০১. আর কতদূর

আর কতদূর?

আর খুব বেশি দূর নয়। এই বাবুরবাজার থেকে পুরনো সড়ক ধরে তিন ক্রোশ দক্ষিণে চলে গেলেই মধুকুপি নামে সেই গাঁ, যে গাঁয়ে দাও ঘরামির একটি ঘর আছে আর ঘরণীও আছে।

গাঁয়ের পাশে ডরানি নামে সেই ছোট নদীটিও আছে, যে নদীতে বৈশাখ মাসেও হাঁটুজল থাকে। আর, সেই পাহাড় দুটিও আছে; ছোটকালু ও বড়কালু, কাদামাখা মোষের গায়ের মতো কালো কালো আর মেটে-মেটে রঙের দুটি বেঁটে আকারের পাহাড়। বোশেখের ভয়ানক শুকনো দুপুরে যখন উরানির স্রোতের কিনারাতে কোন বকও বসে থাকে না, তখন এই দুটি পাহাড়ের গায়ের উপর ছাগল চরে বেড়ায়, কচি বটের পাতা খায়। আর, শ্রাবণের শেষে পাহাড়ের গায়ে, এমন কি মাথার উপরেও পাথরের ফাঁকে ফাঁকে সবুজ ঘাস যখন ঘন হয়ে গজিয়ে ওঠে, তখন গাঁয়ের রোগা-রোগা গরুর দল কাকুরে ডাঙর কুশে ঘাস ছেড়ে দিয়ে বরং ছোটকালু আর বড়কালুর কোলে বুকে ও মাথায় চড়ে তাজা ঘাসের গোছ খেতে ভালবাসে।

সন্ধ্যা হয়েছে। মোটর বাস থেকে নেমে বাবুরবাজারের পথের উপর দাঁড়িয়ে একটা আরামের হাঁপ ছেড়ে সোজা দক্ষিণের আকাশের দিকে তাকিয়ে দূরের আবছায়াময় মধুকুপির সেই জঙ্গলটাকেও চিনতে পারে দাশু ঘরামি। জঙ্গলটা আছে, সেই কপালবাবার জঙ্গল, যার কিনারায় বেলগাছের তলায় একটা গোল পাথর আর একটা খুলি পড়ে আছে।

আছে, সবই ঠিক আছে। কপালবাবার আসন যেখানে ছিল আজও নিশ্চয় সেখানে আছে। কিছুই বদলায় নি। এই পাঁচ বছরের মধ্যে বদলে যাবারই বা কি আছে? আর তিন ক্রোশ পথ হেঁটে পার হয়ে যেতে পারলেই দাশু ঘরামি তার পুরানো মধুকুপিকে, ছোটকালু আর বড়কালুকে, নুড়ি-ছড়ানো আর বালুমাখা সেই ডরানিব কলকল জলের স্রোতটাকেও পেয়ে যাবে। হরিপদ নিশ্চয় এখনও কপালবাবার জঙ্গলে মৌচাক ভাঙে; আর সুরেন মান্‌ঝি রোজ দুপুর হতে-না-হতে তার ছোট গো-গাড়ি মরা শালে বোঝাই করে জঙ্গলের ভিতর থেকে বের হয়ে আসে। আজও নিশ্চয় রোজই পালকি বইতে গোবিন্দপুরে যায় হরিশ নিধিরাম আর লটবর।

মধুকুপি জনমজুরের গাঁ, যে গাঁয়ের মানুষেরা সবাই মনিষ। পরের মাটি কাটে, পরের জমি চষে, পরের গো-গাড়ি হাঁকায়, পরের ঘরের চালা ছায় আর পরের পালকিতে বেহারা খাটে।

জঙ্গলকে একেবারে পর ভাবে না, কিন্তু ক্ষেতের মাটিকে বেশি ভালবাসে; কাঁড় টাঙ্গি ছেড়ে দেয়নি, কিন্তু লাঙ্গল কোদাল হাতে তুলে নিয়েছে। কর্মঠ ভূমিজ জীবনের ছোট্ট একটি উপনিবেশ এই মধুকুপি। জাতের পেশা নামে ধরাবাঁধা কোন পেশা নেই। ঘরের চালা ছেয়ে দু পয়সা রোজগার করতে প্রতি বছরের দুটি মাস গোবিন্দপুর যেত দাশু; দাশু তাই দাও ঘরামি। দাশুর বাবা ছিল কাঠুরিয়া, বাবার বাবা মাটিয়াল।

ত্রিশ মাইলের মধ্যে রেললাইন নেই, এহেন মধুকুপির মনে একটা অহংকারও আছে যে, গাঁয়ের কোন মানুষ আজ পর্যন্ত গোবিন্দপুর হাসপাতালের ওষুধ মুখে দেয় নি। কপালবাবার সেই বেলগাছের পাতাই যথেষ্ট, মধুকুপির সব রোগের ওষুধ, সব ভয়ের কবচ আর সব মানতের আশ্বাস। হোই, হোই সেই মধুকুপি!

এখানে সড়কের দু পাশে গোটা দশেক চালাঘর, তারই নাম বাবুবাজার। যাই হোক, বাবুরবাজারের এই দশা কেন? একেবারে স্তব্ধ। সব দোকানঘর বন্ধ। একটাও গো-গাড়ি নেই। এই তো সেই বাবুরবাজার, যেখানে ঠিক সন্ধ্যার পর যত ধানের গাড়ি এসে ভিড় করত, আর মানপুরের পাইকারেরা টাকার থলি হাতে নিয়ে চেঁচিয়ে দর হাঁকত। কোথায় গেল তারা? বাবুরবাজারের সন্ধ্যার প্রাণটা পালিয়ে গেল কোথায়?

নিতাই মুদির দোকান আছে দেখা যায়। দোকানের ঝাপ বন্ধ। কিন্তু ভিতরে আলো জ্বলছে। এগিয়ে যায় দাশু ঘরামি। চাপা গলায় ডাক দেয়–নিতাইদাদা আছ হে?

–কে?

–আমি দাশু।

দোকানের ঝাপ খুলে নিতাই মুদি বের হয়ে এসে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকে। এ কি! তুই হঠাৎ এই অসময়ে! ছাড়া পেলি কবে?

দাশু–আজই ছাড়া পেলাম। নিতাই সন্দিগ্ধভাবে প্রশ্ন করে কিন্তু তোর মেয়াদের পাঁচ বছর কি শেষ হয়েছে? দাশু হাসে : না দাদা। নিতাই মুদি তার কাঁপা হাতে দোকানের ঝাপ ধরে হঠাৎ একটা টান দেয়। দরজার অর্ধেকটা বন্ধ করে দিয়ে বলে-জেলখানার পাঁচিল-টাচিল টপকে পালিয়ে এসেছিস মনে হচ্ছে।

–না গো। সাজার চার মাস মকুব হয়েছে।

অনেকক্ষণ দাশুর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর চোখ বুজে যেন মনের সন্দেহটাকে আস্তে আস্তে সামলাতে চেষ্টা করে নিতাই মুদি দোকানের ঝপ আবার একটু ঠেলে সরিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করে নিতাই-সাজার চার-চারটে মাস মকুব করে দিল, এটাও যে আশ্চর্যের কথা বলছিস দাশু!

–হ্যাঁ। একটা ক্ষেপা দাগীর হাত থেকে ছুরি ছিনে নিয়ে জমাদারকে বাঁচিয়েছিলাম। সে বাবদ দু মাস মকুব হয়েছে। আর জেলের ফুলবাগানে চারটে করাইত সাপ মেরেছিলাম। সে বাবদ এক মাস।

নিতাই-এ তত মোট তিন মাস হল। হিসাব ভুল করছিস কেন রে?

দাশু–একটা বুড়ো কয়েদী কুয়ার ভিতর পড়ে গিয়েছিল, সে বেটাকে আমিই টেনে উঠিয়েছিলাম—সে বাবদ এক মাস মকুব হয়েছে।

নিতাই মুদি দাশুর চেহারাটাকে আর একবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। প্রশ্ন করে নিতাই-গায়ে নতুন গেঞ্জি, নতুন ধুতিও পরেছিস দেখছি। এসব এরই মধ্যে জোটালি কেমন করে?

দাশু—এগার টাকা দশ আনা বকশিশ জমা হয়েছিল।

নিতাই–বকশিশ?

দাশু–হ্যাঁ, একটি বেলাও অসুখ নিয়ে হাসপাতালে যাই নাই। জেলের বাগানের এক বিঘা মাটি আমি একা ভেঙেছি। দুই হাজার ধুদুল আর ঝিঙা ফলিয়েছি। আমি বকশিশ পাব না তো কে পাবে? জেলারবাবু বলেছে, দাশু ঘরামির মত ভাল মেজাজের কয়েদী আর নাই।

নিতাই—এগার টাকা দশ আনার সবই খরচ করে ফেলেছিস?

দাশু–না। আট টাকা ছ আনা খরচ করেছি।

নিতাই-একটা গেঞ্জি আর একটা ধুতি আট টাকা ছ আনা হবে কেন?

দাশু হাসে, লাজুক হাসি; সেই হাসির আভা লেগে চোখ দুটোও জ্বলজ্বল করতে থাকে : এক শিশি ফুলেল তেল, আর এক শিশি আলতাও কিনেছি, দু টাকা দু আনা দাম পড়েছে।

কিছুক্ষণ মাথা চুলকোয় নিতাই, তারপর হাঁপ ছাড়ে। বুঝলাম। বেশ করেছিস, তা হলে হাতে এখন মোট তিন টাকা চার আনা আছে?

দাশু–হ্যাঁ।

নিতাই–ভেতরে এসে বস। কি খাবি বল? মুড়ি আছে, মটর আছে, গুড় আছে।

দাশু–কিছু খাব না।

নিতাই-খাবি না মানে?

দাশু–ঘরে গিয়ে খাব।

নিতাই–এখন ঘরে যাবি কি রে? সন্ধ্যা পার হতে চলল। তার ওপর এই তিন ক্রোশ পথ।

দাশুও হাসে? এ তো আমি এক ছুটে পার হয়ে যেতে পারি গো।

নিতাই মুদি চোখ বড় করে আতঙ্কিতের মত তাকায় : পারবি না দাশু। এমন সাহস করিস না।

দাশু আশ্চর্য হয় : কিসের ডর?

নিতাই-দেখছিস না বাজারের দশা? সন্ধ্যা হবার আগেই যে-যার ঘরে চলে গিয়েছে। আজ এক মাস ধরে এই কাণ্ড চলছে। কোন কারবারী আর এমুখো হয় না।

–কেন?

–এক মাসের মধ্যে তিনটে গরু, পাঁচটা ছাগল আর দুটো মানুষ গিয়েছে।

–কোথায় গেল?

–আঃ, সোজা কথাটা বুঝতে পারিস না কেন দাশু? কানারানীর পেটে গিয়েছে।

নিতাই মুদির মুখের এত বড় আতঙ্কের গল্পটা শুনে আতঙ্কিত না হয়ে দাশুর বিস্মিত চোখের তারা দুটো ঝিক করে হেসে ওঠে। তা হলে কানারানীও আছে। এই পাঁচ বছরের মধ্যে কানারানী মরে যায় নি। জঙ্গলের কাটার আঁচড়ে নয়, নিজেরই বাঘের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে বাঘের থাবার আঘাতে একটা চোখ কানা হয়ে গিয়েছিল যে বাঘিনীর, সেই কানারানী। মধুকুপির আখের ক্ষেতের মধ্যে সারা রাত ধরে বাঘ-বাঘিনীর সেই লড়াই চলেছিল, সে আজ প্রায় আট বস্তু আগের কথা। ঘরে দরজা বন্ধ করে সারা গাঁয়ের মানুষ সারা রাত জেগে বাঘবাঘিনীর সেই ভয়ংকর ঝগড়াটে গর্জন শুনেছিল। ছোটকালু আর বড়কালুর পাথরের উপর আছড়ে পড়ে সেই গর্জনের প্রতিধ্বনি আরও ভয়াল হয়ে উঠেছিল। এবং ভোর হতেই আখের ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে গাঁয়ের লোক দেখতে পেয়েছিল, শুকনো ঘাসের উপর বাঘিনীর দুটো বাচ্চা হুটোপুটি করছে, আর ঘাসের ওপর এলিয়ে শুয়ে রয়েছে বাঘিনী, কাদামাখা একটা চোখ থেকে রক্ত ঝরছে।

অদ্ভুত একটা খুশির স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে দাশু–সেই কনারানী!

নিতাই-হ্যাঁ রে বাবা, হ্যাঁ। জনার্দনের মা সেই মুটকি বুড়িকে মনে পড়ে তো? শেষ রাতে উঠে সড়কের উপর গিয়ে গোবর কুড়তো যে বুড়িটা?

-হ্যাঁ।

-এই তো সাত দিন হল বুড়িকে খেয়ে ফেলেছে কানারানী। গোবিন্দপুর থানা থেকে চারজন শিকারী এসে আজ বিশ দিন হল জঙ্গল তছনছ করছে। মাচান বেঁধে সারা রাত ধরে তাক করছে, কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। গুলি করলেও কানারানীর গায়ে লাগে না।

দাশু–কানারানী তো বাঘিন নয়; কনমাতা বটে।

নাক সিঁটকে খেঁকিয়ে ওঠে নিতাই-হ্যাঁ, খুব দয়াময়ী বনমাতা বটে।

চুপ করে নিতাই মুদির দোকান-ঘরের দরজার কাছে দাড়িয়ে কি-যেন ভাবতে থাকে দাও। আর, স্তব্ধ বাবুরবাজারও এইবার ঘন অন্ধকারে যেন আরও ভাল করে গুটিশুটি হয়ে লুকিয়ে পড়তে থাকে।

দাশু বলে—আচ্ছা, এবার আমি চলি।

নিতাই–যাবি?

দাশু–হ্যাঁ।

নিতাই–মাত্র পাঁচটি আনা পয়সা খরচ করে মুড়ি-গুড় খেয়ে এখানে আজকের রাতটার মত থেকে গেলে ভাল করতিস। পাঁচ আনা পয়সা বাঁচাবার জন্য শেষে কানারানীর পেটে যদি যেতে হয়।

হেসে ওঠে দাশু : আমাকে কিছু বলবে না কানারানী।

নিতাই বলে—সে না হয় হলো, কিন্তু আমার কথাটা শুনলে ভাল করতিস দাশু। এ রকম অসময়ে হঠাৎ ঘরে গিয়ে ঢুকলে…।

কি যেন বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে যায় নিতাই মুদি। দাশু বলে—কি বললে নিতাইদাদা?

নিতাই মুখ টিপে হাসে : যাচ্ছিস যা। কিন্তু ঠকবি।

ঝট করে হাত চালিয়ে দরজার বাপ বন্ধ করে দেয় নিতাই মুদি।

 

তিন ক্রোশ পথ হন হন করে হেঁটে পার করে দিতে কতক্ষণই বা লাগবে? পথের দূরত্বকে নয়, অন্ধকারকে নয়, এবং কানারানীর রক্তলোলুপ ভয়ানক ক্ষুধার উৎপাতকেও নয়, কাউকেই ভয় করতে ইচ্ছা করে না। ভয় করেও না। দাশু ঘরামির বুকের ভিতরটাই যে স্বপ্নলোলুপ একটা পিপাসায় মত্ত হয়ে উঠেছে। বার বার মনে পড়ে, শুধু একটি মুখের ছবি। মুরলীর মুখটা। ঝালদার মহেশ রাখালের যে মেয়েকে একান্ন টাকা পণ দিয়ে বিয়ে করে ঘরে এনেছিল দাশু ঘরামি, সেই মুরলী।

আকাশের তারার দিকে মাঝে মাঝে তাকায় আর পথ হটে দাশু। হাতের পুঁটলিটা দোলে, যার ভিতর এক শিশি ফুলেল তেল আর এক শিশি আলতাও দোলে। ঠিক যেদিন মুরলীর জন্য ঠিক এই দুটি জিনিস কিনতে গোবিন্দপুর যাবার জন্য তৈরি হয়েছিল দাশু, প্রায় পাঁচ বছর আগের সেই সকালে দাশু ঘরামির জীবনের একটা আক্রোশ এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসে রইল। তার পরেই গ্রেপ্তার আর চালান। এক মাসের মধ্যেই পুরুলিয়ার দায়রা আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে হাকিমের রায় শুনতে হয়েছিল, সাংঘাতিক অস্ত্র দিয়ে মানুষকে সাংঘাতিকভাবে জখম করার অপরাধে দাশু ঘরামির পাঁচবছরের শক্ত কয়েদ।

যার জন্য এই সাজা তার চেহারাটাও মনে পড়ে। মুরলীর মত জীবন্ত হাসি হাসে না সে, কিন্তু হাসে ঠিকই। সে হল, গুলঞ্চের বেড়া দিয়ে ঘেরা দেড় বিঘের মত জমি।

মাত্র দেড় বিঘে চাকান জমি, মাটি এঁটেল। কিন্তু চেষ্টা করলে ওই এঁটেলকেই সামান্য গোবরসার দিয়ে তৈরি করে বছরে দুটো ফসল তোলা যায়। শীতের তিন মাসে ভাল সব্জী তোলা যায়। তারপর জিরে বুনে দিলেই হয়। মানপুরের পাইকারেরা জিরের ভাল দর দিতে রাজি আছে।

জিরে বুনব, জিরে বুনব, দশটা টাকা জমাতে পারলেই ওই দেড় বিঘেতে সোনার দানার মত জিরে ফলাব, মুরলীর কাছে কতবার এরকমের আশার কথা বলেছে দাশু।

কিন্তু কোথা থেকে এসে দেখা দিল এক রায়বাবু, ইঁটের ঠিকাদার। দাশু ঘরামির সেই দেড় বিঘে জমি তার চাই, প্রকাণ্ড এক ইঁটখোলা চালু করবে রায়বাবু। পঁচিশ টাকা নাও, আর ঐ দেড় বিঘে জমি ছেড়ে দাও; নোক পাঠিয়ে বার বার দাশুকে একটা রফার প্রস্তাব জানিয়েছিল রায়বাবু। কিন্তু জমি ছাড়তে রাজি হয় নি দাও।

–পাঁচশো টাকা দিলেও না। বেশ জোর গলায় হাঁক দিয়ে রায়বাবুর সরকারের দিকে একদিন মারমুখো হয়ে তেড়ে গিয়েছিল দাও।

–ঈশানবাবুর মত মানুষ তার তিন বিঘে ব্রহ্মোত্তর পর্যন্ত রায়বাবুর ইঁটখোলার জন্য ছেড়ে দিতে পারলেন, আর তুমি তোমার এক টুকরো চাকরান ছেড়ে দিতে পারবে না, কোথাকার লাট হে তুমি?

রায়বাবুর সরকার মশাইয়ের এই গর্জনের উত্তরে দাশুও গর্জন করেছিল–চুলায় যাক ঈশানবাবুর বেরোমতোর। ঈশানবাবু সদরে বসে মোজারি করে, আর গায়ে এসে জমি মারে। ওর কত জমি! ডরানির জলে ওর দশ বিঘা জমি গলে গেলেও ওর কোন দুখ নাই; কিন্তু আমার দুখ হয় গো মশাই।

–শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দিতেই হবে বাবা।

–কেন?

নতুন সেটেলমেন্টের কাগজে দেখেছি, তাতে তোমার এই দেড় বিঘে চাকরানের কোন দাগ নেই। এখান থেকে শুরু করে ওই সড়ক পর্যন্ত সবই ঈশানবাবুর সাবেক পতিত, রায়বাবু ইজারা নিয়েছে।

–কাগজে দাগ নাই তো নাই। সারা গাঁয়ের লোক জানে ওটা আমারই তিন পুরুষের ভোগদখলের জমি। লাঙ্গল গরু নাই, বীজ কিনবার পয়সা নাই, তাই চাষ দিতে পারি নাই; কিন্তু তাই বলে জমি ছেড়ে দিব কেন?

–জমিটা তোমার কোন কাজে লাগছে না, তবুও ছাড়বে না?

–না।

–আচ্ছা।

সেই যে শাসিয়ে গেল রায়বাবুর সরকার, তার দশ দিন পরে সকালে ঘুম থেকে উঠেই মাঠের দিকে লোকের হল্লা শুনতে পেয়ে চমকে ওঠে দাশু ঘরামি।

গোবরমাখা হাত নিয়ে ছুটে এসে মুরলীও চেঁচিয়ে ওঠে ইঁটখোলার লোক এসে মাটি কাটতে লেগেছ গো।

দেখতে পায় দাশু, গুলঞ্চের বেড়া উপড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। দেড় বিঘে চাকরান, সেই শান্ত শক্ত চৌরস এঁটেলের উপর ঝপাঝপ কোদালের আঘাত পড়ছে। এরই মধ্যে মস্ত বড় দুটো গর্ত হয়ে গিয়েছে। রায়বাবুর সরকার দাঁড়িয়ে আছে। লাঠি হাতে নিয়ে তিনজন ভাড়াটে লেঠেলও দাঁড়িয়ে আছে।

-আমার টাঙ্গি কোথা রে মুরলী? কাঁপতে কাঁপতে চেঁচিয়ে ওঠে দাশু দাশু ঘরামির পঁচিশ বছর বয়সের মজবুত শরীরের হাড়গুলি যেন আক্রোশে ক্ষিপ্ত হয়ে কটকট করে বাজতে থাকে। চোখ দুটো নেশাড়ে মানুষের চোখের মত ঘোলাটে হয়ে যায়।

গোবরমাখা হাতেই মুরলী দাশুর হাত চেপে ধরে অনুনয় করে—যেও না। ওরা অনেক লোক, তোমাকে ওরা মেরে ফেলবে।

এক ধাক্কা দিয়ে মুরলীকে সরিয়ে দিয়ে ঘরের চালা থেকে টাঙ্গিটা টেনে বের করে নিয়ে ছুটে চলে দাশু। যে টাঙ্গি দিয়ে ফণী-মনসার ঝোপের অনেক শজারুকে এক কোপে দু’টুকরো করেছে দাশু সেই টাঙ্গি হাতে তুলে নিয়ে দাশু ঘরামির মনে হয়েছিল, ইঁটখোলার লোকগুলিও যেন উৎপাতের শজারু। সেই মুহূর্তে…

সেই মুহূর্তে দাশুর টাঙ্গির একটি আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রায়বাবুর সরকার। ঠিক ঘাড়ের কাছে কোপটা পড়েছে। রক্তের ফোয়ারা ছুটেছে। পাগড়ি বাঁধা মাথা, সব চেয়ে লম্বাচওড়া চেহারার লেঠেলটার মাথা লক্ষ্য করে দাশু ঘরামির টাঙ্গি হিংস্র হয়ে লাফিয়ে উঠতেই মাথা নীচু করে মাথা বাঁচায় সেই লম্বা-চওড়া লেঠেল। টাঙ্গিকেও ধরে ফেলে। দাশু ছুটে এসে ঘরের আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে হাঁক দেয়—আমার কাটারিটা দে তো মুরলী।

কাটারিটা লুকিয়ে ফেলে মুরলী। চিৎকার করে, গাঁয়ের মানুষ কে কোথা আছ গো জলদি এস।

যারা কাছে ছিল, তারা মুরলীর ডাক শুনে ছুটে এসে দাশুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ও একটু থাম দাশু। মাথা খারাপ করিস না; পাগলপারা কাণ্ড করছিস কেন?

পালিয়ে গেল ইঁটখোলার লোকজন। ভাড়াটে লেঠেলরা সরকারের জখম শরীরটাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে দূরের সড়কের উপর একটা মোটর গাড়ির দিকে চলে গেল।

তার পর মাত্র একটি দিন মুরলীকে চোখের সামনে দেখবার সুয়োগ পেয়েছিল দাশু। পরের দিন সকালে দাশুকে গ্রেপ্তার করার জন্য যখন পুলিস এসে ঘরের দরজায় দাঁড়াল, তখন মুরলীর মুখের দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলেছিল দাও আমি তো চললাম, কিন্তু তোর কি করে দিন চলবে মুরলী? ঝালদা চলে যাবি?

মুরলী-না।

দাশু—এই ঘরে থাকবি?

মুরলী-হ্যাঁ।

দাশু–কিন্তু কতদিন থাকতে পারবি?

মুরলী-যতদিন না তুমি ফিরে আস।

দাশু বেঁচে থাকবি তো?

হাতের তেলো দিয়ে চোখের জল মুছে মুরলী বলে–থাকবো।

মুরলীর সেই মুখটাকে মনে পড়ে। কী সুন্দর একটা প্রতিজ্ঞার জোরে মুরলীর চোখ-মুখ শক্ত হয়ে উঠেছিল। বয়সটি সুন্দর, চেহারাটি সুন্দর, আর কথাগুলিও কত সুন্দর। যত দিন না দাশু ফিরে আসে, ততদিন নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবেই আর এখানেই পড়ে থাকবে মুরলী।

সেই মুরলী আজ এখন ওই মধুকুপির একটা মাটির ঘরে ঘুমিয়ে পড়ে আছে। মধুকুপি বদলায় নি, মুরলীই বা বদলাবে কেন? মুরলীর বয়সটা আঠার থেকে তেইশ হয়েছে, এই মাত্র। কাচপোকার টিপ কপালে লাগিয়ে কেমনটি হাসত মুরলী! আজও কাঁচপোকার টিপ পরে তো মুরলী?

ওই তো ওই জমাট অন্ধকার হলো কপালবাবার জঙ্গল। বাতাসটা ঠাণ্ডা। ডরানির স্রোতের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। এইবার ডান দিকে একটু ঘুরে গেলেই মধুকুপির ডাঙা কাছে এসে পড়বে।

দাশু ঘরামির পথ চলার আবেগ হঠাৎ যেন একটা ধাক্কা খায়। একটা নতুন বিস্ময়ের আঘাত। এই সড়ক তো ঠিক সেই সড়ক নয়। লাল কাঁকর আর ধুলোয় ভরা থাকত যে সড়কটা, সেটা এরকম ভরাট আর শক্ত হয়ে গেল কেমন করে? কালো কাতরা ঢেলে সড়কটাকে পাকা করা হয়েছে বলে মনে হয়। ধুলো নেই। লড়াইয়ের সময় এই সড়ক দিয়ে গোরা পল্টন কতবার কাতার দিয়ে যাওয়া-আসা করেছে। ঢেঙা ঢেঙা, হট্টাকাট্টা, সাদা সাদা আদুড় গা; যত আমরিক গোরা।

এই সড়কটাই তো দাশু ঘরামির সেই মাটির ঘরের গা ঘেঁষে চলে গিয়েছে। আজও ভুলে যায় নি দাশু, কী ভয়ানক উৎপাতের দিনই না গিয়েছে, কানারানীর উৎপাতের চেয়েও ভয়ানক মানুষখেগো উৎপাত। ঘরের দরজা সব সময় বন্ধ করে রাখতে হত। দরজার কাছে এক মিনিটও নিশ্চিন্ত মনে দাঁড়াবার সুযোগ পেত না মুরলী। পল্টনের দল আসছে আর যাচ্ছে। সাঁজোয়া গাড়ি যায়। ঝনঝন শব্দের হুল্লোড় তুলে লোহার জানোয়ারের মত একএকটা ট্যাঙ্ক যায়। রামগড়ের দিক থেকে আসে, আর কোথায় যে চলে যায় কে জানে? আবার কোথা থেকে যেন আসে, আর রামগড়ের দিকে চলে যায়। মুরলীর শাড়ির আঁচলটা, মুরলীর খোঁপার ছায়াটাও যদি ভুল করে দরজার কপাটের আড়াল থেকে বের হয়ে পড়ত, তবে সেই মুহূর্তে পল্টনের মুখ থেকে কী ভয়ানক লুব্ধ একটা আহ্লাদের আওয়াজ উথলে উঠত। সেই পুরনো জামকাঠের জীর্ণ দরজার কপাটের উপর কতবার ঝুপঝাপ করে লুটিয়ে পড়েছে গোরা পল্টনের মতলবের যত উপহার-চকোলেটের প্যাকেট, এক গাদা লেবেনচুষ, সিগারেটে ভরা ডিবে, এঁটো মদের বোতল। মুরলী সেই সব জিনিস কোনদিন পা দিয়েও ছোয় নি।

থমকে দাঁড়ায় দাশু। হঠাৎ গা ছমছম করে উঠেছে। মনের ভিতরেও একটা কাঁপুনি যেন সিরসির করে। ছোটকালুর মাথার উপরে চাঁদ উঠেছে দেখা যায়।

চাঁদের আলোতে অনেক কিছু দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু চিনতে পারা যাচ্ছে না। কি এগুলি? কোথায় ছিল? কেমন করে কেন এল? মধুকুপির ডাঙার দূরকিনারায় ওসব কিসের ইমারত গড়ে উঠেছে? ডরানির এই স্রোতটার উপর পুল বাঁধা হল কবে? এদিকে ওদিকে এত রাস্তা কেন? কোন দিকে কার কাছে ছুটে গিয়েছে কালো সাপের মত কিলবিলিয়ে এইসব রাস্তা? অনেক দুরে ধোঁয়া ছাড়ছে একটা চিমনির মুখ। তবে কি ওখানে কারখানা হয়েছে?

না, ঠিক সে মধুকুপি নয়। ডরানির ভাদুরে জলের ঢলে মধুকুপির ডাঙা বোধহয় আর ভেসে যায় না। বোধহয় বড়কালুর মাথার উপর বাজ পড়ে না; পোড়া ঘাসের বন থেকে গরম ধোঁয়া আর ফুরফুর করে ওড়ে না। জোরে হাঁপ ছাড়তে গিয়ে দাশুর হতাশ নিশ্বাসটা কেঁপে ওঠে।

তা হলে কি মুরলীর মুখের হাসিটাও বদলে গিয়েছে? কে জানে কেমন করে এই পাচটা বছর নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে মুরলী। জেলে যাবার আগে মুরলীর হাতে পাঁচটা টাকাও রেখে আসে নি দাশু। দাশুর বুকের উপর মাথা রেখে রোজ ঘুমিয়ে পড়ত যে নরমসরম মুরলী, সে এই পাঁচটা বছর নিজেকে একেবারে পাথরের মত শক্ত করে নিয়ে গতর খাটাতে পেরেছে কি? গরু চরিয়েছে? কাঠ ভেঙেছে? জঙ্গলের তেঁতুল কুড়িয়ে হারানগঞ্জের হাটে গিয়ে বেচে এসেছে? কিংবা গোবিন্দপুরের কোন বাবুর বাড়িতে দাই খেটেছে? তা না হলে মুরলী বেঁচে থাকবে কি করে?

ভয়ে ছমছম শরীরটা এইবার ছটফট করে ওঠে ব্যস্তভাবে, প্রায় দৌড়ে দৌড়ে চলতে থাকে দাশু।

ঘুমন্ত মধুকুপির পিপুলের ছায়ার কাছে এসে পড়ে দাশু। দাশুর অনেক চেনা সেই পিপুল, গাঁয়ে ঢুকবার পথে আগেভাগে যেটা পাহারাদের মত দাঁড়িয়ে আছে। পিপুলের কাছে দুখন গুরুজীর বাড়ীটাও আছে। হ্যাঁ, গুরুজীর বাড়ির সামনে সিমেন্ট বাঁধানো একটা চাতাল দেখা যায়। বাঃ, গুরুজীর সুখ আরও জমাট হয়েছে মনে হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *