০১. ইহা খেতে বড় সৌন্দর্য হয়

লিলিয়ান এক টুকরা মাছ ভাজা মুখে দিয়ে হাসিমুখে বলল, ইহা খেতে বড় সৌন্দর্য হয়। তাহের হো-হো করে হেসে ফেলল। লিলিয়ান ইংরেজিতে বলল, আমার ধারণা আমি ভুল বাংলা বলি নি। হাসছ কেন?

তাহের হাসি থামাল না। তার হাসিরোগ আছে। একবার হাসতে শুরু করলে সহজে থামতে পারে না। লিলিয়ান আহত গলায় ইংরেজিতে বলল, আমার বাংলা শেখার বয়স মাত্র। ছমাস। যা শিখেছি নিজের চেষ্টায় শিখেছি। এ ব্যাপারে তুমি আমাকে কোনো সাহায্য করছ না। বরং উল্টোটা করছি। যখনই বাংলা বলার চেষ্টা করছি তুমি হাসছ। এটা কি ঠিক?

তাহের বলল, অবশ্যই ঠিক। একশ ভাগ ঠিক। আমরা বাঙালিরা বিদেশীদের মুখে ভুল বাংলা সহ্য করি না। যতবার তুমি ভুল বাংলা বলবে ততবার আমি হাসব। মাছ ভাজা মুখে দিয়ে বললে, ইহা বড় সৌন্দর্য হয়। মাছ ভাজার মধ্যে আবার সৌন্দৰ্য কী? এটা পিকাসোর ছবি না, আবার রবীন্দ্রনাথের কবিতাও না। মাছ ভাজা হলো মাছ ভাজা। বুঝলে?

না, বুঝলাম না। মাছ ভাজা খেতে ভালো লাগলে আমি কিছুই বলব না?

বলবে–খেতে মজা হয়েছে, কিংবা বলবে–ভালো হয়েছে। খেতে সৌন্দৰ্য হয়েছে আবার কী? সুন্দর আমরা খাই না। চাঁদেব আলো খুব সুন্দর, তাই বলে চাঁদের আলো কি কেউ খায়?

তাহের আবার হেসে উঠল। লিলিয়ান তাহেরের উপর রাগ করার চেষ্টা করছে, পারছে না। কখনো পাবে না। তার মনে হয় না কখনো পারবে। লিলিয়ানের বয়স তেইশ। নেপলস-এর মেয়ে। তাহেরের সঙ্গে তার পরিচয় হয় ইয়েলো ষ্টোন পার্কে। পরিচয়-পর্ব বেশ মজার। লিলিয়ান ত্রিশ ডলারের টিকিট কেটে একটা ট্যুর গ্রুপের সঙ্গে এসেছে। এই প্ৰথম শহর ছেড়ে বাইরে আসা, যা দেখছে তাই তার ভালো লাগছে। সে মুগ্ধ হয়ে একের পর এক ছবি তুলে যাচ্ছে–তখন সে লক্ষ করল, কালো, লম্বামতো ঝাঁকড়া চুলের একটি ছেলে তার দিকে তাকিয়ে হো-হো করে হাসছে। রূপবতী মেয়েদের আশেপাশে যে-সব ছেলেরা থাকে তারা তাদের অজান্তেই অনেক অদ্ভুত আচরণ করে, কিন্তু এরকম অশালীন ভঙ্গিতে দাঁত বের করে কখনো হাসে না। লিলিয়ান ব্যাপারটা অগ্ৰাহ্য করার চেষ্টা করল। কিন্তু অগ্রাহ্য করা যাচ্ছে না। যতবারই সে ছবি তুলছে ততবারই মানুষটা মুখের সব কটা দাঁত বের করে হাসছে। যেন লিলিয়ান তেইশ বছর বয়েসী ঝকঝকে চেহারার তরুণী নয়, যেন সে মহিলা চার্লি চ্যাপলিন। তার প্রতিটি ক্রিয়াকলাপে হাসতে হবে। লিলিয়ান এগিয়ে গেল। বরফ শীতল গলায় বলল, আপনি হাসছেন কেন জানতে পারি?

লিলিয়ানের শীতল গলা শুনে যে-কোনো পুরুষ ঘাবড়ে যেত। এ ঘাবড়াল না। লোকটি হাসিমুখে বলল, অবশ্যই জানতে পারেন। আপনার ছবি তোলা শেষ হোক, তারপর বলব।

এখন বলতে অসুবিধা আছে?

হ্যাঁ অসুবিধা আছে, অবশ্যই অসুবিধা আছে।

আমার ছবি তোলা শেষ হয়েছে, আপনি বলুন কেন হাসছেন?

আপনি আপনার ক্যামেরার মুখ থেকে ক্যাপ সরান নি। মুখে ক্যাপ লাগিয়ে ছবি তুলছিলেন। এই জন্য হাসছিলাম।

না হেসে আপনি যদি আমাকে বলতেন–ক্যামেরাব মুখেব ক্যাপ সরানো হয় নি–সেটাই কি শোভন হতো না?

হ্যাঁ হতো।

বলতে বলতে তাহের আগের চেয়েও শব্দ করে হেসে উঠল। লিলিয়ান সরে এলো। সে জীবনে এত অপদস্ত হয় নি। তার রীতিমতো কান্না পাচ্ছে। ইচ্ছা করছে ক্যামেরাটা ওল্ড ফেইথফুলের পানিতে ছুঁড়ে ফেলতে। সাধারণ শিষ্টতা, সাধারণ ভদ্রতা কি তরুণী মেয়েরা পুরুষদের কাছ থেকে আশা করতে পাবে না? লিলিয়ানের ইচ্ছা করছে খুব কঠিন কঠিন কথা মানুষটাকে শুনাতে। তা সে পারবে না। খুব রেগে গেলে সে গুছিয়ে কোনো কথা বলতে পারে না। সবচে ভালো হয় লিলিয়ান যদি তার হোটেলে ফিরে যেতে পারে। তা সম্ভব হবে না। সে যে গাইডেড ট্র্যারে এসেছে তাদের মাইক্রোবাস ছাড়বে সন্ধ্য মেলাবার পর। ইচ্ছা না করলেও সন্ধ্যা পর্যন্ত তার এখানে থাকতে হবে। ঘুবেফিরে ঐ লোকটির সঙ্গে দেখা হবে। সেও নিশ্চয়ই সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকবে। লিলিয়ানকে দেখামাত্র দাঁত বের করে হাসবে। কত বিচিত্র মানুষই না পৃথিবীতে আছে।

লিলিয়ান লক্ষ করল, লোকটা তার দিকে আসছে। হাসিমুখেই আসছে। লিলিয়ানোব চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল। মুখে থুথু জমতে শুরু করল। মানুষটাকে কোনো কঠিন গালি দিতে পারলে মন শান্ত হতো। লিলিয়ান জানে, তা সে পাববে না। সবাই সব কিছু পাবে না। লিলিয়ান কাউকে কড়া কথা বলতে পারে না।

আমি আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবার জন্য এসেছি।

লিলিয়ান স্থির চোখে তাকাল, কিছু বলল না। লোকটা নরম গলায় বলল, আমি যখন প্রথম এ দেশে আসি, তখন একটা সস্তা ধরনের ক্যামেরা কিনে খুব ছবি তুলেছিলাম। যা দেখেছি। মুগ্ধ হয়ে তারই ছবি তুলেছি। মজার ব্যাপার হলো, সব ছবি তুলেছি ক্যামেরার ক্যাপ লাগিয়ে। আপনাকে দেখে পুরনো স্মৃতি মনে পড়ল। আপনি কি আমেরিকায় নতুন এসেছেন?

না।

ও আচ্ছা, তাহলে ক্যামেরা নতুন কিনেছেন। এ ধরনের ক্যামেরায় এই অসুবিধা হবে ই। সুন্দর দৃশ্য দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়বেন। ক্যামেরার ক্যাপ না খুলেই ছবি তুলবেন। আপনার যা করা উচিত তা হচ্ছে–Single Lens Reflex ক্যামেরা কেনা। এরে বলে SLR.

আপনার অযাচিত উপদেশের জন্য ধন্যবাদ। আমাকে দয়া করে একা থাকতে দিন।

আমি কি আপনাকে বিরক্ত করছ?

হ্যাঁ করছেন।

লোকটা চলে গেল, কিন্তু লিলিয়ানের মনে হলো সে আবার আসবে। সহজে তার সঙ্গ ছাড়বে না। এশিয়ান ছেলেগুলি মোটামুটি নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করে। সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার সামান্যতম সুযোগও এরা ছাড়ে না। এও ছাড়বে না। চেষ্টা চালিয়েই যাবে। লোকটার সঙ্গে কথা বলাই উচিত হয় নি।

লিলিয়ানের অনুমান মিথ্যা হলো না। বিকেলে লিলিয়ানদের দলের সবাই বসে কফি খাচ্ছে। ছেলেটি উপস্থিত। লিলিয়ানের কাছে গিয়ে হাসিমুখে বলল, আমি আপনার জন্য একটা ফিল কিনে এনেছি।

লিলিয়ান কঠিন মুখে বলল, কেন?

আমার কারণে আপনার ফিল্ম নষ্ট হয়েছে। আমি প্রথম থেকেই লক্ষ করেছিলাম। আমার উচিত ছিল আপনাকে সতর্ক করা। তা করি নি, উল্টা মজা পেয়ে হেসেছি। অবশ্যই অপরাধ করেছি, কাজেই অপবাধের প্রায়শ্চিত্ত করছি।

লিলিয়ান কঠিন মুখে বলল, অপরাধ টপরাধ কিছু না। আপনি আমার সঙ্গে গল্প কবার লোভ সামলাতে পারছেন না। সুন্দবি অজুহাত বানিয়ে এগিয়ে এসেছেন।

আপনি ভুল বললেন। নিজেকে খুব রূপবতী ভাবছেন বলে এই সমস্যা হয়েছে। আপনি হয়তো আপনার দেশে, কিংবা খোদ এই আমেরিকাতেই রূপবতী। কিন্তু আমাদের দেশের রূপের বিচারে রূপবতী নন।

আপনাদের দেশে রূপবতী হবাব জন্য কি গায়েী রঙ আপনার মতো কুচকুচে কালো হতে হয়?

তা না। আমাদের দেশে রূপবতী মেয়েদের প্রথম শর্ত হলো–তাদের চোখ সুন্দর হতে হয়।

আমার চোখ সুন্দর না?

না। আপনার চোখের মণি নীল। আমাদের দেশে বাদামি বা নীল চোখের তারার মেয়েদের বলে বিড়াল-চোখা মেয়ে। এদের সহজে বর জুটে না। পুরুষরা এদের বিয়ে করতে চায় না।

কী অদ্ভুত কথা! আপনি কোন দেশের মানুষ?

দেশের নাম আপনাকে বলছি, কিন্তু দয়া করে দেশের নাম শুনে ঠোঁট উল্টে বলবেন না–এই দেশ আবার কোথায়? এ জাতীয় কথা যখন কেউ বলে অসম্ভব রাগ লাগে। আমার দেশের নাম বাংলাদেশ। নাম শুনেছেন?

না।

নাম না শোনার অপরাধ আমি ক্ষমা করলাম, যদিও ক্ষমা করা উচিত হচ্ছে না। যাই হোক, আমি কি আপনার পাশে বসতে পারি?

বিড়াল-চোখা মেয়ের পাশে বসে কী করবেন?

আপনার সঙ্গে এক কাপ কফি খাব, তারপর চলে যাব।

বসুন।

আপনার নাম কি জানতে পারি?

লিলিয়ান গ্রে।

আমার নিজের নামটা কি আপনাকে বলতে পারি?

লিলিয়ান চুপ করে রইল। মানুষটার সাহস দেখে সে বিস্মিত হচ্ছে। লোকটা হাসিমুখে বলল, আমার নাম তাহের। আপনি যেমন লিলিয়ান গ্রে, তেমনি গায়ের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে আমাকে তাহের ব্ল্যাক বলে ডাকা যায়। আমি সম্প্রতি আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক্তারি পাস করেছি। আমার ফিন্ড অব স্পেশালাইজেশন হচ্ছেচোখ। আমি ডাক্তারি পড়ছি, ভবিষ্যতে চোখের ডাক্তার হবো।

ভালো।

চোখের ডাক্তার হিসেবে আপনার নীল চোখ সম্পর্কে আমি আপনাকে মজার একটা তথ্য দিতে পারি। তথ্যটা হচ্ছে–বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আপনার চোখ কিন্তু কালো হতে থাকবে, নীল থাকবে না।

কেন?

চোখের পিগমেন্টগুলি বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বড় হতে থাকে। চোখের বঙ নির্ভর কবে পিগমেন্টের সাইজের ওপর। সাইজ বড় হলে রঙ কালো হয়ে যাবে। এক ধরনের Tyndall effect.

কখন চোখ কালো হবে?

যখন বুড়ো হবেন তখন।

আপনি বলতে চাচ্ছেন বৃদ্ধ বয়সে আমি যদি আপনার দেশে যাই তাহলে আমাকে সবাই রূপবতী বলবে?

তাহের হো-হো করে হাসতে লাগল। এমন হাসি যে লিলিয়ানদের দলের সবাই চোখ ঘুরিয়ে তাকাল। লিলিয়ান নিজেও খানিকটা অপ্ৰস্তুত বোধ করতে লাগল। হাসতে হাসতে তাহেরের চোখে পানি এসে গেল। সে রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল, সরি। আমি একটু বেশি হাসি। আমার হাসি-রোগ আছে। একবার হাসতে শুরু কবলে থামতে পারি না। পুরো এক ঘণ্টা তেইশ মিনিট ক্রমাগত হাসার আমার একটা ব্যক্তিগত রেকর্ড আছে। গিনিস রেকর্ড কত তা অবশ্যি জানি না।

হাসি-রোগ ছাড়া আর কী রোগ আছে?

ঘুম-রোগ আছে।

ঘুম-রোগটা কী?

একবার ঘুমিয়ে পড়লে সহজে আমার ঘুম ভাঙে না।

খুব আনকমন রোগ কিন্তু না। অনেকেরই এই রোগ আছে।

আমারটা আনকমন। উদাহরণ দিলে বুঝতে পারবেন। দুবছর আগে আমি লস এনজেলসে ছিলাম। হোস্টেলে থাকি। একবার ভূমিকম্প হলো। ভূমিকম্পের নিয়ম হচ্ছে প্রথম একটা ছোট দুলুনি হয়–তারপর হয় বড় দুলুনি। প্রথম দুলুনির পর আমার বন্ধুবান্ধবরা আমার ঘুম ভাঙানোর প্রাণপণ চেষ্টা করল। কোনো লাভ হলো না। শেষে ওরা আমাকে চ্যাংদোলা করে বাইরে নিয়ে ফুটপাতে শুইয়ে রাখল। আমার ঘুম ভেঙেছে ভোরে, জেগে দেখি আমি একটা হাইড্রেন্টের পাশে শুয়ে আছি।

লিলিয়ান খিলখিল করে হেসে উঠল। লিলিয়ানের সঙ্গীরা আবারো ফিরে তাকাল। তাহের বলল, আমরা বোধহয় ওদের ডিস্টার্ব করছি, একটু দূরে গেলে কেমন হয়?

ভালো হয় না। আমাদের যাত্রার সময় হয়ে গেছে। আমি এখন উঠব।

আমার সঙ্গে গাড়ি আছে। আমি আপনাকে পৌঁছে দিতে পারি।

ধন্যবাদ। অপরিচিত কারো গাড়িতে আমি চড়ি না।

শুরুতে অপরিচিত ছিলাম। এখন নিশ্চয়ই অপরিচিত না। আপনি আমার নাম জানেন। আমি আপনার নাম জানি।

লিলিয়ান কঠিন মুখে বলল, আপনি শুধু শুধু আমার সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করছেন। আপনার গাড়িতে আমি যাব না।

লিলিয়ান তার সঙ্গীদের দিকে রওনা হলো। একবার তার ইচ্ছা করল পেছন ফিরে মানুষটির মুখের বিব্ৰত ভঙ্গিটা দেখে। অনেক কষ্টে এই লোভ সে সামলাল। মনে মনে ভাবল–ভালো শিক্ষা হয়েছে। কাউকে শিক্ষা দেবার এটাই সবচে ভালো টেকনিক। প্রথম কিছুটা প্রশ্ৰয় দিতে হয়, তারপর ছুঁড়ে ফেলতে হয় আঁস্তাকুড়ে। আশ্চর্য স্পর্ধাফিল্ম কিনে নিয়ে এসেছে। আড়াই ডলার দামের একটা উপহাব কিনে মনে মনে ভেবেছে অনেক দূর এগিয়ে যাবে।

 

লিলিয়ান ডরমিটরিতে থাকে না। রুমিং হাউজে থাকে। রুমিং হাউজগুলি ইউনিভার্সিটির কোনো ব্যাপার না। ব্যক্তিমালিকানায় চলে। বাড়িওয়ালারা সস্তায় ভাড়া দেয়। রুমিং হাউজে। শুধু থাকার ব্যবস্থা। রান্না করার ব্যবস্থা নেই, কারণ কিচেন নেই। কমন বাথরুম। মাসে চল্লিশ ডলারে এরচে ভালো কিছু আশা করাও অবশ্যি অন্যায়। এরচে বেশি খরচ করে ডরমিটরিতে জায়গা নেয়া লিলিয়ানের সাধ্যের বাইরে। পিকনিক করতে এসে পঞ্চাশ ডলার খরচ হয়ে গেছে। এই মাসটা তার কষ্টে যাবে। কয়েকটা বই কেনা দরকার। এ মাসে কেনা হবে না। ভেবেছিল মার জন্মদিন উপলক্ষে মাকে লংডিসটেন্স কল করবে। তাও সম্ভব হবে না। তিন মিনিট কথা বলতেই লাগে আঠার ডলার। তাছাড়া মার সঙ্গে তিন মিনিট কথা বলাও যাবে না। একবার টেলিফোন হাতে পেলে তিনি ছাড়বেন না। রাজ্যের কথা বলতে থাকবেন। লিলিয়ান যদি বলে–এখন রাখি মা, বিল উঠছে। মা বলবেন–আর একটু, জরুরি কথাটাই বলা হয় নি। তোর পজার চাচা ঐদিন কী করেছে শোন। ঐ লোকটার। আক্কেল বলে এক জিনিস এখনো হলো না। এদিকে তার ডেনটিস্ট বলেছে তার না-কি তিনটা আক্কেল দাত। এমন কথা কি শুনেছিস কখনো—তিনটা আক্কেল দাঁত?

 

বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে লিলিয়ানের ঘুম এলো শেষ রাতে। ঘুম আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল। সে অপরিচিত একটা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল নদী। পানিতে কানায় কানায় ভর্তি। নদী, নদীর ওপাশে বন-সব জোছনায় থৈ-থৈ করছে। হঠাৎ মাঝ নদীতে কালোমতো কী দেখা গেল। স্রোতের প্রবল টানে ভেসে যাচ্ছে। লিলিয়ান দেখতে পারছে না, তবু পরিষ্কার বুঝতে পারছে নদীর স্রোতে যে জিনিসটা ভেসে যাচ্ছে তা একটা মৃতদেহ। মৃতদেহটা লিলিয়ানের চেনা। খুব চেনা। মৃত মানুষ প্রশ্নের জবাব দেয় না। তবু লিলিয়ান চিৎকার কবে উঠল— কে কে কে?

স্বপ্নে সবই সম্ভব। মৃতদেহ কথা বলল। অনেক কষ্টে পানিব উপর উঠে বসল। ক্ষীণ গলায় বলল, লিলিয়ান আমি। ওরা আমাকে মেরে নদীতে ফেলে দিয়েছে। তুমি আমাকে देंbi७।

লিলিয়ান আতঙ্কে অস্থির হয়ে বলল, আমি কী করে তোমাকে বাঁচাব? তুমি তো মরেই গেছ।

বাঁচাও লিলিয়ান, বাঁচাও। প্লিজ প্লিজ।

এই সময় নদীর স্রোত বেড়ে গেল। জলের প্রবল টান উপস্থিত হলো। শো-শো শব্দ হতে লাগল। মৃতদেহটি ভাটির দিকে তীব্ৰ গতিতে ছুটে যাচ্ছে। অনেক অনেক দূর থেকে সে ডাকছে–লিলিয়ান লিলিয়ান।

লিলিয়ান নদীর পাড় ঘেসে ছুটতে শুরু করেছে। খানাখন্দ ঝোপঝাড় ভেঙে সে ছুটিছে। মনে হচ্ছে সে আর দৌড়াতে পারবে না। হুঁমড়ি খেয়ে পড়বে। মৃতদেহ এখনো তাকে ডাকছে। মৃতদেহের কণ্ঠস্বর ক্ষীণ। সেই স্বর বাতাস ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। লিলিয়ানের কান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে না।

এই অবস্থায় লিলিয়ানের ঘুম ভািঙল। তার সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গেছে। জেগে ওঠাব পরেও সে অনেকক্ষণ ভয়ে ঠকঠক করে কপিল। তার ভয়ের অনেকগুলি কারণেব একটি হচ্ছে–যে যুবকের মৃতদেহটি ভেসে যাচ্ছিল সেই যুবক তার চেনা। যুবকের নাম–তাহের। দেখা হয়েছিল ইয়েলো স্টোন পার্কে। তার গায়ে ছিল। হলুদ বঙেব গলারন্ধ স্যুয়েটার। স্বপ্নেও সেই একই স্যুয়েটার ছিল, তবে তার রঙ ছিল ধূসর।

তীব্র ভয় অনেকটা যেমন হঠাৎ আসে তেমনি হঠাৎই চলে যায়। রোদ উঠার সঙ্গে সঙ্গে লিলিয়ানের ভয় কেটে গেল। শুধু যে ভয় কাটল তাই না, হাসিও পেতে লাগল। তার মনে হলো সে এমন কিছু ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখে নি। নদী দেখেছে। নদী কোনো ভয়ঙ্কর জিনিস নয়। নদী দেখার কারণও আছে। আগের দিন পুরো সময়টা কাটিয়েছে ওল্ড ফেইথফুল আহদের তীরে। তাহের নামের ছেলেটিকে জড়িযে স্বপ্ন দেখেছে–সেটাও স্বাভাবিক। তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। সাক্ষাৎ-পর্বও খুব সুখকর ছিল না। মস্তিষ্ক এই ব্যাপারগুলিই তার নিজের মতো করে সাজিয়েছে। লিলিয়ানের পরিষ্কার মনে আছেছোটবেলায় সে যার সঙ্গেই ঝগড়া করত রাতে তাকেই স্বপ্নে দেখত। সেই স্বপ্নগুলিও হতো ভয়ঙ্কর।

লিলিয়ান ঠিক করুল আজ ইউনিভার্সিটিতে যাবে না। আজ একটামাত্র ক্লাস। এই ক্লাস এমন জরুরি নয়। না করলে ক্ষতি হবে না। তারচে বরং ক্যান্টিনে যাওয়া যাক। কোনো কাজ পাওয়া যায় কি-না সেই চেষ্টা করা যেতে পারে। চার-পাঁচ ঘণ্টা কাজ করতে পারলে–ইয়েলো স্টোন পার্কের খরচ কিছুটা উঠে আসবে।

ক্যান্টিনে কোনো কাজ পাওয়া গেল না। সে সুইমিং পুলের দিকে গেল। অকারণে যাওয়া। সাঁতার কাটতে হলে টিকিট লাগবে। তার টিকিট কাটার মতো ডলার নেই। কী অদ্ভুত দেশ। এই আমেরিকা! কারো মুখে ডলার ছাড়া অন্য শব্দ নেই।

লিলিয়ান বেশ অনেকক্ষণ সুইমিং পুলে সাঁতার কাটা দেখল। তার কাছে সব সময় মনে হয় পৃথিবীর সবচে সুন্দর দৃশ্যের একটি হচ্ছে–মানুষের সাঁতারের দৃশ্য। মানুষ যদি উড়তে পাবত তাহলে সেই দৃশ্য নিশ্চয়ই খুব সুন্দর হতো।

লিলিয়ান স্যান্ডউইচ কিনে ইউনিভার্সিটি বোটানিক্যাল গার্ডেনের দিকে গেল। লাঞ্চ খাওয়ার জন্য তার এখানে একটি প্ৰিয় জায়গা আছে। মেপল গাছের নিচের বাধানো বেদি। গাছের পাতা হলুদ হতে শুরু করেছে। কী সুন্দর লাগছে গাছটাকে! সে একা একা সন্ধ্যা পর্যন্ত গাছের নিচে বসে রইল। আরো কিছুক্ষণ বসত। শীত শীত করছে। সুয়েটারে শীত মানছে না। তাছাড়া ঘুম ও পাচ্ছে। পড়াশোনা করা দরকার। মনে হচ্ছে আজ পড়া হবে না। সকাল সকাল শুয়ে পড়তে হবে।

আশ্চর্য ব্যাপার, আজ রাতেও লিলিয়ানের ঘুম হলো না। শেষ রাতের দিকে তন্দ্ৰামতো হলো। তন্দ্ৰায় দেখল দুঃস্বপ্ন। আগেব রাতের স্বপ্নটাই অন্যভাবে দেখা। সে এবং তাহের দৌড়াচ্ছে। প্ৰাণপণে ছুটছে। তাদেব তাড়া করছে ভয়ঙ্কর কিছু মানুষ। তাহের বলছে, লিলিয়ান আমার হাত ধৰ্ব্ব। আমি দৌড়াতে পারছি না। প্লিজ, আমার হাত ধব। প্লিজ।

লিলিয়ান চিৎকার কবে জেগে উঠল। নিজেকে শান্ত করতে তার সময় লাগল। হিটিং কয়েল দিয়ে গরম এক কাপ কফি খেয়ে মাকে চিঠি লিখতে বসল।

মা,

আমার কী জানি হয়েছে–দুঃস্বপ্ন দেখছি। ভয়ঙ্কর সব দুঃস্বপ্ন। আমার রাতে ঘুম হচ্ছে না। তুমি চার্চে গিয়ে আমার নামে দুটা বাতি জ্বলিও…

এই পর্যন্ত লিখেই লিলিয়ান চিঠি ছিঁড়ে ফেলল। এ ধরনের চিঠি মাকে দেয়ার কোনো মানে হয় না। তিনি শুধু শুধু দুশ্চিন্তায় পড়বেন। তার হাঁপানির টান উঠে যাবে। সে নতুন একটি চিঠি লিখল। সেখানে খুব সুন্দর করে লেখা হলো-ইয়েলো স্টোন পার্কে বেড়াতে যাবার বর্ণনা। ইউনিভার্সিটি সুইমিং পুলে সাতাবের আনন্দ বিবরণ।

ভোর সাতটায় সে তৈরি হলো ইউনিভার্সিটিতে যাবার জন্য। আয়নায় একবার নিজেকে দেখল। দুরাত ঘুম হয় নি। কিন্তু চেহারায় ক্লান্তির কোনো ছাপ নেই। তার নিজের কাছে মনে হলো আজ তার চোখ অন্যদিনের চেয়েও অনেক উজ্জ্বল।

আজ লাঞ্চ আওয়ারের আগে কোনো ক্লাস নেই। কিন্তু টার্ম পেপার জমা দিতে হবে–লাইব্রেরিতে বইপত্র ঘাটাঘাঁটি করতে হবে। বিরক্তিকর কাজগুলির মধ্যে একটি। যে বইটি তার প্রয়োজন দেখা যাবে সেটি ছাড়া সব বইই আছে।

একেকদিন একেকজনের ভাগ্য খুব ভালো থাকে। আজ লিলিয়ানের ভাগ্য খুবই ভালো। যে বইগুলি তার দরকার ছিল সবই সে পেয়ে গেল–বাড়তি পেল একটি মনোগ্রাফ–তার টার্ম পেপারের সঙ্গে মনোগ্রাফের কোনো বেশিকম নেই। টুকে ফেললেই হয়। দুঘণ্টার মধ্যে টার্ম পেপার লেখা শেষ হলো। লিলিয়ান কফি হাউসে কফি খেতে গেল। ঘুম ঘুম লাগছে। কফি খেয়ে ঘুম তাড়াতে হবে, নয়তো ক্লাস করা যাবে না।

কফি হাউজ ছাত্র-ছাত্রীতে ঠাসা। এখন লাঞ্চ আওয়ার। কফি শাপে এত ভিড় থাকার কথা নয়। আজ এত ভিড় কেন? আজ কি সস্তায় কফি জিচ্ছে? না ফ্রি কফি দিচ্ছে? কফি হাউজ মাঝে মাঝে কিছু কায়দা করে নোটিস দিয়ে দেয়–আজ বোলা নটা থেকে সাড়ে নটা পর্যন্ত ফ্রি কফি। ব্যবসার নতুন কোনো চাল। আজও এরকম কিছু হয়েছে বোধহয়। লিলিয়ান কফির মগ হাতে জায়গা খুঁজছে তখন শুনল হাত উচিয়ে কে তাকে ডাকছে–হ্যালো লিলিয়ান, এদিকে এসো জায়গা আছে।

লিলিয়ান তাকিয়ে দেখে, তাহের।

সে কয়েক মুহুর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল— তারপর এগিয়ে গেল। তাহের হাসি মুখে বলল, এত তাড়াতাড়ি তোমার দেখা পাব ভাবি নি। তুমি কি এই ইউনিভার্সিটির ছাত্রী?

হ্যাঁ।

আমি যাচ্ছিলাম পাশ দিয়ে, কী মনে করে যে ঢুকেছি। তোমার সাবজেক্ট কী? এনথ্রাপলজি।

দাঁড়িয়ে আছ কেন? বসে। বসো।

লিলিয়ান বসবে কি-না বুঝতে পারছে না। তার অস্বস্তি লাগছে। মনে হচ্ছে বসা ঠিক হবে না। এই মানুষটির সঙ্গে যোগাযোগের ফল শুভ হবে না। এর কাছ থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই মঙ্গল। তাছাড়া এই লোক তার সঙ্গে এমন আন্তরিক ভঙ্গিতে কথা বলবে কেন? এই অধিকার তাকে কে দিয়েছে?

তুমি কী খাবে? কফি? কফিতে ক্রিম থাকবে–না ব্ল্যাক কফি?

আমি কিছু খাব না।

কাপাচিনো কফি খাবে? প্রচুর ফেনা থাকে, একগাদা মিষ্টি দিয়ে বানানো হয়। দারুণ মজা। তুমি বসে। আমি নিয়ে আসছি।

তাহের কফি নিয়ে ফিরে এসে দেখে লিলিয়ান শান্ত ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে বসে আছে। মেয়েটিকে তার খুব অসহায় মনে হলো। শুধু অসহায় না, ক্লান্ত বিষণু। এই বয়েসী মেয়েরা অনেক হাসিখুশি থাকে।

কফি কেমন লাগছে?

বেশি মিষ্টি।

একেক ধরনের কফির একেক নিয়ম। এই কফি খেতে হয় প্রচুর মিষ্টি দিয়ে। তোমার কি মন খারাপ?

না।

দেখে মনে হচ্ছে খুব মন খারাপ।

লিলিয়ান কিছু বলবে না ভেবেও বলে ফেলল, রাতে আমার ঘুম হয় নি।

তাহের হেসে ফেলল। শব্দময় হাসি। আশেপাশের টেবিল থেকে ছাত্ৰ-ছাত্রীরা তাকাচ্ছে। অনেকের ভুরু কুঁচকে আছে। কোনো বিদেশী তাদের দেশের কফি শাপে বসে সবাইকে অগ্রাহ্য করে এমন হাসি হাসবে তা বোধহয় এদের পছন্দ নয়।

তাহের লিলিয়ানের দিকে ঝুঁকে এসে বলল, শোন লিলিয়ান—মাঝে মাঝে রাতে ঘুম না হওয়াই সুস্থ মানুষের লক্ষণ। শুধুমাত্র পশুদেরই রাতে ঘুমের অসুবিধা হয় না। মানুষের হয়। আমাকে দেখা–আমি বিছানায় শোয়া মাত্র ঘুমিয়ে পড়ি। এ জন্য নিজেকে পশু পশু লাগে। হা হা হা।

আবারো সেই হাসি। আবারো লোকজন চোখ ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে। লিলিয়ান বলল, আমি উঠব। কফির জন্য ধন্যবাদ।

আহা, বসো আর খানিকক্ষণ।

না না।

কাল তো ছুটি। এত তাড়া কীসের? এখান থেকে নব্বুই কিলোমিটার দূরে একটা পেট্রোফাইড ফবেস্ট আছে। পুরো জঙ্গল পাথর হয়ে আছে। আমি আগামীকাল যাব বলে ভাবছি। দিনে দিনে ফিরে আসা যাবে। তুমি কি আগ্রহী?

না, আমি আগ্রহী না; আমার বেড়াতে ভালো লাগে না।

ঐদিন ইয়েলো স্টোন পার্কে কিন্তু খুব বেড়াচ্ছিলে।

ঐদিন ভালো লেগেছিল। এখন লাগবে না।

লিলিয়ান বের হচ্ছে। তাহের সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে। তাকে মুখের ওপর না বলা হয়েছে তবু কোনো বিকার নেই। অদ্ভুত নির্লজ্জ ধরনের ছেলে তো। সাধারণত আমেরিকান ছেলেগুলি এরকম হয়–আঠার মতো লেগে থাকে। এ তো বিদেশী এক ছেলে। তার মান-অপমান বোধ আরো খানিকটা থাকা উচিত ছিল না?

লিলিয়ান বলল, আর আসতে হবে না। আমি যাচ্ছি।

তাহের বলল, আবার দেখা হবে। ভালো থাক–রাত জেগে জেগে তুমি যে উচ্চ শ্রেণীর মানব সন্তান তা প্ৰমাণ করতে থাক। হা হা হা। ভালো কথা, তুমি কি আমার টেলিফোন নাম্বার রাখবে? রাতে দুঃস্বপ্ন দেখলে টেলিফোন করতে পার।

আমি অন্যের টেলিফোন নাম্বার রাখি না।

অন্যের টেলিফোন নাম্বারই তো রাখতে হয়। নিজেরটা তো মনেই থাকে। হা হা হা।

আমি যাচ্ছি।

লিলিয়ান দ্রুত করিডোরে চলে এলো। সে এমনিতেই দ্রুত হাঁটে, আজ আরো দ্রুত হাঁটছে। মেমোরিয়েল ইউনিয়নের বাইরে এসে হাঁপ ছাড়ল। পেছনে ফিরে তাকাল। তাহেরকে দেখা যাচ্ছে না। নাছোড়বান্দা হয়ে সে যে পেছনে পেছনে আসে নি–এতেই লিলিয়ান আনন্দিত।

লিলিয়ান তার আপার্টমেন্টে ফিরল না। কাঁধে ব্যাগ বুলিয়ে হাঁটতে বের হলো। আজ সারাদিন সে হাঁটবে। হেঁটে হেঁটে এমন ক্লান্ত হবে যে বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়বে। ঘুমুতে যাবার আগে হাট শাওয়ার নেবে। এক গ্লাস আগুন গরম দুধ খাবে। বিছানায় নতুন চাদর বিছিয়ে রাখবে। তার ঘুমের সমস্যা আছে। এক রাত ঘুম না হলে পর পর কয়েক রাত ঘুম হয় না।

বেশিক্ষণ হাঁটতে হলো না। অল্প হেঁটেই লিলিয়ান ক্লান্ত হয়ে পড়ল। হলগুলিতে ঘুরতে এখন আর ভালো লাগছে না। ইচ্ছা করছে আপার্টমেন্টে ফিরে বিছানায় শুয়ে পড়তে। এখন বিছানায় যাওয়াটা হবে বিপদজনক। খানিকক্ষণ ঘুম হবে, কিন্তু রাতটা কাটবে অঘুমো। লিলিয়ান স্যান্ডউইচ কিনল। পার্কে বসে একা একা খেল। একা একা খাওয়া খুব কষ্টের। খাবার সময় একজন কেউ পাশে থাকা দরকার। যে প্রয়োজনেঅপ্ৰয়োজনে কথা বলবে। হাসবে। লিলিয়ানের এমন কেউ নেই। কোনোদিন কি হবে? প্রিয় একজন কি থাকবে পাশে? কে হবে সেই মানুষটি? চার্চের পাদ্রি মাথায় হলি ওয়াটার ছিটিয়ে, বুকে ক্রশ স্পর্শ করে বলবেন–

তোমাদের দুজনকে আমি স্বামী-স্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করলাম। মৃত্যু এসে তোমাদের বিচ্ছিন্ন না করা পর্যন্ত একজন থাকবে অন্যোব পাশে, সুখে দুঃখে, আনন্দে বেদনায়। Till death do you part.

লিলিয়ানের চোখে পানি এসে যাচ্ছে। সে পার্কের অপরূপ দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। মন শান্ত হচ্ছে না। সে একধরনের হাহাকার বোধ করছে–মনে হচ্ছে এই অপরূপ দৃশ্য একা দেখাব নয়। দুজনে মিলে দেখার।

লিলিয়ান আপার্টমেন্টে ফিরুল সন্ধ্যা মিলাবার পর। ক্লাস্তিতে তার শরীর ভেঙে পড়ছে। মনে হচ্ছে এক সেকেন্ডও সে জেগে থাকতে পারবে না। হট শাওয়াব নেয়া, গরম দুধ খাওয়া, বিছানার চাদর বদলানো কিছুই তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে দাবজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। সে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল। গাঢ় গভীর ঘুম। যে ঘুমের সময় মানুষ মানুষ থাকে না, পাথরের মতো হয়ে যায়। গভীব ঘুমের স্বপ্নগুলি অন্যরকম হয়। স্বপ্ন আর স্বপ্ন থাকে না। বাস্তবের কাছাকাছি চলে যায়। হালকা ঘুমের স্বপ্নগুলি হয়। হালকা, অস্পষ্ট কিছু লজিক বিহীন এলোমেলো ছবি। গাঢ় ঘুমের স্বপ্নস্পষ্ট, যুক্তিনির্ভর।

আজ লিলিয়ান দেখল গাঢ় ঘুমের স্বপ্ন। স্বপ্নে সে এবং তাহের দুজন পাশাপাশি শুয়ে আছে। তাহের ঘুমুচ্ছে, সে জেগে আছে। ঘুমের মধ্যে তাহের অফুট শব্দ করল। লিলিয়ান হাত রাখল। তাহেরের গায়ে। হাত ভেজা ভেজা লাগছে। সে চোখের সামনে হাত মেলে ধরল। হাত রক্তে লাল। সে চেঁচিয়ে উঠল। লিলিয়ানের ঘুম ভাঙল নিজের চিৎকারে। বাকি রাত সে ঘুমুল না। জেগে বসে রইল। ভোরবেলা টেলিফোন করল মাকে।

কেমন আছ মা?

আমি ভালো আছি। তোর গলা এমন শোনাচ্ছে কেন? তোর কী হয়েছে?

কদিন ধরে আমি খুব দুঃস্বপ্ন দেখছি।

কী দুঃস্বপ্ন?

ভয়ঙ্কর সব দুঃস্বপ্ন। একটা বিদেশী ছেলেকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন।

এ ছেলের সঙ্গে কি তোর পরিচয় আছে?

না। দুদিন কথা হয়েছে।

কী রকম কথা?

সাধারণ কথা মা। তেমন কিছু না।

ছেলেটার মধ্যে নিশ্চয়ই এমন কিছু আছে যা দেখে তুই ভয় পেয়েছিস।

তেমন কিছু নেই মা। ভালো ছেলে।

দুদিনের আলাপে কী করে বুঝলি ভালো ছেলে?

লিলিয়ান জবাব দিল না। তার মা কয়েকবার বললেন, হ্যালো হ্যালো–লিলিয়ান নতে পাচ্ছিস? আমি তো কিছুই শুনতে পাচ্ছি না–হ্যালো হ্যালো।

লিলিয়ানের সবচে ছোটবোন রওনি কাঁদছে। রান্নাঘরে মা নিশ্চয়ই কল ছেড়ে রেখেছে–পানি পড়ার শব্দ আসছে।

হ্যালো, লিলিয়ান। হ্যালো… ..টেলিফোনটায় কী হলো কিছু শুনতে পারছি না।

লিলিয়ান বলল, মা রওনি কাঁদছে। তুমি ওকে দেখ–আমি টেলিফোন রাখলাম…

না না। টেলিফোন রাখিস না। তুই আমার কথা শোন মা… ..তুই একজন ভালো ডাক্তার দেখা। টাকা। যা লাগে লাগুক… ..আমি যেভাবেই হোক ডলার পাঠাব। কিছু দিন পর পর তুই এমন দুঃস্বপ্ন দেখিস। এটা তো ভালো কথা না।

টেলিফোন বাখলাম মা।

না না না…।

লিলিয়ান টেলিফোন রাখল না। কানে লাগিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। এখনো রওনির কান্না শোনা যাচ্ছে। বাথরুমের ট্যাপ দিয়ে পানি পড়াবা শব্দ আসছে, কেউ একজন বোধহয় এসেছে তাদের বাড়িতে, কলিঃ বেল টিপছে… ..ক্রমাগত বেল বাজছে। লিলিয়ানের মা কাঁদো কাঁদো গলায় বলে যাচ্ছেন, হ্যালো লিলিয়ান হ্যালো। কী হলো টেলিফোনটায়–কোনো কথা শুনতে পাচ্ছি না। অপারেটর হ্যালো অপারেটর…

 

লিলিয়ান মার কথা অগ্রাহ্য করল না। কোনো দিন করেও না। সে একজন সাইকিয়াট্রিস্টেব সঙ্গে কথা বলতে গেল। ইউনিভার্সিটিব সাইকিযাট্রিষ্ট। এরা বলে স্টুডেন্ট কাউন্সিলার। ছাত্র-ছাত্রীদের নানান ধরনে? সমস্যা নিয়ে এঁরা কথা বলেন। এক সময় ছাত্ৰ-ছাত্রীদেব সমস্যা ছিল পড়াশোনা কেন্দ্ৰক–কোর্স ভালো লাগছে না, গ্রেড খারাপ হচ্ছে এই জাতীয়। এখনকার সমস্যা বেশির ভাগই মানসিক। যে কারণে স্টুডেন্ট কাউন্সিলারদের মধ্যে অন্তৰ্গত একজন থাকেন সাইকিয়াট্রিষ্ট।

লিলিয়ান যার কাছে গেল তাঁর নাম ভারমান। ডা. এঙ্গেলস ভারমান। ভদ্রলোক ভারিক্কি ধরনের বেঁটেখাট মানুষ। তাঁর মুখ ভর্তি দাড়িগোঁফ। চুল-দাড়ি সবই পাকা। ফর্স গায়ের রঙের সঙ্গে চুলের রঙ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমাটা ঝুলে আছে নাকের উপর। ভদ্রলোক তাকালেন চশমার ফ্রেমের উপর দিয়ে। লিলিয়ানের মনে হলো–ভদ্রলোকের চোখ সুন্দর। তিনি তাকাচ্ছেন মমতা নিয়ে। ডাক্তাররা যখন রোগীর দিকে তাকান তখন রোগটাকে দেখার চেষ্টা করেন, মানুষটাকে নয়। এই ডাক্তার মানুষটাকে দেখার চেষ্টা করছেন।

লিলিয়ান বলল, গুড মর্নিং ডা. এঙ্গেলস ভারমান।

গুড মর্নিং লিটল মিস।

আমার নাম লিলিয়ান।

গুড মর্নিং লিটল মিস লিলিয়ান।

গুড মর্নিং স্যার।

বলো তো লিলিয়ান, তুমি কেমন আছ?

আমি খুব ভালো নেই।

শুনে খুশি হলাম। সারাক্ষণ ভালো থাকা কোনো কাজের কথা না। তোমরা যদি সারাক্ষণ ভালো থাক তাহলে আমরা কী করব? তোমার সমস্যা কী তা এখন বলো। সহজভাবে বলো। খোলাখুলি বলো।

আমার ঘুম হচ্ছে না।

এটা কোনো সমস্যাই না। ঘুম না হলে এক লক্ষ ধরনের ঘুমের ওষুধ আছে। আর কী সমস্যা?

ঘুমুলেই দুঃস্বপ্ন দেখি।

তুমি তো ভালো আছ, ঘুমিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখ। আমি দেখি জেগে জেগে। চাবদিকে যা দেখছি সবই দুঃস্বপ্ন। গতকাল কী হয়েছে শোন–সাবওয়ে দিয়ে আসছি, আমার চোখের সামনে একজন মহিলার ব্যােগ এক কালো ছোকরা ছিনিয়ে নিয়ে দৌড়ে পালাল। এতগুলি লোক আমরা, কেউ কোনো কথা বললাম না। সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। এটা কি বড় ধরনের দুঃস্বপ্ন না?

আপনিও কিছু বলেন নি?

না। আমি হচ্ছি অবজাবভার, আমি বসে বসে দেখেছি।

লিলিয়ান বলল, অন্যরাও হয়তো আপনার মতো কোনো অজুহাত তৈরি কবে বসে ছিল।

ডা. এঙ্গেলস ভাবমান হাসতে হাসতে বললেন, তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে। তোমার কোনো সমস্যা থাকার কথা না। সমস্যা হয় কম বুদ্ধির মানুষদের। এরা কিছু বুঝতে চায় না। কিন্তু তুমি বুঝবে। যুক্তি দিয়ে বোঝালে বুঝবে। এখন সুন্দর করে তোমার সমস্যা বলো। না-কি বলার আগে কফি খেয়ে নেবে?

কফি খাব।

ঐ টেবিলে কফি মেকার আছে। তোমার জন্য আন এবং আমার জন্য আন। কফির কাঁপে চুমুক দিতে দিতে তোমার সমস্যার কথা বলো। আমার বদঅভ্যাস হচ্ছে, আমি চশমার ফাঁক দিয়ে তাকাই। আশা করি এতে কোনো সমস্যা হবে না। কারণ আমার চোখ খুব সুন্দর। ঠিক বলি নি?

জ্বি, ঠিক বলেছেন।

লিলিয়ান খুব গুছিয়ে তার সমস্যার কথা বলল। ডা. ভারমান কোনো প্রশ্ন করলেন না। চুপচাপ শুনে গেলেন। এক ফাকে উঠে গিয়ে আবার কফির পেয়ালা ভর্তি করে আনলেন। লিলিয়ান কথা শেষ কববার পর ডা. ভারমান মুখ খুললেন। তিনি নরম গলায় বললেন, তোমার পরিবারে লোক সংখ্যা কত?

অনেক। আমাদের যৌথ পরিবার। আমার দুচাচা এবং বাবা… ..এরা তিন ভাই একসঙ্গে থাকেন।

একত্রে রান্না হয়?

হ্যাঁ, এক সঙ্গে রান্না হয়। তবে আমাদের পজার চাচা কিছুদিন পরপর রাগ করে বলেন এখন থেকে তিনি আলাদা রান্নাবান্না করবেন। কারো সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগ নেই। দুএকদিন আলাদা রান্না হয়, তাবপর আবার আগের জায়গায় ফিরে আসেন।

তোমাদের চাচাদের মধ্যে কি খুব মিল?

মোটেও মিল নেই। সারাক্ষণ তাঁরা ঝগড়া করছেন, কিন্তু তারপরেও একজন অন্যজনদের ছাড়া থাকতে পাবেন না। আমার মনে হয় ঝগড়া করার জন্যই তাদের একসঙ্গে থাকা প্রয়োজন। ব্যাপারটা বেশ মজার।

তুমিই প্রথম বাইরে পড়তে এসেছ?

জ্বি।

তুমি যখন বিদেশে রওনা হলে তখন তোমার পরিবারের সদস্যরা কী করল? সবাই খুব কাদল। আমার পজার চাচা পুরো একদিন এক রাত না খেয়ে দরজা জানালা বন্ধ করে ঘরে বসে ছিলেন। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাঁকে খাওয়ানো হয়।

ডা. ভারমান পাইপ ধরাতে ধরাতে বললেন, তোমার সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে তোমার পরিবার। তুমি এমন এক ক্লোজ পরিবার থেকে এসেছি যে পরিবারের সদস্যরা ভালোবাসার কঠিন জালে তোমাকে আটকে রেখেছে। তুমি জাল ছিড়তে চাচ্ছ–পারছি না।

আপনি ভুল বললেন–আমি জাল ছিঁড়তে চাচ্ছি না।

তুমি চাচ্ছ কিন্তু তোমার মন তাতে সায় দিচ্ছে না। তোমার মনে একই সঙ্গে দুটি বিপরীত ধারা কাজ করছে। একটি ধারা তোমাকে জাল কেটে বেরিয়ে আসতে বলছে, অন্যটি তা করতে দিচ্ছে না। এতে মনে প্ৰচণ্ড চাপ পড়ছে।

এর সঙ্গে আমার দুঃস্বপ্নের সম্পর্ক কী? আমি দুঃস্বপ্ন দেখছি অন্য একজনকে নিয়ে।

সম্পর্ক আছে… । ঐ ছেলেটিকে দেখেই তোমার জাল কেটে বেরিয়ে আসবার কথা মনে হলো। তোমার মনের একটি অংশ তাতে সায় দিল না। সৃষ্টি হলো প্রচণ্ড চাপের। দুঃস্বপ্নগুলি চাপের ফল, আর কিছুই না। ছেলেটিকে তোমার খুব ভালো লেগে গেছেতুমি তা স্বীকার করতে চাচ্ছি না।

ছেলেটিকে ভালো লাগার কিছু নেই।

আমার ধারণা আছে। তুমি তোমার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কাকে সবচে ভালোবাসো?

পজার চাচাকে।

চরিত্রের কোন কোন মিল আছে?

ভালো করে চিন্তা কর। আমার ধারণা মিল আছে।

পজার চাচা অকারণে হো-হো করে হাসেন। ঐ ছেলেটিও হাসে।

আর?

এইসব নিয়ে ভাবতে আমার ভালো লাগছে না।

আমি যে তোমার সমস্যাটা ধরিয়ে দিয়েছি তা-কি বুঝতে পেরেছ?

লিলিয়ান জবাব দিল না। ডা. ভারমান হাসলেন। লিলিয়ান বলল, আমাকে আপনি কী করতে বলেন?

উপদেশ চাচ্ছি?

হ্যাঁ।

আমি তোমাকে কোনো উপদেশ দেব না। তুমি কী করবে না করবে তা তোমার ব্যাপার। আমি সমস্যা ধরিয়ে দিয়েছি। সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব তোমার। কারণ সমস্যাটা তোমার, আমার নয়।

লিলিয়ান উঠে দাঁড়াল। ফিরে গেল আপার্টমেন্টে। প্রায় এক ঘণ্টার মতো চুপচাপ বিছানায় শুয়ে রইল। তারপর উঠে হাতে মুখে পানি ছিটাল। সে তার সবচে সুন্দর পোশাকটা পরল। অনেক সময় নিয়ে চুল আঁচড়াল। তার সম্বল অল্প কিছু ডলাবেল সব কটা সঙ্গে নিয়ে বেরুল। সে তাহেরকে খুঁজে বের করবে। এই শহরের মেডিকেল স্কুলের একজন বিদেশী ছাত্রের ঠিকানা বের করা কঠিন হবার কথা না। তবে লিলিয়ান প্রথমে গেল। ডাউন টাউনের এক ফুলের দোকানে। দশ ডলার দিয়ে সে পঁচিশটা চমৎকার গোলাপ কিনল। আধ ফোঁটা গোলাপ! আগুনের মতো টকটকে রঙ। চিরকাল ছেলেরাই মেয়েদের জন্য ফুল কিনেছে। মাঝে-মধ্যে নিয়মেব হেরফের হলে কিছু যায় আসে না।

 

কলিং বেল টেপার সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে গেল। তাহের খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, এসো লিলিয়ান। তার কথা বলার ভঙ্গি থেকে মনে হওয়া অস্বাভাবিক না যে সে লিলিয়ানের জন্যই অপেক্ষা করছিল।

লিলিয়ান বলল, আমি যে এখানে আসব তা কি আপনি জানতেন?

তাহের বলল, জানব কী করে–আগে তো বলো নি।

আমাকে দেখে অবাক হন নি?

আমি এত সহজে অবাক হই না। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে রিকশা করে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে বাবা রিকশা থেকে পড়ে গেলেন। নেমে গিয়ে দেখি মরে পড়ে আছেন। সেই থেকে অবাক হওয়া ছেড়ে দিয়েছি।

লিলিয়ানের চোখে-মুখে হকচকিত ভাব। তার ফর্সা কপাল ঘামছে। হাতের গোলাপগুলি নিয়েও সে বিব্রত। তাহের বলল, ফুলগুলি কি আমার জন্য?

হুঁ।

দাও আমার হাতে। তুমি বসে।

না।

দাঁড়িয়ে থাকার জন্য এসেছ?

লিলিয়ান কী বলবে বুঝতে পারছে না। সত্যি তো সে কী জন্য এসেছে? কেনই বা এসেছে? সে তাকাল চারদিকে। অবিবাহিত পুরুষের ঘর। একপলকেই বোঝা যায়। টেবিলে বা দেয়ালে কোনো তরুণীর ছবি নেই। এটা একটা বড় ব্যাপার। বিছানার কাছে পিন আপ পত্রিকা নেই। লিলিয়ান ক্ষীণ গলায় বলল, আমি এখন চলে যাব।

চলে যাবে ভালো কথা–চলে যাও। হঠাৎ করে একগাদা ফুল নিয়ে এসে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে চলে যাওয়া ভালো।

আপনাকে বিব্রত করার জন্য আমি দুঃখিত।

আমি মোটেও বিব্রত হই নি। বিস্মিত হচ্ছি। অন্যদের বিস্ময় যেমন চোখে-মুখে ফুটে উঠে আমার বেলায় তা হয় না বলেই তোমার কাছে মনে হচ্ছে। আমি পুরো ব্যাপারটা খুব সহজভাবে নিচ্ছি। আসলে তা না। আমার ঠিকানা কোথায় পেলে?

জোগাড় করেছি।

কেন?

লিলিয়ান চুপ করে রইল। তাহেরের মনে হলো এই মেয়ে আর কোনো প্রশ্নের জবাব দেবে না। মেয়েটিকে সহজ করার কোনো পথও সে খুঁজে পাচ্ছে না। কী বললে সে সহজ হবে?

লিলিয়ান, তুমি কি পেট্রিফায়েড ফরেস্টটা দেখতে চাও? ঐদিন আমি যাই নি। তুমি যেতে চাইলে আজ যেতে পারি। সন্ধ্যায্য সন্ধায় চলে আসতে পাবীব।

আমি আমার আপাটমেন্টে ফিরে যাব।

বেশ তো ফিরে যাবে। আমি তোমাকে পৌঁছে দেব।

আপনাকে পৌঁছে দিতে হবে না।

তুমি লক্ষ কর নি বোধহয়–বাইরে খুব ঠাণ্ডা পড়েছে। এই ঠাণ্ডায তুমি এমন পাতলা কাপড় পরে কী করে এসেছি সেও এক রহস্য। তুমি আমার সঙ্গে যেতে না চাইলে একাই যাবে–আমার একটা ওভারকেট আছে, সেটা গাযে চাপিয়ে চলে যেতে পারবে। না-কি আমার ওভারকেটও গায়ে দেবে না?

লিলিয়ান বসল। সে যে বসেছে তাতে সে নিজেও অবাক হয়েছে। তার কাছে মনে হচ্ছে পুরো ব্যাপারটা স্বপ্নে ঘটছে। সে নিজের ইচ্ছেতে কিছু করছে না। যা তাকে করতে বলা হচ্ছে তাই সে করছে। পুবে ঘটনা অন্য কেউ ঘটাচ্ছে। সে অন্য কেউটা কে?

লিলিয়ান।

হুঁ।

কফি খাবে?

হুঁ।

শুনে খুশি হলাম। আমি কফি তৈরি করছি। তুমি সহজ এবং স্বাভাবিক হতে চেষ্টা কর। তারপর তোমার কাছে কয়েকটা জিনিস জেনে নেব। যা যা জানতে চাই তাও বলে নিচ্ছি–এক, হঠাৎ তুমি একগাদা ফুল নিয়ে আমার কাছে কেন এসেছ? দুই, আজ যে আমার জন্মদিন তা-কি তুমি জানো? যদি জানো তাহলে কীভাবে জানো?

লিলিয়ান বিস্মিত হয়ে বলল, আজ। আপনার জন্মদিন?

তাহের বলল, আমি দ্বিতীয় প্রশ্নটির জবাব পেয়ে গেছি। আজ যে আমার জন্মদিন তা তুমি জানো না। এখন বাকি রইল প্রথম প্রশ্ন। তুমি প্রশ্নটির জবাব নিয়ে ভাবতে থাক। আমি একটু গ্রোসরি শপে যাব। ঘরে কফি, চিনি, ক্রিম কিছুই নেই।

আমি কি আপনার এখান থেকে একটা টেলিফোন করতে পারি?

হ্যাঁ পার।

একটা লং ডিসটেন্স কল করব।

একটা কেন, দশটা কর। তুমি আমার এখানে আসায় আমি নিজে যে কী পরিমাণ খুশি হয়েছি তা কোনোদিন তুমি বুঝবে না। প্রথম দেখাতেই ভালোবাসা–এই জাতীয় কিছু কথা সাহিত্যে প্রচলিত আছে। এই জাতীয় বায়বীয় কথা আমি কখনো বিশ্বাস করতাম না। তোমাকে ওল্ড ফেইথফুল লেকের কাছে দেখে প্রথম মনে হলোসাহিত্যের এই কথাটা মিথ্যা না। মেয়েদের পেছনে ঘোরা আমার স্বভাব নয়। তারপবেও আমি খুঁজে খুঁজে তোমার আপার্টমেন্ট বের করেছি। ঐদিন তোমার সঙ্গে ইউনিভার্সিটিতে দেখা হলো। তোমার বোধহয় ধারণা পুরো ব্যাপারটা কাকতালীয়। আসলে তা না। আমি প্রায়ই তোমাদের মেমোরিয়াল ইউনিয়নে বসে থাকতাম। এই আশায় যে তোমার সঙ্গে দেখা হবে। দেখা হলেই বলব, পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম… । কবে। কোথায় কোন রুমে তোমার ক্লাস তাও আমি জানি–প্ৰমাণ দেব?

লিলিয়ান তাকিয়ে আছে, কিছু বলছে না। তাহের আগের মতোই সহজ স্বাভাবিক ভুঞ্জিলিল, আজ ছিল তোমার টার্স পেপার জমা দেয়ার শেষ দিন। আমি কি ঠিক বলেছি?

লিলিয়ান অন্যদিকে তাকিয়ে হাসল। তাহের বলল, আমি কফি নিয়ে আসতে যাচ্ছি। আমার আসতে খানিকটা দেরি হবে। আমার জন্মদিন উপলক্ষে একটা ভালো হোটেলে আমি তোমাকে নিয়ে খেতে যাব। দুশ্চিন্তাগ্ৰস্ত হবার কোনো কারণ নেই। খাওয়ার শেষে আমি তোমাকে তোমার আপার্টমেন্টে পৌঁছে দেব। তুমি যে এসেছ এতেই আমি খুশি। এর বেশি আমি কিছু আশা করি নি। যা হয়েছে তাই যথেষ্ট। যদিও জানি না–ঘটনা এমন কেন ঘটল। ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই আছে। তোমার ইচ্ছা করলে তুমি ব্যাখ্যা করবে। ইচ্ছা না করলে করতে হবে না।

তাহের ঘর ছেড়ে চলে গেল। লিলিয়ান উঠে দরজা বন্ধ করল। টেলিফোন করল তার মাকে। লিলিয়ানের মা আতঙ্ক মেশানো গলায় বললেন, আমি এর মধ্যে তিনবার তোর আপার্টমেন্টে টেলিফোন করেছি। আমরা চিন্তায় চিন্তায় অস্থির।

চিন্তার কিছু নেই মা।

তুই কি গিয়েছিলি কোনো ডাক্তারের কাছে?

হ্যাঁ।

ডাক্তার কী বললেন?

ডাক্তার নতুন কিছু বলে নি। আমি যা জানতাম তাই বলেছেন।

আমি তোর কথা কিছু বুঝতে পারছি না। তুই কী জানতি?

লিলিয়ান হাসল। শব্দ করে হাসল। লিলিয়ানের মা বললেন, কী হলো হাসছিস কেন?

হাসি আসছে তাই হাসছি?

তুই এখন কোথায়?

কেন আমার আপার্টমেন্টে।

না, তুই অন্য কোনো জায়গায়।

কী করে বুঝলে?

আমি জানি। আমার মন বলছে। তুই কি ঐ ছেলেটির কাছে?

হ্যাঁ।

কেন–ঐখানে কেন? কী হচ্ছে লিলিয়ান?

ভয়ের কিছু নেই মা!

অবশ্যই ভয়ের কিছু। তুই কেন ঐ ছেলের কাছে গেলি?

লিলিয়ান খানিকক্ষণ চুপ করে বাইল। ওপাশ থেকে ভদ্রমহিলা বারবার বলতে লাগলেন–হ্যালো হ্যালো।

মা শোন, আমি খুব সম্ভব এই ভদ্রলোককে বিয়ে করব।

কী বলছিস তুই?

আমি এখনো জানি না। ভদ্রলোক এখানে নেই। তিনি কফি কিনতে গিয়েছেন। ফিরে এলেই তাকে বলব।

কী বলবি?

বলব যে আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই। যদি রাজি থাকেন তবেই শুধু আপনার সঙ্গে কফি খাব এবং রাতে ডিনার করতে যাব।

হা ঈশ্বর! মা তুই কী বলছিস? তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে মা। আমি নিশ্চিত তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

অস্থির হয়ে না মা। আমার মাথা খারাপ হয় নি। মাথা ঠিক আছে। আর এক্ষুণি তোমাদের চিন্তিত হতে হবে না। হয়তো বিয়েতে ভদ্রলোক রাজি হবেন না। হয়তো বলবেন–তিনি বিবাহিত।

লোকটা বিবাহিত কি-না তাও তুই জানিস না?

না।

হা ঈশ্বর! এসব কী শুনছি।

কথায় কথায় হা ঈশ্বর বলবে না। মা! শুনতে ভালো লাগছে না।

লিলিয়ান লক্ষ্মী মা, তুই দেশে চলে আয়। তোকে পড়াশোনা করতে হবে না।

কাদছ কেন মা? আমি তো ভয়ঙ্কর কিছু করছি না।

তুই তোর পজার চাচার সঙ্গে কথা বল।

আমি এখন কারো সঙ্গে কথা বলব না।

তোর বাবার সঙ্গে কথা বল।

বললাম তো মা, আমি এখন কারো সঙ্গে কথা বলব ন।

হা ঈশ্বর! আমি এ কী শুনছি?

লিলিয়ান শান্ত স্বরে বলল, ঈশ্বরের প্রতি তোমার অবিচল ভক্তি। কাজেই তুমি ধরে নাও–যা হচ্ছে ঈশ্বরের ইচ্ছার আগোচরে হচ্ছে না।

লিলিয়ান মা লিলিয়ান…

টেলিফোন রাখছি মা। তুমি ভালো থেকে।

লিলিয়ানের মা চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। লিলিয়ান জানালার পাশে দাঁড়াল। বরফ পড়তে শুরু করেছে–বছরের প্রথম বরফ। ইচ্ছে করছে ববফেব ভেতর ছুটে যেতে। সারা গায়ে বরফ মাখতে। লিলিয়ান খানিকক্ষণ বরফ পড়া দেখল। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার জন্যই বোধহয় তার চোখ জ্বালা করছে। সে বাথরুমে ঢুকে চোখে পানি দিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদল। ফিসফিস কবে বলল, মা রাগ করো না। আমি কী করছি আমি নিজেও জানি না। এর ফল শুভ হবে, কি শুভ হবে না। তাও জানি না। শুধু একটা জিনিস জানি–আমৃত্যু আমাকে অচেনা-অজানা এই ছেলেটির সঙ্গে থাকতে হবে। এর থেকে আমার মুক্তি নেই। কিংবা কে জানে আমার মুক্তি হয়তো বন্ধনের ভেতরই ঘটবে।

দরজায় কলিং বেল বাজছে। লিলিয়ান দরজা খুলে দিল। তাহের মুগ্ধ গলায় বলল, বাইরে বরফ পড়ছে দেখেছ?

হ্যাঁ।

গায়ে বরফ মাখবে?

হ্যাঁ মাখব!

বাহু চমৎকার। আমাদের দেশে বরফ নেই, তবে বৃষ্টি আছে। বৎসরের প্রথম বৃষ্টি হলে আমরা বৃষ্টিতে ভিাজ, এতে গায়ের ঘামাচি নষ্ট হয়। বরফে কিছু নষ্ট হয় কি-না কে জানে!

তোমাদের দেশের বৃষ্টি কি তুষারপাতের চেয়েও সুন্দর?

লক্ষ গুণ সুন্দর। আমাদের দেশের প্রথম বৃষ্টিতে কী হয় জানো–এক ধরনের মাছ আছে–নাম হলো কৈ মাছ। এরা এত আনন্দিত হয় যে দলবেঁধে পানি ছেড়ে শুকনায় উঠে আসে।

কেন আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছ?

মোটেই ঠাট্টা করছি না। তোমাকে আমি দেশে নিয়ে গিয়ে নিজের চোখে দেখাব তখন তুমি…

তাহের কথা শেষ করল না, থেমে গেল। বিব্ৰত চোখে লিলিয়ানের দিকে তাকাল লিলিয়ানও তাকিয়ে আছে। লিলিয়ানের চোখে চাপা দ্যুতি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *