আলস্যের জয়গান – বার্ট্রান্ড রাসেল
মুখবন্ধ
রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে অনেক সামাজিক প্রশ্ন অনুকম্পায়ী বিবেচনার সুযোগ পায় না; উপেক্ষিত থেকে যায়। বর্তমান পুস্তকের নিবন্ধগুলোর বিষয় উপেক্ষিত সামাজিক প্রশ্নসমূহ। এখানে চিন্তারাজ্যে অতি-সংগঠনের বিপদ সম্পর্কে সচেতন করার চেষ্টা করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক করা হয়েছে অতিরিক্ত কর্মোদ্যোগের বিপদ সম্পর্কে। এখানে আমি ব্যাখ্যা করে বলেছি কেন আমার পক্ষে কী সাম্যবাদ কী ফ্যাসিবাদ কোনোটার পথ অনুসরণ করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে এই মতবাদ দুটি যে সব ক্ষেত্রে অভিন্ন অভিমত পোষণ করে সে সব ক্ষেত্রেই আমি ভিন্ন মত পোষণ করতে বাধিত বোধ করি। বর্তমান পুস্তকে আমি এ কথাও বলতে চেয়েছি যে, জ্ঞানের গুরুত্ব তার ব্যবহারিক উপযোগিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না; জ্ঞান চিন্তা করার অভ্যাস প্রসারেও সহায়তা করে। এই কারণে আজকাল যে সব জ্ঞানকে অকেজো বলে চিহ্নিত করা হয় সে সব জ্ঞানের মধ্যে অধিকতর উপযোগিতা খুঁজে নিতে পারি। একটা নিবন্ধে স্থাপত্যকর্মের সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক প্রশ্নের সংযোগ বিষয়ে আলোচনা করেছি। বিশেষ জোর দিয়েছি অল্প বয়েসীদের কল্যাণ এবং নারীর মর্যাদা বিষয়ে।
রাজনীতি ক্ষেত্র থেকে সরে এসে, প্রতীচ্য সভ্যতার সাধারণ বৈশিষ্ট্য বিষয়ে আলোচনা এবং কীট-পতঙ্গের অত্যাচারে মানব-বংশের বিলুপ্তির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখে, সবশেষে আত্মার প্রকৃতি নির্ণয় করার চেষ্টা করা হয়েছে। এই পুস্তকের নিবন্ধগুলো একটি সাধারণ সূত্র দ্বারা গ্রথিত, তা হলো: এই জগৎ অসহিষ্ণুতা এবং সংকীর্ণতার কারণে দুর্ভোগপীড়িত। তাছাড়া এই বিশ্বাসের জন্যও দুর্ভোগ পোহাচ্ছে: দিকনিশানাহীন কর্মোদ্যোগও প্রশংসার যোগ্য। অথচ আমাদের জটিল আধুনিক সমাজে সবার আগে দরকার সকল বিষয়ে ধীর-স্থির বিবেচনা, সকল মতবাদ বিষয়ে প্রশ্ন তোলার জন্য সদা প্রস্তুতি। উপরন্তু মন শৃঙ্খলমুক্ত থাকবে, যাতে প্রচলিত নানা দৃষ্টিকোণ ন্যায্য বিচার পেতে পারে।
গ্রন্থের অন্যান্য নিবন্ধ বিষয়ে বলা যায়, কতকগুলো নতুন, কতকগুলো বিভিন্ন সাময়িকীতে ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছিল। বর্তমান গ্রন্থে লেখাগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হলো উক্ত সাময়িকীগুলোর সম্পাদকদের অনুমতিক্রমে। আলস্যের জয়গান এবং আধুনিক মাইড্যাস প্রথমে প্রকাশিত হয়েছিল হার্পার্স ম্যাগাজিনে; ফ্যাসিবাদের পূর্বসূত্র (ভিন্ন নামে) ছাপা হয়েছিল ইংল্যান্ডের দ্য পলিটিক্যাল কোয়ার্টারলি এবং আমেরিকার দ্য আটলান্টিক মান্থলি সাময়িকীতে; সিলা ও কারিবডিস, অথবা সাম্যবাদ এবং ফ্যাসিবাদ প্রকাশিত হয় দ্য মডার্ণ মান্থলিতে; আধুনিক সমরূপতা প্রথম স্থান পায় নিউ ইয়র্কের দ্য আউটলুক (বর্তমানে দ্য নিউ আউটলুক) সাময়িকীতে; শিক্ষা ও শৃঙ্খলা প্রকাশিত হয় দ্য নিউ স্টেটসম্যান এবং ন্যাশন সাময়িকীতে। এছাড়া পুস্তকের নানা নিবন্ধের নানা বিষয় নিয়ে পিটার স্পেন্সের সঙ্গে আলোচনা করে অনেক সহায়তা পেয়েছি।
—-বাট্রান্ড রাসেল
.
অধ্যায় ১ — আলস্যের জয়গান
আমার প্রজন্মের অন্য অনেকের মতো আমিও এই নীতিবাক্যের আবহে লালিত হয়েছিঃ শয়তান এখনো দুষ্কর্ম সাধনের জন্য অলস হাত খুঁজে পায়। অত্যন্ত সুবোধ বালক ছিলাম বলে সেকালে যা-কিছু শুনেছি তাই বিশ্বাস করেছি এবং এমনই বিবেকবান ছিলাম যে আজ পর্যন্ত কঠোর শ্রম দিয়ে যাচ্ছি। তবে আমার বিবেক আমার কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করলেও ইতোমধ্যে আমার মতামতের বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। আমি মনে করি জগতে খুব বেশি কাজ করা হয়েছে। এবং কর্ম মাত্রেই পুণ্যময় এই বিশ্বাসের দরুন সাধিত হয়েছে ব্যাপক ক্ষতি। বস্তুত আধুনিক শিল্পোন্নত দেশগুলোতে যা প্রচার করা দরকার ছিল তা এতকাল প্রচার করা হয়নি। একটা গল্পের উল্লেখ করছি, গল্পটা আপনারা সকলেই জানেন। জনৈক ভ্রমণকারী নেপলসে বারো জন ভিক্ষুককে রোদে শুয়ে থাকতে দেখেন (মুসোলিনীর শাসনকালের আগের গল্প), এবং যে সবচেয়ে অলস তাকে এক লিরা প্রদানে ইচ্ছুক হন। সেই বারো জন ভিক্ষুকের মধ্যে এগারো জন তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে ওঠে ভিক্ষা গ্রহণের জন্য। অতএব উক্ত ভ্রমণকারী দ্বাদশ ব্যক্তিটিকেই এক লিরা প্রদান করেন। তিনি ঠিক কাজটিই করেছিলেন। কিন্তু যে সব দেশের লোক ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের রোদে আলস্য উপভোগ করে না তাদের ব্যাপারটা বোঝানো একটু কঠিন কাজ বটে, তবে ব্যাপক গণপ্রচার দ্বারা এদের অলসদের কাতারে সামিল করা যায়। আমি আশা করছি এই নিবন্ধের পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলো পাঠ করে তরুণদের খ্রিস্টীয় সংঘ প্রচার শুরু করে দেবেন যাতে ভালো ছেলেরা অতঃপর কিছু না করতে বা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে উদ্বুদ্ধ হয়। এবং যদি তাই ঘটে তাহলে আমার জীবন একেবারে বৃথা গেছে বলে মনে করবো না।
অলসতার পক্ষে যুক্তিসমূহ উপস্থাপনের আগে আমি অবশ্যই অগ্রহণযোগ্য একটি যুক্তি বর্জন করবো। একজন ব্যক্তির কথা ভাবুন যার বাঁচার মতো যথেষ্ট সঙ্গতি আছে, তবু তিনি নিত্যনৈমিত্তিক কিছু কাজ করতে চান, যেমন স্কুলে ছাত্র পড়ানো কিংবা মুদ্রাক্ষরিকের কাজ। তাঁর সম্পর্কে বলা হলো যে তিনি অন্যের মুখের ভাত কেড়ে নিচ্ছেন, অতএব তিনি দুষ্ট প্রকৃতির। এই যুক্তি যদি বৈধ হতো তাহলে আমাদের সবার অলস হওয়ার দরকার ছিল শুধু এ জন্য যে আমাদের কেবল প্রয়োজনীয় খাবার থাকলেই যথেষ্ট। যারা এ ধরনের কথা বলেন তারা ভুলে যান যে, একজন ব্যক্তি যা আয় করেন তিনি তা ব্যয় করেন। এবং এই ব্যয়ের মাধ্যমে অপরকে কাজের সুযোগ দেন। যতক্ষণ একজন মানুষ তার আয় ব্যয় করেন, তিনি তার ব্যয় দ্বারা অপরের জন্য যতটুকু আহার্য যোগান, আয় দ্বারা ততটুকুই অপরের মুখের ভাত কেড়ে নেন। তাহলে, এই দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকৃত অবাঞ্ছিত ব্যক্তি হলেন তিনি যিনি সঞ্চয় করেন। প্রবাদের ফরাসি কৃষকের মতো তিনি যদি শুধু সঞ্চয়ের জন্য সঞ্চয় করেন তাহলে এতে কর্মসংস্থানের কোনো সুযোগ হয় না। তিনি যদি তার সঞ্চয় বিনিয়োগ করেন তাহলে ঘটনা ভিন্ন রূপ ধারণ করে।
অনেকানেক ব্যাপারের মধ্যে অতিসাধারণ একটা ব্যাপার হলো সঞ্চয় থেকে ধার দেওয়া। যেহেতু সভ্য সরকার সমূহের প্রধান খরচ হলো অতীত যুদ্ধের ব্যয় পরিশোধ কিংবা ভবিষ্যতে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি; সেহেতু এই দিক থেকে বিচার করলে যিনি সরকারকে ধার দেন তার অবস্থান শেক্সপিয়রের সেই সব দুশ্চরিত্র ব্যক্তির মতো যারা আততায়ী (খুনীও বলা যায়) ভাড়া করেন। তাহলে ঐ ব্যক্তির আচরণে রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি পায়, যে রাষ্ট্রকে তিনি তার সঞ্চয় থেকে ধার দিচ্ছেন। তাহলে এটা পরিষ্কার যে তিনি যদি তার টাকা শুধু শুধু খরচ করে ফেলতেন, কিংবা এমনকি মদ্যপান করে কিংবা জুয়া খেলে ব্যয় করতেন, সেটা অনেক ভালো কাজ হতো।
আমাকে কিন্তু বলা হবে সঞ্চয় শিল্পায়নের উদ্যোগে বিনিয়োগ করা হলে গোটা ব্যাপার ভিন্ন রূপ ধারণ করবে। এই ধরনের উদ্যোগ সফল হলে, প্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপাদন করলে, কথাটা মেনে নেয়া যায়। আজকের দিনে, কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে, অধিকাংশ শিল্প উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। এর অর্থ হলো একটা বিরাট শ্রমশক্তি, যা নিয়োজিত করা যেতে পারত উপভোগ্য সামগ্রী উৎপাদনে, তা ব্যয় করা হয় যন্ত্র উৎপাদনে এবং উৎপাদনের পর ঐ যন্ত্র অলস হয়ে পড়ে থাকে এবং আর কারো কোনো কাজে লাগে না। যে ব্যক্তি এমন উদ্যোগে বিনিয়োগ করে যে উদ্যোগ দেউলে হয়ে পড়ে, সে অপরকে এবং নিজেকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। যদি তিনি ভোজনোৎসবে বন্ধুদের আমন্ত্রণ করে খরচ করেন, তবে তারা (আমি আশা করি) সুখ পাবেন, এবং যাদের জন্য তিনি খরচ করবেন তাদের সবাই সুখ পাবে, এদের মধ্যে কসাই, ময়রা, অবৈধ মদ্য প্রস্তুতকারক এবং বিক্রেতাকে ধরা যায়। কিন্তু তিনি যদি রেলপথ বসানোর জন্য ব্যয় করেন (আমি ধরে নিচ্ছি) এবং উক্ত ব্যয়ে এমন এক জায়গায় রেলপথ বসান যেখানে রেলপথের দরকার নেই তাহলে তিনি এমন ক্ষেত্রে বিরাট শ্রমনিয়োগ করলেন যা কারো সুখের কারণ হলো না। তথাপি, তিনি যখন ব্যর্থ বিনিয়োগের জন্য দরিদ্রে পরিণত হবেন তখন তাকে গণ্য করা হবে অযথা দুর্ভাগ্যের শিকার, অথচ একজন অমিতব্যয়ী, যিনি জনগণের কল্যাণে ব্যয় করেছেন, তাকে অবজ্ঞা করা হবে নির্বোধ এবং লঘুচিত্ত ব্যক্তি হিসেবে।
এতক্ষণ যা কিছু বলা হলো তা প্রাথমিক ব্যাপার মাত্র। আমি আসলে গুরুত্ব দিয়ে বলতে চাই যে, কর্ম পুণ্যময় এই ধারণা থেকে আধুনিক জগতে বিরাট ক্ষতি সাধিত হচ্ছে এবং আমরা কেবল কম কাজ করে সুখ ও সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারি।
প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে কাজ কী? কাজ দুই প্রকারের: প্রথমত পৃথিবীর উপরিভাগে, অন্তত কাছাকাছি, বস্তুর অবস্থানের পরিবর্তন, অন্যান্য বস্তুর তুলনায় দ্বিতীয়ত, অপরকে অনুরূপ কাজ করতে বলা। প্রথম কাজটি বিরক্তিকর এবং এর জন্য পারিশ্রমিকও কম মেলে; দ্বিতীয় কাজটি অত্যন্ত মজাদার এবং এর জন্য বিরাট পারিশ্রমিক লাভ করা যায়। তাছাড়া দ্বিতীয় কাজটির পরিধি অনির্দিষ্টভাবে বিস্তৃত করা সম্ভব। কারণ যারা আদেশ প্রদান করেন তারাই শুধু নয়, যারা কী আদেশ প্রদান করা উচিত তার পরামর্শ দেন তারাও এর মধ্যে রয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই একযোগে পরস্পরবিরোধী দুটি উপদেশ প্রদান করা হয় দুটি সংগঠিত শ্রেণি কর্তৃক; এর নামই রাজনীতি। এই ধরনের কাজের উপদেশের জন্য যে দক্ষতার দরকার করে তার সঙ্গে উক্ত বিষয়ের জ্ঞানের কোনো সম্পর্ক নেই, এখানে শুধু দরকার মানুষকে প্রভাবিত করার উপযোগী বক্তৃতা প্রদানের কায়দার অর্থাৎ বিজ্ঞাপনের জ্ঞান। লেখালেখি করেও বিজ্ঞাপনের কাজ সম্পন্ন করা যায়।
গোটা ইউরোপে, আমেরিকায় যদিও নয়, তৃতীয় এক শ্রেণির লোক রয়েছেন যাদের আলোচিত দুই শ্রেণির চেয়ে অধিক শ্রদ্ধা করা হয়। এক শ্রেণির মানুষ রয়েছেন, যারা ভূমির মালিকানার সুবাদে, অপরকে বেঁচে থাকা এবং কাজ করার সুযোগ দেয়ার জন্য তাদের কিছু প্রদানে বাধ্য করতে পারেন। এই ভূস্বামীরা অলস। অতএব, আমার প্রতি হয়তো আশা করা হবে যে আমি এদের প্রশংসা করবো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, তাদের পক্ষে অলস হওয়া সম্ভব হয় অপরের শ্রমের জন্য। বাস্তবিকপক্ষে, তাদের আরামদায়ক আলস্যের বাসনা থেকেই ঐতিহাসিকভাবে কাজের প্রশংসার জন্ম নিয়েছে। আবার একটা জিনিস তারা একেবারেই কামনা করে না, তা হলো তাদের উদাহরণ অন্যেরা অনুসরণ করুক।
সভ্যতার শুরু থেকে শিল্পবিপ্লবের সময় পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই একজন মানুষ কঠোর পরিশ্রম করে নিজের ও পরিবারের প্রয়োজনের কিছুটা অধিক উৎপাদন করতেন, যদিও তার স্ত্রী তার মতোই পরিশ্রম করতেন, এবং তার সন্তানেরা বয়স হবার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের জন্য শ্রম দিতেন। কিন্তু যে সামান্য উদ্বৃত্ত থাকত তা উৎপাদক পেতেন না, যোদ্ধা এবং পুরোহিতরা তা ভোগ করতেন। দুর্ভিক্ষের সময় কোনো উদ্বৃত্ত থাকত না, কিন্তু যোদ্ধা ও পুরোহিতগণ অন্যান্য সময়ের মতোই দুধ-ভাত খেতেন, ফলে অনেক শ্রমিক অনাহারে মারা যেতেন। এই অবস্থা রুশদেশে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিরাজ করেছে, প্রাচ্যে এখনও বিরাজ করছে; বিলেতে শিল্পবিপ্লব সত্ত্বেও নেপোলিয়নের যুদ্ধবৃত্তি চলাকালে এই অবস্থা দাপটের সঙ্গে চালু থাকে এবং একশো বছর আগেও নতুন উৎপাদনকারীদের ক্ষমতা গ্রহণের আগ পর্যন্ত চালু ছিল। আমেরিকায় বিপ্লবের সঙ্গে-সঙ্গে এই অবস্থার অবসান ঘটে, তবে ব্যতিক্রম ছিল দক্ষিণাঞ্চল, যেখানে গৃহযুদ্ধের সময় পর্যন্ত ব্যাপারটা বজায় ছিল। যে ব্যবস্থা এত দীর্ঘকাল বজায় ছিল এবং অবসান ঘটে অতি-সাম্প্রতিককালে, তা স্বাভাবিকভাবেই মানুষের চিন্তাচেতনায় গভীর ছাপ রাখে। আমরা যে কাজের প্রয়োজনীয়তাকে এতটা অনিবার্য মনে করি তার উৎস কিন্তু এই ব্যবস্থা এবং এই ব্যবস্থা শিল্পবিপ্লবের আগের বলে আধুনিক জগতের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে নি। আধুনিক প্রযুক্তি সীমাবদ্ধতার ভেতর হলেও অবসর ভোগ সম্ভব করে তুলেছে, তবে ক্ষুদ্র সুবিধাভোগী শ্রেণির বিশেষ অধিকার ভোগের জন্য নয়, সমগ্র গোষ্ঠীতে অবসর ভোগ সমানভাবে অধিকার হিসেবে বণ্টনের জন্য। কর্মের নৈতিকতা ক্রীতদাসের নৈতিকতা আর আধুনিক জগতে ক্রীতদাস প্রথার কোনো প্রয়োজন নেই।
এটা পরিষ্কার বোঝা যায়, আদিম গোত্রসমূহে কৃষকদের নিজের নিয়মে চলতে দিলে, তারা তাদের সামান্য উদ্বৃত্ত হাতছাড়া করত না, যে উদ্বৃত্তের উপর যোদ্ধা ও পুরোহিত শ্রেণি নির্ভর করেছে। বরং তারা হয় কম উৎপাদন করত কিংবা উদ্বৃত্ত উৎপাদন নিজেরাই ভোগ করত। প্রথমে তাদের ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে উৎপাদনে এবং উদ্বৃত্ত হস্তান্তরে বাধ্য করা হতো। যাহোক, ক্রমান্বয়ে, বোঝা গেল, তাদের এমন নীতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা যায়, যে নীতিবলে তারা কঠোর পরিশ্রম কর্তব্য মনে করবে, যদিও তাদের শ্রমের একটা অংশ অলসদের পকেটে চলে যাবে। এই উপায়ে প্রয়োজনীয় শক্তি প্রয়োগের মাত্রা কমে যায়। এবং সরকারি ব্যয় হয় হ্রাস। আজকের দিনেও নিরানব্বই শতাংশ ব্রিটিশ শ্রমজীবী সত্যি আহত বোধ করবে যদি তাকে প্রস্তাব দেওয়া হয় যে রাজার আয় সাধারণ কর্মীর বেশি হওয়া উচিত হবে না। ঐতিহাসিকভাবে বলতে গেলে কর্তব্যবোধ দ্বারা ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিরা অপরকে প্রভুদের স্বার্থে বাঁচার জন্য বাধ্য করতেন। তাদের নিজেদের জন্য নয়। অবশ্য ক্ষমতার অধিকর্তৃকগণ এই ব্যাপারটা নিজেদের কাছেই গোপন রাখেন একটা কৃত্রিম বিশ্বাস অর্জন করে যে তাদের স্বার্থ গোষ্ঠীর বৃহত্তর স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। অনেক সময় ব্যাপারটা সত্যও; এথেন্সের দাস মালিকরা, উদাহরণত, তাদের অবসরের একটা অংশ ব্যয় করতেন সভ্যতায় স্থায়ী অবদান রাখার জন্য, যা ন্যায্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সম্ভব হতো না। সভ্যতার জন্য অবকাশ অত্যন্ত দরকারি, অতীতকালে মুষ্টিমেয় ব্যক্তি যে অবসর ভোগ করতে পারতেন তার কারণ জনসংখ্যার সংখ্যাগুরু অংশ শ্রম দিতেন। তাদের শ্রম মূল্যবান ছিল এ জন্য নয় যে কাজ কল্যাণকর, কল্যাণকর হলো অবসর। তবে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে সভ্যতার কোনো ক্ষতি না করেও অবসর ন্যায্যভাবে বণ্টন সম্ভবপর হবে।
বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য নিশ্চিত করতে যে শ্রম দরকার আধুনিক প্রযুক্তি তা ব্যাপকহারে হ্রাস সম্ভব করে তুলেছে। যুদ্ধের সময় এটা পরিষ্কার বোঝা গেছে। তখন সামরিক বাহিনীর সকল লোক, যুদ্ধোপকরণ তৈরির কাজে নিয়োজিত সকল নর-নারী, গোয়েন্দাগিরি, যুদ্ধে অপপ্রচার এবং যুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরগুলোর সকল নর-নারীকে উৎপাদন-খাত থেকে প্রত্যাহার করা হয়। এতদসত্ত্বেও, মিত্রশক্তির অদক্ষ শ্রমজীবীদের বাস্তব অবস্থার স্তর যুদ্ধের আগের চেয়ে কিংবা পরের চেয়েও উচ্চতর ছিল। এই ঘটনার প্রকৃত তাৎপর্য আর্থিক ব্যবস্থা দ্বারা গোপন রাখা হয়; দেনা করে দেখানো হয় যেন ভবিষ্যৎ বর্তমান সময়কে পুষ্টি যোগাচ্ছে। তবু তা হওয়া সম্ভব ছিল না; কারণ রুটি না-থাকলে একজন লোক কী-করে রুটি খেতে পারে। যুদ্ধ সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণ করেছে, বৈজ্ঞানিক উপায়ে উৎপাদন দ্বারা, আধুনিক জগতের শ্রম শক্তির একটি ক্ষুদ্র অংশের সাহায্যেই আধুনিক জনসংখ্যাকে বেশ স্বাচ্ছন্দের ভেতর রাখা সম্ভব। যদি যুদ্ধের পর বৈজ্ঞানিক সংগঠন বা উপায়, যা সৃষ্টি করা হয়েছিল জনশক্তিকে মুক্ত করে যুদ্ধে যোগদান এবং যুদ্ধোপকরণ তৈরির জন্য, রক্ষা করা হতো এবং কর্মদিবসের স্থিতিকাল কমিয়ে চার ঘণ্টা করা হতো, তাহলে সকলের অবস্থাই ভালো না হয়ে পারত না। এটা না-করে পুরাতন বিশৃঙ্খলা পুনর্বাসিত করা হয়। যাদের কাজের চাহিদা রয়েছে তাদের কাজের স্থিতিকাল দেয়া হয় বাড়িয়ে। বাকিদের করা হয় বেকার ও নিরন্ন। কারণ? কাজ হচ্ছে কর্তব্য এবং একজন মানুষকে কাজের অনুপাতে পারিশ্রমিক দেয়া হবে না, তাকে পারিশ্রমিক দেয়া হবে কাজ নামক পুণ্যের অনুপাতে।
এই নৈতিকতা দাস রাষ্ট্রের, এবং তা এমন পরিস্থিতিতে আরোপ করা হয়েছে যে পরিস্থিতির একেবারেই উদ্ভব ঘটেনি। অবাক হবার কিছু নেই যে, এতে ফলাফল দাঁড়িয়েছে বিপর্যয়কর। একটা উদাহরণ ধরা যাক। ধরুন, এক বিশেষ মুহূর্তে নির্দিষ্ট সংখ্যক লোক পিন প্রস্তুতে নিয়োজিত রয়েছে। দুনিয়ায় যত পিনের দরকার তত পিন তারা প্রস্তুত করে। ধরুন তারা দিনে আট ঘণ্টা কাজ করে। এখন কোনো ব্যক্তি এমন উপায় উদ্ভাবন করেছে যে উপায়ে উক্ত সংখ্যক লোক আগের চেয়ে দ্বিগুণ পিন উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু দুনিয়ায় দ্বিগুণ সংখ্যক পিনের দরকার নেই; এবং পিনের দাম ইতোমধ্যেই এত সস্তা হয়েছে যে ঐ বস্তুর দাম আরো কমে গেলেও বাড়তি পিন কেউ ক্রয় করবে না। যুক্তিনির্ভর জগতে, পিন প্রস্তুতের সঙ্গে যারা জড়িত তারা সবাই আট ঘণ্টার বদলে চার ঘণ্টা কাজ করবে এবং অন্য সবকিছু আগের মতোই চলবে। কিন্তু বাস্তব জগতে এই ভাবনাকে অনৈতিক গণ্য করা হয়। যদি লোকগুলো আট ঘণ্টাই কাজ করে তাহলে খুব বেশি পিন তৈরি হবে। অনেক নিয়োগকর্তা হবেন দেউলে, পূর্বে পিন তৈরিতে নিয়োজিত কর্মী সংখ্যার অর্ধেক হবে বেকার। এতে কর্মী সংখ্যার অর্ধেক থাকবে সম্পূর্ণ অলস, অপরপক্ষে বাকি অর্ধেক হবে কর্মভারপীড়িত। এই উপায়ে অনিবার্য অবসর সার্বিক দুরবস্থার কারণ হবে। অথচ হওয়া উচিত ছিল সার্বজনীন সুখের উৎস। এই অসুস্থকর অবস্থার কথা ভাবা যায়?
আসল ব্যাপার হলো, দরিদ্র লোকেরা অবসর ভোগ করবেন এই ধারণায় ধনীরা সর্বদাই আহত বোধ করেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে একজন কর্মীর সাধারণ কর্মদিবসের পরিধি ছিল পনেরো ঘণ্টা; শিশুদেরও প্রায় সমান সময় কাজ করতে হয়েছে, অন্তত দিনে বারো ঘণ্টা কাজ তাদের করতে হয়েছেই। অপরের ব্যাপারে অযথা নাক গলানো যাদের অভ্যাস তারা যখন ইঙ্গিত প্রদান করেন যে এত ঘণ্টা কাজ খুব বেশি সময় হয়ে যায়, তখন তাদের বলা হয় যে কাজ বয়স্কদের সুরাপান থেকে বিরত রাখে, আর শিশুদের বিরত রাখা যায় অপকর্ম থেকে। আমার ছেলেবেলায় শাহরিক শ্রমজীবীরা ভোট প্রদানের অধিকার লাভের পর আইন দ্বারা নির্দিষ্ট কয়েক দিনের জন্য সরকারি ছুটি প্রতিষ্ঠা করা হয়, এতে উচ্চবিত্তের লোকেরা হয় দারুণ ক্ষুব্ধ। মনে পড়ে, জনৈক প্রবীণ ডাচেস-কে বলতে শুনেছি; দরিদ্র লোকেরা ছুটি দিয়ে কী করতে চায়? তারা কাজ করতে বাধ্য। জনগণ আজকাল খোলাখুলি কথা কম বলেন, তবে ঐ মেজাজ রয়েই গেছে, আর এটা পরিণত হয়েছে আমাদের অর্থনৈতিক বিভ্রান্তির উৎস।
এক মুহূর্তের জন্য আমরা কাজের নীতি সম্পর্কে খোলাখুলিভাবে এবং কুসংস্কার বর্জন করে বিবেচনা করি। প্রত্যেকটি মানুষ প্রয়োজনে, তার জীবৎকালে, মানবশ্রমে উৎপন্ন সামগ্রী নির্দিষ্ট মাত্রায় ভোগ করে। ধরে নিচ্ছি, শ্রমের ব্যাপারটা সর্বোপরি মেনে নেয়া যায় না এবং এটা অন্যায্য যে একটা মানুষ যতটুকু উৎপাদন করবে তার চেয়ে বেশি ভোগ করবে। অবশ্য তিনি সামগ্রী উৎপাদন না করে, উদাহরণত, ডাক্তারদের মতো সেবা দান করতে পারেন; কিন্তু তাকে থাকা ও খাওয়ার বদলে কিছু দিতেই হবে। এ পর্যন্ত কর্তব্যকর্ম অনুমোদন করতেই হবে। তবে এ পর্যন্তই কেবল।
সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে সকল আধুনিক সমাজে এই সামান্যটুকু কাজও অনেকে করেন না। অন্তত যারা উত্তরাধিকার সূত্রে অর্থ লাভ করেন কিংবা অর্থ বিয়ে করেন, কিন্তু এ বিষয়ে আমি আলোচনা করতে চাই না। তবে আমি মনে করি না যে, এদের আলস্য অনুমোদন করে যতটা ক্ষতি করা হয় তা শ্রমজীবীদের বেশি কাজ করিয়ে কিংবা অনাহারে রেখে যে ক্ষতি করা হয় তার সমান।
যদি সাধারণ শ্রমজীবীরা দিনে চার ঘণ্টা কাজ করত তাহলে পর্যাপ্ত সামগ্রী সবার জুটত, এবং কেউ বেকার হতেন না-এখানে ধরে নিতে হবে একটা যুক্তিশীল সংগঠন বর্তমান। এই ধারণা ধনবানদের আহত করে, কারণ তারা নিশ্চিত যে এতটা অবসর কীভাবে ভোগ করতে হয় তা শ্রমিকদের জানা নেই। আমেরিকায় স্বচ্ছল ব্যক্তিরাও প্রায়ই দীর্ঘ সময় কাজ করেন; এই ধরনের লোক স্বাভাবিকভাবেই মজুরদের অবকাশের কথা শুনে ক্ষেপে যান; আবার বেকারত্বের কড়া শাস্তির ব্যাপারে তাদের আপত্তি নেই; বস্তুত তারা স্বীয় পুত্রদের অবকাশ যাপনও অপছন্দ করেন। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, তারা চান পুত্ররা কঠোর পরিশ্রম করুক, তাদের সভ্য হবার মতো সময় নাই-ই বা থাকল, অথচ তাদের স্ত্রী ও কন্যারা যদি একেবারেই কাজ না করেন তাহলে তারা কিছু মনে করেন না। প্রয়োজনহীনতার প্রতি উন্নাসিক সমর্থন আভিজাতিক সমাজের নর-নারীর অনুমোদন লাভ করে; কিন্তু ধনিক শ্রেণির শাসন ব্যবস্থায় এটা নারীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে; যা হোক এটা কোনো মতেই কাণ্ডজ্ঞানের সঙ্গে মিলিয়ে চলে না।
বিজ্ঞতার সঙ্গে অবকাশের ব্যবহার, মানতেই হবে, সভ্যতা ও শিক্ষার ফসল। যে লোক সারা জীবন প্রতি দিন দীর্ঘ সময় কাজ করে সে যদি হঠাৎ অলস হয়ে যায় তবে সে অস্বস্তি বোধ করবে। কিন্তু নির্দিষ্ট পরিমাণ অবকাশের অভাবে একজন লোক জীবনের অনেক ভালো ব্যাপার থেকে বঞ্চিত হয়। অথচ এমন কোনো কারণ এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না জনগণ কেন এই বঞ্চনা ভোগ করবে; কেবল নির্বোধ কৃচ্ছতাসাধন, যা একান্তই নানা জাতের, আমাদের বহুল পরিমাণে কর্মে বাধ্য করে, যার কোনো প্রয়োজন নেই।
যে নতুন নীতি রুশ সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে তার মধ্যে অনেক কিছু রয়েছে যা প্রতীচ্যের প্রথাগত শিক্ষার চেয়ে ভিন্ন, আবার এমন জিনিসও রয়ে গেছে যার কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। শাসক শ্রেণির মনোভাব এবং বিশেষত যারা শিক্ষাক্ষেত্রে অপপ্রচারের দায়িত্বে নিয়োজিত তারা যা শ্রমের মর্যাদা সম্পর্কে প্রচার করে, তা প্রায় একই ধরনের, যা জগতের সকল শাসক শ্রেণি প্রায় সব সময়ই প্রচার করে আসছে, এবং তাকেই বলা হয় সৎ দরিদ্র। রুশদেশে পরিশ্রম, মিতাচার, সুদূর সুবিধার জন্য দীর্ঘ সময় কাজের ইচ্ছা, এমনকি কর্তৃপক্ষের কাছে আনুগত্য, এসবেরই পুনরাবির্ভাব ঘটেছে; উপরন্তু কর্তৃপক্ষ এখনও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শাসকের ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করে, যাকে নতুন নামে ডাকা হয় বস্তুতান্ত্রিক দ্বান্দ্বিকতা বলে। অর্থাৎ মহান ঈশ্বরের সিংহাসন এখন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের দখলে।
রুশদেশে সর্বহারাদের বিজয় এবং অপরাপর কিছু দেশের নারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনকারীদের বিজয়ের সঙ্গে কয়েকটি ব্যাপারে মিল রয়েছে। যুগের পর যুগ ধরে, পুরুষ মানুষ মেয়ে মানুষের সাধুতাকে উন্নততর বলে মেনে নিয়েছে। এবং মেয়েদের হীনতাকে এই বলে সান্ত্বনা দিয়েছে যে, সাধুতা ক্ষমতার চেয়ে অধিক বাঞ্ছনীয়। সব শেষে, নারীর অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তাদের উভয়দিক রক্ষা করতে হবে, আর যেহেতু এই আন্দোলনের সম্মুখভাগের নেতৃবৃন্দ পুণ্যের বাঞ্ছনীয়তা সম্পর্কে পুরুষরা যা বলেছে তার সবই বিশ্বাস করেছে, কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতার মূল্যহীনতা সম্পর্কে যা বলেছে তা মেনে নেয়নি। কায়িক শ্রমের ক্ষেত্রে একই ব্যাপার ঘটেছে রুশদেশে। যুগের পর যুগ, ধনীরা এবং তাদের মোসাহেবদল সৎ পরিশ্রম সম্পর্কে প্রশংসা করে অনেক কিছু লিখেছে, প্রশংসা করেছে সাদাসিধে জীবনের, প্রচার করেছে এমন ধর্মের যে ধর্ম শিক্ষা দেয় যে ধনীদের চেয়ে গরিবদের স্বর্গে যাওয়ার সম্ভাবনা অধিকতর এবং সর্বোপরি কায়িক শ্রমিকদের বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করেছে যে স্থানিক বস্তুর অবস্থা পরিবর্তনের মধ্যে বিশেষ মহত্ত্ব রয়েছে। যেমন পুরুষরা মেয়েদের বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করেছে যে, তারা যৌন-দাসত্ব থেকে বিশেষ মহত্ত্ব লাভ করে। রুশ দেশে কায়িক-শ্রম সম্পর্কিত এতসব শিক্ষা খুব গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা হয়েছে, ফলে গতর-খাটানো শ্রমিকরা অন্যান্যদের চেয়ে অধিক সম্মান পেয়ে থাকে। বস্তুত পুনরুজ্জীবনবাদী আবেদন একই কারণে করা হয়, তবে লক্ষ্য পুরাতন নয়। আবেদনের লক্ষ্য হলো শ্রমিকদের বিশেষ কাজের জন্য তৈরি রাখা। কায়িক শ্রম যুবকদের সামনে আদর্শ হিসেবে খাড়া করা হয়, এবং এটা তাদের সকল নৈতিক শিক্ষার ভিত্তি।
বর্তমানে, সম্ভবত এসবই করা হয় কল্যাণের জন্য। একটা মস্ত বড় দেশ, প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর, উন্নতির জন্য অপেক্ষা করে আছে এবং ঋণ খুব কম ব্যবহার করে উন্নতি করতে হবে।-এই পরিস্থিতিতে কঠোর শ্রম দরকার করে। এবং সম্ভবত বিরাট পুরস্কার অর্জন করা যায়। কিন্তু দীর্ঘ সময় কাজ না করে যদি এমন অবস্থায় পৌঁছা যায় যেখানে সবাই আরামদায়ক জীবন যাপন করতে পারবে, তখন কী হবে?
প্রতীচ্যে এই সমস্যার মোকাবেলা আমরা নানাভাবে করতে পারি। অর্থনৈতিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা আমাদের মধ্যে নেই, ফলে সামগ্রিক উৎপাদনের বৃহৎ অংশ জনসংখ্যার সংখ্যালঘু অংশের ভোগে চলে যায়। এদের অনেকে মোটই কোনো কাজ করে না। উৎপাদনের উপর কোনো প্রকার কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের অভাবে, আমরা এত বেশি উৎপাদন করি যার কোনো দরকার নেই। আমরা কর্মী-জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশকে অলস রাখি, কারণ তাদের বদলে অন্যদের দিয়ে অতিরিক্ত কাজ করিয়ে নিতে পারি। আবার যখন এই সব পদ্ধতিই অপূর্ণ প্রমাণিত হয়, তখন আমরা মুখোমুখি হই যুদ্ধের; বহু লোককে আমরা উচ্চতর বিস্ফোরক পদার্থ প্রস্তুতে লাগাই। আরো অনেককে নিয়োজিত করি বিস্ফোরণে, যেন আমরা এমন শিশু, যে এই মাত্র আবিষ্কার করেছে আতশবাজি। এইসব উপায়ের সম্মিলনে, কঠিন হলেও, আমরা ব্যবস্থা করি এই মনোভাব বজায় রাখতে যে কঠোর কায়িক শ্রম গড়ে মানুষের বিধিলিপি।
রুশদেশে অধিকতর অর্থনৈতিক সুবিচার এবং উৎপাদনের উপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের জন্য সমস্যাটা ভিন্ন উপায়ে সমাধান করতে হবে। যৌক্তিক সমাধান এই হবে যে, যত শীঘ্র সম্ভব প্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপাদন এবং সবার জন্য প্রাথমিক আরাম আয়েশের ব্যবস্থা করার পর, শ্রমের স্থিতিকাল ক্রমান্বয়ে হ্রাস করা, এবং প্রতিটি স্তরে সার্বজনীন ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে অধিক অবসর এবং অধিক সামগ্রীর মধ্যে কোনটার প্রতি পক্ষপাতী হতে হবে। তবে এতকাল কঠোর শ্রম সর্বাধিক পুণ্যবান গণ্য করার শিক্ষা প্রদানের পর, কর্তৃশ্রেণির পক্ষে কঠিন হবে এমন স্বর্গ নির্মাণ করা যেখানে অবসর থাকবে বেশি কাজ হবে কম। সম্ভবত তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করবে, যে পরিকল্পনার বদৌলতে চলতি অবকাশ ভবিষ্যতের উৎপাদনশীলতার জন্য পরিত্যাগ করা হবে। রুশ প্রকৌশলীদের প্রস্তাবিত একটি সরল পরিকল্পনা সম্প্রতি পাঠ করলাম, উক্ত পরিকল্পনায় শ্বেতসাগর এবং সাইবেরিয়ার উত্তর উপকূল উষ্ণ রাখার কথা বলা হয়েছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে কারা সাগর (Kara Sea) বরাবর বাঁধ নির্মাণ করে। এটি একটি খুবই শ্রদ্ধেয় প্রকল্প, তবে এজন্য সর্বহারাদের একটি প্রজন্মের আয়েশ জলাঞ্জলি দিতে হবে, আর আর্কটিক সমুদ্রের বরফ-ক্ষেত্র এবং তুষার ঝড়ের মধ্যে শ্রমের মহত্ত্ব হবে প্রদর্শিত। এই ধরনের ঘটনা যদি ঘটে তাহলে সেটা হবে কঠোর শ্রমের পুণ্যকে উদ্দেশ্য গণ্য করার ফলাফল। তাহলে শ্রম জিনিসটা এমন পর্যায়ে পৌঁছার উপায় আর থাকবে না যখন শ্রমের আর দরকার করবে না।
ব্যাপারটা হলো, বস্তু চারপাশে নড়াচড়া করা আমাদের অস্তিত্বের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণে দরকার হলেও, তা মানব জীবনের অন্যতম উপেয় নয়। ঘটনা তাই হলে প্রত্যেক অদক্ষ শ্রমিককে শেক্সপিয়রের চেয়ে উন্নত বিবেচনা করা হতো। দুটি কারণে আমরা এক্ষেত্রে বিপথে চালিত হয়েছি। একটি হলো দরিদ্র সাধারণকে সন্তুষ্ট রাখার প্রয়োজনীয়তা, এজন্যই হাজার হাজার বছর ধরে ধনীরা পরিচালিত হয়েছেন শ্রমের মর্যাদা প্রচারে, অবশ্য এক্ষেত্রে মর্যাদাহীন থাকার জন্য নিজেরা অত্যন্ত যত্ন নিয়েছেন। দ্বিতীয় কারণটি হলো যন্ত্রের প্রতি নতুন আনন্দ। এর দ্বারা আমরা পৃথিবীর উপরিভাগে বিস্ময়কর চাতুর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটিয়ে প্রফুল্ল বোধ করি। এর কোনো একটি উদ্দেশ্যই প্রকৃত কর্মীর কাছে বড় ধরনের আবেদন রাখে না। আপনি যদি এদের একজনকে জিজ্ঞেস করেন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ অংশ কোনটি, তিনি সম্ভবত উত্তর দেবেন নাঃ আমি কায়িকশ্রম খুব উপভোগ করি, কারণ এতে অনুভব করতে পারি যে আমি মানুষের মহত্তম কর্ম সিদ্ধি করছি। আরো এই কারণে যে, আমি ভাবতে ভালোবাসি মানুষ এই গ্রহ কতটা রূপান্তরিত করতে পারে। সত্য যে, দেহের জন্য মাঝে মাঝে বিশ্রামের দরকার রয়েছে, আমাকে তা যতটা সম্ভব শ্রেষ্ঠ উপায়ে পূরণ করতে হবে। কিন্তু যখন সকাল আসে এবং আমি কর্মস্থলে ফিরে যাই, যেখানে রয়েছে আমার সন্তুষ্টির উৎস, তখন যে সুখ পাই, তা আর কখনো জোটে না। আমি কখনো কর্মজীবীদের এ ধরনের কথা বলতে শুনিনি। তারা কাজকে কাজের মতোই বিবেচনা করে জীবনে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় উপায় হিসেবে এবং অবসর সময়েই তারা যতটা সম্ভব সুখ উপভোগ করে।
এরপরও বলা হবে, কিছুটা অবসর আনন্দদায়ক হলেও, লোকেরা জানবে না চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কেবল চার ঘণ্টা কাজ করে বাকি সময়টা কী করে কাটানো যায়। আধুনিক জগতে এটা কিছুটা সত্য হলেও আমাদের সভ্যতার জন্য নিন্দাবাদ ছাড়া কিছু নয়; আগের যুগের জন্য এটা সত্য হতো না। আগে হালকা চালচলন এবং খেলাধুলার সুযোগ ছিল যার কিছুটা দক্ষতার মতবাদ দ্বারা নিষেধ করা হয়েছে। আধুনিক মানুষ মনে করেন যে সবকিছু করতে হবে অপর কিছুর স্বার্থে, এবং কখনো উক্ত কাজের স্বার্থে নয়। উদাহরণত গুরু-গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ সব সময়ই সিনেমা দেখতে যাওয়ার অভ্যাসকে নিন্দাবাদ জানাচ্ছেন এবং আমাদের বলছেন যে সিনেমা দেখার অভ্যাস তরুণদের অপরাধকর্মে প্রলুব্ধ করছে। কিন্তু সিনেমা তৈরির জন্য যত শ্রম ব্যয় করা হয় তা শ্রদ্ধেয় বলেই গণ্য। কারণ এটি একটি কাজ এবং এই কাজ আর্থিক মুনাফা আনে। বাঞ্ছনীয় কাজ তাকেই বলতে হবে যা মুনাফা ঘরে আনে, এই মনোভাবটাই সব কিছু উল্টাপাল্টা করে দিয়েছে। যে কসাই আপনাকে মাংস যোগান দেয় এবং যে রুটি প্রস্তুতকারক আপনার রুটি যোগায় তারা প্রশংসার যোগ্য। কারণ তারা অর্থ উপার্জন করছে; কিন্তু আপনি যখন তাদের যোগানো খাদ্য ভোগ করছেন, তখন আপনি নিতান্তই লঘুচেতা, যদি আপনি কাজ করার জন্য শক্তি সঞ্চয়ের প্রয়োজনে আহার না করে থাকেন। স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, মনে করা হয় যে অর্থ উপার্জন ভালো। আর অর্থ ব্যয় মন্দ। একে একই আদান-প্রদানের দুই দিক হিসেবে দেখা, একেবারেই অসংগত তাহলে একজন ধরে নিতে পারেন চাবি ভালো, তালার চাবি ঢুকানোর ছিদ্র মন্দ। পণ্য উৎপাদনে যে ধরনের গুণই থাক না কেন তা অবশ্যই নির্ভর করবে উক্ত পণ্য ভোগ থেকে কতটা সুবিধা লাভ করা গেল তার উপর। আমাদের সমাজে যে-কোনো ব্যক্তি মুনাফার জন্য কাজ করে; কিন্তু তার কাজের সামাজিক উদ্দেশ্য উৎপাদিত পণ্য উপভোগের মধ্যে নিহিত। উক্ত ব্যক্তি এবং উৎপাদনের সামাজিক লক্ষ্যের মধ্যে এই যে বিচ্ছেদ তা বর্তমান দুনিয়ায় মানুষকে স্বচ্ছভাবে চিন্তা করা কঠিন করে দেয়। কারণ এই জগতে মুনাফা অর্জন কর্মের উৎসাহ হিসেবে কাজ করে। আমি উৎপাদনের কথা খুব বেশি ভাবি। ভোগের কথা ভাবি খুবই কম। এতে একটা ফল দাঁড়ায় আমরা উপভোগ ও সরল সুখের প্রতি কম গুরুত্ব প্রদান করি, এবং উৎপাদনের বিচার আমার ভোক্তা কতটা আনন্দ পেল সে অনুসারে করি না।
যখন আমি ইঙ্গিত দেই যে কাজের সময় কমিয়ে চার ঘন্টা করা উচিত, তখন আমি কিন্তু এটা বোঝাই না যে বাকি সময় অবশ্যই লঘুচিত্ততার ভেতর কাটিয়ে দিতে হবে। আমি বোঝাতে চাই যে দিনে চার ঘণ্টা কাজ করলে একজন মানুষ জীবনের প্রয়োজন এবং প্রাথমিক আরামের জন্য ব্যয় করার মতো সুযোগ ও সময় পাবে, এবং বাকি সময় সে যে ভাবে ইচ্ছে করে সে ভাবে ব্যয় করবে। অনুরূপ সমাজ ব্যবস্থার আবশ্যিক অঙ্গ হলো বর্তমানে শিক্ষাদর্শ যে অবস্থায় আছে তার থেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে এবং এই শিক্ষাদর্শ, অংশত, মানুষের রুচি গড়ে তুলবে যাতে সে অবসর সময়টা বুদ্ধির সঙ্গে কাজে লাগাতে পারে। আমি যে ধরনের কাজের কথা প্রধানত ভাবছি তাকে বিবেচনা করা হয় নাক উঁচু। দূর পল্লি অঞ্চল ছাড়া সর্বত্র আজ কৃষক-নৃত্য ইন্তেকাল করেছে, কিন্তু যে তাড়নার জন্য ঐ নৃত্য চর্চা করা হতো তা নিশ্চয় মানব প্রকৃতি থেকে উধাও হয়ে যায় নি। শাহরিক জনসংখ্যার আনন্দ প্রধানত নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে; সিনেমা দেখা, ফুটবল খেলা দেখা, রেডিও শোনা ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর কারণ হলো জনগণের সক্রিয় শক্তিকে কাজ পুরোপুরি গ্রাস করে; তাদের যদি অধিকতর অবসর জুটত তবে তারা পুনরায় আনন্দ উপভোগ করত, যে আনন্দে তারা আগে সক্রিয় অংশ নিয়েছে।
অতীতে অবসরভোগী শ্রেণি ছিল ক্ষুদ্র, কর্মী শ্রেণি ছিল বৃহত্তর। অবসরভোগী শ্রেণি যে সুবিধাদি উপভোগ করতেন তাতে সামাজিক ন্যায় বলতে কিছু ছিল না; ফলে উক্ত শ্রেণি অত্যাচারী হয়ে পড়ে, তাদের সহানুভূতি হয়ে যায় সীমাবদ্ধ, এবং এমন কারণ উদ্ভাবন তাদের করতে হয় যাতে ঐ সুবিধাদি ন্যায্যতা পায়। ফলে এর চমৎকারিত্ব হ্রাস পায়, তবে এই ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও, যাকে আমরা সভ্যতা বলি তার প্রায় সবটুকুতেই এটা অবদান রেখেছে। এটা শিল্পকলা চর্চা করেছে। আবিষ্কার করেছে বিজ্ঞানসমূহ; পুস্তক লিখেছে, দর্শনাদি করেছে উদ্ভাবন, এবং সামাজিক সম্পর্কগুলোকে করেছে সুন্দর ও সূক্ষ্মতর। এমনকি নির্যাতিতরা যে মুক্তি লাভ করেছে তাও স্বাভাবিকভাবেই উপর থেকে উদ্বোধন করা হয়েছে। অবসরভোগী শ্রেণি না থাকলে মানবতা বর্বরতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারত না।
উত্তরাধিকার সূত্রে উদ্ধৃত কর্মহীন, অবসরভোগী শ্রেণি অবশ্য ছিল একেবারে অপচয়ী। এই শ্রেণির একটি সদস্যকেও পরিশ্রমী হতে শেখানো হয়নি। এবং শ্রেণিটি সামগ্রিকভাবে অসাধারণ কোনো বুদ্ধিমান ছিল না। এই শ্রেণি একজন ডারুইন জন্ম দিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু বিপরীতে লক্ষ লক্ষ গ্রামীণ ভদ্রলোকের নামোল্লেখ করা যায় যারা কোনোদিন খেঁকশিয়াল শিকার এবং অবৈধ শিকারিদের শাস্তি প্রদানের চেয়ে বুদ্ধিমান কোনো কাজের কথা চিন্তা করেনি। বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যা যোগান দেয়ার কথা, অধিকতর নিয়মবদ্ধভাবে, তা অবসরভোগী শ্রেণি যোগান দিয়েছে কাকতালীয়ভাবে এবং উপজাত হিসেবে। এটা একটা বিরাট উন্নতি, কিন্তু এর নির্দিষ্ট কিছু ত্রুটিও রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন বৃহত্তর জগতের জীবন থেকে এতটা পৃথক যে, যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আবহে বাস করেন তারা সাধারণ নর-নারীর মেজাজ ও সমস্যা ঠিক বুঝতে পারেন না; উপরন্তু তারা তাদের যে স্বাভাবিক নিয়মে বক্তব্য প্রকাশ করেন তাতে সাধারণ জনগণের উপর তাদের মতামতের যে প্রভাব থাকা উচিত ছিল তা থাকে না। অপর একটি অসুবিধা এই যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে চর্চা ব্যাপারটা অত্যন্ত নিয়মনিষ্ঠভাবে হয়, এবং যারা একটু আলাদাভাবে গবেষণা করার কথা ভাবেন তাদের করা হয় নিরুৎসাহিত। সুতরাং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যতটাই দরকারে লাগুক, তার চার দেয়ালের বাইরের জগতের সবাই উপযোগবাদী ধান্দায় খুবই ব্যস্ত বলে প্রতিষ্ঠানগুলো সভ্যতার স্বার্থ সংরক্ষণের উপযোগী অভিভাবকে পরিণত হতে পারে না।
যে জগতে কোনো ব্যক্তি চার ঘণ্টার বেশি কাজ করতে বাধ্য নয়, সেখানে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসাসম্পন্ন প্রত্যেকে তার কাজের সুযোগ পাবেন, প্রত্যেক চিত্রকর কেবল চিত্র এঁকে যাবেন এবং তাকে অনাহারে থাকতে হবে না, তার চিত্রকর্ম যতই চমৎকার হোক না কেন। মহৎ সৃষ্টিকর্মের জন্য অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবে তরুণ লেখকরা রোমাঞ্চকর কেচ্ছা লিখতে বাধ্য হবে না। পেশাগত জীবনে যারা অর্থনীতি কিংবা সরকারের কোনো পর্যায় সম্পর্কে উৎসাহী হয়, তারা প্রাতিষ্ঠানিক নিবিষ্টচিত্ততা ছাড়াও নিজেদের ধারণাকে বিকশিত করতে পারবে। যে নিবিষ্টচিত্ততার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদদের অনেক সময় মনে হয় বাস্তবতাবর্জিত। ডাক্তাররা তাদের শাস্ত্রের সর্বশেষ বিকাশ সম্পর্কে খবর রাখার সময় পাবে; শিক্ষকদের, তারা যৌবনে যা শিখেছে, একঘেয়ে পদ্ধতিতে তা ছাত্রদের শেখানোর বিরক্তিকর সংগ্রাম করতে হবে না। তার যৌবনে অর্জিত জ্ঞান ইতোমধ্যে ভুলও প্রমাণিত হয়ে থাকতে পারে।
সর্বোপরি, ক্ষয়ে-যাওয়া স্নায়ু, ক্লান্তি এবং অজীর্ণতার বদলে থাকবে সুখ এবং জীবনে আনন্দ। যতটুকু কাজ করা হবে তা অবসর আনন্দময় করার জন্য হবে যথেষ্ট। কিন্তু অত্যন্ত ক্লান্তি উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট হবে না। যেহেতু মানুষ তাদের অবসর সময়ে ক্লান্তি বোধ করবে না সুতরাং তারা নিষ্ক্রিয় এবং নিরস আমোদ দাবি করবে না। জনসংখ্যার অন্তত এক শতাংশ যে সময় পেশাগত কাজে ব্যয় করেনি তা জনসাধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োগ করবে এবং যেহেতু তাদের জীবিকার জন্য উক্ত ধান্দার উপর নির্ভর করতে হবে না ফলে তাদের মৌলিকতা ক্ষুণ্ণ হবে না, এমনকি বৃদ্ধ পণ্ডিতদের দ্বারা নির্ধারিত নীতিমালার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলারও দরকার করবে না। এই সব ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রেই শুধু অবসরের সুবিধাগুলো লাভ করা যাবে না। সাধারণ নারী-পুরুষ, সুখী জীবনের সুযোগ থাকার দরুন, অধিক দয়াশীল ও কম অত্যাচারী হবে এবং অন্যদের কম সন্দেহের চোখে দেখবে। যুদ্ধের রুচির হবে মৃত্যু, অংশত এই কারণে, অংশত সবাইকে যুদ্ধ শুরু হলে দীর্ঘ ও কঠোর শ্রম দিতে হবে বলে। সকল নৈতিক গুণাবলির মধ্যে এই জগতের সবচেয়ে বেশি দরকার সৎ স্বভাবের, আর সৎ স্বভাব হলো স্বচ্ছন্দ জীবন এবং নিরাপত্তার ফলশ্রুতি, শ্রমসাধ্য সংগ্রামের ফল নয়। উৎপাদনের আধুনিক পদ্ধতি আমাদের সবার জন্য আয়েসি ও নিরাপদ জীবনের সম্ভাবনা সম্ভব করেছে; অথচ আমরা কারো জন্য বেছে নিয়েছি অতিরিক্ত কাজ, আর বাকি লোকদের জন্য বেছে নিয়েছি অনাহার। এতকাল পর্যন্ত আমরা যন্ত্রাদি উদ্ভাবনের আগের সময়ের মতো কঠোর কর্মে লিপ্ত রয়েছি; আর কী নির্বোধের মতোই না আমরা তা করছি; তবে অনন্তকাল বোকা থাকার কোনো যুক্তি নেই।