একটু আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। বাতাসে এখন তাপ নেই। সকাল বেলার আলো স্পষ্ট উজ্জ্বল। পৃথিবী যেন এইমাত্র স্নান সেরে পরিচ্ছন্ন রূপসি হল।
গোটা পৃথিবীটাকে একসঙ্গে খালি চোখে দেখা যায় না। দেখা যায় চওড়া রাস্তা, ডান পাশের গলি, রায়বাড়ির বাগান থেকে ঝুঁকে আসা নারকেল গাছ, একটি ছাদের প্যারাপেটে একঝাঁক শালিক, কিছু ব্যস্ত মানুষ রিকশায়, স্কুলযাত্রী বাচ্চাছেলে।
তিনতলার বারান্দার দরজা খুলে ইন্দ্রাণী বাইরে এসে দাঁড়াল। সে এখন পৃথিবীর এই ক্ষুদ্র অংশটুকু দেখছে। কিংবা তিনতলা থেকে সে আরও খানিকটা দূর পর্যন্ত দেখতে পায়। তাদের বাড়ির বাগানেই তো অনেক গাছপালা।
যদিও ইন্দ্রাণী কিছুই দেখছে বলে মনে হয় না। তার মুখ উদাসিনীর মতন। যেন সে আজ দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছে। পিঠের ওপর চুল খোলা, অবিন্যস্ত। সে পরে আছে একটা উজ্জ্বল হলুদ শাড়ি, লাল পাড়। তার ফর্সা শরীর, হলুদ শাড়ি এবং সকালের রোদ, সব মিলিয়ে একটা ম্যাজিকের সৃষ্টি হয়। বলতে ইচ্ছে হয়, রৌদ্রে এসে দাঁড়িয়েছে প্রতিমা।
তিনতলার বারান্দার রেলিং ধরে ঈষৎ ঝুঁকে ইন্দ্রাণীর এই যে দাঁড়িয়ে থাকা, আপাতত পৃথিবীতে এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কিছু নেই। রাজপথ দিয়ে দ্রুত হেঁটে আসতে আসতে সেই দিকে চোখ পড়তেই আমার বুকটা আকস্মিক ভূমিকম্পের মোচড় খায়। দু-এক পলক আমি চোখ ফেরাতে পারি না। নিজেকে আমার মহান ও গ্লানিহীন মনে হয়। সেই মুহূর্তে আমি পৃথিবীর সমস্ত অপরাধীকে ক্ষমা করে দিতে পারি।
ইন্দ্রাণীর হাত দু-টি নিরাভরণ। লাল ব্লাউজের হাতা ওর দুই বাহু যেন কামড়ে আছে। মুখের ওপর পড়েছে চুর্ণ চুল। আজ ইন্দ্রাণী যেন ইন্দ্রাণীর চেয়েও বেশি সুন্দর।
আমি আর একবার ওপরে তাকিয়ে ওর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করি। আর কিছু না। শুধু কী, কেমন আছ, এইটুকু বলার জন্য। কিন্তু ইন্দ্রাণী আমাকে লক্ষ করেনি। অনেক সময় চোখ চেয়ে থাকে, কিন্তু মন চলে যায় অতীত কোনো দৃশ্যে। আমি থমকে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত দিই। কয়েকটা খুচরো পয়সা বার করে গুনি অকারণেই। আমার মনের মধ্যে অদ্ভুত এক শান্তি। জীবনে কী এমন করেছি, যার জন্য এতখানি সৌভাগ্য হবে আমার। আজ সকালে এই যে ইন্দ্রাণীকে দেখা! মুনিঋষিরা যে সুন্দরকে দেখতে বলেছেন, এই তো সেই।
রাস্তার মাঝখানে এমন থমকে থাকা যায় না। আমি আবার মন্থরভাবে হাঁটতে থাকি। শেষ কয়েক পলক আবার দেখে নিই ওকে। ও আমাকে দেখতে পায়নি, তাতে কী হয়েছে, আমি তো দেখলাম! ওর ওই রূপের প্রভা আমাকে যেন একমুহূর্তে কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখরের কাছে নিয়ে যায়।
জানি, নারীর রূপ নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি করা অতিরোম্যান্টিকতার কুলক্ষণ। কেউ কেউ বলবেন, এটা আমার রোগ। হতে পারে। আমি নাকি নারীর শুধু রূপটাই দেখি, তার সমগ্র জীবনটা দেখতে পাই না। তাও ঠিক। আমি কী জানি না, রূপসি নারীরাও ঝি-চাকরকে কটু ভাষায় বকে, দোকানে দরাদরি করে, অনেকের বুকের মধ্যে দাউদাউ করে হিংসা, তারা বাথরুমে যায়, তারা সংসারের গাধা, তারাও ফুল ও ফলের মতো ঝরে যায় একদিন? তবু বারান্দার রেলিং-এ একটু ঝুঁকে এই যে হলুদ শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে থাকা—এই দৃশ্যের মধ্যে আর সব কিছু মুছে যায়। তখন আমি স্পষ্ট জেনে যাই, এই নারী আর সকলের চেয়ে আলাদা তখন আমি ওই নারীকে দেখে রূপের চেয়েও আরও বেশি কিছু দেখি। শুধু ওই দিকে তাকিয়ে দুনিয়ার দেখা ও অদেখা শ্রেষ্ঠ দৃশ্যগুলি আমার কাছে চলে আসে। দেখে দেখে আমার আশ মেটে না। আমার লোভ হয় না, বরং আমি প্রেরণা পাই। যেমন ইন্দ্রাণী এইমুহূর্তে আমার মধ্যে এক প্রশান্ত অহংকার জাগিয়ে তুলল। ইন্দ্রাণী আমার কেউ নয়। একসময় সে আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর প্রেমিকা ছিল। ইন্দ্রাণীর চোখে আমার চোখ পড়লে আমি ওর সঙ্গে দু-একটা সামান্য সাধারণ কথা বলতাম মাত্র। তার চেয়ে ওর নীরবতা আরও মধুর লাগে। একটা অস্থিরতা আমার শরীরে সঞ্চারিত হয়ে যায়। ইন্দ্রাণী তুমি ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকো। আপাতত আমি এই কাহিনি থেকে প্রস্থান করছি।