ঋগ্বেদ-এর দিনের মানুষ
পণ্ডিতেরা বলেন ঋগ্বেদসংহিতা-র রচনাকাল ১২০০ থেকে ৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। দেবতাদের স্তব ও তাঁদের কাছে প্রার্থনাই মুখ্যত এর বিষয়বস্তু। অধিকাংশ সূক্তই তৎকালে বা তার পরে যজ্ঞে প্রযুক্ত হত; যদিও চতুর্দশ শতকে বিজয়নগরে যজ্ঞের পুনঃপ্রাদুর্ভাব কালের ভাষ্যকার সায়ণাচার্যও বেশ কিছু সূক্তের কোনও যজ্ঞীয় প্রয়োগ নির্দেশ করতে পারেননি; অর্থাৎ সব সূক্তই যজ্ঞের উদ্দেশ্যে রচিত নয়, যজ্ঞে ব্যবহারও হত না। অধিকাংশ সূক্ত কবিতার মতো স্বতঃউৎসারিত; তাই হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় বলেছেন, ঋগ্বেদসংহিতা পল্গ্রেভের গোল্ডেন ট্রেজারি-র ন্যায় একখানি কবিতা-সংকলনগ্রন্থ।
সূক্তগুলির গঠনবিন্যাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় গ্রিক স্তবের মতো এগুলিরও মূলত তিনটি অংশ:
১. দেবতার রূপবর্ণনা: যার মধ্যে দুটি অংশ; প্রথমত, দেবতার আকৃতি, বেশবাস, অলংকার, অস্ত্রশস্ত্র, রথ ও বাহনের বর্ণনা; দ্বিতীয়ত, দেবতার শৌর্য, কীর্তি ও পূর্বপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহের উল্লেখ।
২. আপ্যায়ন: এ অংশে ভক্ত কী নৈবেদ্যে দেবতার তুষ্টিবিধান করছেন— ভোজ্য পানীয়ে ও স্তোত্রে— তার বিবরণ। নূতন স্তব রচনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রলুব্ধ করা হয় দেবতাকে, আবার প্রাচীন— পরীক্ষিত ও দৈবশক্তিযুক্ত— স্তবগানেরও উল্লেখ থাকে।
৩. প্রার্থনা: প্রার্থিত বস্তু সারা ঋগ্বেদ জুড়েই এক—বিজয়, শত্রুবিনাশ, পশুধন, স্বর্ণ, স্বাস্থ্য, শস্য, সন্তান, রোগমুক্তি এবং সর্বোপরি দীর্ঘ পরমায়ু। প্রায়ই শোনা যায়, একশো শরৎ বাঁচবার প্রার্থনা: দীর্ঘকাল যেন সূর্যকে দেখতে পাই— জ্যোক্ চ সূর্যং দৃশে, (১:২৩:২১) অথবা জ্যোক্ পশ্যেম সূর্যমুচ্চরন্তম্, (১০:৬০:৬)। সূক্তগুলিতে সাধারণ ভাবে একটা আদানপ্রদানের ভাব থাকে; হব্যের বিনিময়ে দেবতা যেন এই পৃথিবীর জীবনকে নিরাপদ ও চিরায়িত করেন। মোটের ওপরে, প্রার্থনা সবই ঐহিক, জীবনমুখীন; পরবর্তীকালের জীবনবিমুখতার চিহ্নমাত্র নেই। এমনকী, স্বর্গের প্রার্থনা— যা পরবর্তীকালে সংযোজিত অংশে আছে— তা-ও ঐহিক জীবনের সুখের ও ভোগের অনিঃশেষ বিস্তার মাত্র।
স্তব ও প্রার্থনাই ঋগ্বেদের তিন-চতুর্থাংশ; এ ছাড়াও গোটা কুড়ি ‘সংবাদ-সূক্ত’ আছে— দুই বা ততোধিক ব্যক্তির (নদী, দেবতা, মানুষ, অপ্সরা এবং মনুষ্যেতর প্রাণীরও) সংলাপ। এগুলির বিনিয়োগ অর্থাৎ যজ্ঞগত প্রয়োগ নেই। কয়েকটি সূক্তে আছে সৃষ্টিতত্ত্ব ও পরমাত্মা বিষয়ে অনুসন্ধান— কাল, হিরণ্যগর্ভ, প্রজাপতি, বৃহস্পতি, ব্রহ্মণস্পতি, পুরুষ এবং সৃষ্টির উপাদান ও প্রকরণ সম্বন্ধে। এগুলিতে পাই জীবনের তত্ত্ব সম্বন্ধে সে যুগের মানুষের চিন্তা, উপলব্ধি ও অনুসুন্ধিৎসা।
এ ছাড়াও অন্য ধরনের কিছু সূক্ত আছে যাতে প্রাঋগ্বেদ যুগের অস্পষ্ট আভাস বিধৃত; যেমন আপ্রীসূক্ত। এগুলিতে অগ্নিকে বিভিন্ন নামে ও ভূমিকায় আহ্বান করা হচ্ছে। সভ্যতার প্রথম পর্যায়ে আগুনের ব্যবহারে যে বিস্ময়, সহসা সভ্যতার যে প্রকাণ্ড, প্রবল যুগপরিবর্তন, নিরাপত্তা ও আত্মপ্রত্যয়ের যুগপৎ সম্ভাবনা, অগ্নিরক্ষী আদিম পুরোহিতের মর্যাদা এবং অগ্নির সাহায্যে প্রথম সংক্ষিপ্ত যজ্ঞের অনুষ্ঠান— এ সবই যেন আপ্রীসূক্তের মধ্যে অনুধাবন করা যায়।
ঋগ্বেদ-এর সম্পূর্ণ কোনও সূক্ত ‘দানস্তুতি’ নয়; অন্যান্য দেবতার উদ্দেশে রচিত কয়েকটি সূক্তের কতকটা অংশ দানস্তুতি। এগুলি কিন্তু দানের স্তুতি নয়, দাতার প্রশংসা। প্রাচীনকালে কোন যজ্ঞে কোন রাজা কোন পুরোহিতকে কী কী দান করেছিলেন, তারই তালিকা; বলা বাহুল্য, ভাবী দাতাকে প্রচুরতর দানে উদ্বুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে। সমস্ত ঋগ্বেদ-এ একটিমাত্র ঋকে দানক্রিয়ার প্রশংসা আছে।
‘সূর্যাসূক্ত’ (১০:৮৫)-তে বিবাহ সম্বন্ধে আচার-অনুষ্ঠান, প্রার্থনা, নববধূ সম্বন্ধে আশংসা (শ্বশুর শাশুড়ি ননদ দেবরের কাছে সম্রাজ্ঞী হয়ো) ও আশীর্বাদ আছে। ‘অক্ষসূক্ত’ (১০-৩৪)-তে শুনি জুয়াড়ির আত্মগ্লানি ও খেদ: তার স্ত্রীকে অন্যে নিয়ে গেছে, তার পিতামাতা তাকে অস্বীকার করেন, সে নিঃসম্বল, সমাজে অপাঙক্তেয় অতএব রাত্রিচর। ‘মণ্ডুক সূক্ত’ (৬:১০৩)-র যজ্ঞীয় বিনিয়োগ নেই। এতে শুনি অতি রাত্রে সোমযাগে যেমন ব্রাহ্মণরা বেদপাঠ করেন, তেমনিই বর্ষার ভরা পুকুরে ব্যাঙ ডাকছে। যজ্ঞে বেদপাঠ কি তখনই কতকটা যান্ত্রিক ও কৃত্রিম আবৃত্তি বলে মনে হচ্ছিল? ঋগ্বেদ-এর মানুষের বসতির চারি পাশ যে দুর্ভেদ্য অরণ্য পরিবেষ্টিত অঞ্চল ছিল ‘অরণ্যানী সূক্তে’ হয়তো তারই চিত্র: সে অরণ্যানী ‘অঞ্জনগন্ধি, সুরভি, বহু-অন্না, কৃষকের সঞ্চরণরহিত, বন্যপশুর মাতৃস্বরূপিণী।’
ঋগ্বেদ-এ পাই নিসর্গ সম্বন্ধে সূক্ষ্ম একটি বোধ ও স্বতঃউৎসারিত আনন্দ— আকাশ, সূর্য, রাত্রি, ঊষা, ঝড়-বৃষ্টি, তৃণভূমি, অরণ্য— সবই এক সহজ আনন্দের বার্তা বহন করত এদের কাছে। তারই সঙ্গে ছিল জীবন সম্বন্ধে কৌতূহল ও বিস্ময়। সূর্য প্রত্যহ পূর্বাকাশে উদিত হয়ে গগন-পরিক্রমা-অন্তে পশ্চিমে অস্ত যায়। বেদের কবি বলেছেন, আকাশে বরুণ সুন্দর একটি সোনার দোলনা টাঙিয়ে রেখেছেন— বরুণশ্চক্র এতংদিবি প্রোং হিরণ্যয়ং শুভোকম্। (৭:৮৭:৫) গো দোহনের পরে দুধে উষ্ণতা দেখে এরা বিস্মিত: কাঁচা গরু থেকে রাঁধা মিষ্টি দুধ আসছে। কালো গরুর থেকে উজ্জ্বল শাদা দুধ নামছে— আ গোরামা সচা মধুমৎ পক্কামগ্নে। কৃষ্ণা সতী রুশতা ধাসিনৈষা জামর্ষেণ পয়সা পীপায়।। (৪:৩:৯) অথবা দেবতাকে কবি বলছেন, তুমি কৃষ্ণা ও পাটল গাভীতে উজ্জ্বল শুভ্র দুধ রেখেছ— ত্বমেধারয়ঃ কৃষ্ণাসু রোহিণীষু চ। পরুষ্ণীষু রুশৎ পয়ঃ।। (৮:৯৩:১৩)
গ্রামীণ জীবন নানা ভাবেই আপৎসংকুল। ঋগ্বেদ-এ ষোলটি ঋকের পুরো একটি সূক্ত (১:১৯১) সর্পবিষ নাশের উদ্দেশ্যে রচিত, নাম ‘বিষনির্ভরণী উপনিষৎ’। সাপ ছাড়া বিছে, বন্যা ও অন্যান্য বিপদের কথাও এখানে আছে। অন্যান্য বহু সূক্তের পটভূমিকায় দেখি শ্বাপদসংকুল হিংস্র বন্যপ্রকৃতি, আদিম অপরাজিত প্রতিকূল প্রকৃতির নানা অপঘাতের কালো পর্দাটা দুলছে, তারই মধ্যে অপর্যাপ্ত বিস্ময় ও আনন্দ। সজীব জীবনরসিক মানুষের মনের উচ্ছ্বাসে ঋগ্বেদ সমৃদ্ধ।
ঋগ্বেদ-এ দেবতারা যে যে কারণে প্রশংসিত হচ্ছেন মোটামুটি সেটা তৎকালীন সামাজিক মূল্যবোধের দ্বারা নির্ধারিত, একথা মনে করা যেতে পারে। প্রধান যে গুণটি প্রশংসা পাচ্ছে তা হল শৌর্য, যার দ্বারা শত্রুবিনাশ, লুণ্ঠন, শত্রুর স্বর্ণ, পশু, শস্য ও দাস অপহরণ এবং পরাভূতকে দলন ও হত্যা করা যায়। এই গুণেই ইন্দ্র ঋগ্বেদ-এর এক-চতুর্থাংশ সূক্তে স্তব পাচ্ছেন : যাযাবর আক্রমণকারী আর্যদলের সেনাপতি ও প্রধান যোদ্ধা ইন্দ্র। প্রচুর পরিমাণে মাদক সোম পান করে ইন্দ্র প্রাগার্য গোষ্ঠীর অগণ্য দলপতিকে হত্যা করে, দুর্গ ভেদ করে তাদের নগরে প্রবেশ করে, পশুধন ও অন্যান্য সম্পদ হরণ করে এনে আর্যদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন। এরই জন্যে সারা সংহিতা জুড়ে তাঁর অক্ষয়-গৌরব কীর্তন করা হয়েছে। ‘বায়ুবাতাঃ’ ও ‘পর্জন্য’ স্পষ্টতই আর্য সেনাদলের কল্পচিত্র— প্রবল শক্তিমান, দ্রুতচারী, বিজয়ী। ‘অশ্বিনৌ’ পরোপকারী দুটি বৈদ্যের দেবায়ন— এঁরা বিপন্নকে, রোগীকে, জলমগ্ন বা অগ্নিবেষ্টিত ব্যক্তিকে দ্রুত উদ্ধার করেন। নিরুক্তকার যাস্কও মনে করেন এঁরা আদিতে পুণ্যকৃৎ রাজা ছিলেন। ‘ঊষা’ সুন্দরী চিরতরুণী। ‘বরুণ’ বিচারক— অজস্র নেত্র মেলে অহর্নিশ চেয়ে আছেন মানুষের দিকে, দুষ্কৃতকারীকে দণ্ড দেওয়ার জন্যে। যম’লোকান্তরিত মানবাত্মাদের নিয়ে তরুছায়াতলে আপ্যায়ন করেন। বলা বাহুল্য, এ-সব দেবচরিত্রে সমাজের ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন ভূমিকায় আসীন মানুষের প্রতিফলন দেখা যায়।
পরবর্তী কালে ভারতীয় সমাজে যে-নীতিবোধ ঋগ্বেদ-এ তার চিহ্নমাত্র নেই। উন্নততর কৃষিজীবী সভ্যতার অধিকারী সিন্ধু সভ্যতার মধ্যে যাযাবর পশুচারী আর্যরা তাদের অশ্ববাহিত রথ ও লোহার অস্ত্র বজ্রের জোরে যুদ্ধে জয়লাভ করে প্রাগার্য গ্রামনগর দখল করে বসবাস করছে— এমন অবস্থায় নৈতিক মান স্বভাবতই পরবর্তী সামন্ততন্ত্র বা শিল্পযুগের মান থেকে স্বতন্ত্র হবে। এ সময়ের মূল্যবোধ যা কিছু যুদ্ধজয়, আত্মরক্ষা, লুঠ ও সমৃদ্ধি বিস্তারের অনুকূল, প্রাথমিক ভাবে তারই পরিপোষক হবে, তাই সমস্ত ঋগ্বেদ-এ অত্যন্ত প্রচ্ছন্ন ভাবে ছাড়া পরবর্তী কালের নীতিবোধ অনুপস্থিত। নীতির যা উদ্দেশ্য— সমাজের মঙ্গল ও সংহতিবিধান করা— তা সে যুগের মানুষের মতে যজ্ঞের দ্বারাই সম্পাদিত হত। প্রথম পর্যায়ে যজ্ঞ ছিল যৌথ, সমষ্টিগত অনুষ্ঠান, পুরো সমাজের কল্যাণসাধনের উদ্দেশ্যে আয়োজিত। কাজেই যজ্ঞ করাই পুণ্য, যজ্ঞ না করা পাপ। এরা বিশ্বাস করত যজ্ঞের দ্বারাই প্রথমে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্ট হয়েছিল এবং পরবর্তী যজ্ঞগুলি সেই আদিম সৃষ্টিকৃতিরই অনুকরণ। যে পরাজিত প্রাগার্য গোষ্ঠী ও কৌমগুলিকে আর্যরা ‘দাস’, ‘দস্যু’, ‘রাক্ষস’ বা ‘অসুর’ বলে অভিহিত করত তাদের দ্বারা প্রতিনিয়ত আক্রান্ত ও প্রতিক্ষণে ধ্বংস-সম্ভাবী এই সৃষ্টি যজ্ঞের দ্বারাই রক্ষিত হয়, অসুরশক্তি বিনষ্ট হয়ে শুভশক্তি জয়যুক্ত হয়, জীবনপ্রবাহ অক্ষুণ্ণ থাকে। যজ্ঞই পুণ্য, তাই আর্যবর্ণ যজ্ঞ করে, অযাজী অসুরবর্ণ তাই পাপী; এর বাইরে পানপুণ্যের বোধ নিতান্তই ক্ষীণ, অস্পষ্ট।
এই কারণে আজ যাকে পাক বা অন্যায় মনে করা হয় তার অনেক স্পষ্ট অসংকোচ উচ্চারণ ঋগ্বেদ-এ পাওয়া যায়। শত্রুমর্দনে অকুণ্ঠিত আনন্দ বহু ভাবে প্রকাশ পেয়েছে বৃত্র ও অন্যান্য অসুরদের প্রসঙ্গে; বৃত্রকে ইন্দ্ৰ কুপিয়ে কেটেছেন যেমন করে কুঠার দিয়ে ছেদক গাছের ডাল কাটে। (১:৩২:৫) শত্রুর সম্পত্তি হরণ সম্বন্ধেও কোনও দ্বিধা নেই, বারবার বলা হয়েছে, ওদের সর্বনাশ কর। যারা আর্যব্রত (=যজ্ঞ) সম্পাদন করে না তারা মরুক, তাদের ধন আমাদের এনে দাও। (৮:৯৭:৩) জনজাতি কীটদের গাভী থেকেই-বা কি হয়? আশির (সোমরস আর দুধ বা দইয়ের মিশ্রণ) হয় না, (প্রবর্গযাগের) পাত্রে তাদের দুধও ফোটে না। হে মঘবন্, প্রমগন্দের ও নৈচাশাখদের (পতিত) ধন আমাদের এনে দাও। (৩:৫৩:১৪) বণিকদের মন ভেজাও, হে পূষ, ওদের ধন আমাদের এনে দাও। (৭:৫৩:৬) তোমার ‘আরা’ অস্ত্র দিয়ে পণিদের হৃৎপিণ্ড বিদ্ধ কর, ওদের ধন আমাদের এনে দাও। (৭:৫৩:৭)
পুরুষের বহুবিবাহ সমাজে প্রচলিত ছিল। (১:৬২:১) ফলে, নারীর সপত্নীযন্ত্রণা ছিল, সে জন্যে তাকে বারেবারেই সপত্নীকণ্টক উদ্ধারের জন্যে দেবতাদের দ্বারস্থ হতে হত। (১০:১৪৫, ১০:১৬০) অবিবাহিতা কন্যার দীর্ঘকাল পিতৃগৃহে থাকাটা সমাজ অনুমোদন করত না; এমনই এক মেয়ে ‘ঘোষা’অশ্বীদের কাছে সে-দুঃখ নিবেদন করেছে। (১০:৩৯:৩) বিধবা নারী যখন গতপ্রাণ স্বামীর পাশে শুয়ে আছে তখন দেবর এসে বলবে: ওঠ, নারী, এই গতপ্রাণ মানুষের কাছে শুয়ে আছ, এস, জীবলোকের অভিমুখে চল। যে তোমার হাত ধরছে সে তোমার গর্ভে সন্তান এনে দেবে, তার অভিমুখে এস। (১০:১৮:৪) উপমাতেও দেখি, বিধবা নারী যেমন শয্যায় দেবরের অভিমুখিনী হয়… তেমনই, হে অশ্বীরা, বেদীর ওপরে কে তোমাদের অভিমুখী হয়?— কো বাং শযুত্ৰা বিধবের দেবরং মর্যোন ন যোযা কৃত সধস্থ আ। (১০:৪০:২) সহমরণ তো নয়ই, এমনকী, কঠোর বৈধব্যযাপনও নয়, সদ্য-বিধবাকে দেবর ডেকে ওঠাত, ‘জীবলোকের অভিমুখে এস’—এই বলে। জীবনকে জয়যুক্ত করবার অভীপ্সা— এই পরিস্থিতিতেও— ঋগ্বেদ-এর জীবনমুখীনতার একটি প্রকৃষ্ট প্রমাণ বহন করে।
ঋগ্বেদ-এ সমাজচিত্র সরাসরি যত না পাওয়া যায় তার চেয়ে অনেক বেশি পাওয়া যায় উপমা থেকে। সর্বজনপরিচিত বাস্তবজীবন থেকেই উপমান সংগ্রহ করেন কবি, কাজেই তার সত্যতা অভ্রান্ত। যেমন বলা হয়েছে: হে অশ্বিনৌ, তোমরা আমাদের অপর্যাপ্ত ধন দাও, যেমন দেয় পরস্ত্রীতে আসক্ত কামুক তার অভিলষিতাকে— জারঃ কনীন ইব চক্ষুদানঃ। (১:১১৭:১৮) এমনই আবার পরনারীকে গভীর রাত্রে হরণ করতে চলেছে যে-নায়ক সে প্রার্থনা করছে: তার মা ঘুমোক, বাবা ঘুমোক, তাদের কুকুরটা ঘুমোক, জামাতা ঘুমোক, সমস্ত জ্ঞাতিরা ঘুমোক, চারি দিকের লোকেরা ঘুমোক। (৭:৫৫:৫-৮) কতকগুলি উপমার মধ্যে অন্য, প্রাচীনতর, হয়তো ঋগ্বেদের প্রথম পর্যায়ের সমাজচিত্র পাওয়া যায়। সে-যুগে স্ত্রী স্বামীর আগে আগে চলত, ‘যেমন সূর্যের স্ত্রী ঊষা চলেছেন, বা সূর্য ঊষার পশ্চাতে আসছে, যেন স্ত্রীর পশ্চাতে পুরুষ-—‘উষো যাতি স্বসরস্য পত্নী কিংবা মৰ্যো ন যোষামভ্যেতিপশ্চাৎ। (১:১১৫:২) বধূরূপে পাওয়ার জন্য নারীর পিছনে পিছনে ঘুরছে পুরুষ একথাও উপমায় পাই— বধুয়ুরির ঘোষণাম্। (৩:৬২:৮) বধূ স্বামীকে খুশি করার জন্যে সজ্জাপ্রসাধন করছে— জায়েব পত্য উশতী সুবাসাঃ। (৪:৩:২) ‘পুরুষ নিজের বাড়িতে যেমন সুখী’—এমন উপমা আছে— ‘মর্য ইব স্ব ওক্যে’। (১:৯১:১৩) এর থেকে দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবনের সুখশান্তির একটা আভাস হয়তো পাওয়া যায়। এই সমাজে বধূ গৃহের অলঙ্কারস্বরূপিণী ছিল— জায়েব যোনাবরম্। (১:৯১:১৩) পরবর্তী কালের রচনা দশম মণ্ডলে শুনি: তেমন বধূই সুকল্যাণী হয়, যে বহুজনের মধ্যে নিজের সঙ্গীকে বেছে নেয়— ভদ্রা বধূর্ভবতি যৎ সুপেশাঃ। স্বয়ং সা মিত্রং বুনতে জনে চিৎ। (১০:২৭:১২) মরুৎ’রা নানা স্বর্ণাভরণে অঙ্গসজ্জা করে নেয়, যেমন বর নানা অলঙ্কারে সেজে নেয় বিয়ের দিনে —বরা ইবৈদ্রেবতাসো হিরণ্যৈরভি স্বধাভিস্তম্বঃ পিপিশ্রে। (৫:৬০:৪) কুৎসিত জামাতাকে বারবার ডাকলেও যেমন সে আসতে চায় না তেমন করেই যেন, হে ইন্দ্র, তুমি আমাদের যজ্ঞে আসতে দেরি কোরো না— অশ্রীর ইব জামাতা। (৮:৭৬:১০) ইন্দ্র এবং অগ্নি, আমাদের প্রভূত পরিমাণে ধন দিও, যেমন দেয় নির্গুণ জামাতা কন্যার পিতাকে কিংবা শ্যালক দেয় ভগিনীর প্রীত্যর্থে। (১:১০৯:২) এখানে অধুনাপ্রচলিত বরপণের পরিবর্তে কন্যাপণের কথাই দেখতে পাই।
শ্রেণীবিভক্ত সমাজে আর্যরা দাসদের প্রচণ্ড তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখতেন, যেন তারা মনুষ্যেতর জীব। এ মনোভাব এবং আচরণকে সমর্থন করবার জন্যে বলা হয়েছে যে, ইন্দ্রই দাসদের সমাজে নিচু স্থান দিয়েছেন— যো দাসং বর্ণমধরং গুহাকঃ। (২:১২:৪) পুরুষসূক্তেও এর সমর্থন: ব্রাহ্মণরা পুরুষের মুখ থেকে, রাজন্য তাঁর বাহু থেকে, বৈশ্য তাঁর ঊরু থেকে এবং শূদ্র তাঁর পা থেকে সৃষ্ট হয়েছিল। (১০:৯০:১৫)
আমাদের অদ্ভুত একটা ধারণা আছে, বৈদিক যুগের ভারতবর্ষে এত প্রাচুর্য ছিল যে, সমাজে দুঃখী-দরিদ্র ছিল না। ঋগ্বেদের চিত্র এ-ধারণার পরিপোষক নয়। চোরদের কথা বারেবারেই আছে: চোররা যেমন নিজেদের পদচিহ্ন গোপন করে (৫:১৬:৫); আবার চোরের মতো চুপিসাড়ে চলাফেরার কথাও শুনি। (৬:১২:৫) আরও শুনি, সূর্য তাপ দিচ্ছে যেন চোরকে সাজা দিচ্ছে। (৫:৭৯:৯) মনে হয়, প্রচণ্ড তাপে তপ্ত করে— হয়তো ফুটন্ত তেলের কড়াইতে ফেলে বা লোহার কড়াইতে রাখা আগুন বইয়ে (যেমন পরবর্তী কালে উল্লেখ পাওয়া যায়) চুরির অপরাধীকে শান্তি দেওয়া হত। চুরি ছিল, অভাব ছিল, অবস্থার প্রচণ্ড বৈষম্য ছিল বলে ধনীকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি অতি সাবধানে রাখতে হত। ‘সোনায় ভরা কলসী যেমন লোকে পুঁতে রাখে তেমনি কুয়োয় পড়ে ছিলেন রেভ, অশ্বীরা তাঁকে উদ্ধার করলেন —হিরণ্যস্যৈব কলশং নিখাতম্’। (১:১১৭:১২) পথেঘাটে লোকে ডাকাতের হাতে পড়ত, উপমায় পাই ‘পরিপন্থী’র কথা, যারা ঠেঙাড়ের মতো পথিককে মেরেধরে লুঠ করে পালাত—পরিপন্থীব। (১:১০৩:৬) বুড়ো বাপের টাকাপয়সা ছেলেরা কেড়েকুড়ে নিয়ে নিত এমন কথাও পাই উপমার মধ্যে— পিতুন জিব্রের্বি বেদো ভরন্তঃ। (১:৭০:৯)
সমাজে চুরি যখন ছিল অভাবও ছিল; তার নজিরও আছে। অক্ষসূক্তে সর্বস্বান্ত জুয়াড়ি অনুতাপ করছে জুয়া খেলে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার চেষ্টা করার জন্যে, সংকল্প করছে এবারে সে কৃষিজীবী হবে। দারিদ্র্য নিবারণ করবার জন্য ভক্ত দেবতার দ্বারস্থ হচ্ছে এমন কথাও দেখছি। তবে যজ্ঞ ক্রমেই অতিরিক্ত ব্যয়সাধ্য হয়ে উঠছিল এবং কেবল ধনীরই সাধ্য হত এমন ব্যয়বহুল অনুষ্ঠানের আয়োজন করার। তেমন লোকেরা অবশ্য সামগ্রিক কল্যাণের প্রার্থনা যজ্ঞে প্রয়োগ করবেন, কিন্তু ব্যক্তিগত বা শ্রেণিগত ভাবে দুঃস্থের যন্ত্রণার গান ওই সব যজ্ঞে প্রযুক্ত হবে— এমন কথা মনে করার কোনও কারণ নেই। এমন বহু গান নিশ্চয়ই ছিল যা ধনীর বা ব্রাহ্মণের অনুমোদন পায়নি। সে-সব গান হারিয়ে গেছে; হয়তো সেগুলো লোকগাথার মতো দরিদ্রমহলে গাওয়া হত, প্রতিষ্ঠিত বিত্তশালী ব্রাহ্মণ রাজন্যমহলে তার কোনও সন্ধান পাওয়া যাবে না। তবু এক-আধটা চিহ্ন থেকে গেছে: বামদেব বলছেন, তিনি অভাবে পড়ে কুকুরের নাড়িভুঁড়ি রান্না করে খেয়েছিলেন— অবর্তা শুন আস্ত্রাণি পেচে। (৪:১৮:১৩) সোমযাগে রীতি ছিল, এক শূদ্র সোম বিক্রি করতে আসবে, একটি বাছুরের মূল্যে সোম কেনা হবে। কিন্তু শূদ্রটি যখন বাছুর নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হবে তখন মারধর করে তার কাছ থেকে বাছুরটা কেড়ে নিয়ে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। এটা নিশ্চয়ই সোমযাগের অনুষ্ঠান, কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটায় সাধারণ ভাবে সামাজিক মনোভাবের ও আচরণের কোনও প্রতিফলন নেই— এ কথা মনে করা কি ঠিক হবে? যে-সমাজে শূদ্র দাস এবং তার একমাত্র কর্তব্য অন্য তিন বর্ণের সেবা সেখানে তার যে কোনও নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক অধিকার থাকবে না তা সহজেই বোঝা যায়। ঈষৎ পরবর্তী কালের ‘ব্রাহ্মণ’ সাহিত্যে একথা স্পষ্টই প্রমাণিত। ঋক্সংহিতাকালে ‘দাস’ ‘দস্যু’ ‘অবর বর্ণের’ অর্থাৎ পরাজিত প্রাগার্য জাতি ও গোষ্ঠীগুলির স্থান অন্যরকম ছিল তা মনে করার কোনও কারণ নেই। দরিদ্র শ্রমজীবীর একটি চিত্র অমর হয়ে আছে: গরিব ছুতোর কাজ করার ক্লান্তি ও পিঠের ব্যথার কষ্টে হাই তুলছে— তষ্টেব পৃষ্ট্যাময়ী উজ্জিহীতে। (১:১০৫:১৮)
আর্যরা যাযাবর পশুচারী সভ্যতার স্তরে থাকবার সময়েই এসে পড়েছিল এদেশে; পরে প্রাগার্যদের কাছে শিখে কৃষিজীবী হয়ে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে ও অতি ধীরে ধীরে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ছোটছোট শহরের পত্তন করে নগর-কেন্দ্রিক গ্রামীণ জনপদের বিস্তার ঘটায়। আদিম কৃষিজীবী সভ্যতায় খাদ্যসংস্থানের কোনও স্থিরতা ছিল না— অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টি প্লাবন পঙ্গপাল ইত্যাদিতে বারেবারেই শস্য উৎপাদন ব্যাহত বিপর্যস্ত হত। বলা বাহুল্য, এতে নিচের তলার সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকেরা অনেক বেশি মার খেত; তাদের কান্না ঋগ্বেদের সূক্তে ধরা পড়েনি। কিন্তু বড় রকমের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে যখন উৎপাদন নষ্ট হয়ে যেত, তখন আহার্যসংস্থানের অনিশ্চয়তা সমস্ত সমাজকেই স্পর্শ করত। তাই ঋগ্বেদ জুড়ে অন্নের জন্যে দেবতার কৃপাভিক্ষা এবং অন্নকে প্রায় দেবত্বে উপনীত করা হয়েছে; প্রথম মণ্ডলের ৮৭তম সূক্তের এগারোটি ঋকে পাই অন্নের স্তব— স্বাদো পিতো মধো পিতো বয়ং ত্বা হবামহে। (১:৮৭:২)
সমাজে বাণিজ্য প্রচলতি ছিল এবং সেখানে স্বাভাবিক নিয়মেই প্রতারণা, শঠতাও ছিল। ইন্দ্রের মূর্তি নিয়ে কেনাবেচা চলছে; বিক্রেতা ক্রেতার কাছে গিয়ে পণ্য (ইন্দ্রমূর্তি) ফেরত চাইছে, নইলে আরো বেশি দাম চাইছে এবং ক্রেতা সেটা দিতে অস্বীকার করছে। ইন্দ্রমূর্তির মালিক ফেরি করছে মূর্তি: কে দশটা গরু দিয়ে এই ইন্দ্রকে কিনবে? শত্রুবিনাশ হলে পর আমাকে আবার ফেরত দিয়ে যাবে?— ভূয়সা বস্নমচরৎ কনীয়ঃ, অবিক্রীতো অকানিষং পূণর্যৎ/স ভূয়সা কনীয়ো নারিরেচীদ্দীনা দক্ষা বি দুহস্তি প্র বাণম্/ক ইমং দশভির্মমেন্দ্ৰং ক্রীণাতি ধেনুভিঃ/যদা বৃত্রাণি জঙ্ঘনদথৈনং মে পুনদদাৎ।। (৪:২৫:৯, ১০) এ ঠিক কেনাবেচাও নয়, ভাড়া খাটানো; ইন্দ্র শত্রুনাশে দক্ষ— এই বিশ্বাস যে, সমাজে ওতপ্রোত, সেখানে জাগ্রত একটি ইন্দ্রমূর্তি নিয়ে এ ভাবে ব্যবসা চলবে সেটা বেশ কল্পনা করা যায়।
পরবর্তী কালের সমাজে সুরাপান ও মাদকসেবন মহাপাতক বলে গণ্য হলেও দেবরাজ ইন্দ্রের সোমপানে অত্যধিক আসক্তি নিয়ে ঋগ্বেদে কোনো সংকোচ নেই। সৈনিক চিরকালই যুদ্ধকালে মাদক সেবন করে; বিজয়ী বীর আর্যসেনাপতি ইন্দ্রের সোমে রীতিমত নেশা হত। ইন্দ্রকে আহ্বান করা হচ্ছে: তৃষিত গৌরমৃগের মতো সোমপান কর। (১:১৬:৫) প্রলুব্ধ করা হচ্ছে: এই সোম তীব্র মধুমান, এই কাম্য সোম পান করে মত্ত হও। (২:৪১:১৪) ইন্দ্রের জঠর যেন সোমে পূর্ণ হ্রদ (৩:৩৬:৮), সোমপানের তৃপ্তিতে ইন্দ্র দাড়ি নাড়ছেন— প্রোধুবৎশ্মশ্রুষ প্রীণানঃ। (২:১১:১৭) ইন্দ্রের সোমের নেশা নিয়ে অতিশয়োক্তিও পাই: একবারে তিনি ত্রিশ সরোবর পরিমাণ সোম পান করেন— একয়া প্রতিধাপিবৎ সরাংসি ত্রিংশতম্/ইন্দ্ৰঃ সোমস্য কাণুকা।। (৮:৭৭:৪) সোমযাগ সমাজে বিস্তার লাভ করতে করতে সোম সম্বন্ধে উদ্দীপনা বাড়তে লাগল। সোমের নেশার চমৎকার বর্ণনা নবম (সোম) মণ্ডলে: যেখানে অজস্র জ্যোতি, স্বর্গ যেখানে নিহিত, যেখানে আনন্দ, মোহ, কাম, স্বধা, তৃপ্তি— হে সোম, সেখানে আমাকে অমৃত কর। (৯:১১৩:৭-১১) সোমপায়ীর মনে সোমের উন্মাদক প্রভাবে যে তুরীয় অবস্থা আসে সেই উপলব্ধিরই বর্ণনা এখানে। বলা বাহুল্য, সোমযাগের প্রচার ও প্রসারের মূলে সোমপানজনিত আনন্দ-উন্মাদনাও কার্যকরী ছিল। ‘সত্র’ হল দ্বাদশবর্ষব্যাপী সোমযাগ। আরও দীর্ঘতর সোমযাগেরও উল্লেখ আছে, কিন্তু সত্ৰ বেশ বহুল-অনুষ্ঠিত যজ্ঞ ছিল; সোমযাগের বাইরে অন্যান্য যজ্ঞ এত দীর্ঘকালব্যাপী নয়। এর থেকে সোমপান সম্বন্ধে আগ্রহের একটা পরিচয় পাওয়া যাবে। বেশ কিছু যজ্ঞে সোমের সঙ্গে বা স্বতন্ত্রভাবে সুরাও ব্যবহৃত হত; সাধারণত সে-যজ্ঞের যজমান থাকত ক্ষত্রিয়।
বৈদিক সমাজ বলতে যে সর্বসুখময়, আদর্শ, নিষ্পাপ সমাজের কল্পরূপ সাধারণ ভারতীয়দের মানসলোকে উদিত হয়, ঋগ্বেদ-সংহিতায় চিত্রিত সমাজে তার কোনও সমর্থন নেই। বস্তুত ঋগ্বেদের প্রধান ও অনন্য আকর্ষণ এইখানেই: সুখে দুঃখে পাপে পুণ্যে সাধারণ সজীব সমাজের যে রূপটি এখানে প্রতিভাত তা ওই বাস্তবনিষ্ঠার জন্যেই এত মূল্যবান অত প্রাচীনযুগের সমাজের এত পূর্ণায়ত আলেখ্য আমরা অন্যত্র পাই না, হোমারও এর অন্তত তিন শতক পরের। এ কথা সত্য যে ঋগ্বেদ-সংহিতা-য় তৎকালীন সমাজের পূর্ণচিত্র নেই। প্রথমত সংখ্যাগরিষ্ঠের সমাজ— যেখানে চাষি চাষ করছে, রাখাল গরু চরাচ্ছে, অগণ্য মজুর খাটছে, বহু বিভিন্ন শ্রমশিল্পে— সেই বৈশ্যশূদ্রের সমাজ এখানে উপেক্ষিত; প্রাসঙ্গিক উল্লেখ বা উপমায় যেটুকু পাওয়া যায়, তা ছাড়া তাদের বিষয়ে কিছুই আমরা জানতে পারি না। ঐশ্বর্যবান্ রাজা যিনি যজমান, পুরোহিতদের যিনি দক্ষিণা দেবেন— তাঁর কথা ও তাঁর আশ্রিত ঋত্বিক পুরোহিতদের কথাই এখানে প্রধান ভাবে আছে। দেবচরিত্রের মধ্যে গৌণ অপ্রত্যক্ষ ভাবে সামাজিক মানুষই প্রতিফলিত, এ কথা সত্য। কিন্তু সে চিত্র অনেকটাই অনুমাননির্ভর, অস্পষ্ট। যেটুকু পাওয়া যায় তা অপেক্ষাকৃত বিদ্বান্ ও বিত্তশালীরই চিত্র।
আর পাঁচটা সমাজে যেমন আদর্শবাদ থাকে তেমনই এ সমাজেও ছিল; আবার অন্য-সব সমাজের মতো এখানে শঠতা, ক্রুরতা, ব্যসন, প্রতিহিংসাও ছিল; অর্থাৎ এখানে পাই সজীব মানুষের সমাজের রূপ। এরা দেবতাকে প্রলোভন দেখিয়ে কার্যোদ্ধারের চেষ্টা করে; এদের দেবতাও প্রলুব্ধ হন, যেমন বৃষাকপি সূক্তে ইন্দ্র বলছেন, বৃষাকপির বাড়িতে আমার জন্যে পনের-বিশটা ষাঁড়ের মাংস রাঁধা হচ্ছে তাই খাব আর সোমরসে জঠর পূর্ণ করব— উক্ষো হি মে পঞ্চদশ সাকং পচন্তি বিংশতিম্/ইতাহমদ্মি পীব ইদুভা কুক্ষী পূণন্তি মে।। (১০:৮৬:১৪) তেমনই আবার এরা সৃষ্টিরহস্যের আদিবিন্দুতে পৌঁছবার জন্যেও ব্যাকুল। লক্ষ্য করি, তত্ত্বমূলক সূক্ত গুলিতে কি আত্যন্তিক উৎকণ্ঠা ঔৎসুক্য নিয়ে এরা জীবনরহস্যের শেষ আবরণখানিকে উন্মোচন করতে উদ্যত। বিত্তগত শ্রেণিবিভাগ, জন্মগত জাতিভেদ— এই বহুধাবিভক্ত সমাজে থেকেও অস্পষ্ট ভাবে একটা সংহতির সন্ধানে অনির্দেশ্য কোনও তত্ত্বগত বৃহতের মধ্যে ভেদাভেদ ঘুচিয়ে মিলে যাওয়ার স্বপ্নে এরা সৃষ্টি করেছে ‘পুরুষ’কে, ‘ব্রহ্মা’কে, ‘বৃহস্পতি’কে, ‘পরমাত্মা’কে। তেত্রিশ কোটি দেবতাকে (১:৪৫:২) হবিদান করেও সন্ধান করেছে একক কোনও স্রষ্টার। সন্দেহ করে নেম ভার্গবের ভাষায় বলেছে: কে সেই ইন্দ্ৰকে দেখেছে? কার স্তব করি আমরা? — ক ঈং দদর্শ কমভি স্তবাম (৮:১০০:৩) কার উদ্দেশ্যে হবিদান করব? কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম। (১০:১২১) সূক্তের ধ্রুবপদ) কেই-বা নিঃসংশয়ে জানে, কে বলবে, কোথা থেকে উদ্ভুত হয়েছে, কোথায় উৎস এ সৃষ্টির… সে-ই হয়তো জানে, কিংবা সেও হয়তো জানে না— কো অন্ধা বেদ ক ইহ প্ৰ বোচৎ কুত আজাতা কুত ইয়ং বিসৃষ্টিঃ। ….সো অঙ্গ বেদ যদি বা ন বেদ। (১০:১৩০:৬, ৭) মনে হয়, এই সংশয়ে ঋগ্বেদের ঋষি আমাদের কাছে অনেক বেশি সজীব ও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠেন, কারণ চক্ষুষ্মান্ মানুষ কোনও যুগেই অন্ধ বিশ্বাসে সব কিছু মেনে নিয়েছে এটা ভাবতে হলে হতাশ লাগত। এবং ঋগ্বেদে মানবিকতার চূড়ান্ত স্বাক্ষর তার জটিল দ্বিধাগ্রস্ত চৈতন্যে, এক ধরনের অক্ষয় মূল্য এই ত্রুটিবিচ্যুতিশীল সংশয়ী মানুষের চিত্রণে। ভক্তির যুগ ছিল না সেটা, বরং ইষ্টসিদ্ধির জন্যে যে এক ধরনের বিশ্বাসের প্রয়োজন, তাই ছিল অধিকাংশের মনে বহুদিন পর্যন্ত। কিন্তু নিশ্চয়ই বহু বহুবার যজ্ঞ করেও অভীষ্ট লাভ হয়নি অথবা কাকতালীয়বৎ লাভ হলেও মানুষের যে সন্দেহ করবার ক্ষমতার মধ্যে তার অগ্রগতির বীজ নিহিত সেই সংশয়, সেই ঐশী অতৃপ্তির পরিচয়েই সে-যুগের মানুষ আমাদের কাছে বাস্তবের চূড়ান্ত স্বীকৃতি পায়।
সমস্ত ঋকে সমস্ত যজ্ঞে ঋগ্বেদ-এর মানুষ চেয়েছে এই পৃথিবীতে দীর্ঘকাল ধরে সুস্থ নির্বিঘ্ন স্বচ্ছন্দ জীবনযাপন করতে। এই আকুতিই মধ্যযুগের শেষে ভারতবর্ষে আবার উচ্চারিত হয়েছে: আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। দুধভাতের সঙ্গে তার মননের ক্ষুন্নিবৃত্তিও সে অপরিহার্যরূপেই চেয়েছে; জানতে বুঝতে উপভোগ করতে চেয়েছে জীবনকে পূর্ণ ভাবে, কারণ তা অভাব্য। ঋগ্বেদ কখনওই এ কথা বলেনি যে মর্ত্যজীবন বন্ধন, এর থেকে মুক্তিই পরম লক্ষ্য: বরং বারবার দ্বিধাহীন ভাবে ঘোষণা করেছে জীবন আনন্দের, যতদিন ধরে যত ভাবে এ আনন্দ ভোগ করা যায় তারই চেষ্টা করতে হবে। এই মানসভূমিতেই সে দিন রবীন্দ্রনাথ আবার একবার বলেছেন: মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই। তিন হাজার বছর আগে ঋগ্বেদে উচ্চারিত হয়েছিল জীবনের লক্ষ্য: জীবাতবে ন মৃত্যবে— বাঁচবার জন্যে, মরবার জন্যে নয়। (১০:৬০:১০)