০১. তিথি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে

তিথি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

কেন দাঁড়িয়ে আছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। অবশ্যি আঠার-উনিশ বছরের মেয়েরা বিনা কারণেই আয়নার সামনে দাঁড়ায়। তিথির বয়স একুশ। সেই হিসেবে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকার একটা অর্থ করা যেতে পারে। এই বয়সের মেয়েরা অন্যের মাঝে নিজের ছায়া দেখতে ভালবাসে। যে কারণে পুকুর দেখলেই পুকুরের পানির উপর ঝুঁকে পড়ে। আয়নার সামনে থমকে দাঁড়ায়। নিজেকে দেখতে বড় ভাল লাগে।

তিথির বয়স একুশ হলেও এইসব যুক্তি তার বেলায় খাটছে না। কারণ ঘর অন্ধকার। আয়নায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। যদিও বাইরে শেষ বেলার আলো এখনো আছে। সেই আলোর খানিকটা এ ঘরে আসা উচিত। কিন্তু আসছে না। বৃষ্টির মধ্যে দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখা হয়েছে। সারাদিন অবিশ্রান্ত বর্ষণ হয়েছে। এখন বৃষ্টি নেই। দরজা-জানালা অবশ্যি খোলা হয়নি। কারণ আবার বৃষ্টি আসবে। আকাশে মেঘা জমতে শুরু করেছে।

এই ঘরে সে ছাড়াও আরো একজন মানুষ আছে, তার বাবা শিয়ালজানি হাই স্কুলের রিটায়ার্ড অ্যাসিসেটেন্ট হেড মাস্টার জালালুদ্দিন সাহেব। জালালুদ্দিন সাহেব চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমুচ্ছিলেন। খানিকক্ষণ আগে তার ঘুম ভেঙেছে। তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার চোখে সমস্যা আছে। চোখ প্রায় নষ্ট। কিছুই দেখতে পান না। কড়া রোদে আবছা আবছা কিছু দেখেন। সত্যি দেখেন না কল্পনা করে নেন তা বোঝা মুশকিল। আজ তার কাছে মনে হচ্ছে তিনি তার বড় মেয়েকে এই অন্ধকারেও দেখতে পাচ্ছেন। শ্যামলা মেয়েটির বালিকাদের মত সরল মুখ, বড় বড় চোখ সব তিনি পপিন্ধাব দেখতে পাচ্ছেন। কী আশ্চৰ্য্য কাণ্ড।

জালালুদ্দিন সাহেব প্রচণ্ড উত্তেজনা বোধ করলেন। তার চোখ কি তাহলে সেরে গেল নাকি? গত সাতদিন ধরে একটা কবিরাজি ওষুধ তিনি চোখে দিচ্ছেন নেত্র সুধা! ওষুধটা মনে হচ্ছে কাজ করেছে। জালালুদ্দিন চিকন গলায় ডাকলেন, ও তিথি।

তিথি বাবার দিকে ফিবে তাকাল। কিছু বলল না।

চোখে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি রে মা! তোর পরনে একটা লাল শাড়ি না? পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি।

তিথি বলল, শাড়ির রঙ নীল। বলেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। আজ সে বাইরে যাবে। বাইরে যাবার আগে কারো সঙ্গে কথা বলতে তার ভাল লাগে না।

তিথি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বইল আবার বৃষ্টি আসবে কি না বুঝতে চেষ্টা করল। বৃষ্টি আসুক বা না। আসুক তাকে বেরুতেই হবে। সে রান্নাঘরে ঢুকল। রান্নাঘরে তিথির মা মিনু চুলা ধরানোর চেষ্টা করছেন। কাঠ ভেজা। কিছুতেই আগুন ধরছে না। বোতল থেকে কেরোসিন ঢাললেও লাভ হয় না। ধপ করে জ্বলে উঠে কিছুক্ষণ পর আগুন নিভে যায়। কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া বেরুতে থাকে। তিথি একটা মোড়ায় বসে মাকে দেখছে। মিনু বিরক্ত গলায় বললেন তুই বসে বসে ধোঁয়া খাচ্ছিস কেন? বারান্দায় গিয়ে বোস। তিথি নিঃশব্দে উঠে এলো। বারান্দায় এসে দাঁড়াল। আবার বৃষ্টি হচ্ছে। টিনের চালে ঝমঝম শব্দ। ঘোর বর্ষা।

