০১. থেয়েস্টাস বনাম এট্রিউস

অ্যাকিলিসের টেন্ডন – মালিহা তাবাসসুম
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২২ 

উৎসর্গ 

দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনীর কর্মভারে পরিশ্রান্ত যে মানুষটার নিঃস্বার্থ ভালোবাসার কারণে পুঁজিবাদী-পূতিগন্ধময় পরাকাষ্ঠার পৃথিবীতে আমরা নিয়ত বর্তে যাই, সেই মানুষটাকে-আমার বাবাসহ পৃথিবীর সবার বাবাকে, চিরায়ত বটবৃক্ষদের। 

ভূমিকা

বেশ কিছুদিন আগের কথা। বাংলাদেশের প্রভাবশালী এক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকের প্ররোচনায় মুনিয়া নামের একটি মেয়ের মৃত্যু ঘটে। আমি যখন এই লেখাটি লিখছি, সদ্য পদচ্যুত এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব চিত্রজগতের এক নায়িকাকে নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে ধর্ষণের হুমকি দিচ্ছেন–এমন একটি অডিও ক্লিপ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। 

কামদুষ্ট ধনপুষ্ট শিল্পপতি, রাজনৈতিক উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তির কাছে সমাজে প্রচলিত কোনো আইন আইন নয়। তাদের কৃত ভয়ংকরতম অপরাধটিও অপরাধ নয়। জগতের যাবতীয় নিয়মকানুন শৃঙ্খল কেবল পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পিছিয়ে পড়া, সীমিত সম্পদের অধিকারী মানুষগুলোর জন্য। পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে মিলিতভাবে বিদ্রোহ করার সুযোগ থাকলেও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তারা এই পরগাছাসদৃশ জীবনকেই বেছে নেয়। টিকটিকির খসে যাওয়া লেজের মতো তাদের স্বপ্ন-কল্পনাগুলো প্রতি মুহূর্তে খসে খসে পড়ে। আমার বহুদিনের ইচ্ছে ছিল, পুঁজিপতি শ্রেণি আর দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষগুলোর অসাম্য নিয়ে একটি রহস্যোপন্যাস লিখব। ভাব আর বিষয়ের শক্তিমত্তার নিরিখে নিজেকে ততটা যোগ্য এত দিন মনে করিনি। তবে ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্সের আশাতীত সাফল্যের পর আত্মবিশ্বাস পেলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম–এই উপন্যাস লেখার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেব। 

গ্রিক মিথোলজি আমার অসম্ভব প্রিয়। গ্রিক মিথোলজির দেব-দেবীর চরিত্রগুলোর মানবীয় রূপ, ক্ষমতা আর শক্তিমত্তার প্রদর্শনী পুঁজিবাদীদের নিপীড়ক সত্তারই প্রতীতি। তাই উপন্যাসটি লেখার জন্য গ্রিক মিথোলজিকে অবলম্বন করার সিদ্ধান্ত নিই। 

গ্রিক মিথোলজির এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র অ্যাকিলিস। অ্যাকিলিসের জন্মের পর তার মা থেটিস অ্যাকিলিসকে অমর করার জন্য তার গোড়ালির একটি নির্দিষ্ট অংশ ধরে স্টিক্স নদীতে নিমজ্জিত করেন। অ্যাকিলিসের পুরো শরীর অমর হলেও গোড়ালির সেই নির্দিষ্ট অংশ, যেখানে ক্যালকেনিয়াস টেন্ডন নামে এক বিশেষ টেন্ডন অবস্থিত, হয়ে পড়ে নশ্বর। ক্যালকেনিয়াস টেন্ডন কালক্রমে অ্যাকিলিসের টেন্ডন নামে চিকিৎসাবিজ্ঞানের জগতে বেশি পরিচিতি পায়। পুঁজিবাদীরা অর্থ-বৈভব ক্ষমতার বলে নিজেদেরকে অজর-অক্ষয় ভাবতে শুরু করে। অ্যাকিলিসের পুরো অক্ষয় শরীর তাদের কাছে হয়ে ওঠে শক্তিমত্তার প্রতিভূ। 

মধ্যবিত্তের যাবতীয় অকারণ আবেগ, অযৌক্তিক ভালোবাসা আর পরার্থপ্রবণতাকে তারা অ্যাকিলিসের টেন্ডনের মতোই দৌর্বল্যের প্রতীক হিসেবে আখ্যায়িত করে। সত্যিই কি অ্যাকিলিসের টেন্ডন মানুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা? নাকি আদতে সবচেয়ে বড় শক্তি?

মালিহা তাবাসসুম,
শ্যামলী,
১০.১০.২০২১ 

১. থেয়েস্টাস বনাম এট্রিউস এবং নরমাংসখেকোর গপ্পো

হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থডে টু ডিয়ার অবন্তি হ্যাপি বার্থডে টু ইউ– 

জীবনের সাতাশতম বছরে পদার্পণের দিন হ্যাপি বার্থডে গানটা এত বালখিল্যপনায় ভরা মনে হবে, অবন্তি স্বপ্নেও ভাবেনি। 

পঁচিশের কোঠা পার হওয়ার পর একেকটা দিন যেন উৎসব-অভিপ্রায় নিভে যেতে যেতে দূরগামী রেখায় ফিকে হয়ে যাওয়া ফানুসের মতো। মিড এইজ ক্রাইসিস বোধ হয় এই বয়সকেই বলে।

এই যে পাশে মা দাঁড়িয়ে আণুবীক্ষণিক চোখ দিয়ে বার্থডে পার্টিতে আগত বন্ধুবান্ধব, অফিস-কলিগদের মাঝে সুপুরুষ যুবাকে কন্যার যোগ্য পাত্র হিসেবে খুঁজে চলেছেন, পুরো ব্যাপারটাই অবন্তির ভীষণ অপছন্দ। মেয়ে যতই যোগ্য হোক না কেন, বীক্ষণ কোণ দিয়ে মেপে-চেখে মেয়ের জন্য পাত্র নির্বাচনের আদিমতম প্রবৃত্তি মায়েদের জিনের মাঝেই বোধ হয় খোদাই করে লেখা আছে।

ভালোবাসা, সংসার-গোটা ব্যাপারটা স্বতঃস্ফুর্ত। পুঁজিবাদের নির্বাচন প্রক্রিয়া সেই স্বতঃস্ফূর্ততাকে রুদ্ধ করে দেয়, যেন শেয়ারবাজারে মানবসম্পদের বিকিকিনি। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার প্রতি অবন্তির বিরূপ মনোভাবের বীজটা অবশ্য চে গুয়েভারার একনিষ্ঠ ভক্ত আবরারেরই প্রোথিত করে দেওয়া। 

আজকের পার্টিতে আবরারকে দারুণ মিস করছে অবন্তি। মায়ের টিউমার অপারেশনের জন্য জাপান গিয়েছে এক মাস আগে, অপারেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। আবরার আসবে বলে কথা দিয়েছিল, শেষ মুহূর্তে কী একটা কনফারেন্সের কারণে আটকে গিয়েছে। 

সিআইডি প্রধান পর্যন্ত এসেছেন আজকে কিছুক্ষণের জন্য। এসে দেখা করেই অবশ্য চলে গেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে জরুরি কাজ ছিল! 

ডিআইজি তামিম সাহেব, অ্যাডিশনাল ডিআইজি ফজলে রাব্বি সাহেব, সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত এসপি মাহফুজ মোরসেলিন সাহেব-উচচপদস্থ সব কর্মকর্তার পাশাপাশি সাব-অর্ডিনেটররাও এসেছেন। এসেছে অবন্তির স্কুল কলেজজীবনের ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধুবান্ধবও।

অবন্তি বরাবর স্কুলের বন্ধুদের অন্য রকমভাবে ভালোবাসে। স্বল্পস্থিতি জীবনে বিশ্ববিদ্যালয়, কর্মজীবনে গড়ে ওঠা সম্পর্কগুলো কেমন যেন ঠুনকো! দক্ষিণ মেরুর উদাসী হাওয়ায় ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ে সম্পর্কের ইট-সুরকি, বালুকণা। কিন্তু স্কুলজীবনে গড়ে ওঠা বন্ধুত্ব বুকের মাঝে হিমালয় হয়ে রয়ে যায়; সময়ের ব্যস্ত স্রোত টলাতে পারে না এই পর্বতকে। 

বনানী এগারো নম্বরে অবন্তিদের ছিমছাম সাজানো ডুপ্লেক্স বাড়িটা; এখানে উঠেছে প্রায় আট বছর হয়ে গেছে। লিভিং রুমটা বিশাল পরিসরে সাজানো। অবন্তির বাবা আসাদুজ্জামানের উন্নত রুচি, আভিজাত্য আর পারিপাট্যের ছোঁয়া ঘরজুড়ে। 

আসাদ সাহেব অফিসিয়াল জরুরি কাজে নিউইয়র্ক যাওয়ায় স্ত্রী রাইদাকেই আজকের পার্টির যাবতীয় দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।

রান্নার দায়িত্বটা বরাবর নিজের কাঁধে নিতে ভালোবাসেন তিনি, তা সে যতসংখ্যক লোকের রান্নাই হোক না কেন। পার্টির বাদবাকি কাজের জন্য অনলাইন পার্টি প্ল্যানারের সাহায্য নিয়েছেন, মেয়ের তদারকির সুবাদে অনলাইন দুনিয়ার খুঁটিনাটি সবকিছুই জানা হয়ে গেছে রাইদা জামানের। 

সফল অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অনলাইন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট গ্রুপগুলো সবার পছন্দের শীর্ষে, কিছুদিন ফেসবুকে স্ক্রল করেই বুঝে গেছেন তিনি। 

কয়েক দশক পরে না জন্মানোর জন্য আক্ষেপের শীতল অনুভব তার অনুভূতির অভিধানে সহিষ্ণু ক্ষতচিহ্ন রেখে যায় মাঝে মাঝে, আজকালকার ছেলেমেয়েদের দারুণ ঈর্ষা করেন তিনি। পৃথিবীটা কী সুন্দর সবার হাতের মুঠোয় কেবল কয়েক ইঞ্চি চতুষ্কোণ বাক্সের কল্যাণে! 

মেয়ের আঠারোতম জন্মদিন সেই কবে শেষ পালন করা হয়েছিল বিশাল বড় করে! নয় বছর পেরিয়ে গেছে দেখতে দেখতে। আজ অবশ্য কেবল জন্মদিন উপলক্ষ্যেই যে অনুষ্ঠান করা হচ্ছে, এমনটা নয়। 

এত অল্প বয়সে এত বড় পোস্টে প্রমোশন, সেদিনের সেই ছোট মেয়েটা আজ এত বড় অফিসার! ভাবতেই রং-রেখার চিত্রলেখায় কাল্পনিক ক্যানভাসে ছোট এক চঞ্চল বাচ্চা মেয়ের জলছবি আঁকেন, ঝাপসা হয়ে ওঠে চোখ। সময় এত তাড়াতাড়ি বয়ে যায়! 

অবস্থাপন্ন ঘরে জন্ম, বাবা-মায়ের একমাত্র আদরের দুলালি হলেও অধিকাংশ বড়লোকের ছেলেমেয়েদের মতো পুতুল স্বভাবের মেয়ে নয় অবন্তি। শিক্ষা, সংস্কৃতি, মানসিকতার বিকাশে সংস্কৃতিমান আর রুচিমান বাবা কখনোই আপস করেননি। তবে মেয়েদের বয়স পঁচিশ পেরোনোর পর মিড এইজ ক্রাইসিস ব্যাপারটা বোধ হয় চূড়ান্ত প্রগতিশীল বাবা-মায়েরাও ঠিকঠাক বুঝতে পারেন না। 

অবন্তির ধারণা, বয়স অনুপাতে মানসিকভাবে বুড়িয়ে যাচ্ছে সে, আর এর পেছনে দায়ী আবরার। ছেলেটার এক অদ্ভুত সম্মোহন শক্তি আছে। এই দুই বছর একসঙ্গে কাজ করতে করতে নিমেষেই সেই প্রাণচঞ্চল, ছটফটে অবন্তি পরিণত মানুষদের মতো চিন্তাভাবনা করতে শিখে গেছে। 

স্কুল-কলেজজীবন থেকে রপ্ত বলিউডপ্রীতিও গুণোত্তর হারে কমে গেছে, কম খোটা তো শুনতে হয়নি আবরার থেকে এই এক বছরে।

নীল রঙের বেলুন দিয়ে তিন হাজার স্কয়ার ফিটের বাড়ির পুরোটা সাজানো হয়েছে। ক্লাসিক্যাল মিউজিক বাজছে, অভ্যাগতদের রুচির অনুগামী ভেবে জন্মদিনের থিম মিউজিক হিসেবে ক্লাসিক্যালকেই নির্বাচন করেছে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ। চেনা সুরের রাগ-রং, চেনা গানের সাথে আহিরী রাগের মিতালি সবাই বেশ উপভোগ করছে। 

খাবারের মেন্যুতে বাঙালি, কন্টিনেন্টাল, চায়নিজ-কয়েক রকমের পদ রাখা হয়েছে। শেষ পাতে আইসক্রিম, দই, কফি আর খিলিপান। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের অভিনব সন্নিবেশ শেষ পাতেই বা বাদ যাবে কেন! 

একবার আবরার বড়সড় বক্তৃতা দিয়েছিল। মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাস, নিওকর্টেক্স আর অ্যামিগডালার তথ্যভান্ডারে অবস্থান করছে সেই বক্তৃতালব্ধ তথ্য। 

মাঝে মাঝে অবন্তির মনে হয়, সে ও আবরারের বক্তৃতা শুনতে শুনতে ছোটখাটো ডাক্তার হয়ে যাবে। খটমটে মেডিক্যাল টার্মগুলো আজকাল আর খটমটে মনে হয় না। যেন বয়সের সাথে সাথে ক্রম অপস্রিয়মাণ আত্মবিশ্বাস আর অপস্রিয়মাণ নয়, পাইয়ের ধ্রুবকের মতো চিরায়ত! 

আইসক্রিমের উৎপত্তি নিয়ে প্রচলিত ধারণায়, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে রোম নগরের রাজা নিরো তার বাবুর্চির কাছে মুখরোচক কিছু খেতে চেয়েছিলেন। 

রাজবাবুর্চি তখন কর্মচারী মারফত ইতালির পর্বতশ্রেণি অ্যাপেনাইন থেকে বরফ সংগ্রহ করে বাদাম আর মধু দিয়ে বিশেষ এক পদ তৈরি করে রাজাকে খাওয়ালেন। আইসক্রিমসদৃশ পদটি রাজার দারুণ পছন্দ হয়েছিল, বলাই বাহুল্য। 

কিন্তু আবরার প্রথাগত ধারণায় বিশ্বাস করে না। অনলাইন-অফলাইনে দীর্ঘদিন ধরে যথাসম্ভব গবেষণা করে আইসক্রিমের জন্মস্থল হিসেবে গ্রিসের রাজধানী এথেন্সকেই প্রচার করে সে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ শতাব্দীতে এথেন্সে আইসক্রিম বিক্রি করা হতো বরফকুচির সঙ্গে মধু এবং ফলের রস মিশ্রিত করে। 

আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক গ্রিক মহামানব হিপোক্রেটিস, মহাবীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট-দুজনই আইসক্রিম খাওয়াকে বেশ উৎসাহিত করেছেন। তবে তখনকার আইসক্রিম আর এখনকার আইসক্রিমের গঠনগত উপাদানে পার্থক্য আছে মোটা দাগে। 

নাহ, আবরার ছেলেটার ভূত কিছুতেই ঘাড় থেকে নামছে না। ভাবনাগুলোর বিশ্লিষ্ট কণা কেবল ঐ সম্মোহনী ক্ষমতাবিশিষ্ট ছেলেটাকে কেন্দ্রে রেখেই ঘুরপাক খেতে থাকে। 

লিভিং স্পেস আর ডাইনিংয়ের মাঝে কোনো দরজা না থাকায় অবন্তিদের লিভিং আর ডাইনিং স্পেস মিলিয়ে এক হাজার স্কয়ার ফুটের মতো। 

তাই যেকোনো অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে বাড়িকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। লিভিং রুমের নান্দনিক সৌন্দর্য বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে ঘরের ঠিক মাঝখানে রাখা ক্রিস্টালের ঝাড়বাতির কল্যাণে। 

ধাতু, ক্রিস্টাল আর এন্টিকের আবরণে গঠিত স্ফটিকাকার ঝাড়বাতি সম্পূর্ণতার দ্যোতনা ছড়িয়ে দেয় উপস্থিত সবার মনে। ঝাড়বাতির নীলাভ আলোর নিচে দাঁড়িয়ে অবন্তির মনে হলো সদর দরজার সামনে একটা আবছা অবয়ব দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। 

ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা দীর্ঘদেহী এক অবয়ব, মুখের খোঁচা খোঁচা দাড়ির আবডালে নিরালম্ব পৃথ্বীর মায়াজাল। 

আরেকটু কাছে এগোলো অবন্তি। প্রশস্ত কপাল, ক্রমশ ম্রিয়মাণ ক্ষীণ চিবুক, স্যুটেড-বুটেড অবতার ভেদ করে উঁকিঝুঁকি দেওয়া পেশি। চোখে রিমলেস চশমা না থাকলে মানি হাইস্টের প্রফেসর বলে চালিয়ে দেওয়া যেত। 

চশমার আড়াল ভেদ করে গভীর চোখ দুটো অবন্তির বড় চেনা। পটলচেরা চোখ দুটোর ধারাল চাহনিতে থরে-বিথরে কবিতার পাতা স্কুপ করে রাখা। পেছন ফিরে চোখ বন্ধ করে ফেলল অবন্তি। এতক্ষণ তো কেবল ছেলেটার কথা মনে হচ্ছিল। এখন আবার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে! 

হ্যালুসিনেশন নয় ম্যাডাম। ফিরে দেখুন আবার। আমি সত্যিই এসেছি। 

সাঁই করে ঘুরে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করে আবরারকে দেখল অবন্তি। কী করে ছেলেটা যে মনের কথা বুঝতে পেরে যায় কে জানে! 

আপনি না বললেন আজকে আসতে পারবেন না? কনফারেন্সের কাজে আটকে গেছেন? 

ভেবেছিলাম আসতে পারব না। তবে কনফারেন্সটা দুদিন আগেই শেষ হয়ে গেল, টিকিট পেতেও ঝামেলা হয়নি কোনো। আজ ভোরে দেশে এসে পৌঁছেছি। 

তা একবার ফোন করা গেল না? 

মানুষকে জন্মদিনে সারপ্রাইজ দেওয়ার একটা প্রচলিত রীতি আছে। যদিও আমি প্রথাগত ধারণার তেমন একটা অনুসারী নই, তবু কারো চমকে ওঠা মুখ দেখার সুযোগ ফ্রিতে পাওয়া গেলে সেই সুযোগ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করব, এতটারও প্রথাবিরোধী আমি নই। 

উফ, আবার লেকচার শুরু! হাহ! আপনি না এলে আমার বয়েই গেল।

তাই নাকি?

চোখ পাকিয়ে বলল আবরার।

জি, তাই। 

যাইহোক, কংগ্রাচুলেশনস অন বিইং প্রমোটেড। আচ্ছা, হাতে কতক্ষণ ধরে ফুলের তোড়াটা ধরে থাকব? দরজার সামনেই দাঁড় করিয়ে রাখবেন, না ভেতরে যেতে বলবেন? 

অপ্রতিভ ভঙ্গিতে ফুলের তোড়াটা নিয়ে অন্য উপহারগুলোর মাঝে রাখল অবন্তি। আবরারকে লিভিং রুমের অপর প্রান্তে মঞ্চের মতো জায়গাটায় নিয়ে যেতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে আবরারের চোখের দিকে তাকাল উদ্ধত দৃষ্টিতে,

আচ্ছা! একটা প্রশ্নের উত্তর দিন তো। বুর্জোয়ারা তো আপনার চক্ষুশূল। পুঁজিপতি শাসনব্যবস্থার বিষোদ্গার করে তো সুযোগ পেলেই লম্বা লম্বা বক্তৃতা শুরু করে দেন। তা মহাশয়, পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থার নির্ধারণ করে দেওয়া টিপিক্যাল পুরুষালি সৌন্দর্যের স্ট্যান্ডার্ড তো নিজের ভেতরে ধারণ করে আছেন। সিক্স ফিট হাইট, সিক্স প্যাক, নিকোটিনের সাক্ষী হালকা পোড়া ঠোঁট, রেগুলার এক্সারসাইজ করা পেটা শরীর। পুরো আউটলুকটাই বুর্জোয়াদের স্ট্যান্ডার্ডে নিজেকে বিকিয়ে দেওয়া করপোরেটসুলভ কৃত্রিম। 

সব মেয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকুক আর গায়ের ওপর হামলে পড়ুক-এই তো চান, তাই না? আরে বাবা, বিপ্লবীরা কখনোই নিজের লুক, আউটফিট আর ফিটনেস নিয়ে এত যত্নশীল হয় না। আপনি কোন হিসেবে নিজেকে চে গুয়েভেরার ভক্ত দাবি করেন? এই আপনি বিপ্লবী? 

ওরে বাবা! এটা কী প্রশ্ন ছিল। আমার তো মনে হচ্ছে আমার ফিমেল অ্যাটেনশন পাওয়ার কারণে কিছুটা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। তা, মেল অ্যাটেনশন তো এই সাতাশ বছর বয়সে এসেও আপনি কম পান না! এত হিংসে কেন? 

মোটেই না। মেয়েরা আপনার গায়ে পড়লে তাতে আমার কী? এমনিতেই জানতে চাইছিলাম। 

আচ্ছা, একে একে উত্তর দিই তাহলে। প্রথমত, বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থা আমার চক্ষুশূল এমনটা নয়। কারণ রাতারাতি সিস্টেমকে পাল্টে দেবার মতো সুপারহিরোসুলভ ক্ষমতা নিয়ে আমি জন্মাইনি। তবে পুঁজিবাদী বা বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার অসংগতি অন্য সব সমাজব্যবস্থার তুলনায় আমার চোখে বেশি পড়ে। 

আমি চরমপন্থী যেকোনো কিছুকে অপছন্দ করি, এটা একটা কারণ হতে পারে। পুঁজিবাদ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে মুষ্টিমেয় কিছু অংশ ছুঁড়ে দেয় সাধারণ জনগণের মাঝে। যেন তারা এক উৎকৃষ্ট প্রজাতি, তাদের জন্মই হয়েছে পৃথিবীর যাবতীয় সুন্দরতম পণ্য ভোগ করার জন্য। উদ্বৃত্ত ছুঁড়ে দেওয়া অংশের জন্য পিঁপড়ের মতো কাড়াকাড়ি করে অর্থবিত্তের মাপকাঠিতে পিছিয়ে পড়া মানুষগুলো। ঠিক এখানেই আমার আপত্তিটা। সো কল্ড এলিট শ্রেণি নিজেদের অতিমানবীয় ক্ষমতাসম্পন্ন, মহাশক্তিধর ভাবছে। মৃত্যুকে পরাভূত না করতে পারলেও সৃষ্টিকর্তার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর্যন্ত ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে। 

অথচ অধীনস্থরা মানুষ হিসেবে ন্যূনতম সম্মানটুকু পাচ্ছে না। সামান্য পরিমাণ উচ্ছিষ্টের উপর যেমন সারি সারি পিঁপড়ে হামলে পড়ে, ঠিক তেমনি মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত শ্রেণি দুটো ভোগ্যপণ্যের উচ্ছিষ্ট অংশের অধিকারের জন্য নিজেদের মাঝে প্রাণপণ লড়াই করছে, কাড়াকাড়ি করছে। 

নিজেদের ঈশ্বর ভেবে বসে থাকা মানুষগুলো পায়ের ওপর পা তুলে বসে সামান্য অর্থের জন্য জীবন পণ করা মানুষগুলোকে পশুর নজরে দেখছে। তাদের দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় জীবন থেকে সুখের রসদ নিচ্ছে। সবকিছু বুর্জোয়াদের কাছে একটা নিষ্ঠুর খেলা।

মুগ্ধ হয়ে শুনছিল অবন্তি। আবরারের জ্ঞানগর্ভ কথাগুলো কখনোই নীরস বুলি মনে হয় না, অদ্ভুত ভালো লাগে। আগে জ্ঞান জাহির করত বলে মনে হতো, তবে ইদানীং খুব সার্বজনীন মনে হয় ওর মুখ থেকে নিঃসৃত যেকোনো জ্ঞানের বুলি। 

লাঙলে লেগে থাকা প্রপিতামহের রক্তের দাগ থেকে শুরু করে বাষ্পশকটে বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়ানো লাট সাহেব-এমন কোনো আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট নেই, যা সম্পর্কে ছেলেটা যৌক্তিকভাবে গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। 

আপনার কথা শুনে সেপ্টেম্বরে রিলিজ পাওয়া সাউথ কোরিয়ার স্কুইড গেম সিরিজটার কথা মনে পড়ে গেল। অ্যালিগরিক্যাল ডার্ক ড্রামা থ্রিলার সিরিজ। নেটফ্লিক্সে বর্তমানে ওয়ার্ল্ড-ওয়াইড ট্রেন্ডিংয়ে আছে। 

ক্যাপিটালিজমের ডার্ক সাইডকেই মেটাফরের মাধ্যমে রিপ্রেজেন্ট করা হয়েছে সিরিজটায়। অনেকটা এমনই, যেমনটা আপনি বললেন। পুত্র পিপল আর একুইভ্যালেন্ট টু হর্স টু ক্যাপিটালিস্টস। যাহোক, আমার প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এখনো পাইনি। 

আমার কথা তো এখনো শেষ হয়নি। আপনি পুঁজিবাদীদের ফিক্স করা পুরুষালি সৌন্দর্যের স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে কী যেন বলছিলেন? সিক্স ফিট হাইট, সিগারেটে পোড়া ঠোঁট, মেদহীন পেটা শরীর আর সিক্স প্যাক? উম… আমার উচ্চতার ওপর আমার হাত নেই। আল্লাহ মেহেরবানি করে বেশ ভালো উচ্চতা দিয়েই আমাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।

উঁহুহু… আবার বিপ্লবীদের সাথে সাংঘর্ষিকতা। আপনি লম্বা উচ্চতাকে আল্লাহর মেহেরবানি বলে নিজেকে উচ্চতর শ্রেণিভুক্ত আর যারা খাটো তাদের নিম্নতর শ্রেণিভুক্ত করে ফেলছেন। এটাও একধরনের পুঁজিবাদ। 

আপনি মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বড় বেশি বাজে বকেন। মেহেরবানি বলেছি এই কারণে যে বিজ্ঞান প্রমাণ করে প্রজননগত উপযোগিতার ক্ষেত্রে অধিক উচ্চতার পুরুষ গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠিতে অগ্রগণ্য। জানি, বৈষম্যের কিছুটা ছাপ আছে এই গবেষণালব্ধ ফলাফলে। 

প্রথমেই আমি বলে নিয়েছি, সমাজ পরিবর্তনের মতো অতিমানবীয় ক্ষমতা নিয়ে আমি জন্মাইনি। তাই আমার দ্বারা কারো প্রত্যক্ষ ক্ষতি না হবার আগপর্যন্ত আমার আদর্শের ব্যত্যয় হবার কথা নয়। 

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। আমি যদি আমার থেকে কম উচ্চতার কাউকে প্রজননগত উপযোগিতার ক্ষেত্রে একটু পেছানো বলে শ্লেষসূচক বাক্য বর্ষণ করি, সে ক্ষেত্রে এটা হবে চে গুয়েভেরার ভক্ত হিসেবে আমার আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিকতা। এখন প্রসঙ্গে আসি। রেগুলার এক্সারসাইজ করা হলো। পুঁজিবাদের নির্ধারণ করে দেওয়া পৌরুষের মানদণ্ড-আপনার এই ধারণাটা আসলে ভুল। 

একজন ডাক্তার হিসেবে আমি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি, নিয়মিত এক্সারসাইজ করি। মানুষকে যেই পরামর্শগুলো দেব, তা নিজের জীবনে পালন করব না, এতখানি হিপোক্রেট আমি নই। আর টেনশন রিলিফের জন্য ধুমপান করা হয়, তবে এই অভ্যাসটা ধীরে ধীরে ছেড়ে দেবার প্রাণান্ত চেষ্টা করছি। ঠোঁটের ধূসর বর্ণ যদি আপনার ভাষ্যমতে পুঁজিবাদীদের নির্ধারণ করা পুরুষালি সৌন্দর্যের মানদণ্ড হয়, তাহলে আমি নিশ্চিত করছি যে জ্ঞাতসারে এই মানদণ্ড আমি অনুসরণ করিনি। 

বিপ্লবীদের পোশাক-আশাক চালচলন নিয়ে আপনার ধ্যানধারণা জানতে পেরে আমি হতাশ। বিপ্লবের বীজ প্রোথিত হয় মগজে-অন্তরে। চে গুয়েভারার ছবি আমার ঘরে টানানো দেখে যে আমাকে ঠোঁটে ১ মিটার দৈর্ঘ্যের চুরুট নিয়ে ঘুরতে হবে আর সপ্তাহে একদিন গোসল করে অফিস কলিগদের থেকে চানচো (শূকর) উপাধি পেতে হবে, ব্যাপারটা মোটেই এমন নয়। 

কী ব্যাপার? এখানে তো দেখছি ছোটখাটো কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। সেলিব্রেটি সিআইডি অফিসার আর সেলিব্রেটি ফরেনসিক ডাক্তারের মধ্যে বেশ উত্তপ্ত বাদানুবাদ চলছে। তা আমি কী যুক্ত হতে পারি এই কর্মশালাতে? 

সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের অ্যাডিশনাল ডিআইজি ফজলে রাব্বিকে দেখে অপ্রতিভ ভঙ্গিতে অবন্তি একপাশে সড়ে দাঁড়াল। গভীর আলোচনায় কখন এত মত্ত হয়ে হয়ে গেছে টেরই পায়নি। স্যার কি সব কথা শুনতে পেয়েছেন নাকি, কে জানে! 

আবরার, তুমি কবে এলে জাপান থেকে? একটা কনফারেন্সে নাকি আটকে গেছ, অবন্তির কাছ থেকে শুনলাম। কিসের কনফারেন্স? 

স্যার, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথের হেডের অনুরোধে পার্টটাইম ফরেনসিক সাইকোথেরাপিস্ট হিসেবে জয়েন করেছি বেশ হলো। টোকিওতে একটা কনফারেন্সে সেই সূত্রেই আমন্ত্রণ পাওয়া। 

বাহ, সিআইডি ডিপার্টমেন্টের ফরেনসিক এক্সপার্ট এখন ফরেনসিক সাইকোথেরাপিস্টও! প্রাউড অব ইউ ডিয়ার। অবশ্য জেসমিন ডিসুজার কেস সলভ করার পর মিডিয়ার চোখে তো তুমি এমনিতেই সেলিব্রেটি।

আপনারা সবাই এখানে? এদিকে আমি সবাইকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। হাসান স্যারের ফোনকল এলো মাত্র। ভীষণ জরুরি একটা খবর দেওয়ার আছে। যদিও একটা আনন্দঘন পার্টিতে এভাবে…। 

ডিআইজি তামিম সাহেবের কথা শেষ হতে না হতেই আবরারের দিকে চোখ পড়ল, এতক্ষণ মগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন ফোনকলের আকস্মিকতায়। 

আরে আবরার যে? আসতে পারলে তাহলে শেষ পর্যন্ত। ভালোই হলো, তোমরা সবাই আছ এখানে। তোমাদের মনে আছে নিশ্চয়ই, দুই দিন আগে ঢাকা ১৬ আসনের এমপির স্ত্রী আর তার ভাইয়ের পাঁচ বছর বয়সি ছেলের মিসিং রিপোর্ট করেছিল নিখোঁজের পরিবার। আজ বিকেলে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে দুটো লাশ পাওয়া গেছে। একটা ত্রিশোর্ধ্ব মহিলার, আরেকটা ছোট বাচ্চা ছেলের।

আমাদের টিমের কাছে মিসিং দুজনের যে ছবি আছে, তার সাথে রিকভার করা ডেড বডি দুটোর বর্ণনা পুরোপুরিভাবে মিলে যায়। এন্ড মোস্ট ডেঞ্জারাস ফ্যাক্ট ইজ, বাচ্চা ছেলেটার বডির বুকের অংশ থেকে কোনো স্লাইসিং মেশিন দিয়ে মাংস আলাদা করা হয়েছে, এমন নমুনা পাওয়া গেছে। বুকের অংশ থেকে আয়তাকার আকারে মাংস মিসিং। 

আটকে রাখা দমটা কোনো রকমে বের হতে দিলো উপস্থিত সবাই। আবরার চিন্তিত কণ্ঠে বলল,

হোয়াটস অ্যাপে আপনি আমাকে মিসিং কেসটা সম্পর্কে জানিয়েছিলেন। স্যার। বডির যে অবস্থা বললেন, আমাদের তো তাহলে ইমিডিয়েটলি অ্যাকশন নিতে হবে। ডিএনএ টেস্টিংটা সবার আগে দরকার। 

আবরারের সুরে সুর মেলালেন অ্যাডিশনাল ডিআইজি রাব্বি সাহেব, 

এমপির আত্মীয়; উপর মহল থেকে নিশ্চয়ই দ্রুত কেস সলভের চাপ থাকবে। কাল থেকে তাহলে আমাদের সবার উপরই বেশ প্রেশার যাবে। 

ফোঁস করে একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলল অবন্তি। জীবনের নতুন বছরে পদার্পণের দিনটা স্বপ্নালু অনুভূতি নিয়ে শুরু করতে চাইলেও বোতলবন্দি ভূতের কাহিনি-কেচ্ছার মেডিক্যালিয় সংস্করণ দিয়ে শুরু করতে হবে। বোতলে বন্দি ভূতের জায়গায় থাকবে মানুষের মাংসের নমুনা। 

২. পুঁজিবাদ বনাম দ্রোহ এবং বিপ্লব

ফরেনসিক ল্যাবে সারি সারি মাইক্রোস্কোপের মাঝে তৃতীয় সারিতে রাখা ধুলা জমা অপরিত্যক্ত এক মাইক্রোস্কোপের সামনে বসে আছে আবরার। তার সামনে প্যাথলজিক্যাল স্পেসিম্যান কালেক্টরে নিনহাইড্রিন দ্রবণে পিউবিক হেয়ারের স্যাম্পল রাখা সযত্নে। 

কিন্তু আবরারের দৃষ্টি ল্যাবের জানালা পেরিয়ে তীর্থগামী তীরবিদ্ধ বলাকার মতো চক্ৰবাকে পাক খেয়ে আবার ল্যাবের ভেতরে ফিরে আসে। মনটা ভীষণ বিক্ষিপ্ত কয়েক সপ্তাহ ধরে। 

স্যার, যৌতুকের দাবিতে স্ত্রী নির্যাতন মামলায় অভিযুক্ত আকরাম খানের ফিঙ্গার প্রিন্ট রিপোের্ট এসে গেছে। আপনার ক্রস চেক শেষ হলেই AFIS (Automated Fingerprint Identification System) ইন্সপেক্টরের কাছে সিগনেচারের জন্য পাঠানো হবে। 

অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিএনএ অ্যানালিস্ট মুসার ডাকে ভাবনার সিন্ধুশঙ্খ সাগরের তীর থেকে মুহূর্তেই রূঢ় বাস্তবতার জগতে ফিরে এলো আবরার। নীরস মুখে তাকাল মুসার দিকে, 

টেবিলের উপর রেখে যান। আমাকে হেডস্যারের রুমে দেখা করতে যেতে হবে। কালকে পেয়ে যাবেন। 

বিক্ষিপ্ত মনটাকে কেন্দ্রীভূত করে সিআইডি প্রধান হাসান স্যারের দরজায় আলতো হাতে টোকা দিলো আবরার। ভেতরে গমগমে কণ্ঠ শুনতে পাওয়া গেল, 

ইয়েস কাম ইন। 

ভারী দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। ভেতরে ডিআইজি তামিম স্যার, অ্যাডিশনাল ডিআইজি ফজলে রাব্বি স্যার-সবাই গম্ভীর মুখে বসে আছেন। আবরারকে দেখেই মুখ খুললেন সিআইডি প্রধান, 

আবরার, তোমাকে নিয়ে যা শুনছি, তাতে কিন্তু মোটেই খুশি হতে পারছি না। তুমি নাকি ঢাকার সেই এমপির স্ত্রী আর ভাতিজার কেসটা বন্ধ হবার পরেও দোষীদের নিয়ে ব্লগে, সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখালেখি করছ? সাংবাদিক আর নিউজ চ্যানেলগুলোর সাথেও নাকি গোপনে কথাবার্তা বলছ?

স্যার, আপনি যা শুনেছেন তা সম্পূর্ণ সত্যি। আমি পুরো ব্যাপারটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না।

দেখো আবরার, ঐ এমপি কিন্তু কোনো যা তা লোক নয়। বাংলাদেশের লিডিং শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে অন্যতম এক শিল্পপ্রতিষ্ঠান তাকদির গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির মালিক সে। তার ক্ষমতার দৌড় কতখানি তুমি তা ভাবতেও পারবে না। দেশের অনেক প্রথম সারির মিডিয়া, নিউজ পেপার তার কেনা গোলাম। এসব করে কোনো লাভই হবে না, উপরন্তু তুমি নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলবে। 

তুমি একজন ডাক্তার মানুষ, ফরেনসিক এক্সপার্ট হিসেবে এত নাম কুড়িয়েছ। জেসমিন ডিসুজার কেস সলভের পরে দেশের বাইরেও তোমার নাম ছড়িয়ে পড়েছে। এত সম্ভাবনাময় একজন ইয়াংস্টার হয়েও কেন তুমি নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলবে? 

স্যার, চিকিৎসক হিসেবে যখন আমরা হিপোক্রেটিক শপথ নিয়েছিলাম, তখন বিত্ত-ক্ষমতা বিচার করে রোগীকে বাঁচাবার শপথ নিইনি। পরিষ্কার দিনের আলোয় এক প্রভাবশালী শিল্পপতি কাম রাজনীতিবিদ তার নিজের স্ত্রীকে হাত-পা বেঁধে সাগরে ফেলে দিলো। রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে নিজের আপন ছোট ভাইকে সেই ভাইয়েরই ঔরসজাত ছেলের মাংস রান্না করে খাওয়াল। অথচ মিডিয়া আর নিউজ পেপারে গোটা ঘটনাটাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হচ্ছে শুধু পত্রিকা-টিভি চ্যানেলগুলো ঐ শিল্পপতির কেনা গোলাম দেখে? 

তুমি ভুলে যাচ্ছ কেন, তার নিজের স্ত্রীর সাথে পরকীয়ার সম্পর্ক ছিল ঐ এমপির ছোট ভাইয়ের। আর রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও আপন ভাই-ই ছিল তার মন্ত্রী হবার পথে সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। 

স্বামীর রাজনৈতিক অনেক অফিশিয়াল সিক্রেট দেবরের কাছে পাচার করত এমপির স্ত্রী। সাপের লেজে পা দেওয়া বোধ হয় এটাকেই বলে।

ডিআইজি স্যারের চোখের দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকাল আবরার।

স্যার, আপনারা জানেন যে আমাদের ইনভেস্টিগেশন টিমের কাছে ফাইভ স্টার হোটেলের সেই বাবুর্চি সব স্বীকার করেছে। সেই রাতে ভাইয়ের দেওয়া পার্টিতে নিজের ছেলেরই মাংস খেয়েছিল এমপির ছোট ভাই। 

এত বড় নারকীয় ঘটনার পরেও আপনারা এভাবে আমাকে অ্যাকিউজ করছেন? আমি কেন ব্লগে ঘটনাটা নিয়ে লেখালিখি করছি, সোশ্যাল মিডিয়ায় আন্দোলন গড়ে তুলতে চাইছি, তার কৈফিয়ত চাইছেন? 

ফরেনসিকের অ্যাডিশনাল ডিআইজি ফজলে সাহেব আর্দ্র দৃষ্টিতে তাকালেন আবরারের দিকে, আবরারের চোখের উত্তাপ ক্ষণিকের জন্য ছুঁয়ে গেল তাকেও। সিআইডি প্রধানের উদ্দেশে বললেন, 

আচ্ছা, মিসিং কেস রিপোর্ট করেছিলেন কে? 

এমপির শ্বশুর। অবশ্য পরে কেস উইথড্র করে ফেলেন। মেয়ের হত্যার বিচার হার মেনে যায় মোটা অঙ্কের টাকার কাছে। 

কিছুক্ষণ বাক্যবিরতি দিয়ে সিআইডি প্রধান নিজের কাঁচাপাকা গোঁফে হাত বুলাতে বুলাতে বাগ্‌বিতণ্ডার উত্তপ্ত খরতাপকে প্রশমিত হবার সময় দিলেন কিছুক্ষণ। এরপর শীতল দৃষ্টিতে আবরারের দিকে তাকালেন। 

কিছুক্ষণ আগেই তুমি হিপপাক্রেটিক শপথ নেওয়ার কথা বললে না? হিপোক্রেটিস কোন দেশের মানুষ ছিলেন বলো তো। 

গ্রিস।

নিচু লয়ে উত্তর দিলো আবরার। 

আবরার, আমরা সবাই জানি তুমি একজন সব্যসাচী মানুষ। গ্রিক মিথোলজি সম্পর্কে নিশ্চয় জানাশোনা আছে তোমার? 

জি স্যার। 

গ্রিক দেবতা জিউসকে ফাঁকি দিয়ে স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে এনেছিল প্রমিথিউস, মানুষ যাতে আগুনের ব্যবহার ঘটিয়ে সুসভ্য জীবনযাপন করতে পারে।

জিউসের মনে আশঙ্কা দেখা দিলো, দেবতাদের সৃষ্টি করা মানুষ জাতি আগুনের ব্যবহার শিখে সভ্য হয়ে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে দেবতাদের সমকক্ষ হয়ে যাবে। তাই প্রমিথিউসকে কঠিন শাস্তি দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন দেবরাজ। 

এক পর্বতমালার উচ্চ শিখরে প্রমিথিউসকে পাথরখণ্ডের সাথে শৃঙ্খলবদ্ধ করার আদেশ দেন তিনি। 

এখন তুমি আমাকে বলল, এসব গ্রিক দেবতাদের গালগপ্পো বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হিসেবে আমাদের কারোরই বিশ্বাস করার কথা নয়, ঠিক? 

ঠিক স্যার।

খ্রিস্টপূর্ব কত সালের দিকে যেন গ্রিক সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়? 

যত দূর মনে পড়ে, ২৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে। 

লক্ষ করলে দেখতে পাবে, গ্রিক মিথোলজির দেব-দেবীদের সবাই মানবীয় আকৃতিবিশিষ্ট। নিদারুণ তাদের শক্তিমত্তা, প্রজ্ঞা, জ্ঞান, অন্তর্দৃষ্টি। 

সত্যিকার অর্থে দেব-দেবী বলতে আসলে কেউই ছিল না। তঙ্কালীন সময়ের ভূতাত্ত্বিক সম্পদ আহরণ করে যারা সভ্য জীবনযাপনের উপায় সর্বপ্রথম উদ্ভব করেছে, তারাই নিজেদের দেব-দেবীর মতো উচ্চস্থানে বসিয়েছে। ক্ষমতার বলে গোত্রের ভেতর থেকে সবচেয়ে সুন্দরী নারীদের স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছে। 

আর হিউম্যান সেলফিশ জিনের তত্ত্ব অনুযায়ী স্বাভাবিকভাবে জ্ঞানবিজ্ঞানে আর সভ্যতার দিক থেকে যারা পিছিয়ে ছিল, তারা যাতে চিরকাল অন্ধকারেই ডুবে থাকে, সর্বতোভাবে সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে। তা না হলে যে কর্তৃত্ব হারাতে হবে! 

ঐ যুগের সৃষ্টিশীল মানুষেরা বিভিন্ন গল্পগাথায় বিবর্তনের ধারায় পিছিয়ে পড়া বিশাল অংশকে মানুষ অভিধায়িত করে গোত্রপতিদের মহাশক্তিধর দেব-দেবী হিসেবে উপস্থাপন করেছে। তাদের স্বেচ্ছাচারিতা নিয়েই দেব দেবীর কামলীলার গল্প ফেঁদেছে।

জিউস ইচ্ছামতো মর্ত্যের নারীদের ধর্ষণ করতে পারত, অথচ মর্ত্যের এক মানুষ যখন জিউসের স্ত্রী হেরাকে ধর্ষণ চেষ্টা করল, তখন সেই মানুষটার ভয়ংকর শাস্তি হলো। তোমার মনে কি প্রশ্ন জাগে না, এই দ্ব্যর্থবোধকতা ইতিহাসের প্রান্তিকাল থেকে কেন ছিল? 

ছিল, কারণ একই সমাজে অবস্থানের বিচারে যারা অগ্রগণ্য, তাদের জন্য আইন কখনোই আইন ছিল না, এখনো নেই আর ভবিষ্যতেও থাকবে না। এটাই পুঁজিবাদের মূলনীতি। 

পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা ভিন্ন ভিন্ন মোড়কে, ভিন্ন আঙ্গিকে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই বর্তমান ছিল। গ্রিক সভ্যতা বা মিশরীয় সভ্যতার সময়কালে পুঁজি ছিল শৌর্য-বীর্য, প্রতিপত্তি। আজ মার্কিন মুলুক থেকে শুরু করে পুরো পৃথিবীতে পুঁজির অপর নাম অর্থ। ফলাফল, একই সমাজে বিধান প্রণেতাদের জন্য যেকোনো কিছুই ভোগ্যপণ্য, তাদের করা নিকৃষ্টতম অপরাধটাও অপরাধ নয়।

সূর্যাস্তের ম্রিয়মাণ আলোর মতো দ্যুতি নিয়ে স্যারের চোখে চোখ রাখল আবরার। মানুষটা যথেষ্ট প্রজ্ঞাবান। বিন্দুবিসর্গ ভুল বলেননি। 

বিশিষ্ট আচরণ বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স তার The Selfish Gene বইয়ে বিজ্ঞানসম্মতভাবেই মানুষের জিনে খুব সীমিত পরার্থপরতা আর প্রভূত স্বার্থপরতাকে গাণিতিকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। 

মানুষ বংশমর্যাদার কারণে বা যোগ্যতার মাপকাঠিতে কোনোভাবে উপরের অবস্থানে পৌঁছে যেতে পারলে জিনগতভাবেই প্রশংসা পেতে চায়, চায় তার জায়গার অধিকার যেন কেবল তারই থাকে। 

বিবর্তনের ধারায় কিছু মানুষ হয়তো থাকে, যাদের জিনে Altruism অর্থাৎ পরার্থপ্রবণতা বেশি থাকে, তারাই হয়তো পুঁজিবাদকে প্রতিহত করতে চায়। কিন্তু প্রথমোক্ত মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে সেই উদ্যোগ হালে পানি পায় না। 

মন্ত্রমুগ্ধের মতো সিআইডি প্রধানের কথা শুনে চলেছিলেন উপস্থিত সবাই। ডিআইজি তামিম আহমেদ কথোপকথনের প্রাসঙ্গিকতার সুর ধরে বলে উঠলেন, 

আমার ধারণা, হিন্দু মিথোলজির ক্ষেত্রেও পুঁজিবাদের তত্ত্ব প্রাসঙ্গিক। লক্ষ্য করে দেখুন, অসুর আর সুরের মাঝে অসুরদের যেই ছবি আমরা দেখতে পাই, তার সাথে কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে যারা নেটিভ অধিবাসী ছিল, তাদের গায়ের রং, চেহারার গঠন-সবদিক থেকে মিল রয়েছে। আর যেই আর্যদের নিয়ে এত বীরগাথা, তারাই কিন্তু মূলত অনুপ্রবেশকারী। 

উত্তর-পশ্চিম ইউরোপ থেকে পারস্য হয়ে সিন্ধু নদীর অববাহিকায় ভারতীয় অঞ্চলে এসে ভারতের নিজস্ব মানুষদেরই উচ্ছেদ করেছে, জায়গা দখল করেছে।

অথচ লোকগাথায় ভারতের আদিম অধিবাসী, যারা অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছে, তাদেরকেই কী অবলীলায় ডিফেমিং করা হয়েছে! 

তামিম সাহেব, আপনার কথার পেছনে যুক্তি নিশ্চয় আছে, তবে অন্য কোথাও এত অবলীলায় মত প্রকাশ করলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ আসতে পারে।

অ্যাডিশনাল ডিআইজি ফজলে সাহেব এতক্ষণ ধরে কেবল শুনেই যাচ্ছিলেন। কিছুটা মিতভাষী তিনি, স্থিতধী প্রকৃতির মানুষ। শান্ত স্বরে সবার উদ্দেশে বললেন,

আবরার জিনে পরার্থপ্রবণতার কথা বলল না? আমার ধারণা, আবরারের মতো আমার মাঝেও এই প্রবণতা আছে। পুঁজিবাদী সমাজের কাছে আমরা বোধ হয় সত্যি মিসফিট। ক্যানিবালিজমের ঘটনাটা জানার পর দুই রাত চোখের পাতা এক করতে পারিনি আমি। 

সন্তর্পণে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাসকে বেরিয়ে যেতে দিলেন সিআইডি প্রধান। 

খারাপ আমাদের সবারই লেগেছে। তবে সত্যি বলতে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সাথে মানিয়ে নেওয়া ছাড়া আমাদের কাছে কোনো উপায় নেই। 

তাই আমি আবরারের কাছ থেকে আশা করব, তোমাকে আমরা যতখানি বিচক্ষণ হিসেবে জেনে এসেছি, তার মর্যাদা অব্যাহত রাখবে। 

নারী নির্যাতনের কেসে যেই লোক আটক হয়েছে, সে কোনো বিধানপ্রণেতা বা শিল্পপতি নয়। লোকটির অপরাধ প্রমাণিত হলে আমরা তার যথাযোগ্য শাস্তি নিশ্চিত করতে কাজ করব। 

সো, কনসানট্রেট অন দিস নিউ কেস অ্যান্ড ফরগেট দ্য প্রিভিয়াস ওয়ান। আশা করি, আমার কথা বুঝতে পেরেছ। 

আবরারের মুখের কোণে এক চিলতে পরিহাসের হাসি সিআইডি প্রধান দেখতে পেলেন না। কেবল বুঝতে পেরেছি শব্দ দুটো শুনেই পরিতৃপ্তির হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠল তার মুখে। 

বাসায় ফিরে নিজের কম্পিউটার অন করে দীর্ঘ সময় বসে রইল আবার। গ্রিক মিথোলজি নিয়ে দীর্ঘ সময়ের কথোপকথনের পর থেকে কেন যেন মনে হচ্ছিল যে এমপির কেসটার সাথে গ্রিক মিথোলজির কোথায় যেন একটা বড় ধরনের মিল আছে। কী মিল, সেটা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না আবরার। 

.

মামা, হোয়াট ইজ অ্যাট্রিয়াম অফ হার্ট? গুগল করেছিলাম, কিন্তু বুঝতে পারছি না। কাল সায়েন্স মিসের একটা অ্যাসাইনমেন্ট আছে।

রাতুলের ডাকে সংবিৎ ফিরে পেল আবরার। আদরের ভাগ্নের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল সযতে, 

আমার আইপ্যাডটা ও ঘর থেকে একটু নিয়ে আয়। ফিগার এঁকে তোকে বুঝিয়ে দিচ্ছি। 

রাতুল বেরিয়ে যেতেই হাজার ওয়াটের আলো আবরারের মস্তিষ্কের সব কটি কোষকে আলোকিত করে ফেলল। অ্যাট্রিউস। অ্যাট্রিয়াম শব্দটা থেকে মনে পড়ে গেল-অ্যাট্রিউস। গ্রিক মিথোলজির এক রাজার চরিত্র। 

এই নামটাই এতক্ষণ ধরে অশান্ত করে রেখেছিল আবরারকে। রাতুলকে পরে পড়া বুঝিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিলো। একমনে নিজের ব্লগে লিখে চলল আবরার, 

অ্যাট্রিউস মাইসিনিয়ার রাজা হবার পড় অগাধ ক্ষমতার মালিক হলেন। তার আপন ভাই থেয়েস্টাস নিজের ভাইয়ের এত ক্ষমতা মেনে নিতে পারলেন না। ভাইয়ের স্ত্রী এইরোপের সাথে শুরু করলেন পরকীয়া। 

এইরোপ স্বামীর রাজ্য সম্পর্কিত গোপন তথ্য সরবরাহ করতেন থেয়েস্টাসকে। সবকিছু জানতে পেরে অ্যাট্রিউস নিজের স্ত্রীকে হাত-পা বেঁধে সাগরে ফেলে দেন, আর থেয়েস্টাসের ছেলের মাংস এক ভোজসভায় থেয়োসকে খাওয়ান। এমপির কেসের ক্ষেত্রেও ঠিক একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। স্বামীর ক্ষমতা, স্ত্রীর পরকীয়া, হিউম্যান ক্যানিবালিজম, মৃত্যু। 

অদ্ভুত তো! দারুণ রহস্যজনক। এত বড় কোইন্সিডেন্ট?

আবার জানত না, সামান্য এই কয়েক লাইন লেখার মুহূর্মুহূ বিজলিবিলাস তার জীবনের জলবায়ুতে কত প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় নিয়ে আসছে। 

৩.দুঃস্বপ্নের সূচনালগ্ন 

মহাখালীতে সিআইডি কেমিক্যাল ল্যাব থেকে ল্যাব রিপোর্ট সংগ্রহ করে বাসায় ফিরছে আবরার। কাল সকাল থেকে কাজের বিশাল চাপে চিড়েচ্যাপটা হয়ে যেতে হবে। 

সকাল আটটায় ন্যাশনাল মেন্টাল হেলথ ইনস্টিটিউটে সাইকোথেরাপির একটা সেশন আছে, দুপুর বারোটায় ন্যাশনাল টেলিভিশনে একটা টক শোতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকতে হবে।

দেড়টার দিকে সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজে লেকচার ক্লাস নিতে হবে, চারটার মাঝে ল্যাব রিপোর্ট জমা দিতে মালিবাগে সিআইডির অফিসে যেতে হবে। 

আজকের দিনটাও কোনো অংশে কম কর্মক্লিষ্ট ছিল না! ড্রাইভারকে রবীন্দ্রসংগীতের ভলিউমটা একটু বাড়িয়ে দিতে বলে ব্যাকসিটে গা এলিয়ে দিল আবরার। 

কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে তোমারে দেখিতে দেয় না- ফাল্গুনের সুরভিত দিন কি তপ্ত দুপুর, বিষণ্ণ ভারাক্রান্ত মন কি ক্লান্ত একাকী প্রহর, এই গানটা শুনলেই আবরারের সব ক্লান্তি এক লহমায় দূরে হারিয়ে যায়। 

কিছুটা তন্দ্রামতো এসে গিয়েছিল প্রিয় গানের সম্মোহনী ক্ষমতায়, হঠাৎ তীক্ষ্ণ ক্লোরোফর্মের গন্ধে সংবিৎ ফিরে পেল আবরার। নাহ, ঠিক ক্লোরোফর্ম নয়, গন্ধটা আরেকটু বেশি চাপা, তবে মিষ্টি। বিষাক্ত উপাদান নিয়ে যার নিত্যদিনের কাজ, গ্যাসের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সময় লাগবেই বা কেন!

আবরার বেশ বুঝতে পারল হ্যালোথেন গ্যাস স্প্রে করা হয়েছে গাড়ির ভেতর। অচেতনকারক গ্যাসটির উৎস খুঁজতে খুঁজতে গভীর ঘুমে জড়িয়ে যেতে লাগলো আবরারের চোখ। 

চেতন এবং অবচেতনের মাঝামাঝি সময় আবরার দেখতে পেল ড্রাইভারের আসনে থাকা অবয়বটা পেছনে ফিরে ত্রুর ভঙ্গিতে হাসছে। 

অবয়বটি আর যারই হোক, দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত ড্রাইভার সালাম চাচার নয়। পেছন থেকে আকৃতিগত দিক থেকে সামঞ্জস্য থাকায় ড্রাইভারের আসনে আসীন অনুপ্রবেশকারীকে আগে চিনতে পারেনি সে। 

জ্ঞান ফেরার পর চোখ খুলে ধড়মড় করে উঠে বসল আবরার, ধাতস্থ হতে সময় নিলো কয়েক মুহূর্তে। বিশাল এক সফেদ বিছানায় শুয়ে ছিল এতক্ষণ। 

চারপাশে চোখ বুলিয়ে চকিত ভয়ে হৃদকলোনির চাঁদটা মেঘের আড়াল থেকে প্রকাশ্যে এলো। এ কোথায় এসে হাজির হয়েছে সে? যেদিকে চোখ যায় শুধু শ্বেতশুভ্র দিগন্ত। 

এত বিশাল হলঘর আগে কখনো কোথাও দেখেছে বলে মনে পড়ে না। সাদা বিছানা থেকে নেমে ধীর পায়ে সামনের দিকে এগোল আবরার। 

হলিউডের নির্মাতাদের মতো নিপুণ যত্নে তৈরি করা চলচ্চিত্রের সেট মনে হচ্ছে পুরো জায়গাটাকে। দেয়ালের পাশে সারি সারি ম্যানিকুইন পুতুলের মতো কারা যেন দাঁড়িয়ে আছে, ঘরের মাঝ থেকে ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না। 

ত্রস্ত ভঙ্গিতে নিজের প্যান্টের পকেট হাতড়ে দেখল, নিজের হাত দুটো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। হাতের ঘড়ি, পকেটের মোবাইল-সবকিছু সরিয়ে ফেলা হয়েছে। 

হলঘরের প্রান্তে এসে বিস্ময়ের আতিশয্যে বিহ্বল হয়ে গেল মুহূর্তের জন্য। ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে যেন এক অভিনব সিনেমার সেট তৈরি করা হয়েছে। ম্যানিকুইন পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকা সশস্ত্র প্রহরী বলে যাদের মনে করছিল, কাছে এগিয়ে এসে তাদের দেখে আবার দু-পা পিছিয়ে গেল আতঙ্কে। 

যেন কোনো চশমা ব্যবহারের উপযোগিতা না রেখেই স্টেরিওস্কোপিক ইমেজের মাধ্যমে গল্পের মূল চরিত্রকে যত্ন নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। 

পরস্পর নির্দিষ্ট ব্যবধানে দাঁড়িয়ে আছে গ্রিক মিথোলজির প্রধান চরিত্ররা-সবার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে জিউস। কী ভীষণ জীবন্ত! নিজের চোখে না দেখলে আবরার কখনোই বিশ্বাস করত না। পাথরে খোদাই করা মূর্তি হলে হয়তো এতটা জীবন্ত লাগত না, অপহরণকারীদের কাছে হাইটেক প্রযুক্তি আছে সন্দেহ নেই। 

এক বেদির উপর দাঁড়িয়ে আছেন জিউস, এক জ্যোতির বলয়ে ঘেরা তার চারপাশ। এই সেট নির্মাণকারীদের আলোকসজ্জার উপর প্রভূত জ্ঞানের প্রশংসাই করতে হলো। 

জিউসের পরনে সোনালি টোগা (একধরনের গ্রেকো-রোমান পোশাক), সুগভীর দুটো চোখের সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে গেছে ঘন আখিপল্লব। দীর্ঘ শত্রু গুফ মণ্ডিত, পেশিবহুল দীর্ঘকায় জিউস দণ্ডায়মান অবস্থায় দ্রুত অগ্রসরমাণ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে ধরে আছেন বজ্র-বিদ্যুতের আলোকবর্তিকা। এটা জিউসের স্বাতন্ত্র্যসূচক চিহ্ন। 

অব্যবহিত পরেই দাঁড়িয়ে আছেন অলিম্পিয়ানদের রানি হেরা। মাথায় কয়েক স্তরের প্রাচীন মুকুট। কয়েক মিটার ব্যবধানে প্রেমের দেবী আফ্রোদিতি, রূপের দ্যুতি যেন ঠিকরে পড়ছে। পায়ের কাছে এক পুরুষের অণ্ডকোষ আর সেই অণ্ডকোষ আবৃত হয়ে আছে ফেনাপুঞ্জে। 

মিথোলজি মতে, মা গায়া অর্থাৎ পৃথিবীর অনুরোধে টাইটান ক্রনাস তার পিতা ইউরেনাসকে নপুংসক করে দিলে ইউরেনাসের অণ্ডকোষ সিথেরার সমুদ্রে পতিত হয়। তরঙ্গে উদ্বেলিত হয় সমুদ্রের উচ্ছ্বসিত ফেনাপুঞ্জ, সেই ফেনাপুঞ্জের মাঝে আবির্ভূত হয় বর্ণশোভিত এক ঝিনুক। আর সেই ঝিনুক থেকেই জন্ম হয় স্কুটযৌবনা আফ্রোদিতির। 

পুরো অবয়ব এত জীবন্ত যে আবরারের ইচ্ছে হলো ছুঁয়ে দেখে আলগোছে। এরপর আফ্রোদিতির স্বামী কামার দেবতা হেফাস্টাস, বিখ্যাত সুর-সংগীত, চিকিৎসাবিজ্ঞানের দেবতা অ্যাপোলো-সবাই নির্দিষ্ট ব্যবধানে বৃত্তাকার পথে দাঁড়িয়ে আছেন। 

গ্রিক পুরাণের আবেগ স্পন্দিত বাসনা আর সম্মোহনের জগতের এক টুকরো অংশকে কোন শিল্পীর নিপুণ দক্ষতায় আলো-আঁধারির খেলার মাঝে নাম না-জানা কোনো এক রহস্যের আধারে স্থান দেওয়া হয়েছে। 

সবার শেষে যে অবয়বটি হলঘরের প্রান্তকে ঘিরে রাখা দেব-দেবীর চক্রাকার অবস্থানকে পূর্ণতা দিয়েছেন, তিনি হলেন মেডুসা। মেডুসার কিলবিলে সাপবিশিষ্ট মাথাসহ এক মানবীয় অবয়ব দেখতে পেল আবরার। মুখটা নিদারুণ তীক্ষ্ণ, তবে খুব বেশি ভয়ংকর মনে হচ্ছে না। 

আধুনিক যুগের যন্ত্রসভ্যতা আর উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে এই আদিগন্ত বিস্তৃত ঘরে গ্রিক মিথোলজিকে যেন পুনর্জন্ম দেওয়া হয়েছে। 

৪. HellMyth Game – পুঁজিবাদ বনাম মানবতাবাদ 

আবরার হলঘরের প্রান্তসীমা থেকে সন্ত্রস্ত পায়ে হেঁটে হেঁটে অপর প্রান্তে গেল। বন্দি হয়ে এই বিশাল ঘরে আসার পর থেকে সময়ের ঠিকঠাক হিসাব মেলাতে পারছে না। অনন্তকাল আর কয়েক মুহূর্ত-দুটো যেন স্থির ক্ষেত্র আর চৌম্বক বলয়ে থাকা পরস্পর পরিবর্তনশীল ধ্রুবক।

হ্যালোথেনের প্রভাবটাও তেড়েফুঁড়ে উঠছে শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ক্লিষ্ট শরীরটা কোনোমতে এগিয়ে নিয়ে দেওয়ালের অপর প্রান্তে বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগের কোনো উপায় খুঁজতে লাগল আবরার। 

দুর্বল দেহে অবশিষ্ট মনোযোগের পুরোটুকু কেন্দ্রীভূত করল। বিশেষ ধরনের এই হলোগ্রাফিক স্ক্রিনের সাথে পরিচিত সে। SA*3D হলোগ্রাফিক স্ক্রিনগুলো জার্মান কোম্পানির সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রযুক্তির মাঝে একটি। 

ইলেক্টোরালাল লাইট টেকনোলজি ব্যবহার করে তৈরি স্ক্রিনটি হলোগ্রামে পরিণত হয়ে প্রোজেক্টরে স্থিরচিত্র প্রতিফলিত করে, ইন্টারনেটে দেখেছে সে। হঠাই ঘড়ঘড় শব্দে চমকে পেছনে ফিরে তাকাল। 

সাদা রঙের মসৃণ দেয়াল মুহূর্তে দুই ভাগ হয়ে গেল। স্বয়ংক্রিয়ভাবে অন্ধকারাচ্ছন্ন গহ্বর থেকে ভেতরে ঢুকল আপাদমস্তক আলখেল্লা পরিহিত এক ব্যক্তি। মাথায় পরিব্রাজকদের ব্যবহার্য টুপি, টুপির দুপাশ থেকে বের হয়ে আসা দুটি ডানা কানের চারপাশসহ পুরো মাথাকে বেষ্টন করে আছে। 

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একনজরে দেখেই বুঝতে পারল আবরার, আগত লোকটি গ্রিক দেবতা হার্মিসের মতো পোশাক পরেছে।

সম্ভবত খুব বিত্তশালী কোনো সংগঠনের উদ্ভট খেয়ালে গ্রিক মিথোলজি নিয়ে কোনো গেমিং সফটওয়্যার তৈরি করা হয়েছে, আর খেলোয়াড় হিসেবে আবরারকে নির্বাচন করা হয়েছে। মাত্র ভেতরে ঢোকা লোকটি অলিম্পিয়ান দেবতা হার্মিসের প্রতিনিধিত্বকারী। দেবতাদের বার্তাবাহক হিসেবে আবরারের কাছে গেমসের নিয়মকানুন জানাতে এসেছে-দূরদৃষ্টি কাজে লাগিয়ে এই অনুকল্পটুকু তৈরি করে ফেলল আবরার। 

হাঁটতে হাঁটতে আবরারের খুব কাছে এগিয়ে এলো মূর্তিটি, কাছ থেকে মূর্তিটির মুখ দেখার চেষ্টা করতেই ব্যর্থ মনোরথে আবিষ্কার করল, সাদা রঙের মুখোশ দিয়ে পুরো মুখটা আবৃত করে রেখেছে হার্মিসরূপী লোকটি। 

শ্বেতশুভ্র মুখোশের উপর সূক্ষ্ম সূচিকর্ম দ্বারা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দেবতা হার্মিসের চিহ্ন-ক্যাডুসিয়াসকে। গোলাকার মাথাবিশিষ্ট লম্বা একটি দণ্ডের দুপাশে স্ফীতকায় দুটো ডানা, আর দণ্ডটিকে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে থাকা দুটো সাপ ভীষণ জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে পুরো মুখোশজুড়ে। 

চিকিৎসাবিজ্ঞানের কর্মী হওয়ায় ক্যাডুসিয়াস সম্পর্কে আবরার অনবগত নয়। গ্রিক মিথোলজির খুঁটিনাটি সম্পর্কে ছোটবেলা থেকে নিজের উদ্যোগে বহু পড়াশোনা করায় গ্রিক মিথোলজির বহু ভুল প্রয়োগ সম্পর্কেও লেখালিখি করেছে সময়ে অসময়ে বিভিন্ন ব্লগে। 

যেমন ধরা যাক, ক্যাডুসিয়াস আর অ্যাসক্লেপিয়াসের কথাই। ১৮৫০ সালে ইউএস আর্মি পরিচালিত হাসপাতালের কর্মীদের জন্য তৈরি করা পোশাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের সত্যিকারের চিহ্ন রড অব অ্যাসক্লেপিয়াসের জায়গায় কর্তৃপক্ষের ভুলের কারণে ক্যাডুসিয়াসের চিহ্ন যুক্ত করা হয়। 

পরে এই ভুল মানুষের চোখে ধরা পড়লেও মার্কিন পুঁজিবাদের গোঁয়ার্তুমির কারণে ভুল প্রয়োগই পুরো বিশ্বে প্রচলিত হয়ে যায়। মূলত ক্যাডুসিয়াস চিহ্নের স্থলে জায়গা পাবার কথা ছিল রড অব অ্যাসক্লেপিয়াসের। 

অ্যাসক্লেপিয়াস ছিলেন অ্যাপোলোর পুত্র। নিজে যখন তখন মর্তের নারীদের সাথে রামলীলায় মেতে উঠলেও ব্যভিচারের অপরাধে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে আগুনে নিক্ষেপ করেন অ্যাপোলো। পরে গর্ভের সন্তানকে বাঁচাতে আগুনে পুড়তে থাকা স্ত্রীর পেট কেটে নিজের সন্তানকে বের করেন।

মিথ হলেও চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এটাকে ধরা হয় পৃথিবীর প্রথম সিজারিয়ান অপারেশন। এ ঘটনার কারণেই নবজাতকের নাম রাখা হয়। অ্যাসক্লেপিয়াস, যার অর্থ কেটে বের করা হয়েছে এমন কিছু। 

এই অ্যাসক্লেপিয়াস বয়স বাড়ার সাথে সাথে ক্রমে ক্রমে চিকিৎসাবিজ্ঞানে কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন। অ্যাসক্লেপিয়াসের চিহ্ন ছিল একটা লাঠিকে পেঁচিয়ে ধরে রাখা সাপ। 

হঠাত্র প্রচণ্ড শব্দে অতীতের ব্লগিংবিষয়ক স্মৃতি রোমন্থনের জগৎ থেকে আপাত উদ্ভূত এই বিড়ম্বনার জগতে ফিরে এলো আবরার। মুখোশ পরিহিত আগন্তুক হাতে থাকা ছোট একটি রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে প্রোজেক্টর চালু করে দিয়েছে। 

স্ক্রিনজুড়ে দেখা গেল একটি লোগো, সাথে বিজাতীয় ভাষায় আধিভৌতিক এক সংগীত বেজে উঠল। গানের মাঝে এমন একটা অস্বাভাবিকতা ছিল যে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল আবরারের। সম্ভবত গ্রিক ভাষায় কোনো সংগীত হবে। 

হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে দেখানো গোলাকার লোগোর ঠিক মাঝখানে শ্মশ্রুমণ্ডিত জিউসের মুখ আর তার নিচে বৃত্তাকার অংশের পরিধির সাথে সংযুক্ত হয়ে আছে রড অব অ্যাসক্লেপিয়াস। পুরো বৃত্তটি সোনালি রঙের। বৃত্তাকার লোগোস্থ জিউসের মুখের ঠিক উপরে সমান্তরালে ইংরেজি অক্ষরে লেখা HellMyth Game। আবরারের ক্ষুরধার মস্তিষ্ক গেমের নাম দেখে সন্ধিবিচ্ছেদ করতে সময় নিলো না বেশিক্ষণ। 

গ্রিক সভ্যতার অপর নাম হেলেনিক সভ্যতা। এই হেলেনিকের ইংরেজি প্রতিশব্দ Hellenic থেকে Hell আর উপকথার ইংরেজি Mythology থেকে Myth অংশ গ্রহণ করে গেমের নামকরণ করা হয়েছে। কিন্তু কী গেম! কেনই বা এখানে এভাবে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে আবরারকে। এরা কারা!

ওয়েলকাম টু হেলমিথ গেম, মিস্টার আবরার ফাহাদ, আওয়ার বিলাভেড প্লেয়ার! 

কী ভয়ংকর শীতল স্বর! এত শীতল কণ্ঠস্বর আগে কখনো শোনেনি আবরার, মানুষের কণ্ঠের গভীরতা এত বেশি হবার কথা নয়। 

সম্ভবত নিজের আসল কণ্ঠ গোপন রাখতে লোকটা কোনো ডিভাইস ব্যবহার করেছে-ভাবতে ভাবতে আবরার কালো আলখেল্লার মাঝে আটকে রাখা ছোট ভয়েস চেঞ্জিং মডিউলটা দেখতে পেল। 

পোশাক আর মডিউল-দুটোই কালো রঙের হওয়ায় মডিউলটা আলাদা করে চোখে পড়াটা দুষ্কর। ছোট একটা দম নিয়ে আবার বেশ স্পষ্ট কণ্ঠে বলে উঠল,

আপনারা আমার মতো একজন আইনের লোক এবং চিকিত্সককে বেআইনিভাবে অপহরণ করেছেন, আবার বিলাভেড বলে সম্বোধন করছেন। খুব সস্তা রসিকতা হয়ে যাচ্ছে না এটা?

কাষ্ঠহাসি হেসে উঠল মুখোশের আড়ালের মানুষটা। ভয়েস প্রোগ্রামিং সফটওয়্যার সম্ভবত হ্যালোইন প্রোগ্রাম সেট করে রেখেছে। সেই কাষ্ঠহাসির শব্দ শুনে আবরারের মতো দুঃসাহসী ছেলেরও বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। 

আমরা আইনের অনেক অনেক ঊর্ধ্বের মানুষ। আমরা সাদাকে কালো, কালোকে সাদা; দিনকে রাত আর রাতকে দিন করার ক্ষমতা রাখি। 

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের শিল্পপতি হয়েই এত ক্ষমতার দাপট! শুনে মনে হচ্ছে আপনারা পৃথিবীর সেরা ধনী অ্যামাজনের কর্ণধার জেফ বেজোসের লোক। 

হাসালে ইয়াং ম্যান। অর্থের জোরে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন আমাদের বাম হাতের খেল। আর তুমি কিনা ভাবছ ছোট একটা দেশের সামান্য কয়েকটা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির মালিক হয়েই আমরা ক্ষমতার দাপট দেখাব? 

কারা আপনারা? আমি আপনার একটা কথাও বিশ্বাস করি না। সম্ভবত আমার সাথে পূর্ববর্তী কোনো শত্রুতার জের ধরে আমাকে কোনো ফিল্ম সিটিতে ধরে নিয়ে এসেছেন আর তখন থেকে ব্লাফ করে চলেছেন! আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মতো ক্ষমতাশীল, আন্তর্জাতিক কোনো সংগঠনের নোক দাবি করছেন নিজেকে, আর কথা বলছেন বাঙালিদের মতো! 

নিজের আলখেল্লার ভেতর থেকে M1991A1 মডেলের Colt রিভলভার বের করে আবরারের দিকে তাক করল মুখোশমানব। নিজের হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে বিস্ময়ের আতিশয্যকে জানান দেওয়া রোধ করল আবরার। 

লোকটার হাতে যে মডেলের রিভলভার আছে, সেটা আবরার চেনে। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি মডেলের রিভলভারগুলোর মাঝে একটি এটি। লাইসেন্সসহ এমন একটা রিভলভার নিজের কাছে রাখতে হলে যে পরিমাণ ক্ষমতা, অর্থ এবং প্রভাব থাকার প্রয়োজন, তা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ধনকুবেরেরও নেই। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই মডেলের পূর্বসূরি M1911 ব্যবহার করা হয়েছিল। 

আমি আমাদের বসের বাংলাদেশি প্রতিনিধি হিসেবে তোমার সাথে কথা বলছি। আমাদের ক্ষমতার প্রমাণ এখন থেকে প্রত্যেকটা মুহূর্তে তুমি পেতে থাকবে, এরপর থেকে আমার কথা আর ব্লাফিং মনে হবে না। 

স্থির দৃষ্টিতে মুখোশমানবের দিকে তাকিয়ে রইল আবরার, মুখোশের আড়ালে থাকা মুখের সাথে কথা বলা ভীষণ অস্বস্তিকর একটা ব্যাপার। 

মানুষের সাথে মানুষের সংযোগের প্রধান মাধ্যম মুখের ভাষা হলেও আবরার চোখের দিকে না তাকিয়ে কারো সাথে কথা বলে কখনোই স্বস্তি পায় না। মুখোশমানব মডিউলেটরের মাধ্যমে ভাবলেশহীন, ভয়ানক যান্ত্রিক কণ্ঠে বলে চলেছে, এই গেমটা একটু ভিন্ন ধরনের। তুমি সারভাইভাল গেমের কথা শুনে থাকবে। কিন্তু আমাদের গেমের থিম হলো লাইফ সেভিং। দিস ইজ আ প্রটেকিং গেম (Protecting Game)। 

বিস্ময়ের আতিশয্যে কথা জড়িয়ে গেল আবরারের, 

প্রটেক্টিং গেম! এটা আবার কেমন ধরনের গেম? আর আমি যদি গেম না খেলতে চাই, তাহলে আপনারা আমাকে কীভাবে জোর করবেন? অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে? 

উঁহু মিস্টার। তুমি ভুল করছ। এটা একটা লাইফ সেভিং গেম। গেমের প্রত্যেকটা লেভেলে তুমি একটা করে প্রাণ বাঁচানোর সুযোগ পাবে। 

প্রত্যেকটা লেভেলে থাকবে ভিন্ন ভিন্ন জীবনের ঘটনা। কোনো কল্পকাহিনি নয়। হানাহানি, দ্বন্দ্ব, জিঘাংসায় লিপ্ত মানুষগুলো একে অন্যকে শেষ করে দিতে চাইবে। কখনো টাকার জন্য, কখনো নারী লোভের জন্য, কখনো বিনা কারণে। 

পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সুযোগ, স্বাধীনতার সুযোগ থাকলেও তারা পরাধীন হয়ে, একে অন্যের জীবন কেড়ে নিয়ে বেঁচে থাকার মাঝে আনন্দের রসদ খুঁজে নেবে। আর গেমের প্রত্যেক লেভেলে তুমি সুযোগ পাবে সেই মানুষগুলোকে বাঁচানোর। 

তার মানে আপনারা নিজেদের নিছক বিনোদনের জন্য এত এত মানুষের জীবন ঝুঁকিতে ফেলবেন? আপনারা নিশ্চয়ই কোনো বড় মাফিয়া দলের কর্মী? 

ইউ আর মেকিং আ বিগ মিস্টেক ডিয়ার। আমি একবারও বলিনি আমরা ঝুঁকিতে ফেলব। প্রতিটি ঘটনা ঘটবে তার নিজস্ব নিয়মে। নিজস্ব জ্বালানির রসদেই জ্বলবে জিঘাংসার আগ্নেয়গিরি। আমরা শুধু অনুঘটক হিসেবে জ্বালানির জন্য কাঠের জোগান দেব। হয়তো আগুনটাকে বাড়িয়ে দেব। 

ধরো, তোমার দেশের কোনো এক প্রান্তে ক্ষোভে জ্বলতে থাকা কোনো প্রেমিক তার প্রেমিকাকে হত্যার পরিকল্পনা করছে, পরিকল্পনাটি হয়তো বাস্তবিক নয়। হয়তো কাঁচা হাতে লেখা ক্রাইম ফিকশনের মতো প্লট হোলে ভরা। 

আমরা সেই পরিকল্পনাকে পূর্ণতা দেব। আমরা নিজেদের লোক পাঠিয়ে পুরো হত্যাপ্রক্রিয়াটি যাতে নিচ্ছিদ্র হয়ে ওঠে, তার জন্য যাবতীয় উপকরণ সরবরাহ করব। পরিকল্পনাকারীকে যথাসম্ভব আইনি নিশ্চয়তা দেব। 

বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল আবরার, বিস্ফারিত অথচ আহত দৃষ্টি।

এটাও তো একধরনের পরোক্ষ হত্যা। 

হতে পারে! কিন্তু আমরা প্রচলিত তত্ত্বে বিশ্বাসী নই। মানুষ নিজের জিনের ভেতরেই প্রচণ্ড স্বার্থপরতা ধারণ করে চলে। সৃষ্টির আদিকাল থেকে 

আজ পর্যন্ত এ সত্য বারবার প্রমাণিত। 

সভ্যতার চরম উৎকর্ষের জন্য মানুষের স্বার্থপরতা, সাফল্যের চূড়ায় ওঠার লোভ বরাবর মানুষের পরার্থপরতার থেকে যোজন যোজন ব্যবধানে এগিয়ে আছে দেখেই আজকের পৃথিবীটা এত সমৃদ্ধ। 

এত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, এত বড় বড় ইমারত, এত উচ্চমার্গীয় শিল্প সাহিত্য, সংস্কৃতি-এই চরম উৎকর্ষের পেছনে কিন্তু প্রচণ্ড স্বার্থপর মানুষগুলোর অবদানই সবচেয়ে বেশি। এই স্বার্থপর মানুষগুলোই কিন্তু পুঁজিবাদের ভিত্তি। 

কিন্তু একচেটিয়াভাবে বিজয়ের স্বাদ নিতে নিতে আমরা বুর্জোয়ারা পরিশ্রান্ত। আমাদেরও তো মাঝে মাঝে শক্ত প্রতিপক্ষের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সাধ জাগতে পারে, নয় কি? 

দিনরাত পায়ের কাছে পড়ে থাকা চাটুকারের দল, আরাধ্য ভোগ্যপণ্যের সহজলভ্যতা আমাদের কাছে একটা পর্যায়ে বিবমিষা উদ্রেকর মনে হয়। গ্ল্যামার জগতের সবচেয়ে সুন্দরী নায়িকার সঙ্গও পানসে লাগে। আমরা তোমাকে এই গেমে খেলোয়াড় হিসেবে চাই। কারণ তুমিই তোমার দেশের প্রথম ব্যক্তি, যে একটা সাড়াজাগানো হত্যাকাণ্ডের সাথে গ্রিক মিথোলজির অন্যতম মানবচরিত্র অ্যাট্রিউস আর থেয়েস্টাসের মিল খুঁজে পেয়েছ। 

হৃদযন্ত্রটা নিজের নিয়মে ধকধক করতে গিয়ে মুহূর্তের জন্য থেমে গেল, আবরার মাত্র যা শুনল, তা যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। 

তার মানে সেদিন রাতের ব্লগের লেখাগুলোর ভিত্তিতেই খেলোয়াড় হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে তাকে। মুখোশমানব তার কৃত্রিম মহাশঙ্খ বজ্রনিনাদ কণ্ঠের গাম্ভীর্য বাড়িয়ে বলে চলেছে, 

এই HellMyth গেমের প্রবর্তক পৃথিবীর অন্যতম ধনকুবেরদের একজন। গ্রিক মিথোলজি তার ভীষণ পছন্দের। তার ধারণা অনুসারে, গ্রিক সভ্যতা সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা না হলেও ইউরোপের নবজাগরণের জোয়ার আর শিল্পবিপ্লবকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে গ্রিক মিথোলজি। 

গ্রিক মিথোলজি পুঁজিবাদেরই ধারক। গ্রিক চরিত্রগুলো সবচেয়ে বেশি মানবীয়। পৃথিবী, চন্দ্র-সূর্য, সাগর-পাহাড়ের নিজস্ব দেব-দেবী আছে-এই কনসেপ্টকে বাদ দিলে আমাদের মতো অগাধ ক্ষমতাশালীদের সাথে সবচেয়ে বেশি মিল খুঁজে পাওয়া যায় গ্রিক মিথের দেব-দেবীর। 

নিজেদের আকর্ণ ভোগবিলাসে নিমজ্জিত রেখে জিউস, পসাইডন, অ্যাপোলো, আফ্রোদিতি, হেরারা মানুষের জন্য সীমিত ভোগ্যপণ্য, সুযোগ সুবিধা বরাদ্দ রাখে! 

মানুষের জন্য দ্বন্দ্বের দেবী, ভাগ্যের দেবী-সবার কার্যসীমা নিশ্চিত করে দেয়, যেমনিভাবে আমাদের হাতে সাধারণ মানুষের নিয়তি, জীবন-মৃত্যু, সচ্ছলতা নির্ভর করে।

আমরা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করি না, কারণ আমাদের কাছে অর্থই ঈশ্বর যদিওবা কেউ বিশ্বাস করেও, তার অনেকটাই লৌকিকতা-বিধায়ক। নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করতে, সাধারণ মানুষের কাছাকাছি যেতে ঐ লোকদেখানো আস্তরিকতা প্রয়োজন বিশেষ ক্ষেত্রে, অন্তর থেকে নয়। সীমিত ভোগ্যপণ্যের জন্য মানবপ্রজাতি নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, মারামারিতে স্বজাতিদেরই শেষ করে দেয় অবলীলায়, যেমনটা আমরা চাই। জিউস, অ্যাপোলোর ধর্ষণ, আফ্রোদিতির পরকীয়া, আর কামাসক্ততা, এরিসের শঠতা, হেরার জিঘাংসা–কোনো কিছুরই বিচার হয় না। 

তেমনিভাবে আমাদের মতো বিত্তশালী বুর্জোয়াদের অগাধ ক্ষমতার জন্য আমরা হতে পারি ইচ্ছেমতো নারীলিঙ্গু, যেকোনো নারীকে করতে পারি শয্যাসঙ্গী; নারীটিকে কোনোভাবে রাজি করাতে না পারলে করি ধর্ষণ। আমরা যে কাউকে গোলাম বানিয়ে রাখতে পারি, কিংবা পৃথিবী থেকে নাম নিশানা মুছেও দিতে পারি, ঠিক মৃত্যুর দেবতা হেডিসের মতো। 

আমাদের কারো কাছেই জবাবদিহি করতে হয় না। পৃথিবীর যত আইন, যত নিয়মকানুন শৃঙ্খল-সব কেবল সাধারণ মানুষের। এই সাধারণ শ্রেণির আছে সীমিত সম্পদ, সীমিত ভোগ্যপণ্য।

এরা কাউকে ধর্ষণ করলে বিচারের কাঠগড়ায় এসে দাঁড়াতে হয়। এরা কাউকে হত্যা করলে ফাঁসিকাষ্ঠে এসে ঝুলতে হয়। 

তবু স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এরাও অরাধ করে। কখনো টাকার অভাবে করে চুরি, কখনো খাবারের অভাবে না খেতে পেয়ে মারা যায়। কখনোবা নিজের ভালোবাসার মানুষকে টাকার অভাবে নিজের করে নিতে পারে না। চোখের সামনে অন্য কারো হতে দেখে ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে প্রেয়সীকে খুন করে। 

আমরা উৎপন্ন শস্য নিজেদের স্বার্থে পুঞ্জীভূত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করি। আমাদেরই কারণে পৃথিবীতে আসে মহামারি, বাজে যুদ্ধের দামামা। 

যুদ্ধের সময়ে আমরা কিন্তু নিরাপদে, বিনা ক্লেশে লোকদেখানো কারাগারে বন্দি থাকি, নামে কারাগার হলেও যেখানে থাকে আধুনিক জীবনের সব রকম সুযোগ-সুবিধা।

আমরাই নেতৃত্বের ধোঁয়াশা তুলে সৈনিকদের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানাই, আবার আমরাই হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ফেলি। 

তবে সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের চরম সীমায় আমাদের জীবন দারুণ নিরানন্দ। তখন আমরা বিকৃত উপায়ে আনন্দ খুঁজতে চেষ্টা করি। 

জীবনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকলে কোনোভাবেই অবসন্নতা দূর করা সম্ভব নয়। তাই আমরা তোমাদের মতো বীরদের খুঁজে বেড়াই। 

পুঁজিবাদের অবকাঠামোর ভেতর থেকে ক্ষণে ক্ষণে এমন কিছু মানুষ জন্মায়, যারা জাগতিক যেকোনো লালসা, ভোগবিলাসকে দুপায়ে মাড়িয়ে চলে যায়। যারা আমাদের নীতিবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সাধারণ মানুষদের কাছে তারা বীর। 

গ্রিক মিথোলজির নিরিখে বিচার করলে তোমাদের ডেমিগড বলা যেতে পারে। দেবতাদের অমরত্ব রূপকার্থে ক্ষমতাশালীদের বিলাসব্যসন। সেই ভোগবিলাসে ডুবে যাবার সুযোগ থাকতেও তোমরা স্রোতের বিপ্রতীপে সাঁতার কাটো। তোমার জীবনযাপন পদ্ধতি, জীবনদর্শন, সাম্যের নীতি পর্যালোচনা করে আমাদের গেমিং প্যানেলের তাই ধারণা। 

নিদিধ্যাসনের নিবিষ্ট সমাবেশে আবরার সামনে দাঁড়ানো মুখোশমানবের প্রত্যেকটা শব্দ শুনে চলেছে। বক্তার সামান্য বাক্যবিরতির সুযোগটুকু লুফে নিয়ে বলে উঠল, 

বিশিষ্ট ধনকুবের, গেমের ফাউন্ডার, আপনার বসের নাম জানতে পারি? নাম না জানালেও তিনি কোন দেশের অধিবাসী, এতটুকু নিশ্চয়ই জানতে পারি? 

সময় হলে সব জানতে পারবে। আফটার অল অনেক সাধনার পর তোমাকে খুঁজে পেয়েছি। আমাদের বস তার অবসর সময়ে অদ্ভুত অদ্ভুত শৌখিন কাজ করেন। গ্রিক মিথোলজির চর্চার পাশাপাশি আরেকটা কাজ হলো বিভিন্ন দেশের ভাষা শেখা।

ভাষা শেখার পর্বে আপাতত বিরতি দিয়ে তিনি পৃথিবীর অতিদরিদ্র, স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে প্রতিদিন ঘটে যাওয়া যেই অপরাধগুলো পুলিশ প্রশাসনের অধিদপ্তরে লিপিবদ্ধ হয়, সেই অপরাধগুলোর সাথে গ্রিক মিথোলজির সামঞ্জস্য খুঁজে চলেছেন। আমরা তাঁর হয়েই কাজ করছি। 

দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকার অনেক দেশে দৈনিক সংঘটিত অপরাধগুলোর মাঝে আমাদের অধিভুক্ত অপরাধবিজ্ঞানীরা এ রকমই বেশ কিছু অপরাধ তালিকাভুক্ত করে ফেলেছে। বলতে পারো, আমাদের বসের অবসন্নতা কাটানোর জন্য এটা একটা অদ্ভুত খেলা। 

অভাবী মানুষরা সামান্য কিছু অর্থের জন্য ঠিক কতটা নিচে নামতে পারে বা দরিদ্র দেশে উচ্চবিত্ত আর নিম্নবিত্তের ব্যবধান, উচ্চবিত্তের ক্ষমতালোভ সাধারণ মানুষের জীবনে ঠিক কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে-এটাই আমাদের গেমের বিবেচ্য বিষয়। 

বাংলাদেশ বর্তমানে স্বল্পোন্নত নয়, মধ্যম আয়ের দেশ।

এই না হলে আমাদের নির্বাচিত খেলোয়াড়! স্বজাত্যবোধ, দেশপ্রেমে একেবারে পরিপূর্ণ! 

তা আপনি যেহেতু হার্মিসের পোশাক পরিধান করে আছেন, বলা যেতে পারে, আপনার বস নিজেকে মহাপরাক্রমশালী জিউস বলে মনে করেন। আপনি তার খুব বিশ্বস্ত একজন মানুষ, তাই না? 

সত্যি বলতে গেমের ফাউন্ডার, আমাদের বস একজন হলেও তারই মতো বিভিন্ন দেশের আরও অনেক ধনকুবের আছেন আমাদের গেমিং প্যানেলে। সবাই মিলেই গেমটার রূপরেখা তৈরি করেছেন। 

শুধু বাংলাদেশই নয়-এশিয়ার ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান আর আফ্রিকায় হাইতি এবং কঙ্গোতেও আমাদের অপরাধবিজ্ঞানীরা কাজ করছে। 

তা সেখানে কী খেলোয়াড় খোঁজার প্রক্রিয়া চালু আছে, নাকি খেলোয়াড় পাওয়া গেছে?

প্রতিটি দেশের জন্য ঐ দেশের ভাষা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল বার্তাবাহক থাকেন, যিনি সরাসরি খেলোয়াড়ের সঙ্গে কথা বলেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমাকে নির্বাচন করা হয়েছে। যাইহোক, এর বেশি তথ্য খেলোয়াড়কে জানাবার নিয়ম নেই। 

আপনি তো কৃত্রিম মডিউলেটরের সাহায্যে কথা বলছেন। সেখানে কী ভাষা রূপান্তরিত হচ্ছে নাকি আপনি বাংলাদেশি? 

জানাবার নিয়ম নেই।

আমি যদি গেম খেলতে না রাজি হই? 

তাহলে প্রতি মাসে একটি করে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের পূর্ণ ভিডিও প্রতি মাসের শেষে তোমার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আইন প্রশাসন কেউ কিছুই করতে পারবে না। কারণ প্রতিটি হত্যার পেছনে কারিগর থাকবে তোমারই দেশের কোনো প্রভাবশালী বুর্জোয়া। 

আমি আগেই বলেছি, আমরা নিজেরা কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটাব না, কেবল হত্যা করতে ইচ্ছুক সহিংস মানুষটিকে আমরা লোক পাঠিয়ে হত্যার উপায় জানিয়ে প্রশিক্ষিত করে তুলব এবং হত্যার উপকরণ সরবরাহ করে সাহায্য করব। 

প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের ভিডিও এবং পরদিন খবরের কাগজে শিরোনাম দেখে তোমার মনে হবে তুমি চাইলেই এই প্রাণটি বাঁচাতে পারতে। তোমার মতো মানবপ্রেমীর জন্য যা হবে চূড়ান্ত অবসাদের কারণ। আমি আগেই জানিয়েছি, এটি একটি প্রটেকিং অর্থাৎ রক্ষাকারী গেম। 

নিশ্চল দৃষ্টিতে মুখোশমানবের অদেখা চোখ বরাবর তাকাল আবরার, মুখোশের আড়ালের চোখ দুটো দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল ভীষণ। 

রবোটিক ভঙ্গিতে একটানা দাঁড়িয়ে দীর্ঘ কথোপকথন শেষ করে মুখোশমানব হলঘরের সাদা দেয়ালের হলোগ্রাফিক স্ক্রিনের ঠিক অপর পাশের দেয়ালে হাত রাখল। 

তার হাতের ছোঁয়া পেতেই দেয়ালের গায়ে ভেসে উঠল ইয়েস এবং ননা লেখা দুটো স্বয়ংক্রিয় বোতাম। মুখোশমানব আবরারকে উদ্দেশ করে বলল, 

তুমি এগিয়ে এসে বাটন দুটোর মধ্য থেকে যেকোনো একটি বাটন স্পর্শ করো। তোমাকে গেমে অংশগ্রহণ করতে আমরা জোর করব না। তবে তোমার উত্তর যদি না হয়, তবে আমাদের কথার সাথে কাজের মিলও তুমি দেখতে পাবে, এতটুকু নিশ্চিত থাকো। 

বীতশ্রদ্ধ ভঙ্গিতে তিন পা সামনে এগিয়ে ইয়েস বোতাম স্পর্শ করল আবরার। মুহূর্তেই দেয়ালের সাদা অংশটি দুদিকে সরে গিয়ে উন্মুক্ত হলো একটি সাদা বাক্স। 

মুখোশমানব বাক্সের কাছে এগিয়ে হাতের স্পর্শ দিতেই স্বয়ংক্রিয় বাক্সটি মাঝখান থেকে ঘড়ঘড় শব্দে দুদিকে উন্মুক্ত হয়ে গেল। অবাক বিস্ময়ে আবরার দেখল গ্রিক মিথোলজির ছয়জন প্রখ্যাত বীরের ছয়টি মূর্তি পাশাপাশি সাজানো। 

ডান থেকে প্রথমে আছে পার্সিয়াস (Perseus), এরপর অ্যাকিলিস (Achilles)। পর্যায়ক্রমে থিসিউস (Theseus), হেরাক্লেস (Heracles), জেসন (Jason), আলেকজান্ডার (Alexander)। মুখোশমানব আবরারের দিকে ফিরে তাকাল, 

এবার তোমাকে যেকোনো একজন গ্রিক বীরকে নির্বাচন করতে হবে। এই গেমে খেলোয়াড়দের গ্রিক বীরদের নামে ডাকা হয়। তুমি যেই গ্রিক বীরের নাম ধারণ করতে চাও, তার কপালে স্পর্শ করো। 

হেরাক্লেস গ্রিক নাম হলেও রোমান নাম হারকিউলিসই আবরারের বেশি পছন্দ। সব গ্রিক বীরের মাঝে হারকিউলিসকেই ভীষণ আপন আপন লাগে। দ্রোহ আর বিপ্লবের নিদারুণ মিশেল আছে হারকিউলিসের মাঝে।

আলতো করে হারকিউলিসের কপালে হাত রাখতেই বিশাল হলোগ্রাফিক স্ক্রিন পুরোদমে জীবন্ত হয়ে উঠল। মুখোশধারী এক নারী অবয়বের মুখে ওয়েলকাম টু হেলমিথ গেম ডিয়ার হেরাক্লেস শুনে সচকিত হয়ে উঠল আবরার। 

নারীমূর্তির মুখোশে বিশাল এক পেঁচার ছবি কোনো যত্নশীল চিত্রকর এঁকে দিয়েছেন। দেবী এথেনার প্রতিনিধিত্বকারী কোনো নারীর রেকর্ডেড ক্লিপ সম্ভবত দেখানো হচ্ছে!-নিজের অনুমানের সত্যাসত্য যাচাই করতে আবরারের অবশ্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। 

মুখোশ পরিহিতা নারীমূর্তি স্ক্রিনের ভেতর থেকে রক্ত-মাংসের মানুষের মতো জীবন্ত হয়ে উঠেছে। যান্ত্রিক গলায় বলে চলেছে, 

প্রিয় খেলোয়াড়, আপনি আমাদের হেলমিথ গেমে অংশগ্রহণে সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন। তাই আপনার জ্ঞাতার্থে এখন জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে গেমের নিয়মাবলি। 

মুহূর্তেই স্ক্রিন থেকে মুখোশ পরিহিতা মানবী মূর্তিটি সরে গিয়ে গোটা গোটা বাংলা ছাপার অক্ষরে গেমের লিখিত নিয়মাবলি আবরারের চোখের সামনে পরিদৃশ্যমান হয়ে উঠল। 

প্রতিটি নিয়ম স্ক্রিনের পর্দায় ভেসে ওঠার সাথে সাথে সেই যান্ত্রিক মানবী কণ্ঠটি গেমের নিয়ম অফস্ক্রিন থেকে বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষাতেই ধীরে ধীরে স্পষ্ট উচ্চারণে পড়ে শোনাতে লাগল। 

হেলমিথ গেমের নিয়মাবলি।

১. প্রিয় খেলোয়াড়, হেলমিথ গেমে আপনি প্রবেশ করবেন নিজের ইচ্ছায়, কিন্তু একবার গেমে প্রবেশ করলে সবগুলো লেভেল সম্পন্ন না করে গেমটি থেকে আপনি বের হতে পারবেন না। 

২. আপনি বীর হিসেবে হেরাক্লেসকে বেছে নিয়েছেন। হেরাক্লেস দ্বাদশ শ্রমের মাঝে দশটি শ্রম সম্পন্ন করে অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়েছিলেন। হেরাক্লেসের দুটো শ্রম বাতিল ঘোষণা করা হয়েছিল। এই গেমে আপনার জন্যও থাকবে ১০টি লেভেল। প্রতিটি লেভেলে আপনাকে এক বা একাধিক প্রাণ বাঁচাতে হবে।

৩. দশটি লেভেল সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারলে অর্থাৎ সবগুলো প্রাণ বাঁচাতে পারলে আপনাকে এই গেমের চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হবে। 

সেক্ষেত্রে পুরস্কার হিসেবে আপনাকে প্রদান করা হবে অচিন্তনীয় পরিমাণ অর্থ এবং এরই সাথে আমাদের বস নিজ হাতে আপনাকে প্রদান করবেন বিশেষ উপহার।

৪. এই গেমে আপনার জন্য থাকছে একটিমাত্র লাইফলাইন। অর্থাৎ কেবলমাত্র একবারই আপনি ব্যর্থ হতে পারবেন।

একাধিকবার ব্যর্থ হলে গেমের নিয়মানুযায়ী দশটি লেভেল আপনাকে ঠিকই সম্পন্ন করতে হবে কিন্তু আপনি পুরস্কারের অর্থ হারাবেন এবং একই সাথে হারাবেন সংশ্লিষ্ট লেভেলে মানুষের প্রাণ বাঁচানোর সুযোগ।

৫. চলমান ২০২১-এর নভেম্বরের ১ তারিখ থেকে শুরু করে ২০২২ এর আগস্টের ৩১ তারিখ পর্যন্ত চলবে হেলমিথ গেম। প্রতিটি লেভেল সম্পন্ন করতে আপনি সময় পাবেন এক মাস। লেভেল ১ শুরু হবে আগামীকাল অর্থাৎ পয়লা নভেম্বর থেকে।

৬. প্রতিটি লেভেল শুরুর প্রথম দুই দিনের মাঝে আপনি গ্রিক মিথোলজির কো-অর্ডিনেট পাবেন। প্রতিটি কো-অর্ডিনেট দেওয়া হবে কোড আকারে।

কোডের কোনো সুনির্দিষ্ট প্যাটার্ন জানাবার নিয়ম নেই, তবে আপনার জ্ঞানের পরিধির মাঝেই প্রতিটি কোড ডিকোডের কৌশল থাকবে। অন্তদৃষ্টি এবং বুদ্ধিদীপ্ততার সাথে আপনাকে কোডগুলো ডিকোড করতে হবে।

৭. আপনাকে এখান থেকে ফিরিয়ে দেবার পর আপনি আপনার বা হাতের মধ্যমায় একটি আংটি দেখতে পাবেন। আংটিটি বিশেষায়িত প্রযুক্তির মাধ্যমে নির্মিত হয়েছে, যার মাধ্যমে আমরা আপনাকে পর্যবেক্ষণ করতে পারব। 

আংটির উপরে স্বচ্ছ পাতের মতো অংশে যুক্ত আছে একটি অডিও ভিজুয়াল রেকর্ডার এবং ভেতরে একটি কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত ন্যানো বিস্ফোরক। 

জাপানের বিখ্যাত সায়েন্টিফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট RIKEN এ আমাদের অর্থায়নে তৈরি করা হয়েছে এই আংটি। আপনি আংটিটি খুলে ফেলার চেষ্টা করলেই আমরা সেই বার্তা পেয়ে যাব এবং আপনি ও আপনার চারপাশের ১০ মিটারের মতো জায়গা সম্পূর্ণভাবে উড়ে যাবে।

৮. আপনি গ্রিক মিথের কোড ডিকোড করতে পারলে আমরা আংটির স্পাই অডিও ভিজুয়াল রেকর্ডারের মাধ্যমে জানতে পারব।

কেবলমাত্র তখনই আপনাকে দেওয়া হবে পরবর্তী কো-অর্ডিনেট। এই কো-অর্ডিনেটে কোনো কোড থাকবে না, বরং আপনাকে একটি ভিডিও পাঠানো হবে, যার মাধ্যমে ২০-৪০ সেকেন্ডের একটি আলট্রা শর্টফিল্ম দেখানো হবে।

সেই ভিডিওর মাধ্যমে ভিকটিম এবং তাকে কেন হত্যার পরিকল্পনা করা হচ্ছে-সেই কার্যকারণ সম্পর্কে আপনি জানতে পারবেন। গ্রিক মিথোলজির ডিকোড করা গল্পের সাথে কো রিলেটও করতে পারবেন।

বিভিন্ন দেশের পেশাদার অভিনয় শিল্পীদের দিয়ে আলট্রা শর্টফিল্মটি চিত্রায়িত করা হবে। ভিডিও শেষে যে সত্যিকারের ভিকটিম হতে চলেছে, তার ছবি অথবা নাম অথবা দুটোই প্রকাশ করা হবে।

৯. পরবর্তী কয়েক দিনের মাঝেই আপনি আবার পাবেন তৃতীয় কো অর্ডিনেট। এই কো-অর্ডিনেটে কোডের মাধ্যমে আপনাকে হত্যার পদ্ধতি সম্পর্কে কু আকারে জানানো হবে।

১০. গেমের প্রতিটি লেভেল সম্পন্ন করার জন্য আপনাকে ১ মাস সময় প্রদান করা হয়েছে। তাই ফেয়ার প্লের স্বার্থে প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকে আমরা এমনভাবে প্রভাবিত করব, যাতে হত্যা সংঘটনের সর্বোচ্চ সীমা আপনার জন্য বরাদ্দকৃত সময়ের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গড়ায়। ধরা যাক, লেভেল ১-এর কথা। লেভেল ১-এর শুরু নভেম্বরের ১ তারিখ থেকে হলে হত্যাকাণ্ডটি ঠিক নভেম্বরের ৩০ তারিখ দিবাগত রাত বা দিন যেকোনো সময় ঘটবে এবং সংঘটনের শেষ সময় ৩০ নভেম্বর দিবাগত রাত ১২টা পর্যন্ত। অন্য লেভেলগুলোর ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য।

১১. তৃতীয় কো-অর্ডিনেটে পাওয়ার পর কোড ডিকোড করে হত্যার পদ্ধতি অনুমান করতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে আংটির মাধ্যমে সবুজসংকেত পাঠানো হবে এবং গ্রিক ভাষায় আমাদের পক্ষ থেকে একটি যান্ত্রিক কণ্ঠ আংটির ভেতর থেকে আপনাকে জানিয়ে দেবে cheis dikio- বাংলায় যার অর্থ হচ্ছে, আপনি সঠিক অনুমান করেছেন। এর কিছুদিনের মধ্যে আপনাকে পাঠানো হবে চতুর্থ কো-অর্ডিনেট। চতুর্থ কো-অর্ডিনেটে কোড আকারে ক্রাইম ভেন্যু উল্লেখ করা থাকবে। চতুর্থ কোড ডিকোড করতে পারলে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হবার দিন আপনি ভেন্যুতে গিয়ে যেকোনো পদ্ধতিতে ভিকটিমকে বাঁচাতে পারেন।

১২. ক্রাইম ভেন্যু হবে দুই রকম। আমাদের নির্বাচিত গোপন ক্রাইম ভেন্যু, যেখানে আমরা হত্যাকারীর হয়ে হত্যা প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত করব।

আরেক প্রকার ভেন্যু বাংলাদেশের যেকোনো জায়গাই হতে পারে।

আমাদের নির্বাচিত ক্রাইম ভেনু হলে কোডের মাধ্যমে আপনাকে নির্দিষ্ট একটি স্থানের ঠিকানা দেওয়া হবে। সেখানে আপনি ঠিক রাত ৮টায় এসে দাঁড়ালে আপনাকে আমাদের লোক গেমের ভেন্যুতে নিয়ে আসবে।

এ ক্ষেত্রে ভিকটিমকে বাঁচাতে প্রয়োজনীয় যন্ত্র এবং সামগ্রী আমরাই আপনাকে সরবরাহ করব। 

১৩. আমাদের নির্বাচিত গোপন ভেন্যু না হলে প্রাণ বাঁচাতে আপনি সাহায্য নিতে পারেন যেকোনো যন্ত্রের বা উপকরণের।

কিন্তু মিডিয়া অ্যাটেনশন পাবার চেষ্টা করলে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের গোপন হেলমিথ গেম সম্পর্কে কোনো তথ্য ভাইরাল করে জনসাধারণের সহানুভূতি পেতে চাইলে সঙ্গে সঙ্গে পূৰ্বোল্লিখিত আংটির মাধ্যমে আপনাকে হত্যা করা হবে।

কাউকে হত্যা করে তার স্মৃতিটুকু নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্য আমাদের পর্যাপ্ত ক্ষমতা আছে, এতক্ষণে এতটুকু আপনি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছেন।

উল্লেখ্য, প্রতিটি কোড ডিকোডের জন্য আপনি যেকোনো মানুষের সাহায্য নিতে পারেন।

১৪. নয়টি গেম সুসম্পন্ন করতে পারলে দশম গেমটিতে থাকবে আপনার জন্য একটা বিশেষ চমক। এই গেমে চারটি কো-অর্ডিনেটের স্থানে আপনাকে দুটি কো-অর্ডিনেট দেওয়া হবে।

১৫. দশটি লেভেল সুসম্পন্ন করতে পারলে আমাদের বিশেষ জেট বিমানের মাধ্যমে এই গেমের প্রবর্তকের কাছে আপনাকে নিয়ে যাওয়া হবে। তার হাত থেকেই আপনি আপনার পুরস্কারের অর্থ এবং দ্বিতীয় বিশেষ পুরস্কার গ্রহণ করতে পারবেন।

একটানা যান্ত্রিক স্বরে গেমের ধারাবিবরণীর মতো হেলমিথ গেমের নিয়মকানুন বর্ণনা করে থামল কৃত্রিম কণ্ঠের মালকিন। 

আবরার অনুভব করল, রক্তের ভেতর পাক খেয়ে ওঠা অসহ্য ক্রোধ ঘূর্ণাবর্তের মতো মাথার মধ্যে আলোড়ন তুলে হঠাৎ শান্ত হয়ে গেছে। 

এতক্ষণ গেমের নিয়মাবলির মাঝে এতটাই ডুবে গিয়েছিল যে রোবটিক ভঙ্গিতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা মুখোশ পরিহিত হার্মিসের দিকে একবারও তাকায়নি।

মুখোশমানবের দিকে দৃষ্টি পড়তেই আবরারের মনে হলো মুখোশের ভেতর থেকে লোকটা ক্রুর ভঙ্গিতে হেসে চলেছে। 

আবরারের শূন্য দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করে মুখোশমানব বলে উঠল, সাদা বাক্সের পেছনে একটা গ্যাস চেম্বার আছে। তোমাকে তোমার বাড়ি পৌঁছে দেবার আগে অচেতন করতে হবে। এটাই গেমের নিয়ম। আশা করি, তুমি কোনো রকম অসহযোগিতামূলক আচরণ করবে না। 

আমি নিজে পায়ে হেঁটে গ্যাস চেম্বারে ঢুকব। আপনি শুধু আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দেবেন?

জিজ্ঞেস করো। 

মডিউলেটরের কৃতিত্বে কৃত্রিম যান্ত্রিক স্বরে জবাব মুখোশমানবের। 

আপনাদের এই গেমের যেই উদ্দেশ্যের কথা বলেছিলেন, আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল তা কেবলমাত্র বলতে হয় বলে বলা। 

আমার অনুমান, আমার মতো মানুষদের আপনারা একই সাথে ঈর্ষা করেন, আবার ভয়ও পান। তাই আমাদের নিজেদের খেলার পুতুল বানিয়ে ব্রেইনওয়াশ করে পুঁজিবাদের প্রতি একনিষ্ঠ অনুরাগী করে তুলতে চান। নিজেদের দল ভারী করতে চান। আমার অনুমান কি ঠিক? 

মুখোশের আড়ালে থাকা হার্মিস কোনো উত্তর দিলো না। আবরারের মনে হলো হার্মিসের টুপিস্থ স্ফীত ডানা এক জীবন্ত শকুনের রূপ নিয়ে উড়ে আসছে তার দিকে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *