০১. আমি কোন মহাপুরুষ নই

জার্নালিস্টের জার্নাল – নিমাই ভট্টাচার্য

আমি কোন মহাপুরুষ নই যে আত্মজীবনী লিখব; যশস্বী বা কৃতি পুরুষদের মত স্মৃতিকথা লেখার অধিকারও আমার নেই। তবু সব মানুষের মতই জীবনের পথ চলতে চলতে কিছু দেখেছি, কিছু শুনেছি। কিছু কিছু উপলব্ধিও করেছি। অত্যন্ত সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মেছি। ছোটবেলায় শিয়ালদহ স্টেশনের আশেপাশের পেট মোটা কনস্টেবল দেখেই ঘাবড়ে যেতাম। কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দিতে না দিতেই খবরের কাগজের রিপোর্টার হলাম। রাইটার্স বিল্ডিংস-লালবাজার যাতায়াত তখন নিত্যকর্ম হল। মাঝে মাঝে রাজভবনে বা দমদম এয়ারপোর্টে বা ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউণ্ডে রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর দর্শনও জুটে যেত। তারপর হঠাৎ অনেক কিছু ঘটে গেল আমার জীবনে। যা কোন দিনই হবার কথা নয়, যা কোন দিন স্বপ্নেও ভাবিনি, তাই ঘটে গেল। একের পর এক। মাসের পর মাস বছরের পর বছর।

মাঝে মাঝে সেই সব ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে অনেক স্মৃতি, অনেক কাহিনী। কোন ধারাবাহিক ইতিহাস নয়, সেই সব টুকরো টুকরো স্মৃতি আর কাহিনী নিয়েই আমার জার্ণালিস্টের জার্ণাল।

.

আমি তখন কলকাতার এক অখ্যাত দৈনিকে পনেরো-বিশ টাকা মাইনের রিপোর্টার। তা হোক। সংবাদ সংগ্রহের ব্যাপারে আমার অদম্য উৎসাহ। নিত্যই রাইটার্সে কিছু মন্ত্রীর ঘরে হানা দিই। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা কলকাতায় এলেও তাদের কাছাকাছি যাবার চেষ্টা করি।

সে সময় উদ্বাস্তু সমস্যা ছিল কলকাতার সংবাদপত্রগুলোর অন্যতম প্রধান খোরাক। তাই তো নেহরু মন্ত্রীসভার আইন ও সংখ্যালঘু দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী শ্রীচারুচন্দ্র বিশ্বাস কলকাতায় এলেই অনেক রিপোর্টারই ওঁর কাছ থেকে কিছু সংবাদ সংগ্রহের জন্য বিশেষ তৎপর হয়ে উঠতেন। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য তখন কেন্দ্রীয় সরকারের সংখ্যালঘু দপ্তরের একটা অফিসও ছিল কলকাতায়। তাই চারুবাবুকে প্রায়ই আসতে হত কলকাতায়।

সেবার অন্য কোন রিপোর্টার পৌঁছবার আগেই আমি চারুবাবুর কলকাতার বাড়িতে হাজির। খবরের কথা বলতেই উনি চমকে উঠলেন, না না, কিচ্ছু খবর দিতে পারব না।  

সবিনয়ে প্রশ্ন করলাম, কেন?

উনি বললেন, আই এ্যাম আণ্ডার ওথ। আই কান্ট ডিসক্লোজ এনিথিং।

আমি ওঁর কথা শুনে অবাক। কলকাতা হাইকোর্টের ভূতপূর্ব বিচারপতি মাননীয় সি. সি. বিশ্বাসের কাছে সবিনয়ে নিবেদন করলাম, অন্যান্য মন্ত্রীরা মন্ত্রগুপ্তির শপথ নিলেও তো রিপোর্টারদের খবর দেন।

জাস্টিস বিশ্বাস আবার বললেন, নো নো, আই এ্যাম আণ্ডার ওখ। আই কান্ট ডিসক্লোজ এনিথিং।

আমি বার বার ওঁকে অনুরোধ করলাম এবং প্রতিবারই উনি এক জবাব দেন, সরি, আই এ্যাম আণ্ডার ওথ। আমি কোন খবর ফাঁস করতে পারব না।

আমি খবর পাবার আশায় প্রায় জলাঞ্জলি দিয়েছি, এমন সময় হঠাৎ উনি ওঁর পার্সোন্যাল এ্যাসিস্ট্যান্টকে ডেকে প্রশ্ন করলেন, আমি কি কালকের ডায়েরীর নোট দিয়েছি?

পি. এ. বললেন, না স্যার।

জাষ্টিস বিশ্বাস বললেন, নোট ডাউন।

পার্সোন্যাল এ্যাসিস্ট্যান্ট সর্টহ্যাণ্ড নোটবই-পেন্সিল নিয়েই ঘরে এসেছিলেন। উনি আমার পাশের চেয়ারে বসতেই জাষ্টিস বিশ্বাস সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে বলতে শুরু করলেন–আমি যথারীতি ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠি এবং বেড়াতেও গিয়েছিলাম। বাংলোয় ফিরে এসেই শুনি, মাননীয় ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার সর্দার প্যাটেল আমাকে অবিলম্বে দেখা করতে বলেছেন। আমি এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে সর্দার প্যাটেলের বাড়ি রওনা হলাম। …

জাস্টিস বিশ্বাস চোখ বুজে তার আগের দিনের সবকিছু ঘটনা বলছেন। পার্সোন্যাল এ্যাসিস্ট্যান্ট এক মনে সর্টহ্যাণ্ডে নোট নিচ্ছেন। আর আমি? শুনছি আর মনে মনে হাসছি।

..সর্দার প্যাটেল আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আজকের ক্যাবিনেটে পূর্ব পাকিস্তান থেকে নতুন করে উদ্বাস্তু আগমন নিয়ে যে আলোচনা হবে, তার জন্য কোন নোট তৈরি করেছি কি? আমি মাননীয় ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টারকে জানালাম, ড্রাফট তৈরি হয়েছে এবং এখনই বাড়ি গিয়ে ওটাকে ফাইন্যাল করব। ঐ ড্রাফট নোটস সম্পর্কে দু-চারটে প্রশ্ন করার পর সর্দার প্যাটেল বললেন, ঐটি ফাইন্যাল করে আমার কাছে নিয়ে আসুন।

তারপর?

জাস্টিস বিশ্বাস বললেন, সর্দার প্যাটেল আমার তৈরি নোটটি পড়েই বললেন, না, এটা ঠিক হয়নি। তারপর উনি নিজেই পি. এ-কে ডেকে একটা নতুন নোট ডিক্টেট করলেন। পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে পি. এ. ঐ নোটটি টাইপ করে আনতেই সর্দার প্যাটেলের নির্দেশ মত আমি তার নীচে সই করলাম। তারপর সর্দার প্যাটেল আমাকে বললেন, আমি যে এই নোট তৈরি করেছি, তা যেন ক্যাবিনেটের কেউ না জানেন।…

আমি জাষ্টিস বিশ্বাসের কথা শুনতে শুনতে মনে মনে চঞ্চল হয়ে উঠলেও পাথরের মত চুপ করে বসে আছি।

….ক্যাবিনেট মিটিং-এ পূর্ব পাকিস্তান থেকে আবার নতুন করে হাজার হাজার উদ্বাস্তু আসার প্রসঙ্গ উঠতেই আমি আমার নোটটি বের করলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে সর্দার প্যাটেল এটি আমার কাছ থেকে নিয়ে সবাইকে পড়ে শোনালেন। অন্য কেউ কিছু বলার আগেই মাননীয় ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার মন্তব্য করলেন, জাস্টিস বিশ্বাসের নোটটিতে বর্তমান পরিস্থিতি ও আমাদের মনোভাব বেশ পরিষ্কার ভাবেই বলা হয়েছে। সুতরাং এই নোটের ভিত্তিতেই অবিলম্বে পাকিস্তান সরকারের কাছে একটা প্রতিবাদ-পত্র পাঠানো যেতে পারে। সামান্য আলোচনার পরই ক্যাবিনেট সর্দার প্যাটেলের প্রস্তাব মেনে নিলেন।…

চারুবাবু সারাদিনের সব ঘটনা বলতেই. পি. এ. পাশের ঘরে চলে গেলেন।

আমি ন্যাকামী কবে বললাম, আমাকে যদি কিছু বলতেন তাহলে…

আমাকে পুরো কথাটা বলতে না দিয়েই চারুচন্দ্র বিশ্বাস আবার বললেন, আই এ্যাম আণ্ডার ওথ। আমি কিচ্ছু বলতে পারব না।

আমি অতি কষ্টে হাসি চেপে বললাম, তাহলে আমি যাই।

হ্যাঁ এসো।

আমি নমস্কার কবে ওঁর ঘব থেকে বেরুতেই হেসে ফেললাম।

***

খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে সাংবাদিকদের নানা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। আমিও হয়েছি কিন্তু নিঃসন্দেহে স্বীকার করব, অনেক ঘটনাই ভুলে গেছি। তবু কিছু মনে আছে। এই প্রসঙ্গে মাস্টার তারা সিং-এর কথা মনে পড়ছে।

১৯৪৭ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারী ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী এটলি ঘোষণা করলেন, পনেরো মাসের মধ্যে (জুন, ১৯৪৮) ভারত বর্ষে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবেই। লর্ড মাউন্টব্যাটেন দিল্লীতে পৌঁছুলেন ২২শে মার্চ। শপথ নিলেন ২৪শে মার্চ। মাউন্টব্যাটেন দিল্লীতে পৌঁছবার তিয়াত্তর দিনের মধ্যেই ঘোষণা করলেন, ভারত দ্বিখণ্ডিত হবে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্লান্ত ও বৃদ্ধ সেনাপতিরা জীবনের শেষ অধ্যায়ে দিল্লীর তখৎ-এ-তাউস দখলের নেশায় এমনই মশগুল হয়ে উঠেছিলেন যে তাঁরাও ভারত দ্বিখণ্ডিকরণের প্রস্তাব মেনে নিলেন। মাউন্টব্যাটেনের এই সর্বনাশা ঘোষণার ঠিক বাহাত্তর দিন পরে ১৫ই আগস্ট ভারত স্বাধীন হল।

মাউন্টব্যাটেনের এই তাড়াহুড়োর জন্যই র‍্যাডক্লিফ সাহেব কোন মতে কেটেকুটে দু টুকরো করলেন পাঞ্জাব আর বাংলাকে। দেশ স্বাধীন হবার কয়েক বছরের মধ্যেই দাবী উঠল, পাঞ্জাবী সুবা চাই। ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের সময় এই দাবী অগ্রাহ করা হয়। কেন্দ্রীয় সরকার বার বার বললেন, ঐ এক টুকরো রাজ্যকে প্রায় দু টুকরো করার কোন যুক্তি নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের মনোভাব যত কঠোর হয়েছে, মাস্টার তারা সিং-এর নেতৃত্বে পাঞ্জাবী সুবার দাবীও তত তীব্র হয়েছে।

১৯৬০ সালের শেষের দিকে মাস্টার তারা সিং পাঞ্জাবী সুবার দাবীতে আমরণ অনশনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করায় পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠল। এই পরিস্থিতির পটভূমিকায় শুরু হল ভবনগর কংগ্রেস অধিবেশন।

.

কংগ্রেস অধিবেশনের প্রথম বা দ্বিতীয় দিনের কথা। মধ্যাহ্ন ভোজের বিরতির পর অপরাহ্নকালীন অধিবেশন শুরু হবার কয়েক মিনিট বাকি। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ ভবনগরের মহারাজার রোলস রয়েস এসে থামল। আস্তে আস্তে লাঠিতে ভর দিয়ে বেরিয়ে এলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পণ্ডিত গোবিন্দবল্লভ পন্থ। সঙ্গে তাঁর পার্সোন্যাল সেক্রেটারি জানকীবাবু। আমাকে দেখেই পন্থজী জিজ্ঞাসা করলেন, এখানে কি করছ?

হেসে বললাম, এমনি দাঁড়িয়ে আছি।

এবার পন্থজী একটু হেসে বললেন, ওদিকে যে অনেক কিছু ঘটে গেল।….

তার মানে?

পন্থজী একটু চাপা গলায় বললেন, প্রাইম মিনিস্টারের কাছে মাস্টার তারা সিং এসেছেন।  

খবরটা শুনেই আমি ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম। চোখ দুটো বড় বড় করে জিজ্ঞাসা করলাম, মাস্টার তারা সিং কখন এলেন?

পন্থজী আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন, আর সময় নষ্ট করে তাড়াতাড়ি যাও; তা নয়তো দেখা হবে না।

পন্থজী আর দাঁড়ালেন না। অধিবেশনে যোগ দিতে ভিতরে চলে গেলেন।

জানকীবাবুকে প্রশ্ন করতেই জানতে পারলাম, প্রধানমন্ত্রী নেহরুর অনুরোধেই মাস্টারজী এসেছেন ভারতীয় বিমান বাহিনীর এক বিশেষ বিমানে। বিমানটি ভবনগর এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছে এবং মাস্টারজীকে নিয়ে বিমানটি একটু পরেই দিল্লী রওনা হবে।

…এ তো দারুণ খবর! হেডলাইন স্টোরি!

জানকীবাবুর সাহায্যে কংগ্রেসের একটা জীপ পেলাম। জীপ স্টার্ট দিতেই হঠাৎ কোথা থেকে এসে লাফ দিয়ে উঠল হিন্দুস্তান টাইম-এর বিশেষ সংবাদদাতা সুদর্শন ভাটিয়া।

বিরাট এলাকা নিয়ে ভবনগরের রাজপ্রাসাদ। গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখি, চারপাশে অজস্র গাছপালা। কোথাও বা সুন্দর ফুলের বাগান, সবুজ মাঠ। অনেকগুলি ছোট-বড় প্রাসাদ। বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর যখন আসল রাজপ্রাসাদের সামনে হাজির, তখন দেখি নেহরু মাস্টার তারা সিংকে বিদায় জানাতে বেরিয়ে এসেছেন। ইতিমধ্যে আমরা দুজনে হাজির। অবিলম্বে কংগ্রেস অধিবেশনে যেতে হবে বলে নেহরু মাস্টারজীকে বারান্দা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েই চলে গেলেন কিন্তু যাবার আগে আমাদের দুজনকে দেখিয়ে ঠাট্টা করে বললেন, নাউ দে উইল লুক আফটার ইউ।

বৃদ্ধ ক্লান্ত মাস্টারজী একটা চেয়ারে বসলেন; পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন ওঁর সঙ্গী এক উকিলবাবু। আমি আর সুদর্শন ভাটিয়া প্রায় একসঙ্গেই প্রশ্ন করলাম প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কি কথা হল? অনশন কি করবেন? নাকি…

মাস্টার তারা সিং বললেন, নেই বেটা, এখানে কিছু বলব না।…

উকিলবাবু বললেন, পালাম এয়ারপোর্টে ফরেন করসপন্ডেন্ট আর টি, ভি, ক্যামেরাম্যানরা অপেক্ষা করছে। যা বলার তা ওখানেই বলা হবে।

ভাটিয়া হঠাৎ মেঝেতে বসেই মাস্টারজীর পা টিপতে শুরু করল। এই ইশারায় আমিও মাস্টারজীর পিঠ-ঘাড়-হাত টিপতে শুরু কবলাম। মাস্টারজী চোখ বুজে আমাদের সেবা উপভোগ করছেন। ওদিকে সিকিউরিটির লোকজন মাস্টারজীকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেবার জন্য গাড়ি আনতে গেছে। হাতে সময় অত্যন্ত কম। মাঝে মাঝে মাস্টারজী বলছেন, এদিকটা-ওদিকটা টিপে দাও।

এরই মধ্যে আমার আর ভাটিয়ার সকাতর প্রার্থনা, মাস্টারজী, শুধু বলুন কি কি বিষয়ে কথা হল? প্রাইম মিনিস্টারকে দেখে মনে হল, আপনার সঙ্গে কথা বলে উনি খুব খুশি। আপনিও কি খুশি?

উকিলবাবু বলেন, না না, এখানে কিছু বলা হবে না। মাস্টারজী উইল মেক এ স্টেটমেন্ট ওনলি অন এ্যারাইভ্যাল এ্যাট পালাম।

ভাটিয়া মাস্টারজীর পদসেবা করতে করতেই আবার আবেদন জানায়, সব কথা তো জানতে চাইছি না! শুধু বলুন, প্রাইম মিনিস্টারের মনোভাব কেমন দেখলেন?

আমিও মাস্টারজীর সেবা করতে করতে কিঞ্চিৎ তৈলমর্দন করলাম কিন্তু উকিলবাবু ফোঁস করে উঠলেন, নো নো, উই কাণ্ট সে এনিথিং হিয়ার।

বোধহয় আমাদের সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে হঠাৎ মাস্টারজী বললেন, ভকিলসাব, আমি পণ্ডিতজীর সঙ্গে কথা বলে যে স্টেটমেন্ট তৈরি করেছি, তার দুটো কপি এদের দিন।

উকিলবাবু টুঁ শব্দটি না করে আমাদের হাতে বিবৃতির দুটি কপি দিতেই আমরা মাস্টারজীকে ধন্যবাদ দিয়েই এক দৌড়।

সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশনে সময় সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। যে সাংবাদিক যত আগে সঠিক সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশন করতে পারেন, তার কৃতিত্ব তত বেশি। সেদিন আমি আর সুদর্শন ভাটিয়া প্রধানমন্ত্রী ও মাস্টার তারা সিং-এর গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার খবর দেশী বিদেশী সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছবার ঘণ্টা চারেক আগে সংগ্রহ করে সত্যি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিলাম।

***

এই সংবাদ সংগ্রহের কাহিনী লিখতে লিখতে আরো একটা কাহিনী মনে পড়ল। ১৯৫৯-১৯৬০। শান্ত স্নিগ্ধ হিমালয়ের এখানে-ওখানে কখনও কখনও বারুদের দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। হিন্দী-চীনী ভাই-ভাই আর শোনা যাচ্ছে না। ছোটখাট ঘটনাকে কেন্দ্র করেই পার্লামেন্টে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আকশাই-চিন এলাকায় চীনের রাস্তা তৈরি ও নেহরুর বিখ্যাত উক্তি নট এ ব্লেড অফ গ্রাস গ্রোজ দেয়ার নিয়ে তর্ক-বিতর্কের শেষ নেই।

এরই পটভূমিকায় লোকসভা-রাজ্যসভায় নিত্যই প্রশ্নোত্তর। বাদ-প্রতিবাদ। বিরোধীদের খুশি করার জন্য নেহরু বার বার ঘোষণা করছেন, না না, চীনের সঙ্গে কোন আলোচনা নয়।

সেদিন সকালেও লোকসভায় নেহরু বললেন, না, চীনের সঙ্গে কোন আলোচনার কথা আমরা ভাবছি না। পার্লামেন্টের খবর পার্লামেন্ট হাউস পোস্ট অফিস থেকে টেলিগ্রাম করে আমার সংবাদপত্রে পাঠিয়ে দেবার পর সেন্ট্রাল হলের আড্ডাখানায় চলে গেলাম। তারপর বিকেলের দিকে ঘুরতে ঘুরতে চলে গেলাম সাউথ ব্লকে দেশরক্ষা মন্ত্রী কৃষ্ণ মেননের কাছে। কফি খেতে খেতে আমরা কথা বলছিলাম। হঠাৎ মেনন হাসতে হাসতে বললেন, আমার এখানে আড্ডা দিয়ে তোমার মূল্যবান সময় নষ্ট না করে প্রাইম মিনিস্টারের অফিসের ওদিকে গিয়ে ভাল খবর জোগাড় করার চেষ্টা কর।

পার্লামেন্টে অভূতপূর্ব উত্তেজনার পর কৃষ্ণ মেননকে ঐভাবে হাসতে ও ঠাট্টা করতে দেখে খটকা লাগল। সন্দেহ হল, তবে কি সত্যি কিছু ঘটতে চলেছে?

আমি উঠে পড়লাম। মাঝখানের করিডর দিয়ে পশ্চিমের দিকে এগুতে এগুতে নানা কথা ভাবছিলাম। ভাবছিলাম, কি ঘটতে পারে? কি ঘটা সম্ভব? এমন কি ঘটতে চলেছে যা বর্তমান পরিস্থিতিতেও মেননকে খুশি করতে পারে? সীমান্ত-বিবোধ নিয়ে কিছু ঘটছে নাকি?

সাউথ ব্লকের পশ্চিম প্রান্তে পৌঁছতেই দেখি, ফরেন সেক্রেটারি ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দু-তিনজন জয়েন্ট সেক্রেটারি নেহরুর ঘরে বারবার যাতায়াত করছেন। সবাই ব্যস্ত-ত্রস্ত ভাবে ছোটাছুটি করলেও কারুর মুখেই কোন উৎকণ্ঠার ছাপ দেখলাম না। তবে কি এমন কিছু ঘটল যার জন্য সবাই খুশি?

কয়েক মিনিটের মধ্যেই নেহরু হাসি মুখে ফরেন সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। দরজার সামনে দাঁড়িয়েও ওঁরা দু-এক মিনিট কথা বললেন। ফরেন সেক্রেটারি দু একটা ফাইল হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে নিজের ঘরের দিকে এগুলেন। নেহরু নিচে নামার জন্য দু-এক পা এগুতেই আমাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এখন তুমি এখানে কেন?

আমি হাসতে হাসতে বললাম, শুনলাম খুব জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ খবর পাবার সম্ভাবনা আছে তাই চলে এলাম।

নেহরু লিফট-এর পরিবর্তে সিঁড়ি দিয়েই নিচে নামতে নামতে প্রশ্ন করলেন, তোমাকে কে বললেন?

সংবাদের সূত্র কি প্রকাশ করা উচিত?

দ্যাটস রাইট।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসারও নিচে নামছিলেন। হাতে বিশেষ সময় ছিল না। তাই আমি আর সময় নষ্ট না করে বললাম, আজ আপনি এত খুশি কেন?

নেহরু পাশ ফিরে অফিসারদের দিকে তাকিয়ে চাপা হাসি হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলেন, আজ আমাকে খুশি দেখাচ্ছে নাকি?

প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নে অফিসাররা শুধু হাসেন।

সিঁড়ির প্রায় নিচের ধাপে পৌঁছেছি। দু-চার পা এগিয়েই গাড়ির সামনে পৌঁছবেন। আমি আবার প্রশ্ন করি, নিশ্চয়ই কোন ভাল খবর পেয়েছেন?

পেয়েছি বৈকি।

কি সেই ভাল খবর?

তোমাকে বলব কেন?

আপনার ভাল খবর মানে তো সারা দেশের ভাল খবর।

তারপর নেহরু গাড়ির মধ্যে ঢোকার আগে শুধু বললেন, হ্যাঁ, আমার এক বন্ধু আসছেন বলে আমি খুশি।

কে সেই বন্ধু?

নেহরু আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে হাসতে হাসতে ড্রাইভারকে বললেন, গাড়ি চালাও।

কৃষ্ণ মেননের ইঙ্গিত আর নেহরুর কথা শুনে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, এমন কেউ আসছেন, যার আগমনের ফলে হয়তো কোন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান হতে পারে। নেহরু চলে গেলেও আমি সাউথ ব্লক ছেড়ে এলাম না। আবার ওপরে উঠলাম। ভাবলাম, আবার কৃষ্ণ মেননের কাছে যাই। দোতলায় উঠতেই চায়না ডেস্কের ইন-চার্জ জয়েন্ট সেক্রেটারি আর চীফ অব প্রটোকলকে একসঙ্গে ফরেন সেক্রেটারির ঘরে ঢুকতে দেখেই হঠাৎ আমার মনে হল, তবে কি চীন থেকেই কেউ আসছেন? নেহরু যে বন্ধুর কথা বললেন, তিনি কী চীনের প্রধানমন্ত্রী?

ঢুকলাম আমার এক শুভাকাঙ্গী জয়েন্ট সেক্রেটারির ঘরে। ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞাসা করলাম, দাদা, তাহলে চৌ-এন-লাই আসছেন?

উনি অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, তুমি কি করে জানলে?

কি করে জানলাম, তা আর বলে লাভ কি? তবে চৌ-এন-লাই এর সফর সফল না হলে কি হবে?

লেট আস হোপ ফর দ্য বেস্ট!

আচ্ছা চলি দাদা।

আমি পাগলের মত ছুটে গেলাম সি-টি-ও-র প্রেস রুমে। সঙ্গে সঙ্গে টাইপ করতে শুরু করলাম, চাইনীজ প্রিমিয়ার চৌ-এন-লাই ইজ সর্টলি কামিং টু ইণ্ডিয়া টু হ্যাভ টকস উইথ প্রিমিয়ার নেহরু….

জাপানের Kyodo নিউজ এজেন্সীর বিশেষ সংবাদদাতা মিঃ শিমীজু পাশের টেবিলে টাইপ করছিলেন। প্রেস রুমে আর কেউ ছিলেন না। উনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, হোয়াত আর ইউ তাইপিং?

আমি হেসে বললাম, দেখে যাও।

মিঃ শিমীজু টাইপরাইটারে আমার কপি দেখেই লাফ দিয়ে উঠলেন, নো নো, নট পসুবুল। এ হতেই পারে না, অসম্ভব। আজও পার্লামেন্টে নেহরু বলেছেন, নো তক্‌স উইথ চায়না আর তুমি….

আমি মৃদু হেসে বললাম, আমার খবর ঠিক। তুমি ইচ্ছা করলে এই খবর পাঠাতে পারো; তবে আর কাউকে বলবে না।

নো নন, আই কান্ত। এ খবর আমি পাঠাব না।

পরের দিন দুপুরে মিঃ শিমীজু জিজ্ঞাসা করল, তোমার খবর বেরিয়েছে?

হ্যাঁ।

দু একদিন পর ও আমাকে বলল, আমি যদি তোমার কাগজকে কোট করে এই খবরটা পাঠাই, তাতে কি তোমার সম্পাদক আপত্তি করবেন?

না।

তাহলে আমি খবরটা পাঠাচ্ছি।

পাঠাও কিন্তু আর কাউকে বোলো না।

নো নো, নেভার।

ঠিক তার পরের দিন লোকসভার কোশ্চেন আওয়ার শেষ হবার পরই স্পীকার অনন্তশয়নম আয়েঙ্গার ঘোষণা করলেন, প্রাইম মিনিস্টার টু মেক এ স্টেটমেন্ট। নেহরু সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করলেন, আই এ্যাম গ্ল্যাড টু ইনফর্ম দ্য হাউস দ্যাট প্রিমিয়ার চু-এন-লাই হ্যাজ কাইলি এ্যাকসেপ্টেড মাই ইনভিটেশন….

আমি প্রেস গ্যালারীর এক কোণায় বসে ছিলাম। নেহরুর তিন চার লাইনের বিবৃতি শেষ হতেই মিঃ শিমীজু ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মত আমার সারা মুখে চুমু খেলেন।

আসল ব্যাপার হল এই যে Kyodo’র টোকিও অফিস থেকে খবরটি প্রচারিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিশ্বের কয়েকটি রেডিও স্টেশন থেকেও এই সংবাদ বলা হয়। এইভাবে খবরটি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই পৃথিবীর নানা রাজধানীতে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। Kyodoর খবর দিল্লী ও চীনের রাজধানীতে পৌঁছতেই দুটি সরকার ঠিক করেন, এই ব্যাপারে অবিলম্বে সরকারী ঘোষণা করাই যুক্তিযুক্ত হবে।

এই চাঞ্চল্যকর খবরটি আগে দিতে পেরেছিলাম বলে সম্পাদক আমার মাইনে বাড়িয়ে দিলেন।

***

সে সময় আমি একই সঙ্গে বাংলা হিন্দী গুজরাতি ও মারাঠী দৈনিকের রাজনৈতিক সংবাদদাতার কাজ করতাম রাজধানী দিল্লীতে। তাই ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আমাকে কাজ করতে হত। পার্লামেন্ট চললে তো কথাই নেই। সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সারাটা দিনই পার্লামেন্টে কাটাতাম। শুক্রবার সকালে প্রশ্নোত্তরের সময় না গেলেও জিরো আওয়ার-এর সময় নিশ্চয়ই প্রেস গ্যালারীতে হাজির হতাম।

শুক্রবারে ঐ জিরো আওয়ার শেষ হতে না হতেই পার্লামেন্টে উইকএণ্ডের হাওয়া বইতে শুরু। শুক্রবার পার্লামেন্টের অর্ধেক সময় বেসরকারী প্রস্তাব ও বিল নিয়ে আলোচনা হয় বলে অনেকেই সে সময় উপস্থিত থাকেন না।

ঐ শুক্রবার বিকেল থেকে রবিবার রাত্রি বা সোমবার সকাল পর্ষন্ত অনেক মন্ত্রীই দিল্লীর বাইরে যান। যে সময়ের কথা বলছি, সে সময় আমি কোন না কোন ভি. আই. পির সঙ্গে এয়ার ফোর্সের স্পেশাল প্লেনে ঘুরতাম ভারতবর্ষের এখানে-ওখানে। এর ওপর বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতি ও ঘটনার সংবাদ সংগ্রহের জন্যও আমাকে প্রচুর ঘুরতে হত দেশে ও বিদেশে।

প্রায় হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। তাই কোন সম্পাদককে কিছু না জানিয়েই কলকাতা চলে এলাম, কিন্তু লাভ হল না। দুদিন পরেই আমাকে বোম্বে মেলে চড়তে হল রায়পুর কংগ্রেস অধিবেশন কভার করার জন্য। আগেই ঠিক করেছিলাম প্রকাশ্য অধিবেশনে নেতাদের বক্তৃতা শুনব না। তাই প্রকাশ্য অধিবেশনের দিনের নাগপুরের স্পেশ্যাল ট্রেনেই রিজার্ভেশন করলাম।

স্টেশনে এসে ভারী মজার কাণ্ড হল। আমি রিজার্ভেশন চার্ট দেখে নির্দিষ্ট ফোর-বার্থ কামরার একটা লোয়ার বার্থ দখল করলাম। একটু পরেই এস. কে. পাতিল, কে. ডি. মালব্য ও আরো কয়েকজন নেতা আমারই বগীর অন্যান্য কামরায় উঠলেন। ওদের কাছেই শুনলাম, এই বগীটি জি, টি, এক্সপ্রেসের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হবে। অর্থাৎ সোজা দিল্লী। খবরটায় সত্যি খুশি হলাম।

খানিকক্ষণ পরে লম্বা-চওড়া এক ভদ্রলোক আমার কামরায় এসে বললেন, হাউ কুড ইউ বী হিয়ার? দিস কম্পার্টমেন্ট ইজ রিজার্ভড, ফর ইউনিয়ন প্ল্যানিং মিনিস্টার গুলজারীলাল নন্দা।

আমি একটু অবাক হলাম। মনে মনে ভাবলাম, ভুল কামরায় উঠেছি নাকি? বললাম, জাস্ট এ মিনিট! আই উইল চেক আপ ওয়ান্স এগেন।

আমি তাড়াতাড়ি প্ল্যাটফর্মে নেমে আবার রিজার্ভেশন চার্ট দেখলাম। আমার টিকিটের নম্বরের সঙ্গে খুব ভাল করে মিলিয়ে দেখলাম, না, ভুল করিনি। নির্দিষ্ট বগীর ঠিক কামরাতেই উঠেছি। আমি আমার কামরায় ফিরে এসে ভদ্রলোককে বললাম, এখানেই আমার রিজার্ভেশন।

উনি আমার কথা শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। চিৎকার করে বললেন, আমি রেলওয়ে অফিসারদের বলেছি, আপনাকে অন্য কোন বগীতে একটা বার্থ দিতে। এই ফোর-বার্থ কম্পার্টমেন্টে নন্দাজী যাবেন।

আমি জানি, এই বগী ছাড়লে আমি সোজা দিল্লী যেতে পারব না এবং কদিন যে আমাকে নাগপুরে পড়ে থাকতে হবে, তার ঠিক নেই। তাই ভদ্রলোককে স্পষ্ট বললাম, হৈ-হুল্লোড় করে লাভ নেই। আমি এই বগীর এই কামরার এই বার্থে শুয়ে-বসেই দিল্লী যাব।

ভদ্রলোক চিৎকার করে উঠলেন, দ্যাট কান্ট বী। এই বগীতে আর কোন ফোর-বার্থ কম্পার্টমেন্ট খালি নেই; সুতরাং এইটাতেই নন্দাজী যাবেন।

আমি হেসে বললাম, আমি পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর বা কোন বেনিয়া না যে নন্দাজীর নাম শুনেই ভয়ে এই কামরা ছেড়ে পালিয়ে যাব। এখানে তিনটে বার্থ খালি আছে। ইচ্ছা করলে শুধু নন্দাজী কেন, আপনিও এই কামরায় যেতে পারেন।

আমার কথায় ভদ্রলোক আহত ব্যাঘ্রের মত হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন। বললেন, সেন্ট্রাল মিনিস্টাররা সব সময় ফোর-বার্থ কম্পার্টমেন্টে ট্রাভেল করেন।

আমি বললাম, নন্দাজী তো সরকারী কাজে এখানে আসেননি; এসেছেন কংগ্রেস অধিবেশনে যোগ দিতে। তাই এই কামরায় আমি থাকলে তার মত সোস্যালিস্টের জাত যাবে না।

এই চিৎকার চেঁচামেচি শুনে পাশের কামরার দু-চারজন সহযাত্রী ছাড়াও অনেক রেল কর্মমারী এগিয়ে এলেন। এই কংগ্রেস অধিবেশনের জন্য কলকাতা থেকে সাউথ ইস্টার্ণ রেলের অনেক বাঙালী কর্মচারী রায়পুর গিয়েছিলেন। তারা আমার অনমনীয় মনোভাব দেখে মহা খুশি। কয়েকজন রেলওয়ে অফিসারও আমাকে অনুরোধ-উপরোধ করলেন কিন্তু তাদের আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম, নগদ টাকায় টিকিট কেটেছি। রিজার্ভেশন চার্ট দেখে বসেছি। সুতরাং কোন কারণেই এ কামরা ছাড়ছি না। তাছাড়া এ বগী ছাড়লে আমি সোজা দিল্লী যেতে পারব না।

শেষ পর্যন্ত নন্দাজী দুই বার্থের একটা কূপেতে গেলেন এবং আমার কামরায় নন্দাজীর তিনজন ব্যক্তিগত কর্মচারী এলেন। মজার কথা, যার সঙ্গে আমার এত তর্ক-বিতর্ক হল, তিনি অবাঙালী হলেও বাঙালী মেয়েকে বিয়ে করেছেন এবং দিল্লী যাবার পথেই তার সঙ্গে আমার বিশেষ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠল।

***

এই তর্ক-বিতর্কের ফলে আরো একটা সুফল হল। আমাদের বগীতেই এস. কে. পাতিল, কে, ডি, মালব্য ও আরো কয়েকজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছাড়াও মধ্যপ্রদেশের দু-তিনজন মন্ত্রীও সফর করছিলেন। ঐ তর্ক-বিতর্কের ফলে আমি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম এবং দীর্ঘ যাত্রাপথে আমিও তাদের বন্ধু হয়ে গেলাম। মধ্যপ্রদেশের মন্ত্রীদের সঙ্গে গল্প করতে করতে এক চাঞ্চল্যকর কাহিনী জানতে পারলাম।

কিছুদিন আগেই ভূপালের নবাব দেহত্যাগ করেছেন। নবাবের দুই বেগম। বড় বেগমের দুই মেয়ে। বড় মেয়ে পতৌদীয় বেগম। ছোট মেয়ে পাকিস্তান চলে গেছেন। ভূপালের নবাবের বড় বেগম খুবই ধর্মপ্রাণা। বিষয়-সম্পত্তির ব্যাপারে তিনি উদাসীন। সারাদিনই মালা জপ করেন। ছোট বেগম ঠিক এর বিপরীত। ছোট বেগমের কোন সন্তান নেই কিন্তু বড় বেগমের ছোট মেয়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বিশেষ অন্তরঙ্গ।

ভূপালের নবাবের মৃত্যুর পর পরই ভূপাল নবাবের গদী ও সেই সঙ্গে রাজ ভাতার দাবীদার হলেন ওর দুই মেয়ে। পতৌদীর বেগম কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পণ্ডিত গোবিন্দবল্লভ পন্থকে বললেন, আমি শুধু নবাবের বড় মেয়ে নই, ভারতীয় নাগরিকও। সুতরাং ভূপালের গদী ও রাজন্য ভাতা যেন কেন্দ্রীয় সরকার আমাকেই দেন।

করাচী থেকে উড়ে এলেন নবাবের ছোট কন্যা। পন্থজীর ব্যস্ততার জন্য ওকে কদিন অপেক্ষা করেই তার সঙ্গে দেখা করতে হল।–আমি নবাবের ছোট মেয়ে ঠিকই কিন্তু নবাব আমাকেই বেশী ভালবাসতেন এবং তিনি চেয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর যেন আমিই ভূপালের গদী পাই। 

পন্থজী অত্যন্ত ধীর-স্থিরভাবে বললেন, ভূপালের গদী বা রাজন্য ভাতা তো আমরা কেউ নেব না, আপনাদেরই কোন বোনকে দেওয়া হবে। আপনার দাবী যে যুক্তিযুক্ত তার যদি প্রমাণ থাকে, তা আমাদের দেবেন। আমরা দুজনের দাবীই পরীক্ষা করে যাকে উপযুক্ত মনে করব তাকেই রাজন্য ভাতা ও ভূপালের গদী দেওয়া হবে।

স্বৰ্গত নবাবের ছোট মেয়ে সঙ্গে সঙ্গে পন্থজীর হাতে কিছু কাগজ পত্র দিয়ে বললেন, এইসব চিঠি ও কাগজপত্র দেখলেই বুঝবেন, আমার দিদির চাইতে আমার দাবী অনেক বেশী যুক্তিযুক্ত।

পন্থজী অত্যন্ত ধীর-স্থিরভাবে বললেন, আপনার আপত্তি না থাকলে কাগজপত্র রেখে যান। আমরা পরীক্ষা করে দেখব।

এবার নবাব-নন্দিনী বললেন, আমি করাচী থেকে সোজা দিল্লী এসেছি। আপনি ব্যস্ত ছিলেন বলে এখানেই কদিন কেটে গেল। ভাবছিলাম, কদিনের জন্য ভূপাল যেতাম।

হ্যাঁ হ্যাঁ, যাবেন বৈকি।

আপনার সঙ্গে আবার কবে দেখা করব?

ভূপাল থেকে একটা টেলিফোন করেই চলে আসবেন। ব্যস্ত না থাকলে যখনই আসবেন, তখনই দেখা করব।

নবাব-নন্দিনী ভূপাল চলে গেলেন।

ভূপালের বড় বেগম এ সব ব্যাপারে মাথা না ঘামালেও ছোট বেগমও ছুটে এসেছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পন্থজীর কাছে। তিনি বড় বেগমের ছোট মেয়ের দাবীকে সমর্থন করে বলেন, নবাবের শেষ জীবনে আমিই তার ঘনিষ্ঠতম ছিলাম এবং নানা বিষয়ে তার মনের কথা আমাকে বলতেন। আমি জোর করে বলতে পারি, নবাব তাঁর ছোট মেয়েকেই বেশী ভালবাসতেন এবং তিনি চেয়েছিলেন, তার মৃত্যুর পর ছোট মেয়েই ভূপালের গদীতে বসুক।

হায়দ্রাবাদ, মহীশূর, জম্মু-কাশ্মীর বা বরোদার মত ভূপাল খুব বড় দেশীয় রাজ্য ছিল না। তবে মধ্য ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলির মধ্যে ভূপালের গুরুত্ব ও প্রভাব ছিল যথেষ্ট। মোগল সম্রাট বাহাদুর শার রাজত্বকালে দোস্ত মহম্মদ নামে অতিলোভী আফগান চাকরি-বাকরি জোগাড়ের চেষ্টায় দিল্লীতে আসেন ও পরবর্তীকালে ভূপাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে ইনি মালবার বারসিয়া পরগণার ইজারা লাভ করেন এবং মালবার রাজার মৃত্যুর পর অরাজকতার সুযোগে ভূপাল ও তার সংলগ্ন কিছু এলাকায় নিজের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। পিণ্ডারীর যুদ্ধের সময় ইংরেজ সরকার ভূপালের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করেন এবং ভূপালের অখণ্ডতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেন। পরবর্তীকালে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিও ভূপালের অখণ্ডতা রক্ষা করে। ১৮৪৪ থেকে ১৯২৬ পর্যন্ত তিন বেগম এই রাজ্য শাসন করেন। এরপর ভূপালের গদীতে বসেন স্যার হামিদুল্লা খান।

স্যার হামিদুল্লা এগারো লাখ টাকা রাজন্য ভাতা পেতেন। এই টাকার দশ লাখ পেতেন নবাব নিজে এবং এক লাখ পেতেন তার বড় মেয়ে। এই বড় মেয়েই ছিলেন নবাবের আইনসঙ্গত উত্তরাধিকারিনী। এই রাজ্য ভাতা ছাড়াও নবাবের বহু নিজস্ব সম্পত্তি ছিল নানা জায়গায়। অন্যান্য অনেক দেশীয় রাজাদের মত ভূপালের নবাবের বেশ কিছু ধনসম্পত্তি ছিল বিদেশী ব্যাঙ্কে। বোধ হয় বিদেশে বেশ কিছু ব্যবসা-বাণিজ্যও ছিল এবং ভারত সরকারকে না জানিয়েই এ সব ব্যবসা-বাণিজ্য চলছিল।

যাই হোক মৃত নবাবের দ্বিতীয় কন্যা ভূপালে গিয়ে হৈ চৈ শুরু করে দিলেন। উনি অনেকের মনেই এমন ধারণা সৃষ্টি করলেন যে, ভূপালের গদী উনিই পাবেন এবং অনেকের কাছ থেকে টাকাকড়ি নিয়ে স্ফুর্তি শুরু করলেন। পন্থজীর কানে এ খবর পৌঁছাতেই উনি গোয়েন্দা দপ্তর ও মধ্যপ্রদেশ সরকারকে বললেন; নবাব-নন্দিনীর বন্ধুদের জানিয়ে দাও যে একজন পাকিস্তানীকে টাকাকড়ি দিয়ে সাহায্য করলে ভারত সরকার অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হবেন।

ভূপাল রাজকোষ থেকে টাকা নেবার অধিকার তাঁর ছিল না; সরকারী হুমকীতে ভয়ে বন্ধুরাও টাকা দেয়া বন্ধ করলেন। মহা মুশকিলে পড়লেন নবাব-নন্দিনী। বার বার টেলিফোন করেন দিল্লী, কিন্তু পন্থজীর ব্যস্ততার জন্য কিছুতেই তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পান না। এদিকে ভিসার মেয়াদ প্রায় শেষ। আবার ট্রাংকল করেন দিল্লীতে; না, পন্থজী এখন কথা বলতে পারবেন না। ক্যাবিনেট মিটিং চলছে।

নবাব-নন্দিনীর ভারতবাসের শেষ দিন উপস্থিত। মধ্য রাত্রেই ভিসার মেয়াদ শেষ হচ্ছে। আবার ট্রাংকল দিল্লীতে। হ্যাঁ, এবার পন্থজীকে পাওয়া গেল। নবাব-নন্দিনী কিছু বলার আগেই পন্থজী গভীর দুঃখ প্রকাশ করে বলেন কদিন এত ব্যস্ত ছিলাম যে আপনি বার বার টেলিফোন করা সত্ত্বেও আমি কথা বলতে পারিনি। যাই হোক, বলুন কেমন আছেন? ভূপালে কেমন দিন কাটাচ্ছেন। নিশ্চয়ই খুব আনন্দে। নবাব-নন্দিনী বললেন, দিনগুলো ভালই কাটছে কিন্তু আজ রাত্রেই যে আমার ভিসার মেয়াদ শেষ।

পন্থজী চমকে উঠে বলেন, সে কি! আগে বলেননি কেন? আপনার ভিসার মেয়াদ অনায়াসে বাড়িয়ে দেয়া যেত।

কিন্তু আপনার সঙ্গে যে কিছুতেই যোগাযোগ করতে পারলাম মা।

আপনি দিল্লী চলে এলেন না কেন?

সেটা আমার ভুল হয়েছে।

কিন্তু এখন কি করবেন? ভূপাল থেকে তো করাচীর কোন প্লেন নেই। আপনাকে তো বোম্বে বা দিল্লী হয়ে যেতে হবে।

ভিসার মেয়াদ বাড়ানো যায় না?

যায়, কিন্তু আজ অফিস ছুটি হবার আগে কি আপনি দিল্লী পৌঁছতে পারবেন?

না, সে অসম্ভব।

খুবই দুঃখের কথা যে আজ মাঝ রাত্তিরের মধ্যেই আপনাকে ইণ্ডিয়া ছাড়তে হবে।

যাই হোক, শেষ পর্যন্ত পন্থজী ওকে কয়েক ঘণ্টা বিলম্বে ভারত ত্যাগের বিশেষ অনুমতির ব্যবস্থা করে দিলেন এবং নবাব-নন্দিনী পরের দিন বোম্বে থেকে করাচী চলে গেলেন।

নবাবের বড় মেয়ে পতৌদীর বেগম আবার তাঁর ছোট্ট সাদা গাড়িটা চড়ে ছ নম্বর মৌলানা আজাদ রোডে এলেন। নিজের স্বপক্ষে পন্থজীকে অনেক কিছু বললেন।

পন্থজী বললেন, শুনেছি বিদেশের নানা ব্যাঙ্কে নবাবের বেশ কিছু টাকাকড়ি ও মূল্যবান গহনাপত্র আছে-এটা কি ঠিক?

কিছু আছে বৈকি?

কিন্তু সরকারের বিনা অনুমতিতে বিদেশী ব্যাঙ্কে কিছু রাখা তো বে-আইনী।

হ্যাঁ, তা তো জানি।

আপনি কি জানেন কোথায় কি আছে? নবাবের সব সম্পত্তির সঠিক হিসাবনিকাশ পেলে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে আর সময় লাগবে না।

পন্থজীর কথার অর্থ বোঝেন পতৌদীর বেগম। উনি বললেন, হ্যাঁ, কিছু কিছু খবর জানি বৈকি এবং এ সব সম্পত্তির ওপর আমার কোন দাবী নেই। বেগমসাহেবা একটু ভেবে বললেন, তবে আমার ছেলে মনসুর আলি খান বিলেতে পড়ছে। তার পড়াশুনার জন্য….

পন্থজী সঙ্গে সঙ্গে বলেন, আপনার ছেলের পড়াশুনার খরচের জন্য যে ফরেন এক্সচেঞ্জ দরকার, তার ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করা হবে।

ঐ টাকা বাদ দিয়ে বিদেশী ব্যাঙ্কের সব টাকা ও বিদেশের নানা কোম্পানিতে নবাব যে সব টাকা লগ্নী করেছিলেন, তার অধিকার ভারত সরকার গ্রহণ করার পরই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরকারী বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হল, পরলোকগত নবাবের বড় মেয়ে পতৌদীর বেগমই ভূপালের গদী পাবেন।

এক ঢিলে দুই পাখি মারলেন পন্থজী। দিল্লীতে এসেই টাইপরাইটার খট খট করে এক দীর্ঘ রিপোর্ট তৈরি করলাম কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কাগজের অফিসে পাঠালাম না। মনে মনে ভাবলাম, পন্থজী যখন আমাকে এত স্নেহ করেন, তখন এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ খবর তাকে না জানিয়ে ছাপা উচিত নয়।

পন্থজীর পার্সোন্যাল সেক্রেটারি জানকীবাবুকে টেলিফোন করেই ছনম্বর মৌলানা আজাদ রোডে হাজির হলাম। পন্থজীর হাতে রিপোর্টটা দিলাম। উনি পড়েই বললেন, এ খবর তুমি কোথায় পেলে?

আমি বললাম, রায়পুর কংগ্রেস অধিবেশন থেকে ফেরার পথে কিভাবে খবরটা পেয়েছি।

পস্থজী হেসে বললেন, খবরটা ঠিকই পেয়েছ কিন্তু এ সময় এ খবর না বেরোনই ভাল।

এ প্রায় কুড়ি বছর আগেকার কথা কিন্তু আজই প্রথম এ খবরের কথা লিখলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *