দাশগুপ্ত ট্রাভেলস / দেবারতি মুখোপাধ্যায়
প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর ২০১৯
.
শুধু আই টি সেক্টরের ব্যস্ত ইঞ্জিনিয়াররা নয়,
মধ্যমেধা ও মধ্যবিত্ত সমাজ যাদের ‘উন্মাদ’ আখ্যা দেয়,
যারা গতানুগতিকতাকে উপেক্ষা করে নিজেরা কিছু করতে চায়,
সেইসব ব্যতিক্রমী মানুষদের জন্য এই বই।
.
মুখবন্ধ
আই টি সেক্টরের অন্দরমহল। বর্তমান সময়ের শিক্ষা ও সমাজব্যবস্থা। ইঁদুরদৌড় থেকে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে অন্ত্রেপ্রেন্যিয়র হওয়ার ব্যতিক্রমী স্বপ্ন। তরুণ প্রজন্মের চাওয়া—পাওয়া, অনুভূতি, হতাশা।
অনেক মানুষ। অনেক মুখ। প্রতিটি মুখের আড়ালে রয়েছে তাদের জীবনের ওঠাপড়া, সুখ দুঃখ। ভালোবাসা। সেই চলমান জীবনের অলিতেগলিতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে নানা অজানা অধ্যায়।
‘দাশগুপ্ত ট্রাভেলস’ নামটি মানুষের জীবনসংগ্রামের প্রতীক, যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন সামাজিক স্তর থেকে উঠে আসা নানা বয়সের মানুষের জীবনের জটিল অধ্যায়। বহুমাত্রিক স্তর নিয়ে গড়ে উঠেছে এই উপন্যাস। ভরকেন্দ্রে রয়েছে যে তরুণী, সেই জিনিয়া দাশগুপ্ত নানা ঘটনার আবর্তের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে তার লক্ষ্যে। তার চলার বাঁকে ফুটে উঠেছে বর্তমান কর্পোরেট জগতের ভেতরের নানা প্রতিচ্ছবি। শুধু সে—ই নয়, অতন্দ্র, অম্বিকেশ, আলোকপর্ণা, অল্পা, যাদবচন্দ্রের মতো চরিত্ররা শেখায় বাঁচতে। দুঃখের কুয়াশা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে নতুন উদ্যমে আলোর মুখ দেখতে। বলে ‘চরৈবেতি’।
এই উপন্যাসের স্রষ্টা নিজে এমন এক দুর্লভ ব্যক্তি যিনি অতি অল্প বয়সে দেশের বেসরকারি আই টি জগৎ, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক সংস্থা এবং সরকারি প্রশাসনিক পদ, তিন ধরনের কর্মজগতেই কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। ফলে, লেখকের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ সুলেখনীতে ‘দাশগুপ্ত ট্রাভেলস’ পাঠককে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াবে দেশ থেকে বিদেশে, কর্পোরেট জগতের অলিগলিতে। দাঁড় করাবে নানা অজানা সত্যের মুখোমুখি।
একান্ত সামাজিক কাহিনি হলেও প্রায় রহস্যপাঠের মতোই আমি আকৃষ্ট হয়েছি এই দীর্ঘ উপন্যাসের পর্ব থেকে পর্বান্তরে। লেখার মুনশিয়ানার প্রতিটি অধ্যায় অন্তে চড়েছে কৌতূহলের পারদ। পেয়েছি একাধারে কর্পোরেট জগৎ, সমাজ—জীবনের দ্বন্দ্ব, অন্যদিকে ভ্রমণোপন্যাসের স্বাদ। আগ্রহী ও একনিষ্ঠ পাঠকের বিচারে এই উপন্যাস বর্তমান কর্পোরেট জগতের একটি সার্থক দলিল হিসেবে পরিগণিত হবে, এমন আশা করাই যায়।
বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়
লেখকের জবাবদিহি
বহুদিন আগে প্রণম্য সাহিত্যিক শ্রীযুক্ত তারাপদ রায়ের একটি রম্যরচনা পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। কোনো একটি সংবাদপত্রের সাপ্তাহিকী কলামে প্রকাশিত হয়েছিল সেই নাতিদীর্ঘ সরস লেখাটি। পত্রিকার নাম, দিনক্ষণ কিছুই আর মনে নেই, কিন্তু স্মৃতির কোনো এক গুপ্ত প্রকোষ্ঠে সেই লেখাটি আজও রয়ে গিয়েছে।
সংক্ষেপে নিজের ভাষায় সেই রচনাটি আগে নিবেদন করি।
পার্কে দুই বৃদ্ধ প্রত্যহ প্রাতঃভ্রমণে যান। নিজেদের সুখ দুঃখ ভাগ করে নেন একে অন্যের সঙ্গে। এক বৃদ্ধের দুই মেয়ে, দু—জনেই বিবাহিতা। তিনি একদিন ভারাক্রান্ত মনে প্রাতঃভ্রমণের সঙ্গীটিকে বললেন, ‘মন ভালো নেই, ভায়া। বড়োজামাইটাকে নিয়ে চিন্তা নেই, খুব বড়ো চাকরি করে। মোটা মাইনে। কোম্পানি থেকে গাড়িও পায়। চিন্তা ছোটোজামাইকে নিয়ে। তার তো ব্যবসা। কোনদিন লাটে ওঠে তার ঠিক আছে?’
‘সেই তো!’ দ্বিতীয় বৃদ্ধ সম্মতি জানালেন, ‘ছোটোজামাই কোনো চাকরি পায়নি? আহা গো! ব্যবসার কোনো ভরসা আছে নাকি? আজ রাজা তো কাল ফকির।’
‘তবেই বলো। দিনরাত দুশ্চিন্তায় কাঁটা হয়ে থাকি। কী যে আছে ছোটোমেয়েটার কপালে!’
দ্বিতীয় বৃদ্ধ সমব্যথী সুরে বললেন, ‘তা, আপনার বড়োজামাই কোথায় চাকরি করে?’
প্রথম বৃদ্ধ সেই একইরকম দুঃখ দুঃখ মুখ করে বললেন, ‘ছোটোজামাইয়ের কোম্পানিতে।’
এটা নিছকই একটি রম্যরচনা হলেও বাঙালির ব্যবসাবিমুখতা সর্বজনবিদিত। ব্যবসার ঝুঁকি, নিরন্তর অনিশ্চয়তার চেয়ে সুখী বাঙালি পছন্দ করে ডিগ্রির পর ডিগ্রি নিয়ে বড়ো কোনো চাকরি এবং সুখে—শান্তিতে নিরুপদ্রব ঘরসংসার। সুধীপাঠক যদি এখনই আমার এই কথার প্রতিবাদ করেন, ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে ধরেন শোভারাম বসাক, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে হাল আমলের ‘বেরোলীন’—এর গৌরমোহন দত্ত, ‘শ্রীলেদার্স’—এর সুরেশ চন্দ্র দে কিংবা বন্ধন ব্যাঙ্কের চন্দ্রশেখর ঘোষের কথা, সেক্ষেত্রে আমি সবিনয়ে বলব, ব্যতিক্রম কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রমাণ নয়।
এখনও ক—জন অভিভাবক নিজের সন্তানকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সরকারি আমলা বা অধ্যাপক করতে চান, আর ক—জন নিজের ছেলে বা মেয়েকে নিশ্চিত চাকরির ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে নিজে কিছু করতে, স্বাধীন কোনো উদ্যোগ নিতে উদবুদ্ধ করেন, সেই তুলনা করলেই প্রভেদটা স্পষ্ট হবে। স্পষ্ট হবে বাঙালি সমাজে ‘Entrepreneur’ শব্দটির এখনও আড়ষ্ট অনিয়মিত আনাগোনা দেখেও।
‘দাশগুপ্ত ট্রাভেলস’ উপন্যাসে আমি মূলত এই প্রশ্নেরই অন্বেষণ করেছি। শুধু তাই নয়, তুলে ধরতে চেয়েছি এই প্রজন্মের অন্যতম কর্মক্ষেত্র ‘আই টি সেক্টর’—এর অন্দরমহলকে। আলোয় আনতে চেয়েছি নব্যপ্রজন্মের যুবক যুবতীদের জীবন, ভালো লাগা, স্বপ্ন, হতাশাকে। ঘটনাচক্রে আমি নিজে বেশ কিছুদিন আই টি দুনিয়ায় কাজ করেছি, সেখানকার কর্পোরেট আবহাওয়া সম্পর্কে আমার ধারণা আছে। আর নিজে এখনও তিনের কোঠায় উপনীত হইনি, ফলে এই কাজের জন্য আমি খুব একটা ‘বুড়ো’ নই বলেই আমার বিশ্বাস।
এ ছাড়া দাশগুপ্ত ট্রাভেলসে রয়েছে এক উড়ানের গল্প। নানান চরিত্রের ভিড়ে ও নানান দেশের মাঝে মূর্ত হয়ে উঠেছে ‘জিনিয়া’ নামের লড়াকু মেয়েটি, যে কোনো কিছুর বিনিময়েই নিজের স্বপ্নপূরণের সঙ্গে আপোশ করেনি। তার চলার পথে এসেছে প্রতিকূলতা, বার বার সে হোঁচট খেয়েছে ব্যক্তিগত জীবনে, কর্মজীবনে। তবু ফিনিক্স পাখির মতোই বার বার ফিরে এসেছে সে, নতুনভাবে শুরু করেছে সংগ্রাম। সেই সংগ্রাম কোনো নারী হিসেবে নয়, সেই সংগ্রাম লিঙ্গ নির্বিশেষে মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে।
এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র অনেকে। জিনিয়া, অতন্দ্র, আলোকপর্ণা, যাদবচন্দ্র, অম্বিকেশ, আরও অনেকে। একেকটি চরিত্র একেকরকম সামাজিক স্তর থেকে হলেও, একেকরকম প্রজন্ম থেকে হলেও কোথাও একটা অদৃশ্য সুতো দিয়ে তাদের বাঁধার চেষ্টা করেছি আমি। বলার চেষ্টা করেছি, দিনের শেষে সবাই কোনো—না—কোনো লড়াই করে।
সফল হয়েছি কতটা, তা বলবেন পাঠক।
পরিশেষে বলি, পিকলুদা ও আলোকপর্ণার নিজেদের মধ্যে কথোপকথনের চারটি দ্বিপংক্তি কবিতার রচয়িত্রী আমি নই, আমার আত্মীয়া ও বন্ধু পিউ ভট্টাচার্য মুখার্জী। তার মতো করে কবিতায় রোমান্স ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা আমার নেই, তাই তার সাহায্য এই উপন্যাসকে সমৃদ্ধ করেছে।
গৌরচন্দ্রিকা আর দীর্ঘায়িত করে পাঠকের বিরাগভাজন হব না, উপন্যাস পাঠান্তে প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় রইলাম।
দেবারতি মুখোপাধ্যায়
পাগল যে তুই, কণ্ঠ ভরে
জানিয়ে দে তাই সাহস করে।।
দেয় যদি তোর দুয়ার নাড়া
থাকিস কোণে, দিস নে সাড়া —
বলুক সবাই ‘সৃষ্টিছাড়া’, বলুক সবাই, ‘কী কাজ তোরে’।।
.
ট্রাফিক সিগনালে নিজের খেয়ালে বেজে চলেছে রবীন্দ্রসংগীত। সুচিত্রা মিত্রর অপরূপ কণ্ঠ নিখুঁত সুরের মূর্ছনায় চারপাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে সংগীতপ্রবাহ। সেই সুরলহরীতে অতিব্যস্ত পথচারীও মুহূর্তের জন্য মজে যাচ্ছে।
গ্রীষ্মের সকাল। ব্যস্ত কলকাতা শহর। শিয়ালদা স্টেশন থেকে বেরিয়ে কিছুটা এগোলেই ফ্লাইওভার।
সেই ফ্লাইওভারে ওঠার মুখে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল ট্যাক্সিটা। বেশ অনেকক্ষণ ধরে। সাধারণত এমন জায়গায় দাঁড়ালে ট্রাফিকে ডিউটিরত সিভিক ভলান্টিয়াররা ছুটে আসে। কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে আজ তাদের দৃষ্টি এই গাড়ির ওপর পড়েনি।
ট্যাক্সিটার একটা বৈশিষ্ট্য আছে। কেউ সময় নিয়ে তাকালে চোখে পড়বে। কলকাতার চিরাচরিত ট্যাক্সির মতো এরও হলুদ গায়ের ওপর গাঢ় নীল রঙের বর্ডার। কিন্তু সেই নীল রঙের সরলরৈখিক বর্ডারের সঙ্গে সমান্তরালে আঁকা হয়েছে সূক্ষ্ম নকশা। অনেকটা আলপনার মতো। সেই আলপনা নীল বর্ডারের সঙ্গে পথ চলে আষ্টেপৃষ্ঠে মুড়ে ফেলেছে গোটা গাড়িটাকে। তাই দূর থেকে দেখলে গাড়িটাকে একটু অন্যরকম লাগে।
ফ্লাইওভারে ওঠার আগে যে স্টপেজ, তাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে অন্তত চল্লিশজন মানুষ। প্রত্যেকেই অপেক্ষা করছে বাসের জন্য। নানা রুটের ভিড়ে ঠাসা বাস আসছে মিনিটে দশটা করে। এসে স্টপেজে দাঁড়ানোমাত্র ধানের জমির পঙ্গপালের মতো লোকজন ঝাঁপিয়ে পড়ছে সেটার ওপর। কয়েক সেকেন্ডের ঠেলাঠেলি, কনডাক্টরের চিৎকার, মানুষের অসহিষ্ণুতা, তারপরই বাস ছেড়ে দিচ্ছে, উঠে যাচ্ছে ফ্লাইওভারের ওপর। ভেতরে চিঁড়েচ্যাপটা হওয়া মানুষকে সাময়িক স্বস্তি দিয়ে হু হু করে ছুটছে।
রোজকার অফিস টাইমের চিরাচরিত দৃশ্য।
ট্যাক্সিটা স্টপেজ থেকে সামান্য এগিয়ে এমনভাবে দাঁড়িয়ে ছিল, যেন তার যাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। দেখলেই মানুষ চোখ ফিরিয়ে নেবে এই ভেবে, যে, নির্ঘাত গাড়িটা বিগড়েছে। অথবা ড্রাইভার বেপাত্তা।
নাহলে এই জায়গায় কোনো ফাঁকা ট্যাক্সি দেখলেই লোকজন হামলে পড়ে। কিন্তু এই ট্যাক্সিটা দাঁড়িয়ে আছে দেখেও অপেক্ষারত কোনো মানুষ এদিকে ভ্রূক্ষেপ করছিল না।
তাই স্টেশন থেকে সোজা বেরিয়ে আসা লম্বা রোগাটে গড়নের মেয়েটা যখন ট্যাক্সিচালকের সঙ্গে জানলা দিয়ে কয়েক সেকেন্ড কথা বলেই গাড়িতে ওঠার তোড়জোড় করতে লাগল, অনেকেই বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকাল এদিকে।
ভাবখানা এমন, ‘কি আশ্চর্য! আমরা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি, আর এ কোত্থেকে নাকের ডগা দিয়ে …!’
গরমকাল হলেও একটু আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টির ছাঁটে চওড়া রাস্তার অনেকদূর পর্যন্ত ঝকঝকে দেখাচ্ছে। কর্পোরেশন থেকে লাগানো দু-পাশের গাছগুলো একটু বেশিই সবুজ সতেজ হয়ে উঠেছে। ভিজে চুপচুপে বাস, অটো, রিকশাগুলো নিজেদের গতিতে ভিড়ভাট্টা সামলে চলছে ঠিকই, কিন্তু সবের মধ্যেই একটা খুশীর মেজাজ। এই প্যাচপেচে গরমে হঠাৎ বৃষ্টি, সবার মনে পুলক জাগানোই স্বাভাবিক। দু-একদিনের জন্য হলেও অসহনীয় গরম ভাবটা একটু কমবে।
মেয়েটা তড়িঘড়ি করে হাতের লম্বা লম্বা ফ্লেক্স ব্যানারের স্টিকগুলো একটার পর একটা ট্যাক্সির মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে সেগুলোকে এমন মমতার সঙ্গে ট্যাক্সির সিটে শোয়াতে লাগল, মনে হতে লাগল সে যেন কোনো শিশুকে সাবধানে ঘুম পাড়াচ্ছে।
তারপর কাঁধে ঝুলতে থাকা চামড়ার ভারী ব্যাগটা সামনে টেনে নিয়ে ধপ করে ট্যাক্সির এক কোণে বসে পড়ে বন্ধ জানলার কাচটা খুলে দিল।
ট্যাক্সি ড্রাইভার পাপ্পু সিং একবার অভ্যেসমতো একবার লুকিং গ্লাস দিয়ে প্যাসেঞ্জারকে দেখে নিল। প্যাসেঞ্জারকে একবার মেপে নেওয়াটা তার ডিউটির মধ্যে পড়ে। নাহলে পরে কখন কোথায় দরকার পড়বে, কেউ কি বলতে পারে?
এই তো, বছর দেড়েক আগেই ওর ট্যাক্সি চড়ে একটা ক্রিমিনাল শিয়ালদা স্টেশন এসেছিল। লোকটা নাকি কত কেজি রুপো নিয়ে পালাচ্ছিল। পুলিশ যখন এসে ওকে জিজ্ঞেস করল, ও এমন গড়গড়িয়ে লোকটার বর্ণনা দিয়েছিল, যে ওসিসায়েব অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। দু-বার পিঠও চাপড়ে দিয়েছিলেন খুশি হয়ে।
সেটা ওর তীক্ষ্ন পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার জন্যই তো। আর সেই ক্ষমতাটুকু না নিয়ে জন্মালে ওর লুকনো স্বপ্নটাও কখনো পূরণ হত না যে!
ওর এখনকার প্যাসেঞ্জার হলুদ রঙের কুর্তি আর সমুদ্রনীল জিনস পরা একটা মেয়ে। গায়ের রং শ্যামলা, চুলটা চুড়ো করে মাথার পেছনদিকে পনিটেল করা, সেটা দুলছে পিঠের নীচ পর্যন্ত। মাথার ওপরে এঁটে রাখা সানগ্লাস। চোখে মেঘলা দিনের আকাশের মতো ধোঁয়া ধোঁয়া কাজল টানা। ঠোঁটে কী একটা লাগিয়েছে, কোনো রং নেই, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন ভেজা।
মেয়েটার হাতে অনেক জিনিস, কলেজে কোনো সেমিনার-টেমিনার আছে বোধ হয়।
কিন্তু এ কি অল্পবয়সি কোনো মেয়ে না মহিলা? বুঝতে গিয়ে পাপ্পু সিং বেশ ধন্দে পড়ে গেল। এমনই ধন্দে পড়ল যে, অন্যমনস্কভাবে সে অকারণে দু-বার স্টিয়ারিং-এ হর্নের জায়গাটা চেপে ফেলল।
এই এখন এক ঝামেলা। পনেরো-কুড়ি বছর আগেও যখন সদ্য গাঁও থেকে কলকাতা শহরে এসেছিল ট্যাক্সি চালাতে, মেয়ে আর মহিলার ফারাক করা ছিল অনেক সোজা। ওর এই লাইনের গুরু যশপাল ভাই ওর এক কাঁধে হাত রেখে অন্য হাতে আলগা করে স্টিয়ারিং ধরে গাড়ি চালাতে চালাতে বলেছিল, ‘শোন পাপ্পু, জামা-প্যান্ট, ফ্রক, স্কার্ট এইসব পরা দেখলে জানবি লেড়কি, আর শাড়ি কিংবা সালোয়ার কামিজ-দোপাট্টা পরে আছে মানেই জেনানা। বাঙালি ঔরত হলে দেখবি হাতে লাল সাদা চুড়ি থাকবে, মাথায় লাল সিঁদুর থাকবে। আর হ্যাঁ, ইশকুলের ইউনিফর্ম শাড়ি পরা হলেও জানবি সেটা লেড়কিই। বুঝলি তো?’
পাপ্পু গুরুর সেই জ্ঞান কাজে লাগিয়ে অনেকদিন অবধি গাড়ি চালিয়েছে। পরনের পোশাক দেখে সে কখনো ম্যাডামজি, কখনো দিদিমণি, আবার কখনো বেটি সম্বোধন করেছে।
কিন্তু গণ্ডগোলটা হল, কিছু বছর ধরে সব জেনানাই লেড়কি হয়ে গেছে। শাড়ি আর কেউ পরেই না বলতে গেলে। আর জামা-প্যান্ট পরলে সব মেয়ের বয়স যেন একলাফে কমে যায়। যাকে শাড়ি পরলে মাইজি বলার কথা মনে আসে, সে-ই যখন জামা পরে গাড়িতে ওঠে, মনে হয় বুঝি কোন কমবয়সি ঔরত। একবার এমন বয়স্ক এক জেনানাকে বেচাল সম্বোধন করে বেশ বিপদে পড়েছিল সে।
না, মেয়েদের জামাকাপড় নিয়ে পাপ্পু সিং-এর কোনো সমস্যা নেই। যে যা ইচ্ছে পরুক। কিন্তু ট্যাক্সিচালক হিসেবে এ এক বিপদ বটে। ওইজন্য তাকে এখন মুখের ভাঁজ, চোখের কোণ, চোখের দৃষ্টির পরিপক্বতা দেখে বয়স আন্দাজ করতে হয়। সেটা যথেষ্ট কঠিন কাজ।
এই যেমন, এই মেয়েটাকে দেখে সে কিছুই বুঝতে পারছে না। তেইশ-ও হতে পারে, আবার ত্রিশও।
মেয়েটা পেছনে বসে কাকে ফোন করতে করতে একবার আলগোছে সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চলুন দাদা, নেতাজি ইনডোর যাব। একটু তাড়া আছে।’
কথাটা শেষ করে সে আবার ফোনের দিকে মন দিল, ‘হ্যালো, আরে আজ অনলাইন ক্যাবগুলোর কিছু সমস্যা চলছে, গাড়ি দেখাচ্ছে একগাদা, কিন্তু কিছুতেই বুক করা যাচ্ছে না। ট্রেনটাও খুব ঝোলাল। এদিকে অনেক দেরি হয়ে গেছে। … হ্যাঁ, বিকাশ পৌঁছে গেছে। কিন্তু ওর কাছে তো এগজিবিটর’স আই কার্ড নেই, ওকে ঢুকতে দিচ্ছে না … অ্যাঁ? হ্যাঁ হ্যাঁ, সব আমার কাছেই রয়েছে, ঠিক করেই গুছিয়ে নিয়েছি। তুমি কখন আসছ বলো তো?’
পাপ্পু সিং নির্বিকার মুখে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে স্টিয়ারিং-এর একটু ওপরদিকে লটকে থাকা গণেশটার পেটটা আলতো করে টিপে দিল। লুকিং গ্লাসে দেখল মেয়েটা মুখ বাড়িয়ে জানলা দিয়ে বাইরের ভেজা কলকাতা দেখছে। কপালে বিন্দু বিন্দু যে ঘাম জমেছিল, সেগুলো ঠান্ডা হাওয়ায় ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। আর গালের দু-পাশের কুচো চুলগুলো হাওয়ায় উড়ছে পতপত করে।
পাপ্পু রাস্তায় সতর্ক দৃষ্টি রেখে ধীরে ধীরে মনের মধ্যে ছবি তুলে নিতে লাগল মেয়েটার। নেতাজি ইনডোর শিয়ালদা স্টেশন থেকে মিনিট পনেরোর রাস্তা। তবে জ্যামে, ট্রাফিক সিগনালে সেটা আধ ঘণ্টায় গিয়ে পৌঁছোবে।
ততক্ষণে পাপ্পু মনের মধ্যে মেয়েটার পুরো চেহারাটাই তুলে নিতে পারবে। এ তার বহু বছরের অভ্যেস।
এইভাবে সারাদিন কয়েকটা পছন্দের ছবি জড়ো করে রাতের অন্ধকারে বাড়ি ফিরবে সে। তারপর সারারাত জেগে তাদেরকে ফুটিয়ে তুলবে আঁকার ক্যানভাসে। যেগুলো ভালো লাগবে সেগুলো রেখে দেবে যত্ন করে, আর যেগুলো মনে হবে আসল মানুষটাকে ঠিকমতো ছোঁয়াই যায়নি, কুচিয়ে ফেলে দেবে। আবার আঁকবে।
তারপর সেই ছবি ও আপলোড করবে সোশ্যাল মিডিয়ায়, নিজের পেজে।
ও সেই পেজের নাম দিয়েছে ‘চিত্রকর’।
নিজের কোনো ছবি নেই, তথ্য নেই, ওর পেজে ব্যক্তিগত কিছুই নেই। আছে শুধু অচেনা সারি সারি মানুষের পোর্ট্রেইট। ওর হয়ে সেখানে শুধুই কথা বলে ওর আঁকা ছবিগুলো। সেগুলো মানুষের বিস্ময়সূচক প্রতিক্রিয়া পায়, উচ্ছ্বাস পায়। পাপ্পু সিং বাড়ি ফিরে ক্লান্ত দেহে দেশ-বিদেশের নানাপ্রান্ত থেকে সেই সব প্রতিক্রিয়া পড়ে উদবুদ্ধ হয়।
ওর পেজের জনপ্রিয়তা বেড়েই চলে।
শুধু ছবি আঁকার নৈপুণ্যের জন্য নয়, ডিজিটাল পেইন্টিং-এর যুগে ওর সূক্ষ্ম ডিটেইলিং নাকি বেশি করে মুগ্ধ করে মানুষকে। অনেকেই কমেন্ট করে, ‘যেভাবে গলার ভাঁজটা ফুটিয়ে তুলেছেন, যেভাবে অস্পষ্ট মেঘের মতো এঁকেছেন জড়ুলটা, অনবদ্য! আপনি কে মশাই? মেঘের আড়াল থেকে এমন একেকটা বোম ফেলছেন!’
অথচ ও কোনোদিনও আঁকা শেখেনি। তবু তিল, জড়ুল, কাটা দাগ এসব আঁকার সময় মনে ছাপ রেখে যাওয়া স্মৃতি থেকে নিখুঁতভাবে তুলে আনতে পারে পাপ্পু। ভুলে গেলেও সমস্যা নেই, বছর তিনেক হল তার গাড়িতে ঝোলা গণেশের পেটের মধ্যে ছোট্ট ক্যামেরা আছে। গণেশের পেট টেপা মাত্র যেটা নীরবে ছবি তুলে নেয় পেছনে বসা মানুষটার।
তবে, খুব দরকার না পড়লে সেই ছবি দেখে আঁকতে বসে না পাপ্পু। যেদিন একান্তই ছবি দেখতে হয়, সেদিন তার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। মনে হয় তার মনের ক্যামেরাটা বুঝি আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
ব্যস্ত এই কলকাতা শহর, কত মানুষ কত স্বপ্ন নিয়ে রোজ কাজে বেরোয়, হাঁটাচলা করে। ট্যাক্সিওয়ালা পাপ্পু সিংও সারাদিন কাজ করে ফিরে তার বউবাজারের ঘরে শুয়ে স্বপ্ন দেখে। সেই স্বপ্ন লটারির টিকিট কেটে লাখপতি হওয়ার নয়, আরও দু-তিনটে ট্যাক্সি কেনারও নয়।
সে যখন অথর্ব হয়ে যাবে, বয়সের ভারে কাজে বেরনো দূর, হাঁটতে চলতেও পারবে না, তখন পুরোনো টেপ রেকর্ডারের মতো ওর ভার্চুয়াল পেজে ও দেখবে ওর জীবনের সেইসব মানুষদের ছবি। যাদের সে নানা প্রয়োজনে নানা সময়ে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছে।
দেখে দেখে তৃপ্তিতে ভরে উঠবে তার মন।
মাঝে মাঝে নিজেই ভেবে অবাক হয়ে যায় যে, খাকি জামাপ্যান্ট পরে সে যখন ঘেমো গায়ে ট্যাক্সি চালায়, পেছনে বসা কোনো যাত্রী কি জানতে পারে যে একজন চিত্রশিল্পী তাকে নিয়ে চলেছে? দৈবাৎ যদি জেনেও যায়, তখন কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে তার?
‘দাদা, একটু তাড়াতাড়ি চলুন প্লিজ!’ মেয়েটা পেছন থেকে তাড়া দিতেই পাপ্পু সিং বাস্তবে ফিরে এল।
মেয়েটা বলে চলেছে, ‘আর দেরি করলে আমি ঢুকতেই পারব না। একেই ট্রেনটা লেট করেছে অনেক।’
পাপ্পু সিং অ্যাক্সিলারেটরে চাপ দিয়ে গতি বাড়াল, তারপর দাঁত বের করে বলল, ‘কলেজের সেমিনার বুঝি আজ ইনডোরে দিদিমণি?’
মেয়েটা একটু থমকে লুকিং গ্লাস দিয়ে পাপ্পু সিং-এর দিকে তাকিয়ে হাসল, ‘কলেজ? না না, আমি কলেজে পড়ি না। ইনডোরে মেলা চলছে তো, সেখানে যাচ্ছি।’
হাসলে মেয়েটার বাঁ-গাল থেকে একটা গজদাঁত বেরিয়ে পড়ে, আর তাতে মেয়েটার মুখটাই পালটে যায়, লক্ষ করল পাপ্পু সিং। দাঁতটা না বেরোলে মনে হয় গম্ভীর, কিন্তু দেখা গেলে বয়সটা আরও কম লাগে। তখন মেয়েটাকে স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছাত্রী মনে হয়।
দ্রুত ঝুলন্ত গণেশের পেটটা আরেকবার টিপে দিল পাপ্পু সিং। দাঁতের শেপটা এত দূর থেকে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না, আঁকার সময় অসুবিধা হতে পারে। ও বলল, ‘কীসের মেলা?’
মেয়েটা বলল, ‘পর্যটন মেলা চলছে তো। আমি ওখানে স্টল দিয়েছি।’ পরক্ষণে পাপ্পুর মুখ দেখে সে বোধ হয় বুঝল যে কথাটা এই ট্যাক্সিওয়ালার ঠিক বোধগম্য হয়নি, আরও ভালো করে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল, ‘ট্রাভেল এজেন্সি জানেন তো? লোকজনকে ঘোরাতে নিয়ে যায়? সেইসব ট্রাভেল এজেন্সিরা এখানে স্টল দেয়। মানুষ আসে, ওখানেই প্যাকেজ বুক করে, কিংবা টুর সম্পর্কে জানে।’
‘আচ্ছা!’ পাপ্পু সিং মাথা নাড়ল। সে শিল্পমেলা, বইমেলা, খাদ্যমেলা শুনেছে, এতদিন অনেক কাস্টমারকে সেসব জায়গায় পৌঁছেও দিয়েছে। কখনো নেতাজি ইনডোর, কখনো সায়েন্স সিটির উলটো দিকের মিলনমেলা প্রাঙ্গণে, কিন্তু ঘুরতে যাওয়ারও কোনো মেলা হয় সেটা ওর জানা ছিল না।
মেয়েটার মুখের হাসিটা এবার আরেকটু চওড়া হল। বেশ গর্বিতমুখে সে বলল, ‘আমি নতুন ট্রাভেল এজেন্সি খুলেছি। সেই ব্যাপারেই স্টল দিয়েছি ওখানে। আজ প্রথম দিন তো, দেরি হয়ে গেলে মুশকিল হবে।’
পাপ্পু অ্যাক্সিলারেটরে আর চাপ দেয়। মেয়েটা এই বয়সেই একটা টুর কোম্পানি খুলে ফেলেছে? বাহ! আচমকাই তার মুখে দিদিমণিটা এবার ম্যাডামজি হয়ে যায়, ‘আপনি ওই টুর কোম্পানির মালিক আছেন, ম্যাডামজি?’
‘হ্যাঁ।’ মেয়েটা একটু থেমে বলল, ‘আমি একাই নই, আমার হাজব্যান্ডও আছে।’
পাপ্পু সিং বলল, ‘ক-জন কাম করেন আপনাদের কোম্পানিতে, ম্যাডামজি?’
মেয়েটা এবার বোধ হয় একটু লজ্জা পেল, দু-দিকে মাথা নেড়ে বলল, ‘আপাতত আমি, আমার হাজব্যান্ড আর আমার মামা। এ ছাড়া আরেকজনকে মেলার কয়েকদিনের জন্য নিয়েছি। সবে নতুন কোম্পানি তো, এখন প্রোমোট করছি। আমার হাজব্যান্ড আগে দুটো মেলা কভার করে এসেছে। এই মেলাটা আমি করছি। মেলাটা শেষ হওয়ার পর থেকে টুর শুরু করব। তখন আরও লোক লাগবে। আসলে আমি চাকরি করি অন্য জায়গায়। এই মাসটা করে চাকরি ছেড়ে দেব। তারপরেই ঠিকমতো শুরু হবে।’
‘কোথায় অফিস আপনার কোম্পানির?’ পাপ্পু সিং জানতে চায়।
মেয়েটা বলল, ‘অফিস বলতে এখনও তেমন বড়ো কিছু নয়, সল্টলেকের একটা ফ্ল্যাটের গ্যারাজে শনি-রবিবার বসি এখন। খুব শিগগিরই ঠিকঠাক একটা অফিসঘর ভাড়া নেওয়ার ইচ্ছে আছে পার্ক স্ট্রিটের দিকে।’
‘পার্ক স্ট্রিটেই কেন নেবেন? ওখানে তো বহত ভাড়া আছে!’
‘কি করব।’ মেয়েটা বলল, ‘ওদিকেই তো সব টুর কোম্পানিগুলোর হেড অফিস। ওইখানে থাকলে আমাদের ক্রাউড পুল করতে সুবিধা হবে।’
নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামের একটু দূরে গাড়িটা থামিয়ে পাপ্পু ব্রেক কষল, ‘আর যেতে দেবে না, ম্যাডামজি। মেলার ভলান্টিয়াররা আটকে দিচ্ছে ওই দেখুন। আপনাকে এখান থেকে হেঁটে যেতে হবে।’
‘না না ঠিক আছে। আমি এখানেই নেমে যাচ্ছি।’ মেয়েটা তড়িঘড়ি পার্স খুলল, মিটার দেখে ভাড়াটা মিটিয়ে দিয়ে একটু হেসে বলল, ‘আপনি ঘুরতে যান?’
পাপ্পু সিং পেছন ফিরে হাসল, ‘হামি কলকাতায় আনোখা আদমি আছি ম্যাডামজি, এখন আর তেমন কোথাও যাই না। বছরে দু-বার বিহারে হামার গাঁও যাই। তবে আগে বহত ঘুরতাম। বেনারস, লখনৌ, দিল্লি, আগ্রা। এদিকে পুরী, ভাইজাগ গিয়েছি।’
‘বাহ!’ মেয়েটার মুখটা আবার আলোয় ঝলমল করে উঠল, পাপ্পু সিং আবার মেয়েটার গজদাঁতটা দেখতে পেল। মেয়েটা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘যদিও আমরা এখনও সব টুর শুরু করিনি। তবু …’ সে পার্স খুলে একটা কার্ড এগিয়ে দিল, ‘এই আমাদের কার্ড। কখনো কোথাও যেতে মন চাইলে ফোন করবেন। যতটা সম্ভব কম খরচে কোয়ালিটি মেইন্টেইন করাটাই আমার লক্ষ্য। আর লক্ষ্য কাস্টমারকে ভালো লাগানো। এইজন্যই ভালো চাকরি ছেড়ে এই ব্যবসায় ঝাঁপ দিতে চলেছি। ভরসা করে দেখবেন, ঠকবেন না। চলি।’
মেয়েটা গাড়ি থেকে নেমেই দ্রুতপায়ে ছুটতে থাকে মেলার প্রবেশপথের দিকে। পিঠের নীচ পর্যন্ত নেমে আসা চুলটা দুলতে থাকে চলার ছন্দে, হাওয়ায়।
পাপ্পু সিং চোখ ফিরিয়ে নিয়ে গাড়ি ঘোরাতে থাকে। আজ বাড়ি গিয়ে একটা নিখুঁত পোর্টেইট আঁকতে পারবে ভেবে ওর মনটা খুশিতে ভরে ওঠে। আজকের মতো খিদে মিটে গেছে।
এবার ও চুপচাপ কোথাও গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। যে ক-টা ট্রিপ হয়, হবে। একা মানুষ, বেশি কামিয়ে হবে টা কী!
চকিতে হাতে-ধরা কার্ডটার দিকে চোখ ফেরায় ও।
একটা টুর কোম্পানির কার্ড। একপাশে লোগো, অন্যপাশে দেশ-বিদেশের নানা দ্রষ্টব্য স্থানের ছবি, কোম্পানির ফোন নম্বর, ঠিকানা।
ডান পাশে নীচের দিকে ছোটো হরফে লেখা :
জিনিয়া দাশগুপ্ত
প্রোপ্রাইটর
দাশগুপ্ত ট্রাভেলস
১
কলকাতা শহরের উপকণ্ঠের এক অঞ্চল। বছর দশেক হল এখানে গড়ে উঠেছে বিদেশি আই টি বহুজাতিক সংস্থা টেকি ওয়ার্ল্ডের চোখধাঁধানো ক্যাম্পাস। পনেরো বছর আগেও এই জায়গাগুলো ছিল শুধু জলা। বিচ্ছিন্নভাবে মাঝে মাঝে জমে উঠেছিল আবর্জনা ফেলার ঢিবি। জলা জায়গার ধারে ধারে ছিল কিছু গরীব মানুষের বাস। আর দৌরাত্ম্য ছিল অসামাজিক ক্রিয়াকলাপের। দু-একবার ত্রাসজাগানো অপরাধের জন্য খবরের শিরোনামেও এসেছে এই অঞ্চল।
মূল শহর থেকে এই এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা এতই অপ্রতুল ছিল ও দূরত্বও এতটাই বেশি ছিল যে বহুদিন পর্যন্ত কোনো শিল্পপতির এদিকে চোখ পড়েনি।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গোটা কলকাতা শহর নাগরিক সভ্যতার গ্রাসে অতিসম্পৃক্ত হয়ে যাওয়ার পর অজগরের সেই খিদে গ্রাস করতে শুরু করল মহানগরের আশপাশের শহরতলিকেও। উল্কার গতিতে জঙ্গল কেটে সাফ হতে শুরু করল, হাজার হাজার গাছ কেটে বানানো হতে লাগল উড়ালপুল। সবুজের বুক চিরে মাথা উঁচু করতে লাগল ইট সিমেন্টের কংক্রিট। খেলার মাঠ, পুকুর, ডোবা বুজে গিয়ে উঠতে লাগল আবাসন।
জনসংখ্যা বাড়তে লাগল, একান্নবর্তী পরিবার ভাঙতে লাগল, মানুষ আরও বেশি করে শুধু নিজেরটুকু বুঝতে শুরু করল, আর তার সঙ্গে খুঁজতে শুরু করল শুধু নিজের জন্য একফালি ঘর। ফলে বাড়ি গুঁড়িয়ে গজিয়ে উঠতে লাগল সারি সারি ফ্ল্যাট, আবাসন। যৌথ সংসারের উঠোন, দালান, আলোবাতাস খেলা বারান্দা ছেড়ে এসে মানুষ ঘাড় গুঁজতে শুরু করল ফ্ল্যাটগুলোতে। প্রথমে খাস শহর, তারপর সাধ্যের অতীত হয়ে গেলে সন্ধান শুরু হল শহরতলিগুলোয়। ক্রমে শহরতলিগুলোও ভরতি হয়ে গেল, মানুষ তখন ঝুঁকল আরো দূরের ফাঁকা অঞ্চলের দিকে।
এভাবেই কলকাতা শহর বাড়তে লাগল উত্তরে, দক্ষিণে, পূর্বে, পশ্চিমে।
আগে কলকাতায় অফিসপাড়া বলতেই চোখের সামনে ভেসে উঠত ডালহৌসি চত্বর, বিবাদি বাগ কিংবা স্ট্র্যান্ড রোডের ব্যস্ত রাজপথ। সাবেক আমলের বিলিতি মার্কেন্টাইল কোম্পানি, গুজরাটি সাপ্লাইয়ের অফিস থেকে শুরু করে রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাঙ্ক কিংবা ইন্সিয়োরেন্স অফিসগুলোর সদর দপ্তর, সিংহভাগ অফিস ছিল ডালহৌসিতেই। কেউ সকাল ন-টা সাড়ে ন-টায় ভিড়ে ঠাসা বাসে করে হাওড়া বা শিয়ালদা থেকে, কেউ স্টিমারে করে গঙ্গা পেরিয়ে, কেউ আবার পাতালরেলে আসত অফিস। দুপুর বেলা টিফিনের সময় রাস্তার দু-পাশ ছেয়ে যেত হরেক রকমের খাবারে, চাইনিজ থেকে মোগলাই, বাঙালি থেকে বিলিতি সব ধরনের খাবার মিলত সেখানে।
সেইসব খাবার আজও মেলে। লোকে আজও ডালহৌসিতে একইভাবে অফিসে যায়।
কিন্তু গত কুড়ি পঁচিশ বছরে এর সমান্তরালে আর এক কর্মক্ষেত্র গজিয়ে উঠেছে কলকাতায়। তথ্যপ্রযুক্তি সেক্টর। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের গরিষ্ঠভাগেরই কাজের জায়গা এখন আই টি।
আর সেই আই টি সেক্টরের কেন্দ্রবিন্দু সল্টলেকের সেক্টর ফাইভ কিংবা রাজারহাট নিউটাউনও এখন কলকাতার অফিসপাড়ার মধ্যেই পড়ে। ছোটো বড়ো পাঁচশোরও বেশি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা শেষ দুই দশকে পথ চলা শুরু করেছে ওই চত্বরে।
কিন্তু বিদেশি সংস্থা টেকি ওয়ার্ল্ডের এই বিশাল ক্যাম্পাস সল্টলেক বা রাজারহাট থেকে অনেকটাই দূরে।
টেকি ওয়ার্ল্ডের সিনিয়র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার অতন্দ্র প্রধান প্রবেশপথের বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেটে টান দিচ্ছিল। আঙুলের ফাঁকে ধরে থাকা পুড়তে পুড়তে ছোটো হয়ে আসা সিগারেটটা ছ্যাঁকা দিতেই ও চমকে উঠে সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিল গেটের বাইরের রাস্তায়।
তারপর পকেট থেকে আই কার্ডটা বের করে গলায় ঝুলিয়ে ঢুকল অফিসে।
ঘড়িতে সবে সকাল সাড়ে আটটা। ওর আট বছরের চাকরিজীবনে এর আগে কবে এত সকাল সকাল অফিস ঢুকেছে ও মনে করতে পারল না। এটা নয় যে এর আগে ও কখনো দুর্গাপুরের বাড়ি থেকে সরাসরি অফিস আসেনি। এসেছে। অনেকবারই এসেছে।
কিন্তু ভোর সাড়ে চারটেয় কোনোদিনও বাড়ি থেকে বেরোয়নি।
আই ডি পাঞ্চ করে ঢুকে বাগান পেরিয়ে মেইন লবিতে ঢোকার আগে অতন্দ্র একটা লম্বা দম নিল মুহূর্তের জন্য, তারপর ঋজু পায়ে লিফটের দিকে এগিয়ে গেল।
দিনের অন্যান্য সময় এই দুটো লিফটে ওঠার এতই ভিড় থাকে, অন্তত মিনিট দুয়েক দাঁড়াতেই হয়। কিন্তু এখন একদম ফাঁকা। এখনও কেউ এসে পৌঁছোয়নি।
অতন্দ্র লিফটের ভেতরে ঢুকে ‘তিন’ টিপতেই স্বয়ংক্রিয় এলিভেটরের দরজা বন্ধ হয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল।
অতন্দ্রর হাঁটার মধ্যে একটা বৈশিষ্ট্য আছে। কেউ যদি খুঁটিয়ে দেখে তবে বুঝতে পারবে, তার চলার প্রতিটি পদক্ষেপে প্রচ্ছন্নভাবে লুকিয়ে থাকে আত্মবিশ্বাস। ‘আমিই ঠিক’ জাতীয় হঠকারী অহমিকা বোধ নয়, তার চোখের দৃষ্টি, মুখের পরিমিত হাসি, গালের হালকা দাড়ি সবসময় বুঝিয়ে দেয় তার স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বকে। যে ধরনের ব্যক্তিত্ব এই কর্পোরেট জগতে বেশ বিরল। মাখন লাগানোর এই দুনিয়ায় এই ব্যক্তিত্ব দেখতে অনভ্যস্ত অনেকেই তাই তার এই দৃঢ়তাকে ঔদ্ধত্য ভেবে ভুল করে।
সংগত কারণেই সকলের মধ্যে আলাদা হওয়ার মাশুলও তাই ওকে মাঝেমধ্যেই দিতে হয়।
লিফট থেকে নেমে অতন্দ্র দেখল গোটা করিডরটাই ফাঁকা। আসলে রাতজাগা ঘুমে ক্লান্ত ওদের কোম্পানি এখন আবার নতুন উদ্যমে সবে জেগে উঠছে সকাল বেলা। নাইট শিফটের ছেলেমেয়েরা ঘণ্টাখানেক হল বেরিয়ে গেছে। অতন্দ্র গোটা দেওয়াল জোড়া কাচের জানলা দিয়ে নীচে দেখতে পেল, বাগান পরিচর্যার দায়িত্বে থাকা মালিরা হোসপাইপ দিয়ে ফুলগাছগুলোতে জল দিচ্ছে। সেক্টর ফাইভের চেয়ে এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা একটু হলেও অসুবিধাজনক বলে টেকি ওয়ার্ল্ডে ডে শিফটের দিন একটু দেরিতেই শুরু হয়।
টেকি ওয়ার্ল্ড প্রথমে সেক্টর ফাইভেই অফিস খুলেছিল, তারপর ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠতে নিজেদের জমি কিনে শহর থেকে বেশ দূরে এখানে তৈরি করেছে বিশাল আই টি পার্ক। রোজ অন্তত সাত থেকে আট হাজার কর্মী কলকাতা কিংবা কলকাতা সংলগ্ন মফস্সল উজিয়ে আসে এখানে কাজ করতে, দিনের শেষে ক্লান্ত ঘর্মাক্ত দেহে ফিরে যায় বাড়ি। যাদের বাড়ি আরো দূর, তারা থাকে আশপাশে গজিয়ে ওঠা মেসে কিংবা পেয়িং গেস্ট হয়ে।
অতন্দ্রর নিজের বাড়ি দুর্গাপুর, বিয়ের পর জিনিয়ার সঙ্গে লেকটাউনের নতুন ফ্ল্যাটে সংসার শুরু করার আগে অবধি সেও এই তল্লাটে মেসে থাকত।
একসময় এটা ছিল পঞ্চায়েত এলাকা, টেকি ওয়ার্ল্ড এসে এর সম্পূর্ণ ভোল বদলে দিয়েছে। রাস্তা চওড়া হয়েছে, দু-পাশের মাছের ভেড়ি বুজিয়ে হয়েছে বাগান।
বস্তুত কম্পিউটার যখন প্রথম এদেশে এল, তখন লোকে ধারণা করতে পারেনি কয়েক বছর পরে কম্পিউটারের হাত ধরে তথ্যপ্রযুক্তি মানুষের দৈনন্দিন জীবনটা আমূল পালটে দেবে। কাগজ পেনের কাজ বদলে যাবে কম্পিউটারে কী-বোর্ড চালানোয়, বন্ধুরা মিলে আড্ডা দেওয়া পালটে যাবে ভার্চুয়াল মিডিয়ায় আঙুল ঘসে প্রতিক্রিয়া দেওয়ায়, পাড়ার ফাস্ট ফুডের দোকানে খেতে যাওয়া বদলে যাবে অনলাইন অ্যাপে খাবার অর্ডার দেওয়ায়, হাতিবাগানে বা নিউমার্কেটে দরদাম করে পুজোর বাজার করা বদলে যাবে মোবাইল ফোনে অফিস বা কলেজ যেতে আসতে করা অনলাইন শপিং-এ।
আর আই টি সেক্টর এই দেশে শুধু কোটি কোটি তরুণ তরুণীর কর্মসংস্থানই করেনি, মাত্র একুশ বাইশ বছরে তাদের সামনে খুলে দিয়েছে স্বাবলম্বী হওয়ার দিশা। এক প্রজন্ম আগেও পশ্চিমবঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিং ছিল শুধুমাত্র উচ্চমেধার মতো ছেলেমেয়েদের জন্য। জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করলে এবং ভালো র্যাঙ্ক করলে তবেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, শিবপুর বি ই কলেজের মতো সীমিত আসনের সরকারি কলেজগুলোয় ভরতির সুযোগ পাওয়া যেত।
কিন্তু আই টি বিপ্লব আসার পর রাতারাতি গজিয়ে উঠতে লাগল জেলায় জেলায় বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। তারা কলেজ ক্যাম্পাসে ছোটো বড়ো আই টি কোম্পানিগুলোর প্লেসমেন্ট করিয়ে তৃতীয় কিংবা চতুর্থ বর্ষেই চাকরি পেয়ে যাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ তুলে ধরল মধ্যবিত্ত স্বপ্ন দেখা অভিভাবকদের সামনে। ফলে মৌচাকে মধুর খোঁজে ঝাঁপ দেওয়ার মতো করে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ যথেচ্ছভাবে বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেধার মানও পড়তে শুরু করল। প্রথম কয়েক বছর উচ্চমেধা, তারপর মধ্যমেধা, শেষে এমন হতে লাগল মেধা নির্বিশেষে যেকোনো ছাত্রছাত্রী বেসরকারি কোনো-না-কোনো কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে লাগল।
কিছু বয়স্ক লোক নাক কুঁচকে বললেন বটে, ‘নাহ! সবাই দেখি ইঞ্জিনিয়ার। কোনো কৌলীন্য রইল না আর!’ কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে প্রচুর ছেলেমেয়ে ভালো চাকরি পেল একুশ বাইশ বছর বয়সেই। কিছু বছর পরেই তারা বিদেশ চলে যেতে লাগল কাজে। আই টি সেক্টরের ভাষায় এই বিদেশযাত্রাকে বলে অনসাইট। বাঙালির বিদেশ নিয়ে বরাবরই হ্যাংলামি বেশি, পাড়ার ছেলেটা বা মেয়েটা ‘লেখাপড়ায় আহামরি কিছু ছিল না’ হয়েও দিব্যি বিদেশে চলে যাচ্ছে দেখে অভিভাবকেরা পঙ্গপালের মতো ছেলেমেয়েদের ঠেলে দিতে লাগলেন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার দিকে। সরকারি চাকরির অনিশ্চয়তার মাঝে এমন সুযোগ কেউ ঠেলে?
শেষে আই টি সেক্টরের হুজুগ এমন এল যে মেকানিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল কিংবা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মতো কোর বিষয় পড়েও ছেলেমেয়েরা আই টি-তে ঢুকতে শুরু করল। যে ছেলেটা ভেবেছিল ফিজিক্স নিয়ে পড়বে, তাকেও ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ঢোকানো হল, যে মেয়েটা বিজ্ঞানে ভালো হয়েও ভেবেছিল ইংরেজি নিয়ে এগোবে, তাকেও ঢুকতে হল এই একই জাঁতাকলে।
এইভাবে একটা গোটা প্রজন্মের ইচ্ছা-অনিচ্ছা-মেধা-ভালোলাগা গিলে ফেলল আই টি সেক্টর।
অর্থনীতির অমোঘ নীতি বলে কোনো সেক্টর প্রথম বৃদ্ধির সময়ে তরতরিয়ে বাড়ে, তারপর একটা সময় গিয়ে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। তখন তার বৃদ্ধির হারও কমে, বরং ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে।
গত কয়েক বছর ধরে আই টি সেক্টরেও তাই হয়েছে। এখন ছেলেমেয়েরা যেখান সেখান থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে আর ভালো চাকরি পাচ্ছে না, তাদেরও এখন প্রতিযোগিতায় লড়তে হচ্ছে ভালোমতো। তাদের মেধার মানও পড়তির দিকে।
ফলে অতন্দ্রদের মতো সিনিয়রদের অধীনে যে নতুন ছেলেমেয়েগুলো এখন ঢুকছে, তাদের অনেকেই উৎকর্ষের দিক থেকে বেশ পিছিয়ে। কিন্তু কিছু করার নেই। তৃতীয় বিশ্বের এই দেশ থেকে সস্তায় অনেক, অনেক লোক দরকার কোম্পানির। মেধার চেয়েও বেশি এখানে প্রয়োজন বেশিক্ষণ থাকতে পারার ক্ষমতা, মুখ বুজে কাজ করার সামর্থ্য। এই দুটো গুণ থাকলেই হল, কোম্পানি মাথা পিছু মোটা অঙ্কের ডলার বা ইউরো গুনে নেবে বিদেশি ক্লায়েন্টের কাছ থেকে।
যেমন এই মুহূর্তে অতন্দ্রর ওপরে যে দুটো নতুন ছেলেকে তৈরি করার ভার পড়েছে, সেই অরিন্দ্রজিৎ আর সত্যব্রত। দুটো ছেলেই সদ্য বিটেক পাশ করে এসেছে, আর দু-জনেরই প্রোগ্রামিং-এর ভিতটা এত নড়বড়ে, যে এই অল্প সময়ে এই প্রোজেক্টে কাজ করার মতো করে তৈরি করাটা বলতে গেলে অসম্ভব।
তবু অতন্দ্র চেষ্টা করছে আপ্রাণ। প্রোজেক্টে শুধু সিনিয়র বলেই নয়, ভালো বোঝাতে পারায় ওর বেশ সুনাম আছে। নতুন কেউ এলেই তাই ওকে ‘কেটি’ দেওয়ার দায়িত্ব দেয় ম্যানেজার। ‘কেটি’ অর্থাৎ নলেজ ট্রানজিশান। গোদা বাংলায় জ্ঞান বিতরণ।
অতন্দ্র লিফট লবি থেকে নেমে নিজেদের উইং-এ ঢুকে একটু আশ্চর্য হয়ে গেল। ও পুরো জনশূন্য ‘বে’ দেখবে আশা করেছিল, কিন্তু এখন দেখছে এর মধ্যেই অন্তত পাঁচ-ছ’জন এসে পড়েছে, ডেস্কটপে মুখ গুঁজে বসে আছে তারা।
অদ্ভুত ব্যাপার। ওদের এই ‘উইং’-এ সবকটা প্রোজেক্টই নর্মাল শিফটের। নাইট শিফট এই ফ্লোরে একটাও নেই। সেখানে এই ছেলেমেয়েগুলো আজ সকাল পৌনে ন-টার সময়েই চলে এসেছে কেন?
পরক্ষণেই ওর মনে পড়ে গেল, এটা এপ্রিল মাস। সারাবছরের রেটিং বেরোনোর সময়। ওর নাহয় সেই ঝক্কি নেই, এই কোম্পানিতে ওর থাকার মেয়াদ আর মাত্র কয়েকটা দিন। কিন্তু অন্যদের তো তা নয়। এইসময় সবার একটু কাজ দেখানোর প্রবণতা চলে আসে।
বছরের অন্য সময় এখনও বলতে গেলে কেউই অফিস ঢোকে না। কারণ আই টি সেক্টরের বেশিরভাগ প্রোজেক্টেই দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজের মাত্রা বাড়তে থাকে। কেউ সকাল আটটায় এসে সারাদিন মাথা গুঁজে কাজ করলেও সন্ধে ছ-টায় যদি ক্লায়েন্টের থেকে ই-মেল পায় যে, ‘বাই ইওডি’ অমুক কাজ করে পাঠাতে হবে,’ তো সেটা তাকে করতেই হবে। তাই সকালে সাততাড়াতাড়ি এসে লাভ কী?
আর অতন্দ্রর নিজের এই লাইনে আট বছর হয়ে গেল, এখনও ‘ইওডি’ শব্দটার তাৎপর্য বুঝতে পারে না।
আক্ষরিকভাবে ইওডি-এর পুরো অর্থ এন্ড অফ দ্য ডে, অর্থাৎ কিনা যেদিন কাজের হুকুম করা হচ্ছে, সেই দিনের মধ্যেই কাজটা শেষ করতে হবে।
কিন্তু কর্পোরেট অফিসগুলোয় এই শব্দটা এখন একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাত সাড়ে আটটার সময় ম্যানেজার কোনো কর্মীকে ই-মেল করে কাজ পাঠাচ্ছে, সেখানেও ইওডি, আবার ক্লায়েন্ট রাত সাড়ে এগারোটার সময় বাড়ির বিছানায় বসে নিজের আদেশ পাঠাচ্ছে, সেখানেও ইওডি।
ও চিরকালের এঁড়ে, এই নিয়ে বছর কয়েক আগে ওর তখনকার ম্যানেজারের সঙ্গে একবার ঝামেলা লেগে গিয়েছিল। তার নাম ছিল সুমিত মিত্র। তার কিছুদিন আগে থেকেই সেই সুমিত মিত্র বড্ড বাড়াবাড়ি করছিল। ইচ্ছে করে উইকএন্ডে মিটিং ফেলা, রাতবিরেতে ফোন করে উৎপাত করা, তার সঙ্গে নিজের অর্ধেক ম্যানেজারিয়াল কাজ ওর ঘাড়ে চাপিয়ে ডেলিগেট করা। লোকটা নিজে ডিভোর্সি, বউ মনে হয় তিতিবিরক্ত হয়ে চলে গিয়েছিল, নিজের কোনো ব্যক্তিগত জীবন ছিল না, আর অন্য কাউকেও সেটা রাখতে দেবে না বলে সম্ভবত শপথ নিয়েছিল। এমন লোক কর্পোরেটে মোটেই বিরল নয়।
তখন আর কয়েক মাস পরেই ছিল অতন্দ্রর বিয়ে। প্রতি সপ্তাহান্তেই টুকটাক কেনাকাটির জন্য ও আর জিনিয়া বেরোতে চায়। কিন্তু ওই লোকের জ্বালায় কিছুতেই বেরোতে পারেনা। প্রতি শনি রবিবার কোনো-না-কোনো কাজ চাপিয়ে দেয়। জিনিয়া ফোন করলেই অনুযোগ করত, ‘তুমি কিছু বলছ না কেন?’
এইরকম চলতে চলতে একদিন অতন্দ্র বিশাল খেপে গিয়েছিল। খেপে গেলে ও চিরকালই অন্য মানুষ হয়ে যায়। ওর সেদিন দেরি হয়ে গিয়েছিল খুব, আগে থেকেই বলা ছিল ও সেদিন দুর্গাপুর যাবে, অথচ রাত ন-টা বেজে গিয়েছিল। লোকটা ঠিক ওর বেরোনোর সময় নিজের কিউবিকল থেকে উঁকি মেরে দেখে নিয়েছিল ও ব্যাগপত্র গোছাচ্ছে, আর তখনই একটা অন্তত চারঘণ্টার কাজ করতে বলে ই-মেল করেছিল ওকে।
নীচে লিখে দিয়েছিল সেই গায়ে অ্যাসিড ঢেলে দেওয়ার মতো সেই শব্দটা, ইওডি।
ও সেদিন সোজা সুমিত মিত্র-র কিউবিকলের সামনে গিয়ে সবার সামনে প্রশ্ন করেছিল, রাত ন-টার সময় ওকে চার পাঁচ ঘণ্টার কাজ পাঠিয়ে সেদিনই শেষ করতে বলা হয় কী করে?
ওর কথার তোড়ে সেদিন লোকটা সামনে দাঁড়াতে পারেনি। কিছুক্ষণ তুতলে বসে পড়েছিল সিটে। অতন্দ্রও রাগের মাথায় কাজটা ফেলে রেখে বেরিয়ে গিয়েছিল।
সুমিত মিত্র অবশ্য ওকে ছাড়েনি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ চিরকাল যেভাবে বদলা নেয় অধস্তনদের ওপর, সেভাবেই নিয়েছিল। ওই বছরে ওকে তিন নম্বর রেটিং দিয়েছিল লোকটা।
সমস্ত আই টি কোম্পানিতেই বছরশেষে প্রতিটা কর্মীকে তার সারাবছরের কাজের ভিত্তিতে রেটিং দেওয়া হয়। সেই রেটিং-এর ওপর নির্ভর করে তার ইনক্রিমেন্ট কতটা হবে, অর্থাৎ মাইনে কতটা বাড়বে, নির্ভর করে প্রোমোশন হবে কি না, বিদেশে অনসাইটে যেতে পারবে কি না। এমনকী চাকরিটা টিকবে না যাবে সেটাও রেটিং এর ওপরেই নির্ভর করে। সাধারণত চার ধরনের রেটিং হয় বেশিরভাগ কোম্পানিতে। এক, দুই, তিন, চার। কোথাও সেটাকে এ বি সি ডি নামে ডাকা হয়, কোথাও আবার ফাস্ট, সেকেন্ড, থার্ড, ফোর্থ এইভাবে। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, বিষয়টা একই।
আইটি সেক্টরে কাজ করার সবচেয়ে বড় শর্ত হল নিত্যনতুন টেকনোলজি শিখতে পারার ক্ষমতা ও নিরবচ্ছিন্ন চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মানসিকতা। আজ যে টেকনোলজিতে কেউ কাজ করছে, দু-বছরের মধ্যে তা বাতিল হয়ে যেতে পারে। তখন চটজলদি নতুন প্রযুক্তি শেখার উৎসাহ ও লড়াই প্রয়োজন।
বলাই বাহুল্য, এইদুটি শর্ত একেবারেই সহজ নয়। একটু বেলাইন হলেই চার্লস ডারউইনের ‘সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট’ থিওরিকে স্মরণ করতে হয়।
আর সেই টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন প্রতিবছর ভাল রেটিং।
যারা সবচেয়ে ভালো কাজ করবে তারা পাবে এক নম্বর রেটিং, যারা আরেকটু কম কাজ করবে তারা পাবে দুই, এইভাবে চারটে রেটিং দেওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়েই তা হয়না। যে ছেলেটা ম্যানেজারের সঙ্গে একটু ভালো সম্পর্ক রাখে, ক্লাবে, কাফেটেরিয়ায় তেল দেয়, সে-ই অধিকাংশ ক্ষেত্রে সবাইকে টপকে যায়। আর অমানুষিক কাজ ছাড়া কেউ বলতে গেলে এক রেটিং পায় না।
ওদের অফিসে একটা রসিকতা প্রচলিত আছে। এক পাওয়া মানে ডিভোর্স পাক্কা। আসলে এক রেটিং পেতে গেলে অফিসে এত সময় দিতে হয়, যে বাড়িতে বউয়ের রাগ হওয়া অবশ্যম্ভাবী। তাই এই প্রবাদবাক্য।
অতন্দ্র ডেস্কে এসে ব্যাগ রেখে কিছুক্ষণ মাথা টিপে বসে রইল। গত কয়েকদিন ধরে শরীর-মনের ওপর দিয়ে যে ধকল ওর যাচ্ছে, তাতে এই সকালবেলাতেই ও বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছে।
একটু পরে উঠে গিয়ে ও এক কাপ কফি নিয়ে এল লবির এক্সপ্রেসো থেকে। মনটা সেদিনের পর থেকে এত অসম্ভব তেতো হয়ে রয়েছে, যে, কিছুই ভালো লাগছে না। জিনিয়ার প্রতি রাগে মাঝে মাঝেই সারা শরীরটা কেঁপে উঠছে, অনেক কষ্টে নিজেকে ও সংবরণ করছে।
কিন্তু যে মুহূর্তে মনে পড়ছে ওকে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই গীতিকার মুখোমুখি হতে হবে, ওর ভেতরটা খিঁচড়ে যাচ্ছে।
খুব প্রয়োজন না পড়লে ও কামাই করে না, কিন্তু এই একটা কারণে ও গত দু-দিন অফিস আসেনি। ফোন বন্ধ রেখে বসেছিল দুর্গাপুরের বাড়িতে। কিন্তু তারপর নিজেই উপলব্ধি করল যে এইভাবে চোরের মতো লুকিয়ে থাকা ওর পক্ষে সম্ভব নয়।
এই কোম্পানিতে ও ঢুকেছিল সদ্য কলেজ পাশ করা ফ্রেশার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে, তারপর আটটা বছর কেটে গেছে। গঙ্গা দিয়েও গড়িয়েছে অনেক জল। এই আট বছরে ম্যানেজমেন্ট এইটুকু বুঝেছে যে অতন্দ্র গুপ্ত মেরুদণ্ড সোজা রাখতে ভালবাসে, কিন্তু কাজে বা নিয়মনিষ্ঠায় কোনো ফাঁকি দেয় না। আর এই ধরনের আত্মপ্রত্যয়ী শিরদাঁড়া যুক্ত কর্মীকে অন্যদের মতো রেটিং-এর ভয়ে দাবিয়ে না রেখে কৌশলীভাবে ব্যবহার করলে প্রফিট অনেক বেশি। কাজেই ওদের গোটা ব্যাঙ্কিং ডোমেনে ওর আলাদা কদর।
আর এই আলাদা কদর নিয়েই ও মাথা উঁচু করে বেরিয়ে যাবে ভেবেছিল। কিন্তু রেজিগনেশন দেওয়ার পর তিন মাস নোটিশ পিরিয়ডে থাকতে হয় এখানে। সেই মেয়াদেই যে ওকে এত বড়ো লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হবে, তা ও স্বপ্নেও ভাবেনি।
এখন পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, ও যে কারণে রেজিগনেশান দিয়েছিল সেটাও গুরুত্বহীন হতে চলেছে, আর রেজিগনেশান উইথড্র করে এখানে থেকে গেলেও মানসম্মান নিয়ে টানাটানি হবে।
আর ওর এই অবস্থার জন্য যে দায়ী, সে মহানন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্বার্থপরের মতো শুধু নিজেরটুকু ভেবে চলেছে। এদিকে অতন্দ্র নিজে তার খুশির জন্য, তার স্বপ্নকে সত্যি করার জন্য কী-না-কী করেছিল!
কথাটা মনে হওয়ামাত্র ওর গলাটা আর তেতো হয়ে উঠল। মনে হল সোজা এখান থেকে বেরিয়ে চলে যায় সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে জিনিয়ার অফিসে, গিয়ে উইং-এর সবার সামনে যা তা শুনিয়ে দিয়ে ওর সম্মান ধুলোয় লুটিয়ে দিয়ে আসে।
ঠিক যেমনটি ওর সঙ্গে করা হয়েছে।
২
দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত এক শপিং মলের দ্বিতলে বহুজাতিক এক ভ্রমণ সংস্থার অফিস ‘গ্লোবাল টুরস’। দেশের প্রথম সারির টুর কোম্পানিগুলোর মধ্যে গ্লোবাল টুরসের নাম গত কয়েক দশক ধরে ওপরের সারিতে। মহারাষ্ট্রের এক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যবসায়ী প্রায় ত্রিশ বছর আগে খুলেছিলেন এই ভ্রমণ সংস্থা। তখন একেবারেই ছোটো ছোটো ট্যুর করা হত। কিন্তু ভালো সার্ভিস, পরিচ্ছন্ন রেপুটেশনে সেই ছোটো ব্যবসা এখন ডানা মেলে ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বহু শাখাপ্রশাখায়। করানো হচ্ছে নামিদামি বিদেশ টুর। অজস্র প্যাকেজ এদের, তেমনই ভালো এদের সমস্ত ব্যবস্থাপনা।
এদের প্রতিটা অফিসেই রয়েছে ম্যানেজমেন্টের সুরুচির ছাপ। ঝাঁ চকচকে সোফা, দেওয়ালে চোখ জুড়িয়ে দেওয়া দেশ-বিদেশের ছবি, ততোধিক মনোরম সমস্ত রিসেপশনিস্ট তো আছেনই, তার সঙ্গে রয়েছে টেবিলে বহুমূল্য ফুলদানি কিংবা দেওয়ালে মনোরম চিত্রকলা।
দামি কাচের ভারী সুইং ডোর ঠেলে এই অফিসের ভেতরে ঢুকলেই বাইরের সেন্ট্রালাইজড এসির তুলনায় আরও ঠান্ডা হাওয়া শরীরকে যেন মুহূর্তে স্নিগ্ধ করে দেয়। যারা শপিং মলে নিছকই ঘুরতে আসে, তারাও একের পর এক স্টোরে ঢুঁ দিতে দিতে ঢুকে পড়ে এখানে, সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরিয়ে দেওয়া হয় একাধিক টুর প্যাকেজের বিবরণ, রঙিন সমস্ত হ্যান্ডবিল।
ভেতরটা শুধু যে ঠান্ডা তা-ই নয়, অস্বাভাবিক রকমের একটা নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে চারদিকে। অথচ এখানে জনসংখ্যা যথেষ্ট, লম্বা করিডোরে পরপর পাতা রয়েছে টেবিল-চেয়ার, আর প্রতিটা টেবিলের উল্টোদিকে বসে রয়েছেন একজন করে সেলস এগজিকিউটিভ, তাঁরা প্রত্যেকেই সামনের লোকের সঙ্গে বা টেলিফোনে অদ্ভুত নিচুস্বরে অথচ পরিষ্কার উচ্চারণে হাসিমুখে কথা বলে যাচ্ছেন। প্রত্যেকের পরনে একই ধরনের সুদৃশ্য কোট, যার বুকে কোম্পানির গর্বিত লোগো খোদাই করা।
এই সেলস এগজিকিউটিভদের কাজ হল কাস্টমার নতুন টুরের সম্পর্কে জানতে এলে সবচেয়ে ভালো প্যাকেজটা তাঁদের জন্য অ্যালোকেট করা, পেমেন্ট নেওয়া ও টুরে যাওয়ার দিন পর্যন্ত টিকিট, ভিসা বা যাবতীয় প্রয়োজনে সাহায্য করা।
শুধু তাই নয়, কোনো মানুষ এমনিই কোনো টুর সম্পর্কে জানতে এলে তাঁকে বুঝিয়ে শুনিয়ে প্রলোভিত করাটাও তাঁদের কাজের মধ্যে পড়ে। আর এই ব্যাপারে এঁদের প্রত্যেকের মাথার ওপর ঝোলানো থাকে কড়া টার্গেট, যার ফিরিস্তি প্রতি মাসের শেষে পার্কস্ট্রিটে অবস্থিত কলকাতার সদর দপ্তরে দিতে হয়।
টেবিল চেয়ারগুলো ছাড়াও করিডোর থেকে বাইরের দরজার দিকে রয়েছে দুটো আরামদায়ক সোফা। সব সেলস এগজিকিউটিভই যখন কোনো-না-কোনো কাস্টমার নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তখন নতুন কাস্টমারদের সোফায় বসে অপেক্ষা করতে হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁদের ডেকে নেওয়া হয় সামনের টেবিলগুলোর কোনো একটায়।
তবে এখন এই সোফা দুটোর একটিতে বসে রয়েছেন এমন দু জন, যাদের এই কেতাদুরস্ত অফিসে বেশ বেমানানই লাগছে। শুধু এই অফিসেই নয়, দক্ষিণ কলকাতার এই শপিং মলে ঢোকার পর থেকেই সিকিউরিটি থেকে মলে আসা মানুষজন ক্রমাগত ভ্রূ কুঁচকে তাকাচ্ছে এঁদের দিকে।
গ্লোবাল টুরসের অফিসে কোনো কাস্টমার এলেই করিডোরের ভেতরদিকে টুলে বসে থাকা বেয়ারাটি একটি বিশাল ট্রে-তে করে ঠান্ডা জল নিয়ে আসে, তার ওপর এমনই আদেশ। কিন্তু এঁদের দেখে সেও বেশ দ্বিধায় পড়ে গেছে যে কোম্পানির দু-গ্লাস বরফঠান্ডা জল আদৌ অপচয় করা উচিত কি না।
এঁরা কি আদৌ জানেন এটা কীসের অফিস? না এমনি এমনি নিছক কৌতূহলে ঢুকে পড়েছেন উচ্চবিত্তের এই শপিং মলে, তারপর বসতে পারার প্রলোভনে চলে এসেছেন এই অফিসের ভেতরে!
কাস্টমার দু-জন নিজেরাও যেন এই পরিবেশে এসে একটু হকচকিয়ে গিয়েছেন, নিজেদের সঙ্গে এখানকার পার্থক্যটা তাঁরাও বোধ হয় উপলব্ধি করতে পারছেন।
তাঁদের মধ্যে একজন রীতিমতো বৃদ্ধ, বয়স পঁচাত্তরের ওপরে তো হবেই। মুখে অজস্র বলিরেখা, গলার চামড়া ঝুলে নুয়ে পড়েছে বুকের সামনে। পরনে আধময়লা ফতুয়া, পাজামা কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ। বৃদ্ধের গায়ের রং যতটা না চাপা, তার চেয়ে বেশি পুড়ে গিয়েছে, সম্ভবত অত্যধিক রোদে থাকার জন্য। এখন অনেকটা পরিশ্রম করে আসার জন্যই বোধ হয়, চোখের দু-কোনায় ঘনঘন জল জমছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই তা আকার নিচ্ছে সাদা পিঁচুটির।
খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে তিনি এখন পলিথিনে মোড়া একটা বহু ব্যবহৃত প্লাস্টিকের বোতল থেকে জল খাচ্ছেন ঢকঢক করে।
সেই জল ঠোঁট বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে বুকে, ভিজিয়ে দিচ্ছে তাঁর ফতুয়ার বুকের অংশটা।
তাঁকে দেখলেই বোঝা যায় শহুরে আদবকায়দায় একেবারেই অভ্যস্ত নন তিনি। আর সত্যিই তাই। কলকাতা থেকে বহুদূরের এক গ্রামে তাঁর বাড়ি। খবরের কাগজের পাতায় এই কোম্পানির পাতাজোড়া বিশাল বিজ্ঞাপন দেখেই তিনি ছুটে এসেছেন এখানে।
অন্যজনের বয়স মধ্য ত্রিশ। তার পরনেও সাধারণ শার্ট-প্যান্ট, একটু অপ্রতিভ মুখ-চোখ, চারপাশ সে দেখছে কৌতূহলে। সে অবশ্য বৃদ্ধের মতো কলকাতায় নতুন নয়, তার বাড়ি বৃদ্ধের গ্রামে হলেও কর্মসূত্রে সে এখন কলকাতারই বাসিন্দা।
কিন্তু তার থাকা ও কাজ বড়োবাজারের ব্যস্ত গলিতে। আর এখানকার সঙ্গে সেই পরিবেশের আকাশ-পাতাল পার্থক্য। সেখানে জামাকাপড় তৈরির এক মাড়োয়াড়ি গদিতে কাজ করে সে। লরিতে করে গাঁটরি গাঁটরি মাল আসে, যত রাতই হোক, সেই মালের হিসেব নিতে হয় তাকে। তাকে থাকতেও হয় লেবারের হইহল্লার মাঝে।
সিকিউরিটি গার্ড ওমিনাথ ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে এঁদের দিকে। তার বিরক্ত হওয়াটা স্বাভাবিক।
গ্লোবাল টুরস কোনো ছোটোখাটো ট্রাভেল এজেন্সি নয় যে বুড়োবয়সে বাঙালির ‘দিপুদা’ ভ্রমণ অর্থাৎ দিঘা, পুরী, দার্জিলিং সুলভে ঘোরার দায়িত্ব নেবে, রান্নাবান্না করে হলিডে হোমে পিকনিকের আয়োজন করবে। গ্লোবাল টুরসের নব্বই শতাংশ টুরই বিদেশি, আর ভারতের মধ্যে যে ক-টা হাতেগোনা ঘোরার জায়গা তাদের লিস্টে রয়েছে, সেগুলো প্রায় বিদেশের মতোই ব্যয়বহুল। চারতারা কিংবা পাঁচতারা হোটেলে থাকা, খাওয়া-দাওয়ার এলাহি আয়োজন, সব মিলিয়ে বিলাসিতার মাপকাঠিতে খুবই সন্তোষজনক।
কাজেই যে এজেন্সিতে যেকোনো জায়গায় জনপ্রতি ঘোরার খরচ শুরুই হয় লাখ-দেড় লাখের ওপর থেকে, সেখানে এইরকম পোশাক-আশাকের দু-জন লোকের কী করার থাকতে পারে?
এঁরা আসার পরেই ওমিনাথ একবার চোখের ইশারায় সবচেয়ে কাছে বসা সেলস এগজিকিউটিভ আলোকপর্ণা ম্যাডামকে জিজ্ঞেস করেছিল যে এদের আসার উদ্দেশ্যটা কী।
দুধসাদা সোফায় মানুষ দুটো বসার আগে আলোকপর্ণা সামান্য ইতস্তত করে নিজের টেবিল থেকেই সামান্য গলা চড়িয়ে জানতে চেয়েছিল, ‘কী দরকার আপনাদের?’
কমবয়সি লোকটা কিছু বলার আগে বুড়োটাই বলেছিল, ‘ইয়ে … একটু ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপারে কথা বলব। তা আপনি হাতের কাজটা সেরে নিন না দিদিমণি। অসুবিধে নেই কিছু।’
দিদিমণি? আলোকপর্ণার দিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকিয়েছিল আরেক সেলস এগজিকিউটিভ সংযুক্তা। এইরকম পরিবেশে ওরা ম্যাডাম কিংবা মিস অমুক শুনতেই অভ্যস্ত, দিদিমণি আবার কে বলে! যতসব অশিক্ষিতের দল।
আলোকপর্ণা মুখে কিছু বলেনি। সংযুক্তার ইশারা করে হেসে গড়িয়ে পড়া দেখে ও কাজে মনোনিবেশ করেছিল। কিন্তু একটু পরেই বুড়োটার চোখের কোণে জমাট বেঁধে শুকিয়ে থাকা পিঁচুটির দিকে অজান্তেই চোখ চলে গিয়েছিল ওর।
নিজেকে সামলে ও তখন মনোযোগ দিয়েছিল সামনে বসে থাকা হাইপ্রোফাইল কাস্টমারের ওপর। মনে মনে ঠিক করেই ফেলেছিল, যতক্ষণ সম্ভব সামনের ভদ্রলোককে আটকে রাখবে। যাতে ফাঁকা হলেই ওই দু-জনকে ডিল না করতে হয়।
এমনিতেই আজ একটু চাপ আছে। ওদের কলকাতা সার্কলের রিজিওনাল অফিস পার্কস্ট্রিটে, সেখান থেকে গোটা সার্কলের হেড সান্যাল স্যার আজ আসবেন ওদের এই দক্ষিণ কলকাতা ব্রাঞ্চ ভিজিটে। সঙ্গে নাকি থাকবেন মুম্বাই হেড অফিসের আর এক কর্তা।
এখনো এই কোয়ার্টারে ওদের ব্রাঞ্চে আলোকপর্ণা আর অতীশ তেমন কোনো প্যাকেজ সেল করতে পারেনি, ম্যানেজমেন্ট থেকে দুবার ধমকও খেয়েছে ওরা এই নিয়ে। ওদের দু-জনের পারফরম্যান্সের ওপরেই এখন কড়া নজর রাখা হচ্ছে।
আজ দুই কর্তা আসার আগে আলোকপর্ণা যদি সামনের ক্লায়েন্টের থেকে বুকিং নিয়ে নিতে পারে, ওর টেনশন অনেকটাই কমে যাবে। আপাতত এই কোয়ার্টারের জন্য নিশ্চিন্তও হতে পারবে কিছুটা।
সোফায় বসে থাকা ওই দু-জন তো বোঝাই যাচ্ছে এত দামি প্যাকেজ কেনার ক্ষমতা রাখে না। তার চেয়ে যারা আসল কাস্টমার, তাদের গুরুত্ব দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের লক্ষণ।
ও আরও উৎসাহের সঙ্গে সামনের সুট-টাই পরা ব্র্যান্ডেড রিমলেস চশমার ভদ্রলোককে প্যাকেজ বোঝাতে উদ্যত হল।
পরিকল্পনা একটু পরেই সফল হল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ওর পাশের টেবিলের অতীশের সামনের চেয়ার দুটো ফাঁকা হয়ে গেল আর অতীশের ডাকে লোকদুটো গুটিগুটি পায়ে গিয়ে বসল সেখানে।
আলোকপর্ণাসহ বাকি চারজন সেলস এগজিকিউটিভ, কিছুদূরে বসে থাকা বেয়ারা, এমনকী দরজার সামনে দাঁড়ানো উর্দি পরা ওমিনাথ পর্যন্ত কান পাতল এদিকে।
অতীশ অভ্যাসমতো মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘গ্লোবাল টুরসে আপনাদের স্বাগত। বলুন স্যার, আপনাদের কী সাহায্য করতে পারি?’
কমবয়সী লোকটা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে বৃদ্ধ বলে উঠলেন, ‘ইয়ে, আসলে আমরা জানতে এসেছি … মানে আপনারা কি আমাদের মতো বুড়োদের ঘুরতে নিয়ে যান?’
‘অবশ্যই, স্যার।’ অতীশ ঘাড় নাড়ল, ‘আপনাদের মতো মানুষদের জন্য আমাদের রয়েছে সিনিয়র সিটিজেনস স্পেশাল প্যাকেজ। এই প্যাকেজে আপনি দেশের মধ্যে পাঁচটা টুর পাবেন। হিমালয়ের চারধাম অর্থাৎ কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী হয়ে হরিদ্বার দর্শন, মধ্যপ্রদেশের অমরকণ্টক, গুজরাটের সোমনাথ মন্দির, দ্বারকা হয়ে কচ্ছের রণ, উত্তর ভারতের দিল্লি, আগ্রা, বৃন্দাবন। এছাড়া গোটা দক্ষিণ ভারতের মন্দিরগুলো নিয়ে একটা প্যাকেজ। আপনি কোনটা চাইছেন বলুন?’
বৃদ্ধ এবার একটু থমকালেন। ফতুয়াটা টেনে গলার কাছে নিয়ে মুছলেন, তারপর ছোটো একটা ঢোঁক গিলে বললেন, ‘না মানে, এইগুলো নয়।’
‘তবে?’ অতীশ এবার কথোপকথন শেষ করার ভঙ্গিতে দু-পাশে মাথা নাড়ল, ‘স্যরি স্যার। আপনি কি তারাপীঠ, বকখালি জাতীয় কাছেপিঠে কোথাও যেতে চাইছেন? সেক্ষেত্রে আপনাকে বলব অন্য কোনো এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করতে। আসলে আমাদের এখানে ওই টুরগুলো হয় না।’
বৃদ্ধ এবার পাশের যুবকের দিকে তাকালেন। যুবক কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু বৃদ্ধ তাকে ইশারায় থামিয়ে দিয়ে অতীশের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললেন, ‘আচ্ছা, আপনারা কি প্যারিস শহরে নিয়ে যেতে পারবেন? ওই যে, যেখানে আইফেল টাওয়ার রয়েছে?’
আলোকপর্ণা এতক্ষণ আড়চোখে গোটা ব্যাপারটা দেখছিল, এবার চমকে তাকাল অতীশের পাশেই বসে থাকা বহ্নিশিখার দিকে। তারও একই অভিব্যক্তি। বিস্ময়ে চোখদুটো গোলগোল হয়ে গেছে।
‘নিশ্চয়ই।’ অতীশ অবাক ভাবটা গিলে নিয়ে তৎক্ষণাৎ পেশাদার ভঙ্গীতে ছোট্ট করে মাথা নাড়ল, ‘শুধু প্যারিস কেন স্যার, পৃথিবীর খুব কম শহর আছে, যেখানে গ্লোবাল টুরস ঘোরাতে নিয়ে যায়না। প্যারিস থেকে সিডনি, হংকং থেকে রিও ডি জেনেরিও। আমাদের সঙ্গে একটা টুর করলেই বুঝতে পারবেন অন্যদের থেকে আমরা কোথায় আলাদা। শুধু যে আমরা প্যাকেজের মধ্যে সেখানকার সমস্ত জায়গা ঘুরিয়ে দেখাই তাই নয়, সেখানকার সেরা হোটেলগুলোতে আমরা রাখি, খাওয়া-দাওয়া প্রোভাইড করি। এ ছাড়া প্রতিটা টুরে থাকেন অভিজ্ঞ টুর ম্যানেজার, যিনি দলের প্রত্যেককে সমস্ত ব্যাপারে সাহায্য করেন। টুরিস্টদের ভিসার ব্যবস্থাও আমরাই করি। বাই দ্য ওয়ে,’ কথাটা বলে অতীশ সামান্য থামল, ‘স্যার, আপনাদের পাসপোর্ট আছে তো?’
বৃদ্ধ বললেন, ‘হ্যাঁ, আগের মাসেই করিয়েছি।’ কথাটা বলে হাতড়ে হাতড়ে সঙ্গের ঝোলা ব্যাগ থেকে তিনি দুটো নীলচে শক্ত মলাটের পাসপোর্ট বের করলেন, ‘এ … এই যে! এতে হবে তো?’
‘অবশ্যই স্যার।’ অতীশ উলটে পালটে দেখেই ফিরিয়ে দিল, ‘আপনি আর আপনার স্ত্রী যেতে চাইছেন, তাই তো?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ।’ বৃদ্ধ আগ্রহের সঙ্গে বললেন, ‘প্যারিস যাব। কীরকম খরচ পড়বে?’
অতীশ এবার কম্পিউটারের স্ক্রিনে চোখ রাখল, ‘দেখুন, শুধু ফ্রান্স আলাদা করে ঘোরার প্যাকেজ তো আমাদের নেই। আপনাকে গোটা ইউরোপ টুরের প্যাকেজ নিতে হবে স্যার।’
‘ওহ।’ বৃদ্ধের চোখ মুহূর্তে নিষ্প্রভ হয়ে এল, ‘সে তো অনেক খরচ তবে!’
‘না, স্যার। আমরা ভেবেচিন্তেই এমন প্ল্যান করেছি। দেখুন, আপনি তো বারবার ওখানে এত টাকা করে প্যাসেজ মানি দিয়ে ঘুরতে যাবেন না, একবারই যাবেন। আর ইউরোপের প্রতিটা দেশ এত ছোটো ছোটো, আপনি দেড় থেকে দু’ঘণ্টায় এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে পারবেন।’
‘কিন্তু, আমার স্ত্রী খুব অসুস্থ। উনি কি পারবেন? ওঁর অনেক ওষুধ চলে সারাদিন …।’
‘কোন অসুবিধা নেই স্যার।’ অতীশ বলল, ‘আমাদের এই প্যাকেজটাই তো সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য। এই টুরে আমরা একজন কেয়ারগিভারকে দেব যিনি সকলের শরীরের খেয়াল রাখবেন, ওষুধ খাওয়াবেন। আর ধকল নিয়েও চিন্তা নেই। আমাদের বাস থেকে শুরু করে হোটেল সবই অত্যন্ত আরামদায়ক। বরং আপনারা একবার এই প্যাকেজে ঘুরতে গেলে ছোটোবড়ো অনেক দেশ একবারেই দেখা হয়ে যাবে।’
‘সেটা ঠিক।’ বৃদ্ধ পাশের ছেলেটার দিকে তাকালেন, ‘ইউরোপ মহাদেশে ক-টা দেশ জানিস, পুতো?’
‘ক-টা মাস্টারমশাই?’ পুতো নামক যুবকটি সাদা চোখে তাকায়।
‘প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। ছবির মতো মহাদেশ। একসময় এর অনেকগুলো দেশ গোটা বিশ্বের ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছে, পায়ের তলায় রেখেছে নিজেদের থেকে কয়েকগুণ বড়ো বড়ো দেশকেও।’ বৃদ্ধ একটা নিশ্বাস ফেলে আবার অতীশের দিকে তাকালেন, ‘আপনারা কি পঞ্চাশটা দেশই ঘোরাবেন?’
‘না না।’ অতীশ দ্রুত মাথা নাড়ল। এতদিন ধরে এত কাস্টমারকে সে ইউরোপ প্যাকেজ বিক্রি করেছে, অথচ ও নিজেই জানত না যে ইউরোপে এতগুলো দেশ আছে! মুখে বলল, ‘তা তো সম্ভব নয়! যেগুলো বিখ্যাত দেশ, ধরুন ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, ইটালি আমরা এইগুলোই ঘোরাব।’
‘বুঝেছি।’ বৃদ্ধ মৃদু হেসে বললেন, ‘পশ্চিম ইউরোপের বুর্জোয়া দেশগুলোই শুধু আপনাদের প্যাকেজে রয়েছে। বেশ। তো বলুন কোনটা আমরা নিতে পারি?’
বৃদ্ধের কথা শেষ হয়না, দূরে বসে থাকা বেয়ারা সুখদেব এসে হিমশীতল জলের গ্লাস বাড়িয়ে দেয় সামনে, ‘স্যার, জল!’
৩
কেউ যত বড়ো প্রকৃতিপ্রেমিকই হোক, এগারো তলার ওপরে যদি তাকে দিনের দশ থেকে বারো ঘণ্টা একভাবে চেয়ারে বসে কম্পিউটারের স্ক্রিনে মুখ গুঁজে কাটাতে হয়, তবে তার প্রকৃতি দেখার চোখ নষ্ট হয়ে যাবেই।
সে যতই তার কিউবিকলটা একদম জানলার পাশে হোক না কেন।
জানলা মানেই অবশ্য যে খোলামেলা হাওয়া খেলা ছবি ভেসে ওঠে চোখের সামনে, এই জানলা সে-জানলা নয়। এ হল জিনিয়াদের কোম্পানি প্রাইমা ইনফোটেকের হাল ফ্যাশানের উইন্ডো, একদম মাটি থেকে সিলিং অবধি পুরু কাঁচের মোড়কে ঢাকা, কোথাও একফোঁটা হাওয়া ঢোকবার জো নেই। তুমি কিউবিকলে বসে কাজ করতে করতে সেই মোটা কাচ ভেদ করে বাইরের ক্রমশ কমলা হয়ে যাওয়া সূর্যের অস্ত যাওয়া দেখতে পারো, নীচের পিঁপড়ের মতো খুদি খুদি মানুষগুলোর হেঁটে বেড়ানো দেখতে পারো, দূরের আকাশছোঁয়া অফিসবাড়িগুলোকেও দেখতে পারো, কিন্তু ভুলেও তোমার চুলের ডগা কোনো মুক্ত বাতাসে নড়ে উঠবে না কিংবা কখনো কোনো চড়াই পাখি পথ ভুলে উড়তে উড়তে ছোট্ট ডানা ঝাপটে তোমার সিটের কাছে এসে বসবে না।
এই হল আই টি সেক্টরের অফিসগুলোর পাশ্চাত্য স্টাইল।
এই এখনও যেমন, জিনিয়া চুপচাপ বসে বসে কাচ পেরিয়ে ওপাশের রাতের কলকাতাকে দেখছিল।
আগে ওর কিউবিকল ছিল এই ফ্লোরের ভেতরের দিকে, সেখানে চারপাশের জ্যামিতিক আকারের ‘বে’ আর গুচ্ছের সিরিয়াস মুখের ছেলেমেয়ের কম্পিউটারের স্ক্রিনে প্রায় ঢুকিয়ে দেওয়া মুন্ডু ছাড়া সারাদিন ও কিছুই দেখতে পেত না। ভেতরে ভেতরে এত হাঁপিয়ে উঠছিল ও, তক্কে তক্কে ছিল জানলার পাশের কোনো কিউবিকল কবে খালি হয়।
হোক এইরকম বদ্ধ জানলা, নেই মামার চেয়ে কানামামা শতগুণে ভালো।
তারপর টেস্টিং টিমের অল্পাদি বলা নেই কওয়া নেই, দুম করে প্রোজেক্ট থেকে রিলিজ হয়ে যেতেই ম্যানেজারকে বলে-কয়ে প্রায় বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে ও দখল করেছিল এই কিউবিকলটা। নিজের মতো করে এই একফালি জায়গাটা সাজিয়েছিল ছোটো ছোটো ছবিতে।
বেশিরভাগই ওর আর অতন্দ্রর।
জিনিয়া নিজেও অবশ্য অল্পাদি-র মতো এই কিউবিকলের সাময়িক বাসিন্দা। এই সেক্টরে সবই সাময়িক। কে আর এখানে অনন্তকাল থাকতে এসেছে!
তবে অল্পাদি-র প্রসঙ্গ উঠলেই এখনও প্রোজেক্টের অনেকের মুখে ভয়ের ছায়া পড়ে। আর জিনিয়ার রাগ হয়। মনে হয়, এই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও চার্লি চ্যাপলিনের সেই ‘মডার্ন টাইমস’ সিনেমাটা ওদের জীবনে ভীষণভাবে সত্যি।
‘মডার্ন টাইমস’-এ যেমন কারখানার শ্রমিকদের যাতে খেতে গিয়েও একফোঁটা সময় নষ্ট না হয়, সেইজন্য আমদানি করা হয়েছিল খাইয়ে দেওয়ার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র, ঠিক তেমনই এই প্রাইমা ইনফোটেকেও ওদের প্রতিটা সময় মনিটর করা হয়। যত প্রয়োজনই পড়ুক, দিনে ন-ঘণ্টা অফিসে থাকা হল কি না তার সময় গোনে কার্ড পাঞ্চ করে ঢোকা বেরোনোর মেশিন। কিন্তু অদ্ভুতভাবে সেই থাকার ন্যূনতম সীমা রয়েছে, কিন্তু নেই কোনো ঊর্ধসীমা। বরং অলিখিতভাবে তুমি যতক্ষণ অফিসে থাকবে তুমি ততই দক্ষ কর্মী, এমনই ধারণা প্রচলিত এখানে।
আর ঠিক এই জায়গাটাতেই প্রথম আঘাত করেছিল অল্পাদি। একাই মুখর হয়েছিল প্রতিবাদে। আর তার মাশুলটাও তাকে ভালোমতোই দিতে হয়েছিল।
অল্পাদির চাকরি ছাড়াও একটা বড়ো সময় নিত তার নিজের একটা প্যাশন। একটা নিখাদ ভালো লাগার জায়গা।
অল্পাদি কেক বানাত। বাড়িতেই। যেমন তেমন বানানো কেক নয়, রীতিমতো দামি কনফেকশনারির কেকের মতো সুন্দরভাবে বেক করে, তার ওপর ক্রিম, ফনডেন্ট দিয়ে নানারকমের ডিজাইন করে। অল্পাদি-র কেক এত সুন্দর খেতে হত যে বোঝাই যেত না সেটা বাড়িতে তৈরি। কখনো বাটারস্কচ, কখনো ভ্যানিলা, নানাধরনের কেক বানিয়ে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের জন্মদিনে বা কোনো বিশেষ দিনে উপহার দিত অল্পাদি। এইজন্য ও বেকিং কোর্সও করেছিল। চাইলেই সেটাকে পেশা হিসেবে নিতে পারত।
কিন্তু অল্পাদি তার এই প্রতিভাটাকে কখনো টাকা রোজগারের পথ হিসেবে নেয়নি। বরং প্রোজেক্টের কোনো সহকর্মীর জন্মদিন থাকলেই বাড়িতে রাত জেগে খেটেখুটে কেক তৈরি করে নিয়ে আসত অফিসে। এইসব পাশ্চাত্য ঘরানার অফিসে কর্মীদের জন্মদিনে ছোটোখাটো একটা উপহার আর কেক খাওয়ানোর প্রচলন আছে। কোনো প্রোজেক্টে সহকর্মীরা সারাবছরের জন্য চাঁদা তুলে একটা ফান্ড তৈরি করে, তা থেকে খরচ দেওয়া হয়। কোথাও আবার প্রোজেক্টেরই একটা ফান্ড থেকে পয়সা নেওয়া হয়।
অল্পাদি যখন যে প্রোজেক্টে থাকতো, সেই প্রোজেক্টের লোকেদের উচিত ছিল অল্পাদি কেক বানিয়ে আনলে সেটা বানাতে যে জিনিসগুলোর প্রয়োজন পড়েছে সেই খরচটুকু অন্তত দিয়ে দেওয়া। কিন্তু কেউ সেসবের ধার মাড়াত না। অল্পাদিও চক্ষুলজ্জার খাতিরেই হোক কিংবা নিজের ভালোলাগার জিনিস বলে সেসব নিয়ে মাথা ঘামাত না। প্রতি মাসে দুই থেকে তিনবার কারুর না কারুর জন্মদিন প্রোজেক্টে লেগেই থাকত, আর অল্পাদিও প্রত্যেকবার নতুন নতুন থিমের কেক নিয়ে হাজির হত। জিনিয়ার তখনকার ম্যানেজার সোহিনীদি, সিনিয়র ম্যানেজার অমৃতদা থেকে শুরু করে নতুন ঢোকা ছেলেমেয়ে, প্রত্যেকে সেই কেক খেয়ে আঙুল চাটতে চাটতে অল্পাদি-র কেকের গুণগান গাইত।
জিনিয়া তখন প্রাইমা ইনফোটেকে নতুন। একদিন কথায় কথায় অল্পাদিকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আচ্ছা অল্পাদি, তুমি তো কেকের অর্ডার নিতে পারো। সিরিয়াসলি বলছি। তোমার কেক বানানোর যা হাত, এক বছরের মধ্যে তুমি নামকরা কনফেকশনারিগুলোকে গুনে গুনে গোল দেবে।’
‘ধুর!’ অল্পাদি হেসে বলেছিল, ‘কেক তো আমি ভালবেসে বানাই। প্রতিবার নতুন ফ্লেভার, নতুন স্বাদ, নতুন ডিজাইন বানাতে আমার ভালো লাগে। আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে কোনো বাচ্চার জন্মদিন হলে তার জন্য বানিয়ে দিয়ে আসি। কেক বানানোটা আমার নেশা রে। আর নেশাকে কোনোদিনও পেশা করবি না। তাহলে দেখবি, রোজকার লক্ষ্যপূরণের দৌড়ে, অর্ডার সাপ্লাইয়ের তাগিদে ভালোবাসাটাই নষ্ট হয়ে যাবে। নেশা নেশার জায়গাতে থাকাই ভালো।’
‘কিন্তু’ জিনিয়া বলেছিল, ‘তুমি এত দামি দামি ইনগ্রেডিয়েন্টস দিয়ে কেক বানাও, তারও তো একটা খরচ আছে, অল্পাদি। আমি সোহিনীদিকে বলব প্রোজেক্ট কস্ট থেকে এই খরচটা তোমায় দিতে?’
‘একদম না। ওরা নিজে থেকে বললে আলাদা কথা, যেচে বলার কোনো প্রয়োজন নেই।’ ভ্রূ কুঁচকে বলেছিল অল্পাদি, ‘আর টাকাটাই সব হল নাকি রে? আমার ওই কেকের জন্য প্রোজেক্টের প্রতিটা লোক আমায় কত ভালোবাসে দেখিস না?’
অল্পাদি সিনিয়র কর্মী হয়েও এই একটা ব্যাপারে ভুল করেছিল। ও বুঝতে ভুল করেছিল যে অফিসে যতই খাওয়াও, যতই ভালো করার চেষ্টা করো, এখানে কেউ কারুর নয়। সুযোগ পেলেই সবাই তোমার পেছনে বাঁশ দিতে উঠে-পড়ে লাগবে।
ঠিক সেটাই হল। অল্পাদির বাড়ি ছিল অনেকটা দূরে। দক্ষিণে বারুইপুর স্টেশনে নেমে আরও অনেকটা। ওর স্বামী আর্মিতে ছিল। বছরে দু-বার বাড়ি আসত। অল্পাদি-র পাঁচ বছরের ছেলেকে বাড়িতে আয়ার কাছে একা একাই থাকতে হত।
অল্পাদি তাই একটা নির্দিষ্ট টাইম মেইন্টেইন করত অফিসে। সকালে ঠিক সাড়ে ন-টায় ঢুকত, শুধুমাত্র দুপুরের খাওয়া ছাড়া সারাদিন কোনো সময় নষ্ট না করে সন্ধ্যাবেলা ঠিক সাড়ে ছটায় বেরিয়ে যেত। টানা ন-ঘণ্টা কাজ কিছু কম জিনিস নয়। আর অল্পাদি-র ক্লায়েন্টেরও কোনো সমস্যা ছিল না ওকে নিয়ে।
কিন্তু আঘাত এল অন্যদিক থেকে। প্রোজেক্টে যাদের অল্পাদি দিনের পর দিন কেক বানিয়ে নিয়ে এসে ভালোবেসে খাওয়াত, সেই বিধানদা, নিলয়দা, যোগিতাদিরাই ক্রমাগত ম্যানেজার সোহিনীদির কাছে অনুযোগ করতে লাগল। সেখানে বিশেষ পাত্তা না পেয়ে সিনিয়র ম্যানেজার অমৃতদার কাছে।
‘এগুলো কী অমৃতদা, তুমিই বলো! আমরা রাতে আটটা, সাড়ে আটটায় বেরোই, কোনো কোনোদিন তেমন কাজ থাকলে ন-টাও হয়ে যায়, আর সেখানে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড রসাতলে গেলেও অল্পাদি ঠিক কাঁধে ব্যাগ নিয়ে সাড়ে ছ-টায় বেরিয়ে যাবে।’ নিলয়দা ক্যাফেটেরিয়ায় অমৃতদার সঙ্গে কফি খেতে খেতে বলতো।
যোগিতাদি বা প্রমিতাদিরাও কম যায়নি তখন, ‘আগের সপ্তাহে যেদিন সার্ভার ক্র্যাশ করল, আমরা রাত দশটায় বেরিয়েছিলাম। আর অল্পাদি সেই সাড়ে ছ-টা। আরে আমরাও তো মেয়ে, আমাদেরও তো বাড়ি গিয়ে সংসার বলে একটা বস্তু আছে নাকি!’
জিনিয়া তখন একেবারে নতুন, তবু এই সেক্টরের কালচার দেখে ওর আশ্চর্য লাগত! বলতে ইচ্ছে হত, ‘অতই যদি তোমাদের সংসার আছে, তাহলে আধঘণ্টা অন্তর অন্তর উঠে গিয়ে লাউঞ্জে বসে পরনিন্দা পরচর্চা কর কেন। অল্পাদি-র মতো টানা কাজ শেষ করে বাড়ি গেলেই পারো!’
কিন্তু সেটা তখন সবার চেয়ে জুনিয়র হয়ে বলা যায় না। কিন্তু ও এটা বলেছিল যে, সেদিন অল্পাদি বেরোনোর আগে তো জানত না যে সার্ভার ক্র্যাশ করবে! তাও তো বাড়ি ফিরে নিজের ল্যাপটপ থেকে সাপোর্ট দিয়েছিল।
কিন্তু ওর বলায় কিছুই লাভ হয়নি। সে-বছর সমান দায়িত্বের সঙ্গে কাজ করেও অল্পাদিকে সবচেয়ে কম রেটিং দেওয়া হয়েছিল। জিনিয়া নিজে তো বটেই, বাকি জুনিয়ররাও অবাক হয়ে গিয়েছিল, যে এত কাজ করে তার এই দশা?
অল্পাদি অবশ্য প্রতিবাদ করেছিল। সবার সামনেই সেদিন ম্যানেজার সোহিনীদিকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এই প্রোজেক্টে কে কাজ করে সোহিনীদি? যারা সকাল দশটায় ঢুকে চোদ্দোবার বাইরে বেরিয়ে আড্ডা মারে, ক্যান্টিনে গিয়ে টেবিল টেনিস খেলে, সন্ধেবেলা অফিসের জিমে গিয়ে শরীরচর্চা করে হেলেদুলে রাত আটটায় বেরোয়, তারা? না যে এসব কিছুই না করে টানা কাজ করে সময়মতো বেরোয়। কর্মী কী ডেলিভারি দিচ্ছে সেটা হল আসল প্রশ্ন, কতক্ষণ থাকছে সেটা তো সব হল না! একজন মানুষের কাজের জায়গায় যেমন দায়িত্ব থাকে, বাড়িতেও তো থাকে!’
কিন্তু অল্পাদি যতই যুক্তি দিয়ে বিদ্রোহ করুক, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। খারাপ রেটিং দেওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবেই রিলিজ করা হয়েছিল ওকে। তারপর বেশ কিছুদিন ও কোনো প্রোজেক্ট পায়নি, চুপচাপ অফিসে আসত, কার্ড পাঞ্চ করে সারাদিন লাউঞ্জে বসে থেকে বাড়ি ফিরে যেত। আই টি পরিভাষায় এটাকে বলে ‘বেঞ্চে থাকা’।
বেঞ্চে থাকার কয়েক মাসের মধ্যেই ওকে স্যাক করে দেওয়া হয়। সেদিন হয়ত অল্পাদি বুঝেছিল, এই দুনিয়ায় যতই করো, কেউ কারুর নয়। সে অফিসই বলো, আর সংসার। সুযোগ পেলেই মানুষ ক্ষতি আর প্রতারণা করার জন্য মুখিয়ে আছে।
জিনিয়া অন্যমনস্কভাবে স্মৃতির কোন অতলে চলে গিয়েছিল। হলদে হয়ে যাওয়া পুরোনো বিবর্ণ ফটো অ্যালবামে রাখা একটা করে ছবি যেন অগোছালোভাবে ভেসে উঠছিল ওর চোখের সামনে।
ভাবতে ভাবতে ও ডেস্কে রাখা ওর আর অতন্দ্র-র ছবিগুলোর ওপর আলতোভাবে হাত বোলাচ্ছিল।
সত্যি, মানুষ বদলে যায়, কিন্তু ছবিগুলো কেমন একই রয়ে যায়। ছোটো ছোটো দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে জিনিয়া আঙুলের একেকটা টোকায় পেছন দিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছিল ছবিগুলো।
যাক, সব চোখের সামনে থেকে সরে যাক আস্তে আস্তে!
এখন রাত প্রায় আটটা। এত উঁচু থেকে শহরটাকে অনেকটা এরোপ্লেন থেকে দেখার মতোই লাগছে। মনে হচ্ছে গোটা সেক্টর ফাইভটা যেন অজস্র আলোকবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ছোটো ছোটো অসংখ্য আলো কোথাও মালার মতো বৃত্তাকারে, কোথাও সারি বেয়ে সাজানো রয়েছে। মাঝখান দিয়ে চলমান আলোকবিন্দুগুলো বাস বা গাড়ির হেডলাইট। সেগুলোকেও একেকটা বিদ্যুৎ শিখা মনে হচ্ছে।
জিনিয়া কফির মাগটা দু-হাতে চেপে ধরে তাতে ঠোঁট ডোবাল। তারপর কিছুটা কফি গিলে নিয়ে কাচের ওপরের দিকটা তাকাল। রাতের আকাশ। বেশ পরিষ্কার। ছোটো ছোটো তারাগুলো মিটমিট করছে।
আর ওকে যেন নিঃশব্দে হাতছানি দিচ্ছে, বলছে, ‘বেরিয়ে পড়ো! সব ছেড়েছুড়ে বেরিয়ে পড়ো! আর কতদিন? আর কত? সংসারে কেউ কারুর নয়। যত জড়াবে তত কষ্ট পাবে!’
ছিন্ন শিকল পায়ে নিয়ে ওরে পাখি
যা উড়ে, যা উড়ে, যা রে একাকী।।
‘কীরে, তোকে না ডাক্তার বলেছে বেশি কফি না খেতে? সকাল থেকে তো পাঁচ-ছ-কাপ খেয়ে ফেললি!’
জিনিয়া চমকে তাকাল। সামান্যতেই চমকে যাওয়া ওর এক বিশ্রী অভ্যেস। নাহয় ঋতুপর্ণা আচমকাই ডেকেছে, কিন্তু তাই বলে টেকনোপলিস বিল্ডিং-এর এই এগারো তলায় কোনো বাঘ সিংহ তো আসবে না যে ওকে সটান খেয়ে ফেলবে!
জিনিয়াকে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঋতুপর্ণা আবার বলল, ‘কী হল? কী ভাবছিস এত!’
জিনিয়া এবার মাথা নাড়ল। চোখ ফিরিয়ে বলল, ‘না কিছু না। মাথাটা খুব ধরেছে, তাই আবার একটু কফি নিয়ে এলাম।’
‘এত কফি খাস না। শরীরের জন্য ভাল নয়।’ ঋতুপর্ণা ওর কাঁধের ওপর হাত রাখল, ‘আটটা তো বেজে গেছে। বেরোবি কখন?’
জিনিয়া গায়ের পাতলা চাদরটা ভালো করে আরেকবার জড়িয়ে নিল। সারাদিন এই বদ্ধ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে থাকতে থাকতে এত ঠান্ডা লাগে, যে বারো মাস ওদের এই চাদর জড়িয়ে বসে থাকতে হয়।
মাঝে মাঝে ওর মনে হয় কোনো দামি মর্গে বসে কাজ করে ওরা। মর্গে যেমন ঠান্ডা, নিস্তব্ধ ঘরে সারি দিয়ে দিয়ে বেওয়ারিশ লাশ রাখা থাকে, তেমনই ওরাও যেন একেকটা লাশের মতো পর পর কিউবিকলে বসে মুখ বুজে কাজ করে যায়।
মর্গে শুয়ে থাকা পচা গলা লাশগুলো জোরে কথা বলে উঠতে পারে না, হালহা করে হাসতে কিংবা চিৎকার করে কাঁদতে, কিছুই পারেনা। আর জিনিয়াদের সেগুলো করার ক্ষমতা থাকলেও এখানে সেসব করা যায় না।
কাজেই ওরা প্রত্যেকেই একেকটা পচা গলা লাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। মনের দিক থেকেও তাই।
ও ক্লান্ত গলায় বলল, ‘বেরোতে তো যাচ্ছিলাম। গিরীশদা আটকে দিল। সাড়ে আটটার সময় একটা অনসাইটের কল আছে। সেটা নিতে হবে। তাই বেকার বসে আছি এখন।’
ঋতুপর্ণা চোখ কপালে তুলে বলল, ‘সাড়ে আটটা? এত দেরি? বাবা! কেন একটু আগে শিডিউল করতে কী হয়, বুঝি না। লোকজন কী বাড়ি যাবে না নাকি?’ তারপরই ও গলার স্বর পালটে ফেলে গলা নামিয়ে বলল, ‘আর তুইই, বা এখনও এত কাজ দেখাচ্ছিস কেন? তোকে আর কে কী বলবে? পাতা তো অলরেডি ফেলেই দিয়েছিস, আর তো পনেরো দিনও বাকি নেই, তারপরই মুক্তি। তুই বেরিয়ে যা, বল, এতক্ষণ থাকতে পারব না।’
জিনিয়া একটা ছোটো নিশ্বাস ফেলল। কোনো উত্তর দিল না। ঋতুপর্ণা এমনিতে অফিসে ওর বেশ ভালো বন্ধু, এই ল্যাং মারামারি আর পেছনে কূটকচালি করা সেক্টরে সহকর্মী যতটা ভালো বন্ধু হতে পারে, তার চেয়ে খানিকটা বেশিই বলা চলে। গত কয়েকমাসে নানা ব্যাপারে ছোটোবড়ো অনেক উপকারও পেয়েছে ও ঋতুপর্ণার থেকে।
কিন্তু এই মুহূর্তে ওর উপস্থিতি যেন খানিকটা বিরক্ত করে তুলল জিনিয়াকে।
ও কথা না বাড়ানোর জন্য বলল, ‘হ্যাঁ। এবার তাই বলতে হবে।’
‘বলতে হবে, বলতে হবে করেই তো এতগুলো দিন কাটিয়ে দিলি। শেষ অবধি বলবি আর কবে?’ ঋতুপর্ণা ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘আমি যদি তোর জায়গায় থাকতাম, গোটা প্রোজেক্টে বিক্ষোভ দেখিয়ে দেখিয়ে শোরগোল ফেলে দিতাম। কিছুই করতে পারত না। কোনো অ্যাপ্রেইজালের চাপ নেই, রেটিং-এর চাপ নেই, উফ শান্তি শান্তি!’
জিনিয়া একটা হাই তুলে বলল, ‘তুই কখন বেরোবি?’
‘আমাদের টিমে তো রোজই ন-টা বাজে জানিসই তো।’ ঋতুপর্ণা চুলে হাত বুলোতে বুলোতে বলল, ‘ওইজন্যই তো দেরি করে ঢুকি। কী হবে সাততাড়াতাড়ি এসে!’ বলতে বলতে ও চুপ করে গেল। জিনিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে নরমগলায় বলল, ‘এই! কী হয়েছে বল তো তোর? কেমন একটা ভ্যাবলার মতো বসে রয়েছিস সেই থেকে! বিকেলেও সিট থেকে দেখলাম মাথা নিচু করে শুয়ে আছিস!’
জিনিয়া ঢোঁক গিলল। বলল, ‘কিছু না।’
ঋতুপর্ণা ভ্রূ কুঁচকোল, ‘কয়েকজন কাস্টমার তো পেয়েছিস বললি, অতন্দ্র জোগাড় করেছে। আর লোক হচ্ছে না?’
জিনিয়া মাথা নাড়ল, ‘সেসব নয়।’
ঋতুপর্ণা ছাড়ার বান্দা নয়, বলল, ‘ব্যাঙ্কে আবার কোনো সমস্যা হয়েছে?’
জিনিয়ার এবার বিরক্ত লাগল। মানুষের এত অযাচিত কৌতূহল কেন সেটা ওর মাথায় কিছুতেই ঢোকে না। অবশ্য ওরই ভুল, ব্যাঙ্কের ঝামেলাটা যখন চলছিল, তখন ও-ই সেটা আগ বাড়িয়ে ঋতুপর্ণার সঙ্গে শেয়ার করেছিল। না করে উপায়ও ছিল না। ঋতুপর্ণার দাক্ষিণ্যেই অত সস্তায় সল্টলেকের ওই গ্যারাজ ঘরটা অফিস খোলার জন্য ভাড়া পেয়েছে ও। লোনের সমস্যাটা ওকে খুলে না বললে কি ওর বর অত সস্তায় ওর কাকার গ্যারাজটা ভাড়া দিতে উদ্যোগী হত?
ঋতুপর্ণা মেয়েটা ভালো, ওর শুভাকাঙ্ক্ষীও, কিন্তু মাঝে মাঝে এমন সময় আসে, কাউকে কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় বলে, পারো তো মুখ দেখে বুঝে নাও আমার কষ্টটা। জিজ্ঞেস করো কেন!
ও বিরসমুখে বলল, ‘তোকে তো বলেইছি লোনটা স্যাংশন হয়ে গেছে। ফ্ল্যাটটা মর্টগেজ দিলাম। ফুলুমামার এক বন্ধু ওই ব্যাঙ্কের উঁচু পোস্টে আছেন। উনিই ক্যাশ ক্রেডিটটার ব্যাপারে সাহায্য করেছেন।’
ঋতুপর্ণা বলল, ‘তবে? তবে তুই মুখটা তোলো হাঁড়ির মতো করে রেখেছিস কেন এটাই তো মাথায় ঢুকছে না আমার! কাস্টমারও পেয়ে গিয়েছিস, কোম্পানির ট্রেড লাইসেন্স, রেজিস্ট্রেশন সব হয়ে গেছে, লোনও পেয়ে গেলি, এবার তো তোদের স্বপ্নটাকে সত্যি করার সময় জিনি!’
জিনিয়া ম্লান হাসল। অফশোর ডেলিভারি সেন্টারের এই বে এবার আস্তে আস্তে ফাঁকা হতে শুরু করেছে। লোকজন পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে চলে যাচ্ছে লিফট লবিতে।
আজকের মতো গম পেষার কাজ শেষ!
কথাটা মনে করেই মনটা আরও তেতো হয়ে গেল ওর। আই টি সেক্টরের কাজকে মশকরা করে গম পেষা বলাটা অতন্দ্রর কথা।
আর সেটা ওর এখনই মনে পড়তে হল?
ঋতুপর্ণা আবার খোঁচাল, ‘কি হয়েছে বল না রে। আমার এখনও কিছুটা কাজ পেন্ডিং রয়েছে। তুই এমন মুখ করে বসে থাকলে যেতেও পারছি না।’
জিনিয়া একবার ভাবল কিছু বলবে না। কিন্তু তারপরে উদাস চোখে দূরের অফিসবাড়িগুলো দেখতে দেখতে বলেই ফেলল, ‘আমাদের সম্পর্কটা আর টিকবে না মনে হয়, জানিস!’
‘টিকবে না’ শব্দটা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে উচ্চারণ করা মাত্র নিজে থেকেই চোখের কোণে ওর জল চলে এল। সেটা লক্ষ করে ও নিজেই অবাক হয়ে গেল। রাগও হল প্রচণ্ড। এতটা বেহায়া কেন ও। অত বাজে বাজে কথা শোনার পরেও ওর চোখে জল আসছে কী করে!
মানুষ খারাপ হলে তার সঙ্গে মানিয়ে গুছিয়ে থাকা যায়, কিন্তু চণ্ডালের সঙ্গে থাকা যায় না। প্রতারকের সঙ্গে জীবন কাটানো যায় না।
ঋতুপর্ণার চোখ দুটো মুহূর্তে দশ টাকার রসগোল্লার সাইজের হয়ে গেল, ‘ইয়ার্কি মারছিস নাকি!’
জিনিয়ার বিরক্তি উত্তরোত্তর বাড়ছিল। রুমাল দিয়ে চোখের পাতায় টলটল করতে থাকা অশ্রুবিন্দুকে মুছে নিতে নিতে ও প্রায় খিঁচিয়ে উঠে বলল, ‘তোর যদি মনে হয় আমি ইয়ার্কি মারছি, তাহলে আমার আর কিছু বলার নেই। বিরক্ত করিস না।’
‘দাঁড়া দাঁড়া।’ ঋতুপর্ণা ওর খেঁকিয়ে ওঠাটাকে পাত্তাই দিল না, ‘তুই আর অতন্দ্র তোরা দু-জনেই অফিসে রিজাইন করে দিয়েছিস এবং এই মুহূর্তে নোটিশ পিরিয়ডে রয়েছিস, রাইট? দু-জনেরই অফিসে শেষ দিন আসতে আর বারো-তেরোদিন বাকি। তারপর তোরা নিজেদের ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছিস এবং সেখানে তোরা দু-জনে বিজনেস পার্টনার। গত মাসে অতন্দ্র দুটো ট্রেড ফেয়ারে গিয়ে কয়েকজন কাস্টমার পেয়েছে। তুইও আরেকটা মেলা কভার করলি। আমার বরের সোর্সে আমার এক কাকাশ্বশুরের সল্টলেকের গ্যারাজ ভাড়া নিয়ে ছোট্ট অফিসও করেছিস। আমি ঠিক বলছি তো?’
‘এগুলো সবই তুই ভালমতো জানিস, এখন আবার ফাটা রেকর্ড বাজানোর কী মানে!’ জিনিয়া ভ্রূ কুঁচকে বলল।
‘বাজাচ্ছি কারণ এর মধ্যে এইসব ভুলভাল জিনিস কোথা থেকে চলে এল!’ ঋতুপর্ণা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘ঝগড়া কোন বাড়িতে হয় না? আমার সঙ্গে ইমরানের হয় না?’
জিনিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
‘তোর তো তবু বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি সবাই আছেন, দুজনকে তাঁরা বোঝাতে পারেন।’ ঋতুপর্ণা এবার নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরল, ‘আমার কে আছে? কেউ যোগাযোগ রাখে? বাবা-মা-বোন? গত একটা বছর কারুর গলা অবধি শুনিনি। বাবা পরিষ্কার বলে দিয়েছিল, বোনের সঙ্গেও যেন যোগাযোগ না রাখি, তাতে ওর বিয়ে দিতে সমস্যা হবে। একদিন ইমরানের সঙ্গে কথা বন্ধ থাকলেই ভেতরটা অস্থির লাগে। মনে হয় গোটা পৃথিবীতে আমার বুঝি কেউ নেই।’
জিনিয়া চোখ সরিয়ে সামনের অফিসফোনটার দিকে তাকাল। সেটা বিপ বিপ শব্দ করে আলো জ্বালাচ্ছে। তার মানে অনসাইট থেকে ফোন ঢুকছে।
আই টি সেক্টরে এই কল নেওয়া ব্যাপারটা একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। একটা প্রোজেক্টের প্রধানত দুটো ভাগে কর্মী থাকে, কয়েকজন থাকে অনসাইটে অর্থাৎ বিদেশে ক্লায়েন্টের কাছে, আর একদল থাকে অফশোরে মানে এদেশে। প্রতিদিনের কাজের ব্যাপারে দুই তরফের মধ্যে দিনের কোনো একটা সময়ে ফোনে কথা বলে প্রোজেক্টকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই কলের প্রধান উদ্দেশ্য।
জিনিয়া ফোনের ‘রিসিভ’ বোতামটা টিপে দিয়ে নরম গলায় বলল, ‘তুই এখন যা। তোর সঙ্গে পরে কথা বলব।’
ঋতুপর্ণা অমনি ঝুঁকে পড়ে ফোনের স্ক্রিনটা দেখে নিল। মাল্টিপার্টি কল এটা। মানে একসঙ্গে প্রায় কুড়ি-পঁচিশজন কনফারেন্সে কথা বলবে। কেউ বসে আছে চেন্নাইয়ের অফিসে, কেউ পুনাতে, কেউ আবার মার্কিন মুলুকে। এই ধরনের কলগুলোয় কাজের কথা কম, এর ঘাড়ে ওর দোষ চাপানো বেশি হয়। ও বলল, ‘তুই একা তো কলে নেই, মিউট করে দে না।’
জিনিয়া এবার আগুনচোখে ঋতুপর্ণার দিকে তাকাল, চাপা গলায় বলল, ‘তুই কিন্তু খুব জ্বালাচ্ছিস ঋতুপর্ণা!’
ঋতুপর্ণা দমল না, জিনিয়াকে ও ভালো করে চেনে।
ওদিকে কনফারেন্স কলে এর মধ্যেই দুটো লোক উত্তেজিত হয়ে কিসব পরিসংখ্যান তুলে কাজের হিসেব বুঝিয়ে চলেছে। দু-জনের ইংরেজি অ্যাকসেন্টই যাচ্ছেতাই রকমের জড়ানো। একজন দক্ষিণ ভারতীয়, অন্যজন আমেরিকান।
ঋতুপর্ণা হাত বাড়িয়ে ফোন সেটের ‘মিউট’ বোতামটা টিপে দিল, ‘চল পাঁচমিনিটের জন্য ক্যাফেটেরিয়া থেকে ঘুরে আসি। একটা স্যান্ডউইচ না খেলে মুখটা কেমন তেতো তেতো লাগছে।’
জিনিয়া আর কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না। ওর স্বভাবটাই এ-রকম। রেগে গেলে দুমদাম বলে দেয়, কিন্তু পরক্ষণে ভালো ব্যবহার পেলেই রাগ গলে জল হয়ে যায়। যা হোক তবু তো কেউ একজন জিজ্ঞেস করছে বার বার! এই মুহূর্তে ঋতুপর্ণাকেই সবচেয়ে বড়ো শুভাকাঙ্ক্ষী মনে হল ওর।
ও একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গা থেকে চাদরটা খুলে ভাঁজ করে রাখল টেবিলে, ফোনে চলতে থাকা কথার ভলিউমটাকে একদম কমিয়ে দিল, তারপর ম্লান মুখে বলল, ‘চল।’
৪
অতন্দ্র উদাস চোখে করিডরের এককোণে বসে ছিল। শুধু বসে ছিল বলা ভুল, হাতে ধরা একটা পেপারব্যাকের পাতা ওলটাচ্ছিল আর দুই কানে হেডফোন গুঁজে পা-দুটোকে আনমনে নাচাচ্ছিল।
পাশেই কেয়ারি করা সবুজ গাছ শুরু হয়েছে, তারপর চোখ জুড়োনো বাগান। ওদের টেকি ওয়ার্ল্ড অফিস ক্যাম্পাসের নান্দনিক সৌন্দর্যের সত্যিই কোনো তুলনা নেই। হতে পারে শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে অনেক দূরে, হতে পারে এখানে অফিস করতে হলে সবাইকে সাতসকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্রেন, বাস অনেক কিছু উজিয়ে আসতে হয়, তবু একবার ঢুকে পড়া মাত্র মনটা যেন তাজা হয়ে যায়। মন চলে যায় দুর্গাপুরের সেই ফাঁকা রাস্তাগুলোয় যেখানে কেটেছে ওর শৈশব, কৈশোর।
এখন দিনের শেষ। লবি দিয়ে দল দল ছেলেমেয়ে কাঁধে ব্যাগ আর গলায় আইডেন্টিটি কার্ড ঝুলিয়ে হেঁটে যাচ্ছে গেটের দিকে। তাদের বেশিরভাগ কথাবার্তাই প্রোজেক্ট ও কাজ সম্পর্কিত। আর কয়েকদিন বাদেই এই বছরের রেটিং বেরোনোর কথা। কে ম্যানেজারের ফ্ল্যাটে নিত্যদিন স্কচ নিয়ে যায়, কার রাত দুটো অবধি বসের সঙ্গে অন্তরঙ্গ ভিডিয়োচ্যাট চলে, কে কাকে লেঙ্গি মারতে পারে এইসব নিয়েই চলছে তাদের আলোচনা।
অতন্দ্র বেশ খানিকটা দূরে বসে আছে, ফলে তাদের কথাবার্তা ঝিঁঝিঁপোকার গুঞ্জনের মতো হয়ে হেডফোন ছাপিয়ে ঢুকে পড়ছে অতন্দ্রর কান দুটোয়।
দুটো ছেলে কথা বলতে বলতে এদিকে আসছিল, অতন্দ্র তাদের দেখেই বইটাকে যতটা সম্ভব চোখের কাছাকাছি তুলে আনল। ছেলে দুটোর মধ্যে একজন ওর পুরোনো একটা প্রোজেক্টের জুনিয়র, নাম শুভ্রদীপ।
কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের মুখে-চোখে যেন অবসাদ মাখানো থাকে। দিব্যি খাইদাই বগল বাজাই টাইপ মুডও যেন পলকে হতাশায় পরিণত হয় এইসব মানুষের সংস্পর্শে এলে। এই শুভ্রদীপ ছেলেটাও তেমনই। সারাক্ষণ মুখটা বাংলার পাঁচ করে রেখেছে, দেখা হলে একটাই কথা, এই কোম্পানিতে আর পেরে উঠছি না গো, অন্য কোথাও ইন্টারভিউ দিচ্ছ?
অতন্দ্রর এখন মুখে চার অক্ষরের গালাগালি এসে যায়, মনে হয় বলে দেয়, কেন রে ভাই, তোর এই কোম্পানি পোষাচ্ছে না বলে কি অন্যদেরও পোষাবে না?
কিন্তু অতন্দ্র প্রাণপণ নিজেকে লুকিয়েও রক্ষা করতে পারল না, শুভ্রদীপ ঠিক ওকে দেখতে পেয়ে গেল। এগিয়ে এসে বলল, ‘হাই অতন্দ্রদা!’
অতন্দ্রদা মুখের সামনে থেকে পেপারব্যাকটা নামিয়ে কাষ্ঠ হেসে বলল, ‘আরে শুভ্রদীপ যে! কী খবর?’ তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করে বলল, ‘বন্ধুর সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। ঘোর ঘোর, এনজয় ইয়োরসেলফ ব্রো!’
‘আরে না, না!’ শুভ্রদীপ অমনি পাশের বন্ধুটাকে বলল, ‘তুই ডেস্কে যা, আমি একটু পরে যাচ্ছি।’ বলে অতন্দ্রর পাশে বসে পড়ল, ‘তোমার কী খবর, বলো। এত রাতেও রয়েছ? তুমি তো এখন আমাদের উইং-এর হিরো!’
অতন্দ্র মনে মনে বাছা বাছা দুটো খিস্তি দিয়ে বলল, ‘কেন ভাই?’
‘এই যে, কেমন ঘ্যাম নিয়ে রিজাইন করছ। ক-জন পারে বলো!’ মাথা দুলিয়ে শুরু করল শুভ্রদীপ, ‘আমার কথাই ধরো না, এই নিয়ে উনিশটা কোম্পানিতে কল পেলাম, প্রতিটায় লাস্ট রাউন্ডে গিয়ে কেটে যাচ্ছি। ভালো লাগে?’
‘ভালো তো। তুই তো দেখছি সুকুমার রায়ের সেই গঙ্গারাম হয়ে গেছিস! গঙ্গারাম উনিশবার ম্যাট্রিকে ধেড়িয়েছিল আর তুই চাকরির ইন্টারভিউতে।’ ব্যাজারমুখে বিড়বিড় করল অতন্দ্র।
‘কিছু বললে?’ শুভ্রদীপ ঝুঁকে এল, ‘তার ওপর আমার ম্যানেজারটা এত বাড়াবাড়ি শুরু করেছে, বলছে সামনের দুটো মাস উইকএন্ডেও আসতে হবে, নাহলে রেটিং-এ ঝুলিয়ে দেব। কী বলি বলো!’
অতন্দ্র সমব্যথীর ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়তে নাড়তে হেডফোনের ভলিউমটা বাড়িয়ে দিল।
কোথাও শান্তি নেই। শালা, একে মেজাজ খিঁচড়ে আছে, তার ওপর এর বকবকানি। সরু চোখে চারপাশে তাকাতে তাকাতে দূরে একটা মেয়ের দিকে চোখ পড়তেই ওর বুকের ভেতরটা প্রথমে কেমন যেন ধক করে উঠল।
তারপর ভালো করে নজর করে বুঝল, না, ওটা জিনিয়া নয়। জিনিয়া তো এখন সেক্টর ফাইভে ওর অফিসে, এখানে কী করে আসবে!
কিন্তু এই মেয়েটার মতো জিনিয়ারও ঠিক এইরকম একটা কুর্তি আছে। অতন্দ্রই কিনে দিয়েছিল কয়েক মাস আগে কী যেন একটা উপলক্ষ্যে। মেয়েটাকে আলগা দেখতে দেখতে ওর মনটা চট করে দু-ভাগে ভাগ হয়ে গেল।
একদিক বলল, এই যে জিনিয়ার সঙ্গে ওর মামুলি ঝগড়াটা তিক্ততার দিকে চলে যাচ্ছে, এটার কি সত্যিই কোনো মানে আছে? এখন সময় আছে, ওর নিজের কি উদ্যোগ নিয়ে ঝামেলাটা মিটিয়ে নেওয়া উচিত নয়?
অন্যদিক অমনি ফোঁস করে উঠল, মামুলি কি করে বলছে ও? যে বউ নিজের বরের সম্মান অসম্মানের তোয়াক্কা করে না, সামান্য ব্যাপার নিয়ে তুলকালাম বাধায়, তার সঙ্গে আবার ঝামেলা মেটানো কীসের?
অতন্দ্র যখন ভেতরে ভেতর দোনোমনায় ভুগতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই হেডফোনের ভলিউম ভেদ করে ও শুভ্রদীপের গলা শুনতে পেল, ‘কাল রাতে জিনিয়াদির সাথে চ্যাট করছিলাম। বলল, তুমি নাকি তোমাদের ওই জয়েন্ট বিজনেসটায় ইন্টারেস্টেড নও? এদিকে রিজাইন তো করে দিয়েছ।’ কথাটা বলেই একশো চৌত্রিশ নম্বর বার সেই একঘেয়ে কথাটা বলল ছেলেটা, ‘তাহলে কি অন্য কোথাও ইন্টারভিউ দিচ্ছ? দিলে, আমাকে বোলো। আমিও অ্যাপ্লাই করবো।’
অতন্দ্র পা নাচাতে নাচাতে হঠাৎ থেমে গেল। কান থেকে হেডফোনটা খুলে বলল, ‘জিনিয়া তোকে বলেছে আমি বিজনেসে ঢুকছি না?’
‘হ্যাঁ, বলল তো।’ শুভ্রদীপ সেই মিনমিনে গলায় বলল, ‘আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের বিজনেস শুরু করার কতদূর? ক-টা পার্টি পেলে? দেখলাম আমার মেসেজটা দেখল, কিন্তু দেখেই অফলাইন হয়ে গেল। আমি ভাবলাম বুঝি ইন্টারনেটের সমস্যা, তখন আবার ফোন করলাম। দু-বার রিং হওয়ার পর রিসিভ করে বলল অতন্দ্র এই বিজনেস করবে না।’
কোথা থেকে কী হল কে জানে, অতন্দ্রর মাথায় আচমকা যেন খুন চেপে গেল। কয়েক সেকেন্ড আগের ঝামেলা মিটিয়ে নেওয়ার কথাটা যেন মুহূর্তের মধ্যে ধূমকেতুর মতো হাওয়া হয়ে গেল ওর মস্তিষ্ক থেকে।
কলেজ, চাকরি, বিবাহিত জীবন মিলিয়ে জিনিয়াকে দেখছে আজ এতগুলো বছর হয়ে গেল, এই একটা জঘন্য স্বভাব মেয়েটা কিছুতেই পালটাতে পারল না। সেটা হল ঘরের কথা বাইরে গিয়ে বলা।
নিজেদের দাম্পত্য কলহের কথা বাইরে থেকে শুনলে মাথায় রক্ত উঠে যায় অতন্দ্রর, মনে হয় ওকে কেউ যেন রসিয়ে রসিয়ে উলঙ্গ করে দিচ্ছে বাজারের মাঝখানে।
কতবার ঝগড়াশেষে অতন্দ্র বুঝিয়েছে ওকে, আচ্ছা আমরা আদর করি দরজা বন্ধ করে, ঝগড়া করার সময় কেন সেই দরজা হাট করে খুলে দেব বলো তো?
কিন্তু কোনো লাভ হয়না। যে কে সেই!
শুভ্রদীপকে ওরই মতো জিনিয়াও পছন্দ করে না, কিন্তু তার কাছে এসে অতন্দ্রর নামে কুকথা বলতে একটুও বাধল না ওর!
তার ওপর কথার ভঙ্গিমা শোনো। অতন্দ্র নাকি এই বিজনেসে ইন্টারেস্টেড নয়, অতন্দ্র এই বিজনেস করবে না।
শালা, তাহলে আমার এত টাকা ইনভেস্টমেন্টের কী হল? আমি নাহয় বিজনেস করব না, ট্রেড লাইসেন্স জিনিয়ার নামে, তাহলে আমার টাকাটা মানে মানে দিয়ে দাও, চাঁদু!
আগের মাসে অফিস থেকে এতগুলো ছুটি নিয়ে যে খদ্দের জোগাড় করলাম, নিজের বন্ধুদের বলে বলে মুখ ব্যথা করে ফেললাম, তার জন্য কোনো কৃতজ্ঞতা বোধও নেই!
তা ছাড়া যে ফ্ল্যাটটা মর্টগেজ দিয়েছ, সেটাতেও তো আমার ইনভেস্টমেন্ট আছে। সেইসব টাকাও ফেরত দেবে না, এদিকে লোকের কাছে সব খুল্লাম খুল্লা বলে বেড়াচ্ছ! মামদোবাজির একটা লিমিট আছে।
অতন্দ্র মনে মনে গজরাচ্ছিল।
‘কী গো, বললে না তো, অন্য কোথাও ইন্টারভিউ দিচ্ছ?’ শুভ্রদীপ নির্বিকার মুখে প্রশ্নটা আরও একবার করল।
খুন করার আগে খুনি যেভাবে ঠান্ডা চোখে শিকারকে লক্ষ করে, অতন্দ্র সেইভাবে শুভ্রদীপের দিকে তাকাল। মনে হল ঘুসি মেরে প্রথমেই ছেলেটার চার টাকার শিঙাড়ার মতো নাকটাকে ফাটিয়ে দেয়।
অনেক কষ্টে নিজেকে কন্ট্রোল করল ও। গোটা ইউনিট জানে অতন্দ্র ব্যবসা করবে বলে রিজাইন করেছে, সেখানে ব্যবসা করবে না শুনলে সবারই আশ্চর্য লাগার কথা। কিন্তু এই ক্যালানে কেষ্টটার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। শুভ্রদীপের জীবনে একটাই কৌতূহল, কে এই কোম্পানি থেকে বেরোনোর জন্য ক-টা ইন্টারভিউ দিচ্ছে।
ওয়ার্থলেস একটা!
অতন্দ্র অতি কষ্টে নিজেকে ঠান্ডা রেখে বলল, ‘হ্যাঁ রে, দেব। তুই একদম চাপ নিবি না, দিলেই তোকে জানাব, কেমন? এখন আসি। কল আছে একটা।’ বলে আর উত্তরের অপেক্ষা না করে হনহন করে হাঁটতে আরম্ভ করল বাইরের দিকে।
পেছনে শুভ্রদীপ বোধ হয় অবাক হয়ে গেছে, হাঁ করে দেখছে যে কল আছে বলে অতন্দ্র অফিসের ভেতর না ঢুকে বাইরের দিকে চলে যাচ্ছে কেন।
যা ভাবে, ভাবুক! অতন্দ্র নো স্মোকিং জোন থেকে বেরোতে বেরোতে ফস করে একটা সিগারেট ধরাল। তারপর ধোঁয়াটাকে যতটা পারা যায় নাকমুখ দিয়ে গিলতে গিলতে ফোন করল জিনিয়াকে।
বড্ড বাড় বেড়েছে। ও যখন লোকজনের কাছে অতন্দ্রর প্রেস্টিজ নয়-ছয় করে বেড়াচ্ছে, অতন্দ্ররই-বা কী দায় পড়েছে স্বামী হিসেবে রাখঢাক করার? আর তা ছাড়া কীসের স্বামীস্ত্রী? সেদিন অত বড়ো অন্যায় কাজ করল, তারপর বড়ো মুখ করে বলে গেল যে স্বামী ঠকায়, কথায় কথায় জিনিস ছোড়ে, কাচের গ্লাস ভাঙে, তার সঙ্গে নাকি থাকা যায় না।
বলে গেল এরপর নাকি সোজা কোর্টে দেখা হবে।
তা হোক! অতন্দ্রর কী? কত বড়ো স্পর্ধা! সেদিনের ওইরকম অশান্তির পরেও লোকের কাছে এইসব বলে বেড়াচ্ছে।
ফোনটা প্রথমে বেজে বেজে কেটে গেল। অতন্দ্র থামল না। আবার করতে লাগল।
এবারেও যখন ফোনটা কেটে যাবে কেটে যাবে করছে, সেইসময়েই জিনিয়া ফোনটা রিসিভ করল, কাঁপা গলায় বলল, ‘হ্যালো?’
‘এই, তুই কী ভেবেছিসটা কী, অ্যাঁ?’ বাঁ হাতের দুটো আঙুলের ফাঁকে সিগারেটটা গুঁজে অতন্দ্র চিবিয়ে চিবিয়ে ডাইরেক্ট তুইতোকারি শুরু করল, ‘তুই লোকের কাছে বলে বেড়াবি যে তুই আমাকে তোর ব্যবসা থেকে লাথি মেরে তাড়িয়ে দিয়েছিস আর আমি সেটাকে মুখ বুজে সহ্য করব? শালা, মিথ্যুক?’
এমনি সময় নিজেরা যতই স্বামীস্ত্রী হোক, ঝগড়ার সময় যেন কলেজজীবনের সেই তুইতোকারিটা না করলে ঝগড়া করে ঠিক তৃপ্তি আসে না অতন্দ্রর। এই ব্যাপারে ওর নিজস্ব একটা থিয়োরিও রয়েছে। ঝামেলা করার সময় ও প্রান্তে যে রয়েছে সে পুরুষ না মহিলা, স্ত্রী না প্রেমিকা, বন্ধু না আত্মীয়, অত কিছু দেখলে চোখা চোখা বাক্যবাণের স্বতঃস্ফূর্ত স্রোতটাই হারিয়ে যায়।
তাই যখন যাকে ঝাড়বে, বিনা শর্তে ঝাড়ো।
‘আমি কী বলে বেড়িয়েছি?’ জিনিয়ার এবার অবাক কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘আমি … আমি…!’
‘তোর এই নাটক নিজের কাছে রাখ। অনেক সহ্য করেছি, বুঝেছিস? সেদিন ওইরকম অসভ্যতা করেছিলি, কিচ্ছু বলিনি। আমাকে প্রোজেক্টে সবাই দেখে লুকিয়ে লুকিয়ে হাসছে তোর কাজকর্মের জন্য। কিছু বলিনি বলে তোর সাহস বেড়ে যাচ্ছে, তাই না? আর নয়। তুই কে আমাকে বিজনেস থেকে বের করে দেওয়ার? এখনও বিজনেসের ব-ও আরম্ভ হল না, তাতেই সাপের পাঁচ পা দেখেছিস, না? এদিকে যখন লোক হচ্ছিল না, তখন আমি জুতোর সুখতলা খুইয়ে খুইয়ে কাস্টমার জোগাড় করলাম।’
‘দেখো অতন্দ্র।’ জিনিয়া এবার ফোনের মধ্যে ফোঁপাতে শুরু করেছে, ‘তুমি কিন্তু যা মুখে আসছে, তাই বলছ! আমি কাউকে কিচ্ছু বলিনি এরকম, আর মাত্র পাঁচটা কাস্টমার দিয়েছ তুমি, নিজের বিজনেসের জন্য করে আবার শোনাচ্ছ কেন?’
চিরকালই অতন্দ্র রেগে গেলে অন্য মানুষ হয়ে যায়, এবারেও তার অন্যথা হল না। জিনিয়ার কান্না ফোনের ভেতরের ইথার তরঙ্গ বেয়ে এসে ওকে আরও উন্মাদ করে তুলল, ‘নিজের বিজনেস, মাই ফুট! তুই নাচিয়েছিলি, আমিও নেচেছি। আমাকে তোর চাকর ভেবে ফেলেছিলি, তাই না? কী করিনি তোর জন্য? তিন লাখ টাকার ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙে পুরো টাকাটা দিয়েছি তোর ওই বিজনেসে। আর যে ফ্ল্যাট দেখিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে লোনটা বাগিয়েছিস, সেটাতেও আমার ইনভেস্টমেন্ট আছে, অস্বীকার করলে গিয়ে জিভ টেনে ছিঁড়ে দিয়ে আসব। রিজাইনও করেছিলাম তোর ওই ঢপের ব্যবসায় নামব বলে! কে করে রে? সেখানে তুই আমার কী করছিস?’
‘স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আমার তোমার কী করে আসছে অতন্দ্র? বিজনেসটা তো আমাদের!’ জিনিয়া হিস্টিরিয়া রুগির মতো অস্থিûরভাবে বলল, ‘সেদিনের জন্য তো আমি অনেকবার ক্ষমা চেয়েছি। সেদিন অতরাতে ফেরার পরেও ফোন দেখে আমার মাথাটা … তার ওপর তুমি ওইরকম ভাঙচুর শুরু করলে …!’
অতন্দ্রর কানে কথাগুলো ঢুকল বলে মনে হয় না। চিবিয়ে চিবিয়ে ও বলে যেতে লাগল, ‘তুই ভালোমানুষির মূল্য দিতে জানিস না আসলে। জানলে সেদিন ওই কাজটা করতে পারতিস না। শোন, আমি শেষবারের মতো তোকে বলে দিচ্ছি, ফ্ল্যাট, লাইসেন্স সব তোর নামে বলে সব টাকা নিয়ে ফুর্তি করছিস কর, কিন্তু লোকের কাছে আলতু-ফালতু বলে বেড়ালে সোজা খড়দা গিয়ে তোকে মজা দেখিয়ে আসব, তোর কাউন্সিলর বাবাও কিছু করতে পারবে না। মনে থাকে যেন! আমার নাম অতন্দ্র গুপ্ত। রাখ শালা ফোন!’
জিনিয়া তখনও চিৎকার করছিল, ‘তুমি প্রথম ট্রিপটায় চলো, কিছু একটা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। শোনো, তুমি এভাবে সব গোলমাল করে দিও না…।’
‘কোত্থাও যাব না আমি। দেখি কী করে তুই ওই সব ঘাটের মড়াদের নিয়ে ট্রিপ করিস!’ অতন্দ্র উল্কার গতিতে নিজের গোটা রাগটা উগড়ে দিয়ে ফোনটা ধাঁ করে কেটে দিল।
জিনিয়া ফোনটা রেখেও বিশ্বাস করতে পারছিল না, ফোনের ও প্রান্ত থেকে যে গলাটা এতক্ষণ এই নোংরা কুৎসিত কথাগুলো বলে যাচ্ছিল, সে অতন্দ্র।
এ সেই অতন্দ্র, যাকে ও ভালোবেসে বিয়ে করেছিল?
এ সেই অতন্দ্র, যার সঙ্গে কলেজের অ্যাসাইনমেন্ট, প্রোজেক্ট থেকে শুরু করে ক্যাম্পাস প্লেসমেন্ট সবকিছুর স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে ও?
এ সেই অতন্দ্র, যে বলত রাতের বেলা জিনিয়া ওর বুকে মাথা না রাখলে ওর ঘুম আসে না?
ঋতুপর্ণা জিনিয়ার মুখ-চোখ দেখে বুঝতে পারছিল মারাত্মক সিরিয়াস কিছু ঘটেছে। অতন্দ্রর নাম স্ক্রিনে ভেসে ওঠার পর ও-ই জোর করছিল ফোনটা রিসিভ করতে, এখন জিনিয়াকে জ্বোরো রুগির মতো থরথর করে কাঁপতে দেখে ও কী করবে বুঝতে না পেরে ধীরে ধীরে জিনিয়াকে ঝাঁকাতে শুরু করল, ‘জিনি! জিনি! কী হয়েছে তোর! এমন করছিস কেন!’
জিনিয়া কাঁপতে কাঁপতে ঋতুপর্ণার দিকে তাকাল। ওর দুটো চোখ লাল টকটকে, জলে ভরে এসেছে, যেকোনো মুহূর্তে বড়ো বড়ো জলের ফোঁটা নামবে গাল বেয়ে। হাতের আঙুলগুলো কাঁপছে থরথর করে, রোগা হাতে শিরাগুলো অতিরিক্ত চাপে নীল হয়ে ফুটে উঠছে যেন।
ঋতুপর্ণা চারপাশে আড়চোখে তাকাল, এতরাতে ক্যাফেটেরিয়ায় ভিড় নেই ঠিকই, কিন্তু একেবারে ফাঁকাও নয়। ও বন্ধুকে নিয়ে গিয়ে বসাল একদম শেষ টেবিলটায়। তারপর বলল, ‘কী হয়েছে তোদের মধ্যে, একটু বলবি আমায়? এরকম করে তখন থেকে চুপ করে থাকলে আমি কী বুঝব বল!’
জিনিয়া বেশ কিছুক্ষণ পর ধাতস্থ হয়ে ঋতুপর্ণার দিকে তাকাল। তারপর ঠোঁটটা কামড়ে ধরে চোখের জলটাকে প্রাণপণে আটকাতে আটকাতে বলল, ‘অতন্দ্রর প্রোজেক্টে কয়েক মাস আগে একটা মেয়ে ঢুকেছে। প্রথমে সব ঠিকঠাকই ছিল, আমাদের ফ্ল্যাটের গৃহপ্রবেশে এসেওছিল অন্য কলিগদের সঙ্গে। কিন্তু ইদানীং ওদের কথাবার্তা যেন বড্ড বেড়ে গিয়েছিল। একে তো অতন্দ্র বেরোয় সকাল আটটায়, রাতে ফিরতে ফিরতে দশটা সাড়ে দশটা। তারপরেও ঢুকতে-না-ঢুকতেই মেয়েটা ফোন করবে জানিস!’
‘ওহ এই ব্যাপার!’ ঋতুপর্ণা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, ‘আমি ভাবছিলাম কী না কী! সত্যি মাইরি, তোরা পারিসও বটে। একদিকে এত বড়ো একটা ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা করতে যাচ্ছিস, অন্যদিকে চরম বাচ্চাদের মতো কাজকর্ম করছিস আরে, ফোন করছে তো করছে, তোর বরটাকে তো আর হাইজ্যাক করে ফেলছে না! কী কথাবার্তা বলে, শুনেছিস?’
‘শুনেছি।’ জিনিয়া বলল, ‘ওই, প্রোজেক্টের কথা। তা রাতদুপুরে তাই নিয়ে বকবক করার কী আছে? সারাদিন তো পাশাপাশি বসে কাজ করছে, তখন বলতে পারেনা?’
‘করেছে, করেছে।’ ঋতুপর্ণা বলল, ‘তাই নিয়ে তোর এত হিংসার কী আছে?’
‘হিংসার প্রশ্ন নয়। সেই নিয়ে কথা কাটাকাটি হতে হতে ঝগড়াটা এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে এখন আর ফেরা সম্ভব নয়।’ মুখ-চোখ শক্ত করে বলল জিনিয়া।
ঋতুপর্ণা বলল, ‘কেন? কী পর্যায়ে চলে গেছে?’
জিনিয়া আর কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল। কিছু কথা প্রিয়তম বন্ধুকেও বলা যায় না। বুকের ভেতরটা ভেঙে খান খান হয়ে গেলেও বলা যায় না যে বাধ্য হয়ে মাঝরাতে সেদিন জিনিয়া ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।
বলা যায় না যে ভালোবেসে বিয়ে করা স্বামী ওকে ফোনে এতক্ষণ অশ্রাব্য ভাষায় আক্রমণ করছিল।
এগুলো শুধু নিজের মধ্যেই ওলটপালট করে কষ্ট পেতে হয়।
ঋতুপর্ণা এবার নরমভাবে হাত রাখল জিনিয়ার হাতের ওপর, ‘শোন, মাথা গরম করে ভালো কিছু হয় না, জিনি। তুইও জানিস ওকে ছেড়ে থাকতে পারবি না, অতন্দ্রও জানে ও তোকে ছেড়ে থাকতে পারবে না। শুধু শুধু নিজেদের মনের ক্লেদগুলো এইভাবে একে অন্যের ওপর ছুড়ছিস। তাও আবার এমন একটা সময়ে, যে সময়ে তোদের দু-জনের ঐক্যটা খুবই দরকার।’
জিনিয়া আর কিছু বলতে পারল না। কখনো কখনো সামান্য স্পর্শ মনকে বড় দুর্বল করে দেয়। চোখে এতক্ষণ ধরে জমে থাকা জলটা এবার টপ টপ করে পড়ে ভিজিয়ে দিতে লাগল ক্যাফেটেরিয়ার গোলাপি টেবিলটাকে।
৫
গ্লোবাল টুরসের কলকাতা রিজিয়নাল অফিসের কর্তা অম্বিকেশ সান্যাল মুম্বাই থেকে আসা সেলসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার জোশীকে নিয়ে যখন দক্ষিণ কলকাতার ব্রাঞ্চ অফিসে ঢুকলেন, তখন দুপুর প্রায় সোয়া তিনটে।
সেলস এগজিকিউটিভ আলোকপর্ণা ম্লানমুখে নিজের চেয়ারে বসে বাড়ি থেকে টিফিনবক্সে আনা চানাচুর মুড়ি খাচ্ছিল।
তার সেই সোনার ডিম পাড়া হাঁস মনে করা কাস্টমারটা অনেকক্ষণ হল চলে গিয়েছে। এই নিয়ে চারদিন এল লোকটা, খালি হ্যাজানো ছাড়া কোনো লাভ হয়নি আলোকপর্ণার। লোকটা প্রথমদিন এসেই গ্রামভারী স্বরে নিজের পরিচয় দিয়েছিল কলকাতার এক নামি বহুজাতিক সংস্থার কর্তা বলে, এদিকে এখনও কোথায় ঘুরতে যেতে চায় ঠিক করতে পারল না এখনও। একবার বলে ইজিপ্ট, একবার বলে আফ্রিকা, আবার আরেকবার বলে অস্ট্রেলিয়া। অ্যাডভান্স পেমেন্ট তো অনেক দূরের কথা! প্রতিদিনই সুখদেবকে দিয়ে ও কফি আনায় কিংবা কোনো ঠান্ডা পানীয়। কিন্তু লাভ হয়না কিছুই।
দুর দুর! এই মাসে একটাও ইন্টারন্যাশনাল তো দূর, ন্যাশনাল প্যাকেজও বিক্রি করতে পারেনি আলোকপর্ণা। আগের সপ্তাহে নিজের উদ্যোগে একটা ভ্রমণমেলায় ক্যাম্পেইনে গেছিল, সেখানেও কোনো সুরাহা হয়নি। লোকে স্টলে এসে কফি খেয়ে, আলোকপর্ণার ডেমো শুনে, গুচ্ছের রঙিন রঙিন লিফলেট বগলদাবা করে বাড়ি চলে গেছে।
তাই সুইং ডোর খুলে দু-জন জাঁদরেল বসকে ঢুকতে দেখেই ওর বুক দুরুদুরু করে উঠল। এই খিদের মুখেও চানাচুর মুড়ি মুহূর্তে বিস্বাদ লাগল ওর।
ওরা এখানে চারজন আছে। অতীশ, সংযুক্তা, বহ্নিশিখা আর ও নিজে। অতীশ ছাড়া ওদের তিনজনের সামনের চেয়ারগুলো এখন ফাঁকা। বহ্নিশিখা অলস হাতে মোবাইল টিপছিল, সংযুক্তা কোনো একটা বিজ্ঞাপন ডিজাইন করছিল কম্পিউটারে। একমাত্র অতীশই ব্যস্ত ছিল কাস্টমার নিয়ে। সেই বৃদ্ধ আর যুবক।
এবারে আর কোনো সন্দেহ নেই, এই মাসের সেরা কর্মীর অ্যাওয়ার্ডটা অতীশই পাচ্ছে। ইউরোপ টুরের সবচেয়ে লোভনীয় প্যাকেজটা এর মধ্যেই সে বৃদ্ধকে জপিয়ে ফেলেছে প্রায়। কী অবস্থা! আজ সকাল অবধিও ওর আর অতীশের অবস্থা ছিল সবচেয়ে খারাপ। এখন কুয়োতে পড়ে রইল ও একাই।
আর আশ্চর্য হলেও সত্যি, এই বৃদ্ধ সাড়ে তিন লক্ষ টাকার দুটো সিট বুক করতে রাজিও হয়ে গিয়েছেন। প্রাথমিকভাবে কনফার্ম করার জন্য আপাতত কুড়ি হাজার টাকার একটা চেক কেটে দিয়ে যাচ্ছেন এখন।
সত্যি, মানুষের পোশাক দেখে কোনোকিছু বিচার করা যে কত বড়ো ভুল, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে আলোকপর্ণা। অতীশের ওপর ঈর্ষায় ভেতরে ভেতরে ওর মনটা তেতেপুড়ে যাচ্ছে। এই মন্দার বাজারে দুটো মোটা বাজেটের ইউরোপ প্যাকেজ বিক্রি করতে পারাটা মুখের কথা নয়। এই বৃদ্ধের বেশভূষা দেখে কেউ কল্পনাতেও আনতে পারবে যে ভদ্রলোক সাত লক্ষ টাকা দিয়ে ঘুরতে যাওয়ার বিলাসিতা করতে পারেন?
নিজের মনেই আফশোসে ঠোঁট কামড়ায় আলোকপর্ণা। ইস, তখন যদি বুদ্ধি করে ওই লোকটাকে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিয়ে নিজের টেবিলে এই দুজনকে ডেকে নিত, আজ বুক ফুলিয়ে বসদের সামনে দাঁড়াতে পারত।
কলকাতার অফিসের সর্বময় কর্তা অম্বিকেশ সান্যাল ঢুকেই সবার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকালেন, ‘গুড আফটারনুন! কেমন আছ তোমরা সবাই?’
স্প্রিং দেওয়া পুতুলের মতো ওরা সবাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। দরজা দিয়ে ঢুকে প্রথমেই আলোকপর্ণার টেবিল, ও হাসি হাসি মুখে বলল, ‘ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন, স্যার?’
ওরা এই ব্র্যাঞ্চে থাকলেও কিছুদিন ধরে রিজিয়োনাল অফিস থেকে ফোনে কানাঘুসো শোনা যাচ্ছে অম্বিকেশ স্যার নাকি রিজাইন করতে চলেছেন। প্রথম যেদিন আলোকপর্ণা কথাটা শুনল, বেশ অবাকই হয়ে গিয়েছিল। কারণ ওদের এই টুরিজম ইন্ডাস্ট্রিতে অম্বিকেশ সান্যাল কলকাতায় একটা জবরদস্ত নাম। বহু বছর ধরে উনি গ্লোবাল টুরসে রয়েছেন, অনেক কোম্পানি তাঁর কর্মদক্ষতার জন্য প্রচুর লোভনীয় অফার দিলেও কেন জানা যায় না, উনি কখনোই গ্লোবাল টুরস ছাড়েননি। শুধু তাই নয়, কলকাতায় টুরিজম ইন্ডাস্ট্রির অনেক প্রাচীন ধ্যানধারণা অম্বিকেশ স্যার গত দুই দশকে পালটে দিয়েছেন। বিজ্ঞাপনের চমক থেকে শুরু করে নানারকম প্রদর্শনী করে, ক্লায়েন্টদের স্যাটিসফ্যাকশনের নানারকম মেট্রিক বানিয়ে, সবরকমভাবেই গ্লোবাল টুরসকে কলকাতার সমস্ত নামি ট্রাভেল এজেন্সির সামনে পথপ্রদর্শক হিসেবে রেখেছেন তিনিই।
কাজপাগল মানুষ হিসেবে তাঁর সুনাম রয়েছে গোটা সেক্টরে। তাই এইভাবে অবসরের আগেই তাঁর স্বেচ্ছায় রেজিগনেশন দেওয়ার খবরটা অনেকেরই বিশ্বাস হয়নি। অম্বিকেশ সান্যাল অবিবাহিত, সংসারে কোনো পিছুটান নেই। মুম্বাই হেড অফিসের সঙ্গে তাঁর কোনো মনোমালিন্যের কথাও শোনা যায়নি। তবে হঠাৎ কী কারণে এই সিদ্ধান্ত তা অনেকেরই প্রশ্ন।
এমনিতে তিনি অধস্তন কর্মচারীদের সঙ্গে বেশ সহজভাবেই মেশেন, কিন্তু ব্রাঞ্চ অফিসে থাকার কারণে আলোকপর্ণারা চারজন অতটা সহজ নয় ওঁর সঙ্গে। তাই আলোকপর্ণা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করতে পারল না যে গুজবটা সত্যি কিনা।
অতীশ, বহ্নিশিখা আর সংযুক্তাও কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে রয়েছে এদিকে। যদি আলোকপর্ণার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে স্যার কিছু বলেন।
কিন্তু পেশাদার অম্বিকেশ সান্যাল সেই পথে পা-ই বাড়ালেন না। তিনি অভিজ্ঞ কর্পোরেটের লোক, অফিশিয়াল ভিজিটে এইসব ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ উত্থাপন করে এই শেষসময়েও নিজেকে মুম্বাইয়ের বস মি জোশীর সামনে খেলো করবেন না।
অম্বিকেশ আলোকপর্ণার সামনের চেয়ারটা টেনে বসে পড়ে আমুদে গলায় বললেন, ‘আমি কেমন আছি? তোমরা কেমন কাজ করছ, তার ওপর তো নির্ভর করছে আমরা কেমন আছি, তাই না? হা হা!’ কথাটা বলে তিনি তাকালেন সঙ্গে মুম্বাই থেকে আসা মি জোশীর দিকে, ‘কি বলেন মি জোশী? কিছু ভুল বলেছি?’
‘না না, আপনি একদম ঠিক কথা বলেছেন মি. সানিয়াল।’ মি জোশী মৃদু হেসে কথাটা বলে আসল প্রসঙ্গে চলে গেলেন, ‘হ্যালো ফ্রেন্ডস, আমি অমৃতলাল জোশী, ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার, সেলস ডিপার্টমেন্ট, মুম্বাই অফিস। তা এই ব্রাঞ্চের অপারেশনাল হেড কে?’
অপারেশনাল হেড নামেই, আলোকপর্ণারা চারজনই এক র্যাঙ্কে কাজ করে। তবু প্রতি বছর ওদের মধ্যেই একজনকে হেড করা হয়, রিজিয়নাল অফিসের সঙ্গে মেল চালাচালির সুবিধার জন্য। পরের বছর আবার অন্যজনকে।
আলোকপর্ণা একটা ছোটো ঢোঁক গিলে উঠে দাঁড়াল, ‘হ্যালো স্যার। মাইসেলফ আলোকপর্ণা লাহিড়ী, অপারেশনাল হেড।’
কথাটা বলার সময় অতীশের টেবিলের দিকে চোখ পড়তে দেখল, সেই বৃদ্ধ একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছেন ওর দিকে।
মি জোশী কাজের লোক, অন্য কথাবার্তা বলে তিনি বেশি সময় নষ্ট করেন না।
বৃদ্ধের আজকের মতো কাজ হয়ে গেছিল, যুবক তাঁকে ধরে ধরে উঠে দাঁড় করাতেই মি জোশী ইঙ্গিতে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বেয়ারা সুখদেবকে স্টাফ মিটিং অ্যারেঞ্জ করার জন্য ইঙ্গিত করলেন।
এই লম্বা করিডোরের একদিকে রয়েছে ভেতরে যাওয়ার দরজা। ভেতরে রয়েছে ছোটো একটা কনফারেন্স রুম, টয়লেট আর একচিলতে খাওয়ার ঘর। খাওয়ার ঘর অবশ্য ফাঁকাই পড়ে থাকে, কাজের চাপে কেউ আর ওই ঘরে গিয়ে খেতে সময় পায় না, নিজের টেবিলে বসেই সেই পাট চুলিয়ে ফেলে।
মাঝেমধ্যে অতীশ বা ওমিনাথ ওই ঘরে গিয়ে কনকনে এসির মধ্যে সিগারেট খায়।
মিনিট দশেকের মধ্যে কনফারেন্স রুমে সবাইকে নিয়ে বসে মি জোশী এই মাসের সেলস রিপোর্ট চাইলেন আলোকপর্ণার থেকে। আর রিপোর্ট দেখতে দেখতে তাঁর ভ্রূ-দুটো কুঁচকে উঠল। পাশে বসে থাকা মি সান্যালের সঙ্গে নীচু গলায় কিছু আলোচনা করতে লাগলেন তিনি।
আলোকপর্ণা নার্ভাস মুখে বহ্নিশিখার দিকে তাকাল। সেও আলোকপর্ণার মতোই টেনশনে রয়েছে, ক্রমাগত সযত্নে ম্যানিকিয়োর করা হাতের নখগুলো খেয়ে যাওয়া দেখেই বোঝা যাচ্ছে। যদিও ওর অবস্থা আলোকপর্ণার মতো এত খারাপ নয়। আন্তর্জাতিক প্যাকেজ বিক্রি করতে না পারলেও বেশ কয়েকটা সিকিম টুর বেচেছে বহ্নিশিখা। সেগুলো ছোটো টুর হলেও ওর ভাঁড়ার তাই শূন্য নয়।
ওপাশে সংযুক্তা ভাবলেশহীন, মিটিং এর এটিকেট-বহির্ভূত জেনেও টেবিলের নীচে পা নাচিয়ে চলেছে ক্রমাগত। ওর অবস্থাই বলতে গেলে চারজনের মধ্যে সবচেয়ে ভালো। গত দুটো কোয়ার্টারেই ও টার্গেট অ্যাচিভ করতে পেরেছিল। দুটো ট্রেড ফেয়ারে অংশগ্রহণ করেও কিছু ক্লায়েন্ট এনেছিল।
আলোকপর্ণা চোখ সরিয়ে অতীশের দিকে তাকাল। গত কয়েকদিনের যে ভয় আর অবসাদ তার মুখে লেগেছিল, তা এখন উধাও। অতীশ এখন দৃঢ় চোখে মি জোশীর দিকে তাকিয়ে আছে।
আলোকপর্ণা মনে মনে আরও রেগে উঠল। বেটা আজ সকালে বরাত খুলে গেছে বলে খুব ভাও নিচ্ছে, নাহলে তো অবস্থা হত সেই ওর মতোই!
মি. জোশী কিছুক্ষণ পর গোটা ঘরের নিস্তব্ধতা খান খান করে বলে হিন্দিতে বলে উঠলেন, ‘আজ তো মাসের সাতাশ তারিখ। গোটা মাসই বলতে গেলে গন। এই পুরো মাসে অপারেশনাল হেড মিস আলোকপর্ণা লাহিড়ীর কোনো সেলসই নেই! নো কন্ট্রিবিউশন!’
আলোকপর্ণার শিরদাঁড়া মুহূর্তে শক্ত হয়ে যায়। এবার না চাইতেও কিছু কড়া অপমানজনক কথা শুনতে হবে তাকে।
ট্রাভেল ইন্ডাস্ট্রিতে সে নতুন নয়, গ্লোবাল টুরসে তার তিন বছর হতে চলল, রিভিউ মিটিং-এ কর্তাদের এইসব কড়া কড়া কথা শুনতে সে এখন বেশ অভ্যস্ত। টুরিজম ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়ার সময় এইগুলো কীভাবে গায়ে না মেখে হেলায় ঝেড়ে ফেলতে হয়, সেই পাঠও ওদের দেওয়া হত। তাই পরিস্থিতির চাপে অনেকদিনই হল চেহারার ওপরে একটা গণ্ডারের চামড়া তাকে পরে নিতে হয়েছে।
কিন্তু আজকের ঘটনাটা বেশি করে পীড়া দিচ্ছে অন্য কারণে। চারজন বন্ধু একসঙ্গে ব্যর্থ হলে কষ্ট হয় না, বরং একে অন্যকে সহানুভূতির চাদরে মুড়ে দিতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু হঠাৎ চারজনের মধ্যে একজন এগিয়ে গেলে তখন মনের মধ্যে প্রচণ্ড রাগ চলে আসে, সেই রাগটা সামলানো যায়না।
আলোকপর্ণা নিজের নার্ভাসনেসটা প্রকাশ করল না। ওর এই কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছে, ভয় পেয়ে গেলে ওপরমহল আরও চেপে ধরে, দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করে।
ও কৃত্রিম হাসি ঠোঁটের ডগায় দুলিয়ে রেখে বলল, ‘স্যার, আসলে এই মাসে স্কুলের ছেলেমেয়েদের এগজাম থাকে। বাবা মায়েরা তাই নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তাই টুর একটু কম হয়েছে। আমরা মেলাগুলোও অ্যাটেন্ড করেছি, তেমন লাভ হয়নি। নেক্সট মাসে সেলস ডেফিনিটলি বাড়বে স্যার, আই প্রমিস!’
মি জোশী চোখ থেকে দামি চশমাটা খুললেন, তারপর সামান্য ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে বললেন, ‘মিস লাহিড়ী, গোটা ইন্ডিয়াতে গ্লোবাল ট্যুরসের এখন ক-টা ব্রাঞ্চ বলতে পারবেন?’
কথা হচ্ছিল সেলস রিপোর্ট নিয়ে, সেখান থেকে দুম করে কোম্পানি প্রোফাইল নিয়ে এমন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে আলোকপর্ণা স্মার্টনেস দেখাতে চেয়েও পারে না। তিন বছর আগে গ্লোবাল টুরসে জয়েন করার পর মুম্বাইতে সাতদিনের ট্রেনিং-এ এইসব তথ্য ওদের গেলানো হয়েছিল। সেই তথ্য এতদিনে একবারের জন্যও কাজে আসেনি। কোম্পানির কী কী প্যাকেজ আছে তাই নিয়েই ওদের দিন কেটেছে।
এত কাজের মাঝে কোম্পানির এই প্রোফাইলগুলো কি করে মনে থাকবে? তাও এতদিন পর? প্রতিমাসেই দেশের কোথাও-না-কোথাও ব্রাঞ্চ খুলছে।
ও ফ্যাকাশে হেসে বলল, ‘স্যার, মানে, দু-শোর বেশি … অ্যাকচুয়ালি …।’
‘জানতাম আপনি বলতে পারবেন না।’ সবার সামনে আলোকপর্ণার মনোবল আরও ভেঙে দিয়ে বলে চললেন মি জোশী, ‘এই মুহূর্তে নম্বরটা হল একশো বারো। ষোলটা রাজ্যে। আপনার অ্যাজাম্পশন ঠিক তথ্যের ধারেকাছেও পৌঁছোতে পারেনি। যেটা একটা ব্রাঞ্চের অপারেশনাল হেডের কাছে অত্যন্ত লজ্জার, তাই না মিস লাহিড়ী?’
আলোকপর্ণা আরক্তমুখে মাথা নিচু করে ফেলল। গোটা ঘরটায় পিন পড়লেও বুঝি শব্দ শোনা যাবে।
অম্বিকেশ সান্যাল সম্ভবত আলোকপর্ণাকে এই অপ্রীতিকর পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করতে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু মি জোশী তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আর এই একশো বারোটা ব্রাঞ্চের পঞ্চাশটারও বেশি ব্রাঞ্চ আমি গত তিনমাসে ভিজিট করেছি। বিশ্বাস করুন মিস লাহিড়ী, আপনার ব্রাঞ্চের মতো হোপলেস পারফরম্যান্স নতুন ব্রাঞ্চগুলোরও নয়। একবছরও হয়নি ওপেন হয়েছে এমন ব্রাঞ্চগুলোও মাসে কুড়ি লাখ সেল করেছে। সেখানে আপনার ব্রাঞ্চের এই মাসের নিট সেল গতকাল অবধি সাড়ে সাত লাখ। মাত্র সাড়ে সাত লাখ! এটা বিশ্বাসযোগ্য? কলকাতার এইরকম পশ লোকেশনে মাসে এত টাকা ভাড়া দিয়ে কোম্পানি ব্রাঞ্চ খুলেছে সাড়ে সাত লাখ টাকা সেলের জন্য?’
মি জোশী যেন সামনে কোনো প্রেতাত্মা দেখছেন এইভাবে হতভম্ব মুখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপর সামনে রাখা কফিমাগে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘অ্যান্ড দিজ ইজ নট আ গভর্নমেন্ট জব। আপনাদের কোম্পানি স্যালারি দিচ্ছে যাতে আপনারা তার চেয়ে বেশি প্রফিট কোম্পানিকে দিতে পারেন, তাই নয় কি? যদি সেলসের এই অবস্থা হয়, তাহলে আপনাদের রেখে লাভ কী? কোম্পানি কি এখানে চ্যারিটি করতে এসেছে? বলুন, মিস লাহিড়ী?’
বহ্নিশিখা ধূসর চোখে আলোকপর্ণার দিকে তাকাল। মি জোশী কি ওদের তাড়ানোর পরিকল্পনা করছেন?
আলোকপর্ণা চোখ সরিয়ে নিল। চেয়ারের নীচে ওর পায়ের আঙুলগুলো তখন একে অন্যের ওপর জোরে জোরে ঘষতে শুরু করেছে, লজ্জায়।
কেন জানে না, এই সমস্ত সংকটময় মুহূর্তে ওর দিদির কথা খুব মনে পড়ে। দিদি যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরিতে ঢুকেছিল, তখন ও কলেজে। চাকরি পাওয়ার পর দিদি যতটা উচ্ছ্বসিত ছিল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে সে উত্তেজনা হ্রাস পেতে শুরু করেছিল।
কতদিন দিদি ওকে রাতে বিছানায় শুয়ে বলেছে, ‘ভালো লাগে না রে। জানি এই চাকরি আমার ভাত জোগাচ্ছে। শুধু আমার নয়, আমাদের গোটা পরিবারের। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যেন বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়ছি, ছোটু। খালি ইঁদুর দৌড় আর এ ওর পেছনে লাগা। কোনো ক্রিয়েটিভিটি নেই, নেই কোনো মাথা খাটানোর জায়গা, আমরা সবাই যেন এক একটা যন্ত্র!’
এই মিটিং রুমে বসে দিদির ‘ছোটু’ ডাকটা মনে পড়ে যেতে আলোকপর্ণার বুকের ভেতরটা কেমন যেন চিনচিন করে ওঠে। দিদিকে কতদিন হয়ে গেল ও দেখেনি!
হঠাৎই ওর ঘুম পেতে শুরু করে। মনে হয় এখনই এই জোশী লোকটার কাছ থেকে উঠে চলে যায়, গিয়ে কোনো একটা শান্ত টেবিলের কোনায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে।
আহ! তারপর কী শান্তি!
মি জোশী অন্যদের দিকে তাকিয়ে এবার একরকম গর্জে উঠলেন, ‘বাকিদেরও অবস্থা খুব একটা ভালো নয়! মিস সংযুক্তা বিশ্বাস, সেল মোটামুটি করেছেন বটে, কিন্তু আপনার নামে গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকটা অভিযোগ এসেছে। আপনার কনডাক্ট ঠিক নয়। ক্লায়েন্টরা আপনার ব্যবহারে সন্তুষ্ট নন। সেই ব্যাপারে পরে আসছি। বহ্নিশিখা পৈতণ্ডী শুধু কয়েকটা সিকিম — রাবাংলা টুর সেল করতে পেরেছেন। আর অতীশ মজুমদার সেল করেছেন দুটো সিঙ্গাপুর, টোটাল এক লাখ সত্তর হাজার টাকার। এই তো অবস্থা! নো আফ্রিকা, নো ইউ এস এ, নো ইউরোপ!’
অম্বিকেশ সান্যাল গলা খাঁকারি দিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু মাঝখান থেকে অতীশ বলে উঠল, ‘সরি টু ডিফার উইথ ইউ, স্যার। ডেটাতে একটু ভুল আছে। ওটা এক লাখ সত্তর নয়, আট লাখ সত্তর হবে।’
‘আট লাখ সত্তর?’ মি জোশী ভ্রূ কুঁচকে আবার হাতে ধরা এক্সেল শিটের দিকে তাকান। অতীশের কথার সঙ্গে এক্সেল শিটের এতটা গরমিলে তিনি বেশ আশ্চর্য হয়েছেন, সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে।
অতীশ এবার বেশ গর্বিত স্বরে বলল, ‘আজ একটু আগেই আমি দুটো ইউরোপিয়ান এসেন্স প্যাকেজ সেল করেছি, স্যার। পার্টি অ্যাডভান্স পেমেন্ট করে বুকিং কনফার্মও করে দিয়ে গেছে।’
‘ইউরোপিয়ান এসেন্স! ওয়ান্ডারফুল’ মি জোশী মুগ্ধতা লুকোনোর কোনো চেষ্টাই করলেন না, ‘প্রাউড অফ ইউ মাই সন!’
‘ইউরোপিয়ান এসেন্স গ্লোবাল টুরসের সবচেয়ে দামি প্যাকেজ। কলকাতায় এই প্যাকেজ বিক্রি প্রায় হয়ই না। কলকাতার তুলনায় মহারাষ্ট্রের দিকে অনেক বেশি এইসব টুর বিক্রি হয়।
ইউরোপিয়ান এসেন্সের বিক্রির সুবাসেই বোধ হয় অতীশ ভোজবাজির মত মি. জোশীর ‘মাই সন’ হয়ে উঠল। আবার পরের কোয়ার্টারেই এর অন্যথা হলে মি. জোশীর মতো ম্যানেজমেন্টের লোকেরা ‘মাই ফুট’ বলতে দ্বিধা করবেন না। আলোকপর্ণা এগুলো হাড়ে হাড়ে জানে। সবাই অম্বিকেশ স্যারের মতো সংবেদনশীল হয় না। বরং সত্যি বলতে কী, স্যারই এই সেক্টরে বিরল, মি জোশীর মতো লোকই গিজগিজ করছে চারপাশে।
মি জোশী কিছুক্ষণ উজ্জ্বল মুখে তাকিয়ে রইলেন অতীশের দিকে। বোঝাই যাচ্ছে তিনি অত্যন্ত খুশী হয়ে পড়েছেন।
মুখে উনি যতই হম্বিতম্বি করুন, এটা ঠিকই যে এই সিজনটা ট্রাভেলিং-এর জন্য মন্দা থাকে। সব অফিসেই কম বেশি খারাপ সেলস। তবু কর্তা হিসেবে কর্মীদের চাপে রাখা তাঁর নৈতিক কর্তব্য। গ্লোবাল টুরসের শেষ কোয়ার্টারে প্রফিট মার্জিন বেশ কমেছে, দাম পড়েছে শেয়ারেরও।
তাই এঁদের মতো বড়ো কর্তারা সারা দেশ ঘুরে ঘুরে কর্মীদের বাধ্যতামূলক প্রেশার দিয়ে চলেছেন। নরমগরম কথা বলে, চাপ দিয়ে, ভয় দেখিয়ে যতটা লাভ করা যায়।
‘ভেরি গুড জব, ইয়ং ম্যান!’ মি জোশী আলোকিত মুখে অতীশকে বললেন, ‘কাস্টমারকে প্ল্যাটিনাম ক্লাবে এনরোল করেছ? আমি তো দু-দিন আছি শহরে, আমার সঙ্গে একটা মিটিং ফিক্স করাও কোনো রেস্টুরেন্টে। এমন কাস্টমার যাতে বছরে একটা করে গ্লোবাল টুরসের প্যাকেজ নেন, সেটা তো এনশিয়োর করতে হবে।’
‘শিয়োর স্যার।’ অতীশ গর্বিত মুখে বলল।
কিছু কিছু সময় মনে হয়, পৃথিবী উলটে গেলে, ভূমিকম্পে সব ধ্বংস হয়ে গেলে বেশ হয়। এখনও তেমনই একটা সময়।
আলোকপর্ণা মাথা নিচু করে বসেছিল। নিস্তব্ধ মিটিং রুমে ঘড়ি নিজের পথে এগিয়ে চলেছিল টিক টিক শব্দে।
৬
অতন্দ্র একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে চলেছিল। অনেকক্ষণ হল এই আই টি পার্কে সন্ধে নেমে গেছে। অনেক দূরে বাইপাসের আলোগুলো ঝিকমিক করে জ্বলছে, একেকটা বিদ্যুৎ বিন্দুর মতো দেখতে লাগা গাড়ি উল্কার গতিতে ছুটে চলেছে সমান লয়ে। সবাই যেন এই পৃথিবীতে প্রচণ্ড ব্যস্ত। সবাই ছুটছে নিজের কেরিয়ার, স্বপ্নপূরণের তাগিদে।
একমাত্র অতন্দ্ররই কোনো তাড়া নেই। অলস ভঙ্গিতে তার সামনে একটা চায়ের দোকানের গুমটি। সে টান দিয়ে চলেছে।
দোকানটা অবশ্য অনেকক্ষণ বন্ধ হয়ে গেছে। এই সব দোকানগুলো খোলে বন্ধ হয় অফিস শুরু, লাঞ্চ, বিকেলবেলা আর ছুটির সময় অনুযায়ী। এখন ঘড়িতে রাত প্রায় সাড়ে আটটা। অফিসের বহুতল বিল্ডিং-এর ফ্লোরগুলোতে অবশ্য আলো জ্বলছে, কিন্তু একেবারে অভাগা ছাড়া বেশিরভাগ লোকজনই বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছে।
নাইট শিফটের ছেলেমেয়েরা অলস পায়ে একে একে ঢুকছে গেট দিয়ে।
অতন্দ্রর পাশ থেকে শুরু হয়ে যাচ্ছে একটা সাজানো বাগান, সেটা অফিসের বাইরে হলেও ওদের কোম্পানিই সেটার রক্ষণাবেক্ষণ করে।
বাগানটার পাশে টহল দেওয়া সিকিউরিটি গার্ডটা বোধ হয় অনেকক্ষণ ধরে অতন্দ্রকে লক্ষ করছিল। কাজের চাপে মাথা তুলতে না পেরে আবসাদগ্রস্ত হয়ে অন্ধকারে বসে থাকা এই অফিসে বিচিত্র কিছু নয়, কিন্তু এতক্ষণ ধরে একভাবে একা একা থাকাটা বোধ হয় গার্ডটার কাছে একটু অস্বাভাবিক মনে হল। লক্ষ করতে করতে লোকটা অন্ধকারে ছায়ামূর্তির মতো অতন্দ্রর সামনে এসে দাঁড়াল, ‘এক্সকিউজ মি স্যার, আপনি ঠিক আছেন তো?’
অতন্দ্র তন্ময় হয়ে কী ভাবছিল, হঠাৎ এমন আকস্মিক ডাকে ও কিছু সময়ের জন্য থতোমতো খেয়ে গেল। তারপর রুক্ষ স্বরে জবাব দিল, ‘ঠিক থাকব না কেন? এখানে বসে আছি বলে কি কোনো সমস্যা হচ্ছে? যতদূর জানি, টেকি ওয়ার্ল্ডের যে কোনো কর্মী এই বাগানের বেঞ্চে বসে থাকতে পারে।’
‘না না স্যার, কোনো সমস্যা নেই, আসলে আপনাকে অনেকক্ষণ ধরে দেখছি এখানে একা একা স্মোক করছেন, তাই ভাবলাম যদি কোনো অসুবিধা হয় …!’
‘তো? এটা তো নো স্মোকিং জোন নয়?’ অতন্দ্র একটা বড়ো ধোঁয়া ছেড়ে উঠে সিকিউরিটি গার্ডটার মুখোমুখি দাঁড়াল, ‘আর আপনি কি একটাও সিগারেট দেখেছেন ডাস্টবিন ছাড়া অন্য কোথাও ফেলতে?’
গার্ডটা এবার মিষ্টি হেসে আর কথা বাড়াল না, ‘কোনো ব্যাপার নয়, স্যার। আপনি সময় কাটান। কোনো প্রয়োজন হলে আমাকে বলবেন। আমি কাছেই আছি। থ্যাংক ইউ।’
গার্ডের ছায়াটা অন্ধকারে অস্পষ্ট হতে হতে একসময় অদৃশ্য হয়ে যেতেই অতন্দ্রর মনের ভেতরটা কেমন যেন সংকুচিত হয়ে গেল। গার্ডটা তো ওর সঙ্গে কোনো দুর্ব্যবহার করেনি, বরং যথেষ্ট বিনয়ের সঙ্গে কথা বলছিল। তবু ও কেন এমন উদ্ধতভাবে কথা বলতে গেল!
ও কি দিন দিন অত্যন্ত দাম্ভিক হয়ে যাচ্ছে? কী হচ্ছে ওর? এক হাতে মাথার চুলগুলো খামচে ধরল অতন্দ্র, কেন ও সারাক্ষণ লোকজনের সঙ্গে খিঁচিয়ে কথা বলছে?
এমন তো ও ছিল না? অস্থির হয়ে ও উঠে দাঁড়াল, তারপর কী করবে বুঝতে না পেরে আবার অফিসের দিকে পা বাড়াল।
গেটে আই ডি পাঞ্চ করে ঢুকতে ঢুকতে ওর মনে হল, এই সব কিছুর জন্য দায়ী একমাত্র জিনিয়া। ওরই জন্য সকলের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছে অতন্দ্র। ওরই জন্য সেদিনের পর থেকে ও প্রোজেক্টে ভালো করে মুখ তুলে কারুর সঙ্গে কথা বলতে পারছে না।
যদিও অতন্দ্র ভালো করে জানে, গীতিকা প্রোজেক্টের কাউকে ব্যাপারটা বলেনি। বলার মতো বিষয়ও এটা নয়, তা ছাড়া গীতিকা তেমন মেয়ে নয়। অন্য কেউ হলে হিউম্যান রিসোর্স ডিপার্টমেন্টে অতন্দ্রর নামে কমপ্লেন করে দেওয়াটাও বিচিত্র কিছু ছিল না। এমন আকছারই হচ্ছে। এই তো ক-মাস আগে অতন্দ্রদের পাশের ইন্সিয়োরেন্সের প্রোজেক্টের একটা ছেলে নাকি অফিশিয়াল মেসেঞ্জারে প্রোজেক্টেরই একটা মেয়েকে বিরক্ত করছিল, মেয়েটা এইচ আর ডিপার্টমেন্টে অভিযোগ জানানোর দশ দিনের মধ্যে একটা নামমাত্র এনকোয়্যারি কমিটি বসিয়ে ছেলেটাকে বের করে দেওয়া হয়েছে। ডিসিপ্লিনারি ইস্যু।
মেয়েদের অভিযোগ এখানে খুব গুরুত্ব নিয়ে দেখা হয়। কোম্পানি এই ব্যাপারে একেবারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করে। অর্থাৎ কিনা, এইসব বেয়াদপির কোনো ওয়ার্নিং নেই, একবার করলেই তাড়িয়ে দেওয়া হবে।
এই কয়েক দিনে ও বুঝেছে গীতিকা সেসব কিছুই করেনি। তবু প্রোজেক্টে ভীষণভাবে গুটিয়ে রয়েছে অতন্দ্র। গীতিকা তিনদিনের ছুটি কাটিয়ে জয়েন করার পর আরও বেশি করে। যদি একবারও মেয়েটার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায়, সেই ভয়ে স্ক্রিন থেকে অতন্দ্র চোখ তোলেইনি এই ক-দিন, তুললেও বাইরে এসে বসে থেকেছে। এদিক-ওদিক ঘুরেছে।
কার জন্য ওর এই লুকিয়ে বেড়ানো? জিনিয়ার জন্যই নয় কি? অতন্দ্র হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল।
কখনো কখনো মানুষ যেটা ভয় পায়, সেটাই অযাচিতভাবে সামনে চলে আসে। অদ্ভুতভাবে এখন তাই হল। গেট থেকে এগিয়ে লিফট লবিতে যেতে না যেতেই অতন্দ্রর বুকটা কেমন ঝাঁকুনি খেয়ে স্থির হয়ে গেল।
উলটো দিক থেকে হেঁটে আসছে গীতিকা। কাঁধে অফিসের ব্যাগ। চোখেমুখে সারাদিনের ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। একটা পা-কে প্রথমে টানছে, তারপর বেশ কষ্ট করে এগিয়ে আনছে দ্বিতীয় পা-টা।
আর এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই, কারণ ইতিমধ্যে চোখাচোখি হয়ে গেছে।
অতন্দ্র কী বলবে বুঝতে না পেরে সামান্য এগোতেই গীতিকা নিজে থেকে হাসল, ‘তোমাকে তো সিটে দেখতেই পাচ্ছি না অতন্দ্রদা!’
‘এই তো।’ অতন্দ্র কোনোমতে হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘বেরোচ্ছিস?’
‘হ্যাঁ, আজকের মতো রেহাই!’ গীতিকা বলল, ‘তোমার তো দিন ফুরিয়ে এল। আর তো কয়েকদিন, তারপরেই নতুন জীবন শুরু।’
অতন্দ্র ক্লিশে হাসল।
গীতিকা ম্লান চোখে সামান্য হেসে বলল, ‘সব ঠিকঠাক এগোচ্ছে তো? কাস্টমার আর পেলে? তোমাকে খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দিতে বলেছিলাম, দিয়েছ? ওতেই কিন্তু বেশি কাজ হয়।’
‘দেব।’ অতন্দ্র একটু ইতস্তত করে বলল, ‘তোর শরীর ঠিক আছে তো এখন, গীতিকা?’
‘আছে।’ গীতিকা এক মুহূর্ত থামল, তারপর খুব ধীরে ধীরে বলল, ‘অতন্দ্রদা, সেদিনের ব্যাপারটায় আমার জন্য তোমাদের মধ্যে যে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে, তার জন্য আমার খুব খারাপ লাগছে। একেই নিজে সমস্যায় রয়েছি, তার মধ্যে তোমাদেরও … কাল থেকে ভাবছি জিনিয়াদিকে একবার ফোন করব।’
অতন্দ্র ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিল। গীতিকা এসে যেকোনো মুহূর্তে ওই প্রসঙ্গ নিয়ে কথা তুলবে, আর ওকে লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে হবে, এই আশঙ্কাই ওকে দু-দিন তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। আর সেটাই সত্যি হল।
ও কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘আরে নানা, ওই ব্যাপারটা মিটে গেছে। ওসব নিয়ে চিন্তা করিস না। আমারই ভুল হয়েছিল। ব্যাপারটা আমার আরও সিক্রেট রাখা উচিত ছিল।’
কথাটা বলেই ওর মনে হল গীতিকা মুখে যা-ই বলুক, মনে মনে হাসছে। মিটিমিটি হাসি নয়। হা হা করে বিদ্রূপের হাসি। ওর দিকে আঙুল তুলে বলছে, ‘কাপুরুষ একটা!’
অতন্দ্র পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছল, তারপর বলল, ‘একটু দাঁড়াতে পারবি? ব্যাগটা নিয়ে আসতাম তাহলে। বেরিয়ে যাব তোর সঙ্গেই।’
‘শিওর।’ গীতিকা যেন একটু অবাক হল, ‘কিন্তু তুমি তো লেকটাউন যাবে। আমি তো যাব দমদমে হোস্টেলে। দু-জন দু-দিকে।’
অতন্দ্র মাথা নাড়ল, ‘নাহ, আজ লেকটাউন যাব না। বাড়ি যাব। তুই দমদমে চলে যাস, আমি এসপ্ল্যানেড থেকে যদি বাস পাই ভালো, নাহলে ট্রেনে বেরিয়ে যাব।’
‘বাড়ি মানে দুর্গাপুর?’ গীতিকা বিস্মিত, ‘এত রাতে?’
‘হ্যাঁ। এক্সপ্রেস পেয়ে যাব কোনো একটা।’ অতন্দ্র পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল লিফটের দিকে, ‘একটু দাঁড়া। আসছি।’
লিফটে করে নিজের ডেস্কে গিয়ে ব্যাগ নিয়ে আবার ফেরত আসতে ওর সময় লাগল আট মিনিট মতো। কিন্তু এই আট মিনিটে অতন্দ্র অনেক কিছু ভেবে ফেলেছে।
ছ-মাস আগে গীতিকা যখন কলেজ থেকে বেরিয়ে ঝকঝকে ফ্রেশার হিসেবে ওদের প্রোজেক্টে জুনিয়র হিসেবে যোগ দিয়েছিল, তখনও ও ভাবেনি যে একে কেন্দ্র করে ওর আর জিনিয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়তে পারে একটা এভারেস্ট সমান পাহাড়।
ভাবেনি যে মেয়েটার সঙ্গে হতে পারে একটা নিখাদ বন্ধুত্ব।
তবু হয়েছিল। অতন্দ্র ওদের প্রোজেক্টের টিম লিডার, সবচেয়ে সিনিয়রও বটে। প্রথম প্রথম সেই গাম্ভীর্যের সঙ্গেই ও কথা বলত গীতিকার সঙ্গে। কিন্তু মেয়েটা এমনই জীবনীশক্তি আর প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর, যে সেই গম্ভীর ভাবটা বেশিক্ষণ রাখা যেত না।
অতন্দ্রর সঙ্গে গীতিকা-র ঘনিষ্ঠতাটা বলতে গেলে হয়েছিল গীতিকা ঢোকার মাস দুয়েকের মধ্যে ক্লায়েন্টের থেকে একটা বড়োসড়ো এসক্যালেশনে।
ক্লায়েন্ট ওদের কোনো কাজে খুশী না হলে যে অসন্তোষপূর্ণ ই-মেল করে, সেটাই ওদের আই টি পরিভাষায় এসক্যালেশন। গীতিকারই ভুলে ক্লায়েন্ট গোটা প্রোজেক্টকে বিশাল ঝেড়েছিল তখন। অতন্দ্রর চিরকালের মাথাগরম, তায় কাজ নিয়ে ও ভীষণ সিরিয়াস। এমনও হয়েছে কোনো নতুন রিসোর্স অতন্দ্রর ঝাড় সহ্য করতে না পেরে কেঁদে ফেলেছে। সেদিন গীতিকাকেও ও ছাড়েনি, নরম-গরম সবরকমভাবেই যথেষ্ট বকাঝকা করেছিল ও।
গীতিকা কিছুক্ষণ গুম হয়েছিল, তারপর লাঞ্চের সময় সটান অতন্দ্রর কাছে এসে বলেছিল, ‘অতন্দ্রদা, আজ তুমি আমার সঙ্গে লাঞ্চ করতে যাবে?’
অতন্দ্র তখন বসে বসে গীতিকার করা কোডিং-এর ভুলগুলো লাইভ সার্ভারে শুধরোচ্ছিল। আচমকা গীতিকার প্রস্তাব শুনে বেশ আশ্চর্য হয়েছিল।
ও প্রোজেক্টে যথেষ্ট গাম্ভীর্য নিয়ে থাকে, জুনিয়ারদের সঙ্গে ইয়ার্কি-ফাজলামো তো দূর, হালকা রসিকতা পর্যন্ত করে না। জুনিয়াররাও ওকে বেশ ভয় পায়। সেখানে এত নতুন একটা মেয়ের এসে সটান লাঞ্চে যাওয়ার প্রস্তাব দেওয়াটা বেশ আশ্চর্যের বই কী! বিশেষ করে যাকে একটু আগে সবার সামনে ও বকাবকি করেছে। মেয়েদের আত্মসম্মান এমনিতেই একটু বেশি হয়। কিন্তু এ তো অদ্ভুত!
ও ভ্রূ কুঁচকে গীতিকাকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে আবার মনিটরের দিকে চোখ ফিরিয়েছিল, ‘হঠাৎ? তুই তো তোর বন্ধুদের সঙ্গে লাঞ্চে যাস বলে জানি!’
‘সে তো অন্যদিন।’ গীতিকা এক হাতে টেবিলে ভর দিয়ে অন্য হাত নাচাতে নাচাতে বলেছিল, ‘অন্যদিন তো প্রোজেক্টে এইরকম পাবলিকলি ক্যালানি খাই না।’
একটা নতুন মেয়ের মুখে এইরকম ভাষা শুনে অতন্দ্রও বেশ ভেবলে গিয়েছিল, বেশ রাগত গলায় বলেছিল, ‘মানে? তোকে কি এমনি এমনি বলেছি? আজ তোর এই ভুলগুলোর জন্য আমাকে ম্যানেজারের কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে।’
‘আহা আমি তো বলিনি, তুমি এমনি এমনি বলেছ।’ গীতিকা মুখ টিপে হেসেছিল, ‘কিন্তু বলেছ যখন আমাকে উদ্ধারও তোমাকেই করতে হবে।’
‘মানে? কী উদ্ধার করব!’
‘দেখো বস।’ গীতিকা অতন্দ্রর চোখের সামনে আঙুল নাড়িয়েছিল, ‘আমি মেকানিক্যালের মেয়ে। ক্যাম্পাসিং-এ কলেজ থেকে ঝেড়েপুঁছে আমাদের সবাইকে টেকি ওয়ার্ল্ড তুলে এনেছে। ইংরেজি আর অঙ্কের একটা মামুলি পরীক্ষা নিয়েছিল, পাশ করেছি, নিয়ে নিয়েছে। আমরা কী করব? সে যতই ট্রেনিং-এ শেখাক, আমরা কি আই টি-র ছেলেমেয়েদের মত অতো ভালো কোডিং জানব? সেটা তো তোমাদেরই শেখাতে হবে।’
‘আমাদের শেখাবার কী দায় পড়েছে?’ অতন্দ্র আরও বেশি রুক্ষতার বর্ম চড়িয়েছিল কণ্ঠে, ‘আমরা প্রোজেক্টের কাজ সামলাব, না, ছেলেমেয়ে শিখিয়ে পড়িয়ে মানুষ করব? আজব আবদার তো! অত বাজে সময় আমার নেই। আর এক সপ্তাহ মনিটর করব, তারপর স্রেফ ম্যানেজারকে কমপ্লেইন করে প্রোজেক্ট থেকে খালাস করে দেব।’
‘তাহলে তাই করো। এমনিই তো জুনিয়র রিসোর্স ওপর থেকে দিচ্ছে না, আমাকে তাড়িয়ে দিলে দু-জনকে নিয়ে কাজ চালাতে হবে। সেটা মনে রেখে এখন সিদ্ধান্ত নাও, আমাকে পিটিয়ে ঘোড়া করবে নাকি গাধার মোট একাই বইবে।’
অতন্দ্র কটমট করে তাকিয়েছিল। এই মেয়েটা ভীষণ ঠ্যাঁটা। ছোটোখাটো রকমের ঠ্যাঁটা নয়, একেবারে বেয়াড়া ধরনের ঠ্যাঁটা।
কিন্তু চট করে কোনো জুতসই জবাবও ও খুঁজে পাচ্ছিল না। কথাটা তো ঠিকই বলেছে। চারমাস ধরে দু-জন মাত্র জুনিয়র নিয়ে ঠিকসময়ে ডেলিভারি দিতে হিমশিম খাচ্ছিল অতন্দ্র, অনেক বলে-কয়ে এই নতুন মেয়েটাকে টিমে দিয়েছে। এখন ম্যানেজারের একটাই কথা, কম লোকে বেশি কাজ চাই। এখন যদি ও একে রিলিজ করে দেয়, নতুন কাউকে পাওয়া খুব মুশকিল।
গীতিকা ঠোঁট উল্টে আরও বলেছিল, তোমার সঙ্গে লাঞ্চ করতে যেতে চাইছিলাম জাভা প্রোগ্রামিং-এর কিছু ভালো বই জানতে চাই বলে। কোডিংটা সত্যিই ভালো করে শিখতে চাই। এখন তুমি যদি নেহাতই হেল্প না করো, আমি ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকবো।’
মেয়েটার কথা বলার ধরন দেখে অতন্দ্রর গলা নিজের অজান্তেই নরম হয়ে গিয়েছিল। হেসে বলেছিল, ‘ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকবি? বটে? এটা আগেকার দিনের সরকারি চাকরি নয় বুঝলি, যে, আসবি যাবি মাইনে পাবি। এটা হল আই টি সেক্টর। বছরের শেষে অ্যাপ্রেইজাল বলে একটি বস্তু আছে। সেখানে যখন ঝুলিয়ে দেবে, তখন চাকরিটি কুচুৎ করে চলে যাবে। তখন কী করবি? তখন কি আর নিজের মেকানিক্যাল স্ট্রিমে চাকরি পাবি?’
‘পাগল!’ গীতিকা তখন হেসে বলেছিল, ‘একেই অ্যাপ্টিটিউড কষে কষে ওয়েল্ডিং ফিটিং-এর কিস্যু মনে নেই, তার ওপর তোমাদের এই কোম্পানির ট্রেনিং-এ প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ শিখতে শিখতে সব ভুলে গিয়েছি। কী আর করব, যাকে ভালোবাসি, তার সঙ্গে ছাদনাতলায় গিয়ে বসে পড়ব।’
‘হুম। ওইটাই তো মেয়েদের সুবিধা। তোরা আবার জেন্ডার ইকুয়ালিটির বড়াই করিস!’ অতন্দ্র আর কথা বাড়ায়নি, হাসতে হাসতে নিজের লাঞ্চবক্সটা কাঁধে ঝুলিয়ে ওর সঙ্গে ক্যান্টিনের দিকে পা বাড়িয়েছিল।
সেই শুরু। সেদিন থেকে প্রতিদিন লাঞ্চের পর আধ ঘণ্টা অতন্দ্র গীতিকাকে জাভা পড়াত। প্রথম প্রথম কেঁচে গণ্ডূষ করতে হলেও মেয়েটার আগ্রহ দেখে ও-ও উৎসাহ পেয়েছিল।
গীতিকার বাড়ি উত্তরবঙ্গে, ও জলপাইগুড়ির মেয়ে। গীতিকার বাবা ছোটোবেলাতেই মারা গেছেন। মা অনেক কষ্ট করে ওকে মানুষ করেছিলেন, কিন্তু প্রচণ্ড পরিশ্রমের জন্যই বোধ হয় গীতিকার কলেজে পড়ার সময় তিনিও মারা যান।
খোলামেলা স্বভাবের গীতিকা প্রথম দিকেই কথায় কথায় বলেছিল, ‘বিয়ে করে আমাকে কোনো কিছু চেঞ্জ করতে হবে না জানো, অতন্দ্রদা। জাস্ট এই বাড়ি থেকে টুক করে পাশের বাড়ি চলে যাব।’
‘কেন, তোর কি পাশের বাড়িতেই বিয়ে ঠিক হয়েছে নাকি?’ অতন্দ্র গীতিকার কোডিং-এর সিনট্যাক্স চেক করতে করতে নোটবুকের পাতা থেকে মুখ তুলেছিল।
‘ঠিক আবার কে করবে?’ গীতিকা হেসে ফেলেছিল, ‘আমার কে আছে যে ঠিক করবে? বইয়ের ভাষায় বলতে গেলে আমি হলাম গিয়ে একশো ভাগ খাঁটি অনাথ।’
‘ধুর, এভাবে বলিস না!’ অতন্দ্র একটু বিব্রত বোধ করেছিল।
গীতিকা তখন বলেছিল, ‘দোখো, শুনতে খারাপ লাগলেও কথাটা তো সত্যি। বিবস্বানের সঙ্গে আমার রিলেশন বহু বছরের। আমরা দু-জনেই তখন ক্লাস এইটে পড়ি। একদম পাশাপাশি বাড়ি আমাদের। ওর অবশ্য পড়াশুনোয় তেমন আগ্রহ ছিল না। ও এখন কেবল লাইনের ব্যবসা করে।’
‘বাহ, ভালোই তো। তবে আর দেরি কেন! বিয়েটা করে ফেল।’ অতন্দ্র বলেছিল।
‘দাঁড়াও, এই তো সবে আমি চাকরি পেলাম, কিছুদিন একটু গুছিয়ে নিই। ও-ও ব্যবসাটা একটু বড় করুক, বাড়িতে জানাক।’ গীতিকা একগাল হেসেছিল, ‘চাপ নিয়ো না, ততদিনে যদি তুমি ম্যানেজারকে কমপ্লেইন করে আমাকে প্রোজেক্ট থেকে খালাসও করে দাও, নেমন্তন্ন তুমি পাবেই।’
অতন্দ্র হেসে ফেলেছিল। হাসতে হাসতে মন দিয়েছিল কোডিং-এ।
এইভাবে যত দিন যাচ্ছিল, অতন্দ্রর সঙ্গে গীতিকার একটা ভালো বন্ধুত্ব তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু সেটা নিখাদই বন্ধুত্ব। তার বেশি আর কিচ্ছু নয়। কিছু হওয়ার প্রশ্নও ওঠে না। লিঙ্গ আলাদা হলেই কিছু মানুষ কেন সেই সম্পর্ককে অন্য চোখে দেখতে শুরু করে, কে জানে!
এক-দেড়মাস পর জিনিয়ার জন্মদিন উপলক্ষ্যে বাড়িতে ছোটোখাটো একটা গেট-টুগেদারের আয়োজন করা হয়েছিল, তাতে ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের সঙ্গে অতন্দ্র গীতিকাকেও নিমন্ত্রণ করেছিল। প্রাণোচ্ছল, জীবনীশক্তিতে ভরপুর মেয়েটা হইহুল্লোড় করে মাতিয়ে দিয়েছিল গোটা সন্ধে। গীতিকার সঙ্গে পরিচিত হয়ে জিনিয়াও বেশ খুশি হয়েছিল। এমনকী ওদের নিজেদের মধ্যে মেসেজে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় কথাবার্তাও হত।
কিন্তু কোথা থেকে যে কী হল! এই শেষ দু-মাসে সব কিছু বদলে গেল! জিনিয়া যে সন্দেহবাতিক তা কিন্তু একদমই নয়। ও যথেষ্ট বুঝদার ছিল। কিন্তু সন্দেহ এমন একটা বিষাক্ত ভাইরাসের মতো, যে, একবার মনে ঢুকলে বোধ হয় বের করা যায় না। দু-মাস ধরেই নানা ছোটোখাটো বিষয়ে জিনিয়া একটু বেশিই প্রশ্ন করছিল। অতন্দ্র আবার চিরকালই মেজাজি, এমনি হাজার উত্তর ও হাসিমুখে দেবে, কিন্তু একবার যদি বুঝতে পারে কোনো সন্দেহ নিরসনের জন্য ওকে জেরা করা হচ্ছে, ওর মাথা গরম হয়ে যায়। প্রথম কিছুদিন ধৈর্য সহকারে জিনিয়াকে বোঝাত, তারপর ধীরে ধীরে জিনিয়ার সাধারণ প্রশ্নগুলোকেও ও উলটোভাবে নিতে শুরু করল। ওর সবসময় মনে হত গীতিকাকে নিয়ে জিনিয়া ওকে সন্দেহ করছে। আর মনে হওয়ামাত্র ওর প্রচণ্ড অপমানিত লাগত, মাথাটা গরম হয়ে উঠত।
অতন্দ্র ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এসে দেখল গীতিকা ঘন ঘন ঘড়ি দেখছে। ও পা চালিয়ে কাছে এসে বলল, ‘চল।’
‘এত রাত হয়ে গেল, বাসগুলো এখন যা ভিড় হয়!’ হাঁটতে হাঁটতে গীতিকা বলল।
টেকি ওয়ার্ল্ডের অফিস শহর থেকে অনেক দূরে বলে কোম্পানির নিজস্ব বাস রয়েছে হাওড়া, শিয়ালদা, দমদমের মতো কিছু সেন্ট্রাল পয়েন্টে কর্মীদের পৌঁছে দেওয়ার জন্য। আগে সেইসব বাসে কোম্পানির কর্মী হওয়ার সুবাদে নামমাত্র ভাড়ায় চাপা যেত, কিন্তু ইদানীং ‘কস্ট কাটিং’ করতে করতে সেই ভাড়া এখন বেশ চড়া।
তা ছাড়া সেইসব বাস একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ছাড়ে। এত রাতে সেই বাসগুলোর একটাও নেই।
অতন্দ্র ঘড়ির দিকে তাকাল। সাড়ে ন-টা বাজে। এখন বাস পেলেও পৌঁছোতে পৌঁছোতে সত্যিই অনেক দেরি হয়ে যাবে। ও কী ভেবে ফোনে খুটখাট করতে করতে বলল, ‘দাঁড়া, একটা ক্যাব বুক করি। ক্যাবে করে দুজনে দমদম চলে যাই। আমি ওখান থেকে বাস ধরে নেব। কি বলিস?’
অন্য সময় হলে গীতিকা সঙ্গে সঙ্গে বলতো, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই করো।’ কিন্তু এখন কেমন যেন গুটিয়ে গেল। সামান্য ইতস্তত করে বলল, ‘আমার সঙ্গে যাবে? কোনো অসুবিধা নেই তো?’
৭
হাওড়া স্টেশনে আজ চরম ভিড়। লোকজন উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক থেকে ওদিকে ছুটে চলেছে। এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের এদিকে টিকিট কাউন্টারে ভিড় উপচে পড়ছে। অন্যদিকে পাঁচ নম্বরের ওখানে চলছে চেকিং। টিকিট পরীক্ষকরা বেছে বেছে আজ সঙ্গে বড়ো মালপত্র থাকা লোকদের ধরছেন। সব মিলিয়ে গোটা জায়গাটা লোকে লোকারণ্য। জায়গায় জায়গায় কিছু জটলাও বেঁধেছে।
যাদবচন্দ্র বাস থেকে নেমে একটুও দাঁড়াননি, হাঁপাতে হাঁপাতে কোনোমতে স্টেশনে এসে ঢুকেছেন। এখন ভেতরের ভিড়ের বহর দেখে তিনি বেশ ঘাবড়েই গেলেন। এদিক-ওদিক দেখে বললেন, ‘হ্যাঁ রে পুতো, ট্রেনে উঠতে পারব তো?’
পুতো মানিব্যাগে টিকিট দুটো ঠিকমতো আছে কি না দেখে নিচ্ছিল। এমনিতে ও কলকাতায় বড়োবাজারেই থাকে, মালিকের গদিতে রাতে একটা তক্তায় শুয়ে পড়ে, তাই রোজ রোজ আর যাতায়াত করার অভ্যেসও নেই। ছুটিতে মানকড় গিয়েছিল, মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে এখন আবার শহরে এসেছে।
ও বলল, ‘হ্যাঁ মাস্টারমশাই, আমাদের ট্রেনের এখনও দেরি আছে। চলুন আস্তে আস্তে হাঁটি।’
মানিব্যাগ দেখতে গিয়ে লিফলেটটা মাটিতে পড়ে গেল। পুতো উবু হয়ে কুড়িয়ে নিল। সাদামাটা একটা হ্যান্ডবিল। পুতোর মনে পড়ল, গ্লোবাল টুরসের অফিস থেকে যখন স্যারকে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে বেরোচ্ছিল, তখন ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকা একটা লোক এসে হাতে গুঁজে দিয়েছিল।
ওকে নিবিষ্ট মনে দেখতে দেখে যাদবচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী রে ওটা?’
‘আরেকটা টুর পার্টির বিজ্ঞাপন।’ পুতো বাক্যবয় না করে বাঁ-কাঁধে মাস্টারমশাইয়ের যে ঝোলাটা ও বইছিল, তাতে লিফলেটটা ঢুকিয়ে দিল।
বিজ্ঞাপন হোক বা বই, লেখাজোখার জগত থেকে ও যত দূর সম্ভব দূরে থাকতে চায়।
যাদবচন্দ্র ট্রেন ছাড়তে দেরি আছে শুনে আশ্বস্ত হয়ে ঢিমেতালে হাঁটছিলেন। বহুবছর পর তিনি হাওড়া স্টেশনে এসেছেন।
শেষ এসেছিলেন সম্ভবত রাজুর চাকরি পাওয়ার দিন। তা প্রায় বছর বারো তেরো তো হলই। রাজু হাওড়ারই একটা গ্রামের স্কুলে চাকরিটা পেয়েছিল। তার অবশ্য প্রথমদিন স্কুলে জয়েন করতে আসার সময় বাপকে নিয়ে আসার তেমন ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু যাদবচন্দ্র একরকম জোর করেই এসেছিলেন। সেই আসার মধ্যে যতটা না কাজ করছিল ছেলের ভাবী কর্মস্থান দেখার ইচ্ছে, তার চেয়েও বেশি ছিল গর্ব। শিক্ষকের পুত্র শিক্ষক হতে চলেছে, সে কি কম আনন্দের কথা? গ্রামের স্কুলশিক্ষকের মূল্যবোধ, আদর্শ সেদিন ঠিকরে বেরোতে চাইছিল।
পাশ দিয়ে একটা মেয়ে হুড়মুড়িয়ে যাওয়ার সময় বেশ জোরে যাদবচন্দ্রের সঙ্গে ধাক্কা লেগে যেতেই মেয়েটা ঢাউস ব্যাগ নিয়ে ব্যস্তসন্ত্রস্ত হয়ে বিরক্ত মুখে চশমার ফাঁক দিয়ে যাদবচন্দ্রের দিকে তাকাল।
যাদবচন্দ্র একটু অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে কিছু বলার আগেই মেয়েটা হাত নেড়ে বলল, ‘সরি, কিছু মনে করবেন না দাদু। দেখতে পাইনি।’ কথাটা বলেই মেয়েটা হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গেল, মুহূর্তের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে গেল দৃশ্যপট থেকে।
যাক বাবা, এখন রাস্তাঘাটে কিছু লোকের জন্য সব বুড়োদের যেভাবে দোষের ভাগীদার করা হচ্ছে বলে কাগজে পড়েন, ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলেন! যাদবচন্দ্র একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে পুতোর দিকে তাকালেন। সে তখন প্ল্যাটফর্মের ডিজিটাল বোর্ডে ট্রেনের নাম পড়ার চেষ্টা করছে।
যাদবচন্দ্র আবার ভাবলেন, হাওড়ায় এত বছর পরে এলেও আরতিকে নিয়ে এই কয়েক বছরে কম বার কলকাতা আসতে হয়নি। তবে সে সবই গাড়ি করে। আরতিকে নিয়ে এই ভিড় ট্রেনে আসা সম্ভব নয়। মানকর থেকে পুতোর মামার গাড়িটা ভাড়া করে সোজা চলে আসতেন কলকাতার একপাশের ওই ঝকঝকে নতুন গড়ে ওঠা শহরটায়।
এতবার এসেছেন যে রাজারহাটের ওই ক্যান্সার হসপিটালের অলিগলি পর্যন্ত চেনা হয়ে গেছে শেষ কয়েক বছরে।
‘চলুন মাস্টারমশাই, দিয়ে দিয়েছে ট্রেন।’ পুতো যাদবচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে পা বাড়াল, ‘এট্টু জল-টল খাবেন নাকি?’
‘না রে, জল আমি ব্যাগে নিয়েই এসেছি।’ যাদবচন্দ্র পুতোর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে এসে ট্রেনে উঠে পড়লেন। বেশ ফাঁকাই আছে। এই ট্রেন যাবে বর্ধমান। তারপর সেখান থেকে আবার আসানসোল যাওয়ার ট্রেন ধরে মানকর।
যাদবচন্দ্র একটা নিশ্চিন্ত নিশ্বাস ফেলে পুতোকে বললেন, ‘এই এজেন্সিটা বেশ ভালোই মনে হল, বল?’
‘বলল তো সব কিছুই দেবে মাস্টারমশাই।’ পুতো সঙ্গের ব্যাগটা ওপরের বাঙ্কে তুলে রাখছিল, ‘আগে যেটায় ফোন করেছিলেন, কী বলেছিল মনে আছে? বারোদিনের প্রোগ্রামে রোজ শুধু ইয়ে কী বলে, বেকফাস দেবে। বলি, দুপুরের খাবার, রাতের খাবার তাহলে কে দেবে? বিদেশবিভুঁই, বাইরে গিয়ে গিয়ে খেয়ে আসবে? সে তো ঢাকের দায়ে মনসা বিক্কিরি হয়ে যাবে!’
‘কথাটা বেকফাস নয়!’ যাদবচন্দ্র বিরক্ত হলেন, ‘কথাটা হল ব্রেকফাস্ট। ব্রেক মানে কী?’
‘বেরেক?’ পুতো আমতা আমতা করে বলল, ‘গাড়িতে থাকে, পা দিয়ে চিপলে গাড়ি থেমে যায়!’
‘গর্দভ!’ যাদবচন্দ্র রাগতমুখে বললেন, ‘তোর জন্য মাঝে মাঝে আমার মাথা ঠুকতে ইচ্ছে হয়। কী যে পড়িয়েছিলাম ছোটোবেলায় কে জানে! ব্রেক মানে ভাঙা, আর ফাস্ট মানে উপবাস। দিনের প্রথমে যে খাবার খেয়ে আমরা উপবাস ভঙ্গ করি, সেটাই ব্রেকফাস্ট। অর্থাৎ জলখাবার।’
‘যাহ কলা, ফাস্ট মানে আমি এক নম্বর জানতাম!’ পুতো কান এঁটো করে হাসল। মাস্টারমশাইয়ের সব ভালো, শুধু মাঝে মাঝে কোথা থেকে সেই ছোটোবেলার মাস্টারমশাই সত্তাটা বেরিয়ে আসে।
আর তখনই মুশকিল হয় পুতোর। মানকর রত্নবালা প্রাইমারি স্কুলে কোনোমতে ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়েছিল ও, তার মধ্যেই কতবার যে হেডমাস্টার যাদবচন্দ্রের বেতের বাড়ি খেয়েছে, ভাবলে এখনও পিঠটা টনটন করে ওঠে। থ্রি-তে ফেল করেই লেখাপড়ায় ও ইতি দিয়েছিল, সে অবশ্য ওদের বংশের পুরুষানুক্রমে রেওয়াজ। ওদের বংশে আজ অবধি কেউ প্রাইমারি পাশ করেনি। তাই পুতোও থ্রি পর্যন্ত পড়ে স্কুল ছেড়ে দিয়ে ঐতিহ্য বজায় রেখেছিল। ওর বাপ-মাও সেটাকে স্বাভাবিক ধরে নিয়েছিল, ওকে লাগিয়ে দিয়েছিল চায়ের দোকানে কাজে।
কিন্তু মাস্টারমশাই সেটাকে কিছুতেই হজম করতে পারেননি। মাস্টারমশাইয়ের বাড়ির পাশেই খড়ের ছাউনি দেওয়া মাটির বাড়িতে তখন থাকত পুতোরা। মাস্টারমশাই নরম গরম অনেকরকম চেষ্টা করেছিলেন পুতোকে স্কুলে ফেরানোর। কোনো লাভ হয়নি। পুতো স্কুলছুট হয়ে পুরোদস্তুর কাজে নেমে পড়েছিল।
কিন্তু পড়াশুনো ছেড়ে দিলেও মাস্টারমশাইয়ের বাড়ির সঙ্গে ওর যোগাযোগ ছিন্ন হয়নি। তখন মাস্টারমশাইয়ের ছেলে রাজুদাদা বর্ধমানের কলেজে পড়ত, থাকত ওখানেই, হোস্টেলে। মাস্টারমশাইও দিনরাত স্কুল, বাড়ি ফিরে ছেলে পড়ানো নিয়ে ব্যস্ত। জেঠিমার টুকটাক বাজার থেকে এই আনা ওই আনা, সব ফাঁক পেলে পুতোই করত।
এই করতে করতে মাস্টারমশাইয়ের হাজার ধমকধামক শুনলেও কখন যেন ওদের বাড়ির ছেলে হয়ে গিয়েছিল পুতো। রাজুদাদার স্কুলের চাকরি পেয়ে কলকাতা চলে আসা, তারপর বিদেশে পড়তে চলে যাওয়া, মাস্টারমশাইয়ের রিটায়ার করা, জেঠিমার অমন কালরোগ ধরা পড়া, এই সমস্ত কিছুর সাক্ষী ও নিজে।
যাদবচন্দ্র আবার মুখ খুললেন, ‘যা দেখলাম, সব মিলিয়ে প্রায় আট লাখ মতো খরচা, বুঝলি!’
পুতো চটকা ভেঙে মাস্টারমশাইয়ের দিকে তাকাল। ওর মুখ হাঁ হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘আট লক্ষ! জেঠিমার চিকিৎসায় পরে লাগবে না তো মাস্টারমশাই?’
‘না রে!’ যাদবচন্দ্র সরু চোখে জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন। প্ল্যাটফর্মের এক বেঞ্চিতে বসে থাকা একটা বাচ্চা ছেলে এলিয়ে শুয়ে আছে মায়ের কোলে, তার মা এই দুর্ধর্ষ গরম থেকে ছেলেকে একটু অব্যাহতি দেওয়ার জন্য নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে বাতাস করে চলেছেন। মায়ের নিজেরও গলা দিয়ে দরদরিয়ে নামছে ঘাম, কিন্তু সেদিকে তাঁর ভ্রূক্ষেপ নেই। ছেলে তাঁর করা বাতাসে আরাম পাচ্ছে, তিনি তাতেই তৃপ্ত। উদগ্রীব হয়ে ঝুঁকে পড়ে তাকিয়ে আছেন ছেলের মুখের দিকে।
অত্যন্ত পরিচিত এবং স্বাভাবিক একটি দৃশ্য। কিন্তু সেটাই যাদবচন্দ্রের মনকে কেমন যেন নাড়া দিয়ে গেল। তাঁর মনে পড়ল, আরতিও এমনভাবেই রাজুকে আগলে রাখতেন। রাজু স্কুল থেকে ফিরতে সামান্য দেরি করলে উদবিগ্ন মুখে বার বার ঘরবার করতেন, স্বামীকে মোড়ের মাথায় দেখতে পাঠাতেন বার বার। খেলতে গিয়ে কেটেছড়ে এলে এমন আহা উহু করে বাড়ি মাথায় করতেন যে যাদবচন্দ্র কতবার বিরক্ত হয়েছেন। বলেছেন, ‘আহ, বাচ্চারা খেলতে গিয়ে কাটবে, পড়বে, কত কী হবে। ওইসব নিয়ে তোমার এত উতলা হওয়ার কী আছে? একটু আয়োডিন লাগিয়ে দাও, ঠিক হয়ে যাবে।’
আরতি শুনতেন না। রাজু সামান্য ব্যথায় ককিয়ে উঠলে যন্ত্রণায় তাঁরও মুখ নীল হয়ে যেত, তিনিও যেন সমান কষ্টে নিজের শরীরে টেনে নিতেন যন্ত্রণাটা। স্বামীর কথা শুনে মুখ ভার করে বলতেন, ‘ছেলেটার মুখটা ভালো করে দেখলে একথা বলতে না। আমি তো মা, আমি বুঝি। কতটা কষ্ট হচ্ছে ওর।’
সেই রাজু আজ মায়ের কেমোর পর কেমো চলে, একটা খোঁজও নেয় না, আরতির বুকটা কতটা কষ্টে ফেটে যায়, তা যাদবচন্দ্র অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেন।
না, আরতি মুখে কিছু বলেননা কখনোই। কিন্তু একটা করে কেমোথেরাপির সেশনের পর যখন ক্লান্ত জীর্ণ দেহে বাড়ি ফেরেন, যাদবচন্দ্র খুব ভালো করে খেয়াল করেছেন, গাড়ি দ্বিতীয় হুগলি সেতু পেরিয়ে সাঁতরাগাছিতে উঠলেই আরতি কেমন চঞ্চল হয়ে ওঠেন, ঘোলাটে ক্লিষ্ট চোখ দুটো এদিক-ওদিক ফিরিয়ে দেখতে চেষ্টা করেন কিছু। হয়তো কেউ আরতিকে কখনো বলেছে যে সাঁতরাগাছি হাওড়া জেলায়, আর ছেলে একটা সময় হাওড়ায় ছিল মানেই তা সাঁতরাগাছির আশেপাশে এমন কিছু সেইসময় মায়ের অবুঝ মন ভেবে নেয়।
সত্যি, রাজু যখন হাওড়ার স্কুলে চাকরিটা পেয়েছিল, গর্বে যাদবচন্দ্র সারা গ্রামে মিষ্টি বিলোলেও রাজু যে ভেতর ভেতর অতটা অখুশি ছিল তা বাপ হয়েও ঘুণাক্ষরে টের পাননি তিনি। রাজু দেড়-দু-মাস অন্তর তখন বাড়ি আসত। তখনই একদিন যাদবচন্দ্র দেখেছিলেন রাজু সকালে উঠে মোটা মোটা বই নিয়ে বসছে।
গ্রামের স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিজের রাশভারী ব্যক্তিত্ব বজায় রাখলেও ছেলের সঙ্গে ছোটো থেকে বন্ধুর মত মিশতেন যাদবচন্দ্র। পড়াশুনোর বাইরেও অনেকরকম জানা অজানা বিষয়ে ছেলের কৌতূহল জাগিয়ে তোলা, যত কাজই থাক, তিন-চার মাস অন্তর কাছাকাছি কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, এইসবই যাদবচন্দ্র রাজুর ছোটোবেলা থেকে করেছেন অক্লেশে। সেদিন তাই বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কী পড়ছিস?’
‘একটা পরীক্ষা দেব। তারই পড়াশুনো করছি, বাবা।’ রাজু শান্ত গলায় বলেছিল।
যাদবচন্দ্র শুনে মনে মনে খুশিই হয়েছিলেন। সত্যি বলতে কী, রাজুর মতো মেধাবী ছেলে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হয়ে থাকবেই-বা কেন! নেহাত নিজের খুশিতে এম এস সি পড়তে পড়তে পরীক্ষাটা দিয়েছিল তাই, নাহলে মাস দুয়েক আগে এম এসসি-র ফাইনাল রেজাল্ট বেরিয়েছে আর রাজু গোটা বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড হয়েছে। তিনি সাগ্রহে বলেছিলেন, ‘হাইস্কুলের চাকরির পরীক্ষা? না কলেজ সার্ভিস কমিশন?’
‘কোনোটাই নয়।’ রাজু বলেছিল, ‘ডক্টরেট করতে যাব বিদেশে। সেইজন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
‘বিদেশে ডক্টরেট?’ যাদবচন্দ্র হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকেছিলেন, ‘সে তো অনেক খরচ! তা ছাড়া অনেকরকম রেকমেন্ডেশনও লাগে শুনেছি!’
‘জি আর ই-তে ভালো স্কোর করতে পারলে অনেকটাই স্কলারশিপ পাওয়া যায়। আর তা ছাড়া …’ রাজু একটু ইতস্তত করে বলেছিল, ‘আমার এক বন্ধুর বাবা ফ্রান্সের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব নামী অধ্যাপক। তিনি রেকমেন্ড করবেন।’
পুতো আবার একবার ডাকতে যাদবচন্দ্রের চটকা ভেঙে গেল, ‘মাস্টারমশাই!’
‘হ্যাঁ, বল।’ যাদবচন্দ্র মুহূর্তে বর্তমানে ফিরে এলেন।
‘জেঠিমার চিকিৎসার খরচ …!’
যাদবচন্দ্র বললেন, ‘ডাক্তার তো জবাব দিয়েই দিয়েছেন পুতো। বড়োজোর আর ছ-মাস। শেষের কেমো দুটোয় তোর জেঠিমা কোনো রেসপন্সই করতে পারেনি। ও চলে গেলে আমি একা মানুষ, কী করব? তার চেয়ে চলে যাওয়ার আগে কয়েকদিন যদি ওকে একটু আনন্দ দেওয়া যায়, যদি রাজুকে একবার চোখের দেখা দেখানো যায়… !’
‘কিন্তু এতগুলো টাকা …!’ পুতো কিন্তু কিন্তু করে বলল।
‘রাজু তো আর এদেশে ফিরবে না।’ যাদবচন্দ্র বললেন, ‘কেষ্টগঙ্গার পাড়ের দিকে কয়েক কাঠা জমি কেনা ছিল, চাকরি করতে করতে পি এফ থেকে টাকা তুলে অনেক কষ্টে কিনেছিলাম। ভেবেছিলাম, রিটায়ারের পর একটা ছোটো বাড়ি করব ওখানে। সেসব কিছুই তো হল না। ওই জমিটা বেচে দেব।’
৮
কিছু কিছু স্বপ্ন মনের মধ্যে চারাগাছ হয়ে ঘুমিয়ে থাকে অনেকদিন ধরে।
যখন তা শেষপর্যন্ত ডালপালা মেলে বেরোতে শুরু করে, তখন কখনো পারিপার্শিক পরিবেশ অনুকূল হয়ে তার বৃদ্ধিতে সাহায্য করে, কখনো আবার আঁকড়ে টেনে ধরতে থাকে নীচে নামানোর জন্য।
জিনিয়ার জীবনে এই দুটো সমান্তরালে ঘটে চলেছে। একদিকে কিছু ঘটনা এগিয়ে নিয়ে চলেছে ওর স্বপ্নকে, অন্যদিকে বাধা আসছে একের পর এক।
মাঝে মাঝে আর কাউকে না পেয়ে ওর প্রচণ্ড রাগ হয় ফুলুমামার ওপর। সত্যিই তো, মনে হয় সব গণ্ডগোলের জন্য ফুলুমামাই একমাত্র দায়ী। ছোটো থেকে ওকে নিয়ে এত না ঘুরলে, দেশ-বিদেশের অত গল্প না করলে এই পায়ের তলায় সরষে মার্কা অ্যাটিটিউডটা কি ওর তৈরি হত? নাকি দু-একমাস পরপরই অফিস ছুটি নিয়ে, যাহোক করে কোথাও-না-কোথাও পিঠে রুকস্যাক বেঁধে বেরিয়ে পড়ার জন্য আঁকুপাকু করত মন!
শিক্ষিত মধ্যবিত্ত আর পাঁচটা বাঙালি পরিবারের চেয়ে জিনিয়ার পরিবারও কিছু আলাদা ছিল না। ছোটো থেকে পড়াশুনো করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোটাই যে জীবনে সফল হওয়ার মূল উদ্দেশ্য তা ওর মাথায় বলতে গেলে পেরেক দিয়ে গেঁথে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সত্যিই যখন সে নিজের পায়ে দাঁড়াল, তখন প্রাথমিক কয়েক মাসের উচ্ছ্বাসটা কেটে যেতেই ও উপলব্ধি করছিল এই দশটা-আটটার চাকরি, এই দিনরাত এসক্যালেশন, অনসাইট, ডিপ্লয়মেন্টের দৌড় ওর জন্য নয়। গড়পড়তা এই আই টি-র চাকরিতে ষাট বছর পর্যন্ত থাকা ওর পক্ষে অসম্ভব।
কাজের ফাঁকেই ধীরে ধীরে ও যেন হাঁপিয়ে উঠতে শুরু করল। আর তখনই ওর মাথায় ব্যবসার ভূতটা চাপল। মনে হল ওর মতো স্বাধীনচেতার জন্য ব্যবসাই আদর্শ পেশা।
সময় কারুর জন্যই থেমে থাকে না। নিরন্তর বইতেই থাকে। এভাবেই অসন্তোষ, বিরক্তি মনের মধ্যে চেপে ও কাটিয়ে দিচ্ছিল একটার পর একটা বছর। এক সময়ে বিয়েও করল অতন্দ্রকে। অতন্দ্র কলেজে ওর সহপাঠী ছিল, এখন যদিও অন্য কোম্পানিতে চাকরি করে। ভালোবাসার মানুষটাকে বিয়ে, তারপর নিজেদের দু-কামরার ছোটো একটা স্বপ্নের ফ্ল্যাট, তাও হল। খড়দার মেয়ে জিনিয়া দুর্গাপুরের অতন্দ্রর সঙ্গে সংসার পাতল লেকটাউনে। দু-জনের ব্যস্ত চাকরি, বাড়ি ফিরে রান্নাবান্না, ছুটির দিনে বাজার-দোকান, কখনো কখনো কোনো সিনেমা দেখতে যাওয়া, সপ্তাহ কয়েক অন্তর দুর্গাপুরে শ্বশুরবাড়ি, দু-তিনমাস অন্তর ঘুরতে যাওয়া এভাবেই কাটছিল ওদের জীবন।
মাঝেমধ্যে যে একঘেয়ে লাগত না তা নয়, কিন্তু তাই বলে যে কোনোদিন অতন্দ্রর সঙ্গে ওর সম্পর্কে চিড় ধরতে পারে, কখনো যে এইভাবে অন্তিম বিচ্ছেদ আসন্ন হতে পারে তা ও কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি। আর এইজন্য শুধু তৃতীয় ব্যক্তিকেই দায়ী করে তো লাভ নেই, নিজেদের মধ্যের সেই বাঁধনের রাশ যে দৈনন্দিন ব্যস্ততা আর অভ্যেসের মধ্যে অনেক আলগা হয়ে গেছে, সেটাও একটা মস্ত অনুঘটক!
নিজের অজান্তেই চোখের কোণ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল জিনিয়ার, সামনে এত বড়ো কর্মকাণ্ড অপেক্ষা করছে, আর এখনই এসব হতে হল!
অতন্দ্রকে ও অনুরোধ করেছিল অন্তত প্রথমবারটা সঙ্গে চলুক, এতদিনের ভালোবাসার দোহাই দিয়ে জিনিয়ার জন্য ও এইটুকু নাহয় করল! কিন্তু আজ ফোনে যা ভাষা বলল অতন্দ্র, এরপরেও কী করে আর ওর সঙ্গে যাবে জিনিয়া!
হোক ওদের ডিভোর্স আসন্ন, তবু তো জিনিয়া এখনও ওর স্ত্রী!
আর কীই-বা বলেছিল ও শুভ্রদীপকে? শেষদিন যখন জিনিয়া সেই প্রচণ্ড অশান্তির পরে ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে আসছিল, তখনই অতন্দ্র বলেছিল ও কোনোভাবেই আর দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের সঙ্গে যুক্ত থাকবে না। এদিকে তারপর থেকে পরিচিত সবাই ওর কথা জিজ্ঞেস করতে শুরু করেছিল। তাই সেদিন বাধ্য হয়ে শুভ্রদীপকে ক্রমাগত প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে বলে ফেলেছিল অতন্দ্রর অনিচ্ছার কথা।
তাই বলে নিজের স্ত্রীকে কেউ এত কদর্য ভাষা বলতে পারে? যত মাথাগরম ছেলেই হোক না কেন, অতন্দ্রর মনের মধ্যে তার মানে কতটা ঘৃণা জমা হয়েছে জিনিয়ার বিরুদ্ধে, যেটার জন্য আজ ওর মুখের কোনো আগল নেই।
হ্যাঁ, জিনিয়া স্বীকার করছে যে সেদিন উত্তেজনার বশে ও একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেছিল, কিন্তু তাই বলে অতন্দ্রর কি কোনো দোষই নেই? জীবনের এমন একটা সন্ধিক্ষণে মানসিক দিক থেকে এতটা চাপ জিনিয়া কঈ করে নেবে?
দাশগুপ্ত ট্রাভেলস। জিনিয়ার বড়ো আদরের একটা স্বপ্নউড়ান। মাসকয়েক আগে ট্রেড লাইসেন্সের আবেদন করার আগে যখন কোম্পানির নাম ঠিক করতে বসেছিল, তখন ফুলুমামা আর অতন্দ্র অনেক নামের সুপারিশ করেছিল। হ্যাপি জার্নি, গো ট্রাভেল, আরও অনেক কিছু।
কিন্তু জিনিয়া সেসব প্রথমেই নস্যাৎ করে দিয়েছিল। বলেছিল, ‘খাঁটি বাঙালি নাম রাখব। বেশিরভাগ বাঙালিই ঘুরতে ভালোবাসে। সারা দেশের মধ্যে সব জায়গায় তাদের দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু মধ্যবিত্ত আড়ষ্টতা থেকেই হোক কিংবা ঠিক গাইডেন্সের অভাবেই বিদেশ ভ্রমণে এখনও বাঙালি খুব একটা এগিয়ে আসে না। এসব দিকে মারাঠি বা দক্ষিণ ভারতীয়রা এগিয়ে। তাই আমি প্রথমে আমাদের বাঙালিদের নিয়েই এগোব। নাম হবে দাশগুপ্ত ট্রাভেলস।’
অতন্দ্র মিটিমিটি হাসলেও ফুলুমামা অমনি অতন্দ্রর হয়ে হাঁ হাঁ করে উঠেছিল, ‘ও কী! শুধু তোর নিজের পদবি কেন! আমাদের জামাইও তো কো-ফাউন্ডার নাকি, তারটা বাদ গেল কেন?’
‘কী মুশকিল, বাদ কোথায় গেল।’ জিনিয়া বলেছিল, ‘তোমাদের জামাইয়ের পদবি তো আমারটার মধ্যেই ঢুকে রয়েছে। গুপ্ত তো দাশগুপ্তর মধ্যেই। দাশগুপ্ত গুপ্ত ট্রাভেলস তো আর করা যায় না! সুতরাং আমি ওর সুপারসেট বলতে পারো।’
ফুলুমামা আর অতন্দ্র দু-জনেই তখন হেসে ফেলেছিল।
মাত্র কয়েক মাস আগের ঘটনা। অথচ দুটো পরিস্থিতির কত আকাশ পাতাল ফারাক! জিনিয়া ভাবতে ভাবতে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলল।
পাশের ঘর থেকে বাবা খক খক করে কেশে উঠল হঠাৎ। ওই মানুষটার জীবনেও শান্তি নেই। সারাজীবন আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করে এসেছে, এখন এই যুগে আদর্শহীন সুবিধাবাদী মানুষের সংখ্যা প্রতিটা দলে এমনভাবে বেড়ে যাচ্ছে যে বাবার মতো আদর্শপন্থী মানুষরা দলে কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে। মুড়ি মুড়কির মতো এখনকার নেতারা শুধুমাত্র নিজের স্বার্থের তাগিদে দল পরিবর্তন করছে। দলের প্রতি নেই কোনো বিশ্বস্ততা বোধ, নেই কোনো আত্মিক টান। আর এই নিয়ে প্রতিবাদ করতে গেলেই নিজের দলের মধ্যেই নিজেকে হয়ে পড়তে হচ্ছে একঘরে। কাউন্সিলার হলেও পরিণত হতে হচ্ছে পার্টির ক্যাডারদের হাতের পুতুলে। এবারের টার্মে যে বাবা আর টিকিট পাবে না, সেটাও সবাই বুঝে গেছে।
ও অনেকবার বলেছে, ‘বাবা, বয়স তো হল। এবার পার্টি করা ছেড়ে দাও।’
বাবা মৃদু হেসেছে, বলেছে, ‘পার্টি করা আবার কী রে? এটা কোনো চাকরি নয় যে ছেড়ে দেব। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমরা দলের হয়ে কাজ করি বুঝলি? কাজেই মুক্তি।’
জিনিয়া আলগোছে দূরের দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল। স্ট্রিটলাইটের আলো পড়ে ঘড়ির কাঁটাগুলো অন্ধকারেও আলোকিত হয়ে উঠেছে। রাত সাড়ে বারোটা। বাবা ঘুমের ওষুধ খেয়ে রোজ শুতে যায়, শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু আজ এখনও জেগে রয়েছে।
সম্ভবত জিনিয়ারই কারণে।
জিনিয়া বেশ বুঝতে পারছে, ও আচমকা খড়দার বাড়িতে চলে আসার পর থেকে মা-বাবার মনে শান্তি নেই। মুখে কিছু না বললেও দু-জনেরই হাবভাব অভিব্যক্তি বুঝিয়ে দিচ্ছে যে জিনিয়া কেন দুম করে লেকটাউনের ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে এল। গত কয়েক মাস ধরে এমনিতেই অসন্তোষ চলছিল জিনিয়ার চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় নামা নিয়ে। তা নিয়ে বাবা-মা দুজনেরই অনুযোগ, অভিযোগ ফোনের মাধ্যমে হোক বা সরাসরি, জিনিয়াকে সহ্য করতে হচ্ছিল।
এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এই নতুন ইস্যু।
অথচ জিনিয়া কিন্তু কিছুই বলেনি। অতন্দ্র যে কতটা বাড়াবাড়ি শুরু করেছে, ওরা দু-জনেই যে আইনি বিচ্ছেদের দিকে পা বাড়ানোটা চূড়ান্ত করে ফেলেছে, এসব কিছুই ও এখনো জানায়নি বাবা মাকে। কী হবে জানিয়ে? এমনিতেই দু-জনের বয়স হয়েছে, বাবা এখনও মনের জোরে মিউনিসিপ্যালিটির কাজ চালিয়ে গেলেও শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়ছে দিন দিন। মায়েরও হাঁটু, চোখ, প্রেশার এইসব নিয়ে ভোগান্তির শেষ নেই। তার মধ্যে নতুন করে ওকে নিয়ে ওরা চিন্তা করুক, জিনিয়া তা চায়নি।
হ্যাঁ, এটা ঠিক যে এই জিনিস লুকিয়ে রাখার নয়। তবু যতদিন চেপে রাখা যায় ততদিনই মঙ্গল, এটাই ভেবেছিল ও।
কিন্তু মায়ের চোখকে হয়ত ফাঁকি দেওয়া অতটা সহজ নয়।
জিনিয়া তখন এ বাড়িতে এসেছে তিনদিনও হয়নি, একদিন অফিস থেকে ফেরার পর মা এসে কিছুই হয়নি এমন ভাব করে বলল, ‘অতন্দ্রকে একবার ফোনটা ধরিয়ে দে তো, জিনি! আমি করছি, রিং হয়ে যাচ্ছে, কিছুতেই তুলছে না।’
জিনিয়া তখন সবে ব্যালকনিতে একটু আরাম করে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল, মায়ের কথায় হকচকিয়ে বলল, ‘হঠাৎ? কেন, কী বলবে তুমি?’
‘কাল তো তোর বাবার জন্মদিন। একটু পায়েস করব। ভালমন্দ রাঁধব। তুই যখন এখানে, ও একা একা ফ্ল্যাটে থেকে কী করবে, শনিবার, ছুটিও আছে, এখানে চলে আসবে। সেটা বলতেই ফোন করব।’ মা নির্বিকার মুখে হাত বাড়িয়েছিল, ‘দে। ফোনটা ধরিয়ে দে।’
‘না।’ জিনিয়া ভ্রূ কুঁচকে তাড়াতাড়ি বলেছিল, ‘ওকে ফোন করতে হবে না। ও কাল পরশু দু-দিনের ছুটিতে দুর্গাপুরের বাড়িতে চলে যাবে।’ তারপর একটু ইতস্তত করে ঠোঁট কামড়েছিল ও, ‘আর তোমার ফোন থেকেও করবে না যেন।’
মা সেদিনই যা বোঝার বুঝে গিয়েছিল। তারপর এই পাঁচ-ছয়দিনে মায়ের মুখ গম্ভীর থেকে গম্ভীরতর হয়েছে, বাবাও চুপ হয়ে গেছে, জিনিয়া ভালোমতো খেয়াল করেছে।
একটা ব্যাপার ওর ভারী আশ্চর্যের লাগে। ও বিবাহিত বলে কি শান্তিতে ক-টা দিন নিজের বাড়িতে এসে থাকার অধিকারটুকু অবধি নেই? বিয়ের আগে যেমন স্বাভাবিকভাবে বাড়িতে নিজের ঘরে ও থাকত, ঘুমোত, সেই তালটা যেন কোথাও কেটে গেছে, খেয়াল করে দেখেছে ও। এমনিতেই ও এখন এই বাড়িতে এলেই বাবা যেন একটু অতিরিক্ত যত্ন নেওয়া শুরু করে।
বাজার থেকে ভালো মাছ কিনে আনে, মাংস কিনে আনে। কথায় কথায় মাকে বলে, ‘হ্যাঁগো, জিনিকে ওইটা খেতে দাও, এইটা দিয়েছ?’
আশ্চর্য! রাগে জিনিয়ার শরীর জ্বলে ওঠে। মনে হয় চিৎকার করে বলে, ‘আমি কি এ বাড়ির কোনো অতিথি? বিয়ের পর কি এতটাই পর হয়ে গেছি যে বিশেষভাবে আমার যত্ন নিতে হবে, আতিথেয়তা করতে হবে?’
এমনিতেই এই, সেখানে এবার পরিস্থিতি জটিল বুঝে বাবা মা আরও বাড়াবাড়ি আরম্ভ করেছে। ও বিলক্ষণ বুঝতে পারছে মা এরই মধ্যে খেয়াল করে ফেলেছে যে এই কয়েকদিনে অতন্দ্রর সঙ্গে ও একবারও ফোনে কথা বলেনি।
আজ অফিস থেকে ফেরার পর মা ব্যালকনিতে ওর কাছে এল। ও লক্ষ করল, বাবা তার একটু আগেই কিছু একটা কাজের অজুহাত দেখিয়ে বেরিয়ে গেল। সম্ভবত দু-জনে আগে থেকে পরিকল্পনা করে রেখেছিল। মা এসে একথা সেকথার পর হঠাৎ বলল, ‘একটা কথা ঠিক করে বল তো জিনি, তোদের মধ্যে কি কিছু হয়েছে?’
জিনিয়া এই প্রশ্নটা দু-তিনদিন থেকেই শোনার অপেক্ষায় ছিল। তবু বাস্তবে মায়ের মুখ থেকে কথাটা বেরোতেই ওর মেজাজটা তেতো হয়ে গেল। নিজেকে প্রাণপণ সংবরণ করতে করতে ও বলেছিল, ‘কেন বলো তো?’
এমনিতেই মেয়ের অভিমান বেশি, তায় সব বিবাহিতা মেয়েই স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে বাপের বাড়ি এলে একটু বেশি সংবেদনশীল হয়ে থাকে। সামান্য কথাকেও বড়ো করে ধরে, সোজা কথাকে অন্যভাবে নিয়ে কষ্ট পায়।
মা সেটা বুঝে সতর্ক গলায় ধীরে ধীরে শুরু করেছিল, ‘না, এতদিন হয়ে গেল তুই এখানে এসে রয়েছিস …!’
কিন্তু জিনিয়া নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেনি, ‘মানেটা কী মা? নিজের বাড়িতে এসে রয়েছি বলে কি আমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে? বিয়ে করে ফেলেছি বলে কি এটা এখন আর আমার বাড়ি নয়? তাই যদি হয়, আমার আসা, থাকা নিয়ে তোমাদের যদি এতই সমস্যা হয়, তবে খোলাখুলি বলতেই পারো, আমি আর আসব না এখানে!’
মা কিন্তু একটুও রাগেনি। বরং ধীর কণ্ঠে বলেছিল, ‘জিনি, তুই শুধু শুধু মাথা গরম করছিস। এটা তোর বাড়ি, এখানে এসে থাকবি, তাতে আমাদের কী বলার আছে? বরং বাড়ির মেয়ে বাড়িতে এসেছে, এতে তো আমাদের আনন্দ, বুড়োবুড়ি একাই থাকি। কিন্তু তুই যদি ঝগড়া করে আসিস, মুখ কালো করে বসে থাকিস, তাতে তো আমাদেরও খারাপ লাগে, এটা কেন বুঝছিস না! আমরা তোর বাবা-মা, আমরা চাই তুই সুখে থাক, আনন্দে থাক …!’
জিনিয়া মা-র কথার মাঝপথে বাধা দিয়ে রূঢ়কণ্ঠে বলেছিল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি সুখেই রয়েছি, আনন্দেই রয়েছি। আর এখন থেকে আমি এখানেই থাকব। তোমাদের যদি একান্তই অসুবিধা থাকে তাহলে বলে দাও, আমাকে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।’
এখন সন্ধেবেলার কথাগুলো মনে পড়তে রাতের অন্ধকারে বিছানায় শুয়ে অপরাধবোধে কুঁকড়ে গেল জিনিয়া। সত্যি, সব জোরজুলুম কি বাবা-মায়ের ওপর করাটা ওর শিক্ষার নমুনা? কে কোথায় জিনিয়াকে খারাপ খারাপ কথা বলছে, সম্পর্কে বিশ্বাসঘাতকতা করছে, সেই রাগ সহ্য করতে হবে কিনা বাবা মাকে?
কেন? তারা জিনিয়াকে জন্ম দিয়েছে, একরত্তি থেকে বড় করে তুলেছে বলে? এই পৃথিবীতে তারাই শুধুমাত্র নিঃস্বার্থভাবে জিনিয়াকে ভালোবাসে বলে তাদেরকেই বুঝি সব মেজাজ সহ্য করতে হবে?
জিনিয়ার চোখ দিয়ে আবার জল গড়াতে লাগল। ছিঃ! নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে ওর। যে অপমান করছে, তাকে কিছু বলার সাহস নেই বলে ও কিনা নরম মাটিতে আঁচড় কাটছে।
ওর আবার সেদিন অতন্দ্রর ফোনে হঠাৎই আবিষ্কার করা মেসেজটার কথা মনে পড়ে গেল।
‘প্লিজ অতন্দ্রদা! আমার এই অ্যাবরশনের ব্যাপারটা কাউকে বোলো না যেন! আমার দিব্যি!’
মনে পড়ামাত্র ওর শরীরের প্রতিটা রোমকূপ খাড়া হয়ে উঠল।
সেদিন ছিল নেতাজি ইনডোরে পর্যটন মেলার শেষ দিন। তিনদিন ধরে চলছিল মেলাটা, শেষ দিন স্টল গুছিয়ে, সব হিসেবনিকেশ করে ওর আর বিকাশের বেরোতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। অফিসে তখন ও ছুটি নিলেও অতন্দ্র নিতে পারেনি, ওদের তখন একটা প্রোজেক্টের ডিপ্লয়মেন্ট ছিল।
অতন্দ্রর সেদিন অফিস থেকে ফিরতে অনেক দেরি হয়েছিল। ঘড়ির কাঁটা রাত সাড়ে দশটা পেরিয়ে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার আগে থেকে অতন্দ্র ফোনে কারুর সঙ্গে ব্যস্ত ছিল। অফিসের ব্যাগ রাখা থেকে শুরু করে জিনিয়ার বাড়িয়ে দেওয়া গ্লাস থেকে ঢক ঢক করে জল খাওয়া সবই করছিল বাঁ কানে ফোন চেপে ধরে।
জিনিয়া ইশারায় ফোনটা রাখতে বলছিল। মেজাজ দু-দিন ধরে ওর এমনিতেই খারাপ ছিল। পর্যটন মেলায় চব্বিশ হাজার টাকা দিয়ে স্টল নিতে হয়েছিল, সঙ্গে বিকাশ বলে একটা ছেলেকে দৈনিক পাঁচশো টাকা দিয়ে রেখেছিল স্টলে সারাক্ষণ থাকার জন্য।
সেখানে মেলা থেকে ওর প্রাপ্তি আক্ষরিক অর্থে শূন্য।
প্রথম দু-দিন বলতে গেলে মাছিই তাড়িয়েছিল ও। সবাই আসছে, এসেই নামকরা টুর কোম্পানিগুলোর স্টলে ঢুকে যাচ্ছে। তাদের স্টলও যেমন বিশাল, স্টলের বাইরে দাঁড়িয়ে তেমন সব সুন্দর ইউনিফর্ম পরা ছেলেমেয়ে, তাদের হাতে গোছা গোছা রং বেরঙের লিফলেট। আর লোকজন ঘুরতে যাক না যাক, ছাপার অক্ষরে লিফলেট দেখলেই যে নেওয়ার জন্য হামলে পড়ে, তা জিনিয়া আগেও খেয়াল করেছে।
আর সেটা ভেবেই নিজে দু-রকমের লিফলেট ছাপিয়েছিল ও, বিকাশকে দিয়ে একঘণ্টা অন্তর বিলি করাচ্ছিল স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে।
কিন্তু ভারতবিখ্যাত সব এজেন্সির দারুণ গ্রাফিক্সের কাজ করা ঝলমলে বাহারি লিফলেটের সঙ্গে ওর সাধারণ ফটোশপে বানানো লিফলেট পারবে কেন? যতই ও ভালো অফার দিক, ভালো হোটেল, ভালো খাবারের আশ্বাস দিক। লোকজন নিয়েও একনজর দেখেই হেলায় ঢুকিয়ে রাখছিল হাতের ব্যাগে। কেউ আবার কোনো কিছুর পরোয়া না করে ওদের সামনেই ছুড়ে দিচ্ছিল ডাস্টবিনে।
সারাটা দিন ধরে অনেক আশা নিয়ে বসে বসে শেষে জিনিয়ার চোখে জলই এসেছিল। না, কোম্পানির প্রোপ্রাইটর হিসেবে ওর এমন প্রত্যাশা ছিল না যে আনকোরা কোম্পানি হওয়া সত্ত্বেও লোকজন ছুটে এসে ওর প্যাকেজ বুক করবে।
কিন্তু, স্টলের সামনে এসে দেখতেও তো পারে। জিনিয়া তাহলে একটু বোঝানোর সুযোগ পায়। কিন্তু তা হয়নি। বাইরে থেকে একঝলক তাকিয়েই সরে গিয়েছে বেশিরভাগ মানুষ। বড়ো ব্র্যান্ড, বড়ো বড়ো ফ্লেক্স নেই বলেই হয়তো।
তবু তৃতীয় দিন অর্থাৎ সেদিন মনটা একটু হলেও হালকা হয়েছিল। সেদিনই মেলা শেষ, বেশিরভাগ স্টলের কর্মীরা অনেক হালকা মেজাজে ছিল। আশপাশের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপও হয়েছিল। তারা সবাই নামিদামি টুর কোম্পানির সেলস এগজিকিউটিভ। তারা অবশ্য সবাই জিনিয়াকে খুব প্রশংসা করেছিল, সারাক্ষণ টার্গেটের খাঁড়া মাথা না ঝুলিয়ে রেখে নিজেই নেমে পড়েছে বলে।
অতন্দ্র তো শুধু ওর স্বামী ছিল না, ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধুও ছিল। তখন অবধি যে ক-জন লোক হয়েছিল প্রথম টুরের জন্য, তা অতন্দ্রই জোগাড় করেছিল। ছোটোবড়ো কোনো কথাই ওকে না বললে পেটের ভাত হজম হত না জিনিয়ার। তাই ভেতরে ভেতরে ছটফট করছিল কখন পুঙ্খানুপুঙ্খ বলবে ওকে।
কিন্তু অতন্দ্রর সেদিন ফোন রাখার কোনো লক্ষণই ছিল না। চুপচাপ ও প্রান্তের কথা ও শুনে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে হুঁ-হাঁ করছিল শুধু।
জিনিয়ার বিরক্ত লাগলেও কিছু বলেনি। মাঝেমধ্যে ক্লায়েন্টের এমন ফোন আসে, যে কোনো উপায় থাকে না। নিজে আই টি-তে থেকে সেটা বিলক্ষণ বোঝে ও। এমনও হয়েছে, ভিড় বাসে এক হাতে কোনোমতে হাতল চেপে ধরে বকতে বকতে আসতে হয়েছে ওকে।
যদিও ওর ভুল ভেঙ্গেছিল খানিক পরেই। অতন্দ্র খুব নরম গলায় কাকে যেন বোঝাচ্ছিল, ‘তুই এত চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আরে, আমি তো আছি নাকি!’
জিনিয়া বুঝতে পেরেছিল, আর যাই হোক, অতন্দ্র অফিশিয়াল ব্যাপারে কারুর সঙ্গে কথা বলছে না।
তবে? দুর্গাপুরের কোনো বন্ধু বিপদে পড়েছে নাকি? অনেক ছোটোবেলার বন্ধুকেই বিপদে টাকা ধার দিয়ে সাহায্য করে থাকে অতন্দ্র। কিন্তু তাও মনে হচ্ছে না। এতক্ষণের কথোপকথনে টাকার কথা একবারও শুনতে পায়নি জিনিয়া। প্রায় কুড়িমিনিট চুপ করে থেকে ও বিরক্ত হয়ে ইশারায় জানতে চেয়েছিল, ‘কে?’
অতন্দ্র উত্তর দেয়নি, উলটে জিনিয়াকে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলে সরে গিয়েছিল বারান্দার দিকে। গলার স্বরও প্রায় খাদে নামিয়ে দিয়েছিল।
আসল বিস্ফোরণটা সেদিনই হয়েছিল।
তবে তাল কাটতে শুরু করেছিল তার প্রায় এক মাস আগে থেকেই।
জিনিয়ার জন্মদিনে যেদিন টিমের বাকি সবার সঙ্গে অতন্দ্র নিমন্ত্রণ করেছিল গীতিকা বলে নতুন জুনিয়র মেয়েটাকে। জিনিয়া আগে থেকেই অতন্দ্রর টিমের বাকিদের চিনত, সেদিনই প্রথম পরিচয় হয়েছিল গীতিকার সঙ্গে। কোনো ষষ্ঠেন্দ্রিয় বা অবচেতন ইঙ্গিতেই হোক, সেদিনই জিনিয়া খেয়াল করেছিল অতন্দ্র আর গীতিকার মধ্যে অন্যদের থেকে একটু বেশিই রঙ্গরসিকতা চলে। সেটা নিজেদের মধ্যে মজার খুনসুটিই হোক বা লেগ পুলিং।
স্বভাবগত দিক থেকে জিনিয়া বরাবরই বেশ খোলামেলা, মনের গভীরতম কোটরে সামান্যতম অভিমান জমা হলেও সেটাকে চেপে রাখতে পারে না ও। যতক্ষণ না সেটা অতন্দ্রর কাছে উগড়ে দিতে পারে, ততক্ষণ ও স্বাভাবিক হতে পারে না।
সেদিন রাতেই অতন্দ্রকে ও প্রথম প্রশ্ন করেছিল, ‘গীতিকা বলে মেয়েটা তোমাকে পকাই বলে ডাকে?’
অতন্দ্র তখন সারা দিনের হইহুল্লোড় শেষে খাটে বসে টিভির রিমোট টিপে এ চ্যানেল ও চ্যানেল করছিল, জিনিয়ার প্রশ্নে টিভির পর্দা থেকে চোখ না সরিয়েই বলেছিল, ‘হ্যাঁ। শুভঙ্কর একদিন টিম লাঞ্চে গিয়ে আমার ডাকনামটা ফাঁস করে দিয়েছিল।
‘সে ফাঁস করলেই-বা! মেয়েটা তো তোমার থেকে অনেক জুনিয়র বললে!’ জিনিয়া ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলেছিল, ‘অতন্দ্রদা না বলে এইরকম ডাকনাম ধরে ডাকে কেন? তাও আবার অফিস কলিগ হয়ে?’
‘আরে, এমনিতে অতন্দ্রদা বলেই ডাকে।’ অতন্দ্র যেন একটু বেশিই বিরক্ত হয়েছিল জিনিয়ার উপর্যুপরি প্রশ্নবাণে, ‘মেয়েটা একটু খেপি টাইপ আছে। মাঝে মাঝে পকাই বলে ডেকে ইয়ার্কি মারে!’
জিনিয়া সেদিন চুপ করে গিয়েছিল, কিন্তু ওর বেশ আশ্চর্যও লেগেছিল। অফিসে অতন্দ্রর রাশভারী ইমেজের কথা ওর ভালোমতোই জানা ছিল। সেখানে নতুন একজন জুনিয়ারের এইভাবে সবার সামনে ডাকনাম ধরে ডাকাটা ওর একটু অদ্ভুত লেগেছিল বই কী!
সেই শুরু। তারপর থেকে যত দিন যাচ্ছিল, গীতিকার ফোনের মাত্রা বেড়েই চলছিল। কারণে অকারণে ফোন। ঘুরতে ফিরতে মেসেজ। জিনিয়ার কোনোদিনই অতন্দ্রর ফোন চুপিসারে চেক করা স্বভাবের মধ্যে ছিল না, এসব ও পছন্দও করত না। পারস্পরিক বিশ্বাস না থাকলে আর সম্পর্ক কী!
কিন্তু জিনিয়া যেন নিজের অজান্তেই বদলে যাচ্ছিল। ওর খালি মনে হত ওরা সারাদিন কী মেসেজ চালাচালি করে সেটা দেখতে। ও বুঝতেও পারত, এটা ঠিক নয়, অন্যায়। কিন্তু কিছুতেই নিজেকে সংবরণ করতে পারত না। অতন্দ্র কখনো ফোন ফেলে রেখে বাজার-দোকানে গেলেই ও অতন্দ্রর ফোন নিয়ে বসে পড়ত। উত্তেজনায়, খারাপ কিছু দেখার আশঙ্কায় ওর বুকটা তখন ঢিব ঢিব করত।
না, কোনোদিন আপত্তিজনক ও কিচ্ছু পায়নি যেটা নিয়ে ওর সন্দেহ আরও বাড়তে পারে। সাধারণ কথাবার্তা, পেছনে লাগা, ইয়ার্কি। কিন্তু যতই বাজে কিছু দেখতে পাচ্ছিল না, ততই যেন জিনিয়া আরও অস্থির হয়ে উঠছিল। মনে হত, নির্ঘাত অতন্দ্র সেইরকম মেসেজগুলো জিনিয়ার দেখার আগেই মুছে দিচ্ছে।
সন্দেহ এমন একটা জিনিস, গলা টিপে না মারলে আগাছার মতো দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে। শেষমেষ এমন হল, অতন্দ্র দু-এক মিনিটের জন্য বাথরুম গেলেও জিনিয়া হিস্টিরিয়া রুগির মতো ওর ফোন ঘাঁটত।
এভাবে একদিন অতন্দ্র গোটা ব্যাপারটা টের পেয়ে গেল। প্রথম কয়েকবার জিনিয়াকে বোঝাবার চেষ্টা করল, তারপর ও-ও রেগে উঠতে লাগল। ইচ্ছে করে ফোনে পাসওয়ার্ড দিতে শুরু করল, বাথরুমেও ফোন নিয়ে যেতে লাগল।
এতদিন রাখঢাক চলছিল, লুকোচুরির বর্ম খসে পড়তে দু-জনেই হিংস্র হয়ে উঠতে শুরু করল। জিনিয়া সাধারণ কথোপকথনকে অন্য মানে করে কৈফিয়ত চায়, অতন্দ্রও তাতে রেগে গিয়ে আজেবাজে বলে।
শেষে সেদিনের সেই মেসেজ!
তার পরের ঘটনাগুলো মনে পড়ামাত্র জিনিয়ার শরীর কেমন অবশ হয়ে এল।
দূরের জানলা দিয়ে গভীর রাতের আকাশ দেখতে দেখতে ও ঠিক করল, সকাল হলেই ওই দুর্ব্যবহারের জন্য মায়ের কাছে ক্ষমা চাইবে। একজনের অমানবিক আচরণের প্রভাব ভালোবাসার মানুষগুলোর ওপর দেখানোর কোনো অধিকার ওর নেই।
কাজই হবে এখন ওর সব। সেদিন ফোনে অতন্দ্রর সেই ব্যঙ্গ করে দাশগুপ্ত ট্রাভেলস সম্পর্কে বলা কথাগুলোর উত্তর ওকে কাজ দিয়েই দিতে হবে।
ভাবতে ভাবতে কোথায় চলে গিয়েছিল জিনিয়া, এখন চারপাশের নিস্তব্ধ পরিবেশ খান খান করে তারস্বরে মোবাইলটা বেজে উঠতেই ও চমকে উঠে বসল।
মোবাইলের ঢাউস স্ক্রিনটা জ্বলছে, নিভছে। দূর থেকে জিনিয়া দেখতে পেল ঘড়িতে দেড়টা বাজতে কয়েক মিনিট বাকী। এত রাতে কে ফোন করছে ওকে?
এখানে খড়দার বাড়িতে থাকলে যে এত রাতে ফোন করত, তার সঙ্গে তো সব কিছুই আজ তলানিতে এসে ঠেকেছে! সে এখন হয়তো অন্য কারুর সঙ্গে ফোনে ব্যস্ত।
তবে?
চশমাটা বালিশের কোণে ঢুকে গিয়েছিল, হাতড়ে হাতড়ে সেটা খুঁজে চোখে পরে বিছানা থেকে উঠে ফোনটা ধরতেই জিনিয়া সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল।
আন্তর্জাতিক টেলিফোন। জিনিয়া ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে খাঁটি ব্রিটিশ অ্যাক্সেন্টের ইংরেজিতে একটা মহিলাকণ্ঠ শোনা গেল, ‘হ্যালো, আমি কি দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের সঙ্গে কথা বলছি?’
মেয়েটা যেভাবে থমকে থমকে ‘দাশগুপ্ত’ কথাটা উচ্চারণ করল, তাতে ওর বেদম হাসি পেলেও ও প্রকাশ করল না। প্রাণপণে হাই চাপতে চাপতে বলল, ‘হ্যাঁ বলছি। বলুন?’
বাইরের ঘরের দেওয়ালঘড়িটা ঢং ঢং করে বাজল। একবার।
৯
আলোকপর্ণা ম্লানমুখে ধীরগতিতে বাড়ির দিকে হাঁটছিল। একে প্যাচপেচে গরম, তার ওপর ট্রেনে চিঁড়েচ্যাপটা ভিড়। সারাদিনের ক্লান্তি আর পরিশ্রান্তিতে ওর মুখটা কালো হয়ে গিয়েছিল। প্রতিদিনই তাই হয়, কিন্তু আজ মি জোশীর সেই অপমানজনক কথাগুলো ও চাইলেও কিছুতেই ভুলতে পারছে না। একটুর জন্য ওই বৃদ্ধ কাস্টমারটাকে হাতছাড়া করার আফশোস ওকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।
আসলে ওর সময়টাই খারাপ যাচ্ছে। গত দু-তিন মাস ধরেই কোম্পানি ওর কাজে সন্তুষ্ট নয়। কারণে-অকারণে বকুনি খেতে হচ্ছে ওকে হেড অফিস থেকে। আজকের ওই কাস্টমারটাকে ও ক্যানভাস করলে গুড বুকে উঠতে পারত, সেটাও হল না।
কিছু কিছু মানুষের জীবন পুরোপুরি ডুবে যায় অবসাদের অন্ধকারে। ওরও যেন তাই হচ্ছে।
হিন্দমোটর স্টেশন থেকে বেশ কিছুটা হেঁটে ওর বাড়ি। গঙ্গার দিকে নয়, উলটোদিকে। বেশ জোরে পা চালালেও মিনিট পনেরো হাঁটতে হয়ই। অন্যদিন ও সাইকেলে স্টেশন আসে। কিন্তু সেটা দু-দিন হল বিগড়েছে। আর আলোকপর্ণার এই চাকরিতে রবিবার ছাড়া কোনো সময় নেই। তাই সপ্তাহ না ফুরোনো পর্যন্ত ওকে হেঁটেই যাতায়াত করতে হবে।
বছর দুয়েক আগে হলেও সাইকেল বিগড়োলে বা কোনো সমস্যা হলেই বাবা স্টেশনে চলে আসতেন। এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন ওর আর দিদির জন্য। সবসময় যে ও আর দিদি এক ট্রেনেই ফিরত তা নয়, তবু বাবা দু-জনের জন্যই অপেক্ষা করতেন, একজনকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আবার স্টেশন চলে যেতেন অন্যজনকে আনতে। কোনো ক্লান্তি ছিল না, আলস্য ছিল না সেই যাতায়াতে।
তরতাজা, প্রাণশক্তিতে ভরপুর একজন মানুষ কীভাবে মাত্র দুটো বছরের মধ্যে বুড়িয়ে যেতে পারে, হারিয়ে ফেলতে পারে সমস্ত জীবনীশক্তি, তা আলোকপর্ণার বাবাকে নিজের চোখে না দেখলে কারুর পক্ষে বিশ্বাস করা শক্ত।
হিন্দমোটর কারখানা যখন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, প্রায় এক যুগ ধরে চলা টালমাটালের পর কর্মহীন হয়ে পড়েছিলেন বাবা এবং বাবার মতো আরও অনেক কর্মী।
তখনও বাবা এতটা ভেঙে পড়েননি। অথচ তখন সংসারে দায়দায়িত্ব ছিল অনেক বেশি। দিদি আর ও দু-জনেই তখনও স্কুলে পড়ছে। মা গৃহবধূ। তা সত্ত্বেও বাবার মানসিক জোর ছিল অটুট, কোম্পানি থেকে শেষ সময়ে পাওয়া পুঁজির কিছুটা বিচক্ষণের মতো হিসেব করে ভবিষ্যতের জন্য ব্যাঙ্কে রেখেছিলেন, বাকিটা নিয়ে নেমে পড়েছিলেন খুচখাচ সাপ্লাইয়ের ব্যবসায়।
সংসারে তারপর থেকে ততদিন আর আর্থিক সাচ্ছল্য আসেনি, যতদিন না দিদি চাকরিটা পেয়েছিল। কিন্তু সাচ্ছল্য না আসুক, ওদের বাড়িতে শান্তি ছিল। ছিল অপার আনন্দ। ছুটির দিনে বাবা-মা, ও আর দিদি হা হা করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ত, নিজেরা হইহই করে রান্না করত, দুপুরবেলা পুরোনো বাংলা সিনেমা দেখত, টুকটাক ছুটিতে চলে যেত দিঘা কিংবা শান্তিনিকেতন।
সেইসব দিনগুলো মনে পড়লে এখন পূর্বজন্মের স্মৃতি বলে মনে হয় ওর।
অর্ডার সাপ্লাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাবা একইরকম ব্যস্ত থাকতেন ক্লাব, পাড়ার আড্ডা, নানা সৃজনমূলক সামাজিক অনুষ্ঠান নিয়েও, মায়ের মুখ থেকে কথা বেরোতে-না-বেরোতে টুকিটাকি জিনিস আনার জন্য চোদ্দোবার বাজারে দোকানে ছুটতেন।
আর সেই মানুষই এখন ধূসর চোখে সারাদিন বারান্দায় বসে তাকিয়ে থাকেন শূন্য দৃষ্টিতে। গালের দাড়ি খোঁচা খোঁচা হয়ে বাড়তে থাকে এবড়োখেবড়ো হয়ে, তা ঠিকমতো কাটাও হয় না। কেউ একবারের বেশি দুবার কোনো প্রশ্ন করলে বিরক্তিতে তাঁর মুখ কুঁচকে যায়।
বাবা আজকাল বাজারেও যান না। মাকেই বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁকে যাওয়া সবজিওয়ালাদের থেকে রোজ অল্প অল্প করে বাজার করতে হয়।
আর বাবা সারাদিন চুপচাপ বসে থেকে স্বেচ্ছায় বুড়ো হতে থাকেন।
বাবার এই আমূল পরিবর্তনের জন্য সবাই দিদিকে দায়ী করে। বাবাকে দেখতে এসে সবাই মা কিংবা ওর সামনেই নির্দ্বিধায় প্রকাশ করে দিদি কতটা স্বার্থপর, কীভাবে একা গোটা একখানা সংসারকে ছারখার করে দিল।
কিন্তু সত্যিই কি দিদির অপরাধ অতটা গুরুতর? আলোকপর্ণা এই প্রশ্নে প্রতিবার এসে নিজের কাছেই হোঁচট খেয়ে থেমে যায়।
দিদি কারুর ক্ষতি করেনি, কাউকে অসম্মান করেনি, শুধুমাত্র নিজের ভালোবাসার মানুষের হাত ধরতে চেয়েছে। কিন্তু ভিন্নধর্মের একজনকে ভালোবাসা এখনো সমাজে একটা বড়োসড়ো কেলেঙ্কারি বলে গণ্য করা হয়। যেদিন থেকে বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন দিদির আর ইমরানদার সম্পর্ক জানতে পেরেছিল, ছিছিক্কারে ভরিয়ে দিয়েছিল দিদির জীবন। বাবা-মা কখনো কখনো একটা আলোচনার পর্যায়ে আসতে চাইলেও অন্যান্য শুভানুধ্যায়ীদের জ্বালায় পারত না। দিদির মতো মেয়ে, যে কিনা ওদের গোটা পরিবারে ছোট্ট থেকে খালি প্রশংসাই কুড়িয়ে এসেছিল, এতদিন পরে তার এতবড়ো দোষের খোঁজ পেয়ে সমস্ত আত্মীয়রা সবাই যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
যখন বাবার কোম্পানি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তখন ভুলেও যারা খোঁজ নেয়নি কীভাবে চলছে ওদের সংসার, কীভাবে পড়াশুনো করছে ওরা দুই বোন, সেইসব পিসি-মাসি-মামা-কাকারা হঠাৎ করেই প্রচণ্ড চিন্তিত হয়ে পড়েছিল দিদির এত বড়ো পদস্খলনে।
সেইসব দিনের কথাগুলো এখনও কানে বাজে আলোকপর্ণার। নোয়াপাড়ার বড়োপিসি, যার নিজের আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো, পাছে কিছু সাহায্য করতে হয়, সেই ভয়ে সাতজন্মে খোঁজ রাখতেন না ওদের, আচমকাই এতদূর গাড়ি করে ছুটে এসেছিলেন।
দিদি সেদিন তখনও অফিস থেকে ফেরেনি। আলোকপর্ণা ঘরের এক কোণে বসেছিল। বড়োপিসি কথাগুলো দিদিকে সরাসরি শোনাতে পারবেন না বলে একটু দুঃখই পেয়েছিলেন, কিন্তু বাবা আর মাকে শুনিয়ে সুদে-আসলে উশুল করে নিচ্ছিলেন।
বাবার ব্যস্তসমস্ত হয়ে কিনে আনা মোগলাই পরোটা খেতে খেতে বলেছিলেন, ‘ছি ছি! কেউ ভাবতে পারে? আমরা হলাম গিয়ে কৃষ্ণনগরের লাহিড়ী পরিবার। খোদ রাজা কৃষ্ণচন্দ্র আমাদের পূর্বপুরুষকে ভক্তিশ্রদ্ধা করতেন, জানিস নিশ্চয়ই ভাই? এত বড়ো বামুন ঘরের মেয়ে হয়ে কিনা তোর মেয়ে একটা মুসলমানের প্রেমে পড়ল?’
বাবা নিজেই যেন কোনো মুসলমান মেয়েকে বিয়ে করেছে, এইভাবে নতমস্তকে বসে ছিল।
বড়োপিসি বলে চলেছিলেন, ‘আমরা ভাবতাম বুঝি তোর বড়োমেয়ে কত ভালো। ছোটো থেকে ইশকুলে ফার্স্ট হত নাকি। এখন বড়ো চাকরি করে। ওমা, তার যে রুচি এতটা নীচু তা তো টের পাইনি! কোনো শিক্ষিত মেয়ের মুসলমান ছেলেকে ভালোবাসতে মন যায়?’
‘না বড়দি।’ মা জলের গ্লাস রাখতে রাখতে নীচু গলায় বলেছিল, ‘ছেলেটা পড়াশুনোয় খুব ভালো। আইআইটি থেকে পাশ করেছে। এখন একটা বিদেশি কোম্পানির উঁচু পোস্টে …।’
‘তুমি থামো দিকিনি সরমা! শাক দিয়ে আর মাছ ঢেকো না বুঝলে! পচা গন্ধ ছড়াচ্ছে।’ বড়োপিসি সঙ্গেসঙ্গে দাবিয়ে দিয়েছিল, ‘মেয়ের এমন দোষ যে ঢাকে, সেই মায়ের শিক্ষেদীক্ষে কেমন সেটা বিলক্ষণ বুঝতে পারছি। এইজন্যই মেয়েও এমন হয়েছে। নাহ, বাবা যে কী বাড়িতে তোর সম্বন্ধ করেছিল ভাই!’
মা সেদিন সেই যে চুপ করে গিয়েছিল, আর মুখ খোলেনি। বড়োপিসি অনেক ভাষণ দিয়ে চলে যাওয়ার আরো এক ঘণ্টা পর ফিরেছিল দিদি।
বাবা তখন কালো মুখে অন্ধকার বারান্দায় বসে রয়েছে। মা ঘরে আলো নিভিয়ে বসে চোখের জল ফেলছে।
দিদি এসে জিজ্ঞেস করতেই মা সজোরে একটা চড় কষিয়েছিল দিদির গালে। এতদিন পরেও দিদির সেই আহত হতভম্ব মুখটা স্পষ্ট মনে আছে আলোকপর্ণার।
তারপরেও দিদি হাল ছাড়েনি। অনেকবার সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারেনি। উল্টে অপমানিত হয়েছে, কোণঠাসা করে দেওয়া হয়েছে।
দিদি বাড়ির সবাইকে পাশে পেতেই চেয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে তা অসম্ভব বুঝে নীরবে নিজে সরে গেছে। শুরু করেছে নতুন জীবন।
এটাকে কি অন্যায় বলা চলে? ভাবল আলোকপর্ণা। ও যতই রেগে থাক দিদির ওপর, যতই দিনরাত নিজেদের পরিণতির জন্য দিদিকে দায়ী করে শান্তি পেতে চাক, দিনের শেষে এই প্রশ্নটা ওকে রাতের বিছানায় অস্থির করে তোলে।
এমন তো নয়, দিদি নিজে থেকে যোগাযোগ রাখে না, বা রাখতে চায় না। চলে যাওয়ার আগে তো বটেই, চলে যাওয়ার পরেও দিদি একাধিকবার ফোন করে কথা বলতে চেয়েছে বাবা-মা-র সঙ্গে। কেউই বলেনি। বরং বাবা মা-ই নিষ্ঠুরভাবে দূরে ঠেলে দিয়েছে দিদিকে।
তাহলে দিদি কীভাবে স্বার্থপর হল?
বাড়িতে দিদি যেন একটা নিষিদ্ধ অধ্যায়, দিদির প্রসঙ্গ তোলা অলিখিতভাবে বারণ। ইচ্ছে হলেও বাবা মা-কে উত্তেজিত করতে চায়না বলেই আলোকপর্ণা এই দু-বছরে দিদির সঙ্গে যোগাযোগ করে উঠতে পারেনি।
অনেককিছু সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে আলোকপর্ণা হাঁটছিল, কিন্তু ঝপ করে ওর চোখের সামনে স্ট্রিটলাইটগুলো নিভে গেল। আশপাশের বাড়িগুলোও একলহমায় অন্ধকার হয়ে এল।
যাহ, আবার লোডশেডিং। আলোকপর্ণার মুখটা বিরক্তিতে কুঁচকে গেল। এখনও এই গলি দিয়ে প্রায় সাত-আটমিনিট হাঁটতে হবে ওকে। গলিটার অবস্থা এমনিতে খুব একটা ভালো নয়। কিছুটা অন্তর দুটো বড়ো ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি হচ্ছে, সেইজন্য জায়গায় জায়গায় সিমেন্ট বালি ফেলে রাখা হয়েছে ইচ্ছেমতো। কেউ কিছু বলার নেই, বললেও শোনার নেই।
যতদূর চোখ যাচ্ছে, গলিতে কেউ নেইও। শুধু আলোকপর্ণা একা যেন এই অন্ধকারের পথে হেঁটে চলেছে।
আলোকপর্ণা কাঁধে ব্যাগটাকে শক্ত করে ধরে অন্য হাতে মোবাইলের টর্চলাইটটা জ্বালল। মোবাইলটা সাবধানে উঁচু করে সামনের দিকে তুলে ধরে কিছুক্ষণ হাঁটার পরই আতঙ্কে ওর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল।
ওর একদম উলটোদিক থেকে একটা লোক হেঁটে আসছে। জুতোর শব্দ হচ্ছে মৃদু। ওর থেকে লোকটার দূরত্ব বড়োজোর আর হাতদশেক। অন্ধকার গলিতে আলোকপর্ণা আর ওই লোকটা ছাড়া এই মুহূর্তে আর কেউ নেই। কিন্তু আলোকপর্ণার আতঙ্ক সেইজন্য নয়। অন্ধকার নির্জন গলি দিয়ে আলোকপর্ণা আগেও হেঁটেছে।
কিন্তু এই লোকটার মুখ স্পষ্ট না দেখা গেলেও তার কাজটা আলোকপর্ণা আগেই দেখতে পেয়ে গেছে। জনশূন্য রাস্তায় একাকী একটা মেয়েকে আসতে দেখেই তার ভেতরের বিকৃতকাম জেগে উঠেছে। প্যান্টের জিপার খুলে নিজের পুরুষাঙ্গটাকে প্রদর্শন করতে করতে ও মৃদু নাড়াতে নাড়াতে সে এগিয়ে আসছে। তার হাতের টর্চটাও জ্বলছে নির্লজ্জভাবে।
আলোকপর্ণার শরীর হিম হয়ে আসছিল, লোকটার স্থির দৃষ্টি ওর দিকে। বোঝাই যাচ্ছে মুখোমুখি হওয়ামাত্র লোকটা আরও নোংরা কিছু করতে উদ্যত হবে।
আলোকপর্ণা বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো ছিটকে উঠে চিৎকার করে উঠল, তারপর কী করবে ঠিক করতে না পেরে একদম পাশের যে বাড়িটা অন্ধকারে ভূতের মত দাঁড়িয়ে ছিল, সেটার গেটের গ্রিল ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে খুলে ঢুকে পড়তে গেল।
ততক্ষণে লোকটা আলোকপর্ণার কাছে এসে পড়েছে, পেছন থেকে থাবা বাড়িয়ে খামচে ধরতে যাচ্ছে আলোকপর্ণার কাঁধটা।
কিন্তু লোডশেডিং-এর জন্যই বোধ হয় গরমের হাত থেকে বাঁচতে বাড়িটার বাসিন্দারা সামনের বারান্দায় বসে ছিল, তারা গেটের কাছে চিৎকার ও গোলমালে ‘কে? কে?’ করে চেঁচিয়ে উঠতে লোকটা এবার ভয় পেয়ে গেল। এক সেকেন্ডের মধ্যে এদিক ওদিক দেখে নিয়ে ছুট লাগাল তিরের বেগে।
আলোকপর্ণা রাগের চোটে নিজের ব্যাগটা ছুড়ে মারতে গেল, কিন্তু সেটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ছিটকে পড়ল রাস্তায়। ওদিকে বারান্দায় বসে থাকা বাড়ির অধিবাসী হেঁটে এগিয়ে এসেছে গেটের দিকে।
গোটা ঘটনাটা ঘটতে লাগল বড়োজোর ত্রিশ সেকেন্ড। কিন্তু এইটুকু সময়েই আলোকপর্ণার স্নায়ুগুলো দুর্বল হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে শুরু করেছে।
ও দুর্বল কণ্ঠে কোনোমতে বলল, ‘এ-একটা লোক … অন্ধকারে অসভ্যতা করতে চাইছিল …!’
‘কী অবস্থা! পাড়ার মধ্যে … কী সাহস বেড়েছে এদের!’ একজন বয়স্কা মহিলার উদবিগ্ন গলা শোনা গেল, ‘দেখেছিস পিকলু, এই গলিটা কারেন্ট চলে গেলেই বদমাশদের আখড়া হয়ে উঠছে। আমি আগেও সুজনকে বলেছি, যে এই গলিটার দিকে নজর রাখো। মেয়েদের চলাফেরার বিপদ তো বটেই, আরও অনেকরকম অসামাজিক কাজকর্ম চলছে এখানে সন্ধের পর থেকে।’
‘এখন সামনে ভোট, সুজনকাকার বয়ে গেছে তোমার এই সব কথা কানে তুলতে! ওরা এখন ভীষণ ব্যস্ত।’ এবার কিছুদূর থেকে একটা পুরুষকণ্ঠ বলে উঠল।
মহিলা মৃদুকণ্ঠে প্রতিবাদ করলেন, ‘এভাবে বলিস না। কারুর সম্পর্কে না জেনে দুমদাম মন্তব্য করাটা ঠিক নয়, তোকে আগেও বলেছি। পার্টিপলিটিক্সের কথা বলছি না, এমনিতে সুজন ছেলেটা কাজের। আগে যখন পার্টি করত না, তখনও দেখেছি মানুষের বিপদে-আপদে ছুটে যেতে। কোনো অহমিকা বোধ ওর মধ্যে ছিল না। এখনও নেই।’
আলোকপর্ণার হাত-পা তখনও কাঁপছিল, কী হতে পারত সেই আশঙ্কায়। তার মধ্যেই ওর মনে হল, এঁরা কি স্থানীয় কাউন্সিলর সুজন মিত্র-র কথা বলছেন? উত্তরপাড়া কলেজের অধ্যাপক সুজন মিত্র এলাকায় অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব, তাঁকে নাম ধরে ডাকার মানুষ এই অঞ্চলে খুব বেশি নেই। বেশিরভাগ মানুষই তাঁকে সুজনবাবু বা ‘স্যার’ বলে ডাকে।
‘আচ্ছা ঠিক আছে। আগে ওঁকে একটু বসতে বলো। জল-টল খান। তারপর কথা বোলো নাহয়!’ পুরুষকণ্ঠ বলল।
আলোকপর্ণা কুলকুল করে ঘামছিল। এইরকম পরিস্থিতিতে পড়লে আচম্বিতে যে ট্রমা শরীর মনকে গ্রাস করে ফেলে, তা কাটতে সময় লাগে বেশ কিছুদিন। অনেক সময় ঠিকমতো কাটতেও চায় না, তীব্র অবসাদ এসে বাসা বাঁধে।
এর আগেও এরকম ঘটনা আলোকপর্ণার সঙ্গে হয়েছে। শুধু আলোকপর্ণা কেন, ভারতবর্ষের মেয়ে হয়ে জন্মে এমন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়নি, এমন মধ্যবিত্ত মেয়ে বোধ হয় এই দেশে একটাও নেই।
ও ক্লান্ত গলায় বলল, ‘আমি ঠিক আছি। ধন্যবাদ।’
ঠিক এই সময় কারেন্ট চলে এল। ঝপ করে জ্বলে উঠল রাস্তার লাইটগুলো। এই বাড়ির সামনের গেটের দু-পাশের আলোও জ্বলে উঠল সঙ্গেসঙ্গে।
বাড়িটার আলোকিত লনে দাঁড়িয়ে আলোকপর্ণা দেখতে পেল, বয়স্কা সেই মহিলা ওর একদম সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন। বয়স আন্দাজ পঞ্চান্ন-ষাট হবে, কাঁচা সোনার মতো গায়ের রং, বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শরীর একটু ভারীর দিকে হলেও বেশ শক্ত গড়ন।
মহিলা পরে আছেন সাদা-হলুদ মেশানো একটা তাঁতের শাড়ি। সঙ্গে লম্বা হাতা ব্লাউজ। চুল খোলা, তা ঘন হয়ে নেমেছে কোমর পর্যন্ত। এই বয়সে এমন সুন্দর চুল বেশ বিরল। এক হাতে চিরুনি। সম্ভবত লোডশেডিং-এর অন্ধকারে বারান্দায় বসে চুল ছাড়াচ্ছিলেন উনি।
দূর থেকে হাতে এক গ্লাস জল নিয়ে এগিয়ে আসছে বছর সাতাশ আঠাশের এক সুদর্শন যুবক। গায়ের রং, মুখের গড়ন, নাক মুখ চোখ দেখলেই বোঝা যায় এই ভদ্রমহিলার পুত্র সে। গায়ে লম্বা পাঞ্জাবি, পাজামা। তার হাঁটার গতি অত্যন্ত স্বাভাবিক, কোথাও কোনো জড়তা নেই। তবু চোখের ঢাউস চশমা ও হাতের আঙুলগুলোর সামান্য কাঁপুনি দেখে অবচেতন মন বলে দেয় তার দর্শনেন্দ্রিয় সম্ভবত বেশ দুর্বল।
আলোকপর্ণা চোখ তুলে বাড়িটার দিকে তাকাল। রাস্তার আলোর প্রতিফলনে দোতলা বাড়িখানা বড়ো সুন্দর লাগছে। খুব বেশি আড়ম্বর নেই, বেশ ছিমছাম, অথচ সুরুচির ছাপ রয়েছে প্রতিটা জায়গায়।
সামনে ফুলের বাগান, সেখান থেকে সাপের মতো এঁকেবেঁকে বোগেনভিলিয়ার ঝাড় উঠে গেছে সোজা বাড়ির দোতলার বারান্দা পর্যন্ত। বোগেনভিলিয়ার থোকা থোকা ফুলে ভরে আছে চারদিক। ছোটোবড়ো অজস্র ফুলগাছ ছাড়াও বাগানের দু-পাশে দুটো বড়ো গাছ। আলোকপর্ণা গাছ চেনে, এক ঝলক দেখেই কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া গাছ দুটোকে সে চিনতে পারল।
আশ্চর্য, এত বছর ধরে সে এই গলি দিয়ে যাতায়াত করছে, তার নিজের পাড়া না হলেও পাশের পাড়া তো এটা বটেই, এত সুন্দর বাড়িখানা তো কখনো তার চোখে পড়েনি!
পিকলু নামক যুবকটি এসে জলের গ্লাসটা সামনে বাড়িয়ে দিতে ও বাস্তবে ফিরে এল। আর ফিরে আসামাত্র ও উপলব্ধি করল, ভয়ে, দুশ্চিন্তায় বা যেকোনো কারণেই হোক, ওর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। কোনো কথা না বলে গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঢক ঢক করে পুরো জলটা খেয়ে ফেলল ও।
‘আর এক গ্লাস খাবে?’ ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করলেন।
ও দু-পাশে মাথা নেড়ে জানাল, ‘না।’
ভদ্রমহিলা এবার আলোকপর্ণার মুখের দিকে কিছুক্ষণ স্থিরচোখে তাকিয়ে রইলেন, তারপর প্রশান্তিমাখা গলায় বললেন, ‘মন খারাপ কোরো না। কিছু মানুষ নামেই দু-পায়ে হাঁটে মা, আসলে তাদের চার পায়ে হাঁটারও যোগ্যতা নেই। তাদের জন্য তুমি কেন মন খারাপ করবে! হ্যাঁ, প্রতিবাদ করা, শাস্তি দেওয়াটা অবশ্যই প্রয়োজন, সেটা করবেও, কিন্তু তাদের কৃতকার্যের জন্য নিজে কখনো কষ্ট পাবে না।’
আলোকপর্ণার চোখে আবার জল চলে এসেছিল। ও আলগোছে বাঁ-হাতের চেটো দিয়ে চোখের জল মুছে নিয়ে মৃদু মাথা নাড়ল। ভদ্রমহিলা ঠিকই বলছেন। অনেক কষ্ট করে, রোজ অনেক সংগ্রাম করে ও এই টার্গেট-ওরিয়েন্টেড চাকরি করছে। প্রতিদিনের চাপ, পরোক্ষ অপমান, চাকরি হারানোর ভয় সহ্য করে। ইদানীং মা মানসিক কারণে এতটাই ভেঙে পড়েছে, যে সকালে উঠে অর্ধেক রান্নাও আলোকপর্ণাকে সেরে আসতে হয়। সপ্তাহান্তের বেশিরভাগ বাজারহাটও।
দিদি চলে যাওয়ার পর সংসারে আনন্দ নেই, হা হা করে হাসি নেই, গল্প নেই, শখ নেই, আহ্লাদ নেই, খালি দায়িত্ব আর দায়িত্ব।
আর ওই লোকটা কিছুই জানল না, কিছুই বুঝল না, শুধু শুধু আলোকপর্ণাকে একটা মাংসের তাল ভেবে ওর সঙ্গে অসভ্যতা করে এসে ওকে কিছুটা হলেও ভেঙে দিয়ে চলে গেল।
মেয়ে হয়ে জন্মানোর কি এটাই পুরষ্কার? ওর বয়সি কোনো ছেলে ওরই মতো কষ্ট করতে পারে, সংগ্রাম করতে পারে, কিন্তু এইসব তো তাকে সহ্য করতে হয় না!
দু-বছর আগেও নিজের মাইনের টাকাটা ওর কাছে নিছক হাতখরচা ছিল, নিজের টুকটাক শখ আর বাড়ির সবার জন্য এটাওটা কিনেই সেটা খরচ করত ও। তখন দিদি ভালো রোজগার করে, বাবা-মা-দিদি আর ও মিলে ছিল ওদের সুখের সংসার।
দিদি ছোটো থেকেই ছিল পড়াশুনোয় ভীষণ ব্রিলিয়ান্ট, আলোকপর্ণার মতো সাধারণ মানের ছিল না। মুখে কিছু না বললেও বাবার সমস্ত আশাভরসা যে দিদিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হত, তা আলোকপর্ণা ছোটো থেকেই বুঝে গিয়েছিল। তবে তা নিয়ে যে ওর কোনো রাগ বা হিংসা ছিল, তা নয়।
দিদিকে ও খুব ভালোবাসত, এখনও বাসে। যে যাই বলুক, ও মন থেকে বিশ্বাস করে, দিদি নিজের ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে নতুন জীবন শুরু করে কোনো ভুল করেনি। দিদি অনেক চেষ্টা করেছিল বাবা-মাকে বোঝানোর, চেয়েছিল কাছাকাছি বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে। বাড়ির বড়ো সন্তানের মতোই বিয়ের পরেও পালন করতে চেয়েছিল সমস্ত দায়দায়িত্ব।
কিন্তু বাবা-মা দিদিকে সেটা করতে দেননি। কঠোর হাতে ছিন্ন করেছিলেন সব সম্পর্ক।
পিকলু নামের যুবকটি বলল, ‘আপনি একটু বসে যান। একটু থিতু হয়ে তারপর যাবেন। কোথায় বাড়ি আপনার?’
আলোকপর্ণা একটু থেমে বলল, ‘নতুনপল্লিতে।’
ভদ্রমহিলা ও যুবকের পিছু পিছু লন দিয়ে হেঁটে কিছুটা এগিয়ে বারান্দায় উঠল আলোকপর্ণা। বারান্দাটাও বাড়ির বাইরের মতোই সুচারুভাবে সাজানো। সামনের গ্রিলে অনেকগুলো ফুলের টব সারি দিয়ে ঝুলছে, দুটো বেতের চেয়ার মুখোমুখি বসানো। দেওয়ালে অনেকগুলো জলরঙের ছবি।
মহিলা স্মিতমুখে বললেন, ‘বোসো। একটু জিরিয়ে নিয়ে যাও। নতুনপল্লি তো কাছেই। তেমন হলে তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করব আমি।’
মহিলার চোখের দৃষ্টি ও কথা বলার মধ্যে এমন এক আভিজাত্য মেশানো স্নেহ রয়েছে যে আলোকপর্ণা চাইলেও আপত্তি করতে পারল না। অথচ ওর এখন ইচ্ছে করছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি গিয়ে নিজের একচিলতে ঘরের বিছানায় মুখ ডুবিয়ে শুয়ে থাকতে। থেকে থেকে চোখের সামনে ভেসে উঠছে লোকটার সেই ঘৃণ্য কাজটা। আর ভেসে ওঠামাত্র বুকের ভেতরটা কেমন ধক করে কেঁপে উঠছে।
মহিলা ঘরের ভেতরের দিকে তাকিয়ে কাউকে কিছু নির্দেশ দিলেন। তারপর আলোকপর্ণার দিকে ফিরে বললেন, ‘এখনও ওই বাজে অভিজ্ঞতার কথাই ভাবছ, তাই না? ভেবো না। খারাপ কাজের কথা ভাবতে নেই। তাতে মন শুধু খারাপই হয় না, সংকীর্ণও হয়ে যায়। ওসব থেকে মন সরিয়ে নাও, জীবনের আনন্দগুলোর কথা ভাবো। দেখো, ভালো লাগবে।’
এই মহিলা কি মানুষের মন পড়তে পারেন নাকি?
আলোকপর্ণা নিচু গলায় বলল, ‘হ্যাঁ। সেটাই।’
মহিলা আবার বললেন, ‘তোমার বাড়িতে কে কে আছেন? নতুনপল্লিতে কোথায় তোমাদের বাড়ি?’
‘বাবা, মা।’ আলোকপর্ণা একটু থমকে বলল, ‘দিদি।’
মহিলা তখনও চেয়ে আছেন দেখে ও বলল, ‘নতুনপল্লিতে ঢুকে রাধাকৃষ্ণর মন্দিরের বাঁ-হাতে গোলাপি রঙের একতলা বাড়িটাই আমাদের। আমার বাবার নাম কৃষ্ণেন্দু লাহিড়ী।’
পিকলু নামের ছেলেটা এবার একটা আশ্চর্য কথা বলল, ‘আপনি ঋতুপর্ণার কে হন?’
আলোকপর্ণা একটু চমকে উঠল। এই প্রশ্নের জন্য ও একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। তবু অনেকদিন পর দিদির নামটা হিন্দমোটরের কারুর মুখে শুনে ওর যেন মনে হল দিদি আচমকাই ‘আবার জেগে উঠল এখানকার মানুষের মনে। ও বলল, ‘আমি ঋতুপর্ণার বোন। আমার নাম আলোকপর্ণা।’
‘ওহ! তাই গলাটা তখন থেকে এত চেনা চেনা লাগছে।’ যুবকের মুখ হাসিতে, আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল, মায়ের দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘মা, মনে আছে তোমার ঋতুপর্ণাকে? সেই যে, ইলেভেন টুয়েলভে আমাদের বাড়িতে রতন স্যারের কাছে কেমিস্ট্রি পড়তে আসত?’
‘হ্যাঁ।’ মহিলা এবার চওড়া করে হাসলেন। হাসলে ওঁকে সত্যিই সুন্দর দেখায়, ‘গোল মুখ, দু-দিকে দুটো বিনুনি। পড়াশুনোয় খুব ভালো ছিল তো!’
‘হ্যাঁ।’ যুবক আলোকপর্ণার দিকে ফিরে সহজ গলায় বলল, ‘আমি তো এখন চোখে একেবারেই ভালো দেখতে পাই না। কিন্তু কারুর গলার স্বর একবার শুনলে কখনো ভুলি না। ঋতুপর্ণা আমার স্কুলজীবনের কোচিং-এর বন্ধু। সেইসময় একবার আপনাদের বাড়ি গিয়েওছিলাম। তখন অবশ্য আমার চোখ দুটোর এতটা বেহাল দশা হয়নি। আপনার দিদির সঙ্গে আপনার গলার খুব মিল, তাই না?’
আলোকপর্ণা মাথা নাড়ল, পরক্ষণেই খেয়াল হতে ও গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ। সবাই বলে তাই। আপনি দিদির সঙ্গে এক ক্লাসে পড়তেন?’
‘হ্যাঁ।’ যুবক বলল, ‘ঋতুপর্ণা কেমন আছে এখন? অনেকদিন কোনো যোগাযোগ নেই।’
আলোকপর্ণা সামান্য হেসে বলল, ‘ভালো। আমি বাড়ি যাচ্ছি। দেরি হয়ে যাচ্ছে তো, বাবা-মা চিন্তা করবেন। আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।’
ভদ্রমহিলা এবার বললেন, ‘ওমা, ও কী। প্রথমবার এলে তুমি, ঋতুপর্ণার বোন। দাঁড়াও। ওরে লতা, কোথায় গেলি রে, তাড়াতাড়ি নিয়ে আয়।’
আলোকপর্ণা এবার ভেতরে ভেতরে বিব্রত হয়ে পড়ছিল। সম্পূর্ণ অচেনা একজন মানুষকে বাড়ির ভেতরে ডেকে নিয়ে আতিথেয়তা করানোটায় ও ঠিক অভ্যস্ত নয়। এখনকার দিনে এমন ধরনের মানুষ নেইও। বেশিরভাগ মানুষই এখন বড়ো বাড়িতে একান্নবর্তী পরিবারে থাকার চেয়ে ছোটো পায়রার খোপের ফ্ল্যাটে শুধুমাত্র নিজেরটুকু নিয়ে থাকতে ভালোবাসে। আর নিজেরটুকু নিয়ে থাকতে থাকতে তার মনটাও পায়রার খোপের মতো হয়ে যায়। ইদানীং পাড়ার চেনা লোকের বাড়িতে কোনো দরকারে গেলেও অনেকে দরজায় দাঁড়িয়েই কথা বলে, ঘরের ভেতরে ঢুকতে বলতেও তাদের অনীহা।
সেখানে এদের এমন ব্যবহার কিছুটা অপ্রত্যাশিত বই কী!
ভেতর থেকে একজন কাজের মহিলা প্লেটে করে কিছু নিয়ে এল। আলোকপর্ণা তাকিয়ে দেখল, ফালি ফালি করে পরিচ্ছন্নভাবে কাটা খোসা ছাড়ানো আম।
ভদ্রমহিলা হাসলেন, ‘আমাদের গাছের আম। হিমসাগর। খেয়ে নাও। তারপর পিকলু তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসবে।’
কথাটা শুনে আলোকপর্ণার নিজের অজান্তেই পিকলু নামের যুবকটির দিকে চোখ চলে গেল।
ভদ্রমহিলা এবারেও নিমেষে ওর মন পড়ে নিলেন, ‘কোনো অসুবিধা নেই। ও জলের মতো রাস্তাঘাট চেনে। তোমার কোনো অসুবিধা হবে না।’
আলোকপর্ণার খেতে ইচ্ছে করছিল না। লোকটার সেই জঘন্য অঙ্গভঙ্গিটা এখনও ভুলতে পারছিল না। কিন্তু না খেলে ভদ্রমহিলা যে ওকে ছাড়বেন না, সেটাও ও বুঝতে পারছিল। তাই কথা না বাড়িয়ে খেতে শুরু করল।
‘তুমি কি চাকরি কর?’ ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করলেন।
‘হ্যাঁ।’ আলোকপর্ণা খেতে খেতে উত্তর দিল, ‘একটা ট্রাভেল এজেন্সিতে।’
মুখে উত্তর দিলেও মনে মনে বিষিয়ে যাচ্ছিল ওর ভেতরটা। ওর সঙ্গেই কেন হল এরকম? লোকটা ওকে দেখে এমন অসভ্যতা করার স্পর্ধাটাই বা পেল কী করে? ওকে দেখে কি দেখে এতটাই সস্তা মনে হয়?
ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবা?’
‘হিন্দমোটরে চাকরি করতেন। এখন বাড়িতেই থাকেন।’ আলোকপর্ণা ভাবলেশহীন গলায় বলল।
ভদ্রমহিলা একটু থামলেন। তারপর শান্তগলায় বললেন, ‘তুমি কি এখন নিজেকে খারাপ ভাবছ আলোকপর্ণা? ভাবছ তোমার দোষেই এমন হল? এসব ভেবো না। স্বামীজি কী বলেছিলেন জান তো, নিজেকে শ্রদ্ধা না করলে জীবনে কিছু অর্জন করা যায় না। ঠিকমতো বাঁচাও যায় না।’
আলোকপর্ণা স্থিরচোখে তাকাল।
মহিলা এবার এগিয়ে এসে ওর কাঁধে আলতো করে হাত রাখলেন, ‘আমার নাম মিনতি। ঋতুপর্ণা আমাকে মাসিমা বলত। তুমিও আমাকে মাসিমা বলেই ডেকো।’