কনফেশন – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
বেগ-বাস্টার্ড সিরিজের চতুর্থ উপন্যাস
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৩
.
উৎসর্গ : সিরাজুল ইসলাম নিউটনকে
আমার গূলার উপন্যাসগুলোর ‘থৃলিং’ প্রচ্ছদ করে দেয়ার জন্য!
.
মুখ বন্ধ
রাত। আকাশে পূর্ণ চন্দ্র। চারপাশের পরিবেশ কেমন এক ঘোরলাগা আবেশে ডুবে আছে। ইঞ্জিনের মৃদু গুঞ্জনটা সম্মোহনের মতো কাজ করছে যেনো। কালো রঙের প্রাইভেটকারটি ছুটে চলেছে মহাসড়ক ধরে। স্থিরচোখে সামনের দিকে চেয়ে আছে গাড়ির একমাত্র যাত্রি। এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে রেখেছে, তার ভাবনার জগত জমে আছে বরফের মতো। নিজের ভেতরে জমাটবাধা ক্রোধ সযত্নে আগলে রেখেছে সে, একটু পরই সেটার বিস্ফোরণ ঘটবে। বিস্ফোরণ ঘটার আগে বরাবরের মতো একেবারে ধীরস্থির থাকছে। এটাই তার স্বভাব। এভাবেই সে কাজ করে।
কাজ!
কথাটা তার মধ্যে একটু আলোড়ন তুললো। দু’তিন দিন আগেও সে নিশ্চিত ছিলো এ জীবনে এরকম কাজ আর কখনও করবে না। কিন্তু সময় কতো দ্রতই না সব হিসেব পাল্টে দেয়! তার সুকঠিন প্রতীজ্ঞা, দৃঢ়তা, মনোবল এক নিমেষে উবে গেলো। ফিরে এলো আগের সবকিছু। আমূল পাল্টে যাওয়ার পর আবার ফিরে যাওয়া-হ্যাঁ, এভাবেই সে পরিণত হয়েছে আগের মানুষটিতে। এই মানুষটাকেই সবাই চেনে। এর কথাই সবাই জানে।
নিরিবিলি মহাসড়কের চারপাশটা শব্দহীন এক জগতে নিপতিত হয়েছে। মাঝেমধ্যে সেই নিঃশব্দে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে দূরপাল্লার বড় বড় বাস-ট্রাক। ঢাকার বাইরে এ জায়গাটি সে বেছে নিয়েছে অনেক ভেবেচিন্তে। তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আদর্শ একটি জায়গা।
একটু পর যে কাজটা করবে সেটা নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে যাচ্ছিলো এতোক্ষণ কিন্তু চাপা গোঙানিটা আবারো তার মনোযোগে বিঘ্ন ঘটালো। আওয়াজটা পেছন থেকে আসলেও সেদিকে ফিরে তাকালো না। তার ঠোঁটে দেখা গেলো এক চিলতে বাঁকা হাসি। সঙ্গে সঙ্গে সেটা মিলিয়ে গেলো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো বীভত্স একটা মুখ। কতোই না ফুটফুটে ছিলো। হ্যাঁ, সে নিশ্চিত। যদিও ফুটফুটে চেহারাটা কখনও দেখা হয় নি, তারপরও সে নিশ্চিত। যে ছবিটা দেখেছে সেটা পৈশাচিক কোনো তৈলচিত্রের মতো। যেনো শিল্পীর হাতেসৃষ্ট অপূর্ব সুন্দর একটা ভাস্কর্যের উপর জঘন্য কোনো লোক নির্মমতার সাথে কাদামাটি লেপ্টে দিয়েছে। সুন্দরের সবকিছু বিনাশ করে জান্তব উল্লাসে মেতেছে পশুটা।
পশু!
না। পশুর সাথেও পাশবিকতা করা চলে না। এ হলো দানব। দানবের সাথে তুমি এটা করতে পারো।
দানবটাকে তুলে আনতে খুব একটা বেগ পেতে হয় নি। পত্রিকায় তার নাম-ঠিকানা সবই দেয়া ছিলো। রিপোর্টার বলেছে, এই দানব নারকীয় কাজটা করার পরও দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুলিশ নাকি তাকে খুঁজে পাচ্ছে না।
এমনই হয়, ভাবলো সে। ক্ষমতাসীন দলের পরিবহণ শ্রমিকদের এক অঙ্গ সংগঠনের পুচকে নেতা-পুলিশ তাকে দেখেও না দেখার ভান করতে পারে। পুলিশের হাতে-পায়ে ডাণ্ডাবেরি পরিয়ে রাখে ক্ষমতাসীন রাজনীতিকেরা। তাদেরকে ব্যবহার করে পোষা গুণ্ডাবাহিনী হিসেবে। তাদের এতো সাহস হয় নি ঐ শ্রমিক নেতাকে ঘাটাবে। এখন সে পুলিশের চোখে অদৃশ্য। থানার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করলেও পুলিশ তাকে খুঁজে পাবে না।
তার অবশ্য এ সমস্যা নেই। সে ঠিকই খুঁজে বের করতে পারবে।
পরিকল্পনাটা মাথায় আসতেই সোজা বাইক নিয়ে ঢাকায় চলে যায়। তারপর বাচ্চু নামের চোরাই গাড়ির ব্যবসা করে যে ছেলেটা তার কাছে বাইকটা রেখে এই গাড়িটা নিয়ে নেয়। এটার লাইসেন্স, নাম্বারপ্লেট সব ভুয়া।
গাড়িটা নিয়ে চলে যায় দানবটার এলাকায়। মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যেই কিছু লোককে টাকা দিয়ে জেনে নেয় এর অবস্থান। রাত বারোটার পর নেশাগ্রস্ত দানব নিজের ডেরায় ঢোকার আগেই মুখোমুখি হয় এক আগন্তুকের। ল্যাংড়া বুদ্দিনের বাড়িটা খুঁজে পাচ্ছে না সে। ল্যাংড়া বুদ্দিন?! দানবটা যারপরনাই বিস্মিত হয়েছিলো। ধুর মিয়া, এই নামের কেউ এইহানে থাকে নি! বিরক্ত হয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই পেছন থেকে সজোরে আঘাত করে পিস্তলের বাট দিয়ে। নেশাগ্রস্ত দানবটা টলে যায়। তাকে জাপটে ধরে দ্রত গাড়িতে তুলে নেয় সে। হাত-পা-মুখ বেধে পেছনের সিটে ফেলে গাড়ি নিয়ে চলে আসে। এক নির্জন রাস্তায় এসে দানবটাকে গাড়ি থেকে তুলে পেছনের বুটে রেখে আবার চলতে শুরচ করে। মৃত্যুর আগে কবরের বিভীষিকা মনে করিয়ে দেবার জন্য বুটে রাখে তাকে।
ইটভাটাটা দূর থেকে দেখতে পেলো। চাঁদের আলোয় নিষ্প্রাণ চিমনিটা যেনো ঝিমুচ্ছে।
সমস্ত ক্রোধ আর হিংস্রতা উগলে দেবার সময় এসে গেছে এখন। গাড়ির হেডলাইট বন্ধ করে দিলো। বাকি পথটা চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মহাসড়ক থেকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে মাটির তৈরি একটি রাস্তা। সেই রাস্তার দু’পাশে নীচু জমি আর জলাশয়। গাড়ির গতি কমিয়ে এগিয়ে চললো সে। ভালো করেই জানে এখানে কোনো লোকজন নেই।
চারদিকে ক্ষেত আর বিস্তীর্ণ মাঠের মাঝখানে মাটি ফেলে বেশ উঁচু একটি জায়গায় বানানো হয়েছে এই ইটের ভাটাটি। এক সময় যেখানে ছাঁচে ফেলে মাটি দিয়ে ইট তৈরি করা হতো সেই চত্বরটি এখন বিরান পড়ে আছে। অবৈধভাবে গড়ে তোলা এই ভাটাটি এক মাস আগে আদালতের নির্দেশে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অবশ্য এর মালিক বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের লোক হলে এটা কোনোদিনও বন্ধ হতো না। এ ব্যাপারে সে একদম নিশ্চিত।
ইটভাটার খোলা চত্বরে এসে গাড়িটা থামালো। এখনও কিছু ইটের স্তূপ এদিক ওদিক পড়ে আছে। নিঃসঙ্গ আর পরিত্যক্ত চিমনিটা দাঁড়িয়ে আছে নির্বিকার ভঙ্গিতে। এঞ্জিন বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপ মেরে বসে রইলো সে। বেশ কয়েকবার ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে আরো ধীরস্থির করে নিলো শেষবারের মতো। খুন করার ব্যাপারে তার দক্ষতা প্রশ্নাতীত কিন্তু আজকের কাজটা নিছক কোনো খুনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। আজকের জন্য তাকে অন্যরকম কিছু করতে হবে। দানবের জন্য দানবীয় কিছু!
আবারো তার চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটালো সেই চাপা আর্তনাদ। এবার। পেছনে ফিরে তাকিয়ে আওয়াজটা ভালো করে শোনার চেষ্টা করলো। প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে সংকীর্ণ পরিসরে ছোটার চেষ্টা করছে। দেখতে না পেলেও দৃশ্যটা কল্পনা করতে পারলো সে। দানবটার গোঙানি তার কানে সুমধুর শোনালো! মস্তিষ্কে আলোড়ন তুলে কিছু একটা উস্কে দিলো যেনো। আবারো এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে। একটা চনমনে ভাব বিরাজ করলো মুহূর্তে। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে গেলো। আশেপাশে কেউ নেই, তারপরও একটু সময় নিয়ে ভালো করে দেখে নিলো চারপাশটা। গ্রামের বখাটে আর নেশাখোরেরা রাতেরবেলা এরকম পরিত্যক্ত জায়গায় আস্তানা গাড়ে, মদ-জুয়া আর মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করে।
কেউ নেই। এমনটা যে থাকবে সে জানতো। গত সপ্তাহে এখানে দু’জনকে ক্ৰশফায়ারে দিয়েছিলো র্যাব। সুতরাং আরো দু’এক সপ্তাহ জায়গাটা এরকম ভুতুড়ে থাকবে। আশেপাশে কেউ এখানে ঢু মারতেও আসবে না। এটি এখন নিষিদ্ধ আর অভিশপ্ত একটি জায়গা। যতোদিন স্থানীয়দের স্মৃতিতে ক্ৰশফায়ারের ঘটনাটা থাকবে ততোদিন এরকম পরিত্যক্তই থাকবে। তবে সে জানে বাঙালির স্মৃতি কতোটা দুর্বল। স্মৃতি দুর্বল বলেই চারিত্রিক দৃঢ়তাও কম। বড়জোর মাসখানেক পরই বেশিরভাগ লোক এটা ভুলে যাবে।
না, ভুলবে না। নিজেকে সুধরে দিলো সে। আজকের পর তাদের দুর্বল কাদামাটির স্মৃতিতে আরেকটি বীভৎস ঘটনা প্রোথিত হবে। আর সেটা ভুলতে একটু বেশিই সময় নেবে।
ইটভাটার দিকে তাকালো ভালো করে। চাঁদের আলোয় এরকম জায়গাও সুন্দর আর মায়াবি হয়ে উঠেছে। একটু চোখ বুলিয়ে নিতেই যেটা খুঁজছিলো সেটা পেয়ে গেলো। ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গেলো সেদিকে।
ইটভাটাগুলো সব সময়ই পরিবেশ অধিদপ্তরের আইন ভঙ্গ করে পুরাতন আর অচল টায়ার ব্যবহার করে জ্বালানী হিসেবে। এই ভাটায় এখনও পরিত্যক্ত অবস্থায় বেশ কিছু টায়ার স্তূপাকারে পড়ে আছে। এগুলো কেটে টুকরো টুকরো করে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার কথা ছিলো।
বেশ কিছু টায়ার স্তূপ করে রাখা হয়েছে এক জায়গায়। স্তূপটার উচ্চতা আনুমানিক চারফুটের মতো হবে। তার পরিকল্পনার জন্য একদম উপযুক্ত। ফিরে এলো গাড়ির কাছে। পকেট থেকে চাবি বের করে পেছনের বুটটা খুলে ফেলতেই একটা জান্তব গোঙানি শোনা গেলো। হাত-পা-মুখ বাধা অবস্থায় পড়ে আছে দানবটা। চোখ দুটো ভয়ে বিস্ফোরিত হয়ে আছে। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে এই সংকীর্ণ জায়গায় নরকযন্ত্রণা ভোগ করেছে। মুক্ত বাতাস পেয়ে নাক দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে এখন। দানবের নাকের ছিদ্র দুটো রেসের ঘোড়ার মতো ফুলে উঠেছে। জ্বলজ্বলে চোখে চেয়ে আছে নিজের মৃত্যুদূতের দিকে।
কোনো কথা না বলে দানবের মাথার চুল মুঠো করে ধরলো সে, অন্যহাতে শার্টের কলারটা খামচে ধরে জোরে হ্যাঁচকা টান মারতেই দানবটা বুট থেকে মাটিতে পড়ে গেলো। হাত-পা-মুখ বাধা অবস্থায়ই ছোটার জন্য দাপাদাপি করার চেষ্টা করলো সে। সঙ্গে সঙ্গে সজোরে একটা লাথি বসালো তার তলপেটে। ইঙ্গিতটা সুস্পষ্ট : সুবোধ বালকের মতো থাকো, নইলে…
দানবটার মাথার চুল শক্ত করে ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলো টায়ারের স্তূপের কাছে। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করার চেষ্টা করলেও চাপা গোঙানি আর ঘোঘোৎ শব্দ ছাড়া কিছুই বের হলো না। দাবনটা শারিরীকভাবে খুব বেশি শক্ত-সামর্থ্যের নয়, উচ্চতায় বড়জোর পাঁচ ফিট দুই ইঞ্চির মতো হবে। পেছনমোড়া করে হাত বাধা, পা আর মুখও দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেধে রাখার কারণে খুব সহজেই তাকে তুলে টায়ারের গর্তে ঢুকিয়ে দিতে পারলো সে।
দানবটা এখন দাঁড়িয়ে আছে টায়ারের স্তূপের মাঝখানে। চার ফুট উঁচু কুয়োর মতো দেখাচ্ছে সেটা। আরো দুটো টায়ার এনে বদমাশটার চারপাশে টায়ারের দেয়াল আরেকটু উঁচু করে দিলো। এখন শুধু বুক আর মাথাটা দেখা যাচ্ছে, বাকি শরীর ডুবে আছে টায়ারের গর্তে। দানবটা বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে এমন একজনের দিকে যাকে এর আগে কখনও দেখে নি। যার সাথে তার কোনো শত্ৰচতাও ছিলো না। পুরো ব্যাপারটা কোনোভাবেই তার মাথায় ঢুকছে না। তবে একটা জিনিস বুঝতে পারছে, এই মৃত্যুদূত তার সাথে এখন কি করবে!
এতোক্ষণ ছোটার জন্য হাসফাস করলেও এ হূর্তে চেহারায় করল ভাব আনার চেষ্টা করছে। যেনো তার সামনে থাকা আজরাইলটার হৃদয়ে একটু দয়ামায়া হয়।
আবারো গাড়ির কাছে গেলো সে। নিজের কাজে বেশ সন্তুষ্ট। পেছনের দরজা খুলে একটা অয়েলক্যান নিয়ে ফিরে এলো টায়ারের স্তূপের কাছে। অয়েলক্যানের মুখ খুলে নীচের দিকে টায়ারগুলো পেট্রলে ভিজিয়ে দিলো। এ দৃশ্য দেখে দানবটার নিঃশ্বাস বন্ধ হবার জোগার হলো, দম আটকে বার বার হেচকি দিতে লাগলো সে।
সবগুলো তেল ঢেলে দেবার পর ক্যানটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো ইটভাটার মধ্যে। তারপর পকেট থেকে দেয়াশলাইয়ের বাক্সটা বের করে আস্তে করে তাকালো টায়ারের গর্তে দাঁড়িয়ে থাকা দানবটার দিকে। দেড় ঘণ্টার মধ্যে এই প্রথম মুখ খুললো সে।
“আগুনের মৃত্য খুব কষ্টের হয়!” তার কণ্ঠ একদম শান্ত। যেনো আগুনে পুড়িয়ে মারার অনেক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তার রয়েছে। সত্যি বলতে, কয়েক মাস আগে দিল্লির এক বাড়িতে কুখ্যাত সন্ত্রাসী ব্লাকরঞ্জুকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে সে। চোখের সামনে দেখেছে রঞ্জুর জ্বলন্তচিতা। আগুনের নির্মমতা তার চেয়ে ভালো কে বোঝে। “এতো কষ্টের যে তুই নিজেই দ্রত মরে যেতে চাইবি!”
দানবটা চোখমুখ খিচে কিছু বলার চেষ্টা করছে কিন্তু বৃথাই সে চেষ্টা। তার মুখের ভেতর একটা ময়লা কাপড় দলা পাকিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। তার উপর শক্ত করে গামটেপ লাগানো।
“ভাবছিস এই আইডিয়াটা কোত্থেকে পেলাম?” কথাটা বলেই মুচকি হাসলো। “কলম্বিয়ার ড্রাগলরা এভাবে প্রতিপক্ষ আর বিশ্বাসঘাতকদের শাস্তি দেয়,” একটু থেমে আবার বললো, “শাস্তি! বুঝতে পেরেছিস?”
দানবটা উদভ্রান্তের মতো দু’পাশে মাথা দোলাতে লাগলো।
“আমার মনে হয় তুই বুঝতে পেরেছিস,” একটু থেমে চারপাশটা আবার দেখে নিলো। “ঐটুকু একটা ফুটফুটে মেয়ের সাথে তুই কী জঘন্য কাজটাই না করেছিস!” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে।
দানবটার চোখ এবার বিস্ফোরিত হলো। এতোক্ষণ ধরে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেছে সে।
“তুই হয়তো ভাবছিস আমি কে?” মুচকি হাসলো। “আমাকে তুই চিনবি না। চেনার কোনো দরকারও নেই।”
উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে এক ঘষাতেই আগুন ধরিয়ে ফেললো ম্যাচের কাঠিতে। জ্বলন্ত কাঠিটা দানবের মুখের কাছে এনে একটু দোলালো। ছোট্ট অগ্নি শিখার দিকে দাবনটার দু চোখের মণি উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ালো কয়েক মুহূর্ত। তারপরই জ্বলন্ত কাঠিটা ফেলে দিলো টায়ারের নীচে। সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠলো আগুন। কয়েক পা পিছিয়ে গেলো সে। পকেট থেকে মোবাইলফোনটা বের করে ছবি তুলতে শুরু করলো।
নীচের দিকে টায়ারগুলো দাউ দাউ করে জ্বলছে এখন। দানবটা উন্মাদগ্রস্তের মতো চিৎকার করার চেষ্টা করছে। তার গলার রগ ফুলে উঠেছে ভয়ঙ্করভাবে। যেনো রগগুলো ফেটে যাবে। আকাশের দিকে মুখ করে বোবা আর্তনাদ করছে সে।
গাড়ির কাছে যখন ফিরে এলো দেখতে পেলো পুরো টায়ারের স্তূপটা জ্বলতে শুরু করেছে। আগুনের শিখার মাঝে দানবটার চেহারা অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এখন। আরো কিছুক্ষণ বেঁচে থাকবে সে, তবে সেজন্যে নিজেকে দুর্ভাগা মনে করবে। এটা হলো নরক যন্ত্রণা। এটাই সে চেয়েছিলো-দানবের জন্য দানবীয় কিছু!
গাড়িতে উঠে বসলো, শেষবারের মতো ফিরে তাকালো জ্বলন্ত টায়ারের দিকে। জ্যোৎস্নার আলোয় প্রজ্জ্বলিত আগুন আরো বেশি অদ্ভুত লাগছে।
ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে গাড়িটা আস্তে করে ঘুরিয়ে মাটির তৈরি ঢালু রাস্তা দিয়ে উঠে এলো মহাসড়কে। এবার পূর্ণ গতিতে ছুটে চললো পূর্ব দিকে। তার গন্তব্য এখন ঢাকা। যদিও বিগত তিনমাস ধরে এই শহরে বাস করে না। আরো দু’এক মাস পর এ শহরে মুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াতে পারবে। কিছু দরকারি কাজ সেরে আগামীকাল দুপুরের আগেই ফিরে যাবে নিজের গোপন ঠিকানায়।
কালো রঙের প্রাইভেটকারটা যখন মহাসড়ক ধরে পূর্ণগতিতে ছুটে চলেছে তখন তার মধ্যে অদ্ভুত এক অনুভূতি বয়ে গেলো। এরকম অভিজ্ঞতা কখনও হয় নি। সে খুব অবাক হলো।
এ জীবনে খুন করে কখনও এতোটা ভালো লাগে নি।
অধ্যায় ১
সকালের এ সময়টাতে কোনো ট্রাফিক পুলিশ থাকে না, যানবাহনের ভীড়ও নেই, তারপরও গাড়ি থামালো জেফরি বেগ। ট্রাফিক সিগন্যালে লালবাতি জ্বলছে। তাকে পাশ কাটিয়ে পর পর বেশ কয়েকটি গাড়ি চলে গেলো। সবগুলোই প্রাইভেটকার, দামি দামি মডেলের। গাড়ির লোকগুলো বেশ ধনী, হয়তো শিক্ষিতও, কিন্তু লাল বাতিকে তারা থোরাই কেয়ার করে। সে জানে, ঐ গাড়ির যাত্রিরা তাকে কি ভাবছে-আস্ত একটা গর্দভ!
আইন ভাঙার এই দেশে আইনমান্যকারীরা গর্দভই বটে!
আজব একটি দেশ, যেখানে আইন ভঙ্গ করে লোকজন অনুশোচনা আর অপরাধবোধে ভোগা তো দূরের কথা বরং গর্ব বোধ করে।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে। কবে যে এ দেশের মানুষ বুঝবে আইন না মানলে, আইনকে শ্রদ্ধার চোখে না দেখলে প্রকারান্তরে তাদের জীবনটাই অনিরাপদ হয়ে ওঠে, অযাচিত সব দুর্ভোগ নেমে আসে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, জন্ম থেকে দেশটা এভাবেই চলছে। যেটা হওয়া উচিত সেটা হচ্ছে না, যেটা হওয়া মোটেও কাম্য নয় সেটাই হচ্ছে সব সময়।
তার ভাবনায় বিঘ্ন ঘটালো একটা শব্দ। চেয়ে দেখলো জানালার কাঁচে এক বৃদ্ধ টোকা মারছে। নোংরা জামাকাপড় পরা, মাথায় চুলের জট। বাড়ন্ত দাড়ি। তার সাথে চোখাচোখি হতেই হেসে ফেললো সে। কাঁচটা নামিয়ে দিয়ে পকেট থেকে দু টাকার একটি নোট বের করে বাড়িয়ে দিলো লোকটার দিকে।
এ পথ দিয়ে অফিসে যাবার সময় প্রতিদিনই এই ভিক্ষুকের সাথে তার দেখা হয়। আশেপাশে সবাই একে ‘আঙ্কেল’ বলে ডাকে। তার জন্য প্রতিদিন দু টাকার বাজেট বরাদ্দ রাখে জেফরি। আজ একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলো তাই আঙ্কেল রাস্তার আইল্যান্ড থেকে নেমে এসে তাকে তাড়া দিতে বাধ্য হয়েছে। অন্যসব দিনে লোকটা আইল্যান্ডে দাঁড়িয়ে দু’হাত ছুঁড়ে বিভিন্ন ধরণের ভঙ্গি করতে থাকে। তাকে দেখলে মনে হবে কে মাইম আর্টিস্ট বুঝি নিজের শিল্পকর্ম প্রদর্শন করছে। সব সময় জেফরি চুপচাপ তার দিকে টাকা বাড়িয়ে দিয়ে চলে যায়।
টাকাটা জেফরির হাত থেকে ছোঁ মেরে নিয়েই নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে উঠলো : “যা!” ভিক্ষুকটি ডান হাত সামনের দিকে ইঙ্গিত করে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকলে কিছুক্ষণ।
সবুজ বাতি জ্বলে উঠতেই হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটরের গাড়িটা এগিয়ে গেলো সামনের দিকে।
সকালের এ সময়টাতে যানবাহনের ভীড় কম থাকায় গাড়ি চালিয়ে অনেক মজা। নইলে জ্যামের এই শহরে গাড়ি চালানোটা যেনো ড্রাইভিং পরীক্ষা দেয়ার মতো ব্যাপার হয়ে ওঠে।
অফিসের খুব কাছে আসতেই তার সেলফোনটা বেজে উঠলো। ড্রাইভিং করার সময় কখনও ফোনকল রিসিভ করে না সে। দেশের আইনও তাকে সেটা করতে নিষেধ করে। গাড়িটা রাস্তার একপাশে থামিয়ে কলটা রিসিভ করলো।
“বলো?”
“তুমি কোথায়?” রেবা জানতে চাইলো।
“এই তো অফিসে যাচ্ছি…খুব কাছেই আছি এখন।”
“আজকে অফিসে না গেলে হতো না?” একটু অভিমানী সুরে বললো। “এই একটা দিনেও কি তোমাকে অফিস করতে হবে?”
জেফরি বেগের মনে পড়ে গেলো, কাল রাত বারোটার পরই শুভ জন্মদিন জানিয়ে রেবা তাকে এসএমএস করেছিলো। ফাদার মারা যাবার পর এই দিনটি আর ওভাবে পালন করে না। যদিও রেবা সব সময় চেষ্টা করে কিছু একটা করতে।
“তুমি তো জানোই আমি এসব সেলিব্রেট করি না।” যেনো একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। “এটা আমার সত্যিকারের জন্মদিন না,” বললো সে। “রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া একজনের জন্মদিন থাকে নাকি?”
ফোনের অপরপ্রান্তে রেবা চুপ মেরে থাকলে কিছুক্ষণ।
ফাদার হোবার্ট কখনও নিজের জন্মদিন পালন করতেন না কিন্তু জেফরির জ্ঞান হবার পর থেকে নিজের এবং দত্তক ছেলের জন্মদিন পালন করা শুরচ করেন তিনি। ছোট্ট জেফরিকে বলতেন, তাদের দুজনের জন্ম একই দিনে হয়েছে। কৈশোর পর্যন্ত জেফরি মনে করে এসেছে, এ পৃথিবীর সব ছেলে আর বাবাদের জন্ম একই দিনে হয়ে থাকে!
সত্যি বলতে, রেবা বাদে তার ঘনিষ্ঠ কেউ জানেও না কবে তার জন্মদিন। ফাদার মারা যাবার পর থেকে নিজের জন্মদিন পালন একটা কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে দেয় সে : সকালে উঠে সেমেট্রিতে গিয়ে ফাদার হোবার্টের কবরে ফুল দিয়ে আসা।
আজো তাই করেছে। বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা চলে গেছিলো সেমিট্রিতে। ফাদারের কবরে একগাদা ফুল দিয়ে সেখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে এসেছে। ফাদার হোবার্টকে তার কখনওই মানুষ বলে মনে হয় না। তার কাছে এই লোকটা স্বর্গ থেকে আসা দেবদূত। ঈশ্বর তার বাবা-মাকে পৃথিবী থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে হয়তো অনুশোচনায় আক্রান্ত হয়েছিলো! অবশেষে ফাদার হোবার্টের মতো দেবদূতকে পাঠিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করেছে।
“এ কথাটা কেন যে তুমি বলো বুঝি না, অনেকক্ষণ পর ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে রেবা বলে উঠলো। তার কণ্ঠ গম্ভীর।
জেফরি বুঝতে পারলো এভাবে কথাটা বলা উচিত হয় নি। রেবা খুব কষ্ট পেয়েছে। আস্তে করে বললো, “সরি।”
“ছোট্ট করে সরি বলে দিলে তো হবে না। আমার মনটা খুব খারাপ করে দিয়েছে।”
“সরি সরি সরি!” আন্তরিকমাখা কণ্ঠে বললো সে। “হয়েছে এবার?”
“না।”
“না?”
“শুধু সরিতে হবে না। কঠিন শাস্তি পেতে হবে তোমাকে।”
হেসে ফেললো জেফরি। “কী শাস্তি দেবে?”
রেবা কিছু বললো না।
“যে শাস্তি দেবে মাথা পেতে নেবো। তবে একটা রিকোয়েস্ট আছে আমার।”
“কি?”
“সশ্রম কারাদণ্ড দিও না। বিনাশ্রম হলে ভালো হয়।”
“মনে হচ্ছে না বিনাশ্রম দিতে পারবো।”
“প্লিজ, চেষ্টা করো।”
“এখন আর চেষ্টা করে লাভ নেই। যা হবার তা হয়ে গেছে।”
কথাটা কেমন জানি শোনালো জেফরির কাছে। “যা হবার হয়ে গেছে মানে?”
রেবা একটু চুপ থেকে বললো, “আমার পিরিয়ড বন্ধ হয়ে গেছে।”
“কি!?” আৎকে উঠলো সে। “মাই গড!”
“বুঝতে পারছি না এরকম কেন হলো,” অসহায় কণ্ঠে বললো রেবা।
“আমিও তো বুঝতে পারছি না,” উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো জেফরি। “এরকম তো হবার কথা না, তাই না?”
“হুমম…সেটাই তো ভাবছি। এখন কি করি?”
“অন্য কোনো কারণেও কি এরকম হতে পারে না?”
“হতে পারে…ডাক্তার দেখালে হয়তো সে বলতে পারবে।”
“তাহলে দেরি না করে আজই ডাক্তার দেখাও,” তাড়া দিয়ে বললো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর।
ফোনের ওপাশে রেবা চুপ মেরে রইলো কিছুক্ষণ। “আমার খুব লজ্জা লাগছে।”
জেফরি কী বলবে বুঝতে পারলো না। কাচুমাচু করে বললো অবশেষে, “ইয়ে…মানে…ডাক্তার তো দেখানো উচিত, তাই না?”
“যদি সত্যি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায় তাহলে?”
জেফরি বেগ দু’চোখ বন্ধ করে ফেললো।
“কী লজ্জার ব্যাপার!” আস্তে করে বললো রেবা।
“তুমি এ নিয়ে চিন্তা কোরো না,” রেবাকে সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে বললো সে। “ওরকম কিছু হলে আমরা দ্রুত বিয়ে করে ফেলবো।”
জেফরির মনে হলো ফোনের ওপাশ থেকে ফিক করে চাপা হাসির শব্দ হয়েছে।
“বিপদে না পড়লে আপনি আমাকে বিয়ে করবেন না দেখছি,” রেবার কণ্ঠে কৃত্রিম অভিমান।
“কি!” দারুণ অবাক হলো জেফরি।
“স্টুপিড!” কপট ভর্ৎসনার সুরে বললো রেবা।
“তুমি আমার সাথে…” আর বলতে পারলো না। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে রেবার মতো শান্ত একটা মেয়ে এরকম একটা তামাশা করেছে। তাও আবার তার জন্মদিনের দিন।
“সকাল সকাল ঘাবড়ে দিলাম মনে হয়,” রেবা হাসছে।
“তুমি আমাকে মোটেও ঘাবড়ে দাও নি, শুধু…” বেশ শান্তকণ্ঠে বললো সে।
“শুধু কি?”
“কয়েক মুহূর্তের জন্য বাবা বানিয়ে দিয়েছিলে,” হেসে বললো এবার। “আমি তো রীতিমতো ভাবতে শুরু করে দিয়েছিলাম ছেলে হবে না মেয়ে। হবে। ছেলে হলে কি নাম রাখবো? মেয়ে হলেই বা-”
“অ্যাই চুপ! একদম চুপ!” ধমকের সুরে বললো রেবা। এখন আমার সাথে ফাজলামি করা হচ্ছে?”
“আমার তো কোনো শালি থাকবে না সুতরাং ফাজলামি করতে হলে তোমার সাথেই করতে হবে।”
ফোনের ওপাশ থেকে রেবার হাসি শোনা গেলো। “আফসোস হচ্ছে নাকি?”
“একটু…তবে বেশি না।”
“আহা রে!”
“আজ কি আমাদের দেখা হচ্ছে?” জেফরি অন্য প্রসঙ্গে চলে এলো।
“আমি তো বিকেলে ফ্রি-ই আছি কিন্তু…”
“কিন্তু কি?”
“এ শহরে কোথায় আবার খুনখারাবি হয়ে যাবে, দেখা যাবে তুমি সেটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। গত জন্মদিনে কতো প্ল্যান করেছিলাম তার কিছুই তো করতে পারি নি। চলে গেলে ক্রাইম সিনে।”
মুচকি হাসলো জেফরি। “আজ যদি খুনখারাবি কিছু না হয় তাহলে শুধু প্রেম হবে, ঠিক আছে?”
“শুধু প্রেম। আর কিছু না।”
“সবই প্রেম। সবকিছুই প্রেম। আমরা যা করবো তা-ই প্রেম।”
আবারো রেবার মিহি হাসির শব্দ। “না। শুধু প্রেম। আক্ষরিক অর্থে।”
“আহ্, প্রেমকে তুমি ব্যাকরণে ফেলে দিলে!”
“দিলাম,” হেসে বললো রেবা। “আজ অন্তত ব্যাকরণ মেনে চোলো একটু?”
“ওকে,” একটু টেনে বললো কথাটা। “সন্ধ্যার আগে আমি তোমাকে পিক করছি। বাই।”
জেফরি বেগ গাড়িটা আবার স্টার্ট দিলো।
অধ্যায় ২
অন্ধকার ঘরে টিভি চলছে। অ্যানিমেল প্লানেট। একটা চিতা ঘাপটি মেরে বসে আছে লম্বা লম্বা আফ্রিকান ঘাসের মধ্যে। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। বহু দূরে এক ঝাঁক হরিণ নিশ্চিন্তে ঘাস খেয়ে যাচ্ছে। একটা অগভীর জলাশয়ের চারপাশ ঘিরে প্রচণ্ড গরমে তৃষ্ণা মেটাচ্ছে আরেক পাল হরিণ।
একটু উঠে কয়েক পা এগিয়ে আবার থমকে গেলো চিতা। শিকার নির্বাচন করে ফেলেছে। এখন কাজে নেমে যাবার পালা।
রিমোটটা হাতে নিয়ে সাউন্ডের ভলিউম কমিয়ে দিলো সে। শিকারের আর্তনাদ শুনতে চাচ্ছে না।
শিকারী পশুদের এই দিকটা তার ভালো লাগে। সামনে অসংখ্য শিকার ঘুরে বেড়ালেও তারা যেকোনো একটাকে বেছে নেয়। বিক্ষিপ্তভাবে অনেকগুলোর পেছনে লাগে না। ঐ একটাই তাদের ধ্যানজ্ঞান। সবগুলোকে বাদ দিয়ে ঐটাকেই ধরা চাই। মানুষের ক্ষেত্রে এরকম একাগ্রতা খুব কমই দেখা যায়। একাগ্রতার চেয়ে তার বুদ্ধি অনেক বেশি। এই বেশি বুদ্ধি ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। সময়মতো ব্যবহার করতে পারে না অনেকেই। একাগ্রতার সাথে, নিষ্ঠার সাথে বুদ্ধিকে কাজে লাগাতে পারলে মানুষ হয়ে উঠতে পারে অনেক বেশি অসাধারণ।
চিতাসহ শিকারী পশুদের বুদ্ধি খুবই সাধারণ কিন্তু তাদের একাগ্রতা সেই ঘাটতি পূরণ করে দেয়। শিকারের প্রতি, নিজেদের কাজের প্রতি এই একাগ্রতা তাদেরকে জঙ্গলের মতো নির্মম পরিবেশে বাঁচিয়ে রাখে দিনের পর দিন।
চিতাটা এখন দৌড়াচ্ছে। তার শিকার হরিণটি প্রাণপনে চেষ্টা করছে নিজেকে বাঁচানোর। সে জানে এই চেষ্টা বৃথা। কয়েক মুহূর্ত পরই চিতা তার লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে।
চিতা আর হরিণের মধ্যে দূরত্ব কমে আসছে এখন। আর মাত্র কয়েক ফিট দূরত্ব ঘুচে গেলেই…
ফোনের রিং বেজে উঠলো এ সময়। বেডসাইড টেবিলে রাখা ফোনটার দিকে তাকালো বিরক্তি নিয়ে। এই বিরক্তির সাথে মিশে আছে কিছুটা বিস্ময়। এখানে তাকে কেউ ফোন করার কথা নয়–শুধু একজন ছাড়া!
ডিসপ্লের দিকে চোখ যেতেই সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা তুলে নিলো হাতে।
“কখন ফিরেছো?” ওপাশের ভারি আর শান্ত কণ্ঠটা বললো। নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো সে। অমূল্য বাবুর সাথে মিথ্যে বলা যায়। এই লোকের অনেক ক্ষমতার মধ্যে একটি হলো শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব। সেই ব্যক্তিত্বের সামনে মিথ্যেগুলো এলোমেলো হয়ে যায়। ছেলেমানুষী বলে মনে হয় নিজেকে।
“গতকাল দুপুরে,” আস্তে করে বললো বাবলু।
একটা দীর্ঘশ্বাস শোনা গেলো অপর প্রান্তে। “ঐ মেয়েটার সাথে দেখা করতে গেছিলে?” কণ্ঠটার চাপা ক্ষোভ সুস্পষ্ট।
বাবলু চুপ মেরে রইলো। বাবু কি ভাবছে সে জানে। কিন্তু পরিহাসের বিষয় হলো দেশে ফিরে আসার পর উমার সাথে মাত্র একবারই দেখা হয়েছে তার। সেটাই তাদের মধ্যে শেষ দেখা। হয়তো এ জীবনে আর দেখা হবে না।
“কাজটা তুমি ঠিক করো নি,” বাবু বললো।
“আমি ওর সাথে দেখা করতে যাই নি,” তার কণ্ঠের দৃঢ়তা প্রশ্নাতীত।
“তাহলে?”
“অন্য একটা কাজ ছিলো।”
“কাজ!” বিস্মিত হলো অমূল্য বাবু।
“আপনি যা ভাবছেন তা নয়,” শুধরে দিলো বাবলু। ভালো করেই জানে ফোনের অপরপ্রান্তের লোকটি কাজ বলতে কি ধরে নিচ্ছে। অবশ্য ভদ্রলোকের ধারণা বরাবরের মতোই সঠিক। গত পরশু রাতে সে যা করেছে। সেটা কাজ’-এর মধ্যেই পড়ে।
“আমি এখন কি ভাবছি, জানো?” কণ্ঠটা আরো বেশি শীতল শোনালো।
এ কথার কোনো জবাব দিলো না সে।
“আমি ভাবছি, তোমার মতো একজন হয়তো গত পরশু রাতে কোনো এক এসিড-সন্ত্রাসীকে নির্জন ইটখোলায় নিয়ে গিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছে!”
ওহ! বাবলু একটু অবাক হলো কথাটা শুনে। যদিও সে জানে অমূল্য বাবু অনেক খবর রাখে, ভদ্রলোকের ক্ষমতার পরিধি আঁচ করাই অসম্ভব, তারপরও গত পরশু রাতের ঐ ঘটনাটা কিভাবে জেনে গেলো সেটা তার মাথায় ঢুকছে না। এ ঘটনা তো বাবুর পক্ষে জানা অসম্ভব। কিন্তু আবারো অসম্ভবকে সম্ভব করলো ভদ্রলোক।
“তোমার সাথে ঐ মেয়েটার কি কানেকশান?” অমূল্য বাবু একটু থেমে আবার বললো, “আমি নিশ্চিত টাকার বিনিময়ে তুমি এ কাজ করো নি।”
“লম্বা গল্প,” বললো বাবলু।
“তাহলে পরে শুনবো। এখন সময় নেই।”
হাফ ছেড়ে বাঁচলো সে।
“ছবি তুলে পত্রিকা অফিসে পাঠানোর কি দরকার ছিলো?”
চুপ মেরে থাকলো সে। এই ব্যাপারটা এখন তার নিজের কাছেই পাগলামি বলে মনে হচ্ছে। টায়ারের স্তূপের মধ্যে এক এসিড সন্ত্রাসী জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হচ্ছে-এরকম ছবি কয়েকটি পত্রিকা অফিসে বেনামে পোস্ট করে দিয়েছে সে। সাথে এও জানিয়ে দিয়েছে, ভবিষ্যতে সব এসিড সন্ত্রাসীকে এরকম পরিণাম ভোগ করতে হবে।
“আর মাত্র এক মাস…তারপরই তুমি মুক্ত হয়ে যাবে। এই একটা মাস সাবধানে চলাফেরা করতে হবে। কোনো রকম ছেলেমানুষী আচরণ করা যাবে না।”
কিছু বললো না বাবলু। অমূল্য বাবু চেষ্টা করে যাচ্ছে তার মামলাগুলো যাতে রাজনৈতিক হয়রানি মামলা হিসেবে তুলে নেয়া হয়। নতুন সরকার এখনও এই প্রক্রিয়াটি শুরু করে নি। তবে সামনের মাসে এটা শুরু হতে পারে।
“আমি চাই না এই সময়ের মধ্যে তুমি এমন কিছু করো যাতে সব ভেস্তে যায়। ঐ ইনভেস্টিগেটর কিন্তু তোমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। ব্ল্যাকরঞ্জুর দলের ব্যাপারটাও মাথায় রাখতে হবে।”
চুপ মেরে থাকলো সে। যদিও তার ধারণা জেফরি বেগ মোটেও তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে না। এই তিন মাসে সেরকম কিছু টের পায় নি। আর রঞ্জুর দলটি ভেঙে গেছে। দলছুট কোনো সন্ত্রাসী মৃত বসের জন্য জানবাজি রাখবে বলে তার মনে হয় না।
“কথাটা মনে রেখো।” শান্তকণ্ঠে বলেই লাইনটা কেটে দিলো বাবু।
কিছুক্ষণ চুপ মেরে রইলো বাবলু। অমূল্য বাবু কি করে এটা জানতে পারলো-এই প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগলো তার মাথায়। কিছুক্ষণ পরই জবাবটা পেয়ে গেলো সে।
প্রায় সবগুলো পত্রিকায় আজ খবরটা বেরিয়েছে। সংবাদপত্র আর ইলেক্ট্রনিকস মিডিয়ার জন্য এটি দারুণ একটি আইটেম ছিলো। কিছু সংবাদপত্র কাজটাকে র্যাবের ক্রশফায়ার’-এর নতুন সংস্করণ বলে চিল্লাফাল্লা করতে শুরু করে দিয়েছে। টিভি চ্যানেলগুলো ‘অদৃশ্য একজন’ এর পরিচয় জানার জন্য হন্যে হয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিলেও সফল হতে পারে নি এখন পর্যন্ত। কেউ কেউ আবার নিজের ডেস্কে বসে এসির ঠাণ্ডা বাতাস খেতে খেতে মনের মাধুরি মিশিয়ে গল্প তৈরি করে ফেলেছে।
বাবুর চোখেও খবরটা নিশ্চয় পড়েছে। তারপর যখন জানতে পেরেছে গত পরশুরাতে সে রিসোর্টে ছিলো না তখনই দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে নিয়েছে ভদ্রলোক।
সম্ভবত এই রিসোর্টের মালিকদের একজন সে। দিল্লি থেকে ফিরে আসার পর এখানকার একটি লজে তার থাকার ব্যবস্থা করে দেয় বাবু। এটা এখন তার গোপন আশ্রয়। রিসোর্টের ম্যানেজার নিশ্চয় বাবুকে তার ব্যাপারে সব খবরাখবর জানিয়ে দেয় নিয়মিত।
আরো একটা কারণে বাবু নিশ্চিত হতে পেরেছে, সে ভাবলো। যে ইটভাটায় ঘটনাটা ঘটেছে সেটা এই রিসোর্ট থেকে খুব কাছে।
স্বস্তির ব্যাপার হলো বাবু তার কাছ থেকে পুরো ঘটনাটা জানতে চায় নি। এই লোক খুব অল্প কথা বলে। হয়তো এরপর রিসোর্টে যখন আসবে তখন ঘটনাটা জানতে চাইবে। কিংবা আর কখনও এ নিয়ে তাকে কোনো প্রশ্নই করবে না। লোকটার মধ্যে অসম্ভব নির্লিপ্ততা রয়েছে। যেনো নিজের মধ্যে একটি জগত বানিয়ে রেখেছে। চারপাশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সেই জগতে ডুব মেরে থাকতেই বেশি পছন্দ করে।
অবশ্য এই গল্পটা বলতে খুবই সংকোচ হতো। তার ধারণা এটা শোনার পরও অমূল্য বাবু পুরোপুরি বিশ্বাস করতো না। শুধু এ কারণে নিজের নিরাপত্তার কথা ভুলে, আর কখনও এমন কাজ করবে না সেই সুদৃঢ় প্রতীজ্ঞা ভঙ্গ করে সে এমন একটা কাজ করতে পারলো?
জবাবটা তার নিজেরও জানা আছে। উমার সাথে হঠাৎ করে ওভাবে বিচ্ছেদ না হলে সে কি প্রতীজ্ঞা ভঙ্গ করে এমন একটা কাজ করতে পারতো?
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। যার জন্য এই কঠিন প্রতীজ্ঞা সে-ই যখন নেই তখন….
হ্যাঁ, উমা তার জীবন থেকে এক পশলা বৃষ্টির মতোই হারিয়ে গেছে।
দিল্লি থেকে একটা স্বপ্ন নিয়ে ফিরে এসেছিলো। একেবারে স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবনযাপন করবে। উমাকে নিয়ে বাকি জীবনটা খুব সাচ্ছন্দেই কাটিয়ে দেবে। জীবনধারণের জন্য যতোটুকু টাকা থাকা দরকার তারচেয়ে বেশিই আছে তার কাছে। অমূল্য বাবুও তাতে আপত্তি করে নি। ব্ল্যাকরঞ্জুর দলকে মোকাবেলা করতে গিয়ে যা করেছে তারপর আর ওখানে থাকা সম্ভব ছিলো না। দেশে ফিরে আসার পর অমূল্য বাবু তার কাছ থেকে কয়েক মাসের সময় চেয়ে নেয়। এই সময়ের মধ্যে তার বিরুদ্ধে যতোগুলো মামলা আছে সবগুলো তুলে নেয়া হবে। সরকারের উঁচুমহলের সাথে এ নিয়ে একটা সমঝোতা হয়ে গেছে। শুধু একটু অপক্ষো করতে হবে, এই যা।
তারপর থেকেই নদীতীরের এই মনোরম রিসোর্টের একটি নির্জন লজে তার ঠাঁই হয়। কারো সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। একদম একা। সর্বগ্রাসী একাকীত্ব। দরকার না পড়লে রিসোর্টের কারো সাথে খুব একটা কথাবার্তাও হয় না। এই রিসোর্টে একজন রহস্যময় অতিথি সে। এখানকার অনেকেই তার ব্যাপারে কৌতূহলী কিন্তু অমূল্য বাবুর কড়া নির্দেশের কারণে নিজেদের সমস্ত কৌতূহল দমিয়ে রাখে।
ব্ল্যাকরঞ্জুর দলের হাত থেকে উমা উদ্ধার পাবার পরই ওর বাবা-মা ওদের সম্পর্কের কথা জেনে যায়। খুব নাটকীয় প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলো তারা। এরকমটি যে হবে সেটা আন্দাজ করতে পারে নি তাদের কেউ। উমার ঘরে ঢুকে বিষের শিশি নিয়ে তারা তাদের একমাত্র সন্তানের কাছে জানতে চায় নিজের জাতধর্ম বিসর্জন দিয়ে, বাবা-মা’র মুখে চুনকালি মেখে ঐ মুসলিম ছেলের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবে নাকি চোখের সামনে নিজের মা-বাবার আত্মহনন দেখবে?
সব সন্তানের যেমনটি করা উচিত উমা ঠিক তাই করেছে। এজন্যে মেয়েটাকে মোটেও দোষ দেয় না বাবলু, শুধু নিজের দুর্ভাগ্যকে ছাড়া।
যে জীবন সে বেছে নিয়েছে, যে জীবন সে যাপন করে এসেছে। দীর্ঘদিন, সেই জীবনে উমার মতো কাউকে জড়ানোই উচিত হয় নি।
আন্ডারওয়ার্ল্ডে থাকাকালীন এক পোড় খাওয়া বড়ভায়ের কাছ থেকে শুনেছিলো : খুনি অবশ্যই খুন হবে! যারা খুন করে তাদের নিয়তি একটাই-খুন হওয়া। কথাটা তার জন্যে মিথ্যে হবে কেন? সেও জানে যেকোনো দিন যে কারো হাতে তার মৃত্যু অবধারিত। সেটা ঐ ইনভেস্টিগেটর হতে পারে, হতে পারে পুলিশের কেউ কিংবা তার মতোই একজনের হাতে। এটাই ঘটবে, এটাই তার নিয়তি। মাঝখান থেকে অবুঝের মতো নিজেকে পাল্টানোর যতো ব্যর্থ চেষ্টা করে গেছে।
এখন তার কিছু নেই। সুতরাং হারাবারও ভয় নেই। যতোদিন বাঁচবে নিজের ভেতরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা ঐ মানুষটার কথামতোই চলবে। শুধু তার কথাই শুনবে, আর কারোর নয়। গতপরশুর ঘটনাটির মধ্য দিয়ে ঐ মানুষটার দাবিই মিটিয়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, কাজটা করার পর থেকে সুকঠিন প্রতীজ্ঞা ভঙ্গ করার অনুশোচনার বদলে তার মধ্যে অন্য রকম এক সুখানুভূতি বয়ে যাচ্ছে। খুব হালকা বোধ করছে এখন। মনে হচ্ছে এক ধরণের প্রায়শ্চিত্তের মধ্যে আছে সে।
ঘরে থাকতে ইচ্ছে করছে না। বাইরের মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়ানোর তাড়া দিচ্ছে ভেতরের মানুষটি। কোনো কিছু না ভেবেই ঘর থেকে বের হয়ে গেলো সে। লজের বাইরে তার বাইকটা স্ট্যান্ড করা আছে। এখানে আসার পর এটা কিনেছে। রিসোর্টে থাকতে থাকতে যখন হাপিয়ে ওঠে তখন বাইকে করে ঘুরে বেড়ায় আশেপাশে। কখনও কখনও ঢাকার ত্রিসীমানায়ও চলে যায়। বহুদিনের চেনা শহরটা দূর থেকে দেখে আবার ফিরে আসে।
বাইকের কাছে আসতেই থমকে দাঁড়ালো।
এক অল্পবয়সী ফুটফুটে মেয়ে তার বাইকের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আগ্রহভরে বাইকটা নেড়েচেড়ে দেখছে সে। তার এক হাতে একটি টেডি বিয়ার। মিনিস্কার্ট আর গেঞ্জিতে দারুণ স্মার্ট লাগছে। মেয়েটির বয়স ছয় সাত বছরের বেশি হবে না।
বাবলু অবাক হলো। রিসোর্টে অনেক লোকজনই পরিবার-পরিজন নিয়ে বেড়াতে আসে, দুএকদিন থেকে চমৎকার সময় কাটিয়ে চলে যায়। তাদের সাথে বাচ্চা-কাচ্চাও থাকে কিন্তু এভাবে কোনো বাচ্চা একা একা রিসোর্টে ঘুরে বেড়ায় না। বিশেষ করে তার লজের আশেপাশে তো নয়ই। এই লজটা রিসোর্টের দক্ষিণ-পূর্ব সীমানায় যে লেক আছে সেটার শেষ প্রান্তে অবস্থিত। এখানে যে কয়টা লজ আছে তার প্রায় সবগুলোই মালিকপক্ষের ব্যবহারের জন্য। বেশিরভাগ সময় লজগুলো খালিই পড়ে থাকে।
বাচ্চা মেয়েটা তাকে দেখেই থমকে গেলো, হয়তো কিছুটা ভয় পেয়েছে।
বাবলু হেসে ফেললো। “কি করছো তুমি?”
মাথা দোলালো মেয়েটি। কিছু করছে না সে।
“বাইকটা তোমার পছন্দ হয়েছে?”
মাথা দোলালো আবার।
“পছন্দ হয় নি?” বসে পড়লো বাবলু। “কেন?”
“এটার কালার আমার ভালো লাগছে না,” বেশ স্পষ্ট উচ্চারণে বললো।
আবারো হেসে ফেললো সে। “তুমি ব্ল্যাক কালার পছন্দ করো না?”
মাথা দোলালো মেয়েটি।
“তাহলে তোমার কোন্ কালার ভালো লাগে?”।
একটু ভেবে বললো, “রেড, ইয়েলো, বু…” খেই হারিয়ে ফেললো অল্পবয়সী বাচ্চাটা।
“গুড,” বললো বাবলু। “তাহলে আমি এটার কালার চেঞ্জ করে রেড কালার করবো, ঠিক আছে?”
মাথা দোলালো বাচ্চাটি। “রেড না…ইয়েলো,” বেশ জোর দিয়েই বললো।
মুচকি হাসলো সে। মেয়েটার গেঞ্জির রঙও হলুদ। “ওকে, ইয়েলো।” বলেই মেয়েটার মাথার উপর আল্ততা করে হাত বুলিয়ে দিলো। “তোমার আব্দু-আম্মু কোথায়?”
“ওরা ঝগড়া করছে,” আস্তে করে বললো ফুটফুটে মেয়েটি।
হা হা হা করে হেসে ফেললো বাবলু।
“হাসছো কেন?” কিছুটা অবাক আর বিরক্ত হয়ে বললো।
“এমনি।”
“জানো না, বড়রা যখন ঝগড়া করে তখন ছোটদের থাকতে নেই,” বড়দের মতো করে বললো মেয়েটি।
“আচ্ছা,” বাবলু তার হাসিটা জোর করে চেপে রাখলো। “সেজন্যে তুমি ওদের ছেড়ে চলে এসেছো?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো এবার।
“এতোক্ষণে নিশ্চয় তোমার আব্লু-আম্মু-”
কথাটা শেষ করতে পারলো না বাবলু। একটা পুরুষ কণ্ঠ বলে উঠলো দূর থেকে : “দিহান!”
বাবলু আর মেয়েটি একসঙ্গে তাকালো সেদিকে। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের এক ভদ্রলোক ছুটে এলো তাদের দিকে। একটু পেছনে এক ভদ্রমহিলা। বরফের মতো জমে গেলো বাবলু। ভদ্রলোক দৌড়ে এসে নিজের মেয়েকে কোলে তুলে নিলো।
“আম্মু, তুমি এভাবে আমাদেরকে না বলে…উফ! জানো আমরা কতো টেনশনে পড়ে গেছিলাম!” ভদ্রলোক মেয়ের গালে চুমু খেলো।
“দিহান!” উদ্বিগ্ন এক মা ছুটে এলো এবার। ভদ্রমহিলা ইতিমধ্যেই বিপর্যস্ত। চোখেমুখে কান্নাকাটি করার সুস্পষ্ট চিহ্ন। কাছে এসে বাবলুকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। কয়েক মুহূর্ত সময় নিলো নিজেকে সামলে নিতে। তারপর কিছুটা দ্বিধার সাথে মেয়েকে বাবার কাছ থেকে অনেকটা ছিনিয়ে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো। বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো সে।
“আম্মু, তুমি এভাবে একা একা চলে আসলে কেন? আমি কতো ভয় পেয়ে গেছি, জানো?”
“তোমরা ঝগড়া করছিলে তাই আমি চলে এসেছি…তুমি না বলেছিলে, বড়রা যখন ঝগড়া করে তখন ছোটদের সেখানে থাকতে নেই?” মায়ের কথার জবাবে হরবর করে বললো দিহান।
মেয়েটার বাবা-মা দুজনেই বিব্রত হলো কথাটা শুনে। দিহানকে নীচুস্বরে তার মা কিছু বললেও বাবলু সেটা শুনতে পেলো না।
মেয়ের বাবা বাবলুর দিকে ফিরলো। “সরি, আপনাকে ডিস্টার্ব করলাম মনে হয়।”
“আরে না। ইটস ওকে,” স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো সে। অনেক বেগ পেতে হলো নিজের অভিব্যক্তি লুকিয়ে রাখতে গিয়ে।
“আমরা লেকের ঐদিকটায় ঘুরছিলাম…হঠাৎ খেয়াল করলাম দিহান নেই। খুব ঘাবড়ে গেছিলাম…”
“এই রিসোর্টে বাচ্চা হারানোর ভয় নেই। জায়গাটা খুব সিকিউর্ড।”
“তা ঠিক। তবে আমরা ভয় পেয়ে গেছিলাম অন্য এটা কারণে…” ভদ্রলোক চুপ মেরে গেলো। যেনো অপ্রিয় কথাটা বলতে তার বাধছে।
বাবলু কিছু বললো না।
“মানে লেকের পানিতে পড়ে যেতে পারতো…বুঝতেই পারছেন…খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম।”
ভয় পাবারই কথা। এই রিসোর্টের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সুদীর্ঘ একটি লেক রয়েছে। ওটা বেশ গভীর। রিসোর্টের শেষ সীমানার পর মাত্র কয়েক শ’ গজ দূরে মেঘনা নদীর সাথে যুক্ত এটি। এখানে আসার পর বাবলু প্রায়ই লেকের পানিতে সাঁতার কাটে। এভাবে সাঁতার কাটতে কাটতে দক্ষ সাঁতারু হয়ে উঠেছে সে। এক দমে পানির নীচে বেশ খানিকটা সময় থাকতে পারে এখন।
“হুম, তা ঠিক…” বললো বাবলু।
মেয়ের মা বাবলুর দিকে তাকালেও চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।
“যাইহোক, আপনাকে অনেক থ্যাঙ্কস,” কথাটা বলেই হাত বাড়িয়ে দিলো মেয়ের বাবা। “আমি এহসান চৌধুরি…”
করমর্দন করতে করতে বললো বাবলু, “আমি তওফিক আহমেদ।”
“নাইস টু মিট ইউ,” বলেই পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়ের মায়ের দিকে তাকালো। “ও আমার মিসেস, দিহানের মা।”
বাবলু কোনোরকমে একটা হাসি দিতে পারলো শুধু। মেয়ের মা অবশ্য কিছুই করলো না। নির্বিকারভাবে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত।
“আজ সকালে এসেছি…কাল বিকেলেই চলে যাবো। আমরা উঠেছি ঐ লজটায়,” একটু দূরে জারুল গাছের পাশে যে লজটা আছে সেটার দিকে আঙুল তুলে দেখালো। “যদি থাকেন তো আবার দেখা হবে,” হাতটা ছেড়ে দিয়ে বললো এহসান চৌধুরি।
জবাবে শুধু হাসি দিলো বাবলু।
মেয়েকে নিয়ে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চলে গেলো নিজেদের লজের দিকে।
একটি সুখি পরিবার।
বাবলু অনেকক্ষণ ধরে চেয়ে রইলো সেদিকে। তার নিজের জীবনটাও এরকম হতে পারতো। প্রেমময়ী স্ত্রী আর সন্তান নিয়ে…আট-দশটা সাধারণ মানুষের মতো…একেবারে স্বাভাবিক একটি জীবন!
দূরের রাস্তা দিয়ে শব্দ করে একটা প্রাইভেটকার চলে যেতেই অন্যমনস্ক ভাবটা কেটে গেলো।
হেলমেট না পরেই বাইকটা নিয়ে বের হয়ে গেলো সে। জানে না কোথায় যাবে-কী করবে। শুধু জানে এখন তাকে যেতে হবে। এই রিসোর্ট থেকে বহু দূরে, হয়তো কিছুক্ষনের জন্য! কিন্তু যেতেই হবে।
দ্রুত গতিতে বাইকটা নিয়ে রিসোর্ট থেকে বের হবার সময় তার সামনে পড়ে গেলো ম্যানেজার ভদ্রলোক। হেলেদুলে বিশাল বপু নিয়ে মেইনগেট থেকে রিসোর্টের বারের দিকে যাচ্ছিলো, তাকে যেতে দেখে থমকে দাঁড়ালো। অন্যসব দিনের মতো হাই-হ্যালো না বলে সোজা মেইনগেট দিয়ে বের হয়ে গেলো বাবলু। ভালো করেই জানে, কিছুক্ষণ পরই অমূল্য বাবুর কাছে এই খবরটা পৌঁছে দেবে ম্যানেজার।
রিসোর্ট থেকে বের হয়ে মহাসড়কে উঠতেই ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাঁপটা এসে লাগলো তার মুখে। গতপরশু রাতে ঐ খুনটা করার পর থেকে যে ভালো লাগার অনুভূতিতে ডুবে গিয়েছিলো তার সাথে যোগ হলো বহু পুরনো একটি স্মৃতি।
মেয়েটি ঠিক তার মায়ের মতো হয়েছে।
অধ্যায় ৩
এক সপ্তাহ পর
হোমিসাইডের নিজের অফিসে বসে আছে জেফরি বেগ। কয়েকটি পুরনো কেসের অগ্রগতি খতিয়ে দেখছে। তার সামনে ল্যাপটপে কেসগুলোর বিস্তারিত রিপোের্ট রয়েছে। সকাল থেকে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে আর ভাবছে নতুন কিছু ইনভেস্টিগেটিভ টুলস দরকার। কিন্তু হোমিসাইডের মহাপরিচালককে রাজি করানো যাচ্ছে না। ডিভাইসগুলো যে খুব বেশি দামি তা নয়, বরং সরকারী কেনাকাটার জটিল প্রক্রিয়ায় যেতে বড় অনীহা ফারুক সাহেবের। এতো বেশি পেপারওয়ার্ক আর জবাবদিহিতা করতে হয় যে, মনে হয় এই জিনিসগুলো বুঝি ভদ্রলোক নিজের ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই কিনছে।
জেফরিও ব্যাপারটা বোঝে, তাই বলে উন্নত প্রযুক্তি থেকে এখানকার ইনভেস্টিগেটররা বঞ্চিত হবে সেটা মেনে নিতে পারে না। এ দেশে অপ্রয়োজনে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে যায় আর হোমিসাইড, পুলিশ, ফায়ারসার্ভিসের মতো জনগনের সরাসরি সেবায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের জন্য শত কোটি টাকার বরাদ্দ দিতে গেলেই গরীব দেশ-টাকা নেই-বাজেট কম’ বলে জ্ঞান দেবে রাজনীতিকেরা।
বায়োমেক্সি, ফেসক্যাম, রেটিনা রিডার, এসব প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আর সফটওয়্যার ছাড়া আধুনিক ক্রাইমের ইনভেস্টিগেশন সত্যি দুরূহ। পৃথিবী প্রতিদিনই এগিয়ে যাচ্ছে, আর অপরাধীরা এগিয়ে যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। তার সাথে তাল মিলিয়ে না চললে শুধু পেছনে পড়েই থাকবে না, মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে হবে।
“স্যার?”
কণ্ঠটা শুনে মুখ তুলে দেখতে পেলো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। জামান। হেসে বললো, “আসো।”
একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো জেফরির সহকারী। “কিছুক্ষণ আগে কাকরাইল মোড়ে একটা প্রাইভেটকারে ড্রাইভার খুন হয়েছে,” একটু থেমে আবার বললো সে, “লোকাল থানা ক্রাইমসিনটা প্রটেক্ট করে রেখেছে…ওরা আমাদেরকে যেতে বলছে।”
“কাকরাইল মোড়ে,” আপন মনেই বললো কথাটা। হোমিসাইডের প্রধান কার্যালয় থেকে খুব বেশি দূরে নয় জায়গাটা।
“ডাকাতির কেস হবার সম্ভাবনাই বেশি,” জামান মন্তব্য করলো।
“এভিডেন্স ভ্যানটা পাঠিয়ে দিয়েছো?”
“জি স্যার।”
“গুড,” ল্যাপটটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো সে। “চলো।”
.
গাড়িটা রাস্তা থেকে সামান্য সরে আছে। বেশ দামি গাড়ি। খুব বেশি হলে কয়েক মাস আগে কেনা। ড্রাইভিং সিটের দরজাটা পুরোপুরি ভোলা। ড্রাইভারের নিথর দেহ পড়ে আছে সিটের উপর। হলুদ রঙের পুলিশ-টেপ দিয়ে পুরো জায়গাটা কর্ডন করে রাখা হয়েছে। চারপাশে অসংখ্য লোকজন জড়ো হয়েছে দৃশ্যটা দেখার জন্য। এভিডেন্স ভ্যানটা রাস্তার একপাশে পার্ক করা। হোমিসাইডের টিম কাজে নেমে পড়েছে দ্রুত। কৌতূহলী লোকজন তাদের হাতে থাকা যন্ত্রপাতি আর কাজকর্ম দেখছে বিস্ময় নিয়ে।
এডলিনকে দেখা গেলো গাড়ির বিভিন্ন জায়গা থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট কালেক্ট করার কাজে ব্যস্ত। জেফরির গাড়িটা ঘটনাস্থলে পৌঁছাতেই চোরাচোখে একবার তাকালো সেদিকে। গাড়ির ভেতর থেকেই সেটা দেখতে পেলো জেফরি বেগ। কিন্তু তার মেজাজ বিগড়ে গেলো অন্য একটা কারণে।
এরইমধ্যে পাঁচ-ছয়জন এসে গেছে।
জেফরির গাড়িটা কাছে আসতেই কাকরাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এগিয়ে এলো। তাকে এগিয়ে যেতে দেখে পিছু নিলো পাঁচ-ছয়জন রিপোর্টার। এদের মধ্যে একজন টিভি রিপোর্টারও আছে।
জেফরি বেগ একবার ভাবলো গাড়ির ভেতরেই বসে থাকবে কিন্তু সেটা করা ঠিক হবে না। অগত্যা গাড়ি থেকে নামতেই হলো তাকে। সহকারী জামান ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তার আগেই নেমে এলো রিপোর্টারদের সামলানোর জন্য।
কাকরাইল থানার ওসি স্যালুট দিয়ে যে-ই না হাত মেলাতে যাবে অমনি তাকে পাশ কাটিয়ে চলে এলো সেই টিভি রিপোর্টার।
“এটা কি ডাকাতির ঘটনা নাকি অন্য কিছু?” মাইক্রোফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে মেয়েটা জানতে চাইলো।
মাইক্রোফোনের হ্যাঁন্ডেলে লোগোটা দেখে বুঝতে পারলো চ্যানেল এইট। অল্পবয়সী ক্যামেরাম্যান ছেলেটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো জামান। তার ভাবভঙ্গি বেশ আগ্রাসী।
প্রশ্ন শুনে জেফরি যারপরনাই বিরক্ত, তবে সে মোটেও অবাক হলো। না। প্রায়ই ক্রাইমসিনে এরকম বালখিল্য প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। যে কেসের কিছুই তারা জানে না, মাত্র তদন্তে নেমেছে, সেই কেসের ব্যাপারে মতামত জানতে চায়! যেনো আধুনিককালের ইনভেস্টিগেটররা এক একজন শার্লক হোমস। আসবে, দেখবে আর ঘোষণা করবে খুনটা কে করেছে। তার উচ্চতা কতো। গায়ের রঙ কেমন। এক পা খোঁড়া কিনা। কোন ধরণের গাড়িতে করে এসেছিলো।
যত্তোসব!
আরে বাবা, শার্লক হোমসেরও কিছু সময় লাগতে চারপাশ অবজার্ভ করতে, পুরো ক্রাইমসিনটা খতিয়ে দেখতে। কে বোঝাবে এদের!
কাকারাইল থানার ওসির সাথে করমর্দন করলো জেফরি। যেনো মেয়েটার প্রশ্ন তার কানেই যায় নি। “কি অবস্থা, ওসি সাহেব?” প্রশ্নের জন্যই প্রশ্নটা করা।
“আমি একটা প্রশ্ন করেছিলাম আপনাকে,” মেয়েটা এবার তার খুব কাছে এসে জবাবদিহি চাইবার ভঙ্গিতে বললো।
এই প্রথম মেয়েটার দিকে ভালো করে তাকালো সে। সবার আগে চোখে পড়লো কটকটে লাল রঙের ফ্রেমের হালফ্যাশনের চশমাটা। একটা ফতুয়া আর জিন্স প্যান্ট পরা। “আই অ্যাম নট ইন অ্যা পজিশন টু কমেন্ট,” শান্তকণ্ঠে বললো জেফরি বেগ। “মাত্র এলাম, অপেক্ষা করেন, কয়েক দিন পর সব জানতে পারবেন।”
মেয়েটা ভুরু নাচালো। কাকরাইল থানার ওসির হাতটা ছেড়ে দিলো জেফরি।
“স্যার, ড্রাইভার ছাড়া গাড়িতে আর কেউ ছিলো না। আমি একটু আগে গাড়ির মালিকের সাথে কথা বলে-”।
ওসির কথার মাঝখানে বাধা দিলো মেয়েটা।
“দেখুন, আপনার লোক আমার ক্যামেরাম্যানের সাথে মিস বিহেভ করছে।”
জেফরি ফিরে তাকালো। জামান ক্যামেরার লেন্সে হাত দিয়ে রেখেছে। চাপাকণ্ঠে কিছু একটা বলছে ক্যামেরাম্যানকে। জেফরি জানে পুরো ব্যাপারটা এখন বেগতিক হয়ে যেতে পারে। এসব সাংবাদিক সামান্য ঘটনাকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে সেটা তার ভালোই জানা আছে। ঠাণ্ডা মাথায় সামলাতে হবে। মনোযোগ দিতে হবে কাজে। উটকো কোনো ঝামেলা হোক সেটা সে চায় না।
“ওসি সাহেব,” বেশ জোরেই বললো কথাটা।
“জি স্যার?” নড়েচড়ে উঠলো ভদ্রলোক।
“আপনি তো ক্রাইমসিনটা পুরোপুরি প্রটেক্ট করেন নি,” চারপাশে তাকালো একটু। “শুধু গাড়ির চারপাশটা ঘিরে রাখলে হবে না। অনেক মূল্যবান এভিডেন্স থাকতে পারে এখানে, ওখানে…” বলে আঙুল তুলে নিজের চারপাশটা দেখালো। “আপনার উচিত ছিলো এই এলাকাটাও ঘিরে রাখা। এখানে এতো লোকজন থাকলে সব আলামত নষ্ট হয়ে যাবে।”
“জি, স্যার,” ওসি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। “এক্ষুণি ক্লিয়ার করছি।”
নিজের লোকজনকে ডেকে সব ক্লিয়ার করে দিতে বললো ভদ্রলোক। একজন এসআই’র নেতৃত্বে কয়েকজন কনস্টেবল এসে লোকজনকে সরিয়ে দিলো, সেই সাথে সাংবাদিক আর টিভি রিপোর্টারকেও। জেফরির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি সরে যেতে বাধ্য হলো এবার।
গুড, মনে মনে বললো সে। একটু দূরে থেকে ঐ মেয়েটিসহ টিভি রিপোর্টাররা তাকে কিছু বললেও সেদিকে না তাকিয়ে সোজা গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেলো। এখন সব কিছু বাদ দিয়ে মনোযোগ দিতে হবে। ক্রাইমসিন হলো ইনভেস্টিগেটরদের জন্য সত্যিকারের একটি পরীক্ষা। এখানে ফেল করা মানে পুরো কেসটা তালগোল পাকিয়ে ফেলা। দিকে থেকে ক্রাইমসিন অনেকটা মাছের মতো-দ্রুত পচে যায়। ফরমালিন দিয়ে মাছের পচন প্রলম্বিত করা গেলেও ক্রাইমসিন সুরক্ষা করা সহজ কাজ নয়।
মৃত ড্রাইভারের কাছে এগিয়ে গেলো জেফরি বেগ। কপালের ডান দিকে গুলি করা হয়েছে। মাথার ঘিলু ছিটকে বের হয়ে লেগে আছে গাড়ির ভেতরে বিভিন্ন জায়গায়। জামান এসে দাঁড়ালো তার পাশে।
“মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করেছে, স্যার।”
সহকারীর দিকে না তাকিয়েই মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি।
গুলির স্পটের চারপাশে একটু পোড়া দাগ দেখা যাচ্ছে। অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করলে চামড়ায় এরকম পোড়া দাগের সৃষ্টি হয় উত্তপ্ত গান-পাউডারের কারণে।
“ঐ রিপোর্টার কি এখনও আছে?” জামানের দিকে না তাকিয়েই বললো সে।
“আছে, স্যার। রাগে গজগজ করছে আর আমাদের গুষ্টি উদ্ধার করছে।”
সহকারীর দিকে তাকালো জেফরি। “আমাদেরকে ক্যামেরায় কতোটুকু শুট করতে পেরেছে?”
মুচকি হাসলো জামান। “একটুও পারে নি।”
জেফরি আবারো গাড়ির ভেতরে তাকালো উপুড় হয়ে। “তুমি নিশ্চিত?”
“জি, স্যার।”
“গুড,” ছোট্ট করে বলেই সোজা হয়ে দাঁড়ালো এবার। রাস্তার চারপাশটা দেখে নিলো। এখনও প্রচুর লোকজন জড়ো হয়ে দেখছে। যে দেশে ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে রাখা হলে পঞ্চাশ-ষাটজন লোক জড়ো হয় সেখানে দিনে দুপুরে একটা প্রাইভেটকারের ড্রাইভারের খুনের দৃশ্য দেখতে কয়েক শ লোকের ভীড় হওয়াটাই স্বাভাবিক।
“আমি নিশ্চিত এটা ডাকাতির ঘটনা,” জামান আবারো বললো।
“ড্রাইভারের কাছে কী এমন ছিলো যে ডাকাতি হবে?” বললো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর।
“ডাকাতরা হয়তো জানতো না গাড়িতে শুধু ড্রাইভার আছে?” অনুমাণ করে বললো জামান।
জেফরি একটু ভেবে আঙুল দিয়ে গাড়ির দিকে ইঙ্গিত করলো। “আমার তা মনে হচ্ছে না।”
আইন অমান্য করে অনেকেই গাড়িতে ঘোলা কিংবা কালো কাঁচ ব্যবহার করে। তবে এই গাড়িতে আইন অমান্য করার কোনো নিদর্শন নেই। স্বচ্ছ কাঁচের কারণে বাইরে থেকে ভেতরের সবকিছু স্পষ্ট দেখা যায়।
জামান কিছু বললো না। বসের কথা মেনে নিলো।
এমন সময় জেফরি টের পেলো পারফিউমের কড়া গন্ধ। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলো এডলিন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
“স্যার, ফিঙ্গারপ্রিন্টগুলো কালেক্ট করেছি,” জেফরির সাথে চোখাচোখি হতেই বললো মেয়েটি।
“গুড।”
“আমাদের কাজ শেষ। এখন এভিডেন্স ভ্যানে গিয়ে কি ম্যাচিং করা শুরু করবো নাকি অফিসে গিয়ে করবো?”
একটু ভাবলো জেফরি। ব্যস্ততম সড়কের পাশে এভিডেন্স ভ্যানটা বেশিক্ষণ পার্ক করে রাখা ঠিক না। “আপনারা অফিসে চলে যান। ওখানে গিয়েই ম্যাচিং করুন। আমি অফিসে এসে রেজাল্ট দেখবো।”
“ওকে, স্যার।” এডলিন তার কিটবক্স নিয়ে চুপচাপ চলে গেলো এভিডেন্স ভ্যানের দিকে।
জেফরি এবার রাস্তার চারপাশে তাকালো।
ব্যাপারটা জামানের চোখ এড়ালো না। “কিছু খুঁজছেন, স্যার?”
ফিরে তাকালো সহকারীর দিকে। “হ্যাঁ।”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো জামান।
“ওখানে,” হাত দিয়ে আইল্যান্ডের দিকে ইঙ্গিত করলো সে। “আমি এ পথ দিয়ে প্রতিদিনই আসি…ওখানে একজন ভিক্ষুক থাকে সব সময়।”
জামানও এ পথ ব্যবহার করে, সেও জানে ওখানে একজন ভিক্ষুক থাকে। “জি, স্যার।”
“সে এখন কোথায়?”
জামান চারপাশটা ভালো করে দেখলো। ভিক্ষুককে আশেপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। “খুনখারাবির ঘটনায় ভয় পেয়ে চলে গেছে মনে হয়।”
“হুম, তাই হবে,” বলেই গাড়ি থেকে সরে এলো জেফরি বেগ। “লাশটা মর্গে পাঠিয়ে গাড়িটা থানায় নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করো।”
“জি, স্যার,” বলেই জেফরি আরো কাছে এসে বললো, “আমরা কি এখন অফিসে ফিরে যাবো?”
“না।”
কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে গেলো জামান কারণ জেফরি চোখের ইশারায় কাকরাইল থানার ওসিকে ডাকলো।
একট দরে দাঁড়িয়ে নিজের লোকজনকে এটা ওটা করতে বলছিলো সে। জেফরির আহ্বানে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো সে। “জি, স্যার?”
“ওসি সাহেব, গাড়ির মালিকের বাসার ঠিকানা আর ফোন নাম্বারটা জামানকে দিন…আমি এক্ষুণি উনার সঙ্গে কথা বলবো।”
অধ্যায় ৪
দরজায় জোরে জোরে আঘাতের শব্দ শুনে লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসলো বাবলু। কয়েক সেকেন্ড লাগলো ব্যাপারটা বুঝে উঠতে। জানালার পর্দা ভেদ করে সকালের রোদ ঢুকে পড়েছে কিন্তু কয়টা বাজে বুঝতে পারলো না। সঙ্গে সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়ায় বেডসাইড ড্রয়ার থেকে পিস্তলটা হাতে তুলে নিয়ে চেক করে দেখলো ম্যাগাজিন লোড করা আছে কিনা। আছে। তারপর দ্রুত উঠে দাঁড়ালো সে। তার পরনে শুধু একটা ট্রাউজার। খালি গা। পা টিপে টিপে দরজার কাছে চলে এলো। এখনও দরজায় জোরে জোরে আঘাত করা হচ্ছে।
এই রিসোর্টে তার ঘরের দরজা কেউ এভাবে ধাক্কা দেবে না। অসম্ভব! এখানকার ম্যানেজার পর্যন্ত তাকে সমীহ করে, তার সাথে ভেবেচিন্তে কথা বলে। আজ এতোদিন ধরে এখানে আছে কোনোদিন কেউ তার দরজায় ভুলেও টোকা মারে নি। আর এখন তো রীতিমতো ধাক্কাচ্ছে!
পুলিশ!
কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব? অমূল্য বাবু ছাড়া কেউ জানে না সে এখানে আছে। রিসোর্টের ম্যানেজার অবশ্য জানে কিন্তু সে তার পরিচয় সম্পর্কে কিছুই জানে না।
মাথাটা ঝাঁকিয়ে নিলো। মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। এখনও পুরোপুরি ধাতস্থ হয় নি। নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিলো, মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। কিন্তু বাইরে যদি পুলিশ থেকে থাকে তাহলে মাথা ঠাণ্ডা রেখেই বা কী লাভ। এরকম একটা ঘরে বন্দী হয়ে কীইবা করতে পারবে সে? যদি পুলিশ হয়ে থাকে নিশ্চয় তারা প্রস্ততি নিয়ে এসেছে। এই লজের চারপাশ ঘিরে রেখেছে তারা।
পিস্তলটার দিকে তাকালো। এটা দিয়ে কি করবে এখন? পুলিশ তার হাতে পিস্তল দেখলেই গুলি চালাবে। একা, একটা পিস্তল দিয়ে কয়জনকে ঘায়েল করতে পারবে? আক্ষেপে মাথা দোলালো। ওভাবে ঐ এসিড সন্ত্রাসীকে ইটভাটায় পুড়িয়ে মারাটা ঠিক হয় নি। ব্যাপারটার মধ্যে অতিনাটকীয়তা ছিলো, আবেগের উকট প্রকাশ থাকলেও বিচক্ষণতার লেশমাত্র ছিলো না। অন্য সময় এরকম কাজে যতোটুকু সাবধানতা অবলম্বন করে তার কিছুই করে নি ওইদিন। হয়তো শক্ত কোনো আলামত নিজের অজান্তে রেখে এসেছে আর সেই আলামতের সূত্র ধরে পুলিশ চলে এসেছে এই রিসোটে।
দরজার ধাক্কাটা এখন আরো প্রকট হলো। যে ধাকাচ্ছে সে অধৈর্য হয়ে উঠেছে এতোক্ষণে। বাবলু জানে না দরজার ওপাশে কারা আছে, কয়জন আছে। তবে একটা ব্যাপার খুব দ্রুত ধরতে পারলো, যে দরজা ধাক্কাচ্ছে। সে মুখে কোনো শব্দ করছে না। শুধু ধাক্কা মেরে যাচ্ছে। এটা তো পুলিশের স্বভাবের সাথে যায় না। এরা দরজা ধাক্কাবে আর বস্তির ভাষায় গালাগালি করবে।
তবে কি র্যাব।
সম্ভবত। বাবলু টের পেলো তার হাত-পা একটু ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। অনেক বছর পর এই প্রথম এরকম হলো। আন্ডারওয়ার্ল্ডে থাকার সময় একবার প্রতিপক্ষের লোকেরা এভাবেই তাকে একটা ঘরে ঘিরে ফেলেছিলো, তবে সেখান থেকে শেষ পর্যন্ত বেঁচে যেতে পেরেছিলো কারণ যে ঘরে আটকা পড়েছিলো সেটা ছিলো পুরনো ঢাকার দুশ’ বছরের পুরনো একটি দোতলা বাড়ি। জানালা দিয়ে অন্য বাড়ির ছাদে লাফিয়ে, ছাদ থেকে ছাদ পেরিয়ে চলে যেতে পেরেছিলো বহু দূর। কিন্তু এখানে এই রিসোর্টে সে-সুযোগ নেই।
আবারো গভীর করে দম নিলো বাবলু। এরকম পরিস্থিতিতে কি করতে হবে সেটা নিয়ে দ্রুত ভেবে গেলো, তারপর দরজার হাতলে হাত রাখলো সে। ডান হাতটা রাখলো দরজার আড়ালে, যাতে পিস্তলটা দেখা না যায়। বুকভরে নিঃশ্বাস নিয়ে দরজাটা আস্তে করে খুললো।
দরজার সামনে কেউ নেই।
কয়েক মুহূর্তের জন্য পুরো ব্যাপারটা তার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো মনে হলো। টের পেলো নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আছে। ডানে-বামে তাকালো দ্রুত। কেউ নেই। তারপরই দেখতে পেলো রিসোর্টের ম্যানেজার রীতিমতো দৌড়ে ছুটে আসছে!
.
বারিধারার লেকের পাশে যে বাড়িটায় জেফরি বেগ আর জামান ঢুকলো সেটা কোনো অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং নয়। রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের আগ্রাসনের আগে অভিজাত এলাকায় যেরকম বাড়ি দেখা যেতো এই বাড়িটা ঠিক সেরকম। বিশ কাঠার উপর একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি। সামনে বিরাট লন-সম্ভবত মোট আয়তনের অর্ধেক আকারের হবে।
ড্রইংরুমটা বিশাল, কম করে হলেও তিন জোড়া সোফা আছে সেখানে। একজন কাজের লোক তাদেরকে বসতে দিয়ে ভেতরে চলে গেছে। এখানে আসার আগেই এই বাড়ির মালিকের সাথে ফোনে কথা হয়েছে তার।
প্রায় পাঁচ মিনিট বসে রইলো, কারোর কোনো সাড়া-শব্দ নেই। জেফরি তার অভিজ্ঞতা থেকে জানে, যতো বড় বাড়ি ততো কম লোক বাস করে। আর ছোটো বাড়িতে গাদাগাদি করে থাকে লোকজন। দেশগুলোর বেলায়ও এ কথা প্রযোজ্য। সুইডেন, কানাডা আর অস্ট্রেলিয়ার মতো আস্ত একটি মহাদেশের লোকসংখ্যা এ দেশের চেয়ে কতো কম। আর ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলে বাস করে…
জেফরির ভাবনায় ছেদ পড়লো একটা শব্দে। ড্রইংরুমের এককোণের দরজা বন্ধ করে মাঝবয়সী এক লোক তাদের দিকে চেয়ে আছে। পরনে খুবই সাদামাটা নাইটড্রেস। তবে লোকটার ভাবভঙ্গি বেশ অভিজাত। জেফরি বুঝতে পারলো এই ভদ্রলোকই বাড়ির মালিক হবে। শান্তভঙ্গিতে এগিয়ে এসে তাদের সামনে দাঁড়ালো সে। জেফরি আর জামান উঠে দাঁড়ালো।
“আমি জেফরি বেগ, একটু আগে আপনার সাথে আমার ফোনে কথা হয়েছিলো, মি: চৌধুরি,” বললো হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর।
এহসান চৌধুরি করমর্দন করে দু’জনকে বসার জন্য ইশারা করলো। “ঘণ্টাখানেক আগে কিন্তু পুলিশের সাথে আমার কথা হয়েছে, মি: বেগ, কথাটা বলেই সোফায় বসে পড়লো বাড়ির মালিক।
“হ্যাঁ, কাকরাইল থানার ওসি আপনার সঙ্গে কথা বলেছে,” জেফরি একটু হেসেই বললো। ভদ্রলোক যেনো পুলিশের লোক ভেবে আড়ষ্ট হয়ে না যায় সে-চেষ্টা করলো।
“তাহলে বলুন, আপনারা কি জানতে চান,” কথাটা বলেই ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। “সকাল থেকেই মনটা খুব খারাপ। বাতেন আমাদের অনেক পুরনো ড্রাইভার ছিলো।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। “কতোদিন ধরে কাজ করছিলো ও?”
“দশ বছর তো হবেই,” ছোট্ট করে বললো।
“গাড়িটা যাচ্ছিলো কোথায়?”
একটু বেবে নাক চুলকে নিলো এহসান চৌধুরি। “আমার মেয়েকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরে আসছিলো।”
“আপনার মেয়ে কোন্ স্কুলে পড়ে?”
“উইলস লিটলে…”
“আচ্ছা,” একটু থেমে কথাগুলো গুছিয়ে নিলো জেফরি। “গাড়িতে কি মূল্যবান কিছু ছিলো?”
“না,” বেশ জোর দিয়েই বললো ভদ্রলোক। আবারো নাক চুলকালো। “গাড়িতে ওরকম জিনিস থাকবে কেন।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। “আপনার সাথে কি কারো কোনো ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব আছে, মি: চৌধুরি?”
“অবশ্যই আছে। বিজনেস আর পলিটিক্সে কনফ্লিক্ট থাকবেই। এটাই ন্যাচারাল। এ কথা জানতে চাচ্ছেন কেন?”
“নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। আসলে কেসটা তদন্ত করতে হলে আমাদেরকে সবকিছুই জানতে হবে। যতো বেশি তথ্য আমাদের হাতে থাকবে তদন্তের কাজে ততো বেশি সাহায্য হবে।”
“ও,” আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলো জ্বলোক। কিন্তু আমার সাথে যাদের ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব আছে তারা আমাকে খুন করার মতো কোনো স্টেপ নেবে না…দ্যাটস ফর শিওর।”
মুচকি হাসলো জেফরি। “অতোটা নিশ্চিত হবেন না…আফটার অল সিদ্ধান্তটা নেবে আপনার প্রতিপক্ষ। সেটা তো আপনার পক্ষে জানা সম্ভব নয়।”
“ওকে, তর্কের খাতিরে আপনার কথা মেনে নিচ্ছি,” বললো ভদ্রলোক। “কিন্তু তারপরও আমি বলবো, আমার ওরকম কোনো শত্রু নেই। তাছাড়া আমাকেই যদি মারার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে তাহলে ড্রাইভারকে মারবে কেন?” কথাটা বলে জেফরির দিকে স্থির চোখে তাকালো। “তাও আবার বাতেনকে…যে কখনও আমার ড্রাইভারই ছিলো না।”
“মানে?” বুঝতে না পেরে বললো জেফরি। “বাতেন আপনার ড্রাইভার ছিলো না?”
“বাতেন যে গাড়িটা চালাতো ওটা আমার স্ত্রী ব্যবহার করে।”
“ও,” তারপর বললো, “একটু আগে কিন্তু বলেছিলেন আপনার মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আসছিলো ওই ড্রাইভার?”
ভদ্রলোক কয়েক মুহূর্ত চুপ মেরে রইলো। “হুম…আমার স্ত্রীর গাড়িটাই মেয়েকে স্কুলে আনা-নেয়ার কাজ করে। আমার আরেকটা গাড়ি আছে। ওটা আমি নিজেই ড্রাইভ করি।”
“আপনার স্ত্রী কোথায়?” প্রশ্নটা করলো জামান। এতোক্ষণ সে চুপ মেরে বসেছিলো জেফরির পাশে।
“ও বাসায় নেই। একটু আগে আমার শ্বশুড়বাড়িতে গেছে।” জেফরি সপ্রশ্নদৃষ্টিতে চেয়ে থাকলে ভদ্রলোক আবার বললো, “বাতেনের খুন হবার কথা শুনে আমার মেয়েটা খুব কান্নাকাটি করছিলো। ও বাতেনকে মামা বলে ডাকতো। আমার স্ত্রী বাতেনকে বড় ভায়ের মতো দেখতো। মেয়েটা খুব কান্নাকাটি করছিলো বলে ওর নানুর বাড়িতে নিয়ে গেছে।”
“আচ্ছা, জেফরি আর কিছু বললো না।
“আমার শ্বশুড়বাড়ি এখান থেকে খুব কাছেই, গুলশান এক নাম্বারে…”
একটু চুপ থেকে বললো জেফরি, “বাতেনের বাড়ির লোকজন ঘটনাটা জানে?”
আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো ভদ্রলোক। “হ্যাঁ। ওই কঠিন কাজটা আমাকেই করতে হয়েছে। একটু আগে ওর ছোটো ভাইকে জানিয়েছি।”
“বাতেনের নিজের পরিবার আছে?”
“ওরা দেশের বাড়িতে থাকে।”
“বাতেন কোথায় থাকতো?” জামান বললো।
“এখানেই…এই বাড়ির ছাদের উপর একটা ঘর আছে…সেখানে…”
একটু চুপ থেকে জেফরি বেগ বললো, “ইদানিং কারো সাথে বাতেনের কি কোনো ঝামেলা হয়েছিলো?”
“না,” সঙ্গে সঙ্গেই নাকচ করে দিলো ভদ্রলোক। “ওর সাথে কার ঝামেলা হতে যাবে?”
“আপনার কাছে কি মনে হচ্ছে, মি: চৌধুরি?”
জেফরির এমন প্রশ্নে ভদ্রলোক চেয়ে রইলো। বুঝলাম না?”
“মানে ড্রাইভার খুন হবার সম্ভাব্য কি কারণ থাকতে পারে? কোনো আইডিয়া?”
নাক চুলকেই বললো, “কোনো আইডিয়া নেই, তবে আমার মনে হচ্ছে এটা গাড়ি ছিনতাইচক্রের কাজ।”
জেফরি আর জামান একে অন্যের দিকে তাকালো। এটা তাদের মাথায়ও এসেছিলো কিন্তু খুব একটা আমলে নেয় নি। ড্রাইভারকে খুন করার পর খুব সহজেই গাড়িটা নিয়ে চম্পট দিতে পারতো তারা কিন্তু সে রকম কিছু করে নি।
“আপনার কেন এটা মনে হচ্ছে?” প্রশ্নটা করলো জামান।
“ঐ গাড়িটা মাত্র গত সপ্তাহে কিনে দিয়েছিলাম আমার স্ত্রীকে। লেটেস্ট মডেল…বেশ দামি গাড়ি…ঢাকা শহরে তো এমন ছিনতাইর ঘটনা ঘটে, তাই না?”
“তা তো ঘটে-ই,” বললো জেফরি।
“হয়তো গাড়িটা ছিনতাইয়ের সময় বাতেন বাধা দিয়েছিলো…”
জেফরি এ নিয়ে আর কিছু বললো না। বাতেন যে খুব বেশি বাধা দিতে পারে নি তা সে জানে। নিজের সিট থেকেই উঠতে পারে নি বেচারা।
“ঠিক আছে, আজকে আর বেশি সময় নষ্ট করবো না, পরে দরকার হলে আবার আসবো,” বলেই উঠে দাঁড়ালো সে, তার দেখাদেখি জামানও।
ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালো না। সোফায় বসে রইলো। “বাতেনের লাশটা কখন পাবো?”
“আশা করছি বিকেলের মধ্যেই পেয়ে যাবেন,” কথাটা শেষ করেই হাত বাড়িয়ে দিলো জেফরি। “আজ তাহলে আসি, মি: চৌধুরি।”
ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে তার হাতটা ধরলো, তবে কিছু বললো না।
“থ্যাঙ্কস ফর ইউর কো-অপারেশন,” বললো জেফরি বেগ তারপর জামানকে নিয়ে চলে গেলো।
অধ্যায় ৫
“আমার ফোন?” যতোটা না বিস্ময় তারচেয়েও বেশি চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো বাবলু।
“আমি কিন্তু প্রথমে স্বীকার করি নি…উনি আপনার নাম বললো, তাই…” অনেকটা কাচুমাচু ভঙ্গিতে জানালো ম্যানেজার।
কিছুক্ষণ আগে এক ভদ্রমহিলা ফোন করেছে ম্যানেজারের কাছে। তওফিক আহমেদকে চায় সে। খুব জরুরি। ম্যানেজার প্রথমে অবাক হলেও মহিলার চাপাচাপিতে অবশেষে তাকে ফোনে অপেক্ষা করতে বলে। রিসোর্টের এক বোবা ছেলেকে পাঠায় বাবলুর রুমে। ছেলেটা তার দরজায় ধাক্কাধাক্কি করে চলে যায় ম্যানেজারের কাছে। অবশ্য ম্যানেজারের ভুল ভাঙতে দেরি হয় নি। সে বুঝতে পারে একজন বোবাকে দিয়ে তাকে ডেকে পাঠানোটা ঠিক হয় নি, তাই নিজেই চলে আসে ডাকার জন্য। অবশ্য তার আগেই বাবলু দরজা খুলে দেয়।
কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো বাবলু। তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। এই রিসোর্টে অমূল্য বাবু ছাড়া আর কেউ তাকে ফোন করে না। রাতে ঘুমাতে যাবার আগে তার মোবাইলফোনটা অফ করে রেখেছিলো সুতরাং বাবু তার ফোন বন্ধ পেয়ে ম্যানেজারের কাছে ফোন করতেই পারে, সেটা অস্বাভাবিক নয়। অথচ এই লোক বলছে বাবু না, কোনো এক ভদ্রমহিলা তাকে ফোন করেছে। প্রথমেই উমার কথা মনে হলেও পরক্ষণেই সেটা বাতিল করে দিলো। ম্যানেজারের ফোন নাম্বার তো দূরের কথা, উমা জানেই না সে এই রিসোর্টে আছে।
তাহলে কে?
“মনে হলো ভদ্রমহিলা খুব তাড়ার মধ্যে আছেন…আমাকে বললেন জরুরি দরকার,” ম্যানেজারের কথায় ভাবনায় ছেদ পড়লো। “নাকি বলে দেবো আপনি আর এখানে থাকেন না?”
“মহিলার নাম কি?”
ম্যানেজার কাচুমাচু খেলো। “সেটা তো জিজ্ঞেস করি নি…মানে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছিলাম।”
বাবলু কিছু না বলে সোজা হাটা ধরলো ম্যানেজারের রুমের দিকে। ভুড়ি নিয়ে তার পিছু নিলো ভদ্রলোক।
রুমে ঢুকতেই থমকে দাঁড়ালো সে, ঘুরে তাকালো ম্যানেজারের দিকে। ভদ্রলোক থতমত খেলো প্রথমে তারপর বুঝতে পেরে দাঁত বের করে হাসলো। “আপনি কথা বলুন, আমি রিসেপশনে আছি।”
ম্যানেজার চলে যাবার পর বাবলু ঘরে ঢুকলো। বিশাল ডেস্কের উপর ফোনের রিসিভারটা তুলে রাখা হয়েছে। লাইনে যে আছে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে সে। কে জানে এরইমধ্যে লাইন কেটে দিয়েছে কিনা। গভীর করে দম নিয়ে রিসিভারটা তুলে নিলো। স্বভাববশত নিজে থেকে কিছুই বললো না। ওপাশেও সাড়াশব্দ নেই। কয়েক সেকেন্ড পর একটা
উদ্বিগ্ন নারীকণ্ঠ বলে উঠলো : “হ্যালো…হ্যালো…বাবলু?”
কণ্ঠটা শুনে সে বিশ্বাসই করতে পারলো না। এতোকাল পরেও কণ্ঠটা চিনতে তার একমুহূর্তও দেরি হয় নি। যদিও আগের চেয়ে কিছুটা ভারি আর শান্ত হয়ে গেছে।
“মেঘলা!”
.
শান্তিনগর মোড়ে বিশ্রী ট্রাফিকজ্যামে বসে আছে জেফরি বেগ আর জামান। স্টিয়ারিংয়ের উপর অলসভঙ্গিতে একটা হাত রেখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে জেফরির সহকারী। বারিধারা থেকে তারা চলে আসে কাকরাইলের ক্রাইমসিনে। সেখানকার লোকজনকে জিজ্ঞেস করে আঙ্কেল নামে পরিচিত ভিক্ষুকের ডেরার খবর জেনে নিয়েছে। এখন ছুটছে সেই গন্তব্যে। জামানের মাথায় কিছুই ঢুকছে না। গাড়ির মালিকের সাথে কথা বলার পর রাস্তার এক ভিক্ষুকের কাছে যাচ্ছে তারা! ওই বেচারার কাছ থেকে কী এমন তথ্য জানতে পারবে তার বস্?
“ঐ ভিক্ষুককে বস্তিতে গিয়ে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না, স্যার, বললো জামান।
এতোক্ষণ উদাস হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিলো সে, এ কথায় ফিরে তাকালো। “কেন পাওয়া যাবে না?”
“হয়তো অন্য কোথাও ভিক্ষা করছে এখন। ভিক্ষুকরা একটা দিন মাটি করে ঘরে বসে থাকার কি না।”
কিন্তু জেফরি জানে ঐ আঙ্কেলকে বস্তিতেই পাওয়া যাবে। ইচ্ছে করলেই কোনো ভিক্ষুক ঢাকা শহরের যেকোনো জায়গায় গিয়ে ভিক্ষা করতে পারে না। পুরো শহরটাকে ভিক্ষুকের দল বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে নিয়েছে, ঠিক যেমন পুরো দেশটা ভাগ করে নিয়েছে রাজনীতিকেরা! তবে জামানের কথার কোনো জবাব দিলো না সে।
আধঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে একঘণ্টারও বেশি সময় লাগলো। আগারগাঁওয়ের বস্তির সামনে গাড়িটা রেখে নেমে পড়লো জেফরি। জামানকে গাড়ির কাছেই থাকতে বললো। জায়গাটা সুবিধার নয়, খালি গাড়ি রেখে চলে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
বস্তির সামনে তিন-চারটা টং দোকান আছে, চা-বিস্কিট, সিগারেটসহ নানান জিনিসপত্র বিক্রি করে। এরকম এক দোকানির কাছে গিয়ে জানতে চাইলো আঙ্কেল নামের ভিক্ষুক কোথায় থাকে। প্রথম দোকানদার চিনতে পারলো না। সে এখানে বেশিদিন হয় নি এসেছে। তবে লেদু মিয়া নামের এক দোকানি জানালো আঙ্কেল নামে কোনো ভিক্ষুক এখানে থাকে না। সে একদম নিশ্চিত। এই বস্তির সবাইকে চেনে, কোনোদিন এ নামের কাউকে এখানে থাকতে দেখে নি।
আরো কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো জেফরি।
“পেলেন না?” গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জামান বললো।
“ওরা তো বলছে এ নামের কেউ এখানে থাকেই না।”
“তা হতে পারে, স্যার। আঙ্কেল নামটা হয়তো বস্তির কেউ জানে না। লোকটার আসল নাম জানা গেলে ভালো হতো।”
জেফরিও জানে জামানের কথা ঠিক। কিন্তু লোকটার আসল নাম কাকরাইল এলাকার কেউ জানে না।
গাড়িতে উঠে বসতেই ইঞ্জিন স্টার্ট দিলো জামান। “স্যার, দুপুর তো হয়ে গেলো, লাঞ্চ করবেন না?”
“হুম, বাইরে কোথাও খেয়ে নেই, চলো।”
“ওকে স্যার।”
তাদের গাড়িটা ঘুরে রাস্তায় নামতেই সামনে পড়ে গেলো এক বৃদ্ধ লোক। হনহন করে বস্তির দিকে যাচ্ছিলো সে। জামান সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক কষলে লোকটা অল্পের জন্য বেঁচে গেলো এ যাত্রায়, নইলে নির্ঘাত আহত হতো।
“ওই মিয়া, দেইহা চালান না?” রেগেমেগে বললো বৃদ্ধ। “এরহম জায়গায় এতো জোরে কেউ গাড়ি চালায়, অ্যাঁ?”
জামান কিছু বলতে যাবে অমনি জেফরি তার হাতটা ধরে থামিয়ে দিলো। “কি খবর আঙ্কেল, কেমন আছেন?”
ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে জানালা দিয়ে মাথা বের করে আছে জেফরি বেগ। বৃদ্ধ লোকটি তার দিকে পিটপিট করে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। একটু ঘাবড়ে গেছে মনে হলো।
“আ-আপনে?” তোতলালো সে। এমনিতে ভিক্ষা করার সময় আধাপাগল সেজে যাকে তাকে তুই তোকারি করে এ লোক কিন্তু এখন বেশ কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় দিচ্ছে।
“হুম, আপনাকেই খুঁজছিলাম,” হেসে বললো জেফরি। “কিন্তু এখানে তো কেউ আপনাকে আঙ্কেল নামে চেনে না।”
লোকটা ধন্দে পড়ে গেলো। “আমারে খুঁজতাছেন ক্যান, স্যার?” ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলো সে।
“জরুরি একটা দরকার আছে।” কথাটা বলেই গাড়ি থেকে নেমে এলো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর।
মনে হলো ভিক্ষুক লোকটি ঢোক গিললো। না পারছে দৌড়ে পালাতে, না পারছে জেফরি বেগের মুখোমুখি হতে। সে ভালো করেই জানে এই লোক পুলিশের একজন বড় কর্মকর্তা।
“আঙ্কেল,” কাছে এসে বললো জেফরি বেগ। “আজ এতো তাড়াতাড়ি চলে এলেন যে?”
ভিক্ষুক ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। “আইজ…আ-আইজকা আমার শরীলটা ভালা না,” আমতা আমতা করে বললো সে। “আইজকা আমি কামে–
জেফরি তার কাঁধে হাত রেখে তাকে থামিয়ে দিলো। “আজ সকালেও আপনাকে আমি দেখেছি, দু টাকাও দিয়েছি। ভুলে গেছেন?”
আবারো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো ভিক্ষুক। এ সময় জামানও গাড়ি থেকে নেমে এলো। আঙ্কেল একবার জেফরি আরেকবার জামানের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিললো আস্তে করে।
“ভয় পাচ্ছেন কেন?” জেফরি বললো তাকে। “আপনি যা দেখেছেন শুধু তা-ই বলবেন। ভয়ের কিছু নেই।” কথাটা বলে আবারো ভিক্ষুকের কাঁধে হাত রাখলো সে। তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলো। “আমি জানি আপনি পুরো ঘটনাটি দেখেছেন। এখন বলুন, ওখানে আসলে কি হয়েছিলো?”
একটু সময় নিলো ভিক্ষুক, তারপর মিনমিনে গলায় বললো, “ওরা গাড়িটারে আটকাইয়া ড্রাইভারে গুলি করলো।”
“হুম।” জেফরি আরো বেশি আন্তরিকমাখা কণ্ঠে বললো, “তারপর?”
বৃদ্ধ ঢোক গিলে বললো, “মাইয়াটারে মুখ চাইপ্যা ধরলো…গাড়িতে তুইল্যা নিয়া গেলো গা…”
অধ্যায় ৬
বাবলু বুঝতে পারলো না কী করবে। টেলিফোনের ওপাশ থেকে কেঁদে যাচ্ছে মেঘলা। পুরো ঘটনাটি এক নিঃশ্বাসে বলার পর তার এই কান্না যেনো বাধ ভেঙে যাওয়া প্লাবনের মতো তীব্রতা নিয়ে হাজির হয়েছে।
আজ এতোকাল পরে মেঘলার সাথে তার কথা হলো। অবশ্য সপ্তাহখানেক আগে রিসোর্টে তার লজের সামনেই দেখা হয়ে গিয়েছিলো আচম্বিত। সেদিন কোনো কথা হয় নি। সঙ্গত কারণেই তারা এমন ভান করেছিলো যেনো কেউ কাউকে চেনে না।
আট-দশ বছর আগের কথা, আন্ডারওয়ার্ল্ডে কাজ করার সময় দীর্ঘদিন পর মেঘলার সাথে তার দেখা হয়েছিলো একবার, তখনও মেয়েটা তার জন্য অপেক্ষা করছিলো। মেঘলার অশ্রু ভেজা চোখ দুটো এখনও তার মনে পড়ে। কতোটা আকুতি নিয়েই না তাকে ফিরে আসতে বলেছিলো স্বাভাবিক জীবনে, কিন্তু তার পক্ষে সেটা সম্ভব হয় নি। ভালো করে জানতো, যে পথে চলে গেছে সেখান থেকে হুট করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা প্রায় অসম্ভব। চেষ্টা করে হয়তো দেখা যেতো কিন্তু তাতে মেঘলার জীবনটাই তছনছ হয়ে যাবার সম্ভাবনা ছিলো।
সে এটা চায় নি। বরং বাস্তবতা বুঝে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে। এরপর রিসোর্টে দেখা হবার আগে মেঘলার সাথে তার আর দেখা হয় নি। একই শহরে থাকার পরও তারা হয়ে যায় দুই ভুবনের বাসিন্দা।
উমার সাথে সম্পর্ক হবার পর অনেকটা সচেতনভাবেই মেঘলাকে ভুলে থাকতে চেয়েছিলো সে। হয়তো পেরেছিলো।
মেঘলার সাথে বিচ্ছেদের পর সে চেয়েছিলো মেয়েটা তাকে ভুলে যাক, ভালো একজন মানুষের সাথে ঘর বাধুক। তার জীবনটা সুন্দর হোক। কোল জুড়ে আসুক ফুটফুটে বাচ্চা।
তাই হয়েছে। মেঘলার বিয়ে হয়েছে বেশ ধনী পরিবারের এক ভদ্রলোকের সাথে। দিহানের মতো ফুটফুটে একটি মেয়েও আছে তার। স্বাভাবিক একটি জীবন। যে-জীবন থেকে যোজন যোজন দূরত্বে বাস করে বাবলু। কিন্তু এখন তার সেই জীবনটা তছনছ হয়ে যাচ্ছে। বাবলুর যে অন্ধকার জীবনটা মেঘলা ঘৃণা করতো, সেই জীবনের কাছেই ছোট্ট একটা দাবি নিয়ে এসেছে আজ নিরুপায় হয়ে।
“তুমি আমার দিহানকে আমার কাছে এনে দাও, বাবলু…” কান্না চেপে কোনোরকমে বললো মেঘলা। “ওরা আমার মেয়েটাকে মেরে ফেলবে…”
শেষ কথাটা বলার সময় তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো। নির্মম বাস্তব হলেও নিজের নাড়িছেঁড়া সন্তানের অমন পরিণতির কথা কোনো মা সহজে বলতে পারে না।
“যতো টাকা লাগে আমি তোমাকে দেবো…তুমি শুধু আমার দিহানকে উদ্ধার করে দাও।” আবারো কান্নায় ভেঙে পড়লো সে।
“মেঘলা,” আস্তে করে বললো বাবলু। “প্লিজ, কেঁদো না!”
বাবলু টের পেলো তার নিজের গলা বাষ্পরুদ্ধ হয়ে গেছে। অনেকদিন আগে, ঠিক এভাবে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলো মেঘলা। তার মনের পর্দায় সেই দৃশ্যটা ভেসে উঠলো। মেঘলার ফোলা ফোলা ভেজা চোখ, তীব্র মায়াভরা মুখটা বাবলুর হৃদয় দুমড়েমুচড়ে দিয়েছিলো। ঐদিনের মতো অনুভূতি হলো তার। হুবহু একই রকম।
“আমি তোমার দিহানকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দেবো,” শান্তকণ্ঠে বললো সে।
কথাটার মধ্যে যে দৃঢ়তা আছে সেটা যেনো ফোনের ওপাশ থেকে মেঘলাও টের পেলো।
“কিন্তু আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে।”
মেঘলা জোর করে কান্না থামালো। “বলো আমাকে কি করতে হবে? আমি সব করতে রাজি আছি…টাকাপয়সা নিয়ে তুমি ভেবো না…আমাকে শুধু বলল কি করতে হবে।”
মেঘলা জানে কিডন্যাপাররা টাকা পাবার পরও তার সন্তানকে জীবিত ফেরত দেবে না। আজকাল তো এরকমই হয়ে আসছে। কিডন্যাপারদের দাবি মোতাবেক এক কোটি টাকা দিয়ে দেয়াটা তার জন্য খুব বেশি কঠিন কাজ নয়। দিহানের বাবা, মেঘলার স্বামীও টাকা দিতে রাজি আছে কিন্তু টাকা দিয়ে দিলেই যে মেয়েকে জীবিত ফিরে পাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
বাবলুও সেটা জানে। দিহানকে যারা কিডন্যাপ করেছে তারা পেশাদার লোকজন। এরা কখনও মুক্তিপণ পাবার পর জিম্মিকে বাঁচিয়ে রাখবে না। কারণটা খুব সহজ-জিম্মিকে আটকে রাখার মতো নিরাপদ জায়গার অভাব এবং জীবিত ফেরত দেয়ার ঝুঁকি। আর যদি ঘনিষ্ঠ বা পরিচিত কেউ অপহরণের সাথে জড়িত থাকে তাহলে জিম্মির অনিবার্য পরিণতি একটাই-মৃত্যু!
“কোনো টাকা লাগবে না। এখন কান্না থামাও। তোমাকে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। আমি যা যা বলবো তা করতে হবে, ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে, বাবলু, কান্না চেপে বললো মেঘলা।
গভীর করে দম নিয়ে নিলো সে। তার নিজের মাথাটাও এলোমেলো হয়ে গেছে মেঘলার ফোন পাবার পর থেকে। এখন দরকার ঠাণ্ডা মাথায় দ্রুত একটা পরিকল্পনা করে ফেলা। তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে কি করা দরকার।
“বলো বাবলু?” ওপাশ থেকে তাড়া দিলো মেঘলা। “আমাকে কি করতে হবে, বলো?”
“বলছি…” আস্তে করে বললো সে।
অধ্যায় ৭
“ওরা কয়জন ছিলো?”
“তিন-চাইরজন তো অইবোই,” জেফরির প্রশ্নের জবাবে বেশ জোর দিয়ে বললো ভিক্ষুক। পুরো ঘটনাটি সে খুব কাছ থেকে দেখেছে তাই ভুল হবার কথা নয়। “মাইয়াটার মুখে রুমাল চাইপ্যা ধরছিলো একজন…তারপর কোলে কইরা গাড়িতে নিয়া চইলা যায়…”
“ওদের গাড়িটা কি রঙের ছিলো?”
“কালা রঙ্গের একটা গাড়ি…”
জামানের দিকে তাকালো জেফরি। বৃদ্ধের মুখ থেকে এ কথা শুনে ছেলেটা নড়েচড়ে উঠেছে। এবার বুঝতে পারলো, তার বস কেন এখানে এসেছে।
“মেয়েটার বয়স কতো হবে?”
জেফরির এ প্রশ্নে ভিক্ষুক একটু ভেবে নিলো। “পিচ্চি মাইয়া…বয়স আর কতো অইবো…ধরেন সাত-আট?”
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো জেফরির ভেতর থেকে। এটা সে তখনই আঁচ করতে পেরেছিলো যখন এহসান চৌধুরি বলেছিলো বাতেন তার মেয়েকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরছিলো। কিন্তু ক্রাইমসিনে গাড়িটার অভিমুখ ছিলো স্কুলের দিকে! ছোট্ট এই অসঙ্গতিটা জেফরির চোখে ধরা পড়লে পুরো ব্যাপারটা অন্যভাবে খতিয়ে দেখতে শুরু করে সে। তাছাড়া কথা বলার সময় মেয়েটার বাবা বার বার নাক চুলকাচ্ছিলো। এটা মিথ্যে কথা বলার লক্ষণ। এফবিআই’তে ট্রেনিঙের সময় তাদেরকে ছোট্ট কোর্স করানো হয়েছিলো কিভাবে মানুষের মিথ্যে কথা ধরা হয়। তাদের ইন্সট্রাক্টর এ বিষয়ে উদাহরণ দিতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টনের ঐ ঘটনাটি উল্লেখ করেছিলেন, যেখানে মনিকা লিউনিস্কির সাথে নিজের সম্পর্কের কথা জোর দিয়ে অস্বীকার করেছিলেন। টেলিভিশনে কোটি কোটি দর্শক দেখেছে, মি: ক্লিন্টন অস্বীকার করার মুহূর্তে বার বার নাক চুলকেছিলেন। একই কাজ করেছে মি: চৌধুরি। সেও মিথ্যে বলেছে।
তবে ভদ্রলোক কেন এটা করেছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না তার।
আবারো একটা অপহরণ-তবে এবার কোনো হোমমিনিস্টারের ছেলেকে করা হয় নি, এক ধনীপরিবারের আদরের সন্তানকে কেউ অপহরণ করেছে সম্ভবত মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ আদায় করার জন্য।
আঙ্কেল নামের ভিক্ষুকের কাছ থেকে এর বেশি জানা গেলো না কারণ ড্রাইভার খুন হবার সাথে সাথে সে ভয় পেয়ে ওখান থেকে চলে আসে। পুলিশ এসে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে, হেনস্তা করতে পারে এরকম আশঙ্কা ছিলো তার।
জেফরি আর জামান আগারগাঁওয়ের বস্তি থেকে সোজা চলে এলো হোমিসাইডে। পুরো কেসটা অন্য দিকে মোড় নিয়েছে এখন। ড্রাইভারের খুনের চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে একটি শিশুর জীবন।
অফিসে এসে জানতে পারলো ডাটা ব্যাঙ্ক সার্চ করার কম্পিউটারটা সমস্যা করছে। সেজন্যে সংগৃহীত ফিঙ্গারপ্রিন্টগুলো ম্যাচিং করা সম্ভব হচ্ছে না। আইটি সেকশনের লোকজন দ্রুত সারিয়ে তোলার চেষ্টা করছে এখন।
খবরটা শুনেই জেফরির মেজাজ বিগড়ে গেলো। নিশ্চয় এডলিন আবারো ওটার মধ্যে ফালতু কোনো সফটওয়্যার ইন্সটল করেছে। এই মেয়েটা ওরকম দরকারি একটা পিসিতে হোরোস্কোপসহ হাবিজাবি অনেক গেমও ইন্সটল করে রাখে।
জামানকে নিয়ে নিজের অফিসে চলে এলো সে। ডেস্কে বসতে বসতে বললো, “আমাদেরকে খুব সাবধানে কাজ করতে হবে,” বলেই আনমনা হয়ে গেলো। “এবং দ্রুত।”
“তাহলে এখন কি করবেন, স্যার?” বললো সহকারী। কিন্তু তার বস্ ফাঁকা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। মেয়েটার বাবা-মায়ের সাথে যোগাযোগ করা দরকার না?”
তার দিকে তাকালো জেফরি। “না,” বেশ দৃঢ়ভাবেই বলো সে। “আপাতত দরকার নেই।”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো সহকারী কিন্তু মনে হলো সে কিছু ভেবে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর বললো, “একটা বিষয় আমাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।”
“কি, স্যার?”
“ওরা যদি টাকা দিতে রাজিও হয় তারপরও মেয়েটাকে জীবিত ফেরত পাবে কিনা সন্দেহ।”
জামান বুঝতে পারলো কথাটার অর্থ। সাম্প্রতিক সময়ে এ দেশে কিডন্যাপিং হয়ে গেছে শাখের করাতের মতো। টাকা না দিলে অপহৃত ব্যক্তিকে জীবিত ফেরত পাওয়া যায় না, আবার টাকা দিলেও ফেরত পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। যাদের নিকটজন অপহরণ করা হয় তাদের পক্ষে এই পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেয়াটা সহজ হয় না। তাদের মনে আশংকা থাকলেও নিরুপায় হয়ে অপহরণকারীদের দাবি মিটিয়ে থাকে। আর শতকরা নিরানব্বইটি ঘটনায় দেখা যায় অপহরণকারীরা জিম্মিকে খুন করে সটকে পড়ে।
“রাজি হলেও মনে হয় না এতো তাড়াতাড়ি মুক্তিপণের টাকা দিতে পারবে,” বললো জামান।
“মেয়ের বাবা খুব ধনী। একমাত্র সন্তানের জন্য সবই করতে পারে। দ্রুত টাকা জোগার করে দিয়ে দেয়াটা অস্বাভাবিক হবে না।”
“টাকার পরিমাণ যদি বেশি হয় তাহলে এতো দ্রুত দেয়া সম্ভব হবে। ওরা নিশ্চয় অতো টাকা বাড়িতে রাখে না।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। “টাকার পরিমাণ কতো হতে পারে?”
“আমার তো মনে হয় না কোটি টাকার নীচে।”
“এ পরিমাণ টাকা পরিচিত বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকেও জোগার করতে পারে তারা।
জেফরির এ কথায় সায় দিলো জামান।
“আমাদের নিশ্চিত হতে হবে ওরা কখন টাকা দেবে।”
“ওদের সাথে যোগাযোগ না করে এটা কিভাবে জানতে পারবো আমরা?”
সহকারীর দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকালো জেফরি বেগ। “খুব সহজেই সেটা জানা যাবে।”
অধ্যায় ৮
বাবলুর বাইকটা ছুটে চলছে দ্রুতগতিতে কিন্তু তারচেয়েও দ্রুত চলছে মাথার ভেতরকার চিন্তাভাবনা। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে মেঘলার একমাত্র সন্তান ছোট্ট দিহানকে একদল পেশাদার সন্ত্রাসী অপহরণ করেছে। ছোট্ট মেয়েটার মুখ স্পষ্ট মনে আছে তার। বড়দের মতো করে কথা বলে! দেখতে একেবারে মেঘলার মতোই হয়েছে।
দিহানের মুখটা তার মনের পর্দায় ভেসে উঠতেই বাইকের গতি আরো বাড়িয়ে দিলো। তাকে এখন যতো দ্রুত সম্ভব ঢাকায় যেতে হবে। যারা ঐ নিষ্পাপ শিশুটিকে অপহরণ করেছে তাদেরকে খুঁজে বের করাটা তার জন্য অসম্ভব কাজ নয়। আজ হোক কাল হোক এটা সে করতে পারবে কিন্তু তার আসল লড়াইটা সময়ের সাথে। খুব দ্রুত ওদের খুঁজে বের করতে না পারলে মেয়েটার পরিণতি কি হতে পারে সেটা সে ভালো করেই জানে।
মেঘলা যা বলেছে তাতে মনে হচ্ছে অপহরণকারীরা আগামীকালের মধ্যে টাকা না দিলে দিহানকে মেরে ফেলবে। মা হিসেবে মেঘলা প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছে-সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভঙ্গুর মানসিক অবস্থায়ও এটা ভুলে যায় নি, অপহরণকারীরা টাকা পাবার পরও তার মেয়েকে জীবিত ফেরত দেবে না। অসহায় মেঘলা এমন পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে বাবলুর শরণাপন্ন হয়েছে।
কয়েক দিন আগে এই রিসোর্টেই তাদের দেখা হয়ে গেলে দু’জনেই চমকে গিয়েছিলো। শুধু কয়েক পলকের দৃষ্টি বিনিময় ছাড়া তাদের মধ্যে কোনো কথাবার্তা হয় নি সেদিন। তবে মেঘলার স্বামীর কাছে নিজেকে তওফিক আহমেদ হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলো সে। এটা যে বাবলুর আসল নাম মেঘলা সেটা জানতো। এ নামটাই কলেজে ব্যবহার করেছিলো, যদিও সবাই তাকে বাবলু বলেই ডাকতো।
রিসোর্টে ফোন করে মেঘলা এ নামে কাউকে চাইলে ম্যানেজার প্রথমে অস্বীকার করেছিলো। কিন্তু সে যখন জানায় ব্যাপারটা খুবই জরুরি, তওফিক সাহেব তার ঘনিষ্ঠজন, জরুরি একটা প্রয়োজনে তাকে দরকার, অনেকবার কল করেছে, তার মোবাইলফোনটা বন্ধ, তখন ম্যানেজার বাবলুকে ডেকে আনতে পাঠায়।
হেলমেটের আড়ালে বাবলুর মুখে ফুটে উঠলো বাঁকা হাসি। জীবন আসলেই বিচিত্র। উমা তার জীবন থেকে চলে যেতে না যেতেই পুণরায় মেঘলার আর্বিভাব হলো, তাও এভাবে! সে কখনও ভাবে নি মেঘলার সাথে এ জীবনে আবার দেখা হবে। মেয়েটাকে সে অনেক দুঃখ দিয়েছে। এজন্যে তার মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করে সব সময়।
বাবলুর জীবনটাই পাল্টে দিয়েছিলো এই মেয়ে। পাগলের মতো তাকে ভালোবাসততা। অতীতকে পেছনে ফেলে নতুন করে তাকে বাঁচতে শিখিয়েছিলো অমূল্য বাবু কিন্তু মেঘলা তার জীবনে না এলে সেটা আদৌ সম্ভব হতো না। সেই মেঘলার সমস্ত স্বপ্ন ভেঙেচুড়ে একাকার করে দিয়েছে বাবলু। এখন সময় এসেছে তার জন্যে কিছু করার। অন্তত তার অপরাধের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত যদি হয় তাতে।
খেয়াল করলো ঢাকা শহরের খুব কাছে এসে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে মাথা থেকে সমস্ত চিন্তা ঝেড়ে ফেললো বাবলু। তাকে এখন দ্রুত কাজে নেমে পড়তে হবে। মেঘলার কাছ থেকে অপহরণকারীদের সম্পর্কে যতোটুকু জানতে পেরেছে তা দিয়েই শুরু করবে। অপ্রতুল হলেও ওইটুকু তথ্য দিয়েই কাজ হবে কারণ তার বাড়তি একটা সুবিধা আছে-আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার মতো তার হাত-পা বাধা নেই। নিজের লক্ষ্য পূরণের জন্য যা যা করা দরকার সবই করতে পারবে।
রাস্তার পাশে বাইকটা থামিয়ে একটু জিরিয়ে নিলো। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। প্রথমে কোথায় যাবে, কিভাবে শুরু করবে ভেবে নিলো আবার। মেঘলার সাথে কথা বলার পর কোনো কিছু না ভেবেই বাইকটা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। সে জানতো দীর্ঘ পথে পরিকল্পনা করার যথেষ্ট সময় পাবে, ছোট্ট দিহানকে বাঁচানোর জন্য খুব বেশি সময় যে তার হাতে নেই।
হ্যাঁ, ঠিক আছে। গভীর করে দম নিয়ে মনে মনে বললো সে। তারপরই বাইকটা নিয়ে ছুটে গেলো পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
অধ্যায় ৯
এহসান চৌধুরি ড্রইংরুমের সোফায় বসে আছে। মাথাটা এলিয়ে দিয়ে সিলিংয়ের দিকে ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে আছে অনেকক্ষণ ধরে। নীরবে অশ্রুপাত করছে সে। বার বার দিহানের মুখটা ভেসে উঠছে আর ভেতর থেকে কান্নার দলা বেরিয়ে আসছে বিনা বাধায়।
তার এত আদরের মেয়েটা এখন একদল কুৎসিত আর জঘন্য লোকজনের হাতে বন্দী। ওরা দিহানের সাথে কেমন ব্যবহার করছে কে জানে। বাবা হিসেবে যে চিন্তাটা কোনোভাবেই ভাবনায় ঠাঁই দিতে চাচ্ছে না সেটাই যেনো বার বার ফিরে আসছে-টাকা দেবার পর দিহানকে ওরা ফেরত দেবে তো?
নীরব অশ্রুপাত এবার ফোপানিতে পরিণত হলো। কিছুক্ষণ এভাবে কেঁদে যাবার পর টের পেলো ফোন বাজছে। দিহান কিডন্যাপ হবার পর থেকেই এই ল্যান্ডফোনটার সামনে বসে থাকে সে। চোখ দুটো মুছে নিয়ে ফোনটা তুলে নিতে যাবে ঠিক তখনই টের পেলো কেউ তার কাঁধে হাত রেখেছে।
“এখন থেকে ওদের সাথে আমি কথা বলবো,” বেশ দৃঢ়তার সাথে বললো তার স্ত্রী আনিকা। এহসান চৌধুরি কিছু বলতে পারলো না। চুপচাপ বসে রইলো সোফায়।
তার স্ত্রী, দিহানের মা ভীষণভাবে মুষড়ে পড়েছিলো মেয়ের অপহরণের পর থেকে, হঠাৎ তার মধ্যে যেনো বিরাট একটা পরিবর্তন এসে গেছে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কান্নাকাটি করা, বার বার তার কাছে ছুটে এসে অবুঝের মতো বলা “আমার দিহানকে এনে দাও! যেভাবে পারো আমার কাছে এনে দাও!”–সবটাই যেনো উধাও হয়ে গেছে এখন।
শান্ত ভঙ্গিতে রিসিভারটা তুলে নিলো আনিকা। “বলুন।”
এহসান চৌধুরি চেয়ে রইলো স্ত্রীর দিকে। যা ভেবেছিলো তাই, অপহরণকারীদের কেউ ফোন করেছে।
“আমি দিহানের মা।”
আনিকা তার স্বামীর দিকে তাকাচ্ছে না। তার দৃষ্টি ড্রইংরুমের বিশাল ফ্রেঞ্চ জানালার ওপাশে ছোট্ট বাগানের দিকে।
“ওর শরীর খুব খারাপ, প্রেসার হাই…ডাক্তার এসে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে গেছে…যা বলার আমাকে বলুন।”
দিহানের বাবা মাথা নীচু করে মেঝের দিকে তাকালো এবার। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। বার বার শুধু মনে হচ্ছে এতো কিছু না ভেবে ওদেরকে মুক্তিপণের টাকা দিয়ে দিলেই বরং ভালো। দেরি করলে বিরাট সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে।
“পুলিশ কেন এসেছে মানে?…আশ্চর্য, আমরা কেন ওদের ডাকবো?…ড্রাইভারের খুনের ব্যাপারে এসেছিলো..”
আনিকার ঝাঁঝালো কণ্ঠ শুনে আবার তাকালো তার দিকে। বাড়িতে যে পুলিশ এসেছিলো সে খবরও জেনে গেছে ঐ বদমাশগুলো! তার মানে বাড়ির আশেপাশে ওদের লোকজন আছে। সর্বনাশ!
“দিহানের বাবা তো বলেছেই, আমরা টাকা জোগার করার চেষ্টা করছি…এক কোটি টাকা কেউ বাড়িতে রাখে না…ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করুন।” কথাটা শেষ করে আনিকা ওপাশ থেকে কিছু শুনে গেলো। “যতো দ্রুত সম্ভব টাকা পেয়ে যাবেন…দয়া করে টাকা নিয়ে তাড়া দেবেন না…”
এহসান চৌধুরির বলতে ইচ্ছে করছিলো, ওদের সাথে এভাবে কথা না বলাই ভালো কিন্তু কিছুই বলতে পারলো না।
“আমি নিজে চেষ্টা করছি কতো দ্রুত টাকাটা দিয়ে দেয়া যায়…ঠিক আছে?” নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো আনিকা। অনেক কষ্টে নিজেকে দৃঢ় রাখতে হচ্ছে। আমার মেয়েকে একটু দিন, কথা বলবো ওর সাথে…কি?…আশ্চর্য, একবার কথা বলেছি বলে আর বলতে পারবো না?…হুম…” ওপাশে থেকে কিছু শোনার পর চোখেমুখে কালো ছায়া নেমে এলো তার। “ঠিক আছে।”
রিসিভার রাখার শব্দে ফিরে তাকালো এহসান চৌধুরি। “দিহানের সাথে কথা বললে না যে?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফায় বসে পড়লো আনিকা। “জানোয়ারটা বলছে ও নাকি অন্য জায়গা থেকে ফোন করেছে…পরে দিহানের সাথে কথা বলিয়ে দেবে।”
“আর কি বললো?”
“এই তো, পুলিশ কেন এসেছিলো, ওরা কি কিডন্যাপের কথা জানতে পেরেছে, এইসব।”
“মনে হচ্ছে আমাদের বাড়ির সামনে ওদের লোকজন আছে,” বললো দিহানের বাবা।
এর কোনো জবাব দিলো না আনিকা। তাকে দেখে মনে হলো কিছু একটা ভাবছে।
“আমার কিছু ভালো লাগছে না। এতো ঝামেলা না করে টাকাগুলো ওদের দিয়ে দিই, কি বলো?”
মাথা দোলালো দিহানের মা। “না।”
স্ত্রীর দৃঢ়তায় আবারো অবাক হলো সে। কোত্থেকে এরকম দৃঢ়তা পেলো এই মেয়েটি, ভেবে পেলো না। একটু আগেও ভীষণভাবে মুষড়ে পড়েছিলো। একেবারে ছেলেমানুষের মতো আচরণ করছিলো সে, অথচ আচমকাই যেনো তার মধ্যে বিরাট পরিবর্তন চলে এসেছে। এতো বছর ধরে সংসার করার পরও নিজের স্ত্রীকে ঠিকমতো চিনতে পারে নি। সাধে কি আর বলে, নারীর মন দেবতারাও বুঝতে পারে না।
“তাহলে এখন কি করবো?”
এবার সরাসরি তাকালো স্বামীর চোখের দিকে। “তুমি কিছু করবে না…যা করার আমি করবো। আর এখন থেকে ওদের সাথে শুধু আমিই কথা বলবো।”
কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ালো, কিছু একটা বলতে গিয়েও বললো না। সোজা চলে গেলো উপরতলায়।
এহসান চৌধুরি স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো হঠাৎ করে বদলে যাওয়া স্ত্রীর দিকে।