০১. কেউ কেউ কবি নয়, সকলেই কবি

এই বইয়ের নাম দিয়েছি ‘কবিতা ক্লাস’। এতে চমকাবার কিছু নেই। অনেকে মনে করেন যে, কবিতা একটি অপার্থিব দিব্য বস্তু, এবং তাকে আয়ত্ব করবার জন্যে, মুনিঋষিদের মতো, নির্জন পাহাড়ে-পর্বতে কিংবা বনে-জঙ্গলে গিয়ে তপস্যা করতে হয়। আমি তা মনে করি না। আমার বিশ্বাস, জাতে যদিও আলাদা, তবু কবিতা-ও সাংসারিক বিষয় ছাড়া আর-কিছুই নয়, আমাদের এই সাংসারিক জীবনের মধ্যেই তার বিস্তর উপাদান ছড়িয়ে পড়ে আছে, এবং ইস্কুল খুলে, ক্লাস নিয়ে, রুটিনমাফিক আমরা যেভাবে ইতিহাস কি ধারাপাত কি অঙ্ক শেখাই, ঠিক তেমনি করেই কবিতা লেখার কায়দাগুলো শিখিয়া দেওয়া যায়। ‘কায়দা’ না-বলে অনেকে বলবেন ‘কলাকৌশল’, তা বলুন, কথাটা তার ফলে আর-একটু সম্ভ্রান্ত শোনাবে ঠিকই, কিন্তু মূল বক্তব্যের কোন ইতরবিশেষ হবে না। বিশ্বাস করুন চাই না-করুন, কবিতা লেখা সত্যিই খুব কঠিন কাণ্ড নয়।
সেই তুলনায় পদ্য লেখা আরও সহজ। শুধু কায়দাগুলো রপ্ত করা চাই, ঘাঁতঘোঁত জেনে নেওয়া চাই। কবিতা আর পদ্যের তফাত কোথায়, এক্ষুনি সেই তর্কে ঢুকে ব্যাপারটালে ঘোরালো করে তুলতে চাই না। তার চাইতে বরং জিজ্ঞেস করি, আপনার বয়স যখন অল্প ছিল, তখন ছোটপিসি কি ন-মাসি কি সেজদির বিয়ের সময়ে কি আপনার একখানা উপহার লিখবার ইচ্ছে হয়নি? হয়তো হয়েছিল। হয়তো ভেবেছিলেন, “বাঃ কী মজা, বাঃ কী মজা, খাব লুচি মন্ডা গজা” ইত্যাদি সব উপাদেয় খাবারদাবারের কথা দিয়ে লাইন-কয় লিখে তারপর “বিভুপদে এ-মিনতি—“ জানবেন যে, নবদম্পতি যেন চিরকাল সুখে থাকে।
কিন্তু হায়, শেষ পর্যন্ত আর হয়তো লেখা হয়নি। হবে কী করে? ‘মজা’র সঙ্গে ‘গজা’র মিলটাই তখন মনে পড়েনি যে। আর তাই, কড়িকাঠের দিকে ঘণ্টাখানেক তাকিয়ে থেকে, এবং নতুন-কেনা মেড-ইন-ব্যাভেরিয়া পেনসিলের গোড়াটাকে চিবিয়ে ছাতু করে, শেষপর্যন্ত হয়তো ‘ধুত্তোর’ বলে আপনি উঠে পড়েছিলেন। মনে-মনে খুব সম্ভব বলেছিলেন, “ওসব উপহার-টুপহার লেখার চাইতে বরং মুদির দোকানের খাতা লেখা অনেক সহজ।”
মুদির দোকানের প্রসঙ্গে একটা পুরোনো কথা মনে পড়ল। বছর পঞ্চাশেক আগেকার ঘটনা। আমার বয়স তখন বছর-দশেক। সেইসময়ে আঁক কষতে-কষতে শেলেটের উপরে আমি একটা পদ্য লিখেছিলুম। তার আরম্ভটা এইরকম—

আজ বড়ো আনন্দ হইয়াছে।
দেখিয়াছি, রান্নাঘরে কই আছে।

অর্থাৎ আমি বলতে চেয়েছিলুম যে, মা যখন কইমাছ রান্না করছেন, তখন দুপুরের ভোজনপর্বটা বেশ জমাট হবে, সুতরাং আজ আমার বড়োই আনন্দের দিন। আনন্দ অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হল না; এক জ্যাঠতুতো দাদা এসে চুলের মুঠি ধরে আমাকে শূন্যে তুলে ফেললেন, তারপর বাঁ হাতে আমাকে শূন্যে ঝুলিয়ে রেখে ডান হাতে একটা চড় কষালেন, তারপর বললেন, “হতচ্ছাড়া, তোমাকে আঁক কষতে দেওয়া হয়েছে, আর তুমি কিনা বসে-বসে কাব্যি করছ? এই আমি বলে রাখলুম, পরে তোমাকে মুদির দোকানের খাতা লিখে পেট চালাতে হবে।”
বাজে কথা। যে-ছেলে আঁক কষতে ভয় পায়, তার পক্ষে মুদির দোকানের খাতা লেখা সম্ভব নয়। চাল-ডাল-গোলমরিচ-জিরে-হলুদ-পাঁচফোড়নের হিসেব রাখা কি চাট্টিখানি ব্যাপার? সে-কাজ সকলে পারে না। তার জন্যে সাফ মাথা চাই। সেই তুলনায় বরং কবিতা লেখা অনেক সহজ। কবিতা লেখবার জন্যে, আর যা-কিছুরই দরকার থাক, মাথাটাকে সাফ রাখবার কোনও দরকার নেই। বরং, সত্যি বলতে কী, মাথার মধ্যে একটু গোলমাল থাকলেই ভালো। কিন্তু না, মাথার প্রসঙ্গ এইখানেই ছেদ টানা যাক, কেন-না বিশুদ্ধ আগমার্কা কবিরা হয়তো এইটুকু শুনেই চোখ রাঙাতে শুরু করেছেন, বাকিটুকু শুনলে তাঁরা আমাকে আস্ত রাখবেন না। তার চাইতে বরং যে-কথা বলছিলুম, তা-ই বলি।
আমার বলবার কথাটা এই যে, অল্প একটু চেষ্টা করলে যে-কেউ কবিতা লিখতে পারে। আমার মাসতুতো ভাইয়ের ছোটছেলেটির কথাই ধরুন। গুণধর ছেলে। টুললিফাই করেছে, পরীক্ষার হলে বোমা ফাটিয়েছে, গার্ডকে ‘জান খেয়ে নেব’ বলে শাসিয়েছে, উপরন্তু চাঁদা তুলে, মাইক বাজিয়ে সরস্বতী পুজো করে বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবীকে তুষ্ট করেছে, তবু—এতরকম কাণ্ড করেও—স্কুল-ফাইনালের পাঁচিলটা সে টপকাতে পারেনি, তিন বার পরীক্ষা দিয়েছিল। তিন বারই ফেল। এখন সে আমাদের হাটবাজার করে দেয়, হরিণঘাটার ডিপো থেকে দুধ আনে, পঞ্চাশ রকমের ফাইফরমাশ খাটে, এখানে-ওখানে ভুল-ইংরেজিতে চাকরির দরখাস্ত পাঠায়, এবং—
এবং কবিতা লেখে। তা সে-ও যদি কবি হতে পারে, তবে আপনি পারবেন না কেন?
আমার গিন্নির খুড়তুতো ভাই এক সওদাগরি আপিসের বড়োবাবু। আগে সে-ও কবিতা লিখত, কিন্তু আপিসে তাই নিয়ে হাসাহাসি হওয়ায় এবং বড়োসাহেব তাকে একদিন চোখ পাকিয়া “হোয়াট্‌’স দিস্‌ আয়া’ম্‌ হিয়ারিং অ্যাবাউট ইউ” বলায়, কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়ে সে এখন গোয়েন্দা-গল্পের ভক্ত হয়েছে। তার কাছে সেদিন একটা ইংরেজি বই দেখলুম। বইয়ের নামে বুচার্‌ বেকার্‌ মার্ডার মেকার্‌। অর্থ অতি পরিষ্কার। যে-কেউ খুন করতে পারে। নৃশংস কসাইও পারে, আবার নিরীহ রুটিওয়ালাও পারে। খুন করবার জন্যে যে একটা আলাদা রকমের লোক হওয়া চাই, তা নয়।
তুলনাটা হয়তো একটু অস্বস্তিকর হয়ে যাচ্ছে, তবু বলি কবিতার ব্যাপারেও তা-ই। কবিতা লিখবার জন্যে আলাদা রকমের মানুষ হবার দরকার নেই। রামা শ্যামা যদু মধু প্রত্যেকেই (ইচ্ছে করলে এবং কায়দাগুলোকে একটু খেটেখুটে রপ্ত করে নিলে) ছন্দ ঠিক রেখে, লাইনের পর লাইন মিলিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতে পারে।
তা জন্যে, বলাই বাহুল্য, কিছু জিনিস চাই, এবং কিছু জিনিস চাই না।
আগে বলি কী কী চাই না—
১) কবি হবার জন্যে লম্বা-লম্বা চুল রাখবার দরকার নেই। ওটা হিপি হবার শর্ত হতে পারে, কিন্তু কবি হবার শর্ত নয়। পরীক্ষা করে দেখে গেছে, চুল খুব ছোটো করে ছেঁটেও কিংবা মাথা একেবারে ন্যাড়া করে ফেলেও কবিতা লেখা যায়। চুলের সঙ্গে বিদ্যুতের সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে, কবিতার নেই।
২) সর্বক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবার দরকার নেই। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, মাটির দিকে তাকিয়েও কবিতা লেখা যায়। সবচাইতে ভালো হয়, যদি অন্য কোনও দিকে না তাকিয়ে শুধু খাতার দিকে চোখ রাখেন।
৩) কখন চাঁদ উঠবে, কিংবা মলয় সমীর বইবে, তার প্রতীক্ষায় থাকবার দরকার নেই। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, অমাবস্যার রাত্রেও কবিতা লেখা যায়, এবং মলয় সমীরের বদলে ফ্যানের হাওয়ায় কবিতা লিখলে তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয় না।
৪) ঢোলা-হাতা পাঞ্জাবি পরবার দরকার নেই। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, স্যানডো গেঞ্জি গায়ে দিয়েও, কিংবা একেবারে আদুর গায়েও, কবিতা লেখা সম্ভব।
এইবার বলি, কবিতা লিখতে হলে কী কী চাই।
বিশেষ-কিছু চাই না। দরকার শুধু—
১) কিছু কাগজ (লাইন-টানা হলেও চলে, না-হলেও চলে)।
২) একটি কলম (যে-কোনও শস্তা কলম হলেও চলবে) অথবা একটি পেনসিল এবং–
৩) কিছু সময়।
কিন্তু এতসব কথা আমি বলছি কেন? কবিতার কৌশলগুলিকে সর্বজনের হাতের মুঠোয় এনে না-দিয়ে কি আমার তৃপ্তি নেই? সত্যিই নেই। ইংরেজিতে ‘পোয়্‌ট্রি ফর দি কমন ম্যান’ বলে একটা কথা আছে। আমার ইচ্ছে, কমন ম্যানদেরও আমি পোয়্‌ট বানিয়ে ছাড়ব। পরশুরামের কথা মনে পড়ছে। তাঁর প্রতিজ্ঞা ছিল, পৃথিবীকে একেবারে নিঃক্ষত্রিয় করে ছাড়বেন। কিন্ত, না-পারবার হেতুটা যা-ই হোক, কাজটা তিনি পারতে-পারতেও পারেননি। বিশ্বসংসারকে যাঁরা নিষ্কবি করে ছাড়তে চান (অনেকেই চান), তাঁরাও সম্ভবত শেষ পর্যন্ত পেরে উঠবেন না।
আমার প্রতিজ্ঞাটা অন্য রকমের। আমি ঠিক করেছি, বাংলা দেশে সব্বাইকে আমি কবি বানাব। দেখি পারি কি না।
কবিতা লিখবার জন্যে কী কী চাই, তা তো একটু আগেই বলেছি। চাই কাগজ, চাই কলম (কিংবা পেনসিল), চাই সময়। তা আশা করি কাগজ-কলম আপনারা জোগাড় করতে পেরেছেন। বাকি রইল সময়। তা-ও নিশ্চয়ই আপনাদের আছে। রেশনের দোকানে লাইন না-লাগিয়ে, এই যে আপনারা গুটিগুটি ‘কবিতার ক্লাস’-এ এসে হাজির হয়েছেন, এতেই বুঝতে পারছি যে, সময়ের বিশেষ অভাব আপনাদের নেই।
সুতরাং ‘দুর্গা দুর্গা’ বলে শুরু করা যাক। অয়মারম্ভঃ শুভায় ভবতু।
আগেই বলি, কবিতার মধ্যে তিনটি জিনিস থাকা চাই। কাব্যগুণ, ছন্দ, মিল।
বিনা ডিমে যেমন ওমলেট হয় না, তেমনই কাব্যগুণ না থাকলে কবিতা হয় না। তার প্রমাণ হিসেবে আসুন, আমার সেই মাসতুতো ভাইয়ের ছোটোছেলের লেখা চারটে লাইন শোনাই:

সূর্য ব্যাটা বুর্জোয়া যে,
দুর্যোধনের ভাই।
গর্জনে তার তুর্য বাজে,
তর্জনে ভয় পাই।

 বলা বাহুল্য, এটা কবিতা হয়নি। তার কারণ, ছন্দ আর মিলের দিকটা ঠিকঠাক আছে বটে, কিন্তু কাব্যগুণ এখানে আদপেই নেই। এবং কাব্যগুণ না-থাকায় দেখা যাচ্ছে ব্যাপারটা নেহাতই বাক্যের ব্যায়াম হয়ে উঠেছে।
এবারে মিলের কথায় আসা যাক। মিল না-রেখে যে কবিতা লেখা যায় না, তা অবশ্য নয়, তবু যে আমি মিলের উপর এত জোর দিচ্ছি তার কারণ:
১) প্রথমেই যদি আপনি মিল-ছাড়া কবিতা লিখতে শুরু করেন, তাহলে অনেকেই সন্দেহ করবে যে, মিল-এ সুবিধে হয়নি বলেই আপনি অ-মিলের লাইনে এসেছেন। সেটা খুব অপমানের ব্যাপার।
২) মিল জিনিসটাকে প্রথম অবস্থায় বেশ ভালো করে দখল করা চাই। তবেই সেটাকে ছেড়ে দিয়েও পরে ভালো কবিতা লেখা সম্ভব হবে। যেমন বড়ো-বড়ো লিখিয়েদের মধ্যে অনেকেই অনেকসময়ে ব্যাকরণের গণ্ডির বাইরে পা বাড়িয়ে চমৎকার লেখেন, এ-ও ঠিক তেমনই। ব্যাকরণ বস্তুটাকে প্রথমে বেশ ভালো করে মান্য করা চাই, তবেই পরে সেটাকে দরকারমতো অমান্য করা যায়। ঠিক তেমনি, পরে যাতে মিলের বেড়া ভাঙা সহজ হয়, তারই জন্যে প্রথম দিকে মিলটাকে বেশ আচ্ছা করে রপ্ত করতে হবে।
ছন্দ কিন্তু সবসময়ই চাই। আগেও চাই, পরেও চাই। আসলে আমার ক্লাসে আমি ছন্দের কথাই বলব। সেই বিচারে ‘কবিতার ক্লাস’ না-বলে একে ‘ছন্দের ক্লাস’ও বলা যেতে পারত। তাতে কিছু ক্ষতি ছিল না।

1 Comment
Collapse Comments
অতন্দ্র অনিঃশেষ November 14, 2013 at 5:27 pm

কবিতা লিখি তাই নিজেকে কবি দাবি করি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *