০১. কাঁথার মতো চুল

শহর-ইয়ার – সৈয়দ মুজতবা আলী

০১.

যৌবনে আমার মাথায় ছিল কাঁথার মতো চুল। সেলুনের তো কথাই নেই, গায়ের নাপতে পর্যন্ত ছাঁটতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে যেত। কাজেই সমস্ত অপারেশনটা এমনই দীর্ঘস্থায়ী আর একঘেয়ে লাগত যে আমি ঘুমের বড়ি খেয়ে নিয়ে সেলুনে ঢুকতুম। চুলকাটা শেষ হলে পর সেলুনের নাপতে ধাক্কাধাক্কি করে ঘুম ভাঙিয়ে দিত। সেদিনও হয়েছে তাই। কিন্তু ইয়াল্লা, আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখি চুলের যা বাহারে কট দিয়েছে সে নিয়ে চিতা-শয্যায় পর্যন্ত ওঠা যায় না, ডোম পোড়াতে রাজি হবে না। কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই। মেঘে মেঘে বেলা হয়ে গিয়েছে। মহা বিরক্তি আর উম্মা গোস্সাসহ রাস্তায় নাবলুম।

ঠিক যে ভয়টি করেছিলুম তাই। দশ পা যেতে না যেতেই পাড়ার উত্তমকুমারের সঙ্গে দেখা। উভয়েই থমকে দাঁড়ালুম। আমার মস্তকে তখন বজ্রপাত হলে আমি বেঁচে যেতুম– উত্তমকুমার তা হলে সে বাহারে হেয়ার কট দেখতে পেত না। কিন্তু আমি জানি, আপনারা পেত্যয় যাবেন না, উত্তম শুধোলে, খাসা ফ্যাশানে চুলটা হেঁটেছ তো হে– সেলুনটা কোথায়? তোমার আবিষ্কার বুঝি? গোড়ায় ভেবেছিলুম বাবু আমাকে নিয়ে মস্করা করছেন। পরে দেখলুম, না। সে গড় ড্যাম সিরিয়স।

সেইদিন থেকে একটি বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ হয়ে গিয়েছি। যা-ই করো, যা-ই পরো, কেউ না কেউ সেটার প্রশংসা করবেই। এমনকি যা-ই লেখ না কেন– সে লেখা সাগররমাপদমণীন্দ্রা সবাই ফেরত পাঠানোর পরও দেখবে, সেটি লুফে নেবার মতো লোকও আছে।

তাই আমার বিশ্বাস, কোনটা যে সরেস সাহিত্য আর কোনটা যে নিরেস সে সম্বন্ধে হলপ করে কিছু বলা যায় না। যদি বলেন, সবাই অমুকের লেখার নিন্দা করছে তবে আমি উত্তর দেব : প্রথমত ভোট দিয়ে সাহিত্য বিচার করা যায় না (এমনকি রাশায় নাকি একবার গণভোট প্লেবিসিট নেওয়া হয়, ভগবান আছেন কি নেই এবং ভগবান শতকরা একটি ভোট পান!), দ্বিতীয়ত, ভালো করে খুঁজলে নিশ্চয়ই সে লেখকের তারিফদার পাঠকও পাবেন।

তাই আমার পরের স্টেপ : সরেস সাহিত্যিক এবং নিরেস সাহিত্যিকে পার্থক্য করা অসম্ভব।

অবশ্য আপনারা নিশ্চয়ই বলতে পারেন, আমি নিরেস সাহিত্যিক বলে এই মতবাদটি প্রচার করছি। আমি ঘাড় পেতে মেনে নিলুম।

মেনে নিয়েছি বলেই ট্রেনে-প্লেনে বিশেষ করে ট্রেনে আমি আমার পরিচয় দিইনে। দু একবার আমার সঙ্গীসাথীরা মানা না শুনে ট্রেনে আলোচনার মাঝখানে অপরিচিতদের কাছে আমার নাম প্রকাশ করে দেন। দেখলুম, আমার ভয় বা ভরসা অমূলক। কেউ কেউ আমাকে চিনতে পারলেন। যদিও আমি নিরেস লেখক।

এসবের স্মরণে, একদিন যখন আমি একটা মহা বিপদে পড়েছি তখন নিষ্কৃতি পাবার জন্য আমার নাম, আমি যে সাহিত্যিক সে কথাটা প্রকাশ করলুম। সঙ্গে সঙ্গে যেন বোমা ফাটার শব্দ। কে একজন ব্যঙ্গ শ্লেষ ঠাট্টা মশকরা সবকিছুর একটা ঘাট বানিয়ে বললেন, সাহিত্যিক! ছোঃ! এরকম ঢের ঢের সাহিত্যিক দেখছি নিত্যি নিত্যি। আমি মশাই আমাদের পাড়ার লাইব্রেরি কমিটির মেম্বার কই, আপনার নাম তো কখনও শুনিনি! আর-সবাই তাঁরই কথায় সায় দিল।

ওইদিন থেকে স্থির করেছি, জেলে যাব, ফাঁসিতে ঝুলব তা-ও সই কিন্তু নিজের পরিচয় প্রকাশ করব না। পেঁয়াজ-পয়জার দুই-ই কবুল বিলকুল উল্লুকই শুধু করে।

***

আমার আপন ভাগ্নি পর্যন্ত ফরিয়াদ করে, আমার লয়েলটি-বোধ নেই। মুসলমান হয়েও মুসলমানদের নিয়ে গল্প উপন্যাস লিখিনে। এবারে সে বুঝতে পারবে কেন লিখিনে।

খুব বেশিদিনের কথা নয়, বোলপুর থেকে শেয়ালদা যাচ্ছি। এবং পূর্ব সঙ্কসম অনুযায়ী মুখ যা বন্ধ করেছি তার পর কি ইরেসপনসিবল কি রেসপনসিবল কোনও টকের জন্যই ডিআই আর আমার গোপাগ্র স্পর্শ করতে পারবে না– যদ্যপি তখন কম্পার্টমেন্টে তুমুল তর্ক বেধেছে শ্লীল-অশ্লীল সাহিত্যের জাতিভেদ নিয়ে। একবার লোভও হয়েছিল কিছু বলি, যখন একে অন্যে সবাই সবাইকে শুধতে আরম্ভ করেছেন, কেউ লেডি চ্যাটারলিজ লাভারজ পড়েছেন কি না? দেখা গেল কেউই পড়েননি। আমার পড়া ছিল। কিন্তু পূর্বপ্রতিজ্ঞা স্মরণ করে আলোচনাতে কোনও প্রকারের সাহায্য করলুম না– পাছে ওই খেই ধরে শেষটায় কেউ না দুম করে শুধিয়ে বসে, মহাশয়ের নাম? এদেশে এখনও অধিকাংশ লোক নাম জিজ্ঞাসা করাতে কোনও-কিছু আপত্তিজনক দেখতে পায় না। আমিও পাইনে অবশ্য আমি যখন কৌতূহলী হয়ে অন্যকে শুধোই, ভাইস-ভারসা নয়।

তবু আমি চুপ এবং এমনই নিশূপ যে স্বয়ং কম্যুনিস্ট ফরেন আপিস পর্যন্ত আমার বাক-সংযম দেখে, খরশো, খরশো, শাবাশ শাবাশ জয়ধ্বনি তুলত।

মাঝে মাঝে লক্ষ করছিলুম, এক কোণে যে একটি যুবতী বসে আছেন তিনি যেন আমার দিকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছেন– আড়নয়নে না, পুরোপাক্কা সাহস ভরেই। আমি বিশেষ শঙ্কিত হলুম না, কারণ পারতপক্ষে আমি কাউকে আমার ফটো উপহার দিই না, আর খবরের কাগজে আমার যা ছবি উঠেছে তার তুলনায় আলীপুরের শিমপানজির ছবি উঠেছে ঢের ঢের বেশি।

১৮৩০ না ৪০ খ্রিস্টাব্দে আসামে বুনো চায়ের গাছ আবিষ্কারের দিন থেকে আজ পর্যন্ত বর্ধমান-কেনার খবর পায়নি যে চা নামক পানীয় আদৌ এ পৃথিবীতে আছে এবং বাঙলা দেশেও পাওয়া যায়। কারণ গত চল্লিশ বৎসর ধরে আপ্রাণ চেষ্টা করেও আমি বর্ধমান-কেনারের কাছ থেকে চা আদায় করতে পারিনি। এ তত্ত্বটি অনেকেই জানেন; কাজেই বর্ধমানে গাড়ি দাঁড়ানোমাত্রই কামরার অধিকাংশ লোকই চায়ের নিষ্ফল সন্ধানে প্ল্যাটফর্মে নেবে গেলেন। আমি মুসলমান–শ্রীশ্রীগীতার মা ফলেষু কদাচনতে না-হক কেন বিশ্বাস করতে যাব? বসে রইলুম ঠায়।

এমন সময় হুঙ্কার শোনা গেল, এই যে আলী সায়েব, চললেন কোথায়? এবং সঙ্গে সঙ্গে মালপত্রসহ রেলের মজুমদারের প্রবেশ। আমি ভালোমন্দ কিছু বলার পূর্বেই ফের প্রশ্ন, তার পর? শবনম কীরকম কাটছে?

এর পর যা ঘটল সেটা অবিশ্বাস্য না হলেও আমার জীবনে ইতোপূর্বে কখনও ঘটেনি। সেই অন্য প্রান্তের যুবতীটি হরিণীর মতো ছুটে এসে, আমার আরে করেন কী, করেন কী, থামুন সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, মুসলমানি কায়দায় পা ছুঁয়ে সেলাম করে বাঙ্কের উপর উঠে বসলেন আমার মুখোমুখি হয়ে। ঠিক যেরকম গুরু-শিষ্য পদ্মাসীন হয়ে মুখোমুখি হয়ে বসেন। কারণ, একটু আরাম করার জন্য আমি ইতোপূর্বে বাঙ্কের হাতলটাকে হেলান বানিয়ে বসেছিলুম হাফ-পদ্মাসনে। যুবতী যেভাবে আসন নিলেন। তাতে আমাদের একে অন্যের হাঁটুতে হাঁটুতে আধ ইঞ্চিরও ব্যবধান নয়। এবং সমস্ত অভিযানটি তিনি সম্পূর্ণ করলেন, মজুমদার, তাঁর মালবাহী-কুলি, দু একজন প্যাসেঞ্জার যাঁরা ভাঁড়ের চায়েতেই সন্তুষ্ট হয়ে ইতোমধ্যে গাড়িতে উঠে পড়েছেন– এঁদের সকলের ব্যুহ অবহেলে ভেদ করে।

হার্ড-বয়েলড মজুমদারও যে বেকুবের মতো তাকাতে পারে এটা আমি জানতুম না। আমার কথা বাদ দেওয়া যেতে পারে। আমি যে বেকুব সে আমি চার বছর বয়েস থেকে বড়দার মুখে শুনেছি; এখনও শুনি।

যুবতী একবার শুধু বাইরের দিকে তাকিয়ে বেশ উচ্চ কণ্ঠে ডাকলেন, ওগো, এদিকে এসো– আমাদের আলী সাহেব! আমাকে শুধু বললেন, বে-আদবি মাফ করবেন, আমি প্রথমটায় ঠিক চিনতে পারিনি। ব্যস্ তখনকার মতো আর কিছু না। আমি তো মুঠোর মধ্যে এসে গিয়েছি– বাদবাকি ধীরেসুস্থে হবে।

ইতোমধ্যে ওই ‘ওগো’টি, এবং আর পাঁচজনও কামরায় ঢুকলেন। যুবতীর আদেশে তিনি তাঁর পরিচয় দিলেন। ডা. জুলফিকার আলী খান। যেমন দেবী তেমন দেবা নন। ভদ্রলোক বরঞ্চ একটু মুখ-চোরা। শুধু একটু খুশিমুখে বললেন, ইনি আপনার প্রকৃত ভক্ত পাঠিকা। দেবী মুখঝামটা দিলেন, আর তুমি বুঝি না? ভদ্রলোক কোনও গতিকে জান বাঁচিয়ে কামরার অন্য কোণের দিকে পাড়ি দিলেন।

নিজের অপ্রতিভ ভাব কাটাবার জন্য আমি যুবতীর সঙ্গে মজুমদারের আলাপ করিয়ে দিলুম। বাঁ হাত দিয়ে ঘোমটাটি তোলার একটুখানি ইঙ্গিত দিয়ে বললেন, আপনাকে বহুত শুকরিয়া। শবনম বিবিকে এ কামরায় দাওয়াত না করলে আমি তার স্বামীকে পুরোপুরি চিনে নিতে পারতুম না।

সেই বর্ধমান থেকে দক্ষিণেশ্বর অবধি বেগম খান কী কী প্রশ্ন শুধিয়েছিলেন, তার আপন মনের কথা কী কী বলেছিলেন তার পুরো বয়ান কেন, নির্যাস দেওয়াও আমার তাগতের বাইরে। গোড়ার দিকে তো তার কোনও কথাই আমার কানে ঢুকছিল না। বেচারি ডা. খান যে বেশকিছুটা অপ্রতিভ হয়েছেন সে তো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। বিশেষত দেবীর বসার ধরনটা। আমার দু হাঁটুর সঙ্গে তাঁর দু হাঁটু ছুঁইয়ে দিয়ে, আমাকে শব্দার্থে কোণঠাসা করে– আমিই-বা করি কী, নড়তে গেলেই যে হাঁটুতে গোত্তা লাগবে আসন না নিয়ে যদি ভদ্রস্থতার দূরত্ব বজায় রেখে স্কুল-গার্লটির মতো ব্রীড়াভরা ব্যবহার করত তা হলে তো ওদিকে আর কারও দৃষ্টি আকৃষ্ট হত না। এ তো আকছারই হয়। গোড়াতেই আমি নিবেদন করিনি সব লেখকই বরাবর? সক্কলেরই কিছু-না-কিছু ভক্ত, অন্ধ স্তাবক থাকার কথা। তদুপরি এ মেয়ে মুসলমান। বাকি গাড়ি হিন্দু। অবশ্য আমাকে আর ওই হাফ-হিন্দু মোন্দারকে বাদ দিয়ে। হিন্দুদের ধারণা এবং সেটা হয়তো ভুল নয় যে, মুসলমান মেয়েরা মাত্রাধিক লাজুক (নইলে বোরকা পরতে যাবে কেন?) কিন্তু এখানে যে ঠিক তার উল্টোটা!

তা সে যাই হোক, গাড়ির সবাই সন্তান; তারা আমাদের দু জনকে আল্লার হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজেদের নিয়ে পড়লেন। বেগম খান শুধু মাঝে মাঝে মজুমদারকে তাঁর বাক্য সমর্থনের জন্য বরাত দিচ্ছিলেন। সে-ও এতক্ষণে হালে পানি পেয়ে গিয়েছে বলে শুধু যে সায় দিচ্ছিল তাই নয়, মাঝে মাঝে খাসা টুইয়েও দিচ্ছিল। তখন আর বেগমকে পায় কে? একে ছিল নাচিয়ে বুড়ি, তায় পেল মৃদঙ্গের তাল! আমার মনে পড়ল মজুমদার কলেজ আমলে মেয়েদের নিয়ে মশকরা করে কবিতা লিখে রীতিমতো নটরিয়াস হয়েছিল। বাদরটার খাসলত তিরিশটি বচ্ছরেও বদলাল না!

আমি শুধু একটিবার বেগমকে শুধিয়েছিলুম, আচ্ছা মিসিস খান—

বাধা দিয়ে বললেন, আমার নাম শহর-ইয়ার– আরব্য রজনীর শহর-ইয়ার।

আচ্ছা, বেগম শহর–

 না, শুধু শহর-ইয়ার।

আচ্ছা, শহর-ইয়ার, আপনি কি কখনও সত্যকার বড় লেখকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন– যেমন মনে করুন, পরশুরাম–

সত্যিকার, মিথ্যেকার জানিনে– আপনি বড় লেখক।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললুম, যাক। আমার কিন্তু সত্যি একবার দেখতে ইচ্ছে করে, কোনও গ্রেট লেখকের সঙ্গে পরিচিত হলে আপনি কী করেন। বোধ হয় কবিগুরু যে বর্ণনা দিয়েছেন,

অমল কমল চরণ কোমল চুমিনু বেদনা ভরে—

বেগম খান সঙ্গে সঙ্গে পদপূরণ করে বললে,

বাধা না মানিয়া ব্যাকুল অশ্রু পড়িতে লাগিল ঝরে।

আমি অবাক হয়ে ভাবলুম, এই কবিতাটি যে খুব পরিচিত তা নয়, তবু মেয়েটি এর সঙ্গে পরিচিত। এর কাছে কি তবে মুড়ি-মুড়কির একই দর!

এবারে আমি শক্ত কণ্ঠে বললুম, দেখুন, আপনি যদি আমার রচনা সম্বন্ধে আলোচনা বন্ধ না করেন, তবে আমি আর একটিমাত্র কথা বলব না।

বিন্দুমাত্র দুঃখ প্রকাশ না করে বললে, আপনার মজি। ভবিষ্যতে তো সুযোগ পাব। আমার ভাবনা কী? কলকাতায় আপনার বাসা কোথা?

আমি অবাক হয়ে বললুম, আমি কি লক্ষপতি? শান্তিনিকেতনের বাসা ঠেলতে গিয়েই আমি লবেজান! বন্ধুর বাসায় উঠব।

সঙ্গে সঙ্গে আসন ত্যাগ করে চলে গেল স্বামীর কাছে। আমিও তনুহর্তেই পা নামিয়ে বাঙ্কে সোজা হয়ে বসলুম। পদ্মাসনব্যুহের দুই হাঁটুতে আমি আর হরগিজ বন্দি হব না।

একটু পরেই ডাক্তার খানকে সঙ্গে নিয়ে এসে আমাকে মাঝখানে বসিয়ে দু জনা দু দিকে বসল। আমি বললুম, ভালো হল আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে। মরার আগে একটা ট্রাঙ্ক কল পাবেন। তখন এসে শেষ ইনজেকশনটি দিয়ে দেবেন।

ডাক্তার বললেন, তওবা, তওবা! আর আমি তো প্র্যাকটিক্যাল ডাক্তারি ক্রমেই ভুলে যাচ্ছি। আমি তো রিসার্চ নিয়ে পড়ে আছি।

বেগম ফিসফিস করে ডাক্তারকে বললেন, আহ! যা কইবার তাই কও না!

ডাক্তার বললেন, যদি ইজাজত দেন তবে একটা আরজ আছে। শুনলুম, কলকাতায় আপনি এক দোস্তের বাড়িতে উঠবেন। তার চেয়ে এবারে আমাদের একটা চান্স্ দিলে আমরা সেটা মেহেরবানি মেনে বড় খুশি হব। আমাদের বাড়িতে প্রচুর জায়গা আছে। যদি হিম্মত দেন তো বলি, আপনার কোনও তকলিফ হবে না।

আমি অনেক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললুম, কিন্তু এ যাত্রায় হবে না, আমারই কপাল মন্দ। আসছে বার নিশ্চয়ই।

বেগম ডাগর চোখ মেলে বললেন, আপনার দোস্ত কি ডাক্তার?

আমি বললুম, ঠিক তার উল্টো। বহুকাল ধরে শয্যাশায়ী।

বেগম বললেন, আমাদের বাড়িতে ওই আরেকটি মাইনর সুবিধে। যা খুশি খান, যত খুশি খান, কিংবা তিন দিন ধরে কিছুই খেলেন না, হিমে সমস্ত রাত ছাতে চক্কর মারুন, যা খুশি করুন ডাক্তার তো হাতের কাছে রয়েছে, ভয় কী?

আমি হেসে বললুম, উনি-না ডাক্তারি বেবাক ভুলে গিয়েছেন!

 বেগম বললেন, কী যেন নউজুবিল্লা, বলতে নেই– হাতির দাম লাখ টাকা।

আমি ভালো করে বুঝিয়ে বললুম যে, আমার শয্যাশায়ী বন্ধু আমার জন্য প্রহর গুনছে। তাই সেখানে না গিয়ে উপায় নেই। কিন্তু আসছে বারে অতি অবশ্য, সাত সত্য, তিন কসম ওঁরাই হবেন আমার কলকাতার অন্নদাতা–মেজুমান।

ট্রেন দক্ষিণেশ্বরে থামল বলে বেঁচে গেলুম। আমার এক চেনা এবং দোস্ত, পাশের ভিমকোতে কাজ করে; বোস বলেছিল স্টেশনে আমাকে দেখতে আসবে। লাফ দিয়ে নামলুম প্ল্যাটফর্মে। মজুমদারও বোসকে চেনেন। তিনিও নামলেন।

কই, রাস্কেলটা আসেনি!

মজুমদার বললেন, জানেন আলী সাহেব, মেয়েটি বড়ই সরলা। কিন্তু যে কোনও লোক অতি সহজেই ভুল বুঝে মনে করতে পারে উনি বুঝি পুশিং ফ্লার্ট। এ টাইপ আমি খুব বেশি দেখিনি কিন্তু যা দু একটি দেখেছি সে-ও মুসলমান পরিবারে।

আমি বললুম, আমারও তাই মনে হয়, কিন্তু আপনি এ মীমাংসায় পৌঁছলেন কোন পর্যবেক্ষণের ফলে?

মজুমদার আমাকে ধাক্কা দিয়ে কামরায় তুলে দিয়ে নিজে পিছনে ঢুকলেন। বললেন, পরে হবে।

এবারে কামরাতে সার্বজনীন আলোচনা হল হিন্দুসমাজে যে ডিভোর্স বা লগ্নচ্ছেদ প্রবর্তন হয়েছে তাই নিয়ে। মুসলমানদের ভিতর তো গোড়ার থেকেই আছে; কিন্তু প্রশ্ন তার সুবিধে নেয় বাঙলা দেশের কী পরিমাণ মুসলমান নরনারী? অল্পই। তবে হিন্দুদের বেলা? আলোচনাটা জমল ভালো, কারণ ডাক্তার আর আমি, হিন্দুদের অজানা, মুসলমানদের পারিবারিক ভিত্তি সম্বন্ধে তথ্য সাপ্লাই করলুম, আর হিন্দুরা তাই নিয়ে স্পেকুলেট করলেন।

বেগম সাহেব মুখ খুললেন না। তবে ওস্তাদের মার শেষ রাতে। ট্রেন যখন শেয়ালদা পৌঁছল তখন তিনি মোক্ষম বাণ ছাড়লেন, হিন্দুদের মেয়ে-স্কুলে এখনও স্ট্যান্ডার্ড টেক্সট বুক ভূদেববাবুর পারিবারিক প্রবন্ধ। আমার বান্ধবীর মেয়েকে দিন সাতেক আগেও পড়িয়েছি।

.

০২.

হিন্দুরা বলে মুসলমানরা সাম্প্রদায়িক। বোধ হয় কথাটা সত্য, নইলে শহর-ইয়ার আমার ক্যালিবারের লেখককে নিয়ে অতখানি মাতামাতি করবে কেন? এদেশে তো আর গণ্ডায় গণ্ডায় মুসলমান লেখক নেই, কাজেই আলী, আলীই সই। কথায় আছে, বিপদে পড়লে শয়তান তক্‌ মাছি ধরে ধরে খায়।

উপস্থিত অবশ্য স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি মাছিই শয়তান খাবে। কথাবার্তায় তো মনে হল ডাক্তার পরিবার কলকাতার খানদানিদের একটি। অতএব নিশ্চয়ই উত্তম মোগলাই খানাপিনার অনটন হবে না। সুভাষিতের একটি দোহা সামান্য ট্যারচা করলে অর্থ দাঁড়ায় পণ্ডিতদের সবই গুণ; দোষের মধ্যে এই যে, ব্যাটারা বড় মূর্খ। হিন্দুদের বেলাও তাই। ওদের অনেক গুণ; দোষের মধ্যে এই যে, তারা মাংস রাঁধতে জানে না। সেটা মেরামত করার জন্য সমস্ত জীবন ধরে জীবনটা তো ওদের সঙ্গেই কাটালুম চেষ্টা দিয়েছি। মাতাল যেমন গাঁটের পয়সা খর্চা করে অন্যকে মদ খেতে শেখায়, পরে তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে নেশাটি করবে বলে, আমিও তেমনি বিস্তর হিন্দুকে গায়ে পড়ে মোগলাই শেখাবার চেষ্টা করেছি, অর্থাৎ ফাঁকি দিয়ে শটকে শেখাবার মেহন্নত বরদাস্ত করেছি, পরে তারই মেওয়াটি খাব বলে, কিন্তু হলে কী হয়, ওই যে মুসলমানরা বলে হিন্দুরা বড় সঙ্কীর্ণচেতা, আপন ধর্মের গণ্ডির ভিতর কাউকে ভাই-ব্রাদার বলে নিতে চায় না, রান্নার বেলা অন্তত নিশ্চয়ই তাই। তা সে যাকগে, এখন যখন শহর-ইয়ার গঙ্গোদক জুটে গেছে তখন কূপোদকের কী প্রয়োজন।

কিন্তু হায়, নল রাজার ভাজা মাছটির মতো আমার মুগ্ম-মুসল্লমগুলো হঠাৎ পাখনা গজিয়ে ডানা মেলে কোক্কোরো রব ছেড়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ট্রেনে কথা ছিল, যেখানেই উঠি না কেন, ডাক্তার-পরিবার প্রথম একটা ডিনার দিয়ে মুখবন্ধ অবতরণিকা সেরে পরের পরিপাটি ব্যবস্থা করা হবে, কিন্তু বন্ধুর বাড়িতে উঠেই দেখি আমার নামে টেলিগ্রাম– তদ্দশ্যেই শান্তিনিকেতন ফিরে যেতে হবে।

সে রাত্রেই আপার-ইন্ডিয়া ধরতে হল। রেলের মোন্দার ঠেলেঠুলে একটা কামরায় ঢুকিয়ে দিল।

ঘন্টু বাগচীকে বরাত দিয়ে এলুম সে যেন আমার আকস্মিক নির্ঘণ্ট পরিবর্তনটা শহর-ইয়ার বানুকে জানিয়ে দেয়। আমার রাঢ়ী, বৈদিক, কুলীন, মৌলিক মেলা চেলা আছে, কিন্তু মুসলমানকে ট্যা করতে হলে বারেন্দ্রই প্রশস্ততম। ওরা এখনও বদনা ব্যবহার করে।

বোলপুরে ফিরে হপ্তা তিনেক সাধনার ফলে মুরগি রোস্টের শোক ভুলে গিয়ে যখন পুনরায় ঝিঙ্গে-পোস্ত, কলাইয়ের ডাল আর টমাটোর টকে মনোনিবেশ করছি এমন সময় শুনি তীব্র মধুর বামা-কণ্ঠ। আমার বাড়িটা এক্কেবারে শুশানের গা ঘেঁষে, অর্থাৎ লোকালয় থেকে দূরে নির্জনে। বামা-কণ্ঠ কেন, কোনও কণ্ঠই সেখানে শোনা যায় না। বারান্দায় বেরিয়েই দেখি, শহর-ইয়ার, দূরে ডাক্তার, তারও দূরে প্রাচীন যুগের ইয়া লাশ মোটরগাড়ি।

আমার মুখ দিয়ে কথা ফোটেনি। শহর-ইয়ার পুরো-পাক্কা বাঙালি-মুসলমানি কায়দায় মাটিতে বসে, মাথায় ঘোমটা টেনে, দু হাত দিয়ে আমার দু পা ছুঁয়ে সালাম করল। আমি তাকে দোয়া জানালুম, মনে মনে দরুদ পড়লুম।

এবারে দেখি ওর ভিন্ন রূপ। আমি আশঙ্কা করেছিলুম সে কলরব করে নানান অভিযোগ আরম্ভ করবে– খবর না দিয়ে চলে এলুম, এসে একটা চিঠি-পত্র দিলুম না– বাকি আর বলতে হবে না; মেয়েরা ফরিয়াদ আরম্ভ করলে যাদুকরের মতো ফাঁকা বাতাস থেকে ফরিয়াদের খরগোশ বের করতে পারে।

শুধু অত্যন্ত নরম গলায় বলল, আমরা কোনওপ্রকারের খবর না দিয়ে এসে আপনাকে কোনও বিপদে ফেলিনি তো?

আমি বললুম, আমি সত্যই ভারি খুশি হয়েছি যে আপনারা আমাকে আপনজন ভেবে কোনওপ্রকারের লৌকিকতা না করে সোজা এখানে চলে এসেছেন বলে।

ইতোমধ্যে ডাক্তার এসে পৌঁছেছেন। তার সঙ্গে কোলাকুলি করে তাকেও সেই কথা বললুম এবং যোগ করলুম, আপনারা জানেন না, এদেশে আমার খুব বেশি আপনজন নেই।

শহর-ইয়ারের চোখ দুটি বোধ হয় সামান্য একটু ছলছল করছিল। বলল, আমাদেরও বেশিরভাগ আপনজন পাকিস্তান চলে গিয়েছেন। আমার দাদারা, দিদিরা সবাই। সেদিক দিয়ে আমার কর্তা লাকি।

আমি কিছু বলার পূর্বেই ডাক্তার প্রায় হাতজোড় করে বললেন, আমার একটা গরিবানা আর আছে।

আমি বললুম, কী উৎপাত। আমাকে চিনতে আপনার শতাব্দী লাগবে?

তা হলে বলি; আপনার চেলা ঘন্টুবাবু এসেছিলেন আপনার চলে যাওয়ার খবর দিতে। উনি সত্যি আপনার আপনজন। তাঁকে ইনি নানা রকমের প্রশ্ন শুধোন– এ জায়গা সম্বন্ধে। ঘন্টুবাবু বললেন, আপনি নাকি বাজার-হাট থেকে অনেক দূরে থাকেন, এবং চাকর-বাকর কামাই দিলে নাকি শুধু টিন-ফুড খেয়ে চালিয়ে দেন। তাই আমরা এটা-সেটা কিছু কিছু সঙ্গে এনেছি। যদি

আমি বললুম, কী আশ্চর্য! নদীতে চানে যাবার সময় কলসি ভরে জল নিয়ে যাওয়া আহামুকি কিন্তু আমার এই সাহারা-নিবাসে জল না নিয়ে আসা ততোধিক আহাম্মুকি। আপনি সমুচা হবাজার কিনে এনে থাকলেও অন্তত আমার কোনও আপত্তি নেই। চলুন, আপনাদের ঘর দেখিয়ে দিই; হাত-মুখ ধোবেন।

আমার লোকটি খুব মন্দ রাধে না। সে-বিষয়ে আমার অত্যধিক দুশ্চিন্তা ছিল না।

বারান্দায় বসে আছি। হঠাৎ দেখি শহর-ইয়ার তালগাছ সারির গা ঘেঁষে ঘেষে একা একা চলেছেন রেললাইনের দিকে। আমি বসার ঘরে ঢুকলুম ডাক্তারের খবর নিতে। তিনি দেখি আমার জর্মন এনসাইক্লোপিডিয়া খুলে একটার পর একটা ছবি দেখে যাচ্ছেন– আরামসে বড় কেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে। আমি যেতেই বললেন, শহর-ইয়ার বেড়াতে বেরিয়েছে; ও একা থাকতে ভালোবাসে আবার, মজার কথা, খানিকক্ষণ পরে সঙ্গী না হলেও চলে না। এই দেখুন না, একশো কুড়ি মাইল ঠেঙিয়ে এল এখানে আপনার সঙ্গে দেখা করতে, আর আপনার সঙ্গে দুটি কথা না বলে হুট করে বেড়াতে চলে গেল একা একা।

তা আপনি সঙ্গে গেলেন না কেন?

ওর মুড আমি জানি। আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলে বেঁধে নিয়ে যেত– আমি শত আপত্তি জানালেও। বেড়াক না একটু আপন মনে। আপনার বাড়ির বড় সুবিধে সিঁড়ি দিয়ে নামামাত্রই বেড়াবার মাঠ আরম্ভ হয়ে গেল! কলকাতার হাল তো জানেন। তার পর একটু থেমে গিয়ে বললেন, কিন্তু আপনার কাছে অনুরোধ, আপনার ডেলি রুটিন আমাদের আসাতে যেন আপসেট না হয়।

আমি হেসে বললুম, আপনি নির্ভয়ে থাকুন, ডাক্তার, আমার রুটিন বলে কিছু নেই। আমি শুধু বলি, এনজয় ইয়োরসেলভস। আচ্ছা, এখন চলুন না, আমরা ম্যাডামকে খোয়াইডাঙার মাঝখানে গিয়ে আবিষ্কার করে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে আসি। এখানে এই বিরাট খোলামেলার মাঝখানে যে কীরকম টপ করে অন্ধকারটি ড্রপ করেন সেটা শহুরেরা অনুমানও করতে পারে না।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে বললুম, ওই ওখানে যে গোটা দুই ভিতের মতো ঢিপি দেখতে পাচ্ছেন, ওইটেই এ অঞ্চলের সবচেয়ে উঁচু জায়গা। সেখানে উঠলেই ঠাহর হয়ে যাবে বিবি কোথায় কবিত্ব করছেন।

ডাক্তারটি স্বল্পভাষী। আমি শুধালুম, আপনি ডাক্তারির কী নিয়ে কাজ করছেন?

বললেন, এখনও ঠিক হদিস পাচ্ছিনে। ভাবছিলুম, যমজ, বামন এদের স্কেলিটেন নিয়ে।

আমি বললুম, ডক্টর ইয়াংকার যা নিয়ে–

তিনি অবাক হয়ে থমকে দাঁড়ালেন। শুধোলেন, আপনি জানলেন কী করে?

আমি বললুম, আপনারা দু জনাই বড় সরল আর কর্তাভজা। কর্তাভজা ইচ্ছে করেই বললুম। কর্তার গুণ আছে কি না চিন্তা পর্যন্ত করেন না। আপনি খুব ভালো করেই জানেন, আমি ডাক্তারির কিছুই জানিনে; অতএব ইয়াংকারকে চেনা আমার পক্ষে আকস্মিক যোগাযোগ বই আর কিছু না। বন শহরে আমি যখন পড়তুম তখন তিনি আমার প্রতিবেশী এবং আমার সংস্কৃতের অধ্যাপকের বন্ধু ছিলেন। মোটামুটি ওই সময়, অর্থাৎ ১৯৩৩/৩৪-এ তিনি পুরো মানুষের এক্সরে নেবার কল আপন হাতে বানান। ওসব কথা আরেক দিন হবে। এই তো পৌঁছে গেছি আমাদের এভারেস্টে, আর ওই– ওই যে– দুটো তালগাছের মাঝখানে বসে আছেন বেগম সাহেবা।

অতদূরে আমাদের সাধারণ কথাবার্তার কণ্ঠস্বর পৌঁছনোর কথা নয়। কিন্তু এই নির্জনতার গভীরতম নৈঃস্তব্ধ্যে বোধ হয় ধ্বনি ও টেলিপ্যাথির মাঝখানে এক তৃতীয় ট্রান্সমিটারহীন বেতারবার্তা বহন করে। শহর-ইয়ার হঠাৎ অকারণে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই আমাদের দেখতে পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে আমার আলসেশিয়ান মাস্টার তাঁর দিকে ছুট লাগাল।

মাঝপথে দেখা হতেই আমি বললুম, আত্মচিন্তার জন্য এ ভূমি প্রশস্ততম।

বানু বললেন, না, আমি শবৃনমের কথা ভাবছিলুম।

আমি বললুম দেখুন, ম্যাডাম, আপনাদের আনন্দ দেবার জন্যে আমার পক্ষে যা করা সম্ভব আমি তাই করব। ওই তালগাছটা যদি চড়তে বলেন তারও চেষ্টা দিয়ে দেখতে পারি কিন্তু একটি জিনিস করতে আমার সাতিশয় বিতৃষ্ণা। আপনারা দু জনাই আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট; তাই যদি আমি করজোড়ে একটি মেহেরবানি–।

শহর-ইয়ার যদি বটতলার চার আনা দরের সাক্ষীর পেশা কবুল করতেন, তবে তিনি ও-লাইনের সুলতানা রিজিয়া হতেন নিশ্চয়ই। উকিল আধখানা প্রশ্ন শুধোতে না শুধোতেই বটতলার ঘড়েল সাক্ষী আমেজ করে ফেলে, উকিলের নল কোন দিকে নিশানা করেছে। আমাকে বাধা দিয়ে শহর-ইয়ার বললেন, আর বলতে হবে না। ট্রেনে বেশ ধমক দিয়ে বলেছিলেন আপনি নিজের রচনা নিয়ে আলোচনা পছন্দ করেন না, এখানে সেটা ভদ্রভাবে বলতে যাচ্ছিলেন–এই তো? আচ্ছা, আমি মেনে নিচ্ছি, যদিও অতিশয় অনিচ্ছায়। শুধু একটা শেষ প্রশ্ন শুধাব; আপত্তি আছে?

আমি উৎফুল্ল হয়ে বললুম, চালান গাড়ি! ফাঁসির খানা খেয়ে নিন।

শবনমের সঙ্গে সেই শেষ বিরহের পর আপনাদের আবার কখনও দেখা হয়েছিল?

আমি বললুম, এ প্রশ্ন একাধিক পাঠক-পাঠিকা আমাকে বাচনিক, পত্র মারফত শুধিয়েছেন। তাঁর মধ্যে একজন হিন্দু মহিলা; পাবনার মেয়ে স্কুলের হেডমিসট্রেস্। অন্যদের আমি এ প্রশ্নের উত্তর দিই না। এর বেলা ব্যত্যয় করলুম। লিখলুম, মহাশয়া, আপনি যখন পাবনা সেকেন্ডারি স্কুলের হেড-মিসট্রেস তবে নিশ্চয়ই আপনার স্কুল রাজশাহী ডিভিশনে পড়ে। আমার স্ত্রী সেখানকার স্কুল-ইন্সপেট্রেস। তিনি যখন আবার আপনার স্কুল দেখতে আসবেন, তখন তাঁকে জিগ্যেস করলে পাকা উত্তর পাবেন। আপনাকে ঠিক তা বলছিনে। তবে তারই কাছাকাছি। আমার গৃহিণী বছরে একাধিকবার পুত্রদ্বয়সহ এখানে আসেন। পথিমধ্যে কলকাতায় কয়েক ঘণ্টা জিরোতে হয়। এবার না হয় আপনাদের ওখানেই উঠতে বলব।

শহর-ইয়ারকে সেই ট্রেনে দেখেছিলুম উল্লাসে লম্ফ দিতে, আর দেখলুম এই। সেবারে অপ্রত্যাশিত বিস্ময়ের, এবারে অবিমিশ্রিত উল্লাসের। শুধালেন, কিন্তু তার সঙ্গে আলোচনা করতে পারব তো?

আমি বললুম, কী আশ্চর্য! সেটা আপনাদের দু জনকার একান্ত নিজস্ব, অল রাইটস রিজার্ভড কারবার। সেখানে আমিই-বা কে, আর ডাক্তার জুলফিকারই-বা কে? কী বলেন ডক?

ডাক্তার বললেন, আমার বিবি কী আলোচনা করবেন আর কী করবেন না তার ওপর আমাকে আমাদের ইমাম আবু হানিফা সাহেব কোনও হক দিয়ে থাকলেও খুব সম্ভব তিনি দেননি– আমি কসম খেয়ে বলছি, আমি হক চাইনে– আমি চাই শান্তি।

আমি বললুম, আমেন, আমেন! হায়, এই না-হক্কের ওপর গড়া দুনিয়ার সিকি পরিমাণ স্বামী-সমাজ যদি আমাদের ডাক্তারের এই মহামূল্যবান তত্ত্বকথাটি মেনে নিত তবে বাদবাকি তাঁদের সদৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ডিভোর্স প্রতিষ্ঠানটির উচ্ছেদ সমাপন করত।

ইতোমধ্যে আমরা বাড়ি পৌঁছে গিয়েছি।

শহর-ইয়ারকে বললুম, একটা কথা আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলুম। আমার কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভালো ভালো রেকর্ড আছে যার বেশিরভাগ না কাম, না অর্থ নাইদার ফর লাভ নর ফর মানি আজ আর পাওয়া যায় না। যখন খুশি বাজাবেন। রাত তিনটেয় বাজালেও আমার আহার-শয্যাসন-ভোজন কোনও কিছুরই ব্যাঘাত হয় না।

শহর-ইয়ার বলল, আমি এখুনি দেখব। হুট করে চলে গেল।

আমি বললুম, ডাক্তার, আপনার বাঙলাতে বিস্তর আরবি-ফারসি শব্দ থাকে। এটা কি আপনাদের পরিবারের বৈশিষ্ট্য, না আপনাদের গোষ্ঠীর, কিংবা আপনারা যে মহল্লায় বাস করেন?

ডাক্তার বললেন, বিশ্বাস করুন, আমি একটি আস্ত অশিক্ষিত প্রাণী। চিকিৎসাশাস্ত্র আমি বলি স্বাস্থ্যশাস্ত্র, তার মানে হাইজিন নয়– আমাকে এমনই মোহাচ্ছন্ন করেছে যে আমি যেটুকু সামান্য সাহিত্য, ইতিহাস এমনকি গণিত স্কুল-কলেজে পড়েছি সেসব ভুলে গিয়েছি। শহর-ইয়ারের সঙ্গে একই জিনিস উপভোগ করার উদ্দেশ্য নিয়ে আমি একাধিকবার চেষ্টা করেছি তার সব শখের বিষয়ে দিল-চসৃপি নিতে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়ে উঠল না। সে এক ট্র্যাজেডি সে কথা পরে হবে। তা সে যাই হোক, মোদ্দা কথা এই, আপনি যে প্রশ্ন শুধিয়েছেন সেটার উত্তর দিতে হলে যেসব বিষয় জানার দরকার তার একটাও আমি জানিনে। তবে যেটুকু শুনেছি তার থেকে বলতে পারি, জব চার্নকের আমলের তো কথাই নেই, এমনকি ক্লাইভের সময় এবং তার পরও কোনও দ্র মুসলমান এবং হিন্দু ও নবাবের মুর্শিদাবাদ, খানদানি-ঢাকা ছেড়ে এই ভুইফোড় আপৃস্টার্ট কলকাতায় আসতে চায়নি। আমার পিতৃপুরুষ আসেন রাজা রামমোহন রায়ের আমলে, বাধ্য হয়ে, কোনও রাজনৈতিক কারণে। তারা আপসে কী ভাষা বলতেন, জানিনে, তবে আমার ঠাকুরদার আমল পর্যন্ত তাঁরা ফারসি ভিন্ন অন্ন কোনও ভাষাতে লেখেননি। আমার পিতা হুতোমের ভাষা বলতে পারতেন, কলকাতার উর্দু ডায়লেট এবং উত্তর ভারতের বিশুদ্ধ দরবারি উর্দুও, কিন্তু আমার মা ছিলেন খাস শান্তিপুরের মেয়ে। তিনি উর্দু জানতেন না এবং সেটা শেখবার চেষ্টাও করেননি। আমাকেও কেউ উর্দু শেখাবার চেষ্টা করেনি। ফলে আমি যে কোন বাঙলা বলি সে আমিও জানিনে। খুব সম্ভব ডাইলিয়ুটেড হুতোম। আমার হিন্দু ক্লাস-ফ্রেন্ডরা আমার ভাষা নিয়ে ঠাট্টা করত। কিন্তু তাদেরই একজন খানদানি কলকাত্তাই সোনার বেনে আমাকে বলেছিল, তার ঠাকুরমা আমারই মতো বাঙলা বলেন।

আমি বললুম আশ্চর্য! বাঙলা ভাষা কী তাড়াতাড়ি তার ভোল বদলেছে! ভারতচন্দ্র এমনকি আলাল-হুঁতোম দু জনাই আপনার চেয়ে বেশি আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন। অবশ্য বেনামি লেখাতে বিদ্যেসাগর মশাই আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন হুতোমের চেয়ে কম। কিন্তু তিনিও যা করেছেন সেটা নগণ্য নয়। আজ যদি প্যারীচাঁদ, কালীপ্রসন্ন, বিদ্যেসাগর কলকাতায় নেমে আড্ডা জমান তবে তাই শুনে বোধ হয় আপনার হিন্দু ক্লাস-ফ্রেন্ডরা ভিরমি যাবেন। কাজেই আমার পরামর্শ যদি নেন তবে বলব, আপনার ভাষা বদলাবেন না। কেউ যদি মুখ টিপে হাসে, হাসুক। আমার অঞ্চলের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরাও অত্যন্ত সংস্কৃতঘন বাঙলা বলেন– যেমন হপ্তা দুত্তিন না বলে বলেন– পক্ষাধিককাল এবং তাই শুনে হিন্দু-মুসলমান উভয়ই কৌতুক অনুভব করে। তাতে কী যায়-আসে?

এমন সময় শহর-ইয়ার চিন্তাকুল ভাব নিয়ে সভাস্থলে উপস্থিত। শুধালেন, আপনার রেকর্ড-সঞ্চয়ন অদ্ভুত। আপনি বাছাই করেছিলেন কীভাবে?

আমি হেসে বললুম, কোনওভাবেই না। আমি বরোদায় ছিলুম ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৪। এই সময়টার মধ্যে যা রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড বেরিয়েছে তাই কিনেছি– কোনওপ্রকারের বাছবিচার না করে। তার বহু বৎসর পর মোহরদি দু চারখানা রেকর্ড আমাকে দেয়– ব্যস্। ৪৪-এর পর, আজ পর্যন্ত, কোথাও ভালো করে আসন পেতে বসতে পারিনি। ফলে কলেকশন্‌টা বাড়াতে পারিনি। সে নিয়ে আমার কোনও মনস্তাপ নেই।

সাধের জিনিস ঘরে এনেই
এনে দেখি লাভ কিছু নেই।
খোঁজার পরে চলে আবার খোঁজা।

 চলুন মাদাম, চলুন মসিয়ো ল্য দত্যোর,

দুইটি বস্তু প্রতি মানবেরে টানিতেছে বরাবর।
দানাপানি টানে একদিক থেকে অন্যদিকেতে গোর ॥
 দো চিজ আদা কশদ জোর জোর।
য়কি আব ও দানা দিগর খাক্-ই-গোর

ওই তো এ বাড়ির দানা-পানির প্রতীক দিলবর জান সশরীরে উপস্থিত। আমি তার রান্নার প্রশংসা বা নিন্দা কিছুই করব না। আপনি শহর-ইয়ার বানু যখন এখানে রয়েছেন তখন আহারাদির জিম্মেদারি আপনার।

শহর-ইয়ার শুল্ক কণ্ঠে বললেন, আপনার রচনা সম্বন্ধে আলোচনা ট্যাবু; তার উল্লেখ না করে বলছি, আপনি খেতে ভালোবাসেন সেকথা আমি জানি, কিন্তু

আমি যেন আসমান থেকে পড়ে তার বক্তব্যে বাধা দিয়ে বললুম, আপনিও পেঁচি-টেপির মতো এই ভুলটা করলেন? লেখার সঙ্গে জীবনের কতখানি সম্পর্ক রবিঠাকুর নিদেন হাজারটি প্রেমের কবিতা লিখেছেন। অতএব, তিনি সমস্তক্ষণ প্রেমে পড়ার জন্য ছোঁক ছোঁক করতেন? সেই সুদূর ইয়োরোপে বসে মাইকেল কপোতাক্ষ-র স্মরণে কী যেন লিখেছেন– সতত পড় হে নদ আমার স্মরণে; ফিরে এসে সামান্যতম চেষ্টা দিয়েছিলেন এক ঘণ্টার তরেও ওই নদীর পারে যাবার! এ তো আমি চিন্তা না করেই বলছি। খুঁজলে এমন সব উদাহরণ পাবেন যে আপনার চক্ষুস্থির হয়ে যাবে। একাধিক কবি লিখছেন, আ মরি আ মরি গোছ প্লাতোনিক, দেহাতীত শিশির-বিন্দুর ন্যায় পূতপবিত্র স্বর্গীয় প্রেমের কবিতা– ওদিকে, তাঁদেরই একজন, হাইনে, বেরুতেন নিশাভাগে প্যারিসের কুখ্যাত– নেভার মাইন্ড, আপনি ডাক্তারের স্ত্রী, সহজে শফ্ট হবেন না–

এবং আমাদের বিয়ে হয়েছে দশটি বছর আগে, বললেন শহর-ইয়ার।

.

০৩.

এ কী! আপনি এখানে!

বাড়িটার একাধিক বারান্দা, তার একাধিক প্রান্তে একান্তে অন্তরালে বসে থাকা যায়। তারই একটাতে বসে আমি পূর্বাকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলুম। আজ কৃষ্ণপক্ষের ষষ্ঠী বা সপ্তমী, রাত প্রায় এগারোটা, একটু পরেই চাঁদ উঠবে, তারই আভাস লেগেছে তালের সারিতে। ঘরের ভিতরে শহর-ইয়ার রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজাচ্ছিল। তার বাজানোর পদ্ধতিটা সত্যই বিদগ্ধ। একটা গান বাজানোর পর অন্তত মিনিট দশেক পর আরেকটা বাজায়। অনেকক্ষণ ধরে তার কোনও সাড়াশব্দ শুনতে পাইনি বলে ভেবেছিলুম সে বুঝি শুতে গেছে। ডাক্তার আমার ঘরে পেয়ে গেছেন নুরুনবের্ক মোকদ্দমার একখানা বই– যেটাতে যুদ্ধের সময় নাৎসি ডাক্তারদের অদ্ভুত অদ্ভুত এক্সপেরিমেন্টের পরিপূর্ণ বর্ণনা দেওয়া আছে। রাত দশটা বাজতে না বাজতেই তিনি সেই বই নিয়ে রাতের মতো উধাও।

শহর-ইয়ার বারান্দার নিভৃত প্রান্তে আমাকে আবিষ্কার করলেন।

আমি বললুম, ঠিক সময়ে এসেছেন। একটু পরেই চাঁদ উঠবে আর এই জায়গাটা থেকেই সে দৃশ্যটি সবচেয়ে ভালো দেখা যায়। ডাক্তারের ঘরে তো এখনও আলো জ্বলছে; ওকে ডেকে আনুন না।

শহর-ইয়ার চুপ করে রইলেন। তার পর বললেন, শুনুন, আপনার সঙ্গে সোজাসুজি পরিষ্কার কথা হয়ে যাওয়াই ভালো। আমার স্বামীর অনুপস্থিতিতে কি আমার সঙ্গ পেলে আপনার অস্বস্তি বোধ হয়?

ঠিক ধরেছে। আমার বোঝা উচিত ছিল শহর-ইয়ারের বুদ্ধি এবং স্পর্শকাতরতা দুই-ই তীক্ষ্ণ। কিন্তু আমি এর উত্তর দেব কী?

আমি বললুম, না। কিন্তু তিনি যদি সেটা পছন্দ না করেন তবে আমি দুঃখিত হব।

শহর-ইয়ার বললেন, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আপনি তো জ্ঞানী লোক; আপনি তো বুঝলেন যে, তাঁর কোনও আপত্তি থাকলে তিনি আমাকে আপনার এখানে নিয়ে আসবেন কেন?

আমি বললুম, আমাদের এই বাঙলা দেশে মুসলমান মেয়েরা সবেমাত্র অন্দর মহল থেকে বেরিয়েছেন। এরা পরপুরুষের সঙ্গে কীভাবে মেলামেশা করবেন, কতখানি কাছে আসতে পারবেন এ সম্বন্ধে আমাদের কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই, থাকার কথাও নয়। ইয়োরোপে এ বাবদে মোটামুটি একটা কোড় তৈরি হয়ে গিয়েছে, কয়েক পুরুষের মেলা-মেশা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে। এই দেখুন না, কন্টিনেন্টের একটা মজার কোড়। নাচের মজলিসে কোনও বিবাহিতা মহিলার সঙ্গে আমার আলাপ হল, কিন্তু পরিচয়টা তার স্বামী করিয়ে দেননি। এস্থলে আমি যদি মহিলাটির সহিত ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করি তবে লোকে আমাকে আর যা বলে বলুক ছোটলোক বলবে না। পক্ষান্তরে স্বয়ং স্বামী যদি তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেন, এবং তারও বাড়া, যদি তাঁর বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে খাইয়েদাইয়ে এবং তার পর যদি স্বামীর অজানতে আমি মহিলার সঙ্গে মেলামেশা আরম্ভ করি তবে সমাজ আমাকে বলবে ছোটলোক, নেমকহারাম। ভাবখানা এই, ভদ্রলোক তোমাকে বিশ্বাস করে তার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন, আপন স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, আর তুমি সেই বিশ্বাস ভঙ্গ করলে! আবার—

আমার লেকচার আর শেষ হল না। ইতোমধ্যে শুনি শহর-ইয়ার খিলখিল করে হাসতে আরম্ভ করেছেন। হাসি আর কিছুতেই থামে না। ইয়োরোপীয় সমাজতত্ত্ব সম্বন্ধে আমার এই সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণে এতখানি হাসবার কী থাকতে পারে, আমি ঠিক বুঝতে পারলুম না।

হাসি পুরো থামার পূর্বেই শহর-ইয়ার বলতে লাগলেন, এবং বলার মাঝে মাঝেও চাপা হাসি কলকলিয়ে উঠল– আপনি কি বেবাক ভুলে গেলেন, ট্রেনে আমি নিজে, স্বেচ্ছায়, গায়ে পড়ে, ইংরেজিতে যাকে বলে উইদাউট এনি প্রোভোকেশন, আপনার সঙ্গে আলাপ করেছিলুম?

আমি বললুম, কী আশ্চর্য! আমি এমনি একটা উদাহরণ দিচ্ছিলুম। আমি কি আর আপনি– আমি ডাক্তারের কথা ভাবছিলুম?

শহর-ইয়ার তবু হাসতে হাসতে বললেন, বুঝেছি বুঝেছি, খুব ভালো করেই বুঝেছি। ইয়োরোপের উদাহরণ যে এদেশে খাটে না সে আমি ভালো করেই জানি। ইয়োরোপের কেন, বাঙালি হিন্দুর উদাহরণও আমাদের বেলা সর্বক্ষেত্রে খাটে না, সে-ও তো জানা কথা। জানেন, এ নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি।

যে সাহিত্য মানুষ পড়ে সেটা যে তার জীবনের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে এ তো জানা কথা। বাঙলা সাহিত্য গড়ে তুলেছে হিন্দুরা। বৈষ্ণব পদাবলি থেকে রবীন্দ্রনাথ। সৈয়দ আলাওল বা নজরুল ইসলাম তো এমন কোনও জোরালো ভিন্ন আদর্শ দিয়ে যাননি যার উল্লেখ করা যেতে পারে। এই হিন্দুর গড়া বাঙলা সাহিত্যে বিবাহিতা নারীর আদর্শ কী, সে তো সবাই জানে। সে সহধর্মিণী, অর্ধাঙ্গিনী এবং সর্বোপরি সে পতিব্রতা। ওদিকে দেখুন আপনার স্ত্রী আপনার সহধর্মিণী না-ও হতে পারেন, তিনি যদি খ্রিস্টান হন। এবং এই পন্ত্রিতার আদর্শটা আমাদের, মুসলমানদের ভিতর তো ঠিক সেরকম নয়। কোনও সন্দেহ নেই, স্ত্রী সেবা করবে, ভালোবাসবে তার স্বামীকে, তার সুখ-দুঃখের ভাগী হবে, তার আদেশ মেনে চলবে– কিন্তু, এখানে একটা বিরাট কিন্তু আসে– স্ত্রী তার সর্বসত্তা সর্বব্যক্তিত্ব সর্বঅস্তিত্ব স্বামীতে লীন করে দিয়ে পব্ৰিতা হবে এ কনসেপশন তো আমাদের ভিতর নেই। খুব একটা বাইরের মামুলি উদাহরণ নিন। আমার আব্বাজানের নাম মুহম্মদ আল্লাবখৃশ খান– তাঁর পূর্বপুরুষ পাঠান হন আর না-ই হন, তাঁরা সাতপুরুষ খান উপাধি ব্যবহার করেছেন। আমার আম্মা আবার চৌধুরীবাড়ির মেয়ে– তাই তিনি শেষদিন পর্যন্ত নামসই করেছেন মিহরুন্নিসা চৌধুরী। তিনি মাত্র কয়েক বছর হল ওপারে গেছেন। শেষের দিকে সবাই যখন হালফ্যাশান মাফিক তাঁকে বেগম খান, মিসেস খান বলে সম্বোধন করছে তিনি তখনও সই করছেন, মিহরুন্নিসা চৌধুরী।

আমি শুধালম, সমস্যাটা ঠিক কোনখানে আমি বুঝতে পারছিনে। অর্থাৎ বাঙালি মুসলমান মেয়ের বিশেষ সমস্যাটা কোনখানে?

শহর-ইয়ার বড় মধুরে হাসল। বললে, আমার মগজটা বড্ডই ঘোলাটে আর হৃদয় সেটা যেন ফেটে ফেটে বেরুতে চায়, তাই না আপনাদের বাঙালি মেয়ে বলেছে,

ইচ্ছা করে কলিজাডারে
গামছা দিয়া বান্ধি

শুনুন। হিন্দু মেয়েরা অন্দর থেকে বেরিয়েছেন কবে? বছর তিরিশের বেশি হবে না। অথচ স্বরাজ লাভের ফলে এবং অর্থনৈতিক অবনতিবশত কিংবা আকাশে-বাতাসে এক অভিনব সর্বব্যাপী স্বাধীনতার আবহাওয়া সৃষ্ট হওয়ার দরুন এই দশ-পনরো বৎসরেই মুসলমান মেয়েরা দ্রুত হিন্দুদের কাছাকাছি এসে যাচ্ছে। গত ত্রিশ বৎসর ধরে হিন্দু মেয়েরা এই যে তাদের আংশিক স্বাধীনতা ক্রমে ক্রমে বাড়িয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে তারা জানা-অজানায় চেষ্টা করছে সে স্বাধীনতা ঠিক কীভাবে কাজে লাগাবে, তার কোস্ কী, তার নম্ কী। একটা সামান্য দৃষ্টান্ত নিন। কন্টিনেন্টে কোনও মেয়ে যদি বিয়ের উদ্দেশ্যে কিংবা অন্য যে কোনও উদ্দেশ্য নিয়েই হোক তার পরিচিতের সংখ্যা বাড়াতে চায় তবে সে তার বান্ধবী নিদেন ল্যান্ডলেডির সঙ্গে নাচের হলে যায়। পুরুষরা এসে বাও করে নাচবার জন্য নিমন্ত্রণ জানায় তার জন্য কোনও ফর্মাল ইনট্রোডাকশন দরকার নেই এবং এই করে করে মেয়েরা যত খুশি তাদের পরিচিতের সংখ্যা বাড়াতে পারে। এদেশে এখনও সমস্তটা চান। বান্ধবীর মাধ্যমে, অফিসের সহকর্মিণীদের মাধ্যমে যে আলাপ-পরিচয় হয় সেটাকে উটকো মেথড– অর্থাৎ চান্স্ বলা যেতে পারে।

আমার বক্তব্য, হিন্দু মেয়েরা যে উদ্দেশ্যে চলেছে সেটা মুসলমানদের ঠিক সুট করবে না।

একটা কথা তো ঠিক, স্ত্রী-স্বাধীনতা অর নো স্ত্রী-স্বাধীনতা সাড়ে পনরো আনা মেয়ে বিয়ে করে মা হতে চায়। পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে, আপন স্বাধীন স্বেচ্ছায় হিন্দু মেয়ে বর বাছাই করে নিয়ে হবে– কী হবে?– পন্ত্রিতা।

মুসলমান মেয়েও ঠিক ওই একই পন্থায় আপন স্বামী বেছে নেবে কিন্তু সে হিন্দু মেয়ের মতো পতিব্রতা হওয়ার আদর্শ বরণ করে নিতে পারবে না। দোহাই আল্লার, তার অর্থ এই নয় যে সে অসতী হবে– তওবা, তওবা!–তার অর্থ, আবার বলছি, সে তার সর্বসত্তা স্বামীতে বিলীন করে দিতে পারবে না।

আপনি ভাববেন না, আমি কোনটা ভালো কোনটা মন্দ সেকথা বলছি– আমি শুধু। পার্থক্যটা পরিষ্কার করার চেষ্টা করছি।

আমি বললুম, পতিব্রতা-ফতিব্রতার আদর্শ আজকাল হিন্দু রমণীরা কি আর খুব বেশি বিশ্বাস করে? আর আজকালই বলছি কেন? ইংরেজি সভ্যতাকৃষ্টির সংস্পর্শে এসে তারা সতীদাহ বন্ধ করল, বিধবা-বিবাহ আইন পাস করাল, তার পর সিভিল মেরিজ যার ভিতর তালাকের ব্যবস্থা রয়েছে, হালে হিন্দুশাস্ত্রমতো বিবাহ-প্রতিষ্ঠানের ভিতরও তালাকের ব্যবস্থা প্রবর্তিত করা হয়েছে।

শহর-ইয়ার বানু দেখলুম অনেক চিন্তা করে রেখেছেন। বললেন, সতীদাহ বন্ধ। করাটা হিন্দুকে মেনে নিতে হয়েছে, নইলে সাজা পেতে হয়। কিন্তু যেখানে বাছাই করার স্বাধীনতা রয়েছে সেখানে হিন্দু নারী কোনটা বরণ করেছে? এ যাবৎ কটা বিধবাবিবাহ হয়েছে।

আমি বললুম, মুসলমান মেয়েদের ভিতরই-বা কটা হয়? কিংবা ধরুন তালাক। এদেশের মুসলমান ভদ্রসমাজে কি আরবিস্তানের আধার আধারও তালাক হয়?

শহর-ইয়ার বললেন, আরবিস্তানে তালাক দেয় পুরুষে– মেয়েদের তালাক দেবার অধিকার এতই সীমাবদ্ধ যে, সে-অধিকার আদপেই নেই বললে চলে। আমি মেয়েদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা তুলছি– যেমন বিধবাবিবাহ। প্রশ্ন উঠবে, আরও অধিক সংখ্যক মুসলিম বাল-বিধবা বিয়ে করল না কেন?

আসলে কী জানেন, পরাধীন অবস্থায় মানুষে মানুষে পার্থক্য কমতে থাকে; স্বাধীন অবস্থায় মানুষের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য ফুটে বেরোয়। অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য নানা কারণে এদেশের হিন্দু-মুসলমান রমণী উভয়ই ছিল স্বাধীনতালুপ্ত হারেমবদ্ধ (বরঞ্চ আফগানিস্থান, ইরান-আরবের মেয়েরা বোরকা পরে রাস্তায় বেরোয়, আত্মীয়স্বজনের মোলাকাত করে এমনকি বাজার-হাটেও যায়– এদেশে সে ব্যবস্থাও ছিল না। তাই আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় দুই-ই এক। এই যে আপনার ড্রইংরুম এর ভিতর ডার্বি ঘোড়া এবং ছ্যাকড়া গাড়ির ঘোড়াকে ছেড়ে দিলে দু জনাই ছুটবে মোটামুটি একই বেগে। কিন্তু ছেড়ে দিন আপনার বাড়ির সামনের খোলা মাঠে। তখন কোথায় ডার্বি, আর কোথায় ছ্যাকড়া! যার যার ভিতরকার সুপ্ত বৈশিষ্ট্য তখন পরিপূর্ণ মাত্রায় চোখের সামনে জাজ্বল্যমান হয়।

অন্দর মহল থেকে বেরিয়ে আসুক হিন্দু-মুসলমান দুই নারীই; তখন দেখতে পাবেন তাদের পার্থক্য কোন জায়গায়।

আবার বলছি, কসম আল্লার, আমি আদৌ বলছি না, মুসলমান মেয়ে হিন্দু মেয়ের চেয়ে সুপেরিয়র; আমি বলছি, সে ডিফরেন্ট।

এমন সময় দুটো তালগাছের মাঝখান দিয়ে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ একটা গাছের উপর ঈষৎ হেলান দিয়ে আকাশের পূর্বপ্রান্ত আলোকিত করে দিলেন।

শহর-ইয়ার বললে, আহ! বড় সুন্দর এ জায়গাটা। অতএব এখন থাক নারী-সমস্যা!

চুপ করে তাকিয়ে আছি লবাবুর বাড়ির পরিত্যক্ত ভিটে ছাড়িয়ে, রেললাইন পেরিয়ে তালসারির দিকে। বার বার এ দৃশ্য দেখেও আমি তৃপ্ত হইনে, কিন্তু এ-ও সত্য শহর ইয়ারের আনন্দ তার এখানে আসা অবধি প্রত্যেক আনন্দ ছাড়িয়ে যায়। চুপ করে আছে বটে কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল তার সর্বাঙ্গ থেকে যেন সে-আনন্দ বিচ্ছুরিত হচ্ছিল।

ঘোরঘুট্টি অন্ধকার দূর করতে করতে চাঁদ আর কিছুক্ষণ পরেই তার জ্যোতিঃশক্তির শেষ সীমানায় পৌঁছবেন– এর পর রাতভর যে আলো সেই আলোই থাকবে। আমি শহর-ইয়ারকে বললুম, পূর্ণিমা চাঁদের যেন বড় দেমাক, অন্তত এর তুলনায়। আচ্ছা, একবার ডাক্তারকে ডেকে দেখালে হয় না?

বললে, নিশ্চয়ই, কিন্তু কী জানেন, উনি নিজেই বলেন, এসব দৃশ্যের সৌন্দর্য তিনি বুঝতে পারেন কিন্তু সেটা তাঁর হৃদয় স্পর্শ করে না। ওদিকে অসম্ভব ভদ্রলোক বলে আমরা যতক্ষণ চাই তিনি আমাদের সঙ্গ দেবেন এবং বিশ্বাস করবেন না, সানন্দে। এবং তাতে কণামাত্র ভণ্ডামি নেই। ঠিক সেইরকম শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। দরকার হলে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে সংগীতের সূক্ষ্মতম তত্ত্ব নিয়ে বড় বড় সঙ্গীতজ্ঞের সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন। কারণ সমস্ত সংগীতশাস্ত্র তিনি কঠোর কঠিন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আয়ত্ত করেছেন। জানেন, একবার একটি অজানা অচেনা তরুণ গাওয়াইয়াকে এক জলসায় গোটাকয়েক দম্ভী অযথা আক্রমণ করে- ঘরানা ঘরানায় আড়াআড়ি তো এদেশে একটা কেলেঙ্কারির ব্যাপার। কেন জানিনে, উনি গেলেন ক্ষেপে অবশ্য বাইরে তার কণামাত্র প্রকাশ তিনি হতে দেননি, কখনও দেন না, একমাত্র আমিই শুধু বুঝতে পেরেছিলুম এবং তার পর সে-কী তর্কযুদ্ধ! শুধু যে সেই তরুণের ন্যায্য প্রাপ্য সম্মান প্রমাণ করে দিলেন তাই নয়, তার বিরুদ্ধপক্ষের মহারথীদের সঙ্গীতশাস্ত্রজ্ঞান সম্বন্ধে নিরপেক্ষ পাঁচজনের মনে গভীর সন্দেহ জাগিয়ে বাড়ি ফিরলেন। অথচ তিনি আমাকে বহুবার বলেছেন, সঙ্গীত তাঁর হৃদয় স্পর্শ করে না! কী জানি, হয়তো ডাক্তারি শেখার পূর্বে রসগ্রহণ করার ব্লটিং পেপারখানা করকরে শুকনোই ছিল; এখন সেটা চিকিৎসা-জ্ঞানে জবজব।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললেন, কী জানি! আমার প্রতি তার ভালোবাসাটাও বোধ হয় ওই ধরনের! তবে কি না, বিয়ের দশ বছর পরে, এই ত্রিশ বছর বয়সে এটা নিয়ে চিন্তা করা বেকার!

হঠাৎ উঠে বললেন, এবারে শুতে যাই। যে ঘরখানা আমায় দিয়েছেন তার জানালা দিয়ে মেটার্নেল আনকল মি. মুনের সঙ্গে মনে মনে রসালাপ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ব। কিন্তু তার পূর্বে একখানা শেষ রেকর্ড বাজাব। বলুন, কী বাজাব?

আমি চিন্তা না করেই বললুম, কেটেছে একেলা বিরহের বেলা আকাশ-কুসুম চয়নে।

.

০৪.

পরের দিন ওরা চলে যাওয়ার সময় আমাকে দিয়ে যে শুধু কলকাতা আসার প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিল তাই নয়, শহর-ইয়ার পাকা মহকুমা মোক্তারের মতো ক্ৰস্ এগজামিনেশন করে করে একেবারে তারিখ এমনকি কোন ট্রেন ধরতে হবে সেটা পর্যন্ত ঠিক করে দিয়ে গেল। একাধিকবার বললে, এখানে তো দেখে গেলুম, আপনি কীভাবে থাকেন, আমাদের ওখানে সেভাবেই ব্যবস্থা করব। আপনার খুব অসুবিধে হবে বলে মনে হয় না।

তিন দিন পরেই চিঠি।

১২ গোলাম সিদ্দিক রোড
কলকাতা

সালাম পর আরজ এই,

আপনার ওখানে কীভাবে আমার সময়টা কাটল সেটা আপনি নিজেই দেখেছেন।

আমরা আলোচনা করছিলুম, মুসলমান মেয়েদের নিয়ে, যারা অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে আসছে; বলুন তো, আপনার ওখানে গিয়ে আমি যে-আনন্দ ও বৈভব গনিমত শব্দটা আরও ভালো পেলুম, কটা মুসলমান মেয়ের ভাগ্যে সেটা জোটে? আমরা যে কী গরিব সে তো আপনি জানেন না, কারণ আপনি সমস্ত জীবন কাটিয়েছেন আপনার হিন্দু আত্মজনদের সঙ্গে।

স্বাধীনতা বড় সম্পদ। আমরা, মুসলমান মেয়েরাও ক্রমে ক্রমে স্বাধীন হচ্ছি কিন্তু সে-স্বাধীনতার ফল আস্বাদন করার সুযোগ পাচ্ছি কই? মনে হয়, আমি যেন একাকিনী কোনও নির্জন দ্বীপে বাস করছি; প্যাটরায় লক্ষ টাকা কিন্তু কিনব কী? লোকালয়ে এই লক্ষ টাকা দিয়ে যে কতকিছু করা যায় সেটা না জানা থাকলে ব্যঙ্গটা অতখানি নিষ্ঠুর মনে হত না। এই লক্ষ টাকা বিলিয়ে দিয়েও আমি আনন্দ পেতুম। কিন্তু দেব কাকে?

আপনার ডাক্তার লেবরেটরিতে গেছেন সকাল সাতটায়; তাঁকে ফের পাব রাত আটটায় কপাল যদি মন্দ না হয়!

আপনি আমার বৃহৎ বৃহৎ আদাব তসলিমাৎ জানবেন।
খাকসার
শহর-ইয়ার।

অনেকক্ষণ ধরে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে চিঠিখানা পড়লুম। এই প্রথম নয়, আগেও ভেবেছি, এ মেয়ের অভাব কোনখানটায়? স্বামী আপন কাজ নিয়ে ব্যস্ত বলে সে তার যথেষ্ট সঙ্গ পায় না–এইটেই দুঃখ? উঁহু, তা নয়। এ মেয়ে গতানুগতিক অর্থে শিক্ষিতা নয়; এ মেয়ে বিদগ্ধা এবং এর কল্পনাশক্তি আছে। দিন-যামিনীর অষ্টপ্রহরের প্রত্যেকটি প্রহর নিঙড়ে নিঙড়ে তার থেকে কী করে আনন্দ-রস বের করতে হয় সে সেটা খুব ভালো করেই জানে। তাকে তাস মেলে পেশেন খেলে দিন কাটাতে হবে না। এ মেয়ে গোপালভাড়, কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থে। গোপাল ঢেউ গুনে পয়সা কামিয়েছিল। এ মেয়ে ঢেউ গুনে আনন্দের ভাণ্ডার ভরে তুলবে। এবং বাড়ি ফিরে তাই দিয়ে হরিনুট লাগাবে।

আচমকা খেয়াল গেল, কই, আমার কলকাতা যাওয়ার কথা তো কিছু লিখল না? যাকগে– তার জন্য এখনও সময় আছে।

কোন এক পোড়ার বিশ্ববিদ্যালয় তুলনাত্মক ধর্মতত্ত্ব প্রবর্তন করতে চায়। আমাকে অনুরোধ করছে প্ল্যানটা করে দিতে। সাধারণ অবস্থায় এসব বুনো হাঁস খেদাতে আমি তো রাজিই হই না, উল্টো কয়েকটি সরল প্রাঞ্জল বাক্যে এমনসব আপত্তি উত্থাপন করি যে, তারা প্ল্যানটার আঁতুড়ঘরে তার গলায় নুন ঠেসে দেয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সে পথ বন্ধ। পোশাকি সরকারি চিঠির এক কোণে আমার বন্ধু– সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চেনূসেলর– ক্ষুদে ক্ষুদে হরফে ফরাসিতে লিখেছেন, বাপের সুপুতুরের মতো প্ল্যানটি পাঠিয়ো, নইলে এ শহরের যে-সব পাওনাদারদের ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছিলে তাদের প্রত্যেককে তোমার বর্তমান ঠিকানাটি জানিয়ে দেব– উইদ মাই বেস্ট কমপ্লিমেন্ট।

প্ল্যানটা তৈরি করা তো সোজা কিন্তু সিমেন্ট কই, লোহা কোথায়? অর্থাৎ এই পবিত্র আর্যভূমিতে যাবনিক ধর্মগুলোর মেটিরিয়েল পাই কোথায়?

তারই যোগাড়যন্ত্রের দুর্ভাবনায় দিনগুলো কোন পথে যে চলে গেল খেয়ালই করিনি। অবশেষে একদা রাত্রে দ্বিপ্রহরে ত্রিশটি পাতার শেষ পাতাটি টাইপ করে ঘুমুতে গেলুম।

মাস্টার বড় ঘেউ ঘেউ করছে– চতুর্দিকে প্রতিরাত্রে চুরি হচ্ছে সে খবর বাবুর্চি আমায় দিয়েছিল কিন্তু এ চোরটা তো একেবারেই রামছাগল। দু দুটো আলসেশিয়ান আমার বাড়িতে। এ দেশটাই মোস্ট ইনকমপিটেন্ট, চোরগুলো পর্যন্ত নিষ্কর্মা– দিনের বেলা একটু খবরাখবর নিলেই তো বুঝতে পারত ভদ্র চোরের পক্ষেই এ বাড়ি ভাদ্রবধূ।

নাহ! উঠতেই হল। মাস্টার ওরকম করছে কেন? বিষাক্ত খাবার দিচ্ছে নাকি কেউ?

দরজা খুলে বারান্দার আলো জ্বাললুম।

দু বার চোখ কচলালুম। গায়ে চিমটি কাটলে অবশ্য ভালো হতো– স্বপ্নটা তা হলে উপে যেত।

ব্যাকরণে যখন সে ভুল হয়েই গেল তখন স্বীকার করতেই হয় সামনের ডেকচেয়ারে বসে শহর-ইয়ার ঠোঙা থেকে শিককাবাব বের করে করে মাস্টারকে খাওয়াচ্ছেন। আমাকে দেখে তাচ্ছিল্যভরে বললেন, আপনি আবার উঠলেন কেন?

আমি বললুম, বেশ, শুতে যাচ্ছি। শুধু একটা কথা শুধোই, শ্মশানের কাছে এসে টাঙার পথ যেখানে শেষ হয় সেখান থেকে আপনি এলেন কী করে? তার পর তো পথ নেই, অন্ধকার

ও। রিকশাওয়ালা খানিকটে পথ এসেছিল। আমি বিদেয় করে দিলুম। ব্যাগটা তো ভারী নয়।

রবীন্দ্রনাথের মতো কবি পরিপকু বয়সে তাঁর যত অভিজ্ঞতা, অন্যের হৃদয়ে তার অনুভূতি সঞ্চারণ করার যত দক্ষতা, তার সম্মোহিনী ভাষা অলঙ্কারধ্বনি সর্বস্ব প্রয়োগ করে একটি দীর্ঘ কবিতার মাঝখানে এসে থমকে দাঁড়িয়ে, যেন হার মেনে বলছেন, দুটি শব্দ–

বৃথা বাক্য।

যামিনীর তৃতীয় যামে, জীবনেরও তৃতীয় যামে অর্থাৎ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে গুরুবদননিঃসৃত এই আপ্তবাক্যটি পরিপূর্ণভাবে হৃদয়ঙ্গম করলুম। চুপ করে বসে থাকা ভিন্ন গতি কী?

মাস্টারকে খাওয়ানো শেষ হলে বাথরুমে গিয়ে হাত ধুয়ে এসে, ঘোমটা টেনে আগের চেয়ে আরও বিনয় সেলাম করল।

পাশে চেয়ার এনে বসে বললে, আজ আর চাঁদ উঠবে না। না?

আমি বললুম, আজ শুক্লা-পঞ্চমী। চন্দ্র অনেকক্ষণ হল অস্ত গেছে। আচ্ছা আমি শুধু আপনাকে একটি প্রশ্ন শুধাব। এ আসাটা কীভাবে হল?

অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললে, একটি কেন, আপনি যত খুশি আমাকে প্রশ্ন জিগ্যেস করতে পারেন; আমি নিশ্চয়ই আমার সাধ্যমতো উত্তর দেব। কথা ছিল উনি লেবরেটরি থেকে সন্ধ্যা আটটায় ফিরে আসবেন। আমরা খেয়েদেয়ে সাড়ে নটার গাড়ি ধরে এখানে দেড়টায় পৌঁছব। তিনি নিশ্চয়ই কাজে ডুবে গিয়ে সব কথা ভুলে গেছেন, আর এরকম তো মাঝে মাঝে হয়ই। আমি আদপেই দোষ দিচ্ছিনে। যে যে-জিনিস ভালোবাসে তাতে মজে গিয়ে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে যাবে এ তো সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। আমি তার জন্য শেষ মুহূর্ত অপেক্ষা করে দুটি খেয়ে স্টেশনে এসে গাড়ি ধরলুম।

আমি তো কাল বিকেল পাঁচটার গাড়িতে কলকাতা আসতুমই।

 একজেকটলি। যাতে সেটাতে কোনও নড়চড় না হয় তাই আসা।

 এবারে পরিপূর্ণ বিশ্বাসে মনে মনে বললুম, বৃথা বাক্য।

বললুম, দুটি খেয়ে বেরিয়েছেন, এখন অল্প অল্প খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই। সামান্য কিছু খাবেন?

আর কঘণ্টা বাকি? সকালবেলা চা খাব।

আমি একটু হেসে বললুম, কে বললে মুসলমান মেয়ে, বিশেষ করে আপনি, আপনাদের স্বাধীনতার ফল উপভোগ করতে পারছেন না? কটা হিন্দু মেয়েরই এ রকম সাহস আছে?

খুশি হয়ে বললে, এবং ঠিক সেই কারণেই এইখানে বসে আপনাকে বলেছিলুম, মুসলমান মেয়ে ডিফরেন্ট, কিন্তু কলকাতায় ফিরে গিয়ে যত চিন্তা করতে লাগলুম, ততই মনে হল এই যে আমি বার বার ডিফরেন্ট ডিফরেন্ট বলছি এটা আমারই কাছে খুব পরিষ্কার নয়, এবং যেটুকু পরিষ্কার সেটুকুও বুদ্ধি দিয়ে বুঝিনি, অনুভব করেছি হৃদয় দিয়ে। বুদ্ধির জিনিস বোঝানো তেমন কিছু কঠিন নয়, কিন্তু অনুভূতির জিনিস অন্যের ভিতর সঞ্চারিত করতে পারে শুধু আর্টিস্ট সে-ও বহু সাধনার পর। কিন্তু এ সব কথা পরে হবে। আপনি ঘুমুতে যাবেন না?

আর আপনি?

আমি একটা কাজ সঙ্গে নিয়ে এসেছি। তার কিছুটা এইখানে বসে করব। ওয়েস্ট জর্মনি থেকে একটা খবরের কাগজ এ দেশের নারীসমাজের অবস্থা জানতে চেয়েছে। কিন্তু বিপদ হল গিয়ে যে লেখাটেখার অভ্যাস একে তো আমার নেই, তার ওপর ইয়োরোপীয় কাগজের জন্য লেখা, ইয়োরোপ গিয়ে কন্টিনেন্টাল ডিগ্রি যোগাড় করা, আরও কত কী- এক কথায় ইয়োরোপ ইয়োরোপ সর্বক্ষণ ইয়োরোপ এই মনোবৃত্তিটাই আমাকে পীড়া দেয়। তাই লেখাটা তৈরি করবার জন্য কোনও উৎসাহ পাচ্ছিনে। কিন্তু আর না, আপনি দয়া করে শুতে যান।

নিশ্চয়ই যাব, যদি আপনিও কাজটা আজ রাতের মতো মুলতুবি রেখে ঘুমুতে যান।

আপনার কোনও আদেশ আমি কখনও অমান্য করেছি?

শুয়ে শুয়ে ভাবছিলুম, এ মেয়ে কী ধাতু দিয়ে তৈরি? এক দিক দিয়ে দেখতে পাচ্ছি, আমার পর্দানশিন মা-বোনের মতো শান্ত, নম্র, বিনয়ী। ট্রেনে একবার ওই যেটুকু যা হামলা করেছিল সেটা নিশ্চয়ই ব্যত্যয়। এটার মূলে আছে, আত্মবিশ্বাসের দৃঢ়তা। মেয়েটির মন-হৃদয় যে সম্পূর্ণ নিষ্পাপ সে-বিষয়ে আমার মনে কণামাত্র সন্দেহ নেই। এই আত্মবিশ্বাসের দৃঢ়তার সঙ্গে নিষ্পাপ চরিত্রের সম্মেলন এটা বিরল এবং এর সঙ্গে উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্তি বা অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে আসা না-আসা অচ্ছেদ্য সম্পর্কে গ্রথিত নয়। সম্পূর্ণা অশিক্ষিতা কট্টর পর্দানশিন আমার সম্পর্কে এক ভাবী তাঁর স্বামীর নষ্টাচারে ক্রুদ্ধ হয়ে রাতদুপুরে থানা-ঘাটে হাঁকডাক ছেড়ে নৌকো যোগাড় করে চলে যান কয়েক মাইল দূরের গোসাঁইদের আখড়ায়। একে তো ছোট সেই শহরের সবাই সে কেলেঙ্কারির কথা জেনে যায়, তদুপরি ওই আখড়াটির মোহান্তের আবার খুব সুনাম ছিল না। শুধু তাই নয়, বউদিটি আখড়ায় দু দিন কাটানোর পর ফের সেই পাটনিকে ডেকে পাঠিয়ে ফিরে এলেন শহরে। দাসীকে দিয়ে জড়ো করালেন পাঁচজন মুরুব্বিকে। ওঁরা সবাই এসেছিলেন অত্যন্ত অনিচ্ছায়, কিন্তু জানতেন, না এলে আমার বউদিটি এঁদের প্রত্যেকের বাড়িতে গিয়ে যা হুলস্থুল লাগাবে তার চেয়ে পঞ্চায়েতে যাওয়াই ভালো বউদির পয়েন্ট অতি পরিষ্কার আপনারা বিচার করে দিন, আমার তালাক পাওয়ার হক্ক আছে কি না। মুসলমান হিসেবে এস্থলে কেউ বউদির আচরণে কোনও খুঁত ধরতে পারে না। শেষটায় বউদি তালাক পেল, নির্মম কাবুলির মতো তার মহর, অর্থাৎ স্ত্রীধনের প্রত্যেক কড়ি আদায় করে মক্কা চলে গিয়ে সেখানে বাকি জীবন কাটাল। এর সব-কিছু সম্ভব হল কারণ আমাদের অঞ্চলের সবাই জানত, ওই বউদির মতো পুণ্যশীলা নারী আমাদের মধ্যে কমই আছেন। এবং তাঁর সুদৃঢ় আত্মবিশ্বাস– আমি যা করছি ঠিকই করছি।

বউদির উদাহরণটি মনে এল বটে এবং শহর-ইয়ারের চরিত্রের সঙ্গে তাঁর চরিত্রের মিল আছে বটে, কিন্তু দু জনার বাতাবরণে আসমান-জমিন ফারাক। আমার সম্পর্কের দাদাটি ছিলেন মাইডিয়ার লোক, কিন্তু একেতে– অর্থাৎ একমাত্র ভাবীতে তাঁর জিনিয়াস সীমাবদ্ধ না রেখে ভূমাতে সুখের সন্ধান করতেন। ডাক্তার জুলফিকার তার ঠিক বিপরীত। অতিশয় একদারনিষ্ঠ এমনকি স্ত্রীর খামখেয়ালি পর্যন্ত হাসিমুখে মেনে নিয়ে তাঁকে সঙ্গ দেন। শহর-ইয়ারও তাঁকে গভীরভাবে ভালোবাসেন এবং ভক্তি করেন– সেটা এ যুগে কিছু কম কথা নয়।

তবে?

 তার পর ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম।

স্বপ্নে শুনছিলুম কে যেন অতি মধুর কণ্ঠে গান গাইছে। প্রত্যেকটি স্বর, প্রত্যেকটি শব্দ যেন এক একটি নিটোল শিশিরবিন্দু। আর শিশিরবিন্দুরই মতো যেন আপনার থেকে জমে উঠছে; তার পিছনে কোনও সচেতন প্রচেষ্টা নেই। এরকম স্বতঃস্ফূর্ত মধুর ধ্বনি বছরের পর বছর আপ্রাণ রেওয়াজ করে হয় না এর সঙ্গে একমাত্র তুলনা করে শুধু বলা যায় এ যেন মাতৃস্তন্যে সহজ দুগ্ধসঞ্চার। সহজে বয় তার স্রোত। সহজে পান করে নবজাত শিশু। যে শুনবে সে-ই পান করবে এ সঙ্গীত শিশুরই মতো অপ্রচেষ্টায়।

ধীরে ধীরে উঠে সঙ্গীত-উৎসের সন্ধানে বেরুলুম। কোথা থেকে আসছে এ সঙ্গীত? বেহেশত থেকে না হলে খুঁজে পাওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব না-ও হতে পারে। মাটিতে পা ফেলতেই বুঝলুম এটা স্বপ্ন নয়। মোটামুটি অনুমান করলুম কোন জায়গায় এ গানের উৎস।

এ বাড়ির দেড়তলায় একটি ছোট্ট কুটুরি আছে। সেখানে দেখি শহর-ইয়ার নড়াচড়া করে কীসব সাজাচ্ছে। আমাকে দেখেই শুধাল, চা খেয়েছেন?

না।

বসুন এই মোড়াটায়, আমি বানিয়ে দিচ্ছি। কাটু স্টেশনে গেছে, ফেরার পথে হাট করে নিয়ে আসবে– আজকে হাটবার।

তখন ভালো করে তাকিয়ে দেখি শহর-ইয়ার কুটুরিটি চা বানাবার, এবং সেইখানেই আরামে বসে চা খাবার অতি চমৎকার ব্যবস্থা করেছে। বললে, এ ঘরের যা যা প্রয়োজন সেগুলো আমি বাক্সের ভিতর রেখে এসেছি স্টেশনে। কাটু আনতে গেছে। আপনি জানেন না, আমি বেলা-অবেলায় চা খাই। তাই এ ব্যবস্থা। রান্নাতে আমার কোনও শখ নেই। তবে মা ডাকসাইটে রান্নার আর্টিস্ট ছিলেন। হাঁসের বাচ্চা কি আর সাঁতার কাটতে পারে না তাই যদি নিতান্তই চান–।

একটু থেমে বললে, ভয় নেই, ভয় নেই। এ বাড়িটাকে আমরা উইক-এন্ড কটেজ রূপে দেখছিনে। এটা কী রকম জানেন? খুব বড়লোক যেরকম ব্যাঙ্কে টাকা রাখে। ওটা খরচ করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না, কারণ মাসের আমদানিটাই পুরো খরচ হয় না কোনও মাসেই।

আমি বললুম, আমার কী মনে হয় জানেন? আপনি যদি এখানে এসে আনন্দ পান তবে যত খুশি আসবেন। কিন্তু ভালো হয় ডাক্তারকে যদি সঙ্গে নিয়ে আসেন। বিশেষ করে এই কারণে বলছি, ভদ্রলোক যেরকম বেদম খাটছে সেটা তার পক্ষে ভালো নয়। এখানে এলে দেহমন দুই-ই তার জুড়োয়, আমার তো তাই মনে হয়। ওদিকে আপনারও কোনও অসুবিধা হবে না, কারণ আমি খুব ভালো করেই জানি আপনি এখানে আপন মনে ঘুরে বেড়ালে, আমার সঙ্গে বসে গল্প করলে উনি ভারি খুশি হন। নয় কি?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ওঁকে ওঁর কাজ থেকে ছিনিয়ে এখানে আনা বা অন্য কোনখানে, সে আমার শক্তির বাইরে।

তার পর একটু চিন্তা করে নিয়ে বলল, হয়তো সবকিছুই আমার আদিখ্যেতা। আমার সমস্যা আর এমন কী নতুন? আমার শ্বশুরমশাইকে আমি দেখিনি কিন্তু শুনেছি সেই যে সকালবেলা বৈঠকখানায় গিয়ে বসতেন, তার পর ফের অন্দরমহলে ঢুকতেন রাতদুপুরে কিংবা তারও পরে– দু বেলার খাওয়া-দাওয়াই ওই বৈঠকখানায় ইয়ার-দোস্তদের সঙ্গে। সে হিসেবে তো আমি অনেক ভালো।

আমি জিগ্যেস করলুম, আর আপনার শাশুড়ি এ ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট ছিলেন?

কী জানি। তখনকার প্যাটার্নটাই ছিল আলাদা। আমার চোখের সামনে ছবিটা যেন পরিষ্কার হয়ে ফুটে ওঠে না। কারণ আমার বাপের বাড়িতে ছিল অন্য প্যাটার্ন। আম্মাকে আমি অল্প বয়সেই হারাই। আব্বা সমস্ত দিন কাটাতেন নামাজ পড়ে, তসবি, তিলাওত আর দীনিয়াতির কিতাব পড়ে। সংসারের সঙ্গে তাঁর মাত্র এইটুকু যোগ ছিল যে বেশ কড়া নজরে রাখতেন, আমার যত্ন-আত্তি ঠিকমতো হচ্ছে কি না। থাক, এসব কথা এক দিনে ফুরোতে নেই। মেয়েছেলের পুঁজিই-বা কতটুকু? ছেলেরা ঘোরাঘুরি করে, কত রকমের বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাদের হয়। আপনিই কত না ভ্রমণ করেছেন, কত না অদ্ভুত অদ্ভুত

আমি বললুম, কিছু না, কিছু না। আমার বড় ভাইসাহেব তার জীবনে মাত্র একবার কলকাতা আসেন, সেখান থেকে আমাকে দেখবার জন্য এই বোলপুর ব্যস্! মেজদা বুঝি একবার আগ্রা গিয়ে সেখানে দুটিমাত্র দিন ছিল। দেশ-ভ্রমণের শখ তাঁদের মাইনাস নিল। অন্য লোকে আমার ভ্রমণ সম্বন্ধে যা খুশি রোমান্টিক ধারণা পোষণ করে করুক, কিন্তু আমি জানি, আমরা তিন ভাই যখন একসঙ্গে বসে আলাপচারী করি তখন কার দৌড় কতখানি। কিছু না, কিছু না–ওসবেতে কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না।

হুঁ, অনেক কিছু দেখেছেন বলে এসব কথা কইছেন। আচ্ছা, এবারে আমি নাইতে, সাজগোজ করতে চললুম।

***

সমস্ত দিন শহর-ইয়ার আপন কামরা থেকে বেরুল না। তবে কি সে নিজের সঙ্গে কোনওরকমের বোঝাঁপড়া করছে? তা হলে মাঝে মাঝে আবার গান গেয়ে উঠছে কেন? আল্লা জানে তার কিসের অভাব। একাধিকবার সে বলছে সে মুসলমান মেয়ে, বহু যুগ পরে এ যুগে এসে অন্দরমহল থেকে বেরিয়েছে; তাই তার সমস্যা এক নতুন প্যাটার্নের প্রথমাংশ- ক্রমে ক্রমে বহু মেয়ের চোখের জল আর ঠোঁটের হাসি দিয়ে প্যাটার্ন সম্পূর্ণ হবে। তার পর নব যুগান্তরের সমস্ত প্যাটার্নটা যাবে মুছে, ভাগ্যবিধাতা বসে যাবেন আবার নতুন আল্পনা আঁকতে।

কিন্তু আমার কাছে এটা কিছুতেই পরিষ্কার হচ্ছে না যে শহর-ইয়ার মুসলমান।

আইনের দিক দিয়ে দেখতে গেলে হিন্দু মেয়ে আর মুসলমান মেয়ের মধ্যে অধিকারে পার্থক্য আছে। এবং সে আইনের ভিত কুরান-হাদিসে। হিন্দুধর্মের ব্যবস্থা অন্যরকম– যেমন, হিন্দুসমাজে ব্রাহ্মণের হিন্দুর কোনও ধর্মানুষ্ঠান অবশ্যকর্তব্য নয়। মুসলমানকে দিনে পাঁচ ওৎ নামাজ পড়তে হয়, খ্রিস্টানকে রোববারে রোববারে গির্জেয় যেতে হয়, ইহুদিকে শনিবারে সিনাগগে, এবং খুদ হিন্দুধর্মে একমাত্র ব্রাহ্মণকে সন্ধ্যাহ্নিক করতে হয়। সেখানেও আবার স্ত্রী-পুরুষে কোনও পার্থক্য নেই : পুরুষকে যে রকম পাঁচ ওকৃৎ নামাজ পড়তে হয়, পুরো রোজার মাস উপোস করতে হয়, স্ত্রীলোককেও তাই। এবং তারই ফলে জানা-অজানাতে মুসলমান মেয়ে অনুভব করে যে স্বয়ং আল্লার সামনে যখন নামাজ-রোজার মারফতে পুরুষ-স্ত্রীলোককে একইভাবে দাঁড়াতে হয় তখন এই পৃথিবীতেই তার অধিকার কম হবে কেন? অবশ্য কর্মক্ষেত্রে অধিকারভেদ থাকার কথা, কিন্তু মূল নীতি তো অতিশয় অপরিবর্তনীয় সুদৃঢ়।

পক্ষান্তরে ধর্ম যাই বলুক, আইন-কানুন যে আদেশই দিক, একই দেশে যুগ যুগ ধরে থাকার ফলে সামাজিক প্যাটার্ন ভিন্ন ভিন্ন ধর্মে খুব বেশি ভিন্ন হয় না। এর সর্বোকৃষ্ট উদাহরণ পাওয়া যায় প্যালেস্টাইনে। ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমান এই তিন সম্প্রদায়ের ভিতর তিন ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের আদেশ অনুযায়ী স্ত্রী-পুরুষে তিন ভিন্নপ্রকারের অধিকারভেদ- অথচ কর্মক্ষেত্রে দেখা যায় সামাজিক প্যাটার্ন তিন সমাজেরই মোটামুটি এক। একটি ছোট উদাহরণ মনে পড়ল : হিটলারের ভয়ে যখন ইহুদি নরনারীরা জৰ্মনি ত্যাগ করে জেরুজালেমে এল তখন বার্লিনের কোনও কোনও অত্যাধুনিক যুবতী সুদ্ধমাত্র শর্ট শার্ট পরে রাস্তায় বেরুতে আরম্ভ করল। এই বে-আব্রু বেহায়া বেশ দেখে জেরুজালেমের আদিম ইহুদিরা লজ্জায় ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিত, এবং নিজেদের সবচেয়ে বেশি কুণ্ঠিত বিড়ম্বিত বোধ করত প্রতিবেশী খ্রিস্টান ও মুসলমানের সম্মুখে। কারণ তিন সম্প্রদায়েরই একই মান, একই স্ট্যান্ডার্ড আ, ইজ্জৎ, হায় সম্বন্ধে।

মনে মনে ভাবলুম, শহর-ইয়ার যা-ই বলুক, বাঙলা দেশেও কি তাই নয়? এমনকি আমাদের ইলিয়ট রোডের এংলো-ইন্ডিয়ানদের আচরণ লন্ডনের খ্রিস্টানদের সঙ্গে যত না মেলে তার চেয়ে বেশি সাদৃশ্য ধরে প্রতিবেশী হিন্দু-মুসলমানের সঙ্গে।

তার পর দুপুরে শহর-ইয়ারের সঙ্গে দেখা।

খানার টেবিলে বাবুর্চি একটা মাংসের কালিয়া দেখিয়ে বললে, এটা বেগম সায়েবা বেঁধেছেন। খেয়ে দেখি, আশ্চর্য, এক্কেবারে হুবহু কাবুলি রীতিতে তৈরি। কিন্তু রাধল কখন?

শহর-ইয়ার বোধ হয় একটুখানি মৌজে ছিলেন। বললেন, আমার মা এক কাবুলির কাছ থেকে এটা শেখেন। তার পর আরম্ভ করল সেই কাবুলির ইতিহাস। কেন জানিনে সেই খান সায়েবের এ দেশটা ভারি পছন্দ হয়ে যায়। আব্বা তাকে একটু জমি দিলেন। সে মামুলি ধরনের ঘরবাড়ি বেঁধে বিয়ে করল আমাদেরই এক রায়তের মেয়েকে। তার পর ডালভাত খেয়ে খেয়ে সে তার পাঠানত্ব ভুলে গেল, গাঁয়ের লোকও সেটা গেল ভুলে।

বিয়ের পরের বছর খানের একটি মেয়ে হয়েছিল। তার পনেরো বছর পর খান মেয়ের জন্য একটি বর বাছাই করে তার বিবিকে সুখবরটা দিল। কিন্তু পরের দিন সকালে বিবি খানকে জানালেন, মেয়ে তাকে পরিষ্কার বলে দিয়েছে এ বর তার পছন্দ হয়নি।

তাজ্জবকি বাৎ! বাঙলা দেশের মুসলমান মেয়ে বিয়ের কথাটি মাত্র উঠলেই লজ্জায় ঘেমে-নেয়ে কাই হয়ে যায়। তার যে একটা মতামত থাকতে পারে সে নিয়ে তো কেউ কখনও মাথা ঘামায় না। এ আবার কী? খান বউকে অভয় জানিয়ে বলল যে আখেরে সব দুরস্ত হয়ে যাবে এবং বিয়ের ব্যবস্থা করে যেতে লাগল। হয়েও গেল সবকিছু ঠিকঠাক। বরপক্ষ এলেন ঢাকঢোল বাজিয়ে, আতশবাজি পোড়াতে পোড়াতে। তার পর যথারীতি এক উকিল আর দুই সাক্ষী বিয়ের মজলিস থেকে বরের প্রস্তাব নিয়ে গেলেন অন্দরমহলে সেখানে কনেকে সাজিয়েগুজিয়ে, লম্বা ঘোমটা সহযোগে তাকে একটি আস্ত পুঁটুলি বানিয়ে চতুর্দিকে বসেছেন তার সখীরা। সখীদের কাজ হচ্ছে, উকিল বিয়ের প্রস্তাব করার পর কনে লজ্জায় হা বলতে দেরি করে বলে তারা তখন কনেকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কবুল বলায়। উকিল প্রস্তাব পেশ করলেন। ভুল বললুম, প্রস্তাব ভালো করে শেষ করার পূর্বেই মেয়ে পরিস্কার গলায় বলে উঠল, না, কবুল নয়।

হঠাৎ কাহিনী থামিয়ে আমাকে বললে, কই, আপনার কাবুলি-কালিয়া খাচ্ছেন না যে বড়?

আমি বললুম, কী আশ্চর্য রসভঙ্গ করতে পারেন আপনি! বখতিয়ার খিলজির আমল থেকে অই সুবে বাংলার সুদীর্ঘ ইতিহাসে কোন মুসলমান বঙ্গনারী এরকম কবুল নয় বলেছে শুনি? তার পর কী হল বলুন।

আমি সেখানে ছিলুম না, তবু খানিকটে অনুমান করতে পারি। ওই কনের মজলিসে একশোটা বাজ একসঙ্গে পড়লেও বোধ হয় তার চেয়ে বেশি ধুন্দুমার লাগাতে পারত না। তারই ভিতর যাদের একটু মাথা ঠাণ্ডা ছিল তাঁরা কনেকে পাশের ঘরে তাড়াতাড়ি সরিয়ে নিয়ে বোঝতে আরম্ভ করলেন, হাতে-পায়ে ধরলেন তাঁদের মাথায়, তাদের গোষ্ঠীর মাথায় যেন কেলেঙ্কারি না চাপায়। কনের মামারা তো পাগল হয়ে যাবার উপক্রম। আর বাপ, কাবুলি খান সাহেব- সে তার সর্ব পাঠানত্ব হারিয়ে ফেলা সত্ত্বেও একটা সামান্য জিনিসে তখনও তার কিছুটা আটকা পড়েছিল, সেটা তার প্রাচীন দিনের একখানা তলওয়ারে। কুড়ি বছর ধরে সে ওই তলওয়ারখানা সাফসুতরো রেখেছে। ওইটে নিয়ে করল ধাওয়া মেয়েকে খুন করবে বলে।

ওদিকে বাইরে বরপক্ষের কানে খবরটা পৌঁছে গিয়েছে। একসঙ্গে গর্জে উঠল সবাই, এ কী বেইজ্জতি? আমাদের গায়ের লোক দলে ভারী কিন্তু হলে কী হয়, ওদের সঙ্গে ছিল জনাতিনেক জাহবাজ লেঠেল– বরের মুরুব্বিদের ভিতর। আর জানেন তো, চাষাভূষোর বিয়েতে নানারকমের ঢং-তামাশার মেকি লড়াই হয়– ভাবটা যেন বরপক্ষ কনেকে ডাকাতি করে লুটে নিয়ে যাচ্ছে তাই সঙ্গে এনেছে যার যার লাঠি। ব্যস! লাগ লাগ লাগ। আমাদের গায়ের মোল্লাজি, মসজিদের ইমাম সাহেব, এমনকি বরপক্ষ যে তাদের মোল্লাজি সঙ্গে এনেছিল তিনি পর্যন্ত, সবাই মিলে আল্লা-রসুলের দোহাই দিয়ে ওদের ঠেকাবার জন্য প্রায় পায়ে ধরেন আর কি।

শেষটায় আমার চাচা খবর পেয়ে ছুটে গিয়ে লড়াই ঠেকালেন। নিজের থেকেই বললেন, বিয়ের জন্য বরপক্ষের যা খরচা-পত্র হয়েছে তিনিই সেটা দিয়ে দেবেন।

কিন্তু বরপক্ষ কনে না নিয়ে শুধু হাতে যদি বাড়ি ফেরে তবে সারা রাস্তা ধরে তাদের শুনতে হবে পাঁচখানা গাঁয়ের টিটকারি। তার ব্যবস্থাও চাচা করে দিলেন। ওদের মোল্লাজিকে আড়ালে নিয়ে আলাপ করে খবর পেলেন আমাদের পাশের গায়ে বরপক্ষের পাল্টাঘর আছে ও তাদের একটি মেয়েকে এই বরের সঙ্গে বিয়ে দেবার জন্য একটা ইশারাও দিয়েছিল। চাচা বরের বাপ-চাচার সঙ্গে কথা বলে আমাদের মোড়লকে তাঁর নিজের ঘোড়া দিয়ে বলে দিলেন সে যেন আমার চাচার হয়ে বিয়ের প্রস্তাবটা পাড়ে। চাচা নামকরা জমিদার আর এরা সাধারণ রায়ৎ- এ যে কত বড় সম্মান আর ইজ্জতের কথা–।

আমি বললুম, খুব বুঝতে পেরেছি। আমার আব্বাকে বিয়েশাদির দোয়া-দরুদ পড়তে আমার জীবনে মাত্র একবার আমি দেখেছি। আমাদের বাড়ির দাসীর যখন বিয়ে হল আমাদের এক কুটুম-বাড়ির চাকরের সঙ্গে, পরের দিন বরের দেমাকটা যদি দেখতেন! তার পর কী হল বলুন।

তার পর আর বিশেষ কিছু বলার নেই। সেই রাত্রেই বরপক্ষ পাশের গায়ে গিয়ে বিয়েশাদি সাঙ্গ করে কনে নিয়ে মান-ইজ্জতের সঙ্গে বাড়ি ফিরল। তবে শুনেছি, আমাদের গাঁ থেকে বেরুবার সময় তারা নাকি ভিতরে ভিতরে শাসিয়ে গিয়েছিল যে এ তল্লাটের মাথা, আমার চাচা, তাদের হাত বন্ধ করে দিলেন কিন্তু সামনের হাটবারের দিন আমাদের গায়ের লোক যেন হুশিয়ার হয়ে হাট করতে যায়।

আর কনেটা?

সে কি আর বেশিক্ষণ চাপা থাকে, কার সঙ্গে সে মজেছে? ছোঁড়াটা অবশ্যি তুলকালাম দেখে গা-ঢাকা দিয়েছিল। তালাশ করে ধরে নিয়ে এসে বর সাজানো হল।

তা মেয়েটা ওরকম শেষ মুহূর্তে এরকম নাটুকে কাণ্ড করল কেন?

ওর নাকি কোনও দোষ নেই। সে বেচারী তার মাকে অনেকবার তার অমত বেশ জোর গলায়ই জানিয়েছিল, কিন্তু মা পাঠানকে বার বার বিরক্ত করতে সাহস পায়নি। আশা করেছিল, শেষ পর্যন্ত সবকিছু দুরস্ত হয়ে যাবে।

আমাদের খাওয়া অনেকক্ষণ সাঙ্গ হয়ে গিয়েছিল কিন্তু উঠি-উঠি করে উঠিনি। আমি বেশ বুঝতে পেরেছিলুম, শহর-ইয়ার অন্য কিছু-একটা ভাবছে এবং সেইটে চাপা দেবার জন্য ঘটনাটি বলে গেল।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললে, চলুন।

বসার ঘরে এসে বললে, কিন্তু খানের মেয়ের বিয়ে বাবদে আসল কথাটি আপনাকে এখনও বলা হয়নি। মেয়েটির বিয়ে চুকে-বুকে যাওয়ার মাসখানেক পরে খান একদিন তার বউকে বললে যে, সে বড় খুশ যে তার মেয়ের গায়ে পাঠান রক্ত আছে। ওই রকম ঘটনা পাঠান মুল্লুকে নিত্যি নিত্যি না ঘটলেও ব্যাপারটা একেবারে অজানা নয়।

আমি বললুম, তবেই দেখুন, ইসলাম যেসব অধিকার আমাদের দিয়েছে আমরা সেগুলো ব্যবহার করিনে। শুনেছি, আরবভূমিতে এখনও নাকি মেয়েরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মাঝে মাঝে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়।

শহর-ইয়ার একটু হেসে বললে, ঠিক ওই জিনিসই এখন বাঙলা দেশে অল্প অল্প আরম্ভ হয়েছে। যেসব মুসলমান মেয়েরা এখন ছেলেদের সঙ্গে কিছুটা অবাধে মেলামেশা করে তারা নিশ্চয়ই কিছুটা হিট দেওয়ার পর ছেলেরা বিয়ের প্রস্তাব পাড়ে।

আমি বললুম, ইংরেজিতেও বলে Courtship is the process a woman allowing herself to be chased by a man till she catches him.

শহর-ইয়ারের পছন্দ হল প্রবাদটি। তার পর বললে, তবেই দেখুন, যে অধিকার মুসলমান মেয়ের ছিল ইসলামের গোড়াপত্তনের সময় থেকে, সেইটেই সে ব্যবহার করল ইংরেজি সভ্যতার সংস্পর্শে এসে, অন্দরমহল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর। পাঠান মেয়েরা কিন্তু চিরকাল ধরে এ হক্কটা দরকার হলেই কাজে লাগিয়েছে। শুনেছি, তারা নাকি অনেক ক্ষেত্রেই বাপ-মার তোয়াক্কা না রেখে আপন পছন্দের ছেলেকে ভালোবাসতে জানে। আপনি তো আপনার লেখা নিয়ে কোনও আলোচনা করতে আমাকে দেন না, কিন্তু কাবুলে ওই যে একটি পাঠান মেয়ে আপনাকে ভালোবেসেছিল–

আমি বাধা দিয়ে বললুম, আপনি নির্ভয়ে, প্রাণভরে মণিকে নিয়ে যত খুশি আলোচনা করতে পারেন। এ কাহিনীতে আমি এমনই না-পাস ফেল মেরেছি যে ওটার কথা স্মরণে এলে মণির কাছে মনে মনে বার বার লজ্জা পাই আর মাফ চাই– এত বৎসর পরেও।

সে কী? আমি বুঝতে পারলুম না।

আমি গভীর দুঃখ প্রকাশ করে বললুম, মণির কাহিনী গল্প নয়, হাজার পার্সেন্ট সত্য। আমি তার সিকির সিকিও ফুটিয়ে তুলতে পারিনি। আমি আমার জীবনে মাত্র একটি বার– ওই নিষ্পাপ কিশোরী মণির কাছ থেকে অকুণ্ঠ, সর্বত্যাগী, হিতাহিতজ্ঞানশূন্য প্রণয় পেয়েছি। ও ছিল সত্যই কাবুল পাহাড়ের চুড়োর উপরকার ভার্জিন স্নো– এটা আমার ভাষা নয়, এটা বলেছিলেন মণির মুনিব বল, জাতভাই বল–জানো তো পাঠানরা সাম্যবাদে কীরকম মারাত্মক বিশ্বাসী– সেই রসকষহীন স্টোন-হার্ড-বয়েল ডিপ্লোমেট শেখ মহবুর আলি খান। তিনি আমাকে একাধিকবার বলেছিলেন যে, পেশাওয়ারে তাঁদের পরিবারে পরে এখানে ব্রিটিশ লিগেশনে পাঠান চিফ একাউন্টেন্ট থেকে আরম্ভ করে পাঠান অরডারলি পর্যন্ত- আবার সেই প্রাণঘাতী ডিমোক্রেসি মণির কৃপাদৃষ্টি লাভ করতে চেয়েছিল, কেউ কেউ বিশুদ্ধ পাঠান-রীতিতে মহবুর আলির কাছে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে মহবুর আলির শেষ কথাগুলো, ওমেদারদের দৃঢ়তম প্রচেষ্টাও যেন মণির মনে কোনও ক্ষণেকের তরে ছায়াটুকু পর্যন্ত ফেলতে পারেনি। যেন ওসবের কোনও অর্থই হয় না, যেন তার বয়েস ষোল নয়– চার। তাই বলছিলুম, ভার্জিন স্নো, যার উপর রত্তিভর ধুলোবালি পড়েনি। তার পর সে আপনাকে দেখল–একবার দরজা খুলে দেবার সময়, আরেকবার যখন আপনার জন্য নাশতা নিয়ে এল। সেদিন আপনি এখানে ছিলেন আধ ঘণ্টাটাক। পরদিন আমার স্ত্রী বললেন, মণি যেন জীবনে এই প্রথম জেগে উঠল। নরনারীর একে অন্যের প্রতি বাছাই-অবাছাই-না-করা আকর্ষণ, বিবাহ, মাতৃত্ব সব যেন ওইদিন এক লহমায় সে বুঝে গেল। এ সমস্ত কবি একজন ধুরন্ধর ডিপ্লোমেটের মুখ থেকে হৃদয়ের সূক্ষ্মানুভূতি, স্পর্শকাতরতা যার কাছে আকাশকুসুম, সোনার পাথরবাটি।

মণির সেই প্রেম পরিপূর্ণভাবে অনুভব করেছিলুম আমি, কিন্তু তার প্রেমের আবেগ, সে প্রেমের ভিতর তার সম্মোহিত অবস্থা, যেন সে নিশির-ডাকে-পাওয়ার মতো চোখ বন্ধ করে ভিতরকার প্রেমের প্রদীপালোকে চলেছে দয়িতের অভিসারে কাবুলের শঙ্কাসঙ্কুল গিরিপর্বত লঙ্ঘন করে– এসব পারলুম না আপনাদের হৃদয়ে সঞ্চারিত করতে। জানেন তো, আমাদের কোনও কম ল্যানগুইজ ছিল না?– তৎসত্ত্বেও আমার হৃদয়ে মণির প্রতিটি হৃদস্পন্দন সঞ্চারিত হয়েছিল অব্যবহিত ভাবে।

আমার আফসোস, আফসোস– হাজার আফসোস– যে আমি মণির প্রেমের নেমক খেয়ে সে নেমকের কিম্মৎ দিতে পারলুম না আমার সবসময় মনে হয় আমি যেন নেমকহারাম রয়ে গেলুম। জানেন, মণির এই বেদনাকাহিনী লেখার পর সেটা আর কখনও পড়িনি? লেখার সময়ই আমি প্রতি লহমায় হৃদয় দিয়ে অনুভব করছিলুম, সুর লাগছে না, কিন্তু প্রাণপণ আশা করছিলুম যে সৃষ্টিকর্তা আমাদের নগণ্য সৃষ্টির চলার পথ তৈরি করে দেন তিনি কোনও এক মিরা অবতীর্ণ করে শেষরক্ষা করে দেবেন। কিন্তু আফসোস, তিনি প্রসন্ন হলেন না।

শহর-ইয়ার গভীর দরদ দিয়ে শুনছিল। শেষটায় বললে, মাফ করবেন, আমি আপনার সঙ্গে একমত হতে পারলুম না। কিন্তু তবু জানতে ইচ্ছে করে, আপনার এই ধারণাটা জন্মাল কী করে?

অত্যধিক আত্মপ্রত্যয়, দম্ভ। আমি ভেবেছিলুম এ তো জলজ্যান্ত ঘটনা। কোনও-কিছু বাড়াতে-কমাতে হবে না। স্মৃতির গভীরে কলম ডোবাব আর লিখব। এতে তো কোনও মুশকিল নেই। সেই হল আমার কাল। আপন কল্পনা, সহানুভূতি বাদ পড়ে গেল– এককথায় আমার হৃদয়রক্তে রাঙা হয়ে রক্তশতদলের মতো মণি ফুটে উঠল। হয়ে গেল ফটোগ্রাফ সে-ও আবার রদ্দি ফটোগ্রাফ। ফোকাস ঢিলে, কোথাও না ওভার-একসপোজড, কোথাও-বা আন্ডার। ফ্ল্যাট, কন্টুর নেই আর ক্যামেরাও বাঁকা করে ধরা ছিল বলে টিলটেড়।

শহর-ইয়ার শব্দার্থে তামাম শহরের ইয়ার। ইনি আমার লেখার অকৃত্রিম ইয়ার। ঘন ঘন মাথা নেড়ে নেড়ে আমার বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাল।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *