উনিশ শো পনেরো সাল। ইউরোপে প্রথম মহাসমর সবে শুরু হয়েছে। কিছু বছরের ব্যবধানে যে দুটি বিশ্বযুদ্ধ মানবেতিহাসকে আমূল বদলে সম্পূর্ণ নতুন পথে প্রবাহিত করবে, তার আভাসমাত্রও কেউ তখনো জানে না। যুদ্ধ একটা হচ্ছে বটে, যারা নিজের জনপদের বাইরে কর্মসূত্রে যাতায়াত করে, তারা খবরটা জানে। কিন্তু সে যুদ্ধ হচ্ছে অন্য মহাদেশে, ভারতে তার বিশেষ কোনো ঢেউ এসে লাগেনি। লোকপরম্পরায় শ্রুত কিংবদন্তীর মত তা সামান্য ঔৎসুক্য জাগায় মাত্র, মানুষকে সন্ত্রস্ত বা উদ্বিগ্ন করে না। সবুজ গাছপালায় ঢাকা শ্যামমিন্ধ গ্রামবাংলার জীবন চিরাচরিত ধীরলয়ে বয়ে চলেছে। হুগলী জেলার অন্তঃপাতী এমনই একটি ছোট গ্রামে এই কাহিনীর শুরু।
তারকেশ্বর লাইনের সিঙ্গুর স্টেশনে নেমে আট-দশ মাইল হেঁটে কিম্বা গরুর গাড়িতে গেলে পড়বে রামজয়পুর গ্রাম। গ্রামটি ব্রাহ্মণপ্রধান, কায়স্থ এবং বৈদ্যের বাসও কিছু রয়েছে। গ্রামের প্রত্যন্তসীমায় শ্রমজীবী অন্যজাতির কয়েকটি পরিবার বাস করে। কিন্তু সেই যুগে সমাজে যে জাতপাত-ঘটিত বৈষম্য বিরাজ করত, রামজয়পুরে তার নামগন্ধও ছিল না। ভাগ্যের আশ্চর্য যোগাযোগে এখানে কিছু উদার ও ভদ্র মানুষ একজায়গায় হয়েছিল। তারা হাসিমুখেই বাস করত গ্রামে। প্রতিবেশীর সুখ এবং শান্তি সচরাচর কারো সহ্য হয় না, তাই কাছাকাছি দু-একটি গ্রাম থেকে সমাজপতিদের প্রতিনিধিরা এসে মাঝেমধ্যে বিরোধ তৈরি করার প্রচেষ্টা যে করেনি এমন নয়, কিন্তু রামজয়পুর সে চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে।
শ্রাবণ মাসের শেষের দিক। দিন তিনেক হল অবিশ্রাম বৃষ্টি হয়ে চলেছে। কখনো সামান্য ধরে আসে, একটু বাদেই আবার ঝমঝমিয়ে নামে। গ্রামের ভেতরে প্রায় সব রাস্তাতেই কমবেশি কাদা। পথে লোক চলাচল নেই। কে আর এমন দুর্যোগে অকারণে ঘর ছেড়ে বেরুবে? চাকরির জন্য কলকাতায় নিত্যযাত্রার প্রচলন তখনো এমন ব্যাপকভাবে শুরু হয়নি। হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র জীবিকার প্রয়োজনে গ্রাম ছেড়ে বেরিয়েছিল, তারা সারা সপ্তাহ কলকাতার মেসে থেকে শনিবার বাড়ি আসত, আবার সোমবার সকালে ফিরে যেত। লোকে নিজের ভদ্রাসনেই বাস করত, পারিবারিক জমিজমা আর আমকাঠালের বাগানের উপস্বত্বে সংসার চলে যেত সচ্ছলভাবেই। চাহিদা কম থাকায় জীবনে সুখ ছিল।
আকাশে মেঘ থাকায় সন্ধে নেমেছে একটু তাড়াতাড়ি। সরসী চাটুজ্জের বৈঠকখানায় সান্ধ্য আড্ডা জমে উঠেছে দারুণ। বেশ বড় বাড়ি, তারপরে দুর্গামণ্ডপ আর নাটমন্দির। নাটমন্দির পার হয়ে দুদিকে দেউড়ির ভেতর দিয়ে বাড়িতে ঢোকার পথ। এরই ডানদিকে বড় বৈঠকখানা। চৌকি বা তক্তাপোশ নয়, মেঝেতে মোটা সতরঞ্চি পাতা, তার ওপর সাদা ফরাস। একসঙ্গে পনেরো-কুড়িজন বসে আড্ডা দিতে পারে। সরসী চাটুজ্জের আড্ডা এ গ্রামে বিখ্যাত। এমন ঢালাও তামাকের ব্যবস্থা আর কারো বাড়ি নেই। তাছাড়া আর মধ্যে অন্তত একবার কাঁসার বাটিতে করে সরষের তেল দিয়ে জবজবে করে মাখা মুড়িহোলাভাজা আসবেই। সরসী চাটুজ্জের উঠোনে বাইশ হাত বেড়ের ধানের গোলা চারটে, ধান ছাড়াও বিভিন্ন রকমের শস্য আর সবজির চাষ আছে বহু বিঘের। আপ্যায়নের বিষয়ে তার কষ্ট হবার কথা নয়। গ্রামবৃদ্ধেরা রোজ ভিড় করেন তাঁর বাড়িতে।
আজ হচ্ছিল গল্পের রাজা-ভূতের গল্প। বাড়ির ভেতর থেকে চালভাজা-ছোলাভাজা এসে গিয়েছে, হুঁকো ঘুরছে হাতে হাতে। ঘরের কড়িকাঠ থেকে লোহার বাঁকানো হুকে ঝুলছে হিঙ্কসের ডবল পলতের বাতি। সজল বাতাসে সেটা সামান্য দুলছে, ফলে আচ্ছাধারীদের ছায়া দুলছে বৈঠকখানার দেয়ালে। আলোছায়ার মায়ায় জমে উঠেছে অপ্রাকৃত গল্পের আসর।
আদিনাথ চক্রবর্তী বললেন—তোমরা বেশির ভাগই শোনা কথা বলছ, নিজেরা কিছুই দেখোনি। ওসব গল্পের মূল্য কী?
নিবারণ ভাদুড়ি হুঁকোটা রাম গাঙ্গুলির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন-সরসী, এ ভ্যালসা তামাক কোত্থেকে জোগাড় করলে? গলায় একটু সেঁকও লাগে না ছাই! একটু ভদ্র তামাকের ব্যবস্থা করা, নইলে নিজের তামাক ট্যাকে খুঁজে আড্ডায় আসতে হবে। আর হ্যাঁ, আদিনাথ, তুমি তো বড় বড় কথা বলছ। নিজে কী দেখেছ বল, আমরা একটু শুনি। কেবল বাগাড়ম্বর করে তো বাজার গরম হবে না—
সরসী চাটুজ্জে বললেন–সেই ভাল। চক্কোত্তিমশাই এতক্ষণ চুপ করে শুনে যাচ্ছিলেন, এবার ওঁর গল্পই হোক—
আদিনাথ বললেন—গল্প নয়, সত্য কাহিনী।
–বেশ তো, তাই হোক।
পতিরাম মজুমদার একটু ভালমানুষ ভীতু ধরণের লোক। আড্ডায় অনেকক্ষণ ধরে ভূতের গল্প তার পছন্দ হচ্ছিল না। এবার তিনি একটু সন্ত্রস্ত হয়ে বললেন–আজ এই পর্যন্ত থাকলেই ভাল। দেখছ তো আকাশের গতিক, বেশি জোরে নামলে আর বাড়ি ফেরা মুশকিল হয়ে পড়বে। শুনছ মেঘের ডাক?
সরসী চাটুজ্জে হেসে বললেন—আরে বোসো। আমার চাকর তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে এখন–
পতিরাম হতোদম হয়ে বসে পড়লেন।
আদিনাথ বললেন–তামরা তো জানো, শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি পেয়ে আজ সতেরো বছর হল আমি এই গ্রামে এসে বাস করছি। আমার ছোটবেলা এবং বিবাহিত জীবনের প্রথম কয়েকবছর কেটেছে পৈতৃক গ্রাম বাহিরগাছিতে। সেখানে আমাদের তিনমহলা বাড়ি, বাপ-জ্যাঠা পিসি-খুড়ি আর একগাদা ছেলেপুলে নিয়ে সে বাড়ি গমগম করত সর্বদা। নিজেদের মধ্যে ভাব-ভালবাসা ছিল। এখানে বাস করতে আসি ঝগড়া করে নয়, কোনো বিরোধের জন্যও নয়। এসেছিলাম বাবার কথায়। তিনি বলেছিলেন—আদিনাথ, আমার কথা শোনো। তুমি রামজয়পুরে গিয়ে বাস করো, অন্তত কিছুদিনের জন্য। বৌমার বাবা গত হয়েছেন, রয়েছেন কেবল বেয়ানঠাকরুণ। তিনিও শয্যাগতা। তাকে দেখাশুনো করা তোমাদের কর্তব্য। তাছাড়া কিছু মনে কোরো না-যতদূর জানি তাদের সম্পত্তির পরিমাণও কম নয়। বৌমাও তাদের একমাত্র সন্তান, সবকিছু তারই প্রাপ্য। এ সময়ে সেখানে উপস্থিত থেকে নিজেদের জিনিস বুঝে নেওয়া ভাল। আর এই বাড়িতেও তো ক্রমেই স্থানাভাব ঘটছে দেখতেই পাচ্ছ। লোকসংখ্যা বাড়ছে, সে তুলনায় থাকার জায়গা বাড়ছে কই? যদি আলাদাও থাক, তাতে প্রীতির ভাব কমবার কারণ নেই। যাওয়া-আসা বজায় রেখো, সেটাই বড় কথা।
বাবার কথা শুনে এখানে আসি। বছরখানেকের মধ্যে শাশুড়ি ঠাকরুণ মারা গেলেন। সম্পত্তি দেখাশুনোর ভার আমারই ওপর এসে পড়ল। তবুও বছরে অন্তত একবার, পূজোর সময়ে, বাহিরগাছি যেতাম। কয়েকবছর পরে বাবাও মারা গেলেন। পৈতৃক গ্রামের সঙ্গে সেভাবে আর কোনো যোগসূত্র বজায় রইল না।
যাই হোক, যে সময়ের কথা বলছি তখন আমার বয়েস বারো-তেরো হবে। শীতকাল। দোলাই গায়ে দিয়ে বাইরের দালানে বাবার কাছে বসে পড়াশুনো করছি। বাবা বসে হিসেবের খাতাপত্র দেখছেন। এমন সময়ে একটা ভবঘুরে চেহারার লোক এসে উঠোনে দাঁড়া ল।
আমি তখন নেহাৎই ঘোট, মানবচরিত্র ঠিকঠাক বোঝবার মত বয়েস হয়নি। কিন্তু লোকটাকে দেখে প্রথমেই যে কারণে আমার অবাক লাগল তা হল এই—আমি লোকটার বয়েস আন্দাজ করতে পারলাম না। এ ব্যাপারটা ভাল করে বুঝে নাও। কোনো মানুষকে প্রথম দেখলে এবং তার বয়েস সঠিক না জানলে আমরা ত্ৰিশ কী পঁয়ত্রিশ, কিম্বা পঞ্চান্ন কী ষাট—এরকম মনে করি। অর্থাৎ কারো বয়েস একদম ঠিক বলতে না পারলেও আন্দাজটা কাছাকাছি থাকে। এই লোকটাকে দেখে মনে হল এর বয়েস ত্রিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশ বা ষাট কিম্বা সত্তর যা কিছু হতে পারে। পরণে খাটো আধময়লা ধুতি, গায়ে তৎ আধময়লা ফতুয়া, কাধে ভাজ করা রয়েছে একটা খয়েরি রঙের মোটা চাদর। এই ভয়ানক শীতেও লোকটা সে চাদর গায়ে জড়ায়নি। গালে খোঁচা খোঁচা কাঁচাপাকা দাড়ি, মাথায় অবিন্যস্ত ঝাকড়া চুল। সবচেয়ে আশ্চর্য হল তার চোখদুটো। সোজাসুজি সামনে তাকিয়ে আছে, অথচ মনে হচ্ছে সে কিছুই দেখছে না। পাগলের মত, কিন্তু পাগল নয়। তার দৃষ্টিতে চিন্তাসঙ্গতির বাঁধুনি আছে।
বাবা মুখ তুলে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন–কী ব্যাপার, কোথা থেকে আসছ? কে তুমি?
খুব মোলায়েম, মৃদু গলায় সে বলল—আমি একজন পথিক। কোথাও থেকে আসছি, আমার বাড়িঘর নেই। আমি আজ এখানে ভাত খাব।
তার কথাগুলো অসংলগ্ন। হঠাৎ এভাবে কেউ কারো বাড়ি ভাত খেতে চায় নাকি? বাবা বললেন তোমার নাম কী? এখন বাড়ি না থাকতে পারে, কিন্তু একসময় তো ছিল, মানুষ আকাশ থেকে পড়ে না। পরিচয়টা দাও।
সে কেমনভাবে যেন হেসে বলল—আমার নাম অমর। বাবা ছিলেন পণ্ডিত মানুষ, নাম ঈশ্বরচন্দ্র সার্বভৌম। আমি আজ আপনার কাছে ভাত খাব।
-বাবা ‘ছিলেন’ মানে কী? এখন তিনি কোথায়?
অমর ডানহাতের তর্জনী ওপরে তুলে দেখাল।
বাবা লজ্জিত হয়ে বললেন—ও, আচ্ছা, আচ্ছা। মা-ও কি?
–মাও ওইখানে।
—ও। তা, বাড়ি কোথায় ছিল?
অনির্দিষ্ট একটা দিক দেখিয়ে অমর বলল—ওইদিকে।
তারপর একটু থেমে বলল—ভয় নেই, আমি চোর-ডাকাত না।
বাবা লজ্জা পেয়ে বললেন-না, না, আমি তা মনে করিনি। আসলে তোমার কথাবার্তা একটু অদ্ভুত ধরণের কিনা, তাই আরকি—
উঠোনে নিমগাছতলার ইঁদারা থেকে বালতি করে জল তুলে হাতমুখ ধুয়ে অমর এসে বারান্দায় উঠে বসল। বাবার ভয়ে সেদিকে বেশি তাকাতে পারছি না, কিন্তু কান খাড়া করে রয়েছি। বাবা জিজ্ঞাসা করলেন—এখন কি কিছু খাবে? রাত্তিরে কোথায় ছিলে? সকালে উঠেই হাঁটছ বুঝি?
বাবা কেন এ প্রশ্ন করলেন তা আবছা আবছা বুঝতে পারলাম। মাইল চারেক দুরে চাপাগাড়ি ছাড়া কাছাকাছি অন্য কোন গ্রাম নেই। তার পরের গ্রাম ময়নাচাঁদা অনেক দূর, সকালে উঠে সেখান থেকে হেঁটে আসা সম্ভব নয়। লোকটা কী বলে বাবা দেখতে চাইলেন।
অমর সহজভাবেই বলল-না, আমি এখন কিছু খাব না। একেবারে দুপুরে ভাত খাব। আর যদি থাকতে দেন তাহলে আজ রাত্তিরটাও থেকে যেতে পারি। এই ভিটেতে একটু স্বপ্ন দেখতে হবে কিনা–
এবারে আমি বাবার শাসনের কথা ভুলে অমরের দিকে তাকালাম। চোর-ডাকাত না হতে পারে, কিন্তু পাগল নিশ্চয়। স্বপ্ন দেখতে হবে মানে?
বাবা এবার একটু কড়া গলায় বললেন—পাগলামি কোরো না। আমি যা বলছি তার সোজা উত্তর দিচ্ছ না কেন? তোমার নাম তো অমর?
—আজ্ঞে। অমরজীবন।
–বাবার নাম ঈশ্বর?
—সবারই বাবার নাম ঈশ্বর।
—আবার পাগলামি করে! স্বপ্নের ব্যাপার কী বলছিলে? ওর মানে কী?
অমরের কণ্ঠস্বর ভারি মৃদু, মিষ্টি আর ভদ্র। সে বলল-রাগ করবেন না, আমার কথাবার্তা একটু ওই পাগলাটে মতন, কিন্তু আমি লোকটা খারাপ নই। আপনাদের এই বাড়ির দক্ষিণ দিকের ভিত সামান্য নিচু, তা জানেন? সমস্ত বাড়িটা একটু কাত হয়ে আছে। উত্তরে উঠে, দক্ষিণে ঝুঁকে। আপনাদের বাড়িতে শালিক বসে না, খেয়াল করেছেন কখনন? আপনি তো এ বাড়ির কর্তা, আপনার অনামিকা মধ্যমার চেয়ে বড়। এ বাড়ির প্রত্যেক বড়ছেলের তাই। ঠিক বলছি তো?
আমি অবাক হয়ে গেলাম। সত্যিই তো তাই। আমার মাঝের আঙুলের চেয়ে পরের আঙুলটা বড়। মেজকাকা আর ছোটকাকার বড়ছেলেরও তাই। এই লোেকটার পক্ষে সেকথা এত তাড়াতাড়ি কী করে জানা সম্ভব?
বাবা বললেন—তাতে কী?
অমর বলল—সেজন্য আমি এই বাড়িতে একটা রাত ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখতে চাই। এটাই আমার কাজ। পথে পথে ঘুরে বেড়াই, মন্দিরের চাতালে, গাছতলায় বা কোনো গেরস্তর বাড়ি আশ্রয় নিই। সব জায়গাতে কিন্তু স্বপ্ন দেখা যায় না। ওর একটা নিয়ম আর লক্ষণ আছে। সে বুঝিয়ে বলা যায় না, কিন্তু আমি ঠিক টের পাই। কাল সকালে আমি আরো অনেক কথা বলতে পারব।
বাবা কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন-তুমি তাহলে আজ রাত্তিরে এখানে থাকতে চাইছ?
–বা রে, নইলে স্বপ্ন দেখব কী করে? জেগে কি স্বপ্ন দেখা যায়? বাবা আর কিছু বললেন না, মুখ নামিয়ে আবার হিসেবের খাতায় মন দিলেন। আমিও কাঠাকালি-বিঘাকালি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
অমর দুই হাতে হাঁটু বেড় দিয়ে তার ওপর থুতনি রেখে বসে রইল। অনেকক্ষণ পরে বারান্দা থেকে নেমে নিমগাছের গোড়ায় পড়ে থাকা একটা লম্বা কঞ্চি তুলে সেটা দিয়ে পরো উঠোনটা মেপে ফেলল। তারপর নিজের মনে মনেই বিড়বিড় করতে লাগল আটত্রিশ। আটত্রিশ কেন? বাকি চার কোথায় গেল? বাকি চার? তা কেমন করে হবে?
আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। বাবার মুখ খাতার দিকে নামানো, কিন্তু চোখ দিয়ে তিনি অমরের কাণ্ড দেখছেন। কীসের আটত্রিশ? আরো চার বেশি হলেই বা তাতে কী হত?
উঠোন মাপা হয়ে গেলে কঞ্চিটা অমর আবার যত্ন করে নিমগাছের তলায় রেখে এল। আমরাও (অর্থাৎ আমি এবং খুড়তুতো ভাইয়েরা) পড়ায় মন দিলাম।
দুপুরে খেতে বসে অমরজীবন ভাত খেল খুব কম। পাড়াগায়ে একটা বাচ্চা ছেলেও তার চেয়ে বেশি খেয়ে থাকে। বাবা খেতে খেতে একবার বললেন—আর ভাত নেবে না? মাছের ল্যাজা দেবে একটা?
-নাঃ, বেশি খেলে স্বপ্ন দেখা যায় না। খালি পেটমোটা হয়—
খাওয়া হয়ে গেলে গুরুজনেরা বিশ্রাম করতে গেলেন। অমর উঠোনে নেমে মনোযোগ দিয়ে নিমপাতা কুড়োতে লাগল। তার কাজ করার ভঙ্গিও খুব সুন্দর। একটি একটি করে হলুদ ঝরা পাতা তুলে ফুঁ দিয়ে ধুলো ঝেড়ে সে হাতের মুঠোয় গুছিয়ে রাখছে। অনেক পাতা জড়ো হয়ে গেলে সে বারান্দায় উঠে এসে সেগুলোকে আলপনার মত করে সাজাতে লাগল। আমরা ছেলেপুলেরা তার কাছে দাঁড়িয়ে তার কাজ দেখছি। একটু একটু করে বারান্দার ওপর নিমপাতা দিয়ে তৈরি সুন্দর একটা আলপনা ফুটে উঠল। সে মাথা একদিকে কাত করে নিজের শিল্পকর্ম দেখতে লাগল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম—এটা কী হল? সে আমার দিকে তাকাল, বলল—বল তো এটা কী হল?
-এটা তো আলপনা। কিন্তু এ দিয়ে কী হয়? সরাসরি সে কথার উত্তর না দিয়ে অমর বলল—আচ্ছা, এটা দেখে তোমার মনে কী ভাব জাগছে আমাকে বল
বললাম—ভাল লাগছে। দেখতে সুন্দর বলে আনন্দ হচ্ছে।
-বাঃ, তাহলে তো তুমি আসল জিনিসটাই বুঝে গিয়েছ। এটা দিয়ে কিছু হয় না। ভাল লাগে তাই বানালাম।
আমার খুব পছন্দ হয়ে গেল লোকটিকে। তার কথার অর্থ সবটা বুঝতে না পারলেও যেহেতু আমাদের পরিবারে কিছু কিছু জ্ঞান এবং সংস্কৃতির চর্চা ছিল, সেহেতু তার বক্তব্যের সৌন্দর্য এবং গভীরতা আমাকে স্পর্শ করল।
মাঝে মাঝে বাতাসে দু-একটা পাতা এদিক-ওদিকে সরে গেলে সে হালকা আঙুলের ছোঁয়ায় সেগুলোকে আবার ঠিক করে সাজিয়ে দিচ্ছিল।
রাত্তিরে সে কিছু খেল না। বাড়ির ভেতরে মা অবাক হয়ে বললেন—ওমা! সে
আবার কী কথা! অতিথি মানুষ না খেয়ে থাকবে কী রকম?
বাবাও তাকে বললেন-বাপু, পাগলামি করতে হয় তার জন্য অন্য কত জায়গা ছিল, খামোক আমার বাড়িতে এসে বিব্রত করা কেন?
অমরজীবন রাগও করে না, কিছুই না। কেবল মৃদু হাসে আর ঠাণ্ডা গলায় বলেও আমার অভ্যেস আছে। স্বপ্ন দেখার দিন রাত্তিরে মুখ এঁটো করতে নেই।
আমাদের বাড়িতে অতিথিকে যত্ন করা হত আপনলোকের মত। এমনিতেই সেই যুগে মানুষকে সম্মান করা হত, অতিথিকে মনে করা হত নারায়ণ। বাংলায় অন্নের জন্য হাহাকার ছিল না। সবার হাতে নগদ পয়সা না থাকলেও বাড়িতে ধান ছিল। কারো বাড়িতে আশ্রয় চেয়ে কেউ পায়নি এমন শোনা যেত না। সেই স্বাভাবিক সৌজন্যবশত বাবা অমরজীবনকে বৈঠকখানার ভেতরে মশারি টাঙিয়ে বিছানা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সে শুলো উঠোনের পাশে বারান্দায়।
আমি রাত্তিরে শুতাম মায়ের কাছে। ভেতরবাড়ির সেই শোবার ঘরের জানালা দিয়ে নাটমন্দিরের ওপাশে বারান্দার দিকটা কিছুটা দেখা যায়। অনেক রাত্তিরে ঘুম ভেঙে একবার তাকিয়ে দেখি নাটমন্দিরের ওধারটা যেন খুব হালকা নীল একটা আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে রয়েছে। আমার চোখে তখন গভীর ঘুম লেগে আছে। খাটের ওদিকে ঘুমন্ত মায়ের গভীর নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। ঝিমঝিম করছে দুপুর রাত। সেই আবছা চেতনার মধ্যেও অবাক হলাম কীসের আলো ওখানে? ওদিকে তত বারান্দায় সেই অতিথি লোকটা শুয়ে আছে। এইসব ভাবতে ভাবতে কখন আবায় ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা।
সকালবেলা নাটমন্দিরে আসর বসল স্বল্পকাহিনী শোনার। মোটা মোটা থামের আড়ালে মা-কাকিমারাও এসে দাঁড়িয়েছেন। পুরুষেরা বসেছেন ঠাকুরদালানের মেঝেতে। বাবা গম্ভীর গলায় বললেন—স্বপ্ন দেখেছ তাহলে কাল রাত্তিরে?
অমর বলল–আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি জানতাম দেখতে পাব।
কী দেখলে?
অমর বলতে শুরু করল। তার বাচনভঙ্গিও পরিশীলিত এবং মার্জিত। আমরা অবাক হয়ে তার কথা শুনে যেতে লাগলাম।