কাজটা যত জটিল হবে ভেবেছিলাম ততটা জটিল হলো না।
কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই কাজ শেষ হলো। ঘড়িতে এখন বাজছে আটটা কুড়ি মিনিট। শুরু করেছিলাম আটটা পাচে। পনেরো মিনিট সময় লাগল। জলজ্যান্ত একটা মানুষ পনেরো মিনিটে মেরে ফেলা সহজ ব্যাপার নিশ্চয়ই নয়। কঠিন ব্যাপার। তবে রুবা নিজেই ব্যাপারটা আমার জন্যে সহজ করে দিয়েছে।
আজ আমাদের একটা বিয়ের দাওয়াতে যাবার কথা ছিল। রুবার সাজগোজ শুরু হলো বিকেল থেকে। শাড়ি পরে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। পছন্দ হয় না, আবার বদলায়। আমাকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করল কেমন দেখাচ্ছে। আমি প্রতিবারই বললাম–খুব সুন্দর লাগছে। আসলেই সুন্দর লাগছিল। শেষ পর্যন্ত বেগুনি রং একটা শাড়ি তার পছন্দ গুলো। সেই শাড়ি পরার পর দেখা গেল, চায়ের দাগের মতো কী একটা দাগ লেগে আছে। কিছুতেই সেই দাগ আড়াল করা যাচ্ছে না। সে ঠিক করল বিয়েতে যাবে না। রুবাব মাথা ধরল। তখন। শাড়িতে দাগ পাওয়া না গেলে মাথা ধরত না। আমাদের বিয়েবাড়িতে যাওয়া বাতিল হতো না। আমার কাজটা পিছিয়ে যেত।
রুবা মুখ শুকনো করে বসে বইল বাবান্দায়।
আমি বললাম, দুটা সিডাকসিন খেয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাক। মাথাধরা সেরে যাবে। দুটা সিডাকসিন একটা প্যারাসিটামল। সে বাধ্য মেয়ের মতো তাই করল। ঘরে প্যারাসিটামল ছিল না। আমিই ডিসপেনসারি থেকে এনেছিলাম। সে ওষুধ খেয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। আমি বললাম, মাথা টিপে দেব? সে বলল, দাও। আমি বসলাম তার মাথাব পাশে। সে ঘুমিয়ে পড়ল দেখতে দেখতে। এখন আমার কাজ হচ্ছে বালিশটা মুখেব উপর চেপে ধরা। এই কাজটা পায়ের দিকে বসে কখনো করতে নেই। সম্ভাবনা শতকরা একশ ভাগ, জীবন বাঁচানোর জন্যে শেষ মুহুর্তে প্ৰচণ্ড লাথি বসাবে। কাজেই বালিশ দিয়ে মুখ চেপে ধরার আগে বসার জায়গাটা ঠিক করে রাখতে হবে। সবচে ভালো হয় কাজটা যদি দাঁড়িয়ে করা যায়। দাঁড়িয়ে থেকে যতটা চাপ মুখের উপর দেয়া যাবে বসে থেকে ততটা দেয়া যাবে না। তারপরেও সম্ভাবনা থাকে যে, ভিকটিমা হাত পা ছুঁড়ে নিজেকে মুক্ত করে নেবে। একবার যদি কোনোক্রমে নিঃশ্বাস নিয়ে ফেলতে পারে তাহলেই সর্বনাশ। বুদ্ধিমানরা সেদিকটা খেয়াল রেখে অন্য ব্যবস্থাও হাতেব কাছে রাখেন, যাকে বলে ব্যাক আপ সিস্টেম। আমিও বেখেছিলাম। তার প্রয়োজন পড়ে নি। ঐ তো রুবা আড়াআড়িভাবে বিছানায় পড়ে আছে। চোখ খোলা, যে কেউ দেখলে ভাবাবে শুয়ে আছে। আজ তার পা এত বেশি ফর্সা লাগছে কেন? টিউব লাইটের জন্যে? নাকি মৃত্যুর পর পর মানুষ ফর্সা হতে শুরু করে? এ ব্যাপারটা আমার জানা নেই। তবে মৃত্যুর পর পর রিগোরাস মার্টিস বলে একটা ব্যাপার হয়, শরীরের মাংসপেশি শক্ত হতে শুরু করে। সেটাও এত চট করে হবে না। সময় লাগবে।
আমি উঠে গিয়ে ওর শাড়ি ঠিক করে দিলাম। মাথার নিচে বালিশ দিয়ে গায়ে চাদর টেনে দিলাম। একটা হাত কোলবালিশের উপর দিয়ে দিলাম। হঠাৎ কেউ এসে পড়লে ভাববে, ঘুমুচ্ছে। তবে তার শোয়াটা ঠিক হয় নি। সরোজিনি শুয়ে আছে জানি না সে শুয়ে আছে কিনা। কার কবিতা যেন এটা? যারই হোক, এখন কবিতার সময় নয়। কবিতা আজকে তোমায় দিলাম ছুটি। এটা কার, সুকান্তের?
আমি বিছানায় বসলাম। মাথা খানিকটা এলোমেলো লাগছে। এলোমেলো লাগছে। বলেই কবিতার লাইন মনে আসছে। একটু বোধহয় রেস্ট দরকার। কাবার্ডে ব্ৰান্ডির একটা বোতল আছে। আমার না, রুবার। তার শরীর খুব খারাপ করল, তখন ডাক্তার তাকে খেতে দিল। তারপর কার কাছে যেন শুনল ব্ৰান্ডি হচ্ছে কড়া ধরনের মদ–ব্যস, খাওয়া বন্ধ। বোতলের পুরোটাই আছে, খানিকটা গলায় ঢেলে দিলে এলোমেলো ভাব কাটবে। আমি কাবার্ডের দিকে যেতে গিয়েও গেলাম না। এলকোহল যা করবে তা হলো সাময়িক কিছু শক্তি। তারপরই আসবে অবসাদ। I can not take any chance… কোনো চান্স নেয়া যাবে না। এখনো প্রচুর কাজ বাকি আছে।
একটা মানুষ মারা তেমন কোনো জটিল ব্যাপার না। ডেডবডি গতি করাই হচ্ছে সবচে জটিল কাজ। তবে সব ব্যবস্থা করা আছে। আমি হুঁট কবে কিছু করি না, যা করি ভেবে-চিন্তে করি। রুবাকে কী কবে মারব তা নিয়ে আমি খুব কম হলেও এক মাস ভেবেছি। তার ডেডবডি কী করে সরাব তা নিয়ে ভেবেছি প্ৰায় এক বছর। অধিকাংশ খুনী ধরা পড়ে ডেডবডি সরাতে গিয়ে। খুনের পরে পরেই এক ধরনের ল্যাথার্জি এসে যায়। নাৰ্ভ ফেল করে। তখন খুব তাড়াহুড়া করতে ইচ্ছা করে। স্বামী হয়তো স্ত্রীকে গল। টিপে মারল–মানুষের কাছে প্ৰমাণ করতে চায়, ফাস নিয়ে মরেছে। ডেডবডি সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিল, কিন্তু দড়ির গিটটা দিল ঘাড়ের দিকে। সে ভুলে গেছে একজন মানুষ ফাস নেবাব সময় দড়ির গিট ঘাড়ের কাছে দেবে না। হাত পেছন দিকে নিয়ে গিট দেয়া খুব মুশকিল। সত্যিকার ফাঁসির আসামির গিট থাকবে সামনের দিকে।
অনেকে আবার খুন করার পর ডেডবডির মুখে খানিকটা বিষ ঢেলে দেয়। হাতের কাছে যা পায় তাই। ইদুর-মারা বিষ র্যাটম, তেলাপোকা মারাব বিষ রোঢ়কিলার। এরা একটা জিনিস জানে না যে সুরতহালের সময় মুখে কী বিষ আছে তা দেখা হয় না। ভিসেরার বিষ পরীক্ষা করা হয়। সবকিছু ঠিকঠাক মতো করে শেষে ফেসে যায়। যাকে বলে তীরে এসে তরী ড়ুবা। আমার সেই ভয় নেই। আমি মানুষ হিসেবে অত্যন্ত মেথডিকাল। একাউন্টেন্টরা সাধারণত মেথডিকাল হয়ে থাকে।
আমি সিগারেট খাই না। কিন্তু আজকের দিনের জন্য একটা সিগারেট কিনে রেখেছিলাম। বেনসন এন্ড হেজেস। সিগারেট ধরলাম। না, হাত কাঁপছে না। হাত স্থির আছে। তৃষ্ণা বোধ হচ্ছে। ফ্রিজ খুলে হিম-শীতল এক গ্লাস পানি খেলাম। যদিও ঠাণ্ডা পানি খাওয়া আমার জন্যে নিষিদ্ধ। আমার টনসিলাইটিসের সমস্যা আছে। ঠাণ্ডা কিছু খেলেই গলা খুস খুস করতে থাকে। প্রথমে খুস খুস, তারপর কাশি। কয়েক দিন কাশি হবার পর গলা বসে যায়। কথা বলতে হয়। হাঁসের মতো ফ্যাসফ্যাসে গলায়।
টেলিফোন বাজছে। টেলিফোন ধরাটা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছি না। প্রথম কথা, এই টেলিফোন আমার জন্যে বাজছে না। আমাকে কেউ টেলিফোন করে না। আমিও করি না। নিশ্চয়ই রুবার টেলিফোন। তার বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা কত তা সে নিজেও বোধহয় জানে না। এরা সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা সব সময় টেলিফোন করছে। এর মধ্যে একজন আছে যে রাত বারটার পর টেলিফোন করে। মিতা কিংবা রীতা বোধহয় নাম। ঐ মেয়েটা চাকর-বাকরের সমস্যা ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে কথা বলে না। এবং রুবা এমন আগ্রহ নিয়ে শুনে যে মনে হয় কোনো ঐশীবাণী শুনছে।
টেলিফোন বেজেই যাচ্ছে। আমি উঠে টেলিফোন ধবলাম। হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে বলল, রুবা ভাবিকে একটু দিন তো। সে বুঝল কী করে যে রুবা টেলিফোন ধরে নি, আমি ধরেছি? টেলিফোনের ব্যাপারে ওদের সিক্সথ সেন্স সম্ভবত খুব প্রবল। অল্প বয়েসী মেয়ের গলা। আমার সঙ্গে আগে কখনো কথা হয় নি। আমি অনায়াসে বলতে পারতাম, রং নাম্বার। সেটা বললে ভুল করা হতো। কারণ ঐ মেয়ে আবার টেলিফোন করত। মেয়েদের ধৈর্য সীমাহীন। একই নাম্বারে এক লক্ষবার টেলিফোন করেও তারা ক্লান্ত হয় না।
হালো, রুবা ভাবি কি বাসায় নেই?
আছে, বাসায় আছে।
উনাকে কাইন্ডলি একটু ডেকে দিন। বলুন লীনা টেলিফোন করেছে।
ও তো ঘুমিয়ে পড়েছে।
এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লেন।
ওর শরীরটা খারাপ। মাথা ধবেছিল। একটা প্যারাসিটামল আর দুটা সিডাকসিন খেয়ে শুয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়েছে।
উনার সঙ্গে খুব দরকার ছিল।
খুব দরকার থাকলে ডেকে দেই? অবশ্যি এইমাত্র ঘুমিয়েছে, ডাকলে রেগে যেতে পাবে। ডাকব?
না থাক।
জরুরি কিছু থাকলে আমাকে বললে আমি ওকে বলতে পারি।
আপনি কি মিজান ভাই?
হ্যাঁ।
স্নামালিকুম মিজান ভাই।
ওয়ালাইকুম সালাম।
আপনি কি আমাকে চিনেছেন? আমি বেনুর ছোটবোন। আমার নাম লীনা।
ও আচ্ছা, লীনা।
আমি কিছুই চিনলাম না। তবু আন্তরিক ভঙ্গিতে হাসলাম। হাসতে হাসতেই বললাম, জরুরি খবরটা কী এখন শুনি। অবশ্যি আমাকে যদি বলা যায়।
রুবা ভাবির জন্যে দুটা কাজের মেয়ে জোগাড় করে ফেলেছি।
বলো কী? এক সঙ্গে দুটা?
মিরাকল বলতে পারেন। দুটা মেয়েই ভালো। একজন মিডল এজ, ধরুন, থাটি ফাইভ হবে; আরেকটা বাচ্চা মেয়ে, বয়স চৌদ-পনেরো হবে। ভালনারেবল এজ। এই বয়েসের মেয়েরাই নানান সমস্যার সৃষ্টি করে। তবে মেয়েটা খুব কাজের। নাম রেশমা। ওর লাইফে একটা খারাপ ইনসিডেন্ট আছে। সেটা আপনাকে বলা সম্ভব না। রুবা ভাবিকে বলব। আপনি উনার কাছ থেকে শুনে নেবেন.
আমি টেলিফোন কানে ধরে বসে আছি। লীনা অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। কোনো দ্বিধা নেই, কোনো সংকোচ নেই। আশ্চর্য কাণ্ড!
টেলিফোনে কথা বলার বিশ্ৰী রোগ কোনো কোনো মেয়ের থাকে। এরও নিশ্চয়ই আছে। সহজে টেলিফোন ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে না।
হ্যালো, মিজান ভাই?
শুনছি।
রুবা আপাকে মেয়ে দুটার কথা বলবেন।
অবশ্যই বলব। ঘুম ভাঙলেই বলব। ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছে তো, কিছুক্ষণের মধ্যেই জেগে উঠবে বলে আমার ধারণা।
ঘুম ভাঙলে আমাকে টেলিফোন করতে বলবেন। যত রােতই হোক। আচ্ছা আমি বলব। আর রুবা ভাবিকে বলবেন সে যেন ঘুমের ওষুধ-টষুধ কম খায়। আমি বললে কি আর শুনবে! তবু বলব। মিজান ভাই, আপনি ঘুমুতে যান কখন? আমার দেরি হয়। বারটা সাড়ে বারটা বেজে যায়। সাড়ে বারটা কোনো রাত হলো? আমি ঘুমুতে যাই কখন জানেন? কোনো দিনও
দুটার আগে না। গতকাল ঘুমুতে গেছি বাত তিনটায়। আমার ইনসমনিয়া আছে তো, প্রায়ই ঘুম আসে না। অনেকক্ষণ আপনার সঙ্গে বকবক কবলাম। আপনি রাগ কবেন নি তো?
না। আমি রাগ করতে পারি না।
রাখি মিজান ভাই?
আচ্ছা।
রুবা ভাবিকে আপনি কিন্তু মনে করে বলবেন। ভুলে যাবেন না। আবার।
ভুলব না।
খোদা হাফেজ।
খোদা হাফেজ লীনা। Sweet Dreams.
আমি টেলিফোন নামিয়ে রাখলাম। কাঁটায় কাঁটায় এগারো মিনিট কথা বলছি। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। সহজভাবে কথা বলতে পেরে ভালো লেগেছে। বুঝতে পারছি, আমার স্নায়ু ঠিক আছে। ১৯-এর ঘরের নামতা কি বলতে পারব? ১৯ একে ১৯, ১৯ দুকুনে ৩৮, তিনি ১৯-এ ৫৭, সাতান্ন না। আটান্ন? বাথরুমে যাওয়া দরকার। আমার যে প্ৰচণ্ড বাথরুম পেয়েছে এটা এতক্ষণ বুঝি নি। এখন বুঝতে পারছি। যে-কোনো বড় কাজ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে মাংসপেশি খানিকটা শিথিল হয়ে যায়। তখন প্ৰচণ্ড বাথরুম পায়।
জ্যাক দি রিপারের কাহিনীতে পড়েছি–সে এক একটা খুন করত। খুন। শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে দাঁড়িয়েই প্রস্রাব করে ফেলত। প্যান্টেবজিাপার খোলারও সময় পেত না।
আমি বাথরুমে ঢুকলাম। সুন্দর বাথরুম, ঝকঝাক তকতক করছে। রুবার বাথরুম গোছানো রোগ আছে। তার বাথরুম থাকতে হবে ঝকঝকে। বাথরুমের মেঝে ভেজা থাকলে চলবে না। মেঝে থাকবে খটখাটে শুকনো। গোসলের পানি যা পড়বে তা পড়তে হবে বাথ ট্রেতে। বাথ ট্রের বাইরে এক ফোঁটা পানিও পড়তে পারবে না।
বাথরুমের বাতি জ্বালালাম। আয়নায় একটা নোটিশ ঝুলছে
ছোট বাথরুম করার আগে দয়া করে
কমোডের ঢাকনা তুলে রাখবেন।
আমি তাই করলাম। রুবা বেঁচে নেই তাতে কী হয়েছে! ওর কথা শুনতে আপত্তি কী? তিনি ১৯-এ কত? ৫৭ না ৫৮? তিন নয়। সাতাশের সাত। হাতে রইল দুই। তিন একে তিন আর দুই পাঁচ…।
মাথা থেকে নামতা ঝেড়ে ফেললাম। বাতি নিভিয়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে এলাম। এখন আমার যা দরকার তা হলো গরম এক কাপ কফি। কফি খেয়ে শরীরটা চাঙ্গা করে শ্বশুববাড়িতে একটা টেলিফোন করতে হবে। চিন্তিত গলায় বলতে হবেরুবা কি আপনাদের ওখানে গেছে? ও-বাড়ির কেউ তেমন চিন্তিত হবে না। কারণ রুবা প্র৩ি মাসে কয়েকবার রাগ করে বাসা ছেড়ে চলে যায়। কখনো তার মার কাছে গিয়ে থাকে, কখনো তার বোনের বাসায় গিয়ে উঠে। মাঝে মাঝে চলে যায়। তার বন্ধু-বান্ধবদের বাসায়।
কফির জন্যে পানি গরম করতে দিলাম। আমাদের রান্নাঘরও বাথরুমের মতোই ঝকঝকে পরিষ্কার। এক কণা ধূলি নেই, তেলের ছোপ নেই। কিচেন ক্যাবিনেটে সুন্দর করে থরে থরে বোতল সাজানো। প্রতিটি বোতলের গায়ে আবার লেবেল লাগানোচিনি, লবণ, হলুদ, মবিচ, গবাম মশল্লা.। রুবা খুব গোছানো মেয়ে ছিল, এটা স্বীকার করতেই হবে। গত একমাস হবে আমাদের কোনো কাজের লোক নেই, এতে কোনো সমস্যাই হচ্ছে না। বরং লাভ হয়ে গেল আমার। কাজের লোক থাকলে হত্যা পরিকল্পনা রদবদল করতে হতো। তাকে ছুটি দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দিতে হতো বা এরকম কিছু করতে হতো। অবশ্যি এতে তেমন ঝামেলা কিছু হতো না। পরিস্থিতি বুঝে পরিকল্পনা। যে কারণে ফ্লাট বাডি ছেড়ে আলাদা একতলা বাড়ি নিলাম। ফ্লাট বাড়ি থেকে একটা ডেডবডি বের করে নেয়া প্ৰায় অসম্ভব ব্যাপার। আর এখানে কোনো ব্যাপারই না। গাড়িবারান্দার বাতি নেভানো থাকবে। গাড়ির দরজা থাকবে খোলা। আমি রুবাকে বড় একটা চাদরে মুড়ে গাড়িতে ঢুকিয়ে দেব।
পানি ফুটছে। কফির ঝামেলায় গেলাম না। আমি কফি ঠিকমতো বানাতে পারি না। তেতো হয়ে যায়। এই মুহুর্তে তেতো কফি খেতে ভালো লাগবে না। এরচে চা বানানো সহজ। একটা টি-ব্যাগ ফেলে দেয়া। চায়ের কাপ হাতে নিয়েই আমি টেলিফোন করতে গেলাম। আমার শাশুড়ি টেলিফোন ধরলেন। আমি বললাম, মা, কেমন আছেন?
তিনি বললেন, ভালো আছি বাবা।
আপনার পিঠের ব্যথা কমেছে?
ব্যথাটা কমেছে, অবশ্যি জ্বর এখনো আছে।
মা, খাওয়া-দাওয়া কী করছেন?
দুপুরে কিছু খাই নি।
কিছু একটা খাওয়া তো দরকার মা–উপোস করা ঠিক না।
কিছু খেতে ইচ্ছা করে না।
আপনার খোঁজ নেয়ার জন্যেই টেলিফোন করলাম মা।
তা তো বাবা করবেই। আমার খোঁজ-খবর যা করার তা তো তুমিই কর। তুমি যা করা কোনো মায়ের পেটের সন্তান তা কবে না।
ছি ছি মা, আমি আবার কী করলাম?
সেই কবে কথায় কথায় খেজ্বর গুড়ের সন্দেশের কথা বলেছিলাম। তুমি ঠিকই মনে রেখেছি। এ ক গাদা সন্দেশ পাঠিয়েছ। তা বাবা, সন্দেশ খাওয়ার বয়স কি এখন আছে?
ঐসব কথা বাদ দিন তো মা?
আচ্ছা বাবা, যাও বাদ দিলাম। রুবা কেমন আছে? ওর কি দিনে একবার মাকে টেলিফোন করতেও ভালো লাগে না?
ও সা সময় বলে আপনার কথা।
থাক বাবা। থাক। আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার দরকার নেই। আমার নিজের পেটেরই তো মেয়ে। আমি জানি না। ওরা কেমন?
ইয়ে মা, রুবা আপনার ওখানে যায় নি? আমি ভাবছিলাম…
ও কি আবার রাগ করে চলে গেছে?
জি।
তুমি ওকে কিছু বলে না কেন? তুমি কিছুই বলো না। এতে সে আরো লাই পেয়ে গেছে। বাবা তুমি শক্ত হও।
আমি হাসলাম। আমার শাশুড়ি এতে রেগে গেলেন। বিরক্ত গলায় বললেন, হাসছ কেন? হসবে না। আমি আমার মেয়েদের নাড়ি-নক্ষত্র চিনি। এরা জানে শুধু যন্ত্রণা দিতে। তোমাকে ভালো মানুষ পেয়ে…
বাদ দিন মা।
কিছু একটা হলেই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। এসব কী? বেশি স্বাধীনতা ভালো না। তুমি স্বাধীনতা বেশি দিয়ে ফেলেছ?
থাক মা, আপনি এটা নিয়ে ওকে কিছু বলতে যাবেন না। ও যদি টেলিফোন করে তাহলে বলবেন, ঘরের আলিমিরার চাবি নিয়ে গেছে, আমি কাপড়-চোপড় বের করতে পারছি না। অরুণের বিয়েতে যাবার কথা। মনে হচ্ছে অফিসের কাপড় পরেই যেতে হবে। যেতে অবশ্যি ইচ্ছা করছে না…
না, না, তুমি যাও। অরুণ আমাদেরকেও কার্ড দিয়ে গেছে। আমি পিঠে ব্যথা নিয়ে যাই কীভাবে? তোমার শ্বশুর সাহেবকে যেতে বলছি, দেখি যায় কি না। রুবার ব্যবহারে তুমি কিছু মনে করো না বাবা। তুমি বিয়েতে যাও। তোমার এতদিনের বন্ধু, না গেলে মনে কষ্ট পাবে।
আচ্ছা মা, আপনি যখন বলছেন যাব। সমস্যা হচ্ছে গিফট যেটা কিনেছিলাম সেটাও রুবা আলমিরায় ঢুকিয়ে রেখেছে। ভুল করে রেখেছে বোধহয়।
মোটেই ভুল করে রাখে নি। এই কাজটা সে ইচ্ছা করেই করেছে। তোমাকে সমস্যায় ফেলা, আর কিছু না। বাবা, তুমি দেরি করো না, চলে যাও?
আমি টেলিফোন নামিয়ে আবার শোবার ঘরে এলাম। রুবা শুয়ে আছে। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে বলেই কিছু কিছু চুল উড়ছে। সবই স্বাভাবিক। শুধু মুখ খানিকটা হাঁ হয়ে আছে। দাঁতের ফাঁক দিয়ে জিহবার খানিকটা অংশ বের হয়ে আছে। মৃত্যুর পরপর মানুষের জিহবা কি খানিকটা লম্বা হয়ে যায়? রুবার শাড়ির আঁচলে একটা তেলাপোকা বসে আছে। এরা কি টের পেয়ে গেছে? বুঝে গেছে যে এই মেয়েটা বেঁচে নেই? তেলাপোকা যখন খবর পেয়েছে তখন পিপড়ারাও খবর পাবে। সারি বেঁধে আসতে শুরু করবে। নকোব ফুটো, কানের ফুটো দিয়ে ভেতরে ঢুকে যাবে। একটা ব্যবস্থা নেয়া উচিত। খানিকটা মটিন ছড়িয়ে দিলে হয়।
এ বাসায় মর্টিন, এরোসল, এয়ার ফ্রেশনার সবই আছে, শুধু খুঁজে বের করাই হলো সমস্যা।
ওয়াস বেসিনের নিচেই এরোসল পাওয়া গেল! একগাদা এরোসল প্রে করলাম রুবার গায়ে। তেলাপোকাটা বিস্মিত হয়ে আমার কাণ্ডকারখানা দেখছে। শুঁড় নাড়ছে।
আমি আয়নার সামনে চলে গেলাম। বিয়েতে যেতে হবে। প্রতিটি কাজকর্ম খুব স্বাভাবিকভাবে করতে হবে। কেউ যেন কিছুই সন্দেহ করতে না পারে। আয়নায় নিজের চেহারায় আমি তেমন কোনো পরিবর্তন দেখতে পেলাম না। একটু ক্লান্ত ভাব আছে, এর বেশি কিছু না। কেউ দেখে বুঝতে পারবে না যে আমি কিছুক্ষণ আগে একটা খুন করেছি।
ঘর থেকে বের হবার আগে রুবাকে পাশ ফিরিয়ে দিলাম। হাঁ করা মুখ দেখতে ভালো লাগছে না। তার শরীর বরফের মতো ঠাণ্ডা। এত ঠাণ্ডা হয় কী করে? ঘরের যে তাপ সেই তাপই তো থাকার কথা। এর চেয়ে ঠাণ্ডা হবার তো কথা না। হাত-পাও শক্ত হয়ে গেছে। রিগরাস মার্টিস শুরু হয়েছে। দাওয়াত থেকে ফিরে এসে ডেডবিডি সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। কী করব। সব ঠিক করা আছে। কোনো সমস্যা হবে না।
বাতি নিভিয়ে ঘর থেকে বের হলাম। বাইরে তালা লাগিয়ে দিলাম। ঘড়িতে এখন বাজছে নটা। নভেম্বর মাসের শেষ, শীত লাগছে। গরম কাপড় আনা উচিত ছিল। দিনের বেলা বেশ গরম ছিল। বাংলাদেশের আবহাওয়া কী হচ্ছে কে জানে? ওজোন লেয়ারের গণ্ডগোলে সব মনে হয় ওলট-পালট হয়ে গেছে। কিছুদিন পর হয়তো দেখা যাবে শীতকালে প্ৰচণ্ড গরম পড়েছে। গরমকালে শীতে লোকজন ঠক ঠক করে কাঁপছে।