এ বাড়ির নিয়ম হচ্ছে যাদের বয়স চৌদ্দর নিচে, তাদের বিকেল পাঁচটার আগে ঘরে ফিরতে হবে। যাদের বয়স আঠারোর নিচে, তাদের ফিরতে হবে ছটার মধ্যে।
খোকনের বয়স তেরো বছর তিন মাস। কাজেই তার বাইরে থাকার মেয়াদ পাঁচটা। কিন্তু এখন বাজছে সাড়ে সাতটা। বাড়ির কাছাকাছি এসে খোকনের বুক শুকিয়ে তৃষ্ণা পেয়ে গেল। আজ বড়চাচার সামনে পড়ে গেলে ভূমিকম্প হয়ে যাবে।
অবশ্যি চমৎকার একটি গল্প তৈরি করা আছে। খোকন ভেবে রেখেছে সে মুখ কালো করে বলবে, সাজ্জাদের সঙ্গে স্কুলে খেলছিলাম, হঠাৎ দেখলাম বিরাট একটা মিছিল আসছে। সবাই খুব স্লোগান দিচ্ছে, জাগো বাঙালি জাগো। আমরা দূর থেকে দেখছি। এমন সময় গণ্ডগোল লেগে গেল। পুলিশের গাড়ির ওপর সবাই ইটপাটকেল মারতে লাগল। চারদিকে হইচই, ছোটাছুটি। আমি সাজ্জাদকে সঙ্গে নিয়ে ছুটতে লাগলাম। পেছনে চারদিকে পটাপট শব্দ হচ্ছে, বোধহয় গুলি হচ্ছে। আমরা আর পেছন ফিরে তাকাইনি, ছুটছি তো ছুটছিই। ফিরতে দেরি হলো এইজন্যে।
খুবই বিশ্বাসযোগ্য গল্প। আজকাল রোজই মিছিল হচ্ছে। আর রোজই গণ্ডগোল হচ্ছে। মিছিলের ঝামেলায় পড়ে যাওয়ার কথা সবাই বিশ্বাস করবে।
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, বড়চাচাকে ঠিক সাধারণ মানুষের পর্যায়ে ফেলা যায় না। তার সম্ভবত তিন নম্বর চোখ বলে কিছু আছে যা দিয়ে তিনি অনেকদূর পর্যন্ত দেখে ফেলেন। কথা বলতে শুরু করেন অত্যন্ত নিরীহ ভঙ্গিতে। ভাবখানা এরকম যেন কিছুই জানেন না। সেবারের ঘটনাটাই ধরা যাক। ফজলুর পাল্লায় পড়ে ফার্স্ট শো সিনেমা (গোলিয়াথ অ্যান্ড দ্য ড্রাগন, খুবই মারাত্মক ছবি দেখে বাড়িতে পা দেওয়ামাত্র বড়চাচার সামনে পড়ে গেল। বড়চাচা হাসিমুখে বললেন, এই যে খোকন, এইমাত্র ফিরলে বুঝি?
জি চাচা।
একটু মনে হয় দেরি হয়ে গেছে।
অঙ্ক করছিলাম।
তাই নাকি?
জি। ফজলুর এক মামা এসেছেন। খুব ভালো অঙ্ক জানেন। উনি দেখিয়ে দিচ্ছিলেন।
পাটিগণিত?
জি পাটিগণিত। পাটিগণিতই উনি ভালো জানেন। তৈলাক্ত বাশের অঙ্কটা আজ খুব ভালো বুঝেছি।
বড়চাচা দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, একটা মুশকিল হয়ে গেল খোকন। তোমার দেরি দেখে ফজলুদের বাসায় লোক পাঠানো হয়েছিল। সে কিন্তু তোমাদের দেখতে পায়নি।
খোকন মহা বিপদেও মাথা ঠান্ডা রাখতে পারে। এবারও পারল। হাসিমুখে বলল, আমরা তো ফজলুর বাসায় অল্প করছিলাম না। ওদের বাসায় খুব গণ্ডগোল হয় তো, তাই আমরা জহিরদের বাসায় গেলাম।
এটা ভালোই করেছ। পড়াশোনা করার জন্যে নিরিবিলি দরকার। ফজলুর মামা যে তোমাদের জন্যে এতটা কষ্ট স্বীকার করেছেন সেজন্যে তুমি তাকে আমার হয়ে ধন্যবাদ দিয়ো।
জি চাচা, দেব।
আর তুমি তাকে আগামীকাল আমাদের বাসায় চা খেতে বলবে। তুমি নিজে গিয়ে তাঁকে নিয়ে আসবে, কেমন?
খোকন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। বড়চাচা চশমার কাঁচ পরিষ্কার করতে করতে বললেন, খোকন, কী সিনেমা দেখলে।
এই হচ্ছেন বড়চাচা। এরকম একজন মানুষের ভয়ে যদি কারও বুক কাঁপে তাহলে বোধহয় তাকে ভীরু বা কাপুরুষ বলা ঠিক হবে না। খোকন এই ঠান্ডার মধ্যেও ঘামতে লাগল।
তবে একতলার সবচেয়ে বাঁ-দিকের ঘরটিতে আলো জ্বলছে। এটা একটা সুলক্ষণ। এর মানে হচ্ছে বড়চাচার কাছে মক্কেল এসেছে। তিনি মামলার নথিপত্র নিয়ে ব্যস্ত। খোকন এত রাত পর্যন্ত বাইরে এটা বোধহয় এখনো ধরতে পারেননি। যা হওয়ার হবে। খোকন খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল।
কিন্তু আশ্চর্য, কিছুই হলো না। সবাই যেন কেমন খুশি খুশি। উৎসব উৎসব একটা ভাব। ছোটরা চিৎকার চেঁচামেচি করছে। কেউ তাদের বকছে না। বড়চাচি পান বানাতে বানাতে কী একটা গল্প বলে হেসে গড়িয়ে পড়ছেন। ঈদের আগের রাতে যেরকম একটা আনন্দভাব থাকে, চারদিকের অবস্থা সেরকম। কিছু ঘটেছে, কিন্তু এখনই কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না। খোকন এমন ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াতে লাগল যেন সে সারাক্ষণ বাড়িতেই ছিল। অনজু আর বিলু সাপলুডু খেলছিল। ওদের পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়াল। বিলুটা মহা চোর। তার পড়েছে চার কিন্তু সে পাঁচ চেলে তরতর করে মই বেয়ে উঠে গেল। পরেরবার উঠল পাঁচ, একেবারে সাপের মুখে। সে আবার চালল চার। অনজুটা এমন বোকা কিছুই বুঝতে পারছে না। খোকন বলল, এসব কী হচ্ছে বিলু?
কিছুই হচ্ছে না। তুমি মেয়েদের খেলায় কথা বলতে এসেছ কেন? কোথায় ছিলে সারা সন্ধ্যা?
ঘরেই ছিলাম। যাব আবার কোথায়?
খোকন সেখানে আর দাঁড়াল না। চলে এল দোতলায়। বাবার ঘরে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, প্যাথলজি শব্দের মানে কী? যাতে বাবা বুঝতে পারেন সে পড়াশোনা নিয়েই আছে।
বাবাকে কিছু জিজ্ঞেস করা মুশকিল। তিনি অল্পকথায় কোনো জবাব দিতে পারেন। প্যাথলজি শব্দের মানে বলতে তিনি পনেরো মিনিট সময় নিলেন। চিকিৎসাশাস্ত্রের কথা বললেন, ভেষজবিজ্ঞানের ইতিহাস বললেন, শারীরবিদ্যায় প্রাচীন গ্রিকদের অবদানের কথা বললেন। খোকন চোখ বড় বড় করে শুনল। তার ভঙ্গিটা এরকম যেন সে খুব মজা পাচ্ছে। বাবা বক্তৃতা শেষ করে বললেন, যা যা বললাম সব খাতায় লিখে রাখবে।
জি রাখব।
লিখবার আগে ছোটদের এনসাইক্লোপিডিয়াটাও দেখে নেবে। আমি হয়তো অনেক পয়েন্ট মিস করেছি।
আমি দেখে তারপর লিখব।
গুড। আর শোনো, সন্ধ্যাবেলা তোমার মা তোমার খোঁজ করছিলেন। সারা বিকাল তুমি তার কাছে যাওনি। চারদিকে ঝামেলা টামেলা হচ্ছে, সে খুব চিন্তিত থাকে। যাও, দেখা করে আসো।
.
মা থাকেন দোতলায় সবচেয়ে শেষ ঘরটায়। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বিছানায় শুয়ে আছেন। হার্টের খুব খারাপ ধরনের একটা অসুখ, যাতে একটুও নড়াচাড়া করা যায় না। রাতেরবেলা একজন অ্যাংলো নার্স মিস গ্রিফিন এসে মার সঙ্গে থাকে। সে ছেলেদের মতো সিগারেট খায়। বাচ্চারা কেউ শব্দ করে সিড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলেই প্রচণ্ড ধমক দেয়।
মিস গ্রিফিন মার ঘরের সামনের বারান্দায় বসে সিগারেট টানছিল। খোকনকে দেখেই ভ্রু কুঁচকে বলল, কী চাও তুমি?
মার কাছে যাব।
এখন না। এখন ঘুমাচ্ছে। সকালে আসবে। গো অ্যাওয়ে।
খোকন নিচে নেমে এসে দেখল টেবিলে ভাত দেওয়া হয়েছে। ফার্স্ট ব্যাচ খেতে বসবে। ফার্স্ট ব্যাচ হচ্ছে বাচ্চাদের, যাদের বয়স পনেরোর নিচে, তাদের। এদের সঙ্গে বসে খেতে খোকনের লজ্জা লাগে। কিন্তু কিছু করার নেই, বড়চাচার নিয়ম। কবির ভাই গত নভেম্বরে পনেরোতে পড়েছেন। কাজেই তিনি এখন গম্ভীর মুখে সেকেন্ড ব্যাচ বড়দের সঙ্গে খেতে বসেন। ফার্স্ট ব্যাচ খেতে বসলেই এক ফাঁকে এসে বলেন, আহ বড় গণ্ডগোল হচ্ছে। খাওয়ার সময় এত কথা কিসের? খোকনের গা জ্বলে যায়। কিন্তু সহ্য করা ছাড়া উপায় কী?
খেতে বসেই খোকন জানতে পারল কী জন্যে আজ বাড়িতে এমন খুশি খুশি ভাব। ছোটচাচারা আমেরিকা থেকে ঢাকা চলে আসছেন। বিদেশ আর ভালো লাগছে না। আনন্দে খোকন বিষম খেয়ে ফেলল। ছোটচাচা এখন থেকে এ বাড়িতেই থাকবেন, এরচেয়ে আনন্দের খবর আর কিছু হতে পারে নাকি?
ছোটচাচা ফুর্তি ছাড়া এক মিনিটও থাকতে পারেন না। সবসময় তার মাথায় মজার মজার সব ফন্দি আসে। খোকন যখন ক্লাস থ্রিতে পড়ে তখন তিনি একবার ঠিক করলেন, ঢাকা শহরের ভিক্ষুকদের গড় আয় কী তা নিয়ে একটা সমীক্ষা চালাবেন। সমীক্ষার বিষয় হচ্ছে একজন ভিক্ষুক দৈনিক কত আয় করে। তারপর একদিন সত্যি সত্যি নকল দাড়িগোঁফ লাগিয়ে ময়লা একটা লুঙ্গি পরে খালিগায়ে ভিক্ষা করতে বেরুলেন। দুপুর তিনটার মধ্যে আড়াই সের চাল, এক টাকা পয়ত্রিশ পয়সা এবং একটা ছেড়া হলুদ রঙের সোয়েটার পেয়ে গেলেন। গম্ভীর হয়ে বললেন, পেশা হিসেবে ভিক্ষাবৃত্তি খুব খারাপ না। যে লোক এমন একটা কাণ্ড করে তাকে ভালো না বেসে পারা যায়?
খোকন খাওয়া শেষ করে যখন হাতমুখ ধুচ্ছে তখন বড়চাচা বেরুলেন তার ঘর থেকে। খোকনের সামনে দাঁড়িয়ে শান্তস্বরে বললেন, সাতটা বাজার দশ মিনিট আগে আমি তোমাকে এ বাড়িতে দেখিনি, কোথায় ছিলে? খোকন বলতে চেষ্টা করল, বাথরুমে ছিলাম। বলতে পারল না। কথা গলা পর্যন্ত এসে আলজিবে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল। বড়চাচা দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, চারদিকে হাঙ্গামা-হুজ্জত হচ্ছে। এর মধ্যে তুমি বাইরে। স্বাধীনতা বেশি পেয়ে যাচ্ছ। যাই হোক, তুমি কোথায় ছিলে কী করছিলে তা শুদ্ধ বাংলায় লিখে আজ রাত দশটার মধ্যে আমার কাছে জমা দেবে।
জি আচ্ছা।
কাল সারা দিন ঘর থেকে বেরুবে না। সারা দিন থাকবে দোতলায়। নিচে নামবে না।
জি আচ্ছা।
মিছিল-টিছিলে গিয়েছিলে নাকি?
জি-না।
আচ্ছা ঠিক আছে, যাও।
খোকন দোতলায় তার নিজের ঘরে এসে মুখ কালো করে বসে রইল। কী জন্যে আজ ফিরতে দেরি হয়েছে তা লেখাটা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারল না। বিষয়টা গোপনীয়। কিন্তু বড়চাচার কাছে গোপন করা কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে? নির্ঘাৎ ধরে ফেলবেন।
খোকন একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সত্যি কথাই লিখতে শুরু করল। লেখা হলো সাধু ভাষায়। আজ (২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১) আমরা একটি গোপন দল করিয়াছি। দলটির নাম ভয়াল-ছয়। দলের সদস্য সংখ্যা ছয়। সদস্যরা কিছুদিনের মধ্যেই পায়ে হাঁটিয়া পৃথিবী ঘুরিতে বাহির হইবে। আমাদের প্রথম গন্তব্য আফ্রিকার গহীন অরণ্য। কঙ্গো নদীর পার্শ্ববতী অঞ্চল।