০১. গর্বাচভের খোলা হাওয়া

হাজি মুরাদ – লিও তলস্তোয় / অনুবাদ – কাজী জাওয়াদ

অনুবাদকের কথা

আশির দশকের শেষভাগে রাশিয়ায় গর্বাচভের খোলা হাওয়া বইছে। দমকা বাতাসে ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। মধ্য এশীয় প্রজাতন্ত্রগুলো স্বাধীন হয়ে গেল। স্বায়ত্তশাসিত চেচেন-ইশ প্রজাতন্ত্র ভেঙে দুটো হলো! খোদ গর্বাচভ বিদায় নিলেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হলেন বরিস ইয়েলৎসিন।

আমার পালেও নতুন হাওয়া লাগায় পাড়ি জমাতে হলো বিলাতে। যোগ দিলাম বিবিসি বাংলা বিভাগে। তত দিনে নতুন দশক শুরু হয়েছে।

রাশিয়া তখন বিবিসির খবরের প্রধান এক বিষয়। বছর দুয়েক কাটলে চেচনিয়া প্রজাতন্ত্র নিজেরাই নাম নিয়ে নিল চেচেন রিপাবলিক অব ইচকেরিয়া। এক গণভোটে এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন দুদায়েভ। ইয়েলৎসিনের সঙ্গে তার কোনো সম্ভব ছিল না, শত্রুভাব বরং। দুয়ের মধ্যে গালমন্দেরও কমতি নেই। দুদায়েভ একতরফাভাবে নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করলেন। ইয়েলৎসিন ও দুদায়েভের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ থাকার কারণে কোনো রকম সমঝোতা হতে পারেনি। শুরু হলো চেচনিয়ার বিদ্রোহ।

১৯৯৪-৯৫ সালের প্রাথমিক অভিযান শেষে গ্রজনি বিধ্বংসী যুদ্ধে পরাজিত হয়ে রাশিয়ার ফেডারেল বাহিনী চেচনিয়ার পাহাড়ি এলাকায় নিয়ন্ত্রণ জোরদার করার চেষ্টা করেছিল। রাশিয়ার জনশক্তি, অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধের যানবাহন, বিমানঘাঁটি ও বিমানসহায়তার দুর্দান্ত সুবিধা সত্ত্বেও চেচেনদের গেরিলাযুদ্ধ এবং সমতলভূমিতে চোরাগোপ্তা হামলা রুশ আক্রমণ ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে রাশিয়ার জনসাধারণের সর্বজনীন বিরোধিতায় বরিস ইয়েলৎসিনের সরকার চেচেনিয়ার সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে ১৯৯৬ সালে শান্তিচুক্তি করে।

সে যুদ্ধের তীব্রতা বোঝা যাবে পরিসংখ্যান থেকে। রাশিয়ার সামরিক মৃত্যুর সংখ্যা সরকারি হিসাবে ৫ হাজার ৭৩২, অনুমান ১৪ হাজারের বেশি। চেচেন বাহিনীর মৃত ও নিখোঁজের সংখ্যা নিয়ে সঠিক পরিসংখ্যান নেই, তবে বিভিন্ন অনুমানে তা ৩ হাজার থেকে ১৭ হাজার ৪০০ জন। বেসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা বিভিন্ন হিসাবে ৩০ হাজার থেকে ১ লাখ এবং আহতের সংখ্যা ২ লাখ। প্রজাতন্ত্রজুড়ে শহর ও গ্রামগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ায় ৫ লাখের বেশি লোক আশ্রয়হীন হয়েছিল। যুদ্ধের ফলে চেচেন জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।

বিবিসিতে চেচনিয়ার যুদ্ধের খবর পরিবেশন করেছি। চেচেন নেতা দুদায়েভের নেতৃত্বে যুদ্ধরত মুক্তিপিয়াসী মানুষের অদম্য মনোবলের খবর জানতে পেরেছি, মুগ্ধ হয়েছি। জেনেছি শহর ও গ্রামগুলোর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে খুঁড়িয়ে দেওয়া হলেও চেচেনরা যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। নৈকট্য অনুভব করতাম তাদের সঙ্গে।

চেচেনদের ইতিহাস ঘেঁটে হাজি মুরাদের নাম পাই। তলস্তায়ের হাজি মুরাদআমাকে টেনে নেয়। আমাদেরও তো বিদ্রোহের, গেরিলাযুদ্ধের ইতিহাস আছে। তাই তা অনুবাদ করার ইচ্ছা হয়।

ঔপন্যাসিকার শুরুতে দেওয়া থিসল ফুলটির বাংলা নাম বের করার ইচ্ছাও আমাকে পেয়ে বসে। বাংলায় নিশ্চয়ই তেজি গাছ আছে। কিন্তু সংগৃহীত কোনো ছবিতেই তা কাটা গেন্ধালির (নামটি ভুলে গিয়েছিলাম) মতো দেখতে না হওয়ায় কাজটি এগোয়নি। একদিন জুতসই একটি ছবি পেলাম। দুই বোন মোজেজা জহুরা আর ইসরাত জহুরা জানাল আমাদের এলাকায় তার নাম। আমার আলস্যের অজুহাত শেষে অনুবাদের কাজটা করতেই হলো।

ককেশীয় যুদ্ধের পটভূমি

ককেশীয় যুদ্ধ রাশিয়ার তিনটি জার প্রশাসনের সময় সংঘটিত হয়েছিল। প্রথম আলেকজান্ডারের সময় (১৮০১-২৫), প্রথম নিকোলাসের সময় (১৮২৫-৫৫) এবং দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের সময় (১৮৫৫-৮১ সালে)। ১৮১৬-২৭ সালে আলেক্সি পেট্রোভিচ ইয়েরোমোলভ, ১৮৪৪-৫৩ সালে মিখাইল সেমিওনিভিচ ভরন্তসভ এবং ১৮৫৩-৫৬ সালে আলেকজান্ডার বারিতিনস্কি শীর্ষস্থানীয় রুশ সেনাপতি ছিলেন।

লেখক মিখাইল লারমন্টোভ ও লিও তলস্তোয় এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তলস্তোয় তার যুদ্ধ ও শান্তি (ওয়ার অ্যান্ড পিস) উপন্যাসে এই যুদ্ধে পাওয়া অনেক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা শব্দবন্দী করেছিলেন। রুশ কবি আলেকজান্ডার পুশকিন লর্ড বায়রনের কবিতার ধাঁচে লিখিত ককেশাসের বন্দী কবিতায় এই যুদ্ধের উল্লেখ করেছিলেন, ১৮২১ সালে তা লেখা হয়েছিল। সাধারণত ককেশীয় যুদ্ধে সেরা রুশ সৈন্যদের নেওয়া হতো; পাশাপাশি রুশ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী থেকেও তাদের বাছাই করা হতো। তাদের মধ্যে ছিল কসাক, আর্মেনীয়, জর্জীয়, ককেশীয় গ্রিক, ওসেটীয়, এমনকি তাতার, বাশকির ও তুর্কমেনীয়রা। কিছু ককেশীয় মুসলমান উপজাতিও রুশদের পক্ষে ককেশাসের মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়েছিল।

রুশ আক্রমণ ভীষণ প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল। প্রথম দফায় যুদ্ধটি শেষ হয় প্রথম আলেকজান্ডারের মৃত্যু এবং ১৮২৫ সালে ডিসেম্বরপন্থীদের বিদ্রোহের কাকতালীয় কারণে। (ডিসেম্বরপন্থী বিদ্রোহ ২৬ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রথম নিকোলাসের বড় ভাই কনস্ট্যান্টিন উত্তরাধিকারসূত্র থেকে সরে যাওয়ার পর প্রথম নিকোলাসের সিংহাসন দখলের প্রতিবাদে রুশ সেনা কর্মকর্তারা আনুমানিক ৩ হাজার সৈন্য নিয়ে বিদ্রোহ করেন। এই ঘটনা ডিসেম্বর মাসে ঘটেছিল বলে বিদ্রোহীদের ডিসেম্বরপন্থী বলা হতো।) ১৮১২ সালে নেপোলিয়নের গ্রেট আর্মির সঙ্গে যুদ্ধে রাশিয়ার বিজয়ের তুলনায় বিস্ময়করভাবে কম সাফল্য নিয়ে এটা শেষ হয়।

রাশিয়া ১৮২৬-২৮ সালে পারস্যের সঙ্গে এবং ১৮২৮-২৯ সালে তুরস্কের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত থাকে। ফলে ১৮২৫-৩৩ সালের মধ্যে ককেশীয়দের বিরুদ্ধে কোনো সামরিক অভিযান চলেনি। তুরস্ক ও পারস্যের যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য সাফল্যের পর, রাশিয়া উত্তর ককেশাসের স্থানীয় বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ককেশাস যুদ্ধ পুনরায় শুরু করে। রুশ বাহিনী আবারও, বিশেষত গাজি মোল্লা, গামজাতবেক ও হাজি মুরাদের নেতৃত্বাধীন বাহিনীগুলোর প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। ইমাম শামিল তাদের অনুসরণ করেন। তিনি ১৮৫৯ সালে দমিত্রি মিলেউতিনের হাতে বন্দী না হওয়া পর্যন্ত ১৮৩৪ সাল থেকে পাহাড়িদের নেতৃত্ব দেন। ১৮৪৩ সালে শামিল আভারিয়ায় রুশ সীমান্ত ফাঁড়িগুলোর ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালান। ২৮ আগস্ট উসুকুলে ১০ হাজার সৈন্য নিয়ে তিন দিক থেকে রুশ বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে ৪৮৬ জনকে হত্যা করেন। পরবর্তী চার সপ্তাহের মধ্যে শামিল আভারিয়ার একটি বাদে সব রুশ সীমান্ত ফাঁড়ি দখল করেন এবং ২ হাজারের বেশি রুশ রক্ষীকে হত্যা করেন। ১৮৪৫ সালে তিনি রাশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ফাড়ি দখলের জন্য আভার ও কাজি-কুমুখ নদীর মিলনস্থলে উত্তর অভিযান চালান। শামিলের বাহিনী সবচেয়ে নাটকীয় সাফল্য অর্জন করেছিল প্রিন্স ভরসভের বিশাল রুশ আক্রমণ ঠেকিয়ে দিয়ে।

১৮৫৩-৫৬ সালে ক্রাইমিয়ার যুদ্ধের সময় রুশরা শামিলের সঙ্গে একটি সমঝোতা করেছিল, কিন্তু ১৮৫৫ সালে তা ভেস্তে যায়। ককেশাসের যুদ্ধ শেষ হয় ১৮৫৬ থেকে ১৮৫৯ সালের মধ্যে, জেনারেল বারিয়াতিনস্কির অধীনে ২ লাখ ৫০ হাজার সৈন্যের বাহিনী ককেশীয়দের প্রতিরোধ ভেঙে দেওয়ার পর।

উত্তর ককেশাসের পূর্ব অংশে যুদ্ধ ১৮৫৯ সালে শেষ হয়। রুশরা শামিলকে ধরে নিয়ে তাঁকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেছিল। জারের প্রতি আনুগত্যে বাধ্য করে তাকে কেন্দ্রীয় রাশিয়ায় নির্বাসিত করা হয়।

যাহোক, সির্কাসীয়রা (মূলত ভৌগোলিক বা ভাষাগতভাবে আদিগে, তবে আবখাজ-আবাজাদেরও এদের সঙ্গে যুক্ত করা হয়) উত্তর-পশ্চিম ককেশীয় জাতিগোষ্ঠী। তারা উত্তর ককেশাসের পশ্চিমাঞ্চলের যুদ্ধ পুনরায় শুরু করে। ১৮৬৪ সালের মে/জুনে দ্বিতীয় আলেকজান্ডার যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন। যুদ্ধোত্তর ঘটনাগুলোর মধ্যে উত্তর ককেশীয়দের ইতিহাসের বিয়োগান্ত পরিণতি হলো (বিশেষ করে সির্কাসীয়দের) মুহাজিরবাদ অথবা মুসলিম জনসংখ্যার অটোমান সাম্রাজ্যে স্থানান্তর।

কাজী জাওয়াদ
বার্মিংহাম, যুক্তরাজ্য
নভেম্বর ২০১৯

বাড়ি ফিরছিলাম খেতের ভেতর দিয়ে। তখন গ্রীষ্মের মাঝামাঝি; খড় কাটা শেষ হয়ে গেছে, শুরু হয়েছে রবিশস্য বোনা। বছরের এই সময়টায় অনেক রকম সুন্দর ফুল ফোটে। যেমন লাল, সাদা বা গোলাপি রঙের সুগন্ধি গোছার ক্লোভার। ঝাঁজালো মিষ্টি গন্ধের দুধসাদা বুনো চন্দ্রমল্লিকা, এই ফুলগুলোর বুকে থাকে উজ্জ্বল হলুদ ফোঁটা। মধুগন্ধি রাইসরিষার হলুদ ফুল। লম্বা উঁটার ঘণ্টাকর্ণ, যার নাম সাদা আর লালচে বেগুনি টিউলিপ আকারের ঝুমকা থেকে। আরও ফোটে কলাইয়ের ফুল; হলুদ, লাল ও গোলাপি খোঁচা খোঁচা বোতাম ফুল; হালকা ঘ্রাণের কাষ্ঠকদলী, যার সামান্য গোলাপি আভার বেগুনি পাপড়ি পরিপাটি করে সাজানো। ফোটে যব ফুলের কলি, ভোরের সূর্যে এগুলোর রং উজ্জ্বল নীল, সাঁঝের দিকে বা একটু বড় হলে যা ফিকে ও লাল হয়ে আসে। আর ফোটে কোমল ক্ষণস্থায়ী স্বর্ণলতা ফুল, গন্ধ যার বাদামের মতো। এই সব বিভিন্ন ফুল দিয়ে একটি হোড়া বানিয়ে বাড়ি রওনা হয়েছি, ঠিক তখনই একটা খাদের মধ্যে দেখলাম টকটকে লাল জাতের পুরো ফোঁটা চমৎকার একটা কাটা গেন্ধালির গোছা, আমাদের এলাকায় এই ফুলের নাম তাতার এবং ফসল বা ঘাস কাটার সময় সবাই খুব সাবধানে এটা এড়িয়ে যায় কিংবা কোনোভাবে কাটা পড়ে গেলে দূরে ফেলে দেয়, যেন হাতে কাটা না বেঁধে। ভাবছিলাম কাটা গেন্ধালিটা আমার হোড়াটার ঠিক মাঝখানে বসিয়ে দেব কি না। তাই খাদের নিচে নামলাম। গোছার একটা ফুলের গভীরে ঢুকে মিষ্টি করে ঘুমিয়ে পড়া মখমলের মতো একটা ভ্রমরকে সরিয়ে ফুলটা তুলতে গেলাম। কিন্তু দেখা গেল কাজটা খুব কঠিন। আমার হাতে একটা রুমাল জড়িয়ে নেওয়া সত্ত্বেও বোটার কাঁটা ফুটল সবদিকে। তার ওপর বোটাটা এত শক্ত যে ওটার আঁশগুলো একটা একটা করে ছিঁড়তে আমার মিনিট পাঁচেক লেগে গেল। ছেঁড়া শেষ হতে দেখলাম বোটাটা পিষে গেছে আর ফুলটাও যেন আগের মতো তাজা আর সুন্দর নেই। আবার ফুলটা শক্ত আর খসখসে হওয়ায় আমার তোড়ার অন্য কোমল ফুলগুলোর সঙ্গে যেন মানাচ্ছিল না। বন্যেরা বনে মানে গাছেই ফুলটা অত্যন্ত সুন্দর। ওটা তোলার বৃথা চেষ্টায় ফুলটা নষ্ট করে ফেলেছি। আমার খুব খারাপ লাগল এবং আমি ওটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম।

কী শক্তি আর নিষ্ঠা! কী রকম সংকল্প নিয়ে সে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছে এবং নিজের জীবন সে কত চড়া দামে বিকিয়েছে! ফুলটি তুলতে আমার যা কষ্ট হয়েছে, সেটা মনে করে আমি নিজে নিজে ভাবছিলাম। বাড়ি যাওয়ার পথটি যে কালো মাটির খেতের ভেতর দিয়ে গেছে, তা কেবল চাষ দিয়ে ওলটানো হয়েছে। আমি ধুলোর পথে উঠলাম। চষা খেতটা একজন জমিদারের এবং এত বড় যে পাশের দুই দিকে এবং আমার সামনে পাহাড়টার চূড়া পর্যন্ত হাল দিয়ে কাটা সীতা আর ভেজা মাটি ছাড়া অন্য কিছু দেখা যাচ্ছিল না। জমিটা খুব ভালো করে চষা হয়েছে, কোথাও একটা ঘাসের পাতা বা অন্য কোনো আগাছা চোখে পড়ে না; পুরোটাই কালো। আহ, মানুষ যে কী ধ্বংসাত্মক প্রাণী… নিজে বাঁচার জন্য কত ধরনের গাছগাছালির জীবন সে ধ্বংস করে! অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রাণহীন ওই কালো

জমিটায় জীবিত কোনো কিছুর খোঁজে চারদিকে দেখতে দেখতে আমি ভাবছি। আমার সামনে, রাস্তার ডান দিকে একটা ঝোঁপ দেখতে পেলাম, কাছে গিয়ে দেখি আমি যে জাতের কাটা গেন্ধালি ছেঁড়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছি, সেগুলোই। এই তাতার গাছটিতে তিনটি উঁটা। তার একটা কাটা হাতের মতো মুড়ে পড়ে আছে। বাকি দুটোয় একটা করে ফুল, আগে লাল ছিল কিন্তু এখন কালো হয়ে গেছে। একটা মাঝবরাবর ভেঙে ঝুলে আছে, সেটার ফুলে মাটি লেপ্টে গেছে। অন্য ডালটা কালো মাটিতে লেপে গেলেও খাড়া দাঁড়িয়ে আছে। বোঝাই যায় কোনো এক্কা গাড়ির চাকা গাছটাকে মাড়িয়ে গেছে, কিন্তু তারপর ওটা আবার দাঁড়িয়েছে। তাই সোজা হয়ে উঠলেও একদিকে মোচড়ানো, যেন এর গা থেকে এক খাবলা মাংস ছিঁড়ে নেওয়ায় এর ভুড়ি বের হয়ে গেছে আর এর একটা চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে; তারপরও এটা অটলভাবে দাঁড়িয়ে এবং হার মানেনি মানুষের কাছে, যারা গাছটির চারপাশের অন্য সব ভাইকে শেষ করে দিয়েছে…

কী তেজ! আমি ভাবলাম। মানুষ সবকিছু জয় করেছে এবং হাজার হাজার গাছ ধ্বংস করেছে, তারপরও এটা বশ্যতা স্বীকার করবে না। আমার মনে পড়ল বেশ কয়েক বছর আগের একটি ককেশীয় কাহিনি, যার কিছুটা আমি নিজে দেখেছি, কিছুটা চাক্ষুষদর্শীদের কাছে শুনেছি এবং বাকিটা আমার কল্পনা।

সে কাহিনি আমার স্মৃতি ও কল্পনায় যেভাবে এসেছে, তা-ই নিচে দেওয়া ঘটনাটা ঘটেছিল ১৮৫১ সালের শেষ দিকে।

নভেম্বরের শীতে এক সন্ধ্যায় হাজি মুরাদ খুঁটে পোড়ার গন্ধে ভরা বৈরী চেচেন গ্রাম মাখকেতের ভেতর দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিলেন। গ্রামটি রাশিয়ার সীমা থেকে মাইল পনেরো দূরে। মুয়াজ্জিনের আজান কেবল শেষ হয়েছে। (মৌচাকের কোষগুলোর মতো সাজানো) মাটির ঘরগুলোয় ফিরে আসা গরুর অনুচ্চ হাম্বা এবং ভেড়ার ভ্যা ভ্যা আওয়াজ। সে শব্দ ছাপিয়ে খুঁটের ধোঁয়ায় মিশেল খাওয়া পরিষ্কার পাহাড়ি বাতাসে ভেসে আসা পুরুষদের চাপা গলায় তর্ক এবং কাছে নিচের ঝরনা থেকে মহিলা ও শিশুদের কথাবার্তা তিনি পরিষ্কার শুনতে পেলেন।

হাজি মুরাদ ছিলেন শামিলের নায়েব, নিজের কীর্তিকলাপের জন্য বিখ্যাত। কখনো নিজের ঝান্ডা ছাড়া ঘোড়ায় চড়েননি। সব সময় তার সঙ্গে কয়েক ডজন মুরিদ থাকত, যারা তার আগে আগে ঘোড়া কোনাকুনি করে চলত। এখন যতটা সম্ভব নজর এড়ানোর চেষ্টায় লম্বা চাদর মুড়ি দিয়ে মাত্র একজন মুরিদ নিয়ে তিনি পালাচ্ছেন, তার চাদরের নিচ দিয়ে একটা রাইফেলের নল বের হয়ে আছে আর তার কালো চোখের দৃষ্টি পথে দেখা লোকদের মুখ ভেদ করে গেছে।

গ্রামটিতে ঢোকার সময় যে রাস্তা গ্রামের খোলা চত্বরে নিয়ে যায়, হাজি মুরাদ সেটায় যাননি, বামে ঘুরে একটা চাপা গলি ধরলেন; পাহাড়ের ঢালে কাটা দ্বিতীয় মাটির কুঁড়েটার কাছে গিয়ে থেমে এবং চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন। সামনের বারান্দাটায় কেউ ছিল না; কুঁড়েঘরটার চালে সদ্য লেপা মাটির চিমনিটার পেছনে একটা লোক ভেড়ার চামড়ায় বানানো গরম কাপড় গায়ে শুয়ে ছিল। হাজি মুরাদ তার চামড়ায় মোড়া চাবুকটার হাতল দিয়ে লোকটাকে স্পর্শ করলেন এবং জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করলেন। নিচ থেকে একটা বুড়ো লোক বের হয়ে এল, তার গায়ে তেলচিটে পুরান বেশমেত (ককেশীয় অঞ্চলে ব্যবহৃত কাফতান-জাতীয় পোশাক আর মাথায় ঘুমানোর টুপি। তার ভেজা লাল চোখের পাতায় কোনো পাপড়ি ছিল না, সেগুলোর জোড়া ছাড়ানোর জন্য সে পিটপিট করল। হাজি মুরাদ আসোলামু আলাইকুম বলে তার মুখের চাদর সরালেন। ওয়ালাইকুম আসোলাম বলল বুড়ো লোকটি। হাজি মুরাদকে চিনতে পেরে সে হাসল ফোকলা মুখে; তার পাতলা পা দুটোয় ভর করে উঠে সে চিমনির পাশে রাখা কাঠের খড়মে পা দুটো গলাতে শুরু করল। তারপর অলসভাবে তার ভেড়ার চামড়ার দোমড়ানো গরম কাপড়টিতে হাত ঢুকিয়ে দিল, চালের সঙ্গে ঠেস দেওয়া মইটার কাছে গিয়ে সে পেছন ফিরে নেমে এল। কাপড় পরা এবং নেমে আসার সময় তার রোদে পোড়া কোঁচকানো চিকন ঘাড়ের ওপর মাথাটা সে নাড়াচ্ছিল আর ফোকলা মুখে বিড়বিড় করছিল। মাটিতে নেমেই সে হাজি মুরাদকে সাদরে নামানোর জন্য তার ঘোড়ার লাগাম এবং ডান দিকের পাদানিতে হাত দিল; কিন্তু হাজি মুরাদের সঙ্গী করিতকর্মা জোয়ান মুরিদটি লাফ দিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে বুড়োকে ইশারায় এক পাশে সরিয়ে দিয়ে নিজে তার জায়গা নিল। হাজি মুরাদও নেমে একটু খুঁড়িয়ে হেঁটে বারান্দার নিচে বসলেন। ঘরের দরজা দিয়ে বছর পনেরোর একটি ছেলে তাড়াতাড়ি বের হয়ে বঁইচির মতো কালো স্থির চোখে অতিথিদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।

হাজি মুরাদের জন্য ক্যাঁচক্যাঁচে পাতলা দরজাটা খুলতে খুলতে বুড়ো লোকটি ছেলেটাকে হুকুম করল, দৌড়ে মসজিদে গিয়ে তোর বাবাকে ডেকে নিয়ে আয়।

বাইরের দরজা দিয়ে ঢুকতেই হাজি মুরাদ দেখলেন, লাল বেশমেতের ওপর ঘন কুঁচি দেওয়া জামা এবং চওড়া নীল পায়জামা পরা হালকা-পাতলা গড়নের এক মধ্যবয়সী মহিলা ভেতরের দরজা দিয়ে বের হয়ে আসছে, হাতে তার কয়েকটি তাকিয়া।

আপনার আগমন আমাদের জন্য সুখ নিয়ে আসুক! বলে সে শরীরটা ধনুকের মতো বাকিয়ে নিচু হয়ে অতিথির বসার জন্য সামনের দিকের দেয়ালে ঠেস দিয়ে তাকিয়াগুলো সাজাতে লাগল।

চাদর, রাইফেল ও তলোয়ার খুলে বুড়োর হাতে দিতে দিতে হাজি মুরাদ জবাব দিলেন, আপনার ছেলেরা দীর্ঘজীবী হোক! ঘরটির দেয়াল মাটির আস্তর দেওয়া এবং সাবধানে চুনকাম করা। বুড়ো পরিষ্কার দেয়ালে ঝোলানো দুটো চকচকে বড় গামলার মাঝখানে বাড়ির কর্তার অস্ত্রগুলোর পাশের একটি পেরেকে রাইফেল ও তলোয়ারটি সাবধানে ঝুলিয়ে রাখল।

হাজি মুরাদ তার পিঠের পিস্তলটি নাড়িয়ে ঠিক করে তাকিয়াগুলোর কাছে এসে তার চাপকানটি ভালো করে গায়ে জড়িয়ে বসে পড়লেন। বুড়ো খোলা গোড়ালি নিয়ে উবু হয়ে বসে চোখ বন্ধ করে হাত দুটো তুলল মোনাজাতের ভঙ্গিতে। হাজি মুরাদও তাই করলেন। তারপর আবার দোয়া করে দুজনেই হাতের তালু মুখে লাগিয়ে ধীরে ধীরে নামিয়ে দাড়ির শেষ প্রান্তে দুহাত মেলালেন।

নতুন কোনো খবর আছে? বুড়ো লোকটাকে জিজ্ঞেস করলেন হাজি মুরাদ।

না, নতুন কিছু নেই, তার নিষ্প্রাণ চোখ দুটো দিয়ে হাজি মুরাদের মুখের দিকে নয়, বুকের দিকে তাকিয়ে জবাব দিল বুড়ো। আমি মৌমাছির খামারে থাকি এবং আজই শুধু ছেলেকে দেখার জন্য এসেছি…সে জানে।

হাজি মুরাদ বুঝতে পারলেন, বুড়ো যা জানে এবং হাজি মুরাদ যা জানতে চান, তা বলতে চাচ্ছে না, তাই আলতো করে মাথা নাড়িয়ে তাকে। আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না।

কোনো ভালো খবর নেই, বলল বুড়ো। একটাই খবর হলো খরগোশগুলো আলোচনা করছে ইগলগুলোকে কীভাবে তাড়ানো যায়; আর ইগলগুলো প্রথমে একটাকে ছিঁড়ে খায়, তারপর তাদের আরেকটাকে। আরেক দিন রাশিয়ার কুকুরগুলো মিচিত গ্রামে খড়ে আগুন দিয়েছে…ওদের মুখগুলো পুড়ুক! রেগে কর্কশ গলায় সে বলল।

মাটির মেঝেয় আস্তে তার সবল পা ফেলে হাজি মুরাদের মুরিদ ঘরে ঢুকল, তার ছোরা আর পিস্তলটা রেখে চাদর, রাইফেল আর তলোয়ার খুলে হাজি মুরাদের অস্ত্রগুলো যে পেরেকে লটকানো ছিল, সেটাতেই ঝুলিয়ে দিল।

নবাগতের দিকে দেখিয়ে বুড়ো জিজ্ঞেস করল, এ কে?

আমার মুরিদ। নাম এলডার, জবাব দিলেন হাজি মুরাদ।

খুব ভালো, এই কথা বলে বুড়ো তাকে হাজি মুরাদের পাশে একটুকরো কম্বলে বসার ইশারা করল। এলডার আসন করে বসে তার ভেড়ার চোখের মতো সুন্দর চোখ দিয়ে ততক্ষণে কথা বলতে শুরু করা বুড়োর দিকে তাকিয়ে থাকল। বুড়ো বলছিল কী করে তাদের সাহসী বন্ধুরা আগের সপ্তাহে দুজন রুশ সেনাকে ধরে ফেলে এবং একজনকে মেরে ফেলে আর অন্যজনকে ভেদেনোয় শামিলের কাছে পাঠিয়ে দেয়।

হাজি মুরাদ তার কথা মন দিয়ে শুনছিলেন না, বাইরে কিছু আওয়াজ পেয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বারান্দায় পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল, দরজাটা ক্যাচ কাঁচ করে উঠল আর ঘরে ঢুকল বাড়ির কর্তা সাদো। তার বয়স প্রায় চল্লিশ, অল্প দাড়ি, খাড়া নাক এবং তাকে বাড়িতে ডেকে আনতে তার পনেরো বছরের যে ছেলেটি গিয়েছিল, তার মতোই কালো চোখ, তবে তত উজ্জ্বল নয়, ছেলেটিও বাবার সঙ্গে ঘরে ঢুকে বসল দরজার পাশে। বাড়ির কর্তা তার খড়ম খুলে রেখেছে চৌকাঠের কাছে, তারপর তার পুরোনো অসংখ্যবার পরা টুপিটা মাথার পেছন দিকে ঠেলে দিয়ে (অনেক দিন কামানো হয়নি বলে মাথার কালো চুল বড় হয়ে গেছে) হুট করে উবু হয়ে বসল হাজি মুরাদের সামনে।

বুড়োর মতো করে মোনাজাতের ভঙ্গিতে হাত উঠিয়ে দোয়া পড়ে সে-ও হাত দুটো মুখের ওপর থেকে দাড়ির প্রান্ত পর্যন্ত নামিয়ে আনল। দোয়া পড়া শেষ হলেই কেবল সে কথা বলতে শুরু করল। সে বলল কেমন করে শামিলের কাছ থেকে হাজি মুরাদকে জীবিত বা মৃত ধরার আদেশ এসেছে; শামিলের চরেরা আগের দিনই ঘুরে গেছে, লোকেরা শামিলের অবাধ্য হতে ভয় পাচ্ছে এবং তাই সাবধান হওয়া দরকার।

আমার বাড়িতে, সাদো বলল, আমি জীবিত থাকতে কেউ আমার অতিথির কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু ভোলা মাঠে কী হবে?…আমাদের এটা ভাবতে হবে।

হাজি মুরাদ খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন আর মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছিলেন। সাদোর কথা শেষ হলে তিনি বললেন, বেশ, আমরা তাহলে একটা লোককে দিয়ে রুশদের কাছে একটা চিঠি পাঠাব। আমার মুরিদ যাবে, কিন্তু তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একজন লোক লাগবে।

আমি বাটা ভাইকে দিয়ে দেব, সাদো বলল। তারপর মুখ ঘুরিয়ে ছেলেকে বলল, যা তো, বাটাকে ডেকে নিয়ে আয়।

ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল যেন তার পায়ে স্প্রিং লাগানো, তারপর হাত দুলিয়ে ছুটে কুঁড়ে থেকে বের হয়ে গেল। মিনিট দশেক পর সে ফিরে এল একজন খাটো পায়ের পেশিবহুল চেচেনকে সঙ্গে নিয়ে, রোদে পুড়ে তার শরীর প্রায় কালো, গায়ে পুরোনো টুটাফাটা হলুদ চাপকান, যার হাতার কিছু অংশ খসে পড়েছে, আর পরনে দলামোচড়া কালো আঁটসাঁট পাতলুন।

হাজি মুরাদ আগতকে সালাম দিলেন এবং আর একটা কথাও না বলে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি আমার মুরিদকে রুশদের কাছে নিয়ে যেতে পারবে?

আমি পারব, সোৎসাহে উত্তর দিল বাটা। আমি নিশ্চয়ই পারব। আর কোনো চেচেন নেই যে আমার মতো পার হতে পারবে। অন্য কেউ হয়তো যেতে রাজি হবে, যে কোনো ওয়াদা করবে কিন্তু কাজ কিছুই পারবে না; আমিই করতে পারব!

ঠিক আছে, হাজি মুরাদ বললেন। তিনটি আঙুল দেখিয়ে তিনি বললেন, তোমার কষ্টের জন্য তিন রুবল পাবে।

বাটা মাথা নাড়িয়ে জানাল সে বুঝতে পেরেছে এবং বলল যে সে টাকার জন্য লোভী নয়, কাজটা সে করছে শুধু হাজি মুরাদের কাজ করতে পারার সম্মানের জন্য। পাহাড়ের সবাই হাজি মুরাদ সম্বন্ধে জানত এবং জানত সে কীভাবে রুশ শুয়োরকে জবাই করেছে।

ঠিক আছে…দাড়ি লম্বা আর কথা খাটো হওয়া উচিত, বললেন হাজি মুরাদ।

বাটা বলল, ঠিক আছে, আমি তাহলে চুপ করলাম।

খাড়া পাহাড়ের কাছে আরগুন নদী যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেখানে বনের ফাঁকা জায়গাটায় দুটো চাই আছে, তুমি চেনো? হাজি মুরাদ জিজ্ঞেস করলেন।

হ্যাঁ, চিনি।

সেখানে চারজন ঘোড়সওয়ার আমার জন্য অপেক্ষা করছে, বললেন হাজি মুরাদ।

হ্যাঁ, মাথা নাড়িয়ে জবাব দিল বাটা।

সেখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে খান মাহোমা কে? সে জানে কী করতে হবে আর কী বলতে হবে। তুমি তাকে রুশ সেনাপতি প্রিন্স ভরসভের কাছে নিয়ে যেতে পারবে না?

আমি তাকে নিয়ে যাব। তাকে নিয়ে যাবে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। পারবে?

পারব।

তাকে নিয়ে যাও আর বনের মধ্যে ফিরিয়ে নিয়ে এসো। আমিও সেখানে অপেক্ষা করতে থাকব।

আমি তা-ই করব, উঠতে উঠতে বলল বাটা আর বুকের ওপর তার হাত দুটো রেখে বের হয়ে গেল।

বাটা চলে যাওয়ার পর হাজি মুরাদ ফিরলেন গৃহকর্তার দিকে।

একটা লোককে চেখিতেও পাঠাতে হবে, তিনি বলতে শুরু করলেন এবং তার চাপকানের গুলির থলেগুলোর একটা হাতে নিতেই দুজন মহিলাকে ঘরে ঢুকতে দেখে সঙ্গে সঙ্গেই তা রেখে দিলেন।

তাদের একজন সাদোর স্ত্রী–পাতলা গড়নের মধ্যবয়সী যে মহিলা আগে হাজি মুরাদের জন্য তাকিয়া সাজিয়ে দিয়েছিল। অন্য মেয়েটি অল্প বয়সী, লাল পায়জামা আর একটা সবুজ বেশমেত পরেছে। রুপোর টাকার একটা মালা তার পোশাকের সামনের দিকের পুরোটাই ঢেকে রেখেছে। তার ঘন কালো চুলের বেণিটা লম্বা না হলেও বেশ মোটা তার কাঁধের পাতলা হাড়ের ফলক দুটোর মাঝখানে বেণির শেষ প্রান্তে একটা রুপোর রুবল ঝুলছে। বাবা ও ভাইয়ের চোখের মতো তার চোখ দুটোও বঁইচি ফলের মতো কালো। তার কচি মুখে জ্বলজ্বল করছে আর মুখটা চেষ্টা করছে বড়দের মতো শক্ত হতে। সে অতিথিদের দিকে তাকায়নি কিন্তু তাদের উপস্থিতি ঠিকই বুঝতে পারছিল।

সাদোর স্ত্রী একটা নিচু গোলটেবিল নিয়ে এল, যেটার ওপরে চা, মাখনে ভাজা পিঠা, পনির, রুমালি রুটি আর মধু। মেয়েটি নিয়ে এসেছে একটা গামলা, একটা বদনা আর একটা তোয়ালে।

পয়সার গয়নাগুলোয় টুংটাং শব্দ তুলে মেয়েরা যতক্ষণ অতিথিদের জন্য আনা জিনিসগুলো সাজিয়ে সামনে দিতে পাতলা চটি পরা নরম পায়ে চলাফেরা করছিল, সাদো আর হাজি মুরাদ ততক্ষণ নীরব ছিলেন। ভেড়ার চোখের মতো চোখ দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে ভাঁজ করা পা দুটোর দিকে তাকিয়ে মূর্তির মতো বসে ছিল এলডার, মেয়েরা ঘরের মধ্যে থাকার পুরো সময়টায়। তারা চলে যাওয়ার পর তাদের হালকা পায়ের আওয়াজ দরজার পেছন থেকে যখন আর শোনা যাচ্ছিল না, কেবল তখন সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।

হাজি মুরাদ চাপকানের একটা গুলির থলেতে আটকে যাওয়া একটা গুলি বের করে ওটার নিচ থেকে একটা পাকানো নোটও বের করে আনলেন। নোটটা বাড়িয়ে ধরে বললেন, আমার ছেলেকে এটা দিতে হবে।

পৌঁছে সংবাদ কাকে দিতে বলব?

তোমাকে, আর তুমি জানিয়ে দেবে আমাকে।

এটা করা হবে, বলে সাদো নোটটা তার নিজের কোটের একটা গুলির পকেটে রাখল। তারপর পিতলের বদনাটা হাতে নিয়ে গামলাটা হাজি মুরাদের দিকে এগিয়ে দিল।

হাজি মুরাদ তার সাদা পেশিবহুল হাতের ওপর থেকে বেশমেতের আস্তিন একটু গুটিয়ে সাদোর বদনা থেকে ঢালা পরিষ্কার ঠান্ডা পানির নিচে হাতটা বাড়িয়ে ধরলেন। আনকোরা ভোয়ালেতে হাত মুছে হাজি মুরাদ ঘুরে বসলেন টেবিলটার দিকে। এলডারও একই কাজ করল। অতিথিদের খাওয়ার সময় মুখোমুখি বসে তাদের আগমনের জন্য বেশ কয়েকবার ধন্যবাদ জানাল সাদো। দরজার পাশেই তার জ্বলজ্বলে চোখ দিয়ে হাজি মুরাদের মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে বসে থাকা সাদোর ছেলেটি একটু মুচকি হাসল যেন বাবার কথাতেই সায় দিতে।

গত চব্বিশ ঘণ্টার বেশি সময়ে হাজি মুরাদ কিছুই না খেলেও এখন সামান্য একটু রুটি আর পনির খেলেন। তারপর তার ছোরার খাপ থেকে ছোট্ট একটা ছুরি বের করে তা দিয়ে রুটির টুকরোয় একটু মধু মাখালেন।

আমাদের মধু ভালো, হাজি মুরাদকে মধু খেতে দেখে খুশি হয়ে বুড়ো বলল। এবার অন্য সব বছরের চেয়ে অনেক বেশি আর ভালো হয়েছে।

আপনাকে ধন্যবাদ, বলে হাজি মুরাদ টেবিল থেকে সরে বসলেন। এলডার আরও খেতে চেয়েছিল, কিন্তু সে তার নেতার অনুসরণ করল এবং টেবিল থেকে সরে বদনা আর গামলাটা এগিয়ে দিল হাজি মুরাদের দিকে।

সাদো জানত সে তার জীবনের ঝুঁকি নিয়েছে হাজি মুরাদকে বাড়িতে বসিয়ে। কারণ, তার সঙ্গে দ্বন্দ্বের পর শামিল চেচনিয়ার সব বাসিন্দার ওপর হুকুম দিয়েছে হাজি মুরাদকে আশ্রয় দিলে তাদের মরতে হবে। সে জানত, গ্রামবাসী যেকোনো মুহূর্তে তার বাড়িতে হাজি মুরাদের উপস্থিতি টের পেয়ে যেতে পারে এবং তাকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি করতে পারে। এটাতে সে কেবল ভয়ই পায়নি, কিছুটা মজাও পেয়েছিল। সে ভাবছিল, জীবন দিয়ে হলেও অতিথিকে রক্ষা করা তার কর্তব্য এবং তার কর্তব্য করতে পারার জন্য সে গর্ববোধ করছিল আর নিজের ওপর খুশি ছিল।

আমার ঘাড়ের ওপর মাথাটা যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ কেউ আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, সে আবার বলল হাজি মুরাদকে।

হাজি মুরাদ সাদোর চকচকে চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন সে সত্যি বলছে, তারপর দোয়া করার মতো বললেন, তুমি দীর্ঘজীবী আর সুখী হও!

এ ধরনের কথায় খুশি হয়ে সাদো নীরবে তার হাত বুকের ওপর রাখল।

কুঁড়ের দরজা বন্ধ করে আগুনে কিছু খড়ি দিয়ে সাদো অত্যন্ত খুশিমনে ঘর থেকে কুঁড়ের যেদিকটায় তার পরিবারের সবাই থাকে, সেদিকে চলে গেল। মেয়েরা তখনো ঘুমায়নি এবং তাদের মেহমানখানায় রাত কাটানো বিপজ্জনক অতিথিদের সম্বন্ধে কথা বলছিল।

হাজি মুরাদ যে গ্রামে রাত কাটাচ্ছিলেন, সেখান থেকে পনেরো ভাস্ত (দৈর্ঘ্যের রুশ মাপ, এক মাইল প্রায় দেড় ভাস্তের সমান) দূরে সীমান্তের দুর্গ ভজভিঝেনস্ক। দুর্গ থেকে শাহগিরনস্কি ফটক দিয়ে তিনজন সৈন্য ও একজন এনসিও (ননকমিশন্ড অফিসার) কুচকাওয়াজ করে বের হয়ে এল। ককেশাসে রুশ সৈন্যদের তখনকার পোশাক ছিল উরু পর্যন্ত লম্বা ভেড়ার চামড়ার কোট, ফারের টুপি এবং হাঁটু অবধি লম্বা বুট। চারজনের দলটির সবার পরনে তেমন পোশাক আর পিঠে ঝোলানো ভাঁজ করা পশমি আলখাল্লা। অস্ত্র কাঁধে নিয়ে সৈন্যরা প্রথমে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলল। তারপর প্রায় ৫০০ কদম গিয়ে ঘুরল। ডান দিকে গেল প্রায় ২০ কদম তাদের বুট দিয়ে শুকনা পাতায় মচমচ শব্দ করে। তারা থামল সেখানে পড়ে থাকা একটা চিনার গাছের গুঁড়ির কাছে। গুঁড়িটা এত কালো যে অন্ধকারেও ওটাকে দেখা যাচ্ছিল। এই চিনারের গুঁড়িটা তাদের ওত পেতে থাকার জায়গা।

সৈন্যরা বনের মধ্য দিয়ে হেঁটে আসার সময় গাছগুলোর ওপর দিয়ে উজ্জ্বল তারাগুলোও তাদের সঙ্গে আসছিল বলে মনে হচ্ছিল। সেগুলো এখন স্থির, পাতাহীন ডালগুলোর মধ্য দিয়ে জ্বলজ্বল করছিল।

ভাগ্য ভালো যে এটা শুকনা, সার্জেন্ট পানভ বলল, তারপর কাধ থেকে খটাং করে রাইফেল আর বেয়নেটটা নামিয়ে চিনারের গুঁড়িটায় ঠেস দিয়ে রাখল। সৈন্য তিনটিও একই কাজ করল।

নিশ্চয়ই আমি ওটা হারিয়েছি! খেঁকিয়ে বিড়বিড় করল পানভ। নিশ্চয়ই রেখে এসেছি, নাহয় পথে কোথাও পড়ে গেছে।

কী খুঁজছ? উৎসুক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল একজন সৈন্য।

আমার পাইপের বোলটা। শয়তানটা যে কোথায় গেল?

নলটা কি তোমার কাছে আছে? জিজ্ঞেস করল সৈন্যটা।

এই তো নলটা।

তাহলে এটা সোজা মাটিতে পুঁতে ফেলছ না কেন?

ওটার দরকার নেই!

দাঁড়াও, এক মিনিটের মধ্যে ব্যবস্থা করে ফেলব।

ওত পাতার সময় ধূমপান নিষেধ, কিন্তু এটা নামেই ওত পাতা। বরং এটাকে বলা যায় পাহারাচৌকি। আগে পাহাড়িরা লুকিয়ে কামান নিয়ে এসে দুর্গের দিকে গোলা ছুড়ত। সেটা যাতে করতে না পারে, সে জন্য এই পাহারার ব্যবস্থা। পানভ ধূমপানের আনন্দ বাদ দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি, তাই উৎসাহী সৈন্যটার প্রস্তাব মেনে নিয়েছিল। সৈন্যটা তার পকেট থেকে একটা ছুরি বের করে মাটিতে একটা গর্ত খুঁড়ল। ওটার চারদিক সমান করে পাইপের নলটা তার মধ্যে লাগিয়ে দিল, তারপর সে গর্তটা তামাক দিয়ে ভরে চেপে দিল; তৈরি হয়ে গেল পাইপ। গন্ধকের দেশলাই মুহূর্তের জন্য জ্বলে মাটিতে উবু হয়ে শুয়ে পড়া সৈন্যটির চওড়া চোয়ালে আলো ফেলল। নলের ভেতর দিয়ে বাতাস হিস হিস করছিল, পোড়া তামাকের মিষ্টি গন্ধ গেল পানভের নাকে।

ঠিক করেছ? উঠে দাঁড়িয়ে সে জিজ্ঞেস করল।

কেন নয়, অবশ্যই!

তুমি একাট চটপটে ছেলে, আভদিয়েভ!…একজন বিচারকের মতো বিজ্ঞ! তাহলে বেটা।

আভদিয়েভ মুখ থেকে ধোঁয়া বের হতে দিয়ে পানভের জন্য জায়গা করে দিতে গড়িয়ে পাশ ফিরল।

উন্মুখ পানভ শুয়ে পড়ে নলের মুখের দিকটা হাতা দিয়ে মুছে তামাক টানতে শুরু করল।

ধূমপান করার সময় সৈন্যরা কথা বলতে শুরু করল।

সবাই বলছে কমান্ডার আবার ক্যাশ-বাক্স হাতিয়েছে, অলস কণ্ঠে একজনের মন্তব্য। জুয়া খেলায় সে হেরেছে, জানো?

সে আবার ফেরত দিয়ে দেবে, পানভ বলল।

অবশ্যই সে দেবে! সে একজন ভালো অফিসার, সায় দিল আভদিয়েভ।

বেশ! বেশ! যে এই আলাপ শুরু করেছিল, হতাশভাবে সে বলল। আমার মতে কোম্পানির (সেনাদল) উচিত তার সঙ্গে কথা বলা। তুমি যদি টাকা নিয়ে থাকো, তাহলে বলল কত নিয়েছ এবং কখন তা ফেরত দেবে।

কোম্পানি যদি ঠিক করে, তাহলে সেটাই হবে, পাইপ থেকে সরে গিয়ে বলল পানভ।

অবশ্যই। দশে মিলি করি কাজ, প্রবাদটি বলে সায় দিল আভদিয়েভ।

বসন্তের আগে যব আর বুট কিনতে হবে। তখন টাকা লাগবে, সে যদি টাকা পকেটে ঢুকিয়ে ফেলে, তাহলে কী হবে? নাখোশ সৈন্যটি বলল।

আমি তোমাকে বলছি কোম্পানির যা ইচ্ছা তা-ই হবে, আবার বলল পানভ। এটাই প্রথম না সে টাকা নেয়, আবার ফেরত দিয়ে দেয়।

তখনকার দিনে ককেশাসে প্রতিটা কোম্পানি তার রসদ বিভাগ চালানোর জন্য নিজেরাই লোক ঠিক করত। তারা রাজস্ব বিভাগ থেকে প্রতি মাসে ১০০ টাকা (৬ রুবল ৫০ কোপেক) পেত এবং কোম্পানির খাবারের ব্যবস্থা করত। তারা বাঁধাকপি চাষ করত, খড়ের গাদা বানাত, তাদের নিজেদের এক্কা থাকত এবং তাদের হৃষ্টপুষ্ট ঘোড়াগুলো নিয়ে তারা গর্ব করত। কোম্পানির টাকা রাখা হতো একটা সিন্দুকে, যেটার চাবি থাকত কমান্ডারের কাছে; প্রায়ই সে সিন্দুক থেকে টাকা ধার নিত। তেমন ঘটনাই আবার ঘটেছে, সৈন্যরা যা নিয়ে আলাপ করছিল। নাখোশ সৈন্যটি, নিকতিন, চায় কমান্ডারের কাছ থেকে হিসাব চাওয়া হোক, আর পানভ ও আভদিয়েভ মনে করে তার দরকার নেই।

পানভের পর নিকতিন ধূমপান করল, তারপর তার আলখাল্লাটা বিছিয়ে তার ওপর বসল চিনারের গুঁড়িটিতে হেলান দিয়ে। সবাই তখন নিশ্চুপ। কেবল তাদের মাথার অনেক ওপরে গাছের মগডালের পাতাগুলো বাতাসে মর্মর শব্দ করছিল। সেই অবিরাম মৃদু মর্মর শব্দ ছাপিয়ে হঠাৎ শুরু হলো শিয়ালের হুক্কাহুয়া, গোঙানি, আর্তনাদ ও খুক খুক হাসি।

শোন, ওই লক্ষ্মীছাড়া জানোয়ারগুলো শোনো কী রকম চিল্লাচ্ছে!

ওরা তোমার হেঁড়ে গলা শুনে হাসছে, চিকন গলায় বলল ইউক্রেন থেকে আসা সৈন্যটা।

আবার সব নিস্তব্ধ। শুধু বাতাস গাছের ডালগুলো দোলাচ্ছে কখনো তারাগুলো ঢেকে দিয়ে, কখনো খুলে!

শোনো, পানভ, হঠাৎ প্রফুল্ল মেজাজে জিজ্ঞেস করল আভদিয়েভ, তোমার কি কখনো মন খারাপ লাগে?

মন খারাপ, কেন? কোনো গা না করেই জবাব দিল পান।

বেশ, আমার মন খারাপ লাগে, কোনো কোনো সময় এত খারাপ লাগে যে জানি না আমি আমার কী করে ফেলতে পারি।

ও, এই কথা! এটুকুই পানভের জবাব।

সেইবার আমি যখন সব টাকা মদ খেয়ে উড়িয়ে দিলাম, ওটা মন খারাপের জন্যই হয়েছিল। তা আমাকে ধরে ফেলেছিল, এমনভাবে ধরে ফেলেছিল যে আমি মনে মনে বললাম, আমি বেহেড মাতাল হয়ে যাব।

কিন্তু কখনো কখনো মদ খেলে তা আরও খারাপ হয়।

হ্যাঁ, আমারও তা-ই হয়েছিল। কিন্তু একজন নিজেকে নিয়ে কী করতে পারে?

কিসের জন্য তোমার এত মন খারাপ হয়?

আমার, কী…কেন, আমার বাড়ির জন্য মন টানে।

তাহলে তোমাদের কি অবস্থাপন্ন বাড়ি?

না, আমরা ধনী নই, কিন্তু স্বচ্ছন্দে চলে যায়। আমরা ভালো আছি। এরপর আভদিয়েভ পানভের কাছে বহুবার বলা কাহিনি আবার বলতে শুরু করল।

দেখো, আমি আমার নিজের ইচ্ছায় ভাইয়ের বদলে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছি, আভদিয়েভ বলল। তার (ভাইয়ের) বাচ্চাকাচ্চা আছে। পরিবারে তারা পাঁচজন। আর আমি কেবল বিয়ে করেছি। মা এসে আমাকে যাওয়ার জন্য মিনতি করতে থাকল। তাই আমি ভাবলাম, বেশ, তারা হয়তো মনে রাখবে আমি কী করেছি। তাই আমি আমার মালিকের কাছে গেলাম…সে ভালো মনিব ছিল, বলল, তুমি একটা ভালো লোক, যাও! তাই আমি আমার ভাইয়ের বদলে গেলাম।

বেশ, সেটা ভালো কাজ করেছ, পানভ বলল।

তারপর দেখো পানভ, আমাকে বিশ্বাস করো, আমার যে মন খারাপ হয়, তার বড় কারণ সেই ঘটনা? কেন তুমি তোমার ভাইয়ের বদলে গেলে? আমি নিজেকে প্রশ্ন করি। সে এখন সেখানে রাজার হালে থাকছে, আর আমি এখানে কষ্ট করে মরছি। আমি যত চিন্তা করি, আমার তত খারাপ লাগে…মনে হয় আমার কপালই খারাপ!

আভদিয়েভ চুপ করে গেল।

একটু থেমে সে বলল, আমরা বোধ হয় আরেকবার ধূমপান করতে পারি।

ঠিক আছে, বানাও! কিন্তু সৈন্যদের ধূমপান করার সুযোগ হলো না। আভদিয়েভ পাইপের নলটি ঠিকমতো বসানোর জন্য উঠতেই তারা গাছের মর্মর শব্দ ছাপিয়ে রাস্তায় পায়ের আওয়াজ পেল। পানভ তার বন্দুক তাক করে ধরল এবং নিকিতিনকে তার পা দিয়ে ধাক্কা দিল।

নিকিতিন উঠে তার পশমি আলখাল্লাটা তুলে নিল।

বন্দারেঙ্কো নামের তৃতীয় সৈন্যটাও উঠল এবং বলল, বন্ধুরা, আমি এমন একটা স্বপ্ন দেখলাম…।

শসস! ইশারা করল আভদিয়েভ, সৈন্যরা সবাই দম বন্ধ করে শুনল। একাধিক মানুষের পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে, নাল লাগানো বুট পরা পায়ের নয়। অন্ধকারের মধ্য দিয়ে ঝরা পাতা আর ডালের টুকরার ওপর মচমচ শব্দ পরিষ্কার থেকে বেশি পরিষ্কার হয়ে আসছে। তারপর এল গলার খাদ থেকে আসা বিশেষ শব্দ। কথা বলার সময় চেচেনরা এমন শব্দ করে। সৈন্যরা এখন কেবল শব্দই শুনতে পাচ্ছে না, দেখতে পেল গাছগুলোর মধ্যে ফাঁকা জায়গা দিয়ে দুটো ছায়া হেঁটে যাচ্ছে, একটা ছায়া অন্যটার চেয়ে লম্বা। ছায়াগুলো সৈন্যদের বরাবর এলে পানভ হাতে বন্দুক নিয়ে রাস্তার ওপর উঠে এল, তার সহকর্মীরা তার অনুসরণ করল।

কে যায়? হাক দিল সে।

আমি, বন্ধু চেচেন, খাটো লোকটি বলল। লোকটা বাটা! বন্দুক নাই, তলোয়ার নাই! নিজের দিকে দেখিয়ে বলল সে। প্রিন্সকে চাই!

লম্বা লোকটি বন্ধুর পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। তার কাছেও কোনো অস্ত্র ছিল না।

সে বলছে যে তাকে খবর নিতে পাঠানো হয়েছে, কর্নেলের সঙ্গে দেখা করতে চায়, পানভ তার সঙ্গীদের বুঝিয়ে বলল।

প্রিন্স ভরন্তসভ…বেশি চাই! বড় কাজ! বলল বাটা।

ঠিক আছে, ঠিক আছে! আমরা তোমাকে তার কাছে নিয়ে যাব, পানভ বলল। তুমি বরং এদের নিয়ে যাও, আভদিয়েভকে বলল, তুমি আর বন্দারেঙ্কো, এদের ডিউটি অফিসারের কাছে দিয়ে ফিরে এসো। মনে থাকবে? সে আরও বলল, সাবধান, এদের তোমাদের সামনে রাখবে!

এটা করলে কেমন হয়? আভদিয়েভ তার বন্দুক আর বেয়নেট দিয়ে কাউকে খোঁচানোর ভঙ্গি করে বলল। আমি যদি এক খোঁচায় তার ভুড়ি বের করে দিই?

তুমি তাকে মেরে ফেললে তার কী দাম থাকবে? মন্তব্য বন্দারেঙ্কোর।

এখন হাঁটো!

খবর নিতে আসা লোকদের নিয়ে যাওয়া সৈন্য দুটির পায়ের শব্দ মিলিয়ে যেতে পানভ আর নিকতিন নিজেদের চৌকির জায়গায় ফিরে এল।

কিসের জন্য তারা রাত্রে এখানে এসেছে? প্রশ্ন নিকতিনের।

মনে হয় খুব দরকার, বলল পানভ। ঠান্ডা কিন্তু বেড়ে যাচ্ছে, বলে সে তার পশমি আলখাল্লাটার ভাঁজ খুলে গায়ে দিয়ে গাছটার পাশে বসল।

ঘণ্টা দুয়েক পর আভদিয়েভ আর বন্দারেঙ্কো ফিরে এল।

কী, তাদের বুঝিয়ে দিয়েছ?

হ্যাঁ, কর্নেলের বাড়িতে তারা এখনো ঘুমায়নি। তাদের সোজা তার কাছে নিয়ে গেছে এবং জানো বন্ধুরা, ন্যাড়া ছেলেগুলি বেশ ভালো? আভদিয়েভ বলে যাচ্ছিল। হ্যাঁ, সত্যি? আমি তাদের সঙ্গে কত গল্প করলাম!

অবশ্যই, তুমি তো বলবেই, পাত্তা না দিয়ে বলল নিকতিন।

আসলেই, তারা ঠিক রুশদের মতো। ওদের একজন বিবাহিত! বাচ্চা আছে দুটো! এত কথা বললাম! ভালো লোক দুটো!

আসলেই, ভালো! বলল নিকতিন। তোমাকে একা পেলে তোমার ভুঁড়ি বের করে দিত।

একটু পরেই ভোর হয়ে যাবে, বলল পান।

হ্যাঁ, তারাগুলো নিভে যাচ্ছে, আরাম করে বসতে বসতে আভদিয়েভ বলল

এবং সৈন্যরা আবার নীরব হয়ে গেল।

দুর্গে ব্যারাক ও সৈন্যদের বাড়িগুলোর জানালা অনেক আগেই অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেখানকার সবচেয়ে ভালো বাড়িটির জানালাগুলোয় তখনো আলো দেখা যাচ্ছিল।

বাড়িটায় থাকতেন প্রিন্স সাইমন মিখাইলোভিচ ভরসভ, কুরিন রেজিমেন্টের সেনাপতি, রাজকীয় পার্শ্বচর (এডিসি) এবং প্রধান সেনাপতির ছেলে। ভরন্তসভ থাকতেন তার স্ত্রী, পিটার্সবার্গের সুখ্যাত সুন্দরী মারিয়া ভাসিলিয়েভনাকে নিয়ে। ককেশিয়ার ছোট্ট দুর্গে তাদের মতো বিলাসে ওই বাড়িতে আগে আর কেউ থাকেনি। ভরসভের, বিশেষ করে তার স্ত্রীর, মনে হতো তারা অত্যন্ত সাদাসিধে এবং কষ্টকর জীবন যাপন করছে, কিন্তু বাড়ির অন্য বাসিন্দাদের কাছে তাদের বিলাসিতা ছিল বিস্ময়কর এবং অসাধারণ।

তাদের বিশাল বসার ঘরের জানালায় দামি পর্দা ঝোলানো এবং মেঝে কার্পেটে মোড়া। সেখানে মধ্যরাতেও একটা তাস খেলার টেবিলে চারটি মোমবাতির আলোয় মেজবান এবং মেহমানেরা তাস খেলছিল। খেলোয়াড়দের একজন ছিল ভরন্তসভ নিজে। লম্বাটে চেহারা আর সুন্দর চুলওয়ালা কর্নেল, পোশাকে রাজকীয় পার্শ্বচরের তকমা এবং কাঁধে সোনালি কর্ড। তার সঙ্গী, পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উষ্কখুষ্ক বিষণ্ণ চেহারার এক স্নাতক, প্রিন্সেস ভরন্তসভ সম্প্রতি যাকে তার আগের ঘরের ছোট ছেলেটির শিক্ষক হিসেবে পাঠিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে খেলছিল দুজন সেনা কর্মকর্তা-একজন চওড়া লালমুখো পুরুষ, কোম্পানি কমান্ডার পোলতোরাৎস্কি। দেহরক্ষী দল থেকে বদলি হয়ে এসেছে। অন্যজন সুদর্শন চেহারায় শীতল নির্বিকারভাব ধরে রাখা রেজিমেন্টের অ্যাডজুট্যান্ট। সে তার চেয়ারে সোজা হয়ে বসে ছিল।

প্রিন্সেস মারিয়া ভাসিলিয়েভনা, স্থূলকায়, বিশালাক্ষী এবং কালো ভুরুধারী সুন্দরী, পোলতোরাৎস্কির পাশে বসে তার তাস দেখছিল, তার ফাঁঁপানো পোশাক পোলতোরাৎস্কির পা স্পর্শ করছিল। তার কথা, তার দৃষ্টি, তার হাসি, তার সুগন্ধি এবং তার অঙ্গের প্রতিটি নড়াচড়ায় এমন কিছু ছিল, যাতে সংকোচে তার নৈকট্য সম্বন্ধে সচেতন থাকা ছাড়া পোলতোরাৎস্কি আর সবকিছু ভুলে যাচ্ছিল এবং সে একের পর এক গুরুতর ভুল করায় তার সঙ্গীর ধৈর্যের পরীক্ষা চলছিল।

নাহ, এটা খুব খারাপ হলো! তুমি আবার একটা টেক্কা নষ্ট করলে, পোলতোরাৎস্কি একটা টেক্কা ছুঁড়ে দিলে মুখ লাল করে রেজিমেন্টের অ্যাডজুট্যান্ট বলল।

পোলতোরাৎস্কি কিছু না বুঝে, যেন এই মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে, এমন মুখ করে তার বড় বড় কালো চোখে করুণ দৃষ্টিতে ক্ষুব্ধ অ্যাডজুট্যান্টের দিকে তাকাল।

ওকে মাফ করে দাও! মুচকি হেসে বললেন মারিয়া ভাসিলিয়েভনা। পোলতোরাৎস্কির দিকে ফিরে বললেন, দেখেছ, এখন? আমি তোমাকে বলেছিলাম না?

কিন্তু তুমি মোটেই এটা বলোনি, হেসে জবাব দিল পোলতোরাৎস্কি।

তাই নাকি? মারিয়াও হেসে জবাব দিল এবং তার মুচকি হাসিতে পোলতোরাৎস্কি এতটাই উদ্দীপ্ত আর খুশি হলো যে সে তাসগুলো নিয়ে ফেটাতে শুরু করল।

এখন তোমার বাটা না, কড়া গলায় বলল অ্যাডজুট্যান্ট এবং তার সাদা আংটি পরা হাতে তাসগুলো দ্রুত বাটতে শুরু করল, যেন শেষ হলেই সে বাঁচে।

প্রিন্সের খানসামা বসার ঘরে ঢুকে বলল, ডিউটি অফিসার প্রিন্সের সঙ্গে দেখা করতে চায়।

মাফ করো, ভদ্রলোকেরা, ইংরেজি উচ্চারণে রুশ ভাষায় বললেন প্রিন্স।

তুমি আমার জায়গাটা নেবে, মারি?

তোমরা সবাই রাজি? জিজ্ঞেস করলেন প্রিন্সেস। তার সিল্কে খসখস শব্দ আর মুখে সুখী মহিলার আভা তুলে মুচকি হেসে দ্রুত সটান দাঁড়িয়ে।

আমি সব সময় সবকিছুতে রাজি, প্রিন্সেস, যে খেলার কিছুই জানে না, এখন তার বিপক্ষে খেলবে বলে খুব খুশি হয়ে বলল অ্যাডজুট্যান্ট।

পোলতোরাৎস্কি কেবল হেসে তার তাসগুলো বিছিয়ে দিল।

প্রিন্স যখন বসার ঘরে ফিরে এলেন, দানটি তখন প্রায় শেষ। তিনি ফিরে এলেন উত্তেজিত এবং খুব খুশি মনে।

তোমরা জানো আমি কী প্রস্তাব করতে যাচ্ছি?

কী?

চলো, শ্যাম্পেন পান করা যাক।

আমি সব সময় তার জন্য প্রস্তুত, বলল পোলতোরাৎস্কি।

কেন নয়, খুব মজা হবে! বলল অ্যাডজুট্যান্ট।

ভাসিলি! নিয়ে এসো তো! বললেন প্রিন্স।

কারা তোমার কাছে এসেছিল? মারিয়া ভাসিলিয়েভনা জিজ্ঞেস করলেন।

ডিউটি অফিসার আর একটা লোক।

কে? কী ব্যাপারে? দ্রুত জিজ্ঞেস করলেন মারিয়া ভাসিলিয়েভনা।

আমি কিছুতেই বলতে পারব না, কাধ নেড়ে বললেন ভরন্তসভ।

আমি কিছুতেই বলতে পারব না, তার অনুকরণে বললেন মারিয়া ভাসিলিয়েভনা। আচ্ছা দেখা যাবে।

শ্যাম্পেন আনা হলে অতিথিরা প্রত্যেকে এক গ্লাস করে পান করে এবং তাদের খেলা শেষ হয়ে যাওয়ায় ফলাফল যোগ করে চলে যেতে শুরু করল।

তোমার কোম্পানিকে কাল বনে যাওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে? বিদায় নেওয়ার সময় প্রিন্স জিজ্ঞেস করলেন পোলতোরাৎস্কিকে।

হ্যাঁ, আমার…কেন?

ওহ, তাহলে কাল আবার দেখা হবে, মৃদু হেসে বললেন প্রিন্স।

খুব ভালো, ভরন্তসভ তাকে কী বলছিলেন, তা মোটেও না বুঝে জবাব দিল পোলতোরাৎস্কি, একটু পরই সে মারিয়া ভাসিলিয়েভনার হাতে চাপ দেবে, এই চিন্তাটাই তার মাথায় তখন ঘুরছিল।

মারিয়া ভাসিলিয়েভনা তার অভ্যাসমতো তার (প) হাত শুধু জোরে চেপেই ধরলেন না, জোরে জোরে ঝাঁকালেন; আবার তাকে রুহিতন তাসটি খেলার ভুটা মনে করিয়ে দিয়ে এমনভাবে হাসলেন যে পোলতোরাৎস্কির কাছে তা প্রেমময় ও অর্থপূর্ণ মনে হলো।

পোলতোরাৎস্কি বাসায় ফিরল খুব উৎফুল্ল মনে। কারণটা কেবল তার মতো লোকেরাই বুঝতে পারবে। যারা উচ্চ সমাজে বড় ও শিক্ষিত হয়ে বহু মাস বিচ্ছিন্ন সামরিক জীবন কাটিয়ে তাদের নিজ শ্রেণির একজন মহিলা, তা আবার প্রিন্সেস ভরসভের মতো মহিলার সান্নিধ্য পেয়েছে।

সে এবং তার সহকর্মী যে ছোট বাড়িটায় থাকে, সেখানে পৌঁছে সে দরজায় ধাক্কা দিল, কিন্তু সেটা তালাবদ্ধ। সে দরজায় টোকা দিল, কিন্তু তারপরও সেটা খুলল না। সে বিরক্ত হয়ে দরজায় লাথি মারতে ও তলোয়ার দিয়ে ঠক ঠক করতে শুরু করল। তখন সে পায়ের শব্দ শুনতে পেল, পোলতোরাৎস্কির গৃহদাস ভভিলো দরজা আটকানোর খিলটি খুলে দিল।

নিজেকে তালা দিয়ে কী করছিলি, বলদ?

এটা কি সম্ভব, স্যার?

আবার মাতাল হয়েছিস! দেখাই তোকে কী করে সম্ভব? এবং পোলতোরাৎস্কি ভভিলোকে মারতে উদ্যত হয়েও থেমে গেল। জাহান্নামে যা! মোমবাতি জ্বালিয়ে আন।

এক মিনিট।

ভভিলো আসলেই মাতাল হয়েছিল। সে রসদ সার্জেন্টের নাম-দিবসের (যে সাধুর নামে নাম রাখা হয়, তার জন্মদিন পার্টিতে মদ খেয়েছিল। বাড়ি ফিরে সে নিজের জীবনের সঙ্গে সার্জেন্ট ইভান পেত্রোভিচের জীবনের তুলনা করছিল। ইভান পেত্রোভিচ বেতন পায়, বিবাহিত এবং বছরখানেকের মধ্যেই ছাড়া পাওয়ার আশা করছে।

ভভিলো ছেলেমানুষ থাকতেই তাকে তুলে নেওয়া হয়। তার মানে তাকে তার মালিকের বাড়ির কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়। এখন তার বয়স চল্লিশের ওপরে এবং জীবন কাটছে বেপরোয়া মালিকের সঙ্গে সেনাশিবিরে। মনিব হিসেবে সে ভালো, তাকে কদাচিৎ পেটায়; কিন্তু এটা কেমন জীবন? আমরা ককেশাস থেকে ফিরে গেলে সে আমাকে মুক্তি দেবে বলেছে, কিন্তু মুক্তি নিয়ে আমি যাব কোথায়? এটা একটা কুত্তার জীবন! ভভিলো ভাবছিল এবং তার এত ঘুম পেয়েছিল যে কেউ ঘরে ঢুকে কিছু চুরি করতে পারে, এই ভেবে দরজার হুড়কোটা লাগিয়ে দিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

.

পোলতোরাৎস্কি তার শোবার ঘরে ঢুকল, এই ঘরে সে তিখোনভের সঙ্গে থাকে।

কী, তুমি হেরেছ? ঘুম ভেঙে তিখোনভ জিজ্ঞেস করল।

যা হয়, আমি হারিনি। আমি ১৭ রুবল জিতেছি এবং আমরা এক বোতল ক্লিকো (ভোভ ক্লিকো, শ্যাম্পেনের উদ্ভাবক এবং সবচেয়ে পরিচিত শ্যাম্পেন) খেয়েছি!

এবং তুমি মারিয়া ভাসিলিয়েভনার দিকে তাকিয়েছিলে?

হ্যাঁ, আমি মারিয়া ভাসিলিয়েভনার দিকে তাকিয়েছিলাম, নকল করে বলল পোলতোরাৎস্কি।

শিগগিরই ঘুম থেকে ওঠার সময় হবে, তিখোন বলল। আমাদের ছয়টার সময় রওনা হতে হবে।

ভভিলো! হাঁকল পোলতোরাৎস্কি, দেখ, কাল সকালে আমাকে ঠিক পাঁচটার সময় জাগিয়ে দিবি!

আপনার যদি যুদ্ধ করতে হয়, তবে আরেকজন কেন জাগাবে?

আমি তোকে বলছি আমাকে জাগাতে! শুনেছিস?

ঠিক আছে। ভভিলো বের হয়ে গেল, সঙ্গে নিয়ে গেল পোলতোরাৎস্কির বুট আর জামাকাপড়। পোলতোরাৎস্কি মুচকি হেসে বিছানায় গেল, একটা সিগারেট টানল এবং মোমবাতিটা নিভিয়ে দিল। অন্ধকারে সে তার সামনে মারিয়া ভাসিলিয়েভনার হাসিমুখ দেখতে পেল।

.

ভরসভরা সঙ্গে সঙ্গে ঘুমাতে যায়নি। মেহমানেরা চলে যাওয়ার পর মারিয়া ভাসিলিয়েভনা গেলেন তার স্বামীর কাছে এবং জোর দিয়ে ফরাসিতে বললেন, বেশ! এখন আমাকে বলল কী হয়েছিল?

কিছু না, আমার বন্ধু।

বন্ধু না! একজন দূত এসেছিল, তাই না?

যা-ই হোক, আমি তোমাকে তা বলতে পারব না।

তুমি বলতে পারবে না? বেশ, আমিই তাহলে তোমাকে বলছি!

তুমি?

হাজি মুরাদ ছিলেন, তাই না? ইংরেজিতে বললেন মারিয়া ভাসিলিয়েভনা। তিনি কয়েক দিন ধরে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনার কথা শুনেছিলেন এবং ভেবেছিলেন, হাজি মুরাদ স্বয়ং তার স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। ভরন্তসভ তা একদম অস্বীকার করতে পারলেন না। কিন্তু তাকে (ম) এ কথা বলে হতাশ করলেন যে হাজি মুরাদ নিজে ছিলেন

কিন্তু একজন দূত পাঠিয়েছিলেন বলতে যে তিনি আগামীকাল তার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। যেখানে তারা গাছ কাটার অভিযানে যাবেন, সেখানে।

তরুণ ভরসভরা, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই, দুর্গের একঘেয়ে জীবনে এই ঘটনায় খুশি হয়েছিলেন এবং এই খবরে তার বাবা কী রকম খুশি হবে, সে নিয়ে কথা বলার পর তারা ঘুমাতে গেলেন। রাত তখন দুটোর বেশি।

তাকে ধরার জন্য শামিলের পাঠানো মুরিদদের এড়াতে তিনটি রাত নির্ঘম কেটেছে। তাই সাদো শুভরাত্রি জানিয়ে ঘর থেকে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজি মুরাদ ঘুমিয়ে পড়েন। পুরো পোশাক পরা অবস্থায় হাতের ওপর মাথা রেখে। তার কনুই মেজবানের সাজিয়ে দেওয়া লাল তাকিয়াটির একদম ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল।

একটু দূরে দেয়ালের পাশে ঘুমিয়েছিল এলডার। সে শুয়েছিল চিত হয়ে। তার সবল হাত-পা এমনভাবে ছড়ানো, যাতে চাপকানের সামনে সেলাই করে আটকানো কাজের কালো থলেগুলো মাথাটির চেয়ে উঁচু হয়ে ছিল। তার সদ্য কামানো মাথাটা বালিশ থেকে পেছনের দিকে গড়িয়ে পড়েছিল। তাতে নীল আয়নার মতো নিচের কিছুটা অংশও দেখা যাচ্ছিল। তার ওপরের ঠোঁট বাচ্চাদের ঠোঁটের মতো একবার ফুলে উঠছিল আবার নিচে নামছিল, যেন সে কিছুতে চুমুক দিচ্ছে। হাজি মুরাদের মতো সে-ও পিস্তল এবং ছোরা বেল্টের সঙ্গে গেঁথে রেখেই ঘুমিয়েছিল। আগুনের মালসাটার ঝাঁঝরির ওপর কাঠিগুলো অল্প আঁচে নিবু নিবু। রাতের বাতিটা মিটমিট করছিল দেয়ালের ছোট্ট কোটরে।

রাত আরও গম্ভীর হলে মেহমানদের ঘরের দরজাটা কাঁচ কাঁচ করে উঠল, হাজি মুরাদ সঙ্গে সঙ্গে জেগে পিস্তলের ওপর হাত রেখে উঠে বসলেন। মাটির মেঝেয় পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকল সাদো।

কী হয়েছে? জিজ্ঞেস করলেন হাজি মুরাদ, যেন তিনি একদমই ঘুমাননি।

আমাদের চিন্তার ব্যাপার, তার সামনে উবু হয়ে বসে বলল সাদো। এক মহিলা তাদের ছাদ থেকে আপনাকে আসতে দেখেছে এবং তার স্বামীকে বলে দিয়েছে; এখন গ্রামের সবাই জানে। একজন প্রতিবেশী আমার স্ত্রীকে এইমাত্র বলেছে যে মুরব্বিরা সবাই মসজিদে জমায়েত হয়েছে, তারা আপনাকে আটকাতে চায়।

আমাকে তাহলে যেতে হবে! হাজি মুরাদ বললেন।

ঘোড়াগুলোয় জিন লাগানো আছে, বলে কুঁড়ে থেকে দ্রুত বের হয়ে গেল। সাদো।

এলডার! ফিসফিস করে ডাকলেন হাজি মুরাদ। এলডার তার নাম শুনে, তার চেয়ে বেশি তার মনিবের গলা শুনে, হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে তার টুপিটা ঠিক করল।

হাজি মুরাদ তার অস্ত্রগুলো ঝুলিয়ে চাদর পরে নিলেন। এলডারও তা-ই করল; তারা দুজনই নিঃশব্দে কুঁড়ে থেকে বারান্দায় বের হয়ে এলেন। কালো চোখের ছেলেটা তাদের ঘোড়া দুটো নিয়ে এসেছিল। শক্ত মাটির ওপর ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনে পাশের একটি কুঁড়ের দরজা দিয়ে মাথা বের করে দেখল, একটা লোক এবং তার খড়মে খটাশ খটাশ শব্দ তুলে দৌড়ে পাহাড় বেয়ে মসজিদের দিকে গেল। চাঁদ ছিল না। কিন্তু কালো আকাশে তারাগুলো জ্বলজ্বল করছিল। তাতে অন্ধকারে কুঁড়েঘরগুলোর চালের আকার বোঝা যায়। সব কটি ঘরের চেয়ে উঁচু মিনারসহ মসজিদটি গ্রামের ওপরের দিকটায়। সেখান থেকে মানুষের গুঞ্জন ভেসে আসছিল।

বন্দুকটা হাতে নিয়ে হাজি মুরাদ পাদানিতে পা রেখে নিঃশব্দে তার শরীর জিনের উঁচু গদির ওপর তুলে দিলেন।

আল্লাহ তোমার ভালো করুন, তার মেজবানকে বললেন। অভ্যাসমতো ডান পাদানিতে পা ঢুকিয়ে যে ছেলেটি ঘোড়া ধরে রেখেছিল, তাকে চাবুক দিয়ে ছুঁয়ে যেতে দেওয়ার ইশারা করলেন। ছেলেটি এক পাশে সরে দাঁড়াল এবং বড় রাস্তার পথ ধরে জোরে হাঁটতে শুরু করল ঘোড়াটা। যেন ওটার জানাই ছিল কী করতে হবে। এলডার চলছিল তার পিছে। সাদো তার চামড়ার পোশাকে হাত দুলিয়ে সরু পথটা ধরে প্রায় দৌড়ে তাদের পিছু পিছু চলছিল। দুই রাস্তার মোড়ে প্রথমে একটা, তারপর আরেকটা ছায়া রাস্তার ওপর এসে পড়ে।

দাঁড়াও। কে? থামো! চিৎকার করে কেউ বলল এবং কয়েকটা লোক রাস্তা আটকে দাঁড়াল।

হাজি মুরাদ না থেমে বেল্ট থেকে পিস্তলটা হাতে নিয়ে রাস্তা আটকানো লোকগুলোর দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন। লোকগুলো দুপাশে সরে দাঁড়াল। হাজি মুরাদ কোনো দিকে না তাকিয়ে জোর কদমে ঘোড়া ছোটালেন। এলডার তাকে অনুসরণ করল দুলকি কদমে। তাদের দিকে দুটো গুলি ছোঁড়া হলো, শাই শাঁই করে গুলি দুটো তাদের পাশ দিয়ে চলে গেল হাজি মুরাদ বা এলডারকে আঘাত না করেই। হাজি মুরাদ একই বেগে ছুটতে থাকলেন কিন্তু প্রায় তিন শ গজ যাওয়ার পর সামান্য ঊর্ধ্বশ্বাস নেওয়া ঘোড়াটি থামিয়ে কিছু শোনার চেষ্টা করলেন।

তার সামনে, নিচে, কলকল করে পানির ধারা বয়ে যাচ্ছিল। পেছনের গ্রামটিতে মোরগগুলো ডাকছিল একের পর এক, যেন একটা আরেকটার জবাব দিচ্ছিল। এসব ছাপিয়ে তিনি তার পেছনে এগিয়ে আসা একদল ঘোড়ার ভারী পায়ের আওয়াজ এবং কয়েকটি লোকের কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছিলেন। হাজি মুরাদ তার ঘোড়াটি স্পর্শ করে সমান গতিতে চলতে থাকলেন। তার পেছনের লোকেরা ঘোড়া দৌড়িয়ে তাকে প্রায় ধরে ফেলল। জনা বিশেক ঘোড়সওয়ার, গ্রামটির বাসিন্দা। তারা হাজি মুরাদকে আটকাতে চেয়েছিল, না হলেও অন্তত শামিলকে দেখাতে চেয়েছিল যে তারা হাজি মুরাদকে আটকাতে চেষ্টা করেছে। অন্ধকারের মধ্যে দেখা যাওয়ার মতো কাছে এলে হাজি মুরাদ থামলেন। লাগাম ছেড়ে দিয়ে অভ্যস্ত বাঁ হাত দিয়ে তার রাইফেলের ঢাকনার বোতাম খুললেন। ডান হাত দিয়ে রাইফেলটি তুলে নিলেন। এলডারও তা-ই করল।

তোমরা কী চাও? চিৎকার করে বললেন হাজি মুরাদ। তোমরা আমাকে ধরতে চাও! তাহলে এসো, ধরো! এবং তিনি রাইফেল তুললেন। গ্রামের মানুষগুলো থেমে গেল এবং হাজি মুরাদ রাইফেলটি হাতে রেখে উপত্যকায় নামলেন। ঘোড়সওয়ারেরাও তাকে অনুসরণ করল, কিন্তু আরও কাছে গেল না। হাজি মুরাদ উপত্যকার অপর দিকে চলে যাওয়ার পর লোকগুলো চিৎকার করে বলল যে তারা যা বলতে চায়, তার তা শোনা উচিত। জবাবে তিনি রাইফেলের একটা গুলি ছুঁড়ে জোরকদমে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণ পর লাগাম টেনে ঘোড়ার গতি একটু কমিয়ে দিলেন। তাকে ধরতে আসা লোকগুলোর কোনো শব্দ, মোরগের ডাকগুলো আর শোনা যাচ্ছে না। বনের ভেতরে পানির নালার কলকল শব্দ আরও পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। তারপর একটা প্যাচা ডেকে উঠল। বনের কালো দেয়াল মনে হলো বেশ কাছেই। এটাই সেই বন মুরিদেরা যেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে।

বনের পাশে পৌঁছে হাজি মুরাদ থামলেন। বুকভরে দম নিয়ে শিস দিয়ে নীরবে অপেক্ষা করলেন কিছু শোনার চেষ্টায়। একটু পর বনের ভেতর থেকে একই রকম শিসের জবাব এল। হাজি মুরাদ রাস্তা থেকে নেমে বনের ভেতরে ঢুকলেন। প্রায় এক শ কদম যাওয়ার পর গাছের গুঁড়িগুলোর ফাঁকে দেখতে পেলেন একটা আগুনের কুণ্ড, তার চারপাশে বসা কিছু লোকের ছায়া এবং আগুনের আধো আলোয় দেখা গেল জিন লাগানো একটা ঘোড়া দাঁড়িয়ে। কুণ্ডের পাশে চারজন লোক বসে ছিল।

একজন লোক চট করে দাঁড়াল এবং হাজি মুরাদের কাছে গিয়ে লাগাম ও পাদানি ধরে দাঁড়াল। সে ছিল হাজি মুরাদের ধর্মভাই, তার বাড়ির সবকিছুর দেখাশোনা করত।

আগুনটা নিভিয়ে দাও, ঘোড়া থেকে নামতে নামতে হাজি মুরাদ বললেন।

লোকগুলো কুণ্ডটা ভেঙে ছড়িয়ে দিল এবং পোড়া ডালগুলো মাড়াতে শুরু করল।

বাটা এখানে এসেছিল? মাটিতে বিছানো একটি চাদরের কাছে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলেন হাজি মুরাদ।

হ্যাঁ, সে অনেক আগে খান মাহোমাকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেছে।

কোন দিকে গেছে?

ওই দিকে, হাজি মুরাদ যেদিক দিয়ে এসেছে, তার উল্টো দিক দেখিয়ে জবাব দিল খানেফি।

ঠিক আছে, বলে হাজি মুরাদ কাঁধ থেকে রাইফেল নামিয়ে তাতে গুলি ভরতে শুরু করলেন।

আমাদের খুব সাবধান থাকতে হবে। আমার পেছনে ধাওয়া করেছিল, আগুন নেভাতে থাকা একটা লোককে বললেন হাজি মুরাদ।

লোকটার নাম গামজালো, চেচেন। গামজালো চাদরটার কাছে গিয়ে সেটার ওপর থেকে একটা রাইফেল তুলে নিয়ে সেটাকে ঢাকনায় ঢেকে কোনো কথা না বলে বনের ভেতরের খোলা জায়গাটার, যেদিক দিয়ে হাজি মুরাদ এসেছিলেন, সেদিকে চলে গেল।

এলডার ঘোড়া থেকে নেমে হাজি মুরাদ এবং তার ঘোড়াটিকে নিয়ে দুটোর মুখ উঁচু করে দুটো গাছের সঙ্গে লাগাম দিয়ে বেঁধে রাখল। তারপর গামজালোর মতো রাইফেল নিয়ে খোলা জায়গাটার অপর দিকে চলে গেল। আগুনের কুণ্ডটা নেভানো হয়ে গিয়েছিল, বনটাকে আর অত অন্ধকার মনে হচ্ছিল না। আকাশে তারা জ্বলছিল কিন্তু আবছাভাবে।

তারাগুলোর দিকে চোখ তুলে তিনি দেখলেন কৃত্তিকাগুলো (সাত বোন নামে পরিচিত নক্ষত্রগুচ্ছ) উঠে মধ্যাকাশে চলে এসেছে। হাজি মুরাদ অনুমান। করলেন, মাঝরাত অনেক আগেই পেরিয়েছে এবং এশার নামাজ কাজা হয়ে গেছে। তিনি খানেফিকে একটা বদনা দিতে বললেন (তারা সব সময় তাদের জিনিসপত্রের সঙ্গে একটা রাখে) এবং চাদর মুড়ি দিয়ে নালাটির দিকে গেলেন।

জুতো খোলার পর অজু করে হাজি মুরাদ আবার চাদরটা গায়ে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলেন, তারপর পুব দিকে ফিরে কানের লতি ছুঁয়ে নামাজ পড়তে শুরু করলেন।

নামাজ শেষ হলে জিনে ঝোলানোর থলিগুলো রাখা জায়গাটার কাছে গিয়ে কনুই দিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন।

নিজের ভাগ্যের ওপর হাজি মুরাদের গভীর বিশ্বাস। কোনো কিছুর পরিকল্পনা করার সময় সাফল্যের দৃঢ় আস্থা তিনি আগাম পেয়ে যেতেন এবং ভাগ্য তার ওপর প্রসন্ন ছিল। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া তার সামরিক জীবনের পুরোটাজুড়েই এমন হয়েছে। তাই তিনি আশা করছিলেন এখনো তেমন হবে। তিনি মনে মনে ছবি দেখছেন। তার অধীনে ভরসভের দেওয়া সৈন্যদের নিয়ে তিনি শামিলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাকে বন্দী করে প্রতিশোধ নিচ্ছেন এবং রাশিয়ার জার তাকে পুরস্কৃত করছেন। তিনি আবার শুধু আভারিয়া নয়, তার কাছে আত্মসমর্পণ করা পুরো চেচনিয়া শাসন করবেন। এসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন, টের পাননি।

তিনি স্বপ্ন দেখলেন, তার সাহসী অনুসারীরা কী করে গান গাইতে গাইতে এবং মুরাদের আগমন…! ধ্বনি দিতে দিতে শামিলকে ধাওয়া করছে। কী করে শামিল ও তার স্ত্রীদের আটক করছে এবং তিনি শামিলের স্ত্রীদের কান্না ও গোঙানি শুনতে পাচ্ছেন। তার ঘুম ভেঙে গেল। গান ও হাজি মুরাদের আগমন! ধ্বনি এবং শামিলের স্ত্রীদের কান্না হিসেবে যা শুনছিলেন, তা ছিল শিয়ালের ক্রুর হাসি এবং হুক্কা রব, যার শব্দে তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। হাজি মুরাদ মাথা তুলে তাকালেন আকাশের দিকে। গাছের গুঁড়িগুলোর ফাঁক দিয়ে যেটুকু দেখা যায়, তাতে পুব দিকে ইতিমধ্যে আলো দেখা যাচ্ছে। তার একটু দূরে বসে থাকা একজন মুরিদের কাছে খান মাহোমার কথা জিজ্ঞেস করলেন। খান মাহোমা এখনো আসেনি শুনে আবার মাথা নোয়ালেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লেন।

তার ঘুম ভাঙল বাটার সঙ্গে অভিযান থেকে ফিরে আসা খান মাহোমার উৎফুল্ল গলার আওয়াজে। খান মাহোমা সঙ্গে সঙ্গে হাজি মুরাদের পাশে বসে পড়ল এবং বলতে লাগল সৈন্যরা তাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করল এবং কেমন করে খোদ প্রিন্সের কাছে নিয়ে গেল। প্রিন্স কত খুশি হয়েছিল, সকালে তাদের সঙ্গে দেখা করার কী অঙ্গীকার করেছিল, মিচিক থেকে একটু দূরে, শালিন নামের ফাঁকা জায়গাটার কোনখানে রুশরা গাছ কাটতে যাবে–এই সব। বাটা তার নিজের বর্ণনা দিতে সঙ্গী দূতকে মাঝেমধ্যে থামিয়ে দিচ্ছিল।

হাজি মুরাদ বিশেষ করে জানতে চাচ্ছিলেন তার রুশদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার প্রস্তাবের জবাবে ভরন্তসভ ঠিক কী বলেছে। খান মাহোমা আর বাটা একই কথা বলল যে প্রিন্স হাজি মুরাদকে মেহমান হিসেবে বরণ করার এবং তার জন্য ভালো হবে, এমন কাজ করার অঙ্গীকার করেছেন।

তারপর হাজি মুরাদ তাদের রাস্তার অবস্থা জিজ্ঞেস করলেন। খান মাহোমা রাস্তাটা ভালো চেনে এবং তাকে ঠিক জায়গায় নিয়ে যাবে বলে আশ্বস্ত করল। শুনে হাজি মুরাদ কিছু টাকা নিয়ে বাটাকে দিলেন এবং তার আগের কথামতো তিনটি রুবলও দিলেন। তারপর তার মুরিদদের জিনের থলে থেকে সোনায় মোড়া অস্ত্র ও পাগড়ি বের করে সেগুলো পরিষ্কার করতে বললেন, যাতে রুশদের সামনে গেলে তাদের ভালো দেখায়।

তারা যখন অস্ত্র, লাগাম ও ঘোড়াগুলো পরিষ্কার করছিল, আকাশের তারারা তখন ডুবে গিয়েছে। আলো বেশ ফুটে উঠেছে এবং সকালের মন্দ বাতাস বইতে শুরু করেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *