০১. গভীরভাবে ধার্মিক একজন অবিশ্বাসী

প্রথম অধ্যায় – গভীরভাবে ধার্মিক একজন অবিশ্বাসী

‘কোন ব্যক্তিগত ঈশ্বরকে কল্পনা করার চেষ্টা আমি করিনা; আমাদের অপর্যাপ্ত ইন্দ্রিয়গুলো যতটুকু বোঝার সুযোগ দেয়, সেটুকু দিয়ে এই মহাবিশ্বের গঠন দেখে বিস্ময়ে হতবাক হওয়াটাই যথেষ্ট।‘– আলবার্ট আইনস্টাইন

যে ‘শ্রদ্ধা’ পাওয়ার যোগ্য

হাতের উপর চিবুক রেখে, ঘাসের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে ছেলেটি, জট পাকানো ঘাসের কাণ্ড আর শিকড় দেখতে দেখতে হঠাৎ করেই তীব্র একটা অনুভূতিবোধ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে : তার চোখের সামনে যেন ক্ষুদ্র কোনো পৃথিবীর এক বনভূমি। রুপান্তরিত এক জগত, যে জগত পিপড়া আর গুবরে পোকাদের। এবং– এমন কি যদিও সেই সময় তার বিস্তারিত কিছু জানা ছিল না– লক্ষ কোটি ব্যাকটেরিয়ার, যারা নীরবে, সবার অগোচরে ক্ষুদ্র এই বিশ্বের অর্থনীতির গুরুদ্বায়িত্ব বহন করে যাচ্ছে। হঠাৎ করে ঘাসের ক্ষুদ্রকায় এই বনভূমি বিশালাকৃতি ধারণ করে এক হয়ে মিশে গেল। মহাবিশ্ব আর ভাবনারত ছেলেটির মুদ্ধ বিমোহিত মনের সাথে। এই অভিজ্ঞতাকে সে ব্যাখ্যা করে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ দিয়ে এবং পরবর্তীতে বেছে নেয় ধর্মযাজকের জীবন। অ্যাঙ্গলিকান (১)পাদ্রী হিসাবে দীক্ষা নেবার পর তিনি আমার স্কুলে চ্যাপলেইন (২) হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর মত কিছু ভদ্র, উদার ধর্মযাজকের জন্যে কেউ কখনো দাবী করতে পারবেন না, আমাকে জোর করে আমাকে ধর্ম শেখানো হয়েছে (৩)।

অন্য কোন সময়ে আর স্থানে, তারা ভরা আকাশের নীচে, এই ছেলেটি হতে পারতাম আমি; ওরাইওন, ক্যাসিওপিয়া আর উরসা মেজর (৪) এর চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যে মুগ্ধ, মিল্কি ওয়ে’র(৫) অশ্রুত সঙ্গীতের মূর্ঘনায় আবেগের অশ্রুভরা চোখ, আফ্রিকার বাগানে ফ্রাঞ্জিপানি আর ট্রাম্পেট ফুলের রাতের গন্ধে মাতাল। কেন সেই একই আবেগ আমার চ্যাপলেইনকে নিয়ে গেছে একদিকে আর আমাকে অন্য আরেক দিকে, সে প্রশ্নের উত্তর দেয়া কিন্তু সহজ নয়। প্রকৃতির প্রতি এধরনের প্রায়-আধ্যাত্মিক প্রতিক্রিয়া বিজ্ঞানী কিংবা যুক্তিবাদীদের মধ্যে প্রায়ই দেখা যায়। তার সাথে কিন্তু অতিপ্রাকৃত বিশ্বাসের কোনই যোগসূত্র নেই। অনুমান করতে পারি, অন্তত তার শৈশবে, আমার চ্যাপলেইনের (এবং আমারও না) ‘দি অরিজিন অব স্পিসিস’ (৬) এর শেষ পংক্তিগুলোর কথা জানা ছিল না, সেই বিখ্যাত ‘এনট্যাঙ্গলড ব্যাঙ্ক’ অনুচ্ছেদটি (৭): ‘ঝোঁপের মধ্যে গান গাওয়া পাখিরা, এদিক সেদিক উড়ে চলা নানা জাতের পোকামাকড়, ভেজা মাটির মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে চলা কেঁচো’– যদি তার জানা থাকতো, তাহলে নিঃসন্দেহে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার সাথে মিল খুঁজে পেতেন, আর ধর্মযাজকের পেশায় দীক্ষিত হবার বদলে হয়তো তিনি ডারউইনের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত হতে পারতেন, কারণ এ সবকিছুরই– ‘সৃষ্টি হয়েছে আমাদের চারপাশে নিরন্তর কাজ করে যাওয়া প্রাকৃতিক নিয়মের মাধ্যমেই’:

এইভাবে, প্রকৃতির যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ আর মুত্যু থেকেই, আমাদের পক্ষে ভাবা সম্ভব এমন সবচেয়ে মর্যাদা সম্পন্ন বস্তু, যেমন উন্নত প্রাণীর সৃষ্টি, সরাসরি জড়িত। জীবনকে এইভাবে দেখার মধ্যে আছে একধরনের মাহাত্ম। (জীবন) তার বহুমুখী ক্ষমতা দিয়ে সূচনা করেছিল এক কিংবা কয়েকটি রুপ নিয়ে, আর খুব সাধারণ সেই সূচনা থেকে, এই গ্রহটি যখন মাধ্যাকর্ষণের ধরাবাধা নিয়মে মেনে মহাকাশে চক্রাকারে ঘুরে চলেছে, সেটাই বিবর্তিত হয়েছে যা কিছু ছিল আর বর্তমানে আছে এমন অগনিত নানা আকার আর প্রকৃতির জীবনের সুন্দর আর বিস্ময়কর রুপে।

কার্ল সেগান (৮) তাঁর ‘পেল বু ডট’(২) বইয়ে লিখেছিলেন:

কেন এমন হলো যে, প্রধান প্রধান ধর্মগুলোর কোনোটাই বিজ্ঞানকে অন্তত সামান্যতম হলেও একটু বোঝার চেষ্টা করেছে আর এমন কোন সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছে, ‘আমরা যা ভেবেছিলাম এটাতো তার চেয়েও আরো অনেক ভালো! এই মহাবিশ্বতো আমাদের নবীরা যা বলে গেছেন তার চেয়েও অনেক বিশাল, আরো বেশী সূক্ষ্ম আর অভিজাত’; বরং তারা বলেছে, “না, না, না! আমার ঈশ্বর হলো ছোট ঈশ্বর আর আমরা চাই তিনি সেভাবেই থাকুন’; কোনো ধর্ম, তা নতুন কিংবা পুরাতন যাই হোক না কেন, যা কিনা আধুনিক বিজ্ঞানের মাধ্যমে উন্মোচিত এই মহাবিশ্বের অসাধারণত্বকে গুরুত্ব দিয়েছে, হয়তো চিরাচরিত বিশ্বাস যা পারেনি, সেটি তার চেয়ে অনেক বেশী শ্রদ্ধার জন্ম দিতে পারতো।

কার্ল সেগানের সব বইগুলোই আমাদের সর্বোচ্চ বিস্ময়ের স্নায়ুতন্তুতে সরাসরি স্পর্শ করে, যার উপর গত শতাব্দীগুলোতে একচ্ছত্র দখল ছিল ধর্মগুলোর। আমার নিজের বইগুলো সেভাবে সবাইকে স্পর্শ করুক সেটা আমারও কাম্য। সম্ভবত সে কারণে একজন গভীরভাবে ধার্মিক বলে আমাকে প্রায়ই বর্ণনা করা হয় বলে আমি শুনেছি। যুক্তরাষ্ট্রের একজন ছাত্রী আমাকে লিখেছিলেন, তার এক অধ্যাপককে, আমার সম্বন্ধে তাঁর কোনো মতামত আছে। কিনা জানতে চেয়েছিল সে। ‘অবশ্যই’, তিনি উত্তর দিয়ে ছিলেন ‘তার ইতিবাচক বিজ্ঞান ধর্মের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় ঠিকই, কিন্তু, প্রকৃতি আর মহাবিশ্ব নিয়ে যেভাবে তিনি আবেগময় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন, আমার কাছে, সেটাইতো ধর্ম!’; কিন্তু ‘ধর্ম’ শব্দটা কি সঠিক হতে পারে এক্ষেত্রে ব্যবহার করার জন্য? আমি সেটা মনে করি না। নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী এবং একজন নিরীশ্বরবাদী) স্টিভেন ওয়াইনবার্গ (১০) তার ‘ড্রিমস অব এ ফাইনাল থিওরী’ (১১) বইটিতে অনেকের মতই এই প্রসঙ্গে লিখেছিলেন:

ঈশ্বর সম্বন্ধে কিছু মানুষের ধারণা এত ব্যাপক আর নমনীয়, এটা অবশ্যম্ভাবী যে, তারা যেদিকে খুঁজবেন সেখানেই ঈশ্বরকে খুঁজে পাবেন। মাঝে মাঝে শোনা যায় ‘ঈশ্বরই চূড়ান্ত’ অথবা “ঈশ্বর আমাদের শ্রেষ্ঠতম অংশ’ বা ‘ঈশ্বরই এই মহাজগত’; অবশ্যই, অন্য যে কোন শব্দের মতোই ঈশ্বর শব্দটিকে আমরা আমাদের ইচ্ছামতন অর্থ দিতে পারি। আপনি যদি বলতে চান বলতে পারেন যে ‘ঈশ্বরই শক্তি’, তাহলে আপনি ঈশ্বরকে এক টুকরো কয়লার মধ্যেও পেতে পারেন। ওয়াইনবার্গ অবশ্যই সঠিক, যদি “ঈশ্বর’ শব্দটিকে আমরা পুরোপুরি অব্যবহারযোগ্য করে ফেলতে না চাই, তাহলে একে ব্যবহার করতে হবে ঠিক সেইভাবে, যেভাবে বেশিরভাগ মানুষ সাধারণত এই শব্দটির অর্থ অনুধাবন করে থাকেন: অর্থাৎ একজন অতিপ্রাকৃত সৃষ্টিকর্তাকে বোঝাতে, যিনি আমাদের উপাসনার উপযুক্ত।

অনেক দুর্ভাগ্যজনক জটিলতার সৃষ্টি হয় যখন আমরা আইনস্টাইনীয় ধর্ম আর অতিপ্রাকৃত ধর্ম, এই দুটোর মধ্যে পার্থক্য করতে পারিনা। আইনস্টাইন (১২) মাঝে মাঝেই God (ঈশ্বর)। শব্দটা ব্যবহার করেছেন (আর শব্দটা ব্যবহার করার ক্ষেত্রে তিনিই কিন্তু একমাত্র নিরীশ্বরবাদী বিজ্ঞানী না), অতিপ্রাকৃতবাদীদের সুযোগ করে দিয়েছেন বিষয়টি ভুলভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য, যারা এমনিতেই বিশেষ ভাবে আগ্রহী এর অপব্যাখ্যা এবং এমন একজন বিখ্যাত মনিষীকে তাদের মতবাদী বলে দাবী করার জন্য। স্টিফেন হকিং (১৩) এর ‘দ্য ব্রিফ হিষ্টরী অব টাইম’ বইটির নাটকীয় (নাকি দুষ্টামীপূর্ণ?) শেষ বাক্য ‘এবং তখনই আমরা ঈশ্বরের মনের কথা জানতে পারবো’; উক্তিটি এধরনের অপব্যাখ্যার জন্য বিশেষভাবে কুখ্যাত, অনেকের মনেই এটি হকিং একজন ধার্মিক মানুষ, এমন ধারণার (অবশ্যই ভুল ভাবে) জন্ম দিয়েছে(১৪) । কোষ জীববিজ্ঞানী উরসুলা গুডইনাফ(১৫) এর ‘দ্য স্যাকরেড ডেপথ অফ নেচার’ আইনস্টাইন কিংবা হকিং এর চেয়েও আরো বেশী ধার্মিকতা সংক্রান্ত ভুল ধারণা দেয়, গীর্জা, মসজিদ আর মন্দির তাঁর খুবই পছন্দের, তার লেখার অনেক অংশই অনায়াসে অপব্যাখ্যা করে অতিপ্রাকৃত ধর্মের পক্ষে ব্যবহার করা যেতে পারে। এমন কি নিজেকে একজন ধার্মিক প্রকৃতিবিজ্ঞানী হিসাবে পরিচয় দিতেও তিনি দ্বিধাবোধ করেননি। কিন্তু একটু মনোযোগ দিয়ে তার লেখা পড়লেই বোঝা যায়, তিনি আসলে আমার মতই একজন কট্টর নিরীশ্বরবাদী।

ন্যাচারালিস্ট বা ‘প্রকৃতি বিজ্ঞানী’ শব্দটি খুবই অস্পষ্ট। আমার জন্য শব্দটি আমার ছোট বেলার নায়ক হিউ লফটিং(১৬) এর ডক্টর ডুলিটলের কথা মনে করিয়ে দেয় (তিনি কিন্তু কিছুটা এইচ এম এস বীগল (১৭) এর সেই দার্শনিক প্রকৃতি বিজ্ঞানীর মতই। ছিলেন); অষ্টাদশ এবং উনবিংশ শতাব্দীতে প্রকৃতি বিজ্ঞানী বলতে যা বোঝাতো, এখনও বেশীর ভাগ মানুষের কাছে সেটাই অপরিবর্তিত আছে : প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের (প্রাণিবিজ্ঞান ও উদ্ভিদবিজ্ঞান) একজন শিক্ষার্থী। সেই গিলবার্ট হোয়াইট (১৮) থেকে, প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা অধিকাংশ সময়ই পেশায় ছিলেন ধর্মযাজক। তরুণ ডারউইনেরও ধর্মযাজক হবার কথা ছিল, আশা। ছিল কোনো গ্রামের প্যারিশের পারসন (১৯) বা যাজকের ঝামেলামুক্ত একটা জীবন হবে তার, পছন্দের গুবরে পোকাদের নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ পাবেন। কিন্তু দার্শনিকরা ‘প্রকৃতি বিজ্ঞানী’ শব্দটা ব্যবহার করেন অন্য অর্থে, তা অবশ্যই ‘অতিপ্রাকৃত বিজ্ঞানীর’ বিপরীতার্থে। জুলিয়ান ব্যাগিনী (২০) তার ‘অ্যাথেইজম: এ ভেরী শর্ট ইন্ট্রোডাকশন’ এ ব্যাখ্যা করেছিলেন, ন্যাচারালিজম বা প্রকৃতিবাদের প্রতি নিরীশ্বরবাদীদের অঙ্গীকারটি আসলে কি: ‘নিরীশ্বরবাদীরা যা বিশ্বাস করে তা হলো, মহাবিশ্বে কেবল একটি জিনিস আছে, যা ভৌতিক, এর থেকেই উৎপত্তি হয়েছে, মন, সৌন্দৰ্য্য,অনুভূতি, ন্যায়, অন্যায়, নৈতিকতাবোধ সংক্ষেপে সবকিছুই, সকল বিস্ময়কর বস্তু যা মানব জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে।

মানুষের চিন্তাশক্তি এবং অনুভূতির উদ্ভব হয় মস্তিস্কের ভিতরে অবস্থিত আর সত্যিকারের অস্তিত্ব আছে, এমন কিছুর (নিউরোন (২১)) অতিমাত্রায় জটিল পারস্পরিক আন্তঃসংযোগের মাধ্যমে। তাহলে দার্শনিক প্রকৃতি বিজ্ঞানী অর্থে একজন নিরীশ্বরবাদী হচ্ছেন সেই জন যিনি বিশ্বাস করেন এই প্রাকৃতিক বা ভৌত মহাবিশ্বের বাইরে আর কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই, আমাদের পর্যবেক্ষণক্ষম মহাবিশ্বের অন্তরালে অতিপ্রাকৃত সৃজনশীল, বুদ্ধিমান কোন সৃষ্টিকর্তা লুকিয়ে নেই, শরীরের মৃত্যুর পর কোন আত্মারই অস্তিত্ব থাকেনা এবং নেই কোনো অলৌকিক ঘটনা শুধুমাত্র তা প্রাকৃতিক কোনো ঘটনা ছাড়া- যা হয়তো এখনও ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি। যদি এমন কিছু থাকে যা মনে হচ্ছে প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে,তা বর্তমানে আমাদের বোঝার সীমাবদ্ধতা মাত্র। আমরা আশা করি একদিন আমরা বুঝতে পারবে এবং প্রাকৃতিক কোন ঘটনা হিসাবে তা আমরা স্বীকার করে নেব। আমরা রঙধনুর রহস্যকে ভেদ করেছি, সেজন্য রঙধনুর মুগ্ধ করার ক্ষমতা কিন্তু কমে যায়নি।

আমাদের সময়ে অনেক মহান বিজ্ঞানী, যাদের কথা শুনলে আপাতদৃষ্টিতে তাদের ধার্মিক মনে হতে পারে, কিন্তু তাদের বিশ্বাসগুলি গভীরভাবে যাচাই করে দেখলে স্পষ্ট হয় ঠিক এর বিপরীতটাই। আইনস্টাইন এবং হকিং এর ক্ষেত্রে কথাটা বিশেষভাবে সত্যি। বর্তমান রাজকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং রয়্যাল সোসাইটির সভাপতি মার্টিন রিস (২২) আমাকে বলেছিলেন, তিনি চার্চে যাতায়াত করেন একজন ‘অবিশ্বাসী অ্যাঙলিকান হিসাবে স্বগোত্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে’; কোনো ধরনেরই ঈশ্বরের উপর তার বিশ্বাস নেই, কিন্তু যে বিজ্ঞানীদের নাম আমি ইতিমধ্যে উল্লেখ করেছি, তাদের মতই, তার মনেও এই মহাজগত, এক ধরনের কাব্যিক, প্রকৃতিবাদী অনুভূতির জন্ম দেয়। সম্প্রতি টেলিভিশনে একটি টক শোতে আমি আমার বন্ধু রবার্ট উইনস্টোনকে, যিনি একজন প্রখ্যাত ধাত্রীবিশেষজ্ঞ ও ইহুদী সমাজের একজন নেতৃস্থানীয় সদস্য, চ্যালেঞ্জ করেছিলাম স্বীকার করে নিতে যে, তার ইহুদীবাদ ঠিক এধরনেরই এবং তিনি আদৌ অতিপ্রাকৃত কোন কিছুতেই বিশ্বাস করেন না (২৩) । প্রায় স্বীকার করতে করতে একেবারে শেষ পর্যন্ত এসে তিনি পিছিয়ে গেছেন। (মানতেই হবে, তারই আসলে সাক্ষাৎকার নেবার কথা ছিল আমাকে, বিপরীতটা না); আমি যখন তাকে জোর করেছিলাম কিছু বলার জন্য, তিনি বলেছিলেন, ইহুদীবাদ তার জীবনকে ঠিকমত সাজাতে প্রয়োজনীয় শৃঙ্খলা দিয়েছে। হয়তো সেটা ঠিক, কিন্তু অবশ্যই, শুধুমাত্র সেটাই, এর (ইহুদীবাদ) অতিপ্রাকৃত অবস্থানের সত্যতার পক্ষে দাবীদার হওয়ার জন্য ক্ষুদ্রতম কোন ভূমিকাই রাখেনা। অনেক বুদ্ধিজীবি ইহুদী আছেন যারা নিজেদের ইহুদী পরিচয় দিতে গর্ব বোধ করেন এবং ধর্মীয় আচারও পালন করেন হয়ত প্রাচীন ঐতিহ্য মেনে বা প্রয়াত স্বজনদের স্মরণে। কিন্তু এছাড়াও অন্য কারণটি হলো, ধর্মকে ‘সর্বেশ্বরবাদ’ হিসাবে চিহ্নিত করে বিশেষ শ্রদ্ধার একটা অবস্থান দেয়ার জন্য আমাদের কিছু বিভ্রান্তি বা বিভ্রান্তিকর ইচ্ছা বা প্রবণতা, যা এর সবচেয়ে বিশিষ্ট সমর্থক আলবার্ট আইনস্টাইনের মত আমরা হয়তো অনেকেই অনুভব করি। তারা হয়তো তা বিশ্বাস করেন না, কিন্তু দার্শনিক ড্যানিয়েল ডেনেটের একটা উদ্ধৃতি ব্যবহার করে বলা যায়,তারা ‘একটি বিশ্বাসকে বিশ্বাস করেন (২৪)।

অতি আগ্রহের সাথে আইনস্টাইনের যে উদ্ধৃতিটি ব্যবহৃত হয় ‘বিজ্ঞান ধর্ম ছাড়া পঙ্গু, আর ধর্ম বিজ্ঞান ছাড়া অন্ধ’, কিন্তু আইনস্টাইন আরো বলেছিলেন:

আমার ধর্ম বিশ্বাস সম্বন্ধে, আপনারা যা পড়ে থাকবেন, তা অবশ্যই মিথ্যা। এই মিথ্যা বারবার একইভাবে পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। আমি কোনো ব্যক্তিগত ঈশ্বরকে বিশ্বাস করিনা এবং আমি কখনোই এই কথাটা অস্বীকার করিনি বরং সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছি। যদি আমার মধ্যে এমন কিছু থাকে যাকে বলা যেতে পারে ধর্মবোধ, সেটা নিঃসন্দেহে, বিজ্ঞান যতটুকু উম্মোচন করেছে সেই মহাবিশ্বের গঠনের প্রতি আমার অসীম মুগ্ধতা।

মনে হচ্ছে কি আইনস্টাইন তাহলে কোনো স্ববিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন? আর বিতর্কের উভয়পক্ষ পক্ষ সমর্থনের জন্য কি তার বক্তব্যকে বেছে বেছে ব্যবহার করা যেতে পারে? না। সাধারণত যে অর্থে ‘ধর্ম” শব্দটি ব্যবহৃত হয়, তিনি সেই অর্থে শব্দটিকে ব্যবহার করেননি কখনোই। আমি যখন একদিকে অতিপ্রাকৃত ধর্ম আর অন্যদিকে আইনস্টাইনীয় ধর্মের মধ্যে পার্থক্য ব্যাখ্যা করছি, মনে রাখবেন, যে আমি ‘অতিপ্রাকৃত’ ঈশ্বরদেরকেই কেবল বিভ্রান্তিকর বলছি।

আইনস্টাইনের ধর্মের স্বরুপ বোঝাতে আমি এখানে আরো কিছু আইনস্টাইনের উদ্ধৃতি উল্লেখ করছিঃ

আমি গভীরভাবে ধার্মিক একজন অবিশ্বাসী। এটাই নতুন কোনো এক ধরনের ধর্ম।

আমি কখনই প্রকৃতির উপর কোনো উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য আরোপ করিনা অথবা এমন কিছু যা মানবিক গুণাবলী

বলে মনে হতে পারে। আমি প্রকৃতিতে যা দেখি তা হলো এর অসাধারণ গঠন, যা আমরা খুব সামান্যই বুঝতে পারি, যে কোনো চিন্তাশীল মানুষকে যা বিনম্র হতে বাধ্য করে। এটা অবশ্যই ধর্মীয় একটা অনুভূতি কিন্তু এর মধ্যে কোন অতিপ্রাকৃত রহস্যময়তা নেই।

ব্যক্তিগত কোনো ঈশ্বরের ধারণা আমার কাছে খুবই অপরিচিত আর এমনকি মনে হয় ছেলেমানুষী।

তার মৃত্যুর পর থেকেই ক্রমশ বাড়তে থাকা ধর্মীয় পক্ষসমর্থনকারীরা বোধগম্য কারণেই আরো বেশী করে আইনস্টাইনকে তাদের নিজেদের একজন বলে দাবী করে এসেছেন। তার সমসাময়িক ধর্ম সমর্থকরা কিন্তু তাকে দেখেছিলেন ভিন্নভাবে। আমি কোনো ব্যক্তিগত ঈশ্বরকে বিশ্বাস করিনা’ কথাটি ব্যাখ্যা করার জন্য, ১৯৪০ সালে তিনি একটি বিখ্যাত প্রবন্ধ লিখেছিলেন। এটি এবং এই ধরনের কিছু বক্তব্যের জন্য তাকে গোঁড়া ধর্ম সমর্থকদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়, সমালোচনা মুখর অসংখ্য চিঠি পান তিনি, যার অনেকগুলোতে তার ইহুদী জন্ম ইতিহাসের প্রতি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল। ম্যাক্স জ্যামারের (২৫) “আইনস্টাইন অ্যান্ড রেলিজিওন (২৬) বইটি থেকেই নিম্নে উল্লেখিত তথ্যগুলো আমরা পাই (ধর্ম সংক্রান্ত আমার ব্যবহৃত আইনস্টাইনের বিভিন্ন উদ্ধৃতির উৎসও এই বইটি) : ক্যানসাস সিটির রোমান ক্যাথলিক বিশপ মন্তব্য করেছিলেন, ‘দুঃখজনক একটা ব্যপার, একজন ব্যক্তি, যে কিনা ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্নিত জাতির সদস্য, তিনি সেই জাতির মহান ঐতিহ্যকে অস্বীকার করছেন।’; অন্যান্য ক্যাথলিক ধর্মযাজকরাও যোগ দিয়েছিলেন সমালোচনায়: ‘ব্যক্তিগত ঈশ্বর ছাড়া অন্য কোনো ঈশ্বর নেই, আইনস্টাইন নিজেই জানেন না কি বিষয়ে কথা বলছেন। পুরোটাই ভুল তিনি। কিছু মানুষ মনে করেন, কোনো এক বিষয়ে সর্বোচ্চ জ্ঞান অর্জন করলেই, সব বিষয়ে তারা মত প্রকাশের যোগ্যতা অর্জন করে ফেলেছেন। অর্থাৎ ধর্ম যেন একটা বিশেষ বিষয় আর কেউ এই বিশেষ বিষয়ে নিজেকে বিশেষজ্ঞ বলেও দাবী করতে পারেন, যিনি সব বিতর্কের উর্দ্ধে। ধারণা করা যেতে পারে, ঐ পাদ্রী পরীদের পাখার সঠিক আকৃতি বা রং এর বিষয়ে কোনো আত্মস্বীকৃত ‘পরী বিশেষজ্ঞ’ র পরামর্শ নিতে হয়তো অপেক্ষা করেন না। তিনি এবং বিশপ দুজনই বলছেন, আইনস্টাইন যেহেতু ধর্মীয় তত্ত্বে প্রশিক্ষিত নয় সুতরাং ঈশ্বরের প্রকৃতি সম্বন্ধে তার ধারণা ভ্রান্ত কিন্তু আইনস্টাইন খুব ভালো ভাবেই জানতেন ঠিক কোন বিষয়টিকে তিনি অস্বীকার করছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের রোমান ক্যাথলিক আইনজীবি যিনি একটি একুমেনিকাল (২৭) কোয়ালিশনের এর পক্ষে কাজ করেন, তিনি আইনস্টাইনকে লিখেছিলেন:

আমরা গভীরভাবে দুঃখ পেয়েছি, আপনি এধরনের একটি মন্তব্য করেছেন .. যেখানে আপনি ব্যক্তিগত ঈশ্বরের ধারণাটিকে উপহাস করেছেন। বিগত দশ বছরে আপনার এই বক্তব্যের মত আর কোনো কিছুই, মানুষকে এই চিন্তা করার সুযোগ দেয়নি যে, জার্মানী থেকে ইহুদীদের বহিষ্কার করার পেছনে হিটলারের আসলেই কিছু কারণ ছিল। আপনার যে কোনো কিছু বলার অধিকার আছে, এই কথা স্বীকার করে নিয়ে বলছি; এ ধরনের বক্তব্য আপনাকে অ্যামেরিকায় বিতর্কের অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

নিউ ইয়র্কের একজন ইহুদী ধর্মযাজক বা রাবাই বলেছিলেন, ‘আইনস্টাইন নিঃসন্দেহে একজন মহান বৈজ্ঞানিক, কিন্তু তার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি ইহুদীবাদের একেবারে বিপরীত।

‘কিন্তু’? ‘কিন্তু’? ‘এবং’ কেন নয়?

নিউ জার্সী হিস্টোরিকাল সোসাইটির সভাপতির লেখা চিঠিটা পড়লে তার ধর্মীয় মানসিকতার দুর্বলতার স্বরুপটা এতই স্পষ্ট হয়। যে এটি দ্বিতীয় বার পড়া যেতে পারে:

ডঃ আইনস্টাইন, আমরা আপনার শিক্ষাকে সম্মান করি। কিন্তু মনে হচ্ছে একটি বিষয় আপনার শেখা হয়নিঃ ঈশ্বর হচ্ছে আত্মার মত, নিরাকার সত্তা, যা কেউ টেলিস্কোপ বা মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজে পাবেনা, যেমন মানুষের চিন্তা আর অনুভূতি, আবেগ মস্তিস্ক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে পাওয়া যায়না। সবাই জানে ধর্মের ভিত্তি হলো বিশ্বাস, কোন যুক্তিনির্ভর জ্ঞান নয়। চিন্তাক্ষম সব মানুষই, হয়তো কোনো না কোনো এক সময় ধর্ম সংক্রান্ত সন্দেহে আক্রান্ত হন। আমার নিজের বিশ্বাসই নাড়া খেয়েছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু আমি কখনোই আমার এই বিশ্বাসের সংকটের কথা কাউকে বলিনি দুটি কারণে: প্রথমত, আমার শঙ্কা ছিল এ বিষয়ে আমার সামান্যতম মন্তব্য কিছু মানুষের জীবন ও তাদের আশাকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে। দ্বিতীয় কারণ আমি সেই লেখকের সাথে একমত, যিনি বলেছিলেন যারা অন্য কারো বিশ্বাসকে ধ্বংস করে তাদের চরিত্রে অন্যের ক্ষতি করার প্রবণতা আছে’.. আশা করি ডঃ আইনস্টাইন, আপনার বক্তব্যটিকে সঠিকভাবে। উপস্থাপন করা হয়নি এবং আপনি নিশ্চয়ই অসংখ্য অ্যামেরিকানদের উদ্দেশ্যে ভালো আর সঠিক কিছু বলবেন, যারা আপনাকে সম্মান জানানোর উদগ্রীব।

কি ভয়াবহ রকমের চারিত্রিক দুর্বলতা উন্মোচন করা একটি চিঠি, যার প্রতিটি পংক্তিতে নৈতিক আর বুদ্ধিবৃত্তিক ভীরুতা ও কাপুরুষতা ঝরে পড়ছে।

আরেকটু কম কাপুরুষোচিত কিন্তু বেশী জঘন্য চিঠিটি লিখেছিলেন, ওকলাহোমার ক্যাভালী ট্যাবেরন্যাকল অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা:

অধ্যাপক আইনস্টাইন, আমি বিশ্বাস করি অ্যামেরিকার প্রত্যেকটি খ্রিষ্টান আপনাকে উত্তর দেবে, ‘আমরা আমাদের ঈশ্বর আর তার পুত্র যীশু খ্রিষ্টের উপর বিশ্বাস পরিত্যাগ করবো না, কিন্তু আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, যদি আপনি এই জাতির ঈশ্বরকে বিশ্বাস না করেন, তাহলে যেখান থেকে আপনি এসেছেন সেখানে ফেরত চলে যান’; ইসরায়েলের ভালোর জন্য যা করা সম্ভব আমি করেছি, ধর্মকে অসম্মান করে আপনার ধর্মনিন্দাপূর্ণ জিহ্বা থেকে উচ্চারিত এই বক্তব্য নিয়ে আপনি বিতর্কে যোগ দিলেন। ইসরায়েলপ্রেমী খ্রিষ্টান এইদেশ থেকে ইহুদী-বিদ্বেষ নির্মূল করার সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, এই বক্তব্য আপনার জাতির জন্য আরো বেশী ক্ষতিকর প্রমাণিত হবার সম্ভাবনা আছে। অধ্যাপক আইনস্টাইন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যেকটি খ্রিষ্টান আপনাকে তাৎক্ষণিক উত্তর দেবে, আপনার এই সব বাতিকগ্রস্থ, বিবর্তনের ভুল তত্ত্ব নিয়ে জার্মানী চলে যান, যেখান থেকে আপনি এসেছেন অথবা এই দেশের মানুষদের, যারা আপনি যখন নিজের দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন, এই দেশে স্বাগত জানিয়েছিল আপনাকে, সেই সব মানুষদের বিশ্বাসকে আঘাত করার চেষ্টা বন্ধ করুন’।

তাঁর ঈশ্বরবাদী এবং ধর্মবিশ্বাসী সব সমালোচকরা একটা বিষয় কিন্তু সঠিক ধরতে পেরেছিলেন, আইনস্টাইন, তাদের দলের কেউ নন। বার বার তিনি ক্ষুদ্ধ হয়েছেন যখনই তাকে থেইষ্ট বা ঈশ্বরবিশ্বাসী বলা হয়েছে। তাহলে তিনি কি ডেইষ্ট বা একাত্মবাদী, ভলতেয়ার (২৮) আর দিদেরো’র (২৯) মতন? কিংবা প্যানথেইষ্ট বা সর্বেশ্বরবাদী, স্পিনোজার (৩০) মতন, যার দর্শনকে তিনি শ্রদ্ধা করতেন; ‘আমি স্পিনোজার ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি, যিনি নিজেকে উন্মোচন করেন অস্তিত্ব আছে এমন সকল কিছুর মধ্যে বিদ্যমান সুশৃঙ্খল সংহতিতে, কিন্তু সেই ঈশ্বরে নয়, যিনি মানুষের নিয়তি আর কর্ম নিয়ে নিজেকে প্রতিনিয়ত ব্যতিব্যস্ত রাখেন?

কিছু শব্দের অর্থ আমরা আবার মনে করে নেই; একজন থেইষ্ট বা ঈশ্বরবাদী হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি অতিপ্রাকৃত, অতিবুদ্ধিমান কোন ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন, যিনি (ঈশ্বর) তার প্রধান কাজ, প্রথমত এই মহাবিশ্বকে সৃষ্টি করা ছাড়াও, তার সেই সৃষ্টির দেখাশোনা এবং পরবর্তীতে এর নিয়তিকে প্রভাবিত করার জন্য যিনি এখনও সর্বশক্তিসহ বিরাজমান। ঈশ্বরবাদীদের বিশ্বাসের কাঠামোতে, মানুষের যাবতীয় কর্মকাণ্ডে এই ঈশ্বর ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। তিনি তাদের প্রার্থনার জবাব দেন, পাপের শাস্তি প্রদান বা ক্ষমা করেন, অলৌকিক ঘটনার মাধ্যমে পৃথিবীর নানা কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করেন, তার সৃষ্টির ভালো আর খারাপ কর্মকাণ্ড নিয়ে তিনি চিন্তাভাবনা করেন এবং তিনি জানেন আমরা কখন এসব করছি (অথবা এমনকি অন্তর্যামী হিসাবে তিনি এও জানেন এমন কি কখন আমরা এসব করার জন্য এমনকি কোন চিন্তা ভাবনাও করছি); একজন ডেইষ্ট বা একাত্মবাদীও, অতিপ্রাকৃত, অতিবুদ্ধিমান, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে বিশ্বাস করেন, তবে তার কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ শুধুমাত্র সৃষ্টির আদিতে মহাবিশ্ব পরিচালনাকারী নিয়মকানুনগুলো সুনির্দিষ্ট করার মধ্যেই। কিন্তু এরপর একাত্মবাদীদের ঈশ্বর তার সৃষ্টিতে আর কোনো ধরনের হস্তক্ষপ করেন না এবং অবশ্যই মানুষের কর্মকাণ্ডে তার কোনো বিশেষ আগ্রহও নেই। প্যানথেইষ্টরা বা সর্বেশ্বরবাদী কোনো অতিপ্রাকৃত, অতিবুদ্ধিমান ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না তবে ‘ঈশ্বর’ শব্দটি তারা ব্যবহার করেন একটি অলৌকিকতার ইঙ্গিতমুক্ত প্রতিশব্দ হিসাবে প্রকৃতি বা মহাজগত বা মহাজগতের সকল কর্মকাণ্ডগুলোকে নিয়ন্ত্রণকারী সুশৃঙ্খলতাকে বোঝাতে। একাত্মবাদীদের ঈশ্বরের সাথে ঈশ্বরবিশ্বাসী ঈশ্বরের পার্থক্য হলো, তাদের ঈশ্বর প্রার্থনার উত্তর দেন না, পাপপুণ্য বা আমাদের পাপের স্বীকারোক্তি নিয়ে আদৌ মাথা ঘামান না, আমাদের মনের কথাও জানার চেষ্টা করেন না, খেয়ালখুশী মত কোনো অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে আমাদের জীবনে কোনো হস্তক্ষেপ করেন না। একাত্মবাদীরা সর্বেশ্বরবাদী থেকে আলাদা কারণ একাত্মবাদীদের ‘ঈশ্বর’ হল কোনো এক ধরনের মহাজাগতিক বুদ্ধিমত্তা, সর্বেশ্বরবাদীদের মত মহাবিশ্বের সুশৃঙ্খল নিয়মকানুন এর রুপকধর্মী বা কাব্যিক কোন প্রতিশব্দ না। সর্বেশ্বরবাদ অনেকটা আকর্ষণীয় আর গ্রহনযোগ্য নিরীশ্বরবাদ অন্যদিকে একাত্মবাদ হল দূর্বল ঈশ্বরবাদ।।

অবশ্যই চিন্তা করার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে যে, কিছু বিখ্যাত ‘আইনস্টাইনবাদ’ যেমন: ‘ঈশ্বর সূক্ষ্ম এবং চতুর কিন্তু তিনি কারো ক্ষতি করার মনোভাব পোষণ করেন না’ অথবা ‘ঈশ্বর কোন জুয়া খেলেননি’ বা ‘এই মহাবিশ্ব সৃষ্টিতে ঈশ্বরের কি কোন বিশেষ পছন্দ ছিল?” এই মন্তব্যগুলো সর্বেশ্বরবাদী, একাত্মবাদী নয়, আর ঈশ্বরবাদীতো অবশ্যই নয়। ‘ঈশ্বর কোন জুয়া খেলেন নি’ এই মন্তব্যটি ব্যাখ্যা করা উচিত ‘মহাজগতের সব কিছুরই কেন্দ্র কিন্তু এলোমেলো লক্ষ্যহীন নয়’– এইভাবে। “এই মহাবিশ্ব সৃষ্টিতে কোন ঈশ্বরের কি বশেষ পছন্দ ছিল?” এর মানে “মহাবিশ্ব কি আর অন্য কোনভাবে শুরু হতে পারতো?”, আইনস্টাইন ‘ঈশ্বর’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন সম্পূর্ণভাবে রুপক বা কাব্যিক অর্থে। স্টিভেন হকিং ও তাই করেছেন, এছাড়াও অন্য আরো অনেক পদার্থবিজ্ঞানী, যারা প্রায়শই ধর্মীয় রুপক ব্যবহার করেছেন তাদের ভাষায়। পল ডেভিসের (৩১) ‘দ্য মাইন্ড অফ গড’, যে বইটার জন্য তিনি টেম্পলটন পুরষ্কার পেয়েছিলেন, সেটি অবস্থান করছে আইনস্টাইনীয় সর্বেশ্বরবাদ আর অস্পষ্ট একটা একাত্মবাদের মাঝামাঝি একটা অবস্থানে (প্রতি বছর বেশ বড় অঙ্কের একটা অর্থ পুরষ্কার হিসাবে দিয়ে থাকে টেম্পলটন ফাউন্ডেশন, সাধারণত ধর্ম সম্পর্কে সুন্দর কিছু কথা বলার জন্য তৈরী কোন বিজ্ঞানীকে)।

আইনস্টাইনেরই আরেকটি উদ্ধৃতি দিয়ে আমি তার ধর্মভাবনা নিয়ে আলোচনা শেষ করতে চাই: ‘সবকিছু যা আমরা অনুভব করতে পারি, পেছনে এমন কিছু আছে যা আমাদের বুদ্ধির ব্যাখ্যাতীত, যার সৌন্দৰ্য্য, বিশালতা আর মহিমময়তা আমাদেরকে স্পর্শ করে পরোক্ষভাবে, ক্ষীণ কোন ভাবনা রুপে, সেটা বোঝা আর অর্থ খুঁজে বের করাটাই ধার্মিকতা; এই অর্থে আমি ধার্মিক’; আর এই অর্থে আমিও ধার্মিক, তবে একটু আপত্তি সাপেক্ষে, বুদ্ধির ব্যাখ্যাতীত এর অর্থ ‘চিরকালই বুদ্ধির ব্যাখ্যাতীত’ হতে হবে এমনটা না। কিন্তু আমি নিজেকে ধার্মিক বলে পরিচয় দিতে চাই না কারণ এর অপব্যাখ্যা হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। অপব্যাখ্যাটা ক্ষতিকর কারণ, অসংখ্য মানুষের কাছে ধর্ম বলতে অতিপ্রাকৃত ধর্মকেই বোঝায়। কার্ল সেগান সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন: ‘ঈশ্বর বলতে কেউ যদি বোঝাতে চায় এক গুচ্ছ প্রাকৃতিক নিয়মাবলী যা মহাবিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে, সেক্ষেত্রে অবশ্যই এরকম একজন ঈশ্বর আছেন। এই ঈশ্বর অবশ্যই আবেগগত দিক থেকে সন্তুষ্টি দিতে ব্যর্থ, মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কাছে কিছু প্রার্থনা করা নিশ্চয়ই খুব একটা অর্থময় অনুভূত হয় না।’

মজার ব্যপার হলো সেগানের শেষ বক্তব্যটির পূর্বাভাস কিন্তু আগেই করেছিলেন, অ্যামেরিকান ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটির একজন অধ্যাপক, রেভারেন্ড ডঃ ফুলটন জে শীন, ১৯৪০ সালে আইনস্টাইনের ব্যক্তিগত ঈশ্বরের ধারণাকে অস্বীকার করার ঘটনার তীব্র সমালোচনার অংশ হিসাবে। তিনি ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় জানতে চেয়েছিলেন, এমন কি কেউ আছে, যে মিল্কি ওয়ের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতে পারে? তিনি মনে করেছিলেন বক্তব্যটি তিনি আইনস্টাইনের বিপক্ষে বলছেন, পক্ষে না। তিনি আরো বলেছিলেন, তার এই ‘কসমিক্যাল বা Cosmical না Comical” ধর্মে একটি মাত্র ভুল আছে, তিনি কেবল একটি বাড়তি অক্ষর ব্যবহার করেছেন শব্দটিতে, ‘s’ হলো সেই অক্ষরটি; আইনস্টাইনের বিশ্বাসের মধ্যে অবশ্যই কোনো ‘কমিক্যাল ব্যপার নেই, তাসত্ত্বেও, আমি আশা করি,পদার্থবিজ্ঞানীরা এভাবে বিশেষ রুপক অর্থে ‘ঈশ্বর’ শব্দটি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকবেন। পদার্থবিদদের রুপকার্থে ব্যবহৃত বা সর্বেশ্বরবাদের এই ‘ঈশ্বর’,বাইবেলে বর্ণিত, সবকিছুতে সরাসরি হস্তক্ষপকারী, অলৌকিক কর্মকাণ্ড ঘটানোয় পারদর্শী, অন্তর্যামী, পাপের শাস্তি প্রদানকারী, প্রার্থনার উত্তরদাতা, পাদ্রী, মোল্লাদের বা রাবাইদের বা সাধারণ ভাষায় ব্যবহৃত ‘ঈশ্বর’ থেকে বহু আলোকবর্ষ দূরে। আমার মতে, ইচ্ছা প্রণোদিত হয়ে এই দুই পৃথক ‘ঈশ্বর’ এর ধারণার মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা একটি মারাত্মক বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্বাসঘাতকতা।

যে শ্রদ্ধা পাওয়ার অযোগ্য

আমার এই বইটির শিরোনাম ‘দ্য গড় ডিলুশন’ এর ‘গড’ বা ঈশ্বর, আইনস্টাইনের বা আগের অনুচ্ছেদগুলোয় উল্লেখ করা কোনো জ্ঞানালোকপ্রাপ্ত বিজ্ঞানীদের ঈশ্বর নন। বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার পূর্বপ্রমাণিত ক্ষমতা আছে বিধায় আমি আগে ভাগেই আইনস্টাইনের ধর্ম ব্যাখ্যা করে নিলাম। এই বই এর বাকী অংশে আমি শুধু ‘অতিপ্রাকৃত’ ঈশ্বরদের কথাই বলবো, এদের মধ্যে, আমার বেশীর ভাগ পাঠক যার সাথে পরিচিত, তিনি হলেন ওল্ড টেস্টামেন্টের ঈশ্বর ‘ইয়াহয়ে’; এ বিষয়ে কথা বলার আগে এবং এই প্রথম অধ্যায় শেষ করার আগে পাঠকদের সাথে আরেকটা বিষয় আমার স্পষ্ট করা উচিৎ, নয়ত পুরো বইটির অপব্যাখ্যা করার সুযোগ থেকে যাবে। এবারের বিষয়টি ভদ্রতার। আমি যা বলতে চেয়েছি তা সম্ভবত ধর্মবিশ্বাসী অনেক পাঠককে তা আহত করবে। মনে হতে পারে বইটিতে তাদের নিজেদের বিশ্বাসের (যদিও তাদের বিশ্বাস অন্য অনেকের কাছে মূল্যবান নাও হতে পারে) প্রতি অপর্যাপ্ত সম্মান দেখানো হয়েছে। খুবই দুঃখজনক হবে যদি সেকারণে তারা বইটি না পড়তে চান, সুতরাং শুরুতেই ব্যপারটার ব্যাখ্যা দিতে চাই।

একটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত ধারণার অস্তিত্ব আছে, যা সমাজের প্রায় সবাই– যারা ধার্মিক না তারাও • মেনে নিয়েছেন, তা হলো, ধর্মীয় বিশ্বাস যে কোনো ধরনের আক্রমণে খুব সহজেই ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে এবং সেই জন্য শ্রদ্ধার মোটা দেয়াল দিয়ে ধর্মকে সুরক্ষিত রাখা উচিৎ। এই শ্রদ্ধার প্রকৃতি মানুষের প্রতি মানুষের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা শ্রেণীর। মৃত্যুবরণ করার কিছুদিন আগে কেমব্রিজ এ একটি উপস্থিত বক্তৃতায় ডগলাস অ্যাডামস এর সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তার বক্তব্য সবার সাথে ভাগ করে নেবার ব্যপারে আমি কখনই ক্লান্তিবোধ করিনা (৩২):

ধর্ম .. এর কেন্দ্রে কিছু বিশেষ ধারণা আছে যা আমরা নাম দিয়েছি, পরম শ্রদ্ধেয় বা পবিত্র ইত্যাদি। যার সার কথাটা। হলো, এই যে এটা হচ্ছে একটা ধারণা বা অভিমত, যার বিরুদ্ধে খারাপ কিছু বলার আপনার কোনই অনুমতি নেই’; আপনি বলতে পারবেন না এটাই চূড়ান্ত। কেন না, কি কারণে?–কারণ আপনি বলতে পারবেন না! এটাই হলো শেষ কথা। কেউ যদি এমন কোন দলকে ভোট দেয় যার সাথে আপনি একমত না, সেক্ষেত্রে আপনি কিন্তু তার সাথে যত খুশি তত তর্ক করতে পারবেন; সবারই কোন না কোন নিজস্ব মতামত আছে, কেউই কিন্তু কোন বিশেষ দুঃখ পায় না সেই বিতর্কে। কেউ যদি মনে করে ট্যাক্স বাড়ানো বা কমানো উচিৎ, সে বিষয়ে যে কোন ধরনে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন বা মতামত প্রকাশের অধিকার আপনার আছে। কিন্তু কেউ যদি বলে, ‘শনিবারে আলো জালানো জন্য সুইচটাও আমার ধরা উচিৎ না, আপনি বলবেন, “আমি সেটা শ্রদ্ধা করি; কেনই বা এটা সম্পূর্ণভাবে ন্যায়সঙ্গত হবে যেমন, লেবার পার্টি কিংবা কনসারভেটিভ পার্টিকে সমর্থন করা, কিংবা রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাটদের, অর্থনীতির এই মডেল বা অন্যটাকে, উইনডোজ এর পরিবর্তে ম্যাকিনটশকে; কিন্তু যখনই কিভাবে মহাবিশ্বের শুরু হলো আর কে এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করলো, এই বিষয়ে কোন মতামত পোষণ করা হচ্ছে না কারণ এটা পবিত্র একটা বিষয়? সাধারণত ধর্মীয় কোন বিষয়কে চ্যালেঞ্জ না করাটাই আমাদের নিয়ম। কিন্তু সত্যি বিষয়টা দারুণ কৌতূহলের কারণ হয়, যখন রিচার্ড (রিচার্ড ডকিন্স) এর সেই কাজটাই করার জন্য হৈ চৈ পড়ে যায়! প্রত্যেকেই প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে ওঠে, কারণ এধরনের কোনো কথা বলার আপনার অনুমতি নেই। অথচ যুক্তি মেনে বিষয়টা ভাবলেই দেখা যাবে, ঐ সব বিষয়গুলো নিয়ে অন্য যে কোন বিষয়ের মত; কেনই বা কোন বিতর্ক করা যাবেনা, তার কিন্তু কোনো কারণ নেই। শুধুমাত্র আমরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে কোনোভাবে একমত হয়ে ঠিক করেছি যে এটা করা যাবেনা।

ধর্মের প্রতি সমাজের অতিমাত্রায় শ্রদ্ধা প্রদর্শনের একটা গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ দেই। যুদ্ধকালীন সময়ে সামরিক দ্বায়িত্ব পালন এড়াতে ‘বিবেকজনিত কারণে বিরোধিতা করার অবস্থান পাবার সবচেয়ে সহজ উপায় হল ‘ধর্মীয় কারণ দেখানো। আপনি হতে পারেন একজন বিখ্যাত নীতিশাস্ত্রবিদ দার্শনিক, হতে পারেন আপনার কোন পুরষ্কার পাওয়া নীরিক্ষাধর্মী ডক্টরাল থিসিস আছে যুদ্ধের ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে, তারপরও সেনাবাহিনীর ড্রাফট বোর্ড আপনার বিবেকজনিত কারণে যুদ্ধের বিরোধিতা” র মূল্যায়ন করতে বেশ ঝামেলা করবে। কিন্তু আপনি যদি বলেন আপনার বাবা ও মা দুজন অথবা তাদের একজন কোয়েকার (৩৩), তাহলে ব্যপারটা পানির মত সহজ হয়ে যাবে আপনার জন্য, সেক্ষেত্রে প্যাসিফিজম বা শান্তিবাদের তত্ত্বের উপর বা এমনকি কোয়েকারবাদের উপরে আপনার সামান্যতম জ্ঞান থাকুক বা না থাকুক কিছুই যায় আসে না।

শান্তিবাদের আবার একেবারে বীপরীতপ্রান্তে পারস্পরিক যুদ্ধরত পক্ষগুলোর ধর্মীয় নাম ব্যবহার করার অনীহা প্রায়ই লক্ষ করা যায়, যেমন উত্তর আয়ারল্যাণ্ডে, ক্যাথলিক আর প্রটেষ্টান্টরা নিজেদের নামকরণ করেছে যথাক্রমে ‘ন্যাশনালিস্ট আর ‘লয়ালিস্ট’; ‘ধর্ম’ শব্দটাই সুকৌশলে সেন্সরশীপের মাধ্যমে পরিবর্তিত করে ব্যবহার করা হচ্ছে ‘সমাজ’ বা ‘গোত্র’ শব্দের সমার্থক হিসাবে, যেমন: ‘আন্তঃগোত্র যুদ্ধ; ২০০৩ সালে ইঙ্গ মার্কিন আগ্রাসনের পর ইরাকে শিয়া এবং সুন্নী মতাবলম্বী মুসলিমদের মধ্যেই গোত্রভিত্তিক গৃহযুদ্ধের সূচনা হয় সুস্পষ্টভাবে ধর্মীয় মতাদর্শের সংঘাত– অথচ ২০০৬ সালের ২০ মে ইনডিপেণ্ডেন্ট পত্রিকা তাদের প্রথম পাতার প্রধান শিরোনাম ও খবর, দুটোতেই গোত্রবিত্তিক গৃহযুদ্ধকে বর্ণনা করেছিল “জাতিগত বিশোধন’ হিসাবে। এক্ষেত্রে জাতিগত শব্দটি আরেক সুভাষণ বা গ্রহনযোগ্য প্রতিশব্দ মাত্র। ইরাকে আমরা যা দেখছি, সেটা আসলে ধর্মীয় বিশোধণ। জাতিগত বিশোধণ’, শব্দটির মূল ব্যবহারক্ষেত্র প্রাক্তন ইয়োগোস্লাভিয়ায়, তর্কসাপেক্ষে বলা যেতে পারে অর্থডক্স সার্ব, ক্যাথলিক ক্রোয়াট, মুসলিম বসনীয় ধর্মীয় বিশোধন’ এর একটি সুভাষণ বা গ্রহনযোগ্য প্রতিশব্দ।

গণমাধ্যম এবং সরকারের সামাজিক নৈতিকতা বিষয়ে কোন ধরনের সাধারণ আলোচনায় ধর্মকে যে বিশেষ সুযোগ দেয়া হয়ে। থাকে, এই বিষয়টার প্রতি আমি আগেও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছি(৩৪); যখনই যৌন বা প্রজনন বিষয়ক ব্যক্তিগত নৈতিকতা সংক্রান্ত কোন ধরনের বিতর্ক হয়, আপনি বাজী রাখতে পারেন যে, বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসী দলকে প্রতিনিধিত্বকারী ধর্মীয় নেতাদের সবসময়ই, প্রভাবশালী কমিটিগুলোতে, রেডিও বা টেলিভিশনের প্যানেল আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ পদে দেখা যায়। আমি বলতে চাচ্ছিনা যে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে এদের মতামতগুলোকে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করা উচিৎ; কিন্তু আমার প্রশ্ন, কেন সমাজকে মতামতের জন্য এদের দ্বারস্থ হয়, কেনই বা আমরা এমনটা ভাবি যে কোন নীতিশাস্ত্রীয় দার্শনিক, কিংবা পারিবারিক আইনে পারদর্শী আইনজীবি অথবা একজন চিকিৎসকের সাথে তুলনা করা যেতে পারে এমন যোগ্যতা এদের আছে?

ধর্মকে বিশেষ সুবিধা দেবার আরেকটা আজব উদাহরণ দেই: ২০০৬ সালে ২০ ফেব্রুয়ারী যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রীম কোর্ট সংবিধান অনুযায়ী রুল জারী করে, নিউ মেক্সিকোর একটি চার্চ হ্যালুসিনোজেনিক মাদকদ্রব্য ব্যবহার সংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় আইনের আওতায় পড়বে না, যা বাকী সবার জন্য প্রযোজ্য;’সেন্ট্রো এসপিরিটা বেনেফিসিয়েন্টো উনিয়াও দো ভেজেটাল (ইউভিডি) এর বিশ্বাসী সদস্যরা মনে করেন ঈশ্বরকে বুঝতে হলে তাদের অবশ্যই হোয়াসকা চা পান করতে হবে, যার মধ্যে বেআইনী হ্যালুসিনোজেনিক ড্রাগ ‘ডাইমিথাইল ট্রিস্টামিন’ আছে (৩৫)। লক্ষ করার বিষয় হলো, তারা যে বিশ্বাস করে এটা তাদের ঈশ্বরকে বোঝার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, সেই বিশ্বাসটাই যথেষ্ট, এর জন্য আদালতে তাদের কোন প্রমাণ দাখিল করতে হয়নি। আরেকদিকে ক্যানাবিস (গাঁজা), কেমোথেরাপী পাচ্ছে এমন ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের বমি বমি ভাব এবং কিছু অস্বস্তিকর উপসর্গ কমাতে সাহায্য করে, তার পক্ষে পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের এই সুপ্রীম কোর্টই ২০০৫ এ সংবিধান অনুযায়ী রুল জারী করেছিল, যারা চিকিৎসা হিসাবে ক্যানাবিস ব্যবহার করছে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় আইনে বিচার করা যেতে পারে (এমনকি সেই সব অঙ্গরাজ্যেও যেখানে বিশেষ ক্ষেত্রে ক্যানাবিসের ব্যবহার আইনসিদ্ধ); ধর্ম, সবসময়ের মতই এখানেও ট্রাম্প কার্ড। কল্পনা করুন তো কি সম্ভাব্য ফলাফল হতে পারে, যদি কোন শিল্পকলা সমঝদার গ্রুপের সদস্যরা কোর্টে আবেদন করেন এমন দাবী করে যে, তারা বিশ্বাস করেন, ইমেপ্রশনিষ্ট (৩৬) বা সুরিয়ালিস্টদের (৩৭) শিল্পকর্ম ভালোভাবে বোঝার জন্য অবশ্যই তাদের হ্যালুসিনোজেনিক ড্রাগ ব্যবহার করা প্রয়োজন। অথচ যখন কোনো চার্চ একই ধরনের প্রয়োজনের জন্য দাবী জানালো, তা সমর্থন করলো দেশটির সর্বোচ্চ আদালত। এরকমই শক্তি ধারণ করে ধর্ম, তাবিজের মতন।

প্রায় আঠারো বছর আগে ছত্রিশ জন লেখক এবং শিল্পী দলের আমিও একজন ছিলাম, যাদের নিউ স্টেটসম্যান পত্রিকা থেকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল প্রখ্যাত লেখক সালমান রুশদীর সমর্থনে কিছু লেখার জন্য (৩৮); একটি উপন্যাস লেখার জন্য তখন সালমান রুশদীর (৩৯) উপর মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া (৪০)। খ্রিষ্টান ধর্মীয় নেতাদের এবং বেশ কিছু ধর্ম নিরেপক্ষ মতবাদীদের, মুসলিম জনগনের ধর্মবিশ্বাসে ‘আঘাত’ আর ‘অপমান’ এর জন্য ‘সমবেদনা’ প্রকাশের ভাষা দেখে ক্ষুদ্ধ হয়ে এরকমই তুলনা করেছিলাম:

যদি বর্ণবাদের সমর্থকরা বুদ্ধিমান হতেন, তারা যদি দাবী করতে পারতেন–আমিও যেটা সত্যি বলে জানি- মিশ্র বর্ণের জাতিকে অনুমোদন দেয়া তাদের ধর্ম বিরুদ্ধ। সেক্ষেত্রে বর্ণবাদ বিরোধীদের বড় একটা অংশ শ্ৰদ্ধার সাথে নীরবে সরে যেত। এধরনের তুলনা করা সঠিক হবে কারণ বর্ণবাদের কোন যৌক্তিক ভিত্তি নেই। আমার মনে হয় এধরনের দাবী করাটা অর্থহীন হবে, ভিত্তিহীনতা হল ধর্মীয় বিশ্বাসেরও সারকথা, এর শক্তি এবং প্রধানতম গৌরব। আমাদের সবাইকে আমাদের সকল সংস্কার বা প্রেজুডিসের ব্যাখ্যা বা আত্মপক্ষ সমর্থন করতে হয়, কিন্তু যখনই আপনি একজন ধর্মীয় ব্যক্তিকে তার বিশ্বাসের যৌক্তিক ভিত্তি ব্যাখ্যা করতে বলবেন, তখনই আপনি তার ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষপ করার অভিযোগে অভিযুক্ত হবেন।

একবিংশ শতাব্দীতে এরকমই কিছু একটা যে ঘটবে তখন আমার জানা ছিল না। লস এনজেলেস টাইমস (১০ এপ্রিল ২০০৬) রিপোর্ট প্রকাশ করে যে, যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অসংখ্য ক্যাম্পাস ভিত্তিক খ্রিষ্টীয় সংগঠনগুলো তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে মামলা করছে ‘সমকামিদের হয়রানি আর নির্যাতন’ নিষিদ্ধ করে প্রনীত ‘বৈষম্যবিরোধী আইন প্রয়োগ শুরু করার জন্য। এ ধরনের আদর্শ উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা যেতে পারে: ২০০৪ সালে ওহাইও’র ১২ বছরের একজন কিশোর, জেমস নিক্সন স্কুলে ‘সমকামিতা হচ্ছে পাপ’, ‘ইসলাম হলো মিথ্যা’,’গর্ভপাত মানে হত্যা এবং কিছু কিছু বিষয় এমন স্পষ্ট সাদা আর কালো’- লেখা টি-শার্ট পরে স্কুলে যাবার অধিকার জিতে নিয়েছিল আদালতে (৪১)। স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে এধরনের বিদ্বেষপূর্ণ টি-শার্ট পরে স্কুলে আসা নিষিদ্ধ করলে তার বাবা মা স্কুল কর্তৃপক্ষর বিরুদ্ধে মামলা করেন। বিবেকের কাছে কিন্তু অনেক বেশী গ্রহনযোগ্য হত যদি তারা মামলা ভিত্তি হিসাবে ব্যবহার করতে সংবিধানের প্রথম সংশোধনী, যা স্বাধীন মতামত প্রকাশ করার অধিকার নিশ্চিৎ করে। কিন্তু তারা তা করেননি, বরং নিক্সনের আইনজীবি আদালতে আবেদন করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের যে ধারায়, ‘ধর্ম পালনের স্বাধীনতার পূর্ণ অধিকার আছে, সেই ধারায় সফল এই মামলাটা পরিচালনায় পৃষ্টপোষকতা করেছিলো, অ্যালিয়েন্স ডিফেন্স ফাণ্ড অফ অ্যারিজোনা, যাদের অন্যতম প্রধান কাজ হলো ‘ধর্মীয় স্বাধীনতার জন্য আইনী লড়াই চালিয়ে যাওয়া।

রেভারেন্ড রিক স্কারবোরো, এধরনের অনেকগুলো খ্রিষ্টীয় ও ধর্মীয় মদদপুষ্ট আইনী লড়াই, যা কিনা ‘সমকামি’ ও অন্যান্য গ্রুপদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করার অধিকারের আইনসম্মত যুক্তিযুক্ত কারণ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে ধর্মকে, সমর্থন করে এদেরকে চিহ্নিত করেছেন, একবিংশ শতাব্দীর নাগরিক অধিকার আদায়ের সংগ্রাম’ হিসাবে: “খ্রিষ্ট ধর্মানুসারীরা খ্রিষ্ট হবার অধিকার আদায়ের সংগ্রামে দৃঢ় অবস্থান নেবে।’; আবারো এই মানুষগুলো যদি স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকার দাবীতে তাদের অবস্থান নিত, হয়ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও অনেকেই সমর্থন জানাতো। কিন্তু ব্যপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। খ্রিষ্টান হবার অধিকার’ এই ক্ষেত্রে অন্য মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলানোর অধিকার (৪২); সমকামিদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণের পক্ষে মামলা এখন উল্টো ব্যবহার করা হচ্ছে তথাকথিত ধর্মীয় বৈষম্যমূলক আচরণের মামলা হিসাবে! আইনেরও সায় আছে বলে মনে হচ্ছে ব্যপারটায়। আইনের হাত থেকে আপনি রেহাই পাবেন না, যদি বলেন, ‘সমকামিদের অপমান করা থেকে আমাকে নিষেধ করার চেষ্টা করা মানে আমার সংস্কার বা ঘণা প্রকাশ করার অধিকারে হস্তক্ষেপ করা’; কিন্তু আপনি রেহাই পেতে পারেন যদি বলেন, এটা আমার ধর্মীয় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে’; যখন আপনি চিন্তা করবেন পার্থক্যটা আসলে কোথায়? এখানে আবারো, ধর্ম সবকিছুকেই ট্রাম্প করে।

একটি বিশেষ কেস স্টাডি দিয়ে এই অধ্যায়টি শেষ করছি, যা বিশেষ করে প্রমাণ করে, ধর্মের প্রতি সাধারণ মাত্রার মানবিক শ্রদ্ধার অনেক উপরে অবস্থান করছে সমাজের মাত্রারিক্ত শ্রদ্ধা। ঘটনাটি বিশাল আকার ধারণ করে বিস্ফোরিত হয়েছিল ফেব্রুয়ারী ২০০৬ এ হাস্যকর এই ঘটনা,যা চূড়ান্ত মাত্রায় কোনো কমেডি আর ট্রাজেডির মধ্যে দিক পরিবর্তন করেছে অপ্রত্যাশিত উন্মত্ততায়; এর আগের বছ(২০০৫) মাসে, একটি ড্যানিশ দৈনিক, ‘জিল্যান্ডস পোস্টেন’, নবী মোহাম্মদকে নিয়ে মাট বারোটি কার্টুন প্রকাশ করে। এর পরবর্তী তিন মাস ডেনমার্কে বসবাসকারী অল্প কিছু সংখ্যক মসুলমান, খুব সাবধানে ধীরে ধীরে পদ্ধতিগতভাবে পৃথিবীর প্রায় সকল মুসলিম দেশগুলোতে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। এদের নেতৃত্ব দেন দুই ইমাম, যাদের একসময় নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছিল দেশটি (৪৩)। ২০০৫ সালে অশুভ অনিষ্ট করার মানসিকতা নিয়ে এই দুই নির্বাসিত ইমাম ডেনমার্ক থেকে মিসরে আসেন একটি ফাইল নিয়ে। সেখানে তা কপি করে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়া হয়, বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়ায়। এই ফাইলে ছিল, ডেনমার্কে মসুলমানদের উপর তথাকথিত নির্যাতনের কিছু বানোয়াট বর্ণনা এবং একটি উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যাচার যা দাবী করছে ‘জিল্যান্ডস পোস্টেন’ একটি ডেনিশ সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা।

এছাড়াও এর সাথে সেই বারোটা কার্টুন তো ছিলই এবং সবচে গুরুত্বপূর্ণ, ইমামরা এর সাথে যোগ করেন আরো তিনটি অতিরিক্ত কার্টুন, যার উৎপত্তি খুবই রহস্যজনক এবং অবশ্যই ডেনমার্কের সাথে তার কোনোই যোগাযোগ নেই। মূল বারো কার্টুনের চেয়ে এই তিনটি কার্টুনগুলো আরো বেশী অপমানজনক ছিল বা হতে পারতো– যদি- এই উৎসাহী প্রচারণাকারীদের অভিযোগ মতে– সেগুলো সত্যি সত্যি মোহাম্মদকে ব্যঙ্গ করে আঁকা হতো; এদের মধ্যে বিশেষ করে ক্ষতিকরটি আদৌ কোনো কার্টনই নাঃ শুকরের নকল নাক ইলাস্টিক দিয়ে মুখে বাঁধা দাড়িওয়ালা মানুষের একটি ফ্যাক্স করে পাঠানো ফটোগ্রাফ। পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছিল, ছবিটা আসলে অ্যাসোসিয়েট প্রেসের তোলা ফ্রান্সের একটা গ্রাম্য মেলায় পিগ স্কুইলিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আসা একজন ফরাসী ব্যক্তির ছবি (৪৫), এই ছবির সাথে মোহাম্মদের কোনো ধরনের যোগাযোগ নেই, ইসলাম ধর্মেরও কোনো সম্পর্ক নেই আর ডেনমার্কেরও কোনো সম্পর্ক তো নেইই। কিন্তু মুসলিম আন্দোলনকারীরা তাদের ঝামেলা পাকানো কায়রো সফরে এই ছবির সাথে এই তিনটি সম্পর্কই জোড়া লাগিয়ে ছিল আর এর ফলাফল যা ধারণা করা হয় ঠিক তাই হয়েছিল।

মূল বারোটি কার্টুন প্রকাশের পাঁচ মাস পর খুব সাবধানে সাজানো এই ‘আঘাত’ এবং ‘আক্রমণ’ এর প্রতিক্রিয়ায় ব্যাপক বিস্ফোরণ ঘটে সারা বিশ্বব্যপী। পাকিস্তান আর ইন্দোনেশিয়ায় বিক্ষোভকারীরা ডেনমার্কের পতাকা পোড়ায় (কার কাছ থেকে তারা জোগাড় করেছিল সেই পতাকা?); ডেনিশ সরকারের প্রতি উন্মত্ত দাবী জানানো হল, ক্ষমা চাইবার জন্য (কিসের জন্য ক্ষমা চাইবে, ডেনিশ সরকারতো কার্টুনগুলো আকেনি বা প্রকাশও করেনি। শুধুমাত্র ডেনিশ নাগরিকরা এমন একটা দেশে বসবাস করে, যেখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আছে, যা অনেক ইসলামী দেশের বসবাসকারীদের পক্ষে খুব সহজে বোঝা সম্ভব না); নরওয়ে,জার্মানী, ফ্রান্স এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও (কিন্তু উল্লেখযোগ্য ভাবে ব্রিটেনে না) বেশ কিছু দৈনিক জিল্যান্ডস পোষ্টেন এর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে কার্টুনগুলো পূণপ্রকাশ করলে তা বিক্ষোভের আগুন আরো উসকে দেয়। দুতাবাস ভাংচুর, ড্যানিশ পণ্য বয়কট, ডেনিশ নাগরিকদের, মূলত সকল পশ্চিমাদের শারীরিক আক্রমণের ভয় দখানো হয়। পাকিস্তানে খ্রিষ্টানদের গীর্জা পোড়ানোর ঘটনা ঘটে, যাদের সাথে ইউরোপিয়ান বা ডেনিশদের কোন সম্পর্কই নেই। লিবিয়ার বেনগাজীতে ইতালিয়ান কনসুলেট এ দাঙ্গাকারীদের আক্রমণের সময় মারা যায় নয় জন। জেরমাইন গ্ৰীয়ার লিখেছিলেন এই মানুষগুলো যা করতে পছন্দ করে আর যেটা ভালো করতে পারে তা হলো, বিশৃঙ্খলা (৪৬)।

ডেনিশ কার্টুনিষ্টকে হত্যা করার জন্য এক পাকিস্তানী ইমাম এক মিলিয়ন ডলার পুরষ্কারও ঘোষণা করে– বোঝাই যাচ্ছে তাদের কোন ধারণাই ছিল না যে, একজন না, বারো জন কার্টুনিষ্টদের আঁকা ছিল সেই কার্টুনগুলো আর অবশ্যই কোনো ধারণা ছিল না যে, তিনটি বিশেষভাবে আপত্তিজনক ছবিগুলো কিন্তু আদৌ ডেনমার্কে উৎপত্তি হয়নি (আর, প্রসঙ্গক্রমে, ঐ মিলিয়ন ডলার যোগড়ই বা হোললা কোথা থেকে?); নাইজেরিয়াতে ডেনিশ কার্টুনের বিরুদ্ধে মুসলিম বিক্ষোভকারী বেশ কিছু চার্চ ধ্বংশ করে এবং ম্যাশেটে (এক ধরনের ছুরি) দিয়ে রাস্তায় খ্রিষ্টানদের (কালো নাইজেরীয়) আক্রমণ ও হত্যা করে। একজন খ্রিষ্টানকে রাবারের টায়ারের মধ্যে বেধে রেখে তার গায়ে পেট্রল ঢেলে জীবন্ত দগ্ধ করা হয়। ব্রিটেনে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদের ছবি সংবাদপত্রগুলোতে

প্রকাশিত হলে দেখা যায়, ‘হত্যা করো যারা ইসলামকে অপমান করে’, ‘জবাই করো যারা ইসলামকে ব্যঙ্গ করে’, ‘ইউরোপকে এর শাস্তি পেতে হবে’; লেখা ব্যানার হাতে বিক্ষোভকারীদের ছবি। সৌভাগ্য যে, ইসলাম যে শান্তির আর দয়ার ধর্ম সেটা আমাদের মনে করিয়ে দেবার জন্য রাজনীতিবিদরা বেশ তৎপর ছিলেন।

এই সব ঘটনার পরবর্তীতে সাংবাদিক অ্যান্ড্রু মুয়েলার ব্রিটেনের নেতৃত্বস্থানীয় মধ্যপন্থী’ বা মডারেট মুসলিম নেতা স্যার ইকবাল স্যাকরানির (৪৭) সাক্ষাৎকার নেন (৪৮); আজকের ইসলামের মাপকাঠিতে হয়ত তিনি ‘মধ্যপন্থি’ হতে পারেন, কিন্তু অ্যান্ড্রু মুয়েলারের সাক্ষাতকার অনুযায়ী তিনি এখনও তার করা, সালমান রুশদীকে মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া দেয়ার সময় করা সেই অসহিষ্ণু মন্তব্য থেকে কিন্তু সরে আসেননিঃ ‘মৃত্যুদণ্ড তার জন্য হয়ত অনেক সহজ শাস্তি’; এই মন্তব্য তাকে অত্যন্ত অসম্মানের সাথে পৃথক করে দেয় তার সাহসী পূর্বসূরী প্রয়াত ডঃ জাকী বাদাওয়ী(৪৯) থেকে, যিনি তার নিজের বাসায় সালমান রুশদীকে নিরাপদ আশ্রয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সাকরানী মুয়েলারকে বলেছিলেন, তিনি ডেনিশ কার্টুন নিয়ে খুবই চিন্তিত, মুয়েলার নিজেও চিন্তিত, কিন্তু ভিন্ন কারণে : ‘আমি চিন্তাগ্রস্থ কারণ অখ্যাত কোনো এক স্ক্যান্ডিনিভিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত এই সব আদৌ হাস্যকর নয়। এমন কতগুলো কার্টুন যে ভাবে অদ্ভুতরকমের মাত্রা ছাড়ানোর প্রতিক্রিয়া ঘটিয়েছে তা স্পষ্ট করে দেয় ইসলাম এবং পশ্চিম আসলে মূল ভাবগতভাবেই অসামঞ্জস্যপূর্ণ, স্যাকরানি অপরদিকে ব্রিটিশ গণমাধ্যমের প্রশংসা করেছে কার্টুনগুলো পুনপ্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে, প্রত্যুত্তরে মুয়েলার ব্রিটেনের অধিকাংশ মানুষের সন্দেহকে কণ্ঠ দিয়ে বলেছিলেন, “কার্টুনগুলো প্রকাশ না করার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ পত্রিকাগুলোর সংযম প্রদর্শনের কারণ মুসলিমদের প্রতি সমমর্মিতা নয়, বরং তারা কেউ তাদের জানালা ভাঙ্গুক সেটা আসলে তারা চাননি।

স্যাকরানি ব্যাখা করেন, ব্যক্তি নবীকে (তার উপর শান্তি বর্ষিত হোক), সমস্ত মুসলিম জগৎ গভীরভাবে শ্রদ্ধা করে, যে ভালোবাসা কোনো শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। যা তাদের পিতামাতা, প্রিয়জন, সন্তানের প্রতি ভালোবাসা থেকেও বেশী। এটা তাদের বিশ্বাসেরই অঙ্গ। এছাড়াও সুস্পষ্টভাবে ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা আছে নবীর কোনো প্রতিকৃতি আঁকার ব্যপারে’; বিষয়টি ব্যাখ্যা করে। মুয়েলারের ভাষা:

তাহলে এর অর্থ হচ্ছে ইসলামের মূল্যবোধ অন্য যে কারোর মূল্যবোধের উপরে অবস্থান করে অন্য যে কোন ধর্মের অনুসারীরা যেমন করে বিশ্বাস করেন, তাদেরটাই একমাত্র পথ, সত্য আর আলোকময়, সেভাবে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীরাও সেটাই মনে করেন। যদি কেউ সপ্তম শতাব্দীর একজন ধর্ম প্রচারককে তাদের নিজেদের পরিবারের সদস্যদের চেয়ে বশী ভালোবাসতে ইচ্ছা পোষণ করেন, সেটা শুধুমাত্র তাদের ব্যপার; বিষযয়টিকে গুরুত্ব দেবার জন্য অন্য আর কেউ বাধ্য নয়।

শুধুমাত্র পার্থক্য, আপনি যদি ব্যপারটা গুরুত্বের সাথে না নেন, এবং প্রয়োজনীয় সম্মান না দেখান সেক্ষেত্রে আপনাকে শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করার হুমকি দেয়া হবে, এবং সেটা এমন এক মাত্রায় যা মধ্যযুগ পরবর্তী আর কোনো ধর্মেই আর কখনো দেখা যায়নি। তাই যে কাউকেই বিষয়টা চিন্তা করতে বাধ্য করে, কেন এই ধরনের সহিংসতা প্রয়োজন, কারণ, মুয়েলারের পর্যবেক্ষণ: “যদি আপনাদের মত ভাড়দের কেউ যদি সত্যি হন আপনাদের ধর্মের ব্যপারে, সেক্ষেত্রে এই কার্টুনিষ্টরাতো নরকেই যাবে, সেটাই কি যথেষ্ট না? আর ততক্ষন মুসলিমদের উপর নির্যাতনের ব্যপারে যদি আপনাদের উত্তেজিত হতে একান্ত ইচ্ছাই করে, তাহলে সিরিয়া আর সৌদি আরবের উপর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টটা পড়লেই হবে।

অনেক মানুষই বিস্মিত হয়ে লক্ষ করেছেন স্নায়ুবিকারগ্রস্থের মত ‘ধর্মীয় বিশ্বাসে ‘আঘাত’ এর কথা বলা মুসলিম আর আরব মিডিয়ায় গতবাধা ইহুদী বিরোধী কার্টুন ছাপানোর ক্ষেত্রে অতিরিক্ত উৎসাহ প্রদর্শনের মধ্যকার পার্থক্যটা। পাকিস্তানে ডেনিশ কার্টুনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের একটা ছবিতে দেখা যায়, কালো বোরখা পরা একজন মহিলার হাতে ব্যানার, তাতে লেখা, “ঈশ্বর হিটলারকে আশীর্বাদ করুন। এইসব বিশ্বব্যাপী উন্মত্ত বিশঙ্খলার প্রতিক্রিয়ায়, ভদ্র, উদারপন্থী দৈনিকগুলো সহিংসতাকে নিন্দা আর বাকস্বাধীনতার উপর দায়সারা গোছের মন্তব্য করেছিল মাত্র। কিন্তু একই সাথে তারা তাদের শ্রদ্ধা’ আর ‘সমবেদনা প্রকাশ করেছে মসুলমানদের এই গভীর ‘আঘাত’

‘অপমান সহ্য করবার জন্য। মনে রাখতে হবে এই আঘাত এবং কষ্ট কিন্তু কোনো ব্যক্তিদের প্রতি নির্দেশিত না, যারা সহিংসতা সহ্য করেছে বা কোনো ধরনের সত্যিকার যন্ত্রণা সহ্য করেছে : বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির লক্ষ্যে উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রচারণা ছাড়া ডেনমার্কের বাইরে কেউই কোনোদিন নামই শুনতো না এমন অখ্যাত এক খবরের কাগজে ছাপা কয়েক ফোঁটা কালি দাগ ছাড়া যা আর কিছুই নয়।

আমি কাউকে অপমান বা আঘাত করার খাতিরে অপমান বা আঘাত করার পক্ষপাতী নই। কিন্তু খুবই অবাক হই আর রহস্যময় মনে হয়, আমাদের এই অন্য প্রায় সব অর্থেই ধর্মনিরপেক্ষ সমাজগুলোয় ধর্মকে কেন এই মাত্রাতিরিক্ত সুবিধা প্রদান করা হয়। সব রাজনীতিবিদরাই হেয় করা কার্টুনের শিকার হন, কিন্তু তাদের সমর্থনে তো কোনো দাঙ্গা হয় না। ধর্মের কি এমন যোগ্যতা আছে যে তাকে এই বিশেষ মর্যাদা দিতে হবে। যেমন, এইচ, এল, মেনকেন (৫০) বলেছিলেন, “অন্য কারো ধর্মকে অবশ্যই আমাদের শ্রদ্ধা করতে হবে কিন্তু সেটা শুধুমাত্র তার স্ত্রী সুন্দরী এবং তার ছেলেমেয়েরা বেশী বুদ্ধিমান, তার নিজস্ব এই তত্ত্বটিকে যে অর্থে এবং যতটুকু আমরা শ্রদ্ধা করি, কেবল ততটুকুই। ধর্মের প্রতি সমাজের এধরনের অতুলনীয় শ্রদ্ধা বিদ্যমান এই পূর্বধারণার আলোকেই আমি এই বইয়ের জন্য আমার নিজস্ব দায়-দায়িত্বের সীমা নির্ধারণ করে নিচ্ছি (৫১)। আমি কাউকে আঘাত করার জন্যে এই বইটি লেখার মূল উদ্দেশ্যের বাইরে যেমন যাবো না, তেমনি আমি ধর্ম নিয়ে আলোচনা করার সময় আর অন্য যে কোনো বিষয় নিয়ে যেভাবে আলোচনা করতাম তার চেয়ে হালকাভাবেও করবো না।

.

পাদটীকা:

(১) চার্চ অফ ইংল্যান্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট।

(২) চ্যাপলেইন: সাধারণত কোন ধর্মনিরপেক্ষ বা সেকুলার প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত কোন ধর্মীয় যাজক।

(৩) আমাদের জন্য মজার একটা খেলা ছিল, ক্লাসে পড়ানোর সময় তাকে বাইবেলের আলোচনা থেকে সরিয়ে ফাইটার কম্যান্ড আর “ দ্য ফিউ’র (Few হচ্ছে রয়্যাল এয়ার ফোর্সের বিমান সেনারা, যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যাটল অব ব্রিটেনে অংশ নিয়েছিলেন, ফিউ নামটি এসেছে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টোন চার্চিলের উদ্ধৃতি : never was so much owed by so many to so few উদ্ধৃতি থেকে) শিহরণ জাগানো গল্পের দিকে নিয়ে যাওয়া। কারণ যুদ্ধের সময় তিনি রয়্যাল এয়ার ফোর্সে কাজ করেছিলেন। কিছুটা পরিচিত আর স্নেহসূলভ একটি অনুভূতি দিয়ে আমি আজও চার্চ অফ ইংল্যাণ্ডকে মনে রেখেছি ( অন্ততপক্ষে এর অন্য সব প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায়); আমি পরে আমি জন বেটচামেন (John Betjamen– ব্রিটিশ রাজকবি, লেখক) এর কবিতায় পড়েছিলাম: Our padre is an old sky pilot, Severely now they’ve clipped his wings’ But still the flagstaff in the recotry garden points to higher things

(৪) ওরাইওন, ক্যাসিওপিয়া ও উরসা মেজর, নক্ষত্রপুঞ্জের নাম।

(৫) মিল্কি ওয়ে হচ্ছে সেই ছায়াপথ বা গ্যালাক্সী, যেখানে আমাদের সৌরজগত অবস্থিত। মিল্কি ওয়ে নামটি ল্যাটিন ভায়া ল্যাকটিয়া শব্দটি থেকে এসেছে,যার উৎস গ্রীক শব্দ গ্যালাক্সিয়াস কিকলোস, বা মিল্কি সারর্কেল।

(৬) অন দি অরিজিন অফ স্পিসিস ( পুরো শিরোনাম On the Origin of Species by Means of Natural Selection, or the Preservation of Favoured Races in the Struggle for Life), চার্লস ডারউইনের (১৮০৯-১৮৮২) লেখা যুগান্তকারী একটি গ্রন্থ, এটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৫৯ সালের ২৪ নভেম্বর।

(৭) Entangled bank –অন দি অরিজিন অব স্পিসিস বইটির শেষ অনুচ্ছেদ।

(৮) কার্ল এডওয়ার্ড সেগান (১৯৩৪-১৯৯৬), আমেরিকার জ্যোতির্বিজ্ঞানী, কসমোলজিষ্ট, জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানী, বিজ্ঞান লেখক।

(৯) কার্ল এডওয়ার্ড সেগানের Pale Blue Dot: A Vision of the Human Future in Space (1994)

(১০) স্টিভেন ওয়াইনবার্গ ( জন্ম ১৯৩৩) আমেরিকার তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ও লেখক। আব্দুস সালাম ও শেলডন গ্ল্যাশোর সাথে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন ১৯৭৯ সালে।

(১১) Dreams of a Final Theory: The Scientist’s Search for the Ultimate Laws of Nature (1994)

(১২) আলবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯-১৯৫৫) জার্মান তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী, পৃথিবীর অন্যতম সেরা ও সুপরিচিত বিজ্ঞানী, তার জেনারেল থিওরী অব রিলেটিভিটি, কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর সাথে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি রচনা করেছে।

(১৩) স্টিফেন উইলিয়াম হকিং (জন্ম ১৯৪২) ইংরেজ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী, কসমোলজিষ্ট।

(১৪) “তবে আমরা যদি একটি সম্পূর্ণ তত্ত্ব আবিষ্কার করতে পারি, সময়ের সাথে এটি সবার জন্য বোধগম্য হয়ে ওঠা উচিৎ, শুধুমাত্র গুটিকয়েক বিজ্ঞানী শুধু নয়। তারপর আমরা সবাই, দার্শনিক,বিজ্ঞানী এবং যে কোনো সাধারণ মানুষ সেই প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা অংশ নেবার জন্য যোগ্য হয়ে উঠবো : কেন আমরা এবং এই মহাবিশ্বের অস্তিত্ব আছে। আমরা যদি এই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে পাই, সেটি হবে মানব যুক্তির চূড়ান্ত বিজয়– কারণ তখনই আমরা ঈশ্বরের মন সম্বন্ধে জানতে সক্ষম হবো। (A Brief History of Time, Stephen Hawking, p.193);

(১৫) উরসুলা ডাবলিউ, গুডএনাফ (জন্ম ১৯৪৩) ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি ইন সেইন্ট লুইসের জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক।

(১৬) হিউ জন লফটিঙ (১৮৮৬-১৯৪৭) একজন ব্রিটিশ সাহিত্যিক, পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন প্রকৌশলী, ডঃ ডুলিটল চরিত্রটির স্রষ্টা।

(১৭) এইচ এম এস বীগল (HMS Beagle), ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনীর একটি জাহাজ। এটি নির্মিত হয়েছিল ১৮২০ সালের ১১ মে। ডারউইনকে নিয়ে এর দ্বিতীয় সমুদ্রযাত্রা ( ২৭ ডিসেম্বর ১৮৩১– ২ অক্টোবর ১৮৩৬) এই জাহাজটিকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে ইতিহাসে।

(১৮) গিলবার্ট হোয়াইট (১৭২০-১৭৯৩), ইংরেজ প্রকৃতিবিজ্ঞানী, এবং পাখি বিশেষজ্ঞ।

(১৯) পারসন, যুক্তরাজ্যের অ্যাঙলিকান চার্চের কর্মকর্তা যাজক, যিনি নির্দিষ্ট একটি এলাকা বা প্যারিশ-এর আইনগত প্রধান হতেন। চার্চের আইন অনুযায়ী।

(২০) জুলিয়ান বাগিনী ( জন্ম ১৯৬৮) ব্রিটিশ দার্শনিক, সাধারণ পাঠকদের জন্য রচিত বেশ কিছু দর্শন বিষয়ক বইয়ের রচয়িতা।

(২১) স্নায়ু কোষ, যারা আমাদের স্নায়ুতন্ত্র গঠন করে, যেমন মস্তিস্ক, মেরুরজ্ঞ।

(২২) মার্টিন জন রীস (জন্ম ২৩ জুন, ১৯৪২) ব্রিটিশ কসমোলজিষ্ট এবং জ্যোতিপদার্থ বিজ্ঞানী, অ্যাস্ট্রোনোমার রয়্যাল ছিলেন ১৯৯৫ অবধি, ২০০৫ থেকে ২০১০ অবধি রয়াল সোসাইটির সভাপতি ছিলেন।

(২৩) টেলিভিশন ডকুমেন্টরী, ইন্টারভিউ যার একটা অংশ: Winstone R (2005). The Story of God. London, Transworld/BBC.

(২৪) ড্যানিয়েল সি ডেনেট (২০০৬); Breaking The Spell: Religion as Natural Phenomenon. London: Viking.

(২৫) ম্যাক্স জ্যামার (১৯১৫-২০১০) ইসরায়েলী পদার্থবিজ্ঞানী, পদার্থবিজ্ঞানের দার্শনিক। তার জন্ম হয়েছিল জার্মানীতে।

(২৬) Max Jammer: Einstein and Religion, Princeton University Press, 1999

(২৭) একুমেনিকাল কোয়ালিশন, খ্রিষ্টীয় ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করার জন্য কাজ করে এমন কোন প্রতিষ্ঠান।

(২৮) ফ্রাসোয়া-মারি আরওয়ে ( ভলতেয়ার নামে সুপরিচিত ১৯৬৪-১৭৭৮) ফরাসী দার্শনিক, লেখক, ইতিহাদবিদ।

(২৯) দনি দিদেরো (১৭১৩-১৭৮৪) ফরাসী দার্শনিক, শিল্প সমালোচক এবং লেখক।

(৩০) বারুখ স্পিনোজা ( বেনেদিতো দো এসপিনোসা, ১৬৩২ ১৬৭৭) ডাচ দার্শনিক।

(৩১) পল চার্লস উইলিয়াম ডেভিস (জন্ম ১৯৪৬) ব্রিটিশ পদার্থ বিজ্ঞানী এবং লেখক।

(৩২) সম্পূর্ণ বক্তৃতাটা আছে অ্যাডামস (২০০৩) কৃত্রিম ঈশ্বর বলে কেউ কি আছেন’ শিরোনামে। Adams, D. (2003). The Salmon of Doubt; London.Pan

(৩৩) Quakers (কোয়েকারস): ১৬৬০ সালে জর্জ ফক্স এর প্রতিষ্ঠা করা খ্রিষ্টান ধর্মীয় গোষ্ঠী।

(৩৪) Dolly and the clothes head: : A Devil’s Chaplain: Selected essays. London: Weidenfeld and Nickolson

(৩৫) http://www.oyez.org/cases/2000 2009/2005/2005-04-1084/; ২০০৫ সালের নভেম্বরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রীম কোর্ট হোয়াসকা টি এর পক্ষে বিপক্ষে যুক্তিতর্ক শোনেন। হোয়াসকা টি (Ayahuasca, সাধারণত উচ্চারিত হয় আইয়াহুয়াসকা নামে, প্রচলিত ভাষায় ইয়াগে, এটি মূলত একটি সাইকাডেলিক বা হ্যালুসিনেশন করতে সক্ষম এমন একটি মাদক মিশ্রণ যা তৈরী করা হয় আমাজন অঞ্চলে জন্ম নেয়া afo tien Banisteriopsis caapi 478 Psychotria viridis এর মিশ্রণ ঘটিয়ে।) উদ্ভিদ দুটিতে মূলত dimethyltryptamine (DMT) নামের হ্যালুসিনেশন সৃষ্টি করতে সক্ষম এমন একটি রাসায়নিক উপাদান থাকে। এই চা টি ব্যবহার করে ব্রাজিল fofga 6 O Centro Espirita Beneficiente Uniao do Vegetal (UDV) এর সদস্যরা তাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে। যুক্তরাষ্ট্রে এই চার্চের মাত্র ১৩০ জন সদস্য বাস করে। সদস্যরা এই উদ্ভিদ দুটিকে পবিত্র হিসাবে গণ্য করে থাকে। ১৯৯৯ সালে মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক কর্মকর্তারা ব্রাজিল থেকে রপ্তানী করা তিন ড্রাম হোয়াসকা টি এর উপকরণ আটক করেছিলেন। এই আটককে চ্যালেঞ্জ করে নিম্ন আদালতের শুনানী শেষে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রীম কোর্টের সামনে আবেদনটি আসে Religious Freedom Restoration Act of 1993 এর আওতায় হোয়াসকা টি আমদানী বৈধ হিসাবে গণ্য করা যায় কিনা (http://faculty.washington.edu/chudler/hoas.html);

(৩৬) ইমপ্রেশনিজম, উনবিংশ শতাব্দীর শিল্পকলার প্যারিস ভিত্তিক একটি আন্দোলন; বৈশিষ্ট্যসূচক সরু, ছোট ছোট ব্রাশস্ট্রোক বা তুলির আঁচড়সহ ইমপ্রেশনিষ্টরা বিশেষভাবে মনোযোগী ছিলেন আলোর সত্যিকার রুপটিকে প্রকাশ করার জন্য, বিশেষ করে সময়ের সাথে এর পরিবর্তন।

(৩৭) সুররিয়ালিজম বা পরাবাস্তববাদের সূচনা ১৯২০ এর দশকে, এই শিল্প আন্দোলনে শিল্পী স্বপ্ন আর বাস্তবতার মধ্যকার পরস্পর বিরোধী প্রথাগত বিভেদটি ভেঙ্গে ফেলে, অবচেতনকে মুক্ত করে দেয় নতুন ধারণা প্রকাশের জন্য।

(৩৮) R. Dawkins, The irrationality of faith, New Statesman (London), 31 March 1989

(৩৯) সালমান রুশদী, ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক।

(৪০) সালমান রুশদীর উপর এই ফতোয়াটি ঘোষণা করেছিলেন ইরানের আয়াতোল্লাহ খোমেনী তার স্যাটানিক ভার্সেস উপন্যাসের জন্য। যেখানে তিনি ইসলামের নবী ও তার স্ত্রীদের নিয়ে অবমাননামূলক ব্যঙ্গ করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছিল।

(৪১) Columbus Dispatch, 19 Aug. 2005

(৪৩) Los Angeles Times, 10 April 2006,

(৪৪) http://gatewaypundit.blogspot.com/2006/02/islamic society-used-fake.html.

(৪৫) http://news.bbc.co.uk/2/hi/south_asia/4686536.stm; http://www. neandernews.com/?cat=6.

(৪৬) The Independent, 5 Feb, 2006.

(৪৭) ইকবাল স্যাকরানি, ব্রিটিশ মুসলিম কাউন্সিল ও মুসলিম এইড এর সাথে সংশ্লিষ্ট। (86) Andrew Mueller, ‘An arugument with Sir Iqbal’, Independent on Sunday, 2 April, 2006. Sunday Review Section,12-16

(৪৯) জাকি বাদাওয়ী, মিসরীয় ইসলামী ধর্মতাত্ত্বিক,সমাজসেবার সাথে জড়িত ছিলেন, লন্ডনে মুসলিম কলেজ এর অধ্যাপক ছিলেন।

(৫০) হেনরী লুইস (এইচ এল) মেনকেন (১৮৮৮-১৯৫৬) সেজ অব বাল্টিমোর হিসাবে পরিচিত মেনকেন ছিলেন আমেরিকার সাংবাদিক,প্রাবন্ধিক,পত্রিকা সম্পাদক, আমেরিকার জীবন ও সংস্কৃতির একজন সমালোচক, স্যাটায়ারিষ্ট ছিলেন।

(৫১) এই পেপারব্যাক সংস্করণটির যখন প্রুফ দেখা হচ্ছে, তখন নিউ ইয়র্ক টাইমস সমাজের এই ধরনের বিশেষ সম্মান প্রদর্শনের একটা ঘটনা প্রকাশ করে। ২০০৭ এর জানুয়ারীতে, এক জার্মান মহিলা দ্রুত বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন জানায় আদালতে, তার অভিযোগ ছিল তার স্বামী তাদের বৈবাহিক জীবনের শুরু থেকেই তাকে প্রায় ভয়ঙ্কর রকমের শারীরিক নির্যাতন করে আসছে। এই ঘটনা মেনে নিয়েই বিচারক ক্রিষ্টা দাট-ভিন্টার কোরানের উদ্ধৃতি উল্লেখ করে তার আবেদন নাকচ করে দেন। এধরনের অভূতপূর্ব রায় মাধ্যমে মুসলিম প্রথা আর ইউরোপিয়ান আইনের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে প্রকাশ করে। বিচারক ক্রিষ্টা দাট-ভিটার বলেন এই দম্পতিরা মরোক্কর সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের, যে সংস্কৃতিতে তার মতে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে প্রহার স্বাভাবিক একটি ঘটনা। তার ভাষায় কারান এধরনের শারীরিক নির্যাতনের অনুমতি দিয়েছে (নিউ ইয়র্ক টাইমস, ২৩ জানুয়ারী, ২০০৭)। এই অবিশ্বাস্য ঘটনা প্রকাশ পায় মার্চে যখন মহিলার আইনজীবি বিষয়টি প্রকাশ করেন গণমাধ্যমে। দ্রুততার সাথেই ফ্রাঙ্কফুর্ট কোর্ট এই বিচারককে এই কেস থেকে অপসারণ করে। তাসত্ত্বেও, নিউ ইয়র্ক টাইমস এর প্রতিবেদনটি মন্তব্য করে, এই ঘটনা অন্যান্য নির্যাতনের শিকার মুসলিম মহিলাদের জন্য ব্যাপক ক্ষতি করবে; যারা অনেকেই স্বামীর বিরুদ্ধে আদালতে যেতে এমনিতেই ভয় পায়। সেখানে বেশ কিছু ‘পারিবারিক সম্মানের জন্য হত্যার ঘটনাও ঘটেছে, যেখানে তুর্কী পুরুষদের হাতে নিহত হয়েছে মহিলারা। বিচারক ক্রিষ্টা দাট ভিন্টার এর উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করা হয়েছে ‘সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা হিসাবে, কিন্তু আরেকভাবে একে বলা যায় ‘অপমানের পৃষ্ঠপোষকতা’ করা। “অবশ্যই আমরা ইউরোপিয়ানরা এধরনের ব্যবহার করার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনা, কিন্তু বৌ-পেটানো তাদের সংস্কৃতির একটা অংশ, ‘তাদের ধর্মে’ এর অনুমতি আছে, আমাদের সেটা ‘শ্রদ্ধা’ করা উচিৎ।

4 Comments
Collapse Comments
খালেদ রাজ্জাক June 18, 2022 at 12:18 am

২য় অধ্যায়টি খুঁজে পাচ্ছি না কেন!

Bangla Library (Administrator) June 18, 2022 at 9:18 am

ভুল হয়ে গিয়েছিল। এখন দেয়া হয়েছে – https://www.ebanglalibrary.com/106327/
ধন্যবাদ।

খালেদ রাজ্জাক June 19, 2022 at 2:56 pm

অজস্র ধন্যবাদ।

আনিস উল হক April 7, 2023 at 2:07 am

বইটা অনেকদিন ধরে পড়ার ইচ্ছা ছিল। আজ প্রথম অধ্যায়টি পড়লাম। শৈশবে রপ্ত বিশ্বাস ও অনুশীলন থেকে বেড়িয়ে আসা প্রায় দুঃসাধ্য। অনেক তথ্যের সমাহার ঘটেছে এখানে বিশেষত আইনস্টাইন ও সিট্ফেন হকিংস এই দুই মহাবিজ্ঞানী প্রাধান্য পেয়েছেন যারা স্রষ্টার মন বুঝতে চেয়েছেন। যাক অনুবাদের মান ভাল। অনুবাদককে ধন্যবাদ জানাই।।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *