০১. তৌহিদের কী যেন হল

রাত তিনটার দিকে তৌহিদের কী যেন হল। বুকে চাপ ব্যথা, ঠিকমতো নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। কী হচ্ছে? সে কি মরে যাচ্ছে? মৃত্যু কি এরকম হয়? তৌহিদ ক্ষীণ স্বরে ডাকল, রিমি, এই রিমিঃ।

রিমি এই বিছানায় তার সঙ্গেই ঘুময়। শুধু আজ ঘুমুয় নি। আজ দুপুরে দুজনের মধ্যে প্রচণ্ড রকমের ঝগড়া হয়েছে। সেই ঝগড়ার পরিণতিতে রিমি ঘুমুচ্ছে বসার ঘরের সোফায়। মশারি খাটানো যায় নি। দুটি মসকুইটো কয়েল জ্বালানো হয়েছে। তার উৎকট গন্ধে মশাদের কিছুই হচ্ছে না, দম বন্ধ হয়ে আসছে রিমির। তার একবারেই ঘুম হচ্ছে না, বার-বার ইচ্ছে করছে শোবার ঘরে মশারির ভেতর চলে যেতে। যাওয়া যাচ্ছে না, ও ঘরে যাওয়া মানে পরাজয় স্বীকার করে নেয়া।

তৌহিদ আবার ডাকল, রিমি। এই রিমি তৌহিদের গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যে রিমি সঙ্গে-সঙ্গে উঠে বসল—তীক্ষ্ণ গলায় বলল, কী হয়েছে?

বাতি জ্বালাও, আমি মরে যাচ্ছি।

রিমির সব এলোমেলো হয়ে গেল। এই ঘরের সুইচ বোর্ডটা কোথায়? সে সোফার কোন দিকে মাথা দিয়েছে? জানালা যে দিকে, সেই দিকে? এত অন্ধকার কেন চারপাশের সোফা থেকে নামার সময় ধাক্কা লেগে টেবিলে রাখা গ্লাস ঝন শব্দে ভাঙল। পাশের ঘর থেকে রিমির শাশুড়ি জোবেদা খানম বললেন, ও বৌমা কী হয়েছে, হয়েছে কী?

ভাগ্যিস তিনি কথা বলছিলেন, তাঁর কথা শুনেই রিমি দিক ঠিক করল। সুইচবোর্ড খুজে পেল। বাতি জ্বালাল। জোবেদা খানম একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছেন, ও বৌমা কি ভাঙলঃ ঘরে চোর ঢুকল না-কি দেখা ভালো করে দেখা খাটের নিচটা দেখ।

রিমি তার শাশুড়ির কোনো কথার জবাব দিল না। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তৌহিদের দিকে, বোঝাই যাচ্ছে, এই মুহূর্তে শ্বাস নেয়ার পুরো প্রক্রিয়াটা তৌহিদের কাছে অত্যন্ত কষ্টকর। তার ঠোঁট কেমন নীলচে হয়ে গেছে। চোখ ঘোলাটে। তৌহিদ। বিড়বিড় করে বলল, জানালা খুলে দাও, ফ্যান ছাড়।

রিমি ফ্যান ছাড়ল। জানালা খুলল। হুক থেকে মশারি খুলে ফেলল যাতে তৌহিদ প্রচুর বাতাস পায়। রিমি কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, পানি খাবে? পানি এনে দেই?

না।

তৌহিদের নিঃশ্বাসের এই কষ্টটা অনেক পুরানো। সবসময় হয় না, মাঝে-মাঝে হয়। যখন হয়; বড় ধরনের নাড়া দিয়ে যায়। তবে কখনোই বেশিক্ষণ থাকে না। আজ বড় দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আছে। এতক্ষণ থাকার কথা না।

পাশের ঘর থেকে জোবেদা খানম এখনো কথা বলে যাচ্ছেন, ও বৌমা, তোমরা কথা বললে জবাব দাও না কেন? চোর না-কি? চোর হলে একটা দা হাতে নিয়ে বের হও। খাটের তলা দেখেছ? এরা খাটের তলায় ঘাপটি মেরে থাকে।

রিমি বিরক্ত গলায় বলল, কিছু হয় নি মা। আপনার ছেলের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।

খোকার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে?

হ্যাঁ।

তুমি একটু এদিকে শুনে যাও তত বৌমা।

বুড়ো মানুষরা বড় বেশি যন্ত্রণা দেয়। একটা মানুষ নিঃশ্বাস নিতে পারছে না, ছটফট করছে আর তার শাশুড়ি শুধু বকবক করছেন।

ও বৌমা, তোমাকে বললাম এদিকে আসতে….

মা চুপ করে থাকুন। প্লিজ।

তৌহিদ বলল, কটা কমেছে। তুমি যাও শুনে এস।

কষ্টটা যে কমেছে এটা এখন বোঝা যাচ্ছে। মুখের ফ্যাকাসে ভাবটা চলে গেছে। চোখ পরিস্কার।

সত্যি-সত্যি কমেছে?

হ্যাঁ। তুমি যাও মাকে শান্ত করে আস।

রিমি বিরক্ত গলায় বলল, ও ঘরে গেলে মার সঙ্গে ঝগড়া হবে।

আহ্‌ যাও। বুড়ো মানুষ।

তোমার শ্বাসকষ্ট কমেছে?

হ্যাঁ, আমাকে এক কাপ কফি করে দাও। বলেই তৌহিদ মিষ্টি করে হাসল। যে কিছুক্ষণ আগেই ছটফট করছিল সে কী করে এত সুন্দর হাসে? আলাদা শোবার জন্যে রিমির নিজের উপর খুব রাগ লাগছে। কেন সে এটা করতে গেল? আর শ্বাসকষ্টটা বেছেবেছে আজকের দিনেইবা হল কেন? একদিন পরে হলেও তো নিজেকে এত অপরাধী মনে হত না।

রিমি, মা কি বলছে শুনে আস। রাগারাগি করবে না–প্লিজ।

রিমি শাশুড়ির ঘরে ঢুকল। বাতি জ্বালাল। জোবেদা খানম বিছানায় চুপচাপ বসে আছেন। তাঁর বয়স আশির কাছাকাছি। সেই তুলনায় শরীর খুব শক্ত। চোখে কম দেখেন তবে ঘ্রাণশক্তি অত্যন্ত প্রবল। রিমি ঘরে ঢোকামাত্রই বললেন, খোকার ব্যথা কমেছে?

হ্যাঁ।

সেটা আমাকে এসে বলে গেলে কি তোমার খুব কষ্ট হয়? আমার ঘরটা কি পাঁচ মাইল দূরে?

খামাখা ঝগড়া করবেন না মা। ঝগড়া করতে ইচ্ছে করছে না।

ঝগড়া কে করেছে, আমি না তুমি? একটা কথা এক শবার জিজ্ঞাস করলে একবার জবাব পাওয়া যায়।

রাতদুপুরে চেঁচামেচি করবেন না তো মা। ঘুমুতে চেষ্টা করুন।

খোকার বুকে তেল মালিশ করে দাও। খোকার আরাম হবে।

ওকে এখন খোকা ডাকবেন না। আপনাকে তোমা বলেছি—খোকা নামটা এখন ওর পছন্দ না।

যার যা নাম তাই তো ডাকব। যার নাম খোকা তাকে আমি কি ডাকব বসিরুদিন?

বসিরুদ্দিন বলার দরকার নাই—তার যা নাম তাই ডাকবেন। বুড়ো ধামড়াকে খোকা বলার দরকার কি?

নিজের স্বামীকে বুড়ো ধামড়া বলছ? এইসব কী বৌ?

স্বামী বুড়ো হলেও তাকে কচি বাবু ডাকতে হবে এইবা কেমন কথা?

রিমির গলা এখন বেশ ধারাল। ঝগড়ায় জোবেদা খানম এখন আর পারবেন না বলেই পিছিয়ে পড়লেন।

রিমি বলল, আরো কিছু বলবেন, নাকি আমি এখন যাব?

জোবেদা খানম বিজবিজ করে বললেন, অনির প্যান্ট বদলে দিয়ে যাও। ওর নিচে একটা কথা দাও। আবার বিছানা ভিজিয়েছে। পাঁচ বছর বয়স হলো—এখনো বিছানা ভেজায়। কতবার বললাম, একটা তাবিজটাবিজ দেয়ার ব্যবস্থা কর, তা শুনবে না। আমি একটা মানুষ না-কি? কে আমার কথা শুনবে? বাড়ির কুকুর-বেড়ালেরও একটা সম্মান আছে। আমার তাও নেই।

রিমি অনির প্যান্ট বদলে দিল। কাঁথা ভাঁজ করে অনির নিচে দিয়ে দিল। ঘমের মধ্যে বড় মিষ্টি লাগছে মেয়েটাকে। তার মেয়েটা রাজকন্যার মতো সুন্দর হয়েছে। রিমি অনির ঠোঁটে চুমু খেল।

জোবেদা খানম কঠিন গলায় বললেন, কতবার বললাম ঘুমের মধ্যে চুমু দেবে না। ঘুমের মধ্যে চুমু দিলে আয়ু কমে। অসুখবিসুখ হয়। নিয়ম-কানুন কিছু মান না বলেই তো অশান্তি হয়।

কোনো অশান্তি হয় না। আপনি চুপ করে ঘুমুতে চেষ্টা করুন তো। যত দিন যাচ্ছে, ততই আপনার যন্ত্রণা অসহ্য হচ্ছে।

জোবেদা খানম চিবিয়ে-চিবিয়ে বললেন, অসহ্য হলে আমার জন্যে হচ্ছে না, তোমার জন্যে হচ্ছে। তখন বলেছিলাম পুলিশের মেয়ে বৌ করে আনার দরকার নাই। কেউ আমার কথা শুনল না। এখন একেবারে হাতেনাতে ফল।

রিমি অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাল। ঝগড়া করতে ইচ্ছে করছে না। তৌহিদের পাশে গিয়ে খানিকক্ষণ বসা যাক।

তৌহিদ বিছানায় উঠে বসেছে। শুধু যে বসেছে তাই না। সিগারেট ধরিয়েছে। রিমি সিগারেট নিয়ে কড়া কিছু কথা বলতে গিয়েও বলল না। আহা খেয়ে ফেলুক। এমন ভয়ংকর একটা খারাপ জিনিস পুরুষ মানুষেরা এত আগ্রহ করে খায় কেন কে জানে।

রিমি বলল, কফি আনব?

হুঁ।

কাল কিন্তু ডাক্তারের কাছে যাবে।

আচ্ছা।

আচ্ছা না, যাবে।

একবার তো গেলাম, কিছু বলতে পারল না। খামাখা টাকা নষ্ট।

ঐ ডাক্তার বলতে পারে নি বলে কেউ পারবে না–তাতো না। কাল যাবে কিন্তু।

আচ্ছা।

তৌহিদ সিগারেটে টান দিতে-দিতে বলল, আবার মার সঙ্গে ঝগড়া করলে? একজন বুড়ো মানুষ।

উনি কি-যে খারাপ ব্যবহার করেন, তা তো তুমি জান না।

তোমার যখন আশি বছর বয়স হবে, তখন তুমি এর চেয়েও খারাপ ব্যবহার করবে।

না আমি করব না। বিশ্বাস কর, আমি করব না।

বলতে-বলতে রিমি তৌহিদের হাতে হাত রাখল। হাতে হাত রাখাটা ঠিক হল না। রাগারাগি এখনো চলছে। এর মধ্যে আগ বাড়িয়ে…….অবশ্য দুপুররাতে শাশুড়ির সঙ্গে ঝগড়া করাটা অনুচিত হয়েছে। না করেইবা সে কী করবে? ভদ্রমহিলার মন এত ছোট। যত দিন যাচ্ছে, ততই ছোট হচ্ছে। এক সপ্তাহ হয় নি তাঁর সব গয়না তিনি দান। করেছেন। সব গয়না পেয়েছে তাঁর তিন মেয়ে। যে ছেলের বাড়িতে আছেন তার স্ত্রীর জন্যে কিছুই নেই। তার জন্যে কোনো চক্ষুলজ্জাও বোধ করছেন না। শাশুড়ির সামান্য গয়নার জন্যে রিমির কোনো ক্ষোভ নেই। কিন্তুি তিনি এমন করবেন কেন?

 

তারা রাত চারটার দিকে ঘুমুতে গেল। সোফা ছেড়ে খাটে উঠে আসতে রিমির একটু লজ্জা লাগছিল। এটা এক ধরনের পরাজয়। তবে মাঝেমাঝে পরাজিত হতে খারাপ লাগে না। তৌহিদ বলল, ঘুম আসছে না। একটা রিলাক্সেন খাব?

কিছু খেতে হবে না। তুমি চুপচাপ শুয়ে থাক।

শুয়েই তো আছি।

শ্বাসকষ্টটা নেই তো?

না।

রিমি স্বামীর কাছে ঘন হয়ে এল। তার ঘুমুতে ইচ্ছা করছে না। ইচ্ছা করছে গল্প করে রাতটা কাটিয়ে দিতে। কিন্তু আশ্চর্য, যে মানুষটা একটু আগেও বলছিল ঘুম আসছে না সে ঘুমিয়ে পড়েছে। জেগে আছে রিমি। একা-একা জেগে থাকতে খুব খারাপ লাগে।

পাশের কামরা থেকে জোবেদা খানমের কথা শোনা যাচ্ছে। তিনি একা-একা ঝগড়া করছেন। আজ তাঁর প্রতিপক্ষ হচ্ছে আজরাইল। আজরাইল এত লোককে রোজ নিচ্ছে: তাকে কেন নিচ্ছে না—এটা তাঁর ক্ষোভের বিষয়। এই সংসারে থেকে তিনি আর অপমান সহ্য করতে পারছেন না। তাঁর মন্দ কপাল বলেই তিনি আশি বছর বয়সে হয়েছেন সকলের চোখের কাঁটা। বিশেষ করে তার ছেলের বৌয়ের। পুলিশের মেয়ে যেন সংসারে না আনা হয়—এই নিয়ে কত আপত্তি করলেন। কেউ তাঁর কথা শুনল না। এখন মজাটা তো হাতে-হাতেই দেখছে। কত কষ্টে যে তিনি এখানকার মাটি কামড়ে পড়ে আছেন তা তিনি জানেন, আর জানেন উপরে মাবুদ।

রিমির ইচ্ছা করছে উঠে গিয়ে বলে এখানে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে কে আপনাকে বলেছে? আপনি চলে গেলেই পারেন। আপনার তো আরো দুই ছেলে ঢাকা শহরেই থাকে। তাঁরা তো আর পুলিশের মেয়ে বিয়ে করে নি। তাদের সঙ্গে গিয়ে থাকলেই হয়। মেজোছেলের সঙ্গে পড়ে আছেন কেন? মেজোছেলে এমন কী রসগোল্লা?

বলা হল না। তবে জমা রইল। এক সময় রিমি বলবে। কঠিন-কঠিন কথা শুনাবে। আজকের রাতটা থাক।

টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। শ্রাবণ মাসের বৃষ্টি তেমন কোন বড় ঘটনা না। তবে এবারে অনেক দিন পর বৃষ্টি হচ্ছে। এটা যে শ্রাবণ মাস-রিমি ভুলেই গিয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *