কেরোসিনের চুলায় জাম্বো সাইজের এক কেতলি। মনজু পাশে বসে আছে–একটু পর পর কেতলির মুখ তুলে পানি ফুটছে কিনা তা দেখার চেষ্টা করছে। তার হিসেবমত ইতিমধ্যে পানি ফুটে যাওয়া উচিত। অথচ ফুটছে না। ব্যাপারটা কি?
মজনুর বয়স তেরো-চৌদ্দ কিন্তু দেখায় অনেক বেশি। তার মুখ চিমসে গিয়েছে, গালের হাড় উঁচু, মাথার চুল জায়গায় জায়গায় পড়ে গেছে। উপরের পাটির দু’টি দাঁত ভাঙা। ভাঙা দাঁতের ফাক দিয়ে পিচ করে থুথু ফেলা ছাড়া তার মধ্যে আর কোনো ছেলেমানুষি নেই।
মজনু পূর্বা নাট্যদলের টি বয়। এদের সঙ্গে সে গত তিন বছর ধরে লেগে আছে। তার কাজ হচ্ছে রিহার্সেল চলাকালীন সময়ে একশ থেকে দেড়শ কাপ চা বানানো। এর বিনিময়ে মাসে সে নকবুই করে টাকা পায় এবং রিহার্সেলের এই ঘরে রাতে ঘুমুতে পারে। এমন কোনো লোভনীয় চাকরি নয়। প্রতি সপ্তাহে মজনু একবার করে ভাবে চাকরি ছেড়ে দেবে। ছাড়তে পারে না। তার নেশা ধরে গেছে। রিহার্সেল না শুনলে তার ভাল ঘুম হয় না। বৃহস্পতি এবং শুক্র এই দু’দিন রিহার্সেল হয় না। মজনুর খুব অস্থির লাগে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার এই কথা ভেবে এখন থেকেই মজনুর মেজাজ খারাপ। মেজাজ খারাপ হলে সে কিছুক্ষণ পর পর দাঁতের ফাঁক দিয়ে থুথু ফেলে। এখনো ফেলছে এবং আড়ে আড়ে দরজার দিকে তাকাচ্ছে। কেউ দেখে ফেললে কপালে যন্ত্রণা আছে। তার থুথু ফেলা কেউ সহ্য করে না।
প্রণব বাবু দরজা দিয়ে ঢুকলেন। মজনু অতিরিক্ত গম্ভীর হয়ে পড়ল। প্রণব বাবুকে সে দুচোখে দেখতে পারে না। তার সঙ্গে চোখাচোখি হলেই সে মনে মনে বলে, হারামজাদা মালাউন।
মজনু।
মজনু জবাব দিল না। তাকালও না।
মজনু, জল ফুটিল না কি রে?
না।
চুলায় আগুন আছে নাকি দেখ তো, তুই দেখি রাত বারোটা বাজাবি।
মজনু প্রণব বাবুর উল্টোদিকে মুখ নিয়ে খুব সাবধানে একদলা থুথু ফেলে মনে মনে বলল, হারামজাদা কুত্তা।
এই দলের দু’জন লোককে মজনু সহ্য করতে পারে না। একজন প্রণব বাবু, অন্যজন জলিল সাহেব। অথচ এই দু’জনই নিতান্ত ভােলমানুষ। বিভিন্ন উপলক্ষে মজনুকে টাকা পয়সা দেন।
প্রণব বাবু পকেট থেকে কুড়িটা টাকা বের করে মজনুর দিকে বাড়িয়ে দিলেন। মধুর স্বরে বললেন, পাঁচটা ফাইভ ফাইভ নিয়ে আয়। বিদেশী। যাবি আর আসবি।
মজনু বেরিয়ে গেল। বিদেশী সিগারেট আনতে তার খুব আগ্রহ। দেশীটাই সে কেনে, কেউ ধরতে পারে না। সব বেকুবের দল। অথচ তারা নিজেরা তা জানে না। পৃথিবীতে বোকার সংখ্যা এত বেশি কেন এই জিনিসটা নিয়ে প্রায়ই মজনু ভাবে।
রিহার্সেল হয়। পুরানা পল্টনের জনতা পারলিক লাইব্রেরির হল ঘরে। দুটো চৌকি একত্র করে একটা স্টেজ তৈরি করা আছে। এই পারলিক লাইব্রেবির প্রতিষ্ঠাতা পূর্বা নাট্যদলের সঙ্গে জড়িত বলে এখানে রিহার্সেলের সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে। তবে বেশিদিন পাওয়া যাবে না। হল ঘরটা লাইব্রেরির রিডিং রুম হয়ে যাবে।
হল ঘরে নাটকের পাত্র-পাত্রীরা উপস্থিত হচ্ছে। মহড়া শুরু হতে দেরি হচ্ছে; কারণ আসিফ এখনো এসে উপস্থিত হয়নি। আসিফের স্ত্রী লীনা অনেক্ষণ হল এসেছে। অন্য কোনো মেয়ে এখনো উপস্থিত হয়নি।
লীনার বয়স পঁয়ত্ৰিশ ছাব্বিশ। তাকে কখনো সে রকম মনে হয় না। হালকা পাতলা গড়নের জন্য আঠারো-উনিশ বছরের তরুণীর মত মনে হয়। লীনার মুখটি স্নিগ্ধ। তবে আজ তাকে কিছুটা বিষন্ন দেখাচ্ছে। মিজান বসেছে লীনার পাশে। সে জিজ্ঞেস করল, ভাবী আপনার শরীরটা কি খারাপ?
লীনা জবাব না দিয়ে হাসল। যে হাসির মানে হচ্ছে শরীর ভালই আছে।
মিজান বলল, আসিফ ভাই দেরি করছেন কেন জানেন?
জানি।
লীনা আবার হাসল। তার হাসি রোগ আছে। যে কোনো কথা বলবার আগে একটু হলেও হাসে। এবং কথা কখনো পুরোপুরি বলে না।
মিজান বিরক্ত হয়ে বলল, জানলে বলুন। আপনি অর্ধেক কথা বলেন, অর্ধেক পেটে রেখে দেন, বড় বিরক্ত লাগে।
লীনা বলল, ও তার বোনের বাসায় যাবে। ওর ভাগ্লির শরীর খারাপ। ওখানেই মনে হয়ে দেরি হচ্ছে! মিজান ভ্রূ কুঁচকে বলল, কোনোদিন টাইমলি রিহার্সেল শুরু করতে পারিনা। কোনো মানে হয়?
লীনার বেশ মজা লাগছে; মিজানের কথা বলার ভঙ্গিটাই মজার। এমন ভাবে সে কথা বলে যেন পুরো নাটকের দায়িত্ব তার ঘাড়ে; অথচ সে এই বছরেই মাত্র গ্রুপে জয়েন করেছে। নাটকে এখনো কোনো রোল পায় নি। পাওয়ার সম্ভাবনাও কম। মিজানের গলাটা মেয়েলি। তবে এ নিয়ে তার কোনো ক্ষোভ নেই। সে যে লেগে থাকতে পারছে এতেই সে খুশি।
মিজানদের থেকে একটু দূরে জলিল সাহেব কয়েকজনের সঙ্গে নিচু গলায় আডিডা দিচ্ছেন। আডিডা ঠিক না। কথা বলছেন জলিল সাহেব একাই! অন্যরা খুব আগ্রহ নিয়ে শুনছে। আদিরসের গল্প। জলিল সাহেব আদিরস বিষয়ক রসিকতা অতি চমৎকার করেন। তবে সব সময় করেন না। এমন সময় করেন যখন আশপাশে মেয়েরা কেউ থাকে। আজ লীনা কাছেই আছে।
জলিল সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, গল্পটা হচ্ছে একটা ভীমরুল নিয়ে। ভীমরুল হুঁল ফুটিয়ে দিয়েছে। ভীমরুল হুঁল ফোটালে কি হয় জানো তো? ফুলে বিশাল হয়ে যায়। এখন চিন্তা কর, একজন লোকের একটা বিশেষ জায়গায় যদি ভীমরুল হুঁল ফোটায় তাহলে?
জলিল সাহেবের কথা শেষ হল না, তার আগেই একেকজন হাসতে হাসতে ভেঙে পড়েছে।
লীনা বলল, মিজান, ওরা হাসাহসি করছে কি নিয়ে জানো?
মিজান বলল, জলিল সাহেব আজেবাজে গল্প বলেন, ঐ নিয়ে হাসোহাসি হয়।
আজেবাজে গল্প মানে কি রকম গল্প?
বাদ দেন তো ভাবী।
জলিল সাহেবের গল্প আরো খানিকটা অগ্রসর হয়েছে। আবার সবাই হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ছে। ঘরের ভেতর খুব গরম লাগছে। লীনা বারান্দায় চলে এল; বারান্দা থেকেই দেখল মেয়েরা সব চলে এসেছে। মেয়েদের আনার জন্যে একটা গাড়ি যায়। নতুন মেয়েটির আজ আসার কথা, সে এসেছে কি না কে জানে।
মজনু চা বানাচ্ছে। প্রথম কাপটা সে লীনার দিকে বাড়িয়ে দিল।
লীনা বলল, চা খাব না রে।
গরম লাগছে?
ঠাণ্ডা কিছু আইন্যা দিমু?
না।
আফনের শইলডা কি খারাপ আফা?
না-শরীর খারাপ না।
লীনা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তার শরীরটা আসলেই খারাপ। কেন খারাপ তা সে নিজেও ঠিক জানে না। রাতে ঘুম ভাল হচ্ছে না। একবার ঘুম ভাঙলে কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না! কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়।
যে চার জন মেয়ে এসেছে তাদের একজন আজই প্রথম এল। শ্যামলা একটি মেয়ে, মুখ থেকে বালিকা ভাবটা এখনো যায়নি। সে অবশ্য লালমাটিয়া কলেজে আই.এ. পড়ছে। এবার সেকেন্ড ইয়ার। ভাল নাম ইসরাত বেগম। সবাই অবশ্যি তাকে পুষ্প পুষ্পা ডাকছে।
মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছে সে খুব লজ্জা পাচ্ছে, তবে কৌতূহলী চোখে চারদিক দেখছে।
সে একা পড়ে গেছে। অন্য মেয়েরা জলিল সাহেবের কাছে চেয়ার টেনে বসেছে। জলিল সাহেব ভূতের গল্প শুরু করেছেন। ভূতের গল্পগুলি অবশ্যি আদিরসের গল্পের মত জমছে না।
লীনা বারান্দা ছেড়ে আবার ঘরে ঢুকল। পুষ্পের পাশে চেয়ারে এসে বসল। হাসি মুখে বলল, নাম কি তোমার?
পুষ্প।
বাহ খুব ভাল নাম।
বলে লীনা নিজেই একটু লজ্জা পেল। বাহ খুব ভাল নাম তো। এই জাতীয় কথাগুলি সাধারণত ছোট বাচাদের বলা হয়। এই মেয়েটি ছোট বাচ্চা নয়।
তুমি কি আগে অভিনয় করেছ?
জি না। আমি হয়ত পারব না।
কেন পারবে না। নিশ্চয়ই পারবে। অভিনয় কঠিন কিছু নয়। আমি যদি পারি তুমিও পারবে।
বাসা থেকে করতে দেবে কি না তাও তো জানি না।
সেকি। বাসায় কাউকে কিছু বলনি?
জি না।
বলনি কেন?
বাসায় বললাম, তারপর এখানে কিছু পারলাম না, আপনারা বাদ দিলেন…
লীনা খানিকটা অবাক হল। এই মেয়েকে যতটা লাজুক শুরুতে মনে হচ্ছিল, এ ততটা লাজুক নয়। গলার স্বর পরিষ্কার ও স্পষ্ট। এ পারবে। লীনা বলল, আমাদের দিকটাও কিন্তু তুমি দেখনি। ধরা যাক আমরা তোমাকে নিলাম, তারপর বাসা থেকে বলল… হবে না। তখন আমরা ঝামেলায় পড়ব না?
আমি আপনাদের দিকটা ভাবিনি, আমি শুধু আমার নিজের দিকটাই ভেবেছি।
সবাই তাই ভাবে পুষ্প।
নাটক পরিচালক বজলু ভাই এসে ঢুকেছে। আজ তিনিও দেরি করেছেন। অসম্ভব রোগা, অসম্ভব কালো এবং প্রায় ছফুটের মত লম্বা একজন মানুষ। খানিকটা কুজো হয়ে হাঁটেন বলে তাঁর অন্য নাম হচ্ছে হাঞ্চ ব্যাক অব মীরপুর।
বজলু ভাই এসেই বিরক্ত স্বরে বললেন, তোমরা বসে আছ কেন? শুরু করে দিলেই হত।
জলিল সাহেব বললেন, আপনি নেই, শুরু করব কি ভাবে?
আমি না থাকলে শুরু হবে না। এটা কেমন কথা?
আসিফ ভাইও এখনো আসেননি।
বল কি? এদের হয়েছে কি? দেখি চা দিতে বল। চা খেয়ে ম্যারাথন। আজ ফুল রিহার্সেল হবে। নতুন মেয়ে একটা আসার কথা। এসেছে? কুসুম কিংবা পুষ্প এ জাতীয় নাম।
পুষ্প উঠে দাঁড়াল। বজলু সাহেব সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন। পুষ্প খুব অস্বস্তি বোধ করছে। এতক্ষণ কেউ তেমন করে তার দিকে তাকায়নি, এখন একসঙ্গে সবাই তাকাচ্ছে।
তোমারই নাম কুসুম?
আমার নাম পুষ্প।
একই ব্যাপার। তৈলাধার পাত্র কিংবা পাতাধার তৈল-অভিনয় করেছ কখনো?
জি না।
এই তো একটা ভুল কথা বললে,-অভিনয় তো আমরা সারাক্ষণই করছি। করছি না? বাড়িতে মেহমান এসেছে, তুমি খুব বিরক্ত, তবু তার সঙ্গে হাসি মুখে গল্প করতে হচ্ছে। দেখাতে হচ্ছে যে তুমি আনন্দিত। এটা অভিনয় না? অভিনয় তো বটেই। কঠিন অভিনয়। আমাদের প্রতিনিয়ত অভিনয় করতে হয়।
পুষ্প তাকিয়ে আছে। এই লোকটিকে তার পছন্দ হচ্ছে না। কথা বলার সময় লোকটির মুখ থেকে থুথু ছিটকে আসছে। আর কথা বলছে কেমন মাস্টারের ভঙ্গিতে। কথাবার্তায় একটা সবজান্তা ভাবা এই রকম সবজান্তা লোক তার ভাল লাগে না।
পুষ্প।
জি।
তুমি একটা কাজ কর। একটু দূর থেকে হেঁটে হেঁটে এখানে এসে দাঁড়াও। তারপর তুমি তোমার মাকে ডাক। এমন ভাবে ডাকবে যেন তাকে তুমি জরুরি খবর দিতে চাচ্ছি।
কি খবর?
মনে কর একটা দুঃসংবাদ।
পুষ্প তাই করল। যদিও তার মোটেও ভাল লাগছে না। একটু দূর থেকে হেঁটে এসে বলল, মা, মা।
বজলু সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, কিছুই তো হল না, আবার কর।
পুষ্পের মুখ লাল হয়ে গেছে। সে একবার ভাবল কিছু করবে না। দাঁড়িয়ে থাকবে। কিন্তু তা কী ঠিক হবে? সবাই তার দিকে তাকাচ্ছে। পুষ্প আবার একটু দূরে সরে গেল। এগিয়ে এল জড়ানো পায়ে। আবার ডাকল। মা, মা।
বজলু সাহেব ভ্রূ কুঁচকে বললেন, রোবটের মত কথা বলছ। ফ্রিলি বল। পরিষ্কার গলায় বলল। জায়গাটা আবার কর।
পুষ্প বলল, আর করব না, আমার ইচ্ছে করছে না।
ইচ্ছে করছে না। মানে?
আমি অভিনয় করব না।
পুষ্প লীনার পাশের চেয়ারটায় বসে পড়ল। তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। কি রকম বিশ্ৰী ভঙ্গিতে লোকটা বলল.কিছুই তো হল না। কিছুই না হওয়াটা যেন তার অপরাধ।
পুষ্পের ইচ্ছা করছে বাসায় ফিরে যেতে। রাত এখনো তেমন হয়নি। সে একটা রিকশা নিয়ে চলে যেতে পারবে। তার এত ভয়-টয় নেই। তবে ইচ্ছা করলেই তো আর যাওয়া যায় না। মীনা আপা তাকে নিয়ে এসেছেন। ফিরতে হবে মীনা আপার সঙ্গেই। মীনা আপার কাণ্ড কারখানাও অদ্ভুত। তাকে নিয়ে আসার পর আর কোনো খোঁজখবর নেই। ফার্স মতো একটা লোকের পাশে বসে ক্রমাগত কথা বলছে। ফার্স লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছে না। সে এইসব কথা মন দিয়ে শুনছে। বরং মনে হচ্ছে ফার্স লোকটা বিরক্ত হচ্ছে।
মীনা আপা পুষ্পদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন। কৃষি ব্যাংকে কাজ করেন আর নাটক থিয়েটার করেন। বয়স ত্ৰিশ ছাড়িয়ে গেছে। এখনো বিয়ে হয়নি। পুষ্পের ধারণা বিয়ে হবার সম্ভাবনা খুব কম। মীনা আপা বছর তিন আগে থেকে মোটা হতে শুরু করেছেন। এখন প্ৰায় মৈনাক পৰ্বত। থুতনিতে ভাঁজ পড়েছে। হাঁটার সময় থপ থপ শব্দ হয়।
মীনা আপার ধারণা টনসিল অপারেশনের জন্যে তার এটা হয়েছে। টনসিল অপারেশন না হলে আগের মতো হালকা পাতলা থাকতেন। এই নাটকে মীনা আপা কিসের পার্ট করেন কে
জানে? আসিফ এসে ঢুকল ঠিক সাড়ে আটটায়। দরজা থেকেই লীনার দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসি হাসল। এই হাসির অনেকগুলি অৰ্থ। আট বছর পাশাপাশি থাকায় লীনা এখন সব কটি অর্থ ধরতে পারে। অর্থগুলি হচ্ছে… দেরির জন্যে আমি লজ্জিত, সারাদিনের পরিশ্রমে আমি খানিকটা ক্লান্ত এবং একটা খারাপ খবর আছে।
আসিফকে ঠিক সুপুরুষ বলা যাবে না। শক্ত সমর্থ গড়ন। মাথা ভর্তি অগোছালো কোঁকড়ানো চুল। চোখ দু’টি ছোট, ঠোঁট বেশ পুরু। চওড়া কাঁধ। সব কিছু মিলিয়েও আলাদা কিছু আকর্ষণ তার মধ্যে আছে।
লীনা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। আট বছর এর সঙ্গে বিবাহিত জীবন কাটানোর পরেও এই মানুষটাকে দেখলে তার মধ্যে তরল অনুভূতি হয়। পাশে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে।
আসিফকে ঢুকতে দেখেই বজলু সাহেব চায়ের কাপ নামিয়ে হুংকার দিলেন, স্টার্ট কর। দ্বিতীয় দৃশ্য থেকে শুরু হবে। আজ কোনো প্রম্পটিং হবে না। একবার ডায়ালগ ভুলে গেলে পাঁচ টাকা করে জরিমানা। আসিফ যাও স্টেজে উঠে পড়। তোমরা চেয়ার আর টেবিল দাও, বা দিকে একটু পেছনে। দর্শকরা যেন শুধু সাইড ভিউ পায়। আমি বলল, পেছনের চৌকির পশ্চিম দিকের কোণায় একটা ভাঙা আছে। খেয়াল রাখবেন
আসিফ বলল, এক কাপ চ খেয়ে নিই বজলু ভাই। খুব টায়ার্ড ফিল করছি।
এক চুমুকে চা শেষ কর। কুইক। সাতদিন পর শো, অথচ এখনো একটা দিন ফুল রিহার্সেল দিতে পারলাম না।
লীনা ভেবেছিল আসিফ চায়ের পেয়ালা হাতে তার পাশে এসে দাঁড়াবে। টুকটাক কিছু কথাবার্তা বলবে। তা সে করল না। চায়ের কাপ হাতে প্রণবকে নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। আসিফ নিজের বাসার বাইরে এলে স্ত্রীর সঙ্গে কেমন যেন আলগা একটা ব্যবহার করে। যেন সে লজ্জা পায়।
পুষ্প বলল, চায়ের কাপ হাতে বারান্দার দিকে যে গেলেন, উনি কি এই নাটকের নায়ক?
লীনা হেসে বলল, তার চেহারাটা কি তোমার কাছে নায়কের মত মনে হল?
না, তা না।
হ্যাঁ, এ-ই নায়ক। নাটকের শুরুটা বলি, তোমার ভাল লাগবে। এক জন বিখ্যাত লেখকের উপন্যাস থেকে নাটক করা। গল্পটা খুব চমৎকার। শুনতে চাও?
হ্যাঁ চাই।
এই নাটকের নায়ক হচ্ছেন একজন লেখক। নতুন বিয়ে করেছেন। স্ত্রীর দিকে তার যতটা সময় দেয়া দরকার ততটা দিতে পারছেন না। রাত দশটার পর উনি লেখার খাতা নিয়ে বসেন। স্ত্রী বেচারী একা একা শুয়ে থাকে। মেয়েটির বয়স খুব কম, এই ধর আঠারো-উনিশ। তার খুব ইচ্ছে করে স্বামীর সঙ্গে রাত জেগে গল্প করতে। স্বামী বেচারা তা বুঝতে পারে না। সে তার উপন্যাস নিয়ে ব্যস্ত। ঘটনাটা শুরু হয়েছে এক রাতে। স্বামী লিখছে। হঠাৎ ঝড়বৃষ্টি শুরু হল। ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। লেখকের স্ত্রী একটা জুলন্ত মোমবাতি হাতে বসার ঘরে ঢুকাল।
লেখকের নাম কী?
পুরো নাটকে লেখকের কোনো নাম নেই। তাকে সব সময় লেখক বলা হয়েছে, তবে লেখকের স্ত্রীর নাম হচ্ছে জরী।
আপনি হচ্ছেন্ন লেখকের স্ত্রী, তাই না?
হ্যাঁ। কি করে বুঝলে?
আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল।
নাটক শুরু হল। স্টেজের এক প্রান্তে লেখার টেবিল। চেয়ারে পা তুলে আসিফ বসে আছে। বজলু সাহেব বললেন, চেয়ারে পা তুলে বসেছে কেন? এটা কি রকম বসা?
আসিফ বলল, ঘরোয়াভাবে বসেছি বজলু ভাই। খুব রিল্যাক্সড হয়ে বসা। পা নামিয়ে ঠিকঠাক মত বসলে ফর্মাল একটা ভাগ চলে আসে।
দেখতে ভাল লাগছে না। দেখতে ভাল লাগার একটা ব্যাপার আছে। দর্শক হিসাবে জিনিসটা দেখতে ভাল লাগতে হবে। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি…
বজলু সাহেব কথা শেষ করলেন না। আসিফ বলল, বজলু ভাই আমি চাচ্ছি যেন আমাকে। ভালো না লাগে। লেখকের সব কাণ্ডকারখানায় তার স্ত্রী যেমন বিরক্ত…আমি চাই দর্শকরাও যেন ঠিক তেমনিভাবে বিরক্ত হয়।
বজলু সাহেব শীতল গলায় বললেন, তুমি পা নামিয়ে বস। আসিফ পা নামাল।
বা হাতে মাথা হেলান দিয়ে লিখতে শুরু কর।
পুষ্প মুগ্ধ হয়ে দেখছে। মুগ্ধ হয়ে দেখার মতই ব্যাপার। একজন লেখক গভীর আগ্রহ নিয়ে লিখছেন এটা এত সুন্দর বোঝা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে লেখা থেমে যাচ্ছে, আবার শুরু হচ্ছে। লেখক একটা সিগারেট মুখে দিলেন। দেশলাই দিয়ে সিগারেটে আগুন ধরাতে গিয়ে ধরালেন না। নতুন কিছু মাথায় এসেছে। দেশলাই ফেলে কলম তুলে নিয়ে আবার ঝড়ের বেগে লিখতে শুরু করেছেন
এমন সময় বাতি নিভে গেল। লেখক কি প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়েই না তাকা চেছন টেবিল ল্যাম্পটার
দিকে। লেখকদের প্রতি সহানুভূতিতে পুষ্পের চোখে প্রায় পানি এসে যাচ্ছে। এমন সময় দেখা গেল লেখকের স্ত্রী জরী আসছে। তার হাতে মোমবাতি। বাতাসের ঝাপটা থেকে বাতি আড়াল করে আসছে। তার মুখে কেমন যেন দুষ্ট দুষ্ট হাসি। পুরুপ দেখছে। মুগ্ধ হয়ে দেখছে। লেখক কথা বললেন। কি চমৎকার ভরাট গলা। স্বপ্ন মাখা স্বর।
লেখক : জরী তুমি এখনো জেগে আছ?
জরী : ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ শুনি খাটের নিচে খুটি খুঁট শব্দ হচ্ছে। কে যেন আবার খুক খুক করে কাশল। পুরুষ মানুষের কাশি। ভয়ে আমি অস্থির। খাটের নিচে কে যেন বসে আছে।
লেখক : আবার আজেবাজে কথা শুরু করেছ?
জরী : মোটেই কোনো আজেবাজে কথা না। আমার মনে হচ্ছে আমাদের খাটের নিচে একটা ভূত থাকে। পুরুষ ভূত। ভূতটার গায়ে তামাকের গন্ধ।
লেখক : জরী, তুমি দয়া করে মোমবাতিটা এখানে রেখে ঘুমিয়ে পড়। প্লিজ, প্লিজ…এই দেখ হাতজোড় করছি।
জরী : ঝড় বৃষ্টির রাতে একা একা ঘুমুব? ভূতটা যদি আমাকে কিছু করে। ওর মতলবটা আমার কাছে বেশি ভাল মনে হচ্ছে না।
লেখক : তোমার সঙ্গে ঘুমুতে পারলে আমি খুবই খুশি হতাম। কিন্তু তুমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না… লেখালেখির একটা মুডের ব্যাপার। মুড সব সময় আসে না।
জরী : এখন এসেছে?
লেখক : হ্যাঁ এসেছে। সারারাত আমি লিখব।
জরী : আর আমি সারারাত ঐ ভূতটার সঙ্গে ঘুমুব?
লেখক : আমি একটা ক্লাইমেক্সে এসে থেমে আছি। আমার নায়ক অভাবে অনটনে পর্যুদস্ত। বেকার, হাতে একটা পয়সা নেই। সকালবেলা খবর পেয়েছে তার প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। সে ঠিক করেছে আত্মহত্যা করবে…।
জরী : এখনো করেনি?
লেখক : না করেনি। তবে স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন পথে পথে ঘুরছে।
জরী : সিদ্ধান্ত যখন নিয়েই ফেলেছে তাহলে আর দেরি করছ, কেন? কোনো একটা ট্রাকের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ুক। ঝামেলা চুকে যাক। আমরা আরাম করে ঘুমুতে যাই।
লেখক : বড্ড যন্ত্রণা করছি জরী।
জরী : আমি আর কত যন্ত্রণা করছি? তোমার নায়ক অনেক বেশি যন্ত্রণা করছে। স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েও পথে পথে ঘুরছে। এত ঘোরার দরকার কিরে ব্যাটা? লাফ দিয়ে কোনো একটা ট্রাকের নিচে পড়ে যা। ঢাকা শহরে কি ট্রাকের অভাব?
লেখক : (কড়া স্বরে) জরী।
জরী : আচ্ছা ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি। যদি চাও তো এক কাপ চা বানিয়ে দিতে পারি।
লেখক : এই মুহূর্তে আমি একটা জিনিস চাই, তা হচ্ছে নীরবে কাজ করার স্বাধীনতা।
জরী : বেশ স্বাধীনতা দিচ্ছি। স্বাধীনতার সঙ্গে এক কাপ চাও দিয়ে যাচ্ছি।
পুষ্প দেখল জরী দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে স্বামীর কাছ থেকে চলে আসছে। ঢুকেছে রান্নাঘরে। চা বানাচ্ছে। চা বানাতে বানাতে তার চোখে পানি এসে গেল। সে চোখে আঁচল দিয়ে খানিক্ষণ কাঁদল তারপর চায়ের কাপ হাতে বসার ঘরে ঢুকাল।
বজলু সাহেব চেঁচিয়ে বললেন, স্টপ। অভিনয় থেমে গেল। বজলু সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, পুরো ব্যাপারটা স্নো হয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই নাটক স্লো। এরকম একটা স্নো নাটকে তার চেয়েও স্লো এ্যাকশন পারলিক মোটেও একসেপ্টট করবে না। চা বানানোর জন্য পাশের ঘরে যাওয়া মানেই নাটক স্নো করে দেয়া। জরী, তোমাকে লেখকের পাশেই থাকতে হবে। ঐ ঘরেই ফ্লাস্কে চা বানানো আছে। তুমি শুধু ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে দেবে।
লীনা বলল, বজলু ভাই একটা সমস্যা আছে তো। ইমোশন বিন্ড আপ করার জন্যে আমার কিছু সময় দরকার। এই সময় তো আমি পাচ্ছি না।
যা করার সময়ের মধ্যেই করতে হবে।
এত অল্প সময়ে চোখে পানি আনতে পারব বলে তো মনে হচ্ছে না।
পারবে। অবশ্যই পারবে। না পারলেও ক্ষতি নেই। সাজেসানের ওপর দিয়ে কেটে বের হয়ে যাবে। নাও শুরু করা। স্টার্ট। লেখকের পাশে তুমি দাঁড়িয়ে আছ। শান্ত ভঙ্গিতে বলছি বেশ স্বাধীনতা দিচ্ছি। স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে এক কাপ চা দিয়ে যাচ্ছি। ওকে স্টার্ট। জরী, ডেলিভারি এত সফট দিও না। একটু হার্ড দিও।
অভিনয় শুরু হল। লেখক একমনে লিখছেন। জরী ফ্লাস্ক থেকে চা ঢালতে ঢালতে লেখকের দিকে আড়াচোখে তাকাচ্ছে। তার মন বিষাদে ভারাক্রান্ত। এক সময় টপ টপ করে চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। পুষ্প অবাক হয়ে দেখল কত সহজে মেয়েটির চোখে পানি এসে গেছে। এটা যেন অভিনয় নয়। বাস্তব জীবন। স্বামীসঙ্গ কাতর একটি মেয়ের অভিমানের অশ্রু। লেখক চোখ তুলে তাকালেন এবং অবাক হয়ে বললেন–
লেখক : কি হয়েছে, চোখে পানি কেন?
জরী : (চোখ মুছতে মুছতে) আমার খুব বাজে একটা চোখের অসুখ হয়েছে। রাত হলে চোখ কড় কড়া করে, চোখ দিয়ে পানি পড়ে।
লেখক : পল্টকে একবার দেখাও না কেন?
এই বলেই লেখক আবার লিখতে শুরু করেছেন।
জরী চলে আসছে। দরজার পাশে এসে থমকে দাঁড়াল। জরী তাকিয়ে আছে লেখকের দিকে। লেখক একমনে লিখছেন। জরীর চোখ দিয়ে জল পড়ছে।
পুষ্প বুঝতে ও পারেনি যে তার চোখ দিয়েও পানি পড়তে শুরু করেছে। মেয়েটির কষ্টে তার বুক ভেঙে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সে এক্ষুণি চেঁচিয়ে লেখককে বলবে-পাষণ্ড কোথাকার। সে কিছুই বলতে পারল না। দুহাতে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে উঠল। সবাই অবাক হয়ে তাকাল তার দিকে। তার খুবই খারাপ লাগছে, কিন্তু সে চোখের পানি থামাতে পারছে না। আসিফ এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে।
আসিফ বলল, তোমার নাম কি?
পুষ্প ধরা গলায় বলল, আমার নাম দিয়ে আপনার কোনো দরকার নেই।
এটা সে কেন বলল কে জানে? লেখকের ওপর তার অসহ্য রাগ লাগছিল। এই রাগের জন্যেই হয়তো বলেছে। এখন আবার তার জন্যে খারাপ লাগছে।
হলঘরের ভেতর অসহ্য গরম।
বাইরে এসে একটু আরাম লাগছে। ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। লীনা হালকা গলায় বলল, বৃষ্টি হবে নাকি? আসিফ জবাব দিল না। মনে হচ্ছে সে অন্য কিছু ভাবছে।
লীনা বলল, কিছু ভাবছি নাকি?
না।
বড্ড পানির তৃষ্ণা পেয়েছে। ঠাণ্ডা কিছু খেলে কেমন হয়?
ভালই হয়।
তারা দু’জন কনফেকশনারি দোকানে ঢুকল। লীনার কি যে একটা বলার কথা, অথচ কিছুতেই মনে পড়ছে না। মাঝে মাঝে তার এ রকম হয়। খুব জরুরি কথা, যেটা না বললেই নয়–অথচ মনে পড়ে না।
লীলা।
কি?
টিভিতে একটা অফার পেয়েছি, যােব কি না বুঝতে পারছি না।
যাবে না কেন?
কখনো করিনি তো। বুঝিও না। তাছাড়া…।
তাছাড়া কি?
রোলটা খুব ছোট। নায়কের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। নায়কের কাছে দুবার টাকা ধার চাইতে আসে। এই পর্যন্তই। অভিনয়ের কোনো স্কোপ নেই।
তা হলে যাবে কেন? তোমার মত এত বড় অভিনেতা। তুমি যদি টিভিতে যাও সুপার স্টার হয়ে যাবে।
আসিফ হাসল। লীনা বলল, আমি মোটেও হাসির কথা বলিনি। তুমি হচ্ছে সুপার সুপার স্টার। তুমি নিজেও সেটা খুব ভালো করেই জান। জান না?
আসিফ জবাব দিল না। নিজের সম্পর্কে তার ধারণা বেশ উঁচু। সে খুব ভাল করেই জানে তার ক্ষমতা কতটুকু। তার আশপাশে যারা আছে তারাও জানে। ক্ষমতা যেমন কাজে আসছে না। তাদের দলটা ছোট. অভিনেতা-অভিনেত্রী তেমন নেই। মঞ্চে যেদিন শো হয়, সেদিন অডিটোরিয়াম প্রায় ফাঁকা থাকে। বড় কোনো দলে যদি সুযোগ পাওয়া যেত। তবে দলটির প্রতি তার মমতা আছে। এরা তার জন্যে অনেক করেছে। প্রথম বারেই প্রধান চরিত্র তাকে দিয়েছে। অন্য কোনো দল তা করত না।
লীনা বলল, তুমি কোনো কিছু নিয়ে খুব চিন্তা করছি বলে মনে হচ্ছে।
না তা করছি না। কোক শেষ হয়েছে? চল রওনা দিই। বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে!
লীনা বলল, কিছুক্ষণ হাঁটি, তারপর রিক্সা নেব। হাঁটতে ভাল লাগছে।
বেশ তো চল হাঁটি।
লীনা ছোট ছোট পা ফেলে হাঁটছে। সে আসিফের হাত ধরে আছে। রিহার্সেলের সময় খুব ক্লান্তি লাগছিল। এখন বেশ ভালো লাগছে। আসিফ ঘড়ি দেখল–রাত দশটা। আশপাশে কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ছিনতাই পার্টির সামনে না পড়লেই হল।
লীনা বলল, তোমাকে কি একটা জরুরি কথা বলতে যাচ্ছিলাম, এখন আর কিছুতেই মনে পড়ছে না।
তাহলে বোধ হয় তেমন জরুরি নয়।
না, জরুরি। খুব জরুরি। আমার মাথায় কি যেন হয়েছে বুঝলে–কিছু মনে থাকে না। ব্ৰেইন টিউমার ফিউমার কিছু একটা হয়েছে।
আসিফ তার জবাব দিল না। সিগারেট ধরাল। হাত ইশারা করে খালি রিকশা ডাকল। ক্লান্ত গলায় বলল, আর হাঁটতে পারছি না, চল রিকশায় উঠি। তোমার জরুরি কথাটা মনে পড়েছে?
না। তুমি যখন আশপাশে থাকবে না। তখন হয়ত মনে পড়বে। আমি ঠিক করেছি মনে পড়লেই একটা কাগজে লিখে ফেলব। কাগজটা থাকবে আমার ব্যাগে।
বুদ্ধিটা খারাপ না।
রিকশা দ্রুত চলছে। হাওয়ায় লীনার শাড়ির আঁচল উড়ছে। লীনা শাড়ির আঁচল সামলাতে সামলাতে বলল, এক সময় আমরা একটা গাড়ি কিনব, বুঝলে। তারপর রোজ রাতে গাড়িতে ঘুরব। তুমি চালাবে। আমি তোমার পাশে থাকব।
আসিফ জবাব দিল না। লীনা যখন কথা বলে তখন সে বেশির ভাগ সময় চুপচাপ থাকে। বিয়ের প্রথম দিকে লীনার অসুবিধা হত। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। আসিফ কথা না বললেও তার অসুবিধা হয় না।
আজি রিহার্সেলে নতুন মেয়েটাকে দেখেছ? পুষ্প নাম।
হ্যাঁ দেখলাম। কথাও তো বললাম। অভিনয় না কি পারে না, বজলু ভাই বলছিলেন।
মেয়েটা অভিনয় দেখে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিল।
হুঁ।
এই দেখে তোমার কোনো স্মৃতি মনে পড়েনি?
কোন স্মৃতি?
একটু মনে করে দেখ।
আসিফ তেমন কিছু মনে করতে পারল না। লীনার খানিকটা মন খারাপ হল। সে চাপা গলায় বলল, তোমার সঙ্গে ঠিক এইভাবে আমার পরিচয় হয়েছিল। মনে আছে? ময়মনসিংহ টাউন ক্লাবে নাটক করছিলে। তুমি হলে মধু পাগলা। মনে আছে?
আছে।
তোমার ছেলে মরে গেছে, তার ডেডবডি নিয়ে তুমি যাচ্ছ। আপন মনে কথা বলছি। অভিনয় যে এত সুন্দর হতে পারে। ঐদিন প্রথম বুঝলাম কেঁদো-কেটে একটা কাণ্ড করেছি। শেষে বাবা আমাকে হলের বাইরে নিয়ে যান। তখনো আমি ফোপাচ্ছিলাম। তোমার কিছু মনে নেই, তাই না।
মনে থাকবে না কেন? মনে আছে। নাটকটা সুবিধার ছিল না। মেলোড্রামা। খুবই দুর্বল সংলাপ।
রিকশা গলির মোড়ে থামল। জায়গাটা হচ্ছে শান্তিবাগা। গলির ভেতর তিনতলা বাড়ির দোতলায় তারা থাকে। একটাই ফ্ল্যাট। দু’টি পরিবার শেয়ার করে। কমন রান্নাঘর। তবে তাতে তেমন অসুবিধা হয় না।
বাড়ির গেটের কাছে এসে আসিফ থমকে দাঁড়াল। বিব্রত গলায় বলল, আমি তোমার সঙ্গে আর যাচ্ছি না। সকালে ফিরব।
লীনা অবাক হয়ে বলল, তার মানে!
শেলীর এ্যাপিন্ডিসাইটিস অপারেশন হবে রাত এগারটায়। থাকা দরকার। দুলাভাই চিটাগাং গেছেন। বড়। আপা একা।
এতক্ষণ এটা আমাকে বলনি কেন?
এই তো বললাম।
চল, আমিও তোমার সঙ্গে যাই।
তোমার যাওয়ার দরকার নেই। তুমি বিশ্রাম নাও। তোমার শরীর খারাপ–রেস্ট দরকার।
আমার শরীর খারাপ তোমাকে বলল কে?
কয়েক রাত ধরেই তো ঘুমুতে পারছি না। যতবার উঠি, দেখি চুপচাপ বিছানায় বসে আছি।
লীনা বলল, বেশ তো যাবে যাও–ভাত খেয়ে যাও।
ভাত খাব না। একদম খিদে নেই। সম্ভাবেলা ভাজাতুজি কি সব খেয়েছি, টক চেকুর উঠছে। যাই
লীনা বেশ মন খারাপ করে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রইল। জরুরি কথাটা এখন তার মনে পড়েছে। চেঁচিয়ে ডাকবে আসিফকে? ডেকে বলবে জরুরি কথাটা? ডাকাটা কি ঠিক হবে? এখন মনে হচ্ছে কথাটা তেমন জরুরি নয়।