০১. ঘুমচোখে নিজের ঘর থেকে বেরোবার মুখে

ঘুমচোখে নিজের ঘর থেকে বেরোবার মুখে পাশের ঘরের পর্দাটা সাবধানে সরিয়ে রবি তার বাবাকে দেখতে পায়। খোলা স্টেটসম্যানের আড়াল থেকে ধোঁয়া উঠছে, আর সামনে একটা ক্ষুদে টেবিলের ওপর এক জোড়া পা, পায়ের পাশে একটা গরম কফির কাপ। ওই স্টেটসম্যান, পা আর কফির কাপ–ওই তার বাবা। রবি প্যান্টের পকেটে হাত ভরে রিভলভারটা বের করে আনল। সেটা তুলল, এক চোখ ছোট করে লক্ষ্যস্থির করল। তারপর টিপল ট্রিগার।

ঠিসুং…ঠিসুং…ঠিসুং…তিনটে বুলেট ছুটে গেল চোখের নিমেষে। স্টেটসম্যানটা খসে পড়ে যায় প্রথমে, দামি স্প্রিংয়ের ওপর দুর্ধর্ষ নরম ফোম রবারের গদির ওপর ঢলে পড়ে যায় বাবা, গদির ওপর দুলতে থাকে শরীর। বাবা চমৎকার একটা মৃত্যু চিৎকার দেয়— আ আ আ আ…..

রবি হাসে একটু। রিভলভারটা আবার পকেটে ভরে দু পা এগোয়, তার বাবা দেবাশিস শুয়ে থেকেই তার দিকে চেয়ে বলে, শট! শট!

রবির ঘুমমাখা কচি মুখে চাপা রহস্যময় হাসি। বলে, নাইস অব ইউ টেলিং দ্যাট।

দেবাশিস উঠে বসে। জ্বলন্ত সিগারেটটা ঠোঁটে নেয়। স্টেটসম্যানটা দিয়ে মুখ ঢাকার আগে বলে, প্রসিড টুওয়ার্ডস দা বাথরুম ম্যান।

ইয়া। বলে রবি হাই তোলে। ডাকে— দিদি!

অমনি অন্য পাশের ঘরের পর্দা সরিয়ে আধবুড়ি ঝি চাঁপার হাসিমুখ উকি দেয়— সোনা। দুহাত বাড়িয়ে রবি ঘুমন্ত গলায় বলে, কোল।

চাঁপা তাকে কোলে নেয়। এই সকালের প্রথম বাথরুমে যাওয়াটা বড় অপছন্দ রবির। একটু সময় সে দিদির কোলে উঠে থাকে রোজ সকালে কাঁধে মাথা রেখে হাই তোলে।

চাঁপা কানে কানে বলে, আজ রবিবার।

হুঁ।

ছুটি।

ইয়া।

সোনাবাবু আজ কোথায় কোথায় যাবে বাবার সঙ্গে?

কচি মুখখানা একরকম সুস্বাদু হাসিতে ভরে যায় রবির। প্রকাণ্ড শার্দিওলা চওড়া জানালার কাছে এসে চাঁপা পর্দা সরিয়ে দেয়। সাত তলার ওপর থেকে বিশাল কলকাতার দৃশ্য ছবির মতো জেগে ওঠে। নীচে একটা মস্ত পার্ক। পার্কের মাঝখানে পুকুর। চারধারে বাঁধানো রাস্তায় লোজন হাঁটছে।

ও ঘরে টেলিফোন বাজে, রিসিভার তুলে নেওয়ার ‘কিট’ শব্দ হয়। তারপর দেবাশিসের স্বর হ্যালো।

রবি বলে, ফোন।

চাঁপা বলে, হুঁ।

কার ফোন বলল তো?

বাবার বন্ধু কেউ!

না, মণিমার। রবি বলে।

চাঁপার মুখখানা একটু গভীর হয়ে যায়। বলে, এবার চলো, মুখখানা ধুয়ে নেবে।

রবি হাই তোলে, বলে, কাল রাতের গল্পটা শেষ করোনি।

চাঁপা হাসে–বলব। দাঁত মাজতে মাজতে।

ও ঘর থেকে দেবাশিসের হাসির শব্দ আসে। বলে, আজই? …হুঁ…হুঁ…না, না, রবিবার শুধু রবির দিন। এ দিনটা ওর সঙ্গে কাটাই।…আচ্ছা…।

রবি উৎকর্ণ হয়ে শোনে। বলে, ঠিক মণিমা।

এখন চলো তো। চাঁপা বলে।

বাথরুমে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করতে করতে হাই তোলে রবি। চাঁপা তার ছোট্ট ব্রাশে পেস্ট লাগাতে যাচ্ছিল, রবি রাগের স্বরে বলে, না, না পেস্ট না!

তবে কী দিয়ে মাজবে?

তোমার কালো মাজনটা দিয়ে।

ও তো ঝাল মাজন! পেস্ট মিষ্টি।

না, পেস্ট বিচ্ছিরি। ফেনা হলে আমার বমি পায়।

বাবা যদি টের পায় আমার মাজন দিয়ে মেজেছ তা হলে রাগ করবে কিন্তু।

টের পাবে কী করে! চুপ চুপ করে মেজে দাও। আঙুল দিয়ে কিন্তু। ব্রাশ বিচ্ছিরি।

চাঁপার বুড়ো মুখখানা মায়ার হাসিতে ভরে ওঠে। সে রান্নাঘর থেকে তার সস্তা কালো মাজনের শিশি নিয়ে এসে দাঁত মেজে দিতে থাকে।

রবি ভ্রূ কুঁচকে বলে, গল্পটা বলবে না?

হ্যাঁ হ্যাঁ তারপর…কতটা যেন বলেছিলাম সোনাবাবু?

তোমার কিছু মনে থাকে না। শিবুচরণ রাত্তির বেলা একা মাছ ধরতে গিয়েছিল নৌকোয়। জাল টেনে তুলতেই দেখে মাছের সঙ্গে একটা কেউটে সাপ।

হ্যাঁ হ্যাঁ লালটেমের আলোয় জাল খুলতেই মাছের সঙ্গে একটা কেউটে সাপ বেরিয়ে এল। ছোট্ট নৌকো, চার হাত খানেক হবে। তার এধারে শিবুচরণ হাঁ করে দাঁড়িয়ে, মাঝখানে লালটেম জ্বলছে, ওধারে ফণা তুলে কালকেউটে। আর খোলের মধ্যে জ্যান্ত মাছগুলো তখনও দাপাচ্ছে। চারধারে কালিঢালা অন্ধকার নিশুত নিঃঝুম। মাঝগাঙে শিবুচরণের সে কী বিপদ! নড়তে চড়তে পারে না, ভয় বুদ্ধিভ্রংশ হাতে পায়ে সাড়া নেই।

রবি প্রথম কুলকুচোটা সেরে নিয়েই বলে, জলে ঝাঁপ দিল না কেন?

চাঁপা একটু খতিয়ে গিয়ে বড় বড় চোখ করে চায়— ঠিক তত সোনাবাবু! কী বুদ্ধি বাবা তোমার ওইটুকুন মাথায়! উঃ!

বলে চাঁপা রবির মুখ তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে কোলে তুলে নেয়। মাথাটা কাঁধে চেপে রেখে বলে, সোনাবাবুর মাথার মধ্যে বুদ্ধির বাসা। এমনটি আর দেখিনি।

রবি মুখ টিপে অহংকারের হাসি হেসে মুখ লুকিয়ে বলে, উঃ তারপর বলো না!

হ্যাঁ, তা শিবুচরণের হাতে পায়ে তো খিল ধরে গেছে তখন। কাঁপুনি উঠছে। ভাবছে এই মলুম, এই গেলুম আর বাপভাই ছানাপোনার মুখগুলো দেখতে পাব না। কালসাপে খেলে আমাকে গো! কে কোথায় আছ মানুষজন, এসে পরাণটা রাখো। কিন্তু কোথায় কে! শীতের মাঝরাতে মাঝগাঙে জনমনিষ্যি নেই। শিবুচরণ বুঝল যে মানুষজনকে ডাকা বৃথা। কেউ তার ডাক শুনতে পাবে না। তখন ভয়ের চোটে শিবু রামনাম করতে থাকে, কিন্তু সাপটা নড়ে না। শিবুর মনে হল, তাই তো রামনাম তো ভূতের মন্ত্র। তখন সে মা মনসাকে ডাকতে থাকল। তাতে যেন আরও জো পেয়ে সাপটা এধার ওধার গোটা-দুই ছোবল মারল। লালটেমটা মাঝখানে থাকতে রক্ষে। কিন্তু সে আর কতক্ষণ। শিবু বুঝে গেল মা মনসা কুপিত আছেন কোনও কারণে তার ওপর। ডেকে কাজ হবে না হিতে বিপরীত হয় যদি! তখন শিবুচরণ মনে করল গাঁয়ের পুরুতমশাই বলেন বটে বাপ পিতেমোর আত্মা…সোনাবাবু বোসো।

চাঁপা ডাইনিং রুমে এনে চেয়ার টেবিলে বসায় রবিকে। রবি বিরক্ত হয়ে চাঁপাকে আঁকড়ে ধরে বলেউঃ! তুমি আগে বাসো, আমি তোমার কোলে বসব।

চাঁপা চারধারে চেয়ে কানে কানে বলেআমি কি চেয়ারে বসতে পারি? বাবা দেখলে যে রাগ করবে।

একটুও রাগ করবে না। উঃ বোসো! কথা শোনো না কেন?

বসছি বসছি। বলে চাঁপা তাকে কোলে নিয়ে বসে। প্লেটে সেঁকা রুটি মাখন, দুধের গেলাস রেখে যায় প্রীতম চাকর। রেখে সে বলে, রবি, কাল যখন সন্ধেবেলা আমি ঘুমোচ্ছিলাম তখন কে আমার কানে জল ঢেলে পালিয়ে গেল শুনি।

তুই ঘুমোস কেন সন্ধেবেলা? বাবা রাগ করে না?

ও ঘুম নয়। চোখ বুজে তোমার জন্য একটা গল্প ভাবছিলাম আর তুমি জল ঢেলে পালিয়ে গেলে। কানের মধ্যে এখনও জলটা ফচ ফচ করছে। আজ বাবাকে যদি বলে না দিই!

পকেট থেকে গম্ভীর ভাবে রিভলভারটা বের করে রবি তুলেই ট্রিগার টেপে। ঠিসুং…ঠিসুং…ঠিসুং…আঃ আ আ, বলে প্রীতম টাল খেয়ে পড়ে যেতে যেতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

দুধের গ্লাসে চুমুক দিয়ে রবি বলে, তারপর বলো।

 চাঁপা অসহায় ভাবে বলে, কী যেন বলছিলাম!

বড্ড ভুলে যাও তুমি।

বুড়ো হচ্ছি না!

বুড়ো হলে কি ভুলে যেতে হয়?

চাঁপা তার গালে গালটা ছুঁইয়েই সরিয়ে নেয় মুখ, বলে, বুড়ো পুরুতমশাই বলেন বাপপিতেমোর আত্মারা সব সময়ে আমাদের নাকি চোখে চোখে রাখেন। এমনিতে কিছু করতে পারেন না, কিন্তু প্রাণ ভরে ডাকলে তারা এসে আপদ বিপদের আসান করে দিয়ে যান। শিবুচরণ তখন ডাকতে থাকে ও মোর বাপপিতেমো, তোমরা কে কোথায় আছ, দ্যাখোসে তোমাদের আদরের শিবের দশাখানা। নিশুত রাতে কে বা জানবে শিবেকে দংশেছে নিঘিন্নে জীব, কে ডাকবে ওঝাবদ্যি, শিবে যে যায়…এইসব বিড়বিড় করে বলছে যখন, তখনই সাপটা হঠাৎ ঠিক মানুষের গলায় বলে, ওহে শিবুচরণ—

ও-ঘর থেকে পর্দাটা সরিয়ে দরজায় দাঁড়ায় দেবাশিস। একটু ভারী গলায় বলে, হারি আপ, হারি আপ–

গী— মুখ ফিরিয়ে হাসে রবি। চাঁপা জড়োসড়ো হয়ে উঠে দাঁড়ায়, কোলে রবি।

দৃশ্যটা দেখে একটু হাসে দেবাশিস, পর্দাটা ফেলে দেয়। ও ঘর থেকে তার গলা পাওয়া যায়ড্রেস আপ ম্যান, ড্রেস আপ।

ইয়া। উত্তর দেয় রবি, তারপর দুটো টেস্ট দু’কামড় করে খেয়ে ফেলে দিয়ে বলে, দিদি, তাড়াতাড়ি করো।

কিছু খেলে না সোনাবাবু!

আঃ খেতে ইচ্ছে করছে না যে।

দুধটুকু তবে দু’ চুমুক, দাদা আমার!

ই কী যে যন্ত্রণা করো না! বলে রবি ঢকঢক করে দুধটা খায়। হাতের উল্টো পিঠে মুখ মুছে ছুটে পাশের ঘরে গিয়ে ডাকে— দিদি, তাড়াতাড়ি।

দেবাশিস ভিতরদিকের দরজা ভেজিয়ে দিল সাবধানে। রবি ও ঘরে পোশাক করছে। ঘড়িতে আটটা বাজে। তৃণা এখন নিশ্চয়ই ঘুম থেকে উঠেছে। ও একটু দেরিতে ওঠে। ওদের বাড়ির এখনকার দৃশ্যটা মনশ্চক্ষে দেখে নিল দেবাশিস। তৃণার বর শচীন এখন বাগানে। এমন ফুল-পাগল, গাছ-উন্মাদ লোক কদাচিৎ দেখা যায়। কেবল মাত্র ওই গাছের জন্য ফুলের জন্য হাজরা রোডের সাতকাঠার মতো জমি সোনার দাম পেয়েও বেচবে না। ওই সাতকাঠার কোনও দরকারই হয় না ওদের, বাড়ির চারধারে বিস্তর জমি। বাড়ি ছাড়িয়ে রাস্তা, রাস্তার ও পাশে ওই ফালতু জমিটায় তার বাগান। এতক্ষণে সেখানে গাছপালার মধ্যে জমে গেছে শচীন। তৃণার এক ছেলে, এক মেয়ে, মনু আর রেবা। মনু টেনিস শিখতে যায় রবিবারে, রেবার নাচগানের ক্লাশ থাকে। আটটা থেকে সোয়া আটটার মধ্যে তৃণার চারধারে চাকর-বাকর ছাড়া কেউ বড় একটা থাকে না। অবশ্য থাকলেও ক্ষতি নেই। সবাই জানে, দেবাশিস আর তৃণার মধ্যে একটা প্লাস চিহ্ন আছে। এমন কী দেবাশিসের বউ চন্দনা আত্মহত্যা করেছিল না খুন হয়েছিল এ বিষয়ে সকলের সন্দেহ কাটেনি এখনও। পুলিশ অবশ্য কেস দিয়েছিল কোর্টে খুনের দায়ে দেবাশিসকে জড়িয়ে, তবে দুর্বল কেসটা টেকেনি। কিন্তু জনগণের মধ্যে এখনও সম্ভবত দেবাশিস আসামি।

ডায়াল করার পর নির্ভুল রিং-এর শব্দ হতে থাকে আর দেবাশিসের একটা দুটো হৃৎস্পন্দন হারিয়ে যায়। শ্বাসের কেমন একটা কষ্ট হতে থাকে।

হেল্লো। তৃণা বলে।

দেব।

বুঝেছি।

কথা বলার অসুবিধে নেই তো!

একটু আছে।

ঘরে কেউ আছে নাকি?

হুঁ।

তা হলে দশ মিনিট পরে ফোন করব।

তৃণা একটু হাসে। বলে, না না, ভয় নেই এসময়ে কেউ থাকে নাকি! একে রোববার, তার ওপর বাদলা ছেড়ে কেমন শরতের রোদ উঠেছে। কেবল আমিই পড়ে আছি একা, কেউ নেই।

কী করছিলে?

টেলিফোনটা পাশে নিয়ে বসে ছিলাম, হাতে খোলা জীবনানন্দের সাতটি তারার তিমির; কিন্তু একটা কবিতাও পড়া হচ্ছিল না।

দেবাশিস গলাটা সাফ করে নিয়ে বলে, কী করবে আজ?

কী আর! বসে থাকব। তুমি?

আজকাল রবি ছুটির দিনগুলোয় চাঁপার কাছে থাকতে চায় না।

বড় হচ্ছে তো, রক্তের টান টের পায়। শত হলেও তুমি বাপ।

তুমি বেরোচ্ছ না?

তৃণা একটা শ্বাস ছেড়ে বলে, জানোই তো, চারদিকে লোকনিন্দের কাঁটাবেড়া, একা বেরোলেই শচীন এমন একরকম কুটিল চোখে তাকায়! আজকাল বুড়ো বয়সে বড্ড সাসপিশাস হয়েছে। ছেলেমেয়েরাও পছন্দ করে না। তাই আটকে থাকি ঘরে।

দুর! ওটা কোনও কথা হল নাকি?

তবে কথাটা কী রকম হলে মশাইয়ের পছন্দ?

আমি বলি, তুমিও বেরিয়ে পড়ো, আমিও বেরিয়ে পড়ি।

তারপর?

কোথাও মিট করব।

তৃণা একটু চুপ করে থেকে বলে, দেব, রবি কিন্তু বড় হচ্ছে।

কী করব?

সাবধান হওয়া ভাল। যা কর ছেলেকে সাক্ষী রেখে কোরো না।

তিনু, তুমি কিন্তু এতটা গেরস্ত মেয়ে ছিলে না, দিনদিন কী হয়ে যাচ্ছ?

বয়স হচ্ছে।

ও সব আমি বুঝি না। গত সাতদিন তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি।

মিথ্যুক।

কী বলছ?

বলছি তুমি মিথ্যুক। তৃণা হাসে।

কেন?

পরশুদিনও তুমি সন্ধের পর গাড়ি পার্ক করে রেখেছিলে রাস্তায়, যেখান থেকে আমার শোয়ার ঘরের জানলা দেখা যায়।

বাঁ হাতে বুক চেপে ধরে দেবাশিস, শ্বাসকষ্ট। হৃৎস্পন্দন হারিয়ে যায় একটা…দুটো… গভীর একটা খাস টানে সে। বুকে বাতাসের তুফান টেনে নেয়।

দেবাশিস আস্তে করে বলে, কী করে বুঝলে যে আমি।

তোমাকে যে আমি সবচেয়ে বেশি টের পাই।

গাড়ির নাম্বার প্লেট দেখেছ।

না। আবছা গাড়িটা দেখেছি। আর দেখেছি ড্রাইভিং সিটে একটা সিগারেট আর দুটো চোখ জ্বলছে।

যাঃ।

আমি জানি দেব, সে তুমি ছাড়া আর কেউ নয়।

দেবাশিস দাঁত টিপে চোখ বুজে লজ্জাটাকে চেপে ধরে মনের মধ্যে। গলার স্বর কেমন অন্য মানুষের মতো হয়ে যায়, সে বলে, তুমি ছাড়া আর তো কেউ জানে না।

জানবে কী করে! তৃণা হাসে তোমাকে যে না চেনে সে কী করে জানবে রাস্তায় কার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কে বসে আছে ড্রাইভিং সিটে একা ভূতের মতো! আমি ছাড়া এত মাথাব্যথা আর কার?

তুমি অনেকক্ষণ বড় জানালাটার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলে। পিছনে ঘরের আলো, তাই তোমার মুখ দেখতে পাইনি। যদি জানতাম যে তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ।

তা হলে কী করতে?

তা হলে তক্ষুনি রাস্তায় নেমে ছক্করবাজি নাচ নেচে নিতাম।

দেব, বয়স বাড়ছে।

দেবাশিস তৎক্ষণাৎ বলে, পাগলামিও।

বুঝলাম। কিন্তু কেন? ওরকম কাঙালের মতো আমার বাড়ির পাশে বসে থাকবার মতো কী আছে? নতুন তো নয়।

দেবাশিস ঠিক উত্তরটা খুঁজে পায় না। রক্ত কলরোল তোলে। বুকে আছড়ে পড়ে অন্ধ জলোচ্ছাস। সে বলে, তিনু, আমি বড় কাঙাল।

তৃণা একটু খাস ফেলে। কিছু বলে না।

দেবাশিস বলে, শুনছ।

কী?

আমি বড় কাঙাল।

কাঙাল কি না জানি না, তবে বাঙাল বটে।

তার মানে?

বাঙাল মানে বোকা। বুঝেছ?

তাই বা কেন?

রবি কোথায়? তোমার এ সব পাগলামির কথা তার কানে যাচ্ছে না তো?

কানে গেলেই কী! ও বাচ্চা ছেলে, বুঝবে না।

তৃণা একটা মৃদু হাসি হেসে বলে, তুমি বাচ্চাদের কিছু জানো না। ওরা সব আজকাল পাকা বিন্দু হয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া বাচ্চারা কিন্তু সব টের পায়।

দেবাশিস একটু হতাশার গলায় বলে, শোনো, রবির জন্য চিন্তার কিছু নেই। চিন্তা করে লাভও নেই। যদি টের পায় তো পাক। আগে বলল, তোমার সঙ্গে দেখা হবে কি না।

তৃণা মৃদুস্বরে বলে, কোথায়?

তুমি যেখানে বলবে।

আমার লজ্জা করে। তোমার সঙ্গে যে তোমার ছেলে থাকবে।

ও তোমায় চেনে না নাকি! এ সব নতুন ডেভেলপমেন্ট তোমার কবে থেকে মনে হচ্ছে?

রবি বড় হচ্ছে তাই ভয় পাই। বুঝতে শিখছে।

ভয় পেয়ো না। গাড়ি নিয়ে বেরোচ্ছি। ঘন্টা খানেক চিড়িয়াখানা আর রেস্টুরেন্টে কাটাব। দুপুরে আমার বোনের বাড়িতে খাওয়ার নিমন্ত্রণ। অবশ্য একা রবিরই নিমন্ত্রণ, ওদের বাড়িতে যে আমি খুব জনপ্রিয় নই তা তো জানোই, রবিকে সেখানে পৌঁছে দিয়ে আমি ফ্রি।

তার মানে এগারোটা কি বারোটা হবে বেলা। আমি কি তোমার মতো স্বাধীন দেব? দুপুরে সকলের খাওয়ার সময়ে বাইরে থাকলে লোকে বলবে কী?

তা হলে চিড়িয়াখানা বা রেস্টুরেন্টে এসো।

তা হলে রবিকে চোখ এড়ানো যাবে না।

উঃ। তুমি যে কী গোলমাল পাকাও না।

তৃণা হেসে বলে, আচ্ছা না হয় দুপুরের প্রোগ্রামই থাকল। কোথায় দেখা হবে।

তুমি ফাঁড়ির কাছে বাসস্টপে থেকো।

দেবাশিস চোখের কোণ দিয়ে দেখে রবি এসে দাঁড়িয়েছে পর্দা সরিয়ে দরজার চৌকাঠে। স্ট্রেচলনের একটা হালকা নীল রঙের প্যান্ট আর দুধ-সাদা একটা টি-শার্ট পরনে, বুকের কাছে বাঁ ধারে মনোগ্রাম করা ওর নামের আদ্য অক্ষর। মাথায় থোপা থোপা চুলের ঘুরলি। একটু হাসি ছিল মুখে। সেটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে এখন।

তা হলে? দেবাশিস ফোনে বলে।

আচ্ছা ছাড়লাম।

সো লং।

ফোনটা রেখে দেয় সে।

হাসিটা আর রবির মুখে নেই, মিলিয়ে গেছে, চেয়ে আছে বাবার দিকে। চোখে চোখে পড়তেই মুখটা সরিয়ে নিল।

দেবাশিস ছেলের দিকে চেয়ে থাকে। বুকের মধ্যে ঝড় থেমেছে, ঢেউ কমে এল, শুধু অবসাদ। টেনশনের পর এমনটা হয়, মুখে একটু সহজ হাসি ফুটিয়ে তোলা এখন বেশ শক্ত, টানাপোড়েন এখনও তো শেষ হয়নি। তৃণার সঙ্গে দুপুরে দেখা হবে, ফাঁড়ির কাছের বাসস্টপে। তার স্নায়ুর ভিতরে এখনও একটা তৃষ্ণার্ত উচাটন ভাব। দেখা হবে, পিপাসা বাড়বে, তবু এক সমুদ্রের তফাত থেকে যাবে সারা জীবন তৃণার সঙ্গে তার।

রবি মুখ তুলতে দেবাশিস ক্লিষ্ট একরকম হাসি হাসে। রবি কি সব বোঝে। বুকের মধ্যে একটা ভয় আচমকা হৃদ্যন্ত্রকে চেপে ধরে তার।

চতুর ভঙ্গিতে দেবাশিস এক পা এগিয়ে হাত বাড়িয়ে বলে, দিস ইজ দেবাশিস দাশগুপ্ত।

বাড়ানো হাতখানা রবি ধরে শেকহ্যান্ড করতে করতে বলে, দিস ইজ নবীন দাশগুপ্ত, প্লিজড টু মিট ইউ।

রবির পিছনে চাঁপা দাঁড়িয়ে। পরিষ্কার শাড়ি পরেছে, চুল আঁচড়েছে। দেবাশিসের চোখ পড়তেই চোখ নামিয়ে ভারী নরম সুরে বলে, বাবা, আমি কি সোনাবাবুর সঙ্গে যাব?

দেবাশিস অবাক হয়ে বলে, কোথায়?

চাঁপা লাজুক গলায় বলে, সোনাবাবু ছাড়ছে না, কেবল সঙ্গে যেতে বলছে!

রবি করুণ মুখভাব করে বলে, দিদি যাবে বাবা?

দেবাশিস একটু ক্ষীণ হাসি হাসে, বলে, তোমার ইচ্ছে হলে যাবে, কিন্তু খাবে কোথায়? ওর তো নেমন্তন্ন নেই।

চাঁপার মুখ একটা হাসির ছটায় আলো হয়ে যায়, বলে, আমি কিছু খাব না, সকালে পাস্তা খেয়ে নিয়েছি, সোনাবাবুর সঙ্গে সঙ্গে থাকব, সেই আমার খাওয়া।

দেবাশিস অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ে, গাড়ির চাবিটা আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে দরজা খুলে লিফটের দিকে এগোয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *