০১. ঈশ্বরের ওঙ্কারাদিনামের ব্যাখ্যা

শ্বরের ওঙ্কারাদিনামের ব্যাখ্যা

ওঁম্‌
অথ সত্যার্থ প্রকাশঃ
পূর্বাৰ্দ্ধ
প্রথম সমুল্লাসঃ।

ওঁম শন্নো মিত্রঃ শং বরুণঃ শন্নো ভবত্বয়মা। শন্ন ইন্দ্রো বৃহস্পতিঃ শন্নো বিষ্ণুরুরুক্ৰমঃ ॥ নমো ব্ৰহ্মণে নমস্তে বায়ো ত্বমেব প্রত্যক্ষং ব্রহ্মাসি। ত্বমেব প্রত্যক্ষং ব্রহ্ম বদিষ্যামি ঋতং বদিষ্যামি সত্যং বদিষ্যামি। তন্মামবতু তদ্বক্তারমবতু। অবতু মামবতু বক্তার। ওম শান্তিশ শান্তি শান্তিঃ। ১ তৈ০ আ০ পা০ ৭। অনু০১।

অর্থ : ‘ওম্‌’ এই ওঙ্কার শব্দ পরমেশ্বরের সর্বোত্তম নাম। কারণ ইহাতে অ, উ এবং এই তিন অক্ষর মিলিয়া এক ‘ওসমুদায় হইয়াছে। এই একটি নাম হইতে পরমেশ্বরের অনেক নাম সূচিত হয়, যথা ‘অ’কার হইতে বিরাট্‌, অগ্নি এবং বিশ্ব প্রভৃতি; ‘উ’ কার হইতে হিরণ্যগর্ভ, বায়ু, তৈজস্ব প্রভৃতি; ‘ম’কার হইতে ঈশ্বর, আদিত্য এবং প্রাজ্ঞ প্রভৃতি নাম সূচিত হয় ও গৃহীত হয়। প্রকরণানুসারে এই সকল যে পরমেশ্বরেরই নাম তাহা বেদাদি সত্য শাস্ত্রে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যাত হইয়াছে।

প্রশ্ন –বিরাট্‌ প্রভৃতি নাম পরমেশ্বর ব্যতীত অন্য পদার্থ বাচক নহে কেন? ব্রহ্মাণ্ড, পৃথিব্যাদি ভূত, ইন্দ্রাদি দেবতা এবং আয়ুর্বেদে শুণ্ঠি প্রভৃতি ওষধিরও এই নাম আছে কিনা?

উত্তর –আছে। কিন্তু পরমেশ্বরেরও আছে।

প্রশ্ন –এই সকল নাম হইতে কেবল দেবতা-অর্থ গ্রহণ করেন কিনা?

উত্তর –আপনার এইরূপ অর্থ গ্রহণ সম্বন্ধে প্রমাণ কী?

প্রশ্ন– দেবতাগণ প্রসিদ্ধ এবং শ্রেষ্ঠ এইজন্য দেবতা অর্থ গ্রহণ করিতেছি।

উত্তর– পরমেশ্বর কি অপ্রসিদ্ধ? পরমেশ্বর অপেক্ষাও উত্তম কেহ আছেন কি?

এইগুলি যে পরমেশ্বরেরও নাম তাহা মানেন না কেন? যখন পরমেশ্বর অপ্রসিদ্ধ নহেন ও তাঁহার সদৃশও কেহ নাই, তখন কেহ তাহার অপেক্ষা উত্তম কীরূপে হইতে পারে? অতএব আপনার এই বাক্য সত্য নহে। কারণ ইহাতে অনেক দোষ দেখা দিবে। যেমন–

উপস্থিতং পরিত্যজ্যানুপস্থিতং য়াচত ইতি বাধিতন্যায়ঃ

কেহ কাহারও জন্য ভোজ্য বস্তু রাখিয়া বলিল, “আপনি ভোজন করুন”, যদি সেই ব্যক্তি তাহা পরিত্যাগ করিয়া অপ্রাপ্ত ভোজ্য বস্তুর জন্য ইতস্ততঃ ভ্রমণ করে, তবে তাহাকে বুদ্ধিমান মনে করা যাইতে পারে না। কারণ সে উপস্থিত অর্থাৎ প্রাপ্ত বস্তু পরিত্যাগ করিয়া অপ্রাপ্ত বস্তু পাইবার জন্য পরিশ্রম করিতেছে। অতএব যেমন সেই ব্যক্তি বুদ্ধিমান নহে, আপনার কথাও সেইরূপ হইল। কারণ আপনি বিরাট্‌ প্রভৃতি নাম সমূহের পরমেশ্বর ও ব্রহ্মাণ্ড প্রভৃতি প্রসিদ্ধ ও প্রমাণ-সিদ্ধ অর্থ পরিত্যাগ করিয়া অসম্ভব ও অনুপস্থিত দেবাদি অর্থ গ্রহণে পরিশ্রম করিতেছেন। এ বিষয়ে কোন প্রমাণ বা হেতু নেই। যদি আপনি এইরূপ বলেন যে, “যে স্থলে যাহার যে প্রকরণ, সে স্থলে তাহাই গ্রহণ করা বিধেয়।” যেমন কেহ কাহাকেও বলিল, “হে ভৃত্য! ত্বং সৈন্ধবমানয়” ‘হে ভৃত্য! তুমি সৈন্ধব আনয়ন কর’ তখন অবশ্যই তাহাকে সময়, অর্থাৎ প্রকরণ বিচার করিতে হইবে। কারণ সৈন্ধব দুইটি পদার্থের নাম– একটি অশ্ব, অন্যটি লবণ। যদি প্রভুর গমন কাল হয় তাহা হইলে অশ্ব, আর যদি ভোজন কাল হয়, লবণ আনা উচিত। কিন্তু যদি সে গমনকালে লবণ এবং ভোজন। কালে অশ্ব আনয়ন করে, তবে তাহার প্রভু তাহার প্রতি জুব্ধ হইয়া বলিবেন, তুমি নির্বোধ, গমনকালে লবণ এবং ভোজনকালে অশ্ব আনিবার প্রয়োজন কী? তুমি প্রকরণবিৎ নহ। তোমার। প্রকরণ-জ্ঞান থাকিলে, যে সময় যাহা উচিত তাহাই আনিতে! তোমার যে প্রকরণ বিচার করা। আবশ্যক ছিল, তুমি তাহা কর নাই, অতএব তুমি মূর্খ, আমার নিকট হইতে চলিয়া যাও। এতদ্বারা প্রমাণিত হইল যে, যে স্থলে যে অর্থ গ্রহণীয়, সে স্থলে তাহাই গ্রহণ করা আবশ্যক। সুতরাং আমাদের এবং আপনাদের সকলেরই এইরূপ স্বীকার তথা কার্য করা উচিত।

অথ মন্ত্ৰার্থঃ

ওম্ খং ব্রহ্ম।১। যজুঃ ৪০। ১৭।
দেখুন বেদে এই রূপ প্রকরণসমূহে ‘ওম্ আদি পরমেশ্বরের নাম পাওয়া যায়।
ওমিত্যেদক্ষরমুৰ্গীথমুপাসীত। ২। ছান্দোগ্য উপনিষৎ ১।১।১।
ওমিত্যেদক্ষরমিদ সর্বং তস্যোপব্যাখ্যান। ৩। মাণ্ডুক্য।১।
সর্বে বেদা য়ৎপদমামন্তি তপাংসি সর্বাণি চ য়দ্বদন্তি।
য়দিচ্ছন্তো ব্রহ্মচর্য্যং চরন্তি তত্তেপদং সংগ্রহে ব্ৰবীমোমিত্যেৎ ॥৪ ॥ কঠোপনিষদ্ ২।১৫।
প্রশাসিতারং সর্বের্ষামণীয়াংসমপোরপি।
রুক্সাভং স্বপ্নধগম্যং বিদ্যাত্তং পুরুষং পরম্ ॥ ৫ ॥
এতমগ্নিং বদত্যেকে মনুমন্যে প্রজাপতিম্‌।
ইন্দ্রমেকে পরে প্রাণমপরে ব্রহ্ম শাশ্বতম্ ॥ ৬ ৷ মনু০ ১২১২৩
স ব্রহ্মা স বিষ্ণুঃ স রুদ্র স শিবসোঅক্ষরস্ স পরমঃ স্বরাট্‌।
সইন্দ্র স কালাগ্নিস্ স চন্দ্ৰমাঃ ॥৭॥ (কৈবল্য উপনিষৎ,)
ইন্দ্রং মিত্রং বরুণমগ্নিমাহুরথো দিব্যঃ স সুপর্ণো গরুত্মান্‌।
একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্ত্যগ্নিং য়মং মাতরিশ্বানমাহুঃ ॥ ৮ ঋ০১।১৬৪। ৪৬।
ভূরসি ভূমিরস্যদিতিরসি বিশ্বধায়াবিশ্বস্য ভুবনস্য ধর্ত্রী।
পৃথিবীং য়চ্ছ পৃথিবীং দৃওঁহ পৃথিবীং মা হিসী ॥৯॥ যজুঃ ১৩১৮
ইন্দ্রো মা রোদসী পথচ্ছব ইন্দ্রঃ সূৰ্যমরোচয়ৎ।
ইন্দ্ৰেহবিশ্বা ভূবনানি য়েমির ইন্দ্রে স্বানাস ইন্দবঃ ॥ ১০ ॥ সামবেদ উত্তরার্চিক ॥৭। ত্রিক৷৮২
প্রাণায় নমো য়স্য সর্বমিদং বশে।
গো ভূতঃ সর্বস্যেশ্বরোয়স্মিনৎ সর্বং প্রতিষ্ঠিত ॥১১ ॥ অথর্ববেদ কাণ্ড১১ প্রপাঠক ॥২৪। অ০২। মন্ত্র।

অর্থ– এ স্থলে উক্ত প্রমাণ সমূহ উদ্ধৃত করিবার তাৎপর্য এই যে, ঈদৃশ প্রমাণ সমূহে ওঙ্কারাদি নামে যে পরমাত্মা অর্থ গৃহীত হয়, ইহাই লিখিত হইয়াছে। যেমন লোক সমাজে দরিদ্র প্রভৃতির ধনপতি আদি নাম থাকে, পরমাত্মার কিন্তু সেইরূপ কোন নামই নিরর্থক নহে। এতদ্বারা সিদ্ধ হইল যে, নাম কোন স্থলে গৌণিক (গুণ-গত), কোন স্থলে কার্মিক (কর্ম-গত) এবং কোন স্থলে স্বাভাবিক অর্থ বাচক।

(ওম) আদি নাম সার্থক। যেমন-ওম্ খস্ ‘অবতীত্যোম’, আকাশমিব ব্যাপকত্বাৎ খ্ম, সৰ্ব্বেভ্যো বৃহত্বাদ ব্রহ্ম।’ রক্ষা করেন বলিয়া ‘ওম’ আকাশের ন্যায় ব্যাপক বলিয়া ‘খম’ এবং সর্বপেক্ষা বৃহৎ বলিয়া ‘ব্রহ্ম’ ঈশ্বরের নাম ॥১॥

(ওমিত্যে০) ওম্যাঁহার নাম এবং যিনি কখনও বিনষ্ট হন না, তাঁহারই উপাসনা করা উচিত, অন্যের নহে ॥ ২॥

(ওমিত্যেত০), বেদাদি শাস্ত্র সমূহে ‘ও’কে পরমেশ্বরের প্রধান এবং নিজ নাম বলা হইয়াছে অন্য সমস্ত নাম গৌণিক ॥৩ ॥

(সর্বে বেদা০) সকল বেদ ও সকল ধর্মানুষ্ঠান রূপ তপশ্চৰ্য্যা যাহার বিষয় বর্ণনা করে ও যাহাকে মান্য করে এবং যাহার প্রাপ্তি কামনা করিয়া ব্রহ্মচর্য্য আশ্রমকে অবলম্বন করা হয়, তাহার নাম ‘ওম্ ॥ ৪ ॥

(প্রশাসিতা০) যিনি সকলের শিক্ষাদাতা, সূক্ষ্ম অপেক্ষাও সূক্ষ্ম, স্বপ্রকাশ স্বরূপ এবং যিনি সমাধিস্থ বুদ্ধি দ্বারা জানিবার যোগ্য, তাঁহাকে পরম পুরুষ বলিয়া জানিবে ॥৫ ॥

স্বপ্রকাশ বলিয়া ‘অগ্নি’, বিজ্ঞান স্বরূপ বলিয়া ‘মনু’, সকলকে পালন করেন বলিয়া প্রজাপতি, পরমেশ্বর্যবান্ বলিয়া ‘ইন্দ্র’, সকলের জীবন-মূল বলিয়া ‘প্রাণ’ এবং নিরন্তর ব্যাপক বলিয়া পরমেশ্বরের নাম ‘ব্রহ্ম’ ॥ ৬ ॥

(স ব্রহ্মা স বিষ্ণুঃ০) তিনি সমস্ত জগৎ সৃষ্টি করিয়াছেন বলিয়া ‘ব্রহ্মা’, সর্বত্র ব্যাপক বলিয়া ‘বিষ্ণু’, দুষ্টদিগকে দণ্ড দিয়া রোদন করান বলিয়া ‘রুদ্র’, মঙ্গলময় এবং সকলের কল্যাণকারী বলিয়া ‘শিব।

‘য়ঃ সর্বশুতেন ক্ষরতিন বিনশ্যতি তদক্ষর’ (১) য়ঃ স্বয়ং রাজতে স স্বরাট্‌, (২) মিেডগ্নিরিব কালঃ কলয়িতা প্রলয়কর্তা স কালাগ্নিরীশ্বরঃ (৩) অক্ষর’ যিনি সর্বত্র ব্যাপ্ত এবং অবিনাশী স্বরা’ স্বয়ং প্রকাশস্বরূপ এবং কালাগ্নি’ প্রলয়কালে সকলের কাল এবং কালেরও কাল; এই জন্য পরমেশ্বরের নাম কালাগ্নি’ ॥ ৭ ॥

(ইন্দ্রং মিত্রং০) যিনি এক ও অদ্বিতীয় সত্য ব্রহ্মবস্তু, ইন্দ্রাদি সমস্ত নাম তাঁহারই। দ্যুযু শুদ্ধে পদার্থেষু ভবোঃ দিব্যঃ।’শোভনানি পর্ণানি পালনানি পূর্ণানি কৰ্ম্মাণি বা য়স্য স সুপর্ণঃ’ ‘য়ো গুৰ্ব্বাত্মা স গরুত্মান্।’য়ে মারিশ্যা বায়ুরিব বলবান্ স মাতরিশ্বা’। দিব্য’ যিনি প্রকৃত্যাদি দিব্য পদার্থসমূহে ব্যাপ্ত সুপর্ণ’ যাহার উত্তম পালন এবং পূর্ণ কর্ম, ‘গরুত্মা যাঁহার আত্মা অর্থাৎ স্বরূপ মহান, মাতরিশ্বা’ যিনি বায়ুর ন্যায় অত্যন্ত বলবান্। এইজন্য পরমাত্মার দিব্য’, সুপর্ণ’, ‘গরুত্মান্ এবং মাতরিশ্বা’ ইত্যাদি নাম। অবশিষ্ট নামগুলির অর্থ পরে লিখিব ॥ ৮ ॥

(ভূমিরসি) ভবন্তি ভূতানি সামস্যাং সা ভূমিঃ, যাহাতে সকল ভূত অর্থাৎ প্রাণী থাকে, এইজন্য পরমেশ্বরের এই নাম ‘ভূমি’। অবশিষ্ট নামগুলির অর্থ পরে লিখিত হইবে ॥ ৯ ॥

(ইন্দ্রোমহ্না) এই মন্ত্রে ইন্দ্র পরমেশ্বরেই নাম। এইজন্য এই প্রমাণ উদ্ধৃত হইল ॥ ১০ ॥

(প্রাণায়০) যেমন সমস্ত শরীর এবং ইন্দ্রিয় প্রাণের অধীন সেইরূপ সমগ্র জগৎ পরমেশ্বরের অধীন ॥১১ ॥

এই সমস্ত প্রমাণের অর্থ যথার্থরূপে জ্ঞাত হইলে এই সমস্ত নামের দ্বারা পরমেশ্বর অর্থ গৃহীত হয় কারণ ‘ওম্ এবং অগ্নি আদি নামগুলির মুখ্য অর্থ দ্বারা পরমেশ্বর গৃহীত হয়। যেরূপ ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ব্রাহ্মণ, এবং সূত্রাদি মুনিদের ব্যাখ্যা হইতে পরমেশ্বরের অর্থ গৃহীত দেখা যায়, সেইরূপ সকলেরই গ্রহণ করা কর্তব্য। কিন্তু ‘ওম’ কেবলমাত্র পরমেশ্বরেরই নাম। কিন্তু ‘অগ্নি’ আদি নামে পরমেশ্বরের অর্থ গ্রহণ সম্বন্ধে প্রকরণ এবং বিশেষণই নিয়ামক। ইহা দ্বারা সিদ্ধ হইল যে, যে সকল স্থানে স্তুতি, প্রার্থনা ও উপাসনা প্রভৃতি প্রকরণ হইবে এবং সর্বজ্ঞ, ব্যাপক, শুদ্ধ, সনাতন ও সৃষ্টিকর্তা প্রভৃতি বিশেষণ থাকিবে, সে সকল স্থলে এই নামগুলির দ্বারা পরমেশ্বরের অর্থ গৃহীত হইবে, আর যে সকল স্থলে এইরূপ প্রকরণ আছে, যথাঃ

ততো বিরাডজায়ত বিরাজো অধিপূরুষঃ ॥১॥ যজুঃ ৩১। ৫ ॥ শ্ৰোত্রাঘায়ুশ্চ প্রাণশ্চ মুখাগ্নিরজায়ত ॥ ২ যজুঃ ৩১।১২ তেন দেবা অয়জন্ত ॥ ৩॥ যজুঃ ৩১। ৯ ॥ পশ্চাদ্ভুমিমথো পুরঃ ॥ ৪ যজুঃ ৩১।৫ ॥ তস্মাদ্বা এতস্মাদাত্মন আকাশ ও সদ্ভুতঃ। আকাশদ্বায়ুঃ। বায়োরগ্নিঃ। অগ্নেরাপঃ । অদ্ভ্যঃ পৃথিবী। পৃথিব্যা ঔষধয়ঃ। ঔষধীভ্যো নম্। অন্নদ্রেতঃ। রেতসঃ পুরুষঃ। স বা এষ পুরুষোত রসময়ঃ। তৈত্তিরীয় উপনিষদ। ব্রহ্ম। বল্লী ০ অনু০১।

ঈদৃশ প্রমাণ সমূহে বিরাট্‌, পুরুষ, দেব, আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল, এবং ভূমি প্রভৃতি শব্দ লৌকিক পদার্থের নাম। কারণ, যে যে স্থলে সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়, অল্পজ্ঞ, জড়, এবং দৃশ্য প্রভৃতি বিশেষাণাত্মক শব্দও লিখিত থাকে, সেই সেই স্থলে পরমেশ্বরের অর্থ গৃহীত হয় না। তিনি সৃষ্টি আদি ব্যাপার হইতে পৃথক। কিন্তু উপযুক্ত মন্ত্র সমূহে উৎপত্তি আদি ব্যাপার আছে বলিয়া এস্থলে বিরাট্‌ প্রভৃতি নামের দ্বারা পরমেশ্বরের অর্থ গৃহীত হয় না, কিন্তু জাগতিক পদার্থ হইয়া। থাকে। কিন্ত যে সকল স্থলে সর্বজ্ঞ প্রভৃতি বিশেষণ থাকে, সে সকল স্থলে পরমাত্মা এবং যে সকল স্থলে ইচ্ছা, দ্বেষ, প্রযত্ন, সুখ, দুঃখ এবং অল্পজ্ঞ প্রভৃতি বিশেষণ থাকে সেই সকল স্থলে। জীব গৃহীত হইয়া থাকে। এইরূপ সর্বত্র বুঝিতে হইবে। যেহেতু পরমেশ্বরের জন্ম-মৃত্যু কখনও। হয় না সেইহেতু বিরাট্‌ প্রভৃতি নাম এবং জন্ম প্রভৃতি গুণ জগতের জড় ও জীবাদি সম্বন্ধে প্রযোজ্য কিন্তু পরমেশ্বর সম্বন্ধে নহে।

এখন কীরূপে বিরাট্‌ প্রভৃতি নাম হইতে পরমেশ্বর অর্থ গৃহীত হইয়া থাকে, তাহা নিম্নলিখিত প্রমাণ সমূহে জানা যাইবে–

অথ ওঙ্কারার্থ :

১। (বি) উপসর্গ পূর্বক ‘রাজৃদীপ্তৌ’ এই ধাতুর সহিত ‘ক্বিপ’ প্রত্যয় যোগে ‘বিরাট্‌’ শব্দ সিদ্ধ হয়। য়ো বিবিধং নাম চরা চরং জগদ্ৰাজয়তি প্রকাশয়তি স ‘বিরাট্‌’। যিনি বিবিধ অর্থাৎ বহু প্রকারের জগৎকে প্রকাশিত করেন, এইজন্য ‘বিরাট্‌’ নামের দ্বারা পরমেশ্বরের অর্থ গৃহীত হইয়া থাকে।

২। (অঞ্চ গতি পূজনয়োঃ ) (অগ, অগি, ইন্ গত্যৰ্থক) ধাতু, এই সব হইতে ‘অগ্নি’ শব্দ সিদ্ধ হয়। ’গতেস্ত্রয়োর্থাঃ’–জ্ঞানং গমনং প্রাপ্তিশ্চেতি। পূজনং নাম সকারঃ।’ য়োঞ্চতিঅচ্যতে গত্যঙ্গত্যেতি, বা সোয়মাগ্নিঃ।’ জ্ঞান স্বরূপ, সর্বজ্ঞ, জানিবার, পাইবার এবং পূজা করিবার যোগ্য এইজন্য সেই পরমেশ্বরের নাম অগ্নি।

৩। (বিশ প্রবেশনে) এই ধাতু হইতে ‘বিশ্ব’ শব্দ সিদ্ধ হয়। ‘বিশন্তি প্রবিষ্টানি সর্বাণাকাশাদীনি ভূতানি যস্মিন, য়ো বাSS কাশা দিষু সর্বেষু ভূতেষু প্রবিষ্টঃ সবিশ্ব ঈশ্বরঃ, যাঁহাতে আকাশাদি সকল ভূত প্রবেশ করিতেছে, অথবা যিনি এই সকলের মধ্যে ব্যাপ্ত হইয়া প্রবিষ্ট হইয়া আছেন, এই কারণে তাহার নাম ‘বিশ্ব’। কেবলমাত্র ‘অ’ কার হইতে এই সকল নাম গৃহীত হইয়া থাকে।

৪। জ্যোতির্বৈহিরণ্যম, তেজো বৈ হিরণ্য মিভৈতরেয়শতপথ ব্রাহ্মণে’ গো হিরণ্যানাং সূয়াদীনাং তেজসাং গর্ভ উৎপত্তিনিমিত্তমধিকরণং’স ‘হিরণ্যগর্ভঃ যাঁহাতে সূৰ্য্যাদি তেজোময় লোকসমূহ উৎপন্ন হইয়া যাঁহার আধারে অবস্থিত থাকে, অথবা যিনি সূৰ্য্যাদি তেজঃস্বরূপ পদার্থ সমূহের গর্ভ অর্থাৎ উৎপত্তি ও নিবাস স্থান, সেই কারণ পরমেশ্বরের নাম হিরণ্যগর্ভ। এ বিষয়ে যজুর্বেদ মন্ত্রে প্রমাণ আছে–

হিরণ্যগর্ভঃ সমবর্তগ্রে ভূতস্য জাতঃ পতিরেক আসীৎ। সদাধারপৃথিবীংদ্যামুতেমাংকস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম ॥(যজুঃ১৩৪) এই সব স্থলে ‘হিরণ্যগর্ভ’ হইতে পরমেশ্বর অর্থই গৃহীত হইয়া থাকে।

৫। (বা গতিগন্ধনয়ো): এই ধাতু হইতে ‘বায়ু’ শব্দ সিদ্ধ হয়। (গন্ধনং হিংসণম’)’গো বাতি চরা চরংজগদ্ধরতি বলিনাং বলিষ্ঠঃ স বায়ুঃ। যিনি চরাচর জগতের ধারণ, রক্ষণ ও প্রলয় কর্তা এবং যিনি সকল বলবান্ অপেক্ষাও বলবান্ সেই কারণে পরমেশ্বরের নাম বায়ুঃ ॥

৬। (তিজ নিশানে) এই ধাতু হইতে ‘তেজ’ এবং ইহার সহিত তদ্ধিত প্রত্যয় যোগে ‘তৈজস’ শব্দ সিদ্ধ হয়। যিনি স্বয়ং স্বপ্রকাশ এবং সূর্যাদি লোক সমূহের প্রকাশক,সেই ঈশ্বরের নাম ‘তৈজস’। কেবলমাত্র ‘উ’ কার হইতে এই সকল এবং অন্যান্য নামার্থ গৃহীত হয়।

৭। (ঈশ ঐশ্বয়ে) এই ধাতু হইতে ঈশ্বর’ শব্দ সিদ্ধ হয়। য় ঈষ্টে সর্বৈশ্বর্যবান্ বৰ্ততে স ঈশ্বরঃ। যাঁহার সত্য, বিচার, শীল, জ্ঞান এবং অনন্ত ঐশ্বর্য আছে, সেই পরমাত্মার নাম ঈশ্বর।

৮-৯। (দো অবখণ্ডনে) এই ধাতু হইতে ‘অদিতি’ এবং উহার সহিত ৩দ্ধি৩ প্রত্যয় যোগে ‘আদিত্য’ শব্দ সিদ্ধ হয়। ‘অবখণ্ডনং নাম বিনাশঃ ‘ন’ বিদ্যতেবিনাশোয়স্য সোয়মদিতিঃ অদিতিরেব আদিত্যঃ’। যাঁহার কখনও বিনাশ হয় না, সেই ঈশ্বর ‘আদিত্য’ সংজ্ঞা যুক্ত।

১০-১১। (জ্ঞা অববোধনে) প্ৰ পূৰ্ব্বক এই ধাতু হইতে ‘প্রজ্ঞ’ এবং ইহার সহিত তদ্ধিত প্রত্যয় যোগে ‘প্রাজ্ঞ’ শব্দ সিদ্ধ হয়। য়ঃ প্রকৃষ্টতয়া চরা চরস্য জগতো ব্যবহারং জানাতি স প্রজ্ঞ, ‘প্রজ্ঞ এব প্রাজ্ঞঃ’। যিনি অভ্রান্ত জ্ঞান যুক্ত এবং যিনি সমস্ত চরাচর জগদ্ব্যাপার যথাযথরূপে জানেন, সেই কারণে ঈশ্বরের নাম প্রাজ্ঞ। এই সকল নামার্থ ‘ম’ কার হইতে গৃহীত হয়। এস্থলে যেরূপে এক এক মাত্রা হইতে তিনটি করিয়া অর্থ ব্যাখাত হইয়াছে, সেইরূপ অপর নামার্থও ওঙ্কার হইতে জানা যায়।

(শণ্ণো মিত্রঃ শং০) এই মন্ত্রে ‘মিত্র’ প্রভৃতি নাম আছে সেগুলিও পরমেশ্বরের। কারণ স্তুতি, প্রার্থনা, উপাসনা শ্রেষ্ঠেরই করা হইয়া থাকে। যাঁহার গুণ-কর্ম স্বভাব এবং সত্য ব্যবহার সর্বাপেক্ষা মহান্ তাহাকেই শ্রেষ্ঠ বলে। শ্রেষ্ঠদিগের মধ্যেও যিনি অত্যন্ত শ্রেষ্ঠ তাহাকেই পরমেশ্বর বলা হয়। তাঁহার তুল্য কেহ হয় নাই এবং হইবেও না। যখন তাহার তুল্য কেহই নাই, তখন তদপেক্ষা মহান্ কীরূপে হইতে পারে? পরমেশ্বরের যেরূপ সত্য, ন্যায়, দয়া, সর্ব-সামর্থ্য এবং সর্বজ্ঞত্ব প্রভৃতি অনন্ত গুণ আছে তদ্রপ অন্য কোন জড় পদার্থ অথবা। জীবের নাই।

যে পদার্থ সত্য, তাহার গুণ-কর্ম-স্বভাবও সত্য। এজন্য মনুষ্যগণ পরমেশ্বরেরই স্তুতি, প্রার্থনা এবং উপাসনা করিবে, তদ্ভিন্ন অন্য কাহারও কখনও করিবে না। কারণ ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহাদেব নামক পূর্ব পুরুষ মহামনা, বিদ্বগণ, দৈত্য-দানব প্রভৃতি নিকৃষ্ট মনুষ্যগণ এবং অন্য সাধারণ মনুষ্যগণও পরমেশ্বরেই বিশ্বাস স্থাপন করিয়া তাহারই স্তুতি, প্রার্থনা এবং উপাসনা। করিতেন, তদ্ভিন্ন অপর কাহারও করিতেন না। আমাদের সকলেরও সেইরূপ করা উচিত। এ সম্বন্ধে বিশেষ আলোচনা মুক্তি ও উপাসনা বিষয়ে করা যাইবে।

প্রশ্ন : –‘মিত্র’ প্রভৃতি নাম হইতে সখা এবং ইন্দ্র প্রভৃতি দেবগণের প্রসিদ্ধ ব্যবহার দৃষ্ট হয়। বলিয়া ঐ সকল অর্থই গ্রহণ করা উচিত।

উত্তর –এস্থলে ঐ সকল অর্থ গ্রহণ করা সঙ্গত নহে। কারণ যিনি কাহারও মিত্র, তাঁহাকেই অন্য কাহারও শত্রু এবং কাহার প্রতি উদাসীন হইতে দেখা যায়। এইজন্য মুখ্য অর্থে সখাদি ভাব গৃহীত হইতে পারে। কিন্তু পরমেশ্বর যেহেতু নিশ্চিতরূপে জগতের মিত্র, কাহারও শত্রু এবং কাহারও প্রতি উদাসীন নহেন, পরমেশ্বর ব্যতীত কোনও জীব তদ্রপ কখনও হইতে পারে না। সুতরাং এ স্থলে পরমাত্মা অর্থই গ্রহণীয়। অবশ্য গৌণ অর্থে মিত্রাদি শব্দ হইতে সুহৃৎ প্রভৃতি মানব অর্থেও গৃহীত হইয়া থাকে।

১২। (ঞি মিদা স্নেহনে) এই ধাতুর সহিত ঔণাদিক ক্ত’ প্রত্যয় যোগে ‘মিত্র’ শব্দ সিদ্ধ হয়। ‘মেদ্যতি স্নিহতি স্নিহ্যতে বা স মিত্রঃ যিনি সকলকে স্নেহ করেন এবং যিনি সকলের প্রীতির যোগ্য সেই পরমেশ্বরের নাম মিত্র।

১৩। (বৃঞ বরণে, বর ঈপ্সায়াম) এই সকল ধাতুর সহিত উণাদি ‘উন’ প্রত্যয় যোগে ‘বরুণ’ শব্দ সিদ্ধ হয়। য়ঃ সর্বান্ শিষ্টান্ মুমুক্ষুন্ধর্মাত্মনো বৃণোত্যথবা য়ঃশিষ্টেমুমুক্ষ ভিধর্মাত্মভিব্রিয়তে বয়ঁতে বা স বরুণঃ পরমেশ্বরঃ যিনি আপ্তযোগী বিদ্বান, মুক্তিকামী, মুক্ত এবং ধর্মাত্মাদিগেরও স্বীকাৰ্য্য অথবা যিনি শিষ্ট, মুমুক্ষু এবং ধর্মাত্মাদিগের দ্বারা স্বীকৃত হন, সেই ঈশ্বরের নাম বরুণ। অথবা বরুণো নাম বরঃ শ্রেষ্ঠঃ যেহেতু পরমেশ্বর সর্বশ্রেষ্ঠ, সেইহেতু তাহার নাম বরুণ।

১৪। (ঋ গতিপ্ৰাপণয়োঃ) এই ধাতুর সহিত য়ৎ প্রত্যয় যোগে ‘অয় শব্দ সিদ্ধ হয় এবং ‘অয়’ পূর্বক (মা মানে) এই ধাতুর ‘কনিন্‌’ প্রত্যয় যোগে ‘অৰ্য্যমা’ শব্দ সিদ্ধ হয়। ‘য়ো র্য়্যান্ স্বামিনো ন্যায়াধীশান্ মিমীতে মানা করোতি সোর্য়মা’ যিনি সত্য ও ন্যায়কারী ব্যক্তিদের মান্য এবং পাপ পুণ্যকারীদিগের পাপ পুণ্যের ফলের যথোচিত নিয়ামক, সেইহেতু সেই পরমেশ্বরের নাম ‘অর্য়মা ॥

১৫। (ইদি পরমেশ্বর্য়ে) এই ধাতুর উত্তর ‘র’ প্রত্যয় যোগে ‘ইন্দ্র’ শব্দ সিদ্ধ হয়। ‘য় ইন্দতি পরমৈশ্বর্য়বান ভবতি স ইন্দ্রঃ পরমেশ্বরঃ’ যিনি নিখিল ঐশ্বৰ্য্যশালী, এজন্য সেই পরামাত্মার নাম ইন্দ্র।

১৬। ‘বৃহৎ’ শব্দ পূর্বক (পা রক্ষণে) এই ধাতুর ‘ডতি’ প্রত্যয়, ‘বৃহৎ’ শব্দের ত কারের লোপ এবং সুগম হওয়াতে ‘বৃহস্পতি’ শব্দ সিদ্ধ হয়। ‘য়ো বৃহতামাকাশাদীনাং পতিঃ স্বামী পালয়িতা স বৃহস্পতিঃ যিনি মহাদিগের অপেক্ষাও মহান্ এবং যিনি আকাশদি ব্রহ্মাসমূহের স্বামী এই কারণে সেই পরমেশ্বরের নাম ‘বৃহস্পতি’।

১৭। (বিষল ব্যাপ্তৌ) এই ধাতুর সহিত ‘নু’ প্রত্যয় যোগে ‘বিষ্ণু’ শব্দ সিদ্ধ হয়, ‘বেবেষ্টি ব্যাপ্নোতি চরা চরং জগৎ স বিষ্ণু পরমাত্মা’ চর এবং অচর রূপ জগতে ব্যাপক বলিয়া পরমাত্মার নাম ‘বিষ্ণু’।

১৮। ‘উরুর্মহান ক্রমঃ পরাক্রমোয়স্য স উরুক্ৰমঃ’ অনন্ত পরাক্রমশালী বলিয়া পরমেশ্বরের নাম ‘উরুক্রম’।

যে পরমাত্মা (উরুক্রমঃ) মহাপরাক্রমশালী, (মিত্রঃ) সকলের সুহৃদ অর্থাৎ অবিরোধী তিনি (শ) সুখকারক, তিনি (বরুণঃ) সর্বোত্তম, তিনি (শ) সুখস্বরূপ,তিনি (অয়মা) ন্যায়াধীশ, তিনি (শ) সুখপ্রচারক, তিনি (ইন্দ্রঃ) সর্বৈশ্বৰ্য্যশালী, তিনি (শ) সর্বৈশ্বৰ্য্যদায়ক, তিনি (বৃহস্পতিঃ) সকলের অধিষ্ঠাতা, বিদ্যাপ্রদ এবং (বিষ্ণু) যিনি সকলের মধ্যে ব্যাপক পরমেশ্বর তিনি (রঃ) আমাদের প্রতি কল্যাণকারী (ভবতু) হউন।

১৯। (বায়ো তে ব্রহ্মণে নমো স্ত) বৃহ বৃহি বৃদ্ধৌ এই সকল ধাতু হইতে ব্রহ্ম’ শব্দ সিদ্ধ হয়। যিনি সর্বোপরি বিরাজমান, সর্বাপেক্ষা বৃহৎ অনন্ত বলশালী পরমাত্মা, সেই ব্রহ্মকে আমরা নমস্কার করি। হে পরমেশ্বর। (ত্বমের প্রত্যক্ষং ব্রহ্মাসি) আপনিই অন্তর্যামিরূপে প্রত্যক্ষ ব্রহ্ম (ত্বামেব প্রত্যক্ষং ব্রহ্ম বদিষ্যামি) আমি আপনাকেই প্রত্যক্ষ ব্রহ্ম বলিব, কারণ আপনি সর্বত্র ব্যপ্ত থাকিয়া সর্বদা সকলের নিকট প্রাপ্ত হইয়া আছেন। (ঋতং বদিষ্যামি) আপনার যে বেদস্থ যথার্থ আজ্ঞা, আমি সকল কে তাহারই উপদেশ দিব এবং স্বয়ং তদনুসারে আচরণও করিব।(সত্যং বদিষ্যামি) সত্য বলিব, সত্য মানিব এবং সত্যই পালন করিব। (তন্মামবতু) অতএব আপনি আমাকে রক্ষা করেন। (তদ্বক্তারমবতু) সেই আপনি আপ্ত, সত্যবক্তা আমাকে রক্ষা করুন, আমার বুদ্ধি যেন আপনার আজ্ঞাতে আজ্ঞাপালনে স্থির থাকে, কখনও বিরুদ্ধগামী না হয়। কারণ আপনার যাহা আজ্ঞা তাহাই ‘ধর্ম যাহা ৩দ্বিরুদ্ধ তাহাই অধর্ম। (অবতুমামবতু বারম), এই দ্বিতীয়বার পাঠ অধিকাৰ্থ সূচক। যথা কশ্চিৎ কঞ্চিৎ প্রতি বদতি ত্বং গ্রামং গচ্ছ গচ্ছ’ এস্থলে ক্রিয়ার দুইবার উচ্চারণ দ্বারা–তুমি শীঘ্রই গ্রামে যাও’ এইরূপ প্রমাণিত হইতেছে। সেইরূপ এস্থলেও আপনি অবশ্যই আমাকে রক্ষা করুন, অর্থাৎ আমি যেন সর্বদা ধর্মে দৃঢ় থাকি এবং অধর্মকে ঘৃণা করি, আমার প্রতি এইরূপ কৃপা করুন। আমি ইহাকে আপনার মহৎ উপকার বলিয়া স্বীকার করিব। (ওম্ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ) ইহাতে তিনবার শান্তি পাঠের প্রয়োজন এই যে, সংসার ত্রিবিধ তাপ অর্থাৎ দুঃখ আছে; প্রথম ‘আধ্যাত্মিক’, আত্মায় ও শরীরে অবিদ্যা, রাগ, দ্বেষ, মূর্খতা এবং জ্বর পীড়াদি হয়, দ্বিতীয়–আধিভৌতিক’, যাহাশত্রু, ব্যাঘ্র এবং সর্পাদিহইতে প্রাপ্ত হওয়া যায়; তৃতীয়–আধিদৈবিক’, অর্থাৎ যাহা অতি বৃষ্টি, অতিশীত, অতিউষ্ণতা এবং মন ও ইন্দ্রিয় সমূহের অশান্তি হইতে উৎপন্ন হয়; আপনি আমাদিগকে এই বিবিধ ক্লেশ হইতে দূরে রাখিয়া সর্বদা কল্যাণ কর্মে প্রবৃত্ত করুন। কেননা, আপনিই কল্যাণস্বরূপ সমগ্র জগতের কল্যাণকারী এবং ধার্মিক ও মুমুক্ষুদের কল্যাণদাতা। অতএব আপনি স্বয়ং নিজ কৃপায় সকল জীবের হৃদয়ে প্রকাশিত হউন, যেন সকল জীব ধর্মাচরণ। করে, অধর্ম পরিত্যাগ করিয়া পরমানন্দ প্রাপ্ত হয় ও দুঃখ হইতে দূরে থাকে।

২০। (সূৰ্য্য আত্মা জগতস্তষশ্চ) যর্জুবেদের এই বচন অনুসারে জগৎ অর্থাৎ চেতন প্রাণীর ও জঙ্গম বা যাহারা চলাফেরা করে এবং “তস্থুষঃ’ অপ্রাণী অর্থাৎ স্থাবর জড়, যথা পৃথিবাদি সকলের আত্মা এবং স্বপ্রকাশরূপে সকলকে প্রকাশিত করেন বলিয়া পরমেশ্বরের নাম সূর্য।

২১-২২। (অত সাতত্যগমনে) এই ধাতুর দ্বারা ‘আত্মা’ শব্দ সিদ্ধ হয়। যোত ততি ব্যাগ্নেতি স আত্মা’ যিনি সব জীবাদি জগতের মধ্যে নিরন্তর ব্যাপক রহিয়াছেন। পরশ্চাসাবাত্মা চ য় আত্মভ্যো জীবেভ্যঃ সূক্ষেভ্যঃ পরো তিসূক্ষ্মঃ স পরমাত্মা’ যিনি সকল জীব অপেক্ষা উৎকৃষ্ট এবং জীব প্রকৃতি ও আকাশ অপেক্ষাও অতি সূক্ষ্ম এবং সকল জীবের অন্তর্যামী আত্মা, এই কারণে ঈশ্বরের নাম ‘পরমাত্মা’।

২৩। যিনি সামর্থ্যবান, তাহার নাম ঈশ্বর। য় ঈশ্বরেষু সমথেষু পরমঃ শ্রেষ্ঠঃ স পরমেশ্বরঃ ‘যিনি ঈশ্বরদের অর্থাৎ সমর্থবানদের মধ্যে সমর্থ, যাহার তুল্য কেহই নহে, তাহার নাম পরমেশ্বর।

২৪। (সূঞ অভিষবে, যূ প্রাণিগর্ভ বিমোচনে) এই সকল ধাতু হইতে ‘সবিতা’ শব্দ সিদ্ধ। হয়। অভিযবঃ প্রাণিগর্ভবিমোচনং চোৎপাদন। য়শ্চরাচরং জগৎ সুনোতি সূতে বোৎপাদয়তি স সবিতা পরমেশ্বরঃ যিনি সকল জগৎ উৎপত্তি করেন এই কারণে পরমেশ্বরের নাম সবিতা।

২৫। (দিবু ক্রীড়াবিজিগীষাব্যবহারদ্যুতিস্তুতিমোদমদস্বপ্নকান্তিগতিষু) এই ধাতু হইতে ‘দেব’ শব্দ সিদ্ধ হয়। (ক্রীড়া) যিনি শুদ্ধ [সমস্ত ] জগৎকে ক্রীড়া করাইবার, (বিজিগীষা) ধার্মিকদিগকে জয়যুক্ত করাইবার ইচ্ছুক (ব্যবহার) যিনি সকল চেষ্টার সাধনও উপসাধন সমূহের দাতা, (দ্যুতি)। স্বয়ং প্রকাশ-স্বরূপ ও সকলের প্রকাশক, (স্তুতি), প্রশংসার যোগ্য, (মোদ) স্বয়ং আনন্দস্বরূপ। এবং অপরের আনন্দদাতা, (মদ) মদোন্মত্তদের তাড়নাকারী, (স্বপ্ন) সকলের নিদ্রার জন্য রাত্রি ও প্রলয়ের কর্তা, (কান্তি) কামনার যোগ্য এবং (গতি) জ্ঞানস্বরূপ–এইজন্য সেই পরমেশ্বরের নাম ‘দেব’।

অথবা ‘য়ো দীব্যতি ক্রীডিতি স দেবঃ’ যিনি স্বরূপে নিজেই আনন্দে ক্রীড়া করেন, অথবা যিনি কাহারও সাহায্য ব্যতীত ক্রীড়াবৎ সহজ স্বভাব দ্বারা সমস্ত জগৎ নির্মাণ করেন, অথবা যিনি সকল ক্রীড়ার আধার। বিজিগীযতে স দেব’ যিনি সর্ব বিজয়ী, স্বয়ং অজেয় অর্থাৎ যাহাকে কেহই জয় করিতে পারে না; ব্যবহারয়তি স দেবঃ’, যিনি ন্যায় ও অন্যায়স্বরূপ ব্যবহারের জ্ঞাতা ও উপদেষ্টা; য়শ্চরাচরং জগৎ দ্যোতয়তি’ যিনি সকলের প্রকাশক। য়ঃ স্তয়তে স দেব’ যিনি সর্বমানবের স্তুতির যোগ্য এবং নিন্দাহ্নহেন; ‘য়ো মোদয়তিস দেবঃযিনি স্বয়ং আনন্দ-স্বরূপ এবং অপরকেও আনন্দিত করেন যাহাতে দুঃখের লেশমাত্রও নাই; ‘য়ো মাদ্যতি স দেবঃ যিনি সর্বদা হর্ষযুক্ত, শোকরহিত, এবং অপরকেও হর্ষযুক্ত করেন এবং দুঃখ হইতে দূরে রাখেন। য় স্বাপয়তি স দেবঃ যিনি প্রলয়কালে অব্যক্ত অবস্থায় সকল জীবকে নিদ্রিত করেন। য় কাময়তে। কাম্যতে বা স দেবঃ যাঁহার সমস্ত সত্যকাম এবং শিষ্টগণ যাঁহার প্রাপ্তির কামনা করেন, তথা ‘য়ো গচ্ছতি গম্যতে বা স দেবঃ যিনি সকলের মধ্যে ব্যাপ্ত ও জানিবার যোগ্য, সেই পরমেশ্বরের। নাম ‘দেব’ ।

২৬। (কুবি আচ্ছাদনে) এই ধাতু হইতে ‘কুবের’ শব্দ সিদ্ধ হয়। য়ঃ সর্বং কুম্বতি স্বব্যাপ্ত্যাচ্ছাদায়তি স কুবেরো জগদীশ্বরঃ যিনি স্বীয় ব্যপ্তি দ্বারা সকলকে আচ্ছাদন করেন, সে কারণ পরমেশ্বরের নাম কুবের।

২৭। (পৃথু বিস্তারে) এই ধাতু হইতে ‘পৃথিবী’ শব্দ সিদ্ধ হয়। য় পর্থতি সর্বং জগদ্বিস্তৃতি তস্মাৎ স পৃথিবী’ যিনি সমগ্র বিস্তৃত জগতের কর্তা, এই কারণে সেই পরমেশ্বরের নাম ‘পৃথিবী।

২৮। (জল ঘাতনে) এই ধাতু হইতে ‘জল’ শব্দ সিদ্ধ হয়। জলতি ঘাতয়তি দুষ্টান্, সংঘাতয়তি-অব্যক্তপরমান্বাদীন তদ ব্ৰহ্ম জল’, যিনি দুষ্টদিগকে দণ্ডদান করেন এবং অব্যক্ত তথা পরমাণু সমূহের পরস্পর সংযোগ অথবা বিয়োগ করেন, এই কারণে সেই পরমাত্মার নাম ‘জল। যুদ্বা হজ্জনয়তি লাতি সকলং জগৎ ত ব্ৰহ্ম জল।অথবা যিনি সকলের জনক ও সর্বসুখদাতা, এ কারণেও পরমাত্মার নাম জল ॥

২৯। (কাশ্য দীপ্তে) এই ধাতু হইতে ‘আকাশ’ শব্দ সিদ্ধ হয়। য় সর্বতঃ সর্বং জগৎ প্রকাশয়তি স আকাশঃ, যিনি সব দিক দিয়া জগতের প্রকাশক, সেই জন্য সেই পরমাত্মার নাম আকাশ।

৩০,৩১,৩২। অদ ভক্ষণে এই ধাতুর হইতে অন্ন’ শব্দ সিদ্ধ হয়। অদ্যতোত্তি চ ভূতানি তস্মাদন্নং তদুচ্যতে তৈতিউ০ ২।২ অহমন্নমহমন্নমহন্ন। অহমন্নাদোহমন্নাদোচহমন্নাদঃ ২তৈউ০ (৩১০)

অত্তা চর চরগ্রহণাৎ (বেসু০১২৯) ইহা ব্যাসমুনিকৃত শারীরক সূত্র। যিনি সকল কে ভিতরে রাখিতে সমর্থ, অথবা যিনি সকলের গ্রহণযোগ্য যিনি চরাচর জগতের ধারণকর্তা, সেই ঈশ্বরের নাম অন্ন’ ও অন্নাদ’ এবং অত্তা। এই স্থলে যে তিনবার পাঠ আছে উহা আদরার্থে। ডুমুর ফলের মধ্যে যেরূপ কৃমি উৎপন্ন হইয়া থাকে এবং উহাতেই নষ্ট হইয়া যায়, পরমেশ্বরের মধ্যে সমস্ত জগতের অবস্থাও সেইরূপ।

৩৩। (বস নিবাসে) এই ধাতু হইতে ‘বসু’ শব্দ সিদ্ধ হয়। বসন্তি ভূতানি যস্মিন্নথবা য়ঃ সর্বেষু বসতি স বসুরীশ্বরঃ যাঁহাতে সব আকাশাদি ভূত বাস করেন এবং যিনি সকলের মধ্যে বাস করিতেছেন, অতএব পরমেশ্বরের নাম বসু।

৩৪। (রুদির অশ্রুবিমোচনে) এই ধাতুর সহিত ণিচ্ (র) প্রত্যয় যোগে রুদ্র’ শব্দ সিদ্ধ হয়। ‘য়ো রোদয়ত্যন্যায়কারিণো জনান্ স রুদ্রঃ’ যিনি দুষ্কর্মকারীদিগকে রোদন করান, এ কারণ সেই পরমেশ্বরের নাম ‘রুদ্র’।

‘য়ন্মনসা ধ্যায়তি তঘাচা বদতি, যুদ্ধাচা বদতি তৎ কর্মণা করোতি য়ৎ কর্মণা করোতি তদভিসম্পদ্যতে।

ইহা যজুর্বেদের ব্রাহ্মণের বচন। জীব মনে যাহা ধ্যান করে, তাহা বাণী দ্বারা প্রকাশ করে। যাহা বাণী দ্বারা প্রকাশ করে, তাহাই কর্মের দ্বারা সম্পাদিত হয়, যাহা কর্মের দ্বারা সম্পাদিত হয়, তাহাই ফলরূপে প্রাপ্ত হয়। এতদ্বারা সিদ্ধ হইল যে, জীব যেরূপ কর্ম করে, সে সেইরূপই ফল লাভ করে। যখন দুষ্কর্মকারী জীব ঈশ্বরের ন্যায়-ব্যবস্থানুসারে দুঃখরূপ ফল পায়, তখন সে ক্রন্দন করে। এইরূপে ঈশ্বর তাহাকে রোদন করান বলিয়াই পরমেশ্বরের নাম রুদ্র।

৩৫। আপোনারা ইতি প্রোক্তা আপো বৈ নরসূনবঃ। তা য়দস্যায়নং পূর্বং তেন নারায়ণঃ স্মৃত। মনুঃ ॥১।১০ ॥

জল এবং জীবগণের নাম ‘নারা’ সেই অয়ন অর্থাৎ নিবাস স্থান যাহার। অতএব সব জীবে ব্যাপক পরমাত্মার নাম ‘নারায়ণ’ ।

৩৬। (চদি আহ্লাদে) এই ধাতু হইতে ‘চন্দ্র’ শব্দ সিদ্ধ হয়। য়শ্চতি চয়তি বা স চন্দ্র, যিনি সকলের আনন্দস্বরূপ এবং যিনি সকলের আনন্দদাতা সে কারণ ঈশ্বরের নাম চন্দ্র।

৩৭। (মগি গত্যৰ্থক) ধাতুর উত্তর মঙ্গেরল’ এই সূত্রানুসারে মঙ্গল’ শব্দ সিদ্ধ হয়। যো মঙ্গতি মঙ্গয়তি বা স মঙ্গলঃ, যিনি স্বয়ং মঙ্গল স্বরূপ এবং সকল জীবের মঙ্গলের কারণ, সেইজন্য পরমেশ্বরের নাম মঙ্গল।

৩৮।(বুধ অবগমনে) এই ধাতু হইতে বুধ’ শব্দ সিদ্ধ হয়। ‘য়ো বুধ্যতে বোধয়তি বা স বুধ যিনি স্বয়ং বোধ-স্বরূপ এবং সকল জীবের বোধের কারণ, সেই কারণে পরমেশ্বরের নাম বুধ। বৃহস্পতি শব্দের অর্থ পূর্বে বলা হইয়াছে।

৩৯। (ঈশুচির পূতীভাবে) এই ধাতু হইতে ‘শুক্র’ শব্দ সিদ্ধ হয়। য়ঃ শুচতি শোচয়তি বা স শুক্রঃ যিনি অত্যন্ত পবিত্র এবং যাহার সংস্পর্শে জীবও পবিত্র হইয়া যায়, সেই পরমেশ্বরের নাম ‘শুক্র।

৪০। (চর গতিভক্ষণয়োঃ) এই ধাতুর সহিত শনৈস্’ অব্যয় উপপদ যোগে শনৈশ্চর’ শব্দ সিদ্ধ হয়। য় শনৈশ্চরতি স শনৈশ্চরঃ যিনি সকলের মধ্যে সহজেই প্রাপ্ত ও ধৈৰ্য্যবান, সেই পরমেশ্বরের নাম শনৈশ্চর।

৪১। (রহ ত্যাগে) এই ধাতু হইতে ‘রাহু’ শব্দ সিদ্ধ হয়, ‘য়ো রহতি পরিত্যজতি দুষ্টান রাহয়তি ত্যাজয়তি (বা) স রাহুরীশ্বরঃ যিনি একান্ত স্বরূপ যাঁহার স্বরূপে অন্য পদার্থ সংযুক্ত নয়, যিনি দুষ্টের ত্যাগ ও অন্যকে পরিত্যাগ করান, অতএব সেই পরমেশ্বরের নাম ‘রাহু’।

৪২। (কিত নিবাসে রোগাপনয়নে চ) এই ধাতু হইতে ‘কেতু’ শব্দ সিদ্ধ হয়। য়ঃকেতয়তি চিকিৎসতি বা স কেতুরীশ্বরঃ যিনি সমস্ত জগতের নিবাস স্থান, যিনি সর্ব রোগরহিত এবং যিনি মুমুক্ষুদিগকে সর্বপ্রকার রোগ হইতে মুক্ত করান, সেই কারণে সেই পরমাত্মার নাম ‘কেতু।

৪৩। (য়জ দেবপূজাসঙ্গতিকরণদানে) এই ধাতু হইতে যজ্ঞ শব্দ সিদ্ধ হয়। যজ্ঞো বৈ বিষ্ণু’ ইহা ব্রাহ্মণ-গ্রন্থের বচন। ‘য়ো য়জতি বিদ্বদ্ভিরিজ্যতে বা স য়জ্ঞ, যিনি সর্বজগতের। পদার্থসমূহকে সংযুক্ত করেন এবং যিনি বিদ্বানদিগের পূজ্য এবং ব্রহ্ম হইতে আরম্ভ করিয়া সকল মুনি ঋষির পূজ্য ছিলেন, আছেন এবং থাকিবেন অতএব সেই পরমেশ্বরের নাম যজ্ঞ।

৪৪।(হু দানাSS দনয়োঃ, আদানে চেত্যেকে) এই ধাতু হইতে ‘হোতা’ শব্দ সিদ্ধ হয়। ‘য়ো জুহোতি স হোতা’ যিনি জীবদিগকে দেয় পদার্থ সমূহের দাতা এবং গ্রাহ্য-গ্রহণ সমূহের গ্রাহক, এই কারণে সেই পরমেশ্বরের নাম ‘হোতা।

৪৫।(বন্ধ বন্ধনে) এই ধাতু হইতে ‘বন্ধু’ শব্দ সিদ্ধ হয়। য় স্বস্মিন্ চরাচরং জগদ্বধাতি, বন্ধুবৎ ধর্মাত্মানাং সুখায় সহায়য়া বা বৰ্ততে স বন্ধু’ যিনি নিজের মধ্যে সমস্ত লোক লোকান্তরকে নিয়মবদ্ধ। রেখেছেন এবং সহোদরের ন্যায় সকলের সহায়ক, এইজন্য তাহারা স্ব স্ব পরিধি অথবা নিয়ম উল্লঙ্ঘন করিতে পারে না। ভ্রাতা যেরূপ ভ্রাতার সাহায্যকারী, পরমেশ্বর সেইরূপ পৃথিব্যাদি লোকসমূহের। ধারণ, রক্ষণ সুখ দান করেন বলিয়া ‘বন্ধু’ সংজ্ঞক ॥

৪৬। (পা রক্ষণে) এই ধাতু হইতে পিতা’ শব্দ সিদ্ধ হয়। য়ঃ পাতি সর্বান্ স পিতাঃ যিনি সকলের রক্ষক। যেরূপ পিতা নিজ সন্তানদের প্রতি সর্বদা কৃপালু থাকিয়া তাহাদের উন্নতি কামনা করেন, পরমেশ্বরও সেইরূপ সকল জীবের উন্নতি কামনা করেন। এইজন্য তাহার নাম ‘পিতা।

৪৭, ৪৮। (যঃ পিতৃণাং পিতা স পিতামহঃ) পিতৃগণেরও পিতা বলিয়া পরমেশ্বরের নাম পিতামহ। য়ঃ পিতামহানাং পিতা স প্রপিতামহঃ যিনি পিতামহদিগের পিতা বলিয়া ঈশ্বরের নাম ‘প্রপিতামহ।

৪৯। (মাঙ মানে শব্দে চ) ইহা দ্বারা ‘মাতা’ শব্দ সিদ্ধ হয়। ’য়ো মিমীতে মানয়তি সর্বান্ জীবান্ স মাতা, পূর্ণ কৃপাময়ী জননী যেরূপ নিজ সন্তানদের সুখ ও উন্নতি কামনা করেন, সেইরূপ পরমেশ্বরও জীবের উন্নতি কামনা করেন, এই কারণে পরমেশ্বরের নাম মাতা।

৫০। (চর গতি ভক্ষণয়োঃ) আঙু পূর্বক এই ধাতু হইতে ‘আচার্য’ শব্দ সিদ্ধ হয়। য় আচারং গ্রাহয়তি সর্বা বিদ্যা বোধয়তি স আচায় ঈশ্বরঃ যিনি সত্য আচারকে গ্রহণ করান এবং সমস্ত বিদ্যা প্রাপ্তির হেতু হইয়া সকল বিদ্যা প্রাপ্ত করাইয়া থাকেন। সেই কারণে পরমেশ্বরের নাম আচার্য।

৫১। (গৃ শব্দে) এই ধাতু হইতে ‘গুরু’ শব্দ সিদ্ধ হয়। ‘য়ো ধর্মান্ শব্দান্ গৃহ্নাত্যুপদিশতি স গুরুঃ ।

স পূর্বেষামপি গুরুঃ কালেমানবচ্ছেদাৎ ॥ যোগ ॥

যিনি সত্য, ধর্ম প্রতিপাদক এবং সর্ববিদ্যাযুক্ত বেদের উপদেষ্টা, যিনি সৃষ্টির আদিতে অগ্নি, বায়ু, আদিত্য, অঙ্গিরা এবং ব্রহ্মাদি গুরুজনেরও গুরু এবং যাঁহার কখনও নাশ হয় না, এই কারণে সেই পরমেশ্বরের নাম ‘গুরু’।

৫২। (অজ গতিক্ষেপণয়োঃ; জনী প্রাদুর্ভাবে) এই সকল ধাতু হইতে অজ’ শব্দ সিদ্ধ হয়। ‘য়ো জতি সৃষ্টিং প্রতি সর্বান্ প্রকৃত্যাদী পদার্থান প্রক্ষিপতি, জনয়তি কদাচিন্ন জায়তে সোত জঃ, যিনি প্রকৃতির সমস্ত অবয়ব আকাশাদি ভূত–পরমাণু সমূহকে যথোচিতভাবে মিলিত করেন এবং জীবদিগকে শরীরের সহিত সম্বন্ধ যুক্ত করিয়া জন্মদান, করেন, কিন্তু স্বয়ং কখনও জন্মগ্রহণ করেন না, সেই পরমেশ্বরের নাম অজ।

৫৩। (বৃহ বৃহি বৃদ্ধৌ) এই সকল ধাতু হইতে ‘ব্রহ্মা’ শব্দ সিদ্ধ হয়। ‘য়ো খিলং জগন্নির্মাণেন বৰ্হতি (বৃংহতি) বৰ্দ্ধয়তি স ব্রহ্ম। যিনি সম্পূর্ণ জগৎ রচনা করিয়া বিস্তৃত করেন, সেই জন্যে সেই পরমেশ্বরের নাম ব্রহ্মা।

৫৪,৫৫,৫৬। সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম। ইহা তৈত্তরীয়োপনিষদের (২।১) বচন।

সন্তীতি সন্ত স্তেষু সৎসু সাধু তৎ সত্যম, যজ্জানাতি চরা চরং জগত্তজজ্ঞান। ন বিদ্যতেন্তোষ বধিময়াদা য়স্য তদনন্তম। সর্বেভ্যো বৃহত্ত্বাদ ব্ৰহ্ম’ যে সকল পদার্থ আছে, সেই সকলকে ‘সৎ’ বলে, তন্মধ্যে ‘সাধু’ বলিয়া পরমেশ্বরের নাম ‘সত্য। তিনি সমস্ত জগতের জ্ঞাতা, এই কারণে পরমেশ্বরের নাম ‘জ্ঞান’। যাঁহার অন্ত-অবধি-সীমা অর্থাৎ এত লম্বা, চওড়া, ছোট, বড় — এরূপ পরিমাপ নাই, এইজন্যে সেই পরমেশ্বরের নাম অনন্ত।

৫৭। (ডুদাঞ দানে) আঙ্‌পূর্বক এই ধাতু দ্বারা ‘আদি’ শব্দ এবং নঞপূর্বক ‘অনাদি’ শব্দ সিদ্ধ হয়। য়স্মাৎ পূর্বং নাস্তি পরং চাস্তি স আদিরিত্যুচ্যুতে’ (মহাভাষ্য ১।১।৫০) “ন বিদ্যতে আদিঃ কারণং য়স্য সোত নাদিরীশ্বরঃ” যাঁহার পূর্বে কিছুই নাই, কিন্তু পরে আছে তাহাকে ‘আদি’ বলে। যাঁহার কোন আদি কারণ নাই, সেই পরমেশ্বরের নাম অনাদি।

৫৮। (টুনদি সমৃদ্ধৌ) আঙ পূর্বক এই ধাতু দ্বারা ‘আনন্দ’ শব্দ সিদ্ধ হয়। ‘আনন্দন্তি সর্বে মুক্তা অস্মিন্ য়দ্বা য়ঃ সর্বাঞ্জীবনানন্দয়তি স আনন্দঃ’ যিনি আনন্দ স্বরূপ, যাঁহাতে সকল মুক্ত জীব আনন্দ লাভ করে এবং যিনি সকল ধর্মাত্মা জীবকে আনন্দিত করেন, সেই কারণে সেই পরমেশ্বরের নাম ‘আনন্দ’।

৫৯। (অস ভুবি) এই ধাতু হইতে ‘সৎ’ শব্দ সিদ্ধ হয়। য়দস্তি ত্ৰিযু কালেষু ন বাধ্যতে তৎসদ ব্রহ্ম’ যিনি সর্বদা বর্তমান, অর্থাৎ ভূত, ভবিষ্যৎ এবং বর্তমান কালে যাহার নাস্তিত্ব নাই, সেই কারণে সেই পরমেশ্বকে ‘সৎ’ বলা হয়।

৬০, ৬১। (চিতী সংজ্ঞানে) এই ধাতু হইতে ‘চিৎ’ শব্দ সিদ্ধ হয়। ‘য়শ্চেতি চেতয়তি’ সংজ্ঞাপয়তি সর্বান্ সজ্জনান য়োগিনস্তচ্চিৎ পরং ব্রহ্ম’ যিনি চেতন স্বরূপ, সকল জীবকে চেতনা যুক্ত করেন এবং যিনি সত্যাসত্যের জ্ঞাপয়িতা, সেই পরমেশ্বরের নাম ‘চিৎ। এই তিন শব্দের বিশেষণে পরমেশ্বরকে ‘সচ্চিদানন্দ স্বরূপ’ বলে।

৬২ (য়ো নিত্যধ্রুবোঃ চলোঃ বিনাশী স নিত্যঃ) যিনি নিশ্চল এবং অবিনাশী,তিনি নিত্য শব্দবাচ্য ’ঈশ্বর’।

৬৩। ‘শুল্ক শুদ্ধৌ’ এই ধাতু হইতে ‘শুদ্ধ’ শব্দ সিদ্ধ হইয়াছে। য়ঃ শুন্ধতি সর্বান্ শোধয়তি বা স শুদ্ধ ঈশ্বর : যিনি স্বয়ং পবিত্র, সকল অশুদ্ধি হইতে পৃথক এবং যিনি সকলকে শুদ্ধ করেন, সেই ঈশ্বরের নাম ‘শুদ্ধ’।

৬৪।(বুধ অবগমনে) এই ধাতুর সহিত ‘ক্ত’ প্রত্যয় যোগে ‘বুদ্ধ’ শব্দ সিদ্ধ হয়। ‘য়ো বুদ্ধবান্ সদৈব জ্ঞাতা স্তি স বুদ্ধো জগদীশ্বরঃ’ যিনি সর্বদা সকলের জ্ঞাতা, সেই ঈশ্বরের নাম ‘বুদ্ধ’।

৬৫। (মুচ মোচনে) এই ধাতু হইতে মুক্ত’ শব্দ সিদ্ধ হয়। ‘য়ো মুঞ্চতি মোয়তি বা মুমুক্ষুন্ স মুক্তো জগদীশ্বরঃ’ যিনি সর্বদা অশুদ্ধতা সমূহ হইতে পৃথক এবং যিনি মুমুক্ষুদের সকলকে ক্লেশ হইতে মুক্ত করেন, সে কারণ পরমেশ্বরের নাম মুক্ত।

৬৬। ‘অতএব নিত্যশুদ্ধবুদ্ধমুক্তস্বভাবো জগদীশ্বরঃ’, এই কারণে পরমেশ্বরের স্বভাব নিত্য, বুদ্ধ, শুদ্ধ ও মুক্ত।

৬৭। (নির ও আঙ) পূর্বক ডুকৃ করণে এই ধাতু হইতে ‘নিরাকার’ শব্দ সিদ্ধ হয়। নির্গত আকারাৎ স নিরাকারঃ’, যাঁহার কোনও আকার নাই, যিনি কখনও শরীর ধারণ করেন না সেই কারণে পরমেশ্বরের নাম ‘নিরাকার’।

৬৮। (অঞ্জু ব্যক্তিমক্ষণকান্তিগতিযু) এই ধাতু হইতে অঞ্জন’ শব্দ এবং ‘নির উপসর্গ যোগে ‘নিরঞ্জন’ শব্দ সিদ্ধ হয়। অঞ্জনং ব্যক্তিৰ্মক্ষণং কুকাম ইন্দ্রিয়ৈঃ প্রাপ্তিশ্চেত্যম্মাদ্যো নির্গতঃ পৃথষ্কৃতং স নিরঞ্জনঃ যিনি ব্যক্তি অর্থাৎ আকৃতি, ম্লেচ্ছাচার, দৃষ্ট কামনা ও চক্ষু ইত্যাদি ইন্দ্রিয় সমূহের বিষয়-পথ হইতে পৃথক, সেই কারণে ঈশ্বরের নাম ‘নিরঞ্জন ॥

৬৯, ৭০। (গণ সংখ্যানে) এই ধাতু হইতে ‘গণ’ শব্দ সিদ্ধ হয়, ঈশ’ বা ‘পতি’ শব্দ যোগে ‘গণেশ’ এবং ‘গণপতি’ শব্দ সিদ্ধ হয়। ‘য়ে প্রকৃত্যাদয়ো জডা জীবাশ্চ গণ্যন্তে সংখ্যায়ন্তে, তেমীশঃ স্বামী পতিঃ পালকো বা যিনি প্রকৃত্যাদি জড় এবং সর্ব জীবাখ্য-পদার্থ-সমূহের পালন কর্তা, এই কারণে সেই ঈশ্বরের নাম ‘গণেশ’ বা ‘গণপতি।

৭১।(গোবিশ্বমীষ্টেসবিশ্বেশ্বরঃ) যিনিসংসারেরঅধিষ্ঠাতা, সেইকারণে পরমেশ্বরেরনাম বিশ্বেশ্বর।

৭২। (য় কূটেনেকবিধব্যবহারে স্বস্বরূপেণৈব তিষ্ঠতি স কূটস্থঃ পরমেশ্বরঃ) যিনি সকল ব্যবহারে ব্যাপ্ত এবং সকল ব্যবহারের আধার হইয়াও কোন ব্যবহারে স্বীয় স্বরূপ পরিবর্তন করেন না, সেই কারণে পরমেশ্বরের নাম ‘কূটস্থ’।

৭৩-৭৪ (দেব) শব্দের অর্থ যতগুলি লিখিয়াছি ‘দেবী’ শব্দেরও ততগুলি অর্থ আছে। পরমেশ্বরের নাম তিন লিঙ্গেই আছে যথা ‘ব্রহ্মচিতিরীশ্বরশ্চেতি’ যখন ঈশ্বরের বিশেষণ হইবে, তখন ‘দেব’, যখন চিতির বিশেষণ হইবে, তখন ‘দেবী’। এই কারণে পরমেশ্বরের নাম ‘দেবী।

৭৫৷ (শুক্ল শক্তৌ) এই ধাতু হইতে শক্তি’ শব্দ সিদ্ধ হয়। য়ঃ সর্বং জগৎ কং শক্লোতি স শক্তিঃ, যিনি সকল জগতের রচনায় সমর্থ, সেই পরমেশ্বরের নাম শক্তি।

৭৬। (শ্রি সেবায়াম) এই ধাতু হইতে ‘শ্রী’ শব্দ সিদ্ধ হয়। য়ঃ শ্ৰীয়তে সেব্যতে সর্বেণ জগতা বিদ্বদ্ভিয়োগিভিশ্চ স শ্রীরীশ্বরঃ’, সমস্ত জগৎ, বিদ্বমণ্ডলী এবং যোগীজন, যাঁহার সেবা করেন,সেই পরামাত্মার নাম ‘শ্রী’।

৭৭। (লক্ষ দর্শনাঙ্কনয়োঃ) এই ধাতু হইতে ‘লক্ষ্মী’ শব্দ সিদ্ধ হয়। ‘য়ো লক্ষয়তি পশ্যত্যঙ্কতে চিহ্নয়তি চরাচরং জগৎ অথবা বেদৈরাপ্তৈয়োগিভিশ্চ য়ো লক্ষ্যতে স লক্ষীঃ সর্বপ্রিয়েশ্বরঃ যিনি সমস্ত চরাচর জগৎকে দেখেন, চিহ্নিত অর্থাৎ দর্শনীয় করিয়া নির্মাণ করেন অর্থাৎ যিনি শরীরে নেত্র, ও নাসিকা, বৃক্ষের পত্র, পুষ্প, ফল, মূল (অগ্নির); পৃথিবী ও জল আদি কৃষ্ণ, রক্ত ও শ্বেত মৃত্তিকা, পাষাণ, চন্দ্র ও সূৰ্য্যাদি চিহ্ন রচনা করেন, তথা সকলকে দেখেন, তিনি সকল শোভার শোভা এবং যিনি বেদাদি শাস্ত্র এবং যিনি বেদাদি শাস্ত্র বা ধার্মিক বিদ্বান্ যোগীদিগের লক্ষ্য অর্থাৎ দর্শনীয়, এই কারণে সেই পরমেশ্বরের নাম লক্ষ্মী।

৭৮। (সৃ গতৌ) এই ধাতু হইতে সরস্’ তদুত্তর ‘মতুপ’ এবং প্রত্যয় যোগে সরস্বতী শব্দ সিদ্ধহয়। সরো বিবিধং জ্ঞানং বিদ্যতে স্যাং চিতৌ সা সরস্বতী’ যাঁহার বিবিধ বিজ্ঞান।

অর্থাৎ শব্দ, সম্বন্ধ ও প্রয়োগের যথাযথ জ্ঞান আছে সেই পরমেশ্বরের নাম সরস্বতী।

৭৯। সর্বাঃশক্তয়োঃ বিদ্যন্তে যস্মিন্ স সর্বশক্তিমানীশ্বরঃ। যিনি স্বকার্য সাধনে অন্য কাহারও সহায়তা ইচ্ছা করেন না, কিন্তু নিজ সামর্থ্য দ্বারাই স্বীয় সর্ব কাৰ্য্য পূর্ণ করেন, এই কারণে সেই পরমেশ্বরের নাম সৰ্ব্বশক্তিমান্।

৮০। (ণী প্রাপণে) এই ধাতু হইতে ন্যায়’ শব্দ সিদ্ধ হয়। প্রমাণেরর্থপরীক্ষণং ন্যায়ঃ, ইহা ন্যায় সূত্রের বাৎস্যায়ন মুনিকৃত ভাষ্যের বচন। পক্ষপাতরাহিত্যাচরণংন্যায়ঃ যাহা প্রত্যাক্ষদি প্রমাণের দ্বারা পরীক্ষার পর সত্য বলিয়া সিদ্ধ হয় এবং যাহা পক্ষপারহিত ধর্মরূপ আচরণ, তাহাকে ন্যায় বলে। ন্যায়ং কর্তৃং শীলমস্য স ন্যায়কারীশ্বরঃ অর্থাৎ ন্যায় পক্ষপাত রহিত ধৰ্ম্ম করাই যাঁর স্বভাব, এই কারণে সেই পরমেশ্বরের নাম ন্যায়কারী।

৮১। (দয় দানগতিরক্ষণহিংসাদানেষু) এই ধাতু হইতে দয়া’ সিদ্ধ হয়। দয়তে দদাতি জানাতি গচ্ছতি রক্ষতি হিনস্তি য়য়া সা দয়া বহ্বীদয়া বিদ্যতে যস্য স দয়ালুঃ পরমেশ্বরঃ যিনি অভয়দাতা, সত্যাসত্য সর্ব বিদ্যার জ্ঞাতা, সজ্জনদিগের রক্ষক এবং দুষ্টদিগের যথোচিত দণ্ডদাতা এই কারণে পরমেশ্বরের নাম দয়ালু।

৮২। দ্বয়োর্ভাবো দ্বাভ্যামিতং সা দ্বিতা দ্বীতং বা, সৈব তদেব বা দ্বৈতম, ন বিদ্যতে দ্বৈতং দ্বিতীয়েশ্বরভাবোয়স্মিংস্তদদ্বৈতম অর্থাৎ সজাতীয়বিজাতীয়স্বগতভেদশূণ্যংব্ৰহ্ম’, দুই বা দুইয়ের দ্বারা যুক্ত হওয়াকে দ্বিতা বা দ্বীতা অথবা দ্বৈত এরূপ ভাব যাহাতে নাই। সজাতীয়–যথা, মনুষ্যের সজাতীয় অন্য মনুষ্য, বিজাতীয়–যথা মনুষ্যের ভিন্ন জাতিবিশিষ্ট বৃক্ষ, পাষাণ ইত্যাদি। স্বগত অর্থাৎ যেরূপ শরীরে চক্ষু,নাসিকা, ও কর্ণ ইত্যাদি অবয়বগুলি ভেদ আছে সেরূপ অন্য স্বজাতীয় ঈশ্বর, বিজাতীয় ঈশ্বর বা নিজ আত্মায় তত্ত্বান্তর বস্তু সমূহ হইতে ভিন্ন এক পরমেশ্বর আছেন, এই কারণে পরমাত্মার নাম অদ্বৈত।

৮৩। গুণ্যন্তে য়ে তে গুণা বা য়ৈগুণয়ন্তি তে গুণাঃ গো গুণেভ্যো নির্গতঃ স নির্গুণ ঈশ্বরঃ। জড়ের সত্ত্ব, রজ, তম, রূপ, রসস্পর্শ ও গন্ধাদি যত গুণ আছে এবং জীবের অবিদ্যা, অল্পজ্ঞতা, রাগ, দ্বেষ ও অবিদ্যাদি ক্লেশ এইরূপ যত গুণ আছে,সে সব হইতে তিনি পৃথক। এবিষয়ে ‘অশব্দম স্পর্শমরূপমব্যয়’ ইত্যাদি উপনিষদের প্রমাণ আছে। তিনি শব্দ স্পর্শ এবং রূপাদি গুণ রহিত, এই কারণে সেই পরমাত্মার নাম ‘নির্গুণ’।

৮৪। ‘য়ো গুণৈঃ সহঃ বৰ্ত্ততে স সগুণঃ’ পরমেশ্বর সর্বজ্ঞান, সর্বসুখ, পবিত্রতা এবং অনন্ত বলাদি গুণযুক্ত বলিয়া সেই পরমেশ্বরের নাম ‘সগুণ। যেমন পৃথিবী গন্ধাদি গুণযুক্ত বলিয়া ‘সগুণ’ এবং ইচ্ছাদি গুণ রহিত বলিয়া ‘নির্গুণ’, সেইরূপ জগৎ তথা জীবের গুণ হইতে পৃথক পরমেশ্বর ‘নির্গুণ’ এবং সর্বজ্ঞতাদি গুণযুক্ত বলিয়া ‘সগুণ’। অর্থাৎ এমন কোন পদার্থ নাই যাহা সগুণতা ও নিষ্ঠুর্ণতা হইতে পৃথক। চেতন গুণরহিত বলিয়া জড় পদার্থ যেরূপ ‘নির্গুণ, এবং স্ব-গুণযুক্ত বলিয়া ‘সগুণ’ সেইরূপ জড় গুণ হইতে পৃথক বলিয়া জীব ‘নির্গুণ’ আবার ইচ্ছাদি নিজ গুণযুক্ত বলিয়া ‘সগুণ। পরমেশ্বর সম্বন্ধেও এইরূপ বুঝিতে হইবে।

৮৫। ‘অন্তয়ন্তং নিয়ন্তং শীলংয়স্য সোয়ময়ামী’ যিনি প্রাণী ও অপ্রাণী জগতের মধ্যে ব্যাপক হইয়া সকলকে নিয়ন্ত্রণ করেন, এই কারণে সেই পরমেশ্বরের নাম অন্তর্যামী।

৮৬। (য়ে ধৰ্ম্মে রাজতে স ধর্মরাজঃ) যিনি ধর্মেই প্রকাশমান, অধর্ম রহিত এবং ধর্মেরই প্রকাশক, এইজন্য সেই পরমেশ্বরের নাম ‘ধর্মরাজ’।

৮৭। (যমু উপরমে) এই ধাতু হইতে যম’ শব্দ সিদ্ধ হয়, য়ঃ সর্বান্ প্রাণিনো নিয়চ্ছতি স য়মঃ যিনি সকল প্রাণীর কর্মফল দানের ব্যবস্থা করেন এবং সকল অন্যায় হইতে পৃথক। থাকেন, এই কারণে সেই পরমেশ্বরের নাম যম।

৮৮। (ভজ সেবায়া) এই ধাতু হইতে ‘ভগ’ সিদ্ধ হয়, ইহার সহিত মতুপ’ প্রত্যয় যোগে ‘ভগবান্ শব্দ সিদ্ধ হয়। ভগঃ সকলৈশ্বয়ং সেবনং বা বিদ্যতে যস্য স ভগবান্ যিনি সমগ্র । ঐশ্বর্যযুক্ত অথবা ভজনের যোগ্য এইজন্য সেই পরমেশ্বরের নাম ‘ভগবান।

৮৯। (মন জ্ঞানে) এই ধাতু হইতে ‘মনু’ শব্দ সিদ্ধ হয়। ‘য়ো মন্যতে স মনুঃ যিনি মনু অর্থাৎ বিজ্ঞানশীল এবং মাননীয় এইজন্য সেই ঈশ্বরের নাম মনু।

৯০। (পৃ পালনপূরণয়োঃ) এই ধাতু হইতে ‘পুরুষ’ শব্দ সিদ্ধ হইয়াছে। য়ঃ স্বব্যাপ্ত্যা চরা চরং জগৎ পৃণাতি পূরয়তি বা স পুরুষঃ। যিনি সকল জগতের মধ্যে পূর্ণ হইয়া রহিয়াছেন, এইজন্য সেই পরমেশ্বরের নাম পুরুষ।

৯১। (ডুyঞ ধারণপোয়ণয়োঃ) ‘বিশ্ব’ পূর্বক এই ধাতু হইতে ‘বিশ্বম্ভর’ শব্দ সিদ্ধ হয়। গো। বিশ্বং বিভর্তি ধরতি পুষ্ণাতি বা স বিশ্বম্ভরো জগদীশ্বরঃ যিনি জগতের ধারণ এবং পোষণ করেন এইজন্য সেই পরমেশ্বরের নাম ‘বিশ্বম্ভর।

৯২। (কল সংখ্যানে) এই ধাতু হইতে ‘কাল’ শব্দ নিষ্পন্ন হইয়াছে। কলয়তি সংখ্যাতি সর্বান্ পদার্থান্ স কালঃ, যিনি জগতের সকল পদার্থের এবং জীবদিগের সংখ্যা করেন, এ কারণ সেই পরমেশ্বরের নাম কাল।

৯৩। (শি বিশেষণে) এই ধাতু হইতে শেষ’ শব্দ সিদ্ধ হয়। য় শিষ্যতে সঃ শেষঃ যিনি উৎপত্তি ও প্রলয়ের পরে শেষ অর্থাৎ অবশিষ্ট থাকেন, এই কারণেই সেই পরমেশ্বরের নাম ‘শেষ।

৯৪। (আল্ ব্যাণ্ঠেী) এই ধাতু হইতে আপ্ত’ শব্দ সিদ্ধ হয়। য় সর্বান্ ধৰ্ম্মাত্মনঃ আপ্ন্যোতি বা সর্বৈধর্মাত্মভিরাপ্যতে ছলাদিরহিতঃ স আপ্তঃ যিনি সত্য উপদেশক, সকল বিদ্যাযুক্ত, যিনি ধৰ্মাত্মাদিগকে প্রাপ্ত হন এবং ধর্মাত্মাদের দ্বারা প্রাপ্ত হইবার যোগ্য ছলকপটাদি রহিত, এইজন্য এই পরমাত্মার নাম ‘আপ্ত।

৯৫।(ডুকৃঞ করণে) শম্পূ র্বক এই ধাতু হইতে শঙ্কর’ শব্দ সিদ্ধ হয়। য় শঙ্কল্যাণং সুখং করোতি স শঙ্করঃ যিনি কল্যাণ অর্থাৎ সুখকারী, এইজন্য সেই পরমেশ্বরের নাম শঙ্কর।

৯৬। মহৎ’ শব্দ পূর্বক’ দেব’ শব্দ হইতে ‘মহাদেব’ শব্দ সিদ্ধ হয়। ‘য়ো মহাতাং দেবঃ স মহাদেবঃ’। যিনি মহান্ দেবগণেরও দেব, অর্থাৎ বিদ্বাদেরও বিদ্বান্, সূৰ্য্যাদি পদার্থ সমূহের প্রকাশক, এইজন্য সেই পরমত্মার নাম মহাদেব।

৯৭। (প্রীঞ তর্পণে কান্তৌ চ) এই ধাতু হইতে ‘প্রিয়’ শব্দ সিদ্ধ হয়। য়ঃ পৃণাতি প্রীয়তে বা স প্রিয়ঃ যিনি সব ধর্মাত্মা, মুমুক্ষু ও শিষ্টদিগকে প্রসন্ন করেন এবং যিনি সকলের কাম্য, এইজন্য সেই পরমেশ্বরের নাম ‘প্রিয়।

৯৮।(ভূ সত্তায়াম) স্বয়ং পূর্বক এই ধাতু হইতে স্বয়ম্ভ’ শব্দ সিদ্ধ হয়। য়ঃ স্বয়ং ভবতি স স্বয়ম্ভরীশ্বরঃ যিনি আপনা আপনিই আছেন, যিনি কখনও কাহারও দ্বারা উৎপন্ন হন নাই, সেইজন্য সেই পরমেশ্বরের নাম স্বয়ম্ভু।

৯৯। (কু শব্দে) এই ধাতু হইতে ‘কবি’ শব্দ সিদ্ধ হয়। ‘য় কৌতি শব্দয়তি সর্বা বিদ্যাঃ স কবিরীশ্বরঃ যিনি বেদদ্বারা সকল বিদ্যার উপদেশ দান করেন ও যিনি বেত্তা, এইজন্য সেই পরমেশ্বরের নাম কবি।

১০০। (শিবু কল্যাণে) এই ধাতু হইতে ‘শিব’ শব্দ সিদ্ধ হয়। বহুলমেতন্নিদর্শনম ইহা দ্বারা ‘শিবু’ ধাতু গ্রহণ করা হয়। যিনি কল্যাণস্বরূপ ও কল্যাণকারী এইজন্য সেই পরমেশ্বরের নাম ‘শিব।

পরমেশ্বরের এই শতনাম লিখিত হইল। কিন্তু এই সকল ব্যতীতও পরমেশ্বরের অসংখ্য নাম আছে। কারণ পরমেশ্বরের গুণ-কর্ম স্বভাব যেরূপ অনন্ত, তাহার নামও সেইরূপ অনন্ত। সেই সকলের প্রত্যেকটির গুণ, কর্ম ও স্বভাব অনুসারে এক একটি নাম হইয়াছে। আমার লিখিত এই নামগুলি সমুদ্রে বিন্দুবৎ। কারণ, বেদাদিশাস্ত্রে পরমাত্মার অনন্ত গুণ-কর্ম-স্বভাব ব্যাখ্যাত হইয়াছে। এই সকলের অধ্যয়ন ও অধ্যাপনের দ্বারা বোধ হওয়া সম্ভব। যাঁহারা বেদাদি শাস্ত্র পাঠ করেন, তাঁহাদের অন্যান্য পদার্থেরও পূর্ণ জ্ঞান হইতে পারে।

প্রশ্ন –অন্যান্য গ্রন্থকারেরা যেরূপ আরম্ভে, মধ্যে এবং শেষে মঙ্গলাচরণ করেন, আপনি সেইরূপ কিছু লিখেন নাই বা করেন নাই কেন?

উত্তর –সেইরূপ করা আমার পক্ষে সঙ্গত নহে। কারণ যে আদি, মধ্যে ও অন্তভাগে মঙ্গল করিবে, তাহার গ্রন্থে আদি, মধ্য ও অন্তের মধ্যস্থলে যাহা কিছু লিখিত হইবে তাহা অমঙ্গলই হইবে। এইজন্য মঙ্গলাচরণং শিষ্টাচারাৎ ফলদর্শনাছু তিতশ্চেতি ইহা সাংখ্য শাস্ত্রের বচন। ইহার অভিপ্রায় এই যে, ন্যায় পক্ষপাতরহিত, সত্য ও বেদ্যেক্ত ঈশ্বরের আদেশ অনুসারে উহার যথাবৎ সর্বত্র আচরণ করাকে মঙ্গলাচরণ’ বলে। গ্রন্থের আরম্ভ হইতে সমাপ্তি পর্যন্ত সত্যাচার করাই মঙ্গলাচরণ। কোন স্থলে মঙ্গল, কোন স্থলে অমঙ্গল লেখা মঙ্গলাচরণ নহে। মহাশয় মহর্ষিগণের লেখা দেখুন–

য়ান্যনবদ্যানি কর্মাণি তানি সেবিতব্যানি নো ইতরাণি ॥ ইহা তৈত্তিরীয়োপনিষদের বচন–হে সন্তানগণ! অনবদ্য অনিন্দনীয় অর্থাৎ ধর্মযুক্ত কর্ম তোমাদের করণীয়, অধর্মযুক্ত কর্ম। করণীয় নহে। এইজন্য আধুনিক গ্রন্থ সমূহে যে শ্রীগণেশায় নমঃ’, ‘সীতারামাভ্যাং নমঃ, ‘রাধাকৃষ্ণাভ্যাং নমঃ’, ‘শ্রী গুরচরণারবিন্দাভ্যাং নমঃ’, হনুমতে নমঃ’, দুর্গায়ৈ নমঃ’, ‘বটুকায় নমঃ’, ‘ভৈরবায় নম’, ‘শিবায় নমঃ, সরস্বতৈ নমঃ, নারায়ণায় নমঃ’ ইত্যাদি লেখা দেখা যায়। এ সমস্ত বেদ ও শাস্ত্রবিরুদ্ধ বলিয়া বুদ্ধিমান ব্যাক্তিরা মিথ্যা বলিয়াই মনে করেন। কারণ বেদ এবং মুনি ঋষিদের গ্রন্থের কোথাও এইরূপ মঙ্গলাচরণ দেখিতে পাওয়া যায় না। আর্ষ গ্রন্থ সমূহে ‘ও’ এবং “অথ’ শব্দই দেখা যায় দেখুনঃ–

অথশব্দানুশাসন। অথেত্যয়ং শব্দোS ধিকারার্থঃ প্রয়ুজ্যতে। ইহা ব্যাকরণ মহাভাষ্য।
অথাতো ধর্মজিজ্ঞাসা’। অথেত্যানন্তয়ে, বেদাধ্যয়নানন্তর। ইহা পূর্বমীমাংসা
‘অথাতো ধর্মং ব্যাখ্যাস্যামঃ। অথেতি ধর্মকথানানন্তরং ধর্মলক্ষণং বিশেষেণ ব্যাখ্যাস্যামঃ। ইহা বৈশেষিক দর্শন। অথ যোগানুশাসনম। অথেত্যয়মধিকারার্থঃ ইহা যোগশাস্ত্র। অথ ত্রিবিধদুঃখাত্যন্তনিবৃত্তিরত্যন্ত পুরুষার্থঃ। সাংসারিক বিষয়ভোগানন্তরং ত্রিবিধদুঃ খাত্যন্তনিবৃত্ত্যর্থঃ প্ৰয়ত্ব ও কর্তব্যঃ। ইহা সাংখ্যশাস্ত্র। অথাতো ব্রহ্মজিজ্ঞাসা’। ইহাবেদান্তসূত্র।১১।১। ‘ওমিত্যেদক্ষরমুগীথমুপাসীত। ইহা ছান্দোগোপনিষদের বচন ১।১।১ ওমিত্যেদক্ষরমিদ সর্বং তস্যোপব্যাখ্যান।

এই ভাবেই অন্যান্য মুনি ঋষিদের গ্রন্থে ‘ও’ এবং অথ’ শব্দ লিখিত হইয়াছে। (‘অগ্নি’, ইট্‌, ‘অগ্নি’, য়ে ত্রিষপ্তাঃ পরিয়ন্তি’) এইসকল শব্দ চারিবেদের আদিতে লিখিত হইয়াছে ‘শ্রীগণেশায় নমঃ’ ইত্যাদি শব্দ কোথাও নেই। বৈদিকগণ যে বেদের আরম্ভে ‘হরিঃ ওম’ লিখেন এবং পাঠ করেন, তাঁহারা উহা পৌরাণিক এবং তান্ত্রিকদিগের মিথ্যা কল্পনা হইতে শিখিয়াছেন। বেদাদি শাস্ত্রের আরম্ভে ‘হরি’ শব্দ কোথাও নাই, সুতরাং ‘ওম’ বা অথ’ শব্দই গ্রন্থের প্রারম্ভে লেখা উচিত। ঈশ্বরের [নাম] বিষয়ে এই কিঞ্চিত্মাত্র লিখিত হইল। ইহার পর শিক্ষা বিষয়ে লিখিত হইবে।

ইতি শ্রীমদ্দয়ানন্দসরস্বতীস্বামীকৃতে সত্যার্থপ্রকাশে
সুভাষাবিভূষিতে ঈশ্বর নাম বিষয়ে
প্রথমঃ সমুল্লাসঃ সম্পূর্ণঃ ॥ ১ ॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *