জুলিয়াস নিশো একটি ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখলেন। যেন তিনি বিশাল একটা মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। ফাঁকা মাঠ। চারদিক ধু-ধু করছে। প্রচণ্ড শীত। হিমেল বাতাস বইছে। তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না, খুব অবাক হচ্ছেন। তিনি কোথায় এসে পড়লেন? হঠাৎ দূরে ঝনঝন করে শব্দ হল। তিনি শব্দ লক্ষ করে এগুচ্ছেন। তাঁর একটু ভয়ভয় করছে। তিনি বেশ কবার বললেন, কে ওখানে? কেউ সাড়া দিল না, তবে একজন-কেউ শব্দ করে হেসে উঠল।
কে ওখানে?
সম্রাট নিশো, আপনি এই নগরীতে কী করছেন?
তুমি কে?
আমি কেউ না। আমি আপনার এক জন বন্ধু।
তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?
দেখতে পাচ্ছেন না, কারণ আপনার চোখ বাঁধা।
নিশো লক্ষ করলেন, তাই তো, তাঁর চোখ বাঁধা! তখন তাঁর মনে হল—এটা স্বপ্ন। এটা সত্যি নয়।
সম্রাট জুলিয়াস নিশো।
বল।
আপনি পালিয়ে যান। এক্ষুনি আপনাকে হত্যা করা হবে। ঘাতকরা আসছে। তাদের পায়ের শব্দ কি আপনি পাচ্ছেন না?
পাচ্ছি।
তাহলে পালাচ্ছেন না কেন?
জুলিয়াস নিশো পালাবার চেষ্টা করলেন। পারলেন না। তাঁর পা লোহার শিকলে বাঁধা। পালাবার কোন পথ নেই। জুলিয়াস নিশো স্বপ্নের মধ্যেই চেচিয়ে উঠলেন—আমার পায়ের শিকল কেটে দাও। দয়া করে আমার পায়ের শিকল কেটে দাও। তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। ঘড়ি দেখলেন রাত দুটো দশ। চারদিকে গভীর নিশুতি। ঝিঝির ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।
ঘামে তাঁর শরীর ভিজে গেছে। তৃষ্ণায় বুক শুকিয়ে কাঠ। স্বপ্নের ঘোর তাঁর এখনো কাটে নি। এরকম ভয়াবহ একটি স্বপ্ন হঠাৎ করে কেন দেখলেন? কী কারণ থাকতে পারে? তিনি ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললেন। মনে-মনে বললেন আমার মন বিক্ষিপ্ত এবং খুব সম্ভব আমি কোনো কারণে অসহায় বোধ করছি। সেই কারণেই আমার অবচেতন মন এরকম একটি ভয়াবহ স্বপ্ন আমাকে দেখিয়েছে।
তিনি বিছানা ছেড়ে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালেন। পানি খাওয়া দরকার। পানির তৃষ্ণা হচ্ছে। অথচ জানালার পাশ থেকে সরে আসতে ইচ্ছা করছে না। বাইরে কী চমৎকার তারারা আকাশ! তাঁর স্বপ্নের সঙ্গে এই আকাশের কোনো মিল নেই। জুলিয়াস নিশো আবার একটি নিঃশ্বাস ফেললেন, আর ঠিক তখন দরজায় নক হল, মৃদুনক। যেন কেউ খুব আলতো করে দরজায় হাত রেখেছে।
কে? মিস্টার জুলিয়াস নিশো? হ্যাঁ।
দরজা খুলুন। আপনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। রাত-দুপুরে?
হ্যাঁ। আপনার পরিচয় জানতে পারি? দরজা খুলুন।
তিনি দরজা খুললেন। যে-লোকটিকে তিনি দেখলেন, তার গায়ে সামরিক পোশক। কাঁধের ব্যাজে দুটি আড়াআড়ি বর্শা। জুলিয়াস নিশোলোকটির পদবী ঠিক বুঝতে পারলেন না। জায়ার সেনাবাহিনীর চিহ্ন তিনি এখন ঠিক বুঝতে পারেন না।
আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে আমি অত্যন্ত দুঃখিত। কিন্তু কোনো উপায় নেই। আপনাকে আমার সঙ্গে আসতে হবে।
কোথায়?
আমি জানি না, কোথায়।
জুলিয়াস নিশো ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললেন। রাত আড়াইটায় সেনাবাহিনীর এক জন অফিসার তাঁর মতো এক জন অসুস্থ বৃদ্ধের ঘুম ভাঙিয়ে বলবেআপনাকে আমার সঙ্গে আসতে হবে? এবং তিনি জানতে পারবেন না, কোথায়? জুলিয়াস নিশা হালকা গলায় বললেন, কোথায় যেতে হবে?
আমি জানি না মিঃ নিশো।
জানলেও তুমি বলতে না। তুমি করে বলছি, কিছু মনে করছ না তো?
আমি কিছুই মনে করি নি।
সঙ্গে ব্যবহারিক জিনিসপত্র নেব?
কিছুই নেবার প্রয়োজন নেই, শুধু আপনার ওষুধগুলি নিয়ে নিন।
জুলিয়াস নিশো মৃদু স্বরে বললেন, যে-মেয়েটি আমার দেখাশোনা করে, তার কাছ থেকে বিদায় নিতে চাই। আমার মনে হয় আমি আর ফিরে আসব না। মনে হচ্ছে, এটা ওয়ান ওয়ে জার্নি।
মিঃ নিশো, কারো কাছ থেকে বিদায় নেবার মতো সময় আমাদের নেই।
মেয়েটিকে আমি নিজ কন্যার মতো দেখেছি।
লোকটির মুখের একটি পেশিও বদলাল না। জুলিয়াস নিশো মনে-মনে তার প্রশংসা করলেন। লোকটি ভালো সৈনিক।
আমি যদি ওর জন্যে কোন উপহার রেখে যাই, সেটা কি ওর হাতে পৌঁছবে?
নিশ্চয় পৌঁছবে।
তুমি কথা দিচ্ছ?
হ্যাঁ, কথা দিচ্ছি। যা করবার তাড়াতাড়ি করুন।
তিনি একটি খামে কয়েকটি নোট ভরলেনখামের ওপর গোটাগোটা করে লিখলেন—ক্যারি, যা ছিল, তোমাকে দিয়ে যাচ্ছি। এটাকায় তুমি তোমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে সুইজারল্যান্ড থেকে ঘুরে এসো। আমার বন্দিজীবনের শেষ কটি দিন তোমার ভালবাসায় সুস্থ হয়েছিল। পরম করুণাময় ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।
নোটটি তাঁর পছন্দ হল না। তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। কাজেই ঈশ্বর শব্দটি ব্যবহার করা ঠিক হয় নি।
অফিসারটি বলল, দেরি হচ্ছে। আমাদের হাতে সময় বেশি নেই।
জুলিয়াস নিশো বললেন, তোমার নাম জানতে পারি?
আমার নাম জানার প্রয়োজন আছে কি? আছে। একটি পশু অন্য একটি পশুকে নাম ধরে ডাকে না। কিন্তু এক জন মানুষ অন্য একটি মানুষকে নাম ধরে ডাকতে চায়।
আমার নাম মার্কটল।
মাৰ্কটল, এই খামটি তুমি মেয়েটিকে দেবে। এখানে কিছু ইউএস ডলার আছে। এবং তুমি আমার হয়ে মেয়েটির সঙ্গে হ্যান্ডশেক করবে। চল, এখন যাওয়া যাক।
আপনি গরম কিছু পরে নিন, বাইরে প্রচণ্ড শীত।
ঘর থেকে বেরিয়ে তাঁদের প্রায় সত্তর গজের মত হাঁটতে হল। কনকনে শীতের বাতাস বইছে। চিল ফেক্টার অনেকখানি নেমে গেছে বোধহয়। কান জমে যাচ্ছে প্রায়। তাঁর কষ্ট হতে লাগল। বয়স হয়েছে। এই বয়সে কষ্ট সহ্য হয় না। বাইরে কোন আলো জ্বলছিল না। চারদিক ঘুঘুটে অন্ধকার। তবু তিনি বুঝতে পারলেন, প্রচুর মিলিটারির আমদানি হয়েছে। মিলিটারি আগেও ছিল, তবে এখন অনেক বেশি। তারা চলাফেরা করছে নিঃশব্দে, তবু টের পাওয়া যাচ্ছে।
মাঠের মতো ফাঁকা জায়গায় একটি আর্মি ট্রান্সপোর্ট হেলিকপ্টার দাঁড়িয়ে। হেলিকপ্টারের লেজের দিকে একটা লাল বাতি জ্বলছে-নিভছে। একচক্ষু দৈত্যের মতো লাগছে হেলিকপ্টারটিকে। নিশো হেলিকপ্টারটির কাছে এসে দাঁড়াতেই তার প্রপেলার ঘুরতে শুরু করল। নিশো অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, এই মাঠটিকেই তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন। অবশ্যি স্বপ্নের মাঠ আরো বিশাল ছিল। এবং এরকম অন্ধকার ছিল না। চাপা এক ধরনের আলো ছিল, যা শুধু স্বপ্নদৃশ্যেই দেখা যায়। মার্কটল হাত ধরে জুলিয়াস নিশোকে উঠতে সাহায্য করল। নিশো আন্তরিক ভঙ্গিতেই বললেন, ধন্যবাদ, তুমিও কি যাচ্ছ আমার সঙ্গে?
না, আমি যাচ্ছি না। আপনার উপহার আমি যথাসময়ে মেয়েটিকে পৌঁছে দেব। শুভ যাত্রা।
যাত্ৰা কি সত্যি শুভ?
মাৰ্কটল কোনো উত্তর দিল না কিন্তু জুলিয়াস নিশোকে অবাক করে দিয়ে সামরিক কায়দায় একটি স্যালুট দিল। এক জন নির্বাসিত মানুষকে বিদেশি সেনাবাহিনীর এক জন অফিসার কি স্যালুট করে? করে না বোধহয়। নিশো মাকটলের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লেন।
হেলিকপ্টারের ভেতর নরম আলো জ্বলছে। অন্ধকার থেকে আসার জন্যেই হয়তো এই আলোতেও সব পরিষ্কার চোখে পড়ছে। বেঁটেমতো এক লোক নিশোকে বসবার জায়গা দেখিয়ে দিল। অত্যন্ত ভদ্র ভঙ্গিতে বলল, আপনার কি ঠাণ্ডা লাগছে?
হ্যাঁ, লাগছে। এই কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে নিন। এক্ষুনি গরম কফি দেওয়া হবে। তোমাকে ধন্যবাদ।
আপনি তো মাঝে-মাঝে ধূমপান করেন। এই চুরুটটি টেস্ট করে দেখবেন? হাভানা চুরুট।
তোমাকে আবার ধন্যবাদ।
হেলিকপ্টারের ব্লেড ঘুরতে শুরু করেছে। আকাশে উড়বে। দরজা বন্ধ করা হয়েছে। ককপিটের পাইলট বেতারে নিচু গলায় কী-সব বলছে। নিশোর গা-ঘেঁষে বেঁটে লোকটি দাঁড়িয়ে। নিশো মৃদুস্বরে বললেন, তোমরা কি আমাকে জেনারেল ডোফার হাতে তুলে দিচ্ছ?
হ্যাঁ।
কেন, জানতে পারি?
না, পারেন না। কারণ, আমি জানি না। কারণটি আপনার সরকার এবং জায়ার সরকারের জানার কথা। আমার জানার কথা নয়। আমার দায়িত্ব হচ্ছে আপনাকে ফোর্টনকে পৌঁছে দেওয়া।
জেনারেল ডোফা এখন কোথায় আছেন?
আলজেরিয়াতেই আছেন। দ্বিপাক্ষিক একটি চুক্তির ব্যাপারে তিনি এসেছেন। আজকের খবরের কাগজেই তো আছে। আপনাকে কি খবরের কাগজ দেওয়া হয় না?
না।
আমি আপনাকে খবরের কাগজ দিতে পারি। আমাদের এখানে দি আলজিরিয়া মর্নিং আছে। দেব?
না, দরকার নেই। কিছু জানতে ইচ্ছে করছে না।
জুলিয়াস নিশোকে কফি দেওয়ার পরপরই হেলিকপ্টার আকাশে উড়ল। নিশো কফিতে চুমুক দিয়ে চারদিক দেখতে লাগলেন। ভেতরটা বেশ বড়। তিনি এবং বেটে। লোকটা ছাড়া আরো তিন জন সৈন্য আছে। তারা আটোমেটিক সাব-মেশিনগান হাতে পেছনের দিকে বসে আছে। চোখে চোখ পড়তেই তারা চোখ নামিয়ে নিল।
নিশো ওদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। ষাট বছর বয়সের এক জন অথর্ব বৃদ্ধের জন্যে এত সতর্কতার প্রয়োজন কী? হালকা গলায় বললেন, তোমরা তোমাদের অস্ত্রশস্ত্র নামিয়ে রেখে কফি খাও। আমি পাব না। হেলিকপ্টার থেকে পালাবার কৌশল আমার জানা নেই।
সৈন্য তিন জন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। বেঁটে অফিসারটি বলল, মিঃ জুলিয়াস নিশো, আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে শ্রদ্ধা করি। আমি আপনার এক জন বিশেষ ভক্ত। কিন্তু……..
তিনি হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিয়ে সোহেলি ভাষায় ছোট্ট একটা কবিতা আবৃত্তি করলেন। সঙ্গে-সঙ্গেই তা ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন। কবিতাটির ভাবার্থ হচ্ছে —
হৃদয় যখন হৃদয়কে বুঝতে না পারে তখনি ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়।
অফিসারটি অস্বস্তিতে কপালের ঘাম মুছল। নিশো বললেন, তোমার নাম এখন জানা হয় নি। তুমি আমার নাম জান। আমার অধিকার আছে তোমার নাম জানার।
আপনি একজন বিখ্যাত ব্যক্তি। আপনার নাম সবাই জানে। আমি একজন অখ্যাত লেফটেন্যান্ট কর্নেল।
আমি কি এই অখ্যাত লেফটেন্যান্ট কর্নেলের নাম জানতে পারি?
স্যার, আমার নাম পেয়েরেন। হোসেন পেয়েরেন।
পেয়েরেন।
বলুন স্যার।
তুমি কি বলতে পার আমাকে হত্যা করা হবে কি না?
মৃত্যুর কথা একমাত্র ঈশ্বরই বলতে পারেন।
জুলিয়াস নিশো চাপাস্বরে হাসলেন। হাসতে-হাসতে বললেন, ঈশ্বর নিয়ে আমি চিন্তা করি না। আমার চিন্তা মানুষদের নিয়ে।
পেয়েরেন চুপ করে রইল। হেলিকপ্টারের পাইলট একটি সাংকেতিক বার্তা পাঠাল—কালো পাখি তার নীড়ে। এই সংকেতের অর্থ হচ্ছে—সব ঠিকমত এগুচ্ছে।
নিশো চোখ বন্ধ করে ফেললেন। ক্লান্ত গলায় বললেন, বাতি নিভিয়ে দাও। চোখে আলো লাগছে। আমি ঘুমুবার চেষ্টা করব। কে জানে এটাই হয়তো আমার শেষ ঘুম।
বাতি নিভিয়ে দেওয়া হল। ইঞ্জিনের একঘেয়ে হুম্ হুম্ শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। চারদিকে বিপুল অন্ধকার। হেলিকপ্টার উড়ে চলেছে। আফ্রিকার চিরসবুজ অরণ্যের ওপর দিয়ে।
জুলিয়াস নিশে ঘুমুতে চেষ্টা করছেন। কালোসোহেলি আফ্রিকানদের নেতাপ্রবাদপুরুষ জুলিয়াস নিশো। মুকুটহীন সম্রাট।