সারেং বৌ – উপন্যাস – শহীদুল্লা কায়সার
থই থই পানি। নদীর পানি। সাগরের পানি।
চারদিকে পানি। মাঝখানে ডাঙা। তবু একে দ্বীপ বলে না কেউ। বলে গ্রাম। কেননা এটা পানিরই দেশ।
গ্রামটাকে বলে বামনছাড়ি। নদীটাকে বলে কয়াল।
বামনছাড়ি যেমন গ্রাম হয়েও গ্রাম নয়, জলঘেরা ভূখণ্ড, তেমন কয়ালও মামুলি নদী নয়। কয়াল সমুদ্র মোহনার উন্মত্ত জলোচ্ছ্বাস। কয়ালের পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখা যায় সমুদ্র, কখনোবা ঝিকিমিকি একটি রুপালি রেখা কখনোবা স্বচ্ছ নীলের একটি চিকচিকে আভা।
শুধু বামনছাড়ি নয় সাগর আর মোহনার তীর ঘেঁষে আরও কত গ্রাম– কদুরখিল, পিয়ালগাছা, মাদারটেক। এসব গ্রামে যাদের বাস বিচিত্র মানুষ ওরা। বিচিত্র ওদের জীবিকা। ওদের আছে জমি। সে জমিতে ধান হয়। ওরা চাষ করে। ওদের আছে গোয়াল। সে গোয়ালে থাকে হালের বলদ, দুধের গাই। তবু ওরা সমুদ্রের মানুষ। সমুদ্র ওদের জীবিকা, সমুদ্র ওদের জীবনের গান! সাগর ঊর্মি ওদের কল্লোল গীত। সাগরের বুকে ডিংগি ভাসিয়ে ওরা মাছ ধরে। সাগরের তরঙ্গে চড়ে ওরা চলে যায় দূরদেশে। ওরা নাবিক।
বামনছাড়ি গ্রামে এমনি এক নাবিক বাড়ি, ওরা বলে সারেং বাড়ি।
সারেং বাড়ির সারেং বৌ। নাম তার নবিতুন।
সারেং বাড়ির তিন হিস্যা। উত্তরের হিস্যা। পুবের হিস্যা। বড় হিস্যা। বড় হিস্যা পশ্চিমে হলেও পশ্চিমের হিস্যা নয়। কেননা, ওদের দুটো বড় বড় ঘর। তার ওপর গোয়াল ঘর, ঢেঁকি ঘর। সারেং বাড়ির ওটা বড় হিস্যা।
বাড়ির ওটা বড় হিস্যা।
উত্তরের হিস্যা নবিতুনের।
উত্তরের হিস্যার সুমুখে মাঝারি গোছের উঠোন। উঠোনের বাঁ কোণে হিস্যার সীমানা বরাবর বরই গাছ।
ঘর ঝাঁট, হাঁড়ি-পাতিল ধোয়া, হাঁস-মুরগির আদার দেয়া– নবিতুনের নিত্যকার ভোরের কাজ। কাজগুলো সেরে পুকুরে গিয়ে ভালো করে হাত-মুখটা ধুয়ে এলো নবিতুন। তারপর বসল দাওয়ার দরজায় ঠেস দিয়ে পা গুটিয়ে। এটা অন্য একটা কাজে হাত দেবার পূর্বক্ষণ।
দাওয়ায় বসে বরই গাছটার দিকে নজর পড়ে নবিতুনের। বরই বেরিয়েছে গাছে। গোল গোল ছোট ছোট দানার মতো। ঘন সবুজ। ঘন সবুজ অংকুরগুলোর দিকে চেয়ে থাকে নবিতুন; চেয়ে থাকে স্থির দৃষ্টিতে। চেয়ে চেয়ে বুকটা বুঝি কেঁদে ওঠে। বুকটা ভারি হয়ে যায়। বুকটা ফেটে যেতে চায় কি এক হাহাকারে।
কতবার বরই ধরল। সে বরই পাকল। নিঃশেষ হলো। নতুন পাতা গজাল বরই গাছে। সে পাতা বুড়িয়ে ফ্যাকাসে হলো। সাদাটে হলো। সে পাতা শুকিয়ে ঝরে গেল। আবার মরসুম এলো। পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঘন সবুজ কুলের অংকুর চোখ মেলল।
নবিতুনের বুকটা শুধু নিঃশব্দে কেঁদে যায়। নবিতুনের বুকটা হাহাকারের নিঃশ্বাসে ফেটে ফেটে চৌচির হয়।
নবিতুন, ও নবিতুন, বলি আর কতকাল! লাঠিতে ভর দিয়ে ঠুকঠুক করে আসে পুবপাড়ার সগির মা। বসে পড়ে দাওয়ায় নবিতুনের পাশে। বলে আবার– আর কতকাল নবিতুন! এবার একটা সাংগা-টাংগা কর। জোয়ানকির সুরুজ একবার ডুবে গেলে আবার কি উঠবেরে?
বয়সের চাপে আর ব্যারামের দাপটে লাঠি ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে চলে সগির মা। তাই সগির মা ওকে কেউ বলে না আজকাল, বলে গুঁজাবুড়ি। গুঁজাবুড়ি কুটনী বুড়ি, গুঁজাবুড়ি পুবপাড়ার লুন্দর শেখের কুটনী মাগী, গুঁজাবুড়ি নবিতুনের নয়ন জ্বালা, গায়ের জ্বালা, গলার বিষ।
ভেবে দেখরে নবিতুন, আমার কথাটা ভেবে দেখ। পালঙ্কে বসে পায়ের উপর পা তুলে খাবি, থুবি, হুকুম চালাবি। হুঁ করবি অমনি হাঁ করে ছুটে আসবে এক গণ্ডা দাসীবান্দী। হাত টিপবে, পা টিপবে বান্দী। চুল আঁচড়াবে, গোসল করাবে বান্দী। এরি নাম না ঘর করা। পানের পিকটা অদ্ভুত কৌশলে গালের ভেতর ধরে রেখে বলে চলে গুঁজাবুড়ি। কি এক ধূর্ত চোখে চেয়ে থাকে নবিতুনের দিকে। তারপর ঢক করে গিলে ফেলে পানের রসটা। চর্বিত পানের অবশিষ্টটুকু দাঁতের মাড়ি আর চামড়ার ফাঁকে রেখে দেয় সুপুরির মতো গোটা পাকিয়ে। ফুলিয়ে তোলে নিচের গালটা। নবিতুনের সকালটাই বুঝি মাটি হয়। কত কাজ পড়ে রয়েছে ওর। কিন্তু গুঁজাবুড়ির ওই শকুনি মুখ দেখলে আর ওই শয়তানি কথা শুনলে না-মেজাজ থাকে ঠিক, না-মন লাগে কামে।
গুঁজাবুড়ি, তুই কুটনী, তুই শয়তান, দূর হ দূর হ তুই। গুঁজাবুড়ির কোলটা ডিংগিয়ে নবিতুন চলে আসে ঘরের ভেতর। ঘরে এসে গুঁজাবুড়ির ওপর রাগটা ঝাড়ে বেচারি আককির পিঠে। দুমদুম দুটো কিল বসিয়ে দেয় ওর পিঠে। চুলের মুঠো ধরে টেনে তোলে ওকে–অলক্ষ্মী মনহুস। ওঠ শিগগির। সেই সকাল থেকে কতবার ডাকছি। তবু যদি ঘুম ভাঙে মেয়ের।
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় আককি। কিল আর চুলের টানে বুঝি পানি এসে যায় ওর চোখে।
কোরাটা নিয়ে যা মুনশি বাড়ি। এক আড়ি ধান দেবে। নিয়ে আসবি।
চোখ মুছতে মুছতে কোরাটা হাতে নেয় আককি। চোখ মুছতে মুছতেই বেরিয়ে যায়।
পেছন থেকে আবার ডাকে নবিতুন–যাবার পথে পোস্টমাস্টারের বাড়িটা খোঁজ করে যাবি।
মনে-মনে হাসে গুঁজাবুড়ি। পোস্টমাস্টারের বাক্সে কি আছে আর নেই সে কথাটা মনে করেই বুঝি হাসে। বলে– বিবির সুখে থাকবিরে নবিতুন। বিবির সুখে থাকবি। বৌদের বড় মহব্বত করে লুন্দর শেখ!
মুখে তোর পোকা পড়ুক । জিব তোর খসে পড়ুক । বলে নবিতুন আর থপথপ করে হাঁটে ঘরের ভেতরে।
সগির মা গুঁজাবুড়ি, মনে-মনে হাসে। প্রথম প্রথম এমনিই হয়। শরম করে। তেজ দেখায়। রাগ দেখায়। রাগের চোটে হাঁড়ি ভাঙে, গালি ছোড়ে। তারপর আস্তে-আস্তে নরম হয়। টোপ গেলে। একদিন সুড়সুড় করে বেরিয়ে আসে সগির মার পেছন পেছন।
কত দেখল সগির মা। কুলকন্যার কুল দেখল, তেজ দেখল, মান দেখল। সতী বৌর সতীত্ব দেখল। সবই লুন্দর শেখের দাসীবান্দীর খেদমতের লোভ, দু পদ জেয়ড়, বড় জোড় কিছু নগদ টাকার কাছে গাংগে-র পানি। গাংগে-র পানির মতোই ভেসে যায়। কত দেখল সগির মা।
সগির মা হাসে মনে-মনে। বলে– তা তুই যা খুশি মুখ কর নবিতুন। আমার তো দিল পোড়ে তোর লাগি। তোর শরীলে যে ঢল ঢল জোয়ানকির জোয়ার। এ ঢল যে বিরথাই যায় নবিতুন!
আহ্ কুটনী বুড়ি! বের হ। বের হ তুই। মেয়ে খাগী ছেলে খাগী খসম খাগী। তোর মুখ দেখলে পাপ। তোর কথা শুনলে পাপ। রাগটা বুঝি আর ধরে রাখতে পারে না নবিতুন।
সগির মা বেওয়া। সগির বাপ, সগি আর সগির ভাইটি একে-একে কবে যে মারা গেল সেটা আজ তারই মনে পড়ে না। এই অলক্ষ্মীর জীবনটা নিয়ে কত টিটকিরি টিপ্পনি শুনতে হয় ওকে। সেসব গা-সওয়া সগির মার।
মনে-মনে হাসে সগির মা। লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বলে, সগির মার ভালো কথায় তো মন লয় না তোর। কিন্তুক এই যে এ্যাদ্দিন ধরে বলেছি সারেং আসবে না– কই এলো সারেং? বিদেশের সোয়াদ পেয়েছেরে, বিদেশের সোয়াদ পেয়েছে সারেং। বিদেশের সোয়াদ যে পায় সে কখনো দেশে ফেরে না।
একখানা পিঁড়ি ধাঁ করে এসে চলে গেল সগির মার কান ঘেঁষে। উঠোনের মাটিতে ঠনঠনিয়ে ওঠে পিঁড়িটা।
এবার আর শুধু মনে-মনে হাসে না সগির মা, অনেক পাপ অনেক কুটনামীর রেখা-জাগা লোলচর্ম মুখটাও ওর হেসে ওঠে। লাঠির ঠুকঠুক শব্দ তুলে চলে যায় সগির মা। যেতে-যেতে বলে– ভেবে দেখরে নবিতুন, ভেবে দেখ। জোয়ানকির ঢলটা গেলে পর পস্তাবি। পস্তানই সার হবে তখন– পাঁচ বৌ লুন্দর শেখের। পাঁচ বৌর মাঝে তুই হবি রানী, রানীর সুখে থাকবি।
খসম খাগী ছেলে খাগী কুটনী মাগী… নিজের মনেই গজগজ করে নবিতুন। ওই শয়তানি বুড়ি শুধু সকাল নয় গোটা দিনটাই বুঝি মাটি করে দিয়ে গেল ওর।
গতকালকার আঁকাড়া চাল আর একটা কুলো নিয়ে নবিতুন বেরিয়ে আসে উঠোনে। সগির মাকে ছুঁড়ে মারা পিঁড়িখানাই টেনে বসে যায় চাল ঝাড়তে।
কি হলো নবিতুন বুয়া? বড় হিস্যার শরবতি কাছে এসে শুধায়।
উত্তরে শুধু চিবুক বেঁকিয়ে মুখের আদলে রোষ ফোঁটায় নবিতুন। কুলোর পিঠে চটাঠ চটাঠ শব্দ তোলে আঙুলের। ঝাড়া চালগুলো রাখে কুলায়। তুষ আর কুড়োগুলো তুলে নেয় মালসায়। তারপর যেন একরাশ রুদ্ধ বাতাস আচমকা ছাড়া পেয়ে ভয় করে বেরিয়ে গেল মুখ দিয়ে, সেই সাথে শব্দটা গুঁজাবুড়ি।
সে তো দেখলাম। তা ওর বাঁকা কোমরটা একেবারে ভেঙে জন্মের মতো অকস্মাৎ করে দিলেই হয়। বলে শরবতি।
মেরেছিলাম পিড়িটা লাগল না গায়ে।
তুষের মালসাটা ঘরে রেখে আসে নবিতুন। কাঁখে তুলে নেয় চালের কোরাটা। শরবতির মুখের ওপর মিনতির দুটো চোখ রেখে বলে–শরবতি বোন, হাতটা একটু লাগাবি। আর একটা ঝাড়া দিলেই ঠিক ঠিক হয়ে যায় চালগুলো। এ চাল চৌধুরী বাড়ি গেলে পর হাঁড়ি চড়বে আমার।
নবিতুন বুয়া, তুমি খালি শরম দাও। বলেছিই তো যখন দরকার পড়বে ডাকবে আমায়। ঢেঁকি ঘরের দিকে পা তোলে শরবতি।
আসলে ঢেঁকিঘর বলে আলাদা কিছু নেই নবিতুনের। কুল্লে একটি মাত্রই ঘর ওর। হাত কুড়ি লম্বা। মাঝামাঝি বেড়া দিয়ে দুভাগ করা। এক ভাগে ঢেঁকি, চুলো, মাচাং সবই; একাধারে ঢেঁকিঘর, রসুইঘর, হাঁস-মুরগির খোঁয়াড়। বাকি অর্ধেক থাকার। তবে দুঅংশই বাইরে থেকে দুটো আলাদা দরজা। সারেং বৌ নবিতুন, ঢেঁকির উপর ও যেন সুসংগত এক তালের ছন্দ, নাচের ঝংকার। খলখলিয়ে হাসে ও খলখলিয়ে নাচে ওর যৌবন পুষ্ট শরীরখানি। ঢেঁকির উপর যেন নেচে চলেছে বিজলির মেয়েটি নবিতুন। পা দেখা যায় না, এমনি দ্রুত ওঠে আর নাবে ওর পা। আর সেই পায়ের আঘাতে ঢেকুর ঢুক কলকলিয়ে যায় ঢেঁকিটা। চালগুলো সব খোলার উপর খইয়ের মতো লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ছিটেভিটে যায় চারদিকে।
তাল রাখতে গিয়ে হিমশিম খায় শরবতি। এক হাতের জায়গায় দুহাত লাগায়। গাইলের উপর থেকে ছিটিয়ে পড়া চালগুলো জড় করে, ভরে দেয় গাইলের মুখটা। ইস্পাতের খাড়ু পড়া মোলাটার দ্রুত উঠতি-পড়তির মুখে সাবধানে রাখে হাতখানি।
এর মাঝেও রসিকতা করে শরবতি– সাধে কি চোখ লেগেছে সুন্দর শেখের। নবিতুন বুয়া, তোর গায়ে যে জোয়ানকির ঢল। আমারই চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।
শুনে যেন ফুর্তি আরো বেড়ে যায় নবিতুনের। মাথাটা ঝাঁকিয়ে কোমর খানি দুলিয়ে ঢেউটির মতো ঢলকে পড়ে ঢেঁকির ওপর। যুগীর বানানো মোটা শাড়িখানাও ধরে রাখতে পারে না ওর ছলকে ঝলকে উছলে পড়া জোয়ানকি। বাঁধন মানে না নিতম্ব দোলা। শাসন মানে না জোড়া বুকের উদ্দাম নাচন। সারেং বৌর দেহের ভাঁজে ভাঁজে এ বুঝি জোয়ানকির উথালি-পাথালি নাচন, কল কল জোয়ার। আর সেই নাচের ছন্দে দ্রুত বোল তুলে যায় ঢেঁকিটা– ঢে্ককুর ঢুক, ঢেককুর ঢুক।
নবিতুনের পায়ের তলায় যদি একটুখানি সুখ পায় ঢেঁকিটা, কিলা দুটো ক্যাঁক ক্যাঁক কেঁদে যায়। থরথর কেঁপে যায় মাটিটা।
অবশেষে এক রকম নাস্তানাবুদ হয়েই বলে শরবতি– নবিতুন বুয়া, এবার একটু থাম।
থেমে যায় নবিতুন। থেমে যায় সুনিতম্ব দোলা। বারবার বিদ্রোহের ভঙ্গিতে দুলে কেঁপে স্থির হয় বুকের সেই এক জোড়া নরম অবাধ্যতা।
আড়ায় হাত রেখে দুহাতের ফাঁকে মুখটাকে ছেড়ে দেয় নবিতুন। ওর গোটা শরীরটা যেন ঝুলে রয়েছে আড়ার উপর রসচিকন একখানি লতার মতো। বারা বান্দাটা তো আর সত্যি নাচের ভঙ্গিতে একখানি হাত–পা দুলিয়ে যাওয়া নয়। বারা বান্দা পরিশ্রমের কাজ, মেহনতের কাজ। অত বড় আর ভারি ঢেঁকিখানাকে টলাতে পায়ের জোর গায়ের জোর সবই ঢেলে দিতে হয়। আড়ায় মুখ রেখে ঘনঘন নিঃশ্বাস নেয় নবিতুন। দূর করে ক্লান্তিটা। ওর কপালে আর নাকের ডগায় মুক্তোর মতো সাদা-সাদা ঘামের বিন্দু।
গাইলের ভেতর থেকে চাল তুষ তুলতে তুলতে আড়চোখে ওকে দেখে শরবতি। বলে লুন্দর শেখের নজর আছে। রসাল জিনিসেই চোখ লাগিয়েছে ও। নবিতুন বুয়া, সাবধানে থাকিস কিন্তু।
সারা সকালে বুঝি এই প্রথম একটু হাসল নবিতুন। স্বেদ-মুক্তোর ফোঁটা আঁকা মুখখানি ওর ছোট্ট একটা হাসির ঝিলিক তুলে যায়। বলে নবিতুন– নিজের দিকে চেয়ে দেখিস কখনো? দিনে-দিনে যে শরবতের মতো মিঠা মিঠা হয়ে উঠেছিস। লুন্দরের কিন্তু সব আবিতি মেয়ে। শরবতি, বুঝে-সমঝে চলিস।
আবিতি অর্থাৎ, কুমারী মেয়ে শরবতি। নিজেকে নিয়ে রসিকতায় তাই এখনো ওর লজ্জা। তাড়াতাড়ি মুখটা নামিয়ে নেয় শরবতি। কোষভরে কাঁড়া চালগুলো তুলে নেয় কোরায়। তুলতে তুলতেই বলে হুঁ, সখ না আরো কিছু। আসুক না খেরের নেড়ায় আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দেব না ব্যাটার মুখটা?
শরবতির রাগের ঠমক দেখে হাসে নবিতুন। হাসতে হাসতে আড়া ছেড়ে নেবে আসে ও। একবার ধপাস করে একবার ক্যাঁক করে যেন হাঁফ ছাড়ল ঢেঁকিটা। হাঁফ ছেড়ে মাটিতে মুখ রাখল ঢেঁকিটা।
সেই যে কোরা নিয়ে গেল মুনশি বাড়ি এখনো ফেরে না কেন আককি? বুঝি আককিকে দেখবার জন্যই উঠোন পেরিয়ে রাস্তাটার উপর একবার চোখ বুলিয়ে এলো নবিতুন।
তারপর কাঁড়া চালগুলো ঝাড়ল, বাছল, নিজের মেহন্নতের পাওনা এক সের চাল পৃথক করে রাখল। বাকি চাল কোরায় তুলল। খুদ আর তুষ আলাদা আলাদা মালায় পুরে নিল।
যেন মস্তবড় অপরাধ করেছে তেমনি কুণ্ঠিত পায়ে কাছে এসে দাঁড়ায় আককি। ওর হাতের শূন্য কোরাটার দিকে তাকিয়ে যেন ছ্যাঁৎ করে ওঠে নবিতুনের বুকটা।
কি রে, ধান আনলি না! শুধায় নবিতুন।
না, ভূঁইয়ার হাটে কল বসেছে। এখন থেকে সেই কলেই নাকি সবাই ধান বানবে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেমে যায় আককি।
পোস্টমাস্টারের বাড়ি যাসনি?
চিঠি নাই, টাকা নাই, কিচ্ছু নাই।
কিচ্ছু নাই? রোজই তো শোনে নবিতুন, কোন খবর নাই। তবু কি এক হতাশায় যেন ভেঙে পড়ে ও।
আককির চোখ এখন মায়ের দিকে নেই। শূন্য কোরাটা মাটিতে রেখে মালসা থেকে এক মুঠ খুদ তুলে নিয়েছে ও। খিদেয় চনচন করছে ওর পেটটা, চিবোতে চিবোতেই আগের কথার বাকি কথাগুলো শেষ করে ও– মা, মুনশিরা বলে কি? বলে, কলে নাকি খুব সাফ হয়, সাদা হয় চাল। ভাত হয় সাফ সাফ, সোন্দর সোন্দর।
অন্যদিন হলে না বলে ওই এক মুঠো খুদ খাওয়ার জন্য গোটা কয় কিল পড়ত আককির পিঠে। নিদেনপক্ষে কিছু বকুনি। কিন্তু আজ ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিল নবিতুন। বলল– বাসনে পান্তা আছে, খেয়ে নেগা। খোরায় লঙ্কা পোড়া আছে। একটা নিবি, বেশি নিবি না। খুশির চোটে লাফাতে লাফাতে ঘরে চলে যায় আককি। পান্তাটা দাওয়ায় এনে খেতে বসে, ওর খাওয়ার দিকে চেয়ে থাকে নবিতুন। মনটা ভারি হয়ে আসে নবিতুনের। সকাল বেলায় খামোকাই মেরেছে মেয়েটাকে।
প্রতিদিনকার সেই ভাবনাটি আবার বুঝি একশো হাত মেলে ঘিরে ধরে নবিতুনকে। কেন? কেন কোন খবর আসে না লোকটার? চিঠি আসে না, টাকা আসে না। কোন লোকের মুখেও খারাপ ভালো একটা খবর পাওয়া যায় না। এমন তো হয়নি কখনো?
সেই বার বছর বিয়ে হয় নবিতুনের। আর এখন তা প্রায় এক কুড়ি পেরিয়েও বছর তিনেক হতে চলল বই কি? এর মাঝে—কতবার বিদেশ করতে গেল মানুষটি। একনাগাড়ে দুবছর, একবার মাত্র তিন বছর থেকেছে বিদেশ। মাঝে মাঝেই চিঠি এসেছে, টাকা এসেছে প্রতি তিন মাসে। তারপর একদিন ফিরে আসত লোকটি। রঙিন শাড়ি, ফুলের তেল, গন্ধ সাবান আরো কত কি নিয়ে আসত নবিতুনের জন্য। এমনি কতবার বিদেশ করতে গেল আবার ঠিক দুবছর বাদে ফিরে এলো। কিন্তু এবার কি হলো। গেছে সেই যেবার মুরগির মড়ক লাগল গ্রামে সেই বছর। তারপর দুবছরের জায়গায় তিনটি বছর কেটে গেল, না একটা খবর, না একখানা চিঠি। এমন তো হয়নি কখনো?
তবে? কি এক আশঙ্কায় ধুক করে ওঠে নবিতুনের বুকের ভেতরটা। অসুখ বিসুখ বা তার চেয়েও মারাত্মক কিছু? আল্লায় না করুক, অমন আশঙ্কা মনের ভেতর ঠাঁই দেয় না নবিতুন।
হঠাৎ সেই মেয়েখাগী ছেলেখাগী খসমখাগী গুঁজাবুড়ির শয়তানি মুখটা ভেসে ওঠে নবিতুনের চোখের সুমুখে। কানের কাছে যেন কিলবিলিয়ে ওঠে সেই শয়তানি কথাটা সারেং আসবে নারে, আসবে না, বিদেশের সোয়াদ যে পায়, সে কখনো দেশে ফেরে না।
নবিতুন বিশ্বাস করে না এসব কথা। কখনো বিশ্বাস করবে না। সারেং তার অমন লোকই নয়।
অবশ্য গুঁজাবুড়ি ছাড়াও আরো লোকের মুখে শুনেছে নবিতুন, বেগানা লোকদের জন্য বিদেশের পথে নাকি শুধু ফাঁদ আর ফাঁদ। সে ফাঁদে আটকা পড়ে এ দেশের জাহাজি। ফাঁদের মায়ায় ভুলে যায় দেশের কথা। শাদি করে। ঘর করে বিদেশিনীর। ধীরে ধীরে বিদেশিনীর জাদুতে মন যায় বদলে। মন থেকে মুছে যায় আপন দেশের ফেলে আসা আবাগী বৌটির স্মৃতি।
নবিতুনের জানামতে এমন ঘটনা যে একেবারে নেই তা তো নয়! এই বামনছাড়ি গ্রামের মিজি বাড়ির ছেলে রইসুদ্দি, সেই যে গেল জাহাজের সুকানি হয়ে আর ফেরেনি। নবিতুন শুনেছে অনেক সাগর পেরিয়ে বহুত দূরে নাকি সাদা সাহেবদের দেশ। সেই সাদা সাহেবদের দেশে থাকে মেম নামের জাদুকরিরা। সেই এক মেম নামের জাদুকরির ফাঁদে বন্দি হয়েছে রইসুদ্দি।
বামনছাড়ি গ্রামে ওই রইসুদ্দি ছাড়া অন্যকোনো নজির নেই। কিন্তু লোকে বলে, বামনছাড়ির গাঙ পার থেকে শুরু হয়েছে কদুর খিল, তারপর যে পিয়ালগাছা, সেসব গ্রামে নাকি এমন ঘটনা আকসার ঘটছে।
এসব কথা যারা বলে তাদের যে একেবারে অবিশ্বাস করতে পারে না নবিতুন! শরবতির বড় ভাই, এই কিছুদিন আগ পর্যন্ত সেও তো দেশ-বিদেশ করত ওই জাহাজেরই কাজে। পুবের হিস্যার কোরবান, সেও তো সারেংয়ের কাম করেছে কমছে কম দশটি বৎসর। তা ছাড়া বামনছাড়ি, মাদারটেক এই সেই দিন পর্যন্ত এসব গ্রামের অর্ধেক লোকই তো পড়ে থাকত জাহাজের কাজে বিদেশ। এখন ওরা যেতে পারে না। বিদেশগামী জাহাজে কাজ পেতে হলে যেতে হয় হিন্দুস্তানে– কলকাতায়। সে নাকি বড় ঝামেলার ব্যাপার। হিন্দুস্তান, কলকাতা এখন বিদেশ, বড় কড়াকড়ি সেখানে। তাই জাহাজের কাজে ক্ষান্ত দিয়ে ওরা এখন ক্ষেতি-গেরস্থালিতেই মন দিয়েছে, পালদের জমি চাষ করছে ভাগে। ওদের কথা ষোল আনা না হলেও আট আনা বিশ্বাস করে নবিতুন। কিন্তু কদম সারেং, নবিতুনের সারেং কি সেই জাতের মানুষ? না, কেউ কসম খেয়ে বললেও বিশ্বাস করবে না নবিতুন। মেম মায়াবিনীর ফাঁদে পা দেবে তেমন মানুষই নয় কদম সারেং।
মনে পড়ে নবিতুনের। নবিতুনের সারেংটি তখন অনেক দেশে ঘোরনা দিয়ে অনেক ভাটি অনেক জোয়ারের পানি ভেঙে ফিরে এসেছে, নবিতুনের বুকের কাছে সায়রেই নোঙর ফেলেছে।
বাপের কাছে রইসুদ্দির চিঠি এসেছে, টাকা এসেছে। সেই সাথে এসেছে ওর মেম জাদুকরির ফুটু।
ফটো দেখে তো তাজ্জব নবিতুন।
ওমা এই ফু-টু! ডাইনী না বেবুশ্যে গো? দেখ না কেমন ছিনালী হাসি, তা আবার মরদটার কাঁদে হাত রেখে কি ঢলাঢলি।
মা গো কি বেশরম বেহায়া বেলাজ। শরমে বুঝি মরে যায় নবিতুন, তবু উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে দেখে ফটোটা। উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে দেখে বুঝি ঘিনঘিন করে নবিতুনের গাটা। নাক কুঁচকায়, চোখ উলটায়।
ওমা! সাহেব দেশের মেম ডাইনীগুলো ন্যাংটা থাকে নাকি গো। মাথায় নেই ঘোমটা, গায়ে নেই কাপড়। আর্ধেকটা উরু খোলা। ছিঃ ছিঃ। রইসুদ্দি শেষে এমন ছিনালীর খপ্পরে পড়েছে!
নবিতুনের ভাবসাব দেখে মুচকি মুচকি হাসে কদম। ভাবে, ফটো দেখেই এই অবস্থা নবিতুনের। মেমদের কাণ্ডকারখানা যদি চোখে দেখত তবে বুঝি মূৰ্ছা যেত নবিতুন।
নবিতুন তখনো বলে চলেছে, ওরে বাবা! এদিক নেই আবার সেদিক আছে। বেবুশ্যের মতো ন্যাংটা, ওদিকে পায়ে জোতা, জোতার সাথে ফের মোজা। ইস, ছিনালের কতো ঠাম! তারপর ঘেন্নার সাথে ফটোটা ফেরত দিয়েছিল নবিতুন।
রইসুদ্দির ভাইর বেটি ফটোটা নিয়ে চলে গেলে পর আস্তে-আস্তে বলল কদম– মেমগুলোকে যত খারাপ ভাবছিস, ওরা অত খারাপ নয়রে নবিতুন।
এ্যাঁ, যেন আচানক একটা ধাক্কা খেয়ে ঢেঁকি থেকে পড়ে গেল নবিতুন।
ওই ডাইনীগুলোকে ভালো বলল কেন সারেং? কোরবানের বৌ হাসমতি। হাসমতি বলে, সব এক গোয়ালের গরুরে, এক গোয়ালের গরু। বিদেশে ওরা কি যে করে আর কি না করে, তার কোনো ঠিক-ঠিকানা আছে? কোরবানকে একটুও বিশ্বাস করে না হাসমতি।
তবে কি হাসমতির কথাটা ঠিক? কদম, কোরবান, শরবতির ভাই, একই জাহাজেই তো ঘুরছে ওরা। তখন কি ওদের মতো কদম সারেংও ডাইনীগুলোর সাথে গা ঢলাঢলি করেছে?
না না, নবিতুনের সারেং অমন লোকই নয়। কদমের দিকে চোখ করে বলে নবিতুন, না গো না ওরা ভালো না। নবিতুনের আতঙ্ক আর দুশ্চিন্তা আঁকা মুখের দিকে চেয়ে আবারও মুচকি মুচকি হাসে কদম। বলে, ভালো বললাম কই রে? বললাম, যতটা ভাবছিস তুই আসলে অতটা খারাপ নয় ওরা।
না, ওরা খারাপ। অমন বেহায়া, বেবুশ্যার মতো ন্যাংটা আর অমন ছিনালী ঢং– ওরা খারাপ।
আচ্ছা খারাপ। ওর কথাটা মেনে নিয়ে ওকে বুকের কাছে টেনে নেয় কদম। আলগা হয়ে আসে নবিতুন। বলে, হ্যাঁ গো, তুমি ওদের থেকে দূরে দূরে থাক তো? ওরা কিন্তু জাদু জানে, অনেক মন্তর জানে।
হুঁ, ছোট্ট করে বলে আবারও মুচকি হাসে কদম।
কদমের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝি সংশয়মুক্ত হয় নবিতুন। কেন যেন মনে হয় নবিতুনের, সব সময়ই মনে হয়, লোকটার মুখ দেখেই ও বুঝে নিতে পারে লোকটার মনের কথা, আসল কথা। তবু বলল নবিতুন, খোদার কসম?
খোদার কসম। কসম খেয়ে রীতিমতো গম্ভীর হয়ে গেল কদম।
এতক্ষণে বুঝি পুরাপুরি আশ্বস্ত হলো নবিতুন। তারপর, সকাল বেলায় ঘরের চাল থেকে যেমন ঝড়ে পড়ে শিশিরের ফোঁটাটা তেমনি টুপ করে ও ঝরে পড়ল কদমের বুকে। কদমের বুকে মুখ গুঁজে ফিসফিসিয়ে বলল, সারেং গো সারেং। সব সময় দূরে রেখ ওদের। বড় বজ্জাত ওরা। দুবাহুতে নবিতুনকে কচলে দলে একাকার করে সেদিন বলেছিল কদম সারেং–হ্যাঁ রে হ্যাঁ।
বিড়বিড় করে গাল পাড়ে নবিতুন। গুঁজাবুড়ি, খানকি মাগী, কুটনী ছিনালী। ওর মায়ের জন্মের ঠিক নেই, ওর নিজের জন্মের ঠিক নেই। মনে-মনে স্থির করে নবিতুন, এবার থেকে উঠোনটির আশপাশে দেখলেই দা লয়ে তাড়া করবে গুঁজাবুড়িকে। ইবলিসের দোসর গুঁজাবুড়ি, কানে-কানে তার কুমন্ত্রণা।
জাদুকরির ফাঁদে পা দিয়ে বিদেশের মধুতে ডুবে থাকবে তেমন লোকই নয় নবিতুনের কদমটি। আবার যদি এমন কথা মুখে আনে গুঁজাবুড়ি তবে কচুবাটা পুরে দেবে ওর মুখে। অথবা ঠুসিয়ে ওর সেই পুঁজা কোমরটার মতোই বেঁকিয়ে দেবে ওর থুতনিটা। মনে-মনে এটাও স্থির করে রাখল নবিতুন।
এক কথায় কত কথা মনে পড়ে যায় নবিতুনের।
বাপজান তখন জিন্দা। বাপজান আর নবিতুন, দুজনের সংসার ওদের। নবিতুন এসেছে বাড়ির পেছনে ডাঙার ঢেঁকিশাক খুঁজতে। আনমনে শাক তুলতে তুলতে ও এসে পড়েছিল ওদের বাড়ির সীমানা কান্দির পাড় অবধি। আচানক শুকনো পাতার মচমচ শব্দ শুনে চমকে তাকায় নবিতুন। চমকে তাকিয়ে হিম হয়ে যায় নবিতুন। ডাঙায় অচল গাছগুলোর মতোই থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। না যেতে পারে সুমুখে, না ছুটতে পারে পেছনে। কাছেই দাঁড়িয়ে রয়েছে মজল সারেংয়ের ব্যাটা। কিছুদিন ধরেই ও ঘুরঘুর করছে নবিতুনদের বাড়ির আশপাশটায়।
মজল সারেংয়ের ব্যাটা, সে নয় মস্ত জোয়ান, কিন্তু তার কাছাকাছি। কদম তার মাঝারি। হাত আর বাজুগুলো যেমন মোটা, তেমনি চ্যাপ্টা, তেমনি শক্ত। দেখে মনে হয় কালো রঙ করা এক জোড়া শালতি কাঠের থাম। গায়ে তার গেঞ্জি, পরনে হলদে সবুজ খোপ আঁকা তবন। মাথায় টেরি। এক পলকে বুঝি অতটুকু দেখে নিয়েছিল নবিতুন। তারপর ঘরের দিকে মুখ ফিরিয়ে পা বাড়িয়েছিল।
মজল সারেংয়ের ব্যাটা, দুঃসাহসের তার অন্ত নেই। ঝট করে দুকদম এগিয়ে আসে ও। আগলে দাঁড়ায় নবিতুনের পথটা। পদ গায় :
হিরামতি হিরামতি
আমি যামু সুধারাম কন্যামতি।
হিরামতি হিরামতি
তোমায় লইগা আন কি,
পুঁতির মালা পইরবে কি?
পুঁতির মালা কালা সুতায়
লাল পুঁতির মালা ধলা সুতায়
নীল?
পুঁতির মালা গলার চিক
পুঁতির মালা গুলবদনি ঝিলিক।
হিরামতি হিরামতি
বড়
গাংগে নাও ভাসিয়ে
গহিন জলে ডুবাল দিয়ে
আমি যামু সুধারাম কন্যামতি।
কি বেহায়া রকমের রসিক মজল সারেংয়ের ব্যাটা। দেখ না, গীত গায় আর কেমন রসিয়ে রসিয়ে হাসে। ওর কি চোখের লাজ মুখের শরম, কোনো কিছুই নেই? নবিতুন যে পালিয়ে বাঁচতে চায়। নবিতুন চোখ তুলতে পারে না, পা তুলতে পারে না ওই বেহায়া হাসি আর বেলাজ দৃষ্টির সামনে। শুধু বেলাজ নয় বেহায়া মজল সারেংয়ের ব্যাটা। ওটা একটা ডাকু। ডাকুর মতোই শালতি শালতি হাত দুখানি দুদিকে মেলে রুখে দাঁড়িয়েছে নবিতুনের পথটা।
কি চাও? ওর দিকে না তাকিয়েই শুধাল নবিতুন।
চাই সাংগা করতে। বুঝি এক মুহূর্তও দেরি হলো না উত্তরটা আসতে। মাগো, মজল সারেংয়ের ব্যাটা কেমন ত্যাঁদড় গো! মুখে কি ওর একটুও পর্দা নেই? শরমে যে লাল হয়ে যায় নবিতুন। গা যে ওর কাঁপে। পা যে ওর ভেঙে পড়ে। নবিতুন বলে– ছিঃ! ছিঃ বলে পা বাড়ায় নবিতুন। বেলাজ বেশরম আর ত্যাঁদড় হলেও মজল সারেংয়ের ব্যাটাটা বড় ভালো, বড় ভাস্যের মানুষ। আস্তে সরে যায় এক পাশে। পথ করে দেয় নবিতুনকে। কিন্তু পেছনে থেকে শুধায়, ছিঃ মানে কি রে?
নবিতুন কি আর জবাব দেবার জন্য ফিরে দাঁড়ায়? পড়িমরি ঘরে পৌঁছে আছাড় খেয়ে পড়ে চাটায়ের ওপর। গরগর করে কাঁপছে ওর শরীরটা। টিপটিপ করছে বুকটা। আর কত যে খুশি। খুশিটাই যেন ভয় আর কাঁপুনি হয়ে ওর সারা অঙ্গে দলে মথে ছড়িয়ে পড়ছে। খুশির ভারে কাঁপতে কাঁপতেই নবিতুন ভাবে, ছিঃ মানে কি? ছিঃ মানে তোমার মাথা। মুখে-মুখে তো এন্তার ছড়া কেটে যেতে পার, আর ছিঃ মানে বোঝ না?
কিন্তু মজল সারেংয়ের ব্যাটা কি আর বুঝতে ভুল করে? পরদিনই নবিতুনদের বাড়ি এসে হাজির ও। এ-কথা সে-কথা কত কথা জুড়ে দেয় নবিতুনের বাপজানের সাথে।
বেড়ার ওপারে শরমে মরে নবিতুন। মিঞা যতই কিসসা জুড়ক বাপজানের সাথে, নবিতুন কি আর বোঝে না কেন এসেছে মিঞা? বেড়াটার সাথে সেঁটে গিয়ে নিষ্কম্প বসে থাকে নবিতুন। চোখ দুটোকে ছোট্ট আর সুচলো করে ধরে বেড়ার ফুটোয়। ফুটো দিয়ে দেখে কালো রঙ শালতি কাঠের থামের মতো শক্ত বলবান দুটো বাহু, সাদা গেঞ্জি আর সেই হলদে-সবুজ খোপ-আঁকা তবন। আজ বুঝি সুরতে আরো চটক লাগিয়েছেন মিঞা। টেরি তার বড় চকচকে আজ। গলায় লাল ডুমা, জড়িয়ে ঘুরিয়ে পিঠ প্যাঁচিয়ে গলার সাথে সুন্দর করে বেঁধেছে ডুমাখানা। লাল ডুমায় বেশ মানিয়েছে ওকে।
বেশ মানিয়েছে ওকে, কথাটা মনে-মনে একটু নাড়িতে গিয়েই কেমন থরথরিয়ে কেঁপে যায় ওর গা-টা। ওর শাড়িটা খসখসিয়ে যায় বেড়ার গায়। ঠিক সেই সময় কি কাণ্ডটাই না করে বসল মজল সারেংয়ের ব্যাটা। মা গো মা, মনে করতে গেলে আজও বুঝি শরমে লাল হয়ে যায় নবিতুন। মজল সারেংয়ের ব্যাটা যেন কানখাড়া করে শুনল শাড়ির ওই খস-খসানি, বুঝিবা বেড়ার গায়ে অতর্কিতে নবিতুনের হাত লেগে খচ করে যে একটু শব্দ হলো, সেই শব্দটাও। চকিতে উঠে এলো মজল সারেংয়ের ব্যাটা, দরজা দিয়ে প্রায় অর্ধেকখানি শরীর গলিয়ে দিল বেড়ার ওধারে। নবিতুনের কোলের উপর দুটো পুঁতির মালা ছুঁড়ে দিয়ে বলল, গেছিলাম শহরে। তোর জন্য দুটো মালা আনলাম।
মরণ আর কি নবিতুনের। দিশেমিশে পায় না ও। না পারে ওভাবে বসে থাকতে, না পারে উঠে একটা ছুট দিতে। বেড়ার সাথে আরো সেঁটে এলো নবিতুন, যেন চোখ বুজে মিলিয়ে গেল। মিলিয়ে গিয়ে থরথরিয়ে বলল, নবিতুন, ছিঃ।
রসের অন্ত নেই মজল সারেংয়ের ব্যাটার। রস করেই শুধায়, ছিঃ মানে কি?
আঃ মরণ। আবার ছিঃ মানে…।
নবিতুনের বাপজান তখন ডাকছে ওপাশ থেকে, আয়নারে নবিতুন। মজল ভাই আমার জ্ঞাতি ভাই নয়, কিন্তু তার চেয়ে বেশি– জানি ভাই। তার ব্যাটার সামনে আবার পর্দা কি রে? আয় এদিকে।
ইস, দেখ না কেমন পটিয়ে নিয়েছে বাপজানকে। বেড়ার গায়ে ধুপ করে একটা প্রতিবাদ রেখে দেয় নবিতুন।
কিন্তু পুঁতির মালা জোড়া হাতে নিয়ে যেন গলে যেতে চায় নবিতুনের সারা অঙ্গ। পদ গাইতে গাইতে যেমনটি বলেছিল মজল সারেংয়ের ব্যাটা, কালো সুতায় লাল, ধলা সুতায় নীল, ঠিক তেমনি রঙ মিলিয়ে এনেছে পুঁতির মালা।
তাড়াতাড়ি মালা জোড়া তোরংয়ে তুলে যেন রক্ষা পায় নবিতুন।
মজল সারেংয়ের ব্যাটাটা ডাকু। মজল সারেংয়ের ব্যাটাটা রসিক। রসের তার শেষ নেই। চোখে তার হায়া নেই। মুখে নেই লাগাম।
কিন্তু মজল সারেংয়ের ব্যাটা কামের ব্যাটা বটে। যেই কথা সেই কাম তার। কদিনের মধ্যেই, শাবানের চাঁদটা শেষ হতে না হতেই, নবিতুনকে বৌ করে ঘরে এনেই শুধায় কদম সারেং, হ্যাঁ রে নবিতুন, ছিঃ মানে কি?
নবিতুনের মুখে তখন বোল ফুটেছে, মরসুমের হাওয়া পেলে যেমন বোল ফোটে আমের শাখায়। নবিতুন বলে, কেমন রসিক নাগর গো তুমি, ছিঃ মানে বোঝ না?
বলো না, ছিঃ মানে কি? মুখটাকে একেবারে নবিতুনের কানের কাছে এনে আবারও শুধায় কদম।
ছিঃ মানে জি। জি মানে হ্যাঁ। অবুঝটাকে এবার পষ্ট করেই মানেটা বুঝিয়ে দিল নবিতুন।
ছিঃ মানে এই। শালতি শালতি থামের মতো বলবান দুটো বাহুতে ওকে লুফে নিয়ে অর্থটা সেদিন বুঝিয়ে দিয়েছিল কদম।
সে-ই তো নবিতুনের কদম।
বিদেশের মধুতে ডুবে যাবে কদম, ভুলে যাবে নবিতুনকে, কেউ কসম খেয়ে বললেও বিশ্বাস করবে না নবিতুন।