গোড়ার কথা : ইতিহাস ও ধর্মকথার দ্বন্দ্ব
রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণগুলি পাঠ করলে দেখা করা যায়, একই ঘটনা বিভিন্ন রূপে ভিন্ন ভাবনায় বর্ণিত হয়েছে। এমনকি একই গ্রন্থে এক অধ্যায় একরকম অন্য অধ্যায়ে অন্যরকম বর্ণনা করা হয়েছে। এটা থেকে এমন অনুমান করা অন্যায় হবে না যে, গ্রন্থগুলি একাধিকবার বিভিন্ন লেখকের লেখনী দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা ও দর্শনে যুগধর্মের উপযোগী করে কখনো সম্পাদিত ও কখনো পরিবর্তিত হয়েছে। সুযোগ-সুবিধা বুঝে, স্বার্থ রক্ষার্থে এবং বিপদ বুঝে যেভাবে সংবিধান সংশোধন হয়। এ ব্যাপারে সমস্ত ঐতিহাসিকই একমত। যেহেতু গ্রন্থগুলি বেদের অনুগত, তাই এগুলি ধর্মগ্রন্থেরও পর্যবসিত হয়েছে। সনাতন ধর্ম মায় হিন্দুধর্মের সকলেরই এইসব গ্রন্থের প্রতি অচলা ভক্তি প্রদর্শন ও অটল বিশ্বাস অব্যাহত। শাস্ত্রকারদের গা-জোয়ারি, অর্বাচীন কবিদের বানোয়াট, সত্য লুকোনোর প্রয়াস এবং মিথ্যাচারের প্লাবন–এই তিন স্পর্শ মানুষের মনকে শত শত বছর ধরে স্থবির করে রেখেছে। শাস্ত্রে উল্লিখিত বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ বিভিন্ন মধ্যে যথাযথ যুক্তি নির্ণয়ে বিমুখ হয়ে তারই অপরাপর অলৌকিক বিবরণগুলির মানুষের মনকে আকৃষ্ট করে এবং নির্বিচারে তা গ্রহণ করতে প্রলুব্ধ করে। এতটাই প্রলুব্ধ করে যে, বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যাও শুনতে চায় না। কানে আঙ্গুল দেন। যেসব পণ্ডিতগণ শাস্ত্রবচন উদ্ধৃত করে মাহাত্ম-কীর্তন পঞ্চমুখে বিতরণ করেন, তাঁরাই আবার শাস্ত্রসম্মত সত্যভাষণ মনঃপুত না-হলে অগ্নিশর্মা হয়ে তেড়ে আসেন, অসহিষ্ণু হয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নিতেও দ্বিধান্বিত হন না। লজিক নয়, ম্যাজিকের প্রতিই তাঁদের অগাধ আস্থা।
রামায়ণ তেমনই একটি গ্রন্থ, যেখানে মানুষের কাছে লজিকের চেয়ে ম্যাজিকের কদর পায়। লজিক আর ম্যাজিকের চিরন্তন দ্বন্দ্বও আছে। রামের ভক্তরা রামায়ণ’ গ্রন্থটিকে ‘ধর্মশাস্ত্র’ ভাবতেই পারেন, আমার কাছে কেবলই মহাকাব্য’, ইতিহাসের উপাদান-আধার। অনেকে মনে করেন, রামকথা বেদের যুগ থেকেই লোকের মুখে মুখেই ফিরত। পরে বাল্মীকি তাঁর প্রতিভায় রামকথা পরিমার্জিত রূপ দেন, সুচারুভাবে সংকলিত হয় অতিরিক্ত সংযোজনের প্রাবল্যে। রামকথার প্রথম বক্তা নারদ। বাল্মীকি উদগীত শ্লোকের সমর্থনদাতা ব্রহ্মা। গায়ক লব ও কুশ। শ্রোতা প্রথমে ব্রাহ্মণ ঋষিকুল। পরে অযোধ্যার জনগণ এবং সবশেষে রাজা রামচন্দ্র। প্রসঙ্গত জানাই “মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।/যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম৷৷”–এটাই বাল্মীকির মুখনিঃসৃত প্রথম শ্লোক বলে জেনে আসছে অনেকে। অনেকে ব্যাখ্যা করে বলেন–ব্যাধ কর্তৃক কৌঞ্চ নিহত হলে যে শোক উৎপাদন হয়, তা থেকেই নাকি শ্লোকের সৃষ্টি। না, এ জানা সঠিক নয়। শ্লোক আরও আগেই সৃষ্টি হয়ে গেছে। এই শ্লোকটি রামায়ণের প্রথম কাণ্ডের দ্বিতীয় সর্গের পঞ্চদশতম শ্লোক। রামায়ণের আদি বা প্রথম শ্লোকটি হল–“তপঃ সাধ্যায়নিরতং তপস্বী বাগ্বিদাং বরম্।/নারদং পরিপপ্রচ্ছ বাল্মীকিমুনিপুঙ্গব৷৷” বাল্মীকি রচিত রামায়ণের প্রথম পংক্তিজোড়াই যে প্রথম শ্লোক তা কিন্তু বলা যাচ্ছে না। কারণ রামায়ণের বহু আগেই বেদ রচনা হয়েছে। বেদের বহু মন্ত্রে ‘শ্লোক’ শব্দের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। বেদ থেকে একটি শ্লোক দেখুন–“মিনীহি শ্লোক মাস্যে পর্জন্য ইবততনঃ।” অতএব ক্রৌঞ্চ মিথুনের বধ থেকে শোক, শোক থেকে শ্লোক–এ মিথ ধোপে টেকে না।
নিরুক্তকারের মতে, শ্রু ধাতু থেকে উৎপন্নের কারণে শ্রবণযোগ্য যা, তাই-ই শ্লোক। কবি বাল্মীকি স্বধ্যায়সম্পন্ন বেদবিদদের অগ্রগণ্য নারদকে সম্বোধন করে এবং সম্প্রতিকালে লোকে সর্বগুণে বিভূষিত শ্রেষ্ঠ কে সম্যক জেনে রামকথা শুরু করেন। নারদের কাছ থেকে রামকথার বিস্তারিত জেনেই রামায়ণ গ্রন্থের ছয়টি কাণ্ডে (উত্তরকাণ্ড বাদে) প্রসারিত করেছেন। অতএব বাল্মীকি মহাকাব্যের স্রষ্টা বটে, কিন্তু রামকথার স্রষ্টা নন। যিনি গ্রন্থটি সংস্কারের কাজ করেছিলেন তিনি বাল্মীকির সম্পূর্ণ রামকথা বা গীত সংগ্রহ পারেননি। তিনি যা সংগ্রহ পারেননি, সেখানে তিনি নিজ কল্পনার আশ্রয় নিয়ে গ্রন্থখানি সমৃদ্ধ ও বর্ধিত করেছিলেন।
লক্ষ করার বিষয়, রামায়ণ পুথিগুলির পাঠে নানা স্থলে বিভিন্নতা দেখা যায়। শুধু তাই-ই নয়, অনেক জায়গাতেই অনেক পাঠে সাধারণ বিচারবুদ্ধিতে অসংগতিপূর্ণ মনে হয়। বোঝা যায়, বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন যুগের লেখকরা ‘স্বাভিপ্রায়ানুযায়ী পরিবর্তন বা সংযোজন করেছেন। এইসব সংগতিবিহীন পাঠকে বিশেষজ্ঞরা ‘প্রক্ষিপ্ত বলেন। সাহিত্যসম্রাট ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রক্ষিপ্ত বিষয়ে বলেন–“(১) যদি কোনো গ্রন্থে দেখা যায় যে, কোনো ঘটনা দুই বা ততোধিক বার বিবৃত হইয়াছে, অথচ সেই বিবরণ পরস্পর বিরোধী, তাহা হইলে একটি প্রক্ষিপ্ত বিবেচনা করিতে হইবে। কারণ কোনো লেখকই অনর্থক পুনরুক্তি করিয়া আত্মবিরোধ উপস্থিত করেন না। অনাবধানতা বা অক্ষমতা প্রযুক্ত যে পুনরুক্তি বা আত্মবিরোধ উপস্থিত হয়, সে স্বতন্ত্র কথা। সেরূপ ত্রুটি অনায়াসে নির্বাচন করা যায়।(২) শ্রেষ্ঠ কবিদিগের রচনা প্রণালীতে প্রায়ই কতকগুলি বিশেষ লক্ষণ থাকে। যদি ঐরূপ রচনা কোনো শ্রেষ্ঠ কবির কোনো রচনার অংশে এরূপ দেখা যায় যে, সেই সেই লক্ষণ তাহাতে নাই; তৎপরিবর্তে এমন সকল লক্ষণ আছে যে, পূর্বোক্ত লক্ষণ সকলের সঙ্গে সংগতি রক্ষিত হয় না, তবে সেই অসংগত লক্ষণযুক্ত রচনাকে প্রক্ষিপ্ত বিবেচনা করিবার কারণ উপস্থিত হয়। (৩) যদি কোনো শ্লোকে এমন শব্দ প্রযুক্ত থাকে, যে শব্দের মূলীভূত বস্তুর উল্লেখ ঐ গ্রন্থে বা উহার সমসাময়িক গ্রন্থে দৃষ্ট হয় না, তাহা হইলে ঐ শব্দ প্রক্ষিপ্ত বলিয়া সন্দেহ হইবে। (৪) যদি শ্লোকাদিতে গ্রন্থকর্তার সমকালীন পরিজ্ঞাত ও বিশ্বসিত বস্তু অথবা ভাবের অতিরিক্ত কোনো বস্তুর বা ভাবের বর্ণনা বা অভিব্যক্তি দেখা যায়। তবে সেই বস্তু ও ভাবকে প্রক্ষিপ্ত বলিয়া সন্দেহ করিবার বিষয় হইবে। (৫) শ্রেষ্ঠ কবিদিগের বর্ণিত চরিত্রগুলির সর্বাংশ পরস্পর সুসংগত হয়। যদি কোথাও তাহার ব্যতিক্রম দেখা যায়, সে অংশ প্রক্ষিপ্ত বলিয়া সন্দেহ করা যাইতে পারে। (৬) যাহা অপ্রাসঙ্গিক তাহা প্রক্ষিপ্ত হইলেও হইতে পারে, নাও হইতে পারে। কিন্তু অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে যদি পূর্বোক্ত লক্ষণগুলির মধ্যে কোনো লক্ষণ পাওয়া যায়, তবে তাহা প্রক্ষিপ্ত বলিয়া বিবেচনা করিবার কারণ হইবে। (৭) যাহা অনৈতিহাসিক, অথবা অস্বাভাবিক তাহা প্রক্ষিপ্ত হউক বা না হউক, ইতিহাসের আলোচনায় তাহা পরিত্যাগ করা উচিত। তাহা বুঝিবার উপায় সমসাময়িক ইতিহাস, ভাব ও সমাজ৷”
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর প্রক্ষিপ্ত ব্যাপারে কিছুটা ভিন্ন মত। তিনি লিখেছেন–“অনেক অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা করে বাল্মীকি রামায়ণের অগ্র এবং পশ্চাৎ অর্থাৎ আদিকাণ্ড এবং উত্তরকাণ্ড ঘেঁটে ফেলা হয়েছে। এর সবচেয়ে বড়ো কারণ হল–রামকে যে একেবারে ভগবান বিষ্ণুর অবতার করে ফেলা হয়েছে তা নাকি প্রধানত এই কাণ্ড দুটিতেই। অযোধ্যাকাণ্ড থেকে লঙ্কাকাণ্ড পর্যন্ত রামের এই ভগবদ্ উপাধি জোটেনি। ব্যাপারটা প্রথম বোধহয় পণ্ডিতদের মাথায় ঢুকিয়েছিলেন হারমান জ্যাকোবি।” তাঁর মতে–“রামের দেবায়ন এবং ক্রমশঃ বিষ্ণুর সঙ্গে একাত্মতা–এই পুরো বাপারটাই ছিল সেই কবির হৃদয়ে যিনি রামায়ণের আদি এবং উত্তরকাণ্ডটি লিখেছিলেন। মূল কাণ্ডপঞ্চকে দেবায়নী ভূমিকা নেই কোনো, বরঞ্চ তিনি সেখানে অনেক মানুষোচিত।” মূল কাণ্ড-পঞ্চকের কতগুলি শ্লোকে এবং আদিকাণ্ড তথা উত্তরকাণ্ডে তো বটেই, যেখানেই রামকে ভগবানের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে সেই অংশটাই প্রক্ষিপ্ত। এই নিরিখে এমন কথা অবশ্যই বলা যায় যে, পণ্ডিতেরা যদি তাঁদের প্রতিপাদ্য সম্বন্ধে পূর্বাহ্নেই সংকল্পিত থাকেন তাহলে তাঁদের যুক্তিও সেই মতেই চলবে এবং সত্যি কথা বলতে কি, তাই চলেছে। যেখানেই পণ্ডিতদের অসুবিধে হয়েছে সেখানেই শ্লোকের পর শ্লোক বাদ পড়ে গেছে। কনটেকস’ মিলছে না, অন্যরকম, শ্লোক বাদ দিয়ে দাও; অবতারবাদ আছে–সব বাদ দাও।… পণ্ডিতদের কথা শুনে বাল এবং উত্তরকাণ্ডের অলংকৃত শৈলীর নিরিখে মূল কাণ্ড-পঞ্চকের অলংকার দুষ্ট অংশগুলি আমরা পরিত্যাগ করব, নাকি পাঁচ কাণ্ডের স্থল বিশেষ অলংকৃত শৈলীর নিরিখে বাল কিংবা উত্তরকাণ্ডের অংশগুলিও আমরা গ্রহণ করব। আমার ধারণা–গ্রহণ করাই ভালো, কেননা তাতে মহাকাব্যশরীরের হানি হয় না। তা ছাড়া কবি কোথায় অলংকৃত ভাষা ব্যবহার করবেন, কোথায় করবেন না, কোথায় তিনি বড়ো বড়ো সমাসবদ্ধ পদ ব্যবহার করবেন এবং কোথায় লঘু সমাস, কোথায় উপমার মালা তৈরি করবেন, কোথায় রূপক–এসব তো আর তিনি ভবিষ্যৎ ভাষাতাত্ত্বিকের গবেষণায় ফমূলা বুঝে করবেন না।”
প্রক্ষিপ্তকে অস্বীকার করে নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী রামের ‘ভগবান’ তত্ত্ব মেনে নিলেও, রামায়ণে যে প্রক্ষিপ্ত রচনায় গিজগিজ করছে না, এটা মানব কী করে! বাল্মীকি-পরবর্তী কবিরা যেভাবে তাঁদের রামায়ণে ‘ভগবান তত্ত্ব’ প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেটা যে মূল রামায়ণের ক্ষেত্রেও হয়নি, একথা জোর দিয়ে বলা যায় না। প্রক্ষিপ্তকে অস্বীকার করা মানে রাম অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ‘ভগবান’, এটা মেনে নিতেই হয়। আগেই বলেছি, বাল্মীকির আদি রচনা ‘পৌলস্ত্যবধ’, সেই রচনাখানির ঠিক কতটা বিস্তার ছিল তার আর বর্তমানে বিচার করা যায় না। তেমন কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণও নেই। তবে ‘পদ্মপুরাণ’-এর পাতালখণ্ডে রামায়ণের যে শ্লোকসংখ্যার উল্লেখ আছে, তা হল এক কোটি। কিন্তু পদ্মপুরাণের টীকাকারের মতে–এখন আর এক কোটি পাওয়া যায় না, মাত্র ২৪,০০০ পাওয়া যায়। টীকাকার মহাবিভাষা বলেন–মাত্র ১২,০০০। উত্তরকাণ্ডের রচয়িতা উত্তরকাণ্ডকে রামায়ণের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়ে যে তাতে মোট ২৪,০০০ শ্লোক আর ৫০০ সর্গ পেয়েছিলেন, তাঁর প্রমাণ উত্তরকাণ্ডের রচয়িতাই উত্তরকাণ্ডের ১০৭ তম সর্গে উল্লেখ করেছেন। মহাভারতের হরিবংশ’-এর মতো রামায়ণের ‘উত্তরকাণ্ড সম্পূর্ণ একটি আলাদা গ্রন্থ, তা অনেক পণ্ডিতই স্বীকার করেন। “প্রাপ্তরাজ্যস্য রামস্য বাল্মীকিভগবানৃষিঃ।/চকার চরিতং কৃৎস্নং বিচিত্রপদমর্থবৎ।/চতুর্বিংশ সহস্রাণি শ্লোকানামুক্তবানৃষিঃ।/তথা সর্গ শতান্ পঞ্চ ষট্ কাণ্ডানি তথোত্তরম্।/কৃত্বাঃ তু তন্মহাপ্রাজ্ঞঃ সভবিষ্যং সহোত্তরম্।/চিন্তয়মানস্য মহর্ষের্ভাবিতাত্মনঃ। /অগৃহীতাং ততঃ পাদৌ মুনিবেশৌ কুশীলবৌ।/কুশীলবৌ তু ধৰ্ম্মজ্ঞে রাজপুত্রে যশস্বিনৌভ্রাতরে স্বরসম্পন্নৌ দদর্শাশ্রমবাসিনৌ।” কেদারনাথ মজুমদার তাঁর রামায়ণের সমাজ’ গ্রন্থে স্পষ্টতই বলেছেন–“শ্লোকাবলীর চতুর্থ পংক্তি দ্বারা মহর্ষি যে ছয় কাণ্ড রামায়ণ লিখিয়াছিলেন, উহা যেমন স্পষ্ট অবগত হওয়া যায়, ষট কাপ্তানির পরবর্তী ‘তথোত্তরম্’ শব্দটি দ্বারা উত্তরকাণ্ডটি যে জাল বা রামায়ণের পরে যোজনা, তাহাও তেমনই সুস্পষ্ট বুঝা যায়। পঞ্চম পংক্তির ‘সভবিষ্যং সহোত্তরম্’ শব্দদ্বয়ও তেমনই স্পষ্ট প্রক্ষিপ্ত।” “রামঃ সীতামনুপ্রাপ্য রাজ্যং পুনরবাবা।/পিলয়ামাস চৈবেমাঃ পিতৃবনূদিতাঃ প্রজাঃ।/অযোধ্যাপতিঃ শ্রীমান্ রামো দশরথাত্মজঃ।” মহাকবি তাঁর রামচরিত এভাবেই শেষ করেছেন। পরে আর কিছু ছিল না। লঙ্কাকাণ্ডের ১৩০ সর্গের ৯৬ শ্লোকে রামায়ণ শেষ করেছেন মহাকবি বাল্মীকি। এর পর আটটি শ্লোকে রামরাজ্যের কল্যাণকর বিবরণ এবং শেষ আঠেরোটি শ্লোকে রামায়ণ শ্রবণ (কেবল শ্রবণই, কারণ রামায়ণের যুগে মুদ্রণ ব্যবস্থা আবিষ্কার হয়নি, তাই পাঠের প্রশ্নই নেই।) করলে কেমন ফললাভ হবে সে কথাই বলা হয়েছে। বস্তুত নিয়মানুসারে গ্রন্থের পাঠ বা শ্রবণের ফল গ্রন্থের শেষেই নিবন্ধিত হয়।
প্রক্ষিপ্ত যে শুধুমাত্র রামায়ণের ক্ষেত্রেই হয়েছে, তা কিন্তু নয়। মহাভারত, বেদ, পুরাণ, ব্রাহ্মণ, সূত্র, গীতা, স্মৃতি, উপনিষদ–সর্বত্র প্রক্ষিপ্ত রচনা বাধাহীন প্রবেশ করেছে। কপিরাইট নেই, না! কৃত্তিবাস যেমন তাঁর রামায়ণে নিজের কল্পনাজাল বিছিয়েছেন, তেমন তুলসীদাসের রামচরিতমানসে বাল্মীকির ছায়া প্রায় অপসারিত। কয়েকটি উদাহরণ : তুলসীদাস রাম-সীতার পূর্বরাগের কথা বর্ণনা করেছেন, কিন্তু বাল্মীকির রামায়ণে হরধনুভঙ্গের আগে এবং বৈধ বিয়ের আগে রাম-সীতার পূর্বরাগ উল্লেখ করেননি। তুলসীদাস রাম-সীতার বিয়ে স্বয়ংবর সভায় হয়েছে বলে বর্ণনা করেছেন, বাল্মীকির রামায়ণে স্বয়ংবর ছাড়াই দুই পক্ষের অভিভাবকদের কথাবার্তার মধ্য দিয়ে রামসীতার বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। কৃত্তিবাসের রাম-সীতার বিয়ে আবার খুব স্বাভাবিকভাবেই বাঙালিদের মতো৷ কম্বন, কৃত্তিবাস স্বয়ংবর সভা করেই রাম-সীতার বিয়ে দিয়েছেন। বাল্মীকি-পরবর্তী রামায়ণগুলিতে স্বয়ংবর সভা সম্ভবত মহাভারতেরই প্রভাব। মহাভারতের প্রচুর স্বয়ংবর সভায় মাধ্যমে বিয়ের উল্লেখ আছে, বাল্মীকির রামায়ণে একটিও নেই। কৃত্তিবাসের রামায়ণে রাম-সীতাও বাঙালি। তাই রাম-সীতার বিয়ে বাঙালিদের মতো আয়োজন করেন।
অক্ষয়কুমার দত্ত তাঁর ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ গ্রন্থে যথার্থই বলেছেন–“রামায়ণে যে মধ্যে মধ্যে নূতন নূতন শ্লোক ও সর্গবিশেষ সন্নিবেশিত হইয়াছে, এটি একটি প্রসিদ্ধ প্রথা। টীকাকারেরাও তাহা স্বীকার করিয়াছেন ও অনেকানেক বচন ও কোনো কোনো সর্গ প্রক্ষিপ্ত বলিয়া অঙ্গীকার করিয়া গিয়াছেন। যেমন অরণ্য : ৫ স, ২৩; ৩১ স ৩৩ ও ৩৪; কিষ্কিন্ধ্যা : ৫৮ স, ২৪ ও ২৫; সুন্দর : ১ স, ৯৭, ৯৮; ২৪ স, ৪২; ২৭ স, ২০; ২৭ স, ৩১ ও ৩২; ৫৭ স ৯; ৫২ স, ১৮ ও ১৯ ইত্যাদি। রামচন্দ্রের অলৌকিক অথবা দেবসদৃশগুণ বর্ণনাত্মক কতকগুলি শ্লোক ও অবশিষ্ট কয়েকটি সর্গ প্রক্ষিপ্ত বলিয়া কতকাদি টীকাকার তাহার ব্যাখ্যা করেন নাই।”
রামায়ণ গ্রন্থটিকে মহাকাব্যও বলা হয়। এখন দেখব মহাকাব্য কাকে বলে? মহাকাব্য শ্ৰবকাব্যের একটি অংশবিশেষ। যে কাব্যে কোনো দেবতা বা অসাধারণ গুণসম্পন্ন পুরুষের কিংবা একবংশোদ্ভব বহু নৃপতি বা রাজা-বাদশাহর বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হয়, তা মহাকাব্য নামে পরিচিত। যিনি মহাকাব্য রচনা করেন, তিনি মহাকবি। দেবতা বা দেবতুল্য নায়কের বৃত্তান্ত নিয়ে বিশেষ রীতিতে রচিত বৃহৎ কাব্য রচনাকেই মহাকাব্য’ বলা হয়। পাশ্চাত্য আদর্শে অনুসরণের মাধ্যমে আমরা মহাকাব্যের সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে বলতে পারি যে, নানা সর্গে বা পরিচ্ছেদে বিভক্ত যে কাব্যে কোনো সুমহান বিষয়বস্তুকে অবলম্বন করে এক বা বহু বীরোচিত চরিত্র অথবা অতিলৌকিক শক্তি সম্পাদিত কোনো নিয়তি-নির্ধারিত-ঘটনা ওজস্বী ছন্দে বর্ণিত হয়, তাকে মহাকাব্য বলে। মহাকাব্যে প্রাকৃতিক বিবিধ দৃশ্যমালা ও পরিবর্তন বর্ণিত থাকে এবং এতে কমপক্ষে আটটি কিংবা ততোধিক সৰ্গ বা ভাগ থাকে। যেমন–রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড, ওডিসি, গিলগামেস ইত্যাদি।
মহাকাব্য ব্যক্তিনিষ্ঠ নয়, বরঞ্চ বস্তুনিষ্ঠ। লেখকের অন্তর অনুভূতির প্রকাশ নয়, বস্তুপ্রধান ঘটনাবিন্যাসের প্রকাশ। গীতিকাব্যোচিত সুরেলা বাঁশি নয়, রণসজ্জার তুর্য-নিনাদ। মহাকাব্য মহাকায়, মহিমোজ্জ্বল, ব্যাপক হিমাদ্রিকান্তির মতো ধীর, গম্ভীর, প্রশান্ত, সমুন্নত ও মহত্ত্বব্যঞ্জক। এই কাব্যে কবির আত্মবাণী অপেক্ষা বিষয়বাণী ও বিষয়বিন্যাসই আমাদের অধিকতর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এছাড়া সংস্কৃত আলংকারিকদের মতে আশীর্বচন, মস্ক্রিয়া অথবা বস্তুনির্দেশ দ্বারা এই কাব্য শুরু হয়। মহাকাব্যের আখ্যানবস্তু পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক। বৈয়াকরণ বিশ্বনাথ বলেছেন–“ইতিহাসোঙবংবৃত্তমন্যদ্বা সজ্জনাশ্রয়”। নায়ক (কখনো কখনো একাধিক নায়কও থাকতে পারে) ধীরোদাত্তগুণসমন্বিত অর্থাৎ সমস্ত সদ্গুণের সমষ্টিভূত; সর্গসংখ্যা অষ্টাধিক এবং পটভূমি স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল প্রসারী। এতে শৃঙ্গার, বীর, শান্ত–এই তিনটির একটি রস মুখ্য বা প্রধান এবং অন্যান্য রস এদের অঙ্গস্বরূপ হবে।
সংস্কৃত আলংকারিকদের মতে যা মহাকাব্য, তার সঙ্গে পাশ্চাত্য মহাকাব্যের কোনো কোনো বৈসাদৃশ্য থাকলেও এদের মধ্যে ভাবগত সাদৃশ্য বর্তমান। পাশ্চাত্য আলংকারিক এরিস্টটলের মতে, “মহাকাব্য আদি, মধ্য ও অন্ত সংবলিত বর্ণনামূলক কাব্য। এতে বিশিষ্ট কোনো নায়কের জীবনকাহিনি অখণ্ডভাবে বর্ণনা করা হয় এবং বীরোচিত ছন্দের সাহায্যে কীর্তিত হয়। মহাকাব্যের বস্তু উপাদান জাতীয় জীবনের ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক তথ্য সরবরাহ করে। এর অনুপ্রেরণা অধিকাংশ সময়ই ঐশীশক্তি; এতে মানব, দানব, দেবদেবীর চরিত্রের সমাবেশ এবং প্রয়োজনবোধে অতিলৌকিক স্পর্শও উপস্থিত থাকতে পারে। তবে মহাকাব্যের পরিসমাপ্তি সকল সময়েই শুভান্তিক হবে এমন কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। এতে জটিল ঘটনাবর্তের সৃষ্টি এবং বহুবিধ চরিত্র সন্নিবেশ থাকলেও সমগ্র কাব্যটিতে একটি অখণ্ড শিল্প-সংগত সৌন্দর্যবোধ ও মহত্ত্বব্যঞ্জক গাম্ভীর্য থাকবে। এর। ভাষা প্রসাদগুণসম্পন্ন, ওজস্বী এবং অনুপ্রাস-উপমা প্রভৃতি অলংকারবহুল হবে।
এ প্রসঙ্গে আরও কিছু মহকাব্যের খোঁজ নিলে বাহুল্য হবে না নিশ্চয়। প্রাচীন মহাকাব্য (পঞ্চম শতক থেকে পঞ্চদশ শতক)। সপ্তম শতক–‘তায়েন বো কোয়াইলেঞ্জ’ (প্রাচীন আইরিশ); পাণিনি প্রণীত রামায়ণ ও ‘অষ্টদেহী’ অনুসরণে সংস্কৃত ভাষায় পরিমার্জিত ‘ভট্টিকাব্য’; মহাভারত অনুসরণে সংস্কৃত ভাষায় ভারবি রচিত ‘কীরাতাজুনীয়’ ও মাঘ রচিত ‘শিশুপালবধ। অষ্টম থেকে উনবিংশ শতক–‘বিউওল্ফ’ এবং “ওয়ালদেয়ার’ (প্রাচীন ইংরেজি); ডেভিড অব সাসুন (আর্মেনিয়ান)। নবম শতক–সংস্কৃত ভাষায় রচিত ‘ভাগবত পুরাণ’। দশম শতক–শাহনামা’ (ফারসি সাহিত্য); সেন্ট গলের একেহার্ড প্রণীত ‘ওয়াথারিয়াস’ (লাতিন)। একাদশ শতক–‘তাঘরিবাত বনি হিলাল’ (আরবি সাহিত্য); জনৈক জার্মান লেখক রচিত ‘রুডলিয়েব’ (লাতিন); বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের বীরকে ঘিরে ‘ডাইজেনিস একরিটাস’ (গ্রিক); ‘এপিক অব কিং গেসার’ (তীব্বতীয় ভাষায়)। দ্বাদশ শতক–‘চ্যানসন ডি রোল্যান্ড’ (প্রাচীন ফরাসি); শোটা রুসট্যাভেলি প্রণীত’দ্য নাইট ইন দ্য প্যান্থার স্কিন’; ওয়াল্টার অব চাটিলন রচিত ‘আলেক্সান্দ্রিস’ (লাতিন); জোসেফ অব এক্সটার প্রণীত’ডি বেলো ট্রোইয়ানো’ ও ‘দ্য লস্ট এন্টিওচিজ’; কারম্যান ডি প্রোডিসিওন গুইনোনিস (লাতিন); জন অব হভিলে প্রণীত ‘আর্কিট্রেনিয়াস’ (লাতিন বিদ্রুপাত্মক কাব্য); পিটার অব এবোলি প্রণীত “লিবার অ্যাড অনুরেম অগাস্টি’; বাইলিনাস প্রণীত ‘দ্য টেল অব ইগোর’স ক্যাম্পেইন’ (একাদশ থকে ঊনবিংশ শতক)। ত্রয়োদশ শতক–‘নিবেলানজেনলাইড’ (জার্মান ভাষা); ওলফ্রাম ভন ইসেনব্যাচ প্রণীত ‘পার্জিভাল’ (জার্মান ভাষা); লায়ামন প্রণীত ‘ব্রুট’; অকসিটান ভাষায় রচিত ‘চ্যানসন ডি লা ক্রোইসেড আলিবিজিওইস’, ‘অন্তরা ইবনে সাদ্দাদ ও “সিরাত আল-জহির বাইবারস’ (আরবি ভাষা); ‘সান্দিয়েতা কেইতা’; ‘এল ক্যান্টার ডি মাইও সিড’ (প্রাচীন স্পেনিশ); জোহানেস ডি গারল্যাডিয়া প্রণীত ‘ডি ট্রামফিস একক্লেসিয়ে’ (লাতিন); উইলিয়াম অব রেনেস প্রণীত ‘গেস্টা রেগাম ব্রিটানিয়ে’ (লাতিন); ই সিয়াং-হাইও প্রণীত ‘জিওয়াং আংগি’ (কোরিয়ান) চতুর্দশ শতক–জন গাউয়ার রচিত ‘কনফেসিও অ্যাম্যানটিস’; জনৈক পাদ্রি রচিত ‘কার্সর মান্ডি’; দান্তে আলিগিয়েরি রচিত ‘ডিভিনা কমেডিয়া’ বা দ্য ডিভাইন কমেডি(ইতালীয় ভাষায়); পেট্রাখি রচিত ‘আফ্রিকা; জাপানিদের যুদ্ধের পৌরাণিক কাহিনিকে ঘিরে রচিত ‘দ্য টেল অব দ্য হিয়েকি’। পঞ্চদশ শতক–অ্যালিটারেটিভ মোর্তে আর্থার; ম্যাটিও মারিয়া বোয়ার্দো রচিত অরল্যান্ডো ইনামোরাতে (১৪৯৫); স্যামুয়েল বুখ; স্লোখিম বুখ; বুক অব ডিডি কোরকুট।
রামায়ণ কি ধর্মগ্রন্থ? রামায়ণ প্রাচীনকালে রচিত (প্রাচীনকাল’ মানে পণ্ডিতগণের মতে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ বছর আগে, অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৩০০০ হাজার বছর আগে।)। প্রাচীন যুগের পুরো ইতিহাসের না হলেও অংশত আকর (ইতিহাসের অনেক উপাদান এখান থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই বইটির অনেক তথ্য সত্যি প্রতিপন্ন করে ঐতিহাসিকরা তত্ত্বও বানিয়ে নিয়েছেন)। যদিও এইচ জি ওয়েলস, টয়েন বি, কান, রমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ বিখ্যাত ঐতিহাসিকদের ব্যাখ্যানুসারে–“কেবল ঘটনাপঞ্জী ইতিহাসই ইতিহাস নহে। সন তারিখ সহ কোনো রাজারাজড়ার কাহিনিকেই কেবলমাত্র ইতিহাস বলতে পারি না, যুগধর্মের ইতিহাস ও প্রাচীন সমাজজীবনের চিত্রপটকেও ইতিহাসের সংজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে।” গ্রন্থটি হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ হিসাবে মেনে নেওয়া হয়েছে (রাম, সীতা, হনুমানের বিরোধিতা করলেই গর্দান। রামের জন্য বাবরি মসজিদ পর্যন্ত ভাঙা সম্ভব হয়)। রামায়ণ প্রথমে সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয়। পরে তামিল এবং তারও পরে ভারত তথা বিশ্বের অন্যান্য ভাষাতেও ভাবানুবাদ হয়। অবশ্য মূল সংস্কৃত রামায়ণ অন্য ভাষায় কাহিনি সংযোজন ও বর্জন হয়ে বদলাতে থাকল। মূল সংস্কৃত ভাষায় রামায়ণ রচনা করেন বাল্মীকি নামে ঋষিকবি। বইটি রচিত হলেও লিখিত আকারে ছিল না। লিখিত না-থাকার কারণ তখনও লিপির জন্ম হয়নি। তাই মুখে মুখে মুখস্থ করেই বংশানুক্রমে কাব্যটির সংরক্ষণ চলছিল। অন্তত পণ্ডিতেরা এমনই বলেন। দুনিয়ার পণ্ডিতরাও এই ধারণাগুলিকে পরম সত্য বলে মেনেও নিয়েছেন।
তবে সত্যটা কী? শ্রীবিবস্বান আর্য ‘মিথ্যাময় ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে বলেছেন–“রামায়ণ নামটার সঙ্গে রাম বা শ্রীরামচন্দ্রের নামের কোনো সম্পর্ক ছিল না। বইয়ের নাম রাখার ব্যাপারে এ ধরনের অসংগতি ইলিয়াড-ওডিসি নামের প্রাচীন গ্রিক ভাষায় লেখা বলে প্রচার করা দুটি কাব্যগ্রন্থের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। ইলিয়াডের সঙ্গে ইলিয়াম স্থাননামের এবং ওডিসির সঙ্গে অডিসিয়ুস চরিত্ৰনামের সম্পর্ক থাকার কথাটাও কষ্টকল্পিত। স্বভাবতই কিছু প্রশ্ন সামনে এসে পড়ে। সম্পর্ক যদি না-ই থাকবে তবে গ্রন্থ চারটির (রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড ও ওডিসি) নাম রাখার আসল কারণটা কী? তবে কি গ্রন্থগুলির নাম রাখার ব্যাপারে কোনো রহস্য আছে? না-হলে চার চারটি বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থের নাম রাখতে একইরকম অসংগতি থেকে যাবে কেন? কেন ইলিয়াড ও ওডিসি শব্দদুটির তর্জমা করেই রামায়ণ ও মহাভারত নামদুটো উদ্ভাবনের ব্যবস্থা হয়েছে?”
গ্রন্থগুলির রচনাকাল সম্পর্কে ২০০/৪০০ বছর এদিক-ওদিক করার খেলা কেউ কেউ দেখালেও এগুলি যে জিশুখ্রিস্ট্রের জন্মের আগে লেখা হয়েছে সে সম্পর্কে কেউই সন্দেহ প্রকাশ করেননি। তবে রামায়ণ কোন্ সময়ে। রচিত হয়েছিল তা নির্ণয় করা সহজ নয়। কারণ রামায়ণে যেমন মূল’ অংশ আছে, তেমনই আছে প্রক্ষিপ্ত অংশ। আবার এই প্রক্ষিপ্ত অংশগুলিও বিভিন্ন সময়ে যোগ করা হয়েছে। কাজেই কালগত বৈষম্যের ফলে সমগ্র রামায়ণের একটি নির্দিষ্ট রচনাকাল নির্ণয় করা সম্ভব নয়। ইয়াকোবি (Jacobi) ও ম্যাকডাওয়েল (McDowell) মনে করেন, রামায়ণ প্রাক্-যুদ্ধযুগের রচিত কাব্য। এর রচনাকাল ৮০০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। কিথ (Keith) বলেন, রামায়ণ খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে রচিত৷ ভিন্টারনিৎস (Winternitz) ও বুলকে (Bulcke) বলেছেন, রামায়ণের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকেই।
বস্তুত ষষ্ঠ শতকের রামায়ণ গ্রন্থ উদ্ধার করা হয়েছে। রামায়ণ লিখিত পৃষ্ঠাগুলি ভারতের কলকাতার সংস্কৃত ভিত্তিক গ্রন্থাগারে পাওয়া যায়। সংস্কৃত সাহিত্য পরিষদ এ তথ্য বার্তা সংস্থা টাইমস অব ইন্ডিয়াকে জানিয়েছে। রামায়ণের এই সংস্করণে রাম-সীতা ও বিভিন্ন মানুষের কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে। তবে এ সংস্করণের বিশেষত্ব হচ্ছে, রাম-সীতার পৃথক হওয়ার কাহিনি বিশেষভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই সংস্করণ চতুর্থ খ্রিস্টপূর্বে রচিত বাল্মীকির রামায়ণ থেকে ভিন্ন। পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে উদ্ধার হওয়া ওই রামায়ণ। অন্যদিকে বাল্মীকির রামায়ণ সাত খণ্ডে প্রকাশিত। যা এখন পর্যন্ত সবার কাছে গ্রহণযোগ্য।
ইয়াকোবির মতকে স্বীকার করে নিয়ে ওয়েবার (weber) কয়েকটি যুক্তি দেখিয়েছেন–(১) রামায়ণ একটি রূপক মাত্র। ভারতবর্ষে গ্রিক আক্রমণের আগেই রামায়ণ রচিত হয়েছিল। রামায়ণে ‘যবন’ শব্দের ব্যবহার থাকলেও তা গ্রিকদের বোঝায় না। উত্তর-পশ্চিম ভারতে একসময় সমস্ত বৈদেশিক আক্রমণকারী সাম্রাজ্যলোভী জাতিকে ‘যবন’ বলে অভিহিত করা হত। (২) রামায়ণ রচনাকালে পাটলিপুত্ৰ (এখন পাটনা) নগরী স্থাপন হয়নি। মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে তা স্থাপিত হয় এবং মগধরাজ অজাতশত্রুর পৌত্র উদয়ী রাজগৃহ থেকে পাটলিপুত্রে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। রামায়ণে এই বিখ্যাত নগরীর উল্লেখ না-থাকার পাটলিপুত্র প্রতিষ্ঠার পূর্বে রামায়ণ রচিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়।(৩) বাল্মীকির ভাষা বহু ক্ষেত্রে পাণিনি ব্যাকরণের নিয়ম মেনে চলেনি। তাই মনে করা যায়, রামায়ণ পাণিনির আগে রচিত। (৪) রামায়ণে মিথিলা ও বিশালা নামে দুটি পৃথক নগরীর উল্লেখ আছে। বুদ্ধের সময়ে ওই দুই নগরী মিলিত হয়ে একটি রাজ্যে পরিণত হয়, সেই রাজ্যটির নাম বৈশালী। রামায়ণে বৈশালীর উল্লেখ না-থাকার মনে করা যেতে পারে রামায়ণ বৌদ্ধযুগের আগে রচিত।(৫) রামায়ণের কাহিনি অনুসরণ করলে দেখা যায়, সে যুগে ভারতবর্ষ অনেক অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল। বৌদ্ধযুগের পূর্বেই ভারতবর্ষের এই অবস্থা। এ থেকেও প্রমাণিত হয় রামায়ণ বৌদ্ধযুগের আগে রচিত। (৬) বৌদ্ধ ও জৈনযুগের সাকেত নগরী আগে কোশলের রাজধানী ছিল এবং তার নামকরণ করা হয় অযোধ্যা। রামায়ণে সাকেত নগরীর উল্লেখ না-থাকার অনুমান করা যায় যে, বৌদ্ধযুগের বহু আগেই রামায়ণ রচিত হয়। (৭) ইয়াকোবির মতে, রামায়ণে পালি ভাষার কোনো চিহ্ন না-থাকার রামায়ণ বৌদ্ধযুগের আগেই রচিত। (৮) রামায়ণের কোনো চরিত্রই ঐতিহাসিক নয়। সীতা মূলত কৃষির রূপক। রামের দ্বারা রাবণ বধ এবং সীতা উদ্ধারের কাহিনি বস্তুত অনার্যদের আক্রমণের হাত থেকে কৃষিভিত্তিক আর্যসভ্যতা রক্ষা করা। সুতরাং বৌদ্ধযুগের বহু পূর্বেই রামায়ণের মূল অংশের রচনা সম্পূর্ণ হয়েছিল। অতএব ওয়েবার ও ইয়াকোবির গবেষণা থেকে যে সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে, তা হল–রামায়ণ খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের পূর্বে রচিত হয়েছিল। দশরথ জাতক, শ্যাম জাতক, বিশ্বম্ভব জাতক, নলিনীকা জাতক, মহাসুত সোম জাতক প্রভৃতি জাতক কাহিনির সঙ্গে মিল দেখে ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন মনে করেন, বাল্মীকি রামায়ণ রচনা করার পূর্ব থেকেই জাতকে বিভিন্ন রামকাহিনি প্রচলিত ছিল।
‘রামায়ণ’ বইটির নায়কের নাম রাম, নায়িকার নাম সীতা, খলনায়ক রাবণ। প্রায় ত্রুটিহীন চিত্রনাট্য। ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কেউ বলেন রামায়ণ হল আর্য আর অনার্যের দ্বন্দ্ব। কে আর্য? কে অনার্য? কেউ বলেন রাম আর্য, অনার্য রাবণ। কেউ বলেন রাম অনার্য, রাবণ আর্য। অনেকে বলেন রাম অন্ত্যজ, তথা অস্পৃশ্যের প্রতিনিধি। আর্যরাই কৌশলগতভাবে অনার্য রামকে দিয়েই অনার্যদের বিনাশ করেছেন। রাবণ আর্য তথা ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতিনিধি। অনেকে রামকে আর্য তথা দেবতার প্রতিনিধি বলেন এবং রাবণকে রাক্ষস তথা অসুর তথা অনার্যের প্রতিনিধি বলেন।
তবে কি রামায়ণ ইক্ষ্বাকু বংশ আর কেকয় বংশের সংঘাত? বিশ্বামিত্র আর বশিষ্ঠের সংঘাত? ক্ষত্রিয় আর ব্রাহ্মণের সংঘাত? রাম আর ভরতের সংঘাত? দশরথ আর কৈকেয়ীর সংঘাত? এক মহাকাব্য, অনেক অভিমুখ। একটি মহাকাব্য–যে যেদিক দিয়ে পারে ব্যাখ্যা করে, বিশ্লেষণ করে, নির্ণয় করে। রামকে কেউ অলৌলিক ক্ষমতার অধিকারী দেবতা মনে করেন, কেউ কেউ আবার রামচন্দ্রকে দোষেগুণে বিচক্ষণ মানুষ ভাবেন। কেউ কেউ রামকে একটি মহাকাব্যের একটি কাল্পনিক চরিত্রের বেশি ভাবতে চান না।
মূল কাব্যের ভিতরে যাওয়ার আগে গ্রন্থের নামকরণে ব্যাপারটা একটু বুঝে নিতে পারি।”নামে কী আসে যায়, গোলাপকে যে নামেই ডাকো না কেন, সুগন্ধ সে ছড়াবেই”–জুলিয়েটে মুখে শেক্সপিয়রের এই আপ্তবাক্য যে ব্যাপ্তির দিকে মন টানে সেদিকে না এগিয়ে বলা যায় সবক্ষেত্রেই নামের একটা গুরুত্ব আছে। চেনার জন্য, চেনানোর জন্য, জানার জন্য, স্বাতন্ত্রের জন্য নাম চাই। হতে পারে সেই নাম বিষয়ভিত্তিক, বস্তুভিত্তিক, ভাবভিত্তিক, ব্যঞ্জনাভিত্তিক, চরিত্রভিত্তিক ইত্যাদি। রচনাকার তাঁর রচনার নাম অনেক ভেবেচিন্তেই দেন। অনেকে বলেন কাব্যটি রামকেন্দ্রিক বলেই কবি রামায়ণ নামকরণ করেছেন। কেউ কেউ বলেন নায়ক চরিত্রের নাম রাম, সেই কারণেই রামায়ণ নামকরণ করা হয়েছে–এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। রামের ‘অয়ন’, অর্থাৎ যাওয়া। রামায়ণের ‘অয়ন’ অংশটি নিয়ে পণ্ডিতেরা অনেক জল ঘোলা করেছেন। বলা হয়েছে–রামায়ণকে “রামস্য চরিতান্বিতং অয়ন শাস্ত্রম্”। অতএব বোঝাই যাচ্ছে ‘অয়ন’ শব্দের অর্থ শাস্ত্র’, এটা কল্পনার ফসল। এইচ. এইচ. উইলসন তাঁর ‘Sanskrit-English Dictionary’ গ্রন্থে আর-এক কায়দায় নামটির ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করেছেন, বলেছেন–‘অয়ন’ শব্দের অর্থ বাসস্থান, অর্থাৎ রামায়ণ মানে দাঁড়াল রামের বাসস্থান। এল, এ. ওয়াডেল তাঁর “The Makers of Civilization in Race and History’ গ্রন্থে বলেছেন–‘অয়ন’ শব্দের অর্থ ‘দুঃসাহসিক অভিযান’ বা ‘অ্যাডভেঞ্চার’। অর্থাৎ রামায়ণের মানে দাঁড়াল ‘রামের দুঃসাহসিক অভিযান’ বা ‘রামের অ্যাডভেঞ্চার। কেউ কেউ ‘অয়ন’ মানে কীর্তি’ বলেছেন, সেই হিসাবে রামায়ণের অর্থ দাঁড়ায় ‘রামের কীর্তি। পাণিনীর সূত্রানুসারে কেউ কেউ বলেন রামায়ণ’ শব্দের অর্থ ‘রামের বংশধর’, অর্থাৎ ‘রামবংশ। সুকুমার সেন বলেন, “কিন্তু শব্দটি (রামায়ণ) যে খাঁটি তাতে সন্দেহ নেই এবং শব্দটির মূলে যে রাম আছে তাতেও সন্দেহ করা চলে না”। আরও হরেক রকমের অর্থ পাওয়া যায়, পাছে বিরক্তির উদ্রেগ হয়, তাই আর উল্লেখ করলাম না। সহস্র পণ্ডিতের সহস্র মত। অয়ন’ শব্দযোগেই যদি নামটা বানানো হয়ে থাকে, তবে তিন ঘর আগে ‘র’ থাকার কারণে ‘অয়ন’-এর ‘ন’ (দন্ত্য) কীভাবে ‘ণ’ (মূর্ধন্য হয়ে যায়? ব্যাকরণে কোন্ নিয়মে এটা সম্ভব হল? তাহলে ‘রসায়ন’ কেন ‘রসায়ণ’ নয়? প্রশ্ন হল রাম বা। শ্রীরামচন্দ্রের নামে ওই রামায়ণের সম্পর্ক ছিল কি না।
বাংলায় ‘রামধনু’ বা ‘রামদা’-র সঙ্গে কিংবা হিন্দি ভাষায় ‘রামতরোই’ বা ‘রামদানা’-র সঙ্গে কিংবা ওডিশায় ‘রামতালি’ বা ‘রামফল’-এর সঙ্গে অথবা গুজরাতি রামপাতর’ বা ‘রামবাণ’-এর সঙ্গে কিংবা মারাঠি ভাষায় ‘রামপাত্র’ ও ‘রামবাণ’-এর সঙ্গে রামনামের বা রামায়ণের সম্পর্ক থাকলে তা আজগুবি। বস্তুত রামায়ণ’ শব্দটি সংস্কৃত বলে চালানোর চেষ্টা হলেও, এটি মূলত খাঁটি গুজরাতি শব্দ। A long series of woes–অর্থে এই ভাষাতে রামায়ণ লোকচল শব্দ হিসাবে চলে। হিন্দি এবং মারাঠিতেও ‘A long series of woes’ রামকথা বা রামকাহানি লোকচল শব্দ হিসাবে প্রচলিত। মারাঠি ভাষায় রামায়ণ শব্দের অর্থ হয় বিরক্তিকর গল্প’ (Tedious yarn)। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন–“ “রামায়ণ’ শব্দের সংস্কৃতে কোন অর্থ হয় না, কিন্তু বাঙ্গালায় সদর্থ হয়। বোধ হয়, রামায়ণ’ শব্দটি ‘রামা যবন’ শব্দের অপভ্রংশ মাত্র। কেবল ‘ব’-কার লুপ্ত হইয়াছে। রামা যবন বা রামা মুসলমান নামক কোন ব্যক্তির চরিত্র অবলম্বন করিয়া কৃত্তিবাস প্রথম ইহার রচনা করিয়া থাকিবেন। পরে কেহ সংস্কৃতে অনুবাদ করিয়া বল্মীকমধ্যে লুকাইয়া রাখিয়াছিল। পরে গ্রন্থ বল্মীকমধ্যে প্রাপ্ত হওয়ায় বাল্মীকি নামে খ্যাত হইয়াছে।”
‘ব্যাস’ (মহাভারতকার) গুজরাতি পদবি হলেও, বাল্মীকি (রামায়ণকার) পদবিটি কিন্তু মগহি-ভোজপুরী। রামায়ণকে বাংলা ভাষায় শ্রীরামের পাঁচালী’ বলা হত। শ্রীরামের পাঁচালী’ লিখেছেন কৃত্তিবাস ওঝা। কৃত্তিবাস ওঝা ‘রামায়ণ’ নামে কোনো গ্রন্থ লেখেননি। তাতে কী হল? বাজারে তো ‘কৃত্তিবাসের রামায়ণ’ নামেই গ্রন্থ পাওয়া যায়। রামায়ণ’ শব্দের অর্থবহতা বাংলা ভাষায় ছিল না। মারাঠি আর গুজরাতি ভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষায় এর কোনো ব্যঞ্জনা নেই। কবির নিজের মাতৃভাষা এক, কাব্য করতেন অন্য ভাষায়? কেমনভাবে সম্ভব হল? কেন সম্ভব নয়? ঝুম্পা লাহিড়ী, অমিতাভ ঘোষ, অরুন্ধতী ঘোষের মাতৃভাষা বাংলা। সাহিত্য করেছেন ইংরেজি ভাষায়। যেমন শঙ্করাচার্য কেরলিয়ান বা মালয়ালম ভাষায় না-লিখে রহস্যজনকভাবে ‘দুর্বোধ্য’ সংস্কৃত ভাষায় লেখেন। “মিথ্যাময় ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে শ্রীবিবস্বান লিখেছেন–“কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে ভারতের নানান ভাষাভাষী পণ্ডিতদের যে ডাকা হয়েছিল এ খবর ইতিহাসেই পাচ্ছি। ডাকা হয়েছিল আঠারো শতকের সাতের ও আটের দশকে। মারাঠি পণ্ডিতদের, গুজরাতি বিদ্বানদের, ওড়িয়া বিদগ্ধদের অনেকেই সেই ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন।…দুনিয়ার প্রথম রাষ্ট্রায়ত্ত কুটির শিল্পের পত্তন হয়েছিল তথাকথিত ক্লাসিক্যাল ভাষাগুলোয় ক্লাসিক্যাল কাণ্ডকারখানা বানিয়ে রাখার ক্লাসিক্যাল মতলবেই। আর তা হয়েছিল ইউরোপ ও এশিয়ার নানান দেশেই। লাতিন, হিব্রু ও প্রাচীন গ্রিক ভাষা প্রাচীন বলে প্রচার করা নানান কেতাব লেখানোর উদ্যোগ আয়োজন নেওয়া হয়েছিল। ভারতে নেওয়া হয়েছিল সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত, অপভ্রংশ, আরবি, ফারসি কেতাব লেখানোর ব্যবস্থা। সরকারি উদ্যোগে কলকাতা, বেনারস, নদিয়া (নবদ্বীপ) মিথিলায় গড়ে উঠেছিল সংস্কৃত মাধ্যম মিথ্যাসৃষ্টির আঁতেলি কর্মশালা। বেনারস, গাজিপুরে তথাকথিত বৈদিক সংস্কৃত ভাষার নেপথ্য কর্মকাণ্ডও চলেছিল। বাংলা, ওডিশা, মারাঠি (প্রাকৃত), গুজরাতি ও হিন্দি প্রধানত এই পাঁচটি ভাষায় (অন্য ভাষায় শব্দ রাখারও ব্যবস্থা হয়েছিল) বেশ কিছু শব্দ অবিকল একইভাবে কিংবা কিছুটা ঘষেমেজে নিয়ে ওই সংস্কৃত ভাষায় বিশেষ ঠাটের শব্দভাণ্ডার তৈরি করে নেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল, আর এটা ঘটেছিল আঠারো শতকের শেষ চতুর্থাংশে। ইংরেজি শব্দের সংস্কৃত প্রতিশব্দ কী রাখা যায় এই নিয়েও নানান কায়দায় জল্পনাকল্পনা হত। ভারতের নানান ভাষার কোন্ কোন্ শব্দ সংস্কৃতে ঠাঁই দেওয়া যায় সেটা নিয়েও ভাবনাচিন্তা কম হত না।…ব্যাকরণসর্বস্ব লাতিন ও সংস্কৃত ভাষা সৃষ্টির পিছনে যেসব নেপথ্যশিল্পী ছিলেন তাঁদের কেউই প্রাচীন যুগের ছিলেন না। ছিলেন অর্বাচীন যুগের। লাতিন এবং সংস্কৃত দুই ভাষায় লেখা কেতাবগুলির প্রায় সবই উনিশ শতকে প্রকাশিত হয়েছে কেন? কেন আঠেরো শতকে সংস্কৃত একখানা কেতাবও ছাপা হয়নি? সংস্কৃত রামায়ণের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৪৯ সালে। ক্রমশ অন্য খণ্ডগুলির প্রকাশ হতে হতে শেষ খণ্ডটির প্রকাশ ঘটেছিল ১৮৭৫ সালে।… বাংলা রামায়ণ ১৮০৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। অর্থাৎ ৭২ বছর পরে সংস্কৃত। রামায়ণ প্রকাশিত হয়। রামায়ণের সম্পূর্ণ কলেবরে পুথি কেউ কি দেখেছেন?
গোড়াতে রামায়ণ যে রূপে ছিল, যত দিন গেছে তত বিচিত্র সব নতুন নতুন কাহিনি সংযোজিত হয়েছে। যেটাকে বলা হয় প্রক্ষিপ্ত প্রক্ষিপ্ত হল সেটাই, মূল কবি যা লেখেননি–লিখেছেন অস্বীকৃত অন্য কেউ। এই প্রক্ষিপ্ত অংশগুলির বেশিরভাগ অলৌকিক, অপার্থিব। উদ্দেশ্য প্রণিধানযোগ্য। রামায়ণে পরবর্তী সংযোজিত অংশগুলি অভিপৌরাণিক, অর্থাৎ পুরাণে প্রতিফলিত যে সামাজিক মূল্যবোধ ও শাস্ত্রীয় অনুশাসনের সমাবেশে ভারতীয় ধর্মচিন্তা তার বিবর্তিতরূপে ক্রমে হিন্দুধর্ম’ বলে চিহ্নিত হল। যে মূল্যবোধ জনমানসে প্রোথিত হয়ে আছে, তা হল–একটি মূল কাহিনির, অপরটি সংযোজিত বা প্রক্ষিপ্ত অভিপৌরাণিকেরা।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন–“কিংবদন্তী আছে যে, ইহা বাল্মীকি প্রণীত। বাল্মীকি নামে কোনো গ্রন্থকার ছিল কি না, তদ্বিষয়ে সংশয়। বল্মীকি হইতে বাল্মীকি শব্দের উৎপত্তি দেখা যাইতেছে, অতএব আমার বিবেচনায় কোন বল্মীকমধ্যে এই গ্রন্থখানি পাওয়া গিয়াছিল। ইহাতে কি সিদ্ধান্ত স্থির করা যায় দেখা যাউক। রামায়ণ নামে একখানি বাঙ্গালা গ্রন্থ আমি দেখিয়াছি। ইহা কৃত্তিবাস প্রণীত। উভয় গ্রন্থে অনেক সাদৃশ্য আছে। অতএব ইহাও অসম্ভব নহে যে, বাল্মীকি রামায়ণ কৃত্তিবাসের গ্রন্থ হইতে সংকলিত। বাল্মীকি রামায়ণ কৃত্তিবাস হইতে সংকলিত, কি কৃত্তিবাস বাল্মীকি রামায়ণ হইতে সংকলন করিয়াছেন, তাহা মীমাংসা করা সহজ নহে; ইহা স্বীকার করি। কিন্তু রামায়ণ নামটিই এ বিষয়ের এক প্রমাণ।
বস্তুত সাতটি কাণ্ডে বিভক্ত রামায়ণকে আমরা যে আকারে পাই, সেটাই রামায়ণের মূল রূপ কি না এবং মূল কবির রচনা কি না–এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। আধুনিক পণ্ডিতদের মতে রামায়ণের আদি ও সপ্তম কাণ্ড পুরোপুরি প্রক্ষিপ্ত বা সংযোজিত। যুক্তিগুলি কী, সেগুলি একটু দেখে নেওয়া যাক–(১) আদি ও সপ্তম কাণ্ডে রামচন্দ্র হলেন বিষ্ণুর অবতার। কিন্তু বাকি পাঁচটি কাণ্ডেই দেখা যায়–তিনি একজন আদর্শ, অমিতবিক্রমী মানুষ। (২) আদি ও সপ্তম কাণ্ডের রচনাশৈলী ও ভাষা অপর পাঁচটি কাণ্ডের তুলনায় অত্যন্ত নিম্নমানের।(৩) বালিদ্বীপে প্রাপ্ত রামায়ণে উত্তরকাণ্ড অনুপস্থিত। (৪) প্রথম কাণ্ডে যেসব কথা বলা হয়েছে, অন্য পাঁচটি কাণ্ডের মধ্যে কোথাও তার উল্লেখ বা সমর্থন তো নেই-ই, উপরন্তু তার বিরোধিতা বা বৈপরীত্য লক্ষ করা যায়।(৫) প্রথম সূচি অনুসারে উত্তরকাণ্ডে সীতা নির্বাসনরূপ কোনো ঘটনার উল্লেখ নেই। কিন্তু দ্বিতীয় সূচিতে এই ঘটনার উল্লেখ থাকার মনে হয় উত্তরকাণ্ডের যোজনা পরবর্তীকালে হয় এবং তারপরেই দ্বিতীয় বিষয়সূচিতে সন্নিবেশ ঘটে। (৬) আদি ও উত্তরকাণ্ডে নানা প্রকার অলৌকিক ও অপার্থিব আখ্যান ও উপাখ্যান সংযোজিত হওয়ায় মূল ঘটনাপ্রবাহের ধারাবাহিকতায় স্খলন হয়েছে। (৭) যুদ্ধকাণ্ডের শেষে রামায়ণ পাঠের ফলের উল্লেখ আছে। এটাই প্রাচীন মূল গ্রন্থের সমাপ্তি বাক্য বলেই মনে হয়। (৮) উত্তরকাণ্ডের বিস্তৃত পরিসরে রাম-সীতার কাহিনি মাত্র এক-তৃতীয়াংশ, অবশিষ্ট অংশ বিভিন্ন বিচিত্র সব আখ্যানে ভরপুর।(৯) আদিকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ডে বাল্মীকিকে রামচন্দ্রের সমকালীন কবিরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু মূল রামায়ণের বাল্মীকি এক পৌরাণিক ব্যক্তিত্ব। (১০) রামায়ণের দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ কাণ্ডগুলির নামকরণ করা হয়েছে বিষয়বস্তু অনুসারে। যেমন–অযোধ্যা কাণ্ড, অরণ্য কাণ্ড ইত্যাদি। কিন্তু প্রথম ও শেষ কাণ্ডের নাম ‘আদি’ ও ‘উত্তর’ কাণ্ড বিষয়বস্তু অনুসারে হয়নি।(১১) প্রথম এবং সপ্তম কাণ্ডে বাল্মীকি নিজেই গ্রন্থটির একটি চরিত্র। কিন্তু পরবর্তী পাঁচটি কাণ্ডে চরিত্র তো ননই, এমনকি কোথাও তাঁর নাম পর্যন্ত উল্লেখ নেই। (১২) বালকাণ্ডের চতুর্থ সর্গের দ্বিতীয় শ্লোকের উক্তি থেকে জানা যায়, ২৪০০০ শ্লোকে রামায়ণ সমাপ্ত হয়েছে। (“সন্নিবদ্ধৎ হি শ্লোকানাং চতুর্বিংশৎ সহস্রক/উপ্যাখ্যানশতঞ্চৈব ভার্গবেন তপস্বিনা।আদিপ্রভৃতি বৈ রাজন্ পঞ্চসৰ্গশতানি চা/কাণ্ডানি ষটকৃতানী সোত্তরাণি মহাত্মনা।) কিন্তু বর্তমানে পাওয়া বিভিন্ন সংস্করণে শ্লোকসংখ্যা অনেক বেশি। (১৩) রামায়ণের ষষ্ঠ কাণ্ডের অন্তর্গত সীতার অগ্নিপরীক্ষা বৃত্তান্তটিও পরবর্তীকালের সংযোজন। মূল গ্রন্থে সীতার অগ্নিপরীক্ষার দৃশ্যটি ছিল না। (১৪) বালকাণ্ডে দেখা যায়, রামচন্দ্রের বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য ভাইদের (লক্ষ্মণ, ভরত, শত্ৰুগ্ন) বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু অরণ্যকাণ্ডে দেখা যায়, শূর্পণখা যখন রামকে বিয়ে করতে চাইছিল, সেসময় রাম শূর্পণখাকে অবিবাহিত লক্ষ্মণের কাছে যেতে বলেন। মনে হয় তখনও লক্ষ্মণের বিয়ে হয়নি। (১৫) বাল্মীকির রামায়ণ ষষ্ঠ কাণ্ডেই পরিসমাপ্ত হয়েছে। রাবণ বধ করে সীতা ও লক্ষ্মণের সঙ্গে রাম অযোধ্যায় ফিরে রাজসিংহাসনে বসেন। তারপর সুখসমৃদ্ধিতে বসবাস করিতে লাগিল। মিলনান্তক যবনিকা। রাজ্যে সর্বত্র শান্তি বিরাজ করছে। তারপর আবার সপ্তম কাণ্ডের প্রয়োজন কী? কৃত্তিবাস ওঝার শ্রীরাম পাঁচালী’-র শুরুতেই রত্নাকর দস্যু থেকে বাল্মীকি হয়ে ওঠার একটা রোমাঞ্চক গল্প আছে। সেই ‘পাপের ভাগ না-নেওয়ার’ গল্প আর ‘মরা মরা’ থেকে ‘রাম রাম’-এর গল্পটি বাঙালি সমাজে বেশ জনপ্রিয়। অন্যদিকে বাল্মীকির কবি হওয়ার রামকথা শুরুর গল্পটি বিখ্যাত। তমসার তীরে এক ব্যাধের শরাঘাতে মৃত ক্রৌঞ্চপতির বিরহে ক্রৌঞ্চপত্নীর করুণ ক্রন্দন ঋষি বাল্মীকির হৃদয়কে বিদীর্ণ করে এবং তার কণ্ঠ থেকে আসে তীব্র অভিশাপবাণী–“মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতী সমাঃ/যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেমবধীঃ কামমমাহিত৷৷”
রামায়ণে বিভক্ত উত্তরকাণ্ডের ৯৪ সর্গে রামপুত্র লবকুশ রামায়ণগান মাঝপথে থামিয়ে অকস্মাৎ বললেন–“ভগবান বাল্মীকি এই কাব্যের রচয়িতা। ইহার শ্লোকসংখ্যা চতুর্বিংশৎ সহস্র এবং উপাখ্যান একশত। ইহাতে আদি হইতে পাঁচশত সর্গ ছয় কাণ্ড এবং উত্তরকাণ্ড নিবদ্ধ আছে।” এ তো দেখছি ঠাকুরঘরে কে, আমি কলা খাইনি। আগ বাড়িয়ে সাফাই।
কী আছে রামায়ণে? বাঙালি পাঠক-শ্রোতা-ভক্তরা যে রামায়ণ আর রামচন্দ্রকে জানেন, তার একটা রূপরেখা এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক–
(১) বালকাণ্ড বা আদিকাণ্ড : এই অধ্যায়ে ৭৭টি সর্গ আছে। আছে রামায়ণ রচনার সূচনা ইক্ষ্বাকু বংশের অযোধ্যারাজ দশরথ দেবতার বরে রাম, লক্ষ্মণ, ভরত ও শত্রুঘ্ন নামে চার জন্ম হয়। একদিন বিশ্বামিত্র ঋষি এসে যজ্ঞবিঘ্নকারী রাক্ষসদের বধ করার জন্য রাম-লক্ষ্মণকে নিয়ে গেলেন। তাড়কা বধের পর জনকের রাজসভায় হরধনু ভঙ্গ এবং রাম সহ লক্ষ্মণ, ভরত, শত্ৰুগ্ন সকল ভাইয়ের বিয়ে হয় ইত্যাদি।
(২) অযযাদ্ধাকাণ্ড বা অযোধ্যাকাণ্ড : এই অধ্যায়ে ১১৯টি সর্গ আছে। রামের অভিষেকের আয়োজন। দশরথের দ্বিতীয়া পত্নী কৈকেয়ী প্রার্থিত দুটি বরে রামের চোদ্দো বছর বনবাস ও ভরতের রাজ্যাভিষেক। পিতৃসত্য পালনের জন্য রামচন্দ্র স্ত্রী সীতা ও ভাই লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে বনে গেলেন। পুত্রবিরহে দশরথের মৃত্যু, চিত্রকূটে রামকে ফিরিয়ে আনার জন্য ভরতের অনুরোধ। অবশেষে রামচন্দ্রের পাদুকা নিয়ে ভরতের রাজ্যশাসন ইত্যাদি।
(৩) অরণ্যকাণ্ড : এই অধ্যায়েও ৭৫টি সর্গ। এই অংশে আছে দণ্ডকারণ্যে রামের হাজার হাজার রাক্ষস হত্যা, লক্ষ্মণ কর্তৃক রাবণের বোন শূর্পনখার নাক-কান কেটে দেওয়া এবং সেই প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে রাবণ কর্তৃক সীতাহরণ। সীতাকে কুটিরে না-পেরে রাম ও লক্ষ্মণের শোকবিহ্বলতা। এরপর সীতার খোঁজ করতে করতে গভীর অরণ্যে প্রবেশ এবং সেখানে দশরথের বন্ধু রাবণের সীতাহরণ বৃত্তান্ত শোনা ইত্যাদি।
(৪) কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড : এই অধ্যায়ে ৬৭টি সর্গ। এই অংশে বালীকে হত্যা করে সুগ্রীবের সঙ্গে রামের সঙ্গে শর্তসাপেক্ষে বন্ধুত্ব এবং সুগ্রীব রাজা হয়ে হনুমানকে সীতার খোঁজে আদেশ দেন। সেই আদেশ অনুযায়ী হনুমানও সীতার খোঁজে বেরিয়ে পড়েন।
(৫) সুন্দরকাণ্ড : এই অধ্যায়ে ৬৮টি সর্গ। এই অংশে হনুমান সমুদ্র পার হয়ে লঙ্কায় অশোকবনে সীতার দেখা পান এবং স্মারকচিহ্নস্বরূপ রামের দেওয়া আংটি দেখালেন। হনুমান সীতাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য রাবণকে অনুরোধ করলেন এবং রামের বীরত্বকাহিনি শুনিয়ে উপদেশও দিলেন। রাবণ হনুমানের উপদেশ ও অনুরোধ সপাটে প্রত্যাখ্যান করেন। এই অংশে লঙ্কার সৌন্দর্যের বর্ণনাও আছে।
(৬) যুদ্ধকাণ্ড বা লঙ্কাকাণ্ড : ১৩০টি সর্গ। এই অংশে রাম সুগ্রীবের সেনাদের সাহায্যে সমুদ্রসেতু করে লঙ্কায় পৌঁছলেন। ত্রিকুট পর্বতে অবস্থিত লঙ্কায় পৌঁছোনোর পর রাবণের আপন ভাই বিভীষণের সঙ্গে পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হয়। বিভীষণের অকুণ্ঠ সহযোগিতায় রামের সঙ্গে যুদ্ধে রাবণ সবংশে মারা যান। এই কাণ্ডে রাম-সীতা। সুখেই বসবাস করতে থাকলেন। আর বলা হয়েছে, রামগান শ্রবণে কী ফল লাভ হবে তার বিস্তারিত বর্ণনা।
(৭) উত্তরকাণ্ড : ১২৫টি সর্গ। এই কাণ্ডটি পরবর্তী অন্য কোনো কবির সংযোজন বলে অনেক পণ্ডিতগণ মনে করেন। এই অংশের প্রথমদিকে প্রাচীন গল্পকাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে। ষষ্ঠকাণ্ড পর্যন্ত তো রাম-সীতার দাম্পত্যজীবন সুখেই কাটছিল। উত্তরকাণ্ডে এসে অকস্মাৎ বিনামেঘে প্রায় বজ্রপাত। সীতার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলল প্রজারা, অপবাদের গুঞ্জন উঠতে থাকল। এহেন অপবাদ থেকে রেহাই পেতে রামের আদেশে লক্ষ্মণ আশ্রম-দর্শনের ছলনায় সীতাকে বাল্মীকির আশ্রমে দিয়ে এলেন। আশ্রমে থাকাকালীন সীতা দুটি যমজ সন্তানের জন্ম দিলেন–লব ও কুশ। অপরদিকে রাম সোনার সীতা নির্মাণ করে অশ্বমেধ যজ্ঞ শুরু করেন। রক্তমাংসের মাকে বাদ দিয়ে সোনার তৈরি মাকে দিয়ে যজ্ঞের আয়োজন-বার্তা লব-কুশের কাছে পৌঁছে যায়। লব-কুশ যজ্ঞস্থলে এসে রামগান শুরু করে। পরে সীতা অযোধ্যায় ফিরলে তাঁকে আগুনে প্রবেশ করিয়ে তাঁর সতীত্বের প্রমাণ নেওয়া হয়। কিন্তু সীতা অপমানিত হন এবং তাঁর মা বসুন্ধরাকে স্মরণ করলে পাতালপ্রবেশ হয়। লব ও কুশ অযোধ্যার সিংহাসনে বসেন। রাম সরযূর জলে প্রাণত্যাগ করেন। সংকসেংক্ষেপে এই কাণ্ডে পাওয়া যাবে–রামজন্মের পূর্বকাহিনি, রাক্ষস ও বানরদের বিবরণ, বেদবতী ইত্যাদির কথা এবং পূর্বকালের কিছু দেবাসুর যুদ্ধের বিচ্ছিন্ন কাহিনি আছে। আছে রাম কর্তৃক ভাইদের বিভিন্ন রাজ্যজয়ে প্রেরণ এবং ভ্রাতুস্পুত্রদের মধ্যে সেইসব বিজিত রাজ্য ভাগ করে দেওয়া–ইত্যাকার ইতিহাস। এই হল সংক্ষিপ্ত রামায়ণ।
জয়ন্তানুজ বন্দোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে তাঁর মহাকাব্য ও মৌলবাদ’ বইয়ে বলেন : “আদি বাল্মীকি রামায়ণে বালকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ড ছিল না। আর পরবর্তীকালে সংযোজিত এই দুই কাণ্ড এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রক্ষিপ্ত কথা বাদ দিলে আদি বাল্মীকি রামায়ণে রামের অবতারত্বের বিশেষ চিহ্ন পাওয়া যায় না। মহাকাব্য হিসাবেও রামায়ণের সাহিত্যগুণ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু তুলসী রামায়ণে বিষ্ণুকে শ্রেষ্ঠ দেবতা রামকে বিষ্ণুর অবতার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করাই ছিল প্রধান লক্ষ্য। যা এমনকি বালকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ড সহ পল্লবিত বাল্মীকি রামায়ণেরও প্রধান বিষয়বস্তু নয়। “
এক ভারত, কিন্তু বহু সংস্কৃতি। বহু সংস্কৃতি, বিচিত্র তার কল্পনা শাখাপ্রশাখায়। ৩০০টি ভিন্ন রামায়ণের সন্ধান পাওয়া যায়–চরিত্রগুলি যথাযথ–রাম, সীতা, রাবণ সবই আছে–বদলে গেছে ঘটনাপঞ্জি, বদলে গেছে সম্পর্ক, বদলে গেছে কার্য-কারণ, বদলে গেছে পরিণতিও। একই রামের গল্প বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ ফিরে ফিরে লিখেছে–ভিন্ন ভিন্ন অর্থে, ভিন্ন ভিন্ন ভাষ্যে। মূল রামায়ণ লিখিত হয়েছিল ২৪,০০০ শ্লোকে। ছিল ৫০০ সর্গ এবং ছয়টি কাণ্ড–“চতুর্বিংশৎ সহস্রাণি শ্লোকানামুক্তবান্ ঋষিঃ।/তথা সৰ্গৰ্শতা পঞ্চ ষটকাণ্ডানি তথোত্তর”। পরে উত্তরকাণ্ড যুক্ত হয়েছে। বাল্মীকির আগেও রামকথা ছিল, বাল্মীকির পরেও রামকথা আছে এবং থাকবে–ভিন্ন রূপে, ভিন্ন বোধে৷ এইভাবেই রামায়ণ বিপুলায়তন এক মহাসাহিত্যের পরিণত হয়েছে।
স্থানীয় বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে অজস্র গল্প-উপগল্প, কথা-উপকথা, ইতিহাস-অনৈতিহাস। তাই রামায়ণে রাম নিশ্চয়ই আছেন, কিন্তু রামায়ণের রাম সর্বত্র একইভাবে চিত্রিত হয়নি। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদরা একমত যে, বাল্মীকি রচিত রামায়ণের রাম আসলে এক আদর্শ ক্ষত্রিয় রাজার বা একজন আদর্শ মানুষের চরিত্রায়ণ। রামায়ণের জনপ্রিয়তা কোনো ধর্মগ্রন্থ হিসাবে নয়, বরং এক সুকথিত কাহিনি হিসাবে দেখা যায়। অবশ্য একথা অস্বীকার করা যায় না যে, পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ লেখকদের দ্বারা তা কিছুটা ধর্মগ্রন্থের রূপ নেয়। এখন হিন্দুত্ববাদীরা ক্ষমতায়নের অলিন্দ ঢুকে পড়তে রামকেই ঢাল বানিয়েছে। বাংলা, তামিল, তেলেগু, মালয়ালম ভাষায় রামায়ণকে ভুলে গেলে চলবে না–কারণ এখানেই রামকে একজন আদর্শ মানুষমাত্র। হিন্দু ধর্মগ্রন্থে কোথাও রামের উপাসনা করতে হবে এমন আদেশ নেই। তবে দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শুরুতে রামনন্দিনের কথা জানা যায়, যাঁরা রামভজনাকে মুক্তির পথ হিসাবে বর্ণনা করেছে।
বস্তুত ইতিহাসের দৃষ্টির দিক থেকে দেখলে রামায়ণের যুগ বলে কিছু হয় না। এমনকি কোনো সময়কেও চিহ্নিত করা যায় না। কারণ এই সাহিত্য বিশেষ কোনো সময়ে লিখিত হয়নি। দীর্ঘ প্রায় ২০০ বছর ব্যাপী এই মহাসাহিত্য গড়ে উঠেছে। নির্মাণ যখনই শুরু হোক, যখনই শেষ হোক না-কেন বেশ কয়েক শতাব্দী জুড়ে বিবর্তন চলেছিল, একই সময়কালে। সংস্কৃত ভাষায় রামায়ণ কেবল বাল্মীকিই লেখেননি, আছে আরও কিছু সংস্কৃতে লিখিত রামায়ণ। যেমন–আধ্যাত্ম রামায়ণ, আনন্দ রামায়ণ, যোগবাশিষ্ট রামায়ণ, ভুশণ্ডি রামায়ণ ইত্যাদি। আছে একে অপরের সঙ্গে বিস্তর পাঠভেদ। কথকও এক নয়। যেমন–বাল্মীকির রামায়ণের মূল কথক নারদ, অপরদিকে ‘আধ্যাত্ম রামায়ণ’-এর মূল কথক শিব। ভুশণ্ডি রামায়ণ’-এর কথকও নারদ। আনন্দ রামায়ণ’ কিন্তু সাতকাণ্ডে নয়, নয় কাণ্ডে। মিল-অমিল যাই হোক–সব রামায়ণেই কাহিনিবিন্যাস, পরিকাঠামো মায় লোকগাথা একদম ভিন্ন। বাঙালিদের কৃত্তিবাসের শ্রীরাম পাঁচালী’-র রামচন্দ্র নয়নাভিরাম, অসামান্য রূপবান, অলৌকিক শক্তিতে ভরপুর, অপরিসীম করুণা আর ভক্তকুলের মনোবাঞ্ছাপূরণে উদার। বাল্মীকির রামায়ণের রামচন্দ্র মহাশক্তিধর, তাঁর বজ্রকঠিন দু-হাত এবং শত্ৰুসংহারে নির্মম। থাইল্যান্ডের রামায়ণ আর কৃত্তিবাসী রামায়ণ এক নয়, ইন্দোনেশিয়ার রামায়ণী নাচগানের সঙ্গে তুলসীদাসের রামায়ণে বিস্তর ফারাক। আমরা ‘চন্দ্রাবতী রামায়ণ’ নামেও একটি রামায়ণ পাই। বেশ কিছুদিন আগে বইটির পিডিএফ কপি আমার হাতে এল। এই রামায়ণ নারীদের জন্য রচনা করেছেন এক নারী। সেই নারী চন্দ্রাবতী একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর রামায়ণে পুরুষকারকে দমন করেছেন কঠোর লেখনীতে। বর্ণিত হয়েছে সীতার কথা, সীতার জীবনকথা। বড়োই দরদে লিখিত হয়েছে নারী ও নারীত্বের অবমাননার কথা।
সুকুমার সেনের ‘রামায়ণী কথা’ গ্রন্থে অনেক রামায়ণের উল্লেখ পাওয়া যায়। গবেষক ক্যামিল বাল্ক ১৯৫০ সালে ৩০০টি রামায়ণ খুঁজে পেয়েছিলেন। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও প্রাবন্ধিক এ কে রামানুজম তাঁর লেখা ‘Three Hundred Ramayanas : Five Examples and Three Thoughts on Translation’ 21203 vooft রামায়ণের কথা বলেছেন। অসমিয়া ভাষায় মাধব-কণ্ডলীর রামায়ণ’, কম্বন লিখিত তামিল রামায়ণ ‘ইরামবাতায়ম’, তুলসীদাস লিখিত হিন্দি ভাষায় ‘রামচরিতমানস’, ভানুভক্ত লিখিত নেপালি ভাষায় ‘নেপালি রামায়ণ’, কন্নড় ভাষায় তোরবেয় রামায়ণ ইত্যাদি রামায়ণ বহুল প্রচলিত। কৃত্তিবাস ওঝা ছাড়াও বাংলা ভাষায় আর-একজন বিস্মৃতপ্রায় কবি রামায়ণ লিখেছিলেন। তাঁর নাম শঙ্কর কবিচন্দ্র। ছয়টি কাণ্ডে রচিত তাঁর রামায়ণের নাম “বিষ্ণুপুরী রামায়ণ”, এই রামায়ণে উত্তরকাণ্ড অনুপস্থিত।
এছাড়াও প্রচুর ভিন্ন ভিন্ন গল্প পাওয়া যায় বিভিন্ন রামায়ণে। আবার বৌদ্ধদের রামের কাহিনি দশরথ-জাতক এ রাম ও সীতা একে-অপরের ভাইবোন (এই রামকথায় কোনো মুনিঋষি নেই, দণ্ডকারণ্য নেই, বানরগোষ্ঠী নেই, রাবণ নেই, সীতাহরণও নেই)। দশরথ রাজার প্রথমার স্ত্রী কৌশল্যার দুটি পুত্র ও একটি কন্যার জন্ম দিয়ে মারা যান। এঁরাই হলেন যথাক্রমে রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা। কৃষিনির্ভর মাতৃতান্ত্রিক সমাজে ভাইবোনের বিয়ে স্বাভাবিকই ছিল। বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। দশরথ-জাতকে রাম রামপণ্ডিত’ বলে পরিচিত। দশরথ-জাতকে রামের পিতৃসত্য পালনের কোনো ব্যাপার নেই। এখানে রাজা দশরথ বলেছেন, মৃত্যু হলেই তোমরা এসে সিংহাসন দখল করবে। বাল্মীকির রামায়ণে ভরত রামের পাদুকা চেয়ে নিয়েছিলেন সিংহাসনে রেখে অযোধ্যা শাসন করার জন্যে। দশরথ জাতকে ভরত কোনোরূপ পাদুকাই চাননি। বাল্মীকির রামকাহিনি অযোধ্যা হলেও, দশরথ-জাতকের রামকাহিনি বারাণসীর। দশরথ-জাতকের শেষ অংশে বুদ্ধ বলছেন–“সেই সময়ে মহারাজ শুদ্ধোদন ছিলেন দশরথ, কৌশল্যা ছিলেন মহামায়া, রাহুলজননী ছিলেন সীতা, ভরত ছিলেন আনন্দ, সারিপুত্ত ছিলেন লক্ষ্মণ এবং রামপণ্ডিত ছিলাম আমি।” এখানে বোঝাই যাচ্ছে এসব কাহিনি অবতারবাদের প্রভাব। দশাবতার বিষ্ণুর নবম অবতার সিদ্ধার্থ গৌতম বা বুদ্ধদেব। কৃত্তিবাস, রঙ্গনাথন, তুলসীদাসদের মতো দশরথজাতকের রচয়িতাও বাল্মীকির রামায়ণের চরম বিকৃতি ঘটিয়েছেন। নাকি বাল্মীকি দশরথ-জাতকের চরম বিকৃতি ঘটিয়েছেন। কারণ অনেক পণ্ডিত মনে করেন বাল্মীকির রামায়ণের অনেক আগেই দশরথ-জাতক রচিত হয়েছে।
রামায়ণের বৌদ্ধ বা জৈন সংস্করণে রাবণকে একজন ভক্ত জৈন হিসাবে উল্লেখ হয়েছে। আবার থাইল্যান্ডের রামায়ণের সঙ্গে কৃত্তিবাসী রামায়ণের মিল নেই। ইন্দোনেশিয়ার রামায়ণের সঙ্গে তুলসীদাসের রামায়ণে প্রচুর গরমিল। তামিল ভাষায় রচিত কম্বন রামায়ণের সঙ্গে খোটানের রামায়ণেও অনেক অমিল। কন্নড় ভাষায় রচিত রামায়ণে যোগীর তুক করা আমের শাঁস খেয়ে রাবণ গর্ভবান হন। কী আর করা! রাবণ তো আর মহিলা নন যে, নির্দিষ্ট পথে সন্তান প্রসব করবে! অতএব হাঁচির সঙ্গে সন্তান বেরিয়ে আসে বাইরে! এই সন্তানই হলেন সীতা। আদিবাসী সমাজের কোনো-কোন অঞ্চলে রাবণ নায়ক–তাঁকে প্রধান চরিত্র করে রচিত হয়েছে রাবণগাথাও।
থাইল্যান্ডে রাম নামে একাধিক রাজা ছিলেন, এঁরা সকলে বিষ্ণুর অবতারও ছিলেন। আর আয়োধিয়া (অযোধ্যা) নামে রাজ্য ছিল। ১৩৫০ সালে নতুন এক রাজবংশের পরাক্রান্তা রাজা রামাধিপতি নতুন অযোধ্যা (Ayuthia > আইযুথিয়া) নগরী স্থাপন করে সেখানেই নিজের রাজধানী পত্তন করেন। শ্যামদেশের (বর্তমানের থাইল্যান্ড) এখনকার রাজবংশের নাম মহাচক্রীবংশ। এই বংশের প্রত্যেক রাজা রাম’ নামে অভিহিত। ১৭৮২ সালে এই রাজবংশের পত্তন হয়। প্রথম রাজার নাম ছিল ‘রাম ফা বুদ্ধয়োদ ফা চূড়ালোক। এই রাজার শাসনকাল ছিল ১৭৮২ সাল থেকে ১৮০৯ পর্যন্ত। দ্বিতীয় রাম ‘ফ্রা বুদ্ধ সোএস লা নাভালৈ’, তৃতীয় রাম ‘ফ্রা নাঙ ক্লাও’, চতুর্থ রাম ‘ফ্রা চোম ক্লাও মহামংকুৎ’, পঞ্চম রাম চূড়ালংকার’, ষষ্ঠ রাম বজ্ৰায়ুধ’, সপ্তম রাম ‘প্রজাধিপক’, অষ্টম রাম অজ্ঞাত, নবম রাম ‘অদুলদেৎ’। থাইল্যান্ডে ১৭০ বছর ধরে সাতপুরুষ জুড়ে রাম-রাজত্ব চলে আসছে। তাহলে থাইল্যান্ডের অযোধ্যার রাম আর ভারতের অযোধ্যার রাম কি একই ব্যক্তি? নিশ্চয় এক নয়। কারণ ভারতের কোনো পুরাণসাহিত্যে এর সমর্থনে কিস্যু জানা যায় না। থাইল্যান্ডে একটি রামায়ণের সন্ধান মেলে, নাম ‘রামাকিয়েন’। থাই ভাষায় ‘রামাকিয়েন’ শব্দের বাংলা অর্থ ‘রামের পুণ্য হউক’। এটি থাইল্যান্ডের জাতীয় গ্রন্থ। এই রামায়ণে বাল্মীকির রামায়ণের সঙ্গে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। সুখখাতা সরকারের মৃত্যুর পর, অযোধ্যা বা আয়োধিয়া রাজ্যে অষ্টাদশ শতাব্দীতে কিংবদন্তিতে থাই সংস্করণটি প্রথম লিখিত হয়েছিল। তবে ১৭৬৭ সালে বার্মা (আধুনিক মায়ানমার) থেকে সৈন্যবাহিনী দ্বারা আয়োয় শহরটি ধ্বংস হয়ে গেলে অধিকাংশ সংস্করণই হারিয়ে যায়। আজকে স্বীকৃত সংস্করণটি সিয়ামের রাজত্বকালে রাজা রাম আমি (১৭২৬ ১৮০৯) চকরি বংশের প্রতিষ্ঠাতা, তাঁর তত্ত্বাবধানে রচিত হয়েছিল। রামাকিনের রামের নাম ‘ফারারাম’ এবং রাবণের নাম ‘থোত্তকান’। বলা হয়েছে শ্রীলঙ্কার দুষ্টদের রাজা খোকন এবং ফারারামের প্রতিপক্ষের শক্তিশালী। থোকানের দশটি মুখ এবং কুড়িটি হাত এবং একটি অরাজক অস্ত্র আছে।
রামকিয়েনের রামকথা বিভিন্ন বিষয়ে স্বতন্ত্র। বাল্মীকি রামায়ণের কাহিনি মোটামুটি ঠিক থাকলেও ছোটো-বড়ো ঘটনাগুলির বিস্তর পার্থক্য আছে। এছাড়া বাল্মীকির রামায়ণের সুপরিচিত নামগুলোও যথেচ্ছ বিকৃতি হয়েছে। যেমন কৌশল্যা, সুমিত্রা, কৈকেয়ীর নাম যথাক্রমে কৌসুরিয়া, সমুদ্রজা, কৈয়কেশী। বশিষ্ঠের নাম ঠিক থাকলেও বিশ্বামিত্রের নাম বদলে স্বমিত্র হয়ে গেছে। রাবণের স্ত্রী মন্দোদরীর নাম হয়েছে মণ্ডো। চার ভাইয়ের গায়ের রং চার ধরনের। যেমন–রামের গায়ের রং হরিৎ বা সবুজ, ভরতের (থাইভাষায় ‘বরত’) গায়ের রং রক্ত বা লাল, লক্ষ্মণের (থাইভাষায় ‘লক্ষ্মণেব’) গায়ের রং পীত বা হলুদ এবং শত্রুঘ্নের (থাইভাষায় ‘শত্রুদ) গায়ের রং রক্তনীল।
মূল রামায়ণকে কেন্দ্র করে যেমন অনেক ভাষায় রামায়ণ লেখা হয়েছে, ঠিক তেমনই রামায়ণের অংশ নিয়ে প্রচুর গ্রন্থ লেখা হয়েছে। মনের রঙে মাধুরী মিশিয়ে রচিত হয়েছে নতুন নতুন কাহিনি। রঘুনন্দন গোস্বামী, রামানন্দ ঘোষ, জগত্রাম, রামপ্রসাদ প্রমুখ এরকম অনেকেই রামায়ণ অবলম্বনে কাব্য রচনা করে প্রভূত খ্যাতি লাভ করেছেন। কালিদসের ‘রঘুবংশম্’, ভাসের প্রতিমা’ ও ‘অভিষেক’, ভবভূতির মহাবীরচরিত’ ও ‘উত্তররামচরিত’, ভট্টির ‘রাবণবধ’, কুমারদাসের ‘জানকীহরণ’, মুরারির ‘অনর্ঘরাঘব’, ক্ষেমেন্দ্রর ‘রামায়ণমঞ্জরী, রাজশেখরের বালরামায়ণ’, জয়দেবের ‘প্রসন্নরাঘব’, ভোজের ‘চম্পূরামায়ণ’, ঈশ্বরচন্দ্রের ‘সীতার বনবাস’, রবীন্দ্রনাথের বাল্মীকির প্রতিভা’, রামশঙ্করের রামায়ণ’, দ্বিজলক্ষ্মণের ‘শিবরামের যুদ্ধ’, মাইকেল মধূসূদনের ‘মেঘনাদবধকাব্য’ ইত্যাদি গ্রন্থগুলি রামায়ণের অংশ নিয়েই রচিত হয়েছে এবং ভারতীয় সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। উল্লেখ্য, এঁরা কেউই বাল্মীকির রামায়ণকে অবিকৃত রাখেননি। বাংলায় কৃত্তিবাস বেশ জনপ্রিয়। কৃত্তিবাসের রামায়ণের সমাদর আকাশছোঁয়া। কৃত্তিবাসের পরবর্তীকালে আরও কয়েকজন স্বল্পখ্যাত কবি রামায়ণ রচনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই চিরতরে হারিয়ে গেছেন সংরক্ষণের অভাবে। কেউ-বা পড়ে আছেন আমাদের অন্যমনস্কতা ও উদাসীনতার আড়ালে। কেউ আবার খ্যাতিমান কবির সঙ্গে মিশে গেছে; ফলে আমরা যে কবির নাম কখনোই শুনিনি, হয়তো তাঁর পদগুলি পড়ে চলেছি। যেমন কৃত্তিবাসের নামে এমন অনেক পদ চলে আসছে, সেগুলি তিনি কোনোদিনই রচনা করেননি। ক-জন চেনেন শঙ্কর কবিচন্দ্রকে? ক জন পড়েছেন ‘বিষ্ণুপুরী রামায়ণ’? ‘বিষ্ণুপুরী রামায়ণ’ শঙ্কর কবিচন্দ্রের রচিত শেষতম বাংলা ভাষায় মহাকাব্য। তাঁর যা কিছু কৃতিত্ব, যা কিছু গৌরব–সবই অধুনা প্রচলিত কৃত্তিবাসী রামায়ণের সঙ্গে মিশে গেছে।
মাইকেল মধুসূদনের পূর্বে বাংলা কাব্যচর্চা মধ্যযুগেই পড়ে ছিল। তিনিই একমাত্র একক প্রচেষ্টায় এক ধাক্কায় বাংলা কাব্যকে মধ্যযুগীয় কাব্যের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করেন এবং আধুনিকতার আঙ্গিনায় উপস্থাপিত করেন। এরকম উদ্ধত, দ্রোহী, আত্মম্ভর পুরুষ এরকম অবিশ্বাস্য প্রতিভাবান কবি বাংলা সাহিত্যে আর জন্মায়নি। হয়তো কোনোদিন আর জন্মাবেও না। মেঘনাদবধকাব্য’ যখন তিনি লেখেন তখন বাংলা ভাষা ছিল একটি অবিকশিত ও অশক্তিশালী ভাষা। বস্তুত এটি ছিল ক্ষুদ্র একটি জনগোষ্ঠীর আঞ্চলিক ভাষা। মহত্তম ভাবপ্রকাশের জন্য অপর্যাপ্ত এবং অপরিশ্রুত এবং অনাদরণীয় ছিল এই ভাষা। সমাজের চাষাভূষা মানুষের অবহেলিত ভাষা এই বাংলা ভাষা। উঁচুমহলে তো এর কোনো ঠাঁই-ই ছিল না।
‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এ তিনি একটি অচিন্তনীয় এবং অভাবনীয় এক ব্যাপার ঘটিয়েছিলেন। যাঁরা গ্রন্থটি পাঠ করেছেন তাঁদের নিশ্চয় সেই রসাস্বাদন করেছেন যে, রাম এবং রাবণের চরিত্র আমরা যেরকম করে জানি, তিনি সেটিকে উলটে দিয়েছিলেন স্পন্দিত স্পর্ধায়। বাল্মিকীর রামায়ণে রাম সৎ, সাহসী, সত্যনিষ্ঠ এবং দয়াবান। অপরদিকে রাবণ পাপীতাপী, অন্যায়কারী এবং অত্যাচারী। কিন্তু মধুসূদনের রাম ভীরু, শঠ, প্রতারক এবং দুর্বল চরিত্রের মানুষ। অপরদিকে রাবণ দুর্জয় ও সাহসী শাসক, স্নেহময় পিতা, প্রজাহৈতিষী। দেবতাদের চক্রান্ত ও কোপানলে পড়ে তিনি একজন বিরহী ও দুঃখী মানুষ। তিনি রামায়ণ নির্দেশিত পথে না চলে রাক্ষস জাতির প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হয়েছেন। তাঁর রচনায় রাক্ষসেরা কল্পিত কোনো বীভৎস এবং ঘৃণ্য কোনো প্রাণী নয়, বরং আমাদের মতোই আবেগ-অনুভূতিতে পূর্ণ মানুষ। রাবণ চরিত্রের জন্যই ‘মেঘনাদবধকাব্য’ করুণ রসের আধার হয়ে উঠেছে। মেঘনাদবধ অমিত তেজী, বিদ্রোহী রাবণের পরাজয়ের বেদনাবিধুর কাহিনি। রাম কর্তৃক আক্রান্ত, পর্যদস্ত, রাবণ বংশগৌরব এবং জাতীয় মর্যাদা রক্ষার জন্য সর্বস্ব পণ করে বসে আছেন এবং প্রতিকূল দৈবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। রাবণের এই মর্মবিদারক ব্যথাই কাব্যটির বিষয়বস্তু। মেঘনাদবধের রাবণ যেন মধুসূদন নিজেই। তার জীবনেও এই একই দুর্বিনীত সংগ্রাম এবং করুণ পরাজয়ের শোকগাথা লেখা রয়েছে। এই শোকগাথার জন্য অবশ্য অন্যেরা যতটুকু না দায়ী, তিনি নিজেও তার চেয়ে বেশি দায়ী। আজকের এই অস্থির পরিবেশে দাঁড়িয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত যদি ‘মেঘনাদবধ কাব্যটি রচনা করতেন, তাহলে হয়তো কাব্যটি ব্যান হয়ে যেত, কবিকে হয়তো জেলযাত্রা করতে হত কিংবা কবির মুখে কালিলেপন করা হত।
ভারতীয় হিন্দুসমাজে রামায়ণের রাম-সীতা দেবত্বে অধিষ্ঠিত হলেও রামকথার প্রকৃত জনপ্রিয়তা লোকসংস্কৃতির ক্ষেত্রেই। এই কারণেই রামকথা শিল্প, সাহিত্য, সংগীত এবং সাধারণ মানুষের সমাজচিন্তার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে। স্থান-কালভেদে রামকথার বিন্যাস ও চরিত্র অনেকাংশেই সংযোজন-পরিমার্জন হয়েছে–একথা সত্য। কিন্ত কাহিনির মূল কাঠামোটি প্রায় অপরিবর্তনীয় আছে। রামায়ণের নিয়ে রচনাকাল নিয়ে যেমন মতান্তর আছে, তেমনই রাম ও অন্যান্য বিষয়টি ঐতিহাসিক কি না সে বিষয়েও যথেষ্ট সংশয় করেছেন পণ্ডিতগণ।
যদিও আমার আলোচ্য বিষয় রামায়ণ, কিন্তু মহাভারত গ্রন্থটিও এ আলোচনায় প্রাসঙ্গিক! রামায়ণের মতো মহাভারতও ভারতীয়দের কাছে পরম আদরণীয়, মহত্ত্বপূর্ণ–পরম পবিত্রও। রামায়ণ ও মহাভারত উভয় মহাগ্রন্থই ভারতের ইতিহাসের আকর রূপে মর্যাদা পায়। মহাভারতকে বাদ দিয়ে রামায়ণ আলোচনা করলে এই আলোচনা অসমাপ্ত থেকে যাবে। তাই মহাভারত প্রসঙ্গ টানতেই হচ্ছে। বাল্মীকি ও ব্যাস উভয়েই যথাক্রমে রামায়ণ ও মহাভারতের সংকলক। বস্তুত উভয়ই ‘ব্যাস’। কারণ বিষ্ণুপুরাণে রামায়ণ রচয়িতা বাল্মীকিকেও ‘ব্যাস’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ব্যাসের ধারণা যখন জন্মলাভ করে তখন বেদই ছিল। দেবমন্ত্রী স্বয়ং ব্রহ্মাই বেদের সংকলক বলে অভিহিত। তিনিই আদি ব্যাস। ব্যাস তিনিই, যিনি জাতীয় জীবনে যা কিছু শুভকর যা কিছু মঙ্গলদায়ক সেগুলিকে সংকলন করে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়। বিষ্ণুপুরাণে ২৯ জন সংকলক বা ব্যাসের কথা জানা যায়।
মহাভারতের বেশকিছু পর্বে রামায়ণের দশরথ, জনক, রাম, লক্ষ্মণ, সীতা, রাবণ, হনুমান প্রভৃতি কথাপুরুষ উদাহরণ বারবার উল্লেখ আছে। কোনো স্থলে যজ্ঞের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদনের জন্য দশরথের নাম, কখনো-বা স্বামীভক্তির দৃষ্টান্ত দেখাতে সীতার পাতিব্ৰত্যের উল্লেখ আছে, কখনো-বা বিদুর কর্তৃক ধর্মপ্রাণ ভীষ্ম ও দ্রোণের প্রশংসা অথবা অর্জুনের বীরত্বের তুলনা প্রসঙ্গে রামচন্দ্রের কথা, কোনো প্রসঙ্গে রাবণের প্রসঙ্গও এসেছে। এমনকি রামায়ণের রামভক্ত হনুমানকেও পাওয়া গেছে মহাভারতের বনপর্বে। মহাভারতের বিভিন্ন পর্বে রামায়ণে বর্ণিত নানা যুদ্ধের বর্ণনা মেলে। দ্রৌপদী ও অন্যান্য ভাইদের সঙ্গে বনবাস জীবনে দুঃখিত যুধিষ্ঠিরকে সান্ত্বনাদানের জন্য মার্কণ্ডেয় মুনির মুখে রামকথা বর্ণিত আছে।
মহাভারতে রামায়ণের বিভিন্ন ঘটনা বিভিন্ন সময়ে মর্যাদার সঙ্গে উল্লেখ হয়েছে। কিন্তু রামায়ণে মহাভারতের কোনো ঘটনাই উল্লেখ নেই। কেন এরকম? দুটি গ্রন্থ কি সমসাময়িক নয়? আগেই উল্লেখ করেছি রামায়ণ গ্রন্থটির রচনাকাল ৮০০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। কিথ (Keith) বলেন, রামায়ণ খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে রচিত। ভিন্টারনিৎস (Winternitz) ও বুলকে (Bulcke) বলেছেন, রামায়ণের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকেই। কিন্তু মহাভারতের রচনাকাল আনুমানিক ৭০০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে শুরু করে ২০০ থেকে ৩৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। সৌত রচনা (জয়), ব্রাহ্মণ্য রচনা (ভারতসংহিতা) এবং শ্রমণগণের রচনা (মহাভারত)–এই তিনটি স্তরে রচনা হয়েছে। সাম্প্রতিককালের গবেষণায় জানা গেছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ খ্রিস্টপূর্ব ৩১৩৬ অব্দে ঘটেছিল। অতএব মহাভারতের রচনাকাল এই সময়ের কিছু পরে হতে পারে। সেই কারণেই কি মহাভারতের পেটের ভিতর রামায়ণের এত ঘটনা ঢুকে আছে? নাকি দুটি গ্রন্থই সমসাময়িক? ব্যাস কী পূর্বজ গুরু বাল্মীকির শিষ্য, তাই কি রামায়ণের প্রতি এত আনুগত্য, কৃতজ্ঞতা? তাই কি পটভূমি ও উপজীব্য প্রায়ই একই–অন্যায়ভাবে যুদ্ধ আর ভুরি ভুরি অলৌকিকতা? তাই নিপাট ইতিহাস হয়ে উঠতে পারেনি। কুহেলিকাময় ইতিহাস মানুষের কাছে প্রশ্নচিহ্ন তুলে ধরে, যুগে যুগে। অপ্রার্থিতা, অলৌকিকতা, কখনোই ইতিহাস হতে পারে না–তা কেবলই রূপকথা। তাই কি রচনাকাল রহস্যাবৃত? রামায়ণ যদি ইতিহাস হয়, তবে বলা যায়–ইতিহাসকে কখনো বিশ্বাস দিয়ে যাচাই করা ঠিক নয়! একটি বিষয়ের ইতিহাস পাঁচ জন লেখকের বর্ণনায় ভিন্ন পার্থক্যের তৈরি করতে পারে! তৈরি তো হয়ই। তাই ঘটনার নিরপেক্ষতা বোঝার স্বার্থে সকল বিশ্লেষক, গবেষক মায় ঐতিহাসিকের লেখা পড়াটাই যুক্তিযুক্ত!
ধর্মপ্রাণ সকল মুসলমান পণ্ডিতদের লেখা থেকে আমরা জানি, ইসলাম আবির্ভাবের পূর্বে আরবের সমাজ ছিল ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’ বা বর্বরতম যুগ! তখন জীবন্ত কন্যা সন্তানকে কবর দেওয়া হত! কবর দেওয়ার এই বিষয়টি এতই মর্মস্পর্শী যে, মানুষ সেই যুগকে ইতিহাসের সবথেকে নিকৃষ্টতম’ অধ্যায় বলে সহজেই বিশ্বাস করে নেয়! আসলে বিষয়টি অনেক প্রশ্নের দাবি রাখে! আমরা জানি, তখনকার পবিত্র কাবা ঘরের ভিতরে ৩৬০ টি দেবতার মূর্তি ছিল। প্রতিটি দেবতা একেকটি গোত্রের প্রধান ‘দেবমূর্তি’ হিসাবেই সহাবস্থান করত এবং সবাই একই উপাসনালয় ‘কাবাগৃহে’ তাদের পূজা অর্চনার কাজ মিলেমিশে করত৷ এই বিষয়টি থেকে পরিষ্কার হয় যে, তৎকালীন আরবে চমৎকার একটা ধর্মীয় সম্প্রীতি বিরাজমান ছিল। সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় আরব ছিল তখন পৃথিবী বিখ্যাত। কবিদের মধ্যে কাব্য রচনার ‘কবি যুদ্ধ’ হত। ইমরুল কায়েসের মতো প্রাচীন। বিখ্যাত অনেক মানবতাবাদী কবি জন্মেছিলেন তখনকার আরবে! সুতরাং বলা যায়, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক চর্চার ক্ষেত্রে আরব সমাজ ছিল তখন একটি প্রকৃষ্ট সম্প্রীতির উদাহরণ।
প্রফেসর পি কে হিট্টির মতে–“শিশু কন্যাকে জীবন্ত কবর দেওয়ার বিষয়টি হিন্দুদের সতীদাহ প্রথার মতোই খুব অনভিপ্রেত এবং গুটিকয়েক ঘটনা ছিল আরবে!” অতি দরিদ্র এবং অতি মূর্খ কুসংস্কারাচ্ছন্ন কিছু আরব এই জঘন্য কাজটি করত। যেটির সংখ্যাগত দিক বিবেচনায় তৎকালীন গোটা আরবকে ‘জাহেলিয়াত’ জাতি বলে বিবেচনা করা অনুচিত হবে। এছাড়াও মহানবির বেশির ভাগ সাহাবিদের গণ্ডায় গণ্ডায় স্ত্রী ছিলেন। সঙ্গে দাসী, যৌনদাসী তো ছিলই–এইসব ছিল আরব সমাজের একটা সাধারণ প্রচলিত প্রথা। নবিজির নিজের বিবাহ সংখ্যা ছিল কমপক্ষে এগারোটি। প্রশ্ন হল, সবাই যদি কন্যাদের মাটিতে পুঁতে ফেলত, তাহলে আরবের লোক এত ‘আওরত’ তখন পেত কোথায়? পুরুষের থেকে নারীদের সংখ্যার অনুপাত আরবে এখনও পর্যন্ত বেশি, যার প্রকৃষ্ট প্রমাণ বেশিরভাগ আরবের ঘরে কমপক্ষে তিনটি চারটি করে বউ থাকে।
তাই দৃষ্টি নির্মোহ না-হলে সত্য-মিথ্যা সব গুলিয়ে যাবে। যুক্তি না-থাকলে ইতিহাসকে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না। এখনও পর্যন্ত যে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, তা হল–রচনাকালের দিক থেকে দেখলে রামায়ণ খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতকের মধ্যেই রচিত। মহাভারত রচনা সম্ভবত শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম বা চতুর্থ শতক থেকে এবং শেষ হয় খ্রিস্টীয় চতুর্থ বা পঞ্চম শতকে। অর্থাৎ বুদ্ধের পরের ৮০০ বা ৯০০ বছরের মধ্যে এই দুটি মহাসাহিত্য রচিত হয়। এদের মধ্যে মহাভারত আগে শুরু হয়ে পরে শেষ হয়। রামায়ণ পরে শুরু হয়ে আগে শেষ হয়। এরপর রামায়ণ শেষ হওয়ার কাছাকাছি সময়ে কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’, বাৎস্যায়নের কামসূত্র’, ‘শ্রীমদ্ভাগবদগীতা’, ‘মনুসংহিতা’ও রচিত হয়ে যায়।পরপরই পুরাণগুলি রচিত হয়েছে।
ল্যাসেন, ওয়েবার, ইয়াকোবিদের মতো পণ্ডিতগণ মহাভারতকে রামায়ণের আগে বলে যে যে যুক্তি দেখিয়েছেন, সেগুলিও জেনে নিতে পারি। তবে লোকপ্রসিদ্ধি ও অধিকাংশ মতানুসারে রামায়ণকে মহাভারতের পূর্ববর্তী বলেই স্বীকার করা যায়। যুক্তিগুলি দেখা যাক–(১) বাল্মীকি আদিকবি রূপেই প্রসিদ্ধ। তাই তাঁর লেখা রামায়ণ আগে রচিত হয়েছিল বলা যায়। (২) চার যুগের মধ্যে ত্রেতাযুগে রামাবতার এবং তারপরের দ্বাপরে কৃষ্ণাবতার হওয়ার আগে রচিত মনে হয়।(৩) রামায়ণে সহমরণের ঘটনা নেই, মহাভারতে মাদ্রীর সহমরণের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।(৪) রামায়ণের যুদ্ধকাণ্ডের একটি শ্লোক (৮১/২৮) মহাভারতে দ্রোণপর্বে অবিকল উল্লেখ আছে।(৫) মহাভারতে বাল্মীকির নাম পাওয়া যায়, রামায়ণে কিন্তু ব্যাসদেবের উল্লেখ নেই। (৬) সূর্যবংশের উল্লেখ রামায়ণে আছে, যা আগে। পরে চন্দ্রবংশের কথা উল্লেখ আছে, যা মহাভারতে আছে।(৭) মহাভারতে রামায়ণের উল্লেখ আছে। কিন্তু রামায়ণে মহাভারতের কোনো চরিত্র বা ঘটনার কথা কোনোভাবেই নেই।(৮) রামায়ণের সভ্যতা অনাড়ম্বর, সরল ও অরণ্য প্রভাবিত। অপরদিকে মহাভারতের সভ্যতা নগরকেন্দ্রিক, জটিল ও কুটিল। (৯) রামায়ণে আর্যসভ্যতার সঙ্গে বানর ও রাক্ষস সভ্যতা পাই। মহাভারতে এরা অনুপস্থিত।(১০) বৈয়াকরণ পাণিনির কাল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক। মহাভারতে পাণিনীয় অনুশাসন মান্য হলেও রামায়ণে অনুপস্থিত। (১১) আর্যদের অধিকৃত এলাকা রামায়ণে মহাভারত অপেক্ষা কম থাকায় রামায়ণ মহাভারতের রচিত বলে মনে করা হয়। (১২) কলেবর অর্থাৎ আকারের দিক থেকে মহাভারত আগে বৃহৎ হওয়ায় রামায়ণকে রচনার দিক থেকে আগে রাখা যায়। (১৩) রামায়ণ অপেক্ষা মহাভারতের যুগে স্ত্রীশিক্ষার প্রসার বেশি ঘটেছিল। তাই রামায়ণ আগে রচিত হয়েছিল বলে মনে করা যয়া(১৪) রামায়ণে আর্যরাজের (রাজপুত্র) সঙ্গে অনার্যরাজের (রাক্ষস) যুদ্ধ বর্ণিত হয়েছে। অপরদিকে মহাভারতে প্রায় সব রাজাই আর্য। (১৫) রামায়ণের যুগে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। সে যুগে সম্পূর্ণ দাক্ষিণাত্য ছিল রাক্ষস’ অধ্যুষিত এবং অরণ্যাবৃত। কিন্তু মহাভারতের যুগে জরাসন্ধাদি শাসিত সুবিশাল ও সুসংহত রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মেলে। অতএব মহাভারত তার সমাপ্তি পর্বে পৌঁছোনোর আগে রামায়ণ তার পূর্ণতা পেয়েছিল।
রামায়ণের রাম-সীতার মাহাত্ম্য, ভাবের গভীরতায় এবং ভাষার প্রাঞ্জলতায় এমনই হৃদয়গ্রাহী যে, ভারতের আবালবৃদ্ধবনিতা তাঁর দ্বারা চির-অনুপ্রাণিত। রামের অসাধারণ মাতৃশক্তি, ভরত ও লক্ষ্মণের অতুলনীয় ভাতৃভক্তি ও সীতার অনুপম পাতিব্ৰত্য জনমানসকে মুগ্ধ করে এবং অনুপ্রাণিত করে। ত্যাগের মহিমায় এঁরা সকলেই স্বমহিমায় ভাস্বর। ক্ষমা, ত্যাগ, সত্য, সহিষ্ণুতা, প্রজাবৎসল্য ও দৃপ্ত পুরুষকারের জ্বলন্ত বিগ্রহ রামচন্দ্র। সতীকুল শিরোমণি সীতা রমণীকুলের রত্নস্বরূপা। দশরথ ও কৌশল্যার মধ্যে আমরা স্নেহকাতর পিতামাতাকে পাই। আদর্শ প্রভুভক্ত হনুমান তো সকলেরই নমস্য। সেও রাম-সীতার অপেক্ষা কম জনপ্রিয় নয়, তাঁরও ভক্তকুল বিশাল। ভারতের নরনারী পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে রাম, সীতা ও হনুমানের নাম জপ (হনুমান চাল্লিশা) করে। রামের একটি বিশেষ মূর্তিতে তাঁর পাশে তাঁর ভাই লক্ষ্মণ, স্ত্রী সীতা ও ভক্ত হনুমানকে দেখা যায়। এই মূর্তিকে বলা হয় রাম পরিবার। হিন্দু মন্দিরে এই ‘রাম পরিবার’ মূর্তির পুজোই বেশি হতে দেখা যায়। ভারতবাসী আজও ‘রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে। তবে সবটাই বাইরে থেকে নয়, পুরো মাহাত্মটাই রামায়ণের ভিতরে ঢুকে দেখতে হবে। ভক্তের দৃষ্টিতে নয়, দেখতে হবে যুক্তির দৃষ্টিতে।
হিন্দুধর্মের রাম উপাসনাকেন্দ্রিক সম্প্রদায়গুলিতে যে রামকে বিষ্ণুর অবতার না-বলে সর্বোচ্চ ঈশ্বর’ হিসাবে মান্য করার প্রবণতা দেখা যায়, সেই রামের বিষয়ে শুরু থেকেই শুরু করা যাক। ব্যক্তিনাম হিসেবে ‘রাম’ শব্দটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদে (১০৯৩১৪): “দুঃসীম প্রথবনের স্তব গাই, বেণ ও রামের স্তব গাই, বিশিষ্ট অসুরদের স্তব গাই, রাজন্যবর্গের স্তব গাই”। রাম শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ হল ‘রামী’, রাত্রির একটি বিশেষণ। বেদে দুই জন রামের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথম জন হলেন মার্গবেয়’ বা ‘ঔপশ্বিনী’ রাম এবং দ্বিতীয় জন হলেন ‘জামদগ্ন্য’ রাম। উত্তর-বৈদিক যুগে তিন জন রামের কথা জানা যায়–(১) বিষ্ণুর সপ্তম অবতার রাম। ইনি দশরথের পুত্র এবং রঘুবংশে জাত।(২) বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরাম। ইনি ‘জামদগ্ন্য’ বা ‘ভার্গব’ রাম নামে পরিচিত। ইনি অমর।(৩) কৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ও বিষ্ণুর অষ্টম অবতার বলরাম।
বিষ্ণু সহস্রনাম স্তোত্রে বিষ্ণুর ৩৯৪ তম নামটি হল রাম। আদি শঙ্করের টীকা অনুসারে রাম’ শব্দের দুটি অর্থ আছে–যোগীরা যাঁর সঙ্গে রমণ (ধ্যান) করে আনন্দ পান, সেই পরব্রহ্ম বা সেই বিষ্ণু যিনি দশরথের পুত্ররূপে অবতার গ্রহণ করেছিলেন। রামের অন্যান্য নামগুলি হল ‘রামবিজয়’ (জাভানিজ ভাষা), ফ্রেয়াহ রাম (খমের ভাষা), ফ্রা রাম (লাও ভাষা ও থাই ভাষা), মেগাত সেরি রাম (মালয় ভাষা), রাকা বানতুগান (মারানাও ভাষা) ও রামায় (তামিল ভাষা)।
ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে ‘রামাসুর’-এর উল্লেখ আছে। পারসিকদের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ আবেস্তায় উল্লেখিত ‘রামাহুর’ একজন শান্তির দেবতা। অনেকেই মনে করেন আবেস্তার ‘অহুর’-কেই বেদে ‘অসুর’ হিসাবে দেখানো হয়েছে। আরবি ভাষায় ‘রামা’ বলে একটি শব্দ আছে, যার অর্থ নিক্ষেপকারী’ মেঘের মানবিক সত্ত্বা কল্পনা করলে মনে হয় সে যেন বৃষ্টির শর নিক্ষেপ করছে। লৌকিক মেঘবন্দনা গানের দেবতা ‘রামা’ যখন আর্যসমাজে তথা সংস্কৃত ভাষায় স্বীকৃতি পেল, তখন ‘রাম’ শব্দে পরিবর্তিত হল। সংস্কৃত ভাষায় রামা’ শব্দের অর্থ রমণীয়া, শুভ্রা, সুন্দরী স্ত্রী, প্রিয়া। লক্ষ্মীর অন্য নামও রামা। সীতাও লক্ষ্মীর অংশজাতা। রামা’ শব্দের পুংলিঙ্গে রাম’ হতে পারে। যেমন মূলশব্দ ‘বামা’ স্ত্রীলিঙ্গে হলেও পুংলিঙ্গে কিন্তু ‘বাম’। রামা’ শব্দের পুংলিঙ্গে ‘রাম’ ধরে নেওয়া হয়। রাম শব্দের অর্থ অসিত, অর্থাৎ কৃষ্ণবর্ণ। অসিতের বিপরীত সিত, সিত শব্দের অর্থ শুভ্রবর্ণ। সিত শব্দটি স্ত্রীলিঙ্গে সীতা, গৌরবর্ণা। অতএব রাম অসিত, সীতা সিত। অনেকে বলেন রাম হল মেঘদেবতা, সীতা কৃষিশ্রী। রামায়ণের মূল ভিত্তিই কৃষি৷ অতএব রামায়ণ হল রামের অর্থাৎ মেঘের বা মৌসুমী বায়ুর অয়ন, অর্থাৎ আবর্তন। অর্থাৎ, রাম (মেঘ) অথবা রামা (কৃষিশ্রী) হয়েছে অয়ন (আশ্রয়) যার। মেঘদেবতা রাম এবং কৃষিশ্রী সীতা আজ হিন্দুধর্মের দেবদেবী।
নতুন এক গবেষণায় বলা হয়েছে রাম এবং রামায়ণ কোনো কাল্পনিক গাথা নয়, ঐতিহাসিক সত্য ঘটনাই এর মূল উপজীব্য–এক প্রদর্শনীতে এমনটাই দাবি করল দিল্লির ললিত কলা অ্যাকাডেমি। সেইসঙ্গে প্রকাশ্যে এনে ফেলল মিথোলজিক্যাল চরিত্রগুলি সম্পর্কে একাধিক তথ্যও। ইন্সটিটিউটের দাবি, রামচন্দ্রের জন্ম ৫,১১৪ খ্রিস্টপূর্বে। ১০ জানুয়ারি দুপুর ১২ টা ৫ মিনিটে জন্ম হয় তাঁর। সময় উল্লেখ করা রয়েছে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধেরও। ৩১৩৯ খ্রিস্টপূর্বে ১৩ অক্টোবর শুরু হয়েছিল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। আর ৫০৭৬ খ্রিস্টপূর্বের ১২ সেপ্টেম্বর, অশোককাননে সীতার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল হনুমান। এক মার্কিন সফটওয়্যার এই গবেষণায় সাহায্য করেছে বলে জানা গিয়েছে। ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর ললিত বালা জানান–আমাদের ইতিহাস ১০,০০০ বছরের পুরনো। রামায়ণ ও মহাভারতে উল্লিখিত সময়ের হিসাব ধরেই আমরা আসল সময় চিহ্নিত করতে পেরেছি।” সাধারণভাবে রামায়ণের অভ্যন্তরীণ সাক্ষ্যের উপরে নির্ভর করে ঐতিহাসিকরা মনে করেন, রামায়ণের কাহিনি ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ঘটনা। এই গবেষণা সেই সময়কালকে এক ধাক্কায় আরও ৩০০০ বছর পিছিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী। স্বাভাবিকভাবেই এক বাক্যে এই মতকে মেনে নিতে আপত্তি রয়েছে ঐতিহাসিক মহলের। আই-সার্ভের গবেষণা পদ্ধতি সবিস্তার না-জানা পর্যন্ত এই মতের গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারণ সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন তাঁরা। অন্য এক তথ্য বলছে–“রাম, যাঁর জন্ম হয়েছিল ৫০০০ বছর আগে এবং কৃষ্ণ, যাঁর জন্ম হয়েছিল ৩৫০০ বছর আগে।” এইসব গবেষণার সত্যাসত্য আমার পক্ষে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। কোনো নির্ভরযোগ্য সিলমোহর দিয়েছেন কি না তাও জানা সম্ভব হয়নি। অতএব এই গবেষণা আমার কাছে অর্থহীন। আমার আলোচনাতেও এ প্রসঙ্গ কোনোভাবেই আসবে না।