০১. ঘুম ভাঙার পর

কাচের দেওয়াল – সুচিত্রা ভট্টাচার্য

.

আমার বাবা
প্রয়াত ধীশঙ্কর ভট্টাচার্যের স্মৃতির উদ্দেশে

.

ঘুম ভাঙার পরও অনেকক্ষণ বিছানায় চুপচাপ শুয়েছিল জয়া। এ সময়টা তার ধ্যানের সময়। প্রতিদিন এভাবেই চোখ বুজে শুয়ে নিজেকে খনন করার চেষ্টা করে সে। কাল রাত থেকে একটা ছবি ধরা দিয়েও ধরা দিচ্ছে না মাথায়। কোথায় যেন একটা বড় রকমের ফাঁক থেকে যাচ্ছে। কোথায় যে ফাঁকটা? কোথায়? ছবির বিন্যাসে? না রঙে? নতুন করে কল্পনায় রঙগুলোকে সাজাতে চাইছিল জয়া।

ভেতরের প্যাসেজে টেলিফোনটা বেজে উঠল। বাজছে। বেজেই চলেছে।

ঘোর অন্যমনস্কতায় জয়ার প্রথমটা মনে হল বাইরের দরজায় কলিংবেল বাজাচ্ছে কেউ। একবার দুবার শোনার পর ভুল ভাঙল। এত সকালে কে ডাকছে টেলিফোনে। দিনের শুরুতেই বাইরের লোকের ডাকাডাকি জয়া একদম পছন্দ করে না।

ধাতব ঝংকার তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হচ্ছে। ফোনটা কেউ ধরছে না কেন? সুধা গেল কোথায়? বিরক্ত মুখে জয়া বিছানায় উঠে বসল। নিজের অজ্ঞাতেই চোখ চলে গেছে পুরনো জার্মান দেওয়াল ঘড়িটার দিকে। সাতটা দশ। মানে সুধা বাজারে। সকালে কেউ বিছানা ছেড়ে ওঠার আগে বাড়ির বাজার সেরে ফেলে সুধা। বাবলুর ঘুম ভাঙলেও ভাঙতে পারে কিন্তু সকালে ধরে বসিয়ে না দিলে নিজে থেকে উঠতে নড়তে পারে না বাবলু। আর বৃষ্টি তো উঠবেই না!

শাড়ির আঁচল গুছিয়ে নিয়ে জয়া ঘর থেকে বেরিয়ে এল। যথেষ্ট বিরস মুখে রিসিভার তুলেছে,

—হ্যালো!

ও প্রান্ত মুহূর্তের জন্য নীরব। মুহূর্ত পরে স্বর ফুটল,

—আমি সুবীর। সুবীর বলছি।

আজ এত সকালে সুবীর কেন! জয়া সামান্য থমকাল সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেছে। আজ বৃষ্টির জন্মদিন। প্রতি বছরই জন্মদিনে মেয়ে ঘুম থেকে ওঠার আগে সুবীরের ফোন আসে।

—বৃষ্টি ওঠেনি এখনও?

জয়ার বুকের ভেতরটা কোন কারণ ছাড়াই কেন যে হু হু করে উঠল! সক্কালবেলা আচমকা সুবীরের গলা শুনল বলেই কি! নাকি আজ বৃষ্টির জন্মদিন বলে! জয়া ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। একেক সময় নিজের মনকেও কেন যে এত অচেনা লাগে! সংযত হতে সময় লেগে গেল বেশ কয়েক সেকেন্ড, তবুও গলার ভারী ভাবটাকে কাটানো গেল না,

—ধরো দেখছি। মনে হয় এখনও ঘুমোচ্ছে।

কথাটা বলেও একটুক্ষণ রিসিভার কানে ধরে রইল। আর কিছু কি বলবে সুবীর? কিছু না হোক, নিছক কুশল জিজ্ঞাসা? ছোট্ট দুটো শব্দ, কেমন আছ? দুজন পরিচিত মানুষের সাধারণ সৌজন্য বিনিময়? নাহ্‌, জয়া টেলিফোন ধরলে কখনই অপ্রয়োজনীয় কথা বলে না সুবীর। দরকার ছাড়া একটি বাক্যও অপচয় করে না। কবেই বা করত? চিরকালই তো এরকম আত্মসর্বস্ব।

জয়া নিঃশব্দে রিসিভার নামিয়ে রাখল। গোটা বাড়ি ঘুমোচ্ছে অঘোরে। নিঝুম। এত নিঝুম যে নিজের নিশ্বাসের শব্দও স্পষ্ট শোনা যায়। ঘর দিয়ে চতুর্দিক চাপা বলে ভেতরের এই প্যাসেজটাতে এমনিতেই আলো কম। দরজা জানলা সব খোলা থাকলে তাও একটু উজ্জ্বল লাগে। ছোটখাটো হলঘর সাইজের এই প্যাসেজটা বাবা মা বেঁচে থাকাকালীন ফাঁকাই থাকত। এখন জয়া নিজের মত করে সাজিয়ে নিয়েছে। অনুজ্জ্বল বলে বেশি কিছু রাখেনি। মাঝখানে একটা শ্বেতপাথরের গোল টেবিলে চাইনিজ পেন্টিং করা একটা মাত্র চিনামাটির ফুলদানি। এধার ওধারে ছড়ানো পেতলের পট হোল্ডারে বাহারী জুনিপার, জেড, মনেস্টেরিয়া। সব একটা করে। দেওয়ালে ওল্ড মাস্টারস প্রিন্ট্‌ একটাই। ভ্যান গখের সূর্যমুখীর খেত। হঠাৎ তাকালে চোখ ধাঁধিয়ে যায় এমন হলুদ। এই ছবিটার জন্যই জায়গাটা খানিকটা যা উজ্জ্বলতা পেয়েছে।

নিখিল সুযোগ পেলেই ব্যঙ্গ করে,

—তোর এই একটা একটা করে সব কিছু রাখার ওপর ফ্যাসিনেশানটা কবে যাবে বল তো? এখনও এত একাকিনী শোকাকুলা ভাব কেন?

এত দিনের পুরনো, এত ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েও, নিখিল যে কেন এমন খোচা মারে হঠাৎ হঠাৎ! জয়া রেগে যায়,

—এটা যার যার পারসোনাল চয়েস্‌। এর মধ্যে অন্য ইঙ্গিত আনছিস কেন?

বলে বটে, কিন্তু অন্তরে যেন নিখিলের কথারই প্রতিধ্বনি শুনতে পায়। অতীত তো একটা না একটা ছায়া ফেলবেই মানুষের ওপর। ইচ্ছে করলেই বা সেই ছায়াকে মুছে ফেলা যায় কই!

প্যাসেজ টপকে মেয়ের ঘরের ভেজানো দরজার পাল্লা ঠেলতেই জয়ার বুক ধক করে উঠল। বৃষ্টি ঘরে নেই।

চোখের সামনে শুধুই সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল একটা ঘর। আধো আলো আধো ছায়ায় ঘরময় যেমন তেমন ছড়িয়ে বৃষ্টির বইখাতা, গানের ক্যাসেট, জুতো। কাঠের বাক্সের ডালায় অজস্র জামাকাপড়ের অগোছালো স্তূপ। রঙিন সুজনি ঝুলছে খাট থেকে। সুবীরের কিনে দেওয়া বিদেশী ওয়াকম্যান বিধ্বস্ত বিছানায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে গোটা ঘর যেন তছনছ করে দিয়ে গেছে কোন অপরিচিত দস্যু।

জয়ার ত্রস্ত চোখ নির্জন ঘরে পাক খেল কয়েক বার। ঘর জুড়ে, ওয়াড্রোবের গায়ে, দেওয়ালে, দরজায় সর্বত্র সারি সারি রঙিন পোস্টার। হাস্যমুখ বরিস বেকার, কপিলদেব, সুন্দরী ম্যাডোনা, ছলনাময়ী সামান্থা ফক্স, শচীন তেন্ডুলকার, গিটার হাতে জর্জ মাইকেল। এছাড়াও আছে আরও অনেকে, জয়া তাদের চেনে না। পোস্টারে পোস্টারে চারদিকের দেওয়াল প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে। ছোটবেলা থেকেই প্রিয় মানুষদের বিচিত্র পোস্টার লাগানোর কি যে নেশা মেয়েটার!

বৃষ্টির বিছানার পাশের টেবিলে মস্‌কিউটো রিপেলেন্টের লাল চোখ স্থির জ্বলছে। পশ্চিমের জানলার পেলমেট থেকে ঝোলা ভারী পর্দা দুটোর গায়ে, বন্ধ কাচের শার্সিতে প্রভাতী আলোর আভাস। মন কেমন করা স্মৃতির মত। মনোরম কিন্তু বিষন্ন।

আবছা আলো, রঙিন পোস্টার, সবুজ পর্দা সব মিলিয়ে পুরো দৃশ্যটার একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। কিন্তু জয়াকে এই মুহূর্তে তেমন করে টানতে পারল না ছবিটা।

গেল কোথায় মেয়েটা! এ সময় ঘুম থেকে ওঠে না তো কখনও! দ্রুত ভেতরের প্যাসেজে ফিরে জয়া বাথরুমের দিকে গেল। বাথরুমের দরজা খোলা; বৃষ্টি সেখানেও নেই। বেরিয়েছে কোথাও, নাকি ছাদে উঠেছে! এই সেদিন পর্যন্তও ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছাদে একা দাঁড়িয়ে থাকত মেয়ে।

জয়া রাগারাগি করত, —লেখা নেই, পড়া নেই, যখনই দেখি বৃষ্টি ছাদে উঠে দাঁড়িয়ে আছে, তোমরা ওকে একটু বকাবকি করতে পারো না মা?

মৃন্ময়ী বলতেন, —সব সময় খিচখিচ করিস না তো। লেখাপড়া তো করেই, নইলে ভাল রেজাল্ট করছে কি করে? ওখানে দাঁড়িয়ে চারপাশটা দেখতে ভালবাসে, তাও বন্ধ করে দেব?

আজকাল সেই মেয়ে বাড়িতে থাকেই বা কতক্ষণ যে চারপাশের পৃথিবীতে চোখ বোলাবে! একটু উঁচু ক্লাসে ওঠার পর থেকেই তো ছাদে ওঠার অভ্যাস চলে গেছে। এখন বাড়িতে থাকলেই সারাক্ষণ ঝমঝম করে বিদেশী বাজনা চালায়, নয়ত স্নায়ু টানটান করা ইংরিজি থ্রিলার পড়ে। এখনকার ছেলেমেয়েদের জীবন থেকে নরমসরম ব্যাপারগুলোই ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিও তার ব্যতিক্রম হল না। অথচ জয়ার বাবা মা মারা যাওয়ার আগেও এই মেয়ে কত নিরীহ ধরনের ছিল, কত শান্তও। কবে থেকে যে বদলে গেল বৃষ্টি! জয়ার বাবা মা দুজনেই পর পর মারা যাওয়ার পর থেকে! না সুবীর বিয়ে করার পর! জয়া ঠিক ঠিক নজর করে উঠতে পারেনি। বদলটাই মাঝে মাঝে বড় চোখে লাগে তার। মেয়ের ভাবভঙ্গিতে ইদানীং কেমন যেন চাপা উগ্রতা।

ছাদে উঠতে গিয়ে সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ টাঙানো নিজের আঁকা পুরনো ল্যান্ডস্কেপটায় চোখ পড়ে গেল জয়ার। ছবিটাতে বেশ ধুলো জমেছে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে না দিলে সুধা কিছুই লক্ষ করে না। আজ একটু সুধাকে বকাবকি করা দরকার। এত অযত্ন কেন! এত অবহেলা!

ছাদে উঠেই জয়া বৃষ্টিকে দেখতে পেল। আলসেতে ভর দিয়ে আচ্ছন্নের মত একদৃষ্টে সামনের পার্কের দিকে তাকিয়ে আছে মেয়ে। ক্ষণিকের জন্য জয়া স্থির। বিহ্বল। মা নয়, যেন এক অপরিচিত নারী অন্য এক পরিপূর্ণ রমণীকে দেখছে। বিশাল আকাশের নীচে, ছাদে একা দাঁড়িয়ে থাকা ওই যুবতী কি জয়ারই মেয়ে! পিছন থেকে কী বড়সড় লাগছে বৃষ্টিকে!

জয়া আড়ষ্ট গলায় ডাকল, —বৃষ্টি, তোমার ফোন।

বৃষ্টি শুনতে পেল না।

জয়া আবার বলল, একটু জোরে,

—অ্যাই বৃষ্টি, তোর বাবার ফোন এসেছে।

বৃষ্টি ঘুরে তাকাল। দৃষ্টি উদাস, ভাবলেশহীন। জয়া অবাক। বাবার নাম শুনলেই তো মেয়ের মুখ চোখ ঝলমল করে ওঠে! আজ ব্যাপার কি!

ধীর পায়ে বৃষ্টি সিঁড়ি দিয়ে নামছে, পিছন থেকে মেয়েকে দেখছিল জয়া। মেয়েটা তার ভারী সুন্দর হয়েছে। নরম। গোলাপি। মাথাভরা থাক থাক চুল। কালো চোখের পাতা। ছোট্ট চিবুক। ফোলা ফোলা গাল। অনেকটা রেনোয়ার পেন্টিং-এর মত। গড়নটাই যা একটু রোগাটে; বেশি লম্বা নয় বলে ততটা রোগা লাগে না অবশ্য।

সুবীরের মা বলতেন, —নাতনি আমার বৌমার গড়ন পাবে, মুখ গায়ের রঙ সুবীরের।

জয়ার বাবা প্রিয়তোষ খুব মজা পেতেন শুনে, — কী করে যে আপনারা ওইটুকু বাচ্চার মুখ গড়ন কেমন হবে বুঝে ফেলেন? আমার তো বাবা ওইটুকু শিশুদের সবাইকেই একরকম লাগে।

ওইটুকু শিশু দেখতে দেখতে কবে এত বড় হয়ে গেল! এই তো সেদিন তিলে তিলে তৈরি হল জয়ারই শরীরের মধ্যে। অদৃশ্য তুলি দিয়ে জয়া মেয়ের চোখ এঁকেছে, মুখ এঁকেছে। লেওনার্দোর মোনালিসার থেকে তার সৃষ্টিই বা কম কিসে!

সেই বৃষ্টি এক দুই তিন করে আজ পুরো আঠেরো।

আঠেরো! আঠেরো শব্দটা ঝন করে মস্তিষ্কে বেজে উঠল কেন?

আলিপুর জজ কোর্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আঙুল তুলে জয়াকে শাসিয়ে ছিল সুবীর, —দেখে নেব। দেখে নেব, মেয়ের আঠেরো বছর বয়স হলে কিভাবে তুমি তাকে আটকে রাখতে পারো।

সুবীরের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াই-এর পর সেদিনই সদ্য কাস্টডির মামলার রায় বেরিয়েছে। হিংস্র আক্রোশে পরস্পরের দিকে প্রকাশ্যে কাদা ছোঁড়াছুড়ি সেদিনই সবে শেষ।

সুবীরের উকিল বলেছিল, —মি লর্ড, এই ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন এঁর পুরুষ বন্ধুর সংখ্যা কত? দুই? পাঁচ? দশ? মনে হয় কড় গুনেও উনি শেষ করতে পারবেন না। উনি যখন স্বামীর বিনা অনুমতিতে মেয়ে ফেলে বিদেশ চলে গিয়েছিলেন তখন কজন পুরুষ বন্ধু ওনার সঙ্গী ছিল? মেয়ের জন্য উনি দিনে কতটা সময় খরচা করেন? আর কতটাই বা নিজের আঁকাঝোকার জন্য? ছবি এঁকেই বা ক পয়সা ওনায় রোজগার যে মেয়েকে প্রপারলি মানুষ করতে পারবেন বলে দাবি করছেন?

জয়ার উকিলও কম যায়নি, —মি লর্ড, আমার মাননীয় বন্ধু আমার ক্লায়েন্টের বিদেশ যাওয়ার কথা তুলে অশোভন ইঙ্গিত করছেন। উনি বাইরে গিয়েছিলেন মাত্র দু মাসের জন্য, ছবির এগজিবিশন করতে, বিদেশী সরকারের ডাকে, ভারতের ডেলিগেট হয়ে যা কিনা যে কোন শিল্পীর কাছে খুবই সম্মানের ব্যাপার। মেয়েও সে সময় আমার ক্লায়েন্টের বাবা মার কাছে অতি আদরেই ছিল। আসলে ওই ভদ্রলোকই স্ত্রীর খ্যাতি, যশ, প্রতিভাকে সহ্য করতে পারেননি। ওনাকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন তো কদিন উনি মদ্যপান না করে সুস্থ অবস্থায় বাড়ি ফেরেন? স্ত্রীকে বাড়ি থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দিয়ে মেয়ের সামনে কোন আদর্শ স্থাপন করেছেন? ঈর্ষাকাতর, মদ্যপ বাবার কাছে থাকা ভাল? না দাদু-দিদার ছায়ায় থেকে শিল্পী মায়ের কাছে বড় হওয়া ভাল?

তিক্ত সেই মামলায় জিতে পাওয়া মেয়ে আজ পূর্ণ যুবতী। বৃষ্টি নীচে এসে ফোন ধরেছে, জয়া একটু তফাতে দাঁড়িয়ে বাপ মেয়ের কথা শোনার চেষ্টা করল। ডাইনিং টেবিলের কাছে রাখা রবার গাছের পাতা দেখার ভান করে ওদিকেই কান সজাগ।

বৃষ্টি একবার পিছন ফিরে জয়াকে দেখে নিল। বেশ নিচু গলায় কথা বলছে। যেন মাকে লুকিয়ে গোপন কথা সেরে নিচ্ছে বাবা নয়, নিষিদ্ধ কোন পুরুষের সঙ্গে। সব কথা পরিষ্কার বুঝতে পারল না জয়া। টুকরো টুকরো দু একটা বাক্য কানে এল মাত্র।

…তুমি একা কিন্তু।

…দুপুরে হবে না। বিকেলে। আফটার ফাইভ। …

…কলেজেই এসো। কলেজ স্ট্রিট ক্রসিং এ।

নিম্ন স্বরে বললেও বৃষ্টির কথাবার্তা স্পষ্টতই কাঠ কাঠ। নির্লিপ্ত। কথা বলতে বলতেই দুম করে ফোন কেটে দিয়ে হনহন করে ঢুকে গেল বাথরুমে।

আশ্চর্য! বাবার সঙ্গে তো এভাবে কথা বলে না বৃষ্টি! জয়ার মনে পড়ল গত বছরও জন্মদিনে সুবীরের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে সন্ধের মধ্যেই বৃষ্টি বাড়ি ফিরে এসেছিল। জয়া জিজ্ঞাসা করেছিল,

—তুই এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলি যে?

জবাব না দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল মেয়ে।

সুবীরের সম্পর্কে কোন কথাই কখনও জয়াকে এসে বলে না বৃষ্টি। জয়ার মতই চাপা অন্তর্মুখী হয়েছে। এমনকি সুবীর যে আবার বিয়ে করেছে সে কথাও বৃষ্টির মুখ থেকে বেরোয়নি কোনদিন। ছেলে হওয়ার খবরও না। জয়া জেনেছিল শিপ্রার কাছ থেকে। শিপ্রার দাদা সুবীরের কলিগ।

জয়া জুনিপার গাছের টবের দিকে এগিয়ে গেল। গোড়ার মাটি শক্ত জমাট বেঁধে গেছে। ছোট্ট একটা লোহার শিক তুলে জয়া গাছটার গোড়া খোঁচাতে শুরু করল। বাবার ওপরও টান কি তবে কমে যাচ্ছে বৃষ্টির? অথচ এই মেয়েই কী ছটফটই না করত বাবার জন্যে! কোর্টের রায়ে সপ্তাহে একদিন মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে যাওয়ার অধিকার পেয়েছিল সুবীর। একদিনই। রবিবার এলেই মেয়েও সকাল থেকে সেজেগুজে তৈরি। গাড়ির হর্ন শুনলেই ছুটে বেরিয়ে যেত বাইরে,

—বাবা এসেছে। আমার বাবা এসে গেছে।

জয়া কী যে কাঁটা হয়ে থাকত সেই সব দিনগুলোতে! যদি বৃষ্টি আর না ফেরে? যদি বাবার কাছেই থেকে যায়? সুবীর আবার বিয়ে করার পর অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করেছিল।

মেয়ে বাথরুম থেকে বেরোতেই জয়া প্রশ্ন করল,

—তোর জন্মদিনে এবারও বন্ধুরা কেউ আসবে না সন্ধেবেলা?

বৃষ্টি নিষ্পলক তাকাল জয়ার দিকে। যেন জরিপ করছে মাকে,

—শুনলেই তো সন্ধেবেলা থাকব না।

জয়া অপ্রস্তুত। মেয়েও তবে এতক্ষণ তাকে লক্ষ করছিল! কথা ঘোরানোর চেষ্টা করল,

—তোর জন্য কাল একটা ফিরহন্‌ কিনে এনেছি। দেখেছিস?

—দেখিনি। দেখে নেব।

বৃষ্টি ঘরে ঢুকে গেল।

মেয়ের গলায় পরিষ্কার ঝাঁঝ! মাঝে মাঝে এভাবেই মুখিয়ে ওঠে আজকাল। ভালভাবে কথাই বলতে চায় না।

নিখিল বলে, —ও কিছু না। এ বয়সে ওরকম একটু আধটু হয়। মা বাবার কথা শুনতে ভাল লাগে না, মনোমত সব কিছু না পেলে বিরক্তি আসে। নিজের কথাই ভেবে দ্যাখ্ না, ওই বয়সে বাবা মা’র কথা শুনে চলতে তোর ভাল লাগত?

জয়া প্রতিবাদ করে না, কিন্তু জয়া জানে জয়া ছিল অন্যরকম। কারুর ওপর মেজাজ করা তার ধাতে ছিল না। সে ছিল অনেক ভিতু, অনেক নরম, খুব বেশি আবেগপ্রবণ। সে ছিল ফারকোটের পকেটে মানুষ হওয়া ডলপুতুলের মত। সামান্যতম নিষ্ঠুরতাও তার সহ্য হত না। একটা কুকুরকে রাস্তায় মরে পড়ে থাকতে দেখলেও সে কেঁদে কেটে একসা হত।

সদরের ইয়েল লক খুলে সুধা বাড়িতে ঢুকল। জয়াকে টবের কাছে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছে।

—কি হয়েছে গো গাছটার?

—হবে আবার কি? ভাল করে দেখাশোনা করিস না, গোড়াগুলো খুঁড়ে ঝরো ঝুরো করে দিতে বলেছিলাম না?

—সময় পাইনি গো। তুমি ছেড়ে দাও, আমি আজ খুঁড়ে দেব।

সুধা বাজারের থলি রান্নাঘরে রাখতে গেল। সেখান থেকেই মুখ বাড়িয়েছে,

—দিদি, চা দেব?

এই সময় ঘুম থেকে উঠে নিজের কাজে ডুবে যাওয়া জয়ার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। সামনে অ্যানুয়াল এগজিবিশন। দুটো ছবি শেষ করতেই হবে। সুধাকে বলল,

—ওপরে দিয়ে যাস। শুধু চা। বিস্কুট-ফিস্কুট না।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়েও জয়া ঘুরে দাঁড়াল,

—কি এনেছিস বাজার থেকে?

—রুই মাছ আর মুর্গি।

—খেয়াল আছে মেয়েটার আজ জন্মদিন? ফ্রাই-এর জন্য ভেটকি মাছের কয়েকটা ফিলেট আনতে পারতিস?

—এনেছি গো এনেছি। সুধা নিজস্ব ভঙ্গিতে মাথা দোলাল, —সুধার সব খেয়াল থাকে। বৃষ্টির জন্মদিনের কথা আমাকে মনে পড়িয়ে দিতে হবে? কার্তিক মাসের সাতাশ তারিখটা আমার ঠিক খেয়ালে থাকে। গতবারও তো আমিই মনে করে….

—থাম তো। জয়া খেপে উঠল। সুধা ইদানীং নিজেকে বড় বেশি বাড়ির গিন্নি ভাবতে শুরু করেছে।

—অত যদি সব দিকে খেয়াল, সিঁড়ির ছবিতে ময়লা জমে কি করে? যেদিকে তাকাব না সেদিকেই…

সুধা কথা না বাড়িয়ে রান্নাঘরে পালাল। তাকে এখন মেল ট্রেনের গতিতে সকালের কাজ সারতে হবে। চা জলখাবারের পাট চুকলেই কুটনো কোটা, মশলা বাটা, রান্নাবান্না…। সাড়ে দশটা এগারোটার মধ্যে জয়া বৃষ্টি দুজনেই যে যার কলেজে ছুটবে।

চিলেকোঠার স্টুডিওতে গিয়ে ক্যানভাসের সামনে বসল জয়া। কাল রাতে অর্ধেক আঁকা হয়েছে ছবিটা। মূলত প্রাথমিক রঙ দিয়েই এবার ছবিটাকে ফোটাতে চাইছে। লাল হলুদ আর নীল মিশিয়ে এক তীব্র একাকীত্বের অনুভূতি। হচ্ছে না। কিচ্ছু হচ্ছে না। তবে কি রঙগুলোকে ভেঙে দেওয়া দরকার? জয়া নতুন করে অস্থির হয়ে উঠল। যে কোন ছবি নিজস্ব উপলব্ধির সঙ্গে না মেলা পর্যন্ত এরকমই অতৃপ্তিতে ছটফট করতে থাকে সে। একবার ভাবল ক্যানভাসটাই মুছে ফেলে প্রথম থেকে শুরু করবে, পর মুহূর্তে মত বদলাল। হাতে ব্রাশ তুলে ক্যানভাসের নীল রঙটাকে গাঢ় করতে চাইল আরেকটু। বার দুয়েক আঁচড় টেনেই ব্রাশ ছুঁড়ে ফেলে দিল। মন বসছে না। একেক দিন এরকমই হয়। কিছুতেই ছবির মধ্যে পুরোপুরি ঢুকতে পারে না।

সুধা চা নিয়ে ঘরে ঢুকেছে। টুলের ওপর কাপ রেখে চলে যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল,

—কিছু বলবি?

—দিদি, দাদাভাই-এর কোমরের ব্যথাটা তো আবার খুব বেড়েছে। কালকেও সন্ধেবেলা খুব যন্ত্রণা হচ্ছিল।

জয়ার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। দু তিন বছর ধরে শীত আসার আগে বাবলুকে কোমরের ব্যথাটা খুব ভোগাচ্ছে। গত বছর তো আট দশ দিন একেবারেই শয্যাশায়ী ছিল ভাইটা। ডক্টর কয়াল বলছিলেন, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ভোগান্তিটুকুও বাবলুর কপালে আছে।

ঊনসত্তর সালে, কলেজ স্ট্রিটে, দু দলের বোমাবাজির মাঝখানে পড়ে মেরুদণ্ডে স্‌প্লিন্‌টার ঢুকেছিল বাবলুর। তখন বাবলু সবে হায়ার সেকেন্ডারি দিয়েছে, জয়া আর্ট কলেজের ফোর্থ ইয়ারে। নিজেদের যথাসর্বস্ব দিয়ে প্রিয়তোষ মৃন্ময়ী চিকিৎসা করিয়েছিলেন ছেলের। সুবীর তখন মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ। জয়ার সঙ্গে সদ্য পরিচয় হয়েছে তার। জয়ার ভাইকে সারিয়ে তোলার জন্য সেও অসম্ভব দৌড়াদৌড়ি, পরিশ্রম করেছিল সে সময়। শেষ পর্যন্ত প্রাণে বাঁচলেও নিম্নাঙ্গ প্রায় অসাড় হয়ে গেল বাবলুর। কোনদিন আর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারল না। একখানা পোর্টেবল টিভি, বই, ম্যাগাজিন, আর বড়সড় একটা অ্যাকোয়ারিয়াম নিয়ে নিজস্ব জগতে নির্বাসিত হয়ে থাকে সে। সেই জগতে সময় স্থির হয়ে আছে প্রায় একুশ বছর। নিস্তরঙ্গ সেই জীবনে বিন্দুমাত্র আলোড়ন উঠলে বাবলু হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। মেজাজ দিনকে দিন আরও তিরিক্ষে হয়ে উঠছে। বৃষ্টির সঙ্গে তো ইদানীং মোটেই বনে না। কথায় কথায় খিটিমিটি, ঝগড়া, চিৎকার, চেঁচামেচি। অথচ ছোটবেলায় এই ভালমামা বলতে বৃষ্টি প্রায় অজ্ঞান ছিল।

জয়া সুধাকে বলল, —ঠিক আছে, আজ ফেরার সময় ডাক্তারবাবুকে খবর দিয়ে আসব।

সুধা চলে যাওয়ার পর জয়া আরেকবার ছবিতে মন বসানোর চেষ্টা করল। ঘণ্টা দেড়েক মগ্ন রইল রঙ তুলি ক্যানভাসে। স্টুডিও বন্ধ করে যখন নীচে নেমে এল তখন তার মন অনেক প্রফুল্ল। ছবিটার পূর্ণ চেহারা চোখের সামনে এসে গেছে, আজ রাতে কাজ করলেই শেষ হয়ে যাবে।

ঘরে এসে ঘড়ি দেখে জয়া চমকে উঠল। নটা চল্লিশ। এগারোটা থেকে ক্লাস আজ। তাড়াতাড়ি জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমের দিকে ছুটল,

সুধা আমার ভাত বেড়ে ফ্যাল। অনেক দেরি হয়ে গেছে।

স্নান সেরে, চিরুনি হাতে ভাই-এর ঘরে ঢুকল একবার। বিছানায় আধশোয়া হয়ে বাবলু খবরের কাগজ পড়ছে। হুইল চেয়ারটা একেবারে দরজার সামনে পড়ে। আস্তে করে খাটের দিকে সেটাকে ঠেলে দিল জয়া,

—কি রে, আজ ব্যথাটা কেমন?

বাবলু কাগজ থেকে চোখ ওঠাল না—ঠিক আছে।

—আজ ডক্টর কয়ালকে বলছি একবার এসে দেখে যাক।

—কি হবে দেখে? বাবলু গোমড়া মুখে খবরের কাগজের পাতা ওল্টালো, আরও কড়া কিছু পেইনকিলার দেবে এই তো।

জয়া কথা বাড়াল না। ভাই-এর মুখের প্রতিটি অভিব্যক্তি সে চেনে। বাবলু ভীষণভাবে চাইছে একবার ডাক্তারবাবু এসে তাকে দেখে যাক কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ করবে না।

ডাইনিং টেবিলে যেতে গিয়েও কি মনে করে একবার বৃষ্টির ঘরেও ঢুকল।

সকালবেলার লণ্ডভণ্ড ঘরখানা ফাঁকা, শুনশান। চতুর্দিকের দেওয়াল জুড়ে বোবা যন্ত্রণার মত শুধুই অজস্র কালশিটে। একটাও রঙিন পোস্টার নেই। কোথ্‌থাও।

জয়া স্তব্ধ হয়ে গেল।

.

০২.

কালীঘাট মেট্রো স্টেশনের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই শব্দটা শুনতে পেল বৃষ্টি। ন’টা চৌত্রিশের ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকে গেছে। বৃষ্টি একটু অসহায় বোধ করল। আজ সে অন্য দিনের মত তাড়াহুড়ো করে নামতে পারবে না। শাড়িতে সে কোন সময়ই খুব স্বচ্ছন্দ নয়। স্কার্ট ব্লাউজ, সালোয়ার কামিজ বা প্যান্ট শার্টই তার নিত্য দিনের পোশাক। আজ সে ইচ্ছে করেই শাড়ি পরেছে। আজকে সে অন্য দিনের থেকে নিজেকে পৃথক করে রাখবেই।

আজ খুব সকালে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল বৃষ্টির। মধ্য হেমন্তের ভোরে তখনও ঘর জুড়ে ছড়িয়ে ছিল আগের রাতটা। দিন আসার আগে রাত শেষবারের মত ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে নিচ্ছিল সব কিছু। ভোরের দিকে এ সময় বেশ হিম হিম ভাব। এখনও যদিও সেভাবে জাঁকিয়ে ঠাণ্ডা পড়েনি, আসি আসি করেও শীত রোজ দোমনা হয়ে একটু করে এগোচ্ছে পিছোচ্ছে তবু সে যে আসছে সেটা স্পষ্ট টের পাওয়া যায়। এ সময় ভোরের পৃথিবী সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ থাকে। এ সময় পৃথিবীতে সব কিছুই বড় পবিত্র। এরকমই একটা সময়ে বাইরে পাঁচিলের গায়ে একটা ছোট্ট পাখি পিকপিক ডেকে উঠেছিল। সেই ডাকেই চমকে বিছানায় উঠে বসেছিল বৃষ্টি। ঘুমের শেষ রেশটুকু কাটার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গিয়েছিল কথাটা। মুহূর্তেই শরীর জুড়ে অচেনা শিহরন, আশ্চর্য অনুভূতি।

… শী উইল বি ইন দা কাস্টডি অফ হার মাদার টিল শী অ্যাটেইনস হার এজ অফ এইট্টিন…..

যত দিন না বৃষ্টির আঠেরো বছর বয়স হয় ততদিন সে মায়ের হেপাজতে থাকবে। যত দিন না বয়স আঠেরো বছর হয়। যতদিন না….. তারপর? আঠেরো বছর বয়স হলে?

ওই শব্দ কটা এখনও বৃষ্টির মনের ভেতর ঘুরপাক খেয়ে চলেছে। কেউ যেন ধাক্কা দিয়ে বার বার মনে পড়িয়ে দিচ্ছে কথাটা। আজকেই। তবে কি কথাটার বিশেষ কোন উদ্দেশ্য আছে! নইলে অত ভোরে আজ ঘুমই বা ভাঙবে কেন? জীবনে খুব কম দিনই এত সকালে ঘুম থেকে উঠেছে বৃষ্টি।

স্কুলে নবনীতা বলত,

—ঘুম হ্যাজ ফোর স্টেজেস। প্রথম রাতে নন্ র‍্যাপিড আই মুভমেন্টের ডিউরেশন বেশি, র‍্যাপিড আই মুভমেন্টের কম। ক্রমে র‍্যাপিড আই মুভমেন্ট প্রোলঙড্ হতে থাকে, শেষ রাত্তিরে গিয়ে….

ভোরের বেলা প্রতিদিনই তো সে গভীর ঘুমে। নবনীতার ভাষায় পুরো নন্ র‍্যাপিড আই মুভমেন্টের স্টেজ। বেশির ভাগ দিনই আটটা নাগাদ সুধামাসি ঠেলেঠুলে তোলে তাকে।

নবনীতার কথা মনে পড়তেই বৃষ্টির অল্প মন কেমন করে উঠল। নবনীতা জে এন ইউতে চলে গেছে। অনেক দিন ওর কোন চিঠি আসছে না। বিজয়া গ্রিটিংসও আসেনি। নতুন বন্ধুবান্ধব পেয়ে বৃষ্টিকে ভুলেই গেছে হয়ত। স্কুলে থাকতে ওই যা একটু কাছাকাছি ছিল বৃষ্টির। তার বাইরে আর বিশেষ কেউ বৃষ্টির নিষেধের কাঁটাতার টপকে তেমন ঘনিষ্ঠ হতে পারেনি কখনও।

মন্থর পায়ে বৃষ্টি প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াল। একটা ট্রেন চলে যাওয়ার পর দু-চার মিনিটও খালি থাকে না প্ল্যাটফর্ম। বিশেষ করে অফিস টাইমে। ডাউনের এদিকটা গিজগিজ করছে মানুষে। তার মধ্যেই ক্লোজ সার্কিট টিভিগুলোতে যথারীতি রঙিন নাচাগানা চলেছে। ব্যস্ত সমস্ত অফিসযাত্রীরা কয়েক মুহূর্তের জন্য গিলে নিচ্ছে গভীর আবেগময় প্রেমের দৃশ্য। বৃষ্টি মুখ ঘুরিয়ে নিল। ওই সব ন্যাকা ন্যাকা জড়াজড়ি করা প্রেমের নৃত্য তার একদম সহ্য হয় না। প্রেম শব্দটাতেই এক ধরনের শারীরিক বিতৃষ্ণা আছে তার। এলোমেলো পায়ে সামনে একটু এগোতেই বৃষ্টির চোখ আটকে গেল আরেকটা টিভির ঠিক নীচে। সকালের সেই বিদ্‌ঘুটে ছেলেটা না! হ্যাঁ, ওই তো। ছেলেটা পাড়ায় নতুন এসেছে। বেশ ম্যাচো টাইপ ফিজিক, রুক্ষ তামাটে মুখ, সলিড গোঁফঅলা। নামটা জানা হয়নি এখনও। রনি পিকলুদের সঙ্গে দারুণ দোস্তি হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই।

টিভি-র দিকে না তাকিয়ে ছেলেটা হাঁ করে তাকিয়ে আছে বৃষ্টির দিকেই। চোখাচোখি হতেই মুখ ঘুরিয়ে নিল। অন্যমনস্কতার ভান করছে! বৃষ্টির হাসি পেয়ে গেল। এ সমস্ত ভান রাস্তাঘাটে পুরুষের চোখে অহরহ দেখে আজকাল। সব সময়ে যে খারাপ লাগে তাও নয়। স্বাভাবিক নারীর মত পুরুষের দৃষ্টি মাঝে মাঝে উপভোগও করে সে। তবে কেউ কেউ যা গোগ্রাসে গেলে! ভাবতেই অবাক লাগে এই সব হ্যাংলা লোকগুলোই যখন বাড়িতে যায় তখন তারা কত সভ্য, ভদ্র। বাবা, দাদা, ভাই, পিসেমশাই, মেসোমশাই। একই মানুষের কতরকম যে চেহারা থাকে! কোনটা যে মুখোশ! কোনটা মুখ!

যেমন তার মা। বাড়িতে সব সময় কী গম্ভীর, দাপুটে। নিজে যা চাইবে সেভাবেই হতে হবে সব কিছু। না হলেই তুলকালাম। সুধামাসিকে বকছে বৃষ্টির ওপর মেজাজ, ভালমামাকে পর্যন্ত ছাড়ছে না। কখনও একেবারেই চুপচাপ, নিজের খেয়ালে একটানা ছবি এঁকে চলেছে। খেয়াল। খেয়াল। এই খেয়ালেই কখনও একগাদা প্যাকেট বুকে চেপে ঢুকছে বাড়িতে,

—বৃষ্টি দ্যাখ্ এই মেখলাটা কি গরজাস্ না? পিংক-এর সঙ্গে ব্লু-এর কনট্রাস্ট। এটা তোকে খুব ভাল মানাবে।

কখনও,—এই ধোতি সালোয়ারটা পরে কামিজের কাঁধটাঁধ দেখে নে তো। আর এই রাখ একশ টাকা। তোর হাতখরচ।

বৃষ্টি আদৌ পিংক বা ব্লু ভালবাসে কিনা, ধোতি সালোয়ার পছন্দ করে কিনা, তা নিয়ে এক বিন্দু মাথাব্যথা নেই মা’র। এই মা’ই আবার নিজের লোকজন বাড়িতে এলে একদম অন্যরকম। হাসিখুশি, উচ্ছল।

—অ্যাই বৃষ্টি, এদিকে শুনে যা তোকে দেবযানী ডাকছে।

উফ্। কী রিপাল্‌সিভ মহিলা ওই দেবযানী। ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল বৃষ্টির। আহ্লাদী আহ্লাদী। আমাদের বরোদাতে বাবা আর্টিস্টদের মধ্যে এত প্রফেশনাল জেলাসি ছিল না। দীপক বলে, কলকাতার সব কিছুর মধ্যেই বড্ড বেশি পলিটিক্স। নেকু। নিজে যেন কখনও পলিটিক্স করে না! এই তো রমেন সাহাই সেদিন মাকে এসে বলছিল তাদের নিউজ পেপার অফিসে গিয়ে দেবযানীমাসি নাকি চুকলি খেয়ে এসেছে। রমেন সাহারই নামে। মার সঙ্গে বেশি ভাব বলে রমেনমামা নাকি মার ছবির বেশি বেশি প্রশংসা করে আর দেবযানী ড্রিঙ্কস্ অফার করেনি বলেই কাগজে বিশ্রী সমালোচনা করেছে তার এগ্‌জিবিশনের। এর পরও নাকি ওর স্বামী দীপক বলে, তোমাদের ক্রিয়েটিভ আর্টের ওয়ার্ল্ডটা বড় নিষ্ঠুর! সব সময়ে ল্যাং মারামারি! সারাক্ষণ বরের কোটেশন ঠোঁটে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দীপক কা জরু কাঁহিকা। কি যেন বলে এদের? কক পেক্‌ড! বরসোহাগী!

শিপ্রা হাল্‌দার তাও একরকম। যদিও অনর্গল বকবক করেই চলে, কারুর কথা শোনে না, কেউ শুনছে কিনা পরোয়াও করে না। অবিরাম সিগারেট খেয়ে চলেছে। চেইন স্মোকার!

আর ফিরোজ আঙ্কল্ যে কখন সেন্সে থাকে, কখন থাকে না! সব সময়ই অ্যালকোহলের গন্ধ ছুটছে মুখ দিয়ে। ছোটবেলায় কি জোর জোর চুল টানত, আদর করত গাল টিপে টিপে। আজকাল দেখলেই, হাই ইয়াং লেডি, তুই তো রোজ একটু একটু করে ব্লুম করছিস্ রে! মাতালের প্রলাপ। পুজোর আগে একদিন তো এসে ড্রয়িংরুমের কার্পেটে পড়ে কি গড়াগড়ি। কোন্ ক্রিটিকের সঙ্গে নাকি ঝামেলা হয়েছে। গড়াচ্ছে আর চিৎকার করছে, আমার ছবিতে ডেপথ্ কম? দাঁত ভেঙে দেব শালাদের। তোর চোদ্দপুরুষ আর্টের কিছু বোঝে, অ্যাঁ? সজ্ঞানে থাকলে এই ফিরোজ আঙ্কল একেবারে ভিন্ন মানুষ। কত মার্জিত, ভদ্র, স্নেহশীল।

বাবাই বা কম কিসে! এমনিতে কত হাসিখুশি, দিলদরিয়া। সব সময় একটা মিষ্টি ভালবাসার গন্ধ যেন বাবার গায়ে। অথচ এই বাবাই রীতাআন্টির সামনে টুক্ করে কেমন খোলসের মধ্যে।

ভাবতেই পুরনো অভিমানটা সারা বুকে ছেয়ে গেল বৃষ্টির। সেই পুরনো পাথরচাপা অভিমান। জমাট। শীতল।

বৃষ্টি দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়েও ফেলতে পারল না। হুড়হুড় করে পাতাল ট্রেন ঢুকে পড়েছে। ভিড় ঠেলে সামনের কামরায় উঠে বৃষ্টি সিটের ধারে দাঁড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গেই গেটের কাছে হাসির রোল দেখে ঘাড় ঘুরে গেছে। গেট বন্ধ হওয়ার সময় গেটে আটকে গেছে। আর কেউ নয়, সেই ছেলেটাই। গেট থেকে ছাড়া পেয়ে দ্বিতীয় চেষ্টায় ভেতরে আসতে পারল। অপ্রতিভ মুখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। সব সময়ই বোধহয় অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা করতে ভালবাসে ছেলেটা। ভোর থেকেই যা কমিক সিন্ দেখিয়ে চলেছে। বৃষ্টি বেশ কৌতুক বোধ করল।

নির্জন ভোরে, সুধাকে ঘুম থেকে না তুলে, বৃষ্টি পায়ে পায়ে ছাদে উঠে গিয়েছিল। ছাদের দরজার ছিটকিনি খুলতেই বুক ছলাৎ। গাঢ় মেঘের মত কুয়াশা চতুর্দিকে, কুয়াশা জড়িয়ে ঘুমিয়ে সামনের পার্ক, রাস্তাঘাট। একটু দূরের সব কিছুই কেমন অস্পষ্ট। বাড়ি ঘরগুলো ঝাপসা হতে হতে অদৃশ্য ক্রমশ। ফিরোজ আঙ্কলের মিস্টিক পেন্টিং-এর মত। রহস্যময়। গোটা ছাদ শিশিরে, রেণুতে মাখামাখি হয়ে আছে। পিছল ছাদে পা টিপে টিপে আলসেতে এসে দাঁড়াতেই সামনের পার্কে ছেলেটা। জগিং করতে করতে গোটা পার্ক শুধু চক্কর দিয়ে চলেছে। পিঠে হ্যাভারস্যাকের মত ভারী এক কিটস্ ব্যাগ। ঘন কুয়াশার মধ্যে কী কিম্ভূতই না দেখাচ্ছিল ছেলেটাকে। পিঠে বস্তা নিয়ে যেন ধোঁয়ায় নাচছে এক রঙিন রোবট। হাল্কা নীল ট্র্যাকস্যুট পরা। আচমকা মাঝমাঠে দাঁড়িয়ে পড়ে ব্রেকডান্সের মত ঘাড় ঘোরাতে শুরু করল। বৃষ্টি থ! কাঁধ থেকে ব্যাগ নামায় না কেন! ঘাড়ে ব্যথা হয়ে মরবে যে! এক্সারসাইজ থামার পর পিঠ থেকে কিটস্ ব্যাগ নামল। ব্যাগ থেকে বেরোল ইয়া এক ক্রিকেট ব্যাট। ব্যাটসুদ্ধ অত বড় ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে দৌড়োয়! ওয়েট ট্রেনিং! দুহাতের গ্রিপে ব্যাট ধরে শ্যাডো প্র্যাকটিস্ শুরু হল তারপর! অদৃশ্য প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কখনও ফরোয়ার্ড খেলছে, কখনও ব্যাকফুট। কখনও স্কোয়্যার কাট্ করছে, কখনও ড্রাইভ।

হাঃ, কলকাতার কপিলদেব। বৃষ্টির ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপের হাসি। কত আজব চিড়িয়াই যে আছে এই শহরে!

এস্‌প্ল্যানেডে, পাতাল থেকে মাটিতে উঠে ট্রামলাইনের ধারে দাঁড়াল বৃষ্টি। কাঁধের ব্যাগ বুকের কাছে জড়ো করে একবার আকাশের দিকে তাকাল। সূর্যের কোন চিহ্ন নেই কোথথাও। সূর্য বোধহয় আজ আর উঠবেই না। যেদিন সে জন্মেছিল সেদিনও নাকি সারাদিন সূর্যের দেখা মেলেনি। নভেম্বরে কোন কারণ ছাড়াই বৃষ্টিতে ভেসে গিয়েছিল কলকাতা। বৃষ্টির দাদু প্রিয়তোষ বলেছিলেন, আমাদের বাড়িতেও বৃষ্টি এসেছে।

বৃষ্টির মুখে মাথার ওপরের ধূসর আকাশটার ছায়া। তার কোন জন্মদিনই কখনও কোন আনন্দের দিন হতে পারে না। আঠেরো বছরও না। তার জন্মটাই একটা দুর্ঘটনা মাত্র। বার্থ বাই মিয়ার চান্স। দুটো মানুষের মুহূর্তের আনন্দের বাই প্রোডাক্ট। কিম্বা ভুলের। আনন্দ ফুরিয়ে গেছে, ভুল ভেঙে গেছে। খেলা শেষ।

কলেজ স্ট্রিট মুখে আধ ফাঁকা ট্রামে উঠে বসবার জায়গা পেয়ে গেল বৃষ্টি। বিষন্ন মুখে জানলা দিয়ে কর্মব্যস্ত শহরটাকে দেখছে। তার আজকের জন্মদিনটাও কি একটু অন্য রকম হতে পারত না? চারদিক রোদ্দুরে ভেসে যেতে পারত, একটা হৈ-চৈ আমোদ আহ্লাদের সাড়া পড়ে যেতে পারত পৃথিবীতে, ঝকঝকে নীল আকাশ ঘোষণা করত বৃষ্টি রায় আজ থেকে সাবালিকা।

আঠেরো বছর বয়স পর্যন্ত বৃষ্টি রায় শুধু মায়ের হেপাজতে থাকবে। আদালতের এই রায়েই কেমন একটা বন্দীজীবন বন্দীজীবন ভাব। বন্দীই তো। একা থাকলেই বৃষ্টি নিজের বন্ধ ঘরে নির্জন সেলের কয়েদী। জানলার মোটা মোটা লোহার গরাদগুলো বলবান পুরুষ প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে পাহারায়। কেন যে সেই লোকটা এমন একটা শাস্তি দিয়েছিল বৃষ্টিকে? লোকটার মুখ চেষ্টা করলেও বৃষ্টি ভুলতে পারে না। মাঝবয়সী গাঁট্টাগোট্টা চেহারা, অনেকটা তাদের পাড়ার কাউন্সিলার সুরেন ভড়ের মত দেখতে। এরই এক কলমের খোঁচায় নাকি টুকরো টুকরো হয়ে যায় মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক। বৃষ্টিরা হয়ে যায় ভাঙা ঘরের শিশু।

সাড়ে ছ’ বছরের বৃষ্টিকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করছে লোকটা;

—তোমার নাম কি মা?

—বৃষ্টি। উহু, শিঞ্জিনী রায়।

—বাহ্, কি মিষ্টি নাম। কোন্ ক্লাসে পড়ো তুমি?

—ক্লাস টু।

—বাহ, তা তুমি কাকে বেশি ভালবাস মামণি? বাবাকে? না মাকে?

—তোমাকে বলব কেন?

—বাহ্, আমাকে তো বলতেই হবে। না হলে আমি জানব কি করে তুমি কার কাছে থাকতে চাও।

বৃষ্টি গুম্।

—বলো মা, কাকে বেশি ভালবাস?

—দুজনকেই।

—কিন্তু তোমার মা বাবা যে এখন থেকে আলাদা আলাদা থাকবে। তুমি কার কাছে থাকতে চাও?

—দুজনের কাছেই।

—কিন্তু লক্ষ্মী মেয়ে, তোমাকে যে দুজনের একজনকে বেছে নিতে হবে। বাবা, কিম্বা মা।

বৃষ্টি সেই মুহূর্তে একটা ছোট্ট চারাগাছ। জীবন্ত কিন্তু অসহায়। প্রচণ্ড ঝড়ের তাণ্ডবে থর থর কাঁপছে।

—আমি কাউকে চাই না, কাউকে না।

দৌড়ে বাইরে এসে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরেছে, বাবা নয়, মা নয়, দাদুর কোমর। দাদুকে আঁকড়ে ধরে আশ্রয় খুঁজছে।

টানা এক বছর বৃষ্টিকে নিয়ে লড়ে গিয়েছিল বৃষ্টির মা বাবা। বৃষ্টিকে নিয়ে লড়াই? না নিজেদের জেদের লড়াই? কী আতঙ্কেই না তখন দিন কেটেছে বৃষ্টির। কোর্ট কেস নিয়ে কেউ আলোচনা করলেই কান খাড়া করে থেকেছে। দাদু যেদিনই তার জন্য বাবল্‌গামের প্যাকেট কিনে এনেছে, দিদা তৈরি করেছে তার প্রিয় এলাচের গন্ধভরা রসগোল্লার পায়েস, সেদিনই বুঝেছে কেসের ডেট্ আছে। কি হবে শেষ পর্যন্ত? আর কি কোনদিন সে বাবাকে দেখতে পাবে? নাকি মাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে চিরদিনের মত?

বোকা। বোকা। কী বোকাই না ছিল তখন। নিজের নির্বুদ্ধিতার কথা ভাবলে এখন নিজের ওপরই রাগ হয় বৃষ্টির। এই রাগটা যদি সবার ওপর ছড়িয়ে দেওয়া যেত! মা, বাবা, ভালমামা, রীতাআন্টি সবাইকে যদি সমঝে দেওয়া যেত একবার!

রীতার নামটা মনে আসতেই দপ করে বৃষ্টির মাথা আরও গরম হয়ে গেল। বাবা তোমাকে বিয়ে করেছে, তোমার সংসার নিয়ে তুমি থাকো, বৃষ্টিকে নিয়ে আদিখ্যেতা করার চেষ্টা কেন? মহিলাকে দেখলেই বৃষ্টির গা জ্বলে যায়। এরই গলা শোনানোর জন্য সকালে টেলিফোনে বাবার কী অনুরোধ উপরোধ!

—বৃষ্টি লক্ষ্মীসোনা, এক সেকেন্ড একটু ধর্। রীতা তোকে বার্থডে উইশ করতে চাইছে।

ভাগ্যিস ঝপ্ করে নামিয়ে দিয়েছিল ফোনটা। নইলে হয়ত ফোনে বাবার পুচকে ছেলেটার গলাও শুনতে হত।

এবার বৃষ্টির রাগ গিয়ে পড়ল বাবার ওপর। বলা নেই, কওয়া নেই, দুম করে গত বছর জন্মদিনে কি আক্কেলে ওই মহিলাকে নিয়ে হাজির হয়েছিল! গোটা সন্ধেটাই তেতো হয়ে গিয়েছিল গতবার। মহিলাকে জব্দ করার জন্য বাবাকে আজ পুরো সন্ধেটাই আটকে রাখতে হবে।

পাশের সিটে এক বিপুলকায় মহিলা ক্রমাগত বৃষ্টিকে ঠেলে ঠেলে নিজের জায়গা বাড়িয়ে চলেছেন। জানলা থেকে মুখ সরিয়ে বৃষ্টি ভদ্রমহিলার দিকে কটমট করে তাকাল,

—ঠিক হয়ে বসুন। আমাকে তো কোণে চিপে ফেলছেন।

মহিলার বয়স বছর পঞ্চাশেক। দেখেই বোঝা যায় নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে খুবই বিব্রত হয়ে থাকেন সব সময়। বৃষ্টির কথার রূঢ়তায় কিছুটা আহত ভাব তাঁর মুখে,

—কি করব বলো? দেখতেই তো পাচ্ছ নিজেই কেমন সিট্ থেকে অর্ধেক বেরিয়ে আছি।

মুখ থেকে প্রায় বেরিয়ে যাচ্ছিল, খেয়ে দেয়ে গায়ে গার্দানে এত বড় শরীরটা তৈরি করার সময় মনে ছিল না? পর মুহূর্তে সামান্য মায়াও হল মহিলার ওপর। অনেকে তো অসুখেও এ রকম মোটা হয়ে যায়। তবে শারীরিক অসহায়তার সুযোগ নিয়ে অন্যের অসুবিধা সৃষ্টি করতে অনেকেই দ্বিধাবোধ করে না। নিজেকে ছাড়া অন্যের সুবিধা অসুবিধা নিয়ে মাথা ঘামাতে চায়ও না চট করে। তার ভালমামাই তো সারাদিন হয় হুইল চেয়ার, নয় খাটে পড়ে আছে। পান থেকে চুন খসলেই চিল চিৎকার। সুধামাসির সঙ্গে কি বিশ্রী ভাষায় কথা বলে একেক সময়। একমাত্র মা’র সামনেই অতটা মেজাজ দেখানোর সাহস পায় না। সাহস পায় না? নাকি সামনেই পায় না মাকে? কতটুকু সময়ই বা। মা বাড়িতে থাকে। সারাদিনই ঘুরছে বাইরে বাইরে। কলেজ, এগজিবিশন, সেমিনার, বন্ধুবান্ধব। আর বাড়ি থাকলে তো হয় মেজাজ, নয় নিজের ইজেল, ক্যানভাস, ব্রাশ, তুলি নিয়েই ধ্যানস্থ। একেক দিন তো সারা রাত ধরে চিলেকোঠার স্টুডিওতে বসে ছবি এঁকে যায়। সে সময় মার সামনে পৃথিবীটারই কোন অস্তিত্ব থাকে না। বিশ্বসংসার ধ্বংস হয়ে গেলেও মা তখন ফিরে তাকাবে না। এমনকি বৃষ্টি মরে গেলেও না।

বৃষ্টির দিদা তখন সদ্য মারা গিয়েছেন। বারো বছরের বৃষ্টি এক বিছানায় শুয়ে। মাঝরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে আঁতকে বিছানায় উঠে বসেছে বাচ্চা মেয়েটা। চোখ টিপে দৌড়েছে পাশের ঘরে। মা নেই। নিঃশ্বাস চেপে, তীর বেগে অন্ধকার টপকে ছুটেছে ছাদের স্টুডিওতে। হাঁপাচ্ছে,

—আমার ভয় করছে।

মা শুনতেও পেল না। টেম্পেরায় কতগুলো বাঁকাচোরা মানুষের মুখ। ফুটিয়ে তুলতে মগ্ন তখন। সাংঘাতিক রাগী মুখ সব। কেউ কেউ ভৌতিক মুখোশ পরা। লাল কালো বেগুনি মুখোশ।

বৃষ্টি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঢোক গিলছে বার বার। তারপর নিঃশব্দ পায়ে নেমে এসেছে সিঁড়ি বেয়ে। সোজা সুধামাসির ঘরে, মেঝেতে পাতা মাদুরের বিছানায়।

—সুধামাসি, ও সুধামাসি…

—কে? কে? কি হয়েছে? সুধামাসি ধড়মড় করে উঠে বসেছে।

—আমি তোমার কাছে শোব।

বৃষ্টির চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। সেই সব দিন কি সে ভুলে যেতে পারে? কি ভাগ্য যে মার মনে আছে আজ তার জন্মদিন। নিজেকে নিয়ে যারা ব্যস্ত থাকে অন্যের কথা ভাবার তাদের সময় কোথায়?

মারা যাওয়ার আগে দিদা প্রায়ই বলত,

—মার ওপর এত অভিমান করিস কেন? সারা দিন ধরে মাকে কত খাটাখাটুনি করতে হয় বল্ তো? সবই তো তোর জন্য।

কচু। যত সব আলগা সান্ত্বনার কথা। বৃষ্টির জন্য কেউ কিছু করেনি কোনদিন। করবেও না। ছোটবেলায় মিছিমিছি কিছু কষ্ট পেয়েছে বৃষ্টি। সারাক্ষণ বোকার মত ভেবেছে কখন মা ফিরবে কাজ থেকে।

আর্ট কলেজে লেকচারারশিপ পাওয়ার আগে ইন্টিরিয়ার ডেকরেশন নিয়ে মা মেতেছিল খুব। নিখিল দত্ত রায়ের সঙ্গে পার্টনারশিপে ব্যবসা। এই একটা অফিস সাজাচ্ছে, ওই একটা শোরুম করছে। সকাল না হতেই নিখিলমামা হৈ হৈ করে হাজির বাড়িতে,

—জয়া, মার্কোনিদের অডারটা পেয়ে গেলাম বুঝলি। ব্যাকসাইডটা যদি মিরর দিয়ে কভার করা যায়, দুপাশেও দেওয়াল জোড়া আয়না, তাহলে দোকানটাকে বেশ ইলংগেটেড্ লাগে।

—বাইরে কয়েকটা মিউরালস্‌ও দেওয়া যেতে পারে। আর ডলফিনের মোটিফটা যদি…

ড্রয়িংরুমের দরজার পাশে তীর্থের কাকের মত দাঁড়িয়ে থাকত বৃষ্টি। কতক্ষণে নিখিলমামার চোখ পড়বে এদিকে, কাজ থামিয়ে চোখ পিটপিট করবে,

—আয় বৃষ্টি ঝেঁপে…

বৃষ্টি সুড়ৎ করে একেবারে নিখিলমামার গায়ের কাছে। তখন থেকেই নিখিলমামার মুখভর্তি দাড়ির জঙ্গল। এত দাড়ি যে চোখ কপাল ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। চুল পর্যন্ত আঁচড়ায় না কখনও।

বৃষ্টি চোখ পাকিয়ে শাসন করত,—আজও তুমি চুল আঁচড়াওনি? সঙ্গে সঙ্গে নিখিলমামা বৃষ্টিকে উঁচু করে তুলে দোলাতে শুরু করত,

—আমায় ক্ষমো হে ক্ষমো…

—নো ক্ষমা। নিলডাউন হও।

—কান ধরে? না, না ধরে?

নিখিলমামা হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ত। তাই দেখে মার কী বিরক্তি, কী বিরক্তি।

—বৃষ্টি এখন যাও তো ঘর থেকে। দেখছ না আমরা কাজের কথা বলছি।

—আহা, থাক্ না একটু। খামোকা বকছিস্ কেন?

—তুই আর ওকে মাথায় তুলিস না তো? ভীষণ অবাধ্য হয়ে যাচ্ছে। কারুর কথা শোনে না। ওইটুকু মেয়ের কী জেদ।

জেদের দেখেছেটা কি? বৃষ্টি বলেই এতদিন সহ্য করে গেছে সব কিছু। আর নয়। আঠেরো বছর বয়স একটা মাইলস্টোন। আজ থেকে জীবনটাকে আমূল বদলে ফেলতে হবে। তাই করবে যা করতে নিজের ইচ্ছে করে। আর কোন ছেলেমানুষি নয়। কোনও উচ্ছ্বাস নয়। মিছিমিছি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলে নিজেকে শুধু খেলো করাই হয়। সকাল থেকেই নিজেকে বদলাতে শুরু করে দিয়েছে। সব পোস্টার খুলে ঢুকিয়ে দিয়েছে খাটের নীচে। মনটা একটু চিনচিন করেছিল; প্রশ্রয় দেয়নি। বেডসাইড টেবিলে এক বছরের বৃষ্টির দারুণ মিষ্টি ছবি ছিল একটা। দুহাত বাড়িয়ে গাবলু গুবলু মেয়েটা কারুর কোলে উঠতে চাইছে। ছবিটাকেও সরিয়ে দিয়েছে চোখের সামনে থেকে।

মেডিকেল কলেজ আর ইউনিভার্সিটির মাঝখানে ট্রামটা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রয়েছে। জানলা দিয়ে মুখ বার করে বৃষ্টি দেখল ট্রামের তার ছিঁড়েছে। একগাদা বাস, গাড়ি জমে গেছে চারপাশে। বৃষ্টি মনে মনে হাসল। আজ যে তার ছিঁড়বে সেটা তো অবধারিত। আজ যে দিনটাই অশুভ। ভাগ্যিস ট্রামের আর কেউ জানে না আজ অপয়া মেয়েটার জন্মদিন বলেই ট্রামটা এখানে এভাবে আটকে গেল!

বৃষ্টি ট্রাম থেকে নেমে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে শুরু করল।

কলেজের গেটের কাছে আসতেই শুভর সঙ্গে দেখা। শুভ বৃষ্টিকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠল,

—আই ব্বাস্, আজ কি ড্রেস দিয়েছ বস্! লুকিং ডেঞ্জারাসলি গরজাস্! মাধুরী দীখ্‌শিতের বাজার ফিনিশড্।

আগুন রঙ রাজকোট শাড়িতে, কপালের লাল টিপে, চুলের বাহারে, অঙ্গে বিভঙ্গে বৃষ্টির এখন মরালীর ভাব। শুভর কথায় অহংকারী স্বর ফোটাল গলায়,

—তুলনা করার আর লোক পেলি না? শেষ পর্যন্ত হিন্দী ফিল্মের হিরোইন?

—কি করব বল্, হলিউডের হিরোইনরা তো আর শাড়ি পরে না। শুভ হাত ওল্টালো, —যাবি নাকি আজকে গ্লোবে? স্ট্যালোনের একটা ভাল বই এসেছে।

বৃষ্টি ঠোঁট টিপে হাসল —সরি, পারলাম না। আজ একটু কাজ আছে।

—কাজ? তোর? ফিল্ম দেখা ছাড়া তোর আর কোন কাজ থাকে নাকি? তোর জন্যই তো এস্‌প্ল্যানেডে ইংলিশ বইগুলো চলে।

—ফালতু বকিস্ না। আমারও কাজ থাকে।

শুভ ফিসফিস করে উঠল—অ্যাপো ট্যাপো আছে নাকি?

বৃষ্টি উত্তর দিল না। মনে মনে বলল, অ্যাপো তো আছেই। বাবার সঙ্গে। শুধু অ্যাপো নয়, বোঝাপড়াও।

.

০৩.

সুবীর মুগ্ধ চোখে দেখছিল মেয়েকে। শাড়ি পরে বৃষ্টি আজ একদম অন্যরকম। প্রথমটা তো দূর থেকে দেখে চিনতেই পারেনি সুবীর। এই বয়সের মেয়েরা হঠাৎ শাড়ি পরলে কেমন সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। একটা সম্পূর্ণ নারী যেন। জীবনের সব রূপ রস বর্ণ গন্ধে ভরা।

অনেক দিন পর গোপন অভিমানটা লম্বা নিঃশ্বাস হয়ে বেরিয়ে এল সুবীরের বুক থেকে। এই মেয়েকে পৃথিবীতে আনতে চায়নি জয়া।

হাল্‌কা সুরে পশ্চিমী সঙ্গীত বেজে চলেছে শৌখিন রেস্তোঁরায়। সন্ধেবেলা পার্ক স্ট্রীটের এই ছোট্ট বিলাসপুরীতে আলো-ছায়ার মায়া। রঙিন আলোর আবছা বিচ্ছুরণ, এয়ারকন্ডিশনারের কৃত্রিম পাহাড়ী শীতলতা, সব মিলে মিশে এক স্বপ্নের পরিবেশ। এত চাপা আলো যে পাশের টেবিলের মানুষগুলোকেও পরিষ্কার বোঝা যায় না। একই ছাদের নীচে, পাশাপাশি থেকেও যে যার মত পৃথক এখানে। অচেনা।

সুবীর মেন্যুকার্ড এগিয়ে দিল বৃষ্টির দিকে।

—মেন্যুকার্ড কি হবে? বলো না যা হোক কিছু।

সুবীরের এতক্ষণে খটকা লাগল। এত চুপচাপ কেন মেয়ে? গাড়িতে আসতে আসতেও কথাবার্তা বলেনি বিশেষ। সুবীরের কথার উত্তরে হুঁ হাঁ করে গেছে মাত্র। এখনও স্বর যথেষ্ট নিরুত্তাপ। অথচ অন্যান্য দিন খেতে ঢুকে বৃষ্টিই আগে মেন্যুকার্ড পড়তে শুরু করে দেয়। হঠাৎ হঠাৎ কোন অদ্ভুত খাবারের নাম বার করে জিজ্ঞাসা করে,

—আজ এটা ট্রাই করলে কেমন হয় বাবা? বেকড্ অ্যাভোক্যাডো উইথ্ ক্র্যাব্? স্যালাড নিকয়েস খাবে? হোয়াইটিং বার্সি?

সব সময় নতুন কিছু খুঁজে বার করার চেষ্টা। আগে আগে সুবরও মেয়ের সঙ্গে মেন্যুকার্ড পড়ে যেত সমান তালে। আজকাল আর সবসময় তাল রাখতে পারে না।

—সিজ্‌লার খাবি? উইথ কাশ্মিরী নান্?

বৃষ্টি কাঁধ ঝাঁকাল, যার অর্থ হ্যাঁ’ও হয়, না’ও হয়। যেন কোন খাবারেই আজ তেমন আসক্তি নেই তার।

ওয়েটারকে নিচু গলায় খাবার অর্ডার দিয়ে মেয়ের মুখোমুখি হল সুবীর,

—কি হয়েছে রে তোর? মন খারাপ? আজকের দিনে আমার ছোট্ট সুন্দর গুড়িয়াটা এত গ্লুমি কেন?

—কিছু হয়নি তো।

বৃষ্টির মুখে হাসি হাসি ভাব ফুটল; হাসল না,

—তুমি ট্যুরে যাবে বলছিলে না? কবে যাচ্ছ?

—দেখি। নেক্সট্ উইকে যেতে পারি।

—কদ্দিনের জন্য?

—এবার গেলে দিন পনেরো তো বটেই। কম্পানি নতুন ব্রাঞ্চ খুলছে ফরিদাবাদে।

—ও।

নিজের মনে নেলপালিশের রঙ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল বৃষ্টি। সুবীর বুঝতে পারল তার ট্যুরে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে মোটেই তেমন আগ্রহী নয় মেয়ে। নেহাত কথা বলার জন্যই প্রশ্ন। হলটা কি! গত বছরের জন্মদিনের রাগটা কি এখনও পুষে রেখেছে মনে?

সুবীর মেয়েকে খোশামোদ করতে গেল,

—আজ তুই দুপুরে এলি না কেন? কাল আমি অফিসের সবাইকে বলে রেখেছিলাম, আজ থেকে আমার মেয়ে অ্যাডাল্ট হচ্ছে, শী ডিজার্ভস্ এ ফুল ডেজ কম্পানি উইথ্ মি।

বৃষ্টি সুবীরের দিকে তাকালই না। ভীষণ মনযোগ দিয়ে হাতের নখ দেখেই চলেছে।

—বাড়িতে আজ কোন প্রোগ্রাম নেই তো? চল্, আজ তাহলে তোকে নিয়ে গোটা কলকাতাটা চক্কর দিয়ে ফেলি।

পাশের টেবিলে পুতুলের মত একটা বাচ্চা বাবা মা’র মাঝখানে বসে স্যুপ খাচ্ছে। মা চামচে করে তুলে দিচ্ছে মুখে, বাবা রুমালে মুখ মুছিয়ে দিল। বৃষ্টির চোখ আঙুল থেকে উঠে সেদিকে স্থির। স্থির চোখেই বলে উঠল,

—আমাকে নিয়ে যতক্ষণ খুশি ঘুরবে? রীতাআন্টিকে বলে এসেছ তো?

সুবীরের আদর মাখানো হাসি ভরা মুখে একটা পিন বিঁধে গেল যেন। কথাটা কি বৃষ্টি সরল ভাবে বলল? না ইচ্ছে করে আঘাত করার জন্য? সুবীর ধরতে পারল না। ইদানীং সব সময় সব জায়গায় ঠিক ঠিক মাথাও কাজ করে না। দিন রাত সহস্র সমস্যা ঘুরছে মস্তিষ্কে। অফিসে এম ডি সর্বদা কাঁটার ওপর দিয়ে দৌড় করাচ্ছে। বাজার ডাল্ বলে আমাদের বসে থাকলে চলবে রায়? রিসেশান থাকবেই। কম্পানিকেও তো থাকতে হবে। ডু সামথিং রায়। অবিরাম পাগলাঘণ্টির মত বেজে চলেছে এম ডির বাণী…তোমার মত এফিশিয়েন্ট মার্কেটিং ম্যানেজার…! কি করবে সুবীর? আবার কাঁধে প্রোডাক্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়বে রাস্তায়? একুশ বছরের সুবীরের মত? যে কিনা ন্যায়রত্ন লেনের অন্ধ কুঠুরি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বাবা মা দাদা কারুর কথা ভাবেনি? পরোয়া করেনি ঠুনকো বংশমর্যাদার? অনামী কম্পানির আলতা সিঁদুর ফিরি করা থেকে শুরু করে আজ পৌঁছেছে মাল্টিন্যাশনাল কম্পানির মার্কেটিং ম্যানেজারে? এখন চব্বিশ ঘণ্টা মাথার ভেতর শুধুই টার্গেট, মান্থলি প্রোজেকশন, রিসেশান…। এরই সঙ্গে রক্তচাপ ওঠা নামা করার মত দিনভর মাথা বেয়ে উঠছে নামছে শেয়ারের দর। কখনও দুচার হাজার আসে না তা নয় কিন্তু চাপা উত্তেজনা ঘুসঘুসে জ্বরের মত শরীর ছেয়ে থাকে সর্বক্ষণ। অফিস থেকে মাঝে মাঝেই ডায়াল ঘোরায়,

—হ্যালো মিত্তালজি, আভি হাল কেয়া হ্যায়?

—ঠিক হ্যায়। প্রাইস্ ইজ সোরিং আপ্।

একটু রিলিফ্। একটুই। এর পরই হয়ত এম ডির ডাক, ডু সামথিং রায়। বাড়িতেও ঠিক মত সময় দিতে পারে না। রীতা অনুযোগ করে,

—একটা দিনও কি তুমি আমাদের সঙ্গে থাকতে পারো না? ছুটির দিনেও এত কিসের কাজ তোমার?

সুবীর করবেটা কি? প্যাডকে চলে এলে ঘোড়াকে ছুটতেই হয়। জকিই ছুটিয়ে নিয়ে চলে।

তার মধ্যেও কখনও একটু জিরোতে পারলে, সামনে বসে থাকা মেয়েটা বুকের ভেতর বিব্ বিব্ করে বেজে ওঠে। নিজের সঙ্গে একা হলেই বৃষ্টি এসে ঘোরাফেরা করতে শুরু করে সুবীরের মনে। দু বছরের দামাল পায়ে হাঁটা বৃষ্টি, পাঁচ বছরের অবিরাম পাকা পাকা কথা বলে যাওয়া বৃষ্টি, সাত বছরের ঠোঁট ফোলানো অভিমানী বৃষ্টি, বারো বছরের আহত চোখে তাকিয়ে থাকা বৃষ্টি, নানান বয়সের বৃষ্টিরা এসে তালগোল পাকিয়ে দিতে থাকে সব কিছু। ভীষণ ভাল লাগাতে বুক থৈ থৈ করে ওঠে। তার সঙ্গে একটা যন্ত্রণাও কুরে কুরে খেতে থাকে সুবীরকে। গোপন এক রক্তক্ষরণের যন্ত্রণা। সব বাবারই কি এমন হয়? নাকি সুবীরের মত বাবাদেরই শুধু?

জয়া নিষ্ঠুরভাবে কেড়ে নিয়ে গেল মেয়েটাকে। প্রিয় সম্পদ হারিয়ে ফেলার পর তার অভাব দ্বিগুণ চতুর্গুণ হয়ে বাজতে থাকে বুকে। প্রথম প্রথম তাও এই অভাবটাকে অনুভব করতে সময় লেগেছিল কিছুদিন। তখনও একটা জেদ, একটা অসহ্য রাগ, পরাজয়ের অপমান সুবীরকে আবিষ্ট করে রেখেছিল। নিস্ফল ক্রোধে বুনো ষাঁড়ের মত লণ্ডভণ্ড করে দিতে ইচ্ছে করত বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড। তবে রাগের আয়ু আর কতদিন? সময়ের নিয়মে ধীরে ধীরে শান্ত হয়েছিল সুবীর। তখনই অভাববোধটা প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয় তাকে। একটা মানুষ সারাদিন পর খেটেখুটে বাড়ি ফিরছে, কেউ তার জন্য কোথ্‌থাও অপেক্ষা করে নেই, এই চিন্তায় নিঃসঙ্গ মানুষ নিঃসঙ্গতর হয়। সেই সময়ই রীতাকে না পেলে…। রীতাকে বিয়ে করার আগে লক্ষবার ভেবেছে সুবীর। আবার ভুল হচ্ছে না তো?

বৃষ্টির দিকে সুবীর নিষ্পলক তাকিয়ে রইল। পুরনো সেলস্‌ম্যানটা মনে মনে কথা সাজিয়ে নিচ্ছে।

মেয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অন্য দিকে। এদিক ওদিকের লোকজন দেখছে।

সুবীর টেবিলের সামনে ঝুঁকল,

—রীতা আজ তোকে একবার নিয়ে যেতে বলেছিল; যাবি, চকিতে মুখ ফিরিয়েছে বৃষ্টি,

—কেন?

—বারে, জন্মদিনে একবার বাড়িতে যাবি না? তোর ভাইটারও তো দিদিকে একটু দেখতে ইচ্ছে করে।

—ভাই ভাই করছ কেন? আমার কোন ভাই টাই নেই।

বৃষ্টির ফর্সা মুখ পলকে থমথমে লাল। রাগ, দুঃখ, অভিমান বড় সহজেই তার মুখে ছাপ ফেলে দেয়।

সুবীর বুঝল কথাটা বলা ঠিক হয়নি। বৃষ্টি রীতা রাজাকে এখনও মেনে নিতে পারেনি। তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ বদলে নিল,

—জন্মদিনে কি নিবি বল্? ক্যামেরা? ফরেন রিস্টওয়াচ্? পারফিউম? বৃষ্টি সন্ন্যাসিনীর মত নির্লিপ্ত,

—দিও যা হোক কিছু।

মেয়ের কথার ভঙ্গিতে হঠাৎ ধৈর্য হারাল সুবীর। কি এমন অপরাধ করেছে সে? নিজের ইচ্ছে মত জীবন বেছে নেওয়ার স্বাধীনতাও তার থাকবে না?

—ওভাবে কথা বলছিস্ কেন? কোন দিন কি দিইনি তোকে? যখন যা চেয়েছিস তাই দিয়েছি। জার্মান টেপ, জাপানি ওয়াকম্যান, ফ্রেঞ্চ পারফিউম, ইটালিয়ান সিল্কের ড্রেস মেটিরিয়াল…

বৃষ্টি দমল না,

—সে তো ঘুষ দিয়েছ।

—ঘুষ!

—নয় তো কি? বৃষ্টির গলা বরফের ছুরির মত ধারালো,

—তুমি দিয়েছ, মা দিয়েছে…। দেবে নাই বা কেন? নিজেদের সুখটুকু বজায় রেখে বৃষ্টিকে ভালবাসতে গেলে তার মাসুল দিতে হবে না? দশ টাকা চাইলে তখখুনি একশ টাকা বার করে দাও, ভাবো কিছু বুঝি না?

সুবীর স্তম্ভিত। এই কি তার সেই আদরের ছোট্ট গুড়িয়া! বার্বিডল আর আইসক্রিম পেলে যে বাবাকে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিত! মেয়ের ঔদ্ধত্য দেখে ভেতরে ভেতরে রাগ হলেও কিছুতেই তেমনভাবে রাগতে পারল না সুবীর। রাগের সঙ্গে একটা চাপা ভয়ও আঁচড় টানছে বুকে। বৃষ্টি যে তার দুর্বলতম জায়গা। গলাটাকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করল,

—খুব রাগ করে আছিস্ মনে হচ্ছে? বোকা মেয়ে, বাবা মার উপহার কি কখনও ঘুষ হতে পারে? ছাড়, ও সব কথা। আজ তুই কি নিবি বল্। আজ তুই যা চাইবি, তাই দেব।

মেয়ে এবার একটু গলেছে,

—যা চাইব তাই দেবে?

—চেয়ে তো দ্যাখ্। সুবীরের গলা মায়ায় ভরে এল।

কি একটা কথা বলতে চেয়েও বলতে পারছে না বৃষ্টি। চোখ বন্ধ করে ঠোঁট কামড়ে ধরল। ঢোঁক গিলল ঘন ঘন। তারপর দুম করে বলে ফেলেছে,

—যদি বলি তোমাকে চাই?

সুবীর হেসে ফেলল। মেয়ের পলকে রাগ, পলকে আবদার। সুবীরের কাছেই।

—পাগলি কোথাকার। আমাকে আবার চাওয়ার কি আছে? আমি তো আছিই।

—এভাবে নয়। বৃষ্টি এবার স্পষ্টভাবে কেটে কেটে বলছে কথাগুলো,

—অন্য কারুর সঙ্গে শেয়ার করে নয়। আমি এখন অ্যাডাল্ট। ইচ্ছে করলে মার কাছে না থেকে তোমার সঙ্গেও থাকতে পারি। শুধুই আমরা দুজন।

চূড়ান্ত ধাক্কাটাতে সুবীরের মুখ নিমেষে রক্তশূন্য। মুখ থেকে প্রায় বেরিয়ে যাচ্ছিল, তা কি করে হয়? ঝানু মার্কেটিং ম্যানেজার সুবীর রায় দ্রুত গিলে ফেলেছে কথাটা। মুখে হাসি ফোটাতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে হল। সামনের মেয়েটা যেন এতদিনকার চেনা বৃষ্টি নয়, অন্য কোন বৃষ্টি, যার বীজ বোনা হয়েছিল প্রায় এক যুগ আগে, কোর্টরুমে, যে সম্ভবত ভূমিষ্ঠ হয়েছে আজই, সে এ কোন খেলায় মেতে উঠতে চাইছে? সুবীরকে কি যাচাই করতে চায় সুবীরের মেয়ে?

ওয়েটার খাবার নিয়ে এসেছে। সামান্য স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারল সুবীর। গরম তাওয়া বসিয়ে দিয়ে গেছে দুজনের মাঝখানে। শব্দ করে ধোঁয়া উঠছে।

বৃষ্টি প্রশ্ন করল, —কি হল? কিছু বললে না যে?

—হুঁ…দেখছি…তুই যখন বলছিস্..সুবীর মেয়ের প্লেটে নান্ তুলে দিল,

—নে, খেয়ে নে তো আগে। পরে কথা হবে।

সিজলার কেটে মুখে পুরল বৃষ্টি। আয়েস করে চিবোচ্ছে মাংসটা। টেরচা চোখে তাকিয়ে আছে সুবীরের দিকে। সুবীরের মনে হল, মাংস নয়, মেয়ে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে তারই অস্বস্তিটুকু।

মাথা নামিয়ে সুবীর খাবারে মন দেওয়ার চেষ্টা করল। বৃষ্টির চোখ দুটো কী অসম্ভব তীক্ষ্ণ। সুবীর বুঝি ধরা পড়ে যাচ্ছে। একটা দৃশ্য পলকে চোখের সামনে দুলে উঠল সুবীরের।

…একজন চব্বিশ বছরের যুবক পার্ক স্ট্রিটের পরিত্যক্ত কবরখানায়, ভাঙা বেদির ওপর বসে, গোগ্রাসে মুড়ি চিবোচ্ছে। চারদিকে ঘন গাছপালা আর ঝোপঝাড়ের মাঝে দুশো বছর আগের অসংখ্য কবর। গাছগাছালি কাঁপিয়ে মাঝে মাঝেই চৈত্রের বাতাস উঠছে এলোমেলো। পাতায় পাতায় শন্ শন্ শব্দ বাজছে। যুবকটি মুড়ি খেতে খেতে আড়চোখে দেখে নিচ্ছিল আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে থাকা তরুণ তরুণীদের। কেউ তার দিকে তাকাচ্ছে না তো! দেখতে দেখতেই চোখ আটকেছে রাধাচূড়া গাছের নীচে বসে থাকা শ্যামলা রঙ মেয়েটির দিকে। মেয়েটির চোখ দুটো খুব উজ্জ্বল, ঘন! সামান্য লম্বাটে মুখ। নাক খুব তীক্ষ্ণ নয়। ঠোঁটের কাছটা অল্প উঁচু। সব মিলিয়ে একটা মায়াজড়ানো ভাব। হাঁটু মুড়ে বসে থাকার জন্য উচ্চতা আন্দাজ করা যাচ্ছিল না; খুব একটা লম্বা নয়। যুবক লক্ষ করল মেয়েটি ছবি আঁকতে আঁকতে ফিরে ফিরে তার দিকেই তাকাচ্ছে। চোখ দেখে মনে হয় সে যেন এই জগতেই নেই। একবার করে যুবককে দেখেই নিজের স্কেচ-বুকে ডুবে যাচ্ছে। যুবক চকিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট। মেয়েটি তাকেই স্কেচ্ করছে নাকি? উঠে দাঁড়াতেই মেয়েটির আত্মমগ্নতা কেটে গেছে। মুখে অপ্রস্তুত হাসি। যুবক সোজা এগিয়ে গেল। একেবারে সামনে গিয়ে ঝুঁকেছে স্কেচ্ বুকের ওপর। হ্যাঁ, সেই তো! জুতোশুদ্ধ পা ছড়ানো, গলায় টাই, নিভাঁজ শার্ট প্যান্টের ক্রিজ্, পাশে ব্রিফ কেসটা পর্যন্ত পড়ে আছে। শুধু মুখটাই তার নয়, কোন ভিখিরির যেন। ঠোঙায় মুখ ডুবিয়ে গোগ্রাসে মুড়ি খাচ্ছে। ভিখিরির দু চোখে বিশ্ব গিলে ফেলার খিদে। …

নিজের ভেতর সুবীর আজও স্পষ্ট দেখতে পায় সেই ধোপদুরস্ত ভিখিরির স্কেচটাকে।

জয়া কি করে যে প্রথম দিনই সুবীরের আসল চেহারাটা ধরে ফেলেছিল?

জয়া বড় বেশি দেখে ফেলেছিল তাকে।

জয়ার চোখের সঙ্গে বৃষ্টির চোখের এত মিল!

বৃষ্টি আবার জিজ্ঞাসা করল, —চুপ করে গেলে কেন? কি ঠিক করলে?

—দাঁড়া, একটু তো সময় দিবি। সুবীর ঢোঁক গিলল।

বৃষ্টির মুখে তবু মরিয়া ভাব। যেন একটা দ্ব্যর্থহীন উত্তর ছাড়া সুবীরকে সে কিছুতেই ছাড়বে না।

—তবু কদ্দিন?

—অন্তত দু এক মাস। যা মুখে এল বলে ফেলল সুবীর। চকিতে উল্টো প্রশ্ন এসে গেল মাথায়, —তুই আমার সঙ্গে থাকতে চাইছিস কেন? মার সঙ্গে কিছু হয়েছে?

—নাআ।

—তোর মা জানে, তুই আমার সঙ্গে থাকতে চাস্?

না।

—তবে?

—তবে আবার কি? আমি এটাই চাই।

—তোর মা আপত্তি করতে পারে…

হু কেয়ারস্।

—দুঃখ পেতে পারে?

বৃষ্টি ফিক করে হেসে ফেলল।

—মার কথা ছাড়ো। তোমার অসুবিধে আছে?

কোন উত্তর না দিয়ে করুণ মুখে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইল বৃষ্টির বাবা। বৃষ্টি বিন্দুমাত্র নরম হল না,—মার দুঃখ কষ্ট নিয়ে তোমার খুব ভাবনা, তাই না?

বিদ্রূপটা তীক্ষ্ণ ফলার মত বিঁধল সুবীরকে। শেষ চেষ্টা করল তবুও,

—ওভাবে নিচ্ছিস কেন? ছোট থেকে তুই মার সঙ্গে রয়েছিস, একটা এতদিনের অ্যাটাচমেন্ট, তুই চলে এলে কষ্ট পাবে না?

বৃষ্টি ন্যাপকিনে হাত মুছে নিল ভাল করে, —আমি কি চাই, আমি তোমাকে বলে দিলাম। এখন তুমি কি করতে পারবে সেটা তোমার ব্যাপার।

সুবীরের মনে হল এই মুহূর্তে তার চারপাশটা বড় বেশি অন্ধকার। নিজের মেয়ের মুখটাও ভালভাবে দেখতে পাচ্ছে না সে। আন্দাজে হাত নেড়ে শুধু ওয়েটারকে ডাকতে পারল সুবীর।

.

০৪.

…..দাস্ দা ফ্রেঞ্চ রেভল্যুশন হ্যাড ডিফারেন্ট স্টেজেস্। ফার্স্টলি ইট ওয়াজ অ্যান অ্যারিস্টোক্র্যাটিক মুভমেন্ট লেড বাই দা…

একটানা ভরাট গলায় লেকচার দিয়ে চলেছেন পি কে সি। লেকচারটা বৃষ্টিকে এক অন্য জগতে নিয়ে চলে যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপ, সেখানকার দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, কামনাবাসনা ভরা সে এক অন্ধকার সময়। একটা যুগ চলে যাচ্ছে, আরেকটা যুগ আসছে। মাঝের সময়টা বড় নিষ্ঠুর। যুগ পরিবর্তনের ধারাই এরকম।

শুনতে শুনতে বৃষ্টির ডিকেন্সের উপন্যাসটার কথা মনে পড়ে যায়। …দোজ ওয়্যার দা বেস্ট অফ টাইমস, দোজ ওয়্যার দা ওয়ার্স্ট অফ টাইমস… মানুষের হিংস্রতা, ক্রূরতা, অব্যক্ত ভালবাসা, মহত্ত্ব….

দেবাদিত্য কিছুতেই বৃষ্টিকে শান্তিতে তার এই প্রিয় ক্লাসটা শুনতে দেয় না। পিছন থেকে অবিরাম ফিসফিস করে চলেছে। কি না বলছে বৃষ্টিকে! মিনার্ভা, এথেনা, ঊর্বশী। বৃষ্টি বারকয়েক কটমট করে পিছন ঘুরে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে মুখ নামিয়ে নিচ্ছে। মাথা নিচু করে নোট নেওয়ার ভান করছে। পেন বন্ধ করেই।

বৃষ্টি আবার সামনে তাকাল। পি কে সি ছড়ানো লেকচার গোটাতে শুরু করেছেন। পিরিয়ড শেষ হয়ে এল।

….বুর্জোয়াজি এবং পুরোহিত সম্প্রদায় তৎকালীন ফ্রান্সের কৃষকদের নিকট বিশেষভাবে ঋণী ছিলেন…

পি কে সির কথা বলার ভঙ্গির সঙ্গে কার যেন খুব মিল! ভালমামার! এক একদিন মনমেজাজ ভাল থাকলে ভালমামা এভাবেই সুন্দর করে ইতিহাসের কথা শোনায় বৃষ্টিকে। সে সব দিন যদিও এখন বিরল। ভালমামার জীবনে দুর্ঘটনাটা না ঘটলে ভালমামাও পি কে সি হতে পারত। ডিগ্রি ছাড়াই হিস্ট্রি, ফিলজফি, পলিটিক্সের ওপর যা দখল। সারাদিনই মোটা মোটা বই ঘাঁটাঘাটি করছে। বৃষ্টির বুকটা টনটন করে উঠল। কি মরতে যে ভালমামা কলেজ স্ট্রীটে এসেছিল কোন এক উগ্রপন্থী নেতার বক্তৃতা শুনতে! তখন নাকি বেশিরভাগ কমবয়সী ছেলেমেয়েদেরই রক্ত বিপ্লবের নামে চনমন করে উঠত। বিপ্লব তো হয়েছে ছাই। মাঝখান থেকে ভালমামার জীবনটাই বরবাদ হয়ে গেল। কেউ কেউ বোধহয় এভাবেই ছিটকে যায় স্বাভাবিক জীবন থেকে।

ঘণ্টা পড়েছে। পি কে সি ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতেই দেবাদিত্যর দিকে ঘুরে দাঁড়াল বৃষ্টি,

—তুই কি রে? একটা দিনও পি কে সির লেকচার মন দিয়ে শুনতে দিবি না?

দেবাদিত্যর মুখে নকল গাম্ভীর্য—তুই পি কে সির ক্লাস শুনিস?

—তো কি করি?

—খালি তো ওই মুখটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকিস? কেন রে? আমরা নেই? আমাদের দিকে তাকাতে পারিস না?

দেবাদিত্যটা এরকমই বিশ্ব ফাজিল। সারাক্ষণ হ্যা হ্যা করে বেড়াচ্ছে। কলেজের যে কোন জায়গায়, পাঁচ সাতটা মেয়ের জটলায় একটা ছেলে দেখলে দূর থেকেও বলে দেওয়া যাবে ওটাই দেবাদিত্য। সব সময় সখী পরিবৃত। বৃষ্টি ভাবতেই পারে না যে ছেলের বাবা মারা গেছে আট বছর বয়সে, মা চোদ্দ বছরে, মানুষ হচ্ছে কাকার কাছে, সে কাকাও নাকি এমন কিছু রাজার হালে রাখে না ভাইপোকে, সেই ছেলের এত লাইফ ফোর্স আসে কোত্থেকে?

তৃষিতা একদিন বলছিল,—দেবাদিত্যর ব্যাপারই আলাদা। ওর পাঁচটা ফুসফুস আছে। একেকটা ফুসফুস একেকটা মেয়ের জন্য রিজার্ভড। একসঙ্গে ও পাঁচটা মেয়ের জন্য প্রাণ দিয়ে দিতে পারে। ফুসফুসগুলোর নেচারও আলাদা আলাদা। শান্ত নরম মেয়ের জন্য শান্ত নরম ফুসফুস, এই ধর বালিহাস টালিহাঁস টাইপের, উদ্দাম বন্য মেয়ের জন্য একটা নেপোলিয়ানিক ফুসফুস, ফাজলামির জন্য মোল্লা নাসিরুদ্দিনের…

পরভিন প্রশ্ন করেছিল,—আর ওই যে ইনা বলে মেয়েটার সঙ্গে ঘোরে, যাদবপুরে জিওলজি না কি পড়ে, মেয়েটার তো হেভি ফান্ডা…ওর জন্য? মীনাক্ষী বলে উঠেছিল,—ওর জন্য একটা বিক্রমাদিত্যের ফুসফুস আছে। সেই ফুসফুসের কিছুটা সেডিমেন্টারি রক, কিছুটা গ্রানাইট। নইলে জিওলজির সঙ্গে খাপ খাবে কি করে?

রণজয় বলেছিল,—আসলে চার পাঁচটা ফুসফুসের কমে ও বাঁচবেও না। যা বীভৎস জায়গায় থাকে! একদিন ওর বাড়ি গিয়েছিলাম…প্রথমে তো কিছুতেই নিয়ে যাবে না, ট্যাণ্ডাই ম্যাণ্ডাই করছে…তারপর সে কি গলি! গলির পর গলি, তস্য গলি, জীবনে কোনদিন সেসব জায়গায় রোদ্দুর ঢোকে না, স্কটিশচার্চ স্কুলের পেছনে, বিশ্রী চাপা দুর্গন্ধ, ভ্যাটে নোংরা পচে আছে, জাস্ট মনে মনে হেল ভিশুয়ালাইজ কর, তা হলেই বুঝে যাবি। ওখানে থাকতে গেলে দুটোর বেশি ফুসফুস লাগবেই, নইলে টিবি হয়ে মরতে হবে। তার ওপর ওর কাকিটার যা পচা মেজাজ…

বৃষ্টি চুপ করে শুনছিল। ওরকম অন্ধকার স্যাঁতসেতে গলির বাড়িগুলো কেমন হয় সে জানে। তার ঠাকুর্দা ঠাকুমাই তো থাকে ওরকম বাড়িতে। খুব ছোটতে মাঝে মাঝে বাবার সঙ্গে গিয়েছে সে। দাদু, ঠাকুমা, জেঠু, জেঠি বাদে আর সবাই কেমন মিন টাইপের। মানে বাবার জ্যাঠা কাকার দল। হঠাৎ হঠাৎ অন্ধকার ঘুপচি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কি জেরাই না করত।

—তুই সুবুর মেয়ে?

বৃষ্টি ভয়ে ভয়ে বলত,—হুঁ।

—তুই তো সুবুর কাছে থাকিস না, তাই না?

বৃষ্টি রা কাড়ত না।

—তোর মা চাকরি বাকরি করছে?

বৃষ্টি গম্ভীর হয়ে যেত,—মা এখন বিজনেস করে। নিখিলমামার সঙ্গে।

শুনে টাকমাথা লুঙ্গিপরা বাবার জাড়তুতো দাদাটার কি খ্যা খ্যা হাসি। ঘরে ঢুকে জোরে জোরে বউকে বলত,— অনু, সুবুর মেয়ের কথা শুনেছ? ওর মা নাকি এখন বিজনেসে নেমেছে।

বৃষ্টি তখন হাসিটার অর্থ বুঝতে পারেনি। বাবাকে বলেছিল, মা বিজনেস করে শুনে ওরা অত হাসাহাসি করছে কেন?

বাবা বলেছিল,—ওদিকে যেতে হবে না। ঠাকুমার কাছে যা।

ওরকম দম চাপা শ্যাওলাধরা বাড়িতে থাকলে মনটাও বোধ হয় ছোট হয়ে যায়। দেবাদিত্যর কাকি নাকি রণজয়কে শুনিয়েই বলে উঠেছিল,

—বন্ধুবান্ধবের চা বিস্কুটের পয়সা কি তোমার বাবা ধরে দিয়ে গেছে?

দেবাদিত্য হাতের মুদ্রায় বোঝাতে চেয়েছিল, কাকি পাগল।

বেচারা। বৃষ্টির দেবাদিত্যর ওপর মায়া হয়েছিল খুব। ওরকম একটা সংসারে আরশোলা টিকটিকির মত থাকতে হয়, বাবা মা কেউ নেই। থাকলেও কি খুব ভাল হত? কে জানে?

হাতের ব্যাগ দিয়ে দেবাদিত্যর পিঠে ঠোক্কর দিল বৃষ্টি, —তোর দিকে তাকাতে যাব কেন রে? নিজের মুখ কখনও আয়নায় দেখেছিস?

সঙ্গে সঙ্গে ফাজিল ছেলেটা একেবারে কাছে এসে বৃষ্টির চোখে চোখ রেখেছে,—দেখেছি। তোদের চোখের আয়নায়। চপ খাওয়াবি?

বৃষ্টি হেসে ফেলল। এমন মজার কথা বলে দেবাদিত্য! তার কলেজের বন্ধুগুলো স্কুলের বন্ধুদের থেকে এত আলাদা। নিষেধের কাঁটাতার তুলতে চাইলেও হেঁচকা টানে সেটাকে উপড়ে দেবে এই সব বন্ধুরা। টাটকা বাতাসের ধাক্কায় বৃষ্টির মনে একটু আগেও জমে থাকা মেঘটা উধাও।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে রনিদের বাড়ির সামনে আসতেই মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল বৃষ্টির। কী তুমুল চিৎকার, তর্জনগর্জন! রনির মা বাবা অশ্রাব্য ভাষায় খিস্তিখেউড় করছিলেন পরস্পরকে। এমন চেঁচামেচি যে বাইরেও লোক দাঁড়িয়ে গেছে দু একটা।

এমনিতে বৃষ্টিদের পাড়ায় অন্যের বাড়িতে সচরাচর উঁকি দেয় না কেউ। আধুনিক সভ্যতার নিয়ম মেনে প্রতিটি বাড়ি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে উদাসীন স্ত্রীটলাইটের মত। কখনও কখনও একটা বাতি নিভু নিভু হলে অন্যের আলো এসে পড়ে তার ওপর। সৌজন্যের। তার বেশি কিছু করা এসব পাড়ায় প্রাচীন গ্রাম্যতা বলে মনে করা হয়। কৌতূহল এখানে ভীষণ চাপা। চাকরবাহী। তবে কলহের মাত্রা বস্তির পর্যায়ে নামলে একটু চাঞ্চল্য তো জাগবেই।

মোড়ের মাথায় পিকলু টুকুনকে দেখে বৃষ্টি জিজ্ঞাসা করেছিল, —কি ব্যাপার রে? সাতসকালে ষাঁড়ের মত চেল্লাচ্ছে কেন দুজনে?

পিকলু বলে উঠেছিল, —রনির বাবা মাসের দু সপ্তা যেতেই সব টাকা ঘোড়ার পেছনে ঢেলে আসে; কোন বউ সহ্য করবে?

টুকুন বলল, —বাজে বকিস না। রনির মার বাতিক আছে। রনির বাপটাকে সবসময় এমন সন্দেহ করে…ভাষা শুনেছিস? দিনের পর দিন রনিটা কি করে যে বরদাস্ত করে!

কি ব্যাপার কে জানে কিন্তু মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের কি শুধু এই পরিণতি? রনির মা কী ভালই না বাসতেন বৃষ্টিকে ছোটবেলায়। একবার সরস্বতী পুজোর দিন রাস্তার মাঝখানে বৃষ্টির শাড়িটাড়ি খুলে বিদিকিচ্ছিরি অবস্থা। মাসিমা কী যত্ন করে কুঁচি দিয়ে পরিয়ে দিয়েছিলেন। রনির সঙ্গে খেলতে গিয়ে ঝগড়া হলে সব দোষ রনির। বৃষ্টি খুব লক্ষী মেয়ে। রনির জন্মদিনে কী সুন্দর হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান শোনাতেন। সেই মাসিমা ওরকম নোংরা ভাষায়….!

দেবাদিত্য আবার খোঁচাচ্ছে বৃষ্টিকে,

—এই বৃষ্টি, খাওয়া না মাইরি। অতগুলো স্কলারশিপের টাকা ড্র করলি…

—অ্যাই না। তৃষিতা পিছন থেকে গলা ওঠাল—বৃষ্টি কদিন ধরে যা ড্রেস মারছে, ক্যান্টিনে ওর নো অ্যাডমিশান হয়ে গেছে। গেলেই হাইজ্যাকড। আর তোরাও সব এমন কিছু মেডিভাল নাইট নো’স যে ওকে উদ্ধার করে আনতে পারবি।

কালো লঙস্কার্টের ওপর মিশকালো টপে বৃষ্টি আজ ভিক্টোরিয়ার পরী। কালো রঙই তার সব থেকে প্রিয়।

নাইটদের নাম শুনে শুভ ফিচেল হাসি হাসল,—নাইটরা কি শুধু মেয়েদের উদ্ধারই করত রে? চেস্টিটি বেল্টের গল্প জানিস না? সেই ক্রুসেড লড়তে যাওয়ার সময় নাইটরা বউদের চেস্টিটি বেল্ট পরিয়ে তালাচাবি লাগিয়ে দিয়ে যেত। অন্য নাইটদের ভয়ে। তার মানে বুঝলি তো? নাইটমাত্রই সাধুসন্ত নয়। আমরা যদি সেরকম নাইট হই সেটা কি ভাল হবে? তা বস্, রোজ রোজ তোমার এরকম খুনখারাবি ড্রেসই বা কেন? এনিথিং ঢুকুটুকু?

দেবাদিত্য বৃষ্টির হাত ধরে টানল,—ঢুকুটুকু কেন? ওপেন। আমার সঙ্গে। চল্ তো বৃষ্টি আমরা নিমতলায় যাই।

কলেজ ক্যান্টিনে ঢুকতে গেলেই প্রথম যে অনুভূতির সম্মুখীন হতে হয় সেটা হল অন্ধকার। তারপর মোহনদার উনুন আর অজস্র সিগারেটের ধোঁয়া মিলেমিশে একটা পোড়া পোড়া গন্ধ। একসময়ের সাদা দেওয়াল বিবর্ণ বাদামী। এটাই দেবাদিত্যর নিমতলা।

প্রথম প্রথম এখানে ঢুকতে বৃষ্টির নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসত। চোখমুখ জ্বালা করত। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।

সুদেষ্ণা নাকে রুমাল চাপা দিয়ে ঢুকেছে যথারীতি,

—শুভ, একটা সিগারেট দে তো।

শুভ প্যাকেট খুলে সিগারেট গুনল। বেজার মুখে বলল, —তুই তো তিনটে টান মেরে ফেলে দিবি, কি লাভ হয় এরকম সিগারেট খেয়ে?

সুদেষ্ণা শুভর প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট প্রায় ছিনিয়ে তুলে নিল,

—ধোঁয়ার গন্ধটা কম লাগে।

বৃষ্টি মুখ বেঁকাল। হুঁ, ধোঁয়ার ভ্যাক্সিনেশান! কত ঢংই না জানে সুদেষ্ণা।

সুদেষ্ণাকে বন্ধুবান্ধবরা প্রায় কেউই পছন্দ করে না। সে কলেজে এসে প্রথমদিনই জানিয়েছে তার বাবা বিখ্যাত হার্ট স্পেশালিস্ট ডক্টর অসিত দাস। তার মা তিনটে নামকরা সোশাল ওয়েলফেয়ার অরগানাইজেশনের প্রেসিডেন্ট কিংবা ভাইস প্রেসিডেন্ট। সে পরপর দুদিন এক রঙের গাড়ি চড়তে পারে না। দরকারে অদরকারে লোকজনকে দেদার টাকা বিলোয় সে। কলেজের দারোয়ানের মেয়ের বিয়েতেও অবলীলায় তিনটে একশ টাকার নোট বার করে দিয়েছিল। সে অর্থ দিয়ে কুর্নিশ কিনতে ভালবাসে। তার দুটো সেকেন্ড জেনারেশান অ্যালসেশিয়ান, একটা খাঁটি বিদেশী স্প্যানিয়েল আর একজন টল ডার্ক হ্যান্ডসাম বয়ফ্রেণ্ড আছে।

ক্যান্টিনের দরজায় দরজায়, সিঁড়িতে দল বেঁধে বসে ছেলেমেয়েরা। গোছায় গোছায়। আলাদা আলাদা। বাংলার শিক্ষাসংস্কৃতির পীঠস্থান ঐতিহ্যবাহী এই কলেজে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত সকলেরই নিজস্ব পরিমণ্ডল আছে। চট করে কেউ তার বাইরে যায় না। আবার সব নিয়মেরই তো কিছু ব্যতিক্রম থাকে। দেবাদিত্য সেই ব্যতিক্রম। সুদেষ্ণাও।

শুভ হাঁক মারল, এই বাচ্চা, কি আছে রে?

এতটুকুন একটা ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে, টেবিলের পাশে। হাইট টেবিলের মাথায় মাথায়। খালি গা, কালো রঙ, দেবশিশুর মত মুখ। কি করে যে মোহনদা ঠিক একটা করে বাচ্চা জোগাড় করে ফেলে। এই চার মাসে কম করেও গোটা পাঁচেক বাচ্চা বদল হতে দেখল বৃষ্টি। শিশুশ্রমিক নাকি এদেশে বেআইনি।

বাচ্চাটা গড়গড় করে ধারাপাত মুখস্থ বলে চলেছে,—চা, চপ, ডিমের ডিবিল, মাপলেট…

একদম উল্টোদিকে, কোণে, ফিলজফির অর্চিতা এক গণ্ডা বাউল নিয়ে বসে। নিজেই মাঝে মাঝে তাদের গুপীযন্ত্র নিয়ে পিড়িং পিড়িং বাজাচ্ছে। একটা বাউল তো বেশ বুড়ো। লোকটার সামনের প্লেটে চারখানা চপ। কী বিদঘুটে শখ যে অর্চিতার! বাউল ধরে গান শোনার!

বৃষ্টি চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল, —কিরে, এবার কোন ডিস্ট্রিক্ট?

—বাঁকুড়া। ওন্দার কাছে হেতমপুর গ্রাম থেকে। শুনবি? এর গান শুনবি?

বৃষ্টি মুখে বলল,—পরে। মনে মনে বলল, রক্ষে করো।

কে যে কিসে আনন্দ পায়!

রণজয় ব্যস্তসমস্তভাবে ক্যান্টিনে ঢুকে বৃষ্টিদের টেবিলে এসে বসে পড়ল, —অ্যাই, ডেট ফেট ফাইনাল। স্যারের সঙ্গে কথা হয়ে গেল। তিনটে জায়গার অপ্‌শন আছে। রাজগীর, নেতারহাট, শিমলিপাল। চুজ করো কোথায় যাবে।

—রাজগীর ঠিক হয়েছিল না?

—দুটো অপ্‌শন বেড়েছে। চারদিনের ট্যুর। বাজেট পার হেড চারশ টাকা।

শুভ হৈ হৈ করে উঠল,—শিমলিপাল, শিমলিপাল।

রণজয়ের কথাটা কানে বাজল বৃষ্টির। রাজগীর, নেতারহাট, শিমলিপাল। নেতারহাট নামটা বড় চেনা চেনা! নেতারহাট না মাদারিহাট কোথায় শেষবারের মত বেড়াতে গিয়েছিল বাবা মার সঙ্গে? দূর, মাদারিহাট তো নর্থ বেঙ্গলে। নেতারহাটেই গিয়েছিল। বাবার কাছে শুনেছে আরও ছোটতে নাকি ওয়ালটেয়ার গিয়েছিল তারা। আরেকবার সিমলা। সেই জায়গাগুলোর কথা কিছুই মনে নেই। বরং আবছাভাবে মনে আছে নেতারহাটের কিছু কথা। নীল আকাশ ছোঁওয়া উঁচু উঁচু গাছ, যতদূর চোখ যায় সবুজ এক উপত্যকা, একটা টলটলে জলের হ্রদ, গাঢ় সোনালি রঙ রোদ্দুর।

—কিরে সুদেষ্ণা, তুই কি ঠিক করলি?

—শিমলিপাল নয়, রাজগীর চলো। হটস্প্রিং আছে, নালন্দা আছে…

—টি এমও সেই কথাই বলছিলেন। আরও কত ধ্বংসাবশেষ…

—ছাড়্ তো, টি এম-এর ধান্দা অন্য। ওখানে জরাসন্ধর কুস্তির আখড়া আছে না? টি এম তো প্রতি বছরই নেতাজি ইনডোরে টিকিট কেটে কুস্তি দেখতে যান। ধোবি প্যাঁচ, এরোপ্লেন স্পিন প্যাঁচ সব কিছুরই তো অরিজিন জরাসন্ধ।

বিক্রমের রসিকতায় হাসির হল্লা উঠল।

—কিরে বৃষ্টি, তুই কিছু বলছিস না যে?

বৃষ্টি অন্যমনস্ক। স্কুল থেকে কতবার বাইরে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, বৃষ্টি কোনও এক্সকারশানেই যায়নি। বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার কথা উঠলেই একটা চাপা অস্বস্তি হত তার। যদি কেউ বাবা মার কথা তোলে! বাবা মার ডিভোর্সের ব্যাপারটা স্কুলের সকলেই জানত যে। ছোটখাটো খোঁচাও সে কম খায়নি।

শম্পা চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলত; —তোর তো মজা রে শিঞ্জিনী, দুটো বাড়ি, ডবল আদর, তার ওপর তোর মা আর বাবা যদি আবার বিয়ে করে তা হলে মোট দুটো মা, দুটো বাবা। তুই কি লাকি রে!

ওই বয়সের ছেলেমেয়েরা এমন নির্মম হয়। কলেজে ব্যাপারটা অন্যরকম। এখানে কেউ কারুর বাবা মার অতীত নিয়ে সেভাবে কৌতূহলী নয়। অন্তত বৃষ্টির তাই ধারণা।

তৃষিতা ঠেলল বৃষ্টিকে,—এই বৃষ্টি, কোথায় হারিয়ে গেছিস? ফের। ফের। নেতারহাট ভোটে জিতছে। এনি অবজেকশন?

বৃষ্টির মনে তবুও দ্বিধা। গেলে হয়।

—কিরে, যাচ্ছিস তো তুই?

—দেখি, পরে জানাব।

—নো পরে ফরে। পরশু টাকা ডিপোজিট করতে হবে। কিরে দেবাদিত্য তুইও চুপ যে?

তৃষিতার প্রশ্ন দেবাদিত্যও যেন এড়ানোর চেষ্টা করল, —আগে তো চপের অর্ডারটা দে। এই শুভ, দ্যাখ না।

শুভ গলা ওঠাল,—এই বাচ্চা, সাতটা ভেজিটেবল চপ। সঙ্গে সাত কাপ গরম জল।

সুদেষ্ণা রসিকতা পছন্দ করে না,

—নারে। সাতটা চপ। সাতটা চা।

শুভ আয়েস করে আবার একটা সিগারেট ধরিয়েছে। ফট করে তার হাত থেকে সিগারেটটা কেড়ে নিয়েছে বৃষ্টি। শুভর মতই আরাম করে টান দিল। আআহ্। ধোঁয়াগুলো মাথায় ঢুকে কারুকার্য শুরু করে দিয়েছে। জন্মদিনের দিন প্রচণ্ড জোরে টেনে ফেলেছিল। জীবনের প্রথম টান। সঙ্গে সঙ্গে বুকে কী জোর ধাক্কা! কাশতে কাশতে চোখ মুখ লাল। কাশি থামার পর কনুই দুটো টেবিলে রেখে চুপচাপ মাথা চেপে বসেছিল অনেকক্ষণ। ক্রমে মাথার ভেতরটা কি আশ্চর্য রকমের হাল্কা!

বিক্রম চোখ গোল করে তাকিয়ে আছে বৃষ্টির দিকে,

—বস্। তুমি তো বেশ ওস্তাদ হয়ে গেছ! কাউন্টারটা আমায় দিও।

বৃষ্টি মনে মনে হাসল। তাকে তো ওস্তাদ হতেই হবে। সে এখন আঠেরো।

দূরের টেবিলে একজনকে হাত নাড়ল দেবাদিত্য। বৃষ্টি ঘুরে তাকাল। অরিজিৎ রোজকার মতই একলা এসেছে চা খেতে।

—এই অরিজিৎ, ওখানে কেন?

অরিজিৎ টেবিলের কাছে এল কিন্তু বসল না।

—বোস্।

—নারে, আমি একটু লাইব্রেরি যাব।

—এক্সকারশনে যাচ্ছিস তো? কদিনের জন্য তোর লাইব্রেরি কিন্তু বন্ধ থাকবে।

ঠাট্টাটা গায়ে মাখল না অরিজিৎ,—ইচ্ছে তো আছে। পরশুই দেখতে পাবি যাচ্ছি কিনা।

সুদেষ্ণা বৃষ্টির কানে কানে বলল, —বাবার পারমিশন পাওয়ার আগে পর্যন্ত ও ডিসিশন জানাতে পারবে না। পিতৃভক্ত রামের এক কাঠি বাড়া। পিতৃভক্ত রামপ্রসাদ। বউ নিয়ে বিছানায় শোওয়ার আগেও বাবার অনুমতি নেবে।

সারাক্ষণ বই-এর পাতায় মুখ গুঁজে থাকে অরিজিৎ, হাই মাইনাস পাওয়ারের চশমা। বয়সের তুলনায় মুখটা বেশ ভারিক্কি। দেখলে মনে হয় যেন কনফুসিয়াসের জীবনপঞ্জি, লাইব্রেরি আর আলাউদ্দিন খিলজির ওপর সেমিনার অ্যাটেন্ড করার জন্যই অনেক কষ্টে বেঁচে রয়েছে সে।

বৃষ্টির সুবীরের মুখটা মনে পড়ে গেল। তার জন্মদিনের পর পরই ফরিদাবাদ চলে গেছে। যাওয়ার দিন সকালে ফোন করেছিল। গলায় নকল উচ্ছ্বাস ফোটালেও বাবার ঘাবড়ানো ভাবটা এখনও যায়নি। মেয়ের একটামাত্র আক্রমণেই অবস্থা বেহাল? হায় রে।

বাচ্চা ছেলেটা সাতটা ডিশ অদ্ভুত কায়দায় ব্যালেন্স করতে করতে টেবিলে এনে রাখল। ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে যেন ভাসতে ভাসতে এল ছেলেটা।

—বাচ্চাগুলো তে সার্কাসে যেতে পারে রে, তবু একটা হিল্লে হয়। দুহাত নেড়ে বাচ্চাটার হাঁটার ভঙ্গি বন্ধুদের নকল করে দেখাচ্ছে দেবাদিত্য,—কি হাতের ব্যালেন্স দেখেছিস?

শুভ কথাটাকে খুব একটা আমল দিল না। চপে কামড় বসিয়ে প্রশ্ন করল,—ড্রিঙ্কস কি কলকাতা থেকে নিয়ে যাওয়া হবে? বিহারে নাকি দাম কম?

তৃষ্ণিতা আঁতকে উঠল,—তুই ড্রিঙ্ক করবি?

—করি তো মাঝে মাঝে। একটু একটু। বাবার বোতল থেকে।

—ধরা পড়ে যাস না?

—যতটা খাই ততটা জল ঢেলে রেখে দিই। বাবাটাও হেভি সেয়ানা। বোতলে দাগ মেরে রাখে আজকাল। সেদিন মার ওপর খুব হম্বিতম্বি করছিল, স্কচ এত লাইট হয় কি করে? এ নিঘাত তোমার গুণধর ছেলেদের কাজ। যেদিন হাতেনাতে ধরব…

বৃষ্টি লক্ষ করল হাসতে হাসতে শুভর চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছে। মুখ চোখ টানটান,

—তুমি শালা নিজে বন্ধুবান্ধব নিয়ে মাল খেয়ে হল্লা করবে, রাতদুপুর অবধি ব্লু দেখবে, আর ছেলেদের বেলায় নীতি ঝরে পড়ছে। হিপোক্রিট। দেব একদিন একখানা ক্যাসেট হাপিস করে… রাজীবদের ফ্ল্যাটটা তো ফাঁকাই….

—অ্যাই। কি হচ্ছে কি? রণজয় ধমকে থামানোর চেষ্টা করল শুভকে।

—হবে আবার কি। আমার কাছে কোন রাখঢাক গুড়গুড় নেই। শুভ বেপরোয়া,—নিজের বাপ বলে কি ধোওয়া তুলসীপাতা নাকি? যা ফ্যাক্ট শুভ সেটা বলবেই।

অবাক চোখে শুভকে দেখছিল বৃষ্টি। অনেকটা যেন তার মনের কথাই বলছে শুভ।

মিনিট খানেক টেবিলে সবাই নীরব। থমথমে আবহাওয়াটা কাটাতেই বোধ হয় বিক্রম বলে উঠল—রণজয়, পরভিন যাবে না?

রণজয় চোখ কুঁচকে তাকাল বিক্রমের দিকে,—আমি কি করে বলব?

বিক্রম আবার জিজ্ঞাসা করল, ও আজকে কলেজে আসেনি কেন রে?

চপে কামড় দিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল রণজয়।

—আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন?

—ওর বাড়ি থেকে ওকে ছাড়বে? বিক্রমের মুখে তবু নিরীহ জিজ্ঞাসা।

তৃষিতা, সুদেষ্ণা, দেবাদিত্য সবাই মুখ টিপে টিপে হাসছে। বৃষ্টি বুঝল একটা নাটক চলছে, কিন্তু কি যে ঘটছে সে ঠিক ঠিক ধরতে পারছে না। বোকা বোকা মুখে তৃষিতার দিকে তাকাল।

তৃষিতা বৃষ্টির কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, —সেদিন রণজয়কে আমাদের সঙ্গে সিনেমায় যেতে বলোম, গেল না, মনে আছে? সেদিনই সন্ধেবেলা নিউ এম্পায়ার থেকে পরভিনের সঙ্গে বেরোচ্ছিল, মীনাক্ষি দেখেছে। বেকবাগানের মোড়েও পরশু বিকেলে…

রণজয় তৃষিতার ফিসফিস কথায় হঠাৎ ভীষণ খেপে গেল, —তোদের কি আর কোন টপিক নেই? সব কিছুর একটা লিমিট আছে।

দেবাদিত্য আর চুপ থাকতে পারল না, —ঠিকই তো। এমনভাবে সবাই রণজয়কে আঙুল দেখাচ্ছে যেন রণজয় একাই মাছরাঙা। এদিকে আমি যে অবিরাম পুকুরে ঠুকরে যাচ্ছি, সেটা কেউ পাত্তাই দেয় না!

ঘন গুমোট আবহাওয়াকে ফুরফুরে করে তুলতে সত্যিই দেবাদিত্যটার কোন জুড়ি নেই। গুম হয়ে যাওয়া শুভ পর্যন্ত হেসে ফেলল।

ঠিক এই মুহূর্তে যে ঘটনাটা ঘটলে সকলেই আশ্চর্য হয়ে যেত, সেই ঘটনাটাই ঘটল। ক্যান্টিনে ঢুকছে পরভিন স্বয়ং। সঙ্গে মীনাক্ষি। এদিক ওদিক তাকিয়ে বন্ধুদের খুঁজছে।

দেবাদিত্য সুর ভেঁজে উঠল, —এই মাছ এসে পড়্, টেবিলেতে বসে পড়্…

রণজয় আর থাকতে পারল না, হিংস্র চোখে সবার দিকে তাকিয়ে উঠে গেল টেবিল ছেড়ে।

পরভিন সরল মুখে জিজ্ঞাসা করল, —আমাদের দেখে রণজয় উঠে গেল কেন?

—ও কিছু না। হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করল দেবাদিত্য, —ওই নেতারহাটে এক্সকারশানে যাওয়া হচ্ছে, সেখানে কটা বোতল যাবে, তাই নিয়ে রণজয়ের সঙ্গে শুভর ঝগড়া হচ্ছিল।

—বোতল? কেন? পরভিনের চোখে অপার বিস্ময়।

—ছিপি খুলে খাওয়ার জন্য ভাই। তুমি ড্রিঙ্কস-এর নাম শোননি?

দেবাদিত্যর ঠাট্টায় পরভিন হোঁচট খেল। নিচু গলায় প্রশ্ন করল, —ড্রিঙ্ক করলে মুখ থেকে খুব গন্ধ বেরোয় না?

বিক্রম হা হা করে হেসে উঠল, —নিশ্চয়ই বেরোয় খুকুমণি। তুমি খাবে? পাঁচদিন মুখ থেকে গন্ধ বেরোবে। মিনিমাম।

সুদেষ্ণা বলল, —কেন এত ভয় দেখাচ্ছিস ওকে? নারে পরভিন, তুই জিন খেয়ে দেখতে পারিস? জিনের গন্ধ বেশিক্ষণ থাকে না। চল, নেতারহাটে তোকে টেস্ট করাব।

পরভিনের মুখটা হঠাৎ কেমন কাঁদ কাঁদ হয়ে গেল। তার গলায় মিনতির সুর,—অ্যাই বৃষ্টি, তৃষিতা, তোরা একবার আমার বাড়িতে গিয়ে বলবি? ছেলেরা যাচ্ছে সে কথা বলার দরকার নেই। বলবি কমপাল্‌শন। লেডি প্রোফেসররাও যাবে।

পরভিনের কথায় শুভ বিরক্ত হল,—কেন? আমরা কি বাঘ ভালুক নাকি? মেয়ে দেখলেই গপ করে খেয়ে ফেলব?

পরভিনের চোখে অসহায় ভাব, —দ্যাখ, সব বাড়ি তো একরকম হয় না। আমি তো তোদের বলেইছি আমাদের বাড়ি কিরকম কনজারভেটিভ। এই কো-এড কলেজে পড়ি বলে এখনও কম কথা শোনায় দাদাসাহেব! আম্মি জোর না করলে…

বৃষ্টি পরভিনের পিঠে হাত রাখল,—ডোন্ট ওরি। আমরা এমনভাবে তোর বাড়িতে গিয়ে ভয় দেখিয়ে আসব যেন না গেলে কলেজ থেকেই তোকে…

—তার সঙ্গে বলে দিস নেতারহাটে মোঘল পিরিয়ডের প্রচুর রেলিক্স আছে। দেবাদিত্য ফুট কাটল, —নতুন খোঁড়াখুড়ি শুরু হয়েছে…

—যদি জানতে পারে গুল মারছি?

—ছাড় তো। প্রত্যেক সপ্তাহে একটা করে নতুন জায়গায় গাঁইতি মারা শুরু হয়, নইলে আমাদের বইগুলো অত মোটা হয় কি করে?

সুদেষ্ণা উঠে দাঁড়াল,—আমি চলি রে। জয়ন্ত ব্রিটিশ কাউন্সিলের গেটে ওয়েট করবে। ওর কাছে আজকের ফিল্মের কার্ড আছে।

—কি বই?

—দা স্প্রিং। রোমান্টিক। জয়ন্ত রোমান্টিক ফিল্ম ভীষণ পছন্দ করে।

রোমান্টিক? না উদ্দাম জড়াজড়ি? বৃষ্টি দেবাদিত্যর দিকে বিচিত্র ভ্রূভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে পড়ল।

শুভ বলল, —কিরে, তুইও সুদেষ্ণার সঙ্গে চললি নাকি?

-ধুস। ওরা হাত ধরাধরি করে চাঁদ দেখুক। আমার খেয়েদেয়ে অনেক কাজ আছে।

কলেজের গাড়িবারান্দার নীচে এসে একটু দাঁড়াল বৃষ্টি। পুরনো আমলের ভারী থামগুলোর পাশে জোড়ায় জোড়ায় ছেলেমেয়েরা প্রেমের ক্লাসে মগ্ন। কি যে এত কথা থাকে এদের? তিন-চারটে জোড়াকে বৃষ্টি চিনতে পারল। তুখোড় প্রেমিক-প্রেমিকা হিসাবে এদের বেশ নাম হয়েছে কলেজে। শেষ থামের পাশে বসা ভাস্বতী আর সন্দীপকে নিয়ে উপকথাও চালু হয়ে গেছে। মীনাক্ষি বলছিল অর্চিতা নাকি গান বেঁধেছে ওদের নিয়ে। গ্রামেগঞ্জে বাউলদের দিয়ে গাওয়াবে সে গান।

সন্দীপ নাকি ভাস্বতীকে বলে, —আমি তোমাকে ভালবাসি।

ভাস্বতী বলে, —জানি।

সন্দীপ বলে, —তোমার ফিলজফির নোটটায় ভুল আছে।

ভাস্বতী বলে, —জানি।

সন্দীপ বলে, —তোমার বাবা আমাকে দেখলেই চটে যায়।

ভাস্বতী বলে, —জানি।

সন্দীপ বলে, —তোমাকে নিয়ে একটু ঝোপের আড়ালে যেতে ইচ্ছে করছে।

ভাস্বতী বলে, —জানি।

তারপর দুজনে হাত ধরাধরি করে উঠে যায়। তারপরের দৃশ্যগুলো অ্যাডাল্ট। এই নিয়েই হবে অর্চিতার গান। ময়মনসিংহ গীতিকার সুরে।

বৃষ্টি ঠোঁট কামড়াল। প্রেমের শেষ দৃশ্য তো রনির মা-বাবা। কিংবা তার নিজের। রোমিও জুলিয়েটের বিয়ে হলেও শেষ পর্যন্ত হয়ত একই অবস্থা হত। জুলিয়েট কৌটো ছুঁড়ছে, বাসন ভাঙছে; রোমিও রাগে গরগর করতে করতে হিংস্র নেকড়ের মতো গোটা বাড়ি দাপাচ্ছে। আর শহরের লোক তালি দিয়ে মজা দেখছে। হাহ্।

হাঁটতে হাঁটতে কলেজের বাইরে এল বৃষ্টি।

ভবানীপুরের নীলামাসির বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই বৃষ্টি বুলবুলদির গলা পেল। চোস্ত হিন্দিতে দক্ষিণ বারাসতের কাজের লোকটাকে ধমকাচ্ছে। বৃষ্টি ঢুকতেই গলার স্বর বদলে ফেলল,

—ওমা তুই এসে গেছিস? আমি আজ সন্ধেবেলা ঠিক তোদের বাড়ি যেতাম।

বৃষ্টি বলল, —ছাড়ো তো, সেই আমাকে ফাঁসালে…? এখন বই দুটো চটপট দিয়ে দাও। না হলে আজ বাড়ি ঢোকা যাবে না।

—কেন রে? বাবলুমামা খুব রেগে গেছে?

—রাগবে না? জানো না ওগুলো ভালমামার হাড়পাঁজরা? কাল বাড়িতে এই নিয়ে তুলকালাম হয়ে গেছে। তোমাকে নাকি তিন-চার বার ফোন করে দিয়ে যেতে বলেছিল..

কাজের মেয়েটা কথার ফাঁকে সুড়ৎ করে ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল, তার মুখ থেকে খবর পেয়েই বোধহয় নীলামাসি বেরিয়ে এসেছে,

—এই তো বৃষ্টি এসে গেছে। বৃষ্টি, তুই একটু বোস তো, চিংড়িমাছের একটা নতুন প্রিপারেশন করেছি চিলি সস, সয়া সস আর ধনেপাতা দিয়ে, এরা কেউ খেতে চাইছে না, তুই একটু টেস্ট করে দ্যাখ তো।

বৃষ্টি ভাবল কী কুক্ষণেই না এসে পড়েছে সে। মার এই মাসতুতো দিদিটির অদ্ভুত সব কুখাদ্য রান্না করার বাতিক আছে। এই ভয়ে বুলবুলদির বন্ধুরা এ বাড়ির পথ মাড়ায় না, আত্মীয়স্বজনরা আঁতকে ওঠে। বৃষ্টিও আসে কচিৎ কালেভদ্রে। তাও কিনা ফেঁসে গেল আজ?

কাজের মেয়েটা স্যুপ খাওয়ার বাটিতে একটি ঘন কালো মণ্ড এনে টেবিলে রাখল। সেদিকে তাকিয়েই বৃষ্টির গা গুলিয়ে উঠল। বুলবুলদি সামনের সোফায় বসে দিব্যি মিটিমিটি হাসছে।

বৃষ্টির একটু রাগই হল এবার, —তুমি কি গো? ভালমামা তোমায় ফোন করল আর তুমি ডুব মেরে বসে রইলে?

বুলবুলদি বলল, —যাহ্ বাবলুমামা ফোন করেছে না হাতি। একবার করেছিল তাও কথা বলতে না বলতেই লাইন কেটে গেল। তোদের কলকাতায় কি এক বাড়িতে তিন-চারবার ফোন পাওয়া যায়?

বৃষ্টি বুলবুলদির মুখ দেখেই বুঝতে পারল বুলবুলদি মিথ্যা কথা বলছে। বুলবুলদি লেখাপড়ায় এত ভাল, সোশিওলজিতে পি.এইচ.ডি. করছে, এত সুন্দর দেখতে, তবু দুটো যা বদভ্যাস আছে! এক, মিথ্যা কথা বলতে চোখের পাতা কাঁপে না, দুই, যে কোন কথা শুরু করলেই তা শেষ করে কলকাতার নিন্দা দিয়ে।

বুলবুলদি বৃষ্টির গম্ভীর মুখ দেখে কি বুঝল কে জানে, গলা নরম করল একটু, —কাল সন্ধেয় ন্যাশানাল লাইব্রেরি থেকে ফেরার সময় ভাবলাম তোদের বাড়ি যাই, এমনভাবে লোডশেডিং হয়ে ট্রামগুলো সব দাঁড়িয়ে পড়ল…সত্যি, তোদের জন্য কষ্ট হয়, কি বিচ্ছিরি শহরে যে মানুষ হয়েছিস তোরা। আমাদের দিল্লিতে বাবা…

নীলামাসি বলল, —থাম্ তো। দিল্লিতে তো শুধু অফিস, বিজনেসডিল্ আর ভাও। ছ্যা ছ্যা ওখানে মানুষে থাকে? কলকাতায় লোডশেডিং হয় বলেই তো লোকে জ্যোৎস্না দেখতে পায়, চাঁদের দিকে তাকায়, কবিতা লেখে…।

নীলামাসির কথায় কৃতজ্ঞ বোধ করল বৃষ্টি। গপগপ করে উৎকট ঝাল খাবারটাও গিলে নিল। নীলামাসি ভীষণ আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করল,

—কেমন হয়েছে রে?

বৃষ্টির বলতে ইচ্ছে করছিল, এক গ্লাস জল; মুখ দিয়ে বেরল, —ভাল।

নীলামাসি গজগজ করতে শুরু করল, —তাও তো তুই কিছু বললি, যেমন বজ্জাত হয়েছে বুলবুলের বন্ধুরা, তেমন হয়েছে তার মা। কিছুতেই এদিক মাড়ায় না। তোর মেসসা এই বয়সে আর কত রকম খাবার খাবে বল।

বীরেনমেস দিল্লিতে অডিট সার্ভিস থেকে রিটায়ার করার পর গত বছর কলকাতায় সপরিবারে পাকাপাকি ফিরে এসেছেন। বুলবুলদি কিছুতেই আসতে চায়নি, নীলামাসি আসার জন্য পাগল। বীরেনমেসোর কাস্টিং ভোট নীলামাসির দিকে পড়েছিল। সেই নিয়ে বুলবুলদির রাগ এখনও যায়নি।

নীলামাসি বলল, —জানি বলে লাভ নেই, তবু জয়াকে বলিস পারলে একবার যেন আসে।

বৃষ্টি ঘাড় নাড়ল। মনে মনে বলল, মাকে বলতে আমার দায় পড়েছে। তোমার যদি টান থাকে, নিজে গিয়ে বোনকে হাত ধরে নিয়ে এসো। সে নিজেই আবার কবে এবাড়িতে আসবে তার ঠিক নেই। কোন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যেতেই তার ভাল লাগে না। এরকম ম্যানিয়াক মাসি আর কুচুটে দিদির বাড়িতে তো নয়ই। সেবার দিল্লিতে গিয়ে নেহাত দায়ে পড়ে…।

মা-র সঙ্গে বছর তিনেক আগে শেষবারের মতো বেড়াতে গিয়েছিল বৃষ্টি। শুধু মা-র সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া সেই একবারই। বেড়াতে যাওয়া না বলে বৃষ্টিকে নীলামাসির বাড়িতে জমা রেখে দিল্লিতে মা নিজের কাজ সারতে গিয়েছিল বলাই ভাল। সাতদিনের সাতদিনই মা ব্যস্ত ছিল নিজের ছবির এগজিবিশন, রিভিউ, সেল নিয়ে। সারাদিন ধরে আর্টিস্ট ফোরাম, গ্যালারি আর আর্ট প্রোমোটার। বৃষ্টি যেন বাড়তি লাগেজ। স্টেশনের ক্লোকরুমে জমা থাকার মতো পড়ে রইল নীলামাসির বাড়িতে।

ভালমামার বই দুটো ব্যাগে পুরে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় নীলামাসির বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল বৃষ্টি।

বাড়িতে ঢুকে বৃষ্টি বাবলুর ঘরে উঁকি দিল। খাটের কাছে রাখা নিজস্ব পোর্টেবল টিভিতে মন দিয়ে সাড়ে সাতটার খবর শুনছে বৃষ্টির ভালমামা। বার্লিনের প্রাচীর ভাঙার পর এখন রোজই কোন নতুন চমকের প্রত্যাশা। এ সময়ে কেউ কথা বললে সে খুব রেগে যায়।

বৃষ্টি খাটের ওপর বই দুটো রাখল। বাবলু একবার সেদিকে তাকিয়ে আবার মন দিয়েছে খবরে।

বৃষ্টির হঠাৎই একটু ভালমামার পিছনে লাগতে ইচ্ছে হল,

—তোমার ভি পি সিং-এর খবর কি? ইস্ট ইউরোপের কোন দেওয়াল-টেওয়াল আর ভাঙল?

বাবলুর ভুরু জড়ো হল।

বৃষ্টি ভালমামার খাটে বসে পড়ল,

—কোন্ড ওয়ার-টোয়ার আর চলবে না বুঝলে। এবার ভাঙাভাঙির পালা। সব ভেঙে যাবে।

খুব একটা কিছু ভেবে নয়, এমনি বলার জন্যই কথাটা বলেছে। দুটো মতবাদের লড়াই শুরু হয়ে গেছে, বিভিন্ন দেশগুলোর দেওয়াল টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে দিন দিন। বৃষ্টির ভালমামা এসব নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত থাকে আজকাল। কাউকে ডেকে যেচে কথা বলার অভ্যাস তার বহুকাল চলে গেছে।

সুধা দরজায় এসে প্রায় ফিসফিস করে ডাকল বৃষ্টিকে। বাবলুর প্রয়োজন ছাড়া সে এ ঘরে ঢুকতে ভয় পায়।

—জলখাবার খাবে কিছু?

বৃষ্টি মাথা দোলালো।

—চা, কফি?

বাবলু টিভি থেকে চোখ না সরিয়ে বলে উঠল, —আমাকে এখন চা কফি দেবে না। সন্ধে থেকে আমার তিন-চারটে চোঁয়া ঢেঁকুর উঠেছে।

বাবলুর স্বর এমনই রূঢ় যে সে ঘরে অন্য যে কেউ বসে থাকতে অস্বস্তিবোধ করবে। বৃষ্টি তবু বসে রইল।

এতক্ষণে বাবলু যেন মৃদু সচেতন হয়েছে, —সোজা বুলবুলদের বাড়ি থেকে ফিরছিস?

—হুঁ।

—ও। তাই এত তাড়াতাড়ি! অন্য দিন তো ন্যাশনাল নেটওয়ার্ক শুরু হওয়ার আগে ফেরাই হয় না।

ভালমামা কি কখনও স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারে না! বৃষ্টিও এরকম লোককে জব্দ করতে জানে।

—বুলবুলদি বলছিল তুমি নাকি মাত্র একবার ফোন করেছিলে? তাও নাকি কথা হয়নি? লাইন কেটে গিয়েছিল?

বাবলু তৎক্ষণাৎ উত্তেজিত, —বুলবুল ডাহা মিথ্যেবাদী। আর কোনদিন আমার কাছে বই চাইতে আসুক।

—তোমারও বলিহারি যাই, বই দুটো দিয়েই ফেরত চাওয়ার জন্য এত ব্যস্ত কেন?

—সে কৈফিয়ত কি তোকে দিতে হবে নাকি? যা, এখান থেকে। কেউ কিছু বলে না বলে দিনকে দিন…

বৃষ্টি খাট থেকে নেমে পড়ল। এ ঘরে বসে থাকা আর নিরাপদ নয়। বৃষ্টি কিছুতেই ভেবে পায় না এত সামান্য কথায় কি করে একটা মানুষ এত উত্তেজিত হয়ে পড়ে! আর যদি হয়ে পড়েও বৃষ্টি তাকে থোড়াই কেয়ার করে।

নিজের ঘরে এসে বৃষ্টি কানে ওয়াকম্যান লাগিয়ে নিল। বিছানায় শুয়ে, পা দোলাতে দোলাতে, হার্ডরকস্ শুনছে। এ সময়ে তার চোখের সামনে থেকে বিশ্বসংসার ভোজবাজির মতো মিলিয়ে যায়। আকাশ গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ভেঙে পড়লেও এখন সে খেয়াল করবে না। কখনও কখনও তার মুখ বিকৃত হয়ে যাচ্ছে, হাত মুঠো করছে, কখনও বা সম্পূর্ণ শিথিল হয়ে শুয়ে থাকছে বিছানায়। যে কেউ এখন তাকে দেখলে উন্মাদিনী ছাড়া কিছু বলবে না।

হঠাৎই দরজায় চোখ পড়তে বৃষ্টি চমকে উঠল। মা তার দরজায় দাঁড়িয়ে। মা কখন এল! আজ এত তাড়াতাড়ি!

মাকে দেখেই মস্তিষ্কে আলোড়ন শুরু হয়ে গেছে। কদিন ধরেই মা যেন নজর করছে তাকে। শুধু বাবা কেন, এই মহিলারও কিছু শিক্ষা পাওয়া দরকার। জয়ার মুখ একঝলক দেখে নিয়েই বৃষ্টি আবার পা নাচাতে শুরু করল।

জয়া কি একটা বলল, বৃষ্টি শুনতে পেল না। পা দোলাতে দোলাতেই কান থেকে ওয়াকম্যান সরাল। বাজনার বিটগুলো মৃদু হয়েছে,

—কিছু বলছ আমাকে?

—বলছি গান শোনা ছাড়া কি আর তোমার কোন কাজ নেই? পড়ছিস না যে?

—ইচ্ছে। জোরের সঙ্গে বলতে গিয়েও গলাটা কেঁপে গেল। বৃষ্টি বুঝতে পারল মা-র সম্পর্কে ভয়টা তার কাটতে সময় লাগবে। তবু জোর করে পা দোলাতে চেষ্টা করল। আবার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *