০১. এক একটা দিন এরকমই হয়

এক একটা দিন এরকমই হয়। কোনও কিছু ভাল লাগে না তোয়ার। সকালে ঘুম থেকে উঠেই টের পায় একটা চোরা কষ্ট দানা বাঁধছে বুকে। তারপর দিনভর তোয়া যাই করুক, স্কুলে যাক, বন্ধুবান্ধবদের দঙ্গলে মিশে থাকুক, হইহল্লায় মেতে উঠুক, কিংবা বাড়িতেই ঠাঁই নিক, কষ্টটা যেন রয়েই যায়। বিচ্ছিরি ঘ্যানঘেনে মাছির মতো। ক্রমশ তার প্রতাপ বাড়ে বই কমে না। কোত্থেকে যে আসে কষ্টটা, কেন যে দিনভর জ্বালায়, তোয়া জানে না।

আজও সেইরকমই একটা দিন। তোয়ার মিইয়ে থাকা মেজাজটা আরও কষ্‌টে মেরে গেল উইকলি টেস্টের পর। ইলেভেনের ক্লাস শুরু হয়েছে মাসখানেক, আজ সূচনা হল পরীক্ষা পর্বের। অঙ্ক দিয়ে। চলবে সেই ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রথম দিনই এমন সহজ একটা ট্রিগনমেট্রির প্রবলেম ভুল করে এল খাতায়!

স্কুল থেকে ফিরে তোয়ার আজ আর নীচে নামতে ইচ্ছে করল না। অন্য দিন, টিউটোরিয়াল না থাকলে, নীচে তাদের হাউজ়িং-এর ক্লাবে গিয়ে টি-টি খেলে খানিকক্ষণ। কিংবা সমবয়সিদের সঙ্গে একটু হাহা-হিহি করে বিকেলটা কাটায়। আজ ও পথ মাড়ালই না। আসা ইস্তক শুয়ে আছে বিছানায়।

সবিতা পরদা সরিয়ে উঁকি দিচ্ছে দরজায়। মাঝবয়সি রাতদিনের কাজের লোক। তোয়া এ সংসারে আসার পর থেকেই আছে তাদের বাড়িতে। দরজা থেকেই বলল, কী হল, স্কুলের ড্রেস ছাড়লে না?

হুঁ।

টেবিলে দুধ দিয়েছি, উঠে খেয়ে নাও।

তুচ্ছাতিতুচ্ছ খাবারও ডাইনিং টেবিলে বসে খাওয়া এ সংসারের দস্তুর। নিয়মটা মা-র বানানো বলেই এই সব দিনে অগ্রাহ্য করতে ইচ্ছে হয় তোয়ার। বালিশে মুখ গুঁজে বলল, এখানেই দিয়ে যাও না।

শরীর খারাপ লাগছে নাকি?

নাহ। এমনিই।

জলখাবার কী করব? পরোটা খাবে? ধোসা খেলেও আছে, বানিয়ে দিতে পারি।

না। খিদে নেই। শুধু দুধ।

মিনিট খানেকের মধ্যেই গ্লাস হাতে ফের এসেছে সবিতা। তোয়াকে ডাকল, কী গো, এনেছি তো।

তোয়া উঠল ধীরে সুস্থে। গ্লাস হাতে নিয়ে চুমুক দিচ্ছে দুধে। নিজের অজান্তেই বিকৃত হয়ে গেল মুখ। বৈকালিক এই দুধটা তার অসহ্য লাগে। কিন্তু সে তো অবাধ্য মেয়ে নয়, মায়ের তৈরি নিয়মটা না ভেঙে খেয়েও নেয় চুপচাপ।

গ্লাস ফেরত নিয়েও সবিতা দাঁড়িয়ে আছে। ভুরু কুঁচকে তোয়াকে নিরীক্ষণ করতে করতে বলল, তোমাকে আবার সেই মন খারাপের ব্যামোটায় পেয়েছে বুঝি?

সবিতামাসি ঠিক তাকে পড়ে ফেলে। তোয়া জবাব দিল না। ম্লান হাসল।

একটু গান চালিয়ে দাও না বাপু। কিংবা টিভি দ্যাখো। নয়তো নীচে একপাক ঘুরে এসো। বিকেলবেলা বিছানায় গড়াগড়ি খেলে মন কখনও ভাল হয়!

কীসে যে মন ভাল হয় তা যদি জানা থাকত তোয়ার!

এবারও জবাব না দিয়ে তোয়া খাট থেকে নামল। ওয়ার্ড্রোব খুলে বার করছে ঘরোয়া পোশাক। লাগোয়া বাথরুমটায় ঢুকতে যাচ্ছিল, সবিতার প্রশ্নে থামল, এই, বাড়িতে কে আসছে গো?

তোয়া ঘুরে তাকাল, জানি না তো।

তোমার মা কাল রাত্তিরে আমায় বলল, তোমাদের বইখাতার ঘরটা সাফসুতরো করে রাখতে। খাট আলমারিও নাকি ঢুকবে ঘরে। কে যেন এসে থাকবে।

বেশ অবাক হয়েছে তোয়া। কেই বা আসতে পারে যার জন্য ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে স্টাডিরুম? কই, মা কিংবা বাপি তো তাকে কিছু বলেনি! অবশ্য তোয়া কী এমন গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী, যে তাকে সব কথা জানাতে হবে! …কিন্তু কে হতে পারে? আসার মধ্যে তো ক্বচিৎ কখনও দিদা। তা দিদাকে তো তোয়ার ঘরেই চালান করা হয়। আর ন’মাসে ছ’মাসে বাপির ভাই কলকাতায় কোনও কাজে এসে ফিরতে না পারলে ফ্ল্যাটে থেকে যায় রাত্তিরটা। এদের কারও জন্যে নিশ্চয়ই স্পেশাল বন্দোবস্ত হচ্ছে না।

আন্দাজ না করতে পারার জন্যই যেন মেজাজটা আরও খাট্টা হয়ে গেল তোয়ার। ঢোলা হাফপ্যান্ট আর টিশার্ট চাপিয়ে আটতলার ব্যালকনিটায় দাঁড়িয়ে রইল একটুক্ষণ। তারপর ঘরে এসে আইপ্যাডখানা খুলে বসেছে। এবারের জন্মদিনে বাপির উপহার। চোখ ধাঁধানো কিছু না দিলে বাপির যেন মন ভরে না। তা ছাড়া তোয়ার মা-টিও তো বর তার মেয়েকে দামি কিছু দিচ্ছে দেখলে খুশিই হয়। মুখে অবশ্য ভ্যানতারা করে নানারকম। তা যাইহোক, আইপ্যাডটি বেশ কাজের হয়েছে। কত কী যে করা যায়। স্রেফ আঙুল বুলিয়ে বুলিয়ে নিজের তোলা ছবিগুলো ঘাঁটো, চরে বেড়াও ইন্টারনেটে, ফেসবুকের দেওয়ালে কমেন্ট লেখো, চ্যাট চালাও, কুটুর কুটুর টুইট করো, গান শোনো, মুভি দ্যাখো, গেমস খেলো…।

আজ অবশ্য তোয়ার কিছুতেই আগ্রহ নেই। তবু লাইব্রেরি ফাইল খুলে একখানা বই বার করল। অর্ধেক পড়া হয়েছে, আবার শুরু করল সেখান থেকে। দু’-চারটে পাতা উলটে আর মন বসছে না। আইপ্যাডকে ঘুম পাড়িয়ে টিভির সিরিয়ালে চোখ রাখল। ইংরিজি সিরিয়াল, খুব মজার। এক উন্মাদ বিজ্ঞানী একটা বোকা লোকের ক্লোন বানিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে এক ফ্যামিলিতে, তাকে ঘিরে উদ্ভট উদ্ভট কাণ্ড ঘটছে অবিরাম। অন্য দিন তোয়া ভারী উপভোগ করে, আজ তার দু’চোখ নিষ্পৃহ। টিভি বন্ধ করে আবার ফিরে গেছে আইপ্যাডে। ফেসবুক করছে।

তা ফেসবুক এমনই এক নেশা, যাতে একবার বুঁদ হয়ে গেলে সময়ের আর জ্ঞান থাকে না। কখন মা ফিরল, বাপি বাড়ি ঢুকল, হুঁশই নেই মেয়ের। তোয়ার ঘরে ঢুকে খানিক বকবকও করে গেল মা, কিন্তু আদৌ তোয়া কিছু শুনল কি? অজানা বন্ধুবান্ধবে ঘেরা এক অলীক জগতে সে তখন বিভোর যে।

বাস্তবে ফিরল রাত প্রায় সাড়ে ন’টায়। মার চেল্লামিল্লিতে। খাবার টেবিল থেকে ডাকছে, তোয়া, কতবার বলতে হবে, খাবার দেওয়া হয়েছে, চলে এসো।

মেজাজটা সামান্য সমে ফিরেছিল তোয়ার, ফের টকে গেল। মা’র এই এক স্বভাব, টেবিল সাজানোর পর আর তর সয় না, চেঁচিয়ে কানের পোকা বার করে দেয়। আরে বাবা, তোমরা তোমাদের মতো খেয়ে নাও না, তোয়ার পিছনে লেগে আছ কেন? একত্রে টেবলে না বসলে কী মহাভারত অশুদ্ধ হবে? সুখী পরিবার ইমেজটায় ধাব্বা পড়বে নাকি? কিছু তো বলাও যাবে না। গায়ে ছ্যাঁকা লাগবে হয়তো।

মুখখানা ভেটকে তোয়া ঘর থেকে বেরোল। অতিকায় লিভিংরুমখানা পেরিয়ে এল ডাইনিং স্পেসে। চেয়ার টেনে বসল তৃষিতার মুখোমুখি। পাশে সিদ্ধার্থ।

তোয়াকে চোখের কোণ দিয়ে দেখছিল সিদ্ধার্থ। ক্যাসারোল খুলে রুটি বার করতে করতে বলল, কী করছিলি, অ্যাঁ? সেই আইপ্যাড?

তোয়া রা কাড়ল না। জগ তুলে দু’-তিন ঢোক জল ঢালল গলায়।

মোক্ষম একটা চিজ় ধরিয়েছ বটে। তৃষিতার স্বরে পলকা বিরক্তি, পড়াশোনার নাম নেই, সারাক্ষণ ওই নিয়েই পড়ে আছে!

তোয়া গুমগুমে গলায় বলল, আমি আমার সময় মতো পড়ি মা।

চোখে তো দেখতে পাই না। মনে আছে কি, সেকেন্ডারি পরীক্ষায় তুমি এমন কিছু ভাল রেজাল্ট করোনি? এবং এখন এই দুটো বছর জীবনের সবচেয়ে ভাইটাল?

মেয়ের জীবনে কোন বছরটা সবচেয়ে ভাইটাল, সত্যিই কি কখনও বোঝার চেষ্টা করেছে মা?

তোয়া গম্ভীর মুখে বলল, রোজ এক কথা বলো কেন বলো? আমি জানি তো।

জানার কোনও ফল যে দেখি না। টিউটোরিয়ালই সব গিলিয়ে দেবে ভাবলে কিন্তু ভুল করবে। তৃষিতার চোখ সরু, আইপ্যাড অফ করে এসেছিস?

সরি। এমন ডাকাডাকি করছিলে…

সুইচটা টেপারও সময় পাওনি, তাই তো? তৃষিতা মেয়ের চোখে চোখ রাখল, শোনো, দামি জিনিস পেলেই হয় না, মেন্টেন করতে জানতে হয়।

সে কি তোয়া বোঝে না? সেই চেষ্টাই কি তোয়া করছে না, গত ন’বছর ধরে? প্রাণপণে? হ্যাঁ, ন’বছর আগেই তো মহার্ঘ বাপির সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল মা’র।

তোয়া মুখখানা নিরীহ করে বলল, অনেক তো হল, এবার কিছু খেতে পাব কি?

নে না। সামনেই তো পড়ে আছে। পনির আলুরদম মেটেচচ্চড়ি…

আমি শুধু মেটেচচ্চড়ি খাব।

সিদ্ধার্থ বলে উঠল, আলুর দম নিবি না কী রে? একদম তোর মনের মতো করে বানিয়েছে। কষকষে।

তৃষিতা ফুট কাটল, তুই খাবি না জানলে কম মশলা দিতে বলতাম।

তোয়া কথা বাড়াল না। হাতা দিয়ে তুলছে খাবার। আন্দাজমতো প্লেটে নিয়ে সিদ্ধার্থকে এগিয়ে দিল পাত্রগুলো। খাওয়া শুরু করেছে।

রুটি মুখে পুরে কী যেন মনে পড়ে গেল তোয়ার। ফস করে জিজ্ঞেস করে উঠল, সবিতামাসি বলছিল কে যেন স্টাডিরুমে এসে থাকবে…?

তৃষিতা যেন পলকের জন্য থতমত। সিদ্ধার্থর সঙ্গে চোখ চাওয়াচাওয়ি করল একবার। ঘুরে রান্নাঘরের দরজায় দণ্ডায়মান সবিতাকেও দেখল ঝলক। তারপর কিছুটা যেন আত্মরক্ষার সুরে বলল, হ্যাঁ, তোকে আজই বলতাম…। স্টাডিরুমে তোর বিস্তর জিনিসপত্র ছড়ানো আছে… বই খাতা সিডি… দু’খানা হেডফোনও দেখলাম গড়াগড়ি খাচ্ছে… ওগুলো সরিয়ে তোকে নিজের রুমে নিয়ে যেতে হবে…

কিন্তু আসছেটা কে?

সোহম। ও এখন থেকে এখানেই স্টে করবে।

কে সোহম?

আশ্চর্য, সোহমকে যেন চিনিস না? তৃষিতার স্বর একধাপ চড়েও মুহূর্তে নেমে এল, তোর বাপির ছেলে।

হ্যাঁ, তাই তো! বাপির ছেলের নাম তো সোহমই বটে। বাপি অবশ্য লাল্টু না পল্টু কী যেন একটা বলে ডাকছিল। একবারই তোয়া দেখেছে সোহমকে, তবে মুখখানা মনে আছে স্পষ্ট। এই তো গত বছরই পুজোর আগে বাপি ছেলেকে নিয়ে এসেছিল এ বাড়িতে। কচি কচি ফরসা ফরসা মেয়েলি টাইপ ফেস। চুলগুলো বাপির মতোই কোঁকড়া কোঁকড়া। কেমন আদেখলের মতো জুলজুলে চোখে দেখছিল ফ্ল্যাটখানা।

তোয়া হতবাক মুখে বলল, সে হঠাৎ এখানে থাকবে কেন?

কারণ সোহম কলকাতায় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে চান্স পেয়েছে। কাছেই বাইপাসের ধারে ওদের ক্যাম্পাস। দেশবন্ধু ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি।

তৃষিতার বক্তব্য মোটেই জটিল নয়। তবু যেন অনুধাবন করতে পারছিল না তোয়া। ফের জিজ্ঞেস করে বসল, ওদের ওখানে হস্টেল নেই?

নেই বলেই তো এখানে এসে উঠছে।

কিন্তু এখানে স্পেস কোথায়?

বললাম যে, স্টাডিরুমটাকে ওর ঘর করে দেওয়া হবে। ওটা তো পার্টিকুলারলি কেউ ব্যবহার করে না, সাজিয়ে গুছিয়ে দিলে একজন দিব্যি ওখানে বাস করতে পারবে।

স্ট্রেঞ্জ! আমার কথা ভাবছ না? তোয়ার মুখ দিয়ে আচমকা বেরিয়ে গেল, হোয়াট উইল হ্যাপেন টু মাই প্রিভেসি?

তোয়ার প্রশ্নটা যেন সপাটে আছড়ে পড়ল টেবিলে। সিদ্ধার্থর মুখমণ্ডল পলকে থমথমে। তৃষিতাও বাক্যহারা। মুহূর্তে নেমে এসেছে এক অস্বস্তিকর নৈঃশব্দ্য।

মিনিট খানেক পর সিদ্ধার্থ প্রায় বিড়বিড় করে বলল, দেখেছ তো, আমি বলেছিলাম লাল্টু এখানে থাকলে তোয়ার অসুবিধে হবে।

তৃষিতা অপাঙ্গে একবার দেখল মেয়েকে। কোনও মন্তব্য করল না।

সিদ্ধার্থ ফের মৃদু স্বরে বলল, প্ল্যানটা বাদ দাও, বুঝলে। আমি বরং লাল্টুর জন্য অন্য কিছু ব্যবস্থা করি। কাছেপিঠে কোথাও যদি ওকে পেয়িংগেস্ট হিসেবে রাখা যায়…

না। তৃষিতা আবার দেখল মেয়েকে। সিদ্ধার্থকে নয়, যেন মেয়েকেই কড়া গলায় বলল, সব কিছু মহারানির ইচ্ছেমতো হবে না। সোহম এই ফ্ল্যাটেই থাকবে।

চরম সিদ্ধান্ত ঘোষণা হয়ে গেল? তোয়ার আপত্তি অসুবিধের একেবারেই মূল্য নেই? অপমানে শক্ত হয়ে গেল তোয়ার চোয়াল। ফুলছে নাকের পাটা। প্রিয় মেটেচচ্চড়ি পানসে সহসা, জিভ ছোঁয়াতে ইচ্ছে করছে না। তবে সিন ক্রিয়েট করা তোয়ার ধাতে নেই, মাথা নিচু করে চিবোচ্ছে কচকচ। তরকারির শেষ অংশটুকু কোনওক্রমে মুখে নিয়ে উঠে গেল। থু থু করে ফেলল বেসিনে। মা কিংবা বাপি যাতে টের না পায়, কাচিয়ে কাচিয়ে সাফ করল বেসিন। তারপর পা অচঞ্চল রেখে নিজের ঘরে চলে যাচ্ছিল, মা’র ডাক শুনে তাকিয়েছে ঘাড় বেঁকিয়ে।

তৃষিতা জিজ্ঞেস করল, কাল তোর টিউটোরিয়াল আছে না?

আছে?

ফিরছিস কখন?

জানো না কখন ফিরি?

জবাবের বদলে পালটা প্রশ্ন হেনে তোয়া মুহূর্তে ফ্রেমের বাইরে। ঘরে এসে আইপ্যাড বন্ধ করল, টিভিও আর খুলল না, গড়িয়ে পড়ল বিছানায়।

মাথাটা জ্বালা জ্বালা করছিল তোয়ার। কী আজব ঘটনা! যাকে তোয়া প্রায় চেনেই না, তেমনই একজনের মুখ দেখতে হবে রোজ? বাড়িতেই? স্টাডিরুমটা তো গেলই, ইচ্ছেমতো চলাফেরাও কি আর করতে পারবে ফ্ল্যাটে? এ তো প্রায় দখলদারি চলে যাওয়া। মফস্‌সলের ওই বোকা বোকা মার্কা ছেলেটার সঙ্গে চলনে বলনে, রহনে সহনে, তোয়ার কণামাত্র মিল নেই, তবু কিনা বাস করতে হবে এক ছাদের নীচে? এ তো রীতিমত নির্যাতন।

বাপি এটা কী করল? মুখে এত তোয়া তোয়া করে, তোয়ার মুখের একটুখানি হাসি দেখার জন্য নাকি মরে যায়, অথচ মনের মধ্যে নিজের ছেলেটাকে ঠিক পুষে রেখেছে গোপনে। মাঝে মাঝে যায় বটে কৃষ্ণনগরে, ছেলেকে দেখে আসে, তা বলে তার জন্য এত দরদ…! সত্যি বলতে কী, এ বাড়িতে ছেলেটার নামই করে না বাপি। অন্তত তোয়ার সামনে। সোহম যে মাধ্যমিকে ভাল রেজাল্ট করেছিল, এও তো তোয়া শুনেছে মা মারফত, বাপি তাকে কিছু বলেনি। এত লুকোছাপার পর বাপির ঝোলা থেকে কিনা এই বেড়াল বেরোল? ছিঃ।

পুরনো একটা দৃশ্য হঠাৎ ঝলসে উঠল তোয়ার চোখে। …গঙ্গার ধারের রেস্তরাঁয় তোয়াকে আইসক্রিম খাওয়াতে নিয়ে গেছে মা, কোত্থেকে সেখানে বাপি হাজির। উঁহু, তখন তো বাপি নয়, আঙ্কল। এসেই মিষ্টি হেসে বলল, হ্যালো লিটল প্রিন্সেস, হাউ ডু ইউ ডু?

সিদ্ধার্থ আঙ্কল তো তোয়ার চেনা। বাবার সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর মা তখন ছোট্ট তোয়াকে নিয়ে দাদু-দিদার কাছে। লেকমার্কেটের বাড়িতে। সন্ধেবেলা অফিসফেরতা মাকে প্রায়ই সেখানে পৌঁছে দিয়ে যেত আঙ্কল। ভেতরে এসে চা-কফি খেত, কোনও কোনও দিন গল্প করত দাদু-দিদার সঙ্গে।

তোয়া ঘাড় দুলিয়ে বলেছিল, আই অ্যাম ফাইন। তুমি কেমন আছ?

তক্ষুনি আঙ্কলের পকেট থেকে বেরিয়ে এল তোয়ার প্রিয় ফ্রুট অ্যান্ড নাট চকোলেটের বার, যে মেয়ে ফাইন থাকে, তাকে আমি এটা উপহার দিই।

চকোলেট হাতে নিতেই মা বলে উঠল, আঙ্কলকে থ্যাঙ্কস বলো।

না না, কোনও ফর্মালিটি নয়। আঙ্কল তোয়ার গাল টিপে দিল, খুশি তো?

তোয়া ঢক করে ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ অ্যা।

কতটা? আঙ্কল দু’হাত ছড়িয়ে মাপ জানতে চাইল, অ্যাতটা? অ্যাতটা? নাকি অ্যাত্তখানি?

সিদ্ধার্থ আঙ্কলকে ভারী মজার মানুষ মনে হয়েছিল সেদিন। তোয়ার তখন ক্লাস টু। আঙ্কল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানছিল তোয়ার কতজন বন্ধু আছে স্কুলে, তাদের কী নাম, কার সঙ্গে তোয়ার বেশি ভাব, কোন কোন টিফিন তোয়ার পছন্দ, কী দেখলে ওয়াক ওঠে…

হঠাৎই এক সময়ে আঙ্কল বলল, আচ্ছা তোয়া, আমি একটা প্রবলেমে পড়েছি। কী করি বলো তো?

তোয়া চোখ ঘুরিয়ে বলেছিল, কী প্রবলেম গো?

তোমার বাবা তো চলে গেছে, তাই তোমার মা বলছে আমাকে তোমাদের সঙ্গে গিয়ে থাকতে।

তোয়া অবাক, দাদুর বাড়িতে?

না। ধরো আমরা যদি একটা ফ্ল্যাট নিই… সেখানে তুমি আমি আর তোমার মা শুধু থাকব…। কথাটা বলে একটু যেন অপেক্ষা করল আঙ্কল। ফের বলল, কী গো, আমাকে থাকতে দেবে তোমাদের কাছে?

ওইটুকুনি তোয়ার মনেও খটকা জেগেছিল। পটাং করে জিজ্ঞেস করে বসল, তুমি কি মাকে বিয়ে করছ?

ধরো যদি করি? শুধু আমরা তিনজনই থাকব। বেড়াব, খেলব, হইহই করব… সিনটা ছিঁড়ে গেল। সেই তিনজনের মাঝে এবার চতুর্থজন ঢুকবে, এ কি এক ধরনের চুক্তিভঙ্গ নয়?

তোয়া ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল। বাপ-মায়ের টাইপটাই এই। নিজেরাই ভাল ভাল কথা সাজিয়ে চুক্তিপত্র বানায়, আবার নিজেরাই অগ্রাহ্য করে অবলীলায়। তার জন্মদাতা পিতাটিও তাকে ছেড়ে থাকতে হচ্ছে বলে গলা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে কত কী বলেছিল, এখন মাসে দু’মাসে দেখা হয়, এবং সেও প্রায় কেজো সাক্ষাত্কার।

ঘরে তৃষিতা ঢুকছে। তোয়া ধড়মড়িয়ে উঠে বসল বিছানায়। গলা ঠান্ডা রেখে জিজ্ঞেস করল, বলবে কিছু?

হুঁ। তৃষিতা বিছানায় বসল, তোর সঙ্গে কিছু জরুরি কথা ছিল।

উঁহু, কথা নয়। বলো অর্ডার।

আহ, তোয়া! তৃষিতার স্বরে চাপা ভর্ৎসনা। মেয়ের কাঁধে আলতো হাত রেখে বলল, তোর আচরণটা কিন্তু ঠিক হয়নি তোয়া। আই অ্যাম অ্যাশেমড।

বুঝে শুনেও তোয়া কাঁধ ঝাঁকাল, কেন? কী করেছি আমি?

এত নির্বোধ তো তুমি নও, যে আমাকে ব্যাখ্যান করতে হবে।

তোয়া সামান্য গুটিয়ে গেল। গোঁজ মুখে বলল, আমার যা মনে হয় সেটা বলতে পারব না?

তোর মনে হওয়াটা কিন্তু বাপিকে খুব হার্ট করেছে। ইনফ্যাক্ট, আমাকেও। বাপি তোকে এত ভালবাসা দেয়, তার ভাল লাগা মন্দ লাগাটা তুই একবার ভাববি না?

আমি অত চিন্তা করে বলিনি। আমার অসুবিধেটা শুধু জানিয়েছি।

হোক না অসুবিধে। মানিয়ে নিবি। তুই না আমার ভাল মেয়ে! লক্ষ্মী মেয়ে! তৃষিতা তোয়াকে কাছে টানল, সিচুয়েশানটা একবার ভাব। ছেলেটার কলেজ তার বাবার ফ্ল্যাট থেকে মাত্র দু’-তিন কিলোমিটার দূরে। সেই ফ্ল্যাট সাইজেও খুব ছোট নয়। এমন অবস্থায় কী করা উচিত?

আমি কী বলব? সিচুয়েশান কি আমি তৈরি করেছি?

এ তো রাগের কথা। …শোন, ছেলেটাকে এখানে রাখার প্রস্তাব তোর বাপির নয়, আমার। তৃষিতা মেয়ের চোখে চোখ রাখল, ভুলে যাস না, এটা সোহমেরও বাড়ি। এখানে থাকার তার ন্যায্য অধিকার আছে।

কথাটা তোয়াকে কোথায় যেন বিঁধল। তোয়াই কি তবে ফালতু? উটকো?

গলায় একটা উদাসীনভাব এনে তোয়া বলল, হ্যাঁ, সে তো বটেই। আমি বাপির কে? স্টেপ ডটারের কী বা রাইট থাকে?

ছি তোয়া। বাপিকে তুই এই চিনেছিস? এত বছর একসঙ্গে থাকার পর সে তোকে নিজের মেয়ে ছাড়া অন্য কিছু ভাবে?

এই প্রশ্নটাতেই একফালি সংশয় লুকিয়ে আছে না? কথাটা মনে হলেও তোয়া নিচুগলায় বলল, সরি। আমি ওভাবে মিন করিনি।

সরিটা তোমার বাপিকে গিয়ে বলো। মেয়ের পিঠে আলগা চাপড় দিল তৃষিতা, যাক গে, ছেলেটা এলে দয়া করে মিসবিহেভ কোরো না। করলে এটাই প্রমাণ হবে, আমি বা তোমার বাপি তোমায় কিচ্ছু শিক্ষা দিতে পারিনি।

ওফ, কত কী যে প্রমাণ করার দায় চাপছে তোয়ার ঘাড়ে। তোয়া মুহূর্তে স্থির করে নিল, সোহমের ধারেকাছেই ঘেঁষবে না। কতই তো সে মানিয়ে নিয়েছে, সোহমকেও নয় সহ্য করে নেবে। অপ্রয়োজনীয় আসবাবের মতো।

তৃষিতা উঠে পড়ছিল। আবার কী ভেবে বসেছে, আর একটা দরকারি কথা। পরের সোমবার থেকে ছেলেটার ক্লাস শুরু, শনিবার হয়তো এসে যাবে।

তো?

তার আগে তোর একখানা ওয়ার্ড্রোব ওঘরে চালান করে দেব।

আমার ওয়ার্ড্রোব? তোয়া হাঁ, কেন?

নইলে ছেলেটা জামাকাপড় রাখবে কোথায়। তোর ছোট ওয়ার্ড্রোবখানা তো শুধুই হাবিজাবিতে বোঝাই, ওটা খালি করে নেব।

তোয়া স্তম্ভিত। তার ছোটবেলার অজস্র উপহার, পুরনো জামাকাপড়, একসময়ের প্রাণের চেয়ে প্রিয় বার্বিডলের সেট, আরও কত মন কেমন করা স্মৃতি ঠাসা আছে ওখানে। মা কিনা অনায়াসে সেগুলোকে জঞ্জাল বলে দিল?

ভার গলায় তোয়া বলল, জিনিসগুলো যাবে কোথায়?

দেখছি কোথায় কী ঢোকানো যায়। একেবারে বাতিলগুলো নয় লফ্‌টে তুলে দেব।

পলকের জন্য তোয়ার মনে হল, এবার তোয়াকে না লফ্‌টে আশ্রয় নিতে হয়। মা যা আদিখ্যেতা আরম্ভ করেছে, সবই সম্ভব।

তৃষিতা হাই তুলতে তুলতে চলে গেছে। তোয়া ভেবে পাচ্ছিল না, মা হঠাৎ সোহম নামের ছেলেটার জন্য এত উতলা হয়ে পড়ল কেন? তোয়া পছন্দ করছে না জেনেও? আদর্শ দয়ালু সৎমার ইমেজ তৈরির বাসনা? যেমনটা বানিয়েছে বাপি, তোয়ার জন্যে?

বাইরে মেঘ ডাকছে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হল। শ্রাবণের ধারা। তোয়া বৃষ্টির শব্দ শুনছিল। মনটা আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছিল তোয়ার।

.

০২.

আট নম্বর প্ল্যাটফর্মের কোণের স্টলটায় দাঁড়িয়ে একটা কফি চাইল সিদ্ধার্থ। গলা ভেজানোও হবে, সময়ও কাটবে। এই বিশ্রী ভ্যাদভ্যাদে গরমে পিলপিলে ভিড়ের মাঝে কিছু একটা না করলে চলে? ট্রেনটাও যা ঝোলাচ্ছে। সওয়া পাঁচটায় নাকি ইন করার কথা, সাড়ে পাঁচটা পেরিয়ে গেল, এখনও তো ডাউন কৃষ্ণনগরটির দর্শন নেই। ঘণ্টাখানেক আগে অফিস থেকে ফোন করেছিল, লাল্টু তখন বলল ট্রেন কল্যাণী পেরিয়ে গেছে। পাছে শেয়ালদা পৌঁছে লাল্টুকে অপেক্ষা করতে হয়, হাঁকপাক করে বেরিয়ে পড়েছিল সিদ্ধার্থ। এখন পড়েছে গেরোয়। ছেলের প্রতীক্ষায় বাপের কোমর ধরে গেল।

আজ স্টেশনে আসা নিয়ে কিঞ্চিৎ দ্বিধা ছিল সিদ্ধার্থর। ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি না দেখায়। লাল্টু তো এসেওছে আগে, শেয়ালদা থেকে ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাওয়াটা তার পক্ষে কী এমন কঠিন কাজ হত। কিন্তু তৃষিতা পুরো উলটো গাইল যে। ছেলেটার সঙ্গে লটবহর থাকবে, ওই নিয়ে ট্যাক্সির লাইনে দাঁড়ানোর কোনও মানে হয় না, তা ছাড়া ছেলে বাবার কাছে থাকতে আসছে, তাকে রিসিভ করতে হাজির থাকা নাকি সিদ্ধার্থর কর্তব্য…!

যুক্তির দিক দিয়ে তেমন জোরালো নয়, তবু তৃষিতার মুখ থেকে শুনতে ভালই লেগেছিল। স্রেফ সিদ্ধার্থকে খুশি করার জন্য বলেনি নিশ্চয়ই, সম্ভবত মন থেকেই…। নাহ, তৃষিতা তাকে অবাক করে দিচ্ছে। যে তৃষিতা আগে কখনও বলেনি ছেলেটা মামারবাড়িতে পড়ে আছে কেন, আমাদের কাছে এনে রাখো, সেই তৃষিতাই যেচে লাল্টুকে ফ্ল্যাটে স্থান দিতে উৎসাহী, আস্ত একখানা ঘর সাজিয়ে দিল…। সত্যি, কাছের লোকের মনেও যে কত অচেনা কুঠুরি লুকিয়ে থাকে!

কফি নেওয়ার জন্য ডাকছে স্টলের লোকটা। কাগজের কাপখানা হাতে নিল সিদ্ধার্থ। ঠোঁটে ছুঁইয়েই বিকৃত হয়ে গেছে মুখ। নামেই কফি, এক মিলিগ্রামও দিয়েছে কি না সন্দেহ, স্রেফ গুঁড়ো দুধে চিনি গোলা গরম শরবত। ইদানীং রক্তে শর্করার মাত্রা বিপদসীমার আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। অফিসে চিনি বিহীন কালো কফিই খায়। এখন এই কিটকিটে মিষ্টি গিলে ক্যালোরি ইনটেক অনেকটা চড়ে গেল না তো?

একটা ট্রেন ঢুকছে সাত নম্বরে। কৃষ্ণনগর লোকাল নাকি? মনে হতেই কাপটা ড্রামে ফেলে দিয়ে সিদ্ধার্থ টানটান। ওফ, লোক বেরোচ্ছেও বটে, ছারপোকার মতো। একঝাঁক নামার আগেই আর একঝাঁক উঠছে গুঁতিয়ে গাঁতিয়ে। মানুষ যে আর মানুষ নেই, প্রায় জন্তুর পর্যায়ে নেমে এসেছে, এসব স্টেশন চত্বরে এলে তা হাড়ে হাড়ে মালুম হয়। মহিলা বাচ্চা বুড়ো মানামানির বালাই নেই, যে যাকে পারছে ধাক্কাচ্ছে… এদের সঙ্গে লড়াই করে ঠিকঠাক নামতে পারবে তো লাল্টু? কোথায় সে অপেক্ষা করছে, জানিয়েছে বটে। তবু ছেলেটা খুঁজে পাবে তো?

পকেটে মোবাইল বাজছে। তৃষিতা? এর মধ্যে দু’দফা খোঁজ নেওয়া হয়ে গেছে, এখন কি তৃতীয়বার?

নাহ, অফিসের সুনীত। কোলাহল রুখতে একটা হাত কানে চেপে অন্য কানে মোবাইল ধরল সিদ্ধার্থ, বলো কী ব্যাপার? ড্রয়িংটা কমপ্লিট করেছ?

হ্যাঁ স্যার। এবার কি স্ক্যান করে মেলে পাঠিয়ে দেব গুপ্তাদের?

না না, অত আঠা দেখিয়ো না। ফোনে জানিয়ে দাও, ওদের কেউ অফিসে এসে দেখে যাক। আগে স্যাটিসফায়েড হোক, ফাইনাল কন্ট্র্যাক্ট সাইন করুক, তারপর তো…

ও-কে স্যার। ওরা কী বলে জানাচ্ছি।

এখন আর আমাকে রিং করার দরকার নেই। জাস্ট একটা মেসেজ দিয়ো।

ফোন অফ করে সিদ্ধার্থ কাজটার কথা ভাবল একটু। নরেন্দ্রপুরে একটা শপিংমলের ডিজাইন করতে দিয়েছে গুপ্তা কন্সট্রাকশান। খুবই ছেঁচড়া পার্টি। আগে একটা ছোট কাজ করিয়েছিল, পেমেন্ট নিয়ে বহুৎ ভুগিয়েছে। এ কাজটা অবশ্য বড়। তবে মার্কেটের খবর, আরও দু’-চারটে আর্কিটেকচারাল ফার্মের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে গুপ্তারা। সিদ্ধার্থদের পরিশ্রমটা না শেষে পণ্ডশ্রম হয়। নাম কা ওয়াস্তে কিছু অ্যাডভান্স ছুঁইয়ে রেখেছে বটে, তবে না আঁচালে বিশ্বাস নেই। দেখছে তো লাইনটা, যা দু’নম্বরিতে ভরে যাচ্ছে দিনকে দিন। স্থাপত্যবিদ্যার দন্ত-স’ও জানে না, অবলীলায় বিদেশি ডিজাইন নকল করছে, তারাও এখন আর্কিটেক্ট। তাই মাথা ঘামিয়ে নতুন কিছু করতে এক একটা সময়ে যা বিরক্ত লাগে।

পিঠে হঠাৎ আলগা হাতের ছোঁয়া। ঘুরে তাকাতেই সিদ্ধার্থর দু’চোখে খুশির আলো। লাল্টু এসে গেছে। কাঁধে একটা বড়সড় কিটসব্যাগ, হাতে ট্রলি সুটকেস।

একটু লাজুক লাজুক মুখে লাল্টু বলল, অনেকক্ষণ ওয়েট করছ?

ওই একটু। তেমন কিছু না। ছেলের কাঁধে মৃদু চাপ দিল সিদ্ধার্থ, ট্রেনে কোনও অসুবিধে হয়নি তো?

না। জানলার ধারে সিট পেয়েছিলাম।

বাহ, আয় আমার সঙ্গে।

ছেলেকে পাশে নিয়ে পার্কিংলটে এল সিদ্ধার্থ। ডিকিতে মালপত্র রেখে সামনের সিটে বসেছে পাশাপাশি। ছেলেকে বলল, বেল্টটা লাগিয়ে নে। পুলিশ ঝামেলা করে।

সিটবেল্ট বাঁধতে গিয়ে একটু যেন ফাঁপরে পড়েছে লাল্টু। খানিক কসরত করে আটকেছে খাপে খাপে। অপাঙ্গে তাকে দেখছিল সিদ্ধার্থ। লাল্টুর পরনে জিন্‌স আর হাফশার্ট। নীল চেক চেক শার্টখানা সিদ্ধার্থই কিনে দিয়েছিল না?

গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে সিদ্ধার্থ খুশি খুশি মুখে বলল, তা ও বাড়ির কী সমাচার? দিদা ভাল আছে?

মন্দের ভাল।

এখন তো বর্ষা চলছে, হাঁপের টান নিশ্চয়ই নেই?

আছে। কম।

অ্যাজ়মা রোগীর আসল বিপদ তো সিজ়ন চেঞ্জের সময়ে। ওই সময়টাতেই তো উনি বেশি কষ্ট পান, তাই না?

মুখে শব্দ নেই, অল্প মাথা নড়ল লাল্টুর। সিদ্ধার্থর মনে পড়ল বর্ণালিরও ফুসফুসটা কমজোরি ছিল। বিয়ের পর পরই বোঝা যায়নি, তবে বছর ঘোরার আগেই শ্বাসকষ্টের উপদ্রবটা শুরু হয়। গোড়ার ওই ক’টা মাসই যা হাসিখুশি ছিল বর্ণালি। তারপরই তো ভর করল বিষাদ রোগ। সিদ্ধার্থ ভেবেছিল বাচ্চাকাচ্চা হয়ে গেলে, ফুসফুস না সারুক, মনের অসুখটা হয়তো ঘুচবে বর্ণালির। কোথায় কী, লাল্টুর জন্মের পর মানসিক অবসাদ আরও যেন বেড়ে গেল। কী যে বিচ্ছিরি একটা পরিণতি হল শেষমেশ!

অস্বস্তিকর চিন্তাটাকে হঠাতে চাইল সিদ্ধার্থ। আলগাভাবে প্রশ্ন করল, তোর বড়মামার ব্যাবসা এখন কেমন চলছে?

ওই একরকম।

এখনও জমল না? অত ভাল পজিশানে ওষুধের দোকান… কোতোয়ালির একেবারে দোরগোড়ায়…? ওখানে তো মেডিকাল স্টোর্স রমরমিয়ে চলা উচিত।

তা ঠিক। তবে কিনা…

লাল্টু থেমে গেল বটে, কিন্তু জবাবটা পড়ে ফেলল সিদ্ধার্থ। হেমন্ত সরকার তার রুটিনটি বদলায়নি। তার আড্ডা, বন্ধুদের সঙ্গে দাবার বোর্ডে গিয়ে বসা, দুপুরে ঘুম, পুকুরে ছিপ ফেলা, সবই বুঝি চলছে পুরোদমে।

ছিপ কাঁধে হেমন্তর আপ্লুত বদনটি স্মরণ করতে করতে সিদ্ধার্থ মুখ টিপে হাসছে। বলল, তোর বড়মামার মতো মানুষরাই সুখী, বুঝলি। আমরা বোকার হদ্দ, দিনরাত, খেটে মরি।

মুখখানা সামান্য হাসি হাসি হল লাল্টুর। যেন বুঝতে পারছে না এ কথার পিঠে কী বলাটা শোভন হবে।

শেয়ালদা পেরিয়ে বেলেঘাটার রাস্তা ধরল সিদ্ধার্থ। শেষবিকেলে কলকাতার পথ এখন জ্যামজমাট, দু’পা এগোতে হোঁচট খাচ্ছে গাড়ি। তাতটাও আজ বেড়েছে খুব। পর পর দু’দিন বৃষ্টি নেই, আকাশ ঘোলাটে, হাওয়াও বইছে না। জানলার কাচ বন্ধ করে সিদ্ধার্থ এসি চালিয়ে দিল। টেরিয়ে ছেলেকে জিজ্ঞেস করল, কী রে, এবার একটু আরাম হচ্ছে?

হ্যাঁ। বলেই বুঝি তাড়াতাড়ি নিজেকে শুধরে নিল লাল্টু, আমার কিন্তু অসুবিধে হচ্ছিল না।

ওরে, অসুবিধে না হওয়া আর তারিয়ে তারিয়ে সুখ উপভোগ করা, দুটো সম্পূর্ণ আলাদা। কলকাতায় এসেছিস, এবার একটু-আধটু আরাম করতে শেখ।

বাইরের হাওয়ায় কি আরাম কম হয় বাবা?

শোনো কথা! ওই ধুলো ধোঁয়া ক্যাচরম্যাচর বুঝি তোর ভাল লাগছিল?

মন্দ কী। আমার তো অভ্যেস আছে।

কোনও সূক্ষ্ম অনুযোগ জানাল কি লাল্টু? সে যে অন্য কোনও ধরনের জীবন পায়নি, অথচ সেটা তার প্রাপ্য ছিল, বোঝাতে চাইল না তো? এখন থেকে তো সে যথেষ্ট মহার্ঘ পরিবেশেই থাকবে, আটতলার জানলা দিয়ে দেখতে শিখবে পৃথিবীটাকে, মনে যদি আপশোস থাকেও তা কি ঘুচে যাবে না ক্রমশ?

লাল্টুর মোবাইল বাজছে। তাড়াতাড়ি ফোন বার করে লাল্টু কানে চাপল। কথা বলছে নিচুস্বরে। গাড়ি চালাতে চালাতে টুকরো টুকরো ধ্বনি শুনতে পাচ্ছিল সিদ্ধার্থ। হ্যাঁ… হ্যাঁ… না… না… আচ্ছা… আচ্ছা…

ছেলেটা এত কম কথা বলে কেন? শুধু আজ বলে নয়, কৃষ্ণনগরে গিয়েও সিদ্ধার্থ দেখেছে, তিনটে প্রশ্ন করলে একটার জবাব দেয়। এই যে তার পাশে বসে আছে এতক্ষণ, নিজে থেকে একটা শব্দও উচ্চারণ করেছে?

না না, এত মুখচোরা থাকাটা ভাল নয়। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়তে যাবে, সেখানে তো বন্ধুরা চাঁটা মেরে পাগল করে দেবে। তৃষিতা তোয়ারাও অন্য অর্থ করতে পারে এই নীরবতার।

ছেলেকে সপ্রতিভ করতেই বুঝি খোঁচাল সিদ্ধার্থ, কার ফোন ছিল রে? তোর কোনও বন্ধু টন্ধু?

না। ছোটমামা।

বলিস কী রে? তার দায়িত্বজ্ঞান তো খুব বেড়েছে? আজকাল কী করছে জয়ন্ত?

যা করে। জনসেবা।

অর্থাৎ সেই নেই কাজ তো খই ভাজ? গতবার তো তাও মিউনিসিপাল ইলেকশানে কেঁদে ককিয়ে জিতেছিল, এবার তো হেরে ভূত। তার পরেও এত এনথু থাকে কী করে?

আছে তো। যার যেরকম নেচার।

আর তাদের স্বভাবের ঠেলায় বাড়ির লোকের প্রাণ ওষ্ঠাগত। বেচারা তোর ছোটমামি একা হাতে সংসার সামলাচ্ছে, চাকরি করছে, বাচ্চা মানুষ করছে…। এতই যাদের সমাজসেবার শখ, বিয়ে-থা তারা করে কেন?

জবাব নেই। লাল্টুর চোখ উইন্ডস্ক্রিনে স্থির।

সিদ্ধার্থ ফের প্রশ্ন করল, তা কী বলছিল জয়ন্ত?

ঠিক ঠিক পৌঁছেছি কিনা জিজ্ঞেস করছিল।

কেন? তোর দিদা তাড়া লাগিয়েছেন বুঝি?

হ্যাঁ। দিদার খুব মনখারাপ। বলেই লাল্টু এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। হঠাৎ উৎসাহী স্বরে বলল, এবার তো আমরা বাইপাসে পড়ছি, তাই না? ডানদিক ধরে সোজা গেলে তোমাদের ফ্ল্যাট? রাস্তার রাইট সাইডে?

সিদ্ধার্থ সামান্য থতমত খেল। একসঙ্গে এতগুলো প্রশ্ন লাল্টুর পক্ষে একেবারেই বেমানান। কৃষ্ণনগর সংক্রান্ত আলোচনা এড়াতে চাইছে কি? সেই কোন ছোট্ট থেকে ও বাড়িতে রয়েছে, সবাইকে ছেড়েছুড়ে এসে ছেলেটার নিশ্চয়ই মন ভাল নেই। এখন মামা মামি দিদা টিদার কচকচানিতে না গিয়ে ছেলেকে একটু চিয়ার আপ করতেই হবে।

গলায় একটা ফুরফুরে ভাব ফুটিয়ে সিদ্ধার্থ বলল, তোর তো দারুণ রোড-সেন্স। একবার এসেই রুটটা চিনে গেছিস?

এ আর কী এমন কঠিন?

হুঁউ?

আমি তো বলেইছিলাম তোমায় আসতে হবে না। আমি একাই পৌঁছে যাব।

কথাটাকে প্রায় লুফে নিল সিদ্ধার্থ। এবার বুঝি স্বচ্ছন্দে তৃষিতার প্রসঙ্গ তোলা যায়। আগে থেকে একটু গান গেয়ে রাখা ভাল। নিজেকে খাপ খাওয়াতে লাল্টুর তা হলে সুবিধেই হবে।

সিদ্ধার্থ কৌতুকের স্বরে বলল, না এলে আমায় রক্ষে ছিল? বাড়িতে তোর একটা মা আছে না? তারই তো হুকুম হল তোকে নিয়ে আসতে। ইনফ্যাক্ট, তুই আসবি বলে সে আজ অফিস ছুটি নিয়ে বসে আছে।

লাল্টু কি খুশি হল? না খানিক কুঁকড়ে গেল? সিদ্ধার্থ ঠিক বুঝতে পারল না। কী করলে যে ছেলে বেশ সহজ হয় ভেবে উঠতে পারছে না। কত বছর ধরে ছেলেটা দূরে দূরে, অবরে সবরে সে কৃষ্ণনগরে যায় বটে, কিন্তু নিয়মরক্ষার সেই ভিজিটে কতটুকু নৈকট্য তৈরি হয়েছে ছেলের সঙ্গে, যে এক লহমায় পড়ে ফেলবে ছেলের মনটাকে? তা বলে লাল্টু সর্বক্ষণ এরকম রামগড়ুর মার্কা মুখ করে থাকবে, এও তো চলতে পারে না। তৃষিতার তো খারাপ লাগতে পারে। পারে কেন, লাগবেই।

গলা নামিয়ে সিদ্ধার্থ ফের বলল, একটা কথা বলব? তুই কিছু মাইন্ড করবি না তো?

কী?

নতুন পরিবেশে যাচ্ছিস… নতুন মানুষজন… নিজেকে একটু অ্যাডজাস্ট করে চলিস।

লাল্টু কেমন একটা চোখে যেন তাকাল। শুকনো হেসে বলল, চিন্তাভাবনা করেই তো এসেছি বাবা। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।

আর একটা কথা। তোয়াকে তো তুই দেখেছিস। একটু খ্যাপাটে টাইপ। ওকে একটু সমঝে-বুঝে ট্যাক্‌ল করিস।

লাল্টু কী ভাবল কে জানে, উদাস দৃষ্টি মেলে দিয়েছে বাইরে।

সিদ্ধার্থ একটু ধন্দে পড়ে গেল। তোয়ার সম্পর্কে আরও কিছু বলে রাখবে কি ছেলেকে? থাক, তোয়া মনে হয় আর বিশেষ ঝামেলা পাকাবে না। মেয়েকে তৃষিতা কী ডোজ দিয়েছে কে জানে, তোয়া মোটেই আর ঘাড় ঝুলিয়ে নেই। এই তো সকালেই কার সঙ্গে মোবাইলে কথা বলতে বলতে হিহি হাসছিল। মনে তো হয় মেঘটা কেটেছে। তবে টিনএজার তো, এদের ক্ষণে ক্ষণে মুড পালটায়। তৃষিতা তো প্রায়শই বলে, বাড়িতে একটা টিনএজার মেয়ে থাকা আর পাগল কুকুর থাকা -দুটোই সমান ডেঞ্জারাস। কখন কামড়াবে, কখন গাল চাটবে, তার স্থিরতা নেই। লাল্টুর সঙ্গে মিসিবাবার এখন মানে মানে পটে গেলে বাঁচোয়া।

এতাল বেতাল ভাবনার মাঝে কখন যেন এসে গেছে সিদ্ধার্থদের আবাসন। স্বপনপুরী। গাড়ি সমেত সোজা বেসমেন্টে নেমে এল সিদ্ধার্থ। তারপর নিজের ল্যাপটপটি বগলদাবা করে, ছেলে আর ছেলের ব্যাগব্যাগেজ নিয়ে সোজা আটতলায়।

বেল বাজাতেই পাল্লা হাট। তৃষিতা স্মিত মুখে দরজায়। আজ তার অঙ্গে ঢোলা কাফতান নয়, ঘরোয়া সালোয়ার-কামিজও নয়, সে পরে আছে পাটভাঙা হালকা রং তাঁতের শাড়ি। কপালে ছোট্ট লাল টিপ। মধ্যচল্লিশের তৃষিতার চেহারায় দিব্য একটা মা মা ভাব।

সিদ্ধার্থর পিছনে লাল্টু। রীতিমতো জড়োসড়ো। তৃষিতাই তাকে হাত ধরে অন্দরে নিয়ে এল, এত দেরি হল যে? কখন থেকে তোমাদের জন্য ওয়েট করছি…

লাল্টু ঝুঁকে প্রণাম করল তৃষিতাকে। সংকুচিত হাসিমাখা ঠোঁটে মৃদু প্রশ্ন, আপনি ভাল আছেন?

অ্যাই, নো আপনি। আগের বারে তোমায় কী বলেছিলাম!

লাল্টুর গলা যেন আরও মিহি শোনাল, সরি। ভুল হয়ে গেছে।

এবার থেকে মাথায় রেখো। তৃষিতা নরম করে হাসল, সেই কোন বেলায় বেরিয়েছ, নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে?

তেমন কিছু নয়।

বললে মানব? মুখ তো একেবারে শুকিয়ে গেছে। তোমার বাবারই বা কী আক্কেল, বুদ্ধি করে প্যাটিজ ফ্যাটিজ কিছু তো নিয়ে যায়।

সিদ্ধার্থ অপ্রস্তুত মুখে বলল, এমন তাড়াহুড়োর মধ্যে অফিস থেকে বেরোতে হল…

লেম এক্সকিউজ়। সত্যি কথাটা বলো, মাথায় ছিল না। সিদ্ধার্থকে লঘু ধমক দিয়ে আবার লাল্টুতে ফিরেছে তৃষিতা, চলো, আগে তোমার ঘরটা দেখিয়ে দিই। এদিকের বাথরুমটায় তোয়ালে সাবান রাখা আছে, চটপট ফ্রেশ হয়ে নাও, আমি ততক্ষণ তোমার জলখাবার রেডি করি।

বেশি উচ্ছ্বাস না দেখিয়েও তৃষিতার এই যে আন্তরিক অভ্যর্থনা, এতেই যেন স্বস্তিবোধ করছিল সিদ্ধার্থ। বেশ কয়েকদিনের মানসিক প্রস্তুতি সত্ত্বেও কে জানে কেন ফ্ল্যাটের দরজায় পৌঁছে কাঠ হয়ে গিয়েছিল শরীরটা। নিজের অজান্তে ধুকপুক করছিল বুক। এবার ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে রক্তচাপ। লাল্টুকে এখন তৃষিতার হাতে সঁপে দেওয়াই যায়।

জুতোমোজা ছেড়ে সিদ্ধার্থ বেডরুমে এল। পোশাক বদলে, ঘাড়ে গলায় জল ছিটিয়ে বসল বিছানায়। সবিতা লিকার চা দিয়ে গেছে, কাপে চুমুক দিতে দিতে দরকারি ফোন সারল কয়েকটা। কান কিন্তু খাড়াই আছে। কলিংবেল বাজল, টিউটোরিয়াল থেকে ফিরল তোয়া। লাল্টুকে হাই হ্যালো করল কি? বোঝা গেল না। যাক গে যাক, তৃষিতা যখন দায়িত্ব নিয়েছে, সব কিছু বোধহয় ঠিকঠাকই চলবে।

মোটামুটি সুস্থিত চিত্তে ল্যাপটপ খুলল সিদ্ধার্থ, ইনকাম ট্যাক্সের এক হোমরা চোমরা বাড়ি বানাবে সল্টলেকে, আধাখেঁচড়া দশায় পড়ে আছে নকশাটা, ফের ধরেছে কাজটা। বেশিদূর এগোতে পারল না, তৃষিতা এসেছে ঘরে। গম্ভীর মুখে বলল, বাহ, এই না হলে বাবা! ছেলেটা সবে বাড়িতে পা রাখল, তুমি এদিকে নিজের জগতে ডুবে গেছ!

সিদ্ধার্থ হালকা গলায় বলল, তুমি একাই তো কাফি ম্যাডাম।

গ্যাস দিয়ো না। বাবারও কিছু ডিউটি থাকে স্যার। ছেলেকে একটু সঙ্গ দিতে হয়।

বলছ? সিদ্ধার্থ পলক ভাবল। তারপর চোখ কুঁচকে বলল, তোয়া কথা বলল লাল্টুর সঙ্গে?

আমার মেয়ে অত বেসহবত নয়। তৃষিতার গলায় যেন অল্প ঝাঁঝ ফুটে উঠেও মিলিয়ে গেল। সহজ স্বরে বলল, আমি তো তোমার ছেলেকে সব প্রশ্ন করতে পারি না, এক্ষুনি এক্ষুনি তা সাজেও না। তুমিই বরং জেনে নাও ইমেডিয়েটলি ওর কী কী লাগবে। তোমায় দেখলে, তোমার সঙ্গে কথা বললে, ও হয়তো অনেকটা ইজ়ি ফিল করবে।

তাই কি? সংশয় আছে সিদ্ধার্থর। তবে তৃষিতার কাছে সেটা প্রকাশ করল না। ল্যাপটপ বন্ধ করে বেরোতে গিয়েও থমকেছে। কী ভেবে পার্সখানা পুরল হাফ-পাঞ্জাবির পকেটে। তারপর পায়ে পায়ে স্টাডিরুম।

এখন তো ঘরটা লাল্টুর। সত্যি, পুরো ভোল পালটে দিয়েছে তৃষিতা। সিঙ্গল বেড খাট ঢুকিয়ে, টিভি বসিয়ে, ফুলদানি সাজিয়ে আগের সেই অবিন্যস্ত ঘরখানা যেন চেনাই যায় না। নতুন পরদা টরদা লেগে ঝকঝক করছে যেন।

খাটের বাজুতে হেলান দিয়ে কী একটা বই উলটোচ্ছিল লাল্টু। সিদ্ধার্থ ঢুকতেই সোজা হয়েছে।

সিদ্ধার্থ চেয়ার টেনে বসল, কী রে, ডেরা পছন্দ?

হুঁ।

তোর মাল টালগুলো আনলোড করেছিস? ভরলি ওয়ার্ড্রোবে?

রাতে করব।

তোর তো পরশুই কলেজ। প্রথম দিন কি যাব সঙ্গে? অনেক বাবা কিন্তু যায়।

আমার লাগবে না।

চিনে যেতে পারবি তো?

পারব।

সামনে থেকে অবশ্য অটো ছাড়ে। কলেজের নাম বললে গেটের মুখে নামিয়ে দেবে। তা ছাড়া বাসও আছে।

জানি।

কে বলল? মা?

একটু সময় নিয়ে লাল্টু জবাব দিল, না। ভরতির দিন দেখে নিয়েছি।

সিদ্ধার্থ অবাকই হল একটু। ছেলেটা সেদিন একা একাই এসেছিল কলেজে, সিদ্ধার্থ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে অ্যাডমিশান করিয়েছে। তারপরই তো এ বাড়িতে থাকার কথা তুলল সিদ্ধার্থ। স্বপনপুরীর গেট অবধি সেদিন এসেছিল লাল্টু, তবে ওপরে উঠল না, কী একটা কাজ আছে বলে নীচ থেকেই ফিরে গেল। তখনই কি রুট ফুটগুলো দেখে নিয়েছে?

সিদ্ধার্থ হেসে বলল, তা বেশ। একাই যাস তা হলে। …কিন্তু গোড়াতেই তো তোকে অনেক কিছু কিনতে হবে রে। টি-স্কোয়্যার, ভাল একখানা ড্রয়িংবোর্ড, আঁকাজোকার ইন্সট্রুমেন্ট, একটা সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটার…

তাড়া কীসের? আস্তে আস্তে হবেখন।

কয়েকটা জিনিস তো তোর এক্ষুনি দরকার। কলেজে গিয়ে প্রথম দিনই একটা লিস্ট বানিয়ে আনবি। পকেট থেকে মানিব্যাগখানা বার করল সিদ্ধার্থ। দশখানা পাঁচশো টাকার নোট বাড়িয়ে দিল ছেলেকে, আপাতত এটা রাখ। যা লাগে খরচা করবি। সবকিছু কেনা হয়তো এতে কুলোবে না, পরে আবার চেয়ে নিস। …অবশ্য বার বার তুই চাইবিই বা কেন? নেক্সট উইকে তোর সময় সুযোগমতো একদিন চল, তোর নামে একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দিই। হাতখরচ টরচ যা লাগবে, টাইম টু টাইম তুলে নিস।

নোটগুলো হাতে নিয়ে লাল্টু আবার সেই অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে। কী যেন আছে ওই দৃষ্টিটায়। ত্বক ভেদ করে অস্থি অবধি চলে যায় যেন।

সিদ্ধার্থ চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, কম্পিউটার তো ইউজ় করতে জানিস?

মোটামুটি।

গুড। এ ঘরের ডেস্কটপটা এখন থেকে শুধুই তোর। ফ্ল্যাটে ওয়াইফাই নেওয়া আছে, ইচ্ছে মতন নেট সার্ফ করতে পারবি।

চুপ করে শুনল লাল্টু। প্রতিক্রিয়া বোঝা দায়।

সিদ্ধার্থ আড্ডা জমানোর সুরে বলল, ওটা কী পড়ছিলি রে?

একটা লিটল ম্যাগাজিন। আমাদের কৃষ্ণনগরের।

তুইও কি ওসব করিস নাকি? আই মিন, লিখিস টিখিস?

তেমন বলার মতো কিছু নয়।

সিদ্ধার্থ বুঝল, চেপে যেতে চাইছে লাল্টু। তবে ছেলেটার যে অল্পস্বল্প সাহিত্য বাতিক আছে, জয়ন্ত একদিন বলেছিল। গল্প, আড্ডা টোটো করে বেড়ানোর চেয়ে ওসবে আগ্রহ থাকা ঢের ভাল।

সিদ্ধার্থ উঠে এসে আলতো হাত রাখল ছেলের কাঁধে। বাবাসুলভ গলায় বলল, পড়ছিস পড়, তবে সন্ধেবেলা এভাবে ঘরে বসে থাকিস না। কম্পিউটার ঘাঁট, টিভি দ্যাখ, ইচ্ছে হলে নীচেও ঘুরে আসতে পারিস…। প্রচুর সবুজ আছে, তোর ভাল লাগবেই। …আর একটা কথা। তুই তো এখন থেকে এ বাড়িরই মেম্বার, তোর জন্য একসেট ডোর-কি বানানো হয়েছে। মা তোকে দেবে, সাবধানে রাখিস।

লাল্টুর চোখে আবার সেই দৃষ্টি। ভাষাটা ফের পড়ার চেষ্টা করল সিদ্ধার্থ। উঁহু, পারছে না।

.

০৩.

শেষবেলায় ক্লাস চলছিল মেকানিক্সের। প্রোজেক্টার আর স্লাইড সহযোগে পড়াচ্ছে এক তরুণ অধ্যাপক। নতুন বিষয় কিছু নয়, উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠক্রমকে আর একটু বিশদভাবে ঝালিয়ে দেওয়া আর কী। একে একে আসছে কৌণিক ভরবেগ, জাড্য ভ্রামক, লম্ব ও সমান্তরাল অক্ষের উপপাদ্য, কোরিওলিস ফোর্স…। অতি দ্রুত গতিতে বদলে যাচ্ছে টপিক, যেন আজই অধ্যাপককে সিলেবাস শেষ করতে হবে।

লাল্টুর অবশ্য অসুবিধে হচ্ছিল না। সে তো শুনছেই না। তবে স্রেফ বসে থাকাটাও কম কষ্টদায়ক নয়। ভীষণ সিরিয়াস মুখ করে খান তিরিশেক ছেলেমেয়ে গিলছে লেকচার, খসখস কলম চালাচ্ছে, এই দৃশ্যও তো যথেষ্ট ক্লান্তিকর। পিরিয়ড সমাপ্তির ঘণ্টা বাজতে লাল্টু হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যাক, আজকের মতো শান্তি। এবার মানে মানে ক্যাম্পাস ছেড়ে বেরিয়ে পড়লে হয়।

কী রে, তুই নোট নিলি না যে বড়?

ব্যাগ গোছাতে গোছাতে পাশের ডেস্ক থেকে প্রশ্ন ছুড়ল দেবাঞ্জন। সবে সাত-আট দিনের পরিচয়, এরই মধ্যে লাল্টুর সঙ্গে খাতির জমেছে খানিকটা। দেবাঞ্জনের বাড়ি বেলডাঙায়, তাই হয়তো এই কলেজের ঝাঁ চকচকে পরিবেশে কৃষ্ণনগরের সোহমকে সে একটু বেশি আপন সহপাঠী বলে ভেবে নিয়েছে।

মুখে একটা হাসি হাসি ভাব ফুটিয়ে লাল্টু বলল, টুকে কী হবে?

ক্লাস নোটটা থাকলে কিন্তু সুবিধে হয়। মালটা পুরো কোয়েশ্চেন ধরে পড়াচ্ছিল। এগজ়ামে নোটখানা নামাতে পারলেই খালাস।

তা হলে দিস। তোর থেকে কপি করে নেব।

ইল্লি রে! আমি শালা খাটব, তুমি মাল ঝাপ্পুস করে দেবে?

দিস না তবে। আমি আমার মতো করে প্রিপেয়ার করব।

সেন্টু খেয়ে গেলে বস? পিঠে বসার মতো ব্যাগখানা চাপাল দেবাঞ্জন। লাল্টুর কাঁধে আলগা চাপড় মেরে বলল, চল, একবার ক্যান্টিনে যাবি তো?

তেমন ইচ্ছে না থাকলেও আপত্তি করল না লাল্টু। নিজের ব্যাগটা তুলে নিল পিঠে। এই ব্যাগগুলোয় অজস্র জিনিস ধরে, কিন্তু এ ব্যাগ মোটেই পছন্দ ছিল না লাল্টুর। স্বপনপুরীর মহিলাটি এমন জোরজার করে হাতে তুলে দিল। পথে-ঘাটে, বাসে-ট্রামে হাত দু’খানা নাকি ফ্রি থাকবে, সুবিধে হবে চলাফেরায়। ওদিকে যে ভিড়ের মাঝে আর পাঁচজন ঝোলার ঘায়ে হাঁসফাঁস করবে, সেটা যেন ধর্তব্যের বিষয়ই নয়। কে জানে, কেরিয়ার বানাতে গেলে হয়তো ওভাবেই গড়তে হয় মনটাকে। এই স্বার্থপর ব্যাগই বুঝি তার প্রথম ধাপ।

এতাল বেতাল ভাবতে ভাবতে করিডর ধরে হাঁটছিল লাল্টু। দেবাঞ্জনের পাশে পাশে। হঠাৎ একটা মেয়ের গলা -লম্বু…? অ্যাই লম্বু…?

একসঙ্গে দু’খানা ঘাড়ই ঘুরে গেল। যা ভেবেছে তাই, ছ’ফুটি দেবাঞ্জনকে ডাকছে মেয়েটা। লাল্টুদেরই ক্লাসের। বেজায় খরখরি। সেদিন একগন্ডা সিনিয়রের সঙ্গে তুমুল তর্ক করছিল। নামটা কী যেন? হ্যাঁ, মেঘনা।

লোকাট জিন্‌স, রংচঙে টিশার্ট পরা মেঘনা তুরতুরে পায়ে এগিয়ে এসেছে। ঘাড় উঁচিয়ে দেবাঞ্জনকে বলল, অ্যাই, খুব তো হুটোপুটি করে নোট নিচ্ছিলি! স্যারটা একেবারে শেষে ওটা কী বলল রে?

কোনটা?

ওই যে সিউডো ফোর্স… না কী ছাতার মাথা…

সিউডো ব্যাপারটা বুঝিস?

নাহ্।

ফান্ডা একেবারে জিরো? দেবাঞ্জন চোখের কোণ দিয়ে ইশারা করল লাল্টুকে, কী রে সোহম, এক্সপ্লেন করে দে তো।

মেয়েদের সামনে লাল্টু একেবারেই সাবলীল নয়। বাড়িতে তোয়াকে দেখলে তো আঁতকে আঁতকে সরে যায়। রাতে খাবার টেবিলে বসতেই হয় মুখোমুখি, কিন্তু ভুলেও মাথা তোলে না। বুকটা কেমন ধড়াস ধড়াস করে কিনা। এখনও খুব একটা স্বচ্ছন্দবোধ করল না, তবে ভয়ও পেল না তেমন। ছোট্ট একটা ঢোক গিলে বলল, সিউডো হল গিয়ে কোনও একটা কিছুর সদৃশ। তবে আদতে তা নয়।

ট্যান হয়ে গেল বস। ভেজায় ঢোকার মতো করে বল।

আপাত চোখে কোয়ালিটিতে মিল আছে, কিন্তু সিমিলারিটিটা এক ধরনের ধোঁকা। একটা যদি রিয়েল হয়, অন্যটা তার সিউডো। কাল্পনিক বলতে পারো। অলীক বলতে পারো। মেকিও বলতে পারো। সিদ্ধার্থর মুখখানা লাল্টুর চোখে ভেসে উঠেও মিলিয়ে গেল। সিউডো বাবা? জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, কোরিওলিস ফোর্সের ক্ষেত্রেও ওরকম হয়। ম্যাথেমেটিকালি ফোর্সের টার্মই আসে, কিন্তু আসলে ওটা অলীক বল।

হুউম। একটু একটু বোঝা গেল। মেঘনা তারিফের চোখে তাকাল, কোন স্কুল?

লাল্টুর আগে দেবাঞ্জনের মুখ চলল, সোহম কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট। আমি বেলডাঙা হাই।

আমি হাওড়া সেন্ট অ্যাগনেস।

ব্যস, বন্ধুত্ব হয়ে গেল একরকম। দেবাঞ্জন কথাবার্তায় তুখোড়, বোঝার উপায় নেই কলকাতা থেকে দুশো কিলোমিটার দূরে এক গঞ্জ মতো জায়গায় তার বাড়ি, কয়েক মিনিটের মধ্যে ঠিকুজি কুষ্টি জেনে নিল মেঘনার। মেয়েটা থাকে সাঁতরাগাছিতে, নিজেদের বাড়ি, ফ্যামিলির পয়সা আছে, দাদা শিকাগোয়, সফ্‌টওয়্যার বউদিটা দাদাকে বোধহয় আর দেশে ফিরতে দেবে না…। দেবাঞ্জন নিজের বায়োডাটাও শোনাচ্ছিল মেঘনাকে। লেকগার্ডেন্সে দিদির বাড়িতে আপাতত আছে সে, জামাইবাবু ব্যাঙ্কের অফিসার, বাড়িটায় স্পেস কম, একটা মেসটেস পেলে সে উঠে যাবে…

কথায় কথায় মেঘনাকে জিজ্ঞেস করল, তুই যে বড় সিভিল পড়ছিস? মেয়েরা তো খুব একটা এই লাইনে আসে না?

কেন? ক্লাসে আমি একাই মেয়ে নাকি?

তবু…হ্যাজ়ার্ডাস কাজ তো…। সাইটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা থাকো, গুন্ডাবদমাইশ সামলাও…

তোর মনে হচ্ছে এই লাইনে হেব্‌বি নলেজ?

আছে বই কী। আমার বাবার তো কনস্ট্রাকশানেরই বিজ়নেস। বহরমপুরে। আরে, বাবার বিজ়নেসটা চালাতে হবে বলেই না সিভিল লাইনে এসেছি।

কিন্তু সে কেন পড়ছে সিভিল? ঠোঁটে কুলুপ এঁটে দুই নতুন বন্ধুর বাক্যালাপ শুনতে শুনতে প্রশ্নটা টোকা দিল লাল্টুর ব্রেনসেলে। তার তো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ারই বাসনা ছিল না কোনওদিন। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে স্পষ্ট কোনও ধারণা ছিল না বটে, তবে মোটামুটি ধরে নিয়েছিল স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ইতি টানবে পড়াশোনায়, চাকরির পরীক্ষায় বসবে, চেষ্টা করবে স্কুলমাস্টারি গোছের কিছু যদি জুটে যায়…। আর কিছুই না পেলে বিপুলদার রাস্তা তো আছেই। ব্যাচের পর ব্যাচ শুধু টিউশ্যনি। বিয়ে-থার দিকে হাঁটবেই না, মনের মতো করে একটা পত্রিকা বার করবে, এভাবে ঘষটে ঘষটে কেটে যাবে জীবনটা।

কিন্তু সর্বনাশটা ঘটে গেল মাধ্যমিকে। এমন একটা মারকাটারি রেজাল্ট করে বসল, বড়মামা ছোটমামা তো বটেই, তার বাবা নামের দূর গ্রহের প্রাণীটিরও চক্ষু স্থির। তখন থেকেই শ্রীযুক্ত বাবা খেঁচিয়ে যাচ্ছিল মামাদের কানে, লাল্টুকে জয়েন্টে বসতে হবে, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হবে, জীবনে শাইন করতে হবে…। এমনি অবশ্য তার বাবাটিকে কোনও মামাই সুনজরে দেখে না এবং তার ন্যায্য কারণও আছে। অথচ হাইফাই জামাইবাবুর এই প্রস্তাবটি তাদের খুব মনোমতো। কোত্থেকে টাকা এল কে জানে, নির্ঘাত বাবাই পাঠাত, তাকে ভরতি করে দিল জয়েন্টের কোচিং-এ। চলতে লাগল অবিরাম ট্যাকট্যাক। সুযোগটা হেলায় হারাসনি লাল্টু, খরচাপাতি তোর বাবাই করবে, কেরিয়ারটা বানিয়ে নে!

তবু মনে মনে খানিক লড়াই করেছিল লাল্টু। আরও ভাল রেজাল্ট করতে পারত জয়েন্টে, ইচ্ছে করে তিনখানা অঙ্ক ছেড়ে এল, ফিজিক্সের জানা প্রবলেম ভুল করল খাতায়। ভেবেছিল, এতেই মোটামুটি আউট হয়ে যাবে। কিন্তু কপালের গেরো, র‍্যাঙ্ক তেমন একটা সাংঘাতিক খারাপ হল না কিছুতেই। প্রথম চার হাজারের মধ্যে আছে সে, যাদবপুর শিবপুর না জুটলেও অনেক ভাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের দরজা তার জন্যে খোলা। বাবাটাই তখন ওপরপড়া হয়ে হাজির হল কাউন্সেলিং-এ, ঘাঁতঘোত বুঝে নিয়ে ঠিক তাকে গেঁথে দিল এই কলেজটায়। সিভিল পড়ানোটাও তারই পরিকল্পনা। ছোটমামা তো বলছিল, সিদ্ধার্থদা নিজে নামী আর্কিটেক্ট, মহা মহা প্রোজেক্টের প্ল্যান বানাচ্ছে, নিজে যখন লাল্টুকে সিভিলে ঢুকিয়েছে, ছেলেকে নিশ্চয়ই দাঁড় করিয়ে দেবে!

অতএব পাকেচক্রে লাল্টুর জীবনের অভিমুখটাই কেমন ঘুরে গেল! কিছু একটা না হওয়া পর্যন্ত তার বুঝি আর ছাড়ান নেই। যতই অখাদ্য লাগুক, এই সাবজেক্টটাই…

অ্যাই, ভাবলুশ মেরে গেলি কেন? দেবাঞ্জন ঠেলছে লাল্টুকে, আমাদের কথা শুনছিস? না, শুনছিস না?

লাল্টুর দূরমনস্কতা মুছে গেল। হেসে একটু বাড়তি জোর দিয়ে বলল, সব শুনছি।

তা হলে কমেন্ট করছিল না যে বড়? আমরা এত কিছু নিয়ে ডিসকাস করছি…

কী বলব?

যা মনে আসে। মেঘনা ঠোঁট উলটোল, তুই তো দেখি কথাই বলিস না?

কন্সটিপেশান কেস। দেবাঞ্জন চোখ টিপল, ডুশ না দিলে কিচ্ছুটি বেরোয় না। ফিউচারে কী করবি জিজ্ঞেস করলে হাই তোলে, ভাবতে পারিস?

ভেতরে কিন্তু বহুৎ ফান্ডা। সিউডো মিউডো সব জানে।

বলেই গা কাঁপিয়ে হিহি হাসছে মেঘনা। দেবাঞ্জনও। মোবাইলে সময় দেখে নিয়ে দেবাঞ্জন বলল, কাঁহাতক আর শুকনো গলায় বাতচিৎ চলে। চল, ক্যান্টিনে গিয়েই গ্যাঁজাই।

ওমনি মেঘনা হাঁ হাঁ করে উঠেছে, মাথা খারাপ? আজ ওইদিক মাড়াস না।

কেন?

কিছুই খবর রাখিস না তোরা? আজ সকালে ফার্স্ট ইয়ার মেকানিকালের একটা ছেলেকে থার্ড ইয়ারের দুই পাবলিক খুব রগড়েছে। ওই ক্যান্টিনেই। কী একটা গান গাইতে বলেছিল, ছেলেটা রাজি হয়নি, ওমনি সপাটে চড়। ছেলেটাও তেমনি টেঁটিয়া, চুকলি গেয়ে এসেছে প্রিন্সিপালকে। ছেলে দুটো জব্বর ধাতানি খেয়েছে আজ। তবে প্রিন্সিপালও তো জানে, সর্বক্ষণ ফার্স্ট ইয়ারকে পাহারা দিতে পারবে না, তাই বলে দিয়েছে নবাগতরা যেন ফ্রেশার্স ওয়েলকাম না হওয়া পর্যন্ত ক্যান্টিন এড়িয়ে চলে।

যাহ, বোঝো ঠেলা। ফ্রেশার্স ওয়েলকাম মানে নেক্সট ফ্রাইডে?

হুঁ। তদ্দিন কলেজের খোলা জায়গায় চরে বেড়াও, বাট নো ক্যান্টিন।

তা হলে এখন কী করা যায়?

বাড়ি।

এত তাড়াতাড়ি? সবে সওয়া চারটে? দেবাঞ্জন ভুরু নাচাল,— আমরা সামনের মলটায় যেতে পারি।

শপিংমলে গিয়ে কী করবি?

ফুডকোর্টে আড্ডা। ভাবছি একটা স্নিকারও কিনব…

একটু ভাবল মেঘনা। তারপর রাজি হয়ে গেল। তবে লাল্টুর এতটুকু ইচ্ছে নেই। বেশি চোখ ধাঁধানো আবহ তার ভাল লাগে না। যতই জৌলুস থাক, ভেতরের ওই কোলাহল তার কেমন সিন্থেটিক মনে হয়। গত রোববার এমনিই ঘুরতে ঘুরতে গিয়েছিল, পালিয়ে এসে বেঁচেছে।

হাঁটতে হাঁটতে কলেজগেটে চলে এসেছে তিনজন। লাল্টু সামান্য ইতস্তত করে বলল, না রে, তোরাই যা। আমাকে এখন ফিরতে হবে।

কেন রে? এক-দু’ঘণ্টা বিন্দাস আড্ডা মারতাম।

আজ নয় রে। অন্য কোনওদিন। আমার একটু কাজ আছে।

কোথায় যেন থাকিস তুই?

কাছেই স্বপনপুরী হাউজ়িং-এ।

কে থাকে ওখানে? মেঘনা জিজ্ঞেস করল, কোনও রিলেটিভ?

হ্যাঁ, ওই রকমই।

সংক্ষিপ্ত জবাবটুকু দিয়ে একটু সিঁটিয়ে রইল লাল্টু। মেঘনার যা কৌতূহল, এক্ষুনি না রিলেটিভের ডিটেল জানতে চায়। মিথ্যে তো বলতে পারবে না, মিছিমিছি অস্বস্তি বাড়বে। বাবা থাকে স্বপনপুরীতে, ছেলের বাড়ি কৃষ্ণনগর —এটাই কি যথেষ্ট খোরাক নয়?

তা এই জটিলতা তো লাল্টুর বানানো নয়। সুতরাং কে কী ভাববে, তা নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলত লাল্টুর। তবে লাল্টুর যা ধাত, তাতে এটা বোধহয় সম্ভবই নয়। এক একটা শৈশব, কৈশোর মানুষকে এক একভাবে বুনে দেয়, নয় কি?

নাহ, ভাবনা নেই লাল্টুর। নতুন সহপাঠীরা এখন আধুনিক বাজারে যাওয়ার উত্তেজনায় বিভোর। লাল্টুকে টা টা করে রাস্তার ওপারে চলে গেল দু’জনে। ধরে নিয়েছে চলন্ত অটো।

পায়ে পায়ে বাসস্টপের দিকে এগোচ্ছিল লাল্টু। ঊর্ধ্বপানে তাকিয়ে। আকাশে আজ ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ, অনেকটা শরতের মতো। মেঘের ফাঁক দিয়ে নামছে হলদে আলো, ছড়িয়ে পড়ছে মাঠ ঘাটে, উঁচু উঁচু অট্টালিকায়। বড় নরম হলুদ, ভারী মায়াবী। দু’চোখ টেনে নেয়।

রাস্তা না দেখে চললে যা হয়, হঠাৎই বিচ্ছিরি হোঁচট। হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তেও লাল্টু কোনওমতে সামনে নিল। দৃষ্টি গেছে জুতোটায়। বেশ বেহাল দশা, মুখখানা হাঁ হয়ে গেছে, সোল এবার খুলল বলে। ওমনি লাল্টুর মনে হল, দেবাঞ্জনদের সঙ্গে গেলে হত। মল থেকে নয় সেও একটা স্নিকার কিনে নিত। অনেক দাম পড়বে? কম করে দেড় হাজার তো বটেই। একজোড়া জুতোর পিছনে অত খরচা করা কি ঠিক? তবে টাকা এখন সমস্যাই নয়, তার মানিব্যাগেই তো এখনও হাজার তিনেক মজুত। কেনাকাটার পর ছিল কিছু, বাবা ফের এককাঁড়ি দিল…। এ ছাড়া এবার তো তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও হয়েছে। সেখানে করকরে কুড়ি হাজার…।

উফ, ভাবতেই পারে না লাল্টু। রাশি রাশি টাকা যেন আসমান থেকে ঝরে পড়ছে লাল্টুর ঝাঁপিতে। এমন একটা আশ্চর্য সময় তো লাল্টুর কল্পনারও অতীত ছিল। একেই কি স্বাচ্ছন্দ্য বলে? কী ধরনের স্বাচ্ছন্দ্য? রিয়েল? না সিউডো? যদি রিয়েলই হবে, এতদিন ছিল কোথায়? যদি সিউডো হয়, কবে উবে যাবে?

নাহ, ফালতু ভাবনা দূরে থাক। আজেবাজে খরচারও দরকার নেই। একদিন নয় শেয়ালদা গিয়ে সস্তা দামের কিছু একটা কিনে নেবে লাল্টু।

সিদ্ধান্তটা নিয়ে লাল্টু যেন মনে মনে আরাম পেল একটু। একটা বাস আসছে, উঠে পড়ল। মাত্র তিনটে তো স্টপ, তেমন একটা ভিড়ও নেই, অটোর চেয়ে এটাই ঢের ভাল।

স্বপনপুরীর গেটে এসে লাল্টু থামল ক্ষণেক। এক্ষুনি ঢুকবে খাঁচায়? হ্যাঁ, ফ্ল্যাটখানা খাঁচা ছাড়া আর কী! কৃষ্ণনগরের বাড়ি মোটেই প্রকাণ্ড নয়, তবু কেমন হাত-পা খেলিয়ে থাকা যেত, এখানে কি তার জো আছে? নিজের ঘরটুকুর বাইরে বেরোনোর সাহস হয় না, পা আটকে যায়। তবু যেতে তো হবেই। সবিতামাসি আজ দুপুরে ছেলেকে দেখতে সোনারপুর যাবে বলছিল, ফিরেছে কি? এদিকে জিভ তো চা চাইছে। প্রবলভাবে। নিজেই অবশ্য সে করে নিতে পারে, কৃষ্ণনগরে তো হরবখতই বানাত, তবে এ বাড়ির রান্নাঘরে দুম করে ঢুকে পড়াটা বোধহয় সমীচীন নয়। তার ওপর তোয়া মেয়েটা যদি স্কুল থেকে চলে এসে থাকে…! তার কি আজ টিউটোরিয়াল… থাকলে সন্ধে অবধি লাল্টু নিশ্চিন্ত।

দূর, এত সাত সতেরো গণনার দরকারটা কী? অল্প দূরেই চায়ের স্টল, লাল্টু সটান সেখানে হাজির। খুবই মামুলি দোকান। অস্থায়ী চালা, মাঝারি একখানা স্টোভ জ্বলছে, খান তিনেক বেঞ্চ আর টেবিল ঠেসেঠুসে সাজানো। রাস্তা চওড়ার কাজ চলছে, কুলিকামিনরাই দোকানটায় ভিড় জমায় বেশি।

দোকান চালাচ্ছে এক মহিলা। তাকে চায়ের অর্ডার দিয়ে লাল্টু বেঞ্চিতে বসল। সামনে চলমান গাড়ির স্রোত, দেখছে উদাসীন চোখে।

তখনই এক ঘড়ঘড়ে গলা, এই যে ভাই, একটু মেরে বসুন তো।

তাড়াতাড়ি খানিকটা সরে গেল লাল্টু। গাঁট্টাগোট্টা বছর পঁয়তাল্লিশের লোকটা বসে পড়ল ধপ করে। মাথার হেলমেটখানা রাখল টেবিলে। চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বলল, একটা চা বানাও তো। কড়া করে।… এক প্যাকেট সিগারেটও দাও। ওই কিং সাইজ়টা।

প্যাকেটখানা হাতে পাওয়ামাত্র খুলে ধরিয়ে ফেলেছে একটা সিগারেট। গলগল ধোঁয়ায় লাল্টুকে ভাসিয়ে দিয়ে ফের হাঁক, খাবার দাবার আছে কিছু? বাটার টোস্ট হবে?

বাটার নেই বাবু। ঘুগনি করেছিলাম…

ওই বদখত মালটা? তাই দাও এক প্লেট। পাঁউরুটিটা একটু ভাল করে সেঁকো। বলতে বলতে আপন মনে বিড়বিড় করছে, শালা এমন একটা জায়গায় কাজ… কাছাকাছি একটা ভদ্রস্থ দোকান পর্যন্ত নেই।

বিচ্ছিরিরকম তেতে আছে লোকটা। লাল্টুর একটু একটু কৌতূহল হচ্ছিল। মহিলা চা রেখে গেছে, গ্লাসে চুমুক দিয়ে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল, আপনি বুঝি এই রাস্তা তৈরির কাজে যুক্ত?

ঘাড় বেঁকিয়ে লাল্টুকে একবার দেখল লোকটা। বিদ্রূপের স্বরে বলল, নইলে কি বাপের শ্রাদ্ধ করতে এসেছি?

লাল্টু গলা আরও মিহি করে বলল, খুব খাটুনি যাচ্ছে, তাই না?

শালার লেবার সামলানো কি কম ঝকমারি! হারামজাদাগুলো কামচোরের হদ্দ, পাছায় লাথ না কষালে একঝুড়ি মাটিও সরাবে না। ওদের পিছনে চেঁচাতে চেঁচাতে তো জান কয়লা।

আপনি বুঝি গোটা কাজটা সুপারভাইজ় করছেন?

আজ্ঞে না স্যার, আমিই কন্ট্রাক্টার। দস্তুরমতো সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ডিগ্রি আছে। গভর্নমেন্টের লিস্টে আছি।

তা নিজে এত ঝক্কি নিচ্ছেন কেন? লেবার খাটানোর লোক রেখে দিলেই তো পারেন।

তবে আর দেখতে হবে না। আমার ইয়ে মেরে ফাঁক করে দেবে। বলে লোকটা খ্যাকখ্যাক হাসছে। গলাটা মধুর হল হঠাৎ, আরে ভাই, অফিস সাজিয়ে বসে থাকলে আমাদের লাইনে পয়সা আসে? মেহনত করতে হয়। শালার ঘাম নিংড়ে টাকা কামাতে হয়।

বোঝাই যায়, লোকটা অতি বাস্তববোধসম্পন্ন। এবং ঘোরতর অমার্জিত। আরও দুটো-একটা সংলাপের পর রীতিমতো গা গুলিয়ে উঠল লাল্টুর। চটপট চায়ের পয়সা মিটিয়ে বেরিয়ে এসেছে। খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে বড় করে শ্বাস ফেলল একটা। এইরকম একটা স্যাম্পেলে পরিণত হওয়াই কি তার নিয়তি? বাবা তাকে ওই দিকেই ঠেলছে কি? বাঁচার স্পৃহাটাই না শেষমেষ মরে যায়। হয়তো তখন লাল্টু মায়ের মতোই…!

লাল্টু কষে ধমকাল নিজেকে। কতবার না সে স্থির করেছে মা’র দুঃসহ প্রসঙ্গটা সে আর কদাচ মনের কোণে ঠাঁই দেবে না! তবু কেন যে বশে থাকে না মস্তিষ্ক? জোরে পা চালিয়ে লাল্টু স্বপনপুরীতে ঢুকে পড়ল। নরম বিকেলে নীচে একটু হাঁটবে ভেবেছিল, ইচ্ছেটা মরে গেছে। লিফ্‌ট ধরে আটতলায় এল। আস্তে করে টিপছে ডোরবেল।

কোনও সাড়াশব্দ নেই। বাড়ি ফাঁকা! লিটার খানেক বাড়তি অক্সিজেন পেল যেন লাল্টুর ফুসফুস। নিজের চাবি দিয়ে দরজা খুলে প্রবেশ করল অন্দরে। শূন্য ফ্ল্যাটে এই তার প্রথম পদার্পণ।

নির্জনতার একটা নিজস্ব গন্ধ আছে, যা শুধু লাল্টুই পায়। তার ভাঙাচোরা শৈশবই বুঝি চিনিয়েছে গন্ধটা। লিভিংরুমের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে একটুক্ষণ ঘ্রাণটুকু নিল লাল্টু। তারপর দূর থেকে একবার তাকাল তোয়ার দরজার পানে। একটু উঁকি দেবে কি? দেখবে কেমনভাবে থাকে ওই আহ্লাদি মেয়েটা?

অশোভন ভাবনাটাকে লাল্টু প্রশ্রয় দিল না। মন্থর পায়ে এল নিজের ঘরে। প্যান্টশার্ট বদলাল না, গড়িয়ে পড়েছে বিছানায়। মিনিট পনেরো শুয়ে রইল মড়ার মতো। তারপর উঠেছে। যন্ত্রের মতো ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। শেষ বিকেলের অপরূপ শোভা যেন তাকে ছুঁলই না, আবার ফিরেছে ঘরে। ঝুম বসে আছে খাটে।

হঠাৎই লাল্টুর চোখ মেঝেতে স্থির। একরাশ লাল পিঁপড়ে চলেছে সারবেঁধে। কোত্থেকে এল? কেন এল? মৃত্যুর গন্ধ পেয়েছে নাকি?

ওমনি একটা পুরনো দৃশ্য হাতুড়ি মারল ব্রহ্মতালুতে। মাটিতে পড়ে আছে লাল্টুর মা, হাতের শিরা বেয়ে নেমেছে রক্তের ধারা, গড়িয়ে গড়িয়ে থেমে আছে মেঝেতে…। জমাট রক্ত ঘিরে ভিড় করেছে পিঁপড়ের পাল।

স্নায়ুকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না লাল্টু। ভয়ংকর একটা বুনো কষ্ট ফুঁসে ফুঁসে উঠছে ভেতরে। ভেঙেচুরে ধ্বংস করে ফেলতে ইচ্ছে করছে সবকিছু। এই খাট, ঘর, ফ্ল্যাট, স্বপনপুরী… আস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডটাকেই যদি নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারত লাল্টু!

দাঁতে দাঁত চেপে লাল্টু সংযত করতে চাইল নিজেকে। উঠে দাঁড়াল কোনওক্রমে, প্রায় টলতে টলতে। থরথর পায়ে ওয়ার্ড্রোবখানা খুলেছে। হাতড়ে হাতড়ে জামাকাপড়ের তলা থেকে বার করল একটা মাউথঅরগ্যান। দু’হাতে চেপে ধরল ঠোঁটে। বাজাচ্ছে।

ভয়ংকর কষ্টটা ক্রমশ বদলে যাচ্ছে সুরে। করুণ একটা ধ্বনি বিছিয়ে যাচ্ছে গোটা ফ্ল্যাটে। উঠছে, নামছে, উঠছে… মূর্ছনায় ভারী হয়ে যাচ্ছে বাতাস। লাল্টুরও দু’চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছিল। অসাড়ে।

নাহ, লাল্টুর তখন চেতনাই নেই। থাকলে টের পেত দরজা খুলে কেউ একজন ঢুকেছে ফ্ল্যাটে। পরদার ফাঁক দিয়ে দেখছে লাল্টুকে। বিস্ফারিত চোখে।

.

০৪.

টিফিনের আগে একটা জরুরি কাজ সারছিল তৃষিতা। খানিক আগে তাদের দিল্লি অফিস থেকে নির্দেশ এসেছে, এ বছর পনেরোই অগস্ট যেন ঘটা করে উদ্‌যাপিত হয়। সেই নোটিশটাই তৃষিতা পাঠাচ্ছিল তাদের প্রতিটি সেবাকেন্দ্রে। পর পর ফোন করল কয়েকটা, এবার চলছে ই-মেলের পালা।

তৃষিতাদের এই ‘সিমপ্যাথি’ সংস্থাটির দুনিয়াজোড়া নাম। এন-জি-ওটি গড়ে উঠেছে আমেরিকার কয়েকজন ধনকুবেরের টাকায়। নিউ ইয়র্ক এদের মূল প্রাণকেন্দ্র। বিশ্বের নানা দেশের নিরাশ্রয় নারী শিশু বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সেবাই এদের লক্ষ্য। ভারতে বেশ কয়েকটি অনাথালয় চালায় এরা। বৃদ্ধাশ্রমও। সম্প্রতি ভবঘুরেদের একটি আশ্রয়ও বানাচ্ছে, কলকাতার উপকণ্ঠে।

সিমপ্যাথির কলকাতা শাখাটি মোটামুটি তৃষিতাই সামলায়। একটা গালভরা নামও আছে তার পদের। এগজ়িকিউটিভ অফিসার। অবশ্য নামেই অফিসার, মাইনে তেমন আহামরি নয়, অধীনে কর্মচারী মাত্র চারজন। এবং কাজেরও তার অন্ত নেই। গোটা রাজ্যে সিমপ্যাথির যতগুলো হোম আছে, নিয়মিত তাদের তদারকি, প্রতিটি কর্মকাণ্ডের রিপোর্ট দিল্লিতে পাঠানো, বিভিন্ন সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, নতুন পরিকল্পনা বানানো…।

কাজের বেশ চাপ থাকে বটে, তবে তৃষিতার মন্দ লাগে না। অফিসের মাথা হওয়ার দরুন কিছুটা স্বাধীনতা তো তার আছেই।

বৈদ্যুতিন বার্তা প্রেরণ শেষ করে তৃষিতা পাশের টেবিলের মণীশকে বলল, হেড অফিসের সার্কুলারটা দেখেছ তো?

মণীশ কম্পিউটারে কিছু ডাটা ঢোকাচ্ছিল। কাজ থামিয়ে বলল, হ্যাঁ দিদি।

ওরা ফান্ডও অ্যালট করে পাঠিয়ে দিয়েছে ব্যাঙ্কে। একবার চেক করে নাও।

নিচ্ছি।

যদি এসে গিয়ে থাকে, কাল ফার্স্ট আওয়ারে গিয়ে তুলে আনবে। আমাদের বাগনান বারুইপুর আর মধ্যমগ্রাম, তিনটে সেক্টর থেকে কাল লোক আসবে। ওদের ক্যাশ টাকা ডিসবার্স করতে হবে।

নো প্রবলেম। হয়ে যাবে।

আমাদের অডিট ফার্মকে খবর দিয়েছ?

কাল ফোন করেছিলাম। ওরা এখন খুব বিজ়ি। এ মাসের শেষ সপ্তাহের আগে আসতে পারবে না।

যাই হোক, আমরা তো পেপার্স রেডি করে রাখি। এ বছর যেন গতবারের মতো খোঁচা না খেতে হয়।

আমাদের কিন্তু দোষ ছিল না দিদি। বারুইপুর অরফ্যানেজই হিসেবপত্র গন্ডগোল করেছিল। বাচ্চাদের জামাকাপড় কেনার কোনও বিলই সাবমিট করেনি।

হতে পারে। কিন্তু দায় তো আমাদেরই। দিল্লি তো আমাদের কাছেই কৈফিয়ত চাইবে।

বছর পঁয়ত্রিশের মণীশ কপাল কুঁচকোল। সামান্য অনুযোগের সুরে বলল, দিল্লি কিন্তু আমাদের স্যালারিটা ঠিক টাইমে পাঠাচ্ছে না।

এই এক বখেড়া হয়েছে সম্প্রতি। সিমপ্যাথির রেওয়াজ অনুযায়ী মাসের দশ তারিখের মধ্যে মাইনে হওয়ার কথা। আগে এক-দু’ তারিখেই জমা হত অ্যাকাউন্টে, এক উন্নিকৃষ্ণণ দিল্লি অফিসের কর্তা হয়ে আসার পর দশ তারিখের আগে টাকা পৌঁছোয় না। এই নিয়ে মণীশদের মনে ক্ষোভ জমেছে। তবে তৃষিতা এসব ব্যাপারকে বিশেষ আমল দেয় না। একটু অ্যাডজাস্ট করে নিলেই তো হয়। দশ তারিখকে মাস পয়লা ভাবতে কী অসুবিধা!

আলগোছে ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোছের একটা জবাব দিয়ে ব্যাগ থেকে টিফিনবাক্স বার করল তৃষিতা। সাদামাঠা খাবার। পরোটা আর মোটা মোটা করে আলুভাজা। সবিতার তৈরি। এই আলুভাজাটা তোয়া আবার একেবারেই পছন্দ করে না। মিসিবাবাকে নির্ঘাত স্যান্ডুইচ বানিয়ে দিয়েছে সবিতা। সিদ্ধার্থর ছেলেটি তো আর এক চিজ়। দুধ ছোঁয় না, টিফিন নেয় না…। বাইরে কী খেয়ে পয়সা ওড়ায় কে জানে!

পরোটায় সবে প্রথম কামড়টা দিয়েছে, তৃষিতার মোবাইল সরব। মনিটরে মাতৃদেবী। এই দুপুরবেলার দিকেই সাধারণত ফোন করে মা।

তৃষিতা পরোটা চিবোতে চিবোতে বলল, কী সমাচার? বাবার জ্বরটা আর আসেনি তো?

তা আসেনি। তবে কাশিটা যাচ্ছে না রে। সারারাত ঘং ঘং করছে।

সিরাপটা খাচ্ছে ঠিকমতো?

দূর, ওতে কোনও কাজই হয় না। উলটে নাকি তোর বাবার পেট এঁটে যায়।

তা হলে কি সিদ্ধার্থকে বলব? ও অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিক, একজন ভাল স্পেশালিস্টকে দেখিয়ে নাও।

ওরে বাবা, সিদ্ধার্থর স্পেশালিস্ট মানে তো বড় বড় ব্যাপার! কান মুলে হাজার টাকা নিয়ে নেবে। আমাদের পাড়ার ডাক্তারই যথেষ্ট।

হয়তো মা কিছু ভেবে বলেনি, তবু কথাটা কানে লাগল তৃষিতার। অয়নকে বাবা-মা দু’চক্ষে দেখতে পারত না, তুলনায় সিদ্ধার্থ তাদের অনেক বেশি পছন্দসই। কিন্তু সিদ্ধার্থ যে তাদের পরিবারের সমস্তরের নয়, একটু উঁচু গোত্রের, এটা মা কিছুতেই ভুলতে পারে না। ন’-ন’টা বছর কেটে যাওয়ার পরেও।

তৃষিতা আলগা ধমক দিল প্রতিমাকে, আহ্ মা, কতবার বলেছি না টাকাপয়সা নিয়ে ভাববে না! বাবা যথেষ্ট পেনশন পায়, তা ছাড়া আমিও তো আছি।

আচ্ছা আচ্ছা, সে হবেখন। আরও দু’-চার দিন দেখি। যারা অত বিড়িসিগারেট খায়, তাদের কাশি কি সহজে কমে!…যাক গে, তোর বাড়ির কী খবর?

ঠিকঠাকই আছে সব। সিদ্ধার্থ ন’টার আগে ফিরছে না, তোমার নাতনি উইকলি টেস্ট দিতে দিতে হাবুডুবু খাচ্ছে…

আর সেই ছেলেটা?

সেও আছে। কলেজ যাচ্ছে, ক্লাস করছে…

যাহ্! ছেলেটা গেড়েই বসল শেষ পর্যন্ত?

ফের ওই কথা? কতবার তোমায় বলব মা, সোহম এখন এখানে থাকবে। যদ্দিন না সে ইঞ্জিনিয়র হয়।

কাজটা কিন্তু তুই ভাল করিসনি। দূরে ছিল, বেশ তো ছিল। হুট করে পরের ছেলেকে তুই ঘরে এনে তুললি?

ওমা, পর কোথায়? ও তো সিদ্ধার্থরই ছেলে!

হোক না। তোর তাতে কী? তোর ছেলে তো নয়। ওপারে প্রতিমার গলা ঝনঝন বেজে উঠল, তোর আক্কেলের বলিহারি যাই। ঘরে তোর মেয়ে নেই? তার কথাটা একবার ভাবলি না?

তোয়ার তো কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। সে সোহমকে মেনেও নিয়েছে।

এটা তোর মেয়ের সুবিধা অসুবিধা মানামানির ব্যাপার নয়। এটা তার বিপদ আপদের প্রশ্ন। তোমরা আজকালকার মা-বাপরা মানো ছাই না মানো, ঘি আগুন পাশাপাশি থাকলে অঘটন ঘটতে কতক্ষণ?

এই প্রসঙ্গটা প্রতিমা দেবীর নতুন আমদানি। তৃষিতা সামান্য রাগ রাগ গলায় বলল, আজেবাজে বোকো না। ওরা তো ভাইবোন।

কীসের ভাইবোন? কোন হিসেবে? তোর আর ওই বাউন্ডুলেটার মেয়ের সঙ্গে সিদ্ধার্থর আগের পক্ষের ছেলের কী রক্তের সম্পর্কটা আছে শুনি?

প্রশ্নটা কি তৃষিতার মনেও আসেনি? তবে আমল দেয়নি তেমন। অনেক ভেবেচিন্তেই দেয়নি। যে যাই বলুক, তোয়া আর সোহম কাছাকাছি থাকলে তাদের মধ্যে ভাইবোন গোছের একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠার সমূহ সম্ভাবনা। তাতে তোয়ার লাভ ছাড়া লোকসান নেই।

তবু একটা ছোট ঘটনা তৃষিতার মনে পড়ে গেল। এই তো গত রবিবারই মেয়েকে জিজ্ঞেস করছিল, হ্যাঁরে? সোহমের সঙ্গে তো তোকে কথা বলতে দেখি না?

মেয়ের তুরন্ত জবাব, গায়ে পড়ে খাতির জমানোটা আমার পোষায় না মা।

এটা কী বললি তোয়া? অপরিচিত পরিবেশে এসে সোহম তো শাই ফিল করবেই। তোরই তো দায়িত্ব দাদার মনের আড় ভেঙে দেওয়া।

দাদা? তোয়ার চোখ বড় বড়। যেন এরকম একটা আজগুবি শব্দ সে জীবনে শোনেনি। ভুরু বেঁকিয়ে বলেছিল, কোন সুবাদে আমার দাদা?

তৃষিতার কানের পরদায় ঝাং করে ঘা মেরেছিল প্রশ্নটা। তবুও সে শক্ত গলায় কেটে কেটে বলেছিল, তোমার চেয়ে বয়সে বড়, তাই দাদা। তোমার বাপির ছেলে, সেই সূত্রে দাদা। বুঝেছ আশা করি?

ঠোঁট উলটে বিচিত্র এক মুখভঙ্গি করে সামনে থেকে উঠে গিয়েছিল তোয়া।

ছবিটা মন থেকে হটিয়ে তৃষিতা বিরস গলায় বলল, ওসব নিয়ে তুমি নয় নাই ভাবলে মা। আমি তো তোয়ার মা, নয় কি? ব্যাপারটা আমারই বুদ্ধি বিবেচনার ওপর ছেড়ে দাও।

হুঁহু, তাও যদি তোমার বোধবুদ্ধির দৌড় না জানতাম! একবার তো তার নমুনা দেখিয়েছিলে। পরিণামটা কী হয়েছিল, অ্যাঁ?

মেয়েকে ঠেস দিতে হলে যে-কোনও প্রসঙ্গে তার প্রথম বিয়ের কথাটা মা তুলবেই। ধরেই নেয় ওটা বললেই মেয়ের ঠোঁটে সেলাই পড়ে যাবে।

তৃষিতা অপ্রসন্ন স্বরে বলল, তোমার পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটা থামাবে?

কিছুই ঘাঁটছি না। শুধু স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। আমাদের কথা না শুনে জীবনটাকে ঝোঁকের মাথায় তো নষ্টই করে বসেছিলি। তবু যে একবার ঠিকঠাক সংসার করার সুযোগ পেয়েছ, এ তো তোমার ভাগ্যের কথা। এখন আবেগে জরজর হয়ে বরের আগের পক্ষের পুত্তুরটিকে নিয়ে নাচানাচি করবে, নিজের মেয়ের বিপদের দিকটা মাথায় রাখবে না, এটা কিন্তু চরম বাড়াবাড়ি। যেচে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনছ, এ আমি বলে দিলাম।

তোমার উপদেশ বর্ষণ শেষ তো?…কাজ আছে, রাখছি।

যা খুশি করো। ফের বাপের বাড়ি এসে কেঁদে লুটোপুটি খেয়ো না, তা হলেই হবে।

ফোন কেটে দিয়ে তৃষিতা গুম হয়ে রইল কিছুক্ষণ। মোবাইল টেবিলে রেখে নিমপাতা গেলা মুখে টিফিন খাচ্ছে আবার। মা যে এখনও কী ভাবে তাকে? আঠেরো বছর আগে যে মেয়েটা এম. এ পড়া জলাঞ্জলি দিয়ে, বাড়িঘর মা বাবাকে তুচ্ছ করে, মোহগ্রস্তের মতো অয়নকে বিয়ে করার জন্য খেপে উঠেছিল, সেই মেয়ে আর এই তৃষিতা কি এক? মা কি একটুও বুঝতে পারে না, সেই তৃষিতা কবে মরে ভূত হয়ে গেছে? সে তো শুধু তার কায়াটি বহন করছে।

জীবনই তৃষিতাকে বদলে দিয়েছে আমূল। ঠোক্কর মেরে মেরে। উঠতি আঁকিয়ে অয়ন বিশ্বাসকে সকলের অমতে বিয়ে করে তারা ঘর বেঁধেছিল গড়িয়ায়। এক-দেড় কামরার ভাড়াবাড়িতে। তখন প্রেমই ভাতের থালা, প্রেমই ফ্যানের হাওয়া, ঘড়া ঘড়া চাঁদের কিরণে তখন সংসার উথলে উঠছে। কয়েক মাস যেতেই টের পেল, বাস্তব অত মধুর নয়। অয়ন রইস মেজাজে রয়েছে, একটা ছবি পাঁচ-দশ হাজারে বিক্রি তো তাতেই ডগমগ, ক্যানভাস আর ছোঁয়ই না। এদিকে সংসারে রীতিমতো হাঁড়ির হাল। তারই মধ্যে এসে গেল তোয়া। বাবা মা তখন বিয়েটা মেনে নিয়েছে বটে, কিন্তু অয়ন যেন কিছুতেই তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। সংসার চালাতে তখন নিজেই হাল ধরেছিল তৃষিতা। চেহারায় মোটামুটি চটক ছিল, ইংরেজিটা ভাল বলত লিখত, তার জোরেই ছোটখাটো চাকরি মিলল। প্রাইভেট কোম্পানিতে অফিস জব। একটু বেশি মাইনে পেতেই সেখান থেকে হসপিটালের রিসেপশনিস্ট। সেখানে থেকে পরিচয়ের সূত্র ধরে এই ‘সিমপ্যাথি’। ততদিনে প্রমাণ হয়ে গেছে, অয়নকে দিয়ে কিছুই হবে না। শিল্পী সুলভ দম্ভ নিয়ে সে শুধু তৃষিতার ঘাড়ে বসে খাবে আর বুকনি মারবে।

তখনই তৃষিতাকে কঠিন সিদ্ধান্তটা নিতে হল। তোয়াকে তো মানুষ করতেই হবে, কিন্তু এই পুরুষটাকেও কি সে টেনে চলবে আজীবন? এতে নিজের তো বটে, তোয়ারও ক্ষতি। একটা কুৎসিত ঝগড়াঝাঁটির পরিবেশ ছাড়া আর কিছু জুটবে না তার। তার চেয়ে বাবা মা আত্মীয় বন্ধু যে যা ভাবুক না কেন, ঠান্ডা মাথায় পৃথক হয়ে যাওয়াই তো শ্রেয়।

প্রস্তাবটা পাড়তে অয়ন প্রথমটায় স্তম্ভিত। দু’দিন তো কথাই বলল না তৃষিতার সঙ্গে। তবে অশান্তি বাড়াল না। সহমতের ভিত্তিতে ঘটে গেল বিচ্ছেদ। অকর্মণ্য অয়ন যে তখন তোয়ার ওপর দাবি ফলাবে না, এও তো প্রায় অবধারিত ছিল। অতএব মেয়েকে নিয়ে তৃষিতা সোজা বাপের বাড়ি।

তা সিদ্ধান্তটা যতই যুক্তিযুক্ত হোক, সাড়ে চার বছরের সম্পর্ক ভেঙে চলে আসা তো খুব সোজা কাজ নয়। তৃষিতার বুকটা হু হু করত প্রথম প্রথম। কত অজস্র মধুর মুহূর্তও যে লেপটে আছে ওই ফেলে আসা দিনগুলোয়! তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে এল তার তীব্রতা। এক সময়ে উবেও গেল সেই মন কেমন করা ভেজা গরম বাতাস।

ক্রমশ একটা ছাঁচে পড়ে যাচ্ছিল তৃষিতা। ধরেই নিয়েছিল, বুড়ো বাবা-মা’র দেখভাল, চাকরির দৌলতে মেয়েকে মোটামুটি ভাবে বড় করে তোলা এবং এক সময়ে নিজেও বুড়ো হয়ে যাওয়া, এটাই তার ভবিতব্য।

তখনই সিদ্ধার্থর সঙ্গে আলাপ। নিরাশ্রয় মেয়েদের জন্য বাগনানে একটা বড়সড় হোম বানাচ্ছিল সিমপ্যাথি, নকশা তৈরির ভার পড়েছিল সিদ্ধার্থর ওপর। প্রকল্পের জায়গাটা দেখাতে তৃষিতাই নিয়ে গিয়েছিল সিদ্ধার্থকে। যাতায়াতের পথে গল্পগুজবে পরিচয়টা খানিক গাঢ় হল। তারপর থেকে মাঝে মাঝেই তৃষিতার অফিসে আসত সিদ্ধার্থ। মুখে বলত, এ পাড়ায় কাজ ছিল, তাই ঢুঁ মেরে গেল। কিন্তু আসলে সে কেন আসে, তা বোঝা কি কোনও মেয়ের পক্ষে আদৌ কঠিন? তখনই ভেবেচিন্তে স্থির করল, এই বিপত্নীক মানুষটাকে বিয়ে করে ফেললে ক্ষতি কী? ছেলে কাছে থাকে না, সিদ্ধার্থ একেবারে একা, একটা গোছানো সংসার পেলে সিদ্ধার্থ তো বর্তে যাবে। তা ছাড়া সিদ্ধার্থ যথেষ্ট স্বচ্ছল, তাকে ধনীই বলা যায়, তোয়াকে একটু স্বাচ্ছন্দ্যের আবহ দেওয়া মোটেই কঠিন হবে না। শুধু একটাই শর্ত থাকবে। এই বিয়েতে যেন আর কোনও বাচ্চাকাচ্চা না হয়। আদর ভাগাভাগি হলে মানসিক জটিলতা তৈরি হতে পারে তোয়ার, মা হয়ে তৃষিতা কি তা চাইতে পারে?

হিসেবটা কষে নিজেই বিয়ের কথা পেড়েছিল তৃষিতা। শুনে সিদ্ধার্থ এক কথায় রাজিই শুধু নয়, বরং খুশিতে আত্মহারা। সেও আর নতুন করে সন্তান চায় না। তোয়া বাড়িতে থাকবে এটাই তার কাছে যথেষ্ট।

তারপর তো সব কিছু যথাযথই চলছিল। তৃষিতার হিসেব মতো। সিদ্ধার্থর প্রতি তার তেমন প্রাণউচাটন ভালবাসা না থাক, একটা সুন্দর বোঝাপড়া তো আছে। তোয়ারও তো কোনও অসুবিধে হচ্ছে না, থাকতে পারছে নিজের মতো করে।

ওই সোহমই আচমকা ঢিল ফেলল নিস্তরঙ্গ পুকুরটায়। প্রথম যেদিন সোহমকে এখানে আনার কথাটা তুলল সিদ্ধার্থ, ভেতর থেকে কেঁপে গিয়েছিল তৃষিতা। চমৎকার একটা ছকে বাঁধা চিত্রনাট্য ধরে এগোচ্ছে জীবন, হঠাৎ সেখানে এ কী উপদ্রব? তারপর আবার অঙ্ক কষল মনে মনে। সোহমের প্রতি সিদ্ধার্থর একটা চোরা দুর্বলতা আছে, এ তো তার অজানা নয়। তৃষিতা এও জানে, সে যদি সামান্যতম আপত্তি তোলে, সোহমকে কখনওই এখানে এনে রাখবে না সিদ্ধার্থ। কিন্তু তাতে তৃষিতার লাভ, না লোকসান? আপাত দৃষ্টিতে তো লাভই, স্থিতাবস্থা বজায় থাকবে। তবে নিক্তিটা যে তৃষিতার অগোচরে উলটোদিকে ঝুঁকে পড়বে না, তার কি নিশ্চয়তা আছে কোনও? সিদ্ধার্থ হয়তো মুখে কিছু বলবে না, তবু তৃষিতার অনুদারতা তো তাকে কোথাও না কোথাও বিঁধবেই। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ছেলেকে কাছে এনে রাখতে পারল না, এতেই হয়তো ছেলের ওপর দুর্বলতা আরও বেড়ে যাবে সিদ্ধার্থর। তা ছাড়া সোহম যদি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে তার বাবার এই বউটির জন্যই এ বাড়িতে তার স্থান হল না, তা হলে কী ধারণা হবে তার তৃষিতার সম্পর্কে? সোহমই সিদ্ধার্থর সম্পত্তির ন্যায্য উত্তরাধিকারী, তোয়ার তো কানাকড়িও প্রাপ্য নয়, এমত অবস্থায় সোহমের সঙ্গে একটা বিতৃষ্ণার সম্পর্ক কি গড়ে তোলা উচিত?

তার চেয়ে বরং আসুক না সোহম, থাকুক না একসঙ্গে। সিদ্ধার্থর প্রতি কৃতজ্ঞতারও তো একটা ব্যাপার আছে, না কী? তৃষিতার মেয়েকে ভরিয়ে রেখেছে সিদ্ধার্থ, সেই ঋণ মেটানোর এটাও তো একটা সুযোগ।

না, তৃষিতার মা এতসব হিসেব বুঝবে না। কোনও আবেগ টাবেগ নয়, স্রেফ অঙ্কই যে এখন তৃষিতাকে চালনা করে, মেপেজুপে পা ফেলতে শেখায়, এই সত্যিটা কি তৃষিতাও মনে মনে মানতে পারে, সর্বদা? হয়তো না। কর্তব্য তো নেহাতই এক প্রাণহীন সমীকরণ, নয় কি?

টিফিন সেরে ফের কাজে বসল তৃষিতা। অনেকগুলো প্রশ্ন এসেছে দিল্লি অফিস থেকে, তথ্য ঘেঁটে ঘেঁটে তৈরি করছে উত্তর। মাঝে মাঝে বিমনা হয়ে পড়ছে কেমন, থমকে যাচ্ছে কাজ। মা এমন এক খচখচানি ধরিয়ে দিল? আদ্যিকালের ধ্যানধারণা বলে যতই মন থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করুক, পুরোপুরি যাচ্ছে কই! কারও সঙ্গে একটু পরামর্শ করতে পারলে হত। বান্ধবীদের কাউকে ফোনে ধরবে? প্রিয়া ডিভোর্সের পর আবার নতুন সংসার পেতেছে। প্রথম বিয়েতে একটা মেয়ে ছিল, দ্বিতীয় বিয়েতেও একটি মেয়ে। প্রিয়া কি বুদ্ধি দিতে পারে কিছু? অদিতিকে একটা ফোন লাগাবে? ধুৎ, এত ভাঁজ মেরে মেরে কথা বলে… বিরক্তি ধরে যায়। তা ছাড়া অদিতিরা হল ডিংক। ডবল ইনকাম নো কিড দলের সদস্য। তৃষিতার সমস্যা সে কী বুঝবে!

হঠাৎ বাউন্ডুলেটাকে মনে পড়ল। আরে, অয়নই তো আছে। ব্যাপারটার সঙ্গে যখন তোয়া জড়িয়ে, অয়নের মতামত তো চাওয়াই যায়। সে এখন মোটেই আগের মতো খ্যাপাটে টাইপ নেই। স্কুলের এক ইতিহাস দিদিমণিকে বিয়ে করে আবার একটি কন্যাসন্তানের জনক হয়েছে অয়ন। ছবি আঁকা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে, সে এখন এক প্রাইভেট স্কুলের ড্রয়িং স্যার।

কম্পিউটারের মাউসখানা ছেড়ে মোবাইল হাতে নিল তৃষিতা। সামান্য দোনামোনা করে টিপল নম্বরটা। দু’বারও বোধহয় রিং বাজেনি, ওপারে উচ্ছ্বসিত স্বর, আরে, মহারানি যে? হঠাৎ বান্দাকে স্মরণ করলে বড়?

এমনিই। তুমি কি এখন ব্যস্ত?

তুমি ডাকলে আমি ব্যস্ত থাকতে পারি? আমার প্রাণমন তো এখনও তোমাতেই সঁপা আছে ডিয়ার।

অয়নের কথার ধারাই এমন। কে বলবে এই মানুষটার সঙ্গে এক যুগ আগে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে তৃষিতার? গলা শুনে বোঝারও উপায় নেই সে একজন আদ্যন্ত ব্যর্থ মানুষ, হৃদয়ের অতলে হয়তো বা বিষাদের নদী বয়ে চলেছে নীরবে। তবে তার এই সদানন্দ রূপটাই এখনও ভারী আপ্লুত করে তৃষিতাকে। মনে পড়িয়ে দেয় প্রথম আলাপ হওয়া সেই দামাল যুবকটিকে, যার অভিধানে দুঃখ হতাশা শব্দগুলো ছিল না।

একটু একটু অপরাধবোধও কি জাগে না তৃষিতার? মনে হয় আর একটু সহিষ্ণু হতে পারত সে? আর একটু ধৈর্যশীল? প্রেরণা জুগিয়ে একটু কি এগিয়ে দিতে পারত না অয়নের শিল্পী-সত্তাকে?

অবশ্য একই সঙ্গে মনে হয়, শুধু বন্ধু হিসেবেই মানায় অয়নকে। যার সঙ্গে শান্তিনিকেতনে বেড়াতে যাওয়া চলে, কফিহাউসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দেওয়া যায়, নির্জন জঙ্গলে পাশাপাশি শুয়ে অনন্তকাল আকাশের পানে তাকিয়ে থাকা যায়…। কিন্তু স্বামীর ভূমিকায় সে নেহাতই অচল পয়সা। সিদ্ধার্থর তুলনায় সে একটি বিগ বিগ বিগ জিরো।

তৃষিতা হাসিমুখে বলল, ফাজলামি রাখো। তুমি কি এখন স্কুলে?

নো ডিয়ার। কলেজ স্ট্রিটে। দু’খানা বইয়ের কভার বানানোর বরাত পেয়েছিলাম, দিতে যাচ্ছি। বলেই হঠাৎ গলায় মজা করা সুর, তোমার নাকি এখন বাড়ি ভরপুর? নতুন এক অতিথি এসেছে? সে নাকি ওস্তাদ মিউজিশিয়ান? দারুণ মাউথ অরগ্যান বাজায়?

একটা ধাক্কা খেল তৃষিতা। সবিতা বলছিল বটে, সোহম মাঝে মাঝে মাউথ অরগ্যান বাজায়। তৃষিতা অবশ্য স্বকর্ণে শোনেনি। আর কেউ তো সম্ভব নয়, অয়নকে নিশ্চয়ই তোয়া জানিয়েছে। আশ্চর্য, বাবার কাছে গল্প করল, অথচ মাকে বলল না? এমনিতে বাবার বাড়ি কালেভদ্রে যায়, কিন্তু বাপ-বেটিতে যোগাযোগটি অক্ষুণ্ণ আছে! ইদানীং একটু বেড়েছে কি? আজকাল মেয়ের পা তো খানিকটা লম্বা হয়েইছে, মাসে এক-আধদিন বন্ধুদের বাড়ি রাতে স্লিপ-ওভার করতে যাচ্ছে। লুকিয়ে চুরিয়ে গড়িয়াও যায় না তো?

ভাবতে গিয়ে কুটুস পিঁপড়ের কামড়। মেয়ের জন্য কিছুই তো করেনি অয়ন, অথচ তোয়ার মনে ওই ভ্যাগাবন্ডটার আকর্ষণ দিব্য রয়ে গেল? এ কি তৃষিতার পরাজয়? নাকি তৃষিতার হিসেবের?

দীর্ঘশ্বাস গোপন রেখে তৃষিতা বলল, হ্যাঁ, এসেছে। সিদ্ধার্থর ছেলেকে এখানে রাখতেই হল।

ভাল। খুব ভাল।

সোহম সম্পর্কে আর কী বলেছে তোয়া? থাক, জিজ্ঞেস করে তৃষিতা খাটো হবে কেন? গলায় সিরিয়াস ভাব এনে তৃষিতা বলল, ছেলেটা… তোয়ার সঙ্গে…এক বাড়িতে থাকছে বলে তোমার আপত্তি নেই তো?

আরে দূর, আমার আপত্তির রাইট থাকলে তুমি তো আগেই জিজ্ঞেস করতে। অয়ন শব্দ করে হেসে উঠল। হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলে উঠল, তোয়াকে নিয়ে আমি ভাবিই না। তবে…

থামলে কেন? তবে কী?

ছেলেটাকে যদি রাখো, ভালবেসে রেখো। ছলচাতুরি কোরো না।

তৃষিতা বিমূঢ়। ফোন অফ করার পরেও বিস্ময় কাটে না। এক ছাদের নীচে এক বিছানায় পাশাপাশি শুয়েও সিদ্ধার্থ যার হদিশ পায় না, কোন অলৌকিক মন্ত্রবলে তৃষিতার সেই ফাঁকিটুকু পড়ে ফেলে অয়ন?

বাড়ি ফিরেও অয়নের কথাগুলো ভুলতে পারছে না তৃষিতা। ভ্যানিটিব্যাগ ড্রেসিংটেবিলে রেখে কয়েক মিনিট শুয়ে রইল চুপচাপ। উঠে মুখহাত ধুয়ে চা দিতে বলল সবিতাকে। ফের ঘরেই ফিরছিল, কী ভেবে গিয়ে দাঁড়িয়েছে স্টাডিরুমের দরজায়।

একটা মোটা বই খুলে কী যেন লিখছিল সোহম। তৃষিতা দরজা থেকেই বলল, খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করছ তো?

সোহম চমকে তাকিয়েছে। ঠোঁট ফাঁক হয়েছে অল্প। যেন হাসছে, অথচ হাসছে না।

তৃষিতা কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করল,— কলেজ থেকে ফিরে চা জলখাবার খেয়েছ?

হ্যাঁ।

তুমি নাকি ভাল মাউথ অরগ্যান বাজাও? আমাকে শোনাবে না?

ছোট করে ঘাড় নাড়ল সোহম। ক্ষণিক ইতস্তত করে বলল, একটা কথা বলার ছিল।

কী বলো?

ভাবছিলাম একবার বাড়ি যাব। শনিবার কলেজ থেকেই…। সোমবার একদম কলেজ করে ফিরব।

বেশ তো, যেয়ো। তৃষিতা মৃদু হাসল, দিদার জন্য মন কেমন করছে বুঝি?

না। রবিবার আমার মা’র মৃত্যুদিন। ওই দিনটা আমি বাড়িতেই কাটাতে চাই।

নিষ্প্রাণ স্বরে উচ্চারিত হল কথাগুলো। তৃষিতার শ্রবণেন্দ্রিয় ঝাঁকি খেল সামান্য। বাড়ি বলতে এখনও কৃষ্ণনগরের মাতুলালয়টিকেই বোঝে সোহম। তার বাবার এই ফ্ল্যাটটিকে নয়। এত আদরযত্ন পাচ্ছে এখানে, তবুও নয়।

এটা ভাল, না মন্দ? দাঁড়িপাল্লা কী বলে? তৃষিতা নিজের ভাবনায় নিজেই চমকে উঠল। অয়নের উপদেশটা মনে পড়ল কি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *