০১. ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলী

রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ুর মতে হগ সাহেবের বাজারের মতো বাজার নাকি ভূ-ভারতে নেই। যারা জানে না তাদের জন্যে বলা দরকার যে হগ সাহেবের বাজার হল আমরা যাকে নিউ মার্কেট বলি তারই আদি নাম। —‘দিল্লি বোম্বাই যোধপুর জয়পুর সিমলা কাশী, সবই তো দেখলুম, আর আপনাদের সঙ্গেই দেখলুম, কিন্তু আন্ডার দি সেম রুফ এমন একটা বাজার কোথাও দেখেছেন কি?’

এ ব্যাপারে অবিশ্যি আমি আর ফেলুদা দু’জনেই লালমোহনবাবুর সঙ্গে একমত। মাঝে একটা কথা হয়েছিল যে এই মার্কেট ভেঙে ফেলে সেখানে একটা মাল্টি-স্টোরি সুপার মার্কেট তৈরি হবে। ফেলুদা তো শুনেই ফায়ার। বলল, ‘এ কাজটা হলে কলকাতার অর্ধেক কলকাতাত্ব চলে যাবে সেটা কি এরা বুঝতে পারছে না? নগরবাসীদের কর্তব্য প্রয়োজনে অনশন করে এই ধ্বংসের পথ বন্ধ করা।’

আমরা তিনজন গ্লোবে ম্যাটিনিতে এপ অ্যান্ড সুপার এপ দেখে বাইরে এসে নিউ মার্কেটে যাব বলে স্থির করেছি। লালমোহনবাবুর টর্চের ব্যাটারি আর ডট পেনের রিফিল কেনা দরকার, আর ফেলুদাও বলল কলিমুদ্দির দোকান থেকে ডালমুট নিয়ে নেবে; বাড়ির ডালমুট মিইয়ে গেছে, অথচ চায়ের সঙ্গে ওটা চাই-ই চাই। তা ছাড়া লালমোহনবাবুর একবার মার্কেটটা ঘুরে দেখা দরকার, কারণ কালই নাকি এই মার্কেটকে সেন্টার করে একটা ভাল ভূতুড়ে গল্পের প্লট ওঁর মাথায় এসেছে। ট্রাফিক বাঁচিয়ে রাস্তা পেরিয়ে প্রাইভেট গাড়ি ও ট্যাক্সির লাইনের ফাঁক দিয়ে এগনোর সময় প্লটের খানিকটা আভাস দিলেন আমাকে —‘একজন লোক রাত্তিরে মার্কেট বন্ধ হয়ে যাবার পরে দেখে কী, সে ভিতরে আটকা পড়ে গেছে। লোকটা রিটায়ার্ড জজ—অনেককে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে। বোঝো তপেশ—এই বিশাল হগ সাহেবের বাজার, সব দোকান বন্ধ, সব বাতি নিভে গেছে, শুধু লিন্ডসে স্ট্রিটের দিকের কোল্যাপ্‌সিব্‌ল গেটের ভিতর দিয়ে আসা রাস্তার ক্ষীণ আলোয় যেটুকু দেখা যায়। গলিগুলোর এ মাথা থেকে ও মাথা খাঁ খাঁ করছে, আর তারই মধ্যে কেবল একটিমাত্র দোকান খোলা, একটা কিউরিওর দোকান, তাতে টিমটিমে আলো, আর তার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একটা কঙ্কাল, হাতে ছোরা! খুনির কঙ্কাল, যে খুনিকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়েছিলেন ওই জজ সাহেব। যে দিকেই পালাতে যান, মোড় ঘুরেই দেখেন সামনে সেই কঙ্কাল, হাতে ছোরা, ড্রিপিং উইথ ব্লাড়!’

আমি মুখে কিছু না বললেও মনে মনে বললাম ভদ্রলোক ভেবেছেন ভালই, তবে ফেলুদার হেল্‌প না নিলে গল্পের গোড়ায় গলদ থেকে যাবে; জজ সাহেবের আটকে পড়ার বিশ্বাসযোগ্য কারণ খুঁজে বার করা জটায়ুর সাধ্যের বাইরে।

সামনেই মোহনস্-এর কাপড়ের দোকানের ডান পাশ দিয়ে ঢুকে, বাঁয়ে ঘুরে গুলাবের ঘড়ির দোকান পেরিয়ে ডাইনে একটু গেলেই একটা তেমাথার মোড়ে ইলেক্‌ট্রিক্যাল গুড্‌সের দোকান। ব্যাটারি সেইখানেই পাওয়া যাবে, আর তার উল্টোদিকেই পাওয়া যাবে রিফিল। দে ইলেক্‌ট্রিক্যালসের মালিক ফেলুদার ভক্ত, দেখেই একগাল হেসে নমস্কার করলেন। আমাদের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একজন লোক ঢুকলেন, তিনি গল্পে একটা বড় ভূমিকা নেবেন, তাই তাঁর বর্ণনা দিয়ে রাখি। বছর চল্লিশ বয়স, মাঝারি হাইট, ফরসা রং, মাথার চুল পাতলা, দাড়ি-গোঁফ নেই, সাদা বুশ শার্ট, কালো প্যান্ট আর হাতে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ।

‘আপনি মিস্টার মিত্র না?’ ভদ্রলোক ফেলুদার দিকে তাকিয়ে অবাক হেসে প্রশ্নটা করলেন।

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘ওই সামনের বইয়ের দোকানের লোক আমাকে চিনিয়ে দিল। বলল, উনি হচ্ছেন ফেমাস ডিটেকটিভ প্রদোষ মিত্র। হাউ স্ট্রেঞ্জ! ঠিক আপনার কথাই ভাবছি আজ দু’ দিন থেকে।’

বাংলায় সামান্য টান। হয় ওদিকের লোক এদিকে সেট্‌লড, না হয় এদিকের লোক ওদিকে।

‘কেন বলুন তো?’ ফেলুদা প্রশ্ন করল।

ভদ্রলোক কিছুটা নার্ভাস কি? গলাটা খাক্‌ রে নিয়ে বললেন, ‘সেটা আপনার সঙ্গে দেখা করেই বলব। আপনি কাল বাড়ি থাকবেন কি?’

‘বিকেল পাঁচটার পরে থাকব।’

‘তা হলে আপনার অ্যাড্রেসটা যদি একটু—’

ভদ্রলোক পকেট থেকে একটা নোটবুক আর ফাউনটেন পেন বার করে ফেলুদার হাতে দিলেন। ফেলুদা ঠিকানা লিখে দিল।

‘স্যরি!’

ভদ্রলোকের ‘স্যরি’ বলার কারণ আর কিছুই না, পেন থেকে সামান্য বেগুনি কালি লিক করে ফেলুদার আঙুলে লেগেছে। আমি জানি ফেলুদা পুরনো ধরনের ফাউনটেন পেনই পছন্দ করে, বলে তাতে হাতের লেখা আরও ভাল হয়, কিন্তু মাঝে মাঝে লিক করে বলে ইদানীং ডট পেনই ব্যবহার করছে।

‘আমার নাম বাটরা,’ পেন-খাতা পকেটে পুরে বললেন ভদ্রলোক, ‘আমার গ্র্যান্ডফাদার ক্যালকাটায় সেট্‌ল করেছিলেন সেভেনটি ফাইভ ইয়ারস আগে।’

‘আই সি।’

‘এর মধ্যেই মক্কেল জুটিয়ে ফেললেন নাকি?’

ভদ্রলোক চলে যাবার পরমুহূর্তেই সামনের দোকান থেকে রিফিল কিনে এনে প্রশ্ন করলেন জটায়ু। ফেলুদা একটা নিঃশব্দ হাসি ছাড়া কোনও মন্তব্য করল না। তিনজনে রওনা দিলাম ডালমুটের উদ্দেশে।

লালমোহনবাবু পকেট থেকে ওঁর ছোট্ট লাল ডায়রিটা বার করে নোট নিতে শুরু করলেন। তার ফলে মাঝে মাঝে একটু পিছিয়ে পড়ছেন, আবার তৎক্ষণাৎ পা চালিয়ে আমাদের পাশ নিয়ে নিচ্ছেন। গত সপ্তাহে একবার লোডশেডিং-এর মধ্যে এসে দেখেছি সারা মার্কেটটার উপরে যেন মৃত্যুর ছায়া নেমে এসেছে। আজ আলো থাকায় ভোল পাল্টে গেছে। পদে পদে কানে আসছে এ পাশ ও পাশ থেকে ছুঁড়ে মারা ‘কী চাইলেন দাদা?’—আর আমরা তারই মধ্যে এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলেছি ভিড় বাঁচিয়ে। ফেলুদার লক্ষ্য একটাই, কিন্তু দৃষ্টি ডাইনে বাঁয়ে সামনে তিন দিকে, যদিও তার জন্য ঘাড় ফেরাতে হয় না, চোখ ফেরালেই হল, আর তাতেই মনের মধ্যে অবিরাম ছাপা হয়ে যাচ্ছে ছবি আর কথা, যেগুলো পরে কখন কোন কাজে লাগবে কে জানে। আমি জানি লালমোহনবাবু অত কসরত করে খাতায় যা লিখছেন, ফেলুদার মাথায় আগেই তা লেখা হয়ে যাচ্ছে। সামনে পুজো, তাই ভিড় বেশি, তাড়া বেশি, কেনার তাগিদ বেশি, লোকের পকেটে পয়সাও নিশ্চয়ই বেশি।

লালমোহনবাবু বেশ সাহেবি কায়দায় ‘কস্‌মোপোলিট্যান’ কথাটা বলার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমরা কলিমুদ্দির দোকানের সামনে এসে পড়লাম। এ দোকানও চেনা, ‘সালাম বাবু’ বলে কলিমুদ্দি তার কাজে লেগে গেল। দিব্যি লাগে দু’ হাতে ঠোঙা ধরে ঝাঁকিয়ে মেশানোর ব্যাপারটা। আর সেই সঙ্গে টাট্‌কা, নোনতা, জিভে-জল আনা গন্ধ।

আমি গরম ঠোঙাটা হাতে নিয়েছি, এমন সময় দেখি ওয়ালেট থেকে টাকা বার করতে গিয়ে কী যেন একটা দেখে ফেলুদা একেবারে স্ট্যাচু।

কারণটা স্পষ্ট। আমাদের পাশ দিয়ে আমাদের সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে যে লোকটা এই মুহূর্তে মার্কেটের আরও ভিতর দিকে চলে গেল, সে হল মিঃ বাটরার ডুপলিকেট।

‘টুইন্‌স,’ চাপা গলায় মন্তব করলেন জটায়ু।

সত্যি, যমজ ছাড়া এ রকম হুবহু মিল কল্পনা করা যায় না। তফাত শুধু শার্টের রঙে। এঁরটা গাঢ় নীল। হয়তো কাছ থেকে সময় নিয়ে দেখলে আরও তফাত ধরা পড়ত, কিন্তু সেও নিশ্চয়ই খুবই সূক্ষ্ম। অবিশ্যি আরেকটা তফাত এই যে ইনি ফেলুদাকে আদপেই চেনেন না।

‘এতে অবাক হবার কিচ্ছু নেই,’ ফেরাপথে রওনা দিয়ে বলল ফেলুদা, ‘মিঃ বাটরার একটি যমজ ভাই থেকে থাকলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।’

‘সে আপনার নীলগিরি, বিন্ধ্য, আরাবল্লী, ওয়েস্টার্ন ঘাট্‌স—যাই বলুন না কেন, পাহাড়ের মাথায় যদি বরফ না থাকে তাকে আমি পাহাড়ই বলব না।’

এবার পুজোয় পাহাড়ে যাবার কথাটা ক’ দিন থেকেই হচ্ছিল। নতুন উপন্যাস বেরিয়ে গেছে, লেখার তাগিদ নেই, তাই লালমোহনবাবু তার সেকেন্ড হ্যান্ড সবুজ অ্যাম্ব্যাসাডারে রোজই বিকেলে আসছেন আড্ডা দিতে। কাশ্মীরটা আমাদের কারুরই দেখা হয়নি, কিন্তু ওখানকার অকটোবরের শীত সহ্য হবে না সেটা বোধ হয় নিজেই বুঝতে পেরে লালমোহনবাবু দু’একবার ‘কাশ’ ‘কাশ’ করে থেমে গেছেন। একটা অ্যাটলাস পড়ে আছে সামনের টেবিলে চা-ডালমুটের পাশে, সেটা খুলে বোধহয় ভারতবর্ষের ম্যাপটা একবার দেখার ইচ্ছে ছিল ভদ্রলোকের, এমন সময় কলিং বেল।

শ্রীনাথ আমাদের বাড়িতে চোদ্দ বছর কাজ করছে, তাই মিঃ বাটরা এসে বসার সঙ্গে সঙ্গে আরেক পেয়ালা চা এসে গেল।

‘আপনার কি কোনও যমজ ভাই আছে?’

বাটরা কপালের ঘাম মুছে রুমালটা রাখার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্নটা করলেন লালমোহনবাবু।

মিঃ বাটরার ভুরু যে কতটা ওপরে উঠতে পারে, আর তলার ঠোঁট যে কতটা নীচে নামতে পারে সেটা এই এক প্রশ্নেই বোঝা গেল।

‘আপনারা…আপনারা কী করে…?’

‘আপনার সঙ্গে দেখা হবার মিনিট পাঁচ-সাতের মধ্যেই নিউ মার্কেটেই তাকে দেখেছি আমরা’, বলল ফেলুদা।

‘মিস্টার মিটরা’,—চেয়ারে প্রায় এক হাত এগিয়ে এসে হাতলে একটা জবরদস্ত চাপড় মেরে বললেন মিঃ বাটরা—‘আই অ্যাম দি ওনলি চাইল্‌ড অফ মাই পেরেন্টস্। আমার ভাই বোন কিছু নেই।’

‘তা হলে—?’

‘সেজন্যেই তো আপনার কাছে এলাম মিঃ মিটরা। এক উইক হল এই ব্যাপারটা আরম্ভ হয়েছে। ফ্রম কাঠমাণ্ডু। আমি কাঠমাণ্ডুর একটা ট্র্যাভেল এজেন্সিতে কাজ করি—সান ট্র্যাভেলস—আই অ্যাম দ্য পি আর ও। আমাকে কাজের জন্য ক্যালকাটা বোম্বাই দিল্লি যেতে হয় মাঝে মাঝে। আমার অফিসের কাছে একটা ভাল রেস্টোরান্ট আছে—ইন্দিরা—সেখানেই লাঞ্চ করি আমি এভরি ডে। লাস্ট মানডে গেছি—ওয়েটার বলছে, আপনি তো আধঘণ্টা আগে লাঞ্চ করে গেলেন, আবার কী ব্যাপার?বুঝুন মিঃ মিটরা! আরও দু’-একজন চেনা লোক ছিল, তারাও বলল আমাকে দেখেছে। দেন আই হ্যাড টু টেল দেম—কী আমি আসিনি। তখন ওয়েটার বলে কী, ওর সাসপিশন হয়েছিল, কারণ যে লোক খেতে এসেছিল, হি হ্যাড এ ফুল লাঞ্চ, উইথ রাইস অ্যান্ড কারি অ্যান্ড এভরিথিং; আর আমি খাই স্রেফ স্যাণ্ডউইচেজ অ্যান্ড এ কাপ অফ কফি!’

মিঃ বাটরা দম নিতে থামলেন। আমরা তিনজনেই যাকে বলে উৎকর্ণ হয়ে শুনছি। লালমোহনবাবু বেশি মনোযোগ দিলে মুখ হাঁ হয়ে যায়, এখনও সেই অবস্থা। মিঃ বাটরা চায়ে একটা চুমুক দিয়ে আবার শুরু করলেন।

‘আমি কলকাতায় এসেছি পরশু, সানডে। কাল সকালে হোটেল থেকে বেরোচ্ছি—আমি আছি গ্র্যান্ডে—ফ্র্যাঙ্ক রসে যাব টু বাই সাম অ্যাসপিরিন। আপনি জানেন বোধহয়, হোটেলের ভিতরেই একটা কিউরিওর দোকান আছে? সেইটের পাশ দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ শুনি ভিতর থেকে আমায় ডাকছে—মিঃ বাটরা, প্লিজ কাম ফর এ মোমেন্ট! —কী ব্যাপার? গেলাম ভিতরে। সেলসম্যান একটা একশো টাকার নোট বার করে আমাকে দেখাচ্ছে। বলে—মিঃ বাটরা, আপনার এই নোটটা জাল নোট, নো ওয়াটারমার্ক, প্লিজ চেঞ্জ ইট!—আমার তো মাথায় বাজ পড়ল মিঃ মিটরা! আমি তো দোকানে ঢুকিইনি! অ্যান্ড দে ইনসিসটেড, কি আমি গেছি আধ ঘণ্টা আগে, আর আমি ওই একশো টাকার নোট দিয়েছি ওদের, অ্যান্ড আই বট এ কুকরি!’

‘কুকরি? মানে, নেপালি ছুরি?’ জিগ্যেস করলেন লালমোহনবাবু।

‘বুঝুন কী ব্যাপার! আমি থাকি কাঠমাণ্ডুতে; কলকাতায় এসে গ্র্যান্ড হোটেলের দোকান থেকে আমি নেপালের জিনিস কিনব কেন? নেপালে তো ও জিনিস আমি হাফ প্রাইসে পাব!’

‘আপনাকে নোটটা বদলে দিতে হল?’ ফেলুদা প্রশ্ন করল।

‘অনেকবার বললাম, যে আই অ্যাম নট দ্য সেম পারসন। শেষকালে এমন ভাবে আমার দিকে চাইতে লাগল যেন আমি আইদার পাগল, অর ফোর টোয়েন্টি। এ অবস্থায় কী করা যায়, বলুন!’

‘হুঁ…’

ফেলুদা ভাবছে। হাতটা সাবধানে বাড়িয়ে চারমিনারের ডগা থেকে প্রায়। এক ইঞ্চি লম্বা ছাইটা অ্যাশট্রেতে ফেলে দিয়ে বলল, ‘আপনি বেশ অসহায় বোধ করছেন সেটা বুঝতে পারছি।’

‘আমার রেগুলার প্যানিক হচ্ছে, মিঃ মিটরা। সে যে কখন কী করবে তার ঠিক কী?’

‘খুবই অদ্ভুত ব্যাপার,’ বলল ফেলুদা। —‘আপনার কথা আমার পক্ষে বিশ্বাস করাই কঠিন হত যদি না আমরা নিজের চোখে সে লোককে দেখতাম। কিন্তু তাও বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমি এ ব্যাপারে আপনাকে কীভাবে হেল্প করতে পারি সেটা ঠিক বুঝতে পারছি না।’

ভদ্রলোকও চিন্তিতভাবে মাথা নেড়ে বললেন, ‘সেটা ঠিক। এখন, আমি তো কাল কাঠমাণ্ডু ফিরে যাচ্ছি। ভরসা কী যে সে লোক আমার পিছে পিছে যাবে না, আর সেখানেও আমাকে হ্যারাস করবে না? এ তো বুঝতে পারছি যে সে লোককে আমি না দেখলেও, সে আমাকে দেখেছে, আর ডেলিবারেটলি আমার পিছনে লেগেছে। দিস ইজ এ নিউ টাইপ অফ ক্রাইম, মিঃ মিটরা। এবারে হান্ড্রেড রুপিজের উপর দিয়ে বেরিয়ে গেছে, এর পরে কী হবে কে জানে?’

বাইরের লোকের সঙ্গে কথা বলার সময় ফেলুদা এমনিতে পায়ের উপর পা তুলে বসে। যখন বোঝে আর কথা বলার নেই, বেশি বললে সময় নষ্ট হবে, তখন পা-টা এমন ভাবে নামিয়ে নেয় যে তাতেই বেশ বোঝা যায় ‘এবার আপনি আসুন’। আজও তাই করল, আর তাতে ফলও হল। মিঃ বাটরা উঠে পড়লেন। বুঝলাম কতকটা ভদ্রতার খাতিরেই ফেলুদা বলল, ‘আশা করি কাঠমাণ্ডুতে গিয়ে কোনও অসুবিধায় পড়তে হবে না।’

‘লেট আস হোপ সো’, বললেন ভদ্রলোক। ‘এনিওয়ে, আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। আপনার খুব প্রশংসা শুনেছি মিঃ সর্বেশ্বর সহায়ের কাছে।’

সর্বেশ্বর সহায় ফেলুদার এক মক্কেল। কোডার্মায় থাকেন। হাজারিবাগে তাঁর একটা বাংলো প্রায়ই খালি পড়ে থাকে; আমরা একবার সেখানে গিয়ে ছিলাম দিন দশেক।

‘কাঠমাণ্ডুতে কোনও গোলমাল দেখলে আপনি পুলিশে খবর দিয়ে দেবেন’, বলল ফেলুদা। ‘এসব লোকের দরকার স্রেফ ধোলাই।’

মিঃ বাটরা চলে যাবার পর লালমোহনবাবুই প্রথম মুখ খুললেন।

‘আশ্চর্য! ফরেন কান্ট্রি বলেই বোধহয় এই হিল স্টেশনের কথাটা একবারও মাথায় আসেনি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *