০১. আমি একটা খুন করব

আমি একটা খুন করব এই সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত নিয়ে ফেললাম। কদিন খুব অস্থির–অস্থির লাগছিল। সিদ্ধান্তটা নেয়ার পর অস্থির ভাব পুরোপুরি কেটে গেল। এক ধরনের আরামদায়ক আলস্যে মন ভরে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে টেবিল ঘড়ির দিকে তাকালাম। ভোর নটা পঁয়ত্রিশ মিনিটের লাল কাঁটা সাতের ঘরে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত যে মুহূর্তে নেয়া হল, সেই মুহূর্তটা জানা থাকা দরকার। টেবিল ঘড়িতে সেকেণ্ডের কাটা থাকে না। কাজেই মুহূর্তটা আরো সূক্ষ্মভাবে জানা গেল না। মনটা একটু খুঁতখুঁত করছে।

আমার চোখ টেবিল ঘড়ির লাল কাঁটায় আটকে গেছে। আমি তাকিয়েই আছি। একসময় রূপা আমার কাঁধে ঝাকি দিয়ে বলল, এই কি দেখছ? রূপা আমার স্ত্রী। সে ধবধবে একটা শাদা চাদর গায়ে দিয়ে গুটিসুটি মেরে আমার পাশে শুয়ে আছে। শাদা চাদর গায়ে জড়ানো বলেই বোধহয় তাকে দেখাচ্ছে একটা বেড়ালের মতো। এমিতে অবশ্যি তার চরিত্রে বেড়াল ভাব অত্যন্ত প্রবল। সে সারাক্ষণই আরাম খোঁজে। নটা সাড়ে নটার আগে কোনোদিনই বিছানা ছেড়ে নামে না। আজ ছুটির দিন। কাজেই দশটা পর্যন্ত শুয়ে থাকবে বলে মনে হচ্ছে। রূপা আবার আমার কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে বলল, কি দেখছ?

আমি হালকা গলায় বললাম, ঘড়ি দেখছি।

কটা বাজে?

নটা পঁয়ত্রিশ।

রূপা হাই তুলে বলল, ঘড়িটা বন্ধ হয়ে আছে। আমি রাতে ঘুমুতে যাবার সময়ও দেখেছি নটা পঁয়ত্রিশ। চাবি দেয়া হয়নি।

আমি আবার তাকালাম রূপার কথাই ঠিক। মিনিটের লাল কাঁটা এখনো সাতের ঘরে স্থির হয়ে আছে। আমি কখন এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলাম তা জানা গেল না। মন আগে থেকেই খুঁতখুঁত করছিল। এখন বিরক্তিতে ভরে গেল। বিরক্ত হলেই আমার মুখে থুথু জমে। থুথু জমছে। মুখ ভর্তি হয়ে যাচ্ছে থুথুতে।

রূপা বলল, ড্রেসিং টেবিলের ওপর আমার হাতঘড়ি আছে। সময় দেখতে চাইলে ঐ ঘড়িতে দেখ। তবে ছুটির দিনে এত কিসের ঘড়ি দেখাদেখি? ঘুমাও তো।

 

এই বলেই সে চোখ বন্ধ করে ফেলল। সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়ল। রূপা অতিদ্রুত ঘুমুতে পারে। মাঝে মাঝে কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যায়। তার সংঙ্গে পরিচিত নয় এমন কেউ হলে ভাবে হয়তো কথার খেই হারিয়ে থেমে গেছে। যারা তার সংঙ্গে পরিচিত তারা সবাই জানে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। ট্রেনে কোথাও যাবার সময় তাকে জানালার কাছের একটা সীট দিতে হয়। সে খোলা জানালায় মাথা রেখে ট্রেন ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ে।

আমি বিছানা থেকে নামলাম। জমে থাকা থুথু জানালা দিয়ে ফেললাম। আমার ঘরটা ঠিক রাস্তার উপর। থুথু কারো মাথায় পড়ল কিনা কে জানে! পড়লে পড়ুক। ড্রেসিং টেবিলে রাখা রূপার হাতঘড়ি দেখলাম, সকাল সাতটা দশ। ছুটির দিনে এত ভোরে বিছানা ছাড়ার কোনো মানে হয়? রূপাকে জড়িয়ে ধরে আরো খানিকক্ষণ শুয়ে থাকব? তেমন কোনো প্রবল ইচ্ছাও বোধ করছি না। তাছাড়া রূপার গা ঠাণ্ডা। ধাতুর নামে নাম রাখার কারণেই বোধহয় তার বডি-টেম্পারেচার স্বাভাবিকের চেয়ে এক দু ডিগ্রী কম! রূপা চোখ বন্ধ করে ঘুম-ঘুম গলায় ডাকল, এ্যাই এ্যাই।

বল।

তুমি কি রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছ?

না।

একটু যাও না, প্লীজ। মুনিয়াকে বল আমাকে এককাপ কফি দিতে। তিন চামচ চিনি দিতে বলবে। দু চামচ উঁচু করে, এক চামচ সমান সমান। আর যদি ক্র্যাকার থাকে তাহলে একটা ক্রাকার। মাখন লাগিয়ে দিতে বলবে। মনে থাকবে?

থাকবে।

ফ্রীজ থেকে খুব ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানিও আনবে। আর শোন, পায়ের কাছের জানালাটা একটু বন্ধ করবে? ঘরে আলো আসছে।

রূপা এই দীর্ঘ কথাবার্তায় একবারও চোখ মেলল না। মনে হচ্ছে সে ঘুমের মধ্যে কথা বলছে। রূপার সংঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে গত আষাঢ় মাসে। এখন ফাল্গুন শুরু। প্রায় আটমাস হয়ে গেল। বিয়ের সময় তার মুখ ছিল লম্বাটে। শুধুমাত্র ঘুমিয়ে সেই মুখ এখন সে গোল করে ফেলেছে। গায়ের রঙও মনে হয় আগের চেয়ে ফর্সা হয়েছে। শাদা চাদরের আড়াল থেকে তার একটা পা বের হয়ে আছে। সে পায়ে শাড়ির আব্রু নেই। শখের মতো ধবধবে শাদা পা। মানুষের পা এত শাদা হয়, রূপাকে বিয়ে না করলে জানতাম না।

এ্যাই, এ্যাই।

বল।

পা-টা একটু ঢেকে দাও না।

রূপা আমার চেষ্টা ছাড়াই তার নগ্ন পা চাদরের ভেতর টেনে নিতে পারে। তা সে করবে না। ঐ যে বললাম বেড়াল স্বভাব। সবার কাছ থেকে আদর নেবে। যত্ন নেবে। আদর পাবার সামান্যতম সুযোগও সে ছাড়বে না।

আমি চাদর দিয়ে তার পা টাকলাম। পায়ের কাছের জানালা বন্ধ করলাম। এখন আমার কফি এবং ঠাণ্ডা পানির সন্ধানে যাওয়া উচিত। যেতে পারছি না। রূপার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। সব মেয়ে ঘুমুবার সময় চুল বেঁধে ঘুমায়। শুধু রূপার চুল থাকে ছাড়া। বালিশ ময় চুল ছড়ানো, মাঝখানে তার গোলাকার মুখ। সেই মুখ এতই সুন্দর যে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। অসম্ভব সুন্দর সহ্য করার ক্ষমতা মানুষের কম। কোনো সুন্দর জিনিসের দিকেই মানুষ বেশি সময় তাকিয়ে থাকতে পারে না। বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। আমাদের এ বাড়ির বারান্দা বেশ বড়। আজকালকার আর্কিটেক্টরা এই বারান্দা দেখলে চোখ কপালে তুলে বলবেন, ইশ কতোটা জায়গা নষ্ট করা হয়েছে। কোনো মানে হয়?

এক সময় মুনিয়ার বারান্দায় ফুলের টব বসিয়ে একটা কাণ্ড করতে চেয়েছিল। গোলাপের টব, অর্কিডের টব, এমন কি কাজী পেয়ারার টব। এখন মুনিয়ার টবপ্রীতি দূর হয়েছে। টব আছে, গাছ নেই। বর্তমানে বারান্দা হল আমাদের ডাম্পিং গ্রাউণ্ড। যাবতীয় অপ্রয়োজনীয় আসবাব এখানে ডাম্প করা হয়। শুধু আসবাব না, কিছু অপ্রয়োজনীয় মানুষও আমরা বারান্দায় রাখি। এই মুহূর্তে বারান্দার শেষ মাথায় ক্যাম্প খাটে একজন অপ্রয়োজনীয় মানুষ শুয়ে আছেন। তিনি এসেছেন দেশের বাড়ি কেন্দুয়া থেকে। মামলার তদবিরে। ভদ্রলোকের নাম রইসুদ্দিন। আমাদের অতি দূর সম্পর্কের আত্মীয়। কিন্তু কথাবার্তা শুনে মনে হয় আমাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তাঁকে যে আমরা বারান্দায় ফেলে রেখে অপমান করার চেষ্টা করছি, এটা তিনি বুঝেও না বোঝার ভান করেন। রইসুদ্দিন চাচা আমাকে দেখেই উঠে বসলেন। ছোট-খাটো মানুষ। মামলা মোকদ্দমা করে যেন আরো ছোট হয়ে গেছেন। গালভর্তি কাঁচা-পাকা দাড়ি না থাকলে তাঁকে বাচ্চা ছেলের মতোই লাগত। তিনি হাসিমুখে বললেন, আব্বাজীর ঘুম ভাঙল?

তিনি আমাকে ডাকেন আব্বাজী, আমার বোন মুনিয়াকে আম্মা এবং রূপাকে ডাকেন আম্মাজী। আমার সবচে ছোট ভাই বাবুকে শুধু নাম ধরে ডাকেন। তার বেলায় এই ব্যতিক্রম কেন কে জানে। কারণ একটা নিশ্চয়ই আছে। রইসুদ্দিন চাচার মতো ধুরন্ধর লোক বিনা কারণে কিছু করবেন না। এঁরা প্রতিটি কাজকর্ম। ভেবে-চিন্তে করেন।

তিনি আগের প্রশ্নই আবার করলেন। এবারে মুখের হাসি আগের চেয়েও বিস্তৃত হল।

আব্বাজীর ঘুম ভাঙল?

জ্বী।

ঘুম হইছে কেমন?

ঘুম হইছে কেমন?

ভাল।

আমারো ঘুম ভাল হইছে। ফুরফুরা বাতাস। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। কম্বল গায়ে দিয়ে লম্বা ঘুম দিলাম। শেষরাতে একটা স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্ন দেখার পর মনটা আরো ভাল হয়ে গেছে। বড়ই মধুর স্বপ্ন।

কেউ স্বপ্নের কথা বললে কি স্বপ্ন দেখা হয়েছে জানতে চাওয়াটা সাধারণ ভদতা। এই মানুষটার সঙ্গে ভদ্রতা করতে আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা করছে না। তবু অভ্যাসের বসে বললাম, কি স্বপ্ন দেখলেন?

দেখলাম শাদা একটা সাপ। গ্রামদেশে এই সাপরে বলে দুধরাজ। এই সাপ আমার হাঁটুতে একটা ছোবল দিল। বিষ যা ছিল সব ঢেলে দিল।

মানুষের কথা শুনে আমি কখনো বিস্মিত হই না। বিশেষ করে এইসব ধুরন্ধর মানুষ কথাবার্তায় সবসময় অন্যদের চমৎকৃত করতে চেষ্টা করে। আমি বুঝতে পারছি রইসুদ্দিন চাচা কথাবার্তায় আমাকে কিছুক্ষণ আটকে রাখার চেষ্টা করছেন। তিনি হয়তো ভাবছেন আমি অবাক হয়ে বলব এরকম ভয়াবহ একটা স্বপ্ন দেখে আপনার মনটা খুশি হয়ে গেল কেন? তার উত্তরে তিনি আরো চমকপ্রদ কিছু বলবেন। আমি তাঁকে সেই সুযোগ দিলাম না। সিঁড়ি দিয়ে একতলায় নেমে গেলাম। সাপ কামড় দিয়েছে এই স্বপ্ন দেখে কেউ যদি আনন্দে আত্মহারা হয়—হোক। মুখে আবার থুথু জমেছে। এ তো বড় যন্ত্রণা হল!

রান্নাঘরে মুনিয়া ছাঁকনি দিয়ে অর্জুন গাছের রস ছাঁকছে। বাবার কবিরাজী ওষুধ। তাঁর হার্টের কি সব সমস্যা। কবিরাজ বলেছে অর্জুন গাছের ছাল সেদ্ধ করে সেই রস খেতে। অর্জুন গাছের সব ছাল নয়। গাছের পুবদিকের ছাল, যেখানে সূর্যের প্রথম রশ্মি পড়ে। মাখন বলে আমাদের যে কাজের ছেলেটি আছে, তার কাজই হচ্ছে সাইকেলে করে দূর-দূরান্ত থেকে অর্জুন গাছের ছাল নিয়ে আসা। মাখনের কোনো কাজে উৎসাহ নেই। এই কাজটিতে খুব উৎসাহ। সে ঢাকা শহরের আশেপাশের সব অর্জুন গাছের ছাল ছাড়িয়ে ফেলেছে বলে আমার ধারণা। ছালছাড়ানো অর্জুন গাছ দেখতে কেমন হয়? মাখনার সঙ্গে একদিন দেখে আসতে হবে।

মুনিয়াকে কেমন যেন অন্যমনস্ক মনে হচ্ছে। মুখ শুকনো। চোখের নিচে কালি। মন হয়তো খারাপ। এটা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার না। মুনিয়ার মন বেশির ভাগ সময়ই খারাপ থাকে। বছর দুই হল স্বামীর সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। ভদ্রলোক আবার বিয়ে করেছেন। স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকা শহরেই থাকেন। তাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে মুনিয়া ঘর থেকে বের হয় না। ঘরে থেকে থেকে বেচারি ফর্সা হয়ে গেছে।

মুনিয়া অর্জুন গাছের রস ছাঁকতে ছাঁকতে রোবটদের মতো গলায় বলল, ভাবীর ঘুম এখনো ভাঙেনি?

না। তোকে কফি আর একটা মাখন লাগানো ক্র্যাকার পাঠাতে বলেছে। কফিতে তিন চামচ চিনি। দু চামচ উচু করে আর এক চামচ সমান সমান।

আর কিছু?

ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি। আইস কোল্ড।

মুনিয়া মুখ টিপে হাসল। আমিও হাসলাম। মুনিয়া আমার পিঠাপিঠি। ওর সংঙ্গে আমার সহজ সম্পর্কের একটা ব্যাপার আছে। আমি ওর সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বললাম, মন খারাপ না কি রে?

মুনিয়া হালকা গলায় বলল, বাসিমুখে আমার সামনে বসিস না। দেখেই বমি বমি লাগছে।

আমি নড়লাম না। গলার স্বর অনেকটা নামিয়ে বললাম, আজ একটা দারুণ ডিসিশান নিলাম।

কি ডিসিশান?

একটা খুন করব।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, এটা হবে একটা পারফেক্ট মার্ডার। কেউ বুঝতেও পারবে না খুন হয়েছে।

মুনিয়া মোটেও বিস্মিত হল না। সে যে বিস্মিত হবে না আমি জানতাম। সে ভাবছে আমি রসিকতা করছি। এটা ভাবাই যুক্তিযুক্ত। যে খুন করবে সে সবাইকে বলে বেড়াবে না।

কাকে খুন করবি কিছু ঠিক করেছিস?

হ্যাঁ, সব ঠিক করা আছে।

আমার কাছে সাজেশান চাইলে দিতে পারি।

কি সাজেশান?

রইসুদ্দিন চাচাকে খুন করে ফেল।

মুনিয়া কথা শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। সে আশা করছে আমি বলব, রইসুদ্দিন চাচা কি করেছে?

আমার কাছ থেকে কেউ যা আশা করে, আমি তা করি না। কাজেই কিছুই বললাম না। উদাস চোখে বারান্দায় লাগোয়া সজনে গাছের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সজনে গাছটা মরতে বসেছে। গাছের মৃত্যুও একটা দেখার মতো ব্যাপার। কিছু কিছু গাছ হঠাৎ করে মরে যায়। ওদেরও মনে হয় হার্ট এ্যাটাকের মতো অসুখ আছে। আবার কিছু কিছু গাছ দীর্ঘদিন রোগ ভোগ করে মরে। এই গাছটা অল্প অল্প করে মরছে। গাছের কোনো ডাক্তার থাকলে তাকে এনে চিকিৎসা করাতাম।

রইসুদ্দিন চাচা কি করেছেন জানিস?

না।

মতির মা আমাকে বলল, ওদের যে বাথরুম রহসুদ্দিন চাচাকেও সেই বাথরুম ব্যবহার করতে হয়। বাথরুমের দরোজায় একটা ফুটো। মতির মা গোসল করছে, হঠাৎ দেখে সেই ফুটো দিয়ে রইসুদ্দিন চাচা তাকিয়ে আছেন। কি রকম ঘেন্নার কথা বল তো!

মতির মা কি ওনাকে কিছু বলেছে?

না। ভাবছি আমি বলব। অবশ্যি সবচে ভাল হয় তুই বললে।

পাগল, আমি এইসব বলাবলির মধ্যে নেই। খুন করার কথা হলে ভিন্ন কথা।

আমি নিজের ঘরে চলে এলাম। রুপা এখনো শুয়ে আছে। আমাকে ঢুকতে দেখেই বলল, কফির কথা বলেছ?

বলেছি।

পানি আননি, ঠাণ্ডা পানি?

কফির সঙ্গে আসবে।

তাহলে দয়া করে একটা গান দাও তো। গান শুনতে ইচ্ছা করছে। এলপিটা দেখে টেবিলের ওপর–চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে, ঐটা দাও। ই আমি তাই করলাম।

ও রূপা হাসতে হাসতে বলল, গানটা শুনতে শুনতে তোমার পা একটু ধরতে চাই। কাছে এসো তো। ঠাট্টা না, সত্যি। কাছে এসো।

আমি রূপার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

রূপা হাসছে। তাকে অসহ্য সুন্দর লাগছে। মানুষ এত সুন্দর হয় কি করে? চোখ ফিরিয়ে নেবার চেষ্টা করেও পারছি না। গান বাজছে। গানের কথাগুলো কেমন যেন অস্পষ্ট হয়ে আসছে—তবু পুরোপুরি অস্পষ্ট নয়।

চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে, নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে–
এ জীবন মরণ সুখ-দুখ দিয়ে বক্ষে ধরিবো জড়ায়ে।।
স্খলিত শিথিল কামনার ভার বহিয়া বহিয়া ফিরি কতো আর–
নিজ হাতে তুমি গেঁথে নিয়ে হার, ফেল না আমারে ছাড়ায়ে।।

রূপার চোখ বন্ধ। মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছে। নিশ্চিত হবার জন্যে আমি পর পর দুবার ডাকলাম, রূপা রূপা। সে সাড়া দিল না। পাশ ফিরল। অথচ ট্রে হাতে মুনিয়া ঢোকামাত্র রূপা বলল, থ্যাংকস মুনিয়া।

রূপা নিশ্চয়ই ঘুমুচ্ছিল না। কিংবা ঘুমের মধ্যেই এমন ব্যবস্থা ছিল যেন মুনিয়া ঢোকামাত্র সে জেগে যায়। কম্পিউটারাইজড কোন সুইচিং ডিভাইস। রূপা বিছানায় উঠতে উঠতে বলল, লাবণ্য কি করছে মুনিয়া? ওকে একটু পাঠাবে।

মুনিয়া গম্ভীর মুখে বলল, ও বই নিয়ে বসেছে। ওকে এখন ডেকো না তো ভাবী।

আচ্ছা, ডাকব না।

লাবণ্য মুনিয়ার একমাত্র মেয়ে। লাবণ্যর বয়স পাঁচ। সপ্তাহে অন্তত একদিন তাকে তার বাবা দেখতে আসেন। সেই বিশেষ দিনে মুনিয়া তার ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। সারাদিন কিছুই খায় না।

রূপার সঙ্গে লাবণ্যের অন্য একধরনের ভাব আছে। সেই ভাবের গুরুত্ব এত বেশি, যা মা হিসেবে মুনিয়া ঠিক সহ্য করতে পারে না। মুনিয়া চলে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে লাবণ্য ঘরে ঢুকল। গম্ভীর গলায় বলল, পিরিচে করে চা খাব।

রূপা তাকে পিরিচে চা ঢেলে দিল।

কেমন আছ লাবণ্য?

লাবণ্য গম্ভীর গলায় বলল, কি জানি কেমন আছি।

মনটা কি তোমার খারাপ?

হুঁ।

কি করলে মন ভাল হবে?

জানি না।

পিরিচে করে আরো চা খেলে কি ভাল হবে?

হুঁ।

রূপা আরো খানিকটা চা ঢেলে দিল। মুনিয়া আবার ঘরে ঢুকল। এই পর্যায়ে মুখ কালো করে বলল, ভাবী, তুমি ওকে আবার চা দিয়েছ? আমি তোমাকে বলিনি চা খাওয়ানোর অভ্যাস করবে না। এই দেখ, নতুন জামায় চায়ের দাগ লাগিয়েছে।

মুনিয়া মেয়ের হাত ধরে বের হয়ে গেল। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে জামায় চায়ের দাগ লাগার শোকে সে কেঁদে ফেলবে। আসলেই কাঁদবে। কারণে এবং অকারণে কাঁদা তার শৈশবের অভ্যাস। এখন তার কাদার অনেক বিষয় আছে।

 

আজ শুক্রবার।

মার হুঁকুমে শুক্রবার সকালে নাশতা সবাইকে একসঙ্গে খেতে হয়। মা অজিমপুর গার্লস স্কুলে মাস্টারি করেন। মর্নিং শিফটের ক্লাস আটটায় আরম্ভ হয়। তাঁকে সাতটার মধ্যে বাড়ি থেকে বের হয়ে রিকশা খুঁজতে হয়। বাবার গাড়ি আছে। তিনি সেই গাড়িতে যাবেন না। বাবার টাকায় নিজের জন্যে কিছু কিনবেন না। সম্ভবত বছর পাঁচেক আগে তাদের মধ্যে বড় ধরনের কোনো ঝগড়া হয়েছে। সে ঝগড়ার জের এখনো চলছে। কে জানে হয়তো আরো বছর পাঁচেক চলবে। ঐ নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। তা ছাড়া ঝগড়ার কারণে তাদের কথাবার্তা পুরোপুরি বন্ধ না। কাজ চালাবার মতো কথা তারা বলেন।

নাশতার টেবিলে বাবা মার দিকে তাকিয়ে বললেন–রইসুদ্দিনের ব্যাপারটা কি বল তো?

মা জবাব দিলেন না। জবাব দেবার অবশ্যি কথাও না। বাবা রুটিতে মাখন। লাগাতে লাগাতে বললেন, মতির মা কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলল, রহসুদ্দিন নাকি বাথরুমের ফুটো দিয়ে তাকিয়ে ছিল। কি অসম্ভব কাণ্ড!

মুনিয়া বিরক্ত গলায় বলল, ও কি সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে নাকি? এটা কি জনে জনে বলে বেড়াবার মতো কথা?

বাবা বললেন, না বলারই-বা কি আছে? তার ওপর একটা অন্যায় করা হয়েছে, সে বিচার দাবি করবে না? সেই অধিকার কি তার নেই?

মুনিয়া কি যেন বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে রূপা উঁচু গলায় বলল, বাথরুমের ফুটো দিয়ে মতির মাকে দেখেছে, তাতে হয়েছেটা কি? মতির মার শরীর তো পচে যায়নি।

বাবা রূপার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন। তাঁর ছেলের বৌ তার মুখের ওপর এরকম কথা বলবে, তা তিনি হয়তো কল্পনাও করেননি। রূপার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে তিনি আমার দিকে তাকালেন। তাঁর চোখের দৃষ্টি বলছে, এই রকম একটা মেয়েকে তুই বিয়ে করলি? রূপা যেন আরো বেফাস কিছু বলে না ফেলে, সে জন্যে টেবিলের নিচে তার পায়ের পাতায় আমি ডান পা নিয়ে চাপ দিলাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে উফ কি করছ? বলে ধমক দিল। আমি হয়ে গেলাম অপ্রস্তুত। রূপ কোনো ব্যথা পায়নি। পুরো ব্যাপারটা সে করল আমাকে অপ্রস্তুত করার জন্যে। বা

বাবা বললেন, বাথরুমের ফুটো দিয়ে কোনো মহিলার দিকে তাকানো জঘন্য অপরাধগুলোর একটি। রইসুদ্দিনকে বলতে হবে, সে যেন সকাল এগারোটার আগেই বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। আর কোনো দিন যেন না আসে। এইসব ন্যুইসেন্সদের বাড়িতে জায়গা দেয়াই ঠিক না।

রূপা বলল, আমার কিছু কথা আছে।

বাবা বিস্মিত হয়ে তাকালেন। আমি খুব দ্রুত চিন্তা করলাম, আরেকবাবু পায়ে চাপ দিয়ে রূপাকে থামানোর চেষ্টা করাটা কি ঠিক হবে? সে অবশ্য আবার উফ! কি করছ? বলে চেঁচিয়ে উঠতে পারে।

মা বললেন, বৌমা, এই বিষয়ে তোমার কিছু বলার দরকার নেই।

কেন মা?

তুমি সব ব্যাপারে কথা বল, এটা ভাল না। তুমি বৌ মানুষ। সংসারের সব কিছুতে তুমি থাকবে কেন?

বৌরা কি সংসারের অংশ নয়?

অংশ তো বটেই, তবে তারা হচ্ছে সংসারের সৌন্দর্য, সংসারের শোভা। তারা নোংরা ঘাঁটাঘাঁটি করবে, এটা ঠিক না।

নোংরা ঘাঁটাঘাঁটি তো না মা। আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হল, আমার ধারণা মতির মা মিথ্যা কথা বলছে।

মিথ্যা কথা বলছে?

হ্যাঁ।

এ রকম ধারণা হবার কারণ কি?

রইসুদ্দিন চাচা কিছুদিন আগে বলছিলেন না—তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে মতির মা পঞ্চাশ টাকার একটা নোট সরিয়েছে। মতির মা কান্নাকটি করল। আপনার হুঁকুমে মতির মার ট্রাংঙ্ক খোলা হল। পঞ্চাশ টাকার একটা নোট সেখানে পাওয়া গেল।

এত ফেনাচ্ছ কেন মা? যা বলতে চাও সহজ কথায় বল।

বেশ, সহজভাবেই বলছি। মতির মা সেই অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছে, আর কিছুই না। বাহান্ন বছরের এক বুড়ির শরীর দেখার জন্যে কেউ বাথরুমের ফুটোয় চোখ রাখে না।

কেউ রূপার কথা বিশ্বাস করল কি না জানি না, আমি করলাম। এবং মুনিয়ার ঠোঁটের কোণে হাসি দেখে মনে হল সেও করল।

বাবা গলার স্বর যথাসম্ভব গম্ভীর করে বললেন, বৌমা, আমার দৃঢ় বিশ্বাস মতির মা সত্যি কথা বলছে। কে সত্যি বলছে, কে বলছে না সেটা আমি বুঝতে পারি। তিরিশ বছর জজিয়তি করেছি। তোমাকে আরেকটা কথাও বলি মা, পৃথিবীতে অনেক বিকারগ্রস্ত মানুষ আছে। তারা বাথরুমে ফুটো দেখলেই চোখ রাখবে। রইসুদ্দিন এরকম একজন বিকারগ্রস্ত লোক। তাকে আজ সকাল এগারেটার মধ্যে বাসা ছাড়তে হবে। এই প্রসঙ্গে আমি আর কারোর কথা শুনতে চাই না।

রূপা বলল, জাজ সাহেব হিসেবে আপনার দুপক্ষের কথাই শোনা উচিত। আসামীরও তো কিছু বলার থাকতে পারে।

বৌমা, তুমি আমার সামনে থেকে যাও।

আচ্ছা যাচ্ছি, না বললেও যেতাম। আমার খাওয়া শেষ হয়ে গেছে।

রূপা খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠে গেল, যেন কিছুই হয় নি।

এগারোটার আগেই রুইলুদ্দিন চাচাকে তার স্যুটকেস, কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে রিকশায় উঠতে হল। মতির মাকে খুব উৎফুল্ল মনে হল। আমাকে দেখে হাসিমুখে বলল, ভাইজান, দেখছেন, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।

আমি গম্ভীর গলায় বললাম, ধর্মের কল বাতাসে নড়বে না তো কিসে নড়বে?

খুবই খাঁটি কথা ভাহজান। খুব খাঁটি কথা। লোকটারে প্রথম দিন দেইখ্যাই বুঝছি বুদ লোক।

সেও তোমাকে দেখে প্রথমদিনেই বুঝে ফেলেছে, তুমি বদ মেয়েছেলে। দেখ না, এত লোক থাকতে তোমাকে চোর সাব্যস্ত করল। শুধু যে চোর সাব্যস্ত করল তা না, চোর প্রমাণও করে ফেলল। টাকা পাওয়া গেল তোমার ট্রাঙ্কে।

মতির মা মুখ কালো করে ফেলল।

আমি বললাম, রইসুদ্দিন চাচাকে তুমি চেন না মতির মা। উনি বিরাট ঘুঘু লোক। প্রতি বছর ছয়-সাতটা করে মামলা করে। সে তোমাকে এত সহজে ছাড়বে বলে মনে হয় না। মামলা-টামলা করে বসবে বলে আমার ধারণা।

মতির মাকে পুরোপুরি ভ্যাবাচেকা খাইয়ে ঘরে এসে দেখি রূপা চাদর জড়িয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। নির্ঘাৎ ঘুমিয়ে পড়েছে। নাশতা খেয়ে আবার বিছানায় এসে ঘুমিয়ে পড়া রূপার পুরনো অভ্যাস। প্রথমদিকে অবাক হতাম। এখন আর হই না।

রূপা ঘুমাচ্ছ নাকি?

না, চেষ্টা করছি।

তোমার যুক্তি কেউ বিশ্বাস করেছে বলে মনে হয় না।

সবাই বিশ্বাস করেছে। লোকটাকে তোমরা কেউ সহ্য করতে পারছিলে না। একটা অজুহাত পেয়ে তাড়িয়েছ।

তুমি কি লোকটাকে পছন্দ করতে?

আরে দূর দূর। আমি পছন্দ করব কেন? মামলাবাজ লোক আমার অসহ্য। এই, একটা গান দাও না। গান শুনতে শুনতে ঘুমাই।

এখন গান দেয়া যাবে না। বাবা গান শুনলেই রেগে যান।

রেগে যান কেন?

জানি না কেন। ছোটবেলা থেকেই দেখছি গান শুনলে বাবার মেজাজ চড়ে যায়। মুনিয়া একদিন উঁচু ভলুমে অনুরোধের আসর শুনছিল বলে চড় খেয়েছিল।

তোমার বাবা লোকটাকে আমি খুবই অপছন্দ করি। তিনিও অবশ্যি আমাকে অপছন্দ করেন। কাজেই কাটাকাটি।

মা। মাকে পছন্দ কর?

মাই গড। ওনার ভেতর পছন্দ হবার মতো কি আছে?

কিছুই নেই?

না, কিছুই নেই। এই শোন, একটা গান দাও না। গান শুনতে শুনতে ঘুমানোর অন্য রকম মজা। ঘুমের মধ্যেও গান হতে থাকে।

না ঘুমিয়ে একটা কাজ করলে কেমন হয় রূপা?

কি কাজ?

চল না কোথাও বেড়াতে যাই।

পাগল হয়েছ। এই রোদে আমি ঘুরব? গায়ের রঙ নষ্ট হয়ে যাবে না?

বাবাকে বলে গাড়িটা নিয়ে যাই। গাড়িতে গেলে তোমার গায়ের রঙ নিশ্চয়ই নষ্ট হবে না?

রূপা জবাব দিল না। আমি কয়েকবার ডাকলাম, এই রূপা, এই। কোনো সাড়া নেই। সে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি কি করবো ভেবে পেলাম না। চুপচাপ ঘরে বসে থাকব, নাকি বাইরে যাব। রূপাকে বিয়ের পর থেকে মোটামুটিভাবে আমি গৃহবন্দী হয়ে পড়েছি। বাইরে যেতে ভাল লাগে না। রূপার আশেপাশে থাকতে ইচ্ছা করে। বেশির ভাগ সময় সে ঘুমিয়ে থাকে। আমি তার পাশে শুয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। রূপার গা ঘেঁষে শোয়া যায় না—তার গরম লাগে। তার গায়ে হাত রাখা যায় না—ভার লাগে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।

মুনিয়া প্রায়ই আমাকে ঠাট্টা করে বলে—ভাইয়া, তোকে তো ভাবী একেবারে মেষশাবক বানিয়ে ফেলেছে। মেরী হ্যান্ড এ লিটল ল্যাম্ব অবস্থা। মেরী যেখানে যায় মেষশাবক যায় তার পিছু পিছু।

ও তো যায় না কোথাও। শুয়ে থাকে, ঘুমায়।

পাগল হয়েছ ভাইয়া, চব্বিশ ঘণ্টা কেউ ঘুমুতে পারে। আমার ধারণা, ভাবী মোটেই ঘুমোয় না। মটকা মেরে পড়ে থাকে।

মটকা মেরে পড়ে থাকবে কেন?

তা জানি না। আমি আমার ধারণার কথা বললাম। তুমি হা করে ভাবীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালবাস, এটা ভাবী জানে বলেই চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকে, যাতে মনের সাধ মিটিয়ে তুমি দেবীদর্শন করতে পার।

চুপ কর তো।

চুপ করছি। আমার ধারণা ভুল নাও হতে পারে ভাইয়া। ভাবী যখন ঘুমায়, তখন তুমি ভালমতো পরীক্ষা করে দেখো তো। সত্যি ঘুম কিনা।

 

আমি সেই পরীক্ষাও করেছি।

ও যখন ঘুমুচ্ছে তখন পাশে বসে মজার মজার কয়েকটা জোক বলেছি। জেগে থাকলে তাকে হাসতেই হবে। সে হাসেনি। তার ঘুম যে নকল ঘুম না—আসল ঘুম, তা সে না হেসে প্রমাণ করেছে।

মুনিয়াকে আমি আমার এই পরীক্ষার কথা বলেছি। সে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেনি। তার ধারণা, রূপার হাসি আসেনি বলে হাসেনি। সে বলল, জেগে থাকা অবস্থায় এ রসিকতাগুলো করে দেখো তো—ভাবী হাসে কিনা। আমার মনে হয় হাসবে না। যা একদিন তাও করলাম। রূপা হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ল। এমন হাসল যে তার চোখে পানি এসে গেল। হেঁচকি উঠতে লাগল। এই ব্যাপারটাও সন্দেহজনক, এত হাসবে কেন? এত হাসির কি আছে?

 

রূপা ঘুমুচ্ছে।

আমি তার খাটের পাশে রাখা টুলে বসে তাকিয়ে আছি তার মুখের দিকে। এই ঘর থেকে বের হয়ে যাবার সাধ্যও আমার নেই। আট মাস আমাদের বিয়ে হয়েছে। এই আট মাসে স্ত্রীর প্রতি আকর্ষণ খানিকটা হলেও ফিকে হবার কথা। আমার তা হচ্ছে না–কারণ এই মেয়েটাকে আমি একেবারেই বুঝতে পারছি না। প্রথম দিনে সে আমার কাছে যতটা অচেনা ছিল, আজও ঠিক ততটাই অচেনা আছে। কিংবা হয়তো আরো বেশি অচেনা হয়েছে।

আমি একটা সিগারেট ধরালাম।

রূপা বলল, আহ, সিগারেট ফেল তো। গন্ধে বমি আসছে।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, তুমি কি জেগে ছিলে নাকি?

রূপা বিরক্ত গলায় বলল, জেগে থাকব কেন? সিগারেটের ধোঁয়ায় ঘুম ভেঙেছে। দয়া করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট শেষ করে এসো।

আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সিগারেট হাতে বারান্দায় চলে এলাম। সজনে গাছটার দিকে তাকিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। গাছটা মরে যাচ্ছে। খুব ধীরে ধীরে মরছে। এত ধীরে মরছে যে অন্য কেউ তা বুঝতে পারছে না। গাছদেরও কি মৃত্যু-যন্ত্রণা আছে? জগদীশচন্দ্র বসু গাছের মৃত্যু-যন্ত্রণা নিয়ে কি বলে গেছেন?

আমার সিগারেট শেষ হবার আগেই বাবা বারান্দায় এসে পড়লেন। আমি নিতান্ত অনিচ্ছায় হাত থেকে সিগারেট ফেলে দিলাম। বাবা রাগী চোখে আমরা দিকে তাকাচ্ছেন। আমি বললাম, কিছু বলবেন?

সচরাচর বাবাকে তুমি করে বলি। মাঝে মাঝে বিশেষ অবস্থায় আপনি বলি। বাবা তুই-তুমির মিশ্রণ ব্যবহার করেন, এই তুই এই তুমি।

বাবা বললেন, তোর সঙ্গে আমার অনেক কথাই আছে।

এখন বলবেন?

না।

বলতে চাইলে বলতে পারেন, আমার হাতে সময় আছে।

বাবা ইংরেজিতে একটি দীর্ঘ বাক্য বললেন যার বাংলাটা হল, মানুষ হিসেবে তুমি দ্রুত বদলে যাচ্ছ। তুমি নিজে তা বুঝতে পারছ কিনা তা আমি জানি না। তবে তোমাকে যতই দেখি ততই শঙ্কিত বোধ করি। তোমার কি রাতে ঘুম হয়?

আমি বললাম, হুঁ।

কোনো জবাব না।

ঘুম হয় কি হয় না?

হয়।

শুনে সুখী হলাম। তোর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় তোর ইদানীং ঘুম হচ্ছে না। লজিক এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তোর মধ্যে আত্মসম্মান বলতে এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তোর স্ত্রী এমন অদ্ভুত আচরণ করল, আর তুই তাকিয়ে রইলি, কিছুই বললি না? তোর কি মনে হয় না–কিছু বলা উচিত ছিল?

রূপার কথা আমার কাছে বেশ লজিকেল মনে হয়েছে।

লজিকেল মনে হয়েছে?

জী।

আমার কথাগুলি কেমন মনে হয়েছে? আমার কথাগুলি কি পাগলের চেঁচামেচি বলে মনে হয়েছে?

আমি জবাব দেবার আগেই রূপা বারান্দায় এসে বলল, তোমরা এত হৈচৈ শুরু করেছ! ঘুমুচ্ছিলাম তো।–বলেই আবার ভেতরে ঢুকে গেল। শব্দ করে দরজা বন্ধ করল। বাবা হতভম্ব হয়ে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি বোধহয় অনেকদিন এত বিস্মিত হননি। বাবার বিস্মিত চোখ দেখে মজা লাগছে। মানুষ খুব বেশি বিস্মিত হলে খানিকটা টিকটিকির মতো হয়ে যায়। কারণ তার চোখ বড় বড় হয়ে যায় এবং কোটর থেকে খানিকটা বের হয়ে আসে। আমি কি বাবাকে বলব যে তাঁকে এখন কালো টিকটিকির মতো দেখাচ্ছে? বলে আরো রাগিয়ে দেব? চূড়ান্ত রকম রেগে গেলে বাবা কি করেন তা কেন জানি দেখতে ইচ্ছা করছে।

মাকে একবার চূড়ান্ত রকম রাগিয়ে দিয়েছিলাম। এক সময় লক্ষ করলাম, তিনি থরথর করে কাঁপছেন। ঠোঁটের দুই কোণায় ফেনা জমছে। তিনি ক্ষীণ গলায় বললেন, রঞ্জু, তুই যে খুব খারাপ ধরনের ছেলে, এটা কি তুই জানিস?

আমি মার প্রতি একটু করুণাই বোধ করছিলাম। তবু বললাম, আমি যে খুব খারাপ ধরনের ছেলে তা আমি জানি, কিন্তু তুমি যে খুব খারাপ ধরনের একজন মা, তাকি তুমি জান?

কি বললি? তুই কি বললি?

সত্যি কথা বললাম মা।

আমি খারাপ ধরনের মা?

হ্যাঁ। তুমি খারাপ ধরনের মা এবং খারাপ ধরনের স্ত্রী। মা হিসেবে তুমি যেমন ব্যর্থ, স্ত্রী হিসেবেও ব্যর্থ। আমার ধারণা, শিক্ষক হিসেবেও তুমি ব্যর্থ। স্কুলের। মেয়েরা তোমাকে ডাইনী ডাকে। তুমিই এই কথা বলেছিলে। তোমার কাছ থেকেই শোনা।

এই পর্যায়ে মা কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন। আমি সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মাকে দেখছি। খুব যে খারাপ লাগছে তা না।

মা বললেন, তোর মাথা ঠিক নেই রঞ্জু। তোর মাথা ঠিক নেই। আমার ধারণা, কোনো একদিন তুই খুন-টুন করবি।

আমি মার কথায় হেসে ফেললাম। মায়ের এক অর্থে ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা, তিনি ঠিকই বলেছেন।

 

আজ ছুটির দিন। এ ছুটির দিনে সব্যর নানান ধরনের পরিকল্পনা থাকে। আমার কোনো পরিকল্পনা নেই। কারণ আমার ছুটি বলে কিছু নেই। গত দুবছর ধরেই আমার ছুটি। চাকরিবাকরি নেই। তার জন্যে চেষ্টাও নেই। ঢাকা শহরে আমাদের যে দুটি বাড়ি আছে, তার ভাড়াতে আমরা একটা জীবন মোটামুটি সুখে পার করে দিতে পারি। এখন যে বাড়িতে আছি, এটা ভাড়া বাড়ি। বাবার বন্ধুর বাড়ি। শুনতে পাচ্ছি এটিও নাকি কেনা হবে। বাবা মৃত্যুর সময় তিন বাড়ি তাঁর তিন পুত্র-কন্যাকে দিয়ে যাবেন।

সবচে বড় বাড়ি ধানমণ্ডি তের নম্বরের গ্রীণ কটেজ পাবে বাবু। সব পরিবারে একজন আদর্শ সন্তান থাকে, বাবু হচ্ছে সেই আদর্শ সন্তান। এম. এসসি, দিচ্ছে ফিজিক্সে। নির্ঘাৎ ফাস্ট সেকেণ্ড হবে। বাবু হচ্ছে সেই ধরনের ছেলে, যারা ফাস্ট সেকেণ্ড ছাড়াও যে কিছু হওয়া যায় তা জানে না। এরা ছুটির দিনেও দরজা-জানালা বন্ধ করে পড়ে। বাথরুমে যাবার সময়ও বগলে করে পড়ার একটা বই নিয়ে যায়। ঈদের দিন ভোরবেলা বিস্মিত হয়ে বলে—আজ ঈদ? জানতাম না তো? কি আশ্চর্য!

বাবু চিলেকোঠার একটা ঘরে থাকে, এবং তাকে বিরক্ত করা নিষেধ। ঘরে বসে। পড়তে পড়তে তার যখন মাথা ধরে যায়, তখন সে বই হাতে ছাদে ঘুরে ঘুরে পড়ে। তখন ছাদে কেউ থাকলে সে বিরক্ত গলায় বলে, এইখানে কি?

আমি বাবুর ঘরে চলে গেলাম। বাবু বই হাতে বিছানায় শুয়ে ছিল। সে বিরক্ত। গলায় বলল, কি চাও দাদা?

আমি হাই তুলে বললাম, তোর কাছে একটা পরামর্শের জন্যে এসেছি।

সে বিস্মিত হয়ে বলল, আমার কাছে কি পরামর্শ।

তোর কাছে কি পরামর্শের জন্যে আসা যায় না? সারা জীবন ফাস্ট সেকেণ্ড। হয়েছিস—তোদের ব্রেইন হচ্ছে কম্পিউটারইজড। সমস্যার খটাখট সমাধান করে। ফেলবি।

বাবু আগের চেয়েও বিরক্ত গলায় বলল, দাদা, মানুষের ব্রেইন কম্পিউটারের চেয়ে কোটিগুণ পাওয়ারফুল। কম্পিউটার মানুষের তৈরি এটা ভুলে যাও কেন?

সবার ব্রেইন তো আর পাওয়ারফুল না। কিছু কিছু ব্ৰহন আছে ইটের টুকরার মতো। সলিড রক।

তোমার সমস্যাটা কি দাদা অল্প কথায় বলে চলে যাও। আমি জটিল একটা বিষয় পড়ছি–নন নিউটোনিয়ান ফ্লো প্যাটার্ন …।

আমি বসতে বসতে বললাম, একটা খুন করতে চাচ্ছি, বুঝলি–পারফেক্ট না মর্ভিার। কিভাবে করব বুঝতে পারছি না।

ঠাট্টা করছ নাকি? না।

ঠাট্টা করব কেন। তুই ভেবেটেবে একটা কায়দা বের কর তো।

কাকে খুন করবে?

আন্দাজ করতো।

রূপা ভাবীকে?

ঠিক ধরেছিস।

রূপা ভাবীকে খুন করবে কেন?

আমি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, এত মানুষ থাকতে তোরই বা রূপার কথা মনে হল কেন?

বাবু থতমত খেয়ে গেল। আমি উঠতে উঠতে বললাম, খুব ভালমতো চিন্তাভাবনা করে তারপর আমাকে বলবি। হুট করে কিছু বলবি না। খুনটা হবে টেক্সট বুক মার্ডার। কোনো রকম ভুলচুক থাকবে না।

বাবু বিড়বিড় করে বলল, তোমার মাথা আগেও খারাপ ছিল এখন আরো বেশি খারাপ হয়েছে। তোমার চিকিৎসা হওয়া দরকার। দাদা, তুমি কি ড্রাগ-ট্রাগ কিছু খাও?

আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, খাই না, তবে খেয়ে দেখব বলে ভাবছি। ইন্টারেস্টিং ড্রাগ কি আছে বল তো।

আমাদের পরিবারের আদর্শ মানব বাবু বিরক্ত মুখে বই পড়তে শুরু করেছে–নন নিউটোনিয়ান ফ্লো মেকানিক্স। অতি জটিল বিষয়, সে নিশ্চয়ই জলের মতো বুঝতে পারছে। তবে সহজ জিনিস সে কিছু বোঝে না বলেই আমার বিশ্বাস। বাবু ভুরু কুঁচকে বলল, দাদা, এখন যাও তো। মূর্তির মতো বসে আছি, আমার খুব বিরক্ত লাগছে।

আমি উঠে পড়লাম। আদর্শ মানবকে বেশিক্ষণ বিরক্ত করা ঠিক না। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দেখি, লাবণ্যও নামছে। চুল বেঁধে, মুখে পাউডার দিয়ে একেবারে পরীদের ছানা। পায়ে লাল ভেলভেটের জুতা। আমি বললাম, এমন সেজেছিস কেন রে লাবণ্য?

লাবণ্য হাসিমুখে বলল, বাবা আমাকে দেখতে এসেছে।

ও আচ্ছা। খুব আনন্দ হচ্ছে?

হচ্ছে।

একা একা বাবার কাছে যেতে পারবি, নাকি আমাকে সঙ্গে যেতে হবে?

একা যেতে পারব।

লাবণ্য রেলিং ধরে খুব সাবধানে নামছে। এই সাবধানতা তার নতুন জুতার জন্যে।

আমি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। লাবণ্যর বাবার গাড়ি এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। গাড়িতে রোগামতো একটি মেয়ে বসে আছে। এই বোধহয় ভদ্রলোকের নতুন স্ত্রী। মেয়েটা মাথায় ঘোমটা দিয়ে বৌ বৌ ভাব নিয়ে এসেছে।

আমি আবার আমার ঘরে ঢুকলাম। আমাদের বিছানায় মুনিয়া উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মুনিয়ার পিঠে হাত দিয়ে বসে আছে রূপা। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই রূপা তীব্র স্বরে বলল, প্লীজ লিভ আস এলোন।

এই ইংরেজি বাক্যটির সুন্দর বাংলা কি হবে–দয়া করে আমাদের একা থাকতে দাও–নাকি পায়ে পড়ি আমাদের একা থাকতে দাও?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *