চার্ব্বাক দর্শন (চার্বাক দর্শন) / চার্বাকদর্শন / চার্বাক-দর্শন
চার্ব্বাক দর্শনের তাৎপর্য্য এই যে, পুরুষ যত কাল জীবিত থাকিবে, কেবল সুখের উপায়ই চেষ্টা করিবে। যখন সকল ব্যক্তিকেই কালগ্রাসে পতিত হইতে হইতেছে, আর মৃত্যুর পর বন্ধুজনেরা শবদেহ ভস্মসাৎ করিয়া ফেলিলে উহাতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকিতেছে না, তখন যাহাতে সুখে জীবন যাপন হয় এমত চেষ্টা করাই সর্ব্বতোভাবে বিধেয়। পারলৌকিক সুখলিপ্সায় ধর্ম্মোপার্জ্জনে আত্মাকে সাতিশয় কষ্টভাগী করা নিতান্ত মূঢ়তার কর্ম্ম, যেহেতু ভস্মীভূত দেহের পুনর্জ্জন্ম কোন প্রকারেই সম্ভাবিত হইতে পারে না। পৃথিবী, জল, তেজঃ ও বায়ু এই চারি ভূত হইতে দেহের উৎপত্ত হয়। যদিও ভূত সকল অচেতন, তথাপি তাহারা মিলিত হইয়া দেহরূপে পরিণত হইলে তাহাতে চৈতন্য জন্মে। হরিদ্রা পীতবর্ণ ও চূর্ণ শুক্লবর্ণ, কিন্তু উভয়ে মিলিত হইলে তাহাতে রক্তিমার উৎপত্তি হয়; গুড় তণ্ডুল প্রভৃতি দ্রব্য প্রতেকে মাদক নহে, কিন্তু ঐ সকল দ্রব্য দ্বারা সুরা প্রস্তুত হইলে তাহাতে মাদকতা শক্তি জন্মে। সেইরূপ এই দেহ অচেতন পদার্থ হইতে উৎপন্ন হইলেও তাহাতে চৈতন্যগুণের উৎপত্তি অসম্ভাবিত নহে। আমি স্থূল, আমি কৃশ, আমি গৌরবর্ণ, আমি শ্যামবর্ণ ইত্যাদি লৌকিক ব্যবহারেও আত্মাই স্থূল কৃশাদিভাবে হৃদয়ঙ্গম হইতেছে; কিন্তু স্থূলতাদিধর্ম্ম সচেতন ভৌতিক দেহেই লক্ষিত হইয়া থাকে। অতএব ইহা বিলক্ষণ প্রতিপন্ন হইতেছে যে, সচেতন দেহই আত্মা, অদতিরিক্ত আত্মা নাই।
এই মতে প্রত্যক্ষমাত্র প্রমাণ, অনুমানাদি প্রমাণ নহে।
আর কামিনীসম্ভোগ, উপদেয় দ্রব্য ভক্ষণ ও উত্তম বসন পরিধানাদি দ্বারা সমুৎপন্ন সুখই পরম পুরুষার্থ। যদিও এই সমস্ত সুখের আস্বাদন করিতে হইলে, তৎসহযোগে দুঃখনিবহেরও ভোগ অপরিহার্য্য, তথাপি তাহাতে অনাস্থা প্রকাশ করিয়া তত্তৎ সুখ সম্ভোগ করাই সকলের উচিত। দেখ, কষ্টকর কণ্টক ও শল্কাদি পরিবৃত বলিয়া কেহই সুস্বাদু মৎস্য ভক্ষণে পরাঙ্মুখ হয়েন না, এবং তুষাদি অসারংশসম্বলিত বলিয়া কেহই পুষ্টিকর ধান্য পরিত্যাগ করেন না; প্রত্যুত সকলেই উহাদিগের কণ্টক তুষাদি অপসারাংশ অপনয়ন করিয়া সারাংশ গ্রহণ দ্বারা তৃপ্তি সুখ প্রাপ্ত হয়েন। পশুগণদ্বারা শস্যাপচয় হইবে বলিয়া কি কেহ ধান্যবীজ বপন করিবেন না? না ভিক্ষুক দ্বারা বিরক্ত হইয়াবার ভয়ে অন্নাদি পাক করিয়া ভোজন করিবেন না? অবশ্যই করিবেন। অতএব সুখানুষঙ্গী অবশ্যম্ভাবী দুঃখে ভীত হইয়া সুখোপভোগে বিরত হওয়া অতি মূঢ়তার কর্ম।
অনেকানেক প্রধান পণ্ডিতেরা অসাধারণধীশক্তিসম্পন্ন হইয়াও বহু ধন ব্যয় ও শরীরায়াস স্বীকারপূর্ব্বক বেদনির্দ্দিষ্ট কর্ম্মের অনুষ্ঠান করিয়া আসিতেছেন, ইহাতে আপাততঃ বোধ হইতে পারে অবশ্যই পরলোক থাকিবে। বস্তুতঃ পরলোক নাই। তবে যে তাঁহারা ঐ সকল নিষ্ফল কর্ম্মে প্রবৃত্ত হয়েন তাহার কারণ এই যে, কতিপয় প্রতারক ধূর্ত্তেরা বেদের সৃষ্টি করিয়া, তাহাতে স্বর্গ নরকাদি নানা প্রকার অলৌকিক পদার্থ প্রদর্শন করত, সকলকে অন্ধ করিয়া রাখিয়াছে এবং তাহারা স্বয়ং ঐ সকল বেদবিধির অনুষ্ঠান করত জনসমাজের প্রবৃত্তি জন্মাইয়াছে এবং রাজাদিগকে যাগাদিতে প্রবৃত্ত করিয়া তাঁহাদিগের নিকট হইতে বিপুল অর্থ লাভ করিয়া নিজ নিজ পরিজন প্রতিপালন করিয়াছে। তাহাদিগের অভিসন্ধি বুঝিতে না পারিয়া, উত্তরকালীন লোক সকল ঐ সমস্ত বেদোক্ত কার্য্যের অনুষ্টান করাতে, বহু কালাবধি এই প্রথা প্রচলিত হইয়া আসিতেছে। বৃহস্পতি কহিয়াছেন অগ্নিহোত্র, বেদাধ্যয়ন, দণ্ডধারণ, ভস্মগুণ্ঠন এই সমস্ত বুদ্ধিপৌরুষহীন ব্যক্তিদিগের উপজীবিকা মাত্র। বেদে লিখিত আছে পুত্রেষ্টিযাগ করিলে পুত্র জন্মে, কারীরীযাগ করিলে বৃষ্টি হয়, শ্যেনযাগ করিলে শত্রুনাশ হয়। তদনুসারে অনেকেই ঐ সকল কর্ম্মের অনুষ্ঠান করিতেছেন, কিন্তু কোন ফলই দৃষ্ট হইতেছে না। এক স্থানে বিধি আছে সূর্য্যোদয় হইলে অগ্নিহোত্র যাগ করিবে, অন্য স্থানে কহিতেছে, সূর্য্যোদয়ে হোম করিবেক না, যে ব্যক্তি সূর্য্যোদয়ে হোম করে, তাহার প্রদত্ত আহুতি রাক্ষসের ভোগ্য হয়। এইরূপে বেদে অনেক বাক্যের পরস্পর বিরোধ দৃষ্ট হইয়া থাকে এবং উন্মত্তপ্রলাপের ন্যায় বারম্বার এক কথার উল্লেখও দেখিতে পাওয়া যায়। যখন এই সমস্ত দোষ দেখা যাইতেছে, তখন কি প্রকারে বেদের প্রামাণ্য স্বীকার করা যাইতে পারে। অতএব স্বর্গ, অপবর্গ ও পারলৌকিক আত্মা সমস্তই মিথ্যা এবং ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়াদির ব্রহ্মচর্য্যাদি চারি আশ্রমের কর্ত্তব্য কর্ম্ম সফলও নিষ্ফল। ফলতঃ অগ্নিহোত্র প্রভৃতি কর্ম্ম সকল অবোধ অক্ষম ব্যক্তিদিগের জীবনোপায়মাত্র।
ধূর্ত্তেরা ইহাও করিয়া থেকে যে জ্যোতিষ্টোমাদি যজ্ঞে যে জীবের ছেদন হইয়া থাকে সে স্বর্গলোকে গমন করে। যদি ঐ ধূর্ত্তদিগের ইহাতে সম্পূর্ণ বিশ্বাস থাকে, তবে তাহারা যজ্ঞেতে আপন আপন পিতা মাতা প্রভৃতির মস্তকচ্ছেদন না করে কেন? তাহা হইলে অনায়াসে পিতা মাতা প্রভৃতির স্বর্গলাভ হইতে পারে, এবং তাহাদিগকে আর পিতা মাতার স্বর্গের নিমিত্ত শ্রাদ্ধাদি করিয়া বৃথা কষ্ট ভোগ করিতে হয় না। আর শ্রাদ্ধ করিলে যদি মৃত ব্যক্তির তৃপ্তি হয়, তবে কোন ব্যক্তি বিদেশে গমন করিলে তাহাকে পাথেয় দিবার প্রয়োজন কি। বাটীতে তাহার উদ্দেশে কোন ব্রাহ্মণকে ভোজন করাইলেই তাহার তৃপ্তি জন্মিতে পারে। অপিচ, এই স্থানে শ্রাদ্ধ করিলে যদি স্বর্গস্থিত ব্যক্তির তৃপ্তি হয়, তবে অঙ্গনে শ্রাদ্ধ করিলে প্রাসাদোপরিস্থিত ব্যক্তির তৃপ্তি না হয় কেন? যাহাতে কিঞ্চিদুচ্চস্থিতের তৃপ্তি হয় না, তদ্দ্বারা অত্যুচ্চ স্বর্গস্থিত ব্যক্তির তৃপ্তি কি প্রকারে সম্ভব হইতে পারে? অতএব মৃতব্যক্তির উদ্দেশে যে সমস্ত প্রেতকৃত্য অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে, তাহা ব্রাহ্মণদিগের উপজীবিকা মাত্র, বস্তুতঃ কোন ফলোপধায়ক নহে।
কিন্তু, এই দেহ ভস্মাবশেষ হইলে, কোন প্রকারে তাহার আর পুনরাগমের সম্ভাবনা থাকে না। অতএব যত কাল পর্য্যন্ত জীবন থাকে, সুখস্বচ্ছন্দে অবস্থান করাই উচিত; অধিক কি, ঋণ করিয়াও ঘৃতাদি পুষ্টিকর আহার করা বিধেয়। যদি শরীর হইতে আত্মা পরলোকে গমন করে এবং তাহার দেহান্তরে প্রবেশ করিবার ক্ষমতা থাকে, তবে বন্ধুবান্ধবের স্নেহে ঐ দেহেই পুনরায় না আইসে কেন?
ভণ্ড, ধূর্ত্ত ও রাক্ষস এই ত্রিবিধ লোক একত্র হইয়া বেদ রচনা করিয়াছে। অশ্বমেধ যজ্ঞে যজমানপত্নী অশ্বশিশ্ন গ্রহণ করিবে ইত্যাদি বিষয় সকল ভণ্ডের রচিত। স্বর্গ নরকাদি বিষয় সকল ধূর্ত্তের প্রণীত। এবং যে সকল অংশে মদ্য মাংশ নিবেদনাদির বিধি আছে, তাহা নিশাচরের কল্পিত। অতএব বেদশাস্ত্র মিথ্যা, বুদ্ধিমান লোকেরা কোন মতেই তাহাতে বিশ্বাস করেন না।