০১. জন্মভিটেতে শরিকি সংঘাতের বিষবৃক্ষ

অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দ – শংকর

সার্ধশতবর্ষ উৎসবের প্রস্তুতিতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিস্ময়কর বিবেকানন্দ-জীবনের নানা অজানা তথ্য সংগ্রহের বিপুল প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। তাঁর পারিবারিক-জীবন, পরিব্রাজক-জীবন, সন্ন্যাস-জীবন ও সঙ্ঘ-জীবন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কৌতূহল আজও সীমাহীন। সেই সঙ্গে নবযুগের নবাগতদের মনেও নানা প্রশ্ন।

পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্ত কেন অন্য নামে ভিটেবাড়ির শরিকদের নিয়ে উপন্যাস লিখলেন? গর্ভধারিণী জননীকে সাহায্য করার জন্য যে-টাকা মঠের তহবিল থেকে স্বামীজি নিয়েছিলেন তার ওপর সত্যিই কি সুদ দিতে হত তাকে?

দেশে-বিদেশে ভক্তের বেশে এসে বেশ কয়েকজন পুরুষ ও নারী কীভাবে বিবেকানন্দকে বিড়ম্বিত করেছিলেন? সমকালের বাঙালিরা কেন তাকে অর্থসাহায্য করেননি? আবার কারা গুরুনির্দেশে অসাধ্যসাধন করার জন্য তিলে তিলে নিজেদের বিসর্জন দিয়েছিলেন? কলকাতার বিখ্যাত ডাক্তার কি সত্যিই সহায়-সম্বলহীন রোগজর্জরিত সন্ন্যাসীর কাছ থেকে চেম্বারে চল্লিশ টাকা নিলেন?

হিসেবের কড়ি সম্পর্কে স্বামীজির সুচিন্তিত মতামতই কি শেষপর্যন্ত বিবেকানন্দনমিকসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করল? তবু কেউ কেউ তাকে কেন জোচ্চোর অপবাদ দিল? ব্র্যান্ড রামকৃষ্ণ কি ব্র্যান্ড বিবেকানন্দ থেকে সত্যিই আলাদা? দীর্ঘদিন ধরে এমন সব সংখ্যাহীন প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন সন্ধানী লেখক শংকর।

স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে শংকর-এর প্রথম পরিচয় নিতান্ত বাল্যবয়সে ১৯৪২ সালে, যার চল্লিশ বছর আগে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের মহাসমাধি বেলুড়ে। তারই নামাঙ্কিত বিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে অতি অল্পবয়সে শংকর-এর বিবেকানন্দ-অনুসন্ধানের শুরু। তারপরেই তো একের পর এক বিস্ময়।

‘অচেনা অজানা বিবেকানন্দের’ পরে ‘অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দ’ বাংলা জীবনীসাহিত্যে আর এক অবিশ্বাস্য সংযোজন।

.

চতুর্দশ সংস্করণ – নভেম্বর ২০১৮

.

উৎসর্গ – শ্ৰীমতী বন্দনা মুখোপাধ্যায়
বন্দনা,
যাওয়া তো নয় যাওয়া।
তাই তোমাকেই আবার।

শংকর
২৯ নভেম্বর ২০১০

.

লেখকের নিবেদন

‘অচেনা অজানা বিবেকানন্দ’ প্রকাশিত হয়েছিল নভেম্বর ২০০৩ সালে, কিন্তু তার পিছনে ছিল সাত বছরের প্রস্তুতি-নানা সূত্র থেকে খুঁটে-খুঁটে ছোট ছোট তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই করতে সময় লেগে যায়। এবারেও অনেক সময় লেগে গেল। যে-বিবেকানন্দ বিস্ময়কর, যার বহু কীর্তিই অবিশ্বাস্য এবং সমকাল যাঁকে জয়মাল্য দেবার আগে কারণে অকারণে বার বার নানা অগ্নিপরীক্ষায় আহ্বান করেছিল তাকে খুঁজে বার করতে, জানতে এবং বুঝতে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন হল।

এই কঠিন কাজে আমাকে অবশ্য কখনও নিঃসঙ্গ বোধ করতে হয়নি, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সন্ন্যাসীরা আমাকে বারবার উৎসাহ জুগিয়েছেন, কেউ কেউ সস্নেহে লুপ্ত পথের সন্ধানও দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ পথভ্রষ্ট হবার আগেই বিভ্রান্ত লেখককে যথাসম্ভব সচেতন করে দিয়েছেন।

আরও একটি কথা, স্বদেশে এবং বিদেশে বহুজনের হাতে বিড়ম্বিত বিবেকানন্দের কাছাকাছি এবং পাশাপাশি এমন কিছু অবিশ্বাস্য ভক্তকে এবার খুঁজে পাওয়া গেল যাঁদের নিঃশব্দ আত্মনিবেদনের কথা বিশ্বজনের কাছে প্রায় অজ্ঞাত। এঁদের কথা বলতে গিয়ে মূল ঘটনাপ্রবাহ যদি কোথাও-কোথাও একটু বিলম্বিত হয়ে থাকে তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করি, তবে অনুসন্ধানকালে মনে হয়েছিল যে এইসব আশ্চর্য মানুষকে এমনভাবে অনুপ্রাণিত করার অলৌকিক শক্তি না-থাকলে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ কিছুতেই অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দে রূপান্তরিত হতে পারতেন না।

শংকর
৭ ডিসেম্বর ২০১০

.

প্রচ্ছদ চিত্র

১৮৮৬-১৯০১ এই পনেরো বছরে দেশে-বিদেশে স্বামীজির যত ছবি ভোলা হয়েছিল তার মধ্যে মাত্র ১০৬টি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এই ছবিগুলি সম্বন্ধে বিস্তারিত তদন্ত করেছেন বেদান্ত সোসাইটি অফ নর্দার্ন ক্যালিফোর্নিয়া।

প্রচ্ছদের ছবিটি কবে কোথায় তোলা হয় সে নিয়ে মতভেদ আছে। প্রথমে ধারণা ছিল ছবির তারিখ ১৮৯৭, কিন্তু পরবর্তীকালে অনুসন্ধানীদের সিদ্ধান্ত ছবিটি কলকাতায় তোলা হয় স্বামীজির দ্বিতীয়বার বিদেশযাত্রার দিনে, অর্থাৎ ২০ জুন ১৮৯৯। ওইদিন রামকৃষ্ণজায়া সারদামণি তার সন্ন্যাসীসন্তানদের মধ্যাহ্নভোজনে আপ্যায়ন করেন বশীশ্বর সেনের বাগবাজার ৮ বোসপাড়া লেনের ভাড়াটে বাড়িতে। পরবর্তীকালে বশীশ্বর জগদ্বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক হয়েছিলেন।

স্মরণীয় এক গ্রুপ ফটো থেকে স্বামীজিকে সাবধানে বার করে আনা হয়েছে। মুখের কোথাও অসুস্থতার চিহ্ন নেই। মূল গ্রুপ ফটোতে যে ছ’জন ছিলেন তাদের নাম : স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ, স্বামী শিবানন্দ, স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী তুরীয়ানন্দ, স্বামী ব্রহ্মানন্দ এবং বিবেকানন্দশিষ্য স্বামী সদানন্দ। শ্রীমা এই সময়ে বাগবাজার বোসপাড়া লেনেই থাকতেন।

সেবারের বিদেশযাত্রায় জাহাজে স্বামীজির সঙ্গে ছিলেন স্বামী তুরীয়ানন্দ ও সিস্টার নিবেদিতা। সেবারেই জাহাজে স্বামীজি তাঁর অনন্য ভ্রমণকাহিনি ‘পরিব্রাজক’ রচনা করেন যা বাংলা সাহিত্যের অক্ষয় সম্পদ বলে স্বীকৃতি পেয়েছে।

এই ছবির ফটোগ্রাফার কে অবশেষে তাও নির্ধারিত হয়েছে-ইনি। স্বামীজির শিষ্য, একদা বেলগাঁওয়ের ফরেস্ট অফিসার শ্রীহরিপদ মিত্র। এঁর স্ত্রী ইন্দুমতী মিত্র স্বামীজির প্রথম দীক্ষিতা মন্ত্রশিষ্যা।

স্বামী ত্রিগুণাতীতার বিদেশিনী শিষ্যা শ্রীমতী কারা ফ্রেঞ্চ তাঁর সংগ্রহের ছবিটির পিছনে লিখে রেখেছেন : “ফটো টেন বাই এইচ মিত্র, বিবেক কুটীর, ভাইতা পোস্ট (বার্ডওয়ান), বেঙ্গল।”

স্মরণীয় গ্রুপ ফটোটি বেলুড়মঠে স্বামীজির ঘরে পশ্চিমমুখো দেওয়ালে টাঙানো আছে।

.

কৃতজ্ঞতা স্বীকার

অদ্বৈত আশ্রম

স্বামী রমানন্দ

স্বামী প্রভানন্দ

স্বামী বামনানন্দ

স্বামী চেতনানন্দ

স্বামী বোধসারানন্দ

শ্বামী বিশোকানন্দ

স্বামী বিভাত্মানন্দ

স্বামী আত্মজ্ঞেয়ানন্দ

প্রয়াত সুনীলবিহারী ঘোষ

শ্রীদিলীপকুমার দে

শ্রীজয়ন্ত ঘোষাল

শ্রীঅভীক দত্ত

শ্রীপ্রণব গোস্বামী

শ্ৰীমতী গোপা বসুমল্লিক

শ্রীপবন লোহিয়া

শ্ৰীমতী পাপিয়া চট্টোপাধ্যায়

শ্ৰীনির্মল সাহা

শ্রীপ্রদীপকুমার সাহা

শ্রীসুধাংশুশেখর দে

শ্রীশুভঙ্কর দে

শ্রীশিবশঙ্কর ঘোষ

শীরবিশঙ্কর বল

শ্রীপ্রশান্ত নন্দী

শ্রীবিশ্বরূপ মুখোপাধ্যায়

শ্ৰীমতী রিনি সেন

ডাঃ সুব্রত সেন

ডাঃ সত্যজিৎ মুখার্জি

শ্রীবঙ্কিম কোনার

শ্রীসোমেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়

এবং অবশ্যই শ্রীঅরুণকুমার দে

.

তথ্যসূত্র (১)

সুলোচনা–বিশ্বনাথ দত্ত

বাণী ও রচনা ১-১০ খণ্ড–স্বামী বিবেকানন্দ

রামকৃষ্ণদেবের জীবনবৃত্তান্ত–রামচন্দ্র দত্ত

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত–শ্ৰীম-কথিত

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ (৫ ভাগ)–স্বামী সারদানন্দ

স্বামী বিবেকানন্দ ১-২ খণ্ড–প্রমথনাথ বসু

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পুঁথি–অক্ষয়কুমার সেন

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলামৃত–বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল

স্বামী-শিষ্য-সংবাদ (২ কাণ্ড)–শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী

আমার জীবনকথা–স্বামী অভেদানন্দ

স্মৃতিকথা–স্বামী অখণ্ডন

স্বামী অখনন্দকে যেমন দেখিয়াছি–সংকলক স্বামী চেতনানন্দ

যুগনায়ক স্বামী বিবেকানন্দ ১-৩ খণ্ড–স্বামী গম্ভীরানন্দ

লন্ডনে স্বামী বিবেকানন্দ ১-৩ খণ্ড–মহেন্দ্রনাথ দত্ত

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের অনুধ্যান–মহেন্দ্রনাথ দত্ত

শ্রীমৎ বিবেকানন্দ স্বামীজির জীবনের ঘটনাবলী ১-৩ খণ্ড–মহেন্দ্রনাথ দত্ত

কাশীধামে স্বামী বিবেকানন্দ–মহেন্দ্রনাথ দত্ত

স্বামী নিশ্চয়ানন্দের অনুধ্যান–মহেন্দ্রনাথ দত্ত

স্বামী শুদ্ধানন্দ : জীবনী ও রচনা স্বামীজির পদপ্রান্তে–স্বামী অজজানন্দ

চিন্তানায়ক বিবেকানন্দ–স্বামী লোকেশ্বরানন্দ সম্পাদিত

স্মৃতির আলোয় স্বামী বিবেকানন্দ–স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ সম্পাদিত

বিবেকানন্দের জীবন–রোমাঁ রোলাঁ

শ্ৰীম-দর্শন ১-১৬ খণ্ড–স্বামী নিত্যাত্মানন্দ

সেবা–স্বামী নরোত্তমান

স্বামী বিবেকানন্দ–ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত

রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ জীবনালোকে–স্বামী নির্লেপানন্দ

শ্রীরামকৃষ্ণের কথা–ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্য

বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ ১-৭ খণ্ড–শঙ্করীপ্রসাদ বসু

স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের এক বিস্মৃত অধ্যায়–ড. বেণীশঙ্কর শর্মা

বিবেকানন্দ চরিত–সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার

আদালতে বিপন্ন বিবেকানন্দ–চিত্রগুপ্ত

রামকৃষ্ণ মঠের আদিকথা–স্বামী প্রভানন্দ

আনন্দরূপ শ্রীরামকৃষ্ণ–স্বামী প্রভানন্দ

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ অন্ত্যলীলা–স্বামী প্রভানন্দ

ইউরোপে স্বামী বিবেকানন্দ–স্বামী বিদ্যাত্মানন্দ

শ্রীরামকৃষ্ণলীলার শেষ অধ্যায়–নির্মলকুমার রায়

শ্রীরামকৃষ্ণ-পরিক্রমা–-কালীজীবন সেনশর্মা

সংসদ চরিতাভিধান

অন্তিমশয্যায় শ্রীশ্রীঠাকুর–ডাক্তার তারকনাথ তরফদার–স্বাস্থ্য শারদীয়া সংখ্যা ১৪০৮

আমি বিবেকানন্দ বলছি–সংগ্রহ শংকর

অচেনা অজানা বিবেকানন্দ–শংকর

.

তথ্যসূত্র (২)

The Complete Works of Swami Vivekananda Vol 1-9

The Life of Swami Vivekananda By His Eastern & Western Disciples

The Master as I Saw Him–Sister Nivedita

The Complete Works of Sister Nivedita Vols I-V

Letters of Sister Nivedità Vol. 1-11-Edited by Shankari Prasad Basu

Swami Vivekananda in the West : New Discoveries Vol I-VI–Marie Louise Burke

A Comprehensive Biography of Swami Vivekananda Vol I-II–Sailendranath Dhar

Swami Vivekananda–Romain Rolland

Days in the Indian Monastery–Sister Devmata

Six Lighted Windows–Swami Yogesananda

Swami Vivekenanda : A Forgotten Chapter of His Life–Dr. Beni Shankar Sarma

Swami Vivekananda–Patriot and Prophet–Dr Bhupendranath Datta

A Concordance to Swami Vivekananda Vol I-III

God Lived with Them–Swami Chetanananda

You Will be a Paramahansa–Swami Sarbagatananda

Western Admirers of Ramakrishna and His Disciples–Dr Gopal Stavig

.

“ঈর্ষাই আমাদের দাসসুলভ জাতীয়চরিত্রের কলঙ্কস্বরূপ। ঈর্ষা থাকলে সর্বশক্তিমান ভগবানও কিছু করে উঠতে পারেন না।”

৩ মার্চ ১৮৯৪
শিকাগো থেকে ‘কিডি’-কে লেখা স্বামীজির চিঠি

“আমি লিখতেও পারি না, বক্তৃতা করতেও পারি না; কিন্তু আমি গভীরভাবে চিন্তা করতে পারি, আর তার ফলে যখন উদ্দীপ্ত হই, তখন আমি বক্তৃতায় অগ্নি বর্ষণ করতে পারি।”

১৫ মার্চ ১৮৯৪
ডেট্রয়েট থেকে হেল ভগিনীদের কাছে লেখা

“হে মাধব, অনেকে তোমায় অনেক জিনিস দেয়–আমি গরীব–আমার আর কিছু নেই, কেবল শরীর, মন ও আত্মা। আছে–এগুলি সব তোমার পাদপদ্মে সমর্পণ করলাম-হে জগদ্ব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর, দয়া করে এগুলি গ্রহণ করতেই হবে–নিতে অস্বীকার করলে চলবে না।”

৩১ জুলাই ১৮৯৪
গ্রীন একার থেকে হেল ভগিনীদের কাছে লেখা

“আমার বন্ধুদের বলবে যারা আমার নিন্দাবাদ করছেন, তাদের জন্য আমার একমাত্র উত্তর–একদম চুপ থাকা। আমি তাদের ঢিলটি খেয়ে যদি তাদের পাটকেল মারতে যাই, তবে তো আমি তাদের সঙ্গে একদরের হয়ে পড়লুম।”

২৭ সেপ্টেম্বর ১৮৯৪
আলাসিঙ্গা পেরুমলকে লেখা চিঠি

“আমি বাঙলা দেশ জানি, ইন্ডিয়া জানি-লম্বা কথা কইবার একজন, কাজের বেলায় শূন্য।”

৯ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৫
নিউ ইয়র্ক থেকে বৈকুণ্ঠনাথ সান্যালকে লেখা

“পরস্পরের সহিত বিবাদ ও পরস্পরকে নিন্দা করা আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য। অলস, অকর্মণ্য, মন্দভাষী, ঈর্ষাপায়ণ, ভীরু এবং কলহপ্রিয় এই তো আমরা বাঙালি জাতি। …বেকুবদের কথা মোটেই ভেবো না; কথায় বলে বুড়ো বেকুবের মত আর বেকুব নেই। ওরা একটু চেঁচাক না।”

২৩ ডিসেম্বর ১৮৯৬
ফ্লোরেন্স থেকে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লেখা

“হিসেবের অভাবে…আমি যেন জোচ্চোর না বনি।”

১২ অক্টোবর ১৮৯৭
স্বামী ব্রহ্মানন্দকে চিঠি

“অল্প বয়স থেকেই আমি ডানপিটে ছিলুম, নইলে কি নিঃসম্বলে দুনিয়া ঘুরে আসতে পারতুম রে।”

ফেব্রুয়ারি ১৮৯৮
শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে নীলাম্বরবাবুর
বাগানবাড়িতে

“ভারতের অনেকে..ইউরোপীয়দিগের সঙ্গে আহার করার জন্য আপত্তি জানিয়েছেন, ইউরোপীয়দিগের সঙ্গে খাই বলে আমায় একটি পারিবারিক দেবালয় থেকে বার করে দেওয়া হয়েছে।”

১৪ সেপ্টেম্বর ১৮৯৯

“লড়াইয়ে হার-জিত দুই-ই হলো–এখন পুটলি-পাঁটলা বেঁধে সেই মহান মুক্তিদাতার অপেক্ষায় যাত্রা করে বসে আছি। ‘অব শিব পার করো মেরা নেইয়া’-হে শিব, হে শিব, আমার তরী পাড়ে নিয়ে যাও প্রভু।’”

১৮ এপ্রিল ১৯০০
ক্যালিফোর্নিয়া থেকে মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডকে

০১. জন্মভিটেতে শরিকি সংঘাতের বিষবৃক্ষ

উনিশ শতকের ছয়ের দশকে বিস্ময়কর বিবেকানন্দের জন্মের সময় কেমন ছিল উত্তর কলকাতার জীবনযাত্রা? এ বিষয়ে নরেন্দ্রনাথ নিজে তেমন কিছু বলে যাওয়ার সুযোগ পাননি, কিন্তু তাঁর মেজভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত বেশ কিছু বিবরণ রেখে গিয়েছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। কয়েকটি ছোট ছোট ছবি মনে রাখলে উত্তর কলকাতার ৩ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটকে বুঝতে সুবিধে হতে পারে।

এখনকার অক্সফোর্ড মিশন ছিল কলুবাড়ি, তার পর হাড়িপাড়া। মহেন্দ্র গোঁসাই গলিটা ছিল ডোমপাড়া, মধু রায় গলি গয়লাপাড়া।

সিমলা থেকে জগন্নাথ ঘাট পর্যন্ত খুব উঁচু বাড়ি না থাকায়, দত্তদের ভিটেবাড়ির ছাদে উঠে জাহাজের মাস্তুল দেখা যেত।

ঘোড়ার গাড়ির প্রথা বেশ কম ছিল, মেয়েরা ঘোড়ার গাড়ি চড়ত না, বাবুরা গদি-বিছানায় শুয়ে পাল্কিতে অফিস-আদালতে যেতেন।

গৃহস্থবাড়িতে কাঠের জ্বালে রান্না হত। ১৮৭৬ সালে লোকের বাড়িতে প্রচারের জন্য বিনামূল্যে কয়লা বিতরণ হত। ক্রমে কয়লার দাম এক আনা মণ হল।

গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে স্বামীজির ভিটেবাড়িতে ছিল তিনটে পাতকুয়ো–এই জল রান্নায় ব্যবহার হত। পাতকুয়োতে একটা কচ্ছপ ছিল। সেকালের কলকাতার অনেক বাড়িতেই কচ্ছপ জল পরিষ্কার রাখত। বাড়ির চাকররা হেদুয়া থেকে বাঁকে জল আনত। “আমরা মাধব পালের পুকুরে স্নান করতাম,” লিখেছে স্বামীজির মেজ ভাই মহেন্দ্রনাথ।

সেকালের কলকাতায় দারুণ শীত পড়ত। তাই শোওয়ার সময় এক মালসা আগুন ঘরে রাখা প্রয়োজন হত।

জামা পিরানের তেমন প্রচলন ছিল না, কমবয়সী ছেলেরা খালি গায়ে, খালি পায়ে থাকত। নেমন্তন্ন খেতে যাওয়ার সময়ে পরতে হত চিনে কোট। বয়োজ্যেষ্ঠরা পরতেন বেনিয়ান।

গরমকালে লালদিঘি থেকে স্বামীজির ছোটকাকা অ্যাডভোকেট তারকনাথ দত্ত ঘোড়ার কম্বলে মুড়ে আমেরিকান বরফ আনতেন। গোঁড়া হিন্দুরা এবং বিধবারা এই বরফ খেতেন না।

সিমলে পাড়ায় বড় মাতালের উৎপাত ছিল। সেই জন্য প্রবাদ ছিল ‘সিমলার মাতাল আর বাগবাজারের গেঁজেল।

কলকাতার বিয়েবাড়িতে অনেক দুষ্ট লোক যেত, জুতো চুরি করত। সেই জন্য গৃহকর্তার সঙ্গে চাকরও যেত জুতো পাহারা দিতে।

শহরে লোকে দিনে আড়াই পোয়া চালের ভাত খেত, রাতে আধসের এবং উপযুক্ত পরিমাণ দুধ। দুধ পাওয়া যেত টাকায় দশ সের থেকে যোলো সের।

নগর কলকাতার রাস্তায় দূরে দূরে শাল কাঠের থামেতে রেড়ির তেলের আলো জ্বলত রাত্রে তেল চুরি হত এবং বাতিওয়ালা গালাগালি করত। রাত্রে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে হলে গৃহস্থরা যে-যার লণ্ঠন নিয়ে যেতেন।

সেকালের গান : হরে মুরারে মধুকৈটভারে, হরি ভজে কি হবে, চপ কাটলেট, কোপ্তা খাও বাবা গবাগব, খাও বাবা গবাগব, হরি ভজে কি হবে?’

গৌরমোহন স্ট্রিটের দত্ত বাড়িতেও চেঁকি ছিল, পরে বন্ধ হয়ে যায়।

মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, “আমাদের সময় আট নয় বৎসরের মেয়ের বিবাহ হইত।” বিয়ের আগে কাঁচা দেখার প্রথা ছিল। পরে শুভদিনে পাকা দেখা হত। কাঁচা দেখা’ কথাটা এখন অভিধান থেকে মুছে গিয়েছে।

শহরের বৃদ্ধেরা অনেকে মাথা মুড়িয়ে শিখা রাখতেন। টেরি কাটার প্রথা ছিল না।

সব হিন্দু বাড়িতেই তুলসী গাছ রাখতে হত।

চাকররা গোঁফ রাখতে পারত না। পাইকরা কিন্তু সেই সুবিধা পেত।

*

৩ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বাড়িতে নরেন্দ্রনাথ দত্তর জন্ম ১২ জানুয়ারি ১৮৬৩ সোমবার সকাল ৬টা ৪৯ মিনিটে। শৈশব, বাল্য ও যৌবনলীলা এখানেই সাঙ্গ করে তেইশ বছর বয়সে সন্ন্যাসগ্রহণ করেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত, যিনি প্রথমে বিবিদিষানন্দ, পরে কিছু সময় সচ্চিদানন্দ এবং অবশেষে স্বামী বিবেকানন্দ।

নামকরা উকিলবাড়ির আদরের সন্তান, কিন্তু ৩ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বাসিন্দা নরেন্দ্রনাথের কৈশোর, বাল্য, যৌবনের কোনও ফটো কারও সংগ্রহে নেই। বিদেশিনী অনুরাগিণী মিস জোসেফিন ম্যাকলাউড ভারতভ্রমণে এসে কোথাও নাকি কলেজের ছাত্র, তারুণ্যেভরা নরেন্দ্রনাথের একখানা ছবি দেখেছিলেন। কিন্তু বিশ শতকের গোড়ায় দত্তবাড়িতে হৃদয়হীন ইংরেজ পুলিশের এমন কৃপাদৃষ্টি পড়েছিল যে সব ইতিহাস তছনছ হয়ে গিয়েছে। ফলে এখনকার চিত্রসংগ্রহে তার প্রথম ছবিটি ২৩ বছর বয়সের সাধক নরেন্দ্রনাথের, কলকাতায় কাশীপুর উদ্যানবাটিতে তোলা ১৮৮৬ সালে। এই ছবিটি কেমনভাবে তোলা হল তার কোনও বিস্তৃত বিবরণ নেই।

পিতৃদেব বিশ্বনাথ ও মাতা ভূবনেশ্বরীর সংসার ছোট ছিল না। ভাই মহেন্দ্রনাথ ছিলেন নরেন্দ্রনাথের ছ’বছরের ছোট। তার কাছে দত্তবাড়ির নানা নির্ভরযোগ্য তথ্যের জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। তার তুলনাহীন বর্ণনা : “গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বাড়ি খুব প্রশস্ত ছিল। বাড়ির অভ্যন্তর দেড় বিঘা ছিল এবং আশেপাশে অনেক জমিতে রেওয়ত ছিল। বাড়ির বর্ণনা বলিতে হইলে প্রথম ঠাকুরদালান হইতে আরম্ভ করিতে হয়। পাঁচফুকুরী ঠাকুরদালান পশ্চিমমুখী, অর্থাৎ ইহার পাঁচটি খিলান ও গোল ইটের থাম। ঠাকুরদালানের সম্মুখে বড় প্রাঙ্গণ। ঠাকুরদালানের উপরের দক্ষিণ দিকে দুইতলা বড় হলঘর। উত্তরদিকের ঘরটিকে ‘বড় বৈঠকখানা ঘর’ বলা হইত। দক্ষিণ দিকে নীচের ঘরটিকে বোধন ঘর’বলা হইত এবং উপরকার ঘরটিকে ‘ঠাকুরঘর’ বলা হইত। তাহার পর বাহিরের উঠানে চকমিলান দালান ও ঘর। অন্দরমহলে দুইদিকে দুটি উঠান ছিল এবং পিছন দিকে কানাচ বা পুকুর ছিল।”

কেমন ছিল সেকালের দত্তবাড়ির খাওয়াদাওয়া? শুনুন ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথের নিজের মুখে : “তখন কলকাতায় পাঁঠার মুড়ি বিক্রি হত না, আমরা পাঁঠাওয়ালাদের সঙ্গে বন্দোবস্ত করেছিলাম যে, তার দোকানে যে কটা মুড়ি থাকবে, আমাদের জন্যে রেখে দেবে। …দশ বারোটা পাঁঠার মুড়ি, সের দুই আড়াই ওলন্দ কড়াইশুটি, এক সঙ্গে ফুটিয়ে একটা তরকারি হত। বিকেলবেলা স্বামীজি আর আমি স্কুল থেকে এসে, আমরা দু’জন ওই কড়াইশুটি দেওয়া ব্রেনের তরকারি দিয়ে, খান-যোলো করে রুটি খেতুম।”

অনেক দিন পরে দক্ষিণেশ্বরের শরৎকে (স্বামী সারদানন্দ) শ্রীরামকৃষ্ণ নির্দেশ দিলেন, নরেনকে দেখে আয়, “নরেন্দ্রনাথ কায়েতের ছেলে, বাপ উকিল, বাড়ি সিমলে”। ১৮৮৫ সালের জ্যৈষ্ঠমাসে শরৎ ও ভ্রাতা শশী (পরে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ) বেলা আড়াইটার সময় ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে এলেন। পিতার মৃত্যুর পর ভূবনেশ্বরী পরিবারের শোচনীয় অবস্থা।”কেবল একখানি ভাঙা তক্তপোষ, একটা মাদুর ভাজকরা, ঘরের পশ্চিমদিকের তক্তপোষের উপর তুলা বের করা একটা গদি, দু’একটা ছেঁড়া বালিশ আর পশ্চিমদিকে একটা কালো মশারি পেরেকের উপর গুটান, কড়িকাঠ হইতে একটা টানা-পাখার ঘেঁড়া ঝালর ঝুলিতেছে।”

এ বাড়ির ওপর দিয়ে তার পরে নানা সময়ে নানা রকম ঝড় বয়ে গিয়েছে। নরেন্দ্রনাথ সন্ন্যাসী হলেন ১৮৮৬ সালে, বাড়ির শরিকি মামলা একটু আয়ত্তে আসবার পরেই তিনি পরিব্রাজক হলেন এবং ১৮৯৩-তে মুম্বই থেকে জাহাজে চড়লেন আমেরিকার উদ্দেশে। বিশ্বজয়ী হয়ে প্রথম দেশে ফিরলেন ১৮৯৭ সালে। আবার বিদেশ যাত্রা ১৮৯৯ সালে, শেষবারের মতো ফিরে এলেন ১৯০০ সালের ৯ ডিসেম্বর।

ইতিমধ্যে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে নানা বিপর্যয় ঘটে গিয়েছে। মেজ ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত খেতড়ির মহারাজের আর্থিক সাহায্য নিয়ে দাদাকে অগ্রিম না জানিয়েই আচমকা হাজির হলেন লন্ডনে, উদ্দেশ্য ব্যারিস্টারি পড়বেন। নিজে কোথায় থাকবেন ঠিক নেই, এই অবস্থায় সহায় সম্বলহীন ভাইকে দেখে বিবেকানন্দ মোটেই সন্তুষ্ট হলেন না। তার ইচ্ছে ভাই ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আমেরিকায় যান। অভিমানী মহেন্দ্রনাথ স্থির করলেন দাদার কাছে জাহাজ ভাড়া না নিয়ে পায়ে হেঁটেই ভারতে ফিরবেন। পদযাত্রায় বেশ কয়েক বছর লাগল। এই পর্যায়ে বাড়িতে তিনি কোনও চিঠি লেখেননি। ৪ জুলাই ১৯০২ সালে মহেন্দ্রনাথ বহু দেশ পেরিয়ে কাশ্মীরে, স্বামী সারদানন্দের কাছে দাদার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে দ্রুত ৩ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে ফিরে এলেন।

জননী ভূবনেশ্বরীর কিন্তু জীবনে একবিন্দু শান্তি নেই। দারিদ্র ও শোকের সঙ্গে লড়াই করতে করতে কিছুদিন পরেই শুনলেন ছোট ছেলে ভূপেন্দ্রনাথ গোপনে দেশের বিপ্লব আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছে। ১৯০৭ সালে রাজদ্রোহের অভিযোগে কলকাতার আদালতে ভূপেন্দ্রনাথের এক বছর জেল হল। সেখানে ঘানি টানতে হত, জেল খাটার পরে আবার আটক হবার আশঙ্কায় মায়ের অর্থানুকূল্যে এবং সিস্টার নিবেদিতার পরামর্শে আত্মপরিচয় গোপন করে দেশ ছেড়ে প্রথমে আমেরিকায় চলে গেলেন ভূপেন্দ্রনাথ, মায়ের সঙ্গে তাঁর আর দেখা হয়নি। আমেরিকা থেকে ইউরোপে গিয়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনে রোমাঞ্চকর অংশ নিয়ে ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দেশে ফেরেন ১৯২৫ সালে।

চিরদুঃখিনী ভূবনেশ্বরীর দেহাবসান হয় ২৫ জুলাই ১৯১১, মেনিনজাইটিস রোগে। শেষ নিঃশ্বাসের কয়েক ঘন্টা আগে সুখদুঃখের নিত্যসঙ্গিনী নিবেদিতার সঙ্গে তার দেখা হয়, শোনেও উপস্থিত ছিলেন নিবেদিতা। প্রায় একই সঙ্গে দেহ রাখলেন দিদিমা রঘুমণি বসু, ভূবনেশ্বরী তাঁর একমাত্র সন্তান।

মহেন্দ্রনাথের দেহাবসান ১৪ অক্টোবর ১৯৫৬ সালে পূজার সময়। মহানবমীর দিনে গুরুতর অসুস্থ মহেন্দ্রনাথকে দেখতে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের দত্তবাড়িতে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় এলেন। বিজয়া দশমীর রাত্রি ১২টা ৪২ মিনিটে মহেন্দ্রনাথের বিদায় মুহূর্তে ঘরের আলোটি হঠাৎ ফিউজ হয়ে গেল এবং সেই সময়েই নিঃশব্দে চলে গেলেন অসামান্য ভ্রাতা ও অসামান্য লেখক মহেন্দ্রনাথ। স্বামীজির বংশের শেষ পুরুষ অকৃতদার ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ওই একই বাড়িতে দেহ রাখলেন ২৫ ডিসেম্বর ১৯৬১। শেষ হল দত্ত পরিবারের ইতিহাস।

*

গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে স্বামী বিবেকানন্দর জন্মভিটে যে শেষ পর্যন্ত রামকৃষ্ণ মিশনের প্রচেষ্টায় এই ভাবে রক্ষা পাবে, তা এ দেশে তার অনুরাগীদের কাছে স্বপ্নেরও অতীত ছিল মাত্র ক’বছর আগেও।

অসম্ভবকে সম্ভব করাটাই রামকৃষ্ণ মঠ মিশনের স্বভাব। তারা আর একবার কাজটা করে দেখিয়ে দিলেন : স্বপ্ন থাকলে, প্রতিভা থাকলে, এবং বিশ্বাস থাকলে কপর্দকশূন্য অবস্থা থেকেও বড় কাজ সেরে ফেলা যায়। এগারো বছরের বেশি সময় ধরে যে-সন্ন্যাসী অশেষ ধৈর্য ও চরম দুঃসাহস মূলধন করে এই প্রচেষ্টার অন্যতম রূপকার হলেন, সেই স্বামী বিশোকানন্দ (পার্থ মহারাজ) বললেন, “আত্মনেপদের কোনও স্থান নেই, রামকৃষ্ণ সংঘের সন্ন্যাসী হিসেবে যে দায়িত্ব পেয়েছিলাম, তা পালন করা গেল বহু মানুষের, বহু প্রতিষ্ঠানের এবং বহু সরকারি সংস্থার অভূতপূর্ব সাহায্যে।”

নিজের কথা কিছুতেই বলবেন না এই কাজপাগল সন্ন্যাসী। শেষে অনেক চেষ্টায় বললেন, “১৯৯৩ সালে ত্রিপুরা থেকে বেলুড় মঠে এলাম, তখনকার জেনারেল সেক্রেটারি স্বামী আত্মস্থানন্দ বললেন, আমরা এত কাজ করছি, কিন্তু বিবেকানন্দের জন্মস্থান উদ্ধার করতে পারছি না। অথচ এটা আমাদের দায়। একটু উঠেপড়ে লাগো। সঞ্জীব মহারাজের সঙ্গে ঠাকুরের নাম করে লেগে পড়া গেল। কাজটা শেষ পর্যন্ত হয়েও গেল।”

ভিটেবাড়ি পুনরুদ্ধার-প্রচেষ্টার শুরু কিন্তু আরও তিরিশ বছর আগে, স্বামীজির জন্মশতবর্ষে ১৯৬৩-তে। ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের আমলে ইচ্ছাপ্রকাশ করা হয়, বাড়িটি অধিগ্রহণ করে স্মৃতিমন্দির করা হবে। তখনকার জেনারেল সেক্রেটারি স্বামী বীরেশ্বরানন্দ সেই কথা শুনে একটা পাল্টা প্রস্তাব দেন : শুধু ৩ নম্বর নয়, ১ থেকে ১০ নম্বর গৌরমোহন স্ট্রিট ও সিমলা স্ট্রিটের কিছু জমি নিয়ে প্রায় ধ্বংস হয়ে-যাওয়া বাড়িটিকে মেরামত করে আদি অবস্থায় ফিরিয়ে এনে মিউজিয়াম, লাইব্রেরি গবেষণাগার ইত্যাদি করা যেতে পারে।

পরে এক সময়ে রাজ্যসরকার জমি ও বাড়ি অধিগ্রহণের নোটিফিকেশন জারি করেন, কিন্তু বহুজন বিরক্ত হয়ে ওঠেন এবং আদালতের শরণাপন্ন হন। একটি সংস্থা বাধাদানে প্রধান ভূমিকা নিয়ে বলে, কিছুতেই আমরা অধিগ্রহণ করতে দেব না। পরিস্থিতি জটিলতর করার জন্য প্রশ্ন তোলানো হয়, রামকৃষ্ণ মিশন কেন? এখানে ন্যাশনাল মিউজিয়াম করতে হবে। সেই সময়ে রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী স্বামী সম্বুদ্ধানন্দ অনেক চেষ্টা করলেন, কিন্তু কিছু করা গেল না।

স্বামী বিশোকানন্দ বলছেন, “১৯৯৩ সালে ভিটেবাড়ির মামলা তদ্বির করতে গিয়ে দেখলাম, যখনই সমস্যাটা একটা সিদ্ধান্তের পথে এগোয়, তখনই কোনো অদৃশ্য শক্তি অনেককে উসকে দিয়ে ব্যাপারটা বানচাল করে দেয়। এঁদের মধ্যে রাজনৈতিক দলের কেউ কেউ আছেন।

নিরাশ না হয়ে স্বামী বিশোকানন্দ স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে দেখা করলেন, মিশনের পরিকল্পনাটা কী তা ব্যাখ্যা করলেন। প্রত্যেক ভাড়াটিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হল। বলা হল, আপনাদের বিকল্প জায়গা দেব। মুরারিপুকুরে ২৮টি ফ্ল্যাট তৈরি করা হল। সরকারি হাউজিং বোর্ড থেকেও ফ্ল্যাট নেওয়া হল এবং পুনর্বাসনের আলোচনা পুরোদমে চালু হয়ে গেল। পার্থ মহারাজ প্রথম যখন সিমলেপাড়ায় এসেছিলেন, “তখন বাড়ি তো দূরের কথা, গলিতেও ঢুকতে পারতাম না। জেদ চেপে গিয়েছিল। আমি যদি ফিরে যাই, আর হবে না।”

বহু চেষ্টায় ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে একজন ভাড়াটিয়াকে নতুন বাড়িতে সরানো গেল, তাকে সরসুনাতে শকুন্তলা পার্কে জায়গা দেওয়া হল। “এই প্রথম ভিটেবাড়িতে দাঁড়াবার একটা জায়গা পাওয়া গেল।” স্থানীয় যুবকদের সঙ্গে নিরন্তর আলোচনা চালালেন সন্ন্যাসীরা, আরও ছ’জন বাসিন্দাকে পুনর্বাসনে রাজি করানো সম্ভব হল, এবং যে দিন তারা উঠে যান, সে দিনই ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন কর্তৃপক্ষ সরকারি ভাবে মিশনকে তা দিয়ে দেন।

এক সময় স্বামীজির ভিটেবাড়িতে কী ছিল না? পানের দোকান, চায়ের দোকান, মিষ্টির দোকান, রেস্তোরাঁ, জ্যোতিষী, অসংখ্য সোনার দোকান, ছাপাখানা, দফতরিখানা, প্রকাশনা, লন্ড্রি, ডেকরেটর, সাইনবোর্ড পেন্টিং কোম্পানি, ব্লেড ফ্যাক্টরি, পেরেক ফ্যাক্টরি, পিচবোর্ড বাক্স তৈরির ফ্যাক্টরি, লেদ মেশিন, জিংক প্লেট ফ্যাক্টরি, এমনকী একটা ক্লাব! স্বামী বিশোকানন্দ বললেন, “উপযুক্ত পুনর্বাসনের জন্য ৬ কোটি টাকা খরচ হয়েছে, কাউকে বঞ্চিত করা হয়নি। ১৪৩টি পরিবার ও ব্যবসা সংস্থাকে অন্যত্র সরাতে হয়েছে। আর দেরি হলে বাড়িটাই ভেঙে পড়ত।”

যথাসময়ে রামকৃষ্ণ মিশন পরামর্শ ও সাহায্য নিলেন আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে সংস্থা এবং ডি সি পি এল নামক আন্তর্জাতিক খ্যতিসম্পন্ন কোম্পানির। শেষোক্ত প্রতিষ্ঠানের প্রধান শ্ৰীমতী শান্তা ঘোষ একটি পয়সাও না নিয়ে সমস্ত কাজটি নিঃশব্দে করে দিলেন, যার আর্থিক মূল্য অন্তত এক কোটি টাকা।

স্বামী বিশোকানন্দ তার মিশন সম্পন্ন করেও সম্পূর্ণ আড়ালে থেকে যেতে চান। বহু অনুরোধের পর তিনি শুধু বললেন, “এ সবই স্বামীজির কাজ, আমাদের দিয়ে করিয়ে নিচ্ছেন। এই সুযোগ পেয়ে আমরা কৃতার্থ।”

ভিটেবাড়ির কঠিনকর্ম সম্পন্ন করে নিস্পৃহ সন্ন্যাসী বিশোকানন্দ নিঃশব্দে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিট ত্যাগ করে ভিন্ন দায়িত্বপালনের জন্য অন্যত্র চলে গিয়েছেন।

.

স্বামী বিবেকানন্দের জন্মভিটা নিয়ে যত আইনি লড়াই হয়েছে তার পুরো ইতিহাস খাড়া করলে মস্ত একখানা বই হয়ে যায়। উকিলবাড়ির ছেলে নরেন্দ্রনাথ দত্ত কলকাতার অ্যাটর্নি পাড়ায় শিক্ষানবিশি করলেও এবং আইনপড়া সম্পূর্ণ করলেও শেষ পর্যন্ত পরীক্ষায় বসেননি এবং পরবর্তী সময়ে ভাই মহেন্দ্রনাথকে বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে প্রবল বাধা দিয়েছিলেন। তবু আইন তাকে ছাড়েনি এবং সন্ন্যাসী হওয়ার পরেও পারিবারিক মামলা-মোকদ্দমার রাহু তাকে কীভাবে ঘিরে ধরেছিল তা এক নিতান্ত দুঃখজনক কাহিনি।

আপাতত আমরা শুধু তার জন্মভিটের আইনি হাঙ্গামার খোঁজখবর করব যার বিস্তৃতি অর্ধশতাব্দীর অধিক কাল ধরে। যদি জন্মভিটের পুনরুদ্ধারের জন্য রামকৃষ্ণ মিশনের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সন্ন্যাসীদের কথা ধরা যায় তাহলে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে মামলা-মোকদ্দমার অবস্থিতি উনিশ, বিশ এবং একুশ শতাব্দী জুড়ে।

দেরেটোনার দত্ত পরিবারের যে মানুষটি (রামসুন্দর) মধু রায় লেনে বসবাস করতে এসে ৩ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে অনেকখানি জমি-সহ বিশাল বসতবাড়ির পত্তন করলেন, তিনি প্রথমে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের ইংরেজ অ্যাটর্নির ম্যানেজিং ক্লার্ক এবং পরে ফার্সি আইনজীবী। আইনপাড়ায় উপার্জন করা প্রভূত অর্থ থেকেই দত্তদের এই ভিটেবাড়ির পত্তন।

রামমোহনের দুই পুত্র (দুর্গাপ্রসাদ ও কালীপ্রসাদ) ও সাত কন্যা। পঁয়ত্রিশ বছরে কালীপ্রসাদের অকালমৃত্যু কলেরায়, আর নরেন্দ্রনাথের পিতামহ দুর্গাপ্রসাদ নিতান্ত তরুণ বয়সে সন্ন্যাসী হয়ে সংসারবন্ধন ত্যাগ করে চলে গেলেও, ভিটেবাড়িতে প্রথম মামলার অনুপ্রবেশ ঘটল তারই মাধ্যমে। সেই সময়ের হিন্দু আইন অনুযায়ী কলকাতা হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের হয়েছিল, যার মোদ্দা কথা দুর্গাপ্রসাদ দত্ত নিরুদ্দিষ্ট, টানা বারো বছর তার কোনও সন্ধান না পাওয়ায় আদালতে তাকে মৃত ঘোষণা করা হোক।

সন্ন্যাসী হয়ে-যাওয়া দুর্গাপ্রসাদের পুত্র বিশ্বনাথ বি এ পাশ করে কিছু দিন ব্যবসা করেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে আইনপাড়ার অ্যাটর্নি অফিসে আর্টিকেলড ক্লার্ক হন এবং পরে হেনরি জর্জ টেম্পলের অ্যাটর্নি অফিসে যোগ দেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বাবা ভুবনমোহন দাশ ওই অফিসে তার সহকর্মী ছিলেন। পরে তিনি যে অ্যাটর্নি অফিস স্থাপন করেন তার নাম ধর অ্যান্ড দত্ত।

অ্যাটর্নি হিসেবে বিশ্বনাথ প্রচুর যশ অর্জন করলেও, দত্তবাড়ির শরিকরা পরবর্তী কালের পারিবারিক মামলায় তাকে বেহিসেবি এবং আর্থিক সঙ্গতিহীন বলে অভিযোগ করেন। আমরা জানি বিবেকানন্দ-গর্ভধারিণীর দুঃখ ও নীরব বেদনা। বিশ্বনাথ একবার বলেছিলেন, “আমি এত টাকা রোজগার করি, আর আমার স্ত্রী পেট ভরে খেতে পায় না।”…বিশ্বনাথের অকালমৃত্যু ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪ সালে, কিন্তু তার জীবিতকালেই শরিকি লড়াইয়ের সূচনা হয়ে যায়। এর প্রথম ইন্ধন জোগানো হয় ১৮৭৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর যখন অর্থের প্রয়োজনে দত্ত পরিবারের দুই নিঃসন্তান বিধবা অবিভক্ত ভিটেতে নিজেদের অংশ নরেন্দ্ৰজননী ভূবনেশ্বরীকে বেচে দেন। ভোলানাথ দত্তর বিধবা বামাসুন্দরী ও মাধব দত্তর বিধবা বিন্দুবাসিনী এর জন্যে যে পাঁচশো টাকা করে পেয়েছিলেন তা আসলে কার উপার্জিত টাকা এই নিয়ে পরবর্তী কালে মস্ত লড়াই আদালতে। নরেন্দ্রনাথের খুড়ো হাইকোর্টের বিখ্যাত আইনজ্ঞ তারকনাথ দত্তর বিধবা জ্ঞানদাসুন্দরী বনাম বিশ্বনাথ দত্তের বিধবা ভূবনেশ্বরী দাসীর আইনি লড়াই স্বামী বিবেকানন্দর অবশিষ্ট জীবনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।

এই মামলার আগেও ১৮৮০ সালে অবিভক্ত বাড়ির আর এক শরিক শচীমণি দাসী (গৌরমোহন দত্তের দৌহিত্রী) ভিটেবাড়ি বিভাজন মামলা এনেছিলেন কলকাতা হাইকোর্টে যাতে অন্য সকলের সঙ্গে বিবেকানন্দ জননী ভূবনেশ্বরীও ছিলেন প্রতিপক্ষ। পরের বছরে আদালতের নির্দেশে কলকাতার বিখ্যাত অ্যাটর্নি রবার্ট বেলচেম্বার্স সম্পত্তি বিভাজনের কমিশনার নিযুক্ত হন এবং চার বছর ধরে সব কিছু খুঁটিয়ে দেখে তিনি দত্তবাড়ির শরিকদের ভাগ ঠিক করে দেন। বেলচেম্বার্সের স্বাক্ষরিত ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের নকশাই পরবর্তী সময়ে বিবেকানন্দ ভিটের পুনরুদ্ধার ও সংস্কারে মঠ ও মিশনের খুব কাজে লেগে যায়।

নরেন্দ্রনাথের বাবা বিশ্বনাথ দত্তের অকালমৃত্যুর পরেই উকিল তারকনাথ ভূবনেশ্বরীর নামে কেনা সম্পত্তি তার বেনামি সম্পত্তি বলে দাবি করতে থাকেন। ১৮৮৫ বড়দিনের সময় এই বাড়ির একটা অংশে বাথরুম মেরামতির জন্য পুরনো দেয়াল ভাঙা নিয়ে ভূবনেশ্বরীর পরিবারের সঙ্গে তারকনাথ উত্তপ্ত কথা কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়লেন। এই মামলায় যথাসময়ে সাক্ষীর কাঠগড়ায় উঠেছিলেন স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ। হাইকোর্টে বিচারপতির নাম উইলিয়াম ম্যাকফারসন। নরেন্দ্রনাথ যখন সাক্ষ্য দেন (৮ মার্চ, ১৮৮৭) তখন শ্রীরামকৃষ্ণ মহাসমাধি লাভ করেছেন, তাঁর ত্যাগী সন্তানরা তখন তপস্যাদীপ্ত বরাহনগরের মঠবাসী। নিরুপায় নরেন্দ্রনাথ হাইকোর্টে যেতেন পায়ে হেঁটে, আর ভূবনেশ্বরী যেতেন পাল্কিতে। নরেন্দ্রনাথের সাক্ষ্যের কিছু অংশ: “..কয়েক মাস পিত্রালয়ে থেকে আমার মা ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে ফিরে এসে দেখেন তাঁরই জমির একটা অংশে তারকনাথ দত্ত একটি পাকা ঘর তৈরি শুরু করেছেন।..ঘটনাস্থলে মায়ের পক্ষ নিয়ে আমি আপত্তি তুলেছিলাম।”

দীর্ঘ শুনানির পরে ১৪ মার্চ ১৮৮৭ হাইকোর্টের বিচারপতি ম্যাকফারসনের সুচিন্তিত রায় প্রকাশিত হল। অভিযোগ প্রমাণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন তারকনাথের বিধবা জ্ঞানদাসুন্দরী দাসী। প্রমাণ হল, প্রয়াত বিশ্বনাথ প্রবাস থেকে নিয়মিত তার স্ত্রীকে টাকা পাঠাতেন। বিপদ সাধল তারকনাথের এক পুরনো চিঠি, যেখানে এক আত্মীয়কে তিনি লিখছেন, সম্পত্তির প্রকৃত ক্রেতা তিনি নন, ভূবনেশ্বরী।

রায়ের বিরুদ্ধে যথাসময়ে আপিল করেছিলেন জ্ঞানদাসুন্দরী। তখনকার প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি আর্থার উইলসন ও জাস্টিস রিচার্ড টটেনহ্যামও ভূবনেশ্বরীর পক্ষে রায় দিলেন ১৫ নভেম্বর ১৮৮৭। কিন্তু জয় অত সহজ হলো না। শাখাপ্রশাখা মিলে এই মামলার রেশ চলল স্বামীজির জীবনের শেষ শনিবার পর্যন্ত–সেই সঙ্গে অজস্র অর্থব্যয় ও সীমাহীন যন্ত্রণা।

পিতৃহীন পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান, আবার বৈরাগ্যের কঠিন সাধনা, অসহনীয় এই টানাপোড়েনে নরেন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন তার গুরুভাইদের অবিস্মরণীয় ভালবাসা ও সমর্থন। দুই গুরুভাই নরেনের টাকার অনটন মেটাবার জন্য বরাহনগর থেকে বালির স্কুলে গিয়ে মাস্টারি করতে চাইলেন। সে বড় করুণ কাহিনি। জীবনের শেষপর্বেও স্বামীজি তাঁর প্রিয় গুরুভাইকে অনুরোধ করেছিলেন, রাখাল আমার শরীর ভাল নয়। শীগগিরই দেহত্যাগ করব। তুই আমার মার ও বাড়ির ব্যবস্থা করে দিস। তাকে তীর্থ দর্শন করাস, তোর ওপর ভারটি রইল।

হাইকোর্টের রায়ের পরেও গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের মামলা কেমনভাবে পল্লবিত হয়ে তার তিরোধানের দিন পর্যন্ত স্বামীজিকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল তার নানা নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন চিঠিপত্রে এবং ইতিহাসের পাতায় পাতায়। হাইকোর্টে হেরে যাওয়ার পরে খুড়ি তার অংশটি ৬ হাজার টাকায় স্বামীজিকে বেঁচে দেন। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে (মার্চ ১৯০২) সিস্টার নিবেদিতাকে স্বামীজি লিখলেন, “ইউরোপ থেকে সামান্য যে টাকা এনেছিলাম তা মায়ের দেনা শোধ এবং সংসার খরচে লেগে গেল। সামান্য যা রয়েছে তাতেও হাত দেবার উপায় নেই। ঝুলে থাকা মামলার জন্য লাগবে।”

বেলুড়ে স্বামীজির মহাসমাধি ৪ জুলাই ১৯০২। তার পাঁচ দিন আগে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের সমস্যা মেটাবার জন্যে স্বামীজি হঠাৎ ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। কয়েক জন শরিকের সঙ্গে স্বেচ্ছায় দ্বন্দ্ব মিটে গেল টাকার পরিবর্তে। দুই পক্ষের অ্যাটর্নি (পিন্টু কর ও এন সি বসু) খুব দ্রুত কাজ করলেন। কারণ, অপেক্ষা করবার মতো সময় আর স্বামীজির হাতে নেই। ২ জুলাই ১৯০২ মহাসমাধির দু’দিন আগে শরিক হাবু দত্ত ও তমু দত্তর দাবি স্বেচ্ছায় মিটমাট হয়ে গেল।

স্বামীজি কিছুটা স্বস্তি নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারলেও আইনের কালো মেঘ এরপরেও মাঝে মাঝে ৩নম্বর গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের আকাশ ঢেকে ফেলেছে।

রাজনৈতিক অপরাধে কেউ আদালতে অভিযুক্ত হলে ভূপেন্দ্রনাথ অনেক সময় বাড়ির মালিক হিসেবে জামিনদার হনে, একজন আসামি মামলা চলাকালীন উধাও হওয়ায় ভূপেন্দ্রনাথকে জামিনদার হিসেবেও জরিমানা দিতে হয়। গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বাড়ির অংশ বিক্রি করে সেই টাকা যে জোগাড় করতে হয়েছিল তা এই প্রজন্মে আমরা ভুলে গিয়েছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *