০১. এই যে আমি

এই যে আমি। আমি জানি যে আমি আপনার একেবারে অপরিচিত নই। কত শতবার কতভাবে দেখেছেন আমাকে! তবু যদি বলেন যে চিনতে পারছেন না, আমি যদি একটু বিশদ ভাবে বুঝিয়ে বলি, তখন আর তা মনে হবে না। সব অপরিচয়ের অন্ধকার সরে গেলে আপনার মনে হবে, হ্যাঁ একে চিনি, আমি দেখেছি এই মানুষটাকে।

মানুষের স্মৃতি খুব দুর্বল। তাই পুরনো কথা মনে করার জন্য স্মৃতির উপর চাপ দেবার কথা বলছি না! এখনই আপনি জানালা দিয়ে সামনের সবুজ মাঠটার দিকে একবার তাকান। দেখতে পাবেন ছাগল গরুর পিছনে পাঁচনবারি হাতে ছুটে চলা আদুল গায়ে এক রাখাল বালককে। বহু বছর ধরে দেখেছেন ছেলেটাকে। মুখটা তাই আপনার চেনা চেনা। ও-ই আমি। ও-ই হচ্ছে আমার বাল্যবেলা।

এবার একটু বের হয়ে আসুন বাড়ির বাইরে। আপনার গলিটা শেষ হয়ে যেখানে এসে বড় রাস্তায় মিশেছে, একবার তাকান মোড়ের চা দোকানটার দিকে। রুক্ষচুল, গায়ে দুর্গন্ধ যুক্ত ছেঁড়া ময়লা গেঞ্জি, হাতে পায়ে দগদগে হাজা, কিছুক্ষণ আগে মালিকের হাতে মার খেয়ে কেঁদে কেঁদে গেলাস ধোয়া ওই যে ছেলেটা–এই হচ্ছে আমার কিশোর কাল।

এরপর যুবা বয়স! রেল স্টেশনে মোট বওয়া, মাথার উপর এক পাঁজা ইট নিয়ে বাঁশের ভারা বেয়ে দোতলা তিনতলার ছাদে ওঠা, রিকশা চালানো, রাত জেগে পাহারাদারি, দুর পাল্লার ট্রাকের খালাসি, মেথর ডোম–এ ভাবেই কেটেছে আমার যুবা বয়স। এর কোন না কোন পর্বে পথে ঘাটে হাটে মাঠে কখনো না কখনো আপনি আমাকে নিশ্চয় দেখে থাকবেন। বলা যায় না হয়তো দেখে থাকবেন সেই উত্তাল সত্তর দশকে পাড়ার গলিতে বোমা পাইপগান নিয়ে ছুটে বেড়াতে। অথবা হাতে হাতকড়ি পড়িয়ে পুলিশ মারতে মারতে ভ্যানে তুলছে।

জীবন আমার পায়ের তলায় সরষে রেখে দিয়েছিল। তাই কোথাও কোন ভূমিকায় দুদিন স্থির দাঁড়াতে পারিনি। বারবার পিছলে গেছি। সেই পেছল খাওয়া-পিছিয়ে পড়া, পিছু হটা এক জীবনকথা আপনাকে শোনাতে বসেছি। সারা জীবনে “জীবন” আমাকে দিয়ে কত কিছু যে করিয়েছে, চাইলেও তার সব কথা কী লিখতে পারবো? আত্মজীবনীর এই এক মস্ত অসুবিধা কোন আড়াল থাকে না। সে আড়াল উপন্যাসে পাওয়া যায়। তাই অকপটে অনেক কথা বলে দেওয়ায় অসুবিধা থাকে না।

আত্মজীবনী লেখার আর একটা বিড়ম্বনা, নিজের ঢাক নিজে বাজাতে হয় নিজের চোখে সব মানুষই সুন্দর। নিজের কাজ সব মানুষের কাছে প্রশংসার। তাই ভয় হচ্ছে, আমার ছেঁড়া ফাটা বেসুর বেতাল ঢাকের বাজনা শুনে বিরক্ত না হয়ে যান। কারণ যে ছবি আমি এখন আঁকতে চলেছি আপনিও তো সেই সময়-সমাজের মানুষ। কে জানে আমার কোনও অভিযোগের আঙুল আপনার দিকেও উঠে যাবে কিনা!

ঠিক জানিনা কে যেন বলেছেন জীবন নাকি এক যাত্রা। জন্ম থেকে এক পা এক পা করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলা। আর আঘাতে ঠোক্করে ক্ষত বিক্ষত হয়ে–পথের বাঁকে বাঁকে রক্ত ছড়িয়ে যেতে যেতে সেই অমৃত পরশের অনুসন্ধান করা, যা জীবনকে সমৃদ্ধ করে। মহান করে, অমরত্ব দেয়।

সবাই সে অমৃত পায় না। কেউ কেউ পেয়ে যায়। যে পায় তার জন্ম সার্থক মৃত্যু সার্থক জীবন সার্থক। আপনি যদি আমাকে অহংকারী না ভাবেন তবে সবিনয়ে বলি, আমি সেই অমৃত স্পর্শ পেয়েছি। তাই একথা উচ্চারণ বোধহয় ধৃষ্টতা হবে না যে আমার জীবনটা সার্থক না বলা গেলেও একেবারে ব্যর্থ এটা বলা যাবে না। অবশ্য আমার সত্যিকারের সার্থকতা বা বিফলতা বলতে ঠিক কি বোঝায় এ বিষয়ে পরিষ্কার কোন ধারণাও নেই।

জন্মগত কারণে অপরাধী ঘোষিত অচ্ছুত অস্পৃশ্য এক দলিত পরিবারে আমার জন্ম। যার জীবন শুরু হয় ছাগল চড়ানো দিয়ে, তারপর দুবেলা দুমুঠো অন্নের তাড়নায় কত ধরনের “হীন নীচ জঘন্য বৃত্তি”। স্কুলে যাবার কোনও সুযোগ ঘটে না কিন্তু জেলযাত্ৰা ঘটে যায় বেশ কয়েকবার। সেই মানুষ যাকে “মানুষ” পৃথিবীর জঞ্জাল মনে করে মেরে ফেলারও চেষ্টা করেছিল কয়েকবার, আজ তাকে যখন মঞ্চে বসিয়ে মালা দেওয়া হয়, সে মনে করতেই পারে জীবন তাকে একেবারে বঞ্চিত করেনি।

জীবনে কখনো বিদ্যালয়ে চৌকাঠ ডিঙাতে পারেনি। রিকশা চালাত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। যখন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পারেটিভ লিটরেচর বিভাগের জার্নাল-ভলিউম নাম্বার ৪৬/২০০৮-২০০৯ এর ১২৫ থেকে ১৩৭-১২ পৃষ্ঠা জুড়ে তার জীবন এবং সাহিত্য কৃতি নিয়ে আলোচনা থাকে, সে তো নিজেকে ধন্য ভাবতেই পারে। বহু সব স্বনামধন্য সম্মানীয় মানুষ যখন তাদের শক্তিশালী কলমে তার কথা লেখেন–যুগান্তর, রাজার বা এ জাত বর্তমান, আনন্দবাজার, প্রতিদিন, আজকাল, ই.পি.ডব্লু, কথাদেশ, নতুন খবর, দিনকাল, দি হিন্দু, স্টেটসম্যান, টাইমস অফ ইন্ডিয়া, মেইনস্টীম আরেক রকম, দৈনিক জাগরণ, যুগশঙ্খ, হিন্দুস্থান টাইমস এই সব পত্রিকায় তার নাম পরিচয়, প্রকাশিত হয়, দূরদর্শনের জনপ্রিয় প্রোগ্রাম “খাসখবর”, আকাশ বাংলায় “সাধারণ অসাধারণ” “খোঁজখবর” প্রোগ্রাম, তারা নিউজের “তারার নজর” ২৪ ঘন্টা, ইটিভির সংবাদে যখন তাকে দেখানো হয় RSTV চ্যানেল তথ্য চিত্র বানায় সে ভাবতেই পারে–জীবন সার্থক।

একবার হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের প্রধান শ্রদ্ধেয়া টুটুন দিদির (টুটুন মুখার্জী) আমন্ত্রণে চলেছি হায়দ্রাবাদ। স্টেশন থেকে চলেছি এক অটো রিকশায়। বলি তাকে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথিশালায় নিয়ে যেতে। অটো চালক পড়াশোনা জানা! সে দেশ বিদেশের অনেক খবর রাখে। আমি কলকাতা থেকে গেছি শুনে জিজ্ঞাসা করে কলকাতার যে রিকশা চালক, কোনদিন কোন স্কুলে যায়নি, এখন এক লেখক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, তাকে আমি চিনি কিনা!

বলেছিলাম-চিনি। এবং একথা একটুও ভুল নয়, যে তাকে আমার মত আর কেউ চেনেনা। আমি চিনি অনেক বেশি। সেই নিয়েই এই আমি। আমার আমি।

.

অধুনা বিলুপ্ত পূর্ব পাকিস্তানের বরিশাল জেলার পিরিচপুরের সন্নিকটে তুরুকখালি নামক একস্থানে হতদরিদ্র এক দলিত পরিবারে আমার জন্ম। সে দিনটা ছিল তাপদগ্ধ বৈশাখ মাসের কোন এক রবিবার।

সেই রাতে কালবৈশাখির প্রবল ঝড় উঠেছিল। যে ঝড়ে উড়ে গিয়েছিল দরিদ্র মানুষের অনেকগুলো কুড়ে ঘরের খড়ের চাল। ভেঙে পড়েছিল বড় বড় গাছের মোটা মোটা ডাল। মানুষ কাঁদছিল, হাহাকার করছিল, বাজ পড়বার বিকট শব্দে ভীত হয়ে পড়েছিল। মা আমাকে বুকের আড়াল দিয়ে রক্ষা করছিলেন সেই ক্রুদ্ধ প্রকৃতির রোষানল থেকে।

মায়ের মুখে শুনেছি সেদিন আমাদের ঘরে রান্না করবার মত একদানা চালও ছিল না। জনমজুরি দ্বারা সংসার প্রতিপালন করা আমার বাবা–যে নাকি মোষের মত খাটতে পারত, তার সে সব দিনে কোন কাজ ছিল না। যার ফলে তিন-চার দিন আগে থেকে আমাদের রান্নাঘরের উনুন জ্বালা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে পড়েছিল। আশেপাশের মানুষ যারা আমাদের স্বজাতি, আত্মীয়, তারাও সব আমাদের মতোই হতদরিদ্র-দিন আনা দিন খাওয়া লোক। তাদের কারও ঘরে দয়া জিনিসটার তখন পৰ্যন্ত অবলুপ্তি ঘটেনি। তাই তাদের কেউ কেউ একটু কম খেয়ে নিজের ভাগ থেকে একমুঠো ভাত বাঁচিয়ে আমার মাকে দিয়ে যেত। এইভাবে গর্ভস্থ সন্তান নিয়ে কোনভাবে বেঁচে ছিল এক গ্রাম বাংলার ভাগ্যাহত গৃহবধূ।

সেদিন সকাল বেলা আমার বাবা মুখে জল না দিয়েই বের হয়ে পড়েছিলেন পথে, কোথায় কিছু চাল পাওয়া যায় সেই সন্ধানে। এই অঞ্চলের সবচেয়ে অবস্থাপন্ন পরিবার ছিল জনৈক ভটচাজ বাবুরা। মায়ের মুখে শুনেছি, চাষের পরে তাদের খামারে চার চারটে ধানের গাদা মারা হত। সে এতবড় আর এত উঁচু যে ধান গাদার মাথার দিকে তাকালে মহিলাদের মাথা থেকে নাকি ঘোমটা খসে পড়ে যেত। বাবা সেই বাড়িতে গিয়েছিলেন কিছু চাল ধার পাবার আশায়।

এরা অঞ্চলের গরিব মানুষকে বিপদের সময় ধান চাল নগদ টাকা ধার দেয়। সে ধার চাষের মরশুমে খেটে পরিশোধ করতে হয়।

কিন্তু এখন সময়টা একটু অন্য রকম। মাত্র বছর চার-পাঁচ আগে দেশভাগ হয়ে গেছে। এ সময়ে দলে দলে লোক দেশ ছেড়ে “ইন্ডিয়ায়” পালাচ্ছে। ভটচাজ পরিবারের কিছু লোক ইতিমধ্যেই ওদেশে চলে গেছে। বাকি যারা আছে আজ যাই কাল যাই করছে। এত জমি জায়গার একটা যথাযথ ব্যবস্থা করে যাওয়া সোজা ব্যাপার তো নয়। এই সময় ধার দিলে তা আর আদায় করা যাবে কিনা কে জানে! সেই জন্য তারা চালের বিনিময়ে তখনই কিছু কাজ করিয়ে নেওয়া উচিং মনে করে বাবাকে দিয়ে একটা আমগাছ কাটিয়ে কাঠের চলা–যা দিয়ে রান্না করা হয়, তা বানিয়ে নেয়।

এ যেন সেই মুনশি প্ৰেমচাঁদের আর এক গল্প অন্য এক পটভূমিতে। তবে সেই গল্পের প্রধান চরিত্রের মত ক্ষুধা তৃষ্ণা পরিশ্রমে বাবাকে প্রাণ হারাতে হয়নি। কাজ শেষ করে গামছার পোটলায় কিছুটা চাল বেধে তিনি ঘরে ফিরে আসতে সক্ষম হন। সারা দিন পরে যখন তিনি ঘরে ফেরেন তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আর আকাশ কালো করে ধেয়ে আসা শুরু করেছে কালবৈশাখি ঝড়ের আভাস। যা কিছুক্ষণ পরে এক ভীষণ তাণ্ডব শুরু করবে এ অঞ্চল জুড়ে।

আমি মা বাবার প্রথম সন্তান। আমার পরে আরও দু ভাই দু বোনের জন্ম হয়। তখনকার দিনে নিয়ম ছিল বধূ তার প্রথম সন্তানের জন্ম দেবে মাতৃগৃহে। সে সময় খুব ছোট্টবেলায় মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত। আর অল্প বয়েসে সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে বহু মেয়ে মারাও যেত। যে কারণে ওই নিয়ম। পাছে দোষ না পড়ে “প্রসুতির ঠিক মত সেবা শুশ্রূষা করেনি শ্বশুর শাড়ির লোক।” দুর্ভাগ্য, আমার মায়ের কোন মাতৃগৃহ ছিল না। আমার দিদিমা ছিলেন বাল্য বিধবা। তিনি বারো বছরে বিবাহ এবং ষোল বছরে মা হন। তারই কিছুদিন পরে আমার মাতামহ মারা যান। তখন দিদিমার ভরণ পোষণের ভার নেবার মত আর কেউ না থাকায় তিনি তার শিশু কন্যাটিকে নিয়ে নিজের মাতৃগৃহে চলে আসেন। যেখানে আগে ভাগে তার পাঁচ বোন বিধবা হয়ে এসে বসে আছে। সে কারণে অঞ্চলে এই বাড়িটার নাম “বিধবা বাড়ি” হয়ে গিয়েছিল। এই ছয় বোনের সন্তান ছিল মাত্র দুটি। আমার মা আর তার এক মাসতুতো দাদা।

আমার দিদিমা মাকে তার বোনদের হেপাজতে রেখে গ্রামের সম্পন্ন লোকদের বাড়ি চাল চিড়ে কুটে, কাঁথা সেলাই করে, মুড়ি ভেজে, যা সামান্য মজুরি পেতেন তা দিয়ে মা মেয়ে কোনভাবে বেঁচেবর্তে ছিলেন। যখন এই মেয়ের বয়স আট কি নয়, তখন সেই বাড়ির সামনের বড় গাঙ বেয়ে নৌকো নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছিলেন আমার ঠাকুরদা। হঠাৎ তার চোখে পড়ল একটি ছোট্ট মেয়ে পিঠময় একরাশ কালো চুল নিয়ে জলঘাটে জল ভরছে তার ছোট্ট ঘটিতে। তখনই তিনি নৌকা থামিয়ে পাড়ে উঠে পড়লেন। খোঁজ নিলেন মেয়েটি কার! আর তারপর মেয়ের অভিভাবকদের সঙ্গে কথাবার্তা সেরে ফেললেন। এবং একদিন এককুড়ি একটাকা কন্যাপন দিয়ে বধু করে নিয়ে এলেন সেই মেয়েকে তুরুকখালি গ্রামের বিখ্যাত “আট ভাইয়ের বাড়ি”-ব্যাপারী বাড়িতে।

আমাদের পূর্ব পদবি ছিল মণ্ডল। ঠাকুরদার কারণেই আমাদের সেই পদবিটি খসে যায়। তার একবার শখ হয় তিনি ব্যবসা করবেন। সেই মনোস্কামনায় এক নৌকা সুপারি নারকেল নিয়ে বরিশাল শহরে যান। তা ব্যবসা মোটামুটি খুব একটা মন্দ হয় না। তাই শহর থেকে ফেরার সময় বউয়ের জন্য দশ টাকা দামের একখানা শড়ি কিনে ফেললেন। সেই শাড়ি দেখে গ্রামের লোকের মুখে তো আর রা সরে না। একজন জানতে চায়–“কত দিয়া কেনলা শাড়িখান?” তখন দাম বলতে গিয়ে সতর্ক হল ঠাকুরদা। লোকে বলে “উনি যদি কিছু বেঁচেন–ঠকেন আট আনা। যদি কিছু কেনেন ঠকেন ষোল আনা। সেই কথা মনে পড়ে যাওয়ায় সঠিক দাম বলতে ইতস্তত করেন। কে জানে এবারও ঠকে এসেছেন কিনা! অবশেষে অনেক ভেবে শেষে বলেন তিনি–”দোকানদার আট টেহা চাইছিল। কইয়া বইলা সাড়ে সাতে আনছি। এয়ার কোমে হালায় পো হালায় কিছুতে দিতে রাজি হইল না।” বলে লোকটা–“তুমি মিছা কতা কওনা তো?” ঠাকুরদা জোরের সাথে জবাব দেয়, মিছা কতা কইয়া আমার কী লাভ! আমি যদি কই দশ টেহায় আনছি কেউ কী তা মাইনা নেবে? তখন মুচকি হেসে বলে সেই লোকটা–“ওই দামে মোরে এ্যাকখান এই শাড়ি আইন্যা দিবা?” “এ্যাকখান কি, কও যদি তো দশখান আইন্যা দিমু” বলে ঠাকুরদা। যথারীতি ঠাকুরদা পরের বার যখন সুপারি নারকেল নিয়ে বরিশাল যাওয়ার জন্য নৌকায় উঠেছেন, দেখেন, কেউ সাড়ে সাত কেউ পনেরো টাকা নিয়ে ধেয়ে আসছে তার দিকে। সবারই একটা দুটো শাড়ি দরকার। সংখ্যায় তারা অনেক।

কথায় বলে–বন্দুকের গুলি আর মুখের বুলি একবার বের হয়ে গেলে আর ফেরানো যায়না। একবার কথা দিয়ে ফেলার পরে আর কিছু করার ছিল না ঠাকুরদার। তাই নিজের গাট থেকে প্রতিটা শাড়িতে আড়াই টাকা করে ভর্তুকি দিয়ে, পুঁজিপাটা সব শেষ করে বরিশাল শহর থেকে সেই যে ফিরে এলেন, আর কোনদিন ওমুখো হননি।

ঠাকুরদার এই বুদ্ধিমত্তার খবর খুব বেশিদিন গোপন ছিল না। বরিশাল শহরে তো আরও এক দুজন ব্যাপারী যায়, যখন মানুষ ঠাকুরদার এই ব্যবসা বৃত্তান্ত অবগত হল–তারা প্রচুর হেসে ঠাকুরদার নামের পিছনে বসিয়ে দিল ব্যাপারী পদবি। যে কারণে আমি মনোরঞ্জন মণ্ডল নই, মনোরঞ্জন ব্যাপারী। এই হল ব্যাপারী হবার আসল ব্যাপার।

এই দেশে মনোরঞ্জন অনেক আছে। খুঁজলে ব্যাপারীও দুপাঁচটা মিলে যাবে। কিন্তু মনোরঞ্জন ব্যাপারী আর একজনও পাওয়া যাবে না। আমিই এক এবং এককও আমিই আদি এবং আমাতেই অন্ত।

সেদিন যখন আমার বাবা চালের পোটলা নিয়ে ঘরে ফিরে এসেছিলেন তার অল্প কিছুক্ষণ আগে মাতৃ জঠর থেকে ধরণীর মৃত্তিকায় অবতরণ করেছি আমি। বাবার এক খুড়িমা-যিনি আমার বাবারও জন্মের সময় ধাত্রীর ভূমিকায় ছিলেন, এখন আমার জন্মের সময়ও সেই একই ভূমিকা পালন করলেন। বাঁশের চটা দিয়ে নাড়ি কেটে ধুয়ে মুছে ন্যাকড়া জড়িয়ে শুইয়ে দিয়েছিলেন আমাকে আমার মায়ের পাশে। বাবা এলে তখন সেই “খুড়িমা” বাবাকে বলেছিলেন একটু মধু যোগাড় করে আনতে। আমাদের সমাজের প্রবীণ মানুষদের বহু পুরাতন এক বিশ্বাস, নতুন মানুষ পৃথিবীতে এলে তার মুখে মধু দিতে হয়। তা না হলে জাতকের জীবন মধুময় হয় না। তিক্ত বিষাক্ত হয়ে রয়ে যায়। বাবা তখন খুব কেঁদেছিলেন। কারণ যে ঘরে চালই নেইমধু আসবে কোথা থেকে? বাবার জন্মের সময়ও তার মুখে মধুর ফোঁটা পড়েনি। মধু বঞ্চিত জীবন যে কত কষ্টের, গ্লানি আর অপমানের তিনি তা মর্মে মর্মে জানেন। কিন্তু তখন সেই প্রবল কালবৈশাখির ঘনিয়ে ওঠা দুর্যোগে কোথায় যাবেন মধুর সন্ধানে! ফলে আমার আর মুখে মধুপাত হল না। জীবন সুমধুর হল না। হতভাগ্য দলিত বাপের অভাগা ছেলে রয়ে গেল মধু বঞ্চিত এক তিক্ত জীবন পথের যাত্রী হয়ে।

.

আমার বাবা তার জাতি পরিচয় দিতে গিয়ে বড়ই গর্ব আর অহংকারের সঙ্গে বলতেন “মোরা নোমোশুদুর, কাশ্যপ গোত্র”। যদিও উচ্চবর্ণের লোকেরা আমাদের অচ্ছুত অস্পৃশ্য ভাবতো, চরম ঘৃণাভরে চাড়াল চণ্ডাল এই সব বলত। বাবা বা আমাদের সমাজের কোনও মানুষ কিন্তু নিজেদের চণ্ডাল বলে স্বীকার করতে চাইত না। তাদের দাবি ছিল, আমরা উঁচু জাত। ব্রাহ্মণের রক্ত আছে আমাদের শরীরে এবং এটা শুধু মাত্র নমঃশুদ্র মানুষেরাই নয়, বর্ণবাদী ব্যবস্থায় সর্বনিম্নধাপে অবস্থানরত প্রায় প্রতিটি জনগোষ্ঠিই দাবি করে। তাদের প্রত্যেকের নিজের হীনমন্যতা আড়াল করে আত্মগর্বে স্ফীত হবার মত একটা লোক গাঁথা প্রচলিত আছে। নমঃশূদ্র সমাজেও এই রকম একটা গল্প প্রাচীনকাল থেকে প্রবহমান।

বিশ্বস্রষ্টা ব্রহ্মার এক পুত্রের নাম মারিচ। মারিচের এক পুত্রের নাম কাশ্যপ সেই কাশ্যপ মুনির এক পুত্রের নাম নমস মুনি। নমস মুনির বিবাহ হয় ব্রহ্মার এক মানস পুত্র রুচির কন্যা সুলোচনার সাথে। সেই কন্যার গর্ভে নমস মুনির ঔরসে দুটি যমজ পুত্রের জন্ম হয়। যার একজনের নাম রাখা হয় উরুবান আর একজনের কীর্তিবান। পুত্রদ্বয়ের জন্মের কিছুকাল পরে নমস মুনি বনে চলে যান তপস্যা করতে। সেই তপস্যায় উনি এমন নিমগ্ন হয়ে পড়েন যে দিনমাস বছরের কোন হিসেব রাখতে পারেন না। এভাবে পার হয়ে যায় চৌদ্দ বৎসর।

শাস্ত্রানুসারে সব মানুষই জন্মমাত্রেই শুদ্র। এরপর উপনয়ন দ্বারা সে হয় দ্বিজ। আর তারপর অধ্যয়ন ও সাত্বিক তপস্যা দ্বারা ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্ত হলে তখন হয় ব্রাহ্মণ। ডাক্তারের পেটে জন্মালেই যেমন ডাক্তার হওয়া যায় না, সেই কালে ব্রাহ্মণের ঔরসে জন্মালেই ব্রাহ্মণ হবার সুযোগ ছিল না। কঠিন শ্রমে তাকে তা অর্জন করতে হত। বিদ্বান হবার প্রথম ধাপ যেমন বিদ্যালয়ে অনুপ্রবেশ, ব্রাহ্মণত্বের দিকে অগ্রগমনের প্রথম ধাপ উপনয়ন। যা দিতে হবে চৌদ্দ বছর অতিক্রান্ত হবার পুর্বে। নমস মুনির অসাবধানতায়বালকটির সে বয়স তখন পার হয়ে গেছে। এখন কী উপায়! এরা যে শূদ্র রয়ে গেল। তবে নমস মুনির পুত্র বলে কথা। শূদ্র হলেও এরা নমস্য। তাই এদের নাম হল নমঃশূদ্র।

এত গৌরবময় যাদের অতীত আজ তাদের এমন দীনহীন দশা কেন! মাথায় তেল, পেটে ভাত, পরনের ত্যানা, পায়ের চপ্পল, ঘরের চালে খড় কিছুই কেন নেই! কেন এত লাঞ্ছনা অপমান অত্যাচার?–আছে। নমঃশূদ্র মানুষের কাছে সেই প্রশ্নের উত্তর আছে।

পাল রাজত্ব শেষ আর সেন রাজত্ব শুরু এর মাঝে অল্প কিছু কাল বঙ্গদেশের কোন এক অঞ্চলের শাসন ক্ষমতা শুর বংশের রাজা আদিশূরের অধিকারে ছিল। উচ্চবর্ণের ঐতিহাসিকরা যার কথা বিশেষ কারণে লিপিবদ্ধ করেননি। পাল রাজারা সবাই ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। এদের প্রচেষ্টায় সমগ্র বঙ্গদেশ তখন প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল বৌদ্ধ ধর্মের বন্যায়। যখন পাল রাজত্বের পতন ঘটে গেছে, তখন রাজা আদিশূর বৈদিক ধর্মের পুনরুত্থান প্রচেষ্টায় এক মহাযজ্ঞ করবার উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। কিন্তু যজ্ঞ করতে হলে তো বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ চাই। বঙ্গে তখন আর তেমন ব্রাহ্মণ কোথায়! বৌদ্ধ ধর্মে তো কোন পূজাপাট হোমযজ্ঞ নেই। রাজ্যবাসীরা কেউ সে সব করে না। ফলে দীর্ঘ অনভ্যাসে ব্রাহ্মণরা মন্ত্রতন্ত্র সব ভুলে বসে আছে।

অগত্যা নিরুপায় রাজা আদিশূর দূর দেশ কান্যকুজ থেকে পাঁচজন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ আনার উদ্দেশ্যে একজন দূত পাঠালেন সে দেশে। দূতের নিকট গেল রাজা আদিশূরের আবেদন–বঙ্গে বৈদিক ধর্মের পুনঃ প্রতিষ্ঠাকল্পে যে মহাযজ্ঞের আয়োজন করা হয়েছে এতে আপনার সহযোগিতা চাই। কিন্তু কান্থকুজের রাজা বীরসিংহ আদিশূরের আবেদনে সাড়া দিয়ে বঙ্গে ব্রাহ্মণ পাঠাতে রাজি হল না। বঙ্গে নাস্তিকদের (বৌদ্ধ) প্রাদুর্ভাবে ধর্মকর্ম বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। সেখানে ব্রাহ্মণেরা গেলে সব স্বধর্মচ্যুত হয়ে পড়বে। সে পাপের দায়ভার রাজার উপরেই বর্তাবে। রাজা বীর সিংহ বড় ধর্মপ্রাণ মানুষ। তিনি কেমন করে এমন মহাপাতকী কর্ম করতে পারেন!

তখন রাজা আদিশূর আর কোন গত্যান্তর না দেখে অবশেষে মনঃস্থির করে ফেললেন, যে, যুদ্ধ করেই পাঁচজন ব্রাহ্মণ ধরে নিয়ে আসবেন। তৈরি হল সাতশত সাহসী যোদ্ধা। যে কোন যুদ্ধের প্রধান উদ্দেশ্য হয় বিজয়। তা সে ছলে বলে কলে কৌশলে যেভাবেই হোক না কেন। তাই আদিশূরের আদেশে সব সেনা গলায় পড়ে নিল একটা করে ধবধবে সাদা পৈতে। চড়ে বসল গরুর পিঠের উপর এবং একদিন তারা গিয়ে দাঁড়াল ‘রণং দেহী’ হুংকার দিয়ে কান্বকুব্জের রাজ্যের সীমানায়। হয় যুদ্ধ কর, নয় পাঁচজন ব্রাহ্মণ দিয়ে দাও। এই না দেখে ধর্মপ্রাণ রাজা বীরসিংহ পড়ে গেল মহা ফাপড়ে। এখন কান্যকুজের সেনা যদি প্রতি আক্রমণ করে, তাদের অস্ত্রে হয় গরু, নয় ব্রাহ্মণ কেউ না কেউ তো মারা পড়বে। বেদজ্ঞ যদি নাও হয় তবু তো ব্রাহ্মণ। শাস্ত্রে ব্রাহ্মণ এবং গরু দুটোকেই অবধ্য প্রাণী বলেছে। এদের যেকোন একটাকে বধ করলে মৃত্যুর পরে অনন্তকাল নরক বাস। নিরুপায় বীরসিংহ তখন পরাজয় স্বীকার করে পাঁচজন বৈদিক ব্রাহ্মণ বঙ্গে পাঠাবার শর্ত মেনে নিলেন। সেই পাঁচ ব্রাহ্মণ তাদের সেবা করার জন্য সাথে করে নিয়ে এল পাঁচজন সেবক। ওই পাঁচ ব্রাহ্মণ আর ওই পাঁচ ভৃত্য পরবর্তীকালে আর স্বদেশে ফিরে যেতে পারেনি। পাকাপাকিভাবে রয়ে গেছে বঙ্গদেশে। শূদ্র জাতির ওই পাঁচভৃত্য এদেশে পরিচিত হয়েছে এক নতুন জাতি হিসেবে কায়স্থ পরিচয়ে।

সে যাই হোক, আদিশূরের মহাযজ্ঞ তো মহা আড়ম্বরে সমাপ্ত হয়ে গেল। রাজা এখন মহাখুশি। এবার সেই সাতশত সেল্লাকে পুরস্কার দেবার পালা। ঝক্সবির্শে বিভুই থেকে পাঁচ পাঁচখানি অমূল্য রতন ধরে নিয়ে এসেছে। “বলো তোমরা কী চাও?” জানতে চাইলেন রাজা আদিশূর। তখন সেনাদের প্রধান এগিয়ে এল সামনে। বলল–মহারাজ আমরা আর কিছু চাইনা। শুধু এইটুকু নিবেদন, যা আপনি দিয়েছেন তা আর ফিরিয়ে নেবেন না। আমাদের এই পৈতাখানি পরে থাকার অনুমতি দিন।

আদিশূর অধার্মিক নন, অকৃতজ্ঞও নন। আদেশ দিলেন তিনি, আমার রাজত্ব সীমায় আজ থেকে তোমরা ব্রাহ্মণ বলেই পরিচিত হবে। সমাজে ব্রাহ্মণের যে সম্মান, তোমরাও আধিকারি হবে সেই সম্মানের।

রাজ্যবাসীগণ রাজার সেই আদেশ নত মস্তকে মেনে নিলেও বেঁকে বসল অনমনীয় নমঃশুদ্র সমাজ। নমসমুনির বংশধর আমরা। না হয় সামান্য ভুলে পৈতেটা পাইনি; তা বলে ওরা আমাদের চেয়ে বড় জাত হয়ে যাবে? আমরা ওদের কিছুতে ব্রাহ্মণ বলে মেনে নেব না। প্রণত হব না এই সব ব্রাহ্মণদের পায়ে। শুরু হয়ে গেল নব ব্রাহ্মণদের সাথে নমঃশূদ্র সমাজের বিরোধ। যা চলতেই থাকল।

এরপর সমগ্র বঙ্গভূমিতে এল সেন রাজত্বের কাল। রাজা হলেন বল্লাল সেন। কিছুকাল পরে রাজা বল্লাল সেন তার এক রক্ষিতার পুত্রকে সামাজিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করবার উদ্দেশ্যে এক পংক্তি ভোজের আয়োজন করলেন। নিমন্ত্রণ পাঠান হল রাজ্যের সর্বত্র। প্রতিটা জাতিগোষ্ঠি থেকে সেই ভোজ সভায় প্রতিনিধি এল কিন্তু এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করল নমঃশুদ্র সমাজ। তারা বলল হোক রাজবীর্যে জন্ম, সন্তান তো রক্ষিতারই। আমরা অংশ নেব না ওই অনুষ্ঠানে।

রাজা প্রজাদের এই ঔদ্ধত্য সহ্য করবেন কেন! এতে ভীষণ ক্রদ্ধ হলেন বল্লাল সেন। নব ব্রাহ্মণরা তো নমঃশূদ্রদের উপর আগে থেকে বিরূপ হয়ে ছিলই। পূর্বাগ্রহ থেকে তারা রাজার ক্রোধকে আরও উস্কে দিল–”দেখলেন তো মহারাজ স্পর্ধাটা। এর একটা বিহিত করুন। ওদের কঠোর কোন সাজা দিন।” তাদের চাটুকারিতায় তুষ্ট হয়ে বল্লাল সেন কৌলিন্য প্রথার প্রবর্তন করে কিছু স্তাবক চাটুকারদের সমাজে উচ্চস্থান দিয়ে পুরস্কৃত করলেন আর শাস্তি দিলেন নমঃশুদ্র সমাজের মানুষকে সমাজচ্যুত করে। ঘোষণা করে দিলেন তিনি–“আজ থেকে এরা সব চণ্ডাল বলে গণ্য হবে। সমাজে চণ্ডালদের যে স্থান, নমঃশূদ্রদের প্রাপ্য হবে সেই স্থান।”

ভারতীয় বর্ণ ব্যবস্থায় চতুবর্ণ বিভাজনে সর্বোচ্চ স্থানে রাখা হয়েছে ব্রাহ্মণকে। যার নিচে ক্ষত্রিয় তার নিচে বৈশ্য এবং সবার নিচে শূদ্র। যাদের কাজ উপরোক্ত তিনবর্ণের সেবা করা এবং তাদের দয়া কৃপা দানের অন্নে জীবন নির্বাহ করা। যে কারণে শূদ্রের আর এক নাম দাস। বলা হয়ে থাকে যে ব্রহ্মার মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উদর থেকে বৈশ্য ও পা থেকে শুদ্রের জন্ম। পা তো দেহের সব চেয়ে নিম্ন ও নিকৃষ্ট স্থান। যার উৎপত্তি ওই স্থানে সে আর উচ্চ হবার অধিকার কি করে পাবে। যে কারণে ওই তিন বর্ণের বিচারে শূদ্র এক হীন নীচ ঘৃণ্য মানবেতর প্রাণী। শাস্ত্র অনুসারে এদের জ্ঞান, বিদ্যার্জনের ধন সম্পদ সঞ্চয়ের, ভদ্রচিত পরিচ্ছদ পরিধানের কোন অধিকার নেই। যদি কেউ শাস্ত্রবিধি লঙ্ঘন করে তার জন্য প্রচলন আছে কঠোর শাস্তির। শম্বুক নামের এক শূদ্র বেদ পাঠ করার কারণে রামচন্দ্র তাকে হত্যা করেছিলেন।

আমাদের মহান হিন্দুধর্মের শাস্ত্রে নির্দেশ আছে, যদি কোন উচ্চবর্ণ ওই হীন নীচ শূদ্র মানুষকে দয়া পরবশ হয়ে কোন খাদ্যদ্রব্য প্রদান করে সে খাদ্য অবশ্যই হতে হবে উচ্ছিষ্ট যা পরিবেশন করতে হবে কোন ভগ্ন পাব এর তাও

যদি কোন শুদ্র ধন সম্পদ সঞ্চয় করে, সেটা হবে শাস্ত্রবিরোধী কাজ। সে ধন সম্পদ কোন ব্রাহ্মণ ছিনিয়ে নিলে, সেটা কোনমতেই অন্যায় কর্ম হবে না।

যদি সে বেদ পাঠ করে তার জিভ কেটে দিতে হবে। যদি সে বেদপাঠ শোনে সিসা গরম করে ঢেলে দিতে হবে তার কানে। যদি কোন শূদ্র সজ্ঞানে কোন ব্রাহ্মণের অঙ্গে পদস্পর্শ ঘটায়, রাজা তাকে মৃত্যুদণ্ড দেবেন। আর যদি কোন ব্রাহ্মণ ক্রোধবশতঃ কোন শূদ্রকে হত্যা করে তিন দিন গায়ত্রী মন্ত্র জপ এবং গঙ্গাস্নানে সব অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত হয়ে যাবে। হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ট মনীষীদের দ্বারা লিখিতশাস্ত্র সমূহে একদল মানুষকে চির পদানত করে রাখার চেষ্টায় এইরকম নীতি নির্দেশিকা শত সহস্র।

যারা শূদ্র জাতির মানুষকে কোন মান মর্যাদা দিতে রাজি ছিল না, যাদের শাস্ত্র শূদ্রকে ঘোষণা করেছে, কাক ও কুকুরের সমগ্রোত্রের জীব বলে, তারা কী করে চাইতে পারে যে তাদের ঘরের কোন মেয়ে ওই “নিকৃষ্ট জাতির” কোন পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হোক। তার বীর্যে গর্ভে সন্তান ধারণ করুক। সেটা যে উচ্চবর্ণের পুরুষ কুলের অযোগ্যতার প্রমাণ। বড় লজ্জা আর অপমানের বিষয়। তাই তারা সমাজের অন্দরে কঠোর প্রহরা বসিয়ে বর্ণসংকর সৃষ্টির পথে বহু কাটা বিছিয়ে রেখেছিল। তবু কখন কখনো বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোয় পর্যবসতি হয়ে যেত। ওই সমাজের কোন কোন নারী কোন শূদ্র পুরুষের পরিশ্রমী পেশিবহুল সুগঠিত শরীর আর তার মনের আদি অকৃত্রিম সারল্য দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়ত। তখন সে প্রলুব্ধ করত ওই পুরুষকে তার ইচ্ছে পূরণের সক্রিয় সহযোগী হবার জন্য। যার ফলে কখন কখনো সেই নারী সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ত।

শাস্ত্রের বিধান আছে, যদি কোন শুদ্র কোন ব্রাহ্মণ কন্যাতে উপগত হয়, তাকে নির্মমভাবে হত্যা করবার। এটা অনুমান করা কঠিন নয় যে একটি মহিলার আবেদন, আকুলতা কতখানি তীব্র হলে একজন পুরুষ প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ত। সে যাই হোক তখন সেই ব্রাহ্মণ কন্যার গর্ভে শুদ্র পুরুষের বীর্যে উৎপন্ন সন্তানকে উচ্চবর্ণ সমাজ আর তাদের সমাজে স্থান দিত না। তারা সেই সন্তানকে ঘোষণা করত অচ্ছুত অস্পৃশ্য চণ্ডাল বলে।

শাস্ত্র বলেছে–চণ্ডালের নিবাস হবে লোকালয় থেকে দূর কোন নির্জন নদী তীরে। শবদাহ ও শুয়োর কুকুর পালন হবে তার পেশা। পরিধান বস্ত্র হবে তার শবগাত্র থেকে খুলে ফেলা পরিত্যক্ত পরিচ্ছদ। শত প্রয়োজন হলেও রাত্রিকালে কোন নগরে প্রবেশ করতে পারবে না। একস্থানে দীর্ঘদিন বসবাস করবার অধিকারও থাকবে না। স্থান থেকে স্থানান্তরে সতত পরিভ্রমণ করে বেড়াতে হবে। বিদ্যার্জনের সুযোগ থাকবে না। রাখতে পারবে না কোন সুভদ্র নাম। সদা সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে যেন তার ছায়া কোন ব্রাহ্মণের শরীরে না পড়ে। শুধু মাত্র এই অপরাধে তার মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে।

নমঃশূদ্র সমাজের মানুষ রাজ রোষানলে–এক আদেশে সামাজিক সম্মানের নিজস্ব অবস্থান থেকে এক ধাক্কায় পতিত হল এই অসহ্য অপমানজনক নরকতুল্য জীবনের অন্ধকার গহ্বরে।

সে কবে কতকাল আগেকার কথা। সেন রাজত্ব শেষ হবার পর বঙ্গে এল মুসলমান শাসন। যা চলে প্রায় সাতশ বছর। এরপর আসে ইংরেজ শাসন। সেও চলে প্রায় দুশো বছর। এই ন’শ বছরে দেশ জ্ঞান বিজ্ঞান শিল্প সাহিত্য–নানা শাখায় কত না এগিয়ে গেছে। কিন্তু এক তিলও অগ্রগতি হয়নি আজও হিন্দুধর্মের বর্ণবাদী মানসিকতার। মানুষকে বিনা কারণে অপমানিত, প্রতারিত করবার যে ধর্মীয় বিধান তাকে আজও বর্জন করতে পারেনি। তারা তা বর্জন করতে চায়ও না।

নমঃশূদ্র থেকে চণ্ডাল হয়ে যাবার হাজার বছর পেরিয়ে আসার পর কেমন ছিল সেই মানব গোষ্ঠীর জীবনযাপন তা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৯১১ সালে লিখিত ধর্মের অধিকার শীর্ষক প্রবন্ধটি পাঠে অবগত হওয়া যায়। তিনি লিখেছেন–

“আমি পল্লী গ্রামে গিয়া দেখিয়া আসিলাম, সেখানে নমঃশূদ্রদের ক্ষেত্র অন্য জাতিতে চাষ করে না, তাহাদের ধান কাটে না, তাহাদের ঘর তৈরি করিয়া দেয় না। অর্থাৎ পৃথিবীতে বাঁচিয়া থাকিতে হইলে মানুষের কাছে মানুষ যে সহযোগিতা দাবি করিতে পারে আমাদের সমাজ ইহাদিগকে তাহারও অযোগ্য বলিয়াছে; বিনা অপরাধে আমরা ইহাদের জীবন যাত্রাকে দুরুহ ও দুঃসহ করিয়া তুলিয়া জন্ম হইতে মৃত্যুকাল পর্যন্ত ইহাদিগকে প্রতিদিনই দণ্ড দিতেছি।”

এত অসহযোগ অপমান অত্যাচার অভাব অনটন অনাহার তবু নমঃশূদ্র সমাজের মানুষ প্রাগঐতিহাসিক প্রাণীদের মত বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। আজও তারা স্বীয় ক্ষমতায় টিকে রয়েছে। এতেই তাদের জীবনীশক্তির প্রমাণ পাওয়া যায়।

এই দেশে সর্ব প্রথম জনগণনার কাজ শুরু হয় ইংরেজ শাসনকালে। ১৮৭২ সালে সেই প্রথম জনগণনার ভার এদেশীয় যে সব উচ্চবর্ণ রাজকর্মচারীদের উপর ন্যস্ত হয়েছিল তারা অভ্যাস এবং ঘৃণাজনিত কারণে নমঃশূদ্রদের জাতি পরিচয় স্থলে নমঃশূদ্র না লিখে চণ্ডাল লেখা শুরু করে দেয়। এরই প্রতিবাদে নমঃশূদ্র সমাজ প্রবল বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বরিশাল ফরিদপুর খুলনা যশোর নমঃশূদ্র অধ্যুষিত এই চার জেলায় এক সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়। তখন নমঃশূদ্র সমাজ জীবনে এক ঝলক আলো প্রবেশ করেছে। ১৮১২ সালে এই সমাজে জন্মেছিলেন হরিচাঁদ ঠাকুর নামে এক মহান মানুষ যিনি মারা যান ১৮৭৮ সালে। এঁর প্রবর্তিত মতুয়া ধর্মের মাধ্যমে সমস্ত নমঃশূদ্র সমাজের মানুষ তখন সংঘবদ্ধ হচ্ছিল। হরির্চাদ ঠাকুরের সুযোগ্যপুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর, যার জন্ম ১৮৪৮ সালে। গুরুচাঁদ ঠাকুরের উদ্যোগে খৃষ্টান ধর্মর্যাজক মিঃ মীড সাহেবের সহযোগিতায় ওড়াকান্দি সহ নানাস্থানে স্থাপিত হয়েছে অনেকগুলো স্কুল। “শিক্ষা আনে চেতনা”–জ্ঞানের আলো পেয়ে নমঃশুদ্র সমাজের মানুষ তখন আলোকিত হয়ে উঠেছে। তাই একদল তরুণ সেই অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে, সমাজ বদলের–সম্মানিত জীবনের স্বপ্নে এগিয়ে চলেছে। সে এক মহা জাগরণের সূচনাকাল, নিদ্রোথিত লক্ষ লক্ষ নমঃশূদ্রদের তখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন হরিচাঁদ ঠাকুরের সুযোগ্য পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর। বেদ ব্রাহ্মণ বিরোধী এক নতুন ধর্মমত “মতুয়া” ধর্ম সংগঠনের মাধ্যমে গুরুচাঁদ ঠাকুর তাদের সংঘবদ্ধ করে, সচেতন করে, মানুষদের মনে জ্বালিয়ে তুলেছেন আত্মসম্মানের দীপ্ত মশাল–আমরা কারও চেয়ে ছোট নই, কেউ বড় নয় আমাদের চেয়ে।তখন নমঃশূদ্র সম্প্রদায়। সংঘবদ্ধ এমন এক শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে যে তাদের ক্ষমতাকে অস্বীকার করবার সাহস কারও ছিল না। তারা ওই অপমানজনক চণ্ডাল শব্দ বদলের দাবিতে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলল। অবশেষে গণ আন্দোলনের চাপে ইংরেজ সরকার ১৯১১ সালে নমঃশূদ্রদের সমস্ত সরকারি নথি পত্রে নমঃশুদ্র জাতি পরিচয় লেখবার আদেশ দেয়। সেই আদেশনামায় এদেশীয় রাজকর্মচারী গণকে সতর্কীকরণ করে বলা হয়, যদি কোন রাজকর্মচারী নমঃশূদ্রদের জাতি পরিচয় স্থলে নমঃশুদ্র না লিখে চণ্ডাল বা অন্য কোন অপমানজনক শব্দ লেখে তাহলে তার চাকরি হারাতে হবে, এই কারণে উচ্চবর্ণের সরকারি কর্মচারীরা আর চণ্ডাল লেখবার সাহস করে না। তখন থেকে নমঃ শূদ্ররা পাকাপাকি ভাবে নমঃশূদ্র নামেই স্বীকৃতি পেতে থাকে।

ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারণা ১৮৭২ থেকে ১৯১১–প্রায় চল্লিশ বছর কালের এই দীর্ঘ লড়াই সবটা এক অকারণ পণ্ডশ্রমে পর্যবসিত হয়েছে। ১৯১১ থেকে ২০১১ শত বছর অতিক্রান্ত। চণ্ডাল নাম বিমুক্ত হয়ে, নমঃশূদ্র নামে হিন্দুধর্মের চতুবর্ণ ব্যবস্থার মধ্যে অনুপ্রবেশ পেয়ে, তারা কী ফিরে পেয়েছে তাদের হৃত সামাজিক সম্মান? পাচ্ছে কী বর্ণপ্রভুদের কাছ থেকে সেই মানবিক ব্যবহার?

আজ নমঃশূদ্র সমাজের মানুষের মধ্যে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার রাজনেতা কবি শিল্পী সাহিত্যিক কম নেই। ডাক্তার তার রোগীর কাছে শিক্ষকতার ছাত্রছাত্রীর কাছে কবি সাহিত্যিক তার পাঠক পাঠিকার কাছে রাজনেতা জনতার কাছে সাধারণতঃ যে শ্রদ্ধা সম্মান পাবার অধিকারী সেটুকু তিনি পেশাগত কারণে হয়ত পেয়ে থাকেন, কিন্তু যখন সমপেশার সম প্রতিভার দশ জন একত্রিত হন, স্বাভাবিক কারণেই সেই দশজনের নয় জন হবে উচ্চবর্ণ, কেউ কী বুকে হাত রেখে বলতে পারবেন যে সেই সংখ্যাগরিষ্ট উচ্চবর্ণ মানুষরা নমঃশুদ্র মানুষটির প্রতি সমসম্মান প্রদর্শন করে? মুখ নিচু করে, আড়ালে হাসাহাসি, নিন্দামন্দ, বিদ্রূপ করে না? যে সব বিশিষ্ট নমঃশুদ্র মানুষদের সাথে আমার মেলামেশা এ বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতা বড় তিক্ত, বড় মনোকষ্টের। তাই আজ মনে হয় সেদিনের সেই নাম বদলের আন্দোলন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে গেছে। নামটির বদল নয়, প্রয়োজন ছিল মানসিকতা পরিবর্তনের আন্দোলন। সেটা হয়নি বলে নমঃশূদ্র সমাজ সামাজিকভাবে আজও রয়ে গেছে সেই অবজ্ঞা অবহেলা অপমানের স্তরে। এক ইঞ্চিও সম্মান বেড়েছে এমন প্রত্যয় হবার মতো কারণ ঘটেনি।

আমার তো এমন মনে হয়, হিন্দু ধর্মের দাসত্ব স্বীকার করে নিয়ে চতুবর্ণ ব্যবস্থার মধ্যে অনুপ্রবেশ করে নমঃশূদ্র সমাজ বর্ণ প্রভুদের গোলাম হয়ে যাবার চেয়ে সেই “পঞ্চমবর্ণ” চণ্ডাল থাকাই অনেক মঙ্গল ছিল। আর যা কিছু হোক সে তো কারও দাস ছিল না। শাস্ত্রে শূদ্রকে দাস বলা হয়েছে। এবং দাসত্ব, তা সে সামাজিক আর্থিক ধর্মীয় যাই হোক তা কোন দিন মনুষত্বের বিকাশের সহায়ক হয় না।

.

আমার মা বাবা দুজনেই ছিলেন সরল সোজা মানুষ। ফলে তারা সঠিক ভাবে বলতে পারেননি আমার জন্ম সাল কোনটি। তবে আমার অনুমান সেটা সম্ভবতঃ ১৯৫০-৫১ সালই হবে। যার মাত্র কয়েক বছর আগে সেই চরম বিপর্যয় ঘটে গেছে যার নাম দেশভাগ। যে দেশভাগের অল্প কিছুদিন আগে সারা দেশকে ঝলসে দিয়ে গেছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়াবহ আগুন। কবীর-নানক-বুদ্ধদেব-শ্রীচৈতন্যের প্রেমবাণী পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল সেই আগুনে, স্বার্থপর রাজনেতাদের ধুর্ত বেওসায়িক কৌশলে। প্রথমে কলকাতা তারপর নোয়াখালি তারপর বিহার, এক দাঙ্গা প্রস্তুত করেছে আর এক দাঙ্গার প্রশস্ত সুতিকাগার। যেখানে জন্ম নিয়েছে শুধু ঘৃণা আর ঘৃণা, হিংসা আর প্রতিহিংসা। যার সর্বশেষ পরিণাম দেশভাগ। দেশভাগের কারণেই লক্ষ লক্ষ প্রাণভয়ে ভীত মানুষ প্রিয় স্বদেশ–“জননী জন্মভূমি” পরিত্যাগ করে পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছে এক অচেনা ভুগোল অজানা ইতিহাস আর অনেক অপমান অত্যাচানা বঞ্চনার অসহ্য এক অধ্যায়ের দিকে। আজও যার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লেখা হয়নি।

বরিশাল জেলার তুষখালির সন্নিকটে যে গ্রামে আমাদের বসবাস ছিল তখন পর্যন্ত সেখানে কোন ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা হয়নি। আজ হয়নি কিন্তু কাল যে হবে না, এর তখন কোন নিশ্চয়তা ছিলনা। সবাই জানে, দাঙ্গার বীজ সমাজ গর্ভে মজুদ হয়ে আছে। দুর কিংবা নিকট ভবিষ্যতে সে বীজে যে বিস্ফোরণ ঘটবে না এমন ভরসা তখন কে দেবে!

আমার ঠাকুরদারা ছিলেন তিনভাই। বরিশাল জেলার জল মাটির এমন গুণ যে সেই জলমাটির স্পর্শ পাবে সে সব জাড্যতা ঝেড়ে ফেলে ভীষণ রকম সাহসী হয়ে উঠবে। যে কারণেই এই মাটি ইংরেজ শাসকদের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া বহু বীর বিপ্লবীর জন্ম এবং কর্মভূমি।

আমার ঠাকুরদার ছোট ভাই একদিন সেই “বরিশাইল্যা” সাহসের নৌকায় সওয়ার হয়ে বের হয়ে পড়ে এক দূরদেশ যাত্রায়। সে যাবে উড়িষ্যার কটক জেলায় মোষ কিনে আনতে। খাল বিলের দেশ বরিশালে এখনও রেল লাইন বসেনি, তখন দেশের অন্যত্রও তা সম্পূর্ণ হয়নি। কটকে যেতে হলে পায়ে হেঁটে যাওয়া ছাড়া অন্যভাবে যাবার বিশেষ সুযোগ ছিল না। আর পথে পথে। তখন ছিল চোর ডাকাত ঠগির খুব উৎপাত। ছিল কলেরা ম্যালেরিয়া প্লেগ এই সব মারণ ব্যাধি। তবে এই সব বিঘ্ন বিপদ তুচ্ছ করে সেখানে গিয়ে দুচার খানা মোষ কিনে, এক দু মাস পায়ে হেঁটে ফিরে আসতে পারলে, এখানে যে দামে সেই মোষ বেঁচা যাবে, আর তাতে যা লাভ হবে, ছয় মাস খেটেও অত টাকা চোখে দেখা দুষ্কর।

কিন্তু ভাগ্য মন্দ তার। স্বদেশ স্বভূমি থেকে দশবারো দিনের পথ পার হয়ে এসে হঠাৎ সে আক্রান্ত হয়ে পড়ল মারণ রোগ কলেরায়। সেইকালে গ্রামবাংলায় কলেরা রোগের আর এক নাম ছিল মড়ক। যা একজনের হলে জনে জনে সংক্রামিত হয়ে পড়ত। মড়ক লেগে যেত সারা গ্রামে। উজার হয়ে যেতনগর জনপদ। মাত্র কিছু বছর আগে ভরত কাঠি নামক এক গ্রামে মড়ক লেগেছিল। প্রায় তিনশো পরিবারের সেই গ্রামে নাকি সব মানুষ মরে গিয়েছিল। ঘরে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালাবার মতো একজনও আর অবশিষ্ট ছিল না।

ছোট ভাইয়ের সঙ্গী সাথী ছিল সাত আটজন। যাদের মনে ভরত কাঠির স্মৃতি আতংক তখনও বড় টাটকা। ছোট ভাইয়ের রোগ দেখে সবার বুকে জেগে উঠল মৃত্যু ভয়। প্রাণ বড় মূল্যবান বস্তু। সে একবার যদি যায় আর ফেরে না। “আমি মরে গেলে আমার বউ বাচ্চার প্রতিপালন কে করবে।” অবশেষে তারা যুক্তি পরামর্শ করে মৃতপ্রায় ছোটভাইকে সেই গাছতলায় ফেলে যে যার প্রাণ নিয়ে পালিয়ে চলে এল এবং গ্রামে এসে বলে দিল, সে মারা গেছে।

যে রোগের কবলে সে পড়েছিল বিনা চিকিৎসায় বিনা সেবা শুশ্রূষায় মারা যাবারই কথা। সেটা হলে ভালই হোত অনেক বড় বিপদের সম্ভাবনা থেকে রক্ষা পেত এখানকার মানুষ। কিন্তু সে মারা গেল না। এক মুসলমান ভোরবেলা যাচ্ছিলেন ফজরের নমাজ পড়তে। তার চোখে পড়ে একজন মানুষ মারা যাচ্ছে। মানুষটা একা মরছে না তার সাথে মারা যাচ্ছে মানব সমাজের মনুষত্ব, বিবেক দয়া মায়া মানবিকতা সব কিছু। তার আর নমাজ পড়তে যাওয়া হল না। ছোট ভাইকে তুলে নিয়ে গেলেন নিজের বাড়িতে, এবং দীর্ঘ সেবা শুশ্রূষায় সুস্থ করে তুললেন তাকে। এরপর যেদিন সে নিজের গ্রামে ফিরে এল ততদিনে দুই দাদা শ্রাদ্ধশান্তি সেরে ফেলেছে তার।

যারা তাকে ফেলে গিয়েছিল তারা তো গ্রামে গিয়ে এই কথাই বলেছিল যে সে মারা গেছে। এখন সে জীবিত ফিরে আসায় সারা অঞ্চলে হৈ চৈ পড়ে গেল। দুটো পক্ষ হয়ে গেল গ্রামে। একদল বলল-এভাবে ফেলে এসে মিথ্যা কথা বলাটা ঘোরতর অন্যায়। আর একদল বলল, না, কোন অন্যায় নয়। একজনার জন্য কী পাঁচজন মরবে! এই নিয়ে বেঁধে গেল দুপক্ষের ঝগড়া লড়াই কঁজিয়া। এরপর গ্রাম সভায় বিচার গেল। গ্রাম্য মাতব্বরগণ বিচার করে, যারা ছোটভাইকে ফেলে এসেছিল তাদের দোষী সাব্যস্থ করে মোটা অংকের টাকা জরিমানা করলেন।

এরপর কেটে গেল বেশ কিছুদিন। হঠাৎ একদিন দূর দেশের সেই মুসলমান লোকটি কয়েকজন সঙ্গীসাথী নিয়ে খোঁজ খবর নিতে চলে এল ছোট ভাইয়ের। তখন গ্রামের সবাই জেনে গেল যে সে মুসলমানের অন্নজল খেয়ে বেঁচে এসেছে। এ যেন সেই লালন ফকিরের প্রাণে বাঁচার মতো আর এক ঘটনা। তখন সেই জরিমানা দেওয়া লোকেরা প্রতিহিংসাবশতঃ গিয়ে হাজির হল গ্রামের মাতব্বরদের দরজায়–“আমরা যা দোষ করছি তার জইন্য আপনেরা দশজোনে যা সাজা দিছেন আমরা মাতা পাইত্যা নিছি। এইবার আপনেরা ছোডোর বিচার করেন। হে যে মিয়াগো ঘরে ভাতগোস্ত খাইয়া আইছে তার কী হইবে”।

তখনকার গ্রামবাংলার বিচার ব্যবস্থা বড় কঠোর। জাতধর্ম রক্ষার জন্য ভীষণরকম নির্দয়। তাদের বিবেচনায়, আগুনে যে হাত দেয়, সে জেনে দিক আর না জেনে, হাত তো পুড়বেই। “ছোট” মুসলমানের অন্নজল খেয়েছে, সে বুঝে খাক আর না বুঝে, এর বিচার তো হবেই। ছেড়ে দেবার কোন প্রশ্নই ওঠে না। জাত ধর্ম বলে কথা! তাই বিচার হল অপরাধীর। সমাজপতিরা রায় দিল সে জাতি দ্রুত ম্লেচ্ছ, বিধর্মী হয়ে গেছে। আর তার সুমহান সনাতন ধর্মে কোন স্থান নেই। ফলে আমার সেই ঠাকুরদাকে জাত খুইয়ে “খেড়ে” হয়ে যেতে হল। যারা সরাসরি হিন্দু থেকে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে, তাদের বলা হয় খেড়ে। আর যারা বৌদ্ধধর্ম থেকে মুসলমান হয় তারা নেড়ে বলে চিহ্নিত হয় হিন্দু সমাজে।

সেদিন সে ছিল সারা গ্রামে একেবারে একা এবং অসহায় এক মানুষ। পরবর্তী কালে দিনে দিনে নানাভাবে “জাতমারা” যাওয়া লোকের সংখ্যা বেড়েছে। বেড়ে গেছে তাদের অন্য গ্রামের একই ধরনের লোকজনদের সাথে ঘনিষ্টতা। ধর্মীয় নিপীড়ন যাদের বেঁধেছে একসূত্রে।

প্রথম দিকে যারা সংখ্যায় ছিল কম এবং সামাজিক দিক থেকে খুবই দুর্বল; কারণ হিন্দুরা তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু ধর্মীয় বিধি পালন না করার জন্য মুসলমানরাও কাছে টেনে নেয়নি। বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক ঘটনাক্রম এবং অন্যান্য মুসলমান ভাইদের সাহস ও সহযোগিতায় তারা এসময়ে ভীষণ রকম বলবান। তারা যে কোনদিন হিন্দুধর্মের অতীত-অন্যায় অবিচারের প্রতিশোধ নিতে ক্রদ্ধ হায়নার মত ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। যুগ যুগান্তের সঞ্চিত ক্রোধে যদি একবার বিস্ফোরণ ঘটে তাহলে সে যে কতখানি নির্মম আর বিভৎস হতে পারে তারই বোধহয় প্রকৃষ্ট উদাহরণ “মুলাদির রায়ট”।

সেখানকার এক ইস্কুলে আশ্রয় নিয়ে ছিল প্রায় চারশো দাঙ্গায় ঘর পোড়া প্রাণভয়ে ভীত নরনারী শিশুবৃদ্ধ। পালাবার সব পথ বন্ধ করে দিয়ে তাদের সারারাত ধরে একে একে জবাই করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। শোনা যায়, এখানে ঘাতকেরা নাকি পায়ে নুপুর বেঁধে নেচে নেচে মানুষ কেটে ছিল। কে বলতে পারে যে তুষখালি, পিরিচপুর, জালোকাঠি, নাজিরপুর, এসব অঞ্চলেও একদিন দাঙ্গা হবে না!

দাঙ্গা! দু অক্ষরের ছোট্ট এই শব্দটার মধ্যে লুকোনো আছে সেই ভয়ংকর মারণ বিষ যা মানুষকে বোধবুদ্ধি বিচার বিবেচনা হীন একটা পাগলা কুকুর তুল্য জীবে পরিণত করে দেয়। যার কাছে তখন দয়ামায়া স্নেহমমতা আশা করা বৃথা।

তুষখালি অঞ্চলে আগে কোনদিন কোন মুসলমান ছিল না। শুধু এখানে কেন, অনেক অঞ্চলেই ছিল না। দুই বাংলা এক করলে জনসংখ্যার নিরিখে এখন হিন্দুর চেয়ে মুসলমানের সংখ্যা বেশি। এরা কেউ ইরাক ইরান সৌদিআরব থেকে আসেনি। সব এই দেশের মানুষ, যাদের পূর্ব পুরুষরা ছিল হিন্দু। এদের একটা বড় অংশ জন্ম নিয়েছে অসহিষ্ণু হিন্দু ধর্মের সংরক্ষকদের ভুল ভ্রান্তির ফাঁক ফোকর থেকে। এখন সেই বিষবৃক্ষের বিষময় ফল ফলতে শুরু করেছে। শত শত বছরের অপমান অবমাননার বদলা নিতে রক্তখেলায় নেমে পড়েছে চির অপমানিতের দল।

এ কী অমানবিক বিধান হিন্দুধর্মে? যে মানুষটা কাল পর্যন্ত ছিল আমার প্রতিবেশী, আত্মীয়, আপনজন, আজ সে যে কোন কারণে ধর্ম পরিবর্তন করে মুসলমান হয়ে গেছে বলে অচ্ছুত অস্পৃশ্য! সে যদি আমার উঠোনে এসে দাঁড়ায় কোন দরকারে, তো আমার উঠোনের মাটি অপবিত্র হয়ে যাবে! আর সেই মাটিকে পবিত্র করবার জন্য ছেটাতে হবে গরুর পায়খানা গোলা জল! সে যদি আমাকে ছুঁয়ে দেয়, স্নান করতে হবে শুদ্ধ হবার জন্য। অথচ বিষ্টাভোজী এক কুকুরের বাচ্চার জন্য এসব কিছুই করবার দরকার নেই। সে ইচ্ছা করলে আমার বিছানায়ও শুতে পারে। এই অপমান-অমানবিক বিধানের বিরুদ্ধে যে খেপে না ওঠে সে তো মনুষ্যপদবাচ্যই নয়। ওই একই ধরনের অপমান, ঘৃণা হিন্দুধর্মের উচ্চবর্ণের নিকট থেকে নমঃশূদ্ররাও পেয়ে থাকে। তাকে ছুঁয়েও ওরা চান করে, উঠোনে দাঁড়ালে গোবর জল ছেটায়। সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে নমঃশূদ্ররা তেমন কোন তীব্র প্রতিবাদ করতে পারেনি। কিন্তু মুসলমানরা পেরেছে। খেপে গেছে তারা, যে ধর্ম-যে মানুষ আমাদের ঘৃণা করে আমরা আর তাদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে রাজি নই।

এই কারণে পুর্ব পাকিস্থান থেকে ভয়ে আতংকে–অসুরক্ষায়, ভিটে মাটির মায়া ছেড়ে, প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল মানুষ “ইন্ডিয়া” নামক এক অচেনা ভূভাগের দিকে। যারা শিক্ষিত, আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল, সমাজের মাথা, উচ্চবর্ণের লোক তাদের প্রায় সবাই পালিয়েছে সবার আগে। যে দু পাঁচ জন আছে তারাও সব পালাই পালাই করছে। এই অবস্থায় যারা নির্ধন নিম্নবর্ণ নিম্নবর্গ তারা সেদেশে বাস করবে কোন সাহসে?

আমার বাবার মোটেই দেশত্যাগ করে আসবার ইচ্ছা ছিল না। মায়ের মুখে শুনেছিমুসলমানদের সাথে তার বেশ সুসম্পর্কই ছিল। তারা বাবাকে দেশে থেকে যাবার জন্য অনুরোধও করেছিল, “থাহো তুমি, দেহি কোন হালায় তোমার কী ছেড়ে।” কিন্তু বাবা তাদের অনুরোধ রাখতে পারেননি। আমাদের জ্যেঠাকাকা, আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী প্রায় সবাই ইন্ডিয়ায় চলে গেছে। ভাঙা দেশে ভাঙা মন নিয়ে দুরুদুরু বুকে বাবা কেমন করে বাস করবেন! তাই একদিন স্ত্রী পুত্রের হাত ধরে রওনা দিয়েছিলেন এপাড় বাংলায়।

আমার তখন সঠিক বয়েস কত জানি না। তবে একদিন আমাদের ঘরের সামনের গাঙপাড়ের রাস্তা ধরে জনা কয়েক লোক ভোটের প্রচার করতে শ্লোগান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল–সেটা মনে আছে। “ভোট দেবেন কাকে, চিত্ত সুতার কে”! কে সেই চিত্ত সুতার, তিনি কোন পার্টির লোক, আমার সে সব জানা নেই, তবে আমার পরের যে ভাই, আর নাম রাখা হয়েছিল সেই নেতার নামে চিত্ত, চিত্তরঞ্জন।

মা বাবা আমি আমার ভাই চিত্ত এবং একমাত্র মেয়ের মায়া ত্যাগ করতে না পারা আমাদের বুড়ি দিদিমা এই পাঁচজন একদিন এসে পৌঁছেছিলাম এই দেশে–“মহান দেশ ভারতবর্ষে।”

এপাড় বাংলায় এসে আমাদের বেশ কয়েকটা দিন কাটাতে হয় শিয়ালদহ স্টেশনের প্লাটফর্মে। সেখান থেকে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় বাঁকুড়া জেলার শিরোমণিপুর ক্যাম্পে। এখানে আমরা আসবার অনেক আগে এনে রাখা হয়েছে আমাদের মতো আরও কয়েক হাজার পরিবার। বিশাল একটা মাঠে সার সার খাটালে আছে লাল লাল ত্রিপলের ছাউনি। হাত আটেক লম্বা হাত ছয়েক চওড়া সেই তাঁবুর মধ্যে গুঁজে দেওয়া হয়েছে পাঁচ ছয় সাত সদস্যের এক একটা পরিবার।

শিরোমণিপুর ক্যাম্পের ঠিক মাঝখান থেকে একটা রাস্তা চলে গেছে উত্তর থেকে সোজা দক্ষিণে। ক্যাম্পবাসীরা নিজেদের সুবিধার জন্য পুবদিকের অংশের নাম রেখেছিল আমবাগান। কেননা এখানে কিছু আমগাছ ছিল। আর পশ্চিম প্রান্তের নাম দিয়েছিল শালবাগান। বলাবাহুল্য এখানে ফরেষ্ট বিভাগ দ্বারা রোপিত একটি শালবন আছে। আমাদের তাবু পড়েছিল আমবাগানে।

পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে বাঁকুড়া একটি খরাপ্রধান উষ্ণ জেলা। যে সময়ে আমাদের এখানে আনা হয় সেটা গ্রীষ্মকাল। প্রখর দাবদাহে তখন চারিদিক যেন জ্বলে যাচ্ছে। ক্যাম্পে তখন মানুষের জলকষ্ট ছিল বড় প্রবল। আম ও শাল দুই বাগানের লোকের জলের প্রয়োজন মেটাবার জন্য সদাশয় সরকার বাহাদুরের পক্ষ থেকে বসানো হয় দুটো টিউবয়েল। এ ছাড়া জলের আর কোন জোগানের পথ ছিল না। ফলে জলের কলের সামনে সারাদিনই মহিলাদের লম্বা লাইন লেগে থাকতো। এক দু ঘন্টা লাইন দিয়ে যে এক দু বালতি জল যোগাড় হোত সেই দিয়ে রান্না খাওয়া বাসন ধোওয়া চান সব কিছু।

এখন আর সঠিক পরিমাণটা মনে নেই তবে মনে আছে, প্রতি চৌদ্দদিন অন্তর আমাদের কিছু চাল ডাল দেওয়া হোত সরকারি গুদাম থেকে। একে বলা হোত ডোল। দেওয়া হোত মাথা পিছু কিছু নগদ টাকা। আমাদের পাঁচজনের পরিবারের জন্য বরাদ্দকৃত সে অর্থের পরিমাণ ছিল কুড়ি টাকা তের আনা। তের আনা মানে একাশি পয়সা। আমরা যে বছর এখানে আসি তখনও দশমিক মুদ্রার প্রচলন হয়নি। সেটা হয়েছিল এক দুবছর পরে। তবে মানুষ তখনও পুরানো হিসাবে “আনার” হিসাবই করত। ছয় নয়া পয়সায় এক আনা বারো নয়া পয়সায় দু আনা। আবার পঁচিশ পয়সায় চার আনা। এক আনা সের পুইশাক। একই দোকান থেকে চার সের কিনলে এক পয়সা বেশি যায় বলে আমাদের পাশের তাবুর রাইচরণ দুসের দুসের করে দুই দোকান থেকে কিনে এক পয়সা বাঁচিয়ে নিত। বাবার মাথায় কোনদিন সে বুদ্ধি আসেনি।

বাবা ডোল পেত যখন তখনও সেই ফুটো পয়সার প্রচলন ছিল, আমাকে একটা পয়সা দিতেন। মা তাকে গেথে দিতেন কোমরের তাগায়। বলে দিতেন এই পয়সা যেন খরচ না করি। যেন জমিয়ে রাখি কোন এক পুজো পার্বণ আনন্দের দিনে খরচা করবার জন্য। না হলে সবাই যখন খাবার কিনবে, খাবে, আমার তখন লোকের মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে হবে।

ডোল পাবার পরেরদিন বাবা ক্যাম্প অফিসে জানিয়ে এক বেলার ছুটি নিয়ে বিষ্ণুপুরের চক বাজারে বাজার করতে চলে যেতেন। সেইদিন আমাদের মাছের ঝোল, আর ভাল চালের ভাত পেট ভরে খাওয়া হোত। চৌদ্দদিনের পঁচা পোকা কাঁকর পাথর খাওয়া মুখে সেদিন যেন অমৃত বর্ষা হোত। ক্যাম্পের সরকারি গুদাম থেকে আমাদের “ভোল” বাবদ যে চাল ডাল দেওয়া হোত ধুলো ময়লা কাকরে মাখামাখি সে চাল যে কতকালের পুরনো তা কে জানে। কেউ কেউ বলত এ চাল নাকি সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর জন্য গুদামজাত করে রাখা হয়েছিল, দশ বারো বছরে যা পঁচে গোবর হয়ে গেছে। সে চালে ভাত রান্না করলে কেমন একটা টকটক বোটকা গন্ধ বের হোত। কেরোসিন তেল তো ছিল না। সারা ক্যাম্পের বেশির ভাগ তাঁবুতে কেরোসিনের অভাবে সূর্য ডোবার আগে রাতের রান্নাখাওয়া সেরে ফেলা হোত। এত তাঁবুতে এক সাথে ভাত রান্না হবার ফলে সেই বোটকা গন্ধে সারা অঞ্চল প্লাবিত হয়ে যেত।

এই চালের ভাত খাওয়ার ফলে প্রথম প্রথম কিছুদিন সবারই পেট পেট গুঢ় করত। জলের মতো পাতলা পায়খানা হোত। ক্যাম্পের ভিতর কোন পায়খানার ব্যবস্থা ছিল না। সবাইকে সে কাজ সারতে যেতে হোত বনে বাদারে মাঠে জঙ্গলে। যারা সুস্থ মানুষ, বিশেষ করে মহিলারা সূর্য ওঠার আগে বা সূর্য ডোবার পরে একর্ম সেরে নিত। তবে যাদের পেট খারাপ-পাতলা পায়খানা হচ্ছে, সে আর অন্ধকারের জন্য অপেক্ষা কী করে করবে, দুরের মাঠে বা কেমন করে যাবে! সে বসে পড়ত তাবুর আড়ালে। যার ফলে ক্যাম্পের চারদিকে জমে গিয়েছিল মলমূত্রের মহাসাগর। পথ চলবার সময়ে সতর্কভাবে পা না ফেললে বিষ্ঠা মাড়িয়ে দেবার সম্ভাবনা ছিল বড় প্রবল। আর এটা আমাদের অর্থাৎ শিশুদের প্রায়ই হয়ে যেত।

এই অখাদ্য চাল ডাল খেয়ে মানুষের নানাবিধ পেটের রোগ, তার উপর ছিল অসহ্য গরম। জলবিহীন শুষ্ক গরম জেলা যেখানে এই সময় “লু” বাতাস বয়। সে বাতাসে যেন আগুনের হল্কা যা শরীরে লাগলে চামড়া ঝলসে যায়। তখন দুপুর হলে মনে হতো আমাদের চারিপার্শ্বে যেন দাউ দাউ আগুন জ্বলছে। সূর্যের শরীর থেকে ছুটে আসা তপ্ত রশ্মিকণা মাটিতে আঘাত করে আবার কেঁপে কেঁপে উপরের দিকে উঠতে থাকত। তখন খালি পা মাটিতে রাখা যেত না। মনে হোত মাটি যেন রুটি সেঁকা চাটুর মতো উত্তপ্ত। এখানকার সব মানুষই নদী মাতৃক দেশ পূর্ববাংলার অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় আজন্ম লালিত পালিত। তারা হঠাৎ ভাগ্য বিপর্যয়ে এমন শুষ্ক নীরস কঠিন মাটিতে আছড়ে পড়ে, সব যেন জলবিহীন মাছের মত ছটফট করে মরছিল।

এমনিতে তো নির্দয় আকাশ আগুন ঢালছে, সে আগুন আবার এসে পড়ছে মোম মাখানো ত্রিপলের ওপর। যার ফলে তাঁবুর মধ্যে তাপমাত্রা চতুগুণ বেড়ে যাচ্ছে। এই অসহনীয় অবস্থায় বেশ কয়েক মাস ধরে ক্যাম্পে মৃত্যুর হার অসম্ভব বৃদ্ধি পেয়েছিল। যেন মড়ক লেগে গিয়েছিল সারা ক্যাম্প জুড়ে। আমাদের সামনে পিছনে ডানে বাঁয়ে অনবরত চলছিল অন্তহীন এক মৃত্যুর মিছিল। একটি মৃতদেহ দাহ করে ফিরে এসে লোজন আর একটা মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে যাবার প্রস্তুতি শুরু করে দিত।

ক্যাম্পের মাঝখান থেকে যে রাস্তাটা পুবদিকে চলে গেছে মাইলটাক সামনে গেলে ছিল একটা ছোট্ট ডোবা। এখানেই দাহকরা হোত সব মৃতদেহ। দিনরাত সেখানে চিতা জ্বলতমড়াপোড়া ধোয়ায় ঢেকে যেত আকাশ। এই সব মানুষের মধ্যে বৃদ্ধ বৃদ্ধা ও শিশু মৃত্যুর হার ছিল সবচেয়ে বেশি। তবে দাহ করা হোত শুধু বয়স্কদের। শিশুদের দেওয়া হত মাটি চাপা।

ক্যাম্পে তখন বার্ডফ্লু রোগ লাগা মুরগির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ মারা যাচ্ছে আর সদাশয় সরকার বাহাদুর কী করছে? তবে কী ক্যাম্পে ন্যুনতম কোন চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না? না, না, মহান ভারত সরকারের মহান মন্ত্রী আমলাদের এমন অপবাদ মরে ভুত হওয়া লোকজনও দিতে পারবে না। রীতিমত উত্তমকুমারের মত সুদর্শন, চুলে ঢেউ তোলা একজন ডাক্তার ছিল। তার চোখে দামি চশমা, মাথায় ইংরেজদের মত টুপি ছিল। মালার মত গলায় ঝোলাবার জন্য ছিল একটা স্টেথেস্কোপ, আর চড়বার জন্য ছিল টুংটাং বেল বাজানো সাইকেল। শুধু তার কাছে ছিল না সেই প্রাণদায়ী ওষুধ যা খেলে রোগী রোগমুক্ত হয়।

সে আর ও বেচারার কী দোষ। সে তো বার বার সরকারের হেলথ ডিপার্টমেন্টে–ওকে কী বলে, রিকুইজেসান পাঠিয়েছে, তারা যদি ওষুধপত্র না পাঠায় ডাক্তার আর কী করবে? ডাক্তারের কাছে ওষুধ বলতে ছিল স্রেফ দু রকম জল। যার একটা মেয়েদের পায়ে পড়বার আলতার মত লাল। আর একটা চুনগোলা জলের মতো সাদা পদার্থ। সর্দিকাশি জ্বরজারি মাথাব্যথা পেটব্যথা আমাশয়, দাস্ত থেকে শুরু করে টাইফয়েড টিবি কলেরা জন্ডিস–সব রোগের এক দাওয়াই ওই সাদা জল দিনে তিনবার। আর কাটা ফাটা পোড়াফোঁড়া সব রোগের জন্য ওই লাল রঙ দিনে দুবার।

যদি আলতা আর চুনজলে রোগ সেরে যায়, রোগী তো বেঁচে উঠবে কিন্তু মরে যাবে হাজার বছর ধরে হাজার মানব দরদি চিকিৎসকদের বহু পরিশ্রমে গড়ে তোলা চিকিৎসাশাস্ত্র। এই যে এত সব নামিদামি ডিগ্রিধারী ডাক্তার বড় বড় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, এত ওষুধ পত্র মেশিন যন্ত্র সব ফালতু, বেকার, মিথ্যে হয়ে যায়। তাই রোগীরা মরে যেত। মরে যেত এই বিশ্বাস নিয়ে যে বিনা চিকিৎসায় মরছি না। এম.বি.বি.এস. ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে মরছি।

ক্যাম্পের শিশুরা যাদের বয়েস সাতআট বছরের নিচে, সেই বাচ্চাগুলোই মারা যাচ্ছিল সবচেয়ে বেশি। তখন এমন রাত খুবই কম আসত যে দিন ক্যাম্পের কোন না কোন তাঁবু থেকে সন্তানহারা মায়ের বুকফাটা কাতর কান্না শোনা না যেত।–”ওরে সোনা মানিকরে আমার, মায়রে ফালাইয়া কই গেলিরে বাবা।” সে কান্নায় সারা ক্যাম্পের আকাশ বাতাস বেদনাতুর হয়ে উঠত। ওই রকম আর্তকান্নার সময়ে অন্ধকার হাতড়ে মা আমাদের দুইভাইকে বুকের মধ্যে চেপে ধরতেন। বিড়বিড় করে তার ইষ্টদেবতাকে ডাকতেন। গ্রামবাংলার সরল মমতাময়ী মা ভক্তি বিশ্বাসে বুঝি এই রকম ভাবত যে তার বুকে থেকে যমরাজ তার সন্তানকে কেড়ে নিতে পারবে না।

ধর্ম বিশ্বাসী মায়ের সে বিশ্বাস টাল খেয়ে গেল একদিন। যেদিন শমনের সমন এসে পৌঁছল আমার কাছে। “চলরে ভোলা, খোল রে ভেলা, সাঙ্গ হল ভবের খেলা।” ছোট্ট পেটটা আমার জয়ঢাকের মতো ফুলেফেঁপে উঠল, সেই সাথে ধুম জ্বর, মাথায় অসম্ভব যন্ত্রণা। একদিন পরে শুরু হল পাতলা পায়খানা। দিন দুয়েক পরে পায়খানার সাথে কাঁচা রক্তের স্রোত। এর ওপর পেটের মধ্যে নাড়িছেঁড়া যন্ত্রণা। দিন পাঁচ সাতেকের মধ্যে গোড়া কাটা পুইগাছের মতো নেতিয়ে পড়লাম আমি। অবসন্ন হয়ে গেল সারা শরীর। তখন আর বিছানা ছেড়ে ওঠবার উপায় রইল না। শুয়ে শুয়েই মলমূত্র ত্যাগ। দিনে দশ পনের বিশবার। তখন কেঁৎ পাড়লেই কাজুফুলের মত মলভাণ্ডটা গুহ্যদ্বার থেকে বাইরে বের হয়ে আসছে। সেটা মা বা দিদিমা হাত দিয়ে ঠেলে ভিতরে যতক্ষণ না ঢুকিয়ে দিচ্ছে, ঝুলে থাকছে বাইরে।

আমার এখন মনে নেই দশ না পনের দিন এইভাবে রোগভোগের পর শেষ পর্যন্ত ‘মারা’ গিয়েছিলাম আমি। আমাদের জাতের লোক মৃত শিশুদের পোড়ায় না। তা ছাড়া সেই সময় এত বয়স্ক মানুষ মারা যাচ্ছিল যে জঙ্গলে শুকনো কাঠের আকাল পড়ে গিয়েছিল। তাই বন্দোবস্ত হয়েছিল আমাকে “গোর” দেবার। পূর্ববঙ্গ থেকে পলাতক এই সব মানুষ আসবার সময় সাথে করে অনেক দামি দরকারি জিনিসপত্রই নিয়ে আসতে পারে নি। সব ফেলে রেখে এসেছে। তবে আর শাবল কোদালের মত জিনিস বয়ে আনবে কী করে। রিফিউজিদের সুবিধার্থে সদাশয় সরকার সে সব যোগাড় করে ক্যাম্প অফিসে রেখে দিয়েছে। একটা কী! একসাথে দশটা মারা গেলেও মাটি দেবার সাজ সরঞ্জামে ঘাটতি পড়বে না।

আমাদের কয়েকজন প্রতিবেশী অফিসে গিয়ে শাবল কোদাল সব নিয়েও এসেছিল। আমি মারা গিয়েছিলাম সন্ধ্যার বেশ কিছু সময় পরে। ফলে তাদের তখন আর গোরস্থানে যাবার ইচ্ছা হয়নি। শাবল কোদাল গুছিয়ে রেখে বসেছিল রাতটা শেষ হবার অপেক্ষায়। তাদের ইচ্ছা ছিল, সকাল হবার সাথে সাথে আমাকে নিয়ে চলে যাবে, আর রোদের তেজ বাড়বার আগেই কাজ সেরে ফিরে আসবে। এবার এই কোন সে অলৌকিক অবিশ্বাস্য অসম্ভব কাণ্ড আমার তা জানা নেই, মায়ের মুখে শুনেছি, সন্ধ্যে রাতে মরে গিয়ে, সারারাত মৃত থেকে ভোরবেলা যখন মোরগ ডাক দেয়, পুণর্জন্ম হয়েছিল আমার। নড়েচড়ে উঠেছিলাম আমি। বেলা যত বাড়ছিল, আমার শরীরে একটু একটু করে প্রকাশ পাচ্ছিল প্রাণের স্পন্দন। এবং এক সপ্তাহের মধ্যে আমি রোগ মুক্ত হয়ে গিয়ে সুস্থ হয়ে যাই।

এই শিরোমণিপুর ক্যাম্প কতদিনের পুরনো সে আমি জানি না। তবে আমরা এখানে এসেছিলাম যখন সেটা মনে হয় ১৯৫৩-৫৪ সাল হবে। তার প্রায় এক দুবছর ধরে সারা ক্যাম্প জুড়ে প্রবল দাপাদাপির পর মৃত্যুর দেবতা দয়া করে অসহায় মানুষগুলোকে একটু রেহাই দিয়েছিল। কথায় বলে, শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাহা সয়। তখন রিফিউজিদের এখানকার পচা পোকা ধুলো কঁকর যুক্ত চাল ডাল, এখানকার জল হাওয়া রোদ মাটি সব সয়ে নেবার ক্ষমতা বেড়ে গেছে। মানুষ আর অত অল্পে কাতর হচ্ছে না, পোঁকা মাকড়ের মতো মরছে না।

এবার আমার বাবার শখ হল আমাকে চক্ষুম্মান বানাবেন। অর্থাৎ লেখাপড়া শেখাবেন। যে লেখাপড়া জানে না সে চোখ থাকতেও অন্ধ। অন্ধ এক বাপ তার ছেলেকে আর অন্ধ রাখতে চাননা। অন্ধত্বের যে কী কষ্ট তা তিনি মর্মে মর্মে জানেন। লেখাপড়া জানা বাবুদের কাছে যদি কখনো একটা সামান্য চিঠিও পড়ে শোনাবার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়, এক প্রহর বেগার না খাঁটিয়ে কিছুতে সে চিঠি পড়ে শোনাবে না।

পূর্ববঙ্গে গরিব-নিম্নবর্ণের মানুষের লেখাপড়া শেখবার তেমন বিশেষ একটা সুযোগ সুবিধা হাতের নাগালে ছিল না। ইচ্ছা থাকলেই তারা লেখাপড়া শিখতে পারত না। এখানে সেই সুযোগ আছে। ক্যাম্পের মধ্যেই সরকারি ব্যবস্থাপনায় একটা প্রাইমারি স্কুল খোলা হয়েছে। সারা ক্যাম্পের বালক বালিকারা এখানে পড়ে।

যেদিন আমাকে স্কুলে ভর্তি করার মনোবাসনা, তার দিন সাত আট আগে থেকে শুরু হয়েছিল তার প্রস্তুতি। বাবা চলে গিয়েছিলেন খুঁজতে কোথায় তালগাছ ও বাঁশঝাড় আছে। শিশুশিক্ষায় এই দুটোর অবদান অসামান্য। তালগাছ পেয়ে তরতর করে বাবা চড়ে গিয়ে ছিলেন তার মাথায়। আর সেখান থেকে বেছে বেছে নামিয়ে এনেছিলেন একগোছা তালপাতা। এরপর বাঁশ বাগানে গিয়ে কেটে এনেছিলেন দুখানা কঞ্চি। একখানা বিঘত খানেক ছোট আর একখানা হাত দেড়েক বড়। ছোটখানার মাথা থেঁতো করে হবে কলম, আর বড়খানা হবে বেত। আমি পড়া না পারলে যা দিয়ে মাষ্টার আমার ছাল তুলবে। বাবা খুব গভীরভাবে লক্ষ্য করেছেন যে, বাচ্চারা পড়া না পারলে মাষ্টার মারবার জন্য তাকেই ঢোলকমলির লাঠি ভেঙে আনতে বলে জঙ্গলে পাঠায়। বাবার বিচারে এটা ঠিক নয়, বনে জঙ্গলে সাপ বিছে থাকতে পারে। তারা যদি কামড়ায় বাচ্চার লঘুদোষে গুরুদণ্ড হয়ে যাবে। বাবা তাই শক্তপোক্ত একটা লাঠি নিজেই দিয়ে দেবেন আমার কাছে। ঢোলকমলি ভাঙবার সেই ভয়াবহ মুহূর্ত এলে আমি যেন সেটা মাষ্টারের শ্রীহস্তে অৰ্পণ করি।

এরপর সেই শুভদিনে, সকালে আমাকে চান করিয়ে, কানের পাশ থেকে গড়িয়ে আসার মত মাথায় চপচপে সরষের তেল দিয়ে চুল আঁচড়ে, নববস্ত্র পরিয়ে, এক বগলে বামুনে পৈতার মত দড়িবাধা একগোছা তালপাতা অন্য বগলে এক বোতল ভুষিকালি, পকেটে কঞ্চির কলম, তালপাতা পোছবার জন্য জল ন্যাকড়া, বসবার জন্য ছেঁড়া চট, দুপুরে যখন খিদে লাগবে, অর্থাৎ টিফিন টাইমে খাবার জন্য খুদের নাড়ু। এসব দিয়ে আমার হাত ধরে বাবা আমাকে নিয়ে গেলেন স্কুলে। স্কুলটি আমাদের তাবু থেকে অতি সামান্যইঁদুরে। স্কুলে ঘন্টা বাজালে আমাদের তাবু থেকে শোনা যায়। বাবা চেয়েছিলেন আমার চোখে আলো জ্বালবেন, স্কুলের সামনে পৌঁছে তার সে আশার আলো দপ করে নিভে গেল। কারণ, স্কুল আর খুলবে না। আজ থেকে সব পড়াশোনা বন্ধ।

এরপর বেলা যত বাড়তে থাকল একটার পর একটা দুঃসংবাদ পাওয়া যেতে লাগল। জানা গেল রিফিউজিরা এতদিন ধরে ডোল বাবদ যে সব চালডাল অর্থ সাহায্য পেত সে আর পাওয়া যাবে না। যার যার দায়িত্ব এখন তার তার। আজ থেকে সরকার রিফিউজিদের আর কোন দায় দায়িত্ব নেবেনা। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া, আর্থিক দিক থেকে দুর্বল একটা সরকারের পক্ষে এভাবে দিনের পর দিন বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ান আর সম্ভবপর হবে না। এতে দেশের যে রকম, প্রকারান্তরে সেই মানুষটির নিজেরও বিরাট ক্ষতি। সে বসে বসে খেতে পেয়ে অলস কর্মভীরু হয়ে যাচ্ছে। এটা কাম্য নয়।

একথা এই সরকার ছাড়া কারও পক্ষে অস্বীকার করবার উপায় নেই যে নমঃ পোঁদ জেলে মালো এই সব লোক কঠোর পরিশ্রমী। এরা কেউই শখ করে ক্যাম্পে বসে খাবার জন্য দেশত্যাগ করে আসেনি। এসেছে প্রাণের দায়ে মান সম্মানের ভয়ে। এদের এসব ভয় না থাকলে কোনদিন দেশ ছেড়ে আসত না। যে মানুষ দেশভাগ জনিত কারণে বাঁধভাঙা বন্যার জলের মত, একান্ত বাধ্য হয়ে আছড়ে পড়েছিল এপার বাংলায়, এই সব ছিন্নমূল মানুষের মধ্যে ছিল স্পষ্টতঃ দুটো ভাগ। একভাগ সচ্ছল শিক্ষিত উচ্চবর্ণ–এক কথায় যাদের বলা হয় ভদ্রলোক। আর একদল হল নিঃস্ব নিরক্ষর নির্ধন, নিম্নবর্ণ।যারা তথাকথিত ভদ্র লোকদের কাছে ছোটজাত ছোটলোক। যারা ভদ্রলোক তারা তাদের চিরকালের বর্ণবিদ্বেষ প্রসূত মানসিকতার কারণে নমঃ পোঁদ জেলে কামার কুমোর জোলা হাড়ি মুচি মানুষদের সাথে সহাবস্থানে রাজি ছিল না। তাই তারা কেউ খাতায় নাম লিখিয়ে ডোল নির্ভর ক্যাম্প বাসিন্দা হতে চায়নি। এরা সরকারের স্বজাতের নেতামন্ত্রীদের সমর্থন সহযোগিতায় কলকাতা ও তৎসংলগ্ন নানা অঞ্চলে একের পর এক প্রায় দেড়শত জবরদখল কলোনী গড়ে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। কিছু লেখাপড়া জানা থাকার কারণে কিছু রাজনৈতিক যোগাযোগের ফলে, কিছু জাতিগত ধূর্ততা শঠতার কৌশলে চাকরি ব্যবসা বা অন্য কোন উপায়ে রুজিরোজগার ধনাগমের সুব্যবস্থা করে নিতে বিশেষ কোন অসুবিধার সামনে পড়েনি। এরা সুখেই ছিল এবং সত্য এটাই যে অনেকে এত সুখ পূর্ববাংলায়ও ভোগ করতে পারেনি।

এর বাইরে যে লক্ষ লক্ষ নিম্নবর্ণ নিম্নবর্গ বাস্তুহারা মানুষ, যারা ওপার বাংলায় সতোর সাথে কায়িকশ্রমে দিনগুজরান করতে বাধ্য ছিল সেই সব মানুষ যারা দেশ ছেড়ে এসেছেশূন্যহাতে তারা নিরুপায় হয়ে আশ্রয় নিয়েছিল রিফিউজি ক্যাম্পে। কারণ কোথাও কোন জবরদখল কলোনিতে নীচু জাত হবার অপরাধে এদের জন্য কোন প্লট দেবার নিয়ম ছিল না। ওই সব কলোনি স্থাপনার প্রাথমিক শর্ত এই ছিল–”এখানে শিক্ষিত ভদ্রলোক ছাড়া আর কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না।” নীচু জাতির কোন কোন সচ্ছল শিক্ষিত মহাশয় নামধাম গোপন করে বিত্তের জোরে কোন কোন কলোনিতে ঢুকে টিকে গেছেন। কেউ কেউ আবার আসল নাম পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়লে গলাধাক্কা খেয়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। এই কারণে কলকাতা এবং তার আশেপাশে গড়ে ওঠা ১৪৯টি জবরদখল কলোনির একটাতেও একটি নমঃশূদ্র জেলে মুচি পরিবার পাওয়া যাবে না। যদি পাওয়া যায়, জানা যাবে সে পরিবার এসেছে অনেক পরে।

বামুন কায়েত বদ্যিরা তাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্যে বুদ্ধিমান হয়, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং আত্মস্বার্থ ভালো বোঝে! তারা সেই উথালপাথাল অস্থির সময়ে খুব বুদ্ধিমত্তার সাথে একাধিক কলোনিতে প্লট দখল করে রেখেছিল। এ নিয়ে অনেক সময় দখলকারি এক কলোনির লোকের সাথে আর এক কলোনির লোকের তুমুল মারামারি পর্যন্ত হয়ে যেত। যার অনেকগুলোকে জমিদারের গুণ্ডাবাহিনীর হামলা বলে দেগে দেওয়া হয়েছে। অবস্থা কিছুটা শান্ত হয়ে গেলে দুচার বছর বাদে, নিজের পছন্দমত একটা প্লট দখলে রেখে বাকিগুলো বিক্রি করে দেয়। তখন আর ক্রেতার জাতপাতের ব্যাপারটা নিয়ে বিশেষ মাথা ব্যথা থাকে না। মাথায় ঘোরে দরদামের বাস্তব ব্যাপারটা। এই কারণেই নিচুজাতের কিছু পয়সাওয়ালা লোক কলোনিতে প্রবেশ পেয়ে যায়। আর এইভাবে জমি বিক্রি করে বহু কলোনিবাসী হঠাৎ লাখপতি হবার সুযোগ পায়। এইসব ভাগ্যবানের বাইরে ক্যাম্পবাসী যে হতভাগ্য লক্ষ লক্ষ নিম্নবর্ণ যাদের শিক্ষাদীক্ষা নেই, পেটে ভাত পরিধানে ত্যানা নেই, যাদের হয়ে কথা বলার মতো কোন রাজনৈতিক মুরুব্বিও নেই, এরা কোথায় যাবে। এরা তো সেই মানুষ যাদের দিয়ে দেশের কোন মঙ্গল হবার নয়। বলতে গেলে এরা সব দেশের কাছে–উদ্বৃত্ত অপাঙক্তেয় আবর্জনা বিশেষ কোথায় নিয়ে ফেলা হবে এগুলোকে? সদ্য ক্ষমতা হাতে পাওয়া স্বাধীনতার স্বাদ প্রাণভরে উপভোগ করতে চেটেপুটে খাবার সুযোগ পাওয়া রাজনেতাদের কাছে এ সময়ে এটা যেন গোঁদের উপর বিষফোঁড়া।

আমরা তো প্রায় ছয়বছর, কারও কারও আরও বেশি। এতদীর্ঘ সময়কাল ধরে এক নারকীয় অবস্থার মধ্যে ক্যাম্পে ফেলে রাখা হয়েছিল হাজার হাজার মানুষকে। কে জানে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের হয়ত আশা ছিল, এত কষ্ট সহ্য না করতে পেরে এরা যে যেখানে পারে চলে যাবে। যখন কেউ ক্যাম্প ছেড়ে নড়ল না তখন তাদের উচ্চবর্ণ উচ্চমস্তিষ্ক থেকে বের হল এক পরিকল্পনা–যেমন মানুষ তাদের পাঠান হবে তেমনই এক উপযুক্ত স্থানে, আর সেটা আন্দামান। ইংরেজ শাসনকালে সাজা দিয়ে যেখানে খুনি ডাকাতদের পাঠান হতো। এগুলোকে সেখানে পাঠিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হওয়া যাক। এরপর মরুক বাঁচুক যা পারে হোক।

বাঙালী মননে চিন্তনে তখনও আন্দামানদ্বীপ কোন মনুষ্য বসবাসের উপযুক্ত স্থান বলে বিবেচিত হয়নি। তাদের ধারণায়, ওটা কঠোর শাস্তিদানের স্থান। যেখানে সব মারাত্মক ধরনের অপরাধীদের মরবার জন্যই প্রেরণ করা হয়। তখনকার কমিউনিস্ট পার্টির বলতে গেলে পায়ের নিচে শক্ত মাটি ছিল না। গোটা কয়েক নেতা সর্বস্ব এই দল থেকে সাধারণ মানুষ ছিল শত মাইল দুরে। গুটি কয়েক বিদ্বান নেতা এর তত্ত্ব নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা, পত্র পত্রিকায় নিবন্ধ লেখা এই নিয়ে মগ্ন ছিলেন। এবার ঘোলাজলে মাছ ধরার একটা সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গেলেন। যে সুযোগের তারা প্রতীক্ষায় ছিলেন। আঁপিয়ে পড়ল তাই নিজেদের উচ্চাশা পূরণের নিমিত্তে রিফিউজিদের মাঝে, পার্টি গড়ার কাজে। নানা রকম কথা বলে বাড়িয়ে দিল তাদের ভয়ভীতি আর জাগিয়ে তুলল আশা।–”আমরা তোমাদের পাশে আছি। কেউ যেওনা আন্দামান। আমরা আন্দোলন করে তোমাদের এই বাংলাতেই পুনর্বাসন দেওয়াব।” এর ফলে রিফিউজিরা আর আন্দামান যেতে রাজি হল না। বন্ধ হয়ে গেল কেন্দ্রীয় সরকারের সেই পুনর্বাসন প্রকল্প।

আজ এত বছর পরে মনে হয় সেদিন রিফিউজিদের জন্য সরকার পক্ষ যা করতে চেয়েছিল, আর কমিউনিস্ট পার্টি যা করেছিল, দুই তরফের কোথাও কোন দয়া দরদ আন্তরিকতার লেশমাত্র ছিল না। ছিল দুরভিসন্ধি, কাপট্য, বেড়ালব্রত, উদ্দেশ্য পূরণের নকড়াছকড়া। তবে সেদিন যদি রিফিউজিরা কমিউনিস্টদের প্ররোচনার ফাঁদে পা না দিয়ে আন্দামান চলে যেত, সেটা অন্ততঃ মন্দের ভাল হোত। এখন যা খবর পাওয়া যাচ্ছে, যারা সেদিন মনভোলানো কথায় না ভুলে চলে গিয়েছিল তারা ভাল আছে, সুখে আছে। অন্ততঃ পশ্চিমবঙ্গের রিফিউজিদের চেয়ে শতেকগুণে ভাল।

এসব যখন ঘটে, আমার বাবা তখনও এদেশে আসেননি। আমরা শিরোমণিপুরে আসবার পূর্বেই সম্ভবতঃ আন্দামান পর্ব চুকেবুকে গিয়েছিল। কারণ এই বিষয় নিয়ে তখন সরকার বা কমিউনিস্ট বা রিফিউজি কোন তরফে কোন হেলদোল কোন আলোচনা তাপ উত্তাপ কিছুই ছিলনা। তখনকার রিফিউজি ক্যাম্পগুলো ছিল একটা বদ্ধ জলাশয়ের মতো নিথর নিশ্চুপ নির্জীব। মানুষগুলোর চোখের মণিতে কোন আলো আশা ঔজ্জ্বল্য ছিল না। মুখে ছিল না গল্প গান হাসি কথা। সব যেন তখন হতাশায় দড়িবাধা জাবরকাটা গরুর মত ধুঁকছে। কীযে হবে আর না হবে সেই ভয় ভাবনায় অনাগত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে শুধু দিন গুনছে।

এইভাবে আরও বেশ কয়েকটা অলসমন্থর বছর পার হবার পর সরকারি কর্তা নেতা মন্ত্রীদের মগজে এল দ্বিতীয় পরিকল্পনা। যার নাম দণ্ডকারণ্য পুনর্বাসন পরিকল্পনা। দণ্ডকারণ্য অথরিটি স্থাপিত হয় ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৫৮ সালে। এখন যার নাম ছত্তিশগড়, এর সাতটি জেলার মধ্যে সবচেয়ে অনুন্নত জেলা বস্তর। ঠিক অনুরূপ উড়িষ্যার সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা অনুন্নত জেলা মালকানগিরি। এই দুই প্রদেশের দুই জেলার অনুন্নত দুর্গম অস্বাস্থ্যকর বন্ধ্যাভূমির কিছু বনাঞ্চল নিয়ে গঠন করা হয়েছে দণ্ডকারণ্য অঞ্চল। এখানেই “পুনর্বাসন” দেওয়া হবে এই সব রিফিউজিদের।

এ এমন এক অঞ্চল যেখানে কোন সভ্য জগতের মানুষের পদচিহ্ন পড়েছে কিনা তা বোঝা যায় না। এখানে বসবাস করে একদল আদিম জনগোষ্ঠীর প্রায় বিবস্ত্র মানুষ। যাদের ভাষা সংস্কৃতি ধর্মাচারণ খাদ্যদ্রব্য সবকিছুর সাথে বঙ্গজীবনের তিল পরিমাণ মিল খুঁজে বের করা মুশকিলই নয়, অসম্ভব কঠিন। এই বনরাজ্যে আধুনিক সভ্যতার অগ্রগতি, জ্ঞান বিজ্ঞানের অতি সামান্য বিকিরণও অনুপ্রবেশ করার পথ পায়নি। সভ্যতা এখানে যেন সদ্য অন্ধকার গুহা ছেড়ে বাইরে এসেছে। প্রস্তর যুগ শেষ হয়ে মানব সমাজ এইমাত্র প্রবেশ করেছে লৌহ যুগে।

এখানকার মাটিতে মুরোম কাঁকর পাথরের মাত্রা খুব বেশি। এই মাটিতে হাল চলে না, কোদাল বসে না তাই ফসল ফলে না। আদিবাসীরা চাষবাস বিশেষ একটা করে না। চাষ করতে জানেও না। বনে যে সব ফলমূল পশুপাখি সাপ ব্যাঙ ইঁদুর বাদর যা পায় ধরে মেরে খেয়ে বেঁচে থাকে। যারা বেঁচে থাকে তার মধ্যে একটা ভাগ নানাবিধ রোগে, জন্তু জানোয়ারের আক্রমণে মরে যায়। এই সব কারণে বিশাল এই অঞ্চলে তুলনামূলক ভাবে জনসংখ্যার পরিমাণ খুবই কম।

এখানে রিফিউজিদের নিয়ে গিয়ে ফেলে দিতে পারলে একঢিলে দুটো পাখি মারা যায়। একটা–রিফিউজিদের পুনর্বাসনের বিচ্ছিরি ঝামেলাটার সহজ সমাধান, আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে, এই যে বিশাল বনাঞ্চল যেখানে রয়েছে শাল সেগুন বীজা মহুয়া করর‍্যা গাছ আর বাঁশের অপার সম্ভার। রয়েছে কেন্দুপাতার অফুরন্ত উৎপাদন। বাঁশে যেমন কাগজ __ মহুয়ার ফুলে মদ, ফলে তেল। শাল সেগুন বীজা গাছে দামি আসবাব।

এখানকার মাটির নিচে আছে লোহা, তামা, সিসা, ডলোমাইট বক্সাইট আরও কত খনিজ সম্পদ। মেহনতি মজদুরের অভাবে সেসব যথাযথ সংগ্রহ সম্ভব হয় না। আদিবাসী মানুষরা সাধারণতঃ এসব কাজে পারদর্শী নয়। তারা শ্রমজীবনের উৎপাদনমুখী শৃঙ্খলাও মেনে চলে না। তাদের দিয়ে এসব কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করা যায় না। রিফিউজিদের এখানে নিয়ে এলে এই সমস্যা মিটে যায়। এখানকার জমি তো এমন নয় যে শুধু চাষবাসে বছর চলে যাবে। তখন পেট চালাতে হলে অন্যকাজ না করে উপায় থাকবে না। এই সব দুষ্ট পরিকল্পনা মাথায় রেখে গঠিত হয়েছে দণ্ডকারণ্য পুনর্বাসন প্রকল্প।

এই পাটিগণিতের হিসাবে একদিন ক্যাম্পের অফিস ঘরের নোটিস বোর্ডে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল একটা নোটিশ। সেই নোটিশের যা বক্তব্য একজন ঢেড়া পিটিয়ে ক্যাম্পের মধ্যে ঘুরে ঘুরে সবাইকে জানিয়েও এসেছিল। এতদ্বারা মহামান্য ভারত সরকারের পুনর্বাসন বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো যাচ্ছে যে শিরোমণিপুর ক্যাম্পের সমস্ত রিফিউজিদের পুনর্বাসনের নিমিত্তেদণ্ডকারণ্য ডেভেলাপমেন্ট অথরিটির অধীনে রিফিউজি প্রেরণ শীঘ্রই শুরু করা হবে। যে আগে নাম নথিভুক্ত করাবে সে আগে যাবে। আপনাদের নিকট আবেদন সত্বর নাম নথিভুক্ত করান।

দণ্ডকারণ্য! পুনর্বাসন! ক্যাম্পের যারা সামান্য অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন, রামায়ণ মহাভারত পড়তে পারে, দণ্ডকারণ্যের নামে বুক হিমশীতল হয়ে গেল তাদের। কোথায় পুনর্বাসন?–এ-তো পুনঃ নির্বাসন। দণ্ডকারণ্য, সে যে এক মহাঅরণ্যের নাম। মহাকবি বাল্মীকি তার মহাকাব্যে লিখেছেন অতীব বিপদ সঙ্কুল সে স্থানের বিশদ বর্ণনা। সেখানে এমন ঘনঘোর অরণ্য যে দৃষ্টি চলে। সে বনে ঘুরে বেড়ায় নরমাংস ভক্ষক রাক্ষস খোক্কসের দলবল। একবার মানুষকে নাগালে পেলে আর কথা নেই, ধরে কচক করে চিবিয়ে খেয়ে নেয়। ওই বনে গিয়ে নররূপী নারায়ণ রামচন্দ্র কী ভীষণ বিপদে না পড়েছিলেন, আর আমরাতো সামান্য মানুষ।

ভয়তাড়িত এইসব সরল সোজা মানুষের ভয়ভীতিকে মূলধন করে আবার রাজনীতির আসর গরম করতে পথে নেমে পড়ল কমিউনিস্ট নামধারী নেতারা। সেই ১৯৫১-৫২ সালে আন্দামান পুনর্বাসন প্রকল্প বানচাল করবার পর এই ৬/৭ বছর আর বানচাল করার মতো কোন কাজ ছিল না। আবার একটা সুযোগ এসেছে। সুদূর কলকাতা মহানগর থেকে বাঁকুড়ার শালবনে-শিরোমণিপুর ক্যাম্পে ছুটে গেলেন এক নেতা। মাইকে মুখ রেখে তারস্বরে চেঁচিয়ে তিনি মানুষকে খুঁসলানি দিয়ে বেড়াতে লাগলেন “আপনারা কেউ যাবেন না দণ্ডকারণ্য। কেন যাবেন! আপনারা এই বাংলার মানুষ। আপনাদের বাংলাতে পুনর্বাসনের অধিকার আছে। আর তাই আপনারা পাবেন। আমি দিল্লি যাব। গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে বলবো বাংলার মানুষকে বাংলার বাইরে পাঠানো চলবে না। ভয় পাবেন না, হতাশ হবেন না, আমরা আপনাদের পিছনে আছি।”

সরকারি দপ্তর থেকে নির্দিষ্ট দিনক্ষণ জানিয়ে নাম নথিভুক্ত করার যে আবেদন জানানো হয়েছিল, সেদিন এক অফিসার মোটা একটা খাতা নিয়ে অফিস ঘরে বসেছিলেন, কিন্তু নাম লেখাতে বিশেষ কেউ এল না। পরের দিন লোক নিতে এসে বেশ কটা ট্রাক খালি ফিরে গেল। কারণ, যারা যাবার জন্য নাম দিয়েছিল শেষ পর্যন্ত তাদেরও বড় একটা অংশ ট্রাকে উঠল না।

এইভাবে প্রায় বছর খানেক ধরে বারবার অফিসঘরে নোটিশ দেওয়া হল। বারবার ব্যর্থ হল সরকারি প্রয়াস। অবশেষে একদিন সকালে যে ট্রাকগুলো এসেছে সেগুলো আর খালি গেল না। অফিসের সব চেয়ার টেবিল আলমারি তোলা হচ্ছে তাতে। অফিসাররা সবাইফিরে যাচ্ছেবিষ্ণুপরের হেড অফিসে। বলে যাচ্ছে তারা যদি কেউ দণ্ডকারণ্য যেতে ইচ্ছুক হয় সে যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হেড অফিসে গিয়ে নাম লেখায়। আগামী সাতদিনের জন্য এই সুযোগ থাকবে।

কাজেই অমানবিক ভারত সরকার রিফিউজিদের দায়দায়িত্ব দুম করে কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে সেটা বোধহয় বলা চলে না। বার বার রিফিউজিদের সময় দেওয়া হয়েছে। সতর্ক করা হয়েছে, “এই সব ভণ্ড কপটাচারী কমিউনিস্টদের প্ররোচনায় ভুলবেন না। এরা আপনাদের ভুল বোঝাচ্ছে।” যখন মানুষ সে কথায় কর্ণপাত করেনি, বাধ্য হয়ে সরকারের যা করবার ছিল তা করে দিয়েছে।

এবার কী হবে আমাদের, কী হবে এরপর? রিফিউজিদের আকুল প্রশ্নের জবাবে বলে নেতারা–এবার আন্দোলন হবে। ঘোর আন্দোলন। এমন একখানা আন্দোলন করব যে সরকার আমাদের ন্যায্য দাবি মেনে না নিয়ে পালাবার পথ পাবে না। বাংলায় পুনর্বাসন দেবে না! দণ্ডকারণ্য পাঠাবে। মামদোবাজি নাকি?

বিষ্ণুপুর শহর থেকে যে বাস রাস্তাটা সোজা কামারপুকুর চলে গেছে সেই রাস্তার ধারে আরও তিনটে রিফিউজি ক্যাম্প ছিল। বাসুদেবপুর ১.২.৩ নাম্বার ক্যাম্প। ওই তিন ক্যাম্প আর শিরোমণিপুর, চার ক্যাম্পের প্রায় হাজার পনের কুড়ি মানুষ এবার প্রস্তুত হল উক্ত নেতার নেতৃত্ব আন্দোলনে ঝাপাবার জন্যে। প্রথম দফায় আন্দোলন শুরু হল অনশন ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে। একটা গাছের নিচে, লোক চলাচলের পাকা রাস্তার ধারে ত্রিপল খাঁটিয়ে প্রায় শ’খানেক লোক বসে পড়ল আমরণ অনশনে। রিফিউজিদের পক্ষে তখন ছিল এটা সব চেয়ে সহজতম একটা আন্দোলন। সরকারি গুদাম থেকে শেষ খেপ যে চালডাল ডোল দেওয়া হয়েছিল সেটা মাস তিনেক আগের। বলা চলে যা প্রায় এক বিস্তৃত অতীতের ঘটনা। এখানকার মানুষগুলো যে জাতি গোষ্ঠি সম্প্রদায়ের মানুষ সেই নমঃ পোঁদ জেলেদের সংসারে তো চিরকালের অভাব দাপাদাপি করে বেড়ায়। এদের সবার সঞ্চয় বলতে শুধুই হা হুতাশ আর দীর্ঘশ্বাস। এদেশে যখন তারা পালিয়ে আসে হাতের মুঠোয় শূন্যতা ছাড়া আর কিছু তো ধরা ছিল না। পেট প্রতিপালন হচ্ছিল সরকারি ডোলের আনুকূল্যে। ফলে সেই শেষ পাওয়া ডোলের চালটুকু ফুরিয়ে যাবার পর ঘরে ঘরে শুরু হয়ে গেছে অরন্ধন-উপবাস-অনাহার। এখন আর কারও কোন আলাদা ভাবে প্রস্তুতি নেবার প্রয়োজন ছিল না। শুধু গাছতলার ত্রিপলের ছাউনির নিচে গিয়ে বসে পড়লেই আমরণ অনশন।

মানুষ কী খায়, আর কী খায় না, এই প্রশ্নের উত্তর আমার অন্ততঃ জানা নেই। সেদিন সেই ক্ষুধার রাজ্যের পাগলপ্রায় মানুষকে আমি যে কত কী খেয়ে পেটের দাউদাউ আগুনকে নিবৃত্ত করবার চেষ্টায় প্রাণপাত করতে দেখেছি সে বলে শেষ করতে পারব না। বুনো ডুমুর, জংলা কচু, যার আর এক নাম খারকোল, কচি খেজুরের আঠি, খেজুর গাছের মাথি, শাপলা গাছের গোড়ায় জন্মানো ড্যাপের খই, বুনো কুল, মহুয়া ফল, চরোটা গাছের পাতা সেদ্ধ আরও কত কী!

এখানে দেখেছিলাম খিদেকে মায়ের মমতা স্নেহ সন্তানের প্রতি যে দরদ তা কেমন করে খেয়ে নেয়। এক মা তার শিশু পুত্রের “মা ভাত দাও আমার খিদে পেয়েছে,” এই কাতর কান্না সইতে না পেরে দুঃখে রাগে উন্মাদিনী হয়ে বাচ্চাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ছিল এক কুয়োর মধ্যে। জল না থাকায় শিশুটি অবশ্য প্রাণে বেঁচে যায়।

এই দেশে যখন ইংরেজ শাসন বলবৎ ছিল এক নেতা অনশনকে অস্ত্ররূপে প্রয়োগ করেছিলেন। তখন কেউ অনশনে বসলে শাসকদের বুক কেঁপে যেত। ইংরেজরা ছিল সাগর পাড়ের মানুষ। তাদের প্রাণে দয়ামায়া বেশি। তারা মানুষের প্রাণের মায়া-মূল্য বুঝত। অনাহার যে কী কষ্টকর তা জানত। তাই কেউ কোন দাবি নিয়ে অনশনে বসলে তারা ছুটে আসত। আলোচনার মাধ্যমে একটা সমাধান বের করার চেষ্টা চালাত। ওই সর্ব সাহেব শাসকদের নামে নির্দয়তার যে সব গল্প চালু আছে, হিসেব করলে দেখা যাবে এদেশীয় শাসকশ্রেণীর তুলনায় তা পাহাড়ের পাশে উইঢিবি, হাতির পাশে পিঁপড়ে, সমুদ্রের সামনে শিশির বিন্দু।

এইজন্য অনশনের আঠাশদিন অতিক্রান্ত হবার পরেও সরকার পক্ষের কেউ অনশনকারীদের কোন তত্ত্ব তালাশ নেবার প্রয়োজন বোধ করল না। এখানকার মত তখন সংবাদ মাধ্যম এত শক্তিশালী ছিল না। তাই সে খবর বিশ্ববাসীর কানে পৌঁছাল না। বাঁকুড়া জেলার ঘনবনের আড়ালে চাপা রয়ে গেল চিরকালের মতো।

অনশন অস্ত্র তখনই শক্তিশালী যখন মানুষের সংবেদনশীল দরদি একটা মন থাকে। সে মন মরে গেলে, অন্ধবধির হলে, আর কোন কাজ হবার নয়। তাই নুন লেবুর জল খেয়ে নিজেরাই অনশন ভেঙে দিল অনশনকারীরা। ঠিকমত স্মরণ নেই, খুব সম্ভবত এর মধ্যে একজন মারাও গিয়েছিল।

নেতা বলল-এত নরম দাওয়াইয়ে হবে না। সরকারকে এবার একটা কড়া ভোজ দিতে হবে।

একদিন স্থির হল, সবাই মিলে মিছিল করে, শ্লোগান দিয়ে হামলে পড়তে হবে বিষ্ণুপুর শহরে। যত কোর্ট কাছারি থানা অফিস যানবাহন বাজার হাট সব অচল করে দিতে হবে। একে বলে জঙ্গি আন্দোলন। যতক্ষণ সরকার আমাদের দাবি মেনে না নেয়, বসে থাকতে হবে সব ঘেরাও করে।

আমার মা নরম মনের মানুষ। তিনি বাবাকে বারণ করেছিলেন “যেতে হবে না আন্দোলনে।” কিন্তু বাবা মায়ের বারণ শুনলেন না। অভুক্ত দুর্বল শরীর নিয়ে তিনিও পা মেলালেন মিছিলে, গলা মেলালেন শ্লোগানে। ইনকিলাব জিন্দাবাদ। আমাদের দাবি মানতে হবে, নইলে গদি ছাড়তে হবে। আমরা বাংলার মানুষ আমাদের বাংলায় পুনর্বাসন দিতে হবে। এই সব শ্লোগান দিয়ে সামনে এগিয়েছিল মিছিল। কিন্তু সে মিছিলকে শহরে প্রবেশ করতে দিল না পুলিশ। তারা লাঠিসোটা কঁদানে গ্যাস নিয়ে শহরের প্রবেশ পথের সামনে আটকে দিল। তাদের কাছে গোপন সূত্রে খবর পৌঁছেছিল–ডোলবন্ধ একদল অনাহারী মানুষ, যারা শহরে মিছিল নিয়ে আসছে, এরা শান্তিপূর্ণ নাও থাকতে পারে। এতে নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। লুঠপাট হতে পারে খাদ্যদ্রব্যের দোকানপাট বাজার হাট। তাই সতর্কতার অঙ্গ হিসাবে জেলা শাসক সারা শহরে একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারি করে সব রকম জমায়েত মিটিং মিছিলের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য আনিয়ে রেখেছেন কমব্যাট ফোর্স। যারা একহাতে বেতের ঢাল আর একহাতে লাঠি উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে রিফিউজিদের পথরোধ করে। “খবরদার, আর এগিও না”। রিফিউজিরা এসব ধারা উপধারার এত মানে জানে না। তারা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে ফেলে জোর করে ঢুকে পড়তে চাইল শহরের মধ্যে। তখন পুলিশ লাঠি চালাল। ছুড়ল কাদানে গ্যাস। বেপরোয়া সেই লাঠির আঘাতে আহত হল প্রায় দেড়শত মানুষ। আমার বাবারও মাথা ফেটে গিয়েছিল। ছেঁড়া গামছায় মাথা বেধে অনেক রাতে তাবুতে ফিরে এসেছিলেন তিনি। ঔষধ পত্রের তো কোন ব্যবস্থা ছিল না, মা গাদা ফুলের পাতা থেতো করে ক্ষতস্থানে পট্টি বেধে দিয়েছিলেন। সেই পট্টি বাধা ফাটা মাথার যন্ত্রণায় বাবা কাতরাচ্ছিলেন,কাঁদছিলেন, নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করছিলেন। আর আমি। আমি সেই শিশু বয়সে শিশুমনে শপথ শানাচ্ছিলাম-যে পুলিশ আমার বাবাকে মেরেছে বড় হয়ে তাকে আমি ঠিক মারব। কোথায় লুকাবে সে। পায়ে বুট গায়ে খাকি জামা, মাথায় টুপি, হাতে লাঠি না হয় বন্দুক, তাকে আমি ঠিক খুঁজে বের করব।

সেদিন পুলিশ প্রশাসন চেয়েছিল “বিয়ের রাতে বেড়াল মারা” নীতি অনুসরণ করতে। প্রথমদিনই আন্দোলনের উপর এমন বর্বর আক্রমণ করে রিফিউজিদের মনোবল ভেঙে দিতে তারা কিছু পরিমাণে সফলও হয়েছিল বলা চলে। ফলে এরপর আরও বেশ কয়েকবার মিছিল নিয়ে বিষ্ণুপুর গিয়েছিল রিফিউজিরা, নেতারা মঞ্চে বসে গরম গরম বক্তৃতাও দিয়েছিল, কিন্তু পুলিশ আর লাঠি টিয়ার গ্যাস চালায়নি। হতে পারে প্রথমদিনের তুলনায় মিছিল মিটিংয়ে লোক সমাগম কমে যাওয়ায় তাদের আর ভয় পাবার কিছু ছিল না।

পুলিশ প্রশাসন তখন একটা অন্য ধরনের পদ্ধতি নিয়েছিল। তারা মিটিংয়ে জমা হওয়া একদল লোককে ধরে ট্রাকে তুলে নিত। তারপর সে ট্রাক চালিয়ে কুড়ি পঁচিশ মাইল দূরে কোন জনহীন মাঠে নিয়ে গিয়ে জোর করে ট্রাক থেকে নামিয়ে দিয়ে খালি ট্রাক নিয়ে ফিরে চলে যেত। তখন আন্দোলনকারীদের সেই পথ ফিরে আসতে হতো পায়ে হেঁটে। পথশ্রমে ক্ষুধাতৃষ্ণায় তারা। বড় কাহিল হয়ে পড়ত।

প্রশাসনের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত উচ্চবর্ণের অফিসারগণ বড় ধূর্ত। তারা তাদের বর্ণবুদ্ধি দিয়ে বুঝে গিয়েছিল এদের ধরে জেলখানায় নিয়ে যাওয়ায় অসুবিধা আছে। সব না খাওয়া মানুষ, যদি এরা জেনে যায় জেলখানায় গরম ভাত তরকারি পাওয়া যায় তাহলে মিটিং মিছিল করার উৎসাহ বেড়ে যাবে। তাই ওই ব্যবস্থা। খালি পেটে এবার হেঁটে দ্যাখ কেমন লাগে। সেইদীর্ঘপথ পার হয়ে কতজন ফিরে আসতে পারত আর অক্ষম অশক্ত শরীর নিয়ে কতজন পথে পড়ে মরত তার হিসাব কে জানে!

বোমা গোলা বন্দুক কামান নয়, যে কোন যুদ্ধের প্রধান অস্ত্র পেটের রসদ। যে কারণে ইংরেজ শাসকরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাজার ঝেটিয়ে সব খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করে ফেলেছিল। আকাল এসেছিল সারা বাংলায়। যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর খাদ্য আপূর্তিতে কোন ঘাটতি রাখা চলে না। কারণ না খাওয়া মানুষ লড়াই করতে পারে না। লড়াই জিততে পারে না।

আন্দোলন–সেও তো একটা যুদ্ধ। রিফিউজিদের সামনে এখন সেই যুদ্ধ। প্রবল প্রতাপ রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে এক মানসিক, সাহসিক সর্বাত্মক সংগ্রাম। কিন্তু যার পেটে ভাত নেই, চোখের সামনে ছোট ছোট বাচ্চারা খিদের জ্বালায় ছটফট করছে, সেই সৈনিক রণক্ষেত্রে অটল থাকবে কী করে? এর চেয়ে কোথায় শাপলা শালুক কঁচুঘেঁচু মেলে সেই সন্ধানে ছুটবে না? তাই হতে লাগল। যারা পুলিশি অত্যাচার উপেক্ষা করে তখন পর্যন্ত মিছিলে যাচ্ছিল, এবার মিছিল ফেলে মাঠে জঙ্গলে ছুটতে শুরু করে দিল।

এরপর যা হয়, ক্যাম্পের লোক সংখ্যা অর্ধেক কমে গেল। এরা সরকারের দরজায় দয়া পাবার আশায় মাথা খোঁড়া বৃথা বুঝে কেউ চলে গেল শহর কলকাতার আশেপাশে কোন রেল লাইনের ধারে, কেউ কোন খালপাড়ে, কেউ ফুটপাতে, কেউ রেল স্টেশনে, কেউ কেউ নিরুপায় হয়ে বিষ্ণুপুর গিয়ে পুনর্বাসন দপ্তরে নাম লিখিয়ে পাড়ি দিল সেই নরখাদকদের দেশ দণ্ডকারণ্যে। মরি তো মরব। মরার বেশি আর কীবা হবে, এই ছিল শেষদলের মনের ভাবনা।

যারা তখনও ক্যাম্পে ছিল, তাদের মধ্যে কেউ কেউ জনমজুর খাটতে, বিড়ি বাঁধতে, রিকশা চালাতে এবার বিষ্ণুপুর শহরে যেতে আরম্ভ করল। আগে বিনা অনুমতিতে রিফিউজিদের ক্যাম্পের বাইরে যাবার উপায় ছিল না। এখন তো অফিস নেই, অফিসঘর নেই, কে কাকে অনুমতি দেবে। আমার বাবা গেলেন জঙ্গলের শুকনো ঈঠ কেটে জ্বালানি হিসাবে বিষ্ণুপুরের মানুষের কাছে বিক্রি করে আসতে। এক বোঝা কাঠ যার ওজন পঞ্চাশ ষাট কিলো তা বেঁচে বাবা দু আড়াই টাকা পেয়ে যেতেন। এতে আমাদের সংসার মোটামুটি ভাবে চলে যাচ্ছিল। পরে বাবার দেখাদেখি ক্যাম্পের আরও বেশ কিছুনোক কাঠ ব্যবসায় নেমে পড়ল। ফলে জঙ্গলে দেখা দিল শুকনো কাঠের আকাল। কথায় বলে প্রয়োজন কোন নীতি মানে না। তখন ক্যাম্পের শত শত মানুষ প্রয়োজনের তাড়নায় কোপ বসাতে শুরু করে দিল কাঁচা গাছে। এটা ভারত সরকারের বনরক্ষা আইনে ঘোর অপরাধ। যাতে জেল এবং জরিমানা দুটোই হতে পারে। তবে বন বিভাগের কর্মচারীরা রিফিউজিদের অবস্থা জানত। তাই তারা এদের ধরে নিয়ে যাবার চাইতে জঙ্গলে দেখতে পেলেই কুড়ুলখানা কেড়ে নিয়ে চড়চাপড় মেরে তাড়িয়ে দিতে লাগল।

আমার বাবা ছিলেন খুবই ভিতু মানুষ। তিনি এর ফলে ভয় পেয়ে কাঠ কাটতে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। এরপর চেষ্টা করেছিলেন বিষ্ণুপুর শহরে গিয়ে জনমজুরের কাজ করতে। তাতে সফল হলেন না। ছোট্ট শহর বিষ্ণুপুরের সাধ্য ছিল না এত হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে। এরফলে মাঝে মাঝে আমাদের ঘরের উনুন একটু আধটু যা জ্বলছিল এবার তা পুরোপুরি নিভে গেল। তখন যে কী ভীষণ অভাব অনটন ভরা দিন আমাদের ঘিরে ধরে ছিল, আমার ভাষার সে ক্ষমতা নেই যে কাউকে বলে বোঝাতে পারি।

বিষ্ণুপুর শহর থেকে আটদশ মাইল দূরে একটা ক্যাম্প। যার পূর্বদিকে মাঠ পেরিয়ে মাইল চারেক গেলে একটা মুসলমান গ্রাম। ছোট ছোট মাটির ঘরে সেখানে যে মানুষরা বাস করে, তারা এত গরিব যে যখন আমরা ডোল পেতাম, আমাদের কাছে খাবার চাইতে আসত।

উত্তর দিকে শশ্মান পার হয়ে, মাইল তিনেক গেলে একটা সাওতাল পল্লী এদের অবস্থাও তথৈবচ। খিদের জ্বালায় এরা সাপ ব্যাঙ সব খায়! দাদন নিয়ে কোথায় কোন দূরদেশে কাজে যায়।

আর আমাদের ক্যাম্পের পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে তো কোন জনবসতিই নেই, শুধু ঘন জঙ্গল। এই এখানকার পরিবেশ। এখানে আশেপাশে আমাদের এমন কোন সম্পন্ন আত্মপরিজনও নেই যার কাছে বিপন্ন সময়ে গিয়ে সাহায্যের হাত পেতে দাঁড়ান যায়।

পেটে ভাত নেই, অসুখে ওষুধ নেই, হাত আছে, কাজ নেই, কোথাও যে চলে যাবে তেমন কোন জায়গা নেই। তখন যেন আমাদের জীবনকে বৃত্ত করে দাঁড়িয়ে একটা বিরাট বিশাল “নেই”। এমন যে পানীয় জল, যার বিহনে প্রাণ বাঁচে না সেও তখন আর পাবার উপায় নেই। “যখন ক্যাম্প ছিল” তখন ভেঙে গেলে অফিসে গিয়ে জানালে ভাঙা টিউবওয়েল সারাবার জন্য মিস্ত্রি এসে যেত। এখন আর কেউ আসে না। বহুদিন জলের কল খারাপ হয়ে পড়ে আছে। ক্যাম্পের কয়েকজন লোকবি.ডি.ও অফিসে কল মেরামতের আবেদন নিয়ে গিয়েছিল বি.ডি.ও বলে দিয়েছে–ওখানে তো কোন লোক নেই জল কী হবে!

আগে আমাদের থাকবার তাবুখানা বছরে একবার বদলে দেওয়া হতো। এবার আর বদলান হয়নি। পচে ছিঁড়ে যাওয়া তাবুর ফোকর থেকে উঁকি দিচ্ছে দিনের সূর্য রোদ রাতের চাঁদ তারা। বর্ষাকালের আর খুব বেশি বাকি নেই, তখন কী যে হবে কে জানে!

সমস্ত ক্যাম্পটা এখন থেকেও “নেই” হয়ে গেছে। শুধু সরকারি কাগজ পত্রেই নয়, পরিবেশ পরিস্থিতিতেও। আগে তবু বাচ্চারা কাঁদত, বুড়োরা কাশত। জলের কলের লাইনে দাঁড়িয়ে মহিলারা ঝগড়া করত, যা থেকে বোঝা যেত এখানে মানুষ আছে–প্রাণ আছে। কয়েক মাসের মধ্যে এখন ধুঁকতে শুরু করেছে সব প্রাণ। আর কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই। মানুষ হাসে না, কথা বলে না। সব যেন মরে পচে গলে শেষ হয়ে গেছে।

আমার বয়েস তখন মনে হয় দশ বছর হবে। তবে বয়েসের তুলনায় রোগে, অপুষ্টিতে শরীরটা সেভাবে বৃদ্ধি পায়নি। যে কারণে মা আমাকে বাবার জেদাজেদি সত্ত্বেও, অন্য বাচ্চাদের তুলনায় একটু দেরি করে বিদ্যাশিক্ষার জন্য স্কুলে পাঠিয়েছিলেন। কলে জল আনতে গিয়ে মা রোজ দেখতে পেত স্কুলের বাচ্চারা পড়া না পারলে কী নির্মম পেটাই হয়। তার ভয় ছিল আমার এই রোগা শরীরে মাষ্টারের বেত সহ্য হবে না। তাই বেত সহ্য করার মত গায়ে মাংস হবার অপেক্ষায়–আর স্কুলের পাঠ নেওয়া হয়নি আমার।

এখন আমার শরীরটা বাড়ছে। তাই পেটও বড় হচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে পেটের খিদে। সেই খিদের কষ্ট আর সহ্য করা যায় না। খিদে পেলে তখন মনে হয় কেউ যেন নাড়িভুঁড়িগুলো ধরে টেনে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে। কান মাথা আঁ আঁ করে। চোখ ঘোলা হয়ে আসে। হাত পা বুক সব তিরতির করে কঁপে।

একদিন নিরূপায় হয়ে আমাদের ক্যাম্প থেকে বহু দূরের এক গ্রামে, মোটামুটি সচ্ছল এক মধ্যম চাষির বাড়িতে ছাগল গরু চড়াবার কাজ নিলাম। কথা রইল তারা আমাকে দু বেলা খেতে দেবে, আর এক বছর টিকে থাকলে পূজোর সময় দেবে একটা গেঞ্জি একটা প্যান্ট আর একখানা গামছা। যে বয়সে শিশুরা বাস করে নানা রঙের এক মায়াবী জগতে, হেসে খেলে নেচে গেয়ে দুষ্টুমি করে দিন কাটায়, জীবন আমাকে ঠেলে দিল রঙরস স্বপ্নহীন এক কঠোর বাস্তবতার কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দুটো বালতি বাঁকে বেধে প্রায় দেড় মাইল দূর থেকে জল বয়ে এনে সবজি ক্ষেত ভিজিয়ে দুটো শুকনো মুড়ি চিবিয়ে ছাগল গরু নিয়ে মাঠে যাওয়া, দুপুরে এক ফাঁকে এসে ভাত খেয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠে থাকা।

লোকে বলে, সকালটা দেখলে নাকি বোঝা যায় সারাদিন কেমন যাবে। যে ভাবে আমার জন্ম, যেভাবে শুরু হয়েছে আমার বালকবেলা এরইমধ্যে প্রচ্ছন্ন ছিল সেই বার্তা–আগামীদিনগুলো কী নিয়ে অপেক্ষা করে আছে আমার জন্য বড় হতভাগ্য এক বালক আমি যার কোন বাল্যকালই ছিল না। রঙিন ঘুড়ি রঙবেরঙের কাঁচের গুলি আমার বাবা কোনদিন আমাকে কিনে দিতে পারেনি। দুর্গা পূজার সময়ে বাচ্চারা যখন নতুন জামাপ্যান্ট পড়ে হুটোপুটি খেলে আমি তখন প্যান্টের পেছনের ছেঁড়া জায়গায় হাত দিয়ে ঢেকে দুরে দাঁড়িয়ে থেকেছি। দোল পূর্ণিমার দিন, যখন সবাই রঙে মাখামাখি হয়, আমি তখন রঙের ভয়ে ছুট মেরে পালিয়ে গেছি দূরে–বিবর্ণ নির্জনতার কোটরে। ভয়, গায়ে রং লেগে গেলে তুলব কী করে। সাবান কেনার পয়সা কই?

আমি সেই দুঃখী বালক যাকে তার দিদিমা কোনদিন কোলের কাছে শুইয়ে রাজারানির রাজকন্যার গল্প শোনায়নি। আমার শিশু স্বপ্নে কোন দিন লাল নীল পরীরা সোনালি পাখনায় ভর করে উড়ে আসেনি। আমার কোনদিন কোন স্বপ্ন রঙিন ছিল না, ছিল কৃষ্ণকুটিল অমানিশাঘন ভীতি দায়ক। আমি অনবরত দেখেছি দাঁত নখ বের করা এক রূঢ় রাক্ষসী বাস্তবতাকে। যে প্রেমহীন পৃথিবীর পথে উদ্দাম ছুটে বেড়াচ্ছে। তার মৃত্যুমাখা করাল মুখব্যাদান সর্বনাশা চোখের নীলাভ অগ্নিশিখা আমার জীবন যাত্রাকে ভীত ত্রস্ত ছিন্ন দীর্ণ করেছে সর্বক্ষণ।

জীবনের সেই প্রথম “চাকরিতে” আমি বোধহয় মাস তিনেক টিকতে পেরেছিলাম। তারপর আর পারিনি। যার কারণ অনেকগুলো। যা আমি আমার “অভিশপ্ত অতীত অন্ধকার ভবিষ্যৎ” নিবন্ধে বিস্তারিত লিখেছিলাম। তাই এখন আর জাবর কাটতে চাইনা। তবে কাজ ছেড়ে চলে আসার একমাত্র কারণ মালিকের ব্যবহারই নয়–তার চেয়ে বড় কারণ, মায়ের জন্য বড় মন কেমন করছিল। এর আগে মাকে ছেড়ে কখনও এতদূরে আসিনি, এতদিন থাকিনি।

ক্যাম্পে ফিরে এসে দেখি আমার একটি কালো কুচকুচে বোন হয়েছে। এর আগে একটা ভাই হয়েছিল মেজ ভাই চিত্তরঞ্জনের পরে! বোন হওয়ায় এখন আমাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা সাত হয়ে গেল। সেই নিয়ে বাবার দুশ্চিন্তা সাতটা প্রাণী এই অবস্থায় বাঁচব কেমন করে। এ এমন এক সংসার যেখানে জন্ম কোন উৎসব নয়, একটা বাড়তি বোঝা। একজন উদ্বৃত্ত মানুষ।

এবার আমার বাবা স্থির করলেন যে অনেক হয়েছে, শিরোমণিপুর ক্যাম্পে আর থাকা নয়। যাবেন তিনি যেখানে আমার কয়জন কাকা জ্যেঠা থাকেন সেই দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ঘোলা দোতলার রিফিউজি ক্যাম্পে। দেশ থেকে আগে বের হবার কারণে যারা বিচ্ছিন্ন হয়ে ওই ক্যাম্পে গিয়ে পড়েছে। আমাদের সেই আত্মীয়দেরও দণ্ডকারণ্য না যেতে চাওয়ার অপরাধে ডোল বন্ধ হয়ে গেছে।নাম কাটা গেছে ক্যাম্প রেজিস্ট্রার থেকে। এখন এরা–এইনাম কাটা যাওয়া মানুষেরা, আর এদেশের কেউ নয়। এদের আর দেশ বলে কিছু নেই। কোন দেশেরই এরা কেউ নয়। কলমের কী অসীম ক্ষমতা। যার এক আঁচড়ে হাজার লক্ষ মানুষ “নেই” হয়ে যায়।

আমার কাকাজ্যাঠাদের আর্থিক অবস্থা আমাদের চেয়ে ভাল নয়। এক দেশ এক বংশ এক রক্ত যে। তবে এই ক্যাম্প কলকাতা মহানগরের সন্নিকটে বলে এখানকার লোক সেখানে গিয়ে কোন কাজ কর্ম, ছোটখাটো ব্যবসাপাতি করে দু চার টাকা রোজগার করবার পথ করে নিয়েছে। কেউ সজি কেউ হোগলা পাতার মাদুর, কেউ ডিম যে যা পারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে আসে। কেউ কেউ যায় জনমজুর খাটতে।

একদিন বাবা আমাদের নিয়ে চলে এলেন সেই ঘোলা দোতলার ক্যাম্পে। কাকারা কেউ বাঁশ কেউ খড় কিনে দিয়ে খালপারে আমাদের থাকার জন্য একটা ঝুঁপড়ি বানিয়ে দিল। বানিয়ে দিল একখানা মাদুর বোনার তাত। সে সময় গড়িয়া স্টেশন থেকে শুরু করে বানতলা পর্যন্ত হাজার হাজার বিঘে জলাভূমি ছিল। এতে মাছ চাষ হত। এই সব মাছের ঘেরিতে প্রচুর পরিমাণে হোগলা জন্মাত। যে হোগলা পাতায় মাদুর বোনা হয়। ঘোলা দোলতলার রিফিউজিরা এই মাদুর শিল্পের সহায়তায় সেদিনের সেই ভয়ংকর দুর্দিনে কিছুটা হলেও রক্ষা পেয়েছিল। এখানকার সব ঘরেই মাদুর বোনা হয়। আমরাও মাদুর বোনা আরম্ভ করলাম।

প্রথমদিকে হোগলা পাতা বিনামূল্যে পাওয়া যেত শুনেছি। ঘেরি মালিকরা ঘেরি সাফ করার জন্য এমনি এমনি দিয়ে দিত এবং খুশি হতো এই ভেবে যে এ কাজে তার পকেটের পয়সা লাগেনি। পরে যখন বুঝতে পারল এর একটা ব্যবসায়িক দিক আছে, তারা দাম হাঁকতে লাগল!

এখন দু আঁটি হোগলার দাম একটাকা, সুতলির দাম আট আনা। এই পুঁজির সাথে দুজন মানুষের সারা দিনের শ্রম যুক্ত হলে যে দুখানা মাদুর তৈরি হবে তার বিক্রয় মূল্য বর্তমান বাজারে তিন থেকে সাড়ে তিন টাকা। সেই সাড়ে তিন টাকা থেকে পরের দিনের হোগলা সুতলির দাম সরিয়ে রেখে যে টুকু যা পয়সা বেঁচে থাকে তা দিয়ে আমাদের এত মানুষের পেট কী চলে।

সেটা সেই কুখ্যাত ছয়-এর দশকের শুরুর দিক। যখন গ্রাম বাংলা ধীরে ধীরে এক ভয়াবহ খাদ্যসংকটের দিকে হাটিহাটি পাপা করে এগিয়ে চলেছে। শোনা যাচ্ছে আর এক অঘোষিত মন্বন্তরের পদধ্বনি। তখন ঘোলা দোতলার বাজারে সবচেয়ে মোটা চালের পালি (আড়াই সের) একটাকা বারো আনায় পৌঁছে গেছে। একপালি চাল না হলে আমালের সংসার চলে না। এর সাথে আছে নুন লংকা আর জ্বালানি। তাই চাল কেনবার সামর্থ আমাদের ছিল না। সে সময় কোথা থেকে কে জানে বাজারে বস্তাবস্তা খুদ আসত। যার অর্ধেক ছিল ধুলো কঁকড়। খুদ যে কোথায় সে বহুকষ্টে খুঁজে পাওয়া যায়। ছয়আনা সের সেই ধুলোকাকড় আমরা দুসের বারো আনা দিয়ে কিনে আনতাম। মা তাকে পুকুরে নিয়ে গিয়ে ঘন্টা খানেক ধরে চেলে চেলে ধুয়ে আনতেন। তারপর তা জ্বাল দিয়ে পাতলা জাউ বানিয়ে, না চিবিয়ে আমরা নুন লংকা দিয়ে গিলে গিলে খেতাম। এর চেয়ে আর একটু সস্তায় পাওয়া যেত মাইলোর আটা, আধভাঙা ভুট্টা। এসব খুদ ভুট্টা মাইলো সবই মুরগির খাদ্য। পোলট্রি জন্য তৈরি করা “সুষম আহার”। কী আমাদের ভাগ্য, মানুষ হয়ে আমরা তখন তাই খেয়ে প্রাণ বাঁচাচ্ছি।

আমরা মনে হয় ১৯৬০ সালের প্রথমদিকে ঘোলা দোতলার ক্যাম্পে এসেছিলাম। এর দু বছর পরই তো সেই ভারত চীন সীমান্ত সংঘর্ষের সময় কাল। যার দু বছর পরে কমিউনিস্ট পার্টিতে ভাঙন। এরই এক বছর আগে ১৯৫৯ সালে খাদ্য আন্দোলন। যে আন্দোলনে পুলিশ মানুষকে সাপ পেটার মত পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল। আমি ঠিক জানি না, সেদিন আট না আশি কতজন মানুষ মারা গিয়েছিল। তবে এটা জানি সেদিন শুধু খাদ্যের দাবিতে আন্দোলন করা মানুষইমরেনি, মারা গিয়েছিল একনির্দয় পাষণ্ড সরকারের সব বিচারবুদ্ধি বিবেচনা শক্তি। জনগণকে খাদ্য বস্ত্র শিক্ষা বাসস্থান চিকিৎসা দেবার জন্য জনগণের দ্বারা নির্বাচিত একটি সরকার বুভুক্ষু জনগণের উপর এমন নির্মম আক্রমণ চালাতে পারে এমন দৃষ্টান্ত বিরল।

সেই ছয়-এর দশকে প্রায় সারা দশক জুড়ে পুরো পশ্চিমবঙ্গে নেমে এসেছিল এক ভয়াবহ আকাল। খাদ্যাভাবে চারদিক যেন জ্বলতে আরম্ভ করেছিল তীব্র ক্ষুধার দহনে। মানুষকে তখন আর মানুষ বলে চেনবার উপায় ছিল না। কিছু ধনী আর মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাদে সারা গ্রামবাংলা জুড়ে দেখা যাচ্ছিল আপামর মানুষের কঙ্কালসার মৃতপ্রায় এলোমেলো চলাচল।

আমাদের সেসব দিনে আর ভুট্টা মাইলো খুঁদ কেনবার মতো ক্ষমতাও ছিল না। তখন মাদুর যে আর বিক্রি হয় না। মানুষের পেটে খাদ্য নেই, মাদুর কিনে কী করবে! সেই সময় আমাদের বঙ্গদেশের একবুদ্ধিমান মুখ্যমন্ত্রী অন্নহীন বঙ্গবাসীকে বাণী দিয়ে ছিলেন-কঁচাকলা খাও, কাঁচাকলায় ভাতের চেয়ে প্রোটিন বেশি। মনীষীদের বাণী কোন ফালতু জিনিস নয়। কিন্তু কলা তা সে পাকা হোক বা কঁচা সে তো মুফতে মেলে না। পয়সা দিয়ে কিনতে হয়। পয়সা কোথায় আমাদের কাছে। অবশ্য নিজের কলা বাগান থাকলে সে কথা আলাদা। আমাদের তো বাগান করার মত একফালি মাটিও নেই। আমরা এক খাল পাড়ে কুড়েঘর বানিয়ে বাস করি। সে এমন কুড়ে যার মধ্যে সোজা হয়ে দাঁড়ান যায় না, ঘরের চাল মাথায় ঠেকে যাবে। ঘরে ঢুকতে হয় হামাগুড়ি দিয়ে, বের হতে হয় হামাগুড়ি দিয়ে। মনে হয়, সেই আদিম অতীতকালে প্রথম গুহাবাসী মানুষ গুহা ছেড়ে যেদিন বাইরে এসেছিল আর বসবাসের প্রয়োজনে সেদিন তার অনভিজ্ঞ হাতে প্রথম যে কুড়ে ঘর খানা বানিয়ে ছিল, সে-ও ছিল এর চেয়ে মজবুত এবং সুন্দর।

এ এমন এক ঘর, এ ঘরে যে সব মানুষ বাস করে নত হতে হতে সারা জীবনের মতো বেঁকে যায়। আর সেই বাঁকা মেরুদণ্ড সোজা করে কোনদিন উঠেদাঁড়াতে পারে না। রেল বস্তি খালপাড়ের এই সব ঘরে সুশিক্ষা সুস্বাস্থ্য সভ্যতার কোন আলো অনুপ্রবেশ করতে পথ পায় না। তাই মানুষ বুনো হয়ে যায়, মানবেতর প্রাণী হয়ে যায়।

আর মাত্র কয়েকটা বছর, বছরও নয়, মাস, তারপর চাঁদের মাটিতে পড়বে পৃথিবীর মানুষের পথচিহ্ন। বিজ্ঞানের জয় জয়কার হবে। আর সেই পৃথিবী গ্রহের আর একদল মানুষ ক্রমে পিছোতে পিছোতে পরিণত হয়ে যাবে ইঁদুরতুল্য এক গর্তবাসী জীবে।

সে সময় দিনে দিনে গ্রামবাংলায় আকালের হা মুখ এতখানি প্রশস্ত হল যে সরকার মৌনিবাবা হয়ে বসে থাকলেও দয়ালু মানুষের পক্ষেচুপ হয়ে থাকা সম্ভবপর হয়নি। তারা বেশ কিছুসমাজসেবী সংস্থার মাধ্যমে কিছু কিছু স্থানে লঙ্গরখানা খুলেছিল। চাল ডাল গমের কুচি মিলিয়ে তা দিয়ে পাতলা খিচুড়ি বানিয়ে এক এক হাতা মেপে বিলানো হয়েছিল বুভুক্ষু মানুষের মধ্যে। সেই এক হাতা খিচুড়ির জন্য এক দেড় মাইল লম্বা লাইন পড়ে যেত। সূর্য ওঠার সময় লাইন দিয়ে সূর্য মাথার উপর এলে খিচুড়ি মিলত। তাও দিনে মাত্র একবার। দিন দশ পনের চলবার পর সে লঙ্গরখানা বন্ধ হয়ে যায়।

একটু পরের কথা আগে বলা হয়ে গেল। ফিরে যাই ৬৪ সালে। আমার বাবা সে সময়ে যাদবপুরে মজুরের কাজে যেতে শুরু করেছিলেন। তখন দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুরের বহু অঞ্চল দখল করে একের পর এক জবর দখল কলোনি গড়ে উঠেছিল। দখলকারীরা উচ্চবর্ণ কায়িকশ্রমে পরাজুখ বাবুশ্রেণির মানুষ। কাজেই তাদের ঘরবাড়ি পথঘাট নির্মাণে চিরকালই যাদের সহায়তা নিতে হয়, সেই নমঃ পোদ কাওড়া বাগদি মুসলমানদের এখানেও সহায়তা নেওয়া হচ্ছে।

এটা একটা ওকে কী বলে–উলঙ্গ সত্য, যে, সে সরকার পক্ষই হোক বা বিরোধী পক্ষ সব দলের শীর্ষে বসে আছে একমাত্র উচ্চবর্ণের লোকেরা। যারা সেই বেদের কালের বর্ণঘৃণায় এখনও আচ্ছন্ন। সেই ঘৃণ্য মানসিকতার কারণে ক্যাম্পবাসী নিম্নবর্ণের মানুষদের প্রতি সেদিন যতটা নির্মম নির্দয় অমানবিক ব্যবহার করেছিল, নিজের আপন আত্মীয় স্বজাতির জবরদখলকারীদের প্রতি ততটা হয়নি।

পশ্চিমবঙ্গের জবরদখল কলোনি পত্তনের দিকদিশারী–সর্ব প্রথম জবর দখল কলোনির নাম বিজয়গড়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন সেনাদের জন্য ইংরেজ সরকার এদেশীয় জমিদারের কাছ থেকে বিশেষ এক আইন বলে এই বিশাল মাপের জমিটা অধিগ্রহণ করে। ফলে এই জমির উপর জমি মালিকানার কোন আইনি অধিকার দেশীয় ভূস্বামীদের আর ছিল না। যুদ্ধ শেষ হবার পর মার্কিন সেনা দেশে ফিরে যায়, আর শহর কলকাতার মধ্যে বিশাল ওই ভূ-ভাগ যেটা বহুমূল্যবানও বটে, সেটা খালিই পড়ে থাকে। যেহেতু এখানে মিলিটারি ক্যাম্প ছিল পথঘাট জল বিদ্যুৎ আবাগমন সুবিধা সবকিছু উন্নত ছিল। এক দু কিলোমিটারের মধ্যে দু দুটো বাস রুট, বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস–কী ছিল না?

এই জমি জনৈক সন্তোষ দত্তের নেতৃত্বে দখল করা হয় এবং যে কলোনি এশিয়া মহাদেশের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম কলোনির স্বীকৃতি পায়। প্রথমটির সম্মান থাকে ইজরাইলের ললাটে।

যখন এই জবরদখল ঘটে, সরকারের পক্ষ থেকে কোন বাধা তো আসেইনি উপরন্তু পশ্চিমবঙ্গের তৎকালিন মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়, রাজ্যপাল মি. কাটজু, ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহেরু, মেজর জেনারেল সত্যব্রত সিংহ, এ ছাড়া ত্রিগুণা সেন, সমর মুখার্জী, সরোজিনী নাইডু, সহ বহু বড় বড় মানুষ স্বজাতি প্রেমে তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে অভয় বাণী দিয়ে গেছেন। যাদের প্রধানমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রী অভয় দেন, তাদের এমন কে আছে যে একটা চুল ছিঁড়ে নেয়?

নিম্নবর্ণের মানুষদের জন্য কার বুকে এমন উথলে ওঠা দরদ ছিল? আজ যখন এই ঘটনার পাশে রেখে মরিচঝাঁপির সেই পৈশাচিক হত্যালীলার বিচার বিশ্লেষণ করতে যাই ক্রোধে দিশেহারা হয়ে পড়ি, কোন হিসাব মেলাতে পারি না। একই কারণে একদেশ থেকে একই সময়ে বিতাড়িত একদল মানুষ। যাদের একদলকে জামাই আদরে কলকাতা শহরের মধ্যের বহুমুল্য জমি বিনা বাধায় দিয়ে দেওয়া হল। আর একদল মানুষকে সুদূর সুন্দরবনের এক দ্বীপ মরিচঝাঁপির নামমাত্র মূল্যের জমি থেকে নৃশংসতায় হত্যা ধর্ষণ অগ্নি সংযোগে লুঠপাট দ্বারা ভীত সন্তস্ত্র করে উৎখাত করে দেওয়া হল। প্রায় তিরিশ হাজার পরিবার গিয়েছিল সেখানে বসবাস করবার জন্য, যাদের দু হাজার মানুষের আজও কোন হদিশ মেলেনি। এর মধ্যে কতজনকে বাঘের পেটে কত জনকে কুমিরের পেটে আর কতজনকে পাথর বেধে সমুদ্রের জলে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে তা কেউ জানে না। আমার বাবাও গিয়েছিলেন ওই চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হত্যাকারীদের উল্লাসভূমি, মরিচ ঝাঁপি দ্বীপে। বুকের হাড় ভেঙে গিয়ে ছিল তার। সে লোমহর্ষক কাহিনী পরে বলব।

এখন একটাই প্রশ্ন, শাসকশ্রেণি দু দল মানুষের প্রতি এই দু-ধরনের মনোভাব কেন দেখিয়ে ছিল? এর পিছনে রয়েছে সেই চিরকালীন বর্ণঘৃণা। ওই মানুষগুলো যদিনমঃ পোদ জেলে না হয়ে বামুন কায়েত বদ্যি হতো, সে যে সরকার তোক কোনদিন এদের উপর এমন পাশবিক অত্যাচার চালাতে পারত না, তখন কলজে পড়ত।

সে যাইহোকতখন এই যাদবপুরে কুড়ি পঁচিশটা এইরকম জবরদখল কলোনি গড়ে উঠেছিল। সে সব কলোনির বাড়িঘর নির্মাণে মুর্শিদাবাদের মুসলমান রাজমিস্ত্রি পূর্ব বাংলার নমঃ পোদ পশ্চিমবঙ্গের কাওড়া বাগদিদের একটা বড় ভূমিকা ছিল।

আমার বাবা রোজ রাত তিনটে সাড়ে তিনটের সময় যখন আকাশে ধ্রুব তারা দেখা দেয়–ঘুম থেকে উঠে ঝুড়ি কোদাল আর গামছা নিয়ে ঘোলা দোতলা থেকে সাত আট মাইল পথ পায়ে হেঁটে এসে পৌঁছাতেন ঘুটিয়ারি শরিফ রেল স্টেশনে। এই পথ হেঁটে আসতে তার প্রায় দেড় দু ঘন্টা লেগে যেত। তখনও ক্যানিং লাইনে দ্রুতগামী ইলেকট্রিক ট্রেন চালু ছিল না। চলত টিকিস টিকিস করে চলা কয়লার ট্রেন। সিঙ্গল লাইনের সে ট্রেন একবার কোথাও দাঁড়িয়ে পড়লে কখন যে নড়বে কোন ঠিকঠিকানা ছিল না। বাবা ভোর পাঁচটা নাগাদ ঘুটিয়ারি শরিফ থেকে ট্রেনে চেপে ছটা সাড়ে ছটা নাগাদ পৌঁছাতে পারতেন যাদবপুর স্টেশনে। তারপর আবার মাইল দুই আড়াই হেঁটে পৌঁছতেন বাঘাযতীন মোড়ে। এই মোড়ে শতশত মজুর জমা হতে কাজের আশায়। মোড়ের সেই ভিড়ের উপর পথচলতি মানুষ আর স্থানীয় দোকানদারদের রাগ ছিল ভীষণ রকম। পরে যখন আমিও কাজের সন্ধানে ওই মোড়ে গিয়ে দাঁড়াতাম তখন দেখেছি, বাঘাযতীন মোেড় থেকে বাঘাযতীন স্টেশনে যাবার যে রাস্তা তার ডান দিকে মোড়ের মাথায় একটা মিষ্টির দোকান ছিল। সেই দোকানের সামনে দাঁড়ালে ঢাকা জেলার দোকানদার মগে করে গায়ে জল ঢেলে দিত। সর সর, সরে যা। দোকানের সামনে দাঁড়াবি না।

বাবা সেই মোড়ের মাথায় একটা কোণ খুঁজে নিয়ে কালীঘাটের ভিখিরির মতো সামনে ঝুড়িকোদাল রেখে বসে থাকতেন, যদি কেউ কাজে নিয়ে যায় সেই আশায়। এদেশে সর্বক্ষেত্রে কর্মসংস্থান কম। সে তুলনায় কর্মীর সংখ্যা বহুগুণ বেশি। সব মানুষের তাই সবদিন কাজ হয়না। যদি বাবার সেদিন কাজ না হয়, না খেয়ে অথবা শুধু জল খেয়ে সারাটা দিন বসে বা গামছা বিছিয়ে শুয়ে থাকতে হতো রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। তারপর খালি হাতে ওই একই পথ পাড়ি দিয়ে একই রকম কষ্ট করে অনেক রাতে একবুক হাহাকায় নিয়ে ঘরে ফিরে আসতেন। ইচ্ছা থাকলেও বাবা দিনের বেলা ট্রেনে চাপতে পারতেন না। কারণটা আর কিছু নয়, তিনি যে বিনাটিকিটের যাত্রী। দিনের বেলা ট্রেনে চেকার থাকে। চেকার বিনা টিকিটের যাত্রী ধরতে পারলে জেলে নিয়ে যায়। সে কারণে তার সাহস হতো না ট্রেনে চড়বার।

যেদিন বাবাকে কেউ কাজে ডেকে নিয়ে যেত সেদিন দুপুর বেলায় মালিকের কাছ থেকে আটআনা পয়সা আগাম চেয়ে নিয়ে একটা পাউরুটি এক প্লেট আলুর দম দিয়ে দুপুরের খাওয়া। সারতেন। বাদবাকি যা মজুরি সেটা কাজের শেষে হাতে পেয়ে অনেক রাতে বাজার করে বাসায় ফিরতেন। সেদিন আমাদের ঘরে রান্না হতো, আমরা খেতে পেতাম।

ঘোলা দোলতলা আসবার কিছুদিন পরে আমার আর একটি বোনের জন্ম হয়েছে। আমাদের সেই আটজনের পরিবার একা বাবার রোজগারের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু বাবার সবদিন কাজ না হবার কারণে আর তার সারাদিন না খেয়ে থাকার ফলে একদিন পেটে ব্যথার রোগ ধরে গেল। প্রথম প্রথম কিছুদিন চিনচিনে থেকে শেষে দাউদাউ হয়ে উঠল সেই ব্যথা। তখন আর বাবা কাজে যাবার মতো অবস্থায় রইলেন না। বিছানায় শুয়ে কাটা ছাগলের মতো ছটফট করতে লাগলেন। ঘরে আমাদের কোন টাকা পয়সা তো ছিল না যে বাবাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাই। বিনা ওষুধ পথ্যে রোগ সারে না, দিনে দিনে বেড়ে চলে।

যে রোজগেরে মানুষ সে যদি বিছানায় পড়ে থাকে তবে তার ঘরের উনুন কী করে জ্বলে? আমাদের খাবার দাবার যোগাড়ের কোন পথ না থাকায় শুরু হয়ে গেল অরন্ধন-অনাহার। না খেতে পেয়ে শুকিয়ে আমরা সব চিমসে মেরে গেলাম। আমার বড় বোন মঞ্জু মরে গেল।

লোকে বলে দারিদ্র্য, গরিবি, অভাব অনটন। কিন্তু এই সব নরম কোমল সাহিত্যের শব্দ দিয়ে আমাদের সেই সময়কার দুরবস্থাকে কোনভাবেই বর্ণনা করা সম্ভব নয়। শুধু বাংলা কেন, বোধ হয় পৃথিবীর কোন ভাষার মধ্যে এমন শব্দ নেই যা আমাদের জীবনের সেই দুঃসহ সময়ের চিত্র তুলে ধরতে সক্ষম।

তখন বাজারে এক আনা দামের প্রায় একশো গ্রাম ওজনের গোল কালো একটা সাবান পাওয়া যেত। আমাদের সেই এক আনা দামের সাবান কেনার মতো সামর্থ ছিল না। ধুলোমাটি পড়ে মাথার চুল এঠেল হয়ে জট বেধে যেত। তখন পুকুর পাড় থেকে মাটি তুলে মাথা ঘসে ঘসে সাফ করতাম। আমাদের ছোট চুল এভাবে সাফ হলেও মায়ের হবে কী করে। শুনেছি আমার মায়ের মাথার একরাশ ঘনকালো চুল দেখেই নাকি আমার ঠাকুরদা তাকে নিজের পুত্রবধূ করে নিয়ে এসেছিলেন। সাবান তেলের অভাবে সে চুলে এমন জট পাকাল যে আর খোলা গেল না। শেষে সব চুল গোড়া ঘেসে কঁচি দিয়ে কেটে ফেলে দিতে হল। মায়ের গায়ের রঙ এক সময় বেশ ফরসা ছিল। সে রঙ এখন রোদে জলে অযত্নে তামাটে আর খসখসে হয়ে গেল। সেই শিরোমণিপুর ক্যাম্পে থাকাকালে সরকার বছরে একবার কিছু কাপড় চোপড় দিত। সেই শেষ। তারপর আর কারও জন্য পরিধানের কিছু কেনা যায়নি। এখন বস্ত্রাভাবে আমার তিনভাই বোন সব উদোম হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল। আমি আমার পেছন ছেঁড়া প্যান্ট পড়ে লোকের সামনে যেতে হলে হাত দিয়ে ঢাকতে লাগলাম ছেঁড়া স্থান।

সবচেয়ে করুণ অবস্থা আমার মায়ের। সেই কবে পাওয়া সরকারি কাপড় এখন পচে ছিঁড়ে ন্যাতা। তা দিয়ে আর লজ্জা নিবারণ করা যায় না। শেষে নিরুপায় আমার মা কবেকার ছেঁড়া এক টুকরো মশারি অঙ্গে জড়িয়ে কুড়ে ঘরের এক অন্ধকার কোণ খুঁজে আত্মগোপন করলেন। শত প্রয়োজনেও আর তার দিনের আলোয় ঘরের বাইরে আসবার উপায় রইল না।

শাস্ত্রে বলা হয়েছে মানুষ নাকি ঈশ্বরের এক মহান সৃষ্টি। চুরাশি কোটি যোনি ভ্রমণ করবার পর মানব জনম মেলে। এ এক দুর্লভ জনম। আমি মানব কুলে জন্ম গ্রহণ করেছি। তাহলে যিনি আমাকে এমন মহান এমন সার্থক জীবন দিয়েছেন তাকে তো ধন্যবাদ দিতেই হয়!

আমার জন্মদাতা পিতা আমার চোখের সামনে পেটের ব্যথায় বিনা চিকিৎসায় তিলে তিলে মারা যাচ্ছেন। আমার গর্ভধারিণী মা এক টুকরো বস্ত্রের অভাবে গর্তে ইঁদুরতুল্য জীবন যাপন করছেন। দিনের আলো তার ভাগ্যে নেই। প্রবল শীতের দিনে যে একটু রোদে এসে বসবেন তা আর পারবেন না। কেননা দিনের আলোয় ওত পেতে থাকে অসংখ্য রাক্ষুসে চোখ। যে চোখ উদোম অঙ্গ প্রত্যঙ্গ শবদেহের কৃমিকীটের মত খুবলে খেতে চায়। আমার একটা বোন না খেতে পেয়ে শুকিয়ে মরে গেছে। তিনটে ভাইবোন শুকোচ্ছে। কদিন পরে মরবে। আমার বুড়ি দিদিমা থলি নিয়ে বাজারে পঁচা আলু পোকা বেগুন শুকনো শিম যা চাষিরা ফেলে দিয়ে গেছে কুড়িয়ে বেড়ায়। যদি ওই পরিত্যক্ত বস্তুর মধ্যে একটু বেঁচে থাকার উপাদান মিলে যায়।

এ জীবন যদি মহান আর সার্থক না হয়, তবে আর সার্থকতা কী!

আমার বাবা ছিলেন একজন সৎ মানুষ। সারা জীবনে কোনদিন কারও অপকার করেননি, মিথ্যা বলেননি। তিনি ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। মায়ের মুখে শুনেছিকাকারাও বলেছেন আশেপাশের দশগ্রামে বাবার মত পরিশ্রম করার ক্ষমতা কারও ছিল না। এক বস্তা ধান এক ঝটকায় একা মাথায় তুলে দুক্রোশ পথ হেঁটে যেতে পারতেন এবং তিনি ছিলেন ভীষণ রকম ঈশ্বর বিশ্বাসী। জীবনে তার কোন বড় আশা ছিল না। দু বেলা দুমুঠো মোটাচালের ভাত। আর তার সাথে যদি একটু তরকারি মিলে যায় তবে তো কোন কথাই নেই। সে যেন উৎসব। কিন্তু তার সত্যবাদিতা সারল্য কঠোর পরিশ্রম ও ঈশ্বর ভক্তি কিছুতেই তার ভাগ্যে সেটুকু সুখ প্রাপ্তি ঘটাতে সক্ষম হয়নি। সারা জীবন আমি বাবাকে কোনদিন পেট ভরে ভাত খেতে পেয়েছে এমন দেখিনি। কোনদিন দেখিনি গায়ে জামা, পায়ে জুতো। তার বুকের হাড়গুলো গোনা যায়।

এমন মানুষের ভাগ্যে এত দুরবস্থা কেন? আমার কিশোর মন যে এই প্রশ্নের উত্তর দাবি করে। কার কাছে আছে এর উত্তর।

উত্তর চাই। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম উত্তর খুঁজতে এবার ঘর ছেড়ে পথে বের হতে হবে। ঘরকুনো হয়ে থাকা আর নয়। খুঁজে দেখতে হবে পৃথিবীর কোন কোণে আমার ভাগ্য আমার জন্য কিছু ফেলে রেখেছে কিনা। নাকি আমার জীবনও নিঃস্ব রিক্ত কপর্দকহীন কাটবে, যেমন কেটেছে আমার বাবা কাকা ঠাকুরদার।

তখন সেই কিশোর ছেলেটির জানা ছিল না পৃথিবী কত রুক্ষ, কঠিন হৃদয়, নির্দয়। এখানকার সকল সুখ সম্পদ কুক্ষিগত করে রেখেছে মুষ্টিমেয় কিছু লোক। যারা তা থেকে এক কানাকড়িও কাউকে দেবে না। সবাই তাকে বঞ্চিত করবে ঠকাবে। শেষে শূন্যহাতে আবার ফিরিয়ে দেবে পুরানো অবস্থায় পুরানো অবস্থানে।

জানত না সেই কিশোর আজ যে ভাবে যে পথ ধরে হেঁটে পৃথিবী পরিক্রমায় চলে যাচ্ছে, সেই পথে সে ভাবে আর ফিরে আসা হবে না। সমস্ত শরীর মনে জড়িয়ে যাবে পথের ধুলো। যার আর এক নাম হতে পারে তিক্ত অনুভব। যা তার আগামী ভাবনা চিন্তা জীবন যাত্রাকে প্রভাবিত করবে, নিয়ন্ত্রণ করবে। সে আর তাকে বাধ্য বিনয়ী সুশীল থাকতে দেবে না, অবাধ্য দুর্বিনীত অসামাজিক, যা কিছু শ্রদ্ধেয়, শ্রেষ্ঠ মহোত্তম সব কিছুর প্রতি এক অসহিষ্ণু ধ্বংস প্রবণ করে তুলবে।

ঘোলা আর দোতলা দুটো গ্রাম। যার মাঝখান থেকে বয়ে যাচ্ছে একটা নোনা জলের খাল। পশ্চিম থেকে সোজা পূর্বদিকে। এই খালের দুপাড় জুড়ে কয়েক হাজার রিফিউজিদের বসবাস। এই খাল পাড় ধরে কিছুটা হাঁটলে সামনে পড়বে রামধারি ব্রিজ। যার উপর দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে চলে গেছে একটা পাকা রাস্তা। এই রাস্তায় ক্যানিং থেকে গড়িয়া পর্যন্ত আশি নম্বর বাস চলাচল করে। বাস রাস্তা পার হয়ে, রামধারি ব্রিজ পিছনে ফেলে, কেটে নেওয়া ধান ক্ষেতের মধ্য থেকে সরু পায়ে হাটা পথ ধরে একে বেকে এগিয়ে গিয়ে সামনে রেল লাইন। লাইনের পাশের পথ ধরে পশ্চিম দিকে মাইল ছয় সাত হেঁটে সামনে ঘুটিয়ারি শরিফ রেল স্টেশন। এ সেই পথ যে পথ ধরে আমার বাবা ঝুড়ি কোদাল কাঁধে নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে রোজ রাত এক প্রহর বাকি থাকতে হেঁটে যেতেন। সেই ধুলো পথে আজ আমি হেঁটে যাচ্ছি ভাগ্যসন্ধান করতে। মনটা এখন বড় কাঁদছে। মা বাবা ভাই বোন সব পড়ে রইল, পড়ে রইল আমার বুড়ি দিদিমা। তাদের দেখার মত কেউ নেই। কী হবে তাদের তা কে জানে! কিন্তু না চলে গিয়ে আমার যে আর কোন পথ নেই। এখানে পড়ে থাকলে সব এক সাথে না খেয়ে মরে যাব।

মহাভারতে একটা গল্প আছে, দুর্যোধন আর দুঃশাসন তার মামা শকুনি এবং তার আরও নিরানব্বই ভাই সবাইকে মাটির তলে এক অন্ধকার ঘরে বন্দী করে রেখেছিল। দুর্যোধনের ভয়। ছিল, শকুনিরাও একশো ভাই। শক্তি সক্ষমতায় সংখ্যায় কৌরবদের সমান সমান। যদি তারা কোনদিন ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে তখন কী হবে। তাই দুর্যোধন চেয়েছিল সবাইকে মেরে ফেলবে। বাঁচিয়ে রাখবে মাত্র একজনকে। যে দুর্যোধনের বৈভব দেখবে আর ঈর্ষায় জ্বলবে। সেই বদ উদ্দেশ্যে দুর্যোধন বন্দী একশো মামার মধ্যে মাত্র একজনার খাবার দেবার নির্দেশ দিয়েছিল। খাবার নিয়ে মারামারি করে নিরানব্বই জন মরে গেলে শেষ পর্যন্ত যে একজন বেঁচে থাকবে তাকে মুক্তি দেওয়া হবে।

দুর্যোধনের উদ্দেশ্য শকুনির বুঝতে বিলম্ব হয়নি। বুঝেছে তার সব ভাইও। তখন তারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে এবং সিদ্ধান্ত নেয়, আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান শকুনি। এই ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ একমাত্র সে-ই নিতে সক্ষম হবে। এ খাদ্য তারই গ্রহণ করা সমীচীন তারই বেঁচে থাকা যুক্তিযুক্ত এবং ভাইয়েরা মৃত্যুবরণ করে বাঁচিয়ে রেখেছিল শকুনিকে। তার ফলাফল কী হয়েছিল সে মহাভারতে লেখা রয়েছে।

আমাকে কি এই গল্প কোনভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে? আমি ঠিক তা জানি না। তবে এটুকু জানি, আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। আমি মরতে চাই না। একবার মরতে মরতে প্রাণ ফিরে পেয়েছি, তাকে এমন কুকুর বেড়ালের মত নষ্ট করতে চাই না।

ঘর থেকে বের হয়েছিলাম সন্ধ্যে ঘোর হয়ে গেলে। ঘুটিয়ারি শরিফ স্টেশনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার নেমে গেল। এসব অঞ্চলে তখনও বিদ্যুৎ এসে পৌঁছায়নি। স্টেশনের বাতি স্তম্ভের ওপর জ্বলত কেরোসিন তেলের কুপি। ট্রেন আসত এক একখানা এক দেড় ঘন্টা পরে পরে। তখনও গ্রামের মানুষের মধ্যে শহর নির্ভরতা এত বৃদ্ধি পায়নি। যে কারণে ট্রেনে খুব একটা ভিড় হত না। সারাদিন মুখে একটা কুটিও কাটিনি, তার ওপর এতটা পথ হাটা; পথশ্রমের ক্লান্তিতে বসে পড়লাম দু নাম্বার প্লাটফর্মে এক কাঠের বেঞ্চিতে। আর কিছুক্ষণ পরে শুয়ে পড়লাম। শেষে ঘুমিয়ে পড়লাম, তলিয়ে গেলাম ঘুমের এক অতল মহা সমুদ্রে।

অনেক রাতে যখন দূর কোন বাঁশবনে যেন শেয়াল ডাকছে, আমার ঘুম ভেঙে গেল একজন অপরিচিত মানুষের গলার শব্দে। সে আমার কাছে জানতে চাইছে, এই খোকা, তুই কোথায় যাবি রে? এমন বেমক্কা প্রশ্নে ফ্যালফ্যাল করে প্রশ্নকর্তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। কোন জবাব দিতে পারি না। আমি কি জানি কোথায় যাব। কোথায় আমাকে নিয়ে চলেছে আমার ভবিতব্য। শুধু এইটুকু জানি, দুর্ভিক্ষের এই অন্ধকার হা মুখ থেকে আমাকে দূরে পালাতে হবে। তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখতে হবে, পৃথিবীর সব অন্ন সব শস্য সর্বসুখ লুঠ হয়ে গ্যাছেনাকি সবার অলক্ষ্যে কোথাও আমার, আমাদের জন্য এককণা পড়ে আছে।

যখন বাসা ছেড়ে চলে আসি, মা বাবাকে বলে আসা হয়নি। বললে তারা আমাকে এমন নির্বান্ধব পথে নিরুদ্দেশ যাত্রায় যেতে দিত না। এমন যে হিংস্র বাঘ সে-ও তার বাচ্চাকে চোখের আড়ালে যেতে দেয় না। মানুষের তো মায়ার শরীর। আমার মা এখন নিশ্চয় জেগে বসে আছেন, আমার অপেক্ষায় পথের দিকে তাকিয়ে। রাত যত বাড়বে তার চিন্তা তত বেড়ে যাবে। শেষে দুচোখ জুড়ে নামবে প্রবল বর্ষণ ধারা।

মাকে কাঁদিয়ে আজ দূর পরবাসের পথে চলেছি ওই মা বাবা ভাইবোন এদের সবার জন্য। যদি কোন দিন সন্ধান পাই, যদি সেখান থেকে সবার জন্য কিছু সুখ কিছু আয়ু নিয়ে ফিরে আসতে পারি সেদিন আবার এই পথ ধরে ফিরে আসব। নচেৎ এই শেষ, এই আমার অগস্ত্য যাত্রা। আমি ঠিক জানি না আমার এই যাত্রার সমাপ্তি কোথায়।

আমি কোন জবাব দিতে পারছি না দেখে আবার প্রশ্ন করে সেই জমাট বাধা অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা। যার হাতে একটা টর্চ। যে টর্চের আলো আমার মুখ মাথা শরীরে। এ্যাই তোরা রেফুজি? তখন মাথা নাড়ি আমি। আর আমার কিছু বলবার দরকার ছিল না। আমার মাথা নাড়ায় সব জবাব পেয়ে যান তিনি। জেনে যান আমার বিগত অতীত আগত ভবিষ্যৎ। রিফিউজি। বাংলা ভাষার অভিধানে এর চেয়ে দরিদ্র নিকৃষ্ট অপমানজনক শব্দ আর একটাও নেই।

পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে রিফিউজি আর বাঙাল সমার্থক শব্দ। যা স্থানিক পরিভাষায় একটা গালাগালিও বটে। যেমন বুর্জোয়া, প্রতিক্রিয়াশীল, জোতদার, সুদখোর, রাস্তার কুকুর। কী ভীষণ বিড়ম্বনা। কী অভিশপ্ত অপরাধময় জীবন আমাদের। আমরা নিজেদের হিন্দু বলে পরিচয় দেই, মূর্তি পূজা করি, সেই অপরাধে একদল মুসলমান আমাদের কাফের বিধর্মী শত্রু বলে। আমরা নিম্নবর্ণ-নমঃশূদ্র জনগোষ্ঠির মানুষ বলে, একদল তথা কথিত উচ্চবর্ণ আমাদের অচ্ছুত অস্পৃশ্য চণ্ডাল বলে গাল দেয়। ঘৃণায় থুতু ছেটায়। এখন এদেশে এসে পড়তে হয়েছে–ওদেশে জন্মাবার অপরাধে আর এক গালাগালির সামনে–বাঙাল। “বাঙাল মনুষ্য নহে, উড়ে এক জন্তু লাফ দিয়ে গাছে ওঠে, লেজ নাই কিন্তু।” এটি এক ঘটি কবি দ্বারা রচিত কবিতার লাইন। ঘটিদের চোখে বাঙালরা সব বহিরাগত। যারা অন্য এক দেশ থেকে এদেশে এসে চাকরি ব্যবসা রাজনীতি শিল্প সাহিত্য সব কিছু কজা করে নিয়েছে। বর্তমানে এই বাঙাল ঘটি বিরোধ এমন তুঙ্গে যে নিকট ভবিষ্যতে শিয়া সুন্নিদের মত একটা রক্তক্ষয়ী লড়াই হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়।

যা ভেবেছিলাম তা নয়, এই ভদ্রলোক ঘটি নন–বাঙাল। বাঙাল, তবে রিফিউজিও নন। ওদেশ থেকে এদেশে এসে নগদ টাকায় জমি জায়গা কিনে ঘরদোর পুকুর সব বানিয়েছেন। লেখাপড়া জানা মানুষ, উনি তাই জানেন কোন শব্দের প্রয়োগে এক রিফিউজি বাচ্চাকে পেড়ে ফেলা যায়। সেই শব্দবাণ ছুড়লেন তিনি, আমার বাড়ি যাবি? থাকবি আমার বাড়ি? ভাত খেতে দেব।

ভাত। আহা রে! সেই কবে কতকাল আগে যেন ভাত খেয়েছিলাম। কী তার রঙ রূপ ঘ্রাণ আর স্বাদ। সে স্বাদ গন্ধে যেন প্রাণ জুড়িয়ে যায়। ভাতের নামে কাত হয়ে যায় এক যুগান্তের অনাহারি বালক। সে লোকটার পিছন পিছন হেঁটে গিয়ে পৌঁছায় তার বাড়ি। কেন আমাকে ভাত দেওয়া হবে পথে আসতে আসতে তা বুঝিয়ে বলে দেন তিনি–কটা গরু আছে, তাদের একটু খড় বিচালি ঘাস জল দেওয়া, গোয়ালটা একটু সাফ সাফাই করা, এই সব আর কী।

লোকটি পেশায় একজন ডাক্তার এবং জাতিতে বামুন। দেশ ভাগের কারণে দেশ ছেড়ে এলেও উনি যে রিফিউজিদের মত ক্যাম্পে গিয়ে ঢোকেননি, কলোনিতে পরের জমি জবরদখলও করেননি, নিজের টাকায় বাড়িঘর বানিয়েছেন সে নিয়ে ওনার খুবই গর্ব ও অহংকার।

মানুষের মধ্যে কত যে ভাগ বিভাগ তা কিছুতেই আমি বুঝে উঠতে পারি না। মানুষের সাথে মানুষের অবাধ মেলামেশার দরজা কতভাবে যে বন্ধ করার অপচেষ্টা করে চলেছে মানুষ, তার তল খুঁজে পাই না। এখন জানলাম বাঙালদের মধ্যে আরও একটা উপভাগ রয়েছে, যারা রিফিউজি বা কলোনি বাসিন্দা নয়।

আমার ছোট্ট জীবন এতদিন যে দুই ক্যাম্পের সীমানার মধ্যে কেটেছে, সেখানে কোন বামুন কায়েত ছিল না। ফলে বর্ণব্যবস্থা জিনিসটা যে কী তাও আমার খুব একটা জানাবোঝর অবকাশ ঘটেনি। বিয়ে বা শ্রাদ্ধের মন্ত্র পড়াতে বাইরে থেকে মাঝে মধ্যে যে দু একজন বামুন ক্যাম্পে আসত, তারা কখনও জাতিগর্বে বুক ফোলাবার মত সাহস দেখাতে পারত না। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় নিজেকে সংযত করে রাখত। এই বাড়িতে এসে প্রথম বর্ণবাদের কুৎসিত কদাকার রূপটা প্রত্যক্ষ করলাম। বুঝতে পারলাম যে হিন্দু ধর্মের মানুষ বলে আমরা পরিচয় দিয়ে গর্বিত হই, সেই ধর্মে আমাদের স্থান কোথায়।

আমি নমঃশুদ্র, যাদের আগে চণ্ডাল বলা হোত, এরা সে কথাটা জানে। ফলে বাড়ির লোক আমাকে এমন ঘৃণিত জীব বলে মনে করে যেন আমি কোন ছোঁয়াচে রোগের রোগী। ভাত খাবার সময়ে ডাক্তারের গিন্নি একটা কলাই করা বেড়ানো থালায় যেন ছোঁয়া না লেগে যায় এমন ভাবে উঁচু থেকে ছরছর করে ভাত তরকারি ঢেলে দিত। যা উঠোনের এক ধারে বসে কাঙালের মতো খেয়ে নিজের থালা নিজে ধুয়ে আনতে হত। সে থালা ওরা ঘরে ঢোকাতনা। গোয়াল ঘরের মধ্যে রাখা থাকত। আমার ঘুমাবার জন্য বরাদ্দ স্থান ছিল গোয়ালের একধারে গাদা মারা ঘুঁটের বস্তার উপর। গরুর চোনার গন্ধে আর মশার কামড়ে সারা রাত ঘুমাতে পারতাম না। ঘুমাতাম দিনের বেলায় গরু চড়াতে গিয়ে, মাঠের কোন গাছ তলায় গামছা পেতে। সেই ঘুমের কারণেই একদিন পিঠেপড়েছিল কঁচা কঞ্চি বাড়ি। আমি সেদিন গরুরপাল নিয়ে রেল লাইনের দিকে চলে গিয়েছিলাম ট্রেন দেখব বলে। ট্রেন আসতে দেরি ছিল তাই গরু মাঠে চড়তে দিয়ে আমি শুয়ে পড়েছিলাম এক গাছের ছায়ায়। যখন ট্রেন এল অবলা জন্তুগুলো সে আওয়াজে আতংকিত হয়ে ছুট দিল ঊর্ধ্বশ্বাসে যে যেদিকে পারে। আর তাতেই পা পিছলে গর্তে পড়ে পা ভেঙে গেল একটা গরুর। সেই অপরাধে ডাক্তার আমার পিঠে ভাঙলেন পাঁচনবাড়ি।

ঘুটিয়ারি শরিফ একটা মুসলমান প্রধান অঞ্চল। এখানে গাঁজিবাবা নামক এক পিরের মাজার আছে। যাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আগমন ঘটেছে কিছু বিহারি মুসলমানের। যারা বাঙালী মুলমানদের মত অতটা” নিরামিশ” প্রবৃত্তির নয়। এখানকার এক রেল লাইনের ধারে এনে বসানো হয়েছে পূর্ববঙ্গ থেকে বিতাড়িত একদল ছিন্নমূল মানুষকে। পুরাতন ক্ষতে খোঁচা দিতে এদের কাছে নিয়মিত আসাযাওয়া করে থাকে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের লোকজন। ফলে এ সময়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে থম থম করে একটা চাপা উত্তেজনা। যা যে কোন সময় ফেটে পড়বার সমূহ সম্ভাবনা বিদ্যমান।

ডাক্তার লোকটি খুবই চালাক। সে খুব বুদ্ধি করে স্থানীয় মুসলমান সম্প্রদায়ের ক্ষমতাবান লোকেদের সাথে মনের ঘৃণা হিংসা ক্রোধ মনে চেপে রেখে একটা সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলার চেষ্টা করে থাকেন।

একদিন ডাক্তার পাশের গ্রামের কয়েকজন মাতব্বর গোছের মুসলমানকে নিমন্ত্রণ করে নিজের বাড়ি নিয়ে এল পায়েস খাওয়াবে বলে। যদি এখানে কোনদিন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, সেদিন এই পায়েস তাকে বিপদ থেকে রক্ষা করবে এই তার ধারণা। কিন্তু ডাক্তারের গিন্নি এত সব কুট কৌশল জানে না। যাদের জন্য দেশত্যাগ করে আসতে হয়েছে সেই গরুষোর নেড়ের জাত উঠোনে এসে দাঁড়াবে, বারান্দায় এসে বসবে, খাবে, সে তার ঘোর অপছন্দের। আজ বারান্দায় বসবে, কাল রান্নাঘরে ঢুকবে। তাহলে আর জাতধর্মের কী রইল!

গিন্নির গজগজানিতে কর্ণপাত না করে ডাক্তার তাদের বারান্দায় নিয়ে গিয়ে বসতে দিলেন। যে বারান্দায় “স্বজাত” হয়ে আমি কোনদিন উঠতে পারিনি, সেইখানে নিয়ে বসানো হল বিধর্মী ম্লেচ্ছদের। গরজ বড় বালাই যে। শোনা যায় মুসলমান শাসনকালেও এমন হোত। নিম্নবর্ণের যে মানুষ হিন্দু উচ্চবর্ণের কাছে কোন মান সম্মান সাম্য ব্যবহার পেত না, যেই সে নিজের জাত ত্যাগ করে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করত সাথে সাথে বৰ্ণহিন্দুদের কাছে সম্মানীয় হয়ে উঠত। রাজার জাত বলে কথা। তখন সম্মান না দিলে অবজ্ঞা দেখালে পেয়াদা এসে যখন প্যাদাবে, কোন বাপবাঁচাবে? এই কারণে নাকি দলিতশ্রেণির বহু মানুষ ধর্ম পরিবর্তন করে মুসলমান হয়ে গিয়েছিল।

সে যাইহোক সমস্যা হল তারা পায়েস খেয়ে চলে যাবার পর। তখন আর ডাক্তারের গিন্নির গলায় কোন রাখঢাক রইল না। চিৎকার করে তিনি ডাক্তারের বেআক্কেলে কাণ্ডজ্ঞানের জন্য ভর্ৎসনা করতে লাগলেন। আর আমার উপর আদেশ হল গোবর জল গুলে যেখানে তারা দাঁড়িয়েছিল, বসে ছিল, সর্বত্র তা ছিটিয়ে শুদ্ধ করবার। তারা যে থালায় খেয়েছে তা ধুয়ে সাফ করবার। এসময়ে তিনি আমাকে “অচ্ছুত হওয়া সত্ত্বেও” মুসলমানের চেয়ে উচ্চে স্থান দিয়েছিলেন।

ওই নিমন্ত্রিত মুসলমানদের একজনের একটা রেডিও সেট ছিল সে সেটা সর্বক্ষণ সাথে নিয়ে ঘুরত। ওটা সে এখানে ফেলে চলে গিয়েছিল। সুইচ অফ থাকায় তার অস্তিত্ব কেউ টের পায়নি। কিছুদূর পথ পার হয়ে গিয়ে রেডিও ফেলে যাবার বিষয়টা মনে পড়ে যাওয়ায় সেটা নিতে তারা ফিরে এসেছিল। কিন্তু ডাক্তারের গিন্নির বিষবাক্য আর গোবর জলের বন্যা দেখে তারা আর বাড়ির ভিতর ঢুকতে পারেনি। পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল পুকুর পাড়ের রাস্তার উপর।

বাড়ির কেউ তাদের দেখতে পায়নি। পুকুরে জল আনতে গিয়ে দেখে ফেলেছিলাম আমি। মৃদুজোছনার আবছা আলো অন্ধকারে অপমানে পাথর হয়ে যাওয়া সেই মানুষগুলোর দুচোখে যেন জ্বলছিল সর্বনাশা আগুন। যে আগুনে ঘর পোড়ে শান্তি সম্প্রীতি পোড়ে সমাজ পোড়ে দেশ পোড়ে।

কেন জানিনা সেদিন আমার অপরিণত কিশোর মনে ছায়া ফেলেছিল একটা অশুভ আশংকা, ওরা এই অপমান হজম করতে পারবে না। কোন একদিন পেটের মধ্যে যাওয়া পায়েস বমি হয়ে বেড়িয়ে আসবে। সেই ঘৃণার স্রোতে ভেসে যাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সকল প্রয়াস। কারণ ঘৃণা তো ঘৃণারই জন্ম দেয়, যেমন ভালোবাসা জন্ম দেয় ভালোবাসার। যে ঘৃণা নিয়ে আজ এরা ফিরে যাচ্ছে, কাল দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দিতে আসবে।

শত শত বছর ধরে এই অভাগা দেশে একদল মানুষ আর একদল মানুষকে ধর্মের নামে বর্ণের নামে বিনা কারণে যে অপমান অত্যাচার করে চলেছে নিউটনের সূত্র যদি সত্যি হয় তবে তা একদিন ফেরত আসবেই। কোন উপায় নেই সেদিন চোখের জলে, বুকের দীর্ঘশ্বাসে তোমার পাওনা, তোমাকে বুঝে নিতেই হবে।

সেদিনের সেই আশংকা আমার সত্যে পরিণত হয়েছিল মাত্র অল্প কিছুদিন পরেই। সেটা যতদূর মনে পড়ে ১৯৬৩ সাল। যেবার কাশ্মীরের কোন এক মসজিদ থেকে যেন হজরত সাহেবের “বাল” চুরি গিয়েছিল। সত্যিই চুরি গিয়েছিল না নিজেরাই লুকিয়ে রেখে গুজব ছড়িয়ে ছিল কিছু দুষ্ট লোক, তা কে জানে। তবে সেই উপলক্ষ্যে সারাদেশ জুড়ে দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। যে দাঙ্গায় বহু নিরীহ মানুষও মারা যায়। সে দাঙ্গার রক্তদাগ আমার কিশোর হাতেও লেগে ছিল। আমার হাতে লেগে যাওয়া সে রক্তের গন্ধ এখনও টের পাই।

শুনেছি সেই সময়ে কে বা কারা ডাক্তারের বাড়িতে রাতের অন্ধকারে আগুন ধরিয়ে দেয়। তার আগে ঘরের মূল্যবান যা কিছু লুঠপাট করে নেয়।

.

শহর কলকাতার মধ্যে একটা জায়গার নাম আমার জানা ছিল। সেটা যাদবপুর। একদিন এসে পড়লাম সেই যাদবপুরে। যেখানে নানা রকম কাজ পাওয়া যায়। আমার বাবা এখানে এসে কাজ পেতেন। বাবা যখন পেয়েছেন ছেলেও পাবে। তাই ট্রেন থেকে নেমেছিলাম এখানে। প্রথম রাতটা কাটাতে হল এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে এখন যেখানে গণশক্তি সাঁটা হয় সেই দেওয়ালের কাছে পানের পিক পোড়া সিগারেটের টুকরো ছেঁড়া কাগজ ধুলোময়লার মধ্যে শুয়ে। সে রাতে ধুম জ্বর এসেছিল আমার। সারা গায়ে ছিল পাকা ফোঁড়ার মত বিষ ব্যথা। ডাক্তারের বেপরোয়া কঞ্চি চালনায় শরীরের নানা জায়গা ছিল দাগড়া দাগড়া ফোলা।

পরের দিন সকালে জ্বর আর ছিল না, ছিল পেটে ভীষণ খিদে। আর গায়ের ব্যথাটা বেড়ে গিয়েছিল বেশ খানিকটা। কিন্তু এইসব অসুবিধার কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে থাকলে সমস্যা যে বেড়ে যাবে। তাই সব শারীরিক ক্লেশ অস্বীকার করে খুঁজতে বের হলাম একটা কাজ। তখন কতই বা বয়স আমার। এই বয়সে এমন কীবা কাজ আমি পেতে পারি। তাই যে কাজ আমার সামর্থে কুলায় যে কাজের আমি যোগ্য, পেয়েছিলাম সেই কাজ, এক হিন্দুস্থানির চায়ের দোকানে গেলাস ধোবার চাকরি। যার মাইনে মাসে দশটাকা। আমার মনের মধ্যে ডাক্তারের বাড়ির স্মৃতি তখন একেবারে টাটকা, নিম্নবর্ণ হবার যে যন্ত্রণা-অপমান তা আমার হাড়ে হাড়ে জানা। তাই নিজের নামটা বদলে একটা নাম রেখে নিলাম যাতে আমাকে কেউ নমঃশূদ্র বলে শনাক্ত করতে না পারে। তাহলে হয়ত আর কাজেই রাখবে না। যদি বা রাখে ব্যবহার করবে ঘৃণ্য কোন জীবের মত। দোকান মালিক উত্তর প্রদেশের লোক। যাদের মধ্যে জাতপাত ছুয়াছুত বাঙালীদের চেয়ে ঢের বেশি। তবে আমার ভাগ্য এসময়ে ভালো বলে তারা আমার জাত বিষয়ে বিশেষ আগ্রহ দেখাল না।

সঠিক মনে নেই বোধ হয় চার পাঁচ মাস এই দোকা্নে কাজ করেছিলাম। এরা মাসমাইনের দশ টাকা মাসের শেষে চাইলেই দিয়ে দিত। তবে ধোবার সময় হাত ফসকে পড়ে গিয়ে গেলাস ভেঙে গেলে তার দামটা মাইনে থেকে কেটে নিত। এটা শাস্তি, যাতে কাজের লোক কাজের প্রতি অমনযোগী না হয়। প্রায় মাসেই শত সাবধানতা সত্ত্বে একটা দুটো গেলাস ভেঙেই যেত। একবার প্রায় চারসের দুধ হাত থেকে পিছলে নিচে পড়ে গিয়েছিল। সে মাসে মাইনে মেলেনি।

আমি তখনও কোন খুন জখম দেখিনি। দাঙ্গা কাকে বলে জানি না। রামায়ণ মহাভারত পাঠ শুনেছি, মানুষ মানুষকে বধ করে সেটা জানি। কিন্তু সেটা যে কী মর্মান্তিক দৃশ্য। সেই দৃশ্যের সামনে পড়তে হল একদিন।

এক সকালে দেখি সামনের রাস্তা ধরে বাঁশ টালি বয়ে নিয়ে দলে দলে লোক চলেছে পুর্বদিকে। কারা এরা! যাচ্ছে বা কোথায় এইসব নিয়ে? এরা চলেছে সন্তোষপুর খাল পার হয়ে এখন যেখানে ইস্টার্ন বাইপাস সেখানে। ওখানে বিশাল এলাকা জুড়ে জমিদারদের কবজা করে রাখা জমি এরা দখল করে নিচ্ছে। এখানে আর একটা জবরদখল কলোনি করবে। অহীন রায় চৌধুরী নামের এক কংগ্রেস নেতার নেতৃত্বে এসব হচ্ছে। তার সাথে রয়েছে সোনাইয়া নামের আর একজন। যে পরে হাতকাটা সোনা নামে খ্যাত হয়। যখন জমি জবর দখল হয় তখন তার হাত ছিল। প্রায় আট দশ দিন ধরে চলল এই পথে দখলদার লোকদের মিছিল। এক দুপুরে আমি সেই নতুন কলোনি দেখতে গিয়েছিলাম। দেখেছিলাম যতদূরে চোখ যায়, তৈরি করা হয়েছে ছোট ছোট ঘর। কোনটা হোগলার কোনটা মুলিবাঁশের। গোনা যায় না, তবে মনে হয় কুড়ি পঁচিশ হাজার পরিবার বসে গেছে ইতিমধ্যে। ইচ্ছে হয়েছিল এখানে এক খণ্ডভূমি আমিও দখল করব। আমাদেরও তো কোথাও থাকবার মত জায়গা নেই। কিন্তু আমার ভাবনাটা ছিল যে পরিমাণ বড় বয়স আর শরীরটা ছিল সে তুলনায় ছোট। তাছাড়া একটা ঝুপড়ি খাড়া করতে যে কটা বাঁশ আর হোগলা দরমা দরকার সে টাকাই বা কোথায় পাব।

গল্পে আছে একজন লোক ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠতে দেরি করার ফলে ট্রেন ফেল করেছে। এতে তার প্রচুর লোকসান হয়ে যাবার জন্য মনভার। কিন্তু যখন আধ ঘন্টা পরে খবর পেল সেই ট্রেনখানা দুর্ঘটনায় পড়েছে তখন আর তার ট্রেন ফেল হবার জন্য মন খারাপ রইল না। তখন ওই ট্রেনে না উঠতে পাবার জন্য নিজেকে নিজে ধন্যবাদ জানাল।

কদিন পরে একরাতে গনগনে আগুনের শিখায় পুবাকাশ লাল হয়ে গেল। শোনা গেল শতশত কণ্ঠের সম্মিলিত আর্তনাদ। নৈশ নিস্তব্ধতা ভেদ করে মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজ। সারা রাতে এ শব্দের বিরাম ছিল না।সকাল হতেই দেখতে পেলাম, যে পথে কাল মানুষ পায়ে হেঁটে গিয়েছিল, এখন সেই পথেই ফিরে আসছে বাঁশের মাচায়, ঠেলাগাড়ি ভ্যান রিকশায়। সবার শরীর থেকেই পথের ধুলায় ঝরে ঝরে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত। মানুষের রক্তে লাল হয়ে যাচ্ছে পথের ধুলো। সারারাত ধরে পুলিশ আর জমিদারদের পোষাগুণ্ডা বাহিনী যে নৃশংস তাণ্ডব চালিয়েছে এ সব তারই নিদর্শন। একসঙ্গে এত রক্তাক্ত আহত নিহত মানুষ দেখে সেদিন সেই কিশোর মন কাতর হয়েছিল আমার। সেদিন পৃথিবীটাকে আমার সভ্য মানুষের বাসভূমি বলে মনে হয়নি। মনে হয়েছিল একদল হত্যাভিলাষী ঘাতকদের উল্লাস ভূমি। এই বধ্যভূমিই আমার দেশ। এই হত্যাকারির উল্লাস মঞ্চই আমার দেশ।

আমার বাবাকে একদিন বিনা অপরাধে পুলিশেরা মেরে রক্তাক্ত করে দিয়েছিল। সেইদিন থেকে পুলিশ নামটার প্রতি আমার জন্মে আছে ঘৃণা ভয় আক্রোশ। এবার সেই সাথে যুক্ত হল আর একটা নাম সেটা হচ্ছে জমিদার। পুলিশ গুণ্ডা আর জমিদার এরা মানুষের শত্রু। এদের মাত্র একটাই কাজ মানুষকে অত্যাচার করা। ডাক্তারের বাড়ির অমানবিক ব্যবহারে বর্ণ প্রভুদের প্রতি ক্ষোভ রাগ সেও যাবার নয়। এই রাগ ক্ষোভ ঘৃণায় ত্রিবেণী সঙ্গমের ঘোলা স্রোতে ভেসে চলল আমার ছোট্ট জীবন তরীখানা। মনের মধ্যে জমা হতে রইল বিস্ফোরণউন্মুখ বারুদ।

জীবন এক যাত্রা, জীবন এক যুদ্ধ, জীবন এক অভিজ্ঞতার নাম। আমি কি তখন জানি যে জীবন আমাকে কোথাও থিতু হতে দেবে না। ক্রমাগত তাড়িয়ে নিয়ে যাবে এক বিভৎসতা থেকে আর এক বিভৎস অভিজ্ঞতার কেন্দ্রে। রক্ত ধ্বংস চোখের জলের বহু পথ পার হতে হবে এই ছোট পায়ে। এই পথই আমার জন্য পূর্ব নির্ধারিত। কেউ আমাকে টানছে, কেউ আমাকে ঠেলছে সেই দিকে চালিত করার জন্য। আমি এক ক্ষুদ্র মানুষ, আমার সাধ্য কোথায় সেই অমোঘ নির্দেশ উপেক্ষা করবার।

যাদবপুর ত্রিকোণ পার্কের সেই দোকনে থেকে কাজ ছেড়ে দিয়ে এবার কাজ খুঁজে নিয়েছিলাম পার্ক সার্কাসের এক চায়ের দোকানে। আগের মালিক মাইনে দিচ্ছিল মাসে দশ টাকা, এ মালিক দেবে তার দেড়গুণ বেশি। মাসে পঁচিশ টাকা।

এই দোকানদার বৃদ্ধ। রোজ সন্ধ্যেবেলায় তার দোকানে তারই মত জনাকয়েক বুড়ো লোক আড্ডা দিতে আসে। একদিন এদের আলোচনায় জানা গেল মুসলমানদের কোন এক মসজিদ থেকে নাকি পবিত্র “হজরত বাল” চুরি গেছে। এদের সন্দেহ ওসব চুরি ফুরির গল্প স্রেফ বানানো। ওই বস্তু নিয়ে কার কী লাভ। এই সব বলে মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে কিছু বদমাশ লোক একটা দাঙ্গা বাধাতে চাইছে। এবং একদিন সত্যি সত্যি সারা দেশ জুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরুই হয়ে গেল। কারণ মুসলমানদের মধ্যে কিছুলোক বিশ্বাসই করে বসল যে এটা হিন্দুদেরই কাজ। দেশের পরিস্থিতি তো অনেক আগে থেকেই পারস্পরিক ঘৃণা ভয় সন্দেহ বিদ্বেষে অগ্নিগর্ভ হয়েছিল। দরকার ছিল মাত্র একটা ছুতোর। সে ছুতো পাওয়া মাত্র পাগলা কুকুরের মতো এক সম্প্রদায় ঝাঁপিয়ে পড়ল আর এক সম্প্রদায়ের টুটি লক্ষ্য করে, দাঁতে কামড়ে ছিঁড়ে নেবে বলে।

পার্ক সার্কাস অঞ্চলে মুসলমানদের সংখ্যা বেশি। উস্কানি যথেষ্ট আছে, তবে এখন পর্যন্ত এ অঞ্চলে দাঙ্গা হয়নি। পথেঘাটে হাটেবাজারে তারই ইঙ্গিত আভাষ বড় প্রকট। রাত নামলে সবার চোখে মুখে ঘনিয়ে ওঠে ভয়ের কালো ছায়া। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পথচলা মানুষ ঘরে ফিরে দরজা এটে বন্ধ করে নেয়। শুনশান হয়ে যায় সব অলিগলি। এখন বড় ভয়ানক দিন। এসব দিনে সন্ধ্যা নামলে কোন মা কোন বাবা তার সন্তানকে ঘরের বাইরে যেতে দেয় না। যদি ঘরের বাইরে থাকে সে ফিরে না আসা পর্যন্ত দুশ্চিন্তায় মা বাবার বুক কাপে।

আমি এক অভাগা মানুষ। আমার এই বিপন্ন “বিদেশে” কোন আপনজন নেই, যে, আমি হারিয়ে গেলে খুঁজবে, মরে গেলে কাঁদবে। আমি কাজের লোক। আদেশ পালন করা যার কাজ। “পারব না” বলা যার মুখে মানায় না। সেটা গর্হিত অপরাধ। কর্মচারিদের প্রতি মালিক শ্রেণির কোন মায়া মমতা থাকেনা। সেটা তাদের মানসিক দুর্বলতার লক্ষন। চিত্ত দুর্বল মালিক–মালিক শ্রেনির–উপহাসের পাত্র। কষাই পাঠা ছাগলের প্রতি মমত্ব দেখালে তার ব্যবসা ফেল মেরে যাবে।

ত্রিকোণ পার্কের দোকান থেকে সরাসরি পার্কসার্কাসে আসিনি। এর আগে দিন কয়েক পালবাজারে এক দোকানে কাজ করেছিলাম। সে দোকানের মালিক রোজ রাত সাড়ে নটার সময়ে আমাকে তার বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসতে পাঠাত। তার বাড়িটা ছিল কালিকাপুর মাঠ পার হয়ে মাইলখানেক আগে। পালবাজার থেকে সে বাড়ির পথ চারপাঁচ মাইলের বেশি নয়। তবে গরফা স্কুল পার হবার পর পুরো পথটাই ছিল এবরো খেবরো–অন্ধকার আর বনজঙ্গলে পূর্ণ। তখনও এ অঞ্চলে এত ব্যাপক জন সমাগম ঘটেনি। সেইসব বনজঙ্গলে বাস করত সাপ শেয়াল অজস্র পোকামাকড়। অত রাতে এ পথে কোন লোকজন থাকত না। একা যেতে খুবই ভয় করত আমার। গরফা স্কুল পার হয়ে অন্ধকার পথে নেমে ভয়ের তাড়সে জোরে জোরে গান গাইতাম আমি। গান মাত্র এক কলি–ভজ শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য প্রভু নিত্যানন্দ, হরে কৃষ্ণ হরে রাম শ্রীরাধা গোবিন্দ। অন্যসব নাম তো ফালতু ফালতু নেওয়া–আসল নাম হচ্ছে রাম। সবাই যা জানে আমিও তা জানি, রাম নামে ভূত পালায়। এখানে যা জঙ্গল ভূতপ্রেত না থাকার কোন কারণ নেই। তাই খুব দ্রুত উচ্চারণে ভজ থেকে রামে পৌঁছে যেতাম।

এক নিশুতিরাতে এভাবেই গান গেয়ে–দুরুদুরু বুকে কাঁপা কাঁপা পায়ে পথ হেঁটে যাচ্ছি। হঠাৎ কালিকাপুর খালের এপাড়ের ঘন জঙ্গল থেকে বের হয়ে এল আটদশটা ক্ষুধার্ত শেয়াল। যেভাবে ওরা ছাগল ছানাকে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরে শিকার করে সেভাবে ঘিরে ফেলল আমাকে। আমার পালাবার কোন পথ নেই।

আমার কাছে তখন আত্মরক্ষা করার মতো কোনকিছুই নেই। এক হাতে টিফিন ক্যারিয়ার অন্যহাতে দু-ব্যাটারি একটা ছোট টর্চ। টর্চের আলোয় দেখতে পাচ্ছি শেয়ালগুলোর নরমাংস লোভী চোখগুলো চক্ করছে। এখানে কোন ঘরবাড়ি নেই যে চিৎকার করলে কেউ এসে আমাকে বাঁচাবে। বেশ কিছু দূরে পাতলা পাতলা কটা পাকা বাড়ি দেখা যাচ্ছে বটে সে সব বাড়ির আলো নেভানো দোর দরজা আঁটা। এতে কোন লোকজন আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না।

আমার অবস্থা এখন চক্রব্যুহে পড়া অস্ত্রহীন অভিমুন্যের মত। এক অসহায় বালককে খাবে বলে বৃত্ত করে থাকা শেয়ালগুলো ক্রমে বৃত্ত ছোট করে আনছে। আর আমি অসহায়ভাবে মাঝখানে দাঁড়িয়ে–কোন দিক থেকে আক্রমণ আসবে সেই ভয়ে ঘুরপাক খাচ্ছি। সেই গ্রাম বাংলার দাড়িয়াবান্ধা খেলার মত নানা দিক থেকে শেয়ালগুলো ‘ঝোল’ মারছে।

আমার পরিধানে কোমরের কাছ বরাবর রবার লাগানো কালো ছাতার কাপড়ের একটা প্যান্ট। গায়ে–এককালে যার রঙ সাদাই ছিল, এখন মেটে মেটে সেই স্যান্ডোগেঞ্জি। প্যান্টের উপর কষে বাঁধা একখানা গামছা। গ্রামবাংলার চাষির ছেলে, গামছা আমার সদাসঙ্গী। গামছা আমার কাছে শুধু চান করবার এক টুকরো বস্ত্র নয়, ঘাম মোছার রুমাল, মাথায় বাঁধার পাগড়ি, গায়ে দেবার চাদর, বিছিয়ে শোবার বিছানা, কোমরের বেল্ট।

আজ এখন মনে হল এটা একটা যুদ্ধের অস্ত্রও হতে পারে। যা আমাকে আত্মরক্ষায় সাহায্য করতে পারে। তাই চট করে পাথের পাশে পড়ে থাকা এক খানা ইটের টুকরো কুড়িয়ে বেঁধে নিলাম গামছার এককোণে। তারপর গামছার অন্যপ্রান্ত ধরে বনবন করে চক্রাকারে ঘোরাতে শুরু করে দিলাম। শেয়ালগুলো বুদ্ধিমান এবং যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ। তারা বুঝে গেল দূর থেকে যতই পায়তাড়া দেখাক আমার কাছে আর এগিয়ে আসতে পারবে না। তাই রণেভঙ্গ দিয়ে জঙ্গলের মধ্যে পালিয়ে গেল।

সামান্য একটা ইঁটের টুকরো যে আমার প্রাণ বাঁচাতে পারে তা আগে জানা ছিল না। আসলে জীবন তো এই। পথে পথে ঠোক্কর হোঁচট খেতে খেতে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠা। এই সমৃদ্ধি যার যত বেশি সে তত অকুতোভয় সাহসী নির্ভীক বেপরোয়া।

পার্ক সার্কাসের বুড়ো দোকান মালিকের একটা বিশেষ শখ, রেল লাইনের পাশে যে ছোট গুমটি মতো বিড়ির দোকান সেই দোকানের মাথা চ্যাপ্টা লাল সুতোর নেপানি আর গুজরাটি তামাকের মিশ্রণে দাড়িআলা বুড়োর হাতে বানানো বিড়িতে। সে এমন বিড়ি যা ভূভারতে আর কোথাও মিলবে না। সে বিড়ির ধোঁয়ায় কলজে মন প্রাণ সব শীতল হয়ে যায়। রোজ রাত সাড়ে নটার সময়ে–চা দোকান বন্ধের ঠিক আধ ঘণ্টা আগে আমাকে পাঠানো হয় সেই বিড়ি আনতে।

আগে এখানকার পরিবেশ পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল, এখন অন্যরকম। আজ এই অন্ধকার রাতে–যখন ছুরি হাতে নিয়ে কষাইয়েরা ওত পেতে আছে, মানুষের গলার নলি কাটবে বলে, তখন মালিক রোজকার মত হুকুম দিল–যা, বিড়িটা গিয়ে নিয়ে আয়। আমি নিশ্চিন্ত জানি, সেদিনের সেই রক্তস্নাত শহর কলকাতায় যদি কারও উপর কারও সামান্য দরদ থাকে, জীবনের মূল্য কানাকড়িও মনে হয়, তাকে রাত সাড়ে নটায় পাঠাতে পারবে না ওই রকম এক এলাকায়। যেখানে ‘দাঙ্গা’ শুরুর আগেই দু-দলে দাঙ্গা চলে রাতদিন। চাকু চলে বোমা পড়ে মানুষ মরে।

আমি মালিকের বেতনভুক ভৃত্য। তার মুখের উপর না বলার কোন অধিকার নেই। তাহলে কাজ চলে যাবে পঁচিশটাকা মাস মাইনের। পঁচিশটাকা অনেকটাকা। সাড়ে বারো কিলো চাল হয়। তাই নিরপায় এক বালক নির্জন অন্ধকারে হাঁটা দিল জীবনের এক রক্তাক্ত বিভৎস অধ্যায়ের দিকে।

সে সময় পার্ক সার্কাস রেল স্টেশনটা তৈরি হয়নি। চারদিকের ঝোঁপঝাড় গাছপালায় এলাকার পরিবেশটা ছিল কেমন বন্যবন্য। যেন বাঘ সিংহ বুনো শূকর বুনো মোঘ অবাধে ঘুরে বেড়ায়।

যাবার সময়ে ঠিকঠাক গেছি, পথে কোন অসুবিধাই হয়নি। বিড়ি কিনেছি এক বাণ্ডিল। ঠিক মাঝখান থেকে একটা বিড়ি বের করে দোকানের পাশে ঝোলানো দড়ির আগুনে ধরিয়ে নিয়ে সুখটান দিতে দিতে ফিরে চলি চায়ের দোকানের দিকে। হঠাৎ এক মোড়ে অন্ধকার ফুড়ে আমার পথরোধ করে দাঁড়াল তিন চারজন ছেলে। দেখলেই বোঝা যায় এরা কোন ভদ্র সভ্য নয়–রেল বস্তির বখাটে বাচ্চা। তারা বয়সে উচ্চতায় ছোট হলেও একজনার হাতে ধরে থাকা চাকুখানা মোর্টেই ছোট নয়, বেশ বড়। একে কানপুরি বলে। ছেলেটার গলার গর্জনও বেশ বড়দের মতো। সে সেই চাকুখানা আমার সামনে বাগিয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করে, “আবে এই, তোর কী জাত রে?” ছেলেগুলো কথা বলছে বাংলায়। তবে এ আমার পরিচিত বাংলা ভাষা নয়, হিন্দির মিশেলে বিকৃত বাংলা বা বাংলা ভাষার “এই সি কী তেইসি”।

এখন চারিদিকে দাঙ্গা। রাজাবাজার খিদিরপুর জ্বলছে, মানুষ মরছে। এই অকটবিকট সময়ে এরা অন্যকোন জাত নয়, স্রেফ আমি হিন্দু না মুসলমান সেটাই জানতে উৎসুক। যদি ওদের স্বজাতির হই গলাগলি করবে। যদি অন্য জাতির হই গলার নলিতে চাকু চালিয়ে দেবে। এই হনন অভিলষিত সময়ে এর বাইরে আর কোন ব্যাসকূট নেই। “বলনা রে কী জাত তোর”। তাড়া দেয় তারা–“জলদি বল”। কিন্তু তখন যে ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে বৈশাখের মাঠ। গলা দিয়ে কোন স্বর সরে না। বুঝেও উঠতে পারি না কোন জাত বলব। কোন জাতের কথা বললে এরা আমাকে না মেরে ছেড়ে দেবে। ওদের মুখে দাড়ি নেই, মাথায় টিকি নেই, পরিধানে লুঙ্গি নেই, কপালে ফোঁটা নেই। কারও শরীরে এমন কোন চিহ্ন নেই যা দেখে চিনতে পারি ওরা কী জাত। তবে তো বলতে পারি–আমি ভাই তোমাদেরই জাত। আমার জবাব দিতে দেরি হওয়ায় ওদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে। বারবার তাগাদা দিচ্ছে “বলনা রে কোন জাত”। আমাদের সমাজের লোকেরা বলে থাকে, বোবার শত্রু নেই। এখন মুখ বন্ধ করে রাখাটাই যে বিপদ ডেকে আনছে। বুঝতে পারি একটা কিছু বলতেই হবে। না হলে এরা আমার পথ ছাড়বে না।

তখনও কেউ আমাকে বলে দেয়নি যে আক্রমণই আত্মরক্ষার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়। সে শিক্ষা দিল সেই অস্থির অবিশ্বাসী সময়ের উদ্ভুত এক পরিস্থিতি। তখন আর আমার এ কথা মনে করবার মতো অবস্থা বা অবকাশ ছিল না, ওরা এক একা কিশোরকে পেয়ে ভয় দেখিয়ে একটু মজা পেতে চাইছে। কিনা! চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম, কোথাও কোন জনমানব নেই। রাস্তার পাশের নিরেট দেওয়ালের ওপাশের মানুষগুলো বিশ্ব জগৎ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ঝড়ের মধ্যে বালির ভিতর মুখ গুঁজে পড়ে থাকা উটের মত নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। তাকালাম আমার ডাইনে বাঁয়ে সামনে পিছনে। দেখলাম সামান্য কিছু দূরে একখানা আধলা ইট পড়ে আছে। এ সেইইট যা একবার আমার জীবন বাঁচিয়ে ছিল। সারা দেশটায় এখন শেয়াল কুকুরে ভরে গেছে। এ সময়ে মানুষকে বাঁচতে হলে বারবার ইট পাথর তুলতে হবে।

ওরা কিছু বুঝে উঠবার আগে বিদ্যুৎ গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে কুড়িয়ে নিলাম আধলা খানা তারপর সমস্ত শক্তি দু-হাতে সংহত করে সেটা বসিয়ে দিলাম চাকু বাগিয়ে থাকা ছেলেটার ব্রহ্মতালুতে। এটা সেই জায়গা যেখানে সাধারণ একটা আঘাতে মানুষ মরে যেতে পারে। ইঁটের একটা কোন বসে গেল মাথার মাঝখানে। ছিটকে নিচে পড়ে গেল তার ধারাল চাকু। গোঁ গোঁ করে সে লুটিয়ে পড়ল পথের ধুলোর উপরে। চাকুটা কুড়িয়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম আমি–আয় এইবার কেডা আবি। কিন্তু তারা কেউ এগিয়ে এল না। আহত সঙ্গীকে পেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালাল অন্ধকারের মধ্যে।

ছোটবেলায় প্রচণ্ড রোগে ভুগেছিলাম। কোনদিন পেট ভরে খেতে পাইনি। সে কারণে শরীরটা ছিল খুবই রোগা আর দুর্বল। আমার বয়সে যে ভাবে বাচ্চাদের শরীর বৃদ্ধি পায় আমার তা হয়নি। ফলে খেলাধুলোয় আমি সব সময় হেরে যেতাম। কারও সাথে ঝগড়া মারামারি হলে মার আমিই খেতাম। সেই আমি–পরাজিত দুর্বল অক্ষম আমি আজ বিজয়ী হয়েছি। আমার পায়ের কাছে এখন পড়ে আছে সবল সশস্ত্র প্রতিপক্ষ। যার গরম রক্তের ছিটে লেগে রয়েছে আমার হাতে। জীবনে কখনও একটা ইঁদুরও মারতে পারিনি। পারব সে বিশ্বাসটাই মরে গিয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে, পারি। আমিও মারতে পারি। আর মারতে যখন শিখে গেছি বাঁচাটাও শিখে নিতে পারব।

আমার আর এরপর বিড়ি নিয়ে সেই দোকানে ফিরে যাওয়া হল না। কে জানে পালিয়ে যাওয়া ওই ছেলেরা কেউ হয়ত আমাকে চেনে। কোন দোকানের কর্মচারী সেটা জানে। ওরা এতক্ষণে নিজেদের মহল্লায় গিয়ে খবরটা নিশ্চয় দিয়েছে। তখন মহল্লার লোক অবশ্যই ধাওয়া করে আসবে চা দোকানের দিকে। আমাকে নাগালে পেলে ধরে পাঠা কাটা করে দেবে। তাই পালিয়ে গেলাম দোকান মালিককে কিছু না বলে, আমার পাওনা পয়সাও না নিয়ে।

সেদিন সেই ভয়ানক রাতে আমার দিগ্বিদিক কোনও জ্ঞান ছিল না। অর্ধচেতন অধঅচেতন একটা বোধশূন্য ঘোরের মধ্যে কেবলই ছুটে যাচ্ছিলাম সামনের দিকে। সর্বক্ষণ মনে হচ্ছিল আমার পিছনে পিছনে কেউ তাড়া করে আসছে। আমি থামলেই সে ধরে ফেলবে।

এইভাবে কতক্ষণ ছুটে ছিলাম, কতপথ পার হয়েছিলাম, কোথায় গিয়ে পৌঁছে ছিলাম তার কিছুই জানা নেই। সামনে একটা পার্ক দেখতে পেয়ে পথশ্রমে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঢুকে পড়েছিলাম তার মধ্যে। একটা অন্ধকার কোণ খুঁজে নিয়ে সেখানে লুকিয়ে কাটিয়ে ছিলাম সারাটা রাত। সূর্য ওঠার আগে পার্ক থেকে বের হয়ে আবার শুরু করেছিলাম ছোটা। ছুটে ছুটে আমি যেন পৌঁছে যেতে চেয়েছিলাম পৃথিবীর সেই প্রান্তে যেখানে কোন মানুষ থাকে না। হিন্দু মুসলমান থাকে না, শ্মশান গোরস্থান মন্দির মসজিদ থাকে না। হন্তা থাকে না হন্তব্য থাকে না।

সেটা সেই ১৯৬৫ সালের কথা। যে বছর ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে একটা যুদ্ধমতো হয়েছিল! দু-দেশই ছিল অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত। তাই মানুষের দৃষ্টি মূল সমস্যা থেকে অন্যদিকে ঘোরাতে একটা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা না খেলে উপায় ছিল না। সে সময় একটা পাকিস্তানি প্লেন উড়ে এসে ব্যারাকপুরে বোমা ফেলে গিয়েছিল। জনরব ছিল, পাকিস্তানি বোমারু বিমান নাকি হাওড়া ব্রিজ গুঁড়িয়ে দেবে। যে কারণে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিভাগ ব্রিজ পাহারার ব্যবস্থা খুবই জোরদার করে রেখেছিল। পঞ্চাশ ফুট অন্তর একজন অস্ত্রধারী পুলিশ।

আমি এক পলাতক ‘খুনি’। বহুদিন ধরে বহু পথ পার হয়ে ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছেছিলাম হাওড়া ব্রিজের উপর। যার নীচ থেকে বয়ে চলেছে হিন্দুধর্মের কাছে বড়ই পবিত্র নদী গঙ্গা। এ নদীতে নাকি একবার স্নান করলে সব পাপ ধুয়ে যায়। যে কারণে কলকাতার বড় বাজারে একটি বেওসায়ি জাতি গোষ্ঠির মানুষ ব্যবসা ফেঁদে ছিল। সারা দিন লোক ঠকাবে আর পরদিন সকালে গঙ্গায় ডুব মেরে আসবে। লোক ঠকানো পয়সায় ইহকাল, গঙ্গাস্নানের পুণ্যে পরকাল, দুকালই সুখে কাটবে।

আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গঙ্গা দেখছিলাম। গঙ্গা নদীর বুক বেয়ে ভেসে চলেছে কত লঞ্চ জাহাজ নৌকা। মানুষ ভেসে চলেছে জলযানে কোথায় কোন নিরুদ্দেশে তা কে জানে। ওই ভাসমান জলযানে চেপে আমার মনটাও ভেসে যাচ্ছে। আমার বাবা কাকা, উধ্বর্তম দশ পুরুষ এমনই জলপথে নৌকা নিয়ে চলে যেতেন মাছ ধরতে। যদি দেশভাগ না হোত আমিও একদিন বাবা কাকার সাথে যেতাম। বলা যায় না, কোন এক নদীর মোহনায় আমার সাথে দেখা হয়ে যেত অতল জলের তল থেকে উঠে আসা কোন এক জলপরীর। সুলোচনা, সুকেশী, সুনাসিকা সেই জলকন্যার দর্শন পেয়ে পূর্ণ হয়ে যেত জীবন। এই সব কত কী ভাবছিলাম তখন সেই কিশোর মনে, ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে। যা একান্তই নাবালক ভাবনা।

কতক্ষণ এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। হঠাৎ আমার কাঁধে একটা মৃদু টোকা পড়ল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি ঠিক আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে রাইফেল হাতে একজন পুলিশ। বহুদিন পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি এখন আর পালাবার কোন পথ নেই। এবার আর কী! হয় ফাঁসি নয় দীপান্তর। মা বাবা ভাইবোন কারও সাথে দেখা হবে না আর কোনদিন। সেই দুঃখে ভয়ে কেঁদে ফেললাম আমি।

পুলিশ লোকটা আমার কান্নায় বিব্রত হয়ে জিজ্ঞাসা করে কাঁদছিস কেন! কী হয়েছে? তার কথায় আমি আশ্চর্য হই। গোলাপ যেমন জানে না কেমন তার গন্ধ পুলিশ তেমনই জানে না তারা কী জিনিস। যাকে পুলিশে ধরে তার কদবার কোন দরকার পড়ে না। চোখ ফেটে আপনা আপনি জল বের হয়ে আসে। আমি তো বাচ্চা, এখনও সতের পার হইনি এই রকম বিপদের সময় বড়বড় লোকের চোখের জলে বুক ভেসে যাবে।

পুলিশ লোকটা আবার জানতে চায়–এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন! হারিয়ে গেছিস বুঝি! কঁদিস না, তোর বাড়ি কোথায়? আমরা পাঠিয়ে দেব। চুপ কর।

আমার মনের জোর এবার খানিকটা ফিরে আসে। যে ভাবে লোকটা কথা বলছে, মনে হচ্ছে সে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। পুলিশ হলেও লোকটা ভাল লোক। এমন ভাল মানুষের কাছে মিথ্যা কথা বলতে নেই। ওতে পাপ হয়। যা থাকে ভাগ্যে এর কাছে সত্যি কথাই বলব। কী আর হবে, হয় ধরে নিয়ে যাবে, না হয় যাবে না।

আমি শুনেছি ভারতীয়–বিশেষ করে বাঙালী লেখকদের মধ্যে লেখক কম দার্শনিক গুণ বেশি। যার হাতে কলম, কমবেশি সবাই দার্শনিক। যেহেতু এখন আমার হাতে কলম, নীরস এই গদ্য রচনা থেকে সরে গিয়ে একটু দার্শনিক আলোচনা সেরে নিতে হবে। এখন কথা হচ্ছে, সত্য জিনিসটা কী? সত্য সেটাই যা আমার কাঙ্খিত, অভীষ্ট ফল লাভের সহায়ক। এই জন্য কবি বলে গেছেন–সেই সত্য যা তুমি রচিবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, সতর্ক থাকতে হবে, যেন জনগণ মিথ্যা বলে তাকে দুয়ো না দিতে পারে। পৃথিবীর যত মহান সাহিত্যকৃতি তার কোনটা সত্যি? সবেতেই ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যার সমাহার। তবে ওই–এমনভাবে পরিবেশন করা হয়েছে যে সত্যের চেয়ে বড় সত্য হয়ে গেছে। কার ঘাড়ে কটা মাথা আছে বলুক দেখি রাম কৃষ্ণ কাল্পনিক চরিত্র। “রামকৃষ্ণ” কোন অবতার ফবতার নয়, আমাদের মতোই মানুষ।

সত্য, একমাত্র সত্য এটাই যে, সত্য কোন অটল বিষয়বস্তু নয়। স্থান ভেদে কাল ভেদে পাত্র ভেদে প্রয়োজন বোধে তার আকার আকৃতি বদলে যায়, সংকোচন সম্প্রসারণ ঘটে। প্রয়োজন বোধে সিরাজউদুল্লা হয়ে যায় মহান দেশপ্রেমিক, প্রয়োজন বোধে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসকে বানানো হয় বিশ্বাসঘাতক, দেশদ্রোহী।

এখন আমি বিশেষ প্রয়োজনে সময় উপযোগী একটি সত্যের বিনির্মাণ করি। বাবু গো মোরা যাদবপুরে কলোনিতে থাহি। ছোটবেলায় মোর মায় মইরা গ্যাছে। হেই লইগ্যা মোর বাপে ফির এট্যা বিয়া করছে। হেই মায় মোরে দুই চক্ষে দেখতে পারে না। দুই বেলা ধইরা ধইরা মারে। প্যাট ভইরা খাইতেও দেয় না। হেই কারণে বাড়ি থেইকা চইল্যা আইছি। যেদিক দুই চক্ষু যায় চইল্যা যামু। কোন চা দোকানে হোটেলে কম করমু। বাড়ি আর যামু না।

এক মাতৃহারা দুঃখী বালকের করুণ জীবন কাহিনি শুনে দ্রবীভূত হয়ে পড়ে পুলিশ লোকটার মন। যদিও আমাদের দেশীয় আইনেঅকারণে পথে পথে ঘোরা, ফুটপাতে ঘুমানো একটা অপরাধ, তবুও কর্তব্য কর্মে ত্রুটি ঘটালেন তিনি। আমাকে ধরে জেলগারদে ঠুসে দিতে চাইলেন না। চাইলেন নিয়ে গিয়ে গরম ভাতের সামনে বসিয়ে দিতে।

বললেন, আমাদের মেসে কাজ করবি? তাহলে আমার সাথে চল। খাবি দাবি থাকবি। মাস গেলে কিছু মাইনেও পাবি।

বহুবার মানুষের মুখে শুনেছি, বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা। এতদিন কথাটার মানে বুঝতে পারিনি। এবার বুঝলাম। আমি এক ফৌজদারি কেসের ফেরারি আসামি। যে কেস কখনো আপনা আপনি মরে যায় না। উকিল ধরে কোর্টে মামলা লড়ে মেরে ফেলতে হয়। নিয়মমত পার্ক সার্কাস থানায় আমার নামে একটা কেস থাকার কথা। কে জানে এখনও হয়ত পুলিশ সেই কেসের আসামিকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আর অমি–সেই অপরাধী এখন লুকিয়ে পড়লাম তাদের সবচেয়ে সুরক্ষিত–সব সন্দেহের ঊর্ধ্বের এক ঘাঁটির মধ্যে। শিবপুর পুলিশ লাইনের এক মেসের কর্মী হয়ে।

আমি দেখিনি তবে শুনেছি মানুষের মধ্যে নাকি দেবত্ব থাকে। আমার ধারণা মানুষের দেবতা হবার খুব একটা দরকার নেই, মানুষ হয়ে থাকলেই যথেষ্ট। যদি সেখান থেকে অধোগমন না ঘটে, অমানুষ না হয়। তখন মানুষ পশু থেকেও ইতর প্রাণী হয়ে যায়। পশুরা পায়ুকামী অগম্যাগমন ধর্ষণকারী প্রকৃতি বিরুদ্ধ কোন কাজ করে না। মানুষের সেই অবনমন নীচতা আমি যেন আমার ছোট্ট জীবনে অনেক বেশি দেখে ফেলেছিলাম। যা আমার সারা জীবনকে প্রভাবিত করেছে। মন মস্তিষ্কে ভরে দিয়েছে অবিশ্বাস অশ্রদ্ধার বিষ। কে যেন বলে গেছেন–মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। আমি জীবনভর সেই মানুষকে খুঁজে বেড়িয়েছি যে আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে সচেষ্ট।

এই পুলিশ লাইনের মেইন গেট থেকে কিছুটা ভিতরে ঢুকলে ডানদিকে একটা বড় মাঠ। এই মাঠে প্যারেড হয়। পনেরই আগস্ট মাঠের এক ধারে ওড়ে ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা। ঠিক মাঠের ওপাশে পুলিশ ব্যারাক। এই ব্যারাকে থাকে এক বছর পঁয়ত্রিশের সেপাই। এমনিতে মানুষের সমাজে যে সব দোষ থাকে যে সব কারণে পুলিশ তাদের ধরে মারে পুলিশরাও তা থেকে মুক্ত নয়। তফাৎ শুধু এই যে, তারা প্রশাসনের পরোক্ষ প্রশ্রয় পেয়ে থাকে। সাধারণ চোর ডাকাত গুণ্ডা বদমাশ তা পায় না। তবে এই পুলিশকর্মীটির একটা বিশেষ দোষ বা অভ্যাস আছে, সেটা হল গঞ্জিকা সেবন।

একরাতে সে বাইরের এক গাঁজার ঠেকে বসে এক পুরিয়া গাঁজা আদারকুচি ধুতরার বিচি আরও কী সব মশলা দিয়ে বানিয়ে বেশ মৌতাত করে খেয়ে মাঠের মাঝখান থেকে হেঁটে ব্যারাকে ফিরে যাবার সময় তার চোখে পড়ে যায় মাঠের আধো আলো আধো অন্ধকারে শোয়া, সদ্য যুবতী হয়ে ওঠা এক কুকুর কন্যাকে। তখন আর সে ধৈর্য রাখতে পারে না। কামেমোহিত হয়ে তাকে বলাৎকার করবার চেষ্টা করে। আর তখন সেই কুকুর কন্যা নিজের মান সম্মান রক্ষার্থে কামড়ে দ্যায় পুলিশ পুঙ্গবের পুরুষাঙ্গে। জখম কিছু বেশি ছিল, ভয় ছিল জলাতঙ্ক হবার তাই তাকে ছুটতে হয় হাসপাতালে। হাসপাতাল পুলিশ ব্যারাকের কাছে। ফলে ঘটনাটা আর চাপা রইল না। পরদিন সে নিয়ে সবাই প্রচুর হাসাহাসি করে। পুলিশ লাইনের অফিসারগণ নিজের বাহিনীর এমন অপকর্মে যারপরনাই বিব্রত হয়ে তাকে একমাসের ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।

এই পুলিশ লাইনে মেস অনেক কটা। নেপালিদের আলাদা বিহারিদের আলাদা, আবার বাঙালীদের দুটো। আমি যেটায় কাজ করি সেখানে যে রান্না করে তার নাম অমূল্য ঠাকুর। গলায় তার একখানা পৈতা ঝোলানো আছে বটে তবে সেটায় চাবি ঝোলানো ছাড়া অন্য কোন কাজে ব্যবহৃত হয় না। নরেশ ঠাকুরের গলায়ও এমন একখানা ময়লা তেল চিটচিটে পৈতা থাকে, সেও রান্নার কাজ করে। যার কথা পরে লিখব। আমার কাছে এটা একটা ধন্দ যে রান্নার কাজ করলে তার গলায় পৈতা কেন থাকতে হবে।

অমূল্য ঠাকুর এই মেসে নাকি কুড়ি বাইশ বছর ধরে রান্নার কাজ করছে। তাই তার পাওয়ার যেন সুপারিডেন্ট পাওয়ার। মেসে তার কথাই শেষ কথা। আমি এখানে আসবার দিনই সে আমাকে বলে দেয়–এতগুলো লোকের খাওয়ানোর ভার আমার উপর। আমি যা বলব যদি মেনে চলিস কাজ থাকবে। যদি না চলিস, কারও বাপের ক্ষমতা নেই তোকে এখানে রাখে।

প্রায় একশো মেম্বার এখানে দু-বেলা খায়। সকালে ভাত ডাল একটা তরকারি আর মাছের ঝোল। রবিবারে মাছের পরিবর্তে মাংস। রাতে রুটি ডাল তরকারি। এই সব মেম্বারের এঠো থালা বাটি গেলাস ধোয়া রান্নার বাসনপত্র মাজা, তরিতরকারি কাটা, টিউবয়েল থেকে পাম্প করে বালতি ভরে জল বয়ে আনা, আটা মাখা, রুটি সেকা, এই সব আমার কাজ। এর জন্য মাসের মাইনে চল্লিশ টাকা। অমুল্য ঠাকুরের বিচারে এ সব কাজ, কোন গুণ নয়। আমার বিশেষ গুণ থাকাটা দরকার।

কী সেই বিশেষ গুণ, যা আমার চাকরির স্থায়িত্ব দিতে সক্ষম তা জানতে পারলাম এক শুক্রবারে। এদিন পুলিশ লাইনে পুলিশদের রাম নামক একটা মদ পান করতে দেওয়া হয়।

পুলিশের চাকরি বড় কঠিন চাকরি। যার সাথে কোন চেনা জানা শত্রুতা নেই, শুধু মাত্র চাকরি রক্ষার প্রয়োজনে উপর ওলার আদেশে তার বুকে গুলি চালিয়ে দেওয়া–এতে সবার না হোক কিছু পুলিশের একটা মানসিক যন্ত্রণা তো হয়ই। পীড়িত হতে পারে পাপবোধের দ্বারা। তাই এই মদের ব্যবস্থা। মনোবেদনা চাপা দিতে মদের মত বন্ধু আর কে আছে! মদ খাইয়ে তাই শাসক পক্ষ পুলিশ মিলিটারিদের মাতাল করে রাখে হুকুম পালনের একটা বিচার বুদ্ধি বিবেক শূন্য মেশিন বানিয়ে দ্যায়। যাদের আত্মা পরমাত্মা ন্যায় অন্যায় পাপ পুণ্যবোধ কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। যার এ সব থাকে দীর্ঘকাল এ চাকরি করতে পারে না।

মদের একটা কোটা অমূল্য ঠাকুরেরও আছে। শুক্রবার খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে বড় পবিত্র দিন। যে কোন পবিত্র দিনই আনন্দের উদ্দাম খুশির জোয়ারে ভেসে যাবার দিন। সেই কারণেই সম্ভবতঃ ইংরেজ শাসকরা মদ্য পরিবেশনের জন্য এই দিনটা বেছে নিয়েছিল। ভারতীয় শাসকরা সেই দিনটা আর বদলায়নি। তো সেই পবিত্র শুক্রবারে অমূল্য মদ্যপান করেছিল একগলা। তখন মেসের মেম্বাররা রাতের খাবার খেয়ে চলে গিয়েছিল। সেদিনের মত শেষ হয়ে গিয়েছিল আমার কাজ। খেয়েদেয়ে আমিও শোবার আয়োজন করছিলাম। এমন সময় অমূল্য ঠাকুর এগিয়ে এল আমার কাছে। খুব কাছে। তারপর সে তার ময়লা তেল চিটচিটে লুঙ্গিটা সরিয়ে বের করল তার কালো মোটা দুর্গন্ধযুক্ত–বমন উদ্রেককারী পুরুষ অঙ্গখানা। তৈল জাতীয় কিছু একটা মাখানো। কোন রকম সংকোচ না করে সেটা চাপিয়ে দিল আমার হাতের তালুর উপর।–“নে, একটু খেঁচে দে তো।”

গা ঘিন ঘিন করে আমার। মনটা বিদ্রোহ করে। তবু নাক টিপে চোখ বুজে আদেশ পালন করি আমি। আর সময় গুণতে থাকি কখন এই বিচ্ছিরি ব্যাপারটা থেকে পরিত্রাণ পাই। কিন্তু সে এক অসহায় বালককে অত অল্পে রেহাই দিতে ইচ্ছুক নয়। সে চাইল শেষ এবং চরমতার চূড়ান্তে পৌঁছে যেতে। ব্যাস, ব্যাস হয়েছে, নে এবার উপুড় হয়ে শুয়ে পড়।”

পরবর্তীকালে যখন আমাকে জেলে যেতে হয়েছিল তখন জেনেছি এটা কারও কারও কাছে বড় প্রিয় বিষয়। তারা পায়ু মৈথুন করে বড় আনন্দ পায়। তবে আমার জন্মজনিত সংস্কার ও শিক্ষার এটা এক বিপরীত মেরুর বিষয়। যা ভীষণ ঘৃণ্য এবং নিন্দনীয়। অন্তরাত্মা রিরি করে ওঠে আমার। কণ্ঠনালি থেকে বের হয় একটা থুৎকার–না।

আমার অসম্মতিতে সে একটু ক্রুদ্ধ হয়, এবং ক্রোধ ভরে একটা লাল দু’টাকার নোট এনে আমার দিকে ছুঁড়ে মারে–নে এবার আর বেশি সতীগিরি দেখাস না, প্যান্ট খোল। কিন্তু তবু নিজেকে কুকুর বানাতে মনের সায় পেলাম না। না, কুকুর নয়, তার চেয়ে খারাপ। এই অবস্থায় কুকুরও তো কামড় দিয়েছিল।

এরপর যা হবার তাই হল। পরের দিন থেকে সে আমার সবকাজে খুঁত ধরতে লাগল। আমি তরকারি ধুলে তাতে বালি থাকে, মশলা বাটলে মিহি হয় না, রুটি সেকলে হয় পুড়ে যায় নয় কাঁচা থাকে। সে নিয়ে তর্ক করলে গালে চড় এসে পড়ে। এত অসন্তুষ্টির কারণ আমার জানা। তবে তা দূর করা আমার সাধ্যের বাইরে। তাই একদিন নিশ্চিন্ত আহার আশ্রয় ছেড়ে পথের মানুষ পথের উপর এসে দাঁড়ালাম আবার। সেই পথঘাট সেই গাড়িঘোড়া লোকজন সেই হাওড়া ব্রিজ সেই গঙ্গা সব একই আছে, শুধু আর একটু বড় হয়ে উঠেছি আমি, আর একটু অভিজ্ঞ।

.

এবার আবার ফিরে এসে আশ্রয় নিলাম সেখানে, যেখানে সব আশ্রয়হীন মানুষ আশ্রয় নেয়। চোর পকেটমার বেশ্যা পাগল ভবঘুরে ভিখারি মাতাল মুটে মজুর আরও বহু বিচিত্র সব মানুষের মিলন মেলা এখানে। এর নাম রেল স্টেশন। ভারি বোঝা বইবার মত শক্তি নেই, সারা দিনে হালকা পলকা এক আধটা মোটফোট বয়ে দুচার পয়সা পেয়ে গেলে তা দিয়ে মুড়ি আলুর দম, রুটি ঘুগনি খেয়ে পড়ে থাকি প্লাটফর্মে। এভাবেই কেটে যায় দিন মাস।

একদিন স্টেশনেই পরিচয় হল ঠিক আমারই মত একটা ভবঘুরে বাউন্ডুলে ছেলের সাথে। আমার চেয়ে বছর চার পাঁচ বড়, রোগা লম্বা কালো এই ছেলেটা মনের কষ্ট পেটের খিদে সবকিছু চেপে রেখে অসম্ভব হাসতে জানে। একে দেখেই ভালো লেগে গেল আমার। বিশ্বাস জন্মে গেল। কথায় কথায় জানাল ও আসাম যাবে। সেখানে নাকি কাজের কোন অভাব নেই। আর তার মজুরি নাকি এখানকার চেয়ে তিনচারগুণ বেশি।

আমার টাকা চাই, অনেক টাকা। বাবার চিকিৎসা করাতে হবে। মাকে বস্ত্র পরিয়ে দিনের আলোয় ঘরের বাইরে আনতে হবে। ভাইবোনকে মৃত্যুর করাল গ্রাস থেকে বাঁচাতে হবে। এর জন্য টাকা চাই। আমার তখন আর সুস্থ মাথায় ভাবনা চিন্তার অবকাশ কোথায়! তৃষ্ণার্ত মানুষ যেমন জল ভেবে মরীচিৎকার দিকে পাগলের মত ছুটে যায় আমিও ছুটে গেলাম সেই সদ্য চেনা ছেলেটার পিছনে–আমিও তোমার লগে আসামে যামু।

আমার কাছে বিষ খাবার মত পয়সাও নেই। পরিধানে নেই কোন ভব্যপোষাক, পেটে নেই জল ছাড়া অন্য পদার্থ। সেই দূরদেশে আপন বলতেও কেউ নেই যে বিপন্ন সময়ে পাশে এসে দাঁড়াবে। তবু এক অসম্ভব সাহস–যার আর এক নাম হতে পারে মহামুখতা, সেই পথ সম্বল নিয়ে বের হয়ে পড়েছিলাম সদ্যচেনা একটা ছেলের সাথে। যে আমাকে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দিতে পারত সেই অপরাধ চক্রের কাছে যারা বাচ্চাদের চোখ অন্ধ হাত পা ভেঙে দিয়ে ভিখারি বানায়। আরবে পাঠায় উটের দৌড়ে উটের পেটে বেঁধে ঝোলাবার জন্য। কিডনি কেটে বের করে নেয়। পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলে হিজড়া বানায়। এই রকম কত কী সেদিন ঘটে যেতে পারত যা ভাবলে আজ বুক কেঁপে যায়।

সেই বিচিত্র বিচ্ছিরি ভ্রমণ কাহিনী লিখেছিলাম আমার ‘চণ্ডাল জীবন’ উপন্যাসে।

যা লিখেছিলাম, যেমন লিখেছিলাম সেটাই তুলে দিলাম এই আত্মজীবনীর মধ্যে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *