিনোদন টিভির মালিকই মানুষজনের বিনোদনের খোরাক হয়ে উঠেছে।

লোকটার স্ত্রী আর দু-সন্তান আছে। সন্তান দু-জন পড়াশোনা করে কানাডায়। গত দু-মাস ধরে তাদের মা-ও সন্তানদের সঙ্গ দেবার উসিলায় সেখানে চলে গেছে।

রুমানা আপা তাকে বলেছে, এ সব লোকজন স্মার্ট আর আধুনিক মেয়েদের সঙ্গ পেলে ধন্য হয়ে যায়। এরা দূর থেকে মেয়েদের দিকে হা-করে তাকিয়ে তাকিয়েই পার করে দিয়েছে নিজেদের স্কুল আর কলেজ জীবনের পুরোটা সময়। নারীসান্নিধ্যের জন্য মনে মনে লালায়িত থাকলেও কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি সাহসের অভাবে। সুতরাং, একা পেলেও অমির সাথে জোরাজুরি করতে পারবে না। ধনী আর ভুলরুচির এই লোক মেয়েদের নিয়ে খেলতে অভ্যস্ত নয়। তারপরও সতর্ক থাকা উচিত, পুরুষমানুষ বলে কথা। মেয়ে মানুষকে একা পেলে বেড়াল থেকে বাঘ হয়ে উঠতে কতোক্ষণ?

“বুঝলে মেয়েরা, হরিণের মাংসই হরিণের সবচেয়ে বড় শত্রু!” রুমানাআপা সব সময় বলে থাকে কথাটা। “সো, মাই ডিয়ার হয়ে থাকবে সব সময় কিন্তু কখনও ডিয়ার হওয়া যাবে না।”

আয়নার সামনে দাঁড়ালো অমি, নিজেকে দেখে অবশ্য ভীত হরিণের মতোই লাগছে এখনও। এটা ওয়াশরুমে ঝেড়ে ফেলে বের হয়ে যেতে হবে তাকে। হরিণ নয়, তাকে প্রজাপতির মতো হতে হবে–নিষ্পাপ, সুন্দর। ফুরুত করে উড়ে যাবে, ধরা দেবে না–রুমানা আপার শিখিয়ে দেয়া অসংখ্য ছলা-কলার একটি।

গভীর করে দম নিয়ে ফোনটা বের করে ছোট্ট একটা মেসেজ পাঠালো :

আমি ওয়াশরুমে। পাঁচ মিনিট পর বের হবো।

মুখের কড়া মেকআপ আর চুলগুলো ঠিকঠাক করে নিলো সে। মিনিট পাঁচেক পর যখন বের হয়ে এলো তখন আর ভীত হরিণী নয়, পা দুটো আগের চেয়ে অনেক দৃঢ়, বুকটাও লাফাচ্ছে না। হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে।

কিন্তু ড্রইংরুমে ঢুকতেই বুঝতে পারলো কিছু একটা হয়ে গেছে। খারাপ কিছু! আশরাফ আলীর চোখেমুখে সুতীব্র ভয় জেঁকে বসেছে। সামনের টেবিলে রাখা আইফোনটার রিং বেজে চললেও কলটা রিসিভ করছে না।

তাকে ঘরে ঢুকতে দেখে মুখ তুলে তাকালো বিনোদন টিভির মালিক। তার চেহারা একদম ফ্যাকাশে, চোখেমুখে অতঙ্ক। অভিব্যক্তি দেখে মনে হলো হিসেবে ভুল করে ফেলা নিছক কোনো জুনিয়র-অ্যাকাউন্টেন্ট।

ভুরু কুঁচকে তাকালো অমি। “এনিথিং রং?”

ঢোক গিলল আশরাফ আলী, ম্রিয়মান কণ্ঠে বলল, “আ-আমারে থ্‌-থেরেট দিতাসে!”

অমি বুঝতে পারলো না। “কি দিচ্ছে!?”

রিংটোনটা বন্ধ হয়ে যাবার পর পরই একটা এসএমএস চলে এলো আশরাফ আলীর ফোনে। ঢোক গিলে টেবিলের উপর থেকে ফোনটা তুলে নিয়ে মেসেজটা ওপেন করলো কম্পিত হাতে, ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো অমির দিকে।

“কী হয়েছে?”

“কল ধরতে কইতাছে, না ধরলে…!” ভীরুকণ্ঠে বলেই আরেকবার ঢোক গিলল, সঙ্গে সঙ্গে তাকে চমকে দিয়ে বেজে উঠল রিংটোনটা। এবার আর দেরি না করে কম্পিত হাতে কলটা রিসিভ করলো সে।

“হ্যাঁ-হ্যালু?”

লোকটার কণ্ঠস্বর ভঙ্গুর আর দুর্বল। অমির কপালে ভাঁজ পড়লো, একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে ভীতসন্ত্রস্ত লোকটার দিকে। মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না, শুধু দেখতে পাচ্ছে কিভাবে একটা বাঘ বেড়ালে রূপান্তরিত হয়ে গেল কিছুক্ষণের মধ্যে। তারপরই শুধরে নিলো মনে মনে। আশরাফ আলীকে এখন বেড়াল না, ফাঁদে পড়া ইঁদুর বলে মনে হচ্ছে।

ছটফট করতে থাকা আশরাফ আলী ফোনের ওপাশ থেকে কথা শুনে অমির দিকে তাকালো ভয়ার্ত দৃষ্টিতে। যেন স্বয়ং আজরাইলের সঙ্গে কথা বলছে। তারপর অবিশ্বাসের অভিব্যক্তি ফুটে উঠল তার চেহারায়।

“ব্‌-বেলাক রঞ্জু?!” তোতলালো একটু।

অধ্যায় ১

আশেপাশের আর কারো কাছে ব্যাপারটা ধরা না পড়লেও গুলশান অ্যাভিনিউর ২৪ নাম্বার রোডের মাহবুব টেরাসের দারোয়ান ফকিরচাঁনের কাছে ঠিকই খটকা লাগলো। সব সময় চোখকান খোলা রাখে সে। এজন্যে নয় যে, দীর্ঘদিন সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করতে করতে তার অভ্যেস হয়ে গেছে। সত্যি বলতে, অন্যের ব্যাপারে তার সীমাহীন আগ্রহ। কোন ফ্ল্যাটে কে কাকে নিয়ে ঢুকছে, কারা বিয়ে-থা না করে একই ফ্ল্যাটে দিনের পর দিন থাকে, এসবই তার আগ্রহের বিষয়। সময় পেলেই এখানকার অন্যান্য ভবনের দারোয়ানদের সঙ্গে এ নিয়ে খোশগল্প করে। তো গল্প করার রসদ জোগাড় করতে হলে তো একটু চোখ-কান খোলা রাখতেই হবে।

ফকিরচাঁন সব সময় দেখে আসছে, বিকেল চারটা-পাঁচটার আগে সিটি কর্পোরেশন থেকে মশা মারার জন্য ফগার মেশিন নিয়ে কেউ কখনও আসেনি। কিন্তু আজকে, কিছুক্ষণ আগে সেটাই হয়েছে।

মেইন গেটের সামনে সিকিউরিটি বক্সের বাইরে ফগার মেশিন নিয়ে নাড়াচাড়া করছে মাস্ক পরা হ্যাংলাপাতলা এক ছোকরা। বয়স বেশি হলে উনিশ কি বিশ। জামার উপরে সিটি কর্পোরেশনের লাল রঙের ভেস্ট পরা, তাতে হলুদ রঙে লেখা ‘ঢাকা সিটি কর্পোরেশন’। সাত ক্লাস পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে ফরিকচাঁন, পেপার-পত্রিকা পড়তে পারে। সিকিউরিটি বক্সের ভেতর থেকে উঁকি মেরে উৎসুক হয়ে দেখে যাচ্ছে ছোকরাটার কাজকারবার।

“নতুননি?”

এ প্রশ্ন শুনে ছোকরাটা বিরক্ত হলো কি না বোঝা গেল না মুখে একটা কাপড়ের মাস্ক থাকার কারণে। “তিন বছর ধইরা কাম করি,” কাটাকাটা জবাব দিলো সে।

“আরে মিয়া, তুমার মেশিনের কথা কইতাছি।”

ছোকরাটা তার ফগার মেশিনের দিকে তাকালো। “ও…এইটা নতুন মডেলের।”

“মিন্সিপাল্টি খালি কামান বদলায়, ওষুধ বদলায় না,” অভিযোগের সুরে বলল ফকিরচাঁন। “পুরানা ওষুধ খায়া মচ্ছরা এহন নিশা করে, মরে না।”

সেই কবে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি রূপান্তরিত হয়েছে সিটি কর্পোরেশনে কিন্তু ফরিকচাঁন এখনও ‘মিন্সিপাল্টি’ নামেই ডাকে। “তুমারে তো আগে কহনও দেখি নাই?” সন্দেহের দৃষ্টি হেনে বলল সে।

ছোকরাটা মুখ তুলে তাকালো। “ক্যামনে দেখবেন, আগে বনানীতে মারতাম, এহন এই জোনে মারার ডিউটি দিছে।”

তারপরও সন্দেহ কাটলো না ফকিরচাঁনের। “এই অবেলায় মারতাছো ক্যান? সব সময় তো বিকালে মারে এইগুলা।”

ছেলেটা এ কথার জবাব না দিয়ে মেশিনটার স্ট্র্যাপ কাঁধে নিয়ে নিলো।

“মারো মারো, ভালা কইরা মারো,” যেন তার হুকুমেই ছোকরাটা কাজ করবে। “ডেঙ্গু দিয়া পুরা গুলশান ভইরা গেছে। কী ওষুধ যে দেও আল্লাহই জানে…মশা তো মরে না।”

“মরবো মরবো,” ছোকরাটা আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল। “এইবার যে ওষুধ আনছি…মশা না, মানুষও মরবো,” কথাটা বলেই সে কয়েক পা সামনের দিকে এগিয়ে গেল।

“মরবো আমার বাল,” ফকিরচাঁন বলে উঠল গজ গজ করতে করতে। “মিন্সিপাল্টির সবগুলা চোর…” এমন সময় ভবনের পার্কিংলট থেকে একটা গাড়ির হর্ন বেজে উঠলে ফিরে তাকালো সে। এই ভবনের ল্যান্ড-ঔনার এমপি মাহবুবসাহেবের একমাত্র ছেলে তার সাদা রঙের গাড়িটা নিয়ে বের হচ্ছে ।

সিকিউরিটি বক্স থেকে বের হয়ে এলো ফকিরচাঁন, মেইনগেটটা যে-ই না খুলে দিতে উদ্যত হবে, অমনি গেটের বাইরে কানফাঁটা বিচ্ছিরি শব্দে সচল হয়ে উঠল সিটি কর্পোরেশনের মশা মারার ফগার মেশিনটা। অবাকই হলো সে। সাধারণ মেশিনের তুলনায় নতুনটা বেশ ছোট, ভেবেছিল আওয়াজ কম হবে। কিন্তু ছোট কাঁচামরিচের মতো এটার ঝাঁঝও একটু বেশি।

“হারামজাদা আর টাইম পায় না, সকাল সকাল আইস্যা পড়ছে কামান লইয়া!” গজগজ করতে করতে গেটটা খুলে দিলো সে। দেখতে পেলো, সাদা ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে গেটের বাইরে সামনের রাস্তাটা। ফকিরচাঁন নাকে হাতচাপা দিয়ে গেটের ডানদিকে দাঁড়িয়ে রইলো।

সাদা রঙের লেক্সাস গাড়িটা মাহবুব টেরাস থেকে আস্তে করে মেইনগেটের কাছে আসতেই ফকিরচাঁন সালাম ঠুকলো নিঃশব্দে। ভেতরে যে আছে সে দেখলো কি দেখলো না তাতে কিছু যায় আসে না, দারোয়ান হিসেবে এটা তাকে করতেই হয়।

বেশ ধীরগতিতে গেট দিয়ে গাড়িটা বের হতেই থমকে গেল। সাদা ঘন ধোঁয়ায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ধোঁয়ার প্রকোপ একটু কমলেই গাড়িটা রাস্তায় নামবে।

সিটি কর্পোরেশনের ছেলেটা ফগার মেশিন দিয়ে ধোঁয়া মারতে মারতে চলে গেল পশ্চিম দিকে। হঠাৎ চারপাশ প্রকম্পিত করে গুলির শব্দ হলো তখনই। একটা নয়, পর পর তিন-চারটা। ফকিরচাঁন আবিষ্কার করলো কখন যে ঝাঁপ দিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়েছে নিজেও জানে না। ঘটনার আকস্মিকতায় তার মাথা কাজ না করলেও শরীর ঠিকই কাজ করেছে!

পুরো ব্যাপারটা ঘটে গেল মাত্র কয়েক সেকেন্ডে। তারপরই সব কিছু সুনশান।

ফকিরচাঁন বুঝতে পারছে না উঠে দাঁড়াবে কি না। ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে, দিগ্বিজ্ঞানশূণ্য হয়ে পড়েছে সে।

তারপরই আর্তনাদের শব্দটা কানে গেল।

অধ্যায় ২

অল্প কিছুক্ষণ জগিং করেই হাঁপিয়ে উঠল জেফরি বেগ। এর কারণ এ নয় যে তার প্রাণশক্তি কমে এসেছে; ফুসফুস আর আগের মতো শক্তিশালি নেই। সত্যিকারের কারণটা, তার নাক-মুখ চেপে বসে আছে!

একটা সার্জিক্যাল মাস্ক। ঢাকায় যে হারে বায়ুদূষণ বেড়েছে, মাস্ক না পরে শীতের এই সাত সকালে জগিং করতে গেলে আসল উদ্দেশ্যই ভেস্তে যাবে। সকাল সকাল বুক ভরে দূষিত বায়ু সেবন করাটা কোনোভাবেই স্বাস্থ্য সচেতনতার অংশ হতে পারে না। এর চেয়ে ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে থাকাও অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর। একটা ট্রিডমিল কিনে ঘরেই জগিংয়ের কাজ সারবে কি না সেই চিন্তাটাও মাথায় উঁকি দেয় আজকাল। মাস্ক পরে আর যাই হোক বেশিক্ষণ জগিং করা যা না।

ধানমণ্ডি লেকের পাশে, রাশান কালচার সেন্টারের সামনে এসে জগিংয়ে বিরতি দিলো সে। মুখ থেকে মাস্কটা খুলে বুকভরে শ্বাস নিলো। লেকটা আছে বলে রক্ষা। ঢাকার খুব কম জায়গাতেই জগিং করা যায়। এখন শীতের শুরুতে যে কুয়াশার চাদর দেখা যাচ্ছে শহরের উপরে, সেটা আসলে কুয়াশা বা ফগ নয়, স্মগ। স্মোক আর ফগ মিলে নতুন এই শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। পুরো শহরটা সেই স্মগে ঢেকে আছে সাতসকালে।

হাতঘড়িতে সময় দেখলো : সাড়ে ছয়টা। পনেরো মিনিটেরও কম সময় জগিং করেছে। আগে কমপক্ষে ত্রিশ মিনিট করতো কিন্তু মাস্ক পরে সেটা সম্ভব নয়। কিছুক্ষণ বুকভরে নিশ্বাস নিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক করে নিলো, ঠিক করলো, ফিরে যাবে।

সামনের ফুটপাতে দু-তিনজন হকার সদ্য ছাপা হওয়া আজকের পত্রিকাগুলো নিয়ে বসে আছে। বাড়ি বাড়ি পত্রিকা বিলি করার আগে সকালে যারা জগিং করতে কিংবা প্রাতভ্রমণে আসে তাদের কাছে বিক্রি করার আশায় এখানে বসে রোজ।

হকারদের পাশ কাটিয়ে যাবার সময় সবচেয়ে জনপ্রিয় দৈনিক মহাকাল এর প্রথম পৃষ্ঠার দিকে চোখ গেল তার। লিড নিউজটার পাশে দু-কলামের আরেকটি সংবাদ গুরুত্ব পেয়েছে।

থমকে দাঁড়ালো জেফরি, পকেট থেকে দশ টাকা বের করে পত্রিকাটা কিনে নিলো। ইচ্ছে করলে এমনিতেই পত্রিকাটা হাতে নিয়ে সংবাদটি পড়ে নিতে পারতো, কিন্তু এ কাজটা সে কখনও করে না। সামান্য হকার এরা, পত্রিকা বিক্রি করে কতই বা পায়? দরকারি নিউজটা মুফতে পড়ে নিলে এদের শুকনো মুখ আরো বেশি শুকিয়ে যায়, যদিও সেই মুখে কোনো রা থাকে না। এখানে যারা আসে, তারা প্রায় সবাই সচ্ছল। সত্যি বলতে, সচ্ছলের চেয়েও বেশি। জেফরির মতো কিছু সরকারি চাকুরে আছে হয়তো, কিন্তু বেশিরভাগই ধনী লোকজন।

দু-বছর ধরে বাড়িতে পত্রিকা রাখা বাদ দিয়েছে সে। পত্রিকাগুলো এখন ভোঁতা ছুরিকেও হার মানায়। এমন নয় যে পত্রিকায় ছাপা হওয়া সব খবরই মিথ্যে, কিন্তু অর্ধসত্য মিথ্যের চেয়েও বেশি বিভ্রান্তিকর। কী দরকার, সকাল সকাল একগাদা অর্ধসত্য পড়ে নিজের মনমেজাজ তেঁতো করার! লক্ষ্য করে দেখেছে, সকালে নাস্তার করার সময় পত্রিকায় চোখ বোলালে মানসিক চাপ তৈরি হয়, মেজাজ নষ্ট হয়। সেই মেজাজ নিয়ে অফিসে গেলে মনের অজান্তেই অধনস্তদের সাথে কখনও কখনও বাজে ব্যবহার করে ফেলে। পরে অনুশোচনায় ভোগে, অনুতাপে পোড়ে সারাটা দিন।

পত্রিকাটা হাতে নিয়ে লেকের প্রবেশ পথের সামনে এসে গ্রিলের বেষ্টনিতে হেলান দিয়ে সংবাদটা পড়তে শুরু করলো সে।

সন্ত্রাসিদের গুলিতে দু-জন নিহত
শীর্ষসন্ত্রাসি ব্ল্যাক রঞ্জুর দিকে অভিযোগের আঙুল

গতকাল রাজধানীর মিলব্যারাকে দিনে-দুপুরে দুই যুবককে সন্ত্রাসিরা গুলি করে হত্যা করেছে। পুলিশ ও স্থানীয়দের মতে, দিগম্বর আলম এবং ভাইগ্না মতিন নামে পরিচিত এ দু-জন কুখ্যাত নাইনস্টার গ্রুপের অন্যতম সদস্য। ইদানিং চাঁদাবাজি এবং টেন্ডারের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে নাইনস্টার গ্রুপের সঙ্গে ঝু্যাক রঞ্জুর দলের প্রায়শই সংঘর্ষ বাঁধছে। উল্লেখ্য, বিগত কয়েক মাস ধরে নতুন করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে রঞ্জুর দলটি। নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, ব্ল্যাক রঞ্জু আবারো ফিরে এসেছে দেশে। এতোদিন গুজব ছিল এই শীর্ষসন্ত্রাসি মারা গেছে। গতকাল বিকেলে দিগম্বর আলম নিজের বাসভবনের সামনে সন্ত্রাসিদের গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হয়, পরে হাসপাতলে নিয়ে গেলে সেখানে মৃত্যুবরণ করে সে। গুলিবিদ্ধ আলমকে হাসপাতালে দেখতে যাবার পথে ভাইগ্না মতিনকেও গুলি করে ওঁৎ পেতে থাকা সন্ত্রাসিরা। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে…

তিক্ততায় ভরে উঠল জেফরির মুখ। তিন-চার মাস ধরে, দীর্ঘ বিরতি দিয়ে আবারো শিরোনাম হচ্ছে ব্ল্যাক রঞ্জুর দলটি, শহরের ধনাঢ্য ব্যবসায়িদের ঘুম হারাম করে ফেলছে তারা। এই তো কিছুদিন আগে এক টিভি চ্যানেলের মালিক এবং নামকরা ব্যবসায়িকে রঞ্জুর দল চাঁদা না পেয়ে গুলি করেছিল। ভাগ্য ভালো, ভদ্রলোক তিন তিনটি গুলি খেলেও এখনো মরেনি। তবে সেটাও সম্ভব হয়েছে তার আর্থিক সচ্ছলতার কারণে। লাইফসাপোর্টে থাকা রোগিকে চারটার্ড বিমানে করে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এ যাত্রায় বেঁচে গেলেও যেতে পারে।

ব্যবসায়ির পরিবার অবশ্য দাবি করেছে, সন্ত্রাসিদের কথামতো নাকি এক কোটি টাকা দেয়া হয়েছিল। তবে পুলিশের ভাষ্য, চাঁদা না পেয়েই হত্যা করতে কিলিং মিশন পাঠিয়েছিল ব্ল্যাক রঞ্জু।

দিল্লিতে এই সন্ত্রাসি মারা যাবার পর তার দলটি এতোদিন নিষ্ক্রিয়ই ছিল, এই সুযোগে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে ফাইভস্টার আর নাইনস্টার গ্রুপ হিসেবে পরিচিত দুটো সন্ত্রাসি চক্র। কিন্তু তিন-চার মাস ধরে হঠাৎ করে আবারো রঞ্জুর নাম শোনা যাচ্ছে। বর্তমানে ফাইভস্টার আর নাইনস্টার গ্রুপকে প্রায় কোণঠাসা করে ফেলেছে রঞ্জর দলটি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনি উঠেপড়ে লাগলেও নতুন করে সংগঠিত হওয়া রঞ্জুর দলের কাউকেই ধরতে পারেনি। আগের চেয়েও অনেক বেশি আগ্রাসি আর সতর্ক তারা। অতীতের নৃশংসতার রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। প্রশাসন রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে তাদেরকে নিয়ে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনিকে যেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে এরা। জেফরির ধারনা, এখন যারা রঞ্জুর দলটা পরিচালনা করছে, তারা যেমন ধূর্ত, তেমনি তৎপর। সত্যি বলতে, রঞ্জু জীবিত থাকতেও তার দলটি এমন অপ্রতিরোধ্য ছিল না। এখন পর্যন্ত পুলিশ-র্যাবের হাতে রঞ্জু গ্রুপের হোমড়া চোমড়া কেউ গ্রেফতার হয়নি। যাদেরকে ধরা হয় তারা সবাই নিচের সারির-ফুট সোলজার। কিংবা এক সময় রঞ্জুর দলে কাজ করেছে।

সাংবাদিকদের উপরে জেফরির পুরনো ক্ষোভটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল আরেক বার। এরা ডাবল-চেক না করে, পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে এমন সব রিপোর্ট করে, যেটা আদতে সন্ত্রাসি আর অপরাধীদের পক্ষেই যায়। মৃত রঞ্জুকে জীবিত করার এজেন্ডাটি তারা ভালোমতোই সফল করে যাচ্ছে। ব্যবসায়িরা এখন আরো বেশি আতঙ্কিত হবে, ফোন পাওয়ামাত্রই চাঁদা দিয়ে দেবে, সাহস করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনিকে জানাতে যাবে খুব কম জনই।

রঞ্জুর তিরোধানের পর কেউ কেউ তার নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করার চেষ্টা করলে পুলিশ-র্যাব তাদের ধরে ফেলে। এরপর অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও তার দলের কোনো খবর পত্রিকায় আসেনি। তাহলে আন্ডারওয়ার্ল্ডে কী এমন ঘটনা ঘটে গেলে যে, এতোদিন পর হঠাৎ করে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল তারা? বিগত তিন-চার মাস ধরে রঞ্জুর নাম নিয়মিত শিরোনাম হচ্ছে পত্রিকার পাতায়। আক্ষরিক অর্থেই ফিনিক্স পাখির মতো ভষ্ম থেকে পুণরুখিত হয়েছে এই সন্ত্রাসি।

তিক্তমুখে পত্রিকাটি ফুটপাতের পাশে রাখা ট্র্যাশ বিনে ফেলে দিলো সে। টয়লেট পেপার!

অধ্যায় ৩

ওয়ারি থানার ওসি দিলীপ কুমার ঘোষ ঘেমে উঠেছে। একটু আগে একটা ফোন কল তাকে উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণে নামিয়ে দিয়েছে।

নিজের অফিস রুমে বসে টাওয়েল দিয়ে মুখটা মুছে নিলো। মাথার পাতলা হয়ে যাওয়া চুলে হাত বোলালো সে। চাঁদিটা গরম হয়ে আছে। সম্ভবত ধোঁয়া বের হচ্ছে সেখান দিয়ে। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে শরীরের সমস্ত রক্ত পায়ে নেমে গেছে। বুকটাও কেমন ধরফর করছে।

“স্যার…?” ঘরে ঢুকলো সাব-ইন্সপেক্টর ইউসুফ আলী।

“বসেন,” দ্রুত নিশ্বাসের মাঝে দুর্বল কণ্ঠে বলল ওসি।

ওসির ডেস্কের সামনের একটা চেয়ারে বসে পড়লো সাব-ইন্সপেক্টর। “স্যার, খুবই ত্যাদড় পোলা, মারতে মারতে হাত ব্যথা হইয়া গেছে, মুখ খোলে না…আরেকটু…”

বিস্ফারিত চোখে তাকালো ওসি, সঙ্গে সঙ্গে ইউসুফ আলী দমে গেল। “মানুষ পিটাইতে খুউব মজা, না?”

সাব-ইন্সপেক্টর অবিশ্বাসে চেয়ে রইলো। ওসির কাছ থেকে এমন কথা শুনে তার মনে হচ্ছে, ভুলেভালে অন্য কোনো জগতে ঢুকে পড়েছে। আধঘণ্টাও হয়নি, এই ওসি-ই তাকে বলেছিল আসামিকে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে হলেও তার মুখ দিয়ে যেন স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়। উপর থেকে না কি প্রচণ্ড চাপ দেয়া হচ্ছে, রঞ্জু গ্রুপের হোমড়া চোমড়া একজন না একজনকে ধরা-ই লাগবে। দু-দিন ধরে ঢাকার প্রতিটি থানা উঠেপড়ে লেগেছে নিজেদের কোটা পূরণ করতে। কিন্তু সবাই হতাশ হয়ে দেখতে পাচ্ছে, কয়েক মাস সারা ঢাকা শহর দাপিয়ে বেড়ালেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনি মাঠে নামতেই সবাই উধাও হয়ে গেছে।

অন্য কোনো সময় হলে যেকোনো একটারে ধরে এনে বলে দেয়া যেতো, রঞ্জুর ঘনিষ্ঠ লোক। কিন্তু সেটা করা যাবে না এখন, সত্যি সত্যিই রঞ্জুর ঘনিষ্ঠ কাউকে ধরা লাগবে। আর এটাই ঢাকা শহরের প্রতিটি থানার ওসিকে পেরেসানির মধ্যে মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

“আপনে শিওর, যেইটারে নিয়া আসছেন ওইটা রঞ্জুর লোক?” ভুরু কুঁচকে সন্দেহের সুরে জানতে চাইলো দিলীপ কুমার ঘোষ।

ওসির কাছ থেকে এমন প্রশ্ন শুনে আরো বেশি অবাক হলো ইউসুফ আলী। “আমি তো শিউর, স্যার। যোগী নগরের শুকুর ইনফর্মার বলছে, এই পোলা রঞ্জু গ্রুপে কাজ করে।”

ওসি দিলীপ কুমার ঘোষের মুখ তিক্ততায় ভরে উঠল। “এইসব ইনফর্মারগো কথা শুইন্যা লাফান ক্যান আপনেরা, বুঝি না।”

“স্যার, শুক্কুর অনেক পুরানা লোক,” আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলল সাব ইন্সপেক্টর। “ওয় আল্লাহর কসম কাইট্টা কইছে…” কথাটা শেষ না করেই থেমে গেল ইউসুফ আলী। দিলীপ কুমার নামধারী একজনের সামনে এটা বলা ঠিক হলো কি না বুঝতে পারছে না।

“আরে, রাখেন আপনের কসম,” ওসির মুখ আরো তিক্ত হয়ে উঠল। “এইসব মানুষজনের আবার কসম! সবগুলান বাটপার।”

সাব-ইন্সপেক্টর চুপ করে রইলো। ঊর্ধ্বতনদের সাথে কখনও তর্ক করে না সে, আর এটাই তার চাকরি জীবনের সবচেয়ে বড় যোগ্যতা।

“কিমুন মাইর দিছেন?”

সাব-ইন্সপেক্টর কী বলবে বুঝতে পারলো না।

“আধমরা কইরা ফালাইছেনি?”

সত্যি বলতে, ওসির হুকুম পেয়ে ইউসুফ আর রুস্তম নামের এক কনস্টেবল মিলে আধমরার চেয়েও বেশি খারাপ হাল করে ফেলেছে রঞ্জু গ্রুপের লোকটাকে।

“খাড়াইতে পারবো নিজের পায়ে?” উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো।

কাচুমাচু খেলো সাব-ইন্সপেক্টর ইউসুফ। “বুঝতাছি না, স্যার।”

নিজের চাঁদিতে হাত বোলালো দিলীপ কুমার। “কী যে করেন না! মানুষ হইয়া মানুষরে এমনে মারে!”

ইউসুফ আলীর চোখদুটো কপালে উঠে যেতো, বহু কষ্টে সেটা থেকে নিজেকে বিরত রাখলো সে। ওসির এখনকার কথাবার্তা শুনে পুরোপুরি ধন্দে পড়ে গেছে। আধঘণ্টার মধ্যে ওসি এমন পল্টি খেয়েছে যে, নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখতে ইচ্ছে করছে, বাস্তবে আছে কি স্বপ্নে বিচরণ করছে।

“ইন-কাস্টডি ডেথ নিয়া কড়া আইন হইছে…খোঁজ রাখেন?”

সাব-ইন্সপেক্টর চুপ থাকাটাই বেছে নিলো। “…ওইটারে ছাইড়া দেন।”

ওসির দিকে চোখ গোল গোল করে তাকালো ইউসুফ। “ছাইড়া দিমু, স্যার?”

“বাংলা বোঝেন না?” দাঁতে দাঁত চেপে বলল ওসি দিলীপ কুমার ঘোষ। মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে।

“কিন্তু, স্যার…এন্ট্রি কইরা ফালাইছি তো।”

আক্ষেপে মাথা দোলালো ওসি। “ভালা করছেন, এইবার চুপচাপ ওইটারে ছাইড়া দেন, বুঝছেন আমার বাংলা?”

ঢোক গিলে উঠে দাঁড়ালো সাব-ইন্সপেক্টর।

“আরেকটারে ধইরা নিয়া আসেন, যে নামে এন্ট্রি করছেন ওইটারে ওই নামে কোর্টে চালান কইরা দিবেন কাইল।”

ইউসুফ আলী বুঝতে পারলো ওসি কী করতে বলছে। এ দেশে এমন 1 কোনো থানা নেই যে এ কাজটা করে না। “জি, স্যার।” ওসির রুম থেকে বের হয়ে গেল সে।

টাওয়েল দিয়ে আবারো নিজের ঘর্মাক্ত মাথাটা মুছে নিলো দিলীপ কুমার ঘোষ। অস্থির হয়ে ডানদিকের জানালা দিয়ে চেয়ে রইলো। এই জানালাটা দিয়ে কে ঢুকলো আর কে বের হলো দেখা যায়।

পাঁচ মিনিট পর দেখতে পেলো ত্রিশ-বত্রিশ বছরের এক যুবক পা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে থানা থেকে বের হয়ে যাচ্ছে, ছেলেটার চোখমুখ ফোলা। বিভৎসভাবে যে পেটানো হয়েছে, দূর থেকেই বোঝা যায়। আবারো টাওয়েল দিয়ে মুখটা মুছলো ওসি। টেনশনে পড়ে গেলে প্রচুর ঘামায় সে। অস্থির হয়ে টেবিলের উপর রাখা মোবাইলফোনের দিকে চেয়ে রইলো। নিজের হৃদপিণ্ডের শব্দটাও শুনতে পাচ্ছে এখন দেয়াল ঘড়ির টিকটিক শব্দের সঙ্গে।

প্রায় দশ মিনিট স্নায়ুবিধ্বংসী অপেক্ষার পর দিলীপ কুমার ঘোষের মোবাইলফোনটা বেজে উঠল। ডিসপ্লেতে অপরিচিত নাম্বার দেখে কয়েক মুহূর্ত হতাশ বোধ করলেও কম্পিত হাতে কলটা রিসিভ করলো সে।

“হ্-হ্যালো?”

“এরপর থেকে আমার লোকজনকে ধরলে মারপিট করবেন না…অপেক্ষা করবেন।” একটু আগে তাকে ফোন দিয়েছিল যে, তার ফ্যাসফেসে কণ্ঠটা বলল।

“আচ্ছা,” কোনোমতে বলতে পারলো ওসি।

“আর শোনেন, আপনার মেয়ে মিথ্যে বলেছে, ও কোচিংয়ে যায়নি, এক বাইকারের সঙ্গে রবীন্দ্র সরোবরে গেছিল। মেয়েটার দিকে খেয়াল রাখবেন…বয়সটা খুব খারাপ।”

তার পরই কলটা কেটে দেয়া হলো।

সঙ্গে সঙ্গে একটা নাম্বারে কল দিলো দিলীপ কুমার ঘোষ।

“হ্যালো বাবা…আবার কি হইসে?”

একমাত্র মেয়ের বিরক্ত হওয়া কণ্ঠটা শুনে কিছুটা আশ্বস্ত বোধ করলো ওসি। “না, মাইনে…ঘরে প্যারা সিটামল ট্যাবলেট আছে, রিঙ্কি?”

“তুমি এইটা জানার জন্য ফোন দিসো?” এইচএসসি পরীক্ষার্থী কিশোরি মেয়ে যারপরনাই অবাক। কিছুক্ষণ আগে তার বাবা ফোন দিয়ে জানতে চেয়েছিল, সে কি করছে এখন, কোথায় আছে-সে বলেছে, আজিমপুরের এক কোচিং সেন্টারে আছে।

“না, মানে…মাথাটা খুব ব্যথা করতাসে…”

“তাইলে প্যারাসিটামল কিইন্যা আনতে বলো কনস্টেবলদের কাউরে…খায়া নাও।”

“হুম,” দিলীপ কুমার ঘোষ বলল। “আচ্ছা, রাখি।”

“শোন শোন,” তড়িঘড়ি বলে উঠল ওসি। “তুই এখন কই?”

জবাবটা দিতে একটু দেরি করলো মেয়ে। যেন এমনভাবে জবাবদিহি করতে তার অহংয়ে লেগেছে। “কোয়ার্টারে…মাত্র রিক্সা থেকে নামলাম।”

“আচ্ছা,” আর কিছু বলল না দিলীপ কুমার ঘোষ।

ও পাশ থেকে কলটা কেটে দিলো তার মেয়ে। ফোন রেখে টাওয়েল দিয়ে আবারো মুখটা মুছে নিলো। তার মেয়ে যে তার কাছে মিথ্যে বলেছে, এটা নিয়ে তেমন উদ্বেগ নেই। মেয়েটা যে এক ছেলের সঙ্গে প্রেম-ট্রেম করে, তাতেও খুব একটা চিন্তিত হচ্ছে না-অবাক হবার মতো ঘটনাই বটে। দিলীপ কুমার ঘোষ এর আগে পুলিশি জীবনে এমন কঠিন পরিস্থিতিতে কখনও পড়েনি। ব্ল্যাক রঞ্জু একেবারে তার হৃদপিণ্ডে হাত দিয়ে দিয়েছে! শুয়োরের বাচ্চা! মনে মনে গালিটা দিলো। নিজেকে রঞ্জুর মতো সন্ত্রাসির হাতে জিম্মি ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠল তার।

একটা বিষয় ভেবে পাচ্ছে না, ব্ল্যাক রঞ্জু কী করে জানতে পারলো সে কোথায় থাকে, তার মেয়ের নাম কি, কোথায় পড়ে?-কার সঙ্গে প্রেম করে!

জবাবটা চট করেই পেয়ে গেল, আর তাতেই হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল তার। অফিসের চারপাশে তাকালো ভয়ার্ত দৃষ্টিতে। নিজের ঘরেই আছে বিভীষণ!

হায় ভগবান!

অধ্যায় ৪

ডেস্কের উপর রাখা বেশ কিছু বাংলা-ইংরেজি দৈনিক পত্রিকাগুলো সরিয়ে রাখলো জেফরি বেগ।

আজকে আর কিছুই পড়তে ইচ্ছে করছে না। একটু আগে চা দিয়ে গেছে আরদার্লি ছেলেটা। চায়ের কাপটা তুলে চুমুক দিয়ে টের পেলো, অন্য দিনের চেয়ে আজকের চা-টা কেমন তেতো লাগছে। কাপটা রেখে দিতেই আরদার্লি ছেলেটা দরজা দিয়ে উঁকি দিলো।

“ডিজিস্যার আপনারে দেখা করতে বলছেন, স্যার।”

অবাক হলো জেফরি। হোমিসাইডের মহাপরিচালক ফারুক আহমেদ বড় কিছু না ঘটলে সাধারণত এতো সকালে অফিসে আসে না। “আসছি,” বলল সে। নিজের ডেস্ক থেকে উঠে চলে গেল মহাপরিচালকের ঘরের দিকে। তার রুম থেকে খুব বেশি দূরে নয় সেটা।

“আসতে পারি, স্যার?” বাইরে দরজায় দুটো টোকা মেরে বলল।

“আসো আসো,” ভেতর থেকে বলে উঠল ফারুক আহমেদ।

দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়লো জেফরি বেগ। “স্লামালেকুম, স্যার।”

মাথা নেড়ে সালামের জবাব নিলো মহাপরিচালক। “বসো।”

“এতো সকালে ডাকলেন যে, কিছু হয়েছে?” চেয়ারে বসেই জিজ্ঞেস করলো জেফরি।

গম্ভীরভাবে মাথা দোলালো মহাপরিচালক। “চা খেয়েছে, নাকি দিতে বলবো?”

“একটু আগেই খেয়েছি, স্যার।”

“ওকে,” কথাটা বলে একটু ভেবে নিলো ফারুক আহমেদ। তার মধ্যে সামান্য দ্বিধা দেখা যাচ্ছে। “আচ্ছা…ঐ ব্ল্যাক রঞ্জু…তুমি তো একদম শিওর…মারা গেছে, না?”

জেফরি বুঝতে পারলো, পত্রিকার রিপোর্টগুলো ফারুক আহমেদকেও দ্বিধার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। “হ্যাঁ, স্যার। দিল্লিতে মারা গেছে বেশ কয়েক বছর আগে।”

গম্ভীর হয়ে মাথা নেড়ে সায় দিলো মহাপরিচালক। “ঐ প্রফেশনাল কিলার, যে ওকে মেরেছে…কী যেন নাম?”

ফারুক আহমেদ সব সময়ই বাস্টার্ডের নাম নিতে গেলে এ রকম করে, আজও ব্যতিক্রম করলো না। মাঝে মাঝে তার কৌতূহল হয়-ভদ্রলোক কেন এটা করে। “বাস্টার্ড। আসল নাম তৌফিক আহমেদ, ডাক নাম বাবলু।”

গম্ভীরভাবে মাথা দোলালো ডিজি। “হুম।”

“পত্রিকায় যে খবরগুলো বের হচ্ছে সেগুলো বেইজলেস, স্যার,” বলল জেফরি বেগ। “রঞ্জুর নাম ভাঙিয়ে-”

“পত্রিকার ঐ সব রিপোর্ট আমিও খুব একটা বিশ্বাস করি না,” কথার মাঝখানে বলল ফারুক আহমেদ।

এবার জেফরি অবাক হলো। “তাহলে রঞ্জু সম্পর্কে জানতে চাইছেন যে?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল হোমিসাইডের ডিজি। কাল রাতে আমেরিকান টোব্যাকোর ম্যানেজিং ডিরেক্টর মুনেম চৌধুরী মারা গেছেন। দু-দিন আগে রঞ্জুর সন্ত্রাসিরা উনার বাড়ির সামনে গুলি করেছিল।”

“নিউজে তো খবরটা আসেনি!”

“সরকার চায়নি ঢাকা শহরে একটি বিদেশি কোম্পানির সিইও’র গুলিবিদ্ধ হবার খবরটি ফলাও করে প্রচার হোক। তাছাড়া ভদ্রলোক তখনও বেঁচে ছিলেন, যেহেতু গত রাতে মারা গেছেন, আগামিকাল হয়তো আসতে পারে খবরটা।”

চুপ মেরে রইলো জেফরি বেগ। পত্রিকা আর নিউজ চ্যানেলগুলোকে যে সরকার পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, তার যতো সুবোধ ব্যাখ্যাই দেয়া হোক না কেন, আদতে এটা ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই করে না।

“সপ্তাহখানেক আগে ব্ল্যাক রঞ্জুর দল তার কাছ থেকে চাঁদা চেয়েছিল, ভদ্রলোক পুলিশকে সেটা জানিয়ে দেন, জিডিও করেন। এ ঘটনার কারণেই রঞ্জুর দল তার উপর হামলা চালায়।”

গভীর করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল জেফরি বেগ। ব্ল্যাক রঞ্জুর দলটা এবার খুব বেশি বেপরোয়া। প্রতিপক্ষদের তো হত্যা করছেই, চাঁদা না পেলে হোমড়া চোমড়াদেরকেও খুন করছে।

“গতকাল থেকেই এটা নিয়ে বেশ দৌড়ঝাঁপ হয়েছে, র‍্যাব আর পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে, রঞ্জুর দলের সম্ভাব্য সবগুলো আস্তানায় রেইড দিয়েছে তারা কিন্তু রঞ্জুর নাগাল পায়নি।”

কখনও পাবে না, মনে মনে বলে উঠল জেফরি বেগ। মৃত মানুষের নাগাল কেউ পায় না!

“আজ সকালে হোমমিনিস্টার জরুরি তলব করেছিলেন…এইমাত্র তার বাড়ি থেকেই এলাম।”

এবার জেফরি বুঝতে পারলো, এতো সকালে ডিজির অফিসে আসার কারণ।

“যেহেতু ভদ্রলোক মারা গেছেন, কেসটা এখন হোমিসাইড দেখবে।”

জেফরি বেগ অবাক হলো না। হোমিসাইড সন্ত্রাসিদের কাজ নিয়ে ডিল করে না। ওটার দায়িত্বে আছে অ্যান্টি-টেররিস্ট স্কোয়াড। দেশের ভেতরে বিভিন্ন ধরণের সংগঠিত সন্ত্রাসি দলের বিরুদ্ধে কাজ করে তারা। কিন্তু রঞ্জুর দলটার বিরুদ্ধে কাজ করার পূর্ব অভিজ্ঞতা কারণে এই কেসটার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে হোমিসাইডকে।

“হোমমিনিস্টার খুব চাপে আছেন। আমেরিকান অ্যাম্বাসেডর সাতসকালে ফোন করেছিলেন, দ্রুত অপরাধীকে ধরার জন্য তাগাদা দিয়েছেন,” একটু থেমে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “পিএমও ফোন দিয়েছিলেন।”

বিস্ময়ের সাথে তাকালো জেফরি। হোমমিনিস্টারের ব্যাপারটা বুঝতে পারছে, আমেরিকান প্রতিষ্ঠান বলে ওই দেশের রাষ্ট্রদূতের তৎপরতা থাকাও স্বাভাবিক, তাই বলে প্রধানমন্ত্রী এটা নিয়ে সকাল সকাল ফোন দেবেন? “ভদ্রলোক কি পলিটিক্স করতেন?”

বিমর্ষভাবে মাথা দোলালো ফারুক আহমেদ। “মুনেম চৌধুরীর বাবা একজন সিটিং এমপি…পিএমের খুবই ঘনিষ্ঠ লোক।”

এবার হোমমিনিস্টারের অবস্থাটা কল্পনা করতে পারলো জেফরি। একদিকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত, অন্যদিকে খোদ প্রধানমন্ত্রী-বেচারার নাভিশ্বাস উঠে গেছে নিশ্চয়। মুনেম চৌধুরীর কেসটা যে তাকে দেয়া হয়েছে তার কারণ তাহলে এই-ই। যদু-মধু কেউ না, এ দেশের সবচেয়ে বেশি সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির একজন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এই শ্রেণির লোকজন মৃত্যুর পরও একটু বেশিই সুবিধা পেয়ে থাকে।

“মুনেমের বাবার যথেষ্ট বয়স হয়েছে,” মহাপরিচালক আবার বলতে লাগলো। “এমনিতেই নানান অসুখ-বিসুখে ভুগছিলেন, ছেলে গুলিবিদ্ধ হবার আগেই হার্টের সমস্যার কারণে হাসপাতালে ছিলেন। এখনও জানেন না তার ছেলে মারা গেছে।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ফারুক আহমেদ। “পিএম খুব রেগে আছেন এই বিষয়টা নিয়ে। হোমমিনিস্টারকে ডেকে দ্রুত আসামিদেরকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন,” চিন্তিত মুখে বলল ডিজি। “হোমমিনিস্টার আমাদেরকে এক সপ্তাহের ডেডলাইন বেঁধে দিয়েছেন।”

“উনি কিভাবে ডেডলাইন বেঁধে দেন?” রাগেক্ষোভে বলে উঠল হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর। “যেখানে কয়েক মাস ধরে সবগুলো বাহিনি মিলে রঞ্জুর দলের কিছু করতে পারছে না, সেখানে এ রকম একটি মার্ডার কেস আমরা এক সপ্তাহে কী করে সভ করবো?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ফারুক আহমেদ। “সেটা আমি জানি কিন্তু পলিটিশিয়ানদের ব্যাপারটা তো বোঝোই, ওরা এ রকম কথা বলতে অভ্যন্ত।”

“এভাবে সময় বেঁধে দিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো কেস কি সমাধান করা গেছে, স্যার?”

গম্ভীর হয়ে মাথা দোলালো হোমিসাইডের ডিজি।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো জেফরির ভেতর থেকে। “আর রঞ্জুর দলটা অনেক বড়, ওদের একেক জনকে ধরাও খুব কঠিন কাজ হবে।”

“সমস্যা হলো, হোমমিনিস্টার বলেছেন যেভাবেই হোক এক সপ্তাহের মধ্যে আসল কালপ্রিট ঐ ব্ল্যাক রঞ্জুকে ধরতে হবে।”

“রঞ্জুকে?!” কয়েক মুহূর্তে জন্য জেফরি বিস্ময়ে থ বনে গেল। “ও তো অনেক আগেই মরে গেছে, ওকে কীভাবে ধরবো? আজব!” তিক্ততায় ভরে উঠল তার মুখ। “এসব কথা হোমমিনিস্টার কি জানেন না?”

ফারুক আহমেদ একটু সামনের দিকে ঝুঁকে এলো। “অবশ্যই জানেন, মানে জানতেন। কিন্তু গভমেন্টের দুটো ইন্টেলিজেন্স জানিয়েছে, কয়েক মাস ধরে রঞ্জু ঢাকাতেই আছে।”

“অসম্ভব!” সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল জেফরি বেগ। “এটা হতেই পারে না। আমি নিশ্চিত, রঞ্জুর নাম ভাঙিয়ে ওর দলের লোকজন চাঁদাবাজি করছে, নতুন করে অর্গানাইজড হচ্ছে। এটা সন্ত্রাসিলের বহু পুরনো কৌশল, স্যার।”

চিন্তিত দেখালো ফারুক আহমেদকে। “গোয়েন্দারা রিপোর্ট দিয়েছে, রঞ্জু এখনও বেঁচে আছে, মারাত্মকভাবে আহত…সারা শরীর পুড়ে গেছে।”

ভুরু কুঁচকে গেল হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটরের। সারা শরীর পুড়ে গেছে।

“এ কয় বছর বিদেশে ট্রিটমেন্ট করিয়েছে, সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছে দেশে।”

মাথা দোলালো জেফরি বেগ। বাস্টার্ড তাকে যেভাবে পুড়িয়ে মেরেছে, তাতে করে কোনো মানুষের পক্ষে তো দূরের কথা, সুপারম্যানের পক্ষেও বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তারপরও কথা থাকে, হুইলচেয়ারে রঞ্জুর জ্বলন্ত দেহটা বেশিক্ষণ দেখেনি সে। সারা ঘরে আগুন লেগে যাওয়ার কারণে এক পর্যায়ে ইয়াহু মেসেঞ্জারের ভিডিওটা বন্ধ হয়ে যায়। আবার এমনও হতে পারে, বাস্টার্ড নিজেও বন্ধ করে দিয়ে থাকতে পারে-যাই হোক, জেফরি শুধু দেখেছে, হুইলচেয়ারসহ রঞ্জুর সারা শরীরে আগুন-জ্বলন্ত চিতার মতোই জ্বলছে সেটা। তার পরও যদি ঐ সন্ত্রাসি বেঁচে গিয়ে থাকে, তাহলে বলতেই হয়, সে কোনো মানুষ না!

“গতকাল ডিবি-পুলিশ-র্যাব রঞ্জুর অনেকগুলো আস্তানায় হানা দিয়েছিল, খুব বেশি সুবিধা করতে পারেনি। পরে পুরান ঢাকার কিছু থানার ইনফর্মারদের সাহায্য নিয়ে রঞ্জুর পুরনো দু-জন ঘনিষ্ঠ লোককে গ্রেফতার করেছে, তারাও জানিয়েছে ঐ সন্ত্রাসি বেঁচে আছে।”

“মিথ্যে বলেছে ওরা। রঞ্জুর দলটা এখন যারা চালাচ্ছে তারা শিখিয়ে দিয়েছে, ধরা পড়লে যেন এ কথা বলে।”

“এর আগে আরেকজন ধরা পড়েছিল…নাইনস্টার গ্রুপের, সে-ও বলেছে ব্ল্যাক রঞ্জু বেঁচে আছে।”

কথাটা শুনে ভুরু কুঁচকে গেল জেফরির। রঞ্জুর তিরোধানের পর নাইজেল নামের এক শীর্ষসন্ত্রাসি নবী নামের আরেক সন্ত্রাসির সাথে মিলে নাইনস্টার গ্রুপটি তৈরি করে অনেকেরই ধারনা নাইন স্টার মানে নয়জনের একটি দল, আদতে এটা ঐ দু-জনের নামের আদ্যাক্ষর। আন্ডারওয়ার্ল্ডে এই নাইনস্টার হয়ে ওঠে একচ্ছত্র অধিপতি। এতোদিন তারাই চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ নানান অপরাধ করে বেড়াচ্ছিল। তাদের হাতে রঞ্জুর অনেক ঘনিষ্ঠ লোক খুনও হয়েছে। ইদানিং তাদের সঙ্গে কঠিন লড়াই শুরু হয়ে গেছে রঞ্জুর দলটির-শোনা যায়, নাইজেল জীবন বাঁচাতে বিদেশে চলে গেছে, আবার অনেকে বলে বেঘোরে মারা পড়েছে-সেই নাইনস্টার গ্রুপের সদস্য কি না বলেছে, রঞ্জু বেঁচে আছে? অবিশ্বাস্য! তারা তো শুরু থেকে দাবি করে আসছে, রঞ্জুর নাম ভাঙাচ্ছে তার দলের লোকজন-আদতে ঐ ঘৃণ্য সন্ত্রাসি বহু আগেই মারা গেছে।

“আমি হোমমিনিস্টারকে বলেছিলাম, কয়েক বছর আগেই ঐ সন্ত্রাসি মারা গেছে দিল্লিতে,” ডিজি বলল। “তিনি প্রমান চেয়েছেন কিন্তু আমাদের কাছে এর কোনো প্রমান নেই। তুমি তো জানোই, নথিপত্র-রেকর্ড ছাড়া কিছু মেনে নেয় না গভমেন্ট।”

রঞ্জু নিহত হবার পর জেফরি বেগ দিল্লির পুলিশকে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য যে দেয়নি, তার কারণও ছিল : বাংলাদেশের একজন সন্ত্রাসি মারা গেছে ওখানে, তাকে মেরেছে এ দেশের আরেক পেশাদার খুনি-কূটনৈতিক দিক থেকে এটা মোটেও সুখকর কোনো বিষয় হতো না। ঘটনাটি দিল্লি পুলিশকে জানাতে হলেও স্বরাষ্ট্র আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে ক্লিয়ারেন্স নিতে হতো। দেশের ভাবমূর্তির কথা বিবেচনা করে এ রকম ক্লিয়ারেন্স তাকে কখনও দেয়া হতো না।

“যাই হোক, ফারুক আহমেদ বলল, “রঞ্জু বেঁচে আছে না কি মরে গেছে সেটা জানা যাবে মুনেমসাহেবের কেসটা সভ হলেই। তুমি ডেডলাইন নিয়ে চিন্তা কোরো না, ওটা আমি দেখবো।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি বেগ। রঞ্জুর দলটা আসলেই মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েক মাস ধরে তারা অনেকটাই বেপরোয়া। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনির ঘুম হারাম করে ফেলেছে। এতোদিন তাদের নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকতো পুলিশ আর র‍্যাব, এখন মুনেমের মতো একজন ভিআইপির হত্যাকাণ্ডের ফলে হোমিসাইডও রঞ্জুর দলটার পেছনে লাগবে। কাজটা চ্যালেঞ্জিং কিন্তু আসল সত্যটা জানতে সে-ও উন্মুখ হয়ে উঠেছে।

“আমি ঐ সব ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টগুলো দেখতে চাই,” জেফরি বেগ বলল। “এখন পর্যন্ত পুলিশ যেটুকু তদন্ত করেছে তার সবই দরকার পড়বে। যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে, রঞ্জুর বেঁচে থাকার কথা বলেছে, তাদেরকে আমি নিজে ইন্টেরোগেট করতে চাই।”

“আমি সব কিছুর ব্যবস্থা করছি,” তাকে আশ্বস্ত করে বলল মহাপরিচালক।

অধ্যায় ৫

প্লেনটা টেক-অফ করার পর ছোট্ট জানালা দিয়ে নিচের ভূ-ভাগের দিকে তাকাতেই চোখ বন্ধ করে ফেলল অমূল্যবাবু।

অসংখ্য পুরনো স্মৃতি ফিরে আসছে দমকা বাতাসের মতো, এলোমেলো করে দিচ্ছে তাকে। খুব করে যে তাড়িয়ে দিতে চাইছে, তা-ও না। দীর্ঘ এ জীবনে ভ্রমণের সময় যথাসম্ভব চেষ্টা করে বিমান এড়িয়ে চলতে। তবে এটাও ঠিক, খুব বেশি ভ্রমণ করার লোকও সে নয়। তার সার্কেলের মধ্যে সে-ই সবচেয়ে কম বিমানে ভ্রমণ করে।

বিমান..বিমলা!

বহু পুরনো একটি খচখচানি। বুকের ভেতরে দলা পাকানো একটি দুঃখবোধ, দীর্ঘ চল্লিশ বছরেও যার অবসান হয়নি। একাতুরে কতো মানুষ কতো কিছু হারিয়েছে কিন্তু সে তুলনায় তার ক্ষতি নিতান্তই সামান্য-মাত্র একজন মানুষ হারিয়েছে সে। আর মানুষটি বেঘোরে গুলি খেয়ে মরেনি, মিলিটারির হাতে ধরা পড়ে নির্যাতিত হয়েও প্রাণ হারায়নি, স্রেফ তার জীবন থেকে দূরে চলে গেছে, পর হয়ে গেছে।

যুদ্ধের সময় লক্ষ-লক্ষ মানুষের মতো বিমলার বাবা বিমান বিহারী দাস নিজের পরিবার নিয়ে ওপাড়ে চলে যায় নিরাপদ আশ্রয়ের আশায়। দেশে থাকলে নির্ঘাত পাকিস্তানী বর্বর মিলিটারির শিকারে পরিণত হতো ওরা। বিমলাদের ওপাড়ে চলে যাওয়ার খবর শুনে যারপরনাই স্বস্তি পেয়েছিল সে, অনেকটা নির্ভার হয়েই যোগ দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। কিন্তু স্বাধীনতার পর যখন নতুন স্বপ্ন দেখার পালা তখনই তার জীবনটা ওলটপালট হয়ে যায় ছোট্ট একটি খবরে-ডিসেম্বরের শুরুতে তারা যখন ত্রিপুরা সীমান্ত দিয়ে ঢুকে আখাউড়া স্বাধীন করে ফেলে, আরেকটু এগিয়ে গিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত করতে পাকিস্তানী বাহিনির সাথে মরনপণ যুদ্ধে লিপ্ত, তখনই বিমলা সাতপাঁকে বাধা পড়ে যায়।

১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে তিনদিন পর এই খবরটা জানতে পারে সে। একুশ-বাইশ বছরের টগবগে যুবকের সব স্বপ্ন ঘোলা হয়ে যায় নিমেষে। যুদ্ধের আগে হলে সে হয়তো পুরোপুরি ভেঙে পড়তো কিন্তু যুদ্ধ তাকে বদলে দিয়েছিল। অসংখ্য সঙ্গিসাথী আর শত্রুপক্ষের মৃত্যু তাকে অন্য মানুষে রূপান্তরিত করে ফেলেছিল। আর যুদ্ধের পরই জীবন নিয়ে পালাতে হয়েছিল তাকে, বিমলার জন্য খুব বেশি শোক করার ফুরসত পায়নি!

প্রথম দিকে সে ছিল মুজিববাহিনির একজন সদস্য, শুরু থেকেই এই তরুণ নেতৃত্বের প্রায় সবাই ছিল তাজউদ্দীনবিরোধী। একাত্তুরের ১১ই এপ্রিল শিলিগুড়িতে যখন অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমেদের প্রথম ভাষণটি প্রচার করা হয়, তখন থেকেই শুরু এই বিরোধীতার। এক পর্যায়ে সে জানতে পারে মুজিববাহিনির কতিপয় ক্ষমতালিন্দু নেতা মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে হত্যার পরিকল্পনা করছে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের বাঘা-বাঘা সব নেতা, নয়নের মণি হিসেবে যাদের ঠাঁই ছিল তাদের মতো তরুণদের চোখে তারা যখন যুদ্ধের সময় নিজেদের সঙ্কীর্ণ দলীয় চিন্তা-ভাবনা আর ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো তখন গম্ভীর হতাশায় ডুবে গেছিল সে। ওটা ছিল জনযুদ্ধ-ছাত্র-যুবা, কৃষক, শ্রমিক, সামরিক, বেসামরিক লোকজনের সম্মিলিত একটি বাহিনি-কিন্তু নেতৃত্বে থাকা আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুটমেন্ট করার সময় ভিন্ন দলের লোকজনের ব্যাপারে সঙ্কীর্ণমনতা দেখাতো। বিশেষ করে বামপন্থীদের বেলায়। যুদ্ধের ও রকম সময় নেতাদের এমন মনোভাব পীড়িত করেছিল তাকে। সে নিজেও বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল, কিন্তু উনসত্তুরের গণঅভূত্থানের ছাত্রনেতার সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল বলে তার প্রতি অমন মনোভাব দেখায়নি কেউ।

কলকাতার ভবানীপুর পার্কের সানি ভিলা ছিল এই বাহিনির আস্তানা। তপুবাবু, রাজুবাবু, সরোজবাবু, মণিবাবু, মধুবাবু, এ রকম সব ছদ্মনামে পরিচিত ছিল তরুণ নেতারা। তাদের মধ্যে অমূল্য ছিল সর্বকণিষ্ঠ এবং সবচেয়ে অখ্যাত একজন, কিন্তু নেতাদের সাথে তার ছিল সখ্যতা আর ওঠাবসা। সে এমন কোনো পরিচিত মুখ ছিল না যে, তাকে নতুন কোনো নাম নিতে হবে। সুতরাং বাবুদের ভীড়ে সে-ও হয়ে ওঠে আরেকজন বাবু-যে নামটি এখনও তার সাথে লেগে আছে অতীতকে ধারণ করে।

সেপ্টেম্বরের এক রাতে সানি ভিলা থেকে ফিরে এসে সারা রাত আর ঘুমাতে পারেনি। পরদিন ঘুম থেকে উঠে সোজা চলে যায় তাজউদ্দীন আহমেদের অফিসে। যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তখন নিজের দফতরে একদম একা। অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি দূরদর্শী ছিল, ভালো করেই জানতো, তাজউদ্দীন আহমেদের হত্যাকাণ্ড কতো বড় সর্বনাশ করে ফেলবে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের জেলে বন্দি, এখন যদি যুদ্ধের মাঝখানে তাজউদ্দীনও নিহত হয় নিজ দলের হাতে তাহলে ফায়দার সবটুকু লুটে নেবে হানাদার পাকিস্তান বাহিনি। মুজিববাহিনির নেতারা ছিল বয়সে তরুণ এবং অপরিপক্ক, তাদের নেতৃত্বে যুদ্ধ পরিচালিত হবে না, মুখ থুবড়ে পড়বে রক্তক্ষয়ী এই সংগ্রাম।

অমূল্য সব কিছু খুলে বলে তাজউদ্দীন আহমদকে। মেধাবি আর ধীরস্থির মানুষটি সব শুনে চুপ মেরে থাকেন কয়েক মিনিট। একটা সময় সে মনে করতে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী হয়তো তার মতো একুশ বছরের ছোকরার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছেন না। অবশেষে তাজউদ্দীন আহমেদ উঠে দাঁড়ান, নিজের নিরাপত্তার কথা না ভেবে বরং অমূল্যকে পরামর্শ দেন, সে যেন সাবধানে থাকে, কারণ সদ্য বাবু হয়ে ওঠা নেতারা তাকে ছেড়ে দেবে না, খবরটা তাদের কাছে পৌঁছে যাবে দ্রুত। ভালো হয় বহু দুরে ত্রিপুরা সীমান্তে গিয়ে যুদ্ধে যোগ দিলে। আর মুজিববাহিনির ব্যাপারটা তিনি দেখবেন, মিসেস গান্ধীর সঙ্গে কথা বলবেন এ নিয়ে।

এরপরই মুজিববাহিনির সঙ্গে সব ধরণের সংস্রব ত্যাগ করে অমূল্য, চলে যায় রণাঙ্গনে। সে আর ভারতীয় সেনাবাহিনি এবং গোয়েন্দাদের তত্ত্বাবধানে

সৃষ্টি হওয়া স্যাম’স বয়েজ’দের না-শুধুই একজন মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের। গ্রামেগঞ্জে থেকে আসা কৃষক-শ্রমিক-ছাত্রদেরই একজন। দেশ স্বাধীন করাই যার প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য।

যেমনটা ধরাণা করা হয়েছিল, মুজিববাহিনির কতিপয় নেতা ঠিকই তাকে বেঈমান হিসেবে চিহ্নিত করে। কিন্তু বহু দূরে রণাঙ্গণে ছিল বলে তার নাগাল পায়নি।

মুজিববাহিনির খুব কম সদস্যই সত্যিকারের যুদ্ধের ধারেকাছে ছিল, সানি ভিলার আরামদায়ক রুমে বসে মহাপরিকল্পনায় ব্যস্ত ছিল একেকজন, ফলে একদিক থেকে তার জন্য সুবিধাই হয়ে গেছিল।

বিপদ দেখা দিলো যুদ্ধ শেষে। ১৬ই ডিসেম্বরের পর মুজিবাহিনির ‘যোদ্ধারা অস্ত্রহাতে মাঠে নেমে পড়েছে। সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধারা টিটকারি মেরে তাদেরকে বলতে ‘সিক্সটিন্থ ডিভিশনের যোদ্ধা! গম্ভীর হতাশার সাথে অমূল্য দেখলো, স্যাম’স বয়েজরা ক্ষমতার দ্বন্দ্বে নিজেরাই বিভক্ত হয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নেমে পড়ে ধারনার চেয়েও দ্রুত গতিতে। তাই যুদ্ধ শেষ হলেও তার নিজের মুক্তি মিলেছিল আরো পরে।

চোখ খুলে প্লেনের জানালা দিয়ে নিচে তাকালো অমূল্য। মেঘের উপরে থাকায় নিচের কিছু স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে না। হাতঘড়িতে সময় দেখলো, আর মাত্র পাঁচ-ছয় মিনিট পরই বিমানটা ল্যান্ড করবে। চোখ বন্ধ করে গভীর করে নিশ্বাস নিতে শুরু করলো সে। বিমানের টেক-অফ আর ল্যান্ডিং, দুটোই তার মধ্যে জঘন্য অনুভূতির জন্ম দেয়।

“আপনার কি সমস্যা হচ্ছে?”

চোখ মেলে পাশের যাত্রির দিকে তাকালো অমূল্যবাবু। ভদ্রলোক এ পর্যন্ত কোনো কথা বলেননি, চুপচাপ একটা ম্যাগাজিন পড়ে যাচ্ছিলেন।

“না,” শান্ত কণ্ঠে বলল সে।

“আমার মনে হলো আপনার ব্রিদিং প্রবলেম হচ্ছে। সমস্যা হলে আমাকে বলতে পারেন, আমি একজন ফিজিশিয়ান।”

“আপনি বিদেশে থাকেন?” পাশের যাত্রি অবাক হলো কথাটা শুনে। “আপনি কী করে বুঝলেন?”

“এ দেশের ডাক্তাররা কেউ নিজেদেরকে ফিজিশিয়ান বলে পরিচয় দেয় না।”

“আপনার অবজার্ভেশন ক্ষমতা তো দারুণ!”

প্রশংসাটা আমলে না নিয়ে বলতে লাগলো বাবু, “আমার কোনো ব্রিদিং সমস্যা হচ্ছে না। আমি আসলে ডিপ ব্রেদ নিচ্ছিলাম বিক্ষিপ্ত মনটাকে শান্ত করার জন্য।”

“আই সি,” ভুরু তুলে বলল ভদ্রলোক। “আপনি ইয়োগা করেন?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো বাবু।

“দ্যাটস গুড।” একটু থেমে আবার বলল, “আমার নাম ফাহাদ ফাহিম। আগেই বলেছি ডাক্তারি করি, থাকি স্টেটসে।”

“অমূল্য রায় চৌধুরী, হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল সে।

“নাইস টু মিট ইউ, মি. চৌধুরী।”

অমায়িক হাসি দিলো বাবু।

“বিজনেস ট্রিপ নাকি ভ্যাকেশন?”

“বলতে পারেন দুটোই।”

ভুরু তুলল ফাহাদ ফাহিম। “সেম টু মি! কক্সবাজারের যে নতুন হাসপাতালটি হয়েছে, আমি সেখানকার কনসালটেন্ট হিসেবে তিন দিনের টুরে যাচ্ছি, পাশাপাশি বিচটাও ঘুরে দেখবো। সেই কলেজ লাইফে গেছিলাম, বুঝলেন।”

“কতোদিন পর এলেন?”

“বিশ বছর তো হবেই!” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ডাক্তার। “ওখানেই স্যাটেলড…বিয়েও করেছিলাম…আমার পরিবার আবার খুবই কনজার্ভেটিভ, মেনে নিতে পারেনি। আমার ওয়াইফ ইহুদি ছিল।”

বাবু বুঝতে পারলো।

“গত বছর আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে। এখন আমার ফ্যামিলি আমার জন্য একটা অ্যারেঞ্জ ম্যারেজের ব্যবস্থা করেছে,” লাজুক হাসি দিয়ে বলল ডাক্তার। “এটাকে রি-ইউনিয়ন অ্যান্ড রি-কনসিলিয়েশনও বলতে পারেন।”

“কগ্রাচুলেশন্স।”

“থ্যাঙ্ক ইউ।”

ডাক্তার ফাহাদ ফাহিমের বয়সটা লক্ষ্য করলো বাবু। সম্ভবত পঞ্চাশের কাছাকাছি, তবে যথেষ্ট ফিট। পরিপাটি, স্মার্ট আর রুচিবানও বটে।

বিমানবালার কণ্ঠটা শোনা গেল। যাত্রিদেরকে সিটবেল্ট বেঁধে নেবার তাগিদ দিচ্ছে।

অমূল্যবাবুর সিটবেল্ট বাধাই আছে। দু-চোখ বন্ধ করে ফেলল সে, গভীর করে শ্বাস নিতে লাগলো আবার।

বিমানটা খুব দ্রুতই নিচে নেমে যাচ্ছে। জঘন্য অনুভূতিটা তীব্র হতে লাগলো।

অধ্যায় ৬

বিগত দু ঘণ্টা ধরে দুটো ফাইল নিয়ে বসে আছে জেফরি বেগ। এমন নয় যে, খুব বিশাল আকারের ফাইল কিন্তু বার বার পড়তে হচ্ছে তাকে। দেখতে হচ্ছে, পুলিশ যে তদন্ত করেছিল তাতে কোনো ফাঁক ফোকর আছে কি না।

হোমিসাইডের মহাপরিচালকের অফিস থেকে বের হয়ে নিজের অফিসে এসেই সহকারি জামানকে ডেকে পাঠিয়েছিল গুলশান থানায় মুনেম চৌধুরীর কেসটার ফাইল নিয়ে আসার জন্য। দেড় ঘণ্টার মধ্যেই জামান সেগুলো জোগাড় করে হোমিসাইডে নিয়ে আসে, তারপর থেকে ফাইলেই ডুবে আছে সে।

মুনেম চৌধুরীর মতো একজন ভিআইপি’র কাছে চাঁদা চেয়েছিল বলে গুলশান থানার পুলিশ দ্রুতই মাঠে নেমেছিল। কিন্তু এক সপ্তাহে খুব বেশি এগোতে পারেনি। দু-দিন আগে নিজের বাড়ির সামনে গুলিবিদ্ধ হবার পর গতকাল রাতে ভদ্রলোক মারা যান। এই অল্প সময়ে পুলিশ বলতে গেলে তেমন কিছু করার সুযোগ পায়নি। ফলে হুমকি পাবার পরই মুনেম চৌধুরী যে গুলশান থানায় জেনারেল ডায়রি করেছিলেন, সেটার কপি, লাশের সুরতহাল রিপোর্ট এবং প্রত্যক্ষদর্শী দারোয়ানের জবানবন্দি ছাড়া আর কিছু নেই ফাইলে। পুলিশ ঘটনাস্থলের সিসিক্যামের ফুটেজ সংগ্রহ করেছে, সেগুলো তাকে মেইল করে দিয়েছে তারা।

ক্ষমতাসীন দলের এমপিপুত্র, বহুজাতিক কোম্পানির সিইও’র উপরে হত্যা প্রচেষ্টা ছিল বলে পুলিশ ব্যাপারটা গুরুত্বের সাথেই নিয়েছিল। ওসি ইনভেস্টিগেশন তার তদন্ত শুরু করে যে নাম্বার থেকে ব্ল্যাক রঞ্জুর পরিচয় দিয়ে ভিক্টিমের কাছে ফোন করা হয়েছিল সেটা ট্র্যাক করার মধ্য দিয়ে। পুলিশ টেলিকমিউনিকেশন্স ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠিত হবার ফলে বর্তমানে এ কাজটা খুব দ্রুততার সাথেই করতে পারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনি। রঞ্জুর ঐ ফোন নাম্বারটা ট্রেস করে দেখা গেছে, সিমটা যার নামে রেজিস্ট্রেশন করা সে পেশায় কাওরান বাজারের একজন তরিতরকারি বিক্রেতা! এই সিমটা কিভাবে তার নামে রেজিস্টার্ড হয়েছে সে ব্যাপারে বেচারা কিছুই জানাতে পারেনি। যদিও পুলিশ ঐ লোককে এখনও আটকে রেখেছে।

জেফরি বেগ জানে আসলে কি হয়েছে। সরকার এতো আয়োজন করে সিম রেজিস্ট্রেশন করালেও অসংখ্য সিম অন্যভাবে রেজিস্ট্রেশন হয়ে গেছে পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে। একজন মানুষের এনআইডি কার্ড আর আঙুলের ছাপ দিয়ে সর্বোচ্চ সাতটি সিম নিবন্ধন করা যায়-এই সুযোগটাই নেয় কিছু অসাধু সিম বিক্রেতা। ছোট্ট একটি কৌশলের আশ্রয় নেয় তারা। স্বল্পশিক্ষিত আর সহজ-সরল লোকজনের আঙুলের ছাপ নেবার সময় টেকনিক্যাল সমস্যা হচ্ছে, নেট কানেকশান পাচ্ছে না, এমন অজুহাত দেখিয়ে একাধিকবার ছাপ নিয়ে নেয়। কেউ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে না আসলে কী করা হচ্ছে। এভাবে অনেক সিম সংগ্রহ করে রাখা হয় পরবর্তিতে চড়া দামে অপরাধী চক্রের কাছে বিক্রি করার জন্য। আজকাল হরহামেশাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনিকে বিপাকে পড়তে হয় এ ধরণের সিম নিয়ে, আর মাঝখান থেকে হয়রানির শিকার হয় নিরীহ মানুষজন।

সিম ট্রেস করে যখন কিছু পাওয়া গেল না তখন কলটা কোত্থেকে করা হয়েছিল সেটা বের করে গুলশান থানার এসআই। দেখা যায়, কলটা আসলে মুনেম চৌধুরীর বাড়ির খুব কাছ থেকেই করা হয়েছিল!

সিসিক্যাম ফুটেজ হলো আরেকটি হতাশার নাম। মুনেম চৌধুরী যে ভবনে থাকতেন সেখানকারসহ আরো দুটো বাড়ির সিসিক্যিাম ফুটেজ সংগ্রহ করেছে পুলিশ। নিজের ডেস্কটপ কম্পিউটারে সেই ফুটেজও দেখেছে জেফরি। দীর্ঘ সময়ের ফুটেজ থেকে শুধুমাত্র ঘটনার সময়কার দৃশ্যগুলোই আছে তাতে। কিন্তু সবটাই ধোঁয়াশাময়।

আক্ষরিক অর্থেই!

মুনেম চৌধুরী তার সাদা রঙের লেক্সাস গাড়িটা নিয়ে নিজের অ্যাপার্টমেন্ট ভবন থেকে বের হবার ঠিক আগে দিয়ে মুখে মাস্ক পরা এক ছোকরা ফগার মেশিন দিয়ে বাড়ির সামনের রাস্তায় ধোঁয়া মারতে শুরু করে। এই ধোয়ার মধ্যেই মুনেম চৌধুরী তার গাড়ি নিয়ে মেইন গেট দিয়ে সকাল সাড়ে নটার দিকে বের হয়, কিন্তু গাড়িটা মেইন গেট থেকে পুরোপুরি বের হবার আগেই ধোঁয়ার কারণে থেমে যায়, আর তখনই মুখে মাস্ক পরা পিস্তল হাতে হ্যাংলা মতোন তিন যুবক দৌড়ে আসে বাঁ-দিক থেকে। বাকিটা ঘন ধোয়ার কারণে স্পষ্ট দেখা যায়নি, যেমন দেখা যায়নি গাড়ির ভেতরে থাকা মুনেম চৌধুরীকেও। গুলি করেই দৌড়ে চলে যায় তিনজন অস্ত্রধারী। তাদের চলে যাবার দৃশ্যটা অবশ্য পরিস্কার দেখা গেছে।

দ্বিতীয় ফুটেজটি বিপরীত দিককার একটি ভবনের মেইন গেটের বাইরে থাকা সিসিক্যামের। এখানেও গাড়ির ভেতরে থাকা মুনেম কিংবা অস্ত্রধারীদের কাউকে ঠিকমতো দেখা যায়নি ধোঁয়ার কারণে।

তৃতীয় ফুটেজটি বিপরীত দিককার আরেকটি ভবনের। ওটাতে দেখা গেছে চতুর্থ সন্ত্রাসিকে। অন্যদের মতো সে-ও মুখে মাস্ক পরে ছিল, তবে তার হাতে পিস্তল থাকলেও গোলাগুলি করেনি। মেইনগেট থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল সে। সম্ভবত ব্যাকআপে ছিল লোকটা। কিংবা হিট টিমের নেতাও হতে পারে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী থেকে দূরে থাকার কারণে তাকে দেখা গেছে অবশ্য। বড়জোর পাঁচ-সাত সেকেন্ডের একটি শুট-আউট, তারপরই সন্ত্রাসি দলটি দৌড়ে চলে যায় পশ্চিম দিকের রাস্তা দিয়ে।

পুলিশ আশেপাশের আরো কিছু বাড়ি এবং প্রতিষ্ঠানের সিসিক্যামের ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখেছে, সন্ত্রাসি চক্রটি গুলি করে বেশ কিছুটা পথ দৌড়ে চলে যায় ভেতরে দিকে, সেখানকার রাস্তার মোড়ে পার্ক করা একটি প্রাইভেট কারে উঠে বসে তারা। পুলিশ খতিয়ে দেখেছে, ঐ গাড়িটার নাম্বারপ্লেটও ভুয়া।

আক্ষেপে আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল জেফরি বেগ। ঢাকার বায়ুদূষণ এ শহরের বসিন্দাদেরকে কেবল স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যেই ফেলেনি, নিরাপত্তা ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিয়েছে, আর সন্ত্রাসিরা পেয়ে যাচ্ছে বাড়তি সুবিধা। এ শহরে বের হলেই প্রচুর লোকজনকে মাস্ক পরা অবস্থায় দেখা যায় আজকাল, বিশেষ করে শীতকালে, যখন শহরটা ধুলোয় নাকাল থাকে। রঞ্জুর দল এই সুযোগটাই নিয়েছে।

সরকারের উপর মহল থেকে চাপ দেয়ার ফলে ইনফর্মারদের সাহায্য নিয়ে রঞ্জুর দলের পুরনো দু-জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তারা যদিও স্বীকার করেছে, এখন আর সন্ত্রাসি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নয়, তবে রঞ্জু যে বেঁচে আছে সেটা জোর দিয়ে বলেছে।

কিন্তু জেফরি বেগ তাতে যথেষ্ট সন্দিহান। তার ধারনা, পুলিশ নির্যাতন চালিয়ে তাদের মুখ থেকে এ রকম স্বীকারোক্তি আদায় করেছে নিজেদের পিঠ বাঁচাতে। আর যদি ঐ দু-জন সত্যি বলেও থাকে, তবুও এই কেসে কোনো সাহায্যে আসেনি, কেন না রঞ্জুর অবস্থান সম্পর্কে তারা কিছুই জানাতে পারেনি পুলিশকে। ঐ দু-জন দরকারি কোনো তথ্য না দিয়ে বরং রঞ্জুর বেঁচে থাকাটাকেই নিশ্চিত করেছে আরো জোড়ালোভাবে।

তিক্তমুখে পুলিশের ফাইলটার পাতা ওল্টালো জেফরি বেগ। মুনেম চৌধুরীর ব্যক্তিগত ফোনটার ডিজিটাল ফরেনসিক এক্সপার্ট দিয়ে অ্যানালিসিস করেছে তারা, সেই অ্যানালিসিসের বিস্তারিত তথ্য দেয়া আছে এখানে। আরেকবার চোখ বুলালো তাতে।

কিচ্ছু নেই।

হতাশ হয়েই ফাইলটা রেখে রেখে চেয়ারে হেলান দিলো, গভীর করে নিশ্বাস নিয়ে দুচোখ বন্ধ করে ফেলল সে। এই কেসটা যে তাকে ভোগাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

বিগত দু ঘণ্টা ধরে ফাইল দুটো পড়ে তার মাথার মধ্যে অসংখ্য তথ্য ঘুরপাক খাচ্ছে কিন্তু তথ্যগুলো তাকে না দিতে পারছে নতুন কোনো সূত্র, না ধরত পারছে কোনো ফাঁক ফোকর। যেভাবে একটি আদর্শ তদন্ত শুরু করতে হয়, এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় পুলিশ সেভাবেই কাজ করেছে। তারা তো সিনেমা কিংবা গল্প-উপন্যাসের গোয়েন্দা চরিত্র নয় যে চট করে সব কিছু উদ্ঘাটন করে ফেলবে।

যে কোনো কেসের ব্যাপারে ঘটনাস্থলে না গিয়ে তদন্ত করাটা ইনভেস্টিগেশনের ক্ষেত্রে সব চেয়ে বড় ভুল। জেফরিও যাবে সেখানে আগামিকাল। শেষ বারের মতো ফাইলটা পড়ার সিদ্ধান্ত নিলো সে। অমনি তার ফোনটা বেজে উঠল।

“হ্যালো?” কলটা রিসিভ করে বলল সে।

“কি করো?” ওপাশ থেকে জানতে চাইলো রেবা। “অফিসে নিশ্চয়ই?”

“হুম…একটা ফাইল নিয়ে বসেছি।”

“কাল সারা রাত ঘুমাতে পারিনি,” ক্লান্ত কণ্ঠে বলল রেবা। “আব্দুর শরীর হঠাৎ করে আবার খারাপ হয়ে গেছিল, খুব ভয় পাচ্ছিলাম।”

আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল জেফরি। “এখন কী অবস্থা?”

“ভালো না। আব্দুর অবস্থা আসলেই খারাপ।”

জেফরি বেগ জানে, ক্যান্সারের রোগির মতোই তার কাছের লোকজন বেশ ভোগে। সামর্থ্য আছে বলে বিদেশে নিয়ে গিয়ে প্রচুর টাকা খরচ করে চিকিৎসা করতে পারছে তারা। রেবার বাবার ব্যাপারে মিথ্যে সান্ত্বনা দিয়ে লাভ নেই, তারাও জেনে গেছে, যতো উন্নত চিকিৎসাই দেয়া হোক না কেন, ভদ্রলোককে বাঁচানো যাবে না। এটা তাদের মনের সান্ত্বনা যে, সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করেছে।

“তুমি রেস্ট নাও, শরীর খারাপ করবে,” বলল সে। “খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো কোরো।”

“হুম…” কথাটা বলেই চুপ মেরে গেলে রেবা।

“তোমাকে একটু শক্তও হতে হবে…” কিসের জন্য শক্ত হতে হবে সেটা আর বলল না। “ভেঙে পড়ো না…প্লিজ। আই নো ইউ আর আ বিগ গার্ল।”

“হুম,” সায় দিলো ফোনের ওপাশ থেকে। “অনলাইনে ঢাকার নিউজ পোর্টালগুলো পড়ি…ব্ল্যাক রঞ্জু নাকি বেঁচে আছে? ফিরে এসেছে আবার?”

কপালের বাঁ-পাশটা চুলকালো জেফরি। “ওর লোকজন নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করছে আসলে।”

“ও।” একটু থেমে আবার বলল, “ঠিক আছে, পরে কথা হবে…কাজ করো।”

“টেক কেয়ার অ্যান্ড লাভ ইউ।”

“লাভ ইউ টু।”

ফোনটা রেখে কয়েক মুহূর্ত উদাস হয়ে বসে রইলো সে। তার পরই ফাইলটা আবার হাতে তুলে নিলো। কিছুটা পড়ার পরই ফাইলের শেষ পৃষ্ঠায় চোখ যেতেই একটা খটকা লাগলো। মুনেম চৌধুরীর মোবাইলফোনের ডিজিটাল ফরেনসিক অ্যানালিসিসটা আছে, দ্রুত আরেকবার পড়ল সেটা, তার পর আবার ফাইলে যে জিডির কপিটা অ্যাটাচড করা আছে সেটাতে চোখ বোলাল।

নড়েচড়ে উঠল জেফরি বেগ।

অধ্যায় ৭

হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যাবার সময় টের পেলো বয়স আর শরীরের ওজন দুটোই বেড়ে গেছে, হাঁপিয়ে উঠেছে সে। এটা অংশত দম ফুরিয়ে যাওয়া এবং নিজের ভেতরে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার কারণেও হতে পারে।

কলাতলি থেকে তার হোটেলের দূরত্ব খালি চোখে দেখলে মনে হয় কতোই না কাছে, কিন্তু দৌড়াতে গিয়ে হাঁড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে এটা গ্রামাঞ্চলের সেই তালগাছের মতোই!

একটু আগে হোটেল থেকে বের হবার সময় ফোনটা ভুল করে রুমে রেখে চলে গেছিল, নইলে এভাবে হোটেলের রুমে আসার কোনো দরকারই হতো না। নাম্বারটাও যদি মুখস্ত থাকতো তাহলে ফোন-ফ্যাক্সের দোকান থেকেই কলটা করতে পারতো। দুঃখের বিষয়, খুব কম নাম্বারই তার মনে থাকে। আর এখন যাকে ফোন করবে তার নাম্বার মনে রাখার কথাও নয়। এই লোককে গত ছয় মাসে একটিবারের জন্যেও কল করার দরকার পড়েনি।

রুমে ঢুকে একটু জিরিয়ে নিলো নিশ্বাস স্বাভাবিক করার জন্য। এরপর কল করলো সে। একবার, দু-বার রিং হলো কিন্তু কলটা ধরা হলো না। কয়েক বার চেষ্ট করলেও একই ফল পেলো। কী করবে বুঝতে না পেরে চুপচাপ বসে রইলো কিছুক্ষণ। সম্ভবত যাকে ফোন করেছে তার কাছে তার এই নাম্বারটা নেই। অচেনা নাম্বার বলে কলটা রিসিভ করা হয়নি। একটা এসএমএস পাঠিয়ে দিলো। সে নিশ্চিত, এই এসএমএসটা পড়ামাত্রই কোনো রকম সময় নষ্ট না করে কলব্যাক করবে।

ঠিক দুই মিনিট পর তার ফোনটা বেজে উঠল। চকচক করে উঠল চোখদুটো। তার ধারনা একটুও ভুল নয়।

“ভাই, স্লামালেকুম…কেমন আছেন?” ফোনের ওপাশে যে আছে তার মধ্যে অধৈর্যের ভাব প্রকট। সালামের জবাব দিয়ে সময় নষ্ট করলো না। সরাসরি প্রশ্নটা করে বসলো তাকে। “হ ভাই, নিজের চোখে দেখছি…একটু আগে!” ফোনের ওপাশের লোকটি যে নড়েচড়ে উঠেছে সেই দৃশ্যটা কল্পনা করতে পারলো। “আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর, কোনো ভুল নাই।” একটু থেমে দম নিয়ে ওপাশের কথা শুনে গেল। “…কোন্ হোটেলে উঠছে সেইটা আমি জানি…তারে ফলো করছি, ভাই। আপনে চাইলে রুম নাম্বারটাও বাইর কইরা ফালাইতে পারুম, এইটা আমার জন্য কুনো ব্যাপারই না। ওই হোটেলে আমার এক লোক আছে।” আবারো ওপাশ থেকে শুনে গেল। “আমি তো একলাই দেখলাম, লগে কেউ নাই।” মাথা নেড়ে সায় দিলো সে যদিও ফোনের ওপাশে যে আছে তার পক্ষে এটা দেখা সম্ভব নয়। এবার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার, দাঁত বের করে হাসলো। “আপনে নিজে আইতাছেন?…আহেন আহেন…দেরি করন ঠিক হইবো না।” আবারো শুনে গেল ওপাশের কথা। “কয়দিন আগে আইছে জানি না। আমি তো আইজকাই দেখলাম।” আবার প্রশ্ন। “মনে হয় না বেশিদিন থাকবো…” মাথা দুলিয়ে জবাব দিলো সে। “এইটা কক্সবাজার…মানুষ এইখানে আহে, কয়দিন ঘুইরা-টুইরা চইলা যায়।” আরো কিছুক্ষণ ওপাশ থেকে নির্দেশনা শুনে গেল এবার। “জি, ভাই…স্লামালেকুম।”

কলটা কেটে দিলো সে। তার মুখ পুরস্কার পাওয়ার আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

অধ্যায় ৮

জ্যামের কারণে ঢাকা শহরের ভেতরে এখন আর প্রাইভেট কার নিয়ে চলাফেরা করে না জেফরি বেগ। সহকারি জামানের যে বাইক আছে, সেটাই হয়ে উঠেছে তার নিত্যদিনের বাহন।

বেইলি রোড থেকে গুলশানের দূরত্ব খুব বেশি নয়, কিন্তু গাড়ি নিয়ে বের হলে কমপক্ষে দেড়ঘণ্টা লেগে যাবে। এ দেশ যে পৃথিবীকে মোটরবাইকের রাইড শেয়ারিং ধারনাটা দিয়েছে, তাতে অবাক হবার কিছু নেই।

“আপনারও একটা বাইক কেনা উচিত, স্যার,” পেছনে বসে থাকা জেফরি বেগের উদ্দেশে বলল জামান। “গাড়িটা তো একদমই ইউজ করেন না আজকাল।”

সহকারির কাঁধে আলতো করে চাপড় মারল। “হুম, সেটাই করতে হবে মনে হচ্ছে,” হেলমেট পরে থাকার কারণে একটু জোরে বলল কথাটা।

সামান্যতম সময়ক্ষেপন না করেই হোমিসাইডের সাবের কামালকে এরইমধ্যে পাঠিয়ে দিয়েছে রঞ্জুর দলের যে দু-জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে তাদেরকে হোমিসাইডে নিয়ে আসার জন্য। আর রমিজ লস্করকে ব্ল্যাক রঞ্জুর দলটা সম্পর্কে ঢাকার থানাগুলোতে যে সব তথ্য আর রিপোর্ট আছে, সেগুলো জোগাড় করার কাজে লাগিয়ে দিয়েছে।

রঞ্জর কারণে এই কেসটা নিয়ে জেফরির মধ্যে প্রচণ্ড আগ্রহ তৈরি হলেও হোমমিনিস্টারের ডেটলাইনের কারণে এক ধরণের অস্বস্তি কাজ করছে। মহাপরিচালক ফারুক আহমেদ যতোই বলুক, ডেটলাইন নিয়ে মাথা না ঘামাতে, বাস্তবতা হলো, এটা শেষ পর্যন্ত চাপ তৈরি করবেই। কিছু দিন তদন্ত করার পর যখন আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে না তখনই শুরু হবে চাপ দেয়া। এ ধরণের চাপ নিয়ে কোনো তদন্তকারি অফিসারই ঠিকমতো মনোসংযোগ করতে পারবে না।

গুলশান অ্যাভিনিউর ২৪ নাম্বার রোডে অবস্থিত মাহবুব টেরাসের সামনে এসে থামলো জামানের বাইকটা। মুনেম চৌধুরীর বাবা একজন এমপি, ভদ্রলোকের নামেই অ্যাপার্টমেন্ট ভবনটির নাম রাখা হয়েছে। আট তলার এই ভবনটির তিনতলায় থাকে মুনেমের পরিবার।

ভবনের দারোয়ানকে পাওয়া গেল গেটের সামনেই। ফকিরচাঁন নামের এই লোকটার জবানবন্দি পুলিশ এরইমধ্যে নিয়েছে। তাকে আবারো জিজ্ঞেস করার সুযোগটা হাতছাড়া করলো না জেফরি।

মাঝবয়সি দারোয়ানকে নিজের পরিচয় দিয়ে ঐদিনের ঘটনাটা জানতে চাইল সে। পুলিশকে যা বলেছিল তা-ই বলল নোকটা। মেইনগেট খুলে দেবার পর গাড়িটা বের হতেই গুলির শব্দ শোনে সে।

“ধুয়ার লইগা আমি ওগোর কাউরেই দেখি নাই,” বলল দারোয়ান।

“যে লোক ফগার মেশিনটা নিয়ে এসেছিল তাকে দেখেছো?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ফকিরচাঁন। “একটা চ্যাংড়া পোলা…বয়স বেশি হইবো না। ওরে দেইহা-ই আমার সন্দেহ হইছিল, স্যার।”

“কেন?”

“সকাল সকাল তো কহনও ধুয়া মারে না, স্যার।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি বেগ।

“আর মেশিনটা খুব ছোটো আছিল, পোলাটাও নতুন, আগে দেখি নাই।”

জেফরি বেগ বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। ভিডিও ফুটেজেও সে দেখেছে, সিটি কর্পোরেশন যে ধরণের ফগার মেশিন ব্যবহার করে, সন্ত্রাসি দল সেরকম মেশিন ব্যবহার করেনি। সত্যি বলতে, অপেক্ষাকৃত ছোটো আকারের এ রকম ফগার মেশিন বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। বড় বড় প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে হোটেলগুলো এসব মেশিন ব্যবহার করে। ভালো করে লক্ষ্য না করলে কেউ ধরতে পারবে না, মেশিনটা সিটি কর্পোরেশন যেমনটা ব্যবহার করে তেমন নয়।

“গুলি হবার সময় তুমি কোথায় ছিলে?”

“আমি তো স্যার এইহানে…” গেটের ডানদিকটা দেখিয়ে বলল, “…খাড়ায়া আছিলাম। গুলি শুরু হওনের পর মাটিতে শুইয়া পড়ি।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। ঠিক কাজই করেছে দারোয়ান, নইলে সে-ও বেঘোরে মারা পড়তো।

“গুলি থামতেই শুনি মুনেমসাব চিকুইর দিতাছে।”

“আচ্ছা, একটু থেমে আবার জানতে চাইলো, “ওরা কোন দিক দিয়ে গেছে…দেখেছো?”

আঙুল তুলে মেইনগেটের বাঁদিকটা দেখিয়ে বলল, “আমি দেখি নাই, তয় লোকজন কইছে, ওইদিক দিয়া ভাগছে। তিন-চাইরজন আছিল…সবগুলার মুখে পট্টি বান্ধা, স্যার।”

এই তথ্যটা এরইমধ্যে জেনে গেছে জেফরি। সন্ত্রাসিলের সবাই মাস্ক পরে ছিল, তাদের বয়সও ছিল কম। ঢাকায় যে কিশোর গ্যাং কালচার তৈরি হয়েছে ইদানিং, রঞ্জুর দল কি সে রকম কোনো গ্যাংকে দিয়ে কাজটা করিয়েছে?

মুনেম চৌধুরী গাড়িটা পুলিশ পরীক্ষা করেছে, ওটা এখন এই ভবনেই আছে। জামানকে নিয়ে মাহবুব টেরেসের ভেতরে ঢুকে পড়লো সে। নিচের পার্কিংলটে থাকা গাড়িটা দেখিয়ে দিলো দারোয়ান, জলপাই রঙের কাভার দিয়ে ঢাকা। জামান কাভারটা সরিয়ে দিতেই দেখা গেল সাদা রঙের লেক্সাস আরএক্স ৩৫০ মডেলের গাড়িটা। মুনেম চৌধুরী নিজেই ড্রাইভ করতেন। ড্রাইভিং ডোর আর কাঁচে তিন-চারটা গুলির ফুটো দেখতে পেলো। কাঁচটা ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। সুতরাং বোঝার উপায় নেই, কাঁচের ভেতর দিয়ে ঠিক কয়টা গুলি করা হয়েছে।

পকেট থেকে স্মার্ট ফোনটা বের করে ছবি তুলে নিলো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর, তারপর অভ্যাসবশত সাউন্ড রেকর্ডিং অপশনটা চালু করে দিয়ে বলতে শুরু করলো :

“দুটো গুলি লেগেছে ড্রাইভিং ডোরের নিচে…দুটো লেগেছে ভিক্টিমের গায়ে।” জামানের দিকে ফিরল সে। “ভিসেরা রিপোর্টমতে, একটা গুলি লেগেছে মুনেম চৌধুরীর মাথার বাঁ-পাশে, আরেকটা তলপেটে।” রেকর্ডিংয়ে পজ দিলো জেফরি।

“ওরা কেন ফগার মেশিন ব্যবহার করলো? কী দরকার ছিল?” অডিও ফাইলটা সেভ করে পকেটে রেখে দিলো বলল জেফরি বেগ।

“ওরা চায়নি ওদের মুখ কেউ দেখুক, স্যার?” বলল জামান।

“ওদের সবার মুখে মাস্ক ছিল।”

নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো সহকারি। “তাহলে গাড়িটা থামানোর জন্য…? এই বিল্ডিং থেকে গাড়িটা বের হবার সময় যাতে কিছুক্ষণ থেমে যায় আর এই ফাঁকে ওরা গুলি করতে পারে…?”

মাথা দোলালো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর। “এরকম ভবন থেকে বের হবার সময় ধীরগতিতেই বের হয় গাড়ি।”

জামান কিছু বলল না। সে সম্ভবত নতুন কোনো সম্ভাবনা ভেবে যাচ্ছে।

“মনে রাখবে, পুরো শুট আউটটা মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই করেছে। ঐটুকু সময় তারা এমনিতেই পেতো।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জামান। ধীর গতিতে গেট দিয়ে গাড়িটা বের হবার সময় এ কাজ করা তেমন কঠিন কিছুই না।

“ভিক্টিম গাড়িতে বসা…একেবারে সিটিং ডাক পজিশনে ছিলেন,” বলল জেফরি। “তারপরও ওরা ফগার মেশিন ব্যবহার করেছে।”

জামান আর নিজের অভিমত দিলো না। সিনিয়র কি ভাবছে সেটাই শুনতে চাচ্ছে।

“আমরা হিট টিমের বডিল্যাঙ্গুয়েজ আর শুটিংয়ের ধরণটা দেখতে পাইনি। ওরা শুটিংটার ধরণ আড়াল করতে চেয়েছে।”

জামান অবশ্য মনে করছে সন্ত্রাসিচক্রের বেপরোয়া আচরণই এই হত্যাকাণ্ডের কারণ। ভয় দেখাতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছ। “স্যার, এই শুট আউটে অংশ নিয়েছে অল্পবয়সি ছেলেপেলে, এদের প্রায় সবাই কোনো না কোনো ড্রাগে অ্যাডিক্টেট, আমি শিওর।”

জামানের দিকে তাকালো জেফরি বেগ। “তুমি বলতে চাইছো, বেপরোয়া গোলাগুলি করতে গিয়ে এটা হয়েছে?”

“হতে পারে না? এমনটা তো অনেক কেসেই দেখি আমরা।”

আবারো দ্বিমত পোষণ করলো জেফরি বেগ। “মাথায় গুলিবিদ্ধ হওয়া, ফগার মেশিন ব্যবহার করা অন্য কিছু ইঙ্গিত করে।”

অনিচ্ছায় মাথা নেড়ে সায় দিলো সহকারি।

“আমি শিওর, ওরা ওদের শুটিং প্যাটার্নটা আড়াল করতে চেয়েছে।”

সন্ত্রাসিচক্র নিজেদের পুরোপুরি আড়াল করতে চাইলে ধোঁয়া কেবল মুনেমের বাড়ির সামনেই মারতো না-যে গাড়িতে করে এসেছে এবং পালিয়ে গেছে, পুরোটা রাস্তাই ধোঁয়াচ্ছন্ন করে রাখতো। সেটা তারা করেনি। ফগার মেশিন নিয়ে এসেছিল যে ছেলেটা, সে তো দারোয়ানের সঙ্গে কথাও বলেছে। মুখে একটা মাস্ক পরা ছিল। কিন্তু এ কথা বাকিদের বেলায়ও খাটে। সবার মুখে মাস্ক ছিল। তাহলে ধোঁয়ার দরকার পড়লো কেন?

“স্যার, আরেকটা ব্যাপার কি হতে পারে না?”

জামানের কথায় তার দিকে ফিরে তাকালো জেফরি।

“অস্ত্রধারীদের কেউ হয়তো মুনেম সাহেবের পরিচিত, তাই…”

“ওরা যদি মুনেম চৌধুরীকে হত্যা করতেই এসে থাকে তাহলে নিজেদের পরিচয় উনার কাছ থেকে আড়াল করতে চাইবে কেন? মৃত মানুষ সাক্ষি দিতে পারে না, জামান।”

সহকারি ইনভেস্টিগেটর মনে মনে জিভ কাটলো নিজের বোকামির জন্য।

“আমি নিশ্চিত, হিট টিমের উদ্দেশ্য মুনেম সাহেবকে ভয় দেখানো ছিল না।” একটু থেমে আবার বলল,

“চলো, উনার ফ্ল্যাটে যাবো,” সহকারিকে বলে লিফটের দিকে পা বাড়ালো সে।

তিন তলার দুটো ফ্ল্যাটই মুনেম চৌধুরীর। একটাতে থাকেন বয়োবৃদ্ধ বাবা-মা আর এক ডিভোসি বোন। অন্যটাতে মুনেম চৌধুরী আর তার স্ত্রী। এই দম্পতির কোনো সন্তান নেই।

জামান রওনা দেয়ার আগেই মুনেম চৌধুরী স্ত্রীকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল তারা আসছে। ফ্ল্যাটের দরজার কাছে এসে কলিংবেল বাজাতেই এক গৃহকর্মি মেয়ে তাদের পরিচয় জানতে পেয়ে দরজা খুলে দিলো।

জেফরি আর জামান ঢুকে পড়লো ফ্ল্যাটের ভেতরে।

ড্রইংরুমটা একটু বেশিই বড়। অবাক হলো না জেফরি। রাজনীতিকদের ড্রইংরুমগুলো এমন বড়ই হয়। এতোদিনে তার অভিজ্ঞতা তাই বলে। পুরো বাড়ির অর্ধেকের মতো জায়গা নিয়ে এরা ড্রইংরুম বানায়।

রুমটার দক্ষিণ দিকে বিশাল বড় একটি জানালা, সেই জানালার পাশে দুজোড়া সোফা সেট পাতা আছে। শাড়ি পরা ভারি শরীরের এক মহিলা থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছে সেখানে। ঘরের এক পাশের দেয়াল জুড়ে বইয়ের শেষ্ণ, অন্য পাশটা অ্যান্টিক দিয়ে সাজানো। বাকি দেয়ালটায় টাঙানো রয়েছে ফ্রেমে বাঁধাই করা মাহবুব চৌধুরীর বেশ কিছু পুরনো ছবি আর সম্মাননা।

“ইনি আমাদের হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ, জামান বলল মিসেস চৌধুরীকে।

মাথা নেড়ে সম্ভাষণ জানালেন ভদ্রমহিলা। “বসুন,” আস্তে করে বললেন তিনি। জেফরি নামটা শুনে অবাক হলেও দ্রুত অভিব্যক্তি লুকিয়ে ফেললেন।

মহিলার বিপরীতে একটা ডাবল সোফায় বসে পড়লো জেফরি আর জামান।

“আপনার হাজবেন্ডের কেসটা এখন আমরাই দেখছি, সেজন্যে একটু কথা বলা দরকার।”

“ঢাকা শহরে একটা সন্ত্রাসি এভাবে মানুষ মেরে যাচ্ছে, কেউ কিছু করতে পারছে না,” আক্ষেপের সাথে বললেন মিসেস মুনেম। তার কণ্ঠ বেশ দুর্বল।

কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকলো জেফরি, তারপর বলল, “রঞ্জু গ্রুপ যখন প্রথম ফোন করে উনার কাছ থেকে চাঁদা চাইলো, তখন কি উনি আপনাকে সেটা জানিয়েছিলেন?”

“না।” ছোট্ট করে জবাব দিলেন মিসেস মুনেম। “আমি এসব একদমই জানতাম না। আমার আবার নার্ভাস ব্রেকডাউন আছে, তাই আমাকে জানায়নি ও।”

“রঞ্জু গ্রুপ ছাড়া, অন্য কারোর সাথে উনার শক্রতা ছিল কি? এ রকম কোনো কিছু জানেন?”

প্রশ্নটা শুনে ভদ্রমহিলা চেয়ে রইলেন কপাল কুঁচকে।

“আমাদের সবারই ব্যক্তিগত শত্রু আছে, আমি সে কথাই জানতে চাচ্ছি।”

মাথা দোলালেন মিসেস মুনেম। “নাহ্, এ রকম কেউ আছে বলে আমি জানি না।” এরপর গভীর করে নিশ্বাস নিয়ে আবার বললেন, “রাজনীতিতে একদমই আগ্রহ ছিল না ওর। আমার শ্বশুড় অসুস্থ হবার পর ওকে ওর বাবার আসন থেকে এমপি নির্বাচন করতে বলেছিলেন পিএম, কিন্তু ও রাজি হয়নি। সব সময় নিজের জব ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত ছিল।”

“কিন্তু উনি যে রাজনীতিতে আগ্রহি নন, সেটা কি সবাই জানতো?”

জেফরির এ কথায় মহিলার ভুরু আবার কুঁচকে গেল। “সবাই মানে?”

“রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ…উনার বাবার নির্বাচনী এলাকায় যারা নির্বাচন করতে চায় তারা?”

মাথা দোলালেন ভদ্রমহিলা। “কী জানি…বলতে পারবো না।”

“অনেক রকম শত্রু থাকতে পারে…উনি কি কখনও এ রকম কারোর কথা আপনাকে বলেছেন?”

একটু ভেবে নিলো ভদ্রমহিলা। “এ রকম কিছু বলেনি আমাকে।”

“ঘটনাটা যেদিন ঘটে আপনি কোথায় ছিলেন?”

মহিলা স্থিরচোখে চেয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। দীর্ঘশ্বাসের সাথে বললেন, “আমি আমার বোনের বাসায় ছিলাম। ও-ই আমাকে ওখানে পাঠিয়ে দেয় হুমকি পাবার পর পর।”

“একটু আগে বললেন হুমকির কথাটা আপনার স্বামী আপনাকে জানাননি?”

মহিলা গভীর করে শ্বাস নিলেন। সম্ভবত নিজের রাগ দমন করলেন তিনি। “ঘটনার পর এটা জেনেছি আমি। তখনই বুঝেছি, হুমকি পাবার পর আমাকে আমার বোনের বাসায় কেন পাঠিয়েছিল।”

“আপনি তখন জানতে চাননি কেন আপনার বোনের ওখানে যেতে বলছেন?”

“ও বলেছে, কয়েক দিনের জন্য ঢাকার বাইরে যাবে, আমি যেন আমার বোনের বাসা থেকে ঘুরে আসি।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। “আপনার বোনের বাসা কোথায়?”

“ধানমণ্ডিতে।”

একটু ভেবে পরের প্রশ্নে গেল জেফরি বেগ। “আপনার হাজব্যান্ড কয়টা ফোন ইউজ করতেন?”

“একটাই ইউজ করতো। পুলিশ সেটা নিয়ে গেছে তদন্ত করার জন্য।”

“আপনি একদম নিশ্চিত, একটা ফোনই ইউজ করতেন উনি?”

জেফরির দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালেন মহিলা। “হ্যাঁ, আমি শিওর হয়েই বলছি। আমি কখনও ওকে দুটো ফোন ইউজ করতে দেখিনি।”

“দুটো সিম ব্যবহার করতেন তাহলে?”

মহিলা মাথা দোলালেন। “ও আইফোন ইউজ করতো…আইফোনে ডাবল সিম ইউজ করার অপশন নেই।”

জেফরি বেগও সেটা জানে। পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করে নোটপ্যাড অ্যাপসটা ওপেন করলো সে। “এই যে, এই নাম্বারটা, এটা কি আপনার হাজব্যান্ডের নাম্বার?” ফোনটার ডিসপ্লে মহিলার দিকে মেলে ধরলো।

মাথা দুলিয়ে অপারগতা প্রকাশ করলেন মিসেস মুনেম। “নাহ, এটা ওর নাম্বার না।”

কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে জেফরি বলল, “আপনি কি একটু খুঁজে দেখবেন এখানে আর কোনো ফোন আছে কি না?”

অবাক হলেন মহিলা।

“এই নাম্বারে ফোন করে বন্ধ পেয়েছি, পরে জিপিএস ট্র্যাকিং করে দেখেছি, এই অ্যাপার্টমেন্টেই আছে ফোনটা।”

“এখানে আছে!” যার পর নাই বিস্মিত হলেন মিসেস মুনেম। “এখানে কোথায় থাকবে?”

“সেটা তো জানি না। আমারা কেবল জানতে পেরেছি, সিমটা যে ফোনে আছে সেটা এই ফ্ল্যাটেই রয়েছে এখন।”

মহিলা অবিশ্বাসে চেয়ে রইলেন।

“আপনি একটু উনার পারসোনাল ড্রয়ার কিংবা ক্লোজিট চেক করে দেখুন।

গভীর করে শ্বাস নিয়ে মহিলা উঠে দাঁড়ালেন, চলে গেলেন ভেতরের ঘরে।

জেফরি আর জামান অপেক্ষা করতে লাগলো চুপচাপ। এই ফাঁকে তাদেরকে দু-কাপ কফি দিয়ে গেল গৃহকর্মি। কফিতে চুমুক দিতে দিতে মাহবুব চৌধুরীর বিভিন্ন ছবিগুলো দেখে গেল। বেশিরভাগই রাজনীতি আর বিদেশ ট্যুরের ছবি।

প্রায় দশ মিনিট পর মিসেস মুনেম ফিরে এলেন একটা ফোন হাতে নিয়ে।

“এটা ওর স্টাডি রুমের ডেস্কের ড্রয়ারে পেয়েছি,” জেফরির দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে চোখমুখ শক্ত করে বললেন।

ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো জেফরি। একটা অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন, বন্ধ করে রাখা। “আমি এটা চালু করছি।”

মাথা নেড়ে সায় দিলেন মিসেস মুনেম। “ও আইফোন ছাড়া অন্য কোনো ফোন ইউজ করতো জানতাম না,” একটা চাপা দীর্ঘশ্বাসের সাথে বললেন। “আর এই ফোনটা কেন রেখেছে তা-ও বুঝতে পারছি না। কখনও দেখিনি এটা।”

মহিলার দিকে চোখ তুলে তাকালেও কিছু বলল না জেফরি, ফোনটা চালু হয়ে গেলে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে। ভুরু কুঁচকে গেল তার। কি-প্যাডে একটা নাম্বার পাঞ্চ করলো। “কল দিচ্ছি,” জামানকে বলল।

সহকারি বুঝতে পেরে মাথা নেড়ে সায় দিলো, কলটা আর ধরলো না।

মিসেস মুনেম একটু কপাল কুঁচকে চেয়ে আছেন। এ সময় জামানের ফোনটার রিং বেজে উঠল। পকেট থেকে ফোনটা বের করে জেফরিকে দেখালো সে।

এটাই সেই নাম্বার।

কলটা কেটে ফোনের কন্ট্যাক্ট লিস্ট স্ক্রল করে দেখলো জেফরি। ব্ল্যাক রঞ্জুর লোক যে নাম্বার থেকে কল করেছিল সেটা ডিলিট করে দেননি মুনেম চৌধুরী। কিন্তু অবাক হয়েই দেখতে পেলো, আর কোনো নাম্বার থেকে কল আসেওনি, করাও হয়নি। এবার মেসেজ বক্সটা ওপেন করতেই ভুরু কুঁচকে গেল তার, পাশে বসা জামানের দিকে তাকালো। গভীর করে শ্বাস নিয়ে ফিরলো মিসেস মুনেমের দিকে।

“এই ফোনটা তদন্তের প্রয়োজনে আমি নিয়ে যাচ্ছি। জামান পরে আপনাকে একটা পেপার দিলে তাতে সাইন করে দেবেন, প্লিজ।”

মিসেস মুনেম স্থিরচোখে চেয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। “ওর ফোনে কী পেয়েছেন?” শান্ত গলায় বললেন। কিন্তু তাতে যে সন্দেহ আর বিষণ্ণতা মিশে আছে, টের পেলো ঘরের দু-জন মানুষ।

“অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য…এখন তদন্তের স্বার্থে কিছু বলতে পারছি না, পরে সব জানতে পারবেন।”

মহিলা আবারো ভুরু কুঁচকে ফেললেন।

উঠে দাঁড়ালো জেফরি, তার দেখাদেখি জামানও। “ঠিক আছে, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। পরে যদি দরকার পড়ে আবার কথা বলবো।”

“আপনারা এই নাম্বারটা কোত্থেকে জানতে পারলেন?”

জেফরি একটু ভেবে নিলো সত্যিটা বলবে কি না। “মুনেম সাহেব থানায় যে জিডিটা করেছিলেন তাতে এই নাম্বারটা দিয়েছিলেন। এই নাম্বারেই উনাকে ফোন করে চাঁদা চেয়েছিল রঞ্জু গ্রুপ।”

মিসেস মুনেম অবাক হলেন, আর সেটা মোটেও লুকালেন না। তবে কিছু একটা বলতে গিয়েও বললেন না তিনি।

মুনেম চৌধুরীর অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে গেল জেফরি বেগ আর জামান। এই ফ্ল্যাটেই থাকেন মুনেমের বাবা মাহবুব চৌধুরী। কয়েক মাস আগে একটা স্ট্রোকের পর তিনি শয্যাশায়ী হয়ে আছেন। মুনেম গুলিবিদ্ধ হবার আগে থেকেই ভদ্রলোক হাসপাতালে।

“আপনি কি অন্য কিছু সন্দেহ করছেন, স্যার?” যে প্রশ্নটা তখন করেনি, এখন সেটা করলো জামান লিফটের জন্য অপেক্ষা করার সময়।

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। “হুম। মুনেম চৌধুরী আদৌ ব্ল্যাকরঞ্জুর দলের হাতে খুন হয়েছেন কি না সন্দেহ আছে।”

লিফটের দরজা খুলে গেলে তারা দুজনে উঠে পড়লো তাতে।

“আপনার কেন এটা মনে হচ্ছে?”

“কারণ ব্ল্যাকরঞ্জুর দল মুনেম চৌধুরীকে মাত্র একবারই ফোন করেছিল চাঁদা চেয়ে। এটা অস্বাভাবিক।”

জামানও এবার বুঝতে পারলো। সন্ত্রাসিরা সাধারণত বেশ কয়েক বার ফোন করে, তাগাদা দেয়। তাহলে তাদের উদ্দেশ্য চাঁদাবাজি ছিল না?”

“এ মুহূর্তে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না,” বলল জেফরি। “তবে এটা অস্বাভাবিক।”

জামান চুপ মেরে রইলো কয়েক মুহূর্ত।

“মাত্র একবার ফোন করার একটাই কারণ,” লিফট থেকে নেমে পার্কিং এরিয়ায় জামানের বাইকের দিকে যেতে যেতে বলল জেফরি বেগ। মুনেম চৌধুরী যেন অতিরিক্ত সতর্ক হয়ে না যান। বার বার ফোন করে হুমকি দিলে তিনি হয়তো বেশ সতর্ক হয়ে যেতেন, পুলিশ নিয়ে চলাফেরা করতেন। তাতে করে তার উপরে আঘাত হানার কাজটি কঠিন হয়ে যেতো।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জামান। “তারপরও মুনেম চৌধুরী জিডি করেছিলেন।”

“হুম। সম্ভবত উনি এটা নিয়ে কারো সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তাকে হয়তো পরামর্শ দেয়া হয়েছিল, ব্যাপারটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনিকে জানানো উচিত।”

“বিনোদন টিভির মালিককেও মাত্র একবার ফোন করে হুমকি দেয়া হয়েছিল, স্যার,” জামান বলল। “উনি অবশ্য থানায় জিডি করেননি।”

“যারাই এ কাজ করছে, তাদের উদ্দেশ্য অন্য কিছু।” জেফরি বেগ যেন প্রায় নিশ্চিত হয়েই বলল কথাটা।

অধ্যায় ৯

অমূল্য বাবু একটু রুষ্ট হলো। বার বার বলে দেবার পরও ম্যানেজার ভদ্রলোক কোনোভাবেই ভুলে থাকতে পারছে না তার সামনে যে লোকটি দাঁড়িয়ে আছে সে এই হোটেলের মালিকদের একজন।

অন্যসব গেস্টের মতোই বাবু ডেস্কে এসে নিজের নাম-পরিচয় বলে একটি রুম ভাড়া করতে গেছিল কিন্তু বাগড়া দিয়ে বসে ম্যানেজার। সে কোনো নাম লেখালেখি, রেজিস্টারে সই করার ধার ধারেনি, বাবুর লাগেজ নিজের হাতে নিয়ে তাকেসহ সোজা লিফটের কাছে চলে যায়। স্বাভাবিকভাবেই হোটেলের কর্মচারিরা এ দৃশ্য দেখে প্রথমে বিস্মিত হয়েছে, পরে সম্ভ্রমের সাথে তাকিয়েছে বাবুর দিকে।

লিফটের দরজাটা বন্ধ হতেই বাবু নিজের ক্ষোভ প্রকাশ না করে পারলো না। “আমি কিন্তু আপনাকে বলেছিলাম একজন সাধারণ গেস্টের সাথে যেমন আচরণ করেন আমার সাথেও তেমনটা করবেন।”

“জি, স্যার…আমি তো তাই করেছি!” বিস্মিত ম্যানেজার শিশুর মতো সরলতায় জবাব দিলো।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল বাবু। “আপনি কি সব গেস্টের লাগেজ এভাবে নিজে ক্যারি করেন? লিফটে করে রুমে পৌঁছে দেন?”

“না, মানে…তা কেন করবো, স্যার?”

“হোটেলের রেজিস্টারে কিছু লিখলেন না, সবার সামনে স্যার-স্যার বললেন…স্টাফরা কী ভাববে?”

এবার দাঁত বের করে নিঃশব্দের হাসলো ম্যানেজার। “আপনি এইসব নিয়ে ভাবছেন, স্যার?” মাথা দোলালো সে। “এটা কোনো সমস্যাই না।”

বাবু স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।

“খুব বড় ব্যবসায়ি, হোমড়া চোমড়া কেউ এলে আমি নিজেই তাদের টেক-কেয়ার করি। দিস ইজ হোটেল ম্যানেজমেন্ট, স্যার…ভিআইপি গেস্টদের এ রকম ট্রিটমেন্ট দিতে হয়। অল ওভার দ্য ওয়ার্ল্ড এটা করা হয়। এটা নিয়ে ভাববেন না, ওরা কেউ বুঝতেই পারবে না আপনি এই হোটেলের একজন ঔনার।”

“কিন্তু আমি যে একজন ভিআইপি গেস্ট, সেটা বোঝানোর কি খুব দরকার ছিল?”

হাত কচলালো ম্যানেজার। “স্যার, আপনাকে ভিআইপি হিসেবে ট্রিট না করলে সমস্যা হতে পারতো।”

ভুরু কুঁচকে তাকালো অমূল্যবাবু। “হোটেলে কতো স্টাফ…একেকজন একেক রকম, কখন কে আপনার সঙ্গে বেয়াদবি করে ফেলতো বলা যায় না, বুঝতেই পারছেন।”

বাবু বুঝতে পারলো। “ঠিক আছে, এখন থেকে এ রকম বাড়াবাড়ি আর করবেন না, একদম স্বাভাবিক ব্যবহার করবেন। এরপর আমি আর কোনো ব্যাখ্যা শুনবো না।”

“ওকে, স্যার…সব কিছু নরমাল থাকবে। আপনি একজন ভিআইপি গেস্ট, একটু নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করেন।”

বাবু কিছু বলল না। লিফটের দরজা খুলে গেলে ম্যানেজারকে কিছু না বলে সোজা পা বাড়ালো নিজের রুমের দিকে। রুম নাম্বার ৭০৭-এর সামনে এসে দাঁড়ালো বাবু, ম্যানেজার একটামাত্র লাগেজ নিয়ে তার পেছন থেকে অনেকটা দৌড়ে এসে ইলেক্ট্রিক-কি দিয়ে দরজাটা খুলে দিলো।

“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। এবার এটা আমাকে দিন,” লাগেজের দিকে হাত বাড়ালো।

“স্যার, আমি রুমের ভেতরে দিয়ে আসি?” বিগলিত কণ্ঠে বলল ম্যানেজার।

“আপনি দেখি খুব দ্রুতই সবকিছু ভুলে যান,” শীতলকণ্ঠে বলল বাবু।

সঙ্গে সঙ্গে ঢোক গিলল ম্যানেজার। “সরি, স্যার!” আর কথা না বাড়িয়ে লাগেজটা বাবুর হাতে দিয়ে দিলো সে।

“আমি না ডাকলে কাউকে রুমে পাঠাবেন না, আপনিও আসবেন না।”

“ওকে, স্যার,” নীরবে সালাম ঠুকে চলে গেল এনামুল হক।

রুমের দরজা বন্ধ করে গভীর নিশ্বাস নিলো অমূল্যবাবু। আজ অনেকদিন পর একদিনে এতো কথা বলতে হলো তাকে। হাঁপিয়ে উঠেছে সে। ঠিক করলো স্নান করে সোজা বিছানায় গিয়ে বিশ্রাম নেবে।

বারান্দার স্লাইডিং ডোরটা সরিয়ে দিতেই সমুদ্রের গর্জন ভরিয়ে দিলো ঘরটি। চোখের সামনে বিশাল সমুদ্র, বিরামহীনভাবে ঢেউ বয়ে নিয়ে এসে আছড়ে ফেলছে সৈকতে। দু-চোখ বন্ধ করে তাজা বাতাসে গভীর করে নিশ্বাস নিলো সে।

1 Comment
Collapse Comments

পরের অংশগুলো কবে দিবেন? তাড়াতাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করবেন প্লিজ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *