কালো কলকাতা
উনিশশো ছেচল্লিশ, ষোলোই আগস্ট, মহম্মদ আলি জিন্নার ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ নীতিকে মান্যতা দিয়ে কলকাতার বুকে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ ঘোষণা করলেন তত্কালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মুসলিম লিগ প্রধান সঈদ সুরাবর্দী। উদ্দেশ্য একটাই ব্রিটিশ সরকার বাহাদুরের কাছে এটা প্রমাণ করা যে, আলাদা পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হলে কলকাতার অন্তর্ভুক্তি তার মধ্যে অবশ্যম্ভাবী। জিন্না, লিয়াকৎ আলি, নেহরুজি, সর্দার প্যাটেলরা রাষ্ট্রক্ষমতা নামক কেকের ভাগ বাঁটোয়ারার স্বপ্নে মশগুল। গাঁধীজি, কালাম আজাদ, বাদশা খানের মতো নেতারা ক্রমেই পরিণত হচ্ছেন অসহায় দর্শকে আর ইংরেজরা তো চাইছিলই— ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’। এর ফল যা হবার তাই হল। ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ থেকে কলকাতা জুড়ে শুরু হয়ে গেল ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। যা পরবর্তীতে ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ নামে কুখ্যাত। শুধু কলকাতা নয় ক্রমে ক্রমে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল বাংলার বরিশাল, নোয়াখালি এবং অচিরেই রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে অসম এবং পাঞ্জাবে। হাজারে হাজারে লাশ পড়ল। ছড়িয়ে পচে রইল রাস্তায়। অলিতে গলিতে। সরাসরি সরকারি মদতে কলকাতা জুড়ে দাপিয়ে বেড়াতে লাগল চিৎপুর কলুটোলার মীনা পেশোয়ারি, হাফিজ খানদের মতো গুন্ডার দল। এরা মূলত পাঠান। আদি নিবাস আফগানিস্তান। প্রাথমিক স্তরে হিন্দুরাই ক্ষতিগ্রস্ত হলেন বেশি। ঠিক এই সময় মূলত মধ্য কলকাতার একদল যুবক নিজেদের মতো করে সংগঠিত হচ্ছিল এর বিরুদ্ধে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম ক্রিক রো-র ভানু বোস, প্রভাত, সত্যেন, বুলু, জগা বোস। জেলেপাড়ার গোবর্ধন বাগ, চিত্ত বাগ, চন্দননগরের রাম চ্যাটার্জি। এদের নেতৃত্বে বউবাজারের গোপাল চন্দ্র মুখোপাধ্যায় যিনি পরবর্তীতে গোপাল পাঁঠা নামে বিখ্যাত (নাকি কুখ্যাত) হন। মীনা পেশোয়ারিদের ‘পাঠান গ্যাং’ এদের সামনে প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। ব্যাপারটা আর একতরফা থাকে না মোটেই। ফলে হত্যা-পালটা হত্যা চলতেই থাকে। এদিকে প্রায় দু’মাস ধরে চলতে থাকা এই দাঙ্গায় লক্ষাধিক মানুষ খুন হয়ে যান গোটা দেশ জুড়ে। বেলেঘাটায় স্বয়ং গাঁধীজি অনশনে বসেন এই নারকীয় গণহত্যার প্রতিবাদে। অবশেষে দাঙ্গা থামে। এর ঠিক এক বছর বাদে দেশ স্বাধীন হয়, তবে দু’টুকরো হয়ে। যার নিট ফল ভারত ও পাকিস্তান। রাজনীতির ভাগ বাঁটোয়ারা শেষ। সুরাবর্দীর স্বপ্ন সফল হয়নি। মানে কলকাতা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। কেন্দ্র এবং রাজ্যে নব গঠিত কংগ্রেস সরকার।
দাঙ্গা তো শেষ। কিন্তু হাতে রয়ে গেছে প্রচুর অস্ত্র, ক্ষমতা আর লোকজন। অচিরেই কলকাতা ছাড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের অন্যত্রও এই মস্তান বাহিনীর ক্ষমতার রথ ছুটতে থাকে জেট গতিতে। নেতৃত্বে অবশ্যই সেই গোপাল পাঁঠা, তত্কালীন কলকাতার ‘আনক্রাউনড কিং’।
ওঁর এই বিচিত্র পদবির পিছনে অবশ্যই একটা কারণ ছিল। গোপালবাবুর কাকা অনুকূলচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন অগ্নিযুগের প্রখ্যাত বিপ্লবী। বিপ্লবীদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করা, অস্ত্রশস্ত্রের আদানপ্রদান এবং লুকিয়ে রাখা, শেল্টারের ব্যবস্থা, গোপন মিটিং/সভা আয়োজন মূলত এগুলোই ছিল অনুকূলবাবুর কাজ। এক কথায় উনি ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক। কলেজ স্ট্রিট আর প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটের সংযোগস্থলে একটা পাঁঠার মাংসের দোকান ছিল ওঁর। সামনে মা কালীর ছবি আর দেয়ালে ঝোলানো একটা বিশালাকার বলির খাঁড়া। অনুকূলচন্দ্রের এই দোকানেই ছিল বিপ্লবীদের যোগাযোগ, খবর আদানপ্রদানের গোপন কেন্দ্রগুলির অন্যতম। ওঁর অবর্তমানে দোকানের মালিকানা বর্তায় ভাইপো গোপালের ওপর। সেই থেকেই ওঁর নামের পিছনে এই বিচিত্র পদবিটা জুড়ে যায়।
গোটা শহর জুড়ে সাম্রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে দাপট দেখানোর আরও দুটি মঞ্চও প্রস্তুত হতে থাকে দ্রুত। পুজো আর জলসা। সে সময় সারা কলকাতায় বিখ্যাত ছিল বৌবাজারে গোপাল পাঁঠার সরস্বতী আর ক্রিক রোয়ে ভানু বোসের কালীপূজা। পুজোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ সারারাতব্যাপী জলসা। স্থানীয় এবং বহিরাগত অসংখ্য মধ্যবিত্তের বিনোদন। নিখরচায়। উইদাউট টিকিট। মহানায়ক উত্তমকুমার থেকে শুরু করে হেমন্ত-মানবেন্দ্র-শ্যামল-ধনঞ্জয় সহ কলকাতা বম্বের অন্যান্য নামী দামি শিল্পীদের ক্রিক রোয়ের বিচিত্রানুষ্ঠানে হাজিরা ছিল মাস্ট (কলকাতা এবং শহরতলিতে আজকাল যে সব বাহুবলী ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের পুজোর জাঁকজমক দেখতে আমরা অভ্যস্ত তার গোড়াপত্তন কিন্তু সেই সময় থেকেই)। ভানু-গোপালদের ওপর শাসকদলের কৃপাদৃষ্টি বর্ষিত হতে থাকে স্বাভাবিকভাবেই। বাজারে চালু আছে তত্কালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শ্রীবিধানচন্দ্র রায় একবার যখন ইলেকশনে বামপন্থী প্রার্থী মহম্মদ ইসমাইলের কাছে প্রায় হারতে বসেছিলেন, শেষ মুহূর্তে কাউন্টিং বুথে হামলা চালিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর মানরক্ষা করে ‘ভানু-গোপাল অ্যান্ড কোং।’
সবকিছুরই একটা শেষ থাকে। চল্লিশের দশক থেকে শুরু হওয়া মস্তানদের আধিপত্যে প্রথম ধাক্কা লাগে ষাটের দশকে, জঙ্গি বামপন্থী ছাত্র-যুব আন্দোলনের হাত ধরে। এই প্রথম কলকাতার রাস্তায় সোর্ড, চাকু, ডান্ডা, সাইকেলের চেন (মস্তান নেতাদের কারও কারও হাতে পিস্তল), বায়রনের সোডার বোতলের বদলে আসরে নামল পেটো। সোজা বাংলায় হাতবোম। আকাশ বাতাস কাঁপানো বজ্রগর্জন। মুহূর্তে এলাকা ফাঁকা। ছিটকে যাওয়া জালকাঠি, পেরেক, ভাঙা কাচের টুকরো, স্প্লিন্টার। ঠিকঠাক লক্ষ্যভেদ করলে সোজা হাসপাতাল। মাসখানেক কমপ্লিট বেডরেস্ট। আর কপাল খারাপ হলে নিমতলা বা ক্যাওড়াতলার ইনসিওরেন্স স্কিম একেবারে পাক্কা। মূলত সেই সময়কার কলেজগুলোয় বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলির সদস্য রসায়নবিদ্যার ছাত্রদের আবিষ্কার এই পেটো। মাস্তানদের বিরুদ্ধে রাস্তার লড়াইয়ে তখন কলকাতার বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে একাধিক যুব-ছাত্র নেতা-কর্মীর নাম। এরা কেউই তথাকথিত সমাজবিরোধী মস্তান নয়। স্রেফ একটা আদর্শের জন্য জান হাজির। মারতে ও মরতে প্রস্তুত সাহসী, শিক্ষিত এবং লড়াকু একদল যুবক। পেটো আর আদর্শবাদী এক ঝাঁক ছেলে। এই দ্বিমুখী সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে পড়ে ক্রমাগত পিছু হটতে বাধ্য হয় মস্তান বাহিনী। ‘ভানু-গোপাল বাহিনী অপরাজেয়’ এই মিথটায় কিন্তু চিড় ধরেছিল বেশ কিছুদিন আগেই। যাদবপুর অঞ্চলে একটা উদ্বাস্তু কলোনি দখলে গিয়ে প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে মস্তানেরা। সে সময়কার কলোনি আন্দোলনের নেতা আমার এক সম্পর্কিত মামার কাছে শুনেছিলাম গাড়ি থেকে নেমেই নাকি হুঙ্কার ছেড়েছিলেন ভানুবাবু—‘আবে, আমাকে চিনিস? আমার নাম ভানু বোস!’ কিন্তু তিনি ও তাঁর দলবল বোধহয় ‘জার্মান পার্টি’র (তত্কালীন এদেশীয়রা ওপার থেকে আসা উদ্বাস্তুদের এ নামেই ডাকতেন) মানসিকতা বুঝতে একটু ভুল করেছিলেন। একে তো সব ভিটেমাটি চাটি হয়ে এপারে এসেছে। দেশভাগ আর দাঙ্গার ক্ষত তখনও দগদগ করছে মনে। আর একবার আশ্রয় থেকে উচ্ছেদ হবার আশঙ্কা। ভিড়ের মধ্যে কে যেন চিৎকার করে উঠেছিল— ‘কে হালায় ভাউন্যা, ক্যাডা হালায় গোপাইল্যা? কে কোথায় আছস। বাইরা সব লাঠি-নাদনা লইয়া।’ এরপর শুরু হয়ে যায় যাকে বলে সংঘবদ্ধ ‘ব্লিত্জক্রিগ অ্যাটাক।’ বাঙাল নামক প্যানজার বাহিনীর ঝটিকা আক্রমণের সামনে কোনওমতে প্রাণ হাতে নিয়ে পালাতে বাধ্য হয় মস্তান বাহিনী।
আবার প্রসঙ্গে ফিরি। ছাত্রযুবদের প্রতিরোধের সামনে পড়ে সেই যে পিছিয়ে আসার শুরু সেটা অন্তিম আকার নেয় নকশাল আমলে। পাড়ার মোড়ে, অলিতে গলিতে রাগী রোগা-রোগা চেহারার সবে দুধের দাঁত গজানো বাচ্চা ছেলেগুলো স্রেফ ধমকাচ্ছে না, বেশি বেগড়বাই করলে জানে মেরে দেবে— এ ভয়টা পুরনো বনেদি মস্তানদের মধ্যে চেপে বসল। এরই মধ্যে কোলে মার্কেটের সামনে এলাকার উঠতি বাঙালি ক্রিশ্চান ছেলে রনি গোমস এবং তার দলবলের হাতে বেধড়ক মার খেয়ে হাসপাতালে যান ভানু বোস। মাসাধিককাল মৃত্যুর সঙ্গে টানাহ্যাঁচড়া করে ফিরে এলেও পুরনো দাপট আর ফিরে পাননি কোনওদিনই। আশির দশকেও মাঝে মাঝে দেখতাম মৌলালির মোড়ে পেতল কাঁসার বাসনের দোকানগুলোর সামনে টুলে বসে আছেন চুপ করে। হাতে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চায়ের ভাঁড়। কীরকম একটা উদ্ভ্রান্ত ফাঁকা দৃষ্টি। পরাজিত কোনও সম্রাটের মতো। ভানু বোসের পতনের মধ্যে দিয়েই চল্লিশ থেকে ষাট দশকব্যাপী মস্তান সাম্রাজ্যের সমাপ্তি ঘোষিত হয়। একমাত্র ব্যতিক্রম তারকেশ্বর-চন্দননগরের রবিনহুড। রাম চ্যাটার্জি। ক্ষমতার খাঁজ-খোঁজ-গলিঘুঁজি এবড়ো খেবড়ো আর পিছল রাস্তা টপকে কীভাবে বাহুবলী থেকে রাষ্ট্রমন্ত্রী পদে উন্নীত হয়েছিলেন সে এক অন্য ইতিহাস।
সত্যি কথা বলতে কী কলকাতার বুকে মস্তানরা প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতিতে পরিণত হয়েছিল ওই একবারই। ষাটের শেষ আর সত্তরের গোড়ায়। যাই হোক, বাহাত্তরের গোড়া থেকেই প্রবল সরকারি দমন পীড়নের মুখে পড়ে নকশাল আন্দোলনের আঁচ স্তিমিত হয়ে যায় অনেকটাই। হাজার হাজার যুবক গ্রেফতার হয়ে জেলে, পুলিশি অত্যাচারে পঙ্গু হয়ে যান অনেকে। শহিদের সংখ্যাও অগুনতি— ‘এনকাউন্টারে’ অথবা দলীয় সংঘর্ষে। বাহাত্তর সালেই এই রাজ্যে ক্ষমতায় আসে সিদ্ধার্থশংকর রায়ের নেতৃত্বাধীন নব কংগ্রেসি সরকার। কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গে আবার ফিরে আসে মস্তানতন্ত্র। এই মস্তানদের সরাসরি দু’ভাগে ভাগ করা যায়— এক) যারা পাড়ায় পাড়ায় প্রত্যক্ষভাবে নকশাল প্রতিরোধ অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিল প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহায়তায়। দুই) এই সব তরুণ-যুবকেরা, কোনওরকম রাজনৈতিক শিক্ষা বা আদর্শ ছাড়াই নকশাল আন্দোলনে ভিড়ে গিয়েছিল স্রেফ অ্যাডভেঞ্চারিজম আর শক্তিপ্রদর্শনের মোহে। আন্দোলনে যখন ভাটার টান সেসময় পাড়ায় ফিরে এসে শাসকদলের নেতাদের কাছে আত্মসমর্পণ অথবা মুচলেকা/ বন্ড দিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে এসে আনুগত্য বদল করেছিল। প্রথম দলে অবশ্যই আসবে মধ্য কলকাতার কেশব সেন স্ট্রিটের কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত (মুখে বসন্তরোগের একাধিক ক্ষতচিহ্নের জন্য ফাটাকেষ্ট নামেই বিখ্যাত গোটা কলকাতা জুড়ে), গৌরীবেড়িয়ায় হেমেন মণ্ডল, কসবার দেবা দত্ত ওরফে হাতকাটা দেবা, কালিকাপুরে কানাই কুমির, চেতলা কালীঘাটে ভীম-টুপি কাশি-সোনা, মুদিয়ালি প্রতাপাদিত্য রোডে নীরেন চ্যাটার্জি ওরফে চিনা, পণ্ডিতিয়ায় নেলো, চারু মার্কেটে টনি, যাদবপুরে কানা অজিত, চাঁদনি কলুটোলায় মীর মহম্মদ ওমর, হাওড়ায় নব পাঁজা, বেলেঘাটায় রতন ঘোষ, ঘোঁতন মিত্র, বেলঘরিয়ায় ইনু মিত্তির, বরানগরে সত্য দুবে-বুটুন চ্যাটার্জি, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ-এ জগা মিত্র এরকম আরও অজস্র নাম। দ্বিতীয় দলে উল্লেখযোগ্য আমহার্স্ট স্ট্রিটের শঙ্কর সিং, টালিগঞ্জের অমল-সজল-কাজল-পণ্ডিত ইত্যাদি। নকশাল থেকে কংগ্রেসে যোগ দেওয়া এই দ্বিতীয় দলের সদস্যরাই সেসময় কংশাল নামে পরিচিত হয়। আগেই বলেছি পুজো অথবা জলসা— স্ট্রংম্যানদের মাস্ল পাওয়ার শো করার অন্যতম সেরা পদ্ধতি। সেই কারণে অচিরেই কলকাতা জুড়ে বিখ্যাত হয়ে ওঠে সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট আর বেহালায় ফাটাকেষ্ট, শঙ্কর পাইনের কালীপুজো, কসবায় দেবা দত্তর জলসা।
প্রথম দুটি দলের বাইরে তৃতীয় একটি দলও ছিল, প্রথমে যাদের কথা বলতে ভুলে গেছি। এদেরও অধিকাংশই জড়িত ছিল নকশাল আন্দোলনে। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে পুরোপুরি ডাকাত বনে যায়। সুদীর্ঘকালীন অস্ত্র নির্ভরতা আর অ্যাডভেঞ্চার প্রবণতা কখনওই পিছু ছাড়েনি এদের। সঙ্গে অতিরিক্ত যোগ হয়েছিল যেটা— সহজে টাকা কামানোর নেশা। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আমহার্স্ট স্ট্রিটের হৃষিকেশ মুখার্জি। একাধিক ট্রেন আর ব্যাঙ্ক ডাকাতির সঙ্গে জড়িত ছিল। আশির শেষাশেষি নদিয়ার হরিণঘাটায় নকশাল আমলের এক ‘এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট’ পুলিশ অফিসারের গুলিতে নিহত হয় হৃষিকেশ। দ্বিতীয় যার কথা এখানে বলব, ব্যক্তিগত পরিচয় থাকার কারণে তার নামটা উল্লেখ করছি না।
মা ছিলেন সরকারি নার্স। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রয়্যাল নার্সিং সার্ভিস কমিশনে যোগ দিয়ে লন্ডনে পাড়ি জমান। সেখানেই আলাপ হয় এক সুদর্শন পাঞ্জাবি আর্মি অফিসারের সঙ্গে। যুদ্ধে আহত হয়ে কম্যান্ড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। পরিচয় প্রেম আর প্রেম পরিণয়ে পরিণত হতে দেরি হয়নি। লন্ডনেই জন্ম হয় আমার পরিচিতের। তীক্ষ্ন মেধা, অসম্ভব জ্ঞানপিপাসু আর অক্লান্ত পাঠক। ইবসেন থেকে অরণ্যদেব— কিছুতেই অরুচি নেই। হস্তাক্ষর সোনার জলে বাঁধিয়ে রাখার মতো আর অবিশ্বাস্য রকম দ্রুত। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দেয়ালে ‘নকশালবাড়ি লাল সেলাম’ লিখে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যেত। একাত্তরের শেষদিকে গ্রেফতার। বছর সাতেক জেল খেটে বেরিয়ে ডাকাত দলে ভিড়ে আর একবার পুলিশের মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। দীর্ঘদিন ক্রমাগত প্রশাসনের চোখে ধুলো দিয়ে বেরিয়ে অবশেষে ধরা পড়ে যায় ডিডি-র হাতে। শ্যাওড়াফুলি না চন্দননগর কোনও একটা স্টেশন থেকে। স্টেশনের বেঞ্চিতে ঘুমন্ত অবস্থায় ধরা পড়ার সময় বালিশের বিকল্প হিসেবে মাথায় রাখা ব্রিফকেসের মধ্যে ছিল লক্ষাধিক ক্যাশ টাকা, ভরি দশেক সোনার গয়না আর ছ’ঘড়ার একটা রিভলবার। শোনা কথা লক আপে হাজারো অত্যাচার সহ্য করেও লুঠ করা এবং লুকোনো টাকার হদিশ দেয়নি। পরবর্তী কালে প্রাক্তন গোয়েন্দা প্রধান দেবী রায় ‘দেশ’ (সম্ভবত) পত্রিকায় বাংলার ডাকাতদের নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন লেখেন। ওর নামটাও সেই প্রতিবেদনে ছিল। দ্বিতীয়বার জেল থেকে ছাড়া পেয়ে একটা মিত্সুবিসি ক্যান্টার ওয়াগন কিনে ভাড়ায় খাটাতে শুরু করে। কোনও ড্রাইভারের হাতে ছাড়েনি। নিজেই চালিয়ে চষে বেড়ায় গোটা পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড। এই তিনটে রাজ্যের প্রতিটা রাস্তাকে চেনে হাতের তালুর মতো, গাড়ির ক্যাবিনেটে সর্বক্ষণের সঙ্গী দেশি-বিদেশি দু’তিনটে বই আর রামের একটা পাঁইট। বিয়ে থা করেনি। ফুর্তিতে রয়েছে সবসময়। সশস্ত্র বিপ্লবের রাজনীতি আর অপরাধ জগৎ দুটোই বর্তমানে ইতিহাস ওর কাছে। গাড়ির গায়ে লেখা ‘দ্য কার ইজ মাই ব্ল্যাক মাদার।’ কোথায় নাকি পড়েছে পৃথিবীর প্রথম মা কৃষ্ণকায়া এবং জন্মেছিলেন আফ্রিকা মহাদেশে।
এই তৃতীয় গোষ্ঠীটিতে এমনও অনেকে ছিল যাদের সরাসরি কোনও রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড নেই সে অর্থে। একেবারে পেশাদার অপরাধী। এক্ষেত্রে নাম আসবে কাঁকিনাড়া জগদ্দলের বাবু মিত্র আর হুগলির কালিপটলা। রাস্তার ইলেকট্রিক তার কাটা আর ট্রেন ডাকাতিকে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে তুলে নিয়ে গিয়েছিল এই দু’জন। সাধারণ গুন্ডাদের কাছে যখন একটা ওয়ানশটার পাইপগান বা কান্ট্রিমেড রিভলবারই বিরাট ব্যাপার, তখন বাবু মিত্তিরের সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল একটা মেশিন কারবাইন। পরবর্তীতে দু’জনেই গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘকাল কারাবাসের পর অপরাধ জগতের চালচিত্র থেকে মুছে যায়।
সত্তর দশকে নকশাল আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন আর একটি দলেরও উত্থান ঘটে কলকাতার বুকে। এরাও বিশ্বাস করত সশস্ত্র বিপ্লবে। তবে মত ও পথ অনেকটাই নকশালদের থেকে ভিন্ন। দলটির নাম ‘ম্যান মানি গান।’ সংক্ষেপে এমএমজি। নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনখ্যাত অগ্নিযুগের বিপ্লবী অনন্ত সিংহ ওরফে ‘মাস্টারমশাই’। এদের থিওরি হল, জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের তেমন একটা প্রয়োজন নেই। অত্যাধুনিক অস্ত্র চাই, চাই আদর্শবোধে উদ্বুদ্ধ একদল যুবক আর চাই টাকা, বিপ্লবের প্রয়োজনে অবশ্যই। টাকা আসবে কোথা থেকে? সোজা উত্তর— ডাকাতি করতে হবে। এই নীতির অনুসরণে কলকাতা জুড়ে ঘটে চলল একের পর এক ডাকাতির ঘটনা। আজ যারা মধ্য পঞ্চাশ বা তার বেশি, তাদের নিশ্চয়ই মনে থাকবে সদর স্ট্রিট পোস্টঅফিস ডাকাতি, পার্ক স্ট্রিট পোস্টঅফিস ডাকাতি এবং গ্রিন্ডলেজ ব্যাঙ্ক ডাকাতির কথা। এইসব ডাকাতির সূত্র ধরেই গোয়েন্দা অফিসারদের তালিকায় উঠে আসতে থাকে একাধিক নাম-বিপুল বাজপেয়ী, হিরণ্ময় গাঙ্গুলি ওরফে হেনা গাঙ্গুলি ওরফে ‘ঠান্ডাদা’। মেধাবী, উচ্চশিক্ষিত, বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ আর অস্ত্র চালনায় পারদর্শী। অসম্ভব ঠান্ডা মাথায় কাজ হাসিল করতে পারার জন্য দলের মধ্যে ‘ঠান্ডাদা’ নামে ডাকা হত ওকে। একবার পার্ক স্ট্রিটে ডাকাতি করে পালানোর সময় পিছু ধাওয়া করে পুলিশের গাড়ি। দু’-একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুযায়ী বিপদ বুঝে একশো টাকার একটা বান্ডিল খুলে গাড়ির জানলা দিয়ে বেশ কিছু নোট বাতাসে উড়িয়ে দেন হিরণ্ময়। পথচারী মানুষজন টাকা কুড়োতে রাস্তায় নেমে পড়ে। ভিড়ে আটকে যায় পুলিশভ্যান। সেই ফাঁকে উধাও হয়ে যায় কালো অ্যাম্বাসাডার যা ওই সময় ডাকাতির বাহন হিসেবে সমার্থক হয়ে উঠেছিল। প্রশাসনকে অনেক ঘোল খাইয়ে অবশেষে বেলেঘাটায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন হেনা। পরবর্তীতে এই দলেরও অনেকে পেশাদার ডাকাতে পরিণত হয়েছিল।
সেটা আশির মাঝামাঝি। পার্ক স্ট্রিটের একটা বারে দলবল সমেত বসে রয়েছেন মীর মহম্মদ ওমর। মধ্য কলকাতার অবিসংবাদিত ডন। এ রাজ্য ছাড়িয়ে সুদূর মুম্বই অবধি যার ক্ষমতার হাত বিস্তৃত ছিল, ওঠা-বসা ছিল হাজি মাস্তান মির্জা আর করিম লালাদের মতো কিংবদন্তী মাফিয়া ডনদের সঙ্গে। হঠাৎই বারের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল একজন। বেঁটেখাটো বলিষ্ঠ চেহারা। হাতে খোলা রিভলবার। টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে সোজা গুলি চালাল ওমরের কপাল লক্ষ্য করে। সেই কপালই ভাল থাকায়, বুলেট গিয়ে লাগে ইঞ্চি দুয়েক ওপরে। কাচের দেয়ালে। গুলি চালিয়েই দ্রুত বার ছেড়ে বেরিয়ে সামনে অপেক্ষমাণ গাড়িতে উঠে মিলিয়ে যায় ওই যুবক। কে এই দুঃসাহসী? বাঘের গুহায় ঢুকে বাঘেরই ল্যাজ মুচড়ে ধরার হিম্মত রাখে? উত্তরটা হল পার্ক সার্কাস এলাকায় জাননগর রোডের জান মহম্মদ ওরফে ‘পাগলা জান’। ঘনিষ্ঠ মহলে পরিচিত ছিল ‘দাদাভাই’ নামে। ওমর যে রাজনৈতিক দলের অনুগামী ছিল সেই দলেই ওমরের বিরোধী গোষ্ঠীর এক নেতার হাত ছিল এর পিছনে বলে অনুমান। মধ্য কলকাতায় ওমরের একচেটিয়া আধিপত্য খর্ব করতে আর একবার সচেষ্ট হয়েছিল ওই গোষ্ঠী। ব্যবহার করেছিল ‘তাড়িবাবা’কে। এলিয়ট রোড রিপন স্ট্রিট অঞ্চলের ছোটখাটো গুন্ডা থেকে হয়ে ওঠা আরেক ডন। ওমর আর তাড়িবাবার দলবলের মধ্যে সংঘর্ষ সে সময় প্রায় নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে উঠেছিল মধ্য কলকাতায়। তবে তাড়িবাবা বা পাগলাজান কারও অপরাধ জীবনই তেমন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পুলিশের তাড়া খেয়ে রাজ্য ছাড়তে বাধ্য হয় তাড়িবাবা। প্রায় নিজের বাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে নিজেরই বিশ্বস্ত অনুচর বাঙালি খ্রিস্টান দুই ভাই কেলো ও ভোলার পিস্তলের পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে ছোঁড়া বুলেটে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে পাগলাজান। এর কিছুদিনের মধ্যে কেলোও খুন হয়ে যায় এ জে সি বোস রোডের একটি কবরখানার ভিতরে।
খুন পালটা খুনের এই খেলার মধ্যেও ওমরের রাজ্যপাট অবশ্য বজায় ছিল আরও বেশ কিছুদিন। কিন্তু তত্কালীন শাসকদল তাদের বিরোধী দলের অনুগামী ওমরকে কোণঠাসা করতে মদত জোগাতে থাকে বউবাজারের সাট্টা ডন রশিদ খানকে। রশিদ আর তার চ্যালা চামুণ্ডা গুড্ডু, কাট্টা শাকিল, লালাদের দাপটে একটু একটু করে নিজের জমি হারাতে থাকে ওমর। তারপর তো একটা খুনের কেসে ফেঁসে গিয়ে দীর্ঘকালীন কারাবাস। অবশেষে জামিন পেয়ে ফেরার বিদেশে। আর কোনও দিনই ফেরা সম্ভব হয়নি। ওমর-পাগলাজান-তাড়িবাবা পরবর্তী সময়েও অনেক মস্তানি, ক্ষমতার দাপট, অস্ত্র আর টাকার ঝনঝনানি দেখেছে সংখ্যালঘু মহল্লা। ফুলবাগান, মেহেদি বাগান, আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে আওরঙ্গজেব, সোলজার, বুইয়া, স্টিলবডি। রাজাবাজারে ছক্কা মনোয়ার। দারাপাড়ায় বড়কা, কাদের, জাহাঙ্গীর। তিলজলায় লুলা বাপি। আনোয়ার শা রোডে রাজেশ, শেখ বিনোদ, শাহজাদা। নিত্য গ্যাংওয়ার নিজেদের মধ্যে ড্রাগ, মেয়ে পাচার, অবৈধ বেআইনি নির্মাণ, মদ ও জুয়া সাট্টার ঠেক আরও একাধিক বেআইনি ব্যাবসার থেকে লব্ধ অর্থের ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে। তবে এদের সবার অপরাধজীবনও স্বল্পমেয়াদী। গ্যাংওয়ার, পুলিশি এনকাউন্টার আর জেলের দেয়াল এদের বৃহদংশকেই অপরাধ জগতের মানচিত্র থেকে মুছে দেয় খুব তাড়াতাড়ি। যদিও এদের মধ্যে কেউ কেউ জেলের মধ্যে বসেই দিব্যি রাজ্যপাট চালিয়ে যাচ্ছে একথা আজকাল প্রায়ই শোনা যায় প্রিন্ট বা ভিশন মিডিয়ার দৌলতে।
এবার যে দুটি ঘটনার কথা বলব ভয়াবহতা আর হাড় হিম করা নৃশংসতায় তা হার মানাবে যে-কোনও বলিউডি ক্রাইম থ্রিলার সিনেমাকে। সেটাও আশির দশক। গোষ্ঠী সংঘর্ষে আহত হয়ে হাওড়া জেনারেল হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে গোরা মিত্তির। সে সময় হাওড়ায় ত্রাস সঞ্চারকারী নাম। বেডের সঙ্গে হাতকড়া দিয়ে বাঁধা বাঁ হাত। পাশে বসা একজন পাহারাদার কনস্টেবল। দুপুরবেলা। ওয়ার্ড মোটামুটি ফাঁকা। ভিজিটিং আওয়ার্স শুরু হতে অনেক দেরি। একটু ঢিলেঢালা ভাব চারদিকে। ঠিক এই সময় কয়েকজন যুবক। হাতে হাতে আধুনিক স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র। ওয়ার্ডে ঢুকেই দ্রুত চলে এল বেডের সামনে। মুহূর্তের মধ্যে গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল গোরার দেহ। হাত বাঁধা থাকায় পালানোর চেষ্টাটুকুও করতে পারেনি। গার্ড কনস্টেবলও এই ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন। কারা মারল গোরাকে? কেনই বা মারল? এর উত্তর পেতে পিছিয়ে যেতে হবে খানিকটা। হাওড়া, যাকে ইংরেজরা বলত—‘শেফিল্ড অফ ইন্ডিয়া।’ শেফিল্ড ইংল্যান্ডের শিল্প নগরী, হাওড়াও তাই। শুধু দেশটা অন্য। অসংখ্য লোহালক্করের কারখানা থেকে বেরোনো লোহার ছাঁট বা স্ক্র্যাপ। চালু ভাষায় ‘বাবরি’। এর দখল নিয়ে মারামারি দু’দলে। একদলের পান্ডা গোরা মিত্তির। অপর দলের নেতৃত্বে নব পাঁজা। সে সময় গোটা হাওড়ার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা জল নেমে যেত এ দুটো নাম শুনলে। স্ক্র্যাপের ধান্দা থেকে ক্রমে ক্রমে রেলের টেন্ডার বা নিলামে ছড়িয়ে পড়ে এই দু’দলের প্রভাব। এদের কমিশন না দিয়ে কোনও ব্যবসায়ীর ঘাড়ে দুটো মাথা ছিল না স্বাধীনভাবে নিলামে অংশগ্রহণ করে। বাবরি আর টেন্ডার। এই দুয়ের দখল নিয়ে দুটো দলের মধ্যে চলতে থাকা নিরন্তর গ্যাংওয়ারের পরিণতি ঘটে গোরার মৃত্যুতে। এর বছরকয়েক পর নবও খুন হয়ে যায়। সেই নব পাঁজা। এক্স মিলিটারি পার্সোনেল। সত্তর একাত্তরে প্রবল পরাক্রান্ত নকশালরা বার বার এলাকা আক্রমণ করেও যাকে বাগে আনতে পারেনি। সেই নবকে কিনা খুন হতে হল অপরাধজগতে সদ্য পা রাখা এক নবাগতের কাছে। শিকারি। সামান্য রিকশাচালক থেকে হয়ে ওঠা পেশাদার খুনি। এই নামটাই উঠে এসেছিল বারবার পুলিশের কাছে। সাময়িক গ্রেফতার হলেও প্রমাণাভাবে ছাড়া পেয়ে যায় শিকারি।
সকাল দশটা সাড়ে দশটার টিকিয়াপাড়া রেল ইয়ার্ড। লাইনের ওপর দিয়ে দৌড়চ্ছে একটা ছেলে। বয়স বছর কুড়ি বাইশ। হাতে খোলা স্টেইনগান। পিছনে ধাবমান বিশাল পুলিশ বাহিনী। চলছে গুলির লড়াই। চালাচ্ছে দু’পক্ষই।
অবশেষে লড়াই থামল। পরপর ছুটে আসা বুলেটে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল তত্কালীন হাওড়ার আতঙ্ক হুলাই। প্রতিপক্ষের একজনকে খুন করে পালানোর সময় পুলিশের ঘেরাওয়ে পড়ে যায়। ফল এনকাউন্টারে মৃত্যু। রেললাইনের ওপর নিস্পন্দ স্থির হুলাইয়ের দেহ। পাশে শোয়ানো নীরব স্টেনগান… এ ছবিটা ছাপা হয়েছিল প্রায় সবক’টি দৈনিক সংবাদপত্রের ফ্রন্ট পেজে। কভার স্টোরি হয়েছিল একাধিক। আলোচনা বুড়বুড়ি কেটেছিল ক’দিন ধরে। তারপর সব চুপচাপ। পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি একটুও। এরপরেও হাওড়ার অন্ধকার জগতে উঠে এসেছে একের পর এক নাম। আপেল-গাম-টুলে, প্রভাত, রাখাল ডেভিড, অমিত, চাল শঙ্কর, মাছ শঙ্কর…। সব মিলিয়ে সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। হু হু করে উঠে আসা অন্ধকার জগতে। গলায় মোটা সোনার চেন। নামী কোম্পানির টি শার্ট-জিন্স-পারফিউম। অ্যান্টিকুইটি, স্মিরনফ অথবা ব্লেনডারস প্রাইড, নারীসঙ্গ, দামি মোটরবাইক আর সেলফোন, কোমরে গোঁজা কালো ঘাতক, নেতাদের সঙ্গে গা ঘষাঘষি, তারপর একদিন…গরাদের পিছনে নয়তো মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা কানাগলির মোড়ে, রেললাইনের পাশে, নর্দমার ধারে, আবর্জনার ভ্যাটে অথবা চিৎ হয়ে ভাসতে থাকা পানাপুকুরের পচা জলে। পাল্টায়নি এ ছবিটাও। বোধহয় পাল্টাবেও না কোনও দিন।
সাতাত্তরের নির্বাচনে রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধ দুনিয়ার ক্যানভাসেও দু’-চারটি পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগতে থাকল। বিধান রায় থেকে সিদ্ধার্থবাবু— এদেশ শাসনকালে রাজনীতির সঙ্গে পেশিশক্তির সম্পর্ক থাকলেও গুন্ডা মস্তানরা পার্টি অফিসের দরজাটা টপকাতে পারেনি কখনওই। রাজনৈতিক দলের নেতারা প্রয়োজনে মাস্লম্যানদের ব্যবহার করেছেন ঠিকই, কিন্তু তারা কখনওই নেতা-মন্ত্রী-সাংসদ-বিধায়ক-নির্ণায়ক কোনওটাই হয়ে উঠতে পারেনি। সাতাত্তর পরবর্তী সময়ে এই সীমারেখাটা মুছে যায়।
দ্বিতীয় যে সমস্যাটি গুরুতর হয়ে দাঁড়াল তত্কালীন শাসকদলের কাছে, সেটা শিক্ষিত এবং লড়াকু জঙ্গি ক্যাডারের আকাল। যারা সারা রাত জেগে পোস্টার মারবে, দেয়াল লিখবে, চে গুয়েভারার ডায়েরি পড়বে, কোট করবে ‘রেড বুক’ বা লেনিনের ‘পার্লামেন্ট অ্যান্ড প্র্যাকটিস’ থেকে। স্ট্রিট কর্নারে উদাত্ত গলায় গেয়ে উঠবে ‘ইন্টারন্যাশনাল’, আবার প্রয়োজনে বোমা-পাইপগান হাতে রাস্তায়ও নামবে। নচিকেতার গানের সেইসব ‘অনিন্দ্য সেন’দের অনেকেই সত্তর একাত্তরে নকশাল আন্দোলনে যোগ দিয়ে নিহত অথবা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে গিয়েছিলেন। বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন কেউ কেউ। যারা তখনও পুরনো দলে রয়ে গেছেন, আশির দশক শেষ হতে না হতেই তাদের একটা বৃহদংশ বীতশ্রদ্ধ হয়ে বসে গেলেন। নীতিতে না মেলার জন্য বহিষ্কারও করা হল অনেককে। মুষ্টিমেয় কয়েকজন নেতা মন্ত্রী হলেন। গদি, ঝাঁ চকচকে পার্টি অফিস, এসি কামরা আর স্করপিও ছেড়ে তাদের পক্ষে আর রাস্তায় নামা সম্ভব নয়। ঠিক এই রন্ধ্রপথ দিয়েই প্রবেশ এবং উত্থান দুলাল-হাতকাটা আশিস-লালি-বুল্টন-পলাশ-হাতকাটা দিলীপ-গব্বর-হুব্বা শ্যামল-রশিদ খান বাহিনীর। পেটে ক্রেন নামালে ‘ক’ উঠবে না। আদর্শ— সেটা খায় না মাথায় মাখে জানা নেই। সাট্টার ঠেক চালাও, চুল্লু বেচো, পুকুর বোজাও, গাছ কাটো, জমি দখল করো, গায়ের জোরে গৃহনির্মাণ সংস্থা অথবা মধ্যবিত্ত গৃহস্থকে বাড়ি তোলার সময় নিম্নমানের ইট-বালি-সিমেন্ট সাপ্লাই করো, চমকে ভয় দেখিয়ে তোলা তোলো। নজরানা পৌঁছে দাও সঠিক সঠিক স্থানে নিয়মিত। তারপর বিন্দাস থাকো। শুধু দলের হয়ে ইলেকশনের সময় আর টুকটাক প্রয়োজনে একটু-আধটু রাস্তায় নামো। এই একটু-আধটু রাস্তায় নামাটা যে কী বিষম বস্তু, টের পেয়েছিলেন বউবাজারের মানুষ, আশির দশকের শেষ দিকে পুরসভার নির্বাচনে। মোটামুটিভাবে বিরোধী দল প্রভাবিত এলাকা। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে বিরোধী প্রার্থীর জয় প্রায় নিশ্চিত। হিসেবটা উলটে গেল ভোটের দিন। সকাল থেকেই হাতে খোলা সোর্ড, বোমা, রিভলবার নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ল ‘ডোবারম্যান গ্যাং’। সব হিসেব গুলিয়ে দিয়ে জয়ী হলেন শাসক দলের প্রার্থী। বাহাত্তরের ইলেকশনে রিগিং প্রায় প্রবাদকথায় পরিণত। তাকেও বলে বলে দশ গোল মেরেছিল বউবাজারের পুরসভা নির্বাচন। রাস্তায় খোলা পিস্তল হাতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দুর্বৃত্ত দল— এ ছবিও ছাপানো হয়েছিল প্রতিটি কাগজের সামনের পাতায়। কিন্তু মস্তানদের কারও টিকিটিও ছোঁয়া যায়নি। এই নব্য মস্তানবাহিনীর সঙ্গে পুরনো বাহুবলীদের ফারাক একটাই। তাঁরা ছিলেন পাড়ার স্বঘোষিত অভিভাবক। সাধারণ মানুষের ওপর অন্যায় জুলুম একেবারেই না পসন্দ ছিল ওদের। এলাকার মেয়েদের সম্মান ইজ্জত নিয়ে প্রচণ্ড সচেতন। আমার এক আত্মীয়া, শ্রীগোপাল মল্লিক লেনের বাসিন্দা (এখন বিয়ে হয়ে দিল্লিতে), তার কাছেই শুনেছিলাম গল্পটা। বাড়ি ফিরছেন একটু রাত করে। পাড়ার মোড়ে দলবল সমেত বসে আছেন গোপাল পাঁঠা। রক থেকেই বাজখাঁই গলায় হুঙ্কার—‘কোথায় গিয়েছিলে মা?’ মিনমিনে গলার উত্তর— ‘মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়তে।’ আবার প্রশ্ন— ‘রাস্তায় কেউ বিরক্ত করেনি তো?’ নীরবে ঘাড় নাড়া কোনওমতে—‘না।’ ‘ঠিক আছে, বাড়ি যাও।’ সেখানে আজকালকার মস্তানবাহিনী। ন্যূনতম মূল্যবোধের বালাই নেই। যে-কোনও অপরাধ করতে কুণ্ঠা নেই বিন্দুমাত্র। শুধু টাকার অঙ্কটা ঠিকঠাক থাকতে হবে। ষাটের দশকের বাহুবলীরা যদি সামন্ততান্ত্রিক গ্রামপ্রধান হন সেখানে আধুনিক মস্তান বাহিনী—‘হাইলি প্রফেশনাল কর্পোরেট’! যেখানে সবটাই— ‘এন্ড অফ দ্য ডে মানি অ্যান্ড প্রফিট ম্যাটারস।’
আজকাল বিস্ময়ভরে একটা ব্যাপার খেয়াল করছি। মেটিয়াবুরুজে হরিমোহন ঘোষ কলেজে ছাত্র সংসদের নির্বাচনের মনোনয়নপত্র তোলাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ এবং সমাজবিরোধীর গুলিতে পুলিশ অফিসার তাপস চৌধুরীর মর্মান্তিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে চ্যানেলে চ্যানেলে আলোচনায় রোজ উঠে আসছে একের পর এক নাম। তাদের সঙ্গে অপরাধ, অপরাধ জগৎ আর রাজনীতির উচ্চতম মহলের যোগাযোগের কথা। গলার শিরা ফুলিয়ে চিৎকার করছেন বিরোধী (পূর্বতন শাসক) দলের নেতারা। যেন মেটিয়াবুরুজ-গার্ডেনরিচ এলাকা এই সেদিন অবধিও স্বর্গরাজ্য ছিল! রাতারাতি ব্রাজিল-কলম্বিয়ার অলিগলি, নিউ ইয়র্কের ডাউন টাউন বা মুম্বইয়ের ধারাভি ডোংরির মতো অপরাধের নরকে পরিণত হয়েছে। অথচ বন্দর এলাকায় মাফিয়াচক্রের কাহিনি তো আজকের নয়। স্মাগলিং, ভাঙা জাহাজের অকশন, কাটা কাপড়ের ধান্দা, ড্রাগ পাচার থেকে হালফিলের বেআইনি নির্মাণের ইতিহাস তো প্রায় চার দশকের পুরনো। বন্দর এলাকার দখল নিয়ে গ্যাংওয়ার, এনকাউন্টার আর মৃত্যু। অপরাধ জগতের গ্রাফটা নীচে নামেনি কখনওই। উলটে রাজনৈতিক রং পালটে পালটে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করেছে বাহুবলীরা। অথচ আলোচনার সময় এ সব কথা বেবাক ভুলে যান এইসব নেতারা। এরা ভুলে যান চুরাশি সালে এই মেটিয়াবুরুজেই বাতিকল কাচ্চিসড়ক এলাকায় নৃশংসভাবে কুপিয়ে খুন করা হয়েছিল সৎ এবং সাহসী পুলিশ অফিসার ডি সি পোর্ট বিনোদ মেহতাকে। এই কাণ্ডে মূল অভিযুক্ত ইদ্রিস মিঞার মৃত্যু হয় পুলিশি হেফাজতে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে একাধিক সংবাদপত্রে বারবার নাম উঠে আসে স্থানীয় প্রভাবশালী এক নেতা ও মন্ত্রীর। যথারীতি নমো নমো করে একটা তদন্ত কমিশন গঠিত হয়। ফল? খুদা মালুম। আলোচনার সময় এসব কথা বেমালুম ভুলে মেরে দেন ওইসব নেতারা। এরা ভুলে যান অনিতা দেওয়ানের কথা। বর্বরভাবে ধর্ষণ এবং খুন করেও ক্রোধ মেটেনি জানোয়ারদের। ময়নাতদন্তের সময় জননাঙ্গের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল প্রমাণ সাইজের একটা টর্চ। ক্ষমা করে দেবেন অনিতা দেওয়ান। সেই বিস্মৃতির তালিকাটা বেশ দীর্ঘ। বিজন সেতু আনন্দমার্গী হত্যা। কারা জড়িত ছিল? এই কেসে তদন্তকারী অফিসার তিলজলা থানার ওসি গঙ্গাধর ভট্টাচার্যের বুকে কে বা কারা মোটর সাইকেল করে এসে গেঁথে দিয়েছিল একের পর এক বুলেট। তদন্ত রিপোর্ট বলছে বুলেটগুলো ছোঁড়া হয়েছিল নাইন এমএম পিস্তল থেকে। ঘাতক অথবা ঘাতকবাহিনীকে কিন্তু ধরা যায়নি কোনওদিনই। ভাববার কথা। ভাবতে হবে। ডান-বাম-লাল-গেরুয়া-তেরঙ্গা সবাইকে। আগের সেদিন আর নেই যে, রাজনীতিকদের অঙ্গুলিহেলনে মস্তানচক্র নিয়ন্ত্রিত হবে। ক্ষমতায় থাকলে সবকিছু চেপে দেওয়া আর ক্ষমতাচ্যুত হলে চেপে যাওয়া আর ভুলে যাওয়া— এই ধারাবাহিকতা যদি চলতে থাকে তাহলে সেদিন আর দূরে নয় যখন রাজনীতি গুন্ডাদের নয় উলটে গুন্ডারাই জার্সি পালটে পালটে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। শেষের সেদিন সত্যিই ভয়ংকর! তবু কোথায় যেন ক্ষীণ আলোর একটা রেখা। সিলভারলাইন ভাঙড়, গার্ডেনরিচ কাণ্ডে একাধিক গ্রেফতারির ঘটনায় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে সেটা (দুর্ভাগ্যবশত নন্দীগ্রাম, কেশপুর, আরামবাগ, খানাকুল, নেতাই, গোঘাট, দাসের বাঁধে সেটা দেখতে পাইনি আমরা)। মিলিয়ে না যায়। তা হলেই অন্য একটা কালো কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের গায়ে আর এক পোঁচ কালো রং লেগে যাবে। লাগতেই থাকবে। বারবার। হাজার প্যাকেট প্রশাসনিক ডিটারজেন্টেও উঠবে না সে রং। অতএব সময় থাকতে, সাধু সাবধান!
অত্যন্ত তথ্য বহুল
কোন বই থেকে পেয়েছেন যদি জানান।আমি সত্তরের দশকের বাংলার গুন্ডা, মাফিয়াদের নিয়ে জানতে চাইছি। বইয়ের নাম বলতে পারবেন?
দারুণ লেখা হয়েছে।