০১. গোয়াডালক্যানেল, সলোমন আইল্যাণ্ড, ১১৭০ এ.ডি.

বিশ্বের এক নম্বর অ্যাডভেঞ্চার লেখক ক্লাইভ কাসলার-এর দ্য সলোমন কার্স
সহযোগী লেখক : রাসেল ব্লেক

রূপান্তর: সাঈম শামস্

অনুবাদকে উৎসর্গ

আফসানা আক্তার বিন্দু
প্রায় চার বছরের বন্ধুত্বের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি,
 “সব মেয়ে খারাপ নয়” এই বাক্যটিকে সঠিক প্রমাণ করেছ তুমি।

.

পাঠকদের উদ্দেশে কিছু কথা

প্রথমেই ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমার অনুবাদের উপর ভরসা রেখে ক্লাইভ কাসলার-এর দ্য সলোমন কার্স সংগ্রহ করার জন্যে। যারা আমার অনূদিত ব্ল্যাক অর্ডার বা শক্ ট্রিটমেন্ট পড়েছেন তারা ইতিমধ্যে জানেন আমি কেমন অনুবাদ করি।

 ব্ল্যাক অর্ডার ও শক্ ট্রিটমেন্ট-এর ভাবানুবাদ যেভাবে পাঠকদেরকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছিল এবার দ্য সলোমন কার্স সেই সম্ভষ্টির মাত্রাকে অতিক্রম করতে পারবে আমার বিশ্বাস।

দ্য সলোমন কার্স ট্রেজার হান্টিং থ্রিলার নভেল। অর্থাৎ, গুপ্তধন উদ্ধার সম্পর্কিত রোমাঞ্চ উপন্যাস। কাহিনি সংক্ষেপ যেহেতু পেছনের কভারে দেয়া আছে। আমি বরং এখানে পাঠকদেরকে এই বইয়ের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে একটু ধারণা দিচ্ছি।

বইটির প্রথম অংশে বেশ সময় নিয়ে টুকরো টুকরো দৃশ্যের সাহায্যে কাহিনির গাঁথুনি শুরু হয়েছে, পাশাপাশি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে বিভিন্ন চরিত্রের সাথে। অতএব, প্রথম অংশ একটু ধীর গতিতে এগিয়েছে। তারপর দৌড়, একটু বিশ্রাম, আবার দৌড়, আবার একটু বিশ্রাম; এভাবে চক্রাকারে এগিয়েছে উপন্যাসের কাহিনি। শেষ অংশে গিয়ে আর বিশ্রাম নেই। শুধু দৌড়! একদম নাভিশ্বাস তুলে তারপর পাঠকদের রেহাই দিয়েছেন ক্লাইভ কাসলার।

বইটি অনুবাদ করার জন্য আমাকে দিয়েছিলেন সম্মানিত প্রকাশক রিয়াজ খান। তার পছন্দের বই। পড়তে গিয়ে আমারও পছন্দ হয়েছে। আর অনুবাদ করে তো এখন প্রেমেই পড়ে গেছি।

পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানচ্ছি যে, এবার প্রথমবারের মতো নিজেই নিজের বইয়ের প্রুফ দেখে প্রয়োজনীয় সংশোধন করেছি। হয়তো তারপরও শতভাগ নিখুঁত করতে পারিনি তবে বানান বিভ্রাটে পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে বলে আমার বিশ্বাস।

আশা করছি, দ্য সলোমন কার্স পাঠকদের ভাল লাগবে। পাঠকবৃন্দ, অনেক কথা হলো, আর দেরি না করে এবার ফারগো দম্পতির সাথে গুপ্তধন উদ্ধার অভিযানে যোগ দিন! শুভ কামনা রইল।

-সাঈম শামস
উত্তরা, ঢাকা

.

.

প্রস্তাবনা

গোয়াডালক্যানেল, সলোমন আইল্যান্ড, এক সপ্তাহ আগে

জীবন বাঁচাতে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে প্রাণপণ দৌড়াচ্ছে আলভো। ছুটতে ছুটতে একটু থামল ও। রাস্তা খুঁজছে। ঘাম গড়াচ্ছে কপাল বেয়ে। গাছের ডালপালার খোঁচা লেগে ওর এখানে ওখানে ছড়ে গেছে, রক্ত ঝরছে জখম থেকে। পেছন থেকে আওয়াজ ভেসে আসতেই ব্যথাকে পাত্তা না দিয়ে আরও জোরে ছুটল ও।

জলধারা বয়ে যাচ্ছে। জঙ্গলের আরও ভেতরে কিংবা সমুদ্রে গিয়ে মিশেছে। এই ধারা।

আওয়াজ শুনতে পেল ও।

কুকুর।

খুব বেশি পিছিয়ে নেই ওগুলো।

আলভোকে এগোতেই হবে। যারা ধাওয়া করছে ও যদি তাদের হাতে ধরা পড়ে তাহলে তার পরিণাম হবে মরে যাওয়ার চেয়েও জঘন্য।

নগ্ন পায়ে পানি মাড়িয়ে এগোতে শুরু করল আলভো। চোখা পাথরে খোঁচা লেগে ওর পা কেটে গেল, ব্যথা পেলেও থামল না বেচারা। ওপারে ওকে যেতেই হবে। পানি মাড়িয়ে ওপারে গেলে হয়তো কুকুরগুলো অনুসরণ করতে পারবে না।

চতুরতা নয় স্রেফ সহজাত প্রবৃত্তি খাঁটিয়ে এগোচ্ছে আলডো। ওর বয়স মাত্র ১৭ বছর। কিন্তু আজ যদি ধরা পড়েই যায় তাহলে কিশোর নয়, একজন পুরুষের মতো মরবে ও।

এই ভাবনাটা ওকে আরও শক্তি যোগাল। তাদের হারাতে হবে নয়তো নিজে মরতে হবে। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

পেছনে ডালপালার মচমচানি শুনে আরও গতি বাড়াল আলডো। শব্দটা খুব কাছেই হয়েছে। ওকে আরও দ্রুত ছুটতে হবে। যদি বাঁচতে চায় তাহলে যেভাবেই হোক ধাওয়াকারীদের সাথে দূরত্ব বাড়াতে হবে ওকে।

গোয়াডালক্যানেলের স্থানীয় বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও আলতো কখনও দ্বীপের এই অংশে আসেনি। শুধু আলডো নয়, কেউ-ই আসেনি এখানে। ফলে দ্বীপের এই অংশ সম্পর্কে ওর বিশেষ কোনো জ্ঞান নেই। তাই কোনো কৌশল অবলম্বন করে নিজের জন্য বাড়তি সুবিধাও করতে পারছে না। আলভোর বর্তমান অবস্থা একটা বেকায়দায় পড়া ইঁদুরের মতো। দিশাহারা ও আতঙ্কিত।

পেছন থেকে আওয়াজগুলো আরও কাছে চলে আসছে।

এই ঘোর বিপদে আলডো কীভাবে জড়িয়ে গেল? ওর বিশ্বাসই হতে চাইছে না, এই রাতের অন্ধকারে ও জীবন বাঁচানোর জন্য দৌড়াচ্ছে। ডান পাশে একটা মোটা বাশ উদয় হলো। এক মুহূর্তের জন্য আলডো ভাবল বাশটাকে এড়িয়ে যাবে কিন্তু পারল না।

 বাশটা আলভোর ডান পাশে আঘাত করেছে। পাজরের কাছে ব্যথা অনুভব করল বেচারা। তবুও জখমকে পাত্তা দিল না। ওকে সামনে এগোতে

কিন্তু যাবে কোথায়? পেছন থেকে ধেয়ে আসা ব্যক্তিদের এড়িয়ে আলডো কোথায় যাবে? নিরাপদ জায়গা আছে? এই দ্বীপটা বেশ ছোট। ও চাইলে পুরো ঘটনাটাকে একটা দুঃস্বপ্ন ধরে নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারে। কিন্তু বাড়িতে পৌঁছুনোর আগেই তো আলডো ধরা পড়ে যাবে। বাকিদের মতো গায়েব করে দেয়া হবে ওকে। কাউকে কিছু বলারও সুযোগ পাবে না।

বিজলি চমকাল আকাশে। স্বর্গ থেকে যেন বৃষ্টি নামতে শুরু করল। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এগোতে এগোতে হাসি ফুটল আলভোর ঠোঁটে। বৃষ্টির কারণে কুকুরগুলো হয়তো ওকে ঠিকঠাকভাবে অনুসরণ করতে পারবে না।

আকাশের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল বিজলির রেখা। ঝলসে উঠল আকাশ। বাঁ পাশে ভারি পাতায় ঢাকা একটা পথ দেখতে পেল ও। মুহূর্তের মধ্যে আলভো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। জঙ্গলের মাটি বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেছে। পানির পাশ ধরে এগোচ্ছে আলডো। কিন্তু ওর কানে এলো কুকুরগুলো ঠিক ওর পিছু পিছুই আসছে। আলডো আর কুকুরগুলোর মাঝে দূরত্ব কম থাকায় এরকমটা হয়েছে।

কুকুরগুলোকে পেছন থেকে খসিয়ে দেয়ার আশা আর করা যাচ্ছে না। দ্রুত এগোতে হবে- ভাবল আলডো। অন্ধের মতো ছুটছে ও, রক্ত ঝরছে পা থেকে।

হঠাৎ পা হড়কে পড়ে গেল আলছো। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ওকে নিচে টেনে নিয়ে গেল। ঢাল বেয়ে নিচে গড়াতে গড়াতে গতি কমাতে চাইল আলডো। আচমকা একটা গাছের গুঁড়ির সাথে আটকে ওর গতি থেমে গেল।

নিজেকে সামলে নেয়ার পর আলো আবিষ্কার করল ওর মাথা আর আঙুলে রক্ত লেগে রয়েছে। ডুবন্ত ব্যক্তির মতো বাতাস ফুসফুসে ভরার জন্য হাসফাস করছে ও। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে জ্ঞান হারানো ঠেকাতে চেষ্টা করছে আলডো।

পাজর আর বাঁ হাতে তীব্র ব্যথা। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে দেখল ওর হাড় ভেঙ্গে গেছে। কপাল ভাল, পায়ের হাড় ভাঙ্গেনি। ব্যথার কষ্ট আর বৈরি আবহাওয়া ভুলে চারিদিকে চোখ বুলাল ও। প্রায় অন্ধকার সব। উপর থেকে গড়িয়ে পড়ার পর ওর দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে গেছে। ঝাপসা দৃষ্টিতে একটা পথ ওর চোখে পড়ল। সেদিকে এগোল ও।

নিজের হৃদপিণ্ডের আওয়াজ আলভোর কানে ড্রামের মতো বাজছে। সহ্য ক্ষমতার সর্বোচ্চ সীমায় চলে এসেছে ও। প্রতিবার শ্বাস নেয়ার সময় তীব্র ব্যথা হচ্ছে ভাঙ্গা পাজরে। এক কিনারে সরে যেতেই পেছন থেকে আসা আওয়াজ কমতে শুরু করল। অবশেষে ওর মনে হলো, হয়তো এ-যাত্রায় বেঁচে যেতে পারবে।

হঠাৎ গাছের গুঁড়ির সাথে হোঁচট খেয়ে ভূপাতিত হলো আলভোর আছড়ে পড়তেই আর্তনাদ করে উঠল বেচারা। পানি গড়িয়ে পড়ল ওর চোখ দিয়ে। ওর সামনে থেকে পুরো দুনিয়া মুছে গেল।

জ্ঞান হারিয়েছে।

কয়েক মিনিট পর যখন জ্ঞান ফিরল, আলভো দেখল কুকুরের নাক ওর মুখের সামনে গন্ধ শুঁকছে। একজনের কথা শুনতে পেল ও। কথার শেষ অংশটুকু শুনে আলডো নিশ্চিত হলো ওর জীবনের এখানেই সমাপ্তি। আর কখনও কোনো কথা শোনা হবে না ওর।

‘তুই জানিস না, এই দ্বীপ থেকে পালানো তোর কম্ম নয়?’

মুখের সাথে মগজের সমন্বয় ঘটিয়ে কিছু একটা বলার আগেই আলডোর কপাল বরাবর একটা বুট ধেয়ে এলো। ও কোনো বাধা, আর্জি কিংবা অভিশাপ কিছুই দিতে পারল না। লাথি খেয়ে চোখের সামনে তারা জ্বলতে দেখল আলডো। তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে ওর। বাধা দিতে চাইল, কিন্তু ওর হাত-পাগুলো যেন সীসার মতো ভারি হয়ে গেছে।

আলডো ভাবল, কোথাও একটা গড়বড় হয়েছে। ভুল বোঝাবুঝি কিংবা ভুল হয়েছে কোথাও। ভাবতে ভাবতে আবার ধেয়ে এলো বুট। এবার আগের চেয়ে জোরে আঘাত করল সেটা। লাখির জোর বেশি হওয়ায় মড়াৎ করে আলভোর ঘাড় ভেঙ্গে গেল। বেরিয়ে গেল প্রাণবায়ু। মুখের উপর বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আছড়ে পড়ছে। কিন্তু আলডো আর এখন এসব কিছুই অনুভব করতে পারছে না। অন্য দুনিয়ায় পাড়ি জমিয়েছে সে।

.

০১.

গোয়াডালক্যানেল, সলোমন আইল্যাণ্ড, ১১৭০ এ.ডি.

শান্ত সাগরের বুক থেকে সবেমাত্র সূর্য উঠতে শুরু করেছে। বনের ভেতর দিয়ে এগোচ্ছে দ্বীপের বাসিন্দারা। ফিসফিস করছে সবাই। সমুদ্রের ঠিক উপরেই এক নতুন শহর বানানো হয়েছে। সেটাই দেখতে যাচ্ছে এরা।

সবার সামনে রয়েছেন প্রধান পুরোহিত। এখন বেশ গরম পড়েছে কিন্তু তিনি সেটাকে তোয়াক্কা না করে রংচঙে গাউন পরে এসেছেন। ইতিমধ্যে ঘাম দেখা দিয়েছে তার চেহারায়। অনেকে গোয়াডালক্যানেলের পশ্চিম অংশে নির্মিত নতুন প্রাসাদে তীর্থযাত্রা সেরে ফেললেও প্রধান পুরোহিত সবেমাত্র নিজের দলবল নিয়ে এগোচ্ছেন। পেছনে তাকালেন পুরোহিত। তার চেহারায় সন্তুষ্টি ফুটে উঠল। এই যাত্রার জন্য তিনি রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ লোকদেরকে সাথে নিয়ে যাচ্ছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই আছে যারা এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে কিছুদিন হলো পার্শ্ববর্তী দ্বীপে এসে উঠেছিল। আজকের এই অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়ে রাখা হয়েছে পাক্কা এক সপ্তাহ আগে। এক সপ্তাহ, সবার প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট সময়।

 জঙ্গলের ডালপালা ভেদ করে ভোরের রূপোলি আলো উঁকি দিচ্ছে। ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সারিবদ্ধ ভাবে এগোচ্ছে সবাই। এই দ্বীপটা বেশ বৈচিত্রময়। গোয়াডালক্যানেলের স্থানীয় উপজাতিরা সাগরের পাড় থেকে ৩০০ ফুটের ভেতরে বাস করে। দ্বীপের গভীরে যেতে চায় না ওরা। অনেক দৈত্য দানবের কাহিনি প্রচলিত আছে দ্বীপকে কেন্দ্র করে। সেগুলোর কিছু বাস্তব আর কিছু কল্পিত। দ্বীপের বিভিন্ন ভূগর্ভস্থ গুহাতে আছে দৈতাকার জন্তু, মানুষের চেয়ে দ্বিগুণ আকৃতির ভয়ঙ্কর দানব। অসতর্ক, বেখেয়ালি মানুষের রক্ত পান করে তৃষ্ণা মেটানোর জন্য ওঁত পেতে রয়েছে ওগুলো। কে দ্বীপের ভেতরে গিয়ে নিজের প্রাণ খোয়াতে চাইবে? আর জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু যখন সাগর থেকেই পাওয়া যাচ্ছে তখন ঝুঁকি নিয়ে দ্বীপের ভেতরে যাওয়ার তো কোনো দরকার নেই।

পুরোহিত একটু থামলেন। সামনে যেন এক অলৌকিক দৃশ্য দেখতে পাচ্ছেন তিনি। প্রাসাদ দেখা যাচ্ছে! সমুদ্রের ঠিক যেখানে আগে শুধু পানি দেখা যেত সেখানে এখন মানুষ নির্মিত ইমারত গড়ে উঠেছে। হাত বাড়িয়ে পেছনের লোকদের এই অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখালেন। প্রার্থনার সুরে রাজার নাম জপলেন পুরোহিত। ইমারত দেখে মনে হচ্ছে, রাজা যেন সরাসরি স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে এসেছেন। একজন সাধারণ মানুষ থেকে নিজের জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছেন এই রাজা।

রাজা লক-এর এই অর্জন তার নিজের অন্যান্য অর্জনকে নিষ্প্রভ করে দিয়েছে। অনুষ্ঠানের পর এই প্রাসাদকে রাজকীয় বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার করা হবে।

দ্বীপের পুরোহিত এই ইমারতকে রাজা লক-এর ঐশ্বরিক শক্তির নিদর্শন হিসেবে ধরে নিলেন। রাজার হাজার হাজার শ্রমিক প্রায় এক যুগ সময় ব্যয় করে এটা নির্মাণ করেছে। দ্বীপ থেকে পাথর বয়ে নিয়ে গেছে সমুদ্রে। অনেক পরিশ্রম করেছে। এরকম নির্মাণশৈলী এরআগে কেউ কখনও দেখেনি। মহামান্য রাজা তার উপদেষ্টাদের বলেছেন, এই ইমারত নির্মাণের মাধ্যমে এক নতুন যুগের শুভ সূচনা ঘটল।

সবাই রাজার এই বক্তব্যের সাধে সম্পূর্ণ একমত। রাজা লক এই দ্বীপকে সাধারণ থেকে এক সম্পদশালী রাজ্যে পরিণত করেছেন। প্রজাদের মাঝে অঢেল সম্পদ বিলিয়ে দিয়েছেন তিনি। মূল্যবান রত্ন আর সোনার খনি খুঁড়ে দ্বীপের চেহারা বদলে দিয়েছেন। অন্যান্য দ্বীপ ও অঞ্চলের সাথে ব্যবসায়ের নতুন দিগন্ত উন্মাচিত হয়েছে তার হাত ধরে।

কয়েক বছরের মাঝে দ্বীপের বাসিন্দারা লক্ষ্য করল তারা বেশ ধনী হয়ে উঠেছে। সূদূর জাপান থেকেও ব্যবসায়ীরা এসে সোনা ও অন্যান্য মূল্যবান রত্নের বিনিময়ে বিভিন্ন পণ্য দিয়ে যায়। তবে সোনার চাহিদা ছিল একদম তুঙ্গে। দ্বীপের বাসিন্দারা পাহাড়ে মূল্যবান ধাতুর খনি খুঁড়তে শুরু করল। নিশ্চিন্তে কাজ করত সবাই, কারণ ওরা জানে রাজা লক ওদের উপর দৃষ্টি রেখেছেন।

পুরোহিতের অনুসারীরা তার পিছু পিছু এসে পাশের জায়গাগুলো ভরাট করে দাঁড়াল। সবাই অবিশ্বাস নিয়ে পাহাড় থেকে ইমারত দেখছে। উপজাতির এক সর্দার পুরোহিতের কাছে গিয়ে ইমারতের পাশের একটা জায়গা নির্দেশ করে দেখাল। ওখানে পাথর দিয়ে নির্মিত এক মন্দির থেকে কয়েকজন ব্যক্তিকে বেরোতে দেখা যাচ্ছে।

‘উনি কি রাজা লক? ওখানকার সবচেয়ে লম্বা লোকটার দিকে নির্দেশ করে জানতে চাইল সর্দার।

‘হ্যাঁ, উনিই।’ পুরোহিত জবাব দিলেন। রাজার পরনে থাকা বিশেষ টিউনিকটা (জোব্বা ধরনের জামা) বিভিন্ন মূল্যবান রত্ন ও সোনায় মোড়ানো হওয়ায় সূর্যের আলো লেগে চকমক চকমক করছে।

 ‘মন্দিরটা চমৎকার,’ বলল সর্দার। ভবিষ্যত্বাণী অনুযায়ী আমাদের পথচলার ১০ লাখ বছরের শুরুটা হয়েছিল এই মন্দিরের মাধ্যমে।

 এটা সর্বস্বীকৃত যে, রাজা লকের হাত ধরে দ্বীপ স্বর্ণযুগে প্রবেশ করেছে। একটা সময় আসবে যখন এই রাজ্য হবে পুরো অঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র ও শক্তির উৎস। সবকিছুকে হারিয়ে দাপট দেখাবে গোয়াডালক্যানেল। ভবিষ্যত্বাণী অনুযায়ী সেই দাপট ২৫ প্রজন্ম ধরে চলবে। ভবিষ্যৎবাণীতে একজন বিশেষ ব্যক্তির’র কথা বলা আছে। যার অনেক জাদুময় ক্ষমতা থাকবে। এখানকার সবাই বিশ্বাস করে রাজা লক হলেন সেই বিশেষ ব্যক্তি। এই দ্বীপ থেকে এত সোনা ভোলা হচ্ছে, এটা শুধুমাত্র তার জন্যই সম্ভব হয়েছে। পৃথিবী যেন ভেতরে থাকা সব সম্পদ তার হাতে ঢেলে দিয়ে হালকা হতে চাইছে, বশ্যতা স্বীকার করেছে নতুন মনিবের কাছে।

মাথা নাড়ল সর্দার। রাজা লক কোনো সাধারণ ব্যক্তি নন, এটা নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ নেই। সর্দারের মনে একবার সংশয় জাগল, ইমারতের পেছনে থাকা সাগর যদি পুরোটা ডুবিয়ে দেয়? ভাসিয়ে নিয়ে যায়? কিন্তু তখনও সে জানে না নিজের দ্বীপে ফেরার সময় অলৌকিক খবর নিয়ে ফিরবে সে।

হঠাৎ কিচির-মিচির আওয়াজ তুলে এক ঝাঁক পাখি আকাশে ডানা মেলল। পাখিদের ডাকাডাকিতে খান খান হয়ে গেল ভোরের নীরবতা। পুরোহিত হতভম্ব হয়ে চারিদিকে চোখ বুলালেন, কী হচ্ছে বুঝে উঠতে পারছেন না। মাটি কাঁপতে শুরু করল এবার। কম্পনের সাথে যোগ হলো চাপা গর্জন। পুরোহিতের গলায় শ্বাস আটকে যাওয়ার দশা। পায়ের তলা মাটি এখন এমন আচরণ করছে যেন এটা একটা জাহাজের ডেক, আর জাহাজটা এখন ঝড়ের কবলে পড়ে নাকানি-চুবানি খাচ্ছে। নিজেকে স্থির রাখার জন্য পাশে থাকা এক গাছের দিকে হাত বাড়ালেন পুরোহিত।

 পায়ের তলার মাটি চিড়ে দু’ফাঁক হয়ে যেতেই এক লোক চিৎকার করে উঠল। পরমুহূর্তে পড়ে গেল ফাটলের ভেতর। আরও ফাটল তৈরি হতেই তার আশেপাশের লোকজন সব ছিটকে সরে গেল এদিক-ওদিক। পুরো দুনিয়া যেন দুলছে। হাঁটু গেড়ে বসলেন পুরোহিত, প্রার্থনা করতে গিয়েও সদ্য নির্মিত ইমারতের দিকে চোখ পড়তেই সেটা তার ঠোঁটের মাঝে আটকে গেল।

একটু আগে যেখানে মন্দির আর জৌলুসপূর্ণ প্রাসাদ ছিল সেটা এখন নেই! সাগরের পানি উঠে এসে প্রাসাদকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে গেছে। প্রকৃতির উপর দিয়ে যে রাজা পণ্ডিতি ফলিয়ে এত বছর সময় ব্যয় করে জিনিসটা নির্মাণ করেছিল এখন ইমারত ও এর নির্মাতা কারওই কোনো চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। দশ বছর ধরে বানানো প্রাসাদকে এক মুহূর্তের ভূমিকম্প স্রেফ গায়েব করে দিয়েছে। গিলে নিয়েছে পুরো প্রাসাদ।

মুহূর্তের মধ্যে শুরু হওয়া প্রলয় মুহূর্তেই শেষ হয়ে গেল। আর কোনো তাণ্ডব নেই। পৃথিবী এখন আর দুলছে না। তবে সদ্য তৈরি হওয়া ফাটল থেকে হিস হিস আওয়াজ আর ভূমিকম্পের ফলে আহত ব্যক্তিদের গোঙানি শোনা যাচ্ছে এখনও। যারা বেঁচে আছে সবাই হাঁটু গেড়ে বসল। পুরোহিতের নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করছে। আতঙ্কিত চোখে সাগরের উপর দিয়ে চোখ বোলালেন পুরোহিত। জোর খাঁটিয়ে নিজেকে দাঁড় করালেন।

‘দৌড়াও সবাই! উঁচু জায়গায় আশ্রয় নাও!’ চিৎকার করে নির্দেশ দিয়েই তিনি নিজেও কম্পিত পায়ে দৌড়াতে শুরু করলেন। যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে সরতে হবে। পূর্বপুরুষদের কাছে এরকম জলোচ্ছ্বাসের গল্প শুনেছেন তিনি। যখন পৃথিবী আর সাগরের দেবতারা প্রভাব বিস্তারের জন্য যুদ্ধ করতে শুরু করে তখন এরকম দূর্যোগ দেখা দেয়। পুরোহিতের চিন্তা হচ্ছে সাগর একটু আগে যে রূপ দেখিয়ে নতুন প্রাসাদকে গ্রাস করে নিয়েছে সামনে আরও ভয়ঙ্কর রূপধারণ করে আঘাত হানতে পারে।

 নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটছে সবাই কিন্তু খুব কম লোকই সফল হলো। সুনামি যখন দ্বীপে আঘাত করল তখন জলরাশির উচ্চতা ১০০ ফুট। দ্বীপের পাড়ে থাকা পাথরগুলোকে দ্বীপের এক মাইল ভেতরে নিয়ে গেল সুনামি। ফেরার সময় সব ধুয়ে মুছে নিয়ে গেল। যেন সব চেটেপুটে পরিষ্কার করে নিয়ে গেলেন সমুদ্রের দেবতা!

 সে-রাতে সাগরপাড় থেকে যত দূরে সম্ভব সরে গিয়ে জীবিত ব্যক্তিদের নিয়ে ক্যাম্পফায়ার করে গোল হয়ে বসলেন পুরোহিত। সাগরকে আর তারা ভাল চোখে দেখতে পারছে না। সাগর আর বন্ধু নয়।

‘দিন শেষ,’ বললেন পুরোহিত। আমাদের রাজা দেবতাদেরকে রাগিয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়া এই ঘটনার আর কোনো ব্যাখ্যা নেই। প্রকৃতির উপর দিয়ে হাত ঘোরানোর জন্য এই শাস্তি হলো আমাদের। এখন আমরা আমাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব এবং আগের মতো সুখ-শান্তি ফিরে চাইব।

 উপস্থিত সবাই মাথা নাড়ল। ওদের রাজা নিজেকে দেবতাদের কাতারে ফেলেছিলেন। আর তিনি তার বেয়াদবির শাস্তিও পেয়েছেন। অহংকার করলে পাপ হয়। সেই পাপের শাস্তি পেয়েছেন তিনি। তাঁর নির্মিত ইমারতসহ সাগরের বুকে বিলীন হয়ে গেছেন। রাজা লক-এর কোনো নাম-নিশানাও নেই এখন। যেন তিনি কখনও এখানে ছিলেনই না!

পরের দিনগুলোতে জীবিত ব্যক্তিরা দেবতাদের এরকম নৃশংস বিচার নিয়ে ফিসফিস করে আলাপ করল। তিন রাত পর পুরোহিত এক সভা ডাকলেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হলো রাজা ও তাঁর রাজ্যের নাম আর কখনও যেন উচ্চারিত না হয়। তাঁর সেই মন্দির, ইমারত কোনো কিছু নিয়েই যেন আর কথা না হয়, সব ভুলে যেতে হবে। তার যাবতীয় কর্ম ভুলে, তার অস্তিত্বকে মুছে দিলে হয়তো দেবতাদের কাছ থেকে ক্ষমা পাওয়া যাবে।

যেখানে ইমারত নির্মাণ করা হয়েছিল সেই স্থানকে অভিশপ্ত ঘোষণা করা হলো। দিন যেতে যেতে মানুষ একসময় ভুলে গেল ঠিক কী কারণে সাগরের ওই অংশকে অভিশপ্ত বলা হয়েছিল। দ্বীপের স্বর্ণযুগ শেষ হয়ে শুরু হলো অন্ধকার যুগ। সেই ঘটনার পর দ্বীপে নানান অসুখ-বিসুখের প্রকোপ দেখা দিতে শুরু করেছিল। এত বছর ধরে দ্বীপের যে সুনাম তৈরি হয়েছিল সেটা পরিণত হলো দুর্নামে।

মাঝে মাঝে রাজার নাম অভিশাপের মন্ত্রে শোনা যায়। সেই লাখ লাখ বছরঅলা ভবিষ্যত্বাণীর কোনো মূল্যই নেই এখন। কয়েক প্রজন্মের মধ্যে রাজা লক-এর স্থান হলো নিষিদ্ধ গল্পে। যে গল্পগুলো শুধু ফিসফিস করেই শোনানো হয়। আরও কয়েক প্রজন্ম পর রাজা লক-এর ঘটনা স্রেফ লোককাহিনিতে পরিণত হলো। তরুণরা আর তার কাহিনিকে পাত্তা দেয় না। অতীতের ভয়ঙ্কর কাহিনি শোনার সময় নেই তাদের।

.

০২.

সলোমন সাগর, ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখ, ১৯৪৩ সাল

প্রবল বাতাস সাগরের পানিতে সাদা ফেনার সৃষ্টি করেছে। সেই ফেনা কেটে এগোচ্ছে জাপানিজ ডেস্ট্রয়ার কোনামি। বুগেইনভিল আইল্যাণ্ডের দক্ষিণ-পূর্ব দিক দিয়ে এগোচ্ছে জাহাজ। রাতের আঁধার চারিদিকে অথচ জাহাজে কোনো আলো জ্বালানো হয়নি। অন্ধকারের ভেতর সাগরের বড় বড় ঢেউ মোকাবেলা করে জাহাজ এগোচ্ছে। চল্লিশ-পঞ্চাশ ফুট উঁচু ঢেউ এসে জাহাজের সামনের অংশে আঘাত করতেই আর্তনাদ করে উঠছে ইঞ্জিন।

জাহাজের অবস্থা ভাল নয়। গোয়াডালক্যানেল থেকে সর্বশেষ সৈন্যদেরকে সরিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক কোর্স থেকে অনেকখানি সরে গিয়ে চলছে কোনামি।

 এই ইয়াগোমো-ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের কার্যকরী ওয়াটারলাইন (জাহাজের যেটুকু অংশ পানিতে ডুবে থাকে) ও মসৃণ ইঞ্জিনিয়ারিঙের বদৌলতে ঘণ্টায় ৩৫ নট গতিতে এগোনোর ক্ষমতা রাখে। কিন্তু আজ তিন ভাগের এক ভাগ গতিতে এগোচ্ছে। খারাপ আবহাওয়ার কারণে কোনামি স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারছে না। কচ্ছপের মতো ধীরগতিতে এগোতে হচ্ছে।

হঠাৎ করে গোয়াডালক্যানেল থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ এসেছে। ওখানে অনেক পরিশ্রম ও সীমিত খাবার পাওয়ায় রোগা-পাতলা হয়ে গেছে সৈন্যরা। তার উপর এখন এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় তারা একদম কাহিল হয়ে পড়েছে। জাহাজের এক নাবিক সৈন্যদের কাছে পানযোগ্য পানি নিয়ে গেল। এই খারাপ পরিস্থিতিতেও যতদূর সম্ভব সৈন্যদেরকে আরাম দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। সৈন্যদের পোশাকের অবস্থা শোচনীয়! একদম ন্যাকড়ার মতো হয়ে গেছে। খাবার না পেয়ে শরীরের অবস্থা খুব খারাপ।

ব্রিজে দাঁড়িয়ে আছেন ডেস্ট্রয়ারের ক্যাপ্টেন হাসিমোটো। সাগরের ঢেউগুলোতে তিনি কোনো ছন্দ খুঁজে পাচ্ছেন না। বিক্ষিপ্ত ঢেউগুলোর সাথে মোকাবেলা করে কোর্সে থাকার জন্য লড়ছে কোনামি। সাগরের এই উত্তাল অংশ এড়িয়ে যেতে পারতেন ক্যাপ্টেন কিন্তু গেলেন না। তাকে কড়া শিডিউল মানতে হবে। কোথাও কোনো কারণে সময় নষ্ট করা চলবে না। কোনামি উত্তর দিকে এগোচ্ছে, গন্তব্য- জাপান।

এই ডেস্ট্রয়ারকে একটা টপ সিক্রেট মিশন দিয়ে রাতের অন্ধকারে পাঠানো হয়েছে। দ্বীপ থেকে সৈন্য সরানোর পাশাপাশি সাথে একজন অফিসারকেও জাহাজে তুলতে হয়েছে। এই অফিসার নাকি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই অফিসার ও তার এলিট বাহিনিও কোনামি-তে অবস্থান করছে এখন। তবে অফিসারের বাকি সৈন্যরা তাদের নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করার জন্য গোয়াডালক্যানেল থেকে বুগেইনভিল আইল্যাণ্ডে যাত্রা করেছে।

 হাসিমোটো অবশ্য জানেন না এই অফিসার কী এমন মহামান্য ব্যক্তি যে তাঁর যাতায়াতের জন্য একটা আস্ত ডেস্ট্রয়ার প্রয়োজন হলো! বিষয়টা নিয়ে ক্যাপ্টেনের কোনো মাথাব্যথা নেই। নির্দেশ পালন করাই তার কাজ। যদিও অধিকাংশ সময় নির্দেশগুলোকে স্বাভাবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে অদ্ভুত লাগে। টোকিও থেকে এই জাপানিজ ডেস্ট্রয়ারের কমাণ্ডার হিসেবে তাঁকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। দায়িত্ব পালন করাটাই হাসিমোটোর কাছে মুখ্য বিষয়। তার এখন একটাই চিন্তা দায়িত্ব পালন করে ভালয় ভালয় কখন নিস্তার পাবে।

হঠাৎ কোত্থেকে যেন একটা ঢেউ উদয় হয়ে জাহাজের পেছনের অংশে সজোরে আঘাত হানল। কেঁপে উঠল পুরো ডেস্ট্রয়ার। হাসিমোটো নিজের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য কনসোল আকড়ে ধরলেন। ভ্রু কুঁচকে ঝড়ো আবহাওয়ার দিকে তাকালেন তিনি। অবস্থা ভাল নয়। যে নির্দেশ দিতে তিনি ঘৃণা করেন সেটাই দিলেন এখন।

 ‘গতি দশ নটে নামাও, মৃদু গর্জন করলেন ক্যাপ্টেন’। কথা বলতে বলতে তার চেহারায় চিন্তার রেখা গভীরভাবে ফুটে উঠল।

 ‘জো হুকুম, স্যার’। হেলমসৃম্যান (জাহাজের কাণ্ডারি) সাড়া দিল।

তারা দুজনই দেখতে পেলেন জাহাজের সামনে পানির বিশাল ঢেউ তৈরি হয়ে এগিয়ে আসছে। দেখতে দেখতে জাহাজের সামনের অংশে আছড়ে পড়ল ঢেউ। পুরো ঢেউ জাহাজের উপর চড়াও হতেই ডানদিকে বিপদজনকভাবে জাহাজ হেলে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই কোনামি তার ভারসাম্য ফিরে পেয়ে আবার এগোতে শুরু করল বিক্ষুব্ধ সাগরের বুক চিড়ে।

সাগরের এমন বৈরি রূপ ক্যাপ্টেন হাসিমোটোর কাছে নতুন নয়। এরআগে অনেক জঘন্য ও বিপদসংকুল আবহাওয়ার ভেতর দিয়েও তিনি তার জাহাজকে বের করে নিতে সফল হয়েছেন। দু’দুটো টাইফুন মোকাবেলা করার অভিজ্ঞতা আছে তার। এছাড়াও অন্যান্য দুর্যোগ তো আছেই। সবকিছুকে হার মানিয়ে বেঁচে ফিরেছেন তিনি। কিন্তু আজ রাতের বিষয়টা ভিন্ন। আজকের ঝড় তার বিগত দিনের সকল দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে হার মানিয়ে দিতে চাচ্ছে।

সকাল হলে বিপদ আরও বাড়বে। হয়তো কোনো প্লেন তার ডেস্ট্রয়ারের দিকে টর্পেডো ছুঁড়ে মারবে। নিরাপত্তার চাদর হিসেবে কাজ করছে রাতের অন্ধকার। দিনের আলোকে সাধারণত বন্ধু ভাবা হলেও ক্যাপ্টেন হাসিমোটোর সাক্ষাৎ যম সেটা। ক্যাপ্টেন হিসেবে অনেক অভিজ্ঞতা থাকলেও যুদ্ধক্ষেত্রে জাহাজ চালানোর ব্যাপারে হাসিমোটোর অভিজ্ঞতা অল্পই। দিনের আলো ফুটলে হয়তো তার যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা আর সমৃদ্ধ হবার সুযোগ পাবে না।

হাসিমোটো জানেন, বিভিন্ন দিক থেকে তিনি অন্যান্যদের তুলনায় একজন দক্ষ ক্যাপ্টেন কিন্তু আজ রাতে সেই খ্যাতির কোনো মূল্য নেই। সাগরের বৈরি বাতাস আর দৈতাকার ঢেউ কারো খ্যাতির পরোয়া করে না। আচ্ছা, জাপান যদি যুদ্ধে হেরে যায় তাহলে কি হাসিমোটোর চাকরি চলে যাবে? যদি তা-ই হয়, তাহলে মৃত্যুর আগপর্যন্ত নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে বীরের মতো মরতে চান হাসিমোটো। নিজের পদমর্যাদা ও পরিবারের নাম যেন সমুন্নত থাকে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি আছে তার। তিনি সহকর্মী ক্যাপ্টেনদের মতো শক্ত হাতে কোর্স অনুসরণ করবেন। সামুরাইরা কখনও রণে ভঙ্গ দেয় না।

যে আর্মি অফিসারকে তারা দ্বীপ থেকে উদ্ধার করে জাহাজে তুলেছেন নীচ থেকে সেই অফিসার ব্রিজে উঠে এলেন। তার চেহারা পাংশুবর্ণ ও বিবর্ণ হলেও হাঁটা-চলায় এখনও মিলিটারি ভাব বজায় আছে। হাসিমোটোর দিকে মাথা নেড়ে মাপা দৃষ্টি মেলে সাগরের দিকে তাকালেন অফিসার।

‘আমাদের গতি কমেছে?’ অফিসারের কর্কশ কণ্ঠ শুনে মনে হলো গলায় শিরিস কাগজ ডলা হয়েছে।

“হ্যাঁ। দ্রুত এগোতে গিয়ে ডুবে মরার চেয়ে সাবধানে এগোনো ভাল।

আপত্তিসূচক ঘোঘোত করলেন অফিসার। আলোকিত ইন্সট্রুমেন্টগুলো পর্যবেক্ষণ করে বললেন, রাডারে কিছু দেখা যাচ্ছে নাকি?

মাথা নাড়লেন হাসিমোটা। জাহাজের সামনে আরেকটা ঢেউ হামলে পড়তে দেখে নিজেকে তৈরি রাখলেন ক্যাপ্টেন। আড়চোখে আর্মি অফিসারের চেহারা দেখে নিলেন হাসিমোটো। অফিসারের চেহারায় দৃঢ়-সংকল্প আর ক্লান্তি ছাড়াও আর একটা কী যেন আছে। চোখের গভীরে কিছু একটা আছে। সেই ‘কিছু একটা ভাল কিছু নয়। তাই হাসিমোটোর দুশ্চিন্তা হলো! অফিসারের চোখগুলো দেখতে হাসিমোটোর ছোটবেলায় দেখা অনি নামের এক দানবের ছবির মতো। এরকম ছেলেমানুষী ভাবনা মন থেকে সরিয়ে দিলেন ক্যাপ্টেন। এখন তিনি আর সেই সাত বছর বয়সী ছোট্ট হাসিমোটো নন। কল্পিত দানব নয়, যুদ্ধের শুরু থেকে বাস্তব জীবনে অনেক মানুষাকৃতির দানব দেখেছেন তিনি। অতীতের কাল্পনিক দানবে বিশ্বাস করার প্রয়োজন নেই।‘

‘অফিসারকে জিজ্ঞাস করতে যাবেন আপনার জন্য কী করতে পারি?” ঠিক তখনই জাহাজ ভয়াবহভাবে ঝাঁকি খেল। অ্যালার্ম বাজতেই ব্রিজে যারা ছিল চিৎকার করে উঠল সবাই।

কী হচ্ছে? জানতে চাইলেন অফিসার।

“আমি জানি না’। এই কথা উচ্চারণ করতে ক্যাপ্টেন খুব ভয় পান কিন্তু তবুও তাকে উচ্চারণ করতেই হলো।

‘আমরা কি কোনো কিছুকে ধাক্কা দিয়েছি?’

ইস্ততত করলেন হাসিমোটো। ধাক্কা দেয়ার মতো কিছু নেই। আমরা যেখানে আছি এখানকার গভীরতা প্রায় ৯ হাজার ফিট।’ একজন জুনিয়র অফিসারকে এগিয়ে আসতে দেখে থামলেন ক্যাপ্টেন। ফ্যাকাশে চেহারা নিয়ে জুনিয়র অফিসার ভয়াবহ রিপোর্ট দিল তাঁকে। হাসিমোটো মাথা নেড়ে সংক্ষিপ্তভাবে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে আর্মি অফিসারের দিকে ফিরলেন। ‘দুঃখের সাথে বলতে বাধ্য হচ্ছি, যে-কোন খারাপ পরিস্থিতির জন্য আমাদেরকে এখন তৈরি হতে হবে। আপনি নীচে চলে যান। প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সেগুলো পালন করুন।

কী?

 ‘রিপোর্ট পেয়েছি, জাহাজের কাঠামোর মেরামতকৃত এক অংশ ফেটে গেছে। আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করব কিন্তু পাম্প কতটা পানি সরাতে পারবে সেটা এখুনি বলা যাচ্ছে না। যদি অবস্থা সুবিধের না হয় আমাদেরকে এই জাহাজ পরিত্যাক্ত ঘোষণা করতে হবে।’

অফিসারের চেহারা মরা মানুষের মতো সাদা হয়ে গেল। এই আবহাওয়ার মধ্যে?’ কাঁচের ভেতর দিয়ে বাইরের ঝড়ের দিকে তাকালেন তিনি।

‘সেটা আমরা খুব শীঘ্রই জানতে পারব। আশা করছি, ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ আমাদের নিয়ন্ত্রনে থাকবে। ক্যাপ্টেন অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিলেন। এখন দয়া করে আমাকে আমার কাজ করতে দিন।’

মুখ হাঁড়ি করে মাথা নাড়লেন অফিসার। নীচে নামার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে পা দিয়েছেন কি দেননি এমন সময় আরেকটা বড় ঢেউ এসে জাহাজের বাম পাশে আঘাত করল।

 হাসিমোটো তার ক্রুদেরকে সম্ভাব্য সবধরনের পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন। ওদিকে হেলমসম্যান জাহাজকে ঠিক পথে পরিচালনা করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু জয় হলো সমদের। কালো ঢেউগুলো একের পর এক হামলে পড়তে লাগল জাহাজের ওপর। ব্রিজে থাকা শেষ লাইটাও অবশেষে নিভে গেল। ডেস্ট্রয়ারের ভারি স্টিলের কাঠামো এখন একটা নোঙ্গরে পরিণত হয়েছে। সাগরের তলদেশের দিকে ছুটছে সেটা। স্ত্রী ইউঁকি আর এক বছর বয়সী ছেলের কথা মনে পড়ল ক্যাপ্টেনের। ছেলেকে চোখের সামনে যুবক হয়ে ওঠা দেখা হলো না তার। খুব একটা সময়ও কাটাতে পারেননি ছেলের সাথে।

তবে তারচেয়ে বড় বিষয় ক্যাপ্টেনকে লজ্জা দিল। মিশনে ব্যর্থতা। নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য কাপুরুষের মতো চেষ্টা করার চেয়ে মিশনে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় জাহাজসহ বীরের মতো মৃত্যুবরণ করা অনেক ভাল।

 তিন ঘণ্টা পর সাগর একদম শান্ত হয়ে গেল। ঝড় উত্তর দিকে সরে গেছে। তবে ইতিমধ্যে ৪০০ ফুট দীর্ঘ একটা জাহাজকে গিলে নিয়েছে সাগর। কোনো চিহ্ন পর্যন্ত রাখেনি। কোনামি-র এই যাত্রার কোনো রেকর্ড রাখা ছিল না, এর সাথে সঙ্গ দেয়ার জন্য ছিল না কোনো জাহাজও। এর ডুবে যাওয়ার কোনো অফিসিয়াল রেকর্ড থাকবে না। সবকিছু মুছে ফেলা হবে। গোপন যা কিছু ছিল ডেস্ট্রয়ার কোনামি সবকিছু নিয়ে সাগরের তলায় চলে গেছে।

মিত্রপক্ষের জাহাজ মাত্র চারজনকে উদ্ধার করতে পেরেছিল। বাকিদের ইহলীলা সাঙ্গ করছে ঝড় ও হাঙ্গররা। জাহাজের কমাণ্ডে থাকা ব্যক্তি জাপানিজ জাহাজ নিয়ে কোনো আগ্রহই দেখালেন না। স্বাভাবিক কোর্সের বাইরে এসে এই জলপথে জাহাজটা কী করছিল কিছুই জানতে চাইলেন না তিনি। উদ্ধারকৃত ব্যক্তিরাও চুপচাপ রইল। যুদ্ধে তাদের অংশ শেষ। মান-সম্মানের কিছু বাকি নেই এই চারজনের। তাদের বেঁচে যাওয়া মরণের চেয়েও খারাপ।

.

০৩.

গোয়াডালক্যানেল, সলোমন আইল্যান্ড, বর্তমান সময়

তিনটে ছোট ছোট নৌকো পাম গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে যেন সাগরের ঢেউয়ের ধাক্কায় ওগুলো হারিয়ে না যায়। নৌকোগুলোর চারিদিকে সমুদ্রের নীল ঘিরে রয়েছে। অবশ্য বিকেলের সূর্যের আলোতে পানিতে রূপোলী ছটা পড়েছে এখন। স্যাম ফারগো আর রেমি ফারগো একটা পাম গাছের ছায়ায় বসে আছে। পাম গাছের পাতাগুলো দুলছে হালকা বাতাসে। ম্যানিকিউর (হাতের নখ কাটা, পালিশকৃত) করা হাত তুলে সূর্যের আলো থেকে নিজের চোখ বাঁচিয়ে ডাইভারদের (যারা পানিতে ডুব দেয়, ডুবুরি) কার্যক্রম দেখছে ও। সমুদ্রপাড় থেকে ২৭০ ফুট দূরের পানিতে চতুর্থ একটা নৌকোর কাছে রয়েছে ডাইভাররা।

স্যাম নিজের হালকা বাদামি চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে ওর স্ত্রীর দিকে তাকাল। রেমির মুখের মেকআপ বাসি হয়ে গেলেও লালচে দীর্ঘ চুল আর মসৃণ তুক ঠিকই সূর্যের আলোতে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। জীবন সঙ্গীনির অ্যাথলেটিক দেহের দিকে তাকাল স্যাম, এক হাত বাড়িয়ে দিল স্ত্রীর পানে। হেসে ওর হাতটা ধরল রেমি। প্রত্নতাত্ত্বিক গুপ্তধনের জন্য অগণিত অভিযানে বেরিয়েছে দু’জন। এতগুলো দিন কেটে যাওয়ার পরও ওরা এখনও একসাথে আছে। যেটা ওদের দুজনের মধ্যকার শক্তিশালী বন্ধনের পরিচয় দেয়।

 ‘এই বিচে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে, স্যাম,’ চোখ বন্ধ করে বলল রেমি।

‘ভালই তো। যাও অনুমতি দিলাম। এই বিচ তোমার!’ স্যাম সম্মতি দিল।

‘কিন্তু যদি এখানে আরেকটু উন্নত ব্যবস্থা…’।

 ‘কিংবা একটা ভাল ডাইভ শপ থাকত।

হুম, ভাল হতো তাহলে। পায়ের গোড়ালি থেকে রেমি হিল খুলে ফেলল।

এই গোয়াডালক্যানেলে আসার ব্যাপারে রাজি হওয়ার আগে ওদের ধারণা ছিল না এখানে এসে এরকম উষ্ণ পানি আর নীল আকাশের দেখা পাবে।

প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়স্ক এক লম্বা ব্যক্তি বালুময় বিচ থেকে এগিয়ে এলো ওদের দিকে। রোদে পুড়ে তার চেহারা লাল হয়ে গেছে। বাজপাখির ঠোঁটের মতো চোখা নাকে স্টিলের রিমঅলা চশমা পরা। প্রতি পদক্ষেপে তার হাইকিং বুটের পেছন থেকে বালুর মেঘ তৈরি হচ্ছে। কয়েকজন দ্বীপবাসী রয়েছে ওখানে, ভাইভারদের কাণ্ডকীর্তি দেখছে আর নিজেদের ব্যক্তিগত কৌতুকে হাসাহাসি করছে। দ্বীপবাসীদের পাশ দিয়ে আসার সময় বিচের উপর তার লম্বা। ছায়া পড়ল। আগন্তুকের দিকে তাকাল স্যাম। নিজের বলিযুক্ত হ্যাণ্ডসাম চেহারায় সেঁতে হাসি দিল।

‘এবার বলো লিওনিড়, কাহিনি কী? জানতে চাইল স্যাম।

‘এটা দ্বীপের অন্যান্য জিনিসের মতো নয়, লিওনিডের উচ্চারণে হালকা রাশিয়ান টান আছে। দেখলে মনে হয় মানুষের বানানো। কিন্তু ফোনে আমি যেমনটা বলেছিলাম, মানুষের বানানো হওয়া অসম্ভব। পানির ৮০ ফুট নিচে রয়েছে ওটা।

‘তাহলে তুমি বোধহয় আটলান্টিস খুঁজে পেয়েছ!’ স্যামের দীর্ঘদিনের বন্ধুর সাথে মশকরা করল রেমি। যদিও মিথ অনুযায়ী আটলান্টিস যেখানে থাকার কথা সেখান থেকে এই জায়গা প্রায় ৫ হাজার মাইল দূরে।

লিওনিড ভ্রু কুঁচকাল। কোনো বিষয়ে একমত হতে না পারলে লিওনিড় এভাবে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে থাকে। মস্কো থেকে তিন বছরের ছুটি নিয়েছে লিও। পুরো নাম: লিওনিড় ভাইয়েভ। হারানো সভ্যতা খোঁজার জন্য ছুটি পেয়ে পুরো পৃথিবী চষে বেড়াতে নেমেও বেচারা খুশি ছিল না। তবে ফারগো ফাউণ্ডেশন থেকে অনুদান পাওয়ার পর অবস্থা বদলেছে।

লিও যখন স্যাম আর রেমিকে ফোন করে জানায় এই দ্বীপে ডুবে যাওয়া কিছু একটা পাওয়া গেছে তখন ওরা লিও’র এই অনুসন্ধানে যোগ দিতে একটুও দ্বিধা করেনি। প্রায় অর্ধেক পৃথিবী পাড়ি দিয়ে সলোমন আইল্যাণ্ডে হাজির হয়ে গেছে। আজ সকালে পৌঁছেছে ওরা। ডাইভিং গিয়ারগুলো আসতে দেরি হবে, হয়তো আগামীকাল পাওয়া যাবে ওগুলো। এই ফাঁকে লিও’র দেয়া বিভিন্ন তথ্য পড়ে আর বিচের সৌন্দর্য দেখে সময় কাটাচ্ছে ফারগো দম্পতি।

 দু সপ্তাহ আগে গোয়াডালক্যানেলে আসা এক হতবুদ্ধ শিক্ষিকা তাঁর অস্ট্রেলিয়াবাসী সাবেক মহিলা প্রফেসরকে ফোন করে একটা অদ্ভুত গল্প শোনান। শিক্ষিকার স্বামী ও ছেলে তাদের নতুন ফিস ফাইণ্ডারে (যে যন্ত্র দিয়ে মাছের উপস্থিতি শনাক্ত করা যায়) অস্বাভাবিক রিডিং পেয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ান প্রফেসর নিজের ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত থাকা শিক্ষিকাকে লিওনিডের কাছে পাঠিয়ে দেন। লিওনিড আর সেই অস্ট্রেলিয়ান প্রফেসর একই ভার্সিটিতে কাজ করেন।

ফোনে ফোনে অনেক আলাপ-আলোচনার পর অনিচ্ছুক লিওনিড অবশেষে এখানে এসে বিষয়টা সরজমিনে দেখার সিদ্ধান্ত নেয়। গত কয়েকদিনে ডাইভাররা তাকে যে তথ্যগুলো দিয়েছে সেগুলো শুনে লিওনিড নিজেই হতভম্ব হয়ে গেছে। জেলেরা ভেবেছিল ওটা হয়তো যুদ্ধের সময়কার কোনো ধ্বংসস্তূপ, কিন্তু তাদের ধারণা ভুল। ফিস ফাইণ্ডারে সর্বপ্রথম এমন কিছু ধরা পড়ে যেটাকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি… দেখে মনে হয়েছে ওটা সাগরের তলায় মানুষ নির্মিত কোনো অবকাঠামো।

সুবিধে করতে না পেরে সাহায্য চেয়ে হাত বাড়ায় লিওনিড। লিওনিড একজন একাডেমিক, কিন্তু ডাইভার নয়। সে বুঝতে পেরেছিল এই বিষয়ের সুরাহা করার জন্য বাড়তি সাহায্য লাগবে। যেহেতু ফারগোরা ওকে অনুদান দিয়েছে তার উপর অনেকদিনের বন্ধুত্বও আছে তাই সরাসরি ফারগো দম্পতিকেই প্রস্তাব দিয়েছিল লিও। ফোনে কথাবার্তা পাকা করে স্যাম ও রেমি গোয়াডালক্যানেলে চলে এসেছে।

‘পানির নিচে যে ক্যামেরা ব্যবহার করেছ ওটাকে একটু ঘষে মেজে নিলেও পারতে, গত দিনে তোলা একটা ঘোলা ছবি দেখতে দেখতে বলল স্যাম। আর এই কাগজে প্রিন্ট করেছ কেন? ফটো পেপার নেই? কাগজ দেখে মনে হচ্ছে পত্রিকার কাগজের উপর ওয়াইন ফেলে ভিজিয়েছে কেউ।

‘শুকরিয়া করো এখানে রঙ্গীন প্রিন্টার পাওয়া গেছে। তোমরা হয়তো ভুলে গেছ এটা গোয়াডালক্যানেল। কোনো বিলাসী রিসোর্ট নয়।’ বলল লিও। ‘এবার বলো ছবি দেখে কী মনে হচ্ছে?

‘কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। এটা যেকোন কিছুই হতে পারে। পানির নিচে ডাইভ না দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। রিপোর্টের হাল দেখে কেউ যদি বলে এটা ডায়েবেটিস রোগীর রিপোর্ট তাতেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।’

মায়ের রাগী মুখ দেখা যাচ্ছে নাকি? সাবলীলভাবে জানতে চাইল রেমি।

লিওনিড ফারগো দম্পতিদের দিকে এমনভাবে তাকাল যেন ওরা দুজন কোনো জারে ভরা কীট! এই গরমেও তোমাদের রসবোধ কমেনি দেখে বেজায় আনন্দিত হলাম!’

মজা নাও, লিওনিড়। আমরা যেখানে আছি এটাকে তো স্বর্গ বলা চলে। আর হ্যাঁ, তুমি যে কেসটা দিয়েছ এরকম রহস্যই আমরা পছন্দ করি। আমরা এর শেষ দেখব, সমস্যা নেই।’ বলল স্যাম। তুমি একটু আগে চেহারায় যে ভাব ফুটিয়ে তুলেছিলে আমার মা রেগে গেলেও এতটা অসন্তোষ প্রকাশ করেন না। ডাইভারদের দিকে তাকাল ও। তুমি শিওর, ওদের কারও কাছ থেকে আমি একটা গিয়ার ধার নিতে পারব না?

মাথা নাড়ল লিও। আমি ইতিমধ্যে চেয়ে দেখেছি। কিন্তু নিজেদের জিনিসের ব্যাপারে এরা সাংঘাতিক রকমের কিপটে। শহরে গেলে আমরা কিছু গিয়ার নিয়ে আসতে পারব।’ এখন আইল্যাণ্ডে পুরো মৌসুম চলছে, তাই প্রয়োজনীয় গিয়ারের বেশ সংকট। যা স্টকে ছিল তার বেশিরভাগই স্থানীয় টুর কোম্পানীরা বুক করে রেখেছে।

‘ঠিক আছে।

‘আমি যাই, গিয়ে দেখি ডাইভাররা এবার কী পেল,’ হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের ভ্রুতে জমা ঘাম মুছতে মুছতে বলল লিও।

ওরা দেখল লিও বিচ ধরে চলে যাচ্ছে। খাকি প্যান্ট আর ট্রপিক্যাল লম্বা হাতার শার্ট পরনে থাকা সারসের মতো ঠ্যাঙা দেখাচ্ছে ওকে। স্যামের দিকে ঝুঁকল রেমি। বিষয়টা নিয়ে কী ভাবছ?’ | স্যাম মাথা নাড়ল। আমার কাছে কোনো সূত্র নেই। আরও কিছু না জানা পর্যন্ত কিছু বলব না। তবে বিষয়টা ইন্টারেস্টিং।

 ‘আমার কাছে একটা বিষয় অদ্ভুত লাগছে। বিচের এত কাছে থাকা সত্ত্বেও এই জিনিসটা আরও আগে আবিষ্কৃত হলো না কেন।

বিচে এখন লোকজন কম। স্যাম বিচের উপর চোখ বুলিয়ে বলল, “এখানে কি খুব বেশি মানুষ আসা-যাওয়া করে?’

রেমি মাথা নাড়ল। একটু আগে বিষয়টা নিয়ে আমরা একমত হয়েছিলাম কিন্তু।’ মাথার লালচে চুল ঝাঁকি দিল রেমি। স্যাম খেয়াল করল রেমির ত্বক ইতিমধ্যে রোদের কারণে তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে। স্ত্রীর শুয়ে থাকা শরীরে আরেকবার চোখ বুলিয়ে কাছাকাছি হলো ও।

ওরা দেখল লিও দ্বীপবাসীদেরকে হাঁক ছেড়ে বলছে ওকে যেন একটা ছোট নৌকো দেয়া হয়। তাহলে ও সেটাতে চড়ে ডাইভারদের কাছে যেতে পারবে। গাঢ় রঙের টি-শার্ট পরা একজন ছোটখাটো লোক এসে স্টিমারের মোটর চালু করার জন্য স্টার্টার কর্ড ধরে বেশ জোরেশোরে দু’বার টান মারল। তিনবারের বার জ্যান্ত হয়ে উঠল পুরোনো মোটর। লিও ওটাতে চড়ে ডুবুরিদের নৌকোর দিকে রওনা হলো।

বিচের অন্যদিকে তাকাল রেমি। ওখানে কয়েকজন দ্বীপবাসী অলসভাবে ঝিমোচ্ছে।

 ‘তবে যা-ই বলো, জায়গাটা বেশ নিরিবিলি, সুন্দর, এটা মানতেই হবে। নীল আকাশ, উষ্ণ পানি, মিষ্টি বাতাস… আর কী চাই বলো?

আবার সেঁতো হাসি দিল স্যাম। ঠাণ্ডা বিয়ার চাই।

 তোমার মন তো ওটাই চাইবে।

 ‘শুধু এটাই নয়, আরও আছে।

রেমি হেসে উঠল। ঠিক আছে আজ রাতে ওরকম দু’একটা জিনিস চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।’

কয়েক মিনিট পর লিও’র স্টিমার ফিরে এলো। বেচারার মুখ একেবারে বাংলার পাঁচ হয়ে আছে। খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে ওকে। ডাইভাররা বলছে জলজ জিনিসের স্তূপ দিয়ে অনেকাংশ ঢাকা পড়লেও জিনিসটাকে কোনো স্ট্রাকচার (অবকাঠামো, ইমারত) বলে মনে হচ্ছে।

চোখ সরু করল রেমি। স্ট্রাকচার? কীরকম স্ট্রাকচার?

‘ওরা ঠিক নিশ্চিত নয়। তবে দেখে নাকি মনে হয়েছে কোনো ভবনের ধ্বংসাবশেষ।

‘ইন্টারেস্টিং। ভেরি ইন্টারেস্টিং। দিগন্তে জমা ঝড়ো মেঘের দিকে তাকিয়ে বলল স্যাম।

‘ওগুলো অনেক প্রাচীন কিছু হবে,’ লিও নৌকোর দিকে তাকাল। এখানকার লোকজন প্রচণ্ডরকমের কুসংস্কারে বিশ্বাসী, যত্তসব!

রেমি ভ্রূ কুঁচকে জানতে চাইল, ‘হঠাৎ এ-কথা?

স্থানীয় টিমের প্রধান খুব জালাচ্ছে। সে ওখানে আর ডাইভ করতে চায় না। তার প্রপিতামহ নাকি এই বিচকে নিয়ে একটা গল্প শুনিয়ে গেছে। এখানে জুজুর ভয়সহ হাবিজাবি কী যেন আছে বলল। আসল কথা হলো, শয়তানটা আমার কাছ থেকে আরও পয়সা খসাতে চাচ্ছে। বাটপারি আরকী।

 ‘তুমি তাকে কী বলেছ?

‘যদি টাকা চায় তাহলে আজকের ডাইভিং তাকে শেষ করতে হবে। সে নিচ থেকে কী দেখে আসছে সেটার উপর আমার পরবর্তী সিদ্ধান্ত নির্ভর করবে তাকে আবার ভাড়া করব কি করব না। আমি তাকে কোনো ভয়-ভীতি দেখাতে যাব না। কাজের জন্য পারিশ্রমিক দিচ্ছি। ওতেই চুপ হয়ে গেছে।

রাশিয়ান বন্ধুকে পর্যবেক্ষণ করল স্যাম! ‘লিও, আমাদের বাজেটের অর্থ খরচের ক্ষেত্রে তোমার মিতব্যয়ীতা দেখে ভাল লাগল। কিন্তু এখানে তো এই লোকগুলোই শেষ ভরসা, তাই না? যদি তুমি তাদেরকে দিয়ে কাজ না করাও তাহলে বিকল্প কোনো রাস্তা খোলা আছে?’

‘আমার নিজস্ব লোকজন আনতে হবে এখানে।

 ‘তাদের সবার নিজস্ব গিয়ার আছে?’

‘অবশ্যই,’ মুখে জোর দিয়ে বললেও লিওনিডের চেহারার অভিব্যক্তিতে অতটা আত্মবিশ্বাস দেখা গেল না।

‘নিচে যদি ধ্বংসস্তূপ থেকে থাকে তাহলে আমাদের কোনো এক্সপিডিশন শিপ (অভিযান পরিচালনার জন্য বিশেষ জাহাজ) যোগাড় করার চেষ্টা করা উচিত, ঠিক? জাহাজ পেলে আমরা লম্বা সময় ধরে ওটার সুবিধে পাব। প্রস্তাব রাখল রেমি। এই ক্ষেত্রে তোমার পরিচিত কেউ আছে?’

স্যাম একটু ভাবল। কারও কথা মনে পড়ছে না… লিও?’

মাথা নাড়ল রাশিয়ান। জিজ্ঞাস করে দেখতে হবে।’

 ‘সেলমাকে ফোন করি। ও খুঁজে দেবে।’

মাথা নাড়ল রেমি। কপাল খারাপ। এখানে ধারে কাছে তো কোনো সেলফোন নেটওয়ার্কের টাওয়ার নেই।’

স্যাম হাসল। কোনো সমস্যা নেই। স্যাট (স্যাটেলাইট) ফোন নিয়ে এসেছি। বলতে বলতে ব্যাকপ্যাকে হাত দিয়ে একটা পুরোনো কিন্তু নির্ভরযোগ্য স্যাটেলাইট ফোন বের করল। ফোনটা চালু করে সময় দেখল স্যাম। আশা করা যায় সেলমা এখন ফোন ধরবে।’

 শরীরের ভার এক পা থেকে আরেক পায়ে চাপাল লিও। ফোনের মিষ্টি রিং শুনতে শুনতে স্যাম ওয়াটার লাইন নিয়ে ভাবল! এদিকে লিও দ্বীপবাসীদের এক দলের দিকে পা বাড়িয়েছে। কয়েক সেকেণ্ড পর সেলমার সজীব কণ্ঠ ভেসে এলো ফোনে।

‘হ্যালো?’

 ‘সেলমা! বলো তো আমি কে?’ বলল স্যাম।

‘কালেকশন এজেন্সী?

 ‘এই সেরেছে! স্যান ডিয়াগোর কী খবর?

‘দুইদিন আগে এখান থেকে যাওয়ার সময় যেরকম অবস্থা দেখে গেছ এখনও তেমনি আছে। তবে জোলটান আরেকটা ১০০ পাউণ্ডের মাংস ভাজা খেয়ে নিয়েছে আর ল্যাজলো এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করে পাগল বানিয়ে দিচ্ছে আমাকে।’

 ‘তাহলে তো তুমি খুব ব্যস্ত। আচ্ছা, শোনো, প্রাথমিক ডাইভিঙে আমরা এখানে কিছু একটা খুঁজে পেয়েছি। একটা শিপ লাগবে। শিপে সবকিছু থাকা চাই। সোনার, ডাইভিং গিয়ার, ম্যাগনোমিটার… কাজের সবকিছু চাই। এরকম একটা জাহাজ খুঁজে দিতে পারবে?

 ‘অবশ্যই পারব। সবকিছু নির্ভর করছে টাকা আর সময়ের ওপর। কখন লাগবে আর কতদিনের জন্য লাগবে?

‘তার কোনো ঠিক নেই। এখন বলো কবে দিতে পারবে তুমি।

আবার সেই অসীম সময়ের শিডিউল।

সময়টা অসীম হলেও বোরিং নয়, সেলমা।

‘তা তো বটেই। আমি দেখছি বিষয়টা। তোমরা হয়তো অস্ট্রেলিয়া কিংবা নিউজিল্যাণ্ডের বাইরে আছে।’

মাথা নাড়ল স্যাম। “ঠিকই ধরেছ। আচ্ছা, প্রাচীন সভ্যতা সম্পর্কে তুমি কোনো সাহায্য করতে পারবে?

‘অবশ্যই। তোমার ই-মেইল আগে দেখি। তারপর যা সম্ভব আমি জানাচ্ছি।

‘সেটাই ভাল হবে। শিপ খোঁজার ব্যাপারে শুভ কামনা রইল।

 ‘বাজেট?

বরাবরের মতোই। তার মানে বাজেটের কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা নেই। ফারগো ফাউণ্ডেশনের এত টাকা আছে যে দশ প্রজন্ম ধরেও খরচ করে শেষ করতে পারবে না। এছাড়াও প্রতিদিনই স্যামের বিভিন্ন আবিষ্কারের বুদ্ধিবৃত্তিক পোর্টফোলিও মেধাস্বত্ত্ব থেকে অর্থ এসে যোগ হচ্ছে। তাই নিজেদের অভিযানে খরচের ব্যাপারে ওদের কোনো মাথাব্যথা নেই।

উপযুক্ত লোক পাওয়ার পর আমি ফোন করব।

“ওকে, সেলমা, থ্যাঙ্কস। আর হ্যাঁ, আমাদের হয়ে প্রাণী দুটোর খেয়াল রেখো’ জোলটান হলো এক বিরাটাকার জার্মান শেপার্ড কুকুরের নাম। ওটাকে রেমি হাঙ্গেরির এক অভিযানের সময় পোষ্য হিসেবে নিয়ে এসেছে।

 ‘নিজের আঙুল হারানোর জন্য এরচেয়ে উপযুক্ত কাজ আর হতে পারে না।’ খোঁচা মারল সেলমা। জোলটান সেলমাকে পছন্দ করে। ফারগো দম্পতি বাইরে বেরোলেই সেলমার সাথে লেগে থাকে ও। নিজের সন্তানের মতো করে আগলে রাখে। সেলমার নিজের কোনো সন্তান নেই। জোলটানকে প্রশয় দিতে দিতে মাথায় তুলে ফেলে সেলমা।

স্যাম ফোন রেখে ব্যাটারি ইনডিকেটর দেখল। অনেক চার্জ আছে। রেমি কাছে গিয়ে টুপ করে বসল ও।’সেলমাকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছি।’

 ‘ভাল। লিওনিডকে ছোট করে বলছি না। কিন্তু ছোট নৌকো আর ওয়েট স্যুট এই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। রেমি বলল।

“ঠিকই বলেছ। কিন্তু ওর যুক্তিটাও তো দেখতে হবে। কী পেয়েছে সেটা না জেনে কীভাবে বড় আয়োজন করবে বেচারা? ওর ধারণা ছিল এটা হয়তো কোনো ভূপাতিত প্লেন কিংবা ওইরকম কিছু একটা হবে। এটা ভুলে গেলে চলবে না যুদ্ধের সময় গোয়াডাক্যানেল অনেক ব্যস্ত একটা জায়গা ছিল। অনেক ধ্বংসাবশেষ আছে এর আশেপাশে।

রেমি মাথা নাড়ল। তারমধ্যে কিছু জিনিস এরকমও আছে যেগুলোকে এখনও বিস্ফোরিত হবার ক্ষমতা রাখে।

‘ঠিক তোমার মতো।

স্বামীর পটানো কথায় কোনো পাত্তাই দিল না রেমি। ডাইভ বোটের দিকে তাকাল ও। কী মনে হয় তোমার?

‘পানির ৮০ ফুট নিচে মানুষ নির্মিত ইমারত? বলতে পারছি না। মাথার উপরে হাত তুলে দু’দিকে প্রসারিত করে টানটান করল স্যাম। রেমির দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু খুব শীঘ্রই আমরা জানতে পারব।’

নিজের চুলে হাত বুলিয়ে রেমি স্যামকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু বলতে পারল না। কারণ বিচের নিরিবিলি পরিবেশ এক রক্তহিম করা চিল্কারে চুরমার হয়ে গেছে।

.

০৪.

উঠে দাঁড়িয়ে এগোল স্যাম, ওর পিছু পিছু রেমিও রওনা হলো। পানির কাছে কুঞ্জবন রয়েছে। রক্তহিম করা চিৎকারটা এসেছে ওখান থেকেই। যদিও চিৎকার নেই এখন। চিৎকারের বদলে এখন ব্যথার আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। হাত বাড়িয়ে রেমিকে থামাল স্যাম। ঝোঁপের ভেতর থেকে কোনো এক সরীসৃপের বিরাটাকার লেজ বেরিয়ে রয়েছে।

 বুদবুদের আওয়াজ আর পানির থপথপানির আওয়াজ এলো কুঞ্জবনের ভেতর থেকে। লেজটা একদম চুপ করে আছে। ওদের পেছনে লিও’র বুটের আওয়াজ শোনা গেল। কয়েকজন দ্বীপবাসীও এসেছে তার সাথে। তাদের মধ্যে দু’জনের হাতে ম্যাচেটি (ল্যাটিন আমেরিকার দা’) আর একজনের হাতে কুড়াল শোভা পাচ্ছে।

যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদ আবার আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে দিল। ঝোঁপ পেরিয়ে সামনে এগোল স্যাম। নোনাজলের বিরাটাকার পুরুষ কুমীর দেখতে পেল ও। ওটার মাথায় কুড়াল দিয়ে আঘাতের তিনটা জখম দেখা যাচ্ছে। মৃত। দ্বীপের এক স্থানীয় বাসিন্দা পড়ে রয়েছে পাশে। তার ডান পা গুরুত্বরভাবে কুমীর কামড়ে দিয়েছে। ভয়াবহ অবস্থা। ওখান থেকে পাঁচ ফুট দূরে আরেকজন দ্বীপবাসী দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার হাতে একটা কুড়াল, রীতিমতো কাঁপছে সে। ভয়, বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেছে তার চোখ দুটো।

আহত ব্যক্তির উরুর কাছ থেকে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কোমর থেকে বেল্ট খুলে নিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তির কাছে হাঁটু গেড়ে বসল স্যাম। লোকটার উরুর উপরে শক্ত করে বেঁধে দিল বেল্টটা। রেমি ওদের কাছে এগিয়ে গেলো।

গুঙিয়ে উঠে জ্ঞান হারাল লোকটি।

‘ওকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া সম্ভব না হলে বাঁচানো যাবে না। টান টান গলায় বলল স্যাম।

 রেমি লিও’র দিকে তাকাল। চলো ওকে নিয়ে একটা ট্রাকে তুলি। প্রতিটা সেকেণ্ড এখন মূল্যবান।’ বলল রেমি।

লিও বিস্ফোরিত নয়নে মৃত কুমীরটাকে দেখছে। রক্ত সরে গেছে ওর মুখ থেকে।

‘চলো, লিও। রেমি একটু কড়া কণ্ঠে তাগাদা দিল।

রেমির ধমক খেয়ে ঘুরল রাশিয়ান। ওর কয়েক ফুট দূরে দাঁড়ানো দ্বীপবাসীদের দিকে তাকিয়ে বলল, এই লোকটাকে তুলে নিয়ে ল্যাণ্ড রোভারে রাখতে। কিন্তু কেউ নড়ল না। অগত্যা স্যাম নিজেই আহত লোকটিকে পাঁজকালো করে তুলে নিল।

‘সর সামনে থেকে!’ রেমি ওকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো। দুজনে মিলে ধরাধরি করে ল্যাণ্ড রোভারে তুলল ওরা, গাড়িটা মেইন রোডের কাছে পার্ক করা ছিল এতক্ষণ।

লোকটাকে পেছনের সিটে বসাল ওরা স্যাম লিও’র দিকে ফিরল। লিও তখন এক স্থানীয় লোকের সাথে তর্কে ব্যস্ত। গাড়ি ভাল চালাতে জানে কে? উপস্থিত সবাই মাথা নাড়ল। কেউ জানে না।

 স্বামী-স্ত্রী তাকাল একে অপরের দিকে। যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে। এক হাত বাড়িয়ে দিল স্যাম। খুব ভাল কথা! চাবি লাগবে আমার। বুঝলাম না এই লোকগুলোর সমস্যাটা কী! তোমাদের এক বন্ধু মারা যাচ্ছে আর তোমরা একটু সাহায্য পর্যন্ত করছ না? এখানে হাসপাতাল কোথায়? আমাদেরকে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাবে কে?

নিজের পকেটে হাত ঢোকাল লিও, কিছু একটা খুঁজছে। নিজেদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু করে দিয়েছে দ্বীপবাসীরা। এমন সময় সদ্য কৈশোর শেষ করা এক ছোকরা সামনে এলো। আমি যামু। উনি আমার চাচা বেনজি। ছেলেটার ইংরেজী উচ্চারণের সাথে আঞ্চলিকতার টান আছে।

নাম কী তোমার?’ যাত্রীর সিটে বসতে বসতে রেমি জিজ্ঞেস করল।

রিকি।

স্যাম ড্রাইভার সিটে বসে পড়েছে। দরজার পাশে এসে লিও ওর হাতে চাবি ধরিয়ে দিল। আমি হলুদ ট্রাকটা নিয়ে তোমাদের পিছু পিছু আসছি।

‘ঠিক আছে। রিকির দিকে তাকাল স্যাম। চাচার পাশে উঠে বসো। সিট বেল্ট বাঁধতে ভুলো না। আচ্ছা, এখান থেকে হাসপাতালে যেতে কতক্ষণ লাগতে পারে?

৪৫ মিনিট লাগব…’ রিকি নিশ্চিত নয়।

ভ্রু কুঁচকাল স্যাম। শক্ত হয়ে বসো সবাই। দেখি ১৫ মিনিটে যেতে পারি কিনা।

ইঞ্জিন চালু করে গিয়ার দিল স্যাম। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে প্যাসেজের মতো সরু আর এবরোথেবড়ো খানিকটা রাস্তা পেরিয়ে তারপর পাকা রাস্তায় উঠবে ওরা। কিন্তু জরুরী মুহূর্তে এসে মনে হলো এই সরু রাস্তা বুঝি আর শেষ হবে না। পাকা রাস্তায় উঠতেই গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল স্যাম। রাস্তার বাঁকে পৌঁছেও গতি কমাল না। স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে বাঁক পার হলো ল্যাণ্ড রোভার। বিপদজনক গতিতে মোড় ঘুরতে দিয়ে টায়ারগুলো প্রতিবাদ করলেও স্যাম পাত্তা দিল না।

শক্ত করে সিটের হাতল ধরে আছে রেমি। এত শক্ত করে ধরেছে যে ওর আঙুলগুলো সাদা দেখাচ্ছে এখন। আমরা যদি দূর্ঘটনায় পড়ি তারপর আমাদেরকেই যদি হাসাপাতালে নেয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হয় তাহলে কিন্তু এই আহত ব্যক্তি খুব একটা উপকার হবে না।

 ‘চিন্তা কোরো না। ফেরারি (বিশ্ববিখ্যাত গাড়ির নাম) চালিয়ে অভ্যস্ত আমি।’

আরেকটা মোড়ে এসে আবার আর্তনাদ করে উঠল চারটে টায়ার। স্যাম ইঞ্জিনে লাগাম দিয়ে গতি কমিয়ে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হাতের মুঠোয় রাখল। স্ত্রীর দিকে এক পলক তাকিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল ও। এবার গতি একটু কমিয়ে চালাচ্ছে। তারপরও এরকম ভারি গাড়ির জন্য এই গতিও কম নয়।

রেমি ঘাড় ফিরিয়ে আহত ব্যক্তির দিকে তাকাল। প্রচুর রক্তক্ষরণের ফলে নিস্তেজ হয়ে পড়েছে সে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। উরুর উপরে বাঁধা স্যামের বেল্টটাকে শক্ত করে ধরে আছে রিকি। ওর চেহারায় আতঙ্কের ছাপ। রিকি চোখ মেলে রেমি দিকে তাকাল। ঢোঁক গিলল রিকি। ভয়ে, আতঙ্কে বেচারা গলা শুকিয়ে গেছে।

‘আপনের কি মনে অয়, চাচা বাঁচব? রিকি প্রশ্ন করল।

‘আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। এখানকার হাসপাতালটা কেমন? কতখানি আধুনিক? জানতে চাইল রেমি।

রিকি মাথা নাড়ল। মনে অয় ভালই। আমি ওই হাসপাতাল ছাড়া অন্য কুনো হাসপাতাল দেহি নাই। তাই তুলনা করবার পারতাছি না।’

‘অনেক আহত ব্যক্তি যায় ওখানে?

‘মনে অয়। দ্বিধা নিয়ে বলল রিকি।

সোজা রাস্তা পাওয়ায় গতি বাড়িয়ে দিল স্যাম, কাঁধের উপর দিয়ে বলল, ‘এখানে কি অনেক কুমীর আক্রমণ করে?

রিকি শ্রাগ করল। করে মাঝে মইধ্যে। তয় অধিকাংশ সময় লোকজন গায়েব হয়া যায়। কুমীর অগো লয়্যা গেছে কিনা কওয়া কঠিন।

ছেলেটির দিকে তাকাল রেমি। ওখানকার কেউ ওনাকে সাহায্য করল না কেন?

রিকি ভ্রু কুঁচকে তাকাল। কুসংস্কার। সবাই কয় ওই জায়গা নাকি অভিশপ্ত। কহন কী করতে হইব কেউ ঠিকমতো বুইঝা উঠবার পারে না।’

 ‘অভিশপ্ত?’ রেমি প্রশ্ন করল।

‘এক বুইড়া ডাইভার কইছিল, গুজব আছে জায়গাডা ভালা না। অশুভ কিছু আছে। একটু আগে কইলাম না, সবাই অভিশাপরে ডরায়। চাচার দিকে তাকাল রিকি। অন্তত আমার তাই মনে অয়।’

কুমীরটা কিন্তু বিশাল। কমপক্ষে ২ হাজার পাউণ্ড তো হবেই।’ বলল স্যাম। কুসংস্কার-টুসংস্কার কিছু না। ক্ষুধার্ত কুমীর আর অসতর্ক মানুষ। এই হলো কাহিনি।

লিও’র কি এখন লোকবল পেতে সমস্যা হবে?’ রিমি জানতে চাইল।

অন্যদিকে তাকাল রিকি। কয়েকটা ডলারের লাইগ্যা কেউ নিজের জীবন কুরবানি দিবার চাইব না।’

রিয়ারভিউ মিররে রেমির অভিব্যক্তি দেখল স্যাম।

না, আমার মনে হয় না তারা ওমন করবে। তবে লিওনিডের অনুসন্ধান বেশ বড় রকমের ঝাঁকি খেয়েছে এটা সত্য। এই অঞ্চলে যেহেতু কুমীর আছে সেহেতু রাইফেলেরও ব্যবস্থা থাকার কথা। এখানে কারও রাইফেল নেই, আমি সেটা বিশ্বাস করতে পারছি না।

মাথা নাড়ল রিকি। বন্দুক রাখার নিয়ম নাই এইখানে। অস্ট্রেলিয়ান মিলিটারিরা চইল্যা যাওনের পর থেইক্যা বন্দুক রাখা নিষেধ করা হইছে।

কুমীরের তো তাহলে পোয়া বারো! রেমি বলল।

দ্বীপের পশ্চিম অংশ ঘুরে এখন পুব দিকে এগোচ্ছে ওরা। ওদিকে হনিয়ারা শহরে এখানকার একমাত্র হাসপাতাল অবস্থিত। ওরা যখন গাড়ি নিয়ে ইমার্জেন্সি অংশে প্রবেশ ততক্ষণে ২৫ মিনিট পার হয়ে গেছে। রিকির চাচার অবস্থা খুবই করুণ। গাড়ি থেকে নেমে সাহায্যের জন্য ছুটল রিকি। একটু পর দু’জন দ্বীপবাসী আর একজন স্মার্ট নারী এসে হাজির হলো। মহিলার পরনে সবুজ রঙের মেডিক্যাল ইউনিফর্ম।

মহিলা যখন গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে তখন রেমি তাকে ভাল করে খেয়াল করল। দেখতে দ্বীপের বাসিন্দা বলে মনে হলেও তার চুলের স্টাইলটা ভিন্ন। দ্বীপের অন্যান্য মহিলাদের চেয়ে আলাদা। তার হাঁটা-চলার ধরন দৃষ্টিআকর্ষণ করতে বাধ্য। পরিষ্কার বোঝা যায়, এই নারী এখানকার উঁচুস্তরে রয়েছে। পদমর্যাদায় বড় হলেও মহিলার বয়স খুব একটা বেশি হবে না। তরুণীই বলা যায়, ত্বক একদম মসৃণ। আহত ব্যক্তির কাছে পৌঁছে জখমের দিকে নজর দেয়ার আগে রেমি আর স্যামের দিকে তাকাল সে।

কতক্ষণ আগের ঘটনা? জানতে চাইল মহিলা। তার ইংরেজি উচ্চারণে অস্ট্রেলিয়ান টান রয়েছে।

‘আধা ঘণ্টা। দ্বীপের পূর্ব পাশে কুমীর আক্রমণ করেছিল। জানাল রেমি।

আক্রান্ত পা দেখে নিয়ে দ্রুত নির্দেশ দিল মহিলা। ধরাধরি করে বেনজির আহত দেহকে স্ট্রেচারে ভোলা হলো। তবে সেটার অবস্থাও ভাল নয়। এখানকার চিকিৎসা সেবার ব্যাপারে স্যাম ও রেমির সন্দেহ তাহলে সত্যি প্রমাণিত হলো।

ওদের দুজনের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে মুখ খুললেন মহিলা। চিন্তার কিছু নেই। হাসপাতালের ভেতরে থাকা যন্ত্রপাতিগুলো এরচেয়ে ভাল অবস্থায় আছে। হাত বাড়ি দিল সে। আমি ডা. ভ্যানা। এখানকার চিফ মেডিক্যাল অফিসার।’ রেমি ও স্যাম দুজনই হাত মেলাল তার সাথে।

‘স্যাম ফারগো, রেমি ফারগো,’ দু’জনের পরিচয় একসাথে দিল স্যাম।

ডা. ভ্যানা একটু সময় নিয়ে ফারগো দম্পতিকে পর্যবেক্ষণ করল। এখন মাফ করবেন। জরুরী কাজ আছে। আপনার ততক্ষণ ইমার্জেন্সি রুমে অপেক্ষা করতে পারেন। একটা বেঞ্চ আর দশ বছর আগের টাইমস আছে। একটা কথা না বললেই নয়, রক্ত পড়া বন্ধ করার জন্য আপনাদের পদক্ষেপটা সুন্দর ছিল।’

স্যাম কিংবা রেমি কিছু বলার আগেই হাসপাতাল ভবনের ভেতরে চলে গেল ভ্যানা। স্যাম গাড়ির সিটে লেগে থাকা রক্তের দিকে তাকাল। এরপর ওর চোখ পড়ল নিজের পোশাকের উপর। শুকনো রক্ত লেগে রয়েছে। এই দ্বীপে এসেছে মাত্র কয়েক ঘন্টা হলো। ইতিমধ্যে একজন মৃত্যু পথযাত্রীর প্রাণ রক্ষা করতে হয়েছে ওদের।

সলোমন আইল্যাণ্ডে ওদের অনুসন্ধানের শুরুতেই এরকম পরিস্থিতি অশুভ কিছুর ইঙ্গিত করছে।

.

০৫.

কয়েক মিনিট পর লিও’র ট্রাক এসে পৌঁছুল। ট্রাক থেকে নেমে ড্রাইভারকে হাত দিয়ে ইশারা করল লিও। মেইন রোডে ধূলো উড়িয়ে চলে গেল ট্রাক। কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে সে স্যামের দিকে এগিয়ে এলো।

‘মারা যায়নি তো?’

‘অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। স্যাম জবাব দিল। খুব বেশি সময় ওকে হাসপাতালে থাকতে হবে না, এটা নিশ্চিত।

‘বেচারা। কী ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেল।’

‘আমার বিশ্বাস হয় না, এখানে কুমীর আছে এ-ব্যাপারে তোমাকে কেউ সর্তক করেনি।’ বলল রেমি।

করেছিল। ম্যাচেটি আর কুড়াল তো সেজন্যই হাতের কাছে ছিল সবার।

লিওর দিকে তাকাল স্যাম। দুটো একে-৪৭ থাকলে আরও ভাল হতো।’

‘বিশ্বাস করো, দোস্ত, যদি এই দ্বীপে সেটার ব্যবস্থা করা যেত তাহলে আমি নিশ্চয়ই রাখতাম।

‘তোমার ক্রুরা কোথায়?

 ‘সাগরে। সব গোছগাছ করে গিয়ার আর নৌকো নিয়ে ওরা চলে যাচ্ছে। আমার সাথে আর কেউ কাজ করতে চায় না। যা বুঝতে পারছি, তাদের বন্ধুর এই দূর্ঘটনার জন্য ওরা আমাকে দায়ী করছে।’ থামল লিও। জানোয়ারটা সাইজ দেখছ? ট্রাকের চেয়েও লম্বা!

‘ওটার পরিবারও আছে নিশ্চয়ই। স্যাম বলল।

মাথা নাড়ল রেমি। হুম। তোমার বন্ধুরা একটা কুমীরকে কুপিয়ে মেরে ফেলেছে। খবর আছে তোমার।

‘আমি কিছু করিনি!

স্যাম আর রেমি দু’জনই তিক্ত হাসি দিল। ওটা আমাদেরকে শুনিয়ে লাভ নেই। কুমীরদের বোলা।’

ভবনের ভেতরে ঢুকল ওরা। বাইরে থেকে দেখতে যেরকম মনে হয়েছিল ভেতরেও একই অবস্থা। ইমার্জেন্সি লাউঞ্জ একটা আয়তাকার রুম। নোংরা পরিবেশ। কয়েকজন আহত ব্যক্তি সারি করে রাখা বেঞ্চের উপর বসে সেবার অপেক্ষায় আছে। রুমে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা খুবই করুণ। রিকি একটু দূরে ফাঁকা জায়গায় বসে আছে। ওরা সেদিকে গিয়ে ওর পাশে বসল। মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে ঠিকই কিন্তু ভেতরের মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রার বিরুদ্ধে ওটা নিতান্তই নস্যি। কয়েক মিনিট ঘাম ঝরানোর পর উঠে দাঁড়াল রেমি। আমি বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করি।’

স্যাম ও লিও ওর পিছু পিছু উঠল। আমরাও আসছি তোমার সাথে। একা একা ভাল লাগবে না তোমার!

রেমি রিকির দিকে ফিরল। কোনো খবর পেলে আমাদেরকে জানিয়ো, হুম?

 ‘আইচ্ছা।’ এই গরমেও রিকি নির্বিকার। ‘ডা. ভ্যানা খুব ভালা ডাক্তার। চাচার সমস্যা হইব না।

কপাল ভাল বলতে হবে।’ ভ্রূ থেকে ঘাম মুছতে মুছতে ধলল রেমি।

কাছে বসা এক বৃদ্ধ লোক কেশে উঠল। শব্দ শুনে বোঝা গেল কাশিতে কফ আছে। রেমির হাত ধরে বাইরে বেরিয়ে এলো স্যাম। বাইরের তাপমাত্রাও কম নয়। তবে ভেতরে বসে সেদ্ধ হওয়ার চেয়ে বাইরে থাকাই আরামদায়ক। কাছেই একটা ছাউনি দেখতে পেল ওরা। স্যাম নিজের শার্ট দেখল।

‘হোটেলে গিয়ে জামা-কাপড় বদলে এলে মন্দ হয় না। রেমি দিকে তাকাল ও ‘চলো, চট করে ঘুরে আসি?’

রেমি ল্যাণ্ড রোভারের দিকে তাকাল। যদি গাড়ি ধোয়ার ব্যবস্থা করতে পারো তাহলে আমি রাজি।’

 মাথা নাড়ল লিও। আমি তোমাদেরকে লিফট দেব। এখানে দাঁড়িয়ে সেদ্ধ হওয়ার কোনো মানেই হয় না।’

ওরা গাড়িতে উঠল, ড্রাইভারের সিটে বসল স্যাম। সাগরপাড় থেকে তুফান গতিতে হাসপাতালে আসার পর এখন লিও’র সাবধানী গতির ড্রাইভিংকে কচ্ছপের গতি বলে মনে হচ্ছে। রাস্তায় চলাচলরত অন্যান্য যানবাহন দেখে লিও যারপরনাই বিরক্ত। ওর চেহারা দেখে মনে হলো কেউ ওকে নিম পাতার তেতো রস খাইয়ে দিয়েছে।

‘আমাদের কাজকর্ম এখন বন্ধ-ই বলা যায়,’ বলল লিও। এই ঘটনার পর ক্রুরা আর কাজে যোগ দেবে বলে মনে হয় না।’

‘ওদের সাথে তোমার কথা হয়েছে?

মাত্র দু’জন কাজে ফিরতে রাজি।’

“আর নৌকা?’

‘নৌকার ক্যাপ্টেনদের কেউ-ই এখন আর কাজ করতে চায় না। কপাল খারাপ।

কপাল খারাপ বেনজির, নিজের শার্ট দেখতে দেখতে রেমি বলল। আমি কল্পনাও করতে পারছি না তার এখন কেমন লাগছে।

‘তার কপাল ভাল, তোমরা দুজন ওখানে ছিলে। বাকিদের আশায় যদি আমরা অপেক্ষা করতাম তাহলে সে মারা যেত।’ বলল লিও।

‘রিকি বলল, এটা নাকি এখানকার মানুষের স্বভাব। এই দ্বীপে কোনোকিছুই দ্রুত নয়।’

কুমীর বাদে।’

হোটেলে পৌঁছে স্টাফ ও অন্যান্য অতিথিদের ভীত-সন্ত্রস্ত চাহনি এড়িয়ে রুমে চলে গেল ওরা। চটপট গোসল সেরে কাপড় বদলে আবার হাসপাতালে যাওয়ার জন্য ওরা তৈরি হলো। এসি করা লবিতে লিও ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। ওর হাতে কয়েকটা ছবি। পানির নিচের দৃশ্য আছে ওগুলোতে। স্যাম আর রেমি এসে লিও’র দু’পাশে বসল।

 ‘এই ছবিটা দেখ, ব্যাকগ্রাউণ্ডে আরেকটা স্ট্রাকচার চোখে পড়বে। ডাইভ টিমের প্রধান যে ছিল, তার ধারণা নিচে এরকম আরও ছয়টা আছে কিংবা বেশিও হতে পারে। একটা ছবি দেখিয়ে বলল লিও।

 ‘যদি তার কথা সত্যি হয় তাহলে এটা একটা উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার হবে। জিনিসটা এতই প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ যে কারও মনে পর্যন্ত নেই। তবে স্ট্রাকচারগুলোর অবস্থান যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং।’ রেমি বলল।

 ‘তা তো অবশ্যই, কোনো প্রাকৃতিক দূর্যোগ হয়েছিল বোধহয়।’ বলল স্যাম। এই অঞ্চলে ভূমিকম্পের রেকর্ড আছে। হতে পারে ভূমিকম্পের ফলে ওগুলো পানির তলায় চলে গেছে।

‘হুম। কিন্তু আমার কাছে আরও ইন্টারেস্টিং লেগেছে এটার নির্মাণ। পাথর দিয়ে বানানো। এই অঞ্চলে তো পাথুরে ভবন সম্পর্কিত কোনো ইতিহাস নেই। অতীতের ব্যাপারে খুব গুরুত্বপূর্ণ সূত্র এই স্ট্রাকচার। সেই অতীত সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই নেই। লিও জানাল।

এই স্ট্রাকচারের ব্যাপারে কোনো রেকর্ড নেই, বিষয়টা অস্বাভাবিক নয়? রেমি জানতে চাইল।

 ছবিগুলো নামিয়ে রাখল লিও। আমার কাছে অস্বাভাবিক নয়। এই অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর বসবাস ছিল। মৌখিক সংস্কৃতি ছিল সবার। দ্বীপে প্রায় ৭০ টি ভাষার প্রচলন আছে। হতে পারে এই স্ট্রাকচারের ব্যাপারে যারা জানতে তাদের কেউ আর বেঁচে নেই। চিন্তা করে দেখ, কত বড় ভূমিকম্প হলে সাগরপাড়ের অতখানি অংশকে ধসিয়ে দিয়ে পানির তলায় পাঠিয়ে দিতে পারে।’

স্যামের মাথায় ভিন্ন ধারণা ঘুরছে। তাহলে ধরে নিতে হবে ওগুলো সাগরপাড়ে নির্মিত ছিল?

প্রশ্নবোধক দৃষ্টিকে ওর দিকে তাকাল রেমি। তো? তুমি কি ভিন্ন কিছু ভাবছ?’

নান মাডোল সম্পর্কে শুনেছ কখন?

না।

“তিনি কোরাল শৈলশিরার (শৈলশিরাকে ইংরেজিতে রিফ বলে। পানির কিঞ্চিৎ উপরে কিংবা নিচে থাকে) উপরে পাথর দিয়ে দ্বীপ তৈরি করেছিলেন। ভেনিসেও এরকম চেষ্টা করা হয়েছিল। সেটা অবশ্য কয়েকটি আন্তঃসংযোগ খালের উপর।’ ব্যাখ্যা করল স্যাম।

লিও ওর দিকে তাকাল। যদি এটা রিফ বা ল্যাগুন (উপহ্রদ) এর উপর নির্মাণ করা হয়ে থাকে তাহলে সমুদ্রের তলায় ডুবে থাকার সহজ ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব। বড় ভূমিকম্পে শৈলশিরা ধসে পড়লেই…’

‘একদম ঠিক। তবে নিচে ডাইভ দেয়ার আগপর্যন্ত এই হচ্ছে আমার ধারণা। সেলমা আমাদের জন্য রিসার্চ শিপ পাঠিয়ে দিলে আমরা এ-ব্যাপারে আরও বিস্তারিত জানতে পারব।’

হোটেল লবির ঠাণ্ডা পরিবেশ থেকে বাইরের গরম আবহাওয়ায় বেরোল ওরা। হাসপাতালের দিকে রওনা হলো। আকাশে কালো মেঘ জমতে শুরু করেছে।

লিও এখানে রয়েছে প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেল। তাই গোয়াডালক্যানেলের আবহাওয়ার মতিগতি ওর এতদিনে বোঝা হয়ে গেছে। নির্বিকারভাবে আকাশের দিকে তাকাল ও। গাড়ির ভেতরে কসাইখানার মতো দূর্গন্ধ। এক মুদি দোকানের পাশে কার-ওয়াশ (গাড়ি ধোয়ার দোকান/গ্যারেজ) দেখতে পেয়ে গাড়ি দাঁড় করাল লিও। এটা কোনো আধুনিক কার-ওয়াশ নয়। এখানে বালতিতে করে পানি এনে গাড়ি ধোয়া হয়। কার-ওয়াশে কর্মরত ছেলেরা হাসতে হাসতে কাজ করছে। ওদের গায়ে কোনো শার্ট নেই, পা-ও নগ্ন।

কিন্তু গাড়ির ভেতরে চোখ পড়তেই ওদের হাসি থেমে গেল। বেনজির রক্ত দেখতে পেয়েছে ওরা। গাড়ি ধোয়ার আধঘণ্টা রেমি, স্যাম আর লিও এক বটগাছের ছায়ায় বসে কাটাল। ওরা দেখল ছেলেগুলো বেশ অস্বস্তির সাথে গাড়ি ধোয়ার কাজ করছে।

 হঠাৎ একটা পুলিশের গাড়ি উপস্থিত হলো। দু’জন অফিসার এলো ওদের তিনজনের দিকে। কুমীরের আক্রমণের ব্যাপারে জিজ্ঞাসবাদ করার পর হাসপাতালে রেডিওতে যোগাযোগ করল তারা। সবকিছু চেক করে, নিশ্চিত হয়ে বিদেয় হলো।

 পুলিশ চলে যাওয়ায় যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল লিও। দূরে কোথাও মেঘ ডাকার আওয়াজ শুনে আকাশে জমা কালো মেঘের দিকে তাকাল।

শব্দ শুনে মনে হচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি কাছে আসছে,’ মন্তব্য করল লিও।

বৃষ্টি হলে পানি ঘোলা হয়ে যাবে। কালকে পানিতে ডাইভ দেয়ার পর আমরা হয়তো নিচে দূরের কিছু ঠিকভাবে দেখতে পাব না। স্যাম বলল। আশা করি, তুমি সাথে আছে।’

‘সাগর পাড়ের অত বড় কুমীর কি তোমার চোখে পড়েনি? জানতে চাইল রেমি।

‘পড়েছে। এখন আমরা জানি কুমীর কোথায় থাকে।

 ‘তুমি সিরিয়াস তো?’।

“আচ্ছা, জীবনে যদি একটু উত্তেজনা-ই না থাকে তাহলে আর মজা কোথায়?

ভ্রু কুঁচকাল রেমি। শব্দটা উত্তেজনা” নয়। “নিরাপত্তা” কিংবা “দীর্ঘ” হবে।’

স্যাম হাত তুলে আকাশ দেখাল। “ওই দেখ, আকাশের চেহারা। চলো, তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যাই। আংকেল বেনজির খোঁজ-খবর নিয়ে কিছু ডাইভিং গিয়ারের খোঁজে বেরোতে হবে। আমি বিষয়টাকে কাছ থেকে দেখতে চাই, সেজন্যই তো এখানে এসেছি। কুমীরের আক্রমণ হয়েছে বিচে। তারমানে সাগরের কোথাও আমরা নিরাপদ নই।

সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল স্যাম। কিন্তু নৌকা পাওয়া কঠিন হবে। আজ যেটাকে ভাড়া করেছিলাম সেটা আর কালকে আসবে না।’

 ‘আমাদেরকে হাসপাতালে নামিয়ে দেয়ার পর তুমি বিভিন্ন জায়গায় নৌকার খোঁজ করবে। যদি খোঁজ পাও হোটেলে মেসেজ দিয়ো।’ স্যাম বলল।

 ‘আর একটা কথা। কুমীরের আত্মীয়দের কথা মাথায় রেখে .৫০ ক্যালিবারের মেশিন গান যোগাড় করতে পারো কিনা দেখো।’ বলল রেমি।

লিও ওদেরকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছুতে পৌঁছুতে মেঘের গর্জন আরও কাছে চলে এলো। বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করার আগে কোনমতে ভেতরে ঢুকল ওরা। একেকটা ফোঁটা সাইজে গলফ বলের সমান। ওয়েটিং এরিয়ার ধাতব ছাদের উপর ধুমাধুম পড়ছে ওগুলো। ওয়েটিং রুমে চোখ বন্ধ করে রিকি বসে আছে, একদম চুপচাপ। লোজনের পরিমাণ এখন কিছুটা কম। কাশিঅলা বৃদ্ধ, ভাঙ্গা হাত নিয়ে এক শ্রমিক আর হাতে গভীর ক্ষত নিয়ে এক জেলে এখনও সেবার অপেক্ষায় বসে আছে।

রিকির পাশের বেঞ্চে গিয়ে বসল ওরা। রিকি নড়ে উঠলে চোখ খুলল। ওর দিকে তাকিয়ে হাসল রেমি। রিকিও ভদ্রতা করে হাসল।

‘কোনো খবর আছে? জানতে চাইল রেমি।

রিকি মাথা নাড়ল। নাহ। মাত্র কয়েক ঘণ্টা হইছে। এত তাড়তাড়ি কোনো খবর পামু বইলা আমি আশা করি নাই।’

সম্ভবত রিকির আংকেলের এক পা কাটা পড়বে। ওরকম ভয়ঙ্কর আক্রমণের পর বেঁচে থাকা রীতিমতো অলৌকিক ব্যাপার। সে-হিসেবে একটা পা হারানো খুব বড় কিছু নয়। দেখা যাক, কী হয়?

আরও এক ঘণ্টা চলে গেল। ইমার্জেন্সি রুম থেকে বেরিয়ে এলো ডা. ভ্যানা। তার পরনে এখনও সার্জিক্যাল স্ক্রাব রয়েছে। রিকি উঠে দাঁড়াল। স্যাম আর রেমিও যোগ দিল ওর সাথে।

‘সুখবর হলো, রোগী এখন আশংকামুক্ত। আমরা যথেষ্ট রক্তের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলাম। রক্তক্ষরণের বিষয়টা সামাল দেয়া গেছে। বাকিটা আগামী ২৪ ঘণ্টার উপর নির্ভর করছে। তবে এখন সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো দূর্ঘটনার মানসিক ধাক্কা আর ইনফেকশন। রোগীর শরীরের অবস্থা ভাল, বয়সেও তরুণ তারপরও কোনো কিছু নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।

আর পা?’ রিকি নরম সুরে জানতে চাইল।

কুমীরের দাঁতের কামড়ে হাড়গুলো শত শত টুকরো হয়ে গেছে। তার জায়গায় আমি হলে আমারও পা-ও কেটে ফেলতে হতো। দুঃখিত, পা-টা কাটতে হয়েছে।’

তাকে দেখতে পারি? জানতে চাইল রিকি।

ডা. ভ্যানা মাথা নাড়ল। তাকে কিছুটা সময় দিই আমরা, হুম? বিকেলে দেখা করা যাবে। স্যাম ও রেমির দিকে ফিরল ডাক্তার। আক্রমণের সময় আপনার অত কাছে ছিলেন কেন? কুমীররা সাধারণত টুরিস্ট বিচ থেকে দূরে থাকে।

‘আমরা তার সাথে দ্বীপের অপর পাশে ছিলাম। ওপাশে লোকজন তুলনামূলক কম। বলল স্যাম। তবে খুব একটা খোলাসা করল না। লিও’র অভিযানের বিষয়টা এখানে বলা ঠিক হবে না। কথা বাতাসের আগে চলে। তার উপর যদি শোনে পানির নিচে ইমারত আছে তাহলে তো কথাই নেই!

‘আপনারা এই দ্বীপে কী করছেন?

 ‘একটা প্রজেক্টে এক বন্ধুকে সাহায্য করছি।’ স্যাম জবাব দিল।

 ‘প্রজেক্ট?

‘আর্কিওলজি (প্রত্নতত্ত্ব)।

“ওহ। আপনারা আমেরিকান, তাই না?

 ‘কেন আমাদের উচ্চারণ শুনে তা-ই মনে হচ্ছে?’ রেমি প্রশ্ন করল।

“আসলে এখানকার বেশিরভাগ টুরিস্টরা আসে অস্ট্রেলিয়া কিংবা নিউজিল্যাণ্ড থেকে। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন অনেক আমেরিকান দেখেছি কিন্তু এখন আর অতটা চোখে পড়ে না। কয়েক বছর আগেও অনেক সাবেক সৈনিকরা এসে তাঁদের যুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থান দেখতেন, শ্রদ্ধা জানাতেন। কিন্তু এখন তারাও আর আসেন না।’

“আচ্ছা, আপনিও তাহলে দ্বীপের বাসিন্দা?’ রেমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করল। ডা. ভ্যানার উচ্চারণে কোনো আঞ্চলিকতার রেশ নেই।

‘দশ বছর পর্যন্ত আমি এখানেই ছিলাম। তারপর আমার পরিবার সিডনি চলে যায়। ওখানকার স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর কোনো একসময় আমার স্থানীয় উচ্চারণ মুছে গেছে। হাসল ভ্যানা। কিন্তু একটা কথা আছে, শুনেছেন বোধহয়… “দ্বীপের বাসিন্দাকে দ্বীপের বাইরে নেয়া গেলেও তার বুক থেকে দ্বীপ নেয়া যায় না।” গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর আমি আমার মাতৃভূমিতে এসে সেবা করতে চেয়েছিলাম। তাই ৯ বছর আগে আবার এই দ্বীপে ফিরে আসি।’

‘দারুণ।’ বলল স্যাম।

‘এখানে আমার বর্তমান প্রজেক্ট হলো, একাধিক গ্রাম্য ক্লিনিক খোলার জন্য অনুদান সংগ্রহ করা। দেখে মনে হতে পারে দ্বীপটা ছোট। কিন্তু যখন আপনার কোনো দূর্ঘটনা হবে কিংবা কোথাও কেটে-ছড়ে যাবে তখন দেখবেন পথ আর শেষ হতে চাইছে না। তাছাড়া বিভিন্ন রোগের টিকা এখানে সহজলভ্য নয়। আমাদের এখানকার সরকার ব্যবস্থা সবসময় নাজুক। কোনো স্থিতিশীলতা নেই। তাই যা করার ব্যক্তিগত উদ্যোগেই করতে হয়।’

‘দারুণ উদ্যোগ।’ স্যাম প্রশংসা করল। এ-ব্যাপারে আমাদেরকে আরও কিছু জানাতে পারেন?

‘কেন? অনুদান দেবেন?’ একটু খোঁচা মেরে বলল ভ্যানা।

এবার রেমি এগিয়ে এলো। আমরা একটা ফাউণ্ডেশন চালাই। ফাউণ্ডেশন থেকে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দাঁতব্য প্রতিষ্ঠানে অনুদান দেয়া হয়।

পরপর দু’বার চোখের পলক ফেলল ভ্যানা। তারপর অপ্রস্তুতভাবে হাসল। ইয়ে, তাহলে তো আপনাদেরকে অবশ্যই আমার সাথে ডিনার করতে হবে। এখানে আছেন ক’দিন?

শ্রাগ করল রেমি। এখনও ঠিক করিনি।’

স্যাম মুচকি হাসি দিয়ে বলল, “দ্বীপ থেকে আমারদেরকে যতদিন না বের করে দেয়া হচ্ছে!

হেসে উঠল সবাই। ভ্যানা মাথা নাড়ল। আপনারা সম্প্রতি যা করে দেখিয়েছেন সেটাকে বীরত্ব বললেও কম বলা হবে। সত্যি! আজ সন্ধ্যায় যদি হাতে কাজ না থাকে তাহলে চলুন একসাথে ডিনার করি। আমার সাথে এক সহকর্মী থাকবেন। আপনাদের প্রজেক্ট নিয়ে সে কথা বলতে আগ্রহী হবে, আমি নিশ্চিত। আমাদের এখানে আর্কিওলজিস্টটরা খুব একটা আসেন না। আর হ্যাঁ, আমার ক্লিনিক সম্পর্কে অবশ্যই বলব।

স্যামের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করল রেমি। আমরা অযাচিত অতিথি হয়ে যাব না? আপনি নিশ্চিত?

“একদম, ভ্যানা বলল। সত্যি বলতে, এখানে টানা কাজ করতে করতে আমি বিরক্ত হয়ে গেছি। নতুন মুখদের সাথে বসে নতুন নতুন গল্প শুনতে ভাল লাগবে। তবে একটা কথা বলে রাখা হলো, আমার এই দাওয়াতের পেছনে কিন্তু শতভাগ স্বার্থ কাজ করছে।

‘সমস্যা নেই।’ স্যাম বলল। আমরা তাহলে আপনার সাথে এখানে দেখা করব?’

যদি চান। থামল ভ্যানা। কী যেন ভাবছে। কিংবা আমি-ই আপনাদের কাছে চলে আসতে পারি। প্রথমে বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হব তারপর পোশাক বদলে চলে আসব, অবশ্য বৃষ্টি থাকলে ভিন্ন কথা। আপনারা যেন কোন হোটেলে উঠেছেন?’

 ভ্যানাকে হোটেলের ঠিকানা দিল স্যাম। রাত আটটায় হোটেলের লবিতে দেখা করবে বলে ঠিক করল। আরও একমিনিট রিকির সাথে থাকল ভ্যানা। আংকেল বেনজির শারীরিক অবস্থা ওকে বুঝিয়ে বলল। তারপর ভাঙ্গা হাত নিয়ে আসা শ্রমিকটিকে পরীক্ষা করে চলে গেল ভেতরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *