০১. জাতির উত্থান

প্ৰথম পরিচ্ছেদ
জাতির উত্থান

কোন জাতিকে যদি বলা হয়—তোমরা বড় হও, তোমরা জাগ—তাতে ভাল কাজ হয় বলে মনে হয় না। এক একটা মানুষ নিয়েই এক একটা জাতি। পল্লীর অজ্ঞাত-অবজ্ঞাত এক একটা মানুষের কথা ভাবতে হবে।

মানুষকে শক্তিশালী, বড় ও উন্নত করে তোলার উপায় কি? তাকে যদি শুধু বলি-তুমি জাগো-আর কিছু না, তাতে সে জগবে না। এই উপদেশ বাণীর সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত আছে। এইটে ভাল করে বোঝা চাই।

আবার বলি—কোন জাতিকে যদি বাহির হতে বলি—বড় হও, তাতে কাজ হবে না। মানুষকে এক একটা করেই ভাবতে হবে।

একটা লোক জাতীয় সহানুভূতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে হাজার হাজার টাকা তুরস্কে পাঠিয়েছিলেন। তিনি যখন অগণ্য আর্ত মানুষের বেদনা কাহিনী গাইতে গাইতে ভিক্ষার বুলি স্কন্ধে নিয়ে পথে বের হতেন তখন প্রত্যেক মানুষের প্রাণ সহানুভূতি বেদনায় ও করুণায় ভরে উঠত। এই ব্যক্তি কিছুদিন পর তার এক নিরন্ন প্রতিবেশীর সর্বস্ব হরণ করতে দ্বিধাবোধ করেন নাই। মানুষের এই ভাবের জাগরণ ও বেদনা-বোধের বেশী মূল্য আছে বলে মনে হয় না। কোন জাতির যখন পতন আরম্ভ হয়; তখন দেশসেবক যে কেউ থাকে না তা নয়। স্বাধীনতার মমতায় কেউ প্ৰাণ দেয় না, তা বলি না; যারা মন দেয়। তাদের মন ভিতরে ভিতরে অন্ধ হতে থাকে। জাতিকে খাঁটি রকমে বড় ও ত্যাগী করতে হলে সমাজের প্রত্যেক মানুষকে বড় ও ত্যাগী করতে হবে কি উপায়ে? দেশের মানুষের ভিতর আত্মবোধ দেবার উপায় কি? প্রত্যেক মানুষ শক্তিশালী-উন্নত হৃদয়-প্ৰেম-ভাবাপন্ন-সত্য ও ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধাবান, অন্যায় ও মিথ্যার প্রতি বিতৃষ্ণ হবে কেমন করে? জাতির প্রত্যেক বা অধিকাংশ মানুষ এইভাবে উন্নত না হলে জাতি বড় হবে না।

প্রত্যেক মানুষের ভিতর জ্ঞানের জন্য একটা স্বাভাবিক ব্যাকুলতা জন্মিয়ে দেওয়া চাই। সংসার এমনভাবে চলেছে, যাতে সকলের পক্ষে বিদ্যালয় বা উচ্চ জ্ঞানের যোগ দেওয়া সম্ভব হয় না। অথবা সারা ছাত্রজীবন ধরে বিদ্যালয়ে জ্ঞানলাভ করা হয়ে ওঠে না।

কেউ বাল্য পিতৃহীন হয়, কারো পিতা জ্ঞানলোচনাকে বিশেষ আবশ্যক কাজ মনে করেন না করে ছেলেকে স্কুলে পাঠান না, কেউ পাঠাভ্যাস কালে উদ্ধত ও দুর্মত হয়ে পড়াশুনা ত্যাগ করে, কেউ বিদেশী ভাষার নিষ্পেষণে বোকা ভেবে পড়াশুনা বাদ দেয়।

পাঁচ হাজার ছাত্রের মধ্যে পঞ্চাশজন ছাড়া বাকী সব ছেলেই সময়ে জ্ঞানান্ধ, হীন ও মৌন মূক হয়ে যায়। ইহা জাতির পক্ষে কত ক্ষতির কথা।

মনুষ্যত্ব লাভের পথ জ্ঞানের সেবা। জীবনের সকল অবস্থায়-সকল সময়ে-আহার স্নানের মত মানুষের পক্ষে জ্ঞানের সেবা করা প্রয়োজন।

 

উন্নত, ত্যাগী, শক্তিশালী, প্রেমিক, সত্য ও ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধাবান মানুষ বিদ্যাহীন বা অল্পশিক্ষিত মানুষের মধ্যে পাওয়া যায় না; মানুষের বা জাতিকে বড় হতে হলে সব সময়ই তাকে জ্ঞানের সেবা করতে হবে।

দেশের সকল মানুষকে জ্ঞানী করে তোলার উপায় কি? জাতির জীবনের মেরুদণ্ড মনুষ্যত্ব ও জ্ঞান। এই দুটি চাপা রেখে জাতিকে জাগতে বললে সে জগবে না।

বুদ্ধির দোষে হোক বা অবস্থার চক্ৰে হোক, কোন দেশে যদি বহু মানুষ অশিক্ষা, অল্পশিক্ষিত বশতঃ অমার্জিতচিত্ত এবং জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধাবোধহীন হয়ে পড়ে, তাহলে সে জাতির জীবন টেকসই হবে না। এই সব লক্ষ মৌন আত্মায় স্পন্দন আনবার এক উপায় আছে, কোটিবদ্ধ মুখে ভাষা তুলে দেবার এক পন্থা আছে। সকল দেশে সকল সময়ে সেই পস্থা কার্যকরী হয়ে থাকে। সেই পন্থা না থাকলে কোন জাতি বাচিত না-উন্নত হওয়া স্বপ্ন অপেক্ষা অসম্ভব হতো।

জাতিকে শক্তিশালী করতে প্রত্যেক সময়ে মানুষ এই পন্থা অবলম্বন করেছে। গ্ৰীক জাতি, রোমান জাতি, বর্তমান ইউরোপীয় জাতি-এই পথকে অবলম্বন করে শ্ৰেষ্ঠস্থান অধিকার করেছেন।

যারা এই পথকে অবহেলা করে নিজদিগকে প্রতিষ্ঠিত করতে ইচ্ছা করে, তারা একটা অসম্ভব কাজ আরম্ভ করে।

এই পথ আর কিছু নয়—দেশের বা জাতির সাহিত্যের পুষ্টিসাধন। যে সমাজে সাহিত্যের কোন আদর নাই, তাহা সাধারণত বর্বর সমাজ। কথা কাগজে ধরে অসংখ্য মানুষের দৃষ্টির সম্মুখে ধরার নাম সাহিত্য-সেবা। এই যে কথা, এ কথা সাধারণ কথা নয়-এই কথার ভিতর দিয়ে জীবনের সন্ধান বলে দেওয়া হয়, পুণ্যের বাণী ও মোক্ষের কথা প্রচার করা হয়, বর্তমান ও অন্তিম সুখের দ্বার মুক্ত করে দেওয়া হয়।

এই কথার ধারা গান ও গল্প, কখনও কবিতা ও দর্শন, কখনও প্ৰবন্ধ ও বিজ্ঞানের রূপ নিয়ে মানুষের সম্মুখে রঙীন হয়ে, মধুরভাবে দেখা দেয়।

দুৰ্গত কণ্টকাকীর্ণ আঁধার পথে কেউ যদি প্ৰদীপ না নিয়ে চলতে থাকে কিংবা আলোর যে আবশ্যকতা আছে, একথা উপহাসের সঙ্গে অস্বীকার করে, তাহলে তাকে কি বলা যায়? কোন জাতি সাহিত্যকে অস্বীকার বা অবহেলার চোখে দেখে উন্নত হতে চেষ্টা করলে সে জাতি আদৌ উন্নত হবে না।

শিক্ষিতকে আরও শিক্ষিত, ভাবুককে আরও গভীর করবার জন্য, দেশের অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত শিক্ষাকেন্দ্রের বাহিরের লোকগুলিকে শক্তিশালী, জ্ঞানী ও মনুষ্যত্ববোধ সম্পন্ন করবার জন্য প্রত্যেক দেশে বহু মনীষী জন্মগ্রহণ করেন।

জাতির পথপ্রদর্শক তাঁরাই। তাঁরাই জাতি গঠন করেন। গ্ৰীস, আরব, হিন্দু ও ইউরোপীয় শক্তি সভ্যতার জন্মদাতা তাঁরাই।

প্ৰত্যেক দেশের সাহিত্যের ভিতর দিয়ে এইসব শিক্ষিত শ্রেণী জাতিকে উর্ধের্ব টেনে তোলেন। ক্ষুধাতুর আর্ত তাদের স্পর্শে রাজা হয়ে ওঠে, পল্লীর কৃষক, দূর অজ্ঞাত-কুটিরের ভিখারী, জমিদারের ভৃত্য, দরিদ্র গো-যান-চালক, অন্ধকারের পাপী, বাজারের দরজী, নগরের ঘড়ি নির্মাতা, নবাবের ভৃত্য, গ্ৰাম্য উরুটে যুবক শ্ৰেণী তাঁদেরই মন্ত্রে মহাপুরুষ হয়। এই মন্ত্র গ্রহণ করবার উপযোগী তাদের কিছু শক্তি-অর্থাৎ কিছু বর্ণ জ্ঞান থাকা চাই। এরাই জাতির মেরুদণ্ড-ছােট বলে এদিগকে অস্বীকার করলে জাতি প্ৰাণ-শক্তিহীন হয়ে পড়ে।

জাতিকে শক্তিশালী, শ্রেষ্ঠ, ধনসম্পদশালী, উন্নত ও সাধারণের মধ্যে সমভাবে বিতরণ করতে হবে। দেশে সরল ও কঠিন ভাষায় নানা প্রকারের পুস্তক প্রচার করলে এই কার্য সিদ্ধ হয়। শক্তিশালী দৃষ্টিসম্পন্ন মহাপুরুষদের লেখনীর প্রভাবে একটা জাতির মানসিক ও পার্থিব পরিবর্তন অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ে সংশোধিত হয়ে থাকে। দেশের প্রত্যেক মানুষ তার ভুল ও কুসংস্কার, অন্ধতা ও জড়তা, হীনতা ও সঙ্কীর্ণতাকে পরিহার করে একটা বিনয়হিমোজুল উচ্চ জীবনের ধারণা করতে শেখে। মনুষ্যত্ব ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করাই সে ধর্ম মনে করে, আত্মমর্যাদা জ্ঞানসম্পন্ন হয় এবং গভীর পুষ্টি লাভ করে। তারপর বিরাট শক্তি জেগে উঠে।

ইংরাজের বিরাট শক্তির অন্তরালে বহু লেখকের লেখনী শক্তি আছে। বস্তুত লেখক বা জগতের পণ্ডিতবৃন্দ নিভৃতে লোকচক্ষুর অন্তরালে বসে বিশ্বের সকল অনুষ্ঠান ও কামকেন্দ্রে গতি প্ৰদান করেন। তাদের অজানা হস্তের কার্যফলে অসংখ্য মানুষ মরুভুমে সাগর রচনা করেন, সাগরবক্ষে পাহাড় তোলেনজগৎ সভ্যতার নির্মাতা তাঁরাই।

কোন দেশের মানুষ যদি এই লেখকশ্রেণীর বা দেশীয় সাহিত্যের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ না করে তবে তারা বড় হীন। জাতির ভিতরকার সকল পণ্ডিতকে হত্যা কর-সমস্ত জাতিটা শক্তিহীন হয়ে পড়বে।

কোন সভ্য জাতিকে অসভ্য করবার ইচ্ছা যদি তোমার থাকে তাহলে তাদের বইগুলি ধ্বংস কর, সকল পণ্ডিতকে হত্যা কর, তোমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে।

লেখক, সাহিত্যিক ও পণ্ডিতরাই জাতির আত্মা। এই আত্মাকে যারা অবহেলা করে, তারা বাঁচে না।

দেশকে বা জাতিকে উন্নত করতে ইচ্ছা করলে, সাহিত্যের সাহায্যেই তা করতে হবে। মানব মঙ্গলের জন্য যত অনুষ্ঠান আছে, তার মধ্যে এইটিই প্রধান ও সম্পূর্ণ। জাতির ভিতর সাহিত্যের ধারা সৃষ্টি কর, আর কিছুর আবশ্যক নাই। কোন দেশকে সভ্য ও মানুষ করবার বাসনা তোমার আছে? তাহলে বিধি-ব্যবস্থার সঙ্গে সেই দেশের সাহিত্যকে উন্নত করতে তুমি চেষ্টা কর। মাতৃভাষার সাহায্যে সাহিত্যকে উন্নত করতে চেষ্টা করতে হবে। বিদেশী সাহিত্যে মানব সাধারণের কোন কল্যাণ হয় না। দেশীয় সাহিত্যকে উন্নত করতে হবে, আবার বিশ্বের উন্নত সাহিত্যের সার সংগ্ৰহ করতে হবে। নিজেদের যা কিছু আছে তাতেই সস্তুষ্ট থাকলে জাতির উন্নতির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।

পারে। মানুষের সকল বিপদের মীমাংসা সাহিত্যের ভিতর দিয়েই হয়ে থাকে।

জাতি যখন দৃষ্টিসম্পন্ন ও জ্ঞানী হয়, তখন জগবার জন্য সে কারো আহবানের অপেক্ষা করে না, কারণ, জাগরণই তার স্বভাব।

1 Comment
Collapse Comments
শহীদুল্লাহ April 25, 2022 at 12:24 pm

খুবই সুন্দর, অনুপ্রেরণা মূলক লেখা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *