০১. আমার বয়স প্রায় বত্রিশ

আমার বয়স প্রায় বত্রিশ।

প্রায় বললাম এই জন্যে যে মাসের হিসেবে একটু গণ্ডগোল আছে। আমার বাবার খাতাপত্রে আছে আমার জন্ম ডিসেম্বর মাসের তিন তারিখ। আমার মা নিজেও বলেন ডিসেম্বর। মা-বাবার কথাই এসব ক্ষেত্রে সঠিক বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু আমার যেখানে জন্ম, সেই নানার বাড়িতে সবাই জানে আমার জন্ম হয়েছে জানুয়ারির তিন তারিখে। পুরো একটা মাসের গণ্ডগোল।

আমার মায়ের কথায় আমি বিশেষ গুরুত্ব দিই না। কারণ তিনি আমার বাবার সব কথাকেই অভ্ৰান্ত মনে করেন। বাবা যদি বলেন–না-না, ফরিদের জন্ম এপ্রিল মাসে। ডিসেম্বরে কে বলল? তাহলে প্রথম কিছু দিন মা কিছুই বলবেন না। তারপর বলবেন-হা তাই তো, ওর জন্মের সময় তো গরমই ছিল। জানালা রাতে খোলা থাকত, স্পষ্ট মনে আছে।

এক মাসের তফাৎ এমন কিছু নয়। আমি অতি নগণ্য ব্যক্তি। পৃথিবীর অনেক। বিখ্যাত মানুষেরই জন্মের দিন-তারিখে গণ্ডগোল আছে। তবু কয়েক দিন ধরে মনে হচ্ছে এক মাস খুব কমও নয়। আমার আয়ু যদি বত্রিশ বছর হয়, তাহলে এক মাস হচ্ছে আমার মোট জীবনের তিন শ চুরাশি ভাগের এক ভাগ। অনেকটা সময়। তিরিশ দিন মানে হচ্ছে সাত শ বিশ ঘন্টা। আরো হোট করে বললে পঁচিশ লক্ষ সেকেণ্ডেরও কিছু বেশি। খুব একটা হেলাফেলা করার মতো ব্যাপার নয়।

গত পনের দিন ধরেই এই সব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আমি ভাবছি, তুচ্ছ বলাটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। কারণ গত পনের দিন ধরেই আমি হাসপাতালে ভর্তি হবার চেষ্টা করছি। ভর্তি হতে পারলেই তলপেটের ড়ুওডেনালের মুখে একটা অপারেশন হবে। কবুতরের ডিমের মতো একটা টিউমার ডাক্তাররা সরিয়ে ফেলতে চেষ্টা করবেন।

টিউমারটি ম্যালিগনেন্ট কিনা, তা আমাকে কেউ বলছে না। ডাক্তার কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে শুধু বলছেন, আরে, এই সব নিয়ে আপনার এত চিন্তা কিসের? হাসপাতালে আগে ভর্তি হয়ে যান, তারপর দেখা যাবে। ডাক্তারের কাঁধ-ঝাঁকুনিটা আমার ভালো লাগে নি। যেন খুব চেষ্টা করে ঝাকান। এর চেয়েও সন্দেহজনক। হচ্ছে, দ্বিতীয় বার যখন এক্স-রে রিপোর্ট নিয়ে তার কাছে গেলাম এবং ভিজিট দিতে গেলাম, তিনি অমায়িক ভঙ্গিতে হেসে বললেন, আরে, এক বার তো ভিজিট দিয়েছেন, আবার কেন?

ভিজিট নেয়ার ব্যাপারে কোনো ডাক্তার আপত্তি করেন বলে জানতাম না। ইনি এই বাড়তি দয়াটি কেন দেখাচ্ছেন? কেন এই অনুগ্ৰহ?

আপনি একটা সীট যোগাড় করেন। দি আরলিয়ার দি বেটার।

চেষ্টা তো করছি, পারছি না তো।

রোজ যাবেন। রোজ খোঁজ নেবেন।

আমি রোজ যাই। হেঁটে যাই। রিকশা করে ফিরি। ঘন্টাখানিক সময় কাটে হাসপাতালে। খুব যে খারাপ কাটে তা নয়। এ্যাডমিশন সেকশনের বেশ কয়েক জনের সঙ্গে আমার খাতির হয়েছে। এক জন হচ্ছে মতি ভাই। অসম্ভব রোগা মানুষ। সাধারণত রোগা মানুষেরা লম্বা হয়–মতি ভাই বেঁটে। তাঁর কাছে বসলেই তিনি নিছু গলায় অনবরত কথা বলেন। বিরক্তিতে কপাল কোঁচকান এবং কিছুক্ষণ পরপর দেয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে দাঁত খোচান। আমাকে দেখলেই চায়ের অর্ডার দিয়ে গলা নিচু করে বলেন, হবে হবে, ধৈর্য ধরেন।

আমি ধৈর্য ধরি। খানিকক্ষণ তার সঙ্গে গল্পগুজব করে ঘরে ফিরে এক মাসের হিসেব করি।

এক মাস হচ্ছে সাত শ বিশ ঘন্টা। তেতাল্লিশ হাজার দু শ মিনিট। পঁচিশ লক্ষ বিরানই হাজার সেকেণ্ড দীর্ঘ সময়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *