টয়লার্স অভ দ্য সী – ভিক্টর হুগো / রূপান্তর : সমীর দাস / সম্পাদনা : ইফতেখার আমিন
[স্যামসনের এক দুঃসাহসী, ভবঘুরে যুবক, গিলিয়াত। বাঁশি বাজিয়ে আর দুরন্ত সাগরে মাছ ধরে ওর দিন কাটে। এরই মাঝে অপূর্ব সুন্দরী দেরুশেতের প্রেমে পড়ল সে। কিন্তু বেচারা মুখ ফুটে কথাটা বলতে পারেনি কোনদিন।
প্রেয়সীর চোখের পানি মোছাতে মহাবিপজ্জনক ডোভার আইল্যান্ডে গেল গিলিয়াত, সফল হয়ে ফিরেও এল।
কিন্তু একদিন যে রেভারেন্ড কড্রের প্রাণ বাঁচিয়েছিল গিলিয়াত, সে-ই কিনা…
তারপর কি হলো? দুরন্ত ইংলিশ চ্যানেল গ্রামে থেকেও গ্রামছাড়া বাড়িটার পায়ের কাছে আছড়ে পড়ে কি আকুতি জানাচ্ছে বারবার?]
.
এক
ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে ইংলিশ চ্যানেল নামে দিগন্ত বিস্তৃত এক সাগর।
তার ঢেউ খেলানো নীল পানির বুক ফুড়ে এখানে-সেখানে জেগে আছে অসংখ্য ছোট-বড় দ্বীপ। সেগুলোর মধ্যে একটার নাম গেরানসি। এই দ্বীপের ছোট্ট এক গ্রাম স্যামসন। আজ এখানকার মানুষের আনন্দের দিন। কারণ আজ বড়দিন, পঁচিশে ডিসেম্বর।
একে বড়দিন, তারওপর এবার শীতের শুরু থেকেই দ্বীপে বেশ তুষারও পড়ছে। এমনিতে নিয়মিত তুষারপাত হয় না গেরানসিতে, তাই ব্যাপারটা শুরু হলে রীতিমত সাড়া পড়ে যায়। কিন্তু আজ নটা বেজে যাওয়ার পরও কোথাও সেরকম কিছু চোখে পড়ছে না।
চারদিক নীরব, নিস্তব্ধ। রাস্তায় মানুষজন নেই। বিশেষ উৎসবের দিনের আনন্দ-উল্লাসের কোন লক্ষণ তো নেই-ই, তুষার নিয়েও কারও যেন কোন মাথাব্যথা নেই। চ্যানেলের তীর ঘেঁষে একটা রাস্তা গ্রামের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত চলে গেছে, ওটাই প্রধান রাস্তা এখানকার। গোটা গ্রামের সাধে সেটাও আজ তুষারের পুরু চাদরের তলায় চাপা পড়ে আছে।
কুয়াশার আবছা পর্দা ভেদ করে সূর্যের নিস্তেজ আলো সবেমাত্র স্যামসনের বুক ছুঁয়েছে। কনকনে শীত। এত শীতও সাধারণত পড়ে না গেরানসিতে, হয়তো সেজন্যেই বিশেষ দিন হওয়া সত্ত্বেও মানুষজন ঘর ছেড়ে পথে বেরোতে তেমন উৎসাহ বোধ করছে না।
তবু, এর মধ্যেও তিনজনকে দেখা যাচ্ছে রাস্তায়। যেন গ্রামবাসীর মন রাখতেই বেরিয়েছে তারা-একটি ছোট ছেলে, এক সুন্দৰী তরুণী এবং এক যুবক। তুষারমোড়া রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে।
ছেলেটি রয়েছে সবার আগে, মাঝখানে তরুণী এবং যুবক পিছনে। ছাড়াছাড়া হয়ে যে যার মত পথ চলেছে ওরা তিনজন। দেখলেই বোঝা যায় কারও সাথে কারও সম্পর্ক নেই। ছেলেটির বয়স বছর আটেক হবে। চলতে চলতে প্রায়ই থমকে দাঁড়াচ্ছে সে, শিশুসুলভ বিস্ময়ের দৃষ্টিতে চারদিকের বরফের বিন্তার দেখছে। চেহারায় প্রচণ্ড কৌতূহল ওর।
সম্ভবত গ্রামের সেইন্ট পিটার গির্জা থেকে আসছে ওরা, বড়দিনের বিশেষ প্রার্থনায় যোগ দিতে গিয়েছিল। যুবককে দেখলে শ্রমিক বা নাবিকগোছের কিছু মনে হয়। পরনে ক্যাম্বিসের ডিলেটালা পাজামা গায়ে বাদামী রঙের মোটা গেঞ্জি। খুব সাধারণ বেশভুষা যুবকের। বিশেষ উৎসবের দিনের কোন আমেজ নেই তাতে। আমনা, উদাসীন প্রকৃতির মানুষ সে। কোনদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই! এমনভাবে হাঁটছে যেন এ জগতেই নেই। সামনের জলজ্যান্ত সুন্দরীটির দিকে পর্যন্ত তাকাচ্ছে না।
তরুণীর সাজ-সজ্জা সম্পূর্ণ উল্টো। আজকের উপযুক্ত সাজেই সেজেছে সে। চলার মধ্যে রয়েছে সাবলীল একটা ভাব। ওকে দেখলে যে কেউ সহজেই বুঝবে জগৎ-সংসারের কঠিন কোন দায়িত্ব এখনও ছুঁতে পারেনি মেয়েটিকে। দিব্যি সুখে আছে।
কিছুদূর যেতে পথের পাশে বেশ কয়েকটা বড় বড় ওক গাছ পড়ে। সেগুলোর তলায় পৌঁছতে অনেকটা যেন বেখেয়ালেই হাঁটার গতি কমে গেল তরুণীর, ঘুরে তাকাল। চোখ পড়ল যুবকের ওপর। সে তখন ওর শখানেক হাত পিছনে, ধীর পায়ে হেঁটে আসছে।
দাঁড়িয়ে পড়ল তরুণী। কিছু ভাবল খানিক, তারপর একটুখানি হেসে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে পথের ওপর কি যেন করল। কাজ সেরে সোজা হয়ে আবার পিছনে তাকাল ও, চোখাচোখি হয়ে গেল যুবকের সাথে।
এবার টনক নড়ল তার, সামনের তরুণীটিকে এতক্ষণে যেন চিনতে পেরেছে। ও আর কেউ নয়, তারই প্রতিবেশী-অপরপা দেরুশেত। যুবকের সাথে চোখাচোখি হতেই মেয়েটি বাতাসে মন পাগল করা এক টুকরো হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বাঁ-দিকের এক গলিতে ঢুকে পড়ল। উধাও হয়ে গেল মুহূর্তে
যুবকের মধ্যে বিশেষ কোন প্রতিক্রিয়া হয়েছে বলে মনে হলো না। যেমন চলছিল, তেমনি চলতে থাকল। আনমন, উদাসীন। দেরুশেত যে গাছগুলোর নিচে থেমেছিল, কয়েক মিনিট পর সেখানটায় এসে পৌঁছল যুবক।
নরম তুষারের বুকে একজোড়া ছোট, মেয়েলি পায়ের ছাপ ফুটে আছে দেখতে পেয়ে ক্ষণিকের জন্যে হাঁটার গতি পড়ে গেল তার। শুধু পায়ের ছাপই নয়, সাথে আরও কিছু আছে ওখানটায়। অতি পরিচিত একটা নাম-গিলিয়াত।
আঙুলে তুষার কেটে আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা রয়েছে যুবকেরই নাম। দেরুশেত লিখেছে।
বুকের রক্ত মুহূর্তের তরে চঞ্চল হয়ে উঠল তার। চার অক্ষরের নামটার দিকে কিছুক্ষণ বোকার মত তাকিয়ে থাকল সে, ছোট ছোট পায়ের ছাপগুলোও কিছুসময় দেখল। খানিক পর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল সে, মাথা নিচু করে ধীর পায়ে এগিয়ে চলল গন্তব্যের দিকে।
দুই
স্যামসন গেরানসি দ্বীপের কয়েকটা নৌ-বন্দরের অন্যতম, ছোটখাট এক বন্দর। এখানকার বাসিন্দাদের বেশিরভাগই সাগরের ওপর নির্ভরশীল পেশাজীবী। কেউ জাহাজের নাবিক, কেউ বা জেলে। অনেকে নিজ নিজ নৌকায় করে আশপাশের দ্বীপগুলোয় নানান পণ্য পরিবহণের কাজও করে।
গিলিয়াত স্যামসনের বাসিন্দা হলেও স্থানীয় নয়, এখানকার কারও সাথে তার তেমন সম্পর্ক নেই। তাই সবার থেকে দূরে দূরে থাকে ও। স্থানীয়রা ভাবে গিলিয়াত খাপছাড়া মানুষ।
তার বাড়িও অনেকটা তেমনি-গ্রামে থেকেও গ্রামছাড়া, চ্যানেলের তীর ঘেঁষে পানির ওপর জেগে থাকা এক টিলার ওপরে। যেন মালিকের মত ওটারও একা থাকতেই পছন্দ।
সরু একটা খাড়ি টিলাটাকে চারদিক থেকে এমনভাবে ঘিরে রেখেছে যে বাড়িটা বলতে গেলে গ্রাম থেকে একরকম বিচ্ছিন্নই হয়ে আছে। সরু একটা পাথুরে রাস্তা এটার সাথে গ্রামের যোগসূত্র রক্ষার কাজ করছে। বাড়ির চারপাশে বাগান করার মত ছোট্ট একটু জায়গাও আছে, তারপরই একদম খাড়া হয়ে সাগরে নেমে গেছে টিলার কিনারা। ওখানটায় সাগরের গভীরতা অনেক বেশি।
জোয়ারের সময় কখনও কখনও বাড়ির চারদিকের জমিটুকুও তলিয়ে যায়। বাড়িটা গিলিয়াতদের নিজেদের তৈরি নয়, অন্যের কাছ থেকে কিনে নেয়া। অতীতে এক সময় স্থানীয়রা ওটাকে দৈত্যপুরী নামে ডাকত।
কারণ জোয়ারের সময় পানি বাড়তে বাড়তে যখন ও বাড়ির ভিটা ছুঁই ছুঁই করত, তখন নাকি ভেতর থেকে বিকট শুম্ গুম্ আওয়াজ উঠত, মনে হত কোন অতিকায় দানব বাড়িটার ছাদে হেঁটে বেড়াচ্ছে বুঝি। সে আওয়াজ কানে এলে ভয়ে বুক কেঁপে উঠত গ্রামের মানুষের।
জায়গাটা মনোরম দেখে অনেক বছর আগে এক লোক সখ করে বাড়িটা তৈরি করিয়েছিল। কিন্তু ওটায় থাকা আর হয়ে ওঠেনি বেচারার। সেই রহস্যময়, ভীতিকর শব্দের কারণে একদিন তল্লাট ছেড়ে পালিয়ে গেল সে।
তারপর কিছুকাল পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল বাড়িটা। গ্রামের কেউ ভুলেও ওটার ত্রিসীমানার ধার ঘেঁষত না। এর বেশ কিছুদিন পর হঠাৎ কোত্থেকে যেন একদিন গিলিয়াতরা এসে ওই বাড়িতে উঠল।
গ্রামের মানুষ ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক মনে নিল না। ওটাই শেষ পর্যন্ত এই আগন্তুক পরিবারটির সাথে গ্রামবাসীর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার পথে কঠিন এক দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
সে কবেকার কথা-আজ থেকে কম করেও পঁচিশ বছর আগে স্যামসনে এসেছে গিলিয়াতরা। এতদিনেও গ্রামবাসীর সাথে তাদের সম্পর্কের বলতে গেলে কোন উন্নতিই হলো না।
একটু পিছনের পানে তাকানো যাক। প্রায় সিকি শতাব্দী আগে, ফরাসী বিপ্লবের শেষের দিকে একদিন মাঝবয়সী এক বিধবা মহিলা তার একমাত্র শিশু সন্তানকে নিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে গেরানসিতে এসে নামল।
ছেলে সন্তান ছিল সেটি। সে সময় তার বয়স পাঁচ কি ছয় হবে। মাহলা ইংরেজ না ফরাসী, নাকি আর কোন জাতের, গ্রামের কেউ জানত না। জানার চেষ্টাও করেনি কখনও। তার চেহারা দেখেও ব্যাপারটা অনুমান করার উপায় ছিল না।
তার উপাধীও আরেক অজ্ঞাত ব্যাপার। সেটা কি যে ছিল, আজ আর তা নিশ্চিত জানার কোন উপায় নেই, কেননা গেরানসির স্থানীয়দের উচ্চারণ অনুযায়ী সেটা ক্রমে বদলে গিয়ে গিলিয়াত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মহিলাকে গ্রামের সবাই মিসেস গিলিয়াত বলে সম্বোধন, করত। সেই সূত্রে ছেলেটিও কালক্রমে গিলিয়াত হয়ে গেল। টাকা-পয়সা মোটামুটি মন্দ ছিল না মিসেস গিলিয়াতের, কিছুদিনের মধ্যেই দৈত্যপুরী কিনে নিল সে। তার এই দুঃসাহস দেখে গ্রামের মানুষজন শুধু যে বিস্মিত হলো তাই নয়, এমন একটা ভাব দেখাতে লাগল যে ওই বাড়িতে উঠে গ্রামের বহুদিনের পুরানো এক সংস্কারের গোড়ায় যেন কুড়াল মেরে বসেছে মহিলা।
যে বাড়িটাকে কেন্দ্র করে গেরানসির মানুষ এতদিন রাজ্যের জল্পনা-কল্পনা করে এসেছে, নানান মুখরোচক গল্প কেঁদে আত্মতৃপ্তি লাভ করেছে, সেই বাড়িতে কোথাকার কোন এক মেয়েছেলে তার শিশু সন্তান নিয়ে একাই বাস করতে শুরু করেছে, কেউ তা মেনে নিতে পারল না।
সে যা হোক, মিসেস গিলিয়াত সুরুচিসম্পন্ন মানুষ ছিল। দৈত্যপুরীতে উঠে প্রয়োজনীয় মেরামতীর কাজ সেরে ওটাকে নতুন করে রং করিয়ে নিল সে, নিজের হারিয়ে যাওয়া রূপ ফিরে পেয়ে ঝকঝকে হয়ে উঠল বাড়িটা।
তারপর গ্রাম থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন সেই বাড়িতে দুই মা ছেলের দিন বেশ ভালভাবেই কেটে যেতে লাগল। দিনে দিনে বড় হয়ে উঠতে লাগল গিলিয়াত!
মিসেস গিলিয়াত বাড়ির সামনের এক চিলতে জমিতে চমৎকার একটা ফুলের বাগান গড়ে তুলল, অল্পদিনে ফুলে ফুলে ভরে উঠল সেটা। শৈশব কাটিয়ে একসময় কৈশোরে পা দিল গিলিয়াত, তারপর তাঙরুণ্যে।
অবশেষে এল যৌবন। এই সময় বড় একটা ধাক্কা খেল সে। বেশ কয়েক বছর থেকে নানান রোগে শয্যাশায়ী ছিল মা-একদিন হঠাৎ করে নিথর হয়ে গেল।
মানুষ যেমন বহু ব্যবহারে জীর্ণ পোশাক একসময় ফেলে দেয়, মহিলার আত্মাও তেমনি করে তার দেহপিণ্ডর ফেলে রেখে কোন অজানার উদ্দেশে পাড়ি জমাল। ব্যাপারটা অপ্রত্যাশিত ছিল না, কিন্তু গিলিয়াত বেশ কঠিন ধাক্কা খেল। অবশ্য ছেলেকে পথে বসিয়ে রেখে যায়নি মিসেস গিলিয়াত, তার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করে রেখেই গেছে।
বাড়িটা তো রইলই, সেই সাথে গিলিয়াতের জীবনধারণের জন্যে কয়েক হাজার নগদ টাকাও রেখে গেছে সে। আরও কিছু রেখে গেছে নিজের শোবার ঘরের এক কোনায় রাখা মস্ত একটা বাক্সে। ওটার গায়ে তার নিজের হাতে লেখা আছে? আমার পুত্রবধূর জন্যে।
গিলিয়াত জানে না ওটার মধ্যে আসলে কি আছে। তবে শুনেছে, তার ভাবী বউয়ের জন্যে মা ওর ভেতরে অনেকগুলো মূল্যবান পোশাক ও অলঙ্কার তুলে রেখেছে যত্ন করে। ছেলের সামনে কখনও বাক্সটা খোলেনি মিসেস গিলিয়াত। তার বড় সাধ ছিল, পুত্রবধূ বাড়িতে পা রেখে নিজের হাতেই প্রথম খুলবে ওটা। কিন্তু এসবে কি মন মানে?
মায়ের মৃত্যুর কিছুদিনের মধ্যে ওর নিঃসঙ্গ জীবন একেবারে হাঁপিয়ে উঠল। ঘরে মন টেকে না, তাই সাগরের তীরে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে। জোর বাতাসে চ্যানেলের পানি যখন ফুলে-ফেঁপে ওঠে, তখন মন তার কোন্ অজানার পানে ছুটে যায় কে জানে!
সদ্য মা হারা সন্তানের অবুঝ অন্তর আকুল আবেগে হাহাকার করতে থাকে তখন, নীরব বোবা কান্নায় গুমরে মরে গিলিয়াত। একসময় ছল-ছল চোখে বাড়ি ফিরে আসে, অবুঝ শিশুর মত বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।
তিন
গিলিয়াত ছেলেটা দেখতে-শুনতে মোটামুটি ভালই। ছিপছিপে গড়ন, কপালটা সামান্য উঁচু। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা, ঝাঁকড়া চুল ওর। বড়বড় চোখ, রাজ্যের মায়াভরা।
উদাস, বেখেয়াল গোছের ছেলে। তার যে বয়স, সে বয়সে সবাই নিজের বেশভূষার দিকে স্বভাবতই একটু বিশেষ দৃষ্টি রাখে, কিন্তু ও সে ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন।
দেহের গঠন যেমনই হোক, তার শক্তি ছিল অসাধারণ। যে সমস্ত ভারী ভারী জিনিস এক কুড়ি মানুষে মিলেও তুলতে পারত না, সেসব গিলিয়াত একাই তুলে ফেলতে পারত। ওর সাথে লড়াই করতে এসে সে কালের অনেক নামকরা কুস্তি গীরকেও হার স্বীকার করতে হয়েছে। দুহাতে সমান দক্ষতার সাথে তীর-বন্দুক চালাতে পারত গিলিয়াত।
এছাড়া গিলিয়াতের মত দক্ষ সাঁতাঙরু আর দুঃসাহসী নাবিক ওই তল্লাটে দ্বিতীয় কেউ ছিল না। একেকসময় ওর উন্মত্ত সাগরকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করার বিপজ্জনক দুঃসাহস দেখে ভয়ে-বিস্ময়ে জবান আটকে যেত গ্রামের মানুষের। এরকম অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে স্যামসনের মানুষ-ভীষণ দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, ইংলিশ চ্যানেল মত্ত আক্রোশে ফুঁসছে, এমন সময় প্রায় সময়ই দেখা গেছে মাঝ সমুদ্রে একটা খুদে নৌকা উথাল-পাথাল করছে, ঢেউয়ের মাথায় চাটি মেরে এগিয়ে চলেছে মরনপণ করে।
কারও বুঝতে বাকি থাকত না ওই নৌকার মাঝিটি কে হতে পারে। একবার এক নৌকা বাইচের উৎসবে গিলিয়াত তার। অসম সাহসিকতার প্রমাণ দিয়ে উপস্থিত প্রত্যেকের তা লাগিয়ে দিল। বাইচে অংশ নিতে যার যার নৌকা নিয়ে অনেকেই এসেছিল সেবার।
তীরে দর্শকদের উপচে পড়া ভিড়। কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার শেষ পর্যন্ত বাইচের অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে গেল সেদিন। তার বদলে আয়োজনকারীরা একটা ছোট নৌকা নিয়ে অন্য এক ধরনের বাজি ধরল।
ঠিক হলো, যে ওই নৌকায় করে গিয়ে তিন মাইল দূরের হার্য দ্বীপ থেকে নৌকা বোঝাই পাথর নিয়ে ফিরে আসতে পারবে, তাকে নৌকাটা উপহার দেয়া হবে। অনেকেই এগিয়ে কে কতখানি পাকা নাবিক, তা প্রমাণ করার সংগ্রাম শুরু হয়ে গেল।
সাগরের মাঝে বাস করতে করতে মানুষ এমনিতেই দুঃসাহসী ও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। প্রতিযোগীরাও প্রত্যেকেই তাই, কিন্তু কিছু সময় যেতে না যেতে দেখা গেল সাত-আটজন নামকরা, দক্ষ নাবিক সাগরের দুরন্তপনার কাছে হার স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছে, ঘাট ছেড়ে যাওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই একে একে তীরে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে। বেয়াড়া ইংলিশ চ্যানেলের সাথে এঁটে উঠতে পারেনি তারা।
সবার শেষে এল গিলিয়াতের পালা। চ্যানেলের অবস্থা আরও খারাপ তখন, ঝড়ের মাতামাতি বেড়ে গেছে। কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ পর্যন্ত করল না যুবক, নৌকা ছেড়ে দিল। তীর থেকে দূরে সরে গেল সেটা। দেখতে দেখতে উত্তাল, এলোমেলো ঢেউয়ের মধ্যে হারিয়ে গেল।
তীরে অপেক্ষমাণ রুদ্ধশ্বাস দর্শকরা ভয়-ডরহীন হতচ্ছাড়া যুবকটির পরিণতির কথা ভেবে হায় হায় করতে লাগল। কিন্তু ঘণ্টাতিনেক পর তাদের অনুমান মিথ্যে প্রমাণ হলো।
হারয থেকে গিলিয়াত নৌকা বোঝাই পাথর নিয়ে নিরাপদেই ফিরে আসতে পেরেছে দেখে চরম বিস্ময়ে আর অবিশ্বাসে চোয়াল ঝুলে পড়ল তাদের।
বাজির শর্ত অনুযায়ী নৌকাটা গিলিয়াতকে উপহার দেয়া হলো। হোট হলেও বেশ মজবুত ছিল সেটা। সেদিন থেকে নৌকাটি হয়ে উঠল ওর প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী। যখনই ও সাগরে যায়, ওটায় চড়েই যায়।
রাতের গাঢ় আঁধার যখন ধরণীকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে ফেলত, চ্যানেলের কুদ্ধ গর্জনে কান পাতা দায় হয়ে উঠত, তখন সেই খুদে নৌকায় চড়ে প্রাণটা হাতের মুঠোয় নিয়ে কতদিন যে সাগরে মাছ ধরতে গেছে সে, কেউ তার হিসেব রাখেনি।
মাছ ধরা ছিল গিলিয়াতের প্রধান সখ। ইচ্ছেমত যখন-তখন সাগরে মাছ ধরে বেড়াত। নিজের প্রয়োজনে তার থেকে একটা-দুটো রেখে বাকি মাছ হয় ছেড়ে দিত ও, নয়তো গ্রামবাসীর মধ্যে বিলিয়ে দিত।
গ্রামের অন্য সবার মত ব্যবসা-ট্যবসার দিকে তেমন নজর ছিল না গিলিয়াতের। মা সঞ্চিত টাকা-পয়সা রেখে গিয়েছিল বলেই হয়তো সেসবের দরকার হত না। তাই বলে বুদ্ধির ঘাটতি ছিল না তার। দুএকটা চমৎকার কারিগরী কাজ নিজে থেকেই শিখে নিয়েছিল।
ছোটখাট এটা-সেটা ভালই তৈরি করতে পারত গিলিয়াত। এ জন্যে বাড়ির আঙিনার একধারে খুদে একটা কামারখানাও গড়ে নিয়েছিল। সেখানে বসে ইচ্ছেমত দা, কুড়ল, নোঙর ইত্যাদি বানাত। সেসব বাড়িতে মজুত রাখত গিলিয়াত, কারও প্রয়োজন হলে তাকে বিনা পয়সায় দিয়ে দিত।
কিছু কিছু অদ্ভুত ধরনের খেয়ালও ছিল গিলিয়াতের। তার একটা হচ্ছে বন্দি পাখি পেলেই ছেড়ে দেয়া। এ খবর গ্রামবাসীর জানা ছিল, তাই অনেকেই পাখি ধরে নিয়ে আসত ওর কাছে। আর ও সেগুলো কিনে নিয়ে ছেড়ে দিত।
মুক্তির আনন্দে পাখিরা যখন আকাশে ডানা মেলে দিত, আনন্দে চিৎকার করতে করতে উড়ে যেত, গিলিয়াত মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকত। কি এক অনাবিল আনন্দে ওর চোখমুখ ঝলমল করত সে সময়ে।
এই পাখিকে কেন্দ্র করে একবার একটা ঘটনা ঘটল। গ্রামের এক কিশোের একদিন গাছে উঠে পাখির বাসা থেকে কয়েকটা পাখির ছানা নিয়ে নেমে আসছিল, এমন সময় গিলিয়াত এসে হাজির সেখানে।
ছেলেটার হাত থেকে ওগুলো কেড়ে নিয়ে তখুনি গাছে উঠে পড়ল গিলিয়াত, পরম যত্নের সাথে জায়গামত রেখে এল। গ্রামের মুরুব্বি গোছের কয়েকজন সেখান দিয়ে যাচিছল ওই সময়। এই ঘটনা দেখে তার লেটির পক্ষ হয়ে গিলিয়াতকে বেশ কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিল।
প্রতিবাদ দূরে থাকুক, গিলিয়াত একটা কথাও বলল না। শুধু হাত তুলে তাদেরকে দেখাল শাবকহারা মা পাখিগুলো কিভাবে অত চিৎকার করছে আর গাছের ওপর অনবরত চক্কর দিচ্ছে। ওর চোখ ছল-ছল করছিল তখন ওর মনের অবস্থা অনুমান করতে পেরে আর কথা বাড়ায়নি লোকগুলো, বিস্ময় চেপে রেখে চলে গেল।
গ্রামের একজন সৈনিকের কাছ থেকে একটা ব্যাগপাইপ বাঁশি কিনেছিল গিলিয়াত। প্রায়ই সন্ধের পর সাগরের তীরে বসে করুণ সুরে বাজাত সেটা।
বাজাতে বাজাতে উদাস হয়ে পড়ত-কখন আঁধার নেমেছে, রাত গভীর থেকে গভীরতর হয়ে চলেছে, হুঁশ থাকত না তার। গভীর নিশীথে হঠাৎ ঘুম ভেঙে জেগে ওঠা গায়ের লোকে কতদিন যে তন্ময় হয়ে গেছে তার সেই বাঁশির করুণ সুরের বিস্ময়কর ঐন্দ্রজালে, তার হিসেব নেই।
নিজের খেয়াল খুশিমত দিন কাটাত গিলিয়াত। গ্রামের মানুষ মনে করত ছেলেটা ছন্নছাড়া, ভবঘুরে। একটা অপদার্থ ছাড়া কিছু নয়।
অথচ অন্যের উপকার করার ক্ষেত্রে স্যামসনে গিলিয়াতের কোন জুড়ি ছিল না। কেউ কোন সমস্যায় পড়লে সবার আগে ওকেই স্মরণ করত, আর ও-ও সানন্দে ছুটে যেত। সে যত কঠিন সমস্যাই হোক না কেন, পরোয়া করত না গিলিয়াত।
ওর বাড়িটা যে টিলায়, তার কিছুটা দূরে, সাগরের মধ্যে গ্যানিট পাথরের আরেকটা উঁচু টিলা আছে। ওটার আকৃতি দেখলে মনে হয় পানিতে ডুব দিয়ে থাকা মোষের খাড়া শিং, পানির ওপর জেগে আছে বুঝি। এই জন্যে স্থানীয়রা ওটার নাম রেখেছে মহিষ পাহাড়।
তীর থেকে একটা সঙ্কীর্ণ পাথুরে রাস্তা আছে ওটায় যাওয়ার। জোয়ারের সময় পানি বাড়লে ডুবু ডুবু হয়ে যায় রাস্তাটা, নইলে এমনিতে সব সময় পানি থেকে অনেকখানি জেগে থাকে। ঢেউয়ের ক্রমাগত ঝাঁপটায় পাথর ক্ষয়ে ক্ষয়ে এক প্রস্থ সিঁড়ির মত বেশ কিছু ধাপের সৃষ্টি হয়েছে টিলাটার গায়ে, সেই ধাপ বেয়ে ওটার চূড়ায় ওঠা যায়।
স্রোতের কারণে মহিষ পাহাড়ের চূড়ার কাছের খানিকটা জায়গা সমতল হয়ে চমৎকার একটা সিংহাসনের আকার পেয়েছে। প্রকৃতি তার অদ্ভুত খেয়ালবশে সিংহাসনটায় ঠেস দিয়ে বসার জন্যে একটা ব্যাকরেস্ট, এমনকি হাত রাখার জন্যে দুপাশে দুই হাতলও তৈরি করে দিয়েছে। পানির ওপরে যখন জেগে থাকে, মহিষ পাহাড়ে গিয়ে ওঠার লোভ সামলানো তখন সত্যিই খুব কঠিন হয়ে পড়ে।
আবার গেলে সমস্যাও আছে। চলমান জাহাজ, পাল তোলা নৌকার বহর আর চারদিকের অপূর্ব নৈসর্গিক শোভা, এইসব দেখতে গিয়ে মানুষ অনেক সময় দুনিয়াদারি ভুলে যায়।
দুর্ভাগ্যবশত কারও বেলায় যদি তেমনটা ঘটে, টেরও পায় না সে কখন জোয়ার এসেছে চ্যানেলে-তার দ্বীপে ফিরে যাওয়ার পথ তলিয়ে গেছে সাগরে, মহিষপাহাড় ডুবিয়ে দিতে খুব দ্রুত উঠে আসছে। অসহায়ের মত মৃত্যুকে মেনে নেয়া ছাড়া তখন আর কোন পথ খোলা নেই তার।
শোনা যায়, ওই টিলায় গিয়ে অতীতে স্যামসনের দুএকজন বেখেয়াল বাসিন্দা এভাবেই প্রাণ হারিয়েছে। তাই স্থানীয় কেউ জোয়ারের সময় ওখানে যাওয়ার দুঃসাহস ভুলেও করে না। অবশ্য গিলিয়াতের কথা আলাদা।
একেবারেই আলাদা ধাচের মানুষ ও, তাই বিশে তাই মহিষ পাহাড়ের সাথে বিশেষ সখ্যতা গড়ে নিয়েছে। ওর বাড়ি থেকে মহিষ পাহাড়ের দূরত্ব তেমন বেশি নয়, ইচ্ছেমত যখন-তখন সেখানে চলে যায় গিলিয়াত। সিংহাসনে বসে প্রায়ই কি যেন গভীর ভাবনায় তলিয়ে যায়। জোয়ারের পানিকে ও ঘোড়াই কেয়ার করে।
কতদিন গভীর রাতে জোয়ারের পানির ভয়াবহ গুরু গর্জনের শব্দ ছাপিয়ে মহিষ পাহাড় থেকে বাঁশির সুর ভেসে আসতে শুনেছে স্যামসনের মানুষ। সেখানকার ছেলে-বুড়ো সবার খুব ভালই পরিচিত ওই বাঁশি।
ওরকম অপূর্ব সুরের মায়াজাল সৃষ্টি করার মত খেয়ালী বাদকটি যে কে, তাও তারা ভালই জানে।
চার
জাহাজ ব্যবসায়ী বৃদ্ধ লেতিয়ারি স্যামসনের নাম করা ধনীদের একজন। পেশাদারী জীবনের শুরুতে জাহাজের সাধারণ নাবিক ছিল লোকটা, আর আজ নিজেই একটা জাহাজের মালিক। তাও যেমন-তেমন কোন জাহাজের নয়, একেবারে স্টীম এজিন চালিত আধুনিক বাণিজ্য জাহাজের।
প্রায় সত্তর বছরের জীবনে অনেক ঝড়-ঝাঁপটা গেছে লেতিয়ালির ওপর দিয়ে, কিন্তু কোনদিন কোনকিছুর কাছেই নতি স্বীকার করেনি সে। অথচ দুর্ভাগ্য, শেষ পর্যন্ত অভিশপ্ত ব্যাধি বাতের কাছে তাকে হার মানতেই হলো।
বাত প্রায় অচল, পঙ্গু করে ফেলেছে তাকে। এখন তাই ঘরের মধ্যে একরকম বন্দী জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে সে। যে জীবন কিছুকাল আগে পর্যন্ত বলতে গেলে জাহাজে করে সাগর পাড়ি দিয়েই কেটেছে, আজকাল সেই জীবনকে সুদূর অতীতের কোন মিষ্টি মধুর স্বপ্নের মত মনে হয় তার। লেতিয়ারিদের কয়েক পুরুষের আদি পেশা ছিল মূলত জাহাজের নাবিকের চাকরি। পৃথিবীর সাথে লেতিয়ারির প্রথম পরিচয়টা বলতে গেলে সাগরের বুকেই হয়েছিল।
তাই তার খুব ইচ্ছে ছিল সময় হলে মৃত্যুও যেন সাগরেই হয়, পানিতে ভাসতে ভাসতেই যেন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারে সে। কিন্তু মানুষের সব ইচ্ছেই কি পূরণ হয়? এখন বাতে প্রায় অচল হয়ে বাড়িতে পড়ে আছে বুড়ো লেতিয়ারি।
যে সাগরের আচরণ, মতিগতি পর্যবেক্ষণ করে জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে, সেই সাগরের সাথে আজ তার সম্পর্ক চিরতরে ঘুচে গেছে। তারপরও স্যামসনে লেতিয়ারির সাথে কারও তুলনাই হয় না।
সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের মানুষ। পরাজয় কাকে বলে জানে না। কাজ যত কঠিনই হোক না কেন, একবার হাতে নিলে সেটা শেষ না করে ছাড়েনি সে কখনও।
প্রায় ষাট বছর ধরে সাগর বহু কঠোর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে তার ওপর দিয়ে, কিন্তু কোনদিন কাবু করতে পারেনি। মহিষ পাহাড়ের মত অটল থেকে সমস্ত ঝড় ঝাঁপটার মোকাবেলা করে গেছে লেতিয়ারি।
বিশালদেহী মানুষ সে। প্রশস্ত, ঢালু কাধ। বুকের পাটাও তেমনি। গলার স্বর ভরাট, গম্ভীর। হাত দুটো দেহের তুলনায় বেশ দীর্ঘ। ও দুটোর মত তার অন্তরটাও বড়, উদার। বিপত্নীক সে, এবং নিঃসন্তান।
সংসারে দুটি স্নেহের পাত্র-পাত্রী আছে লেতিয়ারির। একটি দেরুশেত, অন্যটি দুরান্দ। দেরুশেত তার ভাইঝি। বাপ-মা মরা এই মেয়েটিই বৃদ্ধের জীবনের প্রধান অবলম্বন। খুব ছোট থাকতে মেয়েটিকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছে সে, সন্তানের মত স্নেহ-ভালবাসা দিয়ে বড় করেছে। মোলয় পা দিয়েছে এখন দেরুশেত।
চমৎকার ছিপছিপে গড়ন। চোখ দুটো হরিণের মত টানা টানা, মায়াবী। অতুলনীয় সুন্দর মুখখানায় মিটিমিটি হাসি সবসময় লেগেই থাকে। গেরানসিতে দেরুশেতের মত সুন্দরী মেয়ে দ্বিতীয়টি নাকি নেই।
লেতিয়ারিকে বাবা ডাকে মেয়েটা। গ্রামের সবাই জানে দেরুশেত তারই মেয়ে। আর দুরান্দ? দুরান্দ হচ্ছে তার প্রিয় জাহাজের নাম-গেরানসির প্রথম স্টীম এজিন চালিত জাহাজ। সেই পালতোলা নৌকা-জাহাজের যুগে ওরকম বাষ্প চালিত অত্যাধুনিক জাহাজ সাগরে নামানোর মত যুগান্তকারী পদক্ষেপ কেবল লেতিয়ারির মত দৃঢ়চেতা, কঠিন সংগ্রামী এবং দূরদর্শী নাবিকের পক্ষেই নেয়া সম্ভব।
একসময় লেতিয়ারির পণ্য পরিবহণের খুব রমরমা ব্যবসা ছিল। নিজের পুরানো স্কুনারে নানান মালপত্র বোঝাই দিয়ে মাসের পর মাস এ-বন্দর সে-বন্দর করে বেড়াত সে। এভাবে ঘুরতে ঘুরতেই একদিন এক বন্দরে নিজের মত আরেক দুঃসাহসী নাবিকের সাথে পরিচয় হয় তার।
লোকটির নাম রাতাগ। তার নিজেরই মত দীর্ঘ, বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী ছিল মানুষটা। একই রকম কর্মঠ, নিউঁকি। তাকে এক বিশেষ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করেছিল সে, তাই তার প্রতি রাগের কৃতজ্ঞতার অন্ত ছিল না। লেতিয়ারিরও ভাল লেগেছিল রাতাগকে।
তাই তাকে গেরানসিতে নিয়ে এল সে। এবং তাল্পদিনের মধ্যে বুঝে ফেলল লোকটা যথেষ্ট বুদ্ধিমান এবং বিশ্বস্ত। এরকম একজন সাহায্যকারী থাকলে খুবই উপকার হয় তার। নিজের খাটুনি অনেক কমে যাবে, আবার সেই সাথে ব্যবসাও আগের মত সমান তালেই চলতে থাকবে।
কাজেই লোকটাকে নিজের জাহাজ ব্যবসার একেবারে অধের্ক অংশীদার করে নিয়ে ওটার সম্পূর্ণ ভার তার হাতেই তুলে দিল সে।
রাতাগ ছিল খুব চাপা স্বভাবের মানুষ, সারাক্ষণ মুখ বুজে থাকত। নিজের সম্পর্কে কখনও কারও সামনে মুখ খুলত না। এই কারণে গেরানসিতে দীর্ঘদিন থাকার পরও তার ব্যাপারে বলতে গেলে প্রায় কিছুই জানত না মানুষ।
লোকটার চাল-চলন, কথাবার্তা, গতিবিধি, সবই কেমন যেন রহস্যময় ছিল। লোকে বলাবলি করত, রাতাগ করতে পারে না এমন কাজ নাকি পৃথিবীতে নেই। বেশ কয়েক বছর সাফল্যের সাথে লেতিয়ারির জাহাজের ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব পালন করল লোকটা। পরিবহণ ব্যবসা আবার ফুলে-ফেঁপে উঠল।
তার ব্যাপারে সে যখন পুরোপুরি নিশ্চিত, তখনই হঠাৎ একদিন রাতের আঁধারে উধাও হয়ে গেল রাতাগ। জানা গেল খালি হাতে যায়নি সে, লেতিয়ারির অফিসের সিন্দুকে নগদ টাকাকড়ি যা ছিল, সব ঝেটিয়ে নিয়ে গেছে।
ওটায় তার নিজেরও অল্প কিছু সঞ্চয় ছিল ঠিকই, কিন্তু লেতিয়ারির ছিল পুরো পঞ্চাশ হাজার ফ্রা-বলতে গেলে তার সুদীর্ঘ চল্লিশ বছরের অমানুষিক পরিশ্রমের অর্ধেক ফসল।
মাল কেনার জন্যে মাত্র কদিন আগে টাকাটা সে ব্যাংক থেকে তুলে এনে সিন্দুকে রেখেছিল। রাতাগকে খুঁজে বের করার অনেক চেষ্টা করল লেভিয়ারি, কিন্তু কাজ হলো না। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে সে একেবাবে।
কিন্তু তাই বলে ভেঙে পড়েনি লেতিয়ারি, শেষ সম্বল আয়ও পঞ্চাশ হাজার ফ্রা ছিল তার, ঠিক করল তাই দিয়ে একটা বাস্পীয় এনজিন চালিত জাহাজ কিনবে এবাব, আরেকবার চেষ্টা করে দেখবে ভাগ্য ফেরানোর।
আধুনিক বাষ্পীয় জাহাজের চল সবেমাত্র শুরু হয়েছে সে আমলে। যে কথা সেই কাজ, একদিন ফ্রান্সের পথে পাড়ি জমাল লেতিয়ারি, এবং ছয় মাস পর আজবদর্শন এ জাহাজ নিয়ে দেরুশেত ফিরে ফিরে এল।
ভীষণ গর্জনের সাথে কুচকুচে কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ওটা যখন জেটিতে এসে ভিড়ল, গোটা দ্বীপের মানুষ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। প্রথমে সবাই ভাল জাহাজটায় আগুন ধরে গেছে বুঝি, নইলে ওরকম ধোঁয়া উঠবে কেন?
অবশ্য কিছুক্ষণ পর বুড়ো লেতিয়ারিকে উদ্ভাসিত চেহারায় ওটা থেকে নেমে আসতে দেখে ভুল ভাঙল তাদের। লেতিয়ারি সবাইকে আশ্বস্ত করল, আগুন-টাগুন কিছু নয়, জাহাজটা বাপীয় এনজিন চালিত বলে ওভাবে ধোয়া ছাড়ে।
আরও জানাল, তার নিজের জাহাজ এটা। এক নামকরা ফরাসী এনজিনিয়ারকে দিয়ে তৈরি করিয়ে এনেছে। খরচ পড়েছে চল্লিশ হাজার ফ্লা। গোটা বন্দরে রীতিমত হুড়োহুড়ি পড়ে গেল এই খবরে। অদ্ভুত এনজিনটা দেখার জন্যে রীতিমত প্রতিযোগিতায় লেগে পড়ল আশপাশের প্রতিটা গ্রামের মানুষ।
একমাত্র আদরের ধন দেরুশেতের নামের সাথে মিল রেখে লেতিয়ারি ওটার নাম রাখল দুরা। আবার নতুন করে পুরোদমে ব্যবসায়ে লেগে পড়ল।
সাধারণ পালের জাহাজের তুলনায় দুরান্দের বহন ক্ষমতা এবং গতি, দুটোই ছিল অনেক বেশি। অল্প সময়ে বেশি বেশি পণ্য আনা-নেয়া করতে পারে দুরান্দ। তাছাড়া ওটাতে করে সমুদ্রযাত্রা ছিল যেমন নিরাপদ, তেমনি আরামের। কাজেই দিনে দিনে ওটার চাহিদা বাড়তে থাকল। ফলে লেতিয়ারির তখন একেবারে পোয়াবারো।
তার শূন্য সিন্দুক ক্রমে আবার ভরে উঠতে শুরু করল। দেখতে দেখতে সে গেরানসির অন্যতম শীর্ষ ধনীদের একজনে পরিণত হলো।
কিন্তু হঠাৎ করে বাতরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ায় কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলল লেতিয়ারি। তবে ভাগ্য ভাল, তার আগেই আরেক যুবককে শিখিয়ে-পড়িয়ে ওস্তাদ নাবিক বানিয়ে নিতে পেরেছিল সে।
এখন বাতে প্রায় পঙ্গু লেতিয়ারি। সাগর পাড়ি দেয়ার মত কঠিন দায়িত্ব তার পক্ষে আর চালিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না, তাই দুরান্দের পুরো দায়িত্ব সেই যুবকের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। বাড়িতে বসে এখন কেবল হিসেব-পত্র দেখাশোনার কাজ করে সে সারাদিন।
বন্দরের প্রবেশপথের কাছে মস্তবড় একটা বাড়ি কিনে নিয়েছে লেতিয়ারি। বাড়িটার পশ্চিম আঙিনায় সুন্দর একটা ফুলের বাগান আছে। নানা জাতের, নানা বর্ণের বাহারী ফুলে ভরা সে বাগান দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়।
বাড়ির দক্ষিণদিকে, সামান্য দূরে স্যামসনের জাহাজঘাট। সেদিকটাতেই বৃদ্ধ তার শোয়ার ঘর বানিয়ে নিয়েছে। খাট পেতেছে জানালার কাছে, যাতে ইচ্ছেমত সাগর-জাহাজঘাট সব দেখতে পায়।
শুয়ে-বসে বন্দরের দিকে তাকিয়ে থেকেই দিন কাটে বৃদ্ধের, জাহাজের আসা-যাওয়া দেখে চুপচাপ। দেশ-বিদেশ ঘুরে যেদিন তার দুরান্দ বন্দরে ফিরে আসে, সেদিন বৃদ্ধের আনন্দের সীমা থাকে না।
আবেগে উত্তেজনায় অস্থির হয়ে পড়ে সে, বাতের ব্যাথার কথা ভুলে দেরুশেতকে সাথে নিয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে পায়ে পায়ে একেবারে জেটির কাছে এসে দাঁড়ায়।
দেরুশেতের শোয়ার ঘর বাড়ির পশ্চিমদিকে। বাগানটাও সেদিকেই। লেতিয়ারির সেবা-যত্নসহ সংসারের যাবতীয় কাজ একাই করে সে, অবসর সময়ে বাগান থেকে ফুল তুলে এনে ঘর সাজায়। নিজেও সাজে।
বাগানের নিচু পাঁচিলের ওপাশে একটা রাস্তা আছে, পাচিল ঘেঁষে সাগরের দিকে চলে গেছে। সেই রাস্তার শেষ মাথায় বড় এক পাথরের টিলা। গিলিয়াতের দৈত্যপুরী ওটার ওপরেই। লেতিয়ারি দুরান্দের দায়িত্ব যার হাতে ছেড়ে দিয়েছে, তার নাম ক্লুবিন। যুবক কথা বলে খুব কম, কাজ করে বেশি। সৎ বলে যথেষ্ট সুনাম আছে তার এ অঞ্চলে। চেহারা-সুরতে হিসেবী কেরাণী গোছের কিছু মনে হলেও যুবক আসলে একজন পাক্কা নাবিক। জলচর প্রাণীর মতই সুদক্ষ সাঁতাঙরু সে। উত্তাল সমুদ্রে নির্ভয়ে সাঁতার কাটতে পারত ক্লুবিন। তার অন্তদৃষ্টিও ছিল ভীষণ তীক্ষ্ণ। বিশেষ করে এই গুনটির জন্যে লেতিয়ারি যুবককে বেশ পছন্দ করে।
একদিন এই যুবকই তাকে রাতাগের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিল, রাতাগ লোকটাকে ভুলেও কখনও বিশ্বাস করবেন না দেখবেন, সুযোগ পেলে লোকটা একদিন চরম সর্বনাশ ঘটিয়ে ছাড়বে আপনার।
অবশ্য এই জন্যেই যে লেতিয়ারি ক্লুবিনকে দুরান্দের ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব দিয়েছে, ব্যাপারটা সেরকম নয়। কথায় বলে, গরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ডরায়। বিশ্বাসঘাতক রাতাগ পালিয়ে যাওয়ার পর কিছুদিন লেতিয়ারিরও সেই অবস্থা গেছে।
তাই ছেলেটাকে নিয়োগ দেয়ার আগে তার ব্যাপারে খুব ভাল করে খোঁজ-খবর নিয়ে তবেই দিয়েছে। বেশ কিছু ছোটখাট পরীক্ষাও করিয়ে নিয়েছিল সে তাকে দিয়ে। তার সবগুলোয় বেশ ভালভাবেই উৎরে গেছে ক্লুবিন।