কালিকাপুরাণম্ (কালিকা পুরাণ)
পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত
প্রথম অধ্যায় – কামদেবের জন্ম।
অতীব পবিত্র চিত্ত যোগিগণ ভবভয় ও ভবরোগ বিনাশের যোগ্য যাহাকে অবলম্বন করিয়া বন্দনা করেন, যিনি পদবিক্ষেপে পৃথিবী, অন্তরীক্ষ ও স্বর্গ এই তিনলোক অধিকার করিয়াছিলেন, সেই হরিপাদপদ্মযুগল আবির্ভূত হইয়া তোমাদিগকে পবিত্র করুন। ১
যিনি সকল যোগিজনের চিত্তস্থিত অবিদ্যা-তিমির-বিনাশে সূৰ্য রূপিণী ও মতিগণের মুক্তির হেতু হইয়া থাকেন, যিনি নিখিল জীবকে মোহিত করেন বলিয়া বিষ্ণুমায়া নামে প্রসিদ্ধ এবং যিনি জন্মে শুদ্ধ (মানবগণের) কুমতি দূর করেন, তিনি তোমাদিগকে রক্ষা করুন। ২
নিত্যজ্ঞান-সম্পন্ন, জগতের আদি সেই পুরুষোত্তম ঈশ্বরকে প্রণাম করিয়া কালিকা (নামক) পুরাণ বলিতেছি। ৩
(একদা) কমঠাদি মুণিগণ হিমালয় সন্নিধানে অবস্থিত মুনিশ্রেষ্ঠ মার্কণ্ডেয়কে প্রণাম করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন। ৪
ভগবন্! আপনি সৰ্ব্বশাস্ত্রের তত্ত্ব সম্যকরূপে বর্ণনা করিয়াছেন, ষড়ঙ্গের সহিত সমস্ত বেদ মন্থন করিয়া তাহার সারাংশ উত্তমরূপে ব্যাখ্যা করিয়াছেন; সমস্ত বেদে ও (অন্যান্য) শাস্ত্রে আমাদের যে যে সংশয় ছিল, হে ব্ৰহ্মণ! সূর্য যেমন তমোজাল বিদূরিত করেন, সেইরূপ আপনি আমাদের সেই সেই সন্দেহ দূর করিয়াছেন। ৫-৬
হে চিরজীবী দ্বিজশ্রেষ্ঠ! আপনার প্রসাদে আমরা বেদে ও সকল শাস্ত্রে নিঃসংশয় হইয়াছি। ৭
হে ব্ৰহ্মন। ব্রহ্মা কর্তৃক কথিত সেই ধর্মশাস্ত্র, রহস্য (গূঢ়তত্ত্ব) সহিত আদ্যপান্ত আপনার নিকটে অধ্যয়ন করিয়া আমরা চরিতার্থ হইয়াছি। ৮
পুনরায় আপনার নিকটে শুনিতে ইচ্ছা করিতেছি যে, পুরাকালে কালী সংযমী মহেশ্বর শিবকে কিরূপে সতীরূপে মোহিত করিয়াছিলেন? যিনি সৰ্ব্বদা ধ্যাননিষ্ঠ সংসার বিমুখ সংযত সেই যতিবর হরকে কিরূপে বিচলিত করিয়াছিলেন? সুশোভনা সতী দক্ষপত্নীতে কিরূপে উৎপন্ন হইলেন এবং কেমন করিয়া শিব তাহাকে পত্নীরূপে গ্রহণ করিতে ইচ্ছুক ছিলেন? পুরাকালে সতীই বা কি হেতু দক্ষের প্রতি কোপবশতঃ নিজ দেহ ত্যাগ করিলেন এবং হিমালয়ের কন্যা হইয়া পুনঃ জন্মগ্রহণ করিয়া আসিলেন কেন? এবং পুনরায় কামরিপু শিবের অর্ধশরীরভাগিনী হইলেন কেন? হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ, এই সমস্ত বিষয় সবিস্তারে বর্ণনা করুন। আপনার মত সংশয় দূর করিতে অন্য কেহ নাই এবং কেহ হইবেনও না। সুতরাং এই সমস্ত বিষয় যাহাতে আমরা জানিতে পারি, হে আত্মজ্ঞানসম্পন্ন বিপ্ৰশ্রেষ্ঠ, আপনি তাহা করুন।* ৯-১৪ [* “তৎ কুরুষ সদার্থবৎ” এইরূপ পাঠও আছে। তাহার অর্থ;-আমরা যাহাতে তাৎপৰ্যসমেত ইহা বুঝিতে পারি, আপনি সর্বদা তাহা করুন।” “তংকুরুবৈতদাত্মবিৎ” এই পাঠানুসারে অনুবাদ করিয়াছি।]
মার্কণ্ডেয় কহিলেন;-সেই সাতিশয় গোপনীয়, বাঞ্ছাকল্পতরু, জ্ঞানজনক পরম পবিত্র মঙ্গলকর আখ্যান আজ মুনিমণ্ডলী সকলে শ্রবণ করুন। ১৫
পূৰ্বে ব্রহ্মা, মহাত্মা নারদকর্তৃক জিজ্ঞাসিত হইয়া তাহার নিকট ইহা প্রকাশ করেন। অনন্তর, সেই নারদও বালখিল্যগণসকাশে তৎসমস্ত কীর্তন করেন। ১৬
তৎপরে বালখিল্য মুনিগণ, আবার যবক্রীত মুনিকে বলেন। তিনি আবার অসিত ঋষির নিকটে ব্যক্ত করেন। ১৭
হে দ্বিজগণ! অসিত ঋষি আমাকে ইহা বিস্তৃতরূপে বলিয়াছেন। পরমাত্মা জগদীশ্বর চক্রপাণিকে প্রণাম করিয়া এই পুরাতন উপাখ্যান আমি তোমাদিগের নিকট বলিতেছি। ১৮
যিনি ব্যক্ত অব্যক্ত সৎ অসৎ স্থল সূক্ষ্ম ও জ্ঞান অজ্ঞানরূপে বিরাজমান, যিনি নিত্য, নিত্যজ্ঞানরূপী, নির্বিকার, চৈতন্যময়, কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ মদ-মাৎসর্য এই ছয়টি ভীষণ তরঙ্গ যাহাকে আক্রমণ করিতে পারে না, যিনি সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়কারী হইয়াও উদাসীন; সেই কালরূপী সৰ্বব্যাপক জগন্নিবাস বিশ্বরূপ ঈশ্বরকে প্রণাম। ১৯-২১
বেদবেদাঙ্গ বেত্তা যোগিগণ যাঁহাকে চিন্তা করেন; সেই হৃদয়ের অভ্যন্তরে অবস্থিত পরম জ্যোতির্ময়কে প্রণাম করি। ২২
ভগবান্ লোক-পিতামহ ব্রহ্মা তাহার আরাধনাফলেই সুরাসুর-নর-প্রভৃতি যাবতীয় প্রজা সৃষ্টি করিতে সমর্থ হইয়াছেন। ২৩
বিধাতা, দক্ষ প্রভৃতি প্রজাপতিগণকে সৃষ্টি করিয়া যখন, মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, বসিষ্ঠ, ভৃগু ও নারদ এই দশজন মানব পুত্র সৃষ্টি করেন, তখন তাহার মন হইতে, এক পরম রূপবতী উত্তম রমণী আবির্ভূত হন। তিনি সন্ধ্যা নামে বিখ্যাত। এই সন্ধ্যাই সায়ংকালে অর্চিত হইয়া থাকেন।* ২৪-২৫ [* ১। “সায়ংসন্ধ্যাং যজন্তিযাং”। ২। “সায়ংসন্ধ্যা জয়ন্তিকা”। ৩। সায়ংসন্ধ্যা বরান্তিকা” এই তিন প্রকার পাঠ আছে। আমরা মূলে প্রথমোক্ত পাঠের ব্যাখ্যা করিয়াছি। “ইনি সর্বোৎকৃষ্টা সায়ংসন্ধ্যাধিষ্ঠাত্রী দেবী” ইহা ২ পাঠের অর্থ। “এই সন্ধ্যা দক্ষ প্রভৃতির জ্যেষ্ঠা ভগিনী তুল্য” ইহা ৩ পাঠের অর্থ।]
তাদৃশ সম্পূর্ণ-গুণ-শালিনী রমণী, তৎকালে স্বর্গ-মর্ত্য পাতালে ছিল না; তৎপূৰ্বে বা পরেও হয় নাই, হইবেও না। ২৬
হে দ্বিজোত্তমগণ! এই সন্ধ্যা স্বভাব সুন্দর সুনীল কুন্তলভারে বর্ষাকালীন ময়ূরীর ন্যায় বিরাজ করিতে লাগিলেন। ২৭
ইহার আকৰ্ণবিলম্বী অলকগুচ্ছ-শোভিত আপাটল ললাটদেশ, ইন্দ্রধনু বা নবীন শশধরের ন্যায় শোভা পাইল। ২৮
চকিত হরিণীনয়নবৎ চঞ্চল, প্রফুল্ল-নীল-কমল-সন্নিভ তদীয় নয়নযুগল বড়ই শোভা পাইল। ২৯
হে দ্বিজশ্রেষ্ঠগণ! তাহার স্বভাব-চপল আকৰ্ণবিস্তৃত পরম রমণীয় ভ্রমরকৃষ্ণ যুগল মদনশরাসনের সদৃশ। ৩০
তিলকুসুম-সদৃশ তদীয় নাসিকা ভ্রূ মধ্যের অধোদেশ হইতে নিম্নাভিমুখে আয়ত ও উন্নত। বুঝি ললাটের লাবণ্যই আধিক্যবশতঃ তথা হইতে বিগলিত হইয়া নাসিকা রূপে পরিণত হইয়াছিল। ৩১
কোকনদপ্রভ পূর্ণচন্দ্র সদৃশ কামিজন-মনোহর তদীয় বদনমণ্ডল বিম্বফলসম–অধরোষ্ঠের অরুণ কান্তিযোগে নিরতিশয় শোভা পাইতেছিল। ৩২
যাহার সৌন্দর্য্য ও লাবণ্যগুণে বদনমণ্ডলের পরিপূর্ণতা,–চিবুকের নিকট আসিবার জন্যই যেন তদীয় স্তনযুগলের উদ্যম। হে বিপ্রগণ! তাঁহার সেই কমলকলিকাকৃতি, উত্তুঙ্গ, পীবর পরস্পরসংসক্ত শ্যামাগ্র স্তনযুগল দেখিলে মুনিরাও মোহিত হইতেন। ৩৩
তাহার ত্রিবলি-শোভিত ক্ষীণ কটিদেশ, বসনের ন্যায় মুষ্টি-গ্রাহ্য। তাহার কটিদেশকে সকলেই কামদেবের শক্তি বলিয়া মনে করিয়াছিল। ৩৪
করভ-কর-প্রমাণ আনত করিকর-সদৃশ স্থূল-মূল মন্থরগমনোপযোগী তদীয় সুকোমল ঊরুযুগল দীপ্তি পাইয়াছিল। ৩৫
ফুল্লকমলারুণ সুন্দরপার্ষ্ণি-বিরাজিত তদীয় চরণদ্বয় কুসুম-শর-শরনিকর সদৃশ অঙ্গুলীদলে সমধিক শোভমান হইয়াছিল। ৩৬
সেই চারুদর্শন তনুলোমাবলি বিরাজিতা কৃশাঙ্গী স্মেরবদনা বিশালনয়না চারুহাসিনী, রমণীয় শ্রুতিপুটশালিনী সুলক্ষণ। সুন্দরীকে দেখিয়া বিধাতা মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন। ৩৭-৩৮।
সেই বরবৰ্ণিনীকে দেখিয়া দক্ষ প্রভৃতি প্রজাপতিগণ ও ব্রহ্মার মরীচি প্রভৃতি মানস পুত্রগণ সকলেই নিতান্ত ঔৎসুক হইয়া ভাবিতে লাগিলেন। ৩৯
এই বরবৰ্ণিনী সৃষ্টিমধ্যে কি করিবেন; কাহারই বা হইবেন; ইহাই তাহারা সকলে ঔৎসুক্যসহকারে ভাবিয়াছিলেন। ৪০
হে মুনিবরগণ! ব্রহ্মা এইরূপ চিন্তা করিতে থাকিলে কাঞ্চন-চূর্ণবৎ-পীতবর্ণ এক মনোহর চঞ্চল পুরুষ তাহার মন হইতে আবির্ভূত হইয়া নিঃসৃত হইলেন। ৪১
তাঁহার বক্ষঃস্থল পীবর, নাসিকা সুচারু, ঊরু কটি ও জঙ্ঘা সুবৃত্ত, কুন্তলবর নীল কুঞ্চিত, ভ্রূযুগল পরস্পর সংলগ্ম। মুখমণ্ডল পূর্ণচন্দ্র সদৃশ। ৪২
তাহার সুবিশাল বক্ষঃস্থল লোমাবলিশোভিত; বাহুযুগল ঐরাবতকরবৎ পীবর ও সুবৃত্ত; করতল, চক্ষু, মুখ, পদতল ও নখরশ্রেণী আরক্তবর্ণ। ৪৩
তাহার ক্ষীণ কটিদেশ, মনোহর দন্তপংক্তি, মত্তহস্তীর ন্যায় গমন, প্রফুল্ল কমলবৎ লোচন, বকুলপুষ্পের ন্যায় গাত্ৰ-সৌরভ। তিনি কম্বুগ্রীব, উন্নতকায়, মীনকেতু, মকর-বাহন। ৪৪
পুষ্পময় পঞ্চশরে ও কুসুমকার্মুকে শোভিত সেই কমনীয় পুরুষ স্বীয় নয়ন যুগল ঘুরাইতেছিলেন। ৪৫
দক্ষ প্রভৃতি প্রজাপতিগণ ও ব্রহ্মার মরীচি প্রভৃতি দশজন মানসপুত্র বিস্মিতচিত্তে সেই সুগন্ধপবন-সহচর শৃঙ্গাররস সেবিত তথাবিধ পুরুষকে অবলোকন করিয়া সাতিশয় উৎকণ্ঠিত ও মনোবিকার প্রাপ্ত হইলেন। ৪৬-৪৭
সেই পুরুষও সৃষ্টিকর্তা জগৎপতি বিধাতাকে দেখিয়া প্রণামপূর্বক বিনয়-নম্র ভাবে বলিলেন;–হে ব্ৰহ্মন্! আমি কোন্ কাৰ্য্য করিব? আমি যখন পুরুষ, তখন কাৰ্য্য করাই আমার পক্ষে উচিত, অতএব হে বিধাতঃ আমাকে প্রশস্ত ন্যায্য কর্মে নিযুক্ত করুন। ৪৮-৪৯
হে লোকেশ! আমার অনুরূপ নাম ধাম ও পত্নী করিয়া দিন। যেহেতু আপনি জগতের সৃষ্টিকর্তা। ৫০
মার্কণ্ডেয় বলিলেন;–ব্রহ্মা, সেই মহাত্মা পুরুষের এবংবিধ বাক্য শ্রবণ করিয়াও ক্ষণকাল মৌনভাবে রহিলেন। সৃষ্টি তাহার নিজকৃত হইলেও তিনি তাহা দেখিয়া বিস্মিত হইয়াছিলেন। ৫১
অনন্তর ব্রহ্মা, সম্পূর্ণরূপে বিস্ময় পরিত্যাগপূর্বক চিত্ত সুস্থির করিয়া সেই পুরুষকে তাঁহার কর্তব্য উপদেশ করত বলিলেন। ৫২
তুমি তোমার এই মনোমোহন মূর্তি ও পুষ্পময় পঞ্চশরে স্ত্রী-পুরুষদিগকে মোহিত করত চিরস্থায়িনী সৃষ্টির প্রবর্তক হও। ৫৩
দেব, গন্ধৰ্ব্ব, কিন্নর, সর্প, দৈত্য, দানব, বিদ্যাধর, রাক্ষস, যক্ষ, পিশাচ, ভূত, বিনায়ক, গুহ্যক, সিদ্ধ, মনুষ্য, পশু, পক্ষী, মৃগ, কীট, পতঙ্গ এবং জলজ প্রাণিগণ, সকলেই তোমার শরব্য হইবে। ৫৪-৫৬
হে পুরুষপ্রবর! অন্য প্রাণীর কথা দূরে থাক, আমি বিষ্ণু এবং মহেশ্বর আমরাও তোমার বশবর্তী হইব। ৫৭
তুমি স্বয়ং প্রচ্ছন্নরূপে প্রাণিগণের হৃদয়ে প্রবেশ করত সতত সুখজনক হইয়া সনাতন সৃষ্টির প্রবর্তক হও। ৫৮
সকল প্রাণীর মনই, তোমার পুষ্পবাণের প্রধান লক্ষ্য হইবে। তুমি উহাদিগের সতত মত্ততা ও আনন্দ সম্পাদন করিবে। ৫৯
আমি তোমার এই সৃষ্টিপ্রবর্তনোপযোগী কৰ্ম্ম নির্দেশ করিয়া দিলাম, যাহা অনুরূপ হয়, তোমার তাদৃশ নামকীর্তনও করিব। ৬০
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–সুরজ্যেষ্ঠ বিধাতা এই কথা বলিয়া মানস পুত্রদিগের মুখের দিকে দৃষ্টিপাতপূর্বক ক্ষণমধ্যে পদ্মাসনে উপবিষ্ট হইলেন। ৬৯
কালিকাপুরাণে প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত। ১
খুব ভালো। পঞ্চানন তর্করত্ন অনুবাদিত আরো পুরাণ দিন।