আমাদের সেই শহরে – স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ২০০৯
সুতপা-রাজীব
সুম্পা-পল্লব-গুনিমা
ও
সঞ্জীবন
এই বই তোদের, তোমাদের।
১
“তোর ভবিষ্যৎ অন্ধকার।”
এই প্রেডিকশনটা যে এমনভাবে একেবারে প্রথম দিনেই ফলে যাবে তা বুঝতে পারিনি। সত্যিই চারদিকটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে আছে। মনে হচ্ছে যুদ্ধের বাজার। সাইরেন বেজেছে। বোমারু বিমান হানা দেবে যে-কোনও মুহূর্তে। হস্টেল থেকে বেরোবার সময় শুনলাম, কোথায় যেন ট্রান্সফরমার বিগড়েছে। নাও, ঠ্যালা বোঝে। মেসে গিয়ে রাতের খাবার সারার আগে এবড়ো-খেবড়ো পথে হোঁচট খেয়েই বোধহয় পেট ভরে যাবে। আমি ছোট-ছোট পায়ে এগোতে লাগলাম। নভেম্বরের প্রথম এখন। অল্প হিম পড়ছে। হস্টেল থেকে বেরোবার সময় দেবুকাকা ছিল আমার সঙ্গে। বলেছিল মাফলারটা মাথায় পেঁচিয়ে নিতে। নিয়েওছিলাম। কিন্তু অটো করে দেবুকাকা হোটেলের দিকে চলে যাওয়ার পর মাফলার খুলে নিয়েছি। এমনিতেই অন্ধকার তার উপর মাফলার জড়ালে মনে হচ্ছে যেন আরওই দেখতে পাচ্ছি না কিছু।
“কানা, বদ্ধকানা তুই। না হলে জয়েন্টে কেউ প্রশ্ন পড়তে ভুল করে!এখানে যদি ইঞ্জিনিয়ারিংটায় চান্স পেতিস, তা হলে অতদূর ঠ্যাঙাতে হত তোকে? নে, যা, ইডলি সাম্বার গেল। ওখানে গিয়েও যদি নিজের এমন ক্যালাসনেস দেখাস, তবে কিন্তু তোর ভবিষ্যৎ অন্ধকার।”
হাওড়া স্টেশনে দাঁড়িয়ে যখন মামা কথাগুলো বলছিল, চোখ ফেটে জল আসছিল আমার। এমনিতেই আমি হোমসিক ধরনের, তার উপর এতদূরে থাকা! আমার কেবল বাড়ির কথা, বন্ধুদের কথা মনে পড়ছিল। আর তার মাঝে মামার অমন খোঁচা!
এখন, এই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সেই কথাগুলো মনে পড়তেই চোখটা জ্বালা করে উঠল। কে জানে আমার পোষা বেড়ালটা কী করছে এখন? বন্ধুরা কি আড্ডায় জড়ো হয়েছে সব? বোনটার গানের মাস্টার এসেছে? বাবা কি ফিরেছে অফিস থেকে?
আমি কিছু জানি না। শুধু জানি এই ঘুটঘুটে অন্ধকার পেরিয়ে আমায় আপাতত পৌঁছতে হবে ওই মেসে।
এই জায়গাটার নাম শ্রীপুরম। বেঙ্গালুরু থেকে এর দূরত্ব একশো চুয়াল্লিশ কিলোমিটারের মতো। পাহাড়, ঝরনা, নদী, ছোট্ট রেলস্টেশন, নারকোল গাছ আর দেবদারু-ইউক্যালিপটাসের বাগান দিয়ে ঘেরা ভীষণ সুন্দর জায়গা এই শ্রীপুরম। গতকাল সকালে এখানে এসে হোটেলে উঠেছিলাম আমরা। তারপর আজই ভর্তি হয়েছি কলেজে। এরই মধ্যে আমি আর দেবুকাকা মিলে ঘুরে নিয়েছি চারদিক। কালকেই ফিরে যাবে দেবুকাকা। তারপরই আমি একা।
তবে জায়গাটাকে তখন যেমন সুন্দর লাগছিল, এখন এই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ততটাই কুৎসিত মনে হচ্ছে। কে জানে এখানে চার বছর কাটাব কী করে! আমাদের ক্যাম্পাসের পাশ দিয়েই গিয়েছে ন্যাশনাল হাইওয়ে ২০৬। মেসের মেন গেট দিয়ে ঢুকতে হলে এই হাইওয়ের পাশ দিয়েই যেতে হয়। রাস্তা দিয়ে যাওয়া গাড়ি থেকে ছিটকে আসা আলো ধরে এগোতে লাগলাম আমি। অচেনা জায়গা। কারও সঙ্গে আলাপও হয়নি। তার উপর শুনেছি এখানে ভালই র্যাগিং হয়। মেসে কোনও কিছু হবে না তো?
মেসের সামনে একটা হ্যাজাক জ্বলছে। দুর্বল আলোয় সবকিছুই কেমন যেন ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট লাগছে। দুটো সিঁড়ি ভেঙে বারান্দায় উঠলাম। ডানদিকে সাইনবোর্ড ঝুলছে। লেখা, ‘সমুদ্রম ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি, সিনিয়র বয়েজ় হস্টেল অ্যান্ড মেস, শ্রীপুরম।’
বারান্দা থেকে বাঁদিকে বেঁকলেই বড় একটা প্যাসেজ। তার এক কোণে মেসের দরজা আর তার পাশে সার-সার ঘর। সিনিয়র দাদাদের। দুপুরবেলা ভর্তি হওয়ার পর অফিস থেকে একটা সবুজ রঙের কার্ড দিয়েছিল। বলা হয়েছিল যে, মেসের প্রথম মিল নেওয়ার সময় ওয়ার্ডেনকে দিতে হবে।
ওয়ার্ডেনকে আমি দুপুরবেলাতেই দেখেছিলাম। এখন মেসে ঢুকে দেখলাম দূরে একটা কোনায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি। নাম মিস্টার শিবযোগী। মানুষটার বয়স পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ। ছোটখাটো চেহারা। ফরসা। দেখলে মনে হয়, ফেলুদার পাশ থেকে জটায়ু উঠে এসেছেন স্বয়ং।
আমি পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেলাম ওঁর দিকে।
“ইয়েস?”
আমি কার্ডটা বাড়িয়ে দিলাম, “স্যার, এই যে।”
“ও, নিউ স্টুডেন্ট!” উনি পাশের টেবিলের দিকে এগিয়ে তার উপর রাখা হ্যাজাকের আলোয় কার্ডটা দেখলেন, “সরসিজ চক্রবর্তী। ফার্স্ট ইয়ার, ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড কমিউনিকেশন। হুম। চক্রবর্তী। তুমি তো এদিকের, মানে সাউথের নও। বেঙ্গলি?”
“হ্যাঁ স্যার।”
“গুড। তা বসে পড়ো যেখানে খুশি। আজ তোমাদের ব্যাড লাক। সাধারণত এখানে পাওয়ার কাট হয় না। কিন্তু আজ ফল্ট হয়েছে। জেনারেটর আছে, তবে শুধু কলেজের জন্য। আজ অ্যাডজাস্ট করে নাও। কাল থেকে সব ঠিক হয়ে যাবে হোপফুলি। বাই দ্য ওয়ে, ওয়েলকাম টু সমুদ্রম ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি।”
শিবযোগী স্যার সরে গেলে, আমি চারদিকে তাকালাম। বড়-বড় চৌকো টেবিলের দু’দিকে একটা করে লম্বা বেঞ্চ পাতা। এক একটা বেঞ্চে চারজন করে বসতে পারে। অর্থাৎ প্রত্যেক টেবিলে আটজন করে বসবে। গোটা ঘরে দশটা টেবিল। কিন্তু প্রায় প্রত্যেকটাতেই আটজন করে বসে রয়েছে। আমি বসব কোথায়?
এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে খুব বোকা-বোকা লাগল। চলে যাব কি? কিন্তু না, যেতে হল না। তার আগেই শুনলাম একটা গলা, “কা-রে, খানা নহি হ্যায়? আ বৈঠ যা। জরা জাগা কর না।”
আমি দেখলাম একটু দূর থেকে একটা লম্বা কালোমতো ছেলে হাত তুলে ডাকছে আমায়। দেখেই বুঝলাম সিনিয়র। গলাটা হঠাৎ শুকিয়ে গেল। ছেলেটার মুখ-চোখ কেমন ঘোলাটে লাগছে। লাগছে, নাকি আলো-ছায়ার জন্য এমন মনে হচ্ছে? তবু পায়ে-পায়ে এগিয়ে গিয়ে বেঞ্চের এক কোণে বসলাম। বসামাত্র একটা স্টিলের থালায় দুটো রুটি আর একটু তরকারি চলে এল আমার সামনে। মেসের চারজন কর্মচারী খাবার দেয়। তাদের একজন থালাটা রেখে গম্ভীর গলায় ভাঙা হিন্দিতে যা বলল তার অর্থ হল, ব্যাচের মাঝে বসলে কাল থেকে আর খাবার দেবে না।
রাস্তায় হোঁচট আর এখানে ধমক। আমার পেট অর্ধেক ভরে গেল। রুটিটা অর্ধেক কাঁচা, বাকি অর্ধেক পোড়া। তরকারিটাও জঘন্য। কিন্তু প্রথম দিনেই তো আর খাবার ফেলা যায় না। তাই প্রাণপণ চেষ্টা করে দুটো রুটি শেষ করলাম। এবার ভাত। প্রতিটা টেবিলের মাঝে একটা বড় স্টিলের গামলা। তাতে ভর্তি ভাত রাখা আছে। আর তার পাশেই গর্ব করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ডালের বালতি। সঙ্গে কিছু দেবে না? আমার লোভী মনকে নিঃশব্দে থাপ্পড় মারল আমার চোখ। আশপাশে সবাই শুধু ডাল আর ভাতই খাচ্ছে, সঙ্গে কিছু নেই, আমিও তাই নিলাম। মনে পড়ল, বাড়িতে মাকে কী নাজেহালই না করেছি খাবার নিয়ে। বাবা তখন বলত, খাবার লক্ষ্মী, তাকে অবহেলা করতে নেই। হস্টেল জীবনের প্রথম রাতে এতকালের প্রতিশোধ লক্ষ্মীঠাকরুণ ভালভাবেই নিলেন।
“কী, খাবার কেমন লাগছে?” সেই লম্বা কালোমতো ছেলেটা এবার জানতে চাইল।
“খাবার? ভেরি গুড,” আমি অসম্ভব বিনয়ের সঙ্গে মটন বিরিয়ানি খাওয়ার মতো মুখ করে বললাম।
“তোর ভাল লাগছে! আচ্ছা?” এই অন্ধকারে কালোর মুখে আলো, “এই পুরো গামলার ভাত খেয়ে উঠবি। একটা দানাও যেন পড়ে না থাকে।”
অ্যাঁ? বলে কী? গোটা ভাত খাব কেমন করে? একে-একে টেবিলের সকলে উঠে গেলেও আমি বোকার মতো বসে রইলাম। সত্যিই কি এক গামলা ভাত খেতে হবে? খাবার কেমন লাগছের মতো নিরীহ প্রশ্নের পেছনে যে এমন দুরূহ কাজ লুকিয়ে ছিল বুঝব কী করে? আর প্রথম কোনও জায়গায় গিয়ে খাবার অখাদ্য বলে যে গালমন্দ করতে হয় তাও তো শিখিনি। খাবার টেবিল থেকেই কি তবে শিক্ষার সূত্রপাত হল?
নতুন ব্যাচের ছেলেরা এসে বসছে এবার। আমার থালার ভাত শেষ হয়ে গিয়েছে। আমি কি উঠব? কিন্তু সিনিয়র ছেলেটা যে বলল, সব ভাত খেয়ে নিতে!
“লে আজ মাফ কিয়া। অব হাত ধো লে,” মুখ ফিরিয়ে দেখলাম আবার সেই সিনিয়র। ও বলল, “স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করবি না। আমরা এখানে কেউ চুহা নই। অ্যাক্ট নরমাল। যা ভাগ।”
আমি উঠে গেলাম হাত ধুতে।
মেস থেকে বেরিয়ে আবার তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে, আমাদের, মানে জুনিয়র বয়েজ় হস্টেলে ফিরলাম। আমাদের এই হস্টেলটা কলেজ, মেস, ল্যাব, ওয়ার্কশপ, সিনিয়র হস্টেল সবকিছুর থেকে বিচ্ছিন্ন। খেলতে না নেওয়া ছেলের মতো সে মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমার ঘর তিনতলায়। অন্ধকারে হাতড়ে-হাতড়ে কোনও মতে উপরে উঠলাম। এখন দেখলাম তিনতলার করিডোরে কে বা কারা জানি চারটে মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখেছে। ফলে হাঁটাটুকু মসৃণ হল। কিন্তু ঘরের সামনে গিয়ে থমকে গেলাম। এ কী, দরজা খোলা কেন? আমি তো দরজায় তালা দিয়ে গিয়েছিলাম! দুপুরেই অফিস থেকে একটা তালা আর একটা চাবি দিয়েছিল। মেসে যাওয়ার আগে দরজায় তালা দিয়েছিলাম স্পষ্ট মনে আছে।
ঘরের ভিতর মোমবাতি জ্বলছে। কারা যেন কথাও বলছে। আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে শুনলাম একটা বিরক্ত গলা বলছে, “এটা একটা জায়গা? কারেন্ট পর্যন্ত নেই। তখনই বলেছিলাম এখানে ভর্তি হব না। শুনলে আমার কথা? আশপাশে একটা প্রপার টাউন পর্যন্ত নেই। দেখো বাবা, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তুমি আমায় এই শ্রীপুরম থেকে বেঙ্গালুরুতে দাদাভাইয়ের কলেজে ট্রান্সফার করার বন্দোবস্ত করো।”
গলায় রাগ এবং বিরক্তি স্পষ্ট। এই মহারাজা খাঞ্জা খাঁ মেজাজের মালিকটি কি আমার রুমমেট? মনে-মনে হাসি পেল আমার। অন্ধকারে হোঁচট, খাবারের গুঁতো, তারপর নবাবপুত্তুর!
২
ডাকটা এল ঠিক রাত পৌনে বারোটায়। অন্ধকার ঘরে চুপচাপ শুয়েছিলাম, হঠাৎ দরজায় ঠক-ঠক করে শব্দ হল। আমাদের ঘরের দু’দিকে দুটো খাট। খাটের পায়ের কাছে এক সেট করে চেয়ার টেবিল আর একটা করে দেওয়াল আলমারি। নবাবপুত্তুর বিছানার মাঝখানে শুয়ে টেবিলে পা তুলে একটা এলসিডি স্ক্রিনের কম্পিউটার গেমস ডিভাইস নিয়ে খেলছে। ওর নাম বালার্ক ভদ্র। কিন্তু এখনও পর্যন্ত যা পারফরম্যান্স তাতে ভদ্রর আগে ‘অ’-টা বসাতেই হবে।
ও আমায় শুরুতেই বলেছিল, “দ্যাখ, ফালতু ঝামেলা করবি না আমার সঙ্গে। আমি ফার্স্ট সেমটুকুই এখানে থাকব। আই ওয়ান্ট মাই স্পেস। বুঝেছিস?”
আমি থতমত খেয়ে বলেছিলাম, “ঠিক আছে, ঠিক আছে।”
“ঠিক যেন থাকে। ফালতু হ্যাজাতে পছন্দ করি না আমি।”
এ কেমন রুমমেট জুটল আমার কপালে! একটা গোটা সেমেস্টার এর সঙ্গে এক ঘর শেয়ার করতে হবে চিন্তা করেই মনটা তেতো হয়ে যাচ্ছিল। প্রথম দিন বলেই কিনা কে জানে, অন্যান্য ঘর থেকেও কেউ আলাপ করতে আসেনি। একা-একা শুয়ে চোখ লেগে এসেছিল আমার। ঠিক তখনই ঠক-ঠক শব্দটা হল। বিছানায় উঠে বসে মোবাইলের সুইচ টিপে দেখলাম এগারোটা পঁয়তাল্লিশ।
“হ্যালো, ওপেন আপ,” দরজার ওপার থেকে একজন ডাকছে। নবাবপুত্তুর তো আর উঠবে না। তাই আমি কোটালপুত্র, উঠলাম। বললাম, “জাস্ট আ সেকেন্ড।”
হাতড়ে-হাতড়ে টেবিল থেকে দেশলাই নিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে দরজা খুললাম। একটা ফরসা মতো ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ফুলহাতা শার্ট ছেড়ে পরা। গলার বোতামটা পর্যন্ত আটকানো। মুখে একটা ভালমানুষ ভাব। ছেলেটা বলল, “তোমাদের নীচে ডাকছে।”
“নীচে?” আমি অবাক হলাম।
“একতলায় কয়েকজন সিনিয়র আছে। সেই ঘরে তোমাদের দু’জনকে ডাকছে। প্লিজ় তাড়াতাড়ি যাও। না হলে বকবে ওরা।”
সিনিয়ররা ডাকছে! এত রাতে? এই রে, এখন কী হবে? আমার গলা শুকিয়ে গেল। আমি বালার্কের দিকে তাকালাম। ও পাত্তাই দিচ্ছে না। এমনভাবে গেমস খেলছে যেন অলিম্পিকের কোয়ালিফায়ার। আমি বললাম, “বালার্ক চল, নীচে যেতে হবে।”
“আমি যাব না। তুই যা।”
“কিন্তু সিনিয়ররা ডেকেছে যে।”
“তো? ফালতু হ্যাজাবি না বলেছি না।”
আমি চুপ করে গেলাম। আমার সামনে দাঁড়ানো ছেলেটার মুখেও অবাক ভাব। আমি কথা না বাড়িয়ে করিডোরে বেরিয়ে এলাম। একাই যাই। সিঁড়ি দিয়ে নামতে যাব, এমন সময় ছেলেটা বলল, “শোনো, তুমি আজ এসেছ তো, তাই হয়তো জান না যে, এখানে কয়েকটা নিয়ম আছে।”
“অ্যাঁ?” আমি ভ্যাবলার মতো অন্ধকার সিঁড়ির হ্যান্ড-রেলে রাখা মোমের অল্প আলোয় ছেলেটার দিকে তাকালাম। বলে কী, নিয়ম?
“বাই দ্য ওয়ে, আমার নাম কল্যাণব্রত রায়। তুমি?”
নাম বললাম আমি। তারপর প্রশ্ন করলাম, “নিয়ম মানে? কলেজ থেকে তো কিছু বলল না।”
“না-না, এটা কলেজের নিয়ম নয়। সিনিয়রদের তৈরি করা নিয়ম। আমরা যারা জুনিয়র, তাদের মানতে হয়।”
“কী নিয়ম?”
কল্যাণ সামান্য হাসল, তারপর বলল, “এখানে সিনিয়রদের ‘স্যার’ বলে ডাকতে হবে। দেখা হওয়ামাত্র দিনের সময় অনুযায়ী তাদের গুড মর্নিং, গুড আফটারনুন বা গুড নাইট বলে উইশ করতে হবে। তাদের সব কথা শুনতে হবে। আর হ্যাঁ, একটা ড্রেস কোডও ঠিক করে দেওয়া হয়েছে আমাদের জন্য।”
“ড্রেস কোড?” আমি বুঝতে পারলাম না এরপর কী বলবে কল্যাণ।
“হ্যাঁ ড্রেস কোড,” কল্যাণ ঢোঁক গিলল, “ফুল শার্ট না গুঁজে ছেড়ে পরতে হবে। গলার বোতাম পর্যন্ত বন্ধ করতে হবে। জিন্স বা কর্ডের প্যান্ট পরা যাবে না। আর হ্যাঁ, জুতো বা স্নিকারও চলবে না। স্রেফ হাওয়াই চটি। শুধু যেদিন মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপ থাকবে, সেদিন জুতো পরা চলবে। বুঝেছ?”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। না বুঝে উপায় আছে! এখানে আসার আগে র্যাগিং নিয়ে অনেক গল্প শুনেছি। তবে এ-ও শুনেছি যে, এখন নাকি এসব নিষিদ্ধ, আইনবিরুদ্ধ। তাই ভরসা ছিল। কিন্তু কল্যাণের কথা শুনে আইন যে একুশে তা বুঝতে বাকি রইল না।
কল্যাণ বলল, “যাও, আর দেরি কোরো না। সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাঁদিকে যাবে। নয় নম্বর ঘর। বেস্ট অফ লাক। আর হ্যাঁ, উইশ করতে ভুলো না যেন।”
না, ভুলব না। নিজের নাম ভুলে গেলেও উইশ করতে ভুলব না। নয় নম্বর ঘরের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হল, অক্সিজেন ছাড়া হিমালয়ের মাথার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছি। আমি প্রাণপণে শ্বাস নিয়ে দরজায় টোকা দিলাম।
“কৌন বে?”
“স্যার, আমি।”
“তুই কে? সচিন তেন্ডুলকর?”
“স্যার, জুনিয়র। ডেকেছিলেন বলে এসেছি।”
“চলে আয়।”
দরজা খুলে ভিতরে ঢোকামাত্র হালকা হোমিওপ্যাথি ওষুধের গন্ধ পেলাম। আর দেখলাম ছোট্ট ঘরটার দুটো খাটে ছ’-সাতজন ছেলে বসে রয়েছে। ঘরের মাঝে দুটো ছেলে দাঁড়িয়ে। আমি অল্প আলোতেও সিনিয়রদের ভিতরে চিনতে পারলাম একজনকে। কালো, লম্বা মতো। এই রে, আমি যে তখন এক গামলা ভাত খাইনি তার কি শোধ তুলবে?
বেঁটে মতো একজন সিনিয়র বলল, “চেয়ারে বোস। তোর টার্ন এখনও আসেনি।”
আমি বাধ্য ছেলের মতো চেয়ারে বসলাম। বুঝলাম ঘরের মাঝে দাঁড়ানো দুটো ছেলের টার্ন চলছে এখন। তারপর আমার জবাইয়ের পালা।
বেঁটে মতো সিনিয়রটা বলল, “গুপ্তা, এই দুটো মালকে আর একটা দুটো প্রশ্ন করে ছেড়ে দে।”
লম্বা কালো ছেলেটা তাহলে গুপ্তা। আমি মনে রাখা শুরু করলাম।
গুপ্তা ঘরের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা মোটা লম্বা ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল, “তা রুচির, কোনও গার্লফ্রেন্ড আছে তোর?”
“গার্লফ্রেন্ড? থি স্যার, অভি নহি হ্যায়।”
“ছিল? তা কেমন দেখতে? ফিগারের ডেসক্রিপশন দে।”
“ফিগার?” রুচির ঠোঁট চাটল।
“বল। মাপ কেমন, দেখতে কেমন।”
“দেখতে ঠিকঠাক। আর কি… ফি…”
গুপ্তা খাট থেকে উঠে রুচিরের চুল ধরল, “হ্যাঁরে গাধা, চেহারা কেমন? শরীরে কার্ভস আছে না ক্যারমবোর্ড?”
রুচির চুলের টানে মুখ বেঁকিয়ে বলল, “স্যার, রোগা স্যার, ভীষণ রোগা ছিল…”
গুপ্তা খ্যাঁক-খ্যাঁক করে হেসে বলল, “তাই কাটিয়ে দিয়েছিস? যা ভাগ। তুইও যা।”
ম্যাজিকের মতো রুচির আর অন্য ছেলেটা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অর্থাৎ এবার আমার পালা। আমি তেত্রিশ কোটি দেব-দেবীকে একসঙ্গে স্মরণ করলাম।
“ঘরের মাঝখানে নিল-ডাউন হয়ে বোস,” এবারও গুপ্তাই বলল। আমি দুর্বল হাঁটু নিয়ে বসলাম। সেই ক্লাস সেভেনে থাকতে একবার এভাবে বসেছিলাম, তারপর এখন।
“ইন্ট্রো দে।”
আমার মরুভূমির মতো মুখের ভিতরে শব্দ গজাতে দু’-এক মুহূর্ত সময় লাগল। বললাম, “মাই নেম ইজ় সরসিজ চক্রবর্তী।”
“লাথ খাবি শালা, কোন ইংরেজের গু মারিয়েছিস? রাষ্ট্রভাষায় বল, শিগগির বল!”
শালা ছাড়াও বাক্যটায় আরও চার পাঁচটা খানদানি বিশেষণ ছিল। শরীরের সমস্ত রক্ত এসে কান ও মাথায় ভর করল, এ ভাষার সঙ্গে লড়ব কী করে আমি?
“কীরে…” আবার অমুক, তমুক, এলাটিং, বেলাটিং। এবার শেষ দুটো গালির অর্থই বুঝলাম না। আমি নিরুপায় হয়ে গড়িয়াহাটি হিন্দিতে যথাসাধ্য বললাম যে, আমার নাম সরসিজ চক্রবর্তী। বাড়ি কলকাতায়। এইচ এস-এ ভাল গ্রেড পেয়েছি। এখানে ইলেকট্রনিক্স ও কমিউনিকেশন নিয়ে পড়তে এসেছি ইত্যাদি, ইত্যাদি। এবার বেঁটে রোগা মতো সিনিয়রটা এগিয়ে এসে বলল, “মেরা নাম হ্যায় অজিত। সারা কলেজ মুঝে লয়েনকে নাম সে জানতা হ্যায়। বাপ কা নাম নহি বোলা তুনে। বাপ কা নাম বতা।”
“শ্যামাপ্রসাদ চক্রবর্তী,” ঠাস। আমার মাথা আড়াই চক্কর ঘুরল। গালে দু’ হাজার লঙ্কার গুঁড়ো জ্বলছে। চোয়ালের নাট বল্টুও লুজ হওয়ার উপক্রম। ভাবলাম, তবে কি বাবার নাম ভুল বললাম? কিন্তু তা কী করে হয়?
লয়েন বলল, “এখনও বুঝিসনি কেন চড়টা খেলি?”
আমি মাথা নাড়লাম। চড়ের কি আর ডিকশনারি থাকে!
লয়েন বলল, “শালা, বাপের নামের আগে মিস্টার বা শ্ৰী বলতে হয় জানো না? আর যদি ভুল হয় দেখিস কী করি।”
তা দেখলাম বটে। পরের পনেরো মিনিট ধরে আমায় নাচতে হল। গাইতেও হল। পাঞ্জাবি খুলে হাত ঘুরিয়ে রোগা শরীর নিয়েও বডি বিল্ডিং করতে হল। তারপর দু’ বোতল জল এক মিনিটের ভিতর খেতে হল। এসবের মাঝে দাঁড়ি কমা সেমিকোলনের মতো ছিল চড়, চুল ধরে টান আর তৎসম ও তদ্ভব বিশেষণ।
যখন ছাড়া পেলাম, মনে হল ব্রহ্মাণ্ড শ্রীকৃষ্ণের মুখের থেকে বেরিয়ে আমার মাথায় এসে ঢুকেছে। এত খারাপ কথা শোনার অভ্যেস কোনওদিন না থাকায় যেন নিতে পারছি না। বুঝলাম র্যাগিং যতটা না শারীরিক তার চেয়ে অনেক বেশি মানসিক। এ-ও বুঝলাম, এইসব ঝক্কি সামলে পড়াশোনা করা খুব একটা সহজ হবে না। ঘর থেকে বেরোতে যাব, হঠাৎ পিছন থেকে আমায় ডাকল লয়েন, “এই তোর রুমি এল না তো!”
আমি ঢোঁক গিললাম। এরা যদি বালার্কর রঙের কথা জানতে পারে, তাহলে এই রাতেই না ওকে নামিয়ে এনে দক্ষিণা দেয়। আমি বললাম, “স্যার, ও টায়ার্ড তাই ঘুমিয়ে পড়েছে।”
“টায়ার্ড, না তেল বেড়েছে? শালা দুপুরে অফিসের সামনে ভর্তি হওয়ার সময় আমার কাঁধে টোকা মেরে বাথরুম কোথায় জিজ্ঞেস করেছিল। ওর ব্যবস্থা করতে হবে,” গুপ্তা কথাটা বলে ঠোঁট কামড়াল। আধো অন্ধকারেও দেখলাম ওর চোখ জ্বলছে। আমি আর না দাঁড়িয়ে ঘরের দিকে এগোতে-এগোতে শুনলাম গুপ্তা বলছে, “শালার কথাটা কওশলকে বলতে হবে। ও বাড়ি থেকে ফিরুক, তারপর দেখছি।”
তখনও বুঝিনি সত্যিই কত কিছু দেখার বাকি আছে আমার।
৩
“এ তো কিছু নয়, আসল খেল তো এবার জমবে,” আন্টিস শপে বসে বিজ্ঞের মতো বলল কল্যাণ।
মেস থেকে দুপুরের খাবার সেরে আমরা এসে বসেছি হাইওয়ের ধারে আন্টিস শপে। এখানে প্রধান দোকান বলতে দুটো। আন্টিস শপ আর সুরির দোকান। আমাদের কলেজ ক্যাম্পাস শ্রীপুরমে হলেও, প্রপার টাউনে নয়। সেখান থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে। এই জায়গাটা সুন্দর হলেও নির্জন। এই দুটো দোকান ছাড়াও দূরে রেললাইনের পাশে দু’-চারটে মদের দোকানও রয়েছে। তবে আমরা সেখানে যাই না। সিনিয়ররা যায়।
আন্টিস শপে টুকটাক স্ন্যাক্স, কফি, কেক আর কোল্ড ড্রিঙ্ক পাওয়া যায়। মেসে দুপুরের খাবার সেরে আমরা দল বেঁধে কফি খেতে আসি এখানে। আজ আমাদের সেকশনের ওয়ার্কশপ আছে সেকেন্ড হাফে। দুপুর দুটো থেকে শুরু হবে ক্লাস। এখনও আধ ঘণ্টা মতো সময় আছে। আমাদের কলেজে ক্লাস শুরু হয় সকাল আটটায়। প্রথম ব্রেক দশটা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত। সাড়ে দশটার থেকে ক্লাস হয় সাড়ে বারোটা পর্যন্ত। এরপর দেড় ঘণ্টার লাঞ্চ ব্রেক। তখনই আমরা স্নান খাওয়া সেরে নিই। অবশ্য আমার ক্ষেত্রে খাওয়াটা নামেই। এখানে খাওয়ার পর টক দই দেয়। আমি সেই টক দইটা খাই।
কিন্তু খিদে থাকে পেটে। আজও আছে। তাই বাকিরা কফি খেলেও আমি নুডল্স নিয়েছি এক প্লেট। বিশ্বদীপ আমার প্লেট থেকে এক খাবলা নুডল্স তুলে বলছিল গতকাল রাতে ওর র্যাগিংয়ের অভিজ্ঞতা। সেটাকে পাত্তা না দিয়ে কল্যাণ তার বিশেষজ্ঞের মতামতটা পেশ করল।
এখানে এসেছি প্রায় পাঁচদিন হয়েছে। তাই প্রাথমিক ‘তুমি’ কেটে সম্বোধন ‘তুই’-তে পৌঁছে গিয়েছে। এর মধ্যে আলাপও হয়েছে আমার ব্যাচমেটদের সঙ্গে।
আমাদের ফার্স্ট ইয়ার একটা ছোটখাটো ভারত। এখানে যেমন কোরদ্বেয়ার থেকে আসা ছেলে অভিষেক রাওয়াত রয়েছে, তেমনই আছে কেরলের বাঙারু গিরিশ। আছে নাগাল্যান্ডের বিজয় আর ঝাড়খণ্ডের বিকাশ। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমরা পাঁচ ছ’জনের সঙ্গে গুজরাতের রুচির অগ্রবাল আর কর্নাটকের স্থানীয় ছেলে অরবিন্দ অপ্রমেয়। তবে আমার বেশি ভাব হয়েছে, আশ্চর্য হলেও, নবাবপুত্তুরের সঙ্গে। প্রথম রাতের খিটখিটে ছেলেটা পরদিন সকালেই নিজের পদবির মর্যাদা রেখেছিল। ওর নিজের ভাষায়, “মাথা গরম থাকলে আমার হুঁশ থাকে না। খারাপ কিছু বলে থাকলে, সরি, লেট্স বি ফ্রেন্ডস। এক সেমের জন্য হলেও লেট্স জয়েন হ্যান্ডস।”
আমি নুডলসের প্লেটটা বালার্কর দিকে এগিয়ে দিয়ে কল্যাণকে জিজ্ঞেস করলাম, “হঠাৎ এমন বলছিস কেন? গত চার পাঁচদিন ধরে যা হচ্ছে, তা কি কিছু নয় নাকি? আমায় মেরে পিঠে কালসিটে ফেলে দিয়েছে।”
কল্যাণ হাসল, “খোকাবাবু, এসব কিচ্ছু র্যাগিং নয়। আজ তো সব বাবা মায়েরা চলে যাবে, তারপর দেখবি পেঁদিয়ে সব করমচা বানিয়ে দেবে আমাদের।”
আমি ভাবলাম আমার সঙ্গে তো আর বাবা-মা আসেনি, দেবুকাকা পৌঁছে দিয়ে চলে গিয়েছে। আমার গার্ড তো এমনিতেই নেই।
ময়ূখ প্রশ্ন করল, “করমচা? কেন? করমচা বানাবে কেন? তুই কি গরম চা বানাবার কথা বলছিস?”
কল্যাণের উত্তরটা বলার আগে আমি মুহূর্তকাল সময় চেয়ে নিচ্ছি পাঠকদের কাছ থেকে। ময়ূখ হল আমাদের ব্যাচের একটি রত্ন। আমার মনে আছে আমাদের প্রথম ক্লাস ছিল এমইএস-এর অর্থাৎ সাবজেক্টটার নাম হল মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স। ওয়ার্ডেন শিবযোগীর সাবজেক্ট। উনি প্রথম দিনই ময়ূখকে তুলে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তুমি বলো, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কী?”
ময়ুখ চোখ পিটপিট করে, ঠোঁট চেটে, ভীষণভাবে নড়তে-নড়তে মাথার কদমছাঁট চুল ঘেঁটে যে-উত্তরটা বের করে এনেছিল তা শুনে শিবযোগী স্যার খানিকক্ষণ থতমত খেয়েছিলেন। ময়ূখ বলেছিল, “ইঞ্জিনিয়াররা যখন মেকানিকের কাজ করে তখন তাকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বলে।”
স্যার ব্যাপারটা বুঝে উঠতে-উঠতেই ক্লাসে হাসাহাসি শুরু হয়েছিল। স্যার জিজ্ঞেস করেছিলেন, “প্লাস টু-তে কেমন রেজ়াল্ট হয়েছিল তোমার?”
ময়ূখ গর্বের সঙ্গে বলেছিল, “তেমন সুবিধে করতে পারিনি স্যার। তাই তো বাবা এখানে ডোনেশন দিয়ে ম্যানেজমেন্ট কোটায়…”
আচ্ছা বুঝেছি-বুঝেছি, বোসো,” ময়ূখকে বসিয়ে স্যার যেন নিজেই স্বস্তি পেয়েছিলেন।
কল্যাণ বলল, “ছাগল, তোকে বলেছি না কথা বলবি না। গরম চা! হুঁঃ।”
অরবিন্দ বলল, “খেল জমবে মানে কী?”
কল্যাণ বলল, “মার তুই দেখিসনি এখনও। গতকাল সেকেন্ড ইয়ার মেকানিক্যালের আবিরদা বলছিল, আজ নাকি রণবিজয় কওশল ছুটি কাটিয়ে বাড়ি থেকে আসছে। সবচেয়ে ফেরোশাস র্যাগার হল রণবিজয়।”
আমি ঢোঁক গিললাম। প্রথম রাতের কথাটা মনে পড়ে গেল হঠাৎ। গুপ্তা বলেছিল না, বালার্ককে টাইট দেবার জন্য কওশলকে বলবে! সেই কওশল আজ আসছে! আমি আড়চোখে বালার্ককে দেখলাম। ও নির্বিকারভাবে নুডল্স খাচ্ছে। না, গুপ্তার ওই কথাটা বালার্ককে বলিনি আমি। কী দরকার ফালতু টেনশন দিয়ে। তবে আলতো করে বলেছিলাম সিনিয়রদের যেন না চটায় ও। যেন স্যার বলে ডাকে। কিন্তু বালার্ক শোনেনি। বরং বলেছিল, “ভাগ, কেন স্যার বলব? ওই সব ফালতু ব্যাপারে আমি নেই।”
কল্যাণ বলল, “রণবিজয় চাবুক ছেলে। পড়াশোনায় নাকি দারুণ। তবে খুব মুডি, আর ভীষণ ড্রিঙ্ক করে। ও এই কলেজের লন টেনিস চ্যাম্পিয়নও। গত দু’বছরই জিতেছে।”
“এবার পারবে না,” বালার্কর কথায় আমরা সকলে ওর দিকে তাকালাম।
লম্বা চেহারার ছেলেটা এমনভাবে কথাটা বলল যেন নস্ত্রাদামুস।
“মানে? কেন পারবে না?” কল্যাণ ভুরু কোঁচকাল।
“আমি হারাব তো ওকে।”
ময়ূখ জিজ্ঞেস করল, “কীসে হারাবি?”
বালার্ক কিছু বলার আগেই কল্যাণ বলল, “রান্নাবাটি খেলায়। বোকা একটা,” তারপর বালার্ককে বলল, “এভাবে বলিস না। কওশলের কানে গেলে কিন্তু বিপদে পড়বি।”
বালার্ক নাক টেনে বলল, “বিপদের ভয় দেখাস না কলু। অমন কওশল অনেক দেখা আছে আমার।”
“এই সরসিজ, শোন,” আড্ডার মাঝে ডাকটা শুনে মুখ তুলে তাকালাম। হাইওয়ের ওই দিকে লাল শার্ট পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে একজন। গতকাল এ-ও আমার খুব হেনস্তা করেছে। হাওয়াই চপ্পল মাথায় নিয়ে কলেজের মাঠ প্রদক্ষিণ করিয়েছে। তারপর এক বালতি জামাকাপড় দিয়েছিল কাচতে। আজ সকালে কলেজ শুরুর আগে কাচা জামাকাপড় দিয়ে এসেছি ওকে। জামাকাপড় কি পরিষ্কার হয়নি? এই দুপুরবেলা কি চপ্পলের খেল আবার দেখাবে?
আমি পায়ে-পায়ে উঠে গিয়ে দাঁড়ালাম ওর সামনে। গোলগাল মুখটা কুঁচকে আছে বিরক্তিতে, চুল এলোমেলো।
আমি বললাম, “স্যার ডাকছিলেন?”
“আমায় কিছু টাকা দিতে পারিস?”
“টাকা?” আমি অবাক হয়ে গেলাম। হঠাৎ টাকা চাইছে কেন? এও কি র্যাগিংয়ের অংশ? এ তো আচ্ছা ফ্যাসাদ হল।
“ভয় নেই, নেক্সট উইকে শোধ করে দেব। বাবা টাকা পাঠাবে।”
“মানে…স্যার…ইয়ে কত টাকা?”
“তিন হাজার। ভাড়া আর দোকানের কিছু টাকা বাকি পড়েছে। আর শোন, একা যখন থাকবি আমায় স্যার বলবি না, দাদা বলে ডাকবি, বুঝেছিস?”
“হ্যাঁ, আবিরদা,” আমি মাথা নাড়লাম।
“আর একটা কথা শোন, টাকার কথা যদি কাউকে বলিস তাহলে…”
আমি কষ্ট করে হাসলাম। ফিল ইন দ্য ব্ল্যাঙ্কটা ছোট থেকে খুব ভাল করে আমি জানি।
আবিরদা শেষবারের মতো চোখের ওয়ার্নিং দিয়ে চলে গেল। আমার কাছে হঠাৎ তিন হাজার টাকা চাইল কেন আবির মজুমদার? গতকাল অমন র্যাগিং করার পর হঠাৎ আজ এতটা পারসোনাল হেল্প চাইল? আবির মজুমদার সেকেন্ড ইয়ার মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং- এর স্টুডেন্ট। এবছর, থার্ড ইয়ার মানে ফিফথ সেম-এ উঠতে পারেনি। এখানকার নিয়ম মতো এক বছর ফেল করলেই হস্টেল থেকে নাম কেটে দেয়। তখন আশপাশের বাড়িতে মাথা গোঁজার বন্দোবস্ত করতে হয়। তবে এখানে আট বাই দশ ফুট ধরনের খুপরি পাওয়া যায় সহজেই। আবিরদাও ওরকমই একটা খুপরিতে রয়েছে। আমাদের জুনিয়র বয়েজ় হস্টেলের কাছেই ক্যাম্পাসের পাঁচিল। পাঁচিলের লাগোয়া বাড়ির দোতলায় আবিরদা থাকে।
আন্টিস শপে ফেরার পথে মনটা খচখচ করতে লাগল আমার। না, তিন হাজার টাকার জন্য নয়, আমি ভাবলাম হঠাৎ সকলকে ছেড়ে আমায় এসে ধরল কেন আবির মজুমদার?
ওয়ার্কশপে গিয়ে দেখলাম আমাদের ব্যাচের আঠারোজন এসে পড়েছে এর মধ্যে। চারদিকে হাতুড়ি, ছেনি, হ্যাকসো ব্লেড, জিগ ইত্যাদি ছড়ানো। আমরা খাতা নিয়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে পড়লাম। তারপর ক্রমশ শিখে নিলাম কতরকমের হাতুড়ি হয়, ছেনি হয়, ফাইল হয়, ওয়েল্ডিং কী করে করে, অক্সি-অ্যাসিটিলিন শিখা দিয়ে গ্যাস কাটিং করা হয় কেন, ইত্যাদি এমন নানারকম যান্ত্রিক রসের কথা। এর পর আমাদের সকলের হাতে একটা করে তিন ইঞ্চি বাই তিন ইঞ্চি মাপের মাইল্ড স্টিলের প্লেট ধরিয়ে তাতে একটা ডিজাইন আঁকিয়ে ইনস্ট্রাক্টর বললেন, হ্যাকসো ব্লেড দিয়ে তা কেটে ফেলতে।
কেলেঙ্কারি, লোহা কাটব কী করে? আমি এমনিতেই বেঁটেখাটো, ওজন ঊনপঞ্চাশ কেজি, লোহা কাটা কি আমার কম্ম? তা ছাড়া আমি নিয়েছি ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড কমিউনিকেশন, তাতে লোহা কাটা কোন কাজে লাগবে? তবু, ক্লাসওর্য়াক যখন, তখন করতে তো হবেই।
এর পরের দু’ ঘণ্টা যুদ্ধের ইতিহাস। আমি বনাম তিন ইঞ্চি বাই তিন ইঞ্চি। লোহা যে কী ভয়ানক ঢ্যাঁটা ধাতু তা এই প্রথম বুঝতে পারলাম। দুটো হ্যাকসো ব্লেড ভাঙলাম, তিনবার নিজের হাত কাটলাম, তালুতে ফোস্কা পড়ল কিন্তু লোহা বাবাজির বিশেষ ক্ষয়ক্ষতি হল না। ক্লাস শেষে দেখলাম রাজত্ব ও সম্মান দুই-ই হারিয়েছি আমি। অন্যরা সবাই মাপ মতো লোহা কাটলেও আমি ডাহা ফেল করেছি।
স্যার এগিয়ে এসে আমার হাত থেকে লোহার টুকরোটা নিয়ে বললেন, “এ কী? কাটতে পারনি দেখছি। মেয়েরা সব কেটে ফেলল, আর তুমি পারলে না?”
রাগে আমার গা রি-রি করতে লাগল। সারা ক্লাসের সামনে এ কী বেইজ্জতি! ভাবলাম বলি, এই সময়ে দাঁড়িয়ে ছেলে-মেয়ে নিয়ে জেন্ডার পলিটিক্স করছেন? সুনীতা উইলিয়ামস তো স্পেসে পৌঁছে গেছেন মেয়ে হয়ে, আপনি এই কামারশালায় কেরামতি না দেখিয়ে, যান না দেখি, চাঁদ, সূর্য, বেষ্পতি, শুক্রকে দু’ চক্কর মেরে আসুন না।
কিন্তু জীবনের অনেক অপূর্ণ ইচ্ছের মতো, এই ইচ্ছেটাও মুলতুবি রাখতে হল। বরং সকলের জলবিছুটির মতো হাসির সামনে দিয়ে মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলাম ওয়ার্কশপ থেকে।
“তুমহারা আন্দাজ গলত থা,” আচমকা পিছন থেকে আসা কথার টানে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। তারপর ঘুরে দেখলাম। মেয়েটা আমাদের ক্লাসেই পড়ে। আগে দেখলেও তেমন খেয়াল করিনি। আর করবই বা কী করে? র্যাগিংয়ের গুঁতোয় আর কি মাথার ঠিক আছে? সবসময় এক অজানা আতঙ্ক তাড়া করে আমায়।
আজ কাছ থেকে মেয়েটাকে দেখে বহুদিন পর মনে পড়ল যে, আতঙ্কের বাইরেও অন্য বোধ আমার আছে। কিন্তু আমার তো মেজাজ গরম, তাই মুগ্ধতাটা মুলতুবি রাখলাম। বরং কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “মানে? কী বলছ তুমি?”
“হ্যাকসোটা মাটির সঙ্গে সমান্তরালভাবে ধরলে লোহা সহজে কাটবে না। ওটা ধরতে হবে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণ করে, বুঝেছ লিট্ল বয়?”
লিট্ল বয়! রাগটা আরও জাঁকিয়ে আসতে চাইল। আস্পর্ধা দেখো মেয়ের! না হয় তোকে দেখতে বেশ ইয়ে, তা বলে তুই আমার হাইট নিয়ে এমনভাবে বলবি? সুন্দরী হয়েছ বলে কি সাপের পাঁচ পা দেখেছ?
আমি রাগের গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “মানে, লিট্ল বয় মানে? কী ভাবো নিজেকে? কে তুমি? কী নাম তোমার?”
“তোড়ি৷”
আমার হৃদয় লম্ফ মেরে ব্রেনে ঠোক্কর খেল যেন। কী বলল? তোরই? মানে? আমারই!
৪
শনিবার দুপুরে কলেজ শেষ হয়ে যায় বারোটার মধ্যে। তারপরই যেন ক্রমশ ধুঁকতে থাকে গোটা অঞ্চল। নির্জন হাইওয়ে দিয়ে দু’-একটা বাস যায়। সুরির দোকানের পাশের বটগাছে মনমরা হয়ে বসে থাকে লালমুখো বাঁদরের দল। হাওয়া এসে পাক খেয়ে যায় নির্জন মাঠে। আচমকা ছুটে যাওয়া মোটর সাইকেলের চাকায় ধুলো ওড়ে। ওপাশের পাহাড়ের দিক থেকে ভেসে আসে দমকা হাওয়া। নির্জন মাঠটা দেখলে মনে হয়, কার জানি আসার কথা ছিল, কে জানি বলেছিল আসবে। আসেনি।
“কী রে, জানলা দিয়ে কী দেখছিস?” গালে আফটার শেভ লাগিয়ে শিশিটার মুখ বন্ধ করতে-করতে জিজ্ঞেস করল বালার্ক।
“নাঃ, এই ক্যাম্পাসটা কেমন যেন ফাঁকা লাগছে।”
“ফাঁকা লাগছে, কারণ সকলে হস্টেলের মধ্যে স্নান-টান সারছে। সাড়ে বারোটায় মেসে লাঞ্চ দেবে। চল তাড়াতাড়ি খেয়ে-দেয়ে এসে একটু। পড়াশোনা করতে বসব। ইলেকট্রনিক্সটা বেশ টাফ?”।
আমি উঠলাম। সত্যিই পড়াশোনা বিশেষ হচ্ছে না। একদিকে আড্ডা আর অন্যদিকে র্যাগিংয়ের ভয়, সব গুলিয়ে যাচ্ছে যেন। প্রায় রোজ রাতেই পড়ব বলে বসি, কিন্তু সারাদিনের পর ঘুমিয়ে পড়ি। তাই শনি আর রবিবারগুলোয় ভাল করে পড়াশোনা করতে হবে। আর বালার্ক ঠিকই বলেছে। ইলেকট্রনিক্স বেশ কঠিন। তারপর রমনস্যার যা পড়ান তাতে ইলেকট্রনিক্সের অবস্থা আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে দিন কে দিন। ওনার উচ্চারণ এত খারাপ যে কিচ্ছু বুঝতে পারি না। সার্কিটকে ইনি বলেন সারকুইট, পিওর কন্ডাক্টরকে বলেন পুর কনভুক্টর। সারা ক্লাসে আমাদের নাজেহাল অবস্থায় হয়। তার ওপর ইলেকট্রনিক্স একদম নতুন সাবজেক্ট একা-একা কি আর ম্যানেজ করা যায় নাকি?
এই ক’দিনেই বুঝেছি যে বালার্ক পড়াশোনায় খুব ভাল। তাই জয়েন্ট স্টাডি করে যদি ইলেকট্রনিক্সের প্যাঁচ খানিকটা আয়ত্ত করা যায় তার চেষ্টা করতে হবে। বললাম, “এন-পি ডায়োডের চ্যাপ্টারটার কয়েকটা জিনিস বুঝতে সমস্যা হচ্ছে, তুই একটু হেল্প করবি?”
“করব। খেয়ে-দেয়ে স্ট্রেট চলে আসবি। কোত্থাও গপাতে দাঁড়াবি না। তখন দেখিয়ে দেব।”
“কিন্তু সিনিয়ররা যদি ডাকে?”
“যাবি না। কী করবে? মারবে? কত মারবে? আর তেমন হলে আমি দেখে নেব।”
“তুই?” আমি অবিশ্বাস নিয়ে তাকালাম।
“কেন? পারব না ভেবেছিস?”
আমি আর কথা বাড়ালাম না। তালাটা নিয়ে বললাম, “চল, নীচে যাই।”
বালার্ক দুটো জলের জগ হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরোল। আমরা আমাদের খাওয়ার জল মেস থেকে ভরে আনি। জুনিয়র হস্টেলে খাওয়ার জলের বন্দোবস্ত ভাল নয়। ছাদের উপরের যে-ট্যাঙ্ক থেকে জল আসে তার ঢাকনা নেই।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে পিছন থেকে কল্যাণের ডাকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কল্যাণ এসে কাঁধে হাত রেখে বলল, “এই, তোর সঙ্গে একটা দরকারি কথা আছে।”
“বল,” আমি কাঁধ থেকে ওর হাতটা সরিয়ে দিলাম।
কল্যাণ কিছু না বলে বালাকর দিকে তাকাল। মানে ওর সামনে বলতে চায় না। বালার্ক ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে বলল, “আমি এগোচ্ছি, কিন্তু দেরি করিস না বা ফালতু আড্ডা মারিস না। মনে থাকে যেন এক সঙ্গে পড়তে বসব আজকে।”
বালার্ক চলে যেতেই কল্যাণ বলল, “এমন করে বলল যেন আজই কোর্স কমপ্লিট করে দেবে। মালটার খুব ঘ্যাম। তাও তো থাকবে এক সেম।”
আমি বললাম, “বাদ দে না, তুই কী বলবি বল।”
“ও হ্যাঁ,” কল্যাণ ঠোঁট চাটল, তারপর সামান্য নার্ভাস মুখে বলল, “শ্রীবিদ্যা।”
“কী বিদ্যা?” আমি বুঝলাম না ঠিক।
“শ্রীবিদ্যা রে, দেখিসনি?”
শ্রীবিদ্যা? আমি দ্রুত মনে করার চেষ্টা করলাম। একটা মুখ ক্রমশ স্পষ্ট হল চোখের সামনে। চশমা পরা ছোট করে কাটা চুলের মেয়েটা।
“বুঝেছি,” আমি হাসলাম।
“টিউবলাইট নাকি তুই? অমন এক পিস মেয়েকে মনে করতে একদম হেঁদিয়ে হদ্দ হয়ে গেলি যে। তা, আমায় ওর সঙ্গে একটু সেট করে দে।”
“সেট করে দেব? কীভাবে?” আমার এবার হাসি মুছে অবাক হওয়ার পালা।
“কেন? ও তো তোড়ির বান্ধবী। তোড়িকে বলে ওর সঙ্গে আমায় ফিট করে দে।”
“তোড়িকে বলব?” আমি এবার চিন্তিত হয়ে পড়লাম। এ তো আচ্ছা ঝামেলা হল। বললাম, “আমার কথা শুনবে কেন?”
“তোড়ি দেখিস না তোর সঙ্গে কথা বলার জন্য কেমন করে। ও মাল একেবারে তোর জন্য লাট্টু হয়ে ঘুরছে।”
আমার জন্য তোড়ি লাট্টু! তাও ঘুরন্ত! কিন্তু আমি তো বুঝি না। দেখা হলেই তো সব সময় কেমন একটা খোঁচা দিয়ে কথা বলে তোড়ি। এই তো আজও ছুটির পর বেরোবার সময় ধরেছিল আমায়। বলেছিল, “একটা উত্তর দিতে পারবে?”
“কী উত্তর?” আমার বিরক্তি লাগছিল খুব।
“বলো তো মেয়েদের কোথায় টাচ করলে তাদের সবচেয়ে বেশি উত্তেজিত করা যায়?”
“এ আবার কী অসভ্য প্রশ্ন?” বিরক্ত লেগেছিল আমার। আসলে কলকাতায় আমার মেলামেশার পরিধিটা তেমন বড় নয়। মেয়েদের সঙ্গে একটা দূরত্ব থেকে গিয়েছিল। আর সেখানে এমন একটা প্রশ্ন?
তোড়ি হেসে বলেছিল, “ইডিয়ট, চিন্তা করে উত্তর দেবে,” তারপর আচমকা আমার গালে আঙুল দিয়ে টোকা মেরে চলে গিয়েছিল। টোকাটা আমার গালে পড়লেও চোখে লেগেছিল সবার। সেটা আবার বুঝলাম এখন।
কল্যাণ আবার বলল, “এমন মুখ করছিস যেন বুঝতেই পারছিস সকলের সামনেই গালে টোকা দিচ্ছে, আড়ালে আরও কত কী যে করছে…”
“ভাগ, ফালতু কথা বলবি না,” আমি তেরিয়া হয়ে উঠলাম।
কল্যাণ বলল, “শোন, যা করছিস কর না। আমি শুধু বলছি আমাকেও চান্স করিয়ে দে। তুই বললে তোড়ি না করবে না।”
আমি বুঝলাম, এভাবে হ্যাঁ-না চলতে থাকলে কল্যাণ আরও ঝোলাবে। তার চেয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলা ভাল। বললাম, “ঠিক আছে বলব। এখন ছাড়, খেতে যাব।”
কল্যাণ হাসল, বলল, “সে যেখানে খুশি যা, কিন্তু আমার কেসটা না ফিক্স করলে…”
না, এই ফিল ইন দ্য ব্ল্যাঙ্কটা আমি করতে পারলাম না।
গেট দিয়ে বেরোবার সময় দেখলাম অরবিন্দের সঙ্গে ময়ূখ আসছে। আমায় আর কল্যাণকে দেখে ময়ূখ জিজ্ঞেস করল, “তোরা কোথায় যাচ্ছিস?”
“মেসে,” কল্যাণকে কিছু বলতে না দিয়ে আমি উত্তর দিলাম।
“খেতে?” ময়ূখ আবার জিজ্ঞেস করল।
এই ছেলেটার মাথায় যে কী আছে! আর এবার কল্যাণ আমার আগে বলল, “না রে, সাঁতার কাটতে।”
“সাঁতার কাটতে?” ময়ূখ বিভ্রান্ত।
“তুইও চল না।”
“না রে, এই খেয়ে এলাম তো,” ময়ূখ বলল।
অরবিন্দ কল্যাণকে বলল, “ছাড় কলু, আর লেগপুল করিস না।”
“ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এসেছে! গবেট কোথাকার!”
আমি দেখলাম ময়ূখ মাথা নিচু করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল। গোটা ঘটনার ভিতরে একটা আমোদ পেলেও ময়ূখের চলে যাওয়াটুকু দেখে কেমন যেন কষ্ট হল আমার।
জুনিয়র হস্টেল থেকে মেস বেশ অনেকটা দূর। মাঝের মাঠটাও এবড়ো- খেবড়ো। হাওয়াই চটি পরে হাঁটতে পায়ে বেশ ব্যথা লাগে। তবু কিচ্ছু করার নেই। এখনও সেই ড্রেস কোড চলছে। এখানের মাটিতে লোহার ভাগ বেশি। তা ছাড়া মাটিও আলগা। মাঠের অর্ধেক পেরতে না পেরতে দুটো পা লাল ধুলোয় ঢেকে গেল। এই পা দেখতে গিয়ে মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হয়েছিলাম, আর ঠিক তখনই চটাং করে একটা চড় এসে পড়ল আমার মাথার পেছনে। মনে হল লোহার হাত দিয়ে কেউ মাথার খুলির কোয়ালিটি দেখছে। মুখ থুবড়ে পড়তে গিয়ে সামলে নিলাম। তারপর মাথা ঘুরিয়ে যাকে দেখলাম, তাকে দেখা মাত্র আমার শরীরের সমস্ত রক্ত কেলাসিত হয়ে পড়ল। শিরদাঁড়ার গোড়ায় কে যেন ছুঁইয়ে দিল বিদ্যুৎ।
“কা রে দিখাই নহি দেতে হম? উইশ কাহে নহি কিয়া বে? পিছওয়াড়া তোড়কে হাত মে দে দে কা?” রণবিজয় কওশল চোখ কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
মানুষটা প্রায় সাড়ে ছ’ ফুট লম্বা, চাবুকের মতো চেহারা। টিকলো নাকের পাশে বেমানান ছোট-ছোট চোখ। এর সঙ্গে চৌকো চোয়াল যেন মুখের হিংস্রতা আরও প্রকট করছে। এই তাহলে সমুদ্রম ইনস্টিটিউটের ত্রাস।
আমি কোনওমতে বললাম, “গুড মর্নিং স্যার।”
ঠাস্। এবার গালের চামড়া পর্যবেক্ষণ করা হল। কওশল বলল, “আবে চুহা, ঘড়ি দেখি তুনে? মর্নিং কিঁউ কহা বে? তুম লোগো কো চর্বি চড়ি হুই হ্যায় না?
“সরি স্যার, গুড আফটারনুন,” গাল জ্বলছে আমার। রাগও হচ্ছে। এরা এত গায়ে হাত তোলে কেন?
কওশল পাশে দাঁড়ানো কল্যাণকে বলল, “তু কাহে খড়া হ্যায়? যা পালা এখান থেকে,” কল্যাণ জাস্ট চোখের নিমেষে ‘নেই’ হয়ে গেল। আমি একা দাঁড়িয়ে ভাবলাম কওশল শরীরের আর কী-কী পর্যবেক্ষণ করবে কে জানে।
“তু ইস কলেজ কা আশিক হ্যায় কয়া?”
“অ্যাঁ? কী বলছেন ঠিক বুঝলাম না।”
“শালে, সমঝতা নেহি? তুই এখানে মেয়েদের সঙ্গে হিড়িক দিচ্ছিস?”
“না স্যার, আমি তো কোনও মেয়ের সঙ্গে কথা বলিনি,” আমার গলা কাঁপছে।
“কথা বলিসনি? মিথ্যে বলছিস?” কথা শেষ হওয়া মাত্র আর-একটা থাপ্পড় এসে চোয়ালে লাগল আমার। এবার চোখে জল চলে এল। শরীরের চোটের চেয়েও সম্মানের চোট বেশি জ্বালায়।
“রোতা কহে বে? খুজলির সময় মনে ছিল না?”
আমি ভেজা গলায় বললাম, “স্যার, সত্যিই বুঝতে পারছি না।”
“তোড়ির সঙ্গে ঢলাঢলি করিস কেন? জানিস না ও আমার গার্ল।”
মনের ব্যথা, রণবিজয় কওশল, মার সব ছাপিয়ে শেষের কথাটা পিন ফোটাল আমায়। মনের ছাদে বসে কে যেন বলল, “বাপু তোমার খারাপ লাগছে কেন?”
“শোন, তোড়ির দিকে তাকালে হাত ভেঙে দেব।”
“কিন্তু স্যার…!”এ কী করছি আমি? “তোড়ি তো আমায় কিছু…” আমি প্রাণপণে নিজের জিভকে থামালাম।।
“তুই তর্ক করছিস, শালা…” কওশল চোখ সরু করে তাকাল, “আজ সাড়ে তিনটের সময় পিঙ্ক হাউজে আসবি, বুঝেছিস?”
“কিন্তু স্যার, আমি কিছু করিনি।”
“চোপ শালা। সাড়ে তিনটেয় পিঙ্ক হাউজ়ে। না এলে …”
আবার ফিল ইন দ্য ব্ল্যাঙ্ক। তবে উত্তরটা কমন পড়েছে এবার। মাথা নিচু করে চলে যেতে যাব কিন্তু তার আগেই শুনলাম, “না রণবিজয়, আজ ওর আমাদের কাছে ইন্ট্রোর পালা,” আবিরদা।
“মানে?” রণবিজয় আবিরদার দিকে তাকাল।
“মানে এ মুরগি আজ আমাদের। ওকে আজ ছাড়।”
রণবিজয় চোয়াল চিপল। তারপর দাঁত চেপে বলল, “শোন আবির, ওকে বলে দিস তোড়ির সঙ্গে যেন বেশি চিপকুনা হয়। শালাকে কিন্তু পুঁতে দেব আমি।”
রণবিজয়ের লম্বা শরীরটা হনহন করে মাঠ পেরিয়ে চলে গেল। আবিরদা আমার কান ধরে বলল, “খচড়ামো করছিস? জানিস, কওশল যদি ধরে একবার, হাসপাতালে পাঠিয়ে দেবে! আর পিঙ্ক হাউজ় কী জানিস তো?”
এটা আমি জানি। ক্যাম্পাসের বাইরে স্টুডেন্টরা যেসব বাড়িতে থাকে তার একটা হল পিঙ্ক হাউজ়। কওশল ওই পিঙ্ক হাউজ়ে থাকে। গতকাল ওখানেই রুচির আর অভিষেককে প্রচণ্ড মারধোর করা হয়েছিল। আর আজ ছিল আমার পালা। আবিরদা বাঁচিয়েছে। কারণ অন্য কোথাও ইন্ট্রো ছিল না আমার।
“থ্যাঙ্ক ইউ আবিরদা।”
“শোন, এসব জায়গা খুব ভয়াবহ। সাবধানে চলবি। মেয়েদের কেসে যাস না। না হলে রণবিজয়ের আগে আমি তোকে কেলাব।”
“আমি আসি তা হলে,” আমি যাবার জন্য পা বাড়ালাম।
“ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবি, বুঝেছিস?”
“কোথায়?” আমি অবাক হলাম।
“কেন? বললাম না তোর ইন্ট্রো আছে।”
ইন্ট্রো মানেই তো র্যাগিং! কওশলের থেকে বাঁচিয়ে আবিরদা র্যাগ করবে আমায়? আমি দুর্বল গলায় বললাম, “কোথায় যাব?”
“আমার খুপরিতে আসিস।”
“তোমার বাড়িতে?”
“হ্যাঁ, আজ খিচুড়ি বানাব। রাতে খেয়ে যাবি আমার সঙ্গে। আর যদি বলিস খারাপ হয়েছে, তা হলে…”
এই ব্ল্যাঙ্কটুকু মনের মধ্যে রেখে দিলাম আমি। বুঝলাম সব শূন্যস্থান পূরণ করতে নেই। কারণ এইসব শূন্যস্থান দিয়েই আবির মজুমদারের মতো দু’- একজন ঢুকে পড়ে আমাদের জীবনে।
৫
“এই তোরা শোন, না না বাকিরা নয়, তোরা দু’জন আয়।”
আমরা পাঁচ ছ’জন মিলে ব্যাঙ্কে গিয়েছিলাম। আজ আমাদের সেকেন্ড হাফটা অফ। তাই সবাই ঠিক করেছি যে অফ ডে-তে শ্রীপুরম টাউনে গিয়ে কাজকম্মো থাকলে মিটিয়ে আসব।
আবিরদাকে টাকা দেওয়ার পর আমার কাছে টাকা ছিল না, তাই টাকা তুলতেই মূলত ব্যাঙ্কে গিয়েছিলাম। এ ছাড়াও ওয়ার্কশপের জন্য গাঢ় নীল আর ইলেকট্রনিক্স ও কমিউনিকেশনের জন্য মাখন রঙের অ্যাপ্রন বানাতে দিয়ে এসেছি। আমাদের কলেজ থেকে শ্রীপুরমের মেন টাউন বেশ অনেকটা দূর। অটো করে যেতে আধ ঘণ্টা মতো সময় লাগে। দশ টাকা ভাড়া। তবে ফেরার পথে আর অটো ধরতে হয়নি। আখের গাড়িতে চলে এসেছি। এই গাড়িগুলো কলকাতায় দেখিনি কখনও। গাড়িগুলো ছোট ট্র্যাক্টরের মতো দেখতে। তার পেছনে দু’চাকার একটা কার্ট মতো লাগানো। ওর উপরেই আখ, নারকোল বোঝাই করে আনা-নেওয়া করা হয়।
এমনই একটা গাড়িকে থামিয়ে পার হেড দু’টাকা করে দিয়ে পাঁচজন এসে নেমেছি সুরির দোকানের সামনে। এই সুরির দোকানটা কিন্তু জমকালো কোনও আউটলেট নয়, নিতান্তই আমাদের কলকাতার রাস্তার পাশে গজিয়ে ওঠা প্লাস্টিক, ত্রিপল আর তাপ্পিমারা বেঞ্চের দোকান। তবে দোকানের পজ়িশনটা ভাল। আমাদের মেস ও সিনিয়র বয়েজ় হস্টেলের যে মেন গেট ঠিক তার উলটোদিকে, ন্যাশনাল হাইওয়ের ওপারে সুরির এই দোকান। হস্টেলের ভয়ঙ্কর খাবারের কল্যাণে সুরির খাবারের কাটতি ভালই। তবে সবকিছুর ভিতরেই একটা সাউথ ইন্ডিয়ান টাচ আছে। এই গত রবিবারই আমি খেয়ে দেখেছি। মানে খেতে বাধ্য হয়েছি আর কী।
রোববার দুপুরটায় মেসের খাবারের কোয়ালিটি উন্নত হয়। সেই আধ পোড়া আর আধ সেদ্ধ কম্বিনেশনের রুটি ও ডাল হাওয়া হয়ে সামনে আসে পোলাওয়ের মতো একটা জিনিস। সঙ্গে চাটনি, রসম আর গজা টাইপের মিষ্টি। আর সবশেষে হাতে ধরানো হয় একটা কলা। হ্যাঁ, এখানে এসে দেখেছি কলকাতার দোকানগুলোতে যেমন চিপস্ ঝুলিয়ে রাখে, এরা তেমন কলা ঝুলিয়ে রাখে।
তবে সেই খাবারই আমার মনে হয়েছিল অমৃত। পরে শুনলাম রোববার বলে মেস সন্ধেবেলা বন্ধ থাকবে। তা হলে খাব কোথায়? কেন? টাউন চলে যা। কয়েকজন সিনিয়র পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু আবিরদা আমায় বলেছিল যে টাউনে যে-রেস্তরাঁ সেখানে খাবারের দাম আগুন। তাই সেই আগুনে হাত না পুড়িয়ে আমরা হাজির হয়েছিলাম সুরির দোকানে। কুড়ি টাকার ভেজিটেবল মাঞ্চুরিয়ান আর সঙ্গে চারটে বান রুটি। শস্তায় পুষ্টিকর। আমার আর বালার্কর ইজ়িলি হয়ে গিয়েছে।
আজও গাড়ি থেকে নেমে সবাই মিলে সুরির দোকানে ঢুকেছিলাম। পুরী আর ভাজি খাব। কিন্তু তখনই ওই যে ডাকটা দিয়ে অধ্যায় শুরু হল সেটা এসেছিল।
আমি মুখ তুললাম। গুপ্তা তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তবে একটাই বাঁচোয়, সঙ্গে কওশল নেই। গুপ্তা দেখলাম হাত তুলে আমায় আর বালার্ককেই ইঙ্গিত করছে। সেরেছে, এখন আবার কী?
বালার্ক বলল, “পাত্তা দিস না। এখানে খেয়ে হস্টেলে ফিরব। তারপর মেকানিক্সের অঙ্ক নিয়ে বসতে হবে, খেয়াল আছে তো?”
আমি বললাম, “শোন বালার্ক, ঝামেলা করে লাভ আছে? এখানে যে ক’দিন তুই এসেছিস, একবারও সিনিয়রদের ডাকে যাসনি। ব্যাপারটায় কিন্তু তোর ওপর ওদের রাগ বাড়ছে।”
“রাগ বাড়লে বাড়বে, আমি তো ফার্স্ট সেমের পর কাটছি।”
“ফার্স্ট সেম পর্যন্ত তো থাকতে হবে, নাকি?”।
“কী হল? কেয়া লাথ মারকে লানা পড়ে গা তুম লোগোঁ কো?”
আমি বালার্ককে হাত ধরে টানতে-টানতে বড় রাস্তা পেরিয়ে নিয়ে গেলাম সিনিয়র হস্টেলের সামনে দাঁড়ানো গুপ্তা অ্যান্ড গ্যাংয়ের কাছে। আমি ওদের উইশ করলাম। কিন্তু বালার্ক করল না।
গুপ্তা একটা সিগারেট ধরিয়ে খুব ধীরে-ধীরে বালার্ককে ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত মাপল। তারপর জিজ্ঞেস করল, “হাইট কত?”
“সিক্স ওয়ান।”
“কওশল সিক্স সিক্সের বেশি। তুই বলেছিস কওশলকে টেনিসে হারাবি?”
“হ্যাঁ, বলেছি,” বালার্ক গম্ভীর গলায় উত্তর দিল। আমি অবাক হলাম। কথাটা গুপ্তা জানল কী করে?
“চুহা, যা এক কাম কর। ওই যে চারটে মেয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে লাল টি-শার্ট পরা মেয়েটাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর, ও কী রঙের ব্রা প্যান্টি পরে রয়েছে। যা, ভাগ-কে যা।”
বলে কী রে? ভয়ে আমার ব্রহ্মতালু শুকিয়ে গেল। এ তো ইভ টিজ়িং-এর দায়ে ধরা পড়ব। পিটিয়ে তক্তা তো বানাবেই, তারপর জ্বালিয়ে দেবে। এইজন্য, একমাত্র এইজন্যই বলেছিলাম, বালার্ক ঘ্যাম না দেখিয়ে সিনিয়রদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রাখ।
“তোমার জানার ইচ্ছে থাকলে, তুমি নিজে যাও। আয়্যাম নট পার্ভার্টেড,” বালার্ক গুপ্তার চোখে-চোখ রেখে জবাব দিয়ে দিল!
গুপ্তা হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ। আমি দেখলাম অবস্থা হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। তাই তাড়াতাড়ি বললাম, “স্যার, ও অসুস্থ, ওকে ছেড়ে দিন প্লিজ়।”
“শুয়োর, খুব বন্ধুত্ব হয়েছে, না? চল শালা, এবার তুই যা,” গুপ্তা আচমকা ক্ষেপে গিয়ে আমায় ধাক্কা মারল।
“স্যার, প্লিজ় স্যার…” আমার চোখে জল এসে গেল প্রায়।
“না, ও যাবে না,” বালার্ক গম্ভীর গলায় বলল।
এবার গুপ্তা কিছু বলার আগেই ওর সাঙ্গপাঙ্গরা হঠাৎ এসে চেপে ধরল বালার্ককে। গুপ্তা আমায় বলল, “সরসিজ যা, না হলে এই হারামখোর বালার্কটাকে নাঙ্গা করে দৌড় করাব।”
বালার্ক জালে আটকানো জন্তুর মতো তাকাল আমার দিকে, “যাবি সরসিজ। ও যা পারে করুক।”
দেখলাম সুরির দোকানের সকলেই এদিকে তাকিয়ে আছে।
গুপ্তা বলল, “যাবি? নাকি…”
আমি দৌড় লাগালাম। মেয়েগুলো এখন আরও খানিকটা দূরে চলে গিয়েছে। হাইওয়ের পাশের লাল মাটির এবড়ো-খেবড়ো পথে হোঁচট খেতে-খেতে গিয়ে পৌঁছলাম মেয়েদের সামনে।
আমার অমন উদ্ভ্রান্তের মতো চেহারা দেখে মেয়েগুলো থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। মুখ দেখে চিনতে পারলাম, এরা কলেজেরই সিনিয়র।
একজন প্রশ্ন করল, “হোয়াটস দ্য রাশ ডুড?”
আমি হাঁপাতে-হাঁপাতে লাল টি-শার্টকে জিজ্ঞেস করলাম, “আমি আপনার ফেভারিট কালার জানতে পারি প্লিজ়?”
“ফেভারিট কালার?” লাল টি শার্ট ভুরু কোঁচকাল। তারপর হাসল, “ফার্স্ট সেম?”
“হ্যাঁ,” আমি বোকা-বোকা মুখ করে তাকালাম।
“তুমি যা জানতে চাইছ, তা আমি বুঝতে পারছি। ঠিক আছে তোমার সিনিয়রদের গিয়ে বল যে, আয়্যাম ওয়্যারিং ব্ল্যাক।”
এবার আমার রিভার্স গিয়ারের পালা। গুপ্তার সামনে এসে দাঁড়ালাম। দেখলাম, বালার্ক মুখ লাল করে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। গুপ্তা গা জ্বালানো হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “বল, কী রং?” নোংরা ছেলে, আমার সারা শরীর জ্বলে গেল। না, সত্যি কথা বলব না ওকে।
আমি গোবেচারার মতো মুখ করে বললাম, “স্যার, হোয়াইট।”
“সাদা! মিথ্যে বলছিস,” গুপ্তা মুখটা শক্ত করল।
“না, স্যার, সাদা,” আমি আরও গোবেচারা মুখ করলাম, “বিশ্বাস। না হলে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন। আমি মিথ্যে বলছি না।”
“শালা,” গুপ্তা হাত তুলল আমায় মারবে বলে।
“এ গুপ্তা, কোই অর কাম নহি হ্যায় ক্যায়া?” পরিচিত গলা পেয়ে আমি পাশে তাকালাম। দেখলাম একটা মেয়ের সঙ্গে এদিকেই আসছে আবিরদা।
“আবির, তুই এসবের বাইরে থাক,” গুপ্তা দাঁত চিপল।
“ফালতু রং নিস না, ওদের ছাড়। যা এবার, যাঃ।”
গুপ্তা আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে চলে গেল। ওর চোখের দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল যাতে বুঝলাম, জল আরও গড়াবে।
আবিদা কিছু বলার আগেই বালার্ক ছোট্ট করে থ্যাঙ্কস জানিয়ে হস্টেলের দিকে এগিয়ে গেল।
আবিরদার সঙ্গের মেয়েটি হাসল। বালার্কর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “ছেলেটা তো খুব অ্যারোগ্যান্ট!”
আমি বললাম, “না, ও খুব ভাল। আসলে…”
“জাস্ট আ সেকেন্ড,” মেয়েটি ট্রাফিক পুলিশের মতো হাত তুলল।
“প্রথমে, তুমি কেন উইশ করলে না আমায়? আর সেকেন্ডলি, আমায় সম্বোধন ছাড়া কথা বলবে না। সিনিয়র ছেলেদের যেমন স্যার বলো, আমাদের বলবে ম্যাডাম।”
আমি ঢোঁক গিলে বললাম, “সরি ম্যাডাম, গুড আফটারনুন ম্যাডাম।”
“অ্যাড সাম স্টাইল, ম্যাডাম নয়, ম্যাম। কেমন?”
“ম্যাম,” মাথা নাড়লাম আমি।
আবিরদা বলল, “বৈদভী, এ হল ম্যাওম্যাও।”
অ্যাঁ? আমি ম্যাওম্যাও? মানে? অবাক হয়ে আমি আবিরদার দিকে তাকালাম।
আবিরদা হাসল, “তোকে দেখলেই না একদম বেড়ালের মতো মনে হয়। তোকে দেখতে বেড়ালের মতো। তাই ম্যাওম্যাও। ঠিক নাম দিয়েছি না বৈদভী?”
বৈদভী হাসল, “ইয়াঃ, হি ইজ় জাস্ট লাইক আ ক্যাট।”
আবিরদা বলল, “চল, জোড় হাত করে মাথা ঝুঁকিয়ে ম্যাওম্যাও বল। কুইক।”
আমি জোড় হাত করে মাথা নিচু করলাম। তারপর গলা সরু করে বললাম, “ম্যাও, ম্যাও।”
বৈদভী হাসতে-হাসতে আবিরদার কাঁধে মাথা ঠেকাল। বলল, “যাক, লেট্স গো আবির। এরপর গেলে প্র্যাকটিসের কোর্ট পাব না আর।”
ওরা টেনিস কোর্টের দিকে চলে গেলে আশপাশটা হঠাৎ খুব নির্জন লাগল আমার। আমি হাঁটতে-হাঁটতে হস্টেলের দিকে এগোলাম। শীত আসছে। ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে বেশ। দূরের পাহাড়ের গায়ে গাছগুলো নড়ছে খুব। সূর্য হেলছে এবার। ওই দূরের পাহাড়, আখবন, নারকেল গাছের সারি ডিঙিয়ে সূর্য গড়িয়ে নামছে আকাশ দিয়ে। নিজের লম্বা ছায়া দেখে আমার নিজেরই কেমন লাগল। এই নির্জন মাঠ, দূরের পাহাড়, ওই ঝরনা, এসবের সঙ্গে থাকতে হবে আমায়। আরও অনেক দিন।
হস্টেলের সামনে গিয়ে থমকে গেলাম আমি। এরা কী করছে এখানে? আমায় দেখে দেবদারু গাছের নীচ থেকে এগিয়ে এল ওরা। মানে তোড়ি আর শ্রীবিদ্যা। আমি ভুরু কোঁচকালাম।
শ্রীবিদ্যা বলল, “সরি টু বদার ইউ। বাট, তুমি কি আমার সঙ্গে বালার্কর একটু আলাপ করিয়ে দিতে পারবে?”
“কেন?” আমি অবাক হলাম।
“ওর থেকে মেকানিক্সের কয়েকটা অঙ্ক একটু বুঝে নেবার ছিল।”
“কেন? ওর থেকে কেন? স্যারকে বলো।”
“স্যারের সময় নেই। প্লিজ়, বালার্ক ইজ দ্য বেস্ট। একটু আলাপ করিয়ে দেবে?”
“তোমরা নিজেরা গিয়ে বলো।”
“হি রিফিউজ়ড।” শ্রীবিদ্যা মাথা ঝাঁকাল, “প্লিজ, হেল্প মি আউট।”
আমি দেখলাম কথা বাড়িয়ে লা্ভ নেই। বললাম, “ঠিক আছে, কাল হয়ে যাবে।”
আমি আর কথা বাড়াবার সুযোগ না দিয়ে হস্টেলের দিকে এগোলাম! “সরসিজ, এই সরসিজ,” পেছন থেকে তোড়ি ডাকল। কিন্তু দাঁড়ালাম আমি। তোড়ি তাও ডাকছে। কিন্তু কওশলের মুখটা মনে পড়ল আমার। শরীরে কাঁটা দিল। ভিতু, আমি ভিতু। আমাকে এখনও চার বছর থাকতে হবে এখানে। ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে। তোড়ির ডাকে সাড়া দিলে চলবে না।
৬
সুরির পাগল ভাইটা সবার কাছে কন্নড় ভাষায় কিছু বলে। আজ ধরেছিল আমায়। আমি অনেক কষ্টে ‘কানাড়া গোভিল্লা’, ‘ইল্লে’ ইত্যাদি বলে ওকে কাটিয়ে সুরির দোকানে সবে চা নিয়ে বসেছি, দেখি বালার্কও আসছে।
“কী ম্যাওম্যাও, চা খাচ্ছিস?” বালার্ক এসে বসল আমার পাশে।
পিত্তি জ্বলে গেল আমার। ম্যাওম্যাও মানে? ওটা তো সিনিয়রদের ডাক। তুই আমার ব্যাচমেট, বা আরও গভীরভাবে বললে রুমমেট, তুই এমনভাবে বলবি কেন আমায়? আর আবিরদারও বলিহারি। এই ডেকে খাওয়াচ্ছে তো এই সবার সামনে র্যাগিং করছে। ম্যাওম্যাও নামটা আবিরদাই তো ছড়িয়েছে ক্যাম্পাসে। এখন যখন মেস থেকে খাবার খেয়ে বেরোই, সিনিয়র হস্টেল থেকে নানা ভঙ্গিতে ম্যাওম্যাও ডাক ওঠে। মনে হয় আড়াইশো বেড়াল একসঙ্গে চিৎকার করছে। আমার এত রাগ হয়! কিন্তু ভাল মানুষের মতো মুখ করে চুপ থাকি।
আর সেই ভালমানুষির সুযোগে কিনা তুই-ও নিবি? বালার্কর ওপর রাগ করে বললাম, “ম্যাওম্যাও মানে? আর তোর চোখে কিডনি স্টোন হয়েছে, যে দেখেও জিজ্ঞেস করছিস চা খাচ্ছি না হাঙরের ল্যাজ চিবোচ্ছি।”
“ওরে বাব্বা, এত টেম্পার কেন গুরু?”
প্রশ্নটা এল পিছন থেকে। আবিরদা কেন যে সব সময় পিছন থেকে এসে কথা বলে, কে জানে!
আমি পিছনে তাকালাম। আবিরদার সঙ্গে আর-একজন সিনিয়র দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে উইশ করলাম।
আবিরদা বলল, “তোদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই, এ হল চন্দরদীপ সিংহ, আমাদের কলেজের ইলেকট্রনিক্সে টপার। খুব ভাল ছেলে।”
আমি উঠে নিয়ম মতো বুকের কাছে হাত নিয়ে বললাম, “গুড আফটারনুন স্যার।”
চন্দরদীপ হাসল। তারপর বালার্কর দিকে তাকাল একঝলক, বলল, “তু বালার্ক হ্যায় না? শুনা হ্যায় তেরে বারে মেঁ। উইশ নেহি করতা তু?”
বালার্ক বলল, “নো।”
“কাহে বে? মহারাজ হ্যায় তু?”
“মারলে মারতে পার, কিন্তু…” বালার্ক কথা শেষ করার আগেই আচমকা, আমায় অবাক করে দিয়ে, আবিরদা থাপ্পড় মারল ওকে।
“পিছওড়া তোড় দেগা তেরা। ভাগ হিঁয়াসে,” আবিরদা চন্দরদীপকে আর কিছু করার সুযোগ না দিয়ে বলল, “যা এখান থেকে। অসভ্য ছেলে, ভাগ।”
আমি দেখলাম বালার্ক চলে গেল আর ওর যাওয়ার পথের দিকে লাল মুখ করে তাকিয়ে রয়েছে চন্দরদীপ। বুঝলাম টপার হলেও চন্দরদীপের ভিতরেও র্যাগিংয়ের নোংরা বীজ রয়েছে। আর এ-ও বুঝলাম, বড়সড় গন্ডগোলের হাত থেকে একটা চড় খরচ করে বালার্ককে বাঁচিয়ে দিল আবির মজুমদার।
চন্দরদীপ বলল, “আবির, তুই মালটাকে ভাগিয়ে দিলি কেন? ওর তন্দুরের দরকার। যাক, তা ম্যাওম্যাও হাউ ইজ় লাইফ?”
লাইফের ছদ্মবেশে এ যে নাইফের মতো ব্যবহার করবে তাতে আমার সন্দেহ নেই। এই ক’দিনের অভিজ্ঞতায় র্যাগিং সম্বন্ধে আমার একটা বিতৃষ্ণা এসে গেছে। মনে-মনে ঠিক করেছি যে সিনিয়র হলে আমি কখনও র্যাগিং করব না।
চন্দরদীপের প্রশ্নের জবাবে বললাম, “ফাইন স্যার।”
“অ্যায়সা হি রাখ্খিও, তেরা দোস্ত কে মাফিক হিরো না বনিও, সমঝে। অর অগর ইলেকট্রনিক্স মেঁ কুছ দিক্কত হো তো বতানা। অব্ চল, ভাগ।”
আমি আবার উইশ করে দৌড় মারলাম। মাঠের ওই প্রান্তে এখনও বালার্কর লাল হাফ হাতা সোয়েটারটা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু মাঝপথেই বাধা পেলাম। একটা ছোট্ট স্কুটার নিয়ে এসে দাঁড়াল শ্রীবিদ্যা। এই রে, আবার বালার্কর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দে বলে গন্ডগোল করবে। এদিকে বালার্ক যে ইন্টারেস্টেড নয়!
প্রথম দিন এটা নিয়ে বালার্ককে বলায় ও বলেছিল, “দ্যাখ, এখানে ফ্রি-তে টিউশন দিতে আমি আসিনি। আর শোন, বেঙ্গালুরু প্রপারে ভর্তি হতে হবে আমায়। আমার বাবা ভিতর থেকে ম্যানেজ করবে ঠিক আছে, কিন্তু তার সঙ্গে যদি মিনিমাম সেভেনটি ফাইভ টু এইটি পারসেন্ট স্কোর না করতে পারি, তা হলে কিন্তু আমার আর যাওয়া হবে না। ফলে এখানে অন্যকে হেল্প করার সময় নেই আমার, বুঝলি?”
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কেন? তোকে বেঙ্গালুরুতেই বা যেতে হবে কেন? সবাই মিলে থাকব একসঙ্গে, সেটা মজা না?”
“দ্যাখ, এই কলেজ থেকে ক্যাম্পাসিংয়ে তেমন সুযোগ আসবে কিনা জানি না। প্লাস এই জায়গাটা এত রিমোট। লোকজনও তেমন সব। সবচেয়ে বড় কথা ওখানে দাদাভাই আছে।”
“দাদাভাই মানে?”
“আমার জেঠতুতো দাদা। এখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। আমাদেরই সাবজেক্ট। আর ওখানকার কলেজের প্রসপেক্ট ভাল।”
“কিন্তু তুই তো ভাল স্টুডেন্ট। ভালরা যে-কোনও জায়গা থেকেই শ ইন করে।”
“ফালতু কেন টুনি জ্বালাচ্ছিস? তোকে বলেছিলাম না বেশি চিপকু হবি না। শোন, শ্রীবিদ্যা না শ্রীদেবী তার জন্য কোনও সময় নেই আমার, বুঝলি?”
প্রবলেমটা তো আমার বোঝা নিয়ে নয়, শ্রীবিদ্যার বোঝা নিয়ে। মেয়েটা পুরো ছিনে জোঁক। এমনভাবে এসে আমায় ধরে যেন আমার ইচ্ছেতেই বালার্ক চলাফেরা করে। কেন রে বাবা, তুই নিজে গিয়ে পড়া দেখিয়ে দেওয়ার কথা বল না। না, তা বলবে না। হুঁঃ
“হাই, সরসিজ,” শ্রীবিদ্যা হাসল।।
“হাই। হঠাৎ এখন?” যেন কিছু বুঝতে পারিনি, এমন মুখ করে জিজ্ঞেস করলাম।
“তা, বলেছিলে?”
“কী?” আমি অভিনয় চালিয়ে গেলাম।
“আরে, ওই বালার্কের ব্যাপারটা।”
“ও”, যেন গতজন্মের কথা মনে পড়েছে এমন মুখ করলাম, “আরে তাই তো। হ্যাঁ-হ্যাঁ বলব, বলব।”
“এখনও বলনি?” শ্রীবিদ্যা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “প্লিজ়, আজই বলো কিন্তু।”
“ওকে,” বলে চলে যাব ভাবছিলাম, কিন্তু পারলাম না।
শ্রীবিদ্যা বলল, “আচ্ছা, কল্যাণব্রত কেমন ছেলে?”
“কল্যাণ? মানে কলু? ভালই তো। কেন?”
শ্রীবিদ্যা ঠোঁট কামড়াল, তারপর হাত নাড়িয়ে বলল, “বাদ দাও। এদিকে তোড়ি কিন্তু খুব স্যাড হয়ে আছে।”
তোড়ি? স্যাড? আমার ভেতরে ঝুপ করে বরফ ভেঙে পড়ল যেন। অমন মুখের একটা মেয়ে দুঃখে আছে? এবার তো পৃথিবীতে মহামারী হবে, নিদেনপক্ষে জলোচ্ছ্বাস তো বটেই। কিন্তু আচমকা সাড়ে ছ’ ফুট চেহারাটা ভেসে উঠল আমার সামনে।
শ্রীবিদ্যা বলল, “তুমি ওকে অ্যাভয়েড করছ কেন?”
“অ্যাভয়েড?” আমি না বোঝার ভান করলাম।
“অ্যাক্টিং কোরো না। বালার্কের ব্যাপারটা নিয়ে অ্যাক্টিং করলে মানলাম, আর নিতে পারছি না। কেন অ্যাভয়েড করছ ওকে?”
আমি বললাম, “আমার কিছু প্রবলেম আছে। সরি, এর বেশি কিছু বলতে পারব না।”
শ্রীবিদ্যা আরও কিছু জানতে চাওয়ার আগে আমি দৌড়ে হস্টেলে ঢুকে গেলাম। তোড়ির সঙ্গে কথা না বলতে পেরে আমারও কি খুব ভাল লাগছে? কিন্তু জীবনে সবকিছু যে আমার ভাল লাগা অনুসারে হবে, তার তো কোনও মানে নেই। আমাকে আমার প্রায়োরিটি ঠিক রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, সমুদ্রম ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে কী করতে এসেছি আমি।
এক ঝামেলা শেষ করে হস্টেলে ঢুকে আর-এক ঝামেলায় পড়লাম আমাদের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বেজায় চেঁচাচ্ছে কল্যাণ আর ওর সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ময়ূখ। কী কেস? না, ময়ূখ কল্যাণের খাবার জলের জগ থেকে জল নিয়ে হাত ধুয়েছে। আর তাতেই কল্যাণের ফিউজ উড়ে গিয়েছে।
কল্যাণ যা খুশি তাই বলে গেল আরও মিনিট পাঁচেক, তারপর দুদ্দাড় করে ঘরে ঢুকে গেল। অন্যান্যরাও মজা দেখা শেষ হয়ে গিয়েছে বুঝে চলে গেল। কিন্তু আমার খারাপ লাগল। ময়ূখের বোকামি দেখে আমি নিজেও খুব হাসি। কিন্তু এখন হাসি পাচ্ছে না। বরং ওর ছলছলে চোখ দেখে কষ্টই হচ্ছে। আমি ময়ুখের দিকে এগিয়ে গেলাম। অরবিন্দ অপ্রমেয় ময়ূখের পাশেই দাঁড়িয়েছিল।
আমি বললাম, “ময়ূখ, ফালতু মনখারাপ করিস না। জানিসই তো কল্যাণ রেগে যায় সহজে। ছাড়, ঘরে যা।”
অরবিন্দ ভুরু কুঁচকে বলল, “কল্যাণ ইজ় আ শিট। সবসময় ময়ূখকে যা তা বলে। হি শুড শো সাম ম্যানার্স। অর এলস…”
অরবিন্দ ময়ূখকে নিয়ে চলে গেল।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এখানে সকলে এত ব্ল্যাঙ্ক রেখে দেয় কথায়! কেন যে কথা শেষ করতে পারে না! ‘অর এলস’ কী?
“এই সরসিজ শোন,” দেখলাম কল্যাণ ওর ঘরের দরজা খুলে মাথা বের করে আমায় ডাকছে। চোখে মুখে একটা সতর্ক ভাব। বাঃ, এর মধ্যেই মেজাজ ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।
আমি অবাক হলাম, “কী রে?”
“একবার আমার রুমে আয় তো।”
ওর রুমি বসন্ত ঘরে নেই এখন। আমি ঘরে ঢোকামাত্র দরজায় ছিটকিনি দিয়ে দিল কল্যাণ। আমায় বিছানায় বসতে বলে নিজে চেয়ার টেনে বসল আমার সামনে। বলল, “বল, কী বলছিল ও?”
“ও মানে? ময়ূখ?”
“ভাগ শালা। শ্রীবিদ্যা। জানলা দিয়ে দেখলাম মাঠে দাঁড়িয়ে তোরা কথা বলছিলি? আমার সম্বন্ধে কিছু বলছিল?”
“তোর সম্বন্ধে? কেন?”
কল্যাণ একটু অপ্রস্তুত হল। হাত ঘষল গালে। তারপর বলল, “শোন, একটা গোপন কথা বলছি, কাউকে বলবি না এখনই। বললে কিন্তু…”
ধ্যাত্তেরি। এও কথা শেষ করে না। ‘কিন্তু’ কী? না, কল্যাণ ‘কিন্তু’-র পর কথা শেষ না করে একটা বাক্য শুরু করল। আর তা শুনে আমি চোখের সামনে একটা ট্রায়াঙ্গেল দেখতে পেলাম। না, বারমুডার নয়, শ্রীপুরমের।
৭
অঙ্কটা আমি চিরকালই ভাল পারি। তাই আজ অঙ্কের পেপারটা হাতে পাওয়ার পর শ্রীপুরমে এসে এই প্রথম আমার আনন্দ হয়েছিল। সব অঙ্ক যে আমার জানা! এটা আমাদের প্রথম ক্লাস টেস্ট ছিল। পঁচিশ নম্বরের পরীক্ষা। আর এরপরেই ছিল ইলেকট্রনিক্সের টেস্ট। অঙ্কতে ফুল মার্কস আমার বাঁধা, কিন্তু ইলেকট্রনিক্সে কুড়ি পেলেই আমি পাঁচসিকের পুজো দেব।
এসব মিটিয়ে সেকেন্ড হাফে কেমিস্ট্রি ল্যাব থেকে বেরতেই কল্যাণ প্রায় হামলে পড়ল, “কীরে, ফার্স্ট হাফে কেমন পরীক্ষা দিলি?”
“অঙ্কটা ভাল হয়েছে, কিন্তু ইলেকট্রনিক্সটা ঝুল হয়ে গিয়েছে। শালা, আমায় আবার সেকেন্ড ইয়ার থেকে ইলেকট্রনিক্স নিয়ে…” কথাটা শেষ না করে নিজেই চমকে গেলাম। সকলের হাওয়া কি এবার আমারও লাগল?
“আমি কিন্তু ফাটিয়ে দিয়েছি। হায়েস্ট পাবই!” কল্যাণ এমনভাবে বলল যেন খাতাটা ও-ই দেখছে! আমি মনে-মনে হাসলাম। বালার্ককে এত সহজে ভুলে গেল! আমি কথা না বাড়িয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। কল্যাণ আবার ধরল, “শোন না, ওই শালা বালার্কটা কিন্তু বড্ড বাড়াবাড়ি করছে।”
“মানে?” এবার অবাক হলাম আমি।
অন্যান্য স্টুডেন্টরাও এখন বেরোচ্ছে। তাদের মধ্যে থেকে রুচির, বিকাশ, গিরিশরা ডাকাডাকি করছে আমায়। কিছুদিনের মধ্যেই টেনিস টুর্নামেন্ট শুরু হবে। ওদের সঙ্গে আমাকেও নাকি প্র্যাকটিসে যেতে হবে! না, খেলতে নয়, দর্শক হতে।
কল্যাণ আমার হাত ধরে টেনে একটা বড় দেবদারু গাছের পাশে নিয়ে গেল। বলল, “গতকাল কী দেখেছি জানিস, শ্রীবিদ্যার সঙ্গে আন্টিস শপে বসে কফি খাচ্ছে ও। তুই বল এটা ও ঠিক করছে?”
“মানে? ঠিক করছে না কেন বলছিস?”
কল্যাণ বিরক্ত হল, “গাধার মতো কথা বলিস না। তোকে আমি শ্রীবিদ্যার উপর আমার ব্যথার ব্যাপারটা বলিনি? আর আমার গার্লের সঙ্গে ওই মাইগ্রেটরি বার্ডটা এসে মস্তি করবে?”
“বাজে বকিস না। আন্টিস শপে বালার্ক আমার সঙ্গেই গিয়েছিল। আমি যখন উঠে আসছি তখনই শ্রীবিদ্যা আসে ওখানে। পড়াশোনার ব্যাপারে শ্রীবিদ্যা হেল্প চাইল বলেই বালার্ক ছিল।”
“তাই?” কল্যাণ ভুরু কোঁচকাল, “কিন্তু অত কাছাকাছি বসার কী হয়েছে? আর আমি কি পড়াশোনায় খারাপ? আমায় বললে পারত! আচ্ছা, তুই কি বলেছিস ওকে আমার কথা?”
কল্যাণ অবশ্য বলেছিল বটে। কিন্তু আমি তার কী করতে পারি? বললাম, “তোর শ্রীবিদ্যাকে ভাল লাগে বুঝলাম, কিন্তু আমার কাছে তা নিয়ে গজগজ করে লাভ আছে? শ্রীবিদ্যার কাছে আলতো করে তুলেছিলাম কথাটা, পাত্তাই দেয়নি। দেখ ভাই, বি আ সেল্ফ মেড ম্যান! ‘আমার উপর নেই ভুবনের ভার’, বুঝেছ?”
কল্যাণ কটমট করে তাকাল, “আচ্ছা, কিন্তু তোর রুমিকে বলে দিস, বেশি স্মার্ট হতে চাইলে কিন্তু বিপদে পড়বে!”
কল্যাণ হনহন করে চলে গেলে আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচালাম। ওফ, এখানে নিত্য নতুন সমস্যা। আমি ভাবলাম এবার হস্টেলে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে একটু পড়তে বসব। পরশু এমইএস আর মেকানিক্সের টেস্ট আছে।
আমি পা বাড়াতে যাব, কিন্তু “অ্যাই ম্যাওম্যাও!” আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাঁড়িয়ে পড়লাম। এই সিনিয়রগুলো আমাদের এক রত্তি যদি শান্তি দেয়! দেখি, আজ কার জামা কাচার বা জুতো পালিশ করার আজ্ঞা দেয়।
দেখলাম, সেকেন্ড ইয়ার ইনফরমেশন টেকনোলজির ছাত্র অজিত, মানে লয়েন এসে দাঁড়িয়েছে। নিয়মমতো আমি উইশ করলাম। লয়েন বেঁটেখাটো আর রোগা। তাই হয়তো কোনওরকম কমপ্লেক্স আছে। আর সেটা ঢাকতেই সবসময় মুখ-চোখ কুঁচকে নিজেকে গম্ভীর প্রমাণ করে।
লয়েন বলল, “কা রে ম্যাওম্যাও, বিল্লিওয়ালা উইশ কাঁহা হ্যায়?”
ওর কথা বলতেই আমি তীব্র অ্যালকোহলের গন্ধ পেলাম। এটা এই অঞ্চলের একটা খারাপ দিক। হাইওয়ের ওদিকে, কলেজ থেকে একটু দূরে বেশ কয়েকটা মদের ঠেক আছে। সেখানে মদ ছাড়াও আরও অন্যান্য নেশার বন্দোবস্ত আছে বলেও শুনেছি। আমাদের কলেজের প্রচুর স্টুডেন্ট ওই সব দোকানের নিয়মিত সদস্য। এমনকী আবিরদার ঘরেও মদের ছোট বোতল দেখেছি আমি। মদ বা সিগারেট, যে-কোনও নেশাকেই আমি ঘৃণা করি। মনে হয়, দুর্বল একপাল প্রাণী পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য এসব বিষের সাহায্য নিচ্ছে। এদের নিজেদের কোনও দম নেই।
“উইশ কর,” লয়েন খেঁকিয়ে উঠল।
আমি ‘ম্যাওম্যাও’ করলাম।
লয়েন হাসল, তারপর হাতে কুড়িটা কাগজের বাঞ্চ ধরিয়ে বলল, “নর্থ থেকে যে কুড়িজন এবার এসেছিস তাদের জন্য কোয়েশ্চন পেপার এটা। আজ রাতে পরীক্ষা। সকলকে দিয়ে দিবি। সকলের থেকে আনসার লিখিয়ে নিজের কাছে রেখে দিবি কাগজগুলো। আর রাত এগারোটা নাগাদ গুপ্তার সঙ্গে আমরা যাব তোদের হস্টেলে, বুঝেছিস?”
জলের মতো, একদম জলের মতো বুঝেছি। আজ রাতে আবার র্যাগিং হবে। আমি একটা পাতা দেখলাম। ইংরিজিতে লেখা পাঁচটা প্রশ্ন। এক একটার নম্বর পাঁচ করে। অর্থাৎ পঁচিশ। আর পঁচিশ নম্বর হল প্র্যাক্টিক্যাল, ওয়্যাক্স টেস্ট। এবার আমি প্রশ্নগুলো পড়লাম।
(১) প্রমাণ কর, বন্ধ দরজা = খোলা দরজা।
(২) ধরো, তুমি একটা পিঁপড়ে, একটা শুয়ে থাকা মেয়ের পা থেকে মাথা অবধি হেঁটে যাচ্ছ তুমি। এখন X, Y ও Z অক্ষর দিয়ে গ্রাফ এঁকে বুঝিয়ে দাও, তোমার যাত্রাপথের দূরত্বের সঙ্গে মেয়েটির ও তোমার শারীরিক পরিবর্তনের পর্যায়গুলো।
(৩) তুমি কীভাবে প্রমাণ করবে যে, তোমার বন্ধু হনুমান?
(৪) ফিজ়িক্সের এইচওডি-র বউকে প্রোপোজ় করতে হলে তুমি কী করবে?
(৫) Lady-র ইন্টিগ্রেশন করো।
প্রশ্ন নয়, বোমা। আজ রাতে এসব লিখতে হবে আমায়? তারপর আবার ওয়্যাক্স টেস্ট? পড়াশোনা করব কখন? আর ওয়্যাক্স টেস্ট মানে তো গায়ের জামা খুলে পিঠে গরম মোম ঢেলে দেবে। ফোস্কা পড়বে না, কিন্তু যেখানে-যেখানে গলন্ত মোম লাগবে, মনে হবে সেখান দিয়ে জীবন বেরিয়ে গেল।
দেবদারু গাছের তলায় দাঁড়িয়ে হঠাৎ খুব কান্না পেল আমার। কেন র্যাগিং করে এরা? এতে নাকি জড়তা কাটে, বন্ধুত্ব বাড়ে। কিন্তু এভাবে কি ফ্রি হওয়া যায়? সহজ হওয়া যায়? বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে এভাবে? অন্যকে দুঃখ দিয়ে আনন্দ পাওয়া তো একরকমের মানসিক রোগ। এই যে এত টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউশন, সেখানে যে এত র্যাগার, এরা কি তাহলে এক ধরনের মানসিক রোগী? এরাই তো ভবিষ্যতের কারিগর, সমাজের বিশিষ্ট জায়গা অধিকার করবে এরাই। তা হলে? এরা যে সভ্য মানুষের মতো থেকেও আসলে ভিতরে-ভিতরে এক-একটা ক্ষুদ্র সাইকোপ্যাথ! আচ্ছা, এই জন্যই কি আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার?
হেলে আসা বিকেলে আলোয় সবকিছুই যেন কেমন ম্রিয়মাণ দেখাল। দূরে পাহাড়ের গায়ে সূর্যের ‘যাই-যাই’ আলো লেগে আছে। আরও দূরে রেললাইন দিয়ে এগিয়ে চলেছে নির্জন রেলগাড়ি। সুরির দোকানের পাশের গাছে বসে রয়েছে মনমরা সব বাঁদর। শীত আসছে। শিরশিরে হাওয়া পাক খাচ্ছে মাঠে। পাক খাচ্ছে আর ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাদের।
“আর ইউ আ পোয়েট?” প্রশ্নে সম্বিত ফিরল আমার। বৈদভী!
“গুড ইভনিং ম্যাম,” কাগজগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে বললাম আমি।
“ওগুলো কী? র্যাগিং টেস্টের কোয়েশ্চনেয়ার?” বৈদভী হাসল।
“হ্যাঁ, ম্যাম।”
ও আবার বলল, “এখন কোথায় যাচ্ছ? হস্টেলে?”
“ইয়েস ম্যাম।”
“তার চেয়ে আমার সঙ্গে চলো। কাম।”
“অ্যাঁ? কোথায়?” আমি একটু ভড়কালাম।
“সিনিয়রদের কোয়েশ্চন করার নিয়ম নেই জান না? কওশল শুনলে কী বলবে?”
আমি বললাম, “না-না ম্যাম, ওটা জাস্ট মুখ থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। চলুন।”
বৈদভী মুখ টিপে হাসল, “কওশলকে খুব ভয় পাও, না?”
আমি ঢোঁক গিললাম। গতকালই বসন্তকে পিটিয়ে প্রায় অজ্ঞানের মতো করে দিয়েছিল কওশল। কী? না, বসন্ত নাকি ওর সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল। আর শুধু মারেইনি, বসন্তের উপর হুকুম হয়েছে পরের এক মাস ওর গোঁফের দু’ দিক কামিয়ে চার্লির মতো করে রাখতে হবে। না হলে নাকি কপালে আরও দুর্ভোগ আছে। এ ছাড়াও রুচির, অভিষেক, গিরিশ, বিকাশ, এরাও যথেষ্ট মারধোর খেয়েছে। আমি আর সেই দলে নাম লেখাতে চাই না।
শ্রীবিদ্যার মতো বৈদভীরও একটা ছোট্ট স্কুটার রয়েছে। আমি পিছনে বসামাত্র ও গাড়ি ছুটিয়ে দিল। জিজ্ঞেস করল, “ছোট্ট ফল্সটার দিকে কখনও গিয়েছ?”
আমি শুনেছি ঝরনাটার কথা। কিন্তু যাইনি। কারণ পথটা লেডিস হস্টেলের গা ঘেঁষে গিয়েছে। আমাদের, মানে জুনিয়রদের এই দিকে আসা বারণ। কারণ আমরা নাকি মেয়েদের উত্যক্ত করব।
আমি বললাম, “সিনিয়রদের তো বারণ আছে!”
বৈদভী মেন রোড থেকে লেডিস হস্টেলের পথে স্কুটার ঘুরিয়ে বলল, “সে তো একা যেতে বারণ করেছে। আমার সঙ্গে গেলে কিছু বলবে না।”
ঝরনার সামনে গিয়ে স্কুটার থামাল বৈদভী, বলল, “এসো।”
আমি ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এত সুন্দর জায়গা হয়? দুটো পাহাড়ের খাঁজ দিয়ে ঝরনা লাফিয়ে পড়ছে নীচে। মনে হচ্ছে, কে যেন সাদা ওড়না ভুলে ফেলে গিয়েছে পাহাড়ের গায়ে। সামনেই একটা বড় লেক। তার চারধারে গাছ আর পাথর ছড়ানো। সূর্যের ফেলে যাওয়া গোলাপি আলোয় সবই কেমন অপার্থিব মনে হচ্ছে। এমন একটা জায়গায় আমি কেন আসিনি আগে?
“ভাল?” বৈদভী আমার পিঠে হাত রাখল।
আমি মাথা নাড়লাম। এত সুন্দরের সামনে কথা বলা যায় নাকি!
“চলো, ওদিকটা নির্জন। ওখানে বসা যাক। একটু পরেই হাজারটা মেয়ে চলে আসবে।”
একটু দূরে, জলের কোল ঘেঁষে বড় একটা পাথরের আড়ালে বসলাম আমরা।
“এখানে কেমন লাগছে? ফিলিং হোম সিক?”
“নো ম্যাম,” সটান মিথ্যে কথা বললাম আমি।
“শুনেছি তুমি ভাল গান করো। একটা শোনাও।”
“গান?” আকাশ থেকে পড়ার ভান করলাম আমি, “ও তো র্যাগিংয়ের সময় একটু-আধটু গাইতে হয়। জাস্ট এমনিই গেয়েছিলাম।” আসলে আমি যে ছোট থেকে গান শিখেছি তা তো এদের বলা যায় না। বললে এখনই সব ঘরে গিয়ে গান শুনিয়ে আসতে হবে। আমাদের ব্যাচের চিট্টিবাবু বলে একটা ছেলে নাকি হাত দেখতে পারে। ব্যস, এটা জানাজানি হওয়ার পর থেকে ও এখন সকলের হাত দেখে বেড়ায়। পড়াশোনা সব ডকে উঠেছে।
“তাও গাও,” বৈদভী আদেশ করল।
“সরি ম্যাম, আমি পারি না,” মাথা নিচু করলাম আমি।
বৈদভী সময় নিল এক মুহূর্ত। নিস্তব্ধ প্রকৃতি যেন প্রহর গুনছে বৈদভীর প্রতিক্রিয়ার আশায়। হঠাৎ ক্ষীণ শব্দ শুনলাম। অনেকে হাঁটতে-হাঁটতে, গল্প করতে-করতে, এই ঝরনার দিকে আসছে। হস্টেলের অন্য মেয়েরা কি?
“এ থেকে জ়েড অবধি বলো তাহলে। কুইক,” বৈদভী আবার আদেশ করল।
যাক বাবা, ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল আমার। শুনেছি বড় হলে অনেকে নাকি ক-খ বা এ-বি-সি-ডি অর্ডার ঠিক রেখে বলতে পারে না। বৈদভী সেই দলে আমায় ফেলল নাকি?
আমি স্মার্টলি গড়গড় করে ছাব্বিশটা অ্যালফাবেট বলে দিলাম।
“পাঁচ সেকেন্ড সময় লাগল, বৈদভী হাসল,” “গুড। এবার পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে জ়েড থেকে এ রিভার্স অর্ডার-এ বলো। না পারলে শাস্তি আছে।”
ঘাম দিয়ে যে জ্বর আসতে পারে, এই প্রথম বুঝলাম আমি।
“কাম অন,” বৈদভীর গলাটা হঠাৎ রাগী শোনাল, “কওশলকে বলে দেব না হলে।”
“জ়েড, ওয়াই, এক্স, ভি, ইয়ে না, ডবলিউ, ভি…” আমি ঠোক্কর খেতে লাগলাম।
“স্টপ, তুমি ফেল,” বৈদভী ঠোঁট কামড়ে হাসল। এত সুন্দর একটা মেয়ে এমন শয়তানের মতো মুখ করছে কেন?
“নাউ দ্য পেনাল্টি,” বৈদভী চটপট নিজের ডান পায়ের জুতোটা খুলে ফেলল। এই রে জুতো-পেটা করবে নাকি? আরও ঘাম দিল। জ্বরে যেন ব্রহ্মতালু জ্বলে যেতে লাগল আমার।
“কিস মাই ফিট।”
অ্যাঁ? আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম আমার মুখের সামনে তোলা ফরসা, পেডিকিওর করা পা-টার দিকে। একটা সরু সোনালি চেন ঝুলছে গোড়ালিতে।
“কিস মাই ফিট, অর আই উইল কিক অন ইওর ফেস,” বৈদভী আধশোওয়া হয়ে পা-টা এগিয়ে ঠেসে ধরল আমার ঠোঁটে।
চোখ বন্ধ হয়ে গেল আমার। ঠোঁট বেঁকে গেল। জুতোর চামড়ার গন্ধ পেলাম আমি। বৈদভী আঙুল দিয়ে ঠোঁটে চাপ দিচ্ছে আমার! ঠেসে ধরছে পা-টা! হঠাৎ শুনলাম কে যেন বলল, “লুক,” গলার শব্দে তাকালাম আমি। বড় পাথরের আড়াল থেকে শ্রীবিদ্যার পাশে দাঁড়িয়ে সারা পৃথিবীর ঘৃণা নিয়ে আমায় দেখছে তোড়ি!
৮
এরপরের কয়েকটা দিন বেশ কিছু ঘটনা ঘটল পর-পর। যার ফলে আমাদের জুনিয়রদের মধ্যে একটা ভয় এসে বাসা বাঁধল।
প্রথম ঘটনাটা ঘটল আমার সেই ‘চুমু কেলেঙ্কারির’ রাতে। আমাদের উলটোদিকের ঘরে থাকে কৃষ্ণন আর চন্দ্রন। সে রাতে মেস থেকে দু’জন আর ফিরল না। তবে আমরা তখন খেয়াল করিনি। রাত দেড়টা পর্যন্ত পড়াশোনা করে শুয়ে পড়েছিলাম।
সকালে ঘুম ভাঙে প্রচণ্ড হইচই-এ। আমি আর বালার্ক দরজা খুলে দেখেছিলাম চন্দ্রন আর কৃষ্ণনকে। চোখমুখ ফুলে গিয়েছে, জিভ কেটে গিয়েছে আর হাঁটতেও পারছে না ঠিক মতো। আমরা জিজ্ঞেস করছিলাম কী হয়েছে? ওরা বলছিল না কিছু। শুধু মুখ বুজে ব্যাগ গোছাচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম ভয়ঙ্কর কিছু হয়েছে যার ফলে ওরা চলে যাবে। কয়েকজন গিয়ে ওয়ার্ডেন স্যারকেও ডেকে এনেছিল। কিন্তু ওরা শিবযোগী স্যারের কথাও শোনেনি। খোঁড়াতে-খোঁড়াতে আহত শরীর নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল।
না, কে ওদের এমন অবস্থা করেছিল তা ওরা বলেনি। নালিশও করেনি। তবে কানাঘুষো শুনেছিলাম গুপ্তা, অজিত আর মহেশবাবু, এই তিন সিনিয়র নাকি ওদের অবস্থার জন্য দায়ী। কিন্তু প্রমাণ নেই। কৃষ্ণন আর চন্দ্রন তো সোজা চলে গিয়েছে উটিতে, যার-যার নিজের বাড়ি।
এর পরের ঘটনাটা ঘটল বিকাশের সঙ্গে। ঝাড়খণ্ডের ছেলে বিকাশ। বড়লোকের ছেলে। নিজের খেয়ালে থাকত। হঠাৎ এক রাতে বিকাশও আর হস্টেলে ফিরল না। সেবার কিন্তু সারা রাত আমরা ঘুমোলাম না। বরং রাত দুটো নাগাদ আমরা ছোট একটা দল করে খুঁজতেও বেরোলাম। যদিও জানতাম না কোথায় খুঁজব। তবুও হাইওয়ের ধার, হস্টেলের পিছনের দেবদারু বন আর ওয়ার্কশপের পিছনে ভাঙাচোরা যে একটা বিল্ডিং আছে, সেখানেও খুঁজলাম। কিন্তু কোথাও পেলাম না।
বিকাশও এল পরের দিন সকালবেলায়। আমরা ওকে দেখে ভয় পেয়ে গেলাম খুব। এ কে? বিকাশ? মনে হল, কে যেন বিকাশকে ছিঁড়ে ফেলে আবার আঠা দিয়ে জোড়া দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
বিকাশ চন্দ্রন আর কৃষ্ণনের মতো পালিয়ে না গেলেও একদম চুপ মেরে গেল। দু’ দিন ক্লাস করল না। মেসে গেল না। এমনকী নীচেও নামল না। আমরা পালা করে ওর খাবার নিয়ে এলাম মেস থেকে। এর মধ্যে প্রচুর চেষ্টা করলাম কে ওকে এমন করেছে তা জানার জন্য। বিকাশ কিচ্ছু বলল না, উপরন্তু আরও চুপ করে গেল। এর পরের শিকার হল বসন্ত।
আমরা ভয় পেলাম খুব। ঠিক করলাম একসঙ্গে, একদল হয়ে সব জায়গায় যাতায়াত করব। সিনিয়রদের থেকে দূরে থাকব যথাসম্ভব। সন্ধের পর হস্টেল থেকে খুব দরকার না হলে বেরোব না। লাইব্রেরি যাওয়া বা টুকটাক কেনাকাটা সেরে নেব দ্রুত। একটা অজানা আতঙ্কে দিন কাটতে লাগল আমাদের। ঘটনা ঘটার চেয়ে তা ঘটার আশঙ্কা যে আরও কত মারাত্মক, তা বুঝতে পারলাম এবার।
এসবের মধ্যেই আমাদের লঙ্কাবাটা সমৃদ্ধ জীবনে আরও কতকটা জ্বলুনি অ্যাড করতেই কি না জানি না, এক বিকেলে ওয়ার্কশপ থেকে শ্রীবিদ্যা সটান চলে এল আমাদের হস্টেলে।
এই হস্টেলের একটা অলিখিত নিয়ম হল এই যে, ছেলেরা যেমন মেয়েদের হস্টেলে যাবে না, তেমনই মেয়েরাও ছেলেদের হস্টেলে আসবে না। আর এই অলিখিত নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শ্রীবিদ্যা যখন হস্টেলে আমাদের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল তখন আমি সবে গায়ে পাঞ্জাবির উপর হাতকাটা সোয়েটারটা চাপিয়েছি। ওকে দেখে আমার সর্বাঙ্গে আচমকা কাঁপুনি লাগল।
“তুমি ক্লাসে অমন গরুচোরের মতো থাক কেন বলো তো?” শ্রীবিদ্যা প্রশ্নটা করল। তবে এখানে একটা কথা বলে নিই। শ্রীবিদ্যা কথাটা ইংরিজিতে বলেছিল। তার বাংলা সংস্করণ বের করে প্রশ্নের ঝাঁঝ বোঝাতে গিয়ে গরুচোরটা ব্যবহার করলাম আমি। যা হোক, এবার আমার উত্তর দেওয়ার পালা, কিন্তু উত্তর দেব কী? তার বদলে আমার ভয় প্রশ্ন হয়ে ছিটকে বেরল, “কী করছ তুমি এখানে? সিনিয়ররা দেখে ফেললে আমার চোকলা তুলে দেবে!”।
“হুঁঃ, এত ভয়? তাই অমন স্পাইনলেস হয়ে ঘুরছ?”
“তুমি কেন এসেছ?” প্রশ্ন করতে-করতে দেখলাম আমার দরজার কাছে একজন দু’জন করে ছেলে জমছে। সকলের চোখেই প্রশ্নচিহ্ন।
“তোড়ি তোমায় দেখা করতে বলেছে।”
সেরেছে। সেই পাথরের আড়ালের চোখ দুটো মনে পড়ল আমার। আমি কোনওমতে বললাম, “কেন?”
“আস্ক হার। কাল তো কলেজ ছুটি। কাল জল ট্যাঙ্কের নীচে সকাল দশটায় থাকবে ও। ডোন্ট মিস।”
আমি দেখলাম সকলের চোখে জিজ্ঞাসাকে সাবস্টিটিউট করল ঈর্ষা। কারণ তোড়ির থেকে ডাক পাওয়া তো সহজ নয়!
“তা তোমার বন্ধু কই?” শ্রীবিদ্যা হাত দিয়ে চুল ঠিক করল।
“প্র্যাকটিস করছে, টুর্নামেন্ট তো।”
“হি ইজ় অ্যাভয়ডিং মি। আমার চারটে সল্ভ দেখার ছিল,” শ্রীবিদ্যাকে চিন্তিত দেখাল। আমি ভাবলাম বলি যে খাতাটা রেখে যেতে, বালার্ককে দিয়ে করিয়ে রাখব। কিন্তু তার আগেই ভিড় থেকে লাফ দিয়ে পড়ল কল্যাণ, “আমি দেখিয়ে দেব? প্রবলেম আমি হেভি সল্ভ করতে পারি।”
শ্রীবিদ্যা চোখ কুঁচকে তাকাল কল্যাণের দিকে। মানে ভাবটা এমন, যেন বিরিয়ানিতে আরশোলা পড়েছে! তারপর বলল, “ইউ ডোন্ট হ্যাভ টু। অ্যান্ড আয়্যাম নট টকিং টু ইউ।”
করিডোরে হাসির রোল উঠল একটা।
এর পরের দু’ ঘণ্টা আঠারো মিনিট শান্তিতে কাটলেও উনিশতম মিনিটে আচমকা চিৎকার শুনলাম একটা। ড্রয়িং বোর্ডের ওপর উপুড় হয়ে আমি স্কেচ করছিলাম। চিৎকারে থ্রি ডাইমেনশনাল স্কেচ এলোমেলো হয়ে চতুর্থ ডাইমেনশনে থামল। শুনলাম কল্যাণ চিৎকার করে বলছে, “এই বালার্ক, আমার জিনিস নিয়ে তোর এত টিকরমবাজি কেন রে?”
আমি দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলাম, বালার্ক হতভম্ব মুখে করিডরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
“বুঝতে পারছিস না, না? বলেছি না শ্রীবিদ্যার থেকে দূরে থাকবি। আমার জিনিসে নোলা করছ শালা …”
গালাগাল শুনে বালার্কর মুখ পালটে গেল নিমেষে। ও এগিয়ে এসে হাতের র্যাকেট তুলে বলল, “মুখ সামলে কল্যাণ…”
“না হলে কী করবি রে গাধা? চুহা, বোকা। টেনিস খেলতে যাওয়া হচ্ছে! টেনিস খেলিস না মেয়েদের সঙ্গে হিড়িক দিস? হুঁঃ, পরের সেমে চলে যাবে। তা যাবি যখন, তখন অন্যের জিনিসে হাত বাড়াস কেন? শ্রীবিদ্যার পিছনে আর যদি ঘুরিস তা হলে ওই র্যাকেট তোর ভিতরে যাবে।”
ঠাস! হাত চালাল বালার্ক। মাথা ঘুরে পিছনে দাঁড়ানো ময়ূখের মাথার সঙ্গে ঠুকে গেল কল্যাণের মাথা। মাথায় হাত দিয়ে কল্যাণ অন্ধের মতো লাথি চালাল ময়ূখের দিকে। ওক্ শব্দ করে ময়ূখ পড়ে গেল। কল্যাণ চিৎকার করে বলল, “জানোয়ারের বাচ্চা, আমার পিছনে দাঁড়িয়েছিস কেন? কেন দাঁড়িয়েছিস পিছনে? সব শালাকে এর ফল ভুগতে হবে,” কল্যাণের ঘরের দরজা দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল।
আমি দেখলাম, মাটিতে পড়ে গিয়ে ময়ুখের চশমাটা বেঁকে গিয়েছে। ভয়ে কাঁপছে ও! বালার্কর রাগটা যে এভাবে ওর উপর ফলাবে কল্যাণ, তা বুঝতে পারেনি বেচারা।
বালার্ক ঘরে ঢুকে কটমট করে আমার দিকে তাকাল। তারপর বলল, “শালা, তোর জন্য সব হচ্ছে। কে বলেছে তোকে মেয়েদের সঙ্গে ফুসুর-ফুসুর করতে? এর ফল বুঝবি তুই। আমার কী? আমি তো কাটছি৷”
কথা শেষ করার সঙ্গে-সঙ্গে লোডশেডিং হয়ে গেল ঝুপ করে। আর ওই আধো অন্ধকার ঘরে ভূতের মতো বসে রইলাম আমরা দু’জন। বাইরে আলতা রঙের সন্ধে নামছে। তার আবছা আলোয় দেখলাম বালার্কর মুখটা গম্ভীর।
আমি ভেবেছিলাম আজকের মতো না হয় একটা ঝঞ্ঝাট মিটল, কিন্তু রাত্রি যে তার চোরা পকেটে আরও প্রবলেম লুকিয়ে রেখেছিল বুঝতে পারিনি।
রাতে মেস থেকে বেরিয়ে জলের জগটা আমার হাতে দিয়ে বালার্ক হঠাৎ বলল, “এই সরসিজ, এটা নিয়ে ঘরে চলে যা তো। আমি একটু আসছি।”
“তুই কোথায় যাচ্ছিস?” ভয় পেলাম আমি।
“গার্লস হস্টেলে। শ্রীবিদ্যা মেয়েটাকে টাইট দিতে হবে এবার। ভেবেছিলাম বন্ধুর মতো মিশব, কিন্তু… দাঁড়া, আজ একটা হেস্তনেস্ত করবই।”
“এই, যাস না বালার্ক,” আমি বাধা দিলাম, “কৃষ্ণন, বসন্ত ওদের কী হয়েছিল মনে আছে? দে ওয়্যার অলমোস্ট সেক্সুয়ালি ভায়োলেটেড বাই গুপ্তা গ্যাং! যাস না।”
বালার্ক শুনল না আমার কথা। আমি অন্যদের সঙ্গে ভয়ে কাঁপতে- কাঁপতে অন্ধকার মাঠ ভেঙে হস্টেলে ফিরলাম। তারপর আমার ঘরে বৈঠক বসল। সেখানে সকলে নানা রকম আশা ও নিরাশার কথা শোনাতে লাগল। র্যাগিংয়ের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে লাগল। তার কতটা যে সত্যি, আর কতটা যে গুল, কে জানে! তবে আমরা একমত হলাম যে, আজ বালার্কর কিছু একটা ঘটবেই। কেবল কল্যাণ বলল, “আজ বান রুটিটা বুঝতে পারবে হিরোগিরির ফল৷ গুপ্তা গ্যাং নিয়ে বসে আছে লেডিস হস্টেলের সামনের ঘণ্টা ঘরের কালভার্টে।”
আমার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। বালার্কর কিছু হবে না তো? হঠাৎ মনে পড়ে গেল, সেই র্যাগিংয়ের পরীক্ষার রাত। বাকি সকলেই উত্তর লেখার চেষ্টা করলেও বালার্ক করেনি। বরং গুপ্তা, অজিত, মহেশবাবুদের মুখে-মুখে তর্ক করেছে। তখন আমাদের সামনেই গুপ্তারা অত্যাচার করেছিল বালার্কর উপর। সমস্ত জামাকাপড় খুলে ওর গায়ে ঢেলে দিয়েছিল গরম মোম। না, বালার্ক চিৎকার করেনি। হাত পা ছাড়েনি। শুধু ছাড়া পাওয়ার পর বলেছিল, “একা এলে দেখিয়ে দিতাম কে কাকে নাঙ্গা করে।”
সেই শোধ যদি গুপ্তা তোলে? আমার মনখারাপ লাগল। ইস্, কী কুক্ষণে এখানে যে পড়তে এসেছিলাম! শুনেছি সব জায়গায় প্রথম কয়েকদিনের পর র্যাগিং বন্ধ হয়ে যায়। তারপর ফ্রেশার্স ওয়েলকাম দেওয়া হয়। কিন্তু এখানে তো এসবের বালাই দেখছি না। বরং শুনছি যে, পুরো ফার্স্ট সেম ধরে নাকি র্যাগিং চলবে। এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় এটাই নাকি সিনিয়রদের বিনোদন।
জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম আমি। বড়-বড় গাছ আর তার ফাঁক দিয়ে ছড়ানো ছিটনো কিছু আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। এগুলো সব সোলার চার্জড লাইট। আলোর জোর তেমন নেই। এই আলোছায়া যেন জায়গাটাকে আরও ভয়ানক করে তুলেছে।
“ম্যাওম্যাও,” আচমকা ডাকে আমি তাকালাম। ঘরের অন্যরাও উঠে দাঁড়িয়েছে। আবিরদা! এই সময়ে? আমি উইশ করলাম। দেখলাম আবিরদা সামান্য টলছে।
“এই ম্যাওম্যাও। তোরা এখানে বসে কী করছিস?”
“কেন স্যার?”
“আমার সঙ্গে নীচে আয় তো। ওকে একা তুলতে পারছি না!”
“কাকে?” আমরা কোরাসে বললাম।
“বালার্ক। গুপ্তারা খুব মেরেছে ওকে, আয় তাড়াতাড়ি,” আবিরদা টলতে-টলতে সিঁড়ির দিকে এগোল।
আমরা দৌড়লাম। সিঁড়ির অন্ধকারে প্রায় লাফিয়ে নামলাম নীচে। আরে, বালার্ক কই? সকলেই থমকে দাঁড়ালাম। আবিরদা যে বলল নীচে রেখে এসেছে।
“এই যে আমি,” অন্ধকার কোণ থেকে এগিয়ে এল বালার্ক।
আমরা ওকে ধরলাম। শরীর কাঁপছে ওর। তবু সেই অবস্থাতেও বলল, “ওদের দুটোর নাক ভেঙে দিয়েছি আজ।”
নাক ভেঙে দিয়েছে! কথা শুনে বোবা হয়ে গেলাম আমরা।
৯
“চল তো শালা, বহুত দিন ধরে পড়াশোনা করেছি, আর ভাল লাগছে না। এ তো ক্লাস টেস্ট নয়, যেন গুঁতো,” আবিরদা আমার মাথায় আলতো করে চাঁটি মেরে বলল। আজ আবিরদা একা নয়, চন্দরদীপও রয়েছে।
আমি বললাম, “কেন, গুঁতো কেন?”
“ওই কোয়েশ্চন। শালা বেছে-বেছে কঠিনগুলোই ছাড়ছে। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে যে কী ঝামেলায় পড়েছি!”
চন্দরদীপ আবিরদার পিঠে চাপড় মেরে বলল, “ছোড় ইয়ার। জো হুয়া সে হুয়া। অব চল কুছ করতে হ্যায়।”
“কুছ করতে হ্যায়,” আবিরদা ভেঙাল, “কী করবি তুই এই শ্মশানের মতো জায়গায়? না আছে সিনেমা হল, না আছে রেস্টুরেন্ট বা ডিস্ক। তা কী করবি এই ফাঁকা মাঠে? সুরির দোকানের মুড়ি চিবোবি?”
চন্দরদীপ ছোট করে কাটা চুলে হাত বোলাল, “চল না ঝরনার দিকটায় যাই।”
“ঝরনা? ভাগ। হয় কলেজের বখাটে মেয়েগুলো ওখানে আড্ডা মারে, নয় তো জোড়ায়-জোড়ায় সব ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে বসে থাকে। যাব না ওখানে।”
“তা হলে ম্যাওম্যাও, তুই বল কোথায় যাওয়া যায়?”
“আমি?” মরুভূমিতে পথ হারানো বালকের মতো মুখ করে তাকালাম আমি।
“ওকে কী জিজ্ঞেস করছিস? ও তো বাচ্চা ছেলে,” আবিরদা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল।
বাচ্চা ছেলে। মনে-মনে হাসি পেল আমার। আবার নিজেকে পুরস্কৃত করলাম। যে-কোনও হস্টেলে গিয়ে র্যাগিং সামলে থাকতে হলে যেটা করতে হবে, তা মোটামুটি বুঝে ফেলেছি আমি। লো প্রোফাইল আর একটু বোকা-বোকা। মানে এই দুটো কায়দা রপ্ত করতে পারলেই কাম ফতে। বেশি অ্যারোগ্যান্ট হলেই বিপদ। এই যেমন বালার্ক। ক্যাদ্দানি করে মারামারি করতে গিয়ে এখন গত্তে পড়েছে!
সেদিন রাতের মারামারিটা কিন্তু সেখানেই থেমে থাকেনি। গড়িয়েছিল পরের দিন সকালেও, বা বলা ভাল এখনও গড়াচ্ছে। পরদিন সকালে হস্টেলে একটা নোটিস এসে পৌঁছেছিল। প্রিন্সির ঘরে ডাক পড়েছিল বালার্কর। আমরা খুব অবাক হয়েছিলাম। ভয়ও পেয়েছিলাম। হঠাৎ ডাকল কেন ওকে? বালার্ক কথা না বাড়িয়ে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে এগিয়ে গিয়েছিল প্রিন্সিপ্যালের ঘরের দিকে। আমরাও কৌতূহল চাপতে না পেরে পিছু নিয়েছিলাম। শুধু কল্যাণ বলেছিল, “বেশ হয়েছে। এবার প্রিন্সি বাম্বু দেবে। সবসময় হিরোগিরি। নে, আরও শ্রীবিদ্যার পিছনে ঘোর।”
বালার্ক প্রিন্সিপ্যালের ঘরের ভিতরে ঢুকলেও আমরা আমাদের কান আর চোখকে যতদূর সম্ভব প্রসারিত করে দাঁড়িয়েছিলাম দরজার বাইরে। ঘরের ভিতর বালার্ক ছাড়াও গুপ্তা আর মহেশবাবু ছিল। দু’জনের নাকেই আড়াই কিলোর ব্যান্ডেজ। সেরেছে, এই তা হলে কেস!
এর পরের আধ ঘণ্টা চিৎকার, রাগ, অভিযোগ, পালটা অভিযোগের টুকরো-টাকরা এসে উড়ে পড়ছিল বাইরে। সেগুলো জোড়া দিয়ে যা বুঝেছিলাম তা হল, গতকাল রাতে রমন স্যার সস্ত্রীক ফিরছিলেন শ্রীপুরম টাউন থেকে। তখনই দেখেন, রাস্তার পাশে কয়েকজন মারামারি করছে। স্যার তখন কিছু বুঝতে পারেননি। কিন্তু হাসপাতালের ডাক্তার, যে কিনা রমন স্যারের বন্ধু, সে গুপ্তা আর মহেশবাবুর চিকিৎসা করার ফাঁকে সব জেনে নিয়ে রমন স্যারকে বলে দেয়। ব্যস ‘পুর কনডুকটর’ তাঁর কনডাকটেন্স দেখিয়েছেন। চুপচাপ এসে লাগিয়ে দিয়েছেন প্রিন্সির কাছে। আর তার জেরেই তলব।
বালার্ক বেরোতেই দেখেছিলাম ওর মুখচোখ লাল। আমায় ও বলেছিল, “স্যার আমায় মারলেন, জানিস? এক সপ্তাহ সাসপেন্ড করে দিলেন আর গুপ্তাদের শুধু বকে ছেড়ে দিলেন। এই জন্যই, শালা, এই জন্যই রাগটা হয় আমার। তবে ছাড়ব না, সিনিয়রদের দাদাগিরি, আমি যতদিন আছি, ততদিন মানব না,” খোঁড়াতে-খোঁড়াতে হস্টেলের দিকে চলে গিয়েছিল ও। আমি বুঝেছিলাম যে বালার্ক রাগছে। আর রাগলে তো ওর হুঁশ থাকে না!
ক্রমশ ঘটনাটা চারদিকে চাউর হয়ে যায়। সেদিনই দশটার ব্রেকে শ্রীবিদ্যা এগিয়ে এসে খুব ঝাড় দেয় আমাদের। বলে আমরা ভিতু, স্বার্থপর। বন্ধুত্বের মর্যাদা দিতে পারি না। ওর মতে আমাদের সকলের গিয়ে প্রিন্সিপালের কাছে র্যাগিং নিয়ে অভিযোগ করা উচিত ছিল। আমাদের সকলের জন্য লড়তে গিয়ে আজ বালার্কর এই অবস্থা হল। ময়ূখ বলেছিল, “ও তো চলেই যাবে। বন্ধুত্ব ফলিয়ে আর লাভ কী?”
“আর তোমরা যেতে দেবে? এত সুন্দর জায়গা ছেড়ে সিটিতে গিয়ে থাকবে? হুঁ, শেমলেস ক্রিচারস।”
গার্লস হস্টেলে সফ্ট র্যাগিং খেয়ে আর ঝরনার ধারে গিয়ে গপ্পো করে যাদের সময় কাটে, তারা কীভাবে বুঝবে সত্যিকারের র্যাগিংয়ের বিভীষিকা কী? আমার বাবা তো আর ইনফ্লুয়েনশিয়াল নয়। সামান্য এক ব্যাঙ্ককর্মী। অনেক কষ্ট করে এখানের খরচ চালাতে হচ্ছে বাবাকে। আমি জানি ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বেরোতেই হবে আমাকে। না হলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সেখানে কি হিরোগিরি করা সাজে আমার? আমাকে মারবে, অপমান করবে, কষ্ট দেবে, তবু টুঁ শব্দটি করব না আমি। সম্মানের চেয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং অনেক বড়। পরিচিতদের ঈর্ষা, পড়শির সম্ভ্রম আর বাবা-মায়ের গর্ব। এসব তো তৈরি করতে হবে আমাকেও। তা যতই গুপ্তা আমায় জুতো মাথায় খোলা মাঠে দাঁড় করিয়ে রাখুক, সিনিয়রদের নোংরা জামাকাপড় কাচতে হোক আমায়। ম্যাওম্যাও শব্দ করে যতই নিজেকে চতুষ্পদে নামিয়ে আনি, যতই শ্রীবিদ্যা এসে কাপুরুষ বলুক, স্বার্থপর বলুক, আমায় ধৈর্য হারালে চলবে না! লক্ষ্য থেকে চোখ সরালে চলবে না। বোকা মানুষের মুখ আর গণ্ডারের চামড়া গায়ে চড়িয়ে আমায় লো প্রোফাইল মেনটেন করতে হবে। প্রিন্সিপালের চড় বা সাতদিনের সাসপেনশন আমার জন্য নয়।
“চল আজ রিভেরিতে যাই,” আবিরদার কথায় চটকা ভাঙল।
“সেটা কোথায়?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“সেটা জেনে তোর লাভ? যেতে বলছি, যাবি, ব্যস,” চন্দরদীপ বলল।
আমরা উঠলাম। সূর্য মাথার উপর থেকে পশ্চিম আকাশে গড়াচ্ছে এখন। ছায়ারা লম্বা হচ্ছে। দূরে দেবদারু বনের দিক থেকে এ সময় ঠান্ডা হাওয়া দেয় একটা। ছিপছিপে নদীতে খসে পড়ে ছোট্ট লাল ফল। হাইওয়ে দিয়ে মাঝে-মাঝে দূরে মিলিয়ে যায় টুরিস্ট কোচ। ট্র্যাক্টরের মতো গাড়িতে পার করা হয় নারকেলের ছোবড়া। আর এসবের থেকে দূরে, এককোণে দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের বিষণ্ণ হস্টেল। দেখি ওপরের একটা পাল্লা-খোলা জানলায় মেলে রাখা পাঞ্জাবি হাওয়ায় উড়ছে। মনে পড়ে জন্মদিনে মা কিনে দিয়েছিল এটা। মনে হয় আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরে বসে মা কি ভাবছে আমার কথা? দেখতে পাচ্ছে আমার চেষ্টাটা?
আবিরদা তাজমহল দেখানোর মতো করে আমাকে রিভেরি দেখাল। একতলা প্লাস্টার-খসা বাড়ি একটা। কোনও একসময় বাড়ির বাইরের দেওয়ালের রং সবুজ ছিল। ছোট্ট চাতাল সামনে। সেটা পেরিয়ে একটা দরজা। তাতে আলেকজ়ান্ডারের আমল থেকে না-কাচা একটা পরদা ঝুলছে। কিন্তু সাইনবোর্ড? সাইনবোর্ড কই? আমি জিজ্ঞেস করলাম, “স্যার সাইনবোর্ড কই? মানে রিভেরি লেখা আছে কোথায়?”
“আরে ম্যাওম্যাও, রিভেরি নামটা আমরা দিয়েছি। এখানে এসে দু’ পাত্তর চড়াও, ব্যাস, রিভেরি। চল, ভিতরে চল।”
এটা বার! ছ্যাঁত করে উঠল আমার বুক। মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে আমি। ছোট থেকে ঠাকুরদার কাছাকাছি থেকে বড় হয়েছি। ঠাকুরদা ছিলেন সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ। মাছ, মাংস, ডিম পর্যন্ত খেতেন না। নেশা বলতে ছিল বই। তাঁর কাছেই শুনেছি, কোনও রকম স্টিমুল্যান্ট গ্রহণ করা পাপ। ওসব নরকের পথ। ঠাকুরদার সংস্পর্শে থাকতে-থাকতে সিগারেট দেখলে পর্যন্ত ঘেন্না লাগে আমার আর সেখানে মদ! আমি বললাম, “স্যার, ছেড়ে দিন স্যার। মা কালীর দিব্যি আমার মাথা ঘোরাচ্ছে।”
আবিরদা ঠোঁট কামড়ে কড়া চোখে তাকাল। মুখটা যেন হিংস্র হল একটু। বলল, “না ঢুকলে পিছনে লাথি মেরে ঢোকাব।”
“স্যার, প্লিজ় স্যার, আমি এসব খাই না। গন্ধে গত জন্মের ভাত উঠে আসে। আমায় ক্ষমা করবেন।”
চন্দরদীপ হাসল। তারপর আচমকা আমার দু’ বগলের ভেতর হাত ঢুকিয়ে চাগিয়ে নিয়ে গেল নরকের ভিতরে।
ময়লা মেঝে। সামান্য অগোছালো টেবিল চেয়ার। তাতে রং-জ্বলা সানমাইকা, ব্রিটিশ আমলের ক্যালেন্ডার ঝুলছে দেওয়ালে। প্রতিটা টেবিলে নোংরা প্লাস্টিকের জগ। অ্যাশট্রে আর নুনের ডিবে। আর ঘরের মাঝখানে একটা গোল ফুটখানেক উঁচু মঞ্চ। এটা কীসের?
আমার মনের প্রশ্ন ঠিক বুঝে গেল আবিরদা। বলল, “ওটার উপর রাতে নাচে।”
“কে নাচে?”
“জান না শালা কে নাচে? বানরুটি তুই।”
এমন জায়গায় নাচানাচি হয়? আমি অবাক হলাম।
“আরও রাতের দিকে আরও অন্য নাচ হয়। বুঝলে খোকন সোনা? পৃথিবী কোথায় পৌঁছে যাচ্ছে আর তুমি বসে বেবিফুড খাও। চল, বস ওখানে,” আবিরদা মাথায় চাঁটি মারল আমার।
আমি জানলার পাশে বসলাম। বাইরে খোলা মাঠ দেখা যাচ্ছে তাতে পাখিরা লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। ছাগল চড়ছে, দু’-চারটে বাচ্চা বল নিয়ে খেলছে। আর দূরে অভিমানী রাজপুত্রের মতো পড়ে রয়েছে রেললাইন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই হলুদ তরল ভরা দুটো গেলাস চলে এল আবিরদা আর চন্দরদীপের সামনে। এল দু’ বাটি চানাচুর, বাদাম।
“খা, বাদাম খা। তুই কি ভেবেছিস তোকে আমরা মদ খাওয়াব? নেভার। জুনিয়ররা কখনও সিনিয়রদের সামনে মদ খায় না। বুঝেছিস?” আবিরদা বলল।
কড়া অ্যালকোহলের গন্ধে শরীর পাক দিয়ে উঠল আমার। এর মধ্যে বাদাম খাব? বললাম, “স্যার, ছেড়ে দিন হস্টেলে যাব।”
“শালা ন্যাকামো হচ্ছে?” আবিরদা ক্ষেপে গেল হঠাৎ, “দাঁড়া তোর হচ্ছে। চন্দর জ়রা দেখনা ইসে।”
চন্দরদীপ আমায় বলল, “চল ম্যাওম্যাও উঠ, অর জ়মিন পে বৈঠ যা। বস মাটিতে বস।”
“মানে?” আমি থতমত খেলাম।
“মানে মাটিতে বস। কুইক।”
বুঝলাম হলুদ তরলের প্রভাবেই হোক বা অন্যকিছুর প্রভাবেই হোক, চন্দরদীপ বেশ রেগে গিয়েছে। এবারে বেগড়বাই দেখলেই মারবে। অগত্যা চেয়ার ছেড়ে আমি মাটিতে বসলাম।
“নে এবার ধর,” চন্দরদীপ মদের গেলাসটা আমার হাতে দিল।
মরা ইঁদুর ধরার মতো গেলাসটা ধরলাম। আমার গা ঘিনঘিন করতে লাগল। এই ময়লা মেঝে, তার উপর এমন গেলাস! কিন্তু র্যাগিং বড় বালাই।
“এবার গেলাসটা মাথায় ঠেকিয়ে চিৎকার করে বল, ‘জয় মাল!’ বল,” চন্দরদীপ ধমকাল।
আমি দেখলাম আশেপাশের সকলেই তাকাচ্ছে। মুচকি-মুচকি হাসছে। নিজেদের ভাষায় কিছু বলাবলিও করছে। এর মাঝে আমি গেলাসটা মাথায় ঠেকিয়ে দুর্বল গলায় বললাম, “জয় মাল।”
“জোরে বল,” চন্দরদীপ চেঁচাল।
ভয় পেয়ে আমিও চেঁচালাম।
“আব পুরা পি জা।”
“অ্যাঁ?”
“খা, পুরোটা খা,” চন্দরদীপ উঠে দাঁড়িয়েছে।
“চন্দর বৈঠ,” আবিরদা জোর করে বসিয়ে দিল চন্দরদীপকে। তারপর আমায় বলল, “বোকা ছেলে এখান থেকে যা, পালা।”
“আবির, ডোন্ট ইন্টারফেয়ার,” চন্দরদীপ আচমকা রেগে গিয়েছে।
“ম্যাওম্যাও যা,” আবিরদা চোখ দিয়ে ইশারা করল। বুঝলাম আবিরদা আবার বাঁচাচ্ছে আমায়। আমি আর অপেক্ষা করলাম না। গেলাসটা টেবিলে রেখে চোঁ-চাঁ দৌড় মারলাম। যেতে-যেতে শুনলাম চন্দরদীপ বলছে, “আবির, ইয়ে তুনে ঠিক নহি কিয়া…”
হাইওয়ে পেরিয়ে আমাদের ক্যাম্পাসে ঢুকে খেলার মাঠের একপাশে যে বড় বটগাছটা রয়েছে তার তলায় এসে আমি দম নিলাম। ওঃ, খুব বাঁচান বেঁচে গিয়েছি। চন্দরদীপ যেমন ক্ষেপে গিয়েছিল, আর কী করত কে জানে! এরা সকলেই কি অসুস্থ? ভাগ্যিস আবিরদা ছিল!
“কারও কিছু চুরি করেছ নাকি?” প্রশ্নটা আচমকা এসে আমায় এমন চমকে দিল যে আমি লাফিয়ে উঠলাম।
“চমকাচ্ছ কেন? চোরদের চমকাতে নেই জান না?”
এবার প্রশ্নকর্ত্রীকে দেখলাম আমি। গোলাপি স্কার্টের উপর ব্লু টপ। হাতে র্যাকেট। আমার মনে হল কোটি-কোটি সূর্য এসে যেন ধাক্কা মেরেছে আমার চোখে। মুহূর্তের মধ্যে আমার আপোস, ভয়, পড়াশোনায় ফোকাস মায় রণবিজয় কওশল পর্যন্ত চটকে গেল। মনে হল বিকেলের এই মুহূর্তের সাক্ষী হওয়ার জন্যই আমার পৃথিবীতে আসা। এই মুহূর্তটুকু ফুরিয়ে গেলে বেঁচে থাকাটুকুও ফুরিয়ে যাবে!
“এই যে চোর, চিনতে পারছ আমায়? আমি তোড়ি।”
আমারই? আঃ। সত্যি কি তাই?
তোড়ি রাগী গলায় টিপিক্যাল মহারাষ্ট্রীয় টানে বলল, “তুম বহৎ গিরা হুয়া লড়কা হো, পতা হ্যায় তুমহে?”
ভাবলাম বলি, গিরা হুয়া? হবে হয় তো, তাই তো চন্দরদীপ মাটিতে বসিয়েছিল আজকে। কিন্তু বললাম না। সুন্দরী মেয়েরা রেগে গেলে কখনও তাদের সঙ্গে তর্ক করতে নেই।
না, এটা ঠাকুরদা শেখায়নি আমায়। এটা আমি নিজে শিখেছি।