নীতু বলল, আপা, আমার ভয় ভয় লাগছে।
শাহানার চোখে চশমা, কোলে মোটা একটি ইংরেজি বই–The Psychopathic Mind. দারুণ মজার বই। সে বইয়ের পাতা উল্টাল। নীতুর দিকে একবারও না তাকিয়ে বলল, ভয় লাগার মত কোন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে বলে তো মনে হচ্ছে না।
গা জ্বলে যাবার মত কথা। কি রকম হেড মিসট্রেস টাইপ ভাষা–ভয় লাগার মত কোন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে বলে তো মনে হচ্ছে না। অথচ পরিস্থিতি যথেষ্টই খারাপ। তারা দুজন একা একা যাচ্ছে। দুজন কখনো একা হয় না, সঙ্গে পুরুষমানুষ কেউ নেই বলে নীতুর কাছে একা একা লাগছে। ঠাকরোকোনা স্টেশনে বিকেলের মধ্যে তাদের পৌঁছার কথা। এখন সন্ধ্যা, ট্রেন থেমে আছে। ঠাকরোকোনা, স্টেশন আরো তিন স্টপেজ পরে। যে ভাবে ট্রেন এগুচ্ছে, নীতুর ধারণা পৌঁছতে পৌঁছতে রাত দুপুর হয়ে যাবে। তখন তারা কি করবে? স্টেশনে বসে। ভোর হবার জন্যে অপেক্ষা করবে? মেয়েদের বসার কোন জায়গা আছে কি? যদি না থাকে তারা কোথায় বসবে?
নীতু বলল, আপা, তুমি বইটা বন্ধ কর তো।
শাহানা বই বন্ধ করল। চোখ থেকে চশমা খুলে ফেলল। শাহানার বয়স চবিবশ। তার গায়ে সাধারণ একটা সূতির শাড়ি। কোন সাজসজ্জা নেই অথচ কি সুন্দর তাকে পাগছে! নীতু কিছুক্ষণের জন্যে ভয় পাওয়ার কথা ভুলে গিয়ে বলল, আপা, তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।
সুন্দর মানুষকে সুন্দর লাগবে এটা তো নতুন কিছু না। তোকে তেমন সুন্দর লাগছে না। ভয়ে চোখ-মুখ বসে গেছে। এত কিসের ভয়?
স্টেশন থেকে আমরা যাব কি ভাবে?
অন্যরা যে ভাবে যায় সেই ভাবে যাব। রিকশা পাওয়া গেলে রিকশায়, গরুর গাড়ি পাওয়া গেলে গরুর গাড়ি, নৌকায় যাবার ব্যবস্থা থাকলে নৌকায়। কিছু না পাওয়া গেলে হন্টন।
হেঁটে এত রাস্তা যেতে পারবে?
এত রাস্তা তুই কোথায় দেখলি? মাত্র সাত মাইল। এলিভেন পয়েন্ট টু কিলোমিটার। তিন ঘণ্টার মত লাগবে।
নীতুদের কামরায় লোকজন বেশি নেই। তাদের বেঞ্চটা পুরো খালি। একজন এসে বসেছিল, কিছুক্ষণ পর সেও সামনের বেঞ্চে চলে গেছে। নীতু এই ব্যাপারগুলি লক্ষ্য করছে–কোন্ স্টেশনে কজন উঠল, কজন নামল। সামনের বেঞ্চে এখন সাতজন মানুষ বসে আছে। সবাই পুরুষ। কোন মেয়ে এখন পর্যন্ত তাদের কামরায় উঠেনি। যারা এই কামরায় উঠেছে তারা সবাই বয়স্ক বুড়ো ধরনের গ্রামের মানুষ। শুধু একটি ন-দশ বছরের ছেলে আছে। ছেলেটা বোধহয় অসুস্থ। এই গরমেও তাকে কথা দিয়ে জড়িয়ে রাখা হয়েছে। ছেলেটির পাশে যে বুড়ো মানুষটি বসে আছে তার কোলে ঝকঝকে পেতলের একটা বদনা। সে বদনার নলটা কিছুক্ষণ পর পর ছেলেটার মুখে ধরছে। ছেলেটা চুক চুক করে কি যেন খাচ্ছে। কি আছে বদনায়–পানি? বদনায় করে কেউ পানি খায়?
নীতু ফিস ফিস করে বলল, আপা, বদনায় করে ঐ ছেলেটা কি খাচ্ছে?
শাহানা বলল, আমার তো জানার কথা না নীতু।
একটু জিজ্ঞেস করে দেখো না।
তোর জানতে ইচ্ছা করছে, তুই জিজ্ঞেস কর। আমাকে দিয়ে জিজ্ঞেস করাবি কেন?
ট্রেন চলতে শুরু করেছে। সন্ধ্যা মিলিয়েছে। আকাশ মেঘে মেঘে কালো বলে দিনের আলো নেই। এখন কামরার ভেতরটা পুরোপুরি অন্ধকার। নীতুর ব্যাগে একটা পেনসিল টর্চ আছে। টর্চটা সে বের করবে কি-না বুঝতে পারছে না। নীতু বলল, ট্রেনের বাতি জ্বলছে না কেন আপা?
শাহানা কিছু বলার আগেই সামনের বেঞ্চ থেকে এই একজন বলল, এই লাইনের ট্রেইনে রাইতে বাত্তি জ্বলে না।
নীতু বিস্মিত হয়ে বলল, কেন?
গরমেন্টের ইচ্ছা। করনের কিছু নাই।
নীতু বলল, গভর্নমেন্ট শুধু শুধু বাতি বন্ধ করে রাখবে কেন?
শাহানা মনে মনে হাসল। নীতু গল্প করার মানুষ পেয়ে গেছে। এখন বক বক করে কথা বলে যাবে। এক মুহূর্তের জন্যেও থামবে না। শাহানা জানালা দিয়ে মুখ বের করে দিয়েছে। বাতাসে তার শাড়ির আঁচল উড়ছে। পত পত শব্দ হচ্ছে। ট্রেনের ভেতরটা অন্ধকার, বাইরে দিনশেষের আলো। তার অদ্ভুত লাগছে। ট্রেনযাত্রীর সঙ্গে নীতুর কথাবার্তা শুনতেও ভাল লাগছে। কি বকবকানিই না এই মেয়ে শিখেছে!
আফনেরা দুইজনে যান কই?
আমরা যাচ্ছি সুখানপুকুর। আমাদের দাদার বাড়ি। ঠাকরোকোনা স্টেশনে। নামব। সেখান থেকে রিকশায়, কিংবা নৌকায় যাব। কিছু না পেলে হেঁটে যাব। ঠাকরোকোনা কখন পৌঁছব বলতে পারেন?
এক-দুই ঘণ্টা লাগবে।
ট্রেনের গতি বাড়ছে। শাহানার চুল বাধা। তার ইচ্ছা করছে চুল ছেড়ে দিতে। ট্রেনের জানালায় মাথা বের করা থাকবে, বাতাসে চুল উড়তে থাকবে পতাকার মত। পৃথিবীতে সবচে সুন্দর পতাকা হল তরুণীর মাথার উড়ন্ত চুল। শাহানা কি খোপ খুলে ফেলবে? নীতু ডাকল, আপা!
শাহানা মুখ না ফিরিয়েই বলল, কি?
এই লাইনে ট্রেনে প্রায়ই ডাকাতি হয়।
কে বলল? ঐ বুড়ো?
হুঁ। তারা তো এই ট্রেনেই যাতায়াত করে। সব জানে। ডাকাতরা আউট স্টেশনে ট্রেন থামায় তারপর ডাকাতি করে।
করুক। ডাকাতরা তো ডাকাতি করবেই। ডাকাতি হচ্ছে তাদের পেশা।
একটা কথা বললেই তুমি তার অন্য অর্থ কর। যদি ডাকাত পড়ে আমরা কি করব?
আগে ডাকাত পড়ুক তারপর দেখা যাবে। আউট স্টেশন আসতে দেরি আছে। তুই এত অস্থির হোস না তো নীতু, যা হবার হবে। আগে আগে এত চিন্তা করে লাভ কি? জানালা দিয়ে মুখ বের করে দেখ কি সুন্দর লাগছে।
নীতু নিতান্ত অনিচ্ছায় জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। তার কাছে মোটেই সুন্দর লাগছে না, বরং ভয় আরও বেশি লাগছে। ঘন কালো আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। দমকা বাতাস দিচ্ছে। বাতাসের ঝাপ্টা চোখে-মুখে লাগছে। নীতু ফিস ফিস করে বলল, পেতলের বদনায় ছেলেটাকে কি খাওয়াচ্ছে জান আপা?
না।
তালতলার পীর সাহেবের পড়া পানি। এই পড়া পানি পেতলের পাত্রে রাখতে হয়। না রাখলে পানির গুণ নষ্ট হয়ে যায় ছেলেটার কামেলা রোগ হয়েছে। কামেলা রোগ কি আপা?
কামেলা হল জণ্ডিস।
পড়া পানি পেতলের পাত্রে রাখলে গুণ নষ্ট হয় না কেন আপা?
আমি জানি না। তালতলার পীর সাহেব হয়ত জানেন।
আপা, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে…।
হুঁ। প্রচণ্ড ঝড় হবে, তাই না আপা?
ঝড় হবে কি-না বুঝতে পারছি না, তবে বৃষ্টি হবে।
আমার কাছে মনে হচ্ছে ঝড় হবে। আচ্ছা আপা, ঝড়ের সময় ট্রেন কি চলতে থাকে, না এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে?
জানি না।
আমার খুব জানতে ইচ্ছা করছে।
ট্রেন থেকে আমরা যখন নামব তখন ট্রেনের ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারিস। তারই জানার কথা। জিজ্ঞেস করবি?
তুমি আমার হয়ে জিজ্ঞেস করে দেবে?
আমি করব না। তুই করবি। তোর কৌতূহল হয়েছে, তুই মেটাবি।
তোমার কোন কৌতূহল নেই?
শাহানা সহজ গলায় বলল, ঝড়ের সময় ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকে, না চলতে থাকে। এটা জানার কোন কৌতূহল নেই। পৃথিবীতে জানার অনেক বিষয় আছে।
ট্রেনের কামরায় হারিকেন জ্বলছে। অসুস্থ ছেলেটির বাবা হারিকেন ধরিয়েছে। এরা রাতে ট্রেনে চাপলে হারিকেন সঙ্গে নিয়েই উঠে। হারিকেনটার কাচ ভাঙা। লাল শিখা দপদপ করছে। যে কোন মুহূর্তে নিভে যাবে। নীতু গভীর আগ্রহ নিয়ে হারিকেনের শিখার দিকে তাকিয়ে আছে। তার হাতে পেনসিল টর্চ। টচটা কিচ্ছ করছে না। বাইরে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। হালকা বর্ষণ। শাহানা মাথা বের করে ভিজছে।
ঠাকরোকোনা স্টেশন আসতে দেরি নেই। সামনের স্টেশনই ঠাকরোকোনা। ট্রেনের গতি এখনো কমতে শুরু করেনি। আউট স্টেশনের সিগন্যালের পর কমতে থাকবে। শাহানা হাতের ঘড়ি দেখার চেষ্টা করল। রেডিয়াম ডায়ায় থাকা সত্ত্বেও ঘড়ির লেখা পড়া যাচ্ছে না। তবে রাত নটার মত বাজে। চর ঘণ্টা লেট। রাত নটা ঢাকা শহরে এমন কিছু রাত না–কিন্তু ঢাকার বাইরে গভীর রাত। শাহানা চিন্তিত বোধ করছে। এতক্ষণ সে সাহসী তরুণীর ভূমিকায় অভিনয় করেছে–ট্রেন থামার পর সত্যিকার অর্থেই সাহসী তরুণী হতে হবে। সুখানপুকুরে যাবার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রমাণ করতে হবে–দুটি মেয়ে ইচ্ছা করলে নিজেরা নিজেরা ঘুরে বেড়াতে পারে। বডিগার্ডের মত একজন পুরুষমানুষ সঙ্গে না থাকলেও হয়।
ভরা বৃষ্টির মধ্যে তারা স্টেশনে নামল। তাদের নামিয়ে দিয়েই ট্রেন হুস করে চলে গেল। নীতু বলল, আপা, আমরা দুজনই শুধু নেমেছি–আর কেউ না। এটা স্টেশন তো? নাকি পথে কোথাও নেমে পড়েছি?
চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দূরে বাতির আভাস দেখা যায়। ঐটাই কি স্টেশন মাস্টারের ঘর? শাহানা আলোর দিকে এগুচ্ছে, নীতু আসছে তার পেছনে পেছনে। দুজনের হাতে দুটা স্যুটকেস। নীতু রাজ্যের গল্পের বই তার স্যুটকেসে ভরেছে বলে অসম্ভব ভারী। তার রীতিমত কষ্ট হচ্ছে। কষ্টের সঙ্গে আতংকও যুক্ত হয়েছে–তার এখনো ধারণা তারা স্টেশনে নামেনি। কোন কারণে ট্রেন স্টেশনের আগেই থেমেছিল। তারা নেমে পড়েছে। নয়তো একটা স্টেশনে মাত্র দুজন যাত্রী নামবে কেন?
আপা!
হুঁ।
ভিজে গেছি তো আপা।
বৃষ্টির ভেতর হাঁটলে তো ভিজতে হবেই। তুই ভরা বৃষ্টিতে হাঁটবি আর গা থাকবে শুকনা খটখটে তা হয় না।
আমরা এখন কি করব?
প্রথমেই স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে কথা বলব…।
তারপর?
তারপরেরটা তারপর।
নীতু আতংকিত গলায় বলল, আপা, আমি গোবরে পা দিয়ে ফেলেছি।
ভাল করেছিস।
শাহানা হাসছে। নীতুর প্রায় কান্না পেয়ে গেল। সে লক্ষ্য করছে, আজেবাজে ধরনের দুর্ঘটনা সব সময় তার কপালেই ঘটে। গোবরে শাহানার পাও পড়তে পারত। তা না পড়ে তার পা পড়ল কেন? সে কি দোষ করেছে?
ছোট্ট জানালার ফাঁক দিয়ে স্টেশন মাস্টার মনসুর আলি তাকিয়ে আছেন। তাঁর শরীর ভাল না। জ্বরে কাহিল হয়ে আছেন। এতক্ষণ চেয়ারে বসেই ঘুমুচ্ছিলেন। ট্রেন আসার শব্দে জেগে উঠেছেন। তাঁর চোখ-মুখ ভাবলেশহীন হলেও তিনি যে আকাশ থেকে পড়ছেন তা বোঝা যাচ্ছে। রাত-দুপুরে ফুটফুটে দুটি মেয়ে স্টেশনের জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে, এর মানে কি? একজনের বয়স বার-তের। অন্যজনের বয়স ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। উনিশ কুড়ি হতে পারে আবার চব্বিশ-পঁচিশও হতে পারে। দুটি মেয়েই পরীর মত। সঙ্গে কোন পুরুষমানুষ দেখা যাচ্ছে না। এরা বাড়ি থেকে পালিয়ে আসেনি তো? বাড়ি থেকে পালিয়ে এলে পুলিশে খবর দিতে হয়। বাড়তি ঝামেলা। ঝড় বৃষ্টির রাত–কোথায় বাড়িতে গিয়ে আরাম করে ঘুমুবেন তা না, থানা পুলিশ ছুটাছুটি কর।
নীতু স্টেশন মাস্টারের দিকে অকিয়ে বলল, আপনাদের স্টেশনে টিউবওয়েল আছে? আমি পা ধোব। ভুলে আমি গোবরে পা দিয়ে ফেলেছি। স্টেশন ভর্তি এত গোবর কেন?
স্টেশন মাস্টার মনসুর আলির গলার স্বর এম্নিতেই ভাঙা। সেই স্বর আরো ভেঙে গেল। তিনি গোবর সমস্যার ধার দিয়ে গেলেন না। আগে মূল সমস্যাটা ধরতে হবে। তারপর গোবর। তিনি নীতুকে এড়িয়ে শাহানার দিকে তাকিয়ে বললেন–কোথায় যাওয়া হবে?
আপনি-তুমির সমস্যা এড়িয়ে ভাববাচ্যে কথা বলা। তার রিটায়ারমেন্টের সময় হয়ে গেছে। এই বয়সে বাচ্চা বাচ্চা মেয়েদের আপনি বলতে ইচ্ছা করে না। আবার চট করে তুমিও বলা যায় না।
শাহানা বলল, আমরা সুখানপুকুর যাব। আপনি কি দয়া করে আমার ছোটবোনের পা ধোয়ার একটা ব্যবস্থা করে দেবেন? ওর শুচিবায়ুর মত আছে।
সুখানপুকুর কার কাছে যাওয়া হবে?
শাহানা হাসি হাসি মুখে বলল, সুখানপুকুরে আমাদের দাদার বাড়ি। দাদাকে দেখতে যাব।
আপনার দাদার নাম কি ইরতাজুদ্দিন?
জি।
ও, আচ্ছা আচ্ছা। আপনারা আসুন, ভেতরে এসে বসুন। আচ্ছা দাঁড়ান, তার আগে পা ধোয়ার ব্যবস্থা করি।
মনসুর আলি নিজের চেয়ার ছেড়ে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন। নীতু ফিস ফিস করে বলল–বিখ্যাত দাদা থাকার অনেক সুবিধা, তাই না আপা?
হুঁ। এখন আর আমাদের কোন অসুবিধা হবে না।
মনে হয় না।
এই ভরসাতেই তুমি এত নিশ্চিত হয়েছিলে?
শাহানা হাসল।
মনসুর আলি সাহেবের মুখে কোন হসি নেই। রাত বারটা একুশ মিনিটে নাইন আপ পার করে দেবার পর ভোর নটা পর্যন্ত তার নিশ্চিন্ত থাকার কথা ছিল। সুন্দর বৃষ্টি নেমেছে। আরামের ঘুম ঘুমানো যাবে। এখন মনে হচ্ছে সব এলোমেলো হয়ে গেছে। পয়েন্টসম্যান বদরুলকে খুঁজে বের করতে হবে। কোথাও নিশ্চয়ই ঘুমুচ্ছে। মেয়ে দুটির সঙ্গে পুরুষমানুষ কেউ আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। আছে নিশ্চয়ই। ভং ধরে বৃষ্টিতে ভিজছে। সামান্য স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে কথা বললে তাদের অপমান হবে। এদের চা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়। বদরুলকে পাঠিয়ে চা আনাতে হবে। এরা এইসব চা খাবে না। এক চুমুক দিয়ে রেখে দেবে। তারপরও দিতে হবে। সুখানপুকুরে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে। কাঁচা রাস্তা। হাঁটু পর্যন্ত ডেবে যাবে কাদায়। গরু গাড়ি পাওয়া গেলে গাড়িতে উঠিয়ে দেয়া যাবে। এত রাতে পাওয়া যাবে কি না কে জানে।
মনসুর আলি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে দেখলেন মেয়ে দুটির সঙ্গে পুরুষমানুষ কেউ আসেনি। এরা একাই এসেছে। সারা স্টেশন খুঁজে বদরুলকে পেলেন না। হারামজাদা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ফাজিলদের একজন। বাড়িতে গিয়ে ঘুমুচ্ছে। চায়ের খোঁজে তাকেই যেতে হবে। তার হঠাৎ মনে হল, তিনি সঙ্গে ছাতা আনেননি। এম্নিতেই গায়ে জ্বর। তার উপর বৃষ্টিতে ভিজলে নির্ঘাৎ বুকে ঠাণ্ডা বসে যাবে। জ্বর আরো বাড়বে, ধরবে নিওমোনিয়া।
নীতু বলল, আপনি এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন?
মনসুর আলি বললেন, না না, ব্যস্ত হচ্ছি না তো। ব্যস্ত হবার কি আছে? আপনারা চা খাবেন?
নীতু বলল, পরে খাব। আগে পা খোব। এখানে টিউবওয়েল আছে না?
ও আচ্ছা হ্যাঁ–পা। অবশ্যই। অবশ্যই। টিউবওয়েল আছে। টিউবওয়েল থাকবে না কেন?
বলেই মনসুর আলির মনে হল–টিউবওয়েল আছে ঠিকই, ওয়াসার হয়ে গেছে বলে পানি উঠে না। এখন এই মেয়েকে পুকুরে নিয়ে যেতে হবে। স্টেশনের কাছেই পুকুর–বেশি হাঁটতে হবে না। তবে ঘাট নেই পুকুর। ঝুম করে এই মেয়ে পানিতে পড়ে গেলে ষোলকলা পূর্ণ হয়।
মনসুর আলি বিব্রত গলায় বললেন, টিউবওয়েলটা বোধহয় নষ্ট–আপনাকে কষ্ট করে একটু পুকুরে যেতে হবে।
আমার কোন কষ্ট হবে না। চলুন। গা ঘিন ঘিন করছে। আর শুনুন, আমাকে তুমি করে বলুন। আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি।
মা, তুমি সাঁতার জান তো?
নীতু বিস্মিত হয়ে বলল, পা ঘোয়ার জন্যে সাঁতার জানতে হবে কেন?
না, এম্নি বলছি।
আমি সাঁতার জানি না।
সাঁতার জানা ভাল। কখন দরকার হয় কিছু তো বলা যায় না।
মনসুর আলির মনে হল তার জ্বর বেড়েছে। কথাবার্তা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মেয়ে দুটি বড়ই সুন্দর। তার নিজের মেয়েও সুন্দর–শুধু দাঁত উচু বলে বিয়ে হচ্ছে না। আজকাল না-কি উঁচু দাঁত ঠিক করা যায়। নিশ্চয়ই বিস্তর টাকার দরকার হয়। মেয়েটার দাঁত ঠিক করলে এই মেয়ে দুটির মতই সুন্দর হত।
শাহানা এবং নীতু টিকিট ঘরে বসে আছে। মনসুর আলি গেছেন তাদের জন্যে চায়ের ব্যবস্থা করতে। চায়ের ব্যবস্থা করবেন, সুখানপুকুরে যাবার ব্যবস্থা করবেন। বদরুল হারামজাদাকে খুঁজে বের করবেন। হারামজাদাটাকে সবসময় পাওয়া যায়–শুধু কাজের সময় পাওয়া যায় না।
নীতুর এখন মজাই লাগছে। তার ভয় কেটে গেছে। স্টেশন মাস্টার সাহেব এখন আর তাদের কোন ঝামেলা হতে দেবেন না। টিকিট ঘরের দায়িত্ব তাদের হাতে ছেড়ে ভদ্রলোক যে পুরোপুরি উধাও হয়ে গেলেন এতে নীতু খানিকটা অস্বস্তি বোধ করছে। এখন যদি কেউ এসে টিকিট চায় তাহলে তারা কি করবে? হঠাৎ ঘরে টক টক শব্দ হতে শুরু করল। নীতু বলল, শব্দ কিসের আপা?
শাহানা সহজ গলায় বলল, টেলিগ্রাফ এসেছে। মোর্স কোডে খবর দিচ্ছে।
কি খবর?
ভালমত না শুনে বলতে পারব না। কোড এনালাইসিস করতে হবে।
কি ভাবে এনালাইসিস করবে?
টরে টক্কা হল A, টক্কা টরে টরে টরে হল B, টক্কা টরে টক্কা টরে হল C, D টক্কা টরে টরে…।
তুমি এত সব জানলে কি ভাবে?
বই পড়ে জেনেছি।
বই তো আমিও পড়ি, আমি তো কিছু জানি না…
প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল। বাজ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে টিকিট ঘরের হারিকেন দপ দপ করতে লাগল। নিভি নিভি করেও শেষ পর্যন্ত নিভল না। হারিকেন নিজেকে সামলে নিল। আধো অন্ধকার ঘরে টেলিগ্রাফের টরে টক্কা শব্দ হচ্ছে। বাতাসে জানালা ভেদ করে বৃষ্টির ছাট আসছে।
আপা।
হুঁ।
নীতু থমথমে গলায় বলল, বাইরে একটু তাকিয়ে দেখবে আপা?
প্রয়োজন হলে দেখব। প্রয়োজন বোধ করছি না। বাইরে তাকিয়ে কিছুই দেখা যাবে না। ঘুটঘুট্টি অন্ধকার।
আমি একটা কিছু দেখতে পাচ্ছি।
কি দেখতে পাচ্ছিস?
একটা লোক দেখতে পাচ্ছি আপা। দুষ্টলোক। লোকটা বিড়ি খাচ্ছে। আর তার গোঁফ আছে।
অন্ধকারে দেখছিস কি ভাবে?
ঐ দেখ বিড়ির আগুন জ্বলছে, নিভছে। মুখে নিয়ে যখন টানে তখন বিড়ির আলোয় তার ঠোঁট আর গোঁফ দেখা যায়–দেখতে পাচ্ছ?
হুঁ। বিড়ি না হয়ে সিগারেটও হতে পারে। বিড়ি যে বুঝলি কি করে?
অন্ধকারে সিগারেটের আগুন কেমন হয় আমি জানি–এটা সিগারেটের আগুন। আপা, আমরা এখন কি করব?
আমরা বসে বসে একটা লোকের বিড়ি খাওয়া দেখব।
আর কিছু করব না?
উহুঁ।
আপা, লোকটা কিন্তু আমাদের দিকে আসছে।
আসুক।
লোকটার মতলব ভাল না আপা।
কি করে বুঝলি মতলব ভাল না?
হাঁটা দেখে বুঝছি। দেখ না কেমন থেমে থেমে আসছে। মতলব ভাল হলে থেমে থেমে আসত না।
আজকাল তুই ডিটেকটিভ গল্প-উপন্যাস বেশি পড়ছিস। ডিটেকটিভ বই বেশি পড়লে আশেপাশের সবাইকে চোর বা ডাকাত মনে হয়। ভূতের বই বেশি পড়লে প্রতিটি অন্ধকার কোণে একটা করে ভূত আছে বলে মনে হয়।
লোকটা আমাদের দেখতে পেয়েছে আপা।
স্টেশন ঘরে হারিকেনের আলো আছে। দেখতে না পাওয়ার কোন কারণ নেই।
দেখ আপা, লোকটা আগের বিড়ি ফেলে দিয়ে নতুন করে বিড়ি ধরিয়েছে। বলেছিলাম না–দুষ্টলোক।
দুষ্টলোক-টোক না, চেইন স্মোকার। এ কেহ দিন বাঁচবে না।
বাঁচবে না কেন?
চেইন স্মোকাররা বেশি দিন বাঁচে না। ওদের আর্টারিতে চর্বি জমে আর্টারি সরু হয়ে যায়। তারপর হয় হার্ট এ্যাটাক…। আর্টারি কি জানিস তো?
জানি। রক্তবাহী শিরা।
ভয়ে নীতুর বুক কাঁপছে, কারণ লোকটার মুখ এখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। টিকিট ঘরের ফুটো দিয়ে সে তাকাচ্ছে। লোকটার ঠোঁটে গোঁফ নেই। সে আসলে ভুল দেখেছে। বিশ্রী গোলাকার একটা মুখ, খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে লম্বা চুল। লোকটা সর্দি-বসা গলায় বলল, মাস্টার সাহেব কই?
নীতু বলল, মাস্টার সাহেব কোথায় আমরা জানি না। আপনি কে?
আপনারা কে?
আমরা কে তা দিয়ে আপনার কোন দরকার নেই।
যাবেন কোথায়?
তা দিয়েও আপনার দরকার নেই।
আমার নাম মতি। মাস্টার সাব আমারে চিনে।
উনি চিনলে উনার সংগে কথা বলবেন, এখন দয়া করে আমাদের বিরক্ত করবেন না।
নীতুর টকটক করে কথা বলা শুনে শাহানা মনে মনে হাসছে। ভয়ে এই মেয়ে মরে যাচ্ছে অথচ কেমন কথা শুনাচ্ছে। নীতুর কথায় লোকটি হকচকিয়ে গেছে–বোঝাই যাচ্ছে। সে কথা বন্ধ করলেও সরে গেল না। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রইল।
নীতু বলল, জানালার সামনে বাতাস বন্ধ করে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। সরে দাঁড়ান। আমাদের অক্সিজেনের অভাব হচ্ছে।
লোকটা তৎক্ষণাৎ সরে দাঁড়াল। তবে তাকিয়ে রইল শাহানার দিকে।
নীতু ফিস ফিস করে বলল, আপা দেখ, লোকটা আরেকটা বিড়ি ধরিয়েছে। আপা দেখ, কি ভাবে সে তোমাকে দেখছে। চোখে পলক ফেলছে না।
রূপবতী একজন তরুণী গ্রামের স্টেশন ঘরে বসে আছে। তাকে তো অবাক হয়ে দেখারই কথা।
আপা সে এখন যাচ্ছে।
গুড।
বদমাশ সঙ্গী-সাথীদের খবর দিয়ে আনবে না তো? দেখো আপা, কি বিশ্রীভাবে লোকটা যাচ্ছে।
লোকটা সাধারণ মানুষের মতই যাচ্ছে–তুই ভয়ে আধমরা হয়ে আছিস বলে সাধারণ হাঁটাই তোর কাছে ভয়ংকর হাঁটা বলে মনে হচ্ছে। তাছাড়া ভাললোকের হাঁটা এবং মন্দলোকের হাঁটাতে কোন বেশ-কম নই। ভাল-মন্দ মানুষের মনে, হাঁটায় নয়।
কি লম্বা চুল দেখ না। লম্বা চুলের মানুষ ভাল হয় না।
রবীন্দ্রনাথেরও লম্বা চুল ছিল। উনি কি মন্দ?
তুমি সবসময় স্কুল টিচারের মত কথা বল–আমার ভাল লাগে না আপা। যাদের জ্ঞান কম তারাই সব সময় জ্ঞানী জ্ঞানী কথা বলে।
জ্ঞানীরা কথা বলে না?
না, ভরা কলসির শব্দ হয় না।
জ্ঞানী যদি কোন কথাই না বলে তাহলে আমরা বুঝব কি করে সে জ্ঞানী? তার যে জ্ঞান আছে–সেটা বুঝানোর জন্যে তো তাকে কথা বলতে হবে। ভরা কলসির শব্দ হয় না–এটাও তো তুই ঠিক বললি না। ভরা কলসিরও শব্দ হয়, তবে অন্য। রকম শব্দ। বুঝতে পারছিস?
পারছি। তুমি নিজেকে কি মনে কর আপা? ভরা কলসি?
শাহানা জবাব দিল না। হাসল। নীতুকে রাগিয়ে দিয়ে সে এখন খুব মজা পাচ্ছে। খুব রেগে গেলে নীতু হাত-পা ছুঁড়ে কাদতে শুরু করে, সেই দৃশ্য খুব মজার। নীতুর চোখ-মুখ যেমন দেখাচ্ছে মনে হয় হাত-পা ছুঁড়ে কান্না শুরুর বেশি বাকি নেই।
আপা!
হুঁ।
লোকটা কিন্তু চলে যায়নি–ঐ দেখ দাঁড়িয়ে আছে।
থাকুক দাঁড়িয়ে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির ভেতর যাবে কি ভাবে?
ভয় লাগছে তো আপা।
গুন গুন করে গান গায় গান গাইলে ভয় কাটে।
সব সময় ঠাট্টা কর কেন?
আচ্ছা আর ঠাট্টা করব না।
আপা, লোকটা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার কি বিশ্রী চেষ্টা করছিল লক্ষ করেছ?
না। আমি তোর মত ডিটেকটিভের চোখে সব লক্ষ্য করি না।
আপা, কোন লোকের কথা শুনে কি বলা যায় সে কি করে তার পড়াশোনা কতদূর?
না, বলা যায় না। আমাদের মেডিক্যাল কলেজে সার্জারির একজন প্রফেসর ছিলেন–খাস নেত্রকোনার গ্রাম্য ভাষায় কথা বলো মুখ ভর্তি করে পান খান। পানের কস গড়িয়ে গড়িয়ে তার শার্টে পড়ে।
ছিঃ!
তুই ছিঃ বললে হবে কি, উনি পৃথিবীর সেরা সার্জনদের একজন। চোখ বেঁধে দিলেও তিনি নিখুঁত অপারেশন করতে পারেন।
তিনি কি চোখ বেঁধে কখনও অপারেশন করেছেন?
না।
আপা, দেখ ঐ লোকটা নাক ঝাড়ছে।
নাকে সর্দি জমেছে নাক ঝাড়ছে–এটা তো নীতু দেখার মত দৃশ্য না।
আমার গা ঘিন ঘিন করছে আপা।
তুই ঐ লোকটার দিকে তাকাবি না। অন্যদিকে তাকিয়ে থাক।
নীতু অন্যদিকে তাকাল না। লোকটির দিকেই তাকিয়ে রইল। তার গা আসলেই ঘিন ঘিন করছে। নানান কারণেই করছে। পা ধোয়া হলেও তার ধারণা পা থেকে গোবরের গন্ধ পুরোপুরি যায়নি। বাড়িতে পৌঁছেই সাবান মেখে গোসল করতে হবে। পা আলাদা করে স্যাভলন দিয়ে ধুতে হবে। কে জানে দাদার বাড়িতে স্যাভলন আছে। কি-না। সঙ্গে করে স্যাভলনের একটা বড় বোতল নিয়ে আসা দরকার ছিল।
আপা!
হুঁ।
দাদাজানের বাড়িতে কি স্যাভলন আছে?
নীতু! তুই মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব প্রশ্ন করিস। হঠাৎ করে স্যালনের কথা এল কেন? তাছাড়া দাদাজানের বাড়িতে স্যাভলন আছে কিনা আমি জানব কি ভাবে?
লোকটা আরেকটা বিড়ি খাচ্ছে আপা। এখন চলে যাচ্ছে। বৃষ্টির মধ্যে নেমে গেল–ওর তো বিড়ি ভিজে নিভে যাবে।
নিভে গেলে আবার ধরাবে। পকেটে নিশ্চয়ই দেয়াশলাই আছে।
দেয়াশলাইও তো ভিজে যাবে।
প্লীজ নীতু, তুই আর একটা কথাও বলবি না। তোর কথা শুনে এখন আমার মাথা ধরে যাচ্ছে।
আপা লোকটা কিন্তু ভয়ংকর। ওর চোখের মধ্যে খুনী খুনী ভাব।
চুপ নীতু, আর একটা কথা না।
নীতুর পর্যবেক্ষণশক্তি এবং অনুমানশক্তি দুই-ই বেশ ভাল। তবে মতির ক্ষেত্রে তার এই ক্ষমতা কাজ করেনি। মতি ভয়ংকরদের কেউ না, অতি সাধারণদের একজন। সুখানপুকুরে তার একটা গানের দল আছে। সে গানের দলের অধিকারী। লম্বা চুলের এই হল ইতিহাস। গানের দলের অধিকারীর কদমছাঁট চুলে মানায় না। মাথায় উকুন হলেও চুল লম্বা করতে হয়। নীতুর কাছে মতির চেহারা কুৎসিত এবং ভয়ংকর মনে হলেও–তার চেহারা ভাল। লম্বা চুলে তাকে ঋষি ঋষি মনে হয়। সে কথাবার্তাও ঋষির মত বলার চেষ্টা করে। মতি লম্বা রোগা একজন মানুষ। টকটকে ফর্সা রঙ তবে এখন রোদে পুড়ে তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে।
মতি স্টেশন মাস্টারের খোঁজ করছিল, কারণ মাস্টার সাহেব তার কাছে সতেরো টাকা পান। অনেকদিন থেকেই পান। মতি টাকাটা দিতে পারছে না। টাকা দিতে পারছে না বলেই পাওনাদারকে এড়িয়ে চলবে, মতি সেই মানুষ না। ঠাকরোকোনা স্টেশনের আশেপাশে কোথাও এলেই সে স্টেশন মাস্টারের খোঁজ করে যায়। সতেরো টাকার কথা তার মনে আছে, এই সংবাদ এক ফাঁকে দেয়। টাকাপয়সার কারণে মানুষে মানুষে সম্পর্ক নষ্ট হয়। তার ক্ষেত্রে এটা সে হতে দিতে রাজি না।
স্টেশনঘরে মেয়ে দুটিকে দেখে মতির বিস্ময়ের সীমা রইল না। আকাশের পরীরাও এত সুন্দর হয় না। পরী সুন্দর হয় এটা অবশ্য কথার কথা। পরীরা মোটেই সুন্দর হয় না। মতি নিজে পরী দেখেনি, তবে মতির ওস্তাদ শেলবরস খা পরী দেখেছেন। শেষ বয়সে একটা পরীকে তিনি নিকাহ করেছিলেন। মাঝরাতে মাঝরাতে সেই পরী আসত। শেলবরস তাঁর সঙ্গে রং-ঢং করে শেষরাতে চলে যেত। শেলবরস খাঁ নিজের মুখে বলেছেন–পরী দেখতে সুন্দর না। এরার মুখ ছোট ছোট। ইঁদুরের দাতের মত ধারালো দাঁত। গায়ে মাছের গন্ধের মত গন্ধ! আর এরা বড় ত্যক্ত করে।
মতি বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে জগলুর চায়ের স্টলে গিয়ে বসল। জগলু বিরক্ত চোখে তাকাল। মতির মনটা খারাপ হয়ে গেল–কাস্টমার এসেছে, কোথায় খাতিরযত্ন করে বসাবে তা না, এমন ভাব করছে যেন…
মতি বলল, জগলু ভাই আছেন কেমন, ভাল?
জগলু হাই তুলল। জবাব দিল না।
দেখি চা দেন। বাদলা যেমন নামছে চা ছাড়া গতি নাই।
জগলু নিঃশব্দে গ্লাসে লিকার ঢালছে। তার মুখের বিরক্তি আরো বেড়েছে। বিরক্তির কারণ হচ্ছে–সে মোটামুটি নিশ্চিত মতির কাছে পয়সা নেই। দীর্ঘদিন চায়ের স্টল চালাবার পর তার এই বোধ হয়েছে—কার কাছে পয়সা আছে, কার কাছে নেই তা সে আগেভাগে বলতে পারে। বিনা পয়সার খরিদ্দার দোকানে ঢুকেই রাজ্যের গল্প শুরু করে। জগলুকে জগলু না ডেকে ডাকে জগলু ভাই। চা মুখে দিয়েই বলে ফাসক্লাস চা হইছে জগলু ভাই। মতিও তাই করবে।
মতি চায়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির নিশ্চয় ফলে বলল, চা জবর হইছে জগলু ভাই। তারপর কন দেখি, আপনেরার খবর কন।
খবর নাই।
মাস্টার সাবের খুঁজে গিয়া এক ঘটনার মধ্যে পড়লাম… দেখি পরীর মত দুই মেয়ে…
জগলু মতির কথা থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, চা শেষ কর মতি–দোকান বন্ধ করব।
চা তাড়াহুড়ো করে খাওয়ার জিনিশ না। আরাম করে খেতে হয়। জগলুর দোকানে চা-টা বানায় ভাল। আফিং-টাফিং দেয় কি না কে জানে। আরেক কাপ খেতে ইচ্ছা করছে কিন্তু মতির হাতে আসলেই পয়সা নেই। বাকিতে একবার চা খাওয়া যায়, পরপর দুবার খাওয়া যায় না।
চা আরেক কাপ খাওন লাগব জগলু ভাই–সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজছি–শরীর মইজ্যা গেছে।
চায়ের দাম কিন্তু বাড়ছে–এক টেকা কাপ। দুই কাপ দুই টেকা।
কন কি?
কুড়ি টেকা সের চিনি–পনেরো টেকা গুড়। আমার হাত বান্দা।
আচ্ছা দেন, উপায় কি?
জগলুর মুখের বিরক্তি ভাব এখন কিছুটা দূর হয়েছে। কথা শুনে মনে হচ্ছে–মতির হাতে পয়সা আছে। চায়ের দাম দেবে। তার সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করা যেতে পারে।
স্টেশন ঘরে কি দেখলা বললা না?
পরীর মত দুই মেয়ে। যেমন সুন্দর চেহারা তেমন সুন্দর কথা।
বিষয় কি?
জানি না। জিজ্ঞাস করলাম, কিছু বলে না। এরা হইল শহরের মেয়ে, আর আমার হইল আউলা বাউলা চেহারা। চেহারা দেইখ্যাই ভয় পাইছে। মেয়ে দুইটার, পরিচয় জাননের ইচ্ছা ছিল।
পরিচয় জাইন্যা হইব কি?
তবু পরিচয় জানার ইচ্ছা হয়। দুইটা পিঁপড়া যখন সামনাসামনি দেখা হয়–তারা থামে। সালাম দেয়, কোলাকুলি করে, একজন আরেকজনের খোঁজখবর নেয়, আর আমরা হলাম মানুষ…।
মতি সুযোগ পেয়েই ঋষির মত এক বাণী দিয়ে ফেলল। পিঁপড়াদের জীবনচর্যা বিষয়ক এই বাণী সে প্রায়ই দেয়। জগলুর উপর এই বাণী তেমনি প্রভাব ফেলল না।
সে হাই তুলল।
মনসুর আলি সাহেব হন হন করে আসছেন। তিনি পয়েন্টসম্যান বদরুলকে খুঁজে পেয়েছেন। বদরুল তাঁর মাথার উপর ছাতা ধরে আছে। মনসুর আলির হাতে। ছোট একটা এলুমিনিয়ামের কেতলি। অন্য হাতে দুটা চায়ের কাপ। মনসুর আলির চোখে সমস্যা আছে–কাছাকাছি কেউ দাঁড়িয়ে থাকলেও চিনতে পারেন না। আজ মতিকে দূর থেকে চিনে ফেললেন–খুশি খুশি গলায় বললেন, কে, মতি না?
মতি হাসিমুখে বলল, স্যারের শরীর কেমন?
শরীর ভাল। তুই এখানে করছিস কি?
চা খাই।
চা পরে খাবি–তুই আমার একটা কাজ করে দে। বিরাট ঝামেলায় পড়েছি। ইরতাজুদ্দিন সাহেবের দুই নাতনী এসে উপস্থিত। স্টেশন ঘরে বসে আছে। ওদের। সুখানপুকুর নিয়ে যাবি। পারবি না?
অবশ্যই পারব।
নৌকা জোগাড় কর। ভাল ইঞ্জিনের নৌকা। নিচে বিছানা দিতে হবে। পারবি না?
মানুষ পারে না এমন কাজ দুনিয়াতে আল্লাহপাক দেয় নাই। হযরত আদমকে পয়দা করার পর আল্লাহপাক বললেন–ওহে আদম…
বড় বড় কথা বলার কোন দরকার নাই–তুই যা, নৌকা জোগাড় কর। আর শোন–তোর বেশি কথা বলার অভ্যাস। বেশি কথা বলবি না।
জ্বে আচ্ছা।
জ্বে আচ্ছা না–কোন কথাই বলবি না।
জে আচ্ছা, বলব না–তবে ইরতাজ সাহেবের যখন নাতনী তখন তো। আমরার গ্রামেরই মেয়ে…।
খবর্দার। গ্রামের মেয়ে আবার কি?
মনসুর আলিকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি এখন পুরোপুরি দুঃশ্চিন্তা মুক্ত হয়েছেন। ঘাম দিয়ে জ্বর সেরে রোগি বিছানায় উঠে বসেছে। মনসুর আলি জগলুর দিকে তাকিয়ে বললেন–মতির চায়ের পয়সা আমি দেব। ওর কত হয়েছে?
দুই কাপ চা খাইছে। দুই টাকা।
মনসুর আলি আনন্দিত গলায় বললেন–তুই তাহলে নৌকার খোঁজে চলে যা। নৌকা পেলে আমাদের খবর দিবি।
জ্বে আচ্ছা।
মতি মাথা চুলকে বলল, আফনের টাকাটার একটা ব্যবস্থা স্যার করতেছি। সতেরো টাকা পাওনা ছিল, স্যারের বোধ হয় ইয়াদ আছে।
আচ্ছা, ঠিক আছে, ঠিক আছে।
মনসুর আলি কেতলিতে করে নিজের বাড়ি থেকে চা বানিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। গলুর দোকানে কেতলি গরম করলেন। এক পোয়া জিলাপি কিনলেন–মেয়ে দুটির নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে–এমন জংলী জায়গা… কিছু পাওয়ার উপায় নেই।
মতি!
জ্বি স্যার।
কথা কম বলবি–এরা শহরের বড়ঘরের মেয়ে। চুপচাপ থাকতে পছন্দ করে। কথা শুনলে বিরক্ত হয়–কি দরকার বিরক্ত করার।
বিরক্ত করব না।
নৌকায় উঠেই ফট করে গানে টান দিবি না। এরা শহর-বন্দরে থাকে, গ্রাম্য গান শুনলে বিরক্ত হবে। কোন গান না।
জি আচ্ছা।
মনসুর আলি আবার তৃপ্তির হাসি হাসলেন। মতিকে পেয়ে তার সত্যি ভাল লাগছে।
নীতু উৎসাহের সঙ্গে বলল, আপা, স্টেশন মাস্টার সাহেব আসছেন।
তুই তো বিড়াল হয়ে যাচ্ছিস রে নীতু। অন্ধকারে সব দেখতে পাস। আমি তো কিছু দেখি না। উনি কি খালি হাতে আসছেন, না চা নিয়ে আসছেন?
চা নিয়ে আসছেন, হাতে কেতলি আছে।
চা-টা গরম, না ঠাণ্ডা?
সেটা বুঝব কি করে?
চা গরম হলে কেতলির মুখ দিয়ে ধোয়া বেরুবে। ধোঁয়া দেখতে পাচ্ছিস না হই তো মনে হয় আলোর চেয়ে অন্ধকারেই ভাল দেখিস…।
বৃষ্টি কমে এসেছিল, আবার প্রবলবেগে শুরু হল। হারিকেনে সম্ভবত তেল নেই–উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে। তেল ভরা থাকলে এত সুন্দর করে জ্বলত না।
মনসুর আলি বললেন, আম্মারা, চা খান। চিন্তার আর কিছু নাই। সব ব্যবস্থা হয়েছে।
শাহানা বলল, কি ব্যবস্থা হয়েছে?
ব্যবস্থা তেমন কিছু হয়নি, শুধু মতিকে পাওয়া গেছে। মতি সব ব্যবস্থা করে ফেলবে। মনসুর আলি এই ভরসাতেই বলেছেন সব ব্যবস্থা হয়েছে।
নীতু বলল, আমরা যাব কি ভাবে? হেঁটে?
জ্বি না আম্মা, নৌকায় যাবেন।
নৌকায় কতক্ষণ লাগবে?
নৌকায় কতক্ষণ লাগবে সেই সম্পর্কেও তাঁর কোন ধারণা নেই। নৌকায় করে তিনি কখনো সুখানপুকুর যাননি। নৌকায় যেমন যাননি–হেঁটেও যাননি। যাবার প্রয়োজন পড়েনি। তবে এবার যাবেন। মেয়ে দুটি থাকতে থাকতে যাবেন। ইরতাজুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে দেখা করে আসবেন। এদের একটা-দুটা কথায় অনেক কিছু উলটপালট হয়। তিনি সাত বছর এই জঙ্গলে পড়ে আছেন। তার জুনিয়ররা প্রমোশন নিয়ে ভাল ভাল স্টেশন পেয়েছে। তার কিছু হয়নি। মাঝে মাঝে তার সন্দেহ হয় রেলওয়ের খাতায় তার নাম আছে কি-না। ইরতাজুদ্দিন সাহেবকে দিয়ে একটা কথা রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যানের কানে তুলতে পারলে–
আম্মারা, জিলাপি খান। সন্ধ্যার সময় ভাজে। কারিগর ভাল–।
নীতু বলল–যে জিলাপি ভাজে তাকে কি কারিগর বলে?
ভাল ভাজলে কারিগর বলে।
নীতু জিলাপি এক টুকরা মুখে দিল। ন্যাতন্যাতে জিলাপি–টক টক লাগছে–একবার মুখে দিয়ে ফেলে দেয়াও যায় না–অভদ্রতা হয়। ভদ্রলোক তাকিয়ে আছেন তার দিকে। শাহানা সহজভাবে বলল, মুখে জিলাপি দিয়ে বসে আছিস কেন? ভাল না লাগলে ফেলে দে। নীতু তৎক্ষণাৎ জানালার কাছে চলে গেল। জিলাপি ফেলে দিলে এখন আর অভদ্রতা হবে না। সে নিজ থেকে ফেলেনি–অন্যের কথায় ফেলেছে।
শাহানা বলল, আমরা কখন রওনা হব?
নৌকা ঠিক হলে খবর দিবে। তখন আল্লার নাম নিয়ে রওনা দিব।
আপনি কি যাবেন আমাদের সঙ্গে?
জি না আম্মা। মতি যাচ্ছে, অসুবিধা হবে না। খুব বিশ্বাসী ছেলে।
নীতু বলল, অবিশ্বাসী ছেলে হলে কি করত? আমাদের খুন করে স্যুটকেস-টুটকেস নিয়ে চলে যেত?
স্টেশন মাস্টার সাহেব অবাক হয়ে নীতুর দিকে তাকিয়ে রইলো কি অদ্ভুত কথা যে মেয়েটা বলে! শাহানা মুখ টিপে হাসছে…
ইঞ্জিন বসানো দেশী নৌকা। মাথার উপর ছই আছে। নিচে তোষক-চাদর-বালিশ দিয়ে সুন্দর বিছানা করা। চাদর বালিশ সবই পরিষ্কার। ছই থেকে দড়ি দিয়ে বাঁধা এক হারিকেন। বালিশের কাছে একটা লম্বা টর্চ লাইট। নৌকা শাহানার খুব পছন্দ হল। শুধু ইঞ্জিনের ব্যাপারটা পছন্দ হল না–সারাক্ষণ ভট ভট শব্দ হবে–কিছুক্ষণের মধ্যে মাথা ধরে যাবে। এখনো মাথা ভারি ভারি লাগছে। মতি নামের যে বিশ্বাসী লোকের কথা বলা হয়েছিল, দেখা গেল, সে নীতুর অপরিচিত নয়। স্টেশন পরের জানালায় তার মুখই দেখা গিয়েছিল–তখন তার মুখ যতটা ভয়ংকর লেগেছিল–এখন ততটা ভয়ংকর লাগছে না। নীতুর কাছে এখন লোকটাকে একটু যেন হবার মত লাগছে। লোকটার পরনে লুঙ্গি না–পায়জামা পাঞ্জাবি। পায়জামা আবার হাঁটু পর্যন্ত গোটানো। খালি পা। খালি পায়ে কেউ পায়জামা পাঞ্জাবি পরে ঘুরে?
নীতু বলল, আপনার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছিল না?
মতি লজ্জিত গলায় বলল, জ্বি।
মতি ইঞ্জিন চালুর ব্যাপারে সাহায্য করছে। ঠাণ্ডায় ইঞ্জিন বসে গেছে মনে হয়। স্টার্ট নিচ্ছে না।
শাহানা বলল, ইঞ্জিনের নৌকা জোগাড় করেছেন?
জ্বি। দেড় ঘণ্টার মধ্যে ইনশাল্লাহ পৌঁছে যাব।
ইঞ্জিন না চালিয়ে যাওয়া যায় না?
অবশ্যই যাবে। এক সময় তো আমরা ইঞ্জিন ছাড়াই চলাফেরা করতাম। এখন না ইঞ্জিন হইল। ভটভটি ইঞ্জিন।
ইঞ্জিন ছাড়া কতক্ষণ লাগবে?
ভাল মাঝি হইলে চার-পাঁচ ঘণ্টা।
আমাদের মাঝি কেমন? মাঝি যদি ভাল হয় তাহলে ইঞ্জিন ছাড়া চালাতে বলুন–দরকার হলে কোনখান থেকে আরেকজন মাঝি জোগাড় করে আনুন। অনেকদিন। নৌকায় চড়া হয়নি। চড়ার সুযোগ যখন পাওয়া গেছে–ভালমত চড়া যাক। চারপাঁচ ঘণ্টা এমন কিছু বেশি সময় না।
নীতু বলল, চার-পাঁচ ঘণ্টা অনেক সময় আপা।
অনন্ত মহাকালের কাছে চার-পাঁচ ঘণ্টা কিছুই না নীতু।
আমার তো ঘুম পাচ্ছে।
ঘুম পেলে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়। সকালে ঘুম ভেঙে দেখবি দাদাজানের বাড়ির ঘাটে নৌকা থেমে আছে।
চার-পাঁচ ঘণ্টা নৌকায় থাকলে নিশ্চয় আমাদের ডাকাতে ধরবে। আমার মন বলছে, এই অঞ্চলে খুব ডাকাতি হয়। আচ্ছা শুনুন, এই জ্বলে ডাকাতি হয় না?
প্রশ্নটা করা হল মতিকে, জবাব দিল মাঝি। সে অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে বলল–ডাকাতি বলতে গেলে রোজ রাইতে হয়—গত পরশু মোকামঘাটায় গয়নার নৌকায় বিরাট ডাকাতি। ডাকাইতে রামদা দিয়া হাতে কোপ দিছে।
নীতু ভীত গলায় বলল, মোকামঘাটা ঐখান থেকে কতদূর?
তা ধরেন আফনের সোয়া মাইল।
আমরা কি মোকামঘাটা হয়ে যাব?
হুঁ।
নীতু বলল–আপা শুনছ উনি কি বলছেন? মোকামঘাটায় ডাকাতরা রামদা দিয়ে কোপ মারে।
শাহানা বলল, আমাদের নৌকার ইঞ্জিন থাকবে বন্ধ। কোন রকম সাড়াশব্দ হবে। আমরা চুপি চুপি পার হয়ে চলে যাব। ডাকাতরা বুঝতেও পারবে না।
তোমার মাথা যে খারাপ এটা কি তুমি জান আপা?
জানি।
না, তুমি জান না। তোমার মাথা ভয়ংকর খারাপ। এই ব্যাপারটা শুধু যারা তোমার কাছাকাছি থাকে তারা জানে। আর কেউ জানে না। তোমার যে শুধু নিজেরই মাথা খারাপ তাই না–তোমার আশেপাশে যারা থাকে, তাদের মাথাও তুমি খারাপ করে দাও। নৌকায় যখন ডাকাত পড়বে তখন তুমি কি করবে?
এমন অদ্ভুত কিছু করব যেন ডাকাতরা পুরোপুরি হকচকিয়ে যায়। যেমন ধর, ডাকাতদের যে হেড তাকে বলব–ভাই, আপনি কি গান গাইতে পারেন?
তোমার এই সস্তা রসিকতায় আমি কিন্তু মোটেই মজা পাচ্ছি না, আপা।
তুই মজা না পেলেও অন্যরা কিন্তু পাচ্ছে।
অন্যরা যে মজা পাচ্ছে–তা সত্যি। নীতু নৌকার মাঝিকে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু তার বিশ্রী ভ্যাক ভ্যাক হাসি শোনা যাচ্ছে। মতি নামের লোকটা এ রকম বিশ্রী। করে না হাসলেও–হাসছে! দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসছে। নীতুর গা জ্বালা করতে লাগল।
শাহানা বলল, নীতু, তুই আমার কথা শোন–টেনশানে তুই অসুখ বাঁপিয়ে ফেলবি। ধাই করে ব্লাড প্রেসার বেড়ে যাবে, রক্তে সুগার যাবে কমে… দুই নিশ্চিন্ত হয়ে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে থাক…যা হবার হবেই…আগেভাগে ভবিষ্যৎ চিন্তা করে বর্তমান নষ্ট করার কোন মানে হয় না। তুই আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাক তো। কি সুন্দর ঝমঝমে বৃষ্টি। এই বৃষ্টির ভেতর নৌকা নিয়ে যাওয়া কত ইন্টারেস্টিং এডভেঞ্চার! আয় নীতু।
নীতু এগিয়ে এল এবং আপার কোলে মাথা রেখে ওর পড়ল। সে মতির দিকে তাকিয়ে বলল, মোকামঘাটা পার হলে দয়া করে আমাকে ডেকে তুলবেন।
জি আচ্ছা।
নৌকা চলতে শুরু করছে। বৃষ্টি বন্ধ হয়েছে–হঠাৎ হঠাৎ একটা-দুটা ফোঁটা শুধু পড়ছে। মতি হাতে লগি নিয়েছে। পেছনের মাঝি দাঁড় টানছে, মতি লগি ঠেলছে। লগি ঠেলে অভ্যাস নেই। কষ্ট হচ্ছে। উপায় কি! নীতু ছইয়ের ভেতর থেকে বের হয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে সে পানিতে হাত দিচ্ছে। কি ঠাণ্ডা পানি! পানিতে হাত দিতে তার খানিকটা ভয় ভয়ও লাগছে। পানি থেকে সাপখোপ যদি তার গা বেয়ে উঠে আসে।
ভীতু মানুষকে ভয় দেখাতে খুব ভাল লাগে। নৌকার মাঝি দ্বিতীয় ভয়ের গল্প ফাঁদল।
ছোট আফা, পানির মইধ্যে কিন্তুক হাত দিবেন না। পানির মইধ্যে কুম্ভীর আছে।
নীতু বিরক্ত গলায় বলল, ময়মনসিংহের নদীর পানিতে কুমীর থাকবে কেন? কুমীর থাকবে সমুদ্রের কাছাকাছি নদীতে।
এইটাই তো আচানক কথা। গত বছর বাইস্যা মাসে কারেন্ট জালে এক কুম্ভীর ধরা পড়ল।
কুম্ভীর বলছেন কেন? বলুন কুমীর। কুমীর বলা তো কুম্ভীর বলার চেয়ে অনেক সহজ। যুক্তাক্ষর নেই।
ঘটনাট! কি হইছে শুনেন আফা। সে এক ইতিহাস। আলিশান এক কুম্ভীর। এক গজ দুই ফুট লম্বা। দর্জির দোকানের গজ ফিতা আইন্যা মাপা হইল।
দয়া করে মিথ্যা গল্প বলে আমাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করবেন না। এক গজ দুফিট লম্বা কুমীর এখানকার নদীতে কখনো পাওয়া যাবে না।
ঘটনা কিন্তুক সত্য আফা।
না ঘটনা সত্য না, ঘটনা মিথ্যা।
নীতুর রাগ দেখে মাঝি হেসে ফেলল। কাউকে রাগতে দেখে আনন্দিত হুর। সুযোগ তো সচরাচর পাওয়া যায় না। মাঝি শব্দ করে হাসছে। মাঝির সঙ্গে সঙ্গে নিঃশব্দে হাসছে মতি। হাসছে মুখ ঘুরিয়ে। হাসি দেখিয়ে মেয়েটিকে সে আরো রাগাতে চায় না। মতি বলল, বিরাট হৈ-চৈ হইছিল। ইত্তেফাক পত্রিকায় কুমীরের ছবি ছাপা হয়েছিল। এখনো লোকে ভয়ে নদীতে গোসল করে না।
নীতু থমথমে মুখে বলল, এটা সত্যি হতে পারে না। পত্রিকায় অনেক মিথ্যা খবর ছাপা হয়।
এই খবরটা সত্যি ছিল।
আপনি কি দেখেছিলেন কুমীরটা?
হ্যাঁ। নিজের চোখে দেখা। মানুষের মধ্যে যেমন অনেক পাগল মানুষ থাকে–যা করার কথা না, অন্যে যা করে না, তাই করে। পশু-পাখি, জীব-জানোয়ারের ভিতরেও সে রকম থাকে। ঐ কুমীরটার ছিল মাথা খারাপ। তার থাকার কথা ছিল সমুদ্রের কাছে। তা না কইরা উজানের দেশ দেখতে আইস্যা মারা পরল।
শাহানা কৌতূহলী হয়ে কথা শুনছে। মাথা-খারাপ কুমীরের কথা মাঝি শ্রেণীর কোন যুবকের মুখ থেকে সচরাচর শোনার কথা না। কিংবা কে জানে এই শ্রেণীর যুবকেরা হয়ত এভাবে কথা বলেই অভ্যস্ত।
নীতু বলল, তারপর কুমীরটাকে গ্রামের মানুষ কি করল?
দড়ি দিয়ে তিনদিন বাধা ছিল। তারপর পিটাইয়া মারল।
কেন?
কুমীরের কপালে ছিল মরণ লেখা।
তারপর কি হল?
কুমীরের দাঁতগুলি বিক্রি হইল। একেকটা দাঁত তিন টাকা। কুমীরের দাঁত দিয়া। ভাল তাবিজ হয়। আমরার এলাকায় কিছু গারো মানুষ আছে। তারা কুমীরটা পঞ্চাশ টাকায় কিনল।
কেন?
রাইন্দা খাইছে। পেট ভর্তি ছিল ডিম। ডিমগুলো আলাদা রান্না করছে আর শরীরটা আলাদা। ডিমগুলো খুব স্বাদ হইছিল।
বুঝলেন কি করে যে স্বাদ হয়েছিল?
আপনি খেয়ে দেখেছেন? হ্যাঁ একটা খাইছি। মুরগির ডিমের মতই। বেবাক কুসুম–শাদা অংশ কম।
আপনি সত্যি কুমীরের ডিম খেয়েছেন?
হ্যাঁ।
আপনার কথা আমি প্রায় বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম–এখন বুঝতে পারছি–আপনার সব কথা মিথ্যা। কুমীরের ডিম খাওয়ার কথা বলে আপনি ধরা পড়ে গেছেন।
মতি হাসছে–শব্দ করে হাসছে। মাঝিও হাসছে। নীতু রাগ করে নৌকায় ছইয়ের ভেতর চলে গেল। ফিসফিস করে বলল, আপা, লোকটা কি বলছিল তুমি কি শুনছিলে?
হুঁ।
তোমার কি ধারণা লোকটা কুমীরের ডিম খেয়েছে?
খেতে পারে। কিছু কিছু মানুষের স্বভাব হচ্ছে যে সে অন্যের চেয়ে আলাদা এটা প্রমাণ করার জন্যে উদ্ভট কাণ্ডকারখানা করা। লোক দেখানো ব্যাপার আর কি। লোকজন হা করে তাকিয়ে থাকবে, দেখবে, বিস্মিত হবে–এতেই আনন্দ।
এরকম লোক সংখ্যায় খুব কম, তা না?
না, সংখ্যায় অনেক বেশি।
নীতু ফিসফিস করে বলল, আপা, কথাবার্তা আরো আস্তে বল–ঐ লোক শুনছে। মতি নামের কুমীরের ডিম খাওয়া লোকটা।
শুনুক না–গোপন কিছু তো বলছি না।
তবু আমাদের কথা অন্য মানুষ কেন শুনবে? মিথ্যাবাদী একজন মানুষ? আমার উনাকে অসহ্য লাগছে। শুধু শুধু কেন মিথ্যা বলবে?
শুধু শুধু মানুষ কখনো মিথ্যা বলে না। মিথ্যা যদি বলে থাকে তাহলে উদ্দেশ্য আছে–তবে আমার মনে হয় সত্যি কথাই বলছে–।
তোমার এরকম মনে হবার কারণ কি?
গ্রামের মানুষ তো! এরা মিথ্যা কম বলে–।
শহরের লোক মিথ্যা বেশি বলে?
হুঁ।
কেন?
শহরের লোকদের মিথ্যা বলার প্রয়োজন যতটা গ্রামের লোকদের ততটা না, এই জন্যে কম বলে।
নৌকা হঠাৎ দুলতে শুরু করেছে–এপাশ-ওপাশ করছে। নীতু চট করে ওঠে বসে আতংকিত গলায় বলল, কি হচ্ছে আপা? শাহানা জবাব দেবার আগেই মতি বলল, নৌকা বিলের মুখে পড়ছে এই জন্যে ঢেউ বেশি, ভয়ের কিছু নাই। ঢেউ থাকব না। এইগুলা হইল দেখন ঢেউ। কামের ঢেউ না।
নীতু ফিসফিস করে বলল–তোমাকে বলেছিলাম না আপা, আমাদের সব কথা শুনছে। কেউ আড়াল থেকে কথা শুনলে আমার ভাল লাগে না।
তাহলে কথা বলিস না, চুপচাপ শুয়ে থাক।
নীতু বাধ্য মেয়ের মত আবার শুয়ে পড়ল। মতি বলল, ভিতরের হারিকেনটা, নিভাইয়া দেন।
শাহানা বলল, কেন?
আন্ধাইর খুব জবর। ভিতরে হারিকেন জ্বললে বাইরের কিছু দেখা যায় না। দিক ভূল হয়। হারিকেন নিভাইয়া টর্চ লাইটটা আমার হাতে দেন।
শাহানা হারিকেন নিভিয়ে দিতেই চারদিকের অন্ধকার যেই তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। পেছনের মাঝি বলল, আরে সব্বনাশ! কি আন্ধইর রে! জন্মের আন্ধাইর।
নীতু শাহানার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল–আপা, লোকটার অন্য কোন মতলব নেই তো? হারিকেনটা নিভিয়ে দিতে বলল কেন?
লোকটাকেই জিজ্ঞেস কর, আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন?
তুমি তো পৃথিবীর সব প্রশ্নের উত্তর জান। এই জন্যে তোমাকে জিজ্ঞেস করছি।
তোর এই প্রশ্নের উত্তর শুধু এই লোকটাই জানে।
স্টেশন থেকেই আমার মনে হচ্ছে লোকটা খারাপ–। আমার ভয় লাগছে আপা। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখ। আমার শরীর কাঁপছে। আপা, পানি খাব।
নীতু আসলেই থর থর করে কাঁপছে। হঠাৎ অন্ধকার হওয়াতেই মনে হয় এই কাণ্ডটা ঘটেছে। নীতুর হার্টের কোন অসুখ-টসুখ নেই তো?
শাহানা নৌকার ছইয়ের ভিতর থেকে মাথা বের করে বলল–শুনুন, নীতু খুব ভয় পাচ্ছে। হারিকেনটা জ্বালাতে হবে।
মতি বলল, আপনি পারবেন না, আমি জ্বালায়ে দিব। ভয়ের কিছু নাই। ঢেউ থাকব না।
ও ঢেউকে ভয় পাচ্ছে না। আপনাকে ভয় পাচ্ছে। ওর ধারণা, আপনি খারাপ লোক। আপনার মতলব ভাল না।
কয়েক মুহূর্ত নীরবতার পর হাসির শব্দ শোনা গেল। এমন জোরালো হাসি শাহানা অনেকদিন শুনেনি। মতি হাসছে–মতির সঙ্গে মাঝিও যোগ দিয়েছে। তাদের হাসি আর থামছে না। হাসির মাঝখানে শাহানা নিচু স্বরে বলল–হাসির শব্দ শুনে তোর ভয় কেটেছে, না?
নীতু বলল, হ্যাঁ কেটেছে।
ভয়ংকর লোকজনও কিন্তু হাসতে পারে। একজন লোক শব্দ করে হাসলেই ধরে নিবি সে ভাল লোক তা কিন্তু না। তারপরেও হাসির শব্দ শুনলেই আমাদের ভয় কেটে যায়। কেন বল্ তো?
জানি না আপা।
আমি নিজেও জানি না।
মতি বলল, দেখি হরিকেনটা দেন। ধরাই।
নীতু বলল, হারিকেন ধরাতে হবে না। আপনি নৌকা চালান। আমার ভয়ে কেটে গেছে।
মতি বলল, ভয় কাটল কেন?
জানি না।
পেছনের মাঝি বলল, আমরার মতি ভাইজান এম মানুষ যারে পিঁপড়ায়ও ডরায় না।
নীতু বলল, আপনাকে পিঁপড়াও ভয় পায় না–এটা কি সত্যি?
পিঁপড়া কোন মানুষরেই ডরায় না। ডরাইলে মানুষের মইধ্যে এত সহজে চলাফেরা করত না।
নীতু ফিসফিস করে শাহানাকে বলল–আপা, এই লোকটারও তোমার মত জ্ঞানী-জ্ঞানী কথা বলার অভ্যাস।
তাই তো দেখছি।
তোমার কি ধারণা–উনি কি করেন?
আমার ধারণা কিছুই করে না। যারা কিছুই করে না জ্ঞানী-জ্ঞানী কথা বলার দিকে তাদের প্রবল ঝোঁক থাকে। সব গ্রামে যেমন একটা করে পাগল থাকে তেমনি সব গ্রামে একটা করে অপদার্থ জ্ঞানী লোক থাকে। তারা অন্যদের মত লুঙ্গি-গেঞ্জি। পরে না। শার্ট-পেন্ট পরে খালি পায়ে ঘুরে বেড়ায়। লম্বা চুল রাখে, শুদ্ধ কথা বলার চেষ্টা করে এবং মাঝে মাঝে উদ্ভট কথা বলে মানুষদের চমকে দেবার চেষ্টা করে।
নীতু বলল, আমাদের এত সহজে চমকাতে পারবে না, তাই না আপা?
হ্যাঁ–আমাদের চমকানো খুব কঠিন বরং আমরা তাকে অতি সহজেই চমকে দিতে পারি।
ইঞ্জিন ছাড়া নৌকা চালাতে বলে তুমি তো প্রথমেই চমকে দিয়েছ?
শাহানা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল–তোর খুব বুদ্ধি নীতু। তোর বুদ্ধি দেখে আমি নিজেই মাঝে মাঝে চমকে যাই।
আপা!
হুঁ।
মাঝি যে বলল উনাকে পিঁপড়াও ভয় পায় না–এটা কেন বলল?
গ্রামের মানুষ বাড়িয়ে বাড়িয়ে কথা বলতে পছন্দ করে এই জন্যে বলেছে। এইসব হচ্ছে কথার কথা। যেমন, সে আমাদের সম্পর্কে অন্যদের কাছে বলবে–আজ রাতে নৌকায় দুটা মেয়েকে পার করেছি। দুটাই পরীর মত সুন্দর। এর মধ্যে একটা মেয়ে এমন ভয় পাচ্ছিল, ভয়ে কিছুক্ষণ পর পর ফিট হচ্ছিল। কি, বলবে না এরকম?
নীতু হাসিমুখে বলল, মনে হচ্ছে বলবে। আপা শোন, তুমি আরও নিচু গলায় কথা বল–আমার মনে হয় ঐ লোকটা আমাদের সব কথা শুনছে।
না শুনছে না। ও নৌকা চালাতেই ব্যস্ত।
নীতু গলা বের করে মতির দিকে তাকিয়ে বলল–আচ্ছা, আপনি কি আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছেন?
মতি বলল, জি পাইতেছি। নৌকার ছইয়ের ভেতকে ফিসফিস কইরা কথা বললেও বাইরে থাইক্যা পরিষ্কার শোনা যায়। ছইয়ের পেছনে পর্দা না থাকলে শোনা যাইত না–বাতাসে শব্দ ভাইস্যা যাইত। পিছনে পর্দা এই জন্যে সব শুনতাছি।
আমাদের কথায় রাগ করেননি তো?
জি না।
শীতে মতির শরীর কাঁপছে। ভেজা পাঞ্জাবিটা গা থেকে খুলে ফেলতে পারলে শীত কম লাগত। মেয়ে দুটাও তাকিয়ে আছে, পাঞ্জাবি খোলা ঠিক হবে না।
ইরতাজুদ্দিন সাহেবের নাতনী, এদের সামনে আদবকায়দার বরখেলাফ করা যায় না। মতির ধারণা, ইতিমধ্যেই সে আদবকায়দা অনেক বরখেলাফ করে ফেলেছে। মাস্টার সাহেব তাকে কথা কম বলতে বলেছেন, সে কথা কম বলেনি। বেশিই বলেছে। কিছু কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগে। কারণ ছাড়াই কথা বলতে ইচ্ছা করে। মেয়ে দুটা সেই রকম। তবে বেশি সুন্দর। বেশি সুন্দর মানুষকে আপন বলে মনে হয় না, পর পর লাগে।
শাহানা বলল, আপনি কি করেন?
মতি লজ্জিত গলায় বলল, কিছু করি না। আফনের আন্দাজ ঠিক আছে।
মাঝি পেছন থেকে বলল, মতি ভাই হইল আফনের গানের দলের অধিকারী।
শাহানা বলল, সেটা কি?
মতি আগের চেয়েও লজ্জিত গলায় বলল–আমার একটা গানের দল আছে। ছোট দল।
বলেন কি? আপনি তাহলে মিউজিক্যাল টুপের কনডাক্টার? ইন্টারেস্টিং তে।
মতি অস্বস্তি ঢাকার জন্যে কয়েকবার কাশল। গানের দল করা এমন কোন কাজ না যে বড় গলায় বলতে হয়। এইসব পরিচয় গোপন রাখাই ভাল। গ্রামাঞ্চলে কাজকর্মহীন বাদাইম্যারা গানের দল করে, যাত্রার দল করে।
নীতু শাহানার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। নৌকার দুলুনীতে শাহানারও ঘুম আসছে।
গানের দল ছাড়া আপনি আর কিছুই করেন না?
মতি জবাব দিল না। অস্বস্তি ঢাকার জন্যে অকারণে কাশতে লাগল।
শাহানা বলল, গানের দল যারা করবে অন্য কিছু করার তাদের সময়ই বা কোথায়? এইসব হল ক্রিয়েটিভ কাজ, সৃষ্টিশীল কাজ। সৃষ্টিশীল কাজ যারা করে তারা অন্য কিছু করতে পারে না। তাদের মাথায় সব সময় একটা কাজই ঘুরে তো, সেই জন্যেই পারে না।
মতি মুগ্ধ হয়ে গেল। কি সুন্দর কথা! এ রকম সুন্দর কথা এই জীবনে কেউ তাকে বলেনি।
আপনার দল নিয়ে একদিন একটা উৎসব করবেন। আমরা শুনব।
জ্বি আচ্ছা।
আপনাদের কজনের দল?
চাইর জনের।
বাহ, সুন্দর তো–বিটলসদের দলেও ছিল চারজন।
মতি উৎসাহের সঙ্গে বলল, আমরার মইধ্যে সবচে ওস্তাদ হইল আফনের পরাণ কাকা। ঢোল বাজায়। হাতের মধ্যে আছে মধু। আহা রে কি বাজনা!
আপনি কি করেন?
আমি গান গাই–গলা ভাল না–মোটামুটি। তয় আফনের দরদ দিয়া গাই–গলার অভাব এই কারণে লোকে ধরতে পারে না।
শাহানা হাসল। মতি উৎসাহের সঙ্গে বলল–পরাণ কাকার ঢোল শুনলে আফনের সারা জীবন মনে থাকব–আহা কি জিনিস!
শুনব, উনার ঢোল শুনব।
উনার মন-টন বেশি ভাল–স্ত্রীর সন্তান হবে। শেষ বয়সে সন্তান। শেষ বয়সে সন্তান হলে চিন্তা হবারই কথা।
আরেকজন আছে আবদুল করিম, বেহালাবাদক। তয় উনারে এখনো দলে নিতে পারি নাই। চেষ্টায় আছি।
উনিও খুব ভাল?
আমার টেকা থাকলে উনার দুইটা হাত রূপা দিয়া বান্ধাইয়া দিতাম।
সোনা দিয়ে বান্ধাতেন না কেন? সোনা দিয়ে বান্ধানো ভাল না?
পুরুষছেলের জন্যে সোনা নিষিদ্ধ। এই জন্যে রূপার কথা বলেছে।
ও আচ্ছা।
আফনের সঙ্গে অনেক আজেবাজে কথা বইল্যা ফেলছি। মনে কিছু নিবেন না।
কিছু মনে করব না। তাছাড়া আপনি আজেবাজে কথা কিছু বলেননি। সুখানপুকুর আর কতদূর?
বেশি দূর না। আইস্যা পড়ছি। ধরেন আর এক ঘণ্টা।
শাহানা চুপ করে আছে। মতি ক্লান্ত হয়ে লগি কোলের উপর নিয়ে বিশ্রাম করছে।
দূরে কোথাও শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে। মাঝি বলল, আবার বৃষ্টি নামতাছে। এই বছরের মত বৃষ্টি আর কোন বছর হয় নাই। শাহানার শীত শীত লাগছে। পায়ের কাছে ভাঁজ করা একটা চাদর আছে। কার না কার চাদর, গায়ে দিতে ইচ্ছা করে না। নিজের একটা চাদর থাকলে গায়ে জড়িয়ে শুয়ে থাকা যেত। বৃষ্টি নেমেছে জোরেসোরে। বিলের পানিতে বৃষ্টির শব্দ–কি যে অদ্ভু্ত! কি যে অদ্ভুত!!
ইরতাজুদ্দিন সাহেবের বাড়ির ঘাটে যখন নৌকা থামল তখন দুবোনই ঘুমে অচেতন।
মতি ওদের ঘুম ভাঙল না। ইরতাজুদ্দিন সাহেবকে খবর দিয়ে নিয়ে এল। সাত ব্যাটারির টর্চ হাতে তিনি নদীর ঘাটে এলেন। মেয়েদের মুখে টর্চের আলো ফেলে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেলেন।
তিনি ব্যাকুল গলায় ডাকলেন–শাহানা, এই শাহানা!
শাহানা জাগল না। সে শুধু পাশ ফিরল।