তাদের বাসাটা কল্যাণপুর ছাড়িয়েও অনেকটা দূরে। জায়গাটার নাম সুতাখালি। পুরোপুরি গ্রাম বলা যায়। চারদিকে ধানি জমি। তবে ঢাকা শহরে লোকজন বেশির ভাগ জমিই কিনে ফেলেছে। তিন ফুট উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘিরে সাইনবোর্ড বুলিয়ে দিয়েছে দিস প্রপার্টি বিলংস টু. দেয়াল ঘেরা অংশে পানি থৈ থৈ করে। পানির বুক চিরে যখন-তখন হলুদ রঙের সাপ সাঁতরে যায়। জায়গাটায় সাপখোপের খুব উপদ্রব। তবে অবস্থা নিশ্চয়ই এ রকম থাকবে না। তিন-চার বছরের মধ্যেই চার-পাঁচতলা দালান উঠে যাবে। ইলেকট্রিসিটি গ্যাস চলে আসবে। সন্ধ্যাবেলা চারদিক ঝলমল করবে। তিন কামরার একটি বাড়ির ভাড়া তিন-চার হাজার টাকা। তিথিদের এই বাড়িটার ভাড়া মাত্র ছ’শ। রান্নাঘর ছাড়াই তিনটা কামরা আছে। এক চিলতে বারান্দা আছে। করোগেটেড টিনের শিটের বেড়া দিয়ে ঘেরা। রান্নাঘরের পাশে তিনটা পেঁপে গাছ আছে। তিনটা গাছেই প্রচুর পেঁপে হয়। ছ’শ টাকায় এ-ই বা মন্দ কী?

মিনু চায়ের কাপ দিয়ে বারান্দায় এসে বিরক্ত মুখে বলল, আবার বৃষ্টি নামল! এই বৃষ্টির মধ্যে যাবি কিভাবে? তিথি জবাব দিল না। আকাশের মেঘের দিকে তাকাল। মেঘ দেখতে সব মেয়েরই বোধ হয় ভাল লাগে। তিথির চোখে-মুখে এক ধরনের মুগ্ধতা।

মিনু বললেন, চায়ে চুমুক দিয়ে দেখ মিষ্টি লাগবে কি-না।

চা খাব না। মা। বাবাকে দিয়ে দাও।

তোর বাবার জন্যে তো বানিয়েছি, তুই খা।

ইচ্ছা করছে না। শরীর খারাপ নাকি রে?

না। শরীর ভালই আছে। টুকু ঘরে আছে কি-না দেখ তো মা। আমাকে এগিয়ে দেবে। টুকু ঘরে ছিল। বাবার সাথে চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমুচ্ছিল। মিনু চাদর সরিয়ে প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিলেন–হারামজাদা বান্দর। সন্ধ্যাবেলায় ঘুম। টান দিয়ে কান ছিঁড়ে ফেলব।

জালালুদ্দিন বিড়বিড় করে বললেন। ঘুমন্ত অবস্থায় মারধর করা ঠিক না। ব্ৰেইনে এফেক্ট করে।

মিনু তীব্র গলায় বললেন তুমি চুপ করে থাক। তোমাকে মারধর করা হয়নি। সামনে চায়ের কাপ আছে ফেলে একাকার করবে না।

বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছাবার আগেই হীরুকে দেখা গেল পানিতে ছপছপ শব্দ করতে করতে আসছে। হীরু তিথির এক বছরের বড়। মুখ ভর্তি গোঁফ দাড়ির জঙ্গলের জন্য বয়স অনেক বেশি মনে হয়। হীরুর এক হাতে দড়িতে বাধা ইলিশ মাছ। অন্য হাতে টর্চ। ব্যাটারি ফুরিয়ে যাওয়ায় ঝাপসামত আলো বেরুচ্ছে। হীরু পাঁচদিন আগে আধমণ চাল কিনবার টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল। আজ ফিরছে। তিথি না দেখার ভান করল।

হীরু গম্ভীর গলায় বলল, তোরা কোথায় যাচ্ছিস?

তিথি জবাব দিল না। যেমন হাঁটছিল তেমনি হাঁটতে লাগল। যেন সে এই মানুষটাকে চেনে না। এ যেন রাস্তার একজন মানুষ। পরিচিত কেউ নয়।

কি রে, কথা বলছিস না কেন?

তোর সঙ্গে কথা বলার কিছু আছে?

আরে কি মুশকিল, এত রেগে আছিস কেন? বৃষ্টি-বাদলা দিনে এত রাগ ভাল না। বাসায় চল। বাসায় গিয়ে কী হবে?

হবে। আবার কী? গরম গরম ভাত আর ইলিশ মাছ ফ্রাই খাবি। চল্লিশ টাকা দিয়ে কিনলাম। এমনিতে সত্তর টাকা দাম। বৃষ্টি-বাদলা বলে বাজারে লোক নেই। পানির দামে সব ছেড়ে দিচ্ছে।

তুই আমার সঙ্গে কথা বলিস না। বাসায় যা। বাসায় গিয়ে ইলিশ মাছ ভাজা খা।

রাতে ফিরবি তো? ফিরলে কখন ফিরবি বলে যা, বাস স্ট্যান্ডে থাকব। দিনকাল ভাল না।

আমার জন্যে কাউকে দাঁড়াতে হবে না। আর একটা কথা বললে আমি কিন্তু চড় লাগাব। ফাজিল কোথাকার। চোরের চোর।

আরে কি মুসিবত, মুখ খারাপ করছিস কেন? আমি তোর সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করছি, তুই আমার সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করবি। আমি কী গালাগালি করছি?

চুপ কর।

ধমক দিচ্ছিস কেন? তোর বড় ভাই হই মনে থাকে না? সংসারকে দু’টা পয়সা দিয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করছিস। পয়সা কিভাবে আনছিস সেটা বুঝি আমি জানি না? এই শর্মা মায়ের বুকের দুধ খান না। সব বুঝে। তোর ঐ পয়সায় আমি পেচ্ছাব করে দেই। আই মেক ওয়াটার। বুঝলি ওয়াটার। আমার স্ট্রেইট কথা। পছন্দ হলে হবে। না হলে–নো প্রবলেম।

তিথি দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। সে কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। হীরু লম্বা লম্বা পা ফেলে বাড়ির দিকে রওনা হল।

বারান্দায় উঠেই সে সহজ গলায় বলল মা, মাছটা ধর তো। তার বলার ভঙ্গি থেকে মনে হতে পারে সে কিছুক্ষণ আগে মাছ কেনার জন্যেই গিয়েছিল। কিনে ফিরেছে।

মিনু রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে। হীরু মার দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বলল, ঘরে সর্ষে আছে মা? যদি থাকে, সর্ষে বাটা লাগিয়ে দাও। কুমড়ো পাতা খোঁজ করছিলাম। পাইনি। পেলে পাতুরি করা যেত। বর্ষা-বাদলার দিনে পাতুরির মত জিনিস হয় না।

মিনু শান্ত কণ্ঠে বললেন, তুই বেরিয়ে যা। হীরু অবাক হয়ে বলল, কোথায় বেরিয়ে যাব?

যেখানে ইচ্ছ যা। এই বাড়িতে তোকে দেখতে চাই না।

ঠিক আছে যেতে বলছি যাব।

এক্ষুণি যা।

আচ্ছা ঠিক আছে। মাছটা সখ করে এনেছি, রান্নাবান্না কর খেয়ে তারপর যাই। এক ঘণ্টা আগে গেলেও যা পরে গেলেও তা।

মিনু মাছ উঠোনের কাদার মধ্যে ছুড়ে ফেলে রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। হীরু উঁচু গলায় বলল, আমার ওপর রাগ করছ কর মাছের ওপর রাগ করছে কেন? এই বেচারা তো কোনো দোষ করেনি। একের অপরাধে অন্যের শাস্তি এটা কি রকম বিচার?

মিনু রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বললেন ঘরে ঢুকলে বঁটি দিয়ে তোকে চাকা চাকা করে ফেলব। খবরদার! হীরুর তেমন কোনো ভাবান্তর হল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই হীরুকে দেখা গেল। গামছা লুঙ্গির মত করে পরে বঁটি দিয়ে অন্ধকারে মাছ কুটতে বসেছে। কথা বলছে নিজের মনে। এমন ভাবে বলছে যেন রান্নাঘর থেকে মিনু শুনতে পান।

সব কিছু না শুনেই রাগ। আরে আগে ঘটনাটা কি ঘটেছে শুনতে হবে না? না শুনেই চিৎকার, চেঁচামেচি। চাল কিনতে বাজারে ঢুকেছি। নাজিরশাল চাল। দেখেশুনে পছন্দ করলাম। বস্তার মধ্যে নিলাম বিশ সের। টাকা দিতে দিয়ে পকেটে হাত দিয়ে দেখি পরিষ্কার। সাফা করে দিযেছে। চাল না নিয়ে বাসায় ফিরি কিভাবে? চক্ষু লজ্জার ব্যাপার আছে না? গোলাম রশীদের কাছে টাকা ধার করতে। সেইখানে গিয়ে দেখি রশীদ শালা টেম্পোর সঙ্গে একসিডেন্ট করে এই মরে সেই মরে. গোলাম হাসপাতালে, দিলাম ব্লাড। ব্লাড দেয়ার পরে দেখি নিজের অবস্থা কাহিল। ভিরমি খেয়ে পড়ে যাচ্ছি, সিস্টার এসে ধরল…

মিনু রান্নাঘর থেকে জ্বলন্ত চ্যালাকাঠ নিয়ে বের হলেন। শীতল স্বরে বললেন আর একটা কথা না। হীরু চুপ করে গেল।

জালালুদ্দিন নিচু গলায় বললেন, খালি পেটে চা খাওয়াটা ঠিক হবে না। আলসার ফালসার হয়। ঘরে আর কিছু আছে?

মুড়ি আছে। মুড়ি মেখে দেব?

থাকলে দাও। খিদে খিদে লাগছে।

ঐ একটা জিনিসই তো তোমার লাগে ক্ষিধা। সকালে ক্ষিধা, বিকালে ক্ষিধা, সন্ধ্যায় ক্ষিধা।

মিনু আবার রান্নাঘরে ঢুকলেন। চাপা স্বরে বিড়বিড় করতে লাগলেন, এর নাম সংসার। স্বামীপুত্র-কন্যার সুখের সংসার। এত সুখ আমার কপালে। আমি হলাম গিয়ে সুখের রানী চম্পাবতী।

জালালুদিনের চোখ এখন বন্ধ। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখ করকার করে। চোখ দিয়ে পানি পড়ে। তিনি হাতড়ে হাতড়ে চায়ের কাপ নিলেন। চুমুক দিয়ে তৃপ্তির একটা শব্দ করলেন। নরম স্বরে ডাকলেন ও টুকু। টুকুন রে।

টুকু জবাব দিল না। বিনা কারণে মার খেয়ে তার মন খুব খারাপ হয়েছে। সে বসে আছে গম্ভীর মুখে। জালালুদ্দিন আবার ডাকলেন, ও টুকু। ও টুকুন।

কী?

চোখটা মনে হচ্ছে সেরেই গেছে। খানিক্ষণ আগে তিথিকে দেখলাম। পরিষ্কার দেখলাম। শাড়ির রঙটা অবশ্য ধরতে পারিনি।

টুকু কিছুই বলল না।

তিনি তাতে খুব একটা ব্যথিত হলেন না। এ বাড়িতে বেশির ভাগ লোক তাঁর সঙ্গে কথা বলে না। কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয় না। তার এখন অভ্যেস হয়ে গেছে।

ও টুকু?

কী?

মাগরেবের আজান হয়েছে?

জানি না।

চা খাবি? পিরিচে ঢেলে দেই? জ্বরের মধ্যে চা ভাল লাগবে। ওষুধের মত কাজ করবে। পাতার রসটা ডাইরেক্ট আসছে। কুইনিন কী জিনিস? গাছের বাকলের রস। গাছের রস। খুবই উপকারী।

টুকু কোনো কথা না বলে খাট থেকে নেমে গেল। তার বয়স তের। কিন্তু দেখে মনে হয়৷ ন’দশ। শরীর খুবই দুর্বল। কিছু দিন পরপরই অসুখে পড়ছে। আজ জ্বরের জন্যে সে অবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছিল।

বারান্দায় বালতিতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা। টুকু মগ ডুবিয়ে পানি তুলছে। বরফ শীতল সেই পানিতে মুখ ধুতে গিয়ে শীতে কেঁপে কেঁপে উঠছে। নিশ্চয়ই এখনো গায়ে জ্বর আছে। নয় তো পানি এত ঠাণ্ডা লগত না। মুখে পানি ঢালতে ঢালতে সে তিথির দিকে তাকাল। আপাকে কি সুন্দর লাগছে! আপা আর একটু ফর্সা হলে কি অদ্ভুত হত!

তিথি বলল, টুকু আমাকে বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিবি?

টুকু মাথা নাড়ল। ভেতর থেকে জালালুদ্দিন ডাকলেন তিথি, শুনে যা তো মা।

তিথি বারান্দা থেকে নড়ল না। সেখান থেকেই বলল কি বলবে বল।

এই সন্ধ্যাবেলা কোথায় বেরুচ্ছিস? কি রকম ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে দেখছিস না।

আমার কাজ আছে।

ঝড়বৃষ্টির মধ্যে কিসের কাজ? বাদ দে।

সে জবাব দিল না। জালালুদ্দিন বললেন, খবরদার বেরুবি না। কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে থাক। মানুষ কী পিঁপড়া নাকি যে রাতদিন কাজ করবে।

মিনু ঝাঁঝাল গলায় বললেন, চুপ কর। সব সময় কথা বলবে না।

এই বৃষ্টির মধ্যে যাবে নাকি?

তোমাকে এটা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।

বৃষ্টিতে ভিজে একটা জ্বরজ্বারি বাঁধাবে…সিজন চেঞ্জ হচ্ছে।

বললাম তো তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না।

তিথি যখন বেরুল তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে। চারদিক অন্ধকার। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। সে ঘর থেকে বেরুবার সময় কাউকে কিছু বলে বেরুল না। মিনু বারান্দাতেই ছিলেন তার দিকে তাকিয়ে একবার বললও না মা, যাচ্ছি। যেন সে তাকে দেখতেই পায়নি।

ঘরে ছাতা নেই। তিথি মোটা একটা তোয়ালে মাথায় জড়িয়ে রাস্তায় নেমেছে। খালি পা। স্যান্ডেল জোড়া হাতে। কাঁচা রাস্তা, খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। টুকু আগে আগে যাচ্ছে। তার মাথায় কিছু নেই। বৃষ্টিতে মাথার চুল এর মধ্যেই ভিজে জবজবে। তিথি বলল, বাসায় গিয়ে ভাল করে মাথা মুছে ফেলবি। নয় তো জ্বরে পড়বি।

টুকু মাথা কাত করল। মৃদু গলায় বলল, রাতে ফিরবে না। আপা?

না।

সকালে আসবে?

হুঁ। এবার বর্ষা আগেভাগে এসে গেল তাই না রে টুকু। মনে হচ্ছে শ্রাবণ মাস। তাই না?

হুঁ।

গতবারের মত এবারও ঘরে পানি উঠবে কি-না কে জানে। তোর কি মনে হয় উঠবে?

টুকু জবাব দিল না। তার গা কাঁপিয়ে জ্বর আসছে। কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।

কলাবাগানের ভেতরের দিকে একটা বাড়ির সামনে তিথি এসে উপস্থিত হয়েছে। তার শাড়ি কাদা-পানিতে মাখামাখি। হোচট খেয়ে স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে গেছে। নখের খানিকটা ভেঙে যাওয়ায় রক্ত পড়ছে। অনেকক্ষণ কড়া নাড়বার পর মাঝবয়েসী এক লোক দরজা খুলল। তার খালি গা। হাঁটু পর্যন্ত উঁচুতে লুঙ্গি উঠে আছে। পরার ধরন এমন মে মনে হয় যে কোনো মুহূর্তে খুলে পড়ে যাবে। তার কোলে তিন-চার বছরের একটি বাচ্চা। ভদ্রলোক বাচ্চাকে ঘুম পাড়াতে চেষ্টা করছেন। বাচ্চা ঘুমুচ্ছে না। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ঝিম করে থাকে আবার মাথা তুলে হিক জাতীয় বিচিত্র শব্দ করে।

তিথি বলল, নাসিম ভাই কেমন আছেন? নাসিম বিরক্ত গলায় বলল, এই তোমার বিকাল পাঁচটা, কটা বাজে তুমি জানো?

তিথি চুপ করে রইল।

নাসিম বলল, আটটা পঁচিশ।

তিথি হালকা গলায় বলল, দূরে থাকি। ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। তাই দেরি হল।

দূরে তুমি একা থাক নাকি? অন্যরা থাকে না? কতবার বললাম খুব ভাল পার্টি হাজার খানিক টাকা পেয়ে যাবে। বেশিও দিতে পারে। নতুন পয়সা-হওয়া পার্টি। এদের টাকার মা-বাপ আছে? উপকার করতে চাইলে এই অবস্থা।

ভেতরে আসতে দিন নাসিম ভাই। বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। মনে হচ্ছে জ্বর এসে যাচ্ছে।

আস আস, ভেতরে আস। পা কেটেছে নাকি?

হুঁ।

ইস, রক্ত বের হচ্ছে দেখি। যাও, বাথরুমে ঢুকে শাড়ি বদলে ফেল। তোমার ভাবীকে বল শাড়ি দিবে। আজ রাতে তো আর কিছু পাওয়া যাবে না। ভাল একটা পার্টি চলে গেল।

আজ তাহলে চলে যাব?

ঝড়বৃষ্টির মধ্যে যাবে কোথায়? কথা বলে সময় নষ্ট করছ কেন? বুকে ঠাণ্ডা বসে গেলে মুশকিলে পড়বে।

নাসিম ভাই এখানে কোনো জায়গা থেকে একটা টেলিফোন করা যাবে?

কোথায় টেলিফোন করবে?

তিথি চুপ করে রইল। নাসিম বলল, শোন তিথি একটা কথা বলি, মন দিয়ে শোন পার্টির সাথে বাড়তি খাতির রাখবে না। যত দূরে থাকা যায়। ফেল কড়ি মাখ তেল। এর বেশি কিছু নয়।

সে রকম কিছু না নাসিম ভাই।

সে রকম কিছু না হলেই ভাল।

নাসিম গলা উঁচিয়ে বলল বীনা, কই চা দাও দেখি। ঘরে স্যাভলন-ট্যাভলিন আছে? বাথরুমের তাকে দেখ তো। আর এক বান্দরের বাচ্চা তো ঘুমাচ্ছে না। ইচ্ছা করছে আছাড় দিয়ে পেটটা গালিয়ে দেই। চুপ, কানবি না। একদম চুপ।

রীনা এসে বাচ্চাটিকে নিয়ে গেল। একবার শুধু সরু চোখে দেখল তিথিকে। আগেও অনেকবার দেখেছে কখনো কথা হয়নি। আজও হল না। রীনার বয়স ষোল-সতের। এর মধ্যে দু’টি বাচ্চার মা হয়েছে। তৃতীয় বাচ্চা আসার সময়ও প্রায় হয়ে এল। রোগা শরীরের কারণে তার সন্তানধারণজনিত শারীবিক অস্বাভাবিকতা খুবই প্রকট হয়ে চোখে পড়ে।

নাসিম বলল, এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও, ভেতরে গিয়ে শাড়ি বদলে আস। পায়ে কিছু দাও।

শাড়ি বদলাব না চলে যাব।

এত রাতে?

রাত বেশি হয়নি। বাস আছে।

রাতিবিরাতে এরকম চলাফেরা ভাল না, কখন কোন বিপদ হয়।

রীনা চা নিয়ে এসেছে। এত দ্রুত সে চা বানাল কি করে কে জানে। মেয়েটা খুবমই কাজের। তিথির চা খেতে ইচ্ছা করছে না। মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। জ্বর আসবে কি-না কে জানে। নাসিম পিরিচে ঢেলে বড় বড় চুমুকে চা খাচ্ছে। প্রতিবার চুমুক দিয়ে আহ করে একটা শব্দ করছে। সামান্য চায়ে এত তৃপ্তি। কিছু কিছু মানুষ খুব অল্পতে সুখী হয়।

তিথি।

জি।

থাকতে চাইলে থাক, অসুবিধা কিছু নেই। খালি ঘর আছে।

না থাকব না।

পরশু, তরশু একবার এসো। দেখি যদি এর মধ্যে ভাল কোনো পার্টি পাই। ফরেনার পাওয়া গেলে ভাল। এদের দরাজ দিল। খুশি হলে হুঁশ থাকে না। তবে সব না। কিছু আছে বিরাট খচ্চর। চামড়া সাদা হলেই যে দরাজ দিল হয় এটা ঠিক না। সাদা চামড়ার মধ্যেই খচ্চর বেশি।

নাসিম নিজের ছাতা হাতে তিথিকে বাসে তুলে দিতে গেল। যাবে জানা কথা। যে অল্প কিছু ভাল মানুষের সংস্পর্শে তিথি এসেছে নাসিম তার মধ্য একজন। সে বাসে তিথিকে শুধু সে উঠিয়েই দিয়ে আসবে তাই না বাসের ড্রাইভারকে বলে আসবে একটু খেয়াল রাখবেন ভাইসব, একা যাচ্ছে।

বৃষ্টি ধরে গেছে। ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। রাস্তায় জায়গায় জায়গায় পানি উঠে গেছে। পানি ভেঙে যেতে হচ্ছে। নাসিম বলল, এক ফোঁটা বৃষ্টি হলে দুই হাত পানি হয়ে যায়। এই রহস্যটা কি বুঝলাম না। তিথি কিছু বলল না। নাসিম বলল, তোমার ভাই চাকরি-বাকরি কিছু পেয়েছে?

না।

মটর মেকানিকের কাজ শিখবে নাকি জিজ্ঞেস করো তো। লাগিয়ে দেব। ভালমত কাজ শিখতে পারলে কাঁচা পয়সা আছে, জিজ্ঞেস করো।

আচ্ছা জিজ্ঞেস করব।

টেলিফোন করতে চেয়েছিলে–কার কাছে টেলিফোন?

চেনা একজন।

পাওয়ারফুল কেউ হলে যোগাযোগ রাখবে কখন দরকার হয় কিছু বলা যায় না।

বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছানো মাত্র বাস পাওয়া গেল। ফাঁকা বাস। পেছনের দিকে তিন-চারজন মানুষ বসে আছে। নাসিম বাসের ড্রাইভারকে বিনীত ভঙ্গিতে বলল, ভাইজান একটু দেখেশুনে নামাবেন, মেয়েছেলে একা যাচ্ছে।

পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা এগিয়ে দিল। নাসিম সিগারেট খায় না, অন্যকে দেবার জন্যে সব সময় সঙ্গে রাখে।

তিথির হাতে সে একশ টাকার নোটি গুঁজে দিল। এটা হচ্ছে ধার। হাতে টাকা এলে শোধ দিতে হবে।

বাস না ছাড়া পর্যন্ত নাসিম ফুটপাতে দাঁড়িয়ে রইল। তিথি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। এই মানুষটা তার চমৎকার একজন বড় ভাই হতে পারত। কেন হল না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *