এপিটাফ – হুমায়ূন আহমেদ
শেফার স্মৃতির উদ্দেশে
কালান্তক ব্যাধি বাসা বেঁধেছিল মেয়েটির ছোট্ট শরীরে। সে সেই ব্যাধিকে অগ্রাহ্য করল। মৃত্যুকে গ্রহণ করল অসীম
সাহসিকতায়। কে জানে মেয়েটির সাহস দেখে হয়তো
মৃত্যুও লজ্জা পেয়েছিল।
.
“অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো
সেই তো তোমার
আলো।”
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
.
০১.
কাল রাতে আমার খুব ভালো ঘুম হয়েছে। ঘুমের মধ্যে কোনো দুঃস্বপ্ন দেখি নি। শুধু সারাক্ষণই কেমন যেন শীত শীত করছিল, একটা হিম হাওয়া শরীরের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল। মাঝেমাঝেই অস্পষ্টভাবে মনে হচ্ছিল কেউ যদি গায়ে একটা পাতলা চাঁদর টেনে দিত। আবার মনে হচ্ছিল, গায়ে চাঁদর না থাকাই ভালো। চাঁদর থাকা মানেই হিম হিম ভাব নষ্ট হয়ে যাওয়া।
সকালে ঘুম ভাঙার পর দেখি গায়ে চাঁদর আছে। গলা পর্যন্ত টেনে দেয়া পাতলা সুতির চাঁদর। ঘুমুতে যাবার সময় আমার বিছানায় কোনো চাঁদর ছিল না। এই কাজটা নিশ্চয়ই মা করেছেন। মার ঘর আর আমার ঘরের মাঝখানে একটা দরজা আছে। আগে দরজা বন্ধ থাকত কিংবা ভেজানো থাকত। এখন খোলা থাকে। একমাস আগেও দরজায় সাদার উপর সবুজ প্রিন্টের একটা পর্দা ঝুলত। এখন সেই পর্দাও মা সরিয়ে ফেলেছেন। এটা করা হয়েছে যাতে তার খাটে শুয়ে মা আমাকে দেখতে পারেন। মাঝেমাঝে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখি মা একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। এটা আমার অপছন্দ, খুব বেশিরকম অপছন্দ। কেন মা গভীর রাতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবেন? আমার বয়স এখন তের। এই বয়সের মেয়েরা তাদের অপছন্দের কথা কঠিন গলায় বলতে পারে। আমিও পারি, কিন্তু বলি না। আমার বলতে ইচ্ছা করে না।
আমি মেয়েটা আসলে কেমন তা আমার মা জানেন না। আমার বাবাও জানেন না। আমি সারাক্ষণ ভান করি, কেউ তা ধরতে পারে না। মাঝে মাঝে আমি নিজেও ধরতে পারি না। নিজের ভানগুলি আমার নিজের কাছেই একসময় সত্যি বলে মনে হয়। তখন নিজেরই খুব আশ্চর্য লাগে।
ভোরবেলা মা আমার ঘরে ঢুকে প্রথম যে বাক্যটি বলেন তা হচ্ছে– কী রে নাতাশা, আজ শরীরটা কেমন? আমি মুখ টিপে হাসি, যে হাসির অর্থ শরীর খুব ভালো। এবং আমি মার মুখ থেকে দিনের শুরুর প্রথম বাক্যটি শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়েছি। আসলে পুরোটাই ভান। আমার শরীর মোটেই ভালো না। এবং আমি দিনের প্রথম বাক্যটি শুনে রাগ করেছি কারণ নাতাশা আমার নাম না। আমার খুব সুন্দর একটা নাম আছে– টিয়া। আমার জন্ম হয় নেত্রকোনার নান্দাইলে, আমার দাদার বাড়িতে। হিসেব মতো আমার জন্য আরো মাসখানিক পরে হওয়ার কথা। বাবা মাকে নিয়ে অসুস্থ দাদাজানকে দেখতে নান্দাইল গিয়েছিলেন। যেদিন পৌঁছলেন সেদিন সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ মা’র প্রসবব্যথা উঠে গেল। বাবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ভয়াবহ ধরনের গণ্ডগ্রামে কোথায় পাওয়া যাবে ডাক্তার, কোথায় কী? খুঁজে পেতে দাই আনার আগেই আমি পৃথিবীতে চলে এলাম। আমার জন্মের পর পর দাদাজানের কাঁঠাল গাছ থেকে ঝাকে ঝাকে টিয়া পাখি আকাশে উড়ে গিয়েছিল। আমার বাবা বারান্দায় খুব মন খারাপ করে বসেছিলেন। টিয়া পাখির ঝাক দেখে তার মনে খুব আনন্দ হলো। তার কিছুক্ষণ পরেই বাবাকে আমার জনের খবর দেয়া হলো। বাবা বললেন, আমার মেয়ের নাম হলো টিয়া।
টিয়া নামটা কাবোরই পছন্দ না, কারণ পাখির নামে নাম রাখলে পাখির মতো। স্বভাব হয়। ঘরে নাকি মন টেকে না। কিন্তু নামটা আমার খুব পছন্দ। মা আমার এত পছন্দের নাম ধরে না ডেকে নাতাশা ডাকেন। আমার রাগ লাগে, তারপরেও আমি মুখ টিপে হাসি। আনন্দের ভান করি। মা সেই ভান ধরতে পারেন না। তিনিও হাসেন। আমার মতোই মুখ টিপে হাসেন।
মুখ টিপে হাসলে মাকে অসম্ভব সুন্দর লাগে। অবশ্যি না হাসলেও তাকে সুন্দর লাগে। তিনি যখন রাগ করে থাকেন তখনো সুন্দর লাগে। তখনো তার দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। যারা সুন্দর তারা সবসময় সুন্দর, হাসিতেও সুন্দর কান্নাতেও সুন্দর। আমার চেহারা মোটামুটি। এখন অবশ্যি খুব খারাপ হয়েছে। আমি যখন হাসি তখন আমাকে খুব সম্ভব অতি কুৎসিত লাগে। হাতের কাছে একটা আয়না থাকলে একবার দেখতাম। হাতের কাছে কোনো আয়না নেই। মা’র কঠিন নির্দেশে আমার ঘর থেকে সব আয়না সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কারণ আমি এখন প্রায় একটা পোকার মতো হয়ে গেছি। মানুষের মতো হাত-পাওয়ালা একটা পোকাকে সুন্দর জামা-কাপড় পরিয়ে শুইয়ে রাখলে যেমন দেখায়, আমাকেও নিশ্চয়ই সেরকম দেখায়। আমি সেটা বুঝতে পারি মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে। যারা প্রথমবারের মতো আমাকে দেখে তাদের চোখে একটা ধাক্কা লাগে। সেখানে একটা ঘৃণার ভাব ফুটে ওঠে। সেই ঘৃণার জন্যে তারা লজ্জিত হয়। লজ্জা ঢাকার চেষ্টা করতে গিয়ে তাদের চোখে একটা অসহায় ভাব জাগে। আমি বুঝতে পারি। দিনের পর দিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি অনেক কিছু শিখেছি। সেই অনেক কিছুর একটা হচ্ছে চোখের ভাষা বুঝতে পারা।
ভোরবেলা ঘুম ভেঙেই একটা কুৎসিত পোকা দেখতে কারো ভালো লাগার কথা না। আমার মা’রও নিশ্চয়ই ভালো লাগে না। আমি জানি, ভালো না লাগলেও আমার মাকে এই দৃশ্য আরো কিছুদিন দেখতে হবে। কত দিন তা কি মা’র জানা আছে? মনে হয় না। তবে ডাক্তার সাহেব নিশ্চয়ই জানেন। জানলেও তারা মাকে জানাবেন না। কোনো ডাক্তারের পক্ষেই কোনো মাকে বলা সম্ভব না আপনার মেয়ের মৃত্যুর দিন ঘনিয়ে এসেছে। সে আর মাত্র এতদিন বাঁচবে।
ডাক্তার সাহেব আমাকে যদি চুপি চুপি ব্যাপারটা জানিয়ে দিতেন তাহলে আমার খারাপ লাগত না। কে জানে, হয়তো ভালোই লাগত। ক্যালেন্ডারে দাগ দিয়ে রাখতাম। সেই দাগ দেয়া তারিখের দিকে তাকিয়ে অনেক কিছু ঠিক করে ফেলতে পারতাম। কিন্তু কেউ ব্যাপারটা আমার মতো করে দেখছে না। সবাই ভাবছে, আমি খুব বাচ্চা একটা মেয়ে। মৃত্যু কী তা-ই আমি পরিষ্কার জানি না। আমাকে নানান ধরনের মিথ্যা কথা বলে ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখতে হবে। আমাকে ভুলানোর তাদের চেষ্টা এত হাস্যকর! আমার পেটের ভেতর হাসি গুড় গুড় করে ওঠে। কিন্তু আমি তাদের তা বুঝতে দেই না। আমি ভান করি যেন তাদের প্রতিটি বাক্য আমি বিশ্বাস করছি।
মা আমাকে গত মাসের ৯ তারিখে পিজির নিওরোসার্জন প্রফেসর ডা. ওসমানের কাছে নিয়ে গেলেন। মা’র সঙ্গে ভদ্রলোকের আগেও কয়েকবার দেখা হয়েছে। আমি এই প্রথম তাকে দেখছি। খুব ফর্সা ছোটখাটো ধরনের মানুষ। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। চশমার কাঁচ ভারি বলে চোখ দেখা যাচ্ছে না, তবে আমার মনে হলো দ্রলোকের চোখ সুন্দর। খুব সুন্দর।
আমার কিছু অদ্ভুত ব্যাপার আছে। এই যেমন চোখ দেখছি না, তারপরেও মনে করে নিলাম চোখ সুন্দর। মাঝে মাঝে একটা গল্পের বই হাতে নিয়ে বইয়ের নাম, লেখকের নাম না পড়েই মনে হয়– বইটা খুব সুন্দর। হয়ও তাই। এই ডাক্তার সাহেবের চোখ নিশ্চয়ই খুব সুন্দর হবে। আমি অপেক্ষা করছি কখন তিনি চোখ থেকে চশমা সরাবেন। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে একসময় তিনি চোখ থেকে চশমা সরাবেন। কিংবা চশমাটা আপনাতেই একটু নিচে নেমে যাবে। ডাক্তার সাহেব খুব মন দিয়ে কাগজপত্র দেখছেন। আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ লক্ষ করলাম, কাগজপত্র দেখতে দেখতে ভদ্রলোকের চেহারাটা কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেল। তিনি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। একবার মার দিকে, একবার আমার দিকে তাকাতে লাগলেন। তারপর হঠাৎ খুব স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করতে লাগলেন। এখন তিনি আর কোনো কাগজই মন দিয়ে দেখছেন না, আবার আমার দিকেও তাকাচ্ছেন না। শুধু পাতা ওল্টাচ্ছেন। আমার মনে হলো তিনি নিজেই এখন নিজের উপর বিরক্ত হচ্ছেন। তারপর হঠাৎ হাতের কাগজগুলি একপাশে সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন খুকি, তুমি কিছু খাবে না? কোল্ড ড্রিংকস বা অন্য কিছু?
আমি কিছু বলার আগেই মা বললেন, ও কিছু খাবে না। ওকে আপনি কেমন দেখলেন বলুন?
মা’র গলা খুব কঠিন শুনাল। যেন তিনি খুব বিরক্ত। এমনিতে মা’র গলার স্বর নরম ও আদুরে। শুধু বাবার সঙ্গে কথা বলার সময় সেই স্বর কঠিন হয়ে যায়। এখন দেখছি এই ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে কথা বলার সময়ও স্বর কঠিন হয়ে গেল। শুধু তাই না, তার ভুরু কুঁচকে গেল।
ডাক্তার সাহেব চোখ থেকে চশমা সরিয়ে এখন চশমার কাঁচ পরিষ্কার করছেন। আমি অবাক হয়ে ভদ্রলোকের চোখ দেখছি। আশ্চর্য, এত সুন্দর চোখ!
ডাক্তার সাহেব চুপ করে আছেন। মা আবারো বললেন, আমার মেয়ের অবস্থা কেমন দেখলেন বলুন?
ডাক্তার সাহেব শান্ত গলায় বললেন, ভালোই।
আমি লক্ষ করলাম তিনি শুধু ভালো বললেন না। ভালোর সঙ্গে একটা ‘ই’ যোগ করে দিলেন। ভালোটাকে করলেন ভালোই। যার মানে আসলে ভালো নয়।
মা বললেন, ভালোই বলতে কী বুঝাচ্ছেন?
অবস্থা যা ছিল তারচে’ খারাপ হয় নি। মনে হচ্ছে লোকালাইজড গ্রোথ। যাই হোক, আরেকটা রেডিও নিওক্লাইড ব্রেইন স্কেন করাতে হবে।
সেটা তো একবার করানো হয়েছে।
ঐ স্কেন করাতে টেকনিসিয়াম ডিটিপিএ ইনজেকশান দিতে হয়। রেডিওঅ্যাকটিভ মেটিরিয়েলের ইনজেকশান। আগেরবার ইনজেকশানে কিছু সমস্যা ছিল, স্কেনিং ভালো হয় নি।
মা কঠিন গলায় বললেন, এবার যে ভালো হবে তার নিশ্চয়তা কী?
এবারে আমি পাশে দাঁড়িয়ে থেকে করাব।
মা হ্যান্ডব্যাগ থেকে রুমাল বের করতে করতে বললেন, আপনারা শুধু টেস্টের পর টেস্ট করছেন। আজ এই টেস্ট, কাল ঐ টেস্ট। চিকিৎসা শুরু করছেন না। দয়া করে চিকিৎসা শুরু করুন। আর আপনারা যদি মনে করেন চিকিৎসা করার মতো বিদ্যাবুদ্ধি আপনাদের নেই তাহলে সেটাও পরিষ্কার করে বলুন। আমার মেয়েকে আমি বাইরে নিয়ে যাব। দেশের ডাক্তারদের উপর থেকে আমার বিশ্বাস চলে যাচ্ছে।
এ জাতীয় কথায় যে-কোনো ডাক্তারের রাগ হবার কথা। তিনি রাগ করলেন। তিনি তার অবিশ্বাস্য সুন্দর চোখে মার দিকে তাকিয়ে রইলেন। যেন মা অবুঝ এক কিশোরী যার কথা ধরতে নেই।
আমার গাল ঘামছে, মা রুমাল দিয়ে গালের ঘাম মুছে দিচ্ছেন। মানুষের কপাল ঘামে, আমার ঘামে শুধু গাল। অসুখের পর এটা হয়েছে। আমি কাউকে বলি নি। অসুখের কথা কারো সঙ্গে বলতে আমার ভালো লাগে না। ডাক্তারের সঙ্গেও না।
ডাক্তার সাহেব চশমা চোখে পরে মা’র দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কি কফি খাবেন?
মা বললেন, না।
এক কাপ কফি খান। আমিও আপনার সঙ্গে খাব।
ডাক্তার সাহেব আবারো আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, খুকি, তুমি কিছু খাবে?
আমি হাসিমুখে বললাম, হ্যাঁ।
কী খাবে? জুস?
উঁহু, আমিও আপনাদের মতো কফি খাব।
তিনি কফি আনার জন্যে কাউকে বললেন না। তাঁর ঘরেই কফিপটে কফি জ্বাল হচ্ছে। কফির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। এতক্ষণ গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল না। যেই কফি পট দেখলাম, ওমনি গন্ধ পাওয়া শুরু করলাম। ডাক্তার সাহেব নিজেই মগে করে কফি এনে দিলেন। বালতির মতো সাইজের মগ। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে বললেন, প্রফেসর এলেনা এডবার্গ নামে একজন বিখ্যাত নিওরোসার্জন আছেন– ফিলাডেলফিয়াতে থাকেন। তার সঙ্গে আমার খুব ভালো পরিচয় আছে। টরেন্টোর এক কনফারেন্সে প্রথম আলাপ হয়। ভদ্রমহিলার বয়স চল্লিশের নিচে কিন্তু পৃথিবীজোড়া খ্যাতি। আপনার মেয়ের সব কাগজপত্র আমি তার কাছে পাঠিয়ে দেব। তার একটা মতামত নেব।
কবে পাঠাবেন?
কাল-পরশুর মধ্যেই পাঠাব।
কাগজপত্র পৌঁছতে পৌঁছতেই তো একমাস লাগবে।
না, তা লাগবে না। ফ্যাক্স চালু হয়েছে। আমেরিকায় চিঠি যেতে পাঁচ-ছ মিনিটের বেশি লাগার কথা না। আপনি কিন্তু কফি খাচ্ছেন না।
আমি তো আগেই বলেছি কফি খাব না।
তাহলে কি চা দেব? টি ব্যাগস আছে।
মা বিরক্ত গলায় বললেন, কিছুই দিতে হবে না। আমি আবার কবে আসব বলুন।
দিন পনের পরে আসুন।
আপনি বললেন কাগজপত্র যেতে লাগবে পাঁচ-ছ মিনিট। আমাকে পনের দিন পরে আসতে বলছেন কেন?
উনি তো আর সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেবেন না। তাছাড়া আরেকটা স্কেনিং-এর রিপোর্ট লাগবে।
ঠিক করে বলুন তো–আমার মেয়ের সমস্যাটা কি আপনারা ধরতে পারছেন না।
পারছি– মেনিনজিওমা, তবে ঠিক নিশ্চিত হতে পারছি না। মাঝে মাঝে মেনিনজিওমার গ্রোথ ইলিউসিভ হয়। ধরা দিতে চায় না।
ভালোমতো ধরার চেষ্টা করছেন না বলে ধরতে পারছেন না।
আমি কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না মা ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে এত খারাপ ব্যবহার করছে কেন। এমনভাবে কথা বলছে যেন আমার অসুখটার জন্যে ডাক্তার সাহেবই দায়ী। এরকম ব্যবহার সাধারণত খুব পরিচিত মানুষের সঙ্গেই করা যায়। অপরিচিতের সঙ্গে করা যায় না। আমার ক্ষীণ সন্দেহ হলো, মা এই ডাক্তার সাহেবকে চেনেন। হয়তো ছোটবেলায় পরিচয় ছিল। হয়তো এই ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে তাঁর বিয়ের কথা হয়েছিল, শেষটায় আর বিয়ে হয় নি। কিংবা কে জানে হয়তো প্রেম ছিল। বিবাহিত মেয়েদের সঙ্গে পুরনো প্রেমিকের দেখা হলে মেয়েরা চট করে রেগে যায়। মেজোখালার বেলা এটা আমি দেখেছি। মেজোখালার সঙ্গে মনসুর সাহেবের খুব প্রেম ছিল। এসব অবশ্যি আমার শোনা কথা, আমি তাদের প্রেম-ট্রেম দেখি নি। আমার জন্মের আগের ব্যাপার। মেজোখালার যখন অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক হলো তখন তার একেবারে মাথা খারাপের মতো হয়ে গেল। এই কাঁদেন, এই হাসেন। তারপর ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেললেন। যমে-মানুষে টানাটানি অবস্থা। সেই মনসুর সাহেবের সঙ্গে দেখা হলে এখন তিনি ফট করে রেগে যান। নানান ধরনের অপমানসূচক কথা বলতে চেষ্টা করেন। আড়ালে ডাকেন ছাগলা বাবা। একেবারে রামছাগলা।
.
আমরা ফিরছি রিকশায়। আমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে আসার সময় মা কীভাবে কীভাবে একটা গাড়ি জোগাড় করেন। আজ জোগাড় করতে পারেন নি। সেই জন্যেই কি তার মন খানিকটা খারাপ? তাকে কেমন রাগী রাগী লাগছে। রিকশায় চড়তেই আমার বেশি ভালো লাগে। রিকশার হুড ফেলে মাথা একটু উপরের দিকে তুললেই মনে হয় আমি শূন্যে ভাসছি। কিন্তু মা কখনোই রিকশার হুড ফেলবে না। বাবার বেলা সম্পূর্ণ উল্টো ব্যাপার। রিকশায় উঠেই বাবা বলবে–মাই ডিয়ার টিয়া পাখি, হুড ফেলে দে।
বাবার স্বভাবের সঙ্গে মা’র স্বভাবের কোনো মিল নেই। রিকশায় উঠে মা কোনো কথা বলবেন না, মূর্তির মতো বসে থাকবেন। আর বাবা সারাক্ষণ কথা বলবেন। দুটাই অবশ্যি অস্বাভাবিক। একেবারে কথা না বলাও যেমন অস্বাভাবিক আবার সারাক্ষণ কথা বলাও অস্বাভাবিক।
আমার সঙ্গে বাবার একটা মিল হলো– বাবাও রিকশায় চড়তে খুব ভালোবাসেন। কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ এসে বলবেন, মাই ডিয়ার টিয়া পাখি, রিকশায় করে খানিকক্ষণ ঘুরবি নাকি? মা গেছে তোর মেজোখালার বাসায়। ঘণ্টা দুইয়ের আগে ফিরতে পারবে না। তার আগেই আমরা ফিরে আসব এবং আমরা আমাদের গোপন অ্যাডভেঞ্চারের কথা কাউকে কিছু বলব না। যাবি? আমি খুশি খুশি গলায় বললাম, যাব। বাবা বললেন–
টিং টিং টিটিং টিং।
রেবা রেবা লিং লিং।।
এটা হলো তাঁর চায়নিজ গান। বিভিন্ন ভাষায় তাঁর কিছু গান আছে। আরবি ভাষায় তার গানটা হলো
আহলান আহ আবু।
কাহলান কাহ কাবু৷।
চায়নিজ গানটাই তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। যখন তখন গুন গুন করেন।
বাবার সঙ্গে রিকশায় ঘোরার আনন্দের কোনো তুলনা নেই। কত মজার মজার কথা যে বাবা রিকশায় যেতে যেতে বলেন! হাসির কথা, জ্ঞানের কথা। কত রকম ধাঁধা, কত রকম অংক। একবার বাবা বললেন, টিয়া পাখি, দেখি তোর বুদ্ধি কেমন। কঠিন একটা ধাঁধা দিচ্ছি। হুট করে উত্তর দিতে হবে না। ভেবে-টেবে বলবি। ব্যাপারটা হলো শিকল নিয়ে। শিকল দি চেইন। সবাই চায় চেইন থেকে মুক্তি। চেইন খুলে যাওয়া মানে মুক্তি, আনন্দ। শুধু একটি ক্ষেত্রেই চেইন খুলে যাওয়া মানে বন্ধন। আটকা পড়ে যাওয়া। বল তো দেখি কোন ক্ষেত্রে?
আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, রিকশার ক্ষেত্রে। রিকশার চেইন খুলে যাওয়া মানে রিকশা বন্ধ।
বাবা হৃষ্ট গলায় বললেন, তোর অসম্ভব বুদ্ধি তো রে মা। রানি ভিক্টোরিয়ার বুদ্ধিও তোর চেয়ে কম ছিল বলে আমার ধারণা। তুই বুদ্ধি পেয়েছিস তোর মা’র কাছ থেকে। আমার কাছ থেকে বুদ্ধি পেলে তোর সর্বনাশ হয়ে যেত।
আমি বললাম, তোমার বুদ্ধি কি কম নাকি বাবা?
কম মানে? আমার বুদ্ধি হচ্ছে সর্বনিম্ন পর্যায়ের। প্রায় চতুষ্পদীয় গোত্রের।
বাবাকে আমার খুব বুদ্ধিমান মনে হয়। একধরনের মানুষ আছে যারা নিজেদের অন্যের কাছে বোকা হিসেবে তুলে ধরতে ভালোবাসে। বাবা সে ধরনের। মানুষের এই অদ্ভুত স্বভাবের কারণ কী কে জানে! ইচ্ছে করে বাবা অন্যের সামনে বোকামি সব কাণ্ডকারখানা করে বসেন। যেমন ধরা যাক– মার কিছু বন্ধুবান্ধব এসেছেন। তাদের চা দেয়া হয়েছে। তারা চা খাচ্ছেন। গল্পগুজব করছেন। হাসাহাসি করছেন। তখন বাবা হুট করে ঘরে ঢুকবেন। তাঁর গায়ে থাকবে ময়লা একটা গেঞ্জি, পরনে লুঙ্গি। সেই লুঙ্গি প্রায় হাঁটুর কাছে উঠে এসেছে। তিনি ঘরে ঢুকে খুবই বিব্রত হওয়ার ভঙ্গি করবেন। মা অস্বস্তির সঙ্গে জিজ্ঞেস করবেন, কী ব্যাপার? বাবা আমতা আমতা করে বলবেন– দিলশাদ, খুব খিদে লেগেছে। আমাকে একটা ডিম ভেজে দাও তো, পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে ঝাল করে।
বাবার কথায় অতিথিরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করবেন। মা’র ভুরু কুঁচকে যাবে। চোখের দৃষ্টি সরু হয়ে যাবে। বাবা অসহায়ের মতো সবার দিকে একবার করে তাকাবেন। অথচ কেউ বুঝবেন না বাবা এই কাণ্ড ইচ্ছে করে ঘটিয়েছেন। তাঁর খিদে পেলে তিনি ফুলির মাকে বলে ডিম ভেজে খেতে পারেন। তিনি তা না করে সবার সামনে মাকে বিব্রত করে একধরনের মজা পাচ্ছেন। এই ব্যাপারগুলো আমি বুঝি, মা বুঝেন না। এইজন্যেই মাকে আমার খুব বুদ্ধিমতী বলে মনে হয় না। বুদ্ধিমতী যে-কোনো মেয়ে এই ব্যাপারটা ধরে ফেলত।
সবাই বলে ছোট পরিবার সুখী পরিবার। রাস্তায় সাইনবোর্ডে লেখা থাকে। চিঠির উপর সিল মারা থাকে ছোট পরিবার যার, সুখের অন্ত নাই তার। আমাদের পরিবার ছোট পরিবার। আমি, বাবা আর মা। না, ভুল বললাম, ফুলির মা আছে। সে আমার জন্মের আগে থেকে এ বাড়িতে আছে। কাজেই সেও তো পরিবারেরই একজন। তাকে নিয়ে আমরা চারজন। আমাদের খুব সুখী হবার কথা। আমরা বোধহয় সুখী না। বাবা-মা’র সম্পর্ক বরফের মতো। তারা তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া করেন। এমন কঠিন ঝগড়া! কত তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া তা একটু বলি– আমাদের ফুলির মা’র সিগারেট খাওয়ার বিশ্রী অভ্যাস আছে। বাবার সিগারেটের প্যাকেট থেকে সে সিগারেট চুরি করে রাখে। অনেক রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আরাম করে খায়। মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে স্মাৎ করে নাক দিয়ে সেই ধোয়া টেনে নেয়। আমি কয়েকবার দেখেছি। একদিন বাবা করলেন কী তাকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে এনে দিয়ে বললেন, চুরি করার দরকার নেই। এই প্যাকেটটা রাখ। শেষ হলে বলবে, আবার এনে দেব। মা এটা শুনে হৈচৈ শুরু করলেন। আর ফুলির মা শুরু করল কান্না। ব্যাপারটা এখানে শেষ হয়ে যেতে পারত, শেষ হলো না। রাত দুটার সময় মা বাবাকে বললেন, তোমার সঙ্গে আমার বাস করা সম্ভব না। তুমি চলে যাও। বাবা বললেন, রাত দু’টার সময় আমি কোথায় যাব?
তুমি যদি না যাও আমি আমার মেয়েকে নিয়ে চলে যাব।
ঠিক আছে আমিই যাচ্ছি, তবে আপাতত বসার ঘরের সোফায় শুয়ে থাকছি। ভোর বেলা চা খেয়ে চলে যাব।
তুমি এখনি যাবে।
বাবাকে রাত দুটার সময়েই চলে যেতে হলো। তবে তার জন্যে তাঁকে খুব দুঃখিত বলেও মনে হলো না। এই ঘটনা থেকে মনে হতে পারে মা’র দোষই বেশি। আসলে তা না। বাবা মাকে রাগিয়ে দেবার জন্যে যা যা করা দরকার সবই করেন। খুব গুছিয়ে করেন। মাকে রাগিয়ে তিনি কী আনন্দ পান তিনিই জানেন।
সাপ মা’র খুব অপছন্দের প্রাণী। সাপের নাম শুনলেই তিনি শিউরে ওঠেন। কোনোদিন যদি মা কোনো সাপের ছবি দেখেন তাহলে সেদিন তিনি কিছু খেতে পারেন না। এইসব জেনেশুনেও বাবা একবার সাপুড়ের কাছ থেকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে একটা সাপ কিনে নিয়ে এলেন। ছোট্ট একটা কাঠের বাক্সে সাপটা ভরা। বাক্সের ডালায় সাপের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের জন্যে একটি ফুটো। মা বললেন, বাক্সে কী? বাবা হাই তুলতে তুলতে বললেন, নাথিং। অ্যাবসুলিউটলি নাথিং।
নাথিং মানে কী?
একটা সাপ কিনলাম।
মা চমকে উঠে বললেন, কী কিনলে?
সাপ। সরীসৃপ। আমার অনেক দিনের শখ।
মা আতঙ্কে শিউরে উঠে বললেন, তোমার অনেক দিনের শখ সাপ কেনা?
হুঁ।
তোমার এই শখের কথা তো কোনোদিন শুনি নি।
তুমি সাপ ভয় পাও এইজন্যে বলা হয় নি। এখন যেহেতু সাপ পুষব দেখবে তোমার ভয় কেটে যাবে। এক ঢিলে দুই পাখি। আমার শখ মিটল, তোমার ভয় কাটল।
তুমি এই সাপ পুষবে?
অবশ্যই। সাপ পোষা অত্যন্ত সহজ। খাওয়ার খরচ নেই বললেই হয়। সপ্তাহে একটা ইঁদুর। লোকে যে বলে সাপ দুধ খায়, কলা খায় সবই ফালতু কথা। দুধ চুমুক দিয়ে খেতে ফুসফুস লাগে। সাপের ফুসফুস নেই। কলা খাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। সাপ তো আর বাদর না যে কলা খাবে।
সাপ অবশ্যি শেষপর্যন্ত পোষা হয় নি। বাবাকে কাঠের বাক্সসদ্ধ ফেলে দিয়ে আসতে হয়েছে। বাবাও জানতেন ফেলা হবে। পুরো ব্যাপারটা তিনি করেছেন মাকে কিছু যন্ত্রণা দেয়ার জন্যে। যন্ত্রণা দেয়া গেছে এতেই তিনি খুশি। পঞ্চাশ টাকায় সাপ কেনা তার সার্থক। পঞ্চাশ টাকায় এতটা আনন্দ পাবেন তা বোধহয় বাবা নিজেও ভাবেন নি। তার আনন্দিত মুখের ছবি এখনো আমার চোখে ভাসে।
.
বাবা অনেক দিন হলো আমাদের সঙ্গে থাকেন না। থাকেন পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবনে। কাঠের ব্যবসা করেন। কাঠের ব্যবসা যারা করে তারা ক্রমাগত ধনী হয়, বাবা শুধুই গরিব হন। মা’র ধারণা, ব্যবসা-ট্যাবসা কিছু না। ব্যবসার অজুহাতে জঙ্গলে গিয়ে বসে থাকা, নিরিবিলিতে মদ খাওয়া। মার ধারণা সত্যি হতেও পারে।
নেশা করার কুৎসিত অভ্যাস বাবার আছে। খুব প্রবলভাবেই আছে। যত দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে। তার স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে গেছে। গালটাল ভেঙে কী বিশ্রী যে তাকে দেখায়! অথচ যৌবনে বাবা কী সুন্দরই না ছিলেন! বিয়ের পর তোলা বাবা ও মা’র একটা বাধানো ছবি মা’র শোবার ঘরে আছে (এখন নেই। মা সেই ছবি সরিয়ে ফেলেছে)। সেই ছবিতে বাবাকে দেখায় রাজপুত্রের মতো। মা অসম্ভব রূপবতী, তারপরেও বাবার পাশে মানায় না। রাজপুত্রের পাশে রাজকন্যার মতো লাগে না। রাজপুত্রের পাশে মন্ত্রিকন্যার মতো লাগে।
মা’র যখন বিয়ে হয় তখন বাবা বিদেশী এক ওষুধ কোম্পানির প্রোডাকশান ম্যানেজার ছিলেন। তাঁর ছিল টকটকে লাল রঙের একটা মরিস মাইনর গাড়ি। গাড়ির রঙের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি লাল টাই পরতেন। মাকে পাশে বসিয়ে খুব ঘুরতেন। বিয়ের একবছরের মাথায় চাকরি ছেড়ে দিলেন– তাঁর নাকি বোরিং লাগছে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি নিলেন। সেই চাকরি বছর দুই করার পর তাও তার কাছে বোরিং লাগতে লাগল। প্রাইভেট কলেজে কিছুদিন মাস্টারি করলেন। সেটাও ভালো লাগল না। ব্যবসা শুরু করলেন। ব্যবসার শুরুটা খুব ভালো ছিল। ব্যবসা করতে গিয়েই মদ খাওয়ার অভ্যাস হলো। কাজ বাগাবার জন্যে নানান পার্টিতে নাকি যেতে হয়। ইচ্ছার বিরুদ্ধেই একটু-আধটু খেতে হয়। জীবনের কোনো কিছুই তার দীর্ঘদিন ভালো লাগে নি, মদ খাওয়া ভালো লেগে গেল। মদ খাওয়াটা ছাড়তে পারলেন না। সংসারে অশান্তির সীমা রইল না। অশান্তি শেষ হলো যেদিন বাবা বললেন, দিলশাদ, কাঠের ব্যবসা করব বলে ঠিক করেছি। বান্দরবন চলে যাব। কাঠ কেটে হাতি দিয়ে নামানো। খুবই লাভের ব্যবসা। মা কঠিন গলায় বললেন, তোমরা যা ইচ্ছা কর। কাঠ হাতি দিয়ে টেনে নামাও বা নিজেই টেনে নামাও আমার কিছু যায় আসে না।
তোমাদের ছেড়ে বাইরে থাকতে হবে।
দয়া করে তাই থাক।
কোনোরকম চিন্তা করবে না, প্রতিমাসে খরচ পাঠাব।
তোমাকে কোনো খরচ পাঠাতে হবে না। দয়া করে তুমি ঢাকায় এসো না। তাহলেই আমি খুশি হব।
তোমার যে চাকরি তাতে তো আর বাড়িভাড়া দিয়ে সংসার চালাতে পারবে না।
সেটা আমি দেখব।
তুমি বরং এই অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে ভালো কোনো অ্যাপার্টমেন্ট নাও, যেখানে সিকিউরিটি সিস্টেম ভালো। একা একা থাকবে…।
আমাদের নিয়ে তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না।
বাবা চলে যাবার দিনও বেশ খারাপ ব্যবহার করলেন। সেলাই মেশিন দিয়ে জানালার পর্দা সেলাই করছিলেন। বাবা স্যুটকেস হাতে নিয়ে বললেন, যাই। মা সেলাই করতে করতে বললেন, আচ্ছা। মা ফিরে তাকালেন না বা উঠে দাঁড়ালেন না। বাবা আবার বললেন, যাচ্ছি তাহলে, কেমন?
মা বললেন, আচ্ছা।
চিঠি দিও। আমি পৌঁছেই ঠিকানা জানিয়ে দেব।
মা জবাব দিলেন না। সেলাই মেশিন চালাতে লাগলেন। ঘরঘর শব্দ হতে লাগল। বাবা বিষণ্ণ মুখে দরজার দিকে যাচ্ছেন। তাকে খুব লজ্জিত মনে হচ্ছিল। আমি তাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। তিনি মাথা নিচু করে হাঁটছেন, মনে হচ্ছে আমাকে চিনতেও পারছেন না। রিকশায় ওঠার সময় আমি বললাম, প্রতি সপ্তাহে চিঠি দিও বাবা। তিনি বললেন, হুঁ হুঁ।
সেই রাতেই আমার প্রথম মাথায় যন্ত্রণা হলো। টিভিতে নাচের একটা অনুষ্ঠান হচ্ছিল। নজরুলগীতির সঙ্গে নাচ। গানটা খুব সুন্দর, নাচটাও সুন্দর হচ্ছিল। স্টুডিওতে নকল একটা নদী বানিয়েছে। সেই নদীতে চাঁদের আলো পড়ে ঝিলমিল করছে। বোঝা যাচ্ছে নকল, তারপরেও ভালো লাগছে। এই সময় হঠাৎ আমার কাছে সবকিছু ঝাঁপসা লাগতে লাগল। প্রথম ভাবলাম ইলেকট্রিসিটির ভোল্টেজে কিছু হয়েছে। তারপর দেখি ঘরবাড়ি দুলছে। আমি ভয় পেয়ে ডাকলাম, মা মা! মা ছুটে এলেন আর তখনি তীব্র যন্ত্রণায় মাথাটা ফেটে যাবার মতো হলো। আমি উঠে দাঁড়িয়েছিলাম, হঠাৎ দেখি পড়ে যাচ্ছি। মা এসে আমাকে ধরে ফেললেন। আর তখনি ব্যথা কমে সব স্বাভাবিক হয়ে গেল।
মা ভাবলেন, বাবা চলে গেছেন এইজন্যেই আমার মাথার যন্ত্রণা হয়েছে। আমি কিন্তু পরিষ্কার বুঝলাম বাবার যাওয়া না-যাওয়া না– এই ব্যথা সম্পূর্ণ অন্যরকম। আমার খুব ভয় ভয় করতে লাগল। রাতে মাকে বললাম, মা, আমি তোমার সঙ্গে ঘুমুব।
অনেক দিন পর মা’র সঙ্গে শুয়েছি। মা আমার গায়ে-মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, বাবা চলে যাবার জন্যে মনটা খুব খারাপ, তাই না?
আমি বললাম, হুঁ।
তুই তোর বাবাকে কি আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসিস?
হুঁ।
তাকে কতটা বেশি ভালোবাসিস? সামান্য বেশি না অনেকখানি?
অনেকখানি।
আমাকে তোর ভালো লাগে না?
ভালো লাগে না তা তো বলি নি। ভালো লাগে, তবে বাবার চেয়ে অনেক কম ভালো লাগে।
এই যে তোর বাবা প্রতিরাতে নেশা করে বাসায় ফেরে, নেশার ঘোরে হৈচৈ চিৎকার করে, সংসারের কোনো কিছু দেখে না তারপরেও তাকে ভালো লাগে?
হুঁ।
মা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তাহলে তো স্বীকার করতেই হয় তোর বাবা খুব ভাগ্যবান। এরকম জীবনযাপন করার পরও ছেলেমেয়ের ভালোবাসা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সবার ভাগ্যে এটা হয় না।
আমি বললাম, তোমাকেও আমি খুব ভালোবাসি মা বাবার জন্যে ভালোবাসা একরকম আর তোমার জন্যে ভালোবাসা অন্যরকম।
সেটা কী বুঝিয়ে বল।
বুঝিয়ে বলতে পারব না।
আচ্ছা থাক, বলতে না পারলে বলতে হবে না। ঘুমো।
.
আমার মা খুব গোছানো স্বভাবের মেয়ে। খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এলোমেলো কিছুই তার পছন্দ না। সামান্য একটা শাড়ি যখন ঘরে পরেন তখন এমন গুছিয়ে পরেন, মনে হবে সেজেগুঁজে আছেন– এক্ষুনি কোথাও বেড়াতে বের হবেন। কাউকে যখন কাঁচের গ্লাসে পানি দেবেন সেই গ্লাস ঝকঝক করবে। একবার পানি খাবার পর আবার পানি খেতে ইচ্ছা করবে। মাকে আমার অনেকের চেয়েই আলাদা মনে হয়। মার অন্য দুই বোন– আমার বড় খালা আর মেজোখালার সঙ্গে তার কোনোরকম মিল নেই। অথচ তারা তিনজনই দেখতে একরকম। গলার স্বরও একরকম। বড় খালা ও মেজোখালা দুজনের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্যই হলো শপিং সেন্টারে ঘোরাঘুরি করা। বড়খালা সবসময়ই কিছু না কিছু কিনছেন। মেজোখালা দেখে বেড়াচ্ছেন। কিনছেন না, দরদাম করছেন। তাদের সমস্ত কথাবার্তাই কেনাকাটা নিয়ে। বড়খালা হয়তো এলেন, তিনতলা পর্যন্ত সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে হাঁপিয়ে গেলেন। তাঁর ভারি শরীর, তিনি অল্পতেই হাঁপিয়ে যান। ঘরে ঢুকেই বলবেন, ও দিলশাদ, ঠাণ্ডা পানি দে। মরে গেলাম রে। তাঁকে পানি দেয়া হলো। গ্লাসের দিকে তাকিয়েই বললেন– গুলশানের একটা দোকানে গ্লাসের একটা সেট দেখলাম। অসাধারণ। সোনালি কাজ করা। খুব হালকা কাজ। ছোট ছোট পাতা। গ্লাসে পানি ভরলে গ্লাসটা দেখা যায় না, পানিও দেখা যায় না। শুধু সোনালি কাজগুলি দেখা যায়।
মা এ জাতীয় কথায় অংশগ্রহণ করেন না। চুপচাপ বসে থাকেন। তার চোখের দৃষ্টিতে আগ্রহ বা অনাগ্রহ কিছুই থাকে না। বড়খালার তাতে কিছু যায় আসে না। তিনি কথা বলতেই থাকেন।
মেড ইন জাপান, বুঝলি। জাপানিরা এরকম গ্লাস বানাবে ভাবাই যায় না। দুটা সেট ছিল, একটা কিনলাম। দাম কত বল তো? তোর অনুমান দেখি।
আমার অনুমান ভালো না।
আহা, তবু একটা অনুমান কর না।
এক হাজার টাকা।
তোর কি মাথাটা খারাপ নাকি? এক হাজার টাকা তো সাধারণ একটা গ্লাস সেট কিনতেই লাগে। ঐ দিন জার্মানির কাট গ্লাসের একটা সেট কিনলাম, আট পিসের সেট। দাম পড়ল ন হাজার টাকা। তোর দুলাভাই খুব রাগ করছিল। রাগ করলে লাভ হবে? এরকম জিনিস কি সবসময় পাওয়া যায়? হঠাৎ হঠাৎ পাওয়া যায়। এইজন্যে সবসময় চোখ-কান খোলা রেখে বাজারে ঘুরতে হয়। ভালো জিনিস কখনো পড়ে থাকে না। কেউ দেখল, ফট করে নিয়ে নিল।
বড় খালার দীর্ঘ গল্প কী যে বিরক্তিকর! একনাগাড়ে এই গল্প শুনলে যে-কেউ ঘুমিয়ে পড়বে। বড়খালা আমার মা হলে গুলশান-বনানী নিউমার্কেটের দোকানগুলির সব জিনিসপত্রের দাম আমার মুখস্থ থাকত। তিনি হয়তো পাঁচশ পাতার একটা খাতা আমাকে বানিয়ে দিতেন। সেই খাতায় আমাকে সব জিনিসপত্রের দাম লিখে রাখতে হতো। কে জানে, তখন হয়তো আমাকেও তার সঙ্গে দোকানে দোকানে ঘুরতে হতো।
মেজোখালা ভয়ঙ্কর কৃপণ বলেই কিছু কেনেন না। শুধু দেখেন। তিনি গল্প রেন অন্য বিষয় নিয়ে। তার গল্প হলো কে কে তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে সেই গল্প। মেজোখালার ধারণা, তিনি এই পৃথিবীর সবচে’ রূপবতী মেয়ে এবং তাঁর চোখে আছে অসম্ভব আকর্ষণী ক্ষমতা। যে পুরুষ একবার তার চোখের দিকে ভালোমতো তাকাবে সে সারাজীবনের জন্যে আটকা পড়ে যাবে। মেজোখালা খুব বুদ্ধিমতী। কিন্তু এত বুদ্ধিমতী একজন মহিলা এমন বোকার মতো একটা ধারণা নিয়ে বাস করেন কীভাবে কে জানে। তবে মেজোখালা গল্প করেন খুব সুন্দর করে। গলার স্বর নিচু করে, হাত নেড়ে, চোখ বড় বড় করে সুন্দর বর্ণনা। শুনতে খুব ভালো লাগে।
বুঝলি দিলশাদ, কী কাণ্ড হয়েছে শোন। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সোহাগ কম্যুনিটি সেন্টারের ঘটনা। চন্দনার বিয়েতে গিয়েছি। চন্দনাকে চিনেছিস তো? ঐ যে ব্রিগেডিয়ার লতিফের মেজো মেয়ে। আমি পরেছি একটা কাঞ্জিভরম শাড়ি, বিসকিট কালারের জমিন, মেজেন্টা পাড়। একদিকে মেজেন্টা, অন্যদিকে সবুজ। খাওয়া-দাওয়ার পর আমি পান নিচ্ছি, হঠাৎ সাফারি পরা এক ভদ্রলোক এসে বললেন, ম্যাডাম, কিছু মনে করবেন না। আপনাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছি। আপনি কি শুনবেন? আপনার কাছে হাতজোড় করছি। আমি বললাম, বলুন।
এখানে খুব ভিড়। আপনি যদি গেটের কাছে একটু আসেন। জাস্ট ফর এ সেকেন্ড।
এমন করে বলছে না গেলে খারাপ দেখা যায়। আমি গেলাম ভদ্রলোকের সঙ্গে। তারপর যা হলো সে এক ভয়াবহ ব্যাপার। থাক, নাতাশার সামনে বলব না। সে আবার চোখ বড় বড় করে শুনছে। আয় দিলশাদ, অন্যঘরে যাই।
আমার দুই খালারই অনেক টাকা। ঢাকা শহরে তাঁদের দুটা-তিনটা করে বাড়ি আছে। তাঁরা কেউ গাড়ি ছাড়া বের হতে পারেন না। ঈদের বাজার করতে কোলকাতা যান। শুধু আমার মা গরিব। এখন তিনি এনজিও’র কী একটা চাকরি করেন। বড় একটা গাড়ি এসে তাঁকে নিয়ে যায়। অনেক পোজপাজ, কিন্তু বেতন কম। যা বেতন পান তার অনেকটাই চলে যায় বাড়িভাড়ায়, বাকি টাকাগুলি তাকে খুব সাবধানে খরচ করতে হয়। বুয়া কতটুকু চাল সিদ্ধ করবে তা পর্যন্ত মা মেপে দেন। বুয়া নিজে নিজে চাল নিলে বেশি নিয়ে ফেলতে পারে। মাঝে মাঝে মা’র অসময়ে চা খেতে ইচ্ছা করে। তিনি খুশি খুশি গলায় চেঁচিয়ে বলেন, একটু চা কর তো ফুলির মা। তারপরেই সম্ভবত তার মনে হয় এটা বাড়তি খরচ। অসময়ের চায়ে বাড়তি চিনি লাগবে, দুধ লাগবে। হিসেবের চিনি দুধে টান পড়বে। মা হালকা নিঃশ্বাস ফেলে বিষণ্ণ গলায় বলেন, থাক, লাগবে না। এই সময় আমি একটা কাণ্ড কার। আমি বলি, আমারও খুব চা খেতে ইচ্ছা করছে মা। বুয়াকে তোমার জন্যে চা করতে বলো। আমি তোমার কাপ থেকে দুচুমুক খাব। আমাকে দুচুমুক খেতে দেয়ার জন্যে বাধ্য হয়ে মাকে চা খেতে হয়। সেই চা তিনি বেশ আয়োজন করে খান। মা’র চা খাওয়া পর্বটা বেশ মজার। অনেকটা পদ্মাসনের ভঙ্গিতে বসেন। চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার আগে খুব সাবধানে ঠোঁট আগিয়ে আনেন। যেন চাটা ভয়ঙ্কর গরম। ঠোঁট লাগানো মাত্র পুড়ে যাবে। কয়েক চুমুক চা খাওয়ার পর মা কেমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন। তখন তাকে দেখে মনে হয় তিনি এই জগতে নেই। ভিন্ন কোনো জগতে বাস করছেন। সেই জগতের সঙ্গে এই পৃথিবীর কোনো মিল নেই। তখন যদি দরজার কড়া নড়ে মা শুনতে পান না।
একবার মা এরকম অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছেন। তখন ফুলির মা একটা প্লেট ভেঙে ফেলল। ঝন ঝন শব্দ হলো। মা সেই শব্দও শুনতে পেলেন না। অথচ আমাদের বাসায় কাপ-পিরিচ ভাঙা ভয়াবহ ঘটনা। অন্যমনস্ক অবস্থায় মা কী ভাবেন আমার জানতে ইচ্ছা করে। প্রায়ই ভাবি জিজ্ঞেস করব। তারপর আর জিজ্ঞেস করা হয় না। এখন রিকশায় করে মা’র সঙ্গে ফিরছি। মা ডানহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে আছেন। তার গা থেকে মিষ্টি একটা গন্ধ আসছে। হালকা গন্ধ। যে গন্ধ শুধু মাদের শরীরেই থাকে এবং মাদের সন্তান ছাড়া আর কেউ সেই গন্ধ পায় না। আমি ডাকলাম, মা। মা জবাব দিলেন না। তিনি এখন ডুবে গেছেন তার সেই বিখ্যাত অন্যমনস্কতায়। মা’র তাকানোর ভঙ্গি থেকেই বোঝা যাচ্ছে আমার কোনো কথাই এখন তার কানে ঢুকবে না। রাস্তার গর্তে পড়ে রিকশা বড় একটা ঝাঁকুনি খেল। মা’র অন্যমনস্কতা কেটে গেল। মা ফিসফিস করে বললেন, নাতাশা!
হুঁ।
তুই তোর অসুখ নিয়ে কোনোরকম চিন্তা করবি না।
চিন্তা করছি না তো।
ডাক্তারদের ধারণা, তোর মাথায় ছোট্ট মটরদানার মতো একটা টিউমার হয়েছে। বেনাইন টিউমার। বেনাইন টিউমার কাকে বলে জানিস?
না।
বেনাইন হলো যে টিউমার কোনো ক্ষতি করতে পারে না।
ও।
ডাক্তার অপারেশন করে ঐ টিউমার সরিয়ে ফেলবেন। সেই অপারেশনও খুব সহজ অপারেশন। আমাদের দেশে হচ্ছে না, তবে বিদেশে হরদম হচ্ছে। তোর অপারেশন আমি বিদেশে করাব।
এত টাকা কোথায় পাব?
সেটা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। যেভাবেই হোক আমি জোগাড় করব।
কত টাকা লাগবে?
তাও তোর জানার দরকার নেই। তুই শুধু মনে সাহস রাখবি। তোর মনে সাহস আছে তো?
হুঁ, আছে।
সাহস খুব বড় একটা গুণ। এই গুণ পশুদের অনেক বেশি। মানুষের কম। কেন কম বল তো?
মানুষ বুদ্ধিমান, এইজন্যেই মানুষের সাহস কম। বুদ্ধিমানরা সাহসী হয় না।
মা আমার কথায় চমকে গিয়ে আমার দিকে তাকালেন। এরকম কথা তিনি মনে হয় আমার কাছ থেকে আশা করেন নি। মা আরো শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। নরম গলায় ডাকলেন, নাতাশা!
উঁ।
তুই কি তোর বাবাকে অসুখের কথা কিছু লিখেছিস?
না।
তোর কিছু লেখার দরকার নেই। যা লেখার আমিই লিখব।
আচ্ছা।
রিকশায় করে আরো কিছুক্ষণ ঘুরবি?
আজ আমার রিকশায় ঘুরতে ভালো লাগছে না। খুব ক্লান্তি লাগছে। মনে হচ্ছে রিকশার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ব, তবু বললাম, হুঁ ঘুরব।
তুই আর তোর বাবা রিকশা চড়ায় ওস্তাদ। ঠিক বলি নি?
হুঁ।
তোর ঘুরতে ভালো লাগছে?
লাগছে। রিকশার হুড ফেলে দাও।
না, হুড ফেলা যাবে না। গায়ে রোদ লাগবে।
আমি চোখের পাতা মেলে রাখতে পারছি না। হঠাৎ করে রাজ্যের ঘম আমার চোখে নেমে এসেছে। আমি মার কাছে ঘেঁসে এলাম। তার শরীরের গন্ধ এখন আরো তীব্র হয়েছে। পরিচিত কোনো ফুলের গন্ধের সঙ্গে এই গন্ধের মিল আছে। কী ফুল তা মনে করতে পারছি না। মা বললেন, কী রে, তোর শরীর খারাপ লাগছে নাকি? তুই এরকম করছিস কেন?
আমি জবাব দিলাম না। চেষ্টা করলাম আরো মার কাছে ঘেসে আসতে। সেটা সম্ভব না। কারোরই খুব বেশি কাছাকাছি যাওয়া যায় না। কথাটা কে যেন বলেছিল? বাবা বলেছিল? মনে হয়, বাবা।
এরকম অদ্ভুত আর মজার মজার কথা বাবা ছাড়া কে বলবে? বাবার কথাটা কি সত্যি? যদি সত্যি হয় তাহলে হাজার চেষ্টা করেও বাবা মার খুব কাছে যেতে পারবেন না, আবার মাও বাবার খুব কাছে যেতে পারবেন না।
তবে আমার মনে হয়, কথাটা সত্যি না। ইচ্ছে করলেই মানুষের খুব কাছে যাওয়া যায়। সেই ইচ্ছেটাই কেউ করে না। ‘ আমি বেঁচে থাকলে করতাম। যার সঙ্গে আমার বিয়ে হতো, আমি খুব চেষ্টা করতাম তার কাছাকাছি যেতে। সে খারাপ ধরনের মানুষ হলেও করতাম। সে বাইরে থেকে ঘরে এলে আমি ছুটে গিয়ে দরজা খুলে তার দিকে তাকিয়ে হাসতাম। মা’র মতো চোখ-মুখ শক্ত করে থাকতাম না। সে ঘরে ঢোকামাত্র আমি তার হাত ধরে বলতাম–আজ সারাদিন কী কী করলে বলো তো। সে হয়তো বিরক্ত গলায় বলত, আহা, কী শুরু করলে! হাত-মুখটা ধুতে দাও। আমি বলতাম, আগে বলতে হবে সারাদিন কী করলে, তারপর তোমাকে ছাড়ব।
আচ্ছা, আমি বোধহয় একটু খারাপ হয়ে গেছি। এখন প্রায়ই বিয়ের কথা ভাবি। এই বয়সে কোনো মেয়ে নিশ্চয়ই বিয়ের কথা ভাবে না। মনে হয় দিন-রাত বিছানায় শুয়ে থাকার জন্যে এটা হয়েছে। কিছু করার নেই, শুয়ে শুয়ে থাকা। বাংলা আপা একবার বলেছিলেন, ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের ক্রীড়াভূমি।’ আমার অলস মস্তিষ্ক শয়তানের খেলার মাঠ হয়ে গেছে। কয়েকদিন আগে আবার রাতে বিয়ের স্বপ্ন দেখে ফেললাম। রোগা কালো একটা ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে। ছেলেটা রোগা এবং কালো হলেও তার চোখ খুব সুন্দর। আর খুব হাসতেও পারে– সারাক্ষণ হাসছে। আমি তাকে বললাম, এই শোন, এত মেয়ে থাকতে তুমি আমাকে বিয়ে করলে কেন? তুমি কি জানো না– আমি বাঁচব না? আমার ব্রেইন টিউমার হয়েছে। মেনিনজিওমা।
ছেলেটা সেই কথা শুনে আরো হাসতে লাগল। তারপর বলল, ঠাট্টা করবে না তো। অসুখ-বিসুখ নিয়ে ঠাট্টা করতে নেই। ঠাট্টা করলে সত্যি সত্যি অসুখ হবে।
আমি বললাম, ঠাট্টা করছি না। তুমি মাকে জিজ্ঞেস করে দেখ।
এতে সে মজা পেয়ে আরো হাসতে লাগল। আমি তখন রেগে গিয়ে বললাম, খবরদার, হাসবে না।
ছেলেটা তৎক্ষণাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, তাহলে কি আমি কাঁদব? বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। তার কান্না দেখে আমার এত খারাপ লাগল যে আমিও কাঁদতে লাগলাম।
তখন মা এসে ধাক্কা দিয়ে আমার ঘুম ভাঙিয়ে বললেন, নাতাশা, কী হয়েছে? কাঁদছিস কেন?
আমি আমার সব কথা মাকে বলি– স্বপ্নের কথাটা মাকে বলতে পারলাম না। এমন লজ্জা লাগল।
আচ্ছা, এইজন্যেই কি একজন মানুষ অন্য একজন মানুষের খুব কাছে যেতে পারে না? লজ্জা, দ্বিধা, ভয় একজন মানুষকে অন্য একজন মানুষের কাছ থেকে সরিয়ে রাখে? খুব ঘনিষ্ঠ দুজন মানুষের মাঝখানেও বোধহয় পর্দা থাকে। কারো পর্দা খুব ভারী, কারোটা আবার হালকা স্বচ্ছ মসলিনের। সব দেখা যায় তারপরেও অনেক কিছুই দেখা যায় না।