বঙ্গসুন্দরী
প্রথম সর্গ – উপহার
১ সর্ব্বদাই হুহু করে মন, বিশ্ব যেন মুরুর মতন; চারিদিকে ঝালাপালা উঃ কি জ্বলন্ত জ্বালা! অগ্নিকুণ্ডে পতঙ্গ পতন। ২ লোক মাঝে দেঁতো-হাসি হাসি। বিরলে নয়ন-জলে ভাসি; রজনী নিস্তব্ধ হ'লে, মাঠে শুয়ে দূর্ব্বাদলে, ডাক ছেড়ে কাঁদি ও নিশ্বাসি। ৩ শূন্যময় নির্জন শ্মশান, নিস্তব্ধ গম্ভীর গোরস্থান, যখন যখন যাই, এক্টু যেন তৃপ্তি পাই, এক্টু যেন জুড়ায় পরাণ। ৪ সুদুর্ভর হৃদয় বহিয়ে, কত যুগ রহিব বাঁচিয়ে! অগ্নিভরা, বিষভরা, রে রে স্বার্থভরা ধরা! কত আরো থাকিবি ধরিয়ে! ৫ কভু ভাবি ত্যেজে এই দেশ, যাই কোন এ হেন প্রদেশ, যথায় নগর গ্রাম নহে মানুষের ধাম, প'ড়ে আছে ভগ্ন-অবশেষ। ৬ গর্ব্বভরা অট্টালিকা যায়, এবে সব গড়াগড়ি খায়; বৃক্ষ লতা অগনন ঘেরে কোরে আছে বন, উপরে বিষাদ বায়ু বায়। ৭ প্রবেশিতে যাহার ভিতরে, ক্ষীণ প্রাণী নরে ত্রাসে মরে; যথায় শ্বাপদ দল করে কোলাহল, ঝিল্লী সব ঝিঁঝিঁ রব করে। ৮ তথা তার মাঝে বাস করি, ঘুমাইব দিবা বিভাবরী; আর কারে করি ভয়, ব্যাঘ্রে সর্পে তত নয়, মানুষ জন্তুকে যত ডরি। ৯ কভু ভাবি কোন ঝরণার, উপলে বন্ধুর যার ধার; প্রচণ্ড প্রপাত-ধ্বনি, বায়ুবেগে প্রতিধ্বনি চতুর্দ্দিকে হতেছে বিস্তার;- ১০ গিয়ে তার তীরতরু তলে, পুরু পুরু নধর শাদ্বলে, ডুবাইয়ে এ শরীর, শব সম রব স্থিত কান দিয়ে জল-কলকলে। ১১ যে সময় কুরঙ্গিণী গণ, সবিস্ময়ে ফেলিয়ে নয়ন, আমার সে দশা দেখে, কাছে এসে চেয়ে থেকে, অশ্রুজল করিবে মোচন;- ১২ সে সময়ে আমি উঠে গিয়ে, তাহাদের গলা জড়াইয়ে, মৃত্যু কালে মিত্র এলে, লোকে যেম্নি চক্ষু মেলে, তেম্নি তর থাকিব চাহিয়ে। ১৩ কভু ভাবি সমুদ্রের ধারে, যথা যেন গর্জ্জে একেবারে প্রলয়ের মেঘ সঙ্ঘ; প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ভঙ্গ আক্রমিছে গর্জ্জিয়া বেলারে। ১৪ সম্মুখেতে অসীম, অপার, জলরাশি রয়েছে বিস্তার; উত্তাল তরঙ্গ সব, ফেণপুঞ্জে ধবধব, গণ্ডগোলে ছোটে অনিবার। ১৫ মহা বেগে বহিছে পবন, যেন সিন্ধু সঙ্গে করে রণ; উভে উভে প্রতি ধায়, শব্দে ব্যোম ফেটে যায়, পরস্পর তুমূল তাড়ন। ১৬ সেই মহা রণ-রঙ্গস্থলে, স্তব্ধ হয়ে বসিয়ে বিরলে, (বাতাসের হুহু রবে; কান বেস ঠাণ্ডা রবে;) দেখিগে, শুনিগে সে সকলে। ১৭ যে সময়ে পূর্ণ সুধাকর ভূষিবেন নির্ম্মল অম্বর, চন্দ্রিকা উজলি বেলা বেড়াবেন ক'রে খেলা, তরঙ্গের দোলার উপর; ১৮ নিবেদিব তাঁহাদের কাছে, মনে মোর যত খেদ আছে; শুনি, নাকি মিত্রবরে, দুখের যে অংশী করে, হাঁপ্ ছেড়ে প্রাণ তার বাঁচে। ১৯ কভু ভাবি পল্লীগ্রামে যাই, নাম ধাম সকল লুকাই; চাষীদের মাজে রয়ে, চাষীদের মত হয়ে, চাষীদের সঙ্গেতে বেড়াই। ২০ প্রাতঃকালে মাঠের উপর, শুদ্ধ বায়ু বহে ঝর্ঝর্, চারি দিকে মনোরম, আমোদ করিব শ্রম; সুস্থ স্ফূর্ত্ত হবে কলেবর। ২১ বাজাইয়ে বাঁশের বাঁশরী, শাদা সোজা গ্রাম্য গান ধরি, সরল চাষার সনে, প্রমোদ-প্রফুল্ল মনে কাটাইব আনন্দে সর্ব্বরী। ২২ বরষার যে ঘোরা নিশায়, সৌদামিনী মাতিয়ে বেড়ায়; ভীষণ বজ্রের নাদ, ভেঙে যেন পড়ে ছাদ, বাবু সব কাঁপেন কোঠায়; ২৩ সে নিশায় আমি ক্ষেত্র-তীরে, নড়্বোড়ে পাতার কুটীরে, সচ্ছন্দে রাজার মত ভূমে আছি নিদ্রাগত; প্রাতে উঠে দেখিব মিহিরে। ২৪ বৃথা হেন কত ভাবি মনে, বিনোদিনী কল্পনার সনে; জুড়াইতে এ অনল, মৃত্যু ভিন্ন অন্য জল বুঝি আর নাই এ ভুবনে। ২৫ হায়রে সে মজার স্বপন, কোথা উবে গিয়েছে এখন, মোহিনী মায়ায় যার সবে ছিল আপনার যবে সবে-নূতন যৌবন! ২৬ ওহে যুবা সরল সুজন, আছ বড় মজায় এখন; হয় হয় প্রায় ভোর, ছোটে ছোটে ঘুমঘোর; উঠ এই করিতে ক্রন্দন! ২৭ কে তুমি? কে তুমি? কহ! হে পুরুষবর, বিনির্গত-লোলজিহ্ব, উলট-অধর, চক্ষু দুই রক্ত পর্ণ, কালিঢালা রক্ত বর্ণ, গলে দড়ি, শূন্যে ঝোলে, মূর্ত্তি ভয়ঙ্কর! ২৮ সদা যেন সঙ্গে সঙ্গে ফিরিছ আমার, এই দেখি, এই নাই, দেখি পুনর্ব্বার; নিতে নিজ আলিঙ্গনে কেন ডাক ক্ষণে ক্ষণে, সম্মুখেতে দুই বাহু করিয়া বিস্তার! ২৯ প্রিয়তম সখা সহৃদয়! প্রভাতের অরুণ উদয়, হেরিলে তোমার পানে, তৃপ্তি দীপ্তি আসে প্রাণে, মনের তিমির দূর হয়। ৩০ আহা কিবে প্রসন্ন বদন! তার যেন জ্বলে দু নয়ন; উদার হৃদয়াকাশে, বুদ্ধি বিভাকর ভাসে, স্পষ্ট যেন করি দরশন। ৩১ অমায়িক তোমার অন্তর, সুগম্ভীর সুধার সাগর; নির্ম্মল লহরীমালে, প্রেমের প্রতিমা খেলে, জলে যেন দোলে সুধাকর। ৩২ সুধাময় প্রণয় তোমার, জুড়াবার স্থান হে আমার; তব স্নিগ্ধ কলেবরে, আলিঙ্গন দিলে পরে, উলে যায় হৃদয়ের ভার। ৩৩ যখন তোমার কাছে যাই, যেন ভাই স্বর্গ হাতে পারি; অতুল আনন্দ ভরে মুখে কত কথা সরে, আমি যেন সেই আর নাই। ৩৪ নূতন রসেতে রসে মন, দেখি ফের নূতন স্বপন; পরিয়ে নূতন বেশ, চরাচর সাজে বেশ, সব হেরি মনের মতন। ৩৫ ফিরে আসে সেই ছেলেবেলা, হেসে খুসে করি খেলাদেলা, আহ্লাদের সীমা নাই, কাড়াকাড়ি ক'রে খাই, ব্রজে যেন রাখালের মেলা। ৩৬ নিরিবিলে থাকিলে দুজন, কেমন খুলিয়া যায় মন; ভোর্ হয়ে ব'সে রই, অন্তরের কথা কই, কত রসে হই নিমগন। ৩৭ আ! আমার তুমি না থাকিলে, হৃদয় জুড়ায়ে না রাখিলে, নিজ কর-করবাল নিবাতো প্রাণের আলো, ফুরাত সকল এ অখিলে। ৩৮ তুমি ধাও আপনার ঝোঁকে, সুদূর "দর্শন" সূর্যালোকে; যার দীপ্ত প্রতিভায়, তিমির মিলায়ে যায়, ফোটে চিত্ত বিচিত্র আলোকে। ৩৯ পোড়ে যার প্রখর ঝলায়, কত লোক ঝলসিয়া যায়; তুমি তায় মন সুখে, বেড়াও প্রফুল্ল মুখে, দেবলোকে দেবতার প্রায়। ৪০ আমি ভ্রমি কমল কাননে, যথা বসি কমল আসনে, সরস্বতী বীণা করে, স্বর্গীয় অমিয় স্বরে, গান গান সহাস আননে। ৪১ করি সে সংগীত সুধা পান, পাগল হইয়ে গেছে প্রাণ; দৃষ্টি নাই আসে পাশে, সমুখেতে স্বর্গ হাসে, ভুলে আছে তাতেই নয়ান। ৪২ পরস্পর উল্ট তর কাজে, পরস্পরে বাধা নাহি বাজে, চোকে যত দূরে আছি, মনে তত কাছাকাছি, ঈর্ষার আড়াল নাই মাজে। ৪৩ বুদ্ধি আর হৃদয়ে মিলন, বড় সুশোভন, সুঘটন; বুদ্ধি বিদ্যুতের ছটা, হৃদয় নীরদ ঘটা, শোভা পায়, জুড়ায় দুজন। ৪৪ হেরি নাই কখন তোমার; পদের অসার অহঙ্কার; নিস্তেজ নচ্ছার যত, পদ গর্ব্বে জ্ঞানহত, ঠ্যাকারেতে হাসায় দ্বোধায়। ৪৫ তোষামোদ করিতে পারনা, তোষামোদ ভালও বাসনা; নিজে তুমি তেজীয়ান্, বোঝ তেজীয়ান্-মান; সাধে মন করে কি মাননা? ৪৬ দাঁড়াইলে হিমালয় পরে, চতুর্দ্দিকে জাগে একতরে, উদার পদার্থ সব, শোভা মহা অভিনব, জনমায় বিস্ময় অন্তরে; ৪৭ প্রবেশিলে তোমার অন্তর, মাণিক্যের খনির ভিতর, চারিদিকে নানা স্থলে, নানাবিধ মণি জ্বলে, কি মহান্ শোভা মনোহর! ৪৮ শুনিলে তোমার গুণগান, আনন্দে পূরিয়ে ওঠে প্রাণ; অঙ্গ পুলকিত হয়, দুনয়নে ধারা বয়, ভাসে তায় প্রফুল্ল বয়ান। ৪৯ ওহে সখা সরল সুজন! করি আমি এই নিবেদন, যে ক দিন প্রাণ আছে, থেকো তুমি মোর কাছে, ফাঁকি দিয়ে ক'রনা গমন।